ধর্ম ও দর্শন
বিজ্ঞান
সাহিত্য
1 of 2

বারট্রান্ড রাসেল (১৮৭২–১৯৭০ ) – যুদ্ধ-বিরোধী ও মানবতাবাদী দার্শনিক

বারট্রান্ড রাসেল (১৮৭২–১৯৭০ ) – যুদ্ধ-বিরোধী ও মানবতাবাদী দার্শনিক

বারট্রান্ড রাসেল (Bertrand Russell) তাঁর আত্মজীবনীর একটা জায়গায় নিজের কথা বলতে গিয়ে বলেছেন, “একেবারে সাধারণ কিন্তু প্রচণ্ড শক্তিশালী তিনটি অনুভূতি আমার জীবনকে সতত পরিচালিত করেছে। এগুলো হলো, প্রেমের জন্য প্রবল আকাঙ্ক্ষা, জ্ঞানের জন্য সীমাহীন অনুসন্ধিৎসা এবং আর্তমানবতার জন্য মর্মবেদনা।

আসলে এই আবেগগুলোই তাঁকে সর্বক্ষণ প্রচণ্ড বেগে তাড়িয়ে নিয়ে গেছে আপন স্বেচ্ছাচারিতার দিকে। এই তাড়না থেকেই তিনি করেছেন জ্ঞানের সাধনা, আকুল হয়েছেন প্রেমের জন্য। এই প্রেম ও জ্ঞানই তাঁকে কখনও কখনও আকাশচারী করলেও আর্তমানবতার প্রতি মর্মবেদনা তাঁকে পরমুহূর্তে টেনে নামিয়ে এনেছে পৃথিবীর মাটির ওপর।

তিনি মনে করতেন, মানুষের মধ্যে তাঁর জন্মলগ্নে যে প্রবণতা ও প্রবৃত্তির জন্ম নেয়, তা-ই পরবর্তীকালে শিক্ষার মাধ্যমে পরিমার্জিত ও পরিশীলিত হয়। তাই মানবপ্রেমকে রাসেল সবকিছুর ওপরে স্থান দিয়েছেন।

বারট্রান্ড রাসেলের জন্ম হয়েছিল সমাজের এক অভিজাত পরিবারে ১৮৭২ সালের ১৮ মে। বাবা ছিলেন ভিসকাউন্ট অ্যামবার্লি এবং মা ছিলেন লেডি কেট স্ট্যানলি। লেডি কেট ছিলেন অলডার্নের লর্ড স্ট্যানলির মেয়ে। ব্রিটেনের এক লর্ড পরিবার থেকে এসেছিলেন তাঁর মা।

রাসেলের বাবাও ছিলেন লর্ড পরিবারের সদস্য। রাসেলের পিতামহ ছিলেন লর্ড জন রাসেল এবং পিতামহী ছিলেন লেডি রাসেল। বারট্রান্ডের জন্মের পর তাঁর নাম রাখা হয়েছিল গালাহাড (Galahad)। কিন্তু পিতামহী লেডি রাসেলের আপত্তির কারণে পরে পারিবারিক ঐতিহ্য অনুসারে রাখা হয় বারট্রান্ড রাসেল।

রাসেলের যখন মাত্র এক বছর বয়স, তখনই তাঁর পিতার মৃত্যু হয়। তখন তাঁকে লালনপালন করার জন্য পাঠানো হয় রিচমন্ড পার্কের পেমব্রোক লজে বসবাসকারী তাঁর পিতামহ লর্ড জন রাসেলের কাছে।

এখানে এসে তিনি পরম আদর-যত্ন এবং ঐশ্বর্যের মধ্যে পড়লেও তাঁকে পিতামহীর কড়া শাসনের শৃঙ্খলে আবদ্ধ হতে হয়। পিতামহী ছিলেন কঠোর নিয়মনীতি মানা এক মহিলা। সকলের ওপরে তাঁর কড়া শাসন। এমনকি পিতৃহীন নাতিকেও তাঁর কড়া শাসনের আওতায় চলতে হতো। বাড়ির সর্বত্র ছড়িয়ে ছিল রাজকীয় পরিবেশ। ছিল রাজনৈতিক কর্মতৎপরতা। রাজনীতি নিয়ে মেতে থাকতেন তাঁর পিতামহ আর পিতামহী দু-জনেই।

রাসেল এই বাড়ির পরিবেশে এসে বুঝতে পেরেছিলেন, তাঁর এমনই এক পরিবারে জন্ম, যাদেরকে দেশের সাধারণ মানুষ সম্পর্কে ভাবতে হয়। সাধারণ মানুষের ভাগ্য ও দেশের উন্নয়নে তাঁদের অনেক কিছুই করণীয় আছে।

কিন্তু তবু বাড়ির সার্বিক পরিস্থিতির সাথে নিজেকে পুরোপুরি খাপ খাওয়াতে পারলেন না তিনি। রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড নিয়ে মেতে থাকতেও ভালো লাগত না তাঁর। তিনি সবার কাছ থেকে নিজেকে আড়াল করে থাকতে চাইতেন। তাঁর ভালো লাগত একা থাকতে। আরও বড় কথা হলো, তিনি বাল্যকালে ছিলেন অসম্ভব রকমের লাজুক। দশজনের সঙ্গে কথা বলার চেয়ে ঘরে বসে বই পড়তে তাঁর বেশি ভালো লাগত। বই পড়ার এমন একটা সুযোগ তাঁর এসেও গেল। দাদুর বাড়িতে ছিল মস্তবড় একটি পারিবারিক গ্রন্থাগার। সাহিত্য, দর্শন, বিজ্ঞান, ইতিহাস—নানা বিষয়ের ওপর অজস্র বই ছিল এখানে।

রাসেল যেন এখানেই পেয়ে গেলেন সোনার খনির সন্ধান। তিনি সবার চোখের আড়াল হয়ে পড়ে থাকতেন গ্রন্থাগারে। ডুবে থাকতেন জ্ঞানের সমুদ্রে।

ছোটবেলায় তিনি কেমন লাজুক ছিলেন, সে সম্পর্কে তাঁর বড় ভাই ফ্রাঙ্ক তাঁর স্মৃতিকথায় লিখেছেন, “কেমব্রিজে যাওয়ার আগ পর্যন্ত সে ছিল যেন একটা বাচ্চা শূকরের মতো, যে নিজের খাবারটাও নিজে তুলে খেতে পারত না।”

পড়ার প্রতি প্রচণ্ড আগ্রহের কারণে বাল্যকালেই গণিত, জ্যামিতি এবং অ্যালজেবরার মতো নীরস বিষয়গুলোও তাঁর কাছে প্রিয় হয়ে ওঠে। প্রাচীন অঙ্কশাস্ত্রবিদ ইউক্লিড-এর জটিল সমাধানগুলো তিনি কলেজে প্রবেশ করার আগেই আয়ত্ত করে ফেলেন।

আসলে তাঁর ছিল অসম্ভব মেধা এবং জ্ঞানচর্চার প্রতি নিষ্ঠা। কিন্তু এই অধিক পড়াশোনার কারণেই মাত্র ষোল বছর বয়সেরই তাঁর চোখ খারাপ হয়ে যায়, যার ফলে ডাক্তারের পড়ামর্শে তাঁকে কিছুদিনের জন্য পড়াশোনা থেকে বিরত থাকতে হয়।

কিন্তু রাসেলের জ্ঞানস্পৃহা এতই প্রবল ছিল যে, পড়াশোনা বন্ধ করা তাঁর পক্ষে সম্ভব হল না। অবশ্য তিনি ডাক্তারের পড়ামর্শকেও উপেক্ষা করতে পারলেন না। তাই একটু কৌশল পরিবর্তন করলেন। তিনি অঙ্কশাস্ত্র অধ্যায়ন ছেড়ে এবার মন দিলেন সাহিত্য ও দর্শনের দিকে।

চোখের অসুখের জন্য তিনি নিজে পড়তে পারতেন না। তাই আরেকজন বই পাঠ করত আর তিনি চোখ বুজে শুনতেন। এভাবেই তাঁর সাহিত্য ও দর্শনের পাঠ হতো। তিনি কান দিয়ে শ্রবণ করে হৃদয় দিয়ে তা অনুভব করতেন।

এই সময় থেকেই তিনি ইংল্যান্ডের অন্যতম শ্রেষ্ঠ দার্শনিক ও লেখক স্টুয়ার্ট মিলের রচনা পড়তে শুরু করেন। সেইসাথে অন্যান্য লেখকের রচনাও।

তিনি বুঝতে পারলেন, জ্ঞান লাভ করা কোনো অলৌকিক কাজ নয়। জ্ঞান হলো অভিজ্ঞতার ফসল। অভিজ্ঞতা থেকেই জ্ঞান জন্ম নেয়।

এমনি করে চোখের অসুখ জ্ঞানপিপাসু রাসেলের জন্য শাপে বর হয়ে দাঁড়াল। সাহিত্য ও দর্শন পড়ার পর তাঁর জ্ঞান আরও সম্প্রসারিত হলো। অঙ্কশাস্ত্রের জ্ঞানের সঙ্গে এবার সংযোজিত হলো সাহিত্য ও দর্শন। জ্ঞানের ক্ষেত্রে এলো পরিপূর্ণতা।

বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রবেশের আগে তাঁর পিতামহী লেডি জনের নির্দেশ মতো তাঁকে পাঠানো হলো একজন গৃহশিক্ষকের কাছে। সেখানে তিনি শিখতে লাগলেন ল্যাটিন ও গ্রিক ভাষা। এছাড়াও তিনি এরই মধ্যে নিজের চেষ্টাতেই জার্মান, ফরাসি এবং ইতালিয়ান ভাষাও শিখে ফেলেছিলেন।

তারপর তাঁর বয়স যখন ১৮, তখন তাঁকে ভর্তি করানো হল ট্রিনিটি কলেজে। এই কলেজ সম্পর্কে মন্তব্য করতে গিয়ে রাসেল পরবর্তী সময়ে বলেছেন, “এটি হলো জ্ঞানের এক সীমাহীন জগৎ।” এই সীমাহীন জগতেই এবার তাঁর অভিযানের জাহাজ ভাসালেন রাসেল। ট্রিনিটি কলেজে এসে তাঁর ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক হলো হেগেলের দার্শনিক মতবাদে বিশ্বাসী ম্যাক টাগার্ট এবং অপর আরেক গুণী ব্যক্তি জি. ই. মুরে সঙ্গে।

আগেই বলেছি, প্রথম জীবনে রাসেল ছিলেন অত্যন্ত লাজুক প্রকৃতির। কারও সঙ্গে কথা বলতে গেলে আড়ষ্ট হয়ে পড়তেন। বিশেষ করে মেয়েদের সাথে কথা বলতে গেলে তাঁর আরও মুশকিল হতো। কোনো মেয়ের প্রেমে পড়লে তাঁর সাথেও গুছিয়ে কথা বলতে পারতেন না। তবু এরই মধ্যে কলেজের অ্যালিস পিয়ার্সাল স্মিথ নামের একটি মেয়ের সাথে তাঁর সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ হয়ে গেল। গভীর প্রেমে পড়ে গেলেন তিনি।

কিন্তু লর্ড পরিবারের শাসনকর্ত্রী লেডি জন এসব প্রেম নিয়ে ছেলেখেলা একেবারে পছন্দ করতেন না। তাঁর ভাষায়, পথেঘাটে ছেলেমেয়েদের প্রেম করে বেড়ানো খুবই খারাপ কাজ—খুবই খারাপ। এবার স্বয়ং তাঁর নিজের নাতিই এই ঘটনা ঘটিয়ে বসেছে। ক্ষমা করলেন না লেডি জন। নাতির মাথা থেকে যাতে করে প্রেমের ভূত নামিয়ে ফেলা যায়, সে ব্যাপারে কৌশল অবলম্বন করলেন।

রাসেলের ট্রিনিটি কলেজে পড়াশোনা তখন শেষ হয়েছে। এই সাথে শেষ হয়েছে তাঁর ছাত্র জীবনেরও। তাই লেডি জন তাড়াতাড়ি করে নিজেই তদ্বির করে নাতির জন্য একটি চাকরি জোগাড় করে ফেললেন। প্যারিসে ব্রিটিশ দূতাবাসে চাকরি। তাঁর চালাকি ছিল—রাসেলকে মেয়েটার কাছ থেকে দূরে সরিয়ে ফেলা। ছাড়াছাড়ি হয়ে গেলে প্রেমের বাতি আপনা থেকেই নিবে যাবে।

প্রথমে রাসেলকে বাধ্য হয়েই চাকরি নিয়ে প্যারিসে যেতে হলো। কিন্তু অ্যালিসের প্রেমের আকর্ষণ শেষ পর্যন্ত লেডি জনের চোখ রাঙানিকেও হারিয়ে দিল। প্রেমেরই জয় হলো। রাসেল মাস কয়েক পরেই কাউকে কিছু না জানিয়ে চলে এলেন লন্ডনে। তারপর লন্ডনে এক বন্ধুর বাড়িতে উঠে ১৮৯৪ সালের ডিসেম্বর মসে গোপনে অ্যালিসকে বিয়ে করে ফেললেন।

পরে একেবারে বউ নিয়ে গিয়ে হাজির হলেন শাসনকর্ত্রী লেডি জনের সামনে। সেই মুহূর্তে তিনি অবশ্য কিছু বলেননি। বরং রোগা-পটকা আর বইয়ের পোকা নাতিটার সাহস দেখে নিজেও খুশি হয়েছিলেন। ঘরে তুলেছিলেন নাতবৌকে। তাঁকেও আর চাকরি নিয়ে প্যারিস যেতে হয়নি। লেডি জন তাঁকে ক্ষমা করে দিয়েছিলেন।

সবদিকেই রাসেলের জ্ঞানের প্রসারতা ছিল। কিন্তু প্রথম দিকে তাঁর আগ্রহ বেশি ছিল অঙ্কশাস্ত্রের ওপর। প্রথম জীবনে অঙ্কের উপরই তাঁর সাফল্য আসে। তাঁর যখন মাত্ৰ ৩৮ বছর বয়স, তখনই অঙ্কশাস্ত্রের ওপর প্রকাশিত হয় তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ ‘প্ৰিন্সিপিয়া ম্যাথিম্যাটিকা’ (Principia Mathematica)। তিন খণ্ডে সমাপ্ত এই বিশাল গ্রন্থে তাঁর সহযোগী লেখক ছিলেন সহপাঠী এ. এন. হোয়াইটহেড (A. N. Whitehead)।

এই গবেষণাগ্রন্থটি রচনা করতে তাঁদের সময় লেগেছিল দীর্ঘ সাত বছর। বইটি লেখা সম্পর্কে রাসেল বলেছেন, এর রচনার পূর্ব-প্রস্তুতি গ্রহণের জন্যই আমাদের সময় লেগেছে দু বছর। কাজে হাত দিয়ে লেগে যায় আরও পাঁচ বছর।

এই পুস্তকে তিনি গণিতের অতি সূক্ষ্ম যুক্তিকে যেভাবে বিশ্লেষণ করেছেন, তা বিশেষজ্ঞ মহলে সেকালে প্রচণ্ড আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল। রাসেল তাঁর লিখিত এই গ্রন্থে অসাধারণ পাণ্ডিত্যের পরিচয় দিয়েছেন

আগেই উল্লেখ করা হয়েছে, তাঁদের লর্ড পরিবার ছিল রাজনীতির সাথে জড়িত। তাই পারিবারিক ঐতিহ্য রক্ষার জন্য রাসেলও একসময় রাজনীতিতে নামার চেষ্টা করতে লাগলেন। ১৯০৭ সালে তিনি নারী স্বাধীনতা আন্দোলনের মুখপাত্র হিসেবে ‘ন্যাশনাল ইউনিয়ন অব উওম্যান’স সাফ্রেজ সোসাইটিজ’-এর মনোনয়ন নিয়ে পার্লামেন্টের নির্বাচনে অংশ নিলেন।

কিন্তু মহিলাদের ভোটাধিকার সংক্রান্ত সমিতির মনোনয়ন পেলেও শহরের কোনো মহিলা ভোটার তাঁকে তেমন পছন্দ করলেন না। তিনি ৭০০০ ভোটে হেরে গেলেন।

নির্বাচনে হেরে গিয়ে প্রথমটায় খুব দুঃখ পেলেন তিনি। পরে খেপে গেলেন। জেদ ধরলেন, যেমন করে হোক হাউস অব কমন্সে তাঁকে প্রবেশ করতেই হবে।

১৯১০ সালে অনুষ্ঠিত হাউস অব কমন্সের নির্বাচনী তাঁর স্থানীয় নির্বাচনী এলাকা থেকে আবার প্রার্থী হলেন রাসেল। কিন্তু এবারও জিততে পারলেন না। তাঁর বিরুদ্ধে এই বলে অভিযোগ উঠল যে, লোকটা পণ্ডিত হতে পারেন, ভালো অঙ্কও হয়তো জানেন, কিন্তু ধর্মকর্ম সম্পর্কে বিন্দুমাত্র জ্ঞান নেই। জীবনে কখনও গির্জার বারান্দায় পর্যন্ত প্রবেশ করেননি। এমন ধর্মহীন লোক পার্লামেন্টে যাবে কেন?

দ্বিতীয়বারের নির্বাচনে হেরে গিয়ে রাসেল এবার আরও খেপে গেলেন। জ্ঞানসাধনায় নিমগ্ন থাকার কারণে ধর্মকর্মের দিকে নজর দেওয়া তাঁর পক্ষে সম্ভব হচ্ছে না, তাই বলে তিনিতো সমাজতন্ত্রী নন!

কিন্তু লোকে যখন তাঁকে ধর্মহীন আর সমাজতন্ত্রী বলতেই শুরু করছে, তখন তিনি প্রকাশ্যেই নিজেকে সমাজতন্ত্রী বলেই ঘোষণা দিয়ে বসলেন এদিন।

শুধু সমাজতন্ত্র নয়, তাঁর আরও কিছু কিছু মতবাদ ছিল, যেগুলো সমাজের উচ্চ বা বুদ্ধিজীবীমহলে বাহবা পেলেও সাধারণ রক্ষণশীল মানুষ তখনও গ্রহণ করতে শেখেনি। আর সেই কারণেই অতি সাধারণ মানুষের কাছে তাঁর জনপ্রিয়তা ছিল না, যা একজন রাজনীতিবিদের থাকতে হয়। যা না থাকলে নির্বাচনে জয়লাভ করা যায় না।

বিয়ে সম্পর্কে তাঁর নিজস্ব মতবাদ ছিল। তিনি তাঁর ‘ম্যারেজ অ্যান্ড মরাল’ (Marriage and Moral) গ্রন্থে সব ধরনের শাসন, শোষণ ও উৎপীড়ন থেকে মুক্ত জীবন চেয়েছেন। তিনি প্রথাসিদ্ধ নৈতিকতার বিরুদ্ধেও বক্তব্য রেখেছেন। তিনি নর- নারীর মধ্যে বিদ্যমান বিবাহপ্রথারও বিরোধিতা করেছেন। তাঁর মতে, বিবাহ মানুষের ব্যক্তিস্বাধীনতাকে ক্ষুণ্ণ করে। তিনি স্বামী-স্ত্রীর কথা উল্লেখ করেছেন বটে, কিন্তু বিবাহের নামে সামাজিক বন্ধন মানতে চাননি—যদিও তিনি নিজেও বিয়ে করেছিলেন। শুধু এক বিয়ে নয়, তিনি পরপর চারটি বিয়ে করেছিলেন। প্রথম স্ত্রী অ্যালিসের কাছ থেকে তিনি আলাদাভাবে বসবাস করতে থাকেন ১৯১০ সাল থেকে। কিন্তু তাঁর সাথে আনুষ্ঠানিক বিবাহবিচ্ছেদ ঘটে এরও বহু বছর পরে ১৯২১ সালে। অ্যালিসের সাথে বিবাহবিচ্ছেদের পরই তাঁর চিন্তাধারা নতুন মোড় নিতে থাকে। তিনি পুরোপুরি সমাজতন্ত্রের দিকে ঝুঁকে পড়েন।

এরই মধ্যে শুরু হয়ে যায় প্রথম বিশ্বযুদ্ধ। তিনি এবার নেমে পড়লেন যুদ্ধ-বিরোধী আন্দোলনে।

তিনি তাঁর নিজস্ব ধনতন্ত্রবাদী পরিমণ্ডল থেকে বের হয়ে সমাজতন্ত্র ও মানবতাবাদী ধ্যান-ধারণা ও বিশ্বাসের সাথে গড়ে তুললেন নতুন সম্পর্ক। তাঁর নতুন চিন্তাধারার বন্ধুদের মধ্যে ছিলেন সিডনি, বিয়োট্রিস ওয়েব, বার্নার্ড শ, চার্লস ট্র্যাভেলিয়ান এবং হারবার্ট স্যামুয়েল প্রমুখ।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের বিভীষিকা ও ধ্বংসযজ্ঞ তাঁর পুরাতন চিন্তা-চেতনাকে সম্পূর্ণ ভেঙেচুরে দিয়ে যায়। তিনি হয়ে ওঠেন একজন পুরোপুরি যুদ্ধ-বিরোধী মানুষ। যুদ্ধের বিরুদ্ধে তিনি বক্তব্য পেশ করতে শুরু করলেন উগ্রভাবে, অনেকটা খ্যাপার মতো করেই। তাই অচিরেই তিনি সারা দেশে একজন ভয়ঙ্কর মানুষ বলে পরিচিতি লাভ করলেন।

যুদ্ধ-বিরোধী আন্দোলনকে জোরদার করার জন্য তিনি ‘নো কনসক্রিপশন ফেলোশিপ’ নামে একটি সংগঠনও গড়ে তোলেন। সংগঠনটির লক্ষ্য ছিল কেউ যেন সেনাবাহিনীতে যোগদান না করে। এটা ছিল তাঁর বিশ্ব থেকে সেনাবাহিনী বিলোপ করার আন্দোলন। সৈন্য না থাকলে যুদ্ধও থাকবে না। এই উদ্দেশ্যে প্রচার চালানোর জন্যই তিনি একটি যুদ্ধ-বিরোধী প্রচারপত্রও ‘লেবার লিডার’ নাম দিয়ে প্রকাশ করেন। এতে প্রকাশিত নিবন্ধাদির মাধ্যমে তিনি যুদ্ধের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ জানাতে থাকেন।

এই প্রচারপত্র বিলি করার অপরাধে তিনি ১৯১৬ সালের ১৫ জুন গ্রেফতার হন। বিচারে তাঁর ১০০ পাউন্ড জরিমানা হয়। শুধু তাই নয়, এর ফলে ট্রিনিটি কলেজের অধ্যাপকের পদটিও তাঁকে হারাতে হয়।

কিন্তু তাতেও পরোয়া করলেন না রাসেল। তিনি তখন খ্যাপার মতো নেমেছেন আন্দোলনে। ব্রিটিশ সরকারও তাঁর প্রতি খুব অসন্তুষ্ট হলেন।

এই সময় আমেরিকার হারভার্ড কলেজ থেকে তাঁকে বক্তৃতাদানের জন্য আমন্ত্রণ জানানো হলো। কিন্তু ব্রিটিশ সরকার তাঁকে আমেরিকা যাওয়ার পাসপোর্ট দিলেন না।

এর পরেও তিনি দমলেন না। ১৯১৭ সালের শেষের দিকে আরও উগ্র ভাষায় যুদ্ধ- বিরোধী বক্তব্য দিয়ে ‘দি ট্রাইবুনাল’ নামে আরেকটি প্রচারপুস্তিকা প্রকাশ করলেন। এই অপরাধে আবার তাঁকে গ্রেফতার করা হলো এবং তাঁর সশ্রম কারাদণ্ড হলো ছয় মাসের।

তবে জেলে থাকার সময়টা তিনি পুরোপুরি কাজে লাগালেন। এখানে বসেই তিনি বেশ কয়েকটি বই লিখে ফেললেন। যেমন ‘ইনট্রোডাকশন টু ম্যাথেম্যাটিক্যাল ফিলোসফি’ (Introduction to Mathematical Philosophy), দেওয়ে (Dewey) রচিত ‘এসেস ইন এক্সপেরিমেন্টাল লজিক’ (Essays in Experimental Logic) গ্রন্থের আলোচনা এবং ‘অ্যানালাইসিস অব মাইন্ড’ (Analysis of Mind) নামে একটি দর্শনগ্রন্থ।

প্রথম মহাযুদ্ধের পর থেকে রাসেল পুরোপুরি সমাজতন্ত্রী হয়ে গেলেন। তিনি বলতেন, দেশে যে শিল্পায়ন হচ্ছে তার পুরো কাজটাই শ্রমিক শ্রেণী করছে, সেখানে সরকারের কোনো কৃতিত্ব নেই। তিনি রুশ বিপ্লবের আদর্শের প্রতি প্রচণ্ডভাবে শ্রদ্ধাশীল হয়ে পড়েন। ১৯২০ সালে তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের পক্ষ থেকে তাঁকে সোভিয়েত সফরের আমন্ত্রণ জানানো হয়।

তিনি রাশিয়ায় যান এবং রুশ নেতা লেনিনের সাথে সক্ষাৎ করেন। লেনিনের সাথে সৌজন্য সাক্ষাৎকালে তিনি বলেন, ব্রিটেনেও সমাজতন্ত্র কায়েম করা সম্ভব। কিন্তু লেনিন তাঁর এই প্রস্তাবের প্রতি কোনো গুরুত্ব দেননি। বলেছিলেন, এসব উদ্ভট চিন্তাভাবনা এখন রাখুন।

তাঁর রুশ সফরের অভিজ্ঞতার ওপর ভিত্তি করেই তিনি একটি গ্রন্থ রচনা করেন। নাম “দি প্র্যাকটিস অ্যান্ড থিওরি অব বলশেভিজম’ (The Practice and Theory of Bolshevism)। ওই একই বছর (১৯২০) তিনি চীনও সফর করেন। চীনে বেসরকারি অতিথি হওয়া সত্ত্বেও তাঁকে দেওয়া হয় রাষ্ট্রীয় অভ্যর্থনা ও সম্মান।

পিকিং বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা তাঁর আগমন উপলক্ষে একটি বিশেষ ম্যাগাজিন প্রকাশ করে ‘রাসেল ম্যাগাজিন’ নাম দিয়ে এবং তাঁর সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে প্রেসিডেন্ট সানইয়াৎ সেন বলেন, ‘গোটা ব্রিটিশ জাতির মধ্যে রাসেলই প্রথম ব্যক্তি, যিনি … চিনকে অনুধাবন করতে সক্ষম হয়েছেন। ‘

তিনি দেশে ফিরে গিয়ে চিন সফরের অভিজ্ঞতার ওপরও ‘দি প্রব্লেম অব চায়না’ (The Problem of China) শীর্ষক একটি বই শেখেন।

চীন সফরে গিয়ে এক মজার ঘটনা হয়েছিল। তিনি সহসা ঠাণ্ডা লেগে অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন। ক্রমে তাঁর অসুখ এমন খারাপ পর্যায়ে এসে পৌঁছুল যে পত্রিকাতে একদিন খবর রটে গেল ব্রিটিশ সমাজতন্ত্রী বারট্রান্ড রাসেল মারা গেছেন। তাঁর মৃত্যুর খবর তিনি নিজেই পাঠ করলেন পত্রিকায়। এই সময় তাঁর সফরসঙ্গী ছিলেন নতুন প্রেমিকা (পরবর্তীকালে দ্বিতীয় স্ত্রী) ডোরা ব্ল্যাক। ডোরার সেবাযত্নে অবশেষে তিনি ভালো হয়ে দেশে ফিরে এলেন।

দ্বিতীয় স্ত্রী ডোরাকে নিয়েই ১৯২৭ সালে লন্ডনে ‘বেকন হিল স্কুল’ একটি শিক্ষায়তন প্রতিষ্ঠা করেন। পরবর্তী সময়ে এটি ‘প্রগেসিভ স্কুল’ নামে পরিচিত হয়ে ওঠে।

ট্রিনিটি কলেজের চাকরি চলে যাওয়ার পর থেকে তিনি লেখালিখি করেই জীবিকা নির্বাহ করতে শুরু করেন। ১৯৩০ সালের মধ্যে তিনি রচনা করেন “দি কনকোয়েস্ট অব হ্যাপিনেস’ (The Conquest of Happiness), ‘ইন প্রেইজ অব আইডলনেস’ (In Praise of Idleness) ও ‘রিলিজিয়ন অ্যান্ড সায়েন্স’ (Religion and Science) ইত্যাদি গ্ৰন্থ।

প্রথম মহাযুদ্ধের পর রাসেল তাঁর দ্বিতীয় স্ত্রী এবং তিন সন্তানকে পঠিয়ে দিয়েছিলন আমেরিকায়। তিনি নিজেও ছয় বছর কাটিয়ে এসেছিলেন ওখানে। কিন্তু মজার ঘটনা হলো, রাশিয়া কিংবা চীনে দুদিনের সফরে গিয়েই সে দুটি দেশ সম্পর্ক আস্ত আস্ত বই লিখে ফেলেছিলেন। কিন্তু আমেরিকায় ছয় বছর থেকেও দেশটি সম্পর্কে একটি পাতাও লিখতে পারেনি।

১৯৪০ সালে তিনি ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপক হিসেবে যোগদান করেছিলেন। এর পরের বছর ১৯৪১ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে তিনি যোগদান করেন কলেজ অব নিউ ইয়র্ক সিটিতে। তিনি এখানে ছিলেন ১৯৪২ সালের জুন পর্যন্ত। এখান থেকেই তিনি অবসর গ্রহণ করেন।

আমেরিকাতে চাকরি করতে এসেও তাঁকে কম হয়রানির সম্মুখীন হতে হয়নি। ১৯৪০ সালে তাঁকে বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকরি দেওয়ার বিরুদ্ধে স্থানীয় গির্জার পাদরিরা এই বলে তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ আনেন যে, তাঁকে এদেশে চাকরি দেওয়া যাবে না, কারণ, তিনি আমেরিকার নাগরিক নন। দ্বিতীয়ত তিনি একজন ধর্মবিরোধী ব্যক্তি ও নৈতিকতায় বিশ্বাস করেন না। তৃতীয়ত, তিনি কোনো প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় অংশ নিয়ে উত্তীর্ণ হয়ে যোগ্যতা অর্জন করেননি। কিন্তু তা সত্ত্বেও বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তাঁকে যথাযোগ্য মর্যাদা দিয়েছিলেন।

চাকরি থেকে অবসর নেওয়ার পর হারভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তাঁকে বক্তৃতা দেয়ার জন্য আমন্ত্রণ জানানো হয়। পরে তিনি ১৯৪৩ সালে জনৈক কোটিপতির অধীনে চাকরি নিয়েছিলেন। কিন্তু বেশিদিন সেখানে টিকতে পারেননি।

১৯৪৩ সালেই তিনি রচনা করেন তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ ‘এ হিস্টোরি অব ওয়েস্টার্ন ফিলোসফি’ (A History of Western Philosophy)।

১৯৪৪ সালে আবার ট্রিনিটি কলেজ তাঁকে ডেকে পাঠায়। আবার তিনি সেখানে যোগদান করেন। তখন চলছিল দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ। তিনি আবার পারমাণবিক অস্ত্র- নিরোধের সংগ্রামে যোগ দেন। ১৯৪৮ সালে তিনি পারমাণবিক অস্ত্ররোধের ওপর বিবিসি থেকে ভাষণ দেন।

১৯৪৯ সালে তাঁকে অর্ডার অব মেরিট সম্মানে ভূষিত করা হয় এবং ১৯৫০ সালে তিনি সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার লাভ করেন।

১৯৫২ সালে তিনি চতুর্থবার বিয়ে করেন মিস এডিথ ফিঞ্চ নামের এক মহিলাকে। ১৯৫৯ সালের জানুয়ারিতে তিনি পারমাণবিক অস্ত্রনিরোধের ওপর ওয়েস্ট মিনস্টার সেট্রাল হলে বক্তৃতা দেন।

১৯৭০ সালের ২ ফেব্রুয়ারি ৯৮ বছর বয়সে এই বিশ্ববিশ্রুত মনীষী পরলোকগমন করেন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *