১০. হরিনাথের মৃত্যুর পর

দশম পরিচ্ছেদ

॥১॥

হরিনাথের মৃত্যুর পর ঐন্দ্রিলাকে মা’র কাছেই এসে উঠতে হল। একেবারে শ্বশুরবাড়ির পাট চুকিয়েই চলে এল সে বলতে গেলে।

তার কারণ ওখানে আর থাকবার মতো অবলম্বন কিছু ছিল না ওর, আশ্রয়ও না।

হরিনাথকে অনেকদিন বাঁচিয়ে রেখেছিল ঐন্দ্রিলা। ডাক্তারের মতে তার যে কদিনের মেয়াদ, তার চেয়ে ঢের বেশি দিন। উমার দেখে আসার পরও প্রায় দেড় মাস বেঁচে ছিল।

কিন্তু সেজন্য মূল্যও বড় কম দিতে হয় নি।

উমার কথামত সাহেব-ডাক্তারই ডেকেছিল। উমার কথামতো–অর্থাৎ উমার পরামর্শে। কিন্তু পরামর্শ কথাটা নিতান্তই শোভনতার খাতিরে ব্যবহার করা চলতে পারে। ঐন্দ্রিলা আগেই মন স্থির করেছিল। উমার যখন মত চাইলে তখন উমা আর ‘না’ বলতে পারে নি। জানে অনর্থক, জানে যে শুধু তাতে ওর ইহকালের সম্বলটুকু নিঃশেষ হয়ে যাবে–ফল কিছু হবে না। তবুও পারে নি। সে হরিনাথের মা-ও নয়, শাশুড়িও নয়। টাকার ব্যবহারিক মূল্য তার অত জানা নেই। তার কাছে মেয়ের অন্তরের কথাটাই বড়। জামাই যদি দুটো দিনও বেশি বাঁচে মেয়ের কাছে সেইটেই লাভ। সেই জন্যই তাকে প্রত্যাসন্ন সর্বনাশটার দিকে চোখ বুজে দীর্ঘনিঃশ্বাস চেপে বলতে হয়েছিল, ‘ডাকতে হয় তো এখনই ডাক, দেরি করে লাভ নেই।’

কিন্তু সে একরাশ টাকার দরকার।

অত টাকা ঐন্দ্রিলার কল্পনারও বাইরে। তার গহনা প্রায় সবই চলে গেছে। অফিস থেকে যতটা পাওয়া সম্ভব, তা পেয়েছিল–সে-ও সব শেষ।

‘টাকা? টাকা কোথা থেকে আসবে?’

ক্ষীণকণ্ঠে প্রশ্ন করেছিল হরিনাথ।

‘সব তো শেষ করলে। কেন এ কাজ করছ।’ আবারও বলেছিল সে।

‘তুমি চুপ কর। ….আমার ভাবনা আমিই ভাবব। তোমার অত সব তাইতে কথা কেন বল তো!’

এই বলে সে জোর ক’রে ওর চোখের পাতা বুজিয়ে রেখে চলে এসেছিল।

এসেছিল সটান শাশুড়ির কাছে।

কলকাতায় মাসী আর দিদিমার কাছ থেকে অনেক কথাই শুনেছে সে, অনেক কথা শিখেছে। মোটামুটি ঝাপসা ঝাপসা ভাবে বিষয়-সম্পত্তির মোটা কথাগুলো জানে।

শাশুড়ির কাছে এসে বলেছিল, ‘মা, এ বিষয়ে ওঁরও তো ভাগ আছে। সেই ভাগটা বিক্রি করব। আপনি ব্যবস্থা ক’রে দিন।’

‘ইস! ভারি তো বিষয়! এখানে পাড়াগাঁয়ে এসব সম্পত্তির দাম কি!

‘যত দামই হোক, কিছুওতে। হবে। এখন তাই লাভ। সাহেব-ডাক্তার ডাকতে হবে, একশ টাকা এখুনি চাই।’

‘এখনই চাই বললেই তো হবে না। আমরা তো তোমার খাস তালুকের প্রজা নই বাছা যে হুকুমমত চলব! বিষয় এখনও ভাগ হয় নি! এখনও আমার নাবালক ছেলে আছে। বিষয় আমি ভাগ করতে দেব না। বেচবি কাকে?…রাক্কুসী! আমার সব্বস্ব খেয়েও রাক্কুসীর পেট ভরে নি–নাবালক ছেলেগুলোর মুখের দুটো ভাতও খেয়ে নেবার মতলব।’

ভয়াবহ হয়ে উঠেছিল ওর শাশুড়ির মুখ।

কিন্তু তাতেও ঐন্দ্রিলা ভয় পায় নি। ভয় পাবার উপায় ছিল না ওর। হরিনাথের জন্যে সাহেব-ডাক্তার চাই। আনতেই হবে ওকে।

সে উঠে দাঁড়িয়ে জবাব দিয়েছিল, ‘শুনছি ভাগ না করা বিষয়ও কেনবার লোক আছে। সস্তায় কেনে তারা, মামলা-মকদ্দমা করে নেয়। আমি তাহলে তাদের সন্ধান করি। কায়েত দাদুর কাছে গেলেই খোঁজ পাব।’

বোমার মত ফেটে পড়েছিলেন শাশুড়ি। অকথ্য কদর্য গালি-গালাজও করেছিলেন। কিন্তু ঐন্দ্রিলা অপেক্ষা করে নি, তর্ তর্ করে নেমে এসেছিল দালান পেরিয়ে রক থেকে উঠোনে। কিন্তু তাকে কোথাও যেতে হয় নি শেষ পর্যন্ত। মেজ দেওর শিবু এসে পথ রোধ করে দাঁড়িয়েছিল।

‘আহা-হা, একটু থামো না। ছেলেমানুষি কর কেন! কত টাকার দরকার এখন তোমার? আমি মা’র কাছ থেকে আদায় করে দিচ্ছি। …দাদাকে নিয়ে একটা রসিদ সই করতে পারবে তো! এখনও নাবালকের সম্পত্তি-দস্তুরমত সইসাবুদ রাখতে হবে। এরপর যদি ফটকে মানকে বড় হয়ে নালিশ দেয়!’

ফটিক আর মানিক–হরিনাথের দুই ছোট ভাই।

কিন্তু ঐন্দ্রিলার সে সব কোনদিকে কান ছিল না। কী রসিদ –রসিদ না দলিল তাও দেখে নি সে। হরিনাথের দেখার মত অবস্থা ছিল না। ঐন্দ্রিলা সই করাচ্ছে–তাই যথেষ্ট। এর ভেতর অফিসের টাকা আনাতে কয়েকবারই এমন সই করতে হয়েছে তাকে। এবারেই তাই মনে করেছিল সে। ঐন্দ্রিলাও সই করেছিল–সাক্ষী হিসেবে। কাগজখানা ছুঁড়ে ফেলে তখন কোনমতে টাকাটা নিয়ে সে চলে যেতে পারলে বাঁচে।

সাহেব-ডাক্তার তিন দিন এসেছিলেন। ডবল ফি আর গাড়ি-ভাড়া। এ ছাড়া দামী ওষুধ আছে। সাহেবের দোকান থেকেই ওষুধ আনবার ফরমাশ হয়েছিল। তাতেও কম খরচ হবার কথা নয়। তবু হেম প্রত্যহ হেঁটে গিয়ে ওষুধ কিনে আনত, ডাক্তারের কাছে খবর দিত।

এমনি তিন-চারখানা দলিলে সই করতে হয়েছিল ঐন্দ্রিলাকে।

হেমও জানত না। জানলেও তা রদ করার উপায় ছিল না।

হরিনাথ ডাক্তারের হিসেব এবং অনুমান অতিক্রম করলেও সত্যি সত্যিই এমন কিছু বেশি দিন বাঁচে নি। বাঁচলে হয়তো তার জীবদ্দশাতেই সাংঘাতিক খবরটা পেতে হত তাকে। ঐ চরম আঘাত থেকে অব্যাহতি দিয়েছিলেন ভগবান তাকে নিজের কাছে টেনে নিয়ে।

প্রথম শোকের দুঃসহ আঘাতে এবং হয়তো এতদিনের অমানুষিক ক্লান্তিহীন পরিশ্রম ও দুশ্চিন্তা থেকে অব্যাহতি পাবার প্রথম স্নায়বিক প্রতিক্রিয়ায় ঐন্দ্রিলা মুর্ছিত হয়ে পড়েছিল। সে মূর্ছা তিন দিন ভাঙে নি। কারা নিয়ে গেছে হরিনাথকে, কখন নিয়ে গেছে, কে তার মুখাগ্নি করেছে–কিছুই টের পায় নি।

ওর শাশুড়ির শোক লাগে নি তা নয়–তবু তার মধ্যেই তিনি মন্তব্য করেছিলেন, ‘ঢং! আদিখ্যেতা! বলে মা’র চেয়ে বেথিনী তারে বলি ডান। …গেল আমারই পেটের ছেলে গেল! আমার চেয়ে তো আর ওর বেশি নয়? কদিনের দেখাশুনো তোদের!….আমি যদি এখনও খাড়া থাকি–ওরই এত শোক যে একেবারে মুচ্ছো গেল! শহরে ছিল, নবেল-পড়া মাসীর কাছ তেকে কল্লা সব রকম শিখে এসেছে।’

সুখের বিষয় এ কথাগুলো ঐন্দ্রিলার কানে যায় নি

কিন্তু প্রথম জ্ঞান হবার পরই কানে বা গেল, তাও কম নয়। শুনলে যে এ বাড়িতে, শ্বশুরের সম্পত্তির কোন কণামাত্রেও তার কোন অধিকার নেই। হরিনাথের যা ভাগ তা সে বেচে থাকতে স্বেচ্ছায় সজ্ঞানে ভাইয়েদের কাছে বিক্রি ক’রে গেছে। –সাক্ষী আছে তার বৌ। সুতরাং এখানে আর কোন আশ্রয়ের আশা যেন ঐন্দ্রিলা না করে। এই অশৌচের কটা দিন অবশ্য তাঁরা আর কিছু বলবেন না কিন্তু তার পর যেন মানে মানে সে পথ দেখে। বাপের বাড়ি কি মাসীর কাছে–যেখানে খুশি!

‘ঢের সয়েছি, ঢের সহ্যি করেছি। আর নয়। রাক্কুসী ডাইনী মড়মড় ক’রে আমার স্বামীপুত্তুর চিবিয়ে খেয়েছে–আরও কিছুদিন থাকলে এ বংশে বাতি দিতে কাউকে রাখবে না। সবাইকে খাবে। …শিবেটা তো এক নম্বরের আহাম্মুক, বলে–হাজার হোক দাদা’র বউ, দাদার মেয়ে–থাক না। …আমাদের সংসারে তো কত রবাহুত অনাহূত খেয়ে যাচ্ছে পেত্যহ। সে আমিও জানি। না হয় বুঝতুম ঝি রেখেছি। ঝিয়ের মত থাকত, খাটত, খেত। বলি কত ফেলা-ছড়াও তো যায়। কিন্তু একে রাখব কি করে? নিঃশেষে রক্ত চুষে খাবে। শিবেকে তাই বললুম, খবরদার অমন ভুল করিস নি। কত্তা ওই চাঁদপানা মুখ দেখে ভুলে নিজের সব্বনাশ ক’রে গেলেন। তুই আর ভুলিস নি। ওদিকে চাইবি না পজ্জন্ত–যদি বাঁচতে চাস। ওকে রাখব? আমার কি মাথা খারাপ হয়েছে? ওকে বিদেয় ক’রে তবে আর কাজ। কুলোর বাতাস দিয়ে বিদেয় করব।’

এ কথাগুলো শুধু ঐন্দ্রিলা শোনে নি, হেমও শুনেছিল। অপমান, দুঃসহ ক্রোধে তার মুখ আগুনের মতো লাল হয়ে উঠেছিল, কপালের শিরাগুলো উঠেছিল ফুলে। মাথার মধ্যে রক্ত-সঞ্চরণের এমন ঝাঁ ঝাঁ শব্দ হচ্ছিল যে নিজের কথাগুলোই শোনা কষ্টকর।

তবু সে প্রাণপণেই নিজেকে সংবরণ করেছিল। ওদের জবাব দেয় নি, ওদের দিকে পিছন ফিরে দাঁড়িয়ে বোনকে বলেছিল, ‘তুই এখনও চ খেঁদি। যদি আমাদেরও একবেলা জোটে তো তোরও জুটবে।’

ঐন্দ্রিলার জ্ঞান হয়েছিল ঠিকই–কিন্তু সঙ্গে সঙ্গেই এই প্রচণ্ড আঘাতে ওর দেহ-মন সমস্ত যেন এক হিম অনুভূতিতে নিথর হয়ে গিয়েছিল। তার নড়বার শক্তি তো ছিলই না–কথা কইবারও না।

সে অনেকক্ষণ, বিহ্বল হয়ে দাদার মুখের দিকে তাকিয়ে একসময় স্খলিত শিথিল কণ্ঠে বলেছিল, ‘তার কাজটা শেষ করে যাব না? তার শেষ কাজটা?….তাতে যদি মেয়েটার আবার কোন অকল্যেণ হয়? কী বল তুমি? যা হয় কর। আমি আর কিছু ভাবতেও পারছি না যে।’

হেম আর কথা বলতে পারে নি।

কীই বা বয়স ওর। এই বয়সেই সব চলে গেল। এখন শুধু ঐ গুঁড়োটুকই ওর অবলম্বন। সত্যিই যদি কিছু ক্ষতি হয় তার তো চিরদিন মনে হবে হয়তো এই জন্যেই–। থাক।

শুধু অনেকক্ষণ পরে চুপি চুপি বলেছিল, ‘পারবি থাকতে? এই কটা দিনও কি কাটাতে পারবি? ও মাগী সব পারে, হয়তো খুন করেই ফেলবে।

‘আমি সবই পারব দাদা। আমার দ্বারা হয়তো সবই সম্ভব। হয়তো সত্যিই আমি ডাইনী রাক্কুসী। আমার অসাধ্য কিছুই নেই। আমার হয়তো মরে যাওয়াই উচিত, এখানে সব জ্বালিয়ে পুড়িয়ে দিলুম, যদি সেখানেও দিই। আমার নিঃশ্বাসের বিষ আছে।’

কথাগুলো বলতে বলতে এই প্রথম ওর চোখে জল বেরিয়ে এল। স্বামীর মৃত্যুর পর এই প্রথম কান্না ওর।

।।২।।

শ্রাদ্ধের পরের দিনই হেম নিয়ে ওল ওকে। নিয়মভঙ্গের জন্যে অপেক্ষা করলে না। বললে, ‘ওর আবার নিয়মভঙ্গ কি? ও কি আর মাছ মাংস খাবে? তেল–আমাদের ওখানেই দিতে পারবে।’

শাশুড়ি শেষ মুহূর্তে পৌত্রীর দিকে চেয়ে একবার চোখে আঁচল চাপা দিয়েছিলেন–অস্ফুটকণ্ঠে বলেছিলেন, ‘কেমন থাকে মেয়েটা মধ্যে মধ্যে খবর দিও। ডাইনীর মেয়ে ডাইনীই হবে…তবু হরের মেয়েটা–’

‘আপনারাই খবর নেবেন মধ্যে মধ্যে—’

শুধু এইটুকু উত্তর দিয়েছিল হেম। সম্পর্ক যখন চিরকালের জন্যই উঠছে তখন মিছিমিছি শেষ মুহূর্তে কতকগুলো কটু কথা বলে আর শুনে লাভ কি।…

নিয়ে আসতেই হল ঐন্দ্রিলাকে। শ্যামাকেও ঘরে তুলতে হ’ল। উপায় নেই। চিরকালই বইতে হবে, তার মেয়ে, সে আর কোথায় ফেলবে?

কিন্তু এখন এই বোঝার ওপর বোঝা দুঃসহ হয়ে উঠল।

হেম চাকরি পায় নি এখনও। লড়াই শেষ হয়ে এসেছে–তার সুতীক্ষ্ণ কামড় দরিদ্র সংসারের কণ্ঠনালী কামড়ে ধরেছে বরং বেশি ক’রে–শ্বাসরোধ হয়ে আসছে নিম্নমধ্যবিত্তদের, কিন্তু এখানে তার দরুন কাজ এমন কিছু বাড়ে নি যাতে চাকরি সহজপ্রাপ্য হয়। অভয়পদদের অফিসে ঢোকানো চলত হয়তো কিন্তু হেমের প্রাক্তন অফিসেরই এক সাহেব এ অফিসে চলে এসেছেন। তিনি ওকে বিলক্ষণ চেনেন। অভয়পদর সাহস হয় না ঢোকাতে। সার্টিফিকেট নেই কাজের–বরং কলঙ্ক বা দুর্নাম আছে। কাজ পাওয়া শক্ত বৈকি।

দু’বেলা দু’মুঠো ভাত, তাও যেন অসাধ্য হয়ে আসছে। শ্যামার রাত্রে ঘুম হয় না। ঐন্দ্রিলা আসার পর বহু রাত্রে উঠে এসে সে একা বসে থাকে বাইরের রকে। আরও ঘুম হয় না–মেয়েটাও ঘুমোয় না বলে। প্রায়ই সে রাত্রে শুয়ে শুয়ে নিঃশব্দে কাঁদে, আর কেউ না টের পাক মা পায়।

নরেন আসে নি বহুকাল। মেয়ের এমন হ’ল সে খবরটা পর্যন্ত পেলে না সে। এলেও হয়তো বিশেষ কিছু উপকারে লাগত না, বরং অপকারের সম্ভাবনাই বেশি। তবু মনে হয়–এক-একবার অকারণেই মনে হয়–হযতো মেয়ের এত বড় সর্বনাশ দেখলে একটু প্রকৃতিস্থ হবে সে, হয়তো টান ফিরে আসবে ছেলেমেয়েদের দিকে। কিছুও যদি আনতে পারে সে–চালটা ময়দাটাও–তা হলেও অন্ততঃ উপবাসটা বাঁচে।

ঐন্দ্রিলা আসবার পর তবু একটা উপকার হয়েছে, ওর মেয়ের দুধের জন্যে উমা তিন টাকা ক’রে দিতে রাজী হয়েছে, এক মাসের টাকা পাঠিয়েও দিয়েছে। কমলাও পাঁচটা টাকা পাঠিয়েছে থোক্–কিন্তু এ সবে কীই বা হয়। সমুদ্রে পাদ্যার্ঘ!

হেম ঘোরে টো টো করে. ঘোরার কামাই নেই তার।

কাজ মেলে না। মিছিমিছি শরীরটাই নষ্ট হয়। ওর যথার্থ সোনার মত রং- যেন কে কালি মেরে দিয়েছে, এত রোগা হয়ে গিয়েছে যে খালি গায়ে দেখলে ভয় করে।

এই যখন অবস্থা–তখন হঠাৎ অভয়পদ একটা প্রস্তাব নিয়ে এল। কথাপ্রসঙ্গে বললে, ‘কান্তিকর কথাটা একটু ভাবুন না। আট’ন বছর হয়ে গেল–না ইস্কুল না পাঠশালা! এমনি ক’রেই কি চলবে? বেটাছেলে মানুষ, লেখাপড়া না করলে খাবে কি ক’রে? যা হয় দুটো পাতাও তো পড়তে হবে!’

শ্যামা এখনও ঘোমটার মধ্য দিয়ে কথা বলে জামাইয়ের সঙ্গে–অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে। আজও সেই ভাবেই বললে, ‘সবই তো বুঝি বাবা–এক বামুনের ঘরের গরু নিয়ে চিরকাল জ্বলেপুড়ে মলুম। আবার ছেলেকেও তাই করবার কি আর সাধ। কিন্তু আসল কথা যে অন্যত্তর বাবা। দু’বেলা খাওয়া তো ওরা ভুলেই গেছে বলতে গেলে–একবেলা তাই সব দিন জোটে না। ফল-পাকুড় ডুমুর-সেদ্ধ খেয়ে দিন কাটে। ইস্কুল-পাঠশালে পড়াচ্ছি কোথা থেকে? নিজেরা একটু নিয়ে বসা–তাই হয়ে ওঠে না!’

খানিকক্ষণ চুপ ক’রে বসে থেকে অভয়পদ বললে, ‘ওকে কাছছাড়া করতে রাজী আছেন?’

‘তার মানে? কাছছাড়া মানে–?’ মুখ তুলে বিস্মিত উৎসুক নেত্রে তাকায় এবার, ঘোমটার মধ্য দিয়েই।

আবারও কিছুক্ষণ মৌন থেকে অভয় বলে, ‘মানে এই জানাশুনোর মধ্যেই অবশ্য-ধরুন যদি কেউ নিজের বাড়িতে রেখে লেখাপড়া শেখাতে রাজী থাকে খরচ-পত্তর সবই তার–খাওয়া-পরা কিছুর জন্যই ভাবতে হ’বে না!’

‘সে তো ওর মহা ভাগ্য বাবা।’ তবু কেমন একটু ধীরে ধীরেই বলে শ্যামা। কোথায় যেন একটা দ্বিধা ওর কণ্ঠে। কোথায় একটু সংকোচ।

‘না। আপনি যা ভাবছেন তা নয়।’ অভয়পদ প্রশ্নটা অনুমান করে নিয়ে একটু হেসে জবাব দেয়, ‘ভয় নেই, পুষ্যিপুত্তুর নিতে চাইবে না সে। এমনি আমি আপনাদের অবস্থার কথা বলেই তাকে রাজী করিয়েছি, তার এমন কোন আগ্রহ নেই।’

তা হলে সে তো অতি উত্তম প্রস্তাব বাবা! সত্যি-সত্যিই ভাগ্যের কথা!….অবশ্য অবস্থা যা, পুষ্যি নিতে চাইলেই বা আপত্তি করবার জোর কৈ? ছেলেটা ভাল খেয়ে পরে বাঁচবে, মানুষ হবে–সেইটেই তো মহা লাভ!….তা এ কার বাড়ি রাখবে বলছ? এখানে না কলকাতায়?’

‘কলকাতায়।’

সংক্ষেপে শুধু এই কথাটা বলে আবারও চুপ ক’রে যায় অভয়পদ। শ্যামা বোঝে যে কোথাও একটা কোন কাঁটা আছে প্রস্তাবটার মধ্যে। খুব সরল সহজ নয় ব্যাপারটা। সেও চুপ ক’রেই থাকে। শঙ্কিতও হয় না–কারণ হঠাৎ সৌভাগ্যে সে আস্থা হারিয়েছে অনেক কালই; আজকাল আশা আর সে করে না কোন কারণেই–কারুর কোন আশ্বাসে বা কিছুতেই। এই দীর্ঘকালের অভাবে এবং দারিদ্র্য এটা সে বেশ বুঝেছে যে সহজে কোন মানুষ কারুর উপকার করতে চায় না। যখনই কেউ কারুর উপকার করতে আসে তখন বুঝতে হবে যে, তারও স্বার্থ আছে এই ব্যাপারে। বিশেষতঃ শ্যামার যা অদৃষ্ট তার কিছুমাত্র উপকারের প্রস্তাবও আসলে অদৃষ্টের পরিহাস ছাড়া কিছু নয়। তাই মনে মনে সে হাসেই বরং–আত্ম-বিদ্রূপের হাসি।

অবশেষে অভয়পদই কথাটার জের টেনে বলে, ‘আপনা-আপনির মধ্যেই সজাত, আমাদের আত্মীয়; খুবই আত্মীয়। যত্ন-আত্তির অভাব হবে না। কথাটা কি জানেন, ঠিক আমাদের–মানে গেরস্ত ধরনের নয়। হয়তো, হয়তো আপনি ওর কাছে শুনে থাকবেন কিছু কিছু, আমার মামাতো বোনের কথা বলছি। তার কাছে সেদিন পেড়েছিলুম কথাটা। সে রাজী আছে। আপনার যদি আপত্তি থাকে অবশ্য–’

সব সংকোচ ঝেড়ে ফেলে যেন কোনমতে কথাগুলো বলে ফেলে অভয়পদ।

আশাভঙ্গের কথা নয়–তবু যেন আঘাত লাগে একটা শ্যামার

এতটা নিচে তাদের বংশে কেউ কখনও নামে নি বোধ হয়।

ভ্রষ্টা নারীর অনুদাস। এর চেয়ে ব্রাহ্মণের ছেলের অধোগতি আর কি হতে পারে। প্রস্তাবটা শোনার সঙ্গে সঙ্গে সে যেন একটা উষ্মাও বোধ করে–অভয়পদের এই ধৃষ্টতার…কিন্তু প্রায় তখনই সে উম্মা তাকে দমন করতে হয়। ভিখারীর আবার সম্মানবোধ। বিশেষত নরেনের ছেলেমেয়ে–ব্রাহ্মণ-সন্তানের মর্যাদা সত্যিই কি ওরা দাবি করতে পারে?

অনেকক্ষণ কাঠ হয়ে থেকে আস্তে আস্তে সে উত্তর দেয়, ‘মহা বলে নি অবশ্য, তবে আমি কানাঘুষো কিছু শুনেছি বৈকি। আমি আর কি বলব বাবা, আমার কি আর বলবার কোন উপায় আছে? নাচারের আর বাছবিচার কি?

শ্যামা একটু মিথ্যাই বলে। মহাশ্বেতা তাকে সবই বলে গেছে। তদের বিচিত্র অভিজ্ঞতার কথা না বলে থাকতে পারে নি। কিন্তু সেটা মেনে নেওয়া ঠিক নয়। মেয়ে সব কথা এসে বাপের বাড়িতে গল্প করে–এটা জানালে সে মেয়ের সম্বন্ধে শ্বশুরবাড়ির ধারণাটা খারাপ হতে বাধ্য। তীক্ষ্ণবুদ্ধি অভয় অনুমান করেছে ঠিকই–তবু অনুমানটাকে নিশ্চিত করে লাভ কি?

অভয়পদ কম কথার মানুষ। সে একটু চুপ ক’রে থেকে বলে, ‘তাহলে কি ঠিক করছেন?’

শ্যামা কথাটার ঠিক স্পষ্ট জবাব তখনই দিতে পারে না। যেন নিজেকেই বোঝায় যে, ‘আজকাল আর কোন্ সংসারে কোন বংশে এসব দোষ নেই বল। ছেলে থাকবে–নিরুপায় হয়ে, তাতে এমন দোষ কি? সে রকম বুঝলে এর পর একটা প্রাচিত্তির করিয়ে নিলেই চলবে। কিংবা পৈতের পর না হয় আর পাঠাব না। তদ্দিনে হেমের কি আর একটা উপায় হবে না?….সেই কটা দিন চলুক না? তা ছাড়া কে-ই বা টের পাচ্ছে?…. বললেই হবে কলকাতার মাসীর বাড়ি থেকে পড়ছে। না কী বল বাবা?’

একটু অসহায় ভাবেই শেষের প্রশ্নটা করে শ্যামা।

অভয়পদ ছাতাটা বগলে ক’রে উঠে দাঁড়ায় একেবারে। ‘তা হলে একটা দিন-টিন দেখে নিই। ওর জামা-কাপড় কি আছে ক্ষার ফুটিয়ে রাখবেন–আমিই সঙ্গে করে রেখে আসব।’

সে বেরিয়ে যায় সহজ স্বাভাবিক গতিতে। কিন্তু শ্যামা বসে থাকে অনেকক্ষণ কাঠ হয়ে।

।।৩।।

কান্তিকে নিয়ে যেদিন অভয়পদ চলে গেল, সেদিন আর শ্যামার মুখে অন্ন গেল না। শুধু ছেলের অকল্যাণ হবে বলেই একটু গুড় গালে দিয়ে জল খেয়ে নিয়েছিল ছেলে যাবার সময়। তার বড় আদরের ছেলে কান্তি, বড় সাধ করে নাম রেখেছিল কান্তিচন্দ্র। বাপের নিখুঁত দৈহিক গঠনের সঙ্গে মায়ের গোলাপ ফুলের মত রং নিয়ে জন্মেছে সে।

কিন্তু মাকাল ফলের মতো রূপসর্বস্ব নয় তাই বলে। গুনেরও অন্ত নেই ঐটুকু ছেলের। এই বয়সেই শান্ত, ভদ্র, বিনত ও বিবেচক। সে যে কবে থেকে আবদার করা ছেড়ে দিয়েছে তা শ্যামার মনেও পড়ে না। এত ছেলেমেয়ের মধ্যে এইটিই যেন তার যথার্থ দুঃখের অংশভাগী। প্রাণপণে সাহায্য করে সব কাজে, অথচ কোন দিন মুখ ফুটে কিছু চায় না, কোন অনুযোগ করে না। লেখাপড়ার ঝোঁক খুব–তবু সে সম্বন্ধেও একটা কথা বলে নি কখনও। শুধু দিন-রাতের কোন এক সময়–দুর্লভ অবসরের সুযোগে সামান্য মলিন ছেঁড়া- খোঁড়া বইগুলো নিয়ে নাড়াচাড়া ক’রে–আর মাঝে মাঝে করুণ চোখে সুদূর দিগন্তের দিকে চেয়ে চুপ করে থাকে।

সেই ছেলে চলে গেল ওর–অজ্ঞাত অপরিচিত মানুষ ও আবেষ্টনীর মধ্যে। হয়তো কেউ তাকে ডেকে খেতে দেবে না। সে যা ছেলে–না খেয়ে মরে গেলেও কোন দিন চেয়ে খাবে না। মুখ ফুটে কোন দিনই কোন কথা কাউকে বলতে পারবে না। একেবারে সমস্ত আত্মীয়দের কাছ থেকে বিচ্যুত হয়ে মন- গুমরে-গুমরেই হয়তো একটা অসুখ বাধিয়ে বসবে।

না–ভাল করে নি শ্যামা ওকে পাঠিয়ে। পুরুষ মানুষ, লেখাপড়া না-ই শিখুক–মুটেগিরি ক’রেও তো খেতে পারবে!

অভয়পদকে বলবে সে, কালই ডাকিয়ে পাঠাবে তাকে–বলবে, ‘বড়ই ভুল হয়ে গেছে, বাবা, তোমার সে বোন যেন কিছু মনে না করেন, তুমি গিয়ে কান্তিকে ফিরিয়ে নিয়ে এস।’

কিন্তু অভয়পদ যখন আসে তখন কিছুই বলা যায় না। কারণ সে আসে সম্পূর্ণ এক নতুন প্রস্তাব নিয়ে। শ্যামার দিক্-দিশাহীন অন্ধকার জীবনে আলোকের সন্ধান নিয়ে আসে সে। যা সুদূরতম কল্পনারও অতীত–তাই যেন হঠাৎ একেবারে সামনে, হাতের মুঠোর মধ্যে এসে যায়।

কান্তিকে কলকাতায় রতনের বাড়ি পৌঁছে দিয়ে সেই দিনই ফিরে এখানে এল অভয়পদ। বগল থেকে ছাতাটি নামিয়ে দাওয়ায় পেতে তার ওপরই বসে হাঁক দিলে সে, ‘কৈ গা ছোড়দি, জল খাওয়াও এক ঘটি!’

ছোড়দি অর্থাৎ ছোটশালী, তরুবালা। এই মেয়েটিকে স্নেহ করে অভয়পদ। আদর ক’রেই ছোড়দি বলে ডাকে।

যাকে ডেকে পাঠাবার কথাই সারাদিন ধরে চিন্তা করেছে শ্যামা, অপ্রত্যাশিত ভাবে তাকেই হঠাৎ আসতে দেখে আশঙ্কায় কণ্টকিত হয়ে প্রায় আর্তনাদ করে ওঠে সে, ‘তুমি–আবার এখানে এলে যে আজই? কান্তি, কান্তি কোথায়?’

‘কান্তি তো কলকাতাতে!’ আশ্চর্য হয়ে বলে অভয়পদ, ‘সেখানে পৌঁছে রতনের জিম্মা ক’রে দিয়ে তবে এসেছি। তার ঘর তাকে দেখিয়ে দিয়েছি, ঠাকুর ভাত দিচ্ছিল, খেয়ে গেছে বলে সে খেলে না–তবু মোক্ষদা ঝি জোর করে জলখাবার খাইয়ে দিয়েছে। সে বেশ আছে, তার জন্যে ভাববেন না। কালই তাকে ওরা ইস্কুলে ভর্তি করে দেবে। এই যে একটা চিঠিও দিয়েছে–’

এক টুকরা কাগজ বার করে শ্যামার সামনে ফেলে দেয় অভয়পদ। শ্যামা সাগ্রহে তুলে নিয়ে পড়ে, কান্তিরই গোটা গোটা গোল গোল হরফ, ‘প্রেণাম শতকোটি নিবেদন মিদং (শ্যামাই এসব শিখিয়েছে) মা, আমি নিরাপদে পৌঁছিয়াছি। ভাল আছি। আপনি ভাবিবেন না। সকলকে আমার প্রণাম জানাইবেন, আপনিও জানিবেন। ইতি–সেবক কান্তি।’

কিন্তু চিঠিটা ভাল করে শ্যামাকে পড়বারও অবকাশ দেয় না অভয়পদ। অকস্মাৎ প্রশ্ন করে বসে, ‘আমি এসেছি অন্য একটা কথা জিজ্ঞেস করতে। বাড়ি কিনবেন?

চমকে কেঁপে ওঠে শ্যামা। হাত থেকে চিঠিটা খসে পড়ে যায়। কান্তি কি লিখেছে তা সবটা পড়াও হয় না বোধ হয়।

সে কি ভুল শুনছে?

না কি অভয়পদ ঠাট্টা করছে তাকে?

এত ধৃষ্টতা হবে তার! সে তো সেরকম ছেলে নয়। অথচ আর কীই বা হতে পারে–মর্মান্তিক পরিহাস ছাড়া?

অতি কষ্টে, অনেকক্ষণ পরে সে উচ্চারণ করে, ‘কী বললে? কী কিনব?’

‘বাড়ি। আমি বাড়ির কথা বলছি। এই কাছেই–আঁদুলে একখানা পাকা বাড়ি খুব সুবিধেয় বিক্রি হচ্ছে। লোকটা দায়ে ঠেকেছে তাই অত সস্তায় বেচতে চাইছে। প্রায় তিন বিঘে জমি, তার মধ্যে বারো কাঠা আন্দাজ জলকর–পুকুরটাও বেশি দিনের কাটানো নয়–পাকা বাড়ি। একটা ঘর দালান আগাগোড়াই পাকা, আর একটা ঘরের ভিত পর্যন্ত আছে। বৈঠকখানা ঘরটা সব পাকা নয়–পাকা দেওয়াল খড়ের চাল। মেটে রান্নাঘরও একখানা আছে এ ছাড়া। …যাই হোক, আপনাদের ভাল রকমই সম্পুষ্যি হবে।’

‘কত দাম?’ অসম্ভব জেনেও প্রশ্নটা বেরিয়ে যায় শ্যামার মুখ দিয়ে।

‘দেড় হাজার টাকা চাইছে–যে রকম গরজ, বোধ হয় বারো তেরো শোতেও রাজী হয়ে যাবে।’

‘কিন্তু তা হলে আমাকে আর ওকথা বলতে এসেছ কেন বাবা? এ কি ঠাট্ট করছ? আমার অবস্থা জান না?’ তীক্ষ্ণ হয়ে ওঠে শ্যামার কন্ঠস্বর। জামাইকে সমীহ করে কথা বলা উচিত–এটাও আর মনে পড়ে না।

কিন্তু এ ভর্ৎসনাতে মুখের একটি রেখাও পরিবর্তিত হ’ল না। তেমনি শান্ত ভাবে কিছুক্ষণ মৌন থেকে সে ধীরে ধীরে বললে, ‘আমি জানি সামান্য কিছু টাকা আপনার হাতে জমেছে। ঠিক কত জমেছে বলুন তো!’

শ্যামা এতখানি নিশ্চিত অনুমানের জন্য প্রস্তুত ছিল না। কিন্তু সেও অস্বীকারও করবার চেষ্টা করলে না। একটুকুও সে বুঝেছে যে আজ সারা পৃথিবীতে এই জামাইটির মতো হিতাকাঙ্ক্ষী তার কেউ নেই। সে কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললে, ‘ছশো কুড়ি টাকা। তোমার কাছে মিছে বলব না–হেমের শিশিবোতল বেচা টাকা–এই জন্যেই জমিয়েছিলুম–হাজার দুঃখেও হাত দিই নি। কিন্তু সে তো অর্ধেকেরও কম বাবা!

অভয়পদ একেবারে দাঁড়িয়ে উঠে ছাতাটি তুলতে তুলতে বললে, ‘তা হলে সামনের রবিবার বাড়িখানা দেখে আসবেন চলুন। যদি পছন্দ হয় তা বাকী টাকার জন্য আটকাবে না। ও টাকাটা অম্বিকের কাছ থেকে চেয়ে আমিই ধার দিতে পারব।’

শ্যামা কি জেগে আছে, না স্বপ্ন দেখছ? কানে শুনেও যে বিশ্বাস হয় না। দু’কানের মধ্যে যেন কত কী কোলাহল! এ কি ওর রক্তস্রোতেরই গুঞ্জন?

তবু ক্ষীণ কণ্ঠে একবার বলে, ‘তার পর? এখানকার নিত্যসেবা ছাড়লে খাব কি? ইট কামড়ে তো পেট ভরবে না। আর দু-এক ঘর যজমান এখানে আছে–’

‘বাড়ি কেনামাত্র যে এখনই এসব ছেড়ে-ছুঁড়ে চলে যেতে হচ্ছে তার মানে কি? তা ছাড়া ও সম্পত্তিটারও আয় আছে। উনিশটা নারকোল গাছ, গোটা কুড়ি সুপুরি গাছ আছে। পুকুরে মাছের ডিম ফোঁটালেও মন্দ আয় হবে না। সে তখন পরে দেখা যাবে।’

অভয়পদ ছাতিটি বগলে চেপে চলে গেল। বোধ করি এই-ই প্রথম–ওকে কিছু জলখাবার দেবার কথা শ্যামার মনে পড়ল না।

উনিশটা নারকেল গাছ।

এখানে একটা নারকেল পড়লে সরকারদের সঙ্গে কী নিদারুণ টানাটানি, প্রতিযোগিতা! কত কৌশলে সেটি চুরি ক’রে আনতে হয়। তিনটি কিংবা দুটি পয়সাও মিলবে বিক্রি করে, তারই জন্যে যেন প্রাণপণ!….

অত কষ্টের অর্জিত পয়সা থেকে যেন মরীয়া হয়েই একটা বার করে দেয় শ্যামা–এক পয়সার বাতাসা আনায়।

খাড়া খাড়া হরির লুট দেবে সে।

খবরটা–পুস্তাবটা আসার জন্যই। জামাই অতগুলো টাকা ধার দিতে চেয়েছে যখন–এখানে না হোক অন্য কোথাও হবেই।

এতখানি সৌভাগ্য–তার কি হবে সত্যি-সত্যিই? মনে করতেও ভয় করে। তার যা কপাল!

আশা ও আশঙ্কায় কণ্টকিত হয়ে সারারাত জেগে বসে কাটিয়ে দেয় শ্যামা।

একাদশ পরিচ্ছেদ

॥১॥

রবিবার যখন সত্যি-সত্যিই জামাইয়ের সঙ্গে বাড়ি দেখতে গেল শ্যামা, তখন তার নিজেরই অবাক লাগছিল। এই আশাতীত কল্পনাতীত ঘটনা যে তার জীবনে সত্যিই ঘটবে–এ কে ভেবেছিল! একটা আশা যে কোথাও ছিল না তা নয়–কিন্তু সে সুদূর, সে আশাকে নিজের মনেও স্বীকার করতে ভয় করত, লজ্জাবোধ হ’ত। এ দিন যে তার এত তাড়াতাড়ি আসবে তা সে কখনও স্বপ্ন পর্যন্ত দেখে নি বোধ হয়। যখন রওনা দিচ্ছে তখনও পর্যন্ত ব্যাপারটাকে তাই অবাস্তব দিবাস্বপ্ন বলে বোধ হচ্ছে, এমন কি এখনও এক-আধবার মনে হচ্ছে যে জামাই তাকে নিয়ে একটা তামাশা করছে না তো?

তার পর একসময় আঁদুল রাজবাড়ির পাশ দিয়ে বাজার পেরিয়ে মা সিদ্ধেশ্বরীকে ডাইনে রেখে যখন সে সত্যিই সহদেব দাসের বাড়ির সামনে এসে দাঁড়াল তখন তার দুই চোখ ঝাপসা হয়ে এসেছে। বাড়িটার দিকে ভাল ক’রে তাকাতে শুধু যে সাহস হচ্ছে না তাই নয়–শক্তিও যেন লোপ পেয়েছে।

কত দিনের কত লাঞ্ছনা, কত হতাশ্বাস, কত দুর্ভাগ্য মনে ও মাথায় ভিড় ক’রে এসে দাঁড়িয়েছে। দীর্ঘকালব্যাপী পর পর আশাভঙ্গের ইতিহাস ও বেদনা। বিশেষ ক’রে গত এই দুটো বছরের শ্বাসরোধকারী দুর্ভাগ্যের মিছিল। চারিদিক থেকে চেপে ধরেছে তাকে–একটার পর একটা।

এর মধ্যে বাড়ি! তার নিজস্ব বাড়ি! পরের অনুগ্রহ ও আশ্রয়ের মুখ চেয়ে থাকতে হবে না আর!

কিন্তু বাড়ি তো তাদের ছিল। পাকা বাড়ি। বাগান জমি, পুকুর সব দেখেই তো তার মা তাকে দিয়েছিলেন। ভোজবাজির মতো চকিতে সব উড়ে চলে গেল কোথায়, নিঃশ্বাস ফেলতেও তর্ সইল না যেন। আবারও যদি তেমনি যায়!

বাড়িটা ভাল ক’রে দেখবার আগেই প্রশ্নটা মুখ দিয়ে বেরিয়ে যায়, ‘আবার যদি সব বেচে খায় ঐ হতভাগাটা?’–

‘হতভাগা–?’ ঈৎ বিমূঢ় ভাবেই তাকায় অভয়পদ, তার পরই তার ভাব- লেশহীন প্রশান্ত মুখে প্রচ্ছন্ন একটু কৌতুকের হাসি ফুটে ওঠে, ‘ও আপনি ওঁর কথা–মানে বাবার কথা বলছেন? না তা পারবে কেন? বাড়ি তো আপনার নামে কেনা হবে!’

শ্যামাকে অনায়াসে ‘মা’ বলে ডাকলেও নরেনকে ‘বাবা’ বলতে আজও সংকোচ বোধ হয় অভয়পদর–তা শ্যামা এই বিহ্বলতার মধ্যেও লক্ষ্য করে।

শ্যামা বলে, ‘আমার নামে? বাড়ি আমার নামে কেনা হবে? মেয়েছেলের নামে বাড়ি কেনা যায়?…নয় তো না হয় হেমের নামেও কিনলে হয়, ও তো এখন সাবালক।‘

‘না না,’ দৃঢ় কণ্ঠে আপত্তি জানায় অভয়, ‘বাড়ি আপনার নামেই কিনুন। ছেলের নামে কেনার অনেক ঝুঁকি। বিয়ের পর ছেলে কেমন দাঁড়াবে কে বলতে পারে?….মন না মতি!…তখন যদি অন্য ভাইদের ফাঁকি দেয়? যদি ধরুন আপনাকেই তাড়িয়ে দেয়? আপনার নামে বাড়ি থাকলে ছেলেরা চিরদিন আপনার দাপে থাকবে।’

‘তা হলে আমার নামেই কেনা হবে বলছ? অবশ্য যদি কেনা হয় শেষ অবধি!’

কেমন একটা ছেলেমানুষের মতোই উৎসুকভাবে প্রশ্ন করে শ্যামা।

‘হ্যাঁ, হ্যাঁ। এখন আপনি বাড়িটা দেখুন ভাল ক’রে।’

অভয় যেন মৃদু ধমক দেয় একটা।

শ্যামা আঁচল দিয়ে চোখ রগড়ে দৃষ্টিটাকে পরিষ্কার ক’রে নেয়।

তা বাড়িটা অবশ্য ভালই। অভয়পদ যা বর্ণনা দিয়েছিল, তার এক বর্ণও মিথ্যে নয়, বরং আরও বেশি ভাল। ঘরটা বেশ বড়, সরকারদের যে ঘরে তারা কোনমতে মাথা গুঁজে থাকে–তর চেয়েও বড়। তার সঙ্গে ঘেরা দরদালান, সেও তো আর একখানা ঘরই। ওপাশে এই ঘর আর দালানের মাপেই ‘আদরা’ করা রয়েছে, ঘর তুলতে বেশি সময় লাগবে না। বৈঠকখানা ঘরটায় গোলপাতার ছাউনি বটে–কিন্তু শোবার ঘরের চেয়েও বড়। তার সামনে আবার বাঁধানো রোয়াক। শুধু এই ঘরখানা পেলেও সে বর্তে যেত।

বাড়ি, বাগান, পুকুর সব খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে শ্যামা। নারকেল, সুপারি গাছ একটি একটি করে গুনে নেয়। তিন ঝাড় কলা আছে। সহদেবের বৌ বললে, সব ভাল কালী-বৌ কলার জাত। সজনে গাছ, ডুমুর গাছ তো অগুনতি। চালতা গাছেরও একটি চারা উঠেছে। । তিনটে আম, একটা কাঁঠাল। আম সবই দেশি–কিন্তু একটার নাকি খুব মিষ্টি ফল হয়। এ ছাড়া পুকুরপাড়ে একটা আমড়া গাছ আছে–সহদেবের বৌ বলল, ‘আম ফেলে আমড়া খেতে হবে মাঠাকরুন, যেমন সোয়াদ, তেমনি সৌগন্ধ। …কী বলব, সব শখ ক’রে গাছপালা আর্জানো মা, নিজে এক কোশ পথ হেঁটে বোনের বাড়ি থেকে ঐ আমড়ার চারা এনেছিলুম। এ কী বেচবার জিনিস? কী বলব, মিসের পোড়া কপাল তাই-আর আমারও।’

ডাব পাড়ানোই ছিল, সহদেবের স্ত্রী দুজনকে দুটো কেটে দিলে। অন্তত আড়াই ঘটি করে জল এক একটার। দুর্বার লোভে শ্যামার চোখ দুটো জ্বলতে লাগল, আগ্রহে আশঙ্কায় অধীরতায় মাথা ঝিমঝিম করে উঠল।

বাড়ি থেকে বেরিয়ে পাড়ার দু-চারজনের সঙ্গে আলাপ পরিচয় করে মা সিদ্ধেশ্বরীর মন্দিরে বুক চিরে রক্ত দেবার মানসিক ক’রে যখন আবার পদ্মগ্রামের পথ ধরলে শ্যামা, তখন তার আর, ‘কেনা হবে কি-না শেষ পর্যন্ত, টাকাপয়সার ব্যবস্থা হবে কিনা’–এ প্রশ্ন করবার সাহস নেই। হবে না–সে তো জানা কথাই, সুতরাং যতক্ষণ পর্যন্ত মনের গোপন কোণে এই ক্ষীণ আশাটুকু থাকে থাক না। মিছিমিছি এই সংশয়ের সুখটুকু নষ্ট করেই বা লাভ কি?

অবশেষে কতক্ষণ রুদ্ধ-নিঃশ্বাস প্রতীক্ষার পর অভয়পদই প্রশ্ন করলে, ‘বাড়ি আপনার পছন্দ হ’ল তা হলে?’

‘এ কথা আর কেন জিজ্ঞাসা করছ বাবা। ঘুঁটেকুডুনীর রাজ-প্রাসাদ ভাল লাগবে না–এ কি হতে পারে? যে অবস্থায় আছি, তার হক্কে এ তো ইন্দ্ৰভুবন!’

‘আশপাশে সব কী বললে?’

‘ঐ যে যাকে বললে অর্জুনের বৌ–ঠিক পাশেই যে, সে বলছিল যে জমির কী সব নাকি গোলমাল আছে। পুকুরে নাকি ওদের অংশ আছে একটা। এ নিয়ে নাকি মামলা মোকদ্দমা হতে পারে।’

‘হুঁ। ওরা তো ভাংচি দেবেই। ওরা আটশো টাকা দাম দিয়ে বসে আছে যে! আর কে কি বললে?’

‘নিবারণ দাস বলছিল যে বাড়ির ভিত তেমন ভাল নয়–তা ছাড়া ও ভিটেয় নাকি কী সব দোষ আছে, কারুরই সয় না।

‘নিবারণ দাসের কাছেই বাড়িটা বন্ধক আছে যে। চারশো টাকা ধার দিয়েছে–সুদে আসলে মোটা হলে একদিন ঐ টাকাতেই বাড়িটা নিতে পারবে এই ওর মতলব!’

‘কী জানি বাবা। ওসব তুমি আমার চেয়ে ভাল বুঝবে। ও নিয়ে আমি মাথা ঘামিয়ে কী করব!…আসল কথা এখন–’

এই পর্যন্ত বলে থেমে যায় শ্যামা। আসল কথাটা যেন মুখে উচ্চারণ করতেও বেধে গেল। সশঙ্কিত আগ্রহে উৎসুক হয়ে জামাইয়ের মুখের দিকে চেয়ে রইল শুধু।

কিন্তু অভয়পদর নির্বিকার মুখে কোন উত্তরই ফোটে না। সে যেমন উদাসীন নিস্পৃহতার সঙ্গে হাঁটছিল তেমনিই হাঁটতে থাকে।

শ্যামাকেও অগত্যা নিঃশব্দে পথ চলতে হয়। কিন্তু আশা ও আশঙ্কার এই দ্বন্দ্ব যেন আর সয় না। পথ চলার পরিশ্রম তার কাছে নতুন নয়–কিন্তু এখন যেন পা দুটো ক্রমশ পাথর হয়ে আসে, বার বার শাড়ির আঁচলে কপাল মোছে কিন্তু পরক্ষণেই অজস্রধারে ঘাম গড়িয়ে দুই চোখ ঝাপসা ক’রে দেয়।

অবশেষে পথের ধারের একটা গাছতলায় গিয়ে সে বসেই পড়ে।

‘আমি–আমি একটু বসি বাবা। বড্ড কষ্ট হচ্ছে। আমি আর চলতে পারছি না।’

বিনা বাক্যে অভয়পদও একটু দূরে আর একটি গাছতলায় নিজের বিবর্ণ ছাতাটি পেতে বসে। না জানায় শাশুড়ির এই অবস্থার জন্য কোন উদ্বেগ, না করে কোন প্রশ্ন। এমন কি অযথা দেরি হওয়ার জন্য এতটুকু অসহিষ্ণুতাও প্রকাশ করে না। শুধু চাদরের খুঁটে নিজের মুখটা মুছে নেয় একবার।

অবশেষে আর থাকতে না পেরে, এক রকম মরীয়া হয়েই প্রশ্ন করে শ্যামা, ‘তা হলে কি হবে বাবা এখন?’

‘কিসের কী হবে?’ অভয়পদ নিরুৎসক কণ্ঠে প্রশ্ন করে।

সর্বাঙ্গ জ্বলে যায় শ্যামার, জামাইয়ের এই নিরাসক্তিতে। কোনমতে মনের ভাব দমন ক’রে বলে, ‘ঐ–মানে বাড়িটার? গাছে তুলে দিয়ে এখন মই কেড়ে নেবে না তো?’

অভয়ের মুখে এবার কোন প্রায়-অদৃশ্য হাস্যরেখাও ফোটে না। সে তেমনি অনাসক্ত কণ্ঠে বললে, ‘এখনও তো ঠিক বলা যাচ্ছে না, বায়না করে একটা সার্চ করাতে হবে। উকিলকে দেখাতে হবে কাগজগুলো যদি কোন গোলমাল সত্যিই থাকে তো নেওয়া চলবে না।’

‘কিন্তু যদি গোলমাল না থাকে–’

অদ্ভুত একটা আর্তনাদ কি ফোটে শ্যামার কণ্ঠে?

হে মা সিদ্ধেশ্বরী, স্থানে থেকে কানে শুনো মা।

‘তাহলে আর কি!’

‘টাকা? দাঁতে ঠোঁট চেপে অসহ একটা উষ্মা দমন করে শ্যামা।’

‘সে হয়ে যাবে। পরশু ভাল দিন আছে, আপনি একষট্টিটা টাকা ঠিক করে রাখবেন। একান্ন টাকা বায়ান্ন–আর উকিলকে আপাতত দশ টাকা দিয়ে রাখতে হবে। আরও লাগবে অবিশ্যি–যদি বাড়ি কেনাই সাব্যস্ত হয়।’

আরও কী বলতে থাকে অভয় কিন্তু শ্যামার কানে এক বর্ণও যায় না তার। যেন সহস্র মন্দিরা তার কানের কাছে ঝুঝুন্ করে ওঠে, সমস্ত তন্ত্রীতে তন্ত্রীতে অযুত খঞ্জনীর ঝঙ্কার উঠে কিছু কানে পৌঁছয় না, চোখ আসে ঝপসা হয়ে।

হে ঠাকুর, হে মা সিদ্ধেশ্বরী, অবশেষে কি মুখ তুলে চাইলে মা?

সে গাছেরও গুঁড়িটায় ঠেস দিয়ে অবসন্নভাবে চোখ বোজে।

তারপর অনেকক্ষণ পরে যেন বহুদূর থেকে একটা পরিচিত কণ্ঠ ক্ষীণ অস্পষ্ট ভাবে কানে এনে পৌঁছয়, ‘এবার তা হলে উঠুন মা, অনেক দূর যেতে হবে।’

চোখ খুলে একেবারে উঠে দাঁড়ায় শ্যামা।

‘হ্যাঁ বাবা, চল যাচ্ছি।’

পা দুটোয় আর কিছু মাত্র ভারবোধ হচ্ছে না–আশ্চর্যরকম ভাবে হালকা হয়ে গেছে।

॥২॥

উঠোনে পা দেবার অনেক আগে থেকেই দাপাদাপি ও চেঁচামেচির শব্দ কানে আসে। কে করছে তা আর বলে দিতে হয় না কাউকেই–আর কি জন্য, সে প্রশ্ন তো নিরর্থক।

নরেন এসেছে।

বাড়িতে ঢুকে দেখা গেল সারা উঠোনটায় যেন নেচে বেড়াচ্ছে সে। ঐন্দ্রিলা এখানে নেই–দিনকতকের জন্য মাসীর বাড়ি গেছে। তরু একা। সে ছোট ভাইটাকে নিয়ে ভয়ে ঘরের দোর দিয়ে বসে আছে, পিঁটকীর ছেলেমেয়েগুলো আর মঙ্গলা ঠাকরুনের নিজের ছোট ছেলে-মেয়েরা ওপাশের দরজায় ভিড় করে এসে দাঁড়িয়েছে। কারুর চোখে কিছু ভয়, কারুর চোখে শুধুই কৌতুক।

‘শেষ ক’রে দেব, বুঝলি? গোরবেটার জাতকে এক কোপে শেষ ক’রে দেব আজ। ঝাড়ে-বংশে শেষ। কাউকে রাখব না। ছেরাদ্দ মাখতেও একটাকে আস্ত রাখব না।

এ সবই অতি পুরাতন, তবু যেন জামাইয়ের সামনে অপমানে মাথা কাটা যায়। তারই মধ্যে মনে মনে ভগবানকে ধন্যবাদ দেয় সে, তরুর বুদ্ধির জন্য। কে জানে, ঘরে ঢুকে নিরিবিলি থাকতে পারলে শেষ পর্যন্ত সেই জমনো টাকাটার সন্ধান পেত কি না!

আর তা হলে–বাপ রে!–ভাবলেও শরীর হিম হয়ে যায়। অতি কষ্টে যখন সে আশা করতে শুরু করেছে সবে–দুরাশা হলেও–সেই সুবৃহৎ দুরাশার মূলে এমনভাবে ঘা পড়লে হয় সে পাগল হয়ে যেত, নয়তো তাকে আত্মহত্যা করতে হ’ত।

‘কী হয়েছে কি? ক্ষ্যাপা ষাঁড়ের মতো চেঁচাচ্ছ কেন?’ দ্রুত বাড়ির মধ্যে ঢুকে তীক্ষ্ণ কণ্ঠেই প্রশ্ন করে সে।

‘এই যে মহারাণী সয়ার ক’রে এলেন!….বল্ মাগী, আমার ছেলেকে কেন সেই বেশ্যে মাগীটার কাছে পাঠিয়েছিস কেন কেন! পাঠিয়েছিস বল আগে?….কত বড় বংশের ছেলে সে তা তুই কি জানবি? ওর ঠাকুরদা শুদ্দুরের বাড়ি পা ধুতো না–আর তাতে তুই পাঠিয়েছিস খানকীবাড়ির ভাত খেতে।’

‘তার ঠাকুরদা তো শুদ্দুর বাড়ি পা ধুতো না–কিন্তু তার সেই ঠাকুরদার ছেলে কি। বংশের পরিচয় দিতে লজ্জা করে না!’

‘চোপরাও মাগী। আমি কি সে আমি বুঝব। তুই এখন বার কর ছেলেকে যেখান থেকে পাস। নেকালো–আভি নেকালো হামারা লেড়কাকো।’

আরও এক পাক যেন নেচে নেয় সে।

‘চুপ কর বলছি। ছেলে। ছেলের কথা মুখে আনতে লজ্জা করে না?….ছেলেকে খাওয়াবার বেলা আমি, লেখাপড়া শেখাবার বেলা আমি–আর কত্তাত্তি করার বেলায় উনি।’

‘ফের মাগী মুখ নাড়ছিস। মুখ ভেঙে দেব তা জান না। ডাণ্ডা মারব মাথায়–তবে তুমি জব্দ হবে। বল্ তুই কেন আমার ছেলেকে পাঠিয়েছিস সেখানে, কী এক্তিয়ারে পাঠিয়েছিস তুই? জানিস আমি তার গার্জেন, পুলিস কেস করতে পারি তা জানিস? তোকে সুদ্দ পুলিপোলাও খাওয়াতে পারি?’

‘জানি খুব জানি। আর মুখ নাড়তে হবে না। তোমার মুরোদ আমার আর জানতে বাকি নেই–পুলিসের ত্রিসীমায় যাবার সাহস আছে তোমার? যাও না দেখি–কত মুরোদ।’

‘বটে! আচ্ছা! মরবার পালক গজিয়েছে–বুঝেছি। পিপীলিকার পালক ওঠে মরিবার তরে। …অনেকদিন গোবড়েন খাও নি বটে। …সপুরী এক গাড় করব আজ–সব কটাকে কেটে দুখানা ক’রে ফেলব–তবে আমি ফলনা বাঁড়ু য্যের ছেলে। গোরবেটার জাতকে এক কোপে কেটে বাড়িতে আগুন লাগিয়ে তবে আমার আর কাজ।’

এতক্ষণ বোধ করি সে অভয়পদকে দেখতে পায় নি। সব ঝালটাই তাই পড়ছিল শ্যামার ওপর।

হঠাৎ এইবার জামাইয়ের কাছে এসে হাত পা নেড়ে বলে ওঠে, ‘এই যে কম্মকত্তা খোদও আছেন সঙ্গে। বলি নিজেদের বংশের কেলেঙ্কার নিয়ে সব বংশ জজালে বুঝি চলছিল না বাবাজী? তোমাদের ও আদিখ্যেতা তোমাদেরই থাক–এখন আমার ছেলেকে এনে দাও। ওকে প্রাচিত্তির করিয়ে ঘরে তুলতে হবে। ….তোমাদের চামে-কাটা বংশের ওতে লজ্জা-ঘেন্না হয় না–কিন্তু আমাদের বংশে কেউ কখনও ও কাজ করে নি–বুঝলে? ভিক্ষের ভাত খেয়েছি–তাই বলে বেশ্যের ভাত। চৌদ্দপুরুষ নরকস্থ হয় ওতে—’

অভয়পদ নির্বিকার। কিন্তু শ্যামা এইবার ক্ষেপে উঠল একেবারে। সামনে এসে দাঁতে দাঁত চেপে বীভৎস একটা ভঙ্গি ক’রে বললে, ‘বলি থামবে–না জ্যান্ত মুখে নুড়ো জ্বেলে দেব। এর চেয়ে বিধবা হলেও আমার ঢের ভাল ছিল যে। ফের যদি একটা কথা কও তুমি তো ঐ আঁশবাঁটি দিয়ে কেটে তোমাকে দুখানা করে ফেলব বলে দিচ্ছি। তাতে আমাার ফাঁসি হয় সেও ভাল। তবু ধরার ভার হরণ ক’রে তো যেতে পারব।’

এই ধমকেই যেন কাজ হয় খানিকটা। নরেনের দাপাদাটি অনেকটা কমে আসে। সে যেন একটু ভয়ে-ভয়েই দু’পা পেছিয়ে গিয়ে বলে, ‘হু’–খুব যে চ্যাটাং চ্যাটাং কথা হয়েছে। বিধবা হলে খুব চার হাতে খাবে–নয়? খাওয়াচ্ছি তোমায়। বেশ আমি চললুম সেইখানেই–দেখি কে ঠেকায়। নিজেই নিজের ছেলেকে নিয়ে আসব–তার জন্যে থানা পুলিস করতে হয় সেও ভাল।

হঠাৎ যেন দুষ্টু সরস্বতী বর করে শ্যামার রসনায়। কি বলছে তা বোঝার আগেই ওর মুখ দিয়ে বেরিয়ে যায়, ‘বেশ তো, যাও না। তার কাছ থেকে ঠকিয়ে টাকা এনেছ মনে নেই? সেও দারোয়ানদের বলে রেখেছে–দেখলে সে-ই তোমাকে পুলিসে দেবে!’

অকস্মাৎ জোঁকের মুখে নুন পড়ল। নরেন সত্যিসত্যিই কী একটা অজ্ঞাত আশঙ্কায় যেন কুঁকড়ে ছোট হয়ে গেল। আমতা আমতা ক’রে কেমন একরকম আলগা ভাবে বললে, ‘কে কে বলেছে এ কথা, সেই মাগী বলেছে? তা চোদ্দ পুরুষের পুণ্যি যে বামুনে তার টাকা ছুঁয়েছে! ভারি তো কটা টাকা–তার জন্যে–হুঁ!

তার পরই, সম্ভবত এতক্ষণের দাপাদাপির ফলস্বরূপই, অবসন্ন ভাবে রান্নাঘরের দাওয়ায় বসে পড়ে বলে, ‘দে একটু তামাক দে দিকি।’

কথাটা যখন বলে ফেলেছিল শ্যামা, তখন সে সুদূর কল্পনাতেও এ কথা ভাবে নি যে নরেন কোনদিন সত্যিসত্যিই মেয়ের ননদের বাড়ি গিয়ে–বিশেষত সমাজের বাইরের, অপাঙ্ক্তেয় সেই মেয়েটার কাছ থেকে টাকা নিয়ে আসতে পারে। ঠিকানাই তো জানার কথা নয় তার। কিন্তু আন্দাজী ঢিল এইভাবে অব্যর্থ লক্ষ্যে পৌঁছতে অপমানে ও ক্ষোভে যেন দিশহারা হয়ে গেল সে…এমন কি অভয়ের সেই পাথরের মতো মুখেও একটু বিস্ময় ও উদ্বেগের ছায়া ফুটে উঠল।

শ্যামা দ্রুত একেবারে নরেনের মুখের সামনে এসে দাঁড়িয়ে প্রায় রুদ্ধ কণ্ঠে বলে উঠল, ‘বেরোও বেরোও বলছি, এই দণ্ডে বেরিয়ে যাও আমার সামনে থেকে। নইলে সত্যি সত্যিই একটা রক্তারক্তি কাণ্ড করব বলে দিলুম। ….আমার মুখখানা আর কোথাও পোড়াতে বাকি রাখলে না, সেখানে পর্যন্ত…। তাই তোমার বংশের আর বানাইয়ের এত ভড়ং, তাই এত চেঁচামেচি দাপাদাপি। ওকে তামাক দেবে–। ঐ তামাকের আগুন মুখে গুঁজে দেব। …কৈ, উঠলে? বেরোও বলছি, এই দণ্ডে এখানে থেকে চলে না গেলে আমি অনর্থ করব।’

নরেন একবার ভয়ে ভয়ে শ্যামার মুখের দিকে চেয়ে দেখলে। কী দেখলে সেখানে কে জানে–কিন্তু তার পর একটা কথাও কইতে সাহস করলে না–এতটুকু স্পর্ধার সুর আর তার কণ্ঠে ফুটল না। কেমন যেন হতচকিত বিহ্বল ভাবেই আস্তে আস্তে উঠে পা পা ক’রে বেরিয়ে গেল সে। গামছায় পুঁটুলি বেঁধে কোথা থেকে কী এনে দাওয়ারই এক কোণে রেখেছিল– যাবার সময় সেটার কথাও তার মনে রইল না।

উঠোন পেরিয়ে বাগানে পড়ে–সেই প্রায়ান্ধকার অপরাহ্নের আলোতে এক সময় দৃষ্টিসীমার বাইরে চলে গেল সে।

এই প্রথম নরেনের সম্পূর্ণ পরাজয় ঘটল তার বহুদিনের উৎপীড়িত অত্যাচারিত স্ত্রীর কাছে। ….

মঙ্গলা ঠাকরুন ছেলেমেয়েগুলোকে সরিয়ে এবার সামনে এলেন, ‘সত্যিসত্যিই এই অবেলার ভাতারটাকে তাড়িয়ে দিলি বামনী। হাজার হোক বামুনের ছেলে সোয়ামী।

কথাটা বোধ হয় শ্যামারও মনের কোণে ইতিমধ্যেই কোথায় খচ্ খচ্ করতে শুরু করেছিল, সে নিজের কপালে জোরে জোরে দুটো ঘা মেরে কান্নায় ভেঙ্গে পড়ল একেবারে, ‘আর যে আমার সহ্য হয় না মা, আর কত সহ্য করি। আমার যে মরণও হয় ন। যমে নিলেও যে রেহাই পেতুম। আমাকে বিষ এনে দাও মা এক ডেলা, তাই খেয়ে ছুটি নিই!’

মঙ্গলা তাকে আর কোন সান্ত্বনা দেবার চেষ্টা না ক’রে পাশ কাটিয়ে এগিয়ে এসে তরুকে ডেকে বললেন, ‘ওলো তরী দোর খোল্‌ না, জামাই দাঁড়িয়ে রয়েছেন সেই থেকে–দেখতে পাচ্ছিস না?…এসো বাবা এসো–এ কেলেঙ্কার তো নিত্য এদের। তুমি ঘরে এসে বসো, ঠাণ্ডা হও। একটু জল-টল খাও।’

॥৩॥

নরেনকে তাড়িয়ে দিলেও তার কথাগুলোকে কিছুতেই মন থেকে তাড়াতে পারে না শ্যামা। কানের মধ্যে কেবলই যেন ঘুরে ফিরে প্রতিধ্বনিত হতে থাকে। ক্রমশ তিরস্কারের মতোই শোনায় সে প্রতিধ্বনিগুলো। এর মধ্যে মঙ্গলারাও রসান দেন। ব্যাপারটা থিতিয়ে গেলে অর্থাৎ অভয়পদ জলযোগের পর বিদায় নিলে আবার এসে জাঁকিয়ে বসেন মা ও মেয়ে। দুটো একটা একথা সেকথার পর পানের পিক ফেলে আর একটু চুন এবং দোক্তা সেই অন্ধকার মুখবিবরে ফেলে দিয়ে বলেন, ‘তা যাই বলিস বাছা বামনী, লোকটা পাগলই হোক আর ছাগলই হোক–কথাগুলো যে খুব অনেয্য বলেছে, তা বলে নি। হাজার হোক পুরুত-বামুনের ছেলে, গুরুবংশ–তাকে কি উচিত ঐসব জায়গায় পাঠানো? যা শুনলুম, বাপ্ রে–গা শিউরে ওঠে। তোর কিছু খুব সাহস বাপু–যাই বলিস না খেতে পেয়ে মরে গেলেও আর কেউ পারত না’–

পিঁটকী হি হি করে খানিকটা হেসে নিয়ে বলে, ‘আর কী চাপা বামুনদি বলে কিনা আমার মেয়ের ননদের বাড়ি পাঠিয়েছি। হি হি খুব বুদ্ধি বাপু–বলতেই হবে।

লজ্জায় মাথা কাটা যায় শ্যামার। একটু আশঙ্কাও হয়। কে জানে এ কিসের ভূমিকা? মা-মেয়েতে দল বেঁধে এল কেন? কী বলতে চায়?

আর একবার পিচ্ ফেলে বলেন মঙ্গলা, ‘না–সে না হয় হ’ল। ননদের কথাটা সত্যিও হতে পারে। বামুন-কায়েতের ঘরের মেয়েরা কি আর বেরিয়ে যায় না, এমনতো আছার। …তবে সম্পক্ক যাই হোক্–একবার যে নষ্ট হয়েছে–তার সঙ্গে আর সম্পর্কই বা কি, আর তা জাতই বা কি। …না বাপু, কাজটা ভাল করিস নি বামনী। যা হয় দু’মুঠো তো তোদের জুটছিল। মিছিমিছি নষ্ট মেয়েমানুষের অন্নদাস ক’রে দেওয়া–কথায় বলে অন্নপাপ মহাপাপ!’

‘না না, মা–সে তো বামুনের রান্না ভাতই খায়। বামুনে রাঁধে যে!’

‘ওলো তা জানি। পরকে যে বসিয়ে খাওয়াতে পারে–এত পয়সা–সে কি আর নিজে রান্না করবে? তা নয়। তাকে অন্নপাপ বলে না। পাপের অন্ন তো খাচ্ছে!…আগেকার দিন হলে তোদের এক-ঘরে করত, কেউ কি আর তোদের দিয়ে পূজো-আচ্চা করাত? এখন সে সব আর নেই–সমাজও নেই, শাসনও নেই–তাই।’

কথাটা সেখানেই চাপা পড়ে যায়।

কিন্তু কথাটা কোনদিকে যাচ্ছে বুঝে শ্যামার অন্তরাত্মা কেঁপে ওঠে। ঠিক এই আশঙ্কাই করেছিল সে। একে তো হেমের চাকরি নেই–তার ওপর যদি এই নিত্যসেবার বাঁধা রবাদ্দটুকু ঘুচে যায়, তা হলে তো শুকিয়ে মরতে হবে। …এই যে এখন–মনে মনে সেই কথাটাই খচখচ্ করছে সেই থেকে–বাড়ি কেনা হলেও সেখানে গিয়ে হয়তো বাস করতে পারবে না, সে তো এই নিত্যসেবাটুকুর জন্যেই। এ ছাড়াও এখানে যা দু-চার ঘর যজমান আছে, সরকাররা ছাড়িয়ে দিয়েছে শুনলে তারাও হেমকে দিয়ে পূজো করাবে কি না সন্দেহ। এক কথায় দাঁড়িয়ে সর্বনাশ। নতুন বাড়িতে উঠে যাওয়া মানে নতুন গাঁ–নতুন পাড়া। যজমানি জুটবে কি না–জুটলেও কতদিনে জুটবে তার ঠিক কি? সম্পূর্ণ অনিশ্চিতের ভরসায় নিশ্চিতকে ছাড়া–না সে সম্ভব নয়। হেমের যদি একটা দশ-বারো টাকার চাকরিও জুটত তা হলেও সে একবার দেখতো ভরসা করে বেয়েছেয়ে। নতুন বাড়ির উনিশটা নারকেল গাছ আর কুড়িটা সুপুরি গাছ থেকে বাকিটা চলত।

সারারাত ঘুমোতে পারে না শ্যামা। এক দিনে জীবনের সুদুর্লভ আশা- পূরণের সম্ভাবনা মাত্র দেখা দেবার সঙ্গে সঙ্গেই অপর দিকে এ কী দুর্দৈব! একেবারে ভাত-ভিক্ষেয় টান। ….বাড়ির আয়-পয়ও তো খুব দেখা যাচ্ছে। কেনবার প্রস্তাবেই এই, কিনলে না জানি কী হবে!….

পরের দিন ভোরবেলাই হেমকে দিয়ে খবর পাঠালে শ্যামা জামাই যেন ছুটির পর যত রাতই হোক একবার আসেন। হেম পৌঁছতে পৌঁছতে অবশ্য অভয় বেরিয়ে গিয়েছিল, মহাশ্বেতার কাছে বলে এল সে।

মহাশ্বেতা চোখ দুটোকে যত দূর সম্ভব বিস্ফারিত করে, চুপি চুপি বলবার প্রাণপণ চেষ্টায় প্রায় সবাইকে শুনিয়েই ফিসফিস্ করে ভাইকে প্রশ্ন করলে, ওর ‘ব্যাওরাটা কি বল্ দিকি? তোদের জামাই ঘন ঘন শ্বশুরবাড়ি যাচ্ছে, আবার রবিবার নাকি মাকে সঙ্গে নে কোথায় গেছল, অচলি ঠাকুরঝির দেওর রঘু পথে দেখতে পেয়েছে। কী হচ্ছে রে?’

ছেলেমানুষের মতো উৎসুক নেত্রে চেয়ে থাকে সে।

‘ব্যাওরাটা তাকেই তো জিজ্ঞেস করলে পারিস।’ একটু চুপ করে থেকে সাবধানে জবাব দিলে হেম।

‘তবেই হয়েছে।’ ঠোঁট উলটে বলে মহা, ‘সে যা মানুষ! মানুষ কি পাথর সন্দ হয় মধ্যে মধ্যে। সাতবার হয়তো একটা কথা জিজ্ঞেস করলে তবে জবাব মেলে–তাও হাঁ হুঁ–একটা কথার জায়গায় দুটো কথা নয়। ….জিজ্ঞেস তো করেছিলুম, বলে কি–জেনে কি হবে? তুমি তো কাজে আসবে না! যখন জানবার আপনিই জানতে পারবে।’

‘ঠিকই বলেছে।’ বলে হেম চলে এল।

মহাশ্বেতা খানিকটা গুম্ খেয়ে থেকে আপন মনেই বলে উঠল, ‘মুয়ে আগুন। মুখপোড়ারা সবাই সমান!’

অভয়পদ কিন্তু রাত্রে এসে কথাটা একেবারে উড়িয়ে দিলে।

শ্যামা সারাদিন ভাল ক’রে খেতে পর্যন্ত পারে নি উদ্বেগে।

জামাই এলে তাকে ধরে বসিয়ে, তরুকে বাইরে পাহারায় রেখে খুবই চুপিচুপি বলেছিল কথাটা–আশঙ্কায় কণ্টকিত হয়ে। কিন্তু অভয়পদ গায়েই মাখলে না যেন। বললে, ‘এই কথা! এখনও তো কিছু বলে নি, এরই মধ্যে এত ভাবছেন কেন?’

‘যদি বলে?’

‘বলে তো ছেলেকে আনিয়ে নেবেন–প্রাচিত্তির করিয়ে নিলেই হবে। এখনও তো পৈতে হয় নি। অত ভয় কিসের। আর আমার মনে হয় কিছু বলতে সাহস করবে না।’

‘সাহস। এতে আরার সাহসের কি আছে বাছা?’

প্রিয় কথাই যে বলতে চায় না–অপ্রিয় কথা বলতে তার দ্বিধা হওয়া স্বাভাবিক। তাই কিছুক্ষণ মৌন হয়ে থেকে অভয়পদ উত্তর দিলে–’সকলেরই কিছু না কিছু ঢাকবার থাকে মা! মিছিমিছি আপনার কাছে আর সেসব কেচ্ছা বলতে চাই না। তবে আমারও কিছু জানতে বাকি নেই। সরকাররা ওদিকে ঢিল মারতে এলে পাটকেল খেয়ে যাবে–আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন।’

সে প্রশান্ত মুখেই উঠে দাঁড়ায় একেবারে।

‘আপনার টাকাটা তা হলে দিয়ে দিন, কালই বায়নাটা করে ফেলি এদিকে এসে আবার আঁদুল যাবার সুবিধে হবে না।’

‘এই যে বাবা দিই।’ শ্যামা জামাইয়ের অবিচলিত মুখের দিকে চেয়ে যেন ভরসা পায় খানিকটা।

টাকাগুলো গুনে দেখে নিয়ে পেটকাপড়ে বেঁধে বাড়ির দিকে রওনা হয় অভয়পদ। অফিস থেকে প্রায় ক্রোশখানেক হেঁটে বাড়ি ফিরেই মহার মুখে খবর পেয়ে এই ছাঁকা দু’ ক্রোশ রাস্তা হেঁটে এখানে এসেছে। আবার দু’ক্রোশ রাস্তা ভেঙ্গে বাড়ি ফিরবে এখন। বাড়ি ফিরে জলখাবার খাওয়ার অভ্যাস ওর কোনকালে নেই–সকাল ক’রে একেবারে ভাত খেয়ে নেয়। আজ সে অবসর হয় নি। সব জেনেও ওকে একটু জল খেয়ে যাবার কথা বলতে মনে রইল না শ্যামার। রাত্রে শুতে গিয়ে হঠাৎ কথাটা মনে পড়ায় সে অন্ধকারেই এতখানি ভিজ কাটল সে।

॥8॥

তা বাড়ির পয় ভালই বলতে হবে। বাড়ি কেনার সঙ্গে সঙ্গেই আরও এক দিকে সুরাহা হয়ে যায়। …

বায়না থেকে শুরু করে রেজিস্ট্রি পর্যন্ত নিরাপদে ও নির্বিঘ্নে সব চুকে গেল। বায়নার পরই বাড়ি খালি করে দিয়েছিল সহদেবরা–বিক্রির দিন আদালতে চাবি দিয়ে কাগজ-কলমে দখল দিয়ে দিলে। এরা কোর্টের ফেরত গিয়ে ‘বাঁশগড়ি’ করে এল সকলে মিলে, অর্থাৎ সে তালা খুলে নিজেরা ঘরে- দরজায় তালা লাগিয়ে এল।

এত দিন পর্যন্ত কথাটা সকলের কাছেই চেপে রাখা হয়েছিল কিন্তু আর রাখা গেল না। কারণ ‘দাঁড়া’ হরির লুট মানা ছিল। সেই হরির লুটের বাতাসা দিতে গিয়েই কথাটা জানাতে হ’ল। ছেলের চাকরি হয় নি, সদ্য-বিধবা মেয়ে বুকের ওপর বসে–হরির লুট কিসের?

শ্যামা মঙ্গলার হাত দুটো ধরে বলল, ‘মা, তোমার কাছে আমার ঋণের শেষ নেই–যা হ’ল বলতে গেলে তোমার দয়াতেই হ’ল…একটা মাথাগোঁজের জায়গা করে ফেললুম মা।’

‘মাথা কি–কী বললি? ওবাড়ি?’ মঙ্গলার হাঁ করা মুখ বুজতে বেশ একটু দেরিই হয়, ‘বাড়ি কিনলি?….ও, তাই এত ঘন ঘন জামাইয়ের আসাযাওয়া গুজগুজ ফসুফুস? আমি ভাবি না জানি কী তা। কিন্তু এর এত লুকোছাপার কী আছে?’

‘না মা। লুকোছাপা নয়।’ ঈষৎ অপ্রতিভ ভাবেই বলে শ্যামা, ‘এ তো আমার আশার অতীত, হবার কথাও নয়। তাই না আঁচালে বিশ্বাস করি কী করে বল। নিহাত জামাই দয়া করলেন বলেই তাই, মোটা টাকাটা অভয়পদই ধার দিলেন তো।’

‘বুঝিছি বুঝেছি।’ অপ্রসন্ন মুখে উত্তর দেন মঙ্গলা, ‘আমার কাছে অত শাক দিয়ে মাছ না ঢাকলেও চলবে। জামাই তোমার ভারি তালেবর রহমান কিনা। মোটা টাকা ধার দিলেন। …এ বাড়ির আনাজ ফল যে কোথায় যায় তা আমরা কি আর জানি না। কাজেই টাকা কোথা থেকে এল তা আমাকে বিস্তার ক’রে না বললেও চলবে।’

পিঁটকী কিছুক্ষণ গালে হাতদিয়ে দাঁড়িয়ে থেকে বলে, ‘ধন্যি চাপা মেয়েমানুষ বটে তুমি বামুনদি। বাব্‌বা তোমার পেটে পেটে এত!… কেন, আগে বললে কি আমরা টাকাটা কেড়ে নিতুম–না ভাংচি দিতুম?’

এক রকম মাথা হেঁট ক’রেই নিজের ঘরে ফিরে আসে শ্যামা। অভয় এ ঘর থেকে সবই শুনেছিল, সুতরাং সে সব কথার পুনরুক্তি না ক’রে ম্লান একটু হেসে বললে, ‘শুনলে তো বাবা।’

‘ও তো একটু হবেই মা। এত কাল যে পায়ের নিচে ছিল সে মাথা তুলতে গেলে একটু প্রাণে লাগলে বৈ কি!…ও সবে কান দেবেন না!’

নিরুদ্বিগ্ন কন্ঠেই উত্তর দেয় অভয়।

‘তার মানে এই শত্রুপুরীতে বাস তো।’

‘দেখা যাক!’ বলে উঠে দাঁড়ায় অভয়।

‘তা হলে কবে গৃহ-প্রবেশ করবেন? সামনে চান-পূর্ণিমের দিনটা ভাল শুনছি।’

‘তাই যা হয় কর বাবা। সে তো আবার একগাদা টাকা খরচা। একটু সিন্নিও দিতে হবে, সিদ্ধেশ্বরীর পূজো মানত আছে–’

‘সে এক রকম করে যোগাড় হয়েই যাবে।’ অভয় ছাতা বগলে করে উঠে দাঁড়াল।

‘কিন্তু বাবা একটা কথা’–কুণ্ঠিত ভাবে বলে শ্যামা।

না ফিরেই শুধু দাঁড়িয়ে গিয়ে প্রশ্ন করে অভয়, ‘কী বলুন।’

‘বলছি যদি গৃহপ্রবেশ হয় তো কান্তিকে আনাতে হবে, অন্তত দুটো দিনের জন্যে–আনন্দের দিনে বাছা আমার থাকবে না?’

‘কেন থাকবে না–দু’দিন আগেই বরং আনিয়ে নেবেন। তবে আসার শেষ পর্যন্ত সময় হবে কিনা–বরং হেমকেই পাঠিয়ে দেবেন। –গৃহপ্রবেশের কথাটা আর বলে দরকার নেই–পূজো আচ্চার নাম করে আনিয়ে নেবেন।

দুপা এগিয়ে এবার অভয়পদ নিজে থেকেই থামে আবার।

‘বরং–বরং হেম যদি যায় তো রতনকেও বলতে পারে একবার চাকরির কথাটা। ওর তো অনেক জানাশুনো।

কথাটা ভাল ক’রে শেষ না করেই সে বেরিয়ে গেল।

হেম রতনদের বাড়ি খুঁজে খুঁজে গিয়ে যখন পৌঁছল তখন তার চোখ থেকে যেন বিস্ময় যেতে চায় না। ঐশ্বর্য যে সে দেখে নি তা নয়–এত কাল শহরে আনাগোনা করছে, ঐশ্বর্যের বাহ্য চেহারাটা ভাল ক’রেই দেখা আছে–কিন্তু এত কাছ থেকে আগে কখনও দেখে নি। এত প্রাচুর্য যে সত্যিই থাকতে পারে–এসব যে নিতান্ত গল্প-কথা নয়, তা চোখেও দেখেও যেন বিশ্বাস হওয়া শক্ত।

রতন বেশ সস্নেহেই গ্রহণ করলে ওকে। মোক্ষদাকে ডেকে জল খাবার দিতে বললে, রাত্রে খেয়ে যাবার অনুরোধ জানালে।

তার পর বললে, ‘আপনিই তা হলে কান্তির দাদা? বড় ভাল ছেলে আপনার ভাইটি, সত্যিই বড় ভাল ছেলে। ও খুব উন্নতি করবে দেখবেন। …তা নিয়ে যান, কিন্তু তাড়াতাড়ি ফেরত দিয়ে যাবেন, ওর ওপর যেন বড্ড মায়া পড়ে গেছে।’

একথা সেকথার পর প্রাণপণে সংকোচ কাটিয়ে চাকরির কথাটা পেড়ে ফেলে হেম। বহুদিন ধরে বেকার বসে আছে সে, কোথাও কিছু হচ্ছে না। পনেরো-কুড়ি টাকারও একটা চাকরি পেলে বেঁচে যায়। শেষে অভয়পদের কথাও বলে, ‘তিনিই আরও বলে দিলেন—’

‘আমাকে বলতে বলেছে অভয়দা, বাঃ বেশ তো! আমি কি বেটাছেলে, যে আমার হাতে চাকরির খোঁজ থাকবে?’

বলে বটে কিন্তু একটুখানি চুপ করে ভুরুকুঁচকে বইয়ের আলমারিটার দিকে চেয়ে থেকেই বলে ওঠে, ‘আচ্ছা থিয়েটারে চাকরি করবেন? গেট-কীপারি? দেখুন তা হলে?–ওঁর বন্ধু রমণীমোহন-বাবুর থিয়েটার আছে, বোধ হয় তাঁকে লিখে দিলে কাজ হবে।’

করবেন। এ প্রশ্ন করে মানুষ?

হেম সাগ্রহে বলে, ‘আমি এখন যা পাব তাই করব। শুধু দয়া ক’রে একটু বলে দেন যদি–’

‘বাড়িতে আপত্তি করবে না। মা আছেন তো? তিনি দেবেন এ চাকরি করতে? বড্ড খারাপ জায়গা ওটা।’

কিছু বলবেন না মা। আমার ওপর সেটুকু ভরসা তাঁর আছে আপনি দয়া ক’রে ব্যবস্থা করে দিন একটা–

‘তা হলে বরং আমি চিঠি লিখে দিচ্ছি, এখনই একবার দেখা করে আসুন। এই কাছেই তো–গোয়াবাগানে থাকেন তিনি। দারোয়ানকে সঙ্গে নিয়ে যান–বাড়ি চিনিয়ে দেবে।’

সে চিঠি লিখে খামে এঁটে ওর হাতে দিলে। খামেই ঠিকানা লেখা ছিল–তবু দারোয়ানকেও ডেকে সঙ্গে যেতে বলে দিলে রতন।

সৌভাগ্যক্রমে তখনও বাড়িতে ছিলেন রমণীমোহনবাবু রতনের দারোয়ানকে দেখে বেশ প্রফুল্লমুখেই বললেন, ‘কী ব্যাপার গো শিউনন্দন–কী হুকুম ওঁর?

‘এই যে–বাবুর হাতে চিঠি আছে।’

চিঠিটা পড়ার সঙ্গে সঙ্গেই বেশ মালিকজনোচিত মুখ ক’রে ফেললেন বাবু। এমনিতেই প্রকাণ্ড রাশভারী চেহারা ভদ্রলোকের, তার ওপর মুখ গম্ভীর ক’রে থাকলে রীতিমত ভয়ই হয়। হেমের বুকটা দুর-দুর করে উঠল। ভয়ে ও আশাভঙ্গের আশঙ্কায়।

কিন্তু রমণীবাবু বার-দুই আপাদস্তক ওকে দেখে নিয়ে বললেন, ‘তুমি তো নিতান্তই ছেলেমানুষ দেখছি, আর নিরীহ। পারবে থিয়েটারে কাজ করতে? ভারি বদ জয়গা।’

হেম আর কী উত্তর দেবে, মাথা হেঁট করে দাঁড়িয়ে ঘামে শুধু।

রমণীবাবুই আবার বলেন, ‘আর যে যায় লঙ্কায় সে-ই হয় রাবণ। যত জানাশুনো লোকই রাখি, দু দিন পরে সব শালা চোর হয়ে দাঁড়ায়। — দ্যাখো বাপু, এক কথায় চাকরি দিচ্ছি, নিমকটা রেখো। নইলে এক কথায় তাড়াতেও আমার দেরি লাগবে না। কলকাতায় থাকবার জায়গা আছে তো?’

‘আছে–মাসীর বাড়ি।’

‘বেশ, তা হলে পয়লা তারিখ থেকে কাজে লেগে যাও। কুড়ি টাকা করে মাইনে পাবে–আর হোল-নাইট শো হলে খাবার। –রাজী থাক তো মাসকাবারের দিন দেখা ক’রে জেনে যেও কাটার আসতে হবে!’

হেম মনের আনন্দে হেঁট হয়ে রমণীবাবুকে একটা প্রণামই ক’রে ফেললে। রমণীবাবুরা বিশুদ্ধ কনৌজী ব্রাহ্মণ, তা সে আগেই শুনেছিল রতনের মুখে।

একে থিয়েটার–কল্পলোকের সুখস্বর্গ, শুধুমাত্র ধনীলোকের প্রমোদ বিলাসের অধিকার সেখানে–এ-ই জানত, তায় চাকরি। আনন্দে যেন বাতাসে ভাসতে ভাসতে চলে এল হেম। রতনকে ধন্যবাদ দিতে গিয়ে স্রেফ মনের আনন্দেই বিশেষ কিছু বলতে পারলে না। মাকে সংবাদটা না দিতে পারা পর্যন্ত স্থির হতে পারছে না সে।

কিন্তু শ্যামা খবরটা শুনে খুব খুশী হতে পারল না। থিয়েটারের অনেক কাহিনী শুনেছে সে বাপের বাড়ি থেকে–বহু কেচ্ছা। জোয়ান ছেলেকে সেই সাতশো রাক্ষসীর খপ্পরে পাঠাতে মন চায় না তার, কিন্তু সব দিক বিচেনা করে ‘না’ও বলতে পারলে না। শুধু মনটা খুঁত খুঁত করতে লাগল।

হেমের এ খুঁতখুঁতুনি ভাল লাগে না। তার মন আনন্দে কল্পনাকাশে পাখা মেলেছে তখন! সে গলায় জোর দিয়ে বলে, ‘বেশ তো, এখন কিছু দিন করি না–এধারেও পারজকে বলে রেখেছি, একটা কিছু পেলে এ কাজ ছাড়তে কতক্ষণ?

অগত্যা। শ্যামা একটা নিঃশ্বাস ফেলে।

মা সিদ্ধেশ্বরী যদি এইভাবে মুখ তুলে চান, হেমের ভাল একটা চাকরি হতেই কতক্ষণ?

আবারও বুক চিরে রক্ত দিয়ে পূজো দেবে না হয়।

দ্বাদশ পরিচ্ছেদ

॥১॥

শ্বশুরবাড়ির মধ্যে একদা প্রমীলাকেই সব চেয়ে পছন্দ ছিল মহাশ্বেতার। তেমনি এখন যেন আর যে দুটি চক্ষু পেড়ে দেখতে পারে না ওর এই পাকা-গিন্নী ‘জা’ টিকে। একদিন সহজেই তার শ্রেষ্ঠত্ব এবং অভিভাবকত্ব মেনে নিয়েছিল–সেই মেনে নেওয়াটাই যেন ওর কাল হয়েছে। যে আসনে সে স্বেচ্ছায় নিজেই তাকে বসিয়েছে, এখন সেখান থেকে টেনে নামানো ওর সাধ্যাতীত। কেমন ক’রে কোথা দিয়ে যে সবাইকে ডিঙিয়ে প্রমীলাই সংসারের গৃহিণী হয়ে বসেছে–তা মহাশ্বেতা এতটুকু বুঝতে পারে নি। এখন সে দেখছে–প্রথম দিনটিতেও সে যেমন এ সংসারের পরমুখাপেক্ষী ছিল, আজ এত দিন পরেও–এতগুলি সন্তানের জননী হয়েও তেমনি আছে। কোথাও ওর মর্যাদা কিছুমাত্র বাড়ে নি।

এর জন্য আত্মগ্লানির শেষ থাকে না আজকাল ওর। মনে মনে কেবলই আপসোস হয়–ও যদি গোড়া থেকে একটু শক্ত হ’ত। এতটা ‘নাই’ যদি না দিত ছোট জাকে।

বেচারী মহাশ্বেতা। ও জানে না যে এক-একজন এ পৃথিবীতে আসে সোজাসুজি বিধাতার কাছ থেকেই কর্তৃত্ব করবার পরোয়ানা নিয়ে। প্রমীলাও সেই বিধিদত্ত সহজাত পরোয়ানা নিয়ে এ সংসারে এসেছে, কর্তৃত্ব করবার সহজ অধিকার তার। মহাশ্বেতার কোন দিনই সাধ্য ছিল না প্রমীলার ওপর অভিভাবকত্ব করবার বা জ্যেষ্ঠত্ব ফলাবার।

এই সত্যটা জানে না বলেই তার এই আত্মগ্লানি। মনে হয় প্রমীলাকে সে- ই বুঝি এতটা অগ্রাধিকার দিয়েছে।

অবশ্য আত্মগ্লানি বা অনুশোচনা থাকলেই যে–যাকে কেন্দ্র করে এই গ্লানি–তার ওপর বিদ্বেষ থাকবে না, এর কোন মানে নেই। বিদ্বেষ যথেষ্ট আছে মহাশ্বেতার–ওর এই জায়ের ওপর। আড়ালে সে ফাঁক পেলেই গালাগাল দেয়। বলে, ‘শতেক্‌খোয়ারী আমার সব্বনাশ করবে বলে ও ভিটেয় এসে সেঁধিয়েছে। আমার সাতজন্মের শত্রুর। …হারামজাদা মেয়েমানুষ। চোদ্দ পুরুষ বদ, ওদের ঝাড়ে-বংশে বজ্জাত!’ ইত্যাদি–

আবার শুনিয়ে শুনিয়ে বলে, ‘মহারাণী। উনি মহারাণী, আমি চাকরাণী মহারাজ আর মহারাণী! যে যা বরাত করে এসেছে। ওরা এসেছে রাজত্ব করতে–ক’রে যাচ্ছে।’ আমি যা করতে এসেছি তাই করছি! ঘুঁটেকুডুনীর বেটী ঘুঁটেই কুড়িয়ে যাব জীবন-ভোর, আমার কি আর কোনদিন সুখ হবে!’

প্রমীলা শোনে আর হাসে। জানে মহাশ্বেতা ঢোঁড়া সাপ–একটু ফোঁস করবারও শক্তি নেই। ওর সঙ্গে ঝগড়া করাও শুধু শুধু নিঃশ্বাসের অপচয়।

আর ওর এই নিশ্চিন্ত উপেক্ষাই যেন আরও বেশি ক’রে জ্বালাতে থাকে মহাশ্বেতাকে।

কথাটা বড় মিথ্যাও বলে না ও। মহারাজ আর মহারাণী।

অভয়পদও যদি একটু মানুষের মতো হ’ত (মহাশ্বেতার সেই বড় অনুযাগ)! সর্বস্ব রোজগার করে এনে মেজভাইয়ের হাতে তুলে দেবার দরকারটা কি? তোমার ছেলেমেয়ে হয়েছে, তাদের ভবিষ্য আছে। ভাই যে চিরকাল দেখবে তার কি কিছু লেখাপড়া আছে? সবাই কিনা ওঁর মতো সত্যযুগের মানুষ!

‘দেখব দেখব! রোজগার যদি কোন দিন তোমার বন্ধ হয় সেইদিন দেখে নেব। অত সহজে আমি মরছি না। ঐ ভাই যদি তখন মুখে নাতি না মারে তো আমি কী বলেছি। উনি কলির রামচন্দ্র-গিরি ফলাচ্ছেন! আগে দ্যাখ্–যার ওপর ফলাচ্ছিস সে লক্ষণ কিনা!’

দাঁত কিড়মিড় ক’রে চাপা গলায় বলে মহাশ্বেতা, অভয়পদর সামনেই বনেই বলে আজকাল। একটু সাহস তার হয়েছে।

কিন্তু বলেই বা লাভ কি? এর চেয়ে ঐ ইটের দেওয়ালটাকে বলাও ঢের ভাল। নিজের নিষ্ফল রোষ এবং অর্থহীন সেই রোষের অভিব্যক্তি ফিরে এসে শুধু নিজেকেই আঘাত করে। আরও ক্ষতবিক্ষত হয় সে অন্তরে অন্তরে।

এই যুদ্ধের বাজারে টাকা যে এরা কম রোজগার করে নি, তা মহাশ্বেতা এত দিনে বেশ বুঝেছে। প্রথমটা অত ধরতে পারে নি ঠিকই–কিন্তু প্ৰমীলা চোখ-কান খুলে দেবার পর বুঝতে আর কিছু বাকী নেই ওর। কিন্তু সে টাকা পর্যন্ত সব এনে ঐ ভাইয়ের পেটে পুরছে বোকা লোকটা! মোট-মোট টাকা! রাত জেগে আড়ি পেতে মহাশ্বেতা দেখেছে অনেক কিছুই। নগদ কাঁচা টাকা ইটের মতো ক’রে সাজিয়ে মোটা রাংতা-কাগজে বেঁধে কাপড় দিয়ে সেলাই করেছে অম্বিকাপদ বসে বসে–তার পর ওর ঘরের দেওয়াল থেকে ইট খসিয়ে নিয়ে চুন-সুরকি দিয়ে সে টাকার ইট গেঁথে রাতারাতি বালির কাজ ক’রে মায় চুনকাম পর্যন্ত ক’রে দিয়েছে নিজের হাতে। সে-ও সারারাত জেগেছে–মহাশ্বেতাও তাই। প্রমীলা অত ধার ধারত না, সে পড়ে পড়ে ঘুমোত। ‘ঘুমোবে না কেন, ওর যে বুক-পোঁতা আছে! জানে ওর ঘরের দেওয়ালেই তো গাঁথা রইল।’ আপন মনে গজ্ গজ্ করত মহাশ্বেতা।

শুধু কি টাকা! সোনার বাট কাকে বলে জানতে না সে। এবার চোখে দেখলে। সে বাট তো তৈরি করিয়ে নিয়ে এল এই আহাম্মুকটাই। এনে ধরে দিলেন লক্ষ্মণ ভাইকে! উঃ! এর চেয়ে যদি সে একটা মুখু মুটে-মজুরের ঘরে পড়ত–সেও ঢের ভাল ছিল। এ জগতে সবাই নিজের স্বার্থ বোঝে, কেবল বিধাতা কি বেছে তার জন্যেই নির্জনে বসে এই মানুষটি গড়েছেন!

অবশ্য হ্যাঁ–এর মধ্যে ওদের গয়না কিছু হয়েছে বটে। বৌয়ের সমান ওজনের এক প্যাটার্নের গয়না হয়েছে–যা হয়েছে সবই দু সেটা ক’রে। কিন্তু এর চেয়ে ঢের কম সোনাও যদি অভয় নিজে হাতে ক’রে এনে দিত তো ঢের বেশি খুশি হ’ত মহাশ্বেতা। ‘মুখপোড়া মিসের কি একটা এক কড়ার জিনিসও কোন দিন আনতে ইচ্ছে করে না!’…এই সোনার গয়না শুধু দেওরের হাত দিয়ে আসে বলেই বিষ মনে হয় ওর। পরলে যেন জ্বালা করতে থাকে সর্বাঙ্গ। মাঝে মাঝে পরে, আবার একটু পরেই হয়তো ছুঁড়ে ফেলে দেয়, আপন মনেই বকে, ‘কেন, কিসের জন্যে আমি পরের হাত-তোলায় থাকব? আমার বরই তো বেশি রোজগার করছে, টাকা তো আমার!–ও কলকাতার অফিসে বসে থাকে, এক পয়সা উপরি আছে ওখানে? তবে?–উনি হাত-তুলে দেন–যেন দয়া ক’রে দিচ্ছেন, ভিক্ষে দিচ্ছেন। কেন, কিসের জন্যে? আমার সমান গয়নাই বা ওর বৌ পরবে কেন? এটা হুঁশ থাকে না যে কার ভাতারের টাকা!’

পরাজয় এক দিক দিয়েই নয়–বহু দিক দিয়ে

মাঝে মাঝে এ বাড়ি এসে মনের সব বিষ উজাড় করে সে মায়ের কাছে কিংবা মা’র অনুপস্থিতিতে পিঁটকীর কাছে। বলে, ‘মেজ বৌটা আসলে গুণ জানে, বুঝলে! ওর মা-মাগী তো ভীষণ জাঁহাবাজ মেয়েমানুষ, আমি তাকে দেখেছি। নিশ্চয়ই গুণতুক করে মেয়ের হয়ে। নইলে সবাই ওর হাতের মুঠোর যায়? যেমন আমি বোকা–তেমনি আমার মা। কিছুই করতে শিখলুম না কখনও। সেই জন্যেই আরও আমাকে কেউ গেরাহ্যি করে না। সবাই যেন ওর ভেড়ুয়া। আমার শাশুড়ি মাগী আমাকে কি কম জ্বালিয়েছে–কিন্তু কৈ এখন বলুক দিকি মেজ বৌকে কিছু! একখানা বললে দশখানা শুনিয়ে দেবে সে। চুপ ক’রে জুজু হয়ে বসে থাকে।’

আবার হয়তো খানিক থেমে কপালে করাঘাত ক’রে বলে, ‘কী বলব, আমার ভাতারও যে তেমনি। ওর সুখের কপাল, ভাতার ওর কথায় ওঠে- বসে! আমার একটা কথা কি এ মিসে শোনে। তা হলে আর ভাবনা ছিল কি?’

তার পর আরও গলাটা নামিয়ে বলে, ‘শিবপুরের দিকে শুনেছি কে এক জন গুণিন আছে, একটু খোঁজ করো না মা। খরচা যা লাগে আমি দেব। যদি একটু ওষুধ-বিষুধ দিতে পারে–’

শিউরে উঠে শ্যামা উত্তর দেয়, ‘না মা, খবরদার ওসব করতে যেও না। ঐ চণ্ডীদের একটা বৌ নিড়ের ত্রিগুণা বুড়ীর কাছ থেকে কী ওষুধ এনে বরকে খাইয়েছিল–তার বর তাকে নিত না, কে এক দূর সম্পক্কের মাসীকে নিয়ে পড়ে থাকত, লোক দেখিয়ে ছোঁড়া তাকে বলত মাসীমা অথচ–। যাক তা, সে ওষুধ তো খাওয়ালে, ফলও হ’ল–সে মাগীকে ছেড়ে দিলে একদম। কিন্তু তার পরই কি হ’ল, গুম খেয়ে থাকতে থাকতে হঠাৎ একদিন পাগল হয়ে গেল, একেবারে উন্মাদ পাগল!’

শিউরে ওঠে মহাশ্বেতাও–কথাটা শুনে। শ্যামা সেটা লক্ষ্য ক’রে সমর্থনসূচক ঘাড় নেড়ে বলে, ‘তাই তো বলছি, ওসবে যাস্ নি। কী থেকে কি হয় তা কি বলা যায়! তোর কপালে থাকে–হক্কের ধন হয়–একদিন পাবিই!’

‘ছাই পাব!’ মুখটা ভার ক’রে উত্তর দেয় মহাশ্বেতা–’পাব একেবারে কাঠে-খড়ে উঠলে, তার আগে নয়।’

কিন্তু গুণতুকের দিকে যেতে আর সাহসে কুলোয় না ঠিকই।

.

আরও সহস্য হয়েছে ওর দুর্গাপদর ব্যাপারটা। ওরও ঐ শ্রীচরণে আত্মসমর্পণটা।

ইদানীং সেও, বয়স বাড়বার সঙ্গে সঙ্গে, যেন প্রমীলা একান্ত অনুগত হয়ে উঠেছে ক্রমশ। এইতে আরও অবাক লাগে ওর।

‘মুয়ে আগুন! সব শেয়ালের এক রা! সব কটা ভাই ঐ এক ক্ষুরে মাথা মুড়িয়ে বসে আছে গা! জোয়ান হয়েছিস, ডবলা হয়েছিস–তাই বে-থা কর! নয় তো এদিক ওদিক চন্‌চন ক’রে বেড়া, তা নয় বয়সে-বড় দিদির-বয়সী বৌদির আঁচলে আঁচলে ঘুরছেন। এ আবার কি! আমার হয়েছে জ্বালার ওপর জ্বালা। এ যেন গোদের ওপর বেজি!…আচ্ছা, কী দ্যাখে ওর মধ্যে এরা বলতে পারসি? কী আছে ওর? গায়ের রং আমার চেয়ে অন্তত তিনপুরু ময়লা। মুখচোখ গড়ন–পেটনও এমন কিছু ভাল নয়। ঐ তো মদ্দাটে মদ্দাটে চওড়া চওড়া গড়ন, আর মদ্দাটে ভাব, এই গাছে উঠছে, এই জলে ঝাঁপাই ঝুড়ছে–আর যখন তখন হি-হি হাসি। তাইতেই সবাই যেন মজে আছে। –যেমন ভাতার, তেমনি ছোট দেওর। –আমার এক এক সময় সন্দ হয় কী জানিস খেঁদি, তোর দাদাবাবুও ঐতেই মজেছে। ওকেও নিশ্চয় গুণতুক করেছে ছুঁড়ি। নিহাত ভাসুর-ভাদ্দরবৌ সম্পক্ক, তাই হাতে হাতে যথাসব্বস্ব ওকে তুলে দিতে পারে না, ওর ভাতারের হাতে দেয়। ও আমাদের সকলের সব্বনাশ করবে বুঝলি, সু-পুরী একগাড় করবে একেবারে। ও আস্ত রাক্কুসী, হাড়মাস চিবিয়ে খেতে এসেছে সকলকার!’

ঐন্দ্রিলা হয়তো হেসে জবাব দেয়, ‘তোমার তো খুব বুদ্ধি দিদি, দেওর–ভাজে যদি না সম্পক্কে আটকায়, ভাসুর-ভাদ্দরবৌতে কি সেই জন্যেই আটকে আছে? বলি ভাসুর–ভাদ্দরবৌতে কেলেঙ্কার কি কখনও শোন নি কোথাও?’

কিছু-পূর্বের কথাও ভুলে গিয়ে অমনি সগর্বে জবাব দেয় মহাশ্বেতা, ‘তেমন বান্দা তোর দাদাবাবু নয়, বুঝলি! কখনও কোন মেয়েছেলের দিকে চেয়ে দেখে না। ওদিকে ওর খেয়ালই নেই। বলে, যে কখনও এক দিনের তরে ভাল খেলে না, ভাল পরলে না, বিছানায় শুল না–সে করবে মেয়েছেলে নিয়ে কেলেঙ্কার! তা করলে তো বুঝতুম। যেন আমার কপালেই কোথায় এই গেরস্ত সান্নিসী তৈরি হয়ে বসে ছিল। সন্নিসীরও মন টলে–এর টলবে না, বুঝলি! শিবেরও কলঙ্ক হতে পারে–এর হবে না কোন দিন!’

‘তবে আর মজেছে বলছিস কেন?’ হাসে ঐন্দ্রিলা।

‘কে জানে!’ মুখটা বিকৃত করে কাঁধটা হেলিয়ে উল্টো জবাব দেয় মহাশ্বেতা, ‘তবে আর গুণতুকের কথা বলেছে কেন! ওষুধ বিষুধ মন্তর–তন্তরে কী না হয়–বল্!’

সত্যিই দুর্গাপদর আচরণটা দিন দিন দৃষ্টিকটু হয়ে উঠছে। দিন-রাতই দেওর-ভাজে গুজগুজ, ফষ্টিনষ্টি। চাপা হাসি, চোখে চোখে কৌতুক। অন্ধকার বাইরে বাগানে বাঁশবনে ঘোরাফেরা। দুর্গাপদর ইদানীং চাকরি হয়েছে, অভয়পদই বলে-কয়ে রেল অফিসে একটা কাজ যোগাড় করে দিয়েছে–সেই জন্যেই দিনরাত থাকতে পারে না বাড়িতে–কিন্তু চাকরির সময়টুকু ছাড়া আর এক দণ্ডও দুর্গাপদ বাড়ির বাইরে কাটায় না। ওর বন্ধু বান্ধব আড্ডা সব গেছে, এখন দিনরাতই বাড়িতে থাকে, মায় ছুটির দিনও। ছোট ননদের বিয়ের পর ওরা বাড়ির পাট পালা ক’রে নিয়েছে। একজন ছড়া-ঝাঁট দেয়, গোয়াল কাড়ে–আর একজন বাসন মাজে, রান্নার যোগাড় করে। প্রমীলার যেদিন ছড়া- ঝাঁটের পালা পড়ে, সেদিন ভোর থেকে দুর্গাপদ ওর পেছনে পেছনে ঘোরে, গোবরছড়ার হাঁড়ি এগিয়ে দেয়, নয়তো ঝাঁটাটা খুঁজে আনে, গোয়ালে গিয়ে গরু বাছুর বের ক’রে বেঁধে দেয়। আবার যেদিন ওর বাসন মাজার পালা, সেদিন একটা দাঁতন মুখে দিয়ে গিয়ে পুকুরের পাড়ে বসে, অথবা তালগুঁড়ি পইটেতে এক ধাপ উঁচুতে বসে প্রমীলার আঁচলটা নিয়ে খেলা করে–ওর অজ্ঞাতে আঁচলে ঢিল বেঁধে দেয়, অথবা চুলে কাঁটাফল আটকে দেয়। অজ্ঞাত কিন্তু থাকে না কোন দিনই, গোড়া থেকেই অবহিত থাকে প্রমীলা, কাজেই ঠিক ঘটনাটির মুখেই হাতে-নাতে ধরে কৃত্রিম তর্জন করে, দুজনেই হেসে খুন হয়।

এ সবই দেখে মহাশ্বেতা, আর জ্বলে জ্বলে মরে।

‘বুড়ীও কি দেখতে পায় না এসব!’ শাশুড়ির উদ্দেশে বলে সে, ‘না কি ছোট্ট ছেলের দোষ দেখতে গেলেই দুটি চোখ কানা হয়ে যায় কানীর! এমন ঢলাঢলিও চোখে পড়ে না, আশ্চর্য!’

পাড়াতে কানা-ঘুষো হয় বৈকি।

আশপাশেই জ্ঞাতিদের বাড়ি, সেখানেও গুঞ্জন ওঠে। কিন্তু এরা নির্বিকার যেমন মা তেমনি ছেলেরা।

সব চেয়ে বিস্মিত হয় মহাশ্বেতা অম্বিকাপদর আচরণে।

ওর দাদা না হয় চিরদিনই নির্বিকার, উদাসীন, পাথরের ঠাকুর। তা ছাড়া তার প্রত্যক্ষ ক্ষতির কোন ব্যাপার নয়, অন্তত তার নিজের গায়ে তত জ্বালা ধরাবার মতো ঘটনা নয়–কিন্তু ও চুপ ক’রে থাকে কী ক’রে? তবে কি ওরা ভাইয়ে ভাইয়ে সবাই পাথর?

মায়ের কাছেই মনের কথাটা বলতে পারে খুলে, ‘তুমি যে বল মা! ঘেন্নায় ঘেন্নায় আমি পাথর হয়ে গেলুম, কিন্তু ওদের ঘেন্নাপিত্তি হায়া কি কিছু নেই? গণ্ডারের চামড়া, এ কি কোন পুরুষে সহ্য করতে পারে? অন্য বাড়ি হলে এত দিনে খুনোখুনি হয়ে যেত!’

শ্যামা বলে, ‘ওলো খুনোখুনি ওদেরও হ’ত, যদি না দুগ্‌গো মাস মাস মাইনের সমস্ত টাকাটি এনে ধরে দিত ঐ মেজ ভায়ের হাতে। ও কি অমনি সহ্য করে? টাকাতে সব সয়ে যায় মা–সব সয়! কত লোকে টাকার জন্যে ঘরের মাগ পরের বাড়ি পৌঁছে দিয়ে আসে, তা জানিস না!’

মহাশ্বেতার কথাটা তত পছন্দ হয় না। টাকার এতটা মূল্য নিজের জীবন দিয়ে সে অনুভব করতে পারে নি এখনও। তাই খানিক চুপ ক’রে থেকে ঘাড় নেড়ে বলে, ‘উঁহু, তুমি যাই বল বাপু, ওর মা-মাগী অনেক কিছু জানে, আসলে গুণ করেছে সবাইকে। ঐ যে কী সুপুরি খাওয়ায় না কি, তাই খাইয়েছে নিশ্চয়! শাশুড়ি, ভাসুর, মায় ভাতার সুদ্ধ এত বড় অসৈরন চোখ বুজে সহ্য করে–এ অমনি হয় না মা! আমি তোমাকে বলে দিলুম, একদিন এ কথাটা বাজারে বের হবেই, দেখে নিও। ঐ মা-মাগীর কাজ এসব। সব গুণতুক্। –কী বলব তুমি ভয় দেখিয়ে দিলে, নইলে আমিও একটা গুণিনের কাছে যেতুম একটা ভাল গণক্কারের সন্ধার পেলে আমি চার পাঁচ টাকাও খরচ করতে রাজী আছি।’

শ্যামার ‘টাকা’ সম্বন্ধে সদা-জাগ্রত কান খাড়া হয়ে ওঠে, ‘জামাই তো তোকে কিছুই দেয় না বলিস, তবে টাকা পাস কোথা থেকে?’

‘আমি যে আজকাল সরাই ওর পকেট থেকে। এসে হাত-মুখ ধুয়ে গিয়ে তবে তো বসে দু ভাই। সে যা বাহার! ওধারে ওরা হয়তো রান্নাঘরে, নয় তো পালা না থাকলে, বাইরের দাওয়ায় মুখোমুখি–এধারে এঁরা মেজকর্তার ঘরে দোর দিয়ে মুখোমুখি। দু দলই গুজগুজ ফুসফুস!–তা সেই মুখ-হাত ধোবার ফাঁকেই আমি যা পাই হাতিয়ে নিই। দ্যায়ও মধ্যে মধ্যে দু-একটা টাকা, আজকাল আমি মুখ ধরেছি তো, চেঁচামোচি করি, তাই হাত-খরচ বলে দু-এক টাকা ঠেকায়। বাকী হাত-সাফাই! তবে ঢের পায় ও, ওর গোনাগোনতি হিসেবের টাকা, এক পয়সা ইদিক-উদিক হবার উপায় নেই বাবা–বলে, ঢোলা ঢোলা লাউয়ের পাতা,তোমার ভেয়ের গোলা গাঁথা! টের পায়, তবে কী ভাগ্যি কিছু বলে না। আগে আগে বোধ হয় ওঘরে গিয়ে অপ্রস্তুত হ’ত–এদান্তে তাই পকেট থেকে বার ক’রে আগে গুনে নিয়ে যায়। পেথম পেথম বুক ঢিব্‌ ঢিব্‌ করত, সরে যেতুম সামনে থেকে। এখন সোজা দাঁড়িয়ে থাকি। বলি অত ভয় কিসের? এ তো আমারই হক্কের টাকা। তা কম দেখলে একবার চেয়ে দ্যাখে শুধু, একটু মুচকি হাসে, কিছু বলে না। –তবে কি আর বেশি নিতে ভরসা হয়–সিকিটা আধুলিটা দু’আনিটা! টাকা–সে দৈবে সৈবে?’

শ্যামা কিছুক্ষণ চুপ ক’রে থেকে সাগ্রহে প্রশ্ন করে, ‘তা কত জমালি!’ সঙ্গে সঙ্গে সতর্ক হয়ে যায় যেন মহাশ্বেতা, উড়িয়ে দেবার ভঙ্গিতে বলে, কত আর! ছাই জমিয়েছি। ব্যাঙের আধুলি!‘

শ্যামা অপ্রসন্ন মুখে বলে, ‘থাক। বলতে হবে না। তবু যে বুদ্ধি হয়েছে, নিজেরটা বুঝতে শিখেছিস–এইতেই আমার সুখ। আমি কি আর তোর টাকা নিতে যাচ্ছি–না চাইছি!’

অপ্রস্তুত হয়ে চুপ ক’রে যায় মহাশ্বেতা, তবু যে সংবাদটা শোনবার জন্য শ্যামা সাগ্রহে ভেতরে ভেতরে ছটফট করে–সে সংবাদটা কিছুতেই সে দেয় না। সংসারের শিক্ষাই এমন যে কিছুদিন সেখানে পাঠ নেবার পর অতি বড় নির্বোধও খানিকটা সতর্ক হয়ে যায়, স্বার্থ সম্বন্ধে সচেতন হয়ে ওঠে। ঘা খেয়ে খেয়ে আত্মরক্ষার প্রাথমিক পদ্ধতিগুলোতে অভ্যস্ত হয়ে যায়।

॥২॥

কথাটা অবশেষে একদিন মহাশ্বেতাই পাড়ে শাশুড়ির কাছে। ঠাকুরঘরের বন্ধ দরজার সামনে অন্ধকার দালানে পা ছড়িয়ে বসে নিঃশব্দে মাতগুড় আর নারকোলকোরা দিয়ে মাখা চালভাজার গুঁড়ো খাচ্ছিলেন ক্ষীরোদা–মহাশ্বেতা এসে কাছে বসল। সংসারের কাজ সারা হয়ে গেছে, মায় কাল ভোরের জন্যে উনুনে কলা-বাসনা, সুপুরির বেলদো পর্যন্ত সাজানো, চাল, ধোয়া–সব তৈরি ক’রে রেখে রান্নাঘরে চাবি দিয়ে এসেছে। রাত এগারোটা বেজেও গেছে কখন কুণ্ডুদের ঘড়িতে। রোজই এমনি হয় ওর। যেদিন মেজবৌর পালা থাকে সেদিন দুর্গাপদ অর্ধেক কাজ ক’রে দেয়–ওর তো আর সে সহায় নেই। তবু ভাগ্যি মেয়েটা এখনও পর্যন্ত ওঠে নি। সন্ধ্যে হতে না হতে ঘুমোবে মুখপোড়া মেয়ে আর রাত ঠিক যেই এগারোটা বাজবে অমনি উঠে চিল-চেঁচাতে শুরু করবে। …তার পর তাকে খাইয়ে ঘুম পাড়াতে যার নাম একটি ঘণ্টা। আজ এই একটা মহা সুযোগ মিলেছে। আজ কর্তারাও সব ঘুমিয়ে পড়েছে, মেজবৌ আর দুর্গাপদ উঠেছে ছাদে–আজকাল সিঁড়ি হয়ে এ একটা সুখ বেড়েছে ওদের–এখন আর সহজে নামছে না।

‘কী মা!’ প্রশ্ন করেন ক্ষীরোদা। একটু বিস্মিতই হন। বড় বৌ ছেলেপুলের মা গিন্নী হবার পর থেকে এ সৌভাগ্য তাঁর বড় একটা হয় না।

‘না, এমনিই। খুকীটা আজ ওঠে নি এখনও, তাই বলি যে মা খাচ্ছেন–একটু কাছে গিয়ে বসি। একলা বসে খান–তা একটু আলোয় বসলেও তো হয়!’

‘কী আর হবে আলো মা–কাঁটা-খোঁচা তো নেই। বুড়োমাগী রাতদুপুরে খাচ্ছি, এ আর এমন দেখাবার মত কী ঘটনা বলে? খাবে নাকি মা একটু?’

‘না মা, আপনি খান। দুপুরের ছিষ্টি পান্তা পড়েছিল–এক পেট খেয়ে এসেছি–এখন ঐ গুড়মাখা জিনিস খেলেই অম্বলে বুক জ্বলে উঠবে!’

এও এক অপ্রসন্নতার কারণ শাশুড়ির সম্বন্ধে। প্রতিদিনই জোর ক’রে চাল বেশি নেওয়াবেন। বলবেন, ‘গেরস্তবাড়ি থেকে খাবার সময় অতিথি–ভিখিরী ফিরে গেলে বড় অকল্যেণ মা, বড় লজ্জারও কথা। ভগবানের ইচ্ছেয় শত্রুর মুখে ছাই দিয়ে তোমাদের তো তেমন অভাবও নেই আর–থাক না দুটো ভাত বেশি। ফেলা তো যাবে না। জল দিয়ে রাখলেই চলবে।’

‘হ্যাঁ তা তো চলবেই।’ মনে মনে দাঁত কিড়মিড় করে মহাশ্বেতা। সে ভাত খেতে হবে ওকেই। অতিথি-ভিখিরী আসে কদাচিৎ কোন দিন–তাও ওদের খাওয়া হয়ে গেলে আর দেওয়া চলবে না, সে নাকি দিতে নেই। ফলে রোজই সেই পান্তা তুলতে হয় ওকে। মেজবৌ সাফ বলে দিয়েছে, ‘ও আমার পোষাবে না। আর তুমিই বা খেয়ে মরতে যাও কি জন্যে? পুকুরে ঢেলে দাও গে না চুপিচুপি! যেমন–কে-তেমনি!

সেইটেই পারে না মহাশ্বেতা–জন্মাবধি দীর্ঘকাল অভাবের সংসারে কাটিয়েছে সে, একমুঠো ভাতের মূল্য সে হাড়ে হাড়ে বোঝে। জানে যদিও যে, এক পয়সা বাঁচালে তার ঘরে উঠবে না কানাকড়াও, তবু পারে না।

শাশুড়ি এ খোঁচাটা নীরবে হজম করলেন, অথবা খোঁচাটাই টের পেলেন না। শুধু বললেন, ‘অ। তা শুনেছি মা মুড়ি কি চালভাজার সঙ্গে গুড় খেলে নাকি অম্বল হয় না!’

‘না মা। আমার হয়। ও আপনি খান। তা ছাড়া পেটে আমার জায়গাও নেই। ‘

তার পর মুহূর্তখানেক চুপ ক’রে থেকে হঠাৎ বলে বসে, ‘হ্যাঁ মা, তা ছোট ঠাকুরপোর বিয়ে দেবেন না?’

ক্ষীরোদা কেমন যেন থতমত খেয়ে যান, ‘তা কী জানি, কৈ অম্বিকাপদ তো কিছু বলছে না!’

‘দেবেন আপনি ছেলের বে, তা মেজকর্তা কি বলবে শুনি? ছেলে আপনার না মেজকর্তার?’

‘না–তা নয়।’ আরও যেন থতমত খান ক্ষীরোদা, কেমন একটু অপ্রস্তুত কণ্ঠে বলেন, ‘তা দিতে হবে বৈকি। …দেখি না হয় একবার মেজবৌকে বলে।

‘হাড় জ্বালা করে মা আপনার কথা শুনলে!’ অনেক দিনের নিরুদ্ধ রাগ আর চাপতে পারে না মহাশ্বেতা, দাঁতে দাঁত চেপে অনুচ্চকণ্ঠে বলে, ‘বলি গিন্নী কে এ বাড়ির, আপনি না মেজবৌ? আপনি বেঁচে থাকতে ও কিসের গিন্নী শুনি? সব তাইতে মেজকর্তাকে আর মেজবৌকে টানেন কেন? বেশ তো, আপনি না পারেন আমাকে বলবেন–আমি তো হাজার হোক এ বাড়ির আর বৌ!’

‘বেশ তো, তা দাও না বাপু। আমার কি আর অসাধ ছোট ছেলের বৌ দেখা! তা ওরাই সব করে তো–তাই বলি। তা দাও না তুমিই। না হয় ওদেরই বল না একবার, ওরা আবার না কিছু ভাবে!’

সভয়ে সসংকোচে কথাগুলো বলেন ক্ষীরোদা।

‘বলবই তো! জোরের সহিত বলব। অত ভয় কিসের!’

এই বলে দুম্ দুম্ ক’রে পা ফেলে উঠে যায় মহাশ্বেতা।

শাশুড়ি এখনও একা বসেই খাচ্ছেন এবং খুকীও ওঠে নি–এ কথাটাও যেমন মনে থাকে না তার, তেমনি মেজবৌ ও মেজকর্তাকেই শেষ পর্যন্ত বলতে যে ও রাজী হয়ে গেল সেটাও মাথাতে যায় না।

.

পরের দিন খেতে বসে বলতে গেলে দুম্ ক’রেই কথাটা পাড়লে মহাশ্বেতা, ‘একটা ভাল মেয়ে-টেয়ে খোঁজ কর্ মেজবৌ, ছোট ঠাকুরপোর বিয়ে দেব।’

প্রমীলা কিছুক্ষণ অবাক হয়ে চেয়ে থাকে। তার পর বলে, ‘ছোট কর্তার (মহাশ্বেতার থেকে ‘কর্তা’ কথাটাই এ বাড়িতে চালু হয়ে গেছে) বিয়ে দেবে? তুমি? ‘

ওর সেই দৃষ্টিতে বিস্ময়ের সঙ্গে ঈষৎ প্রছন্ন বিদ্রূপ ছিল কিনা, তা মহাশ্বেতার নজরে পড়ে না–শুধু অকারণ জোর দিয়ে বলে, ‘হ্যাঁ–তা তোরা যখন কিছু উয্যুগ-সঞ্জুগ করছিস না–তখন আমাকেই দিতে হবে বৈকি!…আর ভাল দেখাচ্ছে না। তাছাড়া সোমথ হয়েছে, যা হোক দু পয়সা রোজগারপাতিও করছে, দেব না-ই বা কেন বল্‌!’

‘তা তো বটেই। দেওয়াই উচিত।’ এই বলে মুখ টিপে হেসে বাটিচচ্চড়ির লঙ্কাটা অকারণেই থালার ওপর টিপতে থাকে প্রমীলা। কেন যে আর ভাল দেখাচ্ছে না…সে কথাটাই শুধু জিজ্ঞাসা করতে পারে না কিছুতে।

সেদিন প্রমীলার রান্নার পালা। দুর্গাপদ অফিসে থেকে এসে জামাকাপড় ছেড়ে সবে রান্নাঘরে ঢুকেছে, প্রমীলা বড় জায়ের মতই দুম্ ক’রে বলে উঠল ‘শুনছ, বড়গিন্নী তোমার বিয়ে দিচ্ছেন যে!’

আসলে কথাটা আর চাপতে পারছিল না প্ৰমীলা।

দুর্গাপদ কিছুমাত্র ব্যস্ত হ’ল না। এদিক ওদিক চেয়ে সন্তর্পণে ট্যাক থেকে একটা ছোট্ট পুরিয়া বার ক’রে বললে, ‘শুনব’ খান–এখন চুপিচুপি একটু চা তৈরি কর দিকি!…সেদিনের চিনি একটু আছে না? নইলে বড়গিন্নীর মেয়ের মিছরি থেকে একটু হাতসাফাই কর।’

এখনও এ অঞ্চলে চায়ের তত রেওয়াজ হয় না। কলকাতায় চলছে বটে খুব–কিন্তু বড় মেজ দুই কর্তাই হাড়ে-চটা ও অভ্যাসের ওপর, তা দুর্গাপদ জানে। মেজকর্তার রাগটাই বেশি, সে প্রায়ই বলে, ‘যাদের লক্ষ্মী-ছাড়ার দশা, তাদেরই ঐসব বদ্-অভ্যেস দ্যাখ গে যাও! কলকাতার বাবুদের সব ফোতো নবাবি। এধারে অবস্থা তো জানতে বাকি নেই আমার! দেনার দায়ে মাথার চুল বিকিয়ে আছে–নবাবিটুকু চাই ষোল আনার ওপরে আঠারো আনা। সায়েবরা খায়! আরে তোরা আর সায়েবরা সমান হলি? তাদের রোজগার আর তোদের রোজগার? তারা পায় তিন হাজার টাকা মাইনে, তোরা পাস তিরিশ টাকা। তাদের যা সাজে তা কি তোদের মানায়?’

হয়তো ছোট ভাইয়ের ‘ফোতো নবাবি’র দিকে এক-আধটু টানের আভাস পেয়েই কথাগুলো বলে অম্বিকাপদ, কে-জানে।

তাই লুকিয়ে-চুকিয়েই চালাতে হয়। যেদিন প্রমীলার পালা না থাকে সেদিন সুবিধা হয় না। মেজ বৌকেও ধরিয়েছে সে জোর ক’রে। মেজ-বৌ অবশ্য রোজই আপত্তি করে। বলে, ‘নেশা কি এক দিন অন্তর করলে চলে! তার চেয়ে আমার পানদোক্তাই ভাল। কেউ বলবার নেই!’

দুর্গাপদও ছাড়ে না। বলে, ‘না বাপু, চা আবার একা একা খেয়ে সুখ হয় না। একটু খাও, নইলে মৌতাত জমবে না। -রোস না-একটু সইয়ে নিই ব্যাপারটা, তার পর ডোটো কেয়ার সামনেই খাব!’

আজ কিন্তু প্রমীলার কাছে এ সব ব্যাপার তুচ্ছ হয়ে গেছে। সে জল চড়াবার কিছুমাত্র আয়োজন না ক’রে, ছোটকর্তার মুখের দিকে বঙ্কিম কটাক্ষ নিক্ষেপ ক’রে বলে, ‘ঠাট্টা নয়–সত্যি বলছি। বড়গিন্নী বড় ব্যস্ত হয়ে পড়েছে!’

‘ব্যস্ত হওয়াচ্ছি!…বড়গিন্নীর কি, আমি বিয়ে করি না-করি? বলে এক গাঁয়ে ঢেঁকি পড়ে ভিন্‌ গাঁয়ে মাথাব্যথা!…আমার জন্যে এত দরদ উথলে উঠল কেন হঠাৎ!’

‘এর আর দরদ উথলে ওঠা-উঠির কি আছে!’ একটা ছোট বাটি ক’রে কাঠের উনুনের আঙরার ওপর জল চড়াতে চড়াতে বলে প্রমীলা, ‘সত্যিই তো, বিয়ের কি আর বয়স হয় নি তোমার? সে বড়, তার একটা কর্তব্য আছে তো? আর তার কথাই বা বলি কেন–আমারও তো কর্তব্য। এখন কি রকম মেয়ে পছন্দ তাই বল?’

‘নাও নাও–সারাদিন পরে বাড়ি এলুম, এখন ওসব বেয়াড়া ঠাট্টা ভাল লাগছে না। …দুটো অন্য কথা বল।’

‘ঠাট্টা কিসের?’ প্রমীলা যেন অকস্মাৎ জ্বলে উঠল, ‘ঠাট্টাটা কিসের দেখলে? আমরা তোমার গার্জেন নই? বিয়ের কথায় আবার ঠাট্টা এল কোথায়? আমরা বলছি, বিয়ে করবে।’

‘ওসব হবে-টবে না। বিয়ে আমি করতে পারব না। এই সাফ বলে দিলুম। বেশি ঘাঁটিয়ো না আমাকে! শেষ অবধি একটা কেলেঙ্কার করব!

‘কেন? কেন করতে পারবে না শুনি?’

‘পারব না, ব্যাস্। তার আবার অত কৈফিয়েত কি?’

তার পর কতকটা যেন অর্ধ-স্বগতোক্তি করে–’ন্যাকা!’

‘দ্যাখো–এই আমিও সাফ্ বলে দিলুম–ওসব চ্যাটাগিরি ছাড়। বিয়ে তোমাকে করতেই হবে। আর ভাল দেখাচ্ছে না। বয়স হয়েছে–রোজগারপাতি করছ, এখনও বিয়ে না দিলে পাঁচজনে পাঁচকথা কইবে।’

‘তা বলুক। পাঁচজনের কি ধার ধারি আমি!’

জল ফোঁটা পর্যন্ত অপেক্ষা করা চলে না। এখনই হয়তো কে এসে পড়বে। তাই সামান্য বুজকুঁড়ি কাটতেই কাগজের মোড়ক থেকে চা পাতাটুকু ঢেলে দিয়ে একটা রেকাব চাপা দেয় প্রমীলা, তার পর বলে, ‘তুমি নাধারো, আমরা তো ধারি! আমরা মুখ দেখাব কি ক’রে?…বেশ, বিয়ে না করতে চাও কারো না–তবে এও বলে দিচ্ছি, আমাদের সঙ্গে আর তা হলে কোন সম্পর্ক থাকবে না, আমি অন্তত আর কথা কইব না তোমার সঙ্গে। এইখানেই ইতি!’

দুর্গাপদ এবার রীতিমত হকচকিয়ে যায় যেন। অবাক হয়ে কিছুক্ষণ প্রমীলার মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে, ‘ঐ নাও! যার জন্যে চুরি করি সে-ই বলে চোর।’

মেজবৌ কাঁসার গেলাসে দুধ চিনি ঢালতে যাচ্ছিল, হঠাৎ ঘুরে বসল এদিকে। দুই চোখে তার আগুন। বললে, ‘তার মানে? তার মানে তুমি আমার জন্যে বিয়ে করতে চাইছ না?–তার মানে কি? লোকে এ কথা শুনলে কি বলবে?…কী বলতে চাইছ পষ্ট ক’রে খুলে বল দিকি!’

আর কিছুক্ষণ সেই প্রজ্বলন্ত মুখের দিকে নির্বাক বিস্ময়ে চেয়ে থাকবার পর দুই হাত জোড় ক’রে দুর্গাপদ বললে, ‘আমার ঘাট হয়েছে। তোমার যা খুশি তাই কর। আমি আর কিছু বলব না।

‘ঘাটই তো। একশো বার ঘাট হয়েছে।’

প্রমীলা চা ছেঁকে প্রায় ছুঁড়ে দেবার ভঙ্গিতে গেলাসটা ওর দিকে এগিয়ে দিয়ে জোরে জোরে উনুনে ফুঁ পাড়াতে থাকে। শুকনো কলার বাস্না ঠেলে দেয় তারই ফাঁকে–দেখতে দেখতে দাউ দাউ ক’রে জ্বলে ওঠে উনুনটা।

দুর্গাপদ আর সাহস করে কিছু বলতে পারে না। শুধু একবার উঁকি মেরে দেখে নেয় যে বাটির তলায় একটু চা অবশিষ্ট আছে। প্রমীলা নিজেই রেখেছে।

আশ্বস্ত হয় কতকটা। ভাগ্যিস্ নিজেই রেখেছে তাই, নইলে অন্যদিনের মতো পীড়াপীড়ি করতে সাহসে কুলোতে না ওর

॥৩॥

বিয়ের কথাটা আগেই তুলুক, আর ওর নিজের ভাষায় ‘জোরের সহিত’ই তুলুক–শুধু ওঠার অপেক্ষা, তার পরই মহাশ্বেতা তার যথাস্থানে অর্থাৎ পিছনে পড়ে গেল। প্রমীলাই সহজে এবং অনায়াসে কর্ত্রী হয়ে বসল এ ব্যাপারেও।

সে-ই হাঁক-ডাক ক’রে পাড়ায় সবাইকে বলে এল মেয়ে খুঁজতে, আত্মীয়স্বজনদের চিঠি লিখতে বসল। এক কথায় তোলপাড় তুলল চারিদিকে।

ওর এ ব্যবহার মহাশ্বেতার বুদ্ধির অগম্য। তবে কি তার সন্দেহটাই ভুল?–আসলে মেজবৌর মনের ভেতরটা পরিষ্কার? ‘কে জানে বাপু–বুঝি না!’…আপনমনে হতাশ ভাবে শুধু বলে বার বার।

ওর এতদূর কর্মক্ষমতাও নেই। বিয়ের কথা সে তুলেছিল বটে, তাই বলে তার জন্যে যে এত করতে হয় তা সে জানত না।

যথাসময়ে চারিদিক থেকে বিয়ের প্রস্তাব আসতে লাগল হু হু ক’রে। ওদের এখন অবস্থা ভাল, ছেলে সুপুরুষ, রেল অফিসে চাকরি করে–এ পাত্র দুর্লভ।

ক্ষীরোদা একবার ক্ষীণকণ্ঠে বলেছিলেন, ‘তা পাড়ার নীরো ঘকীকে একবার খবর দিলে না কেন মেজবৌমা?’

প্রমীলা তাতে উত্তর দিয়েছিল, ‘না মা। ঘীর সম্বন্ধে ভাল মেয়ে পাওয়া যায় না। খোঁজখবর কিছু জানি না, যাকে তাকে এনে কি বাড়িতে ঢোকানো ভাল?…জানাশোনা ঘরের মেয়ে চাই, যাদের বাড়ির নাড়ী-নক্ষত্র সব জানা যাবে–তবে না!’

তার পর একটু থেমে মুচকি হেসে বলেছিল, ‘চাই কি তা হলে আমরাও দেখে পছন্দ ক’রে আসতে পারি।’

ক্ষীরোদা চমকে উঠে বলেছিলেন, ‘ওমা সে কি, মেয়েরা আবার পরের বাড়ি হুট্ ক’রে মেয়ে দেখতে যাবে কি?’

‘সেই জন্যেই তো একেবারে নিষ্পরের বাড়ির মেয়ে আনতে চাইছি না মা। আপ্ত-কুটুম্বের বাড়ি যাব, তার আর কথা কি, সে তো এমনিও যেতে পারি।’

‘তাই বুঝি যাচ্ছে আজকাল সব? কে জানে বাপু। আমরা তো জানতুম মেয়েদের এসব কথায় থাকতে নেই!’

‘কলকাতায় তো হামেশা যাচ্ছে। একেবারে অজানা-অচেনা লোকের বাড়িতেও যাচ্ছে। শাশুড়ি–ননদের মেয়ের বাড়ি গিয়ে কনে দেখা খুব চল হয়ে গেছে মা, আপনি ওসব খবরও রাখেন না!

‘তা হবে।’ মিট্‌মিট ক’রে তাকান শুধু ক্ষীরোদা, তার পর বলেন, ‘তবে যে শুনেছি ঘকী এলে মেয়েরা ঘিরে ধরে তাকে, হা-পিত্যেশ ক’রে বসে থাকে, কনে কেমন যদি একটু শুনতে পায় এই লোভে!’

‘ও কবেকার কথা বলছেন মা! ওসব ছিল আপনাদের আমলে। সে সব দিন আর নেই।’

অগত্যা ক্ষীরোদা চুপ ক’রে যান। কথাটা তাঁর বিশ্বাস হয় না–কিন্তু ভরসা ক’রে প্রতিবাদও করতে পারেন না।

.

কুটুম্বদের ঘর থেকেই সম্বন্ধ পাকা হয়ে গেল শেষ অবধি।

ক্ষীরোদারই বড় মেয়ের মামাতো ভাসুরের শালার মেয়ে।

অত দূর-কুটুম্বদের বাড়ি যাওয়া চলল না বটে, কিন্তু প্রমীলা বুদ্ধি ক’রে মেয়েকে ননদের বাড়ি আনাবার ব্যবস্থা করলে। মহাশ্বেতা আর ও গিয়ে দেখে এল অম্বিকাপদকে সঙ্গে ক’রে। দেখে আর কারুর মত না নিয়েই একেবারে পাকা কথা দিয়ে এল। মহাশ্বেতার সামনেই দিলে, কিন্তু এক্ষেত্রে প্রতিবাদ করা বা সবাইয়ের সামনে নিজের জাকে তিরস্কার করা উচিত কিনা ভাবতে ভাবতে আর মহাশ্বেতার কিছুই করা হয়ে উঠল না। একথা সেকথার মধ্যে একসময় বিদায়ের সময় হয়ে এল।

ফেরবার পথে মহাশ্বেতা কথাটা তুলল অবশ্য, ‘তুই যে হুট্ ক’রে কথা দিয়ে এলি, শাশুড়িকে জিজ্ঞেস করলি না, কারুর মত নিলি না কজটা কি ঠিক হল? বাড়িতে ফিরে একটু সব দিক ভেবে দেখা উচিত ছিল না?’

‘তুমি থাম দিকি দিদি! মেয়ে দেখলুম আমরা, শাশুড়ি কি বলবেন তাই শুনি? তা ছাড়া আমরা দুই বড় জা মত করলুম, এর ওপর আর কথা কি? আমরাই তো ঘর করব–না বেটাছেলেরা ঘর করতে আসবে?’

দুই জা যে একমত হয় নি, অন্তত মহাশ্বেতা যে মত দেয় নি, সংকোচে এটুকু কিছুতেই বলতে পারল না মহাশ্বেতা। কথাটা ঘুরিয়ে বলল, ‘তা এত মেয়ে দেখে এই কষ্টিপাথরের মতো কালো মেয়ে তুই পছন্দ করলি কেন?’

‘শুধু বুঝি রংই দেখলে? কালো তো আমরাও উনিশ আর বিশ! গড়ন- পেটন ভাল, কেমন একটা লক্ষ্মীছিরি, এসব দেখলে না? রং নিয়ে কি ধুয়ে খাবে? মেয়েটার কথাবার্তা, চালচলনও বেশ ভাল, কেমন ঠাণ্ডা-ঠাণ্ডা ভাব। শুধু রূপ দেখে উগ্রচণ্ডা মেয়ে এনে বাড়িতে ঢুকিয়ে পোড়ান্তি হোক আর কি!

‘তা হোক বাপু, এ যেন বড্ড কালো। ছোটকত্তার অমন সাহেবদের মতো রং, তার পাশে এই কয়লার বস্তা, লোকে কি বলবে বল দিকি!

‘সেই তো ভাল। বলি কালো মেয়েগুলোও তো পার হওয়া চাই। তারা যাবে কোথায় বল দিকি? তা ছাড়া ছেলেমেয়ে হলে বাপের অত রংয়ের কিছুও তো পাবে–অত কালো থাকবে না। কালোর সঙ্গে কালোর বিয়ে হলে ছেলেমেয়েগুলোরও যে আবলুস কাঠ হ’ত একেবারে।’

‘সে যাদের ঘরে হ’ত তাদের ঘরে হ’ত, আমাদের কি?’ মহাশ্বেতা অপ্রসন্ন কণ্ঠে বলে।

‘দেখব দেখব, বলি তোমারও তো মেয়ে হয়েছে, বাপের ধাতে তো যায় নি। এমন কি মায়ের রং-ও পাবে না, এখন পার কর কি ক’রে বুঝব।’

কথাটা এই প্রসঙ্গে এসেই শেষ হয়ে যায়। মহাশ্বেতার যে এ মেয়েতে অমত, সেটা কিছুতেই স্পষ্ট করে জানাতে পারে না।

বাড়িতে ফিরে শাশুড়িকে বুঝিয়ে দেয় প্রমীলা, ‘রংটা একটু চাপাই হ’ল মা, কিন্তু সব দিক তো দেখতে হবে। শুধু কটা চমড়া নিয়ে কি করব? বংশটা খুব ভাল। ঠাকুরঝি বলল, ওদের সবাই অমনি ঠাণ্ডা-ঠাণ্ডা, খুব মিষ্টি স্বভাব। আমাদের ঘরে ও-ই ভাল। নইলে বাপু ঘর করতে পারতুম না। …বৌ আসতে তিন ভাই তিন ঠাঁই হওয়া কি ভাল? তা ছাড়া বেশ গোলালো গড়ন, মুখচ্ছিরিও মন্দ নয়। সব দিকে ভেবে ও আমি মত দিয়ে এলুম। এখন দেনা পাওনা আপনারা বুঝুন।’

‘তা দ্যাখো তোমাদের যা মত হয়!…তোমরাই ভেবে দ্যাখো, যা ভাল বোঝ সবাই। আমি আর কি বলব! অম্বিকাপদ যদি মত করে–’

তিনি ঐখানেই থেমে গেলেন। প্রমীলা শেষের কথাটা উত্তর দেওয়াও প্রয়োজন মনে করলে না।

অগত্যা রাত্রে স্বামীর কাছেই কথাটা পাড়লে মহাশ্বেতা, ‘কালো কুচকুচে, কয়লার মতো রং। তোমাদের মেজগিন্নী গিন্নীমো ক’রে একেবারে কথা দিয়ে এল। আমাকে একবার জিজ্ঞেস নেই, দুটি ঠোঁট ফাঁক করতে দিলে না। …এর পর যেন দুষো না আমাকে!’

অভয়পদ একটা পুরনো হ্যারিকেন লণ্ঠন সারাচ্ছিল বসে বসে প্রদীপের আলোতে; বাড়িতে কেরোসিনের আলো ঢুকেছে বহুদিন, কিন্তু এ ঘরে তা জ্বালতে দেয় না অভয়পদ। বলে, ‘অত চড়া আলোয় চোখ খারাপ হয়।’ সে কাজ থেকে মুখ না তুলেই বললে, ‘দুজনে দেখতে গিয়েছিলে, মত দিয়ে এসেছ। আমরা এ-ই জানি। তোমার যদি এতই অমত ছিল, সেখানে বল নি কেন? মা’র কাছেও তো বলতে পারতে! আমাকে বলে কি হবে?…তা ছাড়া, কালো রং এইটেই বড় আপত্তির কারণ বলে আমিও মনে করি না।’ তার পর একটু থেমে, অনেক পরে একটু মুচকি হেসে (কাজ থেকে মুখ না তুলেই অবশ্য) বললে, ‘তোমার রং যতই হোক, আমার চেয়ে তো ঢের নিরেস, কৈ তাতে তো তোমাকে পছন্দ করতে আটকায় নি আমার! মা’র মেজবৌমা ও কথাটা ঠিকই বলছেন, বৌ আনতে হয় বংশ দেখে, ঘর দেখে–শুধু রূপটাই করতে নেই।’

সম্ভবত বার বার নিজের রং সম্বন্ধে ইঙ্গিত হতেই মহাশ্বেতা ক্ষেপে গেল একেবারে। বাল্যকাল থেকেই এটা তার বড় দুঃখ, মা-ভাই-বোনদের মধ্যে তার রংটাই সব চেয়ে নীরেস, এখানে এসেও স্বামীর কাছে নিজেকে বড়ই ময়লা লাগে। (এত অযত্নেও ‘মিসে’র গায়ের রং যেন অন্ধকারে জ্বলে!) সে প্রায় খিঁচিয়ে উঠল, ‘বেশ বেশ, মেজবৌমা যখন বলেছেন তখন তো বেদবাক্যি হবেই–ঐ মেয়েই নিয়ে এস এরে-বেরে। আমারই ভুল হয়েছিল মহারাণীর কথার ওপর কথা কইতে যাওয়া। এই নাক-কান মলছি, আর যদি কখনও এমন অন্যায় করি। তোমরা তিনটি ভাই যে এক ক্ষুরে মাথা মুড়িয়ে বসে আছে তা তো জানিই, বোকা বলে তাই আবার গাল বাড়িয়ে চড় খেতে যাই!’

বলতে বলতে সে ঘুমন্ত মেয়েটাকেই সজোরে ঘুম পাড়াবার ভঙ্গিতে চাপড় মারতে থাকে, ফলে সেটা জেগে উঠে তারস্বরে চেঁচাতে শুরু করে। এইবার সব রাগটা গিয়ে পড়ে তার ওপর, সজোরে তার গালটা মুচড়ে দিয়ে বলে, ‘মুয়ে আগুন! হাড়মাস জ্বালিয়ে খেলে একেবারে। মর্ মর্, শত্তুরের দল যত সব!’

অভয়পদর কিন্তু এসব কিছুতেই শান্তিভঙ্গ হয় না, সে আপনমনেই ভাঙা লণ্ঠনটা মেরামত করে যায়। মেয়েটা যে অকস্মাৎ কেন অমন ক’রে একেবারে ককিয়ে কেঁদে উঠল, সে কারণটাও জিজ্ঞাসা করে না।

.

ওর মুখ থেকে সব শুনে পিঁটকী মন্তব্য করেছিল, ওলো, ইচ্ছে ক’রে কালো মেয়ে আনছে, বুঝলি? পাছে সোন্দর মেয়ে এলে ওর ওপর থেকে সোহাগ কমে যায়–এই ভয়ে!’

কিন্তু প্রমীলার অন্য আচরণে সে মনোভাবটা খুঁজে না পেয়ে কেমন যেন একটা অস্বস্তি অনুভব করে মহাশ্বেতা।

পাত্রী-পক্ষের কাছে এঁরা চেয়েছিলেন নগদ টাকাই বেশি। অর্থাৎ বিয়ের খরচটা যাতে ঘর থেকে বার করতে না হয়। অনেক দর-কষাকষির পর আটশো এক টাকা নগদ ও পঁচিশ ভরি সোনা ঠিক হয়েছিল। কিন্তু প্রমীলা বেঁকে বসল, ‘তা হবে না। আমাদের দুই জায়ের যা গহনা আছে, ওরও তাই সমান হওয়া দরকার। তা-নইলে খারাপ দেখাবে।

ফলে আরও প্রায় দশ ভরি সোনা ঘর থেকে বার করতে হ’ল। তার ওপর আবার মেজবৌ ধরে বসল, ‘আর তো সবাই পার হয়ে গেছে, মা’র এই শেষ কাজ, ছোটকত্তার বিয়েতে রসুন-চৌকি বসাতে হবে।’

পাগল নাকি, সে যে অনেক খরচ!’

‘কী আর খরচ? আমি খোঁজ নিয়েছি, দশটা টাকা হলেই হয়ে যাবে।

অম্বিকাপদ অবশ্য আর বিশেষ আপত্তি করে নি, শুধু খোঁচা দিয়ে বলেছিল, ‘এটা তো তোমাদের দুই জায়ের কারুর বেলায়ই হয় নি, তবে এটা করতে চাইছে কেন?’

তার জবাবে মেজবৌ বুঝিয়েছিল, ‘তখনকার অবস্থা আর এখনকার অবস্থা সমান হ’ল? গয়না তো বরং আরও বেশি দেওয়া উচিত ছিল, সে সব চেয়ে ছোট, আমাদের আদরের জিনিস। …বুঝতে পারছ না, একসঙ্গে উঠা-বসা, একসঙ্গে ধর নেমন্তন্নে যাওয়া, সেই সময়টাই বড় দৃষ্টিকটু লাগে। আমরা বড়, আমরা পরে যাব, আর ও পরবে না–খারাপ লাগবে না? সবাই জানে যে এ বাড়িতে যে যার সে তার গয়না গড়ায় না–যা হয় সংসার থেকেই হয়। তখন তো সবাই বলবে যে ছোট ভাইটাকে ছেলেমানুষ বলে ঠকাচ্ছে এরা!’

এর পর অম্বিকাপদ কথা বলে নি। কিন্তু শানাইয়ের প্রস্তাবটা অভয়পদ এক কথায় নাকচ করে দিলে। মেজভাইকে ডেকে সংক্ষেপে শুধু বললে, ‘কী শুনছি মেজবৌমা নবৎ বসাতে চাইছেন? ওসব করতে যেও না। পাড়াঘরে সবাই ভাববে, এদের খুব পয়সা হয়েছে। এমনিতেই কানাঘুষো হয়। শেষ অবধি ডাকাত পড়বে।’

ভাসুরের কথার ওপর কথা খাটবে না, প্রমীলা তা ভাল ক’রেই জানে। অগত্যা চুপ ক’রে যেতে হয়।

কিন্তু শানাই ছাড়া ঘটা করবার আর যা যা ব্যবস্থা আছে, কোনটারই ত্রুটি ঘটল না। প্রতিবারেই ‘ভেতো-যজ্ঞি’ হয়, অর্থাৎ বৌভাতের হাঙ্গামাটা দুপুরে সেরে নেওয়া হয়, এবারে মেজবৌ লুচির ব্যবস্থা করলে, লোকও নিমন্ত্ৰিত হ’ল অনেক বেশি। তা ছাড়া আয়োজনটা হ’ল এবার রাত্রে। প্রমীলা বললে, ‘পাতা পেড়ে বসে খেয়ে যাওয়াই ভাল। সেই জনাজাত ছাঁদা তো দিতেই হয়, মিছি-মিছি দুপুরে বলে লাভ কি? আপিসের সময়, সবাই আসতে পারেনা, কিছু না!’

অভয়পদ একবারই আপত্তি করেছিল আর কোন ব্যবস্থাতে প্রতিবাদ জানায় নি, তবু মহাশ্বেতা তাতেই খুশি। মেজবৌর ‘দপ্প’ যে চূৰ্ণ হ’ল, এই আনন্দে সে পরবর্তী এত সমারোহের সব জ্বালা ভুলে গেল। অবশ্য খুব বেশি একটা ঈর্ষা ছিলও না। …তার বেলা যেমন হয় নি, তেমনি মেজবৌর বেলাও তো হয় নি, সেটাই কি কম সান্ত্বনা! ও ছোট, ওর বেলা হয় হোক। …শুধু মেজবৌর মনের ভাবটাই বুঝতে পারছিল না বলে মনে মনে ছট্‌ফট করছিল।

বিয়ের সব ব্যাপারেই প্রমীলা শাশুড়িকে সম্পূর্ণ পিছনে ফেলে গিন্নী হয়ে বসল। এমন কি বরণের সময় সে যে বড় জাকে ডাকল, এটাও যেন মহাশ্বেতা আশা করে নি। কতকটা কৃতার্থ ভাবেই ছুটে এগিয়ে গেল সে। এতটা দাপট যে মহাশ্বেতা আর এক জন্ম ঘুরে এলেও দেখাতে পারত না, সেটা মনে মনে সে-ও স্বীকার করে।

‘ওরই সাজে, সত্যি! কেমন পারে ও!’ আপন মনেই বলে।

মহাশ্বেতা কেন, ক্ষীরোদা মরে গেলেও যা পারতেন না, প্রমীলা সেটাও পারে অনায়াসে। বৌ আসবার সময় হতে উপস্থিত কুটুম্বিনীদের বেশ হেঁকেই শুনিয়ে দেয়, ‘বৌ আসছে বাপু কালো; তা আগে থেকেই শুনিয়ে দিচ্ছি। কেউ যেন না তখন তাকে শুনিয়ে শুনিয়ে চিপ্‌টিনি কেটে কোন কথা বলে। আগে থাকতে সাবধান ক’রে দিচ্ছি। আমি তা হলে কিন্তু কাউকে ছেড়ে কথা বলব না!’

ওর এই দুঃসাহসে সকলে স্তব্ধ হয়ে যায়। এমন কি সেটা নিয়ে আলোচনা করবারও যেন শক্তি থাকে না কারুর। মৃদু গুঞ্জন একটা ওঠে বটে, তবে সে অনেক পরে।

।।৪।।

বৌভাত নির্বিবাদে চুকলেও ফুলশয্যাতে এমন একটা ঘটনা ঘটল, যা এ পাড়াঘরে কেন, কলকাতাতেও কেউ কখনও কল্পনা করেছে কিনা সন্দেহ।

ক্ষীর-মুড়কি এবং হাতের সুতো খোলার পালা শেষ হবার পর, হঠাৎ দেখা গেল মেজবৌ নেই।

সামান্য একটু খোঁজাখুঁজির পরই সবাই চলে গেল ঘর থেকে। সকলের মুখেই একটু চাপা হাসি। অর্থাৎ মেজবৌয়ের অন্তর্ধানের ব্যাপারে কারুর তেমন কোন দুশ্চিন্তা নেই। কারণটা সকলেই অনুমান ক’রে নিতে পারে।

দেখা গেল সকলের সঙ্গে ছোটকর্তারও ব্যাপারটা অনুমান ক’রে নিতে অসুবিধা হয় নি। সবাই চলে গেলে দুর্গাপদ তড়াক ক’রে উঠে গিয়ে দরজাটা বন্ধ ক’রে দিলে, তার পর হেঁট হয়ে তক্তপোশের তলা থেকে টেনে বার করলে কালো-কাপড়-মুড়ি দেওয়া প্রমীলাকে। এই গরমে পুঁটুলির মতো বসে থেকে আধসেদ্ধ হয়ে গেছে সে।

খুব একচোট হাসাহাসি হ’ল বৈকি!

এমন কি কনে-বৌও ওপাশে মুখ ঘুরিয়ে ফিক্ ক’রে হেসে ফেললে।

টেনে বাইরে এনেও আসামীকে শক্ত ক’রে ধরে ছিল দুর্গাপদ; বেঁকেচুরে এক ঝটকায় হাত ছাড়িয়ে দরজার কাছে পৌঁছল প্রমীলা, ‘বেশ ভাই বেশ, আপদবালাই চললুম, মনের সুখে পীরিত কর–হ’ল তো?’

কিন্তু দুর্গাপদ আরও আগে গিয়ে বদ্ধ কপাটে ঠেস দিয়ে দাঁড়াল।

‘উঁহু, তা হবে না। ছিলে যখন, এখানেই থাকতে হবে।’

‘ছাড় ছাড়, কী ইয়ার্কি হচ্ছে!’

‘ইয়ার্কি আবার কি? থাকই না।

‘হ্যাঁ, তোমার ফুলশয্যের আমি কাঁটা হয়ে থাকি আর কি? ছোটবৌ শাপমন্যি দিক শেষে!

‘ফুলে তো কাঁটা থাকেই, এ আর এমন নতুন কথা কি? না হয় কাঁটাই হয়ে থাকলে।

‘এই ছাড় সত্যি! লোকে কি বলবে? ছোটবৌই বা কি মনে করবে! ফুলশয্যের রাত বলে কথা, এ তো আর জীবনে দুবার আসবে না!

‘লোকে আবার কি ভাববে! আর একজন মানুষ তো আছে। এসো সবাই মিলে গল্প ক’রে কাটিয়ে দিই। কতটুকুই বা রাত বাকী আছে। এসো, এসো!’

এক রকম জোর ক’রেই হাত ধরে বিছানার কাছে টেনে আনে দুর্গাপদ। হয়তো প্রমীলাও শেষ পর্যন্ত খুব জোর দেখায় না। ছোটবৌকে মাঝখানে ঠেলে দিয়ে এক পাশে শুয়ে পড়ে সত্যি-সত্যিই।

তার পর ওরা দুজনে বেশ গল্প জমিয়ে তোলে। এটা-ওঠা তুচ্ছাতি-তুচ্ছ কথা। বিয়ে-বাড়িতে সমাগত আত্মীয়-কুটুম্বিনীদের বিচিত্র আচরণ নিয়ে হাসিঠাট্টাই বেশি। মনে হতে লাগল, ওদের মাঝখানে আড়ষ্ট কাঠ-হয়ে-শুয়ে থাকা আর একটি মেয়ের অস্তিত্ব ওরা ভুলেই গেছে।

.

বাইরে যারা আড়ি পাতবার আশায় ছিল, আড়ষ্ট হয়ে গেছে তারাও। এমন অভাবনীয় কাণ্ড আর এমন প্রচণ্ড দুঃসাহস স্মরণকালের মধ্যে কেউ কখনও শুনেছে বলে কারও মনে পড়ে না। আড়ি পাতবার মজাটা না হওয়ায় তাদের আক্রোশ আরও বেশি। কিন্তু সে শুধুই ব্যর্থ আক্রোশ, মেজবৌকে যে তাদের কোন আঘাত কখনও লাগবে না, তা তারা জানে।

ছোটবৌ তরলার ঠিক কি অনুভূতি হচ্ছিল, তা বলা শক্ত। দুঃখ বা বেদনার চেয়েও বেশি যেটা, সেটা বিস্ময়! এক রকমের নাম-না-জানা আতঙ্ক- মিশ্রিত বিস্ময় শুধু। পনেরো বছর বয়স হ’ল তার, এর মধ্যে বহু মেয়ের ফুলশয্যার বহু বিবরণ সে শুনেছে, কৈ কোনটার সঙ্গে তো মেলে না এ অভিজ্ঞতাটা! এ তার কী হ’ল?

অবশ্য মেজবৌ সকাল পর্যন্ত রইল না ওদের ঘরে। হাসিগল্পের মধ্যেই দূরের চটকলে চারটের ভোঁ বাজা শুনতে পেয়েছিল সে। সঙ্গে সঙ্গে হঠাৎ এক লাফে উঠে, দুর্গাপদ ব্যাপারটা কি বোঝাবার বাধা দেবার আগেই, বাইরে বেরিয়ে গিয়ে কপাটটায় শেকল তুলে দিলে।

তার পর এক মুহূর্ত সেইখানে দাঁড়িয়েই ইতস্তত করল। মেজকর্তা নিশ্চয়ই দোর দিয়েই ঘুমোচ্ছে, ডাকাডাকি করতে গেলে বাড়িসুদ্ধ জেগে উঠবে। এত হাঙ্গামা ক’রে লাভ নেই, ওপাশের দালানে বিছানা ক’রে ওর বড় ননদ ঘুমোচ্ছিল, শেষ পর্যন্ত সেইখানেই গিয়ে এক পাশে গুটিসুটি মেরে শুয়ে পড়ল।

ত্রয়োদশ পরিচ্ছেদ

॥১॥

রতনের বাড়ি কান্তি সুখেই আছে বলতে হবে, কিন্তু শান্তিতে নেই। অথচ কেন যে শান্তিতে নেই, কেন যে সর্বদা একটা অস্বস্তি বোধ করে–তা সে নিজেও তেমন ভাল ক’রে বুঝতে পারে না।

রতনদি তাকে খুবই যত্ন করে অবশ্য। পাছে আশ্রিত মনে ক’রে ঠাকুরচাকররা অবহেলা করে বা তাদেরই সমপর্যায়ভুক্ত ভাবে–এই জন্যে সে ছুটির দিনে দুপুরবেলায় কান্তিকে সঙ্গে নিয়ে খেতে বলে কারণে অকারণে মোক্ষদাকে উপলক্ষ ক’রে সবাইকে শুনিয়ে বলে, ‘দেখিস–কুটুম মানুষ, যত্ন করিস। নিন্দে না হয়।’

রতনদি মানুষ ভাল, খুবই ভাল। এমন মিষ্টি কথাবার্তা, এমন সেস্নেহ মধুর ব্যবহার কান্তির কাছে অবিশ্বাস্য। রতনকে দেখে বড়লোক সম্বন্ধে ধারণটাই তার পালটে যাচ্ছে। বড়লোক বলতে কান্তিরা এত-কাল সরকারদেরই জানত, এখানে এসে কান্তি বুঝেছে যে এরা সরকারদের চেয়ে ঢের বড়লোক। কিন্তু তবু তাদের মতো একটুও নয় তো। সরকার-বাড়ির ছেলেমেয়েদের দেখে ওর মনের মধ্যে বড়লোকত্ত্বের সঙ্গে রূঢ় কর্কশ কথা এবং উদ্ধত অবহেলা অঙ্গাঙ্গী হয়ে গিয়েছিল। তাই, এখানে এসে প্রথম প্রথম এদের, বিশেষত রতনদির কথাবার্তা শুনে, তার সঙ্গে সংসারের চারিদিকে ছড়নো প্রাচুর্য ও ঐশ্বর্যের চিহ্নগুলোকে খাপ খাওয়াতে পারত না। সবটাই যেন মাথার মধ্যে গুলিয়ে যেত।

‘তবু রতনদি যেন কেমন!

ওর মধ্যে যেন দুটো মানুষ আছে।

একটা দিনের বেলা–মানে বেলা আটটার পর থেকে সন্ধ্যা আটটা পর্যন্ত তার সঙ্গে সদয় মধুর ব্যবহার করে, মিষ্টি কথা বলে, লেখা-পড়ার খোঁজ নেয়, কত কি গল্প বলে, ভাল ভাল বই থেকে গল্প পড়ে শোনায়–ওর সুখ-সুবিধার দিকে নজর রাখে; কিন্তু রাত আটটা বাজলেই অন্য একটা মানুষ যেন ওর মধ্যে ভর করে।

সে যেন একেবারে আলাদা। তাকে দেখে ভয় হয় এবং বলতে নেই–ভাবতে গেলে মনের মধ্যে একটু লজ্জাই অনুভব করে কান্তি–ঘৃণাও হয়।

রতনদিও তা জানে বোধ হয়। সে তেতলার একটা ছোট্ট ঘরে কান্তির থাকার ব্যবস্থা ক’রে দিয়েছে। এবং প্রথম দিনই বলে দিয়েছে–’সন্ধ্যের পরই তোমার ঘরে উঠে যেও, লক্ষ্মী ভাইটি। বিশেষ দরকার না পড়লে নিচে নেমো না। রাত্রের খাবার যাতে আটটার মধ্যেই হয়ে যায় বামুন ঠাকুরকে বলে দিয়েছি–খেয়েদেয়ে ওপরে চলে যেও–পড়াশুনো ক’রে ঘুমিও। ভয় পেও না, মোক্ষদাকেও এখন থেকে রাত্তিরে ওপরে শুতে বলেছি। তোমার পাশের ঘরেই সে থাকবে–ভয়-টয় পেলে তাকে ডেকো।’

তার পর একটু থেমে ঢোক গিলে বলেছে যে–’তোমার ভগ্নীপতি বড় রাগী মানুষ, তা ছাড়া কারণে-অকারণে বড় হৈ-হল্লা করে–তাই হয়তো চেঁচামেচি শুনবে কিন্তু তাতে ভয় পেও না। নিচে নামবারও দরকার নেই। কী জানি কি মেজাজে থাকবে, কোন দিন কি বলবে-টলবে–সে তোমারও অপমান আমারও অপমান। দরকার কি!’

কান্তি সে নির্দেশ সাধ্যমতই পালন করত অবশ্য। ইস্কুল থেকে ফিরে দোতলায় রতনদির ঘরে বসে একটু-আধটু গল্প করত–তার পর সন্ধ্যে হলেই ওপরে গিয়ে পড়তে বসত। সাড়ে সাতটা নাগাদ মোক্ষদা আসত ডাকতে–’খাবে চল গো দাদা, তোমার খাবার হয়ে গিয়েছে।’ একবার গিয়ে খেয়ে আসত নিচে থেকে। তার পরই যে ওপরে এসে ঢুকত–আর বড় একটা নামত না। কেবল প্রাকৃতিক প্রয়োজনে এক আধ দিন নামতেই হ’ত–সে দৈবাৎ, কিন্তু তাতেই সে নিচের একটা বীভৎস জীবনের আভাস পেত। শুধু হৈ- হল্লা চেঁচামেচি নয়–আরও সব কত কি! কী একটা উগ্র গন্ধও পেত, প্রথম দিন সে গন্ধে বমি এসে গিয়েছিল ওর। অনেকদিন পরে মনে পড়েছিল–এই গন্ধ একদিন ও শিবপুর থেকে মা’র সঙ্গে হেঁটে ফিরতে ফিরতে পেয়েছিল। ওদের পাড়ারই পেঁকো মল্লিক পাশ দিয়ে চলে গিয়েছিল কেমন একরকম টলতে টলতে–তার গা থেকেও এমনি গন্ধ পেয়েছিল। মা বলেছিল, ‘উঃ পেঁকো মল্লিক মদ খেয়েছে!’ এটাও তাহলে মদের গন্ধ।

সঙ্গে সঙ্গে মনে হয়েছিল, ‘রতনদির বর মদ খায়! ছিঃ!’

একটু দুঃখও হয়েছিল তখন, ‘ঐ জন্যেই রতনদি নিচে নামতে বারণ করে। লজ্জা পায় বলে। আহা বেচারী!’

কিন্তু যেদিন আবিষ্কার করল যে শুধু রতনদির বর নয়–রতনদিও নেশা করে, ওর সেদিনের দুঃখ ভোলাবার নয়।

রাত তখন দশটা বেজে গেছে, কান্তির দু’চোখে ঘুম এসেছে জড়িয়ে। মোক্ষদা অবশ্য শেজ-এর আলোটা জ্বেলে দিয়ে গেছে অনেকক্ষণ–এটা সারারাত জ্বলে, কান্তি আসার পর রতনই এ ব্যবস্থা ক’রে দিয়েছে, বলে, ‘ছেলেমানুষ একা শোবে, আলো না থাকলে ভয় করবে’–সুতরাং হাত বাড়িয়ে ওর পড়বার আলোটা নিবিয়ে দিয়ে চোখ বোজার অপেক্ষা, আর কিছুই করবার নেই। তা-ই করতে যাবে, হঠাৎ নিচে বিরাট একটা হৈ-চৈ গণ্ডগোল উঠল এসব অবশ্য আজকাল ওর কতকটা গা-সওয়া হয়ে গিয়েছে, এমন কি রাশি রাশি কাঁচের বাসন বা বোতল ভেঙে পড়বার শব্দেও বড় একটা ওর শান্তিভঙ্গ হয় না–তবে আজকের এ হৈ-হল্লাটা যেন বিশেষ রকম। অভ্যস্ত শব্দগুলো আজ একটু বেশি হচ্ছে–তাতেও হয়তো কান্তি এত বিচলিত হ’ত না, কিন্তু–কে কাঁদছে না? আর একটু কান পেতে শুনতেই মনে হ’ল–রতনদিই কাঁদছে।

.

আর চুপ ক’রে থাকতে পারল না কান্তি, তাড়াতাড়ি দরজা খুলে বেরিয়ে নেমে এল। নিচে আসতেই নজরে পড়ল, ওরই ঘরের সামনে বারান্দায় রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কাঁদছে রতনাদি–কপালটা কাটা, তা থেকে রক্ত গড়িয়ে পড়ে বুকের কাছে কাপড়টা পর্যন্ত রাঙা হয়ে উঠেছে। চারিদিকে ভাঙা ডিশ ও বোতল ছড়ানো। ভেতর থেকে কে একজন জড়ানো জড়ানো গলায় তখনও চেঁচামোচি করছে। ঠাকুর-চাকররা ছুটে এসে সিঁড়ির মুখে দাঁড়িয়েছে, আর মোক্ষদা এসে হাত ধরে টানছে রতনদিকে। শুধু–ওরই মধ্যে এক ফাঁকে দেখে নিলে কান্তি, নিচে কত্তাঠাকুরের ঘরে তখনও আলো জ্বলছে কিন্তু তিনি বেরিয়ে আসেন নি।

রতনকে ঐ অবস্থায় দেখে কান্তি আর থাকতে পারলে না, কাঁচ বাঁচিয়ে খানিকটা এগিয়ে এসে তাড়াতাড়ি প্রশ্ন করলে, ‘কী হয়েছে রতনদি, কেটে গেল কী ক’রে!’

রতন কান্না থামিয়ে উগ্র কণ্ঠে ওকে তেড়ে উঠল, ‘তুই কেন রে ছোঁড়া এখানে? একশো বার বলেছি না নিচে নামবি না। –এঁচোড়ে-পাকা হয়ে উঠেছ এরই মধ্যে? বালামচালের ভাত* পেটে পড়তে না পড়তেই পিপুল পেকে গেছে?…যা বেরো–ওপরে যা। ফের যদি ভেঁপোমি করতে আসবি তো দূর ক’রে দেব–যেখানে ছিলি সেখানে।’

[* সেকালে বাখরগঞ্জ বা বরিশালের বালামচাল কলকাতায় খুব বেশি চালু ছিল। প্রথম মহাযুদ্ধের পর থেকে এর চলন কমতে থাকে। কিন্তু নামটা ছিল অনেক দিন। ]

ভয়ে, অপমানে, লজ্জায় আড়ষ্ট হয়ে পা পা ক’রে পিছিয়ে গেল কান্তি 1 কিন্তু তবু তারই মধ্যে একটি জিনিস লক্ষ্য ক’রে গেল–রতনদির মুখেও সেই বিশ্রী গন্ধটা। তারও পা টলছে।

তা হরে রতনদিও।

চোখের ঘুম কোথায় চলে গেল ওর। বহু রাত্রি পর্যন্ত ছাদে জেগে বসে রইল কান্তি। প্রথমে অপমানটাই খুব লেগেছিল ওর। ওরও কান্না পেয়ে গিয়েছিল–দাসী-চাকরের সামনে এ কী অপমান! সে যে আশ্রিত, সে যে অন্নদাস, নিরুপায়–যে কথাটা রতনদি নিজেই এতদিন ঢাকবার চেষ্টা করত, সেইটেই প্রচার ক’রে দিলে নিজেই! এর পর ওরা কী চোখে ওকে দেখবে–কি করুণা ও বিদ্রূপের চোখে–সেইটে কল্পনা ক’রেই ওর কান মাথা গরম হয়ে উঠল, চোখ ফেটে জল এল। অপমান ও লাঞ্ছনা ওদের নতুন নয়–কিন্তু এখানে এসে এত আদরযত্ন এত সম্মান পাবার পর এ আঘাতটা যেন বড় বেশি বাজল!

নিচের গোলমাল শান্ত হয়ে এসেছে। মোক্ষদা ঝাঁট দিয়ে ভাঙা কাঁচগুলো সরাচ্ছে আস্তে আস্তে–নিচে রান্নাঘরে সামান্য খুটখাট আওয়াজ, ঠাকুর দ্রুত কাজ সেরে নিচ্ছে তার। একটু পরেই ওদেরও খাওয়া-দাওয়া চুকে যাবে–বাড়ি শান্ত ও নিস্তব্ধ হয়ে আসবে।

তবু ঘুম এল না কান্তির। অনেকক্ষণ ধরে কাঁদবার পর নিজের অপমানের জ্বালাটা গেছে, কিন্তু রতনদির কথাটা ভুলতে পারছে না। কান্নার ফলে রগের পাশ দুটো দপ্‌দপ্ করছে, মাথাটা ধরে উঠছে–তবু ঘুম নেই।

আর একটু পরেই মোক্ষদা শুতে এল। হাতে অভ্যস্ত কেরোসিন তেলের পাত্র। শোবার আগে হাজার দিতে হয় ওর। কিন্তু কান্তিকে দেখে আর ঘরে গেল না, সেইখানেই পা ছড়িয়ে বসল পায়ে তেল দিতে।

‘ওমা, এখনও ঘুমোও নি বুঝি দাদাবাবু? আহা, দিদির ব্যাপারটা বড় নেগেছে, না? তা তুমি ওসব গায়ে মেখো নি, বুঝলে? ও কি আর ও বলেছে, নেশায় বইলেছে। নইরে মানুষ তো দ্যাখো–ঐ সব কথা বলবার কি মানুষ?…এই বাপু তোমাকে বলা রইল, নিচে যাই হোক না কেন, অক্তগঙ্গা কি পেলয় কুলুখেত্তর ঘটে যাক–তুমি নিচে নেমো নি।’

কান্তি আর থাকতে পারলে না, আস্তে আস্তে মোক্ষদার পাশে এসে বসে প্রশ্ন করলে, ‘আচ্ছা রতনদি ঐ সব ছাউভস্ম নেশা করে কেন মোক্ষদাদি? ওতে যে শুনেছি শরীর খারাপ হয়ে যায়। মানুষ আর মানুষ থাকে না!

.

‘করে কেন! আ আমার কপাল!’ ফিস ফিস ক’রে বলে মোক্ষদা, ‘ও কি আর সাধ ক’রে করে? ওকে যে জোর ক’রে করায়! কী করবে বল! আগের যে বাবু ছেল সে ছেল দেবতা। আসত যেত কাকে-পক্ষীতে টের পেত নি! আর নটার পর আসত, ওদিকে আত থাকতে থাকতেই চলে যেত। …কপাল খারাপ তাই সে বাবু গেল। …তা কি দুটো দিন নিস্তার আছে, কি একটু খোঁজখবর ক’রে বেছেবুছে নেবার জো আছে? ঐ যে দত্যিদানা আছে ঐ নিচের ঘরে শুয়ে–মুয়ে আগুন, মাক্কণ্ডির পেরমাই নিয়ে এসেছে যেন, মরণও নি! না ওর না ঐ মাগীর–বসে বসে মেয়েবেচা পয়সায় খাচ্ছে, তবু মরবার নাম নি। …ঐ মিসে গো–ঐ কত্তাবাবু কি চোখে-কানে দেখতে দিলে, আত না পোয়াতে পোয়াতে নিজে কক্করে দুটি হাজার টাকা গুনে নিয়ে এই মিন্‌সেকে জুটিয়ে দিলে। এ কি মানুষ, আক্কস! নিজে পিপে পিপে মদ গিলছে, মেয়েটাকে সুদ্দু, মাতাল ক’রে ছাড়ছে! নইলেই মেজাজ ভাঙবে চুরবে মারধোর করবে–যাচ্ছে- তাই কাণ্ড, বেলেল্লাগিরির একশেষ। তবে হ্যাঁ–দুটো গুণ আছে, পয়সা ঢালে অজচ্ছল, একটা ভাঙলে তিনটে পাঠিয়ে দেবে পরের দিন আর ভোর ভোরটি হবে; দুটি কাপ চা গিলবে পর পর–তার পরই পালাবে। মেয়েটার ছুটি, পরের দিন আত আটটার আগে আর টিকি দেখাবে নি। ছুটির দিনও দোপর আসে না। সেখানে নাকি এক খাণ্ডারনী আছে, তাকে ও ভয় করে খুব শুনেছি।’

মোক্ষদা বোধ করি নিঃশ্বাস নেবার জন্যেই থামল একটু।

কান্তির তখন মাথা ঘুরছে যেন। এসব কথা ওর কাছে একে-বারেই দুর্বোধ্য, জটিল!

‘বুড়োকত্তা’ অর্থাৎ রতনদির বাবা একজন আছেন বটে–শুনেছে, ঠাকুরের আর মোক্ষদার কাছেই শুনেছে, বড্ড বদমেজাজী রাগী–সেই জন্য তাঁর ত্রিসীমানায়ও যায় না কান্তি। আর বুড়ো-মতো মেয়েছেলেও একজন আছেন–তিনিই নাকি রতনদির মা–রোগা ক্ষয়াঘষা একরত্তি। তাঁকে একদিন মাত্র দেখেছিল, তিনি নাকি ঠাকুরঘরের বাইরে বেরোন না। তিন চার দিন অন্ত র সামান্য হবিষ্যি খান। মোক্ষদা বলে, ‘বেরোয়া না তাই বেঁচে গিয়িচ। যা চুঁচিবাই, মাগো, তাইতেই আমার এই হাতেপায় ঘা ধরে গেছে। নিত্যি বেরোলে তো পাগল হয়ে যেতুম!’

কান্তির কানে গেল মোক্ষদা কেরোসিন তেল পায়ে ঘষতে ঘষতে তখনও বলে চলেছে, ‘তেমনি জব্দ হয়েছে মিসে। আগে ওঁরও অমনি ছিল, কথায় কথায় আগ, কথায় কথায় দম্ভয্যি, থালাবাসন ছোঁড়াছুঁড়ি-এ বাবু আসবার পর একেবারে কেঁচোটি। এক দিন কি করেছিল চেঁচামোচি, অমনি তেড়ে নিচে গিয়ে বলে দিলে, ‘দ্যাখো চুপচাপ থাক তো থাক, নইলে দারোয়ান দিয়ে বার ক’রে দেব। মেয়ের পয়সায় খাচ্ছ, অত আবার মেজাজ কিসের? লজ্জা ক’রে না?’–সেই দিন থেকে একেবারে ঠাণ্ডা! খোঁতা মুখ ভোঁতা ক’রে দিয়েছে তো!…বেশ হয়েছে। মুয়ে আগুন। অমন বাপের মুখে নুড়ো জ্বেলে দিতে হয়!’

কান্তির কিন্তু এসব কথায় তত কান ছিল না। তার মনের মধ্যে যে সমস্যাটা প্রবল হয়ে উঠেছিল সেইটেই চেপে রাখতে পারলে না। আস্তে আস্তে বললে, ‘আচ্ছা মোক্ষদাদি, আগের বাবু এ বাবু কি আলাদা?…মানে রতনদির কি দুটো বিয়ে?’

‘বে!’মোক্ষদা যেন থতমত খেয়ে যায়, ‘হ্যাঁ তা বে-ই বলতে পার। …আমার হয়েছে যেন মরণদশা, কি বলতে যে কী বলে ফেলি মুয়ে আগুন, বুড়ো হয়ে মরতে চন্নু, এখনও হষ্যিদীগ্যি জ্ঞান হ’ল না! মুখে লাগাম এল না। …হেই দাদাবাবু এসব কথা যেন ঘুণাক্ষরে বলো নি কাউকে–তা হলে আমার চাকরি থাকবে না। মরে যাব একেবারে। সাত দোহাই তোমার!’

মোক্ষদা কেরোসিনের হাতেই কান্তির হাত দুটো চেপে ধরে।

তাড়াতাড়ি হাতটা টেনে নিয়ে সে বলে, ‘ছি! কী ভাব আমাকে তুমি মোক্ষদাদি! আমি এসব কথা কাকে বলতে যাব? তুমি নিশ্চিন্তি থাক, আমি কাউকে বলব না।’

‘দেখো বাপু!’ তার পর নিজের গালে নিজেই দুই চড় মারে মোক্ষদা, ‘এই, এই! নই নাককান মলা খাচ্ছি। …তবু যদি চৈতন্য হয়!’

তার পর নীরবে আর কিছুক্ষণ পায়ে তেল ঘষে মোক্ষদা প্রচণ্ড একটা হাই তুলে বলে, ‘যাই, আবার তো সেই ভোরে উঠে চোদ্দ বাটি চা দেওয়া। বলি দাসী-চাকর তো পঞ্চাশ গণ্ডা! অথচ যা কিছু সবই তো এই মুকী ছাড়া চলে না! দেখছ তো নিজের চোখে?’

॥২॥

কিন্তু শুধু রাত্রেই নয়, সকালেও স্নানের আগে পর্যন্ত রতনদির মেজাজ যেন কেমন থাকে। কিছুতেই ব্যাপারটা বুঝতে পারে না কান্তি। সাতটায় ওঠে, বিছানা থেকেই চা খেয়ে আটটা নাগাদ কলঘরে ঢোকে, বেরোয় পুরো দেড় ঘণ্টা পরে। তখন একেবারে নতুন মানুষ। কিন্তু বিছানা থেকে ওঠবার পর আর কলঘরে ঢোকার আগে অবধি মেজাজ যেন চড়েই থাকে। যাকে সামনে পায় খিঁচোয়, ঝি-চাকরদের সঙ্গে বকাবকি করে, তুচ্ছ কারণেও রেগে আগুন হয়। এক দিন সেই সময়টা নিতান্ত প্রাকৃতিক কারণেই কান্তিকে নিচে নামতে হয়েছিল, ওর সামনে পড়তেই যেন তেড়ে মারতে এল, ‘এই ছোঁড়া দিন নেই রাত নেই তুই যখন-তখন নিচে ঘুরঘুর করিস কেন বল্ তো? পড়াশুনো নেই তোর? মা এই করতে পাঠিয়েছে এখানে?’

কান্তি তো আড়ষ্ট। প্রথমটা ভয়ে কথাই বেরোয় না, অতিকষ্টে বললে, ‘না–আমি তো মানে এই আজই–’

‘আজই!’ ভেঙিয়ে বলে রতন, ‘আজই! যেদিন দেখি সেই দিনই আজ! না? যা পড়তে বস গে যা!’

প্রাকৃতিক কাজটা মাথায় তুলে ফিরে আসতে হয়েছিল কান্তিকে।

কিন্তু একটু পরেই রতন কলঘরে ঢুকল। মোক্ষদাকেও রোজ প্রথমটা ঢুকতে হয় ওর সঙ্গে, তারই মধ্যে এক ফাঁকে সে ওপরে উঠে বলে গেল, ‘যাও গো দাদা, এবার নিচোয় চলে যাও। আর কিছু বলবে নি, চান ক’রে যখন বেরোবে–তখন দেখো নতুন মানুষ!’

সত্যিই তাই। স্নান ক’রে ঠাকুরঘরে গিয়ে প্রণাম সেরেই রতন ওর পাশে এসে দাঁড়ায়, ‘কান্তি কিছু মনে করিস নি ভাই।’ বলে হঠাৎ পাশে বসে পড়ে দুটো আঙুল ক’রে ওর দাড়িটা তুলে ধরতেই কান্তি আর সামলাতে পারে না নিজেকে, ওর চোখে জল এসে যায়। সঙ্গে সঙ্গে ব্যাকুল হয়ে রতন নিজের মূল্যবান ধোপদস্ত ফরাসডাঙ্গার শাড়ির আঁচল দিয়েই ওর চোখ মুছিয়ে দিয়ে বলে, এই দ্যাখো…পাগল! একেবারে চোখে জল এসে গেল!…ওরে তখন বড্ড মাথা ধরেছিল, কী বলছি কী করছি–সে কি জ্ঞান ছিল কিছু?…রাগ করিস নি লক্ষ্মীটি!

আরও অনেক মিষ্টি কথা বলে চলে গিয়েছিল রতন।

কান্তির কাছে এ আচরণ বুদ্ধির অগম্য। কিন্তু বুঝিয়ে দেয় মোক্ষদাই– সন্ধ্যেবেলা এক ফাঁকে এসে হঠাৎ পা ছড়িয়ে বসে বলে, ‘সকালে বুঝি গিন্নী এসে আবার তোমার কাছে ঘাট মেনে গেল? দেখলে? আমি বলি নি তোমাকে যে চান ক’রে বেরোবে নতুন মনিষ্যি!’

‘আচ্ছা অমন কেন হয় মোক্ষদাদি?’ প্রশ্ন না ক’রে পারে না কান্তি।

‘ওরে বাবা, সকালে যে মাথা ধরে থাকে। পেচণ্ড মাথাধরা, ও আমি জানি যে!…দিনকতক আমার মানুষও ঐসব ছাইভস্ম ধরিয়েছিল কিনা, ঐ দ্যাখো আবার কি বলতে কী বলে ফেলি। মরণদশা আমার!’

‘রোজ মাথা ধরে থাকে?’

‘ওজ! পেত্যহ!…আসল কথা খোঁয়ারী ভাঙে না তো! আবার যদি সকালে একটু ঢুকঢুক চালাত চাঙ্গা তো চালায় না। ঐ চান করে দেড় ঘণ্টা ধরে, কলের নিচে মাথা পেতে বসে থাকে–অন্তত দশ-পনেরো মিনিট–তবে ছাড়ে। তখন আবার মিনিষ্যিজম্ম ফিরে আসে।’

একটু চুপ ক’রে থেকে কান্তি বলে, ‘আচ্ছা অতক্ষণ ধরে জলে থাকেন, অসুখ করে না?

‘অব্যেস! তবে আর অব্যেস বলেছে কেন? অব্যেস সব হয় রে ভাই!’ ওঁর সঙ্গে তুমিও থাক কেন?

‘ওমা তেল মাখতে হয় যে! চান করার কত পব্ব তা তো জান না। ঐ যে দেখছো মাছি-পিছলে পড়ছে ভেলভেট সার্টিংয়ের মতো মোলাম চামড়া, ওকি অমনি হয় নাকি? কত ছেলাবত ওর, অমন ছেলাবতে থাকলে আমাদের চামড়াও অমনি হ’ত! শোন, পেথম তো আমি সুদ্দ কল ঘরে ঢুকে তেল মাখাতে বসব–অমন একটি ঘণ্টা ধরে চুপচুপে ক’রে তেল মাখবে, ঐ কলঘরে বড় সাদা পাথরের জলচৌকি আছে, দেখছ তো? ওটা শুধু তেল মাখবার জন্যেই। তার পর বেসম দিয়ে সেই তেল আবার তুলতে হবে। তার পর তো আমি বেরিয়ে আসব, উনি তখন বেশ ক’রে সাবান মাখবেন। তার পর চান- টান সারা হলে গা মাথা মুছে গন্ধ-তেল মাখা হবে। গায়েও সেই তেল পড়বে, তবে আল্‌তো। তার পর আবার দু-চার ঘটি জল গায়ে ঢেলে গা মুছে তবে বেরোবে। দ্যাখ না যখন বেরিয়ে আসে কেমন ভুরভুর করে খোসবো–গা থেকে ও অমনি খোসবো বেরোয়!’

.

তার পর উঠে যেতে যেতে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে কতকটা স্বগতোক্তিই করে মোক্ষদা, যে ব্যবসার যা! নইলে পয়সা আসবে কেন?

সত্যিই–রতনদির গায়ের চামড়া একটা দেখবার মতো–ভাবে কান্তি, তার মাও তো কত ফরসা, মেঝদির তো কথাই নেই, কিন্তু অমন চামড়া কারুর নয়। …ঐ জন্যেই অত বড় কলঘর লাগে রতনদির–ঐ কলঘরে রতনদি আর জামাইবাবু ছাড়া কারুর যাবার হুকুম নেই। একদিন শুধু ঢুকে দেখেছিল কান্তি। কী বড়–একেবারে একটা শোবার ঘরের মতো। এক দিকে চৌবাচ্চা, ঝাঁঝরি কল, তার মধ্যেই এক কোণে একটা চেয়ারের মত–ঐটে নাকি পাইখানা। জলচৌকিই আছে দুটো। একটা কলের নিচেই–আর একটা শ্বেতপাথরের চৌকি, কিছু দূরে। এক ধারে তাকে সাজানো সার সার তেল সাবান–আর কত কি, শিশিতে শিশিতে কৌটোয়! একটা মানুষের এত কি লাগে চান করতে ভেবে পায় না কান্তি। তার মা-দিদিরা তো মাথার মাঝখানে একটু তেল থাবড়ে দিতে দিতে ছোটে পুকুরঘাটে। তাই মেঝদির কি মেঘের মত একঢাল চুল!

মোক্ষদার শেষ কথাটা ভাল বুঝতে পারে না কান্তি–ওটা কি বলে গেল মোক্ষদাদিটা আস্ত পাগল!

।।৩।।

কিন্তু ক্রমশ একটু একটু আঁচ পায় বৈকি।

আশপাশের বাড়িগুলোও যেন কেমন কেমন। দিনের বেলা সব নিথর–চুপচাপ রাত হলেই জেগে ওঠে। ঘরে ঘরে আলো, হাসি-তামাশা, মধ্যে মধ্যে কোন কোন বাড়ি থেকে গানবাজনারও শব্দ আসে। কিন্তু আবার সকাল হলেই ভোঁ ভোঁ, নিবান্দাপুরী। সেই রূপকথার ঘুমন্ত দেশের মত। তা ছাড়া কোন বাড়িতেই যেন পুরুষ নেই–থাকলে দু’একজন। পুরুষ বলতে চাকর–তাও ঝিই বেশি! তারাই বাজার করে, তারাই দোকানে যায়, সব। এক-একটা বাড়িতে বোধ হয় অনেক ঘর ভাড়াটে থাকে, এক ঝিই কিন্তু সব ভাড়াটের বাজার করে। সে এক মজার কাণ্ড, কতদিন ইস্কুল যেতে যেতে দেখেছে কান্তি, ওধারের বড় রাস্তায় কারুর রকে বসে হিসেব মিলোচ্ছে। একটা ঝি তো পেয়ে বসেছে তাকে, দেখতে পেলেই ডাকবে, ‘ও খোকা শুনে যাও, নক্ষীদাদা আমার–হিসেবটা একটু বুঝ ক’রে দিয়ে যাওনা!’ আসলে সবার বাজার থেকেই চুরি করে–হিসেব ‘বুঝ করতে, গিয়েই বুঝে নিয়েছে। পাছে ওখানে গিয়ে হিসেব গোলমাল হয়ে যায় তাই রাস্তা থেকে হিসেব বুঝে চুরির পয়সা আলাদা পেটকাপড়ে বেঁধে নেয়। যা ফেরত পয়সা হবে–তাও আলাদা নেয়, তার পর বাড়ি ফিরে সেই নতুন হিসেব বুঝিয়ে দেয়। এক-এক দিন কান্তির মুখের দিকে চেয়ে হেসে ফেলে বলে, ‘দুটো পয়সা এই থেকে না সরালে খাব কি বল দাদা? পেটটা চলা চাই তো। মাইনে যা দেয় তা তো বুঝতেই পার। তা থেকে আর কত পয়সা জমে! বলি গতর যতদিন আছে ততদিনই, তারপর কি আর কেউ পুছবে, না বসিয়ে খাওয়াবে? তখন খাব কি?…তাই কি আর এমন হয়, এখন সব স্যায়না হয়ে গেছে। আর বাজারও তো ভারী, চার গণ্ডা, পাঁচ গণ্ডা পয়সার বাজার জনাযাতের–তা থেকে দুটো পয়সা রাখতেই কষ্ট হয়!’

তবু পাড়াটায় যে কোন বিশেষ ‘চিহ্ন’ আছে তা কান্তি বুঝতে পারে নি অনেক দিন। এক দিন হঠাৎ কী কথায় কথায় ওর ক্লাসের একটা ছেলে জিজ্ঞাসা করে বসল, ‘তুই কোথায় থাকিস রে কান্তি?’ কান্তি সরল ভাবেই পথটার নাম বললে। অকম্মাৎ আশেপাশে যারা ছিল–পাঁচ-ছ জন ছেলে বেশ জোরে হেসে উঠল। তারপর কেমন একটা যেন নতুন কৌতূহলে চেয়ে রইল ওর দিকে, তখনও তাদের ঠোঁটের কোণে ঈষৎ কৌতুকের হাসি!

সেইখান দিয়ে যাচ্ছিলেন ওদের এক মাস্টারমশাই–ধীরেনবাবু, বিরাট গোঁফ, প্রথমটা দেখলেই ভয় করে–কিন্তু ভারি ভালমানুষ–তিনি যেন বাতাসে কি একটা অঘটন টের পেয়ে থমকে দাঁড়িয়ে একটা ছেলেকে প্রশ্ন করলেন, ‘কী হয়েছে রে জগু?’

জগু মুচকি হেসে বললে, ‘কিছু না স্যার! এই কে কোথায় থাকে, তাই জানা হচ্ছিল। কান্তি স্যার রামবাগানে থাকে!

আচ্ছা আচ্ছা হয়েছে, এঁচোড়ে-পাকা ভেঁপো ছেলে সব। ফের যদি এইসব প্রাইভেট কথা নিয়ে আলোচনা শুনি তো পিঠের ছাল ছাড়িয়ে নেব এক-একটার বেতের চোটে!’

.

তখনকার মতো সবাই চুপ ক’রে গেল–কিন্তু কান্তির পিছনে যে তাই নিয়ে আরও অনেক্ষণ হাসাহাসি এবং গুজ গুজ চলল তা কান্তি বেশ টের পেলে।

টিফিনের সময় ধীরেনবাবু ওকে এক ফাঁকে একটু আড়ালে ডেকে নিয়ে গিয়ে বলে দিলেন, ‘তোমাকে যদি কেউ বাড়ির ঠিকানা-টিকানা জিজ্ঞেস করে তুমি আসল ঠিকানা বলো না!’

‘কেন’ সে কথাটা আর জিজ্ঞাসা করার সাহস হ’ল না কান্তির। সে কেমন ক’রে যেন বুঝল যে এর মধ্যে একটা গণ্ডগোল আছে। শুধু বলল, ‘তা হলে কী বলব?’

‘যা হোক ব’লো–বিডন স্ট্রিট, কি মানিকতলা স্ট্রিট, যা হয় বলো! ঠিক পথটার নাম বলো না!’

বাড়ি ফিরে অনেকক্ষণ ভাবল কান্তি, কথাটা রতনদিকে বলা উচিত হবে কিনা। আপনা-আপনিই মনে হ’ল ওর, হয়তো এর মধ্যে লজ্জার কোন কারণ আছে, রতনদি হয়তো দুঃখিত হবে। কিন্তু চেপেও রাখতে পারল না শেষ পর্যন্ত সন্ধ্যবেলা রতনদি ছাদে এসে ওকে কাছে ডেকে যখন আকাশের তারা চিনিয়ে দিচ্ছেন–তখন ভয়ে ভয়ে–সংকোচের সঙ্গে হলেও, কথাটা বলেই ফেললে।

সব শুনে রতনদির মুখটা যে ম্লান হয়ে গেল তা সন্ধ্যার আধো-অন্ধকারেই টের পেলে কান্তি। মনে মনে অনুতাপের শেষ রইল না ওর। কিন্তু তখন আর উপায় কি? রতন খানিকটা চুপ ক’রে থেকে বললে, ‘মাস্টারমশাই ঠিকই বলেছেন ভাই, কেউ জিজ্ঞেস করলে তুমি বলো ঐ হেঁদোর কাছে থাকি, নিতান্ত কেউ ঠিকানা জানতে চাইলে মানিকতলা স্ট্রিটই বলো। এ পাড়াটার একটা দুর্নাম আছে ভাই। সেই জন্যেই তো তোমাকে অত দূরের ইস্কুলে ভর্তি করেছি। কাছাকাছি না থাকাই ভাল।

কান্তি চুপ ক’রে যায়। কিসের দুর্নাম সেটা প্রশ্ন করার ইচ্ছা থাকলেও করতে পারে না। মনে মনে বোঝে যে রতনদি তাতে আরও অপ্রস্তুত হবেন।

আরও নানা কারণে কান্তির এখানটা খারাপ লাগে।

এক দিন ইস্কুল থেকে ফিরছে, দারোয়ান ডেকে বললে, ‘ও খোকাবাবু, শোন–তোমার বাবা এসেছিল!’ বুকটা ছাঁৎ ক’রে উঠল ওর। বাবা এখানে!

কিন্তু জিজ্ঞাসা করতে পারল না–অজ্ঞাত আশঙ্কায় বুক ঢিপ ঢিপ করতে লাগল ওর, শুধু বিহ্বল হয়ে চেয়ে রইল।

দারোয়ান যা বললে তার সরল অর্থ হচ্ছে–ওর কাছ থেকে নরেন চার আনা পয়সা ধার নিয়ে গেছে। বলে গেছে যে, ‘দিদিবাবুকে বলবার দরকার নেই, এই বাড়িতে আমার ছেলে থাকে, কান্তি–তার কাছে চাইলেই দিয়ে দেবে। বলো যে তার বাবার বিশেষ দরকার পড়েছিল, নিয়ে গেছে। মানে আত্মীয়ের মধ্যেই তো–মিছিমিছি এই সামান্য কটা পয়সার জন্যে তোমাদের কত্তাবাবু কি দিদিবাবুর সঙ্গে দেখা করতে চাই না!

শুনে পাথর হয়ে গেলে কান্তি। মুহূর্তে ঘেমে উঠল সে। বয়স যতই কম হোক–এর মধ্যে যে অপমানটা আছে তা বোঝবার শক্তি ওর হয়েছে–খানিকটা আমতা আমতা ক’রে বললে, কিন্তু আমি তো–আমার কাছে তো কিছুই পয়সা নেই দারোয়ানজী, আমার কাছে তো থাকে না!’

প্রায় কেঁদে ফেলবার মত অবস্থা তার।

দারোয়ান নিমেষে ব্যাপারটা বুঝে নিয়ে বললে, ‘আচ্ছা আচ্ছা, তার জন্যে কিছু নয়। এ আমি দিদিবাবুকে বলতেও যাচ্ছি না। কটা বা পয়সা, দিলাম না হয় বানকে! তুমি ভেবো না, যাও। যখন তুমি লিখাপড়ি করবে, দরে মোরি করবে, তখন আমাকে গোটা এই টাকা দিয়ে দিও, কেমন?’

সে পিঠ চাপড়ে ভেতরের দিকে ঠেলে দিলে কান্তিকে।

অতিকষ্টে চোখের জল সামলে কান্তি শুধু বললে, ‘কিন্তু তুমি আর কোন দিন এমনি দিও না দারোয়ানজি!’

‘আচ্ছা আচ্ছা, ঠিক আছে!’

নিজের বাবার সম্বন্ধে এমন কথা বলা আরও লজ্জার, তবু না বলাও অনুচিত, এটা মনে মনে বোঝে কান্তি। …প্রকৃতিই কতকগুলো শিক্ষা দিয়ে দেয় মানুষকে। …তার জন্যে বেশি জ্ঞান-বুদ্ধির দরকার হয় না।

কিন্তু নরেন অত সহজে ছাড়ে না। আর একদিন ইস্কুলে যাবার মুখে বড় রাস্তার মোড়টাতে দেখা।

‘এই যে–ভাল হয়েছে তোর সঙ্গে দেখা হয়ে–দে দিকি গণ্ডা-চারেক পয়সা!’

আজও যেন চোখে জল এসে যায় কান্তির, রাগে দুঃখে, অপমানে–মুখচোখ লাল হয়ে ওঠে ওর। তবু অতি কষ্টে নিজেকে সংযত ক’রে বলে, ‘আমার কাছে তো পয়সা থাকে না। পয়সা আমি পাব কোথায়?’

‘সে কি রে? অত বড়লোকের বাড়ি থাকিস, হাতে পয়সা নেই? জল- খাবারের পয়সা দেয় না?’

‘না! সঙ্গে জলখাবার দিত–অত ছেলের সামনে খেতে লজ্জা করে বলে নিয়ে যাই না। তারপর পয়সা দিতে এসেছিল, আমি নিই নি। ইস্কুল থেকে বাড়ি ফিরে দুপুরের ভাত থাকে–খাই! আমার জলখাবার দরকার হয় না–অতবার খাওয়া তো আমার অব্যেস নেই!’

‘হুঁ। তা এদিক-ওদিক হাতাতে পারিস না কিছু? তবে আর ওখানে পড়ে থাকবার মানে কি?…ওখানে তো পয়সা গড়াগড়ি যায় শুনেছি!’

‘যাক গে! আমি কি চোর নাকি?’

দুঃসহ রাগে সাহস বাড়ে কান্তির, আবার ও বলে, ‘আপনি খবরদার ওখানে আর যাবেন না–অমন ক’রে চাকর-বাকরের কাছে পয়সা ভিক্ষে করেন কেন? আমি বারণ ক’রে দিয়েছি, এবার আর চাইলেও পাবেন না!

‘আচ্ছা আচ্ছা হয়েছে! কী-বাড়ির ভাত খেয়ে খুব ট্যাক টেঁকে কথা শিখেছেন–লেখাপড়া যত হোক না হোক! চড়িয়ে গাল লাল ক’রে দেব একেবারে, আমাকে তো চেনো না!’

কিন্তু কান্তি আর ভয় পায় না। আশেপাশে লোক জমে যাচ্ছিল তাইতেই যা লজ্জা।

সে প্রায় মরীয়া হয়ে বলে ফেলে, ‘ফের যদি আপনি কোনদিন ওখানে যান–আমি মা আর দাদাকে বলে দেব। দাদা কলকাতাতেই থাকে।’

নরেনের রুষ্ট ভাব নিমেষে বদলে যায়, ‘ও কলকাতাতেই থাকে বুঝি?…চাকরি হয়েছে তা হলে? কোথায় থাকে রে? আপিসটা কোথায়?

‘জানি না।’ বলে কান্তি হন হন ক’রে এগিয়ে যায়।

যেতে যেতেই শোনে, পিছনে দাঁড়িয়ে তার বাবা দাঁত কিড়মিড় ক’রে বলছে, ‘উ, কলের জল আর বালামচাল পেটে পড়ে বড্ড তেল হয়েছে! তেল বার করছি! গোরবেটার জাতকে যেদিন ধরব, সেদিন একেবারে শেষ ক’রে দোব। …আমাকে তো চেনো না!’

দাদাকে বলে দেবার ভয় দেখালেও শেষ পর্যন্ত কে জানে কেন, বলতে পারে না। এর পরে যেদিন হেম ওর সঙ্গে দেখা করতে এল, মাঝে মাঝে আসে আজকাল, শুধু বললে, ‘আমার কি অন্য কোথাও থাকার ব্যবস্থা হয় না দাদা? এখানে–এখানে আমার ভাল লাগে না থাকতে। এরা অবিশ্য যত্ন করে খুবই, কিন্তু তবু–কেমন যেন–’

হেম কি বুঝলে কে জানে, হয়তো কোন অপ্রিয় কথা শোনবার ভয়েই কিছু প্রশ্ন করলে না, খুব যত্ন করা সত্ত্বেও কেন ভাল লাগছে না সেটা জানতে চাইলে না। শুধু বললে, ‘কী আর উপায় দেখছি না তো, আমার যা মাইনে–তাতে তো কিছুই হয় না। মাসীর ওখানেও আর থাকার উপায় নেই। আর কিছু দিন কাদায় গুণ ফেলে থাক–একটা পাকা চাকরি-বাকরি না হলে কোথায় নিয়ে যাব বল্‌!’

চতুর্দশ পরিচ্ছেদ

॥১॥

হেম মুখে যাই বলুক, এ চাকরি ওর খুব ভাল লাগছে; মাইনে অবশ্য খুবই কম। আলাদা মেসে থাকতে হলে মাকে আর কিছু পাঠাতে পারত না। নেহাত বড় মাসীর কাছে আছে তাই। মাসে পাঁচ-ছ টাকা দিয়েই চলে যায়। মাসী কিছু নিতে চান না–শ্যামারও ইচ্ছা নয় যে ওখানে কিছু খোরাকি দেয় হেম–উমা রোজগার করছে, চলতে নেই গোবিন্দও যা হয় আনছে–আবার ওখানে ঘুষ দেবার দরকার কি? কিন্তু হেমের লজ্জা করে বড়; এদের অবস্থা তো নিজেই দেখছে। গোবিন্দার বিয়ে হবার পর আর একটা ঘর ওদের নিতে হয়েছে। সেও খুরির মতো, তবু দুটো ঘর মিলিয়ে আট টাকা ভাড়া। তাও ওঁরা সুবিধেই ক’রে দিয়েছেন বলতে হবে। বাড়িওলারা খুব একটা লোক খারাপ নয়। হেমকে ওঁরা রাত্রে ওঁদের বৈঠকখানা ঘরে শোবার অনুমতি দিয়েছেন। তার জন্য কিছু নেন না। অবশ্য ওঁদের জামাই-টামাই এলে ছেড়ে দিতে হয়। তখন ভেতরের রকে শোয়। যাই হোক–কিছু না দিয়ে খাওয়া সম্ভব নয়। আয় এবং ব্যয় দুটোই চোখের ওপর দেখছে। মাছ আসে কদাচিৎ কখনো। ডাল, বড়াবড়ি আর পোস্ত-চচ্চড়ি এই তো ভরসা। দেওয়া নেওয়া দুই-ই লজ্জার ব্যাপার বলে হেম নগদ টাকা হাতে ক’রে দেয় না, পয়সা-কড়ি এলে একদিন বড়বাজার গিয়ে পাইকিরী দরে কিছু কিছু ডাল-মশলা-পোস্ত এনে দেয়। কুলোলে কোন মাসে এক-আধ সের ভাদুয়া ঘিও নিয়ে আসে। কমলা আপত্তি করে মুখে, কিন্তু খুশিই হয়। পয়সা-কড়ি এলে কথাটার অর্থ আছে বৈকি!

মাইনে তো ঐ সামান্য–তাও সবটা একসঙ্গে পাওয়া যায় না। কেশিয়ার- ম্যানেজার বাবুর কাছে (দুই-ই এক ব্যক্তি) গিয়ে মাথা চুলকে দাঁড়াতে হয়, ‘কিছু খরচা দেবেন?’ হেম গোড়াতে অবাক হয়ে গিয়েছিল, হক্কের পাওয়া–তার আবার ‘খরচা’ কি? কিন্তু এখানের নাকি এ-ই চাল। কোন দিন ম্যানেজারবাবু সে খরচা দেন, কোন দিন দেন না। দিলেও চার-পাঁচ টাকার বেশি একসঙ্গে পাওয়ার উপায় নেই। ফলে সে টাকাতে আয় দেয় না। তবু ওরই মধ্যে যে মাসে যা পারে–সাত-আট টাকার বেশি হয়ে ওঠে না প্রায় কোন মাসেই–একদিন গিয়ে মাকে দিয়ে আসে। মা ফি-বারই গজগজ করে–কিন্তু সে গজগজানি গায়ে মাখতে গেলে হেমের চলে না।

শ্যামা শেষ পর্যন্ত অনেক ভেবে নিজের বাড়িতেই চলে এসেছে। আধসের চাল বাঁচাতে গিয়ে এ বাগানের ফসল যাবে–হয়তো দরজা-জানালাই কে খুলে নিয়ে যাবে। তা ছাড়া এখানে বাস করার লাঞ্ছনাও যেন আর সহ্য হচ্ছিল না। ফলে কিন্তু কষ্টের সীমা নেই। নিত্য-সেবার চাল দুধ বন্ধ, এদিকেও হেম যজমানি ক’রে যা দু-চার পয়সা আনত, তাও আসে না। আয় বলতে তো হেমের ঐ ক-টা টাকাই। আনাজপাতি অবশ্য কিছুই কিনতে হয় না। অভাব এক আলুর–তা হেম কলকাতা থেকে নিয়ে এলে বাঁচিয়ে বাঁচিয়ে রাখে–এক আধটা ক’রে খরচ করে! নারকেল-সুপুরি থেকে কিছু আয় হয়–এ ছাড়া পেঁপে আছে কলা আছে। হেম এখন মধ্যে মধ্যে যাওয়া-আসা করায় কিছু সুবিধা হয়েছে। বড় বড় নারকেল আর পেঁপে কলকাতায় পাঠিয়ে দেয় শ্যামা। এখানে নারকেল বাইশ টাকা হাজার। কলকাতার বাজারে অনেক বেশি দাম মেলে। তাও এখন আর হেমকে ঘুরে ঘুরে বিক্রি করতে হয় না। উমা ওদের অবস্থা বুঝে সে ভার নিজের হাতে নিয়েছে। প্রথম কথায় কথায় ছাত্রীদের বাড়ি কথাটা পেড়েছিল–তাঁরা সাগ্রহে নিতে চান অনেকেই। ফলে এখন সব বোঝাটাই তার ঘাড়ে চেপেছে অবশ্য, কিন্তু সত্যিই দামে অনেক তফাত হয়। বড় বড় নারকেল শ্যামার বাগানের-এক-একটা পাঁচ-ছ পয়সা দরে বিক্রি করে উমা। এমন কি খুব বড়গুলো দু আনা পর্যন্ত দাম ওঠে। পেঁপের তো কথাই নেই, দু আনা দশ পয়সায় এক-একটা বিক্রী হয়। হয়তো বাজারের থেকে দাম কিছু বেশিই পড়ে, তবু তাঁরা পছন্দমত জিনিস দেখে তাতে আপত্তি করেন না। সাত-আট দিন অন্তর হেম যেদিন বাড়ি যায়–এক-একবার দু টাকা আড়াই টাকা পর্যন্ত জমে যায়। তবে ফেরার সময় তেমনি বোঝা বইতে হয়। ইদানীং শ্যামা লোভ পেয়ে কলার কাঁদিও চালান করতে শুরু করেছে। বড় বড় কালী বৌ ওদের, যে খাবে সে ভুলতে পারবে না, এ জোর তার মনে আছে। যেমন বড়, তেমনি মোলায়েম আর তেমনি মিষ্টি।

তবু অভাবও তো কম নয়। এখন ঐন্দ্রিলা আর তার মেয়ে এসে ঢুকেছে, তরু আছে, একটা রুগ্ন বাচ্চা ছেলে আছে। বাজার না করুক, চাল তেল নুন তো কিনতেই হয়। হপ্তায় পাঁচ ছটাকের বেশি তেল কেনে না শ্যামা ঠিকই–কিন্তু মাথায় দেবার এক ছটাক নারকেল তেল কিনতে হয়। এ ছাড়া একটু-আধটু গুড় আছে, লঙ্কা ফোড়ন আছে–কাপড় গামছা তো আছেই। বাড়ির চৌকিদার, সেস্ এগুলোও না দিলে নয়। প্রাণপণ কার্পণ্য করেও শ্যামা পারত না–যদি না অভয়পদ কিছু কিছু সাহায্য করত। কেরোসিন তেল তো তার উপর দিয়েই চলে, এটা নাকি সে অফিস থেকে পায়। এ ছাড়া মাসকাবারী ডাল-মসলাও কিছু কিছু দিয়ে যায়। ওদের নিজেদের জিনিস যখন কেনে–তখনই এদের জন্য খানিক খানিক সরিয়ে রাখে। আগে এদের বাড়িতে সে পুঁটুলিটা ফেলে দিয়ে নিজের বাড়িতে যায়।

এ দেওয়ার কথা অভয়পদ কাউকেই বলে না অবশ্য। সে নিজে ছাড়া এ ইতিহাস কেউ জানতে পারে না–এমন কি মহাশ্বেতাও নয়। তেমন দেখলে কোন কোন দিন একখানা বা এক জোড়া কাপড় কি গামছাও দিয়ে যায়। কিছুই বলে না, হাতে ক’রে এসে বসে, অন্য কথা বলে, যাবার সময় ফেলে রেখে চলে যায়। শ্যামাও প্রশ্ন করে না। জামাইয়ের কাছ থেকে হাত পেতে নেবার লজ্জা এখনও তার আছে–সেটা জামাইও জানে, তাই কোন কথা না বলেই শুধু রেখে যায়। যেদিন ডাল মসলা কি কেরোসিন তেল নিয়ে আসে সেদিনও এসে তরুর খোঁজ করে–কৈ গো ছোড়দি কোথায় গেলে, এগুলো তুলে রাখো।’ কিংবা বলে, ‘এগুলো আজড়ে নাও গো ছোড়দি ঝারনে আমার কাজ আছে!’ কোন দিন এ কথা শাশুড়িকে বলে না।

তবু–এও এক রকম ভিক্ষা বৈকি!

জামাইয়ের কাছে সাহায্য নেওয়া–পরের কাছ থেকে নেওয়ার চেয়ে ঢের বেশি লজ্জার। জামাই পারতপক্ষে কাউকে জানতে দেয় না সত্যি–কিন্তু লজ্জা তো তার কাছেই।

হেম তা বোঝে। তার যে উঠে পড়ে লেগে একটা ভাল চাকরির অন্তত বাঁধা মাইনের কাজ একটা যোগাড় করে নেওয়া দরকার–তা বাড়ি গেলে প্রত্যেকবারই অনুভব করে। মনে মনে সেজন্য লজ্জা ও আত্মগ্লানিরও শেষ থাকে না। কিন্তু এখানে এলেই সে সব যেন চাপা পড়ে যায়, আর যেন কোন উদ্যম থাকে না।

এ কি শুধুই আলস্য, শুধুই উদ্যমহীনতা?

নিজেকে বিশ্লেষণ করলে দেখতে পেত হেম যে এর মূলে আছে এই নতুন–তার কাছে একেবারে অপরিচিত–এই থিয়েটারটা।

অনাবিষ্কৃত জগতে প্রথম পদক্ষেপের মতোই সে দিশাহারা, রোমাঞ্চিত, বিস্ময়-বিহ্বল!

সত্যিই এ একটা আলাদা জগৎ।

মনে আছে হেড্‌ গেট-কীপার এবং সাট ও* পাট লেখক ও বটেন –(হাতের লেখা ভাল বলে) দক্ষিণাবাবু প্রথম দিনই বলে-ছিলেন, ‘দূর থেকে যা ভাব ছোকরা–তা নয়। দুটো দিন ভেতরে থেকে ‘দ্যাখো, রস ছুটে যাবে, ঘেন্না হয়ে যাবে একেবারে।’

[* মুদ্রিত নাটক ও অভিনীত নাটকে অনেক রকম তফাত থাকে। নাট্য-অধিকর্তার মর্জি ও প্রয়োজন-মাফিক ছাঁটকাট অদল-বদল হয় প্রায়ই। শেষ পর্যন্ত যেমনটি দাঁড়ায়-প্রশ্ট করার সুবিধার জন্য খাতায় লিখে নেওয়া হয় বড় বড় হরফে তাকেই বলে সাট।]

তারপরই নিভে-আসা বিড়িতে একটা শেষ টান দিয়ে বলেছিলেন, ‘তবে ছাড়াও পাবে না বাবা-এ চিটে গুড়ের আটা, পাখা জড়িয়ে যাবে, নট্ নড়ন নট্ চড়ন কিচ্ছু!’

কথাটা মিথ্যে নয়। রস ছুটে, স্বপ্ন ভেঙে ঘেন্না হয়ে যাবারই কথা–তবু যেন কোথায় একটা টান থাকে, একটা মোহ থেকেই যায় শেষ পর্যন্ত!

সে তো নতুন, বয়সেও ‘কাঁচা, তার মোহ থাকা স্বাভাবিক। কিন্তু দক্ষিণাবাবুর বহুদিন কাটল এখানে, বয়সেও ওর চেয়ে ঢের বড়–তবু তিনি মুক্তি পান কৈ? সত্যিই যেন তাঁর পাখা আটকে গেছে এখানের চিটেগুড়ে।

বিচিত্র লোক দক্ষিণাবাবু।

বাড়িতে স্ত্রী আছে, ছেলেমেয়েও আছে চার-পাঁচটি। তাদের খরচ চালাতে পারেন না। নেহাত একান্নবর্তী সংসার বলেই তারা বেঁচে আছে, এবং ছেলেমেয়েগুলোও কোনমতে লেখাপড়া করছে কিছু কিছু। তাদের কথা যে চিন্তা করেন না দক্ষিণাবাবু তাও নয়। কিন্তু তবু অন্য কোন চাকরি খোঁজা বা অপর কোন উপার্জনের পথ ধরার কথা তিনি ভাবতেও পারেন না।

এথচ এখানে পা দিলে পুরুষের যেটা সর্বাগ্রে হবার কথা সে দোষ অর্থাৎ চরিত্র-দোষ তাঁর নেই। মেয়েরা–থিয়েটারে যার সখী সাজে, যাদের ‘সখীরা’ বা ‘ছুঁড়ীরা’ বলে উল্লেখ করা হয় সাধারণত–তারা সবাই ওঁকে দাদা বলে–আর বড় অভিনেত্রীদের উনি দিদি বলেন–পদবী এবং বয়স নির্বিশেষে। সখীদের ‘তুই-তোকারি’ করেন ধমক দেন যখন-তখন, মধ্যে মধ্যে আদি-রস-ঘেঁষা রসিকতা করতেও ছাড়েন না–আবার সাধ্যমত উপকারও করেন, যার যা প্রয়োজন হয়, ওঁর নিজের দ্বারা যতটুকু সম্ভব, ক’রে দেন। আর বড় অভিনেত্রীদের ফাই-ফরমাশ যেন দক্ষিণাবাবুর জন্যেই তোলা থাকে, যার যত কিছু বেগার দেওয়া দরকার, সবই তিনি। তার ফলে তাঁরাও স্নেহের চোখে দেখেন।

কিন্তু এ স্নেহ বা প্রীতিতে পেট ভরে না। মাইনে তো বাড়েই না–নিয়মিতও পাওয়া যায় না। যখন কিছু আদায় হয় তখন বাড়িতে গিয়ে দিয়ে আসেন। নেশায়-টেশায় শেষ অপব্যয় নেই, সেটা যতটুকু পরের ঘাড়ে চলে ততটুকুই। যখন এমন হয় যে দশ-বারো দিনের মধ্যেও কিছু আদায় হ’ল না, তখন লজ্জায় গা ঢাকা দেন ভদ্রলোক–অর্থাৎ বাড়িতে যান না। থিয়েটারেই কাটান–কিংবা কোন মেয়ের বাড়ি কোন বাড়িতে জায়গা থাকলে–অথবা কারুর কোন দিন ‘বাবু’ না আসার কথা থাকলে–তার বাড়ি গিয়ে শুয়ে থাকেন। খাওয়াও ঐভাবে চলে। মেয়েরা এমনিই এটা-ওটা বাড়ি থেকে নিয়ে আসে, সারারাত অভিনয় থাকলে এখানে খাওয়ার ব্যবস্থা তো থাকেই।

মেয়েদের বাড়ি, এমন কি–দক্ষিণাবাবু, দিব্যি গেলে বলেছেন–তাদের সঙ্গে এক ঘরেও শুয়েছেন, কিন্তু চরিত্রদোষ যাকে বলে তা তাঁর ঘটে নি।’

‘মাইরি বলছি তোকে, তুই বামুনের ছেলে, তোর গা ছুঁয়ে বলছি, পৈতে ছুঁয়েও বলতে পারি–পিরবিত্তি হয় না। দাদা বলে ডাকে, ভক্তিছেদ্দা করে, বিশ্বাস করে–ওদের মায়েরাও ভরসা ক’রে এক ঘরে ছেড়ে দেয়–সেখানে সে বিশ্বাসটা নষ্ট করা কি ঠিক! না ভাই, ও কাজ কোনদিন করিনি, হলপ ক’রে বলছি!’

এক-একবার গা-ঢাকা দেওয়ার সময়টা যখন লম্বা হয়ে পড়ে তখন ওঁর স্ত্রী ধৈর্য হারান। ছেলেটাকে সঙ্গে ক’রে থিয়েটারে হানা দেন। ভিতরে আসেন না অবশ্য–ওধারের ফুটপাথে দাঁড়িয়ে ছেলেকে দিয়ে ডাকতে পাঠান, তারপর শুরু হয় জবাবদিহির পালা। দক্ষিণাবাবু মাথা চুলকোতে চুলকোতে গিয়ে দাঁড়ান–বুঝিয়ে-সুঝিয়ে ঠাণ্ডা ক’রে আসেন অনেক কষ্টে। সে লজ্জাও বড় কম নয, স্ত্রী-পুরুষের চেঁচমোচিতে এক-একদিন রাস্তায় লোক জড়ো হয়ে যায়। থিয়েটার সুদ্ধ লোক এ ইতিহাস জানে, অনেকেই বুঝিয়ে বলে, কেউ কেউ টিটকিরিও দেয়,–তবু দক্ষিণাবাবু এ চাকরি ছাড়তে পারেন না। ওঁর এই দুর্বলতার সুযোগ পেয়ে কর্তারা ভূতের মত খাঁটিয়ে নেন, যখন বাড়ি যান না, তখন সারা দুপুর ধরে একা বসে বসে সাট লেখেন–এটা তার করার কথা নয়, অন্তত ঐ মাইনেয়, তা দক্ষিণাবাবু জানেন, অবিচারটা অনুভব করেন–তবুও ছাড়তে পারেন না। জায়গাটা ভূতের মতই পেয়ে বসেছে ওঁকে। মাঝে মাঝে বলেন, ‘জানিস–উপরি উপরি দুদিন এখানের এই ভ্যাপসা গন্ধটা নাকে না গেলে হাঁপিয়ে উঠি। ভূতেই পেয়েছে বোধ হয়। নইলে এমন হয়!’

হেমেরও এক এক সময় ভয় হয়–তাকেও কি এই থিয়েটারের ভূতে পাচ্ছে নাকি? এখনই প্রতিজ্ঞা করে যে এবার উঠে পড়ে লাগবে–কিন্তু শেষ পর্যন্ত আর উদ্যম থাকে না। মনকে প্রবোধ দেয়, ‘অনেক দিন তো টো টো ক’রে ঘুরলুম। ঘুরলেই কি কাজ হয়! ভেতরে লোক থাকা চাই। দেখি–!’

সে দেখাটা যে কোথায় এবং কী ভাবে তাও জানে না।

॥২॥

দক্ষিণাবাবুর ভেতরে যতই দহরম মহরম থাক–হেমের ভেতরে যাওয়ার বিশেষ সুযোগ ছিল না। মাঝে মাঝে এক-আধটা ছোটখাটো ফাইফরমাশের কাজে ফেরে গেছে, দু-একটা কথা যে দু’একজনের সঙ্গে না হয়েছে তাও নয়–কিন্তু তাকে পরিচয় বলে না।

একদিন হঠাৎ একটা সুযোগ এসে গেল।

সেটা থিয়েটারের দিন নয়। অর্থাৎ সেদিন কোন অভিনয় ছিল না।

হেম এমনিই এসেছিল, মাইনের তাগাদায়। ম্যানেজার বাবুর ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছে–মেজাজ বুঝে ভেতরে ঢুকবে বলে–হঠাৎ স্বয়ং মনিব বেরিয়ে এলেন তার ঘর থেকে। এদিক ওদিক তাকিয়ে সম্ভবত যাদের খুঁজছিলেন তাদের কাউকে দেখতে না পেয়ে ফিরেই যাচ্ছিলেন, হঠাৎ নজর পড়ল হেমের দিকে।

‘এই ছোকরা শোন–এদিকে এস একবার! বলে ইঙ্গিতে ডাকলেন রমণীবাবু। হেমের বুক দুর দুর ক’রে উঠল। মনিবকে এখানে সকলেই ভয় করে, অকারণেই করে–সেই সঙ্গে হেমও। রাশভারী চেহারা ও গম্ভীর গলা। যদিও শুনেছে সে যে রমণীবাবু লোক খুব খারাপ নন, বরং কর্মচারীরা বিপদে আপদে পড়লে যথাসাধ্য সাহায্যই করেন–তবু বাইরেটা এমন রুক্ষ ও কর্কশ যে ওর মুখের দিকে চাইলে কিংবা গম্ভীর গলার আওয়াজ কানে গেলেই বুক শুকিয়ে ওঠে।

আজও তার ব্যতিক্রম হ’ল না–তবে ওরই মধ্যে আড়ে একবার তাকিয়ে দেখে নিলে যে যদিও ভ্রূ’কুঞ্চিত, মুখভাব রুষ্ট নয়।

ঘরে গিয়ে নিজের চৌকিতে বসে বললেন, ‘শোন, কি যেন নাম তোমার, হেম না? একটা কাজ করতে পারবে?’

পারবে! মনিবের মুখে এ কী কথা! হেম একটু অবাকই হয়ে গেল।

ওঁর নাম হুকুম–তাদের নাম তামিল–কতকটা তো এই অবস্থা। তবে?

প্রবল বেগে ঘাড় নেড়ে সম্মতি জানালে সে।

‘এমন কিছু নয়, দারোয়ান দিয়েই হয় কিন্তু ব্যাটারা যে কোথায় সব তা জানি না–’

এই পর্যন্ত বলে একটু থামলেন আবার। কেমন যেন সংকোচ।

তারপর অন্য দিকে মুখ ফিরিয়ে বললেন, এক জায়গায় একটা চিঠি পৌঁছে দিয়ে আসতে হবে। কিন্তু খুব সাবধান, কাউকে বলবে না কি গল্প করবে না। যদি আমার কানে যায় কখনও যে কাউকে বলেছ–সেই দিনই তোমার চাকরিতে জবাব হয়ে যাবে–মনে থাকে যেন।

এবার চোখ ফিরিয়ে ওর দিকে কতকটা কটকট ক’রেই চেয়ে রইলেন খানিকটা। তার পর আবার বললেন, ‘কম্বুলেটোলা জান? শ্যামাবাজারের কাছে? ঐখানে একটা বাড়িতে চিঠি পৌঁছে দিয়ে আসতে হবে। নাম ঠিকানা সব লেখা আছে। রাস্তার ওপরই বাড়ি, খুঁজে পেতে অসুবিধা হবে না। দিয়েই চলে এস। যাও। …দাঁড়াও–এই নাও, দু গণ্ডা পয়সা, বরং ট্রামেই যেও না হয়। এখানে কাজ ছিল কিছু?’

তিনি পাশের হাতবাক্স খুলে খুচরো পয়সা বার করতে করতে প্রশ্ন করলেন।

‘না, এমন কিছু নয়।

হাত বাড়িয়ে চিঠি আর পয়সা নিয়ে সে বলতে গেলে ছুটেই বাইরে বেরিয়ে এল। ট্রামে সে চড়বে না এ তো জানা কথাই–সুতরাং একটু জোরে হাঁটতে হবে বৈকি!

বাইরে এসে খামটার নাম-ঠিকনায় নজর পড়ল। নলিনীবালা দাসী 1

নলিনীবালা! ওদেরই তো অভিনেত্রী একজন। খুব একটা উঁচু-দরের নয়–তবে বয়স কম, দেখতে-শুনতেও ভাল।

হেমের একটা কথা মনে পড়ে যায়। হঠাৎ কিছু দিন আগেই কথাটা উঠেছিল–এই নলিনীরই অভিনয় দেখতে দেখতে একদিন ও হঠাৎ সত্য বলে আর এক গেটকীপারকে বলে ফেলেছিল, ‘আচ্ছা, এত বড় পার্টটা হরিভূষণবাবু একে দিয়েছেন কেন বল্ তো, এটা নয়নতারাকে দেওয়াই উচিত ছিল!’ তার জবাবে সত্য ওর হাতে একটা চিমটি কেটে বলেছিল, ‘চুপ কর-শুনতে পেলে চাকরি থাকবে না তোর!’

বিস্মিত হয়ে প্রশ্ন করেছিল হেম, ‘কেন বল্ তো–ব্যাপার কি?’

‘তুই যেমন উজবুগ! বাবুর গিন্নী বদল হয়েছে জানিস না? নইলে ঐ পাৰ্ট ও পায়! ওটা আসলে নয়নতারারই পাৰ্ট!’

‘তার মানে?’ কিছুই বুঝতে পারে নি হেম তখনও। কিন্তু কথাটা সেইখানেই বন্ধ করতে হয়েছিল। পাশেই ছিলেন দক্ষিণাবাবু, প্রচণ্ড ধমক দিয়ে উঠেছিলেন সত্যকে।

আজ কথাটা জলের মতো পরিষ্কার হয়ে গেল।

আরও আগেই হওয়া উচিত ছিল–এখন হেমের মনে হয়। কারণ আর একটা কথাও মনে পড়ে যায় ওর।

সব মেয়ে যে গাড়িতে যাতায়াত করে–নলিনী তাতে করে না। নলিনীর জন্যে খোদ বাবুর গাড়ি পাঠানো হয়। …এটা তো কত দিনই লক্ষ্য করেছে ও–অর্থটা বোঝা উচিত ছিল।

যত অল্প দিনই এ জগতে আসুক সে–এর অর্থ না বোঝার কথা নয়। অভিনেত্রীদের প্রায় সকলেরই ‘বাবু’ আছেন এক-একজন। নলিনীর বাবু তা হলে স্বয়ং কর্তাই!

।।৩।।

বাড়িটার সামনে এসে দাঁড়িয়ে হেম একটু ইতস্তত করল। ওর কপালটা

একটু ঘেমেও উঠল সামান্য। এর আগে সে এ ধরনের বাড়িতে কখনও আসে নি–অবশ্য এ ধরনটা যে ঠিক কি সে সম্বন্ধেও ওর স্পষ্ট কোন ধারণা ছিল না–তবু নম্বরটা মিলিয়ে পাবার পর বুকটা একটু ছাঁৎ ক’রেই উঠল।

তবে পাড়াটা খারাপ নয়, রতনের বাড়ি যাতায়াতের সময় যে অঞ্চল দিয়ে যেতে হয়, সে রকমও নয়। বেশ সম্ভ্রান্ত ভদ্রপাড়া বলেই মনে হ’ল ওর। আর বাড়িটাও আশপাশের বাড়ির মতই–এমন একটা অসাধারণ কিছু নয়। শান্ত নিস্তব্ধ। বরং রাস্তার দিকের দোর-জানলা বেশির ভাগই বন্ধ।

খানিকটা এদিক ওদিক তাকিয়ে হেম বোধ করি একটু বল সঞ্চয় ক’রেই নিলে মনে মনে। তারপর পকেট থেকে ময়লা রুমালটা বার ক’রে কপাল ও গলার ঘাম মুছে নিয়ে–এক রকম মরীয়া হয়েই কড়া নাড়ল দরজার।

দরজা খুলল হিন্দুস্থানী বেহারা গোছের একজন লোক।

ভ্রূ কুঁচকে প্রশ্ন করল, ‘কী চাই আপনার?’

‘এ বাড়িতে–ঐ বাড়িতে নলিনীবালা দাসী বলে কেউ থাকেন?’

‘যেটুকু ভরসা সে এনেছিল মনে মনে, ওর প্রশ্ন করার ধরনে সেটুকু লোপ

পেতে বসেছে তখন।

‘হ্যাঁ–থাকেন। কী দরকার তাঁকে?’

‘এই–মানে তাঁর নামে একটা চিঠি আছে!’

‘কে রে গিরিধারী?’ এইবার ওপর থেকে নারীকণ্ঠে প্রশ্ন হয়।

‘কে একজন আপনার নামে চিঠি এনেছে দিদিবাবু।

‘আমার নামে চিঠি? কে দিয়েছে?’ সেই ভাবেই প্ৰশ্ন হ’ল।

গিরিধারী জিজ্ঞাসু নেত্রে চাইল হেমের দিকে।

‘বল যে আমাদের বাবু, বড়বাবু দিয়েছেন। রমণীবাবু।’

কিন্তু গিরিধারীকে কিছু বলতে হ’ল না। ওপর থেকেই বোধ করি কথাটা শোনা গিয়েছিল–এবার সে মেয়েটি তরতর ক’রে নেমে এল।

‘কে রে গিরিধারী–থিয়েটার থেকে কেউ এসেছে বুঝি? ওমা আপনি! আপনি চিঠি এনেছেন? কি হবে!…কেন শিউরতন কোথা গেল? আমাদের দারোয়ান?

হেম আরও ঘেমে উঠেছে ততক্ষণে। মাটির দিকে চোখ রেখে জবাব দিল, ‘ওরা কেউ ছিল না–তাই বাবু বললেন–আমাকেই দিয়ে যেতে।’

‘তা বেশ ভালই হয়েছে। তবু তো আপনার পায়ের ধুলো পড়ল। আসুন আসুন, ওপরে আসুন।’

‘আর ওপরে–মানে এই চিঠিটাই দেওয়ার দরকার ছিল তো…আমি বরং এখন যাই। এই যে চিঠিটা

‘ওমা, সে কখনও হয়! কখনও তো আসেন না–কোন দিন। আজ প্ৰথম দিনটা এলেন–এমনি এমনি চলে যাবেন! আসুন, আসুন–একটুখানি অন্তত বসে যান!’

হেমের গলা শুকিয়ে উঠেছে। পা দুটো ওর কাঁপছে বুঝি।

‘না–মানে বাবু হয়তো ভাবছেন। ফিরে খবরটা দিতে হবে কিনা।’

‘আচ্ছা আচ্ছা সে হবে। আপনি আসুন তো। একটুখানি বসে গেলে কিচ্ছু, মহাভারত অশুদ্ধ হবে না। আপনি অত সংকোচ করছেন কেন–আমরা এক জায়গায় কাজ করি–বন্ধু হলুম তো সম্পক্কে, আপনিও তো ওখানে কাজ করেন–আমি আপনাকে দেখেই চিনেছি। এই গিরিধারী–একটা মিষ্টিজল নিয়ে আয় তো ঠাকুরের দোকান থেকে।’

অগত্যা হেমকে ভেতরে ঢুকতে হ’ল, নলিনীর পিছনে পিছনে ওপরেও যেতে হ’ল।

বাইরে থেকে যতটা নির্জন মনে হয়েছিল বাড়িটা–দেখা গেল ঠিক ততটা জনহীন নয়। নিচের সব ঘরেই লোক আছে। আর তার অধিকাংশই মেয়ে। মেয়েরা কেউ কেউ ওদের কথাবার্তার শব্দে বেরিয়ে এসেছিল, তারা নীরব কৌতূহলে তাকিয়ে দেখতে লাগল হেমকে–সেটা মাথা না তুলেই বেশ বুঝতে পারল সে। ফলে আরও যেন রাজ্যের লজ্জা তাকে পেয়ে বসল। সিঁড়ি দিয়ে যখন সে ওপরে উঠছে তখন পা দুটো তার যেন আর স্ববশে নেই, প্রতিমুহূর্তেই মনে হচ্ছে পড়ে যাবে সে হুমড়ি খেয়ে।

ওপরের যে ঘরে হেমকে নিয়ে গিয়ে বসাল নলিনী–সে ঘরটা বেশ প্রশস্ত। রাস্তার দিকে সবটা জুড়ে টানা ঘর একটা। একপাশে প্রকাণ্ড বড় পালঙ্কে পুরু গদির বিছানা। এছাড়া মেঝেতেও একটা বিছানা পাতা আছে–ওপরের বিছানার চেয়েও এটা বড়। অত পুরু না হলেও, এর তলাতেও গদি আছে। এ বিছানায় মাথার বালিশ বা পাশবালিশ নেই…শুধুই চারদিকে প্রকাণ্ড আটটা তাকিয়া সাজানো।

নলিনী ওকে সেই বিছানাটার কাছেই নিয়ে এল, বলল, ‘বসুন ভাল হয়ে। আমি আসছি।’

কিন্তু সে বিছানার দিকে তাকিয়ে হেমের সংকোচের অবধি রইল না। ফরসা ধপ্ ধপ্ করছে বিছানা–বকের পালকের মতো। সে ওখানে বসবে কি? ক্ষারে কাঁচা লালচে কাপড়-জামা তার, জুতোটা ফুটো হওয়ার ফলে পথের ধুলো জমেছে আঙুলের খাঁজে খাঁজে। বিছানাটাই হয়তো শেষ পর্যন্ত ময়লা হয়ে যাবে। তখন মুখে কিছু না বললেও মনে মনে নিশ্চয় রাগ করবে–হয়তো কটূক্তিও করবে। হয়তো–

আরও অনেক সম্ভাবনাই মনে হ’ল। এর আগে নিজের বেশভূষার দীনতার জন্য এত লজ্জা আর কখনও অনুভব করে নি। ওর মনে হতে লাগল, ধরিত্রী দ্বিধা হয় তো সে সীতাদেবীর মতো তাতে প্রবেশ ক’রে বেঁচে যায়।

দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ঘামছে–একটা কাঁচের গ্লাসে লেমোনেড নিয়ে আবার ঘরে ঢুকল নলিনী।

‘ওমা কি হবে, আপনি এখনও ঠায় দাঁড়িয়েই আছেন? বসুন বসুন! বেটাছেলের এত লজ্জা কি? না, না–মাটিতে নয়। ছিঃ, মেজেয় কি বসতে আছে? বিছানাতেই বসুন ভাল হয়ে–’

অগত্যা হেমকে বসতে হয়–তবু সে ভরসা ক’রে পুরোপুরি বিছানায় বসতে পারে না। দেহের বেশির ভাগই মেঝেতে রেখে কোনমতে বিছানাটা ছুঁয়ে বসে শুধু

প্রথমটা মনে হ’ল–বসবার সময়–নলিনী বুঝি ওর হাতটা ধরে জোর ক’রেই বিছানাতে বসিয়ে দেবে, নলিনী এগিয়েও এসেছিল যেন সেইভাবেই, কিন্তু কী ভেবে নিজেকে দমন ক’রে নিলে।

‘নিন্ জলটা ধরুন। আপনার আবার যা লজ্জা!’

‘এ–এ জল–শুধু জল দিন না!’

‘কেন–আপনি বোতলের জল খান না বুঝি?’

‘না, মানে কখনও খাই নি। আমাদের পাড়াগাঁয়ে বলে ওসব মুসলমানে তৈরি করে, বামুনদের খেতে নেই।’

‘আপনি ব্রাহ্মণ বুঝি? ভাগ্যি ভাল আমার। ব্রহ্মচারী ব্রাহ্মণের পায়ের ধুলো পড়ল। …তবে থাক–এ জল খেয়ে কাজ নেই। আপনি বরং এমনি একটু জল খেয়ে যান। –গিরিধারীকেই না হয় আনতে বলি–ও ভাল জাতের লোক। দেখুন বাধা নেই তো?’

আরও ঘেমে ওঠে হেম।

‘না না। সে সব কিছু না। দিন না হয় ঐটেই খাই। নষ্ট হবে!

‘না থাক। আমার এখানে একদিন এসেছেন, আপনার জাতটা মেরে দেব কেন? আর কেউ খেয়ে নেবে। আমার হাতে জলটা চলবে তো? না কি গিরিধারীকেই আনতে বলব?’

‘না, না। খুব চলবে। আপনার চেয়ে কি ঐ খোট্টা বেয়ারা ভাল?’

একটু যেন বেশি ঝেঁকি দিয়েই বলে ওঠে হেম–আর বলার সঙ্গে সঙ্গে লজ্জায় আগুন-বর্ণ হয়ে ওঠে।

নলিনী ওর সেই সুগৌর কপোলের রক্তোচ্ছ্বাস যেন একটু অবাক হয়েই তাকিয়ে দেখে কিছুকাল। বেশভূষা মলিন, গেট-কীপারের চাকরি করে–এত দিন তাই ভাল ক’রে তাকিয়ে দেখার কথাও তার মনে হয় নি। আজ সামনা- সামনি কাছ থেকে বিস্ময়ের সঙ্গেই লক্ষ্য করলে যে হেম রূপবান–বেশ একটু অসাধারণ রকমেরই রূপবান।

অবশ্য তাকিয়ে রইল সে মুহূর্ত দুই-এর বেশি নয়–তারপরই আবার ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।

বেশ ভাল ভাল আসবাব। অবস্থা ভালই। অবশ্য থিয়েটারের মাইনেতে এসব হয় না। নিশ্চয় রমণীবাবু দিয়েছেন। আয়না-বসানো আলমারি, বুককেস, পাথর দেওয়া টেবিল তার ওপর কাঁচের ঢাকনা, শৌখিন ঘড়ি, দেওয়ালে সোনালী ফ্রেমে আঁটা আয়না, বড় বড় ছবি, আরও কত কি!–

ঘাড় ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখছে তখনও, নলিনী একটা আসন আর পাখা নিয়ে ঘরে ঢুকল আবার। পিছনে গিরিধারীর হাতে একটা রেকাবিতে গোটাকতক রসগোল্লা, সাদা পাথরের গ্লাসে জল।

‘নিন, আসুন দেখি। একটু জল খেয়ে নিন।

‘এসব আবার–। না না, থাক শুধু জল দিন একটু। আমার মানে–একটুও ক্ষিদে নেই। সত্যি বলছি।’

‘এসব খাবার ক্ষিদে না থাকলেও খাওয়া যায়। এমন কিছু হাতি-ঘোড়া নয়। শুধু জল খেতে নেই–তাই। আসুন আসুন। কত ভাগ্যিতে পায়ের ধুলো পড়ল, আবার কবে আসবেন–আসবেন কি-না তারও ঠিক নেই। আমি বুঝি অমনি ছেড়ে দেব? ব্রাহ্মণ-ভোজনের একটা পুণ্যিও তো আছে। … আসুন, উঠুন। হাত ধোবেন? বাইরেই জল আছে। গিরিধারী, জল ঢেলে দে তো একটু।

অগত্যা উঠে এসে আসনে বসতে হয়।

এমনিই খাওয়া-দাওয়া সম্বন্ধে হেমের লজ্জা একটু বেশি–তার ওপর অপরিচিত মেয়েছেলেদের সামনে বসে একরাশ রসগোল্লা খাওয়া। প্রতি গ্রাসেই গলায় বেধে বেধে যেতে থাকে ওর।

তার ওপর নলিনী সামনে বসে হাওয়া করে।

‘থাক থাক।’ অতি কষ্টে একবার বললে ও–কিন্তু সে প্রতিবাদ গ্রাহ্যের মধ্যেই আনলে না নলিনী।

‘ওমা, একটু হাওয়া করলে কি আমার হাত ক্ষয়ে যাবে? যা গরম আজ। আপনি তো গলগল ক’রে ঘামছেন। অবশ্য গরমের চেয়েও লজ্জাই বেশি–কিন্তু তবুও গরমও পড়েছে বাপু। …টানাপাখার ব্যাপারটা আসে রাত্তির বেলা। বাবু থাকেন তো, হাওয়া না হলে ওর একদণ্ড চলে না। দুবেলা আর কিছু টানাপাখা চালানো যায় না। কী বলেন?’

গলার আটকে গেলেও হেম কোনমতে জল দিয়ে দিয়ে সেই আটটা রসগোল্লাই গলাধঃকরণ করে। ভাল জিনিস ফেলবার অভ্যাস নেই–তায় এঁটো পড়ে থাকলে ফেলাই যাবে হয়তো, সেই সম্ভাবনার কথাটা মনে করেই আরও জোর করে খায় সে–কষ্ট ক’রেও।

খাওয়া শেষ হলে নলিনী অন্য কথা পাড়ে

‘দেখুন আমার একটা উপকার করবেন? বাবু লিখে পাঠিয়েছেন বাবুর জন্য তিন-চার বন্ধু আসবে রাত্তিরে, এখানেই খাবে। আমার গিরিধারী মোটে মাংস মাছ চিনতে পারে না। বাজার করে ঠিকে ঝি–সে আসবে সেই সন্ধ্যের পর। তা ছাড়া সে বিকেলে বাজার করতেও চায় না। আপনি গিরিধারীকে সঙ্গে নিয়ে যাবার সময় মাংসটা আর মাছটা একটু কিনে দিয়ে যাবেন?’

‘তা–না, আর কিছু নয়। দেরি হলে বাবু রাগ করবেন না তো? তিনি হয়তো ভাবছেন–চিঠিটা পৌঁছল কি না!’

‘আমার বাজার ক’রে দিয়ে গেছেন শুনলে কিছু বলবেন না!’ বলে মুখ টিপে হাসে একটু নলিনী।

‘তা হলে দিন।’

‘বাঁচা গেল। পাঁচপো মাংস আর এক সের ভাল বাগদা চিংড়ি মাছ। দেড়- পোয়াখানেক কাটা-পোনাও। বুঝলেন? বাকী যা দই প্যাজ-সে আমি গিরিধারীকে বুঝিয়ে দিচ্ছি।’

গিরিধারী বাজারের ঝুড়ি টাকা প্রভৃতি বুঝে নিয়ে প্রস্তুত হয়ে হেমের পিছু পিছু এলে নলিনীও নিচে নেমে আসে। দোরের কাছে এসে চাপা গলায় বেশ একটু আন্তরিক ভাবেই বলে, ‘আলাপ পরিচয় তো হয়ে গেল, এবার আসবেন কিন্তু মধ্যে মধ্যে। …এখানে এলেই কিন্তু লোক খারাপ হয়ে যায় না। আমরা বাঘ-ভালুকও নই। …তা ছাড়া সবাই এক জায়গায় কাজ করি, বন্ধুর মতোই। না কি বলেন? আসবেন কিন্তু। না এলে আমি ভারি দুঃখ করব।’

ওর মতো হতদরিদ্র দীনহীন ব্যক্তির জন্য এক আকিঞ্চনে খুশি হবার কথা। হেমও খুশি হ’ল। এই আদর যত্ন, এই আন্তরিকতা, কণ্ঠে এই মিনতির সুর অনেকক্ষণ পর্যন্ত একটা মধুর রেশ জাগিয়ে রাখল ওর মনে, সব চেয়ে এই সাধারণ সহজ ব্যবহারটা ওকে মুগ্ধ করেছে বেশি। এই সব মেয়েদের এবং তাদের বাড়ি সম্বন্ধে একটা যে অজ্ঞাত আতঙ্কের ভাব ছিল, সেটাও কেটে গেছে–এখন বরং সে আতঙ্কের জন্য একটু লজ্জাই বোধ করছে মনে মনে।

সত্যিই তো, মানুষ মানুষই–বাঘ-ভালুক তো নয়! এত ভয়ই বা কেন হ’ত ওর?

আর–এক পয়সার মুরোদ নেই যখন তার, তখন পয়সার লোভে তাকে যত্ন করেছে বা ভোলাচ্ছে, এমন মনে করবারও কোন কারণ নেই।

আসলে মানুষটা ভালই। বেশ সরল। বেশ মিষ্টি কথাবার্তা।

আরও খানিকটা পরে ওর মনে হ’ল–নলিনী কেমন দেখতে তাও ভাল ক’রে বলতে পারে না কাউকে। এতক্ষণের মধ্যে একবারও ভরসা ক’রে চাইতে পারে নি তার মুখের দিকে।

মনে মনে ঠিক করলে থিয়েটারের দিন এবার ভাল করে দেখবে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *