ধর্ম ও দর্শন
বিজ্ঞান
সাহিত্য
1 of 2

সক্রেটিস (আনু. ৪৬৯–৩৯৯ খ্রি. পূ.) – দর্শনশাস্ত্রের আদিজনক

সক্রেটিস (আনু. ৪৬৯–৩৯৯ খ্রি. পূ.) – দর্শনশাস্ত্রের আদিজনক

দর্শনশাস্ত্রের জনক বলে সেই আদিকাল থেকে আজও যিনি বিশ্বের সর্বত্র সম্মানিত ও স্বীকৃত, তিনি আর কেউ নন, মহাজ্ঞানী সক্রেটিস। সমৃদ্ধ এথেন্স নগরে এই মহান পুরুষের জন্ম ৪৬৯ খ্রিস্ট পূর্বাব্দে। সেই কালে গ্রিসের নগর রাষ্ট্রের অন্যতম প্রধান অ্যালোপেকি গোষ্ঠীতে। যতোটুকু জানা যায়, সক্রেটিসের পিতা সাফ্রোজিক্স পেশায় ছিলেন একজন ভাস্কর। যৌবনকালে সক্রেটিস নিজেও জীবন নির্বাহ করতেন ভাস্কর্য তৈরি করে। তাঁর মা ফেশরিটি ছিলেন একজন ধাত্রী। উত্তরাধিকার সূত্রে পিতার কাছ থেকে প্রচুর ধনসম্পদ পেয়েছিলেন সক্রেটিস। সেকালে গ্রিসের নিয়ম ছিল, ধনসম্পদশালী না হলে কেউ এথেন্সের সেনাবাহিনীতে যোগ দিতে পারত না। তাই উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া অর্থসম্পদের কল্যাণে সক্রেটিস যোগ দিয়েছিলেন সেনাবাহিনীতে। অতুলনীয় বীরত্বও দেখিয়েছিলেন তিনি পেলোপনিশীয় যুদ্ধে।

সক্রেটিসের দৈহিক গড়ন আর চেহারা ছিল বলতে গেলে, কিম্ভূতকিমার। ছিলেন বেঁটেখাটো, মোটাসোটা। নাকখানা ছিল ছড়ানো আর চ্যাপ্টা। দু চোখ ছিল কোটরের বাইরে। শোনা যায়, তাঁর স্ত্রী জাথিপি ছিলেন খুবই বদমেজাজি স্বভাবের। কারো কারো মতে, সেটা সত্যি নয়। তিনি ছিলেন তিন সন্তানের জনক।

জ্ঞান সাধনাই ছিল যাঁর জীবনের মুখ্য আদর্শ ও উদ্দেশ্য, সেই সক্রেটিসের কাছে জীবন রক্ষার জন্য জরুরি প্রয়োজনের চাইতে অতিরিক্ত সম্পদের প্রয়োজন ছিল না। তাঁর ছিল কষ্ট সহ্য করার অপরিসীম ক্ষমতা। তাই তাঁর ব্যক্তিগত ও পারিবাকি জীবন ছিল খুবই সাদাসিধে। একটিই মাত্র পোশাক ছিল তাঁর। সেটাই উল্টেপাল্টে পরতেন। জাঁকজমকের ধার ধারতেন না তিনি। এমন কি জুতো পর্যন্ত পরতেন না। বলতেন, পোশাক হলো বাইরের আবরণ। মানুষের প্রকৃত সৌন্দর্য নিহিত তার ভেতরের জ্ঞান আর জ্ঞানের পিপাসায়। এই সাধারণ বেশেই ঘুরে বেড়াতেন তিনি শহরের পথে-পথে। আর যাকেই সামনে পেতেন, তাকেই শোনাতেন জ্ঞানের কথা। এথেন্সের লোকেরা তাঁর এসব নতুন চিন্তাধারার কথা শুনে অবাক হয়ে যেত। তন্ময় হয়ে শুনত তাঁর জ্ঞানের কথা। ক্রমে সারা দেশে নাম ছড়িয়ে পড়ে তাঁর। দলে দলে লোক ছুটে আসতে থাকে তাঁর কাছে তাঁর জ্ঞানের কথা শোনার জন্য।

এমনি করেই চারদিকে বাড়তে থাকে তাঁর খ্যাতি। শহরের বড় বড় ধনী ব্যক্তি পর্যন্ত জ্ঞানের সাধক সক্রেটিসকে নিজের বাড়িতে নিমন্ত্রণ করে খাওয়াতেন। তাঁকে ডেকে জ্ঞানের কথা শুনতেন। এই যে বড়লোকদের বাড়িতে নিমন্ত্রণ খেতে যেতেন সক্রেটিস, তখনও কিন্তু তাঁর পরনে থাকত সেই একই অতি সাধারণ বেশবাস। জুতো ছাড়া পা। মাথায় উসকোখুসকো চুল। কোনো পরিবর্তন নেই।

এ সম্পর্কে কেউ কিছু জিগ্যেস করলেই তিনি বলতেন, পোশাক দিয়ে কী হবে? জ্ঞানই মানুষের সত্যিকার সৌন্দর্য। তার আসল রূপ।

সক্রেটিসের সময় গ্রিসের রাজাদের ছিল দোর্দণ্ড প্রতাপ। তাঁরা কথায়-কথায় যার- তার গর্দান নিতে পারতেন। তখনকার রাজারা বলতেন, তাঁরা হলেন ঈশ্বরের প্রতিনিধি। তাঁদের কথা মানেই ঈশ্বরের কথা। তাই তাঁরাও ঈশ্বরের মতো সম্মান পাবার যোগ্য। কিন্তু সক্রেটিস বলতেন, না, মানুষ কখনও ঈশ্বর হতে পারে না। সব মানুষই ঈশ্বরের সৃষ্টি। ঈশ্বরের কাছে রাজা ও প্রজা সবাই সমান।

সক্রেটিসের এই কথাগুলো সাধারণ মানুষের খুব ভালো লাগত, বিশেষ করে দেশের তরুণসমাজ সক্রেটিসের এই আদর্শকে মনেপ্রাণে গ্রহণ করতে লাগল। তারা দলে দলে এসে তাঁর শিষ্যও হতে লাগল। আর এই ঘটনাই সক্রেটিসের জীবনের কাল হয়ে দাঁড়াল। বাড়তে লাগল শত্রু। যারা রাজার লোক, তারা এই দার্শনিকের বিরুদ্ধে রটাতে লাগল দুর্নাম।

আসলে সক্রেটিস যে কী বলতে চাইছেন, তারা সেটা বুঝতেই পারত না। তাঁর কথার ভুল ব্যাখ্যা করা হতে লাগল। তারা রটাতে লাগল, সক্রেটিস দেশের সকল মানুষের, বিশেষ করে তরুণসমাজের মাথা মাথা বিগড়ে দিচ্ছে। তাদের বিপথগামী করা হচ্ছে। তাদের মাথায় নানারকম রাষ্ট্র ও সমাজ বিরোধী স্বাধীন নীতি ও ভুল ধারণা ঢুকিয়ে দেওয়া হচ্ছে।

তারা আরও প্রচার করতে লাগল, সক্রেটিস হল নাস্তিক। সে রাজাকে মানে না। সে একজন মস্ত বড় পাপী। তাই তারা ঠিক করল, এই বিপথগামী নাস্তিককে অবশ্যই উপযুক্ত শাস্তি দিতে হবে। তারা রাজার কাছে গিয়ে সক্রেটিসের বিরুদ্ধে নানা কথা বলতে লাগল। সবকিছু শুনেটুনে রাজাও খেপে গেলেন তাঁর বিরুদ্ধে। ফলে দেশদ্রোহিতার অভিযোগে রাজার আদেশে তাঁকে করা হলো গ্রেফতার। নিক্ষেপ করা হলো কারাগারে।

এক মাস পর তাঁর বিচারের নামে অনুষ্ঠিত হলো প্রহসন। আদালতে তাঁকে বলা হলো, যদি সক্রেটিস তাঁর রাজদ্রোহিতা থেকে বিরত থাকেন, যদি রাজাকে ঈশ্বরের প্রতিনিধি বলে মেনে নেন, তা হলে তাঁকে ক্ষমা করা হবে। তাঁকে স্বীকার করতে হবে, এতদিন তিনি যা বলেছেন, তার সবই ভুল।

কিন্তু সক্রেটিস ছিলেন নির্ভীক ও সত্যদর্শী। তিনি বললেন, মিথ্যের কাছে আত্মসমর্পণ করার চেয়ে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করা অধিকতর শ্রেয়। আমি যা সত্য বলে জানি, তাকে অস্বীকার করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়।

বিচারক বললেন, তবে মৃত্যুই তোমার একমাত্র শাস্তি।

—তাই হোক। তবু আমার উচ্চারিত সত্য বেঁচে থাকুক।

এই সময় সক্রেটিসের শিষ্যেরা কারাগারের প্রহরীদের ঘুস দিয়ে তাঁর পালাবার ব্যবস্থা করেছিলেন। একথা শুনে তিনি বলেছিলেন, বিচারকের দেয়া দণ্ডাদেশের তিনি বিরোধিতা করতে পারেন না। হোক না সেই দণ্ডাদেশ অবিবেচনা প্রসূত। হোন না যতোই তা অবিচারের নামান্তর। আইন অমান্য তিনি করতে পারবেন না।

অবশেষে ঘনিয়ে এলো তাঁর জীবনের অন্তিম দিনটি।

সেকালে এথেন্সে হেমলক নামে এক জাতের গাছ ছিল। এর রস ছিল ভয়ানক বিষাক্ত। এই রস পান করার সঙ্গে সঙ্গে মানুষের মৃত্যু হতো। আদেশ হলো, সক্রেটিসকে এই হেমলকের রস পান করে আত্মহত্যা করতে হবে। সত্যি সত্যি তা-ই হল। তিনি সত্যের জন্য হাসিমুখে রাজার আদেশ মান্য করে হেমলকের বিষ পান করে মৃত্যুকে আলিঙ্গল করলেন।

সক্রেটিসকে হত্যা করা হয় ৩৯৯ খ্রিস্টপূর্বাব্দে। তিনি মারা গেলেও তাঁর প্রচারিত আদর্শের কিন্তু মৃত্যু হয়নি। তিনি তাঁর আদর্শ আর দার্শনিক তত্ত্বকে রেখে গিয়েছিলেন। আর রেখে গিয়েছিলেন প্লেটোর মতো সুযোগ্য ও মহান শিষ্যকে। প্লেটো এবং তাঁর শিষ্য অ্যারিস্টটলই সক্রেটিসের তত্ত্বকে পরবর্তীকালে প্রতিষ্ঠিত করেছেন জগতে। তাই সক্রেটিস মরে গিয়েও অমর। দর্শনজগতের সর্বকালের শ্রেষ্ঠ গুরু বলে আজও তিনি সর্বত্র স্বীকৃত ও সম্মানিত।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *