০৪. গবেষণার প্রণালী

গবেষণার প্রণালী

কোনো একটি পরিকল্পনাকে কার্যে পরিণত করিতে হইলে তাহার জন্য একটি বিশেষ প্রণালী অনুসরণ করিতে হইবে, তাহার বিশেষ উপকরণ সংগ্রহ করিতে হইবে। আর ঐ কাজের জন্য কারিগরগুলিকে, তাহাদের আবশ্যক বিশেষ গুণগুলি আছে কিনা দেখিয়া লইয়া, তাহাদের ঐ কাজের জন্য বিশেষ প্রাথমিক শিক্ষা দিয়া উপযুক্ত করিয়া তুলিয়া তবে কাজটি আরম্ভ করিতে হইবে। এরূপ গোড়াপত্তন শক্ত করিয়া না গাঁথিলে, কাজটি সম্পন্ন হইতে পারে না।

মৌলিক গবেষণার উদ্দেশ্য, জগতের এ পর্যন্ত সংগৃহীত জ্ঞানের উপর আরও কিছু নূতন তত্ত্ব যোগ করিয়া দেওয়া, আমাদের পূর্ব্ববর্ত্তী পণ্ডিতগণ যাহা জানিতেন তাহা হইতে আমাদের আরও একটু অগ্রসর করিয়া দেওয়া। যেমন বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে, তেমনি ঐতিহাসিক গবেষণার ক্ষেত্রে সত্যই বলা হয়, Continual Supersession is the rule of progress, অর্থাৎ আমাদের কবির ভাষা একটু বদলাইয়া বলি, “ওরে সবুজ, ওরে সুবুঝ, শুকনো পাতাকে ঠেলে ফেলে দিয়ে তার জায়গা নে।”

অতএব, আমাদের প্রথম জানা আবশ্যক যে, জ্ঞানের বিশেষ ক্ষেত্রে, যেমন ইতিহাস, সমাজতত্ত্ব, অর্থনীতি, বিজ্ঞান বা দর্শনের কোনও একটি শাখায়– আজ সভ্যজগৎ কতটা জানিতে পারিয়াছে। একটি বেশ করিয়া বুঝিয়া, জ্ঞাত তত্ত্বের শেষ সীমানা হইতে জঙ্গল কাটিয়া অজ্ঞাতের রাজ্যে প্রবেশ করিতে হইবে, সত্যের রাজ্য আরও একটু বিস্তৃত করিতে হইবে। এজন্য পরিপূর্ণজ্ঞানযুক্ত পুঁথিগত বিদ্যার পণ্ডিত আসিয়া আমাদের গবেষণা-পিপাসী ছাত্রকে বলিয়া দিবেন, “ঠিক এইখান থেকে তুমি কাজ আরম্ভ করবে।” মহা ভুল হইবে যদি আমরা সদ্য পাসকরা একজন মেধাবী ছাত্রকে একটা বৃত্তি দিয়া, লাইব্রেরীর দ্বার খুলিয়া বলিয়া দিই, “যা ভিতরে গিয়ে মনের সুখে চর গে। দুবৎসর পরে রিপোর্ট দিস কি পেয়েছিস।” ধৰ্ম্মসাধনায় যেমন, ঠিক তেমনি জ্ঞানযোগের সাধনার কাজেও সদ্গুরু চাই, নচেৎ সিদ্ধি হইবে না।

বর্তমান জগতে গবেষণার সব ক্ষেত্রে একই বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি অনুসৃত হয় এবং যে পরিমাণে আমরা এই পদ্ধতি অবিচলিত ভাবে অক্লান্ত চেষ্টায় অনুসরণ করি, তাহার উপর গবেষকের নিজ আরব্ধ কাজে সফলতা নির্ভর করে, শ্রম পণ্ড হয় না।

বিশেষ কাজের জন্য উপযুক্ত ছাত্র পাইলে তাহাকে আরম্ভ করিবার ঠিক স্থানটি দেখাইয়া দিয়া এবং কোন্ অদৃশ্য লক্ষ্যে অবশেষে পৌঁছিতে হইবে তাহা বুঝাইয়া দিয়া, তাহাকে জ্ঞানগুরু একটি উপকরণপঞ্জী অর্থাৎ bibliography রচনা করিয়া দিবেন। ইহার আবশ্যকতা দেশে অনেকেই জানেন না, বিশ্ববিদ্যালয়ের মহার্ঘ চেয়ারে আসীন প্রধান প্রোফেসরও অনেক সময় ইহাতে অবহেলা করেন। হয়ত বলেন, অমুক বড় ইতিহাসের অমুক অধ্যায়ের শেষে যে গ্রন্থপঞ্জী ছাপা আছে তাহা দেখিয়া পড়। এরূপ ভাসা ভাসা উপদেশের মত বিড়ম্বনা আর নাই। আমি অনেক ডক্টরেট থীসিস পরীক্ষা করিবার সময় এই অবহেলার বিষময় ফল দেখিয়া, ব্যর্থ ছাত্রদের দুর্ভাগ্য ভাবিয়া কাঁদিয়াছি।

এইরূপ উপাদানপঞ্জী রচনা করিবার জন্য প্রত্যেক বিভাগে প্রত্যেক ক্ষুদ্ৰ শাখায় এক এক জন বিশেষজ্ঞ শুরু আবশ্যক, একজন সাৰ্ব্বভৌম পণ্ডিত জ্ঞানের সব ক্ষেত্রকে সমান সফলতার সহিত আয়ত্ত করিতে পারেন না। শুধু এখানকার গবেষণামন্দির নহে, মহাধনী প্রদেশবিস্তৃত বিশ্ববিদ্যালয়েও সব বিষয়ে, অথবা একটিমাত্র বিষয়েরও সব শাখায় বিশেষজ্ঞ পণ্ডিত পাওয়া সম্ভব নহে। কিন্তু তাহাতে কোন ক্ষোভ নাই, ক্ষতি নাই। মধু অন্বেষণে ভ্রমর যেমন পুষ্প হইতে পুষ্পান্তরে যায়, তেমনি প্রকৃত জ্ঞানপিপাসু ছাত্র এক গুরু হইতে অন্য গুরুর নিকট যাইবে। ছাত্রটি নির্দিষ্ট বিষয়ে বিশেষজ্ঞের খোঁজে লাহোর, পুনা বা লক্ষ্ণৌ যাইবে, এবং তথা হইতে উপদেশ ও উপাদানপঞ্জী আনিয়া শান্তিনিকেতনে ফিরিয়া শান্ত মনে নিজ কাজ করিবে, যাহা লাহোর, পুনা বা লক্ষ্ণৌয়ে তাহার পক্ষে তত সহজ নহে। জ্ঞানের বড় বড় সব ক্ষেত্রে গবেষণার পথপ্রদর্শক এখানে নাই বলিয়া গবেষণার কাজ ঠেকিবে না। আমাদের ছাত্রগণ প্রাথমিক শিক্ষায় তৈয়ারি হইয়া অন্যত্র ভ্রমণ করিবে, যেমন মধ্যযুগে এবং এখনও ইউরোপের গ্রাজুয়েটগণ বিদেশে পণ্ডিতদের চরণে বসিয়া জ্ঞানভাণ্ডার পূর্ণ করিত ও করে।

আমরা দেখিলাম যে প্রথমে চাই ছাত্র ও বিষয়নির্বাচন, তারপর চাই গুরু বা বিশেষজ্ঞ পথপ্রদর্শক; তৃতীয় আবশ্যক উপকরণসংগ্রহ।

গবেষণার ক্ষেত্র বাছিয়া লইবার পর দেখিতে হইবে যে তাহার জন্য আবশ্যক গ্রন্থ-উপকরণ এখানে আছে কি না। না থাকিলে সেই বিষয়টি নির্ব্বাচন করা অতি হাস্যকর বিড়ম্বনা হইবে। ধরুন ভারতের মধ্যযুগের ইতিহাস সমাজ ধৰ্ম্ম শিল্প-বাণিজ্য কলা এগুলির বিষয়ে গবেষণা করিবার সঙ্কল্প হইল তখন ঐ ঐ বিষয়ে অত্যাবশ্যক প্রামাণিক গ্রন্থ, অভিধান, ম্যাপ, হস্তলিপি, মুদ্রা ও শিল্পদ্রব্যের ছবি, এ সবগুলিতে এখানকার লাইব্রেরী পূরণ করিতে হইবে। যাহা এখানে আছে তাহার তালিকা পড়িয়া এক এক বিশেষজ্ঞ তাঁহার নিজ গবেষণার বিষয়ের জন্য যে-যে বই বা হস্তলিপির ফটো আবশ্যক তাহার নাম ও ঠিকানা লিখিয়া দিবেন, এবং সেগুলি এখানকার জন্য সংগ্রহ করিতে হইবে, এক বৎসরে না হউক পাঁচ ছয় বৎসরে। ম্যাপ, মুদ্রার তালিকা, প্রত্নতত্ত্বের নিদর্শনগুলির ছবি– এ সব আবশ্যক, এগুলিকে মূল্যবান ভাবিয়া ছাড়িয়া দিলে চলিবে না, কাজ হইবে না। প্রত্যেক বিষয়ে সৰ্ব্বশ্রেষ্ঠ অভিধান ও এনসাইক্লোপীডিয়ার নূতন সংস্করণ আনানো আবশ্যক।*

[প্রবাসী, ভাগ ৪৫, খণ্ড ২, সংখ্যা ৪, মাঘ, ১৩৫২।]

* শান্তিনিকেতনের আশ্রমিক সংঘের সভাপতির অভিভাষণ।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *