০১. মনুষ্যত্ববোধ আছে এমন একজন মানুষ

আঙ্কল টমস কেবিন – হ্যারিয়েট বিচার স্টো
অনুবাদক ॥ অসিত সরকার

১. মনুষ্যত্ববোধ আছে এমন একজন মানুষ

ফেব্রুয়ারি মাস। কনকনে শীতের বিকেল। মার্কিন দেশের কেন্টাকি রাজ্যের এক শহরে একটি বড় বাড়ি। সুন্দর সাজানো-গোছানো। একটি নিরিবিলি বৈঠকখানা। এইমাত্র খাওয়া শেষ করে মুখোমুখি বসে দুজন লোক জরুরি আলাপ করছেন। তাদের আলোচনা এতোই জরুরি আর গোপনীয় যে আশেপাশে কোনো ভৃত্যকেও থাকতে দেয়া হয় নি।

দুজনের মধ্যে একজনের মেজাজ খুব কড়া। বেঁটেখাটো হৃষ্টপুষ্ট চেহারা তার। বিশেষ করে তুলে ধরার মতো আর কোনো বৈশিষ্ট্য নেই লোকটার চেহারায়। কিন্তু হাবভাব দেখলে বোঝা যায়, বহু মানুষের মাঝখান থেকে তার নিজের পথ নিজেই তৈরি করে নিয়েছেন। তার পরনে বেশ দামি পোশাক। গায়ে বিচিত্র রঙের ঝলমলে জামা। গলায় নীল রঙের রেশমি রুমাল। তাতে হলদে ফুটকি আঁকা। লোমভরা দুটি হাতে কয়েকটা আংটি। পকেটঘড়ির সোনার বেল্টটা বেশ ভারি। চকচক করছে আলো। তাকে দেখেই মনে হয়, নিজেকে একজন ভদ্রলোক হিসেবে প্রমাণ করার জন্যে প্রাণপণ চেষ্টা করছে সে।

এ-বাড়ির মালিকের নাম মিস্টার শেলবি। অবশ্য তাঁকে দেখলে বোঝা যায় যে, তিনি আসলেই একজন ভদ্রলোক। পরিপাটি সাজানো ঘরদোর। ঘরের পরিবেশ থেকে গৃহকর্তার রুচি আর স্বচ্ছল অবস্থার কথাও অনুমান করতে কষ্ট হয় না। দুজনে এখনো গভীরভাবে জরুরি আলাপে মগ্ন।

মিস্টার শেলবি বললেন, ‘কাজটা ওভাবেই আমাকে করে দিতে হবে হ্যালি।’ সুরার গ্লাসটা আলোর সামনে নিয়ে হ্যালি বলল, ‘এভাবে এ-ব্যবসা করা সম্ভব নয়, মিস্টার শেলবি … কোনো অবস্থাতেই সম্ভব নয়।’

‘আসল কথা কী জানো হ্যালি, টম মোটেই আর দশটা ক্রীতদাসের মতো নয়। শুধু টাকা-পয়সার হিসেবে দাম ধরা যায় না ওর। টম যেমন কাজের, তেমনি সৎ। আমার খামারের কথাতো জানোই। টম সব কাজই ঘড়ির কাঁটার সঙ্গে মিলিয়ে করে রাখে।’

‘তাহলে আপনি বলছেন, টম খুব সৎ। মানে নিগ্রোরা যতটা সৎ হতে পারে ততটাই?’

‘ওভাবে বলবেন না, টম আসলেই খুব সৎ। চার বছর আগে টম একটা ধর্মীয় উৎসবে গিয়েছিল। তখন থেকেই ও মনেপ্রাণে খ্রিস্টান। ওকে বিশ্বাস করতে পারি বলে ওর হাতে টাকা-পয়সা, ঘরবাড়ি, জমিজমা, খামার, ঘোড়া, আমার সবই তো ছেড়ে দিয়ে নিশ্চিন্তে থাকতে পারি। কাজের দরকারে টম যখন যেখানে খুশি আসা-যাওয়া করে। আমাকে কখনো ঠকায় নি। ওর মতো সৎ আর বিশ্বাসী ক্রীতদাস আর কখনো দেখি নি।’

হ্যালি হাসতে হাসতে বলল, ‘মিস্টার শেলবি, নিগ্রোরা যে সৎ হয় এ কথা কেউই মানতে চায় না।’

মিঃ শেলবি একটা লম্বা নিশ্বাস ছেড়ে বললেন, ‘হয়তোবা তাই। কিন্তু সত্যিকার অর্থেই টমের কোনো তুলনা হতে পারে না। একটা মানুষ যতটা সৎ হতে পারে টম ঠিক ততটাই সৎ! এইতো মাত্র কদিন আগে, ব্যবসার একটা কাজে আমার যাওয়া হলো না। টমকে সিনসিনাটিতে পাঠিয়ে দিলাম। টমই বিক্রিটিক্রি করে পাঁচশ ডলার নিয়ে ফিরে এল। কিন্তু বাজে লোকেরা ওকে লোভ দেখিয়েছিল, ‘টাকা-পয়সা নিয়ে কানাডায় পালিয়ে যাও।’ টম বলেছিল, ‘অসম্ভব, কর্তা আমাকে বিশ্বাস করেন, আমি বিশ্বাসঘাতক হতে পারব না।

পরে লোকমুখে আমি একথা শুনেছিলাম। আমি ভালোভাবেই জানতাম টম ফিরে আসবেই। এখন একেবারে নিরুপায় বলেই ওকে ছাড়তে হচ্ছে। টমকে নিয়েই আমার সমস্ত দেনা মাফ করে দেওয়া উচিত। হ্যালি, তোমার বিবেচনা বলে কিছু থাকলে তুমি তা করবে।’

হ্যালি বললেন, ‘মিস্টার শেলবি, একজন ব্যবসায়ী হিসেবে কোনো মানুষের যতটুকু বিবেচনা থাকা দরকার, অন্তত সেটুকু আমার আছে।’ হ্যালির কণ্ঠস্বরে বিদ্রূপ মেশানো একটুকরো হাসি। একটু থেমে আবার বললেন, ‘আমি সব সময়ই বন্ধুদের সাহায্য করার জন্যে তৈরি থাকি। আপনি বিশ্বাস করবেন কিনা জানি না, এ-বছর ব্যবসার খুবই বাজে অবস্থা। এতই খারাপ অবস্থা যে, আপনাকে বলে বোঝানো সম্ভব নয়।’ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে হ্যালি তার পেয়ালায় আরো খানিকটা ব্রান্ডি ঢেলে নিল।

কিছুক্ষণ অস্বস্তিকর নীরবতার পর শেলবিই প্রথমে মুখ খুললেন, ‘তাহলে এ ব্যাপারটার কী করা যায় ঠিক করলে?’

‘সত্যিই তোমাকে দেয়া যায় তেমন কেউ এখানে নেই। তুমি বিশ্বাস করবে কিনা জানি না, আমি খুব দায়ে পড়েই টমকে বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছি। তাছাড়া এতদিনের পুরনো আর বিশ্বাসী কোনো চাকরকে ছেড়ে দেওয়ার কোনো কথাই ওঠে না।’

দুজনের কথার মধ্যেই দরজা খুলে একটা নিগ্রো ছেলে ভেতরে এল। চার-পাঁচ বছরের ছেলেটা দেখতে বেশ। ছেলেটার সমস্ত চেহারায় এমন একটা উজ্জ্বলতা ছড়িয়ে রয়েছে যা সবার চোখে পড়ে। রেশমের মতো নরম একরাশ কোঁকড়ানো কালো চুল। টোল খাওয়া সুন্দর মুখখানা ঘিরে টানাটানা দুটো চোখ। সে চোখের মণিতে ঢেউ খেলে যাচ্ছে অদ্ভুত একটা উজ্জ্বল আভা। গাঢ় লাল রঙের চমৎকার পোশাকে ওকে দারুণ মানিয়েছে।

ঘরের ভিতরে ঢুকে বাচ্চা ছেলেটা সাবধানে একবার চারদিকে তাকাল।

ছেলেটির চোখে চোখ পড়তেই শিষ দিয়ে ছেলেটাকে কাছে ডাকলেন মিস্টার শেলবি, ‘হ্যালো, জিম ক্রো!’ পরম আদরে একগুচ্ছ মনাক্কা ছেলেটার দিকে ছুড়ে দিয়ে বললেন, ‘কুড়িয়ে নাও। মহা খুশিতে ছেলেটাকে উপহারটির দিকে ছুটে যেতে দেখে তার মনিব খুশিতে হেসে উঠলেন।

‘জিম, এদিকে এস।’

ছেলেটি ছুটে এল। শেলবি তার গাল টিপে আদর করতে করতে কোঁকড়ানো চুলেল হাত বুলিয়ে বললেন, ‘তুমি কেমন নাচতে পার, গাইতে পার, এই ভদ্রলোককে একটু দেখিয়ে দাও তো।’

ছেলেটি নিঃসঙ্কোচে জনপ্রিয় একটা নিগ্রো সংগীত তার কচি মিষ্টি গলায় গেয়ে শোনাল। সেই সঙ্গে সুরের তালে তাল রেখে হাত-পা নেড়ে, হাস্যকর ছন্দে সারা শরীর হেলিয়ে-দুলিয়ে নাচতে লাগল।

‘চমৎকার, চমৎকার হয়েছে!’ কমলার কয়েকটা কোয়া বাচ্চাটার দিকে ছুড়ে দিল হ্যালি।

শেলবি বললেন, ‘আচ্ছা জিম, দেখাও তো দেখি কুঁজো কাকার বাত হলে কেমন করে হাঁটে।

বলতে না বলতেই জিম মনিবের ছড়িটার ওপর শরীরের ভার রেখে, পিঠটাকে যতটা সম্ভব বাঁকা করে বেশ কষ্টে হাঁটতে শুরু করল। তার কচি মুখটায় ভেসে উঠল বৃদ্ধ কোনো মানুষের তীব্র যন্ত্রণা।

জিমের ভাবভঙ্গিতে দুজনেই হো হো করে হেসে উঠল। ‘এইযে জিম, বুড়ো রবিন কীভাবে উপাসনা করে একটু দেখিয়ে দাও তো এবার।’ জিম তখুনি গোলগাল মুখটা টানটান করে উপর দিকে তুলে, কিছুটা নাকি সুরে, তা নকল করে দেখাল।

‘বাঃ ছেলেটা দেখছি সব ব্যাপারেই একেবারে তাক লাগিয়ে দেয়ার মতো। আচ্ছা … হঠাৎ শেলবির দিকে ফিরে হ্যালি তাঁর হাত দুটো সবেগে আঁকড়ে ধরল। একটু আমতা আমতা করে বলল, ‘এখানে তো আর এমন কাউকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না, আপনি বরং টমের সঙ্গে এই ছেলেটাকেও দিন। বিশ্বাস করুন, আমি কথা দিচ্ছি, আপনার সম্পূর্ণ দেনা শোধ হয়ে যাবে।

হ্যালির কথা শেষ হতে না হতেই আলতো করে দরজা ঠেলে একটি নিগ্রো মহিলা ঘরে ঢুকল। পঁচিশ কি ছাব্বিশ বছরের মহিলাটি খুবই সুন্দর। এক ঝলকেই বলে দেয়া যায় মহিলাটি জিমের মা। জিমের মতো তার মারও দীর্ঘ পল্লবঘেরা টানাটানা চোখ, মাথায় রেশমের মতো একরাশ কোঁকড়ানো কালো চুল। গায়ের রঙ হালকা বাদামি। ওকে দেখে নিগ্রোদের চাইতে বরং শ্বেতাঙ্গদের কথাই বেশি করে মনে পড়ে। ওর সুন্দর মুখ আর সুঠাম দেহের সঙ্গে পোশাকটাও চমৎকার মানিয়েছে। মসৃণ দুটো হাত, নিটোল পায়ের পাতা আর গোড়ালি দেখে হ্যালির পাকা চোখ এক নজরেই বলে দিতে পারে নারী পণ্যের হাটে এই সুন্দরী মেয়েটার দাম কত?

মেয়েটিকে নীরবে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ওর মনিব জিজ্ঞেস করলেন, ‘এলিজা, কী ব্যাপার?’

‘স্যার, আমি হ্যারিকে খুঁজছিলাম।

জিম দৌড়ে এসে তার কুড়িয়ে নেয়া মনাক্কার গুচ্ছ আর কমলার কোয়াগুলো মাকে দেখাল।

শেলবি বললেন, ‘জিমকে নিয়ে যাও।’

এলিজা ছেলেকে সঙ্গে সঙ্গে বুকের মধ্যে জড়িয়ে ধরে তাড়াতাড়ি ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।

হ্যালি প্রশংসার চোখে শেলবির দিকে তাকিয়ে বলল, ‘চমৎকার! আপনার ঘরে তো দেখছি খুব দামি একটা বস্তু রয়েছে! যখন তখন অলিয়েন্সের হাটে নিয়ে গিয়ে মেয়েটাকে বিক্রি করলে আপনার ভাগ্য ফিরে যেতে পারে। আমি বহু মেয়ে বিক্রি করেছি, কিন্তু এমন সুন্দরী আর একটাও চোখে পড়ে নি।’

‘এলিজাকে বিক্রি করে আমি ভাগ্য ফেরাতে চাই না।’ শুকনো গলায় শেলবি বললেন।

‘আচ্ছা, ঠিক আছে।’ ঘনিষ্ঠ বন্ধুর মতো শেলবির কাঁধে হাত রেখে হ্যালি বলে ফেলল, ‘আমি না হয় নিজেই মেয়েটাকে কিনব। আপনি কত চান বলুন?’

‘ওকে আমি মোটেই বেচতে চাই না হ্যালি। ওর সমান ওজন সোনার বদলেও আমার বউ ওকে ছাড়তে রাজি হবে না।’

‘মেয়েরা অমন বলেই থাকে। ওরা কখনোই হিসেবের ধার ধারে না। যদি আপনি আপনার স্ত্রীকে বোঝান যে ওর দামে অনেক ভালো ভালো পোশাক আর নামী দামি গয়না হতে পারে, আমার তো মনে হয়, উনি ঠিকই আপত্তি করতে পারবেন না।’

শেলবি দৃঢ়কণ্ঠে বলে উঠলেন, ‘তোমাকে স্পষ্টই বলছি হ্যালি, একথা তুমি আর একবারও মুখে আনবে না।’

‘আচ্ছা ঠিক আছে, তাহলে টমের সঙ্গে আপনি ওই ছোট্ট ছেলেটাকেই দিন। সমস্ত দেনা শোধ হয়ে যাওয়ায় আশা করি আপনি মোটামুটি ভালোই দাম পাবেন।’

শেলবি অবাক হয়ে বললেন, ‘কিন্তু অতটুকুন একটা বাচ্চাকে দিয়ে তুমি কী করবে?’

‘আমার এক বন্ধু আছে, সুন্দর সুন্দর বাচ্চা ছেলে কিনতেই তার বেশি আগ্রহ। দাস- ব্যবসার ওদিকটা নিয়েই তার কারবার। বাচ্চাগুলোকে খাইয়ে পরিয়ে বেশ বড়সড় করে হোটেল রেস্তোরাঁয় কাজের জন্যে বাজারে খুব দামে বিক্রি করে। এতে তার খুব ভালো লাভ হয়। আপনার এই বাচ্চাটা যেমন সুন্দর, তেমন চটপটে। একে পেলে আমার তো মনে হয় বেশ বড় একটা অঙ্কের টাকা পাওয়া যাবে।’

‘ওকে বিক্রি করার কোনো ইচ্ছে আমার নেই’, কিছু একটা ভাবতে ভাবতেই শেলবি বললেন, ‘সত্যি বলতে কি জানো হ্যালি, আমি নিজেকে একজন মানুষ বলে মনে করি এবং এভাবে মার কোল থেকে কোনো শিশুকে কেড়ে নেয়াটাকে আমি ঘৃণা করি।’

‘ঘৃণা যে আমি করি না এমন নয়। মেয়েদের কান্নাকাটি আমার একেবারেই সহ্য হয় না। তবে অসুবিধে কী জানেন, ব্যবসা করতে গেলে এসব ভাবলে চলে না। আচ্ছা, কয়েকদিনের জন্যে বাচ্চাটার মাকে কোথাও পাঠিয়ে দেয়া যায় না? এই সুযোগে ছেলেটাকে সরিয়ে নেয়া যাবে এরপর ওর মা ফিরে এলে নতুন কিছু পোশাক কিংবা ওই ধরনের কোনো উপহার দিলে মেয়েটা ঠিকই সব ভুলে যাবে।’

শেলবি অস্বস্তি বোধ করতে লাগলেন, বললেন, ‘আমার কিন্তু তা মোটেই মনে হয় না।’

‘হয় না কেন, নিশ্চয়ই হয়। সত্যি কি জানেন ওই কালো ভূতগুলো মোটেই শ্বেতাঙ্গদের মতো নয়। ওদের মধ্যে দয়ামায়া বলতে কিছুই নেই। তবে ব্যাপারটা অবশ্য বেশ কায়দা করে করা দরকার। অন্যেরা যেভাবে করে, তাদের ধরনের সঙ্গে আমার মেলে না। এতে আসল জিনিসটাই নষ্ট হয়ে যায়। আমি জানি, একবার এক ভদ্রলোক অলিয়েন্সের হাট থেকে একটা মেয়ে কিনেছিলেন। সত্যিই বেশ সুন্দর দেখতে মেয়েটা। কিন্তু ভদ্রলোক তার বাচ্চাটাকে কেনেন নি। বাচ্চার জন্যে কান্নাকাটি করার ফলে ভদ্রলোক মেয়েটাকে ঘরে তালাবদ্ধ করে রেখেছিলেন। দুঃখশোকে মেয়েটা পাগল হয়ে যায়, এমনকি দিনকয়েক পরে মারাও যায়। ফলে ভদ্রলোকের নগদ এক হাজার ডলার একদম জলে গেল। কিন্তু একটু কায়দা করে করলে তাঁর এতো বড় ক্ষতিটা হতো না। আমার বন্ধু, টম লকারও মেয়েদের মারধর করে, তাদের ওপর অত্যাচার করে। আমি অনেকবার নিষেধ করেছি। এতে আসলে তারই ক্ষতি। মেয়েদের চেহারা খারাপ হয়ে পড়ে, বিক্রির সময় ভালো দাম পাওয়া যায় না। এ জন্যে আমি সাধারণত নিগ্রোদের ওপর কখনো খারাপ ব্যবহার করি না।’

‘শুনে সত্যিই খুব খুশি হলাম, হ্যালি।’

একটু নীরব থেকে হ্যালি জিজ্ঞেস করল, ‘তাহলে মিস্টার শেলবি, আমার প্রস্তাবটার ব্যাপারে আপনি ভাবছেন?’

‘আরো ভেবে পরে বলব। এ-ব্যাপারে আমার স্ত্রীর সঙ্গে একবার কথা বলা দরকার।’

‘ঠিক আছে।’ হ্যালি উঠে দাঁড়িয়ে ওভারকোটটা গায়ে জড়িয়ে বলল, ‘কিন্তু আপনি বুঝতে পারছেন তো, আমার হাতে সময় খুবই কম।’

‘আচ্ছা, সন্ধ্যে ছটা থেকে সাতটার মধ্যে এলে চলবে, তখনি আমার উত্তর পেয়ে যাবেন।’

‘ধন্যবাদ।’

হ্যালি ঘর থেকে বেরিয়ে পড়ল। বন্ধ ঘরে নীরবে একা বসে শেলবি নিজের মনেই ভাবতে লাগলেন, ‘বিশ্রী লোকটাকে আমার ঘর থেকে দূর করে দিলেই ঠিক হতো। অথচ কোনো উপায়ই দেখছি না। ওর কাছেই তো আমার ঘরবাড়ি সব বাঁধা রয়েছে। নইলে শুধু এলিজার ছেলে কেন, টমকেও বিক্রি করার কোনো প্রশ্নই ওঠে না। এর জন্যে স্ত্রীর কাছেও আমাকে কথা শুনতে হবে। শেলবি দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন। ‘উঃ, দেনা যে কী ভয়ঙ্কর, যার আছে সেই জানে!’

.

অন্যান্য রাজ্যের তুলনায় কেন্টাকিই সম্ভবত নিগ্রো ক্রীতদাস-দাসীদের প্রতি অনেক বেশি উদার। এদের মধ্যে মিস্টার শেলবি আবার সবচাইতে ভদ্র আর স্নেহপ্রবণ। অধীনস্থ সমস্ত দাসদাসীদের সুখস্বাচ্ছন্দ্যের প্রতি তাঁর কোনো ত্রুটিই তেমন করে চোখে লাগে না। কিন্তু বেশ কিছুদিন ধরে ফটকায় লোকসান দিতে দিতে ঋণের পরিমাণ এমন একটা অঙ্কে গিয়ে দাঁড়ায়, যেখান থেকে মুক্তি পাওয়া তাঁর পক্ষে সম্ভব ছিল না। ঋণের সময় তিনি যেসব হুন্ডি দিয়েছিলেন, তার অধিকাংশই গিয়ে পড়েছিল হ্যালির হাতে। সেই জন্যে আজকের এই আলোচনার সূত্রপাত। এদিকে এলিজা হঠাৎই দরজার কাছাকাছি এসে পড়ায় ভিতরের কথাবার্তার কিছু অংশ তার কানে এসেছিল। তা থেকে সে এইটুকু অনুমান করতে পেরেছিল একজন দাসব্যবসায়ী তার মনিবের সঙ্গে কাউকে কেনার জন্যে দর কষাকষি করছে। তার আরো খানিকক্ষণ আড়ি পেতে শোনার ইচ্ছে ছিল, কিন্তু ঠিক সেই সময় কর্ত্রীর ডাকে তাকে তাড়াতাড়ি ফিরে যেতে হলো। তবু সে যদি নিতান্ত শুনতে ভুল না করে থাকে, তাহলে লোকটা তার হ্যারির জন্যেই দরাদরি করছিল। এতে তার বুকের ভিতরটা থরথর করে কেঁপে উঠল। ছেলেকে এতো জোরে সে বুকের মধ্যে আঁকড়ে ধরল যে হ্যারি অবাক হয়ে মার মুখের দিকে তাকিয়ে রইল।

সব কাজেই আজ এলিজার গোলমাল হয়ে যাচ্ছে। এটা ফেলছে, সেটা ওলটাচ্ছে। শেষপর্যন্ত, রেশমি পোশাকটা চাওয়ায় সে যখন আলমারি থেকে রাতের পোশাকটা এনে দিল, বাড়ির কর্ত্রী অবাক না হয়ে পারলেন না। ‘আজ তোর কী হয়েছে বলতো এলিজা?’

‘গিন্নিমা, একজন দাসব্যবসায়ী আজ বৈঠকখানায় কর্তাবাবুর সঙ্গে কথা বলছিল।’

‘তাতে তোর কী?’

‘ভয় হচ্ছে, কর্তাবাবু বোধহয় আমার হ্যারিকে তার কাছে বেচে দেবেন?’ বলতে বলতে কান্নায় তার গলার স্বর বুজে এল।

‘বেচে দেবে! আচ্ছা বোকা মেয়ে তো! তুহি তো জানিস, তোর মনিব দক্ষিণের দাসব্যবসায়ীদের সঙ্গে কারবার করেন না, নিতান্ত দুর্ব্যবহার না করলে তিনি কখনো কাউকে বেচেনও না। তাছাড়া অতটুকুন দুধের বাচ্চাকে কে কিনতে যাবে শুনি? তোর যতসব উদ্ভট ধারণা। নে, এখন আমার চুলটা সেদিনের মতো ভালো করে বেঁধে দে দেখি। আর কোনোদিনও অমন করে দরজায় আড়ি পেতে শুনবি না

‘আচ্ছা, তবু আপনি কিন্তু কিছুতেই আমার হ্যারিকে বিক্রি করার অনুমতি দেবেন না, মা।’

‘কী আজে-বাজে বকছিস! তুই কি পাগল হয়েছিস? তাহলে তো আমার নিজের ছেলেল জর্জকেও বিক্রি করে দিতে পারি।’

মনিবানির কথায় কিছুটা আশ্বস্ত হয়ে এলিজা প্রসাধনের কাজে মন দিল। প্ৰসাধন শেষ হবার পর মিসেস শেলবি প্রতিদিনের মতো সান্ধ্যভ্রমণে বেরিয়ে গেলেন। এলিজার কথাগুলো তার আর একটুও মনে রইল না।

২. জর্জ হ্যারিস

শৈশব থেকে এলিজাকে নিজের মেয়ের মতো করে মানুষ করেছেন মিসেস শেলবি।

ক্রীতদাসী হলেও এলিজা রূপে গুণে অসাধারণ। শুধু চোখধাঁধানো রূপ নয়, চাল-চলন আচার-ব্যবহারে সে যেকোনো ভদ্রমহিলারই মতো শোভন। জর্জ হ্যারিস নামে অত্যন্ত প্রতিভাবান একজন তরুণের সঙ্গে মিসেস শেলবি তার বিয়ে দিয়েছিলেন। পাশের জমিদারিতে জর্জ ছিল নিগ্রো ক্রীতদাস। তার মনিব, মিস্টার হ্যারিস তাকে চট তৈরির একটা কারখানায় ভাড়া খাটাতেন। কর্মচারী হিসেবে জর্জ সত্যিই অতুলনীয়। তার মিষ্টি ব্যবহার আর নিপুণ কর্মতৎপরতার জন্যে কারখানার সবাই তাকে খুব ভালোবাসত, এমন কি শ্রদ্ধাও করত। অনেক মাথা খাটিয়ে সে শন পরিষ্কার করার একটা যন্ত্র আবিষ্কার করেছিল, যা তার মতো স্বল্পশিক্ষিত তরুণের পক্ষে ইটনির তুলো পাকানোর যন্ত্র-উদ্ভাবনী প্রতিভার চাইতে কোনো অংশে কম ছিল না। তবু আইনের চোখে জর্জকে আদৌ মানুষ হিসেবে গণ্য করা হতো না। বিশেষ করে তার সংকীর্ণমনা মনিবটি ছিল অত্যন্ত নীচু, অভদ্র আর অত্যাচারী। জর্জের যন্ত্র আবিষ্কারের কথাটা তিনি শুনেছিলেন বটে। কিন্তু যার সম্পর্কে সবাই এতো বলাবলি করে সেই জিনিসটাকে কোনোদিন চোখে দেখেন নি। তাই নিজেই একদিন ঘোড়ায় চড়ে কারখানায় এসে হাজির হলেন।

জর্জের মতো প্রতিভাবান একজন ক্রীতদাসকে লাভ করতে পারার জন্যে কারখানার মালিক মিস্টার হ্যারিকে সাদর অভ্যর্থনা জানালেন। জর্জ বিপুল উৎসাহে যন্ত্রের কার্যকারিতা সম্পর্কে তাঁকে বোঝাতে লাগল। খুশিতে ঝলমল করা মুখ, মাথা উঁচিয়ে রাখা পৌরুষদীপ্ত সুন্দর চেহারার তুলনায় মনিবকে কেমন যেন নিকৃষ্ট মনে হতে লাগল। মিস্টার হ্যারি মনে মনে ভাবলেন, নিগ্রো ক্রীতদাসটার কী দরকার ছিল এই যন্ত্রটা আবিষ্কার করার? ও কি ভদ্রলোকদের মতো মাথা উঁচু করে চলতে চায়? তখনি তিনি মনে মনে ঠিক করলেন খুব তাড়াতাড়ি ওর দর্প চূর্ণ করা দরকার। মিঃ হ্যারিস তাই জর্জের পাওনা মিটিয়ে যখন নিজের খামারবাড়িতে ফিরিয়ে নিয়ে যাবার কথা বললেন, সবাই তখন অবাক হয়ে গেল। কারখানার মালিক বললেন, ‘ব্যাপারটা খুব অপ্রত্যাশিত হয়ে যাচ্ছে না স্যার?’

‘হলোই বা, লোকটা তো আমারই।’

‘আমরা ওর মাইনে বাড়িয়ে দিতে রাজি আছি।’

‘আমি ঠিক করেছি আমার আর কোনো লোককেই ভাড়া খাটাব না।’

‘কিন্তু এই ছেলেটি আমার সব কাজের উপযুক্ত।

‘হ্যাঁ, তাই তো দেখছি; শুধু আমার ছাড়া ও আর সবারই কাজের উপযুক্ত।’

‘কিন্তু একবার ভেবে দেখুন স্যার, যে এমন দারুণ একটা যন্ত্র আবিষ্কার করেছে…’

‘সে শুধু খাটুনি বাঁচাবার ধান্দা। প্রতিটি নিগ্রোই যখন এক-একটা খাটুনি বাচাবার কল, তখন আর এটাকে নতুন করে বানাবার দরকারটা ছিল কী? না, ওকে যেতেই হবে।’

মনিবের কথা শুনে জর্জ একেবারে স্তম্ভিত হয়ে গিয়েছিল। হাতে হাত জড়িয়ে, ঠোঁটে ঠোঁট চেপে, পাথরের প্রতিমূর্তির মতো সে চুপচাপ দাঁড়িয়ে ছিল। শুধু তার বুকের মধ্যে তখন ঝড় বইছিল, শিরায় শিরায় প্রবাহিত হয়ে যাচ্ছিল অগ্নিস্রোত, চোখ দুটো গনগনে ভাটার মতো জ্বলছিল। ঠিক সেই সময় ব্যাপারটা বুঝতে পেরে কারখানার মালিক আলতো করে ওর হাতে চাপ দিয়ে কানে কানে যদি না বলতেন, ‘এখনকার মতো যাও জর্জ। পরে তোমাকে ফিরিয়ে আনার আপ্রাণ চেষ্টা করব।’ তাহলে সেদিন হয়তো উত্তেজনার বশে জর্জ একটা কেলেঙ্কারি কাণ্ডই বাঁধিয়ে বসত।

জর্জের প্রভু, মিস্টার হ্যারিস, জর্জকে ফিরিয়ে এনে তার খামারবাড়িতে আগাছা পরিষ্কার করার মতো নীরস কাজে লাগিয়ে দিলেন। সবসময় নানাভাবে তিনি জর্জকে দমিয়ে রাখার চেষ্টা করলেও, তার চোখ থেকে আগুনের সেই দীপ্তিটাকে কিছুতেই নিভিয়ে দিতে পারলেন না।

জর্জের কাছে কারখানার দিনগুলো ছিল সব চাইতে সুখের। বন্ধুরা যেমন তাকে ভালোবাসত, কারখানার বৃদ্ধ মালিকের মনটাও ছিল তেমনি উদার। ফলে সে যখন যেখানে ইচ্ছে যেতে পারত। মিসেস শেলবি নিজে দেখেশুনে এলিজার বিয়ে দিয়েছিলেন এবং জর্জের মতো প্রতিভাবান, প্রিয়দর্শন তরুণের সঙ্গে এলিজার বিয়ে দিতে পেরে নিজেই খুশি হয়েছিলেন। শেষের কয়েকটা বছর খুশিমতো আসা-যাওয়া করতে পারত। বিশেষ করে হ্যারির জন্মের পর থেকে, জর্জ আর এলিজার জীবনে সুখের অন্ত ছিল না। কিন্তু কারখানা থেকে সরিয়ে মনিবের লৌহকঠিন শাসনের শৃঙ্খলে ফিরিয়ে আনার মুহূর্তে জর্জ বুঝতে পারল তার জীবনে সুখের দিন শেষ হয়ে গেছে।

দু-এক সপ্তাহ পরে কারখানার মালিক তাঁর প্রতিশ্রুতি মতো জর্জকে ফিরিয়ে আনার জন্যে মিস্টার হ্যারিসের সঙ্গে দেখা করলেন। কিন্তু হ্যারিস কিছুতেই রাজি হলেন না।

‘এর জন্যে এতদূর কষ্ট করে আসার কোনো প্রয়োজন ছিল না।’ রুক্ষ স্বরেই হ্যারিস জবাব দিলেন, ‘লোকটা আমার; আমি কোনো শর্তেই ওকে আর ভাড়া খাটাব না।’

জর্জ সেদিনই স্পষ্ট বুঝতে পারল তার জীবনে এক চরম দুর্দিন ঘনিয়ে আসছে।

৩. এলিজা

মিসেস শেলবি বাড়িতে নেই, বেড়াতে বেরিয়েছেন। এলিজা মন খারাপ করে বারান্দার এককোণে চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে। হঠাৎ কে যেন তার কাঁধে হাত রাখল। চমকে ফিরে তাকাতেই তার সুন্দর চোখ দুটো খুশিতে ঝকমক করে উঠল।

‘ওঃ জর্জ তুমি? উঃ, আমাকে যা ভয় পাইয়ে দিয়েছিলে! তুমি আসায় সত্যিই আমার খুব ভালো লাগছে। গিন্নিমা এখন বাইরে বেড়াতে গেছেন। চলো, আমরা ভিতরে গিয়ে বসি।

সামনেই সুন্দর বারান্দা। সাজানো-গোছানো ছোট্ট বসার জায়গাটায় সে জর্জকে টানতে টানতে নিয়ে এল! অবসর সময়ে সাধারণত সে এখানে বসেই সেলাই-ফোঁড়াই করে, যাতে মনিবানি ডাকলেই সে শুনতে পায়।

‘কী ব্যাপার, আজ যে হাসছ না?’ এলিজা জিজ্ঞেস করল, তারপর তার ঘাঘরার প্রান্ত আঁকড়েধরা ছেলেকে দেখিয়ে বলল, ‘দেখ, হ্যারি কত বড় হয়ে গেছে … আর কী সুন্দর দেখতে হয়েছে।’

‘আমার মনে হয়, ও না জন্মালেই ভালো হতো, এলিজা! আরো ভালো হতো যদি আমি নিজেই না জন্ম নিতাম।’ জর্জের কণ্ঠস্বরে ঝরে পড়ল তিক্ত বেদনা। স্বামীর কাঁধে মাথা রেখে এলিজা সজল চোখে বলল, ‘এ তুমি কী বলছ জর্জ!

‘ঠিকই বলছি এলিজা। তোমার মতো এতো সুন্দর মেয়ে আমি আর একটাও দেখি নি। অথচ সেই তোমাকেই আমি সুখী করতে পারলাম না। তোমার সঙ্গে আমার কোনোদিন দেখা না হলে ভালো হতো। আমার জীবনে উন্নতির আর কোনো আশা নেই। সব শেষ। বেঁচে থেকে কী লাভ? আমার বরং মরাই ভালো।’

‘না, না, ও কথা বলো না জর্জ! আমি বুঝতে পারছি, কারখানা থেকে সরিয়ে নিয়ে এসেছে বলে তোমার কষ্ট হচ্ছে। কিন্তু একটু ধৈর্য ধর জর্জ। দেখো একদিন …’

ধৈর্য কি আমি ধরি নি এলিজা? সবাই যেখানে আমাকে চেনে জানে ভালোবাসে, সেই কারখানা থেকে একেবারে কোনো কারণ ছাড়া সরিয়ে আনার সময় আমি একটি কথাও বলি নি। আমার উপার্জনের প্রতিটা পাই-পয়সা তাঁকে দিয়েছি, নিজের জন্যে একটা কপর্দকও রাখি নি।

‘সবই জানি জর্জ, তবু তিনি তোমার মনিব।’

‘মনিব! কে আমার মনিব? তাঁকে কে আমার মনিবের আসনে বসিয়েছে? আমার উপর তাঁর কী অধিকার থাকতে পারে? তিনি যতটা লেখাপড়া জানেন, আমি তার চাইতে বেশি জানি। আমি শিখেছি নিজের চেষ্টায়। একটা ঘোড়া যে কাজ করতে পারে, তিনি তার চাইতেও নোংরা কাজ আমাকে দিয়ে করিয়ে নিচ্ছেন।’

‘তোমার কথা শুনে আমার বুক কেঁপে উঠছে জর্জ! তোমাকে আমি কখনো এভাবে বলতে শুনি নি। আমার ভয় হচ্ছে তুমি হয়তো সাংঘাতিক একটা কাণ্ড বাঁধিয়ে বসবে। জর্জ তোমার কষ্ট আমি বুঝতে পারছি। কিন্তু আমার আর হ্যারির মুখের দিকে তাকিয়ে তোমার একটু ধৈর্য ধরা উচিত।’

‘ধৈর্য আমি সত্যিই ধরেছিলাম এলিজা। কিন্তু রক্তমাংসের শরীরে এর চাইতে বেশি আর সহ্য করা যায় না। মুখ বুজে ভালোভাবে কাজ করে যাওয়া সত্ত্বেও সারাক্ষণ তিনি আমাকে অপমান করেন, নির্যাতন করেন, বোঝার উপর আরো বোঝা চাপিয়ে দেন। তিনি বলেন, আমার মধ্যে নাকি একটা শয়তান আছে। সেই শয়তানটা যেদিন নিজের মূর্তি ধারণ করবে সেদিন আমার আর কিছুই করার থাকবে না।

‘আমাদের কী হবে জর্জ?’ আর্তস্বরে এলিজা জিজ্ঞেস করল।

কিছুক্ষণ নীরব থেকে জর্জ বলল, ‘এই তো, গতকালেরই ঘটনা। ঘোড়ায়-টানা একটা গাড়িতে আমি পাথর তুলছি আর মনিবের ছেলেটা ঘোড়ার খুব কাছে দাঁড়িয়ে বনবন্ শব্দে চাবুক ঘোরাচ্ছে। ঘোড়াটা ভয় পাবে ভেবে আমি তাকে চাবুক ঘোরাতে নিষেধ করলাম। ছেলেটা সঙ্গে সঙ্গে ঘুরে আমাকেই চাবুক মারতে শুরু করল। আমি তার হাত দুটো ধরতেই সে আমাকে লাথি মারতে লাগল। তারপর চেঁচাতে চেঁচাতে বাবার কাছে গিয়ে নালিশ করল, আমি নাকি তার সঙ্গে মারপিট করছিলাম। সঙ্গে সঙ্গে তার বাবা ছুটে এসে বললেন, ‘দাঁড়া হারামজাদা, এবার তোকে দেখাচ্ছি কে তোর প্রভু।’ তারপর আমাকে একটা গুড়ির সঙ্গে বেঁধে, সেই গাছেরই ডাল থেকে চাবুক বানিয়ে ছেলের হাতে দিয়ে বললেন, ‘যতক্ষণ পার শুয়োরটাকে চাবকে যাও।’ ছেলেটাও বাবার উৎসাহে আমাকে মারতে শুরু করল। এর প্রতিশোধ একদিন আমি নেবই। সেদিন দেখব কে লোকটাকে আমার মনিব বানিয়েছে।

‘আমি কিন্তু মনিব বা মনিবানিকে অমান্য করার কথা ভাবতেই পারি না জর্জ।’

‘এলিজা, তোমার ব্যাপারটা কিন্তু একেবারেই ভিন্ন। খাইয়ে-পরিয়ে ওঁরা তোমাকে নিজের মেয়ের মতো করে মানুষ করেছেন, লেখাপড়া শিখিয়েছেন। ওঁরা তোমার ওপর দাবি করতে পারেন, কিন্তু আমার মনিবটি একটা অমানুষ। কার্লো নামে তুমি আমাকে একটু কুকুরছানা দিয়েছিলে, মনে আছে? সারাক্ষণই সে আমার পেছনে পেছনে ঘুরঘুর করত, আমার সঙ্গে শুয়ে থাকত। মাঝে মাঝে এমনভাবে আমার মুখের দিকে তাকাত যেন আমার দুঃখকষ্ট সে বুঝতে পারছে। একদিন রান্নাঘরে মাংসের কয়েকটা ছাঁট পড়েছিল, সেগুলো কুড়িয়ে আমি তাকে খাওয়াচ্ছি, এমন সময় মনিব এসে বললেন, তাঁর পয়সায় কুকুরকে খাওয়ানো চলবে না এবং কোনো চাকরকে কুকুর পুষতে দেবেন না। তখন তিনি হুকুম দিলেন আমি যেন কুকুরটার গলায় পাথর বেঁধে পুকুরের পানিতে ফেলে দিই।’

‘ও, জর্জ; তুমি নিশ্চয়ই তা কর নি!’

‘আমি করি নি, কিন্তু উনি আর ওঁর ছেলে করেছিল। বেচারি কার্লো যতবার পানি থেকে ওপরে ওঠার চেষ্টা করছিল, ওঁরা দুজনে ততবারই ঢিল মেরে তাকে ডুবিয়ে দিচ্ছিল। উঃ, তখন যে আমার কী কষ্ট হচ্ছিল তোমাকে বলে বোঝাতে পারব না! আমি নিজে কুকুরটাকে ডুবিয়ে মারি নি বলে সেদিনও আমাকে চাবুক খেতে হয়েছিল। আমার মনিবটা যে কী নিষ্ঠুর তুমি কল্পনাও করতে পারবে না। গত কয়েকদিন ধরে উনি বলতে শুরু করেছেন এখানে আমার বিয়ের অনুমতি দিয়ে খুব ভুল করেছেন। কেননা তিনি মিস্টার শেলবি আর মিসেস শেলবি বা ওঁদের মতো উদারচেতা মানুষদের ঘৃণা করেন। উনি চান না আমি এখানে আসি বা তোমার সঙ্গে দেখা করি। ওনার ইচ্ছে ক্রীতদাসী মিনার সঙ্গে আমার বিয়ে দেন।

এলিজা শিউরে উঠল। ‘না, না, তা কী করে সম্ভব জর্জ! একবার তো আমাদের বিয়ে হয়ে গেছে?’

‘তুমি কি জানো না ক্রীতদাসরা কখনো বিয়ে করতে পারে না? এ দেশে ক্রীতদাস- দাসীদের বিয়ে আইনসিদ্ধ নয়। মনিবরা চাইলে যেকোনো মুহূর্তে আমরা বিচ্ছিন্ন হয়ে যেতে পারি। সেই জন্যে বলছিলাম, এলিজা, এ পৃথিবীতে না জন্মালেই বোধহয় ভালো হতো।’

‘না না ও কথা বল না, জর্জ!’ এলিজার দুচোখ বেয়ে পানি নেমে এল; কিন্তু এই দুঃসময়ে জর্জের মনকে সে আর ভারাক্রান্ত করে তুলতে চাইল না। তাছাড়া গিন্নিমা যখন কথা দিয়েছেন, তখন হ্যারিকে ওঁরা নিশ্চয়ই বিক্রি করবেন না।

‘কেঁদ না এলিজা, লক্ষ্মীটি!’ বিষণ্নতার মধ্যেই জর্জ এলিজাকে সান্ত্বনা দেবার চেষ্টা করল, ‘আমি এখান থেকে চলে যাচ্ছি। তোমার কাছ থেকে বিদায় নিতে এসেছি।’

‘তুমি কোথায় যাচ্ছ, জর্জ?’

‘কানাডায়। ইচ্ছে আছে সেখানে গিয়ে তোমাকে কিনে নেবার। আশা করি তোমার মনিব তাতে রাজি হবেন।’

‘কিন্তু জর্জ পালাতে গিয়ে তুমি যদি ধরা পড়?’

‘ধরা আমি কিছুতেই পড়ব না এলিজা। হয় এই দাসত্ব থেকে মুক্তি পাব, নয়ত মরব। জীবিত অবস্থায় ওরা আমাকে কোনোদিনই ধরতে পারবে না।’ জর্জের কথা শুনে এলিজার বুক কেঁপে উঠল। তবু এ কথাটাও সে স্পষ্ট বুঝতে পারল। জর্জ একবার যখন মনস্থির করে ফেলেছে তখন আর কোনোমতেই ওকে ফেরানো যাবে না। তাই সজল চোখে সে কাতর মিনতি জানাল, আমাদের মুখ চেয়ে তুমি খুব সতর্ক থেকো, জর্জ রাগের মাথায় যেন হঠাৎ কিছু করে বসো না।’

‘তোমার কোনো ভয় নেই এলিজা। আমি পালাবার সমস্ত পরিকল্পনা পাকা করে রেখেছি। আমার কয়েকজন বন্ধু এ-ব্যাপারে আমাকে সাহায্য করবে। আর দু-সপ্তাহের মধ্যে সবাই দেখবে আমি নিরুদ্দিষ্ট মানুষদের একজন হয়ে গেছি। আমার হয়ে তুমি ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা কর এলিজা, বিদায়।’

‘বিদায়, জর্জ।’

মুহূর্তের জন্যে স্বামী-স্ত্রী পরস্পরের দিকে অপলক চোখে তাকিয়ে রইল, যেন বলতে চাইছে আবার আমাদের দেখা হবে। তারপর সজল-চোখে দুজন দুজনের কাছ থেকে বিদায় নিল।

৪. টম কাকার কুঠরি : একটি সন্ধ্যা

মনিবের বাড়ির উঠোনের পাশেই চাকরদের জন্যে সম্পূর্ণ আলাদা থাকার জায়গা। এখানেই টমের কাঠের কুঠরি। কুঠরির সামনে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন এক টুকরো বাগান। তাতে সারা বছরই স্ট্রবেরি, সারবেরি থেকে শুরু করে নানা ধরনের ফল আর শাকসবজি ফলে। ফটকের সামনে গাঢ় বেগুনি রঙের ঝাঁকড়া একটা বিগোনিয়া। বেড়ার চারপাশ ঘিরে মাল্টিফ্লোরা, মেরিগোল্ড, পিটুনিয়া, ফোরওক্লক, অজস্র ফুলের মেলা।

কুঠরির ভেতরটাও ঝকঝকে তকতকে। টমের স্ত্রী ক্লোর নিপুণ হাতে সবকিছুই সুন্দর করে সাজানো-গোছানো। একপাশে তক্তপোশের ওপর ধবধবে সাদা চাদর দিয়ে ঢাকা বিছানা। অন্যদিকে, তাপচুল্লির পাশে, পায়া ভাঙা একটা টেবিল আর গোটা দুয়েক চেয়ার। এই অংশটাই টমের কুঠরির বৈঠকখানা। বিছানার উল্টো দিকে, দেয়াল ঘেঁষে চওড়া একটা বেঞ্চি। বেঞ্চির নিচে মস আর পেট তাদের বছরখানেকের ছোট ভাইটাকে নিয়ে হুড়োহুড়ি করছে। দেয়ালে টাঙানো রয়েছে জেনারেল ওয়াশিংটনের বেশ বড় একটা প্রতিকৃতি।

মিস্টার শেলবির পরিবারে ক্লো একজন রাঁধুনি। এমন কোনো রান্না নেই যা ওর অজানা। এবং সবরকম রান্নাতে সত্যিই ওর তুলনা হয় না। বারান্দার রান্নাঘরে এখন কেক তৈরির কাজে ব্যস্ত রয়েছে সে।

মিস্টার শেলবির সবচাইতে বিশ্বস্ত ক্রীতদাস, আমাদের এই গল্পের নায়ক, টম ছেলেরা সবাই যাকে টম চাচা বলে ডাকে। সে এখন শ্লেটে অত্যন্ত ধৈর্য ধরে ইংরেজি বর্ণমালা লেখা অভ্যাস করছে। টম দীর্ঘদেহী। তার চওড়া বুক আর উজ্জ্বল কৃষ্ণবর্ণের পাথরে খোদা বলিষ্ঠ চেহারা প্রকৃত একজন আফ্রিকান মানুষের কথাই স্মরণ করিয়ে দেয়। দৃঢ় আত্মপ্রত্যয়ের সঙ্গে নম্রতা মেশানো অদ্ভুত একটা সরল গাম্ভীর্য জড়ানো রয়েছে তার সারা মুখে। টমের পাশে দাঁড়িয়ে রয়েছে বছর তের বয়েসের ভারি চমৎকার বুদ্ধিদীপ্ত চেহারার একটি কিশোর। টমের ভবিষ্যৎ মনিব, জর্জ শেলবি। তার কোমল মুখের অভিব্যক্তিতে বয়স্ক শিক্ষকদের মতো কপট একটা গাম্ভীর্য।

‘উঁহ, ওভাবে নয়, টম চাচা, ওভাবে নয়! একটুও হচ্ছে না …’ জি-এর লেজটাকে উল্টো দিকে দিয়ে ঘোরাতে দেখে জর্জ দ্রুত বলে উঠল, ‘জি না হয়ে ওটা তোমার ‘কিউ’ হয়ে গেছে।’

তারপর টমের হাত থেকে পেনসিলটা নিয়ে কীভাবে ‘জি’ লিখতে হয় শিখিয়ে দিতে লাগল।

ভিতরে ঢুকে ক্লো অপাঙ্গে স্বামীর দিকে তাকিয়ে বলল, ‘মাস্টারমশাই দেখিয়ে দিলে কী হবে, ছাত্রের একটুও উন্নতি হচ্ছে না। এখন বইপত্তর রেখে দিয়ে এইটুকু খেয়ে নাও তো, মাস্টার জর্জ।’

ধোঁয়া-ওঠা গরম কেকের পাত্রটা ক্লো টেবিলের ওপর রাখল।

‘কিন্তু এখন এসব খেলে রাত্তিরে যে আর কিছু খেতে পারব না।’ দ্বিধা জড়ানো স্বরে জর্জ বলল।

মিষ্টি হেসে ক্লো বলল, ‘তা হোক। আমি জানি ক্লো-কাকির হাতের তৈরি কেক তোমার পছন্দ। এটুকু খেলে কিচ্ছু হবে না।’

এতটুকু দ্বিরুক্তি না করে জর্জ রেকাবিটা টেনে নিল। ছুরি দিয়ে কেটে কেকটাকে কয়েকটা অংশে ভাগ করতে দেখে ক্লো হা-হা করে উঠল। ‘না না, ওদের দিতে হবে না। তুমি খাও।’

‘তা হয় না, কাকি। ছোটদের না দিয়ে আমি একা বুঝি খেতে পারি!’

ক্লোর শত নিষেধ সত্ত্বেও জর্জ আধখানা কেকই মস আর পেট-এর মধ্যে ভাগ করে দিল। ওরা তখন বেঞ্চির তলা ছেড়ে পায়া ভাঙা টেবিলটার নিচেই হুড়োহুড়ি করছিল। কৃত্রিম রাগে টেবিলের নিচে লাথি চালিয়ে ক্লো হুঙ্কার ছাড়ল, ‘এই কালো ভূত কোথাকার, দেখতে পাচ্ছিস না তোদের মনিব এখানে দাঁড়িয়ে রয়েছে? যা, বেরিয়ে যা সব ঘর থেকে। মুখভর্তি থাকা অবস্থাতেই জর্জ বলল, ‘আঃ ক্লো চাচি, ওরা ছোট, কেন ওদের মিছিমিছি এভাবে বকছ?’

‘তুমি জানো না মাস্টার জর্জ, ছোট হলে কী হবে, ওগুলো এক-একটা রামবিচ্ছু। যত দাও না কেন, খিদে ওদের আর কিছুতেই মিটবে না। তারপর হঠাৎ বাচ্চাগুলোর দিকে ফিরে ক্লো আবার ধমক লাগাল। ‘কিরে, এখনো এখানে দাঁড়িয়ে রয়েছিস? শিগগির বেরিয়ে যা বলছি। নইলে মাস্টার জর্জ চলে যাবার পর তোদের জামার বোতামঘর ঠিক নিচে নামিয়ে দেব।’

জামার বোতামঘর নিচে নামিয়ে দেয়ার মধ্যে ভয়ঙ্কর রকমের কোনো আতঙ্ক জড়ানো আছে কিনা স্পষ্ট বোঝা না গেলেও, বাচ্চা-দুটো কিন্তু সুড়সুড় করে বাইরে বেরিয়ে গেল। ছোট ছেলেটাকে কোলে তুলে নিয়ে ক্লো বসল টমের পাশে হাত ভাঙা চেয়ারটায়।

জর্জ বলল, ‘জানো ক্লো চাচি, তোমার কেকে এমন সুন্দর একটা রঙ হয় যা আমি আর কোথাও দেখি নি।’

ক্লো ঠোঁট টিপে মুচকি হাসল, ‘হবেই তো, রাঁধুনি হিসেবে কি আমার কম নাম-ডাক?’

‘তবে টম লিনকন কী বলে জানো তো ক্লো চাচি?’

‘কী?’

‘ও বলে রাঁধুনি হিসেবে জিনি নাকি তোমার চাইতেও ভালো।’

‘আরো রাখো তো তোমার টম লিনকনের কথা। জিনিকে যে আমি নিজে হাতে রান্না শিখিয়েছি, সে খবর তো আর টম লিনকন জানে না। জিনি পারবে আমার মতো পেস্টি রাঁধতে, যা মুখে দিলেই গলে যায়?’

‘হ্যা, তা অবশ্য সত্যি।’ জর্জের ঠোঁটের প্রান্তে ফুটে উঠল দুষ্টুমির হাসি। আমিও টম লিনকনকে তাই বলেছি। আমার ক্লো চাচির হাতে পাই খেলে কোনোদিন ভুলতে পারবি না।’

‘তুমি তাই বলেছ বুঝি?’

‘হ্যাঁ।’

‘ঠিক আছে, এবার একদিন মাস্টার লিনকনকে চিকেন পাই করে খাওয়াব।’

‘তুমি তাই করো তো। সামনের সপ্তাহেই ওকে একদিন আমাদের বাড়িতে নেমন্তন্ন করব। সেদিন তুমি এমন ভালো করে চিকেন পাই বানাবে না ক্লো চাচি, যা খেয়ে ও দিন- পনেরো আর নড়তে না পারে।’

জর্জের বলার ভঙ্গিতে ক্লো হাসতে হাসতে লুটিয়ে পড়ল, টমও না হেসে পারল না। জর্জের স্বভাবটা হয়েছে ঠিক ওর মার মতো। যেমন হাসিখুশি, তেমিন সরল। মিষ্টি স্বভাবের জন্যেই ছোটবড় সবাই ওকে অসম্ভব ভালোবাসে। হাসি ঠাট্টা আর গল্প-গুজবে ওর সন্ধ্যেগুলো কেটে যায় টমকাকার কুঠরিতেই।

এমনি একসন্ধ্যায় টমকাকার কুঠরিতে যখন ওইসব ঘটছে, মনিবের নিভৃত বৈঠকখানায় তখন ঘটে চলেছে সম্পূর্ণ অন্য এক দৃশ্য।

দাসব্যবসায়ী আর মিস্টার শেলবি, টেবিলের দুপ্রান্তে দুজন বসে রয়েছেন। টেবিলের ওপর ছড়ানো রয়েছে কাগজপত্র আর খেলার সরঞ্জাম।

তোড়া থেকে স্বীকৃতিপত্রগুলো বেছে নিয়ে মিস্টার শেলবি প্রথমে গুনে দেখলেন, তারপর সেগুলো এগিয়ে দিলেন হ্যালির দিকে। হ্যালিও সেগুলো খুব সাবধানে একটা একটা করে গুনল।

‘হ্যাঁ, ঠিক আছে। এবার অনুগ্রহ করে এগুলো সই করে দিন।’

বিক্রয়-দলিলগুলো দ্রুত টেনে নিয়ে শেলবি এমনভাবে সই করে সেগুলো ফিরিয়ে দিলেন যেন এই জঘন্য ব্যাপারটা যত তাড়াতাড়ি মেটে ততই ভালো। পুরনো একটা থলি থেকে রীতিমতো জীর্ণ হয়ে আসা চামড়ার কাগজখানায় একবার করে হ্যালি এক ঝলক চোখ বুলিয়ে নিল, তারপর বাড়িয়ে দিল শেলবির দিকে। শেলবি নিতান্ত হেলা ভরেই সেটা গ্রহণ করলেন।

মিছিমিছি আর অপেক্ষা না করে হ্যালি উঠে পড়ল। ‘যাক, কাজটা তাহলে মিটল!’ অনেকটা স্বপ্নাচ্ছন্নের মতো গভীর একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে শেলবি বললেন, ‘হ্যাঁ, মিটল।’

‘মনে হচ্ছে আপনি তেমন খুশি হতে পারেন নি?’

‘হ্যালি, আশা করি তুমি নিশ্চয়ই তোমার প্রতিশ্রুতির কথা মনে রাখবে। টমকে অন্য কোথাও বিক্রি করার আগে অবশ্যই খোঁজ নেবে লোকটা কেমন। তুমি বিশ্বাস করো, নিতান্ত বাধ্য না হলে টমকে আমি সত্যিই বিক্রি করতাম না।’

‘নিতান্ত বাধ্য না হলে আমি নিগ্রোদের ওপর কখনো খারাপ ব্যবহার করি না। তবে কথা যখন দিয়েছি টমকে বেচার সময় নিশ্চয় কোনো ভালো লোকের কাছেই বেচব।’

হ্যলির এই আশ্বাসবাণী সত্ত্বেও শেলবি এতটুকুও স্বস্তি পেলেন না। তাই হ্যালি নীরবে বিদায় নেবার পরেও একটা চুরুট ধরিয়ে তিনি দীর্ঘক্ষণ চুপচাপ বসে রইলেন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *