২১. মানুচীর পাণ্ডুলিপির ইতিহাস

মানুচীর পাণ্ডুলিপির ইতিহাস

১৬৫৩ খ্রিস্টাব্দের নভেম্বর মাসে চতুদশবর্ষ বয়সে নিকালো মানুচী মাতৃভূমি ভিনিস নগর ত্যাগ করেন। জাহাজ-ভাড়া দিবার মত অর্থ সঙ্গতি না থাকায় তিনি জাহাজে লুক্কায়িত থাকিয়া, ঐ সহর হইতে যাত্রা করিয়াছিলেন। ১৬৫৬ খ্রিস্টাব্দের জানুয়ারী মাসে ভারতে পৌঁছিয়া তিনি প্রথমে কুমার দারা শুকো ও পরে শাহ্ আলমের অধীনে কর্ম্ম গ্রহণ করিয়াছিলেন। মধ্যে মধ্যে তিনি চিকিৎসকের কার্য্যও করিতেন; বলা বাহুল্য, চিকিৎসাশাস্ত্রে তিনি সম্পূর্ণ অনভিজ্ঞ ছিলেন। তিনি ভারতের সর্ব্বত্র পরিভ্রমণ করিয়াছিলেন এবং নানা ঘটনাচক্র ও ভাগ্য পরিবর্তনের পর অবশেষে মাদ্রাজ ও পণ্ডিচেরীতে শেষ জীবন অতিবাহিত করেন। ১৭১৭ খ্রিস্টাব্দে তাঁহার মৃত্যু হয়। এইরূপে মানুচী ভারতে প্রায় ৬০ বৎসরের অধিককাল অবস্থান করিয়াছিলেন।

মানুচী তাঁহার মুঘলগণের ইতিহাস Storia do Moger কখন পর্তুগীজ, কখন ফরাসী, আবার কখন ইতালীয় ভাষায় রচনা করিতেন। গ্রন্থের এক তৃতীয়াংশ তিনি নিজের মাতৃভাষা ইতালীয় ভাষায় রচনা করিয়াছিলেন এবং প্রায় সমস্ত গ্রন্থই পর্তুগীজ (এবং অংশতঃ ফরাসী) ভাষায় পুনর্লিখিত হইয়াছিল। মানুচীর গ্রন্থ পাঁচ ভাগে বিভক্ত–

(ক) গ্রন্থকারের ভিনিস হইতে আগ্রা-যাত্রা এবং বাবর হইতে আওরংজীব পর্যন্ত মুঘল সম্রাটগণের সংক্ষিপ্ত বিবরণ।

(খ) আওরংজীবের শাসনকাল ও গ্রন্থকারের ব্যক্তিগত ইতিহাস

(গ) মুঘল দরবার, রাজ্য শাসন পদ্ধতি, রাজস্ব; ইহার সহিত মানুচী ইউরোপীয় কোম্পানীগণের কথা মিশ্রিত করিয়া, নানা অবান্তর বিষয়ের অবতারণা করিয়াছেন। হিন্দুধর্ম্ম ভারতীয় জীবজন্তু; ভারতে ক্যাথলিকগণ ইত্যাদি।

(ঘ) ১৭০১ খ্রিস্টাব্দ হইতে দাক্ষিণাত্যে মুঘল-শিবিরের ঘটনাবলী এবং জেসুইট ও ক্যাথলিকগণের কার্যাবলীর বিস্তৃত বিবরণ।

(ঙ) ১৭০৫ ও ১৭০৬ খ্রিস্টাব্দের ঘটনাবলী; নানা স্থানে পূর্ব্ববর্ত্তী কালের উপাখ্যানাবলীর উল্লেখ ৷

মানুচী তাহার গ্রন্থের প্রথম তিন ভাগ, ফরাসী রাজ চতুর্দশ লুই-এর অর্থানুকূল্যে প্রকাশের আশায় ফরাসী ইষ্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানীর কর্মচারী M. Bourean Deslandes-এর নিকট ১৭০১ খ্রিস্টাব্দে প্যারি নগরে প্রেরণ করেন। Deslandes সাহেব ফ্রান্সিস্ কত্রু (Catrou) নামে একজন জেসুইট্‌কে মানুচীর এই হস্তলিপি পাঠ করিতে দিয়াছিলেন। কত্রু ১৭০৫ খ্রিস্টাব্দে অন্যান্য নূতন বিষয় সন্নিবিষ্ট করিয়া, ফরাসী ভাষায় মানুচীর গ্রন্থের এক বিকৃত, অবাস্তব ও অসম্পূর্ণ সংস্করণ বাহির করেন। ইহাতে আওরংজীবের রাজ্যারম্ভ (১৬৫৮ খ্রিস্টাব্দ) পর্যন্ত ইতিহাস আছে। কক্র কর্তৃক প্রকাশিত মানুচীর এই সংস্করণের দুইখানি ইংরাজী অনুবাদও গত ১৫ বৎসরের মধ্যে কলিকাতা হইতে পুনঃপ্রকাশিত হইয়াছে। ১৭১৫ খ্রিস্টাব্দে কত্রু মানুচীর দ্বিতীয়ভাগ প্রায় আগাগোড়া চুরি করিয়া আওরংজীবের রাজত্বকালের একখানি ইতিহাস প্রকাশ করেন। ইহা অদ্যাবধি ইংরাজীতে অনূদিত হয় নাই; কিন্তু ইহা হইতে অৰ্ম্ম, টড ও হুইলার প্রচুর উপাদান সংগ্রহ করেন, এবং ইহাই বঙ্কিমের “রাজসিংহের” অনেক গল্পের ভিত্তি।

মানুচীর পাণ্ডুলিপির যে অংশ প্রথমে ইউরোপে প্রেরিত হয়, তাহা ১৭৬৩ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত প্যারি নগরে, জেসুইট্‌দিগের পুস্তকাগারে রক্ষিত ছিল; পরে ঐ ধর্ম্মযাজকগণের মঠ বিনষ্ট হওয়ার পর উহা অন্যান্য গ্রন্থের সহিত বিক্রিত হইয়া বার্লিনের রাজকীয় পুস্তকালয়ে (১৮৮৭) উপস্থিত হয়। ইহার বিবরণ Berlin Codex phillipps 1945 প্রদত্ত হইয়াছে, পর্তুগীজ ভাষায় লিখিত তিন ভলুমে সম্পূর্ণ; কিন্তু তিন স্থলে যে অংশ বাদ ছিল, তাহা পরে ফরাসীতে পূরণ করা হইয়াছে। আর্ভিন হস্তলিপিই অনুবাদ করিয়া চার ভলুমে বাহির করেন।

ভারতে অবস্থানকালে মানুচী যখন শুনিলেন যে, কত্রু তাহার গ্রন্থ হইতে চুরি করিয়া পুস্তক প্রকাশ করিয়াছেন, তখন তিনি ইতালীয় ভাষায় লিখিত Storia গ্রন্থের ১ম, ২য় ও ৩য় খণ্ড (ইহা সর্ব্বসময়ে তাঁহার নিকট থাকিত), ফরাসী ভাষায় লিখিত ৪র্থ খণ্ড এবং ফরাসী ও পোর্তুগীজ ভাষায় লিখিত ৫ম খণ্ডের পাণ্ডুলিপি ভিনিসের মন্ত্রী-সভার নিকট পাঠাইলেন। (১৭০৬) তিনি কর্তৃপক্ষকে তাঁহার গ্রন্থখানি প্রকাশ করিবার জন্য আবেদন করিলেন এবং জানাইলেন যে, এই ক্ষুদ্র গ্রন্থ পর্য্যটক, ধর্ম্মযাজক ও বর্নিদিগের যথেষ্ট উপকারে আসিবে, ইত্যাদি। মানুচীর এই পাণ্ডুলিপি Zanetti-র ক্যাটালগে Venice Codex XLIV সংখ্যায় বর্ণিত হইয়াছে। পঞ্চম খণ্ডের একমাত্র সম্পূর্ণ ও ধারাবাহিক মূল পাণ্ডুলিপি কাউন্ট কার্ডিয়েরা ১৭১২ খ্রিস্টাব্দে পর্তুগীজ হইতে ইতালীয় ভাষায় অনুবাদ করেন। তাঁহার হস্তলিপি Venice Codex XLV নম্বর।

ইউরোপে সুধীন মণ্ডলীর মধ্যে বহুদিন ধরিয়া এইরূপ ধারণা ছিল যে, মানুচী ভিনিসীয় Senate কে তাঁহার গ্রন্থের যে পাণ্ডুলিপি প্রেরণ করেন, তাহা নেপোলিয়নের ঐ শহর আক্রমণের সময় হারাইয়া গিয়াছে; কিন্তু নেপোলিয়ন (১ম) ১৭৯৭ খ্রিস্টাব্দে কেবলমাত্র মুঘল কুমার ও দরবারের খ্যাতনামা ব্যক্তিগণের ৫৬ খানি সমসাময়িক চিত্র লইয়া গিয়াছিলেন। এই চিত্রগুলি ১৬৮৬ খ্রিস্টাব্দের পূর্ব্বে মানুচীর আগ্রহাতিশয্যে শাহ্ আলমের চিত্রকর মীর মুহমুদ কর্তৃক অঙ্কিত হইয়াছিল এবং মানুচী Senate কে ইহা উপহার দিয়াছিলেন। এক্ষণে ইহা প্যারি নগরীস্থ National Library-র O. D No. 45. এই মূল্যবান চিত্রগুলি আভিন-সম্পাদিত Storia গ্রন্থে প্রকাশিত হইয়াছে। হিন্দু দেবতা, ধৰ্ম্মবিষয়ক উৎসব- অনুষ্ঠান প্রভৃতির আরও ৬৬ খানি চিত্র মানুচী ওই সময়ে ভিনিসে প্রেরণ করিয়াছিলেন- তাহাও তথায় অদ্যাপি বিদ্যমান রহিয়াছে।

বিচক্ষণ ইতিহাসজ্ঞেরা প্রায় এক শতাব্দীকাল ধরিয়া মানুচীয় মূল পাণ্ডুলিপির অন্তর্দ্বানে হতাশ হইয়া পড়িয়াছিলেন; অথচ সেই সময় উহা নিৰ্দ্দিষ্ট স্থানে– ভিনিসের Saint Mark-এর পাঠাগারে রক্ষিত ছিল! ১৮৯৯ খ্রিস্টাব্দে আর্ভিন তথায় উহার পুনরাবিষ্কার করেন এবং তিন বৎসর পরে স্বীয় ব্যবহারার্থ উহার নকল গ্রহণ করেন। সদাশয় ভারত-গবর্ণমেন্টের নিকট আর্ভিন যথেষ্ট অর্থ সাহায্য পাইয়াছিলেন এবং তাঁহার সম্পাদিত মানুচী ভারত-গবর্ণমেণ্টের ব্যয়ে Indian Tax Series-এ চারখানি সুবৃহৎ খণ্ডে ১৯০৭-৮ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত হয়। এইরূপ মানুচীর গ্রন্থের যথার্থ অবিকৃত অনুবাদ পাঠকবর্গের সমক্ষে উপস্থিত হইল,–প্রায় দুইশত বৎসর ধরিয়া যে সমস্ত ভ্রমপ্রসাদ, অচত বিষয় প্রভৃতি চলিয়া আসিতেছিল, তাহা এতদিনে বিদূরিত হইল। ইহাই আর্ভিনের কীৰ্ত্তি।

আর্ভিনের মহানুভবতা

আর্ভিনের চরিত্রের একটি বিশেষ গুণ ছিল, যে কেহ তাঁহার নির্দ্ধারিত বিষয়ে গবেষণা করিতেন, তাঁহাদের তিনি সাধ্যমত সাহায্য করিতে কখনও কুণ্ঠিত হইতেন না। প্রাচ্য বিদ্বন্মণ্ডলী যেরূপ পরস্পর পরস্পরকে হিংসাদ্বেষের চক্ষে দেখেন এবং বিষময় বাদ-প্রতিবাদ করিয়া লোক হাসান, আর্ভিন সে প্রকৃতির লোক ছিলেন না। অন্যান্য বহু ভারতেতিহাস আলোচনাকারীর সঙ্গে আমিও যখনই কোন উপদেশ বা কোন কিছু জটিল অর্দ্ধজ্ঞান বিষয়ের উপর আলোকপাতের জন্য আর্ভিনের শরণ লইয়াছি, তখনই তিনি অম্লানবদনে আমাকে সহায়তা করিয়াছেন। যদি তিনি কষ্ট স্বীকার করিয়া আমার ব্যয়ে ইংলন্ডে, ফ্রান্স ও জর্ম্মানী হইতে নানা দুষ্প্রাপ্য ফার্সী পাণ্ডুলিপি সংগ্রহ করিয়া ও ও নকল করাইয়া না দিতেন, তাহা হইলে আমার রচিত আওরংজীবের রাজত্বের মৌলিক ইতিহাস প্রকাশিত হইতে পারিত কি না সন্দেহ। অধিকন্তু তিনি তাঁহার নিজ পুস্তকালয় হইতেও আমাকে নানা হস্তলিপি ব্যবহার করিতে দিয়াছিলেন এবং বিলাত ও ফ্রান্স হইতে ফার্সী হস্তলিপির একপ্রকার শস্তা ফটো (Rotary Bromide Print) লইবার জন্য ফটোগ্রাফারদিগের সহিত বন্দোবস্ত করিয়া তাহাদের মূল্য কমাইয়া দিয়াছিলেন। যখনই আমি কোন সংশয় বা সন্দেহে পড়িয়া তাহাকে লিখিয়াছি, তখনই তিনি অকাতরে আমাকে সাহায্য করিয়াছিলেন। লক্ষ্ণৌবাসী একজন নবাবের নিকট বহু ফার্সী ঐতিহাসিক পত্রের একটি সংগ্রহ ছিল। আমি ঐ নবাবের অনুমতি লইয়া উহার নকল লইবার জন্য নিজ খরচে একজন লিপিকর নিযুক্ত করিয়াছিলাম; কিন্তু দুঃখের বিষয়, নবাবের কর্মচারীরা নানা মিথ্যা আপত্তি করিয়া আমার নিয়োজিত লোককে নকল লইতে দেয় নাই। অবশেষে হতাশ হইয়া, আমি এ বিষয় আর্ভিনের গোচর করিয়াছিলাম। তিনি এলাহাবাদের একজন উচ্চপদস্থ সিভিলিয়ন বন্ধুকে এ-বিষয়ে লেখেন। তাঁহার বন্ধু আবার নবাবকে লেখেন ৷ এক্ষণে ওই পাণ্ডুলিপির স্বত্ত্বাধিকারী স্বীয় ব্যয়ে উহা নকল করাইয়া, নকলটী রেশমী কাপড় ও মরক্কো চামড়ায় বাঁধাইয়া, আভিনকে উপহার দেন! আর্ভিন উহা প্রাপ্তিমাত্র আমাকে পাঠাইয়া দিয়াছিলেন। অধিকন্তু তিনি আমার আওরংজীবের ইতিহাস-এর প্রথম পাঁচ অধ্যায় অতীব যত্নের সহিত পাঠ করিয়া পরিবর্তন ও পরিবর্দ্ধনাদি করিয়া দেন।

প্রকৃতপক্ষে আর্ভিন এত অধিক পরিমাণ সময় অপরের সাহায্যকল্পে নিয়োজিত করিতেন যে, সময়ে সময়ে তাঁহার নিজ কার্যে ক্ষতি করিয়া তাঁহার সাহায্য ভিক্ষা করিতে আমি লজ্জিত হইতাম। আমার রচিত India of Aurangzib অর্থাৎ মুঘল সাম্রাজ্যের ভৌগোলিক বিবরণ সম্বন্ধে আমি অভিযোগ করিয়া তাঁহাকে লিখিয়াছিলাম যে, প্রাচীন ইজিপ্টের ন্যায়, প্রাচীন ভারত-বিষয়ে শিক্ষা করিতে হইলে, ভারত অপেক্ষা ইউরোপীয় রাজধানীতে গমন করিলে উপকরণ পাওয়া সহজ। আর্ভিন ইহার উত্তরে আমাকে, অষ্টাদশ শতাব্দীতে রচিত ভারতীয় ভৌগোলিক বিবরণ সম্বলিত “চাহার গুলশানে”র তিনখানি ফার্সী পাণ্ডুলিপি স্বেচ্ছায় পাঠাইয়া দিয়াছিলেন। তাঁহার দয়ার এইরূপ অনেক দৃষ্টান্ত দেওয়া যাইতে পারে।

তথাপি তিনি এরূপ সাধু প্রকৃতি সম্পন্ন ও ন্যায়পরায়ণ ছিলেন যে, যে কেহ তাঁহাকে অতি সামান্য সাহায্যও করিয়াছেন, তিনি স্বীয় গ্রন্থের পাদটীকা ও পরিশিষ্টে, তাঁহাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করিতে কুণ্ঠিত হ’ন নাই। যতদিন তিনি জীবিত ছিলেন, ততদিন তিনি আমাকে বহুল পরিমাণে সাহায্য করিয়াছেন; তথাপি তিনি মৃত্যুর দুই মাস পূর্ব্বে আমাকে যে পত্র লেখেন, তাহার শেষে লিখিয়াছিলেন : “আপনার নিকট হইতে আমি যে নানা সাহায্য পাইয়াছি, তাহার জন্য ধন্যবাদ গ্রহণ করিবেন” (“Thanks for all the help of many sorts I have received from you”)।

ঐতিহাসিক আর্ভিন

ঐতিহাসিক আর্ভিনের এক অপূর্ব্ব বিশেষত্ব ছিল। তিনি পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে আলোচনা করিতেন এবং যাহা লিখিতেন, তাহা নির্ভুল হইত। এই দুই গুণে তিনি কোন জৰ্ম্মান পণ্ডিত অপেক্ষা লেশমাত্র হীন ছিলেন না। তাঁহার আদর্শ অতি উচ্চ ছিল

“A Historian ought to know everything and thought that is an impossibility, he should never despise any branch of learning to which he has access.” (Letter to me, 2 Oct. 1910).

আর্ভিন তাঁহার আলোচ্য বিষয়ের উপর নানা দিক দিয়া আলোক-সম্পাত করিয়াছেন। ফার্সী, ইংরাজী, ওলন্দাজ, পর্তুগীজ বিবরণাদি, ভারতে জেসুইট মিশনারীদের পত্রাবলী, ভ্রমণ-কাহিনী, সমধৰ্ম্মী সাহিত্য (Parallel Literature)-এ সমস্ত হইতেই তিনি উপকরণ সংগ্রহ করিয়াছেন। তিনি তাঁহার Storia ও Army of the Indian Mughals পুস্তকদ্বয়ের পরিশিষ্টে যে প্রমাণ-পঞ্জী দিয়াছেন তাহাতেও যথেষ্ট শিখিবার জিনিস আছে। তিনি সত্যনিষ্ঠ ঐতিহাসিকের ন্যায় প্রত্যেক বিষয়ের নজীর প্রদান করিয়াছেন। এই সমস্ত কারণে আমার মনে হয়, আমাদের দেশের ইতিহাস-লেখকগণ যেন তাঁহার Later Mughals অধ্যয়ন করেন এবং ইহাকে বিশুদ্ধ ঐতিহাসিক পদ্ধতির আদর্শ এবং মানসিক তপস্যার (Intellectual discipline) উপায়স্বরূপ অনুকরণ করেন।

কেহ কেহ আভিনকে “ভারতের গীবন” এই নামে অভিহিত করিতে আপত্তি করেন। তাঁহারা বলেন, আর্ভিন কেবল ঘটনার বিবরণই প্রদান করিয়াছেন, গীবন তাঁহার রোম সাম্রাজ্যের পতনের মহা ইতিহাসে (Decline and Fall) যে মতামত ও গবেষণা দেখাইয়াছেন, তাহা তাঁহার ইতিহাসকে উচ্চ দর্শন এবং আদর্শ সাহিত্য-শ্রেণীর অন্তর্গত করিয়াছে– সে প্রকার চিন্তা ও দর্শন আর্ভিনের ইতিহাসে নাই। কিন্তু এই সমস্ত সমালোচক একটা কথা ভুলিয়া যান। কথাটি এই যে– গীবন যখন রোমের ইতিহাস লেখেন, তখন সে দেশের ইতিহাসের ঘটনা-পারম্পর্য্য, সাহিত্য ও দর্শনের বিবরণ বিশুদ্ধ ও বিস্তৃতভাবে পণ্ডিতগণ কর্তৃক রচিত হইয়াছিল; কিন্তু আর্ভিন যখন মুঘল ইতিহাস লিখিতে আরম্ভ করিয়াছিলেন, তখন ভারতেতিহাস লিখনের আদিম যুগই কাটে নাই। আমাদের এখনও অনেক বিবরণ সংগ্রহ ও সুসম্বদ্ধ করিতে হইবে- এখনও আবশ্যক ভিত্তি গঠন করিতে হইবে;-অগ্রে অবিসম্বাদিত সত্য নির্দ্ধারণ করিলে তবেই সেই পাষাণ-ভিত্তির উপর চিন্তা বা ঐতিহাসিক দর্শনের অট্টালিকা নির্ম্মিত হওয়া সম্ভব। আমরা এই বুনেদ গাঁথিয়া যাইব। তাঁহা যদি খাঁটি হয়, তবে আমাদের পরবর্তী যুগে সৌভাগ্যবান ইতিহাস লেখকগণ ইতিহাসের দার্শনিকতার সুরম্য হর্ঘ্য নির্ম্মিত করিতে পারিবেন, অবিশ্বাস্য প্ৰবাদমূলক সংবাদ ও বিসম্বাদী ঘটনার উপর নির্ভর করিয়া অপরিপক্ক দার্শনিক গবেষণা আরম্ভ করিলে, কেবল কতকগুলি জ্ঞানপূর্ণ মত এবং অতীতের কাল্পনিক ইতিহাসের ভিত্তি নির্ম্মিত হইবে। ইহার সাক্ষীস্বরূপ হুইলার সাহেবের ভারতেতিহাসের নামোল্লেখ করা যাইতে পারে। এই দোষে উহা বহুবর্ষব্যাপী পরিশ্রমের ব্যর্থফল হইয়াছে এবং বিস্মৃতির গর্ভে কোন্‌দিন লীন হইয়া গিয়াছে। আর কেহ যেন এইরূপ পশুশ্রম না করেন।

[ভারতবর্ষ, বর্ষ ৪, খণ্ড ১, সংখ্যা ২, শ্রাবণ, ১৩২৩।]

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *