১৫. গোবিন্দর বৌ কালীতারা

পঞ্চদশ পরিচ্ছেদ

॥১॥

গোবিন্দর বৌ কালীতারা বরাবরই খুব সপ্রতিভ–বেশ একটু ভারিক্কী চালের গিন্নী-বান্নী গোছের মেয়ে। সে সংসার করতে চায়–আর করতে জানেও। বিয়ের পর প্রথমবার বাপের বাড়ি থেকে ঘুরে এসেই রান্না করা, জল তোলা, বাসন মাজা–এক কথায় সংসারের যাবতীয় কাজ নিজে হাতে তুলে নিয়েছিল। যেমন তেমন ক’রে যে করত তাও না–বরং শাশুড়ির চেয়েও এসব কাজে তার পরিপাট্য ও শৃঙ্খলা বেশি ছিল। সংসার ভালবাসে যে সব মেয়ে–কালীতারা সেই দলেরই একজন।

বিনা সম্মতিতে ছেলের বিয়ে হলে প্রত্যেক ছেলের মায়েরই বিদ্বেষটা আগে গিয়ে পড়ে বধূর ওপর। কমলার ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম হয় নি–তবে সহজাত ভদ্রতা ও সুশিক্ষায় সে বিদ্বেষটা খুব স্পষ্ট হয়ে উঠতে পারেনি হয়তো। কিন্তু বিবাহ সম্বন্ধে মূল আপত্তি এবং সেই চাপা বিদ্বেষটা কাটতেও যে খুব বেশি দেরি হয় নি তার কারণ বোধ হয় বধূর কর্মদক্ষতা। বৌকে নিয়ে সে বেশ সুখীই হয়েছিল। কমলা নিজে অল্প বয়সে বিয়ে হয়ে অবস্থাপন্ন স্বামীর ঘরে গিয়ে পড়েছিল। –কাজকর্ম গুছিয়ে করার শিক্ষা বা অভ্যাস কোনটাই উমার মতো পাকা হয়নি। সে বেশ অসুবিধাই বোধ করত প্রথম প্রথম নিজে-হাতে কাজ করতে গিয়ে। এখন বৌয়ের ওপর ছেড়ে দিয়ে-অথবা ছেড়ে দিতে পেরে সে নিশ্চিন্ত হয়ে হাঁফ ছেড়ে বেঁচেছে। বধূ সম্বন্ধে তাই স্নেহ ও প্রশ্রয়ের অভাব ছিল না তার মনে।

কিন্তু কে জানে কেন গোবিন্দ খুশি হতে পারে নি। অন্তত উমার তাই মনে হ’ত।

তার যে খুব নালিশ করবার মতো কিছু ছিল তাও নয়। বরং প্রতিটি প্রয়োজনের জিনিস মুখে মুখে যুগিয়ে কালীতারা তাকে বেশ খানিকটা অকর্মণ্য আর বাবু ক’রেই তুলেছিল। তবু স্ত্রীর সামনে এলেই গোবিন্দ যেন কেমন একটা অস্বস্তি অনুভব করতো। কালীতারা বোধ হয় তার সমবয়সী–উমা সন্দেহ করত সামান্য একটু বড়ই হবে হয়তো–তার ওপর ওর ঐ ভারিক্কী চালচলনে ওকে দেখলেই

ওকে দেখলেই একটা সম্ভ্রমের ভাব আসত গোবিন্দের মনে–প্রাণপণ চেষ্টা সত্ত্বেও স্বামীর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত করতে পারত না। অথবা বলা চলে স্ত্রীকে সমীহ না ক’রে পারত না। তার ওপর দৈহিক গঠনেও কালীতারা–পূর্ণ যুবতী মেয়ের যেমন হওয়া উচিত, তেমনিই ছিল; বরং তার যৌবন যেন একটু বেশি প্রস্ফুট বলে মনে হ’ত বাড়ির অন্য মেয়েদের কাছে। ঠিক মোটা না হলেও, স্বাস্থ্যটা ছিল একটু বেশি রকমের ভাল–তার জন্যও বোধহয় আচমকা দেখলে নবযৌবনা তরুণী বধূ নয়, পূর্ণযৌবনা নারী বলে মনে হ’ত। আর এই সব কারণেই সম্ভবত গোবিন্দর নিজের অজ্ঞাতসারেই মাঝে মাঝে কালীতারাকে মনে হ’ত ওর দিদি। ওর নিজের দিদি নেই কেউ–দিদি সম্বন্ধে স্পষ্ট কোন ধারণাও যে ছিল তাও নয়…তবু ঐ ধরনেরই যে একটা অনুভূতি হ’ত তাতে কোন সন্দেহ নেই।

কালীতারাও স্বামী সম্বন্ধে শ্রদ্ধা, ভক্তি বা স-কাম প্রেমের অনুভূতি থাকলেও প্রচ্ছন্ন ছিল খুবই। যেটা সবচেয়ে স্পষ্ট এবং প্রকট ছিল… সেটা হচ্ছে একটা সস্নেহ প্রশ্রয়ের ভাব। বয়স্কা বিবাহিতা দিদিদের অনুজ সম্বন্ধে যেমন হয় তেমনিই। উৎকণ্ঠা উদ্বেগের অভাব ছিল না…বরং হয়তো একটু বেশিই ছিল। কোনদিন গোবিন্দর বাড়ি ফিরতে দেরি হলে প্রকাশ্যেই বিচলিত হয়ে পড়তে সে, তবু তার মধ্যেও…উমার যেন কেমন মনে হ’ত–বাৎসল্যভাবই বেশি।

তখনও দিনের বেলায় কিংবা গুরুজনের সামনে স্বামীর সঙ্গে কথা বলার খুব চলন হয়নি। কড়াকড়িটা কমেছে…আগের মত বিধিনিষেধের বেড়াটা অত উঁচু নেই…তবু একেবারে সমভূমও হয় নি সেটা। তখনও পাড়াঘরের আশপাশে কিছুটা সংকোচ কিছুটা কুণ্ঠা ছিল, কিন্তু কালীতারা যেন সেটুকুরও ধার ধারত না। প্রয়োজন হলেই অভ্যস্ত ঘোমটাটা শুধু আর আধ ইঞ্চি মাত্র সামনের দিকে টেনে শাশুড়িদের সামনেই নিঃসংকোচে কথা কইত সে। শুধু কথাই নয়, ওঁদের সামনে ধমক-ধামকও করত অনায়াসে। আর সে ধমক গোবিন্দ মা-মাসীর তিরষ্কারের মতই নিঃশব্দে হজম করত। কখন বা নিতান্ত কুণ্ঠার সঙ্গে মাথা চুলকোতে অথবা ক্ষমাপ্রার্থনার ভঙ্গিতে কৈফিয়ত পেশ করত।

এসব কোন কিছুই কমলা কোনদিন লক্ষ্য করে নি। অতশত তার মাথাতেও যেত না। সে সবটাই সহজভাবে নিয়েছিল। কিন্তু উমা সব লক্ষ্য করত। ওদের প্রাত্যহিক জীবনাযাত্রার কোন অসঙ্গতিই তার চোখ এড়াত না। যেখানেই এতটুকু বেসুর বাজত, ঘটত এতটুকু ছন্দপতন, সেখানেই সচেতন হয়ে উঠত সে। নিঃশব্দে তাকিয়ে দেখত ওদের দিকে আর কেমন একটা নাম- না জানা আশংকা অনুভব করত ওদের ভবিষ্যৎ সম্বন্ধে। গার্হস্থ্য সুখের অভাব নেই–সহস্রবিধ আরামে আর সেবায় অভিভূত ক’রে রেখেছে কালীতারা তার স্বামীকে–কিন্তু দাম্পত্যসুখ যাকে বলে তা ওরা পুরোপুরি উপভোগ করতে পারছে কি? ওরা কি পরস্পরকে স্বামী-স্ত্রীর মতো ভালবাসতে পেরেছে? এমনি নানান্ প্রশ্ন মধ্যে মধ্যে দেখা দিত উমার মনে–কিন্তু তার কোন সদুত্তর কোথাও খুঁজে পেত না সে। শুধু সেই নিরুত্তর সমস্যা তার নিজের দুর্ভাগ্যের চিন্তার মধ্যে আর একটা বোঝার মতো চেপে বসে থাকত।

অবশেষে একদিন সে দিদির কাছে এক অদ্ভুত প্রস্তাব ক’রে বসল, ‘দিদি বৌমা তো প্রায় দু বছর বাপের বাড়ি যান নি–এবার ওঁকে একবার পাঠানো দরকার।’

‘কেন বল্ দিকি?’ কমলা সবিস্ময়ে, কিছু টা সশঙ্ক চিত্তেও তাকায় ওর মুখের দিকে, ‘বৌমা বলেছেন কিছু?’

‘না, বৌমা বলেন নি–আর হয়তো কোন দিন বলবেনও না। কিন্তু আমাদের একটা বিবেচনা আছে তো। ছেলেমানুষ একটানা এতদিন এই দেড়খনা ঘরে আটকে আছে আর কলুর বলদের মতো এক-ঘেয়ে সংসারের ঘানি ঘোরাচ্ছে।’

কমলা কথাটা শুনে খুব খুশি হ’ল না। হবার কথাও নয়। বৌমা যাওয়া মানে সংসারের সহস্রবিধ কাজ নিজেদের ঘাড়ে পড়া। অপ্রসন্ন মুখে বললে, ‘ও, আমাদের বিবেচনা। তা সেখানেও তো শুনেছি বেয়াইয়ের অবস্থা ভাল নয়–তার ওপর আবার ঘাড়ে গিয়ে পড়া–

‘অবস্থা এমনও খারাপ নয় যে নিজের মেয়েকে খেতে দিতে পারবে না। সেই বাড়িরই তো মেয়ে!

‘তা বটে।’ একটু থেমে বলে আবার কমলা, ‘আমাদের যে এদিকে আতান্তর।’

‘এটা বড্ড স্বার্থপরের মতো কথা হ’ল না দিদি! ছেলেমানুষ মেয়েটা কি আমাদের সংসারে কেনা বাঁদীর মতো খাটতেই এসেছে শুধু? এতকাল তো চলছিল আমাদের–তেমনিই না হয় চলবে। আমিই চালিয়ে নেব

কমলা আর কথা কইল না। কথাটা সেখানেই চাপা পড়ে গেল।

উমা কিন্তু বেশি দিন চাপা পড়তে দিলে না। আবারও তুললে।

আসলে একটা নতুন চিন্তা তার মাথায় এসেছে। এদের নিয়ে একটা নতুন খেলা খেলতে চায়। বিচ্ছেদে বিরহে এদের মনে–অন্তত গোবিন্দর মনে সকাম তৃষ্ণা বা আবেগ জাগে কিনা তাই দেখতে চায়। যাকে সহজ, না চাইতে হাতের কাছে পাওয়া যায়–তার সম্বন্ধে আমাদের সহজাত অবহেলা। দূরে গেলে দাম বাড়ে। গোবিন্দর কাছে কালীতারা একটা পুরনো অভ্যাস মাত্র দাঁড়িয়ে গেছে–তাই হয়তো তার সেবাটাও চোখে পড়ে না। সরে গেলে সেই সেবার অভাবটাই হয়তো প্রেম বা তৃষ্ণা জাগাতে সহায়তা করবে।

নিজের দুর্ভাগ্যে উমা এই বিষয়টায় অতিমাত্রায় সচেতন হয়ে পড়েছে, কিন্তু সেই কারণেই কথাটা খুলে বলতেও পারে না সে কাউকে। শুধু কালীতারার বিশ্রামের প্রয়োজনীয়তার ওপর জোর দেয়।

কালীতারার কানে কথাটা যেতে সে-ই প্রতিবাদ করে সব চেয়ে বেশি। আকাশ থেকে পড়ে বলে, ‘ওমা আমি গেলে এখানে চলবে কি ক’রে? মা’র শরীর খারাপ, আপনার তো এই টো-টো ঘোরা চাকরি–ঠাকুরপো সুদ্ধ এখানে এসে রয়েছেন–সে কখনও হয়?’

‘খুব হয় মা। তুমি যখন ছিলে না তখন কি আর আমাদের সংসার চলত না? আমি তো আছি–চালিয়ে নেব এক রকম ক’রে। তুমি মাসখানেক কাটিয়ে এসো গে অন্তত!’

তবু না কালীতারা আর না কমলা–কথাটা কেউই গায়ে মাখে না। শেষ পর্যন্ত হয়তো উমাকে শ্রান্ত হয়েই চুপ ক’রে যেতে হ’ত–কারণ আর বেশি পীড়াপীড়ি করলে ব্যাপারটি দৃষ্টিকটু হয়ে উঠত–কৈফিয়তের হেতু তো হ’তই। কিন্তু হঠাৎ কালীতারার এক জ্যেঠা-মশাই কী এক মকদ্দমার ব্যাপারে কলকাতায় এসে পড়লেন এবং দেখা করতে এসে–পশ্চিমে-বাঙালির অভ্যস্ত কাঠখোট্টা চালে বলে ফেললেন, `কী রে তারা, যাবি নাকি আমার সঙ্গে আরায়? দ্যাখ, যাস তো চল্। কী বলেন বেয়ান–ছাড়বেন, না কোন অসুবিধা আছে–কাজ-কর্মের?’

সত্য কথাটা বেশি স্পষ্ট করে বললে অনেক সময় রূঢ় শোনায়, এমন কি কমলার কানেও তা শোনাল। সে একটু চাপা রাগের সঙ্গেই বললে, ‘আপনাদের মেয়ে কি আমাদের ঝি যে কাজকর্মের জন্যে তাকে আটকে রাখব? ওকে ঘরের লক্ষ্মী ক’রেই ঘরে তুলেছি বেয়াই–ঝি হিসেবে নয়। …কাজকর্ম ও আসবাব আগেও কিছু আটকে থাকত না–এখনও থাকবে না। আমরাই বরং ওকে কত দিন বলছি, অনেক দিন যাও নি–একবার ঘুরে এস দিনকতক। আপনাদের মেয়েই যেতে চায় না!’

বেয়াই অপ্রস্তুত হয়ে পড়েন। বলেন, ‘তা তো বটেই–তা তো বটেই। না, আমি সেভাবে কিছু বলি নি। নিজের ঘরে নিজের কাজ করবে–সে আর এমন বড় কথাই বা কি! কী রে যাবি নাকি তারা?’

সপ্রতিভ তারা বাজে কথার মধ্যে না গিয়ে দরকারী প্রশ্নটিই করে শুধু, ‘তার পর? ফিরব কবে? কার সঙ্গে?’

‘কেন জামাই যেতে পারবেন না? বাবাজীও তো যান নি ওখানে অনেক দিন।

‘না, উনি যেতে চান না? যা ব্যাভার তোমরা করেছ ওঁর সঙ্গে!’

মুহূর্ত কয়েক চুপ ক’রে থেকে কালীতারার জ্যেঠামশাই বলেন, ‘আচ্ছা, সে যা হয় হবে এখন। না হয় আমরাই কেউ এসে পৌঁছে দিয়ে যাব।’

আর কোনও পথ খোলা থাকে না কোথাও।

কালীতারা মুখটা গোঁজ ক’রে বলে, ‘আমি কিন্তু বেশি দিন থাকব না। তা বলে দিচ্ছি।’

‘আচ্ছা, আচ্ছা, তাই হবে। দেখেছেন বেয়ান-মেয়েদের যদি বিয়ে হ’ল তো আর শ্বশুরবাড়ি ছেড়ে দুটো দিনও বাপের বাড়ি থাকতে চায় না। বিয়ে হ’ল কি পর–না কী বলেন। হা হা হা।’

তিনি নিজেই জোরে হেসে উঠে আবহাওয়াটাকে হালকা ক’রে দেন।

॥২॥

কালীতারা আরা যাবার দিন পনেরো পরেই ঘটনাটা ঘটল।

রাত তখন বোধহয় তিনটে হবে, উমা আর কমলা একসঙ্গেই ঘুম ভেঙে চমকে উঠে বসল বিছানায়।

‘কী দিদি? কি হ’ল? প্রশ্ন করল উমাই।

‘বড় একটা বাজে স্বপ্ন দেখলুম রে। দুঃস্বপ্নে স্মর গোবিন্দ। দুর্গা দুর্গা!’

‘কি স্বপ্ন দিদি?’ উমা ও বিছানা থেকে এ বিছানায় উঠে আসে। কণ্ঠস্বরটাও তার অস্বাভাবিক তীক্ষ্ণ শোনায়।

‘দেখলুম বৌমা যেন এসে আমার মশারির মধ্যে ঢুকে পা ঠেলে ডাকছেন, বলছেন… মা, ঘরে তো আর ঠাঁই দিলেন না–তবে পায়ের ধুলো দিন–আমি যাই।’

‘দুর্গা দুর্গা’ শিউরে উঠে উমাও বলে অস্ফুট কণ্ঠে।

‘কেন বল্ দিকি? তোরই বা ঘুম ভাঙল কেন?’

‘দিদি, আমারও যেন মনে হ’ল বৌমা এসে পা ঠেলে ডাকছেন মশারির মধ্যে। যেন বলছেন–’একবার উঠুন না মাসীমা, একটু পেন্নাম ক’রে যাই!

‘সে আবার কি!….তুইও–একসঙ্গে এক সময়ে। এক মানে কি? কৈ এমন তো কখনও শুনি নি

‘কে জানে বাছার কী হ’ল। ভালয় ভালয় ফিরলে বাঁচি।’

এর পর আর ঘুম অসম্ভব। দুই বোনই বাইরের রোয়াকে বেরিয়ে আসে। আর বাইরে আসতেই প্রথম নজরে পড়ে রকের ওপর স্তব্ধ হয়ে বসে আছে গোবিন্দ।

‘এমন ক’রে বসে আছিস কেন রে খোকা?’

আর্তনাদের মতো শোনায় কমলার কণ্ঠস্বর।

গোবিন্দ শুষ্ক মুখে যা বলে তার মর্মার্থ হচ্ছে এই যে, সে এই মাত্র তার স্ত্রীকে স্বপ্নে দেখেছে–কালীতারা যেন এসে ওকে ঠেলে বলছে, ‘ওগো তোমার আপদবালাই জন্মের মতো বিদেয় হয়ে যাচ্ছি–এখনও যাও দিকি, তাড়াতাড়ি নতুন কস্তাপেড়ে শাড়ি একখানা আর একথান সিঁদুর কিনে আনো দিকি। এক পাতা আল্লাও এনো অমনি। সেজেগুজে যাব বাপু বেশ ক’রে–তা বলে রাখছি!’

এবার কমলার অশ্রু আর বাধা মানে না! ডুকরে কেঁদে ওঠে। উমার দুই চোখেও জল ভরে আসে। কালীতারাকে সেও ভালবাসত। তার ওপর তার একটা অপরাধীর কুণ্ঠা আছে মনের মধ্যে–বলতে গেলে সে-ই, জোর করে পাঠিয়েছেন।

কান্নার শব্দে বাড়িওয়ালারা উঠলেন। হেম অনেক রাতে এসে শুয়েছে, তবু তারও ঘুম ভাঙল। তখনই একটা মন্ত্রণাসভা গোছের বসল। বহু আলোচনার পর স্থির হ’ল যে সকালেই স্টেশনে গিয়ে গোবিন্দ আবার গাড়ির খবর নেবে এবং প্রথম ট্রেনেই চলে যাবে। জানা-শোনা অফিস, ছুটির জন্য চিন্তা নেই–হেম গিয়ে একটা খবর দিলেই হবে।

কিন্তু শেষ পর্যন্ত কোথায়ও যাবার প্রয়োজন হয় না!

আলোচনা করতে করতেই ভোর হয়ে যায়। আর সামনের বিশ্বাসদের বাড়ির তেতালার কার্নিসে ঊষার প্রথম আভাস লাগার সঙ্গে সঙ্গেই প্রায় দরজায় ঘা পড়ে।

কালীতারার জ্যেঠামশাই।

দোর খুলতেই আছড়ে পড়লেন তিনি।

অতি কষ্টে সেই বুকফাটা কান্নার মধ্য থেকেই সংবাদ আহরণ করা গেল তা এই :

আজ তিন দিন থেকে কালীতারা এখানে আসার জন্য কান্নাকাটি করছিল। কাল কতকটা জোর করেই সে জ্যেঠার সঙ্গে রওনা হয়। পথে আসানসোল পেরোবার পরেই ভেদবমির লক্ষণ দেখা দিল। দুবার দাস্ত এবং একবার বমি–তারপরই শেষ। রেলের ডাক্তার দেখে বলছেন এসিয়াটিক কলেরা। মৃতদেহ হাওড়তেই পড়ে আছে। এরা না গেলে ছাড়বে না বোধ হয়।

মরবার আগে শেষ অনুরোধ জানিয়ে গেছে কালীতারা–ওর জ্যেঠামশাই বুক চাপড়াতে চাপড়াতে বললেন,–লাল কস্তাপেড়ে শাড়ি আর আলতা-সিঁদুরে যেন সাজানো হয় তাকে শ্মশানযাত্রার আগে, আর গোবিন্দ যেন নিজে হাতে সাজায়!

॥৩॥

মৃত্যুপথযাত্রিণীর শেষ অনুরোধ কোনটারই অন্যথা হ’ল না। ভাল লালপাড় ফরাসডাঙার শাড়ি এল–সিঁদুর আলতা ফুলের মালা–হেমই চোখ মুছতে মুছতে গিয়ে নিয়ে এল। উমা ও কমলার কারোরই তখন কিছু দেখবার অবস্থা নয়, উমা মূর্ছাহত, স্তম্ভিত; কমলা আছাড় খেয়ে খেয়ে কাঁদছে–বাড়িওয়ালা গিন্নীই দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে নির্দেশ দিলেন, গোবিন্দ অপটু হাতে সাজিয়ে দিল। মায় আলতা পর্যন্ত পরিয়ে দিল সে-ই।

কালীতারার শেষ অনুরোধ।

স্বপ্নে দেখা দিয়ে জানিয়ে গেছে সে।

গোবিন্দ যথাসাধ্য যত্নের সঙ্গেই সে অনুরোধ রাখবার চেষ্টা করলে।

কিন্তু যা করেছে সে–যন্ত্রচালিত পুতুলের মতো। আসলে গোবিন্দ যেন কেমন বিমূঢ় স্তম্ভিত হয়ে গেছে। ঘটনাটা তার কাছে এখনও কেমন অবাস্তব, স্বপ্নের মত ঠেকছে।

এই বয়সে বিয়েই হয় না কারুর কারুর–সে বিপত্নীক হ’ল।

তা ছাড়া, ক’বছরের কালীতারা কেমন যেন অভ্যাসে দাঁড়িয়ে গিয়েছিল। সে থাকবে না–কোন দিন সে কোথাও চলে যাবে একবারে–এমন যেতে পারে–এইটেই তো অবিশ্বাস্য। আর এই আকস্মিক মৃত্যু–এমন সহসা চিরবিচ্ছেদ–এখনও তার স্পষ্ট বিশ্বাস বা ধারণা হচ্ছে না।

হাওড়া গিয়ে নিয়ে আসা থেকে শুরু ক’রে, সাজানো, হরিধ্বনি দিয়ে কাঁধে তোলা, মায় মুখাগ্নি পর্যন্ত সবই তাই কতকটা সে তেমনি স্তম্ভিত ভাবেই করলে। তারপর সেই ভাবেই একটু দূরে এসে বসল সে উদাসীন নিস্পৃহবৎ।

তার এই বিমূঢ় ভাব অনেকেই ভুল বুঝল।

আসবার সময় হাহাকার কান্নার মধ্যেই কমলা হেমকে বলে দিয়েছিল, ‘ওকে একটু কাঁদতে বল হেম, কোনমতে ওকে কাঁদিয়ে দে নইলে বুক ফেটে মরে যাবে যে!’

এখন কালীতারার জ্যেঠামশাইও আবার ভুল করলেন।

আস্তে আস্তে কাছে এসে বসে বললেন, ‘বাবাজী–কান্না পাচ্ছে না? একটু কাঁদবার চেষ্টা কর না। এতকাল ঘর করেছ, সতীসাধ্বী স্ত্রী জন্মের মতো চলে যাচ্ছে–এরপর আর মাথা খুঁড়লেও দেখতে পাবে না। কথাগুলো ভাববার চেষ্টা কর–কান্না পাবে নিশ্চয়ই। না কাঁদতে পারলেও বড্ড কষ্ট পাবে যে বাবা!’

ওর কথায় বিস্মিত হ’ল গোবিন্দ। সম্ভবত এই প্রথম তার মাথায় গেল যে ওর এই স্তম্ভিত ভাবটাকে ওঁরা দুঃসহ আঘাতের স্তব্ধতা বলে ভুল করছেন।

এইবার ওর সেই বিস্ময়-বিমূঢ় ভাবটা–সেই অবিশ্বাসের–স্বপ্নের ভাবটা কেটেও গেল খানিকটা। একটা বিস্ময়ের আঘাতে আর একটা বিস্ময়ের ঘোর বুঝি কাটল। সে এবার নিজের মনের দিকটা তাকিয়ে দেখার চেষ্টা করল।

কিন্তু সেখানেও নবতর বিস্ময় অপেক্ষা করছে তার জন্য। বিস্ময় আর তার সঙ্গে সামান্য একটু লজ্জাও।

কৈ, খুব একটা শোকাভিভূত তো সে হয় নি।

খুব একটা কষ্ট তো হচ্ছে না। হাহাকার করে তো তার কাঁদতে ইচ্ছা যাচ্ছে না। বুক ফেটে যাবে এই আঘাতে–এমনও তো মনে হচ্ছে না তার!

বরং–লজ্জার সঙ্গে হলেও–বার বার এ বিশ্বাসটা মন থেকে তাড়াবার চেষ্টা করলেও–এক সময় মানতে বাধ্য হ’ল সে–কেমন যেন একটা স্বস্তির ভাব, একটা অব্যাহতির ভাবই মনে জাগছে। তার যেন বোঝা নেমে গেল মাথা থেকে, যেন একটা–খুব কষ্টকর না হলেও–বন্ধন থেকে মুক্তি পেলে সে!

তবে কি কালীতারার কোন স্থান ছিল না তার মনে?

ছিল বৈ কি! সে যে নিত্যকার সহস্র অভ্যাসের সঙ্গে জড়িত হয়ে গিয়েছিল। সেই অভাববোধ, শূন্যতা তো আছেই। সেই সঙ্গে একটা বিপন্ন ভাবও।

কালীতারা না থাকলে খুব অসুবিধা হবে তার–যেমন এই কদিন হয়েছে। দৈনিক জীবনযাত্রা বিড়ম্বিত হবে।

একা-একা থাকাও বড় অসুবিধা।

সারাদিনের পর ঘরে এসে একটু সেবা, একু স্বাচ্ছন্দ্য–রাত্রে পার্শ্ববর্তিনীর সঙ্গে সুখদুঃখের গল্প করা, তার নানা কথা শুনতে শুনতে আরাম ও তৃপ্তির স্বাদের মধ্যে তন্দ্রার চোখটি বুজে আসা–একটা যেন শুধু অভ্যাস নয়, প্রয়োজনও হয়ে পড়েছে তার!

কিন্তু কৈ, খুব একটা কান্না তো পাচ্ছে না।

অথচ কান্নাটিই যে শোভন এবং সঙ্গত সেটা সে বুঝতে পারছে। …

একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে স্ত্রীর চিতার কাছে এসে দাঁড়ায় গোবিন্দ।

পুড়ে যাচ্ছে–এই দৃশ্যটা সামনাসামনি দেখে যদি কান্না পায়!

.

আরও দু-তিনটি চিতা জ্বলছিল। কালীতারার চিতার আশেপাশে।

তাদেরই শবযাত্রীদের মধ্য থেকে একজন পাশে এসে দাঁড়ালেন। মধ্যবয়সী একহারা গড়নের একটি ভদ্রলোক। ব্রাহ্মণ–উত্তরীয়ের মধ্যে থেকে মোটা পৈতার গোছা বেরিয়ে আছে।

‘বাবাজীরই বুঝি অর্ধাঙ্গিনী গেলেন?’

একটু অবাক হয়েই তাকাল গোবিন্দ। কিন্তু অস্বস্তিকর চিন্তা থেকে রেহাই পেয়ে কিছুটা কৃতজ্ঞতাও বোধ করল লোকটি সম্বন্ধে।

‘আজ্ঞে হ্যাঁ।’ সংক্ষেপে বললে সে।

‘আহা-হা। কীই বা বয়স, তেইশ-চব্বিশ হ’ল বোধহয়–না হয় সামান্য একটু বেশিই হবে। এই বয়সে–বড়ই অসুবিধে, সত্যি।’

এ কথার উত্তর নেই, অগত্যা চুপ ক’রেই থাকে গোবিন্দ।

‘আমার দেখুন না–সংসারের নানা ঝক্কিতে তিত-বিরক্ত হয়ে দুটো দিন শ্বশুরবাড়ি জুড়োতে আসা–তা এসে পড়ে এই বিভ্ৰাট। শালার ছেলেটি–বললে বিশ্বাস করবেন না বাবা, সাতদিনের জ্বরে। কে আর জানে বলুন, খবর তো পাই নি, হঠাৎ এসে পড়েছি–বলি শহর-বাজার জায়গা, তাও শহরের মতো শহর–কলকেতা। কদিন একটু আরাম ক’রে আসি গে। তা এসে দেখি এই কাণ্ড! কাল এসেছি, আজই এই–!’

এই পর্যন্ত বলে চুপ ক’রে যান ভদ্রলোক। গোবিন্দও চুপ ক’রে থাকে। এমনিতেই সে খুব আলাপী নয়–তা ছাড়া এই মানসিক অবস্থায় সম্পূর্ণ অপরিচিত ভদ্রলোকের সঙ্গে কী কথা কইবে তাও ভেবে পায় না। শোকের সংবাদ–সান্ত্বনা দেওয়াই উচিত। কিন্তু তাকেই কে সান্ত্বনা দেয় তার ঠিক নেই–সে অপরকে কী দেবে?

অনেকক্ষণ পরে–বোধ করি কোন কথা খুঁজে না পেয়েই প্রশ্ন করে, ‘আপনি থাকেন কোথায়?’

‘দেশে থাকি বাবা। নিকটেই দেশ।’ উৎসাহিত হয়ে ওঠেন ভদ্রলোক, ‘খুব একটা দূর কোথাও নয়। বি. এন. আর লাইন দিয়ে যেতে হয়, নতুন ইস্টিশান হয়েছে আলাদা–তা কাছেই মানিকপুর। …আমরা ব্রাহ্মণ, শ্রীগোপীনাথ চক্রবর্তী আমার নাম, ঠাকুর ছিলেন ঈশ্বর জানকী চক্রবর্তী। মানিকপুরের চক্কোত্তি-বাড়ি। ডাকসাইটে–এককালে দোল-দুগ্‌গোচ্ছব দুই-ই হ’ত। এখন আর কি, আসলই নেই–বিষ হারিয়ে ঢোঁড়া সাপ হয়ে বসে আছি, কিছুই আর হয় না, পাল-পাব্বন বলতে আর কিছু নেই। কোনমতে দিন গুজরান করা। তবু গুপী চক্কোত্তি বললে ও-অঞ্চলের সবাই চিনবে। ইস্টিশানে নেমে জিজ্ঞেস করলে কানাও দেখিয়ে দেবে আমার বাড়ি।’

তারপর যেন দম ফেলবার জন্যেই কতকটা থেমে বললেন, ‘আপনারাও তো ব্রাহ্মণ দেখছি, সবাইকার কাঁধেই সুতোটা ঝুলছে–তা আপনাদের পরিচয়?’

গোবিন্দ সংক্ষেপে নিজের নাম বলে।

‘থাকা হয় কোথায়? সিমলে? কলকাতার সিমলে? ও তো ধরুন আমার শ্বশুরবাড়িরই পাড়া। আমার শ্বশুরবাড়ি হ’ল ভালুকবাগান। নিজের বাড়ি? ভাড়া–? তা কলকাতার আর কটা লোকেরই বা বাড়ি আছে! সবই তো ভাড়া। কত তা-বড় তা-বড় লোক ভাড়া বাড়িতেই কাটিয়ে দিলে সারা জীবনটা। করা হয় কি? চাকরি? তবে আর কি? মাস গেলে যার বাঁধা আয় আছে তার আর বাড়িভাড়াতে ভয় কি?

ক্রমশ ছোট হয়ে আসছে অঙ্গারবর্ণ দেহটা।

ভরা যুবতী কালীতারার পুরন্ত দেহ বহ্নিরূপী রাক্ষসটা যেন লেলিহান জিহ্বা মেলে লেহন করছে–তাতেই ক্ষয়ে যাচ্ছে সেটা একটু একটু ক’রে। সেদিকে চেয়ে চেয়ে যেন অবাক লাগে, ভয়-ভয় করে।

হেম গিয়ে হাত ধরে অল্প টান দেয়–

‘এদিকে সরে এসে বসো না বড়দা।’

‘হ্যাঁ বাবাজী, তাই চল। এসব দৃশ্য না দেখাই ভাল, বুঝলে না? কাঁচা বয়স–এখন কি আর এসব দেখার কথা–না দেখা উচিত? এসো এসো।’

তারপরই সামান্য একটু জিভ কেটে বলেন গুপী চক্কোত্তি, ‘ঐ যা! তুমিই বলে ফেললুম। অবিশ্য তাতে দোষই বা কি, তোমার ডবলের ওপর বয়স আমার–তবে নাকি আজকালকার ইয়ং বেঙ্গলরা আবার রাগ করে শুনেছি।’

উত্তর না দিলেও গোবিন্দ তাঁকে এড়াতে পারে না–কারণ সে তাঁর পাশে গিয়ে না বসলেও গোপীবাবুই এসে বসেন।

‘তা কতকাল ঘর করলে বাবাজী মায়ের সঙ্গে?’

গোবিন্দ উত্তর দেয় না। এবার ও যেন কেমন ক্লান্তি বোধ করছে–সমস্ত ব্যাপারটা সম্বন্ধে একটা বিতৃষ্ণাও। কিন্তু তাতে গুপী চক্কোত্তির উৎসাহ কমে না। তিনি বলেন, ‘তা বছর পাঁচ ছয় হ’ল নিশ্চয় কী বল? ইস্–তা হলে তো বড্ড কষ্ট লাগবে। ফাঁকা লাগবে–তা লাগুক, কিন্তু অসুবিধে হবে, কষ্ট হবে, সেইটেই বড় কথা। তেল, তামাক, বৌ–এসব অভ্যেস হয়ে গেলে ছাড়া শক্ত। তোমার তো দেখছি বাবাজী অবিলম্ব আবার সংসার করতে হবে।

গোবিন্দ এবারও চুপ করে থাকে–কিন্তু কথাটা শুনে যতটা বিরক্ত বোধ করার বা চমকে ওঠবার কথা–ততটা কিছু লাগে না ওর। বরং নিজের মনের অবচেতনে যে অনুভূতিটা সুপ্ত আছে, প্রকাশের পথ খুঁজছে–গুপী চক্কোত্তির কণ্ঠে সেইটের প্রতিধ্বনি শুনে কেমন একটা বল পায় মনে মনে, অনুভূতিটা স্বীকার করতে যে সংকোচ বোধ করার কথা–সে সংকোচের কারণও দূর হয়ে গিয়ে স্বস্তি অনুভব করে।

গুপী চক্কোত্তি একটু থেমে মেরজাইয়ের পকেট থেকে একটা বিড়ি বার করেন।

‘বাবাজী কিছু মনে করো না–এখানে বসেই স্বার্থের কথা তুলছি–কিন্তু আর তো সময়ও পাব না, এখানেই যখন ভগবান দেখা করিয়ে দিলেন তখন এটাকে বিধাতারই যোগাযোগ মনে করতে হবে। আমার একটি ভাগ্নী আছে বাবা, বিধবা বোনের সে মেয়ে ইস্তক সমস্ত আমার ঘাড়ে–তা ঘাড়ও তো আমার এই পল্কা, কখন মটকে ভেঙে পড়ে তার ঠিক নেই–কিন্তু যতক্ষণ আছি ততক্ষণ তো আমাকেই দেখতে হবে। বয়স ঠিক যেমনটি মানানসই হয়–বারো পূর্ণ হয়েছে–ভারি ফুটফুটে, দেখলে চোখ জুড়িয়ে যায়, আর তেমনি বুদ্ধি; ব্যাটা-ছেলে হলে জজ-মেজেস্টার হতে পারত। কী বলব বাবা, এ মেয়ে রাজ রাজড়ার ঘরেই মানায়। তা আমায় তো বুঝতেই পারছ, না অর্থবল না লোকবল। সম্বন্ধ করছেই বা কে, আর রেস্তর জোরই বা কোথায়! তা একবার দেখবেন না কি বাবা? মেয়েটাকে? মাইরি বলছি–দেখলেই পছন্দ হবে!’

হেম পাশেই বসে ছিল। সবাই শুনেছে। মানুষ যে এত হৃদয়হীন হতে পারে তা তার ধারণার অতীত। সর্বাঙ্গ রাগে বি-রি করতে লাগল তার।

কিন্তু গোবিন্দর কাছ থেকে এ প্রস্তাবের যে প্রতিক্রিয়া আশা করেছিল সে–তার কিছুই দেখতে পেল না। যে কড়া উত্তর গোবিন্দর দেওয়া উচিত ছিল–যা হেমের গলার কাছে ঠেলাঠেলি করছিল প্রকাশের জন্য, তা অনুক্তই রয়ে গেল। গুপীর কথায় যতটা অবাক সে হয়েছিল তার চেয়ে ঢের বেশি অবাক হ’ল, যখন শুনল যে গোবিন্দ ধীরে ধীরে উত্তর দিচ্ছে, ‘এ সব কথা আমাকে বলে কী লাভ বলুন, বরং যদি কথা পাড়াতে চান তো মা’র সঙ্গে দেখা করবেন। মা আছেন, মাসী আছেন,–তাঁরাই আমার গার্জেন!’

কানে শুনেও বিশ্বাস হতে চায় না হেমের, সে অবাক হয়ে তাকিয়ে দেখে যে কথাগুলো ঠিক গোবিন্দর মুখ থেকেই বেরোচ্ছে না আর কারুর–কিন্তু গুপী চক্কোত্তীর উৎসাহের অবধি থাকে না। তিনি প্রায় গোবিন্দর মুখের কথা কেড়ে নেন, ‘বটেই তো, বটেই তো! আমারই ভুল ওটা। তা ভুল তো সব মানুষেরই হয় বাবা–ইংরেজরা নাকি বলে। তাঁদের কথাই খোঁজ করা আমার আগে উচিত ছিল। তা তাঁদের ঠিকানাটা বাবাজী–? মানে তোমারই ঠিকানা ধর। মাসীমা ওখানেই থাকেন। তোমাদের সঙ্গে? বিধবা নাকি?

অসহ্য ক্রোধ সামলাতে না পেরে হেম বলে বসে, ‘অত কথায় আপনার দরকার কি? এখনই হাঁড়ির খবর না নিলে চলছে না? আগে দেখুন তাঁরা এখন ছেলের বিয়ে দেবেন কিনা–এখন থেকেই অত আত্মীয়তা করছেন কেন?’

গুপী চক্কোত্তী কয়েক মুহূর্ত তাঁর শান্ত কোটরগত চোখ দুটি মেলে মিট্‌মিট্ করে তাকিয়ে রইলেন। হেমের মুখের দিকে–যেন ওর সমস্ত পরিচয় ও মনোভাব একসঙ্গে সেই এক নজরেই জেনে নিলেন, তর পর বললেন, ঠিক বলেছ বাবা, আমারই অন্যায়। আসল কথা কি জান–বুড়ো হলে সব জ্ঞানগম্যি লোপ পেতে থাকে। …তা ঠিকই হয়েছে–তোমার কথাটা বলা কিছু অন্যায় হয় নি। শিক্ষার বয়সও নেই। বয়স হলে সন্তানদের কাছ থেকেই শিক্ষা নিতে হয়। ধর না কেন–শান্তরেই তো বলেছে যে স্বয়ং বেম্মাও তাঁর সন্তানদের কাছে জ্ঞানলাভ করেছিলেন। সনৎকুমার না কে যেন ধমক নিয়ে শিখিয়ে গিয়েছিল তাঁকে। … তা সে কিছু নয়। এখন তোমার ঠিকানাটা শুধু দরকার। কাগজ পেন্সিল কারুর কাছে কিছু আছে? নেই? কাগজ এক টুকরো বোধ হয় হবে–কিন্তু উটপ্যান্সিল একটা চাই যে। দাঁড়াও খুঁজে নে আসছি–কারুর কাছ থেকে চেয়ে!’

এই বলে–আর উত্তরের অপেক্ষামাত্র না করে প্রায় লাফিয়ে উঠে চলে গেলেন এবং বোধ হয় কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই কোথা থেকে একটা পেন্সিল সংগ্রহ করে ছুটতে ছুটতে ফিরে এলেন।

তার পর পকেট থেকে কাগজ বার ক’রে পেন্সিলসুদ্ধ গোবিন্দর শিথিল হাতের মধ্যে গুঁজে দিয়ে বললেন, ‘বেশ গোটা গোটা ক’রে লিখে দাও দিকি বাবাজী ঠিকানাটা–আমার আবার চশমা নেই কিনা!’

।।৪।।

দিন তিনেক পরেই গুপী চক্কোত্তী এসে হাজির হলেন।

বিকেলের দিক-পুরুষেরা কেউ বাড়ি নেই, উমাও পড়াতে গেছে। খবরটা নিয়ে এসেছিল নীলা–বাড়িওলার ছোট মেয়ে। তার দিকে অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে চেয়ে কমলা বললে, ‘আমার সঙ্গে দেখা করতে চাইছে? বুড়োমতো বেটাছেলে? দূর পাগলী–খোকাকে খুঁজছে নিশ্চয়। বল্ গে যা গোবিন্দবাবু বাড়ি নেই, রাত আটটার পর দেখা হবে।’

উঁহু–সে আমি বলেছিলুম। লোকটা বলছে, আমি গোবিন্দবাবুর মা’র সঙ্গেই দেখা করতে চাই। বিশেষ দরকার আছে।’

কমলার এখনও অপরিচিত পুরুষের সামনে বার হতে বিষম সংকোচ বোধ হয়–এখনও পরপুরুষের সঙ্গে কথা বলতে অভ্যস্ হয় নি সে। ছেলের বন্ধুরা কেউ বাড়ি এলে একগলা ঘোমটা টেনে বসে থাকে!

সে বিপন্ন কণ্ঠে বললে, ‘আমর সঙ্গে কী দরকার–না না বল্ গে যা, কথাবার্তা যা আছে যেন গোবিন্দবাবুকেই বলেন।

গুণী চক্কোত্তীর কান খুব সাফ্। বাইরের দালান থেকেই কমলার অনুচ্চ কণ্ঠ তাঁর কানে গেছে। তিনি সেখান থেকেই হেঁকে বললেন, ‘ওঁকে বল খুকী যে তাঁর সঙ্গে কথাবার্তা আমার হয়ে গেছে–এখন দরকার ওয়াকেই। বল যে বৃদ্ধ ব্রাহ্মণ বহু দূর থেকে এসেছি, বিশেষ প্রয়োজনেই। তোমার সঙ্গেই উনি একটিবার বাইরে এসে পায়ের ধুলো দিন, তোমার মারফতই কথাবার্তা চলতে পারবে। …কিংবা এ বাড়িতে যদি আর কোন ছেলেপুলে থাকে–তাকেই সঙ্গে করে আসুন না হয়!’

অগত্যা কমলাকে বাইরের দালানে আসতে হয়।

তার আগে জানালার ফাঁক দিয়ে মানুষটাকে দেখে নেয়–নিতান্তই সাধারণ চেহারার মধ্যবয়সী ভদ্রলোক। খাটো মেরজাইয়ের মধ্য থেকে পৈতের গোছা ঝুলছে, পালা উড়ুনির ভেতর দিয়ে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে সেটা।

না, লোকটাকে খুব ভয়ঙ্কর বলে মনে হচ্ছে না! গুণ্ডা বদমাইশের মতো চেহারা নয়।

নীলাকে দিয়ে একটা আসন পাতিয়ে দিয়ে–নিজে একটু দূরে মেঝেতেই বসল কমলা। নীলাকে টেনে কোলের কাছে বসিয়ে তার একটা হাত ধরে রইল। সাত বছরের মেয়ে হলেও সে-ই এখন যেন ওর প্রধান ভরসা ও অবলম্বন।

কিন্তু অতঃপর গুপী চক্কোত্তী মশাই যথোচিত ভূমিকা ক’রে যে প্রস্তাবটি পাড়লেন–আর যাই হোক সে কথার জন্য প্রস্তুত ছিল না কমলা। হেম কিছুই বলে নি–হয়তো বলবার মতো কথা নয় বলেই বলে নি–অথবা এত তাড়াতাড়ি গুপীবাবু এসে হাজির হবেন তা সে কল্পনা করে নি। সুতরাং কমলার বিস্ময়ের সীমা রইল না। আর সেই অবিশ্বাস্য রকমের বিস্ময়ের প্রবল আঘাতে স্থানকালপাত্রের হিসেব ভুলে গেল সে–নীলাকে মধ্যস্থ ক’রে কথা বলবার সংকল্পটাও মনে রইল না। সে তার বিস্ফারিত চোখ সোজা গুপীবাবুর দিকেই মেলে প্রশ্ন করল, ‘গোবিন্দ রাজী হয়েছে। সে নিজে ঠিকানা দিয়েছে। …না না, এ কী বলছেন আপনি?’

‘আজ্ঞে মিছে কথা কি আর বলছি? আর এসব ক্ষেত্রে মিছে কথা কতক্ষণ বজায়ই বা থাকবে বলুন? ছেলে বাড়ি ফিরলেই তো সব জানতে পারবেন। তা ছাড়া বাবাজী না বললে আমি আপনার ঠিকানাটা বা জানব কি করে! দেখুন না কেন তার নিজের হাতে লেখা ঠিকানা। তার হাতের লেখাটা আমি পাব কি করে?…তার হাতের লেখা তো চেনেন!’

মেরজাইয়ের পকেট থেকে কাগজের টুকরোটা বার করে সগর্বে মেলে ধরেন গুপী চক্কোত্তী। সামান্য একটু বিজয়ের হাসিও বুঝি ফুটে ওঠে ওঁর মুখে।

হাতের লেখাটা সত্যিই গোবিন্দর। সেদিকে একবার মাত্র চেয়েই বুঝতে পারে কমলা। অবিশ্বাসের কোন কারণ নেই!

অনেকক্ষণ স্তম্ভিত শূন্য দৃষ্টিতে সেদিকে তাকিয়ে থেকে কমলা ধীরে ধীরে উত্তর দেয়, ‘তা তার সঙ্গে যখন সব কথাই হয়ে গেছে, তখন আর মিছে আমার কাছে এসেছেন কেন? বাকী যা কথা তার সঙ্গেই শেষ করবেন!’

দুঃখের চেয়ে অভিমানই যেন বেশি ফুটে ওঠে তার কণ্ঠে।

সঙ্গে সঙ্গে এতখানি জিভ কেটে দু কানে হাত দেন গোপীনাথ চক্রবর্তী। ‘বাপ্ রে! তাই কখনও হয়? সে ছেলে আপনার নয়–বলেই দিয়েছে যে মাথার ওপর মা আছেন, মাসী আছেন, তাঁরাই গার্জেন। আপনাদের ছাড়া কিছুই হবার জো নেই। তবে তার অমত নেই–এই হ’ল কথা। ….কী জানেন বেয়ান ঠাকরুন–বেয়ানই বলি, মেয়েটার অদেষ্টে থাকে এমন শাশুড়ি পাবে–না পায় তবু সম্বন্ধটা পাতিয়ে রাখতে ক্ষেতি কি–অনুগ্রহ ক’রে যখন কথাই কইলেন আত্মীয় ভেবে-কী জানেন–বিধবা বোনের মেয়ে, নিজের মেয়ের চেয়ে বেশি দায়িত্ব, তা ছাড়া আমার সাধ্যি তো এই–কাজেই দিনক্ষণ সময়-অসময় বিচার করতে গেলে আর চলে না। শ্মশানেই কথাটা পাড়া যে আমার উচিত হয় নি তা কি আর জানি না–না কি এই অশৌচের মধ্যেই এখানে আসা যে কত অন্যায় তাও বুঝি নি! কী বলব, নিরুপায়। কাল ভোরের টেরেনে দেশে ফিরব, এখন আর হয়তো আসার যোগাযোগই হবে না কত কাল! তবে যদি আপনার দয়া পাই তো–এই জন্যেই আসব। খরচাপত্তর করে শুধু শুধু আসবার মতো আমার অবস্থা নয় বেয়ান।’

কণ্ঠস্বরের আন্তরিকতায় ও বলবার সেই একান্ত দীন ভঙ্গিতে নরম হয়ে আসে কমলা। মাটির দিকে তাকিয়ে বলে, ‘তা আমিও তো এখন কিছু পাকা বলতে পারব না চক্কোত্তী মশাই–বোন আছে, এক বোনপো আছে। তারা আসুক, ছেলেও আসুক–তার সঙ্গে কথা কই, পরামর্শ করি, তবে তো! এখন কোন কথা দিতে পারব না আপনাকে।

‘ব্যস্! ব্যস্! এই ঢের! এইটুকু যে দয়া করেছেন এতেই আমি কৃতার্থ। নারাজ হন নি একেবারে, এইটেই বড় কথা। তবে আজ আমি উঠি–এধারেও আপনাদের অশৌচটা চলে যাক দিন দশেক পরে একেবারে এসে মেয়ে দেখাবার ব্যবস্থা করব। আপনারা তো আর সে ধাাড়া গোবিন্দপুরে যেতে পারবেন না–এখানেই আমার শ্বশুরবাড়িতে এনে দেখাবার বন্দোবস্ত করতে হবে। চাই কি বলেন তো এখানে এনেও দেখাতে পারি, একেবারে আপনার শ্রীচরণের কাছে ফেলে দিয়ে নিশ্চিন্তি। …তবে আসি, প্রণাম হই!’

অনেকগুলো বিপরীত মনোভাবের সংঘাতের মধ্যে সাধারণত ভদ্রতা ও লৌকিকতারই জয় হয়। কমলা ইতস্তত ক’রে বলে–অশৌচ চলছে, এখানে তো–মানে আপনাকে কিছু খেতে-টেতে বলতে পারলুম না–’

মুখের কথা কেড়ে নিয়ে গুপীবাবু বলেন, ‘না না, সে কি কথা! খাওয়া- দাওয়ার ঢের সময় মিলবে। কুটুম্বিতে যদি হয়–তখন আপনার কাছে চেয়ে প্রসাদ পেয়ে যাব। ….মেয়েটার কি এমন ভাগ্যি হবে–আপনার মতো দেবীকে শাশুড়ি পাবে!…তবে কি জানেন, ভগবান এক কূল ভাঙেন এক কূল গড়েন। বোনটাকে অনেক দুঃখ দিয়েছেন, মেয়েটার একটা ভাল হিল্লে করেও দিতে পারেন।

স্মিত প্রসন্ন মুখে বিদায় নেন গুপীবাবু।

থিয়েটারর দিন নয়–শুধু একটু আড্ডা দিতে আর অভ্যাসমত বাকী মাইনের তাগাদা করতে যাওয়া–হেম সকাল ক’রেই ফিরল, প্রায় গোবিন্দরই সঙ্গে।

কমলা গোবিন্দকে সোজাসুজি প্রশ্ন না ক’রে হেমকেই নিয়ে পড়ল, ‘হ্যাঁরে হেম, গুপী চক্কোত্তী মশাই লোকটা কে–কৈ তুই তো কিছু বলিস নি!’

হেম নিমেষে জ্বলে উঠল, ‘এসেছিল নাকি সেই বদমাইশ বাস্তু-ঘুঘুটা? লোকটার সাহস তো কম নয়! পাজী পাঝাড়া বেটা!…কী বললে? ইস্–আমি থাকলে ঘাড়ধাক্কা দিয়ে তাড়িয়ে দিতুম!’

‘ছিঃ বাবা, ভদ্রলোককে অমন করে বলতে নেই। কন্যাদায়গ্রস্ত ব্ৰাহ্মণ, তায় গরিব-ওদের কি আর অত ভাবতে গেলে চলে! বিপদে পড়ে ভদ্রাভদ্র জ্ঞান হারিয়েছে। ওর দোষ কি?…তা ছাড়া খোকার মত না থাকলে–সে ঠিকানাই বা দিলে কেন?’

শেষের কথাগুলো বলবার সময় আড়ে একবার ছেলের মুখের দিকে তাকায় কমলা।

গোবিন্দ রাঙা হয়ে ওঠে–সেটা হ্যারিকেনের আলোতেও টের পাওয়া যায়। সে জড়িয়ে জড়িয়ে আমতা’ ক’রে বলে, ‘বা রে–তা আমি কি করব–জোর ক’রে বললে ভদ্দরলোক–আর সত্যিই তো–গার্জেন আছে মাথার ওপর তাই বলেছি। এমন তো কিছু—’

হেমও গোবিন্দর কথা সমর্থন করে।

‘সত্যিই তো–দাদার কি দোষ। যা ছিনে-জোঁক লোকটা। তা ছাড়া সেখানে দাঁড়িয়ে তখন কী আর কথা-কাটাকাটি করতে ইচ্ছে করে? তা তুমি তাকে একেবারে হাঁকিয়ে দিয়েছে তো?’

‘বেশ বাবা তোমরা। ছিনে-জোঁককে তোমরা বেটাছেলে হয়ে ছাড়াতে পারলে না–আমি ছাড়াব। কিছুই বলি নি, এখন এসব কথা আলোচনা করা যাবে না–শুধু এইটুকুই বলেছি। সেও পরে আসবে বলে চলে গেছে।’

‘আসাচ্ছি! উঃ–কী স্বার্থপর লোকটা! এই শোকের সময়–এখনও বোধ হয় সে মানুষটার চিতে জুড়োয় নি!’

কমলা তখনকার মতো কথাটা বন্ধ ক’রে দিলে অন্য প্রসঙ্গ পেড়ে। এই আলোচনার সময় কিন্তু গোবিন্দর কণ্ঠে বা মুখের রেখায় যে কোন প্ৰতিবাদ বা বিতৃষ্ণা ফোটে নি একবারও–এটুকু তার চোখ এড়াল না।

সারাদিনের পর ক্লান্ত উত্ত্যক্ত হয়ে ফেরে উমা–সাত-আট ঘণ্টা বকে বকে তার মাথা ঠিক থাকে না। এটা সবাই জানত। তাই উমার সামনে প্রসঙ্গটা কেউই তুললে না। কমলা ওকে খবরটা দিলে একেবারে রাত্রে–বিছানার শুয়ে।

কিন্তু সে যতটা আশা করেছিল উমা ততটা উত্তেজনা প্রকাশ করলে না। বরং শান্ত ভাবেই প্রশ্ন করলে, ‘তা তুমি এখন কি করবে ভাবছ? যা শুনেছি, সে লোক তো শ্রাদ্ধের দিন গুনছে। …কটা দিন গেলে মেয়ে নিয়েই এসে হাজির হবে!’

একটুখানি চুপ করে থাকে কমলা। বোঁধ হয় একটু সংকোচই অনুভব করে। তারপর বলে, ‘দেখিই না মেয়েটা যদি সত্যিই ভাল হয়–। বিয়ে তো দিতেই হবে। এই বয়স থেকে তো সন্ন্যিসী হয়ে থাকতে পারে না ছেলে।’

‘তা থাকতে পারে না ঠিকই–’, কণ্ঠে তিক্ততা আর চাপা থাকে না উমার, ‘তবু দিদি, মনুষ্যত্ব বলে একটা কথা আছে। সে মেয়েটা তোমার সংসারে ক’বছর কেনা বাঁদীর মতো খেটেই গেল শুধু–না পেলে এদিকের কোন সুখস্বাচ্ছন্দ্য আর না পেলে স্বামীর তেমন ভালবাসা। তোমার সংসারের ভাবনাতেই সে বাপের বাড়িতে যেতে চাইত না–চায়ও নি শেষ পর্যন্ত–সেই মেয়েটা অমন বেঘোরে মারা গেল, তার জন্যে ছটা মাসও তোমরা অপেক্ষা করতে পারছ না! অশৌচটা কাটাতেও তর সইল না? লোকে কি বলবে? মানুষের চামড়া আছে–তাই যে কেউ বিশ্বাস করবে না!’

কমলা অপ্রতিভ হয়, একটু বিরক্তও হয়। খানিকটা চুপ করে থেকে বলে, বলছে বলেই যে এখনই হচ্ছে তাও তো নয়। মেয়ে দেখে পছন্দ হলেও তো আমরা দুমাস চার মাস নিত পারি। তা ছাড়া সত্যিই তো, সংসারে তো লোক চাই। আর খোকারও হাতে হাতে পান-জল কাপড়জামা কে যোগায়। হরেক রকম তোয়াজ ওর–আমার তো বযস বাড়ছে দিন দিন–না কি কমছে?’

‘সবই ঠিক দিদি–তবু মানুষ পারে না এটা। ভাব দিকি–যদি তোমার মেয়ে হ’ত?’

কলমা চুপ করে যায়। খানিকটা পরে অসংলগ্ন খাপছাড়া ভাবে হঠাৎ প্রশ্ন করে, ‘স্বামীর ভালবাসা পেলে না–এ কথা বললি কেন? গোবিন্দ তো বৌমাকে কোনদিন অযত্ন করে নি!

অযত্ন না করলেই ভালবাসা হয় না দিদি। আমাদের তো চোখ আছে–গোবিন্দ একদিনের জন্যেও মনেপ্রাণে বৌ বলে নিতে পারে নি তাক–তুমিও কি আর তা লক্ষ্য কার নি!’

কমলা এ কথার কোন জবাব দেয় না।

গলির প্রান্ত থেকে তেরছা ভাবে একফালি গ্যাসের আলো এসে পড়েছে ওদের ঘরে–সামনের বুককেসটার ওপর। কাঁচের মধ্য দিয়ে দেখা যায় ওপর ওপর সাজানো–বিবর্ণ হয়ে যাওযা লাল কাপড়ে বাঁধা ওর স্বামীর তন্ত্রের পুঁথিগুলো। এগুলো তার বুকের হাড় ছিল বলে কমলা প্রাণ ধরে ফেলতে পারে নি। ছেলেকে বলে রেখেছে, আমি মলে এগুলো গঙ্গায় দিস। তোর তো কোন কাজেই লাগবে না–আর ও কাজে লেগে দরকারও নেই।’ এখন চুপ করে সেই দিকে চেয়ে শুয়ে থাকতে থাকতে অনেকক্ষণ পরে আপনিই একটা দীর্ঘশ্বাস পড়ল। আজ যদি তিনি বেঁচে থাকতেন। এসব কথা নিয়ে তাকে মাথা ঘামাতেই বা হবে কেন।

॥৫॥

গুপী চক্রবর্তী বোধ হয় সত্যিই দিন গুনছিলেন। কালীতারার শ্রাদ্ধ মিটে যাবার ঠিক পরের রবিবারটিতেই তিনি একেবারে পাত্রী নিয়ে এসে হাজির হলেন।

পাত্রী আর তার সঙ্গে তার বিধবা মাও। আটঘাট বেঁধেই কাজ করতে অভ্যস্ত গুপীবাবু।

তখন বেলা তিনটে। সকলেই বাড়িতে আছে। সম্ভবত গুপীবাবু সেটাও হিসেব করেই এসেছিলেন। গোবিন্দ তখনও ঘুমোচ্ছে–হেম উঠে বসে গল্প করছে মাসীদের সঙ্গে, আর একটু পরে সে থিয়েটারে যাবে। উমা ও কমলা অনন্ত চতুর্দশীর সলতের সুতো কাটছে টেকোতে।

বাইরে একটা ঘোড়র গাড়ি দাঁড়াবার শব্দ হয়েছিল–কিন্তু সেদিকে কেউ কান দেয় নি। কারণ ছুটির দিন এ গলিতে গাড়ি আসা কোন বিচিত্র ঘটনা নয়। সামনের বাড়ি, পাশের বাড়ি–এ বাড়িতেও বাড়িওয়ালার আত্মীয় কুটুম আসতে পারে। কিন্তু গাড়ির আওয়াজের সঙ্গে সঙ্গেই যখন গুপী চক্কোত্তীর ঈষৎ মেয়েল ধরনের গলাটি নিখাদে বেজে উঠল–কৈ গো বেয়ান ঠাকরুনরা, দরজাটা খুলবেন দয়া ক’রে?’–তখন আর সন্দেহের কোন অবকাশ রইল না।

কমলা বিপন্ন উদ্বিগ্ন মুখে প্রথমেই একবার উমার মুখের দিকে তাকিয়ে নিল–দেখল ব্যাপারটা অনুমান করতে তার এক মুহূর্তও দেরি হয় নি এবং সমস্ত চেহারাটা সঙ্গে সঙ্গে অগ্নিবর্ণ ধারণ করেছে। আর সে রক্তিমার কারণ যে আর যাই হোক লজ্জা নয়–তা বুঝতে বাকী রইল না কমলার।

কিন্তু তখন আর সেদিকে তাকাবার অবকাশ নেই।

অর্ধাবগুণ্ঠিতা বিধবা এবং তার পেছনে একটি কিশোরী মেয়ে উঠান পেরিয়ে রোয়াকে এসে উঠেছে। অগত্যা অভ্যর্থনা করতে এগিয়ে যেতেই হয়। উমাকে কিছু বলবার সাহস নেই–কমলাই উঠে তাড়াতাড়ি মাদুর এনে বিছিয়ে দেয়।

গুপী চক্রবর্তী সময়ের মূল্য বোঝেন। গাড়োয়ানের সঙ্গে তকরার করলে আরও দু আনা বাঁচত, কিন্তু সে দু’আনার চেয়ে বর্তমান-কালের একটি মিনিটের দাম অনেক বেশি। তিনি নির্বিবাদে হাওড়া থেকে আসার ভাড়া আট আনার জায়গায় পুরো দশ আনাই দিয়ে তাড়াতাড়ি বাড়ি ঢুকলেন এবং অপেক্ষাকৃত চাপা অথচ তেমনি তীব্র নিখাদে নির্দেশ দিলেন, ‘করছিস কি নিস্ত রি, পায়ে পড়, পায়ে পড়–এমন পা আর পাবি না। সাক্ষাৎ মা দয়াময়ী–ওঁর দয়া হলে তোর রাণীর আর কোন ভাবনা থাকবে না। রাণী তোর সত্যিই রাজরাণী হবে।’

নিস্তার অর্থাৎ নিস্তারিণীও প্রস্তুত হয়েই এসেছিলেন। তিনিও আর কালবিলম্ব করলেন না, সত্যিসত্যিই কমলার পায়ের কাছে বসে পড়ে আর্দ্রকণ্ঠে বলে উঠলেন, ‘বড় জ্বালায় জ্বলে শীতল হতে এসেছি দিদি, আপনি তো আমার মতোই দুঃখী, দুঃখীর ব্যথা বুঝবেন। মেয়েটাকে পায়ে ঠাঁই দিয়ে আমায় বাঁচান। ইহজীবনে আর কোন সাধ-আহ্লাদ নেই–ওর সদ্‌গতি হলেই আমার সব হ’ল। …এখন আমার এই ধ্যানজ্ঞান এই চিন্তা। আমাকে রক্ষা করুন দিদি–করতেই হবে। নইলে এ পা আর ছাড়ব না।’

কিন্তু এ নাটকের সত্যিই কোন প্রয়োজন ছিল না। ততক্ষণে নিস্তারিণীর পশ্চাদ্ববর্তিনী সেই কিশোরী মেয়েটির দিকে চেয়ে এরা সকলেই মুগ্ধ হয়ে গেছে।

রাণী যেন সাক্ষাৎ রাধারাণী।

বুঝি বা এই কিশোরীকে দেখেই সাধক মহাজনরা পদাবলী রচনা করেছিলেন–ভগবান কিশোরীভজন লীলা কল্পনা করেছিলেন।

শ্বেতপদ্মের মতো ঈষৎ হরিদ্রাভ শুভ্র বর্ণ, পদ্মের পাপড়ির মতোই বিশাল বিস্ফারিত চোখ, তার সঙ্গে মানানসই টিকলো নাক, সুকুমার চিবুক। বারো তেরো বছরের মেয়ে–যৌবনের সুঠামতা এখনও লাভ করে নি তার তনু দেহ–কিন্তু ভবিষ্যতের সম্ভাবনায় পূর্ণ হয়ে উঠেছে। কী হবে,তা কী হয়েছে দেখেই বোঝা যায়। ছিপছিপে অথচ গোলালো, গড়ন, ছোট ছোট রক্তাভ হাতে চম্পক-কোরকের মতো আঙুল, কৃষ্ণনগরের মূর্তির ধাঁচে ঈষৎ বেঁকে আছে। শুধু রূপ নয় মনটিও যে নির্মল, এখনও কাঁচা–গুপী চক্রবর্তীর আওতায় থেকেও অকালে পাক ধরে নি তাতে–বোঝা গেল প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই। মা’র কীর্তি দেখে–সম্ভবত পথে আসতে আসতে মামার রিহার্সাল কল্পনা ক’রেই মেয়েটি খিল খিল ক’রে হেসে উঠল। আর তাতে দেখা গেল দাঁতগুলিও তার মুক্তার মতই সাজানো–এমন কি শিল্পী বিধাতা সেই অনিন্দ্যসুন্দর মুখে টোলটি দিতেও ভুল করেন নি।

নিস্তারিণী মেয়ের নির্বুদ্ধিতায় জ্বলে উঠলেও সে উম্মা বাইরে প্রকাশ করলেন না–শুধু এক হ্যাঁচকায় মেয়ের হাত ধরে টেনে এনে চাপা তর্জন করে উঠলেন, ‘পেন্নাম কর হতভাগ্নী–স্বগের দেবতা এঁরা–এঁদের গায়ে হাত দিবি–এ তোর জন্মান্তরের পুণ্যি।’

ততক্ষণে মেয়েটিও নিজেকে সামলে নিয়েছে। ছেলে মানুষ হ’লেও এই রকম ক্ষেত্রে তার পক্ষে হাসাটা যে উচিত নয়–সেটুকু বোঝবার মত জ্ঞান বুদ্ধি তার হয়েছে। সে এবার তাড়াতাড়ি এগিয়ে এসে কমলাকে প্রণাম করতে গেল।

কিন্তু কমলা তাকে পুরোটা হেঁট হতেই দিল না–তার আগেই তাকে নিজের কোলের কাছে টেনে নিয়ে তার চিবুক স্পর্শ ক’রে সুগভীর স্নেহে বলে উঠল, ‘তোমার আর পায়ে হাত দিতে হবে না মা, তুমি যে আমার মা- জননী!’

তার পর উমাকে দেখিয়ে দিয়ে বললে, ‘এঁকেও প্রণাম কর মা–আমার বোন।

উমাকে প্রণাম ক’রে মেয়েটি অবশিষ্ট উপস্থিত ব্যক্তি হিসেবে হেমকেও প্রণাম করতে যাচ্ছিল, কমলা তাকে ধরে ফেলে বললে, ‘উঁহু–উঁহু, ওকে প্রণাম করতে হবে না, ও যে সম্পর্কে তোমার দেওর হবে মা!’

ভাবের উচ্ছ্বাসের আতিশয্যে এরা সকলেই ভাসছে তখন–কে কি বলছে, কী আচরণ করছে কারুরই তখন সে সম্বন্ধে কোন সচেতনতা নেই। কমলারই যদি এই রকম মুগ্ধ অবস্থা হয়–হেমের যে কী হবে তা সহজেই অনুমেয়। মুখের কাছে কড়া কড়া কথাগুলো তৈরি হয়েছিল গুপীবাবুর উদ্দেশে–সেগুলো যে কখন বাষ্প হয়ে মিলিয়ে গেছে তা হেম বুঝতেই পারে নি। এই ত্রয়োদশী কিশোরীর রূপের মোহ জাদু বিস্তার করেছে তার মনে মস্তিষ্কে চৈতন্যে–সে বিহ্বল হয়ে গেছে। কী করা উচিত, কী বলা উচিত কিছুই বুঝতে না পেরে ঘেমে লজ্জায় রাঙা হয়ে বিমূঢ় অবস্থায় দাঁড়িয়ে রইল। রাণী তাকে স্পর্শ করে নি–কিন্তু তাকে প্রণাম করতে, স্পর্শ করতে আসছিল–এইটে অনুভব করেই অকারণে কণ্টকিত হয়ে উঠল 1

কিন্তু গুপীবাবুর বুদ্ধি, দৃষ্টি কিংবা শ্রুতিশক্তি কিছুমাত্র আচ্ছন্ন বা মুগ্ধ হবার কারণ ঘটে নি। তিনি এই সুযোগ মুহূর্তকালের জন্য নষ্ট হতে দিলেন না, কমলার মুখের কথার শেষটুকু শেষ হবার আগেই চেঁচিয়ে উঠলেন, ‘জয় মা ব্রহ্মময়ী, জয় গৌর আনন্দময়। ব্যস্–জবাব পেয়ে গেছি, আর কিছু ভাবি না বেয়ান, দরিদ্র ব্রাহ্মণকে যে ভিক্ষাটি দিলেন আর এই অনাথা বেওয়া বিধবাকে–এর জন্যে মা আনন্দময়ী আপনার প্রাণ পুরে মনস্কামনা পূর্ণ করবেন। নিস্তার কার মুখ দেখে উঠেছিল আজ, তোর মেয়ের হিল্লের মতো হিল্লে হয়ে গেল!’

বিচার শুরু হবার আগেই যদি আসামি অপরাধ কবুল করে বসে থাকে, তা হলে পরে আর সওয়াল জবাব জমে না। মামলা চলারও আর কারণ থাকে না।

এক্ষেত্রে কমলারও হ’ল তাই।

কোন্ এক দুর্বল মুহূর্তে এমন কথাই বেরিয়ে গেল যে পরে আর কোন ওজর আপত্তি ওঠাবার অবসর রইল না। গুপীবাবু এবং তার উপযুক্ত বোন নিস্ত ারিণী দুজনে পালা ক’রে এমনই কৃতজ্ঞতা প্রকাশ শুরু করলেন যে এ পক্ষে আর কেউ কোন কথা কইবার বিশেষ ফাঁকও পেলে না। তাঁরা বিবাহের প্রতিশ্রুতি তো নিয়ে গেলেনই–এক দিন ঠিক করা ছাড়া বলতে গেলে আর কোন কথা-বার্তাও বাকী রইল না। কমলা বা হেমের পক্ষ থেকে সামান্য একটু দ্বিধার ভাব দেখাবার ক্ষীণতম চেষ্টাও কোথায় উড়ে চলে গেল এঁদের আন্তরিকতার প্রবল বাতাসে। দেনাপাওনার কথাও তোলা গেল না–এঁরা বিশেষ কিছু‍ই চাইবেন না এক রকম এই কথা আদায় করেই নিয়ে গেলেন গুপীবাবু। বাকী রইল শুধু দিনটা ঠিক করা–সেটা গোবিন্দকে জিজ্ঞাসা করে ঠিক হবে–এই স্থির রইল, অর্থাৎ শোভনতার জন্য কতটা অপেক্ষা করা যায় সেইটে ভেবে দেখতে হবে। তা ছাড়া–কমলা মনে মনে শঙ্কিত হয়ে উঠল–হয়তো আর্থিক প্রশ্নও উঠবে, গোবিন্দকে ওর বন্দ-মনিবের কাছ থেকে শেষ পর্যন্ত কিছু টাকা ধার করতেও হবে।

সে কথাটাও এখন সারতে পারলে গুপীবাবু খুশি হতেন। কিন্তু মানুষের কোন সার্থকতাই পরিপূর্ণভাবে দেওয়া বুঝি বিধাতার ইচ্ছা নয়–তাই সেটা আর হয়ে উঠল না। এঁরা আসাতেই গোবিন্দর ঘুম ভেঙে গিয়েছিল–সে ওধারের দরজা দিয়ে প্রায় তখনই সরে পড়েছে। …

উপযুক্ত জলযোগের পর গুপীবাবুরা বিদায় নিতে কমলা উমার মুখের দিকে তাকাবার অবকাশ পেল। বড় রকমের একটা ঝড়ই সে আশঙ্কা করেছিল, সেদিক থেকে, কিন্তু প্রাথমিক রোষরক্তিমা মিলিয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই তার মুখে যে একটা ভাবলেশহীনতা ফুটে উঠেছিল–তার আর কোন পরিবর্তন হ’ল না। অভদ্রতা করার মানুষ সে নয়, নিস্তারিণীর দু-চারটে প্রশ্নের উত্তর ভদ্রভাবেই দিয়েছে–তবে সেটা কমলার কাছে খুব বড় আশ্বাস নয়। সে সারা সন্ধ্যাটা বার বার ভয়ে ভয়েই তাকাতে লাগল উমার মুখের দিকে, কিন্তু সেখানে কোন বৈলক্ষণ্য টের পাওয়া গেল না। তার শান্ত উদাসীন মুখভাবে বা সহজ আচরণে কোথাও এতটুকু রূপান্তর ঘটল না।

তবু কমলার ভয় সবটা যায় নি-রাত্রে শুতে গিয়ে একান্তে হয়তো কথাটা উঠবে এ আশঙ্কাও ছিল। কিন্তু রাত্রেও সহজ ও স্বাভাবিক দু-চারটে কথাবার্তার মধ্যেই উমা এক সময় ঘুমিয়ে পড়ল। নিজে থেকে বিকেলের কথাটা তুলবে এত সাহস কমলার হ’ল না–তবু এইবার সে কথঞ্চিৎ আশ্বস্ত হ’ল।

মনকে সে আশ্বাস দিলে, আর যাই হোক–কোন বড় রকমের তুফান আর উঠবে না।

.

এরপর দুই কাটল নিরাপদেই। এর মধ্যে গুপীবাবু বারকতক এসেছেন, দিনও ঠিক হয়ে গেছে, বিবাহের উদ্যোগ-আয়োজন শুরু হয়ে গেছে সামনের অঘ্রানেই বিয়ে। কমলার মনে যেটুকু আশংকা ছিল সেটুকুও আর নেই। বিবাহের আয়োজনে উমা কোন সক্রিয় অংশগ্রহণ করে নি বটে কিন্তু তার তরফ থেকে কোন অসহযোগেরও আভাস পাওয়া যায় নি।

বিনামেঘে বজ্রপাতের মতই একেবারে প্রথম সে আভাস পাওয়া গেল পাকা দেখার হাঙ্গামাও মিটে যাওয়ার পরের দিন–বিবাহের যখন আর মাত্র সাতটি দিন বাকী আছে।

উমা সহজভাবেই সন্ধ্যার পর পড়িয়ে ফিরে-আহ্নিক করতে যাবার আগে দিদির কাছে কথাটা পাড়লে, ‘দিদি আমার এক ছাত্রী থাকে এই কাছেই, ক্রিশ্চানদের হোস্টেলটার পেছনে–তারাও ব্রাহ্মণ, দু-তিনটি বিধবা আছেন বাড়িতে। তাঁরা একটা ছোট ঘর ভাড়া দেবেন–বাড়ির মধ্যে ভাড়াও খুব কম–মনে করছি এই মাসের পয়লা থেকে আমি সেখানে গিয়েই থাকব।’

খুব স্বাভাবিকভাবে, একান্ত শান্তকণ্ঠে কথাগুলি বললে উমা–কিন্তু তাতেই আরও দুর্বোধ্য ঠেকল কমলার কাছে। সাধারণ শব্দেরও যেন অর্থ গ্রহণ করতে পারলে না সে–হাঁক’রে অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল।

অবশেষে যখন ওর কণ্ঠে কথা ফুটল, তখন শুধু বিহ্বলভাবে এই প্রশ্নটুকুই করতে পারল, ‘তুই–তুই একলা থাকবি? আলাদা ঘরভাড়া ক’রে? কী বলছিস?’

‘দোষ কি? আর অন্তত আমার স্বভাব-চরিত্রের দোষ কেউ দেবে না।

দশ বাড়ি মেয়ে পড়িয়ে খাই, সে দোষ দিলে এত কাল ঢের দিতে পারত। তা ছাড়া সে বয়সও আর নেই।’

‘কিন্তু তার দরকারটা কি পড়ল…সেইটেই তো বুঝছি না!’

‘সব কথা সবাই বুঝতে পারে না দিদি। ….সে মেয়েটাকে আমিই একরকম জোর করে পাঠালুম, আমি না পাঠালে সে হয়তো যেত না–মরতও না। সেজন্যে তার কাছে চিরদিন আমি অপরাধী হয়ে থাকব। ….তার বড় সাধের সংসার–সংসার করবারও তর বড় শখ! তার জায়গায় এই ঘরে এই সংসারে তার সতীন এসে ঢুকবে–তিন মাস না যেতে যেতে–এ আমি কিছুতেই সইতে পারব না। মনে হবে আমি তাকে খুন করেছি–এই মতলবে। তার আত্মা আমাকে অভিসম্পাত করতে থাকবে স্বর্গ থেকে। না দিদি, মাপ কর আমাকে–এখানে আর থাকতে পারব না। এ ঘরে আর একটা মেয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে–এ দেখলে এখানে আমার মুখে অন্ন রুচবে না।’ বলতে বলতে, নিজেকে সংযত করবার প্রাণপণ চেষ্টা সত্ত্বেও উমার কণ্ঠস্বর বাষ্পরুদ্ধ হয়ে এসেছিল, সম্ভবত সেই আসন্ন চোখের জল গোপন করতেই সে আর উত্তর- প্রত্যুত্তরের অবকাশ না দিয়ে নিজের পূজোর আসনে গিয়ে বসে চোখ বুজল।

ঈশ্বরের কাছে আত্মনিবেদনের অশ্রুর মধ্যে অনুশোচনা ও আত্মগ্লানির অশ্রু আত্মগোপন করতে পারবে–সুলভ ভাবাবেগ প্রকাশ হয়ে পড়ার লজ্জায় পড়তে হবে না।

ষোড়শ পরিচ্ছেদ

॥১॥

কথাটা কেমন ক’রে রাষ্ট্র হয়ে গেল তা হেম বুঝতে পারলে না সম্ভবত কম্বুলে- টোলা থেকে ফিরে এসে রুষ্ট এবং উৎকণ্ঠিত রমণী বাবুকে যখন দেরি হওয়ার কৈয়িত দিচ্ছিল, সেই সময়ই কেউ শুনে থাকবে।

বাবু বেশ একটু তেতে ছিলেন, আর তাতাই স্বাভাবিক–সেটা হেমও মনে মনে স্বীকার করে। বাড়িটা শেষ পর্যন্ত খুঁজে পেলে কি না–চিঠিটা ঠিকমত পৌঁছল কিনা–সে সময় তাঁর উৎকণ্ঠা বোধ করারই কথা; কারণ কয়েকজন সম্ভ্রান্ত বন্ধু যাবেন তাঁর সঙ্গে, তাঁদের আতিথেয়তার দায়িত্ব আছে। কিছু জরুরি কাজও ছিল–খবরটার জন্য অপেক্ষা করতে করতে সে সময় পার হয়ে গেল, কাজটা নষ্ট হ’ল। সুতরাং ঝাঁজটা অনেকক্ষণ থেকেই মনের ভেতর জমা হয়েছে, তার ফলে চাপা গলায় কথা কইবার অর্ধ-আন্তরিক ক্ষীণ চেষ্টাটা প্রথম দুটো-চারটে শব্দের সঙ্গে সঙ্গেই কোথায় ভেসে চলে গেল–বেশ চড়া গলাতেই কথা শুরু করলে! নিজের কার পণ্ড হওয়ার তিক্ততা, ওর নির্বুদ্ধিতার জন্য বিরক্তি এবং সবটা জড়িয়ে অতিরিক্ত একটা উষ্মা–গলার আওয়াজে একসঙ্গে উপচে বেরিয়ে এল যেন।

বাবু প্রচণ্ড রাশভারী মানুষ। তাঁর এই উষ্ণ কণ্ঠস্বরের সামনে বহুদিনের পুরনো কর্মচারীদের মাথার ঠিক থাকে না–হেম তো সেদিনের লোক। তাঁর চোখমুখের চেহারা দেখেই এক নিমেষে ঘেমে উঠেছিল–এখন ধমক খেয়ে গলাতে যেন আওয়াজটাই জড়িয়ে গেল, প্রাণপণ চেষ্টাতেও বিলম্ব হওয়ার কারণটা গুছিয়ে বলতে পারলে না। ফলে যে কৈফিয়তটা এক মুহূর্তে দেওয়া যেত সেইটে বলতেই তার বহু সময় লাগল এবং ইতিমধ্যে আরও কয়েকটা চড়া চড়া ধমক খেতে হ’ল।

যাই হোক–বিলম্বের কারণটা শেষ পর্যন্ত অতি কষ্টে তার সেই জড়ানোগলায় আওয়াজ এবং উল্টো-পাল্টা কথার মধ্যে থেকে উদ্ধার ক’রে বাবু খুশিই হলেন। আরও খুশি হলেন হেমের এই অহেতুক ভয় দেখে। কর্মচারীদের কাছ থেকে প্রীতি বা শ্রদ্ধার চেয়ে ভয়টাই তাঁর বেশি পছন্দ। তাঁর দাপট আছে, তাঁকে ওরা যমের মত ভয় করে–এইটে জানলে তিনি খুশি ও নিশ্চিন্ত হন।

আজও তাঁর মুখ প্রসন্ন হতে দেরি হ’ল না। তবু প্রচ্ছন্ন একটা আশ্বাসমিশ্রিত মৃদু ধমকের সুরেই বললেন, ‘এই তো–এই কথাটা এতক্ষণ বলে ফেললেই তো হয়ে যেত। বাজারটা ক’রে দিয়ে এসেছে–কাজটা তো কিছু অন্যায় কর নি। তার জন্যে এত ভণিতা কেন? তা মাছ-টাছ বেশ ভাল দেখে কিনে দিয়ে এসেছে তো?….পচা পাকা হলে খুব মুশকিল হবে কিন্তু–বড় বড় লোক সব যাবে, দুজন ব্যারিস্টার, একজন হাকিম। সাবধান! দেখো বাপু, আমাকে ডুবিও না যেন।’

এ কণ্ঠস্বরের খানিকটা আশ্বস্ত হ’ল হেম। মাথা হেঁট ক’রেই জবাব দিলে, ‘আজ্ঞে না–টাটকা দেখেই কিনেছি। জিনিস কোনটা খারাপ হবে না।’

‘বেশ বেশ–তা হলেই হ’ল।’ তার পর জামাটা উলটে ট্যাক থেকে একটা আধুলি বার করে ওর দিকে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে বললেন, ‘এটা রাখো–বাড়ির জন্যে মিষ্টি কিনে নিয়ে যেও।’

পকেটে মানিব্যাগ থাকে, তাতে টাকারও অভাব নেই–তবু সর্বদা ট্যাকে কিছু রেজগি রাখা রমণীবাবুর অভ্যাস। বলেন ‘একশো বার ব্যাগ বার করে পয়সা দেওয়া বড় হাঙ্গাম! তা ছাড়া কেউ তুলে নিলে তো সব গেল–একটা পয়সার আজীর!’

দুখানা গাড়ি থাকা সত্ত্বেও রমণীবাবু হামেশাই ট্রামে যাতায়াত করেন–সুতরাং পকেটমারের ভয় থাকাটা স্বাভাবিক।

.

সেই চেঁচমেচির ফলে দু-চারজন বাবুর ঘরের বাইরে এসে জমাটা আশ্চর্য নয়–আর দুজনের কথাবার্তা থেকে ঘটনাটা অনুমান করতেও কারুর অসুবিধা হবার কথা নয়।

তার ফলে হেমেরই প্রাণান্ত। একটা ঘাড়ে কারও দুটো মাথা নেই যে বাবুর সামনে রসিকতা করবে। আড়ি-পাতার ইতিহাসটাও তাঁর জানার সম্ভাবনা ছিল না–কারণ তাঁর বাইরে আসার আভাস মাত্র পেয়েই সবাই পালিয়েছিল। হেমও প্রথমটা তাই বুঝতে পারে নি। বুঝতে পারলে একেবারে যখন চারিদিক থেকে বাক্যবাণ বর্ষিত হতে শুরু হ’ল–তখনই

প্রথমেই শুরু করল নন্দ–ওরই এক সহকর্মী গেট-কীপার।

চোখ মট্‌কে মুচকি হেসে বললে, ‘আর কি হেমচন্দর–তোমার কপাল তো খুলে গেল–দেখো বাবা,

বাবা, সুসময়ে গরীবেরর কথা একটু মনে রেখো–একেবারে পায়ে ঠেলো না!’

ওরা যে কেউ অপরাহ্নের ঘটনার বিন্দু বিসর্গও জানে–এ অনুমান হেমের স্বপ্নের অগোচর। সে বিহ্বল হয়ে খানিকটা নন্দর মুখের দিকে চেয়ে থেকে বললে, ‘তার মানে?’

‘না–তাই বলছি!’ আবারও মুচকি হাসে নন্দ।

প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই কানাই এসে পড়ে।

‘বাবা ডুবে ডুবে জল খাও–ভাবো শিবের বাবা টের পাচ্ছে না। হুঁ- হুঁ–সবাই বলে পাড়াগেঁয়ে মেড়া, ভূত, বোকা। আমি চিরদিন বলে এসেছি পাড়াগাঁয়ের লোকেরা আমাদের এক হাটে বেচে আর এক হাটে কিনে আনতে পারে। তা ভাল ভাল–নিজের আখের দেখবে বৈ কি। তবে একটু সাবধানে চ’লো ধন–একদিকে মেয়ে-মানুষ আর এদিকে বড়লোক। দুই-ই সমান। লোকে কথায় বলে–বড়র পরীরিত বালির বাঁধ, ক্ষ্যাণে হাতে দড়ি ক্ষ্যাণেকে চাঁদ। …আর মেয়েমানুষ, আরও সাংঘাতিক–ও হ’ল শাঁখের করাত, যেতেও কাটে আসতেও কাটে।

হেম আরও বিহ্বল হয়ে পড়ে। একটা অস্পষ্ট ঝাপ্‌সা-মতো সন্দেহ যে মনের কোণে উঁকি না মারে তা নয়–তবু সে অবাকই হয় সত্যি-সত্যি। বলে, ‘কী যে তোরা বলছিস বুঝতেই পারছি না।’

‘ইল্-লো!’ কানাই ওর দাড়িটা ধরে নেড়ে দিয়ে বলে, ‘কচি খুকী একেবারে! কিচ্ছু জান না!…অত বড় ঘুঘু কন্ট্রাকটারকে ঘায়েল ক’রে তার মেয়েমানুষের দিকে হাত বাড়িয়েছ–তুমি কিছু জান না! ন্যাকা!’

‘এই কেলো–কী করিস। চুপ কর্।’ সতর্ক করে দেয় নন্দ।

একটু পরে দক্ষিণাবাবুর সঙ্গে দেখা হতে তিনিও মুখ টিপে…হাসেন। অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে বলেন, ‘দেখো হে ছোকরা, সাবধান। …বেশি বাড়াবাড়ি করতে যেও না যেন। ও হল নৈবিদ্যির মোণ্ডা

–কুকুরের ওতে মুখ দিতে নেই!’

লাল হয়ে ওঠে হেম-লজ্জাতেও বটে, অপমানেও বটে। কিন্তু এতকাল এখানে থেকে এইটুকু বুঝেছে যে, এ ধরনের কথা নিয়ে বাদানুবাদ বা তর্কের ক্ষেত্র এটা নয়। পাঁকে নাড়া দিলে, পাঁকই ঘুমোয়–পরিষ্কার জল মেলে না তাতে।

সে শুধু আস্তে বলে, ‘কী বলছেন দক্ষিণাদা তা বুঝছি না–মনিব হুকুম করেছিলেন–তামিল না ক’রে উপায় ছিল না। এতে এত টিটকিরির কী আছে তাও বুঝি না!

দক্ষিণাবাবু আর কথা বাড়ান না, ওর পিঠে গোটা দুই মৃদু চাপড় মেরে বলেন, ‘রাগ হয়ে গেল অমনি! ঠাট্টা করছিলুম রে!…তবে ভাই সাবধানে থাকিস একটু। এখানে অনেক বছর কাটল তো–অনেক দেখলুম।’

কিন্তু এধারে যতই যা রাষ্ট্র হোক–হেম নিজের ভাগ্যের কোন পরিবর্তন‍ই দেখতে পায় না। বরং উল্টোটাই দেখে।

কৃতজ্ঞতা সে আশা করে নি–কী-ই বা সে করেছে কৃতজ্ঞতা পাবার মতো? ও কিছু নয়–তবে পরিচয়ের স্বীকৃতিটা অন্তত আশা করেছিল। কিন্তু দিন-তিনেক পরেই কী একটা কাজে ভিতরে যাবার দরকার হতে এবং (হয়তো নিজের সচেতন মনের অগোচরে সেরকম একটা চেষ্টাও ছিল) নলিনীবালার সামনে পড়ে যেতেও, সে অবাক হয়ে দেখলে, সামান্য মাত্র ব্যক্তিগত পরিচয়ের দাপ্তিও ফুটল না তার চোখে। যেমন সাধারণভাবে অন্য দিন নির্লিপ্ত স্মিতমুখে চেয়ে বসে থাকে–তেমনিই রইল নলিনী।

শুধু অবাক হ’ল না হেম–আহতও হ’ল।

এতটা সে আশঙ্কা করে নি। হলেই বা বাবুর প্রেয়সী–তা বলে চিনতে পারবে না, এত অহংকার কিসের!

অপমান-বোধ, ক্ষোভ অথবা উষ্মা–কারণ যা-ই হোক, হেমের কান দুটো আগুনের মতো গরম হয়ে উঠলো। বিশেষ করে তার মনে হ’ল চারিদিক থেকে অসংখ্য কৌতূহলী দৃষ্টি বিদ্রূপে উদ্ভাসিত হয়ে উঠেছে।

সে স্থান কাল পাত্র সব ভুলে সম্পূর্ণ অকারণেই, নলিনীর সামনে দাঁড়িয়ে দাঁত বার ক’রে হেসে বলল, ‘এই যে, ভাল আছেন?’

নলিনী একটু যেন বিস্মিত হয়েই ভ্রূ কুঁচকে তাকালে, তার পর তেমনি থতমত ভাবেই বললে, ‘ভাল–হ্যাঁ–তা–। অ, আমাদের হেমবাবু। পোড়া কপাল আমার। সেদিন বুঝি বাবুর চিঠি নিয়ে গিছলেন। ঠিক বটে। হ্যাঁ ভাই, বেশ ভাল আছি। আপনার খবর ভাল সব? আহা, আপনি সেদিন কষ্ট না করলে বড় বিপদে পড়তে হ’ত!’

এই বলে চারিদিকে একবার বিচিত্র অমায়িক ভঙ্গিতে তাকিয়ে নিয়ে পাশের আর এক অভিনেত্রীর দিকে হাত বাড়াল, ‘দেখিলা নেড়ী তোর ডিবেটা–আমার চাকরটা আজ আবার এমন ঝাল পান এনেছে, মোটে মুখে দিতে পারছি না!’

হেম তখন পালাতে পারলে বাঁচে–শুধু এখান থেকে নয়–এই থিয়েটার থেকেও! মনে হচ্ছে আরও উপহাস এবং টিটকিরি নির্বোধের মতো সেধে নিজের ওপর টেনে আনল সে।

অন্ধের মত হোঁচট খেতে খেতে এবং প্রায় ছুটতে ছুটতে এসে একটা উইংস-এর পাশে অন্ধকারে দাঁড়িয়ে কপালের ঘাম মুছছে–কানের পাশ থেকে হিস্হিস্ ক’রে উঠল দক্ষিণাদার কণ্ঠস্বর, ‘ইস্টুপিড়। সেধে অপমান হতে না গেলে বুঝি চলছিল না? ঐটুকু কথা কয়ে কী স্ব-লাভ হ’ল তাই শুনি!…নিজেও মরবি ও ঐ ছুঁড়ীটাকেও মারবি যে–এটাও বুঝিস না?’

আরও বিস্মিত হ’ল হেম–কিন্তু তবুও ওঁর মন্তব্যের অর্থটা জিজ্ঞাসা করতে পারল না দক্ষিণাদাকে। অপমানে লজ্জায়, কেমন এক ধরনের অবর্ণনীয় গ্লানিতে কান-মাথা ঝাঁ-ঝাঁ করছিল–গলা দিয়ে একটু স্বরও বেরোল না।

॥২॥

দক্ষিণাবাবুর কথাগুলোর অর্থ বুঝল হেম–আর কদিন পরে।

সেদিন বহুরাত্রি পর্যন্ত জেগে এপাশ ওপাশ করতে করতে প্রতিজ্ঞা করেছিল যে–আর নয়। চাকরি করতে গেছে, চাকরিই করবে। বাইরে তার কাজ–বাইরে থাকাই ভাল–কোন দিন কোন ছুতোয় সে ভেতরে যাবে না, কোন ছেলেমেয়ের সঙ্গে কথাও কইবে না। কিন্তু সে প্রতিজ্ঞা রইল না-দিন পনেরো পরেই আবার এক অপারাহ্নে বাবু ওকে ডেকে পাঠালেন নিজের ঘরে।

ভয়ে ভয়েই গেল হেম–যদিচ অনেক ভেবেও এমন কোন অপরাধের কথা তর মনে পড়ল না যাতে ভয় পাবার কারণ থাকে–কিন্তু বাবু ডাকলেই বুকটা ধড়াস ক’রে ওঠে। এইরকম অভ্যাসে দাঁড়িয়ে গেছে সকলের।

যাই হোক–ঘরে ঢুকে দেখলে বাবুর মুখ অনেকটা প্রসন্ন। নিজেয় ডেস্কের সামনে বসে একটা কাগজ মেলে আগের দিনের হিসেব দেখছিলেন। কাগজ থেক মুখ না তুলেই বললেন, ‘এসেছ? দাঁড়াও।’ তারপর হিসেবটা দেখা শেষ হতে ওর দিকে খানিকটা নিঃশব্দে চেয়ে থেকে বললেন, ‘ও, হাঁ–তোমাকে ডেকেছিলুম বটে। কী যেন তোমার নাম–হেম না? তা শোন, একটা কাজ করতে পারবে? সেদিন যে বাড়িটায় গিছলে, মনে আছে তোমার?…আজও একবার সেখানে যেতে হবে। …মানে–আজও কজন লোক খাবে, একটু বাজার দরকার। সেদিন নাকি তুমি বেশ ভাল বাজার করেছিলে–অনেক সস্তায়ও। বাজার-ঝিকে দিয়ে বাজার করানো–সে বেটি দু’হাতে চুরি করে; তা পারবে বাজারটা করে দিতে?’

প্রতিজ্ঞার কথাটা মনে পড়ে বৈকি!

তবুও মনিবের মুখের ওপর ‘না’ বলতে পারে না। মাথা হেঁট ক’রে বলে, ‘পারব।’

‘বেশ, বেশ। এই তো চাই, কোন কাজেই না বলতে নেই। আমি–আমাকে আজ এই দেখছ। একদিন গামছা কাঁধে করে ফিরি করেছি এই কলকেতার রাস্তাতেই, মেড়োদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে। আজও–লাখ লাখ টাকার ঠিকেদারি করি বটে–কিন্তু নিজে ছাতি মাথায় দিয়ে রোদেজলে দাঁড়িয়ে মিস্তিরি খাটাই। …তোমার উন্নতি হবে। ….এই নাও ফর্দ। দু-রকম মাছ, একটু মাংস–আর আদা পিঁয়াজ টকদই, আলু হিসেব-মত। সবই লেখা আছে, এই দশটা টাকাও ধর–বেশ ভাল দেখে জিনিস কিনো–বিশিষ্ট ভদ্দর-লোকেরা খাবেন।

তার পর কী ভেবে ট্যাক থেকে আরও দুটো টাকা বের ক’রে দিয়ে বলেন, ‘এটাও রাখো–যাচ্ছ যখন তখন অমনি তিনকড়ি ময়রার দোকান থেকে দইসন্দেশও কিনে নিয়ে যেও–দশে বোধ হয় কুলোবে না, আরও লাগবে।

হেম ফর্দটায় একবার চোখ বুলিয়ে নিয়ে বলে, ‘কিন্তু এত বাজার নিয়ে যাব কী করে? ঝাড়ন কি গামছা একটা–। ও বাড়িতে কি আগে যেতে হবে? গিরিধারীকে সঙ্গে নেব?’

‘তোমরা তো খুব মনে থাকে হে ছোকরা! গিরিধারীর নামটাও মনে ক’রে রেখেছ?’ তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে একবার তাকান রমণীবাবু ওর মুখের দিকে, না তার দরকার নেই। একেবারে এই নতুন বাজার থেকে বাজার ক’রে একটা ঝাঁকামুটের মাথায় চাপিয়ে নিয়ে যেও। …কতই বা নেবে–চারটে পয়সা বড় জোর! তার জন্যে আর দোকর আসা-যাওয়া ক’রে লাভ কি? নতুন বাজারে মাল কিনলে কিছু ওয়ারাও পাওয়া যাবে–তাতেও মুটের পয়সাটা উসুল হবে।’

মুটের পয়সা ওর ট্রামভাড়াতেও উসুল হবে, মনে মনে গজগজ করতে লাগল হেম, মুটের মাথায় মাল চাপিয়ে কিছু ট্রামে যেতে পারবে না। মাঝখান থেকে ওর পয়সাটা মাটি!

কিন্তু সেটা মুখে বলা সম্ভব নয়। ‘যে আজ্ঞে’ বলে কোঁচার খুঁটে টাকা কটা বাঁধতে বাঁধতে বেরিয়ে পড়তে হ’ল তখনই।

.

করতেই হবে–তাই করা। কিন্তু মনটা অপ্রসন্ন হয়ে রইল সারাক্ষণ। আবার নলিনীর সামনে গিয়ে দাঁড়াতে হবে–এই ভেবেই আরও বিশ্রী লাগছিল।

মুটের মাথায় মোট চাপিয়ে নিজের দু’হাতে দইয়ের খুলি আর সন্দেশের হাঁড়ি নিয়ে ভাদ্রের খর-রৌদ্রে হেঁটে যেতে যেতে বার বার নিজের মনকে শাসাল, ‘খবরদার আর কোনও রকম ঘনিষ্ঠতা করা নয়। …দোরের কাছ থেকে গিরিধারীকে ডেকে বুঝিয়ে দিয়েই চলে আসতে হবে। বসতে বললেও বসব না!’

কিন্তু বাড়িতে পৌঁছে কড়া নাড়তে দোর খুলে দিলে গিরিধারী নয়–নলিনী স্বয়ং।

‘আসুন, আসুন। আপনার জন্যেই সেই থেকে নিচে বসে আছি হ-পিত্যেশ ক’রে। ‘আসুন, আসুন–ভেতরে আসুন। যা রোদ আজ বিকেল অদি!’

হেম এ আত্মীয়তায় ভিজবে না–সে শুষ্ক স্বরেই বলবার চেষ্টা করলে, ‘থাক, আমি আর এখন ভেতরে যাব না। জরুরি কাজ আছে একটা–আপনি গিরিধারীকে ডাকুন–মালগুলো নামিয়ে নিক্। এই ফর্দ বাবু দিয়েছিলেন, মিলিয়ে নেবেন–

‘আচ্ছা আচ্ছা! হয়েছে। অত রাগ করতে হবে না। দয়া ক’রে ভেতরে আসুন দিকি। ঘাট হয়েছিল আমার, আমার, গলবস্ত্র হয়ে মাপ চাইছিল। নিন–কী অবস্থা হয়েছে বলুন তো–এই ভাদ্দরের রোদটা মাথার ওপর দিয়ে গেল–তা একটা ছাতাও কি নিতে নেই? অবিশ্য ছাতা থাকলেই বা কি হ’ত–দু হাত বোঝাই। …বাবুর যেমন কাণ্ড। এখানে এসে গিরিধারীকে ডেকে নিয়ে গেলেও হ’ত। আসুন।

অগত্যা ভেতরে আসতে হয়।

দইয়ের খুলি আর সন্দেশের হাঁড়ি নলিনীই নামিয়ে নেয় হাত থেকে।

‘কৈ রে কোথায় গেল–আ অগিরিধারী। এই নে, এগুলো ধর–ভাল ক’রে চাপা দিয়ে রাখ গে যা মা’র ঘরে। …দেখিস বেড়ালে না খায়। মুটেটাকেও অমনি নিয়ে যা; রান্নাঘরে মালগুলো নামিয়ে রাখ সাবধানে। ওকে চারটে পয়সাও দিয়ে দিস

‘না, না, ওর পয়সা আমার কাছে আছে।’

‘থাক গে যাক!’ গলা নামিয়ে বলে নলিনী, ‘ওই ঠেকো রোদ্দুরে এতটা পথ হেঁটে এসেছেন–ট্রামভাড়া বলেও তো বাবু কিছু দেয় নি। ওটা আপনিই রাখুন।’

তারপর গলাটা আরও নামিয়ে বলে, ‘হ্যাঁ রে গিরিধারী, মা ঘুমোচ্ছে তো–না?’

‘না তো দিদিবাবু–মা তো মাসীমার ওখানে বেড়াতে গেছে।’

‘যাক নিশ্চিন্ত–তা হলে সন্ধ্যের আগে আর এ-মুখো হচ্ছে না। আসুন আসুন, ওপরে আসুন।’

আপত্তি এবং প্রতিজ্ঞা যেন কোন্ বহু দূর অতীতের কথা, এরই মধ্যে বিস্মৃতির অতলে তলিয়ে যেতে বসেছে। মানুষটার সহৃদয়তা শুধু নয়–অন্তরঙ্গতা এবং আত্মীয়তাই–মুগ্ধ করল হেমকে। সে ওর পিছু পিছু অভিভূতের মতই উঠে গেল।

সে-ই পূর্ব-পরিচিত ঘর। মেঝেতে একটা মাদুর বিছানো রয়েছে তার সঙ্গে একটা ছোট বালিশও কার শোবার চিহ্ন বহন করছে–সম্ভবত গরমের জন্যে নলিনীই এখানে শুয়েছিল। হেম সেই মাদুরেই বসতে যাচ্ছিল, নলিনী খপ ক’রে একটা হাত ধরে ফেললে।

‘না-না, ওখানে নয়। ভাল হয়ে বসুন–বিছানায়।’

এক রকম জোর ক’রেই টেনে নিয়ে গিয়ে ঢালা বড় বিছানায় বসাল সে। হেম আরও অভিভূত। সুগৌর মুখ তার অঙ্গার-বর্ণ ধারণ করেছে, ঘামে সমস্ত দেহটার অবস্থা হয়েছে ভিজে গামছার মত–কিন্তু সে কতটা ভাদ্রের রৌদ্রে আর কতটা এখন লজ্জায় সংকাঁচে–তা বলা শক্ত। বার বার নিজের ছোট ময়লা রুমালটা দিয়ে মুখ মোছবর চেষ্টা করছে কিন্তু সেটা ইতিমধ্যেই ভিজে সপসপে হয়ে উঠেছে বলে তাতে আর কোন কাজ হচ্ছে না।

নলিনী এতক্ষণ ওর মুখের দিকেই চেয়েছিল–কেমন এক রকমের মুগ্ধ দৃষ্টি–এখন রুমালের বদলে কোঁচার খুঁটে ঘাম মোছবার চেষ্টা করতেই তার সংবিৎ ফিরে এল–সে তাড়াতাড়ি আলনা থেকে একটা ফরসা তোয়ালে টেনে নিয়ে ওর হাতে গুঁজে দিয়ে বললে, ‘এইটে নিন। একেবারে ধোপদস্ত–কাঁচা। আমাদের কারুর ব্যাভার করা নয়। …ইস্ কী হয়েছে মনে হচ্ছে যেন বালতি ক’রে কে জল ঢেলে দিয়েছে। লোকটা মানুষ নয়, চামার–চামার! কেন, আর একটু রোদ পড়লে পাঠানো যেত না!’

সে একটা পাখা এনে জোরে জোরে হাওয়া করতে লাগল। তাতে হেম আরও বিব্রত বোধ করল–হাত বাড়িয়ে পাখাটা টেনেও নিতে গেল একবার, কিন্তু আশ্চর্য ক্ষিপ্রতার সঙ্গে ডান হাতটা সরিয়ে নিয়ে বাঁ হাতে ওর হাতটা চেপে ধরল নলিনী, ‘অত কিন্তু হচ্ছেন কেন বলুন তো! ব্রাহ্মণ মানুষ, একটু সেবা করলুমই বা।

-কত পাপ করেছিলুম গেল জন্মে, তাই এই সব ঘরে জন্মেছি, আবার এজন্মে ব্রাহ্মণকে দিয়ে ব্যাগার খাঁটিয়ে পাপে ডুবব! একটু সেবাও করি–যদি সেই পুণ্যে পাপটা খণ্ডায়!’

ইতিমধ্যে সাদা পাথরের গ্লাসে কী একটা পানীয় নিয়ে প্রবেশ করে গিরিধারী। সম্ভবত প্রস্তুতই ছিল।

‘দাঁড়া, ওখানে রেখে যা। ঘামটা আর একটু মরুক। বেশি করে বরফ দিয়েছিস তো?’

গিরিধারী কিছু দূরে গ্লাসটা রেখে চলে যেতে নলিনী বললে, ‘এ মোচলমানের জল নয় ঠাকুর। আমি নিজে মিছরি ভিজিয়ে শরবত ক’রে রেখেছিলুম। বলা ছিল আপনি এলেই বরফ আনিয়ে দিয়ে যাবে। –নিন্–এবার বরং খেয়ে ফেলুন। রোদ্দুরের ততটা কমেছে বোধ হয় একটু। তাতের ওপর ঠাণ্ডা খেলে সর্দিগর্মি হয় শুনেছি।

শুধু শরবত নয়–একটু পরে একথালা ফল এবং সন্দেশ-রসগোল্লাও বসে খেতে হ’ল ওকে। কিছুতেই ছাড়লে না নলিনী। এমন সহজ অন্তরঙ্গতার সঙ্গে জোর-জবরদস্তি করতে লাগল যে চেষ্টা ক’রেও এড়াতে পারল না হেম।

সমস্তটাই স্বপ্নের মতো মনে হচ্ছে ওর। এই ঘর, এই শয্যা শ্বেত পাথরের রেকাবে এমন দেবভোগ্য জলযোগের আয়োজন, এমন একটি মেয়ে বসে বাতাস করছে, সবটাই অবিশ্বাস্য, অবাস্তব, স্বপ্নের মতো। তবু–হয়তো অসম্ভব অবিশ্বাস্য বলেই, ক্ষণেক পরে রূঢ় বাস্তবে নেমে আসতে হবে বলেই–এই ক্ষণিক সুখস্বপ্নটুকুর মায়া কাটাতে পারে না হেম। তার অদৃষ্টে কোনদিনই তো এসব জুটবে না–যদিও স্বপ্নেও এটুকু ভোগ ক’রে নিতে পারে তো মন্দ কি!–

অবশ্য বেশিক্ষণ বসে থাকতে সাহসে কুলোয় না। স্বাভাবিক সংকোচ তো আছেই, বাবু হয়তো ওর প্রত্যাগমনের অপেক্ষা করছেন সেদিনের মতো। বাজারে যতটা দেরি হতে পারে–তার সমস্ত কাল্পনিক সীমা ছাড়িয়ে এসেছে বহুক্ষণ। এমনিতেই এখন ট্রামে ফিরতে হবে–নইলে অশোভন হয়ে পড়বে।

‘চললেন? আচ্ছা আসুন আজকের মতো। আবার আসবেন কিন্তু–এ তো আমি অছিলে করে ডেকে আনলুম। বাজারের সুখ্যেত ক’রে দাম কমের কথা বলে–কত কাণ্ড ক’রে। নইলে তো আসতেন না! দুপুরের দুটোর পরে–মানে মা খেয়ে ঘুমোলে (গলার স্বরটা নামিয়ে আনে নলিনী, হয়তো অকারণেই) যে কোন দিন চলে আসবেন। তারপর এই পাঁচটা পর্যন্ত নিশ্চিন্তি। বেলা দুপুর থেকে থিয়েটারেই বা গিয়ে পড়ে থাকেন কেন? বাড়ি থেকে বেরিয়ে এখানে আসবেন এখান থেকে বরং থিয়েটারে যাবেন।’

তারপর জোর করে একটু কেশে গলাটা পরিষ্কার করে নিয়ে–কণ্ঠস্বরটা আরও নামিয়ে বলে, ‘সেদিন খুব রেগে গিয়েছিলেন–না হেমবাবু? আপনি যে বড্ড ছেলেমানুষ!…নইলে এসব কথা কি আর বুঝিয়ে বলতে হয়। ওখানে- ওখানে আলাপ-পরিচয় মাখামাখি না করাই ভাল, বুঝলেন না? সাতশো রাক্কুসীর ঘর করি বলতে গেলে। নৈবিদ্যির কলা সবাই ঢেঁকে বসে থাকে একবার একটা ছুতো পেলেই হ’ল। লাগিয়ে ভাঙিয়ে মন ভারী করতে কতক্ষণ? বেশি কথা কি বলব, আমার মা-টিই অষ্টপ্রহর গোয়েন্দাগিরি করছে। তার ভয় আমি যদি এমন বাবুটা ক্ষুইয়ে বসি? এসব লজ্জার কথা–বলতেও ঘেন্না হয়- তবে আপনি জানেন না বলেই একটু সাবধান ক’রে দিলুম। মোদ্দা আসবেন আবার। ….আমায় কথা দিচ্ছেন তো? বলুন আসবেন?’

হেমের কানের ডগা এমন কি পেছনের ঘাড়টা পর্যন্ত যেন লজ্জায় রাঙা হয়ে ওঠে। কোনমতে মাথা নামিয়ে ছোট্ট একটা ‘হ্যাঁ’ বলে একরকম ছুটেই বেরিয়ে পড়ে।

সন্ধ্যার আর বেশি দেরি নেই। বাবু কী ভাবছেন কে জানে! আজ আবার কী মূর্তিতে থাকবেন।

॥৩॥

একেবারে রাত্রে বিছানায় শুতে গিয়ে দিনের ঘটনাগুলোকে মনের মধ্যে রোমন্থন করবার অবসর মিলল। সন্ধ্যাবেলাটা খুব ব্যস্ত থাকতে হয়েছিল, কিছু ভাববার সময় বা সুযোগ পায় নি–তবু মনটা যে খুব খুশি-খুশি ছিল তাতে সন্দেহ নেই। এখন বিকেলের কথাটা ভাবতে ভাবতে ওর মনে হ’ল–আসলে অনেকিদন পরে একটা মানুষের কাছ থেকে ভদ্র ব্যবহার পেয়েছে বলেই মনটা এত খুশি আছে। এইটেই তো তার জীবনে একটা অসাধারণ অননুভূত অভিজ্ঞতা। না–মেয়েটা যে ভদ্র খুব তাতে কোন ভুল নেই। খুবই ভাল। হেম এ কদিন তাকে ভুলই বুঝেছিল।

ক্রমে ক্রমে সেই ঘর, মেয়েটির সেবা, সমস্ত পরিবেশ–স্মৃতির পটে পরিষ্কার ফুটে উঠল। যতই সবটা পর্যালোচনা করে দেখলে মনে মনে, ততই যে শুধু ঐ প্রত্যয়টা দৃঢ় হ’ল তাই নয়–কেমন একটা অনাস্বদিত-পূর্ব মাধুর্যেও মনটা আবিষ্ট হয়ে উঠল।

এক এক সময় গোপনবাসী কোন এক সত্তা তাকে সতর্ক ক’রে দেবার চেষ্টাও করল বৈ কি। মনে হল শেষ পর্যন্ত এটা গরিবের ঘোড়া-রোগেরই সূচনা নয় তো। কিন্তু সে অন্তরের সুদূরতম প্রান্তের কথা–তা ভাল ক’রে শোনাও গেল না–তার আগেই সে হেসে উড়িয়ে দিল সম্ভাবনাটাকে। একটা মানুষ একটু ভদ্র ব্যবহর করেছে–তার ভাল লেগেছে। এর ভেতর আর এত মাথা ঘামাবার মত আছেই বা কি!

এবং শেষ পর্যন্ত এক সময়–নিজের অজ্ঞাতসারেই–আবার কবে ভদ্রভাবে, নিজের তরফ থেকে কোন অশোভন ঔৎসুক্য প্রকাশ না করে ওর বাড়ি যাওয়া যায়, এই চিন্তাতেই তন্ময় হয়ে উঠলো। আধো ঘুম আধো জাগরণের মধ্যে বার বার নিজেকে এই কথাটাই বোঝাতে লাগল যে অত ক’রে অনুরোধ করেছে যখন–তখন এক-আধবার যাওয়া যেতে পারে। তাতে এমন কিছু অশোভনতা প্রকাশ পাবে না।

পরের দিন সকালে যখন ঘুম ভাঙল তখনও মনটা বেশ প্রসন্ন আছে। অকারণেই খুব খানিকটা হৈ-চৈ করল, যেচে বাজারে গিয়ে নিজের পয়সাতে (গত বিকেলে সামান্য যা লাভ হয়েছিল তাইতে) বড় মাসীর জন্য করলা এবং গোবিন্দর জন্য মৌরলা মাছ কিনল। সেটা ওর কামাবার দিন নয়–সাধারণত দু’দিন অন্তর কামায় আর আগের দিনই কামিয়েছে–তবু পরিপাটী করে দাড়ি কামাতে বসল, এবং সেদিন দুপুরবেলা রিহার্সাল হবে মনে পড়ে যাওয়াতে খাওয়ার পরই থিয়েটারে ছুটল।

কমলা জিজ্ঞাসা করল, ‘এমন সময়ে বেরোচ্ছিস যে!’

‘কাজ আছে একটু–এই এই–এক জায়গায় একটা কাজের সন্ধান আছে, তাই যাচ্ছি!’

এমন সময় থিয়েটার যাবার কোনও কৈফিয়তই দিতে পারবে না বুঝে মিথ্যার আশ্রয় নিল। রিহার্সাল আছে বলা চলবে না। –’রিহার্সাল তো তোমার কি?’–এখনই এই প্ৰশ্ন উঠবে।

রিহার্স্যালের সময় যেমন ওদের যাওয়ার প্রয়োজন ছিল না–তেমনি নিষেধও ছিল না। অনেকেই আসত এমন,–যারা থিয়েটারে কাজ করে থিয়েটারের বাইরে তাদের জীবনটা কোথাও যেন খাপ খেতে চায় না–তাই তারা সকালে দুপুরে যখন তখন এখানে আসে। ওকে দেখে সেজন্য কেউ বিস্মিতও হ’ল না, কোন কারণও জিজ্ঞাসা করল না–অকারণে এমন সময়ে আসবার!

হেম প্রথমটা একটু ভয়ে-ভয়েই ছিল–পাছে সহকর্মীদের জেরায় পড়তে হয়। কিন্তু কেউই যখন বিশেষ প্রশ্ন করল না তখন নিশ্চিন্ত হয়ে ভেতরে এসে দাঁড়াল এবং পেছন দিকের একটা কোণ থেকে রিহার্সাল দেখতে লাগল।

রিহার্সাল নলিনীর ছিল। থাকার কথাই–কারণ আজকাল ও বড় বড় পার্ট পায়।

অবশ্য হেমের রিহার্সালে তত মন ছিল না। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ও নলিনীকেই ভাল ক’রে দেখল। আর দেখতে দেখতে এক সময় মনে হ’ল–সাজলে-গুজলে নলিনীকে ভালই দেখায়।

তন্ময় হয়েই দেখছিল–হঠাৎ কানের কাছে দক্ষিণাদা যেন হিস হিস ক’রে উঠলেন, ‘এরই মধ্যে লকেছে’! ইস্–এরা একেবারে কাঁচা-খেগো। …ওরে ছোঁড়া তোর কি প্রাণের ভয় নেই? গরিবের ছেলে মরবি যে!’

ভারি বিরক্ত হয়ে উঠল হেম। দক্ষিণাদার কথাগুলো আদৌ ভাল লাগল না। বড্ড ছোট মন ভদ্রলোকের। সবতাতেই খারাপটা আগে দেখেন–

সে কোন উত্তর দিল না, তেমনি আর দাঁড়ালও না। বাইরে বেরিয়ে নন্দরা যেখানে বসে জটলা করছিল সেইখানে এসে দাঁড়াল।

এবং সাধারণত যেটা কোন দিন ওর নজরে পড়ে না–আজ সেইটেই পড়ল–নন্দ বেশ চুনোট-করা কোঁচানা দেশী দামী ধুতি পরে এসেছে। সে আর থাকতে না পেরে–কী বলছে তা বোঝাবার আগেই–বলে উঠল, ‘মাইরি–থিয়েটারে গেটকীপারি ক’রে এত পয়সা পাস কোথা থেকে নন্দ।’

‘কেন–পয়সার কি দেখলে বাবা। খাচ্ছি তো এক পয়সায় দশটা বিড়ি।

‘না তা বলি নি। দামী ধুতি পরছিস আজকাল–তাই বলছি।’

হো হো ক’রে হেসে উঠল নন্দ। বেশ কিছুক্ষণ ধরে হাসল। তারপর বললে, ‘এই কাপড় দামী। ওর মু–এ যে হেটো ধুতি! হাওড়ার হাটের ধুতি–এক টাকা দু আনায় একখানা!’

‘যাঃ!’ অবিশ্বাসের হাসি হাসে হেম, ‘আঠারো আনায় দিশী ধুতি–কী যে বলিস। বাঙ্গালকে হাইকোর্ট দেখাচ্ছিস নাকি?’

‘তাই তো দাঁড়াচ্ছে। তুই যে এত আনাড়ী তা জানতুম না। এ কী তোর ফরাসডাঙার ধুতি? দেখে বুঝতে পাচ্ছিস না?’

কানাই এতক্ষণ নীরবে দাঁড়িয়ে বিড়ি টানছিল, সে বলে উঠল, ‘অত কথায় কাজ কি বাবা, হাতে পাঁজি মঙ্গলবার। আজই তো মঙ্গলবার, হাটবার–চল তোকে হাটটা ঘুরিয়ে নিয়ে আসি। কাপড় কিনেই নে একখানা, তা হলে তো সন্দেহে ঘুচবে!’

আঠার আনার এমন কুচকুচে কালাপাড় ধুতি।

তবু আঠারো আনাও কম নয় তার কাছে–চৌদ্দ আনার ধুতিতেই বেশ চলে যায়।

মুখ ফুটে বললে ও কথাটা, ‘কী দরকার ভাই আমার অত নবাবীতে–এই সাত সিকে জোড়ার কাপড়েই তো আমার দিব্যি চলে যাচ্ছে!’

‘তা যাচ্ছে বটে। তবে কী জানিস, তোর ও মিলের কাপড়ের চেয়ে এ ঢের বেশি দিন যাবে।’

হেম ঠোঁটটা চেপে ভ্রূ কুঁচকে অনেকক্ষণ।

দু পয়সা এক পয়সা করে জমিয়ে তোরঙ্গের তলায় টাকা-দুই সে সরিয়ে রেখেছে। কেন রেখেছে তা অবশ্য অত ভাবে নি–নিজের কোন একটা বিশেষ প্রয়োজনে কাজে লাগাতে পারে–এই ভেবেই জমিয়ে রেখেছে হয়তো। কিন্তু–ঝোঁকের মাথায় হঠাৎ মন স্থির করেই ফেলল হেম–বললে, ‘তোদের কারুর কাছে একটা টাকা হবে? তা হলে না হয় যাই! বাড়িতে আছে, কাল দিতে পারব।’

‘খুব মক্কেল ধরেছ বাবা। আমাদের বলে ট্যাক গড়ের মাঠ– সদাসর্বদাই…। তবে দাঁড়া–একবার হোটেলটা দেখে আসি, যদি রঘুদা থাকে তো দেবে–তুই কাল দিবি তো ঠিক?’

কানাই দোতলায় উঠে গিয়ে হোটেলওয়ালার কাছ থেকে একটা টাকা চেয়ে নিয়ে এল। তিন-চার আনা পয়সা হেমের পকেটে আছে। সুতরাং এবার নিশ্চিন্ত হয়ে দুজনে হাওড়ার পথ ধরল। …

.

বাড়ি ফিরে আবারও মিথ্যে কথা বলতে হ’ল কমলাকে।

কাপড়খানা দেখে সে অবাক হয়ে প্রশ্ন করল, ‘কি রে, কী ব্যাপার। হঠাৎ একেবারে দিশী কাপড় কিনে হাজির করলি যে! আল্টপ্‌কা টাকা এল নাকি কোথাও থেকে?…নাকি তোর মা তোর বের সম্বন্ধ করেছে কোথাও। পাকা দেখায় বসবার কাপড় নিয়ে এলি!’

মুখ টিপে একটু হাসল সে।

হেম লজ্জায় রাঙা হয়ে উঠে জবাব দিল, ‘কী যে বল মাসী–তোমার যেন আজকাল কি হয়েছে!….এটা হয়েছে কি–দ্যাখো না, ঐ আমাদের থিয়েটারের কানাই–ওর কে জানাশোনা তাঁতী ওকে জোর ক’রে এক জোড়া কাপড় গছিয়েছে। তা ওরও তো আমারই মতো অবস্থা-একেবারে দু’খানার দাম কোথায় পাবে–তাই ও আবার আমাকে গাছালে একখানা।’

‘তা তুই-ই বা কোথায় পাবি?’

‘না–’ আরও অপ্রতিভ, আরও বিব্রত হয়ে পড়ে যেন হেম, ‘না–মানে সাত-আট আনা আছে, তুমি যদি আর আট আনা ধার দাও তা হলে ওর দামটা চুকিয়ে দিতে পারি। দামটা কমই–কী বল? সেই-জন্যই আরও। যোগে- যাগে যদি একখানা ভাল কাপড় হয়ে যায় এমনি করে–এই আর কি।’

এর আগে এদের বহু প্রয়োজনে কাঠ হয়ে থেকেছে সে, তোরঙ্গের কাগজের নিচে জমানো পয়সার কথা ঘুণাক্ষরেও জানতে দেয় নি কাউকে। তাই আজও সে কথা বলা চলল না। একটা মিথ্যা ঢাকতে বহু মিথ্যার অবতারণা করতে হ’ল।

প্রয়োজন-মতো কেমন একটার পর একটা মিথ্যা মুখে এসে গেল ভেবে হেমের নিজেরই খুব অবাক লাগল।

॥8॥

এর পর চার-পাঁচটা দিন হেম যেন কতটা ছট্‌ফট ক’রে বেড়াল। খেয়ে বসে কিছুতেই যে তার স্বস্তি নেই, কারুর সঙ্গে কথা কইতেও ইচ্ছা হয় না। বিশেষ ক’রে থিয়েটারে সহকর্মীদের সঙ্গ যেন আরও অসহ্য। ওদের সেই সব অর্থহীন রসিকতা এবং নিরুদুম একঘেয়ে আড্ডা যেন বিষ মনে হতে লাগল। অথচ ওখান ছেড়েও কোথাও থাকতে পারে না সে। বরং ঐ নন্দ-কানাইদের মতোই সেও যখন-তখন থিয়েটার যেতে শুরু করল।

তার এই অস্থিরতা আর ভাবান্তর ক্রমে এতই প্রকট হয়ে উঠল যে কমলার মতো শিথিল স্বভাবের মানুষও তা লক্ষ্য না ক’রে পারল না। সে একদিন সোজাসুজিই প্রশ্ন ক’রে বসল, ‘তোর কি হয়েছে বল্ তো হেম? অমন ক’রে মুখ শুকিয়ে দিনরাত কি ভাবিস?’

কৈ, কী আবার ভাবব!’ বলে উড়িয়ে দেয় বটে, কিন্তু কেন কে জানে–তার কানের ডগাগুলো সুদ্ধ যেন লাল আর আগুন হয়ে ওঠে 1

ধরা পড়ে দক্ষিণাদার কাছেও। তিনি শুধু এক দেখে মুখ টিপে হাসেন আর হাতের বিচিত্র একটা ভঙ্গি করেন। কখনও হয়তো একটি মাত্র শব্দ উচ্চারণ করে–’নিয়তি!’ কিন্তু ঐ হাসিটাই অসহ্য বোধ হয় হেমের। সে আজকাল প্রাণপণে ওঁর সংসর্গ এড়াবার চেষ্টা করে। ….

বিকেলের দিকে কদিন সে কারণে-অকারণে বার বার মনিবের ঘরের সামনে ঘুরে বেড়াল। কিন্তু এর মধ্যে এক দিনও তাঁর আর ওকে স্মরণ করার দরকার হ’ল না। এমন কি একদিন ঘর থেকে বেরোবার মুখে ওর সঙ্গে চোখাচোখিও হ’ল, কিন্তু রমণীবাবু ওকে চিনতে পারলেন বলেও মনে হ’ল না। এমন কি যেন ওর দিকে চেয়েই চোখটা সরিয়ে নিলেন।

অবশেষে রবিবার দিন সে এক কাণ্ড ক’রে বসল। কেন করল তা নিজেও জনে না, আর কেউ জানতে চাইলেও বলতে পারত কিনা সন্দেহ। সে অভিনয়ের মধ্যেই এক সময় স্টেজের ভেতর ঢুকে পড়ল।

কাজটা যে খুব ভাল করে নি। তা হেমও জানে। কর্তাব্যক্তি কারুর সামনে পড়লে ধমক খেতে হবে। ম্যানেজারবাবু জানতে পারলে তো কথাই নেই–লাঞ্ছনার শেষ থাকবে না। হয়তো খোদ বড়কর্তার কানেও উঠবে কথাটা। অথচ দেবার মত একটা জুতসই কৈফিয়তও ওর ছিল না, আগে থাকতে কিছু ভেবে নিতেও পারে নি। হঠাৎ একটা ঝোঁকের মাথাতেই ঢুকে পড়েছিল।

যাই হোক–ভাগ্যটা সেদিক দিয়ে সেদিন ভালই ছিল। তেমন কারুর সামনেই পড়ে নি। উইংসের আশেপাশে পর্দার পেছনে দু-চারজন ক’রে জটলা যে না করছিল তা নয়, কিন্তু তারা কেউ লক্ষ্যও করল না। এক পাশে কতকগুলো অল্পবয়সী মেয়ে বসে গুলতানি ও নিজেদের মধ্যে হাসাহাসি করছিল, তারা কেউ কেউ একটু অবাক হয়ে চেয়ে রইল–এক-আধজন বোধ হয় কিছু মন্তব্যেও করলে। কিন্তু হেম জানে যে ওরা ধর্তব্যের মধ্যে কেউ নয়। ওরা নিতান্তই–দক্ষিণাদার ভাষায় ‘ছুঁড়ীরা’ এবং কেশিয়ার বাবুর ভাষায় ‘সখীরা’। সে ওদের গ্রাহ্য না করেই এগিয়ে গেল।

কিন্তু কোথায় যাবে তাই যে ও জানে না। কেন ঢুকেছে সেটাও তো স্পষ্ট নয় ওর কাছে।

তা ছাড়া দিনের বেলায় স্টেজ একরকম। সবটা খোলা থাকে। রাত্রে, বিশেষত অভিনয়ের সময়, ও বিশেষ কখনও ঢোকে নি এর ভেতর। এ যেন গোলকধাঁধা বলে মনে হয়। একটু পরেই হাঁফিয়ে উঠল, ভয়-ভয়ও করতে লাগল। এবং সেই–কতকটা দিশাহারা অবস্থাতেই সে ওদিক বেরোবার চেষ্টা করতে গিয়ে খোদ দানীবাবুর ঘরের দরজার সামনে এসে পড়ল। আর ঠিক সেই মুহূর্তে তাঁর সামনের আর একট ঘরের দরজা খুলে বেরিয়ে এল নলিনী।

মুহূর্ত ধড়াস ক’রে উঠল ওর বুকের মধ্যেটা। আগেই ওর মধ্যে ঢোকবার জন্যে ঘামতে শুরু করেছিল–এখন যেন একেবারে নেয়ে উঠল এক নিমেষের মধ্যে।

কিন্তু আজ আর নলিনী অপরিচয়ের ভান করল না। সম্ভবত এদিকটা কেউ ছিল না বলেই। মধুর হেসে বরং একটু এগিয়েই এল ওর দিকে : বললে, ‘এই যে হেমবাবু, কৈ গেলেন না তো আমাদের ওদিকে আর এক দিনও। আমি বলে রোজ দুপুরবেলা আপনার আশায় হা-পিত্যেশ ক’রে জেগে বসে থাকি!’

অভিমান-আবদারে-সোহাগে-মেশা সে নারীকণ্ঠ সেই মুহূর্তে হেমের কাছে একান্ত মোহনীয় এবং দুনিরোধ্য বলে মনে হ’ল। সে কোন উত্তরই দিতে পারল না। বিহ্বল দৃষ্টিতে ওর মুখের দিকে তাকিয়ে রইল শুধু।

কিন্তু নলিনীর তখন আর অপেক্ষা করলে চলবে না। সে আর একটু কাছে এসে এক হাতে ওর একটা বাহুমূল ধরে ফিস ফিস করে বলল, ‘কবে আসবেন বলুন ঠিক করে। কথা দিন। এবার কিন্তু একটা বলতে হবে–আমি আর কোন কথা শুনব না।’

হেম কোনমতে ঢোক গিলে জড়িয়ে জড়িয়ে বলল, ‘দেখি–কাল কি পরশু–এর ভেতর এক দিন–’

‘না না। ওসব দেখি-টেখি আমি শুনব না। কালই আসুন তা হলে। আসবেন তো? লক্ষ্মীটি–’

এই বলে ওর হাতের যেখানটা ধরা ছিল সেখানটায় একটু চাপ দিয়ে ব্যস্ত ভাবে স্টেজের দিকে চলে গেল সে।

এরপর আর ইতস্তত করবার কোন কারণ রইল না। যে দ্বিধা সংকোচ এবং শোভনতা-বোধ পথ রোধ ক’রে ছিল এ ক’দিন, সে সবই কালকের সেই অপূর্ব কণ্ঠস্বরের মিনতিতে সরে গেছে। এতটা আন্তরিকতা যেখানে, সেখানে আর না যাবার কোন প্রশ্নই থাকতে পারে না। এখন আর অন্তত তাকে লোভী বা ‘হ্যাংলা’ মনে করার কোন করণ নেই।

মন স্থির করার সঙ্গে সঙ্গেই আগের সেই অস্থিরতা ও অন্যমনস্কতা অনেকটাই কমে গেল। বাড়ল একটু অধীরতা। সে রাত্রিটা ভাল ক’রে ঘুম হ’ল না–ওধারেও ভোর না হতে ঘুম ভেঙে গেল। সে সেই সাত-সকালেই উঠে আগে গবিন্দর চটিটায় কালি মাখিয়ে চকচকে করলে। ওর নিজের জুতোটার প্রায় শতচ্ছিন্ন অবস্থা, কয়েকটা তালি তো পড়েইছে, আরও গোটাকতক পড়া দরকার। তার চেয়ে গবিন্দর চটিটাই ভাল। একটু বড় হয় ওর পায়ে –কিন্তু সেটা তত চট ক’রে ধরা পড়বে না। ছুটির দিন না হলে গোবিন্দর চটির দরকার হয় না। ঘুম থেকে উঠে চা খেয়ে স্নান করতে করতেই তার সাড়ে আটটা বেজে যায়–নটায় বেরোতে হয়। চটি পায়ে দিয়ে আর কোথায় যাবে।

শার্টটা ফরসাই ছিল, মাত্র শনিবারই সাবান দিয়েছে–তবু সেটায় আর একবার সাবান বুলিয়ে নিলে। কমলা ওর ধরন-ধারণ দেখে সন্দিগ্ধ হয়ে উঠল, বার বার প্রশ্ন করতে লাগল, ব্যাপার কি বল্ তো? কোথায় যাবি আজ যে সকাল থেকে এত সাজগোজের ঘটা?’

উত্তর প্রস্তুতই ছিল, এক কথায় জবাব দিয়ে দিলে, ‘আজ এক জায়গায় যেতে হবে–একটা আপিসে চাকরির খোঁজ আছে!

কমলার পক্ষে এই উত্তরই যথেষ্ট। কিন্তু গোবিন্দ একটু বিপদে ফেললে, ঘরের মধ্যে থেকেই হেঁকে হেঁকে প্রশ্ন করতে লাগল, ‘কী আপিস রে? কাদের ফার্ম? কী চাকরি?’

অতিকষ্টে-তাড়াতাড়ি অন্য কী একটা প্রসঙ্গ এনে কথাটা চাপা দিলে হেম….

সব চেয়ে কষ্টকর হচ্ছে খাওয়ার পর দুটো অবধি অপেক্ষা করাটা। এগারোটার মধ্যেই ওদের বাড়ির ও-পাট চুকে যায়। তারপর এতখানি সময় কী করে? ঘুমোতে সাহস হ’ল না–যদি বেশি ঘুমিয়ে পড়ে? তা ছাড়া দুপুরে ঘুমিয়ে ওঠার পর অনেকক্ষণ পর্যন্ত মুখচোখ্ ফুলে থাকে, বিশ্রী দেখায়। …

কোনমতে বেলা একটা পর্যন্ত ছট্‌ফট ক’রে–একটা বাজবার সঙ্গে সঙ্গেই বেরিয়ে পড়ল সে। নতুন কেনা ধোয়া দেশী ধুতিটা বার করল আজ! তার সঙ্গে অবশ্য সাবান কাঁচা শার্টটা ঠিক মানাল না–মনটা খুঁত খুঁত করতে লাগল একটু–কিন্তু সে আর উপায় কি? তবু অন্য দিন বিছানার নিচে চাপা দিয়ে রেখে ইস্ত্রির কাজ সারে–আজ নিজে ঘাড়ে করে নিয়ে গিয়ে সেই হাবসীবাগানে ওদের ধোপানীর কাছ থেকে ইস্ত্রি করিয়ে এনেছে।

সবে একটা; এখনই কিছু যাওয়া যায় না। হাঁটতে হাঁটতে এসে হেদোতে বসল খানিকটা। কিন্তু সেখানেও বসে থাকতে পারল না বেশিক্ষণ। ওখান থেকে উঠে, থিয়েটারের সামনেটা এড়াতে রামবাগানের ভেতর দিয়ে, ঘুরতে ঘুরতে এসে আবার কোম্পানির বাগান। তও–একটা দোকানের ঘড়িতে দেখল দেড়টার বেশি হয় নি তখনও। কোনমতে আরও দশটা মিনিট সেখানেই কাটিয়ে এবার সোজা কম্বুলেটোলার পথ ধরল। আস্তে আস্তে গেলে ঠিক দুটোতেই পৌঁছাতে পারত। কিন্তু এই চড়া রোদে হেঁটে গেলে ঘামে ভিজে জামাকাপড়ের যে অবস্থা হবে তা অনুমান ক’রে আজ ট্রামেই চড়ে বসল। তিনটে পয়সা খরচ হবে–তা হোক। বড্ডই রোদ আজ।

॥৫॥

কড়া নাড়বার প্রায় সঙ্গে সঙ্গে আজও নলিনী নিজেই এসে দোর খুলে দিলে। সম্ভবত ওর জন্য চলনটাতেই বসে অপেক্ষা করছিল সে।

‘আসুন আসুন। কী ভাগ্যি আমার!–আপনি যে সত্যিসত্যিই কথাটা মনে ক’রে আসবেন শেষ পর্যন্ত–এ ভরসা আমার ছিল না। আমি ভেবেছিলুম নিশ্চয়ই ভুলে বসে থাকবেন।’

‘না না। তা কেন? এরই মধ্যে–বা?’ এমনি ধরনের কতকগুলো কী এলোমেলো কথা বললে হেম–তা তার নিজের মাথাতেও গেল না। নলিনী অবশ্য আর উত্তরের জন্য বিশেষ অপেক্ষা করল না, ওর একটা হাতে একটু টান, দিয়ে বলল, ‘ও কি, তা বলে দাঁড়িয়ে রইলেন? চলুন, চলুন, ওপরে চলুন।’

হেম অভিভূতের মতোই ওর পিছু পিছু চলল। সিঁড়ি দিয়ে উঠে ওপরের বারান্দায় পড়তে গলাটা একটু নামিয়ে নলিনী বলল, ‘একটু আস্তে আসুন ভাই, মা আবার বেছে বেছে ঠিক আজকের দিনটিই পাড়া বেড়াতে বেরোল না, ঘরে শুয়ে আছে।’

আজ আর ঘরে মাদুর পাতা ছিল না। গৃহকর্ত্রীর শোবার প্রয়োজনই হয় নি সম্ভবত। হেম সামান্য একটু ইতস্তত ক’রে প্রথম দিনকার মতো বিছানার ধার ঘেঁষে মেঝেতে বসতে যাচ্ছিল, নলিনী ‘ও আবার কি হচ্ছে, ভাল হয়ে বসুন’, বলে হাত ধরে জোর ক’রেই নিচের ঢালা বিছানাতে বসিয়ে দিলে। তারপর একটা হাতপাখা নিয়ে নিজে ওর গা ঘেষে মেঝেতে বসে হাওয়া করতে লাগল।

‘ইস, কী ঘেমেছেন আপনি। বড্ড কষ্ট হয়েছে, না? সত্যি, এই ঠেকো রোদ্দুরে মানুষকে ঠিক দুপুরবেলা আসতে বলাই অন্যায়!’

হয়তো এই মৃদু অনুশোচনার সুরের জবাবে প্রবল প্রতিবাদ করাই উচিত ছিল, কিন্তু হেম কিছুই করতে পারল না। তার কণ্ঠ এমন কি তালু সুদ্ধ যেন শুকিয়ে উঠেছিল–নির্বাক হয়ে বসে বসে ঘামতে লাগল। যে ঘাম এড়াতে সে নগদ তিনটে পয়সা খরচা ক’রে ট্রামে এল–সে ঘাম কিছুতেই এড়ানো গেল না। এ বাড়িতে পা দেবার সঙ্গে সঙ্গেই যেন কে বালতি বালতি জল গায়ে ঢেলে দিতে আরম্ভ করেছে। জামা-কাপড় সব যেন গায়ের সঙ্গে লেপটে গেছে। সে অসহায়ভাবে রুমাল নিয়ে বার বার কপালটা মোছবার চেষ্টা করতে লাগল কিন্তু ফল কিছুই হ’ল না।

নলিনী হাওয়া করতে করতেই সেটা লক্ষ্য করেছিল। বললে, ‘জামাটা খুলে ফেলুন না। এ পাখার হাওয়া তো আর ঐ মোটা জামা ভেদ করে গায়ে পৌঁছচ্ছে না। তাতেই অত ঘাম হচ্ছে। জামাটা খুলুন বেশ আরাম করে বসুন।’

জামা খুলবে! সর্বনাশ! হেমের ঘাম আরও বেড়ে গেল। ভেতরের গেঞ্জিটার যা অবস্থা! ভদ্রসমাজে সেটা প্রকাশ করা যায় না কোনমতেই।

কিন্তু নলিনী ততক্ষণে নিজেই ওর জামার বোতাম খুলতে শুরু করেছে। ‘নিন নিন, অত লজ্জা করার মত কিছুই নেই। জামাটা খুলে দিন, আলনায় মেলে রাখছি। ও কি, জামা চেপে ধরছেন কেন? ও, গেঞ্জিটা ময়লা বুঝি? তাতে আর কি হয়েছে? ও আমরা জানি।’

এরপর আর বাধা দেওয়া যায় না। হাতটা ছেড়ে দিতে হয়। নলিনী জামাটা বলতে গেলে নিজেই খুলে নিয়ে গিয়ে আলনায় মেলে দিয়ে আসে। তার পর হঠাৎ নিজের আঁচল দিয়েই ওর মুখটা মুছিয়ে দিয়ে জোর জোরে হাওয়া করতে থাকে।

এর ভেতর বহু কথা হতে পারত। কিন্তু হেমের কণ্ঠ ভেদ করে যেন আজ একটা কথাও বেরোতে চাইছে না। তার বুকের ভেতর যেন ঢেঁকির পাড় পড়ছে, হাত-পায়ে বল নেই। এমন অবস্থা তার কখনও হয় নি এর আগে! এক সময় তার মনে হ’ল যে তার শরীরটাই নিশ্চয় খারাপ হয়ে পড়েছে, এখানে থাকলে হয়তো আরও খারাপ হয়ে পড়বে। আর হয়তো সে যেতেই পারবে না।

সে সহসা–যেন মরীয়া ভাবেই সোজা হয়ে বসল। প্রাণপণ চেষ্টাতে কথাও ফুটল, বললে, ‘আমি যাই আজ–’

‘ওমা! সে কি! এই পাঁচ মিনিটের জন্যে বুঝি এত কাণ্ড ক’রে আনলুম!’

‘না শরীরটা–শরীরটা যেন কেমন করছে।’

‘বুঝেছি। ও অমন হয়।’ মুখ টিপে একটু হাসে নলিনী। সে হাসি যেন কেমনধারা–হেমের ভাল লাগে না। আর সেটা বুঝতে পেরেই সঙ্গে সঙ্গে সামলে নেয় নলিনী। বলে, ‘এই রোদে এতটা এসেছেন তো। …দাঁড়ান, ডাব আমি আনিয়েই রেখেছি। এবার দিতে বলি। তা হলেই অনেকটা সুস্থ হয়ে উঠবেন। বসুন–ততক্ষণ নিজে নিজেই হাওয়া খান।’

সে ত্বরিত লঘুপদে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল এবং আজ গিরিধারী মারফত নয়, মিনিট কয়েক পরে নিজেই পাথরের গ্লাসে বরফ দেওয়া ডাবের জল নিয়ে ঢুকল। তারপর দরজাটা একেবারে ভেজিয়ে দিয়ে কাছে এসে–বলতে গেলে ওর গায়ের ওপর বসে মুখের সামনে সেটা বাড়িয়ে ধরে বললে, ‘নিন, এবার এটা খেয়ে নিন তো। জলখাবার কিন্তু এখন আনলুম না। এখন খেতেও পারবেন না–যাবার সময় বরং খেয়ে যাবেন, কেমন?’

হেম প্রবলবেগে ঘাড় নেড়ে বলতে গেল, ‘না না। রোজ রোজ খাওয়া কি? আর আমি এই তো খেয়ে এলাম। ওসব–’

নলিনী আবারও মুখ টিপে হেসে বললে,’এখন এটা তো খেয়ে নিন। ওসব নৌকতা পরে হবে’খন। ডাবের জলে বাতাস লাগতে নেই। ‘

ঠাণ্ডা ডাবটা খেয়ে সত্যিই কিছু প্রকৃতিস্থ হ’ল হেম। কিন্তু অস্বস্তিটা গেল না! তা ছাড়া সহজভাবে কথা বলতে না পারতেই যেন আরও অস্বস্তি। কি যে হয়েছে আজ, কথা কইতে গেলেই ভেতরে ভেতরে যেন গলা কেঁপে যাচ্ছে, ঠিকমতো কথা যোগাচ্ছেও না।

নলিনী কিন্তু অনর্গল বকে যেতে লাগল। ওর বাড়ির কথা, মায়ের কথা, ভাড়াটেদের কথা, থিয়েটারের কথা। এই বাড়িতে এককালে ও-ও ভাড়াটে ছিল, এই মোটে গত সন বাড়িটা কিনে নিয়েছে। বাবুই টাকা দিয়েছেন। বাবু বলেছেন আরও একটা বাড়ি কিনে দেবেন। ওর ইচ্ছে এবার কাশীতে একটা বাড়ি কেনে, তা হলে মাকে সেখানে রাখতে পারবে; ইত্যাদি-এমনি কত কি!

হেম কিন্তু কিছুতেই প্রকৃতিস্থ হতে পারল না। তার বুকের মধ্যে আজ যেন কী করছে! শরীরটা বড়ই দুর্বল ঠেকছে। নিজের নাড়ীর চাঞ্চল্য যেন সে নিজেই টের পাচ্ছে।

অবশেষে এক সময় সে আবারও উঠতে যায়। কোনমতে প্রাণপণে বলে, ‘আজ তা হলে আমি উঠি!’

‘না, না, এরই মধ্যে উঠবেন কি? বা রে, এই তো এলেন! এখনও এক ঘণ্টাও হয় নি।’

‘না, মানে একটু কাজ আছে কিনা–এই সাড়ে তিনটেতেই–’

কথাগুলো মুখের মধ্যেই যেন কেমন এড়িয়ে যাচ্ছে। তাঁবুও বলে–থেমে থেমে, ঢোক গিলে গিলে।

‘থাক গে কাজ। কাজই বুঝি এত বড়! কাজ নিয়ে এলেন কেন?.. তা তো নয়, আমার সঙ্গে বসে কথা কইতেই ভাল লাগছে না আসলে, এই তো? সেইটেই পষ্ট ক’রে বলুন না!’

‘না না। এ কী বলছেন। আপনি এমন বললেন যা-তা!’

হেম ওঠবার চেষ্টা ত্যাগ ক’রে বসে পড়ে।

নলিনীর পাখাটা নামিয়ে রাখে। তারপর কণ্ঠে আশ্চর্য রকমের অভিমান ঢেলে দিয়ে বলে, ‘তবে কেন আপনি এসে এস্তক উঠি-উঠি করছেন? দু দণ্ড বসলে কি হয়?’

এবং হেম সেই অননুভুক্ত অভিজ্ঞতার বিস্ময় কাটিয়ে ওঠবার আগেই সহসা সে নিবিড়ভাবে ওর গলাটা জড়িয়ে ধরে বুকের ওপর এলিয়ে পড়ে ওর চোখের দিকে কেমন একরকম দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলে, ‘তোমাকে আমি এখন ছেড়ে দেব না। কিছুতেই না। কৈ যাও দিকি কেমন ক’রে যাবে।’

তার সেই দৃষ্টিতে আর সেই কণ্ঠস্বরে কেমন যেন মাথার মধ্যে গোলমাল হয়ে যায় হেমের। সমস্ত চৈতন্য আচ্ছন্ন সম্মোহিত হয়ে পড়ে। তারপর কখন যে এক সময় এই মোহিনী নারীর জাদু তাকে সম্পূর্ণরূপে অভিভূত করে–তা সে বুঝতেও পারে না।

সপ্তদশ পরিচ্ছেদ

॥১॥

তরুর বিয়ে যে আর না দিলেই নয়, সেটা শ্যামাও বোঝে, কিন্তু কী ক’রে যে কি করবে সেইটেই বুঝতে পারে না। পাড়াপড়শী আত্মীয় স্বজন অবশ্য তাঁদের কর্তব্য সম্বন্ধে এতটুকুও অনবহিত নন–তাঁরা প্রথম প্রথম শুধু কথাটা স্মরণ করিয়ে দিয়ে কিংবা অনুযোগ ক’রে ক্ষান্ত থাকতেন, এখন গঞ্জনা ও ধিক্কার দেন। তার বেশি তাঁদের কাছ থেকে কীই বা আশা করা যায়? শ্যামা তা ক’রেও না–শুধু যখন নিজের বিপুল দুশ্চিন্তার মধ্যে কেউ এসে পড়ে চিপ্‌টনে কেটে কেটে কথা বলেন–তখন আর চুপ করে থাকতে পারে না, সেও বেশ চাট্টি কথা শুনিয়ে দেয়। বলে, ‘বলি পাত্তর কি আমার বাড়িতে জাওয়ানো আছে তবু আমি মেয়ের বে দিচ্ছি না! নাকি তোর পাঁচ-সাতটা পাত্তর এনে কথা বলছ–আমি কানে তুলো দিয়ে বসে আছি। না ন’শো পঞ্চাশ টাকাই কেউ দিয়ে রেখেছে। আমি মেয়েছেলে একটা–বলতে গেলে আবীরে-পাত্তরটাই বা খুঁজে দেয় কে আমার হয়ে–আর কোমার বেঁধে দাঁড়ায়ই বা কে? টাকাও তো চাই এতটি–শুধু হাত তো আর মুখে উঠবে না? তোমাদের আর কি বল না–বলেই খালাস। যাকে এ বাজারে মেয়ের বে দিতে হয় সে-ই জানে। বলে কত তালেবর তালেবর লোকই হিমশিম খেয়ে যাচ্ছে–তবু তো তারা পুরুষ, তাদের কোমারে জোর আছে। …আর আমি কি? সোয়ামী থেকেও নেই–ছেলে সেও এক রকম বলতে গেলে খরচের খাতায় লিখে রাখা। রোজগার করে কি করে না ভগবান জানেন–আমি তো তার কিছু চোখে দেখতে পাই না। দৈবে- সৈবে পাঁচ-সাতটা টাকা ভিক্ষের মতো ফেলে দেয় এই পর্যন্ত। বলে আছে গরু না বয় হাল–তার দুঃখ সর্বকাল। তোমরা তো বলেই খালাস–আমি কি করব কেউ বলে দিতে পার?’

তবু–বাইরে যতই মুখসাপোট করুক, এত কাল যে বিশেষ কিছু চেষ্টা করতে পারে নি বা করে নি–তা শ্যামাও জানে। করে নি তার প্রধান কারণ অর্থাভাব। অনেকগুলো টাকা লাগবে। সংসার চালিয়ে বাড়ির দেনা শোধ করতেই তার প্রাণান্ত হয়ে যাচ্ছে। হেম যা দেয় তাতে তাও চালটাও পুরো কেনা হয় না। ভরসার মধ্যে তো ঐ কটা গাছের নারকোল আর সুপুরি। পেঁপেও দু-চারটে পাওয়া যায় বটে–তবে সব সময় তো বেচা যায় না–কারণ লোকাভাব। হেম বাড়ি আসে বহুদিন অন্তর। নারকোল সুপুরি জমিয়ে রাখা যায় কিন্তু কলার কাঁদি বা পেঁপে পাকলে রাখা যায় না। তারা শ্যামার সময় হিসেব ক’রেও পাকে না। এখানে বাজার আছে, কিন্তু ভদ্রঘরের মেয়েছেলে বাজরে গিয়ে বসে কলা পেঁপে বেচতে পারে না। কান্তিও নেই যে তাকে পাঠাবে। অনেক সময় ঘরেই খেতে হয়–কিন্তু এগুলো বেচে কত পয়সা আসতে পারত সেকথা ভেবে পাকা কালী-বৌ কলার বা বড় পেঁপের অমৃত- স্বাদও বিষ লাগে তখন।

দেনা অবশ্য বাইরের কিছু আর নেই–যা আছে জামাইয়ের কাছে, তাতে সুদ লাগছে না এটাও ঠিক–তবু তা দেনাই। তাছাড়া সেটা শোধ না হলে আর চাওয়াও যাবে না তার কাছে, এটাও বড় কথা। সুতরাং পাত্র দেখেই বা লাভ কি।

ঐন্দ্রিলাটা যদি ঘাড়ে না চাপত তো এত ভাবনা ছিল না। খরচ বেড়েছে–কিন্তু আয় বাড়ে নি। কুটি ভেঙে দুটি করবে না মেয়ে। কত মেয়ে আজকাল ঠোঙা গড়ে বেশ পয়সা রোজগার করছে–সে কথা ওর কাছে তোলবারই জো নেই! এমন কি, নারকেল পাতাগুলো গাদা হয়ে পড়ে আছে–পচে মাটি হয়ে যাচ্ছে বলে একবার বলতে গিয়েছিল–’পাতা-কটা চেঁচে রাখবি মা?’ তাতে সাফ জবাব দিয়েছিল–’ওসব উঞ্ছ কাজ আমার দ্বারা হবে না। !’ আবার তেজ কত–বলে, ‘গতর খাঁটিয়েই যদি খাব তো তোমার কাছে বিনি মাইনেয় খাটব কেন মা, অপর জায়গায় কাজ করলে পেট-ভাতা ছাড়াও মাইনে মিলবে।’ একবার শ্যামার মনে হয়েছিল বলে–ঠোঁটের কাছে জবাবটা এসেও ছিল–’তাই যা না, কোথায় ঐ বাচ্ছা মেয়ে সুদ্ধ তোকে কাজ দেয় আর দুটো পেট ভরিয়ে আবার বাড়তি মাইনে দেয় দেখি!’ কিন্তু সাহস হয় না বলতে, যা তেজ মেয়ের, হয়তো সত্যিই চলে যাবে। যাবে আর কোথায়–দিনকতক পরেই ফিরে আসতে হবে তা জানে শ্যামা–তবে রূপের খাপ্পা মেয়ে কোথায় গিয়ে পড়ে কী কেলেঙ্কারি ক’রে আসবে–তখন ভুগতে তো হবে শ্যামাকেই। ও মেয়ে একদিনও চোখের আড়াল করে নিশ্চিন্ত থাকা যায় না যে!

আয়ের দিক তো দেখেই না–ব্যয় সম্বন্ধেও সচেতন নয়। শ্বশুর-বাড়ি থেকে বড়মানুষী মেজাজ নিয়ে এসেছে। রান্নার দিকটা অনায়াসে দেখতে পারে–আর তাতে খুব আপত্তিও নেই হয়তো–কিন্তু হলে কি হবে–গরীবের সংসারে হিসেব একেবারেই মাথাতে ঢোকে না। একদিন রাঁধতে বললে এক সপ্তাহের তেল কাবার ক’রে বসে থাকে। কাজেই–পাতা কুড়িয়ে, বাগানের কাজ ক’রে এগারোটা-বারোটায় এসে আবার রাঁধতে বসতে হয় শ্যামাকে। অত বড় মেয়ে শুধু নিজের মেয়েকে আদর ক’রে সাজিয়ে নাচিয়ে ফুঁ দিয়ে ঘুরে বেড়ায়। আর কাজ না থাকলেই যা হয়–খুনসুটি ক’রে বেড়ায় সবাইয়ের সঙ্গে। মুখ তো নয়–ক্ষুরের ধার একেবারে। সব চেয়ে আক্রোশ যেন তার তরুটার ওপরই। ওকে হাতে পেলে দুখানা ক’রে কাটে যেন। দিনরাত ঝগড়া আর ঝগড়া–কাক-চিল বসতে পারে না। অথচ এই মেয়েটাই–রূপে না হোক গুণে গর্ভের সেরা মেয়ে শ্যামার। মুখ বুজে গাধার খাটুনি খাটে–বাসনমাজা, জলতোলা, ঘরের পাট, ক্ষারকাঁচা সবই এখন তরুর ঘাড়ে। শুধু রাঁধতে দেয় না শ্যামা ইচ্ছে ক’রেই–আইবুড়ো মেয়ের বিয়ে দিতে হবে, কাঠের বা পাতার জ্বালে রান্না, হাতের লোম পুড়ে যায়, আঁচ লেগে লেগে কর্কশ হয়ে ওঠে হাতের চামড়া। একেই তো রংটা ওর হয়েছে মহাশ্বেতার মতই মাজামাজা–মা বা ঐন্দ্রিলা তো নয়ই–এমন কি হেম বা কান্তির রঙও পায় নি। গড়নপেটনও খুব যে একটা সাকারা তাও নয়। সুতরাং যেটুকু বাঁচানো যায় বাঁচিয়ে চলে শ্যামা। তবু রান্নার সময় এটা ওটা যোগাড় তো তরুই দেয়। ঐন্দ্রিলাকে ডাকতে সাহস হয় না শ্যামার–কাজ যা করবে বাক্যি শুনতে হবে তা ষোল গুণ। তার চেয়ে দূরে থাকে সেই ভাল।

.

তবু একসময় সক্রিয় হয়ে উঠতেই হয়। এক ভরসা অভয়পদ–তাকেও বলে মধ্যে মধ্যে। পাড়া-ঘরেও দু-চারজনকে বলতে হয়। চট্টখণ্ডীরা মল্লিকরা চৌধুরীরা অনেক ঘরই ব্রাহ্মণ আছে, তাদের ঘরে যে ছেলে নেই তাও নয়, কিন্তু তারা কথাটা শুনেও কান দেয় না। কারণ জানে এখানে একেবারে শুধু- হাত মুখে তুলতে হবে, মেয়েও এমন কিছু আহা-মরি নয়। শ্যামা কলকাতাতে চিঠি লেখে গোবিন্দর কাছে। হেমকে বলে যে কিছু হবে–এমন মনে নেয় না, ও আজকাল সর্বদাই কেমন যেন অন্যমনস্ক হয়ে থাকে, নেশাখোরের মতো ভাবভঙ্গি হয়েছে ওর–যে-কোন কথাই শ্যামা বলুক না কেন, মনে হয় যেন ডান কান দিয়ে ঢুকে বাঁ কান দিয়ে বেরিয়ে যায়। তাই ওর ওপর ভরসা না ক’রে এক পয়সা খরচ করে একটা পোস্ট কার্ডই ফেলেছে শ্যামা। কিন্তু গোবিন্দ তার উত্তরও দেয় নি–সেখানে যে কিছু সুবিধে হবে এমন ভরসা পায় না।

এই যখন অবস্থা–হঠাৎ একদিন মনে পড়ে গেল মঙ্গলার কথাটা। বলতে গেলে দুটো মেয়ের বিয়েই মঙ্গলা দিয়ে দিয়েছেন। তাঁর কাছেই যাওয়াটা উচিত ছিল। এখানে চলে আসার পর,–প্রথম প্রথম মঙ্গলা আসতেন মধ্যে মধ্যে, কিন্তু এখন আর আসতে পারেন না। অক্ষয়বাবু শরীর খারাপ বলে চাকরি ছেড়ে দিয়ে বসে আছেন–ভরসার মধ্যে বড় ছেলের রোজগার–সে এমন কিছু নয়। পিঁটকীর ছেলেরা কেউ কিছু করে না–তাই নিয়ে নিত্য অশান্তি। ভাইয়ের গঞ্জনা সইতে না পেরে মাঝে মাঝে শ্বশুরবাড়ি চলে যায় পিঁটকী কিন্তু সেখানেও টিকতে পারে না। এতকাল তাদের অগ্রাহ্য

এতকাল তাদের অগ্রাহ্য শুধু নয়, অবজ্ঞা ক’রে এসেছে–এখন তারা শোধ তুলতে ছাড়বে কেন? কাঁদতে কাঁদতে যায়, আবার কাঁদতে কাঁদতে আসে। ভায়েরা আরও পেয়ে বসে, বলে, ‘সধবা মেয়েকে চিরকাল বিধবা মেয়ের মতো পুষে এসেছেন বাবা–সে তাঁর পয়সা তিনি যা খুশি করেছেন–এখন আর কেন? ছেলেমেয়ে বড় হয়েছে–এত পুষতে আমরা পারব না। যেখানকার জিনিস সেখানে চলে যাক।

মঙ্গলা হয়তো ক্ষীণকণ্ঠে বলতে যান, ‘তোরা কি পুষছিস? এখনও তো সে-ই পুষছে। কত রোজগার করিস তোরা দু’শ পাঁচশ টাকা শুনি–

তারা আরও জোরে জবাব দেয়, ‘সেই জন্যেই তো আরও তাড়ানো দরকার। বাবার তো রোজগার নেই, কলসীর জল ক্রমাগত গড়াতে গড়াতে কত দিন থাকবে? আমাদের চলবে কিসে? আমাদের হক্কের ধনে ওদের ভাগ বসাতে দেব কেন?

এ ঝগড়ার শেষ হয় না। মেয়ের জন্যেই মঙ্গলাকে আরও বেশি করে খাটতে হয়–গতরে খেটে যতটা খরচা কমাতে পারেন। তাঁর ওপর বিষম শুচিবায়ু বেড়েছে তাঁর। এক কাজ দশবার করেন। পঞ্চাশবার পুকুর-ঘর করতে হয়। তাতেই আরও সময় পান না।

সুতরাং তাঁর উপর ভরসা ক’রে থাকলে চলবে না। শ্যামা নিজেই এক দিন কোলের ছেলেটার হাত ধরে হাঁটা দেয়। বুড়ো বয়সে এই এক পাপ–তিন বছরের ছেলে কোলে। ফল-টানেই শুধু বাড়ি আসে যেন। নইলে আর খবরটা পর্যন্ত রাখে না। তার ছেলেমেয়ে–অথচ যত বোঝা বইতে হয় ওকেই। …যেতে যেতে স্বামীর কথাই ভাবে শ্যামা। মনে মনে হিসেব ক’রে দেখে এবার অনেক দিন বাড়ি আসেনি। কে জানে কী হ’ল। এত দিন তো কখনও দেরি করে না। কে জানে কোথাও রোগে পড়ে আছে কিনা। কিংবা হয়তো বা–ভাবতেই শিউরে ওঠে শ্যামা। নিজের লোহা আর শাঁখার দিকে চায়। না, না অমন বেঘোরে মরবে না কখনও। এত পাপ শ্যামা কিছু করেনি–। ভাবতে ভাবতেই হাঁটে সে। কেমন যেন একটু মন-কেমনই করে নরেনের জন্যে।

॥২॥

মঙ্গলাদের বাড়ির কাছাকাছি আসতেই বুঝতে পারল সেখানে একটা ধুন্ধুমার ব্যাপার চলছে। চেঁচামেচির অন্ত নেই। একসঙ্গে সবাই যেন চিৎকার করছে। কী একটা ব্যাপার নিয়ে সবাই কটু-কাটব্য করছে কোন-একজনকে। কিন্তু যে কোন উপলক্ষেই হোক না কেন–সব চেঁচামেচিতেই যার গলা সর্বাগ্রে শোনা যায় আজ তার গলা শোনা যাচ্ছে না কেন? তবে কি মঙ্গলা বাড়ি নেই? একটু উদ্বিগ্ন হয়েই বাড়িতে ঢুকল শ্যামা। কিন্তু উঠোনে পা দিতেই কারণটা বোঝা গেল–এক্ষেত্রে আসামি খোদ মঙ্গলাই। তাঁকেই উপলক্ষ ক’রে চারিদিক থেকে এত তিরস্কার এবং লাঞ্ছনা বর্ষিত হচ্ছে।

কারণটাও জানতে বেশি দেরি হল না। শ্যামাকে দেখেই আর এক দফা সকলে চেঁচিয়ে উঠল। ওকেই মধ্যস্থ মানলে সবাই–’বামুনদিই বলুক, এ মানুষকে নিয়ে কি সংসার করা চলে। একে খাঁচায় পুরে রাখা ছাড়া আর কী উপায়!’

চিৎকারটা একটু থিতিয়ে আসতে ব্যাপরটা বোঝা গেল। আগের দিন অক্ষয়বাবু কলকাতা থেকে সালু কিনে এনে নতুন লেপ তৈরি করিয়েছেন আসন্ন শীতের জন্য। যেহেতু মুসলমান ধুনুরী লেপ সেলাই করেছে এবং বাইরের বাগানে ফেলে তৈরি হয়েছে–সেখানে কুকুর-বেড়ালের বিষ্ঠা থেকে শুরু ক’রে মাছের কাঁটা এবং পাঁঠার হাড় কী নেই–সেই হেতু গতকাল বা আজ সকালে কাউকে কিছু না বলে দুপুরবেলা চুপিচুপি সকলে শুয়ে পড়লে সেটাকে নিয়ে গিয়ে পুকুরে ফেলেছেন, পরিতৃপ্তি করে কেচেওছেন–কিন্তু তারপর আর টেনে তুলতে পারেন নি। বেগতিক দেখে এসে পিঁটকীর শরণাপন্ন হয়েছেন কিন্তু সেও মোেয়র এ কাজটা সমর্থন করতে পারে নি। তার ফলে এই জানাজানি ও চেঁচামেচি।

শ্যামারও কষ্ট কম হ’ল না খবরটা শুনে। পয়সার অভাবে কত কাল তারা একটা বাঁদিপোতার লেপও গায়ে দিতে পারে নি। ছেঁড়া কাপড়ের কাঁথা গায়ে দিয়ে শীত কাটাচ্ছে। সে কাঁথাও স্থানাভাবে গরমের দিন বিছানা পেতে রাখতে হয়–তার ফলে শুধু যে কতকগুলো ছারপোকার বাসা হয় তাই নয়–আট মাসের চাপে আরও ভারি হয়ে ওঠে এবং চিপ্‌টান খেয়ে যায়। অমন সালুর লেপখানা ছুঁচিবাইতে নষ্ট ক’রে দিলে। কত খরচ পড়েছিল কে জানে!

যাই হোক শ্যামা গিয়ে পড়ার জন্যই সে-যাত্রা মঙ্গলা অল্পে অব্যাহতি পেয়ে গেলেন। সম্ভবত নিজে বাড়ি ক’রে চলে যাওয়ার জন্যই–এখন এ বাড়িতে শ্যামার কিছু আদর হয়েছে, পিঁটকী মেয়েকে এক ঘটি পা ধোবার জল আনতে বলে তাড়াতাড়ি ওকে হাত ধরে টেনে নিয়ে গিয়ে দাওয়ায় বসালে, একটা পাখাও এনে দিলে।

মঙ্গলাও এতক্ষণে কিছুটা সহজ হয়েছেন–অবশিষ্ট অল্প কয়েকটি পানদোক্তা-খাওয়া দাঁত মেলে হেসে বললেন, ‘তারপর বানি, কি মনে ক’রে?’

‘কী মনে ক’রে আবার! কেন শুধু অমনি দেখতে আসতে নেই? মা না হয় খোঁজ নেয় না–তাই বলে মেয়ে কি ভুলে থাকতে পারে?’

শ্যামা একটু হাসবারও চেষ্টা করে।

‘ওমা–এখনও তোর এমনধারা মিষ্টি মিষ্টি বাক্যি আসে। তাই তো বলি পিঁটকীকে যে মেয়েলোকে লেখাপড়া শেখাতিস তো তবু কাজ হ’ত। আজকাল ইস্কুলে-পড়া মেয়েদেরই কদর। দেখিস না, বামুন-মেয়ে কীই বা দু পাতা লেখাপড়া শিখেছে–তারই জোরে কেমন গুছিয়ে গুছিয়ে কথা বলে। আমরা যে ষাঁড়ের নাদ হয়ে রইলুম। থাকত পেটে একটু কালির আঁচড়, তা হলে দেখতুম কে মুখের সামনে দাঁড়ায়। তা হলে কি আর ভাতারেরই কথা সহ্য করতুম, না ছেলেদেরই হাতে এমন খোয়ার হতে পারত? কী বলব অদেষ্ট মন্দ–তাই অত বড় ঘরে জন্মে এই নাথি-ঝাটা খাচ্ছি।’

বলতে বলতে চোখে জল এসে যায় মঙ্গলার।

শ্যামা বেগতিক দেখে পিঁটকীকে ধরেই কুশল প্রশ্ন করে। পিঁটকীও আল্‌তো জবাব দেয়। বেশ একটু বাঁকা বাঁকা তার বলবার ভঙ্গিমা। একটু পরে তার কথাও অস্বস্তিকর পথ ধরবে বুঝে শ্যামা সোজাসুজি নিজের কথাই পাড়ে। ওদের পারিবারিক অশান্তির মধ্যে জড়িয়ে পড়ার ইচ্ছা ওর আদৌ নেই। তা ছাড়া সত্যি কথা বলতে কি, পিঁকী আর তার ছেলেমেয়েদের দুর্গতিতে সে মনে মনে খুশিই।

সে মঙ্গলার দিকে ফিরে বললে, ‘মা, যা হোক ক’রে তো দুটো মেয়েকে পার করলেন–এবার এটার একটা গতি করুন–নইলে জাতধম্ম থাকে না আর।’

‘গতি–! ও তরুর বে’র কথা বলছিস? ওমা, এখনও কিছু করিস নি বুঝি! মেয়ে যে ধাড়ী হয়ে গেল। সময় বে হলে তিনটে-চারটে নেণ্ডি-গেণ্ডি হয়ে যেত। আমি ভাবি এই বুঝি নেমন্তন্ন আসবে, তা মূলেই হাবাত!’

‘আমি কি করব মা! জানেনই তো। ওর তো ঐ গতি। ভরসা এক ছেলে–তা তারও চাকরি-বাকরির কিছু হল না–থিয়েটারে পড়ে আছে, কী পায় আর কী পায় না তা তো বুঝি না–আমি তো কোন মাসে পাই সাতটি কোন মাসে পাই আটটি টাকা। যে মাসে খুব পেলুম–সে মাসে দশটি টাকা। তার চেয়ে এখানে থেকে যদি চালকলা বাঁধত তো বেশি রোজগার হ’ত। টাকা কোথায় যে বে’র কথা ভাবব? ঐ তো কটা গাছের ফলফুলুরি ভরসা। তা থেকে সংসার চালাব, না ধার শোধ করব?’

‘তা তবু তা থেকেই কিছু জমিয়েছিস বল–তাই য়্যাদ্দিন পরে পাত্তরের সন্ধান করতে বেরিয়েছিস। ধন্য মেয়েমানুষ দুই বামনী। তোর ক্ষুর-ধোয়া জল পেলেও আমার বর্তে যেত।’

কেমন এক রকম ধূর্তভাবে শ্যামার মুখের দিকে চেয়ে হা-হা করে হেসে ওঠেন মঙ্গলা। তাঁর সেই পানদোক্তা খাওয়া কালো বিরাট মুখগহ্বর আর পাকা উচ্ছেবীচির মতো কয়েকটা অবশিষ্ট দাঁতের হাসিটা কেমন বীভৎস মনে হয়।

শ্যামা তাড়াতাড়ি বলে,’টাকা জমাব। কী বলছেন মা–এখনও জামাইয়ের দেনাই শোধ করতে পারিনি। তবু আর তো রাখা যায় না–তাই। আমারও ধারই করতে হবে–নইলে ভিক্ষে। তাই বলছিলুম আপনার সন্ধানে যদি কিছু থাকে–’

মঙ্গলা ভ্রূটা কুঁচকে আকাশের দিকে চেয়ে কী ভাবেন খানিকটা, তারপর বলেন,’আড়গোড়ের ঘোষালদের সঙ্গে সম্বন্ধ করবি? মানে ওদের নয়–ওদেরই ভাগনাগুষ্টি। একটা ভাল ছেলে আছে। রেলে কাজ করে, এখনই প্রায় চল্লিশ টাকার মতন মাইনে পায়–’

শ্যামা ওঁর কথা শেষ করতে দেয় না–হাত জোড় ক’রে বলে, ‘রক্ষে করুন মা–ওদের সংস্পর্শে আর আমি যাব না। তার চেয়ে হাত-পা বেঁধে জলে ফেলে দেব সেও ভাল।’

‘দিবি নি? তাই তো আর কোথাও তো কিচ্ছু মনে পড়ছে না। হ্যাঁ–একটা সম্বন্ধ আছে বটে–কে যেন বলছিল সেদিন–নিবড়েতে একটা খুব ভালো পাত্তর আছে। চাকরিতে ঢুকেছে সবে–মা-বাপ কেউ কোথাও নেই, বুড়ী ঠাকুমা আছে, অগাধ বিষয়। অন্তত পাঁচ বিঘের ওপর ভদ্রাসনটাই। তবে একটা কথা–সতীন আছে।’

‘সতীন!’

‘না–না, সতীনের নিয়ে ঘর করতে হবে না।

তাকে ত্যাগ করেছে–দু’ বিঘে জমি তাকে লেখাপড়া করে দিয়ে ঠাকুমা মাগী তার বাবাকে দিয়ে লিখিয়ে নিয়েছে যে আর কোন দিন সে ফিরে আসবে না, আসতে চাইবে না। বিষয়-সম্পত্তিতেও তাঁর কোন কেলেম্ থাকবে না!’

‘কিন্তু তাঁকে ত্যাগ করেছে কেন?’

‘সে অনেক পব্ব। কী সব মনান্তর হয়েছিল তত্ত্বতাবাস নিয়ে বুড়ী বলেছিল বৌ পাঠাব না। পাঠায়ও নি পুরো দুটি বছর। তার পর তার বড় ভেয়ের বে আসতে মেয়ের বাবা এসে হাতে-পায়ে ধরলে, পাঠালে না। এধারে মা আছড়ে পড়ল–তাদের ঐ একটা মেয়ে, সে না এলে বড় ছেলের বিয়ে হবে না। তখন বেগতিক দেখে–আর বাপেরও প্রাণ তো–থানা থেকে পুলিস এনে মেয়েকে নিয়ে গেল সে। তাইতে বুড়ীর বড্ড অপমান হয়েছে, সে আর ও বৌ ঘরে তুলবে না। তা ছাড়া সে মেয়েটাও নাকি ভাল ছিল না। তবে-নিজে যখন দেখিনি, জানি না, তখন বদনাম একটা দেওয়া ঠিক নয়। …এই ব্যাপার, দ্যাখ্ দিবি তো দে!,

‘অমন দজ্জাল দিদিশাশুড়ি–দেওয়া কি ঠিক হবে? যদি আমার সঙ্গেও অমনি করে–না পাঠায়?

‘দ্যাখ্ অত বাছতে গেলে কি তোর চলবে! এমন পাত্তর একবরে হলে শুধু- হাত মুখে উঠত না! এ তোর বেশি পয়সা খরচা হবে না। তাছাড়া বার বার এমন করতে সাহস করবে না। দুর্নাম হয়ে যাবে যে। …আর বুড়ীই বা কদিন–পেরায় চারকুড়ি হতে চলল বয়েস। …না পাঠায় না-ই পাঠাল–তুই-ই বা কত এরে-বেরে মেয়েজামাই আনতে পারবি? এইখান থেকে এইখানে, ছেলেরা গিয়ে দেখে আসবে এখন। আমার তো মনে হয়–একবার এক কাণ্ড হয়ে গেছে, এখন সাবধানে চলবে। … দ্যাখ্ দিস তো কথা তুলি–ওরা একটু ডাগর-ডোগর মেয়েই চাইছিল, হয়তো নগদ কিছু দিতে হবে না। দানসামিগ্‌গিরও চাপ দিয়ে কমিয়ে নেওয়া চলবে।’

চুপ ক’রে থাকে শ্যামা। উত্তর দিতে পারে না। ‘না’ বলতেও ভয় করে–’হ্যাঁ’ বলতেও বাধে।

মঙ্গলা একটু অপক্ষা ক’রে থেকে বলেন, ‘বেশ তো–একটু ভেবেই দ্যাখ্ না। কোমরের জোর থাকে অন্য পাত্তর দ্যাখ্–নইলে এটা মন্দ নয়। …না হয় হেমের সঙ্গেও একটু পরামর্শ কর না।’

‘হেম!’ অকম্মাৎ হি-হি করে হেসে ওঠে পিঁটকী। সে উঠে গিয়েছিল শ্যামাদের জন্যে জলখাবার আনতে। একটা পেতলের সরায় করে মুড়ি, বাতাসা, নারকোল নাড়ু এনে শ্যামার সামনে নামিয়ে রেখে ছেলেটার হাতে একটা নারকোল নাড়ু ধরিয়ে দিতে দিতে হেসে গড়িয়ে পড়ল পিঁটকী।

‘হেম! তাকে খরচের খাতায় লিখে রাখ বামুনদি। বলে আগ ন্যাঙলা যেমনে যায়, পেছন্যাঙলাও তেমন যায়। বাপের বেটা তো! গত মাসে শ্বশুরবাড়ি গিছলুম, শুনে এলুম–তোমার হেম আজকাল কম্বুলেটোলার কোন মেয়েমানুষের কাছে যাচ্ছে–নিত্যি দুপুরবেলা যায় সেখানে। আমার দেওর দেখেছে, দেওরেরও সেই বাড়িতেই বাঁধা রাঁড় আছে–শুনেছিল তার মুখেই–এক দিন হঠাৎ দুপুরে গিয়ে পড়ে নিজের চোখে দেখেছে!’

কাঠ হয় যায় শ্যামা। কতক্ষণ জবাবই দিতে পারে না।

‘না না, এ হতে পারে না পিঁটকী। মেয়েমানুষ রাখতে গেলে টাকার জোর চাই। সে বড়লোকেরা রাখতে পারে। তোমার দ্যাওর তো কোন হৌসের মুছুদী না কি বলেছিলে! সে যা পারে আমার হেম তাই পারবে? কাকে দেখতে কাকে দেখেছে—’

‘না গো–এ পয়সা দিয়ে রাখা নয়। বেশির ভাগ বাজারের মেয়েমানুষেরই–যারা বাঁধা থাকে কোন বাবুর কাছে–একটা-দুটো ক’রে শখের পতি থাকে। বলি তাদেরও তো সাধ-আহ্লাদ আছে-মনের মানুষ দরকার! হেমও তেমনি হয়েছে তার–বুঝলে না? নইলে দুপুরে যাবে কেন–লুকিয়ে-চুরিয়ে?’

এরপর আর মুড়ি বাতাসা গলা দিয়ে নামে না শ্যামার। চুপ ক’রে জন্তুর মতো বসে থাকে। যেন কিছু ভাবতেও পারে না।

‘নে নে–মেয়ের কাণ্ড দ্যাখ্–দিলি বামণীকে ভাবনা ধরিয়ে। তুই ভাবিস নি বামনি–বড় জামাইকে ডেকে বল্–তার পায়ে মাথা খোঁড়–ঠিক একটা সায়েবাড়ির চাকরি জুটিয়ে দেবে। তার পর ছেলেকে ও হচ্ছে পেঁশের চাকরি ছাড়িয়ে নিয়ে আয়। নইলে আগেই নিয়ে আয়। কী হচ্ছে তোর ঐ সাত-আট টাকায়? ঘরে বসে বাগান দেখলে ওর চেয়ে বেশি রোজগার করবে। ঘণ্টা না হয় নাই নাড়লে–যদিও ওতে খুব রোজগার। বাপরে দেখে বোধ হয় ও কাজে ঘেন্না হয়ে গেছে…তাছাড়া–সত্যিই কাকে দেখতে কাকে দেখেছে ওর দেওর তাই বা ঠিক কি! দু-একদিন এখানে কাজকম্মের বাড়িতে দেখছে হয়তো–অমনি তাইতেই কি আর এত চিনে রেখেছে? তুই মিছে এখন থেকে অত ভাবিস নি বামনী, ওঠ–মুখে জল দে। আবার এতটা পথ যাবি!’

মঙ্গলা বেশ গলায় জোর দিয়ে কথাগুলো বলতে শ্যামা সত্যি-সত্যিই যেন খানিকটা বল পায় মনে মনে।

তবু খেতে ইচ্ছে করে না কিছুই। কোনমতে দুটো নাড়ু মুখে পুরে এক ঘটি জল খেয়ে আবার বাড়ির পথ ধরে।

কোলে ছেলেটা আছে–কিন্তু এমন ভার বওয়া আর হাঁটা ওর নতুন নয়। এর চেয়ে ঢের বেশি হেঁটেছে ও। তবু কে জানে কেন–আজ যেন পা দুটো বড় ভারী বোধ হয়।

॥৩॥

ফেরবার পথে সিদ্ধেরশ্বরীতলাতে অনেকক্ষণ ধরে কেঁদে আর মাথা কুটে ফিরছিল শ্যামা। একটা মানতও ক’রে ফেলেছিল বড় গোছের। হেম ভালয় ভালয় বাড়ি ফিরে এসে বসলে–তাঁর সুবুদ্ধি হলে–আর তার কোথাও একটা ভাল পাকা চাকরি হলে–প্রথম মাসের মাইনে থেকেই সোনার বিল্বাপত্র গড়িয়ে বুক চিরে রক্ত দিয়ে পূজো দেবে। প্রার্থনাও অনেকখানি অবশ্য–কিন্তু মানসিকও তাঁর পক্ষে সাধ্যের অতীত প্ৰায়।

কল্পনাতীত রকমেই অনেকখানি।

হয়তো বা ওর মানসিকের জোরেই–হেম ফিরে এল।

অথবা ওকে ফিরতে হ’ল। কিন্তু সেও ঐ মানসিকেরই জোরে হয়তো।

কারণ–হেমের ফেরার মূল কারণটা যেমন তুচ্ছ, তেমনি হাস্যকর।

নলিনীর ভাড়াটেদের মধ্যে ক্ষীরি বলে একটি মেয়ে ছিল। তার ভাল নাম একটা আরও ছিল–আশালতা, কিন্তু নলিনীর মা তাকে ছোটবেলা থেকে ক্ষীরে বলেই জানত–তাই ঐ নামটাই এখানে চালু। ক্ষীরির বাবু পূর্ববঙ্গের লোক, ব্রাহ্মণ। নিমতলার দিকে কাঠের গোলা আছে–অবস্থা মাঝারি। কিন্তু ক্ষীরির রং কালো–গোলগাল, অতি সাধারণ চেহারা–এর চেয়ে ভাল বাবু তার পাওয়া মুশকিল। সুতরাং সে ঐতেই সন্তুষ্ট ছিল। কিন্তু বিপদ হয়েছে এর যে–সেই ভট্টাচার্য বাবুটিও ইদানীং প্রায় আসছে না, ডুব মারছে। সম্ভবত তার প্রাণের পাখা অন্য কোন আকাশে উড়তে চাইছে, এ দাঁড়ে আর থাকতে চাইছে না। হয়তো কিছু দিন পরে একেবারেই শিকল কাটবে। ক্ষীরির এজন্যে দুঃখ আর দুশ্চিন্তার শেষ ছিল না।

কিন্তু দুঃখ-দুশ্চিন্তা ছাড়াও বেদনার অন্য কারণ ছিল।

এ বাড়ির সব মেয়েই ক্ষীরির বাঙাল বাবু উপলক্ষ ক’রে ওকে খেপাত। বরাবরই খেপিয়ে এসেছে। তাতে ওর এত দিন রাগের কারণ থাকলেও আঘাতের কারণ ছিল না। ইদানীং ওর মনে আঘাত লাগতেও শুরু করেছে। ওর কেমন মনে হয়–সত্যিসত্যিই তারা ওকে একটু কৃপার চোখে দেখে–ওর বাবু বাঙাল এবং সাধারণ ব্যবসায়ী বলে। এখন আরও একটু কৃপার চোখে দেখছে। হয়তো ওর এই দুর্গতিতে তারা মনে মনে উল্লসিত–হয়তো নিজেদের মধ্যে আলোচনা ক’রে বেশ একটু কৌতুকই উপভোগ করছে।

এই রকম মনোভাব থাকলে সাধারণ সহানুভূতিকেও লোক বিদ্রূপ বলে মনে করে।

ক্ষীরিও তাই মনে করত।

কার ঘরে বাবু এল কিংবা এল না–সে খবরটা রাত্রে জানা না গেলেও সকালবেলা টের পাওয়া যায়।

সুতরাং—-হ্যাঁলা ক্ষীরি, ভট্‌ট্চায বুঝি কালও আসে নি?’ এ প্রশ্নটা আজকাল প্রায়ই শুনতে হয় ক্ষীরিকে–এবং এটাকে সে রীতিমতো উদ্দেশ্য প্রণোদিত [অপমানের বা ব্যঙ্গের উদ্দেশ্য।  বলে মনে করে। ফলে অতি সাধারণ প্রশ্নও তার কাছে অসাধারণ হয়ে ওঠে। কথাগুলো শোনামাত্র তার সর্বাঙ্গে বিষের জ্বালা ধরে।

তবু মানুষ এক রকম। তার সঙ্গে ইতর প্রাণীও যোগ দেয়,–সহ্যের সীমা অতিক্রম করে বৈকি।

সেদিন ভোরবেলা সবে বেচারী দোর খুলে ঘরের বাইরে এসেছে–(টাকাকড়ির টানাটানিতে ঠিকে ঝিয়ের বিলাসও ত্যাগ করতে হয়েছে ওকে, আর সেই কারণেই ভোরবেলা উঠে অন্য ভাড়াটেদের ঝি আসবার আগে কাজ সেরে নেয়। নইলে তাদের কাছেও অপমান–ভাড়াটেদের কাছে তো বটেই–দোতলার বারান্দায় ঝোলানো খাঁচা থেকে নলিনীর পোষা ময়নাটা পরিষ্কার প্রশ্ন ক’রে বসল, ‘হ্যালো ক্ষীরি, ভট্‌ট্চায বুঝি কালও আসে নি?’

একেই সেদিন নিয়ে পর পর চার দিন অনুপস্থিত ভট্চায–নিয়মিত টাকা দেওয়া তো প্রায় পাঁচ-ছ’মাসই বন্ধ করেছে, এলে জোর-জবরদস্তি ক’রে যা দু- এক টাকা আদায় হয়–তাও চার দিন হয় নি, সকালে হাঁড়ি চড়বে কি ক’রে এই দুশ্চিন্তায় সারারাত ঘুমোতে পারে নি বেচারী, তার ওপর সকালবেলা ঘর থেকে বেরোতেই এই অপমান–মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘা’র মতই বাজল।

দুঃসহ রাগে ক্ষীরির আর দিগ্বিদিক জ্ঞান রইল না। সেদিন ওরই সিঁড়ি এবং উঠোন ধোয়ার পালা বলে–ঘর থেকে বেরিয়েই উঠোন-ধোয়া খ্যাংরাটায় হাত দিয়েছিল সে–সেইটে হাতে ক’রেই ওপরে উঠে গেল এবং দুদ্দাড় মারতে শুরু করলে।

‘তবে রে হারামজাদা পাখি! তোমার এত বড় সাহস। এত আস্পদ্দা। এই! এই! এই!’

বকতে বকতে এবং হাঁপাতে হাঁপাতে পাগলের মত খাঁচাটার গায়েই খ্যাংরা চালাতে লাগল সে।

খাঁচার ওপরেই খ্যাংরাটা পড়েছিল অবশ্য, পাখির গায়ে লাগে নি। তবু তাতে খাঁচাটা দুলছিল বিশ্রী রকম। সেই দুলুনিতে আর ঝাঁটার আষ্ফালনে পাখিটা ভয় পেয়ে ক্যাঁ ক্যাঁ করতে লাগল।

ক্ষীরির চিৎকারে ও পাখিটার আর্তনাদে বাড়িসুদ্ধ সকলেরই গুম ভেঙে গেল–সেই সঙ্গে নলিনীর মা কিরণেরও। দৈবক্রমে সেদিন নলিনী ছিল না, আগের দিন রমণীবাবুর কোন্ এক ব্যারিস্টার বন্ধুর বাগানে বাবুর সঙ্গে মাইফেস্ করতে গিয়েছিল–কথা ছিল সেদিন সকালে ফিরবে। কিন্তু তাতে ক্ষীরি অব্যাহতি পেল না। কিরণ বলতে গেলে সম্প্রতি বাড়িউলির মা হয়েছে–সামান্য এক একতলা ঘরের ভাড়াটে–বিশেষ ক’রে যে ভাড়াটের কাছে প্রায় তিন মাসের ভাড়া বাকি পড়েছে–তার এত ধৃষ্টতা কিরণের সহ্য হ’ল না। সে একেবারে রণরঙ্গিণী মূর্তিতে নেমে এল তেতলা থেকে।

‘বলি তোমার আস্পদ্দা তো কম নয় বাছা। আজ শনিবার সাতসক্কাল বেলো আমার নলুর শখের ময়নাকে তুমি খ্যাংরা মারতে এসেছ? এত সাহস কিসের তোমার? দোতলাতেই বা তেড়ে উঠেছ কিসের জন্য? ভেবেছ কি? নলু বাড়িতে নেই বলে কি সাপের পাঁচ-পা দেখেছ নাকি?

চারিদিকের দোর খুলে যাওয়ার–এবং অন্য ভাড়াটাদের সঙ্গে তাদের বাবুরাও বেরিয়ে আসায়–ঝাঁটার আস্ফালনটা অনেকক্ষণই বন্ধ হয়েছে ক্ষীরির কিন্তু তার আক্রোশটা তখনও যায় নি।

সে হাঁপাতে হাঁপাতে উত্তর দিল, ‘কেন, কেন ও পাখি অমন ক’রে বলবে আমাকে? কেন বলবে তাই শুনি? পাখির এত বড় আস্পদ্দা,ও সুদ্ধ আমাকে অপমান করবে। আমার ঘরে আমার বাবু আসে নি তা বাড়িসুদ্ধ ভালখাগীদের কি? আমার পেছনে না লাগলে কি চলে না তাদের? আবার পাখিকে সুদ্ধ শিখিয়ে দেওয়া!’

কিরণের কর্কশ কণ্ঠে ক্ষীরির গলা ডুবে যায়।

‘আ মর ছুঁড়ী! বলে কিনা পাখিকে সুদ্ধ শিখিয়ে দিয়েছে। লোকের আর খেয়ে-দেয়ে কাজ নেই–ওকে অপমান করবার জন্যে সবাই যুক্তি করেছে। ..একটা আবোলা পাখি–তার ওপর এত আক্রোশ? বলি অত যদি তোর মান ময্যেদাজ্ঞান তো তুই এ বাড়ি ছেড়ে চলে যা না? অত বড় মহামানী রাজা দুর্যোধন, আমাদের এ গরিবের বাড়ি থাকবার দরকার কি!’

‘যাবই তো। চলেই যাব। যাব না তো কি থাকব? অত কিসের। কেন, ঘর কি আর নেই?’

‘তাই যাও না বাছা। আজই চলে যাও। আমি তোমাকে এই এখনই নোটিশ দিয়ে দিলুম। …কে তোমার আছে চোদ্দপুরুষের নাউখোলা–যে বিনা ভাড়ায় থাকতে দেবে–তার কাছে যাও। তবু যদি না তিন-চার মাসের ভাড়া বাকি পড়ত! কিছু বলি নে বলে তাই। বলি, মানুষটার দুঃসময় পড়েছে–থাক না, রয়ে-বসেই নেব না হয়। এ নাইনের হল জানি তো–অমন মাঝে মাঝে ক্ষ্যামাঘেন্না করতে হয়। ভগবানের ইচ্ছেয় নলুর আমার যখন কোন অভাব নেই। …তা দয়া কি করার জো আছে। বলে দয়া ক’রে দেয় নুন, ভাত মারে সাত গুণ। …আর কিছু পেলে না তো আমার নলুর পাখিটাকে খুন করতে এসেছ। …তুমি তো সাংঘাতিক মেয়েমানুষ দেখছি, পেলে কোন্ দিন বা আমাদের গলাতেই ছুরি বসাবে। … এমন সব্বনেশে ভাড়াটেতে আমার দরকার নেই। আজই তুমি আমার বাকি ভাড়া বুঝিয়ে দিয়ে তোমর এস্টেট-পত্তর নিয়ে উঠে যাবে বাছা–এই সাফ বলে দিলুম।’

‘বেশ বেশ। তাই যাব। তাই তো বললেই হ’ত–তার জন্যে সাতগুষ্টি মিলে আমার এত লাঞ্ছনা করবার কী দরকার ছিল?’

এতক্ষণে চোখে জল এসে গেছে ক্ষীরির–গলাটা গেছে ধরে–’তবে তা ও বলে দিচ্ছি যেমন বিনাদোষে আমার পেছনে আদাছোলা খেয়ে লেগেছ–তোমাদেরও ভাল হবে না। তিন দিন ধরে বাড়িউলী হয়ে বসে বড্ড তেজ হয়েছে তোমাদের মা-বেটির! ও তেজ থাকবে না, তেজের মাথা খাবে শিগগিরি–এই বলে দিলুম।’

‘দ্যাখ বাছা, সাত সকালে অমন শাপমন্যি দিও না বলে দিলুম, ভাল হবে না। দুপ্তির শেষ ক’রে ছাড়ব। ঘটি-বাটি নিলেমে তুলব তবে আমার নাম। আমাকে এখনও চেন নি। ভাল চাও তো মুখটি বুজে সহমানে বিদেয় হও।’

কিরণ রুদ্রমূর্তি ধারণ ক’রে সামনের দিকে এগিয়ে আসে দু পা। মনে হয় বুঝিবা মেরেই বসবে।

কিন্তু ক্ষীরি তাতে ভয় পায় না, সমান তেজের সঙ্গে উত্তর দেয়, ‘তুমিও ভাল চাও তো চোখ রাঙিও না ব্রেথা–এই বলে দিলুম। তুমিও আমাকে চেন নি কিরণ মাসী। ভাল আছি তো আছি–কেনা গোলাম, রাগলে আমি কারুর নই। উঠে যদি যেতে হয় তো তোমার মেয়ের সব্বনাশ ক’রে তবে যাব। সোজা গিয়ে উঠব তোমার জামায়ের কাছে–তোমার মেয়ের কীত্তি-কেলেঙ্কারি সব ফাঁস ক’রে তবে ছাড়ব।’

কিরণ এবার যেন ধেই ধেই করে নেচে নেয় এক পাক।

‘বলি অত কি ভয় দেখাচ্ছিস লা! মেয়ের আমার কী কীত্তি কেলেঙ্কারি ফাঁস করবি তাই শুনি! সে কি আর একটা নাগর করছে?’

‘করছেই তো! আর সে কথা এ বাড়ির না জানে কে?’ গলায় জোর দিয়ে জবাব দেয় ক্ষীরি, ‘জিজ্ঞেস কর না, ঐ তো সব ভালমানুষটি সেজে মুখ বাড়াচ্ছে দোরে দোরে–কী বলে ওরা। জানতে কারুরই আর বাকি নেই। …বাবুর মাইনে খাচ্ছেন আর দুপুরবেলা বাবুরই চাকরের সঙ্গে সোহাগ করছেন ঘরে দোর দিয়ে। …বাড়ি ছেড়ে যদি যেতে হয় তো এ হাঁড়ি হাটে না ভেঙে যাব না!’

‘কী–কী বললি? যত বড় মুখ নয় তত বড় কথা? জিবের লাগাম রেখে কথা বলিস হারামজাদী? যার আছুঁয়ে আছিস তার নামেই মিছে বদ্‌নাম দেওয়া?’

কিরণের মুখের চেহারা ভয়াবহ হয়ে ওঠে, কিন্তু বোধ করি অসহ্য ক্রোধেই এর চেয়ে বেশি কিছু বলতে পারে না। অথবা ইতিমধ্যেই একটা কুটিল সংশয় দেখা দেয় ওর মনে–তাইতেই নির্বাক হয়ে যায়।

ক্ষীরি কিন্তু একটুও দমে না, অথবা অত বড় গলাগলিটাও লক্ষ্য করে না। বলে, ‘মিথ্যে বদনাম, তা তো বটেই!…নিজে যদি দুপুরবেলায় পাড়ায় পাড়ায় জুয়ো খেলে না বেড়াতে তাহলে নিজেই দেখতে পেতে চোখে–সত্যি বলছি কি মিথ্যে বলছি। জিজ্ঞেস কর না তোমার পেয়ারের ঐ সব ভাড়াটেদের, ওরা কি বলে। সবাই তো আর চোখের মাথা খেয়ে বসে নেই তোমার মতো!’

কিরণ স্তম্ভিত হয়ে গেল আকস্মাৎ। ঠিক জোঁকের মুখেই নুন পড়ল যেন। ভাড়াটেদের জিজ্ঞাসা করার উপায় ছিল না বটে–কারণ পাছে সাক্ষী দিতে হয় বলে ইতিমধ্যেই–ক্ষীরির কথা শেষ হবার আগেই–যে কটি মাথা বেরিয়েছিল বিভিন্ন ঘর থেকে–সে কটি মাথা আবার ঘরে ঢুকে গেছে, কিন্তু বোধ করি আর সাক্ষী সাবুদের প্রয়োজনও ছিল না। বহুদিনের লোক কিরণ, ক্ষীরির মুখের চোহারায় আর গলার আওয়াজে সে যে সত্য কথা বলছে সে সম্বন্ধে ওর মনে আর সংশয় মাত্র রইল না।

মিনিট কয়েক তেমনি নির্বাক হয়ে দাঁড়িয়ে থেকে থেকে আশ্চর্য কোমল কণ্ঠে ও বলে, ‘কিছু মনে করিস নি মা ক্ষীরি, বুড়ো হেয়ছি–হঠাৎ মাথা গরম হয়ে ওঠে। তুই নিজের ঘরে যা–যা হবার হয়ে গেছে–মনে কিছু রাখিস নি তোরও বোঝার ভুল, ঠাট্টা তোকে কেউ করে না। কে করবে বল্–এ তো আছেই, আজ তোর কাল আমার। যে নাইনের যা। …যা, মাথা ঠাণ্ডা ক’রে বাসি পাট সেরে নিগে যা…আর দ্যাখ্–আমাকে যা বললি, বললি–নলু এলে কিছু বলিস নি, লক্ষ্মী মা আমার।’

।।৪।।

হেম এসব ঘটনার কিছু জানতে পারে নি।

তার পক্ষে তখন কোন কিছু জানতে পারার কথা নয়। চোখের সামনে কোন ইঙ্গিতপূর্ণ ঘটনা ঘটলেও সে ইঙ্গিত সে নিতে পারত না তা থেকে। কানের কাছে মুখ এনে কেউ হুঁশিয়ার করলেও বুঝতে পারত না। চোখ এবং কান দুই-ই তার তখন বন্ধ। সে তখন মধুর মরণে মরছে–পতঙ্গের মতো তেজদীপ্ত মৃত্যুর দিকে উড়ে চলেছে দুই পাখা মেলে।

এক কথায় তাকে নেশায় পেয়ে বসেছে। মধুর, সাংঘাতিক, আশ্চর্য নেশা। সেই নেশায় বুঁদ হয়ে আছে সে। আর নেশা লাগবারই তো কথা ভিখারীর সামেন হঠাৎ রাজপ্রাসাদের দ্বার উন্মুক্ত হয়ে গেছে, দরিদ্রের সামনে অবারিত হয়ে গেছে কুবেরের ভাণ্ডার। যা সে কোন দিন কল্পনা করে নি, স্বপ্ন দেখেনি–এমন কি যা এর পৃথিবীতে আছে এমন কোনো ধারণাও ছিল না–তাই তার জীবনে ঘটেছে। অভূতপূর্ব অভিজ্ঞতা, অনাস্বাদিতপূর্ব সুখ

সে সারা সকাল ছটফট করে, সারা সন্ধ্যা থাকে অন্যমনস্ক।

সকাল থেকে মুহূর্মুহূ ঘড়ি দেখে–কখন দুপুর হবে, বেলা একটা বাজবে, প্রতীক্ষিত লগ্ন আসবে। আর বিকাল সন্ধ্যা এবং রাত্রি–দ্বিপ্রহরের সেই অত্যাশ্চর্য অভিজ্ঞতার স্বপ্ন–রামন্থনে তন্ময় থাকে। প্রতিটি ঘটনা, তুচ্ছাতিতুচ্ছ কথাবার্তা, সামান্যতম রসিকতার বিনিময়গুলিও মনে ক’রে ক’রে আবার সেই রসটা উপভোগ করতে চায়।

সবটাই তার কাছে আশ্চর্য। এ বাড়ি, ঐ শয্যা, ঐ সুশ্রী যুবতী নারী–সবই। ঐ নারী যে তাকে ভালোবাসবে, কামনা করবে, যত্ন করবে, সেবা করবে–তা কে জানত। চোখে দেখে, উপলব্ধি করেও বিশ্বাস হতে চায় না তার। বারবার মনকে প্রশ্ন করে–একি সত্যি, এ সত্যিসত্যিই ঘটছে তার জীবনে–না স্বপ্ন দেখছে।

এ যেন রূপকথার মত। হঠাৎ এক রাজকন্যা আর রাজত্ব পাওয়া।

নলিনী শুধু তাকে ভাল খাওয়ায় না–পয়সাও দেয় মধ্যে মধ্যে।

ভাল দেশী ধুতি দিয়েছে, জামা দিয়েছে,–বিলিতি শাল পর্যন্ত কেনবার টাকা দিয়েছে। সে আরও এক যন্ত্রণা হয়েছে, অজস্র মিথ্যা কথা বলতে হয়–গোবিন্দ আর কমলার কাছে। কোনটা ব্রতের পাওনা, কোনটা বন্ধুর উপহার–এই বলে ঢাকতে হয়। কিন্তু বেশি দিন যে ঢাকতে পারবে বলে মনেও হয় না। ক্রমই সন্দিগ্ধ হয়ে উঠছে ওরা–বিশেষ ক’রে গোবিন্দর নতুন বৌয়ের নজর বড় তাফ, তার সুডৌল ওষ্ঠাধরের হাসিটাও বড় বাঁকা। ওর মিথ্যে কথা যখন সবাই বিশ্বাস করে তখন সে-ই শুধু একটু মুখ টিপে হেসে টোল-খাওয়া গাল ও টেপা চিবুকের একটা বিচিত্র ভঙ্গি ক’রে চলে যায়। তবু তো এ কাপড়জামা পরে কস্মিন্-কালেও বাড়ি যায় না হেম–কারণ সে জানে মা কোন কথাই শুনবে না–এমন কাপুড়ে-বাবুগিরি তার কাছে অমার্জনীয় অপরাধ বলে গণ্য হবে। হয়তো বা এগুলো বেচে টাকা করতে উপদেশ দেবে।

থিয়েটারেও পরে যায় না সে। এমনিই তো জানে দক্ষিণাদার অভিজ্ঞ দৃষ্টিতে কিছু এড়ায় না। যা সত্য তিনি তা অনেক দিনই অনুমান করতে পেরেছেন। তবু এও জানে যে দক্ষিণাদা তার অনিষ্ট যাতে হয় তা করবেন না। কিন্তু বাকি যারা আছে, তারা কোনমতে ঘুণাক্ষরে আন্দাজ করলেও ছেড়ে দেবে না–জীবন দুর্বহ করে তুলবে। এবং–সব চেয়ে যেটা ভয়–মনিবের কানে উঠবে কথাটা।

তাই যতটা সম্ভব সেখানে সে পূর্বের দীন ভাবটা বজায় রেখেছিল।

কিন্তু সে আরও বিপদ। দুপুরবেলা দু-তিন ঘণ্টা কোথায় কাটিয়ে আসে সাজগোজ ক’রে–রাত্রে বেরোবার সময় আবার সাজ পালটায়–এসবের কোন ভাল জবাবাদিহি ইদানীং আর খুঁজে পাচ্ছিল না। চাকরির খোঁজে যেতে গেলে একটু ভাল সাজগোজ ক’রে যাওয়া দরকার–এ কৈফিয়তটা ইদানীং বড়ই মামুলী ও অর্থহীন হয়ে পড়েছিল।

এই যখন অবস্থা–দুদিক নয় তিন-দিক সামলাতে গিয়ে যখন প্রাণান্তকর হয়ে উঠেছে ব্যাপরটা–তখনই এই ঘটনাটা ঘটল।

হেম কিছুই জানে না। সেদনিও বেলা বারোটায় বাড়ি থেকে বেরিয়ে খানিকটা কোম্পানির বাগানের বেঞ্চিতে কাটিয়ে, এদিক ওদিক ঘুরে দেড়টা নাগাদ কম্বুলেটোলায় পৌঁছেছে। এটা ওর যাকে বলে নিতান্তই অকারণ কষ্ট পাওয়া–স্বচ্ছন্দে একটু ঘুম দিয়ে বেলা একটাতেই বেরোতে পারে–কিন্তু বেলা এগারোটা-বারোটা নাগাদ এমনই অধীর হয়ে উঠে সে, যে বাড়ি থেকে না বেরিয়ে পড়তে পারলে যেন যন্ত্রণা বোধ হয়।

আজও সে আসন্ন মিলন-স্বপ্নে বিভোর হয়েই–প্রতিটি পদক্ষেপ উপভোগ করতে করতে এবং পথের দুধারের ঘড়ি দেখতে দেখতে এসেছিল। কী হবে, কী ঘটবে–তা সে জানে। যে কোন দিনের ঘটনা অল্পবিস্তর অন্যদিনের পুনরাবৃত্তি। ছোট্ট ক’রে কড়াটি নাড়লেই গিরিধারী এসে দোর খুলে দেবে। নলিনীর শেখানো আছে তাকে, তার জন্যে মোটা বকশিশ পায় সে–এই সময়টা সে কোথায়ও যায় না, দরজার চলনে বসে অপেক্ষা করে। …বাড়িতে ঢুকে ওপরে উঠতে উঠতে নলিনীর সঙ্গে দেখা হবে। সে হেসে বলবে,’আজ আর একটু সকাল ক’রে এলেও ক্ষেতি ছিল না, মা আজ বারোটা বাজতে না বাজতেই বেরিয়ে গেছে!

তারপর–

তারপর তো স্বর্গ–বাস্তব ও কল্পনায় মেশা সুখস্বর্গ। এক দীর্ঘ সুখস্বপ্ন।

আজও সে যথাসময়ে এসে স্বর্গের দরজায় পৌঁছল। আজও গিরিধারী এসে দোর খুলে দিলে, আজও সিঁড়ির মাঝে দেখা মিলল নলিনীর।

নলিনী ওর কাঁধের ওপর থেকে নতুন কেনা জার্মানীর শালটা তুলে নিয়ে বললে, ‘ইস, এই রোদ্দুরে এখানা কাঁধে ক’রে এসেছে কী বলে। দ্যাক দিকি–অঘ্রান মাস বলেই কি আলোয়ান গায় দিতে হবে-শীত না পড়লেও? দরদর ক’রে ঘামছে যে!’

হেম সে কথার জবাব না দিয়ে ওর একটা হাত ধরেই ঘরে গিয়ে পৌঁছল। জুতোটা নিজেই খুলে ঢুকল বটে, কিন্তু তারপর আর তার কিছু করতে হল না। জামাটা নলিনীই খুলে নিল। তোয়ালে দিয়ে মুখ মুছিয়ে দিলে। হেম সুখে ও আলস্যে ঢালা বিছানার ধারে একটা তাকিয়ে ঠেস দিয়ে এলিয়ে পড়ল।

আর ঠিক সেই মুহূর্তেই রণাঙ্গিণী মূর্তিতে থরে ঢুকল কিরণ।

কিরণ পাড়া বেড়াতে বেরোলে বেলা চারটের আগে ফেরে না–নলিনী তাই নিশ্চিন্ত থাকে। আজকের সকালের ঝগড়াটা তাকে কেউ বলে নি–কিরণের কড়া শাসন ছিল। সুতরাং সতর্ক হবার সময় পায় নি।

‘বলি হ্যাঁ লা ও শতেকক্ষোয়ারী, হায়া পিত্তি বলতে কি তোর কিছু নেই। রাজ্যেশ্বর জামাই আমার…তার জায়গা তারই খেজমতের চাকরটাকে বসিয়েছিস? ছি ছি! কী পিরবিত্তি তোর। যদি একথা তার কানে যায়? বলে পাঁচ দিন চোরের এক দিন সেধের–বাতাসে কথা ভাসে। কখন কানে গিয়ে পৌঁছবে তার ঠিক আছে? শত্তুর তো চারিদিকে। যেখানে রাণীগিরি কচ্ছিস সেইখানেই তো বাঁদীগিরি করতে হবে। আর থ্যাটারের চাকরিই থাকবে? পাট তো যা করিস অপর জায়গা হলে পঁচিশ টাকার বেশি মাইনে দেবে না কেউ। অমন তারা দু’পোেয় জড়ো করতে পারে গণ্ডা গণ্ডা ফ্যা ফ্যা ক’রে বেড়াচ্ছে। না কি বাবুই আবার অমনি পাবি? লেকেটার চোখে লেগেছে তাই। ও বাবু গেলে আর অমন জুটবে না মনে রাখিস। ঐক্ষীরির মতো গোলাদার বাবু খুঁজতে হবে!’

প্রথমটা বিদ্রোহী হয়ে। উঠেছিল নলিনীর মন। বহুবার ঠোঁটের ডগায় এসেছিল কথাটা–’তোমার কি? আমি যা–খুশি তাই করব। আমার বাড়ি, আমি রোজগার করি।’ কিন্তু সাহসে কুলোলো না। মাকে সে চেনে। কেউ না লাগায় মা-ই গিয়ে লাগাবে। লেজে-পা পড়া সাপের মতো হিংস্র হয়ে উঠবে মা–এত বড় রোজগারটা বন্ধ হয়ে যাবার সম্ভাবনাতে ক্ষেপে উঠেছে, তার ওপর অপমান করলে সইবে না। আর বাবুর কানে উঠলে–।

মা যা বলেছে তা যে কতদূর মর্মান্তিক সত্য তা ওর চেয়ে কেউ জানে না। পাংশু বিবিৰ্ণ নত মুখে বসে বসে ঘামতে লাগল নলিনী, প্রতিবাদের একটি কথাও বলতে পারল না।

অবশ্য তার কাছ থেকে কোন প্রতিবাদ আশঙ্কাও করে নি কিরণ, সে তাকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা ক’রেই হেমকে নিয়ে পড়ল এবার।

‘আর বলি বাছা। তুমিই বা কি রকম বেইমান নেমোখারাম হারামজাদা লোক। যার খাচ্ছ পরছ–তারই সব্বনাশ করছ। এ-ও যা, মনিবের ঘরে সিঁদকাটাও তো তাই। এ তো ঘুমন্ত বাপের বুকে ছুরি মারা। আর সাহসই বা কী তোমার? কুকুর হয়ে–ঠাকুরের নৈবিদ্যিতে মুখ দিতে চাও! বামন হয়ে চাঁদে হাত। পথের ভিখিরীর রাজরাণীতে সাধ। কী বলব তুমি শুনলুম বামুনের ছেলে তাই–নইলে ঐ স্যেখানার ঝ্যাঁটা এসে গুনে গুনে সাতবার মারতুম তোমার মুখে।’

এই পর্যন্ত বলে–ঝ্যাটা মারবার মতো ক’রেই হাতের ভঙ্গি ক’রে বোধ করি বা একটু দম নেবার জন্যই থামল কিরণ।

হেম অভিভূত, বিহ্বল। ভয়ে তার কপালে ঘাম দেখা দিয়েছে–হাত পায়ে কোন জোর নেই–ঠক ঠক করে কাঁপছে। কিছু বলা তো দুরে থাক, ব্যাপারটাই যেন ভাল ক’রে অধিগম্য হ’ল না তার–সে শুধু কিরণের দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইল।

তার সেই বিহ্বল দৃষ্টির দিকে তাকিয়ে যেন আরও ক্ষেপে উঠল কিরণ, ‘নাও নাও ওঠো–আর অমন ন্যাকাবোকা সেজে চেয়ে থাকতে হবে না। ঢের হয়েছে। বামুন বলেই পার পেলে–কিন্তু বেশি যদি নেই–আঁকড়েপনা কর তো রেয়াত করব না এই বলে দিলুম। গায়ে হাত দেবার আগে সরে পড়–যদি ভাল চাও তো। আর কখনও এ-মুখো হবার চেষ্টা করো না। কাল থেকে আমি দুপুরবেলা দোরে তালা দিয়ে রাখব। আর ভেবো না বাইরে কিছু ক’রেও পার পাবে। থ্যাটারেও আমার চোখ থাকবে–মনে করো না যে সেখানে কেউ পাহারা দেবার নেই? যদি শুনি যে আবার এদিকে বাড়িয়েছ তো তোমারই একদিন কি আমারই একদিন। কৈ, এখনও উঠলে না, বসে আছ কি জন্য? দারোয়ান ডাকতে হবে না গলাধাক্কা দেবার জন্যে–তোমাকে আমিই তাড়াতে পারব, এটি মনে রেখো।’

হেম ইচ্ছে ক’রে বসে থাকেনি–বিহ্বল হয়েই বসে ছিল। এবার সে বিহ্বলতা কাটিয়ে ওকে উঠতেই হ’ল। হাত কাঁপছে, পায়ে জোর নেই। তা হোক; আরও বেশি অপমান হওয়ার আগেই যেতে হবে–এটুকু এরই মধ্যে ওর মাথাতে গিয়েছিল। কোনমতে–জামাটা হাতে ক’রে বেরিয়ে এল ঘর থেকে। আলোয়ানটার কথা মনে রইল না। সেটা এক টানে আলনা থেকে নিয়ে সিঁড়ি দিয়ে নামবার সময় ওর গায়ের ওপর ছুঁড়ে ফেলে দিলে কিরণ।

নলিনী কিছুই বলতে পারল না, ভয়ে অপমানে বেদনায় সেও পাথর হয়ে গিয়েছিল।

প্রতি ঘরে কৌতূহলী, কৌতুকোসুক জোড়া জোড়া চোখ তাকে লক্ষ্য করছে তা হেম জানে। এই কটা সিঁড়ি এবং সামান্য রকটুকু–তাও যেন ফুরোতে চায় না। এর চেয়ে এই মুহূর্তে যদি মরে যেত সে তো এর চেয়ে ভাল হ’ত। কত লোকের তো এরকম আঘাতেই হার্ট ফেল ক’রে মৃত্যু হয় শুনেছে সে–তার হচ্ছে না কেন?

না, কিছুই হ’ল না। কোনমতে স্খলিতপদে টলতে টলতে বাড়ির বাইরে আসতে হ’ল তাকে। পিছনের দরজাটা সশব্দে বন্ধ হয়ে গেল। সম্ভবত চিরকালের জন্যই। তার উদ্‌ভ্রান্ত বেশভূষা ও কালিপড়া মুখ দেখে মধ্যাহ্নের সেই জনবিরল গলির স্বল্প দু-চারজন পথিকও বিস্মিত দৃষ্টিতে চেয়ে রইল। সে সম্বন্ধে সচেতন হয়ে উঠতে প্রাণপণ চেষ্টায় নিজেকে সামলে নিলে হেম। জামাটাও গায়ে গলিয়ে আলোয়ানখানা কাঁধে ফেলে অপেক্ষাকৃত দ্রুত গতিতেই গলিটা পেরিয়ে এল। কিন্তু শ্যামবাজারের মোড় পর্যন্ত পৌঁছে আর চলতে পারল না, অবসন্নভাবে একটা বাড়ির রকে বসে পড়ল সে।

অষ্টাদশ পরিচ্ছেদ

॥১॥

অনেকক্ষণ বিহ্বল অবস্থায় বসে থেকে–এখানেও সে ক্রমশ বিস্ময় ও কৌতূহলের পাত্র হয়ে উঠছে বুঝতে পেরে–হেম একসময় উঠে পড়ল। বাড়ি ফিরতে হবে, পোশাক বদলাতে হবে। থিয়েটারে যাবার সময় হয়ে এল–আজ সন্ধ্যায় অভিনয় শুরু হবে। আগে ‘ক্যাল্ লাইট’ বলে বিজ্ঞাপন করা হ’ত–তখন সুবিধা ছিল, আধ ঘণ্টা দেরি হলেও কথা উঠত না। এখন আবার সময় দিয়ে দেওয়া হয়।

কিন্তু থিয়েটারে আর যাওয়া কি উচিত হবে ওর?

অবশ্য কথাটা কিছু এখনই বাবুর কানে পৌঁছবে না। নলিনীর মায়ের সে সাহস হবে না নিশ্চয়–কারণ তাতে মেয়েরই বেশি অনিষ্টের সম্ভবনা।

কিন্তু–, যদি অন্য কোন ভাবে লাগায়?

যদি–যদি চোর বলে?

এতদিনের থিয়েটার মহলের অভিজ্ঞতা থেকে অনেক শিক্ষাই তার হয়েছে, অনেক কথাই কানে এসেছে। এই শ্রেণির মেয়েমানুষের অসাধ্য কিছুই নেই–এটুকু সে বুঝেছে বেশ।

নলিনী! নলিনীও হয়তো ঐ ‘গোড়েই গোড়’ দেবে!

এই তো সে চুপ ক’রে মাথা হেট ক’রে বসে রইল। কেন–তার বাড়ি তার ঘর, একটা কথাও কি সে বলতে পারত না? হ’লই বা মা–মা’র মুখের ওপর কি কোন কথা বলে না সে?

দারুণ উত্তেজিত হয়ে ওঠে হেম। চলতে চলতেই থমকে দাঁড়িয়ে যায়। নলিনী! নলিনীও তো ঐ দলেরই মেয়েছেলে! তার আর কত ভাল হবে?

উত্তেজনাটা কিন্তু স্থায়ী হয় না। নলিনীর কথাটা মনে পড়তেই তার চেহারাটাও মনে পড়ে যায়–আর তার ফলে জীবনে প্রথম নারীসঙ্গের বিচিত্র অভিজ্ঞতাও মনে পড়ে গিয়ে মনটা কোমল হয়ে আসে। ওর দোষ দিলে চলবে কেন? আসলে ভয়ের কারণ তো যথেষ্টই আছে। ভাতভিক্ষা শুধু নয়–প্রতিষ্ঠা, প্রতিপত্তি, শক্তি সবই হারাতে হবে–জানাজানি হয়ে গেলে।

না। নলিনীর পক্ষে প্রতিবাদ করা সম্ভব ছিল না।

ভবিষ্যতেও করতে পারবে না।

রমণীবাবুর কোপবহ্নি থেকে বাঁচাবার কোন চেষ্টাও সম্ভব হবে না তার দ্বারা সে চেষ্টা করতে গেলে হিতে বিপরীতই হবে।

তা হলে এখন কী করবে সে? যাবে–না যাবে না?

মূল প্রশ্নটা রয়েই যাচ্ছে যে!

টাকাও পাওনা রয়েছে অনেকগুলো। একেবারে না বলে ডুব মারলে আর কোনদিনই সে টাকা আদায় হবে না।

ভাবতে ভাবতে কোম্পানির বাগান পর্যন্ত এসে গিয়েছিল হেম। ভেতরে ঢুকে আবারও অবসন্নভাবে বসে পড়ল একটা বেঞ্চিতে।

আরও খানিকটা ভাবলে বসে বসে।

শুধু পয়সার আকর্ষণও নয়–আরও কিছু আছে। মনের মধ্যে অপ্রতিহত আশা আবার মাথা তোলে একটু একটু ক’রে।

বেশ তো, চোখে তো দেখতেও পাবে অন্তত নলিনীকে একবার

তার পর? তার পর আবার কোথাও কোন রকম সুযোগ-সুবিধা হতে কতক্ষণ? সত্যিই কিছু কিরণবালার গোবরের চোখ নেই।

না–যাওয়াই যাক। দেখা যাক না। চাকরি ছাড়িয়ে দিলে মাইনে দিয়ে ছাড়াতে হবে। বদ্‌নাম আর কী দেবে! ওদের যা বাজার-হাট করে মাঝে মাঝে–তাই থেকে চুরি করেছে–এই বলবে বড় জোর। কিংবা বলবে যে ‘অমুক জিনিসটা কিনতে টাকা দিয়েছিলুম ফেরত দেয় নি!’ বলুক গে। তার জন্যে বড় জোর ওখানে আর পাঠাবে না। সে তো এমনিই আর যাবে না। তার আর ক্ষতি কি? আসল কর্মস্থলের বাইরে বেগার দিতে গিয়ে কিছু সরিয়েছে–এ অভিযোগে এখানে তার চাকতে পারবে না কেউ!

মনকে এমনি প্রবোধ দিয়ে নিজেকে খানিকটা চাঙ্গা ক’রে তুলল হেম।

তারপর দ্রুত বাড়ির পথ ধরল।

অগ্রাহায়ণের বেলা ম্লান হয়ে এসেছে, থিয়েটারে পৌঁছতে হবে এখনই।

.

বাড়িতে ঢুকতেই প্রথম দেখ হ’ল গোবিন্দর বৌয়ের সঙ্গে। সে তখন সন্ধ্যা দিতে চলেছে। ভেতরের রকের যে ঘেরা জায়গাটায় ওদের রান্না হয়–তারই এক কোণে, নিচে নামবার পইঠেটার পাশে একটা ভাঙা টবে ওদের তুলসী গাছ থাকে। সেইখানেই প্রত্যহ সন্ধ্যে দেওয়া হয়। সেই উদ্দ্যেশ্যেই ছোট্ট একটি পেতলের পিদিমে ঘিয়ের সন্ধ্যা-দীপ জেলে নিয়ে দেওয়ালে টাঙানো মা-কালীর পটের সামনে প্রণাম করছিল সে। সামনে হেমকে দেখে অভ্যাসগত মুখ-টিপে হেসে প্রশ্ন করলে, ‘কী ঠাকুরপো–এত দেরি? আজ ওখানে যেতে হবে না?’

‘হবে বৈ কি। দেরি হয়ে গেল একটু–এমনি–,’ থেমে থেমে উত্তর দিলে হেম। কারণ কথা বলতে বলতেই অন্যমনস্ক হয়ে গিয়ে ছিল সে। তার মনে হ’ল বড় বৌদিকে আজ নতুন দেখলে সে। রাণী সুশ্রী, খুবই সুশ্রী–কিন্তু তার যে এত দীপ্তি তা যেন এর আগে কখনও এমনভাবে চোখে পড়ে নি। সুন্দর ক’রে পাতা কাটা, শিল্পির-হাতে-আঁকা দুই ভুরুর মধ্যে ছোট্ট একটি টিপ, উজ্জ্বল দুটি চোখের ভক্তিতদ্‌গত দৃষ্টি–সবটা জড়িয়ে সেই গলায় আঁচল দেওয়া মুখখানিকে কম্পমান দীপশিখার আলোকে ফ্রেমে-আঁটা-ছবির মতোই মনে হ’ল। আর সে ছবি যেন টাটকা ফোঁটা কোন দেবভোগ্য ফুলের!

অন্যমনস্ক, তন্ময় হয়ে গিয়েছিল বোধ হয় কয়েকটি মুহূর্তের জন্যে।

হঠাৎ চমক ভাঙল রাণীরই কথায়, ‘তোমার কি হয়েছে বল তো ঠাকুরপো?’

চমকে উঠল হেম, ‘কেন, কী আবার হবে?’

‘মুখে যেন কে কালি মেড়ে দিয়েছে, চোখ লাল–কোথাও মার-টার খেয়ে এলে নাকি?’

‘না–না। তোমার এক কথা!’

কোনমতে জড়িয়ে জড়িয়ে অথচ কণ্ঠস্বরে অকারণ জোর দিয়ে উত্তরটা দিতে দিতে সেখান থেকে সরে পড়ল সে। সময়ও আর নেই মোটে। ব্যস্ত হয়ে বেরিয়ে যাবার তো যথেষ্টই কারণ রয়েছে।

মেয়েটা বড়ই জ্বালালে। ওর ঐ উজ্জ্বল চোখে যে কিসের কৌতুক, কতটা দেখতে পায় ও–আজ পর্যন্ত ঠিক বুঝে উঠতে পারল না হেম। আর সেই জন্যেই বড় অস্বস্তি বোধ হয়।

.

আরও একজনের অস্বস্তিকর দৃষ্টি এড়ানো যায় না। দক্ষিণাদার তীক্ষ্ম অভিজ্ঞ চোখও বাইরের সব আবরণ ভেদ ক’রে একেবারে যেন মর্মস্থলে পৌঁছয়।

প্রথমটা অবশ্য অবসর মেলে নি কথা কইবার। হেম গিয়ে পড়েছিল একেবারে সময়ে সময়ে। দু-চারজন লোক এর মধ্যেই এসে গেছে, সে গিয়ে দাঁড়াতে না দাঁড়াতে ভিড় শুরু হয়ে গেল। নিঃশ্বাস নেবার সময় নেই তখন। তবুও তার ভেতরেই অনুভব করলে হেম যে দক্ষিণাদার চোখটা তার মুখের ওপর পড়ে কয়েক মুহূর্তের জন্য স্থির হয়ে রইল।

সেই টুকুতেই হেম ঘেমে উঠেছিল।

কিন্তু ভয়টা যে মিছে নয় সেটা বোঝা গেল ক’মিনিট পরেই–ঐ ভিড়েরই মধ্যে একফাঁকে কানের কাছে চুপি চুপি বলে গেল দক্ষিণাদা, ‘প্লে আরম্ভ হলে মিনিট কতক পরে বাইরে আসিস একবার, কথা আছে।’

তবু দাঁড়িয়ে ছিল স্থাণুর মতোই। প্রথম দৃশ্য শেষ হয়ে গিয়ে দ্বিতীয় দৃশ্য শুরু হয়ে গেল। দর্শকরা যা আসবার মোটামুটি এসেই গেছে, এরপর এলেও এক-আধজন হয়তো আসতে পারে–তার জন্যে হেমের না দাঁড়ালেও চলবে, পাশের গেটের কেউ কাজ চালিয়ে নেবে–এ সবই জানে সে। তবু যেতে পারে না। কিন্তু শেষ পর্যন্ত থাকা গেল না, দক্ষিণাদা এসে জামার আস্তিনাটা ধরে টেনে নিয়ে গেলেন। একেবারে সোজা বেরিয়ে খাবার জলের বড় চৌকো ট্যাঙ্কটার পাশে টেনে নিয়ে গিয়ে প্রশ্ন করলেন, ‘কী হয়েছে কি? ধরা পড়ে গেছিস বুঝি?…কে ধরলে, খোদ বাবু না বুড়ী?’

এর পর আর গোপন করতে যাওয়ার কোন অর্থ হয় না।

হেমও সে চেষ্টা করলে না। মাথা হেঁট ক’রে প্রায় সব ইতিহাসই খুলে বললে,–অবশ্য সংক্ষেপে।

‘ইস! কত ক’রে বললাম তোকে ইষ্টুপিড যে গরিব বামুনের ছেলে এ সবে জড়াস নি, তা তো শুনলি না। তা এখন কি করবি?’

ভয়ে ভয়ে পাল্টা প্রশ্ন করে হেম, ‘ও–ও কি বলবে বাবুকে কিছু? বলতে সাহস করবে?’

‘মেয়ের দোষ তো দেবে না! দেবে তোরই দোষ–মেয়েও সতীসাধ্বী সেজে ঠিক পার পেয়ে যাবে। মরলে তুই-ই মরবি। এমন একটা কাণ্ড হবে–অপমানের চূড়োন্ত ক’রে ছাড়বে। এসব বাবুরা ঘরের মাগের সতীত্ব ছেড়ে দিয়ে আসে চাকর বেয়ারার জিম্মেয়, বাইরের মেয়ে-মানুষের সতীত্বের ওপর ওদের কড়া নজর। বুঝলি, কানে গেলে ক্ষেপে উঠবে একেবারে। আর যতই হোক–ওরা ধনী, ওরা মনিব–ওদের হাতে শতেক ব্যবস্থা। না ভাই, তোর আমি দাদার মতো, আর দাদাই তো বলিস–আমি বলছি তুই চাকরি ছেড়ে চলে যা। আর কীই বা হচ্ছে, এ যা রোজগার কচ্ছিস, দেশে গিয়ে শাঁকে ফুঁদিলে এর চেয়ে ঢের বেশি হবে!’

হেম মাথা হেঁট ক’রে দাঁড়িয়ে শোনে। তার অন্তরের আশঙ্কারই প্রতিধ্বনি তোলেন দক্ষিণাদা, সুতরাং উত্তর দেবার কোন কথা খুঁজে পায় না।

কিন্তু তাই বলে সায়ও দিতে পারে না ঠিক।

সব আশার সত্যি সত্যি পরিসমাপ্তি ক’রে দিয়ে, এই অত্যন্ত অসময়ে তার প্রথম প্রণয়ের সমাধি রচনা করে চিরকালের মতো চলে যেতে হবে? সত্যি- সত্যিই পূর্ণচ্ছেদ টানতে হবে তাদের সম্পর্কে?

এ মানতে চায় না তার মন। কল্পনাতেই বিদ্রোহী হয়ে উঠে।

কাছাকাছি থাকলে, সামনাসামনি থাকলে কত সুযোগ ঘটতে পারে। এই তো থিয়েটারের মধ্যেও কত মেয়ে কত কি করে–তাছাড়া ওর মাও কোথাও যেতে পারে তীর্থ করতে–বাবু কাজে যান অনেক সময়, বাইরে বাইরে ঘোরেন–কখনও কি ওরা দুজনে একসময়ে বাইরে যাবে না কোথাও! সে সব সুযোগের তো সদ্ব্যবহার করতে পারবে তারা! তরুণ মন হেমের–নিমেষে বহু স্বপ্ন রচনা করে এগিয়ে যায়। বয়স হয়েছে, মরতেও তো পারে নলিনীর মা। বাবুরও তো এ রক্ষিতায় অরুচি ধরতে পারে। তিনি অন্য কাউকে ধরতে পারেন তো! দূরে চলে যাওয়া মানে একেবারেই যাওয়া।

অভিভূতের মতো হেম আবার ভেতরে এসে দাঁড়ায়।

এখনই প্রথম অঙ্কের শেষ দৃশ্য শুরু হবে এই দৃশ্যে নলিনী বেরোবে প্ৰথম।

একবার চোখের দেখার জন্য উৎসুক হয়ে ওঠে হেম। অনেক আশার দেখা তাদের অসমাপ্ত থেকে গেছে অপরাহ্নে। মনে হচ্ছে যেন কতকাল দেখে নি নলিনীকে। এখান থেকে দেখতে তো দোষ নাই–এই দূর থেকে। এমন তো আরও চার-পাঁচশ জোড়া চোখ দেখছে তাকে। সেও না হয় দেখলে তার সঙ্গে।

ব্যগ্র ব্যাকুল ভাবে প্রতীক্ষা করল সে।

নলিনী আসে। অভিনয় করে সে অন্য দিনের মতোই। সহজ স্বাভাবিক আচরণ। তার ভাব-ভঙ্গিতে মনে হয় না যে তার চিত্তে আলোড়ন জাগবার কোন কারণ ঘটেছে। শুধু–প্রতিদিনিই অভিনয় করতে করতে মাঝে মাঝে এদিকে তাকায়–এই গোর দিকে। সে জানে হেম এই দুটো গেটের একটাতেই থাকে; তাকায় তাকে দেখবার জন্যই–সেই খানেই যেন তার চেষ্টাকৃত ঔদাসীন্য ধরা পড়ল।

আজ চাইল না। কিন্তু তাতে দুঃখ নেই হেমের। বরং এই না চাওয়াতেই একটা সান্ত্বনা বোধ করলে সে। এদিকে–তার দিকে চাইলে কষ্ট হবে বলেই চাইছে না। এই তো তার প্রেমের, প্রীতির লক্ষণ।

এইটে ভাবতে ভাবতেই তার অন্তর একটা অবর্ণনীয় আবেগে উদ্বেল হয়ে ওঠে। বরং বলা যেতে পারে অপরাহ্নেয়ই অসমাপ্ত আবেগ। সে যেন আর স্থির থাকতে পারে না। তার পা দুটো ভেতরে ভেতরে কাঁপে একটু, সে কাঁপন ছড়িয়ে পড়ে ক্রমশ সারা দেহেই। একবার ভাল ক’রে ওকে দেখবার জন্য, সামনাসামনি কাছ থেকে দেখবার জন্য, একবার ওকে স্পর্শ করবার জন্য আকুল হয়ে ওঠে সে।

কোনমতে সে প্রথম ও দ্বিতীয় অঙ্কের মধ্যেকার বিরতিটা কাটায়। অন্যমনস্কভাবে–আচ্ছন্ন অভিভূতের মতো। ভুল হয় বার বার।

ধমক খায় কানাইয়ের কাছ থেকে। কিন্তু দ্বিতীয় অঙ্ক শুরু হয়ে যেতে–আর স্থির থাকতে পারে না কোনমতেই। কে যেন অপ্রতিহত বলে ওকে ভেতর দিকে টানে। এই সময়েই সুবিধা তা হেম জানে–এর পরের দৃশ্যটা বেশ বড়, সে দৃশ্যে অনেক চরিত্রই স্টেজে আসে–ভেতর ভিড় থাকে খুব কম। অথচ নলিনীর প্রথমে যা দু-চার লাইন পার্ট, তার পরেই সে ভেতরে চলে যাবে। সম্ভবত একাই থাকবে। শুধু চোখের দেখা নয়–মুখের কথারও সুবিধা মিলতে পারে।

হেম বাইরে বেরিয়ে এসে আগেই পানের দোকনটার দিকে এগিয়ে যায়। এক খিলি পান তাদের প্রাপ্য প্রতিদিন, যুধিষ্ঠির পানওলা হাসিমুখেই এটা দেয়। এখানে এলে কেউ সন্দেহ করবে না। পান নিতে নিতে একবার চারিদিক তাকিয়ে নেয় হেম, সকলেই এ সময়টা ভেতরে, শুধু সত্য বাইরে আছে–তা সে-ও যেন কী একটা পড়ছে গেটের মাথায় ক্ষীণ আলোতে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে। সকলের অলক্ষ্যে যাবার এই পরম সুযোগ।

কোনমতে সত্যের কাছটা সন্তপর্ণে পার হয়ে হেম ত্বরিত লঘুপদে স্টেজের দোর পেরিয়ে ভেতরে চলে যায়।

সেই দৃশ্যটা আরম্ভ হয়ে গেছে। নলিনীই পার্ট বলছে এখন। এখনই ভেতরে আসবে। দুরু দুরু কম্পিত বুকে হেম স্টেজ থেকে বেরিয়ে নলিনীর নিজস্ব ঘরে যাবার সরু পথটায় দাঁড়িয়ে থাকে।

নলিনী আসছিলও এদিকে। মাথা হেঁট ক’রে কী একটা ভাবতে ভাবতে আসছিল সে–হঠাৎ সামনে একটা ছায়া দেখেই বোধ করি মাথা তুলে চেয়ে দেখল। আধা আলো আধা অন্ধকার–তবু হেমকে চিনতে ভুল হবার কোন কারণ নেই, সে অস্ফুট এবং অব্যক্ত কী একটা শব্দ ক’রে দুপা পিছিয়ে গেল এবং নিমেষে ঘুরে দাঁড়িয়ে যে সীনটা সাজানো রয়েছে এখন, তার পিছন দিয়ে সোজা চলে গেল ওধারে–যেখানে বসে ‘সখী’র দল গুলতানি করছিল।

হেমের মুখের ওপর কে যেন এক ঘা চাবুক মারলে সজোরে। ঠিক তেমনিই লাগল তার, তেমনিই জ্বালা করতে লাগল মুখটা। বাবুর ‘ঘরণী’ হবার পর থেকে নলিনীর এখানে সামাজিক প্রতিষ্ঠা হয়েছে–নলিনীর নিজের ভাষাতে ‘পোজিশন’- সে ঐ ছুঁ’ড়ীদের সঙ্গে কথা বলে কদাচিৎ। তাদের কাছে গিয়ে দাঁড়ানোটা তো সম্পূর্ণ অভাবনীয়, কল্পনাতীত। এপার থেকে ওধারের ক্ষীণ আলোতে পরিষ্কার দেখা গেল–ওদের দল সন্ত্রস্ত হয়ে উঠেছে, কেউ কেউ উঠে দাঁড়িয়েছেও।

হেম আর দাঁড়াল না। দাঁড়াতে পারল না। প্রায়-অবশ পা দুটোকে টেনে টেনে কোনমতে বাইরে এসে দাঁড়াল।

আর যা-ই হোক–নলিনীর কাছ থেকে এ ব্যবহার আশা করে নি। ভয়ের কারণ তার যথেষ্ট আছে তা হেমও জানে–কিন্তু সত্যি-সত্যিই কিছু গোবরের চোখ নেই এখানে কিরণের, অন্ধকারে নির্জনে নিভৃতে দাঁড়িয়ে একটা কথা বললে সেটা তখনই কিছু তার কানে উঠত না।

একটা ক্ষমাভিক্ষা করারও কি ছিল না তার? একটা সান্ত্বনার কথা বলাও কি উচিত ছিল না? হেম নিজে সেধে যায় নি–নলিনীর আগ্রহেই গেছে–না- হক যে অপমানটা হ’ল আজ, সে অপমানের পুরো না হোক বেশির ভাগ দায়িত্বই নলিনীর। সে কথাটাও কি একবার ভেবে দেখল না?

একটা অবোধ মূঢ় অভিমানে হেমের চোখে জল এসে গেল।

কিন্তু সেই মুহূর্তেই সে মন স্থির ক’রে ফেললে।

এখানে থেকে দিনের পর দিন এই মার সে খেতে পারবে না–এ জ্বালা তার সহ্য হবে না। একদিনের এই আঘাতেই মনে হচ্ছে বুকের ভেতরটা ছিন্নবিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। প্রতিদিন এই যন্ত্রণা–চোখের সামনে থাকবে, বারবার দেখা হবে, মনের সমস্ত আবেগ ও বাসনা উত্তাল হয়ে উঠে ওর কাছে ছুটে যেতে চাইবে–চাইবে ওর সঙ্গে দুটো কথা কইতে, ওকে একটু স্পর্শ করতে, অথচ পারবে না–এ যন্ত্রণা অসহ্য।

না, দক্ষিণাদাই তার যথার্থ হিতাকাঙ্ক্ষী। সে-ই ঠিক বলেছে।

হেম দাঁড়াল না। কারুর সঙ্গে দেখাও করলে না। সকলের অলক্ষ্যে একেবারে থিয়েটার থেকেই বেরিয়ে এল।

ঠিক এখনই বাড়ি যাওয়া সম্ভব নয়। অসময়ে ফেরার জন্য অজস্র জবাবদিহি করতে হবে, এখনও সকলে জেগে–রানীর তীক্ষ্ম চোখের সকৌতুক চাহনিকে আরও বেশি ভয়। সে খানিকটা ইতস্তত ক’রে কোম্পানির বাগানেই গিয়ে বসল।

কিন্তু এখানে ভাল লাগল না। এখানেও বসার সহস্র স্মৃতি জড়ানো। নলিনীর বাড়ি যাওয়ার পথে সানন্দ প্রতীক্ষার স্মৃতি। সে যেন অস্থির হয়ে উঠে পড়ল আবার। পথে পথেই ঘুরলো খানিকটা। তার পর, ওদের শুয়ে পড়ার সময় উত্তীর্ণ হয়ে গেছে আন্দাজ ক’রে বাড়িই ফিরে এল এক সময়।

তা পরের দিন খবরটা ভাঙলে বড় মাসীর কাছে, বললে, ‘চাকরি ছেড়ে দিয়ে এলুম মাসীমা! আর ওখানে যাব না। ‘

‘সে কী রে, কেন? কী ব্যাপার?’

‘এমনিতেই তো মাইনে দিতে চায় না ব্যাটারা, খামচা খামচা ক’রে দেয়–সব জুড়লে আমার অমন ছ মাসের মাইনে পাওনা বেরোবে। তার ওপর আবার মেজাজ। কাল একটু যেতে দেরি হয়েছিল বলে যাচ্ছেতাই করলে সকলের সামনে। আমিও–এই রইল তোমার চাকরি বলে চলে এলুম।’

‘তার পর? এখন কী করবি?’ খানিকটা যেন আড়ষ্ট হয়ে বসে থেকে বলে কমলা।

‘এখন তো দিনকতক বাড়ি থেকে ঘুরে আসি। তারপর আবার চাকরির জন্যে উঠে পড়ে লাগা যাবে। একটা যা হোক বাঁধাধরা ছিল বলে অত গা-ও ছিল না, এখন যা পাব তাই নেব।’

নানারকম ঘাত-প্রতিঘাতের মানসিক বৈকল্যে হেমের একবারও মনে পড়ল না যে, সে কিছুদিন ধরে সারা দুপুর বিকেল টো-টো ক’রে ঘুরছে চাকরির জন্যেই–অন্তত এই কথাই এদের কাছে বলেছে।

কমলা পর্যন্ত একটু বিস্মিত হয়ে তাকাল এই কথায়। কিন্তু মুখে কিছু বলল না। এই থিয়েটারের চাকরিটা অস্বস্তিরই কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল ইদানীং–কিছু না বুঝেও অস্বস্তি হ’ত তার। গেল ভালই হল। বেটাছেলে মোট বয়েও খেতে পারবে। আরও কিছু একটা ঘটেছে, যা বলছে তা সবটা সত্যি নয়–তা বুঝলেও তাই আর সে কিছু জেরা করলে না।

.

সেই দিনই বিকেলে বাড়ি চলে গেল হেম। মাকে গিয়ে বললে, ‘চাকরি ছেড়ে দিয়ে এলুম মা। জাতও যাবে, পেটও ভরবে না, রাত জেগে জেগে শরীর কালি হতে বসেছে, অছচ তোমাদের দুটো টাকাও দিতে পারি না এক এক মাসে–অমনি চাকরিতে দরকার কি? আর যদি কিছু না জোটে শাঁকে ফুঁই দেব না হয়। কী বল?’

শ্যামা উদ্দেশে দু হাত তুলে মা সিদ্ধেশ্বরীকে প্রণাম করে।

॥২॥

মহাশ্বেতা অনেক দিন ধরেই অভয়পদকে খোঁচচ্ছিল হেমের চাকরির জন্যে–এবার উঠে পড়ে লাগল।

‘বলি নিজের ভায়েদের জন্যে তো বেশ টুকটুক ক’রে চাকরি যোগাড় করতে পার–আমরে ফয়ের বেলাই আর কিছু খুঁজে পাওয়া যায় না–না? এতটা বয়স হ’ল, কবে বা কী কাজকর্ম পাবে আর কবেই বা বে-থা ক’রে সংসারী হবে?

প্রথম প্রথম অভয়পদ তার স্বভাবমত চুপ ক’রেই থাকত, ইদানীং –বোধ করি বা উত্ত্যক্ত হয়েই–দু-চারটে কথা বলে। বলে,’আমার ভাইদের যখন চাকরিতে ঢুকিয়েছি তখন দিনকাল অন্যরকম ছিল। এখন একটা পাস নইলে কোথাও নিতে চায় না, আর নেবেই বা কেন–পাস করা ছেলেরাই কত গণ্ডা ফ্যা ফ্যা ক’রে ঘুরে বেড়াচ্ছে। তাও এত বয়েস হয়েছে–এই প্রথম চাকরির চেষ্টা করছে তা তো আর বলা যায় না–এর আগে কোথায় কাজ করেছে জিজ্ঞাসা করবেই–তখন কী পরিচয়টা দেব? সেখানেও তো মুখ পুড়িয়ে রেখেছে।’

‘সে ওর বরাত। নইলে এই যে–তোমরাই কি চুরিটা কম করলে। লোকে বলে পুকুর চুরি করা, তুমি তো বলতে গেলে বড় বড় দীঘিই চুরি ক’রে মেরে দিলে। …বরাত, নইলে সামান্য দুটো শিশি চুরি করেই বা ধরা পড়বে কেবন–আর তোমরা গাড়ি গাড়ি মাল চুরি করে মেজ বোয়ের বুক-পোঁতা ক’রে পার পেয়ে যাবে কেন। সে সে ছেড়ে দাও। বলি যে যেমন–তায় তেমনিও তো জুটবে। বেটা ছেলে–তার একটা মুটেমজুরের কাজও কি জোটে না?’

মেজোবৌয়ের বুক-পোঁতা করবার অভিযোগটা প্রায় নিত্য হয়ে দাঁড়িয়েছে–কোন দিনই এর কোন জবাব দেয় না অভয়পদ। শেষ কথাটারই জের টেনে বলে, ‘মুটে-মজুরের কাজ আবার যোগাড় করে দিতে হবে কেন, সে তো পড়েই আছে। বড়বাজারে গিয়ে দাঁড়ালেই মোট মেলে। আর আমরা হলে থিয়েটারে চাকরি নেওয়ার আগে সেই চেষ্টাই দেখতুম।’

বার বার একই ইঙ্গিতে মহাশ্বেতা ক্ষেপে যায়। এ খোঁচা ঘরে বাইরে খেতে হয় তাকে। স্বামীর মুখেও সেই একই খোঁচার অনুবৃত্তি সহ্য হয় না। সে চাপা গলাতেই যথাসাধ্য চেঁচায়, কেন থ্যাটারে চাকরি করে কি সে একেবারে বয়ে গেছে নাকি। কী করছে সে তাই শুনি? কটা রাড় রাখার কথা শুনেছ? নাকি কাপ্তেনি ক’রে মোট মোট টাকা ওড়াচ্ছে!’

এর জবাবে অনেক কথাই বলা চলত। বলা চলত যে, কাপ্তেনি করার মতো চাকরি সে করে না, গেটকীপারের চাকরিতে পেটে খেতেও জোটে না। বলা চলত যে, পুরো মাইনে কোন মাসেই ঠিকমতো আদায় হয় না বলেই যে নাকে কাঁদে. তার পরনে দেশী ধুতি এবং জার্মানীর শাল মানায় না। কত মাইনে পেয়েছে সে আজ পর্যন্ত, আর তার কতখানি সংসারেরে উসুল দিয়েছে–তার হিসাবও কেউ দেখেনি কোনদিন।

কিন্তু অভয়পদ কোন দিনই এসব কথা বলে না। বলার অভ্যাস নেই তার। কোন দিনই কারুর সঙ্গে সে দুটোর বেশি তিনটে কথা বলে না–বিশেষত বিনা প্রয়োজনে। তাছাড়া এর পরে কী শুনতে হবে তাও সে জানে। আর শুনতে হয়ও। অভয়পদকে চুপ ক’রে থাকতে দেখে মহাশ্বেতা আরও ক্ষেপে যায়। গলাটা আর একটু চাপবার বৃথা চেষ্টা করতে করতে সে বলে, ‘বলি থ্যাটার তো ভাল, সে তো তবু বাজারের মেয়েমানুষ নিয়ে ঢলাঢলি। সে ঢলাঢলি তো ঘরে তোলে নি সে!’

কথাটা বলেই সেখান থেকে সরে যায় মহাশ্বেতা। অনেক দিনের পরে এই সাহসটা যে হয়েছে তার–তাতেই সে একটু অবাক হয় মনে মনে। নিজেই নিজেকে বাহবা দেয় একসময়। তবু এই খোঁচাটা দেবার পরও স্বামীর সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে সাহসে কুলোয় না–কোথাও হয়তো একটা সহজাত ভদ্রতাবোধও বাধে। সে লেখাপড়া শেখেনি কিন্তু সে দিদিমাকে দেখেছে, মাসীমাদের দেখেছে–এমন কি মা’ও তার আজ পর্যন্ত কতকগুলো ভদ্র চালচলন ছাড়তে পারে নি–তাও সে দেখেছে।

মোটামুটি একটা সংস্কার তার আপনিই থেকে গেছে ভেতরে। সামনেও থাকে না, তাই কোনদিন লক্ষ্যও করে না–তার স্বামীর সুগৌর বর্ণ এত রড় আঘাতেও রক্তবর্ণ হয়ে ওঠে কি না।

লক্ষ্য করলে অবাক হয়ে যেত।

অভয়পদের মুখে লজ্জা কি উম্মার কোন রক্তিমাভাই ফেটে না।

প্রশান্ত মুখে হাতের কাজ করে যায়।

বাড়িতে থাকলেই–যতটুকু জেগে থাকে–টুকটাক মেরামতির কাজ করে যায় সে। যা পায় হাতের কাছে। বাইরের দিকে একটা করোগেট টিনের চালা মতোও খাড়া করেছে এই জন্যে। নানা যন্ত্রপাতি থাকে সেখানে। এমন কি একা ছোটখাটো হাপরও ক’রে নিয়েছে, কেমন চাকা ঘোরালেই আগুনটা ধরে ওঠে–মহাশ্বেতা প্রথম প্রথম অবাক হয়ে চেয়ে দেখত। স্বামীর সঙ্গে কথা কইতে গেলে এখানে এসেই কইতে হয়–সেই হয়েছে আরও ঘেন্নার ব্যাপার। ‘মুখপোড়া মিসে’ সাতজন্মে যদি ঘরে ঢোকে! হয় আপিস, নয় এই হাপরখানা। রাত্তিরে শোবে তো সেই চলনে–একখানা কাঠের বেঞ্চিতে। শীত গ্রীষ্ম বর্ষা–সমান ব্যবস্থা। শীতে দয়া ক’রে একখানা কাঁথা গায়ে দেয়, এই বোধ হয় মহার বাবার ভাগ্যি। যুদ্ধের বাজারে হাতে দু’পয়সা আসতে মেজ কর্তা বাড়িতে ধনুরি ডেকে জনা-জাত লেপ তৈরি করিয়ে দিয়েছে–মায় ছেলেপুলের সুদ্ধ। তৈরি হয়েছে ওর জন্যেও–কিন্তু এক দিনও কি গায়ে দিল সে লেপ! এক দিনও না। সেবার পৌষ মাসে বর্ষা হয়ে হাড়-কাঁপানো শীত পড়েছিল–এক দিন রাত্রে শুয়ে মহাশ্বেতার মায়া হ’ল–সে লাজলজ্জার মাথা খেয়ে নিজে নিজেই লেপখানা এনে গায়ে চাপা দিয়ে দিলে। সকালবেলা দেখে–মাগো, মনে হলে এখনও গালে মুখে চড়াতে ইচ্ছে করে ওর–সেখানা পাট ক’রে কখন শাশুড়ির দোরের সামনে রেখে এসেছে, নিজে সেই কাঁথামুড়ি দিয়েই শুয়ে আছে। ভাগ্যিস ভোরে ওঠে মহাশ্বেতা–ও-ই আগে দেখেছিল, নইলে শাশুড়ি ঠিক লেপ-খানা বাজেয়াপ্ত করতেন–আর প্রথম সুযোগেই বড় মেয়ের বাড়ি চালান করে দিতেন। সেই থেকে নাক–কান মলেছে মহাশ্বেতা, ওকে আর স্বাচ্ছন্দ্য দেবার চেষ্টা সে করে না। নষ্ট হোক দুষ্টু হোক–মেজবৌ কথাগুলো বলে ঠিক ঠিক। বলে, ‘ভোগ করারও বরাত থাকা চাই, বুঝলি দিদি। বঠাকুর গতজন্মে কি প্রাণে ধরে কাউকে কিছু দিয়ে এসেছিল যে এজন্মে ভোগ করবে। ওরা কষ্ট করতেই জন্মেছে। গেল জন্মের পাপের সাজা।’

.

ঘরের ঢলাঢলি নিয়ে অভয়পদকে ইঙ্গিত করার সাহসটাও এক দিনে হয়নি মহাশ্বেতার। মেজবৌয়ের অনেক বাড়াবাড়ি সহ্য করতে হয়েছে তাকে। অনেক সাহস। কতকগুলো জিনিস যে সম্ভব তা-ই জানা ছিল না মহাশ্বেতার। প্রথমটা চোখে দেখেও বিশ্বাস হতো না। ভয় হ’ত প্রমীলার জন্যই। এতটা সহ্য করবে না কেউ, এতটা ধৃষ্টতা এবং দুঃসাহস। মাথার ওপর ধর্ম তো আছেন। ভগবান এর সাজা দেবেনই ওকে।

কিন্তু দিনের পর দিন যায়। মাসের পর মাস। ভগবানও যেমন প্রকাশ্যে কোন সাজা দেন না, তেমনি গুরুজনরাও না। কানকানি গা-টেপাটেপি করেন অনেকেই–তবু মুখ ফুটে প্রমীলার মুখের ওপর কিছু বলতে পারেন না। এমনই দাপট তার যে সামনে এসে দাঁড়ালেই যেন সবাই কেঁচোটি হয়ে যান। আসলে ওর ক্ষুরধার রসনাকেই সবাই ভয় করে–মুখে তো আটকায় না কিছু।

বলতে যিনি পারতেন–যাঁর বলার অধিকার সর্বাগ্রে–তিনিই যে কিছু বলেন না। ক্ষীরোদা যেন বুড়ো হয়ে আরও ভীতু, আরও জবুথুবু হয়ে গেছেন। বেশি ভয় তাঁর মেজছেলে আর মেজবৌকেই। আহা দেখলেও দুঃখ হয় মহাশ্বেতার–ইদানীং কাউকে কিছু দেবার ইচ্ছে হলে কি খেতে ইচ্ছে হলে আড়ালে অভয়পদকে বলেন, এদিক ওদিক দেখে–কেউ কাছে না থাকলে। অথচ ভয় যে কাকে তা বোঝে না মহাশ্বেতা। বড় ছেলে আর বৌ যখন মান্য করে তোমাকে, তখন এত ভয় কেন? তাও–এই তো সেবার, মুখ ফুটে বলেছিলেন মেজ ছেলেকে অনন্ত চতুর্দশীর ব্রতের কথা–তা কৈ অম্বিকাপদ তো দ্বিরুক্তি করেনি। ব্রত উদযাপনে বারোটি বামুন খাওয়াবার কথা, রীতিমতো বাড়িতে ভিয়েন ক’রে দেড়শ’ লোক খাইয়ে দিল। তবে?

এই তবেটাই বুঝতে পারে না। আড়ালে গজগজ করে শুধু।

প্রমীলার যে খুব দোষ তাও তো দিতে পারে না মহাশ্বেতা। সেই যা ফুলশয্যার রাত্রে ‘ধাষ্টামো’ করেছিল–খুবই ‘গর্হিত কাজ’ সন্দেহ নেই (মহাশ্বেতার যা দু-একটি সংস্কৃত সাধুশব্দ জানা আছে এই গর্হিত শব্দটি তার মধ্যে অন্যতম, যদিও উচ্চারণ করার সময় সে অকারণে একটা হসন্ত দেয়)–তবু তার পরে সে আর ছোটকর্তাদের ধারে কাছে যায় নি। বরং ছোট বৌকে নিজে ভাল ক’রে সাজিয়ে-গুছিয়ে ছোটকর্তার ঘরে পাঠিয়ে দিত। দোষ ষোল আনা দুর্গাপদরই–এটা মহাশ্বেতা স্বীকার করতে বাধ্য। বিয়ের আট দিন কোনমতে শুয়েছিল ছোট বৌয়ের সঙ্গে, তার পর বৌ বাপের বাড়ি যেতে গোনা দুটো কি তিনটে দিন শ্বশুরবাড়ি গিয়েছিল, কিন্তু প্রথম দিন ছাড়া রাত্রে থাকে নি এক দিনও। তারপরে দ্বিরাগমনের পরই কী হ’ল–ছেলে কিছুতে বৌয়ের কাছে শোবে না। আবার বলে কিনা–’অত কালো আমার ঘেন্না করে।’ সেই যে ছেলে বেলায় দাদা পড়ত কথামালা না কিসের গল্পে আছে–মন্দ লোকের ছুতোর অভাব হয় না-এ-ও তাই। আসলে ওর মনে আছে অন্যকথা–মন পড়ে আছে অন্যখানে।

তা থাক। বেটাছেলে একটু এদিক ওদিক চনমন করেই–বয়সকালে নানারকম ক’রে থাকে, কিন্তু তাই বলে ঘরের বৌকে কে এমন ত্যাগ করে? ‘কত রকম কল্লাই জানে ছোটকত্তা!’ মনে মনে গজরায় মহা, ‘ওসব কল্লা! আমি বেশ বলতে পারি, ও মাগীর সঙ্গে ষড় আছে দস্তুরমত।’

বাস্তবিক অসৈরণ হবারই কথা।

রোজ রাত্রে শোওয়া নিয়ে এক কেলেঙ্কারি। বাবু ঘরে শোবেন না বৌয়ের কাছে। বৌ শুতে যাবার আগেই ছেঁড়া মাদুর আর বালিশ নিয়ে ছাদে দৌড়বেন। মেঘ বৃষ্টি হ’ল তো রান্নাঘরের দাওয়ায়। একদিন মেজবৌ মাদুর লুকিয়ে রেখেছিল সবগুলো–সে বাবুর তেজ কত–বিছানা থেকে চাদর তুলে নিয়ে গিয়ে পেতে শুয়েছিল ছাদে।

তা তো নয়–আসলে ওটা মেজবৌকে সুযোগ দেওয়া।

মেজবৌ অমনি সেই রাত্তিরে ছুটবে ছাদে–কী সমাচার, না বুঝিয়ে সুঝিয়ে ঘরে পাঠাতে যাচ্ছি।

তারপর দুপুর রাত পর্যন্ত ছাদে চলবে–মহাশ্বেতার ভাষায়–দুপুরে মাতন’। কী য ওদের এত কথা তা বোঝে না–শুধু হা-হা-হি-হি হাসি আর ফিসফিস গল্প। যে শাসন করতে যাচ্ছে তার এত হাসি-মস্করা কিসের? আর রোজ রোজ এত বুঝোবারই বা কি আছে। এ কী কচি খোকা? একই তো কথা–রোজ নতুন ক’রে সেটা আওড়ালেই কি নতুন কথা হয়? এক-আধ দিন সিঁড়িতে দঁড়িয়ে আড়িও পেতেছিল মহাশ্বেতা–তা শুনবে কি, নিজেরই এমন বুক ঢিপঢিপ করে যে তার আওয়াজে কিছু শোনাই যায় না। শুধু ফিস্ফিস্ আওয়াজ আর মধ্যে মধ্যে ঐ হাসি। তাই কি ছাই নিশ্চিন্দি হয়ে দাঁড়াবার উপায় আছে? হতভাগা ছেলেমেয়েরা ঠিক সময় বুঝে তখনই উঠবে, কাকে মোতাও, কাকে দাঁড়াতে চল বাগানে–এই সব।

রোজ এই ঘটনা। দুপুরে মাতন শেষ ক’রে দুজনে নামবে। মেজগিন্নী চাপা হাসির লহর টেনে শুতে যাবে, ছোটকর্তা সুড় সুড় ক’রে সেঁধোবে নিজের ঘরে। তবু কিন্তু আধিক্যেতার সেইখানেই শেষ নয়–কত ঢং যে জানে ছোঁড়া। ঘরে ঢুকবে, মোদ্দা বিছানায় শোবে না–ঢালা বিছানা ক’রে দিয়েছে মেজকর্তা রীতিমতো গদিবালিশ দিয়ে–সেখানে যাবে বৌ–উনি শোবেন মেঝেতে মাদুর পেতে কিংবা অমনি। প্রথম প্রথম ছোট বৌ শুতে আসত মাটিতে, সে বাবুর প্রচণ্ড ধমক–’যাও ওপরে গিয়ে শোও বলছি! নইলে আমি আবার বেরিয়ে যাব!’

ছোট বৌ তরলার এইতেই বেশি আপত্তি।

আহা চোখের জল শুকোয় না বেচারার–একটি দিনের জন্যেও।

হোক কাল রং, চেহারাটা ওর মহাশ্বেতার কোন দিনই পছন্দ হয় নি এটাও ঠিক–তবু মেয়েটা যে খুব ভাল তা যত দিন যাচ্ছে ততই বুঝতে পারছে সে। ভারি লাজুক আর শান্ত। গতরও তেমনি। ভোরে উঠে সেই যে গাধার মতো খাটতে শুরু করে–রাত এগারোটার আগে এক দণ্ড বিশ্রাম নেয় না। সকলকার মুখে মুখে ছিষ্টি যোগান দিচ্ছে। ঐ ছোটকর্তারই কি কম ফৈজত। বাবুর আবার এদান্তে এক নোংরা নেশা হয়েছে, নস্যি নেওয়া-নিত্যি একরাশ ময়লা রুমাল কাঁচতে দিয়ে যাবে। মায় জুতোয় কালি দেওয়া পর্যন্ত শিখেছে ছোট বৌ। বলে ভাত দেবার ভাতার নয়–নাক কাটবার গোঁসাই। কেন রে বাবু, তাকে যদি তোর পছন্দ নয়, যদি নিবিই না ঘরে–তো অত ফরমাশ করিস কোন্ লজ্জায়? ঘেন্না করে না পরের মেয়েকে অমনি ক’রে শুধু ঝিয়ের মতো খাটাতে?

ছোট বৌও তেমিন, মুখ বুজে সব করবে। একটি কথাও শোনাতে পারে না। হ’ত মেজ বৌয়ের মত মেয়ে তো দেখিয়ে দিত মজা। এ মেয়ে খালি কাঁদতে জানে আর খাটতে জানে। দুপুর বেলা অবধি শোয় না একটু। সব চুকল তো শাশুড়ির পা টিপতে বসল, নয়তো এসে মহাশ্বেতার ছেলেমেয়েদের নিয়ে পড়ল। এমন কি কোলেরটার নোংরা ব্যাপারগুলো পর্যন্ত সে-উদ্ধার করে।

তরলার কাছে এ অবহেলাটা বড় প্রশ্ন নয়। তার কাছে সব চেয়ে মর্মান্তিক হচ্ছে অপমানটাই। চুপ ক’রেই কাঁদে–কিন্তু এক-আধ দিন, বোধ হয় মুখ না খুলে পারে না বলেই ওর কাছে দুঃখ প্রকাশ করে, ‘দিদি, সে-ই মেঝেতে শোয়, আমি তো মেনেই নিয়েছি–তবু শুধু শুধু আদ্ধেক রাত পর্যন্ত এ কেলেঙ্কারি কেন। পাড়াসুদ্ধ লোক জানজানি. ঢিঢিক্কার! কী লাভ হয় এতে বলতে পারেন? সবাই রোজ জানছে একবার ক’রে যে বৌটাকে ওর বর নেয় না। নিতে চায় না–ঘেন্না করে!

আর একটা বড় ক্ষোভ ওর–মেজ বৌয়ের ঐ অভিনয়টা। প্রত্যহ সন্ধ্যার সময় সাজাতে আসাটা। সত্যি বড় ভাল মেয়ে তরলা তাই, নইলে মহাশ্বেতা হলেও বোধ হয় এক চড় কষিয়ে দিত কোনদিন। জানিস তো তুই এ সাজের দিকে দুর্গাপদ কোনদিন ফিরেও তাকাবে না, তবে শুধু শুধু এ মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘা কেন। জোর ক’রে ধরে সাজানোও চাই অথচ অর্ধেক রাত পর্যন্ত নিত্যি তার বরকে আগলে রাখাও চাই।

ছি! ছি! ঘেন্নায় মহাশ্বেতার গলা পর্যন্ত তেতো হেয় ওঠে যেন। তাই এক- একদিন নিজের স্বামীকে অন্তত না শুনিয়ে পারে না। কিন্তু শোনালেই বা কি–এরা কি মানুষ! যেমন ইনি তেমনি মেজবাবু।’এক ভস্ম আর ছার, দোষগুণ কব কার!’–অন্ধকারে শুয়ে শুয়ে অথবা নির্জন পুকুরঘাটে বসে আপনমনেই হাত-পা নেড়ে বলে মহাশ্বেতা, ‘এরা কি মানুষ। কেউ মানুষ নয়। মানুষের রক্ত গায়ে থাকলে–পুরুষ-বাচ্ছা হলে এ কেলেঙ্কার কিছুতে সহ্য করত না!’

.

স্ত্রীকে যা-ই বলুক, সত্যিই কিছু হাল ছেড়ে বসে ছিল না অভয়পদ। ভেতরে ভেতরে খোঁজখবর নিচ্ছিল নানা দিকেই। অবশেষে একটা খবর নিয়েও এল এক দিন, কিন্তু ওর প্রস্তাব শুনে হেম অবাক হয়ে গেল। বক্তব্যটার মর্মোদ্ধার করতেই বেশ কিছুক্ষণ সময় লাগল তার।

সকালবেলা বড় ভাগ্নে এসে খবর দিয়ে গিয়েছিল। হেম যেন বাড়ি থাকে, সন্ধ্যাবেলা অভয়পদ আসবে। অবশ্য খবর দেওয়ার দরকার ছিল না, কারণ এবার চাকরি ছেড়ে দিয়ে আসবার পর থেকে, বিশেষ কাজ না থকালে হেম কোথাও যায় না। শুধু অনেক ফল জমলে কি কলার কাঁদিতে রং ধরলে শ্যামা জোর ক’রে পাঠায় কলকাতাতে–তা না হলে সে বাড়িতেই বসে থাকে–বাগানের তরি-তদারক করে।

দরকার না থাক, খবরটা পাওয়া অবধি হেম একটু আগ্রহের সঙ্গেই অপেক্ষা করছিল তখনও। এ খবরের সঙ্গে নিজের চাকরির কোন যোগাযোগ কল্পনা করে নি। তবে অকারণে লোক পাঠিয়ে অপেক্ষা করতে বলবার লোক নয় অভয়পদ এটা সে জানে। তাই কৌতূহলের শেষ ছিল না তার–হয়তো একটু দুশ্চিন্তাও ছিল। কোন বিপদের খবর নয় তো–তরুর বিয়ের খবরও হতে পারে, কিন্তু তার জন্যে তো মা রয়েছে–তার কাছে কেন?

অবশ্য বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হ’ল না। সেদনি কোন্ সাহেবের রিটায়ারমেণ্ট উপলক্ষে একটু আগেই ছুটি হয়েছিল–সুতরাং চারটে বাজবার আগেই মল্লিকদের বাঁশঝাড়ের আড়ালে সেই বিবর্ণ হয়ে যাওয়া অদ্বিতীয় ছাতাটির উদয় হ’ল।

ছাতাটি পেতে দাওয়াতে বসে বিনা ভূমিকাতেই একেবারে কাজের কথা পাড়ল অভয়পদ। হরিনাথের ভাই শিবু দাদার অফিসে ঢুকেছে–লিলুয়ার কারখানায় চাকরি করে। ওখানকার এক সেকশনের বড়বাবু মেয়েকে বিয়ে ক’রে ইতিমধ্যেই সে এস্টাব্লিশমেন্টে চলে গেছে। তাকে ধরলে এখনই কাজ হতে পারে একটা।

কথাটা শুনে প্রথম কিছুক্ষণ মুখে কথা যোগাল না হেমের। শিবুর কাছে যাবে সে চাকরির জন্যে। শিবু!

অনেকক্ষণ পরে যখন কথা বলতে পারল–তখন ঐ প্রশ্নটাই বেরোল, ‘শিবুর কাছে যাব চাকরির জন্যে! এত কাণ্ডের পরে? কী বলছেন!’

‘কেন, তাতে অসুবিধেটা কি?’ স্থির অবিচলিত মুখেই পাল্টা প্রশ্নটা করে অভয়, ‘তোমরা তাদের তো ক্ষতি কর নি কিছু, বরং উপকারই করেছ। তোমরা নিয়ে না এলে ভাজ-বাইঝিকে পুষতেই হ’ত তাদের–যা হোক ক’রে ভাইঝিটার বিয়েও দিতে হ’ত। মুখে যত যাই বলুক–পাড়াঘরে মুখ দেখাতে পারত না নইলে। তা ছাড়া–ধর এখানে এনেও বোনকে দিয়ে তোমরা নালিশ- মকদ্দমা করাতে পারতে–অত বড় শক্ত অসুখের ভেতর সই করিয়ে নিয়েছে দলিলে–সেটা আদালতে কতখানি টিকত তা বলা কঠিন। তোমরা কিছু‍ই করনি–ঝগড়াঝাটি মামলা-মকদ্দমা। তবে আর তোমাদের লজ্জাটা কি বাপু?’

যুক্তি অকাট্য। কিন্তু এভাবে ভেবে দেখেনি কোন দিন হেম ভাবতে অভ্যস্ত নয়। সে বিমূঢ়ের মতো বসে রইল অভয়পদের মুখের দিকে চেয়ে।

তখন শ্যামাকে ডেকেও কথাটা বলল অভয়।

শ্যামাও প্রথমটা প্রবল আপত্তি ক’রে উঠেছিল, ‘না না। ঐ ছোটলোকদের কাছে যাবে মাথা হেঁট ক’রে চাকরির জন্যে। ছিঃ। তার চেয়ে ও চিরকাল শাঁকে ফুঁ দিয়ে খায় সে-ও ভাল।’

‘দেখুন সে আপনাদের যা অভিরুচি। তবে চাকরির জন্যে, টাকার জন্যে মানুষ অনেকখানি নিচু হয়। আপনারা একটু আশ্রয়ের জন্যে তো কম অপমান হন নি সরকারদের কাছে। অথচ এখন তো তাদের সঙ্গে দিব্যি সদ্ভাব। যাওয়া আসা সবই আছে। তা ছাড়া দেখুন, ছোটলোকি তারাই করেছিল–আপনারা তো করেন নি। ..আর শাঁকে ফুঁ–সে ওখানে থাকলে যাও বা হ’ত–এখানে আপনারা নতুন এসেছন, এখানে আপনার ছেলেকে যজমানি দেবে কে? আপনাদের নামই হয়ে গেছে নতুন বামুন। পুরোনো পুরুতও আছে। এই তো এতদিন ঘরে এসে বসে রয়েছে, ক পয়সা আনতে পারল?.. যাই হোক, ভেবে দেখুন আপনারা।’

বলতে বলতে একেবারে উঠে দাঁড়াল অভয়পদ।

মা-ছেলে দুজনেই হাঁ হাঁ করে উঠল। হেম হাত ধরে টেনে বসাল, শ্যামা ছুটে গেল ঘরে জলখাবার আনতে। জামাই অফিসের ফেরত আসবে খবর পেয়ে সে গুড় দিয়েই চন্দ্রপুলি করে রেখেছিল, আর ক্ষুদ-ভাজার নাড়ু। তার সঙ্গে দুটো পাকা কলা কেটে জামাইয়ের সামনে সাজিয়ে দিলে।

অগত্যা অভয়পদকে বসতে হ’ল।

আবারও কথাটা উঠল।

প্রথম প্রথম যতটা অসম্ভব ব’লে মনে হয়েছিল প্রস্তাবটা–ক্রমশ আর ততটা অসম্ভব রইল না। প্রথম মাথা ঠাণ্ডা হ’ল শ্যামারই। রেলের চাকরি পাকা চাকরি। না হয় শত্রু হাসবে একটু প্রথম প্রথম। ভাল চাকরি আজকাল অত সোজা নয়। চাকরি পাবার সময় একটু মাথা হেঁট করতেই হয়।

তারপর অত বড় অফিসে কে কোথায় থাকবে! কে-ই বা মনে রাখবে কথাটা!

‘কিন্তু গেলেই কি ক’রে দেবে? মিছিমিছি সেই মুখ পুড়িয়ে যাওয়া ছোটলোকদের কাছে।’ তবু একটু দ্বিধাগ্রস্তভাবে বলে শ্যামা।

‘তা বোধ হয় দেবে। শিবু ঠিক ওর মায়ের মতো নয়, পথে যখনই দেখা হয়–আসা যাওয়ার সময়–ভাইঝির খবর নেয়,আপনাদের কথাও জিজ্ঞাসা করে। তা ছাড়া হাজার হোক ছেলেমানুষ–বাহাদুরি দেখাবার লোভও তো একটা আছে। …বরং এক কাজ করা যেতে পারে। শনিবার হাওড়া স্টেশনে দাঁড়িয়ে থাকলে দেখা হতে পারে। কোন্ ট্রেনে ফেরে তা আমি জানি। কথায় কথায় চাকরির কথাটা পেড়ে দেখা যেতে পারে। তেমন বুঝলে তখন বাড়ি যাওয়া যাবে।’

তারপর একেবারে ছাতা হাতে ক’রে উঠে দাঁড়িয়ে বলে, ‘তাহলে শনিবার একটার সময় ইন্টার ক্লাস ওয়েটিং রুমের সামনে দাঁড়িয়ে থেকো।

হয়ত আর একটু আলোচনা করতে পারলে খুশি হ’ত এরা–একবার ব্যাকুলভাবে কী বলতেও গেল শ্যামা, কিন্তু অনাবশ্যক বোধেই সে চেষ্টা আর করল না। জামাইকে এত দিনে ভাল ক’রেই চিনেছে। অকারণ আলোচনা সে করে না। আর তার হিসেবে কথাও সে অনেক বলেছে, বৃথা এখন আর একটি কথাও কইতে রাজী হবে না।

॥৩॥

শিবুর ক্ষমতা বা সদিচ্ছা সম্বন্ধে অভয়পদ যতই যা বলুক না কেন–শ্যামার বেশ খানিকটা সন্দেহ ছিল। যারা নিজের বংশের বৌ আর মেয়ের সঙ্গে অমন শত্রুতা করতে পারে, মতলব এঁটে যথাসর্বস্বে বঞ্চিত করতে পারে–তাদের যে কোন রকম মনুষ্যত্ব আর অবশিষ্ট আছে বলে মনে হল না ওর। শুধু-শুধুই শত্রু হাসাতে যাওয়া হয়তো। শত্রু হাসানোও বড় কথা নয়–যাদের মুখ দেখতে ইচ্ছে ক’রে না ইহজীবনে–তারই দোরে গিয়ে ‘কালামুখ নীলে ক’রে দাঁড়ানো। –এর চেয়ে সত্যিই যেন গলায় দড়ি দেওয়াই ভাল। নিতান্ত নাকি ছেলের নামে একটা কালি থেকে গেছে, তাও পাস-করা ছেলে নয়–বয়সেরও গাছপাথর নেই–এই ভেবেই বিদ্রোহী মনকে শান্ত করে শ্যামা। এখনও যদি চাকরিতে না ঢোকে তো কবে কি হবে? এমনিতেই তো সরকাররা যখন-তখন বলে, ‘ওর আর চাকরির বয়স নেই বামুনদি, মিথ্যে ও চেষ্টা করো না। বরং কোনও দোকানে খাতা লেকার কাজ-টাজ দেগ গে, হাতের লেখাটা ভাল–হয়ে যেতে পারে। তবে তাও যে পাবে বলে মনে হয় না, যা চোর-বদনাম রটে গেছে।’

এই সব কথা মনে পড়েই চুপ ক’রে যায় শ্যামা।

কিন্তু কার্যকালে দেখা যায় অভয়পদর হিসেবে কিছুমাত্র ভুল হয়নি। শিবু সম্বন্ধে তার অনুমান অভ্রান্ত। সত্যিই সে অসাধ্য সাধন করলে। মাস দেড়েকের চেষ্টাতেই অফিসে বসিয়ে দিল সে। কেরানীরই চাকরি–কারখানা বলে লোহাপেটানোর কাজ নয়, যদিচ তখন যা হেমের মানসিক অবস্থা, লোহা পেটানোতেও খুব আপত্তি ছিল না। মাইনেটা অবশ্য যৎসামান্য–মাসে আঠারো টাকার মতো–তাব এ মাইনে বেশিদিন থাকবে না, শিবু বারবার বেশ জোর দিয়েই সে ভরসা দিয়েছে। কোনমতে খাতায় নামটা একবার ওঠা নিয়ে কথা, তার পর একটু ভাল জায়গায় সরিয়ে দিতে কতক্ষণ।

সে যা হোক, মাইনে নিয়ে শ্যামা মাথা ঘামায় না–চাকরি একটা হয়েছে এইতেই সে খুশি। রেলের চাকরি–লোককে বলতে কইতে, বিয়ের বাজারে ছেলের দাম উঠে গেল।

.

কিন্তু ছেলের বিয়ের কথা এখন ভাবলে চলবে না তা শ্যামা জানে। ছেলের বয়স যতই হোক–বেটাছেলের বিয়ের বয়স পার হয় না কখনও–মেয়েকে নিয়েই এখন তার বড় সমস্যা। তরুকে আর কোনমতেই রাখা যায় না ঘরে। যা হোক ক’রে এবার পার করতে হবে। পাড়াঘরের লোক এখানকার ভাল তাই–অন্য জায়গা হলে হয়তো একটা দুর্নাম তুলে দিয়েই বসে থাকত।

শ্যামা অবশ্য ঠিক ছেলের চাকরির জন্যে বসে ছিল না। টাকা, এই বলতে গেলে বিনা আয়ে সংসার চালিয়েও, কিছু জমেছে তার। উমার কাছে যে ফল পাঠায়–কিছুদিন ধরেই তার দাম নিচ্ছে না সে। বলে দিয়েছে, ‘তোর কাছে রেখে দে, যা হোক ভিক্ষে-দুঃখু ক’রেও চালাব আমি ঠিক–এইটেই আমার ভরসা রইল। একেবারে শুধু হাতে কিছু মেয়ের বিয়ে হবে না, আর সবটাই জামাইয়ের ওপর ভরসা করা ঠিক নয়।’

জামাই টাকা দেবে সে তা জানে। এবার নিতেও তার খুব সংকোচ নেই–কারণ সে এমনি নেবে না, ধারই নেবে। ধার শোধ করতেও পারবে এ বিশ্বাস তার এখন হয়েছ। এর ভেতরে সে রোজগারের আর একটা উপায় বার ক’রে ফেলেছে। এখানে চার আনা আট আনা এক টাকা ধার করবার লোক ঢের। থালা বাটি ঘটি বাঁধা রেখে নেয়, টাকা মারা যাবার ভয় নেই, অথচ সুদ পাওয়া যায় ভাল। চার আনা আট আনায় এক পয়সা সুদ। এক টাকা হলেই দু পয়সা।

প্রথম প্রথম শ্যামা ফিরিয়েই দিত। সে এক যন্ত্রণা। নতুন বামুনদি একরাশ নগদ টাকা দিয়েই বাড়ি কিনেছে অথচ তার হাতে চার আনা আট আনা পয়সা নেই এ কেউ বিশ্বাস করে না। আর ‘নেই’ বলতে–এবং সেটা বিশ্বাস করবার জন্যে যতখানি জোর দিয়ে বলতে হয়, ততটা জোর দিয়ে বলতে নিজেরও সংকোচে বাধে। মাথাটা বড় বেশি হেঁট হয়ে যায় যেন। তবু তাও করতে হয়েছে বাধ্য হয়েই, কিন্তু তার পরই বুদ্ধিটা খুলে গেল। জামাই একগাদা টাকা ধার দিয়ে রেখেছে–অম্বিকাপদর নাম ক’রে দিলেও টাকাটা যে ওরই তা জানে–সুতরাং তার কাছে চাওয়া যায় না আর। অথচ আয়ের এমন পথটাও ছেড়ে দিতে মন সরে না। ছেলের রোজগার নেই, সরকারবাড়ির বাঁধা- বরাদ্দ বন্ধ–তার ওপর খরচ বেড়ে গেছে আগের চেয়ে। জামাইয়ের দেনা শোধ করতে হবে, সে তাগাদা না দিক, নিজের চক্ষুলজ্জা আছে। আগে আগে সে মনে করত যে চার আনা আট আনা পয়সা ধার করতে আসে অমনহি–চার আনার আবার সুদ কি? দৈবাৎ একদিন সুদের হারটা শুনে আর স্থির থাকতে পারলে না। মহাশ্বেতাকে ডেকে কাকুতি-মিনতি ক’রে তার কাছ থেকে কুড়িটা টাকা চেয়ে নিলে–ধার হিসেবেই। যুদ্ধের বাজারে যখন অভয়পদর পকেট বোঝাই থাকত তখন মহাশ্বেতা টাকাটা সিকেটা সরিয়ে হাতে দু-চার টাকা করেছে তা শ্যামা জানে। ধার বলে চাইতে মহাশ্বেতাও ইতস্তত করেনি। তবে টাকাটা নিয়ে শ্যামা কি করবে তা মহাশ্বেতাও জানতে চায় নি–শ্যামাও বলে নি। ইচ্ছে ক’রেই বলেনি। ওর এই অবস্থায় টাকা ধার নিয়ে তেজারতি কারবার করতে চায়–কথাটা অত্যন্ত হাস্যকর এবং অবিশ্বাস্য। তা ছাড়া এই টাকা খাঁটিয়ে রোজগার করবে সে–শুনলে মহাশ্বেতা মাথাতে যাবে না, সে দিক দিয়ে শ্যামা নিশ্চিন্ত। যার এক পয়সা আয় নেই–এতগুলি পেট খেতে–সে সুদে খাটাবার জন্যে টাকা চাইছে–এ মহাশ্বেতা কেন, কারুর মাথাতেই যাবে না।

সেই কুড়ি টাকা মূলধন খাঁটিয়ে ইতিমধ্যে অনেক কটা-টাকাই করেছে শ্যামা। দুটো থলে বোঝাই হয়ে গেছে বন্ধকী বাসনে। চার আনা ধার দিলে মাসে এক পয়সা সুদ–অর্থাৎ টাকায় এক আনা। কিন্তু গোটা টাকা নিলে দু’ পয়সার বেশি পাওয়া যাবে না। শ্যামা তাই চেষ্টা করত চার আনা হিসেব ধার দিতেই। আট আনা চাইতে এলে চার আনা দিত। আবার চার আনা দিত হয়তো পরের দিন–আলাদা একটা বাটি কি একটা হাতা রেখে, এ দুটো মিলিয়ে আট আনার হিসেব ধরা হ’ত না–আলাদা আলাদা ঋণ হিসেবে পৃথক পৃথক সুদ ধরে নিত। তাতে টাকা পিছু এক আনাই দাঁড়ায় মাসে।

এই সুদের প্রায় সবটাই জমে। খুব প্রয়োজন না হলে–অর্থাৎ একেবারে হাঁড়িচড়া বন্ধ না হলে এ থেকে খরচা করে না সে। তার ফলে একদিন হিসেব ক’রে দেখেছিল যে মোট এখন তার দেড়শোর ওপর খাটছে এই কারবারে। বাসন বাঁধা রেখে কারবারের সুবিধা এই–বেশিদিন টাকা পড়ে থাকে না। পুরো মাস রাখে না প্রায় কেউই। দরকারের জিনিস, চার আনা আজ নিলে কাল হয়তো জন-খেটে হোক কি কারুর বাগানে কাজ ক’রে হোক মজুরি পেলেই সতেরোটি পয়সা শোধ দিয়ে গেল। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এই ধরনের ধার করতে আসে মেয়েরা–তাদের হাতের জিনিসে টান বেশি–তারা পুরুষের অসুবিধা থাকলেও জোর ক’রে আদায় করে আনে ধারের পয়সা। একবার সীতার শাশুড়ি একটা পাঁইজোর রেখে পাঁচ টাকা নিয়ে গিয়েছিল টাকায় তিন পয়সা সুদ কবুল করে–আর এ মুখো হয়নি। সুদে আসলে জিনিসের দাম চাপিয়ে গেছে কিন্তু ঠিক বেচে-কেনে নিতে সাহসে কুলোয় নি শ্যামার–কে জানে এরপর এসে যদি দাঙ্গাহাঙ্গামা করে। সেই থেকে নাকে কানে মলেছে সে–পুরো এক টাকার বেশি ধার কাউকে দেয় না। বেশি চাইতে এলে চোখ কপালে তুলে বলে, তিন টাকা। ওমা অত টাকা কোথা পাব বাছা। তোমরা তো বেশ লোক, দেখচ গামছা কানি পরে থাকি, সারা দিন পাতা কুড়িয়ে নারকোল পাতা চেঁচে পেট চালাই–তার কাছে এসেছ তিন টাকা ধার চাইতে। মল্লিক গিন্নির কাছে যাও! নয়তো বলে, ‘চৌধুরীদের বড় বৌ থাকতে এখানে কেন এসেছ বাছা?’

চার আনা করে ধার দিলে সাত দিনে উসুল হয়; তাতে–হিসেব ক’রে দেখেছে শ্যামা–গড়পড়তা এক টাকা খাটলে মাসে অন্তত পাঁচ পয়সা আয় হয়ই। তার মানে তিনটে টাকা খাটলে এক মাসে চার আনা–সে চার আনা আবার মাসে সওয়া পয়সা দিতে থাকে। বেশি লোভে কাজ নেই তার।

টাকার জন্য কৃচ্ছ্রতা বড় কম করছে না সে। আরও করতে পারত যদি ঐন্দ্রিলাটা একটু বুঝদার হ’ত। ওর বড়লোকের হাত হয়ে গেছে। ছেলেবেলা দিদিমার সংসারে ছিল, তার পর পড়ল গিয়ে ঘোষালদের ঘরে। সেখানে ফেলাছড়ার মতো অবস্থা না হোক–প্রাচুর্য ছিল। ফলে রান্না করতে দিলেই বিপদ–কিছুতে হাত-টেনে চলতে পারে না। পরিষ্কার মুখের উপর বলে দেয়, ‘ওসব ডোয়ো-ডোকলার রান্না কখনও শিখি নি, এখন আর শিখতে পারব না। রাঁধতে হয় তুমি রাঁধ।’

রাঁধতে পারে শ্যামা–তার জন্য কিছু নয়। এত দিনের দারিদ্র্যই তাকে হাতে ধরে শিখিয়েছে, আদৌ তেল না দিয়ে বা মশলা না দিয়ে কেমন ক’রে রাঁধতে হয়। কিন্তু সে যদি ঐ নিয়ে থাকে তো এদিক করে কে? পাতা কুড়নো, পাতা চাঁচা, বাগোেনর তদবির করা, সুদ কষা, তেজারতি, পাইকদের সঙ্গে নারকোল-সুপুরি নিয়ে দর কষাকষি, টাকা আদায়–এক কথায় পুরুষের কাজ। তা ছাড়া বিনা বাজারে রান্না তার, সকাল থেকে সুষুনি কলমি শাক তুলতে, ডুমুর পাড়তে, কি কঁচকলা গুনে দেখে কাটতেই এক প্রহর বেলা কেটে যায়। সে ছাড়া এগুলো যে আর কেউ পারবে না। তরুকে আসতে দিতে চায় না, হয়তো রং ময়লা হয়ে যাবে রোদে পড়ে মাটি ঘেঁটে। আইবুড়ো মেয়ে চেহারা দেখিয়ে পার করতে হবে। হেম বাইরে থাকে, আর এক-আধ দিনের জন্য এলেও এসব উঞ্ছবৃত্তি তার দ্বারা হয় না। বড় জোর বাগানের মাটিটা কুপিয়ে দিলে কি কলাঝাড়ের এঁটে মারলে। এই কাজগুলোই তার জন্যে রেখে দেয় শ্যামা।

তাছাড়া শ্যামা দেখেছে–কাজ নিয়ে থাকলে তবু ঐন্দ্রিলা এক রকম থাকে, বসে থাকলে অহরহ ঝগড়া। দিনরাত কাক চিল বসতে দেয় না একেবারে। তার সব চেয়ে বেশি রাগ যেন তরুর ওপর–কথায় কথায় শাপশাপান্ত করে। ‘দেখব তোর তেজই বা কদ্দিন থাকে। তেজ ভাঙবে, আমার মতো হাল হবে, সর্বস্ব খুইয়ে তুইও পথে বসবি।’ তরু শান্ত স্বভাবের মেয়ে–সে এই অকারণ বিদ্বেষ ও অহেতুক আক্রমণের কোন জবাবই দিতে পারে না, শুধু চোখের জল ফেলে। শ্যামা দু-একবার শাসন করতে যে যায় নি তা নয়, কিন্তু তাতে লাভের মধ্যে শুধু গালাগালিটা তরুর ওপর থেকে ওর ওপরই এসে পড়েছে। এমন অকথা-কুকথা বলে গালাগাল দেয় যে শুনলে কানে আঙুল না দিয়ে পারা যায় না। মেয়েকে হয়েছে ওর সাপের ছুঁচো ধরা, ফেলাও যায় না, গেলাও যায় না।

সুতরাং রাঁধতেই দিতে হয়। আর তা নিয়ে অশান্তির শেষ নেই। এক পয়সা ক’রে তেল কিনতে পরলে হয় বটে–কিন্তু কে নিত্য দোকানে যায়? কান্তি নেই, পরের ছেলেটা সাত বছরের হয়ে মারা গেছে–এমন কেউ নেই যে হাট-বাজার করে। শেষে অনেক খেচাখেচির পর ঐন্দ্রিলাই এক ফন্দি বার করছে, বলেছে, ‘তুমি বাবা তেলের শিশিতে দাগ কেেট দাও ওষুধের দোকানের মতো। পাঁচ ছটাক তেল তো আসে–যদি আট দিন চালানোর মতলব হয় তো আটটা দাগ কেটে দিও–কি দশটা। যা পারি যেমন করে পারি আমি ঐ দাগেই চালাব।’

মেয়ের মেজাজ ভাল থাকলে শ্যামা বুঝিয়ে বলার চেষ্টা করে, ‘তেল মোটে আগে দিবি নি। যেটুকু তেল দিবি তাতে আনাজ কষাও হবে না, মিছিমিছি তেলটা মাটি। আগে নুন বাটনা দিয়ে সেদ্ধ করে নিবি–পয়ে সুদ্ধ একটু ফোড়ন চেঁয়ানের মতো তেল ঢেলে সাঁত্সাবি। তাতে গন্ধটা আে হবে–তাতেই ব্যান্নন উরে যাবে দেখবি। বলি তেলের তো কোন স্বাদ নেই–শুধু গন্ধ। যত শেষে দিবি তত গন্ধ ঠিক থাকবে। বুঝলি না? তবে লঙ্কাফোড়ন দিস নি কখনও–যেটুকু তেল তা হলে এ লঙ্কাতেই শুষে নেবে!’

মেয়ে হাত-পা নেড়ে বলে, ‘মাইরি মা তুমি একটা পয়সা বাঁচাবার ইস্কুল খোল। বিস্তর মেয়ে পাবে বলে দিচ্ছি। চার গণ্ডা ক’রে মাইনে নিলেও তোমার পয়সা খায় কে! মেয়েরা না আসুক, পুরুষরা জোর ক’রে ভর্তি ক’রে দিয়ে যাবে।’ কিছুমাত্র অপ্রতিভ না হয়ে শ্যামা বলে, ‘তা তো পারি খুলতে। অনেকেরই সুসার হয় তাতে, বুঝিলি। বেশির ভাগই দেখি ডাইনে আনতে বাঁয়ে কুলোচ্ছে না–অথচ বাইরের ঠাট বজায় দিতে গিয়ে সব্বস্বান্ত। কেন বাবা, যেমন আয় তেমনি ব্যয় কর না–তাতে অশান্তি হয় না কিছু। তা তো নয়, ফোতো নবাবিটুকু চাই ষোল আনা। বিশেষ দেখি মাগীদেরেই নবাবি বেশি। আমি কম তেলে রাঁধতে পারি না–আমি আতেলা তরকারি মুখে দিতে পারি না–সুর টেনে টেনে আদিখ্যেতার কথা শুনলে বেম্ভাণ্ড জ্বলে যায় আমার। টাকা তো রোজগার করতে হয় না–কী কষ্টে আসে তা তোরা কি বুঝবি!’

।।৪।।

শেষ পর্যন্ত মঙ্গলার সেই সম্বন্ধই নিতে হয়। এদিকে ভাল ছেলে, কি এক বিলিতি সওদাগরী আপিসে কাজ করে, মাইনে চল্লিশ টাকা–উপরিতে দুনো পুষিয়ে যায়। একটা পাসের পড়া পর্যন্ত পড়েছিল, পাসটা দিতে পারে নি। মা- বাপ নেই, আছে বুড়ী ঠাকুরমা। বুড়ী বাপের বাড়ির দরুন বিস্তর জমিজমা পেয়েছিল, সে সবই আছে। হয়তো তা ছাড়াও নগদ টাকা কিছু আছে। বুড়ীর আদরেই পাস দিতে পারে নি। ঘুড়ি উড়িয়ে ডাংগুলি খেলে কাটিয়েছে। তা হোক-মাথা আছে। কথাবার্তা পরিষ্কার। পাত্র সব দিক দিয়েই ভাল। একমাত্র দোষ ঐ সতীনের। তা এমন কিছু নয়–বুড়ী লেখাপড়া করিয়ে সব দিক দিয়ে পরিষ্কার ক’রে রেখেছে। সে বৌ আর তার বাবা দুজনেই সে নাদাবি-নামায় সই ক’রে দিয়েছে–জমিটা পেয়ে তারা সব স্বত্ব ছেড়ে দিচ্ছে। তাছাড়া এই তো মোটে তেইশ বছর বয়স—-তা এ বয়সে তো কত লোকের পেরথম পক্ষই হয় না, এই তো ধর না কেন তোরই ছেলে, দেখতে দেখতে যেটের কম বয়সটি কী হ’ল। এরপর ওর কনেই পাবি না। তখন মিছে ক’রে বলতে হবে দোজবরে, নইলে লোকে ভাববে ছেলের কোন দোষ ছিল, তা নাহলে অ্যাদ্দিন বে হয় নি কেন?’

বলেন আর অন্ধকার মুখগহ্বর বিস্তার ক’রে হাসেন হা-হা ক’রে।

শ্যামা এবার মন তির করে। কিন্তু তাও, এ সৌভাগ্য যেন তার বিশ্বাস হয় না। বলে, ‘এ কী আর আমার বরাতে হবে মা, কত কি হেঁকে বসবে তার ঠিক কি!’

‘তুই রেখে বোস দিকি! সতীনের ওপর আবার খাঁই কি! খাঁই করলে চলবে কেন। হাজার হোক একবার দাগ তো পড়ে গেছে। দোজবরে এমন ফুটফুটে মেয়ে পাচ্ছে এই কত না…সে আমি বলে দিয়েছি বুড়ীকে মুখের ওপর। ওলো বামুনি কে জানিস, আমার পিসতুতো নন্দাই দুড়কি দত্ত, সে হ’ল বুড়ীর প্রেজা। ওদের বাড়িতে আসে পেরায়। সেইখানে দেখা আমার সঙ্গে। কথায় কথায় কথা উঠল, বুড়ী বলে আমার হারানোর জন্যে একটা ভাল মেয়ে দেখে দাও না। আগে মনে পড়ে নি, বলেছিলুম কায়েতের ঘর হলে দু কুড়ি দশ গণ্ডা মেয়ে এনে দিতে পারতুম–এ যে বামুনের ঘরের মেয়ে চাইছ মা। …তার পরই মনে পড়ে গেল। সোন্দর মেয়ে শুনে বুড়ী বলেছে আমার এক পয়সা চাই নি। মেয়ে পছন্দ হলে দেনাপাওনার কথাই তুলব না। যা দেবে তাই নেব। তা তোর এখন থেকে অত ভাবনা কি, মেয়ে দেখা না আগে।

শ্যামা একটু আশ্বস্ত হয়। মেয়ে ঐন্দ্রিলার মতো রূপসী নয় ঠিকই–নাক- চোখ-মুখ খুব একটা সাকারও নয়–তবে আর পাঁচটা মেয়ের তুলনায় ভালই দেখতে। তাছাড়া গৌর বর্ণটা আছে। সেখানেও হয়তো ঐন্দ্রিলার চেয়ে কিছু নিরেস–কিন্তু তবু ফরসাই যে তাতে সন্দেহ নেই। আর সর্বোদোষ হলে গোরা।

‘তাই তা হলে দেখাও মা। কবে কী হবে–আমি খবর পাব কী ক’রে?’ ‘খবর তোকে নিতে হবে না। আমি বুড়ীকে বলে দিয়েছি–সামনের রবিবার খোদ নাতিকে সঙ্গে ক’রে যাব তোদের বাড়ি। নাতি ঢুকবে না, ওখানে ঐ চৌধুরীপাড়াতেই ওর কে ফেরেন্ড আছে, তায় বাড়ি গে বসে থাকবে। বুড়ী যাবে। কেমন, ঠিক করি নি?’

নিজের বুদ্ধির তারিফে নিজেই হেসে ওঠেন আবার হা-হা ক’রে।

তারপর বলেন, ‘ভালয় ভালয় বে হয়ে গেলে ঘটকী-বিদেয় দিবি তো? দ্যাখ্–ভাল ঘটকী বিদেয় কবুল না করলে ফাংচি দেব।’

‘তোমার নাত্নীর বিয়ে–ঘটকী-বিদেয় আবার কি। নুন-ভাত যা জোটে খেয়ে এসো এক পেট।’

‘তবেই হয়েছে।’ পিঁটকী খন খন্ ক’রে ওঠে। ওর এই বয়সেই দাঁত পড়তে শুরু হয়েছে, কথা জড়িয়ে যায়। তাই গলায় জোর দিয়ে কথা বলা অভ্যাস হয়ে গেছে। বলে, ‘মা কি কোথাও খায় নাকি? খাওয়া দাওয়া তো ছেড়ে দিয়েছে। এখন তো মার কাছে বিশ্বব্রেহ্মাণ্ড নোংরা। দেখছ না উঠোনের মাঝখানে আড়ষ্ট হয় দাঁড়িয়ে আছে, অথচ কাপড় এখনও ভিজে, সদ্য গা ধুয়ে আসছে ঘাট থেকে। ঐ যে নতুন এক ঘর পিরিলী বামুন এসেছে এখানে, ওদের বৌ সেদিন দশটা টাকা ধার নিয়েছিল একটা নাকছাবি রেখে, মা গা ধুয়ে আসছে, সেই টাকা শোধ দিয়ে গেল। তা গেল তো গেল–সে তো আর অতশত জানে না, টাকাটা দিয়ে গেল হাতে হাত ঠেকিয়ে–ব্যাস, আর রক্ষে আছে–এখন আবার পুকুরে যাবে, গলা অবধি ওলাবে, নোটখানা ধোবে–তবে ঘরে ঢুকবে।’

‘নোট ধোবে কি!’ প্রায় আর্তনাদ করে ওঠে শ্যামা। দশ-দশটা টাকা–যদি নষ্ট হয় যায়। টাকা–তা সে যারই হোক–নষ্ট হচ্ছে শুনলে বুকে বাজে বৈকি!

‘তবে না তো কি! ধোবে তারপর উনুনপাড়ে রেখে শুকোবে, তবে বাক্সয় তুলবে।’

‘তুই থাম দিকি। হাটিপাটি পেড়ে সব কথা সবাইকে না শোনালে চলে নানা? বলে আহাম্মুক নম্বর চার–ঘরের কথা করে বার!’

মঙ্গলা রেগে গজগজ করতে করতে ঘাটের দিকে চলে যান।

শ্যামা বলে, ‘তা ভিজে কাপড়ে ছুঁয়েছে তাতেও দোষ?’

‘নিশ্চয়ই, কাপড়ের জলটা তো ওর ছোঁওয়া হয়ে গেল। পুস্করিণীতে দোষ নেই–পিতিষ্টে করা বলে। কাপড়ে বয়ে আনলে দোষ জন্মায় বৈকি!’

পিঁটকী ম্লান হাসে। কারণ এটা তাদের পক্ষে–বিশেষ ক’রে তার পক্ষে আর কৌতুকের কথা নয়। এর ধাক্কা বেশির ভাগ তাকেই পোয়াতে হয়। পাত্রপক্ষ তরুবালাকে দেখে পছন্দ ক’রে গেলেন। পাত্রের ঠাকুমা ভারি খুশী–তখনই আশীর্বাদ করে যেতে চান। অতি কষ্টে নিবৃত্ত করে শ্যামা, ভাল দিন দেখে পাকা-দেখাটা করা দরকার। সিদ্ধেশ্বরীতলায় পাঁজি দেখিয়ে না এলে সে আশীর্বাদ করতে দেবে না।

হারানের ঠাকুমা বললেন, ‘সে যা হয় করো মা, কিন্তু সামনের তিন মাস বে নেই–যা করতে হবে এই মাসে। আমার এই ধর চার কুড়ি বছর বয়স হতে চলল, শরীরেরও এই অবস্থা–কবে বলতে কবে ফেঁসে যাব, তখন ছেলেটা একটু ভাত-জলের পিত্যিশী হয়ে দোরে দোরে ঘুরে বেড়াবে–তা হতে দোব না। মেয়ে আরও দু-একটা দেখে রেখেছি–অবিশ্য পছন্দের মেয়ে নয় সে সব–তবে নাপায্যিমানে তাদেরই কাউকে নিতে হবে, অগত্যে। এই সাফ্ সাফ্ বলে দিলুন!’

এ মাস অর্থাৎ আর কুড়ি দিন বাকী। শ্যামার মুখ শুকিয়ে যায়।

কিছু দিতে হবে না–বুড়ী গিন্নী বলে দিয়েছেন বটে, কিন্তু সেই সঙ্গে এও বলে দিয়েছেন যে ‘দানসামিগিরীমমস্কারী যেন খারাপ না হয়। আমাদেরও তো পাঁচটা কুটুম্বসাক্ষেৎ আসবে, কিন্তু এসব সামনে ব্যাভ্রম না হই। নগদ টাকাটা কেউ সিন্দুক খুলে দেখতে আসবে না, কিন্তু এসব সামনে থাকবে! লোকে না ভাবে এর নাতির বে হচ্ছিল না বলে কোনমতে হাভাতের ঘরের মেয়ে এনেছে!’

শ্যামা তখনই ছোটে সিদ্ধেশ্বরীতলায় দিন দেখাতে। এ মাসের শেষ বিয়ের দিন পড়ছে আর ঠিক বারো দিনের মাথায়। মাথায় হাত দিয়ে বসবার কথা, কিন্তু মাথায় হাত কেন, মেঝেতে মাথা কুটলেও বিয়ে হবে না তা সে জানে। বুড়ী তিন মাস অপেক্ষা করবে না–তা তার গলার আওয়াজেই বুঝেছে সে, তা ছাড়া তিন মাস অনেক সময়, শ্যামাও সে ঝুঁকি নিতে প্রস্তুত নয়। যদি আরও ভাল মেয়ে পেয়ে যায় ওরা–অথবা মাঝারি মেয়ের সঙ্গে টাকার পাওনাটা ভাল হয়–তা হলে কি আর তখন ওর মেয়ে নেবে?

অথচ বারো দিন। কী ক’রেই বা হয়।

সেই রাত্রে হেমকে পাঠায় শ্যামা বড় জামাইয়ের কাছে। এক দেনা শোধ হয় নি, আবার দেনার প্রস্তাব পাঠানো–কথাটা মুখে উচ্চারণ করতেই লজ্জায় মাথা কাটা যায়–অথচ ওরই বা কে আছে ঐ অধম-তারণ জামাইটি ছাড়া।

অভয়পদর কোমরে একটা ব্যথা ধরেছে, সে আসতে পারলে না, সে কিন্তু হেমের মুখে সব শুনে বলে দিলে, ‘মাকে ও সম্বন্ধ হাতছাড়া করতে বারণ কর। যা হোক ক’রে হয়েই যাবে। ও ছেলেকে আমি জানি–প্রথম বয়সে বড় বকে গিয়েছিল, কিন্তু এখন মন দিয়ে চাকরি-বাকরি করে শুনেছি, থিয়েটারের শখ খুব–তা নিজের বাড়িতেই ক্লাব বসিয়েছে, বাইরে কোথাও যায় না। নানা ঝঞ্ঝাটে ওর কথাটা এতদিন মনে পড়ে নি। তা ছাড়া–শুনেছি কী সব ফাঁড়া- টাড়া ছিল। অবিশ্যি যদি সে সব কেটে গিয়ে থাকে তো আর আপত্তি কি!’ শ্যামা পরের দিন ভোরবেলাই ছুটল কলকাতাতে। উমা নতুন বাড়িতে চলে আসার পর একবার মাত্র এসেছিল সে–গোবিন্দকে সঙ্গে ক’রে। বাড়ি ঠিক মনে নেই–তবু আগে দিদির বাড়ি গেল না ইচ্ছে ক’রেই। দিদির কাছে কান্নাকাটি ক’রে মোটা কিছু আদায় করতে হবে, উমার কাছে টাকা আদায় করতে যাচ্ছে শুনলে দিদির হাত গুটিয়ে আসবে!

উমা শুনে আনন্দ প্রকাশ করলে। নিজে থেকেই বললে, খান দুই নমস্কারী সে দেবে। ওর ছাত্রীরা কাপড় দেয় কেউ কেউ–তা থেকে ভাল শাড়ি দুখানা তুলে রেখেছে সে তরুর বিয়ের কথা ভেবেই।

উমার তখন রান্না চড়েছে। এখানে এসে রাত্রে আর রান্নার হাঙ্গামা করে না–বাড়ি ফিরতেই আটটা-নটা হয়ে যায়, তখন উনুন ধরিয়ে রাঁধতে বসা পোষায় না। তা ছাড়া ঘুঁটে-কয়লা খরচের কথাও ভাবতে হয়। প্রথম প্রথম রুটি ক’রে রাখত, কিন্তু সকাল দশটার রুটি রাত দশটায় এসে চিবোতে রীতিমত কষ্ট হয়। এখন অনেকখানি ক’রে সাবু ক’রে রাখে। রাত্রে এসে দুধসাবু খায়। দুধসাবু–তার সঙ্গে ঘরে নারকোল নাড়ু করা থাকলে তাই দুটো–নইলে বাজার থেকে সস্তার মিষ্টি নারকোল ছাপা বা তিলকুটো কিনে আনে–তাই। শীতকাল হলে একটু তরকারিও রেখে দেয়।

শ্যামা যখন এল তখন উমার সাবু আর একটা তরকারি নেমেছে, ভাত চড়াতে যাচ্ছে। ওকে দেখে একেবারে চালেডালে চড়িয়ে দিলে। ঘরে অন্য জলখাবার ছিল না কিছু, অগত্যা দুধসাবুই একবাটি ধলে দিলে ওকে–তার সঙ্গে দুটো তিলকুটো। তার পর নিজের তোরঙ্গ খুলে (মা’র দরুন তোরঙ্গ এটা–তার ভেতরই শ্যামা লক্ষ্য করে এখনও কেমন মজবুত আছে, সেকালের জিনিস, ওর দাম কত! উমিটা কত কী-ই পেলে!) কাপড়ের তলা থেকে একটা ন্যাকড়ায় বাঁধা টাকা-পয়সা বার ক’রে ওর সামনে দিয়ে বললে, ‘দ্যাখ দিকি গুনে কত আছে। আমার গোনা-গাঁথা নেই যেদিন যা পাই এনে ঐতেই রেখে দিই। হিসেবনিকেশ গোনাগাঁথার সময়ই বা কৈ, করেই বা কে!

পুঁটুলির আকৃতিটা দেখেই শ্যামা যেন অনেকখানি দমে যায়। ওর যে অনেক আশা এর ওপর। সে ব্যগ্র কম্পিত হাতে পুঁটুলিটা খুলে গুনতে বসে। টাকা, নোট, খুচরো–একগাদা। কিন্তু তবু অভ্যস্ত চোখে বুঝতে পারে এর মোট মূল্যের পরিমাণ ওর আন্দাজের চেয়ে অনেক কম।

বার বার তিনবার গোনে শ্যামা, ছিয়াশি টাকা সাত আনা।

‘এ কী রে! আর? ভগ্ন স্খলিত কণ্ঠে প্রশ্ন করে সে। যেন আর্তনাদের মতো শোনায় প্রশ্নটা।

‘আর কোথা পাব! তোমার যা ফলবেচা টাকা সব ঐতেই আছে।’

‘সে কি! এ কী সব্বনেশে কথা রে! আমার যে ঢের বেশি পাবার কথা, আমি যে এর ওপর ভরসা ক’রে বসে আছি।’

‘পাবার কথা!’ তীক্ষ্ণ হয়ে ওঠে উমার কণ্ঠস্বর, ‘পাবার কথা, তার মানে কি। কত পাবার কথা, তুমি জানলে কী ক’রে? এর কি কোন লেখাপড়া হিসেব-নিকেশ আছে?’

‘ঠিক হিসেবনিকেশ নেই–তবু একটা আন্দাজ তো আছে। এত দিন নিই নি–এই ক’টি টাকা হবে কী ক’রে। তুই অন্য কোথাও রাখিস নি তো? মনে ক’রে দ্যাখ একবার বরং; ভুলে–কি এমনি–হাত আজাড়ের অভাবে?’

মিনতির মত শোনায় শ্যামার গলা। কিন্তু তবু তার ভেতরেই যেন একটা অন্য ধরনের সন্দেহও কোথায় উঁকি মারে।

আর সেইটে লক্ষ্য করেই নিমেষে জ্বলে ওঠে উমা, ‘বলছি এই সব হিসেবে-নিকেশের ভয়েই তোমার ফল বেচা টাকা আমি কোথাও রাখি না–যত কাজই থাক, বাড়ি ফিরে আলাদা ক’রে রেখে দিই কাপড় কেচে এসে, শত কাজ ফেলে, এমন কি ইষ্টমন্ত্র জপ করবারও আগে তোমার টাকা তুলে রেখে দিই! আর কোথাও থাকে না, তুমি নিশ্চিন্ত থাকো। তা ছাড়া এই টাকাটাই কি সোজা–পনরো-কুড়ি দিন অন্তর অন্তর তো হেম দিয়ে যায় চার-পাঁচটা পেঁপে, সাত-আটটা নারকোল–তাতে হবেই বা কী ক’রে। কী এমন নশো পঞ্চাশ টাকা দামের জিনিস ওসব!

‘চার-পাঁচটা পেঁপে আট-দশটা নারকোল ঠিকই–কিন্তু সেই কী সাধারণ জিনিস! তা ছাড়া ছড়াকলাও তো পাঠিয়েছি, ভাল কালীবৌ কলা আমার। যেমন মোটা তেমনি বড় মোলাম কলা। একোটা কলা এক পয়সা আমার ওখানে বসে বিক্রি হয়!’

বলতে বলতে পেট-কাপড়ে বাঁধা তিন-চারখানা কাগজ বার করে শ্যামা। কান্তির ফেলে যাওয়া বাদামী কাগজের খাতা থেকে ছেঁড়া তাতেই তারিখ দিয়ে দিয়ে সে লিখে রেখেছে কবেকার চালানে কী কী মাল এসেছে। কটা পেঁপে কটা নারকেল কটা কলা! মাল আর তার পারে আনুমানিক মূল্য। সেটা যোগ দিয়ে দাঁড়িয়েছ প্রায় পৌনে দুশো টাকার মতো।

কাগজগুলো উমার সামনে ফেলে দিয়ে বিজয়গর্বে বলে ওঠে শ্যামা, ‘এই তো! হিসেব তো সামনেই রয়েছে, আমি কি আর বিনা হিসেবে এত কথা বলছি! একশো বাহাত্তর হবার কথা–নিদেন দেড়শোও তো হবে। এত কম হয় কি করে!’

উমার মুখ লাল হয়ে ওঠে, সে তাড়াতাড়ি কাগজগুলো তুলে নিয়ে চোখ বুলিয়েই ফেলে দেয় শ্যামার সামনে ‘এ কী করেছ, সব পেঁপে গড়পড়তা তিন আনা হিসেবে দাম ধরে বসে আছ, সব নারকোল তিন আনা! তাই কেউ দেয়? ছোট বড় একদাম? বাজারে একটা মাঝারি পেঁপের দাম চার পয়সা–সেই জিনিসের কত দাম নেওয়া যায় বল! তারাও তো বাজারে যায় রোজ-না কি? খুব বড় হলে–দেখাবার মতো হলে সেটায় তিন কেন চার আনাও আদায় করা যায়। তাই বলে গড়পড়তা সব তিন আনা! আর নারকোল তো তুমি বেচছ সাড়ে তিন টাকা শ–পঁয়ত্রিশ টাকা হাজার। সেই নারকোল এখানে কত দাম হবে মনে কর? বাজারে গিয়ে দ্যাখ, বড় বড় নারকোল এক একটা এক আনায় বিক্রি হচ্ছে। তাও দেইনি আমি, তবু ছ পয়সার কম নিই না কোনটা, খুব মিষ্টি মোলাম নারকোল–এমনি নানান বক্তৃতা দিয়ে গছাই। বড়গুলো দু আনা পর্যন্ত ধরি। তাও তোমার ফল তো ছোটই হয়ে আসছে ক্রমশ। দাতার নারকোল বকিলের বাঁশ–তোমার নারকোল ছোট হবে জানা কথাই।’

হতাশ ক্ষুব্ধ মুখে বসে থাকে শ্যামা কিছুক্ষণ, তারপর রীতিমত বিরস কণ্ঠে বলে, ‘কী ক’রে জানব বল, এই ফলই আগে তুমি যে দামে বিক্রি করেছ সেই হিসেবেই আমি দাম ধরে রেখেছি। মেয়ে বে দিতে হবে, আকণ্ঠ দেনায় ডুবে আছি–সেই জন্যেই আরও এত হিসেব রাখা। কোথায় দাঁড়াছি সেটা বুঝতে হবে তো। এমন জানলে সদ্য-সদ্যই নিয়ে নিতুম। তাতে ভুলচুক হবার অত পথ থাকত না। আমারই বোকামি–টাকাটা ওখানে সুদে খাটালে দশ গুণ বেড়ে যেতে। উলটে এ কমেই গেল আসল থেকে!’

‘তার মানে কি বলতে চাইছ, পষ্ট করে বল দিকি! আমি তোমার টাকা মেরে দিয়েছি–এই তো? চুরি করে খেয়েছি–না নাকি? বেশ তো, এতকাল ধরে ঘাড়ে ক’রে ক’রে ফিরিওয়ালার মতো বেচেছি তারও তো একটা দালালিদস্তুরি আছে, মজুরি আছে, সেইটেই ধর না কেন!’

এবার শ্যামার হিংস্র চেহারাটা পুরোপুরি বেরিয়ে পড়ে। সে সমান ভাবেই জবাব দেয়, ‘সে নিলেও তো বাঁচতুম–তাতে এত যেত না। এ যে মূলেই হাভাত!’

উমাও আর সামলাতে পারে না। বলে, ‘ইতর ছোটলোকদের সঙ্গে ঘর ক’রে ক’রে তুমিও ইতর হয়ে গেছ, তাই এমন কথাটি বলতে পারলে। আমার কী গরজ পড়েছিল এতখানি নীচু হয়ে লোকের বাড়ি বাড়ি ফল বিক্রি ক’রে বেড়াবার? এই সব ফলের যে এত দাম হতে পারে, তা তুমি জানতে কখনও? তোমার ওধারে বাজারে কী দরে বিক্রি হয়? এ পথ দেখালে কে? সে প্রবৃত্তি যদি আমার থাকত, তা হলে প্রথম থেকেই তো পয়সা সরাতে পারতুম। যে পেঁপে চার আনা পাঁচ আনায় বিক্রি করেছি এককালে, সে পেঁপের জন্যে তিন আনা দশ পয়সা দিলেও তুমি বর্তে যেতে। তোমার উপকার হবে বলেই তো করা; কারবার করছি জানলে নগদ কিনে নিয়ে কারবার করতুম–তাতে ঢের লাভ হ’ত। বেশ হয়েছে–উচিত শিক্ষা হয়েছে। তুমি যাও, কত টাকা তোমার চুরি ব’লো হিসেব ক’রে–একেবারে না পারি মাসে মাসে দিয়েও কড়াক্রান্তিতে শোধ ক’রে দেব। আর কখনও কিন্তু এ-মুখো হয়ো না। ফলও পাঠিও না!’

এবার শ্যামা অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে। ভয়ও হয় তার। সত্যিই যদি ফল না এখানে পাঠাতে পারে তো সিকি দামও পাবে না। অর্ধেক ফল বিক্রিই হবে না, ওখানে খদ্দের কোথায় এত? আর বাজারে বসে বিক্রিই বা করতে যাচ্ছে কে?

অপেক্ষাকৃত নরম সুরে বলে, ‘না, না। তাই কি আমি বলছি–তা বলছি না। ভুলও তো হতে পারে–তাই বলা। আমার বড্ড ভরসা ছিল কিনা, এই টাকাটা হিসেবে ধরা ছিল তাই। চুরির কথা কে বলেছে–তোর সব উল্টো- পাল্টা কথা–’

বলে আর আড়ে আড়ে উমার পানে তাকায়। উমার মুখ অঙ্গার-বর্ণ হয়ে উঠেছে, দৃষ্টি কঠিন। সেদিকে চেয়ে ভয়-ভয়ই করে শ্যামার। উমা কিন্তু আর জবাব দেয় না, কথাও বলে না। অগত্যা সে একটি দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে টাকাগুলো আর একবার গুনতে বসে। এ টাকাতে কিছুই হবে না ওর, অন্তত একশো টাকা পুরো হলেও কথা ছিল। দান-সামগ্রী, বরযাত্রী খাওয়ানো–কন্যাযাত্রী দু-চার জন বলতে হবে, নতুন পাড়ায় নতুন বাড়িতে এসে এই ওর প্রথম কাজ–তা ছাড়া বরের আংটি আছে, মেয়েকেও কোন্ না দুগাছা রুলি আর কানের একটা কিছু দিতে হবে। বড় জামাইয়ের জামাই- বরণের ধুতি চাদর দেওয়া আছে–একজন তো এ দায় থেকে অব্যাহতি দিয়ে গেল। তবে সে বেঁচে থাকলে এ বিয়ের দায়টা সম্পূর্ণ তার ওপরই চাপাতে পারত। বড় জামাইকে অবশ্য বরণের সময় একখানা গামছা দিলেও সে কিছু বলবে না–কিন্তু তা করতে চায় না শ্যামা। জামাইয়ের মতো জামাই–সে যা করেছে ছেলেতেও তা করতে পারে না আজকাল। স্বামীপুত্র থেকে যে আশা করে নি, সেই আশা সে সফল করে দিয়েছে, নিজের বাড়ি ক’রে দিয়েছে।

আবারও একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে শ্যামা। উমা হেঁট হয়ে খিচুড়ি নাড়ছে। মুখটাও ভাল ক’রে দেখতে পাওয়া যাচ্ছে না তার। রাগ করছে বটে–কিন্তু এত তফাত কখনো হতে পারে না। অন্তত আরও পঁচিশ-তিরিশ টাকা কি ওর ন্যায্য প্রাপ্য নয়? নিজেকে রীতিমত বঞ্চিত বোধ করে শ্যামা। যে হিসেবে দাম পেয়ে এসেছে এতকাল, সেই হিসেবেই সে দাম ধরেছে মনে মনে–তবে এত তফাত কেন হবে?

নিজের মনকে শাসন করতে চায় শ্যামা, উমা ঠকাচ্ছে তাকে–এমন সন্দেহ যেন সে না করে, ভুল হওয়াই স্বাভাবিক। হয়তো ভুল করে নিজে দু- চার আনা খরচ ক’রে ফেলেছে মধ্যে মধ্যে, মনে নেই। হয়তো আঁচলে ক’রে নিজের পয়সাও নিয়ে গিয়েছিল, ফলের দামও সেই আঁচলে বেঁধেছে, ফিরে এসে একসঙ্গেই নিজের বাক্সয় রেখে দিয়েছে, এমনও হতে পারে। সেকি দিয়ে একবারও ভাবছে না উমা, কেবল রাগ করছে।

কিন্তু তাতেই কি এত তফাত হয়! অবশ্য শ্যামাও হয়তো বেশি বেশি ধরেছে হিসেব। তবে তার জন্যে না হয় পঁচিশটে টাকা কম হোক! তাই বলে এত?

একটা কুটিল সংশয় তার মনের মধ্যে একটু একটু ক’রে মাথা তোলেই, কিছুতে তাকে দমন করতে পারে না শ্যামা। …

খিচুড়ি নামিয়ে ঠাঁই ক’রে নিঃশব্দেই তাকে খেতে দেয় উমা। নিজেও খেতে বসে। কিন্তু দুজনের কেউ খেতে পারে না। উমা নিঃশব্দ দহনে দগ্ধ হচ্ছে–তার আহারে রুচি থাকা সম্ভব নয়; আর শ্যামার এই টাকার শোক। বহু ছেলেমেয়ে মারা গেছে তার, সে শোকের মতো না হোক, কাছাকাছিই এটা। তবু শ্যামা কোনমতে জোর ক’রে পাতের আহার্য শেষ করে, কিন্তু উমার পক্ষে তা সম্ভব হয় না। খানিকটা খেয়েই উঠে পড়ে।

তার পর তাকে দ্রুত কাজ সেরে নিতে হয়। বাসন-কোসন মেজে উনুন নিকিয়ে, রান্নার জায়গা ধুয়ে একেবারে কাপড় কেচে আসে সে। এবার বেরোবে ছেলে পড়াতে। বেলা দেড়টা বেজে গেছে, দুটোর মধ্যে বেরিয়ে পড়বে।

শ্যামা ইঙ্গিত বুঝে উঠে পড়ে। তাকেও দিদির ওখানে যেতে হবে। উমার ফিরে আসা পর্যন্ত অপেক্ষা করলে চলবে না। কথা আছে কিছু কিছু বাজার সেরে হেমের সঙ্গে বাড়ি ফিরবে। হেম পাঁচটার মধ্যে দিদির ওখানে পৌঁছবে।

কিন্তু কাপড় দুখানার কথা উমা আর উচ্চবাচ্য করছে না যে! সে দুটো পেলেও তবু অনেকখানি হয়। একটু কেশে গলাটা পরিষ্কার ক’রে নিয়ে শ্যামা বলে, ‘হেমকে পাঠাব বরং রবিবার শাড়ি দুটো তার হাতে নিয়ে দিস?’

‘না দাঁড়াও। তুমিই নিয়ে যাও। হেমকে পাঠাতে হবে না।’

‘হেম তো আসবেই। তুই একবার যাবি তো, তরুর বিয়েতে?’

‘যাব না যে তা তুমি ভাল করেই জান ছোড়দি। মিছিমিছি হেমকে তার জন্যে পাঠাতে হবে না।

উমা মায়ের দরুন দেরাজটা খুলে শাড়ি দুখানা বার করে। তার পর মায়েরই ক্যাশবাক্সটা খুলে হাতড়ে হাতড়ে কতকগুলো টাকাপয়সা বার করে। সেগুলো একটা ন্যাকড়ায় জড়িয়ে শ্যামার সামনে ধরে দিয়ে বলে, ‘এগুলো নিয়ে গিয়ে বাড়িতে গুনে দেখো কত আছে। আর কত দিতে হবে চিঠি লিখে জানিও–আমি মাসে মাসে যেমন ক’রে পারি না খেয়েও শোধ দেব। তবে আমার তো ন’শো পঞ্চাশ টাকা আয় নয়–খেয়ে-পরে সামান্যই বাঁচে, তার মধ্যে খাওয়াটা কমাতে পারি, তাই বাঁচিয়েই দেব।’

শ্যামা ব্যস্ত হয়ে ওঠে, ‘আমি কি তাই বলিছি? তুই বা দিবি কেন, আর আমার হিসেবই যে বেদবাক্য তাই বা কে বলেছে। আমি একটা আন্দাজ ক’রে রেখেছিলুম এই পর্যন্ত। আমারও তো ভুল হতে পারে।’

উমা ক্লান্ত কণ্ঠে বলে, ‘ভুল দুজনেরই হতে পারে। সব চেয়ে বড় ভুল হয়েছে আমার এ কাজ ঘাড় পেতে নেওয়া আর তোমার ভুল হয়েছে বিশ্বাস ক’রে টাকাগুলো আমার কাছে ফেলে রাখা। নাও, এখন ওঠ দিকি–আমার দেরি হয়ে যাচ্ছে।’

শ্যামা একবার ওর মুখের পানে চেয়ে শুধু শাড়ি দুখানা হাতে ক’রে তুলে নিয়ে উঠে দাঁড়াল। উমা আঙুল দিয়ে টাকাটা দেখিয়ে বললে, ‘ওটাও নিয়ে যাও ছোড়দি–নইলে আপসোসের সীমা থাকবে না। চক্ষুলজ্জায় টাকাটা খুইও না। তা ছাড়া বিয়েটা তো দেওয়া চাই। টাকা যখন হিসেবে কমই পড়ল, তখন ওটা দিয়ে ভোক্তন ক’রে নাও। টাকা কুড়ির মতো হবে বোধ হয়।’

শ্যামা রাগ ক’রে বলে, ‘তোর দিন দিন বড় চ্যাটাং চ্যাটাং বাক্যি হয়েছে উমা। আমি কি বললুম আর তুই কি বুঝলি। ও টাকায় আমার দরকার নেই। মেয়ের বে আমার অদৃষ্টে থাকে তো হবেই। তোর যদি দেবার মন থাকত তো এমনিই দিতে পারতিম–এভাবে আমি নিতে পারব না।’

‘সে তোমার ইচ্ছে। কিন্তু নিলেই ভাল করতে। মনে মনে চির দিনই আমাকে চোর ধরে রাখবে। তখন এটা না নেওয়ার জন্য হাত কামড়াবে শুধু শুধু।’

সে টাকাটা তুলে রাখে আবার। শ্যামা সেদিকে চেয়ে আর একটা ছোট নিঃশ্বাস ফেলে বেরিয়ে পড়ে।

টাকাটা পেলে একশো টাকা পুরো হ’ত এটা ঠিকই। কিন্তু ভবিষ্যতের কথা চিন্তা ক’রেই এ টাকার লোভ সংবরণ করলে সে। যদি এর পর সত্যিই আর কিছু না বেচে উমা!

তা হলে একেবারে দাঁড়িয়ে লোকসান। হেম যা ছেলে, সে কিছুতেই বাজারে গিয়ে ওসব বেচতে পারবে না। আর বেচলেই কি এত দাম উঠবে? ওর অর্ধেকও হবে না।

ঊনবিংশ পরিচ্ছেদ

॥১॥

তরুর বিয়ে উপলক্ষে অনেকগুলো অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটে গেল। আর সেজন্য তরুর ভবিষ্যৎ ভেবে শ্যামা বেশ একটু কণ্টকিত হয়েই রইল। মহাশ্বেতা যখন ওর কোলে এসেছে তখন সব চেয়ে দুর্দিন, তবু তার বিয়েই সব চেয়ে নির্বিঘ্নে এবং এখন দেখা যাচ্ছে সব চেয়ে ভাল হয়েছে। ঐন্দ্রিলারও বিয়ের সময় অন্তত কিছুমাত্র বেগ পেতে হয় নি। ওর বরাত–নইলে ঘর বর সবই ভাল পেয়েছিল; কিন্তু তরুর বিয়েটা যেন কি রকম হয়ে গেল।

প্রথমত উমার সঙ্গে কাটান-ছিড়েন হয়ে যাওয়া।

সেদিন যখন নগদ কুড়ি-পঁচিশ টাকার মায়া কাটিয়ে চলে এসেছিল শ্যামা, তখন ভবিষ্যতের কথাটাই বেশি ক’রে ভেবেছিল। উমা যে এমন কাণ্ডটা করবে তা সে একবারও ভাবে নি। এমন কি দু-তিন দিন পরে যখন কুড়ি টাকার একটা মনিঅর্ডার এল ওর নামে–তখনও ঠিক এতটা বুঝতে পারে নি। কুপনে লেখা ছিল–’তরুর আইবুড়ো-ভাতের জন্যে যৎসামান্য পাঠালাম।’ তাতেও ভেবেছিল যে, উমা একটু নরমই হয়েছে পরে–নইলে টাকাটা এভাবে পাঠাত না। তা ছাড়া আইবুড়ো ভাত তো তার দেওয়া উচিতই–না হয় কিছু বেশি দিয়েছে, সাহায্য হিসেবে।

তবু অস্বস্তি একটা ছিলই। তাই বিয়ের একদিন আগে হেম যখন বাজার করতে কলকাতায় গেল তখন তার হাতে জোর ক’রেই কয়েকটা নারকোল পাঠিয়ে দিলে সে। বাজারের জন্যে বস্তা ঝুড়ি নিয়ে যাচ্ছিল হেম তার মধ্যে এগুলো নিয়ে যাওয়া খুবই অসুবিধা, আপত্তিও সে যথেষ্ট করেছিল কিন্তু শ্যামা একরকম অনুনয় বিনয়, ক’রেই গছিয়ে দিলে। বললে, ‘আমি বিয়ের কথা হচ্ছে বলে এসেছি, ঠিক নেমন্তন্ন সেদিন ক’রে আসতে পারি নি। একবার সেভাবে বলাও তো দরকার। দিদি যদি না-ও আসে, গোবিন্দ বৌমা যেন আগের দিন থেকে এসে থাকে, জোর দিয়ে বলে আসবি। আর উমা অবশ্যি আসবে না, কিন্তু তবু আমাদের কর্তব্য আসতে বলা। যাচ্ছিসই যখন, সেই ঝাড়নও নিয়ে যেতে হবে এ-কটা বয়ে নিয়ে যেতে অসুবিধা কি? ওখানে ঢেলে দিয়ে চলে আসবি, বয়ে তো বোড়তে হবে না!

কিন্তু হেম রাত্রে ফিরল মুখ কালি ক’রে। মাকে প্রায় যাচ্ছে তাই বললে সে, ‘তুমি এই কাণ্ড ক’রে বসে আছ। মাসী তোমার পয়সা চুরি করে! আর সেই কথা বলে এসে তিন দিন পরেই আবার তার কাছে মাল পাঠিয়েছ! কী রকম হেবায়া মেয়েমানুষ তুমি! ছি ছি! আমাকে ঘুণাক্ষরেও তো বল নি এ কথা–তা হলে কি এ গুখুরি করতুম! একেবার অপদস্থের শেষ! তা-ও এটুকু বুদ্ধি হ’ল না যে ব্যাপারটা একটু জুডুতে দাও!…তা না সাত দিনের মাথাতেই আবার সেইখানে মাল পাঠাতে গেলে! তোমার ভীমরতি হয়েচে–বেশ বুঝতে পারছি।’

না, উমা নারকোল রাখে নি। পরিষ্কার বলে দিয়েছে যে এ ভূতের ব্যাগার তার হবে না। বোন-বোনপো খেতে পাচ্ছিল না বলেই সে এতটা নীচু হয়ে ফিরিউলীর কাজ করেছে। আর তো এখন দরকার নেই। আর কেন? তা ছাড়া ভাল ঘোড়ার এক চাবুক, তার যথেষ্ট শিক্ষা হয়ে গেছে–আর নয়। প্যাঁচ- পয়জার-গুণগার–এর মধ্যে আর সে নেই। হেম যদি এমনি যায় তো স্বচ্ছন্দে যেতে পারে–তাদের ভালবাসে উমা, কল্যাণই চায়–কিন্তু এসব কেনাবেচার ব্যাপারে যেন আর না যায়, তা হলে ওর দরজা বন্ধ হয়ে যাবে এটা যেন মনে রাখে।

অগত্যা হেম সেই আট-আটটা নারকোল কমলাদের বাড়ি ঢেলে দিয়ে এসেছে। ওদের খেতে দিয়ে এসেছে! কী করবে, এত মালের মধ্যে ঐ বোঝা টেনে বেড়াবে কে! বেশি লাভের আশা তো গেলই–আসলেও টান। এখানে শ-দরে বেচলে তবু যে কটা পয়সা হ’ত–তাও গেল! বোন-বোনপো খাক–তার জন্যে কিছু নয়, সে তো মধ্যে মধ্যে সে দেয়ও এক-আধটা — কিন্তু তারই বা এত খয়রাত করতে গেলে চলে কি ক’রে, ঐ কটা নারকোল গাছই তো ভরসা! নিজের নির্বুদ্ধিতায় নিজেরই গালে মুখ চড়াতে ইচ্ছে করে শ্যামার–বেছে বেছে আজকের দিনই বা এত তাড়াতাড়ি করতে গেল কেন! ঘি-ময়দা-পাঁপর, একগাদা কাঁচা বাজার, তার মধ্যে নারকোলগুলো বয়ে ফিরিয়ে আনা সত্যিই সম্ভব নয়। তাও হাঁদারাম ছেলে যদি ‘এখন রইল পরে নিয়ে যাব’ বলেও রেখে আসত। কী সমাচার–না, লজ্জা করে! এত লজ্জা কি তোদের মানায়, যারা মোটা টাকা রোজগার করে তারা লজ্জার কথা তুললে তবু সাজে!

এদিকে তো এই–ওদিকে একটা বিশ্রী ব্যাপার হয়ে গেল সরকারদের সঙ্গে। ‘মাথার ওপর অভিভাবকের মতো দাঁড়িয়ে থেকে উদ্ধার করিয়ে দেবেন’ –এ কথা শ্যামাই বলে এসেছিল অক্ষয়বাবুকে। আর সত্যিই তার কে আছে, এক বড় জামাই, তা সে ওসব আদর-আপ্যায়ন-তত্ত্বাবধানের ধার ধারে না, নিজে ভূতের মতো খাটতে পারে শুধু। তা ছাড়া সে তো ভিয়েনের কাছেই জোড়া থাকবে–বলেই দিয়েছে যে, ‘একজন শুধু বামুন ব্যবস্থা করো, যোগাড়ে দরকার নেই, আমিই যোগাড় দেব।’ বড় জামাইয়ের বাড়ি, মেজ জামাই- বাড়িও বলতে হয়েছে-সদ্য সদ্য শিবু চাকরিটা ক’রে দিয়েছে,–সরকার-বাড়ি, তা ছাড়া বাড়ির ঠিক আশেপাশে যারা আছে–বাড়ি-পিছু একজন ক’রে বলতে বলতেই পঞ্চান্ন-ষাটজন হয়ে গেছে। তা ছাড়া বরযাত্রীও আসবে কুড়ি-পঁচিশজন মোট–অর্থাৎ প্রায় একেশোর ধাক্কা। হালুইকর বামুন তাই এবার একটা ঠিক করতে হয়েছে। তার সঙ্গে যোগাড় দেওয়া সহজ কাজ নয়, বড় জামাইকে অন্য কোন দিকে পাওয়া যাবে না।

সুতরাং সরকারদের ওপরই ভরসা।

তা অক্ষয়বাবু এসেও ছিলেন, তদ্‌বির তদারক করছিলেন যেমন করতে হয় তেমনিই। গোলমাল বাধল বরযাত্রী আসতে। বরের এক পিসেমশাই এসেছিলেন গাঁজাখোরের মতো চেহারা, তেমনিই গলার আওয়াজ…পরে শুনেছে শ্যামা যে লোকটা অতি হতভাগা, এদের সঙ্গে বিশেষ সম্পর্কও নেই, নিহাত মাথার ওপর একজনকে দাঁড়াতে হয় তাই আসতে বলেছিল বুড়ী দিদিশাশুড়ি,–তিনি এসেই তম্বি শুরু ক’রে দিলেন, ‘এই দান–? দানের বাসন তো মশাই আপনাদের মেয়েই ভোগ করবে–তা ঐ ফুঁয়ে-উড়ে যাওয়া বাসন কখানা না দিলেই পারতেন। ও আর কদিন! ও কি, বরের জুতো দেন নি?…গরদের পাঞ্জাবি দিয়েছেন তো? আংটি কৈ? সেটা একটু ভারি-ভুরি দিয়েছেন, না কি সেও অমনি ফঙ্গবেনে? বন্ধু-বান্ধবের কাছে মুখ দেখাতে পারবে না তা হলে আমাদের হারান। ঘড়ি, ঘড়ি কৈ? ঘড়ির চেহারা তো দেখছি না। ও হরি, আপনারা তা হলে ডোমের চুপড়ি ধুয়ে তোলাতে চান দেখছি…যা ছিরির ব্যবস্থা, মেয়েটাকেও শেষ অবধি ন্যাড়াবঁচো বার করবেন নাকি? কী ব্যাপার কিছুই তো বুঝতে পারছি না। ও মশাই কন্যেকর্তা কে আছেন–একবার আসুন তো দিকি এধারে, গয়না-গাঁটি কি কি দিলেন বলুন তো!’

হেম চটে আগুন হয়ে উঠেছিল, শ্যামা অতিকষ্টে তাকে সরিয়ে দিলে। তারও বুক দুর দুর করেছিল–এ আবার কি কথাবার্তা! না জানি কি অঘটন ঘটে!

এগিয়ে গেলেন অক্ষয়বাবু, ‘আপনি কে তা তো জানি না–বরের অভিভাবিকা যিনি এসেছিলেন দয়া ক’রে, যাঁর সঙ্গে বিয়ের কথাবার্তা হয়েছে–তিনি জানেন আমরা কিছুই দিতে পারব না। তিনি বার বার বলেও গেছেন কিছু চাই না তাঁর। এদের বলতে গেলে ভিক্ষে-দুঃখু ক’রে বে দেওয়া–কোথায় কি পাবে বলুন। যা দিয়েছে তাতেই খুশি হয়ে আপনারা দয়া ক’রে মেয়েটি উদ্ধার করুন!’

পিসেমশাইয়ের চোখ রক্তবর্ণ হয়ে উঠল–হয়তো আগে থাকতেই ছিল একটু, তিনি বললেন, ‘ও, আমি কে তা জানেন না? তা মশায় কে তা জানতে পারি কি? মশায়ের সঙ্গে এদের সম্বন্ধটা?’

একটু অপ্রস্তুত হলেন বৈকি অক্ষয়বাবু। একটু ঢোক গিলতে হ’ল। বললেন, ‘আমার নাম শ্রীঅক্ষয়চন্দ্র দে সরকার। এঁরা—’

.

‘এঁরা আমাদের পুরোহিত’–এই বলতেই যাচ্ছিলেন তিনি। কিন্তু তার আগেই বাড়ি-ফাটানো হাসি হেসে উঠলেন পিসেমশাই। বামুনের মেয়ের কায়েত অভিভাবক! বামুনের ঘরে কায়েত কন্যেকর্তা! …ওহে জগমোহন ব্যাপারটা তো ঘোরালো দেখছি। এখনও ভেবে দ্যাখ, এখানে বিয়ে দেবে কি না!…শাশুড়ি ঠাকরুন খোঁজখবর করেছিলেন তো ভাল করে?… এই তো–কথায় বলে স্ত্রী-বুদ্ধি প্রলয়ঙ্করী, মেয়ে-কর্তা কোন ব্যাপারেই ভাল না। এসব কি ওদের কাজ! দশহাত কাপড়ে কাছা দিতে পারে না ওরা। কী করতে কী ক’রে বসে রইল দ্যাখ দিকি!’

এর পরে অক্ষয়বাবুর মেজাজ ঠিক রাখা শক্ত। তিনি বললেন, কী বলছেন মশাই যা তা। একটু বুঝে-সুঝে বলুন। ভদ্রলোকের বাড়িতে এসে এসব কী কথা!’

‘কী, কী বললেন!…ভদ্রলোকের বাড়ি! তা যার বাড়ি–যাদের বাড়ি তারা কৈ? আমি বরের পিসেমশাই, ইনি জগমোহন ওর মামা–আপনি কনের কে বলুন আগে তবে এর পর কথার জবাব দেব। কথা হয় সামনে সামনে- কায়েতের সঙ্গে বামুন এ সব বে’র ব্যাপারে কথা কইবে কি?

জগমোহন–বরের মামা বটে, কিন্তু বরেরই প্রায় সমবয়সী–সে হাঁ হাঁ ক’রে উঠল। ও পক্ষে আরও দু-চারজন তিরস্কার করলেন, বর নিজেও যেন ধমক দিল একবার। এ পক্ষে বড়জামাই এসে হাতজোড় ক’রে দাঁড়াল (হেমকে ইচ্ছে ক’রেই সামনে আসতে দিলে না শ্যামা)–পিসেমশাই শান্ত হয়ে এলেন। বোধ করি নেশাতেও আচ্ছন্ন হয়ে এসেছিলেন, তিনি তার পর থেকে সমস্ত সময়টাই ঝিমিয়ে রইলেন, কনে যখন সভায় এল তখন তার গায়ে কী গয়না আছে না আছে ফিরেও দেখলেন না। তা ছাড়া জামাইয়ের ওপর বুড়ীর যে কী পর্যন্ত ভরসা–তা বোঝা গেল যখন সম্প্রদানের পর জগমোহন বুড়ীর পাঠানো চুড়ি আর হার বার ক’রে কনেকে পরিয়ে দিতে বললে। ওঁদেরই মুখ- দেখানি গহনা এগুলো, শুধু-গায়ে বৌ এসে নামবে, সেই লজ্জা থেকে বাঁচবার জন্য আগেই পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। বোঝা গেল নিজের জামাই বরকর্তা থাকতে ছেলের শালার ওপর তাঁর বিশ্বাস বেশি।

কিন্তু শান্ত হলেন না অক্ষয়বাবু। তিনি সম্প্রদান পর্যন্ত অপেক্ষা করলেন ঠিকই- –তবে জলস্পর্শ করলেন না। ছেলেমেয়েদেরও খেতে দিচ্ছিলেন না- নিহাত শ্যামা এসে ঢিপঢিপ ক’রে মাথা খুঁড়তে ওদের খেতে বললেন। নিজে শুধু এক গ্লাস জল খেয়ে বাড়ি চলে গেলেন। অথচ এদের কী দোষ তাও বোঝা গেল না। গাঁজাখোরই হোক আর নেশাখোরই হোক–একে বরযাত্রী তায় বরের পিসেমশাই, কুটুমের কুটুম–তাকে গলাধাক্কা দেওয়া যায় না। বিয়ের রাত্রে বরযাত্রীর বহু দাপট সহ্য করতে হয় সেটা অক্ষয়বাবুর জানা উচিত 1 শ্যামা অনেক বোঝালেও, কিন্তু তিনি অবুঝের মতো রাগ ক’রেই রইলেন। আশ্রয়দাতা উপকারী বন্ধু, এককালের মনিব বলতে গেলে–তিনি অভুক্ত চলে গেলেন বিয়েবাড়ি থেকে, মনটা খচখচ করতে লাগল শ্যামার। এদের অকল্যাণ বাঁচবার জন্যেই এক গ্লাস জল খেয়ে গেলেন বটে, কিন্তু তাতে কোন সান্ত্বনা পেলে না শ্যামা।

।।২।।

তবে যতই যা হোক–এ বিয়ে উপলক্ষে কিন্তু সব চেয়ে অশান্তি বাধালে ঐন্দ্রিলা। সেদিন উমার বাড়ি থেকে ফিরেই শ্যামা দক্ষযজ্ঞের মধ্যে পড়ল বলতে গেলে। একে উমার সঙ্গে ঐ বিরোধ উপলক্ষে মনটা যৎপরোনাস্তি খারাপ হয়ে ছিল, তার ওপর দিদির কাছে গিয়েও খানিকটা আশাভঙ্গ হয়েছে। ইদানীং ঝি রাখতে হয়েছে, বৌমা পোয়াতি, তাকে এটা-ওটা খাওয়াতে হচ্ছে–আরও নানা কারণে সংসারের খরচ বেড়ে গেছে–অথচ গোবিন্দর অফিসের অবস্থাও নাকি টলোমলো, এক মাসের মাইনে তিন মাস ধরে আদায় হচ্ছে–ইত্যাদি টানাটানির নানা অজুহাত দেখিয়ে দিদি দিয়েছিল মাত্র দশটি টাকা। এবার গোবিন্দ চাকরি-বাকরি করছে, আরও অনেক বেশি পাবার আশা ছিল শ্যামার, সে জায়গায় আগের বারের চেয়ে কমেই গেল টাকাটা। সেখানেও একটা বহু দিনের চাপা অসন্তোষ মাথা তুলেছে–ওর এখনও ধারণা থিয়েটারে কাজ করার সময় হেম মোটা মোটা টাকা দিয়েছে বড়মাসীকে। সেদিক দিয়ে একটু কৃতজ্ঞতাও থাকা উচিত ছিল না দিদির? ‘তা তো নয়–তখন খুব হাত বাড়িয়ে ফেলছেন, এখন আর তাল সামলাতে পারছেন না ঠাকরুন! মোটা আয় একটা বন্ধ হয়ে গেছে তো!’ মনে মনে যতটা ঝাঁজের সঙ্গে বলা সম্ভব ততটাই বলে সে।

একে তো এমনি নানা কারণে তিক্ত হয়ে ফিরছে, তার ওপর স্যাকরাদের বাঁশঝাড়টা ছড়াতেই কানে এল এক বিকট চিৎকার। নৈশ নিস্তব্ধতার মধ্যে সে চিৎকার ভয়াবহ শোনাচ্ছে–মনে হ’ল যেন বাড়িতে ডাকাত পড়েছে।

শোনা মাত্র দারুণ বিতৃষ্ণায় মন ভরে গিয়েছিল ঠিকই–তবু তার মধ্যেও কোথায় যেন একটা ক্ষীণ আশাও উঁকি মেরেছিল একবার। নরেন নিশ্চয়। সে- ই এসে তার অভ্যস্ত চেঁচামেচি শুরু ক’রে দিয়েছে, বেধেছে বাপেতে আর বেটীতে। বহুকাল আসে নি সে, কিছুদিন ধরে সমস্ত কাজ-কর্মের মধ্যে বার বারই মনে হয় তার কথা। কে জানে কোথায় আছে, কী ভাবে আছে! কোথাও হয়তো পঙ্গু হয়ে পড়ে আছে, মুখে জল দেবার কেউ নেই–কিংবা মুখ থুবড়ে পড়ে কোথাও মরেই গেছে হয়তো, ওরা কেউ জানতেও পারলে না। হয়তো ভিক্ষে ক’রেই খাচ্ছে–কে জানে! তার পক্ষে সবই সম্ভব।

সে আশার চমক লেগেছিল এক লহমা মাত্র! আরও দু কদম এগিয়ে যেতে যখন বোঝা গেল শুধুই নারীকণ্ঠের চিৎকার এবং একতরফা, তখন আর সে আশা রইল না। চুপ ক’রে মেয়ের গলাবাজি সহ্য করবার লোক নরেন নয়। এটা শুধুই একতরফা চিৎকার–ঐন্দ্রিলারই।

দারুণ বিতৃষ্ণায় মন ভরে গেল দুজনেরই। নিশীথ রাত্রের নিস্তব্ধতায় বহু দূর পর্যন্ত এ আওয়াজ পৌঁছচ্ছে, আশেপাশে ভদ্রলোকের বাড়ি। তারা না জানি কি মনে করছে! লোকে বলে হাড়াই-ডোমাই, কিন্তু তারা মদ খেলে চেঁচায় না। ভদ্রলোকের বাড়িতে রাতদুপুরে ডাকাত পড়া চেঁচানি–অলক্ষ্মীর দশা।

দুজনেই এগিয়ে গেল তাড়াতাড়ি।

দেখা গেল ব্যাপারটা আজ বহু দূর গড়িয়েছে। তরু শোবার ঘরে খিল দিয়ে দাঁড়িয়ে ঠক্‌ঠক্ ক’রে কাঁপছে। মেয়েটা পালিয়ে এসে অন্ধকারেই পুকুরঘাটে বসে আছে চুপ ক’রে। মা’র কাছে তার অন্ধকার বাগানের ভয়ও তুচ্ছ হয়ে গেছে আজ। আর ঐন্দ্রিলা একগাছা ঝাঁটা নিয়ে আস্ফালন করছে, মধ্যে মধ্যে বদ্ধ দোরে লাথি মারছে এবং অবিরাম অকথ্য গালিগালাজ চালিয়ে যাচ্ছে।

‘কী হয়েছে কি? ছোটলোকপনা! চুপ করবি–না কি?

আরও যেন জ্বলে উঠল ঐন্দ্রিলা, এদিকে ফিরে যেন একপাক নেচে নিলে সে, ‘কেন চুপ করব? কিসের জন্যে মুখ বুজে থাকব তাই শুনি! ঝিয়ের মত খাটব আর অপমান হব! আমি আর আমার মেয়ে হয়েছি তোমাদের চক্ষুশূল–নয়? মেয়েটাকে মেরে ফেলতে পারলে বাঁচো তোমরা, একটা পেট বেঁচে যায়। সে ফন্দিই এঁটেছ মায়েতে ঝিয়েতে–আমি কি কিছু বুঝি না? কেন, আমরা থাকলে ছোট মেয়েকে রাজরাণীর মতো বিয়ে দেওয়া যাবে না বুঝি–চক্ষুলজ্জায় বাধবে, না? ঘোচাচ্ছি তোমাদের বিয়ে, দাঁড়াও না। ফন্দি- আটা বার করছি আজ?’

.

হয়তো আরও বহুক্ষণ এইভাবে চলত, কারণ ওর সে রণচণ্ডী মূর্তির সামনে শ্যামাও ভয় পেয়ে গিয়েছিল। সে যাত্রা রক্ষা করলে হেমই–তার অকস্মাৎ ধৈর্যচ্যুতি ঘটল। এরকম অকারণ কলহ আজকের নয়, এক দিনের ঘটনা নয়, এ প্রায় নিত্য-নৈমিত্তিক হয়ে দাঁড়িয়েছে। সহ্যের সীমা লঙ্ঘন করেছে তার। মাত্র কিছুক্ষণ আগেই কমলাদের বাড়ি থেকে ফিরছে সে–হাসিতে, কৌতুকে, আদর-যত্নে অপরূপ নারী-মূর্তি দেখে এসেছে। সে মধুর স্মৃতি যে মধুরতর স্বপ্নরসে মনকে আচ্ছন্ন ক’রে রেখেছিল তা থেকে এই জাগরণ বড় বেশি রূঢ়, বড় বেশি দুঃসহ মনে হল। সে এগিয়ে এসে একেবারে ওর চুলের মুঠি ধরে ঠাসঠাস ক’রে গোটাকতক চড় বসিয়ে দিলে, ‘চুপ! একেবারে চুপ! নইলে শেষ ক’রে দেব একেবারে!’

সত্যিই কিন্তু এইতে কাজ হ’ল। স্তব্ধ হয়ে গেল একেবারে ঐন্দ্রিলা। জ্ঞান হবার পর থেকে তার গায়ে কেউ কোন দিন হাত তোলে নি। মা-বাবা নয়–দাদা নয়, কেউ নয়। মানুষ হয়েছে সে মাসীর কাছে, দিদিমার কাছে। রাশভারী লোক ছিলেন দিদিমা, তাঁর দৃষ্টিই ছিল যথেষ্ট, কারুর গায়ে হাত তোলবার তাঁর কোন দিন দরকার হ’ত না উমাও সেই স্বভাবই পেয়েছে কতকটা। সুতরাং এটা ওর একেবারে অভিজ্ঞতার বাইরে।

সে খানিকটা হতভম্বের মতো তাকিয়ে রইল দাদার মুখের দিকে। তার আয়ত চোখ দুটি বিস্ময়ে বিস্ফারিত হয়ে যেন স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল–পলকও পড়ছিল না। সেই ভাবে অবাক হয়ে কিছুক্ষণ থাকবার পর আস্তে আস্তে এক পা এক পা ক’রে পিছিয়ে গিয়ে রান্নাঘরের দাওয়ায় পৌঁছে বসে পড়ল!

তরুর মুখে তার পর ব্যাপারটা শোনা গেল।

হঠাৎ বিকেল থেকে শুরু করেছে ঐন্দ্রিলা, একেবারে যাকে বলে গায়েগাছকেটে ঝগড়া বাধানো। তরুকে উদ্দেশ্য ক’রে বলতে শুরু করেছে, ‘ঘোষালদের জ্ঞাতি বলে ভাল বরও পছন্দ হ’ল না। তা তার বদলে কী এমন তালেবর জুটল শুনি! ঐ তো ছিরির বর দাদাবাবু বলেছে বিশ্ববকাটে হয়ে গিয়েছিল–তাও সতীন সুদ্ধ–নিক্ না নিক্, সে কাঁটা বজায় আছে তো! কেন, ঘোষালদের ঘরে পড়লে কী মহাভারত অশুদ্ধটা হ’ত–তোর মেজদাদাবাবু তো ঐ ঘরেরই ছেলে! তার পায়ের নখের যুগ্যি বর পেলেও তরে যেতিস। তোদের বড্ড তেজ হয়েছে–বুঝেছিস! এত তেজ ভাল নয়। আমি হাজার হোক তোর দিদি, বয়সে বড়–আমাকে এত অপমান করা এতে হেনস্থা করা ধর্মে সইবে না বুঝলি!’

তরু অনেক্ষণ ধরে শুনেছে চুপ ক’রে, তার পর আর থাকতে পারে নি–বলেছে, ‘তা আমাকে এসব কথা বলছ কেন মেজদি, আমি কি আমার সম্বন্ধ ঠিক করেছি!’

না–তা নয়, তবে তুইও জানিস। শলাপরামর্শ তো হচ্ছে দেখছি দিনরাত, মায়ে-ঝিয়ে গুজগুজ ফুসফুস। তবে একটা কথা মনে করিয়ে দিস–বেইমানি ভাল নয়। সেই ঘোষালরাই ছিল তাই তো ছেলে চাকরি পেয়েছে, কৈ আর তো কেউ পারে নি চোর ছেলেকে চাকরি ক’রে দিতে!’

এইবার বোধ করি তরুর অবিচলিত ধৈর্যও টলেছে, সে জবাব দিয়েছে, ‘তা মেজদি, এত যদি ভাল ঘোষালরা তো তাদের ঘরের মেয়ে তারা পুষছে না কেন, চোরদের ঘরে এনে তুলেছে কেন! এই তো শুনেছিলুম, জুচ্চুরি ক’রে তারা যথাসর্বস্ব তোমার নিয়ে নিয়েছে–আজ আবার এত ভাল হয়ে গেল!’

ব্যস, এই টুকুই যথেষ্ট। তার পরই একেবারে রণরঙ্গিণী মূর্তি ধরেছে ঐন্দ্রিলা, কী, কী বললি–তুই সুদ্ধু আমার মেয়েকে ভাতের খোঁটা দিবি! তোর খাচ্ছে সে, না তোর ভাতারের খাচ্ছে! এখনও তো ভাতার হয়নি, তবে কোথা থেকে রোজগার ক’রে আনছিস তাই শুনি, খবরটা একবার নিবড়েয় পৌঁছে দিয়ে আসি। বড় বেশি খাচ্ছে, না? তাই আমি আর আমার মেয়ে হয়েছি তোমাদের চক্ষুশূল! কেন আমার মেয়েকে ভাতের খোঁটা দিবি তুই? পয়সা বাঁচলে কি তুই পাবি ভেবেছিস! বাঁচলে ভাইয়েরই থাকবে। তোকে বেশি করে দেবে না–ভয় নেই। ভাইয়ের সংসারে এত টান–ওরে আমার ভাই সোহাগী রে!’ ইত্যাদি ইত্যাদি–

তার পর থেকেই চলেছে। তরু একেবারে স্তব্ধ হয়ে গেছে কিন্তু তাইতে ওর আরও রাগ। ক্রমশ সে আবিষ্কার করেছে যে তাকে আর তার মেয়েকে মেরে ফেলবারই ষড়যন্ত্র চালিয়েছে এরা। নিত্য নূতন অপমান তাকে করে শুধু সেই অপমানে ঘেন্না হয়ে গিয়ে পুকুরে উলবে বলে।

গজরাতে গজরাতে বোধ করি রক্ত আরও চড়েছে মাথায়। শেষে খ্যাংরা হাতে তেড়ে এসেছে–’মরতে যদি হয় তো তোকে মেরে মরব!’ সেই সময়ই ভয় পেয়ে কোলের ভাইটাকে নিয়ে ঘরে দোর দিয়েছে তরু। পাড়ার দু-চারজন এসেছিল কিন্তু ঐন্দ্রিলার ঐ সংহার-মূর্তি দেখে সকলেই আবার সরে পড়েছে। ইশারায় শুধু তরুকে বলে দিয়ে গেছে যে সে দোর না খোলে–কোন কারণেই।

সারারাত তেমনি স্তব্ধ হয়ে রান্নাঘরে দাওয়ায় বসে রইল ঐন্দ্রিলা। শ্যামা ডাকলে না। রান্না হয় নি–বিকেল থেকেই এই কাণ্ড চলেছে, রাঁধবে কে? তখন আর কারুর ইচ্ছেও হ’ল না। ঘরে মুড়ি ভাজা ছিল–একটা নারকোল কুরে নিয়ে তাই ক’জনে ওরা খেলে এক গাল ক’রে। মেয়েটাকে আগেই টেনে এনেছিল শ্যামা, তাকে দিয়ে জিজ্ঞাসা ক’রে পাঠাল ঐন্দ্রিলাকে–সে কিছু খাবে কি না। ঐন্দ্রিলা জবাব দিলে না। মেয়েটাও কোনমতে একবার জিজ্ঞাসা ক’রেই দৌড়ে পালিয়ে এল, ‘আমার ভয় করছে দিদিমা, মা কেমন ক’রে চেয়ে আছে।’

ভয় শ্যামারও ছিল। ও যা মেয়ে, বাড়িতে আগুন লাগিয়ে পুড়িয়ে মারাও বিচিত্র নয় ওর পক্ষে। ওর মেয়েকে নিয়েই দোরে খিল দিয়ে শুয়ে পড়ল ওরা, কিন্তু কারুরই সে রাত্রে ভাল ক’রে ঘুম হ’ল না!

তবে ভয়ানক কিছুই করলে না সে। তেমনি জেগে বসে রইল শুধু। পরের দিন ভোরে মেয়েটা ঘর থেকে বেরোতেই তার একটা হাত ধরে টানতে টানতে বাড়ি থেকে বেরিয়ে চলল।

প্রথমটা অত বুঝতে পারে নি শ্যামা। একেবারে যখন ওদের বাগান পেরিয়ে আগড়ের কাছে এসে পড়েছে তখন ছুটে এসে একটা হাত ধরল সে, ‘কোথা চললি সাতসকালে! বাড়ি আয়, মেয়েটা খায় নি কাল থেকে–ওকেই বা টেনে নিয়ে যাচ্ছিস কেন?’

আবারও ভীষণ মূর্তি হয়ে উঠল ঐন্দ্রিলার, ‘খবরদার, আমাকে ধরবে তো বেটাদের মাথা খাবে–এই বলে দিলুম, পেয়ারের ছোট মেয়ের আমার মত হাত-মাথা দেখবে। যদি মার খেয়ে অপমান হয়ে পড়ে থাকতে হয় তো শ্বশুরবাড়িতেই পড়ে থাকব–সে আমার ঢের বেশি সম্মানের। ভায়ের সংসারে ঝিয়ের মতো খেটে বকশিশ পাব মার–চড়চাপড় গায়ের কাপড়–সে আমার দরকার নেই। ঘোষালদের ঘেন্না কর তোমরা, তাদের বৌ মেয়ে রাখতে ঘেন্না করে–রাখতে হবে না তোমাদের–আমরা যেখানকার জিনিস সেখানেই যাচ্ছি।’

মেয়েটাকে একটা হ্যাঁচকা টান দিয়ে আরও জোরে হাঁটতে শুরু করল সে।

।।৩।।

ঐন্দ্রিলা চলে যাওয়ার ফলে শ্যামা রীতিমত অসুবিধায় পড়ল। তরুর বিয়ের পর এক দিন মাত্র জোড় এসেছিল মেয়ে-জামাই, তার পর আর তরুকে ওর দিদিশাশুড়ি পাঠাল না। বললে, ‘আমার সংসার চলছে না বলেই তো ধেড়ে মেয়ে নিয়ে আসা। নাতির বে’র এত তাড়াও তে সেই জন্যে। আমি বুড়ো মানুষ বাতে পঙ্গু হয়ে পড়ে থাকি আদ্দেক দিন, ওকে ভাত জল দেয় কে! না, বৌ পাঠানো হবে না। আর–ঢের দিন তো বাপের বাড়ি রইল, আর কেন?’

ফলে সংসারের যাবতীয় কাজ–দু বেলা রান্না, বাসনমাজা, ঘর উঠোন নিকোনো ছড়া ঝাঁট–সবই শ্যামার ঘাড়ে এসে পড়ল। রান্না অবশ্য হাতি- ঘোড়া কিছু নয়–তবু দু বেলাই হাঁড়ি চাপাতে হয়। লিলুয়ায় যাওয়া, এখানে সাড়ে ছটার ট্রেন বাড়ি থেকে ছটার সময় না বেরোলে সে ট্রেন ধরা যায় না। তার মধ্যে স্নান খাওয়া সারতে হবে। সুতরাং রাজগঞ্জের কলে চারটে ভোঁ বাজার সঙ্গে সঙ্গে উঠে পড়েছে হয়তো, উনুনে পাতা জ্বেলে দিয়ে তবে মুখহাত ধুতে যাওয়া। সে ভাত-তরকারি দুপুরে নিজে খাওয়া যায়–কিন্তু আবার সন্ধ্যার পর কিংবা রাত আটটা নটায় ফিরে যে খাবে তার সামনে আর ধরে দেওয়া যায় না।

ঐন্দ্রিলা থাকতেও ভোরের রান্না অবশ্য শ্যামাকেই রাঁধতে হ’ত, কারণ অত ভোরে উঠে সে রাঁধতে পারবে না সাফ্ বলে দিয়েছিল–কিন্তু তার পর ছিল ছুটি, সারা দিন ধরে পুরুষ মানুষের কাজ–অর্থাৎ বাগান দেখা, ফল বিক্রি করা, পুকুরে ডিম ফোঁটানোর তবির, পাতা কুড়ানো–ক’রে বেড়াত নিশ্চিন্ত হয়ে। ঐন্দ্রিলা থাকত হেঁসেল আর রান্নাঘর নিয়ে, ক্ষার কাঁচাও তার উপর ভার ছিল। এধারে বাসনমাজা, ঘরদোর পরিষ্কার করা, বিছানা তোলা-পাড়া, ছড়া ঝাঁট–এগুলো ছিল তরুর। এখন সবগুলো ঘাড়ে এসে পড়ায় চোখে অন্ধকার দেখলে একেবারে।

.

ঐন্দ্রিলা যেদিন যায় সেদিনও শ্যামা এত বুঝতে পারে নি, ভেবেছিল সেখানে তারা আর কিছুতেই ঢুকতে দেবে না, দিলেও এক দিন কি দু দিন বড় জোর, তার পরই আবার ফিরে আসতে পথ পাবে না। কিন্তু হেম নিমন্ত্রণ করতে গিয়ে ব্যাপারটা বুঝে এল। হরিনাথের মা মাস-দুয়েক ধরে পক্ষাঘাতে পড়ে আছে বিছানায়, শিবুর নতুন বৌ পোয়াতি–কে কার মুখে জল দেয় তার ঠিক নেই। এই সময় ঐন্দ্রিলা গিয়ে পড়াতে ওরা হাত বাড়িয়ে স্বর্গ পেয়েছে। শুধু পেটভাতায় এত খাটবে এমন লোক কোথায় পাওয়া যাবে? সুতরাং মৌখিক আপ্যায়নের ত্রুটি হয় নি, এখন নাকি শাশুড়িও বৌমা বলতে অজ্ঞান। অর্থাৎ ঐন্দ্রিলা এখন সহজে ফিরছে না।

এর একমাত্র উপায় হচ্ছে আর একটি পরের মেয়ে নিয়ে আসা–অর্থাৎ হেমের বিয়ে দেওয়া। চাই কি–তাতে দেনাও খানিকটা হাল্কা হয়ে যেতে পারে। দেখতে ভাল, রেলে কাজ করে, নিজের বাড়িঘর আছে,–হাজার না হোক সাতআট শো টাকা নগদ খুব পাবে। তাতে বিয়ের খরচা ক’রেও খানিকটা দেনা শোধ দেওয়া যাবে। চাই কি যদি একটু নীরেস মেয়ে নেয় তো দেড় হাজার দু হাজার পাওয়াও বিচিত্র নয়। তবে তা করবে না শ্যামা, সুন্দরের ঘর ওর, পণ খারাপ করবে না।

এক দিন রাত্রে খেতে দিয়ে সেই কথাই তুলল শ্যামা, ‘সামনের একটা মাস পরেই তো আবার বে’র মাস পড়বে–এইবার তা হলে খোঁজখবর করি–কী বলিস? জামাই বলেছেন ওঁদের জানাশোনা কোথায় একটি মেয়ে আছে–দেখতে ভাল, বড় বংশ–একবার দেখে আসব ভাবছি!’

‘আবার কার বিয়ে?’ অন্যমনস্কভাবে খাচ্ছিল হেম, হঠাৎ চমকে উঠল, ‘আবার কী বিয়ে!’

‘ওমা, তোর বিয়ে দিতে হবে না?’

‘রক্ষে করো না। এই রোজগারে বিয়ে! আগে দুটো দিন খেয়ে পরে বাঁচি!’

‘রোজগার নিয়ে তোর কি হবে? সংসার কি তুই চালাস? তা ছাড়া এই তো আড়াইখানা পেট কমে গেল, তার জায়গায় একটা পেট চালাতে পারব না? আর এমন কি নবাব-নন্দিনী আনব যে তার জন্যে নিত্যি কালিয়া পোলাও চাই, লালবাগানের শাড়ি ছাড়া তাঁকে পরতে দেওয়া যাবে না! আমরা যা খাচ্ছি সুষুনি শাকের ঝোল ডুমুর ছেঁচকি, সে-ও তাই খাবে!

‘না না–ওসব এখন থাক।’ অত্যন্ত বিরস কণ্ঠে বলে হেম, ‘চিরদিন দুঃখের পেছনে দড়ি দিয়ে কাটল, টানাটানি আর টানাটানি–দুটো দিন হাঁফ ছাড়তে দাও। মেয়েরা তো পার হয়েছে, ছেলেকে নিয়ে এত মাথাব্যথা কেন!’

‘ওমা মাথাব্যথা কি সাধ ক’রে হয়, বয়স কত হ’ল বল দিকি। ঐ যে এক জন দোজপক্ষে করলে তা-ও তো তোর চেয়ে ঢের কম বয়সে।’

‘তা কি হবে! আজকাল অমন অনেকে করেছে। তেজবরেও তো করে ঢের লোক। একটু সামলে নাও দিকি, দেনাটা একটু কমুক। বৌ মানে তো একটা পেট নয়–এর পর যখন বাচ্ছা বাড়তে শুরু করবে তখন। কান্তিটা সামান্য একটু লেখাপড়ার জন্যে কোথায় পড়ে আছে! এই কি বিয়ে করার সময়?’

তা বটে। চুপ ক’রে যায় শ্যামা।

কান্তি অবশ্য খুব খারাপ নেই। তরুর বিয়েতে এসেছিল। ঢ্যাঙা হয়েছে অনেকটা–তবু খুব রোগা হয় নি। বেশ দেখতে হয়েছে। জামা-কাপড়ও দিব্যি, হেম সেরকম জিনিস কখনও চোখে দেখে নি। গত বছর ফার্স্ট হয়ে ক্লাসে উঠে প্রাইজ পেয়েছে। সব দিক দিয়েই ভাল। কুস্থান বটে–তা এমন কী আর, কুটুমের বাড়ি তো বটে।

খানিকটা পরে বলে, ‘আমি যে আর এধারে পারছি না। একা একা।’

‘বৌ এসেই কি একেবারে চার চালের ভার নেবে মাথায়! এখন দু’দিন থাক–এত বিরক ক’রো না।

হেম তাড়াতাড়ি আঁচিয়ে নিয়ে বাইরের চালা ঘরটার বারান্দায় এসে বসে। তাই কি একটু শান্তিতে বসবাস জো আছে, এমন দক্ষিণ-খোলা বারান্দা–তা গামড়া ছোবড়া নারকোল পাতা বোঝাই হয়ে আছে। ওরই মধ্যে জায়গা ক’রে নিয়ে বসে বটে কিন্তু কেমন ভয়-ভয়ও করে সাপ বিছে থাকা, বিচিত্র নয় তো।

বেশি রাত হয় নি–আটটা হবে বড় জোর। কিন্তু এরই মধ্য পাড়া-ঘর নিযুতি হয়ে এসেছে। মল্লিকদের কোন কোন ঘরে আলো জ্বলছে–বাগানের ফাঁক দিয়ে চোখে পড়ে! স্যাকরাদের বাড়ির দিক থেকে অস্পষ্ট একটা কথা বলার শব্দ কানে আসছে। আর কোন চিহ্ন কোথাও নেই জনবসতির। বিপুল এক নিশ্ছিদ্র অন্ধকারে সব যেন লেপে মুছে এক হয়ে গেছে। এমন কি ওদের সামনের পুকুরটাও দেখা যাচ্ছে না আর ভাল ক’রে। মধ্যে মধ্যে কাতলা মাছগুলো ঘাই না মারলে পুকুরের অস্তিত্বই টের পাওয়া যেত না!

তবে হ্যাঁ–মানুষের আলো নেই কিন্তু প্রকৃতির আলো আছে! জোনাকি আছে। হাজার হাজার–লক্ষ লক্ষ জোনাকি। দপদপ ক’রে নিভছে আর জ্বলছে। ওর সামনে পুকুরপাড়ের যেখানটা আমড়া গাছে চালতা গাছে আর আম গাছে জড়াজড়ি, তার ওপাশে নতুন বাঁশঝাড়টা উঠছে–সেইখানের সেই জমাট অন্ধকারে যেন জীবন্ত নীহারিকার মত তাল পাকিয়ে ঘুরছে সংখ্যাহীন জোনাকির দল। তাদের সেই লক্ষ লক্ষ অগ্নিকণার ঘুরপাক খাওয়া দেখতে দেখতে কেমন যেন ভয়-ভয় করে হেমের। মনে হয় মানুষ সংখ্যায় কত কম–এইসব পতঙ্গের তুলনায়! যদি তেমন কোন দিন আসে, ওরা আর সামান্য একটু শক্তি সঞ্চয় করে–তা হলে মানুষের কী দুর্গতিই না হবে!

এদিকে জোনাকি, ওদিকে ঝিঁঝিঁ পোকা। তার সঙ্গে গাং-ফড়িংগুলোর একঘেয়ে ডানা নাড়ার শব্দ। ঠিক ওর পিছনেই একটা ফড়িং–বোধ করি দেওয়াল আর ঢিপি-করা গামড়ার মধ্যে আটকে গেছে! মনে হচ্ছে পাশে বসে কে বাতাস খাচ্ছে পাখা নেড়ে। জানে ফড়িং–তবু যেন গা ছমছম করে কেমন! মানুষের আশেপাশে কত অসংখ্য প্রাণী রয়েছে কত রকমের, তারা নিঃশব্দে তাকিয়ে আছে ওদের দিকে–মানুষের দিকে। মানুষ লক্ষ্য করে না, অবজ্ঞা করে–কিন্তু তারা লক্ষ্য ক’রে যাচ্ছে ঠিকই! হয়তো হিংস্র দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে, অপেক্ষা করছে সুযোগের–যেদিন সময় পাবে সেইদিনই মানুষের এতকালে অকারণ হিংসার প্রতিশোধ গ্রহণ করবে। আর করেও তো–মাতাল রমা লাহিড়ীর বৌয়ের থেকেই বুঝেছে সে। বড় মাসীমার বাড়ির কখানা বাড়ি পরেই তারা থাকত–রমা লাহিড়ী চাবি দিয়ে বেরিয়ে গিয়েছিল, রুগ্না স্ত্রী–কে আবার উঠে দোর খোলে–এই জন্যে। তার পর পাল্লায় পড়ে দু দিন মদ খেয়েছে বসে বসে কোন আড্ডায়, যখন খেয়াল হয়েছে এসে দেখেছে–জ্যান্ত মেয়ে-ছেলেটাকে পিঁপড়েতে খাচ্ছে! খুব অসুস্থ, উঠে কোথাও যেতে পারে নি, রাজ্যের পিঁপড়ে এসে ছেঁকে ধরেছে। রমা লাহিড়ী যখন এসেছে তখনও প্ৰাণটা আছে, ধুক ধুক করছে–কিন্তু তখনই তাই চোখ কুরে খেয়ে ফেলেছে পিঁপড়েতে!…

শ্যামার নিজের খাওয়া শেষ হয়ে গেছে। ‘ল্যাম্পো’ নিয়ে ঘাটে এসেছে বাসন মাজতে। বাসন মাজা শেষ হলে অন্ধকারে হাতড়ে হাতড়ে চাল এনে ধুয়ে রাখবে। হাঁড়িতে জল চাল ঠিক করাই থাকে, উনুনে পাতা সাজানো–ভোরে উঠে আগে একটা দেশলাইয়ের কাঠি জ্বেলে দিয়ে তবে ঘাটে বেরোবে, প্রাকৃতিক কাজের জন্য। মোটা চালের ভাত–সেদ্ধ হতে ঠিক একটি ঘণ্টা সময় লাগে। ভাত আর একটা কিছু ভাতে নেমে গেলে–যা হোক একটা তরকারি কি ডাল চাপিয়ে দেয়। পৌনে ছটায় খেতে বসবে হেম–তার মধ্যে অন্ততঃ ভাতগুলো ঠেলবার মতো উপকরণও একটু কিছু তৈরি করা চাই।

কষ্ট খুবই। রাত চারটেয় ওঠে–রাত নটার আগে কাজ চোকে না। কিন্তু এখন তাও ছুটি মেলে না! রান্নাঘরের দাওয়ায় বসে এই ‘ল্যাম্পো’র ক্ষীণ আলোতেই নারকোল পাতা চাঁচবে। এক আনা সের ঝ্যাঁটার কাঠি বিক্রি হয়–পয়সা রোজগারের ব্যবস্থা বন্ধ রাখতে তো চলবে না।

তাই বলে বিয়ে!

নিস্তব্ধ অন্ধকারে বসে বসে নিজের মনের মধ্যেটা দেখবার চেষ্টা করে। না বিয়ের কথা ভাবতে ভাল নাগছে না আদৌ। নলিনীর স্মৃতি এখনও বড় স্পষ্ট, বড় উজ্জ্বল। ভালবেসেছিল কিনা তা এখনও বলতে পারে না–ভালবাসা কাকে বলে ঠিক জানেও না সে–তবে আজও সেই স্মৃতি মনে হলে মনটা উদ্বেল হয়ে ওঠে, মনের মধ্যে কেমন করতে থাকে, হাতপা–গুলোয় একটা কাঁপন অনুভব করে। এক-এক সময় ইচ্ছে করে ছুটে যেতে–সমস্ত বিপদ তুচ্ছ ক’রে সমস্ত বাধা লঙ্ঘন ক’রে। এখনও বোঝায় মনকে, এখন তো আর সে রমণীবাবুর কর্মচারী নয়–এখন আর ভয়টা কি!

.

আবার মনে পড়ে যায় শেষের দিনের স্মৃতিটা, তাকে পরিহার ক’রে পালিয়ে যাওয়ার কথা–সঙ্গে সঙ্গে উদ্বেলিত আবেগ শান্ত হয়ে আসে আপনা-আপনিই ছিঃ! সে কি ভিখিরী, না এতই হেয়? না, দরকার নেই। ভালবাসা হয় সমানে সমানে, ভিক্ষা ক’রে হয় না। তার যদি পয়সার জোর থাকত তা হলে কি আর সে এমন অবহেলা করতে–অবহেলারও বেশি, এড়িয়ে চলতে পারত! তা ছাড়া এ পথের এই দস্তুর। পয়সা দিয়ে কিনতে হয় যে জিনিস–বিনা পয়সায় তা চাওয়াই অন্যায়।

না, ওপথে আর যাবে না। তার চেয়ে তার যেমন অবস্থা সেই মতো থাকবে। বিয়েই করবে। বৌ অন্তত তাকে অবজ্ঞা করে এড়িয়ে যেতে সাহস করবে না, তার ভালবাসায় খাদ থাকবে না। স্বামী-স্ত্রীর ভাগ্য একসঙ্গে জোড়া।

তবু ঠিক এখনই সে কথা যেন ভাবা যাচ্ছে না।

তার বৌ–তাকে যে মেয়ে দেবে–সে মেয়ে কেমন আর হবে। এই পাড়াগাঁয়েরই কালো-কালো একটা মেয়ে, যে না বুঝবে দুটো রসিকতা না বুঝবে তার সুখ-দুঃখ। যে শুধুই খাটবে খুটবে, খাবে এবং সেবা করবে!

ভাবতে ভাবতে মনে পড়ে যায় রাণী-বৌদির কথা।

যত দেখছে অবাক হয়ে যাচ্ছে! কী প্রাণ-প্রাচুর্য! চোখেমুখে কি প্রখর বুদ্ধির আভা! অথচ মনটা কি মিষ্টি। চোখের চাহনিতে মানুষের প্রয়োজন বুঝে নেয়, আর সে প্রয়োজন মেটানোতেই যেন তার সব চেয়ে আনন্দ। যতক্ষণ হেম থাকে ওদের বাড়িতে, যেন কী এক মধুর স্বপ্নে সময় কেটে যায় ওর–হাসিতে ঠাট্টাতে গল্পে মাতিয়ে রাখে সমস্তক্ষণ। তার কৌতুক প্রতি মূহূর্তে বিচ্ছুরিত হতে থাকে চারদিকে, হাসিতে যেন সৌন্দর্যের তরঙ্গ ওঠে। এত কথাও জানে। মনে হয় দিনরাত বসে বসে শুধু ওর কথা শোনা যায়–অন্তত- কালেও যেন শান্তি আসবে না।

সকলের কী আর জোটে অমন বৌ! ও মেয়ে দুর্লভ! দাদার ভাগ্যটাই ভাল! সে বৌ-ও ভাল ছিল, অবহেলায় কোন দিন সেদিকে তাকাল না দাদা–আর এ তো অমূল্য রত্ন–কিন্তু তাই কি এর দামও পুরোটা বোঝে!…

শরতের অসহ্য গুমোট–তবু তার মধ্যে সারাদিনের পর ভাত পেটে পড়ায় চোখ দুটো তন্দ্রায় ভারি হয়ে আসে। কেমন যেন ঘুমে জাগরণে চিন্তায় কল্পনায় স্বপ্নে একাকার হয়ে যায় মনের মধ্যে! …

মা’র বাসন মাজা শেষ হয়ে গেছে। ধুয়ে ধুয়ে তুলছে তালের গুঁড়ির পৈঠেতে। ধোওয়ার সময় জলে নাড়া পেয়ে ছোট ছোট ঢেউ উঠেছে পুকুরে! তাতে ল্যাম্পোর আলোটা পড়ে চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে যাচ্ছে। ছোট ছোট ভাঙা অসংখ্য আলোর ঢেউ। সেদিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে এক সময় হেমের মনে হ’ল আসলে রাণী-বৌদিরই হাসি ওগুলো, আলোর তরঙ্গ তুলে শতখণ্ডে ভেঙে ভেঙে দূরে ছড়িয়ে পড়ছে!

না, এখন তার পক্ষে বিয়ে করা সম্ভব নয়।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *