১৭. ঐন্দ্রিলার চলে যাওয়ার খবর

সপ্তদশ পরিচ্ছেদ

ঐন্দ্রিলার চলে যাওয়ার খবর কমলারা পেলেন আরও চার-পাঁচ দিন পরে। এই কদিন ঘর-সংসার গুছিয়ে নিতেই কোথা দিয়ে সময় চলে গেছে তা যেন টের পান নি ওঁরা। কমলারই উৎসাহ সবচেয়ে বেশি, তাঁর স্তিমিত জীবনে যেন নব উদ্যমের আর আশার জোয়ার লেগেছে–একা তিনজনের খাটুনি খাটছেন। শরীরটা কলকাতা থেকে আসবার পর আরও খারাপ হয়েছে–আজকাল পেটটা আদৌ ভাল থাকছে না–জ্বরও হচ্ছে মধ্যে মধ্যে প্রায়ই, তবু খেটে যাচ্ছেন ভূতের মতো। এতদিন পরে, এই জীবনের প্রায় শেষ প্রান্তে পৌঁছেও যে অন্তত নিজেদের বাড়ি বলে একটা জায়গা পেয়েছেন–সেখানে এসে পড়তে পেরেছেন এতে তাঁর তৃপ্তির শেষ নেই যেন। প্রাণভরে আশীর্বাদ করেন বৌকে। বলেন, ‘তবু যে শেষ নিঃশ্বেসটুকু ফেলবার মতো একটা জায়গা হ’ল বৌমা–এতেই শান্তি। উনি বলতেন না, ভাড়াটে বাড়িতে থেকে নিশ্চিন্তে খাবি খাবারও জো নেই, তখনও হয়ত দেখ গে বাড়িওলা এসে ভাড়ার তাগাদা দিচ্ছে।…. তারপর যদি বোঝে যে বাড়ির কর্তা গেল, রোজগেরে কেউ নেই–তাহলে আর চোখের জল ফেলবারও সময় দেবে না, অশৌচের মধ্যেই বাড়ি ছাড়বার নোটিশ এসে যাবে!… ঝ্যাঁটা মারো, বহু জন্মের পাপ থাকলে তবে লোকে পরের দোর ঝাঁট দেয়!’

অভিজ্ঞতাটা এদের সকলের কাছেই অভিনব। হোক ছোট বাড়ি, মোট দুখানা ঘর, তবু নিজের। সামান্যই জমি–তবু এরই মধ্যে রানী রাজ্যের গাছ এনে পুঁতেছে। সব চাই তার–কলা, পেয়ারা, আম, কাঁঠাল, বাতাবি লেবু–নারকেল সুপুরি ছিলই দুটো দুটো, তাও আবার এনে পুঁতেছে–এদিকে তো ফুলের গাছ যেখানে যত মনে পড়েছে আর পাড়াঘর ঘুরে যত যোগাড় করতে পেরেছে। মল্লিকগিন্নী তো দেখে হেসেই খুন, ‘অ আবাগের বেটি, এ করেছিস কি! এত ঘন ঘন বসালে গাছ-গাছালি থাকে কখনও। একটু বড় হ’লেই তো আওতায় আওতায় নষ্ট হয়ে যাবে। এতগুলো গাছ বাঁচাতে হ’লে অন্তত দু বিঘের বাগান চাই। একটা আম গাছ কাঁঠাল গাছ কতটা জায়গা নেয় দেখছিস না?’

সবই দেখেছে রানী, জানেও সব–কারণ তারও পাড়াগাঁয়েই বাপের বাড়ি, তবু আশ মেটে না বলেই তথ্যের দিকে, অভিজ্ঞতার দিকে চোখ বুজে থাকে। মনে হয় হয়ত সবগুলোই লেগে যাবে। এসব গাছ তো চাই-ই, নিজেদের বাড়িতে আম জাম কাঁঠাল গাছ একটা ক’রে না থাকলে চলে!….

এমনি স্বপ্নের মধ্য দিয়েই দিন এবং রাত কাটছিল–তবু তার মধ্যেই একদিন মনে পড়ল, ও বাড়ি থেকে সেই মালপত্র নিয়ে আসার পর থেকে আর একদিনও যাওয়া হয় নি। কাজটা খুবই খারাপ হয়েছে–অপর কেউ এ ব্যবহার করলে তাঁরাও একে বেইমানি আখ্যাই দিতেন। অবশ্য ওরাও কেউ আসতে পারত। গৃহপ্রবেশের পর একটি দিন মাত্র ঐন্দ্রিলা এসেছিল, সেও আর আসে না। কমলা বললেন, তুমি একবার যাও মা, দেখে এসো গে। আমার শরীরটা ভাল নেই, কাজও ঢের–আমি বরং মেয়ে দুটোকে সামলাব–তুমি খোকাকে নিয়ে ঘুরে এসো!’

খবরটা অবশ্য যেতে যেতেই পাওয়া গেল মল্লিকগিন্নীর কাছে, তিনিও দক্ষিণ পাড়ায় বেড়াতে আসছিলেন, বললেন, ‘ওমা, শোন নি? খেঁদি তো চলে গেছে। এখন তো গিন্নী একা। পাগল মেয়ে আর নাতি নিয়ে সেই হাবুডুবু শুরু হয়েছে!’

‘চলে গেছে? সে কি! অত কাণ্ড ক’রে আমাদের তাড়ালে, নিজে পাকাপাকি বসবে বলে–আবার কি হ’ল?’

রানীর যেন বিশ্বাস হ’তে চায় না কথাটা!

‘কিছুই নাকি হয় নি–গিন্নী যা বললেন, একেবারের তলে তলে চাকরি ঠিক করে যাবার সময় বলে গেছে। এই কাছেই নাকি কোথায় আছে হাওড়ায় কোথায়–চৌধুরীগিন্নীর কে কুটুমের বাড়ি। আসলে কি জানো বৌমা, যে লোকগুলো বদ হয় তারা মন্দ করতে চাইলে অনেক সময় ভালো লোকের উপকারই হয়ে যায়। ও অমন ক’রে আদাজল খেয়ে না লাগলে বোধহয় তোমাদের এ বাড়ি কেনার এত চাড় হ’ত না। ও একদিক দিয়ে তোমাদের উপকারই করেছে। বরাতে ছিল বলেই বোধহয় ওর মাথায় ছেমো ছেপেছিল।’

তা বটে। হয়ত সত্যিই তাই। তবু রানী যেন ঐন্দ্রিলার মনের তল খুঁজে পায় না। শ্যামার জন্যে মন খারাপ হয় খুব। আহা বেচারী–অসময়ে ওদের আশ্রয় দিয়েছিলেন এটা তো ঠিক, অনেকগুলো টাকা তাদের বাঁচিয়ে দিয়েছেন। আবার সেই একা একহাতে নাটা- ঝামটা খাওয়া!….

শ্যামা রানীকে দেখে প্রথমটা গম্ভীর হয়েই ছিলেন। ঐন্দ্রিলা চলে যাওয়ার পর আরও যেন বেশি ক’রে রাগটা গিয়ে পড়েছিল এদের ওপর। পড়েছিল কতকটা অবুঝের মতোই। ওঁর মনে হচ্ছিল, ‘সেই তো চলে গেল সে, মধ্যে তো বেশ ঠাণ্ডাও হয়ে এসেছিল, এত একেবারে উতলা হবার কী ছিল! আর যাবে না তো কী, যেতে তো তাকে হ’তই–সে তো জানা কথাই! মাঝ-খান থেকে আমারই এখানে ব’সে বেশ ক’রে গুছিয়ে নিয়ে সব সরে পড়ল!’

তিনি জানেন যে তাদের যাওয়া স্থির না জানলে মেয়ের রাগারাগি কমত না, উনি জানেন যে তার যাওয়ার স্থিরতা সম্বন্ধে তিনি নিজেও নিশ্চিত ছিলেন না–তবু রাগ করেন, জোর ক’রেই যেন সত্যগুলোর দিকে চোখ বুজে থাকেন তিনি।

অবশ্য রাগ বেশিক্ষণ রাখতেও পারেন না। রানী এসে যতটা পারে কাজকর্ম টেনে ক’রে দেয়। তরুকে জোর ক’রে ধরে চুলের জট ছাড়িয়ে চুল বেঁধে দেয়, পুকুরে নিয়ে গিয়ে গা ধুইয়ে আনে, ছেলেটাকেও পরিষ্কার ক’রে দেয়। ঘরদোর ঝাঁট দিয়ে অনেকখানি সুসার করে দেয় শ্যামার। শেষ পর্যন্ত তাঁকেও বলতে হয়, ‘তুমি একটু এবার বসো বৌমা, ছেলেটা ধুলোকাদা ঘাঁটছে, ওকে একটু ধরো।’ সেই এসে পর্যন্তই তো খাটছ তোমার ও তো শরীর ভাল নয়! আর একদিনে তুমি কতটাই বা আসান করবে মা–ও তো আমার নিত্যকার সমিস্যে। আমার কর্মফল আমাকে ভুগতে হবেই–কেউ খণ্ডাতে পারবে না।’

রানী অবশেষে সত্যিই ক্লান্ত হয়ে ওঁর কাছে এসে একটু বসে পা ছড়িয়ে। ঐন্দ্রিলা যাবার আগের দিন ক্ষুদভাজার নাড়ু ক’রে রেখে গিয়েছিল গোটাকতক, এখনও সব ফুরোয় নি, শ্যামা তাই দুটো বার ক’রে ওদের হাতে দিলেন। বাড়িঘরের কথা, বোন-বোনপোর কুশল জিজ্ঞাসা করলেন। বললেন, ‘আমার তো আর নড়বার পথ রইল না মা, বন্দী একেবারে। রবিবারে কান্তি বাড়ি থাকে বটে, তাও সব রবিবারে নয়, এক-একদিন বেরোতেও হয়–আর তাও, না বেরোলেই বা কি, ও বদ্ধ কালা মানুষ, ওর ভরসায় কি পাগলকে রেখে যেতে পারি!…. তোমরাই মধ্যে মধ্যে খবর নিও–মলুম কি বাঁচলুম। এ যা হয়েছে–একটা কারও যদি অসুখ হয়ে পড়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে ডাক্তারখানায় যেতে পারব না। কত মাসের যে সুদ বাকি পড়েছে চারিদিকে –তাগাদা করবার পথ পৰ্যন্ত বন্ধ!’

খানিকটা চুপ ক’রে থেকে রানী বলে, ‘একটা কাজ করবেন মাসীমা, আমার সন্ধানে একটি ভাল মেয়ে আছে, কান্তি ঠাকুরপোর সঙ্গে বিয়ে দেবেন?’

‘ওর বিয়ে দেব কি মা, ওর আয় কত যে বিয়ে দেব? ভূতের খাটুনি খেটে–দিন নেই রাত নেই শরীর পাত ক’রে বলতে গেলে–নাকি লাফিয়ে উন্নতি হয়েছে, তাও কিনা যতদিন পরে হবার কথা ছিল তার আগেই হয়েছে–দশ টাকা মাইনে। ….একটা চাকরের মাইনে। ওপরটাইম হ’লে কিছু বেশি পায় তা সেও তো ঐ মাইনের হিসেবেই। দশ টাকা মাইনে আর দু পয়সা জলখাবার। তার এক পয়সা তো খেতেই চলে যায়, বারো চোদ্দ ঘণ্টা পরে বাড়ি আসে, মধ্যে যদি এক পয়সার মুড়িও না খায় তো বাঁচবে কী ক’রে বলো? যা পায় তা থেকে মাসিক টিকিটভাড়া দিয়ে দশ-এগারো টাকার বেশি হাতে দিতে পারে না। এর মধ্যে বৌ এনে খাওয়াবো কি?’

‘সে যা হয় হয়েই যাবে মাসীমা,’ রানী জেদ করে, ‘আপনার ভাত-হাঁড়ির ভাত দুবেলা দুমুঠো খাবে–কেউ টেরও পাবে না। আপনিই তো চালাচ্ছেন, কেউ এসে পড়লে তো দুটো ভাত দিতে কোনদিন আপনাকে কাতর দেখি নি। মনে করবেন যে আপনার সেই মেয়েই এসে আছে। আর আপনি তো বড়লোকের মেয়ে আনবেন না যে রোজ মাছের মুড়ো দিয়ে খেতে দিতে হবে–গরিবের মেয়ে না হ’লে এ পাত্তরে দেবেই বা কেন? আসবে খাটবে খুটবে খাবে। যেমন আপনারা খাচ্ছেন–তেমনিই খাবে।’

তবু শ্যামা মন স্থির করতে পারেন না, বলেন, ‘আমার যা বরাত, বৌ এনেই কি সুখ হবে! ঐ তো এক বৌ ছিল, ঘরকন্না সব বুঝেও নিয়েছিল, রইল কি, মুখে লাথি মেরে ভাতারকে নিয়ে সুখভোগ করতে চলে গেল। আজকালকার সব মেয়েই চায় একলা ঘরের গিন্নী হ’তে–মাগটি আর ভাতারটি থাকবে, জোড়ের পায়রার মতো দিনরাত্তির বসে শুধু বক-বকুম করবে, আর কেউ থাকবে না মাথার ওপর আলশোল।

বলতে বলতে কণ্ঠস্বর তীক্ষ্ণ হয়ে ওঠে তাঁর, কনক সম্বন্ধে বিষের পাত্র উপচে ওঠে যেন গলাতে।

রানী একটু চুপ ক’রে থেকে খুব ঠাণ্ডা গলায় বলে, ‘সে বৌ গেছে, তার বরের কোমরের জোর ছিল ধরুন–একে আনার তো সেই সুবিধে, আপনার তাঁবে থাকতেই হবে তাকে। ঐ আয় যার সে তো আর ঘর ভাড়া ক’রে গিয়ে আলাদা থাকতে পারবে না।… আপনি ধরুন মেজ-ঠাকুরঝিকে সব খরচ দিয়ে উলটে মেয়ের জন্যে কটা টাকা দিয়েও আনিয়ে রাখতে চেয়েছিলেন, তার চেয়ে একটা বৌ আনলে কি বেশি খরচ হবে বলুন?’

তা বটে। বড় বৌয়ের কথায় যুক্তি আছে–তা মানতেই হয় শ্যামাকে মনে মনে। এইজন্যেই তিনি এত পছন্দ করেন বৌটাকে। রূপেগুণে সমান! তেমনি মিষ্টি স্বভাব। কাজকর্মও যেন হাতে পায়ে লাগে না। আর এই বুদ্ধি। পরিষ্কার কথাবার্তা কয়–সর্বদিকে আটঘাট বেঁধে। যত দেখছেন বৌটাকে তত মুগ্ধ হয়ে যাচ্ছেন। এ মেয়ে গোবিন্দর চেয়ে ঢের ভাল পাত্রে পড়া উচিত ছিল, তাঁর মনে হয় এক-এক সময়।

খানিকটা চুপ করে থেকে বলেন, ‘কান্তি কি রাজি হবে?’

‘সে ভার আমার মাসীমা, সে আমি তাকে বুঝিয়ে বলে রাজি করাব। নিদেন হত্যে দিয়ে পড়ে থেকেও–’

‘তা দ্যাখো–’, শ্যামা যেন কতকটা অভিভূতের মতোই হয়ে যান, এমন ভাবে কথাগুলো কখনও ভেবে দেখেন নি, এখন যত ভাবছেন ততই ভাল লাগছে তাঁর প্রস্তাবটা, কথাটা এইভাবে মনের মধ্যে তোলাপাড়া করতে করতেই জবাব দেন, তা দ্যাখো না হয় একটা মেয়েটেয়ে, খোঁজে থাকো না হয়!’

‘মেয়ে একটি খোঁজে আছে মাসীমা, ঠিক যেন আপনার মাপেই ভগবান যুগিয়ে রেখেছেন। আমার এক কাকার ভায়রাভায়ের ভাইঝি। সে ভাই নেই, বিধবা ঐ মেয়েসুদ্দ ঐ ভারয়াভাইয়ের ঘাড়ে পড়েছে। তিনি কী এক সামান্য চাকরি করেন কোন্ মাড়োয়ারির গদীতে, খুবই কম মাইনে–নিহাৎ নিজের বৌদি আর ভাইঝি বলেই ফেলতে পারেন নি, নইলে সেরকম অবস্থা নয়। তার ওপর তাঁর নিজেরও যেটের চার-পাঁচটি ছেলেমেয়ে। সবাইকেই বলে বেড়াচ্ছেন ভদ্রলোক। এখানে আসবার আগে যে একবার বাপের বাড়ি গেছলুম, সে সময়ই কাকা বলেছিলেন, দ্যাখ্ না তোদের পাড়াঘরে। দিতে তো কিছুই পারবে না–তবে ওদের তেমনি কোন আহিঙ্কেও নেই, দোজবরে তেজবরে পেলেও দিয়ে দেবে।’

‘একেবারে কিচ্ছু দেবে না?’ শ্যামার কণ্ঠে হতাশার সুর, সঙ্গে সঙ্গে যেন ঈষৎ বিরূপতারও।

‘না, সে বলতে গেলে কিছুই না। মার নাকি একটি জোড়া বালা আছে ভরি পাঁচেকের মতো–তাই ভেঙ্গে রুলি হার ক’রে দেবে শুনেছি–আর কাকা ভিক্ষে দুঃখু ক’রে, যা দানসামিগির বরাভরণ না দিলে নয়, তাই দেবে। তার বেশি তার ক্ষমতা নেই। তবে ধরুন–মেয়েকে আমি দেখেছি, মেয়ে দেখতেও খুব ফেনা নয়–হতচ্ছিরি তো নয়ই! এধারেও বেশ গাট্টাগোট্টা আছে, খাটতে পারে নাকি মোষের মতো। ….আপনি বরং একবার দেখুন মাসীমা–একেবারে অমত করবেন না।’

শ্যামার মনে হয় বুড়োর বৌয়ের কথা। মেয়েটা না কাজ ক’রে যেন থাকতে পারে না। আজকাল তো যত ভারী কাজ গিন্নীরা ঐ বৌটাকে দিয়ে করায়। দমাদম বাটনা বাটছে জল তুলছে, টিন টিন ক্ষার কাঁচছে–সব তো ঐ বৌ। ওরকম হ’লে সত্যিই মন্দ হয় না। টাকা কিছু খরচ হবে, কিন্তু উপায়ই বা কি।… একে ঐ বদ্ধ কালা ছেলে তায় এই উপাৰ্জন, শুধু তাঁকে দেখে কে আর পাঁচশ হাজার দিয়ে বিয়ে দেবে এ পাত্রে।

সেই কান্তি। তাঁর গর্ভের সেরা সন্তান। আশা ছিল কান্তির রাজার ঘরে বিয়ে হবে।…. আর সত্যিই, ঐ রূপবান ছেলে–লেখাপড়া শিখে মানুষের মতো মানুষ হ’লে নিশ্চয়ই বড় বড় জমিদারের ঘর থেকে, রাজার ঘর থেকে সম্বন্ধ আসত, কত হাতিঘোড়া এসে দাঁড়াত তাঁর এই কুঁড়েঘরের সামনে। হয়ত সে বৌ এসে তাঁর পুকুর সরত না–তাঁর ঘর করত না, তবু একটা বলবার মতো সম্বন্ধ হ’ত তো! তার জায়গায় এই!

একটা অর্ধোত দীর্ঘীনঃশ্বাস কষ্টে দমন করেন শ্যামা। অনেকক্ষণ পরে মুখে বলেন শুধু, তা দ্যাখো না হয়। সেই মেয়েই কি আর বসে আছে এতদিন?’

.

দেখা গেল যে সে মেয়ে বসেই ছিল। শ্যামা দেখতে যেতে পারবেন না ব’লে তারাই এসে মেয়ে দেখিয়ে গেল। খুব ফরসা নয়, তবে ময়লাও নয় একেবারে। মাজামাজা রঙ, গড়নপেটনটা একটু যেন কেমন মদ্দাটে গোছের মনে হ’ল শ্যামার, তবে মুখশ্রী মন্দ নয়। মুখে চেহারার দৈন্য মানিয়ে যাবে। যেখানে স্পষ্ট কোন অভিযোগ নেই, ধারণার প্রশ্ন যেখানে আর ও গড়নপেটনের প্রশ্নটা তুলে লাভ নেই। তাছাড়া, শ্যামার মনে হ’ল, ওটা হয়ত ছেলেবেলা থেকে খাটাখাটুনির জন্যেই হয়েছে, শারীরিক শক্তি ও কর্মদক্ষতারই পরিচায়ক ওটা। তিনি মেয়ে পছন্দ করলেন। ছেলেও তাদের পছন্দ হয়েছিল, যারা তেজবরেতে পর্যন্ত বিয়ে দিতে প্রস্তুত তাদের পক্ষে আর ছেলে খারাপ কি। এক যা কানে শুনতে পায় না–তা মেয়ের কাকা বললেন, ‘আমাদের মেয়ে ওখানকার মাইনর ইস্কুলের পড়া শেষ করেছে, একবোরে ক-অক্ষর-গোমাংস তো নয়–ও চিঠি লিখে কথা কইতে পারবে!’

তবু শ্যামা ভদ্রতার খাতিরে একবার বললেন, ‘মেয়েকে বলে-কয়ে এ কাজ করছেন তো, লুকোচাপা করছেন না তো? শেষে এসে পা ছড়িয়ে কাঁদতে বসবে না তো?’

‘না না –সব বলেই নিয়েছি। এমন সুন্দর বর পাচ্ছে, এ তো ভাগ্যের কথা ওর। এই তো আশার অতীত। আমাদের ঘরে যখন জন্মেছে তখন কী আর রাজপুত্তুর পাবে! আপনারাই একটু দয়া ক’রে মানিয়ে টানিয়ে নেবেন, অনাথ মেয়েটা—’

পাত্রপাত্রী পছন্দর পর দেনাপাওনার প্রশ্ন ওঠে। রানী অবশ্য বলে রেখেছিল যে ওরা এক পয়সাও দিতে পারবে না–কিন্তু শ্যামা সুকৌশলে বেয়াইকে দিয়ে ‘যৎসামান্য’ দেবার প্রতিশ্রুতি আদায় ক’রে’ নিলেন। সে যৎসামান্যটা কত তা নিয়ে আর খোঁচাখুচি করলেন না, রানীকে আড়ালে বললেন, ‘যতই কম দিক, একশ টাকার কম তো আর দিতে পারবে না–আমি এখন তাই ধরে রাখছি। যথা লাভ! কিছুই তো আশা ছিল না সে জায়গায় পড়ে-পাওয়া চোদ্দ আনা জোটে তাই ভাল।’

শুধু যৎসামান্য নগদের কথাই নয়–আরও একটি কথা পাকা ক’রে নিলেন, গায়ে হলুদের তত্ত্ব এঁরা করবেন না, শুধু নিয়মরক্ষার মতো মাছ, হলুদ, একটু মিষ্টি, আর লালপাড় শাড়ি। ওঁদেরও ফুলশয্যার তত্ত্ব পাঠাতে হবে না। মেয়ে-জামাইয়ের কাপড় ক্ষীরমুড়কি বাটিসুদ্ধ, আর ফুল মিষ্টি–এই পাঠালেই চলবে।

কথাবার্তা সব পাকা হয়ে গেল। শুধু এখন হেমের কাছে খবর পাঠানো যা বাকি, তার ছুটি পাবার সময়টা জানতে পারলে এঁরা পাকা দেখা ও বিয়ের দিন ঠিক করবেন, হেমই এসে আশীর্বাদ করবে, সেই সঙ্গেই বিয়ে সেরে চলে যাবে।…

দীর্ঘদিন পরে ছেলেকে বিস্তৃত চিঠি লিখলেন শ্যামা। ভাল মেয়ে পাওয়া গেছে, রানীর আত্মীয়ই বলতে গেলে, রানীই জেদ্ ক’রে এ বিয়ে দেওয়াচ্ছে, সে-ই কথাবার্তা ঠিক করেছে–তারই পীড়াপীড়িতে শ্যামাকে রাজি হতে হয়েছে–ইত্যাদি খবর দিয়ে, অর্থাৎ চিঠির মধ্যে ‘তোমার বড় বৌদি’ শব্দকটি অন্তত পনেরো-ষোলবার ব্যবহার ক’রে, ‘যৎসামান্য’র কথাটা বেমালুম চেপে গিয়ে লিখলেন, ‘উহারা এক-পয়সাও খরচ করিতে পারিবে না, সে সামর্থ্যও উহাদের নাই। থাকিলে আমার ঐ ছেলেকেই বা মেয়ে দিতে রাজি হইবে কেন? অথচ এধারে সত্যই আমারও দিন চলে না। এবম্বিধায় আমাকে রাজি হইতে হইল। নমো নমো করিয়া সারিলেও দুশ-আড়াইশটি টাকা খরচ হইবে কমপক্ষে। অবশ্য আমিও কিছু খরচ করিব, তবে তোমার নিকট হইতে অন্তত একশটি টাকার ভরসা রাখি। আশা করি তোমার অশক্ত অক্ষম ছোট ভাইয়ের জন্য এটুকু ত্যাগ স্বীকার করিতে দ্বিধা করিবে না। ইত্যাদি–

কান্তিকে রাজি করানো যতটা সমস্যা হবে ভেবেছিলেন শ্যামা, এবার তা আদৌ হ’ল না। হয়ত সে-ও সংসারের সমস্যা ও মায়ের কষ্ট দূর করার একটা উপায় চিন্তা করছিল, বড় বৌদি সেই দোহাই নিয়ে কথাটা পাড়তে, প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই রাজি হয়ে গেল। এবং, রাজি হওয়ার পর থেকে যেন একটু উৎসুকভাবেই সেই অভাবনীয় ঘটনাটার অপেক্ষা করতে লাগল। নিজের আগ্রহ দেখে তার নিজেরই অবাক লাগত এক একদিন।

অবশ্য বিয়ের বয়স তার হয়েছে। বরং অনেক আগেই সে বয়সে পৌঁছে গেছে সে, আরও আগে হওয়াই হয়ত উচিত ছিল। কিন্তু বয়সের প্রশ্ন ছাড়াও অভিজ্ঞতার প্রশ্ন আছে। যে বাঘ নররক্ত পান করেছে, সে নররক্তের জন্য অধীর এবং লোলুপ হয়ে উঠবে এইটেই স্বাভাবিক। রতনদিকে আর যেন খুব ভাল ক’রে মনে পড়ে না–একটা বেদনা-বিজড়িত মধুর স্মৃতিতে মাত্র পরিণত হয়েছেন তিনি, এমন কি তাঁর মুখচোখের ছবিটাও যেন ক্রমশ ঝাপসা হয়ে আসছে মনে–তবু সেই সুরনারীদুর্লভ দেবাকাঙ্ক্ষিত বরতনু আলিঙ্গন ও সম্ভোগের স্মৃতি–তার দৈহিক ছবিটা মন থেকে মুছে গেলেও–স্নায়ুতে স্নায়ুতে যেন একটা তড়িৎপ্রবাহের সৃষ্টি করে আজও, ওর প্রতিটি রক্তকণা সে রভসস্মৃতিতে উন্মত্ত অধীর বুভুক্ষু হয়ে ওঠে। ছবিটা মনে নেই, কিন্তু অনুভূতিটা আছে। সেই অনুভূতির পুনরভিজ্ঞতার আকাঙ্ক্ষা ওকে অস্থির ও চঞ্চল করে তোলে। লজ্জায় কাউকে প্রশ্ন করতে না পারলেও ঘটনাটা ঘটতে কত দেরি আছে এখনও–পরোক্ষে সেটার খোঁজ করে। আজকাল প্রায়ই খেতে বসে মাকে প্রশ্ন করে, ‘দাদার চিঠি-টিঠি পাচ্ছ?’ এখন যে দাদার ছুটি পাওয়ার ওপরই সবটা নির্ভর করছে–এটুকু সে জানে। আর প্রশ্নটা যে সেইজন্যেই তা শ্যামা ও বোঝেন–তিনি মুখ টিপে হাসেন শুধু। পরিতাপও করেন মনে মনে–’কী না পেতে পারত, বড় ঘরের সুন্দরী মেয়ে পায়ে লোটাত এতদিনে–নিজের বুদ্ধির দোষে সব নষ্ট করলে। এখন ঐ হাঘরের ঘরের শাঁকচুন্নির জন্যেই লালায়িত। হায় রে!

অবশ্য হেমের ছুটি পেতে খুব দেরি হ’লও না। অনেকদিন ধরেই ছুটির তাগাদা দিচ্ছিল সে। রানীবৌদিরা এত কাছে এসেছে–বাড়িতে যতদিন ছিল আসা তো হ’লই না, তবু এখনও খুব দূরে নেই, এপাড়া ওপাড়া–সবাই মিলে একসঙ্গে দিনকতক হৈ-চৈ করবার জন্যে মনটা উন্মুখ হয়ে রয়েছে কবে থেকে। সেই ছুটির তাগাদাই কাজে লাগল, বড়বাবু এবার ছাড়লেন ওকে। পাঁজি দেখে বিয়ে বৌভাত পাকা দেখার দিন হিসেব ক’রে তেরদিনের ছুটি নিয়ে বাড়ি এল–রবিবার আর অন্য কী একটা ছুটি মিলিয়ে যাতে ষোল সতেরো দিন পুষিয়ে যায় এই ভাবেই ছুটিটা নিলে।

রাণীকে দেখে ওদের খুব মন খারাপ হয়ে গেল। হেমেরও, কনকেরও। কনক খুব পীড়াপীড়ি করতে লাগল, আমাদের সঙ্গে জামালপুরে চলুন দিদি, টানের জায়গা, মাসখানেক থাকলেই সেরে যাবেন। চলুন —

ম্লান হেসে রানী বলে, ‘আর আমার এইসব ডেয়োঢাকা, এরা? এদের কে দেখবে এখানে?’ওমা, ওদেরও নিয়ে যাবেন বৈকি! ছেলেমেয়ে ছেড়ে কি যেতে বলছি।’

একটু চুপ করে থেকে রানী বলে, ‘না ভাই, সে হবে না। মারও শরীর খারাপ, ওঁকে ফেলে আমি যদি যাই সে বড় খারাপ দেখাবে, আর ওঁরও কষ্ট হবে খুব। একা একটা বাড়ি পাট করা, ভোরে ভাত দেওয়া, পেরে উঠবেন না।… চারিদিকে দেনা, একটা ঠিকে ঝি তো রাখতে পাচ্ছি না, সবই তো করতে হয়।’

‘তা আপনিই বা এই শরীরে কতদিন বইবেন? শয্যাগত হয়ে পড়লে তখন?’

‘তখন তুমি আছ। তোমাকে লিখব–এসে সেবা করবে!’ বলে কনকের গাল দুটো টিপে দেয় রানী।

‘না দিদি, ও আপনি কথা এড়িয়ে যেতে চাইছেন।… একটু ভেবে দেখুন, জলহাওয়া খুব ভাল ওখানকার। জিনিসপত্তরও সস্তা, তিন আনা সের মাছ, চার আনা সের মাংস। চলুন, আমি বরং মাসীমাকে বুঝিয়ে বলি!’

‘না না। তাহলে মা ভাববেন যে আমি বলাচ্ছি তোমাকে দিয়ে। বরং মা যদি দিন- কতক থেকে সেরে আসতেন তারপর আমি যেতুম তো ভাল হ’ত।… তা কি আর মা রাজি হবেন? দেখি ব্যাপারটা বুঝিয়ে বলে।’

তারপর একটু হেসে বিচিত্র দৃষ্টিতে কনকের মুখের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করে ‘আমাকে যে ঘরে নিয়ে যেতে চাইছিস, ভয় করছে না?’

‘না দিদি, একটুও না।’ স্থির দৃষ্টি রানীর দৃষ্টির ওপর নিবদ্ধ করেই জবাব দেয় কনক।’

‘কেন রে, এমনি বিচ্ছিরি হয়ে গেছি বলে? তাই আর ভয় করে না?’

‘না দিদি, তা নয়। আপনিও যেমন খোলাখুলি বলছেন আমিও তেমনি খোলাখুলিই জবাব দিচ্ছি, ভয় যখন ছিলও–সে আপনার রূপের জন্যে নয়। আপনাকে যে ভালবাসবে সে রূপগুণ মিলিয়েই ভালবাসবে। আমার মানুষকে আমি চিনে নিয়েছি–সত্যিকার খারাপ চোখে সে কোনদিনই চায় নি আপনার দিকে। আর আপনার কথাও ওঁর মুখ থেকে অনেক শুনেছি, আপনার দ্বারা আমার যাকে অনিষ্ট বলে তা কখনও হবে না–এ জোর খুব আছে মনের মধ্যে!

চোখ দুটো ছলছল করে ওঠে রানীর। সে কনকের দুটো হাত চেপে ধরে বলে, ‘বাঁচালি ভাই, এ যে কী দুশ্চিন্তা ছিল, কেবলই ভাবতুম না জানি আমার সম্বন্ধে কত কী খারাপ ভেবে বসে আছিস। কিন্তু সত্যিই বলছি, এই বামুনের মেয়ে এয়োস্ত্রী তুই –তোকে ছুঁয়ে বলছি, আমার মনে কোন অনিষ্ট চিন্তা কখনও আসে নি।’

‘সে আমি জানি দিদি!’ হেঁট হয়ে আর একবার পায়ের ধূলো নেয় কনক।

দুটো চোখ মুছে রানী আবারও কেমন একরকমের গাঢ়কণ্ঠে বলে, ‘আমি কিন্তু তোমার ওপর অনেক ভরসা করে বসে আছি বোন, তুমি আমাকে কথা দাও–বিপদের দিনে কোনদিন, যদি সত্যি সত্যিই তোমাকে ডাকি, তুমি চলে আসবে ঠিক, আমাকে ত্যাগ করবে না!

‘ওমা, তা করব কেন! কিন্তু এসব কথা কেন বলছেন দিদি?’ একটু উদ্বিগ্ন ভাবেই প্রশ্ন করে কনক।

না, ও কিছু না। রানী উড়িয়ে দেয় কথাটা। জোর করে অন্য প্রসঙ্গ পাড়ে, জামালপুরের কথা তোলে।

বসে গল্প করার খুব সময়ও ছিল না অবশ্য। রানী বিয়ে উপলক্ষে কদিন–রাতটুকু ছাড়া–এ বাড়িতে এসেই ছিল। সংসারের গৃহিণীর যা কিছু করণীয় বলতে গেলে সে-ই একা সব করেছে।

ওকে যত দেখছেন তত মুগ্ধ হয়ে যাচ্ছেন শ্যামা। সবই করছে কিন্তু খরচপত্রের হাত যতদূর সম্ভব টেনে–আর কোন খরচটাই শ্যামাকে না জিজ্ঞাসা করে করছে না। কনক ও অবাক হয়ে যাচ্ছে, গুণের মেয়ে তা সে শুনেছিল কিন্তু এত গুণের তা ধারণা ছিল না। এই শরীরে কী খাটুনিটাই না খাটছে, মনে হয়, একটা মানুষ চারখানা হয়ে বিয়ে বাড়ির সর্বত্র একই সময়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। আর সবচেয়ে যেটা বিস্ময়ের সেটা হ’ল ওর মেজাজ। এ বাড়ির সমস্ত লোকগুলির ওপর, সমস্ত ঘটনা ও ক্রিয়াকর্মের ওপর ওর মধুর স্বভাবের আশ্চর্য প্রসন্নতা যেন একখানি স্নিগ্ধ ছায়া ফেলে রেখেছে সর্বদা, আর সে ছায়া একটি অতি মিষ্টি সুরের আমেজ এনে দিয়েছে সকলের মনে, কোথাও কোন তালভঙ্গ হবার অবসর দিচ্ছে না।… খাটছে সবাই, কিন্তু তার পিছনে আবহসঙ্গীতের মতো তার হাসি, ঠাট্টা, তামাশা ও আন্তরিক সহানুভূতি অহরহ প্রেরণা যুগিয়ে যাচ্ছে।

এমন আর কখনও দেখে নি কনক,কখনও কল্পনা করে নি। হেমের কোন দোষ দেওয়া যায় না–মনে মনে বরং বাহবাই দিল হেমকে, এই মায়া কাটিয়ে উঠতে পেরেছে বলে। অবশ্য তারপরই মনে হ’ল–এই মেয়েই সে মায়া কেটে দিয়েছে। নিজে স্বেচ্ছায় জাল কেটে না দিলে পাখি কোনদিনই উড়তে পারত না, উড়তে চাইতও না।

।।২।।

কান্তির বৌয়ের নাম নাকি বিনতা–কিন্তু দেখা গেল নত সে কোনখানটাতেই নয়। তার বয়স অল্প–আর কিছুই অল্প নয়। জ্ঞান বুদ্ধি অভিজ্ঞতা–এ বোধ হয় বয়স্কা মেয়েছেলের মতোই।

বিয়ের কনে পাল্কী থেকে নেমে কড়ি-খেলাটেলা নিয়মকর্মের পরই–রানী যখন তাকে কাপড় ছাড়াতে নিয়ে যাবে–সে চুপি চুপি বলার চেষ্টায় ফ্যাশ ফ্যাশ করে বললে, ‘চলো। অমনি একেবারে পুকুর ঘাটটা ঘুরে আসি। দেখে-শুনে নিই, একশ’বার কী আর পরের খোশামোদ করব? শুনেছি তো এখানে কলতলা নেই আমাদের খিদিরপুরের মতো, পুকুরেই যা কিছু!’

যেন গালে একটা চড় খেল রানী। কী সর্বনাশ! এ কাকে নিয়ে এল সে! এই যদি ওর স্বরূপ হয়, তাহলে তা প্রকাশ পেতেও দেরি হবে না, মাসীমা কী বলবেন ওকে?

রানী কাঠ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে দেখে বিনতাই আবার বলে, ‘ওমা কী হল, খারাপ কিছু বললুম নাকি? বলি এই ঘরই তো করতে হবে, সব দেখে শুনে নেওয়া ভাল না? ঐ পুকুরই তো সরতে হবে দুবেলা, তা সেটা দেখে নেওয়া আবার দোষের নাকি? আর যদিই দোষের হয়–তুমি তো আমাদের আত্মীয়–তুমি তো বলে দেবে সেটা।’

‘না দোষ আর কি। চলো পুকুরেই যাই।’ রানী কোনমতে সামলে নেয় নিজেকে। একে তো মেয়েটার গলার আওয়াজ কেমন আধো-আধো–হয়ত আলজিবের বা জিবেরই কোন দোষ আছে, অল্পবয়সের খুকী হ’লে এ গলা মানায়, এই বয়সের মেয়ের গলায় ঐ রকম স্বর শুনতে বড় খারাপ লাগে; তার ওপর ঐ গলায় এই রকম পাকা পাকা কথা- আরও অসহ্য।

পুকুরে যেতে যেতে কতকটা কথার পৃষ্ঠে কথা বলার মতোই রানী জিজ্ঞাসা করলে, ‘তোমার ডাক নাম কী ভাই? বিনতা নামটা বড্ড ভারী না? সব সময় ব্যবহার করা যায় না।’

‘হ্যাঁ, বিচ্ছিরি নাম। বাবার কে এক বেম্ম বন্ধু ছিল, সে-ই রেখেছে। কী আর করব, এত বয়সে তো আর নাম বদলানো যায় না। কিন্তু ডাক নামটা আরও খারাপ। মা ডাকে বাঁদী বলে। সে নাম কি কাউকে বলা যায়–বলো না! তা তোমরা বাপু বরং বিনু বলেই ডেকো না কেন। বিনতা থেকে বিনু–মন্দ কি! আমি অনেক ভেবেছি, ঐটেই আমার পছন্দ!’

ততক্ষণে পুকুর ঘাটে পৌঁছে গেছে ওরা। একবার ভ্রূ কুঁচকে ঘাটের দিকে তাকিয়ে বললে, ‘ওমা ঘাটের ওপর কোন গাছপালা নেই যে একটু ছায়া হয়! এত তো বনজঙ্গল দেখছি এধারে, ঘাটের ওপর বুদ্ধি ক’রে কেউ একটা বড় গাছ দিতে পারে নিঃ… এ বাড়িতে তো ঝি নেই শুনেছি, আমাকেই তো বাসন-কোসন ছিষ্টি মাজতে হবে, আমি বাপু তা বলে ঠেকো রোদে বসে বাসন মাজতে পারব না। সেই বিকেলে ছায়া পড়লে তবে–

এই অসহিষ্ণু হয়ে ওঠে রানী, ‘এখনই তো তোমাকে কেউ বাসন মাজতে বলছে না, বিয়ের আটদিন মাজতে হবেও না। পরের কথা পরে। আর কখানাই বা বাসন, মাজতে আমরা অবিশ্যি দুপুরেই মেজেছি, কই পুড়েও তো যাই চাও সন্ধ্যেবেলাই মেজো না। নি–তবে তুমি কাজ করবে, তোমার সুবিধে মতোই করবে বইকি! মাকে বলে নিও—’

‘হ্যাঁ, তাই যা হোক একটা করতে হবে কিছু! ….তবে তুমি আবার বলছ সন্ধ্যেবেলা। সন্ধ্যেবেলা তো বাবুরা বাড়ি ফেরে, তখন বুঝি কেউ বাসন-কোসন নিয়ে জুবড়ে পড়ে থাকে! সন্ধ্যের আগে কাজকম্ম সেরে না নিলে কখন মাথা বাঁধব গা ধোব! তোমার যা বুদ্ধি!’

রানীর আর সহ্য হয় না। বলে, ‘নাও-নাও, যা করবে সেরে নাও। আর দ্যাখো, বিয়ের কনে পাল্কী থেকে নেমেই এত কথা বলতে নেই, ওতে বড় নিন্দে হয়।’

‘তা বটে।’ তৎক্ষণাৎ সায় দেয় বিনু। বলে, ‘মাও সেই কথা একশ’বার বলে দিয়েছে পই পই করে। আমার যে কী এক পোড়া স্বভাব, থাকতে পারি নে চুপ করে।’ …

কাপড়-চোপড় ছাড়িয়ে শরবৎ খাইয়ে রানী তাকে ঘরে বসিয়ে চলে এল। মন যতই খারাপ হয়ে থাক, ক্রিয়াকর্মের বাড়ি, থই থই করছে লোক চারিদিকে, অসংখ্য কাজ পড়ে–মন খারাপ করে বসে থাকবার অবসর নেই।

কিন্তু বিনতাও এক জায়গায় স্থির হয়ে বসে থাকবার মানুষ নয়। সে একটু ইতস্তত ক’রেই ঘরের বাইরে দালানে এসে দাঁড়াল। কুশণ্ডিকা কাল রাত্রে সারা হয়ে গেছে ওখান থেকে, সন্ধ্যারাত্রে লগ্ন ছিল বলে হেমই বলেছিল কথাটা, ওদের কটা টাকাও ধরে দিয়েছিল সব যোগাড় করে রাখতে। আজ তাই অনেকটা নিশ্চিন্ত, এখনই কোন ঝঞ্ঝাট করতে বসতে হবে না। দালানে তখন কনক আর মহাশ্বেতা বসে কুটনো কুটছে। মহাশ্বেতাও তেমনি, ওকে দেখে বলে উঠল, ‘কী লো, কাজ খুঁজে বেড়াচ্ছিস? আয় না, বসে যা না। আমরাই বা একা তোর বিয়ের কুটনো কুটে মরি কেন? কী বলিস ভাই বৌদি?’

বিনুও তৎক্ষণাৎ বসে পড়ে সেখানে, ‘দিন না, কুটনো কোটা তো ভারী কাজ! ও আমার খুব অব্যেস আছে।’

‘থাক, থাক’, কনক ব্যস্ত হয়ে পড়ে, ‘ওমা, তুমি বিয়ের কনে এসেই কুটনো কুটতে বসবে কেন ভাই–আমরা এত লোক থাকতে! আঙ্গুলে দাগ হয়ে যাবে–কী আঙ্গুল কেটেই ফেলবে হয়ত। তুমি এমনিই বসো, গল্প করো বরং। তোমার বাপের বাড়ির গল্প বলো–’

‘বাপের বাড়ির ছাই গল্প। বাপই নেই তার বাপের বাড়ি–আপনি তো আমার বড় জা? এখানকার কথা একটু বলুন দিকি। আপনি তো সব জানেন শোনেন, আমাকে বুঝিয়ে দিন। আপনি তো দুদিন বাদেই ড্যাং করে চলে যাবেন–আমাকেই তো তখন এই ঘরকন্না করতে হবে। বুঝে নেওয়া ভাল আগে থাকতে!’

কনক অবাক হয়ে গেল। এ ধরনের কথা কনে-বৌয়ের মুখে–তার কাছে কল্পনাতীত। সে যেন তথমত খেয়ে গিয়ে ওর দিকে হাঁ করে চেয়ে রইল।

মহাশ্বেতা কথাগুলো ভাল শুনতে পায় নি। ইদানীং সেও একটু কম শুনছে কানে। যদিও সে নিজে সেটা মানতে চায় না। ওর ছেলেরা বলে, ‘চেঁচে চেঁচ্যে মায়ের কানের পর্দা ফুটো হয়ে গেছে। যা চেঁচান চেঁচায় দিনরাত!’ … সে কনকের দিকে ফিরে বললে, ‘কী হ’ল গো–তোমার হাত আবার থেমে গেল কেন! কী বলছে নতুন বৌ ফিস ফিস করে?’

বিনু আর একটু গলা নামিয়ে বলে, ‘ইনিই আমার বড় ননদ না? সেবার মেয়ে দেখা দিতে এসে দেখে গিছলুম। কানে কম শোনেন বুঝি? তাহ’লে কালার বংশ বলো! বাঃ, বেশ বে হ’ল আমার। যত রাজ্যের কালা আর পাগলকে নিয়ে কারবার, জন্মে বরের সঙ্গে দুটো সুখ-দুঃখের কথা কইতে পারব না।… তা হ্যাঁ দিদি, আমার একটি পাগল ননদ আছে শুনেছি–সেটি কোথায়?

তরু তখন দালানেরই একটা জানলার ওপর বসে ছিল চুপ করে–কনক নিঃশব্দে আঙুল দেখিয়ে দিল।

‘ওমা, ওই নাকি? তা কৈ পাগলের মতো তো মনে হচ্ছে না। বেশ তো ভাল মানুষের মতো চুপচাপ বসে আছে। ওকেই বোধহয় গুম্-পাগল বলে–না?’

‘না না, ছোট্ ঠাকুরঝি তেমন পাগল কিছু নয়। অতিরিক্ত শোকেদুঃখে অমনি জবুথবু হয়ে গেছে, জোর করে না নাওয়ালে নায় না, না খাওয়ালে খায় না–এই! চেঁচামেচি করা কি ভাঙ্গাচোরা–সে সব কিছু না!’

‘সব্বরক্ষে! আমার যা ভয় হয়েছিল, পাগল শুনে। বলি কি না কি, মারধোর করবে কি ঘুমের মধ্যে গলাটাই টিপে দেবে–’

‘ষাট! ষাট! ওসব কি অলুক্ষণে কথা। আজকের দিনে ওসব বলতে নেই। ছি!’

‘না, তাই বলছি।’ একটু অপ্রতিভভাবে জবাব দেয় বিনতা।

.

ফুলশয্যায় আড়ি পাতবার উৎসাহটা রানীরই বেশি। সে-ই দল পাকিয়েছিল। কনক আগেই বলেছিল, ‘একজন তো কানে শুনতে পায় না, কথা আর কী হবে, হয় লিখে বলতে হবে নয় তো ঠারে-ঠোরে–আড়ি পেতে কি লাভ দিদি?’

কিন্তু রানী সেসব কথা কানেই তোলে নি। বাইরের ঘরে ওদের ফুলশয্যা হবার কথা। সে বিকেল থেকে অনেক যত্ন অনেক তদ্বির করে একটা জানলার নর্দমা পরিষ্কার করে চেঁচে বাড়িয়ে চোখ চলবার মতো করে নিয়েছিল। আর একটা জানলায় এমনিই ফাঁক একটু বেশি–সেখান থেকে একজন দেখতে পারে। এদিকে –অর্থাৎ রাস্তার দিকের রক থেকেও যাতে দেখা যায় সেটার জন্যে হেমের শরণাপন্ন হ’ল শেষ পর্যন্ত সন্ধ্যের দিকে, ‘হেই ঠাকুরপো, একটা কিছু করে দাও ব্যবস্থা!’

হেম বলে, ‘বেশ লোক তুমি! ভাই-ভাদ্রবৌয়ের ফুলশয্যেয় আড়ি পাতার ব্যবস্থা করবে ভাসুর! লোকে শুনলে বলবে কি!’

‘আরে তুমি তো পাতছ না, পাতব তো আমি। তুমি শুধু একটা দোর-জানলার খাঁজটাজ ঠিক করে দেবে–এই কথা!’

‘ও সব হবে-টবে না আমার দ্বারা। আমার ঢের কাজ আছে এখন, এখনই সব লোকজন এসে পড়বে।’

অগত্যা রানী নিজেই সব ব্যবস্থা করে নেয়। ঠিক হয়, সে, কনক এবং ও বাড়ির মেজগিন্নী প্রমীলা আড়ি পাতবে, আর কারুর অত উৎসাহ ছিল না–মহাশ্বেতা একটু কৌতূহল প্রকাশ করেছিল, তা তাকে হেম ধমক দিয়ে ঠাণ্ডা ক’রে দিল।

খাওয়াদাওয়া চুকে হাতের সুতো খুলতেই রাত দেড়টা বেজে গেল। তারপর ওদের শোওয়ার ব্যবস্থা করে সব বেরিয়ে এল। বেরিয়ে এল প্রকাশ্যে–কিন্তু তারপরই ওরা তিনজনে আড়িপাতা ফোঁকরে চোখ দিয়ে গিয়ে দাঁড়াল। ভেতরে বাগানের দিকে রইল রানী আর প্রমীলা, বাইরের দিকে কনক।

ওরা দোর ভেজিয়ে চলে আসবার পর প্রথমটা দুজনেই চুপচাপ পড়ে রইল বর এবং কনে। বেশ কিছুক্ষণই। এরা যখন প্রায় হতাশ হয়ে উঠেছে তখন বিনতা হঠাৎ উঠে আশ্চর্য ক্ষিপ্রতার সঙ্গে নিঃশব্দে এসে কপাটটায় খিল দিয়ে দিলে। তারপর জানলার কাছে এসে বেশ একটু শ্রুতিগম্য স্বরেই আপন মনে বললে, ‘যে বেটাবেটিরা আজ আড়ি পাতবে তারা কিন্তু ঠকবে–নিজেদেরই ঘুম মাটি। এ তো আর গল্প করার মতো বর নয় যে কথা- বার্তা কইব শুনবে! আর দেখবারই বা আছে কি প্রেথম রাত্তিরে?’

ঘরে আলো রাখা নাকি নিয়ম–এরা হ্যারিকেনটাই কমিয়ে এক কোণে রেখে এসেছিল। বিনতা সেখান থেকে সেটা তুলে পলতেটা বাড়িয়ে আলোটা উজ্জ্বল করে বিছানার পাশে এনে রাখল। তারপর বুকের জামার মধ্যে থেকে একটা পাট করা কাগজ আর এক টুকরো ছোট পেন্সিল বার করে খস্থস্ করে কি লিখে কান্তির দিকে এগিয়ে দিল। বিস্ময়ে কান্তিরও চোখ বড় বড় হয়ে উঠেছিল–বিস্ময়ে আর প্রশংসায়। বধূর বুদ্ধি এবং কর্ম- তৎপরতা লক্ষ করে বুঝি আশ্বস্তও হয়ে উঠেছিল মনে মনে। সেও উজ্জ্বল মুখে কাগজটা টেনে নিয়ে বৌয়ের লেখাটুকু পড়ে তার নিচে কি লিখে আবার তার দিকে ঠেলে দিলে।

এই ভাবেই চলল ওদের প্রথম প্রেমালাপ। আড়ি যারা পাততে গিয়েছিল তাদের কারুরই আর রুচি ছিল না বেশিক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকার। তারা যেন অদৃশ্য এক-একটা চড় খেয়েই অপমানে মাথা হেঁট করে সরে এল আস্তে আস্তে। এখন লজ্জাটা তাদেরই।

নিঃশব্দেই এসে উঠোনে দাঁড়াল তিনজন। মুখে কথা ফুটছে না যেন কারও। কথাটা কেউই কাউকে বলতে চাইছে না আসলে–আঘাত দেবার এবং পাবারও ভয়ে। শেষে প্রমীলাই কতকটা সামলে উঠে বলল, ‘কখন ঐ কাগজ আর পেন্সিলটা যোগাড় করে জামার মধ্যে রেখে দিয়েছে ভাই, আশ্চর্য! আমরা কেউ টের পেলুম না! বোধ হয় বাপের বাড়ি থেকে সব গুছিয়ে তোরঙ্গের মধ্যে করে নিয়ে এসেছিল। একেবারে!’

রানী প্রায় কাঁদো-কাঁদো হয়ে বললে, ‘খুব শিক্ষা হয়ে গেল আমার! আর যদি কারও বিয়ের কথায় থাকি কোনদিন! লোকের ভিড়ে গোলমালে এখনও অতটা লক্ষ করতে পারেন নি মাসীমা, কিন্তু কাল-পরশুই বুঝতে পারবেন, তারপর আমি মুখ দেখাব কি করে! ছি-ছি!’

‘আপনি ভুল করছেন দিদি’, ওকে জড়িয়ে ধরে ঘরের মধ্যে টেনে নিয়ে যেতে যেতে কনক বলে, ‘ওর এমনি বৌই দরকার ছিল। বৌ নয়–ছোট ঠাকুরপোর একটা গার্জেনই দরকার, তাই পেয়েছে। ঐ হাবা কালাকে নিয়ে সংসার করা, বৌ শক্ত না হলে চলত কী করে!’

হয়ত সারারাতই জেগে চিঠি লেখালেখি করেছে ওরা,–কিম্বা বিনতার বাপের বাড়ি থেকে শিখিয়ে দিয়েছিল যে শ্বশুরবাড়ি গিয়ে অন্তত প্রথম প্রথম খুব ভোরে উঠতে হয়, গুরুজনদের ওঠবার পর ঘরের দোর খুলে বেরোনো বড় লজ্জার কথা–ছোটবৌ খুব ভোরেই উঠোনের দিকের দরজা খুলে বেরিয়ে এসেছিল। কিন্তু উঠোনে পড়তেই তার নজরে পড়ল যে তরু তারও আগে উঠে পড়েছে এবং কি একটা করছে। আর একটু কাছে আসতে–কী করছে তাও বুঝতে পারল। আগের দিন রাত্রে অভ্যাগতদের পাতা থেকে নিহাৎ কামড়ানো-চট্‌কানো টুকরো টাকরা বাদে অবশিষ্ট উচ্ছিষ্টগুলো একটা ঝুড়িতে তুলে রাখা হয়েছিল–সকালে ভিখারি কাঙালিদের দেওয়া হবে এই উদ্দেশ্যে। তরু তারই মধ্যে থেকে বেছে বেছে মাছগুলো তুলে খাচ্ছে!

‘ওমা, ওমা, কি হবে মা! এ কি কাণ্ড!’ ছোটবৌ শোরগোল তুলে দিল একেবারে ‘বিধবা মানুষ, তায় বামুনের বিধবা মাছ খাচ্ছ কি! তায় সত্তিকজাতের এঁটো। জাতজম্ম রইল কি তোমার? বলে পাগল না ছাই সেয়ানা পাগল–বোঁচকা আগল! পাগলই যদি তো অন্য কিছু না খেয়ে মাছ খাবে কেন। মাছের সোয়াদটি তো ঠিক জানা আছে! বলি ও ছোট ঠাকুরঝি–ই কি কাণ্ড তোমার? এত নোলা!’

গুঁতোগুঁতি ক’রে অল্প জায়গায় শোওয়া–ঘুম ভাল ক’রে কারুরই হয় নি। এই চেঁচামেচিতে প্রায় সকলকারই ঘুম ভেঙ্গে গেল। হেম বেরিয়ে এল রান্নাঘর থেকে। কনক রানী এরাও ছুটে এল। শ্যামার কোমরটা ছাড়িয়ে নিয়ে উঠতে একটু দেরি হয়–তিনি যখন বেরোলেন তখন হেম হাত ধরে টেনে তরুকে সরিয়ে দিয়েছে, কনক নিয়ে যাচ্ছে ঘাটের দিকে মুখ হাত ধোওয়াতে। ঘটনাটা যাই হোক, নতুন বৌ–বিশেষত ফুলশয্যার কনেবৌকে এতটা চেঁচামেচি করতে নেই, –উপস্থিত সকলকারই এই কথাটা প্রথম মনে হয়েছিল, তরুর আচরণের থেকে ওর আচরণটাই দৃষ্টিকটু শ্রুতিকটু দুই-ই লেগেছিল। কিন্তু শ্যামা সেটা লক্ষ করলেও, নতুন বৌয়ের সামনে তরুর এই কাণ্ডতে অপমান-বোধ এবং লজ্জাটই প্রবল হয়ে উঠল। তাঁর যেন মাথা কাটা গেল এই ব্যাপারে। হয়ত তরুর জন্যেই সবচেয়ে বেশি বিব্রত থাকতে হয়েছে এই ক’মাস, মেজমেয়ের কাছে মাথা হেঁট করতে হয়েছে অযথা–এই সব কারণে একটা অসহায়, প্রতিকার-হীন বিক্ষোভ মনে জমছিল বহু কাল থেকে;এই উপলক্ষে সেইটেরই বিস্ফোরণ ঘটল একেবারে। তিনি দ্রুত এগিয়ে এসে দু হাতে ঠাস ঠাস ক’রে গোটাকতক চড় কষিয়ে দিলেন তরুর দুই গালে। বললেন, ‘হারামজাদী শুধু আমাকে জ্বালাতে পোড়াতে এসেছিল পেটে! জন্মভোর জ্বালিয়ে পুড়িয়ে খাক ক’রে দিলে একেবারে! এত খাও তবু নোলা যায় না! সব্বস্ব খেয়ে বসে আছিস্- এখনও খাওয়ায় এত লালসা! যত অলুক্ষণে আর যত অমঙ্গুলে কাণ্ড ক’রে যাচ্ছ! আর কী বাকি আছে, ঐ ছেলেটা তো? তা তাই না হয় তার মাথাটা কড়মড় ক’রে চিবিয়ে খা। খেয়ে আমাকে অব্যাহতি দে। তুইও বাঁচ আমিও বাঁচি!’

কনক রানী দুজনে মিলে ধরে তাঁকে সরাতে পারে না। বলছেন আর পাগলের মতো মেরেই চলেছেন। কনক বলল, ‘ছি মা, ওর কী জ্ঞানবুদ্ধি আছে যে, ওকে অমন ক’রে মারছেন! একটু হুঁশ থাকলে ও কি আর এটা করে। এমনি তো দেখেন জোর ক’রে না খাওয়ালে খেতেই চায় না। একে লোভ বলছেন কেন! আপনিও কি পাগল হয়ে গেলেন। কাকে মারছেন আপনি, ও কি কিছু বুঝছে! সরুন–ওর হাত ধুইয়ে নিয়ে আসি!’

এবার শ্যামা সমস্ত আবেগ নিঃশেষ ক’রেই বোধ হয় কেঁদে ফেললেন, ‘না মা, আমার আর সহ্যি হয় না। তোমরা বিষ এনে দাও, খেয়ে আমি শান্তি পাই। এ জ্বালানি পোড়ানি কত কাল ভুগব আর।’

ফ্যাশ ফ্যাশ ক’রে নতুনবৌ বলল, ‘সত্যি দিদি, আপনি বলছেন বটে হুঁশ-প নেই–কিন্তু মুখের তারটি তো ঠিক আছে–কই, কুমড়োর ঘাট তো খায় নি, ঠিক মাছটিই বেছে বেছে মুখে দিয়েছে।’

সর্বাঙ্গ জ্বলে গেল যেন কনকের; সে একটু কড়া সুরেই বললে, ‘তুমি চুপ করো! তুমি কনেবৌ–সব তাইতে তোমার কথা বলার দরকার কি!… এক বাড়ি গুরুজনের মধ্যে তোমার এত কথা বলতে লজ্জা করে না!’

এতক্ষণে শ্যামারও যেন খেয়াল হ’ল তাঁর নবনীতা পুত্রবধূর অশোভন আচরণ। অথবা সক্কালবেলাই এই অবাঞ্ছিত ব্যাপারটা ঘটে যাওয়াতে তাঁর মনে ইতিমধ্যে যে অনুতাপ আর অপ্রতিভতার ভাব দেখা দিয়েছিল–তার সম্পূর্ণ চোটটা গিয়ে পড়ল–এই সমস্তটার জন্য দায়ী ঐ মেয়েটির ওপরই। তিনি ঘুরে দাঁড়িয়ে কঠোর স্বরে বললেন, ‘তোমাকেও আমি এই সাবধান করে দিচ্ছি ছোটবৌমা–নোলা দু রকমের আছে, এক বেশি খাওয়া আর এক বেশি কথা বলা। ও কোন নোলাই ভাল না। এক ফোঁটা মেয়ের এত কিসের থগবগানি সব তাইতে? ফের যদি ছোট মুখে এমনি বড় বড় কথা শুনি তো সকলের সামনে সাঁড়াশি পুড়িয়ে ঐ নোলা টেনে ছিঁড়ব। তোমার কোনও কাকা এসে রক্ষে করতে পারবে না বলে দিলুম!’

তাঁর ক্রুদ্ধ ভঙ্গিতে, এবং কিছু পূর্বের চড় মারার দৃশ্য মনে পড়ায়, ভয় পেয়ে গেল বিনতা। সে দ্রুত পিছন ফিরে তাদের ঘরে ঢুকে গিয়ে সেখান থেকে অনুচ্চ কণ্ঠে বলতে লাগল, ‘বারে! সব্বাই এখন আমার ওপরই ঝাল ঝাড়তে শুরু করল। যত দোষ এখন আমারই। বেশ তো!’ …

এতদিনের এত কথা, এত তিরস্কার এত বকুনি এত অনুরোধ উপরোধ মিষ্ট বাক্যেও তরুর স্তম্ভিত ভাবটা কাটানো যায় নি! মনে হ’ত কিছুই তার কানে যায় না, কিছুই তার প্রাণে লাগে না। তার চিত্ত এবং বুদ্ধি দুই-ই বুঝি জড় হয়ে গেছে। কিন্তু আজ পুকুর ঘাটে নিয়ে গিয়ে ওর মুখ ধোওয়াতে ধোওয়াতে–গালের ওপর যেখানে শ্যামার কর্মকঠিন আঙ্গুলের দাগ বসে গিয়েছিল–সেইগুলোই জল ঘষে দিতে দিতে হঠাৎ নিজের হাতের ওপর গরম গরম কয়েক ফোঁটা কি গড়িয়ে পড়ায় কনক চমকে চেয়ে দেখল, তরুর দুই চোখের কোল উপচে তপ্ত অশ্রুই ঝরে পড়ছে। কনক তখনই কোন সান্ত্বনা দেবার চেষ্টা করল না, শুধু নিজের আঁচল দিয়ে মুছিয়ে তুলে নিয়ে গেল। যেতে যেতে কেবল একবার বললে, ‘শোকেতাপে নানা কারণে মার মাথা খারাপ হয়ে গেছে ভাই ঠাকুরঝি, তুমি মনে কিছু নিয়ো না, লক্ষ্মীটি!’

কথাগুলো তরু ঠিক বুঝতে পারল কিনা, ওর জড়ত্ব সম্পূর্ণ কেটেছে কিনা বোঝা না গেলেও কনক মনে মনে একটু আশ্বস্তই হয়ে উঠল। কারণ তরু কোন উত্তর না দিলেও বা কথা না কইলেও এবার নিজেই নিজের আঁচল দিয়ে চোখ দুটো শুকনো করে মুছে নিল কনক এরকম এর আগে শুনেছে তার বাবা কাকার মুখে। এই ধরনের গুম পাগল, যারা কোন মানসিক আঘাতে এমনি জড়ভরত হয়ে যায়–তারা আবার কোন কঠিন আঘাতেই নাকি স্বাভাবিক অবস্থা ফিরে পায়। ওর মনে আশা হ’ল সম্ভবত তরুও এবার সুস্থ হয়ে উঠবে আপনা-আপনিই

সে আশা আরও বাড়ল তার দুপুরবেলা, যখন ভাত খাওয়াবার জন্য ওকে নিতে এল কনক। বহু দিন পরে তরু কথা কইল, সামান্য দুটিমাত্র শব্দ– ভাল লাগছে না, এখন থাক!’ কনক ওকে জড়িয়ে ধরে অনেক আদর ক’রে শেষ পর্যন্ত খেতে নিয়ে গেল, বললে, একটা শুভদিন, এখনও চারদিকে লোকজন–তোমার ছোট ভায়ের বিয়ে, এই দুপুরবেলা যদি না খেয়ে পড়ে থাকো, তাদেরও যেমন অকল্যেণ, মার মনেও তেমনি লজ্জার শেষ থাকবে না, ভাববেন তাঁর জন্যেই তুমি খেতে চাইছ না। তিনি তো তোমাদের জন্যে অনেক করেছেন, তাঁকে একটু মানিয়ে মাপ ক’রে নিতে পারছ না?

আর কোন কথা বলে নি তরু, শান্তভাবেই গিয়ে খেয়েছে, খাওয়া হ’লে বহুকাল পরে নিজেই এঁটো বাসন নিয়ে গিয়ে পুকুরে ভিজিয়ে রেখে মুখ ধুয়ে এসেছে। এ ঘটনাটা আরও অনেকেরই চোখে পড়ল, মহাশ্বেতা আগের দিন রাত্রে এ বাড়িতে থেকে গিয়েছিল, সে শ্যামাকে খুঁজে বার ক’রে উৎসাহের সঙ্গে বললে, ‘বলি তোমার দাওয়াই তো খুব ভালই ঝেড়েছ দেখছি। তরোর তো রোগ সেরে গেল।… হুঁশ তো বেশ খানিকটা ফিরে এসেছে বলেই মনে হচ্ছে। তোমার কেটো হাতের চড়ের গুণ আছে দেখছি!’

শ্যামা অবশ্য উত্তর দিলেন না, সকালের ব্যাপারটার জন্য তাঁর অনুশোচনার সীমা ছিল না। সত্যিই তো–বেচারি জন্মাভাগী, তাঁর কোলে এসে জন্মে জীবনভোর দুঃখই পেয়ে গেল ….ওর আর দোষ কি, গ্রহেই করাচ্ছে বৈ তো নয়! তাঁরও গ্রহ, মেয়েরও। না, মারাটা ঠিক হয় নি অমন ক’রে!….

ইচ্ছে হয়েছিল অনেকবারই, গিয়ে একটু কাছে ডেকে গায়ে হাত বুলিয়ে আদর ক’রে আসেন, কিন্তু বহুদিনের অনভ্যাসে কেমন একটা আড়ষ্টতা এসে গেছে কোথায়, সেটা আর সম্ভব হবে না বুঝে নিরস্ত হলেন। স্বাভাবিক যে কোমলতা থাকলে অনুতাপের এই বহিপ্রকাশে লজ্জা আসে না–সে কোমলাতাকে উনি অনেক দিন পিছনে ফেলে এসেছেন, এখন নারী-সুলভ যে কোন দুর্বলতা প্রকাশ করতেই যেন বাধ-বাধ ঠেকে। ….

খাওয়া-দাওয়ার পর বিকেলের দিকে মহাশ্বেতা নিজের বাড়ি চলে গেল। রানীরাও। বাইরের লোক বলতে আর কেউ ছিল না। কিছু বেঁচে যাওয়া মিষ্টি নিয়ে আর রানীর ছেলেটাকে কোলে ক’রে হেম গেছে রানীদেরই পৌঁছে দিতে। বাসন-কোসন মাজামাজি ক’রে কনকও ক্লান্ত হয়ে ছেলেটাকে নিয়ে এক জায়গায় আঁচল বিছিয়ে শুয়ে পড়েছে। শ্যামা তার অনেক আগেই শুয়েছেন এসে, সন্ধ্যাবেলা বাড়িটা শুধু নিস্তব্ধ নয়–নির্জনও ছিল। কান্তি গিয়েছিল মুদির দোকানে বাড়তি ময়দা প্রভৃতি ফেরৎ দিয়ে তাদের হিসেব মিটিয়ে আসতে। ছোটবৌ নিজের ঘরে বিছানাপাতা চুলবাঁধা টুকিটাকি কাজ শেষ ক’রে সেইখানেই বসে ছিল। এরই মধ্যে কখন তরু চুপিসাড়ে বেরিয়ে গেছে বাড়ি থেকে, তা কেউই লক্ষ করে নি।

প্রথম হুঁশ হ’ল কনকেরই। হেম ও কান্তি ফিরল প্রায় এক সঙ্গেই। উঠে ওদের খেতে দিতে গিয়েই তার লক্ষ পড়ল।

‘মা, ছোট্ ঠাকুরঝি কোথায়? দেখতে পাচ্ছি না তো!

শ্যামা তখনও অত কিছু ভাবেন নি। তন্দ্রাজড়িত কণ্ঠে শুধু বললেন, ‘ঘরে নেই? জানলায়? দ্যাখো, হয়ত বাগ্যানে গেছে কি ঘাটে। লম্পটা কোথায়? লম্প নিয়ে যায় নি?’

কৈ, না তো! বাগান–মানে পাইখানাও দেখে এলুম, কৈ ঘাটেও তো নেই!’

কেমন যেন একটা অশঙ্কার আকুলতা ফুটে ওঠে কনকের কণ্ঠে, ঘুমের ঘোরে শ্যামার কানে সেটা আর্তনাদের মতো শোনায়।

‘কী সর্বনাশ! তাহলে কোথায় গেল সে।’ শ্যামা ধড়মড়িয়ে উঠে বসেন।

প্রথমে বাড়িটাই খোঁজা হল তন্নতন্ন ক’রে। কোথাও পাওয়া গেল না। তখন কান্তি ছুটল বড় মাসিমাদের বাড়ি, হেম গেল বাজারের দিকে। চেনা দোকানদারদের জিজ্ঞাসা ক’রে দেখবে–কারও নজরে পড়েছে কিনা। মহাদের বাড়িতেই যাক, আর খালের দিকেই যাক, ঐ একই রাস্তা।

কিন্তু অত দূর যেতে হ’ল না। সিদ্ধেশ্বরীতলা পর্যন্ত যাবার আগেই খবর পাওয়া গেল। খবর দিতেই আসছিল তিন-চারজন।

নতুন বামুনদের পাগলী মেয়েটা রেলে কাটা পড়েছে।

এই সন্ধ্যের বোম্বে মেল দুখানা ক’রে কেটে দিয়ে গেছে তাকে।

তবে দুর্ঘটনা, না আত্মহত্যা–সেইটেই শেষ পর্যন্তও জানা গেল না। কেউ বললে, লাইন পার হচ্ছিল গাড়ি এসে পড়েছে; কেউ বললে, না ইচ্ছে করেই ঝাঁপিয়ে পড়েছে সামনে।

।।৩।।

সেদিনের রাত্রিশেষটা বোধ হয় কারুর পক্ষেই সুপ্রভাত হয় নি।

অনেক দিন পরে বাপের বাড়ি থেকে খুশি মনেই ফিরছিল মহাশ্বেতা। সে অতশত বোঝে না, নতুন বৌয়ের কথাবার্তা বিশেষ তার কানে যায় নি; হাবাকালা ভাইটার একটা সদ্গতি হ’ল–সেইটেই তার কাছে বড় কথা। বৌ এমন কিছু খারাপ দেখতেও নয়, বেশ নতুন-বৌ নতুন-বৌই তো দেখাচ্ছিল ছুঁড়িকে বাপু।

আর খুশি হবার কারণ তরুর হুঁশজ্ঞান ফিরে আসবার লক্ষণটা। আহা, যদি ভাল হয়ে যায় মেয়েটা সত্যি সত্যিই –ওরও শান্তি, মায়েরও শান্তি। অনেক তো কষ্ট পেলে, এবার কিছুদিন শান্তিতে থাক।’যে যেখানে আছে ভাল থাক।’ এইটেই বলতে বলতে এসেছে সে প্রায় সারা পথটা।

বাড়িতে পৌঁছেও সে অতটা কিছু লক্ষ করে নি।’মহারাণী’র সঙ্গে তার খুব সম্প্রীতি নেই দীর্ঘকালই–তবু আজ বাড়িতে ঢুকে তাকে সামনে পেয়ে তার কাছেই হাত-পা নেড়ে গল্প করতে লেগে গেল। বৌভাতের গল্প, কতটি লোক খেয়েছে (যেন ওরা কেউ যায় নি!), কী কী রান্না হয়েছিল–ইত্যাদি; মার কৃপণতা যে দিন দিন বাড়ছে তার কতকগুলি সদ্য- দৃষ্টান্ত; দাদা কীভাবে সারাক্ষণটা বড়বৌদির পিছনে পিছনে ঘুর ঘুর করেছে (‘এখনও বাপু টানটা যায় নি যে যতই বলো!’) তারই রসালো বিবরণ এবং সর্বোপরি মার তিন-চারটি চড়ে কেমন করে তরুর চৈতন্যোদয়ের লক্ষণ দেখা দিল তারই বিস্তৃত ইতিহাস সালঙ্কারে ও এক নিঃশ্বাসে বিবৃত করছিল, হঠাৎ অনেকক্ষণ একতরফা বকে যাবার পর একসময় তার খেয়াল হল যে, তার শ্রোতা ও শ্রোত্রীরা সকলেই কেমন অস্বাভাবিকভাবে চুপ করে আছে, সকলেরই মুখেচোখে কেমন থমথমে ভাব।

প্রথম যা মাথায় ঢুকতে দেরি–তারপর জিনিসটা পূর্ব অভিজ্ঞতার সঙ্গে মিলিয়ে নেওয়া কঠিন নয়। মেজবৌয়ের ভাবভঙ্গির হদিস মহা কোনদিনই ভাল পায় না ওর কথা না হয় ছেড়েই দিল–কিন্তু ছোটবৌয়েরও বিষণ্ন গম্ভীর ভাবটা উড়িয়ে দিতে পারল না। খানিকটা বোকার মতো এর ওর মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে সে ছোটবৌকেই ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞাসা করে, ‘হ্যাঁরে, কী হয়েছে রে, তোরা অমন মুখ অন্ধকার ক’রে আছিস কেন? সবাই ভাল আছে তো? কোথাও থেকে কোন খারাপ খবর-টবর আসে নি?’

বলতে বলতেই লক্ষ হ’ল মানুষটাকে। রোদ এখনও ও-বাড়ির পাঁচিলের মাথায়– এমন সময় তো কোনদিন ফেরে না। সে মেজ ছেলের দিকে ফিরে বলল, ‘হ্যাঁরে, এই, অ ন্যাড়া। তোদের গুষ্টি আজ এরই মধ্যে বাড়ি ফিরেছে যে? এতক্ষণ ঠাওর করি নি। এত সকালে বাড়ি ফিরল, শরীর ভাল আছে তো? তোরা খবর-টবর নিয়েছিলি একটু?’

এই প্রথম বোধ করি তার ছেলেদেরও চপল ও বাঁচাল রসনা স্তব্ধ রইল। ন্যাড়া কেন, তার পরের আরও দুটো ভাই উপস্থিত ছিল, কিন্তু কারও মুখে কোন কথা সরল না। ন্যাড়া মাথা হেঁট করে বসে মেঝেতে নখ দিয়ে দাগ কাটতে লাগল।

ওদের ভাবভঙ্গিতে মহাশ্বেতার উত্তরোত্তর ভয় বেড়ে যাচ্ছিল, সে প্রায় কান্নার মতো ক’রে চেঁচিয়ে উঠল, ‘আ মর, তোরা অমন করে মুখে গো দিয়ে রইলি কেন সকলে মিলে। ভেঙ্গে বলিব তো কি হয়েছে। আমার যে পেটের মধ্যে হাত-পা সেঁধিয়ে যাচ্ছে তোদের রকমসকম দেখে …. বল না মুখপোড়ারা কী হয়েছে।’

এইবার মেজবৌই কথা বললে, তার স্বভাবসিদ্ধ লঘুভঙ্গি ত্যাগ ক’রে আস্তে আস্তে বললে, ‘বঠাকুরের চাকরি শেষ হয়ে গেল আজ থেকে, তাই সকাল করে ফিরে এসেছেন!

‘কী–কী হয়ে গেল বললি?’ বিশ্বাস হয় না নিজের কানকে। অভয়পদর কোনদিন চাকরি না থাকতেও পারে–একথাটা এতকাল বোধ হয় এ বাড়ির কারও মাথাতে যায় নি। তাই মহাশ্বেতার কণ্ঠ তীক্ষ্ণ হয়ে উঠলেও তেমন করুণ শোনাল না। দৃঢ় অবিশ্বাসই বেশি সে কণ্ঠে। নিজের কানকেই অবিশ্বাস …. অবিশ্বাস আর সন্দেহ।

‘ওঁর নাকি যতদিন চাকরি করার কথা–তার চেয়ে বেশি দিন হয়ে গেছে, তাই ওঁকে সাহেবরা বসিয়ে দিয়েছে। বলেছে যে, আর কতকাল টুল জোড়া ক’রে বসে থাকবে? নতুন লোকদেরও তো ক’রে খাওয়া দরকার। আর ঢের দিন তো হ’ল–অনেক দিন তো খাটলে, এবার কিছুদিন আরাম করো গে!’

এবার আর সন্দেহের অবকাশ রইল না। অবিশ্বাসেরও না। এমন কথা নিয়ে কিছু তামাশা করবে না মেজবৌ। বিশেষ বড়কর্তার কথা নিয়ে তো করবেই না। তাছাড়া, কিছু একটা হয়েছেই নিশ্চয়–নইলে এমন সময় বাড়িতেই বা ফিরবে কেন? এতকালের মধ্যে, আঙুলে গুনে বলে দিতে পারে মহাশ্বেতা, চারদিন না পাঁচদিন সকাল করে ফিরেছে সে। সেও কোন ‘বিপুর্যেয়ে’ কাণ্ড কোথাও হয়েছে, সেই জন্যে অফিসই সকাল করে বন্ধ হয়েছে–তবে! তাছাড়া চুপ ক’রে রকের ধারে বসে আছে–কোন কাজকর্মে হাত না দিয়ে–এটাও একটা নিয়মের প্রচণ্ড ব্যতিক্রম।

লক্ষণ সমস্তই মন্দের। আর মন্দটাই বেশি ফলে–এটা মহাশ্বেতা তার গণ্ডীবন্ধ জীবনেও অনেকবার দেখেছে। যে কথা রটে, যেটা লোকে অনুমান করে তার মধ্যে যা ভাল, তা কদাচ কখনও সত্য হয়, কিন্তু খারাপ যেগুলো, সেগুলো ঠিক সত্যি হয়ে বসে থাকে।

তবু চাকরিটা সত্যিই নেই, আজ থেকেই নেই–সেটা যেন এখনও বিশ্বাস হয় না।

হয়ত নোটিশ দিয়েছে, হয়ত সময় একটা বেঁধে দিয়েছে। সেটাও যথেষ্ট খারাপ খবর, তবু আজ থেকেই–? না না, তা কখনও হ’তেও পারে? হ’লে যে তাদের চলবে না, তাদের এতবড় সংসার অচল হয়ে যাবে! এত বড় ‘বেরৎ গুষ্টি’ খাবে কি? এই জন্যেই মন বিশ্বাস করতে চায় না বোধ হয় চরম দুঃসংবাদটা। মনে মনে কোথায় একটা অস্তিত্বহীন আশ্বাসকে আঁকড়ে ধরে থাকে।

অভয়পদ অবশ্য নাগালের বাইরে কোথাও নেই–সামনেই বসে আছে। তাকে গিয়ে জিজ্ঞাসা করলেই হয়। সে স্ত্রী, তার তো ষোল আনা অধিকারই আছে জিজ্ঞাসা করবার। তবু যেন সাহসে কুলোয় না মহাশ্বেতার। অনেকক্ষণ পরে পা পা ক’রে গিয়ে পেছনে দাঁড়ায় শুধু–কোন প্রশ্ন মুখ ফুটে করতে পারে না।

আজ কিন্তু–বোধ করি এই প্রচণ্ড আঘাতেই–অভয়পদরও একটা বড় রকমের পরিবর্তন ঘটেছে মনের মধ্যে। সে-ই খানিকটা পরে, পিছনে না ফিরেও স্ত্রীর উপস্থিতিটা অনুভব করে বলল, ‘সত্যিই ছুটি হয়ে গেল এবার–। আজ থেকেই।

‘আজ থেকেই একেবারে–?’ কোন মতে ফিসফিস ক’রে বলে মহাশ্বেতা।

‘হ্যাঁ। আরও তিন মাসের মাইনে পাব অবশ্য, তবে আপিসে আর যেতে হবে না। শুধু সাত দিন পরে একবার যেতে হবে হিসেবটা চুকিয়ে নিয়ে আসতে।

আড়ষ্ট হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে মহাশ্বেতা, কোন প্রশ্নই করতে পারে না।

অভয়পদই একটু পরে আবার বলে, তেমনি ধীরে ধীরে, ভাবলেশহীন কণ্ঠে- ‘লোভে পাপ পাপে মৃত্যু এও তো এক রকমের মৃত্যুই –পুরুষ মানুষ ঘরে এসে বসব হাত পা গুটিয়ে–এ আর মৃত্যু ছাড়া কী? –তা সবই সেই লোভ থেকেই হ’ল আর কি! বেয়াল্লিশ তেতাল্লিশ বছর চাকরি হ’ল–বোধ হয় আরও বেশিই হ’বে, আমার হিসেব নেই অত––অফিসেরও সে সব খাতা নষ্ট হয়ে গেছে–তা সবাই মিলে, আমাদের বড়বাবুই উয্যুগী হয়ে বলেছিল, যা হোক দু-চারটে টাকা করেও অন্ততঃ পেনসন দিতে, কিন্তু সাহেবরা কেউ রাজি হ’ল না।… আসলে সেই সাহেব দুটো যে বেইজ্জৎ হ’ল ওদের জাতের মুখ ডুবল–সে কথাটা ওরা ভুলতে পারছে না। আমার ওপর একটা আক্রোশ পড়েছে ওদের। ওদের মনে হয়েছে যে আমি কসাইয়ের মতো সুদ আদায় ক’রে ক’রে তাদের রক্ত মাংস মায় হাড় কখানা পর্যন্ত চুষে খেয়েছি। আমি অমনভাবে টাকা না যোগালে নাকি তারা অতটা অধঃপাতে যেতে পারত না। তাছাড়া আমি সৰ্বস্বান্ত হয়েছি, এও ওরা মানতে চায় না। ওরা স্পষ্টই বলেছে যে, আমি নাকি অনেক টাকা গুছিয়ে নিয়েছি চড়া সুদ খেয়ে খেয়ে। আমার যা ডুবেছে তা নাকি লাভের তুলনায় কিছুই নয়। তাই ওরা কোন রকম দয়া-ধর্ম করতে রাজি হ’ল না কিছুতেই।… প্রভিডেন্ড ফান্ডের টাকা অনেকখানিই তো তুলে নিয়েছিলুম –এখন সব মিলে যা পাব, হয়ত হাজার টাকারও কম দাঁড়াবে।’

‘তাহ’লে এখন উপায়?’

অনেকক্ষণ পরে অতিকষ্টে উচ্চারণ করে মহাশ্বেতা কথাগুলো।

‘উপায় ভগবান!’ শব্দগুলো অভয়পদর পক্ষে স্বাভাবিক–কিন্তু এই প্রথম, তার অভ্যস্ত শান্ত উদাসীন কণ্ঠে বিষণ্নতার সুর ধরা পড়ে একটু। একটা নিঃশ্বাসও পড়ে কথাগুলোর সঙ্গে সঙ্গে।

.

সারা বাড়িটার সেই থমথমে স্তব্ধ আবহাওয়া একটা প্রবল দমকা বাতাসে আবার প্রাণচঞ্চল হয়ে উঠল। কান্তি খবরটা নিয়ে এল প্রায় ছুটতে ছুটতে। তরু আজ সন্ধ্যেয় রেলে কাটা পড়েছে, ওদের কারুর একবার যাওয়া দরকার এখনই। দাদা একা–কী করবে ভেবে পাচ্ছে না। বড়দা আজই কোথায় গেছে থিয়েটার দেখতে– কোথায় গেছে কখন আসবে, তা কেউ জানে না। মা খবর শুনে পর্যন্ত চৌকাঠে মাথা ঠুকছেন–বৌদি তাঁকে সামলাবে, কি ছেলে দেখবে ভেবে পাচ্ছে না। পাড়ার লোকে কেউ কেউ এসেছে বটে–কিন্তু এরা না গেলে দাদা জোর পাচ্ছে না।

ছেলেরা তখনই হৈহৈ ক’রে বেরিয়ে পড়ল। অম্বিকাপদ একবার দাদার মুখের দিকে আড়ে চেয়ে নিয়ে দুর্গাপদকে বললে, ‘তুমিও একবার না হয় যাও–ছেলেরা যতই করুক, পাকা মাথা কেউ থাকা দরকার।’

অভয়পদ তখনও পর্যন্ত রকের ধারের সেই জায়গাটিতে চুপ ক’রে বসে ছিল। তার ঐ একভাবে বসে থাকাতে সকলেই একটা অস্বস্তি বোধ করলেও কেউ কিছু বলতে সাহস করে নি। বোধ হয় কী বলবে, কী বলে সান্ত্বনা দেবে তা ভেবে পায় নি। মহাশ্বেতা অনেকক্ষণ কাছে বসে ছিল চুপ করে, তারপর সেও উঠে গেছে। সংসারের কর্মচক্রে আবর্তিত হওয়া দীর্ঘদিনের অভ্যাসে আর সংস্কারে পরিণত হয়েছিল, তাই সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসার পর ও আর নিষ্ক্রিয় হয়ে বসে থাকতে পারে নি। তার নিজের ভাষাতেই ‘অসুমর’ কাজ পড়ে চারিদিকে, দেখে-শুনে হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকা যায় না।

সে চলে যাবার পরে অন্ধকার আরও গাঢ় হয়ে, অভয়পদকে আচ্ছন্ন ক’রে ঘনীভূত হয়ে এসেছে, কিন্তু তবুও অভয়পদ ওঠে নি, নড়ে নি। এইবার প্রথম, সে শুধু নড়লই না, উঠে দাঁড়াল। বলল, ‘না দুগ্‌গা থাক বরং আমিই যাচ্ছি। আমারই যাওয়া দরকার। পুলিশের ব্যাপার একটা আছে বোধ হয়–ওরা ছেলেমানুষ সামলাতে পারবে না।’

তার এই মানসিক অবস্থায় এসব ব্যাপারে যাওয়া কতটা যুক্তিযুক্ত হবে সে সম্বন্ধে উপস্থিত সকলের মনেই প্রবল সন্দেহ দেখা দিল, মেজবৌ কী একটা ফিসফিস ক’রে বললও অম্বিকাকে–বোধহয় নিরস্ত করারই কথা–কিন্তু অম্বিকা কিছু বলতে পারল না শেষ পর্যন্ত। বহুদিন ধরে এ-বাড়িতে অভয়পদরই সর্বশেষ কথা বলার অধিকার স্বীকৃত হয়ে এসেছে প্রায় নির্বিচারেই, আজও তাই কেউ কোন কথা বলতে পারল না তার ওপর। ….

অভয়পদর সঙ্গে মহাশ্বেতাও যাবে, এইটেই সকলে ধরে নিয়েছিল। স্বাভাবিকও সেটা। কিন্তু বিকেলের ঐ আঘাতের পর এখনই আবার এই আঘাত তাকে একেবার অনড় ক’রে দিল। সে যেন খুব চিৎকার ক’রে কাঁদতেও পারল না –প্রথমটা একবার জোরে কেঁদে উঠেই বুকের মধ্যে একটা যন্ত্রণা অনুভব করে দু’হাতে বুক চেপে শুয়ে পড়ল। ছোট-বৌ তরলা ছাড়া সেটা তখন কেউ লক্ষও করে নি। সংবাদটার অপ্রত্যাশিততা ও আকস্মিকতায় বিস্ময়-বিমূঢ় সকলে সংবাদদাতাকেই ঘিরে দাঁড়িয়েছিল কৌতূহলী হয়ে। তরলাই তাড়াতাড়ি ছুটে এসে তড়িৎকে মাথায় বাতাস করতে বলে নিজে তার বুকে তেল- হাত বুলিয়ে চঁচে দিল খানিকটা। তাতে একটু সুস্থ হয়ে উঠে বসলেও পায়ে বল ফিরে এল না। তার চোখের সামনে দিয়েই ছেলেরা, কান্তি–সবাই চলে গেল, অভয়পদও। সে যেতে পারল না।

অভয়পদ যখন যায়–একবার কাঁদো-কাঁদো গলায় সে বলেছিল অবশ্য, ‘ওগো, তোমরা আমাকে ছেড়ে দাও, ওগো আমার মা যে সেখানে দহড়া পিছে গো একা একা–আমি না গেলে কে তাকে দেখবে।… আমি ঠিক যাবো–আমার কিচ্ছু হবে না। আমার মিত্যু নেই। নইলে কোলের বোনটা চলে গেল, ছোট ভাইটা নিখোঁজ হ’ল– দ্যাখো আমি এখনও ঠিক বেঁচে আছি। আমি বেশ যেতে পারব ছোট–আমাকে যেতে দে তোরা!’

বলছিল, কিন্তু উঠতে গিয়ে শেষ পর্যন্ত উঠতে পারে নি।

হাঁটুটায় কোন জোর ছিল না, পায়ে ভর দিয়ে দাঁড়াতে পারল না কিছুতেই।

ছেলেরা প্রায় সবাই চলে গিয়েছিল, –মেজকর্তার একটি আর ছোট কর্তার একটি ছাড়া। আজ বড়দের কারও খাওয়ার প্রশ্নই ওঠে না। এই মানসিক অবস্থায় ভাত গলা দিয়ে নামবে না কারুরই। শুধু ছোট দুটোকে আর বুড়োর বৌকে ধরে জোর ক’রে যা হয় এক- এক গাল খাইয়ে দিল প্রমীলা। ছোট কর্তাকেও বলেছিল–কিন্তু সে কিছু খেতে রাজি হয় নি। তরলা মহাশ্বেতাকে নিয়ে মহার ঘরে–গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে মাথায় বাতাস ক’রে সুস্থ করার চেষ্টা করছে। অনেকটা শান্ত ক’রে এনেছেও কিন্তু এখনই তাকে ফেলে ওঠা উচিত নয়।

অগত্যা মেজকর্তা আর মেজ-বৌকেই রান্নাঘর সারা, বাসনপত্র দালানে এনে রাখা, খিড়কীর দোর সদর দোরে চাবি দেওয়া, গোয়াল দেখা প্রভৃতি করতে হ’ল। ওরা কখন আসবে তার ঠিক নেই কিছু। সম্ভবতঃ রাত ভোর হয়ে যাবে। ওদের ভরসায় জেগে বসে থেকে লাভ নেই। কেউ আগে ফেরে, খেতে চায়–হাঁড়িতে ভাত, ঢাকার নিচে ডাল- তরকারি সবই রইল কিছু কিছু–খেতে পারবে। …

সব কাজ সেরে, তালাগুলো বার বার টেনে দেখে, বেঞ্চির তলা, তক্তপোশের তলা ‘লম্প’র আলো ফেলে ফেলে দেখে অম্বিকাপদ নিজের ঘরে শুতে গেল। ইদানীং এই ‘বাই’টা তার বেড়েছে। সর্বদাই চোরের ভয়। ভেতর থেকে সব দোরে তালা দেওয়া হয়, শুধু খিল-ছিকিনিতে বিশ্বাস নেই তার। দালান আর নিচের ঘরগুলোর জানালাতে শক্ত মজবুত জাল পরানো হয়েছে। প্রতি দরজায় ডবল ছিটকিনি। অর্থাৎ বাড়িটাকে যতটা সম্ভব দুর্গের মতো দুর্ভেদ্য ক’রে তুলতে যত্নের ত্রুটি নেই। কিন্তু তাতেও সে সম্পূর্ণ নিশ্চিন্ত হ’তে পারে না, খাট-চৌকির তলাগুলো না দেখা পর্যন্ত। তার বিশ্বাস, সন্ধ্যার পর থেকে রাত্রে দরজা বন্ধকরা অবধি এই যে তিন-চার ঘণ্টা সময়, এর ভেতর কেউ যদি কোন বদ মতলবে এসে চৌকি কি খাটের তলায় ঘাটি মেরে থাকতে চায় তো তার সুযোগ-সুবিধার অভাব হবে না। বহু অসতর্ক মুহূর্তে দরজা খোলা হা-হা করে–নিচের তলা বা ওপরের দালানে কেউ থাকে না। হয় নিজের নিজের ঘরে কি ছাদে কি বাগানে থাকে নয় তো রান্নাঘরে বসে জটলা করে। এর ভেতর অমন দশ-বিশটা লোক এসে বিভিন্ন ঘরে তক্তপোশ-খাটের নিচে ঢুকে যেতে পারে। তারপর সকলে ঘুমোলে বেরিয়ে আসতে কতক্ষণ? আর সেরকম ক্ষেত্রে ভেতর থেকে তালাই দাও, ছিটকিনিই দাও–যথাসর্বস্ব বার ক’রে নিয়ে যেতে তাদের কোনই অসুবিধা নেই। এমন কি–জান-প্রাণও নিরাপদ নয় তেমন কাণ্ড হ’লে। কথাটায় যুক্তি যতই থাক, ছেলেদের হাসি পায় কথাট শুনলে। কিন্তু কারও ঠাট্টা-তামাশা-পরিহাস গ্রাহ্য করবার মানুষ অম্বিকাপদ নয়, নিজে তো যতটা পারে দেখেই–যেটা পারে না, যেমন ভাদ্র-বৌ কি ভাইপো-বৌয়ের ঘর–বার বার করে বলে দেয় দেখে শুতে।

তবু, এত করেও যেন স্বস্তি পায় না আজকাল। ন্যাড়ার কথা যদি সত্যি বলে ধরতে হয় ইদানীং মেজকর্তা নাকি রাত্রে ঘুমোয় না ভাল করে… প্রায়ই উঠে উঠে নিঃশব্দে বাড়িটা ঘুরে দেখে যায়। ন্যাড়াই ব্যাথা করে কারণটা, নিজের মনের মত করেই করে অবশ্য। বলে–পোস্টাপিসে ব্যাঙ্কে যা টাকা রেখেছে মেজকা, সেটা লোকদেখানি বৈ তো নয়–তার অন্তত দশগুণ টাকা দ্যাখো গে যাও ঘরে রেখে দিয়েছে। ওর ঘরের দ্যালে আর মাটির ইট ক’খানা আছে সবই তো টাকা আর সোনার বাট দিয়ে গাঁথা গো! চুরি- বাটপাড়ির টাকা ব্যাঙ্কে-পোস্টাপিসে মানে সদুরে রাখতে তো সাহস হয় নে কোন্ ভরসায় রাখবে বলো–তাই অমনি করে রাখা। আর সেই জন্যেই অত পাহারা দেওয়ার বাই! বুঝলে না? …..

আজ আবার ছেলেরা কেউ নেই, বাড়িতে লোকজন কম বলে আরও বেশি সময় লাগল অম্বিকাপদর সব দেখে-শুনে শুতে। সে ওপরে উঠে যাবার পর নিচের দালানের ছোট টিনের দেওয়াল-আলোটা যথাসম্ভব কমিয়ে (এ বাজে খরচটাও ইদানীং করা হচ্ছে অম্বিকাপদর নির্দেশে) প্রমীলা এসে মহাশ্বেতার দোরের সামনে দাঁড়াল। মহাশ্বেতা এতক্ষণে একটু শান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে বোধ হয়–কিন্তু তলা এখনও বসে বসে বাতাস করছে। প্রায় নিঃশব্দে এসে দাঁড়ালেও প্রমীলার উপস্থিতি টের পেল তরলা, সে পাখাখানা নামিয়ে রেখে ঘরের বাইরে এসে দাঁড়াল। চুপিচুপি বলল, ‘এই সবে ঘুমিয়েছে। কিন্তু আজ কি আর ওকে এখন একা রেখে যাওয়া ঠিক হবে? …. আমি বরং থাকি, আপনি আপনার দেওরকে একটু বলে দিন, দোর দিয়ে শুয়ে পড়তে!’

প্রমীলা সে কথার কোন উত্তর দিল না, অল্প কয়েক মুহূর্ত ওর মুখের দিকে কেমন একরকম দুর্বোধ্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে বলল, ‘শোন, আমার সঙ্গে একবার ওপরে আয়, একটা মজা দেখবি!’

সামান্য আলো, তবু তার বিচিত্র দৃষ্টিটা তরলার চোখ এড়ায় নি। তার মনে হল প্রমীলার দুই ওষ্ঠের প্রান্তে একটা কৌতুকের হাসি, চাপবার চেষ্টা করছে সে। অকারণেই তার বুকটা কেঁপে উঠল।

কিন্তু প্রমীলা তাকে কিছু ভাবার সময় দিল না। তার একটা বাহুমূল ধরে একরকম টেনেই নিয়ে চলল ওপরে, যতটা সম্ভব নিঃশব্দে।

.

সিঁড়ি দিয়ে উঠেই বাঁ-দিকে তরলাদের ঘর, কিন্তু সে দিকে গেল না প্রমীলা, ডান দিকে মোড় নিয়ে একেবারে দালানের সর্বশেষ প্রান্তে বুড়োর ঘরের সামনে গিয়ে থামল।

আর প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই নজরে পড়ল তরলার–যা কিছু দেখবার। যা দেখাতে চায় প্রমীলা, যা দেখাতে এনেছে।

ঘরের মধ্যে আলো থাকে না সাধারণত, কিন্তু আজ ছিল। বোধ হয় ছেলেমানুষ একা থাকবে বলেই মেজ-বৌ বলে দিয়েছিল হ্যারিকেনটা কমিয়ে রাখতে–কিম্বা তখনও শুয়ে পড়ে নি বলেই জ্বেলে রেখেছিল তড়িৎ।

মশারির বাইরে দাঁড়িয়ে তড়িতের একটা হাত ধরে টানছে দুর্গাপদ, তড়িৎ চেষ্টা করছে হাতটা ছাড়িয়ে নিতে। সম্ভবত মশারির মধ্যেই ছিল সে–দুর্গাপদই তাকে বাইরে টেনে এনেছে, অন্তত অবস্থা দেখে তাই মনে হয়। কারণ তড়িতের গায়ে মাথায় কাপড় ঠিক অসম্বৃত না হ’লেও অবিন্যস্ত, তার কপালের কোলে কোলে-ঘাম জমে উঠেছে, ঘন ঘন নিঃশ্বাস পড়ছে। সে বেঁকে-চুরে হাতটা ছাড়াবার চেষ্টা করছে কিন্তু পারছে না।

ওরা কেউই লক্ষ করে নি এদের। প্রমীলাই জানিয়ে দিল নিজেদের উপস্থিতিটা। নিঃশব্দে চলে যাবে বলে সে আসে নি, এক ঢিলে অনেক পাখি মারবার ব্যবস্থা তার। সে একটা চাপা হাসিতে ফেটে পড়ল যেন, হাসতে হাসতেই তরলার একটা হাত ধরে বলল, ‘হ’ল তো? চ, এবার নিচে যাই।’

হাসি যতই চাপা হোঁক, তার শব্দ মাত্র হাত-তিনেকের ব্যবধানে না পৌঁছবার কথা নয়। দুজনেই শুনতে পেল। দুর্গাপদ হঠাৎ বিছে-কামড়ানোর মতোই তড়িতের হাতটা ছেড়ে দিল, কিন্তু তখনই কোথাও পালাতে কি আত্মগোপন করতে পারল না, যেন পাথর হয়ে গেল সে। শুধু তড়িৎ ছুটে বাইরে এসে প্রমীলাকে জড়িয়ে ধরল, কাঁদো-কাঁদো গলায় বলল, ‘নিত্যি এমনি ফাঁক পেলেই টানাটানি করবে ছোট্‌-কা। আমি লজ্জায় বলতে পারি না কাউকে, কিন্তু আমার আর ভাল লাগে না বাপু–রোজ রোজ এই জ্বালাতন পোড়াতন। ওকে বললেও যা, না বললেও তাই–দাঁত বার ক’রে হাসে শুধু।…. তুমি তো এবার নিজে-চক্ষে দেখে গেলে–যা হোক একটা বিহিত করো মেজকাকি।’

।।8।।

দুর্গাপদর জীবনে এ এক নূতন অভিজ্ঞতা হ’ল। ওর বিশ্বাস ছিল যে, সাধারণ ভাবে সমস্ত স্ত্রী-জাতিকে এবং বিশেষ ক’রে নিজের স্ত্রীকে চেনা ওর শেষ হয়ে গেছে। এখন হঠাৎ আবিষ্কার করল যে, স্ত্রীর সঙ্গে এই গত উনিশকুড়ি বছর ঘর করেছে সে–তাকে চিনতে এখনও অনেক বাকি।

শুধু দুর্গাপদই নয়, অবাক হয়ে গেল অনেকেই। কারণ তরলা তখন যে শুধু কোনরকম কটূক্তি বা মন্তব্য না ক’রে নিঃশব্দে নিচে নেমে এসে আবার পাখাটা হাতে ক’রে মহাশ্বেতার বিছানার পাশে বসেছিল তাই নয়–পরের দিনও তার নিত্যকার কাজে কি কথাবার্তায় আচারে-আচরণে কোন বৈলক্ষণ্য টের পেতে দিল না কাউকে, যেন এ রকম কিছুই ঘটে নি, অথবা ঘটলেও তরলার কিছু আসে-যায় না তাতে। তবু প্রমীলা অপেক্ষা করেছিল দুপুরটার জন্যে। খাওয়ার সময় ভাতে বসে কিনা সেইটেই বড় প্ৰশ্ন, সেটা দেখলেই বোঝা যাবে কত শক্ত মেয়ে সে, কতটা মনের জোর। কিন্তু দুপুরবেলা খেতে ডাকতেই–নিতান্ত স্বাভাবিকভাবেই এসে বসল তরলা; যেমন অন্যদিন এসে বসে। বরং তড়িৎই যেন মুখ তুলে তাকাতে পারছিল না ছোটকাকির দিকে। সত্যিই তার কোন দোষ নেই–এ বাড়িতে তাকে ধরে টানাটানি করাটা বহু কাল থেকে একটা স্বাভাবিক ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে–অন্তত মেজবৌয়ের তাই বিশ্বাস–তবু, তরলার এই নিঃশব্দ ঔদাসীন্যেই সে যেন কেমন অপ্রস্তুত হয়ে পড়েছিল, তরলার কাছে অপরাধী মনে করছিল নিজেকে।

অবশ্য খেতে বসলেও, খেল খুব সামান্যই। কিন্তু এমন কম নয় যে বিশেষ কারও চোখে পড়ে। এক প্রমীলা ছাড়া সেটুকু চোখে পড়লও না কারও। দুপুরে রাত্রে সহজভাবেই এসে খেতে বসতে লাগল সে–শুধু দুবেলা জল-খাবারটাই ছেড়ে দিল। অবশ্য এ বাড়ির গিন্নীরা কেউ বিকেলে কি সন্ধ্যায় ওপাট রাখে না, কারণ দুপুরের খাওয়া চুকতেই বেলা তিনটে বাজে, সন্ধ্যা পর্যন্ত অম্বলেই ছট্‌ফট্ করে বড় আর মেজগিন্নী। কোন সুদূর-সম্ভাবিত অতিথি-অভ্যাগতদের জন্যে দুবেলাই দুটি দুটি চাল বেশি নেওয়ার প্রথা আজও এ বাড়িতে অব্যাহত আছে, বোধহয় ক্ষীরোদার মৃত্যু না হওয়া পর্যন্ত থাকবেও। ফলে সে ভাত প্রায় দুবেলাই পান্তা হয়ে থাকে, আর তা এদেরই খেতে হয়। আর সেই কারণেই এদের এত অম্বল এবং বদহজম। অবশ্য রাত্রে না হ’লেও–সকালে মুড়ি, নারকেল, বাতাসা কি গুড়, দুটো গাছের কলা –এ খাওয়ার রেওয়াজটা আছে এখনও, বস্তুত ছোটবৌয়ের বিয়ের পর থেকেই এটা চালু হয়েছে–কিন্তু সেটা খুব নিয়মমতো কেউই খায় না–হয়ত সময়ই হয়ে ওঠে না এক-এক দিন, তাই সেটা বন্ধ হ’ল কিনা তাও লক্ষ করবার কথা নয় কারও। প্রমীলাই শুধু লক্ষ করল, জলখাবার বাদ দেওয়া এবং দুবেলা আহারের পরিমাণ কমিয়ে দেওয়া–দুটো মিলিয়ে দেখে সে শঙ্কিত হয়ে উঠল একটু।

তরলার তা’হলে মতলবটা কী?

ও কি এমনি ক’রে আস্তে আস্তে নিজেকে ক্ষয় ক’রে আনতে চায় নাকি?

দিনকতক দেখে সে আর স্থির থাকতে পারল না। এতখানি দায়িত্ব নিজের ওপর রাখা উচিত নয়। সে এক ফাঁকে ছোট কর্তাকে নিভৃতে ডেকে বলল, ‘কী করছ কি, যাহয় ক’রে মিটিয়ে নাও। বৌটার দিকে তাকিয়ে দেখেছ–কী হয়ে যাচ্ছে?’

কদিন ধরে দিনরাত একটা অস্বস্তি অনুভব করলেও এ দিকটা জানা ছিল না দুর্গাপদর। বস্তুত স্ত্রীর মুখের দিকে সে তাকাতেই পারে নি, আর পাছে সে না-পারাটা কারও কাছে ধরা পড়ে, তাই চোখাচোখি হওয়ার সম্ভাবনাগুলোও এড়িয়ে গেছে সে প্রাণপণে। কী খাচ্ছে না খাচ্ছে তাও অত লক্ষ করা হয়ে ওঠে নি। সেই জন্যে — দুবেলা খেতে বসছে ঠিক-ঠিক, সেইটে আড়ে তাকিয়ে দেখে নিয়েছে শুধু, আর তাতেই কতকটা নিশ্চিন্ত ছিল। প্রমীলার কথায় সে তাই রীতিমতো চমকেই উঠল। বলল, ‘কেন — খাচ্ছে না?… বসে তো দেখি–

‘হ্যাঁ বসে কিন্তু কী খায় কতটুকু খায় তা দ্যখো কি? নামমাত্তরই বসে। ও খাওয়ায় মানুষ বাঁচে না, বিশেষ অমন সাজোয়ান সাডোল মেয়ে-মানুষটা! জোর করে জীবনটা নিলে পাছে চারদিকে ঢি-ঢি পড়ে যায়, একটা কেলেঙ্কার হয়–তাই আস্তে আস্তে চুপি চুপি পাত করছে নিজেকে। ও কি কম চাপা মেয়ে!’

‘তুমিই তো এই কাণ্ডটা করলে। বিশ বছরের আকোচটা মেটালো!’

‘এ কাণ্ড না করলে কি তুমি শায়েস্তা হ’তে না তোমার আক্কেল হ’ত? সে যে আরও একটা বড় কেলেঙ্কার হয়ে বসে থাকত–তোমাকে যে গলায় দড়ি দিতে হ’ত সে ক্ষেত্তেরে। তোমাকে বাঁচাতেই এটা করেছি মনে রেখো।’

‘হ্যাঁ–তা আর নয়! আমার ওপর কত টান তোমার।… আসলে তোমার রীষ! …..তোমাকে আমি চিনি না–কত বড় হারামজাদা মেয়ে-মানুষ তুমি!’

প্রমীলা কিন্তু এ বিশেষণে রাগ করল না, বরং মুখ টিপে হাসল একটু। বলল, ‘তাই যদি জানো তো বিশ বছর ধরে একটা আকোচ বুকে ক’রে রেখেছি তাই বা ভাবো কেমন করে?… ওগো ঠাকুর, তোমাকে জব্দ করতে–নাকের জলে চোখের জলে করতে আমার একদিনও লাগত না। তুমি আমার হাতের মধ্যেই আছ। তোমার এত দিকে কালি যে– আর ষড় ক’রে কালি ছিটোতে হয় না।… তা নয়, এ-সব আড়ি-আকোচের কথা নয়, যা করতে যাচ্ছিলে তা যে কত গর্হিত কাজ তা তুমি সহজে বুঝতে না–সে চিজই নও তুমি। আজ বলে তো নয়–তোমার ওপর নজর আছে আমার চিরকাল–আমার চোখের আড়ালে যাবার সাধ্যি নেই তোমার। বাড়াবাড়ি করছিলে বলেই একটু জব্দ ক’রে দিলুম। তা সে যাক–এখন যা বলছি তাই শোন, যেমন করে হোক হাতে-পায়ে ধরও অন্তত রাগারাগিটা মিটিয়ে নাও গে।’

অন্যদিকে চেয়ে মুখটা গোঁজ ক’রে বলে দুর্গাপদ, ‘রাগারাগিটা কোথায় তাই যে বুঝতে পারি নি–তা মিটিয়ে নেব কি বলো!… কথাও কয় সবই করে–’

‘কথা কয়? ….সহজভাবে কথা বলে?’ এবার বিস্মিত হবার পালা প্রমীলার। বিশ্বাস হ’তে চায় না তার কথাটা।

‘বলে বৈকি। নিজে থেকে বলে না। তবে আমি যেচে কথা বললে জবাব দেয় তো দেখি–’

‘তাই তো!’ আরও কি বলতে যাচ্ছিল প্রমীলা কিন্তু ছেলেরা দু’-তিনজন এসে পড়ায় আর বলা হ’ল না। শুধু যেতে যেতে বলে গেল, ‘তবু নিজে থেকেই ওপর-পড়া হয়েও কথাটা পাড়ো অন্তত। এ সব্বনাশ ফেলে রেখে দিও না–’

বিস্ময়টা দুর্গাপদরও বড় কম নয়। সে ভেবেছিল আর যাই করুক, বাইরে যত স্বাভাবিক আচরণই বজায় রাখুক, কথা সে কইবে না স্বামীর সঙ্গে কিছুতেই। অন্তত বেশ কয়েকদিন কঠিন হয়ে থাকবে, হয়ত ঘরেই আসবে না, দালানে কি ছাদে গিয়ে শুয়ে থাকবে কোথাও, সাধ্যসাধনা ক’রে কথা বলাতে হবে রাগ ভাঙ্গাতে হবে। কিন্তু সে সব কিছু হ’ল না। যেমন ছোট ছেলেটাকে নিয়ে সে নিচে বিছানা ক’রে শোয় তেমনিই শুল পরের দিন, এমন কি কোথাও কোন অস্বাভাবিক কাঠিন্যও প্রকাশ পেল না তার চলা-ফেরায় কি ব্যবহারে। বরং দু-তিন দিন দুর্গাপদই সঙ্কোচে বা ভয়ে কথা কইতে পারে নি। শেষে একদিন, এ নীরবতা তার নিজের ছেলেমেয়ের কাছেই সন্দেহের ব্যাপার হয়ে উঠছে দেখে–মরিয়া হয়েই কতকটা–কি একটা প্রশ্ন করেছিল সে। প্রশ্ন করার সময় সঙ্গে সঙ্গে জবাব পাবার আশা আদৌ করে নি–কিন্তু খুব সহজ এবং স্বাভাবিকভাবেই উত্তর দিয়েছে তরলা সঙ্গে সঙ্গেই। সংক্ষেপে হয়ত–তবে নিঃসঙ্কোচে। এত-সহজে উত্তর পেয়ে চমকে উঠেছিল দুর্গাপদ–যেমন এই মাত্র সে সংবাদে প্রমীলা চমকাল।

তারপরও দু-একটা কথা কয়েছে দুর্গাপদ–উত্তরও পেয়েছে। এমন কি ছেলেমেয়েদের প্রয়োজনে নিজে থেকেও কথা কয়েছে তরলা। সে সময় তার স্বাভাবিক মৃদু কণ্ঠস্বর আরও মৃদু হয়েছে বা তাতে কোন ক্ষোভ কি উম্মা কিম্বা ধিক্কার প্রকাশ পেয়েছে তাও বলতে পারবে না দুর্গাপদ।

তবে এও ঠিক যে, অস্বস্তিটা তার কাটে নি। কেন কাটে নি তা হয়ত সে বোঝাতে পারবে না। অস্বস্তিটা অকারণ না হলেও আকারহীন–সেইটেই (যুক্তি দিয়ে কাউকে বোঝানো যাবে না সেটা) হয়েছে তার মুশকিল।

ব্যাপারটা যে ঠিক স্বাভাবিক নয়, এটা বোঝবার মতো সাংসারিক জ্ঞান দুর্গাপদর আছে। নিজে থেকে নিষ্প্রয়োজনে কথা কয় নি তরলা একটিও। নিতান্ত খোশগল্পের অবসর অবশ্য কম এ বাড়িতে–তার স্বভাবটাও সে রকম নয়, স্বভাবতই স্বল্পভাষী সে, এমন কি স্বামীর কাছেও–তাই শুধু প্রয়োজনমতো কথা বলাটা আর কারও কাছে তত অস্বাভাবিক ঠেকে নি–কিন্তু দুর্গাপদর কাছে এই সামান্য তফাৎ-টুকুও পীড়াদায়ক হয়ে উঠেছে।

অথচ সে করবেই বা কি–তাও তো ভেবে পায় না।

এর মধ্যে, সাত-আট দিন কেটে যাবার পর, একদিন রাত্রে তাকে শয্যার দিকেও আকর্ষণ করবার চেষ্টা করেছে দুর্গাপদ, তাতেও বাধা দেয় নি তরলা, তবে স্বেচ্ছাতেও আসে নি। আকর্ষণেই এসেছে শুধু, জড় কোন বস্তুর মতো। এসেছে, বসেওছে বিছানায়। বসেও থেকেছে কিছুক্ষণ–কিন্তু সে সময় ওকে, কাঠের পুতুলও নয়–দাঁড়ায় নি। হয়ত শেষ পর্যন্তও কোন বাধা দিত না। কিন্তু সেটা পরখ ক’রে মড়ার মতোই মনে হয়েছে তার। তবে বাধা দেয় নি সে কোনও সময়, শক্ত হয়ে বেঁকেও দেখতে আর ভরসায় কুলোয় নি। নিজের আচরণ নিজের কাছেই লজ্জাজনক বলে মনে হয়েছে। যা-হোক একটা কিছু বোঝাপড়া হেস্তনেস্ত হয়ে জীবনযাত্রাটা স্বচ্ছন্দ ও স্বাভাবিক হয়ে না এলে এদিকে এগোনোও যাবে না বুঝেছে সে … স্ত্রীর গায়ে জড়ানো হাত শিথিল হয়ে এসেছে তার নিজে থেকেই। যেন কিছুটা লজ্জায়, কিছুটা ভয়েই ছেড়ে দিয়েছে সে।

তরলা কিন্তু আরও কিছুক্ষণ বসে ছিল সেখানে, স্বামীর শয্যায়। তারপর আবার সহজভাবেই এসে নিজের বিছানায় শুয়ে পড়েছিল। কিছুই বলে নি, কোন মনোভাবই তার আন্দাজ করা যায় নি।

বুঝতে পারছে না, কিছুই বুঝতে পারছে না দুর্গাপদ। হয়ত সেদিন ছেড়ে দেওয়া উচিত হয় নি, হয়ত তরলাও তা আশা করে নি–কে জানে! হয়ত সাহস ক’রে আর একটু এগোলেই সব ঠিক হয়ে যেত। কিন্তু সাহসে কুলোয় না। সেদিনও কুলোয় নি, তার পরেও না! কী হবে –কী এবং কতটা প্রতিক্রিয়া হওয়া সম্ভব, কোনদিকে যাচ্ছে তরলা–আসলে তার মতলবটা কি, তাই যে বুঝে উঠতে পারছে না!

যে কুরূপা স্ত্রীকে সে দীর্ঘদিন অবহেলা করেছে, আদৌ তাকে কোনদিন জীবন সঙ্গিনী, শয্যাসঙ্গিনী করবে কিনা সে বিষয়েই সন্দেহ ছিল বহুকাল–সেই স্ত্রীর সামান্য একটু মনোযোগ যে ওর কাছে এমন আরাধনার বস্তু হয়ে উঠবে–তার মনোভাব জানবার জন্যে যে ওর দুশ্চিন্তার অবধি থাকবে না–তা কে ভেবেছিল!

অদৃষ্টের পরিহাস–না কী একটা কথা আছে না–নাটকে-টাটকে প্রায়ই ব্যবহার হয়–এও বোধহয় তাই। একেই বোধহয় অদৃষ্টের পরিহাস বলে–মনে মনে ভাবে দুর্গাপদ।

.

এমনিই যথেষ্ট অস্বস্তি ভোগ করছিল, প্রমীলা সচেতন ক’রে দেবার পর থেকে সেটা সত্যিই দুশ্চিন্তায় পরিণত হ’ল। আরও দিন দুই ভেতরে ভেতরে ছটফট করবার পর সে স্থির করল যে, মেজবৌয়ের পরামর্শই সে নেবে, ওপরপড়া হয়েই স্ত্রীর সঙ্গে একটা মিটমাট করবে।

সেই দিনই রাত্রে, বাড়িটা মোটামুটি নিস্তব্ধ হয়ে এলে খাটের বিছানা থেকে নেমে এসে স্ত্রীর বিছানার পাশে, মেঝেয় বসল। তরলা জেগেই ছিল, স্বামীর এ নিঃশব্দ ও গোপন সঞ্চার সবই টের পেল সে। হয়ত সে অন্ধকারে চেয়েই ছিল এদিকে!

সে যে জেগে আছে দুর্গাপদও তা জানত। আজকাল অনেক রাত অবধি যে তরলা জেগে নিঃশব্দে শুয়ে থাকে সেটা অজানা ছিল না ওর কাছে। তবু তখনই সাহস হ’ল না কথা কইতে। অনেকক্ষণ সেইখানেই চুপ ক’রে বস রইল সে! কথাটা অপর পক্ষ থেকে শুরু হ’লে বেঁচে যায়। কিন্তু তা হ’ল না। তখন–বেশ কিছুটা সময় চুপ ক’রে বসে থাকবার পর–অতি সন্তর্পণে তরলার গায়ে একটা হাত রাখল। কোথায় হাত রাখবে– সেও একটা সমস্যা। একেবারে পায়ে হাত দিতে লজ্জা করে, অথচ সে যে ক্ষমাপ্রার্থী– তা ছাড়া দেহের অন্য কোন অংশে হাত দিলে সেটা বোঝবার সম্ভাবনা কম। অনেক ভেবে সে হাঁটুর কাছটাতেই হাত দিল।

‘এই শুনছ, জেগে আছ?’

হাতটা সরিয়ে দিল না তরলা, নিজের পাও সরিয়ে নিল না। খুব আস্তে হলেও–খুব স্পষ্টভাবেই উত্তর দিল, ‘কি?’

ছোট ছেলে আর মেয়েটা ঘুমিয়ে পড়েছে অনেকক্ষণ–তবু তাদের দিকে, অন্ধকারেই যতটা সম্ভব, তাকিয়ে দেখে নিয়ে তেমনি চুপিচুপি বলল, ‘আমাকে–আমাকে এইবারটি মাপ করো, আর কখনও এমন হবে না। এইবারটি শুধু বিশ্বাস করো আমাকে।

প্রায় মিনিটখানেক চুপ ক’রে রইল তরলা। এসব ব্যাপারে অনভ্যস্ত দুর্গাপদর মনে হ’ল এক যুগ। গোটা বাড়িটা তখন নিস্তব্ধ হয়ে গেছে, এত নিস্তব্ধ যে নিচে মহাশ্বেতার সামান্য নাক-ডাকার শব্দও এখান থেকে স্পষ্ট শোনা যাচ্ছে। আরও নানা বিচিত্র শব্দ হচ্ছে চারদিকে–ঝিঁঝিপোকার ডাক, ব্যাঙের ডাক, দূরে একটা মালগাড়ি যাচ্ছে তার একটানা আওয়াজের সঙ্গে ইঞ্জিনের বাঁশির শব্দ–এতকাল পরে এই যেন প্রথম শুনল দুর্গাপদ। গভীর রাত্রেও এত যে কোলাহল হয় চারদিকে–তা তো সে জানত না!

কিন্তু তরলা চুপ ক’রে ছিল এক মিনিটই। তারপর কেমন যেন নির্লিপ্ত কণ্ঠে উত্তর দিল, ‘কেন, তোমার কি কিছু অসুবিধা হচ্ছে?’

এ আবার কি কথা! কী কথার কি জবাব এটা!

রাগ করলে, অভিমান প্রকাশ করলে, তিরস্কার করলে বুঝতে পারত দুর্গাপদ–কিন্তু এ ধরনের কথার সুদূর গূঢ়ার্থ বোঝা তার সাধ্যাতীত। সে যেন ঘেমে উঠল দেখতে দেখতে।

অনেকবার এদিক-ওদিক চেয়ে, বারকতক মাথা চুলকে, খানিকটা আমতা-আমতা ক’রে বলল, ‘না তা নয়–মানে সুবিধে অসুবিধে আর কি–আমরা ধরো অত কিছু অসুবিধে সুবিধের ধারও ধারি না–। তবে, মানে–অত রাখা-ঢাকা ন্যাকামির দরকারই বা কি, সবই তো বুঝতে পারছ, কাজটা খুবই খারাপ হয়ে গেছে, তা আমিও মানছি- অবশ্য করে ফেলেছি একটা ঝোঁকের মাথায়–তবু হাজার হোক আমি তোমার স্বামী তো–এইবারটির মতো আমাকে মাপ করো, এই তোমার পায়ে ধরছি!’

‘ছিঃ!’ এবার দুর্গাপদর হাতটা সরিয়ে দিয়ে উঠে বসে তরলা, ‘পায়ে হাত দিও না, ছেলেমেয়ের অকল্যেণ হবে। আর সত্যি কথা বলতে কি–তোমার খুব দোষও দিই না। দোষ আমার অদৃষ্টের–সেইটেই বড়, মানুষের দোষ ধরতে গেলে আমার বাপ-মায়ের দোষ, তোমার বৌদিদের দোষ। আমার মতো কালো কুচ্ছিতকে এনে তোমার পাশে দাঁড় করানোই উচিত হয় নি তাঁদের। রূপের আশা মেটে নি বলেই ছোঁক ছোঁক ক’রে বেড়াতে হয়–যেখানে সেখানে হ্যাংলাবিত্তি করতে যাও। … আগে থেকেই করছিলে, মেজদি জানতেনও জেনে-শুনে, তাঁর রূপে-গুণে যে মজেছে, তার বৌ ক’রে আমাকে আনা তাঁর উচিত হয় নি। হয়ত ইচ্ছে করেই এনেছেন, তুমি চিরদিন হাতে থাকবে বলেই–কিন্তু আমিও তো মানুষ, আমার কাছে আমার জীবনের, আমার সুখ-দুঃখের দাম আছে। সেটা উনি ভেবে দেখতে পারতেন। কালো কুচ্ছিত বলে স্বামীর ভাগ ছেড়ে দেব–এটা ভাবা ওঁদের উচিত হয় নি।… সব সময় কিছু আয়নাও বাঁধা নেই মুখের সামনে যে নিজের চেহারার কথাটা অষ্টপ্রহর মনে পড়বে!’

বলতে বলতে হঠাৎ থেমে গেল তরলা। বোধ হয় অবাধ্য চোখের জল সামলে নিতেই। এই স্বামীর সামনে কোন প্রকারে দুর্বল হয়ে পড়া, ভেঙ্গে পড়া চলবে না। তার চেয়ে লজ্জার বা ঘেন্নার কথা আর কিছু নেই।…

একটুখানি চুপ ক’রে থেকে কণ্ঠস্বরটা আগের মতোই আবার নির্লিপ্ত ও ভাবলেশহীন করে নিয়ে বলল, ‘যাও, তুমি শুতে যাও। ….ভয় নেই–আমি এখনই মরছি না। প্রাণের মায়া নয়–যাদের এ সংসারে এনেছি তাদের অন্তত একটুখানি বড় ক’রে দিয়ে যাওয়া কর্তব্য বলেই মরব না। বেঁচেও থাকব, তোমার সংসারের কাজকর্মও করে যাব ঠিক ঠিক, কোন হুকুম থাকলে জানিও–তাও তামিল করব, কিন্তু তার বেশি আর কিছু আশা ক’রো না। ভালবাসা–? আমার মনে হয়–স্বামী-স্ত্রীর ভালবাসায় স্ত্রী যদি স্বামীকে ভক্তিশ্রদ্ধা করতে না পারে তো সেখানে ভালবাসা সম্ভব নয়, অন্তত স্ত্রীর দিক থেকে তো নয়ই। আর সবই তোমাকে দিতে পারব–কিন্তু ভক্তি-শ্রদ্ধা আলাদা জিনিস সেটা মন থেকে আসে। সেটা বোধ হয় আর আসবে না। আজ এই কাণ্ডটা ঘটেছে বলে নয়, বহুকালের বহু আচরণে সে ভক্তি নষ্ট ক’রে দিয়েছ তুমি।… তবে তুমি তো কখনও এসব কথা নিয়ে মাথা ঘামাও নি, আজই বা ঘামাতে যাচ্ছ কেন? প্রয়োজনের সময় কাছে টেনেছ, প্রয়োজন হ’লেই আবার টেনো–কিছু অসুবিধে হবে না।… তোমার খাচ্ছি পরছি, তোমার কাজে ত্রুটি হ’লে চলবে কেন?’

কথা শেষ করে সে এবার খুব সহজভাবেই, ছেলের যে হাতটা এদিকে এসে পড়েছিল সেটা সরিয়ে দিয়ে–তার দিক ফিরেই শুয়ে পড়ল। চিরদিনই কাপড়জামা গুছিয়ে জড়িয়ে শোওয়া অভ্যাস তার, আজও তাই শুয়ে ছিল, তবু একবার হাত বাড়িয়ে পায়ের দিকের কাপড়গুলো টেনে নামিয়ে দিল–কিন্তু তারপরই একেবারে নিথর হয়ে গেল। ঘুমিয়েছে কি জেগে আছে, তা বোঝবার কোন উপায় রইল না।

দুর্গাপদ হতভম্বের মতো সেইখানেই বসে রইল অনেকক্ষণ। প্রথমটা সত্যিই কেমন যেন হকচকিয়ে গিয়েছিল। তরলা যে এত কথা বলবে, এত কথা যে বলতে পারে- সেইটেই আশা করে নি সে। এ ধরনের বক্তব্যও তার কাছে একেবারে নতুন, অপ্রত্যাশিত। এর পুরো অর্থটাও তার বোধগম্য হ’ল না হয়ত। কিন্তু বিস্ময়ের প্রথম ঘোরটা কাটতেই সে জায়গায় দেখা দিল অপরিসীম ক্রোধ। মুখের ওপর যেন চাবুক খেয়েছে সে–সত্যি সত্যিই যেন তেমনি জ্বালা করছে মুখটা। স্ত্রীর কাছ থেকে এ রকম ব্যবহারে অভ্যস্ত নয় সে, এরকম কথাতেও না। অপমানের আঘাতে তাই দারুণ রোষই সৃষ্টি হবার কথা। এক এক সময় মনে হ’তে লাগল যে ঐ মুখখানা নোড়া দিয়ে কিম্বা লাথি মেরে ভেঙ্গে দেয় সে–এই তেজের উপযুক্ত জবাব দিয়ে দেয় এখনই।

‘ওঃ–’, মনে মনে বলতে লাগল সে, ‘একটু এদিক-উদিক কি করেছি তো মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে গেছে একেবারে। পুরুষমানুষ অমন কত কী করে। সেকালে যে বামুনের ঘরে পঞ্চাশ-ষাটটা সতীন নিয়ে ঘর করতে হ’ত–তার বেলায়! তেজ, তেজ দেখাতে এসেছেন আমার কাছে,এখনও ইচ্ছে করলে আমি ওর মতো বৌ দুশো পাঁচশটা এনে জড়ো করতে পারি তা জানে না! মেয়েছেলে হ’ল জুতোর জাত, পায়ের নিচে না রাখলে ঢিট থাকে না। হুঁ!’

কিন্তু মনে মনে যতই গজরাক, মুখে একটি কথাও বলতে পারল না সে। মুখ ভেঙ্গে দেওয়া তো দূরের কথা, গায়ে হাতটা পর্যন্ত রাখতে পারল না আর। কেন যে পারল না, কী যে হ’ল তাও বুঝতে পারল না। কোথায় একটা সঙ্কোচ, নাম্-না-জানা একটা সমীহের ভাব তাকে অনড় ক’রে রাখল।

খানিকটা চুপ ক’রে বসে থেকে দুর্গাপদ এক সময় গিয়ে শুয়ে পড়ল নিজের বিছানায়। তখনও তার রাগটা কমে নি, রুদ্ধ আক্রোশে মনে মনে প্রতিজ্ঞা করতে লাগল যে, যার জন্যে এত কাণ্ড, এবার থেকে তাই করে বেড়াবে সে। যা-খুশি করবে, যেখানে খুশি যাবে। রীতিমতো বেলেল্লাগিরিই করবে সে, দরকার হয় তো বেশ্যাবাড়িও যাবে, দেখবে কে ঠেকায়। কী করতে পারে তার ও মাগী, দেখে নেবে সে।….

বহুরাত অবধি তারও ঘুম এল না। শুয়ে শুয়ে তেমনি নিষ্ফল শব্দহীন আস্ফালন ক’রে যেতে রাগল। কিন্তু যতই ভেতরে ভেতরে গজরাক সে, যতই ভয়ঙ্কর ভয়ঙ্কর প্রতিশোধের সঙ্কল্প নিক–মনের মধ্যে যেন কিছুতেই কোন জোর পেল না। বাইরে চলে গেছে, দয়ার পাত্রী কেমন ক’রে দয়াধাত্রীর আসনে উঠে গেছে–কিছুতেই আপাতবাধ্য শান্ত সহিষ্ণু স্ত্রী তার যেন হঠাৎ কেমন ক’রে হাতের বাইরে নাগালের আর যেন তার ধরা-ছোঁওয়া পাওয়া যাচ্ছে না। কে জানে এটা কেমন ক’রে হ’ল।

সেই সমস্যাটাই মস্ত ব্যর্থ আস্ফালনের পিছনে মনের অবচেতনে তাকে পীড়িত করতে লাগল, বহুক্ষণ পর্যন্ত ঘুমোতে পারল না দুর্গাপদ

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *