২০. অঘ্রানের গোড়াতেই নরেন

বিংশ পরিচ্ছেদ

॥১॥

অঘ্রানের গোড়াতেই কোথা থেকে নরেন এসে পড়ল। স্বামীকে দেখে এত আনন্দ বোধ হয় শ্যামার কখনও হয় নি। একা একা এত বড় বাড়িতে থাকা সারা দিন, আর ভূতের মতন পরিশ্রম ক’রে যাওয়া–এ যেন আরও পেরে উঠছে না কিছুতেই! তেমনি হেমেরও হয়েছে আজকাল–রোজই ফিরতে রাত হচ্ছে। তাও যদি ওপরটাইম ক’রে রাত করত তো শ্যামার একটা সান্ত্বনা থাকত। দুটো পয়সা আসত তাতে। এ শুধুই আড্ডা, জিজ্ঞাসা করলে বলে, ‘ এই বন্ধু বান্ধবদের সঙ্গে দুটো গল্পগুজব করছিলুম।’ কিন্তু শ্যামা জানে বন্ধু বান্ধব কিছুই নয়, প্রত্যেহ সে আজকাল বড় মাসীর কাছে যায়। টানটা কোথায় তাও বোঝে। ওর বয়স হয়েছে ঢের, মানুষ দেখে দেখে কিছুই আর বুঝতে জানতে বাকি নেই। ‘ডব্‌কা হ’ল ছোঁড়া তো ছুঁড়ীর হ’ল গোঁড়া!’ যে বয়সের যা। ঐদিকে টান না হলে আর প্রত্যহ হাওড়া থেকে সিমলে, সিমলে থেকে হাওড়া হাঁটতে পারত না। সবই জানে শ্যামা–তবে এ নিয়ে কেজিয়া করতে ইচ্ছে করে না। সম্পর্কটা বড্‌ড তেতো হয়ে যায়। তা ছাড়া ভয়েরও কিছু নেই। বৌমা ঠিক সে ধরনের মেয়ে নয়, সুযোগ অবসরও কম ও বাড়িতে। দিদি তো দিনরাত বাড়িতে বসে। কথা গান কীর্তন এসব শুনতেও কখনও কোথাও যায় না। আর সব চেয়ে বড় কথা, পয়সা খরচ নেই! মাসের শেষে মাইনের পাই পয়সা এনে ধরে দেয় হেম। মাসকাবারী টিকেটের টাকা আর যখন যা দরকার হয় বলে চেয়ে নেয়। এ ছাড়া আট আনা চার আনা নেয় মধ্যে মধ্যে–বলে, ‘বন্ধু বান্ধবরা পাঁচদিন খাওয়ায়, তাদের না খাওয়ালে চলে না। তা আমি আর কি খাওয়াই–বেগুনি প্যাজের বড়া বড় জোর!’ শ্যামা হাসে মনে মনে–বেগুনি প্যাজের বড়া ছাড়া ও পয়সাতে কিছু কেনা যায় না ঠিকই, বড় জোর দুখানা হিংয়ের কচুরি–কিন্তু সেটা যে কোথায় যায় তাও শ্যামা জানে। বৌমা ভরা পোয়াতি।

এই অবস্থায় নরেনকে পেয়ে যেন বেঁচে গেল ও।

কিন্তু ও কী অবস্থায় এল সে!

.

রোগা কাঠি হয়ে গেছে। পেটটা জয়ঢাক। হাত-পাগুলো ফোলা ফোলা, মাথার চুল একেবারে পাতলা হয়ে গেছে। চোখের কোল ফুলেছে। সদ্য শোথের লক্ষণ।

শঙ্কিত হয়ে উঠল শ্যামা, বুকের মধ্যেই ঢিক্ ক’রে উঠল সেদিকে চেয়ে–যতই হোক লোকটা আছে তাই হাতের লোহাগাছটা আছে, সিঁথিটাও সাদা নেই। সাতপাতের কুড়িয়ে যা-তা খেয়েও চলে যাচ্ছে। রোদে পুড়ে, জলে ভিজে, সারাদিন বাগানে ঘুরে, গাছে ঠেকো দিয়ে আর পাতা কুড়িয়ে, যা ছিরির চেহারা হয়েছে–এর পর শুধু হাত আর সাদা সিঁথি হলে একেবারেই কাঠকুডুনী বলবে লোকে। তার চেয়েও বড় কথা হ’ল লোকটা পাজী হোক, বদমাইশ হোক–চিরজন্মের সাথী! অন্য কোন পুরুষের দিকে চাইবার কখনও অবসরও হয় নি, প্রবৃত্তিও হয় নি। আশা আকাঙ্ক্ষা না হোক, জীবনের কামনা বাসনার দিকেও যদি কখনোও ক্ষণকালের জন্যও কোন আনন্দ কোন তৃপ্তি পেয়ে থাকে তো–এই লোকটাকে উপলক্ষ ক’রেই পেয়েছে। এখনও তাই কোথায় মনের গোপন কোণে একটু একটু কোমলতা একটু মায়া আছে লোকটা সম্বন্ধে।

কিন্তু মনে যাই হোক, মুখে বেশ খানিকটা বিদ্রূপের ভঙ্গিতেই বলে, ‘বাঃ চেহারা তো বেশ খুলিয়ে আসা হয়েছে দেখছি, এবার আর কি–খাটে তুললেই তো হয়!’

কে জানে কত দূর থেকে হেঁটে এসেছে, ক্লান্ত দেহে হেঁটে আসার ফলে হাপ্পরের মতো হাঁপাচ্ছিল নরেন, কোনমতে রান্নাঘরের দাওয়াটাতেই বসে পড়ে হাঁপাতে হাঁপাতে বলে, ‘হুঁ! তো তেমন অবস্থা না হলে আর এ যমপুরীতে আসবই বা কেন!’

‘বলি স্বগপুরীতে থেকেই তো এমনি চেহারা খুলিয়ে আসা হয়েছে, তা সেখানে আর কটা দিন চেপে থাকলেই তো একেবারে খাঁটি স্বগে চলে যেতে পারতে। মিছিমিছি এ যমপুরীতে কষ্ট করতে আসবার কী দরকার ছিল!’

‘নইলে তো স্ববাসের উপায় হয় না যে। দিনকতক সোয়ামীর গু-মুত খাট, নাইলে পরলোকে গিয়ে কি জবাব দিবি?’

তার পর হাতের ময়লা পুঁটলিটা এগিয়ে দিয়ে বলে, ‘নে চুপ কর্ এখন–আসা-মাত্তর ফ্যাচফ্যাচানি শুরু করেছে! একটু তামাক সাজ দিকি! ঐতে সব আছে–’

‘হ্যাঁ, তা আর নয়। মেয়েরা কেউ নেই–এক হাতে জুতো সেলাই চণ্ডীপাঠ সব করছি, তার মধ্যে তোমার তামাক সেজে দিতে বসি! ওসব চলবে না, খেতে হয় সেজে খাও। …কত্তার মতো রোজগার করব, বিষয়-সম্পত্তি দেখব, গিন্নীর মতো রান্নাবান্না করব, ঝিয়ের মতো ঘরবাড়ির পাট করব, বাসন মাজব, ক্ষার কাঁচব, আবার খানসামার মতো তামাক সাজতে বসব–এমন নিকড়ে গতর আর নেই, আমারও বয়স হয়েছে!’

‘মাইরী দে বামনী, এতটা হেঁটে এসে–তবু বসতে বসতে এসেছি, এই সিদ্ধেশ্বরীতলাতেই আধ ঘণ্টার ওপর বসতে হয়েছে–তাও হাঁপ ধরেছে দেখছিস বুকের মধ্যে যেন ঢেঁকির পাড় পড়ছে। এইবারটি অন্তত সেজে দে, এখন আর পারছি না, চোখে যেন ধোঁয়া দেখছি সব!’

.

অগত্যা শ্যামা পুঁটলিটা খুলে নেয়। নরেনের একটা হুঁকো বাড়িতেই থাকত, সেটা ওখান থেকে এখানে আনতে ভোলে নি শ্যামা, কিন্তু তামাক নেই ঘরে! কলকেটাও ভেঙে গেছে একদিন পড়ে গিয়ে–নরেন আর আসে না, এনে রাখবার কথাও মনে হয় নি তাই। তা ছাড়া হুঁকো কলকে তামাক সর্বদা তার সঙ্গেই থাকে–বলতে গেলে ঐগুলোই যথার্থ তার জীবনের সাথীসঙ্গী–সুতরাং জানত যে সে এলে নতুন কলকেও আনবে।

‘তা সে আঁটকুড়ীর বেটীরা গেল কোথায় সব?’ একটু দম নিয়ে এবং শ্যামা তামাক সাজতে বসায় কতকটা নিশ্চিন্ত হয়ে–প্রশ্ন করে নরেন।

‘যাবে আবার কোথায়, যে যার শ্বশুরবাড়ি। তরুর বিয়ের আগে খেঁদি রাগ ক’রে নিজের শ্বশুরবাড়ি চলে গেছে। এখন তাদের কন্না করার লোক চাই তো–বড় বোয়ের নাকি তাই খুব আদরও হয়েছে।’

‘তরুটারও বে হয়ে গেছে! ইস্। জানতে পারলে আসতুম। কত কাল যে বিয়ে-বাড়ির খ্যাট জোটেনি অদেষ্টে!’

‘মুখে আগুন! নিজের মেয়ের বে, তা কেমন পাত্তর হ’ল, কোথায় পড়ল তা জিজ্ঞেস করা চুলোয় গেল–খ্যাটের চিন্তা। ঐ তো চেহারা, উদুরী ধরিয়ে বসে আছ যা বুঝতে পারছি–খ্যাটে হজম হ’ত?’ মুখনাড়া দিয়ে বলে শ্যামা।

কিন্তু যে ধরনের উত্তর আশা করেছিল ওদিকে থেকে সে ধরনের উত্তর এল না। খালি উঠোনের কাঁঠাল চারাটার দিকে কেমন এক রকম অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকেই হাত বাড়িয়ে হুঁকোটা নিতে নিতে বললে নরেন, ‘কোন ছেলেমেয়েরই কখনও খবর নিলুম না, আজ আর নিয়ে কি করব বল্। যা ভাল বুঝেছিস করেছিস–যেমন পাত্তর জুটেছে দিয়েছিস–অদেষ্টে থাকে ভোগ করবে, আর তোর মতো পোড়া বরাত হয় তো জ্বলবে। আমার শাশুড়ি মাগীও তো খারাপ দেখে দেয়নি। তোর কী হাল হ’ল তা তো দেখলিই। ও নিয়ে আর আমি ভাবি না।’

ওর কথা বলবার ধরনে একটা কী ছিল, শ্যামা কেমন যেন থমতম খেয়ে গেল, হঠাৎ কিছু জবাব দিতে পারলে না।

.

নরেন কিছুক্ষণ নিঃশব্দে তামাক টানবার পর একটু সুস্থ হয়ে চারদিকে তাকিয়ে বললে, ‘বাড়িটা মন্দ করিস নি কিন্তু–মাইরি, তোর মাথা খুব। আমাদের যথাসর্বস্ব যখন গেল তখন যদি তুই একটু সেয়ানা হতিস, তা হলে হয়তো সব যেত না।

তার পর এর গোটা দুই টান দিয়ে বললে, ‘বরাত! বুঝলি সবই বরাত। নইলে অমন বুদ্ধি হবে কেন! তুই এখানে এই ইন্দির ভবন করেছিস তা তো জানি না–শুনেছি বাড়ি করেছিস, কিন্তু সে যে এমন পাকা বাড়ি, বাগান পুকুর তা ভাবি নি। ওঃ, যা কষ্ট গেল ক মাস! অসুখে ভুগেছি–এসময় কোথাও কেউ আশ্রয় দিতে কি চায়? পথে পথেই কাটল বলতে গেলে। হঠাৎ খেয়াল হ’ল তাই, লোককে জিজ্ঞেস ক’রে চলে এলুম। ভাবলুম কে জানে শরীরের এই অবস্থা–হয়তো কোথায় কোনদিন থুবড়ে পড়ে থাকব–তোদের সঙ্গে দেখাও হবে না। আর বাড়ি একটা করেছিস যখন, একবার দেখেও নিই!

হঠাৎ যেন শ্যামার চোখে জল এসে যায়! বহুদিনের শুষ্ক রুক্ষ চোখে তপ্ত জল ভরে আসে। প্রাণপণে অন্যদিকে চেয়ে সে জল সামলে নেয় সে। তার পর গলাটা সহজ করার চেষ্টা করতে করতে অর্ধ-বিকৃত কণ্ঠে বলে, ‘কেন, রাজঅট্টালিকা না জানলে বুঝি আসতে নেই? যদি মাটির ঘরই হ’ত তাতে কি তুমি থাকতে পারতে না!

‘না, তা নয়।’ একটু যেন অপ্রতিভই হয়ে পড়ে নরেন–যা এর আগে আর কখনও ওকে হতে দেখেনি–বলে, ‘তা নয়। মনে হ’ত কোনমতে একটু হয়তো মাথা গোঁজার কুঁড়েঘর করেছিস–ছেলেমেয়ে, ঐন্দ্রিলাটা আছে মেয়েসুদ্ধ–তার মধ্যে কোথায় আর গিয়ে সেঁঘুব! শুধু অশান্তি বৈ তো নয়।’

.

দুঃখের মধ্যেও কুট্ ক’রে জবাব দেবার লোভ সামলাতে পারে না শ্যামা, ‘থাকতে তো তুমি কখনই আসতে না। পরের বাড়িতে–তাই তো এসেছ চলে গেছ এমন কতবার। তা নিজের বাড়ি না হয় দেখেই চলে যেতে!’

.

‘না রে–বুঝিস না। শরীর ভেঙে এসেছে। চিত্রগুপ্ত হুলিয়া বার করেছে এবার। কবে বলতে কবে এসে ক্যাক ক’রে চেড়ে ধরবে। এখন একটু একটু সেবা খাবারও লোভ হয়েছে। নিজেদেরে মধ্য এসে পড়লে আর হয়তো নড়তে চাইতুম না!’

.

আবারও বুকের মধ্যেটা কেমন ক’রে ওঠে শ্যামার! তাই, মনটাকে শক্ত করবার জন্যই বুঝি কর্কশ কথা টেনে আনে মুখে। বলে, ‘ সাতজম্মের পাপ তোমার–তাই! নিজের ছেলে, নিজের নাতনী–তার মধ্যে এসে থাকবে, একখানা ঘরই বা কি আধখানা ঘরই বা কি! আমরা যেমনভাবে মাথা গুঁজে থাকতুম তুমিও তাই থাকতে, তোমাকে কি তাড়িয়ে দেওয়া হ’ত! আপনার তো মনে করতে পারলে না কোন দিন, তার কি হবে!

নরেন আর জবাব দেয় না, অন্যমনস্কভাবে হুঁকোয় টান দিতে থাকে। কল্কের আগুন কখন নিভে এসেছে, ভেতরের তামাকও গিয়েছে পুড়ে ঠিকরে হয়ে তা বুঝতেও পারে না।

॥২॥

হেম যখন রাত্রে বাড়ি ফিরল তখন নরেন রান্নাঘরের দাওয়াতে খেতে বসেছে শ্যামা সামনে বসে খাওয়াচ্ছে।

দৃশ্যটা এতই অভাবনীয়–বিশেষত দরজার কাছ থেকে একটা দিক মাত্ৰ দেখা যাচ্ছিল নরেনের, ল্যাম্পের ক্ষীণ আলোতে সেভাবে চেনা সহজ নয়, আর নরেন এত দিন বাড়ি আসে নি, তাকে দেখার সম্ভাবনটাও ছিল সুন্দর কল্পনার বাইরে–কাজেই হঠাৎ একটা লোককে মা এত যত্ন ক’রে সামনে বসে খাওয়াচ্ছে, অথচ পরিচিত কেউ বলেও মনে হচ্ছে না–চমকে ওঠবারই কথা। হেমও চমকে উঠল। খানিকটা গলা-খাঁকারি দিয়ে দরজার কাছেই দাঁড়িয়ে গেল।

সেই আধা-আলোতে আধা-অন্ধকারে চিনতে পারলে না নরেনও। ওর সেই কাশির শব্দে ঘাড় ফিরিয়ে দেখেই চমকে উঠল, হাতের গ্রাস হাতেই ধরে ফিরে বসে প্রশ্ন কররে, ‘মশাই? চিনতে পারলুম না তো!’

পোড়া কপাল! এমনি সম্বন্ধই দাঁড়িয়েছে বটে, বাপ ছেলেকে চিনতে পারে না, ছেলে বাপকে চেনে না। ও তো থোকা।’

‘খোকা? ও, আমাদের হেমচন্দর?….এসো এসো বাবাজী, এসো। বাবুই বলি–রোজগেরে বাবু যখন!’

সে আবার ফিরে বসে মুখের গ্রাস মুখে তুলল।

বাপকে দেখে পুলকিত হবার কথা নয়, তবে বাবার কথাবার্তায় এবং মা’র ধরন-ধারণে সে একটু বিস্মিত হ’ল। এ যেন কেমন অন্যরকম সুর দু’জনেরই গলায়।

হেম আসবার সময় বড়বাজার থেকে খানিকটা ডালের ক্ষুদ কিনে এনেছে–শ্যামা এক-এক-দিন ভিজিয়ে বড়া করে, চালের ক্ষুদের সঙ্গে মিশিয়ে সরুচাকলিও–সেইগুলো নামিয়ে রেখে দাওয়ারই একপাশে বসল একটা পিঁড়ি টেনে নিয়ে।

‘উঃ–কত কাল পরে বাড়ি এলুম, তোমার জননীর হাতের রান্না খাব বলে–তা তোমার গর্ভধারিণী কোথা থেকে গাঁদাল পাতার ঝোল রেঁধে বসে আছেন–কাঁচকলা আর ডুমুর দিয়ে। তবে মাগী রাঁধে ভাল, অনেক দিন পরে খাচ্ছি বলে আরও–অমর্ত লাগছে যেন!’

‘তা কী করব–রোগটি তো বেশ ধরিয়ে এসেছ–শুধু কাঁচকলার মণ্ড খেয়েই তো থাকা উচিত।’

‘তুই রেখে বোস্ দিকি–কাঁচকলার মণ্ড খেয়ে থাকাচ্ছি আমি। একটি- দুটো দিন–এর বেশি আর এ পথ্যি চলছে না, ‘

খেয়ে উঠে শ্যামার হাত থেকে ঘটিটা নিয়ে আঁচাতে আঁচাতে বলে নরেন, ‘এবার আর একটু তামাক দে বাপু, উনুনে তো আা আছেই। বাস্তবিক, কীই বা বলি। একা এক হাতে। তা পুত্রের এবার বিবাহ দাও গিন্নী, আর কেন?’

‘ছেলে যে বিয়ে করতে চায় না!’

‘ছেলে চায় না! ছেলে আবার চাইবে কি? আমরা হলুম ওর অভিভাবক, আমরা সম্বন্ধ ঠিক করব–সুড় সুড় ক’রে গে পিঁড়িতে বসবে! ওর চাওয়া- চাওয়ির কি ধার ধারি!’

হেম বিরক্ত হয়ে উঠে দাঁড়ায়।

‘মা গামছাটা দাও। ঘাটে যাই। আর আমারও ভাত বাড়। বাজে কথা শোনবার সময় নেই ওসব।’

‘ও,-মিলিটারী মেজাজ! রোজগেরে বাবু যে। আচ্ছা, হচ্ছে হচ্ছে। মেয়ে আগে একটা লাগসই খোঁজ করি, তার পর দেখছি। মেজাজ বুঝছি। দে তামাক দে বামনী।

হাত বাড়িয়ে হুঁকোটা নিয়ে বাইরের ঘরের দাওয়ায় গিয়ে বসে! ঐখানেই ওর শোয়ার ব্যবস্থা ক’রে দিয়েছে শ্যামা।

হেম গামছা নিয়ে ঘাটে চলে গেল। তার বিস্ময়ের শেষ নেই। মা’র এত নরম হয়ে আসার কারণটা ঠিক বুঝতে পারছে না! নরেনের চেহারা খারাপ হয়ে গেছে এটা দেখেছে সে–কিন্তু সে খারাপ কতখানি তা বুঝতে পারে নি অন্ধকারে। আরও অবাক হচ্ছে সে বিধাতার যোগাযোগ দেখে। আজই রাণী বৌদি বলছিল, ‘সত্যি, মেসোমশাইকে কখনও দেখলুম না, বড্ড দেখতে ইচ্ছে করে। যে সব গল্প শুনেছি মা’র মুখে আর তোমার দাদার মুখে–দেখবার মত মানুষ বটে! কোথায় থাকেন একটু খোঁজ করো না ভাই–‘

‘জানলে তা খোঁজ করব। কোথায় থাকেন এক ভগবান ছাড়া কেউ জানে না।’

‘আচ্ছা–আসবেন তো এক দিন না এক দিন! খবর পেলেই আমি গিয়ে দেখে আসব, নয়তো ধরেই নিয়ে আসব এখানে! আমি গেলে ঠিক চলে আসবেন দেখো!’

‘এনে কি করবে? পুষবে?’ হেসে প্রশ্ন করেছিল গোবিন্দ।

‘ওমা পুষব কি কথা। মেসোমশাই গুরুজন। মাথায় ক’রে রাখব। তাতে দোষই বা কি?’

‘দোষ কিছু নয়। তবে ঘটিবাটি সাবধান। পোষ মানবার মানুষ সে নয়। ‘ছি ছি। কী বল যা-তা কথা। মুখের রাখঢাক নেই! ঠাকুরূপো বসে আছে, ওর বাবা তো বটে!…তা ছাড়া দ্যাখ বয়স হচ্ছে, শরীর ভেঙে আসছে, এবার ঘরমুখো মন হবে,–সেবার দরকার যে এখন!’

কথাগুলো যখন হচ্ছিল হেম তখন একবারও ভাবে নি যে বাড়ি এসেই বাবাকে দেখতে পাবে আর এমন নরম মেজাজে দেখবে। শরীরের অবস্থা খারাপ বলেই হয়তো। সত্যিই এবার হয়তো ঘরমুখো মন হয়েছে। ঐ লোক দিন-রাত বাড়ি বসে থাকবে আর অবিরত বাজে বকবে–মনে হলেই মনটা বিতৃষ্ণায় ভরে যায়। অথচ মা’র যে রকম ভাবগতিক–এবার তাড়াবার মতো মনের ভাব নয়! বোধ হয় একা থাকে বলেই আরও। খবর পেযে যদি সত্যিই রাণী বৌদি এসে যায়? সব পারে ও মেয়ে। মুখে হয়তো খুব যত্ন-আত্তি করবে, ভক্তি-শ্রদ্ধাও দেখাবে, কিন্তু মনে মনে–? ওরই ছেলে মনে ক’রে হেম সম্বন্ধেও কি একটা খারাপ ধারণা হবে না?

.

কথাটা ভাবতেও যেন কেমন লাগে।

অবশ্য রাণী বৌদির বুদ্ধি খুব! বয়স কম হলে কি হবে, অভিজ্ঞতা কারুর চেয়ে কম নয়। মানুষ চেনে খুব। সত্যি এই বয়সে এত জ্ঞান কি ক’রে হ’ল, ভাবতেও অবাক লাগে। আর কী মায়া–সকলকেই যেন আপন ক’রে টানতে চায়।…

‘ল্যাম্পো’র শিখাটা হেমন্তের কুয়াশাঘন রাত্রে কেমন যেন আব্‌ছা আব্‌ছা দেখায়। হাঁটু পর্যন্ত জলে ডুবিয়ে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে রাণী বৌদির কথাই ভাবে হেম, মুখহাত ধোওয়া আর হয়ে ওঠে না।

অন্ধকারে উঠোনে দাঁড়িয়ে শ্যামা নরেনের সঙ্গে কথা বলছিল–সেইখান থেকেই হেঁকে বলে, ‘কী রে, হিমে কতক্ষণ খালি গায়ে থাকবি? এত কিসের মুখহাত ধোওয়া?’

‘এই যে যাই।’ হেম কোনমতে একটা কুলকুচো ক’রেই জল থেকে উঠে আসে, মুখের ওপরটা ভাল ক’রে ধোওয়ার কথা মনেও পড়ে না।

॥৩॥

নরেন শ্যামাকে ভরসা দিয়েছিল যে তার সন্ধানে অনেকগুলি ভাল পাত্রী আছে, দুটো-একটা দিন একটু সময়মত নেয়ে খেয়ে সুস্থ হয়ে উঠলেই সে বেরোবে মেয়ে দেখতে। কিন্তু দুটো একটা দিন কাটাবার পর–নিয়মমতো শ্যামার গাঁদালঝোল ভাত সত্ত্বেও–অসুস্থ হয়ে পড়ল। হাত-পা আরও ফুলে গেল, ঘর থেকে দাওয়াতে বেরোবার মতো শক্তিও আর রইল না।

নরেন বলে, ‘বুঝলি বামনী-ভগা, ভগার খেলা এসব। আর দুটো দিন দেরি করলেও পথে মুখ থুবড়ে পড়তে হ’ত। এতটা পথ হেঁটে খোঁজ ক’রে ক’রে আসবার আর শক্তি হ’ত না। নিহাত মা-বাপের পুণ্যের জোর আছে তাই পথের মধ্যে গুয়ে-মুতে পড়ে মরতে হ’ল না। আর তোরও অদৃষ্টে আছে ভোগান্তি।’

আবার কখনও বলে, ‘তুই গাঁদালঝোল খাইয়েই আমাকে পেড়ে ফেললি। এ তোর আড়ি-আকোচ আমি পষ্ট বলতে পারি। আমাকে জব্দ করবি বলেই–। আমার হ’ল গে অত্যাচারের দেহ, এ কখনও তোয়াজে ভাল থাকে? এত ক’রে বললুম দুখানা বড়া ভেজে আমাকে একটু বড়ার ঝোল ক’রে দে, নিদেন প্যাজ কুঁচিয়ে এখনকার একটা নতুন বেগুম পুড়িয়ে দে–তা দিলি না। খাওয়া তো এবার ঘুচে এল।’

গজগজ করে আপন মনেই। ভাতের থালা। ভাতের থালা করে–গালাগাল দেয়।

দেখলেই দেখলেই ঝগড়া

‘কী ও–গাঁদালাঝোল? কোন গুয়োটা খায় দেখি! সরিয়ে নিয়ে যা, সরিয়ে নিয়ে যা! আমি খাব না। উপোস ক’রে পড়ে থেকে গোহত্যে ব্রহ্মহত্যে হব বলে দিলুম।’

আবার খানিকটা হাউ হাউ ক’রে কাঁদে, ‘বামদী–অক্ষ্যাম হয়ে এসে তোর দোরে পড়েছি বলেই কি এমনি শোধ নিতে হয়? আমাকে না খেতে দিয়ে মেরে ফেলবি? ঐ কি কেউ খেতে পারে?’

‘না, তা পারবে কেন? শোথ ধরিয়ে এসে এখন কালিয়ে পোলাও খাবেন! নাও ওঠ, খাও বলছি ভাল চাও তো–নইলে হেম এসে টেনে ঐ পাঁদাড়ে ফেলে দিয়ে আসবে। শ্যাল-কুকুরে ছিঁড়ে খাবে জ্যান্তে, এত বড় বড় গো- হাড়গেল, খুবলে খুবলে খাবে, উঠে পালাবারও তো ক্ষমতা নেই। ওঠ, খেতে বসো।’

কখনও ধমক দিয়ে, কখনও ভুলিয়ে, কখনও বা ভবিষ্যতের আশা দিয়ে সেই গাঁদালঝোল আর গলাভাতই খাওয়ায় শ্যামা। রাত্রে মরি বাঁচি ক’রে বার্লিরও ব্যবস্থা করেছে, পাড়ার লোকে বলেছে কাঁচা পেঁপে সেদ্ধ খাওয়াতে–অনেক পয়সার মায়া ত্যাগ ক’রে তাও পেড়েছে সে গাছ থেকে, তবু যেন দিন দিন শয্যাগতই হয়ে পড়ছে নরেন।

শেষকালে এমন অবস্থা দাঁড়াল যে ডাক্তার-বদ্যি একটা কিছু না দেখালেই নয়। অথচ পয়সা খরচ ক’রে ডাক্তার দেখাবার কথা এখন ভাবাও যায় না–মাথার ওপর ‘অসুমর’ দেনা। পাড়ায় মল্লিকদেরই জ্ঞাতি বই দেখে একটু আধটু হোমিওপ্যাথিক ওষুধ দেন–তিনিও নাকি আজকাল আট আনা ভিজিট করেম্বেন, এক আনা ক’রে ওষুধের পুরিয়া। তাই যদি খরচ করবে তো পাল্কি ভাড়া ক’রে সরকারী হাসপাতালে নিয়ে যাবে না কেন? মৌড়ির হাসপাতাল যাওয়া-আসা এক টাকা রেট, তেমন দরদস্তুর করলে বারো আনাতেই রাজী হয়ে যায়। কিন্তু সে-ও ঢের। ওদের যা অবস্থা, মরণাপন্ন রোগীর ক্ষেত্রেও বিবেচনা করতে হয়। সদ্য তরুর বিয়েতে দেনা আরও বেড়েছে জামাইয়ের কাছে, শোধের উপায়ে একান্ত সীমাবদ্ধ।

কিন্তু হেম অবধি চিন্তিত হয়ে পড়ে। শেষে একটা রবিবার দেখে কোনমতে ধরে ধরে রাস্তার ধারে বসিয়ে বসিয়ে–বলতে গেলে সম্পূর্ণটা বয়ে নিয়ে গিয়ে হাসপাতালে হাজির করে। তারা একটা মিক্সচার দেয়, আর কি বড়ি। চিঁড়ের মণ্ড, সিঙ্গি মাছের ঝোল পথ্য ব্যবস্থা।

ওখানে ওরা এসে বসে আছে কার মুখে খবর পেয়ে অভয়পদ ছুটে এল। তাদের বাড়িতে নিয়ে রাখবার প্রস্তাব করলে সে। কাছাকাছি থাকলে হাসপাতালে দেখাবার সুবিধা হবে–এই তার যুক্তি। কিন্তু হেম রাজী হ’ল না। বাবাকে তার এখনও বিশ্বাস হয় না, শুধু বোন ভগ্নীপতি হলেও কথা ছিল, বাড়িতে আরও পাঁচজন আছে, দুর্গাপদর নতুন বৌ, মেয়েরা একজন না একজন সপরিবারে থাকেই–মিছিমিছি তাদের কাছে কুটুমবাড়িতে থাক তাই।

নরেন নিজেও রাজী হ’ল না অবশ্য, ‘না বাবাজী, শরীরের যা অবস্থা হয়েছে–হয়তো মাঠে ঘাটে যাবার অবস্থাও থাকবে না বেশি দিন। সেখানে মাগী করতে বাধ্য কিন্তু এখানে কে ওসব করবে বল? ভরসার মধ্যে তো কন্যা–তা তারও তিন-চারটে নেণ্ডিগেণ্ডি, সেই সব সামলাবে না সংসারের কাজ করবে–না আমাকে দেখবে!…না, এখন থাক, একটু সেরে উঠি তার পর বরং এসে তোমাদের বাড়ি প্রসাদ পেয়ে যাব।

ফেরার পথে কিন্তু ওভাবে আর ফিরতে দেয় না অভয়। একটা পাকি ডেকে তাতে তুলে জোর ক’রে ভাড়ার পয়সাটা হেমের হাতে গুঁজে দেয়।

অনেক দিন অনেক কিছুই এই ভগ্নপতির হাত থেকে হাত পেতে নিতে হয়েছে, এখনও হচ্ছে। মিছিমিছি এই সামান্যর জন্য প্রতিবাদও বেশি করতে ইচ্ছা হ’ল না। আট আনা পয়সা হাত পেতেই নিলে।

অভয়ের মুখে খবর মহাশ্বেতা এল বিকেলবেলা বাপকে দেখতে। তার অভ্যাসমত কোলে একটা ও হাতে একটা ছেলে নিয়ে।

নরেন তখন এক ছিলিম তামাক নিয়ে বাইরের রকে এসে বসেছে কিন্তু হুঁকোয় টান দিতে পারছে না–দুপুরের খাওয়ার পর সন্ধ্যে অবধি হাঁপানির ভাবটা থাকে বড় বেশি–বসে বসে হাঁপাচ্ছে। মহাশ্বেতা এসে প্রণাম ক’রে ছেলেদের বললে, গড় কর সব–বেশ ক’রে পায়ে হাত দিয়ে গড় কর!’

নরেন অবাকও হ’ল, ব্যস্তও হয়ে উঠল।

‘কে মা আপনি–কৈ আপনাকে তো–ও আপনি বুঝি এই চটখণ্ডীদের কেউ হন? নাকি চৌধুরীদের? মানে আমি তো ঠিক থাকি না এখানে—’

মহাশ্বেতা এতখানি জিভ কাটে।

‘পোড়াকপাল! ছেলেমেয়েদের পর ক’রে দিতে হয় বলে কি এমনি ক’রেই পর করতে হয়। নিজের মেয়েকেও চিনতে পারলে না! আমি যে মহা!’

‘অ, মহা। বেশ বেশ, বড় খুশি হলুম। হ্যাঁ, জামাইয়ের সঙ্গেও দেখা হ’ল যে। মহা ভক্তিমান ছোক্রা। সেই হাসপাতালেই প্রণাম ক’রে পায়ের ধুলো নিলেন। এই যে আমার পুত্র, হেমচন্দ্র, কৈ একদিনও তো দেখি না একটা কাঠি ক’রে একটু পায়ে হাত দিতে। কলি-কলি–ঘোর কলি। না-ই বা রইলুম বাড়িতে, জন্মদাতা পিতে তো বটে! না, জামাইয়ের ভাল হবে, খুব উন্নতি হবে–মানুষের মতো মানুষ। নিয়ে যেতে চাইছিলেন বাড়িতে–বলছিলেন, ওখানে থাকলে হাসাপতালে দেখাবার সুবিধে হবে। হেমচন্দ্রের তাই ইচ্ছে ছিল–বুঝলে না, যা শত্রু পরে পরে–কিন্তু আমি রাজী হই নি, বলি, আমার তো একটা বিবেচনা আছে। সেখানে সে মেয়েটা কতকগুলো এণ্ডা-বাচ্ছা নিয়ে নাটা-ঝাপ্‌টা খাচ্ছে, তার মধ্যে গিয়ে উৎপাত বাড়ানো। আমি রাজী হই নি!’

তার পর নিবন্ত হুঁকোতেই গোটা-দুই টান দিয়ে একটা হাঁক দেয়, কৈ গো গিন্নী, কোথায় গেলে গো, একটা আসন-টাসন দাও–এঁরা সব দাঁড়িয়ে রইলেন যে! দেখছেন তো, দেখছেন তো মাগীর বিবেচনা, চিরকাল এই ক’রে আমার হাড়মাস জ্বালিয়ে খেলে। বিবেচনা বলতে কিছু নেই! আপনারা এসে দাঁড়িয়ে রইলেন–একটা আসন দেবে কি কিছু–। তা বরং এখানে বসতে পারেন, বিলিতী মাটির মেঝে, দিব্যি পোস্কার!’

‘ও মা, আমাকে আবার আপনি আজ্ঞে করছ কি গো। বললুম না আমি মহা!’

‘হ্যাঁ হ্যাঁ–তা কি আর আমি বুঝি নি। বলি আমার তো আর ভীমরতি হয় নি। করতে হয়, ছেলেমেয়েকেও আপনি-আজ্ঞে করতে হয়। ছোটটি থাকে

যখন তখন তুইতোকারি চড়-চাপড়–বড় হলে একটা অন্য ব্যবস্থা। ! বোস বোস, এই তোরা বোস না সব?’

ছেলে দুটো কোনমতে আড়ষ্ট হয়ে বসে সামনে। মহাশ্বেতা কিন্তু এক দৌড়ে ভেতরে চলে যায়। শ্যামা তখন রান্নাঘরের দাওয়ায় বসে নারকোল পাতা চাঁচছে–সেখানে গিয়ে প্রায় রুদ্বশ্বাসে বলে, ‘ও গো মাগো, বাবার যে পুরো ভীমরিত গো–আমাকে বলে আপনি, বলে বসুন–বাবা আর বাঁচবে না এ যাত্রা!’

বলেই ভ্যাঁক ক’রে কেঁদে ফেলে মহাশ্বেতা।

নিজের মনের আশঙ্কাটা মেয়ের মনে প্রতিধ্বনিত হতে দেখে শ্যামার বুকটাও ধক্ ক’রে ওঠে হয়তো–কিন্তু সে বিরক্ত মুখেই বলে, ‘ও আবার কি, এখন থেকেই প্যান প্যান করছিস কেন!…খেলে যা! এরকম অসুখ-বিসুখ করলে মাথার একটু গোলমাল হয়ই। আর যদিই বা তাই হয়, তাতেই বা এখন থেকে কান্নাকাটির কী হয়েছে। মা গুণের মানুষ! দুঃখে শ্যাল-কুকুর কাঁদবে।’

‘ও মা–তা বলে–বাপ তো! কী যে বল! মানুষের জীবনে–পিতা স্বগ্‌গ!’

‘হয়েছে, হয়েছে–থাম। তোকে আর শান্তর থগবগাতে হবে না!’

মহাশ্বেতাকে বেশি বলতে হয় না, সব বিষয়েই তার শিশুর মত কৌতূহল। সে আবার এক ছুটেই বাইরে গিয়ে দাঁড়ায় নরেনের কাছে–

‘এই যে, কোথায় গিলি আবার। বোস বোস–এখানেই বোস! পোষ্কার জায়গা–সকালেই মুছে দিয়েছে, তোর গর্ভধারণী। তাই বলছিলুম এই শালাদের, দাদামশাইকে দেখতে এসেছিস–কী নিয়ে এসেছিস বল। …এবার যখন আসবি–মোড়ের দোকান থেকে খাস্তার গজা আর বাজার থেকে ঝাল ফুলুরি নিয়ে আসিস। বাড়ির মধ্যে নিয়ে যাস নি, সাতশো রাক্ষুসীর খপ্পরে গিয়ে পড়লে আর আমি পাব না, গোরবেটার-জাতদের নুনতেল দিয়ে খাওয়াবে সব। আমাকে এইখানে চুপিচুপি দিয়ে যাস, আমি ঐ পাতার গাদার মধ্যে লুকিয়ে রাখব।’

মহাশ্বেতার চোখ কপালে ওঠে প্রায়, ‘ও কি গো! তুমি তেলে-ভাজা ফুলুরি খাবে কি গো! আর ঐ বাজারের খাস্তার গজা। তোমার যে শোথ রোগ হয়েছে!’

‘চুপ চুপ, গাঁক গাঁক ক’রে চেঁচাচ্ছিস কেন! মাগী শুনতে পাবে যে! মিছে কথা, ওসব মিছে কথা! বুঝলি? ডাক্তারদের বাজে কথা যত সব। আমাকে না খেতে দিয়ে মারবার ফন্দি। মাগীর সঙ্গে ষড় করেছে গোরবেটারা! কিচ্ছু না একটু হাঁপানির মতো হয়েছে তাই, আর অনেক দিন তো পোষ্টাই কিচ্ছু খাই নি–হাত-পাগুলো একটু ফুলেছে। শুনেছি ভালমন্দ খেলে সেরে যায়। মাগীর গাঁদালঝোল খেয়ে খেয়ে পাইখানাটা একটু ধরেছে, বুঝলি না, এখন এই হাঁপানিটা সারলেই তোর বাড়ি চলে যাব। জামাই তো বলেইছেন–’

এই বলে খানিকটা আবার বসে বসে হাঁপায়। হুঁকোটায় টানা দেয়–কিন্তু সেখানে তখন আর কিছুই অবিশষ্ট নেই। সেটা দরজার কোণে ঠেস দিয়ে রেখে বসে বসেই মেয়ের কাছে এগিয়ে আসে খানিকটা। চুপি চুপি বলে, ‘ওঃ, কত কাল যে যজ্ঞিবাড়ির খ্যাট জোটে নি। ভেবেছিলুম হেমচন্দরের বিয়েতে পাঁচটা দিনের খ্যাট জুটবে–এই তো ধর না দু দিন পাকা দেখা–দুবাড়িতে দু দিন,তার পর এক এক দিন বে আর এক দিন বৌভাত–আর পরের দিন বাসি-যজ্ঞি। আজকাল ঠাণ্ডার দিন, কিচ্ছু খারাপ হয় না। গরম ক’রে ক’রে রাখলে তিন দিন থাকে। …আপনাদের তো অনেক জানাশুনো–দিন না একটা, ভাল বংশের মেয়ে দেখে। ও আমার রূপ চাই নি। রূপ নিয়ে কি ধুয়ে খাব! সোন্দর মেয়েদের বরাত ভাল হয় না। এই যে আমার ব্রাহ্মণী, বললে,

বললে, বিশ্বাস করবেন না–সাক্ষাৎ জগদ্বাত্রীর মতো রূপ ছিল–কী বরাত কি বলব! আমার সাজানো সংসার–কুবেরের ঐশ্বর্য, মাগীর পায়ে সব যেন ফুসমন্তরে উড়ে গেল। বংশ দেখে মেয়ে আনতে হয়, বংশ আর চালচলন দেখে। মানে একটু লক্ষ্মীছিরি থাকে এই আর কি! তা তেমন মহৎ-বংশের মেয়ে হলে লক্ষ্মীছিরি একটু থামবেই। তবে পাওনা–থোওনা–তা অবিশ্য কিছু দিতে হবে–হেমের গর্ভধারিণী যে শুধু হাত মুখে তুলবেন, তা মনে হয় না। দিন না একটু ভাল দেখে মেয়ে–আমি এই মাসেই দিয়ে দিই–’

‘ও হরি! তুমি খ্যাট খাবে কি গো বাবা, তোমার যে পুরোদস্তুর ভীমরতি হয়েছে। তুমি আবারও আমাকে আপনি বলছ! এ তো মনে হচ্ছে তোমার আর বেশি দিন নয়–বুঝতে পারছ না!’

‘আ গেল যা। গোরবেটার জাত হারামজাদী মেয়ে আমার কল্যেণ আওড়াতে এলেন। আমার মরণ টাঁকছেন বসে বসে। যা দূর হ–আমার সামনে থেকে, এ শোরের পাল সরিয়ে নিয়ে যা! হবে না, কেমন বংশের বৌ! আবাগী সব্‌বনাশী আমার ভীমরতি দেখছেন। তোর ভীমরতি হোক, তোর সোয়ামীর হোক, তোর গুষ্টির যে যেখানে আছে তাদের হোক। আমার কেন হতে যাবে!’

‘ওমা–এ যে একেবারে উন্মাদ পাগল হয়ে গেছে যে! আমি ভাবছি ভীমরতি। চলে আয় চলে আয়। পালিয়ে আয়।’

ছেলে দুটোর হাত ধরে টানতে টানতে ভেতরে চলে যায় মহাশ্বেতা।

মাকে গিয়ে বলে, ‘কী কবিরাজী তেল পাওয়া যায় তাই বাবাকে লাগাও গে, এ যে একেবারে পাগলের অবস্থা!’

শ্যামা সদ্য-চাঁচা কাঠিগুলো গোছ ক’রে নারকোল পাতারই একটা সরু ছোটা দিয়ে বাঁধতে বাঁধতে গম্ভীর মুখে বলে, ‘তোমার এত টান থাকে আর পয়সার জোর থাকে তুমি মাখাও গে মা–আমার এত ক্ষ্যামতা নেই। আর ইচ্ছাও নেই–সত্যি কথা বলতে কি। ঐ মুখে ভাত যে বেড়ে দিচ্ছি এই ঢের!’

মহাশ্বেতা অপ্রস্তুতভাবে বলে, ‘না–ও একটা কথার কথা বললুম। বলছি যে পুরোদস্তুর ভীমরতি দেখছি বাবার।’

‘তা হবে। কী আর করব বল। যতটুকু যা সাধ্যে কুলোচ্ছে করছি। করবার কথা নয়–তবু করছি।’

‘তা বলছ কেন’, হাত-পা নেড়ে বলে মহাশ্বেতা, ‘করা উচিতও তো। হাজার হোক তোমার সোয়ামী, আমাদের বাবা। বলি এ তো ফেলবার সম্পর্ক নয় গো।’

‘আচ্ছা আচ্ছা, ঢের হয়েছে। তোমার কাছ থেকে আর এই মরবার কালে উচিত অনুচিত শিখতে চাই না। আয় রে তোরা–দুটো নাড়ু খেয়ে যা!’

আগের দিন ক্ষুদভাজা গুঁড়িয়ে গুড় দিয়ে নাড়ু করে রেখেছিল, তাই বার ক’রে দেয় শ্যামা নাতিদের। …

মায়ের তিরস্কার মহাশ্বেতা কোন দিনই গায়ে মাখে না, আজও মাখলে না। তা ছাড়া তার তখন কৌতূহলই প্রবল। সে আবারও বাইরে এসে দাঁড়াল। তবে খুব কাছে নয় এবার–একটু দূরে দাঁড়িয়েই বাপের ভাবভঙ্গি লক্ষ্য করতে লাগল। শিশুর মতোই তার কৌতুক আর কৌতূহল।

দূরে দাঁড়িয়ে থাকলেও নরেনের দৃষ্টি এড়ায় নি।

সে একটু এগিয়ে রকের ধারে এসে বসল।

‘ও কে? মা মহা, এদিকে এস মা, কাছে এস। ও কখন কি বলে ফেলি–শোকাতাপা মানুষ, অত ঠিক থাকে না। ওসব গায়ে মাখতে নেই। মরুরক গে যাক্–বুঝছ না মা–পরের সঙ্গেই তো জীবনটা কাটল, আপনি বলে বলেই অব্যেস। পরদারেষু মাতৃবৎ-বুঝলে না, হাজার হোক আমরা গুরুবংশের ছেলে, এসব শিক্ষা যে বলতে গেলে আমাদের মাতৃগর্ভ থেকে পাওয়া। আপনি শব্দটাই আগে বেরোয়। তা ও কিছু নয়–বলছিলুম কি, মেয়ে একটা দেখতে। তোমাদের তো রাবণের বংশ, আর ও কলমির দল, একটা ডগায় টান দিলেই দেখবে সেই কত দূর থেকে আসছে। সদ্বংশের একটি মেয়ে এনে দাও আমাকে, আমার জ্যেষ্ঠপুত্তুরের জন্যে।

‘ও মা-তা মেয়ে ক’রে তো হেদিয়ে গেলে, ছেলে তোমার যে পিঁড়েয় বসতে চায় না। ওর ভগ্নিপোত পজ্জন্ত বলেছিল, মা তো কত ক’রে বলে–ওর একেবারে ধনুকভাঙ্গা গোঁ–আর যা বল বল, বে করতে বলো নি।’

নরেন একটা অশ্রাব্য কটূক্তি ক’রে ওঠে

‘রেখে দে দিকি তোর গোঁ। তুই মেয়ে দেখ–মেয়ে পছন্দ হলে ওর ঘাড়কে দিয়ে বে করার–ও তো ছেলেমানুষ। ও কেন, ওর চোদ্দপুরুষ বে করবে। উঁঃ! ধুনকভাঙ্গা পণ। গোরবেটার জাতের ঘাড় ধরব–পিঁড়েয় নিয়ে গে বসাব। মিলিটারী মেজাজ, ওসব মিলিটারী মেজাজ আমি ঢের দেখেছি। আমার মেজাজও কম নয়! ভাল আছি, তো আছি–রাগলুম তো বাপের কুপুত্তর। আমাকে চেনে নি এখনও! আপনি মেয়ে দেখুন। তার পর আমি আছি।’

উত্তেজিত হয়ে ওঠে দাঁড়ায় নরেন, দু পা এগিয়েও আসে! কিন্তু তার পরই পা দুটো অতিরিক্ত দুর্বল বোধ হওয়ায় রকের সিঁড়ির ওপরই বসে পড়ে ধপ ক’রে।

॥8॥

হাসপাতালের ওষুধ খাওয়া সত্ত্বেও নরেনের অসুখ ক্রমাগত বেড়েই যেতে লাগল। বার বার হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া ব্যয়সাধ্য–তবু পর পর দুটো রবিবার হেম পাল্কি ক’রেই নিয়ে গেল, শ্যামার নিষেধ সত্ত্বেও। কিন্তু তাতেও সুস্থ হবার কোন লক্ষণ দেখা গেল না। আর বেশি পয়সা খরচ করা ওদের ক্ষমতার বাইরে। তা ছাড়া নরেনকে নিয়ে যাওয়ার বিপদও আছে। সেখানে গিয়ে বসে থাকতে হলে হাসপাতালের কর্মকর্তাদের কুৎসিত ভাষায় গালাগালি দেয়–তখন যদি বা ধমক দিয়ে চুপ করায় হেম, ডাক্তাররা দেখার সময় তাদের মুখের উপরই গালাগাল দিতে শুরু করে। লজ্জার শেষ থাকে না। তা ছাড়া নরেনের ও ওষুধের ওপর খুব আস্থাও নেই। অগত্যা ওরা টোটকার ওপরই সমস্তটা ছেড়ে দিয়ে নিশ্চিন্ত হয়! যে যা বলে–নরেনের নিজেও অনেক রকম জানা ছিল–এটা ওটা ওষুধ এবং পথ্য পরীক্ষা চলে।

এর মধ্যে দু-একবার বিয়ের কথা তুলেছিল নরেন–হেম বেশির ভাগ সময় জবাবই দেয় নি, দিলেও মৃদু ধমক দিয়ে উড়িয়ে দিয়েছে। ‘মিলিটারী মেজাজ,’ ‘রোজগেরে বাবুর মেজাজ’ ইত্যাদি বলে ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ করলেও তার বেশি কিছু বলতে সাহস করে নি আর। কিন্তু সেই ঝালটা এবং তম্বিটা গিয়ে পড়তে শুরু হ’ল শ্যামার ওপর। শ্যামা ছেলে মানুষ করতে পারে নি, সভ্যতা সহবৎ শেখাতে পারেনি, গুরুজনদের কাছে কি রকম নম্র ও বিনত হয়ে থাকতে হয়–তা একটুও শিক্ষা পায় নি ছেলেমেয়েরা–বিয়ের কথায় ছেলেমেয়ের নিজস্ব মত থাকা এবং প্রকাশ করাটা-নাকি সর্বপ্রকার শিক্ষা-সভ্যতার বাইরে। ইত্যাদি ইত্যাদি–

শ্যামা অনাবশ্যক বোধেই এ সবের জবাব দেয় না। তার অসংখ্য কাজ, দিনেরাতে কাজ করার সময় আঠারো ঘণ্টার বেশি নয়–এটা সে হিসেবে ক’রে দেখেছে। সুতরাং এই সামান্য সময়ের মধ্যে পাগলের সঙ্গে বাজে বকে যদি দুটো মিনিটও নষ্ট হয় তো সেটা গায়ে লাগে। কিন্তু সে গায়ে না মাখলেও এক দিন এই ধরনের তম্বি হেমের কানে যেতে সে বিষম বিরক্ত হয়ে উঠল, রান্নাঘরের দাওয়ায় বসে বসে বকছিল নরেন, সেখান থেকে একটা কনুই ধরে হিড় হিড় ক’রে টানতে টানতে একেবারে বাইরের ঘরে এনে বসিয়ে দিয়ে বললে, ‘ফের যদি বাড়ির মধ্যে ঢুকে বাজে বকতে থাক কি ঐ সব কথা তোল তো একেবারে এমনি টেনে নিয়ে গিয়ে সরস্বতীর ধারে ফেলে দিয়ে আসব জ্যান্তে। এ বাড়িতে আর তোমার জায়গা হবে না–মনে রেখো!’

তারপর থেকেই–যেন নিজের শারীরিক দৈন্য এবং একান্ত পরনির্ভরতা উপলব্ধি ক’রেই একেবারে চুপ ক’রে গেল নরেন। হেমের আড়ালেও এ প্রসঙ্গ তুলতে সাহস করত না আর।

মাস মাঘ নাগাদ একেবারে শয্যাগত হয়ে পড়ল সে। প্রাকৃতিক কাজগুলোর জন্যে অন্তত হামাগুড়ি দিয়ে দিয়েও বাইরে যাচ্ছিল–আর সেটুকু ক্ষমতাও রইল না! ফলে শ্যামার ঝঞ্ঝাট আরও বাড়ল। অসংখ্য কাজের মধ্যে দিনেরাতে বহুবার গিয়ে পুকুরে ডুবে আসতে হয়। মাথার সে একঢাল চুলের কিছুই আর অবশিষ্ট নেই তার–সামনে তো প্রায় টাক পড়বার মতোই হয়েছে–তবু যা আছে–দিনরাত ভিজে ভিজে দুর্গন্ধ ছাড়ে, শরীর খারাপ হয়!

এ সবই লক্ষ করে হেম–কিন্তু কী যে করবে তা ভেবে পায় না। ঐন্দ্রিলা এর মধ্যে কয়েক দিনই এসেছিল। দূর থেকে উঁকি মেরে দেখেই সরে এসেছে–বাপের কাছেও যায় নি; লাজলজ্জার মাথা খেয়ে শ্যামা বলতে গিয়েছিল, ‘দু-চার দিন এসে থাক্ না–আমি যে আর পারছি না।’ তার জবাবে সটান বলে দিয়েছে সে, ‘হ্যাঁ, এখন আসি আর ঐ বুড়োর-গু-মুত ছিষ্টি সেবার ভার আমার ঘাড়ে ফেলে দাও। ওখানে আছি ঐ এক কড়ারে। রান্নাবান্না যা দাও করব–কিন্তু শাশুড়ির সেবা আমার দ্বারা পোষাবে না। সেবা যা একজনের করেছি সে-ই ঢের, আর করার সাধ নেই!‘

হেমকে কিছু বলে না শ্যামা। তার ভয় হয়–বলতে গেলে হয়তো জবাব দেবে, ‘তুমি করছ কেন? ওর ওপর আমাদের কিসের কর্তব্য? যেখানে ছিল এত কাল সেখানে যাক না!’…

শ্যামা কিন্তু এখনও–এত কালের এত দুর্ব্যবহারের পরও–কেমন একটা মমতা অনুভব করে লোকটা সম্বন্ধে, এখন যদি সে না দেখে তা হলে সত্যিই হয়তো কান্ পাঁদাড়ে গিয়ে পড়ে থাকবে, জ্যান্তেই শিয়াল কুকুরে ছিঁড়ে খাবে। …

এরই মিধ্যে অকস্মাৎ একদিন–রবিবার সেটা, সকালে বসে হেম দাড়ি কামাচ্ছে–নরেন ডাকলে, ‘বাবা হেম, হেমচন্দর। একবারটি এখানে আসবে বাবা?’

কণ্ঠস্বরটা কেমন যেন। হেম একটু ভয় পেয়েই তাড়াতাড়ি কাছে এসে দাঁড়াল।

‘একটু কাছে এসো বাবা, হ্যাঁ–এইখানটায়।

একটু অনিচ্ছাসত্ত্বেও একেবারে বিছানার ধারে গিয়ে বসতে হয়। শ্যামা যত দূর সম্ভব পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করে রাখে–ক্ষার কাঁচার তার বিরাম-বিশ্রাম নেই–তবুও রোগশয্যার কেমন একটা গন্ধ আছেই, একটা অস্বস্তি বোধ করে হেম।

নরেন কনুইতে ভর দিয়ে আধ-বসা ক’রে উঠে সহসা ওর হাত দুটো দু হাতে চেপে ধরে, তার পর হাউ-হাউ ক’রে কেঁদে ওঠে–কতকটা ডাক ছেড়েই।

‘কী হ’ল কী হ’ল!’ ব্যস্ব হয়ে ওঠে হেম। শ্যামাও ছুটে আসে।

‘বাবা হেম, আমি তোমার অক্ষ্যাম পিতা, আমি পশু, পশুরও অধম। তবু আমি তোমার জন্মদাতা, গুরুজন। তোমার হাতে ধরে ভিক্ষা চাইছি বাবা, তুমি একটি বিবাহ কর। মরবার আগে বৌমার মুখখানি দেখে যাব–জল পিণ্ডের ব্যবস্থা হ’ল জেনে নিশ্চিন্তি হয়ে যাব–এ আমার বড় সাধ। এ না হলে আমি নিশ্চিন্তি হয়ে মরতে পারছি না যে বাবা। আমাকে এই ভিক্ষেটি তুমি দাও।’

আবারও হাউ হাউ ক’রে কেঁদে উঠে নরেন। দু হাতে চেপে ধরা হেমের হাতের ওপর নিজের কপালটা ঠোকে।

‘আরে, আরে। এ কি বিপদ! আচ্ছা, আচ্ছা, সে হবে, চুপ কর। চুপ কর। মাথা খারাপ হয়ে গেল নাকি। চুপ চুপ!’

বিব্রত হেম কী বলবে যেন ভেবে পায় না।

কোনমতে হাত দুটো টেনে ছাড়িয়ে নিয়ে বাইরে চলে আসে সে। হাত দুটো কেমন একটা চিন চিন করছে যেন–বিশেষ ক’রে বাপের চোখের জল লেগে আছে যেখানে–সেইখানটায়।

শ্যামা তাকিয়ে দেখে ছেলেরও চোখ দুটো লাল হয়ে উঠেছে, ছলছল করছে। ওর সঙ্গে চোখোচোখি হতে তাড়াতাড়ি মুখটা ফিরিয়ে নেয়, দাড়ি কামাতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। কিন্তু শ্যামা লক্ষ্য করে, তখনও সে ভাল করে ক্ষুরটা ধরতে পারছে না–হাত দুটো কাঁপছে তখনও। …

সেই দিনই সে পাড়ার ফটিকের ভাইকে দিয়ে মহাকে ডেকে পাঠায় ছেলের মত হয়েছে–এবার উঠে পড়ে পাত্রীর খোঁজ করুক।

একবিংশ পরিচ্ছেদ

॥১॥

ব্যাপারটা ঘটে গেল হঠাৎ। সে-ও একটা রবিবার, রবিবার হলেই হেম একটু সেজেগুজে কলকাতায় যেত–অফিস যাওয়ার কাপড়জামা সেদিন ক্ষারে কাঁচা হ’ত–কাজেই ওর সেই দেশী কাপড়, আর পাম্পশু জুতো ছাড়া উপায় থাকত না। শীতকাল হলে তার সঙ্গে সেই জার্মানির শাল। সেদিনও সেই বেশেই বেরিয়েছিল। বড় মাসীমার বাড়িতে এসে দেখলে একগাদা লোক, ছোট দুখানা ঘরে থৈ থৈ করছে, রাণীবৌদির বাপের বাড়ি থেকে এসেছে সব। সুতরাং সেখান থেকে বেরিয়ে পড়তে হ’ল। ছোট মাসীর কাছেও ঠিক যেতে ইচ্ছা হ’ল না–মার সেই কাণ্ডর পর থেকে একটু লজ্জাও করে বটে–তা ছাড়া সেখানে গেলে যেন বড় তাড়াতাড়ি কথা ফুরিয়ে যায়। একটু পরে বলবার মতো আর কথা থাকে না। আর কোথাও যাওয়া যায়–ভাবতে ভাবতে মনে হ’ল অনেক দিন থিয়েটারের পাড়ায় যাওয়া হয় নি–গেলে কেমন হয়? গেট-কীপাররা সব বন্ধু, ওকে গিয়ে পাস লেখাতেও হবে না; তা ছাড়া থিয়েটার না দেখলেও–অনেক রকম গল্পগুজব আছে–একটা ভাল রকম আড্ডা জমানো যেতে পারে।

মনে হ’লে বটে–সেই ভেবেই বড় মাসীমার বাড়ির গলি থেকে বেরিয়ে ওদিকের রাস্তা ধরলে–তবু একটা সংকোচ থেকেই গেল মনে মনে। আবার ঐ সংসর্গ, ঐ মেয়েমানুষটার প্রসঙ্গও হয়তো উঠবে, হয়তো তাকে দেখতে হবে–সবটা ঠিক রুচিকর হবে কিনা এই রকম একটা দ্বন্দ্ব চলতে লাগল মনে মনে। তাই গতিটা হয়ে গেল মন্থর, কতকটা বেড়াতে বেড়াতে যাবার মতোই আস্তে আস্তে পথ চলতে লাগল। তবু যত আস্তেই চলুক, এক সময় সেই বিশেষ রাস্তাটায় এসে পৌঁছল। এবার পা-টা যেন আরও ধীরে পড়তে লাগল, যা-হয় এখনই মন স্থির করতে হবে–যাবে না ফিরবে–আর সেই ভাবেই অন্যমনস্ক ভাবে বেড়াতে বেড়াতে এক সময় বিয়েবাড়িটার সামনে এসে পড়ল।

প্রকাণ্ড চারতলা বাড়ি, ফুটপাথের ওপর পর্যন্ত লাল ভেলভেটের কানাত দিয়ে ঘেরা, ওপরে রসুনচৌকির ঘর, লোকজন, সমারোহ–সবটা গমগম করছে। ফুটপাথ ধরে চলছিল, কানাত ঘের। জায়গাটায় বাধা পেতে চেয়ে দেখতে হ’ল–বিয়েবাড়ি তাও বুঝল–এবং রাস্তায় নেমে ঘুরেও আসতে হ’ল। কিন্তু গতিটা বাড়ল না। সেই ভাবেই অতি ধীরে ধীরে–মানুষ উদ্দেশ্যহীনভাবে বা অনিচ্ছায় যখন কোথাও যায় তখন যেভাবে চলে সেই ভাবেই বিয়েবাড়ির পর্দায় তৈরি ফটকটার সামনে এসে পড়ল। সেইখানে দাঁড়িয়ে ছিলেন কর্মকর্তাদের প্রতিনিধিস্থানীয় কর্মচারী গোছের দু-চারজন, তাঁরাই হঠাৎ ‘আসুন আসুন’ বলে যেন কলরব ক’রে উঠলেন, কোথা থেকে একটা একহালি বেল ফুলের মালা গলায় এসে পড়ল, একটি ছেলে গোলাপজলের পিচকিরি দিয়ে মাথাটা প্রায় ভিজিয়ে দিলে এবং তারই মধ্যে একজন হাত ধরে মৃদু আকর্ষণ করলেন ভিতর দিকে। সবটা এমন অকস্মাৎ ঘটে গেল–এমন অতর্কিতে যে- ঘটনাটা কী ঘটছে ভাল ক’রে বোঝবারও সময় হ’ল না। আর ঠিক সেই মুহূর্তেই দু-তিনটে বড় বড় গাড়ি এসে থামল, সম্ভবত তা থেকে নামলেন সম্মানিত বরযাত্রীর দল, ‘আসুন আসুন’

‘আস্তাজ্ঞে হোক’ বর উঠল চারিদিকে, বাড়ির মধ্যে থেকে মোটা মোটা কর্মকর্তারা বেরিয়ে এলেন এবার অভ্যর্থনার জন্য, আর সেই গোলমাল গণ্ডগোল ভিড়ের মধ্যে কতকটা ঘটনার স্বাভাবিক স্রোতেই হেম গিয়ে পড়ল ভেতরের উঠানে–যেখানে চক-মেলানো ক’রে চেয়ার পাতা–আরও বহু নিমন্ত্রিত অভ্যাগত যেখানে বসে আছেন–সেইখানে। কতকটা অভিভূতের মতই, তারই একখানাতে গিয়ে বসল সে।

যখন এই অনিবার্য গতি বন্ধ হ’ল-অর্থাৎ থিতিয়ে বসতে পারল তখনই প্রথম ব্যাপারটা কী ঘটল একটু ভেবে দেখবার অবসর মিলল ওর।

প্রথম যে অনুভূতিটা হ’ল সেটা কৌতুকের–মনে হ’ল এ তো মজা মন্দ হ’ল না–কোথায় যাচ্ছিল, কোথায় এসে পড়ল, এ যেন কোথা দিয়ে কী একটা হয়ে গেল। তার পর ভয় করতে লাগল। যদি কেউ চিনতে পারে, যদি কেউ এসে প্রশ্ন করে, ‘আপনি কে? কোথা থেকে আসছেন? কে আপনাকে নেমন্তন্ন করেছে?’ যদি তাই নিয়ে কোন শোরগোল ওঠে, তখন সবাই সন্দিগ্ধ দৃষ্টিতে চাইবে, সবাই দেবে ধিক্কার–সে বড় অপমান। অনেক সময় বিয়েবাড়িতে অনেক চুরিও হয়, তখন সবাইকে সনাক্ত করার চেষ্টা চলে–সেই সময়েই ধরা পড়ে যায় কারা রবাহূত অথবা অনাহূত। যে অনিমন্ত্রিত এসেছে বলে ধরা পড়ে তাকেই সবাই সেক্ষেত্রে চোর ভাবে–চোর না হলেও।

এই সেদিনই গোবিন্দ গল্প করছিল–ওর এক বন্ধুর বোনের বিয়েতে এক ছাদ লোক খেতে বসেছে, তার মধ্যে বন্ধুর মামা, দেখেই মন হয় খুব দুদে লোক–এসে একজনকে ধরলেন, ‘আপনি কে মাশাই, আপনাকে তো চিনলুম না! আপনি বরযাত্রী না কন্যাযাত্রী? ও বেয়াই মশাই, এদিকে আসুন তো–ইনি কি আপনাদের নিমন্ত্রিত কেউ? দেখুন তো ভাল ক’রে!’ তার পর বরপক্ষের তিন-চারজনকে দিয়ে সনাক্ত করানো হয়ে গেলে তিনি কন্যাপক্ষকে ডাকলেন, ‘ওহে ও ভবতারণ, এসো দিকি এদিকে–এঁকে কে নিমন্ত্রণ করেছে? চেনো নাকি এঁকে? অরুণ কোথায় গেল–অরুণ, তোমরা এঁকে নিমন্ত্রণ করেছিলে? দেখ তো ভাল করে–’ ইত্যাদি। সে এক হুলস্থুল কাণ্ড। তবে নাকি যে খেতে এসেছিল সে খুব চতুর–সে আসবার আগে সেই রাস্তাতেই আর একটা বিয়েবাড়ি দেখে এসেছিল–সে এক ডাক্তারের বাড়ি, দোরের বাইরে মার্বেলে নাম লেখা আছে–সুতরাং নাম জানবার কোন অসুবিধা নেই–সে বললে, ‘কেন, এটা ডাঃ সামন্তর বাড়ি নয়? ডাকুন না তাঁদের কাউকে–’ এই বলে অব্যাহতি পেয়ে গেল। তাও সে চলে যাবার সময় তাকে শুনিয়েই মামা বললেন, ‘ভাগ্যিস দোরের বাইরে নামটা দেখে এসেছিল–খুব পার পেয়ে গেল। তাও ভজাভজি করতে পারতুম, কে আবার অত কাণ্ড করে–তাই ছেড়ে দিলুম। তা ব্যাটা চালাক খুব, দেখেছ ভবতারণ, ফাঁদে পা দিলে না। ডাক্তারের নাম করলে না–তা হলেই চেপে ধরতুম, ডাক্তার তো মারা গিয়েছে–অনেকে আবার ঐ রকম ভুল ক’রে বসে কিনা–ঠিক জানে না বলেই বললে তাদের কাউকে ডাকুন না। যা ব্যাটা যা–খুব বেঁচে গেলি!’

কন্যার বাবা ভবতারণবাবু নাকি বলেছিলেন মৃদু কণ্ঠে, ‘কেন দাদা এত কাণ্ড করলেন, বেচারী একপেট খেতেই তো এসেছিল। আমি বুঝেছিলুম, কিছু বলি নি।’

তাতে মামা জবাব দিয়েছিরেন, ‘না হে বোঝ না–এদের মধ্যেই এমনি করেই সব চোর আসে। একবাড়ি লোক, চারিদিকে জিনিস, যদি কিছু খোয়া যায়? তখন তো হায় হায় করবে!…না, না, ওসব মায়া করা কাজের কথা নয়। আর বুঝলেন প্রসাদবাবু, আমি যেন এই করতেই আছি। এই অপ্রিয় কাজটি আমাকেই করতে হয় চিরকাল। আর আমার চোখে কি ঠিক ধরাও পড়বে! মুখ দেখেই আমি বুঝতে পারি যে–!’

কথাগুলো সব পর পর যেন বইয়ের পাতায় পড়বার মতো ক’রে মনে পড়ে যায় হেমের। নিমেষে এই মাঘ মাসের শীতেও ঘেমে ওঠে সে। সব কর্ম– বাড়িতেই ঐ রকম চৌকশ দু-চারজন লোক থাকে, এ তো বড়লোকের বাড়ি, বৃহৎ আয়োজন, বহু লোক–তার মধ্যে এ ধরনের অভিজ্ঞ লোকও হয়তো অনেকে। …শেষে কি দারোয়ানের হাতে গলাধাক্কা খেয়ে বেরোতে হবে এখান থেকে?…তার চেয়ে সরে পড়াই ভাল এইবেলা, মানে মানে। কী করবে, ‘একটু ঘুরে আসছি’ বলে বেরিয়ে যাবে?…’না, আমাদের আর সব কই?’ বলে ফুটপাথে গিয়ে দাঁড়াবে–না সোজাসুজি ‘ভুল হয়েছে, অন্য বাড়ি মনে ক’রে এসেছিলুম’ বলে চলে যাবে সাহমানে? তখন যদি আবার প্রশ্ন করে, ‘কোন বাড়ি মনে করেছিলে’–তখন? এ পাড়ায় আর কোন বাড়িতে বিয়ে আছে কিনা তাও তো জানে না, বহুকাল পরে এ রাস্তায় পা দিয়েছে–তখন কী উত্তর দেবে?

কী করবে ভাবছে এমন সময় কে যেন এসে বললে, ‘আপনারা দয়া করে গা তুলুন, পাতা হয়েছে।’ সবাই হৈ হৈ ক’রে উঠে পড়ল। হেমও ‘কিংকর্তব্যবিমূঢ়’ ভাবে উঠে দাঁড়িয়েছিল কিন্তু সে আর বাইরের দিকে যেতে পারল না, চারিদিকের লোক যেন অপ্রতিহত বলে তাকে ভেতরে দিকে ঠেলাতে লাগল।

সকলেরই আগ্রহ ঐ দিকে। কে একজন যেন বললেন ওরই মধ্যে ‘সে কি হে–বর এসে পৌঁছবার আগেই বিয়ের নেমন্তন্ন খেয়ে চলে যাব? তাঁকে সবাই মিলে থামিয়ে দিল, ‘নিন, নিন–এদের তো ছুটি দিতে হবে, বর যখন আসবে তখন থই থই করবে লোক, কজনকে বসাবে? না না, ও কাজ সেরে ফেলাই ভাল।’ কে একজন বললে, ‘ওহে এখনও যে ভাল ক’রে ক্ষিদেই হয় নি, রবিবারের বাজার–বেলায় খাওয়া হয়েছে।’ তাকেও আবার কে থামিয়ে দিলে, ‘নে নে–দুই খাওয়াই এক সঙ্গে হজম হয়ে যাবে, শীতের বুড়ো রাত!

এরই মধ্যে, প্রায় অনিচ্ছায়, হেম এক সময় ছাদে গিয়ে পৌঁছয়। সিঁড়ির মুখে কে যেন বললে, ‘ব্রাহ্মণরা দয়া ক’রে ঐদিকটায় যাবেন–।’ সে কতকটা ভিড়ের চাপেই সেই দিকে ঘুরে গেল। ভিড় বেশ, তারই মধ্যে যতদূর সম্ভব আলসে ঘেঁষে অপেক্ষাকৃত অন্ধকারের দিকটায় গিয়ে বসল। লুচি বেগুন-ভাজা ছক্কা ডাল পাতে দেওয়াই ছিল, ওরা গিয়ে বসবার সঙ্গে সঙ্গে হুড়হুড় ক’রে পরিবেশকের দল বেরিয়ে পড়ল। তখন আর ইতস্তত করার বা পিছিয়ে যাবার সময় রইল না। অগত্যা লুচির গ্রাস মুখে তুলতে হ’ল। ঘাড় হেঁট ক’রে এক মনে খেয়েই যেতে লাগল, তখন কতকটা মরীয়াও হয়ে উঠেছে–যদি অপমান হতেই হয় তো খেয়ে নিয়ে হওয়া ভাল, ঘাড়-ধাক্কা খাবার আগে আশমিটিয়ে খেয়ে নেওয়া যাক!

খেলোও প্রচুর। বহুদিনের মরা পেট, তবু প্রাণপণে আকণ্ঠ খেলো। পেটের অসুখ হয় হবে, না হয় কাল আর কিছু খাবেনই না সারাদিন, তবু এসব সে ছাড়তে পারবে না! বড়লোকের বাড়ি, আয়োজনও সেই মাপে হয়েছে। এত রকমের খাবার এর আগে সে চোখে দেখেনি, অর্ধেকের ওপর খাবারের নামও জানে না। কেউ কেউ বলছে, ‘ওহে এটা দাও’,’ওটা নিয়ে এস’–তখন দেখে দেখে চিনছে কিন্তু মনে যে থাকবে না এসব নাম–সে বিষয়েও সে নিশ্চিত। মিষ্টিও হরেক রকমের, সন্দেশই তিন-চার রকম। কড়াপাক, আবার খাব, কাঁচাগোল্লা। দই ক্ষীর রাবড়ি। কিন্তু তখন আর একটি বোঁদের দানার স্থানও নেই পেটে-এসব আছে জানলে কি আর আগে অতগুলো কুমড়ো কপি এঁচোড় আলুপটলের ডালনা মাছ মাংস খেত। নতুন এঁচোড় আর নতুন পটল–তাই মনে হয়েছে অমৃত। মায় খাস্তা কচুরি হালুয়া পর্যন্ত খেয়েছে একটু আগেই। এখন অনুশোচনায় ক্ষোভে চোখে জল আসতে লাগল। কে একজন তবিরকারক এলেন শেষের দিকে, বিরাট জামিয়ার গায়ে দিয়ে, আঙ্গুলে হীরের আংটি এবং বুকে হীরের বোতাম–তাঁকে দেখেই হেমের বুক ঢিপ ঢিপ করতে লাগল। মনে পড়তে লাগল গোবিন্দার গল্পের সেই মামার কথা–কিন্তু তিনি সেসব দিক দিয়ে গেলেন না, ‘কৈ হে কী রকম খাওয়ালে সব–এঁরা যে কিছুই খেলেন না। কী রকম রেঁধেছে ঠাকুররা–সব যে পাতে পড়ে রইল। …কোন রকমে পেটটা ভরিয়ে নিন আপনারা…এ হে, কিছুই যে খেলে না তুমি ভাই!’–শেষেরটা সোজা হেমকেই। কিন্তু ঘর্মাক্ত রুদ্ধনিঃশ্বাস হেম কোন জবাব দেবার আগেই কে একজন বলে উঠল, ‘আর কত খাব বলুন হেঁ-হেঁ–কত রকম করেছেন…হেঁ-হেঁ একটু একটু চাখতেই…হেঁ-হেঁ। না, ঠাকুররা আপনার রেঁধেছে খুব ভাল, কোন জিনিসটাই খারাপ হয় নি!’

‘দই কেমন খেলে, দই? কাঁসারিপাড়ার সরের দই? বলেছি ব্যাটাকে, খেয়ে সব ভাল বললে দাম দেব–’

‘ফার্স্ট ক্লাস স্যার, ফার্স্ট ক্লাস দই! বহুকাল এমন দই খাই নি।’

‘খাবে কোত্থেকে। এসব যে উঠেই গেল ক্রমশ। কে-ই বা এর কদর বোঝে, কে-ই বা এর দাম দেয়!’ আর একজন বলে উঠলেন কৃতার্থভাবে।

কর্মকর্তা যথারীতি আরও দু-একবার হাত জোড় ক’রে কোনমতে পেটটা ভরিয়ে নিতে অনুরোধ জানিয়ে চলে গেলেন সে দিক থেকে। হেম হাঁপ ছেড়ে বাঁচল। একছাদ লোক–বোধ হয় দু’মহলের দুটো ছাদ বোঝাই লোক বসেছে–কে কাকে চেনে, কেই বা কার হিসেব রাখে। দাদার বন্ধুর বাড়ি আয়োজন সামান্য বলেই ধরতে পেরেছিলেন মামা।

এর পর এল সোনালী তবক দেওয়া পান। সবাই উঠে পড়ল হৈ হৈ ক’রে। আঁচাবার জায়গায় ভিড় দেখে দু-একবার রুমালে হাত মুছে বেরিয়ে এলেন। হেমও সেই পন্থা অনুসরণ করলে। রুমালখানায় বাড়ি গিয়ে সাবান দিলেই চলবে। তাড়াতাড়ি ভিড়ে গা ভাসিয়ে একেবারে বাইরে বেরোতে পারলে বাঁচে সে।

।।২।।

বুক ঢিপঢিপিনিটা বাড়ি এসেও ছিল। মাকে বলতে মা-ও প্রথমটা বললে, ‘কাজটা ভাল করিস নি–কী দরকার বাপু, শেষে বে-ইজ্জৎ হওয়া একটা।’ কিন্তু তার পরই ঘুরিয়ে ফিরিয়ে জেরা ক’রে বার বার শুনতে লাগল কী কী হয়েছিল এবং কোনটা কেমন হয়েছিল। প্রতিটি সুখাদ্যে যেন তার রসনা মানসস্বাদ গ্রহণ করতে লাগল সেই বার বার। পুনরাবৃত্তিতে। শেষকালে অনেকক্ষণ ধরে শোনবার পর বললে, ‘তা যা হোক্ বাপু, যা হয় ক’রে বিপদটা কেটে তো গেল। ইশ্বর যা করেন মঙ্গলের জন্যে। বেশ হয়েছে। এমনি তো খাওয়া হ’ত না। আর তো বলতে গেলে ভগবান হাত ধরে টেনে নিয়ে গেলেন। এতে আর কী হয়েছে।

তবু–তখনও পর্যন্ত, এমনি কি বিছানাতে শুয়ে শুয়েও বার বার প্রতিজ্ঞা করলে হেম যে–এই নাক-কান মলা, এ কাজ আর নয়। কিন্তু পরের দিন, তার পরের দিন মনে মনে কথাটা যতই সে ভাবে, নানা সুঘ্রাণ আহার্যের রসনাসুখকর স্মৃতির রোমস্থন করতে থাকে, ততই আবার লুব্ধ হয়ে ওঠে। শেষে দিনতিনেক যাবার পর মন স্থির ক’রে ফেলে–এই শনি-রবিবারও একবার বরাত ঠুকে দেখবে আর কোন এমনি বড়লোকের বাড়ি পাওয়া যায় কি না। বরং একটু দূর থেকে দেখতে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে–যখন ভিড় বেশি হবে, বরযাত্রী কন্যাযাত্রীতে মাখামাখি–তখনই এক ফাঁকে ঢুকে পড়বে। বরযাত্রী মনে করবে কন্যাযাত্রী আর কন্যাযাত্রী মনে করবে বরযাত্রী। সেদিন বড় সকাল সকাল হয়ে গিয়েছিল।

মন স্থির করতে যা দেরি–তার পরই আগ্রহে অধীর হয়ে উঠল। আজকাল প্রায় প্রত্যহই অফিসের ফেরত বড় মাসীর বাড়ি ঘণ্টাখানেক ঘণ্টাদেড়েক কাটিয়ে যায়–সেখানে এতকাল থেকে গেছে–তাই সেটা কিছু অশোভন বা অস্বাভাবিকও দেখায় না। বড় মাসীর কাছ থেকে পাঁজিটা চেয়ে নিয়ে দেখলে রবিবার কোন ‘বিয়ের দিন’ নেই। শুক্রবার আর শনিবার আছে। প্রথমটা একটু দমে গিয়েছিল কিন্তু তার পরই মনে পড়ে গেল–বিয়ে না থাক রবিবার বৌভাত পড়বে অনেক অনেকগুলো।

এইভাবেই চলতে লাগল–সপ্তাহের পর সপ্তাহ। এক একটা রাস্তা ধরে চলে–যেটা বড়লোকের বাড়ি মনে হয়, দূর থেকে সামিয়ানা, বাড়িও অন্যান্য আয়োজন দেখে–ঢুকে পড়ে। ক্রমশ ভয় ভেঙে গেল, সাহস বাড়ল। দু-চার দিন যাবার পর সবার অলক্ষ্যে এক-আধটা সন্দেশ বা দরবেশ পকেটে ফেলতে শুরু করল। সেজন্য বাড়তি রুমাল বা কাঁচা ন্যাকরাও বাঁদিকের পকেটে রাখত, পকেটটা যাতে নষ্ট না হয়। সেগুলো মাকে এনে দিত ছোট ভাইয়ের নাম ক’রে। ভাল সন্দেশ বুঝলে শ্যামা তা থেকে একটু-আধুটু নরেনকেও ভেঙে ভেঙে দিত।

একদিন এমনি এক রবিরারে একটা বড় রাস্তা দিয়ে চলছিল বিয়েবাড়ির খোঁজ–হঠাৎ দেখা হয়ে গেল শরতের সঙ্গে। হেম আস্তে আস্তেই হাঁটছিল–বেড়াতে বেড়াতে দেখতে দেখতে যাবার মতো ক’রে–জোরে হেঁটে গলদ্‌ঘর্ম হয়ে বিয়েবাড়িতে যাওয়া যায় না–কিন্তু শরৎ আগে আগে আরও আস্তে আস্তে উদ্দেশ্যহীনভাবে চলছিল–তাই পিছন থেকে অনেকক্ষণ ধরে লক্ষ্য করতে করতে একসময় তাকে ধরে ফেলল।

এগিয়ে ঘুরে গিয়ে প্রণাম করতেই শরৎ থতমত খেয়ে দু পা পিছিয়ে একটু যেন অবাক হয়েই চেয়ে রইল ওর দিকে। প্রায় মিনিটখানেক সময় লাগল ওকে চিনতে। তার পরই খুশি হয়ে বললে, ‘এই যে এসো এসো। ভাল তো?’

ওকে যে চিনতে দেরি লাগল তার কারণ ঠিক বিস্মৃতি নয়– হেম ইতিমধ্যেই লক্ষ করেছে–অন্যমনস্কতা। কোথায় যেন কোন্ সুদূরে ওর মন নিবদ্ধ ছিল এতক্ষণ। এই পথ ধরে চললেও–এই পথ কেন, এর ধারে কাছে এমন কি এ জগতে ছিল কি না সন্দেহ। বহু দূর থেকে ছড়ানো মনকে যেন কুড়িয়ে গুটিয়ে টেনে আনল সে।

আবারও বলল একবার–একটু থেমে, ‘তার পর, সব ভাল তো?’

‘আজ্ঞে হাঁ। আপনি ভাল আছেন?’

‘আমি? একটু ম্লান হাসল শরৎ। উদাস করুণ এক রকমের হাসি।

তার পর পাল্টা প্রশ্ন করল, ‘তোমার-–তোমার ছোট মাসী আজকাল কোথায় থাকেন? কেমন আছেন? যাও মধ্যে মধ্যে?’

‘আজ্ঞে হাঁ, যাই বৈকি! এই তো কাছেই আছেন–এই রামধন ঘোষের গলি। যাবেনা নাকি? চলুন না।’

‘ন্-না। থাক গে। ‘

একটু দ্বিধাগ্রস্তভাবেই বলে শরৎ, অনিচ্ছার চেয়ে সংকোচই বেশি।

হেম চেপে ধরে, ‘না কেন– এই তো। চলুন না একটু ঘুরে আসবেন। আমিও যাই নি অনেক দিন, আমারও খবর নেওয়া হবে।’

‘কি আর হবে খবর পেলাম–এই তো…অসুখ-বিসুখ করলে খবর দিও। তা ছাড়া হয়তো এখনও বাড়ি ফেরেন নি!’

‘আজ তো রবিবার, ছোট মাসী আজ বাড়িতেই আছে।’

‘কেন–কোথাও যান না? তোমার বড় মাসীমা–হ্যাঁ, তোমার বড় মাসীমা কেমন? গোবিন্দর কি ছেলেপুলে? সবই একসঙ্গেই আছেন তো?’

‘না–সে তো অনেকদিন ছাড়াছাড়ি।’

‘কেন? ছাড়াছাড়ি কেন?

‘সে অনেক কাণ্ড। দাদার প্রথম পক্ষের বৌকে ছোট মাসীই এক রকম জোর ক’রে বাপের বাড়ি পাঠিয়েছিল–সেখান থেকে ফেরার পথে ট্রেনে কলেরা হয়। …তার পরেই–মানে অল্পদিনের মধ্যেই দাদা আবার বিয়ে করে কি না–তাইতে ছোট মাসীর কী হ’ল, মানে সে বৌয়ের জন্যে–মোট কথা ঐ বিয়ে নিয়েই ছাড়াছাড়ি। দাদা যায়, বড় মাসীমাও যান–কিন্তু ছোট মাসী বিশেষ এ বাড়িতে আসে না। কখনও-সখনও কারুর অসুখ-বিসুখ করলে-

‘ও। তোমার ছোট মাসী তা হলে একাই আছেন? তা চল না হয় যাই একবার। আমার নিজে নিজে হয়তো কোন দিনেই যাওয়া হবে না।’

‘চলুন।

নিমন্ত্রণের খোঁজ আর করা হয় না। কিন্তু হেমের কেমন যেন মনে হয়, এটা ঢের ভাল হ’ল। যথার্থ একটা ভাল কাজ। ছোট মাসী বড় একা পড়ে গেছে আজ কাল, বড় নিঃসঙ্গ–জীবনে বেচারীর কিছুই নেই আর, শুধু প্রাণধারণ আর প্রাণধারণের জন্য পরিশ্রম। যদি–আশা করতেও অবশ্য ভরসা হয় না আর–যদি এই উপলক্ষে এরা দুজনে একটু কাছাকাছি আসে ঘনিষ্ঠ না হোক, মেসোমশাই যদি আসা-যাওয়াও করে মধ্যে মধ্যে–তবু দুটো কথা কইবার লোক পায় ছোট মাসী।

‘তা কোথায়…মানে কার সঙ্গে আছেন তোমার ছোট মাসী?’ যেতে যেতেই প্রশ্ন করে শরৎ।

‘ওঁরই এক ছাত্রীর বাড়ি। তার অবশ্য বিয়ে-থা হয়ে গেছে–তবে সেই জানাশুনোতেই এঁদের এখানে ঘর পেয়েছেন। এঁরাও ব্রাহ্মণ–

‘ও। তা আমরা গেলে–মানে আমি গেলে কেউ কিছু বলবে না তো?’ অত্যন্ত সংকোচের সঙ্গে, কেমন এক রকম ছেলেমানুষের মতোই প্রশ্ন করে শরৎ।

‘সে কি! কে আবার কি বলবে? আপনারই তো– ‘

‘আপনারই তো সবচেয়ে বেশি অধিকার সেখানে যাবার’–বোধ হয় এইটেই বলতে চাইলে হেম–লজ্জায় কথাটা শেষ করতে পারল না।

সামান্য একটু হেঁটেই উমার বাড়ি পৌঁছল ওরা।

সন্ধ্যা উত্তীর্ণ হয়ে গেছে বহুক্ষণ উমা আহ্নিক সেরে মারই পুরনো বড় মহাভারতখানা খুলে বসেছে সবে। বহুবারের পড়া–তবু কোন ভাল বইয়ের অভাবে তা-ই পড়ে মধ্যে মধ্যে। সপ্তাহের ছটা দিন মনে হয় বড় বেশি পরিশ্রম, আর পেরে উঠা যাচ্ছে না, একটু বিশ্রাম পেলে ভাল হয়–অথচ রবিবারটাও বড় বেশি মন্থর, বড় বেশি কর্মহীন–দুঃসহ ঠেকে।

হেমের গলা পেয়ে খুশি হয়েই উঠল উমা। ছোড়দির সম্বন্ধে যা-ই মনোভাব থাক, বোনপো বোনঝিদের সে পছন্দ করে। বিশেষ ক’রে হেম–দীর্ঘদিনের ঘনিষ্ঠতায় বিশেষ স্নেহের পাত্র হয়ে উঠেছে।

শুধু হেম মনে ক’রে সাগ্রহে হলেও সহজ ভাবেই দোর খুলে দিয়েছিল উমা–কিন্তু হেমের পিছনে নতমুখে যে লোকটি দাঁড়িয়ে, তাকে দেখে চমকে উঠল সে। বরং বলা চলে ভূত দেখার মতোই চমকে উঠল। কারণ বহুকাল–বহু দীর্ঘকাল আসে নি শরৎ, পথেঘাটেও দেখা হয় নি।

আরও চমকে উঠল ওরা ঘরে ঢুকতে।

হ্যারিকেনের আলো, তবুও তাতেও যা চোখে পড়ল তা-ই ঢের।

এ কী চেহারা হয়েছে শরতের! এ কি তার সেই স্বামী–শুধু যার চেহারার কথা শুনেই অগ্রপশ্চাৎ কিছু ভাবতে দেয় নি দিদি, কিছু খোঁজ করতে দেয় নি মাকে! সেই রূপবান কান্তিমান স্বামী তার!

উমার বিস্মিত, স্তম্ভিত দৃষ্টি অনুসরণ ক’রে হেমও ভাল ক’রে–যেন নতুন ক’রে চেয়ে দেখল মেসোমশাইয়ের দিকে। সত্যি, এ কী বিশ্রী চেহারা হয়ে গেছে ওঁর! চুলগুলো প্রায় সব পেকে গেছে, গায়ের বিশেষত গলার চামড়া শুধু কুঁচকে যায় নি, রীতিমত ঝুলে পড়েছে, চোখের দৃষ্টিটাও হয়ে গেছে কেমন যেন ঘোলাটে বিবর্ণ!

বোধ হয় ওদের দৃষ্টিতে নীরব প্রশ্নটা ফুটে উঠেছিল, শরৎ একটু অপ্রতিভভাবে হেসে বললে, ‘কেমন আছ?’

ওর সেই প্রশ্নে মনে হয় সংবিৎ ফিরে এল উমার, একটা হাসি ভঙ্গি ক’রে বলল, ‘আমি আর খারাপ থাকব কেমন ক’রে। যমের অরুচি তো! কিন্তু তুমি তো বেশ কাজ সেরে এনেছ বলেই মনে হচ্ছে–এখন পা-পা ক’রে ঐ ঘাটের দিকে এগিয়ে গেলেই তো হয়!’

‘তা আর হচ্ছে কৈ? তা হলে তো বেঁচেই যাই। সরকারী আইন না থাকলে সত্যিই পায়ে পায়ে এগিয়ে যেতুম। আর বাঁচার শখ নেই–দরকারও নেই কিছু!’

একটু ম্লান হাসল শরৎ। তার পর বলল, ‘একটা আসন-টাসন দাও–আর দাঁড়াতে পারছি না। আজকাল একটু হাঁটলেই হাঁট দুটো কেমন ভেঙে আসে!’

‘এই যে দিই–। তা তুমি ঐ বিছানাতেই বসো না।

‘না না। পথের কাপড়! মিছিমিছি তোমার পরিষ্কার বিছানাটা–

‘তা বটে।’ হেম ছিল বলে বাকি কথাটা মুখে এসেও আটকে গেল।

‘কোন দিনই তো আর বিছানাটা ছুঁলে না। পরিষ্কার শুদ্ধই রইল চিরকাল। ঐটের সম্বন্ধেই তোমার যত বিবেচনা!’ এমনি অনেক কথাই গলার কাছ পর্যন্ত এসেছিল বলা হ’ল না। সে তাড়াতাড়ি নিজে যে মাদুরটায় বসেছিল, সেইটেই এগিয়ে দিয়ে বললে, ‘বসো না, দুজনেই বসতে পারবে।’

শরৎ বসল। মনে হ’ল যেন পা দুটো ভেঙে বসে পড়ল, যেন আর দাঁড়াতে পারছিল না। কে জানে কেন, ওর অবস্থা দেখে উমার আজ এই মুহূর্তে একটা অপরিসীম মমতা বোধ হ’ল। বড় বেচারা–বড় হতভাগা লোকটা। সে বিছানা থেকে নিজের বালিশটা নামিয়ে দিয়ে বলল, ‘এইটের ঠেস দিয়ে ভাল ক’রে বসো।’ তার পর গলার কাছে ঠেলে-ওঠা একটা কি অবাধ্য বস্তুকে দমন করতে করতেই হেমের দিকে ফিরে প্রশ্ন করল, ‘তার পর? তোদের খবর কি? তরুরা কেমন আছে? পাঠিয়েছিল ওরা এর মধ্যে একবারও? খেঁদি কোথায়?’

‘খেঁদি তরু সব শ্বশুরবাড়ি। সেই তো মুকিল হয়েছে। বাবা যে ফিরে এসেছেন!

‘ফিরে এসেছেন–তার মানে? তিনি তো আসেনই মধ্যে মধ্যে।’

‘না। তা নয়। একেবারে পাকাপাকি। এখানেই আছেন। শরীর একেবারে গেছে তো। বোধ হয় এবার–। মা’র খুবই কষ্ট হচ্ছে, সংসারের সব কাজ–মা’র আবার আরও কতক বাড়তি কাজ আছে–সে তো তুমি জানই–তার ওপর বাবার সেবা। দিনের মধ্যে চোদ্দবার পুকুরে ডুব দিতে হচ্ছে!’

‘বাবা, এমন! একেবারে অশক্ত হয়ে পড়ে তবে বুঝি স্ত্রীপুত্রের কথা, বাড়ির কথা মনে পড়েছে! তা হলে ছোড়দির তো খুব চলছে। তা তুই এবার একটা বিয়ে-থা কর–বয়স তো পেরিয়ে গেল!’

উমা কথাটা শেষ করার আগেই–এর খোঁচাটা যে অন্যত্রও লাগতে পারে মনে পড়ায়–শরতের মুখের দিকে চাইল। সে তখন বালিশটা টেনে একটা হাঁটু উঁচু ক’রে আর একটা পা সেই ঊরুর উপর তুলে আধ-শোয়া ক’রে বসছে, দুটি চোখই তার বোজা–মুখেও কোন বেদনা বা আঘাতের চিহ্ন নেই, যেমন ভাবহীন থাকে সাধারণত প্রায়, তেমনিই, শুধু লক্ষ্য ক’রে দেখে উমা–কপালে ওর বড় বেশি রেখা পড়েছে, যা পড়া উচিত তার চেয়ে যেন ঢের বেশি।

হেম ওদের দিকে ওত লক্ষ্য করে নি–তার মনে নিজের ভবিষ্যতের প্রশ্নটাই সবচেয়ে বড়–সে হ্যারিকেনের দিকে চেয়ে ঈষৎ লজ্জিত কণ্ঠে বললে, ‘হুঁ! মা তো দিনরাত খ্যাচ্-খ্যাচ্ করছে, কিন্তু মাইনে তো ঐ, তার ওপর আবার খরচা বাড়ানো–। বড় ভয় করে। মাথার ওপর অসুমর দেনা, মা যে কোথা থেকে করে কি শোধ করবে তা জানি না!’

‘মা তো তোর ঐ ক’রেই করছে সব, যখন তোর মাইনে বলতে কিছু ছিল না, তখনও তো চালিয়েছে। তিনটে মেয়ের বিয়েও দিল। তা ছাড়া দুটো পেট তো কমেও গেছে। তরু নেই, খেঁদি নেই —

‘তেমনি বাবা আছে। তা নয়–। ভাবছি তাই।’

শরৎ কি তন্দ্রাচ্ছন্ন হ’ল নাকি?

উমা গলাটা অকারণেই ঈষৎ একটু উঁচু ক’রে বলে, ‘কতক্ষণ বেরিয়েছিস বাড়ি থেকে? খাবি কিছু? ঘরে অবশ্য নারকোল নাড়ু আছে, কিন্তু–। খাবার আনাব?’

প্রশ্নটা যথাস্থনেই পৌঁছয়। –শরৎ এবার নড়েচড়ে বসে। বলে, আমার জন্যে কিছু আনিও না।

‘কিছুই খাবে না? একটু মিষ্টি?’

‘না। মিষ্টি সহ্য হয় না। বড় অম্বল হয়। চা নেই তো ঘরে–না?

‘ঘরে নেই–তবে বাড়িওয়ালাদের কাছে আছে! ওদের একটা উনুন জ্বলছেই দিনরাত, শুধু চায়ের জন্যে। ক’রে দিচ্ছি আমি।’

‘না, না। থাক–আবার অত হাঙ্গামা করতে হবে না। পরের কাছে চেয়ে- চিন্তে–’

‘তাতে কোন হাঙ্গামা নেই। ওর চোদ্দবার চিনি চেয়ে নিয়ে যায় আমার কাছ থেকে। ওরাই ক’রে দেবে এখন

উমা ভেতরে যায়। দু কাপ চা চাই, আর ওদের কোন লোক যদি কখনো হিঙের কচুরি এনে দিতে পারে।

কিন্তু ইতিমধ্যে হেমের মাথা খুলে যায়। সে হঠাৎ উঠে পড়ে বলে, ‘আমি চট ক’রে একটু ঘুরে আসছি মেসোমশাই–যাব আর আসব। এই পাড়াতেই একটু কাজ আছে। এলুম যখন–’

শরৎ যেন ব্যাকুল হয়ে ওঠে। একলা উমার সঙ্গে মুখোমুখি এই নির্জন ঘরে বসতে বোধ করি ভয়ই করে ওর। বলে, ‘আরে ও কি কোথায় যাবে? বসো না। আমিও তো উঠব–। তোমার মাসী হয়তো তোমার জন্যে খাবার আনতে গেল

‘যাব আর আসব মেসোমশাই, পাঁচ মিনিটের মধ্যে।’

শরৎ আর কিছু বলবার আগেই বেরিয়ে যায় সে।

উমা যখন খাবার আর চা নিয়ে ফিরে আসে, তখন হেম নেই। শরৎ একা তেমনি চোখ বুজে বসে আছে।

‘ও কি–হেম কোথা গেল?’

‘পাঁচ মিনিটের মধ্যে ঘুরে আসছি বলে কোথায় গেল। এই পাড়াতেই নাকি ওর কী কাজ আছে।’

‘দ্যাখ দিকি দুষ্টু ছেলে। চা-টা নষ্ট হবে।’ উমা এই বয়সেও রাঙা হয়ে ওঠে কি?

‘দুষ্টু–? ও!’ শরৎ মুখ টিপে হাসে। লজ্জিত হাসি। তার পর বলে, ‘নষ্ট হবে কেন, তুমি খাও না!

‘না। ও আমার সহ্য হয় না। খাই না যে একেবারে তা নয়, এদের পাল্লায় পড়ে সর্দি-কাশি হলে খেয়েছি–কিন্তু রাত্রে ঘুম হতে চায় না!’

‘তা হোক। খাও একটু। একা খাব!’

শরৎ বাকি কাপটা ওর দিকে ঠেলে দেয়, হাতে তুলে দিতে বুঝি সংকোচে বাধে।

উমা অগত্যা কাপটা টেনে নেয়। হেমের জলখাবারের রেকাবিটা তক্তপোশের নীচে সরিয়ে রেখে সামান্য একটু ঠেলে দেয়। বলে, ‘খাও। মিষ্টি নয়, হিঙের কচুরি। নারকোল নাড়ু একটা দিয়েছি, না খেতে চাও খেও না। ঘরে তৈরি ছিল, তাই–’

শরৎ নীরবে কচুরির থালা টেনে নেয়; চিবোতেও থাকে যতটা সম্ভব নিঃশব্দে।

উমা চায়ে একটা চুমুক দিয়ে প্রশ্ন করে, ‘তোমার কী হয়েছে? শরীর খারাপ? অসুখ ধরিয়েছ নাকি?’

‘অসুখ? না–তেমন কিছু নয়, মোটামুটি ভালই আছে শরীর। তবে খাওয়া-দাওয়ার অনিয়ম হচ্ছে তো। হোটেলের খাওয়া কোনকালে সয় না, আমার, অথচ তাই খেতে হচ্ছে–দু বেলাই।’

‘কেন? তার তার মানে? হোটেলে কেন?’

কণ্ঠটা বড় বেশি যেন তীক্ষ্ণ শোনায় উমার। সে নিজেই লজ্জিত হয়ে পড়ে। যে প্রদেশে সে গিয়ে পড়ছে সেখানে তার প্রবেশ নিষিদ্ধ।

শরৎ চায়ের পেয়ালায় একটু চুমুক দিয়ে, বেশ সহজ কণ্ঠেই বলে, ‘গোলাপী মরে গেছে। ছেলেমেয়ে দুটো সুদ্ধ। এক রাত্তিরে তিনজনই গেল কলেরায়, শুধু আমারই কিছু হ’ল না। তার পর আর কি-এই!’

উমা উত্তর দিবে না। ওর বুকে যে তুমুল আলোড়ন উঠেছে, তাতে সহজভাবে কথা বলা আর সম্ভব নয়! রক্তের সে উত্তাল গতির শব্দ বাইরে থেকেও যেন কান পেতে শোনা যায়। সহস্র প্রশ্ন ঠেলাঠেলি করে মনের মধ্যে, সহস্র অভিমান, সহস্র অনুযোগ। কিন্তু কিছুই বলে না সে, বলতে পারে না। শুধু–হাত দুটো বড় বেশি কাঁপতে শুরু হয় বলে চায়ের কাপটা নামিয়ে রাখে।

চা-টা শেষ ক’রে শরৎও কাপটা নামিয়ে রাখে। দুখানা কচুরি খেয়েছে, আর নারকোল নাডুটা। আরও দুখানা কচুরি পড়ে রইল, কিন্তু এখন আর ওর পক্ষে খাওয়া সম্ভব নয় বুঝেই উমা অনুরোধ করল না। তা ছাড়া সেদিকে ওর দৃষ্টিও ঠিক পুরোটা ছিল না, মনও নয়। মন বহুদিনের ফেলে আসা দীর্ঘ মরুদিনগুলিতে বিচরণ করছিল, বহু নালিশ, বহু হাহাকার, বহু ব্যর্থতা সেখানে।

অনেকক্ষণ পরে কথা কইতে পারল উমা। একটা ডেয়ো পিঁপেড়ে ক্রমাগত চক্রাকারে আলোটার পাশে ঘুরছে, সেই দিকে চেয়ে প্রশ্ন করল, ‘তা আর কোথাও–মানে আর কোন আত্মীয়

‘নাঃ! তেমন আর কে আছে। আত্মীয়-স্বজনদের সঙ্গে তো বহুকালই ছাড়াছাড়ি, কে কোথায় আছে তাও জানি না। তেমন পয়সা থাকলে তারাই হয়তো খবর পেয়ে এসে জুটত তাও তো নেই। এখন আমার বোঝা বইবার মজুরি পোষাবে না।’

একটু হাসল সে। তার পর বলল, ‘আর কত দিন বাঁচতে হবে তাও তো বুঝতে পারছি না–নইলে সব বেচে কিনে দিয়ে কোন তীর্থে চলে যেতুম। …ছোট প্রেস, বেচতে গেলে তিন-চার হাজারের বেশি উঠবে না–সে টাকা সম্বল ক’রে কোথাও যাওয়া যায় না, ভরসা হয় না!’

আবারও কিছুক্ষণ দুজনেই চুপচাপ

যে কথাটা গলার কাছে ঠেলাঠেলি করছে সেই থেকে–সেটা কিছুতেই বলতে পারে না, সে অনুরোধ করতে পারে না। অথচ লোকটার জন্য এ কী প্রবল অনুকম্পা বোধ করেছে ও, এ কী অকারণ মমতা। এমন কি–সেই স্ত্রীলোকটার মৃত্যুসংবাদও, এর দিকে চেয়ে যেন দুঃসংবাদ বলেই মনে হচ্ছে।

শরৎ আবারও যেন চোখ বুজে তন্দ্রাচ্ছন্ন হয়ে পড়েছিল, হঠাৎ উঠে বসে বলে, ‘হেম তো এল না। আমি তা হলে উঠি আজ–কী বল!’

আর না বললেই নয়! এ সুযোগ এবং সুবিধা কবে আসবে আবার কে জানে, আবার কত কাল পরে দেখা হবে!

মরীয়া হয়েই বলে ওঠে উমা, ‘তা তোমার প্রেস তো এমন খুব বেশি দূরে নয়, এখান থেকে খেয়ে গেলেই তো হয়!’

.

‘তোমার এখান থেকে?’

‘হ্যাঁ? তাতে দোষ কি?’

‘না, দোষ কিছু নেই। তবে তুমি একার মত যা হয় দুটি রাঁধ চুড়র-বুড়ুর–তার মধ্যে আমি আবার–। …মিছিমিছি তোমার ঝঞ্ঝাট বাড়ানো। থাক, আর কটা দিন দেখি। তার পর একেবারে শরীর ভেঙে গেলে তাই হয়তো এসে উঠতে হবে তোমার ছোড়দির বরের মতো। বোনে বোনে তোমাদের বরাত কিন্তু বেশ!’ হেসে বলল শেষের কথাগুলো, একটু ঠাট্টার সুরেই।

‘না। তার বরাত আমার চেয়ে ঢের ভাল। সে ছেলেমেয়ে পেয়েছে সংসার পেয়েছে, নিজের বাড়িঘর করতে পেরেছে। তার স্বামী পশু হোক সে পশুকেও সে পেয়েছে, অন্তত কিছু দিনের জন্যে। আমি কি পেলুম?’

এতক্ষণে সমস্ত সংযমের ও সংকোচের বাঁধ বুঝি ভাঙে! চেষ্টা ক’রেও কথাগুলোকে বুঝি আটকাতে পারে না উমা।

শরতের মুখের হাসি মুখেই মিলিয়ে যায়, লজ্জায় অপমানে এবং হয়তো বা বেদনাতেও মুখ বিবর্ণ হয়ে ওঠে। কয়েক মুহূর্ত চুপ ক’রে থেকে আস্তে আস্তে বলে, ‘মাপ কর। সত্যিই আমার অপরাধের সীমা নেই। কথাগুলো আমার আরও ভেবে বলা উচিত ছিল।’

সে আস্তে আস্তে ঘরের বাইরে গিয়ে পায়ে জুতোটা গলিয়ে একসময় বাড়িরও বাইরে বেরিয়ে যায়।

উমা আর কিছুই বলতে পারে না। আটকাতেও পারে না ওকে। ব্যাকুলভাবে একবার ঘরের বাইরে এসে দাঁড়ায়, কিন্তু বাড়িতে আরও বহু লোক। ওদের কাছে অপরিচিত একটা পুরুষের পিছু পিছু গিয়ে হাত ধরে বা মিনতি ক’রে টেনে আনা সম্ভব নয়।

এ কী করল ও, এ কী বলল। যা বলতে গিয়েছিল তার উল্টোটাই বলে বসল! এই সময় একটু সেবা, একটু সান্ত্বনা, একটু সাহচর্য দেবার জন্যই বুঝি মনটা উন্মুখ হয়েছিল, সহানুভূতিতে পূর্ণ হয়ে গিয়েছিল মন–কিন্তু সে বার্তা তো ওর কথায় প্রকাশ পেল না, কঠোর নির্ঘাত আঘাতে সে তো সরিয়েই দিল আরও দূরে–

এ সময় যদি হেমটাও থাকত–

সব লজ্জা ত্যাগ ক’রে সে হেমকে দিয়ে ডেকে পাঠাত কিন্তু হেম আর এল না। তখনও নয়–তার পরেও নয়। সে রাতেই আর ফিরল না সে।

ওদের দীর্ঘ নিভৃত অবসর দিয়েই চলে গিয়েছিল–কিন্তু উমা সে অবসরকে কোন কাজেই লাগাতে পারল না। এতদিন ছিল আত্ম-অনুকম্পা আর দুর্জয় অভিমানের মধ্যে একটা আশ্রয়–অদৃষ্টের পরিহাসে সেটুকুও ঘুরে গিয়ে সে জায়গায় দেখা দিল অনুশোচনা।

দ্বাবিংশ পরিচ্ছেদ

॥১॥

হেম বিয়ে করতে রাজী হয়েছে, কথাটা মহাশ্বেতা ও-বাড়ি থেকে ফেরবার পর আর কারুরই জানতে বাকি রইল না। বাকি থাকবার কথাও নয়–আনন্দের কথা, উল্লাসের কথা। গোপন করবারও কোন কারণ মনে পড়ে নি মহাশ্বেতার।

কিন্তু সে-রাত পোহাবার আগেই, কথাটা এত ‘গাঁজাবার’ জন্যে–তার অনুতাপের শেষ থাকে না। কে জানত যে মেজবৌয়ের একটি বোন হাতের কাছে যোগানো ছিল!

প্রমীলা সোজাসুজি বলে নি মহাকে, সাহসে কুলোয় নি বোধ হয়। কারণ মহাশ্বেতার মুখ আজকাল একটু খুলছে, ইদানীং সে ওকে শুনিয়েই নানা কথা বলে, ওর প্রতি মনোভাব যে মহাশ্বেতার ভাল নয় সেটা কারুর কাছেই আর গোপন নেই। বিশেষত বড় আর ছোট হয়েছে একজোট। প্রমীলার প্রতি এতদিনের সমস্ত বিদ্বেষ তরলার প্রতি সহানুভূতি রূপে প্রকাশ পাচ্ছে। ওকে উপলক্ষ ক’রে সে বিষ উদগার করার সুবিধা হয়েছে খুব–আর তরলাও যেন একমাত্র আশ্রয় হিসেবেই, তার বড় জাকে অবলম্বন করেছে।

সুতরাং সন্ধ্যাবেলা পুরুষরা অফিস থেকে ফিরতেই প্রমীলা কথাটা বলেছে অম্বিকাকে, অম্বিকা বলেছে দাদাকে।

অভয়পদ অবশ্য শুনে বলেছিল, ‘তাই নাকি? তা তুমিই বলো না তোমার বৌদিকে!’

‘না দাদা–তুমিই বলো। মেজ বৌ অতি-অবিশ্যি করে বলে দিয়েছে।’

‘বলছ, তা বলব ওকে। কিন্তু এ তো তোমার বা মেজবৌমারই বলবার কথা।’

আর কিছু বলে নি সে। শুধু ঈষৎ একটু ভ্রু কুঁচকে–অভয়পদর পক্ষে সেইটাই অবশ্য যথেষ্টর বেশি–ভাইয়ের মুখের দিকে চেয়েছিল। অম্বিকা সে দৃষ্টির সামনে সংকুচিত হয়ে দাঁড়িয়ে মাথা চুলকেছে।

রাত্রে শুতে যাবার আগে অভয়পদ স্ত্রীর ঘরে এসে দাঁড়াল। স্ত্রীর ঘরই বলতে হয়–কারণ অভয় কোন দিনই সে ঘরে শোয় না। চলনে তার সেই অদ্বিতীয় কাঠের বেঞ্চিটিই এ জগতে বোধ হয় তার একমাত্র বাসা।

‘কী গো, কি সমাচার। আজ যে এ ঘরে?’ চিমটি কেটে বললে মহা

অভয়পদ সে কথার জবাব না দিয়ে বললে, ‘হেম নাকি বিয়ে করতে রাজী হয়েছে? মা নাকি তোমায় মেয়ে দেখতে বলেছেন!’

‘বাব্‌বা, এরই মধ্যে তোমার কাছে পর্যন্ত খবর পৌঁছে গেছে! আমিই তো বলব ভাবছিলুম। তা বেশ তো, দ্যাখ না–একটা ভাল-দেখে মেয়ে। বাবা বলে দিয়েছেন বেশ সদ্বংশের একটি মেয়ে দেখতে ‘

অভয়পদ মুহূর্তকাল মৌন থেকে বললে, ‘অম্বিকে বলছিল মেজ বৌমার নাকি একটি বোন আছে, আপন খুড়তুতো না জাঠতুতো বোন–তাকে একবার দেখবার কথা!’

‘কে! কার কথা!’ চাপা গলা যত দূর ফেটে পড়া সম্ভব তাই পড়ে মহাশ্বেতা, ‘মেজ বোয়ের বোন! এই কথা পেড়েছে ওরা? সাহস বটে, বলিহারি যাই! আস্পদ্দা!’

অভয়পদর মুখে কোন বিস্ময় ফোটে না; বরং বেশ যেন প্রশান্ত মুখেই প্ৰশ্ন করে, ‘কেন এতে আর সাহসের কী আছে! তোমরা মেয়ে খুঁজছ–তাদের ঘরে আছে, এই তো!’

‘হ্যাঁ–জেনেশুনে ঐ ঝাড়ের বাঁশ আমি বাপের বাড়িতে ঢোকাই! আমার কি হায়া-পিত্তি সব ঘুচে গেছে? ও বেউড় বাঁশের ঝাড়, ও রক্ত যেখানে আছে সেখানে কোন কাজ করব না আমি, করতে দেব না এই আমার পষ্ট কথা। তা তুমি রাগই কর আর গোসাই কর।’

অভয়পদ মুকি হাসে একটু, বলে, ‘তুমি যেখান থেকে মেয়ে আনবে সে কোন্ ঝাড়ের হবে তা কী ক’রে জানছ? বাইরে থেকে কার কতটুকু বোঝ?’

‘সে বরাতে যা আছে তা হবে। তাই বলে জেনেশুনে ঐ ডাকাত মেয়ের বোনকে-না সে আমি পারব না!’

‘তা হলে এই কথাই আমি ব’লে দেব তো?’ একটু চুপ ক’রে দাঁড়িয়ে থেকে প্রশ্ন করে অভয়পদ।

‘দাও না। তাতে কি হয়েছে? আমি কি ভয় করি নাকি? অত ভয় কিসের? তোমার কাছে তোমার ভাই গুরু গোবিন্দ আর মেজ ভাজ মা গোসাঁই হতে পারে, আমার কাছে নয়!’

কথাটা সম্ভবত যথাযথই জানিয়েছিল অভয়পদ! ফলে মেজবৌ যাকে বলে ‘নিজমূর্তি-ধরা’ তাই ধরলে। ঠিক মুখের ওপর বা স্পষ্ট ক’রে না বললেও, কারুরই আর বুঝতে বাকি রইল না যে এ সব শব্দভেদী বাণ কার উদ্দেশ্যে বর্ষিত হচ্ছে।

ভোরবেলা হয়তো উঠোন ঝাট দিতে দিতে দুর্গাপদকে উপলক্ষ ক’রে বলে. ‘লোকে কথায় কথায় বলে বংশ। ভাল বংশ দেখে কাজ করতে হয়! ওসব আমি মানি না! এই যে আমার বড় জা, লোকে বলে বোকা তা বোকাই বলুক আর যা-ই বলুক অমন নিপাট ভালমানুষ তো কই বড় একটা দেখা যায় না। মনে যা এল মুখে বলে ফেললে, কখনও রেখে-ঢেকে কথা কইতে জানে না। মন গঙ্গাজল। আর দ্যাখ কাজে কর্মে আহারে ব্যাভারে বাড়ির বড় বৌয়ের যেমন হওয়া উচিত ঠিক তেমনি–নয় কি? কিন্তু বংশ দেখতে গেলে কি ও মেয়ে আনা চলত? তুমিই বল না ছোট-ঠাকুরপো, গুরুজন–বলা অবিশ্য উচিত নয়, পেন্নাম করি এই খান থেকেই–কী মানুষ বল তো ওর বাবা? ঐ বাপের এই মেয়ে–ভাবাই যায় না। না, ওসব কিছু নয় যাকে যেমন তৈরি করেছেন ভগবান।

সে কথা কানে যাওয়ার কোন অসুবিধে নেই। কারণ বড় বৌ হয়তো তখন রান্নাঘরে ডাল সালাচ্ছে। সে তেলেবেগুনে জ্বলে ওঠে, ‘আমার বংশ! আমার বংশের কথা কেউ যেন না মুখে আনে। বাবা যা-ই হোক কত বড় গুরুবংশ আমাদের দুশো আড়াইশো ঘর শিষ্যি-যজমান ছিল ঠাকুরদার। কত লোক নিত্যি তাঁর পাদোকজল খেত। একজনকে দেখে বংশ বিচার করা যায় না।’

‘আমিও তো তাই বলি ছোট ঠাকুরপো–একজনকে দেখে বংশ বিচার করা ঠিক নয়। কে কেমন তাও কেউ ঠিক ক’রে বলতে পারে না। ন্যাবা হলে মানুষ সব হলদে দেখে শুনেছি, কারুর ওপর কারুর রীষ থাকলে তার সব খারাপ দেখে। কিন্তু যথাধর্ম কার মনে কী আছে কেউ কি বলতে পারে? ওপরটা দেখে বিচার করা চলে না।’

মহাশ্বেতা নিজের ফাঁদে নিজে আটকে পড়ে গজরায় শুধু–লাগসই জবাব একটাও খুঁজে পায় না।

কোন দিন হয়তো আঘাতটা একেবারে সোজা এসে লাগে–বল্লমের আঘাতের মতো।

‘বলি আমি কার ঘরে কী আগুন লাগিয়েছি–কার ভাতারপুতকে ছিনিয়ে নিয়েছি যে আমার ঝাড়ে-বংশে সব খারাপ হয়ে গেল? আমি কি কাউকে ভাঙিয়ে নিয়েছি কলিয়ে সলিয়ে? আমি কারুর পেছনে ঘুরি? আর কারুর পেছনে না ঘুরে যদি আমার পেছনেই কেউ ঘুরে মরে–সে কি আমার দোষ?…তোরা ভোলাতে পারিস না কেন? আমি কি চেষ্টা করে কাউকে ভোলাই? এটি মনে রেখো পুরুষ রূপেও ভোলে না বয়সেও ভোলে না–ভোলে গুণে। নিজেদের দোষ কেউ দেখতে পায় না–শুধু শুধু নিজের খামতি পরের দোষ বলে চালাতে চেষ্টা করে।’

এ আঘাত অবশ্য বড় বৌয়ের চেয়ে ছোট বৌকেই লাগে বেশি। সে এসে কান্নাকাটি করে বড় জায়ের কাছে, ‘দিদি আপনারা তো দেখেশুনেই কালো বৌ আনলেন অমন সুন্দর পুরুষের জন্য–এখন আমাকে দোষ দিলে চলবে কেন? এ তো ইচ্ছে ক’রে আমাকে জব্দ করা।’

আঘাত আসে তরলার ওপর অন্য দিক দিয়েও।

এর পর যেন আরও বাড়ায় প্রমীলা! ওদের দেখিয়ে দেখিয়ে দুর্গাপদর সঙ্গে হাসিঠাট্টা গল্পগুজব বাড়িয়ে দেয়। আজকাল সন্ধ্যে থেকেই দুজনে ছাদে বসে থাকে–রাত্রের রান্না মেজবৌ ছেড়েই দিয়েছে দীর্ঘ কাল একবার শুধু খেতে নামে, আবার উঠে যায়, রাত দেড়টা-দুটো পর্যন্ত বসে গল্প করে!

‘কিসের এত কথা ওদের, কিসের এত গল্প বলতে পারিস না ছোট বৌ? ফুসমন্তর ঝাড়ে বসে বসে–না কি? নাকি গুণজ্ঞান ক’রে পাথর করে বসিয়ে রাখে। আর তুক-গুণের কথা বলবই বা কি বাড়িসুদ্ধ লোককেই তো গুণ করে রেখে দিয়েছে। নইলে ভাসুর সোয়ামী শাশুড়ি সব বিদ্যমান থাকতে এমন বেলেল্লাগিরি করে পার পেয়ে যায়–এ কখনও শুনি নি বাপু। তা ছাড়া শরীরেরও তো কুলোয়। মেজবৌ না হয় সারা দুপুর ঠেসে ঘুমোয় ওর এক রকম পুষিয়ে যায়–কিন্তু ছোট কর্তাকে তো সাতটায় ভাত খেতে বসতে হয় ওর চলে কী করে? … ‘

ইদানীং–মহাশ্বেতা শিখিয়ে দেওয়াতেই–কিছুদিন ধরে দুর্গাপদ গিয়ে শোবার পর তরলা নেমে এসে ওর বিছানাতে বসে পা টিপে দিচ্ছিল। প্রথম প্রথম দু-চার দিন নিষেধ করলেও শেষ পর্যন্ত প্রবল বাধা কিছু দেয় নি। দু-চার দিন পরে নিষেধও করত না! ব্যাপারটা বেশ সহজেই মেনে নিয়েছিল। প্রত্যহই তরলা এসে নিঃশব্দে পা টিপতে বসত, পা টেপার মধ্যেই একসময় ঘুমিয়ে পড়ত দুর্গাপদ–ওর নিঃশ্বাসের শব্দে ঘুম গাঢ় হয়েছে বুঝতে পেরে তরলা ফিরে গিয়ে নিজের বিছানায় শুত–এবং আরও বহুরাত্রি পর্যন্ত জেগে কাটাত।

কিন্তু মহাশ্বেতার সঙ্গে মেজবৌয়ের এক প্রত্যেক্ষ বিরোধের পর দুর্গাপদ বহুরাত্রে ফেরে এখন–সারাদিনের পরিশ্রমের ফলে–তরলার চোখের পাতা ভেঙে আসে ঘুমে, এক-এক দিন টেরও পায় না কখনও এসে শোয়। যদি বা ঘুম ভেঙে উঠে যায় অথবা জোর ক’রে চোখে জল দিয়ে জেগে থাকে–দুর্গা আর ওকে ছুঁতে দেয় না পা। বলে, ‘ঢের হয়েছে, জুতো মেরে গরু দানে আর কাজ নেই। হেন কুকথা নেই যা আমার নামে তোমরা রটাচ্ছ না–আবার এ লোক-দেখানো পতিভক্তি কেন? যাও শুয়ে পড় গে।’

তাতে তরলা হয়তো জবাব দেয়, আমি কি বলেছি কিছু, আমাকে দোষ দিচ্ছেন কেন?’

হ্যাঁ–হ্যাঁ, কে বলছে আর কে কার পেছনে কলকাঠি নাড়ছে সব আমি জানি, থাক্। খবরদার আমার পায়ে হাত দিতে এলে এবার কটু দিব্যি দেব যে টের পাবে মজা! দূর ক’রে দেব ঘর থেকে!

লজ্জায় অপমানে ভয়ে কাঠ হয়ে যায় তরলা।

পরের দিন বড় জায়ের কাছে বলে, ‘গত জন্মে কত পাপ করেছিলুম, কোন্ সতীলক্ষ্মীকে কী বঞ্চিত ক’রে এসেছিলুম তাই এ জন্মে সব পেয়েও বঞ্চিত হলুম। এমন ঘর বর গয়না কাপড়–এমন আপনার মতো জা, নির্বিরোধী শাশুড়ি-কটা মেয়ে পায়? সব পেয়েও আমি আজ কাঙ্গাল। শুধু এই ভেবেই নিজের হাতে প্রাণটা বার করতে পারি না দিদি, নইলে উপায় সব জানি। বলে আত্মহত্যা মহাপাপ, সে জন্মের পাপের ফলে এই ভুগছি আবার মহাপাপ বাড়বে! শুধু সেই জন্যে পিছিয়ে আসি–ভাবি থাক, সব পাপের প্রায়শ্চিত্ত যেন এই জন্মেই হয়ে যায়। কিন্তু আর সহ্য হচ্ছে না। আর পারছি না মাথা ঠিক রাখতে।’

‘তা দিনকতক বাপের বাড়ি ঘুরে আয় না ছোট বৌ।’

‘ছিঃ! তারা তো সবাই জানে–আমি না বললে কী হবে, জানতে কিছু কি বাকি আছে?…সে বাড়িতে পা দেব কোন্ মুখে। সবাই আহা-উঁহু করবে, দয়ার চোখে দেখবে–সে আরও বেশি অসহ্য। তা ছাড়া তারা তো কিছু কম করে নি–যথাসাধ্য খরচ ক’রেই বিয়ে দিয়েছে–তার ওপর তাদের ঘাড়ে চাপব! বাপ-মা’র জ্বালার ওপর জ্বালা! আর বিয়ের পর বাপের বাড়ি পড়ে থাকা মানেই ঝি হয়ে থাকা! শ্বশুর-বাড়িতে হেনস্তা হলে বড় অসহ্য লাগে দিদি! না, যদি বেরোতে হয় তো মরাই বেরোব।’

‘বাপ রে! অমন কথা বলিস নি! আমি বলছি,–তুই সতীলক্ষ্মী মেয়ে, তোর হক্ তুই একদিন ফিরে পাবিই। দুটো দিন সবুর কর!’

॥২॥

কথাগুলো যখন বলেছিল মহাশ্বেতা তখন তা যে এত শিগগির ফলে যাবে, তা বোধ হয় সে নিজেও আশা করে নি।

আর এমন মর্মান্তিক ভাবেই ফলল!

মর্মান্তিক বৈ কি! মেজবৌ অন্য সব ব্যাপারে যতই মহার ওপরে টেক্কা দিক, একটা ব্যাপারে মহাই তাকে টেক্কা দিয়েছে। সন্তান বলতে এ বাড়িতে যা কিছু মহাশ্বেতারই। প্রমীলার একটি মেয়ে হয় বহুদিন আগে মরে গিয়েছিল–আর কিছুই হয় নি। হবেও না আর–তাই সকলে জানত। মহাশ্বেতা সগর্বে বুক ফুলিয়ে বলত সবাইকে, ‘মদ্দর মত গাছে চড়লে কী জলে ঝাঁপাই-ঝুড়লে মদ্দই হয়ে যায়–বুঝলি! সব তাইতে হামবড়া, কত্তামি। তাই ভগবান বললে কত্তামি নিয়েই থাক, তোকে আর গিনেমো করতে হবে না। ওর তো আগাগোড়া বাজা মেয়েমানুষের লক্ষণ, একটা হয়েছিল কি ক’রে তাই ভাবি। …সে যা হয়ে গেছে হয়ে গেছে–আর নয়, এটি জেনে রেখো!’

কিন্তু নজর পড়ল মহাশ্বেতারই।

কিছুদিন ধরেই খেয়ে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে ঘাটে চলে যায় মেজবৌ। কেন যায় অত কেউই মাথা ঘামায় নি, হঠাৎ একদিন মহার বড় ছেলেটা বললে, ‘মা জান–মেজকাকী রোজ খেয়ে উঠেই বমি করে!’

‘তাই নাকি, কে বললে রে!’

‘আমি দেখেছি, যা খায় বমি ক’রে আসে। সকালে আজকাল কিছু খেতে চায় না দেখ না? খেয়েই বমি করতে হয় যে। …মেজকাকী বাঁচবে–হ্যাঁ মা?’

মহাশ্বেতা এখন আর এসব ব্যাপারে অনভিজ্ঞ নেই।

সেদিন দুপুরে রান্নাঘরে তিন জায়ে খেতে বসেছে, ভাত নিয়ে নাড়াচাড়া করছে মেজবৌ–হঠাৎ মহার মনে পড়ে যায় কথাটা।

তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখে মেজবৌয়ের মুখের দিকে। চোখের কোলে কালি পড়েছে, মুখের চেহারাটাও যেন কেমন কেমন।

‘হ্যালা মেজবৌ–তোর রকম-সকম তো ভাল বোধ হচ্ছে না। ‘

‘সে তো তোমার কোন দিনই ভাল বোধ হয় না দিদি!’

‘নে রঙ্গ রাখ। …দেখি জামাটা খোল তো–’

এবার মেজবৌও লজ্জিত হয়, কী যে বল দিদি তার ঠিক নেই। ‘

‘ওমা তা এখানে আবার লজ্জা কি, পুরুষ তো কেউ নেই। আর তোর কি এখনও লজ্জার সময় আছে?’

‘যাও! দেখবেই বা কি! তোমার বুঝি এখন জ্ঞানবুদ্ধি খুব হয়েছে? নিজে তো এককালে পা ছড়িয়ে কাঁদতে বসেছিলে মরে যাচ্ছি বলে–

‘ও। তাই বল! তা হলে মেজকত্তার য়্যাদ্দিন পরে জলপিণ্ডির ব্যবস্থা হচ্ছে! আজ আসুক মেজ কর্তা বাড়িতে–সন্দেশ আদায় না ক’রে ছাড়ছি না। ভোঁদা গয়লার দোকানে অর্ডার দেওয়া রাজভোগ খাওয়াতে হবে।

‘নাও। নাও। ওসব বলো না খবরদার। বুড়ো বয়সে–লজ্জা করে।’

‘লজ্জা আবার কি লা! তোর যেমন কথা। এ তো আনন্দের খবর।’

কথাটা বলতে বলতেই কিন্তু যেন মহাশ্বেতা গম্ভীর হয়ে ওঠে। পরাজয় তো বটেই–সেই সঙ্গে যেন কতকটা আশাভঙ্গও। স্বামী যে যথাসর্বস্ব মেজ ভাইয়ের হাতে তুলে দিচ্ছে তার তবু একটা সান্ত্বনা এত দিন ছিল যে– হয়তো এ যা- কিছু একদিন তার ছেলেরাই পাবে।

তবু–মনে মনে যতই পরাজয়ের গ্লানি এবং আশাভঙ্গের বেদনা বোধ করুক, শিশু-সুলভ কৌতুকবোধ ওকে বেশিক্ষণ চুপ ক’রে থাকতে দেয় না। কথাটা বিকেলের মধ্যেই শাশুড়ির কানে ওঠে, তিনি বলেন, ‘ওমা তাই নাকি? ষাট ষাট! আজ বাপু তা হলে বড় বৌমা পাঁচ পয়সার বাতাসা আনিও, সন্ধ্যেবেলা হরির নোট দিতে হবে। খবরটা যখন আজই কানে পৌঁছল–’

‘কী যে বলেন মা! পাঁচ পয়সার বাতাসা কি! এমন একটা শুভ খবর! অন্ত ত সওয়া পাঁচ আনা বলুন। উচিত তো পাঁচ সিকের দেওয়া।’

তা না হয় সওয়া পাঁচ আনাই আনিও। কে জানে বাপু! পাঁচ পয়সার বাতাসাই তো জানি ঢের। বরাবর আমাদের হরির নোট হলে ‘

বরাবর কজন লোক ছিল মা! এখন ষেটের বাড়িতেই কতজন লোক!’

‘তা দ্যাখ বাপু যা ভাল বোঝ!’

মেজকর্তা আসতেও আর এক চোট চেঁচামেচি হয়। বড়বৌ দু হাতে পথ আগলে দাঁড়ায়, ‘উঁহু–তা হবে না! আজ সটে-পটে ধরেছি–সন্দেশ আর রাজভোগ নিয়ে এলে তবে বাড়ি ঢুকতে পারবে। ডুবে ডুবে জল খাওয়া–ভাবো যে শিবের বাবাও টের পাবে না–না?’

‘নাও, আজ আবার এ কী মূর্তি! বলি-হ’ল কি এত সন্দেশ খাওয়াবার মতো?’

‘কী আবার হবে–জলগণ্ডষের স্থল! উঃ, কী চাপতেই পার মাইরি। সত্যি সত্যি আমি ছাড়ব না বলে দিলুম, আমাকে চেনো নি!’

অম্বিকাপদর মুখের সলজ্জ হাসি ফোটে।

‘আচ্ছা, আচ্ছা, সে হবে। আজ এখনই কি ক’রে হয়। মাস-কাবার হোক। কোথায় কি তার ঠিক নেই–’

‘তা শুনছি না বাপু। নিদেন এখন যা আছে পকেটে বার কর তো।’

সত্যি-সত্যিই পকেট ঘেঁটে সাড়ে তেরো আনা পয়সা বার ক’রে নেয় মহাশ্বেতা। বড় ছেলেকে খাঁটিয়ে বাজারে পাঠায় গরম রসগোল্লা আনতে।

.

এত চেঁচামেচি দুর্গাপদর কানে না পৌঁছানোর কথা নয়।

সে যেন একটু অবাকই হয়ে যায়।

বার বার তাকায় মেজ বৌয়ের দিকে। কথাটার সত্যাসত্য যাচাই করতে চায়। কিন্তু একবারও চোখে চোখ পড়ে না দুজনের। মেজবৌ যেন সযত্নেই এড়িয়ে চলে দুর্গাপদর চোখ।

অন্য দিন সন্ধ্যার পরই ছাদে যায় দুজন। আজ প্রমীলা গিয়ে দেখে তখনও দুর্গাপদর দেখা নেই। তার ওপর নীচে থেকে বড় বৌ হেঁকে বলে, ‘ওলো ও মেজবৌ, খোঁপায় খড়কে কাটি গুঁজেছিস তো? তোদের তো ভয়ডর নেই–আমরা মরি যে বুক কেঁপে। তা ছাড়া এখনই তো তোর ভাসুর হরির নোট দেবে–সেরে একেবারে টং-এ উঠলে হ’ত না!’

প্রমীলা তরতর ক’রে নেমে, আসে।

‘ও কী হচ্ছে দিদি! বঠাকুর বাড়ি এসেছেন, ও কী চেঁচামেচি হচ্ছে! কী মনে করছেন বল তো!’

‘কী আবার মনে করবেন। ! ভাইয়ের বংশরক্ষে হচ্ছে এই মনে করছেন!’ গলা কিছুমাত্র চাপাবার চেষ্টা না ক’রেই হাসতে হাসতে জবাব দেয় সে। বেগতিক দেখে প্রমীলা আর বেশি ঘাঁটায় না, তাড়াতাড়ি রান্নাঘরে গিয়ে ঢোকে!

দুজনে দেখা হয় একেবারে রাত্রে খাওয়ার পর।

দুর্গাপদ একটু দেরি ক’রেই দাঁত খুঁটতে খুঁটতে ছাদে ওঠে।

‘কি ব্যাপার গো, ছোটবাবুর আজ যে দেখাই নেই!’

দুর্গাপদ তখনই কোন জবাব দেয় না। ধীরে সুস্থে, দাঁতে খড়কে দেওয়া শেষ হলে খড়কেটা ফেলে দিয়ে একেবারে সোজাসুজি প্রশ্ন করে, ‘কৈ এসব কথা আমাকে বল নি তো এক দিনও-–’

.

‘কী কথা? ও, নাও। এ আবার কি বলবার মতো কথা। বুড়ো বয়সে

‘বুড়ো বয়সে হতে পারে–বলতেই যত লজ্জা!’

‘আর কীই বা বলব! বা রে, এসব কথা বুঝি মুখ ফুটে বলে কেউ নিজে নিজে! জানি–জানতে তো পারবেই–’

‘হুঁ!’ দুর্গাপদ ট্যাক থেকে নস্যির কৌটোটা বার করে।

‘কী হ’ল-আজ যে মনটা ভার-ভার? এই খবরেই নাকি?’

‘হওয়া তো উচিত।’

‘কেন?’ বা রে। এর সঙ্গে তোমার কি?’

‘না–তাই ভাবছি!’

‘কী ভাবছ তাই তো শুনতে চাইছি।’

‘শুনে লাভ কি!’

‘তবু–’

‘ভাবছি সবাই তো দিন কিনে নিলে। আমিই বোকা–চিরদিন যাত্রার বাইরেই রইলুম, আসরে ঢোকা আর হ’ল না।‘

‘থাকছ কেন! আসরে ঢুকতে কে বারণ করেছে? দিন কিনে নিতেই বা কে আটকে রেখেছে?’ তীক্ষ্ণ কণ্ঠে প্রশ্ন করে প্রমীলা।

দুর্গাপদ নীরবে বসে নস্যি নেয়।

‘কী, উত্তর দিলে না যে?’

‘উঠি। ঘুম পাচ্ছে!’ দুর্গাপদ সত্যিই উঠে দাঁড়ায়।

‘ও আবার কী। সে কি কথা? এরই মধ্যে? প্রমীলা ওর কোঁচাটা চেপে ধরে!

কোঁচাটা এক রকম জোর ক’রেই ছাড়িয়ে নেয় দুর্গাপদ। ধীর ও নিস্পৃহ কণ্ঠে বলে, ‘বড় বৌদি ঠিকই বলছিলেন–এ অবস্থায় এত রাত্রে ছাদে ওঠা তোমার ঠিক নয়। পেটে যেটা এসেছে–নষ্ট হয়ে যেতে পারে। তুমি আর এসো না রাত্তির বেলা-

‘আমার ভাবনা তোমাকে ভাবতে হবে না। তমি ছোট বৌয়ের আঁচলের তলায় ঢোকগে যাও!’ রাগ ক’রে বলে ওঠে প্রমীলা।

দুর্গাপদ এ আক্রমণেও বিচলিত হয় না। বরং ধীরে সুস্থে ছাদ থেকে নামবারই উদ্যোগ করে।

এবার প্রমীলা এসে দু হাত দু দিকের কাঠে দিয়ে দরজা আটকে দাঁড়ায়। ‘ও কী হচ্ছে ছেলেমানুষি! বসবে চল। এরই মধ্যে নামতে হবে না। অন্ধকার–তবু উজ্জ্বল নক্ষত্রের আলোতে মোটামুটি নজর চলে একটা। বড় সাংঘাতিক কটাক্ষ মেজবৌয়ের চোখে। অগত্যা দুর্গাপদকে ফিরে গিয়ে বসতে হয়।

.

কিন্তু প্রমীলা বুঝতে পারে যে তার এ বিজয় ক্ষণস্থায়ী। ওদের আড্ডা আর জমবে না আজ। একথা সেকথার পর–এবং সে কথাও বড় শুষ্ক, বড় প্ৰাণহীন, বড়ই জোর ক’রে বলা–গোটাকতক হাই তুলে দুর্গাপদ আবারও উঠে পড়ে হঠাৎ এক সময়।

‘শরীরটা ভাল নেই, বড় ঘুম পাচ্ছে আজ!’ কৈফিয়ত স্বরূপ বলে সে।

কিন্তু প্রমীলা সে কৈফিয়তের জবাব দেয় না। বাধাও দেয় না আর কাঠ হয়ে বসে থাকে শুধু।

দুর্গাপদ যখন নিজের ঘরে নিজের ঘরে এল তখন তরলা বসে হ্যারিকেনের আলোতে–ওদের বাড়ির অদ্বিতীয় বই–পুরনো রামায়নটা পড়ছে। অসময়ে এত সকাল সকাল স্বামীকে ফিরতে দেখে যৎপরোনাস্তি বিস্মিত হয় সে। স্থানকালপাত্র সব ভুলে অবাক হয়ে চেয়ে থাকে স্বামীর মুখের দিকে।

সে দৃষ্টির সামনে কেমন যেন বিব্রত হয়ে দুর্গাপদ। আপন মনেই ‘শরীরটা ভাল নেই’ বলে মাদুরের দিকে হাত বাড়ায়। তরলা তাড়াতাড়ি উঠে এসে নির্দিষ্ট স্থানে মাদুরটা পেতে দেয়, বালিশ এনে সাজিয়ে দেয়–তার পর তাড়াতাড়ি আলো নিভিয়ে দরজা বন্ধ ক’রে নিজের বিছানায় এসে শোয়।

বার বার ‘ঘুম পেয়েছে’ বলে নেমে আসা সত্ত্বেও দুর্গাপদর চোখে কিন্তু ঘুম নামে না। বার-বারই এপাশ ওপাশ করে। ‘উঁ-আঁ’ও করে মধ্যে মধ্যে।

শেষ পর্যন্ত তরলার আর স্থির থাকা সম্ভব হয় না। নেমে এসে আস্তে আস্তে প্রশ্ন করে, ‘পা টিপে দেব?’

এতকাল পরে ‘দাও’ বলতে সংকোচে বাধে। কিন্তু নিষেধও করে না। সেইটেই সম্মতি বলে ধরে নিয়ে তরলা পা টিপতে বসে।

অনেকক্ষণ পরে স্থির হয়ে আসে দুর্গাপদ, সেই নিথর ভাবটাকেই ঘুম বলে ধরে নিয়ে তরলা আস্তে আস্তে উঠে গিয়ে নিজের বিছানায় শোয়। বহুদিন পরে এইটুকু সাহচর্য লাভ ক’রেই তার তৃপ্তি হয়ে বুঝি খানিকটা। আজ তারও তন্দ্রা আসে তাড়াতাড়ি।

কিন্তু একটু পরেই হঠাৎ কার একটা হাত গায়ে লাগলেই ভয়ে অস্ফুট একটা শব্দ করে চমকে উঠে বসে।

‘ভয় নেই, ভয় নেই আমি!’ চাপা গলায় বলে দুর্গাপদ। সে বিছানায় এক পাশে এসে বসেই বোধ করি ওকে ঠেলেছে।

শুধু চাপা নয়, অস্বাভাবিক কোমলও শোনায় ওর কণ্ঠস্বর।

‘শরীরটা বড্ড ভার-ভার লাগছে, গা-হাত-পা কামড়াচ্ছেও খুব। মেঝেয় শুতে সাহস হচ্ছে না ঠিক। ভাবছি এখানেই–।’

‘না, না! আপনি এখানেই শুয়ে পড়ন। আমি বালিশে এনে দিচ্ছি।

সে উঠে তাড়াতাড়ি দুর্গাপদর বালিশ দুটো এনে দেয় তার পর নিজের বালিশটা টেনে নিয়ে মেঝেয় শোবার উপক্রম করতেই দুর্গাপদ থপ্ ক’রে ওর একটা হাত ধরে ফেলে।

‘না, না। তুমি মেঝেয় শুচ্ছ কেন। এখানেই তো ঢের জায়গা রয়েছে, শোও না।

থর থর করে কেঁপে ওঠে তরলা। সেই হাতটা যেন অবশ হয়ে আসে।

‘না, না, আপনার অসুবিধা হবে হয়তো’–অতি কষ্টে বলে শেষ পর্যন্ত।

‘কিছু অসুবিধা হবে না। এই তো দুজনের মতোই বিছানা। …তা ছাড়া তোমার অভ্যেস নেই, মেঝেয় শুলে তোমার শরীর খারাপ হবে। এখানেই শোও।’

শেষের দুটো কথা আদেশের মতোই শোনায়।

অগত্যা বালিশটা যথাস্থানে রেখে কোনমতে গুটিসুটি মেরে একেবারে দেওয়াল ঘেঁষে শোয় তরলা–মধ্যে যথেষ্ট ব্যবধান রেখে।

শোয়–কিন্তু তার তন্দ্রা আসে না চোখে। এইটুকু অধিকার লাভকেই অচিন্তিত-পূর্ব সৌভাগ্য বলে মনে হয়। বুকের মধ্যে ঢেঁকির পাড় পড়তে থাকে। জড়োসড়ো হয়ে শুয়ে থাকার জন্যেই বোধ হয়–ঘেমে নেয়ে ওঠে।

মনে হয় দুর্গাপদও জেগে আছে। বিঘতখানেক মাত্র ব্যবধান সুতারং নিঃশ্বাসের শব্দ তো বোঝা যায়ই–সামান্য মাত্র নড়াচড়াও অনুভব করা যায়।

খানিক পরে– বোধ হয় মিনিট-পনেরো পরে হঠাৎ দুর্গাপদর একটা হাত ওর গায়ে এসে পড়ে।

‘এত জায়গা থাকতে অমন গুটিসুটি মেরে শুয়েছ কেন?…অমন ক’রে শুয়ে কেউ ঘুমোতে পারে? ভাল হয়ে শোও, নইলে আমার মনে হবে যে আমি তোমার অসুবিধে করলুম–আমার জন্যেই তোমার ঘুম হচ্ছে না।’

আজ কি তরলার মাথা খারাপ হয়ে গেল? না সে অসুখ হয়ে প্রলাপের ঘোরে এসব শুনছে?

অদ্ভুত বিচিত্র ওর মনের গতি। সে এখন প্রাণপণে মনে করবার চেষ্টা করে আজ সকালে উঠে কার মুখ দেখেছিল। দিদির না তার ছোট ছেলেটার? না, বোধ হয় স্বামীরই–কিন্তু সে তো ঘুমন্ত মুখ…

দুর্গাপদর হাত ওকে সামান্য আকর্ষণ করে নিজের দিকে।

সে হাত ক্রমে যেন ওর দেহের অত্যন্ত নিভৃত, অত্যন্ত কোমল প্রদেশে পৌঁছয়।

‘ইস কী ঘেমেছে! দ্যাখ দিকি–এই গরমে এমন ক’রে গায়ে কাপড় জড়িয়ে এতটুকু হয়ে শুলে ঘামবে না! এদিকে এসো এদিকে এসো–ভাল ক’রে শোও!’

এবার আর তরলা স্থির থাকতে পারে না।

তার এতকালের সমস্ত বেদনা ক্ষোভ অভিমান অশ্রুর বন্যায় বেরিয়ে আসতে চায়। দুর্গাপদর সবল আকর্ষণে তার বুকের মধ্যে এসে পড়ে।

‘নাও। এ আবার কী কাণ্ড! কান্নাটান্না থামাও বাপু! আমি আবার এসব ছিঁচ-কাদুনেপনা দেখতে পারি না। কান্নার হয়েছে কি?

তার পর একটু বিরত, একটু অপ্রতিতভাবে বলে, ‘বাতাস করব? খুব গরম হচ্ছে?

ততক্ষণে ওর হাত তরলার সুপুষ্ট, সুগঠিত, যৌবন-প্রস্ফুটিত দেহ যেন লেহন করতে থাকে। সে স্পর্শ ও আকর্ষণে তরলা অর্ধমূর্ছিতের মতো পড়ে থাকে। এইটুকুর জন্যই হয়তো সে সেই বিবাহের দিন থেকে বা সে সম্ভাবনা থেকেই বুভুক্ষু ছিল–কিন্তু বিধাতা সে সাধনার বস্তু যখন অপ্রত্যাশিত-ভাবেই দিলেন, তখন তা উপলব্ধি করারও যেন অবস্থা রইল না। বহু পরস্পর-বিরোধী আবেগের সংঘাতে শুধু দেহ নয়, মনটাও যেন অনড় অবশ হয়ে রইল।

দুর্গাপদ তাকে আরও কাছে টেনে নেয়। আরও নিবিড় হয়ে ওঠে তার বাহুবন্ধন–

পরের দিন ভোরবেলা দোর খুলে বেরোতেই প্রথম যার সঙ্গে তরলার চোখোচোখি হ’ল–সে প্রমীলা 1

দোতলায় দালানোর কোণে নীচের সিঁড়িতে নামবার মুখে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছে–এই দিকেই চেয়ে। তরলা আর একটু কাছে আসতে যেন সাপের মতো হিস্ হিস্ ক’রে ওঠে, ‘তোকে এমন ঝোঁড়ো কাকের মতো দেখাচ্ছে কেন লা ছুট্‌কী–রাত্তিরে ঘুম হয় নি বুঝি?’

তরলা মেয়েরই জাত। সাধারণত এদের কাছে মাথা হেট ক’রেই থাকে সে, কথার ঘা দেওয়া অভ্যাস নেই তারা; কিন্তু আজ বোধ করি বহু বেদনাই তার কণ্ঠে বিষ যোগায়। সে শান্ত ভাবেই জবাব দেয়, ‘না মেজদি, আমার ঘুম যেমন হওয়া উচিত তেমনিই হয়েছে, কিন্তু আপনি এত সকালে উঠেছেন যে? আপনার রাত্তিরে ঘুম হয়েছিল তো? না কি সারারাত আমার ভাবনা ভেবেই কাটিয়ে দিলেন?’

এবার আর প্রমীলা কণ্ঠের বিষ ঢাকবারও চেষ্টা করে না। বলে, ‘বাঃ কথা ফুটেছে যে। তাই তো বলি পাখি কিসের টানে দাঁড়ে ফিরল! ভাল মানুষ ছোটবোয়েরও বাড়ির হাওয়া লেগেছে তা হলে!’

তরলা কিন্তু আর কথা বাড়ায় না। তার মন তখন–পরিপূর্ণ না হোক অনেকখানি তৃপ্তিতে ভরে আছে। পাওনার মাধুর্যটা যে পুরোপুরি মধুর হতে পারে নি তার কারণ এই স্ত্রীলোকটারই বিষস্মৃতি তার সঙ্গে মিশিয়ে ছিল বলে। তবু–যেটুকু পেয়েছে সেইটুকুই সে আপন মনে রোমন্থন ক’রে ভোগ করতে চায় আজ–যে প্রসন্নতার আমেজ থাকলে তা সম্ভব, সেটা এখন এর সঙ্গে কথা কাটাকাটি করলে থাকবে না, বিষ উঠবে আকণ্ঠ ফেনিয়ে।

সে প্রমীলার পাশ কাটিয়ে নিচে নেমে যায়।

ত্রয়োবিংশ পরিচ্ছেদ

॥১॥

অবশেষে মহাশ্বেতাই একটি পাত্রী খুঁজে বার করে। ওর শ্বশুরবাড়ির সম্পর্কেই–জাঠতুতো ভাসুরের মেয়ের ননদ। জানাশুনো ঘর, মেয়েটিও নাকি ভাল। ভাসুরঝি লীলা তো প্রশংসায় পঞ্চমুখ একেবারে–কাজে কর্মে বিবেচনায় ব্যবহারে–সব দিক দিয়েই নাকি ঘরে আনবার মতো। খুব নাকি বড় বংশও ওদের; উলুবেড়ের কাছে যে গ্রামে ওদের বাড়ি–ওরা এককালে সেই গ্রামেরই জমিদার ছিল। এখন বহু শরিকে ভাগ হয়ে গিয়ে পড়ন্ত অবস্থা। লীলার শ্বশুর কোন্ এক বাঙালির বাড়ি চাকরি করেন–সামান্য কিছু জমিজমাও আছে, যেগেযাগে চলে যয়। লীলার বর অবশ্য রেলে কাজ করে–তেমনি তার নিজেরও বেশ একটি সংসার হয়ে গেছে বলতে গেলে। পাঁচটি ননদ ওর–এইটি মেজ। বড়র বিয়ের দেনাই নাকি এখনও শোধ হয়নি, সুতরাং পাওনা-থোওনা বিশেষ হবে না, সে আভাসও দিয়েছে লীলা।

সব খবর নিয়ে মহা ছুটল মায়ের কাছে। মেয়ের সম্পূর্ণ বিবরণ দিয়ে হাত-পা নেড়ে বলল, ‘মেয়ে দেখতেও কুচ্ছিত নয়, রংটা নাকি শুনেছি খুবই ওজ্জ্বল! একেবারে যাকে বলে ফিট্ গৌরবন্ন। মোদ্দা ঐ কথা–টাকার কামড় কর তো হবে না। তবে তাও বলি–গোচ্ছার টাকা দিয়ে যে সোন্দার মেয়ের বে দেবে–সে তোমার ঘরে দেবে না। কী আছে বল? ছেলে একটা পাস করে নি–চাকরিও বেশি দিনের নয়। সম্পত্তি বলতে তো এইটুকু এক বাড়ি–বাঁশের কেল্লা। …কেন দেবে বলতে পার? টাকা চাইলে কুচ্ছিত মেয়ে নিতে হবে–এই পষ্ট কথা বলে দিলুম। কী করবে ভেবে দ্যাখ।’

শ্যামার জবাব আসতে বিন্দুমাত্র দেরি হয় না। সে বলে, ‘তবে মা শুধু গরাসও মুখে তুলতে পারব না–আমারও এই সাফ কথা। মেয়ের বের দেনা শোধ করতে না পারি সে আলাদা কথা, কিন্তু তাই বলে দেনা ক’রে ছেলের বিয়ে দেব সে বান্দা আমি নই। কথা পেড়ে দ্যাখ–একেবারে যদি ডোমের চুপড়ি ধুয়ে ঘরে তোলাতে চায় তো মেয়ে দেখে কাজ নেই।’

মহাশ্বেতা যতটা উৎসাহ নিয়ে ছুটে এসেছিল ঠিক ততটাই নিরুৎসাহ হয়ে ফিরল। কিন্তু দেখা গেল লীলার সাংসারিক জ্ঞান ওর চেয়ে অনেক বেশি। সে বললে, ‘এখন থেকে ওসব কথা বলে তেতো ক’রে দরকার নেই কাকীমা, মেয়েটা আগে দেখিয়ে দাও, যদি মেয়ে পছন্দ হয় তো দিদ্‌মাও অনেক নরম হয়ে আসবে–আর ওরাও–সামান্যর জন্যে তখন তৈরি সম্বন্ধ ভাঙতে চাইবে না। দু পক্ষই তখন অন্য সুর ধরবে দেখো!’

যুক্তিটা সকলেরই মনে ধরে। সবাই সায় দেয় ওর কথায়।

মেয়ে-দেখানোর ব্যবস্থাও লীলাই ঠিক করে একটা। শ্যামা হবু কুটুমবাড়িতে মেয়ে দেখতে যাবে না, অথচ সে ছাড়া কে-ই বা মেয়ে দেখবে! রায় দেবার মালিক যখন সে-ই, তারই দেখা দরকার। আবার মেয়ে এনে দেখানোও বড় অপমানের কথা–পাত্রীপক্ষ যত গরিবই হোক, এককালের জমিদারি রক্ত এখনও গায়ে আছে, তারা রাজী হবে না। অগত্যা ঠিক হ’ল যে, শ্যামাদেরই পাড়ায় মেয়ের এক কাকীর বাপের বাড়ি–মেয়ে কাকীর সঙ্গে সেখানে বেড়াতে আসবে, শ্যামা সেইখানে গিয়েই দেখবে।

মেয়ে এক কথাতেই পছন্দ হ’ল শ্যামার।

রংটা–রাণী বৌয়ের মতো অত গোলাপী নয়, হলুদের ওপর উজ্জ্বল, কতকটা দুর্গাপ্রতিমার মতো। প্রতিমার মতো একটু ওপর-দিকে টানা চোখ, ভুরু তো যেন কে বসে বসে এঁকেছে মনে হয়। খাই-মুখটিও চমৎকার। দোষের মধ্যে কপালটা একটু উঁচু–আর গড়নটাও খুব পুরন্ত গোছের নয়, একটু যেন রোগাটে। তা হোক–এতটাও আশা করে নি শ্যামা। আশা বেশি থাকলে মানুষের খুঁতখুঁত করে–প্রত্যাশাই যেখানে অনেক কম সেখানে একটু বেশি পেলেই খুশি হয়ে ওঠে সে। শ্যামাও দুটো কথা কয়ে, হাত- পাগুলো একটু ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখে বেশ প্রসন্ন মুখেই বললে, ‘তা এধারে তো নন্দ নয়–তা মেয়ে, মেয়েই বলি, লীলার সম্পর্কে তুমি তো আমার মেয়ের বেয়ান হলে গো–চুলটা বেঁধে রেখেছ বাছা, ওটা তো দেখবার উপায় রাখ নি!’

‘ওমা তার আর কি হয়েছে-দেখুন না।’

মেয়ের কাকী খোঁপা এলিয়ে বিনুনি খুলে চুল ছড়িয়ে দেন। ঘন কালো চুল সারাপিঠ ঢেকে যায়। চুলের রাশ। শ্যামা আরও খুশি হয়–খুব লম্বা নয় চুল। শাস্ত্রে নাকি লেখে পায়ের গোছ পর্যন্ত চুলের কথা–কিন্তু শ্যামা দেখেছে যে খুব লম্বা চুল হলে মেয়ের ভাগ্য ভাল হয় না।

‘না–তা চুলও তো দিব্যি! তা হ্যাঁগা বাছা–কী যেন নাম বললে, কনকরেণু? বড্ড গালভরা নাম বাপু, কনকই বলি শুধু, তা দ্যাখ আমার ঘর করতে পারবে তো? গরিবের সংসার, পাতার জ্বালে রান্না, ঝি-চাকর নেই–ঘরের পাট, বাসন মাজা সবই নিজেদের করতে হয়–গিয়ে নাক তুলবে না তো?’

মেয়ের হয়ে কাকীই জবাব দেয়, ‘কী যে বলেন আঁবুই মা! আমাদের সংসারেই কি ঝি-চাকর আছে? সে ক্ষ্যামতা কৈ? তবু তো আপনাদের বাড়ি ধান সেদ্ধ করতে হয় না, গোরুর পাট নেই। আমাদের তো পরিপুন্ন ষোল আনাই সব বজায় রাখতে হয়। এর ওপর আউতি-যাউতি নোক-নৌকতা কুটুম্বিতে–সে সবও তো আছে গো!’

‘তা বটে। সে সব আমার কিছু নেই। মহাদের মতো ঠাকুরও নেই একটা। সে সব পাট অনেক দিন চুকে গেছে! যা কিছু নিজেদেরই পেট-পূজোর ধান্দা! তা দ্যাখ। লীলাকে বল অভয়ের সঙ্গেই কথাবার্তা কইতে। যা করবেন জামাই- ই করবেন। মেয়ে আমার অপছন্দ নয়–এইটুকু বলতে পারি।’

লীলার খুড়শাশুড়ি তখনই পাঁচ পয়সার বাতাসা কিনতে পাঠান–খাড়াখাড়া হরির লুট দিতে হবে।

দিন তিনেক পরে একটা শনিবার দেখে অভয়পদ এল। এ তিন দিন সে বৃথা ব্যয় করে নি–ও-পক্ষের সঙ্গে কথা কয়েই এসেছে–তা শ্যামা জানে। তাই সে পরণের খাটো কাপড়খানাকে টানাটানি ক’রে ঘোমটা দেবার একটা বৃথা চেষ্টা করতে করতে বেরিয়ে এল একটু উৎসুক হয়েই। সহজভাবে এখন কথা কয় বটে–কিন্তু জামাইয়ের সামনে ঘোমটা না দিয়ে বসে না সে আজও।

বিনা আমন্ত্রণে বসা এবং বিনা ভূমিকায় কথা বলা চিরদিনের অভ্যাস অভয়পদর। সে শাশুড়ির পেতে দেওয়া পিঁড়িটাকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা ক’রে নিজের অদ্বিতীয় ছাতিটি পেতেই রান্নাঘরের রকের ধারে বসল। তারপর একেবারেই আসল কথাটা পাড়ল। কাঁঠাল গাছটার দিকে চেয়ে বলল, ‘আমাকে আর এর মধ্যে জড়ালেন কেন–হাজার হোক আমাদের কুটুমের মেয়ে।’

‘তুমি ছাড়া আর আমার কোন্ কাজটা হচ্ছে বাবা, চিরদিনই তো সবই তুমি ক’রে এলে। তুমিই আমার জ্যেষ্ঠ সন্তান। এখন এর বেলা আর কার কাছে যাব বল? তা ছাড়া তুমি কি আর জ্ঞাতি ভাইয়ের মেয়ের শ্বশুরবাড়ির দিক টেনে আমার লোকসান করাবে!’

মিনিটখানেক মৌন থেকে অভয়পদ জবাব দিলে, ‘লোকসান যাতে হয় তার ব্যবস্থা আপনিই খানিকটা ক’রে এসেছেন! একেবারে এক কথায় কন্যাপক্ষকে জানিয়ে দিয়ে এলেন যে তাদের মেয়ে আপনার পছন্দ হয়েছে–তারা খানিকটা জো পেয়ে তো যাবেই। এসব ক্ষেত্রে একটু রেখে ঢেকে মনের কথাটা জানাতে হয়!’

শ্যামা ঘোমটার মধ্যেই এতখানি জিভ কাটে। কথাটা তার ভেবে নেয়া উচিত ছিল। সত্যিই মেয়ে দেখে অমন ক’রে গলে যাওয়া তার উচিত হয় নি!

অভয়পদ আবারও একটু চুপ ক’রে থেকে বলে, ‘দু’শ এক টাকা নগদ, চুড়ি হার কানের মাড়ি–আর যেমন দানসামিগিরি দিতে হয় তা দেবে–বরের আংটি জোড়। নমস্কারী খান-আষ্টেক পর্যন্ত। এর বেশি বাড়ানো গেল না!’

‘মোটে দু’শ এক! কী হবে বাবা তাতে? তা ছাড়া বরের ঘড়ি- বোতাম–কিছু দেবে না? না না–অত কমে আমি পারব না!’

অভয়পদের প্রশান্ত মুখ কিছুমাত্র বিচলিত হয় না। সে শুধু বলে, ‘তা হলে ওদের না বলে দিই?

শ্যামা এবার বিষম বিব্রত বোধ করে! এই এক মানুষ, দুটো পরামর্শ করার উপায় নেই! মাঝামাঝি কোন কথা বোঝে না–একেবারে হ্যাঁ কি না–বলে দাও!

সে বেশ খানিকটা বিপন্ন কণ্ঠেই বলে, ‘একেবারে না-ই বা বলবে কেন? মানে একটু বেগ দিয়ে দেখলে হয় না? ওদের কি একেবারে ধনুর্ভঙ্গ-পণ? বিয়ে ভেঙ্গে যাবার মতো দেখলে আবার খানিকটা বাড়বে হয় তো!’

অভয়পদ ঘাড় নেড়ে বললে, ‘যতটা টানবার তা আমি টেনেছি…ওরা আর বাড়াতে রাজী নয়। অবশ্য অবস্থাও ওদের খারাপ। এর ওপর যে খুব বাড়াতে পারত তাও মনে হয় না! এক উপায় আছে, তত্ত্ব–গায়ে হলুদ, ফলুশয্যে–যদি গায়ে গায়ে কাটান দেন! তাতে আপনার খরচটা কমে একটু।’

‘তেমনি ঘরে আসবে না তো কিছু! প্রথম ছেলের বিয়ে–ফুলশয্যের তত্ত্ব আসবে না–সেটাই বা কেমন কথা! তাছাড়া একটা ভাল কাপড়, হদুল মাখার একখানা আটপৌরে কাপড়, একটু দইমাছ–এগুলো তো পাঠাতেই হবে! লক্ষণ অলক্ষণের কথা তো আছে! তার ওপর আর ক’টা টাকা খরচ করলেই আমার তত্ত্ব সাজানো হবে। ওদেরও ধর–ক্ষীর মুড়কির বাটি, ফুলের রেকাব, মেয়ে-জামাইয়ের কাপড় এগুলো তো বাদ দিতে পারবে না।

এই পর্যন্ত বলে থেমে যায় শ্যামা! বেশ একটু সাগ্রহেই জামাইয়ের মুখের দিকে চায়–অর্থাৎ এক্ষেত্রে আর কী করা যেতে পারে–কিছু একটা সদ্যুক্তি চায় সে!

কিন্তু অভয়পদ সেদিক দিয়ে যায় না। শুধু নিস্পৃহভাবে বলে, ‘বেশ, তা হলে আপনার যা শেষ কথা বলে দিন। আর কতটা পর্যন্ত আপনি তা থেকে নামবেন তাও বলে দিন–আমি সেই মতো বুঝে না ক’রে দেব।’

শ্যামা অসহায়ভাবে চারদিকে চায়। এসব সে করে নি কখনও ভেবেও রাখে নি। কিন্তু এই এক মনিষ্যি–এর সঙ্গে কথা বলাও যা দেওয়ালকে বলাও তাই!

সে খানিকটা চুপ ক’রে থেকে কতকটা প্রশ্ন করার ভঙ্গিতেই বলে, ‘যদি নগদটা চারশ এক করতে বলি–আর বেতাম, ঘড়ি, রাজী করাতে পারবে না?

‘মনে তো হয় না। আমি খানিকটা চেষ্টা করছিলুম বৈকি! যা বলেছে তার ওপর আর সামান্য কিছু বাড়ানো যায়! অত বেশি বাড়বে না।’

শ্যাম্যা চুপ করে থাকে। কী বলবে ভেবে পায় না কিছুতেই!

অভয়পদও উত্তরের অপেক্ষা করে খানিকটা! তার পর বলে, ‘তা হলে ঐ কথাই বলি–আপনি যা বললেন! রাজী না হয়, আবার অন্য মেয়ে খুঁজতে হবে।’

টাকাটা বড়ই কম। যা আশা করেছিল তার থেকে বেশ খানিকটা কম। দেনা শোধ তো হবেই না, বিয়ের খরচটা চালানোও মুশকিল। কিন্তু মেয়েটাও বড় ভাল। বেশ ঠাণ্ডা-ঠাণ্ডা, লাজুক ধরনের মেয়ে। আজকাল যেমন ঘরে ঘরে হয়েছে বেহায়া বাঁচাল, পুরুষের-ঘাড়ে-পড়া মেয়ে–তেমন নয়। ঠিক হাতছাড়া করতেও মন চায় না।

অবশেষে প্রায় মরিয়া হয়েই মন স্থির ক’রে ফেলে সে।

বলে, ‘অন্তত যদি বোতামটাও দেয়, আর একশটা টাকা নগদ বেশি–তা হলেও হয়। সেইটাই বলে দ্যাখ না।

‘যে আজ্ঞে। তাই বলব।’

কার বিবাহোপলক্ষে কুণ্ডুদের বাড়ি থেকে পাওয়া বাসি লুচি আর মোণ্ডা ছিল–জামাইকে জল খেতে দিল শ্যামা। কিন্তু আজ অভয়পদ কিছু খেলে না। বললে, ‘আজকাল প্রায়ই বিকেলের দিকে একটু ক’রে অম্বল হচ্ছে। বাসি লুচিটা আর খাব না। আচ্ছা, তা হ’লে আসি।’

ছাতাটি বগলে ক’রে বেরিয়ে গেল সে।

॥২॥

পরের দিন অভয়পদ এল একেবারে মেয়ের বাপ পূর্ণ মুখুজ্জে মশাইকে সঙ্গে করে। নইলে নাকি উপায় ছিল না–উনি কাল থেকে এসে তাঁর বেয়াইবাড়ি অর্থাৎ অভয়পদর জ্ঞাতিদাদার বাড়ি বসে আছেন–একটা হেস্তনেস্ত না ক’রে যাবেন না। তা ছাড়া যাকে মেয়ে দেবেন তাকে এবং তার বাড়ি-ঘর দেখারও একটা কৌতূহল আছে বৈকি। একেবারেই সব পাট চুকিয়ে দিতে চায় অভয়পদ।

শ্যামা একটু বিব্রত বোধ করে। প্রথমত এসব কথা কওয়া তার অভ্যাস নেই। এতকাল কন্যাপক্ষের হয়ে দয়া ভিক্ষাই ক’রে এসেছে–পাত্রপক্ষের হয়ে সে ভিক্ষা কী ক’রে ফিরিয়ে দিতে হয় শেখে নি। তা ছাড়া ছেলের বাবা যখন রয়েছে তখন উচিত তার কাছেই নিয়ে যাওয়া–নইলে ওরাই বা কি ভাববে? অথচ যা ছিরির মানুষ–

কিন্তু অভয়পদ দেখা গেল আটঘাট বেঁধেই এসেছে।

তার শ্বশুরমশাইয়ের শয্যাশায়ী অবস্থা, দীর্ঘকাল গ্রহণীতে ভুগে মাথাটার ও একটু গোলমাল হয়েছে–এ সব কথাই পূর্ণবাবু জানেন। তাঁকে বাইরের ঘরের দিকেও নিয়ে যায় নি অভয়–রান্নাঘরের দাওয়াতেই এনে বসিয়েছে। সুতরাং সেদিক দিয়ে চিন্তা করার কিছু নেই!

অগত্যা শ্যামাকে খাটে কাপড়টা পাল্টে একমাত্র পোশাকী শাড়ি পরে বেরোতে হয় হবু বেয়াইয়ের সামনে। অভয়পদকে মধ্যস্থ রেখে ঘোমটার মধ্য দিয়ে কথা বলে সে। কিন্তু তবু দেখা গেলে দরদস্তুর টানাটানিতে সে সত্যিই অনেক বেশি পটু অভয়পদর চেয়ে। কন্যাপক্ষের যথারীতি অনুনয়-বিনয়, হাত জোড় করা, এমন কি কান্নাকাটির মধ্যেও কথার পিঠে কথার প্যাঁচ লাগিয়ে তিনশ’ এক টাকায় রাজী করালে সে। তার সঙ্গে সোনার বোতামটাও।

তবে একটা কথা নিয়ে যান পূর্ণ মুখুজ্জে মশাই–গায়ে হলুদের তত্ত্বো বাহুল্য কিছু করবে না শ্যামা, কারণ ও পক্ষ থেকে তার যোগ্য ফুলশয্যা পাঠাবার ক্ষমতা নেই।

‘এমনিতেই–এত দিন যা করিনি তাই করতে হবে–খানিকটা ধান-জমি ছাড়তে হবে। সম্বচ্ছরের চালটা আসত–তা আর আসবে না। কিন্তু উপায়ও তো আর নেই। ধার করবার যত জায়গা ছিল তা বড় মেয়ের বিয়েতে শেষ করেছি–আর কেউ ধান দেবে না।’

একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে বলেন পূর্ণ মুখুজ্জে মশাই।

অবশ্য এ প্রতিশ্রুতি প্রসন্ন মনেই দেয় শ্যামা। বাহুল্য করবার ক্ষমতা কই তার? তারও তো ঐ তিনশ’ এক টাকা পুঁজি। দেনা এমনিতেই যথেষ্ট আছে-ছেলের বিয়েতে দেনা করতে রাজী নয় সে। আর করবেই বা কোথা থেকে? ধার দিতে তো ঐ এক জামাই–তাকে কত দোহন করবে?

অতঃপর ছেলে দেখে জলখাবার খেয়ে প্রসন্নমনেই বিদায় নেন পূর্ণবাবু। ছেলে দেখে ভারী খুশি–প্রকাশ্যেই স্বীকার ক’রে গেলেন যে এমন রূপবান জামাই তার বংশে জাঠতুতো খুড়তুতো জ্ঞাতি জড়িয়ে আর একটিও হয় নি।

শ্যামারও মনটা অনেকদিন পরে বেশ প্রসন্ন হয়ে উঠেছে। নতুন কুটুমকে জলখাবার খাওয়াতে নগদ ছ’ আনা পয়সা বেরিয়ে গেল–কারণ তাঁর সামনেই জামাইকেও দিতে হ’ল, সেখানে কিছু স্বতন্ত্র ব্যবস্থা করা যায় না–তবু তাতেও দুঃখিত নয় শ্যামা। তার হেমের বিয়ে হবে, বৌ আসবে–এ স্বপ্ন সেই যেদিন হেম ভূমিষ্ঠ হয়েছে সেই দিন থেকেই মনের সঙ্গে জড়িয়ে আছে যে! শুধু ইদানীং চারিদিক থেকে যখন দুর্ভাগ্য ঘিরে ধরেছিল তখন যেন আর কল্পনা করতেও সাহসে কুলোত না। একান্ত দুরাশা বলে মনে হ’ত। কিন্তু আজ আর তা দুরাশা নেই, আজ তা বাস্তব আজ তা হাতের মধ্যে এসে গেছে। এতদিনে তার সত্যিকারের সংসার হতে চলেছে–এই মুহূর্তে আরও কিছু বেশি খরচ হলেও বোধ করি দুঃখিত হ’ত না সে।

ওরা চলে গেলে শ্যামা নরেনের কাছে এসে বসল। মনটা বড়ই খুশি আছে, আজ আর এটাকে সময় নষ্ট বলে মনে হ’ল না।

নরেন বিস্মিত হ’ল। স্ত্রীর দর্শন প্রয়োজনের সময় ছাড়া দুর্লভ। বললে, ‘আজ যে এমন অকালে-সকাল বামনী–ব্যাপার কি?’

‘খোকার বিয়ে ঠিক হয়ে গেল যে। সামনের মাসের দোসরাই দিন ঠিক হ’ল।’ শ্যামা হাসি হাসি মুখে বলে।

‘কী হ’ল? বে ঠিক হয়ে গেল? কার বে? খোকা মানে আমাদের হেমচন্দরের?’

বলতে বলতেই বিষম উত্তেজিত হয়ে উঠে বসতে চেষ্টা করে কিন্তু পারে না–আবার এলিয়ে পড়ে হাঁপাতে থাকে।

হ্যাঁ–তা নইলে খোকা আবার কে?’

‘কী রকম? আমার ছেলের বে আমি জানলুম না–আমার সঙ্গে কথা হ’ল না–বে ঠিক হয়ে গেল! বলি ঠিকটা করলে কে? কার এত বড় হেকমত! আমি গার্জেন থাকতে আমাকে না জিজ্ঞেস ক’রে আমার ছেলের বে ঠিক করে! বলি কে–কে ঠিক করলে তাই শুনি? সেই গোরবেটার জাত হারাম-জাদা জামাই নাকি? য়্যা?’

‘দ্যাখ–খবরদার জামাইকে গাল দিও না বলে দিলুম! সাতজন্ম অমন জামাইয়ের পাদোদক জল খেলে যদি মানুষ হতে পার। অমন জামাই পেয়েছিলে তাই সাতগুষ্টি তরে গেল। তাও কি তুমি করেছ–নিহাত আমার বাপ-মা’র পুণ্যের জোর ছিল তাই এ পাত্তরে মেয়ে দিতে পেরেছি!’

‘থাম্ থাম্–অত আর লম্বা লেকচার ঝাড়তে হবে না। মোদ্দা ও বিয়ে হবে না। নেই মাংতা বিয়ে–নেই মাংতা বৌ। …ঠিক করেছেন! ঠিক অমনি করলেই হ’ল! তুই কি জানিস–এর সব নেম-কানুন! বংশ দেখতে হবে, গাঁই-গোত্তর মিলোতে হবে–দেনা-পাওনা আছে–তবে তো বে ঠিক হবে। কথায় বলে লাখ কথা না হলে বে হয় না। উনি এমনি এক কথায় বে ঠিক ক’রে ফেললেন। নে যা–এখনই খবর পাঠা, ওসব চলবে না, বে দিতে হয় মেয়ের বাপ এসে আমার কাছে হাত জোড় ক’রে বসুক!’

‘হুঁ! কত বড় গার্জেন আমার এলেন রে, ওঁর কাছে হাত জোড় ক’রে বসবে! তুমি কে যে তোমার কাছে মেয়ের বাপ আসবে? সে সম্পর্ক রেখেছ? না বাপের কোন কাজ করেছ?…আমিই তার বাপ মা দুজনের কর্তব্য ক’রে এসেছি চিরকাল–আমিই কথা দিয়েছি। আমারই ঝকমারি হয়েছিল তোমাকে খবর দিতে আসা। তুমি কি মানুষ–যে মানুষের মতো কথা বুঝবে,’

‘কী, কী বললি! যত বড় মুখ নয় তত বড় কথা! এত বড় কথা বললি আমাকে! কী বলব ভগবান মেরে রেখেছেন তাই–অত অঙ্গ থাকতে পা দুটোই নিয়ে নিয়েছেন–নইলে নোড়া দিয়ে তোর ঐ বত্রিশ পাটি দাঁত ভেঙে চোপ্রা করা বার ক’রে দিতুম। …আচ্ছা, কুছ পরোয়া নেহি, এয়সা দিন নেহি রহেগা–একবার কি উঠব না! তখন এর সুদসুদ্ধ যদি আদায় না করি তো–’

বলতে বলতে-বোধকরি নিঃশ্বাসের অভাবেই চুপ করতে হয়। আবার যখন বলতে শুরু করে তখন কণ্ঠস্বর অনেকটা কোমল শোনায়, ‘হাতি যখন দঁকে পড়ে ব্যাঙেও তাকে চাট্ মারে। কী বলব নিহাত নাতোয়ান হয়ে পড়েছি তাই। এমন করিস নি বামনী, ভাল হবে না। ধম্মে সইবে না। একটা অনাথ পঙ্গু লোককে এমন ক’রে দু পায়ে থ্যাৎলাতে নেই–’

বলতে বলতেই বোধ হয় একটা অসীম আত্মকরুণা বোধ করে সে। হাউ হাউ ক’রে কেঁদে ওঠে আপন মনেই। কিন্তু সে কান্না শ্যামার কানে যায় না। তার অনেক আগেই সে ঘর থেকে বেরিয়ে গেছে। দামী কাপড়টা ছেড়ে আবার গুছিয়ে তুলে রাখা দরকার। পাতার আণ্ডিল পড়ে আছে। সামনে এত বড় কাজ–তার আগে পরিষ্কার করতে হবে, দুটো পয়সাও দরকার।

.

পাকা দেখা চুকে গেলে ফর্দ করতে বসতে হয়। বাজারের ফর্দ নিমন্ত্রণের ফর্দ সবই করতে হবে! লোক বলতে তো মা আর বেটা ঐ দুটি প্রাণী। কারুর সঙ্গে একটা পরামর্শ করবে এমন কেউ নেই। অভয়পদ এ সবে আসতে চায় না, মহার তো মাথারই ঠিক নেই। লোক-খাওয়ানোর ফর্দ–ঘি ময়দা আনাজ মাছ দই–এ ফর্দ কত লোক হবে বললে অম্বিকাপদ ক’রে দেবে। নিখুঁত হিসেব তার, কম-বেশি কখনও হয় না। কিন্তু তার আগে কাকে কাকে এবং মোট কজনকে বলা হবে তার ফর্দটা করা দরকার।

মোটামুটি হেমের ভাষায় ‘লি’স্টটা সহজেই হয়ে যায়! তিন ঘর কুটুমবাড়ি, পাড়াঘরে একটি একটি, সরকার বাড়ি সব! কলকাতায় গোবিন্দ, গোবিন্দর বৌ–ওদের বাড়িওলাদের একজন। এককালে ঐ বাড়িতে ছিল হেম, খুবই জানাশুনো দহরম মহরম না বললে খারাপ দেখায়। সবাইকে বলাই উচিত, অন্তত একজনকে বলতেই হবে।

‘এ ছাড়া,’ ছেলের মুখের দিকে চেয়ে শ্যামা বলে, ‘তোমার বন্ধু বান্ধব কাকে কাকে বলবে, কে আছে ভেবে দ্যাখ। তার পর বরযাত্তর কাকে বলা হবে–সেটাও লিখে নাও! ওদের বলেছি জনকুড়ি-পঁচিশের বেশি হবে না। আর বরযাত্তর নিয়ে যাওয়া তো নয়, ফুলশয্যের অতটি লোকই নিয়ে আসবে ওরা।’

শেষের কথাগুলো হেমের কানে যায় না। তার বন্ধুবান্ধব কে আছে–যাকে বিয়েতে বলা যায়, তাই ভাবতে থাকে সে। বন্ধুই বা কৈ তার? পুরানো রং- কলে দু-একজনের সঙ্গে একটু অন্তরঙ্গতা হয়েছিল বটে, কিন্তু তার পর বহুকাল তাদের সঙ্গে দেখা-সাক্ষাৎ নেই, বাদ দিলেও চলবে। এ অফিসে এখনও পর্যন্ত এমন কেউ হয় নি, যাকে বন্ধু বলা যায়। বললে পুরো সেকশনটাকেই বলতে হয়। তার দরকার নেই। সে ক্ষমতাও নেই ওর। এক আছে থিয়েটারের কজন। কানাই, নন্দ, ওদের কাউকে না বললেও দক্ষিণাদাকে বলা দরকার। সত্যিকারের হিতাকাঙ্ক্ষী তার। …থিয়েটারে না হয় যাবেই না, বাড়ির ঠিকানা জানে, সেখানে গিয়ে বৌয়ের কাছে বলে আসবে। তা হলেই খবর পৌঁছবে তার কাছে।

দক্ষিণাদার নামটা লেখে হেম।

‘তার পর? আর–?’ শ্যামা প্রশ্ন করে।

কান্তিকে তো জানতে হবে। কেন তাও জানাতে হবে। রতনদাকে বলা উচিত নয়?’ জিজ্ঞাসুদৃষ্টিতে হেম চায় মায়ের দিকে।

‘ওমা, তাকে তো বলতেই হবে। ভাল ক’রে বলে আসবি তাকে। সে তো আসবেই না, মিছিমিছি পাওনাটা ছাড়ি কেন।

‘যদি আসে? কান্তিকে অত ভালবাসে–আসতেও পারে হয় তো!’

একটু যেন উৎসুক, সতৃষ্ণ নয়নে মা’র দিকে চায় সে।

‘আসে তো আসুক না। ভয়টাই বা কিসের! আজকালকার দিনে কে কার অত খবর রাখে! আর রাখলেও–এখন আর সেদিন নেই যে লোকে মুখের ওপর কিছু বলবে কিংবা না খেয়ে চলে যাবে সবাই।’

এইটেই শুনতে চাইছিল হেম। কারণ তার মনের মধ্যে একটা বাসনা জেগেছে ক’দিনই–বিয়ের কথাটা পাকা হয়ে যাবার সময় থেকেই–নলিনীকে নিমন্ত্রণ করলে কী হয়?’

ভালবাসা! না, ভালবাসা আর নেই! বিদ্বেষ তো নেই-ই। সে সব ছেলেমানুষি অনেক দিন চলে গেছে। এখন নলিনীর স্মৃতির সঙ্গে একটা স্নিগ্ধ মাধুর্যই জড়িয়ে আছে মনের মধ্যে। আর কৃতজ্ঞতা। অনেক দিয়েছে সে। কাঙালকে নিয়ে গিয়ে–সত্যি সত্যিই হাত ধরে নিয়ে গিয়ে–রাজসিংহাসনে বসিয়েছে। যা পেয়েছে তার জন্যই যথেষ্ট কৃতজ্ঞ থাকা উচিত, আরও কী পায় নি, কী পেতে পারত সে হিসেব করার কোন অধিকার ওর নেই।

খাওয়া দাওয়া চুকিয়ে রান্নাঘরের দাওয়ায় বসে ল্যাম্পোর আলোতে ফর্দ তৈরি হচ্ছিল। ল্যাম্পোর সেই কম্পিত ধূমমলিন শিখাটার দিকে চেয়ে কত কি ভাবতে লাগল হেম! কত ছোট ছোট টুকরো টুকরো কথা–কত অকিঞ্চিৎকর ঘটনার স্মৃতি। নলিনীকে ঘিরে ওর প্রথম-যৌবন-স্বপ্নের সহস্র ইতিহাস। …

প্রচণ্ড হাই তুলে শ্যামা। একসময় প্রশ্ন করে, ‘কী হ’ল, ঘুমিয়ে পড়লি নাকি? কাজটা শেষ ক’রে ফেল্ না বাপু। ‘

সত্যিই যেন চমকে জেগে ওঠে হেম, একটু অপ্রতিভভাবে বলে, ‘দেখি, এখন আর মাথায় কিছু ঢুকছে না বড্ড ঘুম পেয়েছে–কাল সকালে তখন আর একবার ভেবে দেখব কারুর নাম বাদ পড়ল কিনা!’

সে আর শ্যামার উত্তরের জন্য অপেক্ষা না ক’রেই একেবারে উঠে দাঁড়ায়। যদিও–বিছানাতে শুয়ে বহুক্ষণ, বহুরাত্রি পর্যন্ত তার চোখের পাতায় তন্দ্রায় আভাস পর্যন্ত নামে না।

।।৩।।

আর সব নিমন্ত্রণই সন্ধ্যার পর করা সম্ভব কিন্তু নলিনীকে বলতে গেলে দুপুরে যেতে হবে। সুতরাং যাঁহা বাহান্ন তাঁহা তিপান্ন–হেম পুরোপুরি অফিস থেকে ডুব মারল। কামাই তার বড় একটা হয় না, একদিন ‘সিক রিপোর্টে’ কোন ক্ষতি হবে না।

অবশ্য মাকে সেকথা জানানো চলবে না। তা হলেই হাজার গণ্ডা কৈফিয়ত। নলিনীর কথাটা এখন বলতে চায় না সে। সেদিন গোলমালে চলে যাবে–কে আর তখন খুঁটিয়ে কৈফিয়ত নিচ্ছে? সুতরাং যথারীতি ভোরবেলা খেয়েই বেরিয়ে পড়ল এবং সোজা গোবিন্দর বাড়ি উঠে–সারা সকাল আড্ডা দিয়ে, গোবিন্দর অফিসের বেলা করিয়ে আর একবার বড় মাসী আর রাণী বৌদির সঙ্গে ভাত খেতে বসল। ওদের কাছেও ভাঙলে না কথাটা, শুধু বললে, ‘এমনিই শরীরটা ভাল লাগল না, তাই ডুব মারলুম। বারো মাসেই তো ঠিক ঠিক হাজরে দিচ্ছি–এক দিন না গেলে আর কী হবে?’

তবু কমলা সিন্দিগ্ধ সুরে বলে, ‘দেখিস, চাকরি-বাকরি নিয়ে টানাটানি হবে না তো?’

‘পাগল হয়েছ তুমি! এ কি মার্চেন্ট অফিস? রেল আপিসে অত সহজে চাকরি যায় না।’

গোবিন্দ ও গোবিন্দার বৌ বিয়েতে যাবে। রাণী বৌদির ইচ্ছা দুদিন আগেই যায়–মেসোমশাইকে দেখবার আর তাঁর সঙ্গে গল্প করবার জন্য প্রাণটা ছট্‌ফট করেছে ওর–কিন্তু ‘এই এক পোড়া মেয়ে, পেটে এসে ইস্তক শত্রুতা করছে!’ তখন কমলা যেতে দেয় নি–ভরা পোয়াতি বলে। এখনও আগে যেতে দিতে তার আপত্তি–কোলে কচি মেয়ে, সেখানে গেলে সবাইকে বিব্রত করবে, নিজেও বিব্রত হবে। ঠিক হ’ল যে বিয়ের দিন ভোরবেলা ওরা চলে যাবে–গায়ে হলুদের পালা চুকিয়ে ওখানেই দুটি মাছভাত খেয়ে ফিরে আসবে- গোবিন্দ ওকে এখানে পৌঁছে দিয়ে ফিরে আবার বরযাত্রী বেরোবে। ওরা যে ট্রেনে রওনা হবে সেই ট্রেনেই গোবিন্দ কলকাতা থেকে উঠবে–ঠিক রইল। বৌভাতের দিন ওরা যাবে একেবারে বিকেলে–সেদিনটা কোনমতে রাত কাটিয়ে ভোরবেলা ফিরবে। সেদিন কমলাও যাবে কথা আছে। উমা কোনমতেই যাবে না–তা হেমও জানে। তবুও সে বলেছিল একবার, উমা তারই হাতে তার আইবুড়ো ভাতের কাপড় একখানা আর মিষ্টি বাবদ একটা টাকা দিয়ে দিয়েছে।

গোবিন্দদের বাড়ি থেকে বেরিয়ে দক্ষিণাদার বাড়ি হয়ে যখন কম্বুলে- টোলার সেই বিশেষ পরিচিতি বাড়িটির সামনে এসে দাঁড়াল তখন বেলা দুটো বাজে। সময়টা হিসেব করাই ছিল, কিন্তু তবু একেবারে বাড়ির সামনে এসে পড়ে থমকে দাঁড়াল। কড়াটা নাড়তে গিয়েও হাতটা সরিয়ে নিলে। এতক্ষণ একটা আবেগের বশে সে ঝোঁকের মাথায় চলে এসেছে–সব কথা থিতিয়ে ভাবতে পারে নি। যদি নলিনী কথা না কয়? যদি এড়িয়ে চলে সেদিনের মতো? অনেকদিন পরে এসেছে সে সত্যি কথা–কিন্তু তাতেই যে নলিনীর মত পরিবর্তন হবে তার ঠিক কি? কিংবা যদি কড়া নাড়তেই কিরণের সঙ্গে দেখা যায়? ‘তুমি আবার কী মনে ক’রে এদিকে এসেছ বাছা, তোমার লজ্জা নেই? আভি নিকালো হিয়াসে।’ বলে চেঁচিয়ে ওঠে সে? ‘না, থাক বরং। একবারের অপমান যথেষ্ট। সেধে গাল বাড়িয়ে চড় খেতে যাবার দরকার কি? যে জীবন থেকে চলে গেছে চিরকালের মতো–তাকে আর টানাটানি করতে গিয়ে লাভ নেই।

হেম ফিরে দাঁড়াল। ফিরেই যাবে সে। ডাকবে না। তবু আর একবার পিছন ফিরে বাড়িটার দিকে না চেয়ে পারল না আর ঠিক সেই মুহূর্তেই খুট ক’রে দরজাটা খুলে গিরিধারী বেরিয়ে এল।

‘আসুন আসুন দাদাবাবু। ভেতরে আসুন। ফিরে যাচ্ছেন কেন? দিদিবাবু বোলাচ্ছেন আপনাকে।’

‘দিদিবিাবু কেমন ক’রে জানলেন?’ সন্দিগ্ধ কণ্ঠে প্রশ্ন করে হেম।

‘জানলা দিয়ে দেখল যে!’

অগত্যা ফিরতে হয়।

সিঁড়ির মুখেই দাঁড়িয়ে ছিল নলিনী, আগের মতো। কাছে আসতে একটু এগিয়ে এসে গলায় আঁচল দিয়ে টিপ ক’রে এক প্রণাম করে সে।

‘ওকি, ও কি–ও আবার কি?’ বিব্রত হেম দু পা পিছিয়ে যায় তাড়াতাড়ি। হাতটা ধরে ফেলে আটকানো উচিত ছিল কিনা ভাবতে ভাবতে আর কিছু করা হয় না।

‘তা হোক, ব্রাহ্মণ মানুষ। একে তো কত অন্যায় করেছি। সেদিন থেকে কী জ্বালায় জ্বলছি মনে মনে তা কি বলব। এই দিনটির জন্যেই অপেক্ষা ক’রে ছিলুম। বলি আর কোন দিন কি একটু নিরিবিলি দেখা হবে না! মা কালীর কাছে কত মানত করেছি?…যেদিন শুনলুম চাকরি ছেড়ে দিয়ে চলে গেছ–সেদিন থেকে কেঁদে বাঁচি না। বলি আমার জন্যেই বামনের ছেলের ভাত-ভিক্ষে নষ্ট হ’ল–এ মহাপাপ রাখব কোথায়?

দুপুরবেলা ভাড়াটেরা দোর বন্ধ ক’রে ঘুমোচ্ছে। তবু গলা নামিয়ে ফিসফিস ক’রেই বলছিল নলিনী। তার সেই প্রায় বাষ্পরুদ্ধ কণ্ঠের অস্ফুট কথায় হেমের সর্বাঙ্গে যেন কাঁটা দিয়ে উঠল।

‘চল চল–ওপরে চলো আমার কপাল–এইখানেই দাঁড় করিয়ে রেখে বকছি।’

হাত ধরে নিয়ে যায় ওপরে, আগের মতোই। সেই ঘর, সেই শয্যা।

যেন বহুদিন-আগে-স্বপ্নে-দেখা কোন্ রাজ্যে ফিরে এল সে। নেশা লাগে হেমের। কত দিন কত রাত কী ঐকান্তিক কামনাতেই এই ঘরে আবার ফিরতে চেয়েছে সে, অন্তত একটি বারের জন্যও।

একেবারে নিচের ঢালা বিছানাটাতে বসিয়ে অভ্যাসমত জামাটা খুলে নেয় নলিনী, গেঞ্জিটাও। তার পর ঠিক গা ঘেঁষে না হলেও কাছে এসে হাওয়া করতে বসে!

‘তারপর? এখন কি করছে?’

‘রেলে কাজ করছি।’ গলায় একটু জোর দিয়েই বলে সে।

‘ওমা, তবে তো ভালই হয়েছে। শাপে বর। রেলের কাজে শুনেছি বেশ পয়সা।’

‘সে সব কাজে নয়। আমাদের আপিসের চাকরি। এখানে পয়সা নেই।’

‘তা হোক, বাঁধা কাজ তো। মাসকাবারে মাইনেটা হাতে পাবে। এ যা ছিরির কাজ ছিল। ঝ্যাঁটা মারো।’

‘তা তুমি সেদিন অমন ক’রে আমাকে এড়িয়ে গেলে কেন?’ ছেলে-মানুষের মতো প্রশ্ন ক’রে বসে হেম। বহুদিনের নিরুদ্ধ অভিমানে গলাটা কেঁপে যায় ওর।

‘সেদিন’টা যে কোন দিন তা বুঝিয়ে দিতে হয় না। সেদিনের জ্বালা না হোক, ব্যাথা বুঝি নলিনীরও কম ছিল না। উত্তর দিতে গিয়ে চোখে জল এসে যায় তারও। মুখ নামিয়ে ধরা গলায় বলে, ‘যদি তোমার চোখ থাকত তো দেখতে পেতে–আমার মত অবস্থায় পড়লে বুঝতে সেদিন তোমাকে এড়িয়ে গিয়ে বুঝি আমার খুব সুখ-হয়েছিল! কী শাসনে যে ছিলুম তা তো জান না। বুড়ো বয়সে সেদিন মা আমাকে ধরে মেরেছে পর্যন্ত। তার ওপর ভয় দেখিয়েছিল, থিয়েটারে এসে ঘাপটি মেরে বসে থাকবে। বিষম ভয় পেয়ে গিয়েছিলুম তাই। …সারারাত সেদিন শুধু কেঁদেছি তোমার জন্যে। তাই কি ছাই–প্রাণ খুলে কাঁদবার জো আছে সে মিসে তো পাশে শুয়ে–টের পেলেই হাজারো জবাবদিহি!

চোখে বুঝি জল এসে যায় হেমেরও। নলিনীর মুখখানা তুলে ধরে কোঁচার খুঁটে মুছিয়ে দিতে ইচ্ছে করে তার চোখ দুটো। নলিনী আর সামলাতে পারে নি নিজেকে। টপটপ ক’রে জল ঝরে পড়েছে তার গাল বেয়ে। কিন্তু সাহস হ’ল না হেমের, নিজেরও ভেঙে পড়বার ভয়ে।

সে অন্য দিকে মুখ ফিরিয়ে প্রসঙ্গটা পাল্টে দিলে।

‘তা আজ তোমার মা কোথায়?’

আঁচলে চোখের জল মুছে নিয়ে–ধরা গলাতেই হাসির আভাস এনে বললে, ‘ওমা, তা জান না বুঝি? আমি বলি খবর নিয়েই এসেছ। মা যে আজ তিন মাস আমার সঙ্গে ঝগড়া ক’রে কাশী গিয়ে আছে!’

‘কেন–ঝগড়া কেন?

‘সে অনেক কথা।’

‘কি শুনি শুনি–’ সাগ্রহে সামনের দিকে ঝুঁকে বসে হেম।

একটু একটু ক’রে নলিনী খুলে বলে ইতিহাসটা। দীর্ঘ কাহিনী–তার সংক্ষিপ্তসার হচ্ছে–যে, রমণীবাবু আর নলিনীর ঘরে আসেন না। কালো বলে যে নতুন মেয়েটা এসেছিল সখীর ব্যাচে–ঢ্যাঙা ফরসা মতো–হেম যখন ছিল সে তখন সবে এসেছে–দর্জিপাড়ায় বাড়ি, ওর মা খুব নামকরা বাড়িউলী, সেই মেয়েটাকে নিয়েই আছেন। অনেকদিন ধরেই ঝুঁকেছিলেন, নলিনী লক্ষ্য করেছিল ঠিকই–কিন্তু বকাবকি করলে কান্নাকাটি করলে দিব্যি গালতেন, মিছে কথা বলতেন–দুদিন হয়তো আসতেনও ঠিক–আবার ডুব মারতেন। শেষে তিতিবিরক্ত নলিনীই হাল ছেড়ে দিলে! একদিন স্পষ্ট বলে দিলে রমণীবাবুকে যে তাঁর আর আসবার দরকার নেই।

এই নিয়েই ঝগড়া কিরণের সঙ্গে–কিরণ হাল ছাড়তে রাজী নয়। সে অনেক কিছু মতলব এঁটেছিল–মাদুলি কবচও মেয়েকে পরিয়েছিল গোচ্ছার। শেষে প্রস্তাব করেছিল তারকেশ্বরে নিয়ে যাবার, সেখানে নাকি ধন্না দিতে হবে। প্রকাসী মাসী নাকি ঐখানে ধন্না দিয়ে সত্যেনবাবুকে চিরকালের মতো বেঁধে রেখেছিল। কিন্তু নলিনী কিছুতেই রাজী হয় নি। সে বড় অপমান। তা ছাড়া তারকনাথের কাছে ধন্না দিয়ে বেঁধে রাখতে হবে এমন কিছু তালেবর নয় রমণীবাবু। এদান্তে বড্ড কুঞ্জুস হয়ে গেছে যেন আরও, হাত দিয়ে জল গলে না। আর দরকারই বা কি, নলিনীরও তো মুখ বদল করতে ইচ্ছে হয়। না হয় থিয়েটারের চাকরি আর করতে পারবে না–চোখের সামনে সতীন রাণীগিরি করবে, সে দেখা বড় কঠিন–কিন্তু বাড়িটা তো আছে, যা ভাড়া পায় তাতে টেক্স-খাজনা দিয়ে নুনভাতও তো জুটবে! সেটা তো আর রমণীবাবু কেড়ে নিতে পারবে না। কিরণের সেকথা পছন্দ হয় নি, আসলে এমন ভাবে হাল ছেড়ে দেওয়াটাই পছন্দ নয় তার–এক কথা দু কথায় ধুন্ধুমার ঝগড়া বেধে গিয়েছিল, নলিনীও আর রাগ সামলাতে পারে নি–বলেছিল, ‘বেশ করব, আমার যা খুশি তাই করব, তোমার কি? আমি তোমার খাই, না তুমি আমার খাও?’ তাইতেই অভিমান হয়েছে, কাশী চলে গেছে। বলে গেছে ‘ভিক্ষে ক’রে খাব, ছত্তরে খাব,–অন্নপূর্ণার গলিতে আঁচল পেতে বসব–তবু তোর অন্ন আর খাব না।’

‘তা’–একটু হেসে বলে নলিনী, ‘সেখানে আমাদের জানাশোনা অনেকে তো আছে, দশ টাকা ক’রে পাঠাচ্ছি–নিচ্ছে তা শুনছি। না নিয়ে আর কি করবে? ফিরেও আসবে তা জানি, রাগ ক’রে কত দিন থাকবে!’

‘এখন তা হলে কার কাছে আছ?’ প্রশ্ন করে হেম, থিয়েটারে আর যাও না বুঝি?’

‘না, সেই দিন থেকে আর যাই নি। বাবু মাসকাবারের মাইনেটা পাঠিয়ে দিয়েছিল–ফিরিয়ে দিয়েছি। …এখন আসেন আমাদের মুখুজ্জে মশাই–ওঁরই, মানে রমণীবাবুরই বন্ধু, ওঁর সঙ্গেই আসতেন-টাসতেন। অনেকদিন ধরেই ছোঁক ছোঁক করছিলেন–নিহাত বন্ধুর ব্যাপার বলেই কথাটা পড়েন নি। বাবুকে ছেড়েছি শুনেই ছুটে এসেছেন। মাইনে ও-ই আছে, এধারেও দেয় থোয় মন্দ না। কামায় তো ভাল; খুব নাকি বড় চাকরি, বছর-খানেকের মধ্যেই নাকি আরও উঁচুতে উঠবে, তখন এক খাস বড়সাহেব ছাড়া ওর মাথার ওপর কেউ থাকবে না…এ আমি ভালই আছি ভাই, থিয়েটারের মেহনতটা তো বেঁচে গেছে।’

তার পরই কেমন এক রকম অদ্ভুত দৃষ্টিতে হেমের দিকে চেয়ে বলে, ‘তা তুমি এসব জান না–তো আজ হঠাৎ কী মনে ক’রে এসে পড়লে?’

হেম রাঙা হয়ে ওঠে একেবারে। সলজ্জ হেসে বলে, ‘আমার যে বিয়ে। তোমাকে নেমন্তন্ন করতে এসেছি!’

‘বিয়ে? তোমার? ওমা কী হবে!’ প্রায় চেঁচিয়ে ওঠে নলিনী, ‘তা এতক্ষণ একটা কথাও বল নি! কী চাপা লোক রে বাবা!…তা বেশ, ভালই হয়েছে। সত্যি, বয়স তো হয়েছে–এবার ঘরবাসী হওয়া দরকার। না, বড় আনন্দ, হ’ল শুনে…কোথায় বিয়ে? কত পাচ্ছ? মেয়েটি কেমন? কত বয়স তার–মানাবে তো?’ একসঙ্গে একশোটা প্রশ্ন করে সে।

‘রোস রোস–এক এক ক’রে বল। তুমি যে তুবড়ি ছুটিয়ে দিলে!’

সংক্ষেপে পাত্রী, তার বয়স, বাড়িঘর এবং সম্ভাব্য রূপের একটা বিবরণ দেয় হেম।

নলিনী সত্যিই খুশি হয়েছে মনে হ’ল ওর বিয়ের কথা শুনে। ছুটে চলে গেল বাইরে–গিরিধারীকে পাঁচ রাস্তার মোড় থেকে রাজভোগ আনতে পাঠালে। ছেলেমানুষের মতো ছুটোছুটি করতে লাগল যেন।

‘চা খাবে? খাও আজকাল? এখন মুখুজ্জে সাহেবের জন্যে চায়ের পাট হয়েছে বাড়িতে। ওঁর মুহূর্মুহু চা চাই।’

তার পর আতিথেয়তা সারা হলে বলে, ‘তা সত্যিই নেমন্তন্ন করছ তো? যাব? কোন কথা উঠবে না? মানে কোন আবার ফ্যাসাদে পড়বে না তো আমার জন্যে? কি বলবে?’

‘কিছুই বলব না। বলব আলাপী লোক। বলব আমার আগের মনিবের বৌ। গায়ে কি তোমার কিছু লেবেল মারা আছে?’

‘না থাকলে ভালই। আমি কিন্তু বাপু সত্যিই যাব। গিরিধারীকে সঙ্গে ক’রে বাবুর কাছ থেকে ছুটি নিয়ে ঠিক চলে যাব।

‘নিশ্চয়ই যেও। ইস্টিশানে নেমে একটা পাল্কি নিয়ো–ব’লো যে নতুন বামুনদের বাড়ি–ঠিক নিয়ে যাবে। …তুমি কী বলবে বাবুকে?’ হেম মুখ টিপে হেসে জিজ্ঞাসা করে।

নলিনী হেসে জবাব দেয়, ‘বলব তোমার সতীনের বে। …এ তো সুবিধে গো। বিয়ের নেমন্তন্নে যাচ্ছি আমোদ করতে-অন্য রকম সম্পর্ক হলে কি কেউ যায়–না যেতে পারে? কিছু খারাপ ভাববে না। বলব থিয়েটারের চেনাশুনো নেমন্তন্ন করেছে–অনেক ক’রে যেতে বলেছে। আর কিছু বলবে না। সে রকম লোক নয়–সন্দ-বাই নেই।’

‘এবার উঠি তা হলে, আর দু-এক জায়গা যেতে হবে।’

মুখে বলে হেম, কিন্তু তখনই ওঠে না। কী যেন একটা অপূর্ণ রয়ে যায়, কিসের জন্য যেন মনটা সতৃষ্ণ হয়ে ওঠে। যে মোহ তার আর নেই বলে কিছু দিন আগেই মনকে আশ্বাস দিয়েছে, সেই পুরাতন মোহই আচ্ছন্ন করেছে তার বুদ্ধিবৃত্তিকে। পরিচিত পরিবেশ প্রাক্তন অভিজ্ঞতার মধুরস্মৃতি জাগিয়ে তুলছে। সেই স্মৃতির রসে মন আবিষ্ট হয়ে উঠেছে। কেমন যেন একটা অস্থিরতা অনুভব করেছে ভেতরে ভেতরে। বুকের মধ্যেটা কাঁপছে একটু একটু।

নলিনী কিন্তু ওর কথাটাকে সহজ ভাবেই নিয়েছিল। সে তাড়াতাড়ি গিয়ে আলনা থেকে ওর জামা আর গেঞ্জিটা নিয়ে এসে দাঁড়াল।

‘কি হ’ল–উঠবে বললে যে? না কি একটু বসবে?’

হেম সে প্রশ্নের কোন জবাব না দিয়ে ওর একটা হাত ধরে নিজের দিকে আকর্ষণ করলে। মৃদু আকর্ষণ-সুতরাং প্রস্তুত না থাকলেও হুমড়ি খেয়ে পড়বার মতো কিছু নয়, নলিনী অল্প চেষ্টাতেই সামলে নিলে নিজেকে। এ আকর্ষণের অর্থ তার অজানা নয়। সে এবার তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে হেমের মুখের দিকে চেয়ে দেখলে। ও বিহ্বল দৃষ্টিও সে চেনে। পুরুষের এ আকর্ষণ আর ঐ বিহ্বল দৃষ্টির অর্থ তার কাছে পরিষ্কার।

সে প্রবলবেগে ঘাড় নাড়লে, ‘না না, ছি! বিয়ে করতে যাচ্ছ, একটা ভদ্দর-লোকের মেয়েকে হাত ধরে ঘরে আনছ–কত শিবপূজো ক’রে কত আশা নিয়ে সে আসছে বল দিকি। …আর এসব করো না, যা করেছ করেছ–তখন কোন দোষ ছিল না। কিন্তু এখন আর নয়। আমারও বহু জন্মের পাপ এ জন্মে ভোগ করছি–আবার সতীলক্ষ্মী বামুনের মেয়ের কাছে জেনেশুনে পাপের ভাগী হতে পারব না। কিছু মনে করে না–লক্ষ্মীটি, তুমি আজ বাড়ি যাও!

ওর হাত থেকে জামা দুটো নিয়ে কোনমতে গলাতে গলাতে বেরিয়ে আসে হেম। আজও সেইদিনকার মতো নিষ্ফল আবেগে সমস্ত শরীর কাঁপছে তার–আজও অপমানে না হোক–লজ্জায় পাদুটো তেমনি টল্‌ছে, প্রায় সেদিনের মতোই স্খলিত পদে বেরোতে হ’ল এ বাড়ি থেকে–তেমনি বলতে গেলে হাড়ে হাড়ে। তবে সেদিন অপমানটা বাইরে, সহস্র চক্ষুর সামনে–আজ সবটাই ভেতরে। আজ আত্মগ্লানি ও আত্মধিক্কারই প্রবল। …

ছি ছি, নলিনী কী ভাবলে তাকে! কী ছোটই হয়ে গেল ওর কাছে।

আর কি কোন দিন ওর দিকে মুখ তুলে তাকাতে পারবে?

নলিনী সদর দোর পর্যন্ত এগিয়ে দিতে এসেছিল, সে পেছনে থেকে চুপি চুপি বললে, ‘আমার ওপর রাগ ক’রে যাচ্ছ না তো লক্ষ্মীটি, আমার অপরাধ নিও না। কথাগুলো ভেবে দেখো।’

হেম সে কথার জবাব দিলে না। ফিরে তাকালেও না আর। তবে সে রাগে নয়, লজ্জায়।

।।৪।।

হেমের বৌভাত উপলক্ষে শ্যামাকে আর একটি যা কাজ করতে হ’ল, তা তার চিরকাল মনে থাকবে। এত নিচে যে সে নামতে পারে, তা এত দিনের এত জীবনযুদ্ধের পরেও ধারণা ছিল না তার। আর বুদ্ধি বটে বড়-জামাইয়ের–এ বুদ্ধি সাত বছর এক পায়ে দাঁড়িয়ে ভাবলেও তার মাথাতে আসত না।

কম করতে করতেও প্রায় সওয়া–শ লোক হয়ে গেল বৌভাতে। তিন মেয়ের বাড়ি, সরকারদের বাড়ি–তার ওপর কুটুমবাড়ি, এই তো পুরো একশোর ধাক্কা। তা ছাড়া পড়াঘরে একটি একটি বলতে হয়েছে। প্রথম ছেলের বিয়ে–ভিন্ন পাড়ার লোকও দু-একজন সে বলেছে, একটু মাতব্বর দেখে দেখে।

এসেছিল অনেকেই, নলিনীও সত্যি-সত্যিই এসেছিল। তবে তাকে চেনবার জো ছিল না, ভোল পালটে এসেছিল একেবারে। সাদা গরদের শাড়ি পরে ঘোমটা দিয়ে যখন পাকি থেকে এসে নামল, তখন হেমও প্রথমটা চিনতে পারেনি। প্রায় সঙ্গে সঙ্গে পাল্কির পেছনে গিরিধারীর নজর গিয়েছিল তাই রক্ষা–নইলে হয়তো বোকার মতো প্রশ্ন ক’রে বসত, ‘কোথা থেকে আসছ গা পাল্কিওয়লারা?’

অবশ্য নলিনীর আসল পরিচয় কেউ সন্দেহ না করলেও ওর ঐ অতিরিক্ত সম্ভ্রান্ত বেশভূষা ও ধরনধারণের জন্যেই বিস্ময় ও কৌতূহল উদ্রিক্ত হয়েছিল কিছু কিছু–অনেকের কাছেই জবাবদিহি করতে হয়েছিল হেমকে। বিশেষ করে সোনার মাকড়ি দিয়ে বৌয়ের মুখ দেখার ফলে আরও চাঞ্চল্য।

‘ইটি কে গা হেম–ঠিক চিনতে পারলুম না তো—’

‘হ্যাঁ হে হেমচন্দ্ৰ,–উনি, মানে–তোমার কুটুমমাড়ির কেউ নাকি?’

এক-একজন এক-একবার ডেকে প্রশ্ন করেন।

সকলকেই এক উত্তর দিয়েছিল হেম, ‘আমার পুরনো মনিবের স্ত্রী। তিনি আসতে পারেন নি, উনি একাই চলে এসেছেন। আমাকে খুব স্নেহ করেন কিনা—’

কিন্তু প্রত্যেকবারই কান-মাথা গরম হয়ে উঠেছে তার, লজ্জায় ঝাঁ ঝাঁ করেছে মাথার মধ্যে।

সবচেয়ে বিপদে পড়েছিল প্রমীলাকে নিয়ে। তার চোখ যেন অন্তর্ভেদী–মুকি হেসে প্রশ্ন করেছিল, ‘তা হ্যাঁ দাদা, তোমার মনিবগিন্নীর তো নোয়া একগাছা আছে দেখছি সোনা বাঁধানো–কিন্তু সিঁথির সিঁদুর কী হ’ল!’

এক মুহূর্তে ঘেমে উঠেছিল হেম। ঠিক কোন উত্তর যোগায় নি। ভাগ্যে সেখানে মহা দাঁড়িয়ে ছিল–সে বোকার মতো জবাব দিলে, ‘পরতে নেই হয়তো ক’দিন–মাথা ময়লা হয়েছে!’

বেঁচে গেল হেম। বললে, ‘সত্যি, এসব কথা আমাকে জিজ্ঞাসা করছ কেন মেজদি? মেয়েলী ব্যাপারের আমি কি জানি?’

কিন্তু প্রমীলাও ছাড়বার পাত্রী নয়। সোজা হেমের চোখের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করেছিল, ‘ওঁকে জিজ্ঞাসা করব নাকি?’

‘করো না।’

‘কিছু দোষের হবে না?

‘তা জানি না। বুঝে দেখ। সেখান থেকে সরে পড়েছিল হেম। কে জানে যা মেয়ে––হয়তো কী অপমানই বা ক’রে বসবে। হয়তো জানাজানি হয়ে যাবে।

কিন্তু প্রমীলা আর একটু বাঁকা হেসেছিল শুধু।

একফাঁকে একটু নিভৃতে দেখা হতে হেমই বলেছিল, ‘একজন জিজ্ঞেস করছে সিঁথিতে সিঁদুর নেই কেন?’

নলিনী প্রস্তুত হয়েই এসেছে। বললে, ‘ওমা, সিঁদুর বাঁধা রেখেছি যে–ওঁর অসুখের মানসিক।’ বলে হাসল সে। একটু অপ্রতিভ হাসি।

‘সে তো শুনেছি লোহা-সিঁদুর দুই-ই বাঁধা রাখতে হয়!’

‘তা কেন–যার যা মানাসিক।’ প্রশান্ত কণ্ঠে বলে নলিনী।

রতন আসে নি। নিমন্ত্রণ করতে যাবার সময়ই বলে দিয়েছিল, ‘না ভাই আমি কোথাও যাই না–জানেনই তো। থিয়েটারে বায়স্কোপেই যাই না। একেবারে মরে এ বাড়ি থেকে বেরুব–এই ইচ্ছে। কান্তি যাবে বৈকি। তবে বেশি দিন আগে পাঠাব না, একজন মাস্টার রেখেছি ওর জন্যে, মিছিমিছি পড়ার কামাই হবে। এবার ক্লাসে ফার্স্ট হয়ে উঠল দেখে মাস্টারইমশাই একজন ব্যবস্থা করেছি। সামনের বারেই তো ম্যাট্রিক দেবে–যদি একটা জলপানি পায় তো আর কারুর দ্বারস্থ হতে হবে না–নিজেই নিজের পড়ার খরচ যোগাতে পারবে।’

মাস্টার রাখার খবরটা এরা কেউ জানত না। শুনে শ্যামার মন খারাপও হয়ে গেল যেমনি–তেমনি নতুন একটা আশাও মনের সঙ্গোপনে উঁকি মারতে লাগল। ছেলে যেন বড্ড পর হয়ে যাচ্ছে। বড়লোক-ঘঁষাও হয়ে যাচ্ছে হয়তো। এর পর কি আর ওদের ঘরে বাস করতে পারবে? শাক ডাঁটা ডুমুর-সস্সড়ি ভাত কি মুখে রুচবে! তা ছাড়া জলপানি পেয়ে যদি আরও পড়ে তো–চাকরি-বাকরিই বা করে কি করবে। শ্যামা কি চিরকাল এই দুঃখের পেছনে দাঁড় দিয়ে বেড়াবে? অথচ সেই সঙ্গে একটা অত্যন্ত গোপনে দুরাশা, একটা সুদূর কল্পনাও মনে জাগছে। এত যখন করেছে তখন নিশ্চয়ই ভালবাসে কান্তিকে, ওর তো ছেলেপুলে নেই, অগাধ ঐশ্বর্য লোকে বলে। কে জানে, মা সিদ্বেশ্বরী যদি মুখ তুলে চান, ওকেও দিয়ে যেতে পারে হয়তো।

বিয়ের দিন সকালে দারোয়ান এসে কান্তিকে পৌঁছে দিয়ে গেল। তার সঙ্গে একখানা দামী দেশী ধূতি, একথালা গোলাপছাপ সন্দেশ আর একটা সোনাবাঁধানো চিরুনি বৌয়ের জন্য। কিন্তু সেটাও তত বিস্ময়ের সৃষ্টি করতে পারল না–যতটা করল কান্তি নিজে। ছেলেকে দেখে সবাই অবাক। কেউ যেন চিনতেই পারে না। যেমন ঢ্যাঙা হয়েছে, তেমনি সুন্দর। শুভ্র গৌর বর্ণ, আয়ত চোখ, দীর্ঘ পক্ষা–গোলাপের পাপড়ির মতো ঠোঁটের ওপরে সামান্য একটু গোঁফের আভাস–কচি কিশলয়ের মতো। দেখলে চোখ ফেরানো যায় না। আর বেশ-ভূষাই বা কি। চুনট্ করা দেশীকাপড়, সিল্কের পাঞ্জাবি, পাম্প শু জুতো, আঙুলে একটা শীল আংটি। ফুলবাবু একেবারে।

সকলের সপ্রশ্ন ও সবিস্ময় মিলিত দৃষ্টির সামনে দাঁড়িয়ে ঘেমে ওঠে কান্তি। তার যেন কেমন লজ্জা করতে থাকে। হেম পর্যন্ত একটা স-স্ শব্দ ক’রে ওঠে, মাকে বলে, ‘কী সুন্দর চেহারা হয়েছে মা কান্তিটার–যেন রাজপুত্তুর, না?’

এই উপমাটাই বার বার মনে হচ্ছিল শ্যামার। রাজপুত্র ছাড়া আর কিছু মনে পড়ে না কান্তিকে দেখলে। রূপকথার রাজপুত্র একেবারে। আনন্দে তার চোখে জল এসে গিয়েছিল। তার গর্ভের কোন সন্তানই তো ফেলনা নয়–সবাই সুন্দর। ঐন্দ্রিলা আর কান্তির তো কথাই নেই। ওদের বাপও ঐ বয়সে–। রংটাই যা খুব উজ্জ্বল ছিল না, কিন্তু মুখচোখ ঐ কান্তির মতোই ছিল ঠিক আজও সেই প্রথম চার চোখে চাওয়ার কথা মনে হলে কী রকম করতে থাকে বুকের মধ্যে। সেই মানুষ বদস্বভাবের গুণে ঘুরে ঘুরে আর অত্যাচার ক’রে ক’রে কী পোড়া কাঠই হয়ে গেল। আর সে নিজেও, তার রূপটাই কি সোজা ছিল! সেই রূপ, সেই রংই তো পেয়েছে ওরা। আজ আর কিছু নেই তার–একোবরে ছুঁটেকুডুনী কাকতাড়ানী হয়ে গেছে। আজ কান্তির মা বলে পরিচয় দিতে লজ্জা হয় তার। কে জানে, ওদের লজ্জা হয় কি না।

কান্তি ওদের চোখ এড়াতেই বাবার ঘরে গিয়ে দাঁড়িয়েছিল। নরেনও ওকে চিনতে পারে নি। অনেকটা ভ্রু কুঁচকে চেয়ে থেকে জিজ্ঞাসা করেছিল, ‘কে বাবাজী তুমি, চিনতে পারলুম না তো? তুমি বুঝি আমার হেমচন্দরের শালা?’

লজ্জার ওপর লজ্জা। পকেট থেকে রুমাল বার ক’রে ঘাম মুছতে মুছতে বলে, ‘বা রে! আমি তো কান্তি একবার উঠে বসতে পারবেন? পায়েল ধূলো নেব।’

‘কে? কা–। ও আমাদের কান্তি। আরে, এ যে নমকাতিক একেবারে। ময়ূরে গিয়ে চড়ে বসলেই তো হয়। বাঃ এমন সাজালে কে? সেই কসবী মাগী বুঝি? আর কি–নজরে পড়ে গিয়েছিস দেখছি! চেপেচুপে থাক্―দিন কিনে নিতে পারবি। উঁঃ আবার রুমালে খোসাবো। বাবুয়ানার কিছু বাকি নেই। হবে হবে ও বয়সে ঐ–এ বয়সে এই। আমিও বাবু ছিলুম বৈকি এককালে। তবে এমন মাল-দার কারুর নজরে পড়তে পারি নি এই যা–আমার কপালে জুটেছিল যত খোলার ঘরের মাগী–।’

কান্তির প্রণাম করা হয় না, সেখান থেকে ছুটে পালায়। লজ্জায় আঙার হয়ে উঠেছে তার কানের ডগাগুলো, মুখে কে যেন মুঠো মুঠো আবীর ঢেলে দিয়েছে।

ঝকমারি হয়েছিল তার বাবাকে ঘাঁটাতে আসা। জেনে-শুনেও আসাটা তার উচিত হয়নি।

অবশেষে রান্নাঘরে গিয়ে দাঁড়াতে শ্যামা। একটু অবসর পায় প্রশ্নটা করবার।

হ্যাঁ রে, তোর রতনদি তোকে খুব ভালবাসে, না? এসব কবে কিনে দিলে রে?’

‘কী সব–এই কাপড়জামা? দাদা যেদিন বলে এসেছিল সেই দিনই দর্জিকে ডেকে পাঠিয়ে জামার মাপ দিয়েছে।’

‘ভাল হয়ে থাকিস বাপু, মন দিয়ে লেখাপড়া করিস। কত খরচ করছে বল দিকি! আবার তো শুনছি মাস্টার রেখে দিয়েছে একজন–?’

‘হ্যাঁ। বারণ করলুম অত ক’রে, শুনলে না। এত লজ্জা করে–তাই কি কম, পনেরো টাকা মাইনে নেন মাস্টার মাশাই। অন্য কোন ইস্কুলের মাস্টার একজন। কী জেদ চাপল–খরচার ভূতে পেয়েছে যেন।’

‘ভালই তো। এর আর ভূতে পাওয়া-পাওয়ি কি। ভগবানের ইচ্ছেয় আছে ঢের–তোকে ভালবাসে খরচ করছে। মানুষ হয়ে যদি উঠিস কোন দিন–ওকে দেখিস। এই কথাটা ভুলিস নি।’

তার পরই আর একবার ছেলের আপাদমস্তক দেখে নিয়ে শ্যামা বলে, ‘তা তুই তো সেজেছিসও খুব ভাল। একেবারে বাবুদের মতোই। এমন কাপড় পরতে শিখলি কোথায়?

‘এ তো রতনদি নিজে হাতে পরিয়ে দিলেন আসবার সময়।’

বলতে বলতেই কান্তির সুগৌর মুখ আবারও আবীর-রাঙা হয়ে ওঠে।

শ্যামা বলে, ‘তাই নাকি–তা হলে তো মায়ায় খুব জড়িয়ে পড়েছে বল্–আহা নিজের একটা নেই তো–ছেলের মতোই দেখে আর কি!’

একটা নিঃশ্বাস ফেলে সে, সেটা তৃপ্তির কি ঈর্ষার–তা বোধ হয় নিজেও বোঝে না।

কিন্তু সে সব কথা কান্তির কানে যায় না। তার হঠাৎ একটা কথা মনে পড়ে যায়। কাপড় পরিয়ে দেওয়াটা আজ নতুন নয় অবশ্য–আজকাল প্রায়ই ইস্কুলে যাবার সময় রতন ওকে কাপড় জামা পরিয়ে চুল আঁচড়ে বইখাতা গুছিয়ে দেয়–মোক্ষদাদির আবার তাতে একটু রাগ হয় তা এমন কি কান্তিও বোঝে–মুখে যদিও বলে, ‘ভাল তোমাকে বরাবরই বাসে দিদি–কিন্তু এদান্তে যেন বড্‌ড মায়ায় জড়িয়ে পড়েছে। তা তুমিও যে বড় নিপাট ভালমানুষ–ভালবাসা আদায় করবার ঐ তো কৈশল কিনা। এমনিধারা ছেলের ওপরই মায়া পড়ে যে!’

তার জন্যে নয়–আজ আসবার সময় যা কাণ্ড করলে রতনদি–কাপড় জামা পরিয়ে মাথা আঁচড়ে নিজের আঁচল দিয়ে মুখের তেল-তেল ভাবটা মুছিয়ে দিয়ে দুটো কাঁধ ধরে যেন খানিকটা দূরে দাঁড় করিয়ে এক দৃষ্টে চেয়ে রইল ওর দিকে, তার পর আবার একটু কাছে টেনে দাড়ির কাছে দুটো আঙুল দিয়ে মুখটা তুলে ধরে বললে, ‘সত্যিই তোকে যেন মনে হচ্ছে কোন্ রাজপুত্তুর, পঙ্ক্ষীরজ ঘোড়ায় চেপে কোন্ রাজকন্যাকে আনতে যাচ্ছিস। আমার কিন্তু ছাড়তে ইচ্ছে করছে না।’

তার পর যা কোন দিন করে না রতনদি সুগভীর স্নেহে ওকে একটি চুমো খেয়েই যেন শিউরে উঠে ঠেলে সরিয়ে দেয় খানিকটা কতকটা আপন মনেই বলে, ‘না না গরীব বামুনের ছেলে তুই, তোকে যে মানুষ হতে হবে। রাজকন্যের ফাঁদ ভাল নয়। আর এমনি সাজিস নি তুই। এসব ভাল নয়, ভাল নয়।’

বা রে! যেন কান্তিই সাজবার কথা বলেছে, ভাল জামার আবদার ধরেছে! আর কোন দিন সাজবে না সে, রতনদি বললেও সাজবে না।

ঐন্দ্রিলা বিয়ের খবর পেয়েই চলে এসেছিল। ওখানে যে সে আর টিকতে পারছে না তা অন্য লোকের মুখে আগেই শুনেছে শ্যামা। সে জানতো যে এবার একদিন মান খুইয়ে নিজেকেই ফিরতে হবে। ওখানে হরিনাথের মা একটু সেরে উঠেছেন, বাইরে বেরোতে পারছেন দেওয়াল ধরে ধরে, বসে বসে যা কাজ তা তো অনেকটাই ক’রে দিচ্ছেন–সুতরাং তাঁরও প্রয়োজন কমেছে, এরও স্বভাব নিজের–উগ্রমূর্তি ধারণ করেছে। আগে সকলে গরজে সহ্য করত ওর মেজাজ এখন করে না। ফলে খিটিমিটি বাধতে বাধতে এখন একেবারে ডাকাত-পড়া ঝগড়া শুরু হয়ে গেছে। দু’দিন পরে অপমান হয়েই বেরোতে হ’ত হয়তো–হেম গিয়ে পড়তে বেঁচে গেল দুপক্ষই। ঐন্দ্রিলা পরের দিনই চলে এল। ওরাও আর ধরে রাখবার চেষ্টা করলে না। কিংবা কবে ফিরবে তাও প্রশ্ন করলে না।

যাই হোক–এখানে এসে, বোধ হয় অনেক দিন পরে, কতকটা নতুনের মতো বলেই সে খাটছিল খুব। বলতে গেলে বেঁচে গিয়েছিল শ্যামা ওকে পেয়ে। ঘরদোর সাফ্ করা, কাঁচাকুচি এতগুলি লোকের রান্না চার চালের ভার তুলে নিয়েছিল মাথায়। বৌ আসবার পর থেকেই আবার কোথায় কি মাথার মধ্যে গোলমাল বেধেছে। রাগ-রাগ ভাব। বৌভাতের দিন সকালে সেটাই চরমে উঠল–একেবারে অসহযোগ। শ্যামা চোখে অন্ধকার দেখলে! হালুইকর বামুন এসেছে মোটে একজন, অভয়পদ যথারীতি তাকে যোগাড় দিচ্ছে, তার দ্বারা বাড়ির রান্নার কোন সুসার হবে না। অথচ এদিকেও তো লোক কম নয়। এসব করে কে? ‘পাঁচ-ব্যাঞ্জন’ ভাত বোয়ের হাতেও তুলে দিতে হবে। তার একটু নেমরক্ষে পায়েস চাই, কলার বড়া চাই। তরুকে সে কখনও করতে দেয় নি এসব কাজ,–অভ্যস্ত নয়। মহার রান্না অভ্যাস আছে খুব–কিন্তু তার কোলের ছেলেটা ক’দিন ধরে ভুগছে–তাকেই বা কে দেখে। ছেলেটাকে কেউ নিলে সে করতে পারত। নেয় কে?

অগত্যা শ্যামা যুদ্ধের দিকে না গিয়ে সন্ধির দিকে গেল। হাতে পায়ে ধরে, অজ্ঞাত এবং সম্ভবত অকৃত অপরাধের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা ক’রে কোন-মতে কাজে লাগাল তাকে আবার। কিন্তু সে আগুন একেবারে নেভে নি–ছাই-চাপা পড়েছিল মাত্র। হঠাৎ আবার সন্ধ্যের দিকে ধূমায়িত হয়ে উঠল। কিন্তু তখন কুটুমসাক্ষাৎ এসে পড়েছে, ঐটুকু বাড়িতে লোক গিসগিস করছে–তখন আর ওর মান ভাঙাবার সময় নেই। সে চেষ্টাও করলে না শ্যামা, শুধু সবাইকে টিপে দিলে, ওকে কেউ না ঘাঁটায়। কর্ম-বাড়িতে কেলেঙ্কারি হওয়া ঠিক নয়।

সেই মেজাজেই ছিল সে–কিন্তু একসময় বোধ হয় আবিষ্কার করলে যে সবাই তাকে এড়িয়ে চলছে। আর যাই হোক–বোকা নয় ঐন্দ্রিলা। এমন একঘরে হয়ে থাকার অর্থটা সকলের চোখে পড়বে–হয়তো নতুন কুটুমদেরও। কী মনে করবে তারা–ঝগড়াটি বদনাম তো আছেই, সেটা এবার হয়তো সেখান পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়বে আর সে বড় অপমানের কথা হবে–তাই বুঝেই হঠাৎ যেন আবার সক্রিয় হয়ে উঠল সে, এবং নিজে যেচে-সেধে কাজকর্ম হাতে তুলে নিতে লাগল। কন্যাপক্ষের মেয়েদের আদর-আপ্যায়ন রসিকতা কোনটাই বাদ গেল না। শুধু তাই নয়, মেয়েদের খাওয়ানোর সময় পরিবেশন করার ভার একার ওপরই তুলে নিলে। আর সেই অতিসক্রিয়তার সময়ই ছুটোছুটি করতে গিয়ে পা পিছলে পড়ে গেল দাওয়ার নিচেটায়–যেখানে মাটির গেলাসগুলো ধুয়ে উপুড় ক’রে রাখা হয়েছিল–একেবারে তার ওপর। ফলে অবশিষ্ট সমস্ত গেলাসগুলোই ভেঙে গুঁড়ো গুঁড়ো হয়ে গেল। ভাগ্যে তখন পরিবেশন ক’রে খালি একটা গামলা হাতে ফিরছিল, নইলে তরকারি কম পড়ে যেত। কারণ সবটাই মাপা ওদের। কিন্তু লোকসান যা হ’ল তাও কম নয়। তখন রাত দশটা বেজে গেছে, এখানে আর এ বস্তু পাওয়ার কোন সম্ভাবনা নেই। অথচ তখনও কমপক্ষে পঞ্চাশজন লোক বাকি। যার-পর-নাই কুটুমবাড়ির পুরুষরাই বাকি। স্থান সংকীর্ণতার জন্যে অল্প অল্প ক’রে লোক বসানো হচ্ছিল।

শব্দ পেয়ে ছুটে এল অনেকেই। হেমই এসে হাত ধরে তুললে। হেমের ইঙ্গিতেই লোকসানটার কথা কেউ উচ্চবাচ্য করলে না। ঐন্দ্রিলা এমনিতেই যথেষ্ট অপ্রস্তুত হয়েছে। কিন্তু ক্ষতিটা নিয়ে বেশি আলোচনা করলে হয়তো এখনই ভিন্ন মূর্তি ধারণ করবে। কুটুমরা থাকতে থাকতে অন্তত চেঁচামেচি হওয়া ঠিক নয়। তা ছাড়া লেগেছেও খুব। সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারছে না সে, হয়তো কেটেকুটেও গেছে। এখন কিছু বলা আর মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘা দেওয়া সমান।

রাণী এসে ঐন্দ্রিলাকে ধরে নিয়ে গিয়ে এক জায়গায় শুইয়ে জল দিয়ে ছুঁচে দিতে লাগল। শ্যামা তখন বসে পড়েছে! এত পেতল কাঁসার গেলাস নেই যে মান রক্ষা হয়।

শব্দ পেয়ে অভয়পদও ছুটে এসেছিল। শ্যামা আজ মাথায় কাপড় দিতেও ভুলে গেল তার সামনে। প্রায় কাঁদো কাঁদো মুখে বললে, ‘এখন উপায়?’ ‘উপায় আছে বৈকি। গেলাস আনিয়ে নিচ্ছি। ব্যস্ত হবেন না।

হেম বিস্মিত দৃষ্টিতে ভগ্নীপতির দিকে চেয়ে বললে, এখন কোথা থেকে আনাবেন? সব তো দোকান বন্ধ ক’রে বাড়ি চলে গেছে!’

‘সে যা হয় হয়েই যাবে।’

অভয়পদ সরে যায় সেখান থেকে। একটু পরেই শ্যামা ঘাটের দিকে যেতে–পাশ থেকে ডেকে বলে, ‘শুনুন একটু।’

অভয় তাকে নিভৃতে কথা কইবার জন্য ডাকাবে–এ একেবারে অভাবনীয়। শ্যামা বুঝল গুরুতর কোন কথা আছে।

‘কী বাবা?’ বলে এগিয়ে গেল সে।

‘আপনাকে একটা কাজ করতে হবে। পাতা গোলাসগুলো ঐ ওধারে বাঁশঝাড়ের গোড়ায় ফেলা হচ্ছে তো–ওদিকটা অন্ধকার, কেউ দেখতে পাবে না। আগের গেলাসগুলো সব ভাঙে নি নিশ্চয়, বেছে নিয়ে গোটা কতক এ ধারের ঘাট থেকেই ধুয়ে নিন ভাল ক’রে।

কথাটা বোধগম্য হতে সময় লাগল শ্যামার।

তার পর অস্ফূট-কণ্ঠে দুটি শব্দ শুধু উচ্চারণ করলে, ‘ঐ এঁটো গেলাস?’

‘অ ত ভাবতে গেলে আর চলবে না। কাঁসার গেলাস তো মেজে নেন–তাই নিন। বেশ করে মাটি দিয়ে রগড়ে মেজে নিন। তেলটাও উঠে যাবে তাতে, গন্ধও থাকবে না। মাটি তে শুদ্ধু হাতে মাটি করে শুচি হন–মাটি দিয়ে মেজে এঁটো বাসন শুদ্ধ করেন। মাটির গেলাসে দোষ কি…নইলে কি বেইজ্জৎ হবেন?’

তা বটে। আবার আগের যুক্তিগুলো তেমন নয়। শেষের যুক্তিটা প্রবল। শ্যামাকে বেশি বলতে হয় না। সে ‘আচ্ছা’ বলে সরে পড়ে। তারপর একটা গামছা নিয়ে অন্ধকারে হাতড়ে হাতড়ে ঐ দিকের ঘাটে যায়। পাড়ে কাপড়টা ছেড়ে রেখে হাতড়ে হাতড়েই আবার যায় বাঁশঝাড়ের দিকে। সেখান থেকে হাত দিয়ে দিয়ে দেখে আস্ত গেলাস তুলে নেয় ত্রিশ-চল্লিশটা–তার পর সেগুলো বয়ে বয়ে নিয়ে গিয়ে আস্তে আস্তে ধুয়ে নেয় মাটি বুলিয়ে। সেগুলো আবার পাড়ে তুলে রেখে একটা ডুব দিয়ে আসে একবারে।

ওদিকে কারবাইডের উজ্জ্বল আলো, লোকের ভিড়, কোলাহল। এদিকের অন্ধকার পুকুরপাড়ে কারুর নজর চলবার কথা নয়–চললও না। শুধু সতর্ক ও সজাগ ছিল অভয়পদই, তাকে ইঙ্গিতও করতে হ’ল না, শাশুড়িকে আবার ভিড়ের মধ্যে মিশে যেতে দেখেই সে-ও অন্ধকারে চলে গেল।

একটু পরে গেলাসগুলো এনে দাওয়ায় নামিয়ে দিয়ে সহজভাবেই হেমকে বললে, ‘এই নাও গেলাস। এতেই হবে বোধ হয়, না হয় বাড়ির লোক যা হয় ক’রে চালিয়ে নেবে। একেবারে ধুয়েই এনেছি–বসিয়ে দাও গে পাতে পাতে।’

এই ভগ্নীপতিটিকে বহুবার অসাধ্য-সাধন করতে দেখেছে সে–সুতরাং হেম আর খুব একটা বিস্ময়বোধ করল না। কোন প্রশ্নও করল না। পাতা পড়ে গিয়েছিল তাড়াতাড়ি গিয়ে গেলাসগুলো সাজিয়ে দিলে।

চতুর্বিংশ পরিচ্ছেদ

।।১।।

ভাল ক’রে আলাপ পরিচয় হবার আগেই নতুন বৌ কনক আর হেমের মনের মাঝখানে কোথায় একটা প্রায় অদৃশ্য পাঁচিল উঠল। কনক হেমকে ঠিক বুঝতে পারল না। হেমও তাই। অথচ সে ভুল বোঝাবুঝিটা এতই সামান্য, এতই অকিঞ্চিৎকর যে ব্যাপারটা অপরেরও অনুমান করা সম্ভব নয়।

ফুলশয্যাটা হয়েছিল ওদের রান্নাঘরে। তক্তপোশ একটা আগেই কোথা থেকে আধ-পুরনো কিনে পাঠিয়ে দিয়েছিল অভয়পদ, সেটা স্থানাভাবে তখনকার মতো রান্নাঘরেই রাখা হয়। এখন একবাড়ি লোক থৈ থৈ করছে–বড় ঘর ওদের ছেড়ে দিলে এরা শোয় কোথায়? তাই শেষ পর্যন্ত রান্নাঘরেই ফুলশয্যার ব্যবস্থা করতে হ’ল। আর ফুলশয্যা নামেই। রাত তো কাবার হয়েই এসেছে। কতটুকুই বা শোওয়া–নিয়ম রক্ষা বই তো নয়।

কিন্তু তার পরের দিনও হেম যখন হুকুম করলে রান্নাঘরে ওদের বিছানা করতে, তখনই সকলেই অবাক হয়ে গেল। রান্নাঘর অবশ্য বড়ই। তবে মেটে ঘর, গোলপাতার চাল। জানালাগুলো নিতান্ত খুপরি খুপরি। শ্যামা আপত্তি করলে, এখনও তার মনে হ’ল একবার যে, গতকাল ওখানে ফুলশয্যার ব্যবস্থা হওয়াতে একটু অভিমানই হয়েছে ছেলের। মহা ছিল সেদিনও–সে বললে, ওমা, কী খিটকেল। লোকে বলবে যে আমাদের জন্যেই–সে ভারি মন্দ কথা হবে বাপু।’ তরু, ঐন্দ্রিলা সকলেই কুণ্ঠিত বোধ করতে লাগল। শ্যামা বুঝিয়ে বলতে গেল, ‘কাল গোবিন্দর বৌ-টৌ ছিল, সে এক রকমের কথা। আজ আর দরকার কি বাপু। আমাকে তো বাইরের ঘরে শুতেই হবে, ঐ রুগী একা তো আর ফেলে রাখা যায় না। নিয়ে দিয়ে থাকবে তো খোকা, খেঁদি আর তার মেয়ে। তরু আর মহা একটা রাত থাকবে–কালই চলে যাবে ওরা। একটা দিন কোনমতে দালানেই বেশ থাকবে’খন। নয়তো মহাই না হয় ছেলে নিয়ে রান্নাঘরে শুক। কি বাইরের ঘরেও থাকতে পারে–’

হেম একটু অসহিষ্ণুভাবেই তাকে থামিয়ে দিল, ‘আমি ওখানেই শোব। যদি কোন রাজনন্দিনীর মেটে ঘরে শুতে অসুবিধে হয়–সে যেন বড় ঘরে শোয়!’

এবার শ্যামা একটু আশ্বস্ত হ’ল। হাসলও মনে মনে। জানালার বাইরেই বোন-ভাগ্নী থাকলে ছেলে-বোয়ের সারারাত বকর বকর করার অসুবিধা হবে।

হেসেছিল কনকও। একে পাড়াগাঁয়ের মেয়ে সে–তায় তার বাবা যা-ই বলুন না কেন, আঠারো বছর বয়স হয়ে গেছে তার। সে অনেক কিছুই বোঝে। তার অবশ্য মেটে ঘরে শুতে আপত্তি নেই–অভ্যাসও আছে, তার বাপের বাড়িও পাকাঘর মেটেঘর মিলিয়েই–কিন্তু রান্নাঘর আলাদা। ধোঁয়া ঝুল- কালি–মনে করলেই কেমন হয়। অবশ্য পাতার জ্বালে রান্না বলে শ্যামা আজকাল প্রায় দাওয়াতে বাইরের উনুনেই রান্না করে, নিতান্ত বর্ষাবাদল না হলে আর উনুন জ্বালে না, তবে তাতেও ধোঁয়া ঢোকে বৈকি। তবু–এসব অসুবিধা সত্ত্বেও খুশিও হয়েছিল কনক বরের বিবেচনা দেখে। ফুলশয্যা হতে হতে কাল রাত তিনটে বেজে গিয়েছিল–ক্লান্তিতে ঘুমোতে দুজনের অবস্থাই শোচনীয়, তা ছাড়া ওরা দুজনেই জানত যে এই শেষরাত্রেও অনেক জোড়া কান পুকুরের দিক থেকে ঘুরে এসে জানালার গোড়ায় আড়ি পেতেছে–রাণীদির মিষ্টি হাসির শব্দ তো স্পষ্ট শুনেছে কনক–সুতরাং কথাবার্তা কইবার কেউ চেষ্টা করে নি ওরা। ওদের আসল ফুলশয্যাটা বলতে গেলে আজকেই হবে–প্রথম আলাপ ও পরিচয়টা। সেদিক থেকে একটু নিভৃত অবসর মন্দ নয়।

কিন্তু সেখানেই কোথায় একটা মস্ত গণ্ডগোল হয়ে গেল।

.

বৌ বলতে দুটি বৌকেই হেম ভাল করে কাছ থেকে দেখেছিল। গোবিন্দরই দুই বৌ, তারা ও রাণী। দুজনেই সপ্রতিভ। তারার বয়স হয়েছিল, তাছাড়া সে বাইরের মেয়ে, লজ্জা করতে শেখার অবসর পায় নি। আর রাণী বয়সের তুলনায় একটু বেশি সপ্রতিভ, বরং প্রগল্ভও বলা যায়। কিন্তু সে প্রগল্ভতা মুগ্ধই করে মানুষকে। এ দুজন ছাড়া দেখেছিল সে মহাদের বাড়ির প্রমীলাকেও, কাছ থেকে না হলেও যাতায়াতে অনেকবারই দেখেছে। অসাধারণ বুদ্ধিমতী মেয়ে, কথা কইবার সময় সে বুদ্ধির দ্যুতি তার চোখে মুখে বিচ্ছুরিত হয়। কথাতে তার ক্ষুরের ধার। বেঁধে, তবু ভাল লাগে। আর দেখেছে নলিনীকে–প্রগল্ভও নয়, বুদ্ধীমতীও নয়–তবু বেশ কথা বলে। সহজ ভাবেই বলে।

এদের দেখেই অভ্যস্ত সে–তাই মেয়েদের যে কথা বলাতে হয়, লজ্জা ভাঙাতে হয়–তা জানে না। জোর করবার কথা তো কল্পনারই বাইরে, তাই সে সাধারণ ভাবে সহজ ভাবেই কথা কইতে গেল কনকের সঙ্গে। কিন্তু কনক এটা আশা করেনি। একে সে একটু বেশি লাজুক, তায় জ্ঞান হওয়া থেকে অর্থাৎ কৈশোরে পা দেওয়া থেকে অপর বিবাহিতা মেয়েদের কাছ থেকে শুনে আসছে যে বরেরা অনেক সাধ্য-সাধনা ক’রে কনে বৌদের কথা বলায়। আর সে সাধ্য-সাধানার আগে ওদের কাছে ধরা দিতে নেই, তাতে খেলো হয়ে যেতে হয়।

সুতরাং কনক থতমত খেয়ে গেল। অবাকও হয়ে গেল বেশ খানিকটা। আদৌ কথার উত্তর দিতে পারলে না অনেকক্ষণ। তারপর যখন হেম প্রায় অসহিষ্ণু হয়ে উঠেছে তখন দু-একটা উত্তর দিলে বটে–সে উত্তর বা সে কথার ধরন হেমের ভাল লাগল না। সে সংক্ষিপ্ত উত্তরের মধ্যে কনকের বিস্ময়- বিহ্বলতা এত দিনের স্বপ্নে রূঢ় আঘাত লাগার বিমূঢ়তা এবং কিছুটা আশা- ভঙ্গের বেদনা অনুভব করার মতো শিক্ষা বা অভিজ্ঞতা হেমের ছিল না। অপর কোন নব-বিবাহিত বন্ধুর সঙ্গে এই ধরনের সরস আলোচনা করা তার ভাগ্যে কোন দিনই হয়ে ওঠে নি। সুতরাং কনকের সহজভাবে কথা বলার সাময়িক অক্ষমতাকে স্থায়ী অক্ষমতা মনে করলে সে। তারও মন বিগড়ে গেল।

ওদের সে প্রথম পরিচয়ের ধরনটা একটু নমুনা থেকেই বোঝা যাবে :

হঠাৎ একসময় হেম জিজ্ঞাসা করলে, ‘তোমার বয়স কত?’

কনক নির্বাক।

‘কী হ’ল–বয়সটাও জান না নাকি?’

অনেকগুলো উত্তর মনের মধ্যে গলার কাছে ঠেলাঠেলি করছিল।

বলতে পারত যে, ‘জানব না কেন্ কী বললে তুমি খুশি হবে সেইটেই যে জানি না।’

অথবা পাল্টা প্রশ্ন করতে যে, ‘কেন বল দিকি, বয়স জেনে তবে ভালোবাসবে? বলতে পারত যে, ‘কোন্ বয়সটা তোমার পছন্দ বলে দাও–আমি সেই বয়সেরই।

কিন্তু হেমের ঐ কাঠ-কাঠ প্রশ্নের ধরনে কিছুই বলা হ’ল না। বলা হ’ল না কনকের রসের অভাবে নয়–সে রসের উৎসে পৌঁছতে পারার অক্ষমতার জন্য। ভাল পারসির হাতের আঘাত না খেলে খেজুরগাছ রস দেয় না–বাছুরে না ঢু মারলে গরুরও দুধ বেরোয় না। সুতরাং অসহিষ্ণু ধমকে কনকের কথা কন্ঠেই রয়ে গেল। কেনমতে শুধু ঢোক গিলে বললে, ‘সতেরো পূর্ণ হয়েছে।

‘তবে তোমার বাবা কমিয়ে বললেন কেন? তিনি কি মনে করলেন কনের বয়স কম জানলে আমি আহ্লাদে আটখানা হব?’

এ কথার জবাব নেই। কিন্তু হেম আরও খোঁচায়।

‘কী বাক্যি হরে গেল যে! আমি কি কচি খোকা–যে কম বয়স না হলে বিয়ে হ’ত না? আমার ঢের বয়স হয়ে গেছে। আরও বুড়ো মেয়ে হলেও আমার চলত।

কনক শুনেই যায়। এর উত্তর কি দেবে?

কিন্তু হেমেই আবার খুঁচিয়ে তোলে কথাটা, ‘কী, বাপের নিন্দে শুনেই রাগ হয়ে গেল বুঝি? যার মেয়ের এত আত্মসম্মান জ্ঞান তার এমন জলজ্যান্ত মিছে কথা বলাটা ঠিক হয়নি।’

অগত্যা মুখ খুলতে হয় কনককে। সে জড়িয়ে জড়িয়ে থতিয়ে থতিয়ে হলে,’বাবা কেন কিসের জন্যে কি বলেছেনে–কী করেছেন তা আমি কেমন ক’রে জানব।’

‘অ। জানো না। তবু ভাল।’

তারপর হয়তো কিছুক্ষণ দুজনেই চুপ ক’রে থাকে।

খানিক পরে আবারর হয়তো হেম বলে, ‘তা আমার কত বয়স তা তো তুমি জানতে চাইলে না।’

উত্তরটা ঠোঁটের ডগাতেই এসেছিল কনকের, ‘জেনেই বা লাভ কি, বুড়ো বর জানলেও তো আর বিয়ে ফেরত নিতে পারব না। শুধু শুধু মন খারাপ ক’রে লাভ নেই।’ এও মনে হয়েছিল বলে যে, ‘শিব যত বুড়োই হোন গৌরীর কাছে তিনি চিরযুবা।’

কিন্তু কিছুই বলতে পারলে না। এর কাছে এসব কথা বলতে যেন ইচ্ছা করল না। তার ওপর সংকোচও একটা ছিল বৈকি। ছেলেবেলা থেকে মা কাকী জেঠী মাসীর দল কেবল ভয় দেখিয়েছেন–’দেখিস জিভ সামলে থাকিস, শ্বশুরবাড়িতে যেন বেহায়া নাম কিনিস নি। বরের সঙ্গে কথা কইবিও বুঝে- সমঝে, বর বাঁচাল ভাবলে মনে মনে ঘেন্না করবে।’

শুধু বললে, ‘কী দরকার?’

‘জানতে ইচ্ছা করে না?’

‘না।’

এর মধ্যে একবার হঠাৎ প্রশ্ন ক’রে বসল হেম, ‘রাণীবৌ–মানে আমাদের বড় বৌদিকে কেমন দেখলে বল তো?’

তারপর উত্তরের অপেক্ষা না ক’রেই একটু যেন বেশি আগ্রহেই বলে ওঠে, কেমন কথাবার্তা বলেন শুনেছ? লেখাপড়া-জানা মেয়েরা ওর কাছে দাঁড়াতে পারে না।’

হঠাৎ যেন কনকের মুখের ওপর এক ঘা চাবুক মারলে কে।

এতক্ষণের সমস্ত প্রশ্নের সঙ্গে এই প্রশ্নের যে তফাত আছে–এতক্ষণকার প্রশ্নের ধরনে যে নিস্পৃহতা ঔদাসীন্য এমন কি বিতৃষ্ণার ভাব ছিল–এই প্রশ্নে যে তার কিছুই নেই, বরং আগ্রহে আকুলতায় এই কিছুক্ষণ আগেকার কঠিন কণ্ঠস্বরও যেন কী এক জাদুমন্ত্রে মধুর হয়ে উঠেছে–সেটা তার মনের নজর এড়াল না। কতকগুলো আত্মরক্ষার বর্ম মেয়েরা নিয়ে জন্মায়, কর্ণের সহজাত কবচের মতো–সেগুলো ওদের স্বাভাবিক বৃত্তিও বটে। বিশেষ ক’রে যে মেয়ে পল্লীগ্রামে বহু পরিজনের সংসারে মানুষ হয়েছে তার এ বৃত্তিগুলো শাণিত হয়ে থাকে। কনকও সঙ্গে সঙ্গে অনুমান ক’রে নিল–ঐ সূর্য চোখের সামনে থেকে চোখ ধাঁধিয়ে রেখেছে বলেই প্রদীপের আলো চোখে ধরছে না। দামী বিলিতী চন্দ্রমল্লিকার কাছে কুন্দ হাস্যাস্পদ হয়ে উঠেছে।

সে শুষ্ক কণ্ঠে একটা ‘বেশ’ বলে পাশ ফিরে শুল–তাদের দাম্পত্য জীবনের প্রথম স্মরণীয় প্রণয়-রজনীর বিশ্রম্ভালাপে যবনিকা টেনে দিয়ে।

.

হেমও আর কথা বাড়াল না। বোধ করি রাণী বৌদির কথা মনে হতেই তার মনও সেই মাধুর্য-রসে নিষিক্ত হয়ে গিয়েছিল, সেই রসেই ডুবে থাকতে চাইল সে।

কিন্তু তবু একটু বিরক্তও হ’ল। মনে হ’ল বিধাতা বেছে বেছে তার অদৃষ্টেই এক বোদা মেয়ে রেখে দিয়েছিলেন। প্রাণহীন কাঠের পুতুল। সংসারে হয়তো কাজে লাগতে পারে, তার কাজে লাগবে না।

সে বুঝতে পারল না যে, যে মেয়েই আসুক, তার আশা ভঙ্গ হ’তই। আসলে তার আশাটা যে কতদূর গড়ে উঠেছে–সেই খবরটাই জানত না সে। চোখের সামেন রাণী বৌদি নিত্য নতুন রূপে উদ্ভাসিত, বিলাতী হীরের অসংখ্য পলে বিদ্যুতের আলো পড়লে যেমন চারদিক থেকে চোখ ধাঁধিয়ে দেয়, কতকটা তেমনি। আর তাইতে চোখ বেঁধেই গেছে তার, অল্প কোন আলো আর চোখে লাগবার কথা নয়।

সুতরাং মনের অগোচরে যে আশা, যে ইচ্ছা গড়ে উঠেছিল, সেইখানে একটা প্রচণ্ড আঘাত লাগল। আশাটার খবর জানত না, আঘাতটা জানল। মনটা বিরূপ হয়ে উঠল তার ফলে। সঙ্গে সঙ্গে গুটিয়েও নিল নিজেকে। পরের দিন থেকে আলাপের চেষ্টাও করল না। তা ছাড়া তার এমন দরকারও নেই, বিয়ে তো করেছে সে মা আর বাবার পীড়াপীড়িতে–তারাই ঘর করুক বৌ নিয়ে, তাদের কাজে লাগলেই হ’ল।

তার প্রয়োজন?

না, তার কোন প্রয়োজন নেই। মনের প্রয়োজন এ মেয়ে মেটাতে পারবে না। সে আর একজন মেটাচ্ছে–প্রয়োজনের বেশি। পাত্র উপচ্ েউঠেছে সে মাধুর্যের সুরায়। দৈহিক? না, যত দূর নিজের দিকে তাকিয়ে দেখতে পায় সে তাগিদও খুব নেই। ও জিনিসটাতেই তেমন যেন প্রবল আসক্তি আর নেই। নলিনী একটা অভ্যাসের সৃষ্টি করেছিল। সেদিন তার কাছে গিয়ে সেই অভ্যাসটাই তাকে টেনেছিল–নইলে মেয়েদের সম্বন্ধে ভাবতে গেলেই ঐটে আগে মনে হবে, সে রকম মানসিক গঠন ওর নয়। রাণী বৌদিকে দেখে তার মন ভরে আছে সত্য কথা–কিন্তু ঐ পর্যন্তই, দেহের দিক দিয়ে কখনই ভাবে না সে। তার দীপ্তিতে সে মুগ্ধ। তার বেশি কিছু নয়। শুধু দেখতে চায় তাকে। কাছে বসতে চায়। তার নিত্য নূতন রূপ দেখে চোখ জুড়িয়ে যাবে, নিত্য নব নব বিস্ময়কর কথা শুনে মন ভরে যাবে। আর কিছু চায় না।

॥২॥

কনক এত কথা জানে না। জানা সম্ভবও নয় কোন সাধারণ মেয়ের পক্ষে। হেমের ঔদাসীন্যে যে যেন কাঠ হয়ে উঠল। একটা চাপা অভিমানও বোধ করল বটে–কিন্তু সে অভিমান ত্যাগ করতে তার বিন্দুমাত্র দ্বিধা ছিল না, যদি কোন্ পথে কী ভাবে ত্যাগ করলে তাদের সম্পর্কটা সহজ হয়ে উঠবে বুঝতে পারত। এখন কী করা উচিত, তার দিক থেকে কী করবার আছে, তাও যে সে ভেবে পেল না।

এই ভাবতে ভাবতেই সপ্তাহ কেটে গেল। বাপের বাড়ি যাবার ছুটি মিলল মাত্র পনোরো দিন। শ্যামা বললে, ‘আমি একা আর পেরে উঠি না–বড্ড নাটাঝামটা খেতে হয়। আরও আমার সেই জন্যে সাত- তাড়াতাড়ি ছেলের বিয়ে দেওয়া। বৌমাকে কিন্তু বেশি দিন ফেলে রাখতে পারব না বেই মশাই।’

পূর্ণ বাবু ব্যস্ত হয়ে উঠলেন একেবারে, ‘সে কি কথা, ও তো এখন আপনারই মেয়ে, আপনাদের সম্পত্তি। তা ছাড়া আমরাই রাখতে চাইব কেন? ঢের দিন তো পুষলুম, আবারও?’

সুতরাং পনেরো দিন পরেই ফিরে আসতে হ’ল।

অবশ্য পনেরা দিন কম নয়–যদি সেটুকু সময়েরও সদ্ব্যবহার করতে পারত। পরামর্শ দেবার লোক কম ছিল না, নিজের ও জেঠতুতো খুড়তুতো মিলিয়ে বোনই ওরা অনেক, ওপরে নিচে কাছাকাছি বয়সেরই পাঁচ-ছজন–তা ছাড়া পাড়ার সমবয়সী বন্ধুরা তো ছিলই। কিন্তু কনক কারুর কাছেই মন খুলতে পারল না–পরামর্শ চাওয়াও হ’ল না।

কোথায় একটা আত্মসম্মানবোধে বাধল। কেমন ক’রে যেন আপনা থেকেই অনুভব করলে যে এ বড় অপমানের কথা। আর সকলের জন্যেই তাদের বর পাগল, তবু তো তারা কেউই তার মতো সুন্দর নয়–অথচ তার বরই তার সম্বন্ধে উদাসীন–একথা কি ওদের বলা যায়? বললে তারা আহা উঁহু করবে, সহানুভূতি জানাবে, কিন্তু সে তো করুণা। এই বয়সে সকলের, বিশেষত সমবয়সীদের কৃপার পাত্রী হয়ে লাভ নেই। সকলে যখন চারিদিক থেকে ঘিরে ধরল তাকে–তার দাম্পত্যপ্রণয়ের বিশেষ অভিজ্ঞতার ইতিহাস শোনাবার জন্য, তখন সে যতটা পারল পূর্বশ্রুত বহু কাহিনীর ভাণ্ডার থেকে নানা তথ্য সংগ্রহ করে সাজিয়ে গুছিয়ে একটা কাল্পিনিক চমৎকার প্রথম প্রণয়ের ইতিহাস খাড়া করল। শ্রোত্রীরা যে তখনকার মতো একটু ঈর্ষিত হয়েই বিদায় নিল–সেইটেই বড় লাভ।

তার পর এখানে ফিরে আবার যথাপূর্বং।

বরং আগের চেয়েও খারাপ।

হেম যেন আরও সুদূর–আরও কঠিন হয়ে গেছে।

কথা যে একেবারে কয় না–তা নয়। হুকুম ফরমাশ–’এটা দাও, ওটা তুলে রাখ, জামাটায় সাবান দিও’–সহজেই করে। কিন্তু তার বেশি কিছু নয়। আসেও সে প্রত্যহই বহু রাত ক’রে। এত রাত পর্যন্ত কোথায় থাকে সে–সংকোচে কথাটা শাশুড়িকে জিজ্ঞাসা করতে পারে না–ভাববেন হয়তো যে এরই মধ্যে বৌ ছেলের ওপর খবরদারি করছে। হেমকে তো জিজ্ঞাসা করা সম্ভবই নয়। তবে অনুমান করতে পারে সে। খেতে বসে এক-একদিন মা- ছেলে বা দাদা-বোনে যে টুকরো টুকরো কথা হয়–তা থেকে বোঝে যে সে অনুমান ওর মিথ্যাও নয়। প্রায় প্রত্যহই বড় মাসীমার বাড়ি যায় হেম। এ ছাড়া থিয়েটারেও যায় শনি-রবিবার ক’রে। বিয়ের নেমন্তন্নে যায় হামেশা, প্রায় প্রত্যেক বিয়ের দিনেই যায়। ওকে এত লোক কী সূত্রে নেমন্তন্ন করে তা ভেবে পায় না কনক। শুধু খেয়েই আসে না, মধ্যে মধ্যে ছাঁদাও নিয়ে আসে।

বহু কথাই বলতে ইচ্ছা করে তার স্বামীকে। বহু অনুযোগ, বহু প্ৰশ্ন। কিন্তু কাকে বলবে ভেবে পায় না। রাত দশটায় এসে খেয়েই শুয়ে পড়ে–ওঠে ভোর পাঁচটায়। ছটার মধ্যে স্নান ক’রে খেয়ে বেরিয়ে যায়। এ মানুষ যদি নিজে থেকে কথা না বলে তো ওর পক্ষে বলা কঠিন। তা ছাড়া সংকোচ করতে করতে বাধার একটা দুর্লঙ্ঘ্য প্রাচীর সৃষ্টি হয়েছে–নিজে থেকে যেচে মান ভাঙাতে যাওয়া–ভারি লজ্জা করে ওর। তাছাড়া মান ভাঙাবেই বা কী ক’রে? যে অপরাধ ও করে নি সেই অপরাধের জন্য ক্ষমা চেয়ে?

অবশ্য কথা কয় না–মানে গল্প করে না বলে সেবাও নেয় না–তা নয়। দৈনন্দিন জীবনের সাধারণ সেবা ছাড়া অসাধারণও কিছু কিছু নেয় বৈকি। এবার আসবার সময় মা বিশেষ ক’রে বলে দিয়েছেন, ‘খাওয়াদাওয়া হয়ে গেলে শাশুড়ির কাছে গিয়ে বসবি, তিনি শুতে যাও বললে তবে যাবি। আর রোজ জামাইয়ের পা টিপে দিবি–পুরুষমানুষ ‘খেটে-খুটে ঘুরে-ঘারে আসে– ওটুকু ওদের দরকার। দেখিস–যেন শ্বশুরবাড়িতে আমাদের মুখ নষ্ট করিস নি–কেউ না বলতে পারে যে মা মাগী কোন সহবৎ শেখায় নি মেয়েকে!

মা’র প্রথম উপদেশ মানা কঠিন নয়। কারণ শাশুড়িই ওর জন্যে অধৈর্য হয়ে অপেক্ষা করেন। হেমের খাওয়া হলে সেই পাতে ওকে খেতে দিয়ে শাশুড়ি ননদও খেতে বসে যায়–খাওয়া একসঙ্গেই চোকে–ঐন্দ্রিলা রাত্রে মুড়ি খায় বেশির ভাগই, কোন দিন জুটলে এক-আধখানা রুটি–সে তো আগেই উঠে গিয়ে শুয়ে পড়ে–শাশুড়ি জেগে থাকে বসে থাকেন, কখন সকড়ি মুক্ত করা, বাসন্ মাজা শেষ হবে সেই জন্য। সে যখন ঘাটে যায়–শ্যামাও আলো হাতে ক’রে গিয়ে দাঁড়ায়। সোমথ বউ, এত রাত্রে বাইরের ঘাটে যাওয়া ঠিক নয়। সে ফিরে এসে বাড়িতে ঢুকতে না ঢুকতে সদর দরজা বন্ধ ক’রে শ্যামা চলে যায় বাইরের ঘরে, সুতরাং কনকের আর অপক্ষো করার প্রয়োজন থাকে না।

দ্বিতীয় উপদেশটা নিয়েই একটু বিপদে পড়েছিল সে। প্রথম দিন অযাচিত অনিমন্ত্রিত ভাবে স্বামীর পায়ে হাত দিতে বেধেছিল তার। সবচেয়ে ভয়, এটাকে না সে প্রণয়-ভিক্ষা বলে মনে করে। অবশ্য মনে ক’রে যদি সদয় হয় তো বেঁচে যায় কনক–কিন্তু তবু পায়ে ধরে ভালোবাসানো ছিঃ! মনে হলেই কেমন হয়। আরও ভয় যদি পা সরিয়ে নেয়, যদি রূঢ়ভাবে সেবা প্রত্যাখ্যান করে? যদি পা দিয়ে হাত সরিয়ে দেয়?

কিন্তু কোনা আশা বা কোন আশঙ্কাই তার ফলল না। হেম নির্বিবাদে চুপ ক’রে শুয়ে রইল। বাধাও দিলে না, নিষেধও করলে না–কৃতজ্ঞতা স্বরূপ একটা মিষ্টি কথাও বললে না। সবচেয়ে বিপদ থামতেও বললে না–সে কি সারারাত টিপে যাবে নাকি–এমনি? কী মনে করে হেম–তার রাজপ্রাপ্য? অবশেষে অনেকক্ষণ পরে ক্লান্ত হয়ে আপনিই থামল কনক। তাতেও কোন সাড়া এল না ও তরফ থেকে। একটু পাশে শুয়ে বুঝল সাড়া দেবার অবস্থাও নেই–হেম গাঢ় ঘুমে অচেতন। হয়তো অনেকক্ষণই এইভাবে ঘুমোচ্ছে সে। ক্ষোভে অপমানে কনকের চোখে জল এসে যায়। কান্নাটা আরও লজ্জার বুঝেই কোনমতে আত্মসংবরণ করে।

কিন্তু তার চেয়ওে লজ্জাকর একটা ঘটনা ঘটল দিনকতেক পরে। যেটার জন্য এত আকিঞ্চন, এত সাধনা–সব মেয়েরই যা কাম্য–তা যখন এল তখন সেটা পাওয়ার লজ্জাতেই যেন মরে যেতে ইচ্ছা করল কনকের।

রোজই পা টেপে সে। নীরবে নিঃশব্দে সেবা ক’রে যায়, আর অম্লানবদনে সে সেবা গ্রহণ করে হেম। থামতে বলে না কেনা দিনই, প্রায়ই ঘুমিয়ে পড়ে সে সেবা নিতে নিতেই। কনক আজকাল সেয়ানা হয়ে গেছে, সে দশ-বারো মিনিট পা টিপেই শুয়ে পড়ে, ওর রাজনিদ্রার জন্য অপেক্ষা করে না।

এরই মধ্যে এক দিন–এই পা টেপার সময়ই হেম ওর একটা হাত ধরে আকর্ষণ করল নিজের দিকে।

পূর্ব অভিজ্ঞতা নেই সত্য কথা–তবুও নারীর সেই স্বাভাবিক অনুভূতি, সহজাত বৃত্তিই তাকে যেন সতর্ক ক’রে দিল। সমস্ত শরীরে কাঁটা দিয়ে উঠল ওর–একটা অজ্ঞাত আশা ও আশঙ্কায়। তবু ঠিক কি ব্যাপরটা তা তখনও বুঝতে পারে নি বলে বাধা দিতেও পারলে না–একটু কঠিন হবার চেষ্টা করেছিল, কিন্তু হেমের সবলতর আকর্ষণে একেবারে তার পাশে এসে পড়ল।

সে আকর্ষণের পূর্ণ অর্থ বুঝতে দেরি হ’ল না অবশ্য।

সেদিন আর ঘরে শুয়ে থাকতে পারে নি কনক, হাতড়ে হাতড়ে অন্ধকারেই বেরিয়ে এসে বাইরের দাওয়ায় পড়েছিল। সারারাত ধরে কেঁদেছিল সে–প্রণয়হীন সম্ভাষণহীন চুম্বনহীন দাম্পত্যমিলনের এই অপমান। একবার পুকুরে গিয়ে গা ঢেলে দেবার কথাও যে মনে জাগে নি তা নয়–কিন্তু নেহাত প্রথম বয়স, বহু আশা-আকাঙ্ক্ষা বহু স্বপ্ন তার মানস ভবিষ্যতে, সেই আশা ও স্বপ্নই তাকে এইভাবে সর্বনাশের দিকে যেতে বাধা দিল। ভোরবেলা শাশুড়ির দোরখোলার শব্দে আবার ধীরে ধীরে সে ঘরেই ফিরে এল–সেই অভিশপ্ত শয্যার দিকে।

হেম তখনও অগাধে ঘুমোচ্ছে।

কাজটা ক’রে ফেলে হয়তো সে একটু অনুতপ্ত হয়েছিল, কিন্তু একটা মনগড়া সান্ত্বনা ক’রে নিতে বেশি বিলম্ব হয় নি তার। নিজের একটা অকারণ অহঙ্কার, মিথ্যা আত্মমূল্যবোধই তাকে সে সান্ত্বনা যোগাল। যেন রাণী বৌদির মতো মেয়ে, প্রমীলার মতো মেয়েই তার প্রাপ্য ছিল; কনকের মতো জড় প্রাণহীন মেয়ে দিয়ে তাকে ঠকানো হয়েছে। সে মেয়েকে যা দিয়েছে এই ঢের–তাকে অনুগ্রহই করা হয়েছে।

আর একটা সূক্ষ্ম অহঙ্কার তার চূর্ণ হয়েছে। জৈবিক প্রয়োজন তার নেই বলে সে ভেবেছিল মনে মনে–সে ভাবনা মিথ্যা হয়ে গেছে। এখন একটা মিথ্যা অহঙ্কারকে আর একটা মিথ্যা অহঙ্কার দিয়ে ঢাকা ছাড়া উপায় কি?

॥৩॥

চুরে ক’রে নেমন্তন্ন খাওয়াটা যেন হেমকে এক নেশায় পেয়ে বসেছে। এটা ঠিক খাওয়ার লোভ নয়, হয়তো সেটা প্রথম প্রথম একটু ছিল কিন্তু এখন আর নেই, তা সে হলফ ক’রে বলতে পারে। খাওয়ার সময় যেটা ছিল সে সময়ই খেতে পায় নি–ফলে খাওয়ার শক্তিটাও কমে গেছে। জলখাবার খাওয়ার কোনাকালে অভ্যাস নেই, ছুটির দিনেও সেই একেবারে বেলা বারোটা-একটা নাগাদ ভাতে-জলে বসে। কমলার বাড়িতে যখন থাকত ছুটির দিন সকালে সেখানে হাজির থাকলে গোবিন্দ জোর করে কিছু খাওয়াত–এখানে সে বালাই নেই। শ্যামার মনেও পড়ে না সে কথা।

এখন বৌ আসার পর ছেলে ভাতের সঙ্গে একমুঠো চাল বেশি নেয়–সেই ভাতই একগাল ক’রে কনক ও সীতা খায়. সকালবেলা। সেই তাদের জলখাবার। ছুটির দিনে ওদের জন্যে দুটি মুড়ি ব্যবস্থা। তাও অনেক দিন ভুলে যায় শ্যামা। নিহাত সীতা কান্নাকাটি করে তাই ঐন্দ্রিলা বার ক’রে দেয়, চক্ষুলজ্জার খাতিরে বৌদিকেও দিতে হয়। নইলে কনক কিছুতেই মুখ ফুটে চাইতে পারত না। হেম তার দু বেলা দু মুঠো ভাত–যে কোনও উপকরণ দিয়ে হোক–এই পেলেই খুশি। তাও উপকরণের দিকে ভাল ক’রে চেয়েও দেখে না কোনদিন। প্রথম বয়সে লোভ সংবরণ করতে বাধ্য হয়েছিল বলেই–এখন পেটে ক্ষিদে এবং খাবারের দোকানে থরে থরে সুস্বাদু মিষ্টান্ন সাজানো থাকলেও, সে খাওয়ার কথা মনে পড়ে না ওর। এমন কি পকেটে পয়সা থাকলেও না।

না, লোভটা বড় কথা নয়। এর মধ্যে একটা আনন্দ আছে। ঠকাবার আনন্দ। নিজের চতুরতার সাফল্যের আনন্দ, কৃতিত্বের আনন্দ। ভয় আছে, এখনও মাঝ মাঝে খুবই ভয় করে–যখন কোন কোন কর্মবাড়িতে তীক্ষ্ণদৃষ্টি দু- একজন লোকের সামনে পড়ে যায়, ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে দেখে তারা, ফিস- ফিসও করে তাকে নিয়ে–তখন বুকের মধ্যে দুর-দুর ক’রে বৈকি? একবার একটা জায়গায় অবস্থা এমন হয়ে উঠল যে ভিড়ের মধ্যে গা-ঢাকা দিয়ে পালাতে হ’ল শেষ পর্যন্ত। না খেয়েই বাড়ি ফিরতে হ’ত–যদি না আর একটা বাড়িতে ঠিক সেই সময় বরযাত্রীর নামবার সময় হ’ত। সে বরকর্তা কেমন এক রকম অন্যমনস্ক ধরনের মানুষ–পাশ দিয়ে যাচ্ছিল, হঠাৎ ওর কনুইটা ধরে ফেলে, ‘ও কি বাবা, তুমি যাচ্ছ কোথায়? এসে এসো। এই দ্যাখ ছেলেমানুষ, পালাবার ফিকিরে ছিলে বুঝি?’ বলে ঠেলে দিলেন ভেতর দিকে। সে বাড়িটাও ছোট, বসবার জায়গা কম, কন্যাকর্তা সেইখান থেকেই কতক বরযাত্রীকে একেবারে পাচার করলেন ছাদে। নির্বিঘ্নে খেয়ে নেমে এল।

অবশ্য এ বিপদে খুব কমই পড়তে হয়েছে তাকে। কারণ বড় বিয়ে বাড়ি ছাড়া সে ঢোকে না, ছোট মাপের কাজে ধরা পড়বার ভয় বেশি। তবে খুব তীক্ষ্ণদৃষ্টি লোক দু-একজন থাকে সব জায়গাতেই, যাদের নজর এড়ানো শক্ত, যারা অতিথির মুখ দেখলেই রবাহূত বা অনাহূত বুঝতে পারে।

তবু বিপদ আছে বলেই উত্তেজনা আছে। আর সেই উত্তেজনাটাই হ’ল আসল নেশা। সেই নেশাতেই পেয়ে বসেছে তাকে।

আগে ছিল হেম সম্পূর্ণ একা, তাতে বেশি ভয়-ভয় করত–এখন ওর এই কারবারে একজন অংশীদার জুটে গেছে। সে হ’ল দুর্গাপদ–মহার দেওর।

এক দিন, কী একটা ছুটির দিনে লগ্নসা পড়েছে। হেম সেগেগুঁজে এসে শ্যামবাজারের দিকের একটা রাস্তা ধরে চলতে চলতে বিয়েবাড়িগুলোর আয়তন এবং সমারোহ দেখে অভ্যাগতের একটা আনুমানিক সংখ্যা হিসাব করছে মনে মনে–এমন সময় প্রায় সামনাসামনি ধাক্কা লেগে গেল দুর্গাপদর সঙ্গে।

‘আরে, তুমি এখানে কী করছ! এত সাজগোজ? বিয়ের নেমন্তন্ন নাকি?’

‘হ্যাঁ। তা তুমিই বা এখানে কোথায়?

‘গিছলুম একটু এক বন্ধুর বাড়ি। অনেক দিন ধরেই বলছে আসতে, সময় আর হয় না। আজ মরিয়া হয়ে বেরিয়ে পড়লুম–তা দ্যাখ না–ভাবলুম এত পয়সা খরচ ক’রে এলুম, রাত্তিরেরর খ্যাটটা সেরে যাব–ব্যস আজই বাবু উধাও, তিনি আবার কোন্ তালে গেছেন কে জানে। অবিশ্যি আমি আসব বলে রাখি নি–খুব দোষ দেওয়াও যায় না। যাক– তুমি যাও, আমিও চলি–’

তার পর ঈষৎ ঈর্ষাতুর দৃষ্টিতে আর একবার তার সাজ-পোশাকের দিকে তাকিয়ে বললে, ‘তুমি তো দিব্যি চললে এখন কালিয়া পোলাও খেতে, আমি এখন যাই, দেখি কী জোটে–যদি জল দেওয়া ভাত চাট্টি থাকে তো রক্ষে, নইলে আবার চাপাতে বলতে হবে। এক কেলেঙ্কারি আর কি। … তা বলে তো সারারাত পেটে কিল মেরে শুয়ে থাকা যায় না–কী বল? আমি আবার মরতে কেন যে আমার ভাত রাখতে বারণ করে এলুম তাও জানি না।’

সে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে সামনের দিকে এগোয়ে।

হেম ওর একটা হাত ধরে ফেলে, ‘তা তুমিও চল না।’

‘আমি? আমি কোথায় যাব?’

‘কালিয়া পোলাও খেতে।’

হ্যাঁ… তোমার নেমন্তন্ন তুমি সেজেগুজে এসেছ–আমি সেখানে যাব কি?’

‘কেন–তোমারও দিব্যি ধোপদস্ত কাপড় জামা দেখছি।’

হ্যাঁ, তা অবশ্য আছে। আজই তো ভাঙবার দিন। তা ছাড়া কলকাতায় বন্ধুর বাড়ি আসছি–তোমাদের ওখানে সে বেশে যাওয়া চলে তা তো আর এখানে চলবে না। ‘

‘তবে আর কি–চল চল। রাত হয়ে যাচ্ছে।’ সে দুর্গাপদর হাত ধরে টানে সত্যিই।

‘আরে–আরে–টানছ কোথায়। এমনভাবে বিনা নেমন্তন্নে।’

‘আমাকেই বা কে গলায় কাপড় দিয়ে হাত জোড় ক’রে নেমন্তন্ন করেছে।’

‘তার মানে?’ দুর্গাপদর দুই চোখ বিস্ফারিত হয়ে ওঠে, ‘তবে তুমি কোথায় যাচ্ছ?’

‘যেখানে ভাল ব্যবস্থা পাব সেখানেই।’

ওর বিস্ময় লক্ষ্য ক’রে হেম হাসে। তারপর সংক্ষেপে ব্যাপারটা খুলে বলে। প্রথম দিনকার আকস্মিক ব্যাপারটা থেকে কী করে এটা পেশায় দাঁড়িয়ে গেল।

‘তাই নাকি। ওঃ, চালাক বলে আমাদের খুব অহঙ্কার ছিল। যা হোক দেখালে বটে। খুব দুর্জয় সাহস তো তোমার।‘

‘নাও–যাবে তো চল। এখনও না কোথাও ঢুকে পড়তে পারলে ভিড় কমে যাবে, মওকা পাব না।‘

‘যাব? অনেকদিন ভালমন্দ কিছু খাই নি বটে। সেই যা তোমার বিয়েতে তা সে আবার আমার দাদার ম্যানেজম্যান্ট তো, জুত হয় নি।’

উৎকৃষ্ট ভোজ্যের কল্পনাতেই তার দুচোখ লুব্ধ হয়ে ওঠে। দুর্গাপদ চিরদিনিই খেতে ভালোবাসে।

হেম আর কথা না বাড়িয়ে হাত ধরে টেনে নিয়ে যায় তাকে।

সেই সূত্রপাত। এখন দুর্গাপদ ওর এই অভিযানে নিত্যসঙ্গী। আগে থেকে পাজিপুঁজি দেখে ঠিক ক’রে রাখে–কোন্ দিন কোন্ ট্রেনে আসবে, কারুর সে ট্রেন হঠাৎ ফেল হয়ে গেলে অপরজন কোথায় অপেক্ষা করবে ইত্যাদি। দুর্গাপদ অবশ্য আর একটা ভাল ব্যবস্থা করে ফেলেছে ইতিমধ্যে। হাওড়া স্টেশনের চায়ের স্টলে একটি ছেলে কাজ করে–তার দাদা দুর্গাপদর অফিসের বেয়ারা। সেই হিসেবেই জানাশুনো। অফিসের দিনেও ভারী লগনসা পেলে ছাড়ে না ওরা, সকালবেলাই ধোয়া জামাকাপড় এনে তার কাছে জিম্মা ক’রে দিয়ে যায়, অফিসের ফেরত স্টেশনে এসে ওয়েটিং রুমে মুখহাত ধুয়ে কাপড় পালটে ‘নিমন্ত্রণ রক্ষা’ করতে বেরোয়। রাত্রে বাড়ি ফেরার পথে আবার সেই ছোকরার কাছ থেকেই ময়লা কাপড় জামা নিয়ে নেয়।

একদিন এই বিয়েবাড়ির সন্ধানেই গিয়ে পড়েছিল ও অঞ্চলে। সকাল সকাল লগ্ন সেদিন–ওদেরও সেটা শনিবার, কোন অসুবিধাই হয় নি–তাড়াতাড়ি খাওয়া চুকে গিয়েছিল বরং সেইটেই সুবিধা। অনেকটা সময় হাতে আছে বলে আস্তে আস্তে গল্প করতে করতে ফিরছিল। অন্যমনস্ক হয়েই হাঁটছিল, তবু এক সময় কেমন যেন মনে হ’ল জায়গাটা ওর, খুব অচেনা নয়। আর প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই নজরে পড়ল–সামনেই শরতের ছাপখানা।

দুর্গাপদকে একটু দাঁড়াতে বলে হেম এগিয়ে গেল ওদিকে। ঘরে আলো জ্বলছে যখন–প্রেস খোলা আছে নিশ্চয়। আর মালিকও তা হলে আছেন। অনেকদিন শরতের সঙ্গে দেখা হয় নি। বিয়েতে নিমন্ত্রণ করতে এসেছিল, তখনও দেখা পায় নি–জমাদারের কাছে লিখে রেখে গিয়েছিল। শরৎ যেতে পারে নি। আইবুড়োভাতের কাপড় ও মিষ্টি বলে চারটে টাকা মনিঅর্ডার করে পাঠিয়েছিল। সেই কুপনেই লিখে দিয়েছিল, ‘শরীর খুব খারাপ যাইতেছে, আবার হাঁপানির মতো হইয়াছে–যাইতে পারিলাম না সেজন্য খুব দুঃখিত, আর একদিন গিয়া বধূমাতাকে দেখিয়া আসিব’ ইত্যাদি।

শরীর খারাপ জেনেও এতকালের মধ্যে খবর নেওয়ার কথা মনে পড়ে নি, সেজন্য বড়ই লজ্জিত বোধ করতে লাগল হেম। অনেক আগেই এক দিন আসা উচিত ছিল।

কিন্তু ভেতরে উঁকি মেরে দেখলে শরৎ নেই।

সে জায়গায়–ওরই চেয়ারে বসে আছে আর একজন লোক। শরতের কর্মচারীদের চেনে হেম. তারা কেউ নয়। কর্মচারী শ্রেণির বলে মনেও হ’ল না।

একটু ইতস্ততঃ ক’রে হেম ওপরে উঠে গেল, ‘শরৎবাবু নেই?’

যে বসে ছিল, অপেক্ষাকৃত অল্পবয়সী একটি লোক, সে একটু অবাক হয়েই তাকাল ওর দিকে, ‘তিনি তো আর বসেন না এখানে–বহুদিন হ’ল বসছেন না।’

‘বসছেন না? আর এখানে আসেনই না?’

‘না। তিনি প্রেস ছেড়ে দিয়েছেন।’

‘ছেড়ে দিয়েছেন? মানে বেচে দিয়েছেন?’

‘না, বেচে ঠিক দেননি। লীজ দিয়েছেন, আমিই লীজ নিয়েছি। মাসিক ভাড়া বন্দোবস্ত। মালপত্র টাইপ মেশিন সব তাঁর অবশ্য, তাঁকে জিজ্ঞাসা না ক’রে কিছু হস্তান্তর করতে পারব না। আমার শুধু নেড়েচেড়ে চালানো। তাঁর তো আর নিজে দেখা সম্ভব নয়।’

‘কেন তার কি খুব অসুখ?’

‘দেখুন’, ছেলেটি বিজ্ঞভাবে বলে, ‘খুব যে একটা অসুখ তা বলতে পারি না। হাঁপানির মতো হয়েছে, হজমের গোলমাল–আছে আরও এটা ওটা–তবে আসলে মনটাই গেছে ভেঙে আর কি। এসব আর পেরে ওঠেন না। যোঝবার শক্তিটা চলে গেছে।

তারপরই কী মনে ক’রে যেন সচেতন হয়ে উঠল নতুন মালিক 1

‘কাজকর্ম কিছু আছে নাকি? থাকলে স্বচ্ছন্দে দিয়ে যেতে পারেন। সেই সবই–কম্পোজিটর জমাদার সব ঠিকই আছে–আমি কাউকে ছাড়াই নি। শরৎবাবু নেই বলে কাজের কোয়ালিটি কিছু খারাপ হবে না।’

‘না, আমি কাজ দিতে আসি নি–আমি তাঁর আত্মীয়।’

‘আত্মীয়–অথচ কোন খবর রাখেন না।’ লোকটির কণ্ঠে ঈষৎ বিদ্রূপের সুর। বোধ হয় আশাভঙ্গ জনিত ক্ষোভের ফল সেটা।

‘না, দূরে থাকি কি না। তা সেই বাসাতেই আছেন কিনা জানেন?

‘না, না থাকেন এই কাছেই। নতুন বাজারের পাশে একটা মেসেতে। খুব কষ্টেই আছেন ভদ্রলোক। যান না, দেখেই যান একবার। আমি ঠিকানা লিখে দিচ্ছি।’

সে একটা চিরকুটে বাড়ির নম্বর ও গলির নাম লিখে দেয়।

হেম আবার রাস্তায় ফিরে এসে দুর্গাপদকে বলে, ‘তুমি যাও ভাই দুৰ্গা, আমার একটু ফিরতে দেরি হবে।’

‘কেন বল দেখি–কী ব্যাপার এখানে।’

‘এ আমার মেসোমশাইয়ের প্রেস। খবর নিতে গিয়েছিলুম শুনলুম খুব অসুখ। মনে করছি একবার দেখেই যাই। আবার অন্য একদিন এত দূরে উজোন ঠেলে আসা।’

দুর্গাপদকে বিদায় দিয়ে খুঁজে খুঁজে অতি কষ্টে মেস্-বাড়িটা বার করলে হেম। দর্পনারায়ণ ঠাকুরের গলি থেকে একটা কানাগলি বেরিয়েছে, তার মধ্যে একটা অতি পুরাতন জরাজীর্ণ বাড়ি। সদরের কাছ থেকেই ভিজে ভিজে ভ্যাপসা গন্ধ পাওয়া যায়। কেরানীর মেস্ নয়, নতুন বাজারের যত দোকানদারের কর্মচারীর মেস। দোকানদারেরা অনেকে বাসায় বা বাজারের ওপর ঘরভাড়া ক’রে থাকে। কর্মচারীদের আরও সস্তায় থাকা দরকার। আঠারো, কুড়ি, বাইশ, এই সব মাইনে বেচারীদের। বাড়িটাও সেই মাপেরই। তবু খরচ কমাবার জন্য একটা ঘরে ছটা পর্যন্ত বিছানা ফেলতে হয়েছে। ওপরতলায় সম্ভবত চৌকির বালাই নেই, নিচের ঘরে তবু একটা করে আমকাঠের চৌকি ফেলা আছে।

সদরের পাশে গলির দিকে যে ঘর সেই ঘরেই শরৎ থাকে, একতলাতে। স্যাত্স্যাঁত করছে ভিজে ঘর সেইখানেই চৌকির ওপর বসে হাঁপাচ্ছে সে। অন্ধকারেই বসে ছিল, এখানে এত আলোর সুবিধে নেই ‘গেস্ট এসেছে’ ঠাকুর হেঁকে বলায় চাকর এসে একটা হারিকেন বসিয়ে দিয়ে গেল মেঝের ওপর তাতে আলোর চেয়ে ধোঁয়াই বেশি, দেখতে দেখতে কেরাসিনের গন্ধে ঘরটা ভরে উঠল।

হোক ক্ষীণ আলো–তবু কঙ্কালসার দেহটা দেখতে কষ্ট হয় না। সেই রূপের এই পরিণতি। হেমের চোখে জল এসে যায় যেন।

‘এসো বাবা, বসো। এখানে এলে কী ক’রে। ঠিকানা–? ও, প্রেসে গিছলে বুঝি? তার পর, খবর সব ভাল তো? বিয়ে ঢুকে গেল নির্বিঘ্নে–? বৌমা কেমন হলেন? তোমর মা’র সঙ্গে বনছে তো?’

কষ্ট ক’রে ক’রে হলেও অনেকগুলো কথাই বলে শরৎ। একা একা মুখ বুজে থাকা সারাদিনরাত। দোকানির মেস, সবাই ভোরে উঠে চলে যায়–মাঝে একবার খেতে আসে–তা তখনও কথা কইবার মতো যথেষ্ট ফুরসত থাকে না তাদের–রাত্রে ফেরে এগারোটা-বারোটায়, ক্লান্তিতে মড়ার মতোই এলিয়ে পড়ে। অনেকদিন পরে পরিচিত লোকের সঙ্গে কথা কইতে পেয়ে যেন বেঁচে যায় সে।

হেম কতকটা স্তম্ভিত হয়েই দাঁড়িয়ে ছিল, সে এবার বললে, ‘কিন্তু এ কী হাল হয়েছে আপনার? আপনি ডাক্তার-টাক্তারও দেখান না বুঝি?’

‘ডাক্তার আর কি করবে? বয়স হলে এসব অমন হয়। আর ডাক্তার দেখিয়ে বেঁচেই বা লাভ কি বেশি দিন, তাড়াতাড়ি সরে পড়তেই তো চাই।’

‘তাই বলে এই ঘরে–এমনিভাবে? একে আপনার হাঁপানির মতো হয়েছে, তার ওপর এই ভিজে ঘরে বাস করছেন? সে বাসা ছাড়লেন কেন? মেসে আসবার কী দরকার পড়ল?’

‘না বাবা, সে যেন টিকতে পারলুম না কিছুতেই। একা একা–। তা ছাড়া এক জায়গায় থাকা, এক জায়গায় খাওয়া–এ আর পোষাল না।’

‘তা এই মেস ছাড়া কি আর মেসও জোটে নি আপনার? কলকাতায় কী আর এর চেয়ে ভাল মেস ছিল না?’

একটু অপ্রতিভাবে হাসলে শরৎ।

‘তা ঢের ছিল বৈকি। তবে কি জান–আমার যেন আর কিছুতই কোন হ্যাঁঙ্গাম করতে ইচ্ছে করে না। আমারই এক কম্পোজিটার এইও মেসে থাকত–সে সন্ধান দিলে, চলে এলুম। কে আবার ঘোরে, খোঁজ করে–অত মেহনত পোষায় না। তা ছাড়া এর কতকগুলো সুবিধে আছে–ছাপাখানাটা কাছে, ওদের কোন দরকার হলেই ছুটে আসে, জেনে যায়। গঙ্গাটাও বেশি দূর নয়–টানটা একটু কমলেই মনে করছি রোজ গঙ্গাস্নান ধরব–তোমার মাসীর মতো। আয় কি জান, সস্তাও খুব–সাত টাকায় খাওয়া থাকা ‘

‘কিন্তু এত সস্তার আপনার দরকারই বা কি? এত টাকার অভাব আপনার পড়ল যে দশ-বারো টাকার একটা মেসেও থাকতে পারেন না। কত দেয় আপনাকে ওরা প্রেসের ভাড়া?’

‘ও, তাও জনে এসেছ! আচ্ছা বটে অনাদি ছোকরা, সকলের সঙ্গে হাটিপাটি পেড়ে ঘরের কথা বলা চাই। তা ভাড়া মন্দ দেয় না। চল্লিশ টাকাই দেয় মাসে। তেমনি খরচও তো দেদার–কাপড় আছে জামা আছে–ডাক্তারবদ্যি আছে–কী নেই বল? তবু দশ-বারো টাকা কি আর খরচ করতে পারি না–তা পারি। অন্য একটা মতলব আছে। কখনও তো টাকা জমাতে পারলুম না, রোজগার কম করি নি–কিন্তু থাকল না একটা পয়সাও। কত কর্তব্যেই তো ত্রুটি রয়ে গেল–মধ্যে মধ্যে বড্ড গ্লানি বোধ হয় বাবা মনটার মধ্যে। তাই বাসার পাট উঠিয়ে মালপত্তরগুলো বেচে যখন থোক টাকা খানিকটা হাতে পাওয়া গেল, তখনই এই মতলবটা মাথায় এল। মরবার আগে যদি কিছু জমাতে পারি, দুটো টাকা মিলিয়ে–। যাক সে কথা, তোমার আর শুনে কাজ নেই। …ও হরি, তুমি এখনই উঠে দাঁড়ালে যে–বসো বসো। কিছু একটু আনাই খেয়ে যাও।’

‘না-না এক জায়গায় নেমন্তন্ন ছিল, আপনার ওই ছাপখানার পাড়াতেই–একপেট খেয়ে আসছি। ওসব দরকার নেই। আর একদিন তখন–। আজকের মতো উঠি।’

‘উঠবে? তা ওঠ।’ একটু যেন ক্ষুণ্ণ কণ্ঠেই বলে শরৎ, ‘তোমার তো আবার সেই হাওড়ায় গিয়ে ট্রেন ধরা। রাতও হয়ে যাচ্ছে বটে। আচ্ছা, এসো তা হলে। মোদ্দা মধ্যে মধ্যে–যদি এদিকে কাজকর্ম কিছু থাকে, একটু খবর নিয়ে যেয়ো বাবা।‘

তারপর আরও কানিকটা ইতস্তত ক’রে–প্রথম থেকে যে প্রশ্নটা ঠোঁটের কাছে ঠেলাঠেলি করছিল, হেম ঘরের বাইরে পা দিতেই যেন হঠাৎ সেটা ক’য়ে ফেলে, ‘তোমার–তোমার ছোট মাসী ভাল আছেন? গিয়েছিলেন নাকি তোমার বিয়েতে?’

‘না, উনি তো কোথাও যান না। তবে ভালই আেেছন–যত দূর জানি। ক’দিন আগেও বড়দার সঙ্গে নাকি দেখা হয়েছিল।’

‘বড়দা–? মানে গোবিন্দ?…অ। ভাল থাকলেই ভাল। আচ্ছা এসো।

।।৪।।

হেম কিন্তু তখনই বাড়ির দিকে গেল না, বরং উল্টো দিকেই হাঁটতে শুরু করল। এখনই উমার বাড়িতে যাবে সে। আজই এর একটা বিহিত ক’রে ফিরবে–তা সে যত রাতই হোক।

উমা তখন সবে পড়িয়ে ফিরে কাপড় কেচে পুজোয় বসতে যাচ্ছে। হেমের গলার আওয়াজ পেয়ে তাড়াতাড়ি এসে দোর খুলে দিলে।

‘কী রে, এত রাত্রে হঠাৎ। খবর সব ভালো তো?’ উৎকণ্ঠিত ভাবে প্রশ্ন করে উমা।

‘আমাদের খবর সব ভাল। আজ এদিকে এসে পড়েছিলুম–খবর নিতে মেসোমশাইয়ের ছাপাখানায় গিয়েছিলুম–তাই।’

বুকের মধ্যেটা কেমন যেন ঢিক্ ক’রে উঠে উমার। সে কোন প্রশ্নও করতে পারে না। অসহায়ভাবে হেমের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে শুধু। হঠাৎ যেন পায়ের জোরটাও কমে যায় অনেকখানি। একটু কাঁপুনির ভাব টের পায় নিচের দিকটায়। তাড়তাড়ি কপাটটা ধরে ফেলে সে।

‘না–না। সে রকম কিছু নয়। বলছি, ব্যস্ত হয়ো না।’ উমার অবস্থাটা হারিকেনের আলোতেও লক্ষ্য করে হেম।

উমা আশ্বস্ত হয়ে ভেতরে এসে ওকে পথ ছেড়ে দেয়। মাদুরটা বিছিয়ে বসতেও দেয়।

একটু হাসিও পায় নিজের অবস্থা লক্ষ্য ক’রে। স্বামী বলে যাকে ডাকবার কোন অধিকারই নেই–এক বিয়ের রাতের কটা মন্ত্র ছাড়া–তার জন্যই তার এ কি উৎকণ্ঠা। এ কী শুধু নিজের এই এয়োস্ত্রী অবস্থার সুবিধার জন্যই। মাছ খাওয়া তো সে ছেড়েই দিয়েছে বহুকাল। শুধু এই লালপাড় শাড়ি, এই লোহাগোছটা আর শাঁখা দু’গাছা। ব্রত-পার্বণে ছাত্রীদের বাড়ি থেকে কিছু পাওনা হয়–এই তো।

হেম মাদুরে বসে বলে, ‘মেসোমশাই প্রেস লীজ দিয়ে দিয়েছে–মানে ভাড়া আর কি। প্রেসে আসেও না, বসেও না, দেখাশুনোও করে না। শরীরে আর কিচ্ছু নেই–দেখলে চিনতে পারবে না তুমি–কঙ্কালসার হয়ে গেছে একেবারে–ঐ বাহারে চোখদুটো তেমনি না থাকলে চিনতে পারতুম না সত্যিই। হাঁপানির মতো হয়েছে নাকি–বসে বসে হাঁপাচ্ছে। তার ওপর সে বাসা-টাসা সব উঠিয়ে দিয়ে–বললে বিশ্বাস করবে না–নতুন বাজারের পেছনে এক এঁদো গলির ভাঙা পুরনো ড্যাম্প বাড়ির এক মেসে একতলার ঘরে আছে। এ আত্মহত্যা ছাড়া আর কি?…কলকাতায় যে অমন বাড়ি আছে তা না দেখলে বিশ্বাস হ’ত না আমার?

‘কেন? আর মেস পায় নি? বাড়িই বা ছাড়লে কেন? না কি পয়সা নেই?’

কণ্ঠস্বরটা যেন অতিরিক্ত তীক্ষ্ণ শোনায়। উমা নিজেই অপ্রতিভ হয়ে পড়ে নিজের গলার আওয়াজে। আসলে কঠিন করবার প্রাণপণ চেষ্টাটাকেই অন্তরের ব্যাকুলতা যে বিদ্রূপ করে গেল–এ তীক্ষ্ণতা যে ব্যগ্রতারই নামান্তর তা কি হেমের বুঝতে বাকি থাকবে।

হেম অবশ্য কী বোঝে তা সে-ই জানে। সে একটু বোধ হয় ভয় পেয়েই যায়। সামান্য একটু হাসবার মতো ভঙ্গি ক’রে বলে, ‘সে বাড়িতে একা একা নাকি থাকতে পারছিল না, তাই মালপত্র সব বেচেকিনে সে বাড়ি একেবারে ছেড়ে দিয়ে ঐ মেসে এসে উঠেছে। ছাপাখানার দরুন ভাড়াই পায় মাসে চল্লিশ টাকা–তবু বেছে বেছে ঐ সাত টাকার মেসে এসে না উঠলে চলছিল না। ..আসলে ওঁর কথার ভাবে যা বুঝলুম–এখন টাকা জমিয়ে যাচ্ছে–বোধ হয় তোমাকে দিয়ে যাবে বলে।’

শেষের কথাগুলো একটু ভয়ে ভয়ে বলে হেম।

আর ভয়ের কারণও যে ছিল–তা বোঝা গেল বলা শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই।

উমার সে তপ্তকাঞ্চন বর্ণের কিছুই আর নেই সত্য কথা–রোদে পুড়ে জলে ভিজে বাইরে ঘুরে ঘুরে মুখটা তামাটে হয়ে গেছে একেবারে–তবু অপমানের এবং উম্মার গাঢ় লাল রংটা হেমের চোখে পড়ে। আগুনের মতোই জ্বলে ওঠে উমা। বলে, ‘হ্যাঁ অনেক তো দিয়েছে–ঐ উপকারটাই বাকী আছ শুধু। মরবার সময় টাকা দিয়ে স্বামীর কর্তব্য ক’রে যাবে–না। আস্পদ্দা!’

হেম চুপ ক’রে বসে থাকে। সে যা বলতে এসেছিল–এ যেন উলটোটা হয়ে গেল। কিন্তু একটু পরে উমাই শান্ত হয়ে আসে। হেমের কথাগুলো–আগের কথাগুলো যেন মনে মনে একবার উচ্চারণ করে। ‘কঙ্কালসার হয়ে গিয়েছে।’

‘দেখলে চেনা যায় না।’

‘একা সেই ভিজে ঘরে বসে বসে হাঁপাচ্ছে।’

‘এ আত্মহত্যা ছাড়া আর কি।’

ওর মনে পড়ে যায় সেদিনের কথাগুলো। শরতের সেই বিবর্ণমুখে বেরিয়ে যাওয়া। সেই অসহায় দীন ভঙ্গিটা। সে চলে যাবার পর অনুতাপোর শেষ ছিল না উমার। কে জানে সেদিনের সেই আঘাতের ফলেই লোকটা এমনভাবে নিজেকে শেষ ক’রে দিচ্ছে কিনা।

হঠাৎ যেন ছটফট ক’রে ওঠে সে ভেতরে ভেতরে। কিন্তু প্ৰাণপণে সে আকুলতা দমন ক’রে মুখে শুধু বলে, ‘তা এ কথা এত রাত্তিরে আমাকে বলতে এলি কেন?’

হেম তবুও চুপ করে থাকে। কেন এসেছে সেটা যেন বলতে আর ভরসা পায় না। তার উত্তরে আবার জ্বলে উঠবে কিনা কে জানে।

‘এখানে–মানে আমার কাছে এনে রাখতে চাস?’ যতদূর সম্ভব শান্তকণ্ঠে সহজভাবে প্রশ্ন করে উমা। হঠাৎ এ আশ্চর্য শক্তি কোথা থেকে পেল ও আত্মদমন করবার, নিজেই ভেবে অবাক হয়ে যায়।

‘নইলে মেসোমশাই আর বাঁচবে না।’

এতক্ষণে কথাটা বলে ফেলে যেন বাঁচল হেম।

এবার উমার চুপ করে থাকার পালা।

কত কী মনে হচ্ছে তার। কত বিস্মৃত স্মৃতি ভিড় করে আসছে চিন্তার দরজায়। কত ভুলে যাওয়া আবেগ উদ্বেল হয়ে উঠছে। যে সব চিত্তবৃত্তি মরে গেছে ভেবেছিল–সেইগুলোই জেগে উঠেছে আবার–একসঙ্গে।

মনের ঝড় কান পেতে কি বাইরে থেকে শোনা যায়?

কার বুকে উঠেছে ও ঝড়? কার মনে বেধেছে লড়াই?

উমা যেন বহুদূর থেকে নিরাসক্ত ভাবে চেয়ে থাকবার চেষ্টা করে। যেন অনেকখানি ব্যবধান থেকে শোনার চেষ্টা করে সে ভয়ঙ্কর কোলাহল।

তার পর–তেমনি যেন অনেক দূর থেকেই ক্ষীণকণ্ঠে প্রশ্ন করে সে, ‘সে কি আসবে মনে করিস?’

‘তুমি–তুমি বললেই আসবে। তুমি একবার যেতে পার না?’

‘আমি যাব–সেই মেসে? লোকে বলবে কি?

‘তুমি বাইরে গাড়িতে বসে থেকো। সে গলিতে তো গাড়ি যাবে না। দূরে থাকতে হবে। তুমি চল লক্ষ্মীটি।’

‘আমার এত করার গরজ?’

আবারও তীক্ষ্ণ কণ্ঠে প্রশ্ন করে উমা। কিন্তু এবার হেমও বুঝতে পারে–এ প্রশ্ন হেমকে নয় তার–নিজেকে।

সুতরাং সে চুপ ক’রেই থাকে। উমাই একবার অসহায় ভাবে চারিদিকে চায়। এই ঘরে মা’রই আসবাব বোঝাই। সেদিকে চেয়ে মাকে মনে করবার চেষ্টা করে সে। বোধ হয় মা’র এই স্মৃতির মধ্যে থেকে তাঁর একটা নিৰ্দেশ পাবারও আশা করে।

সেদিকে চেয়েই মনে হয়–কে যেন মনের মধ্যে বলছে, ‘তুমি বড় ছোট হয়ে যাচ্ছ উমা। এখনও এই অভিমানের ঊর্ধ্বে উঠতে পার নি?’

সত্যি–অভিমান কি কখনও মরে না?

তারপর কতকটা ছেলেমানুষের মতোই বলে, ‘এই তো ঘর। বাড়িওলাই কী রাজী হবে? আর সে যে বড় লজ্জার কথা–এখন এ কথা বলতে যাওয়া।’

‘আমি–আমি একবার বলে দেখব?’ ভয়ে ভয়ে প্রশ্ন করে হেম।

‘না না–সে আরও লজ্জার কথা। তুই একটা কাজ করতে পারবি বাবা? কাল তো রবিবার, সকাল ক’রে খেয়ে-দেয়ে চলে আসবি একবার?’

‘নিশ্চয় আসব। আমি আটটার মধ্যে পৌঁছে যেতে পারি।’

‘না না–খেয়ে-দেয়ে দশটা-এগারোটায় আসিস, তা হলেই হবে।’

হেম খুশী হয়ে চলে যায়।

উমা আর একবার অসহায় ভাবে তাকায় ঘরটার দিকে। যেন মনে হচ্ছে ঘরের মধ্যকার বাতাস কমে গেছে একেবারেই। শ্বাস নেওয়া যাবে না একটু পরে। যেন অদৃশ্য এক শক্তি তার গলা টিপে ধরেছে।

সে ছুটে গিয়ে ঘরের বাইরে ভেতরে খোলা উঠোনটায় দাঁড়াল।

.

পরের দিন হেম যখন এল–তখনও উমার চোখ লাল, হয়তো রাত্রি জাগরণের ফলেই। সম্ভবত সারারাতই ঘুমোতে পারে নি বেচারী। তার দিকে তাকিয়ে হেমের কষ্টই হতে লাগল। কেনই বা এর মধ্যে জড়াতে গেল ওকে। সত্যিই যার কাছ থেকে এতটুকু কিছু পেলে না–তার প্রতিই বা কর্তব্যপালনের কী এত গরজ। উমা কিন্তু কথা কইল খুব সহজ ভাবেই।

‘বাড়িওলাদের বলে মত করিয়েছি। বুড়োমানুষ থাকবেন, বাইরের পাইখানা আর কলতলা ব্যবহার করবেন–ওঁদের আপত্তি হবে না। শুধু তাই নয়, ওঁরা এই সিন্দুক আর দেরাজটা আপাতত ওঁদের ঘরে রাখতে রাজী হয়েছেন। যদি ওঁরা পাশের ছোট ঘরটা খালি ক’রে সারিয়ে দিতে পারেন তো চার-পাঁচ টাকা ভাড়া বেশি দেব তাও বলেছি। … সে থাক গে, তোকে একটা কাজ করতে হবে–কোথায় তক্তপোশ পাওয়া যায় আমি তো জানি নে–খোঁজ ক’রে একটা কিনে আনতে হবে। ..টাকা নিয়ে যা– একজনের মতো ছোট তক্তপোশ, নইলে ধরবে না। আর দ্যাখ, একটা পাশবালিশ চাই। ভাল বড় তৈরি পাশবালিশ ওয়াড়সুদ্ধ কিনে আনিস। যে মুটেতে তক্তপোশ আনবে তাদের দিয়েই এই দেরাজ সিন্দুক ওপরে ওদের ঘরে বইয়ে নিতে হবে।’

হেম এতটা আশা করে নি। সে মহা উৎসাহে টাকা নিয়ে বাজারে চলে গেল।

মুটে দিয়ে মাল সরিয়ে চৌকি পেতে যখন ঘর মুছে পরিষ্কার ক’রে স্নান ক’রে এল উমা–তখন বেলা তিনটে।

এতক্ষণে খেয়াল হ’ল হেমের।

‘তুমি কিছু খেলে না তো মাসী?

‘সকালে পুজো সেরে একটু জল খেয়ে নিয়েছিলুম। আর কিছু লাগবে না। চল বেরিয়ে পড়ি। সন্ধ্যের সময় একেবারে রাঁধব।

‘দাঁড়াও। তোমার না হোক, আমার ক্ষিদে পেয়ে গেছে ছুটোছুটি ক’রে। আগে একটু খাবার আনি।’

হেম ছুটে গিয়ে খানকতক কচুরি আর দুটো মিষ্টি নিয়ে আসে।

উমা ম্লান হাসে। এ ক্ষিদে যে ছেলের কিসের তা বুঝতে তিল-মাত্ৰ বিলম্ব হয় না তার। সে প্রতিবাদও করে না, অনাবশ্যক বুঝেই। মিছিমিছি কথা- কাটাকাটি ক’রে লাভ নেই–সেই ধরপাকড়, পীড়াপীড়ি। কোন তর্ক-বিতর্কেই তার রুচি নেই আর। যা করতেই হবে বুঝছে তার জন্য দেরি করতেও ইচ্ছে করে না। আসলে সে ক্লান্ত। করছে সবই করছে ও–কিন্তু ভেতরে এ যে কী প্রচণ্ড অবসাদ আর সীমাহীন ক্লান্তি–তা শুধু সেই বুঝছে।

হেম ছুটেই ফিরল খাবার নিয়ে–নিজেই পাতা খুলে দু ভাগ ক’রে সাজাল। এক ভাগ এগিয়ে দিল মাসীর দিকে। হয়তো প্রচণ্ড একটা প্রতিবাদ আসবে ভেবেছিল, কিন্তু কিছুই করল না উমা, শুধু বলল, ‘দাঁড়া জল গড়াই একটু।

তারপর নিঃশব্দেই খেতে শুরু করল।

ছোট মাসীর বড়ই খিদে পেয়েছিল–মনে মনে ভাবে হেম।

.

শরতের দিক থেকেও যতটা প্রবল আপত্তি উঠবে–যতটা বেগ পেতে হবে রাজি করাতে–বলে আশঙ্কা করেছিল হেম, ততটা কিছুই হ’ল না। শুধু যখন সে গিয়ে বললে, ‘ছোট মাসী বাইরে গাড়িতে বসে আছে, আপনাকে ডাকছে’, তখন প্রথমটা শরতের একটু দেরি হয়েছিল কথাটা বুঝতে। মুহূর্তকয়েক তাকিয়ে ছিল হাঁ ক’রে হেমের মুখের দিকে। তার পরই বিষম ব্যস্ত হয়ে উঠেছিল, ‘কে, কে ডাকছে বললে–তোমার ছোট মাসী? কেন বল তো? কোন বিপদ-আপদ নাকি?…চল চল আমি যাচ্ছি।’

ব্যস্ত হয়েই উঠে দাঁড়িয়েছিল। রোগা মানুষ, দুর্বল শরীর–পাছে আবার ছুটে যাবার চেষ্টা করে বলে হেমই তাড়াতাড়ি ওর হাতটা ধরে ফেলে, ‘না না, তেমন কিছু নয়, ব্যস্ত হবেন না আপনি। আস্তে আস্তে চলুন।’

সে-ই হাত ধরে নিয়ে চলল গাড়ি পর্যন্ত

‘কী ব্যাপার–তুমি এমন হঠাৎ?’

গাড়ির সামনে গিয়ে প্রশ্ন করল শরৎ।

সত্যিই তার দিকে চেয়ে প্রথমটা যেন চিনতে পারে না উমা। এই কি সেই মানুষ। তার চোখে যেন অকারণইে জল এসে যায়। সে তাড়াতাড়ি মুখটা নিচু ক’রে বলে, ‘আমি তোমাকে নিয়ে যেতে এসেছি। উঠে এসো।’

বিস্ময়ের ওপর বিস্ময়। শরতের আবারও খানিকটা সময় লাগে বুঝতে।

‘নিয়ে যেতে মানে–? তোমার কাছে? বাস করব?’

‘আমার কাছে না হলে আর নিয়ে যাবার কথা তুলব কেন?’

‘ও, হেম সেদিন দেখে গিয়ে বলেছে বুঝি? তা এই ঘাটের মড়াকে আবার সেধে ঘাড়ে চাপাচ্ছ মিছিমিছি?’

‘ঘাটের মড়া বলেই তো ঘাড়ে চাপাচ্ছি। এই সময়ই তো আমার দরকার।’ আরও একটা কথা মুখে এসেছিল। মনে হয়ছিল বলে, স্ত্রীর প্রয়োজন দুর্দিনে–রক্ষিতা সুখের দিনের সঙ্গিনী। কিন্তু দুর্বার বলে মনকে শাসন করে ও। কটু কথা আর বলবে না। তাছাড়া সে স্ত্রীলোকটা মৃত। সেও ভালবাসত নিশ্চয়। থাক।

শরৎ একটু হাসে। বলে, তা বটে। মলেও–খবর পেলে তোমাকেই যা কিছু শ্রাদ্ধ-শান্তি করতে হবে। এমনিই শান্তরের আইন। তা আজই যাব? এখনই? জিনিসপত্রগুলোর কিছু করা হ’ল না যে–’

‘তুমি উঠে এসে বসো, তোমার পা কাঁপছে। জিনিস–হেমকে বলে দাও, মোটামুটি যা আছে নিয়ে আসুক। বাকী যা আর একটা রবিবার এসে হেমই নিয়ে যাবে। টাকাকড়ি যদি ওদের পাওনা থাকে তো তাও চুকিয়ে দাও।’

‘না, টাকা আগাম দেওয়া আছে। আর সে কীই বা টাকা। …আচ্ছা, হেম তুমি চাকরটাকে ডাক তো, রঘু ওর নাম। ওকে বলে দিই–বিছানা বাক্সগুলো তোমাকে দিয়ে দেবে।’

সে ক্লান্তভাবেই গাড়িতে উঠে সামনের দিকটায় বসে পড়ে।

বাড়িতে এসে মুখ-হাত ধোবার জল দিয়ে প্রশ্ন করে উমা, ‘রাত্রে কী খাও?’

‘রাত্রে? কী খাই?’ আবারও হাসে শরৎ, ‘ভাল থাকলে দু-একখানা রুটি খাই, ভাতও খাই এক-আধ দিন–নইলে দুধসাবু। মানে খেতুম। তবে এখানে মেসে তো ঢালা ব্যবস্থা। অত তোয়াজ করে কে। ভাল থাকলে যা পারি খাই–নইলে একটা মিষ্টি আনিয়ে খেয়ে শুয়ে থাকি। দুধসাবু খেলেই ভাল থাকি।’

‘তবে তো আমারও সুবিধে। আমার তো ঐ খাদ্য।’

সে ছোট উনুনটায় গুল ধরিয়ে সাগু চাপিয়ে দেয়।

তার পর নতুন চৌকিটাতে পরিপাটি ক’রে বিছানা করতে থাকে।

বিছানা ক’রে সদ্য কেনা পাশবালিশটা যখন সাজিয়ে রাখছে–শরতের মনে পড়ে গেল কথাটা।

ভোলেনি উমা। কথাটা ভোলেনি। এ বোধ হয় কোন মেয়েই ভুলতে পারে না।

নিজের অন্যায়ের বিপুল আয়তনটা এই প্রথম যেন উপলব্ধি করে শরৎ।

ওদের ফুলশয্যার রাত্রে শরৎই পাশবালিশটা আড়াল দিয়েছিল– সদ্য- বিবাহিতা স্বামী আর স্ত্রীর মাঝখানে, পাছে ছোঁয়া লাগে। রক্ষিতার প্রতি একনিষ্ঠতা বজায় রাখতে স্ত্রীর স্পর্শ দোষ বাঁচিয়েছিল।

সেদিকে চেয়ে থাকেত থাকতে একটু করুণ হাসি ফুটে উঠল শরতের মুখে। প্রায় চুপি চুপি বললে, ‘পাশবালিশটা ভোল নি দেখছি।’

‘না। কিছুই ভুলি নি। ও কি ভোলবার।’ প্রায় সহজ কণ্ঠেই বললে উমা, তবু তখনই তাড়াতাড়ি ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। ওর সামনে না চোখের জল পড়ে, গলা না কেঁপে যায়। বড় বেশি দৈন্য প্রকাশ পাবে তা হলে। …

নতুন শয্যা, নতুন মানুষ।

এই প্রথম স্বামী তার ঘরে শয্যা গ্রহণ করেছেন। তবু কতদূর। কত ব্যবধান।

আলোটা নিভিয়ে নিজের বিছানায় এসে শুতে শুতে সেই কথাটাই মন হ’ল উমার।

এ কি এই কয়েক হাতের ব্যবধান মাত্র? দুটো বিছানার মাঝখানে এই সামান্য দুরত্ব?। এ যেন ওদের মধ্যে জন্ম জন্মান্তরের যুগযুগান্তরের সুবিপুল ব্যবধান। সে ব্যবধান আর ঘুচবে না। ঘুচবে না বলেই সে নিজে এই ছোট্ট ব্যবধানটির ব্যবস্থা করেছে। বিরাট অন্তরালের প্রতীক স্বরূপ, সেদিনের সেই অন্তরালের স্মৃতি স্বরূপ–পাশবালিশটা কিনে আনিয়েছে।

যত দিন স্বামীকে সে কাছে পায় নি–যখন কাছে পাওয়ার কোন আশাও ছিল না–ততদিন তখনও কোথায় যেন একটা অতি ক্ষুদ্র অতি ক্ষীণ আশা বেঁচে ছিল। আজ স্বামী তার কাছে ফিরে এসেছেন, হয়তো অবশিষ্ট চিরদিনের জন্যই ফিরে এসেছেন– তবু আজ সে নিজে হাতেই সে আশার সমাধি রচনা করল–ঐ পৃথক শয্যাটি পরিপাটী ক’রে পেতে দিয়ে।

আজ আর সম্ভব নয়। আর কিছুতেই সম্ভব নয়। আজ এক শয্যায় শুতে গেলে বিপুল পরিহাস হয়ে দাঁড়াত। ভাগ্যের বহু পদাঘাত সহ্য করেছে সে–আর নয়।

অন্ধকার ঘরে, অন্ধকার শয্যায় হাতড়ে হাতড়ে এসে শুয়ে পড়ল সে। অনেক–অনেক দিন পরে প্রায় মরুভূমি-হয়ে-যাওয়া। শুষ্ক চোখে কোথা থেকে অশ্রুর উৎস জেগেছে। দুই চোখ জ্বালা ক’রে জল এসে ঝাপসা হয়ে গেছে। কিছুই দেখতে পাচ্ছে না সে। আলোর একটা ক্ষীণ আভাস পর্যন্ত না।

কত দিন পরে মাকে মনে পড়ছে তার।

‘মাগো এবার আমাকে নাও। আমাকে নাও। কত দিন ভুলে থাকবে আর?’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *