১৭. সিয়ার্-উল্-মুতাখ্‌খরীন্‌

সিয়ার্-উল্-মুতাখ্‌খরীন্‌

এই গ্রন্থ বাঙ্গলার এক অমূল্য ইতিহাস। ইহাতে ১৭০৭ হইতে ১৭৮০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত পৌনে এক শতাব্দী কালের অতি সুবিস্তৃত বিবরণ আছে। আওরংজীবের মৃত্যু হইতে আরম্ভ করিয়া, মুঘল রাজবংশের দ্রুত অবনতি, বাঙ্গলার নবাবদের স্বাধীনতা অবলম্বন ও ধন-জন-বল-বৃদ্ধি, ইংরাজ বণিকদিগের উন্নতি এবং বঙ্গে রাজার উপর রাজা হওয়া, উত্তরভারত-ব্যাপী মহাযুদ্ধ, এবং শেষে ওয়ারেন্ হেষ্টিংস কর্তৃক ভারতে ইংরাজশক্তি প্রধান ও স্থায়ী করা,- এই সমস্ত প্রধান প্রধান ও আশ্চর্য্য ঘটনা ইহাতে যেমন বর্ণিত হইয়াছে এমন আর কোন মূল গ্রন্থে হয় নাই। ইহার রচয়িতা সৈয়দ গোলাম হোসেন (আল্ তবা তবাই আল্ হুসেনী) একজন সম্ভ্রান্ত দিল্লীর মুসলমান। তিনি ও তাঁহার পিতা হেদাএৎ আলি খাঁ বাঙ্গলার নবাবদের রাজসভায় অনেক বৎসর বাস করিয়াছিলেন। গোলাম হোসেন এই ইতিহাসের অনেক ঘটনা স্বচক্ষে দেখেন, এবং আরও অনেকগুলি সেই সেই ঘটনার অভিনেতাদের নিকট শুনেন। (ফার্সী গ্রন্থের ভূমিকা)। অনেক ইংরাজ কর্মচারীর সঙ্গেও গ্রন্থকারের বন্ধুতা ছিল। সেনাপতি হেক্টর মনরো তাঁহাকে লেখেন “আপনি যদি যোগাড় করিয়া রোহতাস দূর্গ ইংরাজদের হাতে দিতে পারেন তবে আপনার সহিত আমাদের বন্ধুতা আরও বাড়িয়া যাইবে!” (মূল ফার্সী বহি-র ৩৩৮ পৃষ্ঠা)। গুর্গীন খাঁর সঙ্গে তাঁহার কথাবার্ত্তা ৩০৫ পৃষ্ঠায় দেওয়া হইয়াছে। মুসলমান ও ইংরাজ উভয় পক্ষের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সংস্রব থাকায় সেই শতাব্দীর প্রকৃত ইতিহাস লিখিতে ঘোলাম হোসেন যেরূপ সুবিধা পান সেরূপ সুবিধা আর কাহারই হয় নাই। সুতরাং, সমসাময়িকতা ও মৌলিকতার হিসাবে এ গ্রন্থ অমূল্য।

দ্বিতীয়ত: ইহাতে প্রচুর উপাদান আছে। গ্রন্থকার শাহআলম বাহাদুর শাহ হইতে ৭ জন দিল্লীর বাদশাহের ইতিহাস কতকটা সংক্ষেপে দিয়াছেন বটে, কিন্তু এই সকল অসার অক্ষম রাজ-পুত্তলিকার দীর্ঘ বিবরণ আবশ্যক নহে। তাহার পর আলীবর্দ্দি হইতে বাঙ্গালার নবাবদের বিবরণ এত দীর্ঘ এত সূক্ষ্ম ও বিবিধ ঘটনাপূর্ণ যে তাহা হইতে ইতিহাস কেন, সমাজের অবস্থা, দেশের দশা, ধর্ম্মের পরিবর্তন, জনসাধারণের আচার, ব্যবহার, বিশ্বাস, প্রভৃতি অনেক বিষয়ের সংবাদ পাওয়া যায়। বিশেষত: সেই সময়কার ঐতিহাসিক চরিত্রগুলির এক একটি দীপ্ত ছবি পাঠকের মানসপটে আসিয়া পড়ে। ইহার পাশে রিয়াজ্-উস্-সালাতীনকে স্কুলের ছেলেদের ইতিহাসের সংক্ষিপ্তসারের সংক্ষিপ্তসার বলিয়া বোধ হয় ৷

তৃতীয়ত: ইহা আমাদের দেশের লোকের লেখা দেশের ইতিহাস। আমরা ইংরাজ লিখিত ইতিহাসই বেদবাক্য বলিয়া গ্রহণ করি। “অপর পক্ষ” কি বলেন জানি না, জানিতেও চেষ্টা করি না। সুতরাং, আমাদের জ্ঞান অসম্পূর্ণ, আংশিক সত্য মাত্র। সে অদ্ভুত অশ্রুতপূর্ব্ব ঘটনাগুলি বঙ্গের– বঙ্গের কেন, সমস্ত ভারতের– ভাগ্যপরিবর্তন করিল, তাহা তখনকার একজন শিক্ষিত সম্ভ্রান্ত ও চিন্তাশীল ভারতবাসীর হৃদয়ে কেমন লাগিয়াছিল একথা বুঝিতে হইলে সিয়ার্-উল্-মুতাখরীন পড়িতেই হইবে। গ্রন্থকার সিরাজ-উদ্-দৌলার নিমকহারাম কর্ম্মচারীদের নির্ভয়ে নিন্দা করিয়াছেন (ফার্সীর ২৩০ পৃষ্ঠা); শূজা-উদ্-দৌলা যে আলস্য ও অসাবধানতায় বক্সারে মুষ্টিমাত্র ইংরাজসেনার নিকট পরাস্ত হইলেন তাহাও স্পষ্ট করিয়া লিখিয়াছেন (৩৩১ পৃ.); মীর কাসিমের বিবরণে সেই তেজস্বী ও দক্ষ নবাবের প্রতি শ্রদ্ধা ও সম্মান দেখাইয়াছেন ৷

অথচ ঘোলাম হোসেন ধৰ্ম্মান্ধ ক্ষুদ্রচেতা কূপমণ্ডুক ছিলেন না। গ্রন্থের শেষ দিকে মুঘলরাজ্যের অধঃপাতের কারণ, ইংরাজ ও মুসলমান শাসনের তুলনা প্রভৃতি কয়েকটী চিন্তাপূর্ণ অধ্যায় আছে। অতি কম ফার্সী গ্রন্থে এইরূপ ইতিহাসের দার্শনিকতত্ত্ব (Philosophy of History) দেখিতে পাওয়া যায়।

এই সব কারণে বিজ্ঞ সমাজে এই পুস্তকের বড়ই আদর। গ্রন্থ লেখা হইবামাত্র বড় লাট ওয়ারেন হেষ্টিংস ইহার অনুবাদ করাইবার জন্য ব্যাগ্র হন।

So valuable was it deemed on its first appearence, that Mr. Warren Hastings became extremely anxious to have it translated into English. (Briggs’s Siyarul-Mutakhevin, iv.)

এ অনুবাদ মুস্তফা নামক একজন মুসলমানধর্মাবলম্বী ফরাসী রচনা করেন। তাহার পর শিক্ষাসমিতির আজ্ঞায় (by order of the General Committee of Public Instruction) ১৮৩৩ খ্রিস্টাব্দে হাকিম আব্দুল মজিদ্‌ কর্তৃক আসল গ্রন্থের এক বৃহদাকার মূল্যবান ও সুন্দর সংস্করণ কলিকাতায় মেডিকাল প্রেসে ছাপা হয়। ১৮৩২ খ্রিস্টাব্দে বিলাতেয় বিখ্যাত Oriental Translation Fund নামক সমিতির উদ্যোগে কর্ণেল ব্রিস্‌ আর এক ইংরাজী অনুবাদের প্রথম খণ্ড বাহির করেন। তিনি লিখিয়াছেন–

The work is written in the style of private memoirs, the most useful and engaging shape which history can assume; nor, excepting in the peculiarities which belong to the Mahomedan character and creed, do we perceive throughout its pages any inferiority to those of the historical memoirs of Europe. The Duc de Sully, Lord Clarendon, or Bishop Burnet, need not have been ashamed to be the authors of such a production. (p. iv.)

অর্থাৎ “এই গ্রন্থ লেখকের সমসাময়িক বিবরণের আকারে লেখা। এই প্রকারের ইতিহাস সব চেয়ে বেশী কার্যকর এবং মনোরম। মুসলমান লেখকের নিজ চরিত্র ও ধর্ম্মসম্বন্ধীয় যে বিশেষত্ব আছে তাহা বাদ দিলে এই পুস্তক ইউরোপীয় সমসাময়িক বিবরণগুলি হইতে কোন অংশে নিকৃষ্ট নহে। ফরাসী রাজা চতুর্থ হেনরির মন্ত্রী ডিউক অব সালী, প্রথম চার্লসের মন্ত্রী এবং ইংলণ্ডের রাজবিদ্রোহের ঐতিহাসিক লর্ড ক্লেরেন্ডন, ৩য় উইলিয়মের প্রিয়পাত্র এবং কাহিনীলেখক বিশপ বার্নে গ্রন্থ লেখা অগৌরব মনে করিতেন না।” প্রাচীন ধরনের ইতিহাসের ইহা অপেক্ষা আর কি উচ্চ প্রশংসা করা যাইতে পারে?

সিয়ার-উল-মুতাখীনের বাঙ্গলা অনুবাদ বিশেষ আবশ্যক। ১৭৮৯ খ্রিস্টাব্দে হাজী মুস্তাফা নামধারী নামক ফরাসী সাহেব মুসলমান কেরাণী ইহার ইংরাজী অনুবাদ প্রকাশ করেন (A translation of Seir Mutaqharin, 3 vols quarto, Calcutta, 1789)। এই অনুবাদের প্রায় সমস্ত খণ্ডই কলিকাতা হইতে বিলাত যাইতে জাহাজডুবি হইয়া লোপ পাইয়াছে। আজি কয়েক বৎসর হইল কলিকাতার ক্যাম্বে অ্যান্ড কোং ইহার অবিকল পুনর্মুদ্রণ করিয়াছেন। কিন্তু এই অনুবাদে অনেক দোষ আছে; স্থলে স্থলে ভুল লেখা হইয়াছে, কারণ মুস্তাফা ফার্সীর ঠিক অর্থ বুঝিতে পারেন নাই, কতকগুলি টিপ্পনীও অশুদ্ধ। শেষ মুঘলদের প্রসিদ্ধ ঐতিহাসিক এবং অষ্টাদশ শতাব্দীর ভারত-ইতিহাসে অতুলনীয় জ্ঞানসম্পন্ন লেখক উইলিয়ম আর্ভিন সাহেব, মুস্তাফার অনুবাদ কলিকাতায় আবার ছাপা হইতেছে শুনিয়া আমাকে লিখিয়াছেন, “আমি আশ্চর্য্য হইলাম যে এই অনুবাদের অবিকল পুনর্মুদ্রণের জন্য গবর্ণমেণ্ট সাহায্য করিতেছেন। অগ্রে ইহার ভ্রম সংশোধন করা উচিত, বিশেষত: মুস্তফার অশুদ্ধ ও অশ্লীল টিপ্পনীগুলি বাদ দেওয়া আবশ্যক।” এলিয়াট ও ডাউসন তাঁহাদের প্রসিদ্ধ মৌলিক ভারত-ইতিহাসের ৮ম খণ্ডে এই অনুবাদ ভ্রমাত্মক বলিয়াছেন। তাহার পর ১৮৩২ খ্রিস্টাব্দে কর্ণেল ব্রিস্‌ যে অনুবাদ প্রকাশ করেন, তাহা অসম্পূর্ণ; ইহাতে শুধু নবাব সরফরাজ খাঁর মৃত্যু পর্যন্ত আছে। এখানি নূতন অনুবাদ নহে, কেবল মুসাফার ইংরাজীটুকু সংশোধন করা হইয়াছে। অনুবাদের সব ভ্রমগুলিই রহিয়াছে। (এলিয়া ও ডাউসন ৮ম খণ্ড)।

প্রায় ৩০ বৎসর গত হইল গৌরমোহন মৈত্রের মহাশয় সিয়ার্ উল-মুতাখরীনের এক অবিকল বাঙ্গলা অনুবাদ রচনা করেন। তাঁহার পুত্রেরা এখন উহা ছাপাইতেছেন। সকল বাঙ্গালী পাঠকেরই এই অনুবাদ লওয়া উচিত। ইহার প্রথম গুণ এই যে অনুবাদ শুদ্ধ ও সম্পূর্ণ। আমি আসল ফার্সি বহির সহিত তাঁহার অনুবাদের প্রথম তিন অধ্যায় মিলাইয়া দেখিয়াছি যে অনুবাদ পদে পদে ঠিক একটি কথাও ছাড়া যায় নাই অথবা কোন স্থানে গোঁজামিল দিয়া অর্থ করা হয় নাই।

দ্বিতীয়তঃ মৈত্রেয় মহাশয় হাকিম আবদুল মজিদের ১৮৩৩ খ্রিস্টাব্দে ছাপান ফার্সী বহি হইতে অনুবাদ করিয়াছেন; এই সংস্করণ অত্যন্ত যত্নে ও পণ্ডিত লোকেদের তত্ত্বাবধানে ছাপা হয়। ছাপার শুদ্ধতা ও আবদুল মজিদের বিজ্ঞতা সম্বন্ধে হরেস্ হেমান উইলসন্, ডাক্তার টিলার, অধ্যাপক মিল প্রভৃতি প্রাচ্যতত্ত্ববিদ্ সাহেবেরা প্রশংসা পত্র দিয়াছেন। মুস্তাফা হস্তলিপি হইতে অনুবাদ করেন। ফার্সী হস্তলিপি সাধারণত: কত ভ্রমপূর্ণ ও অস্পষ্ট তাহা সকলেই জানেন। আসলের দোষগুলি সম্ভবত: মুস্তাফা এড়াইতে পারেন নাই। এ বিষয়ে এই বঙ্গানুবাদের শ্রেষ্ঠতা রহিয়াছে।

মৈত্রেয় মহাশয়ের ভাষা গম্ভীর ও তেজস্বী। সাহিত্য-পরিষদের সুধী কর্তৃপক্ষ হস্তলিপি পড়িয়া ইহা ছাপাইতে অনুমোদন ও উৎসাহ দিয়াছেন। আশা করি বঙ্গীয় সাহিত্য জগতে এই গ্রন্থের যথেষ্ট আদর হইবে।

[প্রবাসী, ভাগ ৮, সংখ্যা ৫, ভাদ্র, ১৩৩৫।]

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *