১৯. কত হিড়িকই এল গেল

ঊনবিংশ পরিচ্ছেদ

‘হিড়িক, বুঝলি–ও অমন এক-একটা আসে মধ্যে মধ্যে। ও আমি ঢের দেখেছি। বলি বয়স তো আর আমার কম হল না। কত হিড়িকই এল গেল–আমি ঠিক আছি। কিছুদিন অন্তর অন্তরই এই রকম এক একটা হুজুগ আসে। যারা পাগল যারা ছন্ন, তারাই ঐ সব হুজুগে ধেই ধেই ক’রে নাচে।…ও সব দেখে দেখে হদ্দ হয়ে গেলুম।…তোরা বললি তোমরা চলে যাও, আর অমনি ওরা বাপের সুপুত্তুর হয়ে চলে গেল সব।…ওঁরা খুব বাহাদুর হয়েছেন কিনা, সবাই একেবারে ওঁদের ভয়ে জুজু হয়ে গেছে। ঢাল নেই, তলোয়ার নেই নিধিরাম সর্দার। ইংরেজ একটা বন্দুকের শব্দ করলে বাবুরা কে কোথায় থাকবেন সব তার ঠিক নেই–ওঁরা হুমকি দেবেন আর সেই ভয়ে ইংরেজরা অমনি শ্যালের গত্ত খুঁজবে লুকোবার জন্যে।…সেই সেবার–সেই যখন প্রথম স্বদেশী হুজুগ ওঠে–ব্যাংবাবু না কে এক গান বেঁধে ছিল না, খুব চলত গানটা তখন–বাংলা এবার স্বাধীন হবে বক্তৃতার জোরে, বাংলা ছেড়ে জাহাজ চড়ে সাহেব কাল পালাবে ভোরে* …সেই বিত্তান্তই তো চলছে দেখছি আজও! কী সমাচার না ওঁরা সব কংগ্রেস-ওলারা অনেক ভেবেচিন্তে বেয়ে চেয়ে দেখে বক্তৃতা দিলেন, ইংরেজ, তোমরা ভারত ছাড়!! ওরা যেন ঐ গান্ধী মুখপোড়ার হুকুমটারই ওয়াস্তায় বসে ছিল এত দিন–মোট-ঘাট বেঁধে জাহাজঘাটায় গিয়ে–হুঁকুম পাস হয়েছে, সব অমনি দুদ্দাড় পালাবে! রেখে বোস দিকি ওসব কথা!…ঐ ক’রে মাঝে-মাঝে হুজুগ তুলে এক দল লোক নিজের দিন কিনে নিচ্ছে, আর চিরকাল একদল বোকা মুখ্যু আছে তারা মরছে জেল খেটে ফাঁসির দড়িতে গলা দিয়ে!’

[* ‘বেজায় আওয়াজ’ প্রহসনে গানটি আছে। রচয়িতা দেবেন্দ্রনাথ বসু (ব্যাংবাবু)। দীর্ঘকাল আবুহোসেন গীতিনাট্যর সহিত প্রহসন হিসাবে অভিনীত হইয়াছিল। গানটির পংক্তিগুলি এইরূপ : ‘বাংলা এবার স্বাধীন হবে বক্তৃতার জোরে, বাংলা ছেড়ে জাহাজ চড়ে সাহেব কাল পালাবে ভোরে। বাঙ্গালীর নাইকো একতা, বলো বলে কে একথা? প্ল্যাকার্ড মারো হবে বক্তৃতা, হররঙা পোশাকে অমনি টাউনহল যাবে ভরে।’]

অন্য লোকের অভাবে নাতি বলাইকেই হাত-পা নেড়ে বোঝান শ্যামা। এক-এক সময় দীর্ঘ বক্তৃতা দেন তাকে ধরে। বলাই উপলক্ষ্য, সে এসব কথা বোঝেও না, বোঝার কোন গরজও নেই তার–কিন্তু তাতে শ্যামার কিছু যায় আসে না, কেউ না থাকলেও আজ-কাল অমনি বকে যান শ্যামা। বয়স বাড়ার জন্যই হোক আর নানা রকম আঘাত সয়ে সয়েই হোক, তাঁর সেই আগেকার স্বভাবগাম্ভীর্য একেবারে নষ্ট হয়ে গেছে। যে বকুনি বা ‘থগবগানি’ তিনি চিরকাল অপছন্দ করতেন–সেই বকুনি এখন যেন তাঁকেই পেয়ে বসেছে, বকুনি ছাড়া থাকতেই পারেন না আজকাল। কোন কারণ থাকলেও বকেন, না থাকলেও বকেন, কারণ সৃষ্টি ক’রে নেন বকবার জন্যে।

বকুনির মধ্যে আবার গালাগালেরই অংশ বেশি। কাউকে না কাউকে গালা গাল দিয়েই যান। ছেলে-বৌ মেয়ে-জামাই পাড়া-পড়শী–মায় দেশের সর্বজনশ্রদ্ধেয় নেতারা পর্যন্ত। শেষে, যখন আর কোন মানুষ অবশিষ্ট থাকে না তখন গাছপালাগুলোকে নিয়ে পড়েন, ‘তোরাই কি কম শত্রুর সব! সব বেইমান, একধার থেকে সবাই বেইমান তোরা।…এত ক’রে কন্না করছি, একটা ফল দেবার নাম নেই কারুর! খাচ্ছেন-দাচ্ছেন যেন বনবাগে ধাইছেন সবাই। কেন, অন্য লোকের বাড়ি গিয়ে তো ফল-ফসল ঢেলে দিয়ে আসতে পারো সব!…আমি কী এমন শত্রুরতা করেছি তোদের সঙ্গে যে আমার ওপর এত আড়ি-আকচ?…মর মর সবাই মর তোরা। দোব নবাবী ঘুচিয়ে একদিন–কাঠওলা ডেকে সব গাছ কাটিয়ে যখন বিক্রি ক’রে দোব–তখন বুঝবেন সব।…কেন, কেন–সুখসোমন্দা আমার মাটি জুড়ে বসে থাকবি শুনি! …

পাড়ার লোক বলে পাগল। বলে নতুন বামুনদের বুড়িটার শোকে তাপে মাথা খারাপ হয়ে গেছে। বলাইয়েরও তাই ধারণা। পাগল সে বেশি দেখে নি বটে তবে পাগলদের কথা শুনেছে সে। এখানে বাজারে যে বুড়ো পাগলটা একেবারে উদোম বসে থাকে ময়রাদের উনুনের ধারে–সেও তো অমনি, দিন-রাত বকে আর গান গায়। এ বুড়ি গান গায় না বটে বকে তার চতুর্গুণ।

বলাইয়ের এক দণ্ডও থাকতে ইচ্ছে করে না এখানে। নিহাৎ কোথাও তার স্থান নেই বলেই পড়ে থাকতে হয়। বড়মাসী আগে আগে বলত তার ওখানে গিয়ে থাকার কথা –কিন্তু এখন আর উচ্চবাচ্য করে না। তাদের অবস্থা নাকি খারাপ হয়ে পড়েছে–মেসো-মশাইয়ের চাকরি চলে গেছে–এক পয়সা রোজগার নেই, গুষ্টিসুদ্ধ মেজ-কর্তার ‘হাততোলা’য় দিন কাটাচ্ছে। ও-বাড়ির মেজদার বিয়ের আগে নাকি মেজকর্তা ওদের একটা মুদির দোকান ক’রে দিয়েছিলেন–ওরা সেটা চালাতে পারে নি, হাজার বারো শ’ টাকা ঘুচিয়ে আবার ঘরে এসে বসেছে সবাই। কাজেই সেখানে গিয়ে ওঠবার কোন উপায় নেই।

আর হুট বলতে কোথাও যেতে আর ভরসাও হয় না ওর। ইদানীং দিদিমার মেজাজ হয়ে উঠেছে ভয়ঙ্কর–তেমনি অর্থপিশাচও হয়ে উঠেছে। মেজমাসীর দুর্দশা তো চোখেই দেখল সে। অসুখে ভুগে কঙ্কালসার হয়ে এসে দাঁড়াল–ঠিক রাস্তার কুকুরের মতো দূর দূর ক’রে তাড়িয়ে দিলে দিদিমা। ঝ্যাঁটা মেরে তাড়ানোটা মুখের কথা নয় ওর–সত্যি-সত্যিই ঝ্যাঁটায় হাত দিয়েছিল, যদি আর একটু দেরি করত উঠতে তো হয়ত সত্যিই ঝ্যাঁটা তুলত বুড়ি। বড়মাসীর বাড়ির কেউ বিশ্বাস করে নি কথাটা–কিন্তু বলাই নিজের চোখে দেখেছে। হ্যাঁ, মেজমাসীর দোষ আছে হয়ত–অসময়ে এসে উঠেছে, তারপর সুযোগ পেলেই চলে গেছে, এদের সুবিধে-অসুবিধেয় দিকে তাকায় নি–কিন্তু তবু পেটের মেয়ে তো হাজার হোক– ঐ মড়ার দশা হয়ে এসে দাঁড়াল, এক ফোঁটা জল পর্যন্ত খেতে দিলে না। বাইরে থেকেই বিদেয় ক’রে দিলে। বাইরের বাগানে বসে পড়েছিল, সেইখান থেকেই উঠে চলে গেল চোখের জল মুছতে মুছতে। শেষ পর্যন্ত সেই বড়মাসীর বাড়ি গিয়েই উঠতে হ’ল তাকে। বরং মেজকত্তা– সে তো পর বলতে গেলে–সে অনেক ভদ্রতা করেছে। পাঁচ-ছ দিন ওখানে রেখে, ছেলেদেরে দিয়ে হাসপাতালে পাঠিয়ে, বলে কয়ে একেবারে দশ-পনেরো দিনের মতো ওষুধের ব্যবস্থা ক’রে দিয়ে তবে ছেড়েছে সে। মায় একখানা নতুন থান ধুতি, মেয়ের বাড়ি যাবার গাড়িভাড়া পর্যন্ত দিয়ে দিয়েছে যাবার সময়। বড়-মাসীকেও মানতে হয়েছে যে, ‘হ্যাঁ, মেজকত্তা আমার মানটা রেখেছে বাপু, সেটা গরমান্যি যেতে পারব না।’

বলাই তবু শেষ পর্যন্ত আশা করে ছিল যে দু-চার দিন পরে দিদিমার মনটা নরম হবে, ওবাড়ি থেকে ডেকে পাঠাবে। ডেকে পাঠানো তো দূরের কথা, একটা উদ্দেশও করলে না। বরং মেজদা উপযাচক হয়ে একদিন খবরটা দিতে এলে বলেছিল, ‘ওসব কথা আমাকে শোনাবার দরকার নেই। ওকথা আমি শুনতে চাই নি। আমার মেজ মেয়ে অনেকদিন মরে গেছে, খাল-ধারে গেছে–এই আমি জানি। তার কথা ছাড়া যদি আর কোন থাকে তো বলো!’

এরপর দিদিমার আশ্রয় ছাড়বার কথা ভাবতেও সাহস হয় না বলাইয়ের। দিদিমা যে বলে, ‘কাউকে চাই না আমার, কাউকে দরকার নেই। আমার সগুষ্টি মরে-হেজে গেছে এই জেনে আমি নিশ্চিন্তি আছি’–সেটা কথার কথা নয়। বুড়ি একেবারে একাই থাকতে পারে, সত্যিই হয়ত কাউকে দরকার নেই ওর।

আর গেছেও তো একে একে সবই চলে–নিহাৎ বলাইয়ের কোন উপায় নেই বলেই যেতে পারে নি–কিন্তু শ্যামা তো ঠিক মাথা উঁচু করেই দাঁড়িয়ে আছেন। কাউকে কোনদিন কাকুতি-মিনতিও করেন না এসে থাকতে–কারুর বাড়ি গিয়েও ওঠেন না। নিজের গাছ- গাছালি, তরুকলা আমড়া শসা কলা-নারকেল আর নারকেলের পাতা, ঝাঁটার কাঠি এবং সুপুরি নারকেলের বেল্‌দো–শুকনো বাঁশপাতা আমড়া-পাতা, এই সব নিয়েই দিন কেটে যায় তাঁর। পাঁচটা মানুষের মুখও যে না দেখেন তা নয়, অধমর্ণের দল তো আছেই। নিত্যনিয়তই আসে তারা। সব জড়িয়ে একটা নিরন্ধ্র কর্মব্যস্ততার মধ্যেই দিন কাটে বরং

ওরই মধ্যে এগারোটায় হোক বারোটায় হোক–অথবা তিনটেতেই হোক, উনুন ও জ্বালেন একবার ঠিক। নিহাৎ ভাতে-ভাতও খান না–একটা-দুটো তরকারিও রান্না করেন। কারণ তাঁর ঘরেই রান্নার বহু উপকরণ থাকে। তবে রাঁধেন ঐ একবারই। যা রাঁধেন তাই থেকেই খানিকটা সরিয়ে রেখে দেন বলাইয়ের জন্যে। সে সন্ধ্যার পরই খেয়ে নিয়ে ও-পাট চুকিয়ে ফেলে। একটা ছেলের জন্যে দুবেলা উনুন জ্বালার পরিশ্রম আর করেন না।

তবে এখনও পর্যন্ত–এসব পরিশ্রম ওঁর গায়েও লাগে না। শুধু রান্নাই নয় বা ঘরের কাজই নয়–বাসনপত্রও ওঁকেই মেজে নিতে হয়। একটু ঝুঁকে পড়ছেন আজকাল–ভারী জিনিসপত্র বা বাসন নিয়ে আনাগোনা করতে কষ্ট হয় ঠিকই–কিন্তু করে যান উনি মুখ বুজেই। টাকাখানেক মাইনে দিলেই একটা ঠিকে-ঝি পাওয়া যায়–আজকাল এখানেও ঠিকে ঝিয়ের চলন হয়েছে–কিন্তু শ্যামার কাছে এতটা বাজে-খরচ কল্পনাতীত। একটা টাকা মানে তাঁর কাছে মাসে দু পয়সা হিসেবে সুদ, অর্থাৎ বছরে ছ আনা। তিন বছরেরও কম সময়ে সে টাকাটা দুটো টাকায় পরিণত হ’তে পারে। একটা টাকাও এমন কিছু ফেলনা নয়। টাকা তো টাকা, সাত হাত মাটি খুঁড়লে একটা পয়সা বেরোয় না। একটা টাকা যদি এতই তুচ্ছ হ’ত তা’হলে রাজ্যের লোক সেই এক টাকা ধার করবার জন্যেই হত্যে দিয়ে পড়ে থাকত না তাঁর দোরে–তাও ঘর থেকে জিনিস বার ক’রে।

তাছাড়া, দরকারও নেই তাঁর অত সুখে। তিনি বেশ আছেন। ভালই আছেন! একটু ঝুঁকে পড়েছেন বটে, বেশি চলাফেরা বা বেশি কাজকর্ম করলে পিঠটা টনটন ক’রে ওঠে, তখন হাতের কাজ বা বোঝা ফেলে একবার পিঠটা ছাড়িয়ে না নিতে পারলেও চলে না, কিন্তু তাই বলে দিদির মতো একেবারে অথর্ব হয়েও যান নি। হাত-পা এখনও তাঁর তাঁবে আছে। আর তা যতদিন আছে ততদিন কারও সাহায্য চানও না তিনি। বসে খাবার শখ তাঁর নেই। কোন কালেই ছিল না। সুখ যে তাঁর অদৃষ্টে নেই তা তিনি জানেন। অদৃষ্টে না থাকলে সুখভোগ হয় না। ঐ তো দিদিই–ছেলে পর পর তিনটে বিয়ে করল, শেষের বিয়ে তো করল স্রেফ মায়ের দোহাই দিয়েই, কাজ করার লোক চাই এই অজুহাতেই অমন সোনার প্রতিমার আসনে এনে বসালো কালো ‘ব্রেষকাট’ ঐ মেয়েছেলেটাকে–তাই কি দিদি বসে খেতে পারছে? উঠতে পারে না, পা দুটো পড়ে যাবার মতো হয়েছে–তবু পাছা-ঘষে ঘষে, হামাগুড়ি দিয়েও রান্নাবান্না কাজকর্ম করতে হচ্ছে। না করে উপায় কি, এ বৌ যা কাজের–দিনান্তে এক গাল ভাত কারুর জুটত কিনা সন্দেহ, দিদি না সঙ্গে থাকলে।…পঙ্গু হয়ে, মরে মরেও সব করতে হচ্ছে দিদিকে, অথচ ঐ দিদি এককালে এক ঘটি জল পর্যন্ত গড়িয়ে খায় নি নিজে হাতে।…

না, সুখ যার অদৃষ্টে নেই তার সুখভোগ হয় না কিছুতেই। তাঁরও তো বাড়-বাড়ন্ত সংসার দেখে মা বিয়ে দিয়েছিলেন। সব যেন উড়ে-পুড়ে গেল–তিনি যেতে না যেতে।…তাও, বহু দুঃখ, বহু লাঞ্ছনা সহ্য ক’রে যদি বা আবার একটা সংসার খাড়া করলেন–ভোগে কি এল? বড় ছেলে, বড় বৌ, নাতি-নাতনী–সবাই তাঁকে এই বনবাসে ফেলে রেখে চলে গেল, পর হয়ে গেল হয়ত বা চিরকালের মতোই। আগে বছরে দু-তিনবার আসত–এখন কালেভদ্রে আসে। বছরে একবারও হয় কিনা সন্দেহ। ওঁর এ-বাড়ির খাওয়া খেয়ে নাকি তারা থাকতে পারে না। সেখানে তিন আনা সের মাছ, রোজ মাছ খেয়ে খেয়ে অভ্যাস হয়ে গেছে–এখানে থোড়-সড়সড়ি ডুমুরের ঝোল দিয়ে ভাত রোচে না তাদের মুখে। নবাব সব! নবাবপুত্তুর! তার ওপর আবার গোবিন্দর ছেলেটা গিয়ে জুটেছে ঐখানে–তার আরও নবাবী মুখ।–বৌ গিনেমো ক’রে নিয়ে গেছেন, কাউকে জিজ্ঞেস নেই, মত নেওয়া নেই। দাসীবাদী যা হোক একটা পড়ে আছে তা একবার জানানো পর্যন্ত দরকার মনে করেন নি। যার সুবাদে সুবাদ সে-ই কিছু টের পেল না, একটা বোঝা চেপে গেল মাথায় চিরকালের মতো। ইচ্ছে করে যেচে সে বোঝা চাপানো হ’ল। আহাম্মক সব। আহাম্মক। নইলে ছেলে- মেয়েদেরই কি ঐভাবে তৈরি করে! কত মাইনে পাস রে বাবা–যে মাছ না হলে ভাত ওঠে না মুখে! তোদের বাপের যে ঐ ডুমুরের ডালনা শুষুনি শাকের ঝোল দিয়েও ভাত জোটে নি একককালে। একবেলা শুধু ভাত দুটি পেলেও বেঁচে যেত সে তখন।…তাতেও তার যে স্বাস্থ্য ছিল, যে খাটবার শক্তি–তা কি তোরা অত মাছ দুধ খেয়েও পাবি কখনও?…

না, পাঁচটা মানুষের মধ্যে থাকা কি কারও সাহায্য পাওয়া ভগবান তাঁর অদৃষ্টে লেখেন নি যখন–তখন তিনিও চান না মিছিমিছি টানাটানি করে ছেঁড়া-চুলে খোঁপা বাঁধতে। শুধু বড় ছেলে কেন–ওদের সবাইকেই খরচের খাতায় তুলে রেখেছেন তিনি। নইলে দু-দুটো মেয়ে বিধবা হয়ে শুধু-হাত করে এসে উঠল–তবু, তাদের ভাত-কাপড় দিয়ে পুষতে রাজি হয়েও, তাদের কাউকে ধরে রাখতে পারলেন না কেন, তারা কেউ কাজে এল না কেন?…একজন তো মরেই গেল–মরার বাড়া গাল নেই–আর একজন ‘হুতোশনী’ মূর্তি ধরে ঘুরে ঘুরে বেড়াচ্ছেন সাত দোরের লাথি ঝ্যাঁটা খেয়ে, সেও তার ভাল–তবু মার কাছে সম্মানের ভাত বসে-খাওয়া–তাও ভাল লাগে না। বিনা খাটুনীর রাঁধা ভাত তেতো লাগে তার। তা লাগুক–শ্যামা ঠাকরুনের কিছু এসে যায় না তাতে।…

বেশি কথা কি–কালা-হাবা কাজের-বার ছেলেটার বিয়ে দিলেন–বেছে বেছে যার সাত কুলে কেউ নেই–বাপে-মরা মায়ে-খেদানো মেয়ে দেখে–সেও তেজ দেখিয়ে চলে গেল। তেজ যে দেখাল, দেখাতে পারল সেও বিধাতার বাদসাধা বলতে গেলে। ছাপাখানায় পনেরো টাকা মাইনের চাকরি ক’রে আর বাছাধনকে এই বাজার মাগ-ছেলে পুষতে হ’ত না। কোথা থেকে সেই ছাপাখানার মালিকের বন্ধু এক মাড়োয়ারীর নজরে পড়ে গেল তাই। বদ্ধ কালা আর ভালমানুষ– মতো দেখে কী মনে হ’ল–দয়াই হ’ল কিম্বা অন্য কোন মতলব খেলে গেল মাথায়–এক টুকরো কাগজ দিয়ে এক লাইন ইংরিজি লিখতে দিলে। কান্তির হাতের লেখা চিরদিনই ভাল, মুক্তোর মতো–দেখেই পছন্দ হয়ে গেল ভদ্রলোকের। তখনই ওর সেই মনিবকে বলে একেবারে সঙ্গে ক’রে নিয়ে গেল নিজের গদিতে–এক কথায়, সেধে চল্লিশ টাকা মাইনের চাকরিতে বসিয়ে দিলে সেই দিন থেকে। অফিসে বসে অপর বাবুদের সঙ্গে কাজ করতে হয় না–বাবুর বাড়িতে বসেই কাজ ওর। বিকেলে টিফিন পর্যন্ত দেয় বাবুর বাড়ি থেকে ফল মিষ্টি নানা রকম ঘিয়ে-ভাজা খাবার। মাড়োয়ারী বাবুটির নাকি কি সব নিজস্ব খাতা লেখার কাজ আছে, সে সব হিসেব আলাদা, বাড়িতে বসেই করতে হয়–সেই জন্যেই খুব পছন্দ হয়েছে তাঁর, বদ্ধ কালা লোক– কারও সঙ্গে চট ক’রে গল্প জমাতে পারবে না, এই দেখেই পছন্দ হয়েছে আরও।

তা সে মাইনে কি আর তাঁর ভোগে লাগল? যেমন চাকরি পাওয়া–সর্বনাশী বৌ যেন টাক করে ছিল (‘তা ওরই সিন্নি তো ঠাকুর খেলে বাপু’, শ্যামা মনে মনে বলেন, ‘ঠাকুর মুখপোড়ারাও তো কম এক-চোখো খোলো নয়!’)–সঙ্গে সঙ্গে বরকে নিয়ে আলাদা হয়ে গেল। এমন পাকা ঘরে থাকা, এমন নিজের বাড়িতে সম্মানের থাকা ভাল লাগল না তাদের, বালিগঞ্জের দিকে মনোহরপুকুর না কি এক পাড়ায় গিয়ে বস্তিতে উঠেছে–সেইখানেই দু-টাকা দিয়ে ঘর ভাড়া ক’রে! খুব সুখে আছে। এখানে অর্ধেক কাজ তো শ্যামাই ক’রে দিতেন, উনুনের ধারে তো যেতেই হ’ত না বলতে গেলে–সেখানে জুতো-সেলাই থেকে চণ্ডীপাঠ সব করতে হচ্ছে। ছেলে হয়েছে–হ্যাঁসপাতালে গিয়ে খালাস হয়ে এসে সেই অবস্থাতেই–আঁতুড়ের মধ্যেই নাকি রান্নাবান্না সব করছে। সেই ভাত ছেলেও খাচ্ছে। তবু সেও নাকি ওদের ভাল।

অথচ কী যে অনিষ্ট ওদের করছিলেন তিনি, তা আজও ভেবে পান না। বৌকে যে তেমন কোন বকাঝকা করতেন তাও নয়–সত্যি কথা বলতে কি করতে সাহসই হ’ত না– ঝগড়া তো কোন দিন করেনই নি। তাও তার এত অসহ্য হ’ল? তার চেয়ে ঢের বেশি সয়েছে বড়বৌ–তা মানতেই হবে। আর কান্তি, কান্তিকে তো বুকে করে রেখেছিলেন, যাকে বলে ডানার আড়ালে, সেও অনায়াসে এতটা বেইমানী করতে পারল! আশ্চর্য!

আবার ভাবেন, আশ্চর্য হবারই বা কি আছে! বেইমানের ঝাড় যে ওরা। যেমন বংশ তেমনি হবে তো।

তা তিনিও তেমনি–এক মাসের ছেলে নিয়ে দেখাতে এসেছিল ওরা, উনি কোন কটু কথা বলেন নি বটে, তবে সে ছেলের মুখের দিকে তাকিয়েও দেখেন নি! আর দেখবেনও না কখনও, সেটা স্পষ্ট ভাষাতেই জানিয়ে দিয়েছেন। ও ছেলে তাঁর নাতি নয়, ওকে তিনি পৌত্র বলে স্বীকার করতে রাজি নন।…

এখন বন্ধনের মধ্যে এক বলাই : তবে তার আশাও তিনি রাখেন না আর। বলেন, ‘আগ-ন্যাঙলা যেমন গেছে পেছ-ন্যাঙলাও তেমনে যাবে।’ ওরা সব বুনো পাখি, খাবে-দাবে বনবাগে ধাইবে।…যে কদিন না খুঁটে খেতে শেখে সেই কদিনই কাছে আছে। তারপর একদিনও থাকবে না আর–তা আমি বেশ জানি।…তাই আশা-ভরসাও ওদের ওপর কিছু রাখি না, মায়া-মমতাও কিছু নেই। নিহাৎ কেষ্টোর জীব পড়ে আছে, তাই দুমুঠো খেতে দিচ্ছি। ঐ পর্যন্ত! মায়া-মমতা কারুর ওপর নেইও, তার কথাও নেই!’

বলাইয়েরও যে ও বস্তুটার জন্যে খুব একটা দুঃখ আছে, তা নয়।

আজন্মই তো বলতে গেলে সে মায়া মমতা স্নেহ-ভালবাসার মুখ দেখে নি। বাপের কথা তো ওঠেই না, মা কিছুদিন ছিল, মায়ের কথা মনেও পড়ে কিন্তু সে থেকেও না থাকারই মধ্যে। মায়ের স্নেহ কাকে বলে তা বলাই জানল না একদিনের জন্যেও। জ্ঞান হয়ে অবধি দেখে আসছে নির্লিপ্ত নিরাসক্ত জড়ভরত। দিদিমার কাছে–কে জানে কেন, সে স্নেহ আশাও করে নি কোনদিন। দিদিমার সঙ্গে জড়িয়ে যেন ও বস্তুটি কল্পনাও করা যায় না। এখানে এসে একটু স্নেহভালবাসা যা পেয়েছে বড়মামীর কাছে–কিন্তু সেও এত দিনের কথা হ’ল যে, তার স্মৃতিটা পর্যন্ত ধূসর হয়ে গেছে মনের মধ্যে। ছোটবেলায় তিন বছরের স্মৃতি ভুলতে তিন দিনের বেশি লাগে না–ও বয়সে মনটাও থাকে সামনের দিকে ঝুঁকে, পেছনের কথা নিয়ে মাথা ঘামানো তার স্বাভাবিক নয়।

সুতরাং, স্নেহ মমতার অভাব নয়–বলাইয়ের দুঃখ অন্যত্র। তার বড় দুঃখ এই বন্দীদশা। এই একটা বাড়ি এবং বেড়া দেওয়া এটুকু জমির মধ্যে আটকে থাকা। অবশ্য এ বন্দীদশা কতকটা তার স্বেচ্ছাকৃত। সে-ই বেরোতে চায় না ইদানীং। শ্যামা বেরোতে বললে বিদ্রোহ করে, সোজাসুজি অস্বীকার করে বেরোতে। কারণ লজ্জা নিবারণের মতো কোন বস্ত্র তার নেই। এই জন্যেই তার লেখা-পড়াও বন্ধ হয়ে গেছে। যখন খুব ছোট ছিল তখনকার কথা আলাদা। ছেঁড়া পাঁচী ধুতীর ওপর মহাশ্বেতার, ছেলেদের পরিত্যক্ত ঢলঢলে পুরনো জামা পরে (তাদের নতুন জামারও যা ছিরিছাঁদ–ভদ্রসমাজে পরে যাওয়ার মতো কিনা, বলাইয়ের আজকাল সন্দেহ হয়) সিদ্ধেশ্বরীতলার কাছে পাঠশালায় পড়তে যেত–সেখানে তত বেমানান দেখাত না সেটা। কিন্তু ইংরেজি ইস্কুলের কথা আলাদা সেখানে ছেলেরা ফিট-ফাট হয়ে না আসুক, খুব পাগলের মতোও আসে না। অন্তত হাফ প্যান্ট আর হাফ শার্ট পরে আসে একটা করে। পুরানো হলেও তাতে এক-আধটার বেশি সেলাই থাকে না। অথচ বলাইয়ের আগে যাও বা ভদ্রতা রক্ষার মতো সামান্য কিছু ছিল, তাও রইল না ক্রমশ। শ্যামা দিনদিনই খরচের হাত গুটিয়ে আনছেন। বাড়িতে পরার জন্যে ছেঁড়া গামছা বা দুসুতি বরাদ্দ হয়েছে।

এ দুসুতি বহুকাল আগে অভয়পদ দিয়েছে। আগে তাদের অফিসে বস্তা বস্তা আসত এগুলো। কী যেন কলকব্জা মোছা না কী কাজে লাগত। অভয়পদ মধ্যে মধ্যে কতকগুলো করে নিয়ে আসত। সে আনত বাজারের ঝাড়ন বা রান্নাঘরের হাঁড়ি-কড়া মোছবার জন্য। নিয়ে এলে এ-বাড়িতেও খানকতক করে ফেলে দিয়ে যেত। সেইগুলোই পুতুপুতু করে জমিয়ে রেখে দিয়েছেন শ্যামা। গামছা হিসেবে ব্যবহার করলে গা মোছা যায় হয়ত –কিন্তু পরে লজ্জা নিবারণ হয় না। শ্যামা বলাইকে সেই দুসুতিই মধ্যে মধ্যে একটা ক’রে বার ক’রে দেন। বলেন, ‘বাড়িতে তো দ্বিতীয় জনমনিষ্যি নেই–থাকার মধ্যে তো আমি একা, তা আজকাল আমি তো চোখে ভাল দেখতেও পাই না, সব ঝাপসা ঝাপসা দেখি, কাজকম্ম করি আন্দাজে আন্দাজে–তা এখানে আর অত অ্যালবা-পোশাকে দরকার কি, এ-ই বেশ পরা যাবে। পরে থাক দিকি। অত কাপড় গামছা আমি যোগাতে পারব না। এত আসে কোথা থেকে? তোর বাপ কি জমিদারি রেখে গেছে? আর কী এমন নবাব খাঞ্জা খাঁ তুমি যে সিমলে শান্তিপুরের ধুতি এনে যোগাতে হবে!

কিছুদিন যাবতই বাড়িতে এই ব্যবস্থা চলছে। আগে কোন খাতকের গলার আওয়াজ পেলে ঘরে ঢুকে বসে থাকত–কিন্তু তাতেও অব্যাহতি মিলত না, ঘরে আছে জেনে শ্যামা ডেকে এটা-ওটা ফরমাশ করতেন–আর ডেকে কোন কথা বললে মুখের ওপর কিছু না বলা যায় না–আর বেরোনো মানেই লজ্জা, মনে হয় এর চেয়ে এই মুহূর্তে মরে যাওয়াও ভাল। আজকাল তাই কাউকে বেড়ার আগড় খুলতে দেখলেই বা কারও গলার আওয়াজ পেলেই একেবারে পিছন দিকের পগারের ধারে গিয়ে বসে থাকে। এ অবস্থায় মানুষের সঙ্গর থেকে গোসাপ ভাম ভোঁদড়ের সঙ্গও বাঞ্ছনীয় মনে হয়।

তবু–বাইরে বেরোবার জন্যেও যদি একটা ধুতি দিতেন শ্যামা–অন্তত ওর পড়াশুনোটা বন্ধ হ’ত না। বাপ-মা মরা অনাথ বলে, বিশেষ ওর মা রেলে কাটা পড়ার পর, ওর সম্বন্ধে সকলেই একটু দয়া অনুভব করতেন–প্রথম থেকেই পাঠশালে বা ইস্কুলে ফ্রি পড়ছে। ওর বই-খাতা যা দরকার মাস্টারমশাইরাই চেয়ে-চিন্তে যোগাড় ক’রে দিতেন–পড়াশুনোতেও খুব খারাপ ছিল না–কিন্তু ইস্কুলে যাওয়াই যদি বন্ধ হয় তো লেখাপড়াটা করে সে কী করে!

শ্যামা এ অসুবিধাটা আদৌ বোঝেন না। ও-বাড়ি থেকে কাঁথার নাম ক’রে ছেঁড়া ধুতিগুলো চেয়ে নেন–তাই আবার সেলাই ক’রে তালি দিয়ে পরতে দেন বলাইকে। সেই কাপড় পরে ইস্কুলে যেতে বলেন তাকে। বলেন, ‘তুই যে গরিবের ছেলে অনাথ–সবাই তা জানে, তোর অত ভাল ভাল পোশাক না পরলেও চলবে!’ কাপড় ও-ই, জামার অবস্থা আরও খারাপ। কারণ মহাদের ছেলেরা বেঁটে ধরনের, কাঁধগুলো চওড়া–বলাই এই বয়সেই বেশ ঢ্যাঙ্গা হয়ে উঠেছে–ঢ্যাঙ্গা আর রোগা–ওদের জামা একেবারেই তার গায়ে লাগে না। তবু প্রথম প্রথম–কতকটা পড়ার উৎসাহে, কতকটা এই শূন্য পুরী থেকে অব্যাহতি পেয়ে মানুষের মধ্যে, মানুষের হাসি-গল্প-কোলাহলের মধ্যে গিয়ে পড়ার আগ্রহে–তাও গিয়েছিল বলাই। বেশ কিছুদিনই গিয়েছিল কিন্তু ক্রমশ ছেলেদের ঠাট্টা-তামাশা টিটকিরি অসহ্য হয়ে উঠল। শুধু সহপাঠীরা নয়–ইস্কুল সুদ্ধ ছেলেরা ঠাট্টা করে, ক্ষেপায়, হাততালি দেয়। এমন এমন কথা বলে যে, মায়ের মতো রেলে গিয়ে গলা দিতে ইচ্ছে করে বলাইয়ের।

তাদেরও খুব দোষ দেওয়া চলে না অবশ্য। অপর ছেলেদের সঙ্গে মিলিয়ে দেখে নিজের বেশভূষাটা নিজের কাছেই হাস্যকর বলে মনে হয়েছে বলাইয়ের। উড়ে পুকুরের ধারে ভাঙ্গা চালাটার মধ্যে যে হাজারী বুড়ি থাকে–দোরে দোরে বাসন মেজে অতিকষ্টে দিন কাটে যার– তার নাতি এককড়িও বলাইয়ের চেয়ে ঢের ভদ্র পোশাকে আসে। খাকি হাফ প্যান্ট আর গেঞ্জি–কিন্তু এই ঢলঢলে অথচ খাটো সাত-তালি দেওয়া জমা আর শতচ্ছিন্ন কাপড়ের চেয়ে তো ঢের ভাল। তাও শ্যামা আজকাল চোখে দেখতে পান না, তালি বাঁকাচোরা বসে, তার ওপর সেলাইয়ের সুতোর রঙের ঠিক থাকে না। কারণ সুতো সবই ছেঁড়া কাপড় থেকে বার ক’রে নেন শ্যামা, জমির সাদা সুতোর সঙ্গে পাড়ের রঙিন সুতোও মিশে যায়।

যদি সত্যিই না থাকত তো এক রকম। দিদিমারও টাকা খরচ করতে হয় না। বলাই জানে, বড়মামী পূজোর সময় বলাইয়ের নাম ক’রে আলাদা টাকা পাঠান তার কাপড়-জামার জন্যে। সে টাকায় কাপড় কেনা হয় না কস্মিন্ কালে। শ্যামা বলেন, ‘গরিবের আবার পুজো কি, পুজো তো বড়লোকের। কাপড় না থাকলে তবেই কাপড় কিনব–যদ্দিন চলে চলুক না। যার বাপ কিছু রেখে যায় নি, নিজে যে লেখাপড়া শিখল না, তার নবাবী অব্যেস করা ঠিক নয়।’ মহা মাকে চিনেছে ইদানীং, নগদ টাকা সে দেয় না–যা দিয়েছে দু-একবার কাপড় কিনেই দিয়ে গেছে–কিন্তু সেগুলোও, একবার ক’রে পরিয়েই বাক্সয় তুলে রেখেছেন শ্যামা, শুধু বন্ধ থেকে থেকে সেগুলো বস্তাপচা হয়ে যাচ্ছে। সে কাপড়ের কথা তুললে বলেন, ‘থাক না, ওদের তো আর খেতে দিতে হচ্ছে না, অবরে-সবরে কাজে লাগবে এখন। এক-আধটা ভাল কাপড় তুলে রাখা দরকার–নেমন্তন্ন আমন্তন্ন খেতে যেতেও তো কাজে লাগে!’…

বলাই জানে যে, ‘অবরে-সবরে’ তার কোনদিনই কাজে লাগবে না ও কাপড়। নেমন্তন্নই বা তাকে করছে কে? এই এতকালের মধ্যে একবার ও-বাড়ির মেজদার বিয়েতে যা গিয়েছিল–সে সময় বহুকালের একখানা কাপড় বার ক’রেও দিয়েছিলেন শ্যামা–কিন্তু দীর্ঘকাল আলোর মুখ না দেখার ফলে সে কাপড়ে ভাঁজে ভাঁজে এমন একটা ছোপ ছোপ দাগ পড়ে গিয়েছিল যে তাকে আর যাই হোক ধোপদস্ত কাপড় বলা চলে না কোন মতেই। সকলেই ফিরে ফিরে তার কাপড়ের সেই দাগগুলো দেখছিল বারবার–বলাইয়ের বেশ মনে আছে। তাও, সেই তো শেষ!

কাপড়গুলো নষ্ট হচ্ছে–হয়ে যাবেও, তবু শ্যামা সেগুেলো বার ক’রে কোন দিনও পরতে দেবেন না ওকে, তা বলাই জানে। এর কোন প্রতিকারও তার হাতে নেই। এক একবার মনে হয় যে, সে কোথাও পালিয়ে যায়–তার না-দেখা ছোটমামার মতো। কিন্তু সাহস হয় না। সে কিছুই জানে না এ পৃথিবীর–এই ওর পরিচিত দু-তিন ক্রোশ পরিধির বাইরে যে বিপুল জগৎ, সে সম্বন্ধে ওর কোন ধারণাই নেই। এতকালের মধ্যে ট্রেনে চড়ে নি কখনও। কথা বলার লোকের অভাবে, না বলে বলে মানুষের সঙ্গে কথা বলার অভ্যাসটাও গড়ে ওঠে নি ভাল ক’রে। লেখাপড়াও জানে না। কোথায় যাবে সে, কি খাবে, কোথায় কে তাকে আশ্রয় দেবে–অনেক ভেবেও সে ঠিক পায় না। বাড়ি থেকে পালিয়ে গিয়ে কী ভাবে অন্নসংস্থান করা সম্ভব, তা কল্পনা করার মতো অভিজ্ঞতাও নেই ওর। কারও সঙ্গে পরামর্শও করতে পারে না। ওর পরিচিত মানুষ বলতে ও বাড়ির ছেলেরা। তারা সকলেই ওর চেয়ে বয়সে অনেক বড়–তাছাড়া তারা ওকে জানোয়ার বা অর্ধ-মানুষের মতো কোন প্রাণী মনে করে–ভাল ক’রে কথাই বলে না ওর সঙ্গে। তাদেরও জ্ঞানের পরিধি খুব বিস্তৃত নয়। সেটুকু বোঝার মতো বুদ্ধি বলাইয়েরও আছে।

এর মধ্যে একবার বড়মামী যখন এখানে আসে তখন কথাটা পেড়েছিল বলাই। অনেক সাহসে ভর করে অনেক কষ্টে বলেছিল, ‘আমাকে আপনাদের সঙ্গে নিয়ে চলুন মামীমা, আমি–আমি আপনাদের ওখানে চাকরের কাজ করব সেও ভাল, এখানে থাকলে আমার লেখাপড়াটড়া কিচ্ছু হবে না।’

ওর কথাটা বলার অসহায় দীন ভঙ্গিতে কনকের চোখে জল এসে গিয়েছিল–কিন্তু তবু বলাইকে নিয়ে যেতে সে পারে নি। প্রথমত আরও একটা খরচ বাড়াতে সাহস হয় নি তার নিজের ছেলে-মেয়েরা বড় হচ্ছে, তার ওপর গোবিন্দর ছেলের দায় চেপেছে। যত সস্তাগণ্ডার দেশই হোক, হেমের মাইনেও এতদিনে সত্তর টাকায় দাঁড়িয়েছে। এখানে কুড়ি টাকা পাঠিয়ে যা থাকে তাতে এতগুলো প্রাণীর খরচা চালাতে প্রাণান্ত হয় কনকের। মাসে আট আনা দিলেও বাসন মাজার একটা ঝি পাওয়া যায়–সেটুকুও বিলাস বলে মনে হয়। সর্বদাই টানাটানি করে চলতে হয়। সেক্ষেত্রে আরও একটা পেট যোগ হওয়া, তার লেখাপড়ার খরচা–অনেকখানি দায়িত্ব এবং বোঝা। বলাই গেলেও মাসিক টাকাটা কমাতে দেবেন না শ্যামা। দু-একবার যে সে চেষ্টা করে নি হেম তা নয়–কিন্তু প্রস্তাব মাত্রে শ্যামা মাথা খুঁড়ে গালিগালাজ দিয়ে শাপ-শাপান্ত ক’রে এমন পাগলের মতো কাণ্ডকারখানা করেছেন যে তখন মনে হয়েছে যে-কোন মূল্যেও শান্তি কেনা শ্রেয়। সেদিকে কোন সুবিধেই হয় নি–মাসে মাসে সেই কুড়ি টাকাই টেনে যেতে হচ্ছে।

সুতরাং আয় যেখানে বাঁধা, মোটা ব্যয় কিছু সঙ্কোচ করা সম্ভব নয়, সেখানে আবার একটা খরচের দায়িত্ব ঘাড়ে নিতে সাহস হয় নি কনকের। সেই কথাটাই ওকে বুঝিয়ে বলেছিল কনক। বলাই সব বোঝে নি হয়ত–বিশ্বাসও করে নি। তবে মোটা মোদ্দা কথাটা বুঝেছিল। কনক আরও বলেছিল, ‘তা ছাড়া মা এখানে একা–একেবারে দোসর-হীন- তুমি চলে গেলে তো দেখবারও কেউ থাকবে না। বুড়ো মানুষ, দিন দিন অথর্ব হয়ে পড়ছেন–এইভাবে একেবারে একা ফেলে রাখা কি উচিত? মরে দুদিন পড়ে থাকলেও তো কেউ একটা খবর পাবে না। আর মা-ই বা কি ভাবেন! পাড়ার লোকেও ছি-ছিক্কার করবে। মা আমাকেই কতকগুলো গালমন্দ শাপ-মন্যি দেবেন। সে আমি পারব না বাবা। তা অন্য কোন ব্যবস্থা করা যায় না?’

সে অন্য ব্যবস্থাটা যে কী হ’তে পারে, তা কনকও কিছু বলতে পারে নি অবশ্য। বলাই তো বলতে পারেই নি। জামা-কাপড় চেয়ে কোন লাভ নেই। মিছিমিছি ওদের খরচান্ত করে লাভ কি? সুতরাং সে চুপ করেই গিয়েছিল। ম্লান মুখে নয়–বলাইয়ের মুখ ম্লানও হয় না ইদানীং। কেমন যেন ভাবলেশহীন পাথরের মতো হয়ে গেছে ওর মুখের চেহারাটা। কতকটা ওর মায়ের মতোই। দেখে বুকের মধ্যেটা ছাঁৎ করে ওঠে কনকের।

তবু কনক ওর সমস্যার কোন মীমাংসাই করতে পারে নি। কোন ব্যবস্থাই হয় নি যেটা হয়েছে–বলাইয়ের সাধ্যর মধ্যে যেটা–সেটাই সে করেছে। ইস্কুলে যাওয়াটা বন্ধ করে দিয়েছে। কেন কী হয়েছে–অকারণ বুঝেই হয়ত–কোন কারণও দেখায় নি। হঠাৎই একদিন বলেছে, ‘আর যাব না’,–বই-খাতাগুলো তাকে তুলে রেখে দিয়েছে খুব সহজভাবে, খুব ঠাণ্ডা মাথাতে–যেন হিসেব করে লেখাপড়ার পাট চুকিয়ে দিয়েছে।

তাতে শ্যামারও বিশেষ কোন আপত্তি দেখা যায় নি। দু-একবার খুব মৃদু গোছের একটা অনুযোগ করে একেবারে চুপ ক’রে গেছেন। ও প্রসঙ্গই আর উত্থাপন করেন নি মনের কোন নিভৃত প্রত্যন্ত দেশে যেন তাঁর একটা আপত্তিই ছিল কোথায়–বলাইয়ের লেখাপড়া শেখা সম্বন্ধে–একটা অতি ঘোর স্বার্থপর আশঙ্কা। লেখাপড়া শেখার অর্থই হ’ল তাঁর কাছে চাকরি পাওয়া, বিবাহ হওয়া–আবার পাখির ডানা গজানো। তার-পরই সে পৃথক হয়ে উড়ে চলে যাবে! এ সবই জানা কথা। একটার পর একটা। ছবিটা মনের মধ্যে পর পর যেন আঁকা হয়ে আছে তার মর্মান্তিক সত্য চেহারায়। পরিষ্কার দেখতে পান তিনি সেগুলো, ভৃগুসংহিতার ফলাফলের মতো। তাই তাঁর অবচেতন মন একান্ত-ভাবে চাইছিল বলাই মূর্খ হয়ে, অপদার্থ হয়ে থাক। জীবন-ধারণের জন্যে যেন সর্বদা তাঁর ওপর নির্ভর করে থাকতে হয় ওকে। কোথাও না পালাতে পারে সে কোনদিন। পাখির পায়ে শিকল দিয়ে রাখলেও কোন দিন সে শিকল কেটে উড়ে পালাতে পারে–কিন্তু যার ডানা কেটে দেওয়া হ’ল বা যার ডানা গজাল না আদবেই–সে কোনদিনই উড়তে পারবে না। এই আশ্বাসটুকুকেই আঁকড়ে ধরে থাকতে চান শ্যামা!

বলাই মূর্খ। বলাই অসামাজিক–শহরে-ধরে-আনা বন্য জন্তুর মতোই অসহায় সে– কিন্তু একেবারে নির্বোধ নয়। সহজাত বুদ্ধি কিছুটা তার আছেই। দিদিমার এই স্বার্থপর চেহারাটা তার কাছে ঢাকা থাকে না, এটুকু সেও বুঝতে পারে যে, তিনি ইচ্ছে ক’রেই ওকে অমানুষ ক’রে রাখছেন।

আর কথাটা যখন ভাবে এক-একবার, তখন একটা ব্যর্থ, প্রতিকারহীন অন্ধ রোষে যেন দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে ওঠে। ভয়ঙ্কর একটা কিছু করে শোধ নিতে ইচ্ছে করে এই অবিচারের। সে সময় ওর মনে হয় এক-একদিন যে–এই বাড়িটায়, তার এই জীবন্তসমাধির জায়গাটায় নিজে হাতে আগুন লাগিয়ে দেয় সে। কঠিনও নয় বিন্দুমাত্র, কোণে কোণে পুঞ্জীভূত হয়ে জমে থাকা, ঘরে দালানে স্তূপীকৃত হয়ে থাকা পাতার রাশিতে একটি মাত্র দেশলাইয়ের কাঠি জ্বেলে দেওয়ার ওয়াস্তা। চোখের নিমেষে বেড়াআগুন জ্বলে উঠবে চারিদিকে। বেশ হয়–ঐ বুড়িটা পুড়ে মরে। আর সে-ও। এ জন্তুর জীবন রেখেই বা লাভ কি, তার চেয়ে তার মা যেমন করেছে–এ জন্মের মতো এ জীবন না হয় নিজেই শেষ ক’রে দেবে সে!

।।২।।

সেদিনকার সে ঝড়ের মধ্যেও এই মনোভাবটাই বোধ হয় প্রকট হয়ে উঠেছিল বলাইয়ের। প্রথম যখন ঝড়টা ওঠে, তখন বোঝা যায় নি একটুও যে, কোন অঘটন বা এমন একটা অস্বাভাবিক কাণ্ড ঘটতে যাচ্ছে। পুজোর সময় বাদ্‌লা তো হয়ই–এই সেই রকম একটা কিছু মনে করেছিল সকলে। সারাদিনটাই মেঘলা মেঘলা, মধ্যে মধ্যে দমকা হাওয়া আর ঝিরঝিরে বৃষ্টি–এই ভাবেই চলছিল, বিকেলের দিকে শুধু হাওয়ার বেগটা একটু বেড়েছিল–এই মাত্র। তবু তখনও ঝড় বলে তাকে বোঝা যায় নি।

সেদিন ষষ্ঠী, শ্যামার উপবাস। নিরম্বু নয়, ষষ্ঠীতে নিরম্বু উপোস করতে নেই পোয়াতীদের–তবে ভাতটাও খেতে নেই। সব ষষ্ঠী শ্যামাদের নেই, কিন্তু ‘দুগ্‌গো ষষ্ঠীটা আছে। যদিও ছেলেদের গাল না দিয়ে জল খান না প্রায় কোনদিনই, ঠাকুর দেবতার কাছে আসছে জন্মে আঁটকুড়ো হয়ে জন্মাবারই প্রার্থনা জানান নিত্য–তবু ষষ্ঠীর উপবাস পালনেও ভুল হয় না কখনও। পাঁচ পয়সার পুজোও পাঠিয়ে দেন সিদ্ধেশ্বরীতলায়। বাড়িতে পুজোর পাট অনেকদিনই উঠিয়ে দিয়েছেন, অত কাণ্ড করে কে, লোক কই তাঁর? সিদ্ধেশ্বরী কালী- ওঁর মধ্যেই সব দেব-দেবীর অধিষ্ঠান, তাই ওখানেই যা কিছু পুজো পাঠিয়ে দেন আজকাল জামাইবাড়ি বিগ্রহ আছে, বারো মাসে তের পার্বন তাদের করতেই হয়–সেখানেও পুজো দেওয়া চলে, কিন্তু জামাইবাড়ি পাঁচ পয়সার পুজো দেওয়া চলে না। সেটুকু চক্ষুলজ্জা এখনও তাঁর যায় নি। সিদ্ধেশ্বরীতলায় অত হিসেব কেউ করবে না, পয়সায় পয়সা মিশে যাবে, ও-ই তাঁর ভাল। হুঁশও থাকে শ্যামার–ঘরে পাজী নেই, কিন্তু আন্দাজে আন্দাজে ষষ্ঠী বা একাদশীর দিনগুলো ঠিক জিজ্ঞাসা করে জেনে নেন পাড়ার জীবন চাটুয্যেকে।

ভাত খেতে নেই–ময়দা খাওয়াই বিধি, কিন্তু মুখে দেবার মতো একটু কিছু থাকলে আর ওসব হাঙ্গামা করেন না। পাকা কলা প্রায়ই থাকে ঘরে, আর নারকোল। নারকোল কুরে তার সঙ্গে তিন-চারটে কলা চটকে খেয়ে নেন। শেষে একটু গুড় গালে দিয়ে জল খান। ফলের পরই জল খেলে চণ্ডালের আহার হয়, তাই একটু মিষ্টি খাওয়া বিধি। কিন্তু সে যাই হোক, এইতেই চলে যায় তাঁর একটা দিন, এইতেই চালিয়ে নেনও সাধারণত। এবারে বড় বিপদে পড়েই অন্য ব্যবস্থা করতে হয়েছে। কলা পাকে নি আজ একমাসের মধ্যে এক কাঁদিও। পাক্ত–র ধরব-ধরব হয়েও ছিল–কিন্তু পুরো দুটি কাঁদি কলা ‘কোন্ হাভাতের ঘরের বেটাবেটিরা’, ‘কোন্ আঁটকুড়োর পুষ্যিপুত্তুররা’ কেটে নিয়ে গেছে চুরি করে। আর যা আছে নিতান্তই ছোট, অপুষ্ট। কেটে চট জড়িয়ে রাখলেও পাকবে না এখন।

অন্য ব্যবস্থা বলতে রুটি-পরোটা নয় অবশ্য। বাজার থেকে ময়দা-আটা আনিয়ে রুটি গড়তে বসার মানুষ নন শ্যামা। অবশ্য তার একটা অজুহাতও আছে, দাঁত সব থাকলেও জখম হয়েছে একটু–রুটি-পরোটা চিবোতে কষ্ট হয়। আরও কারণ আছে, রুটির সঙ্গে তরকারী চাই। এই সব দিনে যা সাধারণ দস্তুর তাঁর, তাই করেছিলেন। বহুকাল পরেই এ- পাট করলেন তিনি–ক্ষুদের সঙ্গে এক গাল ডাল ভিজিয়ে সরু-চাকলি করেছিলেন খানকতক। তা-ই দিদি-নাতিতে দুপুরবেলা খেয়েছিলেন বাড়তি তিন-চারখানা পড়েছিল বলাইয়ের ও-বেলার মতো।

জিনিসটার ঘটা যত না থাক, ল্যাঠা আছে। এক হাতে চাল-ডাল বাটা, গোলা আবার একখানি একখানি করে তোলা–এইতেই খেয়ে উঠতে উঠতে বেলা চারটে বেজে গিয়েছিল। তারপর বাসন মেজে, রান্নাঘর আর দাওয়া নিকিয়ে কাপড় কেচে আসতে আসতেই সন্ধ্যে হয়ে গেল। সারাদিন একটানা খাটুনি আজকাল আর পেরে ওঠেন না– ক্লান্ত হয়ে পড়েন। সন্ধ্যে হলে তো আর যেন বয় না, কেবলই শুয়ে পড়তে ইচ্ছে হয়। শুয়েই পড়েন সাধারণত, তবে ঘরদোর তখন সারা হয় না। বলাইয়ের খাওয়ার সময় একবার লম্প জ্বালাই হয়–সেই সময়ই সেসব সেরে নেন। অবশ্য অন্য দিন ভাতের ব্যবস্থা, রান্না-ঘরেই হাঁড়িতে থাকে–সেখানে গিয়ে ঠাঁই করে বেড়ে দিতে হয়। আজ সেসব কোন পাট নেই, সরুচাকলি চারখানা এক চিলতে কলাপাতার ওপর বাটি চাপা আছে দালানের মধ্যে–যখন হোক বাটি তুলে খেয়ে নিতে পারবে। হাওয়ার গতিক ভাল বোধ হচ্ছে না, ক্রমশ যেন বেড়েই চলেছে ঝিরঝিরে বৃষ্টি তবু হাওয়ার বেগে ছুঁচের মতো বিঁধছে গায়ে এসে। সন্ধ্যা দেবার চেষ্টা কররেন শ্যামা–প্রদীপ জ্বলল না। ঘরে দ্বিতীয় আলোর ব্যবস্থা বলতে অদ্বিতীয় লম্প–সে-ও এ বাতাসে জ্বলবে না। সুতরাং দিনের আলোর শেষ আমেজটা থাকতে থাকতে বাইরের ঘর, রান্নাঘরে তালা দিয়ে সদর দরজা ভেজিয়ে খানকতক ইট সাজিয়ে তা আটকে (খিল নেই বহুকাল) দিয়ে একেবারে নিশ্চিন্ত হয়ে দালানে এসে আশ্রয় নিলেন।

আলো জ্বলে না কোন দিনই, তাতে কোন অসুবিধাও হয় না। শ্যামা শুয়ে পড়েন বটে সকাল সকাল কিন্তু জেগে থাকেন অনেক রাত পর্যন্ত। তিনিই রাজগঞ্জের ভোঁ শুনে শুনে সময় নির্ণয় করেন, যথাসময়ে উঠে খেতে দেন নাতিকে। নিজেরও কিছু খাওয়ার প্রয়োজন থাকলে সেই সময়ই খেয়ে দোর-তাড়া দিয়ে শুয়ে পড়েন। বলাই সন্ধ্যা থেকে–যতক্ষণ না শ্যামা উঠে খেতে দেন–মায়ের মতো দালানের একটা জানলাতে চুপ করে বসে থাকে (শ্যামার ভয় হয় মধ্যে মধ্যে–মায়ের রোগে যাবে না তো শেষ অবধি?)–অন্ধকার-জমাট-হয়ে থাকা কাঁটাল গাছটার পাতার ফাঁকে ফাঁকে জোনাকিগুলো জ্বলে আর নেভে, বসে বসে তাই দেখে। বাইরে নক্ষত্রের একটা আলো থাকে, এ-বাড়ির উঠানে তাও নামে না, সে ক্ষীণ আলো এই অসংখ্য গাছপালা পত্রপল্লবের দুর্ভেদ্য অন্তরাল ভেদ করতে পারে না। তা হোক, তবু দালানের খোলা দোরের কাছটাতে একটু আলোর আভাস পাওয়া যায়, দিদিমার বিছানাটাও আন্দাজে আন্দাজে ঠাওর করতে পারে।

আজ কিন্তু দুজনেরই আলোর কথাটা মনে হ’ল। হাওয়া আর জলের ঝাপ্‌টায় জানলা খুলে রাখা গেল না, দরজাও বন্ধ করতে হ’ল। তার ফলে ভেতরের অন্ধকার ভয়াবহ হয়ে উঠল একেবারে–যেন কে গলা টিপে ধরছে ওদের। আলো নিভিয়েই শুয়ে পড়ে অন্যদিন দরজা বন্ধ করে, তবু জানলাটা খোলা থাকে–আজ সবই বন্ধ। শ্যামার নিজেরই হাঁফ ধরার মতো হ’ল–তিনিই বলতে বাধ্য হলেন, ‘তা না হয় লম্পটাই জ্বাল না বাপু একটু– দোর-জানলা বন্ধ আছে, হাওয়ার ভয় তো নেই।’

কিন্তু লম্পটা জ্বালাতে গিয়ে দেখা গেল তাও আছে। পুরনো বাড়ির জানালা-কপাট কম দামেরই ছিল নিশ্চয়, নিবারণ দাসের সঙ্গতি বেশি ছিল না–একেবারে নিরন্ধ্র চাপা নয়। বেশ একটু-আধটু ফাঁক আছে, কোথাও কোথাও আল্‌ল্গাও হয়ে গেছে কাঠ কিছু কিছু। সেই সব সামান্য সামান্য ফাঁক দিয়েই প্রচুর বাতাস আসছে। সংকীর্ণ পথ দিয়ে প্রবল বেগে বাতাস ঢোকার ফলে একটা শিস্ দেবার মতো শব্দ হচ্ছে অবিরাম। সে হাওয়ায় বদ্ধ ঘরেও লম্পর শিখা স্থির থাকে না নিভে যাওয়ার মতোই অবস্থা হ’তে লাগল বার বার। বেগতিক দেখে শ্যামা নিজেই বেঁকেচুরে উঠে প্রায় হামা দিয়ে এসে তাড়াতাড়ি সেটা জলের কলসীর খাঁজে সরিয়ে দিলেন। কিন্তু তাতে নিভে যাওয়াটা বাঁচলেও, শিখার কেঁপে কেঁপে ওঠাটা নিবারিত হ’ল না। আর তার ফলেই ধোঁয়া বেরোতে লাগল প্রচুর, দেখতে দেখতে বিশ্রী কেরোসিনের গন্ধে ঘর ভরে উঠল। অর্থাৎ নতুন এক উপসর্গের সৃষ্টি হ’ল।

বাইরে বাতাসের শব্দ ক্রমেই বেড়ে উঠছে ওধারে। ক্কড়-ক্কড়কটাৎ–বাঁশবনে শব্দ হচ্ছে। কট্ কট্ শব্দ করে বেঁকে বেঁকে উঠছে বড় বাঁশগুলো। বাঁশে বাঁশে ঠোকাঠুকি হচ্ছে অবিরত। রান্নাঘরের মটকাতে চড় চড় করে টান পড়ছে মধ্যে মধ্যে, সমস্ত চালাটা যেন উঠে পড়ছে খানিকটা ক’রে। আরও বারকতক এমন টান পড়লে উড়েই যাবে হয়ত–পুরনো দড়ি, সে প্রবল আকর্ষণ রুখতে পারবে না। ওদের মিষ্টি-আমড়ার গাছটা বোধ হয় পড়ে গেল পুকুরের মধ্যে অন্তত সেই রকমই একটা বিরাট শব্দ হ’ল। গাছ আরও ভাঙ্গছে বোধহয়–মড় মড় ক’রে বড় বড় ডাল ভেঙ্গে পড়ছে, সে শব্দ এই হাওয়ার শব্দ ভেদ করেও শুনতে পাচ্ছে ওরা। দুম্দাম্ নারকোল পড়ছে, সুপুরি নারকোলের বড় বড় পাতাগুলো বাতাসে ঘুরতে ঘুরতে এসে আছড়ে পড়ছে ওদের দেওয়ালে, ওদের ছাদে–অন্য গাছের ওপরও। ঝড়ই–এবার আর কোন সন্দেহ রইল না। রীতিমতো বিরাট ঝড় একটা। শ্যামার মনে পড়ল সেবারের সেই আশ্বিনের ঝড়ের কথা। অস্পষ্ট হ’লেও মনে আছে সে কথাটা। তেমনি প্রলয় কাণ্ড একটা কিছু হবে না তো? আশ্বিন তো শেষ হয়ে আসতে গেল বাপু, আজই বোধহয় সংক্রান্তি কিম্বা আজ কার্তিক মাসের পয়লা। কে জানে বাপু!…

দূরে বোধহয় কার টিনের চালা উড়ে গেল একটা–বিকট ঝনঝন শব্দ হ’তে লাগল কিছুক্ষণ ধরে–গাছে গাছে বা বিভিন্ন বাড়ির দেওয়ালে দেওয়ালে রেধে! গাছও ভেঙ্গে পড়ছে মধ্যে মধ্যে–সে শব্দ ওদের পরিচিত, এখান থেকে ওই ঘরের মধ্যে বসেই বলে দিতে পারে কত বড় গাছ পড়ল। ইস্–সদর দরজাটাও থাকবে না বোধহয়–শুয়ে শুয়েই বিলাপ করতে লাগলেন শ্যামা–সামান্য দশ-বারোখানা ইট এ চাপ আর কতক্ষণ সহ্য করতে পারবে?…

ভেতরে কেরোসিনের ধোঁয়া অসহ্য হয়ে উঠছে। ভুষোগুলো বাতাসে উড়ছে ঘরের মধ্যেই–বলাইয়ের মুখে মাথায় এসে পড়ল কতকগুলো। অবশেষে এক সময় ‘দুত্তোর’ বলে একটা অস্ফুট শব্দ করে দালানের দরজাটা খুলে ফেলল বলাই। দমকা হাওয়ার সঙ্গে জলের ছাট ঢুকে দালানের অনেকখানি পর্যন্ত ভিজিয়ে দিয়ে গেল, আর সঙ্গে সঙ্গে আলোটাও গেল দপ্ ক’রে নিভে।

‘ওকি, ওকি অ মুখপোড়া–আবার দরজা খুললি কেন, যথাসর্বস্ব যে ভিজে গেল–ও আবার কি ঢং? বাগানে যাবি নাকি এত রাত্তিরে আবার? পেট ব্যথা করছে?’

শ্যামা ব্যস্ত হয়ে উঠলেন। তবে তখনই উঠতে পারলেন না। আজকাল এক বার শুলে ওঠা বড় কষ্টকর তাঁর পক্ষে। বেশ একটু সময় লাগে। শ্যামা শুয়েই পুনশ্চ প্রশ্ন করলেন, কী রে–সঙ্গে যাব? দাঁড়াতে হবে?’

বলাই কোন উত্তরই দিল না। সাবধানে একটা কপাট ভেজিয়ে দিয়ে চেপে ধরে রইল সেটা। দাঁড়িয়ে ভিজতে লাগল সামনে।

বাইরে তখন প্রকৃতির একটা বিরাট পাগলামি শুরু হয়ে গেছে। ঝড়ের বেগ যথেষ্ট এমনিতেই, তার মধ্যেই আবার বোঁ-ও-ও ক’রে যেন ক্রুদ্ধ গর্জন করে উঠছে এক একবার সে সময়ে দোর-জানালাগুলো ঝনঝন ক’রে কেঁপে উঠছে। ভাগ্যে অভয়পদ সব জানলাতে দরজায় লোহার আল্লারাপ ছিট্‌কিনি লাগিয়ে দিয়ে গেছে, আগেকার জরাকীর্ণ কাঠের ছিটকিনি থাকলে দোর-জানালা বন্ধ রাখা যেত না।

রান্নাঘরের চালাটার অবস্থাই খুব খারাপ–ক্ষ্যাপা হাওয়ার দমকা আঘাতে ফুলে ফুলে উঠছে, বেশ খানিকটা ওপরে উঠে যাচ্ছে এক-একবার। মনে হচ্ছে এখনই মটকার বাঁধন ছিঁড়ে উড়ে যাবে চালাটা। অথচ ঠিক ছিঁড়ছেও না, শেষ পর্যন্ত শুধু ওর সেই সহস্র বাড়ির পাকে পাকে প্রবল টান পড়ায় চালাটা যেন ঝাঁকিয়ে আর্তনাদ ক’রে উঠছে সেই সময়টায়।

..দূরে কাদের কোলাহল শোনা যাচ্ছে–বুঝি চেঁচিয়ে কাঁদছে কারা–অবশ্য এই বাতাসের তাণ্ডবে কান্নার মতো শব্দ তো চারিদিকেই–তবু মনে হচ্ছে বাউরীদের নাড়ি থেকে কান্নার আওয়াজ উঠছে একটা। ওদের টিনের চালা–উড়ে গেছে সম্ভবত, কিম্বা ঘরই ভেঙ্গে পড়েছে সবসুদ্ধ। গাছ-পালা তো বোধহয় কারও বাগানে থাকল না–প্রায়ই মড়-মড়-মড়াৎ শব্দ উঠছে, বড় বড় গাছ ভেঙ্গে পড়ছে কোথাও না কোথাও। এই বোধহয় প্রলয়–বলাই মনে মনে বলল। এবার শ্যামা উঠে এলেন বেঁকে চুরে কোমরটা সামলে সোজা হয়ে দাঁড়ালেন ওর পেছনে, ‘বলি কী হচ্ছে কি, ঘরে যে নদী নালা বয়ে গেল। এমন করে দাঁড়িয়ে ভিজছিস কেন?’

বলাই যেন এতক্ষণে একটু নড়ে চড়ে উঠল আবার। বলল ‘তুমি দোর দাও দিদিমা, আমি বাইরে থাকি, ডাকলে দোর খুলে দিও।

‘আ মর, বাইরে থাকবি কি, চারদিকে পাতা উড়ছে বড় বড়, গাছের ডাল ভেঙ্গে এসে পড়েছে, শেষে কি একটা খুন-খারাপি কাণ্ড হবে?’

‘তা হোক। তুমি দোর দাও। আমি রান্নাঘরের দাওয়ায় গিয়ে বসছি।’

বলতে বলতেই তরতরিয়ে উঠোনে নেমে গেল সে। যেতে গিয়ে সেই জলকাদার ওপর হুমড়ি খেয়ে পড়লও একবার–’মাগো!’ বলে অস্ফুট শব্দও ক’রে উঠল ভয়ে, কারণ মনে হ’ল কী যেন একটা বিরাট পত্রপল্লবের স্তূপের মধ্যে জড়িয়ে গেল সে। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গেই বিদ্যুৎ চমকে উঠতে আশ্বস্ত হ’ল। কাদের একটা প্রকাণ্ড পেঁপে গাছ–ফুল-ফল সুদ্ধ উড়ে এসে পড়েছে তাদের উঠোনে। তাদের নয়, তাদের এতবড় পেঁপে গাছ নেই। হয়ত মল্লিকদের বাড়ি কিম্বা চাটুয্যেদের বাড়ি থেকে উপড়ে চলে এসেছে ঝড়ের টানে।

শ্যামা নিরুপায় হয়ে দরজা বন্ধ ক’রে দিলেন। তাঁর এ বয়সে এসব দস্যিপানা সয় না। ভিজে জ্বর হয় ও-ই জব্দ হবে, টাঙিয়ে রেখে দেবেন তিনি, একগাল মুড়ি খাইয়ে। আদর সোহাগ ক’রে ডাক্তারও ডাকবেন না, কিম্বা সাগু-বার্লি-মিশ্ৰি এনে তোয়াজ করে খাওয়াতে বসবেন না। পাগল, ছোঁড়াটাও পাগল হয়ে গেছে। মায়ের রোগে গেছে একেবারে।

দরজা বন্ধ ক’রে অন্ধকারেই হাতড়ে হাতড়ে এসে আবার শুয়ে পড়লেন। যা হবার হোক গে, তাঁর মাথায় ছাদটা না ভেঙ্গে পড়লেই হ’ল।…

বলাইও পেঁপে গাছ থেকে মুক্তি পেয়ে দুটো বড় বড় নারকোল পাতায় হোঁচট খেয়ে দাওয়ায় এসে উঠল। চালটার গতিক ভাল নয়, মনে মনে হিসাব করতে বসল বলাই, বছর চারেক আগে বড় মামা শেষ চাল বাঁধিয়েছিলেন দাঁড়িয়ে থেকে–সে দড়ি কি এতদিনে পচে যায় নি?…তা যাক গে, চালাটা উড়ে গেলেও দেওয়াল চাপা পড়বে না। পাকা দেওয়াল। তবে তার ভয় করতে লাগল অন্য কারণে। সদর দরজায় কে যেন দুম দুম করে লাথি মারছে। বেশ জোরেই মারছে, ঝন-ঝন ক’রে উঠছে কপাট দুটো। ঘর থেকে শোনা যায় নি এতক্ষণ, এখানে এসে বেশ স্পষ্ট শুনছে। কে এল এই রাত্রে–এই দুর্যোগের মধ্যে? ডাকাত নয় তো? তার দিদিমার ধন-অপবাদ বেশ ভালো রকমই আছে, ডাকাতি করতে হ’লে এই প্রকৃষ্ট অবসর–আজ একটি প্রাণীও বেরোবে না ঘর থেকে, ওদের খুন ক’রে মেরে রেখে গেলেও না। শুনতেই পাবে না কেউ তাদের চিৎকার

আড়ষ্ট কাঠ হয়ে বসে রইল বলাই। ওদিকে লাথি মেরেই যাচ্ছে তারা। এখনই হয়ত কপাটটা ভেঙ্গে পড়বে, বেশ বুঝতে পারছে বলাই। তারপর–

কিন্তু কপাটটা ভাঙ্গল না অনেকক্ষণ অবধি। লাথি চলতেই লাগল সমানে। ক্রমে বলাইও বুঝতে পারল ব্যাপারটা। লাথি কেউই মারছে না, ওটাও হাওয়ার কীর্তি। হাওয়াতেই ঝন-ঝন ক’রে উঠছে দরজাটা। একটু আশ্বস্ত হ’ল সে। আবার নিশ্চিন্ত হয়ে আকাশের দিকে তাকাল।

আকাশ-ভরা মেঘ কিন্তু তারই মধ্যে কেমন যেন একটা অনৈসর্গিক আলো ফুটে উঠেছে দিক্‌চক্ররেখায়। সে আলো মনে কোন অভয়ের বার্তা আনে না, আতঙ্ক জাগায়। এখান থেকে আকাশটা এতখানি দেখা যায় না অন্য দিন, আজ গাছ-পালা বিস্তর ফাঁক হয়ে যাওয়ায় এতটা পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে। গাছপালা পড়েই যাচ্ছে বিপুল শব্দ ক’রে। ছোটখাটো গাছ অথবা বড় গাছের ডাল মাটির দিক থেকে বাতাসের টানে শূন্যে উঠে যাচ্ছে, শূন্যেই পাক খাচ্ছে ঘূর্ণি হাওয়ায়, পড়ব পড়ব ক’রেও আবার দূরে সরে যাচ্ছে। কোথায় গিয়ে পড়ছে কে জানে, কোথাও পড়বে কিনা আদৌ তাই বা কে জানে! একটা-দুটো বহুক্ষণ ঘুরে–যেন ক্লান্ত হয়েই–ওদের উঠোনে বা ছাদে এসে আছড়ে পড়ছে, আবার চলেও যাচ্ছে হয়ত খানিক পরে। মধ্যে মধ্যে বিদ্যুৎ-চমকের সময় বড় বড় গাছের ডালগুলোকে ঘুরপাক খেতে দেখলে যেন কেমন ক’রে ওঠে মনের মধ্যে।

ঝড় বেড়েই চলল রাত্রি বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে। প্রকৃতি সত্যিই যেন ক্ষেপে গিয়েছে। বহু হাজার পাগলা হাতি যেন ছেড়ে দিয়েছে কে আকাশে। এমন দাপাদাপি বলাই জীবনে কখনও দেখে নি বা শোনে নি। ঝড় জল বর্ষাকালে হয়ই, কিন্তু সে ঝড় যে এমন প্রলয়ঙ্কর হ’তে পারে–তার সামনে মানুষের সমস্ত শক্তিকে এত তুচ্ছ এত অকিঞ্চিৎকর মনে হয়–সে অভিজ্ঞতা ওর ছিল না। কেউ ওকে বলে দেয় নি, বললেও এ জিনিস ধারণা করা সম্ভব নয়।

জলে ভিজে ভিজে শীত করতে লাগল বলাইয়ের, দাঁতে দাঁতে লেগে কাঁপুনি শুরু হ’ল–তবু সে ভেতরে গেল না বা দিদিমাকে দোর খুলে দিতে বলল না। বরং কেমন যেন একটু অদ্ভূত আনন্দ বোধ করতে লাগল সে এই কষ্টের মধ্য থেকেই। পিশাচের মতো এই ধ্বংসলীলা দু চোখ, দুই কান ভরে পান করতে লাগল যেন। যত গাছপালা ভাঙ্গে, যত দূরে পাড়ায় পাড়ায় চালা উড়ে যাবার বা বাড়ি ভেঙ্গে পড়ার শব্দ হয়, ততই যেন আনন্দ বাড়ে তার। হি-হি ক’রে হাসে সে কাঁপতে কাঁপতেই। আর আপন মনে বলে, ‘মর, মর, সবাই মর। সবাই মিলে সপুরী এক গাড়ে যা। কাল সকালে কেউ না বেঁচে থাকে আর। পড়ুক না, সব বাড়িগুলো ভেঙ্গে পড়ুক–ত’হলে আমি হরির নোট দিই–সব যাক। সব যাক্!’

.

পরের দিন সকালেও সে ঝড় থামল না। ঝড়ও না, জলও না। ঘর থেকে বেরোতেই পারে না কেউ। বারোয়ারীতলার ঠাকুর নাকি গলে গেছে জল পড়ে পড়ে, মহাদেবের মা ভিজতে ভিজতে এসে খবর দিয়ে গেল, ‘এমন অলুক্ষুণে কাণ্ড জন্মে দেখি নি মা, কাচ্চা- বাচ্চাগুলোকে বাঁচাব কেমন ক’রে তাই ভেবে পেটের মধ্যে হাত-পা সেঁধিয়ে যাচ্ছে।…তা এই কি তা’হলে কলিযুগের শেষ হ’ল–হেই বামুন মা?’

সে তথ্য শ্যামাও যোগাতে পারেন না। সকালে উঠে বাগানের চেহারা দেখে তাঁর চোখে জল এসে গেছে। ফলন্ত গাছ সব–কোথায় যেন কী লণ্ডভণ্ড হয়ে গেছে। কার একটা নারকেল গাছের মাথা এসে পড়েছে তাঁর পুকুরের জলে, তাঁরও একটা নারকেল গাছ পড়ে গেছে। লোকসান যা হবার তা তো হয়েছেই–এখন এই জঞ্জাল তিনি মুক্ত করাবেন কাকে দিয়ে–কত দিনে? পয়সা খরচ ক’রে লোক লাগাতে হবে নাকি শেষ পর্যন্ত? এসব যে তাঁরা দিদি-নাতিতে পারবেন বলে মনে হয় না!…

রাত্রে জেগে থাকব মনে ক’রেও ঘুমিয়ে পড়েছিলেন শ্যামা। শেষরাত্রে হঠাৎ চমক ভেঙ্গে গাঢ় অন্ধকারে ভয় পেয়ে চেঁচিয়ে উঠেছিলেন একবার, কারণ তখনও সে গর্জন সমানে চলছে বাইরে, দাপাদাপি গর্জনের কিছুমাত্র বিরাম নেই।…তার পর একটু সামলে নিয়ে ব্যাপারটা মনে করবার চেষ্টা করতেই মনে পড়ে গেল বলাইয়ের কথা। তাড়াতাড়ি দরজা খুলে অল্প অস্পষ্ট ভোরাই আলোতে দেখলেন সে তখনও দাওয়ায় বসে বসে ভিজছে আর ঠক্ ঠক্ ক’রে কাঁপছে। অগত্যা শ্যামাকেও ভিজে ভিজে নেমে আসতে হয়েছিল, তিনিও হুমড়ি খেয়ে পড়েছিলেন একবার পেঁপে গাছটায়–তবে তাঁর খুব লাগে নি–উঠে বলাইয়ের কনুইটা ধরে টানতে টানতে ভেতরে নিয়ে এসেছিলেন।

‘আপদ বালাই! সাত জন্মের আপদ বালাই সব! যত রাজ্যের আপদ-বালাইরা আমার কাছে মরতে আসে একধার থেকে। আর কোথাও তো যেতে পারে না, আর কোন চুলো মনে পড়ে না তো! যেন সার বেঁধে বসে থাকে সব আমাকে জ্বালাবে-পোড়াবে বলে।’

বকতে বকতে ওর কাপড় ছাড়িয়ে গা মুছিয়ে বিছানায় শুইয়ে দিয়েছিলেন কাঁথা চাপা দিয়ে। বলাইও কোন প্রতিবাদ করে নি, কাঁপতে কাঁপতে তখন রীতিমতোই কষ্ট হচ্ছিল তার, বিছানার উষ্ণতার মধ্যে আসতে পেয়ে বেঁচে গেল সে।

সেই থেকেই সে ঘুমোচ্ছে। কত বেলা হচ্ছে তা শ্যামা ঠাওর পাচ্ছেন না। রাজগঞ্জের ভোঁ-ও বোধহয় বন্ধ আছে–কিম্বা এই আওয়াজে শুনতে পাচ্ছেন না।…

শ্যামা আর এর ভেতরে ঘর-দোর মোছা বাসি-পাটের চেষ্টা করলেন না। অবিরাম আবর্জনা বাড়ছে, কত করবেন তিনি? ঘরের বাইরেই বেরনো যাচ্ছে না, ভিজে ভিজে এসব করতে পারবেন না।

আজ সপ্তমী পুজো-আটটা-নটার মধ্যে দুটি ভাত ফুটিয়ে খেলে খাওয়া যেত–বলির হাঁড়িতে খেতে নেই, তা বলি কি ভোরবেলা হয়? ওসব মানেন না শ্যামা, সকাল ক’রে দুটো খেয়ে নিলেই হ’ল, তাতে বলির হাঁড়ির দোষ হবে কেন!–তা আজ আর সে ব্যবস্থা করা গেল না। কত বেলা তা-ই ঠাওর হচ্ছে না। মনে পড়ল বাসি সরুচাকলি ক’খানা পাতাতে বাটি-ঢাকা পড়ে আছে, বলাই খায় নি–হয়ত এলিয়ে নাল কেটে গেছে একটু একটু–তা হোক্, ঐগুলোই তিনি খাবেন’খন বলাইকে এক গাল ডাল-ভাতে দিয়ে দুটো ভাত খাইয়ে দেবেন, যখন হোক। বলাই উঠুক। রান্নাঘরের মধ্যেই পাতার জালে তিজেলটা ক’রে ভাত চাপিয়ে দেবেন তখন।

শ্যামাও স্তব্ধ হয়ে বসে বসে প্রকৃতির এই অভাবনীয় তাণ্ডব দেখতে লাগলেন।

.

সেদিন সন্ধ্যার দিক থেকেই একটু-একটু করে কমে এল ঝড়-জলের দাপট। পুরো দুদিন ধরে অশোভন মাতামাতি করার পর যেন শ্রান্ত হয়ে পড়লেন প্রকৃতি। অষ্টমীর দিন ভোর থেকে নিস্তব্ধ শান্ত হয়ে গেল চারিদিক। একটু একটু ক’রে পৃথিবী আবার তার স্বাভাবিক জীবন-স্পন্দন খুঁজতে শুরু করল, থেমে-যাওয়া নিঃশ্বাসটা ভরসা ক’রে টানতে আরম্ভ করল আবার।

কিন্তু এ স্তব্ধতা শ্মশানের স্তব্ধতা। যতদূর দৃষ্টি যায়, ক্ষতিই চোখে পড়ে শুধু। যা কিছু শোনা যায়–শুধু মানুষের সর্বনাশের বিবরণ। বিশেষত গরিব মানুষের। তাদের ঘর গেছে, বাড়ি গেছে, গরু গেছে, ছাগল গেছে, ধান গেছে, চাল গেছে–প্রাণও গেছে বহু জায়গায়। মা এবার এসেছেন যেন শ্মশানবাসিনী ভৈরবীর বেশে, পুত্র-কন্যা নয়–ডাকিনী-যোগিনীদের সহচরী ক’রে। তাদেরই তাথিয়া তাথিয়া নাচে পৃথিবী টলমল করেছে দুদিন, প্রলয়ের আভাস ঘনিয়ে এসেছে তার বুকে। আজ তারা বিদায় নিয়েছে কিন্তু শ্মশানই করে রেখে গেছে চারিদিক।…

তবু তখনও সর্বনাশের পরিমাণটা পুরো জানা যায় নি। কারণ জানার উপায় ছিল না। খবর পাওয়া গেল কদিন পরে। সত্যি-সত্যিই সর্বনাশ হয়ে গেছে মোদিনীপুরে। সেই চীনাসাগরের হারিকেন বা টাইফুন যেন পথ ভুলে এসে হাজির হয়েছিল বঙ্গোপসাগরের কালো জলে। সে তার চিহ্ন রেখে গেছে মৃত্যুতে আর ধ্বংসেতে। সমুদ্র থেকে পর্বতপ্রমাণ ঢেউ উঠে বড় বড় দোতলা তেতলা বাড়ি ডুবিয়ে ভাসিয়ে দিয়ে গেছে, সে ভয়ঙ্কর দৃশ্যের আতঙ্কে মূর্ছাতুর হয়ে পড়েছে অধিকাংশ প্রাণী, প্রাণরক্ষার চেষ্টা করতে হাত-পা ওঠে নি তাদের। এ-রকম যে হয় তাই কারও জানা ছিল না, স্মরণকালের মধ্যে এরকম মূর্তি সাগর- জলের তারা দেখে নি। সাইক্লোন তারা জানে, ঝড় এর আগেও বড় বড় হয়ে গেছে, কিন্তু এর চেহারা একেবারে আলাদা, এ একেবারে ভিন্ন জাতের। সাগরের জল বহুদূর পর্যন্ত জনপদের মধ্যে চলে এসেছে, সচল পর্বতের মতো ঢেউ এসে ডুবিয়ে ভাসিয়ে দিয়েছে তাদের। জল যখন সরে গেছে তখন শুধু সার সার শবদেহই নজরে পড়েছে। জীবিত প্রাণী বিশেষ নয়। কত দেহ ভেসে গেছে তাও কেউ জানে না, কত দেহ পাঁক-কাদা ঘেঁটে বার করতে হয়েছে। এরকম সাংঘাতিক ধ্বংসলীলা এ জেলার লোক কেউ কখনও দেখে নি। মহাপ্রলয়ের স্বাদ পেলে তারা এই ক’ঘণ্টায়।

তাও, সর্বনাশের পূর্ণ পরিমাণটা একেবারেই জানা যায় নি। কারণ বলবার মতো বিশেষ কেউ ছিল না। যারা বেঁচে ছিল, তাদেরও সংবাদ পাঠানোর মতো অবস্থা ছিল না। স্তম্ভিত হয়ে গিয়েছিল তারা। তাছাড়া সংবাদ আসার পথও রুদ্ধ। টেলিগ্রাম টেলিফোন কিছুই নেই–খুঁটিগুলোরও চিহ্ন নেই কোথাও কোথাও।

বৃটিশ সরকার বহুদিন ধরে সুযোগ খুঁজছিলেন মেদিনীপুরকে জব্দ করবার–এই সুযোগে তাঁরা মানুষের যাতায়াতও বন্ধ ক’রে দিলেন। বিনা হুকুমে বাইরের কেউ ঢুকতে পারবে না সেখানে–সেবাব্রতীরাও কেউ নয়।

দুঃখিত হ’ল সবাই। শিউরে উঠল ভগবানের এই নির্মম মার প্রত্যক্ষ ক’রে–শুধু শ্যামা শুনে বললেন, ‘বেশ হয়েছে, খুব হয়েছে! কেন–ইরেজের সঙ্গে লড়াই করার তো অত সাধ, কর্ এখন লড়াই। দেখলি তো, ভগবান সুদ্ধু ওদের দিকে। চালাকি করতে গিছলি, দিলে ঠাণ্ডা ক’রে। এখন থাকো কাঁকরমাটি চিবিয়ে–যেমনকে তেমনি!

তিনি যেন একটা ব্যক্তিগত বিজয়গর্ব অনুভব করেন।–তাঁরই স্বদেশবাসী, স্ব- ভাষাভাষী কতকগুলি মানুষের মর্মান্তিক এই দুর্দশায়।

।।৩।।

কিন্তু সেই অবস্থাটা যে একদিন তাঁর দোরেও এসে উপস্থিত হ’তে পারে তা একবারও ভাবেন নি শ্যামা। চালের দাম উত্তরোত্তর বাড়ছে দেখেও অতটা ধরতে পারেন নি। অবশ্য সে খবরও তিনি তেমনভাবে পান নি। কিছু চাল কেনা ছিল ঘরে–বহুদিনের মধ্যে কেনবার দরকারও হয় নি। যা ভাসা-ভাসা খবর পেয়েছেন পাড়া-ঘরে অধমর্ণদের কাছে, সেটা তত মাথাতে যায় নি।

চাল তেল আর নুন, এই লাগে তাঁর উনোর মধ্যে। আর তার সঙ্গে সামান্য কিছু হলুদ। লঙ্কা তাঁর উঠোনেই ঢের হয়। অন্য মশলা–ধনে জিরেমরিচ আজকাল কমিয়ে দিয়েছেন একেবারে, একবার এক-এক ছটাক ক’রে আনিয়ে রাখলে তাঁর ছ’মাস চলে যায়। ফোড়নও ব্যবহার করেন না বিশেষ, বলেন, ‘যেটুকু তেল খরচ করব তা যদি ঐ লঙ্কা পাঁচফোড়ন কি তেজপাতা চোঁয়াতেই চলে গেল তো ব্যান্ননে রইল কী? আমরা তো বড়লোকদের মতো পলাপলা তেল ঢালতে পারি না, আমাদের অত ফোড়নের শখ করেও দরকার নেই। ফোড়ন তো গন্ধ করার জন্যে, বলি ওর তো কোন স্বদ নেই গা–মিছিমিছি গুচ্ছের পয়সা নষ্ট ক’রে লাভ কি?’

সুতরাং দোকানে যাবার দরকার হয় আজকাল তিন মাসে একদিন। কিম্বা আরও বেশিদিন পরে। নিজেই যান অবশ্য। বলাই কোথাও বেরোতে চায় না। তিনি বলেনও না। দোকানে যেতে গেলেও নাকি ফুলবাবু সেজে বেরোতে হবে। এই তো নাকের ডগায় দোকান। সেখানেও কি একটু ছেঁড়াখোঁড়া কাপড় পরে যাওয়া যায় না? না যায় না যাক। দরকার নেই গিয়ে। এখনও তো ভগবান শ্যামাকে ‘অক্ষ্যাম’ করেন নি একেবারে। একবার গুটি গুটি গিয়ে দোকানিকে বলে আসা! এই তো! সে তিনি খুব পারেন। একেবারে এক বস্তা ক’রে চাল নেন তিনি, তাতে নাকি কিছু ওয়ারা হয়। কিছু ঢল্লাও বাদ পান। দোকানিরা নাকি বস্তা পিছু পাঁচ পো ঢতা বাদ পায়–তিনি তাদের কাছ থেকে এক সের আদায় করেন। এই চাল–আর সেই সঙ্গে পাঁচ পো তেল, আড়াই সের নুন, পাঁচ ছটাক হলুদ। এইতেই তাঁর দু’তিন মাস চলে যায় আজ-কাল। চাল তখনও থাকে, কাজেই শুধু তেল আর নুন আর হলুদ–মাঝে একবার নিয়ে যেতে হয়। তার সঙ্গে দুটি পাঁচফোড়ন আর দুখানা তেজপাতা চেয়ে নেন দোকানীর কাছ থেকে। কোনদিন কিছু একটা ভাল ক’রে রাঁধতে হ’লে কাজে লাগে।

চাল ঘরে ছিল অনেক দিনের মতো–দু’জনে কতই বা খান–তাই চালের দাম বাড়ছে শুনেও অত গা করেন নি। একেবারে বাড়ন্ত হ’তে যখন গিয়ে শুনলেন চাল পঁচিশ টাকায় উঠেছে ইতিমধ্যে–তখন একেবারে চোখে অন্ধকার দেখলেন। প্রথমটায় বিশ্বাস হয় নি কথাটা। তামাশা মনে ক’রে দোকানিকে দুটো মিষ্টি গালি-গালাজও করেছিলেন (দিদি-নাতি সম্পর্ক পাতানো তার সঙ্গে) কিন্তু শেষে যখন দেখলেন তা নয়, তখন তাঁর মুখ শুকিয়ে উঠল। তখনকার মতো আড়াই সের চাল নিয়ে চলে এলেন। বলরাম বলল, ‘এই বেলা নিয়ে যান দিদিমা–এর পর আরও চড়বে। আমার তো ঠাওর হয় আর পাবেনই না, গোটা দেশের লোককে উপোস ক’রে শুকিয়ে মরতে হবে!’

কিন্তু তা আনেন নি শ্যামা। একেবারে অতটা উঠতে পারেন নি। ভরসায় কুলোয় নি। তাছাড়া তিনি ভেবেছিলেন, এটা একটা সাময়িক ব্যাপার, সে যুদ্ধেও বেড়েছিল কিন্তু এত বাড়ে নি। এতটা বাড়া স্বাভাবিক নয়। সরকার যা হোক একটা ব্যবস্থা করবে।…

তিনি খাওয়াটাই কমিয়ে দিলেন। নিজে নিয়ম-রক্ষার মতো এক গাল ভাত খেতে শুরু করলেন। বাকিটা বাগানের ডুমুর কাঁচকলা থোড় পেঁপে খেয়ে পেট ভরাতে লাগলেন। বলাইকে পুরোপেটা ভাতই দেন, তবে সেও এক-বেলা। বিকেলটা তার জন্যে ঐ শাক- আনাজ সেদ্ধ ব্যবস্থা। বলেন, ‘কী করবি মুখপোড়া, যেমন বরাত ক’রে এসেছিস তেমনি তো হবে। বরাত খারাপ না হ’লে এমন হবে কেন?’

তাই কি বাগানের ফসলই শান্তিতে ভোগ করতে পারেন। অভাব দুর্দশা শুধু তাঁরই নয়–আরও অনেকের। তাঁর তো তবু সঙ্গতি আছে কিছু–বেশির ভাগই থালা বাসন বেচতে শুরু করেছে। সুতরাং ফল ফুলুরি আনাজ সব চুরি যেতে শুরু হ’ল। চোর সামলাবার মতো ব্যবস্থা কিছু নেই। বেড়া কি পগারে গরু আটকায়–তার বেশি কাউকে ঠেকাবার শক্তি নেই। শ্যামা শেষ পর্যন্ত নিজেই পাহারা দিতে শুরু করলেন রাত্রে। ঘুমই বন্ধ হয়ে গেল তাঁর প্রায়। নিঃশব্দে প্রেতিনীতির মতো অন্ধকারে ঘুরে বেড়ান–একগাছা বাঁশের লাঠি হাতে ক’রে। সামান্য কোন শব্দ পেলেই–অনেক সময় দেখা যায় তা বাতাসে পাতা নড়ার শব্দ ছাড়া কিছু নয়–তিনি চিৎকার ক’রে গালাগাল দিতে দিতে তেড়ে যান। লাঠি ঠোকেন ঘন ঘন। যেদিক থেকে শব্দ আসছে ঠাওর ক’রে সেই দিকেই ছুটে যান। অবশ্য তাতে কাজও হয়–চোর, যারা চুরি করতে আসে অনেক সময়ই তাদের সে চেষ্টা ত্যাগ ক’রে পালাতে হয়।

শ্যামা সেদিন দোকান থেকে এসে হেমকে একটা চিঠিও লিখেছিলেন। বাজারের এই অবস্থা, কিছু টাকা না বাড়ালে চলছে না। তার উত্তরে হেম কিছু রূঢ় সত্য কথা লিখে পাঠাল। সে মাইনে পায় মাত্র তিয়াত্তরটি টাকা। তা থেকে ফান্ডে কেটে নেয়, মাকে পাঠায় কুড়ি টাকা। বাকি যা থাকে তাতে এতগুলি প্রাণীর ভরণপোষণ করা সস্তার দেশে ও দুঃসাধ্য। দাম সেখানেও বাড়ছে। ভাত তো কবেই ছেড়ে দিয়েছে ওরা, দুবেলা রুটি খায়। তাও বোধহয় দুদিন পরে মিলবে না। রেল কোম্পানি যদি ওদের জন্যে বিশেষ কোন ব্যবস্থা না করে তো শুকিয়ে মরতে হবে। হেম আগে পুরো সংসারের জন্য যে টাকা দিত এখনও তাই দেয়, হয়ত আর বেশি দিন তা দিতে পারবে না। শ্যামার হাতে যা আছে–যা তিনি তেজারতিতে খাটান–এখন কিছু দিন তাই ভাঙ্গিয়েই খান তিনি!…

আর যা-ই হোক, এতটা স্পষ্টভাষণের জন্য প্রস্তুত ছিলেন না শ্যামা। তাঁর খুব ভরসা ছিল অন্তত গোটা-চার পাঁচ টাকা হেম বাড়িয়ে দেৰেই। তিনি আরও একবার চোখে অন্ধকার দেখলেন।

এবার অগত্যাই পঁচিশটি টাকা হাতে ক’রে চাল কিনতে গেলেন আবার। কিন্তু দেখলেন ততক্ষণে–এই ক’দিনের মধ্যেই সে চাল ছত্রিশ টাকায় পৌঁচেছে।…সুতরাং এবারও কেনা হ’ল না চাল। ছত্রিশ টাকা দরের চাল তিনি কিনে খেতে পারবেন না। সে ভাত তাঁর গলা দিয়ে নামবে না। তিনি নাতির মতো আড়াই সের চাল কিনে সেবারের মতোই, বসে বসে– বুকে ক’রে বয়ে নিয়ে বাড়ি ফিরলেন তার বেশি কিনতে যেন সাহস হ’ল না তাঁর। অথচ এও থাকবে না–বলরাম বার বার সাবধান ক’রে দিল, একেবারেই লোপাট হয়ে যাবে চাল বাজার থেকে–তা শ্যামাও বুঝলেন। বলরামের কথাটা আর অবিশ্বাস্য বলে মনে হল না তাঁর। তবু ছত্রিশ টাকায় এক মণ চাল কেনা তাঁর পক্ষে সম্ভব নয়।

তাঁর পক্ষে যা সম্ভব তাই করলেন। নিজে একেবারেই ছেড়ে দিলেন ভাত। শাক কচু আনাজ সেদ্ধ ধরলেন। বলাইকেও এক গাল ক’রে ভাত দিতে লাগলেন–নইলে হয়ত তার পেট ছাড়বে এই ভয়ে। অত দুটিখানি ভাত রাঁধতে অসুবিধা হয় বলে একদিন ফুটিয়ে পরের দিনের জন্যে জল দিয়ে রাখতে লাগলেন। নিতান্তই সে পাখির মতো এত কটি– সত্যিই হাতের একগালে ধরবার মতো। বাকিটা ডুমুর আছে, শুষনি শাক আছে। একটা কুমড়ো হয়েছিল–তাতে তিন চার দিন চলে গেল, সেজন্যে ভাবনা নেই তাঁর। নাতিকে বলেন প্রায়ই, ‘এমন এক আধ দিন নয়–বুঝলি, গুপ্তিপাড়ায় মাসের পর মাস আমরা এই শাক আনাজ সেদ্ধ খেয়ে কাটিয়েছি। তোর দাদামশাই কোন্ এক যজমানের দু’মহল বাড়িতে তুলে দিয়ে ডুব মারল, তিনটে মেয়েছেলে আমরা–সঙ্গে একটা বাচ্ছা–একটা পয়সা নেই হাতে। সে যে কী দিন গিয়েছে! এখন তো তবু বয়স হয়েছে, অনেক শক্ত হয়েছি, তিনটে বেটাছেলের কাজ একা করতে পারি। তখন কিছুই জানতুম না ছেলেমানুষ–তবু দিন কেটে তো গেছে, বেঁচেও তো আছি!

বলতে বলতেই বোধ হয় মনে পড়ে খাওয়া-দাওয়ার ঐ অনিয়মেই তাঁর শাশুড়ীর শরীর একেবারে ভেঙ্গে গিয়েছিল। সেই যে পেট ছাড়ল, আর সামলাতে পারলেন না কিছুতেই। অবশ্য বুড়ো মানুষ বলেই। কিন্তু, তিনিও বুড়ো হয়েছেন এখন। সে সময় শাশুড়ীর যা বয়স ছিল, তার চেয়ে তাঁর বয়স এখন অনেক বেশি। তিনিই কি পারবেন সামলাতে?…স্তব্ধ হয়ে যান শ্যামা–কথাটার মাঝখানেই। কেমন যেন আতঙ্ক বোধ হয় তাঁর।…আবার একটু পরেই জোর ক’রে উড়িয়ে দেন চিন্তাটা। শাশুড়ী সুখী মানুষ ছিলেন, চিরকাল প্রাচুর্যেই অভ্যস্ত তাই সহ্য করতে পারলেন না, শ্যামার শরীর অনেক পাকা অনেক দুঃখকষ্ট অনিয়ম সহ্য ক’রে পেকে গেছে দেহ–তাঁর কিছু হবে না। শুধু একটা ভয় তাঁর–শাক-আনাজও অফুরন্ত নয়, দ্রুত ফুরিয়ে আসছে সেও–এইবার কি করবেন?

অনেক ভেবে একদিন কিছু আটা কিনতে গেলেন। না হয় দু’বেলা রুটি খেয়েই থাকবেন। কিন্তু তাঁদের বাজারে তখন আটা ময়দাও উধাও হয়েছে। কবে আসবে তবে পাওয়া যাবে আবার–তা বলরাম, রামকমল কেউ বলতে পারলে না। শ্যামা এবার সত্যিই ভয় পেয়ে গেলেন। কতকটা দিশাহারা ভাবেই সের দুই গোটা ছোলা কিনে বাড়ি ফিরলেন। কলকাতায় নাকি চিঁড়ে অঢেল পাওয়া যাচ্ছে–কিন্তু সেও পাঁচসিকে সের। জলসা জিনিস চিঁড়ে–এতটার কম পেট ভরে না গায়ে গত্তিও লাগে না। তার চেয়ে ছোলা ভাল। হিন্দুস্থানীরা খায়, ওদের গায়ে জোর কত!…

কিন্তু এই ছোলার ধাক্কা দিদি-নাতি কেউই সামলাতে পারলেন না। অবিরাম শাকপাতা খেয়ে খেয়ে অনভ্যস্ত পেটে বহুদিনই গোলমাল দেখা দিয়েছিল, এবার ভেঙে পড়ল একবারে। তবে দৈব সহায়, এর মধ্যে একদিন মহাশ্বেতা এসে পড়ল মার খবর নিতে

অভয়পদর চাকরি যাওয়ার পর থেকে আসা-যাওয়া কমিয়ে দিয়েছিল মহাশ্বেতা– ন্যাড়ার দোকান উঠে যাবার পর বন্ধই করে দিয়েছে প্রায়। বাড়ি থেকে বেরোতেই যেন লজ্জা করে তার আজকাল, ‘কালা মুখ নীলে করে আর কোথাও যেতে ইচ্ছে করে না।’ যে উৎসাহে যে মনের জোরে সে ঘুরে বেড়াত–সে জোর সে উৎসাহের উৎসটাই শুকিয়ে গেছে তার। এ বাড়িতেও আসে ন’মাসে ছ’মাসে একদিন। এবার তো তবু কিছু ঘনঘনই এসেছে বলতে গেলে। এসেছে কতকটা এই মন্বন্তরের কথা ভেবেই।

‘মা যে কেপ্পন মনিষ্যি–মা কি আর এই বাজারে চাল কিনে খাচ্ছে? দ্যাখো গে যাও হয়ত খাড়া ওপোস দিয়ে পড়ে আছে।’ বলেও এসেছে সে তরলাকে সে কথা। তরলার উৎসাহেই, এত কটি চালও পেট-কাপড়ে ক’রে বেঁধে এনেছে ও বাড়ি থেকে। পাড়া-ঘরে যার যা হোক, ওদের ঘরে এখনও এ বস্তুটির অভাব হয় নি। অম্বিকাপদ দূরদর্শী লোক, সে বাজারের গতিক বুঝে অনেক আগে থেকে সতর্ক হয়েছে। তাদের চাষের চালও কিছু কিছু আসে–তবে তাতে ‘সোম্বচ্ছর’ চলে না। কিনতে হয় সাত আট মাসের মতোই। সাধারণত নতুন চাল ওঠার সময় সে কেনে না, দুচার মাস গেলে ফাল্গুন-চৈত্র নাগাদ সে একেবারে যতটা দরকার কিনে ঘরে তোলে। আগে কেনে না, তার কারণ নতুন চালের রস মরে অনেকটা ওজনে কমে যায়, তাছাড়া তাতে পোকাও ধরে তাড়াতাড়ি। আবার খুচরো খুচরো কেনাও লোকসান, বর্ষার মুখে দাম বাড়ে। তাই চোত-কিস্তির আগে, যখন চাল সস্তা থাকে তখন একেবারে কিনে নেয়।

কিন্তু এবার, যেন বাতাসের মুখে খবর পেয়েই, চাল ওঠার সময়ই পুরো বছরের মতো চাল কিনে রেখেছে। বরং একটু বেশিই কিনেছে। নিজেদের ধানটা অন্য বছর একেবারে ভানিয়ে ঘরে তোলে–এবার এমনিই তুলে রেখেছে, তাতে হাত দিতে দেয় নি কাউকে। রেখেছেও তেমনি কায়দা ক’রে–এমন কি মহাশ্বেতাও তার বুদ্ধি আর বুকের পাটা দেখে প্রশংসা না ক’রে থাকতে পারে না–নিচের ভাঁড়ার ঘরটা খালি করিয়ে তাতেই একেবারে ঠেসে পুরেছে সমস্ত ধান–তারপর আগাগোড়া ইট দিয়ে গেঁথে দিয়েছে তার দোর-জানালার ফাঁকগুলো। মিস্ত্রী ডাকেনি তা বলাবাহুল্য, সেটা বড়কর্তার ওপর দিয়ে গেছে–দু ভাইতে মিলে করেছে অবিশ্যি–মিস্ত্রী ডাকলে জানাজানি চাউর হয়ে যাবে কথাটা, সেও সত্যি; কিন্তু রেখেছে তো বাপু, চারদিকে এই হাহাকার, একটু ফ্যানের জন্যে কী হ্যাঁঙ্গালি জ্যাঙ্গালি, রাত-দুপুর পর্যন্ত হন্যে হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে সব, কার বাগানে কচু কার বাগানে ওল এই খুঁজে খুঁজে–কিন্তু ওদের তো এতটুকু চিন্তাও রাখে নি মেজকর্তা। শুধু এ বছর নয়– বছরেও বেশ কিছুদিন বসে খেতে পারবে, সে ব্যবস্থা ক’রে রেখেছে! ও বছরে বোধহয় আর কিনতেই হবে না, নিজেদেরটা এসে পড়লে পুরো বছর চলে যাবে।

‘মেজকর্তা কেপ্পন হোক আর যা হোক বাপু’, মার কাছে স্বীকার করে মহাশ্বেতা, ‘এদান্তে তো রাত্তির বেলা দু চোখের পাতা এক করে না, সন্ধ্যে থেকে খালি গেলাস গেলাস চা খায় আর ঠায় সারারাত কান খাড়া ক’রে জেগে বসে থাকে। মধ্যে মধ্যে উঠে ভূতের মতো ঘুরেও বেড়ায় গোটা বাড়িটা। আগে যেমন চায়ের পাট দেখলে জ্বলে যেত–ছোট ভাইকে বকত অষ্টপ্রহর–এখন তেমনি নিজেই চোদ্দ পনেরো কাপ চা খায় পেত্যহ। আরও নাকি ভয় তার ঐ ধান-চালের জন্যেই। আঠারো গণ্ডা তালা দিয়েও নিস্তার নেই–বলে যা আকাল, টাকার চেয়ে ধান-চালেই বেশি টাঁক লোকের!’

আবার একটু থেমে বলে, ‘আমাদের এঁর তো দিনেরেতেই ঘুম নেই, ওর মতো ঘুরে বেড়ায় না বটে, তবে সারা রাতই যে জেগে থাকে তা দালানে বেরোলেই টের পাই। এমন ক’রে কদিন বাঁচবে কে জানে। খাওয়া তো ছেড়েই দিয়েছে–দুবেলা ভাতে বসে ঐ অদি। যেন ঐ কটা চাল বাঁচলেই গেরস্তর সব সুসার হয়ে যাবে!…ওর আরও ভাবনা হয়েছে পাঁটাগুনোর জন্যে। মুখে কিছু না বলুক–বলি ওরই তো ছেলে গা। একটা কারও কোন গতি হ’ল না–সব বসে বসে খাচ্ছে, একি কম ভাবনার কথা। একটা যা হোক দোকানদানী ক’রে দিলে মেজকত্তা, তা এমন গাধা সব–দুদিনে মোট মোট টাকার মাল ধার দিয়ে যথাসব্বস্ব ফুঁকে বসে রইল। আবার যে কে সেই–গায়ে হাওয়া লাগিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে আর গেরস্তর অন্ন ধ্বংসাচ্ছে!…বড়টার তিন-তিনটে ছানা হয়ে গেল,–তবু তো একটা আঁতুড়ে গেল তাই–নইলে চারটে–তাই কি তার একটু হুঁশপব্ব কি ভয়ডর আছে। উলটে এখন আর মাগের পাছতলা ছেড়ে নড়ে না এক মিনিট। দিনরাত পাহারা দিচ্ছে বৌকে–মুয়ে আগুন!…আর করবেই বা কি বলো, ওর হয়েছে সেই–দ্যাখ তোর না দ্যাখ মোর, চোর ডাকাতের ভয় পেটে পুরলেই রয়–ভেয়েরা থেকে শুরু ক’রে গুরুজন পজ্জন্ত–সবাই যদি টানাটানি করে ফাঁক পেলেই, ও-ই বা কি ভরসায় নিশ্চিন্তি থাকে বলো।’

কিন্তু এ সব কথা অনেক পরে উঠেছিল। কথা প্রসঙ্গে। মহাশ্বেতা বাপের বাড়ি ঢুকে মা আর বোনপোর অবস্থা দেখে প্রথমে তো কেঁদেই আকুল। দুজনেই কঙ্কালসার হয়ে গেছে। ঘন ঘন পাইখানা যাচ্ছে আর ফিরে এসে মাদুরে পড়ে ধুঁকছে।

কান্না থামতে একেবারে বিপরীত প্রতিক্রিয়া হয় মহাশ্বেতার। যেন জ্বলে ওঠে সে। মাকে চিরকাল ভয় ক’রে এসেছে সে, কিন্তু এখন তাঁর প্রতি আন্তরিক টানেই আর সে ভয় থাকে না।

‘মরণ তোমার! গলায় দড়ি। মা হও–গুরুজন, বলতে নেই–কিন্তু তোমার এবার মরাই উচিত।…পয়সার আণ্ডিলের ওপর বসে আছ তাও দর দেখে পেছিয়ে এলে, ভাত খাবার চাল দুটো–যা খেয়ে প্রাণ বাঁচবে–সে জিনিসও ভরসা ক’রে কিনতে পারলে না? গুচ্ছের ঘাসপাতা খেয়ে মরতে বসেছ! পয়সার এত মায়া! পয়সা কি তোমার সঙ্গে যাবে? ছালা বেঁধে নিয়ে যেতে পারবে পয়সা? এ যা অবস্থা–শ্বাস উঠতে যা বাকি, আর দুদিন এইভাবে চললেই তো ফেঁসে যাবে–তার পর? ছেলেরা তো খবরও পাবে না, তার আগেই তো পাড়ার বারো ভূতে–এসে লুটপাট ক’রে নিয়ে সরে পড়বে–তোমার এত কষ্টের বুকে করে জমানো পয়সা! সেইটেই খুব ভাল হবে–না? তবু প্রাণে ধরে প্রাণ বাঁচাবার জিনিসটা কিনতে পারবে না। হাত্তোর পয়সার মায়া রে! নিজে তো মরছই–ঐ একরত্তি ছেলেটাকে পর্যন্ত না খাইয়ে মারতে বসেছ!…ছোলা! ছোলা খেয়ে জীবনধারণ করবে! ছোলা খায় ঘোড়ারা, ঐ খেয়েই অমন বিশ পঞ্চাশ কোশ দৌড়য় তারা ভারী ভারী মাল নিয়ে তোমাদের কি ঘোড়ার পেট–না অত দৌড়ঝাঁপ করো তোমরা? আর এতই বা কি, মাসে তো তোমাদের আধমণ চালও লাগে না–না হয় কুড়ি টাকার চালই খেতে। শুধু ভাতও তো খাওয়া যায়, নুন দিয়েও ভাত ওঠে ক্ষিদের সময়। দুধ নয়, ঘি নয়–কেনা আনাজ নয়–কোন খরচই তো নেই–একগাছা ক’রে ট্যানা পরে তো থাকা, দুটো পেটের ভাতের জন্যেও পয়সা খরচ করতে পারো না? এ টাকা তোমার কী কাজে আসবে শুনি? নিজের ছেরাদ্দের জন্যে জমাচ্ছ, না ছেলেমেয়েদের ছেরাদ্দের জন্যে?’

এক নিঃশ্বাসে ঝাঁ ঝাঁ ক’রে বলে যায় মহাশ্বেতা। এই উপলক্ষে নিজের কিছু পূর্বসঞ্চিত জ্বালাও বোধ হয় বেরিয়ে আসে তার।

কিন্তু শ্যামাও আজ রাগ করেন না। হয় রাগ করার অবস্থা নেই, নয় তো তিনি নিজেই মনে মনে অনুতপ্ত হয়েছেন এই দুদিনে। তিনি বরং একটু অপ্রস্তুতভাবেই চিঁ চিঁ ক’রে বলেন, ‘তা তাই না হয় বাপু কিনব এবার।…মুশকিল, বাজারে তো পাওয়া যাচ্ছে না। কোথায় পাওয়া যাবে–মেজকত্তা তো ঘাঁৎঘোঁৎ জানে শোনে–তাকেই না হয় বলিস না কিছু চাল যদি কিনে দিতে পারে। যা দাম হয় দোব–’

মহাশ্বেতা নিজেই উনুনে পাতা জ্বেলে সঙ্গে-আনা চাল কটি চাপিয়ে দেয়। সবটা চাপায় না–মরা পেট, বেশি ভাত সইবে না–বরং দুটি থাকলে কাল খেতে পারবে। দুটো কাঁচকলাও যোগাড় করে অতিকষ্টে। তারপর সেই সন্ধ্যাবেলা নিজে বসে থেকে ওদের দিদি-নাতিকে খাইয়ে বাড়ি আসে।…

অম্বিকাপদকে চালের কথা বলতে কিছুক্ষণ চুপ ক’রে থেকে সে বলল, ‘এখন তো কোথাও পাওয়া যাচ্ছে না। আছে যাদের কাছে, তারাও সহজে বার করবে না। কেন না– একবার খবর পেলে হয়ত লুটপাট হয়ে যাবে। তা না হ’লেও–লোকের কাছে মুখ দেখাবে কি ক’রে, এতকাল নেই নেই বলে এসেছে!…তা এক কাজ করো না হয়, তোমার ছেলেদের বলো–পারে তো খানিকটা চাল এখনকার মতো পৌঁছে দিয়ে আসুক। ওর আর দাম দিতে হবে না তাঁকে। আপাতত তো ঐ চলুক। তারপর–শুনছি গবর্মেন্ট থেকে চাল দেবার ব্যবস্থা করছে–মাথা পিছু এক সের না দেড়সের ক’রে–তাহ’লে ওঁদের খুব অসুবিধা হবে না। আর না দেয়–তখন খোঁজ-খবর করা যাবে বরং!’

দুর্গাপদ একটু সন্দেহ প্রকাশ করে, হ্যাঁ, গবর্মেন্ট চাল ছাড়ছে, তুমিও যেমন! ওসব কথা রেখে বসো দিকি! ওরাই তো মিলিটারীর জন্যে চড়া দামে কিনে কিনে চাল পাচার করলে দেশ থেকে, আমাদের জব্দ করবে বলে–তবে আবার ছাড়বে কিসের জন্যে?’

‘ছাড়বে আরও বেঁধে রাখার জন্যে। তাদের হাতে চাল থাকা মানেই তো টিকি বাঁধা পড়া তাদের কাছে।…আর সবাই যদি মরেই গেল তো ওরা রাজত্ব করবে কাকে নিয়ে। জব্দ করতে চেয়েছিল–জব্দ হয়ে গেছে। যারা ইংরেজ তাড়াতে চেয়েছিল তারাই এখন হামলে পড়েছে চাকরির জন্যে। চাকরি দিচ্ছেও দুহাতে। আমি তো ধনাকে বলেছি– চট্ ক’রে ড্রাইভারিটা শিখে নিতে–তাহলে হয়ত একটা ব্যবস্থা ক’রে দিতে পারব। এখন মিলিটারীতে ঢুকতে পারলে চাল চিনি এসব ব্যাপারে নিশ্চিন্তি!

তারপর একটু থেমে অম্বিকা আবার ভাইকে বললে, ‘আর এরাই সব চাল টেনে নিয়েছে বলে চাল উবে গেছে–সেটাও ঠিক নয় হয়ত। এ দেশের চালে এ দেশে কুলোত না কখনই। জাহাজ জাহাজ চাল আসত রেঙ্গুন থেকে, তোমরা তার খবরও রাখতে না। সেইটে বন্ধ হয়েই এত মুশকিল হয়েছে। আমি জানি–আমি দেখেছি, আমাদের এক অফিসের বন্ধুর চালের কারবারও ছিল। আমড়াতলার মুসলমানদেরই একচেটে ছিল প্রায় কারবারটা, জাহাজ জাহাজ চাল আনাত, মোটা চাল–পৌনে তিন টাকা দরে সে চাল বিকোত এখানে। আটচল্লিশ ঘণ্টার মধ্যে চাল খালাস করতে হ’ত জাহাজ থেকে–তা গুদোম-টুদোমের ধার ধারত না তারা। একটা চৌকী পেতে ডকে বসে যেত, চাটি চাটি নমুনা নিয়ে, খবর পেয়ে ব্যাপারীরাই হুম্‌ড়ি খেয়ে গিয়ে পড়ত–মুখে মুখে কারবার–মোটা মোটা টাকার মাল, কেউ বিশ গাড়ি কেউ চল্লিশ গাড়ি গস্ত ক’রে নগদ টাকা জমা দিয়ে আসত, রসিদ নেই পত্তর নেই পুরনো মক্কেল হ’লে ঠিকানাও জিজ্ঞেস করত না, নতুন হ’লে একটা চিল্‌তে কাগজে ঠিকানাটা লিখে নিত বড় জোর। বিশ্বাসের ওপর কারবার- কিন্তু ঠিক সময়ে মাল পৌঁছে যেত–এক চুল এদিক ওদিক হ’ত না। প্রথমবার যেবার যাই, আমার সন্দেহ হয়েছিল, বিকেলে পাঠাবার কথা, আমি সকাল ক’রে অফিস থেকে বেরিয়ে দেখতে গিছলুম মালটা পৌঁছয় কিনা। তা চারটেয় পৌঁছবার কথা–পৌনে চারটেয় গিয়ে দেখি সার সার মোষের গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে তখনই।’

চাল, দুই ছেলে ধনা আর ন্যাড়ার হাতে আন্দাজে দু পুঁটুলি বেঁধে দিলে মেজকর্তা– মহাশ্বেতার মনে হ’ল আধমণের কম নয়। যতই যা বলুক সে, এতদিন মুখের সামনেই নানা কটু কথা বলে এসেছে–গালাগাল-মন্দও কম দেয় নি–কিন্তু এখন এতটা উদারতার সামনে নিজেকেই যেন ছোট মনে হ’তে লাগল। মনে হ’ল–বড়-কর্তা খুব ভুল করে নি হয়ত এত বিশ্বাস ক’রে–দোষেগুণে মানুষটা সত্যিই খুব খারাপ নয়।

.

সত্যি-সত্যিই এর দিনকতক পর থেকেই কন্ট্রোলে চাল দেওয়া শুরু হ’ল। মাথা পিছু এক সের ক’রে চাল–লাইন বেঁধে দাঁড়াতে হবে তার জন্যে। সেই লাইন শুরু হয় আগের রাত থেকে। ক্রমশ আগের দিন বিকেল থেকে লাইন দেওয়া শুরু হ’ল। প্রথম দিকে না থাকতে পেলে ভরসা থাকে না চাল পাবার। কোন দোকান এক বস্তা কোন দোকান হয়ত দু বস্তা চাল পায়–এক সের ক’রে দিলে আশিজন কি একশ’ ষাট জনেই মাল কাবার হয়ে যায়। ভোর থেকে যে দাঁড়াল সে হয়ত বেলা বারোটার সময় শুনল যে চাল ফুরিয়ে গেছে সেদিনের মতো–আবার সেই পরের দিন কি অমুক দিন দেওয়া হবে। সেইজন্যেই সবাই চেষ্টা করে অপরের চেয়ে আগে দাঁড়াতে। সকলের সময় নেই এত, তাদের পক্ষে সম্ভব হয় না লাইনে দাঁড়ানো। ফলে যারা দাঁড়ায় বারো চৌদ্দ ঘণ্টা আগে থেকে, বসবাস করে সেখানে বলতে গেলে, তারা ছ’আনা সেরে কেনা চাল বারো আনা–একটাকা পর্যন্ত দরে বিক্রি করে অনায়াসে। এ একটা যেন নতুন ব্যবসা শুরু হয়ে গেল।

খবরটা শ্যামার কানেও পৌঁছল বৈকি!

লোভে তাঁর স্তিমিত দৃষ্টি জ্বলে উঠল। তিনি বলাইকে বললেন, ‘বসেই তো থাকিস, একটা আসন পেতে বসে থাক্ না ওখানে–তবু দু’চারটে পয়সা আসবে!’

বলাই সংক্ষেপে উত্তর দিল, ‘আমি পারব না।

‘কেন পারবি নি শুনি? বসে বসে তো আছিস। এটুকু পারিস না? খোরাকীটা আসে কোত্থেকে?’

না পারো দিও না খেতে। তুমি নিজেই খাও গে।’

অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে নিরাসক্ত কণ্ঠে উত্তর দেয় বলাই।

ডাক পেড়ে গালাগাল দেন শ্যামা, ‘আ মর্ মুখপোড়া! বাক্যির ছিরি দ্যাকো না! লেখাপড়া শেখা নেই, এক পয়সা রোজগারের চেষ্টা নেই–খাচ্ছেন আর বসে আছেন থুম্‌ হয়ে–কিন্তু চ্যাটাং চ্যাটাং বাক্যির বেলায় তো ঠিক আছে!…হবে না কেন, কেমন বংশে জন্ম! বেউড় বাঁশের ঝাড় যে! হারামজাদার ছেলে হারামজাদাই হবে। এ তো জানা কথা! আমারই দুর্বুদ্ধি, দুধকলা দিয়ে কালসাপ পুষছি!’ ইত্যাদি–

কিন্তু যতই গালাগাল দিন আর যাই করুন বলাইয়ের অবিচল স্থৈর্য নড়াতে পারেন না। মনে পড়ে যায় নিজের ছোট ছেলের কথা, মারের চোটেও তাকে এক বিন্দু টলাতে পারেন নি। চোরের মার সহ্য ক’রেও বসে ছিল চুপ ক’রে ঠায়–এই জানলাতেই। নরাণাং মাতুলক্রম–না কি যেন বলে লোকে–সেই মামারই তো ভাগ্নে।

শেষ পর্যন্ত তোষামোদেরও আশ্রয় নেন। ভাল নতুন কাপড় বার করে দেবেন, এমন প্রস্তাবও করেন। কিন্তু বলাইয়ের সেই এক কথা, ‘আমি পারব না।’

শেষে রাগ ক’রে নিজেই একদিন যান লাইন দিতে। আগের দিন থেকে দাঁড়াতে পারেন না–রাত চারটেয় রাজগঞ্জের ভোঁ বাজতেই উঠে গিয়ে লাইনে দাঁড়ান, কিন্তু তবু চাল পান না। তাঁর থেকে ছ’ সাতজন লোক আগে আসতেই চাল বন্ধ হয়ে যায়। ক্ষুধার্ত ক্লান্ত হয়ে ফিরে এসে শুয়ে পড়েন। দুঃখে ক্ষোভে চোখে জল এসে যায় তাঁর। আর একদফা গাল দেন নাতিকে। ও মুখপোড়া গেলে আগের দিন রাত থেকেই গিয়ে দাঁড়াতে পারে, তাহ’লে আর এমন শুধু-হাতে ফিরতে হয় না!

চাল তো মেলেই না–উল্‌টে কথাটা প্রচার হয়ে যায় পাড়ায় পাড়ায়। ক্রমশ এ বাড়িতেও পৌঁছয় খবরটা। অম্বিকা অবাক হয়ে তার বৌদিকে বলে, ‘সে চাল এরই মধ্যে ফুরিয়ে গেল আঁবুই মার? না, আগে থাকতে সঞ্চয় করতে চাইছেন? তা বলাই থাকতে উনিই বা দাঁড়াতে গেলেন কেন? বলাই যদি না-ই পারে, আমাদের তো বলতে পারতেন, না হয় এরাই কেউ গিয়ে দাঁড়াত!…যাই হোক, মাকে বলে এসো, চাল ফুরোলে যেন আমাদেরই খবর দেন, ওঁকে আর এই বয়সে ঐ সত্তিকজাতের সঙ্গে গিয়ে লাইনে দাঁড়াতে হবে না!’

মহাশ্বেতার মুখ অপমানে কালো হয়ে যায়। সে আবারও মায়ের কাছে এসে ঝাল ঝাড়ে একচোট, ‘বলি আর কত মুখখানা পোড়াবে আমার! এতেও কি শান্তি হ’ল না? আমি বেশ বলতে পারি চাল নয়–পয়সার লোভে গিয়ে দাঁড়িয়েছিলে তুমি, চড়া দামে বেচবে বলে! ছিঃ ছিঃ! পয়সার এত লালস তোমার? এ পয়সা কাকে দেবে তুমি, প্রাণে ধরে তো জ্যান্তে কাউকে দিতে পারবে না। এ তো দেখছি তোমায় যক করতে হবে। তাই না হয় করো, হাতের কাছে নাতিটা আছে–ওকেই যক্ করে দাও–পয়সা আগলে বসে থাকবে চার যুগ!’

এই প্রথম বোধ করি শ্যামা কোন কথা কইতে পারলেন না–বিশেষত বড়মেয়ের কথার জবাবে–মাথা হেঁট করে বসে রইলেন

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *