ধর্ম ও দর্শন
বিজ্ঞান
সাহিত্য
1 of 2

হোমার (আনু. ৭০০-? খ্রি. পূ.) – বিশ্বের শ্রেষ্ঠ দুটি মহাকাব্যের রচয়িতা

হোমার (আনু. ৭০০-? খ্রি. পূ.) – বিশ্বের শ্রেষ্ঠ দুটি মহাকাব্যের রচয়িতা

বিশ্বের সর্বকালের সেরা দুটি গ্রিক মহাকাব্য ইলিয়াড (Illiad) এবং অডিসি (Odyssey)। সেই আদিকাল থেকে অদ্যাবধি যেগুলোর জনপ্রিয়তা এতটুকু ম্লান হয়নি, এ-রকমেরই দুটো কালজয়ী সাহিত্যকর্মের রচিয়তা মহাকবি হোমার ( Homer)।

কিন্তু প্রাচীন এই গ্রিক কবির জীবনবৃত্তান্ত সম্বন্ধে খুব বেশি জানবার উপায় নেই। আর সে কারণেই হয়তো তাঁর সম্পর্কে সৃষ্টি হয়েছে নানারকমের বিভ্রান্তি এবং জটিলতা

জনৈক জার্মান সমালোচক ও দার্শনিকের অভিমত, ইলিয়াড মহাকাব্যটি এককভাবে হয়তো হোমারের রচিত নয়। এটি অসলে একটি জাত মহাকাব্য। প্রাচীন ভারতবর্ষের বৃহত্তম ও শ্রেষ্ঠ মহাকাব্য মহাভারতের মতোই অনেকটা। তিনি মনে করেন, এই সুবৃহৎ ইলিয়াড মহাকাব্যটি হয়তো প্রাচীন গ্রিসের বেশ কয়েকজন গ্রাম্য স্বভাবকবি কর্তৃক রচিত। বিভিন্ন কবির রচিত খণ্ড খণ্ড অংশ একত্রিত করেই সৃষ্টি হয়েছে ইলিয়াডের। এর মধ্যে হোমারের রচিত অংশও আছে।

কথিত আছে, হোমার ছিলেন অন্ধ এবং একজন নিঃস্ব দরিদ্র ভিক্ষুক। কিন্তু তাঁর সবচেয়ে বড় গুণ ছিল, তিনি চমৎকার সুরে গান গাইতে পারতেন।

হোমার ইলিয়াডের পদ্যাংশ অনবদ্য সুরে পথে-পথে গেয়ে বেড়াতেন আর ভিক্ষা করতেন। তাই পরবর্তী সময়ে এই গানগুলো হোমারের নামেই প্রচলিত হয়ে যায় এবং লোকচক্ষুর অন্তরালে হারিয়ে যায় এর সত্যিকারের রচয়িতাদের নাম-পরিচয়।

বিশিষ্ট সাহিত্য সমালোচক স্যামুয়েল বাটলার (১৮৩৫-১৯০২) হোমারের অডিসি সম্পর্কে দিয়েছেন আরও এক চমৎকার তথ্য। তিনি বলেছেন, অডিসি মহাকাব্যটির রচয়িতা আদৌ হোমার নন। এটি যিনি প্রাথমিকভাবে রচনা করেন, তিনি ছিলেন একজন মহিলা। তবে সেই সময়ে হোমার নামে একজন মহাকবি ছিলেন। তিনি সেই কাহিনীকে এর বর্তমান প্রাথমিক রূপ দান করেন।

এখন কথা হলো, যদি এই অনুমানকে সত্য বলে ধরে নিতে হয়, তা হলে বলতে হয়, হোমার নিশ্চয়ই একজন বিশিষ্ট এবং মস্ত বড় গায়ক ও কবি ছিলেন।

এই দুটি মহাকাব্য প্রাচীন গ্রিক ও রোমানদের মধ্যে সেইকালে দারুণ প্রভাব ফেলেছিল। গ্রিসের গোটা শিক্ষা-সংস্কৃতির প্রতীকস্বরূপ ছিল এই ইলিয়াড এবং অডিসি। এই দুটি কাব্য সমগ্র ইউরোপীয় সাহিত্যধারারও মূল সূত্র ছিল, যার শেষ হয়েছিল ভার্জিল এবং দান্তে পর্যন্ত এসে।

মহাকবি হোমার ঠিক কত আগে জীবিত ছিলেন, তারও সঠিক ইতিহাস কারও জানা নেই। তবে ঐতিহাসিক হিরোডোটাস বলেছেন, হোমার এবং হেসিয়ড নামে দুজন কবি অন্তত তাঁদের (হিরোডোটাস) কাল থেকে ৪০০ বছর আগে জীবিত ছিলেন।

হিরোডোটাস বলেছেন, ইতিহাসের যে মহাযুদ্ধ তথা ট্রোজান যুদ্ধের কথা তিনি তাঁর মহাকাব্যে বর্ণনা করেছেন, হোমার হয়তো তাঁর অল্পকাল পর পর্যন্ত জীবিত ছিলেন। তাই হোমারের সঠিক জীবনকাল বের করা খুবই কষ্টসাধ্য।

শুধু জীবনকাল নয়, তাঁর যে সঠিক কোথায় জন্ম হয়েছিল, তাও নিশ্চিত করে বলা যায় না। তবে সাধারণভাবে যে তথ্য প্রচলিত আছে, তা হলো হোমারের জন্ম হয়েছিল এশিয়া মাইনরের পশ্চিম তীরে আইয়োনিয়া নামক স্থানে।

হোমারের সমসাময়িক কিংবা তাঁর কিছু পরেই আরও যেসব কবির আবির্ভাব ঘটেছিল, তাঁরা হলেন : আর্চিলোকুস, আম্যান, টাইরটেউস এবং ক্যালিস। এঁরা ছিলেন খ্রিস্টপূর্ব সপ্তম শতাব্দীর লোক এবং হোমারের সাহিত্যকর্ম দ্বারা বিশেষভাবে প্রভাবিত।

মহাকবি হোমারের জন্মকাল আর জন্মস্থান যেমন অনির্দিষ্ট, তেমনি রহস্যময় তাঁর মৃত্যুকালও। প্রাচীন দার্শনিক হিরাক্লিটাস মহাকবি হোমারের মৃত্যুকাল ও স্থাননির্ণয়ের জন্য বহু দেশ ভ্রমণ করেছেন, কিন্তু কোনো সঠিক তথ্য উদ্ধার করতে পারেননি। তিনি বরং এ বিষয়ে বিচ্ছিন্ন বহু তথ্য সংগ্রহ করতে গিয়ে কবি হোমার এবং কবি হেসিয়ডের মধ্যে জড়িয়ে ফেলে আরও বিভ্রান্তিরই সৃষ্টি করেছেন।

হোমার সম্পর্কে প্রাপ্ত মোটামুটি তথ্য হলো, তিনি ছিলেন মূলত একজন স্বভাবকবি, যিনি মুখে মুখে অনর্গল সমিল পদ্য রচনা করতে পারতেন। বিখ্যাত মার্কিন সমালোচক মিলান পারি (১৯০২–১৯৪৫) বলেছেন, ইলিয়াড ও অডিসি ছিল আসলে মুখে-মুখে রচিত এক বিশেষ ধরনের পদ্য। তখন লেখার কোনো প্রচলন ছিল না। আর হোমার ছিলেন সেকালের একজন শ্রেষ্ঠ গায়ক-কবি। তিনিই স্বরচিত কিংবা অপর কবি কর্তৃক রচিত পদ্যগুলো নিজের সুললিত কণ্ঠে গেয়ে বেড়াতেন।

হোমারের অডিসি মহাকাব্যের সঙ্গে আরও দুজন গায়ক-কবির নাম জড়িত আছে বলে অনুমান করা হয়। এঁরা ছিলেন ইথাকার রাজসভাকবি ফেমিয়ুস এবং অপরজন ফায়াসিয়ান্‌স-এর অধিবাসী ডেমোডেকুস। এঁরাও অডিসিয়াসের জন্য আয়োজিত অনুষ্ঠানে হোমারপ্রবর্তিত পদ্য ছন্দাকারে গেয়েছিলেন। তাঁরা তখন মোট ১০০টি পয়ার গেয়েছিলেন এবং এই গানেই তাঁরা ট্রয়ের ঘোড়ার কাহিনীও সংক্ষেপে বর্ণনা করেছিলেন।

কেবল এই একটি অনুষ্ঠানেই নয়, সেকালে বছরের বিভিন্ন সময়ে নানা ধরনের ধর্মীয় ও সামাজিক অনুষ্ঠানে কিংবা হাটবাজারের বিভিন্ন জায়গায় গানের আসর বসানোর রেওয়াজ ছিল। এসব আসরে দেশের বড় বড় গাইয়ে নিজেদের বাঁধা গান গেয়ে শ্রোতাদের মনোরঞ্জন করতেন। শ্রোতারা গান শুনে তাঁদের পয়সা দিতেন।

গায়করা সেকালে বড় বড় যুদ্ধবিগ্রহ, রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডকে কেন্দ্র করে এই বীরত্বব্যঞ্জক পালাগান তৈরি করতেন। তাঁরা গানগুলো এভাবে তৈরি করতেন, যাতে সেগুলো এক আসরে গেয়ে শেষ করা যায়।

হোমার নিজেও ছিলেন এমনি একজন নামজাদা অন্ধ গায়ক, যাঁর গলার সুর, পদ্যরচনার দক্ষতা ছিল অভূতপূর্ব এবং যাঁর খ্যাতি ছিল শীর্ষচূড়। ফলে তাঁর ভক্ত- অনুরাগীর সংখ্যা ছিল প্রচুর।

ইলিয়াডের কাহিনীগুলোর মূল উৎস ছিল থিবসের বিরুদ্ধে প্যানহেলেনিকদের সাতবার অভিযান পরিচালনার রোমাঞ্চকর কাহিনী এবং আর্গোনাটুস এবং এজিয়ানদের ট্রয় নগরী আক্রমণের বীরত্বব্যঞ্জক গল্প। এগুলোই হোমার খণ্ড খণ্ড আকারে পদ্যে রূপ দিয়ে গাইতেন।

সে সময়, অর্থাৎ এগুলোর জন্মলগ্নে, কোনো লিখিত রূপ ছিল না। তাই প্রথম রচনার পর পরবর্তী গায়কের হাতে এসে এগুলোর নানারকমের পরিবর্তন হয়েছে। এক এক গায়ক তাঁর নিজের মনের মতো করে ঢেলে সাজিয়ে নিতেন গাওয়ার সময়। যোগ করতেন নানা চরিত্র এবং উপকাহিনী। এমনি করেই কাহিনীর মধ্যে প্রবেশ ঘটেছে স্বর্গের দেবতাদের। তাঁরাও মানুষের পাশাপাশি দাঁড়িয়ে যুদ্ধ করেছেন। সাথী হয়েছেন মানুষের সুখ-দুঃখের।

ইলিয়াডের জন্মলগ্নে শ্লোকের সংখ্যা ছিলো ১৬,০০০টি। এই পালাগানগুলো হোমারের রচনা করার আগের থেকেই প্রচলিত ছিল। তবে এ-জাতীয় কবিদের মধ্যে হোমার ছিলেন সর্বশ্রেষ্ঠ এবং সর্বাধিক জনপ্রিয়। অনেকে বলেন, পূর্বে প্রচলিত এই এলোমোলো গানগুলোকে তিনিই প্রথম পরিচ্ছন্ন ভাষায় রূপদান করে সুবিন্যস্ত করেন। আর সেজন্যই এই গানগুলো পরবর্তী সময়ে হোমারের রচনা বলেই প্রচারিত হতে থাকে। আজও আমরা এ-কথাই জানি।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *