ধর্ম ও দর্শন
বিজ্ঞান
সাহিত্য
1 of 2

রামমোহন রায় (১৭৭২–১৮৩৩) – ভারতবর্ষে নবযুগের প্রবর্তক

রামমোহন রায় (১৭৭২–১৮৩৩) – ভারতবর্ষে নবযুগের প্রবর্তক

যাঁর সুগভীর জীবনাদর্শ একদা কুসংস্কারাচ্ছন্ন অধঃপতিত ভারতবাসীকে দেখিয়েছিল নবজীবনের পথ, স্বদেশ ও স্বজাতির কল্যাণে যাঁর অবদান ছিল অবিস্মরণীয়, তিনিই ভারতের নবযুগের প্রবর্তক রাজা রামমোহন রায়। বলতে গেলে তিনি ছিলেন সমগ্র ভারতের জাতীয় নবজাগরণের অগ্রপথিক।

এই নিরন্তর কর্মযোগী মহাপুরুষের জন্ম ১৭৭২ সালের ১০ মে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের হুগলি জেলার অন্তর্গত আরামবাগ সাবডিভিশনের রাধানগর গ্রামে। এক সম্ভ্রান্ত ব্রাহ্মণ জমিদার বংশে তাঁর জন্ম। পিতার নাম ছিল রাধাকান্ত রায় এবং মাতার নাম তারিণী দেবী।

‘রায়’ নবাব সরকার প্রদত্ত উপাধি। রামমোহনের পূর্বপুরুষ পরশুরাম বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাজে খুশি হয়ে নবাব তাঁকে ‘রায়’ উপাধিতে ভূষিত করেছিলেন। সেই থেকে তাঁরা বন্দ্যোপাধ্যায় বাদ দিয়ে ‘রায়’ উপাধি লিখতে শুরু করেন।

বাল্যকাল থেকেই রামমোহনের লেখাপড়ার প্রতি ছিল প্রবল আগ্রহ। তিনি আট বছর বয়সে গ্রামের স্কুলে বাংলা এবং আরবি ভাষা শেখেন। আরও ভালো করে আরবি ভাষা শেখার জন্য আসেন পাটনায়। এখানে তিনি আরবি এবং ফারসি দুটোতেই ব্যুৎপত্তি লাভ করেন।

তখনকার দিনে ফারসি ভাষা জানা না থাকলে চাকরি পাওয়া যেত না। তাই তাঁর পিতা তাঁকে ফারসি ভাষা শিক্ষা দিয়েছিলেন। অতি অল্প বয়সেই তিনি বাংলা, ফারসি এবং আরবি ভাষা শেখেন।

এরপর বারো বছর বয়সে সংস্কৃত শেখার জন্য কাশীধামে যান। সেখানে চার বছর পড়াশোনা করেন। এই সময় তিনি বেদান্ত শাস্ত্রাদির ওপরেও গবেষণা করেন। রামমোহন সনাতন ধর্মের প্রচলিত সাকার উপাসনা পদ্ধতির বিরোধী ছিলেন। তিনি মূর্তিপূজা মানতেন না। এ সম্পর্কে মতবাদ ব্যক্ত করে তিনি “হিন্দুদিগের পৌত্তলিক ধর্মপ্রণালী’ নামে একটি বইও রচনা করেন। কিন্তু এই বই পড়ে রামমোহনের পিতা ছেলের ওপর ভয়ানক রুষ্ট হন এবং তাঁকে বাড়ি থেকেই বের করে দেন। পিতার সাথে মতানৈক্য হওয়ার পর রামমোহন আবার বেরিয়ে পড়েন পথে। ঘুরে বেড়াতে থাকেন এখানে-সেখানে। ঘুরতে ঘুরতে তিনি চলে আসেন তিব্বতে। এখানে এসেছিলেন তিনি বৌদ্ধধর্ম অনুশীলন করার জন্য। কিন্তু এই ধর্মেরও সবকিছু তিনি বিনা দ্বিধায় মেনে নিতে পারেন নি। তিব্বতে গিয়েও তিনি প্রচার করতে থাকেন এক নিরাকার ঈশ্বরের কথা। এতে করে তিব্বতের বৌদ্ধ ভিক্ষুরা তাঁর প্রতি অসন্তুষ্ট হয়ে ওঠেন। এমনকি কোনো কোনো উগ্র বৌদ্ধ ভিক্ষু তাঁকে হত্যা করার ষড়যন্ত্র পর্যন্ত করতে থাকেন।

এই দুঃসংবাদ কানে গেল পিতা রাধাকান্তের। তিনি বহুকষ্টে লোক পাঠিয়ে ছেলে রামমোহনকে দেশে ফিরিয়ে আনেন। তিব্বতে কয়েক বছর থেকে আবার তিনি ফিরে আসেন ভারতে। শেখেন ইংরেজি ভাষা। মাত্র তেইশ বছর বয়সে তিনি দশটি ভাষায় পারদর্শিতা লাভ করেন। ইরেজি, বাংলা, আরবি ছাড়াও তিনি গ্রিক, হিব্রু, ল্যাটিন, ফারসি এবং উর্দু ভাষাতেও লিখতে-পড়তে পারতেন। রামমোহনের ইংরেজি রচনা পড়ে তৎকালীন কলকাতার হিন্দু কলেজের ইংরেজি ভাষার অধ্যাপক ডি. রোজারিও পর্যন্ত অবাক হয়ে গিয়েছিলেন। তিনি ছিলেন আমাদের এই উপমহাদেশের প্রথম ‘লিঙ্গুয়িস্ট’ বা বহু ভাষাবিদ। বাংলা গদ্যেরও তিনি জনকরূপে বিবেচিত।

শিক্ষাজীবন শেষ করে রামমোহন অর্থোপার্জনে মনোযোগী হন। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সিভিলিয়ান কর্মচারীদের মধ্যে জন ডিগবির সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক স্থাপিত হয়। তাঁর অধীনে তিনি রাজস্ব বিভাগের কাজে যোগ দিতে রংপুরে যান। রাজস্ব ও ভূমিসংক্রান্ত বিষয়ে অপূর্ব দক্ষতা ও কর্মকুশলতার জন্য অল্পদিনের মধ্যেই তিনি দেওয়ান পদে উন্নীত হন। রংপুরে কার্যবেপদেশে ছিলেন তিনি ১৮০৫ থেকে ১৮১৪ সাল পর্যন্ত এই সময়।

ডিগবির সাহচর্যে রামমোহনের সমস্ত পুরনো ধ্যান-ধারণা, চিন্তা-চেতনা পাল্টে যায়। বলতে গেলে এই সময়ের মধ্যেই তাঁর নতুন সমাজ-ভাবনা পরিপক্কতা লাভ করে। কিন্তু সাহিত্যসাধনা ও সমাজসংস্কারের কাজে আত্মনিয়োগ করার জন্য চাকরি ছেড়ে দিয়ে তিনি চলে আসেন মুর্শিদাবাদে। পরে কলকাতার মানিকতলায় বাড়ি কিনে সেখানেই বসবাস করতে থাকেন।

রামমোহনের ধর্মমতবাদ নিয়ে তাঁর পারিবারিক জীবনে দেখা দেয় নানারকম অশান্তি। কারণ তিনি সংস্কারমুক্ত মানুষ হলেও তাঁর পিতা রাধাকান্ত ছিলেন গোঁড়া ব্রাহ্মণ। তিনি ছেলের নতুন মতবাদকে মেনে নিতে পারেননি। তাই আবার রামমোহনকে ঘর ছেড়ে বাইরে বের হতে হলো। তিনি আলাদা বাড়ি নিয়ে নিরাকার ব্রহ্মের উপাসনায় আত্মনিয়োগ করলেন।

পারিবারিক বিরোধ কেবল পিতার তাঁর সঙ্গেই ছিল না, এ-নিয়ে মায়ের সঙ্গেও তাঁর বিরোধের শুরু হয়। মা তারিণী দেবীও ছিলেন স্বামীর মতোই গোঁড়াপন্থি।

তারিণী দেবী স্বামীর মৃত্যুর পর আত্মীয়দের প্ররোচনায় ছেলে রামমোহনকে পিতৃ সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত করার চেষ্টা করেন। ব্যাপারটা শেষ পর্যন্ত আদালত পর্যন্ত গড়ায়। পরে মায়ের এই অপচেষ্টা ব্যর্থ হয়।

কিন্তু রামমোহন পিতৃসম্পত্তির অধিকার নিয়ে মামলায় জিতলেও সমুদয় সম্পত্তি আবার মাকেই স্বেচ্ছায় ফিরিয়ে দিয়েছিলেন।

পরে মায়ের মৃত্যুর পর তিনি সেই সম্পত্তি আবার ফিরে পান। এমনকি তাঁর দুই বড় ভাই নিঃসন্তান অবস্থায় মারা গেলে তাঁদের সম্পত্তিও তাঁর অধিকারে আসে। ফলে তাঁর অর্থের অভাব দূর হয়। তখন তিনি চাকরি ছেড়ে দিয়ে সাহিত্যসাধনা, সমাজসংস্কার ও ধর্মপ্রচারে আরো গভীরভাবে মনোনিবেশ করেন।

মুর্শিদাবাদে থাকার সময় ১৮০৩ সালে আরবি ও ফারসি ভাষায় একেশ্বরবাদ সম্পর্কে লিখিত তাঁর প্রথম গ্রন্থ ‘তুফাউল মুহাম্‌হিদ্দিন’ প্রকাশিত হয়।

তখন থেকেই তাঁর সমাজসেবা ও সংস্কারমূলক কাজের শুরু। মানিকতলার বাড়িতেই তিনি প্রথমে ‘আত্মীয় সভা’ নামে একিটি সংঘ প্রতিষ্ঠা করেন এবং কিছুকালের মধ্যে বাংলায় ‘ব্রাহ্মণ পত্রিকা’ এবং ইংরেজিতে ‘East India Gazette’ নামে দুটো পত্রিকা বের করেন।

ব্রাহ্ম মতবাদ প্রচারকে কেন্দ্র করে খ্রিস্টান মিশনারিদের সাথেও রামমোহনের বিরোধ শুরু হয়। এর কারণ ছিল ভিন্ন রকম। এতদিন খ্রিস্টান মিশনারিদের প্রলোভন এবং প্ররোচনায় যেসব নিম্নবর্ণের লোক খ্রিস্টধর্ম গ্রহণ করত, তারা এবার রামমোহনের ধর্মের প্রতি আকৃষ্ট হতে থাকে। এতে করে খ্রিস্টান মিশনারিদের ধর্মান্তরকরণ প্রচেষ্টা বাধাগ্রস্ত হতে শুরু করে। স্বাভাবিক কারণে তারাও রামমোহনের ওপর চটে যান। তিনি একই সাথে গোঁড়া হিন্দুদেরও বিরাগভাজন হতে শুরু করেন। নবদ্বীপ ভাটপাড়া অঞ্চলসহ সমগ্র ভারতের ব্রাহ্মণরাই তাঁকে বিধর্মী বলে গালাগাল দিতে শুরু করেন।

এই প্রবল ও শক্তিশালী বাধাকে অতিক্রম করেও রামমোহন তাঁর ধর্মমতবাদের প্রচারকাজ চালিয়ে যেতে থাকেন নিরলসভাবে। তিনি তাঁর ক্ষুরধার যুক্তি দিয়ে পণ্ডিতমণ্ডলীকে তর্কযুদ্ধে একের পর এক পরাজিত করতে থাকেন।

অবশেষে তাঁরই জয় হতে থাকে। তাঁর প্রতি লোকজনের শ্রদ্ধাও বাড়তে থাকে ক্রমশ। দেশের হিন্দু ধনী সমাজভুক্ত লোকেরা তাঁর ধর্মমত গ্রহণ করতে লাগলেন দলে দলে। রামমোহন তাঁর নব-প্রবর্তিত ধর্মমতবাদের মূল বক্তব্যগুলি গদ্যভাষায় লিখে প্রকাশ করতে লাগলেন।

১৮১৫ থেকে ১৮১৯ সময় পরিসরে তিনি একেশ্বরবাদ ধর্মমত অনুসারে অনুবাদ ও ভাষ্যসহ বেদান্তসূত্র এবং তার অর্থবোধক উপনিষদ প্রকাশে ব্রতী হন। ১৮১৫ সালে তিনি একেশ্বর উপাসনার উদ্দেশ্যে ‘আত্মীয় সভা’ প্রতিষ্ঠা করেন। একেশ্বরবাদের ওপর ভিত্তি করে রামমোহন যে ধর্মমত প্রচার করেন, তার নাম ব্রাহ্মধর্ম। হিন্দুধর্মের নিরাকার ব্রহ্মোপসনাই সর্বোত্তম—এই প্রচারের জন্য রক্ষণশীল হিন্দু সমাজের সঙ্গে তাঁর বিরোধ প্রকট হয়ে ওঠে। এরপর হিব্রুভাষা শিখে বাইবেলের নতুন ব্যাখ্যা দিলে তিনি পাদ্রিদেরও বিরাগভাজন হন। তিনি ১৮২১ সালে ‘ইউনিটারিয়ান কমিটি’ নামক অপর একটি ধর্মসভা প্রতিষ্ঠা করেন।

দেশে পাশ্চাত্য শিক্ষা বিস্তারের জন্য ডেভিড হেয়ার, রামমোহনের একান্ত চেষ্টায় ১৮১৭ সালে কলকাতায় হিন্দু কলেজ স্থাপিত হয় এখানে বিশেষভাবে উল্লেখ করার বিষয় এই যে, “হিন্দু কলেজ’-এর স্থাপন প্রচেষ্টার সঙ্গে একেশ্বরবাদী রামমোহন জড়িত বলে এর হিন্দু সম্প্রদায়ভুক্ত উদ্যোগীরা বেঁকে বসেন। তারা এই বলে আপত্তি তোলেন যে, রামমোহন থাকলে তাঁরা হিন্দু কলেজ প্রতিষ্ঠার সঙ্গে জড়িত থাকবেন না। এটা শুনে রামমোহন বলেন, তবুও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটি প্রতিষ্ঠিত হোক। আমার জন্য কোনো মহতী উদ্যোগ বাধাগ্ৰস্ত হোক আমি তা চাইনা। এমনই মহৎ মনের মানুষ ছিলেন তিনি।

১৮২৭ সালে তিনি প্রতিষ্ঠা করেন ধর্মসমালোচনামূলক প্রতিষ্ঠান ব্ৰাহ্মসভা। ব্রাহ্মসভাই পরবর্তীকালে ব্রাহ্মসমাজ নামে প্রসিদ্ধি লাভ করে। ব্রাহ্মসভার মাধ্যমেই রামমোহন প্রচার করেন তাঁর নতুন ধর্মমতবাদ। তিনি বেদে বর্ণিত অদ্বিতীয় ব্রহ্মের উল্লেখ করে প্রচার করেন যে, ঈশ্বর এক এবং অদ্বিতীয়, তিনিই বেদের ব্রহ্ম। তিনি অদ্বিতীয় ও নিরাকার, এই ব্রহ্মের যাঁরা উপাসক তাঁরা হলেন ব্রাহ্ম। রামমোহন এই ব্রাহ্মধর্মমতবাদেরই প্রতিষ্ঠাতা।

তিনি তাঁর প্রচারিত এই মতবাদ সম্পর্কে ‘ব্রহ্মোপাসনা’ এবং ‘বেদান্ত গ্রন্থ’ নামে দুটো গবেষণাগ্রন্থও রচনা করেন। রামমোহন প্রবর্তিত এই মতবাদ সেকালে প্রচুর আলোড়নও সৃষ্টি করেছিল। আজও ব্রাহ্মধর্ম-মতবাদের অনুসারীদের দেখা মেলে বাংলাদেশ ও ভারতের পশ্চিম বাংলায়।

ব্রাহ্মধর্ম প্রচার ছাড়াও রামমোহনের আর একটি বিশেষ উল্লেখযোগ্য সমাজ- সংস্কারমূলক কাজ হলো সতীদাহ প্রথার নিবারণ। সেকালে সনাতন ধর্মের মধ্যে এই কুপ্রথা প্রচলিত ছিল যে, স্বামী মারা গেলে স্ত্রীকেও স্বামীর সঙ্গে জ্বলন্ত চিতায় আত্মাহুতি দিতে হবে। একেই বলা হতো সহমরণ প্রথা। স্বামীর চিতায় আত্মাহুতি দিয়ে সতী হওয়া—এটা ছিল সনাতন ধর্মের একটা অন্ধবিশ্বাস ও কুসংস্কার। এই বিধানের প্রতিপালনে বাধ্যবাধকতা না থাকলেও অনেক ক্ষেত্রে দুঃখজনকভাবে এর অপপ্রয়োগ করা হতো। রামমোহন এই কুপ্রথার বিরুদ্ধে প্রথমে গড়ে তোলেন আন্দোলন, পরে ১৮২৯ সালে তৎকালীন ব্রিটিশ-ভারতের বড়লাট লর্ড উইলিয়াম বেন্টিঙ্ক-এর সহায়তায় এর বিরুদ্ধে একটি আইন পাস করান। এভাবেই তাঁর অক্লান্ত চেষ্টায় ভারতে হিন্দুসমাজের যুগযুগ ধরে চলে আসা কুখ্যাত সতীদাহ প্রথার বিলুপ্তি ঘটে।

শুধু সতীদাহ প্রথা রোধ করা নয়, তাঁর চেষ্টায় বাংলাদেশের বাল্যবিবাহ, কন্যাপণ এবং গঙ্গায় সন্তান নিক্ষেপের মতো আরও কিছু সমাজিক কুপ্রথাও বন্ধ হওয়ার পথ সুগম হয়।

রাজনীতির ক্ষেত্রে তাঁর মতামত ছিল অতি আধুনিক। জমিদার শ্রেণীর অত্যাচারে জর্জরিত কৃষক সম্প্রদায়ের দুরবস্থার প্রতিকার দাবি করে ব্রিটিশ পার্লামেন্টের কাছে তিনি ১৮৩১ সালে স্মারকলিপি পেশ করেন।

এছাড়া তিনি ছিলেন সংবাদপত্রের স্বাধীনতায় বিশ্বাসী। ১৮১৮ সালে প্রেস রেগুলেশনের প্রতিবাদ করে সুপ্রিম কোর্ট বরাবর তিনি আবেদন পেশ করেন। তিনি বেশ কয়েকটি সংবাদপত্রও প্রকাশ করেন। যেমন : দ্বি-ভাষিক ‘ব্রাহ্মনিক্যাল ম্যাগাজিন ‘ (ইংরেজি ও বাংলায়) ‘ব্রাহ্মণ সেবধি’ (১৮২১), বাংলা ভাষায় ‘সম্বাদ কৌমুদী’ (১৮২১) ও ফারসি ভাষায় ‘মীরাৎ-উল-আখবার’ (১৮২২)।

রামমোহনের জীবনের আরেকটি উল্লেখযোগ্য কাজ হলো ব্রিটিশ কর্তৃক ক্ষমতাচ্যুত মোগল বাদশাহ্ দ্বিতীয় আকবর শাহের বৃত্তির অর্থ বাড়ানোর জন্য বিলেত গমন। তিনি বাদশাহ্ দ্বিতীয় আকবরের প্রতিনিধি হিসেবে বোর্ড অব কন্ট্রোল কোম্পানির বিরুদ্ধে আবেদন জানাবার জন্য ১৮৩০ সালে ইংল্যান্ড গমন করেন।

বিলেত যাবার আগে বাদশাহ্ আকবর শাহ্ই রামমোহনকে ‘রাজা’ উপাধিতে ভূষিত করেন। আর সেই থেকে তিনি রাজা রামমোহন রায় বলেই পরিচিত। বিলেতে অবস্থানকালে তিনি বাদশাহ্ পক্ষে পার্লামেন্টে ভাষন দেন এবং বাদশাহ্ বৃত্তির হার বৃদ্ধি করাতে সক্ষম হন। তিনি ১৮৩১ সালে লন্ডনে উপস্থিত হয়ে দার্শনিক জেরেমি বেনথামের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন।

বাদশার কাজ শেষ করে তিনি ১৮৩২ সালে ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিসে যান। ততদিনে সমগ্র ইউরোপে ছড়িয়ে পড়েছে রাজা রামমোহনের নামডাক। ফ্রান্সের সম্রাট লুই ফিলিপ তাঁর সম্মানে এক ভোজসভার আয়োজন করেন এবং তাঁকে দান করেন রাজোচিত সংবর্ধনা।

পরের বছর তিনি আবার ফিরে আসেন ইংল্যান্ডে। ইংল্যান্ডের ব্রিস্টল শহরে অবস্থানকালেই হঠাৎ করেই তিনি গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং ১৮৩৩ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর ইহলোক ত্যাগ করেন। ব্রিস্টল নগরীর স্টেপলটন গ্রোভে তাঁকে সমাহিত করা হয়।

পরে রবীন্দ্রনাথের পিতামহ প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুর ব্রিস্টল গিয়ে তাঁর পবিত্র মরদেহ সেখান থেকে সরিয়ে আরনোজভেল নামক স্থানে সমাহিত করেন।

তাঁর স্মরণীয় কীর্তি হলো বাংলায় ৩০টি গ্রন্থ প্রকাশ। এই গ্রন্থগুলোর মধ্যে আছে ‘বেদান্তগ্রন্থ’ (১৮১৫), ‘বেদান্তসার’ (১৮১৫), ‘ভট্টাচার্যের সহিত বিচার’ (১৮১৭), ‘গোস্বামীর সহিত বিচার’ (১৮১৮), ‘সহমরণ বিষয়ক প্রবর্তক ও নিবর্তকের সম্বাদ’ (১৮১৮)এবং ‘গৌড়ীয় ব্যাকরণ’ (১৮৩৩) ইত্যাদি। এছাড়া ৩৯টি ইংরেজি রচনারও জনক তিনি।

রাজা রামমোহন ছিলেন উনিশ শতকের বাংলার নবজাগরণের পুরোধা পুরুষ। পাশ্চাত্যের জ্ঞানবিজ্ঞান, রীতিনীতি ও চিন্তাধার সঙ্গে ভারতীয় জ্ঞান, রীতিনীতি ও চিন্তধারার সমন্বয় সাধনেরও প্রথম উদ্যোক্তা তিনি। গুরুগম্ভীর বিষয় নিয়ে বাংলায় প্রবন্ধ রচনার প্রথম কৃতিত্বও তাঁর। প্রাচীন সংস্কৃত শাস্ত্রসমূহকে বাংলা ভাষায় প্রকাশ করে ‘একদিকে যেমন তিনি এ ভাষার ভাব ও শব্দ-সম্পদ বৃদ্ধি করেছেন, অন্যদিকে তেমনি এ ভাষাতে তর্ক ও বিচারমূলক গ্রন্থ রচনা করে এতে প্রকাশভঙ্গির দৃঢ়তা ও মননশীলতা সঞ্চার করে একে সতেজ ও পুষ্ট করেছেন।

প্রতিভা, পাণ্ডিত্য, মনীষা ও কর্মনৈপুণ্যের প্রতীক রাজা রামমোহন ছিলেন নবীন ভারতের নবজাগরণের উদ্‌গাতা।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *