ধর্ম ও দর্শন
বিজ্ঞান
সাহিত্য
1 of 2

লরেঁ লাভোয়সিয়ের (১৭৪৩–১৭৯৪) – রসায়নশাস্ত্রের জনক

লরেঁ লাভোয়সিয়ের (১৭৪৩–১৭৯৪) – রসায়নশাস্ত্রের জনক

কেবল রাজনৈতিক আক্রোশের দাবানলে যুগে যুগে কত যে মহান ব্যক্তিকে বিনা অপরাধে আত্মাহুতি দিতে হয়েছে, তার সব কথা হয়তো ইতিহাসে লেখা নেই। যাঁদের কথা আমরা জানি, এমন একজন ফরাসি পদার্থ ও রসায়নবিদ এবং কৃষিবিজ্ঞানী আঁতোয়া লরেঁ লাভোয়সিয়ের (Antoine Laurent Lavoisier)।

তাঁর ছিল একটাই অপরাধ ছিল। ফরাসি বিপ্লবের সময় তাঁর আনুগত্য ছিল রাজার প্রতি। অভিযোগটি ছিল ভিত্তিহীন। কিন্তু তাতেই তাঁকে দিতে হয়েছিল নিজের অমূল্য প্ৰাণ।

এই নির্মম হত্যাকাণ্ড সম্পর্কে পরবর্তীকালে আরেক মহান পুরুষ জোসেফ লাগাদে (Joseph Lagrande) আক্ষেপ করে বলেছিলেন, তাঁর মতো এক ব্যক্তির মাথা কাটতে এক মুহূর্তই যথেষ্ট, কিন্তু এ ধরনের প্রতিভার জন্ম দিতে কয়েক শতাব্দীও যথেষ্ট নয়।

লাভোয়সিয়ের ছিলেন মধ্যযুগের এক বিরল প্রতিভার অধিকারী। তিনি ছিলেন একাধারে বিজ্ঞানী, অন্যদিকে সমাজসেবক ও রাজনীতিবিদ।

বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে তাঁর সবচেয়ে বড় অবদান—রাসায়নিক পদার্থের দহন প্রক্রিয়ার এমন এক পদ্ধতির আবিষ্কার, যা পূর্বতন সমস্ত ধারণাকে সম্পূর্ণ পালটে দিতে সাহায্য করে।

তাঁর আবিষ্কৃত সূত্র তাঁর মৃত্যুর পরেও শতাধিক বছর পর্যন্ত বিশ্বের বিজ্ঞানীদের শুধু প্রভাবিতই করেননি, রসায়নশাস্ত্রের ইতিহাসেও সূচিত করেছে এক বিপ্লব। আর এজন্যই তাঁকে বলা হয় রসায়নশাস্ত্রের জনক।

বিজ্ঞানী লাভোয়সিয়ের-এর জন্ম প্যারিসের এক সম্ভ্রান্ত বংশে ১৭৪৩ সালের ২৬ আগস্ট। তাঁর বাবা ছিলেন পার্লামেন্টের একজন কাউন্সিলর।

বাল্যকালেই সুশিক্ষা পেয়েছিলেন লাভোয়সিয়ের। স্কুলের পড়া শেষ করে তিনি ভর্তি হন প্যারিসের তখনকার বিখ্যাত কলেজ ম্যাজারি-এ।

এই কলেজেই তিনি প্রথমে সাহিত্য, পরে দর্শনশাস্ত্র এবং বিজ্ঞান নিয়েও পড়াশোনা করে উচ্চতর ডিগ্রি লাভ করেন। বিজ্ঞানে তাঁর পঠিত বিষয়গুলোর মধ্যে ছিল জ্যোর্তিবিদ্যা, রসায়নশাস্ত্র এবং উদ্ভিদবিদ্যা।

অবশ্য তাঁর পারিবারিক ঐতিহ্য ছিল ওকালতি করা। তাই এই ঐতিহ্য রক্ষার জন্য তাঁকে আবার আইনশাস্ত্র নিয়ে পড়াশোনা করতে হয় এবং ওকালতি করার জন্য ১৭৬৪ সালে তিনি সনদপত্রও গ্রহণ করেন।

কিন্তু আইনব্যবসার চাইতে তাঁর মন পড়ে থাকত বেশি বিজ্ঞান গবেষণার দিকে।

এই সময় অর্থাৎ ১৭৬৬ সালে তিনি শহরের রাজপথে নতুন পদ্ধতিতে বাতি জ্বালানো যায় কি না, তার ওপর একটি প্রবন্ধ লিখে প্যারিসের অ্যাকাডেমি অব সায়েন্স থেকে একটি স্বর্ণপদক লাভ করেন।

এ ছাড়াও এই সময়েই তিনি মেরুজ্যোতি, বজ্রপাত এবং জিপসামের রাসায়নিক সংমিশ্রণ ইত্যাদির ওপরেও অনেকগুলো প্রবন্ধ রচনা করেন। পরে তিনি গবেষণা করেন পাথর এবং খনিজপদার্থ নিয়েও। শুধু তাই নয় আইনব্যবসা করার জন্য আদালতে না গিয়ে তখনকার বিখ্যাত বিজ্ঞানী জে. ই. গুয়েটার্ড-এর সাথে বিজ্ঞান গবেষণার কাজ নিয়ে ঘুরে বেড়াতে থাকেন নানা জায়গায়। দুজনে মিলে ফ্রান্সের একটি প্রাকৃতিক মানচিত্রও তৈরি করে ফেলেন।

একসময় লোকজন বিশ্বাস করত যে, জলকে বারবার ঊর্ধ্বপাতন করলে শেষ পর্যন্ত তা মাটি হয়ে যায়। কিন্তু এ ছিল ভ্রান্ত ধারণা। জলকে ছাকলে তার নিচে ময়লার যে তলানি জমে, সেকালের বিজ্ঞানীরা মনে করতেন, ওটাই বুঝি মাটি। জল জমেই বুঝি এ-রকমটা হয়ে থাকে। লাভোয়সিয়ের এই বিষয়েই গবেষণা করে প্রমাণ করে দেখান যে, জল জমে কখনও মাটি হয় না। তাঁর এই গবেষণা সায়েন্স অ্যাকাডেমির খুবই প্রশংসা অর্জন করে এবং অ্যাকাডেমির তিনি সহকারী কেমিস্ট পদে মনোনীত হন। তিনি তাঁর এই সূত্র চূড়ান্তভাবে প্রকাশ করেন ১৭৭০ সালের দিকে।

পরে এই প্রতিষ্ঠানে তাঁর আরও পদোন্নতি হয়েছিল। ১৭৮৫ সালে তিনি এর পরিচালক এবং ১৭৯১ সালে নির্বাচিতে হন ট্রেজারার।

লাভোয়সিয়ের মুখে সোনার চামচ নিয়েই জন্ম নিয়েছিলেন। অঢেল ছিল তাঁদের পারিবারিক ধনসম্পদ। এরপর তিনি নিজের চেষ্টায় সেই ধনসম্পদকে আরও বহুগুণে বাড়িয়ে তোলেন।

১৭৭১ সালে তিনি ম্যারি পজ্ নামের এক শিক্ষিতা সুন্দরী মহিলাকে বিয়ে করেন। ম্যারি শুধু তাঁর সহধর্মিনী ছিলেন না, স্বামীর প্রায় সকল কর্মকাণ্ডের যোগ্য সহচারী হিসেবে নিজেকে প্রমাণ করেছিলেন।

ম্যারি ভালো ইংরেজি জানতেন। এ-ভাষায় বিজ্ঞান বিষয়ক যেসব প্রবন্ধ প্রকাশিত হতো, তা তিনি স্বামীর জন্য ফরাসি ভাষায় অনুবাদ করে দিতেন। পাশাপাশি স্বামীর গবেষণা ও পরীক্ষানিরীক্ষার ফলাফলও রেকর্ড করে রাখতেন। গবেষণা-সহায়ক সব ধরনের নকশা এবং ছবিও তিনি নিজেই এঁকে দিতেন।

লাভোয়সিয়ের অল্পদিনের মধ্যেই ব্লোইস-এর নিকটবর্তী ফ্রেচিনেঁ নামক স্থানে একটি বিশাল জমিদারি তালুক কিনে নেন।

আগের থেকেই এ-রকমের একটা ধারণা প্রচলিত ছিল যে, বিশ্বসৃষ্টির মূল উপাদান হলো চারটি বস্তু। যেমন, মাটি, জল, বায়ু এবং আগুন। লাভোয়সিয়ের দহনক্রিয়ায় বায়ুর ভূমিকা সম্পর্কে পরীক্ষা করতে থাকেন।

১৭৭২ সালে ১ নভেম্বর অ্যাকাডেমি অব সায়েন্স-এর দফতরে দাখিল করা এক নিবন্ধে তিনি তাঁর বৈজ্ঞানিক পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশ করে বলেন যে, সালফার এবং ফসফরাস ((Phosphorus) আগুনে পোড়ালে তাদের ওজন বেড়ে যায়। কারণ, উত্তপ্ত হলে এই দুটো পদার্থই বায়ু আত্তীকরণ করে। অন্যদিকে ধাতু সিসা উত্তপ্ত করলে ওজন কমে, কারণ, তখন এর ভেতর থেকে বায়ু অপসারিত হয়ে যায়।

বিজ্ঞানবিষয়ক তাঁর প্রথম গ্রন্থ ‘Opuscules physiques et chimiques’ প্রকাশিত হয় ১৭৭৪ সালে। এই গ্রন্থেই তিনি মাটি, জল এবং বায়ুর ওপর তাঁর পরীক্ষা-নিরীক্ষার ফলাফলগুলো প্রকাশ করেন।

এই বছরই বিজ্ঞানী জোসেফ প্রিস্টলি এই গবেষণাতত্ত্ব প্রকাশ করেন যে, অক্সিজেন হলো বাতাসের অন্যতম প্রধান উপাদানে। লাভোয়সিয়ে প্রিস্টলির এই আবিষ্কারকে আরো সম্প্রসারিত করেন।

তিনি বলেন, আগুনের দহনকাজে বাতাস যে সহযোগিতা করে, তার মূলে আছে বাতাস থেকে আগুনের অক্সিজেনকে শোষণ করে নেয়ার ব্যাপারটি। কিন্তু বাতাসের আদাহ্য অংশ অর্থাৎ অপ্রধান অংশ পড়ে থাকে। এই অপ্রধান অংশই হল নাইট্রোজেন। তিনি আরও পরীক্ষা করে দেখান যে, বাতাস মূলত বহু গ্যাসের সংমিশ্রণে গঠিত একটি অদৃশ্য পদার্থবিশেষ।

এ সংক্রান্ত একটি গবেষণা প্রবন্ধ তিনি অ্যাকাডেমি বরাবর জমা দেন ১৭৭৭ সালে। তবে তা তখনই প্রকাশ করা হয়নি। তিনি এক অনুষ্ঠানে এটা প্রথম পাঠ করেন ১৭৭৯ সালে এবং পুস্তকাকারে প্রকাশ করেন ১৭৮১ সালে।

লাভোয়সিয়ের ১৭৮৩ সালের ২৫ জুন ঘোষণা করেন যে, জল হলো দুটি গ্যাসের সংমিশ্রণ মাত্র। এই দুটো গ্যাসের একটি অক্সিজেন, অন্যটি হলো হাইড্রোজেন। এটা তিনি আবিষ্কর করেছিলেন ব্রিটিশ বিজ্ঞানী ক্যাভেন্ডিশ এর একটি সূত্রের ওপর ভিত্তি করে। এই সময় ক্যাভেন্ডিশ সদ্য আবিষ্কৃত বেলুন জাহাজে ব্যবহারের জন্য বাতাসের চেয়ে হালকা কোনো গ্যাসের সন্ধান করতে গিয়েই হাইড্রোজেনের সন্ধান পান যা জলের মধ্যেই থাকে।

লাভোয়সিয়ের জলকে বিভাজন করে প্রচুর পারিমাণে হাইড্রোজেন তৈরি করেন এবং এর নাম দেন ‘দাহ্যবায়ু’।

ক্যাভেন্ডিশের এই সূত্র থেকেই তিনি প্রমাণ করে দেখান যে, হাইড্রোজেন জলেরই একটি উপাদান। যে দুটো গ্যাসের সংমিশ্রণে জলের উৎপত্তি, হাইড্রোজেন তার একটি। এই সূত্রের ওপর ভিত্তি করেই ১৭৮৬ সালে তিনি প্রকাশ করেন ‘Nomenclature’ নামে একটি বিখ্যাত গ্রন্থ, যার বিষয়বস্তু পরবর্তীকালের বহু বিজ্ঞানীকে প্রভাবিত করতে সক্ষম হয়। ১৭৮৭ সালে ফ্রান্সের কয়েকজন রসায়নশাস্ত্রবিদ মিলে ‘Elemens d’ his- toire naturelie et chimie’ নামে যে গ্রন্থটি প্রকাশ করেন, তার ওপরও লাভোয়সিয়ে- র ‘Nomenclature’ গ্রন্থের প্রত্যক্ষ প্রভাব রয়েছে।

এরপর ১৭৮৯ সালে তিনি আরেকটি উল্লেখযোগ্য বিজ্ঞান বিষয়ক গ্ৰন্থ প্ৰকাশ করেন। এর নাম ‘Traite elementaire de chimie’। এই গ্রন্থেই তিনি রসায়নশাস্ত্রের তথ্যানুসন্ধান, বিজ্ঞান শিক্ষা এবং গবেষণা পদ্ধতি সম্পর্কে বিস্তারিত ব্যাখ্যা দেন।

তিনি শুধু রসায়নশাস্ত্রের গবেষণা নিয়েই নয়, পাশপাশি তিনি অঙ্কশাস্ত্র এবং জ্যোতির্বিজ্ঞান নিয়েও গবেষণায় ব্যাপৃত ছিলেন। পদার্থবিজ্ঞানের ওপরও অনেক প্রবন্ধ রচনা করেন। যেমন, তাপ সম্পর্কে অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পেশ করার পাশাপাশি তাপমাত্রা পরিমাপের ওপরেও গবেষণা করে বলেছেন, তাপের কারণেই একটি পদার্থের অবস্থার পরিবর্তন ঘটতে পারে। একটি কঠিন পদার্থ তাপের ফলে তরল পদার্থে এবং আরও তাপে তা গ্যাসীয় পদার্থে রূপান্তরিত হয়, যাকে তিনি অভিহিত করেছেন তাপের তারতম্য বলে। তিনি আরও বলেন, প্রাণিদেহেও তাপ আছে। প্রাণিজগতের শ্বাসক্রিয়ার ফলে যে গ্যাস নির্গত হয়, সেটা তার তাপের ক্রিয়ারই ফলাফল। তিনি প্রাণিজগতের ওপর তাপের ক্রিয়া সম্পর্কে আরও অনেক গবেষণা করেছিলেন। এসবের অনেক কিছুই ছিল অসম্পূর্ণ বা অসমাপ্ত। তাঁর বাড়ি থেকে এ সংক্রান্ত কাগজপত্র উদ্ধার করা হয় তাঁর নিহত হওয়ার পর

তাঁর সম্পর্কে আরেকটি উল্লেখযোগ্য তথ্য হলো, তিনি শুধু বিজ্ঞানী ছিলেন না, ছিলেন একজন নিঃস্বার্থ সমাজসেবকও। তিনি দেশের অর্থনীতি, কৃষি এবং সামাজিক উন্নয়নেও অনেক অবদান রাখেন।

১৭৬৮ সালে তিনি সরকারের রাজস্ব আদায় বিভাগের অন্যতম প্রধান কর্মকর্তা নির্বাচিত হন। একই সাথে তিনি সারা দেশের কেন্দ্রীয় রাজস্ব দফতরেরও অন্যতম সদস্য মনোনীত হন।

তিনি ছিলেন ফ্রান্সের একজন অন্যতম সেরা ধনী ব্যক্তি, অন্যদিকে খ্যাতনামা বিজ্ঞানী ও

ও। তাই সব ধরনের কাজেই তাঁর ডাক পড়ত সবার আগে। তাঁর অসম্ভব সংগঠনিক দক্ষতাও ছিল। এই যোগ্যতার কারণেই তিনি দেশের কেন্দ্রীয় বারুদ প্রশাসনের পরিচালক মনোনীত হন ১৭৭৫ সালে। এই পদে আসীন হওয়ার পরই তিনি গান-পাউডার শিল্পের উন্নতি সাধন করেন। সম্প্রসারিত করেন এর বাণিজ্যিক ব্যবহারের বিষয়টিও।

তাঁর সময়ে আজকের মতো প্রচুর পরিমাণে লবণ উৎপাদিত হতো না। লবণ ছিল দুষ্প্রাপ্য বস্তু। তিনি দেশে লবণশিল্পের আইনকে শিথিল করেন এবং এর উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্যে অনেকগুলো গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ নেন। এইভাবে তিনি যেমন দেশের শিল্পের সম্প্রসারণে ভূমিকা রাখেন, তেমনি বড় ধরনের একটি সামাজিক সমস্যারও সমাধানে সাহায্য করেন।

দেশে বারুদ-শিল্পের উন্নয়নের নিয়ন্ত্রণভার হাতে পাওয়ার পর তিনি প্যারিসের আরসেনা-য় একটি বিশাল বাড়ি তৈরি করেন এবং সেখানেই গড়ে তোলেন একটি বিজ্ঞান গবেষণাগার। স্থানটিকে তিনি পরিণত করেন দেশের বিজ্ঞান গবেষণার কেন্দ্ৰবিন্দুতে।

প্রতিদিন এখানে দেশের নানা জায়গা থেকে বিজ্ঞানীরা আসতেন। তাঁদের থাকা- খাওয়ার সমস্ত খরচ বহন করতেন তিনি নিজেই। তাঁদের অভ্যর্থনা জানানো ও আপ্যায়নের দায়িত্বটি পালন করতেন তাঁর স্ত্রী ম্যারি। প্রতিদিনই ডিনারের আয়োজন করা হতো। এ-ভাবেই দেশের বিজ্ঞানীমহলে ম্যারিও যথেষ্ট পরিচিতি লাভ করেন।

এখানে আসা বিজ্ঞানীরা যত দিন খুশি বসবাস এবং লাভোয়সিয়ের গবেষণাগারে গবেষণা চালাতেন, তাঁর সাথে বৈজ্ঞানিক বিষয় ও সমস্যা নিয়ে আলোচনা করতেন।

এই ধরনের সামাজিক দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে ল্যাভোয়সিয়ের প্রচুর সময় নষ্ট হতো। ফলে বাধাগ্রস্ত হতো তাঁর বিজ্ঞান গবেষণা সংক্রান্ত কাজকর্মও। তাই তিনি নিয়ম করেছিলেন, সপ্তাহে অন্তত দুটো দিন তিনি একান্ত নির্জনে তাঁর ল্যাবারেটরিতে কাটাবেন। এই সময় একমাত্র ম্যারি ছাড়া আর কেউ তাঁর সাথে সাক্ষাৎ করতে পরতেন না।

ফ্রান্সের অলিয়ে প্রদেশে লাভোয়সিয়ের-এর ছিল প্রচুর জমিজমা। বিশাল সব কৃষিখামার। তিনি এইসব খামারে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে চাষাবাদের ব্যবস্থা করেন।

শুধু নিজের জমি নয়, অর্লিয়ে-র একজন ভূস্বামী হিসেবে ১৭৮৭ সালে ঐ প্রদেশ থেকে তিনি প্রাদেশিক পরিষদের সদস্যও নির্বাচিত হন। এই সময় তিনি অর্লিয়েঁ প্রদেশের সাধারণ মানুষের, বিশেষ করে, কৃষকদের আর্থিক ও সামাজিক উন্নয়নে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখেন। তাদের জন্য ব্যাঙ্কে সঞ্চয়ী হিসাব খোলার, সেই সাথে তাদের বিনা সুদে ঋণ মঞ্জুর, খাজনা মওকুফ, গৃহনির্মাণ এবং খাল খননেরও ব্যবস্থা করেন।

১৭৮৮ সালে অর্লিয়ে প্রদেশে দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়। এই সময় লাভোয়সিয়ের একান্ত নিজস্ব উদ্যোগে দুর্ভিক্ষপীড়িতদের মধ্যে প্রচুর খাদ্য বিতরণ করে।

পরিমাপ পদ্ধতির পুনর্গঠনের জন্য ১৭৯০ সালে ফ্রান্সে যে কমিটি গঠন করা হয়, তিনি ছিলেন তার প্রধান। পরবর্তীকালে ফ্রান্সে যে ম্যাট্রিক পদ্ধতির প্রবর্তন করা হয়, তাও করা হয় তাঁরই সূত্র অনুসারে। আজ যে এই পদ্ধতি বিশ্বের আধুনিক পরিমাপ পদ্ধতি, তার পেছনেও রয়েছে তাঁরই মুখ্য অবদান।

ফরাসি বিপ্লবের সময় লাভোয়সিয়েরও বিপ্লবের পক্ষেই কাজ করেন। ১৭৮৯ সালে বাস্তিল দুর্গের পতনের পর যখন বিপ্লবীদের জয় হয়, তখন তিনিও প্যারিসে বিপ্লবীদের নেতৃত্বে গঠিত একটি স্টেট কমিটির অন্যতম সদস্য ছিলেন। এরপর তিনি ফ্রান্সের জাতীয় কোষাগারের প্রধান কর্মাধ্যক্ষের পদ লাভ করেন এবং দেশের সঠিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতির ওপর প্রকাশ করেন একটি জরিপ রিপোর্ট।

কিন্তু ফরাসি বিপ্লবের পরপরই সেখানে অরাজক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। আবির্ভাব ঘটে একদল সন্ত্রাসবাদী স্বৈরাচারীর। তারা নিজেদের ক্ষমতা বৃদ্ধি করার জন্য যাকে- তাকে ধরে হত্যা করতে থাকে। যাকেই তাদের প্রতিদ্বন্দ্বী বলে মনে হতো তাকেই তারা পৃথিবী থেকে সরিয়ে দিতে শুরু করে।

আর কী দুর্ভাগ্য, এই অতিবিপ্লবী কুচক্রীদের দৃষ্টিতে পড়ে যান লাভোয়সিয়ের মতো জ্ঞানীগুণী ব্যক্তিরাও। এদের অন্যতম নেতা ছিলেন জাঁ পল মারাত। তিনি অহেতুক সন্দেহের বশবর্তী হয়ে সরিয়ে দেন লাভোয়সিয়েরকে তাঁর সমস্ত ক্ষমতা থেকে। বের করে দেন তাঁর আরসেনাঁ-র নিজের বাড়ি থেকে পর্যন্ত।

এরপর লাভোয়সিয়েরসহ ২৭ জন নির্দোষ ব্যক্তির বিরুদ্ধে এই মর্মে অভিযোগ আনা হলো যে, তাঁরা রাজা ষোড়শ লুইয়ের দালাল। এই অভিযোগ ছিল সম্পূর্ণ।

১৭৯৩ সালে তাঁকে গ্রেফতার করা হয়। তারপর ১৭৯৪ সালের ৭ মে বিশেষ ট্রাইবুনালে অনুষ্ঠিত হয় বিচার। মাত্র এক দিনেরও কম সময়ে অনুষ্ঠিত এই বিচারে ল্যাভোয়সিয়েরসহ ২৭ জন নির্দোষ ব্যক্তিকে দেয়া হয় মৃত্যুদণ্ডাদেশ। বিচার অনুষ্ঠানের পরের দিনই অর্থাৎ ৮ মে এই ২৭ জনকে গিলোটিনে হত্যা করে তাঁদের লাশগুলো শহরের বাইরে এনে একটি গর্ত খুঁড়ে কবরের নামে মাটিচাপা দেওয়া হয়। এই ২৭ জন অভিযুক্ত ব্যক্তির মধ্যে লাভোয়সিয়ে এবং তাঁর বৃদ্ধ শ্বশুরও ছিলেন।

এই সময় লাভোয়সিয়ের-এর বয়স ছিল ৫১ বছর। এ-ভাবেই উন্মত্ত আক্রোশের শিকার হয়ে স্তব্ধ হয়ে যায় একটি অমূল্য প্রাণ। বলতে গেলে অকালে সমাপ্তি ঘটে একটি বিস্ময়কর প্রতিভার।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *