২৫. পাড়ি

২৫. পাড়ি

রেড নদীর ওপর দিয়ে একখানা ছোট স্টিমার ভেসে চলেছে। তারই নিচের ডেকে অপরিচ্ছন্ন একটা প্রান্তে টম বসে রয়েছে। তার হাতে পায়ে বাঁধা রয়েছে লোহার শেকল। লোহার শেকলের চাইতেও ভারি বোঝা যেন চেপে বসেছে তার অন্তরে। তার ভাগ্যের আকাশ থেকে চাঁদ আর প্রতিটা তারা যেন উধাও হয়ে গেছে, কেবল ঢেকে রয়েছে গাঢ় মেঘ। তার দৃষ্টির সামনে দিয়ে এই যে নদীর পাড় আর গাছগাছালিগুলো চলে যাচ্ছে, এগুলো যেমন আর কোনোদিন ফিরে আসবে না, কেন্টাকিতে তার শান্তির নীড়, তার বউ আর ছেলেমেয়ে, শেলবিদের মতো সুন্দর মনিব, সেন্ট ক্লেয়ারের প্রাসাদপম অট্টালিকা, উদার-হৃদয় মনিব, স্বর্গীয় সুষমামাখা ইভার সুন্দর মুখ, দীর্ঘায়ত নীল চোখ আর উজ্জ্বল সোনালি চুল, তার একটুখানি সুখ আর অবকাশের সেই দুর্লভ মুহূর্তগুলো, চিরকালের মতো বিদায় নিয়ে চলে গেছে! তার পরিবর্তে সামনে যে কী আছে সে নিজেই জানে না।

টমের নতুন মনিব, সাইমন লেগ্রি, নিউ অর্লিয়েন্সের বিভিন্ন জায়গা থেকে মোট আট জন ক্রীতদাস-দাসী কিনেছিল এবং তাদের সকলকে দুজন দুজন করে হাতকড়া পরিয়ে স্টীমারে তুলেছিল। ওদের গোছগাছ করে বসাতে না বসাতেই স্টীমার ছেড়ে দিল এবং তখনই লোকটা স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে ওদের দিকে ভালো করে তাকাবার অবকাশ পেল।

আট জনের মধ্যে টমের পোশাক-সবচাইতে ভালো আর পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন। পরনে একই রঙের সুট, গায়ে ইস্ত্রি-করা লিনেনের সাদা সার্ট, পায়ে ঝকঝকে পালিশ করা বুট। টম যে রীতিমতো স্বচ্ছল কোনো পরিবারের ছিল, টমকে দেখলে সেটা স্পষ্টই বোঝা যায়।

অন্য সবার সঙ্গে নিতান্ত একটা করে পুঁটলি ছাড়া আর কিছুই ছিল না, কিন্তু টমের সঙ্গে ছিল মাঝারি আকারের একটা তোরঙ্গ। তোরঙ্গের জিনিসপত্র সব পরীক্ষা করতে করতে লেগ্রি অতি পুরনো একটা পালুন আর জীর্ণ একখানা কোট দেখতে পেল। আসলে এই পোশকটা টম আস্তাবলে কাজ করার সময়ে পরত। লেগ্রি এখন সেই জীর্ণ পোশাকটা বার করে তোরঙ্গের ওপর রাখল, তারপর টমকে বলল, ‘এই, উঠে দাঁড়া।’

টম উঠে দাঁড়াল।

লেগ্রি তার হাতকড়াটা খুলে দিল।

‘এই পোশাকটা খুলে, যা ওখানে গিয়ে ওই কোট-প্যান্টটা পরে আয়।’

কোনো কথা না বল টম কাঠের বাক্সগুলোর আড়ালে চলে গেল এবং কয়েক মিনিটের মধ্যেই পোশাক পাল্টে আবার ফিরে এল।

‘এবার বুট জোড়াটা খুলে ফ্যাল।’

টম তাই করল।

সাধারণত ক্রীতদাসদের যা বরাদ্দ, সেইরকম একজোড়া শক্ত, জীর্ণ জুতো ছুড়ে দিয়ে লেগ্রি বলল, ‘এ দুটো পরে নে।’

এতটুকুও দ্বিরুক্তি না করে টম জুতোজোড়া পরে নিল। তার একটাই মাত্র সান্ত্বনা, পোশাক পাল্টাবার সময় সে তার অতিপ্রিয় বাইবেলটা পকেটে পুরে নিতে পেরেছিল।

লেগ্রি আবার তার হাতে হাতকড়াটা পরিয়ে দিল। এবার সে টমের প্রথম কোটের পকেটগুলো হাতড়ে দেখতে লাগল। প্রথমেই সে সিল্কের সুন্দর রুমালটা নিল নিজের পকেটে। টমের পকেট থেকে পাওয়া অন্যান্য টুকিটাকি জিনিস, একসময় যেগুলো ইভাকে বিপুল আনন্দ দিত, লেগ্রি সেগুলো টান মেরে ছুড়ে ফেলে দিল নদীতে।

তাড়াহুড়ো করতে গিয়ে টম তার প্রার্থনাসংগীত বইখানা বার করে নিতে ভুলে গিয়েছিল, লেগ্রি সেখানা উল্টে-পাল্টে দেখল।

‘হুঁ! ধার্মিক! … তার মানে তুই গির্জায় যাস?’

‘হ্যাঁ, হুজুর।’

‘আমার ওখানে হই-হল্লা, প্রার্থনা, গান গাওয়া ওসব কিছু চলবে না। মন দিয়ে শুনে রাখ’, মেঝেতে পা ঠুকে, ভয়ঙ্কর ক্রুদ্ধ চোখে টমের দিকে তাকিয়ে লেগ্রি বলল, ‘এখন থেকে আমিই তোর গির্জা! আমি যা বলব, তাই শুনবি। কী বললাম, বুঝতে পেরেছিস?

টমের বুকের অতল থেকে কেমন যেন আর্তস্বরে চিৎকার উঠল, ‘না!’ কিন্তু সাইমন কোনো কণ্ঠস্বর শুনতে পেল না, কেননা সেই কণ্ঠস্বর একমাত্র অন্তর্যামী ছাড়া আর কারো পক্ষেই শোনা সম্ভব ছিল না।

নতমুখে দাঁড়িয়ে থাকা টমের দিকে পলকের জন্যে তাকিয়ে থেকে লেগ্রি তোরঙ্গটা নিয়ে স্টিমারের সামনের দিকে চলে গেল। সেখানে গিয়ে ‘ভদ্র হতে চাওয়া’ নিগ্রোটার জামা-কাপড় থেকে শুরু করে যা কিছু ছিল, এমন কী তোরঙ্গটা পর্যন্তও নাবিকদের মধ্যে নিলামে বিক্রি করে দিল। বলা বাহুল্য, বিক্রয়-সমস্ত অর্থই সে পকেটে রাখল। তারপর টমের কাছে ফিরে এসে বলল, ‘এখন থেকে মিছেমিছি ওই ভারী বোঝাটা বয়ে বেড়াবার কোনো দরকার নেই। তোকে যে পোশাকটা দিয়েছি ওটারই যত্ন নিস। আমার ওখানে কোনো নিগ্রোই একটা পোশাক না ছিঁড়লে অন্য পোশাক পায় না মনে রাখিস, তোকে ও এই একটা পোশাকে একবছর চালাতে হবে।’

টমের অদূরে, দলের অন্যান্যদের মধ্যে এমিলিন তখন বিষণ্নমুখে চুপচাপ বসে ছিল, সম্ভবত মার কথা ভাবতে ভাবতেই তার সুন্দর চোখ-দুটো জলে ভরে উঠেছিল। ওর দিকে চোখ পড়তেই লেগ্রি ধমকে উঠল, ‘কি রে, অমন মুখ গোমড়া করে বসে আছিস কেন?’

লেগ্রির কদাকার মুখখানার দিকে তাকাতেই এমিলিন যেন ভয়ে আঁতকে উঠল। সম্ভবত সেটা লক্ষ করেই লেগ্রি আগের চাইতে আরো ভয়ঙ্কর গলায় হুঙ্কার ছাড়ল, ‘এই ছুঁড়ি, কানে শুনতে পাচ্ছিস না? আমি যখন কথা বলব, সঙ্গে সঙ্গে হাসি মুখে উঠে দাঁড়াবি। কি রে, কথাটা কানে গেছে?’

ভয় দেখানো সত্ত্বেও এমিলিন সেই মুহূর্তে কোনো জবাব দিতে পারল না।

দুপা পিছিয়ে এসে, ড্যাব-ড্যাব চোখ দুটোকে আরো বাইরের দিকে ঠেলে বার করে লেগ্রি হেঁড়ে গলায় বলে উঠল, ‘তোদের সবাইকে আমি আগে থেকে সাবধান করে রাখছি, কেউ যদি আমার মুখের ওপর একবারও … করেছিস তো এক ঘুষিতে চোয়ালের হাড় পর্যন্ত গুঁড়িয়ে দেব। এই যে আমার ঘুঁষিটা দেখছিস, নিগ্রোদের মেরে মেরে এটা একেবারে কামারের হাতুড়ির মতো শক্ত হয়ে গেছে। আমি এখনো পর্যন্ত কোনো নিগ্রো দেখি নি, যে আমার একখানা ঘুষি খেয়ে জ্ঞান হারিয়ে ফেলে নি। বুঝতেই পারছিস, আমার মধ্যে দয়ামায়া বলে কোনো পদার্থ নেই। আমি যখনই কথা বলব, সঙ্গে সঙ্গে উঠে দাঁড়াবি, যখনই কিছু করতে বলব, সঙ্গে সঙ্গে করবি। তাহলেই দেখবি আমার সঙ্গে মানিয়ে চলতে পারবি। আর আমার সঙ্গে চালাকি করার চেষ্টা করলে বুঝতে পারবি, তোরও আয়ু ফুরিয়ে এসেছে!’

কথাগুলো বলে লেগ্রি বড় বড় পা ফেলে ওপরের ডেকে চলে গেল। বিহ্বল আতঙ্কের সেই মুহূর্তে কেউ কোনো কথা বলতে পারল না।

অনড় দুঃখের বোঝা বুকে নিয়ে স্টিমার রেড নদীর উচ্ছৃঙ্খল ঘোলা জলের স্রোত কাটিয়ে তরতর করে ছুটে চলেছে, বিমর্ষ যাত্রীরা ম্লানচোখে তাকিয়ে রয়েছে লালচে কাদাভরা নদীর খাড়াই তটের দিকে।

অবশেষে স্টিমার ছোট একটা শহরের ঘাটে এসে ভিড়ল। লেগ্রি তার মালপত্তর নিয়ে নেমে গেল।

২৬. আঁস্তাকুড়

বিশ্রী দেখতে নড়বড়ে একটা ওয়াগন ধুলোয় ভরা আরো কুৎসিত একটা পথ ধরে, যেন পরম ক্লান্তিভরে, ধীরে ধীরে এগিয়ে চলেছে। ওয়াগনের ভেতরে টম আর তার শৃঙ্খলিত সঙ্গীরা নতমুখে চুপচাপ বসে রয়েছে। সাইমন লেগ্রি বসেছে কোচোয়ানের পাশে, সামনের আসনে।

পথটা আসলে পরিত্যক্ত আর দুর্গম, পাইনের নির্জন অরণ্যের মধ্যে দিয়ে এঁকে-বেঁকে চলে গেছে। পাতায় পাতায় জেগে উঠছে বাতাসের করুণ মর্মর। কোথাও কোথাও সাইপ্রেসের প্রকাণ্ড প্রকাণ্ড সব গুঁড়িগুলো জলাভূমির ওপরে একেবারে হেলে পড়েছে আর তাদের গায়ে গজিয়ে উঠেছে কুৎসিত দেখতে কালো কালো সব ছত্রাক। কোথাও কোথাও বা হেলেপড়া গা আর তার ভাঙা ডালপালার মধ্যে জড়িয়ে রয়েছে জঘন্য মোকাসিন সাপগুলো।

পথটা এমনই বিপদসঙ্কুল আর নির্জন যে বেশি পয়সা দিলেও অনেকে গাড়ি নিয়ে আসতে চায় না। পৃথিবীর নির্জনতম কোনো প্রান্তে এসে পড়ার আশঙ্কায় ক্রীতদাস- দাসীদের ভারাক্রান্ত মনগুলো নতুন করে আরো গাঢ় বিষণ্নতায় ভরে উঠল। যদিও লেগ্রি মাঝে মাঝেই তার পকেট থেকে সুরার পাত্রটা বার করে গলায় ঢালছিল আর ওদের অবদমিত মনগুলোকে চাঙ্গা করে তোলার চেষ্টা করছিল, কিন্তু তাতে খুব বেশি ফল হলো না।

গাড়িটা এগিয়ে চলার সঙ্গে সঙ্গে লেগ্রি যত বেশি উল্লসিত হয়ে উঠে, শৃঙ্খলিত ক্রীতদাস-দাসীরা যেন ততই ঝিমিয়ে পড়ে।

লেগ্রি বাজখাই গলায় হেঁকে ওঠে, ‘কি রে, তোরা সব অমন পেঁচার মতো মুখ করে বসে আছিস কেন … গানটান কর।’

বিশেষ কাউকে উদ্দেশ্য করে কথাটা বলা হয় নি বলে কেউই তেমন আর গান করল না। তাছাড়া গান গাওয়ার মানসিকতাও কারো ছিল না।

একটু চুপ করে থাকার পর লেগ্রি রুক্ষ আঙুলে এমিলিনের কানের লতিটা আলতো করে ধরে জিজ্ঞেস কর, ‘কি রে, তুই কানে কিছু পরিস না?’

চকিতে আঁতকে উঠে এমিলিন ছোট্ট করে জবাব দিল, ‘না, স্যার!’

‘ঠিক আছে, তুই যদি ভালো হয়ে থাকিস, তোকে একজোড়া মাকড়ি কিনে দেব।’ পাশের মহিলাটিকে জড়িয়ে ধরে এমিলিনকে থরথর করে কাঁপতে দেখে সাইমন হো হো করে হেসে উঠল। ‘আরে না না, আমাকে অত ভয় পাবার কিছু নেই। ভালোভাবে থাকলে আমি কাউকে কিচ্ছু বলি না। তুই যদি ভদ্র হয়ে থাকিস, তোকে আমি শক্ত কাজ দেব না, আমার কাছেই বেশিক্ষণ কাটাতে পারবি।’

এইভাবে চলতে চলতে লেগ্রি একসময় এমন মাতাল হয়ে পড়ল যে নিজেই হেঁড়ে গলায় গান ধরল। আরো কিছুক্ষণ চলার পর দূর থেকে চোখে পড়ল লেগ্রির তুলো চাষের আবাদ। আবাদটা অনেকখানি জায়গা জুড়ে। আগে এটা ছিল শৌখিন এক ভদ্রলোকের, যিনি নিজে সবকিছু দেখাশোনা করতেন। কিন্তু ভদ্রলোক হঠাৎ দেউলিয়া অবস্থায় মারা যান এবং লেগ্রি প্রায় জলের দামে সম্পত্তিটা কিনে নেয়। আজ যত্নের অভাবে আবাদটার হতকুৎসিত চেহারা স্পষ্টই চোখে পড়ে।

একসময় আবাদসংলগ্ন বিশাল বাড়িটার সামনে ছিল মসৃণ সবুজ ঘাসে ছাওয়া বিস্তীর্ণ একটা লন, লনের চারদিক ঘিরে ফল আর ফুলের বাগান, মাঝে মাঝে সুন্দর সুন্দর সব নিকুঞ্জ আর কারুকার্য—করা থামের গায়ে মধুচক্র। কিন্তু এখন আর সে সৌন্দর্য নেই। সারা বাগান আগাছা আর ঝোপঝাড়ে ভরে গেছে, লনের এখানে ওখানে ভাঙা টব, বালতি আর গামলার স্তূপ, কারুকার্য-করা থামগুলো এখন ঘোড়া বাঁধার খুটি হিসেবে ব্যবহার করা হয়, পাথর-বাঁধানো ফুলের টবগুলোর জঞ্জালের স্তূপ, শুকিয়ে গেছে ফোয়ারার জলধারা।

ইটের থামওয়ালা দোতলা বাড়িটা বেশ বড়ই, চারদিকে চওড়া বারান্দা। প্রতিটা ঘরের দরজা খুললেই এক বারান্দায় আসা যায়। কিন্তু বাড়িটার এখন জীর্ণ দশা। কোথাও পলেস্তরা খসে গেছে, কোনো জানলার খড়খড়ি নেই, কোনোটার আবার পাল্লা খুলে গেছে, কোনোটা বা ঝুলছে একটা মাত্র কব্জার ওপর। হঠাৎ দেখলে মনে হবে ওটা বুঝি একটা ভুতুড়ে বাড়ি এবং এর ত্রিসীমানাতেও কেউ কখনো ঘেঁষে না।

ঝাঁকড়া চায়নাবীথির নিচ দিয়ে নুড়ি-বিছানো চওড়া পথ ধরে গাড়িটা ধীরে ধীরে বাড়িটার দিকে এগিয়ে চলল। পথের দুধারে পড়ে রয়েছে ভাঙা তক্তা, খড়ের টুকরো কাঠের পিপে, টিনের বাক্স। চাকার শব্দে কদাকার দেখতে তিন চারটে কুকুর হঠাৎ কোত্থেকে ভয়ঙ্কর রাগে গর্জন করতে করতে টম আর তার সঙ্গীদের দিকে ছুটে এল। জীর্ণ পোশাকপরা কয়েকজন নিগ্রোকে অতিকষ্টে তাদের সামলে রাখতে হলো।

কুকুরগুলোকে আদর করতে করতে লেগ্রি টমদের দিকে ফিরে বলল, ‘কিরে, চেহারাগুলো দেখেছিস একবার? পালানো নিগ্রোদের খুঁজে বার করার জন্যেই এদের শিক্ষা দেওয়া হয়েছে। ভুলেও যদি কখনো সে চেষ্টা করিস তো ছিঁড়ে একেবারে টুকরো টুকরো করে ফেলবে। সাবধান! কথাটা মনে থাকে যেন!’ তারপর কানাবিহীন টুপি মাথায় একজন নিগ্রোর দিকে ফিরে সে জিজ্ঞেস করল, ‘কী ব্যাপার সাম্বো, এদিককার খবর কী?’

‘ভালো, স্যার।’

‘আর কুইম্বো’, অন্য একজন নিগ্রোকে উদ্দেশ্য করে লেগ্রি বলল, ‘তোকে যা যা করতে বলেছিলাম, করেছিস?’

‘হ্যাঁ, স্যার।’

সাম্বো আর কুইম্বো, এই দুজন ক্রীতদাসই সাধারণত লেগ্রির তুলোর আবাদ দেখাশোনা করা থেকে শুরু করে আর যা কিছু দুষ্কর্ম আছে তার সবগুলোই করে। নিজের শিকারি বুলডগগুলোর মতো লেগ্রি এদেরকেও একটু একটু করে কীভাবে নিষ্ঠুর আর বর্বর হয়ে উঠতে হয় তার শিক্ষা দিয়েছে এবং দীর্ঘ অভ্যাসের ফলে লেগ্রির মতো এদের হৃদয়ও হয়ে উঠেছে কঠিন আর বিবেকহীন। কৃষ্ণাঙ্গ হয়েও স্বজাতির প্রতি এদের ব্যবহার এখন একজন শ্বেতাঙ্গ সর্দার কিংবা বন্য কোনো পশুর চাইতেও হিংস্র। কিন্তু যেহেতু অধিকাংশ শ্বেতাঙ্গের মতো লেগ্রি বিশ্বাস করে, ক্রীতদাসেরা অকৃতজ্ঞ এবং সুযোগ পেলেই বিশ্বাসঘাতকতা করবে, তাই দুষ্কর্মের অংশীদার হওয়া সত্ত্বেও লেগ্রি এদেরকেও বিশ্বাস করে না। এর চাইতেও বড় কথা, সাম্বো আর কুইম্বো, এরা নিজেরাই পরস্পরকে বিশ্বাস করে না। বাইরে গলায় গলায় ভাব থাকলেও এরা পরস্পরকে ঘৃণা করে এবং লেগ্রির কাছে গোপনে পরস্পরের নামে অভিযোগ করে। লেগ্রি নিজেও তাই চায়, কেননা এতে তারই লাভ সবচাইতে বেশি। বাড়ি, বাড়ির বাইরে আবাদের যা কিছু খবরাখবর সে এই দুজনের মাধ্যমেই পেয়ে যায়।

লেগ্রির দুপাশে দৈত্যের মতো বিশাল চেহারা নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা বিশ্বস্ত দুজন ক্রীতদাসের ঝুলেপড়া চোয়াল, বিশ্রী মুখ, ঘৃণা আর অবজ্ঞায় মেশা চোখগুলোর দিকে তাকিয়ে মনে হলো এ পরিবেশে ওরাই সবচাইতে কুৎসিত দুটো জীব।

‘সাম্বো, এদের বাসায় নিয়ে যা। আর …’ এমিলিনের সঙ্গে বাঁধা মহিলাটিকে খুলে সাম্বোর দিকে ঠেলে দিয়ে বলল, ‘এটা তোর জন্যে।’

মহিলাটি সংকোচে একেবারে কুঁকড়ে উঠল। করুণস্বরে বলল, ‘স্যার, নিউ অর্লিয়েন্সে আমার স্বামী আর ছেলেমেয়ে আছে!’

‘তা হোক, তুই ওর সঙ্গে থাকবি।’

‘কিন্তু, স্যার।’

চাবুক উঁচিয়ে লেগ্রি হুঙ্কার ছাড়ল, ‘ফের কথা!’ তারপর এমিলিনের দিকে ফিরে বলল, ‘তুই আয় আমার সঙ্গে।’

টম আগেই নজর করেছিল, ওপরের তলার জানলা থেকে একজন কৃষ্ণাঙ্গ মহিলা সবকিছু লক্ষ করছিল, এমিলিনকে নিয়ে ভেতরে প্রবেশ করার সময় মহিলাটি লেগ্রিকে দ্রুত কী যেন বলল। তার জবাবে লেগ্রি ধমকে উঠল, ‘তুমি চুপ করে থাকো। আমার যা খুশি তাই করব।’

সাম্বোর সঙ্গে যেতে হলো বলে টম আর কিছু শুনতে পেল না।

লেগ্রির বাড়ি থেকে ক্রীতদাস-দাসীদের আস্তানাগুলো অনেকখানি দূর, আবাদভূমির এক অংশে। দুধারে সারি সারি চালা, মাঝখানে নোংরা একটা পথ। ওখানকার অবস্থা দেখে টমের মন দমে গেল। মনে মনে সে আশা করছিল নিজের জন্যে একখানা আলাদা চালা পাবে। চালাখানা যেমনই হোক না কেন, নিজে তা পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করে নেবে, সারাদিনের কঠোর পরিশ্রমের পর সন্ধ্যায় নিজের নিভৃত আবাসে ফিরে এসে সে বাইবেলখানা খুলে বসতে পারবে। কিন্তু তার পরিবর্তে টম দেখল চালার ভেতরে কোথাও কোনো আসবাব নেই, কেবল মাটির ওপরে খড় বিছানো, অজস্র পায়ের চলাফেরায় যা একেবারে নোংরা হয়ে রয়েছে।

সাম্বোকে টম জিজ্ঞেস করল, ‘আমার কোনটা?’

‘জানি না। এত নিগারের আমদানি হয়েছে যে এক-একটা চালাতে অনেককে একসঙ্গে থাকতে হবে বলে আমার মনে হচ্ছে।’

সন্ধ্যের পর ক্লান্ত শ্রান্ত দেহে, জীর্ণ পোশাকে ক্রীতদাসেরা ঝাঁকে ঝাঁকে ফিরে আসতে শুরু করল। নারী আর পুরুষ উভয়দেরই মুখের দিকে টম আগ্রহ ভরে তাকিয়ে দেখতে লাগল, যদি বন্ধুত্ব করার মতো একটা মুখও খুঁজে পাওয়া যায়। কিন্তু ওরা সবাই নিভে যাওয়া এক-একটা ছায়ার মতো, মনুষ্যত্বের শেষ কণাটুকুও যেন নিঃশেষ হয়ে গেছে। ভোরের আলো ফুটে ওঠার আগেই দল বেঁধে ওদের হাজির হতে হয় মাঠে। তুলো সংগ্রহের কাজটা যে খুব কঠিন, তা নয়। কিন্তু কাঠ-ফাটা রোদে এক জায়গায় দাঁড়িয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কাজ করে যাওয়া সত্যিই ক্লান্তিকর আর অসম্ভব একঘেয়ে। এমনিভাবে দিনের পর দিন, মাসের পর মাস, বছরের পর বছর, আশা-আকাঙ্ক্ষা, স্নেহ- ভালোবাসাবিহীন একটা যন্ত্রের মতো কাজ করতে করতে এরা এমনই যান্ত্রিক হয়ে গেছে যে স্বার্থপরতা ছাড়া ওদের কাছ থেকে ভালো কিছু আশা করাটাই অর্থহীন। জীর্ণবাস, শীর্ণ কঙ্কালসার চেহারায় মেয়েদের আর আলাদা করে চেনাই যায় না।

দিনের শেষে ঘরে ফিরে এসেও ওদের কাজ রয়েছে। প্রত্যেককে যাঁতায় গম ভেঙে রুটি সেঁকে নিজের খাবার নিজেদেরকেই তৈরি করে নিতে হবে। তাও সে আহার্যের পরিমাণ আবার যথেষ্ট নয়, কিন্তু কোনো উপায় নেই। লোকের তুলনায় যাঁতার সংখ্যাও এত কম যে, যারা সবল, দুর্বল আর মেয়েদের ঠেলে সরিয়ে দিয়ে নিজেরা আগে গম ভেঙে নেয়। দুর্বলরা সুযোগ পায় সবার শেষে।

‘এই নে, তোর গম। এমিলিনের সঙ্গে সেই মহিলাটির দিকে গমের ছোট একটা থলি ছুড়ে দিয়ে সাম্বো বলল। ‘কী নাম তোর?’

‘লুসি।’

‘বাঃ, চেহারার তুলনায় তোর নামটা তো বেশ ভালোই। তা তুই যখন আমার সঙ্গেই থাকবি, তখন আমার গমটাও ভেঙে খাবারটা বানিয়ে রাখিস।’

‘না, কখনো না!’ হতাশার মধ্যেও দুঃসাহসী হয়ে লুসি তীব্র প্রতিবাদ করল। ‘আমি তোমার সঙ্গে কোনোদিনও থাকব না। চলে যাও এখান থেকে।’

‘এক লাথিতে শেষ করে দেব!’ পা উঁচিয়ে সাম্বো বিশ্রীভাবে ভয় দেখাল।

‘ইচ্ছে করলে মেরে ফেলতে পার। তবু আমি তোমার সঙ্গে থাকব না, কখনো না!’

কুইম্বো তখন যাঁতার সামনে অপেক্ষমাণ দুই-তিন জন দুর্বল মহিলাকে গম ভাগ করে দিচ্ছিল। সাম্বোর দিকে তাকিয়ে বলল, ‘সাম্বো, আমি কিন্তু মনিবকে সব বলে দেব …’

‘আমিও বলব, তুমি মেয়েদের যাঁতা-ঘরে যেতে দাও নি’, সাম্বো বলল, ‘তুমি ওদের নিজের ঘরে আটকে রেখেছিলে …’

সারাদিনের পথশ্রমের ক্লান্তিতে আর ক্ষুধায় টমের তখন প্রায় মূর্ছা যাবার অবস্থা। কুইম্বো তার দিকে গমের একটা থলি ছুড়ে দিয়ে বলল, ‘এই নিগার, নে। এই দিয়ে তোকে সারা সপ্তা চালাতে হবে।’

থলেটা কুড়িয়ে নিয়ে টম অপেক্ষা করল। একটু বেশি রাত্রে সবার গম ভাঙা হয়ে যাবার পর নিজের জন্যে গম ভাঙতে গিয়ে দেখল দুজন বৃদ্ধা তখনো তাদের গম ভেঙে উঠতে পারে নি। সে ওদের গমগুলো ভেঙে দিল, তারপর নিজের গম ভাঙতে বসল। কাজটা নিতান্ত তুচ্ছ হলেও, ওদের অন্তর কৃতজ্ঞতায় পরিপূর্ণ হয়ে উঠল। যদিও এখানে নিজের রুটি নিজেকেইে বানিয়ে নিতে হয়, তবু বৃদ্ধা দুজন স্বেচ্ছায় টমের জন্যে রুটি বানিয়ে দিতে লাগল আর টম আগুনের ধারে বসে তার পকেট থেকে বাইবেলখানা বার করল।

একজন বৃদ্ধ জিজ্ঞেস করল, ‘ওটা কী?’

‘বাইবেল।’

‘হা, ঈশ্বর! কেন্টাকিতে যখন ছিলাম, তারপর থেকে এ জিনিসটা আমি আর কখনো চোখেও দেখি নি।’

আগ্রহভরে টম বৃদ্ধার মুখের দিকে তাকাল। ‘তুমি কেন্টাকিতেই মানুষ হয়েছ বুঝি?’

‘হ্যাঁ, বেশ ভদ্র একটা পরিবারেই ছিলাম!’ বৃদ্ধা গভীর দীর্ঘশ্বাস ফেলল, ‘কিন্তু কখনো স্বপ্নেও ভাবি নি এরকম একটা জঘন্য পরিবেশে এসে পড়তে হবে!

গভীর সহানুভূতির সঙ্গে টম আস্তে আস্তে বলল, ‘হ্যা, সত্যিই এটা দুর্ভাগ্যজনক!’

‘কেন্টাকিতে আমি মিসিসকে বহুবার এই বইটা পড়তে শুনেছি। কিন্তু এখানে চিৎকার চেঁচামেচি আর অসভ্য গালাগালি ছাড়া আর কিছুই শোনা যায় না।’

টম বলল, ‘তোমরা যদি চাও, আমি তোমাদের খানিকটা পড়ে শোনাতে পারি।’

‘হ্যাঁ, পড়ো।’

টম পড়ে চলল, ‘শ্রমের ভারে তোমরা, যাহারা ক্লান্ত পরিশ্রান্ত, আমার কাছে আইস; আমি তোমাদিগকে বিশ্রাম দিব।’

‘বাঃ, শব্দগুলো বেশ ভালো তো!’ দ্বিতীয় বৃদ্ধা প্রশ্ন করল, ‘কথাগুলো কে বলছে?’

টম ছোট্ট করে শুধু বলল, ‘প্ৰভু।’

‘প্রভু কোথায় থাকে যদি একবার জানতে পারতাম …’

‘প্রভু, সবখানে, এমন কী এখানেও রয়েছেন।’

‘আমি জানি নেই’, দ্বিতীয় বৃদ্ধা বলল, ‘থাকলে আমাদের বিশ্রামের কথা কখনো বলত না।’

টম তর্ক করল না। একটু পরে বৃদ্ধারা নিজেদের চালায় চলে গেল বড় রান্না ঘরটায় টম চুপচাপ একা বসে রয়েছে। নিভে আসা আগুনের রক্তিম শিখাগুলো কাঁপছে তার মুখে।

সে জানে, আত্মপ্রত্যয়বিহীন সহজ সরল যে মানুষগুলো সারাটা জীবন পশুর মতো কেবল পরিশ্রম করেছে, মুখ বুঝে সহ্য করেছে দুঃখ বেদনা আর অত্যাচার, ভবিষ্যৎ যাদের নিঃসীম হতাশায় ভরা, একদিনে তাদেরকে কোনোকিছু বিশ্বাস করানো অত সহজ নয়। তাদেরকে যে কেমন করে বোঝাবে, কেউ যদি ঈশ্বরের কাছে সাহায্য চায়, ঈশ্বর স্বেচ্ছায় তাঁর হাতটা বাড়িয়ে দেন!

হাত দুটো বুকের কাছে জড়িয়ে, বাইবেলখানা কোলের ওপর নিয়ে চুপচাপ বসে থাকতে থাকতে টম একসময় দেখল রূপালি মেঘের ফাঁকে সুন্দর গোল চাঁদ উঠেছে, যেন ঈশ্বর তারই দিকে করুণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছেন।

খাওয়া দাওয়া সেরে টম যখন তার জন্যে বরাদ্দ চালাটায় ফিরে এল দেখল খড়ের বিছানাতে জায়গা প্রায় নেই বললেই চলে। বিশ্রী একটা দুর্গন্ধে বাতাস ভারি হয়ে রয়েছে। তবু অসম্ভব ক্লান্ত থাকার জন্যে নোংরা কম্বলটা কোনোরকমে টেনে নিয়ে নিজেকে টান টান করে মেলে দিতেই সে ঘুমিয়ে পড়ল।

২৭. নির্যাতন

খুব শিগগিরই টম অনুমান করে নিতে পারল কী ধরনের অবস্থার মধ্যে তাকে জীবনযাপন করতে হবে। চারদিকেই সে দেখল শুধু নোংরামি, কদর্যতা আর অত্যাচার। এখানকার সকলেরই জীবন দুঃখ, কান্না আর অসুস্থতায় ভরা। তবু সে মনে মনে ঠিক করল নিজে অক্লান্ত পরিশ্রম করবে আর ঈশ্বরে বিশ্বাস রাখবে। একমাত্র ঈশ্বরই পারেন তাকে আশার আলো দেখাতে, তাকে মুক্তি দিতে।

লেগ্রিও লক্ষ করল লোকটা অত্যন্ত কর্মঠ। যে কাজই দেওয়া হোক না কেন সব ব্যাপারে অসম্ভব দক্ষ ও বিশ্বস্ত। তাই লেগ্রি মনে মনে স্থির করল টমকেই তার কাজকর্ম তদারক করতে দেবে। বিশেষ প্রয়োজনে মাঝে মাঝে তাকে দুচারদিনের জন্যে বাইরে যেতে হয়। তখন আবাদ দেখাশোনার ভার টমের ওপর দিয়ে সে নিশ্চিন্ত হতে পারবে। অন্যদিকে সে আবার মনে মনে টমকে ভয় করত। প্রচ্ছন্ন ঘৃণা আর বিদ্বেষে ভরে উঠত সারা মন। কেননা টম খাঁটি মানুষ, মহৎ তার হৃদয়। কারুর মনে সে কষ্ট দেয় না, কাউকে ঘৃণা করে না। তার চাইতেও বড় কথা, অন্যের দুঃখ দেখে সে নিজেই কষ্ট পায়। অথচ লেগ্রির স্বভাব ঠিক তার বিপরীত। মনে মনে সে সংকল্প করল, টমকে তার কাজের উপযুক্ত করে তুলবে। সে জন্যে প্রথমেই দরকার, টমের হৃদয়কে ‘কঠিন’ করে তোলা এবং সেই পদ্ধতির দিকেই সে ধীরে ধীরে এগোতে লাগল।

একদিন টম তুলো তুলে নিজের থলিতে ভরে রাখছিল, হঠাৎ দেখল লুসিও ঠিক তার পাশাপাশি তুলো তুলছে। কিন্তু ও এত দুর্বল আর অসুস্থ যে সোজা হয়ে দাঁড়াতেই পারছে না। টম ধীরে ধীরে ওর পাশে সরে এসে নিজের থলি থেকে বেশ কিছু তুলো ওর থলিতে ভরে দিল।

আতঙ্ক মেশানো চোখে লুসি বলল, ‘না না, দিও না! ওরা দেখতে পেলে আর রক্ষে রাখবে না।’

‘অ্যাই, কি হচ্ছে কী?’ হঠাৎ কোত্থেকে সাম্বো চাবুক দোলাতে দোলাতে খ্যাপা ষাঁড়ের মতো তেড়ে এল। আসলে লুসির ওপর সাম্বোর রাগ ছিল সেই প্রথম দিন থেকে। তাই আড়াল থেকে সে সবসময় ওকে চোখে চোখে রাখার চেষ্টা করত এবং কোনো ছুতো পেলেই তাকে নির্মমভাবে চাবুক মারত। এখন হাতে নাতে ধরতে পারায় সাম্বো রেগে একেবারে আগুন হয়ে উঠল। ভারী বুট দিয়ে সজোরে লাথি মারল লুসির পেটে, চাবুকের একটা ঘা বসিয়ে দিল টমের মুখে।

টম নীরবে আবার তার কাজ করতে লাগল। কিন্তু লুসি সহ্য করতে না পেরে জ্ঞান হারিয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়ল।

‘দাঁড়া, ফুলের ঘায়ে মূর্ছা যাওয়া তোর আমি বার করে দিচ্ছি!’ কোটের হাতা থেকে একটা পিন খুলে সাম্বো লুসির গায়ে ফুটিয়ে দিল।

‘ওঠ, শিগগির ওঠ … ভেবেছিস আমার সঙ্গে শয়তানি করে তুই পার পেয়ে যাবি?’

অসহ্য যন্ত্রণায় গোঙাতে গোঙাতে লুসি চোখ মেলল, তারপর যেন অতিমানবিক একটা শক্তিতে লাফিয়ে উঠে আবার নিজের কাজ করতে লাগল।

বিশ্রীভাবে হাসতে হাসতে সাম্বো বলল, ‘হ্যাঁ, যদি মরতে না চাস, ঠিকমতো কাজ করে যা।

কাজ করার শক্তি কিন্তু লুসির ছিল না। সাম্বো চলে যেতেই টম তার তলিতে যত তুলো ছিল সব লুসির থলিতে ভরে দিল।

লুসি বাধা দিল। ‘না না, আমাকে দিও না। জানতে পারলে ওরা তোমাকে কঠোর শাস্তি দেবে।’

‘তোমার চাইতে আমি বরং সেটা বেশ সহ্য করতে পারব।’ কথাটা বলেই টম আবার নিজের কাজে মন দিল।

বিকেল গড়িয়ে যখন সন্ধ্যে, ক্লান্ত শ্রান্ত মানুষের একটা মিছিল, মাথায় তুলোর বিশাল বিশাল সব গাঁটরি নিয়ে হাজির হলো লেগ্রির বার-বাড়িতে। এখানে প্রতিটা গাঁটরি ওজন করে তবে গুদামজাত করা হয়। একটা শ্লেটে প্রত্যেকের নামের পাশে লেগ্রি তার গাঁটরির ওজনটা লিখে রাখে। দাঁড়ি-পাল্লায় তোলা এবং নামানোর কাজে সাম্বোর কুইম্বো তাকে সাহায্য করে।

ক্লান্ত পায়ে এক-একজন ঘরে ঢুকছে আর মাপার পর লেগ্রি তার নামের পাশে ওজনটা টুকে রাখছে। টমের গাঁটরির ওজন পূর্বনির্ধারিত ওজনের সমান হওয়া সত্ত্বেও লেগ্রি তাকে অপেক্ষা করতে বলল। টমের মনে কেমন যেন খটকা লাগল। নিশ্চয়ই স্যাঙাতটা তার নামে মনিবের কান ভারি করেছে।

বোঝার ভারে একেবারে নুইয়ে পড়ে লুসি যখন ঘরে ঢুকল, টম উদ্বেগের সঙ্গে ওর ওজনটা লক্ষ করতে লাগল। নির্দিষ্ট ওজনের সমান হওয়া সত্ত্বেও লেগ্রি বিশ্রীভাবে খেঁকিয়ে উঠল, ‘কি রে, আবার তুই কম তুলেছিস? সরে দাঁড়া, তোর মজা আমি টের পাওয়াচ্ছি!’

লুসি অস্ফুট আর্তনাদ করে একপাশে সরে দাঁড়াল।

সবার মাপা শেষ হবার পর লেগ্রি টমকে বলল, ‘এদিকে আয়। তুই খুব ভালো করেই জানিস, সাধারণ কাজকর্ম করার জন্যে তোকে আমি কিনি নি। তোকে আমি সর্দার করব। আমি চাই তুই এখন থেকেই কাজ শুরু করে দে। ওই মেয়েটাকে নিয়ে গিয়ে চাবুক মার। আশা করি এতদিন দেখে দেখে কাজটা তুই ভালোই শিখেছিস।’

‘না, হুজুর’, বিনীত স্বরেই টম বলল, ‘আমাকে ক্ষমা করবেন। ও কাজ আমি কখনো করি নি এবং করতে পারব না।’

‘কী বললি, উলুক!’ লেগ্রি সজোরে চাবুকের একটা ঘা কষিয়ে দিল টমের মুখে। ‘আগে যে কাজ কখনো করিস নি, এখন তোকে সেই কাজ করতে হবে।

টম কোনো জবাব দিল না। লেগ্রি তাতে আরো রেগে গিয়ে তাকে বেদম কিল চড় ঘুষি লাথি মারতে লাগল। শেষে এক সময়ে হাঁফাতে হাঁফাতে বলল, ‘কী, এখনো বলবি পারব না?’

‘হ্যাঁ, স্যার।’ গালের ওপর থেকে রক্তের ধারা মুছতে মুছতে টম বলল। ‘আমি খাটতে পারি, যত দিন বাঁচব আপনার জন্যে দিনরাত পরিশ্রম করে যাব। কিন্তু যে কাজ করা উচিত নয়, তা আমি কখনো করব না … কোনোদিনও না!’

টমের সম্ভ্রম জড়ানো নম্রস্বরে লেগ্রি স্তম্ভিত হয়ে গেল। পরক্ষণেই মনিবের অহমিকাবোধ তাকে আবার জাগিয়ে তুলল। হাত পা নেড়ে বিশ্রীভাবে সে চিৎকার করে উঠল, ‘কী উচিত-অনুচিত সেটা তোর কাছে শিখতে হবে? আমি মনিব, আমি তোকে যা বলব সেটাই তোর করা উচিত। তুই কি ভাবিস নিজে খুব ভদ্র হয়ে গেছিস! তোর কি মনে হয় মেয়েটাকে চাবুক মারা অন্যায়?

‘হ্যাঁ স্যার, মেয়েটা অসুস্থ আর দুর্বল। ওর প্রতি কোনো নিষ্ঠুর আচরণ আমি করতে পারব না। আপনি যদি আমাকে মেরে ফেলতে চান, মেরে ফেলুন। তবু আমি কারুর গায়ে হাত তুলব না। তার আগে আমার মৃত্যু হওয়া অনেক ভালো!’

ভয়ঙ্কর ঝড়ের আশঙ্কায় ঘরের ভেতরের সবাই তখন ভয়ে কাঁটা হয়ে রয়েছে। লেগ্রি ও রাগে থরথর করে কাঁপছে, বড় বড় চোখ দুটো দিয়ে যেন আগুন ঠিকরে বেরুচ্ছে। তবু হিংস্র পশু যেমন শিকারকে হত্যা করার আগে তাকে নিয়ে খেলে, লেগ্রি ঠিক সেই রকম নিজেকে সামলে রেখে বিদ্রূপভরে বলে উঠল, ‘আমরা সব পাপী, আর উনিই একমাত্র ধার্মিক! উনি আমাদের নরক থেকে উদ্ধার করার জন্যে এসেছেন! হ্যাঁ রে উলুক, তুই কি জানিস না, বাইবেলে লেখা আছে : ‘ভৃত্যগণ, প্রভুর অনুগত হও?’ আমিই তোর প্রভু। তোর জন্যে কি আমাকে গুনে গুনে ভালো কয়েক শো ডলার দিতে হয় নি?’ বুটসহ একটা লাথি কষিয়ে লেগ্রি বলল, ‘এখনো কি বলতে চাস, দেহ-মনে তুই আমার না?’

অসহ্য যন্ত্রণা সত্ত্বেও টম শান্ত, স্থির। যেন ভেতরের ঐশ্বরিক একটা শক্তিতে সে বলীয়ান। রক্ত আর অশ্রুধারার মধ্যেই দীপ্তস্বরে সে বলল, ‘না, হুজুর, দেহটা আপনার কিন্তু মনটা আপনার নয়। এটাকে আপনি এখনো কিনতে পারেন নি, কোনোদিন কিনতে পারবেনও না। এটার জন্যে যিনি মূল্য দিতে পারেন, তিনি বহুকাল আগেই কিনে রেখেছেন। আপনি আমাকে নিয়ে যা খুশি করুন না কেন, মনটার কোনো ক্ষতি করতে পারবেন না।’

‘আচ্ছা, দেখি পারি কিনা! সাম্বো কুইম্বো, এই কুকুরটাকে নিয়ে গিয়ে এমন মার দে যাতে এক মাসের মধ্যে আর নড়তে না পারে।’

ভয়ঙ্কর দৈত্যের মতো দেখতে দুজন নিগ্রো দুপাশ থেকে এসে টমকে ধরে টানতে টানতে নিয়ে গেল। অদ্ভুত একটা জিঘাংসায় ঘাতকের মুখগুলো তখন উল্লসিত হয়ে উঠেছে। ভয়ে দুহাতে মুখ ঢেকে লুসি আর্তনাদ করে উঠল।

২৮. কেসি

রাত তখন গভীর! ভেঙেপড়া, পরিত্যক্ত গুদামঘরের এক কোণে টম রক্তাক্ত দেহে পড়ে রয়েছে আর মাঝে মাঝে যন্ত্রণায় গোঙাচ্ছে। ঘরটা পুরনো যন্ত্রপাতি, ভাঙা বাক্স, নষ্ট হয়ে যাওয়া তুলোর গাঁটরি আর নানা ধরনের টুকিটাকি জিনিসে একেবারে ঠাসা।

ঘরটা যেমন স্যাঁতসেঁতে, তেমনি ঠাণ্ডা। নড়াচাড়ার ক্ষমতা নেই বলে আরো বেশি করে ছেঁকে ধরেছে মশার ঝাঁক। অসহ্য যন্ত্রণার চাইতেও যা মারাত্মক কষ্টদায়ক, তৃষ্ণায় ফেটে যাচ্ছে বুকের ছাতি।

‘ঈশ্বর! হে ঈশ্বর, আমায় শক্তি দাও!’ কাতরাতে কাতরাতেই টম বেদনার্ত স্বরে প্রার্থনা জানাল।

এমন সময় সে কার যেন পায়ের শব্দ শুনতে পেল, চোখে এসে পড়ল লণ্ঠনের আলোর ক্ষীণ একটা রেখা।

‘কে?’ ভারি চোখের পাতা দুটোকে টম কোনোরকমে মেলার চেষ্টা করল। ‘ঈশ্বরের দোহাই, আমাকে একটু জল দাও।’

একজন মহিলা লণ্ঠনটা মাটিতে নামিয়ে রেখে টমের মাথাটা একটু তুলে ধরে জলের পাত্রটা এগিয়ে দিল।

পরম আগ্রহে টম পান করতে লাগল।

পাত্রে আরো খানিকটা জল ঢেলে মহিলাটি আশ্চর্য মিষ্টি গলায় বলল, ‘সবটুকু খেয়ে নাও। আমি জানি, এখন এটাই তোমার সবচাইতে বেশি প্রয়োজন।‘

আকণ্ঠ পান করার পর টম বলল, ‘অসংখ্য ধন্যবাদ, মিসিস।’

‘আমাকে মিসিস বোলো না। আমি তোমারই মতো একজন হতভাগ্য ক্রীতদাসী।’

স্তব্ধ বিস্ময়ে টম মহিলাটির মুখের দিকে তাকাল, মনে হলো দীর্ঘ পল্লবঘেরা সুন্দর টানাটানা চোখ দুটো সে যেন আগে কোথাও দেখেছে। ছিপছিপে লম্বা চেহারা। বছর চল্লিশ বয়স মুখখানা আশ্চর্যসুন্দর। সর্বাঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে মমতাময়ী একটা শ্রী। গলার স্বরটাও ভারি মিষ্টি।

‘আমার নাম কেসি। ভেবো না, তোমার জন্যে এই প্রথম আমি জল নিয়ে এলাম। গভীর রাতে, সবাই ঘুমিয়ে পড়ার পর আমাকে বহুবারই এখানে আসতে হয়েছে। বৈঠকখানার জানলার ফাঁক দিয়ে আমি সবই দেখেছি। তোমার জন্যে যতটা কষ্ট পেয়েছি, কারুর জন্যে আর এমন কষ্ট পাই নি। এখানে কাউকে আমার মানুষ বলেই মনে হয় না।’ কথা বলতে বলতেই কেসি নিপুণ হাতে তুলোর একটা গাঁটরি খুলে গদির মতো বিছিয়ে তার ওপর একটা চট পেতে দিল। ‘একা আমি তো তোমাকে তুলতে পারব না। তুমি বরং এদিকে একটু গড়িয়ে এসো, টম চাচা।’

শেষের শব্দটায় টম চাবুক খাওয়ার চাইতেও বেশি চমকে উঠল, অদ্ভুত একটা যন্ত্রণায় মুচড়ে উঠল বুকের ভেতরটা। মাস্টার জর্জ আর ইভা ছাড়া কেউ আর কোনোদিন তাকে এত নিবিড়, এমন মিষ্টি করে ডাকে নি। যেন শুধু এই ছোট্ট শব্দটার জন্যেই সে এখনো বেঁচে আছে। টম কৃতজ্ঞতা জানাবার কোনো ভাষা খুঁজে পেল না, কেবল শুকনো ঠোঁট দুটো মৃদু নড়ে উঠল, সজল হয়ে উঠল তার গভীর চোখ দুটো।

শয্যার সামনে উবু হয়ে বসে কেসি ভিজে রুমাল দিয়ে ক্ষতস্থানগুলোর ওপর আলতো করে বুলিয়ে দিতে লাগল। কৃতজ্ঞতা-ভেজা চোখে টম তাকিয়ে তাকিয়ে দেখল, কেসির মাথা থেকে ওড়নাখানা খসে গেছে, ঘন পল্লবঘেরা সুন্দর চোখ দুটো বেদনায় ম্লান, মুখের চারপাশে ছড়িয়ে পড়েছে একরাশ কোঁকড়ানো কালো চুল।

হাতটা একটু তুলে টম কী যেন বলতে যেতেই কেসি বাধা দিতে লাগল। তোমাকে কিচ্ছু বলতে হবে না, টম চাচা, আমি সব জানি, তোমার মতো সৎ, সাহসী মানুষ আমি জীবনে খুব কমই দেখেছি, এবং তুমি যা করেছ সেটাই ঠিক। তবু আমি বলব, তুমি ওর সঙ্গে পারবে না, ওটা একটা আস্ত শয়তান! তুমি বরং ওর কথামতোই চলো।’

‘হা, ঈশ্বর, তা কী করে সম্ভব?’

‘ঈশ্বরকে ডেকে কোনো লাভ নেই, উনি আমাদের কথা শুনতে পান না।’ শান্ত স্বরেই কেসি বলল। ‘আমার ধারণা ঈশ্বর নেই, আর যদি থাকেনও উনি আমাদের বিরুদ্ধে। স্বৰ্গ- মর্ত্য, সবাই আমাদের বিরুদ্ধে। সবাই আমাদের ঠেলে দিচ্ছে নরকের দিকে।

‘হ্যাঁ, একদিক থেকে কথাটা ঠিক। তবুও, মিসিস …‘

‘তুমি এখানকার কিছুই জানো না, টম চাচা; কিন্তু আমি জানি। আজ পাঁচ বছর ধরে আমি এই জায়গাটা দেখছি। দেহ আর মন, দুটোই বিসর্জন দিয়েছি ওই লোকটার পায়ের তলায়। অথচ ওই লোকটাকে আমি শয়তানেরই মতো ঘৃণা করি। এই যে পরিত্যক্ত ঘরটায় রক্তাক্ত দেহে তুমি পড়ে পড়ে কাত্রাচ্ছ, আশেপাশে দশ মাইলের মধ্যে এমন কোনো লোক নেই যে তোমাকে দেখতে আসবে। চাবকাতে চাবকাতে ও যদি তোমাকে মেরে ফেলে, কিংবা টুকরো টুকরো করে ছিঁড়ে ফেলার জন্যে ভয়ঙ্কর কুকুরগুলোকে লেলিয়ে দেয়, ঈশ্বর বা মানুষ, কেউই তোমাকে বাঁচাতে আসবে না, কেউ না। আর লোকটা যে কী হিংস্র, শুনলে তোমার গায়ের লোম খাড়া হয়ে উঠবে। আমি যতটুকু জানি বা দেখেছি, তার কিছুটাও যদি বলি, অনেকেই হয়তো ভয়ে ঠক্ ঠক্ করে কাঁপবে। তা সত্ত্বেও এই পাঁচটা বছর আমি ওর সঙ্গে বাস করে আসছি আর দিনরাত, প্রতিটা মুহূর্ত দাঁতে দাঁত চেপে সহ্য করছি। তার ওপর আবার বছর পনেরো বয়সের একটা মেয়েকে এনে জুটিয়েছে। এমিলিন আমাকে নিজে মুখে বলেছে, ও মানুষ হয়েছে একটা ভদ্র পরিবারে, বাড়ির কর্ত্রী ওকে নিজে হাতে লেখাপড়া শিখিয়েছেন। লুকিয়ে লুকিয়ে ও আবার সঙ্গে করে বাইবেলটাও নিয়ে এসেছে। কিন্তু আমি স্পষ্টই বুঝতে পারছি, ওই বাইবেলখানা নিয়েই ওকে সোজা নরকের পথে এগিয়ে যেতে হবে! ঈশ্বর ওকে কোনো সাহায্যই করবেন না।’

‘না মিসিস, না!’ বন্ধ চোখের পাতায় টম কেঁপে উঠল। ‘আমি মনেপ্রাণে বিশ্বাস করি, ও চাইলে ঈশ্বর ওকে নিশ্চয়ই সাহায্য করবেন। মিসিস, একদিন আমারও সব ছিল, বউ, ছেলে-মেয়ে, ঘর-বাড়ি, দয়ালু মনিব, আর কয়েকটা দিন উনি যদি বেঁচে থাকতেন, আমি মুক্তিও পেতাম। কিন্তু আজ সে-সব চিরকালের মতো হারিয়ে গেছে, তবু ঈশ্বরের প্রতি আমার এই শেষ বিশ্বাসটুকু কিছুতেই হারাতে পারব না!’

কিছুটা অবাক হয়েই কেসি টমের মুখের দিকে অপলক চোখে তাকিয়ে রইল।

‘আমি জানি মিসিস, সবকিছুতেই তুমি আমার অনেক ঊর্ধ্বে। তবু হতভাগ্য এই মানুষটার কাছ থেকে একটা কথা শুনে রাখ, একটু আগেই তুমি বলছিলে, ঈশ্বর আমাদের বিরুদ্ধে, উনি আমাদের কথা শুনতে পান না। যেহেতু আমরা গরিব, তাই আমাদের দিকে কেউ ফিরেও তাকায় না। কিন্তু ঈশ্বরের আপন সন্তানের ক্ষেত্রেই বা কী ঘটেছিল একবার ভেবে দেখো! উনি কি আমাদেরই মতো কনকনে ঠাণ্ডার মধ্যে নির্জন আস্তাবলে জন্মান নি? ওঁকে কি একটাই মাত্র ভেড়ার চামড়া পরে ঘুরে বেড়াতে হয় নি? উনি কি সারাটা জীবন গরিব ছিলেন না। ওঁ আমাদের ভুলতে পারেন না। আমরা যদি ওঁকে স্মরণ করি, উনি চিরকালই আমাদের পাশে থাকবেন। আমরা যদি সাহায্য চাই, উনি আমাদের নিশ্চয়ই সাহায্য করবেন। কিন্তু আমরা যদি ওঁকে অস্বীকার করি, উনি আমাদের এড়িয়ে চলবেন।’

‘কিন্তু উনি কেন আমাদের এমন একটা জায়গায় এনে ফেললেন যেখানে আমরা পাপ করতে বাধ্য হই?’ অভিযোগের সুরেই কেসি বলল।

একটু বিরতির পর শান্তস্বরে টম বলল, ‘আমার মনে হয় বাধ্য আমরা নাও হতে পারি।’

‘কিন্তু তুমি ওদের জানো না, টম চাচা, ওরা হয়তো আবার কালই আসবে এবং তখন তোমার কপালে কী ঘটবে ভাবতে আমি এখনই শিউরে উঠছি!’

‘ঈশ্বর আমাকে সাহায্য করবেন।’

‘যেভাবে হোক, ওরা তোমাকে বাধ্য করাবেই।’

‘না না, তা কখনই হতে পারে না! হে ঈশ্বর, তুমি আমাকে শক্তি দাও! যা অন্যায়, তা যেন আমাকে কখনো না করতে হয়!’

‘এর আগে বহুবার আমি অনেককে ও-রকম কাতর প্রার্থনা জানাতে শুনেছি টম চাচা; কিন্তু কোনো ফল হয় নি। একএক করে সবাইকে ওই শয়তানটার পায়ের তলায় লুটিয়ে পড়তে হয়েছে। এমিলিন প্রতিরোধ করার চেষ্টা করছে, তুমিও করছ। কিন্তু কী লাভ? বাধ্য না করানো পর্যন্ত ও ছাড়বে না, না পারলে খুন করতেও এতটুকু দ্বিধা করবে না।’

‘বেশ, তাহলে মরব। তারপরে তো ওরা আমার আর কিছু করতে পারবে না।’

‘টম চাচা, একদিন আমি তোমার মতোই ভাবতাম, তোমার মতোই ঈশ্বরে বিশ্বাস করতাম।’ টমের মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে কেসি বলে চলল, ‘জীবনে আমি বহুবার মরতে চেয়েছিলাম, কিন্তু আত্মহত্যা করার মতো সাহস আমার ছিল না।

‘আমাকে দেখে তুমি নিশ্চয়ই বুঝতে পারছ, ছোটবেলা থেকে শুধু স্বচ্ছলতা নয়, রীতিমতো প্রাচুর্যের মধ্যেই মানুষ হয়েছি। খুব বড় একটা বাড়িতে থাকতাম, পুতুলের মতো সবসময়ই সুন্দর সুন্দর সব পোশাক পরতাম। যারাই বেড়াতে আসত, সবাই আমার রূপ- গুণের প্রশংসা করত। বাড়ির সামনে বড় একটা বাগান ছিল, কমলাগাছের ছায়ায় আমি ভাইবোনদের সঙ্গে লুকোচুরি খেলতাম। একটু বড় হবার পর আমাকে কনভেন্টে ভর্তি করে দেওয়া হলো। সেখানে আমি ফরাসি ভাষা, গান, সেলাই আর নানারকমের হাতের কাজ শিখতাম। লেখাপড়ায় আমি ছিলাম সবার ওপরে।

‘আমার যখন চোদ্দ বছর বয়স, বাবা হঠাৎ মারা গেলেন। চার ঘণ্টা আগেও আমরা কিছু বুঝতে পারি নি। সেবার নিউ অর্লিয়েন্সে কলেরায় উনিই প্রথম মারা যান। আমার মা ছিলেন ক্রীতদাসী, বাবা আমাকে সবসময়ই মুক্তি দেবার কথা বলতেন। কিন্তু ব্যাপারটা এমন হঠাৎ ঘটে যাবে, আমরা কেউ কল্পনাও করতে পারি নি। অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া মিটে যাবার পরের দিনই আমার বাবার বিয়ে-করা স্ত্রী তাঁর ছেলে-মেয়েদের নিয়ে বাপের বাড়ি চলে গেলেন। বিপুল পরিমাণ দেনা শোধ করার জন্যে চাকর-বাকরদের সঙ্গে সমস্ত সম্পত্তিই বিক্রি করে দিতে হলো। জানি না কেন, ওরা শুধু আমাকেই বিক্রি করল না।

‘আদালত থেকে সম্পত্তিটা দেখাশোনা করার জন্যে একজন তরুণ উকিল প্রায়ই আমাদের বাড়িতে আসতেন, আমার সঙ্গে মিষ্টি হেসে কথা বলতেন। ওঁকে আমার মনে হতো এ পৃথিবীর সবচাইতে সুন্দর মানুষ। সেই সন্ধ্যেটার কথা কখনো ভুলব না, যেদিন আমরা দুজনে গল্প করতে করতে বাগানের মধ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছিলাম। বাবার মৃত্যুর পর থেকে সমস্ত ব্যাপারটাই এমন দ্রুত ঘটে গিয়েছিল যে সবকিছুতেই আমার কেমন যেন অবাক লাগত, আর নিজেকে ভীষণ নিঃসঙ্গ মনে হতো। উনিই আমাকে সেদিন সান্ত্বনা দিতে দিতে বললেন, আমাকে নাকি বহুবার কনভেন্টে যাওয়া-আসার পথে দেখেছেন এবং আমাকে ওঁর খুব ভালো লাগে। আমার বন্ধু ও অভিভাবক হতে পারলে উনি খুব খুশি হবেন। অথচ উনি যে আগেই দুহাজার ডলার দিয়ে আমাকে কিনে নিয়েছেন, সে কথা কখনো বলেন নি।

‘আমি স্বেচ্ছায় হেনরির কাছে চলে গেলাম, কেননা আমি ওকে সত্যিই ভালোবাসতাম। হেনরি এমন সুন্দর আর উদারমনা যে ভালো না বেসে আমার কোনো উপায় ছিল না! গাড়ি-বাড়ি-ঘোড়া, চাকর-বাকর, আসবাপত্র আর পোশাক থেকে শুরু করে অর্থ দিয়ে যা কিছু কেনা যায় ও আমাকে সবই দিয়েছিল। কিন্তু সত্যি বলতে কী শুধু ভালোবাসা ছাড়া ওর কাছ থেকে আমি কোনোদিনই কিছু চাই নি। ওকে আমি ঈশ্বরের চাইতে, আমার নিজের সত্তার চাইতেও বেশি ভালোবাসতাম। সম্ভবত আজো বাসি।

‘আমি শুধু ওর কাছে একটা জিনিসই চাইতাম, হেনরি আমাকে বিয়ে করুক। আমার সম্পর্কে ও সবসময়ই যে-সব কথা বলত তা যদি সত্যি হয়, আমার ধারণা ছিল ও খুশি হয়েই আমাকে বিয়ে করবে। কিন্তু সে সম্পর্কে কখনো কিছু বললেই ও বলত সেটা সম্ভব নয়। আমরা যদি পরস্পরের বিশ্বস্ত থাকি, ঈশ্বরের চোখে সেটাই বিয়ে। হেনরি যা বলত আমি তাই-ই বিশ্বাস করতাম। দিনরাত প্রতিটা মুহূর্ত আমি ওকে ছায়ার মতো অনুসরণ করতাম। অসুস্থ হয়ে পড়লে রাত জেগে সেবা করতাম। সাত সাতটা বছর বিশ্বস্ততার কোথাও কোনো ত্রুটি ছিল না।

আমাদের ফুটফুটে দুটি সন্তান হয়েছিল। প্রথমটা ছেলে। ওর চোখ মুখ কপাল চুল সবই ছিল ঠিক হেনরির মতো; যেমন সুন্দর দেখতে, তেমনি মিষ্টি স্বভাব। আর পরেরটা মেয়ে। ও দেখতে ছিল ঠিক আমার মতো। ছেলের চেয়ে হেনরি মেয়েটাকেই বেশি ভালোবাসত, আদর করে ডাকত কখনো এলিজা কখনোবা এলিস বলে।’

অসহ্য যন্ত্রণার মধ্যেও টম মনে মনে চমকে না উঠে পারল না। এতক্ষণ হাতড়ে বেড়ানো মুখটাকে মনে হলো এবার সে যেন চিনতে পেরেছে। তবু মুখে কিছু না বলে সে নির্নিমেষ চোখে কেসির দিকে তাকিয়ে রইল।

‘ছেলে-মেয়ে দুটো আর আমাকে নিয়ে হেনরির গর্বের অন্ত ছিল না। ও বলত আমি নাকি লুসিয়ানার সব চাইতে রূপসী মহিলা। খোলা গাড়িতে চড়ে আমরা যখন শহরের মধ্যে দিয়ে ঘুরে বেড়াতাম, সবাই অবাক হয়ে আমাদের দিকে তাকাত। একজন মানুষের পক্ষে যতটা সুখী হওয়া সম্ভব, আমি ছিলাম ঠিক ততটাই সুখী। কিন্তু সে সুখ আমার কপালে বেশি দিন সইল না। কোত্থেকে মূর্তিমান দুর্ভাগ্যের মতো এসে হাজির হলো হেনরির চাচাতো ভাই। ওর কাছেই শুনলাম দেনা মেটানোর জন্যে হেনরি আমাদের তিন জনকেই বিক্রি করে দিয়েছে। প্রথমটায় আমি আদৌ বিশ্বাস করি নি। কিন্তু হেনরির নিজে হাতে সই করা কাগজটা দেখার পর আমি অজ্ঞান হয়ে গেলাম। তাতে কোনো লাভ হলো না, লোকটা আমাদের নিয়ে যাবার জন্যে অপেক্ষা করছিল। তখনই বুঝতে পারলাম সমস্ত ব্যাপারটাই পূর্ব পরিকল্পিত। কিছুদিন আগে শ্বেতাঙ্গ একটি মেয়ের সঙ্গে হেনরির আলাপ হয়েছিল, তাকে বিয়ে করার জন্যেই ও আমাদের বিক্রি করে দিল।

‘সেই ঘটনার পর থেকে আমি কোনোদিনের জন্যে একা ফোঁটাও চোখের জল ফেলি নি। লোকটাকে দেখলেই আমার গা ঘিনঘিন করত, তবু ওর ইচ্ছের বিরুদ্ধে আমি কিছুই করতে পারতাম না। ও আমাকে সবসময়ই ভয় দেখাত ওর কথা না শুনলে আমার ছেলে- মেয়ে দুটোকে অনেক দূরে কোথাও বিক্রি করে দেবে। হাত-পা বাঁধা একা পশুর মতো আমাকে ও সারাক্ষণই হুকুম করত, সবসময়ই ছেলেমেয়েদের ত্রুটি খুঁজে বার করার চেষ্টা করত। আমি ওদের আগলে রাখার আপ্রাণ চেষ্টা করতাম, কিন্তু শেষরক্ষা করতে পারলাম না। আমার অজান্তেই লোকটা ছেলে-মেয়ে দুটোকে বিক্রি করে দিল। যখন জানতে পারলাম, আহত বাঘিনীর মতো আমি ঝাঁপিয়ে পড়লাম। চাবুক মেরেও লোকটা আমাকে শায়েস্তা করতে পারল না। যখন দেখল আমাকে কোনোমতেই বাগে আনা সম্ভব নয়, তখন স্টুয়ার্ট নামে একজন ভদ্রলোকের কাছে আমাকে বিক্রি করে দিল।

‘কেন জানি না, ক্যাপ্টেন স্টুয়ার্ট আমাকে কিছুটা সহানুভূতির চোখেই দেখতেন। এমন কী খুঁজে পেলে আমার ছেলে-মেয়ে দুটোকে কিনে নেওয়ারও প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। হেনরির ভাই যেখানে আমার ছেলেটাকে বিক্রি করেছিল, সেই হোটেলে খবর নিয়ে জানা গেল পার্ল নদীর ওপারে একজন আবাদকারীর কাছে ওকে বিক্রি করে দেওয়া হয়েছে। সেই ওদের শেষ খবর আমি পেয়েছিলাম। এলিজার খবর ক্যাপ্টেন স্টুয়ার্ট পেয়েছিলেন। কেন্টাকির একটা ভদ্র পরিবারে ওকে বিক্রি করা হয়েছিল। কিন্তু বাড়ির কর্ত্রী অজস্র অর্থের বিনিময়েও এলিজাকে বিক্রি করতে রাজি হন নি। তারপর থেকে আমি এলিজারও আর কোনো খবর পাই নি।

‘তুমি জানো না টম চাচা, তুমি কল্পনাও করতে পারবে না, ক্যাপ্টেন স্টুয়ার্ট কেনার আগে আমার আর একটা সন্তান হয়েছিল। জন্মের কয়েকদিন পরেই আমি নিজের হাতে তাকে নদীর জলে ভাসিয়ে দিয়েছি! আমি চাই নি আর কোনো সন্তান হারানোর ব্যথা সহ্য করতে। যন্ত্রণা ছাড়া তাকে আমি আর কী দিতে পারতাম, তুমি বলো?

‘ক্যাপ্টেন স্টুয়ার্ট সত্যিই আমার সঙ্গে খুব ভালো ব্যবহার করতেন, ওঁর রুচিও ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন। এই যে বাড়ি, আবাদ সবকিছুই উনি নিজের হাতে গড়ে তুলেছিলেন, সবকিছুই তখন ছিল ছবির মতো সুন্দর সাজানো, কিন্তু হঠাৎ এখানেও একবার মড়ক দেখা দিল। যারা বাঁচতে চেয়েছিল, সবাই মরল। আর যার আদৌ বাঁচার কোনো প্রয়োজন ছিল না, সেই আমিই বেঁচে রইলাম! তারপর এই শয়তানটা ক্যাপ্টেন স্টুয়ার্টের যেখানে যা কিছু ছিল সব জলের দামে কিনে নিল। সেই থেকে আজো আমি ওর হাতের পুতুল হয়ে রয়েছি।’

কখনো টমকে উদ্দেশ্য করে, কখনোবা স্বগোক্তির ভঙ্গিতে কেসি এমন তীব্র ক্ষোভ, বেদনা আর গভীর আন্তরিকতার সঙ্গে ওর জীবনকাহিনী শুনিয়ে গেল যে টম নিজেই নিজেকে অপরাধী না ভেবে পারল না। ছড়িয়েপড়া ঘনকালো চুলের মাঝে কেসির সুন্দর করুণ মুখখানার দিকে তাকিয়ে টম নতুন এক ধরনের যন্ত্রণা অনুভব করল। কেননা কেসির কোমল হাতের স্পর্শে নির্মম আঘাতের যন্ত্রণা সে তখন প্রায় ভুলেই গিয়েছিল, তার পরিবর্তে বুকের ভেতর উদ্বেল হয়ে উঠেছিল সন্তানহারা মায়ের এক করুণ হাহাকার। বেদনাকাতর শুকনো চোখের কোল বেয়ে তখন গড়িয়ে এসেছিল দুফোঁটা অশ্রু, এলিজার মা কেসিকে টম কী বলে সান্ত্বনা দেবে সে নিজেই বুঝতে পারছিল না।

‘এরপরেও কি তুমি বলবে, টম চাচা, ঈশ্বর, আছেন?’

‘হ্যাঁ কেসি, আমি বিশ্বাস করি উনি আছেন।’

‘বেশ, যদি ধরেই নেই উনি আছেন, তাহলে তুমি কি আমাকে বিশ্বাস করতে বলবে, ওপর থেকে সবকিছু তাকিয়ে দেখেও উনি এত অন্যায়, অবিচার মুখ বুজে সহ্য করলেন? ওদেরকে একটু শাস্তিও দিলেন না?’

‘শেষ বিচারের দিন উনি প্রতিটা অপরাধীকেই শাস্তি দেবেন, কেসি।’

‘আমি বিশ্বাস করি না!’ রাগে কেসি যেন ফুঁসে উঠল। ‘ওরা এমনই হীন আর নিষ্ঠুর যে আমাদের দিকে ফিরেও তাকায় না। আমাদের দুঃখ-কষ্ট, ছেলেমেয়েদের যন্ত্রণার কথা ওরা ভুলেও ভাবে না। যেন এসব কোনো ব্যাপারই নয়, অতি তুচ্ছ। যেন আমাদের ওপর অত্যাচার করাটা ওদের জন্মগত অধিকার।

শয্যার পাশ থেকে উঠে জিনিসপত্র গোছগাছ করতে করতেই কেসি বলল, ‘তুমি জানো না টম চাচা, ছোটবেলায় আমি ধর্মে বিশ্বাস করতাম, ঈশ্বরকে ভালোবাসতাম, প্রতিদিন প্রার্থনা করতাম। কিন্তু দিনরাত নির্যাতন করে করে ওই শয়তানগুলোই আমার হৃদয়কে একেবারে পাষাণ করে দিয়েছে। মাঝে মাঝে আমার কী মনে হয় জানো, টম চাচা’, লণ্ঠনের স্বল্প আলোতেও টম কেসির চোখ দুটোকে জ্বলে উঠতে দেখল। ‘রাতের অন্ধকারে দুহাতে গলা টিপে লেগ্রিটাকে খুন করে ফেলি! ওরা যদি আমাকে জীবন্ত পুড়িয়ে মারে, আমি তাতে ভয় পাই না। আর সত্যিই যদি কখনো শেষ বিচারের দিন আসে, ঈশ্বর আমাকে শাস্তি দিতে চান, আমি একা কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে তাদের বিরুদ্ধে সাক্ষী দেব, যারা আমার দেহ-মন, ছেলেমেয়েদের ধ্বংসের পথে ঠেলে দিয়েছে!’

টমের বুকের মধ্যে কেমন যেন একটা অসহ্য যন্ত্রণা হচ্ছে, কথা বলতেও কষ্ট হচ্ছে, তবু কাতর চোখে তাকিয়ে সে কোনোরকমে বলল, ‘ঈশ্বর তোমাকে কখনো শাস্তি দেবেন না, দিতে পারেন না। শুধু তুমি যদি ওঁর কাছে একটিবার ক্ষমা চাও, উনি তোমাকে একেবারে বুকের মধ্যে টেনে নেবেন।’

বলতে গিয়ে হাঁপাচ্ছে দেখে কেসি তাড়াতাড়ি শয্যার পাশে হাঁটু মুড়ে বসে টমের কপালে হাত বোলাতে বোলাতে মিষ্টি গলায় বলল, ‘তুমি আর একটাও কথা বলবে না, তোমার এত কষ্ট হবে আমি ঠিক বুঝতে পারি নি, টম চাচা। তোমার জন্যে আমি তো আর কিছুই করতে পারলাম না, এই জলটুকু সব খেয়ে ফেলো।’

টম নিঃশব্দে হাঁ করল। সেই মুহূর্তে শান্ত স্থির, মমতাস্নিগ্ধ মুখটার দিকে তাকিয়ে টম কেসিকে চিনতে পারল না, মনে হলো ইভাই যেন তার পাশে সে তার দিকে তাকিয়ে রয়েছে।

হাত দিয়ে শয্যাটা ঠিক করে ছোটখাটো দু-একটা জিনিস গুছিয়ে কেসি লণ্ঠনটা তুলে নিল। ঘর ছেড়ে বেরিয়ে যাবার আগে বলল, ‘বিদায়, টম চাচা। এখন তুমি একটু ঘুমানোর চেষ্টা করো।’

২৯. সাইমন লেগ্রি

লেগ্রির বৈঠকখানাটা বেশ বড়। একসময় খুব সুন্দর সাজানো ছিল, কিন্তু এখন ওটার জীর্ণ দশা স্পষ্টই চোখে পড়ে। মাঝে মাঝে পলেস্তরা খসে গেছে, বিবর্ণ হয়ে গেছে দেওয়ালের সাঁটা কাগজের রঙ। এখানে ওখানে ছড়ানো রয়েছে জিন, ঘোড়ায় চড়ার উঁচু বুট, চাবুক, ওভারকোট, ইত্যাদি। ছেঁড়া কাপড় আর হাবিজাবি জিনিসের মধ্যে কুকুরগুলো তাদের শোবার জায়গা করে নিয়েছে। ঘরটা অসম্ভব স্যাঁতসেঁতে বলে দিনের বেলাতেও কাঠকয়লার উনুন জ্বালানো হয়।

সাইমন লেগ্রি পুরনো একটা কাঠের চেয়ারে বসে অন্য একটা কুর্সিতে বুটসহ পা তুলে দিয়ে চুরুট টানছে আর চোখ বুঝে কী যেন ভাবছে। কেসি তার পাশে মুখ ভার করে দাঁড়িয়ে রয়েছে।

একদিকে লেগ্রি যেমন কেসির ওপর অমানুষিক অত্যাচার করত, অন্য দিকে তেমনি আবার মনে মনে অসম্ভব ভয়ও করত। এ বাড়িতে একমাত্র কেসিই পারত বন্য গোঁয়াড় মানুষটাকে বশ করতে। তা সত্ত্বেও কেসি পারতপক্ষে লেগ্রির কাছে কখনো কিছু চাইত না। টমের জন্যে বাধ্য হয়েই আজ ওকে আসতে হয়েছে।

‘না, কেসি’, লেগ্রি বলল, ‘তোমার আচরণ দিনদিন শোভনতার সীমা অতিক্রম করে যাচ্ছে।

‘আর তোমার আচরণটা খুব শোভন, তাই না? তুমি টম বলে ওই লোকটার সঙ্গে কী রকম ব্যবহার করলে, একবার ভেবে দেখেছ? ওই লোকটা কি তোমার সব চাইতে ভালো কর্মী ছিল না? বিশেষ করে, এখন এই তুলা তোলার সময়ে বারোশো ডলার দিয়ে ওকে কিনে তোমার কী লাভটা হলো শুনি?’

‘হ্যাঁ, সেটা অবশ্য ঠিক। কিন্তু কেউ যখন নিজের গোঁ বজায় রাখার চেষ্টা করে তখন সেটা অবশ্যই ভেঙে দেওয়া দরকার।’

কেসি বাঁকা চোখে লেগ্রির মুখের দিকে তাকাল। ‘তুমি কি সত্যিই ওর গোঁ ভাঙতে পারবে বলে মনে হয়?’

‘পারব না?’ লেগ্রি চোখ পাকিয়ে বলল, ‘কেন পারবে না শুনি? তাহলে বলব ও-ই প্রথম নিগ্রো, যে আমাকে চেনে না! ওর প্রতিটা হাড় আমি গুঁড়িয়ে ছাড়ব, দেখি কালো কুকুরটা সায়েস্তা হয় কিনা।’

‘তাতে কিন্তু ক্ষতিটা শুধু তোমারই হবে সাইমন।

‘হোক, তবু আমি দেখতে চাই ও নত হয় কি না।’

এমন সময় সাম্বো ভেতরে ঢুকে লেগ্রিকে অভিবাদন করল, তারপর এগিয়ে এসে কাগজে মোড়া কী যেন একটা সন্তর্পণে বাড়িয়ে দিল তার দিকে।

‘কী রে, এতে কী আছে?’

‘একটা কবচ, হুজুর।’

‘কী বললি?’

‘কবচ, স্যার। নিশ্চয় কোনো ডাইনির কাছ থেকে নেওয়া, যাতে চাবুক মারলেও গায়ে না লাগে। এটা ওই নিগারটার গলায় কালো সুতো দিয়ে বাঁধা ছিল।’

অধিকাংশ নিষ্ঠুর মানুষের মতো সাইমন লেগ্রির মনও ছিল নানান কুসংস্কারে ভরা। কাগজের মোড়কটা খুলতেই তার চোখে পড়ল চকচকে একটা রুপোর ডলার আর উজ্জ্বল একগাছা সোনালি চুল। লেগ্রি চুলের গোছাটা তোলার চেষ্টা করতেই সেটা সজীব একটা পদার্থের মতো আঙুলে জড়িয়ে গেল। ডলারটা ছিটকে পড়ল মাটিতে।

‘এই কুকুর, এটা কোথায় পেয়েছিস? নিয়ে যা শিগগির! পুরিয়ে ফেল!’ আতঙ্কে মাটিতে পা ঠুকে পাগলের মতো চিৎকার করতে করতে লেগ্রি আঙুল থেকে চুলটাকে ছাড়াবার চেষ্টা করল, তারপর কোনোরকমে ওটাকে ছিঁড়ে আগুনের মধ্যে ফেলে দিল। ‘কেন এটা তুই নিয়ে এসেছিস আমার কাছে?’

সাম্বো তখন বিস্ময়ে একেবারে স্তম্ভিত হয়ে গিয়েছিল। কথা বলবে কী, হাঁ করে সে তাকিয়ে রইল মনিবের মুখের দিকে।

লেগ্রি ঘুঁসি পাকিয়ে তেড়ে গেল তার দিকে, সাম্বো সভয়ে দুপা পিছিয়ে গেল।

‘খবর্দার বলছি, আর কক্ষনো এসব জিনিস নিয়ে আসবি না আমার কাছে! যা, বেরিয়ে যা এখান থেকে।’

মাটি থেকে ডলারটা কুড়িয়ে নিয়ে সে জানলার দিকে ছুড়ে দিল। ডলারটা সার্সি ভেঙে গিয়ে পড়ল বাইরের অন্ধকারে।

সাম্বো পালিয়ে আসতে পেরে যেন বাঁচল।

লেগ্রি আবার তার চেয়ারে ফিরে এল। চুপচাপ বসে এমনভাবে সে আঙুলটার দিকে তাকিয়ে রইল যেন ওটা ঝলসে গেছে।

কিন্তু ইভার সোনালি একগাছা চুল দেখে লেগ্রি এত বিচলিত হয়ে উঠল কেন? এর জবাব পেতে গেলে আমাদের ফিরে যেতে হবে তার অতীত জীবনে।

ছেলেবেলা থেকেই সাইমন লেগ্রি ছিল লম্পট আর উচ্ছৃঙ্খল প্রকৃতির। একমাত্র ছেলের চরিত্র শোধরানোর জন্যে তার মা বহু চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু কোনো ফল হয় নি। স্বভাব আর চরিত্রে লেগ্রি ছিল ঠিক তার বাবার মতো, যেমন উগ্র, তেমনি গোঁয়াড়। মাতাল অবস্থায় রেগে গেলে তার কখনো জ্ঞান থাকত না। কখনো বাড়িতে থাকত, কখনো থাকত না, কখনো বা আবার বেশ কিছু দিনের জন্যে কোনো পাত্তা নেই। সমুদ্রের ওপর লেগ্রির টান ছিল বরাবরের। তার মা ঈশ্বরের কাছে কাতর প্রার্থনা জানাতেন ছেলেকে ফিরিয়ে দেওয়ার জন্যে। একবার তিনি ফিরিয়েও দিয়েছিলেন। দীর্ঘ কয়েক বছর অনুপস্থিতির পর একবার লেগ্রি যখন ফিরে এল, তখন সে সম্পূর্ণ মাতাল। মা তাকে বুকের মধ্যে জড়িয়ে ধরে অনেক অনুরোধ করলেন, হাত ধরে মিনতি জানালেন, কিন্তু কোনো ফল হলো না। বরং সে আরো উগ্র হয়ে উঠল, মাকে অশ্রাব্য ভাষায় গালাগালি দিল। মা তখন তার কাছে নতজানু হয়ে জাহাজে ফিরে না যাবার জন্যে কাকুতি মিনতি করলেন। এতে লেগ্রি অসম্ভব ক্রুদ্ধ হয়ে উঠল এবং মাকে দুপায়ে মাড়িয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।

এর কিছু কাল পরে লেগ্রি যখন তার মাতাল নাবিক বন্ধুদের সঙ্গে আনন্দে একেবারে মত্ত হয়ে রয়েছে, হঠাৎ সে একটা চিঠি পেল। চিঠিটা খুলতেই দীর্ঘ একগাছা সোনালি চুল তার আঙুলে জড়িয়ে গেল। চিঠিতে লেখা ছিল মার মৃত্যু হয়েছে এবং মৃত্যুর সময় তিনি ছেলেকে ক্ষমা করে গেছেন।

আজ আবার ঠিক সে-রকম একগাছা চুল আঙুলে জড়িয়ে যেতেই তার মার কথা মনে পড়ে গেল এবং তিনি যদি তাকে ক্ষমাই করে গিয়ে থাকেন, তাহলে এতদিন পর চুলটা আবার এল কোথা থেকে? স্বভাবতই তার কুসংস্কারাচ্ছন্ন মন অজানা একটা আতঙ্কে বিহবল হয়ে পড়েছিল।

আঙুলটার দিকে তাকিয়ে লেগ্রি গুম হয়ে চুপচাপ বসে রইল আর অতীত দিনগুলোর কথা ভাবতে লাগল।

.

ঘরের এক কোণে এমিলিন ভয়ে জড়সেড়া হয়ে বসেছিল, দরজা খোলার শব্দেই সে চমকে উঠল। পরক্ষণেই কেসিকে দেখে দৌড়ে এসে ওকে আঁকড়ে ধরল। ‘ও কেসি, তুমি এসে গেছ! খুব ভালো হয়েছে। সারাক্ষণ একা একা আমার ভীষণ ভয় করছিল, ছাদের ওপর থেকে কী রকম একটা বিশ্রী আওয়াজ আসছিল!’

কথাটা গায়ে না মেখে কেসি হালকাভাবেই জবাব দিল, ‘ও কিছু নয়। ওরকম আওয়াজ আমি প্রায়ই শুনতে পাই।’

‘আচ্ছা কেসি, এখান থেকে অন্য কোথাও পালানো যায় না?’

‘কবর ছাড়া আমাদের আর পালানোর কোনো জায়গা নেই।’

‘তুমি কখনো চেষ্টা করে দেখেছ?’

‘অনেককেই চেষ্টা করতে দেখেছি, কিন্তু কোনো ফল হয় নি।’

‘আমার তো মনে হয়, এখানে বাস করার চাইতে জলা অনেক ভালে।’ জলায় কেউ বাস করতে পারে না। কুকুরগুলো তোমাকে ঠিক খুঁজে বার করবে। তারপর ও তোমাকে ….’

উদ্‌গ্রীব হয়ে এমিলিন কেসির মুখের দিকে তাকাল।

‘ও আমার কী করবে, কেসি?’

‘কী করবে না বরং সেটাই জিজ্ঞেস করো। পশ্চিম ভারতীয় দ্বীপপুঞ্জের জলদস্যুদের চাইতেও ও ভয়ঙ্কর। আমি যা দেখেছি তার কিছুও যদি তোমাকে বলি, রাতের পর রাত তুমি ঘুমোতে পারবে না। আমি এখানে সে অমানুষিক চিৎকার আর বুকফাটা আর্তনাদ শুনেছি, তুমি শুনলে পাগল হয়ে যেতে। জমিতে যাবার পথে আগুনে পুড়ে ঝলসে যাওয়া কয়েকটা গাছ এখনো তার সাক্ষী হয়ে আছে।’

চোখ বুজে দৃশ্যটা ভাবতেই এমিলিন শিউরে উঠল।

‘উঃ কী ভয়ঙ্কর! তাহলে এখন আমি কী করব, কেসি?’

‘খুব সহজ, যা আমি করেছি।’

‘তুমি জানো না কেসি, ও খুব খারাপ।’

‘আমার চাইতে ভালো ওকে আর কেউ জানে না, এমিলিন।’

‘আমার মা বলতেন …’

‘চুপ!’ কেসি ধমকে উঠল। ‘আমি কোনো মার কথা শুনতে চাই না। কোনো মা এখানে তার মেয়েকে বাঁচাতে আসবে না।’

‘কেসি, তুমি আমার ওপর রাগ কোরো না।’

‘রাগ আমি তোমার ওপর করি নি, এমিলিন। রাগ হচ্ছে আমার নিজেরই ওপরে।’

‘উঃ ঈশ্বর, এখন মনে হচ্ছে আমি না জন্মালেই বোধহয় ভালো হতো।’

‘শুধু তুমি নয় এমিলিন, আমাদের সবারই না জন্মালে ভালো হতো।’

‘আচ্ছা কেসি, আত্মহত্যা করাটা কি পাপ?’

দুহাতে কান চেপে কেসি আর্তস্বরে বলে উঠল, ‘জানি না, আমি জানি না, আমি কিচ্ছু জানি না! আমার মনে হয়, যেভাবে আমরা বেঁচে আছি, তার চাইতে বেশি পাপ আর কিছু হতে পারে না।’

দুহাতে মুখ ঢেকে এমিলিন ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগল।

তখনো ভালো করে ভোর হয় নি। আকাশে জ্বলজ্বল করছে শুকতারা। জানলা দিয়ে টম নিষ্পলক চোখে সেদিকে তাকিয়ে ছিল, এমন সময় বাইরে ভারী বুটের আওয়াজ শোনা গেল।

একটু পরেই ঘরে ঢুকে লেগ্রি ঘৃণা ভরে টমকে লাথি মেরে বলল, ‘কিরে, এখন কেমন লাগছে? তোকে বলেছিলাম না দু-একটা শিক্ষা দেব, এবার তোর সাধ মিটেছে তো? না কি আবার বড় বড় জ্ঞান দিতে আসবি?’

টম কোনো জবাব দিল না।

লেগ্রি আবার তাকে একটা লাথি কষিয়ে বলল, ‘এই কুকুর, উঠে দাঁড়া।’

যন্ত্রণায় বিবশ, ক্ষতবিক্ষত দেহ নিয়ে টমের পক্ষে উঠে দাঁড়ানো আদৌ সম্ভব ছিল না তবু সে চেষ্টা করল।

তার কষ্ট দেখে লেগ্রি বর্বরের মতো হেসে উঠল।

‘কি রে, উঠতে পারছিস না কেন? রাতে ঠাণ্ডায় জমে গেছিস বলে মনে হচ্ছে?’

টম ততক্ষণে শক্তি সঞ্চয় করে উঠে মনিবের সামনে একেবারে সোজা হয়ে দাঁড়াল। এখন আর তার পা কাঁপছে না।

‘বাঃ, এই তো উঠে দাঁড়িয়েছিস!’ টমের সর্বাঙ্গে একবার দৃষ্টি বুলিয়ে নিয়ে লেগ্রি খুশির সুরে বলল। ‘আশা করি তোর উপযুক্ত শাস্তি এখনো হয় নি। ঠিক আছে, এবার আমার পায়ের কাছে হাঁটু মুড়ে বসে গতকালের অন্যায়ের জন্যে ক্ষমা চা।’

টম একটুও নড়ল না।

লেগ্রি চাবুক কষিয়ে বলল, ‘এই কুকুর বস।’

‘স্যার, ক্ষমা চাইতে আমি পারি না। যা ন্যায় বলে মনে হয়েছে, আমি তাই করেছি। সুযোগ এলে ভবিষ্যতেও তাই করব। যাই ঘটুক না কেন কোনো অন্যায় কাজ আমি কখনো করতে পারব না।’

‘কিন্তু এর ফল কী দাঁড়াবে তুই কল্পনাও করতে পারছিস না। তুই কি ভাবছিস এই শাস্তিই যথেষ্ট? আমি তোকে বলছি, এসব কিছুই নয়। কিন্তু ধর আমি যদি তোকে গাছের গায়ে বেঁধে, তার চারপাশে আগুন ধরিয়ে দিই, আশা করি নিশ্চয়ই সেটা তোর ভালো লাগবে না।

টম কোনো জবাব দিল না।

‘কি রে, এখন একবারে চুপ মেরে গেলি কেন?’

‘আমি জানি স্যার, আপনি ওর চাইতেও ভয়ঙ্কর অনেক কিছু করতে পারেন। কিন্তু, আপনি শুধু আমার দেহটাকেই খুন করতে পারেন, তার বেশি কিছু নয়। তারপর আমি মিশে যাব সেই অনন্তের সঙ্গে।’

‘অনন্ত’ শব্দটা উচ্চারণ করার সঙ্গে সঙ্গে কৃষ্ণাঙ্গ মানুষের বুকের ভেতরটা যেন আলোড়িত হয়ে উঠল আর পাপী মানুষের বুকটাকে এমনভাবে কাঁপিয়ে দিল, যেন কাঁকড়া বিছে ওকে হুল ফুটিয়ে দিয়েছে। দাঁতে দাঁত চেপে লেগ্রি কোনোরকমে রাগ সামলে রাখল আর টম, দাসত্ব থেকে মুক্তি পাওয়া নির্ভিক কোনো মানুষের মতো, অত্যন্ত সহজভাবেই বলে চলল, ‘স্যার, আপনি আমাকে কিনেছেন, আমি চিরটাকাল আপনার বিশ্বস্তই থাকতে চাই। হাতের কাজ আমাকে যা দেবেন, সবই করব। সারাক্ষণ, সমস্ত শক্তি দিয়েই করব। কিন্তু আমার হৃদয়, আমার সত্তা এ পৃথিবীর কোনো মানুষের কাছে দিতে পারব না। ওটা আমি তুলে রেখিছি ঈশ্বরের জন্যে, উনি যখনই চাইবেন আমি যেন উৎসর্গ করতে পারি। মরি বাঁচি, তাতে আমার কিছুই এসে যায় না। আপনি আমাকে চাবুক মারতে পারেন, খেতে না দিতে পারেন, জীবন্ত পুড়িয়েও মারতে পারেন, কিন্তু আমি কোনো কিছুতে ভয় পাই না। আপনি আমাকে যত তাড়াতাড়ি মারতে পারবেন, আমি তত তাড়াতাড়িই সেখানে পৌঁছতে পারব, যেখানে আমি পৌঁছতে চাই।’

প্রচণ্ড রাগে কাঁপতে কাঁপতে লেগ্রি বলল, ‘আমি তোকে বশ মানাবই। আপনি কোনোদিনই তা পারবেন না। ঈশ্বর আমাকে সাহায্য করবেন।’

‘তোর সাহায্য পাওয়া আমি বার করে দিচ্ছি! হাঁটু মুড়ে বস।’

এক ঘুসিতে লেগ্রি টমকে মাটিতে ফেলে দিল।

ঠিক সেই সময়ে লেগ্রি কাঁধে কোমল একটা হাতের স্পর্শ পেল। চমকে ঘুরে তাকিয়েই দেখল, কেসি।

ফরাসিতে কেসি বলল, ‘তুমি কি পাগল হয়েছে? মাঠে এখন তুলা তোলার সময়, আর তুমি ওকে এভাবে আধমরা করে ফেলে রাখতে চাও?’

কথাটা যুক্তিসঙ্গত ভেবে লেগ্রি নিরস্ত হলো। তবু কেসির দিকে ফিরে বলল, ‘তুমি ছিলে বলে ও আজ বেঁচে গেল, নইলে ওকে আজ আমি মেরেই ফেলতাম।’ টমকে বলল, ‘এখন কাজের খুব চাপ এবং সবাইকে আমার দরকার, তাই এবারের মতো তুই বেঁচে গেলি। কিন্তু কথাটা আমার মনে থাকবে, তখন দেখব তুই আমার কথা মেনে চলিস কি না।’

রাগে গজরাতে গজরাতে লেগ্রি ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।

কেসি টমের দিকে ফিরে বলল, ‘তখন তোমাকে বলি নি, টম চাচা, ও আবার ফিরে আসবে! এখন কেমন আছ?’

টম ম্লান ঠোঁটে হাসল। ‘ঈশ্বর তাঁর দেবদূতকে পাঠিয়েছিলেন বলেই সিংহের হাঁ-মুখটা বন্ধ হলো।

‘হ্যাঁ, সেটা শুধু এবারের জন্যে। কিন্তু তুমি অত সহজে ওর হাত থেকে নিষ্কৃতি পাবে না, টম চাচা। দিনরাত ও তোমাকে ছায়ার মতো অনুসরণ করবে, শিকারি কুকুরের মতো তোমার চুঁটি কামড়ে ধরে জীবনের শেষ রক্তবিন্দু পর্যন্ত শুষে নিয়ে তবে তোমাকে ছাড়বে। আমি ওকে খুব ভালো করেই চিনি।’

‘কিন্তু তুমি জানো না, কেসি; ঈশ্বর আমাকে সত্যিই সাহায্য করবেন।’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *