ধর্ম ও দর্শন
বিজ্ঞান
সাহিত্য
1 of 2

ক্লডিয়াস গ্যালেন (১৩১–২০১ খ্রি.) – চিকিৎসাশাস্ত্রের আধুনিক পদ্ধতির আদি জনক

ক্লডিয়াস গ্যালেন (১৩১–২০১ খ্রি.) – চিকিৎসাশাস্ত্রের আধুনিক পদ্ধতির আদি জনক

ঠিক যে সময়ে প্রাচীন আলেকজান্দ্রিয়াতে টলেমি জ্যোতির্বিজ্ঞান নিয়ে গবেষণা করছিলেন, ঠিক একই সময়ে এশিয়া মাইনরের পারগামাম শহরেও এক মহান বিজ্ঞানী চিকিৎসাশাস্ত্রে অভূতপূর্ব সাফল্য লাভ করেছিলেন। তাঁর নাম ক্লডিয়াস গ্যালেন ( Claudius Galen)। বলতে গেলে তাঁরই সময় এবং তাঁরই হাতে প্রাচীন গ্রিসীয় চিকিৎসাবিজ্ঞান উন্নতির সর্বোচ্চ শিখরে আরোহণ করেছিল।

এই মহান চিকিৎসাবিজ্ঞানীর জন্ম ১৩১ খ্রিস্টাব্দে।

বিজ্ঞানের নবজন্মের যুগের আগের যুগকে পাশ্চাত্যের ঐতিহাসিকেরা ‘অন্ধকার যুগ’ বলে আখ্যায়িত করেছেন। গ্যালেনের মৃত্যুর পরের প্রায় বারোশো বছরের সময়পরিসরকেই চিকিৎসাবিজ্ঞানের অন্ধকার যুগ বলা হয়। গ্যালেন ছিলেন ১৩১ থেকে ২০১ খ্রিস্টাব্দের লোক। তাঁর আগের প্রখ্যাত গ্রিক চিকিৎসক হিপোক্র্যাটিস ছাড়া চিকিৎসাশাস্ত্রে এমন জ্ঞানী ব্যক্তিত্ব আর কাউকে পাওয়া যায় না। গ্যালেনকে বলা হয় পরীক্ষামূলক চিকিৎসাশাস্ত্রের জনক। তাঁর পরের যে-বারোশো বছরের কথা বলা হলো, এই সময়টায় গোঁড়ামি, অন্ধবিশ্বাস আর কুসংস্কারের জন্য চিকিৎসাশাস্ত্রের কোনো উন্নতি হয়নি। উল্টো অগ্রগতি বাধাগ্রস্ত হচ্ছিল বারংবার। আর এ-জন্যই এ-যুগটাকে বলা হয়েছে চিকিৎসাশাস্ত্রের অন্ধকার যুগ। সে-যুগে আলেকজান্দ্রিয়া ছিল জ্ঞান-বিজ্ঞানের সর্বোচ্চ পীঠস্থান। তাই প্রায় সব জ্ঞানী ব্যক্তিই জ্ঞানাহরণের জন্য আলেকজান্দ্রিয়ায় যেতেন।

গ্যালেনের ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম হয়নি। স্বদেশের পাঠ শেষ করে উচ্চশিক্ষা লাভের জন্য তিনিও গিয়েছিলেন আলেকজান্দ্রিয়ায়। সেখানে এসে তিনি বিজ্ঞান, বিশেষ করে, চিকিৎসাবিজ্ঞান, শারীরতত্ত্ব বা অ্যানাটমির ওপর প্রচুর গবেষণা করেন।

এর আগে মানুষের রোগব্যাধি সম্পর্কে প্রচলিত ছিল নানা রকমের কুসংস্কার। রোগব্যাধির জন্য দায়ী করা হতো ভাগ্যলিপিকে, দেবতার ক্রোধকে।

অবশ্য তাঁর আগে পিথাগোরাস ও হিপোক্র্যাটিসও চিকিৎসাবিজ্ঞানের ওপর গবেষণা করে গেছেন। তাঁরাও বলে গেছেন, রোগব্যাধি কোনো দেবতার অভিশাপ নয়। এ হলো শারীর সংক্রান্ত ত্রুটি। কিন্তু সেই ব্যাধির আদি উৎস কী, সেটা তাঁরা বলে যেতে পারেননি। কিন্তু এই কথাটাই বলতে পেরেছেন গ্যালেন।

তিনি তাঁর পূর্বসুরি পিথাগোরাস ও হিপোক্র্যাটিসের জ্ঞানের সূত্রকে নিজের গবেষণার সঙ্গে যোগ করেন। আর এভাবেই তিনি লাভ করেন সাফল্য। চিকিৎসাবিজ্ঞানে সর্বপ্রথম তিনিই একটি কার্যকারণমূলক বিচারকে শৃঙ্খলায় পরিণত করেন।

গ্যালেন তাঁর জীবনের প্রায় অধিকাংশ সময় ব্যয় করেছেন চিকিৎসাবিজ্ঞানের গবেষণার কাজে। আর এই সময়টায় তিনি অবস্থান করতেন রোমে। তিনি ছিলেন রোম সম্রাট মারকাস অরেলিয়াসের (১২১–১৮০) ব্যক্তিগত চিকিৎসক।

গ্যালেন চিকিৎসাবিজ্ঞানের ওপর অসংখ্য গ্রন্থ রচনা করে গেছেন, যদিও সেগুলোর অধিকাংশেরই আজ আর কোনো সন্ধান পাওয়া যায় না।

তিনিই প্রথম গুণাগুণ বিশ্লেষণ করে ওষুধকে তার ক্রিয়া এবং প্রয়োগপ্রণালী অনুযায়ী শ্রেণীবিভাগ করেছেন। আজও সেই পদ্ধতির অনুকরণেই এই প্রণালীকে বলা হয় ‘গ্যালেনিক্যাল প্রিপারেশন’ (Galenical preparation)। গ্যালেনের রচিত গ্রন্থের সংখ্যা এত বিপুল যে, তার সবগুলোকে সংগ্রহ করে একত্রিত করলে মস্তবড় একটি বিশ্বকোষ হতে পারত।

সে আমলে আধুনিক পদ্ধতির মতো রোগী অপারেশনের কোনো ব্যবস্থা ছিল না। তাই শরীরের অভ্যন্তরে কোথায় কী হচ্ছে, সেটা জানার কথা কেউ ভাবতেও পারত না। সেটা ছিল রহস্যময় জগৎ বিশেষ। শুধু উপসর্গ দেখে অনুমানের ওপর নির্ভর করতে হতো চিকিৎসকদের। গ্যালেনই সর্বপ্রথম শরীরের অভ্যন্তরভাগের সেই রহস্য উদ্ধারের চেষ্টা করেন।

আদিকালে মানুষের দেহ কেটে গবেষণা চালানো কারো পক্ষে সম্ভব ছিল না। গ্যালেন নিজেও পারেননি। কিন্তু তিনি মানুষের পরিবর্তে ব্যবহার করেন বন্য জীবজন্তুর দেহ। তাদের দেহ কেটে তার ভেতরকার নাড়ি, রক্ত ও ধমনীর অবস্থান জেনে নিয়েই তিনি মানুষের দেহ-অভ্যন্তরের কথা অনুমান করে নিতেন। সেকালে এই এতটুকু অগ্রসর হওয়াই ছিল এক মস্তবড় দুঃসাধ্যের কাজ।

তিনি জীবজন্তুর শারীরকাঠামো থেকেই মানুষের শরীরের রক্তবাহী শিরাগুলো কীভাবে আছে, কীভাবে রক্ত চলাচল করছে, তা বুঝে নিয়েছিলেন এবং তাঁর বিভিন্ন গ্রন্থে এসবের সুন্দর ছবিও তিনি এঁকে গেছেন।

হৃদযন্ত্র যে একটি পাম্প মেশিনের মতো—হুবহু সেটা দেখাতে না পারলেও তিনি তা দেখিয়েছেন ভিন্নভাবে। অর্থাৎ হৃদযন্ত্র যেন অবিকল একটা বাগানের জলসেচ করার নালার মতো। হৃদযন্ত্র থেকে নালাগুলো বের হয়ে ছড়িয়ে পড়েছে সমস্ত শরীরে। এই নালা দিয়েই রক্তের চলাচল। তিনি তাঁর ছবিটা এঁকেছিলেন এভাবেই। সেই অতকাল আগে এতটা প্রাগ্রসর চিন্তাভাবনা, আজ সে কথা ভাবতেও অবাক লাগে।

শুধু শরীরের চিকিৎসাই নয়, শরীরের ওপর মনের প্রতিক্রিয়া সম্পর্কেও তিনি গবেষণা করেছেন। যেমন, তিনি বলেছেন, মানসিক ব্যাধি শরীরের কোনো রোগ নয়, মন অসুস্থ হলেই মানুষের শরীরে নানারকম বিপর্যয়ের কারণ ঘটায়।

তাঁর এই মানসিক রোগীর চিকিৎসা নিয়ে একটি সুন্দর গল্পও প্রচলিত আছে। একবার এক রোগিণী এলেন তাঁর কাছে। রোগিণীর শরীরে কোনো অসুখ না থাকলেও তার মনটা খুবই ভারাক্রান্ত। তখন বিজ্ঞ চিকিৎসক গ্যালেন তাঁর রোগিণীকে পরীক্ষা করতে লাগলেন এক ভিন্ন পদ্ধতিতে। তিনি রোগিণীর নাড়ি পরীক্ষা করতে করতে তার সাথে জুড়ে দিলেন গল্প।

এই গল্পের মধ্য দিয়েই তিনি রোগিণীর পরচিত বহু নরনারীর খবরাখবর জেনে নিলেন। আর লক্ষ্য করতে লাগলেন এই আলোচনার সময় নাড়ির গতির পরিবর্তন হয় কি না।

তিনি অবাক হয়ে লক্ষ্য করলেন, যেসব লোক সম্পর্কে এই রোগিণীর সাথে আলোচনা হয়েছে তার মধ্যে একটি লোকের প্রসঙ্গ আসতেই রোগিণীর নাড়ির স্পন্দন দ্রুত হয়ে যাচ্ছে। আর এভাবেই রোগিণীর মানসিক ব্যাধি ধরা পড়ল।

মোট কথা, গ্যালেন তাঁর গবেষণা কর্মের মাধ্যমে চিকিৎসাবিজ্ঞানকে যত দীর্ঘ দিন ধরে প্রভাবিত করেছেন, তেমনটা আজ পর্যন্ত আর কেউ পারেননি। বলতে গেলে গ্যালেনের মৃত্যু-পরবর্তী প্রায় দেড় হাজার বছর ধরে তাঁর প্রবর্তিত চিকিৎসাবিদ্যাকেই আদি ও অন্ত বলে মনে করা হতো। আর এ জন্য গ্যালেনকে বলা হয় চিকিৎসাবিজ্ঞানের পরীক্ষা ও পর্যবেক্ষণ পদ্ধতির জনক (Father of the Research Method)। এই মহান চিকিৎসাবিজ্ঞানী ২০১ খ্রিস্টাব্দে মৃত্যুবরণ করেন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *