ধর্ম ও দর্শন
বিজ্ঞান
সাহিত্য
1 of 2

আলবার্ট আইনস্টাইন (১৮৭৯–১৯৫৫) – আপেক্ষিক তত্ত্বের জনক

আলবার্ট আইনস্টাইন (১৮৭৯–১৯৫৫) – আপেক্ষিক তত্ত্বের জনক

যে মহাজ্ঞানী আইনস্টাইনের নাম আজ সারা বিশ্বে শ্রদ্ধার সঙ্গে সর্বত্র উচ্চারিত, যাঁকে এক নজর দেখা এবং যাঁর কথা শোনার জন্য সেকালেও সারা পৃথিবীর মানুষ অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করতেন, সেই মানুষটির ছোটবেলায় ঘটেছিল একটা মজার ব্যাপার। সেই তখন তাঁর প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষক তাঁকে দেখে বলেছিলেন, ছেলেটি একটা আস্ত বোকা। ওকে দিয়ে কিচ্ছু হবে না।

বালক আইনস্টাইন সম্পর্কে শিক্ষকদের এ-রকমটা বলার কিছু কারণও ছিল। কেননা, ওই বয়সে তিনি ক্লাসে কোনো প্রশ্নেরই ঝটপট জবাব দিতে পারতেন না। ভেবে বলতে হতো সবকিছু। আর ভাবতে গিয়েই বেধে যেত যত গোলমাল। শিক্ষকদের কাছে মনে হতো ছেলেটি বোকা।

বিজ্ঞানী আইনস্টাইনের জন্ম ১৮৭৯ সালের ১৪ মার্চ জার্মানির মিউনিখ শহর থেকে ১৩৪ কিলোমিটার দূরে উম্ শহরে এক ইহুদি পরিবারে। কিন্তু তাঁর যখন মাত্র এক বছর বয়স, তাঁর বাবা-মা তখন উলম্ ছেড়ে মিউনিখে চলে যান। সেখানে এসেই তিনি ভর্তি হন শহরের উপকণ্ঠের এক প্রাইমারি স্কুলে।

শিক্ষকরা বোকা বললেও আইনস্টাইনকে নিয়ে তাঁর মায়ের বড় আশা ছিল। মা বলতেন, তোমরা দেখে নিও, ও বড় হয়ে অধ্যাপক হবে। শুনে সবাই হাসতেন।

দশ বছর বয়সে আইনস্টাইনকে ভর্তি করা হলো লুইটবোল্ড জিমনাসিয়াম স্কুলে। এখানে পড়ার সময়ও তিনি তেমন কোনো চমক সৃষ্টি করতে পারেননি।

এই সময় তাঁদের পরিবারে নেমে আসে একটা বিপর্যয়। পারিবারিক ব্যবসা হঠাৎ করেই মার খেল। ফলে গোটা পরিবারটির প্রায় পথে বসার উপক্রম হলো।

এই অবস্থার মুখে আইনস্টাইনের বাবা সিদ্ধান্ত নিলেন তাঁদের মিউনিখের বাড়ি বিক্রি করে দিয়ে চলে যাবেন ইতালির মিলান শহরে। ছেলেকে তিনি হোস্টেলে থাকার ব্যবস্থা করে দিলেন। কেননা, তার শেষবর্ষের পরীক্ষা সামনেই। স্কুল বদল করলে তার পড়াশোনার ক্ষতি হতে পারে ভেবে, তারা তাকে মিউনিখে রেখেই চলে যান ইতালিতে। কিন্তু আইনস্টাইন পরিবারের আপনজনদের ছেড়ে বেশিদিন একা একা থাকতে পারলেন না। ফলে স্কুলের কাউকে কিছু না বলেই চলে এলেন বাবা-মার কাছে।

মিলানে এসেই কিন্তু নতুন স্কুলে ভর্তি হওয়ার সুযোগ পেলেন না তিনি। এ ছাড়া বাবা তাঁকে এক বছর বিশ্রাম নিয়ে আবার স্কুলের পড়াশোনা নতুন করে শুরু করার কথা বললেন। বালক আইনস্টাইনের জন্য এ ছিল এক মজার ব্যাপার। পাক্কা একটা বছর পড়াশোনা নেই। ফলে প্রচুর ঘুরে বেড়ানো যাবে। কী মজাটাই-না হবে!

এদিকে আইনস্টাইনের বাবার ব্যবসা আবার লোকসানের মুখে পড়ল। ফলে মিলানেও থাকা সম্ভব হলো না তাদের। এমনকি আইনস্টাইনের পড়াশোনার খরচ চালানোও অসাধ্য হয়ে পড়ল।

শেষে এক দূর-সম্পর্কের মামার অর্থ সাহায্যে তাঁরা তখন চলে এলেন ইতালিরই আরেকটি ছোট্ট শহর প্যাভিয়াতে। বছরখানেক পর তিনি ভর্তি হন জুরিখের পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটে। এখানকার সবগুলো পরীক্ষাতেই ভালো ফলাফল করে কৃতিত্বের সঙ্গে শেষ করেন তিনি তাঁর শিকক্ষা-জীবন।

কিন্তু পাস করে বের হবার পর চরম হতাশার শিকার হন তিনি। পেয়ে বসল গভীর ভাবনায়, এবার কী করবেন? কে দেবে তাঁকে চাকরি? ঘুরতে লাগলেন পথে-পথে একবার একটা টেকনিক্যাল স্কুলে শিক্ষকতার চাকরি জুটিয়েও বেশিদিন সেখানে থাকা সম্ভব হলো না তাঁর পক্ষে। অবশেষে এক বন্ধুর সুপারিশে বার্নের পেটেন্ট অফিসে সামান্য বেতনে কেরানির চাকরিতে ঢুকে পরলেন।

তারপর হুট করেই তাঁর কলেজ-জীবনের সহপাঠিনী সিলেভা ম্যারিচের সঙ্গে বেঁধে ফেললেন ঘর। ছোট্ট একটি সংসার। এই সামান্য বেতনের চাকরিটা ভালই লাগছিল আইনস্টাইনের। এখানে তাঁকে বড় বড় ইঞ্জিনিয়ারদের সাথে কাজ করতে হয়। ভালই লাগে। আর অবসর সময়ে চলে তাঁর গবেষণা, আপেক্ষিক মতবাদের ওপর নানা চিন্তাভাবনা আর পরীক্ষানিরীক্ষার কাজ।

এরই মধ্যে তিনি গবেষণালব্ধ ফলাফলের ওপর ভিত্তি করে লিখে ফেললেন একটি বিজ্ঞানবিষয়ক নিবন্ধ। অনেক খেটেখুটে তৈরি করা নিবন্ধটি তিনি পাঠিয়ে দিন জার্মানির লিপজিগ শহর থেকে প্রকাশিত ‘অ্যানালোগ ফর ফিজিক’ (Analogue for Physic) পত্রিকায়। মাস কয়েক পর লেখাটি ছাপাও হলো। নিবন্ধ প্রকাশের এই ঘটনাই জীবনের মোড় আমূল ঘুড়িয়ে দেয় আইনস্টাইনের। সেটা ছিল ১৯০৫ সাল। নিবন্ধটি বিজ্ঞানীমহলে দারুণ আলোড়ন সৃষ্টি করল। বার্লিন, প্যারিস এবং লন্ডনের বিজ্ঞানীরা অবাক বিস্ময়ে লক্ষ্য করলেন, এই মতবাদ যে সম্পূর্ণ মৌলিক! কে এই আইনস্টাইন? চারদিকে শুরু হলো তোলপাড়।

আইনস্টাইনের আপেক্ষিক মতবাদ পড়ে বার্লিন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. ফন লাউ নিজেই ছুটে এলেন তাঁর সঙ্গে আলোচনা করতে। এর কিছুদিন পরেই অস্ট্রিয়ার সালবার্গে অনুষ্ঠেয় বিজ্ঞান সম্মেলনে যোগদানের আমন্ত্রণপত্র পেলেন তিনি। এটাই ছিল বিজ্ঞানী হিসেবে আইনস্টাইনের প্রথম স্বীকৃতি।

এরপর তিনি জুরিখ বিশ্ববিদ্যালয়ে পদার্থবিজ্ঞানের পার্টটাইম প্রফেসর হিসেবে যোগদান করেন। পরে লাভ করেন এখানে সহকারী অধ্যাপকের পদ। তখনও আইনস্টাইনের বয়স কুড়ি পার হয়নি। নিজের মেধা ও মননের স্বীকৃতি পেয়ে তিনি তো মহাখুশি। যাক, এবার থেকে তাহলে তিনি গবেষণার কাজে পুরোপুরি আত্মনিয়োগ করার সুযোগ পাবেন।

কিছুদিন যেতে-না-যেতেই একই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এল তাঁর পুরোপুরি অধ্যাপকের পদে যোগদানের আমন্ত্রণ। প্রাগ বিশ্ববিদ্যালয় ছিল ইউরোপের সবচেয়ে পুরনো বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি। কিন্তু এখানে বেশি দিন চাকুরি করা সম্ভব হয়নি তাঁর পক্ষে। আবার তিনি জুরিখে ফিরে যোগ দিলেন পুরনো প্রতিষ্ঠান ফেডারেল পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটে।

এবার আমন্ত্রণ এল বার্লিনের প্রুশিয়ান অ্যাকাডেমি অব সয়েন্সের সদস্যপদ লাভের। এ আমন্ত্রণ অনেক সম্মানের। আর সেখানে গেলে তিনি তাঁর গবেষণার কাজটিও করতে পারবেন একাগ্রমনে। তিনি আমন্ত্রণ গ্রহণ করলেন। কিন্তু তাঁর স্ত্রী মিলেভা কিছুতেই জুরিখ ছেড়ে যেতে চাইছিলেন না। আইনস্টাইন স্ত্রী আর ছেলেদের সেখানে রেখেই চলে এলেন বার্লিনে। এই ঘটনাকে কেন্দ্র করেই মিলেভার সাথে আইনস্টাইনের শেষপর্যন্ত ছাড়াছাড়ি হয়ে যায়।

এরপর থেকে আপনভোলা বিজ্ঞানী আইনস্টাইনকে দেখাশোনা করার দায়িত্ব নিলেন তাঁরই এক বিধবা কাকাতো বোন এলসা। ক্রমে এলসার সাথে তাঁর হৃদয়ের সম্পর্ক গড়ে ওঠে এবং প্রথম স্ত্রী মিলেভাকে তালাক দিয়ে এলসাকে বিয়ে করেন ১৯১৯ সালে।

বিজ্ঞানী আইনস্টাইন ছিলেন একেবারেই আত্মভোলা, বেখেয়ালি ধরনের মানুষ। একবার এক সম্মেলন উপলক্ষ্যে এলসা স্বামীকে এক সেট নতুন পোশাক দেন, যাতে তা পরে তিনি সম্মেলনে বক্তৃতা দিতে যান। কিন্তু সম্মেলন শেষে স্বামীর ফিরে আসার পর, এলসা দেখলেন, যেমনকার নতুন পোশাক তেমনি পড়ে আছে। ঘটনা দেখে লজ্জিত আইনস্টাইন হেসে বললেন, তোমার দেওয়া পোশাকটার কথা আমার মনেই ছিল না, দুঃখিত! আর আসল কথা কী জানো? ওঁরা তো আমার পোশাক দেখতে আসেননি, এসেছিলেন আমার বক্তৃতা শুনতে। এ-রকমই আত্মভোলা আর কৌতুকপ্রবণ ছিলেন তিনি।

এদিকে জার্মানিতে ক্রমেই ইহুদিবিদ্বেষ প্রবল আকার ধারণ করতে থাকে। তাই তাঁকেও এর শিকার হতে হল। নাৎসিবাদীরা বিজ্ঞানী আইনস্টাইনের আপেক্ষিক মতবাদকে ইহুদিবিজ্ঞান বলে অপ প্রচার শুরু করলেন। এতে করে তিনি ভয়ানক মর্মাহত হলেন।

১৯২১ সালে তিনি প্রথমবারের মতো যান আমেরিকা সফরে। আমেরিকাবাসীরা তাঁকে প্রায় রাজকীয় সংবর্ধনা দান করে। পরের বছর অর্থাৎ ১৯২২ সালে তিনি এলসাকে নিয়ে বের হন মধ্যপ্রাচ্য সফরে। এই সফরে বেরিয়েই তিনি শুনতে পান একটি চাঞ্চল্যকর খবর। সুইস অ্যাকাডেমি অব সায়েন্স তাঁকে নোবেল পুরস্কারে ভূষিত করেছে।

১৯২৯ সালে তিনি আবিষ্কার করেন আরও একটি যুগান্তকারী বৈজ্ঞানিক সূত্রে ভর শক্তি সমীকরণ E = mc2। এখানে E = শক্তি, m = ভর ও c = আলোর গতিবেগ।

বছর কয়েক তিনি ভিজিটিং প্রফেসর হিসেবে আমেরিকায় বসবাস করেন। সেখানে থাকতেই তিনি একবার নিউ ইয়র্কের রিভারসাইড গির্জা দেখতে যান। সেখানে পাদরি তাঁকে সমস্ত গির্জা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখানো শেষে বলেন, এখানে ইতিহাসের বিখ্যাত ছয়জন মনীষীর প্রতিকৃতি অঙ্কিত আছে। তাঁদের মধ্যে মাত্র একজন জীবিত এবং সে হলেন আপনি।

১৯৩৩ সালে হিটলার জার্মানির রাষ্ট্রনায়ক হন। তিনি ক্যালিফোর্নিয়ায় বসে এই খবর পেয়েই তিনি স্থির করে ফেলেন, জার্মানির সাথে তাঁকে সব ধরনের সম্পর্ক ছিন্ন করতে হবে। এই সময় জার্মানিতে চলছিল ইহুদিদের ওপর অকথ্য-অমানবিক নির্যাতনের পড় নির্যাতন। অহরহ তিনি পাচ্ছিলেন এসব খবর। আইন স্টাইন তাই এর একটা সুরাহা করার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললেন। কালবিলম্ব না করে তিনি রওয়ানা হলেন বেলিজিয়ামের উদ্দেশ্যে। যাওয়ার পথেই তিনি খবর পেলেন, জার্মানিতে তাঁর যাবতীয় সম্পত্তি হিটলারের নাৎসি সরকার বাজেয়াপ্ত করেছে। এই ঘটনার প্রতিবাদস্বরূপ তিনি তাঁর অ্যাকাডেমির চাকরি ছেড়ে দিলেন। কারণ তিনি জানতেন, তাঁর আর জার্মানিতে যাওয়া হবে না।

চাকুরিতে ইস্তফা দেয়ার এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে জার্মানিতে তাঁর বিরুদ্ধে চলতে লাগল আরও জোর অপপ্রচার। কোনো কোনো পত্রিকা তাঁর ফাঁসির জন্য পর্যন্ত সুপারিশ করতে লাগল।

বেলজিয়ামে আইনস্টাইনের আগমনের সংবাদ পেয়ে দেশটির রাজা ও রানি তো মহাখুশি। তাই তাঁরা এই মহান অতিথিকে রাজপ্রাসাদে অনুষ্ঠানিক নিমন্ত্রণ পাঠালেন আইনস্টাইন রাজ-দম্পতির দাওয়াত রক্ষা করার জন্য একলাই পায়ে হেঁটে রওনা দিলেন। অন্য দিকে রানি তাঁকে প্রাসাদে আনার জন্য পাঠিয়েছেন গাড়ি। কিন্তু রাজকর্মচারীরা গিয়ে খবর দিলেন আইনস্টাইন বাসায় নেই। এর কিছুক্ষণ পরেই আইনস্টাইন রাজপ্রাসাদে এসে হাজির। রানি বিস্ময় প্রকাশ করলে তিনি বললেন, ‘এটুকুই তো পথ, হেঁটেই চলে এসেছি।” আদর অভ্যর্থনা ও আন্তরিক আলাপ আলোচনা শেষে বেলজিয়ামের রানি তাঁকে সাদরে রাজনৈতিক আশ্রয় দিতেও সম্মত হন। কিন্তু জার্মানির নিকটবর্তী কোনো দেশে থাকা তাঁর জন্য নিরাপদ নয় ভেবে তিনি ঠিক করলেন, যুক্তরাষ্ট্রেই ফিরে যাবেন। ·

তারপর তা-ই হল। তিনি নিউজার্সির প্রিন্সটন শহরে ইনস্টিটিউট ফর অ্যাডভান্স স্টাডিতে যোগ দেন। এখানে আসার পর স্ত্রী এলসার মৃত্যু হয় ১৯৩৬ সালে।

এই ঘটনার পর থেকে আইনস্টাইন বিষণ্ন হয়ে পড়েন। তারপরও বাদবাকি জীবন তিনি এই প্রিন্সটনেই কাটান। এখানেই এই মহান বিজ্ঞানীর মৃত্যু হয়।

বৈচিত্র্যে ভরপুর ছিল এই মহান বিজ্ঞানীর জীবন। তাঁর জীবনীকাররা বলেছেন, বিজ্ঞানী হিসেবে তিনি যতখানি শ্রদ্ধার অধিকারী ছিলেন, ব্যক্তিক বা পারিবারিক জীবনে ছিলেন একেবারেই মন্দ-চরিত্র বৈেিষ্ট্যর ধারক। কিন্তু সে আরেক অধ্যায়। সব কিছু ছাপিয়ে তাঁর যে যুগান্তর সৃষ্টিকারী বৈজ্ঞানিক অবদান, আমাদের কাছে সেটাই তাঁর আসল পরিচয়, আইনস্টাইন যাঁর নাম। ১৯৫৫ সালের ১৮ এপ্রিল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *