ধর্ম ও দর্শন
বিজ্ঞান
সাহিত্য
1 of 2

জগদীশচন্দ্র বসু (১৮৫৯–১৯৩৭) – যিনি বলেছিলেন গাছেরও প্রাণ আছে

জগদীশচন্দ্র বসু (১৮৫৯–১৯৩৭) – যিনি বলেছিলেন গাছেরও প্রাণ আছে

আজ থেকে প্রায় শতবর্ষ আগের অর্থাৎ ১৮৯৫ সালের ঘটনা। নেহায়েত তরুণ এক বিজ্ঞানী প্রদশন করলেন এক ভৌতিক কাণ্ড। সেই বিচিত্র কাণ্ড দেখার জন্য সেদিন প্রদর্শনস্থলটি ছিল লোকে লোকারণ্য।

তরুণ বিজ্ঞানী তাঁর সামনে বিচিত্র সব যন্ত্রপাতি নিয়ে ডায়াসে দাঁড়িয়ে বক্তৃতা দিচ্ছেন। আর বক্তৃতা দিতে দিতেই ঘটিয়ে বসলেন তিনি সেই আশ্চর্য কাণ্ডটি।

একটি পিস্তলের গুলির আওয়াজ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই সেখান থেকে পুরো পঁচাত্তর ফুট দূরে তালাবদ্ধ ঘরে রাখা একটি বারুদের স্তূপে ঘটে গেল বিস্ফোরণ। পিস্তলের সেই গুলির আওয়াজের সাথে বদ্ধ ঘরের বারুদস্তূপের কোনোই যোগাযোগ ছিল না। তা হলে ব্যাপারটা ঘটল কেমন করে? উপস্থিত সকলের তো দু’চোখ ছানাবড়া। তাদের বিস্ময়ের সীমা নেই।

কিন্তু খানিক বাদেই সেই তরুণ বিজ্ঞানী নিজেই বুঝিয়ে দিলেন আসল ব্যাপারখানা কী!

বক্তৃতা মঞ্চে দাঁড়ানো তাঁর সামনে যে যন্ত্রটি রয়েছে, তার ভেতর থেকে বিদ্যুৎ তরঙ্গ ছড়িয়ে পড়েই ঘটিয়েছে এই কাণ্ড। আর এই অদ্ভুত ব্যাপার স্যাপারের মধ্যেই লুকিয়ে ছিল মস্তবড় একটি বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারের মূল—বিনা তারে বার্তা প্রেরণের সূত্র।

এই তত্ত্বের উদ্ভাবক বিজ্ঞানীই বাংলার গৌরব এবং শ্রেষ্ঠ বাঙালি বিজ্ঞানী স্যার জগদীশচন্দ্র বসু। তিনিই সর্বপ্রথম বিনাতারে সংকেত আদান-প্রদানের বৈজ্ঞানিক কৌশল উদ্ভাবন করেন। আর এর সাহায্যে তিনিই প্রথম দেড় কিলোমিটার দূর পর্যন্ত বিনা তারে বার্তা প্রেরণে সক্ষম হন।

কিন্তু ভারতীয়দের প্রতি তৎকলীন ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক সরকারের বৈষম্য মূলক আচরণের কারণে ও আর্থিক সাহায্যের অভাবে জগদীশ বসু তাঁর এই আবিষ্কারকে যথাসময়ে সহজে বিশ্বজনসমক্ষে তুলে ধরতে সক্ষম হননি। অথচ অন্যদিকে ইতালির বিজ্ঞানী মার্কনি সাড়ে তিন কিলোমিটার দূরে বিনা তারে বার্তা প্রেরণে সক্ষম হন। আর তাঁর কল্যানেই তিনি বেতারবার্তা আবিষ্কারের বিজয়মুকুট ছিনিয়ে নেন।

বাংলার এই কৃতীসন্তান ও বিজ্ঞানী জগদীশচন্দ্র বসুর জন্ম পিতার কর্মস্থল ময়মনসিংহের ১৮৫৯ সালের ৩০ নভেম্বর। পিতা ভগবানচন্দ্র বসু ছিলেন উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মচারি-ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট।

পিতার কর্মস্থল ফরিদপুরেই প্রাথমিক শিক্ষাজীবন শুরু হল জগদীশের। গ্রামের পড়া শেষ হলে কলকাতা এসে ভর্তি হন সেন্ট জেভিয়ার্স স্কুলে। তারপর কৃতিত্বের সাথে এন্ট্রান্স পাস করে ভর্তি হন সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজে। তখন থেকেই ১৮৭৮ সালে এফ এ. এবং ১৮৮০ সালে বিজ্ঞান শাখায় বি. এ. পাস করেন।

তাঁর ইচ্ছা ছিল, তিনিও পিতার মতো সিভিল সার্ভিস পরীক্ষা দিয়ে বড় সরকারি চাকুর হবেন। কিন্তু পিতা তাঁকে চাকরিতে ঢুকতে দিলেন না। বিজ্ঞানে উচ্চশিক্ষা লাভের জন্য পাঠালেন বিলেতে। পিতার ইচ্ছে জগদীশ মস্ত বড় ডাক্তার হোক। কিন্তু তাঁর সেই ডাক্তারি পড়াও হলো না। অথচ চিকিৎশাস্ত্র অধ্যয়ন করার জন্যই লন্ডনে যাওয়া। সেখানকার মেডিক্যাল ইনস্টিটিউটে ভর্তিও হয়েছিলেন। পড়েওছিলেন একবছর। কিন্তু ম্যালেরিয়ায় স্বাস্থ্যভঙ্গের কারণে ডাক্তারি পড়া ছেড়ে দেন। এরপর তিনি ১৮৮১ সালে কেমব্রিজে ভর্তি হন বিজ্ঞান বিভাগে। পদার্থবিদ্যা, রসায়নশাস্ত্র এবং উদ্ভিদবিদ্যার প্রতি তাঁর ঝোঁক ছিল খুবই প্রবল। চার বছর পড়াশোনা করে জগদীশ বসু কেমব্রিজ থেকে বিজ্ঞানে ট্রাইপস লাভ করেন। তিনি লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয় থেকেও লাভ করেন বি. এস- সি. ডিগ্রি।

অধ্যয়ন শেষে স্বদেশে ফিরে এসে জগদীশের শুরু হয় বিরামবিহীন কর্মজীবন। ১৮৮৫ সালে কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজে বিজ্ঞানের অধ্যাপক হিসেবে যোগ দেন। কিন্তু এসময় প্রেসিডেন্সি কলেজে ভারতীয় ও ইংরেজ শিক্ষকদের মধ্যে বেতন-ভাতাদির ব্যাপারে প্রায় আকাশ-পাতাল বৈষম্য ছিল। যেমন, একই পদে একজন ইংরেজ যে বেতন পেতেন, একজন ভারতীয় অধ্যাপক তার তুলনায় পেতেন অনেক কম বেতন।

এই বৈষম্য জগদীশ খুবই পীড়িত করে। তিনি এর প্রতিবাদে সোচ্চার হন। কিন্তু তাতে ফল হলো না। ফলে তিনি শুরু করলেন এক অভিনব সত্যাগ্রহ। এই বৈষম্যের প্রতিবাদে কলেজ থেকে বেতন নেয়া বন্ধ করে দিলেন। এইভাবে দীর্ঘ তিন বছর সংগ্রাম করার পর ইংরেজ কর্তৃপক্ষ এই তেজস্বী তরুণ অধ্যাপকের কর্তব্যনিষ্ঠার কাছে নতি স্বীকারে বাধ্য হন। তিনি একসাথে তিন বছরের পুরো বেতন লাভ করেন ইংরেজ অধ্যাপকদের সমান হারে।

অধ্যাপনার পাশাপাশি তিনি গবেষণার কাজও চালিয়ে যেতে থাকেন। কিন্তু এই গবেষণার জন্য তিনি এক কপর্দকও সরকারি সাহায্য পাননি। প্রেসিডেন্সি কলেজেও তেমন উন্নত ধরনের কোনো বৈজ্ঞানিক যন্ত্রপাতি ছিল না, ছিল না কোনো গবেষণাগার পর্যন্ত। তবুও এর মধ্যেই তাঁর গবেষণার কাজ চলতে থাকে। ১৮৯৪-৯৫ সালে তাঁর বিদ্যুৎ বিষয়ক মৌলিক গবেষণার বিবরণ বিলেতের রয়্যাল সোসাইটির জার্নালে প্রকাশিত হয়।

জগদীশ বসুর বিজ্ঞান গবেষণার বিষয়বস্তু কয়েকটি পর্যায়ে বিভক্ত। প্রথম পর্যায় পদার্থবিদ্যা বিষয়ক। এই সময়ই তিনি বিনা তারে বার্তা প্রেরণের যন্ত্র আবিষ্কার করেন, যদিও এই কৃতিত্ব তাঁর ভাগ্যে জোটেনি।

১৮৯৬ সালে তিনি বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ও সম্মেলনে বক্তৃতা করার জন্য ইউরোপ গমন করেন। তিনি সেখানকার অনেক বড় বড় বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপকের পদ গ্রহণ করার আমন্ত্রণও লাভ করেন। কিন্তু দেশের মাটি ছেড়ে বিদেশে থাকতে তাঁর মন সায় দেয়নি। তাই তিনি সেসব লোভনীয় আমন্ত্রণ প্রতাখ্যান করেন। ফলে দেশে ফিরে আসেন ১৮৯৭ সালে।

দেশে ফিরে এসেই জগদীশ বসু তাঁর গবেষণারও দিক পরিবর্তন করেন। তিনি পদার্থবিজ্ঞান ছেড়ে মনোনিবেশ করেন উদ্ভিদবিজ্ঞানের প্রতি। এটা ছিল তাঁর বিজ্ঞান গবেষণার দ্বিতীয় পৰ্যায়।

তখন থেকেই তাঁর মনন-ক্ষমতা তীক্ষ্ণ এবং কল্পনাদৃষ্টি অন্তর্ভেদী হয়ে উঠতে শুরু করে। তিনি গবেষণাগত পর্যবেক্ষণের ভেতর দিয়ে এই প্রমাণ পান যে, সাড়া দেবার ক্ষমতা কেবল জীবের মধ্যেই আছে, আর কারও নেই, সেটা সত্যি নয়। তিনিই প্রথম অনুভব করেন, জীবের মতোই তথাকথিত জড়বস্তুও সাড়া দেয় এবং উদ্ভিদজীবনে এর ক্রিয়া অধিকতর পরিস্ফুট।

তিনি নিজের তৈরি যন্ত্রের সাহয্যে দেখালেন, আঘাতপ্রাপ্ত কিংবা উত্তেজিত জড়বস্তু, উদ্ভিদ এবং প্রাণীর স্পন্দনলিপি অবিকল একই রকমের। এর থেকে কী প্রমাণিত হয়? প্রামাণিত হয় যে, পৃথিবীর যাবতীয় প্রাণী, বৃক্ষলতা এবং চেতনাশূন্য পদার্থসমূহ পরস্পর বিচ্ছিন্ন ও আলাদা হলেও তারা এক অদৃশ্য বন্ধনে আবদ্ধ এবং একই নিয়মে পরিচালিত। বিশেষ করে বৃক্ষজীবন ও মানবজীবনের ওপর শক্তির ক্রিয়ার কোনো পার্থক্য নেই। এদের সকলের স্পন্দনলিপি একই।

তিনি নিজের আবিষ্কৃত যে যন্ত্রটির সাহায্যে উদ্ভিদের চেতনাশক্তি ধরতে সক্ষম হন তার নাম Resonant Recorder। এই যন্ত্রের সাহায্যেই বৃক্ষের বিবিধ স্পন্দন লিপিবদ্ধ করা হয় এবং উদ্ভিদটির বৃদ্ধির পরিমাণও মুহূর্তে নির্ণয় করা যায়। এতে উদ্ভিদের বৃদ্ধিকে কোটিগুণ বাড়িয়ে লিপিবদ্ধ করা হয়।

জগদীশচন্দ্র বসু যেসব উদ্ভিদ নিয়ে গবেষণা করেছিলেন সেগুলো হলো-

ক. Root — Carrot, Radish.

খ. Stem – Geranium, Vine.

গ. Leaf stalk – Horse Chestnut, turnip.

Cauli-flower, Celery, Eucharis lily.

ঘ. Flower stalk-Arum lily.

ঙ. Fruit – Egg-plant.

জগদীশচন্দ্র তাঁর এই অত্যাশ্চর্য যন্ত্র সম্পর্কে বক্তৃতাদানের জন্যই আরও তিনবার যথাক্রমে ১৯০৭, ১৯১৪ এবং ১৯২৮ সালে বিদেশ ভ্রমণ করেন।

তিনি চাকরি থেকে অবসর নেন ১৯১৫ সালে। এর দু বছর পর অর্থাৎ ১৯১৭ সালে তিনি তাঁর ৫৯তম জন্মদিবসে সারা জীবনের সঞ্চিত অর্থ দিয়ে কোলকাতায় প্রতিষ্ঠা করেন একটি বৈজ্ঞানিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান। এটাই আজকের ‘বসু বিজ্ঞান মন্দির”।

১৯২০ সালে তিনি ইংল্যান্ডের রয়্যাল সোসাইটির ফেলো নির্বাচিত হন। ১৯২৭ সালে নির্বাচিত হন ভারতীয় বিজ্ঞান কংগ্রেসের সভাপতি। ১৯২৮ সালে ভিয়েনার অ্যাকাডেমি অব সায়েন্স-এর বৈদেশিক সদস্য নির্বাচিত হন।

১৯৩৫ সালে তাঁকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যলয় থেকে ডি. এস-সি. (D. Sc.) ডিগ্রি প্রদান

করা হয়।

তাঁর এই অত্যাশ্চর্য আবিষ্কার দেখে বিজ্ঞানী আইনস্টাইন সশ্রদ্ধচিত্তে বলেছিলেন, “জগদীশচন্দ্রের প্রত্যেকটি আবিষ্কার বিজ্ঞানজগতে এক-একটি বিজয়স্তম্ভ।” মনীষী রম্যা রলার ভাষায়, “জগদীশচন্দ্র হলেন Revealer of a New World।” আর আমাদের বাংলা ভাষার কবি বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ এই বিজ্ঞানতাপসকে শ্রদ্ধা জানাতে গিয়ে বলছিলেন, “ভারতের কোন বৃদ্ধ-ঋষির তরুণ মূর্তি তুমি।”

জগদীশচন্দ্র শুধু যে একজন বিজ্ঞানী ছিলেন, তা-ই নয়, একান্ত সংগোপনে তাঁর মধ্যে লুকিয়ে ছিল একটি সুন্দর কবিমন, একটি লেখকসত্তাও। তাঁর বিজ্ঞান বিষয়ক বাংলা ভাষায় রচিত গ্রন্থ ‘অব্যক্ত’ বাংলা সাহিত্যেরও একটি বিশিষ্ট সংযোজন।

উল্লেখ্য, বিজ্ঞানী জগদীশ চন্দ্র বসুর সহধর্মিনী লেডি অবলা বসু (১৮৬৫-১৯৫১) এ-দেশের নারী জাগরণের অন্যতম অগ্রদূতী ছিলেন। ১৯১৯ খ্রিস্টাব্দে তাঁরই একান্ত উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত হয় নারী শিক্ষা সমিতি। মৃত্যুর আগের দিন পর্যন্ত তিনি কলকাতার ব্রাহ্ম বালিকা শিক্ষালয়ের সম্পাদিকার দায়িত্ব পালন করে যান।

এই মহান তাপস জগদীশচন্দ্রের মৃত্যু হয় ১৯৩৭ সালে ২৩ নভেম্বর পশ্চিমবঙ্গের ছোটনাগপুরের গিরিডিতে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *