২০. টাকা পাওয়ার লোভ

বিংশ পরিচ্ছেদ

দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ এদেশকে অনেক জিনিস শিখিয়েছে, অনেক জিনিস দিয়েছে–বেশির ভাগই মন্দ–তার মধ্যে সবচেয়ে সাংঘাতিক যেটা সেটা হ’ল ফালতু আলটপকা টাকা পাওয়ার লোভ। খেটে যা পাওয়া যায় তাতে আর খুশি রইল না এদেশের মানুষ, আরও কিছু তার চাই। যে টাকার আশা ছিল না, হিসেবে যা ধরা নেই, যার হিসেব রাখতেও হবে না–এমন খানিকটা টাকা। এই লোভের পথ ধরেই এল বহু জিনিস–চুরি-জুচ্চুরি, কালোবাজারী, চোরাকারবার, নিষিদ্ধ মাল পাচার, ঘুষ দেওয়া ও নেওয়া, জালিয়াতি–আরও অনেক। আরও বেশি, অনেক বেশি। অনেক জঘন্য অনেক ঘৃণ্য জিনিস। যে সবের কল্পনা করেও আগে শিউরে উঠত ভদ্র শিক্ষিত মানুষরা। এই টাকার জন্যে, এই লোভের জন্যে সে না করল এমন কাজ নেই, দিল না এমন জিনিস নেই। এই টাকার জন্যে সে বেচল তার সততা, তার সত্যনিষ্ঠা, তার বিবেক, তার ন্যায়-অন্যায়-বিচার–তার আত্মসম্মান, তার সন্তুষ্টি–এমন কি তার অন্তঃপুরের অন্তঃপুরিকাও। টাকা চাই তার–বাড়তি টাকা, ফালতু টাকা, যে টাকা নিয়ে সে যা খুশি করতে পারবে; তার সাধ্যের অতীত, তার প্রাপ্যের অতীত সুখে থাকতে পারবে।

ইংরেজ সরকারও তা জানতেন। মানুষ চিনতেন তাঁরা। এদেশের মানুষকেও চিনেছিলেন। তাই তাঁরা এদের আনুগত্য আর এদের মনুষ্যত্ব কিনতে কিছু টাকা উড়িয়ে দিলেন বাতাসে। কার্নিভালের দিনে আকাশে ওড়ানো কাগজের কুচির মতো নোট উড়তে লাগল চারিদিকে। সে টাকা যারা পারল ধরে নিল। যুদ্ধের বাজারে দু পয়সা করেছে’ সেই ভাগ্যবানদের সম্বন্ধে এইটুকু বলেই নিবৃত্ত হ’ল দেশের বাদবাকি ভাগ্যহীন লোকেরা কীভাবে সে দু পয়সা করেছে, যুদ্ধের বাজারে কে কি ভাবে উপার্জন করল–তা নিয়ে কেউ মাথা ঘামাল না। সহজ সত্যটাকে সহজেই মেনে নিল। ঈষৎ ঈর্ষা বোধ করল হয়ত, কেউ কেউ চুরির পয়সা’য় এই অভিধা দিয়ে সে ঈর্ষা চরিতার্থও করল–কিন্তু সে চুরি ধরিয়ে দিতে, মানুষের সমাজে এই অমানুষদের মুখোস খুলে দিতে চেষ্টা-মাত্র করল না। কারণ যারা গাল দিচ্ছে তারাও আশা রাখে যে তাদের সামনেও একদা এই ‘চুরির পয়সা’ উপার্জনের পথ উন্মুক্ত প্রসারিত হয়ে যাবে।…

পয়সা উড়ছে বাতাসে। যারা ভাগ্যবান আর যারা বুদ্ধিমান তারাই ধরে নিচ্ছে। হরেনও ধরল সে টাকা। স্বর্ণর বর হরেন–মহাশ্বেতার জামাই। নানা বিচিত্র পথ ধরল সে। তার অফিসের ক্যাশ ছিল তার হাতে–তারই কিছু হেরফের করে টাকা খাটাতে লাগল। কিসে খাটাল তা কেউ জানে না। স্পষ্ট করে সে বলল না কাউকেই। ভাইয়েরা বড় হয়েছে, তাদেরও বিয়ে হয়েছে, সংসার হয়েছে। প্রধানত তারাই কৌতূহলী। পয়সার আভাস পাচ্ছে, কিন্তু তার চেহারাটা ঠিক ঠাওর করতে পারছে না। সেটা আসবার পথটাও খুঁজে পাচ্ছে না। দূরের মানুষ পায় সে আলাদা কথা। এ ঘরের মানুষ–এর এই ধনী হবার পথটা তাদের জানবার কথা–আর জানলে তারাও সে পথে যেতে পারে। কিন্তু অনেক প্রশ্ন করেও তারা বার করতে পারল না সে পথের সন্ধানটা।

তাদের আরও কষ্ট–তারা সে পথের ইঙ্গিতটা পাচ্ছে। কারা সব আসে দাদার কাছে, দোর বন্ধ করে কী সব শলা-পরামর্শ আঁটে–আবার বেরিয়ে চলে যায়। অনেক সময় হরেনও চলে যায় তাদের সঙ্গে। হয়ত বা তাদের সঙ্গে করেই নিয়ে আসে। শিবপুরের এই সঙ্কীর্ণ গলিতে বড় বড় মোটরগাড়ি এসে দাঁড়ায়। সে গাড়ি থেকে নামে নানা জাতের নানা বর্ণের লোক। এরা সবাই হরেনের লোক, হয়ত বা তার কারবারের অংশীদার।

হরেন আজকাল ফেরে বহু রাত্রে। সন্ধ্যা রাত্রে ফিরলে লোক সঙ্গে করে নিয়ে আসে, আবার তাদের সঙ্গে বেরিয়ে যায়। ছুটি পেতে প্রত্যহই গভীর রাত হয়ে যায় তার। কোথায় ঘোরে তা কে জানে। কাউকে বলে, কিছু কিছু ঠিকা নিয়েছে সে অপরের সঙ্গে ভাগে। কিন্তু কিসের ঠিকা তা কখনও বলে না। আবার কাউকে বলে, ‘সাপ্লাইয়ের কাজ ধরেছি কিছু কিছু, সময় তো নেই, তাই আপিসের পর ঘুরতে হয়।’ কিসের সাপ্লাই, কাকে সাপ্লাই দেয় তা অবশ্য কেউই জানতে পারে না। ওর কাছে যাঁরা আসেন তাঁদের কাছে ঘেঁষতে পারে না ভাইয়েরা। বেশির ভাগই আসেন পাঞ্জাবী সিন্ধী ভদ্রলোক। মারোয়াড়ীরাও আসেন কেউ কেউ। তাঁরা সহজে কাউকে পাত্তা দেবার মানুষ নন। তাঁদের পেটের কথা টেনে বার করা ওদের অন্তত সাধ্যাতীত! তাঁরা সকলেই অবস্থাপন্ন লোক। খাতিরও করে হরেন যথেষ্ট। তাঁদের মুহূর্মুহূ চা যোগাবার জন্য একটা আলাদা ঝিই রেখেছে সে ইদানীং।

তবে যা-ই করুক, টাকা যে বেশ কিছু আসছে তার, আকাশে ওড়ানো টাকা যে ধরছে সে–তাতে কোন সন্দেহ নেই। সে-টাকা গোপন করতে পারে না সে, করতে চায়ও না হয়ত। তাকে কেন্দ্র ক’রে যে একটা প্রাচুর্য উছলে উঠছে সেটা স্পষ্ট এবং প্রত্যক্ষ, তা চেপে রাখা সম্ভবও নয়। তবে একটা জিনিস তার ভাইয়েরা আঁচ করে ঠিকই, আর তাই থেকে তাদের ঈর্ষাবিষদগ্ধ হৃদয় কিছু সান্ত্বনাও লাভ করে! হরেনের হাতে এমন কোন মূলধন নেই যাতে যুদ্ধের ঠিকা নিয়ে সামাল দিতে পারে। এ টাকা আসছে ওর অফিস থেকে নিশ্চয় হয়ত ওর সঙ্গে আর যারা ক্যাশে থাকে–কিছু কিছু ঘুষ দিয়ে কিম্বা লভ্যাংশের লোভ দেখিয়ে মুখ বন্ধ করেছে তাদের। কিন্তু একথা চাপা থাকবে না। একদিন না একদিন ধর্মের কল বাতাসে নড়বেই। আর তহবিল তছরুপ ঘোরতর অপরাধ, ধরা পড়লে বাছাধনের এই হঠাৎ বড়মানুষী বেরিয়ে যাবে চিরকালের মতো।

কিন্তু সে সান্ত্বনা বা আশ্বাস কোন কাজেই লাগে না বেচারাদের। ধরা পড়বার আগেই ভাঙ্গা ক্যাশ পুরিয়ে দেয় হরেন। মোটা মোটা টাকা যার লাভ হচ্ছে তার সেটা পুরিয়ে দেওয়া কিছু আশ্চর্যও নয়। সুতরাং অফিসে কোন গোলমালই হয় না–বরং টপাটপ মাইনে বাড়ে। মেজভাই জীবেনও ঐ অফিসে কাজ করে, সে-ই সে উন্নতির সাক্ষী দেয়। কালো মুখ আরও কালো হয়ে যায় আত্মীয়দের।

এই সব হুল্লোড়ে–টাকা এবং তার আনুষঙ্গিকে–বেচারী স্বর্ণলতার কথাটা বিশেষ আর মনে থাকে না হরেনের। সে তো আছেই, তার সংসার তার ছেলেমেয়ে নিয়ে সে ব্যস্ত আছে। সবাইকে তো সে-ই দেখে। তাকে আবার দেখতে হবে কেন? বরং সে ভালই থাকবে এবার সংসার ভাল করেই চালাতে পারবে–অভাব যখন আর কিছু নেই কোন দিকে। নিশ্চিন্ত হয়ে সংসার করুক। মাস গেলে শুধু মাইনের টাকা নয়–আরও অনেক টাকা, প্রায় মাইনের দ্বিগুণ টাকা ধরে দেয় স্ত্রীকে। দিন-রাতের ঝি রেখে দিয়েছে হরেন জোর ক’রে। ঠাকুরের রান্না খেতে ঘেন্না করে বলেই রাখে নি। তাদের সংসারের বহু বিচিত্র রান্না, মাইনে করা লোক দিয়ে হওয়াও শক্ত–তবু প্রয়োজন হ’লে তাও রাখতে পারবে। সে কথা তাকে বলেই রেখেছে হরেন। কোন রকম কষ্ট করার আর দরকার নেই স্বর্ণর। এ সব ছাড়াও কাপড় গয়নার জন্যে মাঝে মাঝে দমকা কিছু টাকা ধরে দেয় হরেন। সময় নেই বলেই নিজে কিনে দিতে পারে না। কিন্তু তাতে তো স্বর্ণরই সুবিধা, পছন্দ-মতো মাল কেনার স্বাধীনতা থাকে। …

এই সব সহৃদয় বিবেচনা এবং অবাধ স্বাধীনতায় স্ত্রীদের ভাল থাকবারই কথা। যে কোন স্ত্রীই এমন বন্দোবস্তে সুখী থাকে। স্বর্ণও ভাল আছে নিশ্চয়। অন্তত হরেন তাই ধরে নিয়েছে।

আসলে আজকাল স্বামী-স্ত্রীর দেখাই হয় কম। অত রাত ক’রে ফেরা নিয়ে প্রথম প্রথম স্বর্ণ কিছু অনুযোগ করেছিল, কিন্তু হরেন তাকে বুঝিয়ে দিয়েছে যে, মানুষের জীবনে সুযোগ বেশি বার আসে না। তার মতো কেরানীর জীবনে যে সুযোগ এসেছে তা কল্পনাতীত। এই বেলা ভাগ্য ভাল থাকতে থাকতে, সে সুযোগের সদ্ব্যবহার করতে না পারলে এর পর আপসোসের সীমা থাকবে না। সুতরাং মিছি-মিছি মূর্খ অজ্ঞ স্ত্রীলোকের মতো স্বর্ণ যেন এই তুচ্ছ কথা নিয়ে অশান্তি না করে। দীর্ঘদিনের বিবাহিত জীবন তাদের–এতগুলো ছেলেমেয়ে হয়ে গেল–মরে-হেজে গিয়েও পাঁচটা–এখনও কি স্বর্ণ স্বামীর চরিত্রে সন্দেহ করে?…মদ ভাঙ যে খাচ্ছে না তা তো দেখতেই পাচ্ছে স্বর্ণ–সে গন্ধ তো আর ঢাকা থাকে না। রাত্রে বাইরেও থাকছে না, যখনই হোক, যত রাত্রেই হোক–বাড়িতে ফিরছেই প্রত্যহ–তখন আর অত ভয় কিসের?

স্বর্ণও কথাটা বুঝল। স্বামীর ওপর চিরকালই তার অগাধ বিশ্বাস। হরেন তাকে ভালবাসে ঠিকই। হয়ত একটু বেশিই বাসে। কখনও কখনও সেটা স্বার্থপরতার পর্যায়ে পড়ে যায় বরং। সে বিষয়ে স্বর্ণ নিশ্চিন্ত। সুতরাং হরেনের কথাগুলো সে নিজে তো ষোল আনা বিশ্বাস করেই, অপরে কোন সংশয় প্রকাশ করলে কোমর বেঁধে ঝগড়া করে তাদের সঙ্গে। এ শ্রেণীর সংশয় বা আশঙ্কা প্রকাশ করে তার জায়েরাই বেশি। মেজ জা শোভনা তো প্রকাশ্যেই বলে, ‘পুরুষমানুষের রাশে অতটা ঢিল দেওয়া ভাল নয় দিদি। অতটা নিশ্চিন্ত হয়ে থেকো না। সত্যি কথা বলতে কি–ভাসুর গুরুজন, বলতে নেই কিছু–কিন্তু ওঁর ভাবভঙ্গিগুলো আমার বাপু আর ভাল লাগছে না কিছুদিন থেকে। তুমি একটু চোখ-কান খুলে রেখো।’

তাতে স্বর্ণ বিষম চটে যায়। বলে, ‘তোমাদের চোখ-কান ভাই এত খোলা আছে যে, আমার আর খোলা না রাখলেও চলবে।…পুরুষমানুষ যদি একটু ইদিক-ওদিক করেই–তাতে এমন মহাভারত অশুদ্ধই বা হয়ে গেল কি? আর তাতে কার কি এলো-গেলোই বা? বলি ক্ষেতি হ’লে তো আমারই হবে–বরটা তো আমার, না আর কারুর? অপরের এত মাথাব্যথা কেন তাতে?’

অগত্যা শোভনা চুপ ক’রে যায় তখনকার মতো। কিন্তু হিতৈষী বলতে শোভনা শুধু একা নয়–এমন উৎকণ্ঠা আরও দু’চারজন প্রকাশ করে। সকলের সঙ্গেই ঝগড়া করে স্বর্ণ। বলে, ‘মা না বিয়োলো বিয়োলো মাসী, ঝাল খেয়ে মলো পাড়া-প্রতিবেশী! তা তোদের হয়েছে তাই। বলি আমার চেয়ে তো সে তোদের আপন নয়, তবে তোদের এত চিন্তা কেন? মার চেয়ে ব্যেথিনী, তারে বলে ডান–তা জানিস না?

আবার হয়ত কাউকে হাসতে হাসতে–একটু বা চোখ-টিপে বলে, ‘ওলো, অনেক দিন ঘর করেছি–আমারও অরুচি ধরে গেছে, ওরও। আমার মুখ বদলাবার উপায় নেই তাই, নইলে কি আমিই ছেড়ে কথা কইতুম? যার উপায় আছে–সে দিন-কতক বদলে আসুক না!…আমার অত ভাতার ভাতার বাই নেই তোদের মতো। ভোগও করে নিয়েছি তো ঢের দিন–এখন আর ওতে আছে কি? রসকষ যা ছিল তাতো সব শুক্যে গেছে এ্যাদ্দিনে কিছু কি আর আছে? এখন তো শুধু পড়ে আছে ছোবড়া-খানা, তা ও যে যা পারে নিক, ওর জন্যে অত আঁচলে গেরো দিয়ে রাখার দরকার নেই।…বরং মানুষটাকে নিয়ে কেউ আর চাটি টাকা দেয় তো দিক, আমার টাকাটা এলেই হ’ল!’

কিন্তু ক্রমশ স্বর্ণলতা নিজেও যেন সে অখণ্ড বিশ্বাসটা রাখতে পারে না। ফিরতে রাত হয় বলে শুধু নয়–আজকাল অধিকাংশ দিনই–বাড়িতে খায়ও না হরেন। স্বর্ণলতা এমন বহুদিন খাবার সাজিয়ে বসে থেকেছে দীর্ঘরাত পর্যন্ত–নিজের এবং হরেনের দুজনের খাবারই শোবার ঘরে এনে গুছিয়ে রেখে দিয়েছে–কিন্তু রাত দেড়টা কি দুটোর সময় এসে হয়ত হরেন জানিয়েছে যে কোন্ বিলিতি হোটেলে কার সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিল, সে জোর করে ডিনার খাইয়ে দিয়েছে। অথবা গুরবচন সিং জোর করে ধরে নিয়ে গিয়েছিল তার বাড়িতে, সেইখানে খেয়ে এসেছে। ফল হয়েছে এই যে, স্বর্ণরও খাওয়া হয় নি আর। অত রাত অবধি বসে বসে ঢোলবার পর এই সংবাদ শুনে একা বসে আর খেতে ইচ্ছা করে নি! হরেনের খাওয়ার নানা নটখটি, অনেক রকম রান্না না হ’লে সে খেতে পারে না। বহু দুঃখে বহু মেহনতে প্রস্তুত সে সব খাদ্য হরেনের ভোগে এল না–সেটাও কম দুঃখের হেতু নয়। তখন সেগুলো নিজে নিজে গিলতে স্বর্ণর চোখে জল এসে যেত।

তবু–তখন যদি হরেন সামনে বসে দুটো কথা কইত কি গল্প করত, কি খাবার জন্যে পীড়াপীড়িও করত তো আলাদা। সে এতই ক্লান্ত হয়ে আসে যে স্বর্ণর খাওয়া হ’ল কি হ’ল না, সেটাও চেয়ে দেখবার ধৈর্য থাকে না তার তখন। কোনমতে জামা-কাপড় ছেড়েই শুয়ে পড়ে। এমন কি সকালে কোন ছেলেমেয়ের অসুখ দেখে গেলেও কেমন আছে জিজ্ঞাসা করার কথা মনে থাকে না তার। পরের দিন সকালে তাকে মনে করিয়ে দিতে হয়।

অবশেষে হরেনই প্রস্তাব করল যে, স্বর্ণ যেন তার জন্যে জেগে বসে না থাকে। খাবারও না আর শোবার ঘরে এনে রাখে। সারাদিন খাটা-খাটুনির পর স্বর্ণর এমনভাবে জেগে বসে থাকার কোন অর্থ হয় না। খাবারটাও এ ঘরে রাখার দরকার নেই–এসে ঢাকা খুলে খাবার খেতে গেলেই স্বর্ণর ঘুম ভেঙে যাবে, স্বভাবতই সে ব্যস্ত হয়ে উঠে এসে বসবে, বাতাস করতে চেষ্টা করবে–ফলে রাত্রিজাগরণ তার বন্ধ হবে না কোনদিনই সুতরাং বাইরের ঘরের টেবিলে ভারী লোহার ঢাকা চাপা দিয়ে রেখে দেওয়াই ভাল, খেতে ইচ্ছা হ’লে খাবে, নয় তো খাবে না–এক সময় শুধু গিয়ে চুপি চুপি শুয়ে পড়বে হরেন। একবার উঠে দোর খুলে দেওয়াটা এমন কিছু হাঙ্গামা নয়। আর–যেদিন খুব বেশি রাত হবে, আড়াইটে কি তিনটে–সেদিন অত ঝামেলাও করবে না–বাকি দু ঘণ্টা আড়াই ঘণ্টা ঐ বাইরের ঘরের ইজিচেয়ারে বসেই কাটিয়ে দিতে পারবে।

স্বর্ণ অবশ্যই খুব সহজে এ প্রস্তাবে রাজি হয় নি। এ তার সমস্ত জীবন-সংস্কারের বিরোধী। স্বামী সারাদিন খেটেখুটে এসে বাইরের ঘরে ঢাকা খুলে একা বসে খাবে–আর সে নিশ্চিন্ত হয়ে খাটে শুয়ে ঘুমোবে–এ কেমন করে হয়?…কিন্তু হরেনই জেদ করতে লাগল ক্রমাগত। এবং হয়ত বা কথাটাকে জোর দেবার জন্যেই, পর পর দু-তিন দিন আড়াইটেরও পর ফিরল সে, অত রাত্রে যে খেতে বসল না তা বলাই বাহুল্য। অগত্যাই রাজি হ’তে হল স্বর্ণকে। তার বুদ্ধিমতী জায়েরা আর একবার বিজ্ঞর হাসি হাসল আড়ালে।

এর ফলে স্বামী-স্ত্রীর যেটুকু যোগ ছিল এতদিন–সেটুকুও ছিন্ন হয়ে গেল। আজকাল প্রায়ই শেষ রাত হয়ে যায় হরেনের ফিরতে। ফলে শুধু খাওয়া নয়, শোওয়ার ব্যবস্থাটাও পাকাপাকিভাবে বাইরের ঘরেই ক’রে নিল সে।

কিন্তু রাত হওয়াটাই কি তার একমাত্র কারণ।

বুকের মধ্যে একটা শীতল হতাশা অনুভব ক’রেও স্বীকার করতে হয় স্বর্ণকে শেষ পর্যন্ত যে–তা নয়।

বহুদিন আত্মপ্রতারণার চেষ্টা করেছে সে, দিদিমার ভাষায় ‘মনকে আঁখি ঠারতে চেয়েছে–কিন্তু প্রতারিত করা যায় নি শেষ পর্যন্ত। মনের অগোচর পাপ নেই–মনে মনে মানতেই হয়েছে এক সময়ে যে, তার জায়েদের উপদেশই ঠিক, রাশ অনেক আগেই টানা উচিত ছিল। রাত্রে দেখা হয় না আজকাল আর কোনদিনই–কিন্তু সকালে হয়। চা এনে স্বর্ণকে ঘুম ভাঙ্গাতে হয় প্রত্যহ। বিলাতী সুরার গন্ধ দেশি মদের মতো অত উগ্র নয় হয়ত–তবু পরের দিন সকাল পর্যন্ত তার স্মৃতি রাখার পক্ষে পর্যাপ্ত। গন্ধটা ঠিক না চিনলেও অনুমান করতে পারে। পথে-ঘাটে আসা-যাওয়ার সময় মাতাল দু-একজন পাশ দিয়ে গেছে–সে কথাটাও মনে পড়ে যায় এ গন্ধ থেকে।

আর চুপ করে থাকতে পারে না স্বর্ণ। সকালে ঘুম ভাঙ্গবার সময় কলহ-কেজিয়া করতে নেই বলে–কিন্তু তারই বা আর অবসর কই এ সময় ছাড়া। অগত্যা তাকে সেই সময়েই কথাটা তুলতে হয়, ‘হ্যাঁ গো, কাজ কাজ বলে তুমি সব্বনাশ শুরু করেছ! এই ছাই- ভস্ম ধরেছ! এই জন্যেই বুঝি আলাদা শোওয়ার ব্যবস্থা? এই তোমার ব্যবসা করা? কাজ নেই আর আমার এমন ব্যবসা ক’রে। যাও বা ছিল রয়ে বসে–তাও যাবে বদ্যি এসে, এ নেশা একবার ধরলে পথে বসতে দেরি হবে না। তুমি যেমন চাকরি করছিলে, যেমন সন্ধ্যেয় সন্ধ্যেয় বাড়ি আসছিলে তাই এসো–আমার অত বড়মানুষ হয়ে দরকার নেই আর!’

অপ্রিয় সত্য সকল অবস্থাতেই অরুচিকর, এমন নেশা ভাঙ্গাবার পরের অবস্থার তো কথাই নেই। তবু হরেন কোন রাগারাগি করে না। তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বলে, ‘এই দ্যাখো! তবে আর মুখ্যু বলেছে কেন! ওরে পাগল, সায়েবী ডিনারের এ একটা প্রধান অঙ্গ, বিশ্বাস না হয়, যে লোক একটু লেখাপড়া জানে তাকে ডেকে জিজ্ঞেস করো। আমি কি আর নেশা করার মতো খাই–যেটুকু না খেলে নয়, সেইটুকুই খাই।’

‘কই–এর আগেও তো সায়েবী ডিনার খেয়ে এসেছ কতদিন। তখন তো এমন গন্ধ পাই নি।’

‘পাবে কি, মধ্যে যে ও জিনিস একেবারে মিলছিলই না। না দিতে পারলে আর খেতে বলবে কি ক’রে? বোতল-ধোয়া জল খেতে বলবে কি?

‘তা অত তোমার রোজ রোজ ডিনার-মিনার খাবার দরকারই বা কি! রোজ রোজ পরের ঘাড়ে চেপে খেতে লজ্জা করে না।’

‘পরের ঘাড়ে কী গো। অদ্ধেক দিন তো আমাকেই সব খরচা দিতে হয়। এই তো কালই–একটা ডিনার দিতে সাড়ে আটশো টাকা খরচা হয়ে গেল!’

‘ওমা! কারুর বে-পৈতেতেও তো এত খরচা হয় না। এমন ক’রে পয়সা ওড়ালে কদ্দিন চালাতে পারবে? এইভাবে বাজে পয়সা উড়িয়ে কত রাজা-মহারাজা ফতুর হয়ে গেছে জানো? তুমি তো কোন্ ছার!…না না, তোমাকে আর অত ডিনার ফিনার দিতে হবে না! ফের যদি শুনি তুমি এমনি ইয়ার বগ্‌গ নিয়ে মাইফেল ক’রে টাকা ওড়াচ্ছ, তাহলে আমি মাথামুড় খুঁড়ে রক্তগঙ্গা করব বলে দিচ্ছি!’

চায়ের কাপটা নামিয়ে রেখে একটু উচ্চাঙ্গের হাসি হাসে হরেন। বলে, ‘তুমি একটা আস্ত আবর, মাইরি! ওরে বাবা, ওটা পয়সা ওড়ানো নয়, পয়সার সুতোয় খেলানো। বেনোজল ঢুকিয়ে ঘরোজল বার করতে হয় শোন নি কখনও? এও সেই রকম। আমার আদ্ধেক কাজ তো ঐ ডিনার-লাঞ্চ খেতে-খেতেই হয়। এসব বিলিতি দস্তুর। এই যে ব্যারিস্টার হ’তে সব বিলেতে যায়–কটা ডিনার আর কটা লাঞ্চ খেলেই পড়া শেষ। সেও গাঁটের পয়সা খরচ ক’রে খেতে হয়–তা জানো!’

অত শত বোঝে না স্বর্ণ, তবু স্বামীকে অবিশ্বাসও ঠিক করতে পারে না, ম্লান মুখে বলে, ‘কে জানে বাপু, ও যা জিনিস, ওর নাম শুনলেই ভয় করে। কতলোকের সব্বনাশ যে হ’তে দেখলুম তার কিছু ইয়ত্তা আছে! ঐ একটু আধটু থেকেই শুরু হয়–প্রেথম প্রেথম সব্বাই বলে যে ও কিছু নয়–তারপর নেশা যখন ঘাড়ে চেপে বসে তখন আর জ্ঞান থাকে না কারুরই! এ পোড়ার লড়াই যে কবে শেষ হবে–এই সব কাণ্ডকারখানা বন্ধ হবে–যুদ্ধ শেষ হ’লে কালীঘাটে গিয়ে পূজো দিয়ে আসব খাড়া-খাড়া!’

হরেন তাড়াতাড়ি ওর মুখে হাত চাপা দেয়, ‘ওসব অলুক্ষুণে কথা মুখে এনো না বলে দিচ্ছি, খবরদার! যদ্দিন যুদ্ধ চলে তদ্দিনই লাভ। যুদ্ধই লক্ষ্মী আমার!

তা সত্যি। স্বর্ণ ভাবে, শুধু হরেনের কেন, আরও অনেকের কাছেই এ-যুদ্ধ লক্ষ্মী। ওর ভাইয়েরা যে কেউ কোনকালে রোজগার-পাতি করবে, পয়সা ঘরে আনবে–তা একবারও ভাবে নি সে। এই যুদ্ধের দৌলতেই তা সম্ভব হ’ল! সেজ ভাই ধনা ড্রাইভারী শিখে মিলিটারীতে নাম লিখিয়েছে, সে নাকি কেল্লার লরী চালাচ্ছে আজকাল। শুধু মাইনেই নয়, এদিক ওদিকও বেশ দু’ পয়সা কামাচ্ছে নাকি। বাইরের মাল স্টেশনে জাহাজ-ঘাটায় পৌঁছে দেবার পথে এক বস্তা চিনি কি এক বস্তা সিগারেট নামিয়ে দিয়ে যায়–মোট মোট টাকা পায় তাতে! অবিশ্যি ভাগ দিতে হয় তা থেকে অনেককে–তবু দিয়ে থুয়েও ঢের থাকে। ধনা এর মধ্যে রেডিও কিনেছে, আবার আলমারি কিনব কিনব করছে। মেজকা তো তারও বে দেবার জন্যে উঠে-পড়ে লেগেছে। ন্যাড়াও কি যেন লেদ্ না কী বলে, তারই কাজ শিখে কোন্ পাঞ্জাবির কারখানাতে ঢুকে পড়েছে। বাকি দুটো ভায়েরও হয়ত কিছু কিছু গতি হয়ে যাবে– লড়াইটা আর কিছুদিন চললে। কিছু হ’ল না শুধু বুড়োরই। আর হবেও না কোন দিন তার কিছু। চিরকালই কাকাদের ভায়েদের হাত-তোলায় জীবন কাটাতে হবে। মুখপোড়া!… স্বর্ণ মনে মনে সাধারণভাবে গুরুজনদের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা ক’রে বড়ভাইকে গাল দেয়।…মুখপোড়ার যে আবার সন্দ-বাই ধরেছে। দিনরাত নাকি বৌকে পাহারা দেয় আজকাল, আঁচল ধরে ধরে ঘোরে। বৌটারই শতেক ক্ষোয়ার। বিয়েন তো অগুনতি–কটা জন্মাচ্ছে কটা মরছে আর কটা রইল তা বোধ করি ওরাও হিসেবে রাখে না। সেদিন মেজকাকে জিজ্ঞেস করেছিল স্বর্ণ, সেও বলতে পারে নি। অথচ এ গোটা ভূ-ভারতের হিসেব মেজকার নখদর্পণে সে কথা কে না জানে!…এক মাসও বোধ হয় জিরোতে পারে না বেচারী, বারোমাসেই পেটে বোঝা নিয়ে ঘুরছে আর সংসারের খাটুনি ষোল আনা বজায় দিচ্ছে।

‘মেয়ে জন্মের শতেক জ্বালা। মুয়ে আগুন মেয়ে জন্মের।’ মনে মনে বারবার বলে স্বর্ণ। হয়ত নিজের কথাটা মনে ক’রেই বলে। একটা চাপা নিশ্বাস ফেলে আস্তে আস্তে।

॥২॥

স্বর্ণলতার শরীর ভেঙ্গেছে অনেকদিন; তার স্বাস্থ্য অসাধারণ রকমের ভাল বলেই এতদিন সে তথ্যটা কারও নজরে পড়ে নি। তার প্রসঙ্গে বিশ্রাম বা কর্মহীনতা কেউ কল্পনাও করতে পারে না। সে দিনরাত এই সংসারে খাটবে সেইটেই যেন স্বাভাবিক। সেই কথাই সবাই জানে। সে খাটুনিও উদয়-অস্ত। শাশুড়ী অথর্ব হয়েছেন, অন্ধ হয়ে গেছেন প্রায়–তবু তাঁর খোরাকটি ঠিক বজায় আছে। সে বিচিত্র খাদ্য-ব্যবস্থার কোন পরিবর্তনই হয় নি। আর তার আয়োজনের ভারও স্বর্ণরই ওপর চেপে আছে এতাবৎ কাল। অন্য বৌ এসেছে বটে কিন্তু তাদের রান্না তাঁর মুখে রোচে না। তারা নাকি সব মেলেচ্ছও, তাদের হাতে খেলে বামুনের বিধবার জাতজন্ম থাকে না। তারা নাকি হাত ময়লা হবার ভয়ে গোবরে হাত দিতে চায় না, হাজা হবার ভয়ে হাত ধোয় না। চা খেয়ে কাপটা নামিয়ে রেখেই টপ্ করে ভাঁড়ারে হাত দেয় তারা। তাঁর পৌনে-চারকাল কেটে গেছে, এখন কি আর এসব অনাচার তাঁর সয়? না হয় না-ই খাবেন তিনি। এ তো আর অল্পবয়সী ছুকরীদের মতো নোলা’র জন্যে খাওয়া নয়–তাঁর খাওয়া এখন ‘পেট ব্যাগল্লা’–জীবন-ধারণের জন্য। তা আর বাঁচার দরকারই বা কী তাঁর? বাঁচতে চানও না তিনি। কেউ যদি দয়া করে খানিক বিষ খাইয়ে দেয় তো তাকে আশীর্বাদই করবেন প্রাণ ভরে।

অর্থাৎ সে-ই এধারে বেলা তিনটে এবং ওধারে রাত এগারোটা পর্যন্ত হাঁড়ি-হেঁসেল নিয়ে বসে থাকা অব্যাহত আছে। উপরন্তু ছেলেমেয়েরা বড় হয়েছে–তাদের জন্যে আরও ঢের খাটুনি বেড়ে গেছে তার। জায়েরা এসেছে বটে একে একে, কিন্তু তাতে কোন সুবিধা হয় নি। একটু-আধটু ফায়ফরমাশ খাটা ছাড়া কোন কাজ পায় নি তাদের দ্বারা। তাও, তারা কদিনই বা ঝাড়া-হাত-পা থেকেছে। আসার সঙ্গে সঙ্গেই তো প্রায় আঁতুড়ঘরের ব্যবস্থা। তারপর এখন তো কথাই নেই–যে যার আলাদা সব। বুড়ো শাশুড়ীকে কোন বৌ- ই নিতে চায় নি। তিনিও যেতে চান নি কারুর ভাগে! তিনি ভালভাবেই জানেন যে তাঁর এত ঝামেলা, এত দাপট আর কোন বৌ সহ্য করবে না।

অবশ্য স্বর্ণ বলেও নি কাউকে কিছু। নিজেই নিঃশব্দে বহন করেছে এ-বাড়ির জ্যেষ্ঠা বধূর যত কিছু দায়-দায়িত্ব। শাশুড়ীকে ও ঘাড় থেকে নামাতে চায় নি। নিজেই মুখ বুজে সহ্য করেছে এই অমানুষিক খাটুনি আর অমানুষিক হৃদয়হীনতা।

কিন্তু এবার শুধু তার মন নয়–দেহও বিদ্রোহ করল। আর নয়, আর পারবে না কিছুতেই এ বোঝা বইতে, এ ভার টানতে। তার সহ্যশক্তি সহনশীলতার শেষ সীমা লঙ্ঘন করেছে এবার। দড়িতে টান পড়তে পড়তে শেষ তন্তুটিও ছেঁড়বার উপক্রম হয়েছে। আর সে পারবে না নিত্য নানা লোকের বিবিধ জুলুম সহ্য করতে। এবার পূর্ণচ্ছেদ টানতে হবে দীর্ঘদিনের এই একটানা জীবনযাত্রায়।

জ্বর হচ্ছিল কিছু দিন থেকেই। প্রত্যহই জ্বর আসছিল একটু একটু। বিকেলের দিকে আসত আবার রাত্রে ছেড়ে যেত। কিন্তু ক্রমশ ছাড়াটা বন্ধ হয়ে গেল, সামান্য জ্বর নাড়িতে লেগেই থাকে দিনরাত। উল্‌টে নূতন উপসর্গ দেখা দিল–কাশি। অষ্টপ্রহরই অল্প অল্প খুকে কাশি লেগে থাকে। ইদানীং কাশির বেগও বেড়েছে।

জ্বরের কথা স্বর্ণ কাউকেই বলে নি এতদিন। বিশেষ যে সাবধানে থাকত তাও নয়। স্নানও করত মাঝে মাঝে। ভাত তো খেতই!

অবশ্য সে না খাওয়ারই মধ্যে। ভাতের কাছে বসত শুধু। কিছুই খেতে ইচ্ছে করত না তার। দারুণ বিতৃষ্ণা দেখা দিয়েছিল সর্বপ্রকার খাদ্যবস্তুতে। খাওয়া কমবার ফলেই হয়ত দেহটাও শুকিয়ে যেতে লাগল দিন দিন। সে বেঁটে হ’লেও চিরদিনই তার গোলালো গোলালো নরম নরম গড়ন, সেজন্যে একটু মোটাই মনে হ’ত তাকে হঠাৎ দেখলে–কিন্তু এখন একেবারেই কঙ্কালসার হয়ে উঠল। ওর সেই মেমসাহেবদের মতো ফরসা রঙেও বিবর্ণতা ঢাকা পড়ল না–স্বভাবগৌর বর্ণ ছাপিয়ে উঠল রক্তহীনতার চিহ্ন।

স্বর্ণ না বললেও এসব লক্ষণগুলো অপরের চোখে পড়তে পারত। কিন্তু কার চোখে পড়বে? শাশুড়ী ভাল দেখতে পান না, পেলেও লক্ষ করতেন কিনা সন্দেহ। আর যার চোখে পড়ার কথা সবচেয়ে বেশি, তার সঙ্গে তো দেখাই হয় না আজকাল ভাল করে। সকালটুকুই যা বাড়িতে থাকে শুধু–ঘণ্টা-দুই বড়জোর–সে সময়েও সর্বদা ব্যস্ত থাকে। লোক আসার বিরাম নেই কোন সময়েই, যদি বা কোন সময় একটু ফাঁক রইল তো কাগজপত্র হিসাবনিকাশ আছে। তাতেই সময় কেটে যায়। কোনমতে এক সময় উঠে মাথায় জল ঢেলে খেতে বসে। তাও, অন্যমনস্কভাবেই খায়, কেউ কথা কইলে অন্যমনস্কভাবেই জবাব দেয়। কারও দিকে ভাল করে তার তাকাবারই অবকাশ নেই।

.

তবু এক সময় তাকাতে হ’ল। একদিন আর কোনমতেই উঠে দাঁড়াতে পারল না স্বর্ণলতা। মুখ গুঁজড়ে পড়ল একেবারে।

এরকম এ সংসারের ইতিহাসে কখনও ঘটে নি, এক স্বর্ণলতার আঁতুড়ে ঢোকবার সময় ছাড়া। সে সময় তবু কিছু প্রস্তুতি থাকত আগে থেকে, অন্য একটা বিকল্প ব্যবস্থা করা থাকত। কিন্তু এর কোন প্রস্তুতি ছিল না। মাথাতে আকাশ ভেঙ্গে পড়ল সকলকার। কে কার মুখে জল দেয় তার ঠিক নেই। ছেলেরা কিছুই পারে না, এ বাড়িতে কোন বেটাছেলের জল গড়িয়ে খাওয়ারও রীতি নেই। পারত এক মেয়ে–কিন্তু স্বর্ণর বড় মেয়েটিরই বয়স এই সবে বছর-দশেক। সে একটু-আধটু ফায়-ফরমাশ খাটতে পারে মাত্র। তাকে দিয়ে রান্নার কোন কাজ কখনও করায় নি স্বর্ণ, ও দিকেই যেতে দেয় নি। তাছাড়া এখন ইস্কুলে পড়া রেওয়াজ হয়েছে, পাড়াঘরের অধিকাংশ মেয়েই ইস্কুলে পড়ে–রেবাকেও দিতে হয়েছে। স্বর্ণলতার কতকটা ইচ্ছার বিরুদ্ধেই। সুতরাং সাড়ে আটটা বাজতে না বাজতেই ফ্রক পরে বেণী দুলিয়ে চলে যায়–তাকে কাজকর্ম শেখাবেই বা কখন?

হরেন এতকাল সংসারের দিকে মন দেয় নি–দেবার দরকার হয় নি বলে। এখন আর মন দেওয়া ছাড়া উপায় রইল না। সে দস্তুরমতো বিরক্তও হয়ে উঠল সেজন্য–এটা যেন তার ওপর একটা অবিচার বলেই মনে হ’তে লাগল। বললে, কৈ, তোমার এমনধারা অসুখ হয়েছে–এতকাল ধরে ভুগছ, আমাকে বলো নি তো?’

এর উত্তরে অনেক কিছু বলতে পারত–কিন্তু কখনই কোন কটু উত্তর, কথার দ্বারা কোন মর্মান্তিক আঘাত কাউকে দিতে পারে না স্বর্ণ। আজও পারল না, ম্লান হেসে শুধু বলল, ‘কী আর বলব, তুমি ব্যস্ত থাকো–তুমিও তো খাছ ভূতের মতো, এই সামান্য ব্যাপার নিয়ে ঘ্যান ঘ্যান করব?’

‘সামান্য আর কোথায়–এ তো বেশ ভাল রকমই বাধিয়ে বসে আছ দেখতে পাই!’

‘বেশ ভাল রকম বলে কিছু তো তেমন বুঝতে পারি নি, তা’হলে বলতুম!’

ইষৎ যেন লজ্জিতভাবে, কৈফিয়তের সুরেই বলে স্বর্ণলতা।

সে যেটা বলতে পারে না, সেটা বলে দেয় জীবেন, ওর মেজ দেওর। বলে, ‘এতদিন ধরে ভুগছে, এই চেহারা হয়ে গেছে–তবু মুখ ফুটে বলতে হবে যে অসুখ, তবে তুমি ডাক্তার দেখাবে? বাধিয়েছে–সে তো বৌদির দিকে চাইলেই বোঝা যায়।…তুমি কি একবারও বৌদির দিকে চেয়ে দ্যাখো নি এই একটা বছরে?’

হরেন একটু অপ্রতিভ হয়ে পড়ে, কিন্তু সেটা প্রকাশ করে না সহজে, ‘তা তোরা তো দেখেছিলি, তোরাও তো বলতে পারতিস। দেখছিস তো আমার নাইবার খাবার সময় নেই–এদিকে রাত দুটো-আড়াইটেয় ফিরি, ওদিকে নটা না বাজতে বাজতে বেরুই। আমার কি কোনদিকে চাইবার ফুরসৎ আছে?…একবার কথাটা কানে তুলতে কি হয়েছিল? তোদেরও তো কম করে নি তোদের বৌদি!’

মাকে গিয়েও তিরস্কারের সুরে প্রশ্ন করে হরেন, ‘ওর এমন দশা হয়েছে তা আমাকে একবার বলতে পারো নি!’

ওর মা অবশ্য দমবার পাত্রী নন, সমান ঝাঁঝের সঙ্গে জবাব দেন, আমি কি চোখে দেখতে পাই যে, কী দশা হয়েছে তা টের পাব?…না কি তোমার বৌই আমাকে বলে কখনও–কী হচ্ছে না হচ্ছে! দাসী বাঁদী পড়ে থাকি, যখন হোক দয়া ক’রে দুটো খেতে দেয় ভিক্ষের ভাত–এই পর্যন্ত।…আমাকে কি গুরুজন আপনার জন বলে মনে করে।…আর আমি যদি বুঝতেই পারতুম–তোর টিকি দেখতে পাচ্ছি কখন যে বলব। বছরে একদিন দেখা হয় কিনা সন্দেহ।…আর আমাকেই বা এমন চোখ-মুখ রাঙিয়ে তেড়ে এসেছিস কিসের জন্যে? তোর মাগ, রোজ রাত্তিরে গলা জড়িয়ে শুচ্ছিস, তুই টের পাস না?…আ ম’ল যা! আমার কাছে এসেছেন–বৌয়ের কেন অসুখ করল, কেন সে অসুখের কথা ওঁকে জানানো হ’ল না তার কৈফিয়ৎ চাইতে!…বেহায়া বেইমান কমনেকার!’

কিন্তু বকাবকি অনুযোগ অভিযোগের সময় বেশি নেই হাতে। সেদিনের মতো অবশ্য ভাইয়ের বৌরাই চালিয়ে দেবে–একবাড়িতে থাকা–সেটুকু চক্ষুলজ্জা এখনও আছে তাদের–তার পর?

অগত্যা ডাক্তার ডাকারও আগে ঠাকুরের খোঁজ করতে বেরোতে হয়। অফিস কামাই ক’রে সারা বেলা ঘুরে প্রায় ডবল মাইনে কবুল ক’রে শেষপর্যন্ত এক বামুন ঠাকরুণকে ধরে নিয়ে আসে হরেন। …

মধ্যবয়সী বিধবা একটি, তবে অনেকটা পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন আছে। পাড়াঘরে যে-সব রাঁধুনী দেখা যায় সে রকম নোংরা নয়। বামুনের মেয়েও বটে–জানাশুনো জায়গা থেকে নিয়ে এসেছে। সেই সুদূর বেহালার কাছে সোরশুনো না কী এক জায়গা আছে, সেইখানে বাড়ি–সেখান থেকে আসতেই নাকি আট টাকা ট্যাক্সি ভাড়া দিতে হয়েছে হরেনকে আত্মীয়স্বজন অনেক আছে সেখানে, তাদের সঙ্গে দেখা ক’রে খোঁজখবর ক’রে এনেছে। মার জন্যেই এত কাণ্ড করা–ঠিক সৎ-ব্রাহ্মণের মেয়ে না জানলে তিনি ওর হাতে খাবেন না।

ব্রাহ্মণের মেয়ে, পরিষ্কার কাপড়-জামা, কথাবার্তা ভাল–সবই ঠিক, তবু স্বর্ণর এতকালের ঘরকন্না, তার অতি প্রিয় ও অতিপরিচিত হেঁশেলের মধ্যে একটা অপরিচিত মেয়েছেলে গিয়ে ঢুকল–বহুকাল, হয়ত বা চিরকালের জন্যেই; তার পরিপাটী ক’রে নিজের হাতে সাজানো ভাঁড়ার–কী অগোছালো নোংরা ক’রে তুলবে তা-ই বা কে জানে, কী রেঁধে দেবে তার স্বামীপুত্রকে, হয়ত মুখেই তুলতে পারবে না কেউ–না খেয়ে খেয়ে রোগা হ’তে থাকবে বাচ্ছারা;–এই সব সাত-পাঁচ ভেবে স্বর্ণলতার দুই চোখের কূল ছাপিয়ে জল ঝরে পড়তে লাগল। তার শোবার ঘরের একটা জানলার মধ্য দিয়ে তাদের রান্নাঘরটা দেখা যায়, বামুন-মেয়েকে সেখানে ঢুকতে দেবার পর থেকে আর ওদিকে একবারও চাইতে পারল না সে, দেওয়ালের দিকে মুখ ক’রে রইল সমস্তক্ষণ।…

রাঁধুনী ঠিক হ’তে অনেকটা নিশ্চিন্ত হয়ে ওর চিকিৎসার কথা ভাবতে বসল হরেন। সকালে অবশ্য পাড়ার ডাক্তার–যিনি ওর ছেলেপুলেদের অসুখ হ’লে দেখেন–তাঁকে খবর পাঠিয়েছিল, তিনি এসে দেখে কী সব ওষুধ ইঞ্জেকশনও দিয়ে গেছেন, কিন্তু তার পর তাঁর সঙ্গে দেখা করার আর ফুরসৎ হয় নি। অবশ্য সেজন্যে খুব ক্ষতিও বোধ করে নি কেউ। কারণ তাঁকে দিয়ে যে শেষ অবধি চলবে না সে বিষয়ে সকলে নিশ্চিন্ত। খুব সাংঘাতিক কিছু না হ’লে স্বর্ণ এমনভাবে শুয়ে পড়ত না–এটুকু হরেনও বোঝে।

ভায়েরা পরামর্শ দিল, বত্রিশ টাকা ফিয়ের কোন বড় ডাক্তার ডাকতে। জীবেন বলল, ‘স্যাকরার ঠুক-ঠাক কামারের এক ঘা, এসব ডাক্তার দেখিয়ে কোন লাভ হবে না, মিছিমিছি ভোগান্তি। অল্পে যাবার মতো কিছু হয় নি বৌদির। মানুষটা পড়ে থাকলে তোমারই ক্ষেতি আর ওসব ঢিমেতেতালা চিকিৎসায় শেষ অবধি খরচ কম পড়ে না–মিছিমিছি এখন সামান্যর জন্যে ও দৃষ্টি-কৃপণতা না করাই ভাল!’

হরেনের মা কিন্তু কথাটা শুনে হেসে খুন হলেন। বললেন, ‘পোড়া কপাল। ও ওর শুকনো-সূতিকা হয়েছে–কম বিয়েন তো আর বিয়োলো না এই বয়সে। শরীরের বাঁধুনি ভাল, তোয়াজে আছে, ভাল-মন্দ খাচ্ছে তাই–নইলে কবেই পড়ত।…তা ডাক্তারিতে ওর কী করবে? কোন পুরনো বিচক্ষণ দেখে কবিরাজ দেখা–নয়ত হোমিওপাথী কর। হোমিওপাথীতে এসব রোগ আজকাল খুব চটপট আরাম হচ্ছে!’

কথাটা অবশ্য উপস্থিত কারুরই ভাল লাগল না। তাঁর ছোট ছেলে অতূলই জবাব দিল, ‘তবে মা সেবার তোমার সামান্য আমাশার সময় দাদা হোমিওপাথিক ডাক্তার এনেছিল যখন–তুমি বেঘোরে মেরে ফেললে বলে ডাক ছেড়ে কেঁদেছিলে কেন?’

‘সে আমার সামান্য রোগ হয়েছিল! আমাশা!…সে তো আধা-কলেরা হয়েছিল বলতে গেলে। সে কি সহজ রোগটি বেধেছিল আমার!…তার সঙ্গে এর তুলনা!…বৌ যে! আসলে আমার এ ক্ষেত্রে কথা কইতে যাওয়াই ভুল হয়েছে। বুড়ো মার জন্যে ডাক্তার ডাকা বাজে খরচা–কিন্তু বোদ্দের বেলা তো আর তা নয়। তাদের যে মহামূল্য জীবন…বেইমান, বেইমান না হলে আর এত দুর্দশা হয়। মা না থাকলে সব এক একটা বৌ পেতিস কী ক’রে আজ? এত বড়ড়া হতিস কী করে!…বলে অসৈরণ সইতে নারি শিকে দড়ি বেঁধে ঝুলে পড়ি।…ডাকো বাবা, ডাকো তোমাদের যাকে খুশি, আমার নাকে-কানে খৎ যদি কোন কথা বলি আর। বিলেত থেকে সায়েব ডাক্তার আনাও না, সেই তো ভাল! পয়সা হয়েছে দুটো– খরচ করতে হবে বৈ কি। আধুনিকের ধন হ’লে সে পয়সা ডাক্তার-বদ্যি আর উকিল- বারেস্টারেই খায় চিরকাল–এ তো জানা কথা!’

যাই হোক–শেষ পর্যন্ত বত্রিশ টাকা ফিয়েরই ডাক্তার একজন এলেন। তিনি কিন্তু প্রাথমিক পরীক্ষার পরই গম্ভীর হয়ে উঠলেন, আরও খানিকক্ষণ ভাল ক’রে দেখে বাইরে গিয়ে হরেনকে বললেন, ‘এ তো দেখছি মোক্ষম রোগ ধরিয়ে বসে আছেন। টি-বি। খাওয়া-দাওয়ার ওপর নজর রাখেন নি আপনারা–হয় কিছু খান নি, নয় খাওয়া হজম হয় নি। দারুণ অপুষ্টি–তাঁর ওপর সাত-আটটি সন্তান প্রসব এবং অমানুষিক খাটুনি–এই জন্যেই এটা হয়েছে। এ রোগ অবশ্য আজকাল আর আয়ত্তের বাইরে নয়–কিন্তু ঘরে রেখে কি পারবেন আপনারা চিকিৎসা করতে? ওষুধের চেয়েও এ রোগের বড় কথা শুশ্রূষা আর পথ্যি।…বরং যদি যাদবপুরে কি মদনাপল্লীতে নিয়ে যেতে পারেন তো দেখুন।’

অক্ষর দুটো শুনেই হরেনের মুখ শুকিয়ে উঠেছিল। সে কোনমতে বার দুই ঢোক গিলে শুষ্ককণ্ঠে বললে, ‘টি-বি?…ঠি-ঠিক বলছেন? মানে ভাল ক’রে দেখেছেন তো? ভুল হয় নি?…মা বলছিলেন যে শুকনো সূতিকা না কি একরকম রোগ আছে–ওরও তাই হয়েছে?’

‘সেও একরকমের কনজাম্পটিভ ডিজিজ–কিন্তু না, ভুল হয়েছে বলে মনে হয় না। টি- বি তো বটেই, বেশ অনেকদিনই হয়েছে। উনি কাউকে কিছু বলেন নি, রোগ চেপে চেপে রেখেছেন।…অবশ্য এক্স রে তো করাতেই হবে, আরও কিছু কিছু পরীক্ষা আছে–কিন্তু সে যাই করান, আমার বিশ্বাস ঐ একই রেজাল্ট পাবেন। আমি ওষুধ ইনজেকশন লিখে দিয়ে যাচ্ছি–থুথু রক্তপরীক্ষা এরে–এসব কোথায় কীভাবে করাবেন তাও লিখে দিয়ে যাচ্ছি, তবে সবচেয়ে বড় কাজ হ’ল ওঁকে কোথাও সরানো। বাড়িতে রেখে এ চিকিৎসা করানো শক্ত। তা-ছাড়া ছেলেমেয়েদের এখনই সিগ্রিগেট করা উচিত–সে কি পেরে উঠবেন?’

হরেন তাঁর সব কথা শুনলও না ভাল করে। যন্ত্রচালিতের মতোই প্রেসকৃপশনগুলো নিল তাঁর হাত থেকে। তার তখন মাথা ঘুরছে। সে যে এত ভীতু তা এতকাল বোধ করি সে নিজেও জানত না। রোগটার নাম শোনা পর্যন্ত তার হাত পায়ের জোর চলে গেছে। খুব স্পষ্ট কোন ধারণা নেই বটে তবে রোগটা যে সাংঘাতিক তা জানে। মারাত্মক রকমের ছোঁয়াচে। যদি ওর থেকে আর কারও হয়? ছেলে-মেয়েদের, কিম্বা তার নিজেরই? এতদিন পর্যন্ত খাওয়াদাওয়া সব ওর হাতেই হয়েছে, শোওয়াও–রোজ না হোক, মাঝে-মধ্যে এক আধদিন ওর পাশে শুয়েছে বৈকি! কতদিন ধরে ঐ রোগ ঢুকেছে ওর মধ্যে তার ঠিক কি, ডাক্তার তো বলে গেল অনেকদিন–তিন-চার ঘণ্টাও যদি শুয়ে থাকে তাই যথেষ্ট, ও রোগের বিষ নিঃশ্বাসে ছড়ায় নাকি; ভাবতেই মাথা ঝিম ঝিম করতে লাগল হরেনের।

সে আতঙ্ক–যেমন দুর্বলচিত্ত লোকের হয়ে থাকে–শিগগিরই একটা বিজাতীয় আক্রোশের আকার ধারণ করল। ডাক্তার চলে যেতে সে ভেতরে এসে সেই আক্রোশের বিষ প্রায় সমস্তটাই উদ্‌গীরণ করল তার স্ত্রীর ওপর।…কেন সে এতকাল ধরে এই রোগ ভেতরে ভেতরে পুষে রেখে দিয়েছে–কেন জানায় নি যে রোজ ওর জ্বর আসছে একটু ক’রে–এমনভাবে শরীর ভেঙ্গে যাচ্ছে… হরেন কি চিকিৎসা করাত না শুনলে? না কি সে এতই কৃপণ যে ওর অসুখ হয়েছে শুনেও পয়সা খরচের ভয়ে হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকত? কখনও কি ডাক্তার ডাকে নি সে স্ত্রীর জন্যে? তার এত কি পয়সার মায়া দেখল স্বর্ণ। কী এমন কৃপণতা করেছে সে এতকালের মধ্যে? এমনভাবে এই রোগটি বাড়িয়ে এখন এইভাবে চারিদিক জজাবার কি দরকার পড়ল? এত আড়ি কার ওপর ওর? মরলে তো নিজের ছেলে-মেয়েরাই মরবে–না কি অপর কেউ…ইত্যাদি ইত্যাদি–

কথাগুলো শুনতে খুবই ভাল, আপাত-বিবেচনায় মনে হয় স্ত্রীর জন্যে উদ্বেগই এ উষ্মার মূল কারণ, কিন্তু যে দীর্ঘকাল এই স্বামীর সঙ্গে ঘর করেছে তার তা মনে হবার কোন কারণ নেই। স্বর্ণরও তা হ’ল না। সে মুখে কিছু বলল না বটে কিন্তু তার দুই চোখ দিয়ে দরবিগলিত ধারায় জল ঝরে পড়তে লাগল। হরেন যে কী পরিমাণ ভয় পেয়েছে এবং সেইজন্যেই যে এমন দিশাহারা হয়ে উঠেছে–একটা আপদ একটা বোঝার মতো মনে হচ্ছে এখন স্ত্রীকে–কোন মতে দূর করে দেবার আশু কোন পথ দেখতে না পেয়েই যে এতটা ক্ষেপে উঠেছে–তা বুঝতে বাকি রইল না তার একটুও।

প্রাথমিক ঝাঁঝটা কেটে যাবার জন্যেই হোক–অথবা স্ত্রীর চোখের জল লক্ষ করেই হোক–অনেকটা প্রকৃতিস্থ হল হরেন। বোধহয় নিজের ভুলও বুঝতে পারল খানিকটা। রাগারাগি করলে ঝগড়া-বিবাদ করলে উদ্দেশ্য সিদ্ধ হতে কিছুটা দেরি হয়–বরং মিষ্টি কথায় কাজ হয় অনেক সহজে, এটা এই কিছুকাল ব্যবসা করার ফলে বেশ বুঝেছে সে। তাই খানিকটা চুপ করে থেকে অনেকখানি নরম গলায় আবার বলল, ‘না–রাগ কি আর মানুষের সহজে হয়? দেখছ আমি কী রকম ব্যস্ত থাকি সর্বদা–নাইবার-খাবার সময় নেই–আমাকে একটু মুখ ফুটে বলতে কি হয়েছিল? তুমি চারচালের ভার নিয়ে আছ তাই না আমি এতটা নিশ্চিন্তি হয়ে খাটতে পাচ্ছি। এখন কি আতান্তর অবস্থা হবে ভাব দিকি। ছেলেমেয়েগুলোর কথা ভেবেও তোমার একটু সাবধান হওয়া উচিত ছিল। যতই ব্যস্ত থাকি–তাদের অসুখ হ’লে আমাকে তো ঠিক বলেছ, আমিও তার ব্যবস্থা করেছি–নিজের অসুখের কথাটা একবার কানে তুলতে পারো নি? সেটা বুঝি চক্ষুলজ্জায় বেধেছিল তোমার?–না কি?…আমি কি তোমার কুটুম, না দয়া ক’রে থাকতে দিয়েছি বাড়িতে যে এত চক্ষুলজ্জা?’

খুবই ন্যায্য কথা। শুনলে যে কোন স্ত্রীরই পুলকিত হওয়া উচিত। কিন্তু স্বর্ণর তা হ’ল না। জবাবও দিল না কিছু। পরবর্তী আক্রমণটার জন্যেই অপেক্ষা করতে লাগল শুধু।

সেটা আসতেও অবশ্য আর দেরি হ’ল না। হরেনের ধারণা যে তার স্ত্রী নির্বোধ, অনেকটা ছেলেমানুষ এখনও। তাই বেশি প্রস্তুতির প্রয়োজনও বোধ করল না। একবার সামান্য কেশে গলাটা সাফ্ করে নিয়ে মাথার পিছন দিকটা চুলকোতে চুলকোতে বলল, ‘দ্যাখো একটা কথা ডাক্তার তো বারবার বললেন, হাসপাতালে পাঠাবার কথা–আর যতদিন তা না হয়–অন্তত এবাড়ি থেকে ঠাঁইনাড়া করে অন্য কোথাও রাখার কথা। বেশ জোর দিয়েই বললেন–এ রোগ নাকি বাড়িতে রেখে চিকিৎসা করা কঠিন–হ্যাঁসপাতালেই পাঠাতে হবে। এ রোগের হাসপাতালে খরচা অনেক–তা তাতে আমি ভয় পাই না–কিন্তু যুদ্ধের বাজার বুঝতেই তো পারছ–অনেক সই-সুপারিশ না ধরলে হাসপাতালে বেড পাওয়া যাবে না। তা আমি বলছিলুম কি ততদিন না হয়–তোমাকে মৌড়ীতে রেখে আসি না–?’

‘না।’ হরেনের কথা শেষ করতে না দিয়েই দৃঢ়কণ্ঠে বলে উঠল স্বর্ণলতা। এতক্ষণের মধ্যে এই প্রথম কথা কইল সে–কিন্তু তার চোখের জলের সঙ্গে কণ্ঠের এই অস্বাভাবিক দৃঢ়তা একেবারেই বেমানান মনে হ’ল হরেনের কাছে। সে বেশ একটু চমকেই উঠল।

‘না।’ গলায় রীতিমতো জোর দিয়ে বলল স্বর্ণ, ‘তোমার বাড়িতে ছেলেমেয়ে আছে, তাদের বাড়িতে নেই?…তোমার ছেলেমেয়ের কথা, ভাই-ভাইপোদের কথা–নিজের কথাই ভাবছ শুধু। তোমাদের প্রাণের দাম আছে, আর তারাই একেবারে এত ফেলনা–না? কেনই বা তারা বইবে এ দায়? তোমার লজ্জা করে না একথা তুলতে? তারা একগাদা টাকা খরচ করে বে দিয়েছে তত্ত্বতাবাস লোক-লৌকিকতার কোন ত্রুটি রাখে নি কখনও–তার পরিবর্তে এ-বাড়িতে এসে পর্যন্ত ভূতের মতো খেটে গেছি–একাধারে ঝি আর রাঁধুনীর কাজ করেছি এতবড় সংসারে। উদয়-অস্ত হলেও বাঁচতুম–ভোর পাঁচটা থেকে রাত বারোটা পর্যন্ত বারোমাস তিনশ পঁয়ষট্টি দিন একভাবে খেটে শরীর পাত করেছি তোমার এখানে–এখন এই রোগ ধরেছে বলে আর একদণ্ডও সহ্য হচ্ছে না?…বাড়ির পুরনো ঝিকেও এত সহজে লোকে ঘাড় থেকে নামাতে পারে না। এত কাল তো একবেলার জন্যেও তাদের বাড়ি যেতে দিতে না, আজ আমি কাজের বার হয়ে গেছি বলেই যেখানে হোক ঘাড় থেকে ঝেড়ে ফেলে নামিয়ে রেখে আসবার জন্যে ব্যস্ত হয়ে উঠেছ!…কেন যাব আমি–কিসের জন্যে? এ বাড়িতে আমার কোন জোর নেই? তোমার এ অসুখ করলে আমি কোথাও দূরে পাঠাবার কথা ভাবতে পারতুম? না কোন ছেলেমেয়ের অসুখ করলে তুমি একথা মুখে উচ্চারণ করতে পারতে?’

কাশির ধমকেই চুপ করতে হয় একটু। বোধহয় এতখানি উত্তেজনায় অপরিসীম ক্লান্তও হয়ে পড়ে। খানিকটা চুপ করে থেকে একটু সামলে নিয়ে প্রায়-রুদ্ধকণ্ঠে আবার বলে, ‘বেশ তো, বাড়িতে রাখার যদি এতই অসুবিধে হয় তো–দূর করার অন্য উপায়ও তো আছে। কড়িকাঠও আছে, পরনের ছেঁড়া শাড়িও জুটবে একখানা।…তাতেও যদি মনে করো–পুলিশ-ফুলিশ নানান হ্যাঁঙ্গামে পড়তে হবে–কোনমতে একখানা রিক্শা ডেকে গঙ্গার ধারে পাঠিয়ে দাও, আর কোন দায় বইতে হবে না তোমাদের, কোন ভাবনাও ভাবতে হবে না।…এত পয়সার জোর দেখাও যখন তখন–পয়সা ফেললেও হাসপাতালে জায়গা হয় না? না অনত্থক জেনেই সে বাজে পয়সাটা খরচা করতে চাইচ না? না কি ভয় পাচ্ছ যদি হাসপাতালে গিয়ে ভাল হয়ে আসি? ঠিক ঘর করতেও সাহস হবে না–অথচ সে ক্ষেত্তেরে আর একটা বৌ আনতে চক্ষুলজ্জায় বাধবে! তাই যদি হয় তো–দুটো দিন সবুর করো–খোরাকী বন্ধ করলে আপনিই সব ব্যবস্থা হয়ে যাবে!’

হরেন অপ্রতিভের মতো চুপ করে বসে থাকে। তখনই যেন কোন কথা যোগায় না তার মুখে। তারপর মাথা চুলকোতে চুলকোতে বলে, ‘ঐ নাও! দ্যাখো এক-বার কাণ্ডখানা। বলে যার জন্যে চুরি করি–সেই বলে চোর। তোমার ভালর জন্যে বলতে গেলুম–’

ততক্ষণে আবারও অশ্রুর বন্যা নেমেছে স্বর্ণর চোখে। সে ওদিকে মুখ ফিরিয়ে বলে, ‘থাক আমার ভাল আর ভাবতে হবে না তোমাকে। জীবনভোরই তো ভেবে এলে–আর কেন!’

।।৩।।

বাপের বাড়িতে যেমন সরানো গেল না স্বর্ণকে–তেমনি হাসপাতালেও না। কোন হাসপাতালেই নাকি ‘বেড’ নেই। অর্থাৎ যতটা উদ্যম থাকলে এই যুদ্ধের বাজারে ভর্তি করানো সম্ভব হ’ত–ততটা উদ্যম হরেনের ছিল না। তার নিজের অবসর কম–এ সব ব্যাপারে তাকে বন্ধু-বান্ধবদের ওপরই নির্ভর করতে হয় বেশি। তাদেরই বা কী এত গরজ যে, দিন-রাত ঘুরে তদ্বির তদারক করে বেড়-এর ব্যবস্থা করবে অপরের স্ত্রীর জন্য?

সুতরাং কিছুই করা গেল না–পাড়ার এক সাধারণ ডাক্তারকে দিয়ে মামুলী চিকিৎসা ছাড়া। জীবেন বলেছিল নার্স রাখতে কিন্তু তাও হয়ে ওঠে নি। দিনরাত নার্স রাখতে গেলে অনেক খরচা–খোঁজ নিয়ে দেখা গেল যে, দুটি নার্স দিনে চার টাকা ও রাত্রে আট টাকার কমে হবে না। প্রত্যহ এই বারো টাকা খরচা ছাড়াও তাদের খাওয়ার খরচ এবং ঝঞ্ঝাট আছে। মনে মনে একটা আনুমানিক ব্যয়ের হিসেব ধরেই ‘হ্যাঁ’–এই চেষ্টা করছি’ ‘অমুককে বলে রেখেছি’ ‘সুবিধে মতো লোক দেখতে হবে তো–বাড়ির মধ্যে ঢোকানো’, বলে বেশ কয়েকদিন কাটিয়ে নিশ্চিন্ত হ’ল। কারণ তারপর আর কথাটা কেউ তুলল না, ভুলেই গেল সকলে।

এধারে স্বভাবতই বাড়ির লোক সন্ত্রস্ত ও সতর্ক হয়ে উঠেছে। প্রাণপণে নিজেদের ছেলেমেয়ে সামলাচ্ছে সকলে। ছোট ভাই শাশুড়ীর অসুখের অজুহাতে সপরিবারে শ্বশুরবাড়ি গিয়ে উঠল। তার শ্বশুরদের অবস্থা ভাল কিন্তু বাকি দুজনের সে সুবিধা নেই। তারা যতটা সম্ভব এই ঘরখানা থেকে দূরত্ব বজায় রেখে চলতে লাগল। নিতান্ত সৌজন্যের খাতিরেই জায়েরা একবার করে বাইরে থেকে ‘আজ কেমন আছ দিদি’ জিজ্ঞাসা করে যেত। সেইটুকুর জন্যও সতর্কতার অন্ত ছিল না অবশ্য। মেজবৌ দুই নাকে ইউক্যালিপ্‌টাস তেল দিয়ে তবে ওদিকে যেত। সেই রকমই জীবেনের নির্দেশ। ও রোগের বিজাণু নাকি নিঃশ্বাসেই বেশি আসে।

ওঘর–স্বর্ণদের ঘর সকলেই পরিহার করেছে। স্থানাভাবে হরেনের ছেলে-মেয়েরা ঠাকুরমার ঘরে শোয় এখন। তাঁর অবশ্য প্রবল আপত্তি ছিল কিন্তু হরেন এ ব্যাপারে মায়ের কোন কথাই শোনে নি। পরোক্ষে আভাস দিয়েছে যে তেমন কোন অসুবিধা বোধ করলে তিনি অনায়াসে তাঁর জ্যেষ্ঠা পুত্রবধূর ঘরে গিয়ে শুতে পারেন। প্রায় সত্তর বছর বয়স হ’তে চলল তাঁর–এত আর এখন জীবনের মায়া কিসের?

ছেলেমেয়েরা তাদের মায়ের কাছেও যেতে পায় না। হরেনের কড়া নিষেধ। শুধু বড় মেয়ে রেবা মধ্যে মধ্যে দুপুরে বা বিকেলে এক-আধবার লুকিয়ে মার ঘরে যায়, এটা ওটা হাতের কাছে যুগিয়ে দিয়ে আসে।

আগে স্বর্ণ নিজেও বারণ করত ওদের আসতে। ইদানীং আর করে না। এর মধ্যে একদিন ওর খাবার ঘটির জল ফুরিয়ে গিয়েছিল–বার বার ক্ষীণকণ্ঠে ‘একটু জল’

‘ওগো তোমরা কেউ আমাকে একটু খাবার জল দিয়ে যাও না গো’ বলে হেঁকেছে–কিন্তু কেউই আসে নি বা জল দিয়ে যায় নি। জায়েরা সামনেই উঠোন পেরিয়ে কলঘরে গেছে–তারা শুনতে পায় নি, অথবা শোনে নি। গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে শুকনো কাশিতে বেচারার দম বন্ধ হবার মতো হয়েছিল। মরেই যেত হয়ত–রেবার জন্যেই বেঁচে গিয়েছে সেদিন। কি একটা উপলক্ষে রেবার সকাল করে ছুটি হয়েছিল, বাড়ি ফিরে মার ঐ অবিরাম খুকখুকে কাশি শুনে সে নিজে থেকেই আগে ছুটে এ ঘরে এল। তখন আর জল চাইবার মতোও শক্তি ছিল না স্বর্ণর–সে শুধু ইঙ্গিতে দেখিয়ে দিয়েছিল জলের গেলাসটা। সেদিনের সেই অভিজ্ঞতার পরে আর স্বর্ণ কাউকে নিষেধ করে নি ওর ঘরে ঢুকতে।

নার্স রাখা তো হয়ই নি–এক বন্ধু পরামর্শ দিয়েছিল কোন হাসপাতালের আয়া বা দাইকে বেশি মাইনের লোভ দেখিয়ে এনে রাখতে তাও হয়ে ওঠে নি। নিহাৎ স্বর্ণর অদৃষ্টে বেঘোরে মৃত্যু নেই বলেই বোধহয়–ওদের বুড়ি ঝি আয়না দিনকতক পরে এ ঘরের কাজ নিজের হাতে তুলে নিলে। রাত্রেও ওর ঘরে শুতে শুরু করল। তার একটি মেয়ে আছে গিরিবালা বলে,–দেশে থাকে সে–কদাচিৎ কখনও দেখা হয়–তার জন্যেই বুড়ির আরও চাকরি করা,–সে নাকি কতকটা স্বর্ণর মতোই দেখতে। তার মায়াতেই আয়নার এতটা টান স্বর্ণর ওপর। হয়ত এতাবৎকাল স্বর্ণর সস্নেহ ভদ্র ব্যবহারও একটা বড় কারণ।

আয়না স্বর্ণর ভার নিতে হরেন নিঃশ্বাস ফেলে বাঁচল। নিশ্চিন্তও হ’ল অনেকটা। যতই যা হোক–এই দেড় মাস দু মাস ধরে বিবেকের একটা খোঁচা ভেতরে ভেতরে কোথায় ছিলই তার। স্বর্ণর অস্তিত্বটা একেবারে ভুলে থাকা কোন মতেই সম্ভব হচ্ছিল না। এবার সে খোঁচাটুকু আর রইল না, নিশ্চিন্ত হয়েই পিছন ফিরল স্ত্রীর দিকে। ডাক্তার দেখাচ্ছে, সেবা করার জন্য ঝি রেখেছে–তার কর্তব্যের কোন ত্রুটি আছে এমন অপবাদ কেউ দিতে পারবে না আর। সে সংসারের জন্যে আর একটা ঝি বহাল করল, যাতে আয়নার আর এদিকে কোন দায়-দায়িত্ব না থাকে। বাকি লোকের নিরাপত্তার জন্যেও সেটা আরও দরকার অবশ্য, কিন্তু হরেন তা স্বীকার করল না। আয়নার মাইনে দু টাকা বাড়িয়ে দিল সে নিজে থেকেই। অর্থাৎ খরচের জন্য সে ভাবছে না একবারও, কার্পণ্য করছে না কোন দিকেই। শুধু একদম সময় নেই বলেই–এইসব কারণে আয় বৃদ্ধির দিকে আরও বেশি মনোযোগ দিতে হয়েছে বলেই–স্ত্রীর দিকে ব্যক্তিগত মনোযোগ দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না তার।

এই অসুখে পড়ার পর, বা অসুখটা কী ধরা পড়ার পর স্বর্ণরও অন্তরের দিকটা যেন পাথর হয়ে গিয়েছিল। এসব কোন কিছুই আর তাকে স্পর্শ করতে পারত না–আঘাত দিতে পারত না। এক কলকল্লোলা স্রোতস্বিনী হঠাৎ যেন স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল। সে কোন অনুযোগ কোন নালিশ করত না কারও কাছে। এ বাড়িতে ঢুকে পর্যন্ত স্বার্থের চেহারা সে অনেক রকম দেখেছে–স্বামীর সম্বন্ধেও বিশেষ মোহ তার ছিল না–তবু ঠিক এরকমটা, এতটা জানত না। এমন যে হ’তে পারে তা কখনও ভাবে নি। সারা জীবনটা পাত করেছে সে–সমস্ত শক্তি সমস্ত স্বাস্থ্য–শেষবিন্দু রক্ত ঢেলে দিয়েছে সে এই সংসারে, তার বিনিময়ে এতটা ঔদাসীন্য সে আশা বা আশঙ্কা করে নি। মানুষের এ চেহারাটা তার কল্পনার বাইরে। এই আঘাতেই সে এমন স্তব্ধ হয়ে গেছে একেবারে। পৃথিবীতে কারও কাছ থেকে কিছু চাইবার প্রবৃত্তি আর তার নেই।

শুধু একটা বিষয়ে সে এখনও অনমনীয়।

হরেন তার বাপের বাড়িতে খবর দিয়েছিল ওকে না জানিয়েই। অর্থাৎ তারা যদি এসে নিয়ে যায় তো যাক। এসেছিলও তারা। বাবা মেজকাকা মা সবাই এসেছিল। এমন কি ওর ভায়েরাও এসেছিল সকলে। নিয়ে যাবার প্রস্তাব অবশ্য তারা করে নি। করে নি ছোঁয়াচে অসুখের ভয়ে নয়–ওখানে নিয়ে গেলে চিকিৎসা হবে না সেই ভয়ে। মেজকাকা সে কথা স্পষ্টই জানিয়ে দিয়েছে জামাইকে। তবে মা থাকতে চেয়েছিল মেয়ের কাছে। এভাবে পড়ে থাকলে হয়ত একটু তেষ্টার জলও পাবে না সময়মতো–এই আশঙ্কাই প্রকাশ করেছিল মহাশ্বেতা। কিন্তু স্বর্ণ কিছুতেই রাজি হয় নি সে প্রস্তাবে। বলেছিল, ‘তাহ’লে আমি মুখে জল দেবো না, দাঁতে দাঁতে চেপে পড়ে থাকব।…ওপোস ক’রে শুকিয়ে মরব। কেন, কিসের জন্যে তুমি এসে আমার কন্না করতে যাবে তাই শুনি! দেহটা পাত করেছি যাদের জন্যে তাদের শত্তে পোরে তারা দেখবে; না হয় তো মরে পড়ে থাকব–ঠ্যাং ধরে টেনে ফেলে দেবে এরা–ব্যাস্ চুকে যাবে ন্যাটা!..যদ্দিন পেরেছে আমাকে ঘানিগাছে ফেলে সব রক্ত নিংড়ে বার ক’রে নিয়েছে, এখন এই ছিঁড়েটাতে কোন কাজ নেই, ঘর-জোড়া ক’রে পড়ে আছি বলে বুঝি বাপেদের কথা মনে পড়েছে?…বাবার অমন সব্বনাশের দিনেও একবেলা যেতে দেয় নি এরা–নিদিনিদিখ্যেতে পঞ্চাশ ব্যানন রান্নার অসুবিধে হবে বলে- এদের ঝিগিরি বামনীগিরির কাজ আটকে যাচ্ছিল বলে–সে কথা আমি ভুলি নি, কাঁটার মতো বিঁধে আছে বুকে। এখন কেন যাব? আমিও যাব না, তোমরাও এসো না কেউ। জেনে রাখো তোমাদের মেয়ে মরে গেছে।’…

ওরা অবশ্য এসেছে তার পরেও। মহাশ্বেতা এসেছে, তরলা এসেছে। মেজকাকীও এসেছে দু একবার। কিন্তু থাকতে দেয় নি স্বর্ণ কাউকেই। বাপের বাড়ি যেতেও রাজি হয় নি। বলেছে, ‘এদের বাড়ির রোগ তোমাদের বাড়ি নিয়ে গিয়ে ঢোকাব কিসের জন্যে গা– সুখ-সোমন্দা! এদের বাড়ির রোজগার তো এটা, এখানেই খরচ ক’রে যাই!

তবু, স্বামী যে ঠিক তাকে এইভাবে একেবারে পরিহার করে চলবে অতটা বোধহয় মনে করে নি স্বর্ণ। মনের মধ্যে কোথায় একটা ক্ষীণ আশা ও আশ্বাস ছিল যে এতদিনে একটুখানি মায়াও অন্তত পড়েছে তার ওপর। সামান্য একটা বনের পাখি পুষলেও মানুষের মায়া পড়ে তার ওপর–গোরু-কুকুর পুষলে তো কথাই নেই। কিন্তু সে আশ্বাস আর রাখা যায় না। দিনের পর দিন যায়,–একটা সপ্তাহের সঙ্গে আর একটা সপ্তাহ যুক্ত হয়, হরেন এসে ওর ঘরের সামনেও দাঁড়ায় না একবার। জায়েরা পরের মেয়ে––কথায় বলে দেইজী শত্রু, তবু তারাও তো একবার করে, বাইরে থেকে হ’লেও, দিনান্তে যখন হোক খবরটা নিয়ে যায়–’কেমন আছ দিদি?…দেওররা চৌকাঠের মধ্যেও ঢোকে এক-আধবার! জীবেন বেশ খানিকটা ভেতরে এসেই দাঁড়ায়। হরেন কি একবারও খোঁজ করতে পারে না? তার কি এতই প্রাণের মায়া? না কি সত্যিই তার এত কাজ?

শেষেরটা বিশ্বাস করতে পারলে হয়ত বেঁচে যেত স্বর্ণ। মানুষের ওপর এমনভাবে আস্থা হারাত না। মনের মধ্যে একটা শেষ অবলম্বন থাকত অন্তত। কিন্তু তাই বা পারে কৈ? সে ভেতরে আসছে, মার সঙ্গে ছেলেমেয়েদের সঙ্গে কথা কইছে–এইখান দিয়েই কলঘরে ঢুকছে, বামুন ঠাকরুনকে বিবিধ রান্নার ফরমাশ করছে–এসব তো ঘরে শুয়ে শুয়েই টের পাচ্ছে স্বর্ণ, দেখছেও কতক কতক। এর মধ্যে এইখান দিয়ে চোদ্দবার যাতায়াতের সময় কি একবারও একটু থমকে দাঁড়িয়ে তার খোঁজ নিতে পারে না সে?…আয়নাকে ডেকে নাকি তত্ত্ব নেয় মাঝে মাঝে, ডাক্তারের কাছেও নাকি খোঁজ নেয় অসুখের ও চিকিৎসার। কিন্তু আসল মানুষটার খবর নিতে কি হয়? ও যে এইখানেই কাঙ্গালের মতো তার মুখ চেয়ে পড়ে থাকে তা কি একবারও ভেবে দেখে না সে?… বিশ্বাস হয় না ওর, কিচ্ছু বিশ্বাস হয় না। আয়না মিছে ক’রে বানিয়ে বলে, তাকে মিথ্যে স্তোক দেয়। পুরনো চেনা ডাক্তার–সেও ভদ্রতার খাতিরেই মিথ্যে কথা বলে নিশ্চয়

দিন গোনে একটা একটা ক’রে স্বর্ণ। হরেন শেষ কবে দোরের কাছে দাঁড়িয়ে তার খবর জিজ্ঞাসা করেছে–সে তারিখটা মনে ক’রে রেখেছে সে স্থান-কাল-পাত্র-একাকার- করা ব্যাধির এই প্রবল বিভ্রান্তির মধ্যেও। পনেরো, ষোল, সতেরো–কুড়িও হয়ে যায় একসময়ে।…আগে একটা তীব্র অভিমান, একটা দিক্‌দিশাহীন উষ্মা, প্রচণ্ড চিত্তক্ষোভ ঠেলে ঠেলে উঠত তার মনের মধ্যে, মনে মনেই সহস্র অনুযোগ তুলত, উত্তর-প্রত্যুত্তরের মহড়া দিত। তীক্ষ্ণ বাক্যবাণে প্রতিপক্ষকে ক্ষতবিক্ষত করতে চাইত। কিন্তু ক্রমশঃ অভিমানটুকু রাখার মতোও মূলধন যেন খুঁজে পায় না এখন। একেবারেই দেউলে হয়ে গেছে সে, নিঃস্ব হয়ে গেছে। এখন শুধু তাই একটা অসহায় কান্নাই বুকের মধ্যে ঠেলে ঠেলে ওঠে। তার দাম কারুর কাছে ছিল না কখনও–আজও নেই। হয়ত একদিন ছিল তার শৈশবে কৈশোরে–তার মা কাকা কাকীদের কাছে, হয়ত বাবার কাছেও–আর সেই দীন অনাথ ছেলেটা,–সেই অরুণের কাছেও––কিন্তু এখানে যেটুকু তার দাম তা শুধু তার কাজের। যতদিন কাজে লেগেছিল ততদিনই তার কিছু প্রতিষ্ঠা ছিল এ বাড়িতে। আজ তার সে শক্তি গেছে ফুরিয়ে–আজ আর তাই মূল্যও কিছু নেই।

যত কাঁদে, যত মনের মধ্যে মাথা কোটে–ততই অসুখও বাঁকা পথ ধরে। প্রথম প্রথম চিকিৎসাতে মন্দ ফল হয় নি। বিবর্ণ মুখে একটু রক্তাভা দেখা দিয়েছিল, অবশ হাত-পায়েও একটু বল ফিরে এসেছিল কিন্তু তারপরই আবার যেন কোথায় কী একটা গণ্ডগোল বাধে, ওর প্রাণশক্তি সাড়া দেয় না আর কোন ওষুধেই। বরং অবস্থার যেন দিন দিন অবনতিই ঘটতে শুরু করে।

ডাক্তার সে কথা হরেনকে জানান। প্রাণপণে হাসপাতাল ঠিক করতে বলেন। হরেন চিন্তিত হয়, বিরক্ত হয়–কিন্তু তবু তোড়জোড় ক’রে হাসপাতালে বেড় ব্যবস্থা করতে পারে না।

ডাক্তার অবশ্য আশ্বাস দেন স্বর্ণকে, ‘ওঁকে বলেছি–দরকার হ’লে ঘুষ দিয়েও ব্যবস্থা করতে–এবার মনে হচ্ছে একটা সিট পাওয়া যাবে। হসপাতালে না গেলে সারতে অনেক দেরি হবে কিন্তু। আপনি যেন আবার হাসপাতাল শুনে কাঁদতে শুরু ক’রে দেবেন না।’

স্বর্ণ ওদিকে মুখ ফিরিয়ে বলে, ‘আমি কাঁদব না। আমি এখান থেকে বিদেয় হ’তে পারলেই বেঁচে যাই–কিন্তু হাসপাতালে যাওয়াও আমার হবে না ডাক্তারবাবু, আমি এই আপনাকে বলে রাখলুম!’

‘কেন–উনি তো চেষ্টা করছেন খুব!’

‘মিছে কথা। হাসপাতালে গিয়ে যদি আমি বেঁচে ফিরে আসি আমাকে নিয়ে ও কি করবে বলতে পারেন? ভরসা ক’রে ঘরে নিতে পারবে না–অথচ আর একটা বিয়ের রাস্তাও বন্ধ হয়ে যাবে। এ এমনি ক’রে পড়ে থাকলে শিগিরই সব পথ খুলে যাবে–বুঝছেন না!…ওর এখনও ঢের বিয়ের বয়স আছে, আমার চেয়ে অনেক ভাল বৌ জুটে যাবে!’

হা হা ক’রে হেসে ওঠেন ডাক্তার।

‘এ তো আপনাদের মান অভিমানের কথা হ’ল। ও কোন কাজের কথা নয়। হচ্ছে, হচ্ছে–ব্যবস্থা একটা হয়ে যাবেই এর মধ্যে।’

এ-কথার কোন উত্তর দেয় না আর স্বর্ণ। চোখ বুজে স্থির হয়ে পড়ে থাকে। হায়রে! মান অভিমানের কথা বলে যদি এই মর্মান্তিক সত্যটাকে সেও উড়িয়ে দিতে পারত!… কিন্তু সে সব আর এই নিরীহ লোকটাকে বলে লাভ কি? সে প্রাণপণে শুধু ওঁর সামনে থেকে চোখের জলটাকে গোপন করার চেষ্টা করে।

.

তা হ’লেও, স্বামী সম্বন্ধে স্বর্ণ যতই মোহমুক্ত হোক, হরেন যে আর দুটো দিনও সবুর করতে পারবে না, এত শিগগির এই কেলেঙ্কারি ক’রে বসবে, তা কল্পনাও করতে পারে নি সে।

সন্দেহ করেছিল অবশ্য প্রথম দিন থেকেই। চোখের আড়ালে গেলেও তার মনের আড়ালে যেতে পারে নি হরেন একবারও। স্বর্ণর একটা চোখ আর একটা কান সর্বদা পাতা থাকত হরেনের দিকে, তার মন যেন ছায়ামূর্তি ধরে অনুগমন করত স্বামীকে, বিশ্রামে- অবসরে সমস্ত সময়–ঘরে বাইরে সর্বত্র। ঘরে শুয়ে শুয়েও ওর প্রতিটি গতিবিধি লক্ষ করত সে।…কাজেই হঠাৎ একদিন হরেনের সকাল ক’রে বাড়ি ফেরাটা অগোচর রইল না তার। কোনদিনই যে রাত দুটো-আড়াইটের আগে আসছিল না, বারোটায় আসা তার পক্ষে অপ্রত্যাশিত সকাল।

বিস্মিত হ’লেও বিচলিত হয় নি। নিয়মের ব্যতিক্রম ভেবেছিল।

কিন্তু তার পরের দিনও যখন ঘড়িতে বারোটা বাজবার সঙ্গে সঙ্গে দরজায় এসে ট্যাক্সি দাঁড়াবার শব্দ হ’ল এবং কড়াটা নড়ে উঠল খুব মৃদুস্বরে, তখনই সজাগ ও সচেতন হয়ে উঠল স্বর্ণ। এমন তো হয় না, অন্তত বহুদিন হয় নি। ব্যতিক্রমটা নিত্য ঘটতে থাকলে সেটা আর ব্যতিক্রম থাকে না, এ বুদ্ধিটুকু তার এতদিনে হয়েছে। এর অন্য অর্থ আছে কিছু।

সে সম্বন্ধে সজাগ এবং কৌতূহলী হয়ে ওঠার সঙ্গে সঙ্গেই আব্‌ছা কুটিল সন্দেহটা স্পষ্ট মূর্তি পরিগ্রহ করল মনের মধ্যে। দুই আর দুইয়ে চারের মতোই সহজ হয়ে এল অঙ্কটা। নতুন যে অল্পবয়সী ঝিটি এসেছে সে শ্যামাঙ্গী হ’লেও লাবণ্যবতী। তবু তার সম্বন্ধে কোন কথা হয়ত এত চট্‌ ক’রে ভাবত না, যদি না কদিন আগেই অত্যন্ত বেমানান রকমের ফরসা এবং এই যুদ্ধের বাজার হিসেবেও বেশ মাঝারি দামের কালাপাড় শাড়ি একখানা পরতে দেখত তাকে। একখানা নয়–এক জোড়াই এসেছে মনে হ’ল–কারণ একখানা কেচে আর একখানা পরা চলছে।…

সবাই ঘুমোচ্ছে, গোটা বাড়িটাতে নেমে এসেছে একটা শান্ত নিস্তব্ধতা। অতি সামান্য সামান্য শব্দ–কিন্তু সেগুলোও প্রগাঢ় সুষুপ্তিই সূচিত করে। জীবেনের নাক ডাকে, সেটা এখান থেকেও শোনা যাচ্ছে অল্প। পাশের বাড়ি তিনতলায় রমার ছেলেই বোধ হয়–খুঁৎ খুঁৎ ক’রে কাঁদছে সেই থেকে। আয়নার নাক ডাকে না–কিন্তু দাঁতপড়া তোবড়ানো মুখে ঠোঁটের বাধা ঠেলে বেরোতে নিঃশ্বাসেরই একটা অস্ফুট শব্দ হয়। সেটাও নিয়মিত– সুতরাং তা আর কানে বাজে না।

নিয়মিত এসব শব্দে কান অভ্যস্ত হয়ে গেছে। এর মধ্যে সামান্য যেটি অস্বাভাবিক, নতুন, সেটি ঠিকই কানে এসে পৌঁছয়। দরজা খুলে ভেতরে এল হরেন। কলঘরে গিয়ে মুখ হাত ধুয়ে এল। ফিসফিস ক’রে কাকে কি বলল। বোধহয় ঝিকেই বলল কিছু–কিম্বা রাঁধুনীকে। বামুন ঠাকরুন যে এতরাত পর্যন্ত জেগে আছেন তা মনে হয় না।…এবার বোধহয় ঘরে ঢুকে ঢাকা খুলে খেতে বসল। আবার এল ভেতরে। সম্ভবত আঁচাতে এল এবার।

এ সবই যথাসম্ভব সন্তর্পণে করে হরেন–চিরকাল খুবই সতর্ক সে, আর কারও ঘুমের ব্যাঘাত না হয় সে সম্বন্ধে যথেষ্ট হুঁশিয়ার। কিন্তু তবু যে জেগে কান পেতে আছে তার কাছে সে শব্দ না পৌঁছবার কথা নয়।…

কিন্তু কলঘর থেকে ফিরে গেল–সেও তো প্রায় মিনিট-পাঁচেকের কথা। দরজা বন্ধ করার শব্দ হ’ল না কেন?

স্বর্ণ আর থাকতে পারল না। প্রাকৃতিক কাজের সুবিধার জন্য কদিন আগে সে-ই ব্যবস্থা ক’রে নিচে মেঝেয় বিছানা করিয়েছে। সুতরাং উঠে হামা দিয়ে দিয়ে দরজার কাছে এগিয়ে যাওয়ার খুব অসুবিধা হ’ল না স্বর্ণর। বেশি দূর যেতেও হ’ল না তাকে অবশ্য। চৌকাঠের কাছে যেতেই দৃশ্যটা নজরে পড়ল।

ওর এই সারেরই শেষ ঘরখানা হ’ল বৈঠকখানা ঘর। আজকাল পাকাপাকিভাবেই ঐ ঘরে থাকে হরেন। এই রকের ওপরই সে ঘরের দরজা। একটু উঁকি মারলেই শেষ পর্যন্ত দেখা যায়, সে ঘরের দরজা ছাড়িয়েও–ওদিকের দেওয়াল পর্যন্ত। আর দেখতেও পেল সে। নিঃশব্দে একটা টানাটানি চলছে ঐ দরজারই সামনে। একজন আর একজনকে হাত ধরে টানছে বোধ হয়।…অন্ধকারে মুখ চোখ ঠাওর হবার কথা নয়। হ’লও না। কিছুই ঠাওর হ’ত না এই কৌটোর মতো বাড়িতে, যদি না রাস্তার আলোর একটা আভাস রমাদের সাদা বড় বাড়িটার দেওয়ালে প্রতিফলিত হয়ে একটা ঝাপসা রকমের আছায়া সৃষ্টি করত। যুদ্ধের আগে আরও ভাল আলো পাওয়া যেত অবশ্য, গ্যাসের আলোর অনেকটা এসে পড়ত ওদের দেওয়ালে। কিন্তু এখন ঠুলি-পরা আলো অতদূর পৌঁছয় না। এখন যেটুকু আলোর মতো নামে এ বাড়িতে, তাতে চোখ অভ্যস্ত না হ’লে কিছুই দেখতে পেত না।

কিন্তু মুখ চোখ ঠাওর না হ’লেও চলবে। সাদা ধবধবে শাড়িটাই যথেষ্ট। হরেনের পাটকরা ধুতিটাও।

অল্প কিছুক্ষণের টানাটানি। ধ্বস্তাধ্বস্তি কিছু নয়। যে-পক্ষকে টানা হচ্ছে তার যে খুব একটা অনিচ্ছা তাও নয়। বাধাটা খুবই ক্ষীণ, ক্ষীণতর চক্ষুলজ্জার একটা বহিপ্রকাশ মাত্র। কারণ কয়েক মুহূর্তেই সে প্রতিরোধ শেষ হয়ে গেল। দুজনেই নিঃশব্দে গিয়ে ঘরে ঢুকল। আর সঙ্গে সঙ্গেই প্রায় নিঃশব্দে বন্ধ হয়ে গেল দরজাটা।

আর কিছু দেখতে পেল না স্বর্ণ। আর কিছু দেখতে পারল না।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *