১৮. বিনতা পা ছড়িয়ে বসে

অষ্টাদশ পরিচ্ছেদ

অনেক দুঃখেই কথাটা বলেছিলেন শ্যামা। বোধহয় না বলে থাকতে পারেন নি বলেই।

বিনতা পা ছড়িয়ে বসে গল্প করছিল নিতান্ত সাধারণভাবেই –শুধুমাত্র সামনের ব্যক্তিটিকে শোনাতে–কিন্তু তাতেই তার কথাগুলো যে সামনের অন্তত দু বিঘের বাগান ছাড়িয়ে বাইরের রাস্তা পর্যন্ত শোনা যাচ্ছে সে বিষয়ে সন্দেহমাত্র ছিল না। চেঁচিয়ে এবং হাত-পা নেড়ে ছাড়া যেন সে কথাই কইতে পারে না।

‘এ সম্বন্ধে বহুবার তাকে সতর্ক করেছেন শ্যামা, তিরস্কার করেছেন, কঠিন ব্যঙ্গে বিঁধতে চেয়েছেন–কিন্তু কোন ফল হয় নি। প্রথম প্রথম মনে হয়েছিল মেয়েটা বুঝি শুধুই ‘বক্তার’ অর্থাৎ বেশি কথা বলে, বা সময়ে-অসময়ে কারণে-অকারণে কথা না কয়ে থাকতে পারে না। ক্রমে ক্রমে দেখা গেল গলাও তার কম নয়। আর নতুন বৌয়ের যে অত চেঁচানো বা অত কথা বলা অশোভন–একথাটাও তার মাথায় যায় না কিছুতে।

সেদিনও একটু আগেই শ্যামা বলেছেন, ‘আমি তো নশো পঞ্চাশ ক্রোশ দূরে নেই বৌমা–সামনেই আছি, তবে অত গলা বার করছ কেন?… নতুন বৌয়ের গলা পাশের লোকও ভাল শুনতে পাবে না–এই ছিল আগেকার নিয়ম। বৌয়েরা শ্বশুরবাড়ি এসে একটু চড়া গলায় কথা বললে তার নিন্দে হত, বেহায়া বলত সকলে। …এখন অবিশ্যি অতটা নেই, তবু এত বাড়াবাড়িও কেউ বরদাস্ত করে না। এরই মধ্যে পাড়ায় বেহায়া নাম রটে গেছে তোমার। কেন–একটু আস্তে কথা বললে কী হয়? আমাকেই তো বলছ, ও পাড়ার ভগবতী গয়লাকে তো বলছ না বাছা।’

‘ওমা দুটো কথা কইব–তাও বর নয়, কোন পরপুরুষ নয়–শাশুড়ীর সঙ্গে বসে কথা বলা–অত চেপেই বা বলব কিসের জন্যে? বলি অন্যায় অপরাধ তো কিছু করছি না। এতে আবার বেহায়া বলাবলির কি আছে! আর বলে- যে বেটা-বেটিরা বলবে তারা নিজেদের মুখেই পাইখানা বসাবে আদের কথা আমি গেরাহ্য করি না।

বলা বাহুল্য এবার গলা বরং আরও চড়া। যেন সে বেটাবেটিরা পথের ওপারে কোথাও বসে আছে–তাদের শুনিয়েই বলতে চায় সে।

একটু দম নিয়েই সে আবারও বলল, ‘আপনি কিন্তু বেশ বলেন মাইরি। হি হি, হাসি পায় আমার শুনলে! বললেন কিনা, নতুন বৌ কথা বলবে পাশের লোকও শুনতে পাবে না। হি হি তবে আর কথা বলাই বা কিসের জন্যে, পাশের লোকও যদি না শুনতে পায়? কাউকে না কাউকে শোনাবার জন্যেই তো বলে মানুষ!…. সেকালের লোকগুলো অমনি বোকা ছিল সব!’

তারপর প্রচণ্ড একটা শব্দ ক’রে হাই তুলে বলল, ‘আর নতুনই বা কি, দেখতে দেখতে তো পেরায় এক বছর ঘুরে এল, এখন তো আমি পুরনোর সামিল, আমার তো ঘর-সংসার বুঝে নেবার কথা এতদিনে!’

হাল ছেড়ে দেন শ্যামা। হাল ছেড়ে দিয়েছেন অনেকদিনই। অনেক বৌ-ঝি দেখেছেন তিনি। সবচেয়ে বড় কথা, ঐন্দ্রিলার সঙ্গে ঘর করতে হয়েছে তাঁকে–তার মুখের কাছে দাঁড়াতে তো বোধহয় স্বয়ং নারদমুনিও ভয় পায়–কিন্তু এমনটি আর কখনও দেখেন নি। এ বৌ সবাইকে টেক্কা দিয়েছে। এর সঙ্গে তিনি যেন কিছুতেই পেরে ওঠেন না। ঝগড়া করলে তার সঙ্গে ঝগড়া করা যায়, তর্ক করলে যুক্তি দিয়ে যুক্তি খণ্ডন করা চলে; এ সে সব কিছুই করে না, একেবারে সোজাসুজি যেন উড়িয়ে দেয় তাঁকে, সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করে। আর এমন ভাবেই করে যে মুখের কথাতে আর ওকে শাসন করা যায় না সে সময়। ওর একমাত্র ওষুধ হ’ল সেই সময় ঘা-কতক দেওয়া বা মুখখানা নোড়া দিয়ে থেঁতো করে দেওয়া। কিন্তু সেটা ঠিক ইচ্ছে করে না। চক্ষুলজ্জায় বাধে। অভ্যাসও তত নেই তাঁর, চট ক’রে হাত-পা চলেও না। নিজের ছেলেমেয়েদের গায়েই কখনও হাত দিয়েছেন বলে মনে পড়ে না তেমন। দিলে খুব অল্প, কদাচিৎ কখনও। তাছাড়া খোকা আর তরু তাঁকে চিরদিনের মতো ছেড়ে গেছে এই উপলক্ষ করেই। কেমন একটা ভয় হয়ে গেছে তাঁর, আর কারুর গায়ে হাত তুলতে যেন সাহস হয় না।

আরও একটা কথা। একবার একদিন শাসন করলে বাগ মানবে–তেমন মেয়ে নয় এ। প্রতিদিন দিনরাত কিছু কেজিয়া করা যায় না। ছোটলোকদের ঘরেও তা করে না কেউ, করলে তাদের ঘরেও নিন্দে হয়। তাঁর এ তো বামুনের ঘর, ভদ্রলোকের ঘর।

তাই কিল খেয়ে কিল চুরি করার মতোই সব অসৈরণ হজম করতে হয়। আজও আর বেশি ঘাঁটালেন না শ্যামা। আপন মনে কাজ ক’রে যেতে যেতে এক সময় নিতান্ত ভালমানুষের মতো প্রশ্ন ক’রে বসলেন, ‘আচ্ছা বৌমা, তোমার নাড়ী কেটেছিল কী দিয়ে জানো?’

‘নাড়ী কেটেছিল, আমার? কি দিয়ে–তার মানে?… আপনি কী সব মজার মজার কথা বলেন না এক একসময়! আমার নাড়ী কেটেছিল কি দিয়ে তা আমি কেমন ক’রে জানব বলুন। তখন কি আমার জ্ঞানবুদ্ধি কিছু হয়েছে যে দেখে রাখব।’

‘তা বটে। সত্যি কথাই তো।… না, তাই জিগ্যেস করছিলুম।’ আরও নিরীহকণ্ঠে বলেন শ্যামা।

কিন্তু ততক্ষণে বিনতার কৌতূহল প্রবল হয়ে উঠেছে। সে সামনের দিকে একটু এগিয়ে এসে বলে, ‘কেন বলুন তো মা? ব্যাওরাটা কি?’

‘না, ঐ যে বলে না–’, পাতা চাঁচতে চাঁচতে বঁটির দিকে নজর রেখেই উত্তর দেন শ্যামা, ‘যে চ্যাচারি দিয়ে নাড়ী কাটলে খুব চাঁচা-ছোলা পরিষ্কার গলা হয়। তাই জিজ্ঞেস করছিলুম। কথাটা মনে পড়ে গেল তাই–’

‘ও, আমার গলার কথা বলছেন! সব্বরক্ষে! আমি বলি কী না কি ব্যাপার! … তা কে জানে বাপু কী দিয়ে চেঁচেছিল, –মা জানতে পারে হয়ত। আমি কোনদিন মাকে জিজ্ঞেসও করি নি।’

বলতে বলতেই কী একটা কথা মনে পড়ে উৎসাহিত হয়ে ওঠে যেন ‘ওমা, সে বুঝি জানেন না–অনেককাল, বোধ-হয় অমন চার-পাঁচ বছর বয়স পর্যন্ত আমার কথাই ফোটে নি যে! ওরা তো ভয় পেয়েই গেছল যে বোধহয় বোবাই হবো, জন্মে আর কথা ফুটবে না মুখে। মা নাকি খুব কান্নাকাটি করত সে জন্যে। তারপর মার কান্না দেখেই হোক আর নিজের ধম্ম ভেবেই হোক, কাকা কোন এক বড় ডাক্তারকে দেখিয়েছিল, সে ডাক্তার এসে গলার মধ্যেটা কমনে কি চিরে দিতে তবে বুলি ফুটল!’

‘তাই নাকি! তা সে কে ডাক্তার বৌমা, তার নাম কী?’

‘কে জানে বাপু, অতশত আমি খবর রাখি না। জিজ্ঞেসও করি নি কখনও। কাজ হয়ে বয়ে চুকে গেছে কবে–নিশ্চিন্তি। অত–কী কী বিত্তেন্ত তার চোদ্দপুরুষের নিকেশে আমার কি দরকার!’

‘তা তোমার মার মনে নেই? কী তোমার কাকার? … একটা চিঠি লিখে দ্যাখো না! …নাম ঠিকানাটা কি, আর এখনও বেঁচে আছেন কিনা!’

‘তা লিখতে পারি। কিন্তু সে ডাক্তার দিয়ে আবার আপনার কি হবে! কাকে দেখাবেন–বলাইকে?’

‘না, বলাইকে দেখাব কেন, তোমাকেই দেখাব–।’

‘আমাকে?’

ঈষৎ ভ্রূকুটি ক’রে তাকায় সে। এতক্ষণে বুঝি কি একটা সংশয় ঘনিয়ে আসে বিনতার মনে। দেখাব এই জন্যে যে, যিনি তোমার গলা চিরে বোল ফুটিয়েছিলেন, তিনিই এখন দেখে-শুনে সেটা সেলাই ক’রে আবার বোল বন্ধ করতে পারেন কিনা! তার জন্যে এমন কি যদি ষোল টাকা ভিজিট নেন্ সে ডাক্তার তো আমি দিতে রাজি আছি!’

দেখতে দেখতে ভীষণ আকার ধারণ করল বিনতার মুখ। গলা আরও এক পর্দা চড়িয়ে তীক্ষ্ণ কণ্ঠে বলে উঠল, ‘কেন বলুন তো আমার বুলি বন্ধ করে দেবেন! কিসের জন্যে!… এসব কি অলুক্ষুণে কথাবার্তা! আমি আপনার কি পাকাধানে মই দিয়েছি তাই শুনি!… আমার কথা যদি এত খারাপ লাগে–আমার সঙ্গে কথা কইতে আসেন কেন? কাল থেকে আর কথা কইবেন না–আমার কথা শুনতেও হবে না… বলে–না যাবে নগর না হবে ঝগড়!… তাও অসহ্যি লাগে ভেন্ন ক’রে দিন না। আপনার খারাপ লাগে বলে আমায় কি মুখে কুলুপ এঁটে থাকতে হবে নাকি?… ইলো!… আবদার মন্দ নয়। উনি যেন সাক্ষাৎ ভগবান এলেন একেবারে, কিম্বা খড়দর মাগোঁসাই!… ওঁকে তুষ্টি করতে জিভ কেটে দেব আমি! কেন, আমার গলার ওপরই বা এত নজর কেন, নিজের মেয়েদের গলা কি কিছু কম নাকি?… বট-ঠাকুরঝির গলা তো শুনি সেই রাস-তলা থেকে শোনা যায়! মেজ- ঠাকুরঝি যখন আসে তখন তো শুনেছি আরও এক কাটি সরেস –কাক-চিল বসতে পায় না বাড়িতে। –ওগো, শুনেছি সব–চক্ষে নাই বা দেখলুম, কন্যেদের গুণ শুনতে আর আমার বাকি নেই এর মধ্যে কিছু।… তার বেলা তো কিছু বলবার সাধ্যি হয় না। সে বুঝি সব ভাল। নিজের ময়লায় গন্ধ নেই–না? যত চোর দায়ে ধরা পড়ল বৌবেটি হতচ্ছাড়ি!… বাঃ, বেশ তো, বেশ বিচের যা হোক!’

আরও অনেক কথা বলে যায় সে, ঠিক প্রত্যক্ষভাবে না হ’লেও পরোক্ষে সে গালাগালও দেয় ছড়া বেঁধে। বলতে বলতে গলার পর্দাও চড়ে, ক্রমশ যেন রণরঙ্গিনী মূর্তি ধারণ করে সে। তার দিকে চেয়ে এমন কি শ্যামাও একটু ভয় পেয়ে যান যেন। চোখ দুটো জবা ফুলের মতো লাল হয়ে উঠেছে, মুখের দুই কষে ফেনাল মতো কী জড়ো হয়েছে– এমন কি, চুল-গুলোও যেন খানিকটা খাড়া হয়ে উঠেছে ইতিমধ্যে। ভদ্রঘরের মেয়ের এমন উগ্র মূর্তি কখনও দেখেন নি শ্যামা–বস্তি-টস্তিতে ঝগড়া বাধলে হয়ত এই রকম দৃশ্য নজরে পড়ে।

ভয় পেলেও–বেশিক্ষণ এ দৃশ্য সহ্য করা কঠিন। শেষে থাকতে না পেরে একসময় তিনি বলেন, ‘তা বেশ তো, সে ফিরে আসুক, সেই কথাই ব’লো না বরকে। ভেন্ন হয়ে যেতেই ব’লো। তোমারও হাড় জুড়োয় আমারও হাড়ে বাতাস লাগে। তাছাড়া–সত্যি কথা বলতে কি আমার একটু সুবিধেও হয়–তোমাদের দুজনকে খাওয়াতে পয়সাও তো কম খরচ হচ্ছে না আমার!’

‘অ! জানেন সে অক্ষ্যাম, জানেন সে ভেন্ন হয়ে মাগ-ছেলে পুষতে পারবে না, তাই বুঝি এত টিটকিরি মারছেন!’ ভীষণতর হয়ে ওঠে বিনতার কণ্ঠ ‘তা এত অক্ষ্যামই যদি জানেন, তবে বে দিয়েছিলেন কেন ঐ হাবাকালা ছেলের! যার এক পয়সা রোজগারের মুরোদ নেই তার বে দিয়ে বৌ আনবার শখ জেগেছিল কেন প্রাণে।… না কি ভেবেছিলেন অক্ষ্যাম ছেলে কোনদিন কোথাও চলে যেতে পারবে না–তার বৌকে দু-পায়ে খ্যাতলাবেন মনের সুখে!… হুঁঃ! স্বপ্নেও ভাববেন না আমি সেই বান্দা! খাওয়া! ভারী তো খরচ করছেন খাওয়াবার জন্যে। জেলের কইদীরা এর চেয়ে ভাল খায়। দুবেলা দুমুঠে ভিক্ষের ভাত দিয়ে মাথা কিনে নিয়েছেন একেবারে। সেই ভয়ে আমায় মুখে কুলুপ এঁটে থাকতে হবে!… কেন, কিসের জন্যে! অত সুখে আর রাধামণি বাঁচে না!… যদি ভেন্ন হই তো এটি জেনে রাখবেন যে সহজে ছেড়ে দোব না আমি, দস্তুরমতো খোরাকি আদায় ক’রে ছাড়ব। না দেন–জোর করে আদায় করব। দরকার হয় আদালতে গিয়ে দাঁড়াব–ছেলে চাকরি করে বলে ঠকিয়ে বে দিয়েছেন!’

শ্যামা স্তম্ভিত হয়ে গেলেন। অসহ্য একটা ক্রোধে তাঁর হাত-পা কাঁপছে ভেতরে ভেতরে–কিন্তু কী করবেন, কী করে বাধা দেবেন একে, সত্যিই দু-চার ঘা কষিয়ে দেবেন কিনা–কিছুতেই ভেবে পেলেন না তিনি। এ যা মেয়ে, এ সব করতে পারে, ঘরে আগুন লাগিয়ে দেওয়াও বিচিত্র নয়। এই প্রথম তিনি ঐন্দ্রিলার আগমন প্রার্থনা করতে লাগলেন মনে মনে। একমাত্র সেই বোধহয় পারে–এর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ঝগড়া করতে।

কিছুই বলতে পারলেন না শ্যামা, কোন প্রতিকারই তাঁর মাথায় এল না। এ ধারে কৌতূহলী প্রতিবেশীরা ইতিমধ্যেই উঁকিঝুঁকি মারতে শুরু করেছে–কেউ কেউ সোজাসুজি বাড়ির সামনের রাস্তায় দাঁড়িয়ে চেয়ে আছে এদিকে। ঐন্দ্রিলার কল্যাণে চেঁচামেচি ঝগড়া এ বাড়িতে নতুন নয়, তবু–এখন যে সে নেই তাও অনেকে জানে। বৌ আর শাশুড়ী থাকে শুধু–বলতে গেলে নতুন বৌ–সুতরাং এখনকার চেঁচামেচি কিছু মুখরোচক নিশ্চয়ই। এ কৌতূহলও তাই নিতান্ত স্বাভাবিক। ওদের দোষ দেন না শ্যামা। আর এও তিনি জানেন যে সে কৌতূহল বেশিক্ষণ দূরত্ব ব্যবধান বজায় রাখতে দেবে না। এখনই হয়ত বেড়ার আগড় ঠেলে কেউ কেউ ভেতরে ঢুকবে ব্যাপারটা ভাল ক’রে উপভোগ করতে। তাঁকে এবং বৌকে নানাবিধ উপদেশ দিতে শুরু করবে তারা এখনই। তাদের সেই বিদ্রূপ-শাণিত দৃষ্টি এবং আপাত–আন্তরিক সহানুভূতি থেকে আত্মরক্ষা করতেই যেন শ্যামা হাতের কাজ সরিয়ে রেখে পিছন দিককার বাগানে চলে গেলেন–একরকম রণে ভঙ্গ দিয়েই। আশা যে, এই বিজয়-গৌরবের তৃপ্তিতে এবং একা একঘেয়ে বকে যাবার ক্লান্তিতেই এবার চুপ করবে বৌ।

সত্যিই বিনতা চুপ করতে বাধ্য হ’ল তখনকার মতো। যতবড়ই যোদ্ধা হোক– প্রতিদ্বন্দ্বী না থাকলে যুদ্ধ চালানো অসম্ভব। কিন্তু সেটা শুধুই নিরুপায়ের শান্তি। মনে মনে একটা ভয়ঙ্করতর লড়াইয়ের জন্য প্রস্তুত হ’তে লাগল। কান্তি বাড়ি ফিরলে সে একটা হেস্তনেস্ত বিহিত যা হোক করবেই–এই স্থির প্রতিজ্ঞা তার।

.

কিন্তু তার সব প্রতিজ্ঞা এবং প্রস্তুতি ভেঙ্গে দিল কান্তিই।

সে বাড়ি ফিরল প্রবল জ্বর এবং মাথার যন্ত্রণা নিয়ে। কাজ করতে করতেই জ্বর এসেছে, তার ওপর জোর করে কাজ করতে গিয়ে বেড়ে গেছে আরও। আর সেই জন্যেই বোধহয় এত যন্ত্রণা। তখন মালিক জোর ক’রে বাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছেন তাকে। ছাপাখানারই একজন সঙ্গে এসে পৌঁছে দিয়ে গেল। গাড়িভাড়ার পয়সা তিনিই দিয়ে দিয়েছেন–’উদিগের টেরাম ভাড়া সুদ্দু’। ফেরার পয়সাও হিসেব করে দিয়েছেন। আর কিছু লাগবে না।

কান্তির বরাত ভাল। বদ্ধকালা হয়েও মনিবের সুনজরে পড়ে গেছে,–ওর সহকর্মীর কণ্ঠে সেই প্রচ্ছন্ন ঈর্ষাটুকুও চাপা রইল না।

তা সে যাই হোক–ঝগড়াটা তখনকার মতো মুলতুবী রাখতে হ’ল বিনতাকে। কারণ জ্বরটা খুবই বেশি। শ্যামা যখন কপালে হাত দিয়ে দেখে জ্বরের পরিমাণটা অনুমান ক’রে নিয়ে মাথা ধুইয়ে দেবার আয়োজন করলেন, তখন তাকে ভালমানুষের মতো জল-গামছা- কলাপাতা হাতের কাছে এগিয়ে দিয়ে সাহায্যও করতে হ’ল যথাসম্ভব।

কান্তির জ্বর পরের দিনও কমল না, তার পরের দিনও না।

তখন চিন্তিত হয়ে শ্যামা ফকির ডাক্তারকে ডাকতে বাধ্য হলেন। ফকির এসে মিচার এবং কী একটা পুরিয়ে দিয়ে বলে গেলেন, ‘সাবধানে নজর রাখবেন, জ্বরটা বাঁকা দাঁড়াতে পারে।’

এবার বিনতারও মুখ শুকোল। যার জোরে তার জোর–সে-ই যদি অসহায় হয়ে পড়ে থাকে এমন ক’রে, তাহ’লে আর বিক্রম দেখায় কোথায়? সে অন্যলোকের অভাবে ঘাটে বাসন মাজতে গিয়ে বোধ করি বাসনগুলোকেই শুনিয়ে শুনিয়ে আপসায়, ‘যার কপাল খারাপ হয় তার দেখি সব দিকেই মন্দ। অসুখ-বিসুখ জ্বরজারি হয় লোকের–দুদিন খাড়া উপোস দিয়ে পড়ে থাকে–জ্বর ছেড়ে যায়, নিশ্চিন্ত! এঁর যখনই হবে বাঁকা!…একবার তো শুনেছি এই জ্বর থেকেই কান দুটো গেছে–এবার বোধহয় চোখ দুটোও যাবে! ব্যস্–তবেই আর কি, সুখের ওপর স্ববাস হয় একেবারে! ভরাভরতি চোদ্দ পোয়া ভাগ্যি উপচে পড়ে। ঐটুকু শুধু বাকি আছে দুদ্দশা পুরো হ’তে। ঝাড় মারো বরাতের মুখে–কেন, আমার বরাতেই বা এমন বে হবে কেন? কৈ আর কারুর তো এমন বে হ’তে শুনি নি। ভারী তো ভাতার–পনেরো টেক্‌লো মাইনের চাকর–তাও গোটা একটা আস্ত মনিষ্যি পেলুম না গা! মুখে আগুন বরাতের, জ্যান্ত নুড়ো জ্বেলে দিতে হয় এমন বরাতের মুখে। এবার আর একটা অঙ্গ পড়লেই তো বুঝেতে পাচ্ছি মালা হাতে ভিক্ষেয় বেরোতে হবে!’

শ্যামা ছেলের কাছে বসেছিলেন, অতটা শুনতে পান নি, ওধারের ঘাট থেকে মহাদেবের মা শুনতে পেয়ে ধমক দিয়ে উঠল, ‘ওকি হচ্ছে গা বৌদি, ঘরে রোগা ভাইটা আমার পড়ে ছটফট করছে, আর এখানে বসে বসে তুমি তার ষাট বাঁচাচ্ছ! ওসব কি অলুক্ষুণে কথাবাত্তারা!’

অপ্রতিভ হয়ে তখনকার মতো চুপ ক’রে যায় বিনতা।…

জ্বর পাঁচ-ছ দিন পরে একটু নরম হয়ে আসে। ফকির ডাক্তার অভয় দিয়ে যান, ‘না, যা ভেবেছিলুম তা নয়–টাইফয়েড-টয়েড কিছু নয়। হয়–ওরকম হয়। আজকাল আকছার হচ্ছে এই রকম একজ্বরী-মতো। যাই হোক–এবার আস্তে আস্তে ছাড়বে। তবে ছাড়বার মুখটাতে একটু হুঁশিয়ার থাকবেন, দুর্বল শরীর তো, হঠাৎ সব ঠাণ্ডা হয়ে আসতে পারে। সেই সময়টায় একটু গরম দুধ কি একটু গরম চা–নিদেন গরম চিনির জল খাইয়ে দেবেন–’

ফকির ডাক্তার পাসকরা ডাক্তার নন; এক বড় ডাক্তারের কাছে কম্পাউন্ডারী করতে করতে ডাক্তারখানা খুলে বসেছেন। তা অবশ্য হয়েও গেল অনেক দিন। আগে আদৌ ভিজিট নিতেন না, পরে আট আনা করেছিলেন, এখন নাকি এক টাকা ভিজিটের কম কারও কাছে যান না। তবে শ্যামা বহুদিনের মক্কেল বলে এখনও আট আনা নেন, তাও সব দিন দিতে পারেন না শ্যামা, দুদিন ভাঁড়িয়ে একদিন দেন। কিন্তু ফকির কিছু বলেন না– ডাকলেই আসেনও। ওষুধের দাম ওঁর কাছেই সবচেয়ে কম। অনেক ভেবেই তাঁকে ধরে আছেন শ্যামা।

লোকমুখে খবর পেয়ে বিনতার মা একদিন এলেন জামাইকে দেখতে। এর আগে আর কোন দিন আসেন নি তিনি। শ্যামা অবশ্যই যত্ন-আত্তির ত্রুটি করলেন না, বাজার থেকে বলাইকে দিয়ে মিষ্টি আনিয়ে দিলেন, মায় চা-খাবার অভ্যাস আছে শুনে এক পয়সার গুঁড়ো চায়ের প্যাকেট আনিয়ে বিনতাকে দিয়ে চা করিয়েও দিলেন।

অত দূর থেকে খুঁজে খুঁজে নতুন জায়গায় আসতেই ভদ্রমহিলার অনেক দেরি হয়ে গিয়েছিল, সন্ধ্যার কিছুক্ষণ আগেই মাত্র এসে পৌঁচেছেন তিনি। তাই সন্ধ্যার পর বিদায় নেবার প্রস্তাব করতেই শ্যামা সরাসরি তা নাকচ ক’রে দিলেন।

‘তা কখনও হয়! এই অন্ধকারে অজানা অচেনা জায়গায় আপনাকে ছেড়ে দিতে পারি কখনও।…ও বাড়ির কোন নাতিটাতি এসে পড়লেও না হয় সঙ্গে দিতুম, কলকাতায় পৌঁছে দিয়ে আসত। …আর তার অত দরকারই বা কি, গরীব বেয়ানের কাছে এসে পড়েইছেন যখন–তখন কষ্টসৃষ্ট ক’রে একটা রাত না হয় কাটিয়েই যান না!’

অগত্যা বিনতার মাকে রাজি হ’তে হ’ল। তবে তিনি হাতজোড় ক’রে বললেন, ‘কিন্তু ভোরবেলাই ছেড়ে দেবেন বেয়ান, মানে এখানে তো আর–’

‘সে আমি জানি। নাতি হয় নি এখনও–এখানে ভাত খেতে বলবই বা কেন?’ কুটুম্ব মানুষ–এই প্রথম এসেছেন। তাঁকে আর কিছু ক্ষুদ-ভাজা কি চাল-ভাজা খাইয়ে রাখা যায় না। অগত্যা শ্যামাকে গিয়ে উনুন জ্বেলে রুটি গড়তে বসতে হ’ল। রুটি আর ভালরকম একটা কিছু তরকারি, ডালনা জাতীয়। বিনতা রাঁধে মন্দ নয়, কিন্তু বৌয়ের মায়ের জন্যে তাঁর সামনেই বৌকে রাঁধতে পাঠানো অনুচিত, তাছাড়া তাদের চিরদিন কয়লার জ্বালে রাঁধা অভ্যাস–কাঠ কি পাতার জ্বালে রুটি ভাল গড়তে পারেও না সে। রুটির পাটও কম এ বাড়িতে–শেখার সুযোগও মেলে নি। সুতরাং শ্যামাকে নিজেই যেতে হ’ল রান্নাঘরে। বিনতাকে এই অবসরে ঘরদোরের পাট সেরে নিতে বললেন, বিছানা একটা বাড়তি চাই আজ, বেয়ানের জন্যে। আজ আর ছেলের কাছে বসে থাকার কোন প্রয়োজন নেই। এমনিতেই সে অনেকটা ভাল আছে আজ, তার ওপর শুশ্রূষা করার লোকও আছে আর একজন। তার শাশুড়ীই কাছে বসে বাতাস করছেন, মাথায় গায়ে হাত বুলিয়ে দিচ্ছেন। মিছিমিছি আর একটা লোক সেখানে জোড়া হয়ে বসে থেকে লাভ কি?…

শ্যামা একমনে বসে রান্না করছেন, হঠাৎ বিনতা এসে পিছনে থেকে দারুণ উত্তেজিতভাবে ফিফিস্ ক’রে বলে উঠল, ‘আমি এ সব কিন্তু ভাল বুধতি না মা, আপনি দা হয় এর একটা বিহিত করুন!’

বিনতার উচ্চারণ এমনিই কেমন একটু আধো-আধো–উত্তেজিত হ’লে আরও জড়িয়ে যায় কথাগুলো। সে উত্তেজনার কারণও যে খুব বেশি–তাতেও কোন সন্দেহ নেই। কারণ বিছানা করতে করতেই ছুটে এসেছে–হাতে তার এখনও বিছানাঝাড়া খ্যাংরাটা ধরা।

শ্যামা বিস্মিত হয়ে বললেন, ‘কী ভাল বুঝছ না বৌমা, কী হয়েছে?’

‘না, না, মা-ই হোক আর যা-ই হোক, সত্যি কথা বলব তার অত ঢাকাঢাকি কিসের। মার কি উচিত অত বড় জামাইয়ের মশারীর মধ্যে ঢুকে তার মাথা টিপে দেওয়া? হ’লই বা শাশুড়ী–এমন কি বয়স হয়েছে মার!… না না, আপনি বারণ করুন মা!’

অবাক হয়ে চেয়ে রইলেন শ্যামা। এ বধূ সম্বন্ধে তাঁর বিস্ময়ের বোধ করি শেষ হবে না। বহুক্ষণ নির্বাক হয়ে মুখের দিকে চেয়ে থেকে একটা নমস্কারের ভঙ্গি করে বললেন, ‘ধন্যি মা ধন্যি, তোমার ক্ষুরে ক্ষুরে দণ্ডবৎ!…আমার গলা কেটে ফেললেও আমি গিয়ে এমন কথা তোমার মাকে বলতে পারব না, বলতে হয় তুমিই বল গে।…ওঃ, আমার কান্তির বরাতকেও বলিহারি যাই–কোন, নির্জনে বসে এমন বৌয়ের জন্যে তপস্যা করেছিল!’

মেঘের মতো অন্ধকার মুখ ক’রে বিনতা চলে গেল দুপ দুপ ক’রে পা ফেলতে ফেলতে, ‘বলবই তো, বেশ–না হয় আমিই বলব। অত ভয় কিসের? নিজের সোয়ামীর ভাল-মন্দর কথা যেখানে, সেখানে অত ঢাক্-ঢাক্ চক্ষুলজ্জা করতে গেলে চলে না। খারাপ দেখায় বলেই বলা! তা নয়–সবই আমার দোষ। ভাল কথা বললেও দোষ।..তপিস্যে–কী তপিস্যের বর রে আমার!’

অনেক্ষণ পর্যন্ত চাপা গলায় গজগজ করে সে। তবে শেষ পর্যন্ত–কে জানে কেন– কান্তির ঘরের দিকে আর যায় না, ও ঘরে গিয়েই বিছানা করতে শুরু করে আবার।

॥২॥

অভয়পদর পরে অম্বিকাপদর পালা। অভয়পদর চাকরি যাবার মাসকতক পরে তাকেও হিসেবে-নিকেশ চুকিয়ে ঘরে এসে বসতে হ’ল। রিটায়ার করার কথা তার নাকি আরও আগেই–বহু কৌশল করে নানা ব্যক্তিকে ধরে-পাকড়ে, ক্ষেত্রবিশেষে দু’চার টাকা ঘুষ খাইয়ে এতকাল টিকিয়ে রেখেছিল, কিন্তু আর তা কিছুতেই বাঁচানো গেল না। এবার সত্যিসত্যিই গেল চাকরিটা।

অবশ্য তাতেও কোন সান্ত্বনা পেল না মহাশ্বেতা। কারণ চাকরি যাবার কিছুদিন আগেই মেজকর্তা তার বড় ছেলেটিকে নিজের অফিসে ঢুকিয়ে দিয়েছিল, এখন শোনা গেল মেজটিরও একটা হিল্লে হবে। খোদ ছোটসাহেব নাকি কথা দিয়েছেন–কোথাও একটা টুল খালি হলেই বসিয়ে দেবেন তাকে।

সুতরাং জ্বালা বেড়েই গেল বরং। মহাশ্বেতার একটি ছেলেরও হিল্লে হয় নি আজ পর্যন্ত। কেষ্টপদর বিয়ের বয়স উত্তীর্ণ হয়ে যাওয়া সত্ত্বেও সে প্রস্তাবটা মুখে আনতে পারে নি মহাশ্বেতা। শ্বশুরবাড়ির ঐশ্বর্য সম্বন্ধে যথেষ্ট উচ্চ ধারণা থাকলেও এটা সে বুঝতে পেরেছিল যে, তার বা তার স্বামীর হাতে যখন একটি পয়সাও নেই, তখন তার তরফ থেকে আর কোন খরচা বাড়ানোর কথা মুখে আনা উচিত নয়।

সে অম্বিকাপদর প্রথম ছেলেকে চাকরিতে ঢেকাবার সময় ‘শয়তান’, ‘কুচক্কুরে’, ‘একচোখো’ প্রভৃতি বলে গালাগাল দিয়ে বাড়ি মাথায় করেছিল, কিন্তু পরেরটির আসন্ন চাকরির সংবাদে একেবারে যেন পাথর হয়ে গেল। তার মানে ওরা সব দিক দিয়েই গুছিয়ে নিলে। চাকরি–তা সে যেমনই হোক–মহাশ্বেতার কাছে চাকরি মানেই জীবনের সকল সমস্যার সমাধান–চাকরি মানেই–নিরাপদ নিরুদ্বিগ্ন স্বচ্ছন্দ জীবন; বিয়ে, ছেলেপুলে হওয়া, আবার তাদের মানুষ হয়ে ওঠা–একটার পর একটা আপন নিয়মেই চলবে।

ওদের সব হ’ল–তারই কিছু হ’ল না। কেন হ’ল না তা অবশ্য প্রথম প্রথম যথেষ্ট বোঝাবার চেষ্টা করেছে অম্বিকাপদ। তার ছেলেরা তবু কিছু কিছু লেখাপড়া শিখেছে, ম্যাট্রিক পাস করতে না পারুক, ঘষে ঘষে কোনমতে উঁচু ক্লাস পর্যন্ত উঠেছে, ইংরেজি হরফ চেনে, সাধারণ দু’-একটা কথার মানে বোঝে–ইংরেজি হরফে যোগ বিয়োগ গুণ ভাগ করতে পারে। মহার ছেলেরা কিছুই জানে না, বাংলাও পড়তে পারে না ভাল করে। ওদের মধ্যে একমাত্র ন্যাড়াই যা চার-পাঁচ ক্লাস পড়েছিল ইংরেজি ইস্কুলে। এ অবস্থায় ওদের কোন অফিসে চাকরি হওয়া অসম্ভব। বড়বাবুই হোক আর খোদ সাহেবই হোক– এখন আর কারুর দ্বারাই সম্ভব নয় এমন অঘটন ঘটানো। এক বেয়ারার চাকরি হ’তে পারে, পনেরো টাকাতে ঢুকে ত্রিশ টাকা পর্যন্ত মাইনে। –ওতেই জীবন কাটাতে হবে। কিন্তু তাও, অম্বিকাপদ যেখানে সসম্মানে এতদিন ‘বাবু’র কাজ করে এসেছে, যেখানে তার ছেলেরা ‘বাবু’র কাজে বসেছে বা বসবে, –সেখানে নিজের ভাইপোদের সত্তিকজাতের এঁটো গেলাস ধোবার জন্যে বেয়ারার কাজে লাগাতে পারবে না সে।

কিন্তু এসব কথা মহাশ্বেতার বোঝার কথা নয়। তখনও বোঝে নি, এখনও বুঝল না। তখন নিষ্ফল আক্রোশে গজরেছিল এখন কপালে হাত দিয়ে বসে পড়ল। জিতে গেল ওরা, জিতে গেল! একপুরুষেই নয়, পুরুষানুক্রমেই ওদের কাছে মাথা হেঁট ক’রে থাকতে হবে তাকে বা তাদের। বড় হয়েও কোনদিন বড়র সম্মান পেল না সে। আর কোনদিন পাবে না। কোথায় একটা ব্যর্থ আশা পোষণ করেছিল মহাশ্বেতা এতদিন যে, একদিন না একদিন এই অবিচারের প্রতিকার হবে, একদিন আবার মাথা তুলে দাঁড়াতে পারবে সে, নিজের প্রাপ্য মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত হবে। কি ক’রে সেটা ঘটবে তা সে জানে না, কখনও তলিয়ে ভেবে দেখে নি, যা হোক ক’রে হবেই কোন উপায়–এই আশ্বাসটুকু ধরে ছিল শুধু। সেই আশাতেই আরও সে পাগলের মতো টাকা ধার ক’রে এনে অভয়পদর হাতে তুলে দিয়েছিল অপরকে ধার দেওয়ার জন্য, অকল্পিত সুদের লোভে। অন্তত টাকাও যদি খানিকটা হাতে আসত তা হ’লে দেখে নিত সে ওদের সামনে মাথা উঁচু ক’রে হাঁটতে পারত। তাও হ’ল না, ভগবান চিরদিনই ওদের দিক টেনেছেন, আজও টানছেন।

এক-একবার এই অসহায় নৈরাশ্য–এই দিকদিশাহীন অন্ধকার ভবিষ্যতের চিন্তা যেন নিজে আর বইতে পারে না মহাশ্বেতা–ছুটে যায় স্বামীর কাছে, ‘ওগো এদের কথাটা কি ভাবছ? কি গতি হবে এদের? চিরকালই কি ভিক্ষের ভাত খেয়ে কাটাবে? সেও যতদিন তুমি আছ, তারপর তাও জুটবে কি?’

অভয়পদ আজকাল অনেকটা সামলে উঠেছে, প্রথম দিককার মতো স্থবির হয়ে আর বসে থাকে না–বাগানে টুকটাক এটা-ওটা ক’রে বেড়ায়। বলতে গেলে সারা দিনটাই বাগানে কাটায়, সন্ধ্যার পর এসে নিজের চিরাভ্যস্ত বেঞ্চিটাতে শুয়ে পড়ে। অন্ধকারেই শুয়ে থাকে। তবে ঘুমোয় না যে–সেটা টের পায় এরা। বহু রাত অবধিই ঘুমোয় না। হয়ত বা সারারাতই জেগে থাকে এক একদিন।

স্ত্রীর আকুল প্রশ্নেও তার অবিচল স্থৈর্য নাড়া খায় না। উদাস স্তিমিত চোখ দুটো অপর কোন বস্তুর ওপর নিবদ্ধ ক’রে জবাব দেয় সে, ‘কী জানি। আমি আর কি করব বলো, আমার আর কি হাত!’

‘তাহ’লে কি এরা উপোস ক’রে মরবে?’

‘ভাগ্যে থাকে তাই মরবে। আমি আর কি তাতে বাধা দিতে পারব? ভাগ্যই সব। মানুষের চেষ্টাতে যে কিছু হয় না তা তো দেখলেই।’

‘তা কোন কারখানা-মারখানাতেই না হয় ঢুকিয়ে দাও না। মেজকত্তা তার নিজের আপিসে ছেলেকে ঢুকিয়ে ব্যবস্থা করে তবে বেরুলো। তোমাদের তো আসলে কারখানাই–তুমি তো সেখানে ছিলে এতকাল–সেখানে ঢোকাতে পারবে না? আজকাল তো অনেক ভদ্দরঘরের ছেলে শুনেছি লোহাপেটার কাজ করছে!’

‘সে আগে চেষ্টা করলে হ’ত। আমি থাকতে থাকতে বললে হয়ত এক-আধটাকে ঢোকাতে পারতুম। তাও ওরা পারত না অবিশ্যি। লোহা পিটিয়ে খেটে খাবার ক্ষমতা ওদের নেই। তবু চেষ্টা ক’রে দেখতে পারত। কিন্তু এখন আর আমার কোন হাত নেই। আমার পুরনো সাহেবরা সবাই চলে গেছে। তারা থাকলে আমার চাকরিই বা যাবে কেন? পুরনো বড়বাবুরাও কেউ আর নেই। যারা আছে তারা আমার কথা রাখবে না।’

বক্তব্য শেষ ক’রে নিতান্ত নিরুদ্বিগ্নভাবেই আবার নিজের কাজে মন দেয় অভয়পদ। যেন আর কোন স্বল্পপরিচিত কারও ভবিষ্যতের কথা, কোন পরস্যাপি পরের প্রসঙ্গ তুলেছিল মহাশ্বেতা। চিরদিন এই রকম। কখনও ওর দিকে, ওর ছেলেদের দিকে তাকাল না মানুষটা। কখনও ওদের কথা ভাবল না। স্ত্রী না হয় শত্রু, না হয় মনের মতো হয় নি — এরা তো নিজের ছেলে। কে জানে, কোনদিনই স্বামীর মনের তল পেল না সে।

নিজের মনের তল অভয়পদই পেয়েছে কি কোনদিন?

ভবিষ্যতের চিন্তা তার স্বভাববিরুদ্ধ, কোনদিনই করে নি–আজ নতুন করে শুরু করবে সেটা সম্ভব নয়। কিন্তু অতীতের চিন্তাও তো আগে কোনদিন করে নি, সেটা কেন এখন নতুন করে পেয়ে বসলে তাকে?

এক একসময় নিজেই অবাক হয়ে যায়–নিজের মনের চেহারা দেখে। গীতা পড়ে নি সে বহুদিন অবধি, গীতা কেন–কোন বই-ই বিশেষ কখনও পড়ে নি–পরে এক-আধদিন দু’চারজনের কাছে গীতার কথা শুনে একটা বাংলা পদ্য গীতা যোগাড় ক’রে পড়েছে, এখনও পড়ে মধ্যে মধ্যে। না, সে সব কিছু নয়।

–নিজের মনে মনে, কবে যেন কোন্ সুদূর কৈশোরে প্রতিজ্ঞা ক’রে বসেছিল সে, সম্পূর্ণ নিরাসক্ত নির্লিপ্ত জীবন যাপন করবে। সংসারে থাকবে কিন্তু তাতে বদ্ধ হবে না। পাঁকাল মাছের মতো থাকবে। হাঁস যেমন জলে থাকে অথচ জল তার দেহের কোথাও লাগে না–তেমনই থাকবে সে সংসারের সহস্র আসক্তির মধ্যে।

এ কি কারও কথা শুনে কি কোন উপদেশে হয়েছিল? কে জানে, আজ আর তা মনেও নেই। সম্ভবত কারও মুখে এক সাধুর উপদেশের কথাই শুনেছিল সে। তবে সে কোন্ সাধু তা বলতে পারবে না। পরমহংস ঠাকুর কিংবা আর কেউ। তবে ঠিক সেই উপদেশেই এটা হয়েছে কিনা তারই বা ঠিক কি। আজ সবটাই যেন গোলমাল হয়ে গেছে মাথার মধ্যে, কিছুই পরিষ্কার মনে পড়ে না। হয়ত কোন একজনের কথায় হয়ও নি। ধীরে ধীরে, একটু একটু ক’রে সঙ্কল্পটা মনের মধ্যে গড়ে উঠেছিল।

কিন্তু তাতেই বা লাভ কি হল? পারল কি সেদিনের সে প্রতিজ্ঞা পালন করতে? সে সঙ্কল্পে অবিচল থাকতে? আসলে সে শক্তি ওর কোন দিনই ছিল না। একটা মিথ্যা অহঙ্কারকেই বুঝি এতকাল মনে মনে লালন করেছে–নিজেকে স্তোক দিয়েছে। কিছুই হয় নি তার, সাধনার সিদ্ধি মেলা তো দূরর কথা। যা মিলেছে তা হচ্ছে তার স্পর্ধার উত্তরে বিধাতার পরিহাস।

কে, দুর্দান্ত অর্থলোভ তো ছাড়তে পারে নি সে। কিসের নিরাসক্তি যদি ঐ স্থুল লোভটাই না ত্যাগ করতে পারল। এ লোভই তো তাকে কত না দুষ্কার্যে প্রবৃত্ত করাল, শেষ অবধি সেই লোভের কাছেই চরম মার খেতে হ’ল তাকে। একেই হয়ত ব’লে ভগবানের মার, বিধাতার বিচার!

অহঙ্কার! আসলে সে অহঙ্কারের সাধনা করেছে বসে বসে। এখনও তার চৈতন্য হয় নিবসে বসে আহত অহঙ্কারটাকেই সযত্নে লালন করছে সে। …

কাজ করতে করতে হাত থেমে যায় তার, মন অতীতের রোমন্থনে মগ্ন হয়ে পড়ে। সে মূর্খ, লেখাপড়া শেখে নি; কারখানায় কাজ করা যাকে বলে–হাতে-কলমে যন্ত্রপাতি নিয়ে নাড়াচাড়া করা–তাও খুব বেশিদিন করে নি সে–সাহেবদের স্নেহদৃষ্টিতে পড়ে ‘স্টোরে’ চলে গেছে সে কবেই। বাবুও নয় বেয়ারাও নয়–এমনি একটা কাজে রেখে দিয়েছিলেন সাহেবরা। পদটা যা-ই হোক, শেষ অবধি কার্যত সে-ই স্টোরের সর্বেসর্বা ছিল আর সেই সুযোগেই যুদ্ধের বাজারে দু’পয়সা রোজগারও করতে পেরেছিল।

সে কথা থাক। তখনকার দিনে সাহেবরা যোগ্যের মর্যাদা বুঝতেন। ইঞ্জিনিয়ারিং-এর ক-খ পড়া না থাকলেও যন্ত্রবিদ্যায় অভয়পদর একটা স্বভাবজ জ্ঞান ছিল; ওদিকে মাথা খেলত তার অসম্ভব। শুধু নক্সা দেখে দেখে অনেক জিনিস শিখে গিয়েছিল সে। জটিল যন্ত্রপাতি, কলকব্জা, তার কাছে জলের মতো পরিষ্কার ঠেকত। একদিন দৈবাৎ সেই পরিচয় পেয়েই ওদের এক সাহেব কারখানায় কাজ করার দায় থেকে অব্যাহতি দেন ওকে। তিনি ঝোঁকের মাথায় কোম্পানীর খরচে ওকে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ানোর প্রস্তাব করেছিলেন–কিন্তু অভয়পদই রূঢ় তথ্যের দিকটা দেখিয়ে দিয়ে তাঁকে নিবৃত্ত করে শেষ পর্যন্ত। যে ইস্কুলেই পড়ে নি বলতে গেলে–তাকে ইঞ্জিনিয়ার করা দু-এক বৎসরের কাজ নয়।

তারপর বহুদিন বহু সাহেবই ওকে নিজেদের কামরায় ডেকে পাঠিয়েছেন–নক্সা খুলে দেখিয়ে ওর পরামর্শ চেয়েছেন। সঙ্গে ক’রে যন্ত্রশালায় নিয়ে গেছেন। –অচল যন্ত্রের কোথায় কি গোলমাল ঘটেছে বুঝিয়ে দিয়েছে সে। নক্সার ভুলত্রুটি ধরে দিয়েছে, দুর্বোধ্য অংশ বুঝে নিতে সহায়তা করেছে। এই তো সেদিনের কথা, হাওড়ার ভাঙ্গা পুল মেরামত করার ঠিকা নিয়েছিল তাদের কোম্পানি। বিলেত থেকে ইঞ্জিনিয়ার এসে দেখে গিয়ে নক্সা পাঠিয়ে দিয়েছিল, সে নক্সা এদের মাথাতে ঢুকছিল না। তখন অভয়পদ পিঠে একটা প্রকাণ্ড কার্বাঙ্কল হয়ে শয্যাশায়ী, ডাক্তার এসে কেটে দিয়ে গেছে–চুপ ক’রে শুয়ে থাকতে বলেছে। সাহেবরা স্ট্রেচার আর গাড়ি পাঠিয়ে তাকে নিয়ে গিয়েছিলেন অফিসে, যে অংশটা এখানকার আট-দশ জন মিলেও বুঝতে পারছিল না–সেই অংশটা ওকে দেখাবামাত্র বুঝিয়ে দিয়েছিল সে, বড়সাহেব খুশি হয়ে ওকে পঁচিশটা টাকা দিয়েছিলেন সঙ্গে সঙ্গে– বকশিশ।

সেই কারণেই কেমন একটা বিশ্বাস দাঁড়িয়ে গিয়েছিল যে, যতদিন জীবিত থাকবে সে, ততদিন তার চাকরি যাবে না এ আপিস থেকে। আর যদিই কোনদিন অথর্ব হয়ে পড়ে ছুটি চায় তো সাহেবরা তার একটা পেসনের ব্যবস্থা ক’রে দেবেন–কিম্বা একটা মোটা গোছের থোক টাকা দিয়ে বিদায় দেবেন। এমন দিয়েছেনও ইতিপূর্বে–কোন কোন বিশেষ ক্ষেত্রে। কিন্তু কিছুই পেল না সে, কিছুই মিলল না। আবর্জনার মতো সরিয়ে দেওয়া হ’ল তাকে।

এও সেই লোভ। অতিরিক্ত লোভের জন্যই এমন হ’ল। বহুদিন আগেই অবসর নিতে পারত সে। পুরো মাইনের মায়ায় প্রাণপণে চাকরিটা আঁকড়ে ধরে ছিল। তদ্বির করেছে যাতে তার এই দীর্ঘকাল চাকরির কথাটা সাহেবদের কানে না যায়। সে মায়া যদি না করত, পুরনো সাহেবরা থাকতে থাকতে যদি অবসর চাইত, তা’হলে কিছু একটা সুব্যবস্থা তাঁরাই করে দিতেন। এখন নতুন আমল, নতুন লোক। তারা একটা লোককে এতকাল চাকরির সুযোগ দেওয়ার জন্যে বিরক্ত, ক্রুদ্ধ। পুরনো সাহেবদের নির্বোধ খেয়াল বলে ধরে নিয়েছে এরা। কোন এক বৃদ্ধ কর্মচারী অভয়পদর ইঞ্জিনিয়ারিং জ্ঞানের কথা বলতে গিয়েছিল– তারা হো হো ক’রে হেসে উড়িয়ে দিয়েছে। বলেছে, ‘তখনকার দিনে যে-সব সাহেব এসেছে, তারা নিজেরাও কেউ লেখাপড়া জানত না–তাই ঐ মূৰ্খ বুদ্ধকে নিয়ে নাচানাচি করেছে। এটা ইংরেজ জাতি এবং সমগ্রভাবে শিক্ষারই অপমান।’আমাদের কোন দরকার নেই ঐ ফসিলকে, আমরা যথেষ্ট পড়াশুনো ক’রে এসেছি।’….

শুধু তাই নয়–টাকা ধার-দেওয়ার ব্যাপারেও তারা সমস্ত অপরাধ অভয়পদর ঘাড়েই চাপিয়েছে, একজন স্থানীয় লোকের লোভের ফলে একটি ইংরেজের অকাল-মৃত্যু হল–এ চিন্তাও তাদের কাছে অসহ্য। …আরও শুনেছে তারা, গত যুদ্ধের সময় স্টোরের বহু মাল পাহারার মধ্য থেকে অদৃশ্য হয়ে যাওয়ার কথাও কানে গেছে তাদের। এসব জেনেও আগের সাহেবরা ওকে তাড়িয়ে দেন নি–এইতেই বিস্মিত বোধ করেছে। এমন সন্দেহও প্রকাশ করেছে যে–হয়ত ওর সঙ্গে তাঁদের কোন ভাগের বন্দোবস্ত ছিল নইলে এটা বরদাস্ত করেছিলেন কী ক’রে? তাই কোম্পানীর দেহে পুরাতন বিষাক্ত ক্ষত মনে করেই ওকে সরিয়ে দিয়েছে তারা, ঘৃণা ও অবজ্ঞায়। কোন সহানুভূতি কি বিবেচনার পাত্র মনে করে নি।…. দ্যাট্ ওল্‌ড্ মিসচিভাস্ ম্যান’–দীর্ঘদিন চাকরির পর নিজের সম্বন্ধে ওপরওলাদের এই ধারণা ও অভিযোগ নিয়ে নিঃশব্দেই সরে আসতে হয়েছে ওকে–কোন প্রতিবাদ কি প্রতিকারের পথ খুঁজে পায় নি।….

অপরিসীম আত্মগ্লানিই বোধ করার কথা। নিজেরই অসংখ্য নির্বুদ্ধিতার গ্লানি আর অনুশোচনা। করছেও তাই। আর বোধ করি সেটা থেকে অব্যাহতি পেতেই তার মন বরাবর চলে যাচ্ছে সেই দূর অতীতে, সেই অহঙ্কারের ক্ষেত্রগুলিতে–যখন বহু শত এমন কি সহস্রাধিক টাকা বেতনের সাহেব মনিবরা উদ্বিগ্ন মুখে ওর মুখের দিকে চেয়ে থাকতেন, আর ও স্নেহপরায়ণ বৃদ্ধ অভিভাবকের মতোই মধুর হাস্যে তাঁদের বরাভয় দিত আর শিশুদের অকারণ উদ্বেগ যেমন সস্নেহে ও সপ্রশ্রয়ে অথচ অতি সহজে দূর করে দেন তার পিতা-পিতামহরা–তেমনি ভাবেই দূর করে দিত তা। সে সময় বিনয়-হাস্যের মধ্যেও অহঙ্কারের পরিতৃপ্তিতে মুখ রঞ্জিত হয়ে উঠত ওর।

.

ন্যাড়ার বিয়ের কথাটা মেজকর্তা নিজেই তুলল। একেবারে হঠাৎ! এ নিয়ে যে কোন কথাবার্তা চলছে বা ছেলে-মেয়ে দেখাদেখি হচ্ছে তা কেউই জানত না–বোধ হয় মেজগিন্নীও না। একেবারেই না-বলা-কওয়া সেদিন মহাশ্বেতাকে ডেকে বলল অম্বিকাপদ, ‘ন্যাড়ার জন্যে মেয়ে মোটামুটি আমি একটা দেখে পছন্দ করেছি –তোমরা কেউ দেখেতে চাও? কিম্বা আর কাউকে দেখতে পাঠাবে?’

কথাটা বুঝতে অনেক দেরি লাগল মহাশ্বেতার, সে খানিকক্ষণ অবাক হয়ে দেওরের মুখের দিকে চেয়ে থেকে কতকটা অসংলগ্নভাবে প্রশ্ন করল, ‘কি দেখবে বলছ–? মেয়ে? মানে বে?…. কার বে?’

‘কার আবার–ন্যাড়ার বে গো, ন্যাড়ার। ও ছাড়া এখন বের যুগ্যি আর কে আছে বাড়িতে?’

‘ন্যাড়ার বে? এখন? বলি আমি তো আর পাগলও হই নি, আর ছন্নও হই নি এখন ওর বের কথায় নেচে উঠব! বে ক’রে খাওয়াবে কি ন্যাড়া মাগ ছেলেকে তাই শুনি? একা একটা পুরুষমানুষের দিন চলে যাবে, নিদেন মোট বয়েও খেতে পারবে, কিন্তু যার এক পয়সার রোজগার নেই সে বে করবে কি অনখক ন্যাঞ্জারি হয়ে শুকিয়ে মরবার জন্যে? –না নিজের ছেলেমেয়ে একটা একটা ক’রে চোখের সামনে না খেয়ে মরবে–সেইটে বসে দেখবে বলে?’

‘কেন? বুড়োর বৌ কি খেতে পাচ্ছে না?’ অম্বিকাপদ একটু ঝাঁঝের সঙ্গেই প্রশ্ন করে। হ্যাঁ–তা পাচ্ছে। মানছি! কিন্তু সে তো তোমার দয়া বই নয়। দয়া ক’রে দিচ্ছ তাই। তবে সে হয়ত একটা বলেই দিচ্ছে–গুষ্টিসুদ্ধকে যে তুমি এমনি চারকাল বসে খাওয়াবে– তার কোন লেখাপড়া আছে! পয়সা তো তোমার, তোমাকেই তো বুক-পোঁতা ক’রে দিয়েছে। এখন তুমি দোব না বললে জোর তো কিছু নেই!…তাছাড়া জীবন-মরণের কথাও আছে একটা। তুমি দিচ্ছ–তোমার ছেলেরা যদি না দেয়?….না, যা হয়ে গেছে, হয়ে গেছে–এর একটা কিছু হিল্লে না হ’লে ওকাজে যেতে দোব না। ….তোমার এত মাথাব্যথা তো তোমার ছেলের জন্যে, আমি বলছি তুমি তোমার বেটার বে দাও গে, তাতে কিছু দোষ হবে না। আমি কোন দোষ ধরব না অন্তত। যে যেমন বরাত নিয়ে এসেছে তাকে তাই ভোগ করতে হবে–মিছিমিছি পরকে দোষ দিয়ে লাভ কি?’

নিজের কানকে যেন বিশ্বাস করতে পারে না অম্বিকাপদ। বুড়োর বিয়ের কথা মহাশ্বেতাই তুলেছিল, তোলাই শুধু নয়, বিয়ে না হওয়া পর্যন্ত উত্ত্যক্ত ক’রে মেরেছিল সকলকে। এত হিসেব-নিকেশ তখন শোনা যায় নি। এ ধরনের কথা ওর মুখে একেবারে বেমানানও।

অম্বিকা জানে না, জানতে পারে নি–মহাশ্বেতা এই গত কমাসে অনেক শিখেছে। এতদিন যে জ্ঞানটা তাকে কেউ দিতে পারে নি–সেটা আপনিই তার মনে উদয় হয়েছে। চারদিক অন্ধকার ঠেকতে নিজে-নিজেই বুঝেছে সব। আগে জানবার চেষ্টা করে নি বলেই জানে নি। এখন ছোটবৌকে আড়ালে জিজ্ঞাসা ক’রে জেনে নিয়েছে। ওদের সম্পত্তি বলতে এই বাস্তু ছাড়া তাদের মোট ষোল বিঘে ধান-জমি আছে আর একখানা বাগান। …তার তিন বখরার এক বখরা পেতে পারে তার ছেলেরা। ছ’জন ছেলের পাঁচ বিঘে জমি―ভরসার মধ্যে তো এই। বাকি যা সবই মেজকর্তার। কোথায় একটা বাড়ি কিনেছে–সে মেজগিন্নীর নামে। ভাগের ভয়েই স্ত্রীর নামে কিনেছে। টাকা কম নেই তো হাতে। বড় ছোট চিরকাল সবই এনে ওকে ধরে দিয়েছে। ছোটর অবশ্য আলাদা কিছু আছে, চাকরি ছাড়লেও মোটা টাকা পাবে আপিস থেকে। তারাই শুধু নিঃস্ব।

অবশ্য, ছোটবৌ যা বলে, মেজকর্তা নিজে টাকা বাড়িয়েছেও ঢের। এদিকে ওর মাথা খুব। তেজারতি তো আছেই, ইদানীং আর একটা কারবার ধরেছে, বাড়ি বেচা কেনার কারবার। পুরনো বাড়ি কম দামে কিনে সারিয়ে-সুরিয়ে চকচকে ক’রে অনেক বেশি দামে বেচে দেয়। বলে, ‘এতে লোকসান যাবার ভয় নেই, বসে তো থাকে না–সুবিধেমত দাম পাই ভাল–না পাই ভাড়া বসিয়ে দেব। তাতেও লাভ।’ আরও বলে ‘শেয়ারের বাজারে ফাটকা খেলে, কি দাদার মতো চড়া সুদের লোভে শুধু-হাতে টাকা দিয়ে হঠাৎ নবাব হ’তে চাই না আমি। তার চেয়ে এ অল্প লাভের কারবার আমার ঢের ভাল!’

মহাশ্বেতা প্রতিপক্ষের অভাবে তরলার ওপরই ঝঙ্কার দিয়ে উঠেছিল, ‘বলি তাতেও তো পয়সা লাগে লো! এ তো সব কারবারই–যা যা বলছিস–মোটা টাকার খেলা। সে টাকা তো আর কেউ যোগায় নি। এই বড়কর্তাই এনে হাতে তুলে দিয়েছে। তাতে তো কোন সন্দ নেই আর।… তবে? ওর উচিত নয় এর ছেলেদের ভাগের ভাগ বুঝিয়ে দেওয়া– কি এদের নামে কোন সম্পত্তি ক’রে দেওয়া?’

তরলা কোন উত্তর দিতে পারে নি। শুধু ক্ষীণকণ্ঠে একবার বলেছিল, ‘তা উনি তো তেমনি গোটা সংসারটা টেনেই যাচ্ছেন–বিয়ে পৈতে সব খরচাই তো করছেন, কারও কাছে তো কিছু চান নি কোনদিন

‘হ্যাঁ তা করছেন কিন্তু সে তো ভিক্ষে। আমাদের হক্কের ধন যা তার জন্যে ওদের হাত-তোলায় থাকব কেন আমরা–কিসের জন্যে?’

এ সবই পুরনো কথা, পুরনো যুক্তি।

নতুন যা–তা নিজেদের সম্পূর্ণ অসহায় অবস্থা সম্বন্ধে পরিষ্কার ধারণা। তাইতেই তার কণ্ঠে এই অভূতপূর্ব দৃঢ়তা ফোটে আজ।

অম্বিকাপদ একটু অসহায় ভাবেই বলে, ‘তা কেন। সে আমার ছেলের বে দু বছর পরে হ’লেও চলবে। একেবারে তো অরক্ষণা হয়ে পড়ে নি। ন্যাড়ার কথাই ভাবছি, বয়স তো ওর ঢের হয়ে গেল। আর কবে বে করবে বলো!’

‘তা হোক। বয়স যতই হোক, কিছু একটা না হ’লে–অন্তত মাসে দশটা টাকাও আমদানীর পথ না হ’লে ছেলের বে দিতে দোব না আমি–এই সাফ বলে দিলুম!’

বোধ করি এই দৃঢ়তাতেই খানিকটা কাজ হয়।

দিন-আষ্টেক পরেই একদিন দাদার কাছে এসে কথাটা তুলল অম্বিকাপদ, মহাশ্বেতা সামনেই ছিল, তার শোনবার কোন অসুবিধে নেই দেখেই সে কথাটা সেই সময় পেড়েছিল–নিহাৎ সোজাসুজি বৌদির কাছে কথাটা পাড়তে বোধহয় আত্মসম্মানে আঘাত লাগে ব’লেই। বলল, ‘খটির বাজারে একটা ঘর দেখেছি দাদা, মনে করছি এদের একটা ছোটখাটো ডাল-মশলার দোকান ক’রে দেব। ইচ্ছে হ’লে চালও রাখতে পারবে। বুড়ো, ন্যাড়া, ধনা–এরা তো দিনরাত বসেই থাকে, সবাই মিলে যদি লাগে–বাড়তি লোকও লাগবে না, চুরিরও ভয় থাকবে না।

অভয়ের মুখে কোন ভাব পরিবর্তন হয় না এ প্রস্তাবে। শুধু বলে, ‘পারবে কি চালাতে? শুধু শুধু কতকগুলো টাকা নষ্ট করবে না তো? সব জিনিসেরই শিক্ষা দরকার, ব্যবসা করতে গেলেও সেটা শেখা দরকার। ওরা তো কিছুই শিখল না–’

‘না, আমি মনে করছি এখন খুব কম টাকা ঢালব, ছোটখাটো দোকান–আমাদের এ বাজারে অশ্বিনী যেমন দোকান করেছে তেমনি। শ’পাঁচেকের মতো খরচ করব আপাতত। তারপর–তেমন বুঝলে, ওদের যদি সে রকম আগ্রহ দেখি, আর কিছু দিলেই হবে। তাছাড়া হিসেব-পত্রগুলোও আমি মধ্যে মধ্যে গিয়ে দেখতে পারব–একেবারে নয় ছয় করতে পারবে না!’

‘দ্যাখো–যা ভাল বোঝ করো গে। আমি আর কি বলব।’

সংক্ষেপে এইটুকু বলেই সব দায়িত্ব নামিয়ে দেয় অভয়পদ।

মহাশ্বেতার কাছে প্রস্তাবটা এমনই অভিনব, এমনই অকল্পিত যে প্রথমটা সে কোন কথাই বলতে পারে নি। এইবার সে একটু ক্ষীণ আপত্তির সুরে বলে, ‘মুদিখানা! ভদ্দরলোক বামুনের ছেলে মুদির দোকান দেবে!’

অম্বিকা জবাব দেয়, ‘ভদ্দরলোক বামুনের ছেলেকে তো লোহাপেটা কারখানায় দিতে চাইছিলে, তার চেয়েও কি এ কাজ খারাপ? এ তো স্বাধীন ব্যবসা। লেগে থেকে চালাতে পারলে ঐ থেকেই লাখ লাখ টাকা রোজগার করতে পারবে!’

কথাটা অবিশ্বাস্য, সে বরাত তার নয়–তা মহাশ্বেতা ভাল রকমই জানে। লাখে দরকার নেই, এখন কোনমতে দিনগুজরানের মতো কিছু হলেও তো হয়। তা-ই হবে কি? পারবে কি ব্যাটারা চালাতে?

তবু, সংশয়ের মধ্যেও, কোথায় যেন আশা ও আশ্বাসের আভাস পায়। কিছু তো একটা হচ্ছে। যাই হোক–তবু তাদের নিজস্ব কিছু।

সে মনে মনে মা সিদ্ধেশ্বরীর কাছে পূজো মানত করে। যেদিন দোকান খোলা হবে সে দিন সে আলাদা পূজো দেবে। পূজো আর হরির লুট!

॥৩॥

রানীর শরীর দিন দিন খারাপ হয়ে পড়ছে সেটা সবাই লক্ষ করলেও ঠিক যে এতটা খারাপ হয়েছে তা কেউ বুঝতে পারে নি। একেবারে শয্যাশায়ী হয়ে পড়তে সকলকার খেয়াল হল।

আসলে রানীই বুঝতে দেয় নি কিছু, যতটা পেরেছে যতক্ষণ পেরেছে সংসারে খেটে গেছে। এবার আর পারল না–একেবারেই ভেঙ্গে পড়ল।

কমলা অস্থির হয়ে উঠলেন। তাঁরও শরীর ভেঙ্গেছে দস্তুর মতো। বর্ষা পড়লেই পেট ছেড়ে দেয়, হাত-পা ফুলে ওঠে। এই বৌই তদ্বির-তদারক করে টোটকা-টুটকি খাইয়ে কোন মতে সারিয়ে তোলে। শীতকালটা ভাল থাকেন তিনি গরমটাও কোন মতে কাটে– বর্ষা পড়লেই আবার যে-কে সেই। কিন্তু ভালই থাকুন আর মন্দই থাকুন, খাটবার শক্তি তাঁর একেবারেই চলে গেছে। নতুন বাড়িতে এসে উৎসাহের প্রাবল্যে দিনকতক খুব খেটেছিলেন–এখন আর মোটেই পারেন না। কোন মতে বসে রান্না করতেও কষ্ট হয় তাঁর। এই বৌয়ের ওপরই ভরসা। বৌয়ের চেহারা যে দিন দিন শুকিয়ে কালি হয়ে যাচ্ছে তা তিনিও দেখেছেন–শ্যামা তো বহুবারই বলেছেন তাঁকে, কিন্তু তিনি কি করবেন–কীই বা করতে পারেন! তাঁর যতটুকু সাধ্য-সামান্য সামান্য চিকিৎসা করিয়েছেন, য়্যালোপ্যাথী, হোমিওপ্যাথী, টোটকা, দৈব। সাধ্যে আর সময়ে যতটুকু কুলিয়েছে।

গোবিন্দ কিছুই পারে না। তার আপিসের অবস্থা আরও শোচনীয় হয়ে উঠেছে। ভরসা করে ওখানটা ছাড়তে পারলে হয়ত অন্য কোথাও কাজ পায় এখনও–কিন্তু সেই ভরসাটাই ওর নেই। চিরদিন, বলতে গেলে বাল্যকাল থেকে, এক জায়গায় কাজ করে এসে –অন্য কোথাও যে কাজ পাওয়া সম্ভব, বা সে কাজ পাওয়ার জন্যে কীভাবে চেষ্টা করতে হয়–সে সম্বন্ধে কোন ধারণাই নেই তার। এ চাকরিও পেয়েছে সে বিনা-তদ্বিরে, না চাইতেই; বন্ধু এসে ডেকে নিয়ে গিয়ে বসিয়ে দিয়েছে, কাজ শেখার ব্যবস্থা করে দিয়েছে। লোকমুখে শুনেছে, নিত্যই শোনে যে চাকরির বাজার খুব খারাপ। ভয়ও হয় তার–এই বাজারে কোথায় আবার চাকরি খুঁজতে বেরোবে সে, কার কাছেই বা যাবে! সুতরাং সেইখানেই পড়ে আছে সে–কাজ কমে নি, মাইনে বরং আরও কমেছে।

না, চাকরি ছাড়তে পারে নি সে। যেটা পেরেছে সেটা হ’ল এক বইওলার কাছে উপরি কিছু কাজ যোগাড় করতে। এঁদের চিঠিপত্র লিখে দেওয়া, প্রুফ দেখা, কপিবুকের নক্সা করা– মায় ভূগোলের বইয়ের ম্যাপ আঁকা–সবই করতে হয় তাকে প্রয়োজনমতো–তার জন্য পারিশ্রমিক মেলে মাসিক কুড়িটি টাকা, তাও তিন-চার কিস্তিতে। গোবিন্দর হাতের লেখা ভাল–ম্যাপের কাজ করে করে খুব পরিষ্কার লিখতে শিখেছে, ছাপাখানা সম্বন্ধেও কিছু জ্ঞান আছে, সব মিলিয়ে ওকে পেয়ে তাঁদের সুবিধা হয়েছে ঢের, হয়ত চেপে ধরলে তাঁরা আর কিছু বাড়িয়েও দিতে পারেন–কিন্তু সেটুকু জোর করবারও সাহস নেই ওর।

তবু এটা মন্দের ভাল। মেয়েরা বড় হয়ে উঠেছে, পেট বেড়েছে, শুধু খাই-খরচাই কত। এই বাড়তি টাকাটা পেয়ে গ্রাসাচ্ছাদনের টানাটানিটা কমেছে, দু টাকা মাইনে দিয়ে একটা ঝিও রাখতে পেরেছেন বাসন মাজার–কিন্তু ঐ থেকে আবার ঘটা করে কারও চিকিৎসা চালানো অসম্ভব। তাছাড়া গোবিন্দর সময়টাও একেবারে কমে গেছে। সকালে স্নানাহার সেরে আটটা আঠারোর ট্রেন ধরতে হয় তাকে–পৌনে আটটায় না বেরোলে গাড়ি ধরা যায় না। ঐ ট্রেনে গিয়েও তার নাকি দেরি হয়ে যায়, লোকজন এসে দাঁড়িয়ে থাকে। তারপর দুটো চাকরি সেরে ফেরে একেবারে শেষ গাড়িতে–বাড়ি পৌঁছতে এগারোটা বেজে যায়। শুধু শনিবারটাতে একটু আগে ফেরা হয়–আটটা দশ কি আটটা চল্লিশের ট্রেন ধরে।

এর মধ্যে তো নিঃশ্বাস ফেলবারই অবকাশ নেই। ছুটি বলতে এক রবিবার–কিন্তু সেদিন আর নড়তে চায় না গোবিন্দ। কোথাও বেড়াতে যাওয়া কি আড্ডা দিতে যাওয়া তো দূরের কথা–বাজার-উটনোই আনতে পারেন না কমলা। গোবিন্দরও বয়স হয়ে আসছে, এত খাটুনি তার পোষায় না আর, নিতান্ত বাধ্য হয়েই যেটুকু করতে হয়–তার বেশি কিছু করতে চায় না।

তবু রানী একেবারে শয্যাশায়ী হয়ে পড়তে তারও টনক নড়ে। মরিয়া হয়ে পাড়ার চার টাকা ভিজিটের বড় ডাক্তারকেই ডেকে আনে সে। কিন্তু তিনি এসে পরীক্ষা করে দেখে ভুরু কোঁচকান। বাইরে এসে বলেন, ‘এ করেছেন কি, এ তো শেষ করে এনে তবে ডেকেছেন আমাকে! কতদিন থেকে এমন হয়েছে তা কেউ লক্ষও করেন নি! যা খেয়েছেন তা কিছুই হজম হয় নি–ওঁর দেহ প্র্যাকটিক্যালি কোন খাবারই পায় নি দীর্ঘকাল। লিভার একেবারে নষ্ট হয়ে গেছে। শরীরে এক ফোঁটা রক্ত নেই, হার্টের অবস্থাও খুব খারাপ বাড়িতে এর চিকিৎসা হওয়া অসম্ভব। আপনাদের সাধ্যে কুলোবে না। এখনই যদি কোন বড় হাসপাতালে নিয়ে গিয়ে ফেলতে পারেন তো কিছু আশা আছে–কিন্তু সেও আপনাকে ওআর্ন করে দিচ্ছি–এক আনার বেশি নয়। বাড়িতে রাখলে আর বড় জোর দিন কুড়ি- পঁচিশ, এর বাইরে যাবে বলে মনে হচ্ছে না!

দু-একটা দামি ওষুধ লিখে দিয়ে, তাঁর ফি নিয়ে চলে গেলেন ডাক্তার। গোবিন্দ কিন্তু চোখে অন্ধকার দেখলে একেবারে। সর্বনাশ এত আসন্ন তা সে কল্পনাও করে নি। প্ৰথম কৈশোর থেকেই স্ত্রীর সেবা-যত্নে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছে সে। ভাগ্যক্রমে দুটি স্ত্রীই পেয়েছিল সে সুগৃহিণী, কখনও কোন দিকে তাকাতে হয় নি–দৈহিক আরাম এবং স্বাচ্ছন্দ্য, এই অল্প আয়ের মধ্যে যতটা পাওয়া সম্ভব তার চেয়ে বেশিই পেয়েছে। আজ এই এতকাল পরে, প্রৌঢ়ত্বে পৌঁছে স্ত্রী থাকবে না–তাকে একা সংসার করতে হবে–একথা ভাবতেই বুকের মধ্যে কেমন করে উঠল।

অনেকটা সামলে নিয়েই ঘরে ঢুকেছিল, তবু তার মুখের দিকে চেয়ে একটু হেসে রানী বলল, ‘কী হ’ল–ডাক্তার জবাব দিয়ে গেল তো? তোমার যেমন মাথা খারাপ, মিছিমিছি এক গাদা টাকা দণ্ড!‘

নিতান্তই সহজ শান্ত সুর। যেন আর কারও কথা বলছে সে, আর কোনও কথা। নিজের মৃত্যুর কথা নয়!

গোবিন্দ অবশ্য কথাটা উড়িয়ে দিতে চেষ্টা করে, ‘জবাব দেবার কথা আবার কে বললে! এই তো সব ওষুধ দিয়ে গেল। বাইরে নিয়ে গিয়ে বলছিল–হ্যাঁসপাতালে ভর্তি করে দেবার কথা। শক্ত অসুখ, দামি দামি ওষুধ লাগবে–পারবেন কি সে খরচা চালাতে–এই বলছিল।’

কিন্তু সহজে বলতে পারে না শেষ পযন্ত, গলা কেঁপেই যায়। কান্নার মতো আওয়াজ বেরোয়। রানী কিন্তু আর কিছু বলে না, হাসে একটু। ছেলেমানুষদের কাণ্ডকারখানা দেখলে বয়স্করা যেমন হাসেন তেমনি। খানিকটা পরে একেবারে অন্য কথা পাড়ে, ‘হ্যাঁ গো, আমাকে একখানা খাম এনে দেবে–ডাকের খাম?’

অনুরোধটা যেমন অপ্রত্যাশিত তেমনি আকস্মিক। বর্তমান আলোচ্য বিষয়ের সঙ্গে একেবারেই যোগাযোগহীন। গোবিন্দ ঠিক বুঝতে না পেরে স্ত্রীর মুখের দিকে চেয়ে থাকে, সন্দেহ হয়–মাথার কোন গোলমাল হ’ল কিনা। ভুল বকছে না তো!

কিন্তু রানী খিলখিল করে হেসে ওঠে। সেই মুক্তোঝরা হাসিটা এখনও তার আছে বুঝি। বলে, ‘ওমা, জন্মের মধ্যে কম্ম, মরণকালে একখানা খাম চেয়েছি, তাতেই যে তোমার বাক্যি হরে গেল দেখতে পাই। বলি কোনকালে কি খামের নাম শোন নি–না নশো পঞ্চাশ টাকা খরচের কথা ভাবছ। আমার কি কাউকে একখানা চিঠি লিখতেও নেই?’

‘তা কেন। তা বলছি না। হঠাৎ এর মধ্যে খামের কথা–। বাপের বাড়িতে লিখবে?’

গোবিন্দ অপ্রতিভ হয়ে পড়ে।

‘থাক, হয়েছে। একখানা চিঠি লিখব তা কাকে কী বিত্তেন্ত–ছ বুড়ি ছত্রিশ গণ্ডার কৈফেৎ! দেখছি মেয়েটাকেই পাঠাতে হবে। যা পথ–ডাকঘর কি হেথায়–অন্তত একটি ক্রোশ রাস্তা, মেয়ে বড় হয়েছে–অতদূর পাঠাতে ইচ্ছা করে না। দেখি মল্লিকদের ছোট ছেলেটা যদি এনে দেয়–’

শেষের দিকের কথাগুলো যেন আপন মনেই বলে রানী। কথা বেশিক্ষণ ঠিক মতো বলতে পারে না আজকাল। একসঙ্গে দুটো-চারটে কথা কইলেই শেষের দিকে গলা স্তিমিত হয়ে আসে, শব্দগুলো যেন জড়িয়ে জড়িয়ে যায়। এইতেই আরও ভয় পেয়ে যাচ্ছেন কমলা। লক্ষণ তাঁর ভাল ঠেকছে না আদৌ।

পরের দিন খাম আনিয়ে কোন মতে কনককে চিঠি লেখে একখানা। একেই হাতের লেখা তত ভাল নয়–তাতে দুর্বল হাতে আরও এঁকেবেঁকে যায়, কলম ধরতেই পারে না ভাল করে। তবু মেয়েকে দিয়ে লেখায় না, নিজেই লেখে চেষ্টা করে করে–অনেকক্ষণ ধরে।

লেখে, ‘কৈ লো, খুব তো বলেছিলি মরণের সময় অবিশ্যি আসবি। এবার আয়! আর দেরি করলে তো দেখাই হবে না। বড়জোর আর সাত-আটটা দিন আছি। শিগগির চলে আয়। বর না আসতে পারে, অন্য কাউকে নিয়ে একাই চলে আসিস!

ব্যস। ঐ দু ছত্র চিঠি। কোন সম্ভাষণ নেই, কুশল প্রশ্ন নেই। এইটুকু লিখতেই প্ৰাণ বেরিয়ে গেল তার। আর লেখার প্রয়োজনই বা কি। সচেতন মৃত্যুপথযাত্রীর কাছে আজ যেন সব কিছুই অবান্তর, অর্থহীন ঠেকছে।

কনক চিঠিটা পেয়ে প্রথমে মনে করল তামাশা। রানীর স্বভাবজ কৌতুকপ্রিয়তা। তবু অস্বস্তিও বোধ করতে লাগল একটা। এ আবার কী ধরনের তামাশা। অথচ ঠিক সত্য বলেও ভাবতে পারে না। সত্যি সত্যিই কি মানুষ নিজের মৃত্যুর কথা এমনভাবে লিখতে পারে?… আবার মনে হয় রানী-বৌতে সবই সম্ভব। জীবনটাই তার কাছে প্রকাণ্ড একটা কৌতুক বলে মনে হয়–মৃত্যুটাও হয়ত তাই। তাছাড়া কান্তির বিয়ের সময় গিয়ে ওর শরীরটা খুবই খারাপ দেখে এসেছে, নিয়ে আসতে চেয়েছিল এখানে–তা তো এল না, তারপর যদি সারতে পেরে না থাকে তো, এতদিনে খুবই খারাপ হয়ে পড়বার কথা। আর সারবেই বা কি করে–কি দিয়ে। অবস্থা তো নিজেই দেখে এসেছে কনক।

চিঠি বিলি হয়েছে বেলা বারোটা নাগাদ। অবশিষ্ট সারা বেলাটা ছটফট করে বেড়াল সে। বিকেলে হেম বাড়ি ফিরতে চিঠিখানা তার হাতে দিয়ে উদ্বিগ্ন মুখে চেয়ে রইল।

‘এর মানে কি বলে দাও আমাকে, আমার মাথাতে তো কিছু ঢুকছে না। সত্যি কথাই লিখেছে, না তামাশা?

হেমও কিছু বুঝতে পারে না। তবু পড়তে পড়তে তার মুখও বিবর্ণ হয়ে ওঠে।

‘কি করে বলি বলো দিকি। লেখা তো খুবই জড়িয়ে জড়িয়ে গেছে, তবে সে অনব্যেসেও হতে পারে।…. কিন্তু যার সাত-আট দিনের বেশি বাঁচবার মেয়াদ নেই–তার পক্ষে কি নিজের হাতে চিঠি লেখা সম্ভব?’

‘তা হ’লে কী করবে?’

তাই তো ভাবছি। বড়দাকে একটা চিঠি লিখে দেখব?’

কিন্তু সত্যিই যদি এমন ধারা এখন-তখন অবস্থা হয়–তাহলে কি অত দেরি সইবে…. চিঠি যাবে উত্তর আসবে, তারপর তুমি পাস লেখাবে–সে তো অন্তত পাঁচ-ছ দিন!’

‘তাহলে চলো। কালকেই পাস লেখাই। যদি তেমন হয় তো তোমাকে রেখে চলে আসব, নয়ত তখনই ফিরব। তিন-চার দিনের ছুটি চাইলে হয়তো পাওয়া যাবে।’

কনক বাইরে বেরিয়ে পুরনো দইয়ের হাঁড়িতে বসানো তুলসীগাছটার কাছে এসে গলায় আঁচল দিয়ে প্রণাম করে জানায়, ‘ঠাকুর,এই কটা দিন তাকে বাঁচিয়ে রেখো অন্তত গিয়ে যেন দেখাটা পাই!’ এককালে যে স্ত্রীলোকটি সম্বন্ধে তার ঈর্ষার অন্ত ছিল না, আজ তার সম্বন্ধে নিজেরই এই আকুলতা নিজের কাছেও আশ্চর্য লাগে।..

কনক ঘরে ঢুকে সেই ফ্যাকাশে চামড়ায়-ঢাকা কঙ্কালটার দিকে চেয়ে ডুকরে কেঁদে উঠল বটে, কিন্তু রানীর মুখে-চোখে একটা অনির্বচনীয় তৃপ্তির হাসিই ফুটে উঠল। সেই হাসি–এখনও তেমনি মিষ্টি আছে, আশ্চর্য। যে হাসির দিকে চেয়ে একদা হেমের মনে হ’ত সারা জীবন শুধু এই হাসি দেখে কাটিয়ে দেওয়া যায়; তার চেয়ে বড় সার্থকতার কথা সেদিন ভাবতে পারত না সে। রানী যখনই হাসে কেমন একরকম খিলখিল করে হাসে, যেন একটা আনন্দ সে হাসির সঙ্গে ভেঙ্গে ছড়িয়ে পড়ে চারদিকে। অতি মধুর একটা সুরের মতো মিষ্টি শব্দ হয় সে হাসির, কানে গেলে সুগীত সঙ্গীতের মতোই একটা আবেশের সৃষ্টি করে।

আজও সেই হাসি তেমনি অম্লান, তেমনি প্রাণবন্ত আছে। দেখলে মনে হয় জীবনে কোনদিন কোন দুঃখ পায় নি সে, কোন আশাভঙ্গের বেদনা তাকে স্পর্শ করতে পারে নি, কোন অপূর্ণতা তার ছায়াপাত করতে পারে নি ওর মনে। এই অবিশ্বাস্য রূপ-গুণ নিয়ে যে অনায়াসে রাজা কি রাজার চেয়েও বড় ধনী কি প্রতিপত্তিশালী লোকের ঘরে পড়তে পারত, কোন সম্ভ্রান্ত বা বিখ্যাত লোকের স্ত্রী হ’লেই যাকে বেশি মানাত, তার অসামান্য রূপ-গুণের প্রকৃত সমাদর হ’ত, কাজে লাগত সেগুলো–সামান্য বেতনের উদ্যমহ্যন নিতান্তই সাধারণ একটি কেরাণীর হাতে পড়ে কোনদিকেই কোন সার্থকতা মিলল না জীবনে–তার এই হাসি দেখলে বাস্তবিকই বিস্ময় লাগে। সে হাসি শুধু অপরেরই দুঃখ ভোলায় না শুধু অপরের মনে স্নিগ্ধমধুর মোহের সৃষ্টি করে না–সে হাসি নিজের জীবনেরও পরিপূর্ণতা ঘোষণা করে। সে সুখী, সে তৃপ্ত–কোনও ক্ষোভ, কোন মালিন্য, কোন দৈন্য, কোন রিক্ততা যেন তার জীবনকে কখনও কিছুমাত্র বিড়ম্বিত করে নি, অথবা করলেও সে কথা ভুলে গিয়েছে সে, তার জন্য কাউকে দায়ী মনে করে না–কোথাও সেজন্য এতটুকু অনুযোগ নেই তার মনে।

হাসিটা সামলে কথা কইতে একটু সময় লাগে রানীর। বোধহয় ঐটুকু হাসতে গিয়ে তার দম ফুরিয়ে গেছে সাময়িকভাবে। কিন্তু পরে যখন কথা কয়, একেবারে ধমক দিয়ে ওঠে সে কনককে, ‘আ মর–কেঁদে মরছিস কেন এখন থেকে? এরও কি আগাম বায়না চলে নাকি?…. শোন, চোখ মোছ–কান্নার ঢের সময় পাবি, এখন তুলে রাখ্ ওটা… এই এখানে কাছে এসে বোস দিকি, এত জোরে বেশিক্ষণ কথা বলতে পারি না আর। ভয় নেই, ছোঁয়াচে রোগ নয়। কাছে এলে ক্ষেতি হবে না!’

তারপর, কনক একেবারে বিছানার ধারে এসে বসলে, নিজের শীর্ণ কম্পিত হাত খানি কনকের হাতের ওপর রেখে বলে, ‘এসে পড়েছিস না আমি বেঁচেছি। যা ভয় হয়েছিল। মনে হচ্ছিল চিঠিটা হয়ত পাবি না, কিম্বা পেলেও এতটা বাড়াবাড়ি বিশ্বাস করবি না। অথচ গোনা দিন কেটে যাচ্ছে, মেয়াদ শেষ হয়ে আসছে একটি একটি করে নিত্যই। এরপর এলে হয়ত আর কথা কইতে পারতুম না–বেঁচে থাকলেও!’

তারপর খানিকটা দম নিয়ে আবার বলে, ‘কেমন আছিস কী বিত্তান্ত পরে হবে। এখন মন দিয়ে শোন–কদিনের ছুটি নিয়ে এসেছিস তা তো জানি না, যদি মরা পর্যন্ত থাকতে পারিস তো ভালই, নইলে আগে গেলে আগেই নিয়ে যাস। ছেলেটার কথা বলছি লো, এবার অতি-অবশ্য ছেলেটাকে নিয়ে চলে যাবি, কারও কোন কথা শুনবি না। তোকে একবারে দিয়ে গেলুম, আজ থেকে তোর ওপরই পুরো ভার দেওয়া রইল। তোর ছেলেমেয়ের সঙ্গে মানুষ করবি–যেমন পারিস। খরচ-পত্তর কিছু দিতে পারবে না তোর ভাসুর, সে ভরসা নেই। তবুও তোকে বলতে আমার এতটুকু সঙ্কোচ হচ্ছে না, তার কারণ তোকে আমি চিনে নিয়েছি, হয়ত ঠাকুরপোর চেয়েও ভাল চিনেছি। একমাত্র তোকেই এ দায় গছানো যায় অনায়াসে। নইলে আমার বাপের বাড়িতে তো হাটের ফিরিঙ্গি, বোনই রয়েছে একগাদা। তাদের চেয়ে তুই ওকে ঢের বেশি দেখবি তা আমার বিশ্বাস আছে। তাছাড়া ঠাকুরপোও–যত দুঃখীই হোক, পয়সার যত মায়াই হোক ওর–আমার ছেলেকে ও ফেলবে না–আমি জানি।’

আরও খানিকটা চোখ বুজে শুয়ে থাকে রানী–শ্রান্তভাবে, তারপর চুপি চুপি বলে, ‘কথা কইতে বড্ড কষ্ট হচ্ছে আজ। একসঙ্গে এতকথা আজকাল আর বলতে পারি না। তার ওপর তোদের দেখে এত কথা একসঙ্গে ঠেলাঠেলি করছে বুকের মধ্যে যে–তাইতেই যেন আরও কষ্ট হচ্ছে, হাঁপ ধরছে।’

কনক এতক্ষণ পরে কথা বলার অবকাশ পায়। ব্যাকুল হয়ে বলে, ‘থাক না দিদি, এখনই সব বলতে হবে তার মানে কি? আমরা তো এখনও আছি কদিন!’

‘তোরা আছিস, কিন্তু আমি থাকব কিনা, সেইটেই যে ঠিক পাচ্ছি না। কেবলই ভয় হচ্ছে যদি বা দুটো-একটা দিন আরও থাকি–বুলি হয়ত হরে যাবে। জিভটা কেমন এলিয়ে এলিয়ে যাচ্ছে–দেখছিস না?… না বলেই নিই–যা বলবার।’

তারপর কনকের দিকে কেমন যেন বিস্ফারিত চোখে চেয়ে বলে, ‘আমার বড্ড ভয় হ’ত যে তুই হয়ত আমাকে ভুল বুঝে বসে থাকবি! আবার ভাবতুম যে আমি যখন বিবেকের কাছে খালাস আছি–তখন এত ভয়ই বা কিসের? ঠাকুরপোকে দিয়ে আমার ভাইয়ের অভাব বন্ধুর অভাব মিটেছিল। তার চেয়ে বেশি কিছু–অন্য চোখে কোনদিন দেখেছি কি অন্যভাবে ভেবেছি বলে তো আমার মনে হয় না। নিজের মন বেশ ক’রে দেখবার চেষ্টা করেছি–মনের কাছে পোষ্কার আছি আমি, একথা জোরগলায় বলতে পারি। আর ঠাকুরপোও বোধ হয়– ঠিক যাকে কুদৃষ্টিতে তাকানো বলে তা কোনদিন তাকায় নি। আমাকে দেখে ওর চোখ বেঁধে গিয়েছিল এই পর্যত। কী চায় তা বোধ হয় নিজেও ভেবে পায় নি কোনদিন!’

আবারও হেসে ওঠে একটু, তবে এবার নিঃশব্দে নয়, অভ্যাসমতো খিল-খিল ক’রেই হেসে ওঠে, বলে, ‘তবে ভাই আজ মানছি, মরণের দিকে পা তুলে আর মিথ্যে কথা বলব না, দোষও ছিল একটু। তোর যে কী করে দিন কাটছে তা আমি জানতুম। তবু গোড়াতেই কাটান ছিঁড়েন করে দেবার চেষ্টা করি নি, তোর বরকে সরিয়ে দিতে পারি নি। আমাকে দেখে অবাক হয়ে গেছে, আমার কাছে থাকতে পেলে ও আর কিছু চায় না–এইটেই মিষ্টি লাগত মনে মনে। কে জানে–মেয়ে জন্মেরই দোষ বোধ হয়, পুরুষ পায়ের কাছে ঘুরঘুর করছে এটা জানতে পারলে আর কিছু চায় না, পুরুষ নাচাতে মেয়েজাতের বড় সুখ। আবার তাতে যদি জানতে পারে সে অপর মেয়ের মনে রীষ হচ্ছে এজন্যে, তো কথাই নেই।…কিন্তু আজ সেজন্যে সত্যিই মনে মনে বড় আপসোস হয়, বিশ্বাস কর! আজ বুঝতে পারি সেদিন কী কষ্ট পেয়েছিস তুই, মনে হয় এটা, খেলার জিনিস নয়। তুই তো মিথ্যে বলে জানতিস না–তোর মনে সেটা সত্যি ছিল,…তবে তাও বলি, তুই বড় বোকাও ছিলি, পুরুষকে জোর ক’রে বশ করতে হয়–কবে তার দয়া হবে বলে বসে থাকতে আছে?…যাক, সে সব কথা ভুলে যাওয়াই ভাল। আজ যখন ষোল আনা বুঝে পেয়েছিস তখন মনে আর কোন দুঃখ রাখিস নি বোন– হয়ত সেইটুকু অন্যায়ের জন্যেই আমাকে, ছেলে-মেয়ে স্বামী, নিজের নতুন বাড়ি, এমন পাতানো সংসার ফেলে এমন অসময়ে চলে যেতে হচ্ছে–কে জানে। অন্তত সেই ভেবেই তুই আমাকে মাপ করতে চেষ্টা করিস, আর কোন অভিমান রাখিস নি!’

‘কী বলছ দিদি, ছি! আমার মনে আর কোন ময়লা নেই। যখন ছিলও, তখনও তোমার কোন অনিষ্ট চিন্তা করি নি।’

‘তা জানি। সেইজন্যেই তো এত লোক থাকতে মরবার সময় তোকেই ডেকেছি, সবচেয়ে ভারী বোঝাটা তোর ঘাড়েই চাপিয়ে যাচ্ছি।’

হেম বাইরে গোবিন্দর সঙ্গে কথা কইছিল। এখন দুজনেই কাছে এসে দাঁড়াল। হেমের দিকে চেয়ে হেসে বলল, ‘ঠাকুরপো, তোমাদের হাতে ছেলেকে দিয়ে যাচ্ছি ভাই, যতটা পারো মানুষ ক’রো। মেয়েরা সেয়ানা হয়েছে–ওদের বিয়ে দিতেই হবে তোমার দাদাকে — যেমন করে হোক, আর বিয়ে হয়ে গেলে ওদের দায়ে নিশ্চিন্তি, যে যার শ্বশুরবাড়ি চলে যাবে। ছেলেটার জন্যেই ভাবনা।’

একটু থেমে–স্বামীর দিক তাকিয়ে একটু মুচকি হেসে আবার হেমকেই বলল, ‘তোমার দাদাকে আবার বিয়ে করতেই হবে, বিয়ে না ক’রে থাকতে পারবে না ও, বৌ একটা অব্যেসে দাঁড়িয়ে গেছে তো!…তা সে মানুষটার ওপর চিরকালের জন্যে সতীনের একটা বোঝা চাপিয়ে যেতে চাই না!’

গোবিন্দ ম্লান হেসে বললে, ‘হ্যাঁ–তা আর নয়! আবার বিয়ে করছে না…পঞ্চাশ অনেকদিন পেরিয়ে গেছে…সে হুঁশ আছে?’

‘বড্ড আপসোস হচ্ছে, না? মলুমই যদি সেই তো দু’চার বছর আগে মলুম না কেন?…তা বাপু অত ভেবেচিন্তে দেখি নি–দেখলেও না হয় দু’দিন আগে তৈরি হতুম। সে যাকগে মরুক গে–অপরাধটা ক্ষ্যামাঘেন্না করে নিও; কী আর করবে। তবে বিয়ে তোমাকে করতে হবেই, করবেও–তার জন্যে অনখক লজ্জা পেও না। ষোল বছর বয়স থেকে ঘরণী গিন্নী বৌ নিয়ে ঘর করছ–এই বুড়ো বয়সে বৌ ছাড়া থাকতে পারবে না।…মার তো ঐ অবস্থা, তাঁকেই কে দেখে তার ঠিক নেই।…ঠাকুরপো, একটা মেয়ে দেখেশুনে দিও তো ভাই, লক্ষ্মীটি। তবে যেন খুঁজে পেতে আমার চেয়ে সুন্দর একটা ধরে এনো না–তাহ’লে মরেও শান্তি পাব না! রূপের গরবটা যেন থাকে আমার।’

অনেক চেষ্টায় অনেক কথা বলে একেবারেই বুঝি শক্তির শেষ সঞ্চয়টুকু ফুরিয়ে যায় তার। শ্রান্ত হয়ে হঠাৎ চোখ বোজে, আর বুজেই থাকে। চোখও খোলে না বা কথা বলার চেষ্টাও করে না আর।

.

রানীদি যা আশঙ্কা করেছিল তা যে আদৌ অমূলক নয়–সেটা ক্রমশঃ বুঝতে পারে কনক। নিজের মৃত্যু সম্বন্ধে রানীর নির্ভুল হিসাব দেখে অবাক হয়ে যায় সে। সত্যি সত্যিই বুলি হরে গেল ওর–সেইদিন, সেই মুহূর্ত থেকে। তারপর দুটো দিন দুটো রাত একটাও কথা কইল না, একবারও চোখ খুলল না। অথচ সেটা ঘুম নয়–তাও বুঝতে কোন অসুবিধা রইল না কারও। কারণ কনক যতবার ওষুধ কি পথ্য খাওয়াতে গেল–হাঁ করতে বলতেই হাঁ করল সে। খেলও একটু হয়ত–এক আধ ঢোক। কিন্তু খেতে বোধ হয় কষ্ট হচ্ছিল তার, একটু খেয়েই শ্রান্তি বোধ করছিল–একবার দুবারের পরই ঘাড় নেড়ে নিষেধ করছিল কিম্বা মুখ বুজে ফেলেছিল। অর্থাৎ সবই শুনছে সবই বুঝছে–শুধু নিছক শারীরিক দুর্বলতার জন্যেই চোখ খুলতে বা কথা কইতে পারছে না।

যেমন হঠাৎ মুখ বুজে ছিল, তেমনি হঠাৎই ঐ দুদিন পরে আবার মুখ খুলল সে।

সেদিন সকালে কনক ওর বাসি কাপড়টা ছাড়িয়ে যখন একটা কাঁচা কাপড় পরাচ্ছে– অকস্মাৎ তাকে চমকে দিয়ে চুপি চুপি বলে উঠল, ‘দেরাজের মধ্যে একটা লালপাড় ফরাসডাঙ্গার শাড়ি আছে–আমাকে জন্মের ভাত-কাপড় দিয়েছিল এরা–সেইটে বার ক’রে পরিয়ে দে। ঐ কাপড় পরে মরব–অনেকদিনের ইচ্ছে!’

কনক খুব একটা প্রতিবাদ করতে পারল না, কারণ রানীর কোন কথাই উড়িয়ে দেবার মতো নয়–এটা বুঝেছিল, তবু বলল একবার, ‘তা যেদিন মরবে সেদিন মরবে–আজ তার কী?’

‘ওলো নেকী, আমার কথাটা শোন। যা বলছি জেনেই বলছি।’

তারপর ওর কথার আওয়াজ পেয়েই, গোবিন্দ এসে দাঁড়াতে, চোখ খুলে একবার তার দিকে চেয়ে বলল, ‘একবার কাছে এসো তো, এই বেলা জ্ঞান থাকতে ক্ষমতা থাকতে পায়ের ধুলোটা নিয়ে নিই।…অনেক জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে গেলুম–না কি যেন বলতে হয় না মরবার সময়? সে সব কিন্তু বলতে-টলতে পারব না আমি। এমন কিছু জ্বালাতন-পোড়াত করি নি তোমায়।…কৈ গো, পাথর হয়ে গেলে যে একেবারে, এসো এসো, এইখেনে এসে দাঁড়াও! পায়ের ধুলো দেবে বৈ–খরচের ব্যাপার কিছু নয়।…আর মাকেও একবার আসতে বলো, তাঁর পায়ের ধুলোটাও নিয়ে নিই। সত্যি, শাশুড়ী পেয়েছিলুম রে–যদি মেয়েজন্ম আবার নিতেই হয় তো জন্মে জন্মে যেন এমনি শাশুড়ী পাই!’…

আরও খানিক পরে, হেমকে কাছে ডেকে বললে, ‘জ্বালাতন বরং তোমাকেই যা একটু করেছি ভাই, পার তো আমাকে মাপ ক’রো। আর মরেই যাচ্ছি যেকালে–মাপ না ক’রে উপায় কি? তোমার একটু দুঃখু হবে জানি।…তবু, তুমিই দাঁড়িয়ে থেকে একটু সাজিয়ে-গুজিয়ে দিও– যাতে শ্মশানেও সকলে তাকিয়ে দেখে।…একটা মজার কথা জানিস কনক, তোর বর জানে, ও ছিল সেখানে–আমার বাবা শ্মশানে দাঁড়িয়েই আমার বিয়ের সম্বন্ধ করেছিল!’

হাসবার চেষ্টা করল সে–কিন্তু হাসির সেই মিষ্টি শব্দটা আর বেরোল না গলা দিয়ে।

একটু পরে আবার হেমের দিকে চেয়েই বলল, ‘ছেলেমেয়েগুলোকে সকাল ক’রে খাইয়ে নিয়ে তোমাদের বাড়ি মাসীমার কাছে রেখে এসো গে। মায়ের মৃত্যুটা আর এ বয়সে না-ই দেখল ওরা, শুধু শুধু বিশ্রী স্মৃতি একটা থাকবে।…তোমারাও খেয়ে দেয়ে নাও গে সকাল সকাল। বিকেলের আগেই বাঁশ কাটতে ছুটতে হবে!’

বলতে বলতে কাশির ভঙ্গি হ’ল একটা মুখে। আবার চোখ বুজল।

আবার কথা বলল একেবারে বেলা একটা নাগাদ।

শ্বাসকষ্ট শুরু হয়েছে অনেকক্ষণ থেকেই–সেটা এরা সকলেই বুঝতে পেরেছিল। ডাক্তারও ডেকে এনেছিল একবার–তিনি অক্সিজেন আনার কথা বলেছিলেন। অবশ্য একথাও বলেছিলেন, কলকাতা থেকে ভাড়া ক’রে আনা পর্যন্ত টিকবে কিনা সন্দেহ। সুতরাং সে চেষ্টা করা হয় নি। গোবিন্দ ঘটনাটার এই অপ্রত্যাশিত আকস্মিকতায় যেন কেমন জড়ভরতের মতো হয়ে গেছে–তার মাথাতে কিছু আসছেও না। এত তাড়াতাড়ি শেষ হয়ে আসবে–তা গোবিন্দ ভাবে নি একবারও। দেখা গেল ডাক্তারের চেয়ে রানী নিজের শরীরের অবস্থা বেশি বুঝেছিল।

একটার সময় কনককে চোখের ইশারায় কাছে ডেকে বলল, ‘একবার একটু চুপি চুপি ভগবানের নামটা শুনিয়ে দে তো ভাই–গুচ্ছের চিৎকার আমার ভাল লাগে না। সব যেন কেমন আচ্ছন্ন হয়ে আসছে, এর পর শোনালেও আর শুনতে পাবো না।…আর অমনি, যদি পারিস একটু তো–ডান দিকে পাশ ফিরিয়ে দে। আমার আবার পোড়া অব্যেস–পাশ ফিরে না শুলে ঘুমটা যেন জমে না। সমস্ত শরীর এলিয়ে ঘুম আসছে–এবার একটু আরাম ক’রে ঘুমুই। কতকাল যে ভাল ক’রে ঘুম হয় নি —

তারপর মুখ টিপে একটু হেসে চোখে সেই চিরপরিচিত কৌতুকের নৃত্যোচ্ছলতা ফুটিয়ে বলে, ‘কেমন লো, এবার যমের মুখে দিয়ে নিশ্চিন্তি তো?’

কনক প্রাণপণে চোখের জল চেপে অস্পষ্ট, প্রায় বুজে-আসা কণ্ঠে তিনবার তারকব্রহ্ম নাম শুনিয়ে তাকে আস্তে আস্তে পাশ ফিরিয়ে দেয়। রানীও বেশ গুছিয়ে-গাছিয়ে পাশবালিশটা ভাল ক’রে জড়িয়ে অভ্যস্ত ভঙ্গিতে শুয়ে একটা পরিপূর্ণ তৃপ্তির নিঃশ্বাস ফেলে। তারপর সত্যি-সত্যিই যেন ঘুমিয়ে পড়ে, গাঢ় নিশ্চিন্ত সুখনিদ্ৰায়।

তারই মধ্যে যে কখন শেষনিঃশ্বাসটা পড়ে থেমে যায় সব–সেটা এরা ভালমতো বুঝতেও পারে না।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *