ধর্ম ও দর্শন
বিজ্ঞান
সাহিত্য
1 of 2

হিপোক্র্যাটিস (আনু: ৪৬০–৩৭০ খ্রি. পূ.) – চিকিৎসাশাস্ত্রের আদিজনক

হিপোক্র্যাটিস (আনু: ৪৬০–৩৭০ খ্রি. পূ.) – চিকিৎসাশাস্ত্রের আদিজনক

কুসংস্কারের অন্ধকার—সে সত্যি বড় দীর্ঘ দীর্ঘকালের ইতিহাস। আদিম পৃথিবীতে প্রতিদিনই সূর্যোদয় হলেও জ্ঞানালোকের সূর্য উঠেছিল বড্ড দেরিতে। আজও তার আলো পৃথিবীর সমস্ত প্রান্তে পৌঁছুতে পারেনি।

কয়েক হাজার বছর আগে তার অবস্থা ছিল আরও করুণ। তবু সেই নিবিড় অন্ধকারেই জ্ঞানসূর্যের সন্তানেরা কেউ কেউ আলোর মশাল হাতে এগিয়ে এসেছিলেন। তাঁদের হাতের মশাল তাঁরা তুলে ধরেছিলেন ঘন অন্ধকারে ঢাকা দিক থেকে দিগন্তরে। আর সেই আলোয় কেউ কেউ খুঁজে পেয়েছিলেন নিজেদের পথের দিশা।

আদিকালের সেই আলোর মশাল হাতে এগিয়ে আসা তেমনি এক সূর্যসন্তান ছিলেন বিজ্ঞানী হিপোক্র্যাটিস (Hippocrates)।

তখন বলা হতো, মানুষের যে রোগব্যাধি, আপদবালাই—এসব কিছুর মূলে দেবতাদের আক্রোশ। মানুষের প্রতি তাঁদের অভিশাপের ফল। মানুষের পাপের শাস্তি। মানুষ দেবতার কাছে অপরাধ করলেই দেবতারা তাদের শাস্তি দিয়ে থাকেন।

কিন্তু এই ভ্রান্ত কুসংস্কারের বিরুদ্ধে প্রথম হিপোক্র্যাটিসই প্রতিবাদ করেন। তিনিই প্রথম বললেন যে, রোগবালায়ের জন্য স্বর্গের দেবতারা দায়ী নন। রোগব্যাধিতে মানুষ আক্রান্ত হয় একান্তই প্রাকৃতিক কারণে। এখানে দেবতাদের কোনো হাত নেই। এর মধ্যে রয়েছে মানুষের শরীরের বিভিন্ন অংশের নানারকম প্রতিক্রিয়া—একান্ত বাস্তবসম্মত কারণ। এর জন্য দায়ী কিছু বিজ্ঞানভিত্তিক তত্ত্ব। ইতিহাসে এই তত্ত্বই হিপোক্র্যাটিক তত্ত্ব (Hippocratic Method) নামে সুবিদিত।

মহাজ্ঞনী হিপোক্র্যাটিসের জন্ম হয়েছিল এশিয়া মাইনরের উপদ্বীপের নিকটবর্তী কস দ্বীপে ৪৬০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ। তিনি ছিলেন ওই দ্বীপের প্রাচীন বৈদ্য বা চিকিৎসক সম্প্রদায় এসক্লেপিয়াডার লোক। এই বিখ্যাত বৈদ্য সম্প্রদায়ের আদিপুরুষ ছিলেন চিকিৎসক- দেবতা এসক্লেপিয়স।

হিপোক্র্যাটিসের পিতাও ছিলেন একজন চিকিৎসক। তিনি ছিলেন রাজবৈদ্য। তাই চিকিৎসাশাস্ত্রে হিপোক্র্যাটিসের ছিল জন্মগত অধিকার। পিতার উৎসাহ এবং আগ্রহেই তিনিও চিকিৎসাশাস্ত্রে অধ্যয়ন করেন। প্রাথমিক শিক্ষা সমাপ্তির পর উচ্চশিক্ষার জন্য তিনি গ্রিক সাম্রাজ্যের বহু দেশে ঘুরে বেড়ান। বহু জ্ঞানীগুণী এবং রাজবৈদ্যের সাথে তাঁর সাক্ষাৎ হয়। তিনি তাঁদের সাথে জ্ঞানের আদান-প্রদান করেন।

জানা যায়, হিপোক্র্যাটিস তাঁর জীবিতকালেই গোটা গ্রিক সাম্রাজ্যে প্রচুর সুনাম অর্জন করেন। বহু দূরদূরান্তের দেশ থেকে রোগী এবং শিক্ষার্থীরা আসত তাঁর কাছে চিকিৎসা করাতে বা তাঁর কাছে এই বিদ্যা শিখতে। তিনি তাঁর জীবনের অভিজ্ঞতার ফসল হিসেবে চিকিৎসাশাস্ত্রের ওপর যে লেখা তৈরি করেছিলেন, সেগুলোই পরবর্তীকালে সংকলিত হয়ে প্রকাশিত হয়েছে ‘হিপোক্র্যাটিক সংকলন’ (Hippocratic Collection) নামে।

অবশ্য তাঁর এই রচনাবলির সংকলন প্রকাশিত হয় তাঁর মৃত্যুরও কয়েক শতাব্দী পরে। তাই অনেকে অনুমান করেন, তাঁর নামে সংকলিত ও প্রকাশিত রচনার সবগুলোই হয়ত তাঁর নিজের রচনা নয়। এমনও হতে পারে, তাঁর অনেক শিষ্যের রচনাও তাঁর নামেই প্রকাশিত হয়েছে। সংকলনের সব লেখা যে তাঁর নয়, এমনটা মনে করার পেছনে যুক্তি হলো, এখানে এমন অনেক তথ্য আছে, যা তিনি সর্বপ্রথম প্রবর্তন করেননি। এগুলো তাঁর সময়ের আগে বা পরের বিষয়। যেমন, চিকিৎসকদের আজও একটি নিয়ম পালন করতে হয়। আর সেটা হলো, এই পেশা শুরু করার আগে এর আদর্শ ও সততা সম্পর্কে প্রত্যেককে একটি শপথবাক্য পাঠ করতে হয়। বলা হয়ে থাকে, ডাক্তারদের শপথবাক্য পাঠ করার নিয়ম হিপোক্র্যাটিসই প্রথম প্রবর্তন করেন। কিন্তু প্রকৃত ঘটনা তা নয়। এ ধরনের শপথবাক্য পাঠের নিয়ম তাঁর জন্মেরও বহু বছর আগ থেকেই ইউরোপের বহু জায়গায় প্রচলিত ছিল। তাই এর প্রবর্তক হিপোক্র্যাটিস নন। অথচ তাঁর নামে এ ধরনের একটি রচনা গ্রন্থে সংকলিত হয়েছে। এটা সম্ভবত গুরুর কৃতিত্ব জাহির করার জন্য তাঁর কোনো অতি উৎসাহী শিষ্য করে থাকতে পারেন। হিপোক্র্যাটিসের শপথবাক্যটি হলো এ-রকমের :

“আমি আমার সাধ্য ও বিবেকবুদ্ধি দ্বারাই একজন রোগীর সেবা ও চিকিৎসা করব। একজন রোগীর মঙ্গলসাধনই হবে আমার একমাত্র ব্রত। আমি পবিত্রতা, সততা ও নিষ্ঠার মধ্য দিয়ে আমার চিকিৎসক জীবন অতিবাহিত করতে চাই।”

তাঁর সংকলনে অন্তর্ভুক্ত বিখ্যাত রচনাগুলোর মধ্যে আছে রোগের লক্ষণ (Prognostics), মহামারী (Epidemics) এবং বায়ু-মাটি-স্থান (Air, Earth and Place) অর্থাৎ রোগ হওয়ার এবং আরোগ্যলাভের জন্য বায়ু, মাটি ও স্থান—এই এই তিনের সম্পর্ক ওতপ্রোতভাবে কার্যকর। অর্জিত জ্ঞান থেকেই তিনি উপলব্ধি করতে শেখেন যে, মানুষের রোগব্যাধির রয়েছে বিজ্ঞানসম্মত কারণ। এখানে অলৌকিকতার কোনো স্থান নেই। অথচ তখনকার যুগে লৌকিক বিশ্বাস বা কুসংস্কারের প্রভাব ছিল সমাজে প্রবল। দেবতাদের প্রভাব ছিল অসীম।

চিকিৎসাশাস্ত্রে এমন অনেক শব্দ প্রচলিত আছে, যেসবের উৎপত্তি সেই প্রাচীন অলৌকিক বিশ্বাস থেকেই। যেমন, প্লেগ রোগকে সেকালে বলা হতো দেবতার অভিশাপ বা আঘাত। প্লেগ শব্দটি এসেছে ল্যাটিন শব্দ প্লাগা থেকে, যার অর্থ আঘাত। হাইজিন শব্দটি এসেছে গ্রিক শব্দ হাইজিয়া থেকে। হাইজিয়া হলো ঔষধের দেবতা, এসক্লেপিয়স-এর কন্যা।

এসব থেকেই অনুমান করা যায়, সেকালে চিকিৎসাশাস্ত্রে অলৌকিক বিশ্বাস কেমন করে প্রভাব বিস্তার করেছিল। আর এসব কিছুর মূলে যিনি প্রথম আঘাত করেন, তিনি হলেন চিকিৎসাবিজ্ঞানী হিপোক্র্যাটিস। আর তাই তো তাঁকে আজও সম্মান করা হয় ‘চিকিৎসাশাস্ত্রের জনক’ হিসেবে।

হিপোক্র্যাটিসের চিকিৎসা গবেষণার মূল কেন্দ্রস্থল ছিল নিজের দ্বীপ কস-এ।

তাঁর সময়ে আর একটি চিকিৎসা গবেষণা কেন্দ্র ছিল এশিয়া মাইনরের দক্ষিণ- পশ্চিম প্রান্তে অবস্থিত স্নিডোস-এ। কিন্তু কস ও স্নিডোসের চিকিৎসাপদ্ধতির মধ্যে যেমন কিছু কিছু মিল ছিল, তেমনি অনেক অমিলও।

যেমন, স্নিডোসের চিকিৎসকদের বিশ্বাস ছিল, মানবদেহের চারটি প্রধান জলীয় পদার্থই মানসিক ও শারীরিক দিক থেকে তাকে নিয়ন্ত্রণ ও পরিচালিত করে থাকে। এই চারটি জলীয় পদার্থ হলো, কফ বা শ্লেষ্মা, রক্ত, পিত্তরস এবং জল।

কসের হিপোক্র্যাটিস গোত্রীয় চিকিৎসকদেরও ধারণা ছিল প্রায় একই রকমের। হিপোক্র্যাটিস বলেন, মানবদেহের মূল নিয়ন্ত্রক জলীয় পদার্থ হলো শ্লেষ্মা, রক্ত, পিত্তরস বা হলুদ পিত্ত এবং অবসাদ বা কালপিত্ত।

এখানে একটা বিষয় তাৎপর্যপূর্ণ, তা হলো, দুটো দলই মানবদেহের চারটি মৌলিক উপাদানের কথা বলেছেন এবং উভয় সম্প্রদায়ই আরও একটি বিষয়ে একমত ছিলেন যে, ঔষধ হলো যুক্তিসিদ্ধ চিকিৎসাপদ্ধতি, যা বিজ্ঞানভিত্তিক। এখানে ঐশ্বরিক বা অলৌকিক বলে কিছু নেই। এই দুটো সম্প্রদায়ই চিকিৎসাশাস্ত্রকে অলৌকিক স্বর্গ থেকে মাটির পৃথিবীতে নামিয়ে নিয়ে এসেছেন এবং চিকিৎসাশাস্ত্রের ক্ষেত্রে বিজ্ঞানভিত্তিক গবেষণা ও আবিষ্কারের পথ খুলে দিয়েছেন।

অবশ্য এ ধরনের আধুনিক চিন্তাভাবনা হিপোক্র্যাটিসের আগ থেকেই চলে আসছিল। যেমন, পূর্বসুরি চিকিৎসক ইম্‌পেডোক্লেস (৫০০–৪৩০ খ্রি. পূ.) বলেছিলেন, মানবদেহের রোগব্যাধি ঈশ্বরের দান নয়। এটা হলো শরীরের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ ও শারীরিক উপাদানসমূহের ত্রুটি কিংবা ভারসাম্যহীনতা।

হিপোক্র্যাটিসও তাই বলেছেন, মানুষের শরীরে তখনি রোগব্যাধি দেখা দেয়, যখন তার শরীরের কোনো একটি অংশ তার কার্যক্ষমতা হারিয়ে ফেলে। তিনি আরও বলেছেন, শরীরের একটি রোগ ক্রমে অন্য রোগে রূপান্তরিত হতে পারে। এটা আধুনিক চিকিৎসাশাস্ত্রেও স্বীকার করা হয়েছে। শরীরের একটি রোগ ক্রমে অন্য আরও জটিল রোগের জন্ম দিতে পারে।

অতীতে অনেক জটিল রোগের নিরাময় করা সম্ভব হতো না। কারণ, আধুনিক কারিগরি জ্ঞানের অভাবে এসব জটিল রোগের গতিপ্রকৃতি জানা সম্ভব ছিল না। আর তার ফলেই হিপোক্র্যাটিসের মতো সেকালের চিকিৎসাশাস্ত্রবিদদের পক্ষেও এসব রোগের নিরাময় করা সম্ভব হতো না। কারণ, তাদের জ্ঞান ছিল সীমাবদ্ধ এবং চিকিৎসাপদ্ধতিতেও ছিল না শৃঙ্খলা।

তবু হিপোক্র্যাটিসকেই চিকিৎসাশাস্ত্র বা মেডিসিনের আদি জনক বলা হয়। এ-রকমটা বলার কারণ হলো, সেকালের সীমিত জ্ঞান নিয়েও তিনিই সর্বপ্রথম রোগের কারণ নির্ণয় ও চিকিৎসাপদ্ধতিতে একটি নিয়ম বা নীতিমালা প্রণয়ন করতে সক্ষম হয়েছিলেন। তাঁর প্রণীত নিয়ম-শৃঙ্খলাগুলো ছিল সম্পূর্ণ বাস্তবসম্মত এবং বিজ্ঞানভিত্তিক।

কিন্তু তবু একটা প্রশ্ন থেকেই যায়। আর সেটা হলো, হিপোক্র্যাটিস কি তা হলে সত্যি সত্যি চিকিৎসাশাস্ত্রকে বিজ্ঞানভিত্তিক করতে সক্ষম হয়েছিলেন?

এর উত্তর হলো হ্যাঁ, কথাটা সত্যি। অবশ্য এখানে তাঁর অবদান ছিল খুবই সামান্য। তিনি বিষয়টির সূত্রপাত করেছিলেন মাত্র। বিরাট সাফল্যজনক কিছু করতে সক্ষম না হলেও অবশ্যই বলতে হবে, হিপোক্র্যাটিস চিকিৎসাশাস্ত্রের আদিতে যে সামান্য প্রাথমিক অবদানটুকু রাখতে সক্ষম হয়েছিলেন, তা যদি না হতো তা হলে চিকিৎসাশাস্ত্রের আধুনিকায়নের ভিত্তি স্থাপনের কাজটিও অনেক দেরিতে হতো। ফলে চিকিৎসাশাস্ত্রের আজকের অগ্রগতিও নিঃসন্দেহে এতদূর আসতে পারত না। আর সেকারণেই তাঁকে চিকিৎসাশাস্ত্রের আদি জনক বলা হয় এবং সে মর্যাদা তাঁর অবশ্যই প্ৰাপ্য।

এই মহান জ্ঞানসাধকের বাণী ছিল : “জীবন খুব সংক্ষিপ্ত, কিন্তু শিক্ষা দীর্ঘতর। সুযোগ চলে যাচ্ছে। পরীক্ষানিরীক্ষা করা বিপজ্জনক এবং বিচার-বিবেচনা করাও খুব কঠিন কাজ। তবু আমাদের তৈরি থাকতে হবে, সে শুধু আমাদের নিজের সুখের জন্য নয়, অন্যের জন্যও।”

হিপোক্র্যাটিসের মৃত্যু হয় ৩৭০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *