ধর্ম ও দর্শন
বিজ্ঞান
সাহিত্য
1 of 2

রিচার্ড আর্করাইট (১৭৩২–১৭৯২) – আধুনিক বস্ত্রশিল্পে বৈপ্লবিক ধারা প্রবর্তক

রিচার্ড আর্করাইট (১৭৩২–১৭৯২) – আধুনিক বস্ত্রশিল্পে বৈপ্লবিক ধারা প্রবর্তক

এক ঝোড়োরাতের গল্প দিয়েই শুরু করা যাক। ১৭৬৫ সালের ওই রাতে ইংল্যান্ডের ল্যাংকশায়ার প্রদেশের এক গরিব তাঁতির পর্ণকুটিরের সামনে এসে দাঁড়ালেন এক যুবক।

এ-রকম রাতে তাঁর একটু আশ্রয়ের দরকার। ঝড় প্রবলবেগে তেড়েমের আসছে। এ অবস্থায় কোথায় যাবেন তিনি? তাই সামনের যে কুটিরটি পেলেন, তার দরজার কড়া নাড়তে লাগলেন তিনি।

রাত তখন অনেক। তবু শুধু এই ঘরটিতেই বাতি জ্বলছিল। বাইরে কালো অন্ধকার রাত। টিপটিপ করে বৃষ্টিও ঝরছে। সেইসাথে তীব্র জড়ো বাতাসের ঝাপটা।

যে বাড়িতে আলো জ্বলছিল সেটা ছিল আসলে একজন তাঁতির বাড়ি। নাম তার জেম্‌স্ হারগ্রেভ্স্। তিনি তখনও ঘরের মধ্যে মোমের আলো জ্বেলে চড়কায় সুতা কাটছিলেন। ঠিক তখুনি বাইরে থেকে দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ। জেম্‌স্‌ ভেবেছিলেন, হয়তো তার কোনো সুতার খদ্দের এসে থাকবে। তাই ঘরের দরজা না খুলেই জিগ্যেস করলেন, কে?

–আমি ডিক আর্করাইট।

–সুতা কিনতে এসেছেন? আপনি কোন্ গাঁয়ের তাঁতি?

-না না, আমি তাঁতি নই।

-তবে কী?

—নাপিত। আমি মাথার চুল কিনি। এসেছি সেই বোস্টন থেকে।

–কিন্তু আমি তো চুল বিক্রি করি না।

–আমি খুব বিপদে পড়েছি। কেবল আজকের রাতটার জন্য একটু আশ্রয় চাই। ভাড়া যা চাও দিতে রাজি। তবু একটু আশ্ৰয় দাও।

লোকটার কাতর মিনতিতে অবশেষে তাঁতি জেম্‌স্-এর মন গলে গেল। তিনি আগন্তুককে ঘরে ঢুকতে দিলেন। আর্করাইট এবার ঝড়ের ঝাপটা থেকে মুক্তি পেয়ে স্বস্তির নিশ্বাস ফেললেন।

কিন্তু ঘরে ঢুকেই একেবারে বিস্মিত হয়ে গেলেন আর্করাইট। লোকটি তাঁর নিজের আবিষ্কৃত একটি অদ্ভুত ধরনের সুতাকাটার কলের সাহায্যে সুতা তৈরি করছিলেন। তাঁর কাছ থেকে আর্করাইট যা শুনলেন, সে আরও এক মজার ব্যাপার। তিনি নাকি অনেক মাথা খাটিয়ে সুতার কলটি আবিষ্কার করেছেন। এটার মডেল যাতে বাইরে প্রচার না হয়ে যায়, তাই তিনি নিজের ঘরের দরোজা বন্ধ করে রাতের বেলা সুতা কেটে থাকেন।

কিন্তু আগন্তুক তো নাপিত। সুতার সাথে তার কোনো সম্পর্ক নেই। তাই তাকে দেখালে তাঁর কোনো ক্ষতি নেই। জেম্‌স্‌ তার আবিষ্কৃত কলটি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখালেন আগন্তুককে। আর আর্করাইট যতই কলটি দেখতে লাগলেন, ততই তাঁর বিস্ময় আর কৌতূহল বাড়তে লাগল।

আর সেখান থেকেই তাঁর মাথার মধ্যে ঢুকে গেল সুতার কলের ভাবনা। এই ভাবনা থেকেই আবিষ্কৃত হলো কাপড় বোনার নতুন কল। সূচিত হলো বস্ত্রশিল্পের ক্ষেত্রে এক বৈপ্লবিক পরিবর্তন।

পরিবর্তন এলো আর্করাইটের নিজের জীবনেও। তিনি সামান্য নাপিত থেকে হয়ে গেলেন স্যার রিচার্ড আর্করাইট।

এই মহান আবিষ্কারকের জন্ম ১৭৩২ সালে ব্রিটেনের একটি ছোট্ট গ্রাম প্রেস্টনে। তিনি ছিলেন এক দরিদ্র পিতার তেরো সন্তানের মধ্যে সর্বকনিষ্ঠ। বাবা ছিলেন সামান্য একজন শ্রমিক।

আর্করাইটের যখন যে পরিবারে জন্ম, তখন তেমন পরিবারের সন্তানেরা কখনও স্কুলে পড়াশোনা করে নিজের উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ গড়ে তোলার কথা কল্পনাও করতে পারত না। তাই কোনোদিনও তাঁর স্কুলে যাওয়া হয়নি। যখন তাঁর বই-খাতা নিয়ে স্কুলে পড়তে যাওয়ার কথা, সেই সময়ে, মাত্র দশ বছর বয়সে এক নাপিতের দোকানে চাকরি নেন শিক্ষানবিশ হিসেবে। মানুষের মাথার চুল কাটার প্রশিক্ষণ। অবিশ্বাস্য কিছু নয়, আর্করাইটের পরিবারের লোকজন জীবনে এর চেয়ে বেশি সাফল্য তখন আশাও করতে পারত না।

অবশেষে কাজ শিখে একজন নাপিত হয়েছিলেন তিনি। তাও কোনো নামিদামি নাপিত নয়, একেবারেই সাধারণ গোছের, যার মুজুরি ছিল মাত্র এক পেনি। আর এই এক পেনি দামের নাপিত হিসেবেই তিনি কাটিয়ে দিয়েছিলেন তাঁর জীবনের দশ-দশটি বছর।

এর পরপরই ঘটেছিল তাঁর জীবনে সেই ঝোড়ো রাতের ঘটনা।

তিনি হাতের ক্ষুরকাঁচি ছুড়ে ফেলে দিয়ে বসে যান উন্নত মানের কাপড় তৈরির কল বা স্পিনিং মেশিন তৈরির কাজে। চলতে থাকে গবেষণা। ফলে তাঁর চুলকাটার পুরনো পেশায় ভাটা পড়লেও ক্ষান্ত দিলেন না তাঁর উদ্ভাবনের কাজে। অবশেষে ১৭৬৯ সালে আর্করাইট তাঁর নতুন মডেলের উন্নতমানের স্পিনিং মেশিন উদ্ভাবনে।

চার বছর আগে তিনি তাঁতির ঘরে যে কলের তাঁত দেখে এসেছিলেন, সেটা ছিল একবারেই একটি ক্ষুদ্র এবং অসম্পূর্ণ প্রচেষ্টামাত্র। সেখানে একসাথে মাত্র সাতটি সুতা কাটা যেত। তাও তার গুণগত মান তেমন ভালো ছিল না।

কিন্তু আর্করাইট গবেষণা করে যে তাঁতটি তৈরি করলেন, সেটা তার চাইতেও ছিল ঢের বেশি উন্নতমানের। তার আবিষ্কৃত এই নতুন তাঁতের ছিল দু’সেট রোলার। এর একটি ছিল স্টিলের খাঁজ কাটা, অন্যটি চামড়ায় মোড়ানো। এই রোলারের ভতরে তুলো গুঁজে দিলেই মেশিনটি নিজে থেকেই তুলো ধুনো করে সুতো তৈরি করতে পারত।

শুধু তাই নয়, এর সাহায্যে যতো ইচ্ছে খুশি সুতো কাটা যেত। রক্ষা করা যেত মানও। সুতো মোটা, মাঝারি ও মিহি—যে-কোনো রকমের বোনা যেত।

প্রথম যখন আর্করাইট তাঁর সুতাকল তৈরি করেন, তখন তাকে চালানো হতো ঘোড়ার সাহায্যে। ঘানির মতো করেই ঘোড়া এর চাকা ঘোরাত।

তারপর ঘোড়ার বদলে আনা হলো জলশক্তি বা water power। এরপর যখন বিজ্ঞানী জেম্‌স্‌ ওয়াট তাঁর বাষ্পীয় শক্তি আবিষ্কার করলেন, তখন আর্করাইট সুতাকল ঘোরানোর জন্য বাষ্পশক্তিকে কাজে লাগালেন।

এদিকে দিন-রাতের অধিকাংশ সময় আর্কারাইট তাঁর নতুন তাঁতযন্ত্র আবিষ্কারে ব্যস্ত থাকায়, তার সংসারে দেখা দেয় অভাব-অনটন। আর তারই ফলে তাঁর স্ত্রী তাঁর ওপর ভীষণ খেপে যান। শেষে স্বামীর ঘাড় থেকে এই আবিষ্কারের ভূত তাড়ানোর জন্য তিনি আর্করাইটের দীর্ঘ শ্রমের বিনিময়ে তৈরি তাঁতযন্ত্রের মডেলকে ভেঙে চুরমার করে ফেলে দেন বাড়ির বাইরে।

সন্ধেয় ঘরে ফিরে এসে কাণ্ড দেখে আর্করাইট তো মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়েন। ভীষণ মর্মাহত হন স্ত্রীর এই অপরিণামদর্শী কাণ্ডকারখানা দেখে। কিন্তু ভেঙে পড়েননি। উদ্যম হারাননি। তিনি আবার শুরু করেন গোড়া থেকে এবং অসীম ধৈর্য আর শ্রমের বিনিময়ে মডেলটির নির্মান কাজ শেষ করেন। এরকম ধৈর্য আর অধ্যবসায়ের ঘটনা সত্যিই বিরল।

আর্করাইটের সুতাকলের মডেল আবিষ্কৃত হবার পরপরই চারদিকে অভাবিত সাড়া পড়ে যায়।

এতদিন সুতা কেটে কাপড় তৈরি করার ব্যাপারটি ছিল একান্তই কুটির শিল্প। হাতে গোনা কেউ কেউ একাজ করত। কিন্তু আর্করাইটের মেশিন তৈরি হবার পর বস্ত্রশিল্পে দেখা দিল বিপ্লব। তার উদ্ভাবিত মডেলের মেশিন বসিয়ে প্রতিষ্ঠিত হতে লাগল বড় বড় শিল্পকারাখানা।

ফলে বাড়তে লাগল তাঁর পসার। চুলকাটার কাজ ছেড়ে দিয়ে তিনি হয়ে গেলেন বস্ত্রশিল্পের মালিক। আর কিছুদিনের মধ্যেই সারা ইউরোপে বস্ত্রশিল্পের ক্ষেত্রে সৃষ্টি করলেন এক অভূতপূর্ব বিপ্লব। গোটা ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের অর্থনৈতিক ব্যবস্থার ক্ষেত্রেও সূচিত হলো নতুন যুগের। শুরু হলো অর্থনীতির আধুনিক যুগ, যার প্রায় সবটুকু কৃতিত্বই আর্করাইটের।

১৭৮৬ সালে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের সম্রাট তৃতীয় জর্জ তাঁর অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ তাঁকে ‘নাইট’ উপাধিতে ভূষিত করলেন। নাপিত আর্করাইট এবার হলেন স্যার রিচার্ড আর্করাইট।

আর্করাইট এত বড় বিজ্ঞানী এবং শিল্পপতি হওয়ার পরও কিন্তু সারাজীবনই প্রায় ছিলেন নিরক্ষর। শোনা যায় ৫০ বছর বয়সে নাকি তিনি আবার নতুন করে লেখাপড়া শিখতে শুরু করেছিলেন। ভর্তি হয়েছিলেন স্কুলেও।

শুধু নিষ্ঠা, সততা আর দৃঢ়তার জন্য একজন মানুষ কেমন করে একেবারে সাধারণ স্তর থেকে সর্বোচ্চ স্তরে পৌঁছুতে পারেন, আর্করাইটের জীবন তার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। তিনি কেবল আত্মপ্রত্যয়ের জোরে পর্ণকুটির থেকে আরোহণ প্রাসাদশিখরে।

শোনা যায়, তিনি যখন কোটিপতি এবং সারা বিশ্বে প্রচণ্ড খ্যাতি আর সম্মানের অধিকারী, তখনও তিনি প্রতিদিন আঠারো থেকে বিশ ঘণ্টা পরিশ্রম করতেন।

এই মহান বিজ্ঞানীর মৃত্যু হয় ১৭৯২ সালে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *