মহাবীর আলেকজান্ডার একবার বলেছিলেন, আমার জীবনের জন্য হয়তো আমি আমার জন্মদাতা পিতার কাছে ঋণী, কিন্তু আমাকে পৃথিবীতে বেঁচে থাকার জন্য সত্যিকার মানুষ করে গড়ে তুলেছেন আমার শিক্ষাগুরু অ্যারিস্টটল (Aristotle)।
গ্রিসের এই মহান জ্ঞানের সাধক অ্যারিস্টটল ছিলেন আলেকজান্ডারের শিক্ষক এবং তাঁর সারা জীবনের সুমন্ত্রণাদাতা। কথিত আছে, গ্রিকবাহিনীর মহাশক্তিধর সেনাপতিরা পর্যন্ত যাঁর সামনে দাঁড়িয়ে মাথা তুলে কখনও কথা বলতে সাহস করেননি, সেই মহাবীর আলেকজান্ডারও অ্যারিস্টটলের প্রতিটি বাক্য সুবোধ বালকের মতো মেনে চলতেন। গ্রিক সম্রাটের কাছে জ্ঞানের সম্রাট অ্যারিস্টটলের ছিল এমনই সম্মান ও শ্রদ্ধা।
জ্ঞানসাধক অ্যারিস্টটলের জন্ম হয়েছিল বর্তমান গ্রিসের উত্তর উপদ্বীপের থ্রেস অঞ্চলের স্টাগিরা নামক শহরে ৩৮৪ খ্রিস্ট পূর্বাব্দে। তাঁর পিতা নিকোমাচাস ছিলেন একজন বিখ্যাত শল্যচিকিৎসক এবং মেসিডোনিয়ার সম্রাট দ্বিতীয় ফিলিপ্স্-এর অন্যতম ঘনিষ্ঠ বন্ধু।
অ্যারিস্টটলের প্রথম জীবনে পিতার কাছেই শিক্ষা লাভ করেন দর্শন ও চিকিৎসাশাস্ত্র। তারপর ১৭ বছর বয়সে তিনি এথেন্সে চলে আসেন। এখানে তাঁর আগমনের উদ্দেশ্য ছিল দার্শনিক প্লেটোর কাছে শিক্ষালাভ করা।
এই সময় একটি মজার ঘটনা ঘটেছিল। নবীন যুবক মাত্র। এথেন্সে এসে একজনকে জিগ্যেস করলেন দার্শনিক প্লেটোর বাড়ির ঠিকানা।
অ্যারিস্টটল যার কাছে কথাটা জিগ্যেস করেছিলেন, তিনি ছিলেন জাতে নাপিত। তিনি মহাজ্ঞানী প্লেটো সম্পর্কে এমন তাচ্ছিল্যের ভাব দেখালেন যে, অ্যারিস্টটলের মেজাজ, গেল বিগড়ে। তাই তিনি বেশ রাগত সুরেই সেই লোকটাকে বললেন, আমি দর্শনশাস্ত্রে শিক্ষালাভ করার জন্য এখানে এসেছি, কারও নিন্দা শোনার জন্য নয়।
লোকটি তখন বোকা বনে গিয়ে বললেন, এ যে দেখছি ভয়ানক তুখোড় ছেলে। সামান্য কথাতেই রেগে আগুন। তা যাও না, ওই তো তোমার মহাজ্ঞানী প্লেটোর শূন্য বিদ্যালয়। ওখানে গিয়ে দেখবে কিচ্ছু নেই। তিনি যে কখন কোন চুলোয় থাকেন, কেউ তা জানে না। যাঁর নিজেরই কোনো ঠায়-ঠিকানা নেই, সে আবার পণ্ডিত!
হয়েওছিল তা-ই। অ্যারিস্টটল এসে দেখলেন প্লেটো বাড়িতে নেই। স্কুলও বন্ধ।
যুবক অ্যারিস্টটলের সাথে প্লেটোর সাক্ষাৎ হয়েছিল এই ঘটনার আরও তিন বছর পর। কারণ এই তিন বছরই প্লেটো দেশের বাইরে কাটিয়েছিলেন দর্শনের ওপর বক্তৃতা দিয়ে দিয়ে। দেশে ফিরে আসবার পরই সাক্ষাৎ পেয়েছিলেন তাঁর এই সুযোগ্য শিষ্যের। প্লেটো যখন এথেন্সে ফিরে আসেন, তখন অ্যারিস্টটলেরও প্রচুর নামডাক।
অ্যারিস্টটল এই তিন বছর নিজের চেষ্টাতেই এথেন্সের শীর্ষস্থানীয় পণ্ডিত- দার্শনিকদের মধ্যে নিজের স্থান করে নিতে সক্ষম হয়েছিলেন।
শহরে ফিরে এসেই প্লেটো নাম শুনলেন তরুণ দার্শনিক অ্যারিস্টটলের। তারপর মুখোমুখি সাক্ষাৎ ঘটল গুরু-শিষ্যের। অ্যারিস্টটল শ্রদ্ধায় শিষ্যত্ব গ্রহণ করলেন প্রবীণ দার্শনিক প্লেটোর। আর প্লেটোও সানন্দে বুকে টেনে নিলেন তাঁর এই যোগ্যতম শিষ্যকে। তারপর থেকে অ্যারিস্টটল দীর্ঘ বিশ বছর ছিলেন গুরুর সান্নিধ্যে। প্লেটোর মৃত্যু হয় ৩৪৭ খ্রিস্টপূর্বাব্দে। গুরুর মৃত্যু পর্যন্ত অ্যারিস্টটল ছিলেন তাঁর কাছে। প্লেটোর মৃত্যুর পর অ্যারিস্টটল কেন এথেন্স ছেড়ে চলে এসেছিলেন, তা নিয়ে বিস্তর মতপার্থক্য আছে। কেউ বলেন, গুরুর মৃত্যুর পর শিষ্যদের মধ্যে শুরু হয় দলাদলি। সবার ধারণা ছিল, প্লেটোর মৃত্যুর পর অ্যাকাডেমির অধ্যক্ষ হবেন তাঁরই যোগ্যতম শিষ্য অ্যারিস্টটল। কিন্তু সেই তিনি নিজেই অ্যাকাডেমির সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করে বেরিয়ে এলেন এবং তাঁর সমর্থকদের নিয়ে প্লেটোর মতবাদের ওপর ভিত্তি করে গড়ে তুললেন একটি সংগঠন।
এই সময় তাঁর সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ ব্যক্তিদের মধ্যে ছিলেন দার্শনিক হারমিয়াস। অ্যারিস্টটলের চেয়ে তিনি বয়সে বড় হলেও দু জনের মধ্যে ছিল গভীর বন্ধুত্ব। পরে এই বন্ধুত্ব আত্মীয়তায় রূপ নেয়। অ্যারিস্টটল বন্ধু হারমিয়াসের বোন পাইথিয়াসকে বিয়ে করেন।
কিন্তু দুর্ভাগ্য, এর কিছুদিন পরেই হারমিয়াস মারা যান। বন্ধুর মৃত্যুতে অ্যারিস্টটলের মন আরও ভেঙে যায়। তিনি এথেন্স ছেড়ে সস্ত্রীক চলে আসেন লেসবস নামের একটি দ্বীপে।
এখানে এসে তিনি নতুন করে শুরু করেন জীববিজ্ঞানের ওপর গবেষণা। এখানে থাকাকালেই তিনি রচনা করেন জীববিজ্ঞানের ওপর তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ ‘হিস্টোরিয়া অ্যানিম্যালিয়াম’।
এর কিছুদিন পর রাজনৈতিক কারণে তিনি চলে যান মেসিডোনিয়ায়।
এথেন্সের সাথে মেসিডোনিয়ার রাজনৈতিক সম্পর্ক তখন খুব ভালো ছিল না। এসময় মেসিডোনিয়ার সম্রাট ছিলেন দ্বিতীয় ফিলিপ্স্। সম্রাটের সাথে অবশ্য অ্যারিস্টটলের সম্পর্ক ভালো ছিল। বিশেষ করে অ্যারিস্টটলের পিতা ছিলেন সম্রাটের ব্যক্তিগত চিকিৎসক এবং বন্ধু। তাই সম্রাট ফিলিপ্স্ নিজেই একদিন (৩৪২ খ্রিস্টপূর্বাব্দে) ডেকে পাঠালেন অ্যারিস্টটলকে। তাঁকে নিয়োগ করলেন রাজকুমার এবং ভবিষ্যতের বিশ্ববিজয়ী বীর আলেকজান্ডারের গৃহশিক্ষক হিসেবে। অ্যারিস্টটল সানন্দে গ্রহণ করলেন এই পেশা।
তারপর তাঁর জীবনের সাতটি বছর কাটিয়ে দিলেন এই মেসিডোনিয়াতেই। তিনি প্রথমে ছিলেন আলেকজান্ডারের গৃহশিক্ষক। পরে হয়েছিলেন তাঁর পরামর্শদাতা ও বন্ধু। তিনি আলেকজান্ডারকে পড়াতেন গ্রীক কাব্য ও নাটক। সেইসাথে পড়াতেন রাস্ট্রবিজ্ঞান। আলেকজান্ডারকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ওপর শিক্ষা দিতে গিয়ে এই সময় অ্যারিস্টটল দুটো গ্রন্থও রচনা করেন। গ্রন্থ দুটির নাম ‘কলোনিস্টস’ (Colonists) এবং ‘মোনার্কি’ (Monarchy)।
পিতার মৃত্যুর পর আলেকজান্ডার মেসিডোনিয়ার সিংহাসনে বসেন এবং দিগ্বিজয় শুরু করেন। আলেকজান্ডার বিশ্বজয়ের পরিকল্পনা নিয়ে এশিয়া মাইনরের দিকে অগ্রসর হওয়ার পরই অ্যারিস্টটল পান তাঁর গৃহশিক্ষকতার কাজ থেকে ছুটি। তাই কী আর করা, শূন্য নগরী মেসিডোনিয়া ছেড়ে তিনি আবার ফিরে এলেন এথেন্সে। এখানে এসেই তিনি খুঁজে বের করলেন তাঁর পুরনো ভক্ত আর বন্ধুদের। তিনি এথেন্সের লাইসিয়াম নামক স্থানে একটি স্কুল প্রতিষ্ঠা করলেন এবং আপন আদর্শে শিক্ষা দিতে লাগলেন ছাত্রদের।
লাইসিয়ামে দেবতা অ্যাপোলোর একটি মন্দির ছিল। দেবতা অ্যাপোলোর আরেকটি নাম লাইসিয়াম। এই দেবতার নামেই জায়গটির নামও লোকের মুখে-মুখে লাইসিয়াম হয়ে যায়। অ্যারিস্টটলের স্কুলটিও এই মন্দিরের পাশেই ছিল। তাই জায়গার নামানুসারে তাঁর স্কুলটিকেও বলা হতো লাইসিয়াম স্কুল। শুধু স্কুল নয়, এখানে তিনি একটি গ্রন্থাগারও প্রতিষ্ঠা করেন, যেখানে সংরক্ষিত হয় পুরনো গ্রন্থের বহু পাণ্ডুলিপি এবং মানচিত্র। গ্রন্থাগারের একটি অংশ জাদুঘর হিসেবেও ব্যবহার করা হতো। শুধু তাই নয়, এখানে সংরক্ষণ করা হয় জীববিজ্ঞান ও উদ্ভিদ বিজ্ঞানের নানা দুর্লভ নমুনা।
কথিত আছে, অ্যারিস্টটলের প্রতিষ্ঠিত গ্রন্থাগার ও জাদুঘরকে সমৃদ্ধিশালী করে গড়ে তোলার জন্য আলেকজান্ডার প্রচুর অর্থ অনুদান হিসেবে দিয়েছিলেন। সমগ্র গ্রিক সাম্রাজ্যে এই বলে ঘোষণা দেওয়া হয়েছিল যে, কেউ যদি কোথাও কোনো বিচিত্র ধরনের পশুপাখি, মাছ বা উদ্ভিদের সন্ধান পায়, তা হলে সঙ্গে সঙ্গে তা এথেন্সের জাদুঘর কর্তৃপক্ষকে জানাতে হবে। এর জন্য দেওয়া হবে প্রচুর পুরস্কার।
এভাবেই অ্যারিস্টটল গড়ে তুলেছিলেন তাঁর গ্রন্থাগার ও জাদুঘর।
অ্যারিস্টটলের স্কুলের ছাত্ররা এসব নমুনার সাহায্য গবেষণা করার সুযোগ পেত। তিনি স্কুলের শিক্ষাদানেরও কতগুলো চমৎকার নিয়ম করেছিলেন। নিয়মিত পাঠদানের পাশাপাশি প্রতি সপ্তাহে, কখনও মাসে আয়োজন করা হতো আলোচনা সভা, নানা বিনোদনমূলক অনুষ্ঠান এবং একত্রে বসে খাওয়া বা প্রীতিভোজের। এতে ছাত্রদের মধ্যে গড়ে ওঠে আন্তরিক সৌহার্দ্য। বেড়ে যায় তাদের শিক্ষালাভের আগ্রহও। তারা পরস্পরের মধ্যে জ্ঞান বিনিময়েরও সুযোগ পায়।
অ্যারিস্টটলের গ্রন্থাগার ও জাদুঘরে ছাত্ররা জীববিজ্ঞান ও প্রত্নতত্ত্ব ইত্যাদির পাশাপাশি অন্য বহু বিষয়ের ওপর গবেষণা করার সুযোগ পেত।
অ্যারিস্টটলের প্রথম পাইথিয়াস নিঃসন্তান অবস্থায় মারা গেলে তিনি আবার বিয়ে করেন। দ্বিতীয় স্ত্রীর গর্ভে তাঁর এক পুত্রসন্তান হয়। তার নাম রাখা হয় পিতামহের নামে নিকোমাচাস।
কেউ কেউ বলেন, অ্যারিস্টটল শুধু তাঁর পিতার নামে নিজের ছেলের নামই রাখেননি, তিনি ছেলেকে গড়েও তুলেছিলেন সম্পূর্ণ পিতার আদর্শে। পুত্রকেও তিনি পিতার মতো চিকিৎসাশাস্ত্রে পণ্ডিত করে তুলেছিলেন। আর এর জন্য তিনি নিজেই একটি গ্রন্থ প্রণয়ন করেছিলেন। যার নাম ছিল ‘নিকোমাচিয়ান এথিস্’ (Nicomachean Ethics)। পিতার আদর্শ ও গবেষণার ওপর ভিত্তি করেই রচিত হয়েছিল এই গ্রন্থ। এটাই ছিল পুত্র নিকোমাচাসের পাঠ্য গ্রন্থ।
পরে নিকোমাচাসও খুব বড় পণ্ডিত হয়ে উঠেছিলেন এবং পিতা ও পিতামহের আদর্শের হয়ে উঠেছিলেন যোগ্য উত্তরসুরি। তিনি বড় হয়ে পিতা অ্যারিস্টটলের রচিত ও তাঁর পাঠ্য গ্রন্থ নিকোমাচিয়ান এথিক্স্ গ্রন্থটি সম্পাদনা করে আবারও প্রকাশ করেছিলেন।
অ্যারিস্টটল তাঁর স্কুল, গ্রন্থাগার এবং জাদুঘরের কাজ শুরু করলেও তা শেষ করে যেতে পারেননি, তার আগেই তাঁর জীবনে নেমে আসে বিপর্যয়।
মহাবীর আলেকজান্ডার তাঁর সামরিক অভিযান নিয়ে দেশ জয় করতে করতে একেবারে চলে এসেছিলেন ভারতবর্ষ পর্যন্ত। তারপর বিজয় অভিযান শেষ করে স্বদেশে প্রত্যাবর্তনকালে পথিমধ্যেই মৃত্যুবরণ করেন ৩২৩ খ্রিস্টপূর্বাব্দে।
আলেকজান্ডারের মৃত্যুর সাথে সাথে সমগ্র গ্রিক সাম্রাজ্যে শুরু হয়ে যায় লঙ্কাকাণ্ড। সবগুলো বিজিত দেশ সুযোগ বুঝে আবার স্বাধীনতা ঘোষণা করে বসে। ছিন্নভিন্ন হয়ে যায় পুরো সাম্রাজ্য। তাঁর সেনাপতিরাই একেকটি দেশ দখল করে নিয়ে সেসবের স্বাধীন রাজা হয়ে বসেন।
এই বিশৃঙ্খল পরিস্থিতির উদ্ভব হয় তাঁর নিজের দেশেও। আলেকজান্ডার ছিলেন মেসিডোনিয়ার রাজা। এথেন্সে তখনও চলছিল ভিন্ন রাজার রাজত্ব। আলেকজান্ডার এথেন্স দখল করার পর তাকে নিজের সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত করে নেন
এথেন্স মেসিডোনিয়ার অধীনস্থ হলেও এথেন্সবাসী আলেকজান্ডারকে তাদের নিজেদের রাজা ভাবতে পারেনি। সেইসাথে মেসিডোনিয়ার লোকদেরও তারা বিদেশী দখলদার বাহিনীর অংশ বলে মনে করত।
ফলে আলেকজান্ডারের মৃত্যুর পর তারা স্বাধীন হবার চেষ্টা করতে লাগল। শুরু হলো বিদেশী হটানোর অর্থাৎ মেসিডোনিয়ানদের বিতাড়নের পালা। এই সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার মধ্যে পড়ে গেলেন স্বয়ং অ্যারিস্টটল। তাঁর ওপর এথেন্সবাসীদের আক্রোশ ছিল আরও বেশি। কারণ তিনি একজন সাধারণ মেসিডোনিয়ান ছিলেন না, ছিলেন স্বয়ং আলেকজান্ডারের সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ সহচর, তার গৃহশিক্ষক এবং পরামর্শদাতাও। সকলের ধারণা, তাঁর পরামর্শেই আলেকজান্ডার এথেন্স দখল করেছিলেন।
তবে এথেন্সবাসীরা তাঁকে হত্যা করল না, কারণ, এ ধরনের একটি কলঙ্কজনক হত্যাকাণ্ড ঘটে গেছে এই এথেন্সেই অল্প কিছুদিন আগে। মহাজ্ঞানী সক্রেটিসকে মিথ্যে অভিযোগে বলপূর্বক বিষপানে আত্মহত্যা করতে বাধ্য করা হয়েছিল। তাই আবারও সে-রকমের কোনো ঘটনা ঘটুক, তেমনটা কেউ চাইল না। তাই অ্যারিস্টটলকে প্রাণে না মেরে সসম্মানে এথেন্স ছেড়ে চলে যেতে বলা হলো। এ-রকম অবস্থায় তিনি তাঁর বিদ্যালয়টিকে এথেন্সবাসী শিষ্যদের হাতে তুলে দিয়ে চলে গেলেন ইউবোয়া দ্বীপের রাজধানী চালসিস নগরীতে। সেখানেই তিনি এক বছর পর ৩২২ খ্রিস্ট পূর্বাব্দে পরলোকগমন করেন।
প্রাচীন লিখিত বিবরণী থেকে জানা যায়, অ্যারিস্টটল দেখতে ছিলেন ছোটখাটো। মুখাবয়বে ছিল প্রচণ্ড গাম্ভীর্য। কথা বলতেন স্পষ্ট ভাষায়। তাঁর বাগ্মিতা ছিল তুলনাবিহীন। সবসময় ঝলমলে পোশাক পরতে ভালবাসতেন।
তবে রাজাদের মতো অহঙ্কারী এবং নিষ্ঠুর ছিলেন না। তিনি ক্রীতদাসদের উপর কখনও নিষ্ঠুর আচরণ করতেন না। এমন বহু ক্রীতদাস ছিল, যাদের তিনি নিজের অর্থে অত্যাচারী মনিবদের কাছ থেকে কিনে নিয়ে তাদের মুক্ত করে দিয়েছেন। তাদেরকে আর্থিক সহযোগিতা দিয়ে জীবনে প্রতিষ্ঠিত হতে সাহায্য করেছেন।
অ্যারিস্টটলের অধিকাংশ রচনা এবং বৈজ্ঞানিক সংগ্রহই নষ্ট হয়ে গেছে। সামান্য কিছু রক্ষা করা সম্ভব হয়েছে। তাঁর রক্ষা পাওয়া সেসব রচনাকর্মও যথাসময়ে গ্রন্থাকারে প্রকাশ করা যায়নি। প্রকাশিত না হওয়ার অবশ্য অনেক কারণও ছিল। তাঁর বিক্ষিপ্ত রচনাকে সুবিন্যস্ত করে সম্পাদনা করা ছিল এক দুরূহ কাজ। অনেক লেখাই এমন টুকরো টুকরো অবস্থায় পাওয়া গেছে যে, সেগুলোকে একত্রিত ও বিন্যস্ত করা সহজ কাজ ছিল না।
কথিত আছে, রাজরোষ থেকে রক্ষা করার জন্য অ্যারিস্টটলের রচনাসমূহ প্রায় দুশো বছর পর্যন্ত লুকিয়ে রাখা হয়েছিল। তারপর এই দুষ্প্রাপ্য রচনাসমূহ ৮৪ খ্রিস্টপূর্বাব্দে নিয়ে যাওয়া হয় রোমে। সেখানে এগুলো গ্রন্থাকারে প্রকাশ করা হয় যিশু খ্রিস্টের জন্মের সামান্য কিছু আগে।
রোম থেকে তাঁর রচনাকর্ম প্রকাশিত হওয়ার আগ থেকেই অনেকে অ্যারিস্টটলের নাম জানতেন, তাঁর মূল্যবান রচনার কথাও জানতেন, কিন্তু কারও পড়ে দেখার সৌভাগ্য হয়নি।
আলেকজান্ডারের মৃত্যুর পর থেকে তিনশো বছর পর্যন্ত অনাদর-অবহেলা এবং তাঁর রচনাবলির দুষ্প্রাপ্যতার কারণে অ্যারিস্টটল বিস্মৃতির অতলে প্রায় হারিয়ে যেতেই বসেছিলেন।
অবশেষে রোম থেকে যখন তাঁর রচনাবলি প্রকাশিত হলো এবং তাঁর অনুসারীরা যখন অনুশীলন শুরু করলেন, তখন থেকেই আবার নতুন করে শুরু হলো তাঁর উত্থান। শুরু হলো নতুন অ্যারিস্টটলীয় দর্শনের পঠন ও গবেষণার কাজ নতুন উৎসাহে।
তবে আরেকটি মজার ব্যাপার হলো, অ্যারিস্টটলীয় দর্শন যতখানি ইউরোপীয় পণ্ডিতদের প্রভাবিত করতে পেয়েছিল, তার চেয়ে বেশি জয় করেছিল মধ্যপ্রাচ্যের মুসলিম মনীষীদের মন। অ্যারিস্টটলের বহু রচনা আবু সিনা, আবু রুশদ প্রমুখ মুসলিম মনীষী আরবি ভাষায় অনুবাদ করে প্রকাশ করেছিলেন। তাঁরা সেসবের টীকাভাষ্য ও রচনা করেছিলেন। পরবর্তীকালে মুসলিম পণ্ডিতদের আরবি অনুবাদই ল্যাটিন ভাষায় রূপান্তর করা হয়। এই সমস্ত রচনা মধ্যযুগে সুগভীর প্রভাব বিস্তার করতেও সক্ষম হয়েছিল। তাঁরা অ্যারিস্টটলকে নতুন করে চিনেছিলেন মুসলিম মনীষীদের কল্যাণে।
অ্যারিস্টটল প্রথমে লিখতে শুরু করেন তাঁর শিক্ষাগুরু তাঁর অনুকরণে। প্লেটোর মতো করেই তিনি ডায়লগ্স্ (Dialogues ) লিখতে শুরু করেন। কিন্তু অচিরেই তার রচনাকর্ম আপন বৈশিষ্ট্যে ভাস্বর হয়ে ওঠে। এমনকি কোনো কোনো ক্ষেত্রে তিনি প্লেটোর মতবাদের বিরোধিতা পর্যন্ত করতে শুরু করেন। তিনি ছিলেন একজন দার্শনিক এবং প্রকৃতিবিজ্ঞানীও। তাই তিনি প্লেটোর অনেক বক্তব্য বাতিল করে দিয়েছেন। প্রতিষ্ঠিত করেছেন নিজের বাস্তববাদী মত।
অ্যারিস্টটলের অন্যতম শ্রেষ্ঠ বিজ্ঞানভিত্তিক গ্রন্থ হলো ‘মেটাফিজিক্স’ (Metaphysics)। এই গ্রন্থে তিনি বিশ্বের যাবতীয় বস্তুকে তিনটি বিভাগে ভাগ করেছেন। যথা :
১. পচনশীল বস্তু : যেমন,—পৃথিবীর যাবতীয় বৃক্ষলতা ও প্রাণিকুল।
২. ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বস্তু : মহাকাশের বস্তুসমূহ তথা গ্ৰহ-নক্ষত্র ইত্যাদি।
৩. অন্যান্য বস্তু : যা পচনশীলও নয়, ইন্দ্রিয়গ্রাহ্যও নয়, যেমন, ঈশ্বর ও জীবের বিদেহী আত্মা।
অ্যারিস্টটল ঈশ্বরের অস্তিত্বে বিশ্বাস করতেন। তিনি বলতেন, বিশ্বজগতের যাবতীয় বস্তুর আদি স্রষ্টা হলেন ঈশ্বর। বিশ্বজগতের সকল বস্তুই গতিশীল এবং তার শুরু আছে, শেষও আছে। কিন্তু একমাত্র ঈশ্বরই হলেন স্থির এবং অবিনশ্বর। তাঁর কোনো উৎস কিংবা শুরু নেই, শেষও নেই। ঈশ্বর জীবন্ত, সদা জাগ্রত, অবিনশ্বর এবং সদা মঙ্গলময়। তাই ঈশ্বরের সাথে মিলিত হবার কারণে জীবসমূহ অবিরাম ঘুরে মরছে।
অ্যারিস্টটল তাঁর ‘অন দি সৌল’ (On the Soul) গ্রন্থে প্লেটো এবং পিথাগোরাসের আত্মার জন্মান্তরবাদকে উপহাস করেছেন। প্লেটো এবং পিথাগোরাস বিশ্বাস করতেন, আত্মা অবিনশ্বর। তা এক দেহ ছেড়ে করে অন্য দেহে আশ্রয় গ্রহণ করে। এভাবেই ঘটে তার জন্মান্তর।
কিন্তু অ্যারিস্টটল বলেন, আত্মা হলো দেহেরই একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ। দেহ বিনাশের সঙ্গে সঙ্গে আত্মারও বিলুপ্তি ঘটে।
তবে তিনি বলেন, জীবের মন হলো একটি স্বাধীন সত্তা। এই মন তার দেহ ও আত্মার বিনাশের পরও নিজেকে ধ্বংস থেকে রক্ষা করতে সক্ষম হয়।
তিনি বংশ মর্যাদা এবং আভিজাত্য মেনে চলতেন প্রচণ্ডভাবে। তাঁর মতে, বংশ- মর্যাদা ও আভিজাত্য হলো স্বর্গীয় দান। দেশ শাসনে তাই অভিজাতদেরই একচেটিয়া অধিকার থাকবে। কারণ, তাঁরাই সমাজের সর্বোচ্চ শ্রেণীর মানুষ। তাঁরা পবিত্র এবং উচ্চগুণসম্পন্ন আত্মার অধিকারী। সমাজের সাধারণ মানুষ কখনও এই উচ্চস্তরে আসার কথা চিন্তা করতে পারে না। পুণ্য খুব কম মানুষের ভাগ্যেই জুটে থাকে। এমন লোকের সংখ্যা সমাজে খুবই কম।
তিনি তাঁর ‘পলিটিক্স’ (Politics) গ্রন্থে বলেছেন, গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে সরকার গঠন উত্তম পন্থা। তিনি তাঁর এই গ্রন্থের মাধ্যমে প্লেটোর ‘রিপাবলিক’ (Republic) গ্রন্থের সমালোচনা করেছেন।
গ্রিক দার্শনিক অ্যারিস্টটলের মতবাদ পশ্চিম ইউরোপে প্রসার ঘটে মধ্যযুগ থেকে। কিন্তু প্রথম দিকে ইউরোপীয় পণ্ডিতরা তাঁর মতবাদকে গ্রহণ করেছিলেন দ্বিধাদ্বন্দ্বের সঙ্গে। ত্রয়োদশ শতকে এসে ইউরোপীয় পণ্ডিতদের মধ্যে অ্যালবার্টাস ম্যাগনাস এবং টমাস অ্যাকুইনাস প্রমুখ পণ্ডিত অ্যারিস্টটলকে সাদরে গ্রহণ করেন। পরে চতুর্দশ শতকে এসে দান্তের মতো জগদ্বিখ্যাত লেখকও অ্যারিস্টটলকে শ্রদ্ধার সাথে গ্রহণ করেন। আজ তাঁর জনপ্রিয়তা আরও বেড়েছে। আজ সারা বিশ্বে অ্যারিস্টটল তাঁর জীবিতকালের চেয়েও বহুগুণে বেশি সমাদৃত এবং জনপ্রিয়।