০৬. প্রথম বিপদের সঙ্কেত

ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ  

প্রথম বিপদের সঙ্কেত পেল কান্তি একদিন মোক্ষদার কাছ থেকেই। সেদিন কী একটা হাফ-হলিডের দিন, শনিবারই বুঝি, দুপুরবেলা ইস্কুল থেকে বাড়ি এসেছে যখন সে– রতনদি তখনও ঘুমোচ্ছেন। একটু ইতস্তত করল, একবার ভাবল ঠেলে ঘুম ভাঙ্গায় রতনদির। আবার কী মনে করে ওপরে উঠে গিয়ে বইখাতা নিয়েই বসল। অনেকদিনের টাস্ক জমে গেছে সব। মাস্টারমশাইদের কাছে কদিন ধরেই বকুনি খাচ্ছে– রতনদি এবার উঠে পড়লে আজও হবে না কিছু। এই বেলা সেরে নেওয়াই ভাল।

সে বিছানাতে বসে অঙ্ক কষছে, মোক্ষদা এল ঘর ঝাঁট দিতে। খানিকটা নীরবেই ঝাঁট দিল সে, তারপর কী মনে করে ঝাঁটাটা ফেলে কান্তির কাছে এসে দাঁড়াল কোমরে হাত দিয়ে।

প্রথমে অতটা বুঝতে পারে নি কান্তি। ঝাঁটার শব্দ থেমে যাওয়াও লক্ষ্য করে নি অত–হঠাৎ এক সময় কাছে একটা মানুষের উপস্থিতি অনুভব করে মুখ তুলে তাকিয়ে অবাক হয়ে গেল। কেমন একটা অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তার দিকে মোক্ষদা। মুখেও তার কেমন একধরনের হাসি। সে কি কৌতুকের না অনুকম্পার– না বিদ্বেষের, তা ঠিক ধরতে পারল না কান্তি। কেমন যেন ভয় ভয় করতে লাগল তার। সে সবিস্ময়ে প্রশ্ন করল, ‘কী গা মোক্ষদাদি, আমায় কিছু বলবে?’

মুচকি হাসল মোক্ষদা। বলল, ‘আর কিছু নয়– বলছিনু কি আর নেকাপড়ার ঠাট কেন ঠাকুর, ঘরের ছেলে ঘরে ফিরে যাও না! আর যে কিছু হবে না এখানে থেকে তা তো নিজেই বুঝতে পারতেছ। এই বেলা পালাও– ভাল চাও তো। তবু এখনও জাত-ধর্মটা আছে– আর কিছু দিন এখানে পড়ে থাকলে সে দুটোও যাবে, ইহকাল পরকাল দুই-ই খুইয়ে বসে থাকতে হবে। লাভ তো হবেই না কিছু উপরন্তু মার খেয়ে বেরোতে হবে এ বাড়ি থেকে, এও বলে রাখছি। মুকী আজকের লোক নয়, দেখল ঢের…ও-মাগীর ছেমো যখন চেপেছে তখন বেশি দিন আর তোমার বাঁচোয়া নেই, তোমার কাঁচা মাথাটি পরিপু করে চিবিয়ে না খেয়ে ছাড়বে না। তবে এখনও সময় আছে, যদি পালিয়ে বাঁচতে পারো তো দ্যাখো। বামুনের ছেলে তায় গরীবের ছেলে– চোখের সামনে নষ্ট হয়ে যাবে সেই জন্যেই বলা।’

সত্যিই সেদিন কিছু বুঝতে পারে নি কান্তি, শুধু একটা অজ্ঞাত ভয়ে বুকের ভেতরটা কেঁপে উঠেছিল তার, অকারণেই কানের কাছটা উঠেছিল লাল হয়ে। অবাক হয়ে বলেছিল, ‘তুমি কি বলছ মোক্ষদাদি, আমি তো– আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না!’

‘বুঝতে যে পারবে না তা আমিও জানি! তাহলে আর তোমাকে সাবধান করতে আসবই বা কেন? এত যদি তোমার বুদ্ধি থাকত তাহলে কি আর এমনি করে নিজের সর্বনাশ নিজে করতে। তাহলে তো দিন গুছিয়ে নিতে। এই যে কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা খরচা করতেছে– এ তোমার কী কাজে আসতেছে বলো? তেমন সেয়না শঠ ছেলে হ’লে বেশ ক’রে দুয়ে বার ক’রে নিত। মাগী যেকালে ফলে হয়েছে সেকালে কি আর কিচ্ছু হিসেব করত– যা চাইতে তাই দিত।… নাও না, তুমিও দিন কিনে গুছিয়ে নাও না– কিছু বলব না। তবু তো বুঝব একটা কাজ হচ্ছে রাখেরের। এ যে ষাঁড়ের নাদ হয়ে থাকছ। জাতও যাবে পেটও ভরবে না!’

আরও বিহ্বল হয়ে পড়ে কান্তি। এ সব ভাষা তার বোধশক্তির বাইরে।’ফলেন্’ হওয়াটা যে কী বস্তু– তা আজও জানে না কান্তি, তবে একটা ঝাপসা ঝাপসা রকমের অর্থ আন্দাজ করতে পারে বটে। কিন্তু সেদিন সবটাই দুর্বোধ্য হেয়ালি বলে বোধ হয়েছিল।

খানিকটা অবাক হয়ে ওর দিকে তাকিয়ে বলেছিল, ‘আমি কিন্তু সত্যিই কিছু বুঝতে পারছি না মোক্ষদাদি, তুমি একটু খুলে বলো। তুমি কি রতনদির কথা বলছ?’

‘না– ওপাড়ার আসু দত্তর কথা বলছি। তুমি বেহেড় বোকা, যাকে রাবর বলে তাই। আমার ঝকমারি হয়েছিল তোমাকে এ সব বলতে আসা! যাবে রধঃপাতে, তুমি যাবে– আমার কি? মাঝখান থেকে লাভের মধ্যে লাভ এই– এখন যদি সাতখানা ক’রে গিয়ে নাগাও আমার চাকরি নিয়ে টানাটানি!’

তারপর ঘুরে গিয়ে ঝাঁটাটা তুলে নিয়ে আবার সামনে এসে বলেছিল, ‘তবে এও বলে রাখছি ঠাকুর, আমার সঙ্গে নাগতে এসো নি। ভাল হবে না তাহ’লে। জলে বাস করে কুমীরের সঙ্গে বাদ করলে ঠকতে হয়; মনে এখো।’

সে অবশিষ্ট ঘরটুকু এক মিনিটের মধ্যে ঝাঁট দেওয়া শেষ করে পাশের ঘরখানাতে ঢুকে গিয়ে দড়াম্ করে দরজাটা বন্ধ করে দিল। ও ঘরটাতে আসলে ঠাকুরের থাকবার কথা– কিন্তু মোক্ষদাদিও গভীর রাত্রে এসে ওঘরে শোয়–এ নিজে চোখে দেখেছে কান্তি। মোক্ষদা ভোরে সকলের আগে ওঠে– কিন্তু কান্তি ওঠে এক একদিন তারও আগে– ভোরবেলা চোখ মুছতে মুছতে ঐ ঘর থেকেই বেরোতে দেখেছে তাকে। তবে তাতে যে কিছু দুষ্য আছে তা ওর মাথাতে অত ঢোকে নি। সেকথা আলোচনাও করে নি সে কারুর সঙ্গে। একদিন শুধু গল্প করতে করতে রতনদির কাছে বলে ফেলেছিল, তাতে রতনদি হেসে ওর গাল টিপে দিয়ে বলেছিল, ‘দূর পাগল! আমার কাছে যা বললে বললে– অপর কারুর কাছে ব’লো না। ঝি-চাকরদের এ সব কথা নিয়ে মনিবদের আলোচনা করতে নেই। ও অমন হয়েই থাকে!’ কী হয়ে থাকে ঠিক তা না বুঝলেও জিনিসটা যে ভাল নয় সেটা বুঝতে পেরেছিল সেদিন।

সেই মোক্ষদাদি আজ ওকে উপদেশ দিতে এসেছে!

চাকরদের কথায় মনিবের থাকতে নেই– চাকররাই বা মনিবের কথায় থাকে কেন?

রতনদিকে খারাপ বলবে কেন? আবার বলছে মাগী! আস্পদ্দা তো কম নয়! কী সাহস ওর!

কথাটা যে রতনকে আর তাকে জড়িয়ে বলা হচ্ছে এটা বুঝতে অবশ্য আরও মিনিট দুই সময় লাগল। কিন্তু তারপরই একটা অসহ্য ক্রোধে কান-মাথা আগুন হয়ে উঠল তার, ইচ্ছে হল ওঘরে গিয়ে খুব দু-কথা শুনিয়ে দিয়ে আসে সে। কিম্বা রতনদিকে ব’লে আজই ওর চাকরিতে ইস্তফা দিইয়ে দেয়। কিন্তু তারপরই মনে পড়ল মোক্ষদা মানুষটি বড় সহজ নয়। যখন কারুর সঙ্গে ঝগড়া করে, তখনকার হিংস্র চেহারাটা ওর দেখেছে কান্তি, তাতে বুকের মধ্যে গুরুগুর্ ক’রে উঠেছে তার।

তাছাড়া– রতনদির বাবা মামাবাবু পর্যন্ত ওকে কতকটা ভয় করে চলেন তা সে দেখেছে। এতদিনের পুরনো ঝি, তার নামে লাগাতে গেলে ওর কথা কি বিশ্বাস করবে কেউ? রতনদিও হয়ত শেষ পর্যন্ত জবাব দিতে পারবেন না–মায়ায় পড়ে। মাঝখানে থেকে প্রবল শত্রু সৃষ্টি হবে শুধু শুধু। ঐ যা বলেছে মোক্ষদাদি, জলে বাস ক’রে কুমীরের সঙ্গে বিবাদ করা ঠিক নয়।

সুতরাং মনের রাগ মনের মধ্যেই পরিপাক করতে হয় কান্তিকে। কোন কালেই কাউকে চড়া কথা বলা অভ্যাস নেই ওর, চিরদিন সকলকে ভয় ক’রেই এসেছে– চেষ্টা করলেও হয়ত ভাল ফল হবে না, উল্টে মোক্ষদার মুখ থেকে আরও কতকগুলো কটু কথা শুনে চলে আসতে হবে মাথা হেঁট ক’রে।

চুপ ক’রে বসেই থাকে তাই কান্তি। বই-খাতা সামনে খোলা থাকে, কলমের কালি নিবের ডগায় শুকিয়ে যায়–বার বার কালিতে ডুবিয়ে কাজ শুরু করতে চেষ্টা ক’রে, বার বারই হাত থেমে যায় কখন।

রাগের প্রথম প্রবলতাটা কেটে যাবার পর আর একটা কথাও ওর মনে হ’ল। আচ্ছা, মোক্ষদাদি যে কথাগুলো বল গেল তার কতকটা কি ঠিকও নয়। অধঃপথে যাওয়ার কথাটাতে ঠিক কতকটা কি বলতে চাইছে তা নয় বুঝলেও–পড়াশুনো যে তার হচ্ছে না কিছুদিন থেকেই, সেটা তো অস্বীকার করার উপায় নেই। এতদিন ইস্কুলের মধ্যে ভাল ছেলে বলেই মান ছিল তার, ইদানীং সে নাম একেবারে ঘুচতে বসেছে। ক্লাসের পড়া পারে না, মাস্টারমশাইদের কথা শুনতে শুনতে অন্যমনস্ক হয়ে যায়–বকুনিও খায় সেজন্যে। পর পর তিন-চার দিন হোমটাস্ক দেখাতে না পারায় অঙ্কের মাস্টার প্রফুল্লবাবু ওকে সেদিন বেঞ্চির ওপর দাঁড় করিয়েও দিয়েছিলেন। অথচ ঐ প্রফুল্লবাবু কী ভালই না বাসতেন ওকে। শুধু দাঁড় করিয়েই দেন নি–খুব বকেও ছিলেন। বলেছিলেন, ‘পিপুল পাকছে বুঝি! হবেই তো, যে পাড়ায় আর যে বাড়িতে থাকো! এতদিন পাকে নি তাই আশ্চর্য। তা আর বেঞ্চিটা জোড়া ক’রে রেখেছ কেন বাবা, যাও না, পান-বিড়ি খেয়ে ইয়ারকি দিয়ে ঘুরে বেড়াও না– তোমারও সুবিধে হবে, আমাদেরও হাড় জুড়োবে।’

সেদিন খুব রাগ হয়েছিল প্রফুল্লবাবুর ওপর। বিশেষত ‘যে বাড়ি’ বলাতে। কথাটা বলার সঙ্গে সঙ্গে ছেলেদের মধ্যে একটা চাপা হাসির ঢেউ বয়ে গিয়েছিল সেটাও চোখ এড়ায় নি ওর। দারুণ অপমান বোধ হয়েছিল। কিন্তু আজ ভেবে দেখল প্রফুল্লবাবু কিছু মিছে বলে নি। দোষ তো তারই। পড়াশুনো করতে এসেছে সে, এমনিই তো অনেক বেশি বয়সে ইস্কুলে পড়ছে–তার ওপর যদি এমনভাবে বকে যায়–। আর বকে যাওয়া না তো কী।

মোক্ষদাদি যা বলেছে ওর হিতাকাঙ্ক্ষীর মতোই বলেছে। রাগ না ক’রে কথাটা ভেবে দেখাই উচিত ওর! সত্যিই তো, গরিবের ছেলে, মানুষ হবে, মানুষ হবে তাঁদের দুঃখ ঘোচাবে এই আশাতেই তো মা-দাদা তাকে এত দূরে ফেলে রেখেছেন। তা যদি না-ই হয় তো এখানে থেকে লাভ কি? বাড়িতে চলে গেলে তবু তাঁদের সংসারের কাজে সাহায্য করতে পারে।

না, মোক্ষদাদি ভালই করেছে ওকে একটু সাবধান ক’রে দিয়ে। এবার থেকে সাবধান হয়ে চলবে। রতনদির আর কি, তাঁর সময় কাটে না–তাই ওর সঙ্গে বসে গল্প করেন কিন্তু তাঁর তো মাথার ওপর এত দায়িত্ব, এত ভাবনা নেই।…

সে আবারও দোয়াতে কলম ডোবায় একবার।

কিন্তু রতনদিকে কেমন যেন দুঃখী দুঃখী মনে হয়। সত্যিই তো, তার কে আছে? বর আসে রাত নটায়, এসেই মদ খেতে শুরু করে। এক একদিন চেঁচামেচি মারধোর কত কী না হয়। তারপর খেয়ে ঘুমোল, ভোর হতে না হ’তে তো চলে গেল। মামা-বাবু নিজের খাওয়া, তামাক খাওয়া আর আরাম এই নিয়েই থাকেন। ঝি-চাকররা বোঝে শুধু পয়সা। রতনদির মুখের দিকে কে চায়! না একটা বন্ধু-বান্ধব না কোন আত্মীয়স্বজন। কথা কইবার পর্যন্ত লোক নেই এ বাড়িতে, সারাদিন মুখ বুজে মানুষ থাকতে পারে! কখনও কখনও দৈবাৎ ওর বরের বন্ধু-বান্ধব দু-চারজন আসে, তবু দুটো বাইরের মানুষের মুখ দেখতে পায়। কিন্তু তারাও সব মাতাল। তারাও এসে মদ খেতে শুরু ক’রে–দু-একজন তো ঘুমিয়েই পড়ে, ধরাধরি ক’রে গাড়িতে তুলে দিতে হয়। এক-একজন বমি ক’রে ভাসায়। সে কী দুর্গন্ধ! সে সব পরিষ্কার করতে হয় তখন মোক্ষদাদিকেই। ঐ জন্যেই ওর আরও জোর। …থিয়েটার-বায়স্কোপ তাই বা কবে যায়। একবার এক সপ্তাহ রতনদির বর কোথায় গিয়েছিল বাইরে, একেবারে তিন-চার দিনের মতো থিয়েটার-বায়স্কোপের টিকিট কিনে দিয়ে গিয়েছিল। হুকুম ছিল মোক্ষদাকে নিয়ে যাবার। সব নাকি ফিমেল সীটের টিকিট। তারই মধ্যে একদিন দারোয়ানকে দিয়ে লুকিয়ে একখানা টিকিট কিনে রতনদি তাকেও নিয়ে গিয়েছিল।’সীতা’ পালা–বড় দুঃখের কিন্তু চমৎকার পালা। দেখে এসে যত কেঁদেছে কান্তি তত উচ্ছ্বাস করেছে।

কিন্তু ঐ পর্যন্ত। রতনদির জীবনটা কি। কী আছে ওঁর সাধ-আহ্লাদ–বলতে গেলে বন্দী হয়ে আছেন। পয়সা আছে ঢের, বর অনেক পয়সা দেয় ঠিকই–কিন্তু পয়সাই কি সব! পয়সা খরচ করার ও তো উপায় নেই নিজের খুশি-মতো। শুধু তার মা’র ভাষায়, ‘ভূত-ভোজন করানো’। সেই জন্যেই তো আরও বিনা দরকারেও কান্তির জামার ওপর জামা করিয়ে দেন, কাপড়ের ওপর কাপড় কেনেন আর একটুখানি গল্প করবার জন্যে ছুটে ছুটে আসেন, হ্যাঁঙ্গালি জ্যাঙ্গালি করেন। …

অর্থাৎ আবারও কখন ডুবে গিয়েছিল ঐ রতনদির চিন্তাতেই। সেটা খেয়াল হ’ল খোদ রতনদির ঘুম ভেঙে ওর খোঁজে ওপরে উঠে আসতে।

‘বা রে ছেলে, কখন ইস্কুল থেকে এসে চুপি চুপি ঘাটি মেরে ওপরে বসে আছ! আমাকে ডাকতে নেই বুঝি! আমি বলে আজ তাড়াতাড়ি খেয়ে শুয়ে পড়েছি যে তুমি সকাল ক’রে এসে ডাকবে, পেট ভরে গল্প করব। আজ তোমার সঙ্গে বসে মুড়ি বেগুনি খাব শখ হয়েছে। তা আমি নিশ্চিন্ত হয়ে ঘুমোচ্ছি–জানি ঠিক এসে ডাকবে।… ডাকো নি কেন? আমি যদি মুকীকে না জিজ্ঞেস করতুম তো টেরই পেতুম না যে চারটে বাজে।’

যে সব ভাল ভাল কথা এতক্ষণ ধরে ভেবে রেখেছিল গম্ভীরভাবে গুছিয়ে বলবে বলে– তা এর পর আর বলতে মন সরে না। যে মানুষটা সকাল থেকে আয়োজন ক’রে রেখেছে তার সঙ্গে গল্প করবে–তাকে কোন্ প্রাণে বলবে যে, ‘আর তোমার সঙ্গে গল্প করব না আমি, গরীবের ছেলে পড়তে এসেছি, লেখাপড়া নিয়েই থাকব। তুমি আর আমার পড়াটা মাটি করতে এসো না।’

কিছুই বলা হয় না তাই। লজ্জায় রাঙা হয়ে ওঠে বরং–যে কথাগুলো বলবে বলে ভেবে রেখেছিল–সেই কথাগুলো মনে ক’রে। তার বদলে কুণ্ঠায় জড়োসড়ো হয়ে বলে, তা নয়। এই টাস্কগুলো–। অনেক দিন হয়ে গেল কিনা, আমারই গাফিলি। আজ বড্ড বকুনি খেয়েছি। তাই ভাবছিলুম–তা যাক, না হয় রাত জেগে সেরে নেবো।’

টাস্ক না দেখাবার জন্যে বকুনি খেয়েছ? তা কৈ বল নি তো। সকালে মাস্টার-মশাই কী করেন? তিনি করিয়ে দেন না কেন?’

‘না, তাঁর অত সময় হয় না। আর এ তো আমারই করবার কথা। তিনি কষে দিয়ে গেলেও আমাকেই তো খাতায় তুলতে হবে।’

‘তাই তো! সত্যি, আমারই অন্যায় হয়ে গেছে– রোজ তোমার সময় নষ্ট করি। ক্লাসের প্রথম ছেলে তুমি –তুমি আঁক কষে না নিয়ে গেলে কী মনে করবেন তাঁরা। যৎপরোনাস্তি ম্লান হয়ে যায় রতনদির মুখ, ‘তা তুমি ভাই অঙ্ক কষো, আমি এখন যাই। তোমার টাস্ক সারা হ’লে বরং নিচে যেও। তখনই বরঞ্চ মুখ-হাত ধুইয়ে জামা-কাপড় ছাড়িয়ে দেবো। আমি তোমার চা-জলখাবার এখানেই দিয়ে যেতে বলছি।’

রতনদি একেবারে উঠে দাঁড়ান। কিন্তু তাঁর সেই ম্লান মুখের দিকে চেয়ে, অপ্রতিভ করুণ কণ্ঠস্বরে কান্তির বুকের মধ্যটা যেন কেমন ক’রে উঠল। সে যা কখনও ক’রে না তাই ক’রে বসল। কিছু না ভেবে-চিন্তেই খপ ক’রে রতনের একটা হাত ধরে ফেলে বলল, ‘না না, রতনদি তুমি যেও না। একটু বসে যাও। টাস্ক আমি রাত্রে ঠিক সেরে ফেলব।’

ঝোঁকের মাথায় ধরে ফেলেই হাতটা ছেড়ে দিয়েছিল অবশ্য কিন্তু সেই সঙ্গেই হঠাৎ মনে পড়ে গেল যে এর আগে কখনও ‘তুমি’ বলে নি রতনদিকে। বলা উচিতও নয়। সে আরও লাল হয়ে মাথা নামাল, দেখতে দেখতে তার কপাল গলা ঘেমে উঠল– ভয়েও বটে, তার এই ধৃষ্টতা কী চোখে দেখবেন রতনদি, যদি রেগে যান এই ভয়ে– আর লজ্জাতেও বটে।

কিন্তু রতনদি রাগ করলেন না, বিরক্তও হলেন না। উল্টে তাঁর চোখ মুখ যেন মনে হ’ল আনন্দে জ্বলে উঠল। যেন কৃতার্থই হয়ে গেলেন তিনি। একটু ইতস্ততও করলেন, একবার বসতেও গেলেন আবার, কিন্তু তারপরই মন শক্ত ক’রে নিলেন যেন। উঠে দাঁড়িয়ে কেমন এক রকমের অদ্ভুত হাসি হেসে বললেন, ‘অমন ক’রে প্রশ্রয় দিও না– কাঙ্গালকে শাকের ক্ষেত দেখাতে নেই। অত নরম হলে দুনিয়ায় টিকতে পারবে না… আমি এখন যাই– সন্ধ্যের সময় আবার আসব বরং। তুমি কাজ সেরে ফেল –‘

চলে গেলেন রতনদি সত্যি-সত্যিই। কিন্তু তিনি যে খুব ব্যথা পেয়েই গেলেন, সেই কথাটা মনে ক’রে কান্তির মন খারাপ হয়ে গেল। এতক্ষণের প্রতিজ্ঞা তো ভেসে গেলই– উপরন্তু যেটুকু লেখাপড়া এতক্ষণ জোর ক’রে হচ্ছিল বার বার চেষ্টার ফলে, সেটুকুও বন্ধ হয়ে গেল। রতনদির ম্লান মুখ, তাঁর করুণ কণ্ঠস্বর আর শেষের এই কথাগুলো– সব জড়িয়ে কেবলই মনে হ’তে লাগল– এত সব থাকতেও রতনদির কিছু নেই, রতনদি বড় দুঃখী। বড় দুঃখেই ছুটে ছুটে আসে তার কাছে। এই একটুখানি যা তার সান্ত্বনা– তা থেকেও বঞ্চিত করল কান্তি। না বললেই হ’ত টাস্কের কথাটা, কেন বলতে গেল! ভারী অনুতাপ হ’তে লাগল।

।।২।।

অতঃপর সোজাসুজি বই-খাতা গুটিয়েই বসে রইল সে। মোক্ষদা এল না– আজ স্বয়ং ঠাকুর এসে ওর চা-জলখাবার দিয়ে গেল। আজ আর বাঁধা-বরাদ্দ ঘরে তৈরি পরোটা নয়– কান্তি যা ভালবাসে বেছে বেছে তা-ই আনিয়েছে রতন। বড় বড় হিংয়ের কচুরি, আলুর দম– তার সঙ্গে খাস্তা গজা। দুঃখই করুক অভিমানই করুক– রতনদির স্নেহ তার প্রতি কিছুমাত্র কমে নি–এই খাবার আনানোতে আর এক দফা তাঁর অপরিসীম স্নেহেরই পরিচয় পেল কান্তি।

এর পর বসে বসে প্রায় ছটফট করতে লাগল সে। রতনদি যে নিজেই উঠে আসবেন একটু পরে কিম্বা ডেকে পাঠাবেন তাতে কোন সন্দেহ নেই। থাকতে পারবেন না কিছুতেই। সেইটেরই অপেক্ষা করছে সে, তার আগে যাওয়াটা ভাল দেখায় না।

কিন্তু অপরাহ্ন ক্রমশ সন্ধ্যার দিকে গড়িয়ে এল, আবছা হয়ে এল বাড়ির ভেতরের দিকটা, তবু রতনদির তরফ থেকে কোন সাড়াশব্দ এল না। এই সময় প্রসাধন শেষ ক’রে চা খেয়ে প্রায় রোজই ওপরে ওঠেন। তবে আজ এমন চুপচাপ কেন? সত্যি বটে একবার বলেছিলেন– ওকেই নিচে গিয়ে মুখ-হাত ধুয়ে জামা-কাপড় বদলাতে, সেইটেই ধরে বসে আছেন নাকি? বেশ মজার লোক তো! আবার যে বলে গেলেন, ‘আমি বরং সন্ধ্যের সময় আসব’– সেটা ভুলে গেলেন! কিন্তু এ ভুল তো স্বাভাবিক নয়। কান্তি বেশ জানে ওদের এই সান্ধ্য আসরে মন পড়ে থাকে তাঁর। তবে কি সত্যি সত্যিই খুব অভিমান হয়েছে? চাপা মেয়ে, অভিমান চেপে অন্য রকম বলে চলে গেলেন?

সে আর থাকতে পারল না। আস্তে আস্তে নিচে নেমে এল। অন্য দিনের চেয়ে একটু সন্তর্পণেই নামল। কেন যে এই সতর্কতা তা সে জানে না। এটা যে সঙ্কোচ এবং এ ধরনের সঙ্কোচের যে কোন কারণ নেই, সে সম্বন্ধেও সে সচেতন নয়, আপনা থেকেই পা টিপে টিপে নামল। রেলিংয়ের ফাঁক দিয়ে–মোক্ষদা নিচে রান্নাঘরের সামনে পা ছড়িয়ে বসে ঠাকুরের সঙ্গে গল্প করতে করতে চা খাচ্ছে দেখে যেন একটু আশ্বস্ত হ’ল। এর পর নিশ্চিন্ত হয়েই ঢুকল রতনদির ঘরে।

কিন্তু ঘরে ঢুকেই চমকে উঠল সে। ঘরে আলো জ্বালা হয় নি, এখনও বেশভূষা সারা হয় নি রতনদির, চুলটা পর্যন্ত বেঁধে দিয়ে যায় নি মোক্ষদা– যেমন সেই বিকেলে ওর কাছে গিয়েছিল তেমনি অবস্থাতেই আছে এখনও। সেই ঘুম-থেকে-ওঠা সাধারণ-কাপড়-পরা আলুথালু অবস্থা। ঝুপসি অন্ধকারে চুপ ক’রে বসে আছেন নিচের ঢালা বিছানাটাতে একটা তাকিয়ায় ঠেস দিয়ে সামনে হাতের কাছে একটা গেলাসে লাল-পানা কী শরবতের মতো।

কী যে সেটা, তা আজ আর বলে দিতে হল না। গন্ধতেই টের পেয়েছে। এতদিনে গন্ধটার সঙ্গে ভাল রকম পরিচয় হয়ে গেছে ওর। সে একটা চাপা আর্তনাদের মতো ‘রতনদি’ বলে ডেকে কাছে গিয়ে বসে বলে উঠল, ‘এ কী করছ রতনদি, এমন ক’রে বসে এখন থেকেই মদ খাচ্ছ!’ তারপর কেমন একটু অসংলগ্নভাবেই বলল, ‘আমার ওপর রাগ করেছ রতনদি? কিন্তু আমার ওপর রাগ ক’রে এ কাণ্ড কেন করতে গেলে। ছি ছি!’

ওর ওপর রাগ করেই এই কাণ্ড করেছেন রতনদি, এটা মনে করবার তার কোন অধিকার নেই– এটাও এক রকমের ধৃষ্টতা, অনধিকারচর্চা তো বটেই –কিন্তু সে সব কথা সে মুহূর্তে মনে এল না ওর। আবারও যে সে তুমি’ বলছে তাও লক্ষ্য করল না।

বরং আরও আবেগের সঙ্গে, ঈষৎ অসহিষ্ণুভাবেই রতনের একটা হাত ধরে নাড়া দিয়ে বলল, ‘ওঠো– উঠে বসো রতনদি লক্ষ্মীটি, তোমার পায়ে পড়ি। তুমি গা-হাত ধুয়ে নাও। এ সব ছাইভস্ম আর এখন থেকে শুরু করো না। মাথায় বরং জল দাও একটু–নইলে সন্ধ্যে থেকেই মাথা ধরবে হয়ত।’

এতক্ষণ পাথরের মতোই বসে ছিল রতন, কিন্তু ওর এই স্পর্শে যেন পাষাণী প্ৰাণ পেল। হাতটা কান্তির হাতের মধ্যে থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে সে-ই দুহাতে চেপে ধরল কান্তির দুটো হাত। তারপর প্রবল আকর্ষণে ওকে আরও খানিকটা কাছে টেনে এনে বলল, ‘সাধ ক’রে কি খাই। না খেয়ে উপায় কি বল্‌? দুঃখ ভুলতে পারি আর যে আমার কিছু নেই, কেউ নেই। ওরে আমি যে বড় দুঃখী, কত যে দুঃখী তা তুই বুঝবি না।’

‘কে বললে বুঝব না রতনদি। আমি বুঝেছি তোমার দুঃখ। বুঝেছি বলেই তো ছুটে এসেছি। কেউ নেই তোমার কেন এ কথা বলছ– আমি তো আছি। আমি তো তোমাকে কখনও ছাড়ব না রতনদি।… তুমি এখানে এমনি ক’রে বসে না থেকে আমার কাছে গেলে না কেন, অন্যদিনের মতো জোর ক’রে ডেকে নিলে না কেন? কেন এমন অন্ধকারে একা বসে ঐ সব বিষ খাচ্ছ?’

‘একটা বিষ নামাতে এই বিষ খাচ্ছি– বুঝলি? নইলে সে বিষে সব ছারখার হয়ে যাবে। তুই যা ভাই আমার কাছে আর থাকিস নি। নয়ত এ বিষে তুইও জ্বলে পুড়ে মরবি। তুই কালই বাড়ি চলে যা!’

আর যা ই হোক ঠিক এ কথাটা আশা ক’রে নি কান্তি। সে একেবারে আড়ষ্ট স্তম্ভিত হয়ে গেল। রতনদির রাগ হয়েছে, অভিমান হয়েছে– এটা সে আগেই আশঙ্কা করেছিল কিন্তু ঠিক এতটা যে হয়েছে, তা বুঝতে পারে নি। সে কিছুক্ষণ চুপ ক’রে থেকে প্রায় ভেঙে-আসা কাঁদো কাঁদো গলায় বলল, ‘তুমি আমার ওপর মিছিমিছি রাগ করছ রতনদি, আমি– আমি তো বলি নি কিছু। আমি তো বললুম রাত জেগে সেরে নেব পড়া– তুমিই তো চলে এলে। আমার ঘাট হয়েছিল টাস্কের কথা তোলা। সত্যি বলছি, আর কখনও বলব না। এই বারটি মাপ করো আমাকে!’

সে হাত দুটো রতনের মুঠো থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে সত্যিই দু হাত জোড় করল।

অকস্মাৎ যেন পাগল হয়ে গেল রতন। একটা প্রবল ধাক্কায় ওকে দূরে ঠেলে ফেলে দিয়ে বলল, ‘যা বলছি আমার সামনে থেকে, দূর হয়ে যা! নাকী কান্না কেঁদে আমার মন ভোলাতে এসেছ! যত সব মায়াকান্না! ওসব আমি ঢের দেখেছি। দূর হ হতভাগা। কাল সকালে উঠে যেন তোর মুখ আর আমাকে না দেখতে হয়। আমি ওঠবার আগে বই-খাতা জামা-কাপড় সব নিয়ে চলে যাবি– কোন চিহ্ন না থাকে তোর!

চাপা হিংস্র গলায় কথাগুলো বলে যেন হাঁপাতে থাকে রতন।

ওর এ চেহারা বহুকাল দেখেনি কান্তি। অনেক দিন আগে একেবারে গোড়ার দিকে একদিন সকাল বেলা স্নান করার আগে মদের খোঁয়াড়ি না ভাঙা অবস্থায় দেখে বকুনি খেয়েছিল–সেই সময় কতকটা এইরকম চেহারা দেখেছিল ওর। কিন্তু তাও এতটা নয়। বাঘিনী কেমন তা জানে না সে, কখনও দেখে নি– কিন্তু বই পড়ে যা ধারণা হয়েছে তার– হঠাৎ মনে হল রতনদি আর মানুষ নেই, সেই বাঘিনী হয়ে উঠেছে।

ভয়ে ভয়ে বিবর্ণ মুখে বেরিয়ে এল সে সেখান থেকে। অপমানে দুঃখে দুই চোখ জ্বালা ক’রে জল আসছিল ভরে, গলা অবধি ঠেলে উঠছিল কান্না– কিন্তু এখানে এর পর চোখের জল ফেলতেও সাহস হল না ওর। প্রাণপণে উদ্গত অশ্ৰু চেপে পা পা ক’রে সে ঘর থেকে বেরিয়ে এসে ছুটে ওপরে চলে এল।

নিজের ঘরে এসে কান্না আর কোন শাসন মানল না। বিছানার ওপর আছড়ে পড়ে রীতিমতো শব্দ করেই কাঁদতে লাগল সে– ছেলেমানুষের মতো। অনেকক্ষণ ধরে কাঁদল। অপমান তো বটেই, দুঃখও তার কম হচ্ছিল না। বিনা দোষে সে এমনি লাঞ্ছিত হল, সেইটেই আরও দুঃখ। কেন এমন হয়ে গেল রতনদি, এতদিনের স্নেহ ভালবাসা একদিনে ভুলে গেল! নাকি বড়লোকের ধরনই এই? এতদিনের এত ঘনিষ্ঠ সাহচর্য–এত হাসি তামাশা গল্প-গুজব একসঙ্গে খাওয়া বসাতেও কান্তি কিছুমাত্র আপন হতে পারে নি রতনদির, কিছুমাত্র কাছে পৌঁছাতে পরে নি। দুজনের অবস্থার মধ্যে– ভিক্ষাদাতা ও গ্রহীতার যে দুস্তর ব্যবধান তা ঠিক রয়ে গেছে। তাই না আজ রতনদি এমন ক’রে অনায়াসে ছেঁড়া জুতোর মতো ছুঁড়ে ফেলে দিতে পারল তাকে!…. ওদের গরীবের ঘরে ছেঁড়া জুতোও বুঝি এমন ক’রে ফেলে না।…. এখন ও বাড়িতে গিয়েই বা কি বলবে, কি কৈফিয়ৎ দেবে? তাঁরা কি বিশ্বাস করবেন যে কান্তির সত্যিই কোন দোষ ছিল না? তাই কি কেউ বিশ্বাস ক’রে? যেখানে এত আদর-যত্ন সেখান থেকে বিনা দোষে বিতাড়িত হয়েছে– এ তো বিশ্বাস করার কথাও নয়।

ছি ছি, এর চেয়ে মরে যাওয়াও ঢের ভাল ছিল। আজকের রাতটা শেষ হবার আগে কোন রকমে তার মৃত্যু হয় না?

কান্নার ফাঁকে ফাঁকে এমনি এলোমেলো আবোল-তাবোল কত কী কথা ভাবতে লাগল সে। মুখেও দু’একটা কথা বেরিয়ে এল। ভাগ্যে এ সময়টা ওপরে কেউ থাকে না। নইলে পাগল ভাবত তাকে! সে চেষ্টা ক’রেও যে সামলাতে পারছে না নিজেকে।

অনেকক্ষণ ধরে কাঁদবার পর অনেকটা শান্ত হয়ে উঠে বসল। বিছানাটা ভিজে গেছে ওর চোখের জলে, মোক্ষদাদি এসে দেখলে কী মনে করবে! যদি প্রশ্নই ক’রে– কিসে ভিজল? অবশ্য রাত্রে বড় একটা ওপরে ওঠবার সময় পায় না। তবু― আসতেও তো পারে। ছিঃ– যদি জানতে পারে, সে বড় লজ্জার কথা হবে।

দুঃখের প্রথম আবেগটা কেটে গিয়ে এইবার মনে হল– তাহলে কী সত্যিই বই-খাতা গুছিয়ে নিতে হবে তাকে? জামা-কাপড় সে নেবে না, যেমন একবস্ত্রে এসেছিল তেমনি একবস্ত্রে চলে যাবে। ওসব ভাল জামা-কাপড় যাকে খুশি দিন রতনদি, নয়ত জ্বালিয়ে দিন–ওতে কান্তির কোন দরকার নেই। আবার মনে হ’ল সত্যিই কি রতনদির ওটা মনের কথা? নেশা কেটে গেলে আবার ওকে খুঁজবে –আনতে লোক পাঠাবে? নিশ্চয়ই তাই। কী একটা ভেবে দুঃখ হয়েছিল, তাই মদ খেতে শুরু করেছে আর মদ খেলেই তো রতনদির অমনি মেজাজ হয়। মাতালের কথা কি ধরা উচিত?

ভাবতে ভাবতে বেশ একটু জোর পেল মনে। সোজা হয়ে উঠে বসল। হাসি পেতে লাগল নিজের ছেলেমানুষিতে। মিছিমিছি এই তুচ্ছ ব্যাপারটা নিয়ে তিলকে তাল ক’রে তুলে নিজেই কষ্ট পেল সে। রতনদির এত স্নেহ– এমন একদিনে মুছে যেতে পারে না। এই তো ক’বছরই দেখছে তাঁকে, এক-আধদিন তো নয়, তা সত্ত্বেও এমন ভুল বুঝতে পারলে কী ক’রে আশ্চর্য!

আবার এক সময়ে মনে হল– কিন্তু যদি সত্যিই বলে থাকেন। ওটা যদি তাঁর অন্তরের কথাই হয়? হয়ত কী শুনেছেন কার কাছে, হয়ত মোক্ষদাদিই মিছে ক’রে কী লাগিয়েছে ওর নামে– সত্যিসত্যিই রেগে গেছেন। যদি তাই হয়, কাল সকালে ওকে দেখে যদি এমনি রেগে ওঠেন, সকলকার সামনে যাচ্ছেতাই করেন? সে যে আরও অপমান!….

অনেকক্ষণ বসে ভাবল কান্তি। অনেক ভেবেও কোন কূল-কিনারা পেল না। কী করবে, কী করা উচিত কিছুই বুঝতে পালল না। খাবার সময় হতে ঠাকুর যখন ডাকতে এল, একবার ভাবল সহজভাবেই গিয়ে খেয়ে আসবে– কেউ না কিছু সন্দেহ ক’রে, লোক- জানাজানি না হয়! আবার ভাবল, খেতে গেলেই সে সম্ভাবনাটা বেশি থাকবে, কারণ এখন তার যা অবস্থা, একগালও বোধ হয় খেতে পারবে না। সমস্ত দেহটা ভেতরে ভেতরে থরথর ক’রে কাঁপছে– গা বমি-বমি করছে সর্বক্ষণ। সে আস্তে আস্তে বলল, ‘আমার শরীরটা ভাল নেই ঠাকুরমাশাই, আজ আর কিছু খাব না। তখন ঐ সব খেয়ে বোধ হয় অম্বলমতো হয়েছে– গা গুলোচ্ছে বড্ড!’

ঠাকুর অবশ্য তাই বুঝেই নেমে চলে গেল। কিন্তু একটু পরেই দেখা দিল মোক্ষদা-ঝি।

‘বলি ব্যাপারটা কি বল তো ঠাকুর– খোলসা ক’রে বল দিকি আমায়? আমার সেই দোপর বেলাকার কথাতেই মন ভারী হল নাকি? নাকি দুজনে সোহাগের আগাআগি হয়েছে? আমার কথাগুলো নাগানো হয়েছে বুঝি?’

‘না–মাইরি বলছি মোক্ষদাদি, এই বিদ্যে ছুঁয়ে বলছি, তোমার কথা কাউকে একটাও বলি নি! বিশ্বাস করো!’

‘তা যদি বল নি বাপু তা হ’লে দুজনেরই মেজাজ গরম কেন? আগাআগিটা হল কী নিয়ে? উনি তো মান ক’রে পড়ে ছিলেন এতক্ষণ– নিহাৎ নটা বাজে দেখে ত্যাখন উঠে যেমন তেমন ক’রে কাপড় বদলে চুল বেঁধে নিলেন, তুমি তো রাহারনিদ্রাই ছেড়ে দিলে! আবার দিদিবাবুর হুকুম হয়েছে, দাদাবাবুর সরকারমশাইকে জোর তলব দিয়ে ডেকে পাঠিয়ে হুকুম দিয়েছেন, কালকের মধ্যেই কোথায় বোটিংওলা রিস্কুল আছে খোঁজ ক’রে দেখে তোমাকে ভত্তি করে দিয়ে আসতে হবে। তোমাকে উনি এ বাড়িতে আর আখবেন না!…. এসব তো অমনি অমনি হয় না বাপু– কারণ একটা আছে। এ সমিস্যেটা কী হল আমাকে একটু বুঝিয়ে দাও দিকি!

এ আবার এক নতুন খবর। মন্দের ভাল অবশ্য। তাড়িয়ে দেবেন না বাড়িতেও যেতে হবে না– বোর্ডিং ইস্কুলে ভর্তি ক’রে দেবেন। একদিক দিয়ে হয়ত খুবই ভাল হল। পড়াশুনোটা হবে। তবে বাড়িতে কী বলবে, সে কথাটা থেকেই যাচ্ছে যে!

আর, আর যেটা–সেটা হ’ল রতনদি আর তাকে এ বাড়িতে রাখতে চান না। তাকে দেখতে চান না তাঁর সামনে। সে কি তারই মঙ্গলের জন্যে– না সত্যিসত্যি তার ওপর রেগে গেছেন?

‘কী গো, মুখে আ নি কেন? শরীর সত্যি খারাপ, না আগ হয়েছে? বল তো খাবার রোপরে পৌঁছে দিয়ে যাই। খাও নি শুনলে কাল সকালে আমাদের কারুর ধড়ে মাথা থাকবে না!’

‘না মোক্ষদাদি, রতনদি আমার ওপর বিরক্ত হয়েছেন, আমার আর মুখ দেখতে চান না। আমি খাই নি শুনলে কিছুই বলবেন না আর, খোঁজও করবেন না!

‘হুঃ!’ অদ্ভুত একটা শব্দ ক’রে ওঠে মোক্ষদা, টক্ ক’রে জিভেরও একটা আওয়াজ ক’রে, তারপর যেন একপাক নেচে নিয়ে বলে, ‘ইলো! মরে যাই লো!…. তা আর না। বেরক্ত হয়েছে! বেরক্ত হওয়া কাকে বলে তা আর কি আমি জানি না! ওসব সোয়াগের কোঁদল– আত পোয়াতে যা দেরি, আত পোয়ালেই সব ঠিক হয়ে যাবে। তোমাকে ঐ বোটিং মোটিং-এ যেতে দেবে ভাবছ? তবেই হয়েছে। তবেই চিনেছ মেয়েজাতকে। মিছিমিছি সরকারমশায়ের অদেষ্টে হয়রানি আছে, ঘুরে মরবে। ওগো ঠাকুর, এই মুকী ঝির রনেক বয়স হয়েছে– অনেক দেখেছে এ।…. নাও, নাও, সোজা হয়ে বসো দিকি। চোখে জল দাও। কেঁদে কেঁদে তো চোখ ফুলিয়েছ দেখছি। একেই বলে ছেলে-মানুষ। খাওয়া- দাওয়া বন্ধ করা ঠিক নয়, কাঁচা বয়স এখন তোমাদের– বলে, আত-উপোসী হাতি পড়ে। খাবার আমি রোপরে দিয়ে যাচ্ছি, লক্ষ্মী ছেলের মতো খেয়ে শুয়ে পড়ো সকাল সকাল। ওসব আগআগি নিয়ে আর মাথা ঘামাতে হবে না তোমাকে।

তারপর যেতে গিয়েও ফিরে এসে– গলাটা আরও নামিয়ে ফিসফিস ক’রে বলে, ‘বরং যদি সেয়ানা হও তো এই তালে কিছু রাদায় ক’রে নাও মোটামুটি। দু’ দণ্ড মান ক’রে বসে থাকলেই যথাসব্বস্ব দিয়ে মেটাবে। নতুন নেশা তো– তার জন্যে সব করতে পারে। হি-হি!’

চাপা হাসিতে যেন ফেটে পড়তে পড়তে চলে গেল মোক্ষদা।

।।৩।।

রাত্রে ঘরের দোর দিয়ে শোওয়ার অভ্যাস ছিল না কান্তির। কৌটোর মতো চারিদিক আঁটা বাড়ি, সদর দরজা বন্ধ হলে আর একটা মাছিরও ঢোকবার উপায় নেই কোনদিক দিয়ে– এমন সব বন্দোবস্ত করা। তাছাড়া কীই বা আছে তার ঘরে যে চোর ঢুকবে? বইখাতা কতকগুলো–দু’-একটা জামা কাপড়, এই তো। বেশি জামাকাপড় নিচেই থাকে আজকাল রতনদির দেরাজে। যেদিন মনে পড়ত সেদিন দরজাটা ভেজিয়ে দিত শুধু, আর যেদিন পড়তে পড়তে খুব ঘুম পেয়ে যেত, সেদিন কোনমতে আলো নিভিয়ে শুয়ে পড়ত, দরজার কথা মনে থাকত না। রাত্রে মোক্ষদা বা ঠাকুর শুতে আসবার সময় কপাটটা হয়ত টেনে দিয়ে যেত।

সেদিনও খোলাই ছিল দরজা। ভেজানো কপাট প্রায় নিঃশব্দেই খুলেছে– তবু খোলবার সঙ্গে সঙ্গেই ঘুম ভেঙ্গে গেছে কান্তির। কারণ বহু রাত অবধি ঘুমোতে পারে নি সে– এলোমেলো চিন্তায় আর পরস্পর-বিরোধী ভাব-সংঘাতে মাথা গরম হয়ে গিয়েছিল ঘুম আসে নি তাই। একেবারে শেষের দিকে, হয়ত এই ঘণ্টাখানেক আগে একটু তন্দ্ৰা এসেছে। তাও খুব পাতলা ঘুম– সামান্য শব্দে জেগে উঠেছে আবার।

কে একজন তার ঘরে ঢুকছে!

তখনও ঘুমের ঘোর রয়েছে চোখে– এবং মনেও। অনিদ্রার গ্লানি আর অতৃপ্ত নিদ্রার জড়তা তখনও জড়িয়ে আছে তাকে।’কে’ বলে ধড়মড়িয়ে উঠে বসল সে, কিন্তু আওয়াজটা ভাল ক’রে বেরোল না গলা দিয়ে। আরও যে চেঁচিয়ে উঠতে পারল না, তার কারণ উঠে বসবার সঙ্গে সঙ্গেই, ‘কে’ বলে প্রশ্ন করার সময়েই, তার মনে হল রতনদি রতনদি ছাড়া আর কেউ নয়।

কিন্তু এ সময় এমনভাবে রতনদির আসাটা এতই বিস্ময়কর, এতই অবিশ্বাস্য যে চোখে দেখেও বিশ্বাস হতে চাইল না।

‘রতনদি?’ বলে প্রশ্ন করতে গেল সে, কিন্তু ভয়ে আর বিস্ময়ে যেন কণ্ঠরোধ হয়ে এল তার– ভাল ক’রে স্পষ্ট উচ্চারণও করতে পারল না। অস্ফুট একটা স্বরই বেরোল শুধু কোন রকমে।

মূর্তিটা আরও কাছে এল। আর সন্দেহের অবকাশ নেই। কৃষ্ণা দ্বাদশীর চাঁদ সবে উঠেছে– পূর্বমুখী দরজা দিয়ে ভেতরে এসেও পড়েছে তার এক ফালি আলো। তাতেই দেখা যাচ্ছে পরিষ্কার। মুখচোখ খুঁটিয়ে দেখা যাচ্ছে না ঠিকই– তার অত দরকারও নেই। এ সবই পরিচিত ওর। ঐ বেশভূষা, ঐ চলবার ভঙ্গি, দেহের গঠন! সেই চওড়া কালাপাড় দেশী শাড়িটা–হাতে সেই ফারফোরের বালা ঝিকঝিক করছে। কানে হীরের টব দুটো এই সামান্য আলোর আভাসেই ঝিলিক দিয়ে উঠল

‘রতনদি!’ এবারে অস্ফুট কণ্ঠে হলেও স্পষ্ট উচ্চারণ করতে পারল। এতক্ষণে উদ্বিগ্ন হয়ে উঠেছে কান্তি। জামাইবাবুর কোন অসুখ-বিসুখ করল না তো– কিম্বা ওঁরই?

রতন ঘরে ঢুকেছিল আস্তে আস্তে– বোধ হয় অন্ধকারে আগে কিছু ঠাওর পাচ্ছিল না– তাই। এখন চোখটা সয়ে আসতে একরকম ছুটে এসেই বিছানায় বসে কান্তিকে জড়িয়ে ধরল একেবারে। যা কখনও ক’রে নি আজ পর্যন্ত–পাগলের মতো একেবারে ওর গালে নিজের গালটা চেপে ধরে চুপিচুপি বলল, ‘তুমি, তুমি আমাকে ছেড়ে চলে যাবে কান্তি? চলে যেতে পারবে? একটু মায়া হবে না তোমার? মন কেমন করবে না? তবে যে তুমি বললে তোমাকে কখনও ছাড়ব না রতনদি! কেন বললে তাহলে?’

কান্তির প্রথমে মনে হল মাথাটা খারাপ হয়ে গেছে একেবারে রতনদির। কিম্বা মদের ঝোঁকেই উঠে এসেছেন।

কিন্তু কৈ না, তেমন উগ্র গন্ধ তো ছাড়ছে না রতনদির নিঃশ্বাসে। খুবই কম– একটু আভাস মাত্র পাওয়া যাচ্ছে! সম্ভবত সেই সন্ধ্যায় যেটুকু খেয়েছিল– তারপর রাত্রে আর খায় নি। কোনমতে এড়িয়ে গেছে ওর বরের জবরদস্তি। কিন্তু তবে? তবে এসব কী বলছে?

সেও তেমনি চুপিচুপিই উত্তর দিল– পাশেই মোক্ষদারা আছে হয়ত, ভয়ে ওর বুক কাঁপছে ঢিপঢিপ ক’রে, যা মুখ, কী সব যাচ্ছেতাই ঠাট্টা করবে হয়ত এই নিয়ে যদি টের পায়– ‘কিন্তু আমি তো– মানে তুমিই বললে আর মুখ দেখবে না। তুমিই তো শুনছি বোর্ডিং-এ পাঠাবার ব্যবস্থা করছ! আমার কী দোষ, বা রে! আমি তো কিছু বলি নি। আমি– আমি তোমাকে ছেড়ে যেতে তো চাই নি।’

‘ছাড়বে না? আমাকে ছাড়বে না তো? যাই কেন হোক না, কোন দিন কিছুতে ছেড়ে যাবে না? বলো বলো– উত্তর দাও। এই আমাকে ছুঁয়ে বলো।’

‘না না– রতনদি, তুমি ‘যাও’ না বললে যাব না।’

‘না, সে আমি বলতে পারব না প্রাণে ধরে। বলাই উচিত, তবু পারব না। অনেক ভেবে দেখলুম। তোমাকে কোথাও পাঠাতে পারব না।… আমার কথা যখন কেউ ভাবে না—আমিই বা অপরের কথা ভাবব কেন? আমি বড় দুঃখী কান্তি, আমাকে তুমি দয়া করো। আমি বড় দুর্বল আর লোভী। যদি অন্যায় ক’রে ফেলে –তবু আমাকে তুমি ছেড়ে যেও না।’

‘ছি ছি। ওসব কথা কেন বলছ রতনদি। তুমি আমার কাছে এমন কোন অন্যায় করতেই পারো না। তোমার কাছে যা পেয়েছি তা কি আমি জীবনে ভুলব? জীবন দিয়েও তোমার ঋণ শোধ হয় না?’

‘ঠিক বলছ? অন্তরের কথা তোমার? জীবন দিতে পারবে আমার জন্যে? আমি যে তাই চাইতেই এসেছি। পালিয়ে চলে এসেছি তোমার কাছে। ওরা ঘুমোচ্ছে, সবাই ঘুমোচ্ছে, কিন্তু আমি ঘুমোতে পারি নি। সারারাত ভেবেছি। ভেবে দেখেছি ভাল ক’রে তোমাকে ছেড়ে আমি থাকতে পারব না। তাতে যা হয় হবে। জীবনে কিছুই পাই নি– এটুকু আমি আদায় করব। কিন্তু জীবন দেবে তো আমার জন্যে? দিতে পারবে? কথার কথা নয় তো মন বুঝে বলছ তো?’

‘ঠিকই বলেছি রতনদি। তুমি যা করতে বলবে আমি তাই করব।’

‘আঃ, বাঁচলুম, বাঁচলুম। তুমি আমাকে বাঁচালে।’

এই বলে অকস্মাৎ আরও জোরে আরও নিবিড় ভাবে ওকে জড়িয়ে ধরল রতন — তারপর পাগলের মতো চুমো খেতে লাগল ওকে বার বার। এত জোরে জড়িয়ে চেপে ধরেছিল যে কান্তির মনে হল পিষে গুঁড়িয়ে যাচ্ছে সে। দম বন্ধ হয়ে আসছে তার। চোখেও কিছু দেখতে পাচ্ছে না। অনুভব করছে শুধু আগুনের মতো ঐ চুম্বনগুলো।

কী যেন ভয়ঙ্কর মোহ গ্রাস করছে ওকে। যেন কোন্ মায়াবিনীর মায়া তার সব শক্তি হরণ করেছে।

ভাববারও অবসর ছিল না কিছু। কারণ একটু একটু ক’রে ওর সমস্ত চৈতন্য আচ্ছন্ন হয়ে এল সেই মায়ায়। তারপর আর কিছু মনে নেই ওর। আর কিছু মনে পড়ে না।

তারপর আর কিছু মনে পড়েও নি। সেই দিনগুলোয় আর কিছু মনে ছিল না। সব একাকার অস্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল মাথার মধ্যে। তার লেখাপড়া বর্তমান-ভবিষ্যৎ– তার মা দাদা বৌদি, যারা তার মুখ চেয়ে আছে অনেকখানি আশা নিয়ে– কিছু না। একটা সীমাহীন নির্লজ্জতায়, এক সর্বনাশা উন্মত্ততায় সব কিছু ঘুলিয়ে তলিয়ে গিয়েছিল। যেন একটা প্রচণ্ড ঘূর্ণিতে আত্মসমর্পণ করেছিল; সেটা যে ঘূর্ণি– ও যে শূন্যেই ঘুরছে ওর জগৎ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে, চারিদিকে ধূলির আবরণ সৃষ্টি করে, এ ঘূর্ণি যেমন অকস্মাৎই একদিন শুন্যে তুলেছে তেমনি অকস্মাৎই একদিন কোথাও আছাড় মেরে ফেলবে– তাও বুঝতে পারে নি। এক আধ দিন নয়, অনেক দিনই– কোথা দিয়ে কেটে গেল তাও টের পায় নি। দিগ্বিদিক জ্ঞান ছিল না, কোন লজ্জার আবরণ ছিল না। সাংঘাতিক এক নেশায় লজ্জা ঘেন্না ইহকাল পরকাল সব কিছু উড়িয়ে দিয়ে বুঁদ হয়ে বসেছিল।

ইস্কুলে যাওয়া ছেড়েই দিয়েছিল বলতে গেলে– কারণ ইস্কুলে গেলে পড়তে হয়, পড়া দিতে হয়– টাস্ক ক’রে নিয়ে যেতে হয়। রতন শুধু মাসে মাসে মাইনে পাঠিয়ে দিত, আর খবর পাঠাত যে শরীর খারাপ, শরীর ভাল হ’লেই যাবে আবার। সে প্রতিদিনই আশা করত যে এবার সে সংযত হবে, কান্তিকে এখান থেকে সরিয়ে দেবে– কোন বোর্ডিংএ কোথাও– যাতে নতুন ক’রে পড়াশুনো আরম্ভ করতে পারে। তার ভরসা ছিল কান্তি ভাল ছেলে– একটা বছর নষ্ট হ’লেও আবার ঠিক ধরে নেবে।

এরই মধ্যে টেস্ট পরীক্ষার দিন কবে পেরিয়ে গেল– কান্তির মনেও পড়ল না। কিছুই মনে ছিল না তার, হুঁশ ছিল না। সকাল থেকে রাত্রি নটা পর্যন্ত কাটত এক উন্মত্ত নেশার মধ্য দিয়ে– রাত নটা থেকে পরদিন প্রভাত পর্যন্ত কাটত সারা দিনের স্মৃতি-রোমন্থনে ও আসন্ন দিনের সুখ কল্পনায়। এর মধ্যে তুচ্ছ জীবন বা ভবিষ্যতের কথা ভাববার মতো ফাঁক কৈ?

অবশেষে আবারও একদিন এল বিপদের সঙ্কেত। নিয়ে এল সেই মোক্ষদাই।

নটার সময় বাবু এসে গেলে একদিন ওপরে উঠে এল সে। কান্তি তখন বিছানায় চুপ ক’রে শুয়ে ভাবছে রতনের কথাই। রতন যেন চির-বিস্ময় তার কাছে, চির-বাঞ্ছিত। তার চিন্তায় ওর ক্লান্তি নেই, অবসাদ নেই। কিন্তু মোক্ষদার রূঢ় পদক্ষেপে সেই চিন্তায় ছেদ পড়ল স্বপ্ন ভঙ্গ হল।’কে’ বলে ধড়মড়িয়ে উঠে বসল সে।

‘ও’ মোক্ষদাদি? তাই ভাল। আমি বলি কি–’

‘কী বলো? ভাবছিলে তোমার অতনদি? হ্যাঁ– ঐটে এখনও বাকি আছে! পয়সা দেনেয়ালা বাবুকে ছেড়ে অসের নগরের কাছে অস করতে আসা! বলি ঠাকুর– অনেক অগ্রেই সাবধান ক’রে দিয়েছিলুম, তা আমার কথা শুনলে না। উলটে বেশি ক’রে মুখ জুবড়ে পড়লে দঁকের মধ্যে। তা আমার কি। আমিও চুপ ক’রই ছিলুম। নিহাৎ শেষ পর্যন্ত একটা খুনোখুনি বেহ্ম-অক্তপাত হবে বলেই আবার হুঁশ করাতে আসা। শোন না শোন তোমার ইচ্ছে!’

‘কী বলছ মোক্ষদাদি– তোমার কথা আমি ঠিক বুঝতে পারছি না!’ কোনমতে জড়িয়ে জড়িয়ে বলল কান্তি। লজ্জা, সামনাসামনি প্রকাশ্যভাবে এই সব কথা আলোচনার লজ্জা আর তার সঙ্গে সত্যিকারের একটা ভয় যেন তার কথা বলার শক্তি কেড়ে নিয়েছে। হঠাৎ ওর মনে হ’ল মোক্ষদার কথাগুলোর মধ্যে সত্যিই একটা আসন্ন বিপদের আভাস আছে।

‘বেশ বুঝেছ।’ চোখ-মুখ ঘুরিয়ে অভ্যস্ত ভঙ্গিতে হাত-পা নেড়ে বলে মোক্ষদা, ‘বলি বুঝতে তো তোমার বাকি নি কিছু। বুঝবে না কেন? সেই য্যাখন কচি খোকাটি ছিলে ত্যাখন বুঝতে পার নি বললে সাজত। র‍্যাখন আর সাজে না। র‍্যাখন আর বুঝতে জানতে কোন্ জিনিসটা বাকি আছে তোমার? বলে সপ্ত কাণ্ড আমায়ণ, সীতে কার পতি।… শোন ঠাকুর, বাজে বকবার সময় নি আমার, বেশিক্ষণ দাঁড়াতে পারব নি। এক আশ কাজ পড়ে আছে নিচোয়। ওসব ন্যাকাঁপানায় আর কাজও নি– যা বলছি ঠিকঠাক মন দিয়ে শোন। বাবু– মানে জামাইবাবু একটা কিছু সন্দ করেছে। ঠাকুরকে দারোয়ানকে ডেকে নানা অকম জেরা করেছে– আমাকে ক’রে নি তার রুদ্দেশ্য এই যে, আমাকে জানে দিদিবাবুর হাতের নোক বলে! তাও করতে পারে। এমনি কেউ বলে দেবে না। দিদিবাবু মুঠো মুঠো টাকা দে মুখ বন্ধ ক’রে এসেছে সব। কিন্তু জেরার মুখে কোন কথার ফাঁকে কী বেইরে যাবে তা কি কিছু ঠিক আছে? ত্যাখন কিন্তু ছেড়ে কথা বলবে নি বাবু, তেমন বাবু নয় কো। আগলে, মদ পেটে পড়লে পিচেশ হয়ে ওঠে তা তো জানই। যদি সটে-পটে কোনদিন ধরে ফেলতে পারে তো তেক্ষুণি কেটে দু-টুকরো ক’রে ফেলবে।’

হয়ত ওর কথাগুলো বলবার এই উদ্ধত অপমান-কর ভঙ্গিতে, কিম্বা তাকে উপলক্ষ ক’রেই ওরা নিয়মিত অর্থ দোহন করছে রতনদির কাছে থেকে– এই কথাটা শুনে, হঠাৎ কেমন রাগ হয়ে গেল কান্তির। সে-ও বেশ চড়াসুরেই উত্তর দিল, ‘তা আমাকে এসব কথা শোনাতে এসেছ কেন? নিজের মনিবকে গিয়ে বলো না। তিনি ছাড়লেই আমি যাব। বিপদ তো শুধু আমার একলার নয়, তাঁরও আর তেমন কিছু হলে, তোমাদেরও। এত সুখের চাকরি কোথায় পাবে?’

মোক্ষদা কিন্তু রাগ করল না। কথাটা মেনে নিয়েই বলল, ‘সে কথা একশো বার। হক কথা এটা। এমন পরিপুষ্টু গাই সহজে মেলে না। দুয়ে উঠতে পারলেই হ’ল। বলি সেই জন্যেই তো এত মাথাব্যথা গো। কিন্তু রোকে তো বলবার যো নি। ও তো পাগল এখন, কোন কি হস্যি-দীঘ্যি জ্ঞান আছে? তুমি একটু বুঝ ক’রে দ্যাখো। মার খেয়ে সে-ই যেকালে বেরোতে হবে, সেকালে এই বেলা মানে মানে সরে পড়া ভাল নয় কি? আর বলি তোমারও রেহকাল পরকাল দু-কালই তো গেল ঝরঝরে হয়ে, এর পরে খাবে কি ক’রে তাও ভাব রাজকাল নেকাপড়া না হলে সায়েবের চাকরি হয় না। তোমার তো অইল ধর গে হয় উনুনে ফুঁ নয়তো শাঁকে ফুঁ। তা যে লবাবী মেজাজ ক’রে দিয়েছে তোমার, তাতে কি আর ঐ ওজগারে মন উঠবে? তার চেয়ে সময় থাকতে এই বেলা দু-চার হাজার বাগিয়ে নে সরে পড়ো। তোমারও রাখেরের কাজ হোক– ও ছুঁড়িও বাঁচুক। নেশা কেটে গেলে এমন কত টাকা দুয়ে বার ক’রে নিতে পারবে বাবুর ঠেঙে। তুমিও চাই কি ঐ টাকায় একটা দোকান- দানী দিয়ে ক’রে খেতে পারবে। আর কেনই বা পড়ে আছে, তোমারও তো সাধ মিটে গেছে– এবার রব্যাহতি দাও না।’

আবারও সেই টাকার ইঙ্গিত।

এবার বেশ রূঢ়ভাবেই বলল, কান্তি, ‘আমি তোমাদের মতো অত ইতর নই মোক্ষদাদি যে এতদিন এত খেয়ে এত হাত পেতে নিয়ে আবার টাকা বাগিয়ে সরে পড়ব। যেতে হয় তো এমনিই চলে যাব। পুরুষমানুষ আর কিছু না হয় মোট বয়ে খাব। তাতে কি?’

মুচকি একটু হেসে আশ্চর্যরকম ঠাণ্ডা মেজাজেই জবাব দিল মোক্ষদা, ‘তা বাপু মানছি আমরা রিতোর ছোটলোক। পয়সা খুব চিনি। পয়সার জন্যেই তো খানকিবাড়ি গতর খাটাতে এসেছি। পয়সা চিনব না। তুমি চেনো না চেনো– নিজের ভাল বোঝ না বোঝ– সে তোমার রভিউচি। তবে তাও বলি, টাকা তোমার পাওনা– বেহক্কের কিছু নয়। নিলে এমন কিছু ছোটনোকপানা হত না। তোমার কাঁচা মাথাটি চিবিয়ে খেয়ে বসে অইল– তার দাম দেওয়া তো রুচিতই।’

এই-বলে আর কোন প্রত্যুত্তরের অবকাশ মাত্র না দিয়ে মোক্ষদা চলে গেল।

কিছুই বলতে পারল না কান্তি। খুব দুকথা শুনিয়ে দিতে পারলে একটু শান্তি হ’ত ওর– কিন্তু বলা হল না। অবসর মিলল না বলে নয়– ডেকে থামানো যেত, জোর ক’রে ধরে দু’কথা বলা যেত– কী বলবে তাই ভেবে পেল না যে। শুধু একটা দুঃসহ রাগে সমস্ত দেহটা চিনচিন করতে লাগল– অব্যক্ত কী রকম কষ্ট হ’তে লাগল। রাগ আর অপমানবোধ। ওদের দুজনকে জড়িয়ে বার বার যে ইঙ্গিত দিয়ে গেল মোক্ষদা সেইটেই যথেষ্ট অপমানকর। অথচ কী-ই বা বলবার আছে? কথাটা এত নির্ঘাৎ সত্য যে অস্বীকার করবার, কি মোক্ষদাকে ধমক দেবার কোনও উপায় নেই কোথাও। আজ তারা এমনভাবেই নিজেদের নামিয়ে এনেছে যে, এইসব সামান্য দাসী-চাকরের বিদ্রূপ-ইঙ্গিত-অপমান নীরবে সয়ে যেতে হচ্ছে। জবাব দেবার মতো কিছু নেই ওদের তরফ থেকে।

কিন্তু তবু বার বার মনে হ’তে লাগল– এত স্পর্ধা ওদের, এত দুঃসাহস! যে মুখ নেড়ে এই অপমান ক’রে গেল সেই মুখখানা ভেঙ্গে গুঁড়িয়ে দিতে পারলে ঠিক জবাব হত এ আস্পর্ধার।

একবার মনে হল, কালই রতনদিকে বলে ওকে জবাব দেওয়ায়। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গেই এ প্রস্তাবের মূঢ়তা নিজের কাছেও ধরা পড়ল। কোন ফল হবে না। রতনদি সাহস করবেন না ওকে জবাব দিতে! এই জন্যেই করবেন না। বড় বেশি জানে ওরা। বিশেষত মোক্ষদা। যে মুহূর্তে জবাব দেওয়া হবে সেই মুহূর্তে মোক্ষদা গিয়ে জামাইবাবুকে খবর দেবে– জানিয়ে দেবে সম্পূর্ণ ইতিহাস! তারা এখন ওদের হাতের মুঠোয় চলে গেছে। একদিক দিয়ে অপমানিতও হতে হবে আর একদিক দিয়ে টাকাও গুণতে হবে। মাথায় পা দিয়ে চললেও কিছু বলবার যো থাকবে না।

মনে পড়ল একদিন ইংরিজী কি খবরের কাগজে ‘ব্ল্যাকমেল’ কথাটা পেয়েছিল। মানেটা ঠিক বুঝতে পারে নি। ইংরিজীর মাস্টারমশাইকে জিজ্ঞাসা করাতে তিনি একটুখানি চুপ ক’রে থেকে বলেছিলেন, ‘ওর মানে কোন গোপন কথা ফাঁস ক’রে দেবার ভয় দেখিয়ে টাকা বা সুবিধে আদায় করা। এই ধরনের ব্যাপার।’ তারপরই বলেছিলেন, ‘বড় খারাপ কাজ ওটা। বড় ঘৃণা। ওর মানে না বোঝাই ভাল। কোনদিন, যেন বুঝতেও না হয়!’ আজ হঠাৎ মনে পড়ে গেল কথাটা। একেই বুঝি ব্ল্যাকমেল বলে। এরা ব্ল্যাকমেল ক’রে রতনদির কাছ থেকে টাকা আদায় করছে।….

কী করবে, এ অবস্থায় কী করা উচিত ভেবে পেল না কান্তি। যেন কী একটা দৈহিক অস্বস্তিতে ছট্‌ফট ক’রে বেড়াল খানিকটা।

বলবে রতনদিকে মোক্ষদার কথাটা?

লাভ কী?

বড় ম্লান হয়ে যাবেন। কষ্ট পাবেন খুব। সেই মলিন মুখ এবং নত দৃষ্টি কল্পনা করেই মায়া হ’তে লাগল কান্তির। অথচ শুনবেনও না কথাটা– তাও সে ভাল করেই জানে। প্ৰাণ ধরে বিদায় দিতে পারবেন না।

কান্তিই কি পারবে এই নিরানন্দ পুরীতে ওঁকে ছেড়ে যেতে?

তার চেয়ে ওদের ঘনিষ্টতাটাই কমিয়ে দেওয়া ভাল। তাছাড়া এইবার চেপে পড়তে বসতেও হবে। আর সময় নষ্ট করা ঠিক হবে না। সামনের বার পরীক্ষা না দিলেই নয়। ভাগ্যিস দাদারা অত হিসেব রাখেন না– নইলে কী কৈফিয়ৎ দিত তার ঠিক নেই। মুখ দেখাতে পারত না তাঁদের কাছে।

সাত-পাঁচ ভেবে কিছুই বলা হল না রতনদিকে। মোক্ষদারা এই ব্যাপার নিয়ে টাকা আদায় করছে তাঁর কাছে, এটা কান্তি টের পেয়েছে জানলে লজ্জায় মরে যাবেন রতনদিন। এতটুকু হয়ে যাবেন অপমানে। না না– ছিঃ, সে মুখ ফুটে বলতে পারবে না এ কথাটা।

.

যেটা বলতে পারে সেটাই বলল একদিন–ঐ ঘটনার দিন চার-পাঁচ পরে। বলল, ‘এবার একটু চেপে পড়তে হয় রতনদি। একটা বছর গেল, আর গেলে চলবে না।’

‘একটা বছর গেল মানে? নষ্ট হয়ে গেল?’

গৈল বৈকি। টেস্ট দেবার কথা ছিল, দিলুম না। এই তো সামনেই এগ্‌জামিন। টেস্টে পাস না করলে তো তাতে বসতে দেবে না!’

‘তা কৈ–।’ কী একটা বলতে গিয়ে থেমে যায় রতন।’তা কৈ বল নি তো’– এই কথাই বলতে যাচ্ছিল। দোষটা যে তার ঘাড়েই এসে পড়বে, সেইটে মনে পড়ে যাওয়ায় আর বলল না। আস্তে আস্তে মাথা নামাল। মুখটা লাল হয়ে উঠল– কানের ডগা পর্যন্ত।

তেমনি মাথা নামিয়েই একটু পরে বলল, ‘তাহ’লে তুমি কাল থেকেই আবার ইস্কুলে যেতে শুরু করো। আর কামাই করে কাজ নেই।’

এবার মাথা নামাবার পালা কান্তির। সে নত-মুখে রতনের ব্রেসলেটটা ঘোরাতে ঘোরাতে বলল, ‘ইস্কুলে আর আমার যেতে ইচ্ছা করে না। সকলে ঠাট্টা করবে, যা-তা বলবে। মাস্টারমশাইরা বকবেন, নতুন সব ছেলেদের সামনে। এখন যারা ফার্স্ট ক্লাসে পড়ছে তারা আমার নিচে পড়ত, কত খাতির করত। তাদের সামনে অপমান হওয়া’

‘তবে কী করবে? নতুন কোন ইস্কুলে ভর্তি হবে? কিন্তু আমি তো সে সব সন্ধান জানি না। সরকারমশাইকে বললে নানান্ কৈফিয়ৎ‍জানাজানি।’

আবার মাথা নামায় রতন।

কান্তির মাস্টারমশাইও, রোজ এসে ফিরে যেতে হয় বলে, গত মাসখানেক আসছেন না সেটাও মনে প’ড়ে গেল দু’জনকারই।

‘মাস্টারমশাইকে বরং খবরটা দিই। এবার থেকে নিয়মিত আসুন।’

‘না-না। ওঁকে না। তুমি বরং সরকারমশাইকে বলো অন্য একজন মাস্টারমশাই ঠিক করতে। এঁকে দিয়ে চলছে না, ভাল একজন মাস্টারমশাই চাই– এ বলতে তো কোন দোষ নেই। তাতে কি কিছু– মানে– মনে করবেন ওঁরা?’

‘না, না। তা মনে করবেন কেন? তাই বলি বরং সরকারমশাইকে। একটু যদি চেপে পড়ান বেশি করে সময় দিয়ে। মানে ঘণ্টা দুই-আড়াই– না হয় বেশি মাইনেও নেবেন কিছু।’

‘সে রকম হলে বোধ হয় কুড়ি-পঁচিশ টাকা হেঁকে বসবেন।’ ভয়ে ভয়ে বলে কান্তি। ‘তা হোক। টাকার জন্যে তোমাকে মাথা ঘামাতে হবে না।’

কান্তি অনেকটা নিশ্চিন্ত হয়। এবার আস্তে আস্তে সে দূরে চলে যেতে পারবে।… কিন্তু সে অবসর আর মিলল না। ঠিক পরের দিনই– সরকারমশাইকে ডেকে নতুন মাস্টার খোঁজার কথা বলবার আগেই ঘটনাটা ঘটে গেল। তখন তিনটে-চারটে হবে, রতনদির খাটে পালা বাঘের ছবি আঁকা বিলিতে কম্বলটার মধ্যে ওরা দুজনে ঘুমোচ্ছিলো। দরজা ছিল ভেজানো। হঠাৎ সজোরে দোরটা খুলে ভেতরে ঢুকলেন রতনদির বর– বা বাবু– দত্তসাহেব। ঘরে ঢুকেই দরজা বন্ধ করে খিল লাগিয়ে দিলেন একেবারে!

ঘটনাটা এতই আকস্মিক আর অপ্রত্যাশিত যে ঘুম ভেঙ্গে গেলেও ব্যাপারটা বুঝতে খানিক সময় লাগল ওদের। তারপরই ধড়মড় করে দুজনে দুদিক দিয়ে নেমে এল খাট থেকে। কিন্তু দত্তসাহেবের মুখ দেখেই বুঝল ওরা যে আর রক্ষা নেই কারুর। ওঁর দুদিকের রগের শিরাগুলো ফুলে উঠে দব্দ করছে তা এখান থেকেই দেখা যায়। দুই চোখ টক্‌টকে লাল–হয়ত মদও খেয়েছেন একটু– কিন্তু এ লাল অঅন্যরকম– মাথায় রক্ত ওঠার দরুন এত লাল হয়েছে নিশ্চয়।

ওদের তরফ থেকে কিছু বলবার– কৈফিয়ৎ দেবার কি ক্ষমা চাইবার– কোন অবসর মিলল না। জিজ্ঞাসাও করলেন না দত্তসাহেব। কেউ কোথাও চুকলি খেয়েছে নিশ্চয়। পাকা খবর পেয়েই এসেছেন। কৈফিয়ৎ অনেক দেওয়া চলতে পারত অবশ্য ভাইবোন, বিশেষ ছোট ভায়ের সঙ্গে এক বিছানায় শোওয়া কিছু অন্যায় নয়, অশোভনও নয়। কিন্তু সে কৈফিয়ৎ শুনবে কে? ওদেরও দেবার মতো অবস্থা নয়। দাঁড়িয়ে ঠকঠক করে কাঁপা ছাড়া আর কিছুই করতে পারলে না ওরা। মুখ দিয়ে একটা শব্দও বেরোল না। আর সেইটেই তো ওদের তরফ থেকে অপরাধের স্পষ্ট স্বীকৃতি।

প্রস্তুত হয়েই এসেছেন দত্তসাহেব।

যে হাতখানা এতক্ষণ পিছনে ছিল সেইটে এবার সামনে এল।

শঙ্কর মাছের চাবুক একটা। এ বস্তুটা চেনে কান্তি। এ ঘরেও একটা টাঙ্গানো আছে।

হিস হিস করে উঠলেন দত্তসাহেব, ‘রাস্তার কুকুর, –তুমি মুখ দিতে এসেছ ঠাকুরের নৈবিদ্যিতে। এত আস্পদ্দা তোমার! এত সাহস! এত সাহস কোথা থেকে এল তাই ভাবছি। ভিখিরী বামুনের ছেলে– পেট পুরে ভাত জুটছিল না– আশ্রয় দিয়ে খাইয়ে- পরিয়ে রেখেছিলুম– তার এই শোধ! চমৎকার! এই তো নিয়ম, আমারই খেয়ে আমারই পয়সায় বিষ সঞ্চয় করে আমাকে ছাড়া আর কাকে কামড়াবে? সাপের দস্তুরই যে এই! তবে সাপের ওষুধও আমার জানা আছে। যেমন কুকুর তেমনি মুগুর। হারামজাদা, কুত্তাকি বাচ্ছা কাঁহাকা!’

সব কথা শুনতেও পেল না কান্তি। কারণ তার আগে সপাসপ চাবুক পড়তে লাগল– পিঠে হাতে বুকে মুখে– সর্বত্র। কেটে কেটে বসতে লাগল শঙ্কর মাছের চাবুক। ফিকি দিয়ে রক্ত ছুটতে লাগল ওর সর্বাঙ্গে। রতন ব্যাকুলভাবে কী বলতে যাচ্ছিল, চাপা রোষে ধমক দিয়ে উঠলেন দত্তসাহেব– ‘চুপ! তুমি কি ভাবছ তুমি বাদ যাবে? ও কসবীর জাতকে শাসন করতে হয় কী ক’রে তা আমি জানি। ওর হয়ে সুপারিশ করতে আসছ!…. নিজের ভাবনা ভাব গে। তবে এ আগে। কসবী কসবীর ধর্ম পালন করবে সেইটেই স্বাভাবিক। কিন্তু এর অন্যায়ের কোন মাপ নেই। বেইমানী হচ্ছে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় পাপ–’

চাবুক কিন্তু বন্ধ নেই এক মিনিটের জন্যও। কান্তি এতক্ষণ ছটফট করছিল, এই বৃষ্টির মতো আঘাতের মধ্যে থেকে আত্মরক্ষার এতটুকু ফাঁক খুঁজছিল আকুল হয়ে– দুই হাত বাড়িয়ে অন্ধের মতো। এবার অবসন্ন হয়ে পড়ে গেল সে।

এক মুহূর্তও থামলেন না দত্তসাহেব, একবার ফিরে তাকালেন না তার দিকে, একবার হাতটা পর্যন্ত বদল করলেন না। বাঘের মতো ফিরে যেন ঝাঁপিয়ে পড়লেন রতনের ওপর। এবারের আঘাতটা যেন আরও নিষ্ঠুর, আরও সাংঘাতিক, আরও অব্যর্থ। কাপড়জামা ভেদ করে সে চাবুক মাংসতে চেপে বসে সেগুলোকে রক্তে ভিজিয়ে তুলল।

এরা কেউই কাঁদে নি, চেঁচামেচি করে নি। কিন্তু নিচে থেকে সবাই ছুটে এসে জড়ো হয়েছে বাইরে। অমন ভাবে অসময়ে অগ্নিশর্মা হয়ে বাবুকে ছুটে ওপরে আসতে দেখেই ব্যাপারটা বুঝেছে তারা। তাছাড়া চাবুকের শব্দ বন্ধ দোরের মধ্যে দিয়েও বাইরে আসছিল।

মোক্ষদা হাউ-মাউ করে চেঁচিয়ে উঠল, ‘ওমা, কী হবে গো। একটা খুনোখুনি করবে নাকি শেষমেষ। ওমা– কোথায় যাব গো। থানা-পুলিশ করতে হবে নাকি শেষ পর্যন্ত। ওগো ও জামাইবাবু, খোল খোল দরজা খোল। দরজা বন্ধ করে আবার কী শাসন। শেষে কি সবাইকার হাতে দড়ি দেওয়াবে নাকি! অ ঠাকুর, যাও যাও কত্তাবাবুকে ডেকে নে এসো। আর, দারোয়ান তুমিই বা কী রকম নোক গা। এত ডালরুটি খাও বস্তা বস্তা… একটু গায়ে জোর নি, দরজা ভাঙ্গতে পার না? মনিব খুন হচ্ছে ওধারে, আর তুমি দাঁড়িয়ে দেখতেছ সঙের মতো। ভাঙ্গ ভাঙ্গ কপাট, ভেঙ্গে ভেতরে সেঁধোও —

দারোয়ান সাহস পেয়ে দুম-দুম লাথি মারতে লাগল দরজায়। একটু পরে কর্তাবাবু অর্থাৎ রতনের বাবাও ছুটে এলেন। ভারী গলার আওয়াজ পাওয়া গেল, ‘এ সব কী হচ্ছে কী? দত্ত, এই দত্ত– দরজা খোল শিগগির।’

ততক্ষণে রতনও অজ্ঞান হয়ে পড়ে গেছে। রক্তাক্ত চাবুক শেষবার ওর অনড় দেহটাতেই আছড়ে ফেলে দোর খুলে বেরিয়ে এলেন দত্তসাহেব। ভ্রূ কুঞ্চিত করে একটু চড়া গলাতেই কী বলতে যাচ্ছিলেন কর্তাবাবু, এক ধমকে তাঁকে চুপ করিয়ে দিলেন, ‘তুমি চুপ করে থাকো! বুড়ো শুয়ার কোথাকার, মেয়ে বেচে খাচ্ছ বসে বসে– মেয়েকে পাহারা দিতে পারো না? পথের কুকুর এসে ঘরে ঢুকছে দেখতে পাও না? ছোটোলোকের জাত!’

তারপর সকলকার সামনে দিয়েই গট গট করে বেরিয়ে চলে গেলেন তিনি। কর্তাবাবু পর্যন্ত একটি কথাও বলতে পারলেন না!

.

এরপর কদিন আর কান্তির কোন জ্ঞান ছিল না। কদিন তাও জানে না সে। গায়ের ব্যথায় আর প্রবল জ্বরে বেহুশ হয়ে পড়েছিল। গায়ে নাকি ঘাও হয়ে গিয়েছিল চার-পাঁচ জায়গায়।

যেদিন জ্ঞান হ’ল সেদিন দেখল পাশে একটা টুলে ডাক্তারি ওষুধ সব রয়েছে। কাটা ঘাগুলোতেও মলম লাগানো। অর্থাৎ ডাক্তার ডাকা হয়েছে, শুশ্রূষাও হয়েছে কিছু কিছু। আরও ভাল ক’রে চেয়ে দেখল যে, সে তার ওপরের ঘরে নিজের বিছানাতেই শুয়ে আছে।

জ্ঞান হবার পর প্রথম যে প্রতিক্রিয়া হ’ল ওর– তা হচ্ছে অপরিসীম লজ্জার। ছি ছি, এ বাড়িতে আর মুখ দেখাবে কি করে– এই সব ঝি-চাকরদের সামনে। এখনই পালিয়ে যাওয়া দরকার, কিন্তু কোথায়ই বা পালাবে! বাড়িতে গিয়েই বা কি বলবে! সেখানে গিয়েই বা কোন্ মুখে দাঁড়াবে।

একটু পরে হাসিমুখে মোক্ষদা এসে দাঁড়াল।

‘এই যে, হুঁশ ফিরে এসেছে? যাক বাবা, বাঁচা গেল। যা ভাবনা হয়েছিল! এধারে ইনি পড়ে রজ্ঞান রচৈতন্যি– ওধারে উনি পড়ে। আমরা যাই কোথায় বল দিকি! তবু ভাগ্যে জামাইবাবুই ডাক্তার পাঠিয়ে দেছল তাই অক্ষে।’

তারপর একটু থেমে আঁচলের নাড়া দিয়ে কান্তির মুখের ওপর থেকে মাছি সরিয়ে দিয়ে বলল, ‘যাও, এবার চটপট সেরে উঠে সময় থাকতে থাকতে সরে পড় দিকি। ব্যবস্থা একটা হয়েছে যেকালে– সেকালে আর দেরি করে নাভ নি। মানুষের মন না মতি। এখন মত হয়েছে আবার সে মত ঘুরে যেতে ক্যাতক্ষণ? এই বেলা কাজ গুছিয়ে নাও!’

কান্তির এ সব বোঝার কথা নয়। তার তখনও একটু জ্বর রয়েছে, দুর্বল মাথায় এ সব কথা ঢুকলও না। সে ফ্যাল ফ্যাল ক’রে তাকিয়েই রইল মোক্ষদার মুখের দিকে।

মোক্ষদাই বুঝিয়ে দিলে এবার, ‘তা বাপু মারুক ধরুক যা-ই করুক– এধারে মানুষটার বেবেচনা আছে, তা কিন্তুক মানতেই হবে। আমরা তো ভাবনু তাড়িয়েই দেবে সোজাসুজি, দেশে গিয়ে যেখানকার ছেলে সেখানে উঠতে হবে। মুখ দেখাবে কী করে সেই ভাবছিলুম। তা সেদিক দিয়ে বাবু যায় নি, হুকুম দিয়েছে কোথায় কোন্ ওর জমিদারীতে কি রিস্কুল আছে সেখানে যদি গিয়ে থাকতে চাও তো রিস্কুলে ভর্তি করে দেবে– কাছারীবাড়িতে থাকবে, রামলাদের সঙ্গে খাবে– রিস্কুলে পড়বে। খরচা সব তেনার। তবে লবাবি চলবে নি। গরিব গেরস্তর চালে থাকতে হবে। পোষায় ভাল, তিনি নোক দেবে, সঙ্গে গিয়ে ভর্তি করে দে আসবে, আর না পোষায় তো পত্তরপাঠ তোমাকে পথ দেখতে হবে।…. তা আমি বাপু তোমার হয়ে বলেই দিয়েছি ও সেখানে যেতেই আজী। …. জানি তো দেশে-ঘাটে যাবার মুখ নি তোমার–কোথায় যাবেই বা।’

এই প্রথম মোক্ষদা সম্বন্ধে কৃতজ্ঞতা বোধ করল কান্তি। আঃ বাঁচা গেল! বাঁচা গেল! বেঁচে গেল সে। বাঁচল এই লজ্জা থেকে শুধু নয়– সর্বনাশ থেকেও। আর কোন পথ কোথাও ছিল না। বাড়ি গেলে পড়াশুনো আর হত না এটা নিশ্চিত। এ তবু নতুন করে জীবন আরম্ভ করার একটা সুযোগ মিলল। এখন যদি চেপে খাটে তাহলে আবারও হয়ত ভাল রেজাল্ট করতে পারবে।

হায় রে! তখন যদি জানত দত্ত-সাহেবের এই আপাত-দয়ার পিছনে কি সুপরিকল্পিত নিষ্ঠুরতা আছে! সামান্য দৈহিক শাস্তিতে কিছুই মন ওঠে নি তাঁর, দুঃসহ ক্রোধের কিছুমাত্র শান্তি হয় নি। বড় রকমের শাস্তির জন্যেই তাঁর এই সদয় প্রস্তাব। পৈশাচিক শাস্তি– যা দীর্ঘকাল মনে থাকে, সারা জীবনে যা বাঘের দাঁতের মতো স্থায়ী দাগ রেখে যায়– তারই জন্যে এই বদান্যতার ব্যবস্থা, এই আয়োজন।

মোক্ষদা বলল, ‘তাই বলছিনু তোমায়– মেজাজ ভাল থাকতে থাকতে সেখানে গে চেপে বসো গে যাও। তারপর আর কী মনে থাকবে ওর! বলে হাকিম নড়ে তো হুকুম নড়ে না। একবার হুকুম হয়ে গেলে রামলা-গোমস্তারা ঠিক খরচা যুগিয়ে যাবে পরের পর। মোদ্দা আর দেরি করো নি। কখন আবার মেজাজ পালটে যাবে, অক্ত চড়ে যাবে মাথায় আবার দুম করে কী বলে বসবে।…. দেখলে তো–যা বলেছিনু সেদিন, তাই ফলে গেল রক্ষরে রক্ষরে। খুন হও নি সে তোমার গুরুর ভাগ্যি, আর আমাদের বাপ-মার পুণ্যি– বামুনের অক্ত দেখতে হল নি। গরিবের কথা বাসি হলেই খাটে। এবার আর দেরি করো নি। আমি যে মানুষ চিনি– এই সব বাবু ভাইদের চিনতে কি আর বাকি আছে। ঘরের মাগকে পাহারা দেয় কে তার ঠিক নি– বাইরের আঁড়কে পাহারা দেবার জন্যে চোখে ঘুম নি! হাত্তোর বড়মানুষ রে!’

বোধ করি একটু দম নেবার জন্যই থামল একবার মোক্ষদা। সেই ফাঁকে কান্তি আস্তে আস্তে বলল, ‘আমি আজই যেতে চাই মোক্ষদাদি, যত শিগ্‌গির পারো একটু ব্যবস্থা করে দাও– সরকারমশাইকে বলে। আমি আর একদিনও থাকতে চাই না।’

‘ওমা তাই বলে কি আজই এক্ষুণি যাওয়া হয়। এখনও গায়ে তাত অয়েছে বেস্তর’- হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে কপালটা দেখে নিল মোক্ষদা, ‘ওঠো, একটু ভাল হও, পথ্যি কর দুটো, তারপর তো যাওয়ার বন্দোবস্ত। ভয় নি– একদিনে কিছু মহাভারত রশুদ্ধ হয়ে যাবে না। সরকারমশাইকে তো আমি তোমার জবানীতে বলেই দিয়েছি, তিনিও নাকি চিঠিপত্তর নিকে দিয়েছে!’

এর তিন-চার দিন পরেই, প্রথম যেদিন ভাত পেয়েছে সে– সেই দিনই রওনা হয়ে গিয়েছিল কান্তি, কিছুতেই আর থাকতে রাজি হয় নি।

যাবার আগে রতনের সঙ্গে দেখাও হয় নি আর। সে কথা কেউ বলেও নি। রতনও চেষ্টা করে নি দেখা করার। কান্তিও মুখ ফুটে কিছু বলতে পারে নি। হয়ত দত্তসাহেব শুনতে পেলে আবার রাগ করবেন, হয়ত রতনদিকেই তার জন্যে কথা শুনতে হবে। কিম্বা আবার মার খেতে হবে–। নিজের আঘাত দিয়েই রতনদির কী পরিমাণ লেগেছিল তা বুঝতে পারে কান্তি। অমন ননীর মতো নরম দেহে ঐ চাবুক যখন কেটে কেটে বসেছে তখন না জানি কী যন্ত্রণাই পেয়েছে রতনদি। আজও সে কথা মনে হলে দু’চোখে জল ভরে আসে তার। সত্যিই বড় দুঃখী রতনদি, বড় অসহায়। সে তো তবু পালিয়ে যেতে পারছে, ওকে পড়ে মার খেতে হবে। থাক, আর দেখা করার চেষ্টা করবে না সে। তাছাড়া, রতনদিও লজ্জা পাবে মিছিমিছি। এমনই বোধ হয় লজ্জাতে মরে যাচ্ছে সে। আর লজ্জা বাড়িয়ে দরকার নেই।

সেও ভাল হয়ে উঠেছে, ভাত খেয়েছে– এটুকু মোক্ষদাই একদিন উপযাচক হয়ে শুনিয়ে দিয়েছিল তাকে। সেই জেনেই নিশ্চিত হয়ে বেরিয়ে এসেছিল কান্তি।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *