২৫. কনকের পক্ষে একমাত্র বৈচিত্র্য

পঞ্চবিংশ পরিচ্ছেদ

॥১॥

এ বাড়িতে কনকের পক্ষে একমাত্র বৈচিত্র্য–এবং বোধ হয় কিছুটা আনন্দ ও সান্ত্বনার স্থলও হ’ল নরেন। বস্তুত নরেন যদি না থাকত তো সে টিকতে পারত না। হয়তো পাগল হয়ে যেত এত দিনে। স্বামী উদাসীন, প্ৰায় গৃহত্যাগী–ছুটির দিন সকালে মাত্র ক’ঘণ্টা সময় সে জেগে এ বাড়িতে থাকে–কিন্তু সেও ভোর থেকে স্নানাহারের সময় পর্যন্ত তার বাগানেই কাটে। ননদ বিদ্বিষ্ট–দিনরাতই কলহের সহস্র ফাঁদ পাতছে–অতি কৌশলে সে ফাঁদ এড়াতে হয়। কনকের অপরিসীম ধৈর্য তাই, নইলে প্রতি মুহূর্তেই দারুণ ঝগড়া বাধত। তার বিবাদের ফাঁদ এড়াতে হয় মানে তাকেও এড়াতে হয়। সামনে পড়লেই বাক্যবাণ ছুটতে থাকে–কাঁহাতক সহ্য হয় মানুষের। তার ভয়ে ভাগ্নী সীতাটার সঙ্গেও কথা কইতে পারে না। আড়ালে-আবডালে কথা কয়ে দেখেছে–সে মেয়ে আবার এমন, কার সঙ্গে কী কথা হ’ল প্রত্যেকটি মার কাছে গিয়ে গল্প করে। তা থেকে বহুদিন ঝগড়ার সূত্রপাত হয়েছে। কনক প্রাণপণে মুখ বুজে (এবং কানও সম্ভবত, নইলে সেকথা হজম করা শক্ত) থেকে তা এড়িয়েছে। শাশুড়িই সাবধান ক’রে দিয়েছেন, ‘কেন মা ওদের সঙ্গে কথা কইতে যাও, খুব দরকার না থাকলে কয়ো না। ও ঝাড়বংশই পাজী, বুঝছ না?’

এ তিনজনকে আর শিশু-দেওরকে বাদ দিলে আর যে সুস্থ লোক এ বাড়িতে আছে–শ্যামা, সেও তার ওপর ঠিক যেন প্রসন্ন নয়। অথচ কেন যে নয়, তা কনক ভেবে পায় না। সে তার কাকী-জেঠিমার সমস্ত উপদেশ পালন ক’রে আদর্শ বধূ হবারই চেষ্টা করে। তার বাড়িরও আর কোন মেয়ে কিন্তু এতটা পারত না। কাজও একা এক-হাতে যতটা করা সম্ভব ততটাই করে–একটি কাজও ফেলে রাখে না। শ্বশুরের নোংরা কাজগুলো শাশুড়ি তাকে করতে দেন না–বারবার স্নান করতে হয় বলে।

একঢাল চুল, ভিজে থাকলে অসুখ করবে। শ্যামার চুল অসম্ভব পাতলা হয়ে গেছে, সামনেটা–মানে সিঁথির কাছটা তো চক্‌চকে টাকের মতোই হয়ে উঠেছে–সুতরাং তার দশবার স্নান করলেও ক্ষতি হয় না। এ ছাড়া ভোরের রান্নাটা তার–সেও গরজে, বাসিপাট সারতে হয় কনককে। শুধু বাসিপাট কেন-ঘর-দোর ঝাড়া-মোছা, রান্নাঘর দাওয়া উঠোন নিকোনো, ক্ষার কাঁচা, বিছানা তোলাপাড়া, বাসন মাজা–কী নয়? ঐন্দ্রিলার যেদিন মেজাজ ভালো থাকে সেদিন সে-ই রাঁধে–কিন্তু সে আর কদিন? তার অসহযোগের দিনই তো বেশি। সে সব দিনে কনককেই রান্না করতে হয়। এ ছাড়া শাশুড়ির ব্যক্তিগত সেবাও করতে প্রস্তুত ছিল–যদি তাঁকে একদণ্ড স্থির দেখতে পেত। শ্যামা তার স্বামী-সেবার মুহূর্তগুলি ছাড়া অষ্টপ্রহরই থাকে তার পাতা-গামড়া গাছপালার ঠেকো এবং নারকোল সুপুরি ও সুদের হিসেব নিয়ে। রাত্রে অন্ধকারেও হাত থামে না–তখন চলে পাতা চাঁচা। (অন্ধকারে হাতও কাটে না তো–অবাক হয়ে কনক ভাবে এক-একদিন। )…তাও শ্বশুরের খাওয়ানো নাওয়ানো ইত্যাদি বড় কাজগুলোর ভার তার ওপরই। তবু শাশুড়ির মন পায় না কেন? ছেলে খুব বেশি ভালবাসলে অনেক সময় শাশুড়িদের হিংসে হয় বৌদের ওপর। তার ঠাকুমা বলেন, ‘ও হ’ল গে সতীনের হিংসে’, মাগো কী নোংরা কথাই বলতে পারেন ঠাকুমা। কিন্তু এক্ষেত্রে তো সে কারণও নেই। সেটা নিশ্চয়ই এত দিনে লক্ষ্য করেছেন শাশুড়ি। তবে? সে কি এত ভাল, এত নির্বিবাদী, এত ঠাণ্ডা বলেই তাঁর রাগ? কোন খুঁত ধরে কি দোষ ধরে তাকে তিরষ্কার করতে পারেন না বলেই? এক-এক সময় সেইটেই মনে হয় কনকের।

সুতরাং শ্বশুর ছাড়া এ বাড়িতে কোন আশ্রয় নেই তার।

নরেনও অষ্টপ্রহরই তার খোঁজ করে–’কৈ গো, আমার মা-লক্ষ্মী কোথায় গেল গো মা, আমার মা-জননী? এসো মা এসো। …একটু বোস্ না মা কাছে, আমার কাছে বসলে তবু দু দণ্ড জিরোতে পারবি। নইলে ঐ মাগী–ও কি কম হারামজাদা মেয়েমানুষ–ও তোর মুখে রক্ত উঠিয়ে ছাড়বে, এই বলে দিলুম। খাঁটিয়ে খাঁটিয়ে মারবার জন্যেই তোকে এনেছে। জানিস না ওকে। ওদের ঝাড়ে-বংশে খচ্চর। ..নিজে শুধু বসে বসে পাতা চাঁচবে আর পাতা কুড়োবে। ঐ পাতা ওর সঙ্গে স্বগে যাবে। ঐ পাতায় ওর মুখে নুড়ো জ্বালা হবে। ঝাঁটা মারো, ঝাঁটা মারো।’

তার পরই গলাটা নামিয়ে বলে, ‘দিস না মা, আজ যখন কাঁচকলা সেদ্ধটা দিবি–তার সঙ্গে ঐ যে তোদের উঠোনে ধানিলঙ্কা আছে–ঐ একটু টিপে আর অমনি এক ফোঁটা তেল। শুধু শুধু ঐ কাঁচকলা সেদ্ধ যে আর খেতে পারি না–মুখে চড়া পড়ে গেল। আর কীই বা হচ্ছে। ওতেই কি আমি সেরে উঠছি?…দিবি মা? জিভটায় তবু একটু ছড়াঝাট পড়ে’?

করুণ কণ্ঠে মিনতি করে।

মায়াও হয় কনকের, মন কেমন করে। … সে নরেনের পূর্ব ইতিহাস কিছু‍ই জানে না–ক’দিনে শাশুড়ি আর ননদের কথাবার্তার ফাঁকে আভাসে-ইঙ্গিতে যেটুকু জেনেছে–তাতে এমন কিছু পরিচয় পাওয়া যায় না–সুতরাং তার মন- কেমন করার সঙ্গত কারণ আছে। তবু সে হেসে ঘাড় নাড়ে, না বাবা, সে আমি পারব না। মা আমাকে জ্যান্তে পুঁতবেন তাহলে। আপনার শরীর তাতে বড্ড খারাপ হবে। আর তা ছাড়া মরিচের গুঁড়ো তো একটু দেওয়া হয়–’

‘হয়েছে? বিষমন্তর কানে ঢুকিয়েছে? দলে টেনে নিয়েছে মাগী? বাঁচলুম বাছা। জানি, মেয়েছেলে মাওরেই বেইমানের ঝাড়–। এ বাড়ির মাটির দোষ যে। এসেই অমনি গোড়ে গোড় পড়েছে। …যা দূর হয়ে যা আমার সামনে থেকে–ছোটলোকের মেয়ে গোরবেটী হারামজাদী–যা।’

কনক হাসতে হাসতে উঠে যায়। রাগ হয় না তার। এ গালাগাল গায় লাগে না। ছেলেমানুষিই মনে হয়।

আবার দু দণ্ড বাদেই ওদিক দিয়ে যেতে দেখলে ডাক পাড়বে, ‘কৈ গো, আমার বৌমা কোথায় গেলেন। সন্তানকে একেবারেই ভুলে রইলেন যে।’

কিংবা বলবে, ‘আর কবে কি করবি বেটী, আমার দিন যে ফুরিয়ে আসছে। এই বেলা আয়, দুটো-চারটে শলা দিয়ে যাই। আমার কথা শুনে রাখ–নইলে ওঁদের সঙ্গে পেরে উঠবি কেন? দেখছিস ঐ মাগীর পাল্লায় পাড়ে আমারই হাড় ভাজা ভাজা হয়ে গেল।’

আপন মনেই এসব কথা বকে যায় সে, কনক আসুক বা না আসুক।

শ্যামা এক-এক দিন হাসে, আবার এক-এক দিন অন্য মেজাজে থাকলে দাঁত কিড়মিড় করে, ‘মুখে আগুন তোমার। আগুন পড়েও কাজ নেই। মুখখানি পচুক তোমার। লোকে বলে সর্ব অঙ্গ থাকতে মুখটি পুড়ক–আমি তাও বলি না। পচুক, পচুক ও বেইমানের জিব খসে পড়ে যাক। দিনরাত গু-মুত ঘাঁটছি তবু সেই এখনও আমার পেছনে না লাগলে আমাকে না গাল দিলে পেটের ভাত হজম হয় না।’

কনক হেসে বলে, ‘কার ওপর রাগ করছেন মা। ওঁর কি জ্ঞান আছে কী বলছেন?’

তুমি জান না মা, জ্ঞান নেই তাতেই ঐ, জ্ঞান থাকলে অষ্টপ্রহর আমার চোদ্দ পুরুষকে চোদ্দবার নরকে ডোবাত।’

আবার মধ্যে মধ্যে নরেন চিনতেও পারে না কনককে। এসে দাঁড়ালে বলে, ‘কে-ও কে? ও মল্লিকদের বাড়ি থেকে এসেছেন বুঝি। বসুন, বসুন, আর কী দেখতে এসেছেন? কিছু কি আর আছে? ওরে কে কোথায় গেলি রে, একটা আসন দিয়ে যা না–মাগীর চিরদিন সমান গেল, ভদ্দরলোকদের আদর অভ্যর্থনা কিছু শিখলে না কোনোদিন। আমাদের গা ইপিস্ করে এসব অসৈরন দেখলে, বুঝলেন না? আমরা কত বড় গুরুবংশের ছেলে–এসব যে নিয়ে জন্মেছি আমরা। …তা বসুন, ঐখানেই বসুন। ময়লা নোংরা যা দেখছেন আমার বিছানায়–মেঝে দিব্যি পোষ্কার–বৌমা আমার চোদ্দবার মুছে নিচ্ছেন। যাব, যাব–একটু ভাল হয়ে উঠি, আপনাদের বাড়ি যাব। আর এই তো এখানেই রইলুম, ব্রতে কম্মে যখন ডাকবেন যাব।

উঠোন থেকে শ্যামা শুনতে পেয়ে বলে, ‘এ যে একোবরে স্পষ্ট ভীমরতি ধরল দেখছি। কাকে কি বলছ, ও তো তোমার ব্যাটার বৌ।’

‘ভীমরতি তোর ধরুক। তোর ছেলেমেয়েদের ধরুক। তোর চোদ্দগুষ্টির যে যেখানে আছে তাদের ধরুক। আমি চিনতে পরছি না। আসুন মা, বসুন। ভাববেন না আমার সত্যি-সত্যিই গোলমাল হয়েছে–ওদিক থেকে আলোটা এসে পড়েছে কিনা তাইতেই–’

তার পর বলে, ‘বসুন মা, বসুন।’

কনক হাসি চাপাতে পারে না বহু চেষ্টাতেও। বলে,’ও কি, আমাকে বসুন বলছেন কেন?’

‘দোষ নেই। কিচ্ছু দোষ নেই। বৌমা তো–মা যখন বলেছি তখন আর কথা কি। কখনও আপনি বলব কখনও তুই বলব। এ যে আপনার জিনিস–মনের মত জিনিস। কখনও মাথায় কখনও পায়ে। সংসারের দস্তুরই যে এই। আর আপনাকে আপনি বলব না তো কাকে বলব মা–কত বড় বংশের মেয়ে আপনি। বলি আমার তো এ তল্লাটের কোন বামুন-বাড়ি জানতে বাকি নেই। পূর্ণ মুখুজ্জেদের কত বড় বংশ ছিল, আজই না হয় দেখছেন অমনি ট্যানাপরা ছাতি-বগলে মুখ শুকিয়ে ঘুরছে–নইলে ওরাই তো ছিল ওখানকার জমিাদর। তবে কি জানেন মা–এসব বুঝবে কে আজকাল? ইজ্জৎ বলুন, ময্যেদা বলুন–এ বোঝে সমানে সামনে। আমরাই কি একটা সাধারণ লোক। ‘

তারপর আবারও গলাটা অস্বাভাবিক নেমে আসে।

‘দে না মা, একগাল চাল-কড়াই ভাজা একটু অল্প ক’রে তেলহাত বুলিয়ে? বলি শরীরটাই না হয় পড়েছে–দাঁত তো দেখছিস, বত্রিশপাটি বজায় আছে ঠিকঠাক। যার যা ধম্ম, দাঁতের কিছু চিবোবার না দিলে চলে? গলা ভাত আর চিঁড়ের মণ্ড খেয়ে খেয়ে দাঁতে জং ধরে গেল যে। …আচ্ছা চাল-কড়াই ভাজা না দিতে চাস–নিদেন দুটো কাঁটালবীচি পুড়িয়ে দে।

কনক নেতিসূচক ঘাড় নাড়লেই সঙ্গে সঙ্গে তার পিতৃবংশ সম্বন্ধে মত পালটে যায়, ‘তা দেবে কেন? তা দিলে যে তবু সদ্বংশের পরিচয় দেওয়া হবে। গোরবেটী হারামজাদী মেয়ে আমার যেমন–খুঁজে খুঁজে কনে ঠিক করলেন। মাথা কিনলেন আমার। ছোটলোকের ঝাড় ওরা–ওদের চিনি না। ওদের সাত পুরুষ ডাকসাইটে ছোটলোক। মেয়ে আমার বেছে বেছে সেই ছোটলোকের ঝাড় ঘরে এনে পুরলেন। …একের নম্বর মামলাবাজ কুচক্কুরে লোক সব– মামলা ক’রে ক’রে সব্বস্বান্ত হয়ে গেল, তবু মামলা ছাড়তে পারলে না। ছোট লোকের বেটী ছোটলোক।

আবার এক-এক দিন কী হয়–হঠাৎ কনকের রূপের প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়ে ওঠে, এসো মা এসো। দেক দিকি–এসে দাঁড়ালে ঘর যেন জ্বলে উঠল। মা আমার সাক্ষাৎ জগদ্ধাত্রী। তা হ্যাঁ মা, একটা কথা বলছি–মনে কিছু ক’রো না–আমার ঐ মিলিটারী মেজাজের ছেলে, ঐ হেমচন্দরের কথা বলছি গো–উনি রোজ রোজ অত রাত ক’রে ফেরেন কেন মা? কী এমন ওঁর রাজকার্য চলে রাত তেরোটা অদি?’

কনকের হাসি হাসি মুখে যেন একট ছায়া ঘনিয়ে আসে। মাথা হেঁট ক’রে বলে, ‘তা আমি কেমন ক’রে জানব বলুন।’

‘সে কি কথা। জানি না বললে চলবে কেন? জান, খোঁজ নাও। জিজ্ঞেস কর, কৈফেত চাও। এত রাত অব্দি কোথায় কী ভাবে থাকে জানা দরকার। এ যে অতিশয় মন্দ কথা, যৎপরোনাস্তি খারাপ কথা। ঘরে এমন রূপের ঢাল বৌ, সে কোথায় অফিস কামাই ক’রে পেছনে পেছনে ঘুরঘুর করবে, না–রাতদুপুর ক’রে বাড়ি ঢোকে। আমি যে সব টের পাই। না মা, খবরদার অত ঢিল দিও না। রক্ত বড় খারাপ ওর, ভারী বদ্ বীর্যে জন্ম। রাশ এতটুকু আলগা দিয়েছ কি মরেছ, দেখছ না ঐ ক’রে তোমার শাশুড়ি মাগীর হাড়ীর হাল হ’ল। বাপ কি বেটা সিপাই কা ঘোড়া–কুছ না হয় তো থোড়া থোড়া। আমি ঐ ক’রে ওর মা’র সব্বনাশ করলুম, বললে বিশ্বাস করবে না ঐ পোড়া চেলাকাঠের রং এককালে ছিল ঠিক বসরাই গোলাপ। আর তেমনি দুগগোপ্রতিমের মতো মুখ। এখন যা দেখছ তা দেখে বুঝতে পারবে না সে চেহারা। আমার হাতে পড়েই সেই চেহারা এই হয়েছে। না মা, এখন থেকে যদি রাশ না টেনে ধর শতেক খোয়ার ক’রে ছাড়বে। আমার বংশ আমি ভাল রকম চিনি।’

শ্যামা দোরের বাইরে থেকে খরখর ক’রে ওঠে, ‘হ্যাঁ তোমর বংশ শুধু হলে তাই দাঁড়াতে বটে, তবে রক্তটা যে আমার। অমন ছেলে লোকে তপস্যা ক’রে পায় না… কেন মিছিমিছি বিষমন্তর ঢোকাচ্ছ ওর কানে তাই শুনি। অমন কুমন্ত্রণা যদি দাও, বৌকে আর এ ঘরে আসতে দেব না।’

‘না না বামনী, রাগ করসি নি। ভালর জন্যেই বলছি, তোর বরাত দেখেই আক্কেল হয়ে গেছে যে! সেই জন্যেই ভয় হয়।

‘ওঃ, কত দরদ রে। এত দরদ তো কখনও বুঝি নি। আক্কেল হ’ল এই মরবার কালে–বলতে গেলে শয়ে উঠে? দুদিন আগে হলে যে তবু কাজ দিত–তুমিও জুড়োতে আমিও জুড়োতুম।’

‘বরাত, বুঝলি বামনী, তোরও বরাত আমারও বরাত। নইলে এমন হবে কেন?… কৈ গো বৌমা, অমন হাঁ ক’রে সঙের মতো এক পায়ে দাঁড়িয়ে রইলে কেন–একটু তামাক সাজ না।’

।।২।।

বর্ষাটাকাইে ভয় ছিল সব চেয়ে বেশি–সেই বর্ষা পার হয়ে যখন পুজো পর্যন্ত কেটে গেল তখন যেন মনে মনে একটু আশ্বস্ত হ’ল শ্যামা। হয়তো আর একটা বর্ষা পর্যন্ত টিকিয়ে রাখা যাবে। খুবই কষ্টকর–এই শয্যাগত রোগীকে সামলানো–বিশেষ সে যা ছেলেমানুষের মতোই অবুঝ–তবু শ্যামা তার মৃত্যুকামনা করে না; ‘আহা, বাঁচুক–আমি যত দিন আছি, আমার ওপর দিয়েই যাক–আর কাউকে তো জ্বালাচ্ছে ন।‘

হেমও যে ঠিক ওর মৃত্যু চায় তা নয়। একটু জ্বালাতন বোধ হয় এটা ঠিকই–তবু মানুষ তো। স্বাভাবিক অবস্থায় কোন মানুষই বোধ হয় কোন মানুষের মৃত্যু কামনা করে না।

মহা তো মহাখুশী। একটা গর্ব করার মতো কথা পেয়েছে সে। রান্নাঘর থেকে শুরু ক’রে পথেঘাটে সর্বত্র গলা চড়িয়ে খবরটা দেয়, ‘হবে না? বলি মা’র এয়োতির জোর নেই?…মা কি একটা যে সে সতী? ঐ পুরুষের সঙ্গে ঘর করেছে তবু কখনও একবার উঁচু পানে চেয়ে দেখেনি। দেখছ না এখনও মা’র সিঁথির সিঁদুর কী রকম ডগডগ করছে লাল। আর শাঁখারই বা কী জেল্লা। ঐ জোরেই বাবা আবার ঠেলে উঠবে ঠিক–দেখো তোমরা!’

শুধু অভয়পদই ঘাড় নাড়ে, ‘বলা যায় না ঠিক। অনেক সময় পচা বর্ষাও কাটে কিন্তু নতুন হিমের সময়টা কাটতে চায় না। পুরনো রুগী বেশি কাবু শীতের মুখটায়।’

দেখা গেল অভয়পদের কথাটাই ফলে যায় শেষ পর্যন্ত। মহার আশা ব্যর্থ ক’রে এবং তার স্বামীর আশঙ্কা সত্য ক’রে অঘ্রানের শেষের দিকটায় একেবারে ফুলে পড়ে নরেন। দিনরাত পড়ে পড়ে হাঁপায়–জল পর্যন্ত সহ্য হয় না, এমন অবস্থা।

শ্যামার মুখ শুকিয়ে ওঠে। দু-তিন দিন দেখে হেমকে ডেকে বলে, আর একবার না হয় বড় ডাক্তার বাবুকেই ডাক। বাঁচবে না হয়তো, তবু লোকে বলবে যে একেবারে বিনা চিকিচ্ছেয় লোকটাকে মেরে ফেললে, সে বদ্‌নামটা তো বাঁচবে। তুই রবিবার সকালেই বরং নিয়ে আয় ডাক্তারবাবুকে–’

হেম বোঝে যে লোকে যত না বলুক–মা’র মনই বলছে কথাটা। কিন্তু মুখে কিছু বললে না। শনিবার সকাল ক’রে বাড়ি ফিরে বড় ডাক্তার বাবুকে ডেকে আনে।

তিনি এসে গম্ভীরভাবে ঘাড় নাড়েন।

বাইরে গিয়ে বলেন, ‘এ আমাদের ক্ষমতার বাইরে। হার্ট খুব ড্যামেজ্‌ড্–লিভারে আর কিছু নেই। আমার তো মনে হয় আর ওষুধ বিষুধে পয়সা খরচ করে লাভ নেই। অবিশ্যি কলকাতা থেকে নীলরতন সরকার- টরকারকে আনলে কী হবে জানি না–ওঁরা কিছু করতে পারবেন কিনা। আমার আর কিছু করবার নেই। বরং টোকা-টুট্‌কি করা ভাল–অনেক সময় তাতে খুব ভাল রেজাল্ট পাওয়া যায়।’

হেম বলে, ‘কিন্তু আগে কথাবার্তা সব গোলমাল হয়ে যেত–এখন সেগুলো বেশ পরিষ্কার।’

‘ও অমন নয়। এসব রোগীর মরবার আগে মাথা পরিষ্কার হয়ে যায়। লোকে বলে না হেগো রুগী মুখে দড়। ওটা তাই–’ অর্থাৎ যাকে বলে ‘এলে দিয়ে যাওয়া’ তাই গেলেন।

খবর পেয়ে মল্লিকদের বড় গিন্নী দেখতে এলেন। ক্ষীরোদাও অতিকষ্টে পালকি ক’রে একদিন দেখে গেলেন।

সবাই উপদেশ দিয়ে গেলেন শ্যামাকে, ‘করছ কি, কি, একটা প্রাচিত্তির–চান্দ্রায়ণ করিয়ে দাও। আর কেন?’

শ্যামা আড়ালে দাঁড়িয়ে ভাল ক’রে চোখ রগড়ে মুছে স্বামীর কাছে এসে বসে। গলাটাকে নিয়েই যেন মুশকিলে পড়ে…সহজ স্বাভাবিক আওয়াজ যেন আর বেরোতে চায় না।

অনেক কষ্টে, খানিকটা একথা সেকথার পর কথাটা পাড়ে, ‘সবাই বলছে, বড় বেয়ানও বলে গেলেন, একটা চান্দ্রায়ণ করিয়ে দিতে–আর ঐ সঙ্গে একটা অঙ্গ প্রাচিত্তির। ওতে নাকি কষ্টটা কমে, অনেক সময় পরমায়ুও ফিরে পায়।’

নরেন হাঁপিয়ে হাঁপিয়েই যেন ঝেঁজে ওঠে, ‘কে, কোন্ গুয়োটা বলেছে তাই শুনি। গাঁজা গাঁজা বুঝলি–স্রেফ গাঁজা। ছাই হয়। কী হবে প্রাচিত্তির ক’রে তাই শুনি–পয়সা বড় সস্তা হয়েছে তোর’ না?’

‘পয়সা সস্তা হবে কেন–কী কষ্টের পয়সা তা তো দেখতেই পাচ্ছ…. লোকে বলে–তাই বলে মহাপাতক কেটে যায়, শরীরটা ঝরঝরে হাল্কা হয়ে ওঠে—’

‘তুই থাম দিকি। ওসব আমার মত বামুনদের পয়সা আদায়ের ফিকির। যদি পাপ ধরতে হয়–এ জীবনে এত পাপ করেছি যে তা তোর ও একহন্দর প্রাচিত্তিরেও কাটবে না। আবার এধারে তো তোদের শান্তরেই বলছে–একবার রামনামে যত পাপ হরে–মানবের সাধ্য কি যে তত পাপ করে!…তা একবার না হয় রামনামই করে নিচ্ছি। আমার ওপর বিশ্বাস না হয়, তুই-ই না হয় দিনে দশবার ক’রে কানের কাছে রামনাম শুনিয়ে যাস। চান্দ্রায়ণ! একদিন উপোস ক’রে খানিক ভেজাল ঘি খেলেই যদি সেরে উঠত আর ড্যাং ড্যাং ক’রে স্বগে যেত তা হলে আর ভাবনা ছিল না। ?’

একসঙ্গে অনেকগুলো কথা বলে বোধ হয় খুব কষ্ট হয়, খানিকটা মড়ার মতো পড়ে হাঁপাতে থাকে।

খানিক পরে আবার চোখ খুলে, বলে ‘ওসব বুজরুকি–বুঝলি বামনী–বুজরুকি। ভড়ং। ও আমিও ঢের করেছি। মন্তর যা পড়িয়েছি তা আমিই জানি–তাইতেই তারা সব নিশ্চিন্তি হয়ে স্বগে চলে গেছে।’

‘হ্যাঁ–সবাই তোমার মতো বামুন কি না।’ শ্যামা রাগ ক’রে বলে।

‘সব সমান, সব সমান। কী জাসিন, গুয়ের এপিঠ আর ওপিঠ। শোন্, তোকে এইবেলা চুপি চুপি একটা কথা বলে যাই–মাছ আর তোকে কে কত খাওয়াচ্ছে তা নয়–আমি থাকতেই তো মাছ খাওয়া বন্ধ হয়ে আছে বলতে গেলে। তবে–নিজে পুকুর করেছিস মাছ-টাছ যদি ভাল ওঠে কোনদিন–মানে আমি যাবার পর বলছি–এদিক ওদিক দেখে দুখানা খেয়ে ফেলিস। কিচ্ছু দোষ হবে না। আমি বলে গেলুম। দোষ হয় আমার হবে। আমার ও তো পাপের ভারা পূর্ণ আছেই–তাতে আর একটু-আধটু চাপলে টেরও পাব না। কিছুতে কিছু হয় না বুঝলি। হবেই বা কি–মাকড় মারলে ধোকড় হয়, চালতা খেলে বাকড় হয়–শুনিস নি ছেলেবেলা? তাই! চোখ বুজলেই সব ফক্কিকার। অনেক দেখলুম, অনেক পুণ্যাত্মাও দেখলুম। কিছু না কিছু না!’

শ্যামা আর বসতে পারে না। চোখের জল যে এই লোকটার জন্যেই তার এমন অবাধ্য হয়ে উঠবে তা কে জানত।

মহা শুনে কান্নকাটি করে। স্বামীকে বলে, ‘একখানা ভাল লালপাড় শাড়ি আনিয়ে দাও, আর মাছের মুড়ো-মাকে খাইয়ে আসি গিয়ে।

অভয়পদ বলে, ‘বল এনে দিচ্ছি। কিন্তু দু’দিন আগে খাওয়াতে পারতে, এখন কি আর মুখে উঠবে। এখন মা মুড়ো খাওয়াতে যাবার মানে কি আর তিনি বুঝবেন না।’

‘তবু এসব করতে হয়। তুমি বড় সবতাইতে খুঁত কাট বাপু। তুমি বারণ করছ, এর পর লোকে বলবে অত বড় মেয়েটা ছিল, কিছু করলে না–’

‘না, না–তুমি কর গে। আমি বারণ করি নি। দুগ্‌গোকে বল, ও ভাল মাছ আনিয়ে দেবে।’

নরেন স্বয়ং ছেলেকে ডেকে পাঠায়। কাছে এলে বলে, ‘বসো বাবা, বসো। দুটো কথা বলে নিই। দু’দিন পরে তো আর বলা হবে না। তুমি আমার সুপুত্তুর–আমিই কু-পিতা, কখনও কিছু করতে পারলুম না, তা বলছি কি–সবই তো বুঝছ, তোমার গর্ভধারিণীর খাওয়া-পরা তো সব ঘুচতে চলল। এই একদিন একটু ভাল করে মাছভাত খাইয়ে দাও। বৌমাকে বল, রেঁধেবেড়ে খাওয়াবে।’

তারপর একটু থেমে বোধ করি বা হেমের উত্তরেরই আশা করে।

কোন জবাব না পেয়ে আবার বলে, ‘আর আমাকেও–যদি কিছু খাওয়াতে ইচ্ছে করে তো এইবেলা খাইয়ে দাও। আর ধারাকাঠ ক’রে কী হবে–বুঝতেই তো পারছ ধারাকাঠের বাবা করলেও বাঁচাতে পারবে না। বিবেচনা কর, মাগী তো চান্দ্রায়ণ প্রাচিত্তির করবে বলে ক্ষেপে উঠেছিল, তাতে তো এককাঁড়ি টাকা খরচ হ’ত–সেটা বাঁচিয়ে দিলুম। ছেরাদ্দশান্তিতে বেশি খরচ করো না–মরা গরু ঘাস খায় না। তাছাড়াও কত ছেরাদ্দ তো করালুম আমি, ভুজ্জিই বল পিণ্ডিই বল সব বামুনকে দেওয়া। কুশের বামুন খাড়া ক’রে তাকে তেল জল অন্নবস্ত্র দেওয়া। কেন রে বাপু? বলে জ্যান্তে দিলে না মুখে তুলে, মলে দেবে বেনার মূলে। তার চেয়ে তুমি আমাকেই যা হয় ভালমন্দ খাইয়ে দাও। যদি সেই বামুনকেই খাওয়াতে হয়–আমাকে খাওয়াতে দোষ কি? আমিও ধর গিয়ে তো বামুন। বামুন তায় বয়োজ্যেষ্ঠ তায় গুরুজন। যারপরনাই তোমার পিতা।’

হেম চুপ ক’রে থাকে। তারই বা মনটা ক’দিন এত খারাপ লাগছে কেন তা বোঝে না।

অনেকক্ষণ পরে শুধু জিজ্ঞাসা করে, ‘তা তোমার কি খেতে-টেতে ইচ্ছে হয়?

‘আমার? আমি বাবা সর্বভূক। বিশ্বব্রহ্মাণ্ড আমার খাওয়ার ইচ্ছে, যা পার খাইয়ে দাও।’

‘বিশ্বব্রহ্মাণ্ড খাওয়াবার তো আমার ক্ষমতা নেই। খুব বেশি যা খেতে ইচ্ছে হয় তাই বল।

‘খুব বেশি–?’ খানিকটা ভেবে নেয় নরেন, তার পর বলে, ‘কদিন ধরে পাতক্ষীরে বোঁদে ফেলে খেতে ইচ্ছে করছে খুব। তা পাতক্ষীর না পাও–একটু রাবাড়ির ঝোল? আর একটু মাংস। করার অসুবিধে হয় কলকাতার কোন হোটেল থেকে একটু কিনেও আনেত পার। চার পয়সা–দুআনা? দেয় দেয়,–অমন ভাঁড়ে ক’রেও দেয়।’

হেম সেই দিনই খুঁজে খুঁজে একটু ক্ষীর আর বোঁদে কিনে আনে। মাংস বাড়িতেই রাঁধাবার ব্যবস্থা করে। মাছ মাংস তো হয়ই না কোন দিন, হলে তবু বৌটাও খেতে পারবে একটু। জলের মতো ডাল আর ডুমুর থোড় কাঁচকলা খেয়ে খেয়ে তো পেটে চড় পড়ে গেছে। একেই পাতলা গড়ন–তার ওপর এই খেয়ে রোগাও হয়ে গেছে খুব–সেটা এমন কি তারও চোখে পড়ছে কিছুকাল থেকে। অভয়পদ প্রায় রোজই সন্ধ্যার সময় এসে খোঁজ নিয়ে যায়।

একদিন কাছে এসে বসতে নরেন গলাটা নামিয়ে বললে, ‘বাবা অভয়, তোমাকে আর কী বলব, তুমিই বলতে গেলে আমার জ্যেষ্ঠ সন্তান–চিরদিন এ সংসারটা তো তুমিই ঠেললে। তা রইল সব, দেখোশুনো। …হ্যাঁ, বলছিলুম কি, বলতেও লজ্জা করে, কখনও তো এক পয়সার বাতাসা কোনদিন এনে দিতে পারিনি–তোমার কাছে এসব বলাও ঠিক নয়-–’

বাধা দিয়ে অভয়পদ প্রশ্ন করে, ‘খাবেন কিছু–বিশেষ কিছু খেতে ইচ্ছে করে?’

‘ঠিক ধরেছ বাবা, মনের কথা টেনে নিয়ে বলেছে। মহাখুশি হয়ে উঠে নরেন–’বিশেষ কিছু নয়, খরচ-পত্তর করাতেই চাই নে তোমায়, শুধু একখানা প্যাজের বড়া আর একটা ঝাল-ফুলুরি।’

অভয়পদ তখনই বেরিয়ে গিয়ে কিনে আনে বাজার থেকে।

শ্যামা যেন শিউরে ওঠে, ঐ রুগীকে দেবে আবার, বাজারের তেলেভাজা?’

‘কি হবে মা না দিয়েই বা? বুঝতেই তো পাচ্ছেন–! আত্মা খেতে চাইছে যখন এত ক’রে–দিয়েই দিন। এর পরে নইলে বহু আপসোস হবে। আর আমি এনেছিও একখানা ক’রেই ঠিক। বেশি দেব না।

সে দুটো খুব তৃপ্তি ক’রে খায়। ক্ষীর-বোঁদেও চেটে খেয়েছিল–কিন্তু মাংস মুখে দিতে পারলে না। মুখে দিয়েই থু-থু ক’রে ফেলে দিলে। কেমন একরকম অদ্ভুত দৃষ্টিতে পুত্রবধূর মুখের দিকে চেয়ে বললে, ‘এইবার সত্যিসত্যিই শিয়রে এসে দাঁড়িয়েছে মা চিত্রগুপ্তের পেয়াদা। নইলে মাংস আমার মুখে তেতো লাগে। না, আর দেরি নেই।’

দেরি যে আর নেই তা সকলেই বোঝে এবার।

হেম কৌশল ক’রে বাপের মাংসের সঙ্গে একটু মাছ কিনে এনেছিল–সঙ্গে বসে খেলে–অত টের পায় নি শ্যামা। কিন্তু মহাশ্বেতা যেদিন তিন-চার রকম মাছ নিয়ে এসে রাঁধতে বসল সেদিন আর তার আসল অর্থটা শ্যামার বুঝতে বাকি রইল না। অভয়ের আশঙ্কাটাই আর একবার সত্য হ’ল। মেয়ে আর বৌ জোর ক’রে শ্যামাকে ধরে এনে পাতের কাছে বসাল বটে কিন্তু সেই সুস্বাদু মাছের একটা টুকরোও মুখে দিতে পারল না সে। ভাত ভেঙে মুখে দিতে গিয়ে পাতের পাশেই হাহাকার ক’রে আছড়ে পড়ল।

‘কেন এনেছ এসব মা, এ তো আমি খেতে চাই নি। যেদিন থেকে আমার হরিনাথ গেছে সেইদিন থেকেই তো আমি পারতপক্ষে মুখ তুলি নি এসব। এতে ক’রে কি আমার লোহা-সিঁদুর বাঁচবে মা?…সেই তো আমার আসল, সেই তো আমার সব। …ভগবান সব দিক দিয়ে মেরেছেন আমাকে চিরকাল, এইটুকু শুধু দিয়ে রেখেছিলেন–তাও কেড়ে নিচ্ছেন এবার। ওরে, ওর কি এই মরবার বয়স হয়েছিল–না বুড়ো হয়েছিল ও? কেন এল এতকাল পরে আমার কাছে–এ কি এই দাগা দেবে বলে? তার চেয়ে বাইরে বাইরে ঘুরে বেড়াত কোথায় থাকত কী খেত তা খবরও রাখতুম না, সেই তো ভাল ছিল। তেমনি ক’রেই ওকে বাঁচিয়ে রাখলেন না কেন ভগবান

সেদিন আর খাওয়াই হ’ল না কারুর

মহা তবু জোর করতে যাচ্ছিল, কনকে ইঙ্গিতে নিষেধ করলে। তার বয়স কম কিন্তু নারীহৃদয়ের সহজাত সহানুভূতি দিয়ে এটা বুঝেছিল যে, এ খাওয়ার চেয়ে শাস্তি মেয়েমানুষের আর কিছু নেই।

।।৩।।

এমনি ক’রে প্রায় একুশ-বাইশ দিন এখন-তখন হয়ে কাটবার পর নরেনের ফুলোগুলো আবার একটু কমতে শুরু হ’ল। এই ক’দিন টনটনে জ্ঞান ছিল সেটাও চলে গেল, আবার সেই আগেকার আধো-আচ্ছন্নভাবে ফিরে গেল। কথাবার্তায় গোলমাল হতে লাগল।

সকলে ভাবলো, এ টালটাও সামলে গেল-আবার ক’টা দিন অন্তত যুঝবে।

পর পর তিন শনি-রবিবার কোথাও ঘোরা হয়নি হেমের, সে যেন হাঁপিয়ে উঠেছিল। রাণীবৌদি এর মধ্যে দুবার এসে দেখে গেছে। নতুন গুড়ের সন্দেশ এনে নিজের হাতে খাইয়ে একরাশ আশীর্বাদ নিয়ে গেছে নরেনের–কিন্তু তাতে মন ভরে না। আড্ডার আলাদা সুখ। সুতরাং সে-শনিবার হেম প্রতিজ্ঞা করেই বেরিয়েছিল যে অন্তত সন্ধ্যা পর্যন্ত আড্ডা না দিয়ে সেদিন সে বাড়ি ফিরবে না। তার ওপর অফিসে গিয়েই শুনলে ওদের এক প্রাক্তন সাহেব বিলেতে মারা গেছেন, কাল খবর পৌঁছেছে–আজ সেই শোকে দু’ঘণ্টা আগে ছুটি হয়ে যাচ্ছে। এমনিতেই বারোটাতে ছুটি সেদিন, তার দুঘণ্টা আগে–অর্থাৎ দশটাতেই সেদিন বেরিয়ে পড়তে পারবে। এটাকে সে ঈশ্বরেরই সুস্পষ্ট ইঙ্গিত বলে মনে করল।

কলতাকাতায় নেমে প্রথমেই সিমলের রান্তা ধরল। কমলারা তখন খেতে বসেছে। গিয়েই তো কেড়ে-বিগড়ে রাণীবৌদির পাত থেকে খানিক ভাত তুলে খেয়ে নিলে, রড়মাসীর কাছ থেকে খানিকটা আমড়ার অম্বল। তার পর গোবিন্দর মেয়েটাকে নিয়ে লোফালুফি করল কিছুক্ষণ–এক কথায় অনেক দিন পরে অনেকটা হৈ হৈ ক’রে যেন বাঁচল সে।

বেশ হাসি-খুশিতেই কাটছিল, কিন্তু খানিকটা গল্প করার পর নাতনী ও ঠাকুমা দুজনেই তন্দ্রাচ্ছন্ন হতে হঠাৎ গম্ভীর হয়ে উঠল রাণী। ইঙ্গিতে হেমকে পাশের–অর্থাৎ নিজেদের ঘরে ডেকে নিয়ে গিয়ে বললে, ‘একটা কথা জিজ্ঞেসা করব ঠাকুরপো, ঠিক ঠিক উত্তর দেবে?’

হেম রীতিমত ঘাবড়ে গেল ওর কথা বলার ভঙ্গিতে। এ যেন নতুন এক রাণীবৌদি। এ মূর্তির সঙ্গে তো সে পরিচিত নয়! সে একটু ভয়ে ভয়েই বলল, ‘কী ব্যাপার বল তো? কিসের কথা?’

‘তুমি বৌকে নাও না কেন?’

ঠিক এই প্রশ্ন এবং এত স্পষ্টভাবে–শোনবার জন্য আদৌ প্রস্তুত ছিল না হেম। সে চমকে উঠল।

‘কে বললে তোমাকে? যে বলেছে সে–সে মিথ্যে কে’রে লাগিয়েছে!’

‘ভয় নেই, কনক বলে নি। সে মেয়েই সে নয়। তার বুক ফাটে তো মুখ ফাটেবে না। ওসব মেয়েদের আমি ভাল ক’রেই চিনি। বিষম আত্মসম্মান জ্ঞান কনকের!

‘তবে–?’

‘ওগো মশাই, আমাদের চোখ আছে, আমরা ঘাস খাই না। আমাকে তো চেন, পেটের কথা তোমরও জানতে কিছু বাকি নেই আমার। বল না কবে, কোথায় কী ক’রে এসেছ সব বলে দিচ্ছি। ওকি, মুখ শুকিয়ে উঠল যে। ভয় নেই–জানলেই বলতে হয় না! কিন্তু এ আলাদা কথা। বড্‌ড ভুল করছ ঠাকুরপো। বাইরে বাইরে ঘুরে শুধু এঁটোপাত চাটাই সার হয়–আসল ভোজের স্বাদ তাতে মেলে না। তোমার বাবাও আর একরকমভাবে বাইরে বাইরে ঘুরেছিলেন–জীবনটাই নষ্ট হয়ে গেল তাঁর–অকালে বুড়ো হয়ে কী অবস্থায় মরছেন দেখতে তো পাচ্ছ। কী লাভ এমন এর দোরে ওর দোরে ঘুরে বেড়িয়ে আড্ডা দিয়ে বলতে পার?’

‘তুমিও এই কথা বলছ? আমি আসি সেটা পছন্দ কর না?’ আহত কণ্ঠে বলে হেম।

‘ছিঃ! সে কথা বলছি না। কিন্তু তুমি কি পেলে? দুটো মুখের কথা, হাসি, গল্প–এই তো? বুকে হাত দিয়ে বল দিকি! সুখ তোমার অন্যত্র। ঘরে সুখের সরোবর টলমল করছে–তা ফেলে আদারে-পাঁদাড়ে খানা-ডোবায় ডুবতে যেও না। অনেক ভাগ্য ক’রে অমন বৌ পেয়েছে। আমার মতো রূপ নয়–সে আমিও জানি। এও জানি–তোমাকে বলেই বলছি, লোকে শুনলে অহঙ্কার বলবে–আমার মতো রূপ পথেঘাটে পড়ে থাকে না! তা নিয়ে আপসোস ক’রে লাভ নেই! যা পেয়েছ তাও কম না। তা ছাড়া ওর মনটা বড় ভাল, বড় বুদ্ধিমতী মেয়ে। ওকে সুখি করো–তার চারগুণ সুখ তোমার লাভ হবে।

আহাওয়াটা কেমন যেন বিশ্রী হয়ে গেল! থমথমে গম্ভীর।

এই জন্যে কি তিন সপ্তাহ পরে ছুটে এল সে আড্ডা দিতে? ঘড়িটার দিকে তাকিয়ে দেখলে সে একটা বেজে গেছে। হঠাৎ উঠে পড়ল।

রাণীবৌদি হেসে বললে, ‘এখন কোথায় চললে তাও জানি। আমার কথা পছন্দ হ’ল না–কিন্তু একদিন বুঝবে। সেদিন না হায় হায় করতে হয়! আমি খুব বোকা নই–আমার কথাটা একেবারে উড়িয়ে না দিয়ে ভেবে দেখো।

‘তুমি বোকা? তোমাকে যে বোকা বলে–শুধু সে-ই বোকা নয় তার ঝাড়বংশে বোকা। গুপ্তকবির কবিতা–তুমিই শোনাচ্ছিলে না সেদিন? আচ্ছা এখন আসি–’

হেসে,. কথাটাকে হাল্কা ক’রে দিয়ে বেরিয়ে পড়ে হেম। আর মুহূর্তেও যেন ওর সামনে থাকতে সাহস হয় না। সাংঘাতিক মেয়ে। ঠিক কতটা জানে আর কতটা ওপর-চাপ–সেটুকু খোঁজ করতেও সাহসে কুলোয় না ওর।

হেম সেখানে থেকে বেরিয়ে সোজা নলিনীর বাড়িতেই যায়। রাণী ধরেছিল ঠিকই। হয়তো ঘড়ির দিকে তাকানো থেকেই বুঝতে পেরেছিল। কিন্তু এ যাওয়াতে দোষ নেই। বিয়ের পর আরও কয়েকবার এসেছে। বসে গল্প ক’রে খেয়ে চলে গেছে। কিরণ ফিরেছে কাশী থেকে–তবে সে কিরণ আর নেই–এখন ঝাঁজ অনেকটা কমে গেছে। হেমকেও সে আর অপছন্দ করে না। বরং এক-এক দিন সেও বসে গল্প ক’রে যায় খানিকটা।

আজ অবশ্য কিরণ ছিল না। নলিনী একাই ছিল। এটা ওটা খুচরো গল্প, কিছু থিয়েটারের গল্প করে–নলিনী এখন আবার থিয়েটারে যাচ্ছে, অন্য থিয়েটার–হঠাৎ হেমের বিয়ের প্রসঙ্গে চলে এল। বললে, ‘দ্যাখ হেমবাবু, সেদিন থেকে একটা কথা কইব কইব ক’রে আর বলা হয়ে ওঠে নি। অবিশ্যি বিয়ের কনে দেখেছি সেই এক দিন–কিন্তু বৌ তুমি বাপু ভাল পেয়েছ। তুমিই জিতেছ। আমি তো বলব অমন বৌ পাওয়া তোমার ঠিক হয় নি। তা তুমি এখনও এমন ক’রে এর দোরে ওর দোরে আড্ডা দিয়ে বেড়াও কেন?

‘তবে কি দিনরাত বোয়ের কাছে ধন্না দিয়ে বসে থাকব?’ বিরক্ত হয়ে ওঠে হেম।

‘তা বলি নি, তুমি রাগ ক’রো না। ঘরবাসী তুমি ঠিক হও নি। অনেক দেখলুম, মানুষের দুখ দেখলে বুঝতে পারি। এখনও বাউণ্ডুলে আছ। আর কেন? ঘরে লক্ষ্মী এসেছেন, ঘরবাসী হও গে। যেদিন দেখব তাঁর তৃপ্তি তোমার মুখে ফুটেছে–সেদিন বুঝব তুমি যথার্থ ঘরবাসী হয়েছ। সেদিন দুদিন দুরাত আড্ডা দিলেও দোষ হবে না!’

হেম এই প্রসঙ্গটাতেই কেমন অস্বস্তি বোধ করে। দু-একটা অন্য কথা পাড়বার চেষ্টা করে কিন্তু আর যেন আলাপটা ঠিক জমে না। শেষে সে সেখান থেকেও উঠে পড়ে।

‘ও কি-এরই মধ্যে চললে কোথায়?’

‘ঘরে। ঘরবাসী হতে!…তুমিই তো উপদেশ দিলে!’ ঈষৎ তিক্ততা ফুটে ওঠে ওর গলায়।

খপ ক’রে ওর কনুইটা ধরে ফেলে নলিনী, ‘অমনি বাবুর রাগ হয়ে গেল বুঝি? আচ্ছা, আচ্ছা হয়েছে, আর কিছু বলব না, আমার ঘাট হয়েছে, বসে যাও একটু।

‘হেম এবার হেসে ফেলে। বলে, ‘তা নয়, বাবার অসুখ তো খুব–তিন শনি-রবিবার তো বেরোতেই পারি নি। সকাল ক’রে ফিরতেই হবে। আর এক দিন তখন আসব।‘

‘অসুখের নাম করলে কী বলব আর! মিথ্যে বলে থাক তো তোমার ধৰ্ম্ম জানে। এসো তা হলে, দুগ্‌গা দুগ্‌গা!’

তবু তখনই ঠিক বাড়ির পথ ধরতে পারে না হেম। তখনও বেলা রয়েছে বেশ। শীতের সূর্যও পাটে বসে নি। কী ভেবে সে পায়ে পায়ে তার পুরনো থিয়েটারের আড্ডাতেই গিয়ে ওঠে

সেদিন শনিবার, সকাল করেই থিয়েটার আরম্ভ হবে। গেট-কীপাররা এসে গেছে সকলেই। আর থিয়েটার না থাকলেও এসে এখানেই জড়ো হয় ওরা। হেমকে দেখে সকলেই হৈ হৈ ক’রে উঠল। দক্ষিণাদার মুখে ওরা বিয়ের খবর পেয়েছে। কানাই বলে, ‘কী বাবা–সিংকিং সিংকিং ড্রিংকিং ওয়াটার শিবস ফাদার ডোন্ট্ নো!…ওসব চলবে না–একদিন ভাল ক’রে খাওয়াও! আর এক দিন কেন, আজই হোটেলে বলে দাও–ঢাকাই পরোটা আর কোর্মা!

নন্দ বাধা দিয়ে বললে, ‘দূর! এ হোটেলে তো খাচ্ছিই এক-ঘেয়ে খাওয়া। টাকা ছাড়ক, এক দিন কোন চীনে হোটেলে খাওয়া যাক। ওদের ওখানে ভাত- ভাজা নাকি খুব ভাল করে–কুঁচো চিংড়ি ফোড়ন দিয়ে!’

‘দ্যুস্!’ কানাই উড়িয়ে দেয়, ‘পয়সা খরচ ক’রে আবার কেউ কুঁচো চিংড়ি ফোড়ন খেতে যায়। ওই তো দু’বেলাই খাচ্ছি। আর কি জোটে বল–চার পয়সায় কুঁচো চিংড়ি এই তো বাস্তুদেবতা অরে ভাত-ভাজা–সেও হামেশা–ভাত বেশি হলেই বৌদি ঐ কম্ম করে–তেলের ওপর প্যাজ কুচিয়ে দিয়ে ভেজে নেয়! বলে খাও চীনেবাজারী পোলাও। …না না, আমার এই ঢাকাই পরোটাই ভাল।’

‘হবে হবে। এক দিন হবে।’ বলে কাটিয়ে দেয় হেম, ‘বাবার খুব অসুখ যাচ্ছে–এখন-তখন অবস্থা।’

বলেই ভুলটা বুঝতে পারে হেম। কানাই সঙ্গে সঙ্গে কুট ক’রে বলে ওঠে, ‘বাবার এখন-তখন অবস্থা আর তুমি থ্যাটারে বসে আড্ডা দিচ্ছ। ভ্যালা মোর বাপ্‌রে।’

‘না, এই দিক দিয়ে যাচ্ছিলুম তাই।’

বলেই সরে পড়বার চেষ্টা করে। কিন্তু সরে পড়া হয় না। দক্ষিণাদার সামনে পড়ে যায়। দক্ষিণাদা বলেন, ‘কী রে–তোর বাবার অসুখ বলছিলি না? আমার কানে গেছে ঠিক–বাপের অসুখ আর তুমি এখানে শনিবার বজায় দিতে এসেছ?’

‘না–না–এদিক দিয়ে যাচ্ছিলুম–তাই একটু খবর নিতে–’

‘হাওড়া থেকে হাওড়ায় ট্রেন ধরবে–এদিক দিয়েই বা যাও কেন?… দ্যাখ্ আমি তোর সব খবর রাখি, কেন যে একটা মায়া পড়ে গেছে তা জানি না, তুই রাগ করিস তবু না বলে থাকতে পারি না…তুই এখনও রাত নটা-দশটা অবধি টো-টো ক’রে পথে পথে ঘুরিস প্রত্যহ–বহু লোক তোকে দেখতে পেয়ে আমাকে এসে বলেছে। নলিনীর কাছেও মাঝে মাঝে যাস শুনেছি। ওর ভাড়াটে রেণু আমাদের এখানে বেরোচ্ছে তো–সে-ই এসে বলে। কেন রে? বৌ মনে ধরে নি? দিব্যি খাসা বৌ তো দেখে এলুম। ওরে অমন করিস নি–ছেলেবেলায় যা ছোঁক ছোঁক করেছিস করেছিস–এ বয়সে আর ঘুরে বেড়াস নি। আমার কথা শোন, ঠেকে শেখা আমার। ঘরে মন বসা। এখন যদি ঘরে না আটকে যাস তো চিরকাল আমার মতো এই রকম ভেসে ভেসে বেড়াবি–জোয়ারের গুয়ের মতো কোন ঘাটে ঠাঁই হবে না। যতই হোক ঘরের বৌ–দোষ হোক ঘাট হোক সে ফেলতে পারবে না।’

কী বিপদ! আজ কার মুখ দেখে কলকাতায় পা দিয়েছিল কে জানে।

তার ভুরু কোঁচকানো দেখেই দক্ষিণাদা মনের ভাবটা বুঝতে পারেন, ‘কী পছন্দ হ’ল না তো কথাটা! রাগ হয়ে গেল তো।’

‘আপনার কথায় কবে রাগ করি দক্ষিণাদা, আপনি যে আমার ভালর জন্যেই বলেন তা এখন অন্তত খুব বুঝি। মনটাই ভাল নেই? চলি এখন!’

তবু ঠিক তখনই হাওড়ায় গেল না। পোস্তা ঘুরে পাঁচ সের আলু কিনে এটা সওদা ক’রে হাওড়ার মোড়ে কপি দর ক’রে ছটার ট্রেনে যখন সে বাড়ি ফিরল তখন বেশ অন্ধকার হয়ে গেছে। বেশ নিশ্চিন্ত মনেই ফিরছিল–হঠাৎ ওদের বাড়ির সামনের রাস্তায় পড়েই মনে হ’ল বাইরের ঘরে যেন বড় বেশি লোক। হ্যারিকেনের স্তিমিত আলো–তবু বাইরের জমাট বাঁধা অন্ধকার যে তাইতেই অত দূর থেকেও অনেকগুলো মাথা নড়বার আভাস পাওয়া গেল।

উদ্বিগ্ন হয়েই জোরে জোরে পা চালাল সে। বাড়িতে ঢুকে বাগানটা পেরোতে পেরোতেই নজরে পড়ল পুকুরের ধারে কে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। একটু চমকেই উঠত হয়তো–অমন সাদামত কী-নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে আছে অন্ধকারে দেখে–কিন্তু সেই মানুষটাই ওকে চিনতে পেরে প্রায় ছুটে কাছে এল, ‘ওগো, আজকেই কি এত দেরি করতে হয়! দ্যাখ গে, বাবার বোধ হয় শেষ অবস্থা–’

কনক। এর আগে কোন দিন ‘তুমি’ বলে নি সে। প্রথম দিন আপনি বলেছিল, তারপর আর বিশেষ প্রয়োজনই হয়নি, সামান্য যা কথা হয়েছে তাতে তুমি আপনি এড়িয়ে গেছে। আজকের এই উদ্বেগের মধ্যেও সেটাও লক্ষ্য করে হেম।

আলুর পুঁটলিটা ছুঁড়ে রকে ফেলে দিয়ে ঘরে ঢুকল সে। এসেছে অনেকে। প্রমীলার কোলে কচি ছেলে সে আসতে পারে নি–মহা এসেছে, তরলা এসেছে, তিন ভাই-ই এসেছে অভয়পদরা। অম্বিকাপদ মাথার কাছে বসে চেঁচিয়ে গীতা পাঠ করেছে। অর্থাৎ শেষ অবস্থারই আয়োজন যে তাতে কোন সন্দেহ নেই।

হেম একটু বিহ্বল হয়েই চাইল অভয়পদর দিকে।

‘হঠাৎ কী হ’লো এমন–। এই তো আমি দেখে গেলুম–কৈ তেমন তো কিছু–‘

অভয়পদ বাইরে গিয়ে সংক্ষেপে ব্যাপারটা বলল। এরা কেউই টের পায় নি। আজকাল প্রায় ঝিমিয়ে পড়ে থাকতো, সেই রকমই ছিল। আজকাল ঘুমোলে নরেনের একটু নাকডাকার মতো আওয়াজ হ’ত। নিঃশ্বাসের সঙ্গে যে আওয়াজটা হচ্ছিল, সেটাকেও ওরা নাকডাকার শব্দই ভেবেছিল। শ্যামা অনেক মৃত্যু দেখেছে কিন্তু সে-ও ধরতে পারেনি। অভয়পদ এসেছে চারটে নাগাদ, সে ঘরে ঢুকেই বুঝেছে শ্বাসের শব্দ এটা। ছুটে গিয়ে ডাক্তার ডেকে এনেছে। তিনিও বলে গেলেন যে তাই–আর খুব বেশি বিলম্ব নেই। তখন যতটা সম্ভব সকলকে খবর দিয়েছে। শুধু কান্তিকে খবর দেওয়া যায় নি। আর তরু পোয়াতি–তার দিদিশাশুড়ি পাঠায় নি।

পাথর হয়ে গিছল হেম।

শোক? ঠিক শোক নয় হয়তো–কেমন একটা বিমূঢ়তা। হাত-পায়ের জোরটাই কেমন যেন কমে গেছে।

ভেতর থেকে অম্বিকাপদ ডেকে বলে, ‘হেম, এবার তোমার শেষ কাজটা কর, মুখে একটু জল দাও আর তারক-ব্রহ্ম নামটা–’

‘হেম’ শব্দটা কানে যেতে সহসা মৃত্যু-পথযাত্রী যেন নড়ে একটু ওঠে 1 ঠোঁটটা কাঁপে তার। একটু চেষ্টার পর চোখটাও খুলে যায়।

‘আহা রে। ছেলেকে দেখবার জন্যই প্রাণটা এতক্ষণ ছিল’–কে একজন মহিলা বলে ওঠেন। সম্ভবত পাড়ার কেউ।

গলা জড়িয়ে গেছে। আওয়াজটাও নাকী হয়ে উঠেছে। নাকটা ভেঙে গেছে নিচের দিকটা–

‘কে’ হেম? মানে আমাদের হেমচন্দর? কৈ বাবা? কোথায়?

হেম ছুটে গিয়ে মুখে কাছে উপুড় হয়ে বসে।

‘কিছু বলবে আমায়?’

‘না’ কী আর বলব। তুমি জ্ঞানবান ছেলে। সুপুত্তুর। মাগীকে দেখো–অবিশ্য ও ভাঙবার মেয়ে নয়। …পথের ভিখিরী করেছিলুম–আবার কেমন বাড়িঘর করেছে দেখছ না। ও খুব শক্ত মেয়েমানুষ। তবে কঞ্জুষ হয়ে যাচ্ছে, হাড় কঞ্জুষ। বৌমাকে দেখো, আর মেয়েগুলোকে। আমার বলাও হয়তো বৃথা, না বললেও দেখবে। বৌমা বড় লক্ষ্মী মেয়ে। ওকেই দেখো। মাগী ওকে জ্বালাবে। আর ঐ খেঁদীটা।’

জড়িয়ে জড়িয়ে হাঁপিয়ে হাঁপিয়ে বলে আবার হঠাৎ চুপ ক’রে যায়।

‘তাউই মশাই, তাঁকে ডাকুন। ভগবানকে ভাবুন। হেম নাম কর!’ অম্বিকা জোরে জোরে বলে।

হেম নাম করতে থাকে। পাশ থেকে অভয়পদও করে।

নরেন যেন একটু বিরক্ত হয়।

‘আ মলো, কানের কাছে চেঁচায় দেখ না। একটু ঘুমোতেও দেয় না। ‘

চুপ ক’রে যায় আবার

এবার কণ্ঠশ্বাস শুরু হয়েছে, শুধু নালির কাছটা ধুক ধুক করছে।

আরও আধঘণ্টা খানেক এইভাবে কাটল। হেম একটু জল দেবার চেষ্টা করল, সে জল পুরোটা গলায় গেল না–কষ বেয়ে গড়িয়ে পড়ল।

তারপর আবার একটু প্রাণের লক্ষণ দেখা দিল মুমূর্ষুর। ঠোঁট দুটো আবার কাঁপতে শুরু করল।

কে একজন বললেন, ‘শোন শোন, কী বলছে শোন–’

হেম অভয় দুজনেই ঝুঁকে পড়ল মুখের কাছে।

ক্ষীণ, অতিক্ষীণ শব্দ, তবু কথাগুলো বুঝতে পারা যায় শেষ পর্যন্ত।

‘ওরে কে কোথায় আছিস বাবারা, আমাকে বাড়িটা একটু দেখিয়ে দিবি? শুনেছি নতুন বাড়ি করেছে, খুব ভাল বাড়ি! দে না বাবা কেউ দেখিয়ে, আমি যে আর ঘুরতে পারছি না!’

আবার চুপ ক’রে যায়।

গলার কাছের নড়াটাও বন্ধ হয়ে আসে এবার। শুধু নাকের কাছটা কাঁপতে থাকে।

সেটাও একসময় স্থির হয়ে গেল।

চির অশ্রান্ত চির অস্থির, ভবঘুরে পথিকের পায়েও বুঝি শ্রান্তি নেমেছে এবার! এবার সে আশ্রয় খুঁজছে একটু। আশ্রয় আর বিশ্রাম। কে জানে ইহলোকে যা মিলল না–পরলোকে গিয়ে তা মিলবে কি না। গৃহহারা তার যথার্থ গৃহ খুঁজে পাবে কি না।

.

শবযাত্রীরা শব নিয়ে চলে গেছে অনেক্ষণ। স্ত্রী-কন্যাদের হাহাকারও শান্ত হয়ে এসেছে অনেকটা। কাল পাড়ার অনেকেই এসেছিলেন, সকাল হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই তাঁরা ধোওয়া-মোছার কাজে লেগে গেছেন। এক বিধবা মহিলা শ্যামাকে ধরে বাইরের সিঁড়িতে বসে আছেন। ওরা ফিরলে শেষ কাজটুকু তাঁকেই সারতে হবে।

আর কোন কাজ নেই। পাগলকে নিয়ে, রোগীকে নিয়ে আর ব্যস্ত থাকতে হবে না। ক্লান্ত শিথিল পায়ে কনক এসে রান্নাঘরের পিছনে জানলাটার কাছে দাঁড়াল। অদ্ভুত একটা শূন্যতা বোধ করছে সে। এখনও এদের কাউকে আত্মীয় বলে ভাবতে পারে নি। আবাল্য যে পরিবেশ সে দেখেছে, তার সঙ্গে কিছুই মিল নেই এখানকার। সম্বন্ধ আছে ঠিকই–কিন্তু তবু কেউই আজ পর্যন্ত আপন হয়ে উঠতে পারে নি এটাও ঠিক। একমাত্র যে জোর ক’রে খানিকটা স্নেহ আদায় করেছিল সেও চলে গেল। এ যে ওর কী একটা মনোভাব তা–ও নিজেই ভাল ক’রে বুঝতে পারছে না যেন। কে জানে এবার সে কাকে নিয়ে জীবনের আশ্রয় রচনা করবে। সে কোথায় খুঁজে পাবে তার বাসা।

তরলা এসে পাশে দাঁড়াল।

‘খুব ফাঁকা ফাঁকা লাগছে–না ভাই? এক বছর ধরে সেবাশুশ্রূষা করা–নাড়া-ঘাঁটা–ফাঁকা তো লাগবেই। অসহায় অবুঝ বুড়ো মানুষ–অনেকটা ছোট ছেলের মতোই তো হয়ে যায়। বড় মায়া পড়ে কিন্তু–’

তা বটে। ছেলেই ছিল তার। কাল সকালে নরেনই সেকথা স্বীকার ক’রে গেছে।

কথাটা মনে পড়ে গেল কনকের। কাল সকালবেলাই–বার্লি খাওয়াতে গিয়েছিল সে, অত্যন্ত ধূর্তের মতো এদিক ওদিক তাকিয়ে নিয়ে নরেন বলেছিল, ‘শোন্ মা একটু–এক মিনিট এদিক আয়। একটা কথা বলে যাচ্ছি মা। বাইরের ঐ পগারধারে নোনা গাছটার গোড়ায় সাড়ে এগারোটা টাকা পোঁতা আছে। মাগীকে দিই নি, ওর তো রাঘববোয়ালের হাঁ, পেটে পড়লে আর বেরোত না। ভেবেছিলুম যদি একটু সুস্থ হয়ে উঠতে পারি, পায়ে একটু জোর পাই তো ঐ কটা টাকা পুঁজি ক’রেই আবার সরে পড়ব। তা আর হ’ল না দেখছি। কটা টাকা তুইই নিস মা। তোকেই মা বলেছি, তুই আমার যথার্থ মা। নিজের মাকে তো কোন দিন হাতে তুলে দিলুম না একটা পয়সাও, চিরজন্ম তারই যথাসর্বস্ব দোহন করে গেলুম উল্টো। তবু তুই নিলে একটু শান্তি পাব। নিধি তো–দ্যাখ মরার আগে সব বন্ধন খুলে দিয়ে যেতে হয়, কিছু রেখে যেতে নেই। বল্ আমাকে কথা দে–ওটা তুই খুঁড়ে বার ক’রে নিজের বলে নিবি?’

কথা দিয়েছিল কনক

নেবেও সে একসময়। যদি এর মধ্যে বাপের বাড়ি যেতে পারে তো ঐ টাকায় সেখানে মনের মতো ক’রে দুটি-তিনটি ব্রাহ্মণ খাইয়ে দেবে। সর্ববন্ধন থেকে মুক্তি দিয়ে দেবে সে।

***

এই উপন্যাসে বর্ণিত প্রধান পাত্রপাত্রীগণ

রাসমণি–কমলা, শ্যামা ও উমার মা।

কমলা–রাসমণির বড় মেয়ে।

গোবিন্দ–কমলার ছেলে।

কালীতারা–গোবিন্দর প্রথমপক্ষের স্ত্রী।

রাণী–গোবিন্দর দ্বিতীয়পক্ষের স্ত্রী।

শ্যামা–রাসমণির মেজ মেয়ে।

নরেন–শ্যামার স্বামী।

দেবেন–নরেনের দাদা।

রাধারাণী–দেবেনের স্ত্রী।

হেম–শ্যামার বড় ছেলে।

কান্তি–শ্যামার বড় ছেলে।

মহাশ্বেতা–শ্যামার বড় মেয়ে।

ঐন্দ্রিলা–শ্যামার মেজ মেয়ে।

তরু–শ্যামার ছোট মেয়ে।

কনক–হেমের স্ত্রী।

নলিনী–জনৈকা অভিনেত্রী।

দক্ষিণা–থিয়েটারের জনৈক কর্মচারী।

পূর্ণ মুখুয্যে–কনকের বাবা।

ক্ষীরোদা–মহাশ্বেতার শাশুড়ি।

অভয়পদ–মহাশ্বেতার স্বামী

অম্বিকাপদ–মহাশ্বেতার মেজ দেওর।

দুর্গাপদ–মহাশ্বেতার ছোট দেওর

লীলা–মহাশ্বেতার ভাসুরঝি।

প্রমীলা–অম্বিকাপদর স্ত্রী।

তরলা–দুর্গাপদর স্ত্রী।

রতন–অভয়পদের মামাতো বোন।

মোক্ষদা–রতনের ঝি।

মাধব ঘোষাল–ঐন্দ্রিলার শ্বশুর।

হরিনাথ–ঐন্দ্রিলার স্বামী।

শিবু–ঐন্দ্রিলার মেজ দেওর।

অক্ষয়–নরেনদের আশ্রয়দাতা যজমান।

মঙ্গলা–অক্ষয়বাবুর স্ত্রী।

পিঁটকি–মঙ্গলার মেয়ে।

উমা–রাসমণির ছোট মেয়ে।

শরৎ–উমার স্বামী।

গোলাপী–শরতের রক্ষিতা।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *