ধর্ম ও দর্শন
বিজ্ঞান
সাহিত্য
1 of 2

চার্লস ডারউইন (১৮০৯-১৮৮২) – প্রাণিজগতের বিবর্তনবাদের ব্যাখ্যাদাতা

চার্লস ডারউইন (১৮০৯-১৮৮২) – প্রাণিজগতের বিবর্তনবাদের ব্যাখ্যাদাতা

অনাদিকালের জটিল প্রশান-নীল আকাশের নিচে এই পৃথিবী। সেই পৃথিবী জুড়ে বিশাল প্রাণি বা জীবজগৎ। কিন্তু এরা এলো কোথা থেকে? মানুষ এই প্রশ্নের উত্তর পেতে চেষ্টা করেছে যুগ-যুগান্তর ধরে। কিন্তু পায়নি। এই প্রশ্নেরই উত্তর দিতে এগিয়ে আসেন চার্লস রবার্ট ডারউইন (Charles Robert Darwin)। আজ থেকে দেড়-দুশো বছর আগে তিনিই প্রথম বললেন, এই যে পৃথিবীর বুকের বিশাল প্রাণিজগৎ, এটা রাতারাতি হয়ে যায়নি। লক্ষ লক্ষ বছরের ধরে নানা ধারা পরিবর্তনের ভেতর দিয়ে জন্ম হয়েছে এই প্রাণিকুলের। প্রথমে ক্ষুদে প্রাণী থেকেই এর শুরু। শেষে এই মানুষের।

চার্লস ডারউইন ছিলেন একজন প্রাণিবিজ্ঞানী। জন্ম ১৮০৯ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি ইংল্যান্ডের শ্রুসবারিতে। পিতা রবার্ট ওয়ারিং ডারউইন ছিলেন একজন ডাক্তার। তাই তিনি স্বাভাবিকভাবে চেয়েছিলেন, ছেলেও তাঁর মতো ডাক্তার হয়ে দু পয়সা রোজগার করতে শিখুক।

কিন্তু পিতার মনোবাঞ্ছা পূরণ হলো না। ডারউইন ডাক্তার না হয়ে হলেন প্রকৃতিবিজ্ঞানী। ছোটবেলা থেকেই প্রকৃতির প্রতি ছিল তাঁর দুর্বার আকর্ষণ। গাছপালা ও জীবজন্তু দু’চোখ ভরে দেখতেন আর ভাবতেন, কেমন করে বনে এত বিচিত্র ফুল ফোটে? কেমন করে জন্ম হলো এত সুন্দর প্রজাপতির ও পোকমাকড়ের, শামুক, ঝিনুক ও গুবরেপোকার? এসব নিয়েই তাঁর দিন কাটত। তাই কিশোর বয়সে স্কুলের পড়ার প্রতি তাঁর আগ্রহ ছিল কম। ধরাবাঁধা পড়াশোনায় তেমন মন বসত না তাঁর। ফাঁক পেলেই তিনি ঘর থেকে বের হয়ে পড়তেন। চলে যেতেন সবুজ মাঠে। তাতে চরে বেড়াতে দেখতেন শয়ে শয়ে গরু-মোষকে। শূন্যে চোখ মেলে দেখতেন ডানামেলা রঙ-বেরঙের সব পাখিদের। এসব দেখতে খুবই ভালো লাগতে তার।

একসময় হাটতে হাটতে তিনি চলে আসতেন নদীর ধারে। সেখানেও কত বিচিত্র করমের গাছতলা! আর সেসবে ধরে আছে কত রকমের স্বাদে ফল! এসবই খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতেন কিশোর ডারউইন।

তাঁর সবচেয়ে বেশি পড়তে ভাল লাগত পশুপাখি আর গাছপালা বিষয়ক বই প্রায়ই বন্ধুদের কাছ থেকে বই ধার করে এনে পড়তেন। পাঠ্য বইয়ের প্রতি তাঁর আগ্রহ ছিল কম। বাবা তবু হাল ছাড়েননি। ১৮২৫ সালে তিনি ছেলেকে ডাক্তারি পড়ানোর জন্য পাঠিয়ে দেন এডিনবরাতে। কিন্তু কোনো কাজ হলো না। লেখাপড়ায় মন বসল ডারউইনের। ফলে ডাক্তারি পাশ করা হয়নি তার।

এডিনবরাতে গিয়ে অবশ্য তাঁর একটা বড় লাভ হয়েছিল। ভূতত্ত্ববিদ ড. আইন্সওয়ার্থ, প্রাণিবিদ ড. কোল্ডস্ট্রিন, ড. গ্রান্ট এবং পক্ষিবিশারদ অধ্যাপক ম্যাকগিলিভারের মতো অনেক বড় বড় ব্যক্তির সংস্পর্শে আসার সুযোগ পেয়েছিলেন সেখানে। ‘ডারউইন পরবর্তী জীবনে যে একজন মস্তবড় প্রকৃতিবিজ্ঞানী হতে পেরেছিলেন, তার পেছনে ছিল এঁদেরই সহযোগিতা এবং অনুপ্রেরণা।

ছেলের খামখেয়ালিপনায় অবশেষে ভীষণ হতাশ হয়ে পড়লেন বাবা রবার্ট ডারউইন। তাঁর ধারণা হলো, ছেলের আর ডাক্তারি পড়া হবে না।

ডাক্তার না হতে পারলে তাঁর জন্য পাদরির পেশাই ভালো হবে। এই উদ্দেশ্যেই তাঁকে কেমব্রিজের ক্রাইঈ কলেজে ভর্তি করিয়ে দেওয়া হলো ১৮২৭ সালে।

সেখানে তাঁর বছর তিনেক কাটল কোনোরকমে। কিন্তু আগের মতোই পড়াশোনায় মন বসাতে পারলেন না। কলেজের বক্তৃতা শোনার চেয়ে নদীর ধারে গভীর জঙ্গলে গিয়ে নানা ধরনের গাছের নমুনা সংগ্রহ করতেই তাঁর বেশি ভালো লাগত।

এ-রকমটা করতে গিয়ে একবার একটা মজার কাণ্ড হয়েছিল। তিনি বনের ধারে ঘুরে বেড়াচ্ছিলেন। এমন সময় তাঁর নজরে পড়ল একজোড়া পোকা। তিনি দু হাতে দুটো পোকা ধরে ফেললেন। এরপর তার নজরে এল আরেকটি পোকা। কিন্তু তাঁর দুটো হাতই তো আটকা। তাই কী আর করা, তিনি ডানহাতের পোকাটা মুখে পুরে দিয়ে তৃতীয় পোকাটা ধরার চেষ্টা করতে লাগলেন।

এদিকে যে-পোকাটা মুখে পুরে দিয়েছিলেন, ওটা তাঁর মুখে ঢালতে লাগল বিষ। জিভ জ্বলে যেতে লাগল। অসহ্য যন্ত্রণা হল। তিনি কোনোমতে পোকাটা মুখ থেকে ফেলে দিয়ে ছুট দিলেন বাড়ির দিকে। এই পোকার বিষে তিনি বেশ কষ্ট পেয়েছিলেন। এমনই পাগল ছিলেন ডারউইন। একেই বলা হয় প্রতিভাধরের পাগলামি।

পড়াশোনায় তেমন ভালো না করেও ২২ বছর বয়সে কেমব্রিজের এই ক্রাইস্ট কলেজ থেকেই তিনি ধর্মতত্ত্বে ডিগ্রি লাভ করেন।

এই বিশ্ববিদ্যালয়ে উদ্ভিদবিজ্ঞানের অধ্যাপক ছিলেন হেন্সলো। ডারউইনের সঙ্গে তাঁর খুব ভাল সম্পর্ক গড়ে ওঠে। প্রায়ই জীবজন্তু এবং বৃক্ষলতা নিয়ে দু’জনের মধ্যে আলোচনা হতো। তারপর এল ১৮৩১ সালের ৩১শে ডিসেম্বর। ক্যাপটেন ফিটজ্-রয়ের অধিনায়কত্বে প্লিমথ বন্দর থেকে বিগ্‌ নামের একটি জাহাজের বিশ্বভ্রমণে যাবার কথা। ডারউইন অধ্যাপক হেন্সলোর সুপারিকো একজন অবৈতনিক উদ্ভিদবিদ হিসেবে এই অভিযানে যোগ দেবার সুযোগ লাভ করেন। এই অভিযান স্থায়ী হয় দীর্ঘ পাঁচ বছর। তিনি এই সময় ভ্রমণ করেন তাহিতি, নিউজিল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া, মরিসাস, সেন্ট হেলেনা, আটলান্টিক দ্বীপপুঞ্জ এবং গালাপাগোস দ্বীপপুঞ্জের নানা অঞ্চল।

তিনি যেখানেই গেছেন যান, থেকেই সংগ্রহ করেন গাছপালা, পাথর, জীবজন্তুর হাড়, ফসিলের নমুনা। পাশাপাশি খাতায় টুকে নেন বিচিত্র সব তথ্য। ঘুরে ঘুরে যতই দেখেছেন, ততই বিস্মিত হয়েছেন, আর তখন থেকেই তাঁর মনে হয়েছে, এই যে পৃথিবীর এত জীবজন্তু আর বৃক্ষলতা, এসব আলাদা আলাদা হঠাৎ করে জন্ম নেয়নি। এগুলো একটি বিশেষ বিবর্তনের ধারায় জন্ম নিয়ে ক্রমে রূপান্তরিত ও জন্মান্তরিত হতে হতে বর্তমানের রূপ পরিগ্রহ করেছে। আর এমনি করেই তিনি সংগ্রহ করেন তাঁর ক্রমবিকাশতত্ত্ব বা বিবর্তনবাদের মালমশলা।

তাঁর তত্ত্বের সূত্র ধরেই ডারউইন বলেন, সব প্রাণীরই পূর্বপুরুষ ছিল একটি। লক্ষ লক্ষ বছরের বিবর্তনের ফলে তারা পরিণত হয়েছে আলাদা আলাদা জাতের প্রাণীতে। এই রূপান্তরের মূলে রয়েছে পৃথিবীর জলবায়ু, তাপমাত্রা এবং খাদ্যদ্রব্যে। তিনি বলেন, মানুষেরও উৎপত্তি এমনই এক বিবর্তনেরই ফল।

১৮৩৭ সালের জুলাই মাসে ডারউইন তাঁর সাড়া জাগানো গ্রন্থ “দি অরিজিন অব স্পেসিস বাই মিস্‌ অব ন্যাচারাল সিলেকসন’ (The Origin of Species by means of Natural Selection), যার আরেক নাম “দি প্রিজারভেশন অব ফেভারড্ রেসেস ইন দি স্ট্রাগল ফর লাইফ’ (The Preservation of Favoured Races in the Struggle for Life)-এর রচনা শুরু করেন। দীর্ঘ বিশ বছর ধরে একটানা কাজ চালিয়ে তবেই শেষ হয় এর কাজ।

১৮৩৯ সালে ডারউইন তাঁর মামাতো বোন এমা ওয়েজউডকে বিয়ে করেন। বিয়ের পর স্ত্রীকে নিয়ে তিনি চলে যান লন্ডনের কাছাকাছি ডাউন নামের ছোট্ট গ্রামে।

ডারউইনের সবচেয়ে সাড়া জাগানো গ্রন্থ ‘অরিজিন অব স্পিসিস’ প্রকাশিত হয় ১৮৫৯ সালে। গ্রন্থটি প্রকাশের মাত্র এক মাসের মধ্যে এর প্রথম সংস্করণ শেষ হয়ে যায় এবং সঙ্গে সঙ্গে সারা বিশ্বের বিজ্ঞানীমহলে হইচই পড়ে যায়।

এর প্রথম মুদ্রণ শেষ হয় প্রকাশের প্রথম দিনেই। তারপর মাত্র কয়েক বছরের মধ্যে বিক্রি হয় বহু লক্ষ কপি এবং পৃথিবীর প্রায় প্রতিটি সভ্যজাতির ভাষায় এটি অনূদিত হয়ে প্রকাশিত হয়।

বইটি একদিকে যেমন প্রচণ্ড পাঠকপ্রিয়তা লাভ করে, অন্যদিকে তেমনি প্রবল বিতর্কেরও ঝড় তোলে। এই গ্রন্থেই তিনি তাঁর বিখ্যাত বিবর্তনবাদের তত্ত্ব প্রকাশ করেন। তিনি বলেন, প্রাকৃতিক পরিবেশ, পরিপার্শ্বিক অবস্থা, আবহাওয়া এবং চারপাশের জীবজগতের সঙ্গে প্রতিযোগিতামূলক যুদ্ধে জয়ী হয়েই সবাইকে টিকে থাকতে হবে। একেই পরবর্তীকালে হারবার্ট স্পেনসার বলেছেন, যোগ্যতমের উদ্‌বর্তনের নীতি বলে। এরই অপর নাম জীবনসংগ্রাম। এই সংগ্রামের মধ্য দিয়েই পৃথিবীর প্রাণিকূলকে বেঁচে থাকতে হয়। আর যারা এই সংগ্রামে জয়ী হতে পারে না অর্থাৎ পারিপার্শ্বিক অবস্থার সাথে নিজেদের খাপ খাওয়াতে পারে না, তাদের অস্তিত্ব বিলোপ হয়ে যায়। এভাবেই পৃথিবীর বহু প্রাণির বিলুপ্তি ঘটেছে, আবার জন্ম নিয়েছে নতুন প্রজাতি। একেই ডারউইন প্রাকৃতিক নির্বাচন বলে অভিহিত করেছেন।

১৮৬২ সালে তাঁর ‘ফার্টিলাইজেসন অব আর্কটিক (Fertilization of Arktic), ১৮৬৪ সালে মুভমেন্টস অ্যান্ড হ্যাবিটস অব ক্লাইম্বিং প্ল্যান্টস’ (Movements and Habbits of Climbing Plants), ১৮৬৮ সালে ‘ভেরিয়েশন অব অ্যানিম্যালস অ্যান্ড প্লান্টস আন্ডার ডোমেস্টিকেশন’ (Variation of Animals and Plants under Domestication) এবং ১৮৭১ সালে বের হয় ‘ডিসেন্ড অব ম্যান’ (Descend of man) নামের তিনটি গ্রন্থ। এই শেষোক্ত গ্রন্থেই তিনি মানুষকে বানর, শিম্পাঞ্জি ও গেরিলাদের বংশধর বলে উল্লেখ করেন। অবশ্য পরবর্তী সময়ে তাঁর এই তত্ত্ব ভুল বলে প্রমাণিত হয়। প্রমাণিত হয়েছে মানুষের পূর্বপুরুষ বানর নয়, তার পুর্বপুরুষ মানুষই ছিল, বানর নয়। ১৮৭৭ সালে প্রকাশিত হয় তাঁর ‘ভেজিটেব্‌ল্‌ মোল্ড থ্রু অ্যাকশন অব আর্থওয়ার্ম’ নামের গ্রন্থ।

চার্লস ডারউইন ব্যক্তিগত জীবনে ছিলেন বন্ধুবৎসল, খোশমেজাজি এবং প্রিয়দর্শন। মৃত্যুর আগে তিনি তাঁর আত্মজীবনীও লিখেছিলেন। মৃত্যুর পরে তা প্রকাশিত হয়। এই মহান জ্ঞানসাধকের মৃত্যু হয় ১৮৮১ সালের ১৯ এপ্রিল। মৃত্যুর সময় তাঁর শেষ বাণী ছিল : ‘মরণে আমার কোনো ভয় নেই’।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *