০১. ইতিহাস এক মহাদেশ

ইতিহাস এক মহাদেশ

শুধু ইতিহাস নিয়ে একখানা পত্রিকা বাঙ্গলায় বাহির করা কেন আবশ্যক? এই প্রশ্ন স্বাভাবিক, ইহারই আজ উত্তর দিতেছি।

আমাদের দেশে ইতিহাস সম্বন্ধে যেসব আলোচনা হয়, ইতিহাসের যে দিকটা আমাদের বাঙ্গালী লেখকগণ চর্চ্চা করেন, তাহা বড়ই সঙ্কীর্ণ। এদেশে যাঁরা ইতিহাস ভালবাসেন, আর যাঁরা ইতিহাস নিয়ে প্রবন্ধ বা পুস্তক রচনা করেন, তাঁরা প্রায় সকলেই প্রাচীন যুগের শিলালিপি ও তাম্রশাসন, পুরাতন হস্তলিপি, বৈষ্ণব ও অন্য ধর্ম্ম সম্বন্ধে মধ্যযুগে রচিত অপ্রকাশিত পদ্য ও গান, অথবা স্থানীয় প্রবাদ নিয়েই ব্যস্ত থাকেন। এগুলির বাহিরে যে ইতিহাসের কত প্রকাণ্ড, কত বিচিত্র এক মহাদেশ পড়িয়া আছে, এবং কত কত ইউরোপীয় পণ্ডিত সেই ক্ষেত্র চাষ করিয়া, কত মূল্যবান ফসললাভ করিতেছেন, তাহা আমাদের অনেকেই জানে না। এই দিক দিয়া বিচার করিলে, বলিতে হয় যে আমাদের গর্বিত বাঙ্গলাদেশ এখনও স্কুলকলেজের ইতিহাস-পর্যায়ের উপরে উঠিতে পারে নাই। অবশ্য গত বিশ-ত্রিশ বৎসরের মধ্যে কয়েকখানি বেশ মূল্যবান ইতিহাসগ্রন্থ বাঙ্গালীরা প্রকাশিত করেছেন, কিন্তু তাহারাও এই সঙ্কীর্ণক্ষেত্রে আবদ্ধ, অর্থাৎ ইতিহাসের বিস্তৃত সংজ্ঞা তাহাদের দ্বারা আবৃত হয় না। আমার কথাটা কয়েকটি দৃষ্টান্ত দিয়া বুঝাইয়া দিব। আমাদের মধ্যে কি নাই তাহা দেখাইতেছি।

প্রথমত: ইতিহাস যে রাজারাজড়ার কাহিনী, যুদ্ধ ও বিদ্রোহ, সাম্রাজ্যের উত্থান পতন এই বিষয় ক’টিতে আবদ্ধ নয়, তাহা অনেকেই জানেন। কিন্তু ইতিহাস সাহিত্য কিম্বা বিজ্ঞান শ্রেণীর গ্রন্থ হইবে, এই প্রশ্ন এখন বিলাতে খুব আন্দোলিত হইতেছে। টাইমস্ পত্রিকার লিটারারি সাপ্লিমেন্ট নামক সাপ্তাহিক যাঁহারা মন দিয়া পড়েন তাঁহারা যদি দু’পক্ষের যুক্তির বাঙ্গালা সারাংশ আমাদের এই পত্রিকায় প্রকাশিত করেন, তবে দেশের লোকের দৃষ্টি এই দিকে যাইতে পারে। বিখ্যাত ঐতিহাসিক জি এম ট্রেভিলিয়ন (কেম্ব্রিজ, ট্রিনিটি কলেজের কর্তা) তাঁহার আত্মচরিত (অটো-বাইওগ্রাফি, লংম্যান প্রকাশিত) গ্রন্থে ইতিহাসকে সাহিত্য অর্থাৎ সজীব ও হৃদয়গ্রাহী করিয়া অথচ সত্য তথ্য অক্ষুণ্ণ রাখিয়া, রচনা করিবার পক্ষে মত দিয়াছেন। এবং দেখা যাইতেছে যে এ যুগের সর্বশ্রেষ্ঠ ইউরোপীয় ঐতিহাসিকগণও ঠিক এই প্রণালী অবলম্বন করিয়া তাঁহাদের মহাগ্রন্থগুলি রচনা করিয়াছেন। মেকলের তো কথাই নাই, তাঁহার আকাঙ্ক্ষা ছিল “এমন একখান ইতিহাস লিখিব, যাহাকে লোকে নূতনতম নবেল ফেলিয়া দিয়া আদর করিয়া পড়িবে”- সে উদ্দেশ্য সফল হয়। গিবনের ইতিহাস, মেকলের দোষগুলি হইতে মুক্ত, কিন্তু সুপাঠ্য হিসাবে ঠিক সেইমত একখানা অমর সাহিত্য, যাকে বলে ওয়ার্লড্ ক্ল্যাসিক। জার্মান প্রণালীর কটমট তথ্যপূর্ণ নীরস বৈজ্ঞানিক গ্রন্থের মত ইতিহাস এখন আর ইউরোপে আদর্শ বলিয়া গৃহীত হয় না।

তারপর, জগৎবিখ্যাত ঐতিহাসিকগণ প্রত্যেকে কোন বিশিষ্ট ধরণে, বিভিন্ন কারিগরিতে নিজ মহাগ্রন্থ রচনা করিয়া গিয়াছেন, এ সম্বন্ধে আমরা একেবারেই খোঁজ লই না। অথচ এই মহা শিক্ষাপ্রদ আবশ্যক বিষয় জানা অতি সহজ। প্রথমত: কেম্ব্রিজ এসেণ্ট হিস্ট্রিতে আদিযুগের আদর্শ ঐতিহাসিকদ্বয়- হেরোডোটস এবং থুকিডিডিসকে তুলনা করা হইয়াছে, এবং সেই সঙ্গে জেনোফন্ যে অকারণে প্রশংসিত তাহাও দেখান হইয়াছে। তারপর অধ্যাপক গুচের গ্রন্থ History and Historians in the Nineteenth Century (2 এডিসন্, লংম্যান প্রকাশিত) রাঙ্কে, মমসেন প্রভৃতি সমস্ত বড় ও মাঝারি নব্য ঐতিহাসিকদের রচনা প্রণালী ও আদর্শের বিশদ ব্যাখ্যা করিয়াছেন। এমন কি কেম্ব্রিজ মডার্ণ হিস্ট্রিতেও এক এক অধ্যায়ে এর আলোচনা করা হইয়াছে, সে বইটা সুলভ ও সর্বত্র প্রাপ্য। গুচের সারাংশ আমাদের এই পত্রিকায় ক্রমশ প্রকাশিত করা উচিত।

তৃতীয়ত: যুদ্ধবিদ্যার ইতিহাস, এবং বিশেষ বিশেষ যুদ্ধ যেমন ওয়াটার্লু, সিডান প্রভৃতির বিশ্লেষণ, বড়ই শিক্ষাপ্রদ এবং মনোরম। দীর্ঘ সময়ে জয়লাভই জাতীয় দক্ষতা ও চরিত্রবলের শ্রেষ্ঠ প্রমাণ। সুতরাং আমাদের জানা উচিত কেন অমুক জাতি হারিল, আর সেই রণাঙ্গনে আর এক জাতি জিতিল। এই যুদ্ধবিদ্যার ক্রমবিকাশের ইতিহাস ইউরোপে একটা অবশ্যপাঠ্য বিষয়। আর আমাদের মধ্যে অনেকে ইহার নামও শুনেন নাই। এ সম্বন্ধে কয়েকখানি আধার গ্রন্থের নাম দিতেছি- Oman’s History of War in the middle Ages (দ্বিতীয় এডিসন্) Cole and Priestley’s British Military History ( Outlines of ), Encyclopaedia Britannicaতে বিশেষ বিশেষ যুদ্ধের বর্ণনা, ইত্যাদি। এর সারাংশ বাঙ্গলায় প্রকাশ করিয়া এক নূতন দিকে দেশের চোখ ফুটাইয়া দিতে হইবে। আমার সদ্যপ্রকাশিত Fall of the Mughal Empire, Vol. IV. গ্রন্থে আমি দেখাইতে চেষ্টা করিয়াছি যে যুদ্ধে কি কি কারণে ইংরাজেরা জয়ী হইল, আর মুঘল ও মারাঠারা হারিল। এই চেষ্টা না করিলে ইতিহাস অর্থহীন হয়।

এদেশে সবচেয়ে বেশী আবশ্যক মনের উন্মুক্ততা, অর্থাৎ পূর্বপুরুষদের সমস্ত সংস্কারগুলি বর্জন করিয়া একেবারে সাদাসিদা মন লইয়া অতীতের ঘটনাগুলির প্রকৃত স্বরূপ বাহির করিবার প্রবৃত্তি এবং তাহার জন্য সমাজের সমস্ত দণ্ড ভোগ করিবার জন্য প্রস্তুত হওয়া। যেমন জার্মান পণ্ডিতগণ প্রথমে যুক্তি দিয়া প্রমাণ করিয়াছেন যে (ক) হোমরের পদ্যগুলি হয়ত একজনের লেখা নয়, অনেক ছোট গীতি “সেলাই করিয়া” হলিয়ড্ ও ওডেসি গঠিত হয়েছে। (খ) রোমের রাজযুগের কাহিনী অক্ষরে অক্ষরে সত্য নয়, কিন্তু সত্য ঘটনার বিকৃত আভাস দেয় মাত্র, সেই সত্য আবিষ্কার করা। (গ) বাইবেলের যিশুর জীবনী যে তাঁর চারজন শিষ্যের লেখা একথা সত্য নয়, মার্ক মেথু প্রভৃতির নামে অপরের লেখা, এবং যিশুর জন্মের ১৫০ বৎসর পরে লেখা জীবনী ওর মধ্যে আছে, অথচ আদি রচিত জীবনীখানি লোপ পাইয়াছে, তাহার এক পরবর্তী পরিবর্তিত সংস্করণ একজন evangelist-এর নামে জগতে চলিতেছে। কি যুক্তির দ্বারা এবং কোন প্রণালীতে অনুসন্ধান করিলে এই সত্য উদ্ধার করা যায় তাহা আমাদের জানা আবশ্যক, এবং সেই প্রণালী ৪ বেদ ও মহাভারত রামায়ণে প্রয়োগ করিতে হইবে। পাঠক এ বিষয়ে অনেক তথ্য অল্প ব্যয়ে পাইবেন এই গ্রন্থগুলিতে Hastings’ Encyclopaedia of Religion and Ethics, Encyclopaedia of Islam, Cambridge Ancient History.

তুলনামূলক নৃতত্ত্ব, জনকাহিনী, প্রবাদ ইত্যাদি বিষয়ের গত পঞ্চাশ বৎসরে যে অগাধ চর্চ্চা হয়েছে তার ফলে প্রাগ-ইতিহাস বলিয়া একটা নবীন মহাদেশ আবিষ্কৃত হয়েছে। এই ক্ষেত্রের ফলগুলিও বাঙ্গলায় দিতে হইবে।

যে কোন ভাষায়ই হউক না কেন, একখানি শ্রেষ্ঠ ইতিহাস বাহির হইলে তাহার বিস্তৃত বর্ণনা আমাদের এই পত্রিকায় দিতে হইবে, যাহাতে দরিদ্র পাঠকও জানিতে পারেন যে কোন দিক দিয়া এই গ্রন্থ আমাদের জ্ঞান বাড়াইল। দৈনিক কাগজের সিকিস্তম্ভ সমালোচনায় এ কাজ হয় না। ভাল ভাল বিদেশী ইতিহাসের অনুবাদ খর্ব্বাকারে ধারাবাহিকরূপে বাঙ্গলায় বাহির করা আমাদের কর্তব্য এবং সেই সঙ্গে বাঙ্গালীদের জানাইয়া দেওয়া আবশ্যক যে অন্য প্রদেশে, যেমন মহারাষ্ট্রে, কি নূতন উপকরণ আবিষ্কৃত হয়েছে, কি মূল্যবান গ্রন্থ সদ্য প্রকাশিত হয়েছে- যাহার সংবাদ ইংরাজীতে অতি সহজেই আমরা পাই ৷

অবশেষে এক পত্রিকায় এক অংশ থাকিবে যাহার নাম “সংবাদ ও জিজ্ঞাসা” (Notes and Queries) অর্থাৎ ইতিহাস সম্বন্ধে অবশ্যজ্ঞাতব্য নূতন সংবাদ, সমাধানের জন্য জিজ্ঞাসু পাঠক বা লেখক যে সমস্যা পাঠাইয়াছেন তাহা, এবং অমুক দুষ্প্রাপ্য গ্রন্থ ভারতে কোথায় দেখিতে পাওয়া যাইবে তাহার প্রশ্ন ও উত্তর। নবীন গবেষক নিজ নির্বাচিত বিষয়ে গ্রন্থপঞ্জি (Bibliography ) চাহিলে তাহাও এখানে ছাপা হইবে। এ সবগুলি আবশ্যক কাজ।

(ইতিহাস, প্রথম বর্ষ, প্রথম সংখ্যা, ভাদ্র, ১৩৫৭)

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *