ধর্ম ও দর্শন
বিজ্ঞান
সাহিত্য
1 of 2

ঈশপ (আ. কা. ৬২০–৫৬০ খ্রি. পূ.) – কালজয়ী নীতিগল্পকার

ঈশপ (আ. কা. ৬২০–৫৬০ খ্রি. পূ.) – কালজয়ী নীতিগল্পকার

এক পুকুরে ছিল অনেকগুলো ব্যাঙ। কিন্তু তাদের কোনো রাজা ছিল না, তাই তারা খুব আফসোস করত। একদিন সবাই মিলে গিয়ে হাজির হল স্বর্গের রাজা জিউসের কাছে।

—হে স্বর্গরাজ, আমরা রাজাহীন রাজ্যে খুব দুঃখে আছি। আমাদের একজন রাজা দিন। দেবরাজ জিউস তাদের অনুরোধ রক্ষা করলেন এবং একটি মরাগাছের খণ্ডকে পুকুরের ব্যাঙদের রাজা করে পাঠালেন।

এতদিন পর রাজা পেয়ে ব্যাঙেরাতো ভীষণ খুশি। তারা রাজাকে মান্য করে ভয়ে ভয়ে গিয়ে লুকিয়ে পড়ল জলের একেবারে তলায়।

কিন্তু দুদিন পরেই তারা দেখল, এ কেমন রাজা তাদের? এ যে নড়েও না, চড়েও না। তাদেরকেও কিছু বলেন না। শাসনও করেন না। তাই কেউ সাহস করে এসে তাকে ঠোকর মারে, কেউবা চড়ে বসে তার মাথায়, লাফায়। রাজা তাতেও কিছু বলেন না। অবশেষে তারা বুঝল, এই রাজার সত্যি কিছু বলার বা করার ক্ষমতা নেই। তাই এই অকর্মা রাজাকে দিয়ে তাদের চলবে না।

তারা আবার গেল জিউসের কাছে, হে স্বর্গরাজ, আমরা অমন অকর্মা রাজা চাই না। একজন সক্রিয় রাজাকে চাই। আমাদের শাসন করতে পারেন, এমন রাজা চাই।

জিউস তাদের প্রার্থনা মঞ্জুর করে নিলেন এবং একটি বাইনমাছকে রাজা করে পুকুরে ব্যাঙদের কাছে পাঠালেন।

বাইনমাছের তো চঞ্চল স্বভাব! সারাক্ষণ পুকুরময় শুধু ছুটে বেড়ায়। এতে ব্যাঙেরা পড়ল আবার ভারি বিপদে। তারা রাজার ভয়ে সর্বক্ষণ অস্থির থাকে। যদিও রাজা তাদের কিছুই বলে না, কিন্তু আরামে থাকতে দেয় না একটুও।

এ তো ভারি মুশকিল হলো! তাই অনেক ভেবেচিন্তে ব্যাঙেরা আবার গিয়ে ধরল জিউসকে, হে স্বর্গরাজ, এই নতুন রাজার জ্বালায় আমরা খুবই অস্থির। সারাক্ষণ শুধু ছুটে বেড়ায় পুকুরময়। আমাদেরকে একটু আরামে থাকতে দেয় না। আমাদের আবার রাজা বদল করে দিন। ভালো রাজা দিন।

একবার, দুবার, তারপর তিনবারের বার স্বর্গরাজ কিন্তু ব্যাঙদের প্রতি খুবই রেগে যান। ভাবেন, এবার তোমাদেরকে শিক্ষা দিতে হবে। এই-না ভেবে তিনি এবার ব্যাঙদের রাজা করে পাঠালেন এক সারস পাখিকে।

নতুন রাজা সারস পাখি পুকুরে এসে দেখল তার প্রজা ব্যাঙগুলো ভারি নাদুসনুদুস। আর তার পেটেও দারুণ খিদে। তাই সে সকাল থেকেই ব্যাঙগুলোকে ধরে গপাগপ গিলতে লাগল। আসলে এটা ছিল জিউসেরই চালাকি। যাতে সারস সবগুলো ব্যাঙকে শেষ করে ফেলে, যাতে ওরা আর কেউ বারবার রাজা বদলাবার জন্য এসে তাঁকে বিরক্ত করতে না পারে। এমনি করে ব্যাঙেরা বেশি ভালো চাইতে গিয়ে নিজেদেরই সর্বানাশ ডেকে আনল।

এই যে মজার গল্পটি বলা হলো, এর রচনাকারের নাম মহামতি ঈশপ (Aesop)। তিনি এই গল্পটি রচনা করেছিলেন একান্ত যুগোপযোগী করে। তখন এথেন্সের প্রজারা তাদের রাজার বিরুদ্ধে কী কারণে খুব খেপে উঠেছিল। তারা চাইছিল রাজা বদল করতে। ঠিক সেই সময়েই ঈশপ রাজাবদলের কুফল সম্পর্কে নগরবাসীদের হুঁশিয়ার করে দিতেই জন্ম দিয়েছিলেন এই মজার গল্পটির।

ঈশপ নামের এই মহান ব্যক্তিটি সম্পর্কেও এখন আর বেশি কিছু জানবার উপায় নেই। তাঁর জীবনচরিতের প্রায় সবটাই হারিয়ে গেছে এক বিস্মৃতির অতলগর্ভে।

শোনা যায়, তিনি ছিলেন একজন সামান্য ক্রীতদাস। তাঁর আবির্ভাবকাল অনুমান করা হয় ৬২০ থেকে ৫৬০ খ্রিস্টপূর্বাব্দের ভেতর।

এক ধনী লোকের নগদ পয়সায় কেনা গোলাম ছিলেন তিনি। দেখতেও ছিলেন কুৎসিত এবং কৃষ্ণকায়। কিন্তু এর মধ্যেও তাঁর একটা গুণ ছিল। বানিয়ে বানিয়ে মজার সব গল্প বলার অসাধারণ শক্তি ছিল তাঁর। যখন-তখন অবলীলার গল্প তৈরি করতে পারতেন তিনি। লোকেরা তাঁর গল্প শুনে মুগ্ধ হয়ে যেত। তাঁর বড় বৈশিষ্ট্য ছিল, তাঁর গল্পের চরিত্রদের অধিকাংশই ছিল ইতর প্রাণীবিশেষ। বনজঙ্গলের বাঘ, ভালুক, হরিণ, কুকুর, বিড়াল, পাখি—এরাই ছিল তাঁর গল্পের চরিত্র। এরাই তাঁর গল্পে কথা বলত মানুষের মতো।

তাঁর গল্পের আরও একটি বৈশিষ্ট্য হলো, গল্পের শেষে থাকত সুন্দর একটি উপদেশবাণী, একটি চমৎকার আদর্শের কথা। আসলে গল্প নয়—এই আদর্শের কথাটাকে শোনানোর জন্যই তিনি ওটাকে গল্পের আবরণে সুন্দর করে পরিবেশন করতেন। এখানেই ছিল তাঁর বিশেষত্ব।

সুন্দর সুন্দর গল্পের জন্যই হয়তো তার সময়কার সবাই এই কুৎসিত কেনা গোলামকেও ভালোবাসত, শ্রদ্ধাও করত। ধীরে ধীরে তাঁর সুনাম ছড়িয়ে পড়তে থাকে সারা দেশে। দেশসুদ্ধ লোক ছুটে আসতে থাকে ক্রীতদাস ঈশপের গল্প শোনার জন্য।

অবশেষে তাঁর মনিব তাঁকে দাসত্ব থেকে মুক্তি দেন। শুধু তা-ই নয়, মনিব নিজেই ঈশপকে নিয়ে আসেন গ্রিসের লিডিয়া রাজ্যের রাজা ক্রোসাসের রাজদরবারে। তাঁকে পরিচয় করিয়ে দেয়া হয় রাজার সাথে। ক্রীতদাস ঈশপ ঠাঁই পেলেন তাঁর দরবারের অন্যতম সভাসদ হিসাবে।

এখানে কিছুদিন থাকার পর রাজা ক্রোসাস ঈশপকে ডেলফি নামক স্থানে অ্যাপোলোদেবের মন্দিরে প্রেরণ করেন। শোনা যায়, এখানে থাকার সময়ই নাকি তিনি ডেলফিবাসীদের রাজার বিরুদ্ধে উত্তেজিত করে তোলেন এবং শহরের লোক খেপে ওঠে। কিন্তু পরে তিনিই আবার তাদেরকে সৃষ্ট উত্তেজনা থেকে নিবৃত্ত করেন। ওপরে বর্ণিত গল্পটি বলে তিনি তাদেরকে আবার শান্ত করেন।

ঈশপ ছিলেন একেবারে নিরক্ষর। তিনি যেসব গল্প বলতেন, তার সবই মুখে-মুখেই তৈরি করতেন। তারপর শোনাতেন শ্রোতাদের। এভাবেই প্রচলিত হতে থাকে তাঁর গল্পগুলো। ঈশপের মৃত্যুরও প্রায় দুশো বছর পরে এথেন্সবাসী তাঁর গল্পগুলোকে সংগ্রহ করে প্রথম গ্রথিত করার চেষ্টা চালান। এরপর গ্রিসের বাবরিয়াস নামের এক পণ্ডিতও অনুরূপ একটি গল্পের সংগ্রহ প্রকাশ করেন।

পণ্ডিত বাবরিয়াস যে প্রচেষ্টা চালান, সেটিই ছিল একটি সত্যনিষ্ঠ গবেষণার কাজ। এতে ঈশপের প্রায় সমস্ত গল্পই সংকলিত হয়েছিল। ১৮৪৪ সালে গ্রিসের মাউন্ট অ্যাথোসের একটি গ্রন্থশালা থেকে পণ্ডিত বাবরিয়াসের সংকলিত ঈশপের গল্পের বইয়ের একটি কপি আবিষ্কৃত হয়।

বর্তমানে পৃথিবীর নানা দেশে নানা ভাষায় ঈশপের যে গল্প প্রচলিত রয়েছে, তা এই বাবরিয়াসের গ্রন্থ থেকেই সংগৃহীত। বাংলা ভাষাতেও ঈশপের গল্পের বহু সংকলন প্রকাশিত হয়েছে। তবে বাংলা ভাষায় ঈশপের নামে যেসব গল্প প্রচলিত, তার সবগুলো ঈশপের গল্প নয় বলেও অনেকে অনুমান করেন।

ভারতের সংস্কৃত সাহিত্যেও ঈশপের গল্পের অনুরূপ প্রচুর গল্প আছে। যেমন, দক্ষিণ ভারতের মহিলারৌপ্য রাজ্যের রাজা অমরশক্তির সভাসদ পণ্ডিত বিষ্ণুশর্মা রচিত ‘পঞ্চতন্ত্র’ গ্রন্থের অন্তর্ভুক্ত গল্পগুলোও ঈশপের গল্পের মতোই। তিনি রাজা অমরশক্তির পুত্রদের শিক্ষাদানের জন্য এই গল্পগুলো রচনা করেছিলেন। এগুলোর মধ্যেও রয়েছে অনুরূপ উপদেশমূলক শ্লোক।

এইসব গল্পের চরিত্রগুলোও জঙ্গলের বন্যপ্রাণী। বিষ্ণুশর্মার বেশ কিছু গল্পও ঈশপের গল্প নামে পরিচিত।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *