২০. সমাজ

বিংশ অধ্যায় – সমাজ

১. সামাজিক পরিবর্তন

আলোচ্য যুগে স্ত্রীলোকের অবস্থার যে পরিবর্তন হইয়াছে তাহা যুগান্তকারী বলিলে কিছুমাত্র অত্যুক্তি করা হইবে না। দুই সহস্র বৎসরে যাহা হয় নাই বর্তমান শতকের তৃতীয় ও চতুর্থ দর্শকে অর্থাৎ, কুড়ি বৎসরে তাহা সাধিত হইয়াছে। বাল্যবিবাহ, অবরোধ প্রথা, শিক্ষার অভাব, সর্ববিষয়ে সম্পূর্ণরূপে চিন্তায় ও কার্যে স্ত্রীলোকেরা স্বাতন্ত্রের যোগ্য নহে–প্রাচীনকালের মনুসংহিতার এই নির্দেশ এবং মধ্যযুগে পুরুষের বহুবিবাহ-এই সমুদয়ের ফলে স্ত্রীজাতির যে অধোগতি হইয়াছিল বৈদিক যুগের শেষভাগ হইতে উনিশ শতকের শেষ পর্যন্ত যে তাহা অব্যাহত ছিল তাহা এই গ্রন্থের তৃতীয় খণ্ডে সবিস্তারে বর্ণিত হইয়াছে। বিংশ শতকের প্রথম দুই শতকেও অবস্থার বিশেষ কিছু উন্নতি হয় নাই। বহু-বিবাহরূপ কুপ্রথা যে বর্তমান শতকের প্রথম দুই শতকেও প্রচলিত ছিল এবং আইন দ্বারা তাহা রহিত করিবার নিষ্ফল চেষ্টার কথা এই গ্রন্থের তৃতীয় খণ্ডে বর্ণিত হইয়াছে। কিন্তু, আলোচ্য যুগের শেষে বিনা-আইনেই এই প্রথা প্রায় লোপ পাইয়াছিল। এই শতকের প্রথমভাগেও ভদ্রঘরের স্ত্রীলোকেরা ঘোড়ার গাড়ী বা পাল্কীতে দরজা জানালা বন্ধ করিয়া যাইতেন। আলোচ্য যুগের শেষে কোন শ্রেণীর স্ত্রীলোকেরাই ট্রামে বাসে ভ্রমণ করিতে দ্বিধা বোধ করিতেন না।

ভদ্রঘরের মেয়েরা আফিসে যাওয়া তো দূরের কথা, কলেজে ছেলেদের সঙ্গে এক ক্লাসে বসিতে সঙ্কুচিত হইতেন। আলোচ্য যুগের শেষে ইহা কেহ অস্বাভাবিক বলিয়া মনে করিত না। বাল্যবিবাহ এখন প্রায় লোপ পাইয়াছে। বস্তুতঃ আলোচ্য যুগের শেষে ছেলেদের ন্যায় মেয়েদেরও বিবাহযোগ্য বয়সের নিম্ন সীমানা প্রায় ১৪/১৫ উঠিয়াছিল, ঊর্ধ্ব সীমানা নির্দিষ্ট ছিল না। চিরকুমারের ন্যায় চিরকুমারীও একেবারে দুর্লভ ছিল না।

এই শতকের প্রথমেও কেহ বিদ্যাশিক্ষার্থে সমুদ্র পার হইয়া বিলাতে গেলে সে জাতিচ্যুত হইত, প্রায়শ্চিত্ত করিয়া সমাজে পুনরায় স্থান পাইত। এখন স্ত্রী-পুরুষ কাহারও পক্ষে সমুদ্রযাত্রা নিষিদ্ধ নহে।

পূর্বে সমাজের অস্পৃশ্যতা ও ব্রাহ্মণ-বৈদ্য-কায়স্থ প্রভৃতি বিভিন্ন বর্ণের একত্রে ভোজন ও পরস্পরের অনুগ্রহণ নিষিদ্ধ ছিল–তাহা লুপ্ত না হইলেও হ্রাস পাইয়াছে। অসবর্ণ বিবাহও আলোচ্য যুগের শেষে আরম্ভ হইয়াছিল।

এইসব পরিবর্তনের মূলে আছে স্ত্রীলোকের উচ্চশিক্ষা এবং সামাজিক চিন্তা ধারার পরিবর্তন। অতঃপর এই দুইটি বিষয় আলোচনা করিব।

২. স্ত্রী-শিক্ষা

পূর্ববর্তী অধ্যায়ে কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় সম্বন্ধে স্যাডলার কমিশনের রিপোর্ট উল্লিখিত হইয়াছে। ইহাতে বঙ্গদেশের স্ত্রী-শিক্ষা সম্বন্ধে সুদীর্ঘ আলোচনা আছে এবং এ বিষয়ে কয়েকজন বিশিষ্ট বাঙ্গালীর মতামতের উল্লেখ আছে। ১৯১৭-১৮ সনে বম্বে প্রভৃতি অন্য প্রদেশের তুলনায় স্ত্রী-শিক্ষা সম্বন্ধে বাঙ্গালীর যে ঔদাসীন্য, এমনকি বিরোধী মনোভাবের পরিচয় পাওয়া যায় তাহার উল্লেখ করিয়া রিপোর্টে মন্তব্য করা হইয়াছে যে, যে-প্রদেশের লোক ছেলেদের আধুনিক শিক্ষার জন্য এত উদ্গ্রীব ও তৎপর, তাহাদের পক্ষে মেয়েদের সম্বন্ধে এই মনোবৃত্তি সত্যই বিস্ময়কর।

স্যার গুরুদাস ব্যানার্জীর অভিমত এই : “অবরোধ ও বাল্যবিবাহ প্রথা স্ত্রীলোকের উচ্চশিক্ষার (অর্থাৎ, সাধারণ লোক উচ্চশিক্ষা মনে করে) প্রধান অন্ত রায়। কিন্তু এই দুইটি প্রথার বিশেষ উপযোগিতা ও উপকারিতা আছে। বুদ্ধিবৃত্তির বিকাশে সাহায্য না করিলেও ইহারা আধ্যাত্মিক উন্নতি সাধন করিয়াছে এবং বাঙালী হিন্দু মাতা ও স্ত্রীর আদর্শ উন্নত করিয়া পরিবারের সুখ ও শান্তি বিধান করিয়াছে।”

খুলনা জিলার অন্তর্গত দৌলতপুর গ্রামে ‘দৌলতপুর হিন্দু একাডেমির প্রতিষ্ঠাতা এবং কলিকাতা হাইকোর্টের খ্যাতনামা উকিল ব্রজলাল চক্রবর্তী যে অভিমত প্রকাশ করিয়াছিলেন তাহার সারমর্ম এই : “পরিবারের নিয়মকানুন প্রধানতঃ স্ত্রীলোকেরাই রক্ষা করে। হিন্দুশাস্ত্রের স্পষ্ট নির্দেশ এই যে, স্বীয় পরিবারের বাহিরে আর কাহারও প্রভাব দ্বারা তাহারা পরিচালিত হইবে না। পারিবারিক ব্যাপারের সহিত স্কুল-কলেজের শিক্ষার কোন সঙ্গতি নাই। সুতরাং এই শিক্ষা সর্বথা পরিত্যাজ্য। গৃহকার্য হইতেই স্ত্রীলোকেরা নৈতিক ও ব্যবহারিক জীবনের যথেষ্ট শিক্ষা (sufficient moral and practical training) পায় এবং এই শিক্ষা স্কুলের শিক্ষা অপেক্ষা অধিকতর প্রয়োজন।”[২] আরও অনেকে স্যাডলার কমিশনের প্রশ্নাবলীর উত্তরে এইপ্রকার অভিমত প্রকাশ করিয়াছেন।

পাশ্চাত্ত্য শিক্ষার প্রতি নেতৃস্থানীয় উচ্চপদস্থ ব্যক্তির এইরূপ মনোভাবের জন্যই বঙ্গদেশ স্ত্রী-শিক্ষা বিষয়ে কত পশ্চাৎপদ ছিল নিম্নলিখিত সংখ্যা দ্বারাই তাহা বোঝা যাইবে। ১৯১৭ সনে বঙ্গদেশে দুই কোটি বিশ লক্ষ স্ত্রীলোকের মধ্যে ইউরোপীয়ান ও অ্যাংলো ইণ্ডিয়ান বাদ দিয়া কেবলমাত্র ৪৯১ (চারিশত একানব্বই) জন উচ্চ ইংরেজী বিদ্যালয়ের প্রথম চারি শ্রেণীতে পড়িত। কারণ, প্রাথমিক বিদ্যালয়ে যে মেয়েরা ভর্তি হইত তাহাদের মধ্যে ৯৮.৩ (আটানব্বই দশমিক তিন) জনেরও বেশির ভাগের পড়াশোনা ঐ বিদ্যালয়েই শেষ হইত। সুতরাং ঐ তারিখে বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্তর্গত মেয়ে-কলেজের ছাত্রীসংখ্যা ছিল মাত্র ১৪৪। আর একটি লক্ষণীয় বিষয় এই যে, মেয়েদের জন্য যে ১৪টি উচ্চ ইংরেজী বিদ্যালয় (H.E.School) ছিল তাহার মধ্যে চারিটি সরকারী এবং সাতটি ছিল মিশনারী স্কুল। যে তিনটি বেসরকারী স্কুল ছিল তাহার মধ্যে দুইটি সরকারী সাহায্য পাইলেও সেখানে শিক্ষাদানের ব্যবস্থা মোটেই ভাল ছিল না। এই সময় বাঙ্গালী ছাত্রদের শিক্ষার ব্যবস্থার সহিত তুলনায় ছাত্রীদের শিক্ষার ব্যবস্থা কত নিকৃষ্ট ছিল এই সংখ্যাগুলি হইতেই তাহা বোঝা যাইবে। স্ত্রী-শিক্ষা সম্বন্ধে ঔদাসীন্য ও প্রতিকূলতা ছাড়াও ইহার অন্য একটি কারণ ছিল, উপযুক্ত শিক্ষয়িত্রীর অভাব। কারণ যে অল্পসংখ্যক ছাত্রী উচ্চশিক্ষা পাইত তাহারা সাধারণতঃ পুরুষ অভিভাবকের সঙ্গে না থাকিতে পারিলে শিক্ষয়িত্রীর পদ গ্রহণ করিত না।[৩]

স্যাডলার রিপোর্টের পরবর্তী ১৫ বৎসরের মধ্যে বঙ্গদেশে স্ত্রী-শিক্ষার দ্রুত উন্নতি পরিলক্ষিত হয়। শিক্ষিত সম্প্রদায়ের মনোভাবের পরিবর্তনে ১৯২৯ সনে ‘সর্দা আইনে’ ১৪ বৎসরের কম বয়সের মেয়েদের বিবাহ নিষিদ্ধ হওয়ায় বাল্যবিবাহের হ্রাস এবং অবরোধ প্রথার লোপ–এই সমুদয়ই এই উন্নতির কারণ। ১৯৩২-৩৭ সনের পঞ্চবার্ষিকী রিপোর্টে দেখা যায়, বঙ্গদেশে হিন্দু ছাত্রীদের সংখ্যা এই পাঁচ বৎসরে কলেজে এবং স্কুলের উচ্চশ্রেণী ও নিম্নশ্রেণীতে যথাক্রমে শতকরা ১১১.৬, ১১১.৪ এবং ৮৪.৯ বৃদ্ধি পায় এবং প্রাথমিক শিক্ষায় শতকরা ৩০.৭ বৃদ্ধি পায়।[৪] মুসলমান স্ত্রীলোকদের মধ্যেও এই সময়ে আধুনিক শিক্ষার প্রচার ও প্রসার হয়।

১৯৩১-৩২ সনে সকলপ্রকার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মোট ছাত্রীসংখ্যা ৩৫৯,৭১২। পাঁচ বৎসর পরে ইহা বাড়িয়া হয় ৭৩৩,৩৮৯। ১৯৪০ সনে কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে কেবলমাত্র মেয়েদের শিক্ষার জন্য আটটি কলেজ ছিল-কলিকাতায় বেথুন কলেজ, লরেটো হাউস, ভিক্টোরিয়া ইনস্টিটিউশন, গোখেল মেমোরিয়াল গার্লস কলেজ, সাউথ ক্যালকাটা গার্লস কলেজ ও লেডী ব্রাবোর্ণ কলেজ, শিলং-এ সেন্ট মেরীস্ কনভেন্ট এবং কার্সিয়াং-এ সেন্ট হেলেন কলেজ।

কলিকাতায় বিদ্যাসাগর কলেজে, আশুতোষ কলেজে ও (কেবল বি.টি. পরীক্ষার জন্য) স্কটিশ চার্চ কলেজে এবং শিলচর গুরুচরণ কলেজে মেয়েদের জন্য পৃথক্ ক্লাস ছিল। মেডিক্যাল কলেজেও ছাত্রীরা পড়িতে পারিত।

১৯২১ সনে প্রতিষ্ঠিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কথা পূর্বেই বলা হইয়াছে। প্রথমে দুইটি মাত্র ছাত্রী ছিল। ১৯৩৮-৩৯ সনে এই সংখ্যা বাড়িয়া হয় ৭০। আলোচ্য যুগের শেষে তাহাদের সংখ্যা অনেক বাড়িয়াছিল এবং তাহাদের পৃথক হোষ্টেল, ইউনিয়ন, বাৎসরিক সম্মেলন, বার্ষিক পত্রিকা প্রভৃতি ছিল। প্রথম কয়েক বৎসর শিক্ষকেরা ছাত্রীদের সঙ্গে করিয়া বসিবার ঘর হইতে ক্লাসে নিয়া আসিতেন এবং সঙ্গে করিয়া ফিরাইয়া নিয়া যাইতেন।

কেবল বঙ্গদেশে নহে, সমগ্র ভারতে স্ত্রী-শিক্ষার কিরূপ দ্রুত প্রসার হইয়াছিল নিম্নলিখিত সংখ্যাদ্বারা তাহা বোঝা যাইবে। ১৯২১-২২ সনে মোট ছাত্রীসংখ্যা ছিল ১২,২৪,১২৮; ১৯৪৬-৪৭ সনে এই সংখ্যা বাড়িয়া হইয়াছিল ৪২,৯৭,৭৮৫ অর্থাৎ আলোচ্য যুগের শেষ ২৫ বৎসরে ছাত্রীসংখ্যা ৩০ লক্ষ বাড়িয়াছিল এবং বৃদ্ধির পরিমাণ ছিল সাড়ে তিন গুণ। এই ২৫ বৎসরে প্রাথমিক শিক্ষালয়ে ছাত্রীসংখ্যা ১১,৮৬,২২৪ হইতে ৩৪,৭৫,১৬৫; উচ্চ ইংরেজী বিদ্যালয়ে ছাত্রীসংখ্যা ২০,১৬৩ হইতে ৬,০২,২৮০ এবং কলেজের ছাত্রীসংখ্যা ৯০৫ হইতে বাড়িয়া ২৩,২০৭ হইয়াছিল। এই তুলনামূলক সংখ্যা দ্বারা আলোচ্য যুগে স্ত্রী-শিক্ষার যুগান্তকারী পরিবর্তন সম্বন্ধে ধারণা করা যাইবে।৬

৩. দলবদ্ধ নারী-আন্দোলন

স্ত্রী-জাতির নবজাগরণের আর-একটি বিশিষ্ট লক্ষণ নিজেদের উন্নতিসাধন এবং অভাব-অভিযোগ দূর করিবার জন্য দলবদ্ধ আন্দোলনের ব্যবস্থা করা। রবীন্দ্রনাথের ভগ্নী স্বর্ণকুমারী দেবীর সাহিত্যিক অবদানের কথা তৃতীয় খণ্ডে উল্লিখিত হইয়াছে। বঙ্গদেশে-নারী আন্দোলনের তিনিই ছিলেন অগ্রণী। ১৮৮৬ সনে তিনি একটি মহিলা সমিতি স্থাপন করেন। কিন্তু ইহা বিশেষ ফলপ্রসূ হয় নাই। আলোচ্য যুগে বঙ্গদেশে গুরুসদয় দত্ত আই.সি.এস-এর পত্নী সরোজনলিনী বিভিন্ন জিলায় এবং অনেক শহরে ও গ্রামে স্ত্রীলোকের উন্নতির জন্য মহিলা সমিতি প্রতিষ্ঠা করিয়াছিলেন।

১৮৮৭ সনে Indian National Social Conference প্রতিষ্ঠিত হয়। প্রথমে মহাদেব গোবিন্দ রানাডে এবং ১৯০১ সনে তাঁহার মৃত্যুর পর স্যার নারায়ণ চন্দ্রভারকার ইহার নেতৃত্ব করেন। ১৯০৩ সনে ইহার সঙ্গে স্ত্রী-জাতির জন্য একটি পৃথক্‌ বিভাগ খোলা হয়। এই শাখা ১৯০৯ সনে ও পরে ১৯১০ সনে এলাহাবাদে একটি কনফারেন্সে স্ত্রী-জাতির জন্য একটি পৃথক্ প্রতিষ্ঠান স্থাপন করিতে মনস্থ করেন। সরলা দেবী এই কনফারেন্সের সেক্রেটারী ছিলেন।

সর্বভারতীয় মহিলা প্রতিষ্ঠানেও বাঙ্গালী রমণীরা সক্রিয় অংশগ্রহণ করিয়াছিলেন। ১৯১৭ সনে Women’s Indian Association এবং তিন বৎসর পরে এই শ্রেণীর সর্বাপেক্ষা প্রসিদ্ধ ও শক্তিশালী প্রতিষ্ঠান Women’s Council of India বম্বে সহরে প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯২৬ সনে The All India Women’s Conference প্রতিষ্ঠিত হয়। ইহা আলোচ্য যুগের শেষ পর্যন্ত এবং তাহার পরেও খুব সক্রিয় ছিল। রীতিমত ইহার বার্ষিক অধিবেশন হইত। কেবল সামাজিক নহে, রাজনীতিক ক্ষেত্রেও নারীর উপযুক্ত স্থান অধিকার করিবার জন্য ইহা সার্থক আন্দোলন করিয়াছিল। শ্রীযুক্তা সরোজিনী নাইডু, সরলা দেবী এবং কমলা চট্টোপাধ্যায় যথাক্রমে ইহার চতুর্থ, ষষ্ঠ ও সপ্তদশ অধিবেশনে (১৯৪৪) নেত্রীত্ব করেন। এই সময়ে এই সভার সদস্যসংখ্যা ছিল পঁচিশ হাজারেরও অধিক এবং ইহার অধীনে ১৮০টি শাখা-সভা ছিল।

৪. সামাজিক সংস্কার বিষয়ে চিন্তাধারার পরিবর্তন

স্ত্রী-জাতির অবস্থার উন্নতি সাধনের আন্দোলন কেবলমাত্র স্ত্রী-জাতির মধ্যেই আবদ্ধ ছিল না। পাশ্চাত্ত্য শিক্ষার ফলে পুরুষদেরও এদিকে মনোযোগ আকৃষ্ট হইয়াছিল। ব্যক্তিগত চেষ্টা ছাড়াও এই উদ্দেশ্যে আইন-প্রণয়নেরও প্রস্তাব হইয়াছিল। কিন্তু প্রথমে তাহা সফল হয় নাই। কারণ ভারতীয় সামাজিক ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করা গভর্নমেন্টের নীতিবিরুদ্ধ ছিল এবং হিন্দু-সম্প্রদায়েরও বড় একটি রক্ষণশীল দল কোনরূপ সামাজিক সংস্কারের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করিত না, এমনকি অনেক সময়েই ইহার বিরুদ্ধাচরণ করিত। স্ত্রী-শিক্ষা বিষয়ে দুইজন বিশিষ্ট ও সম্মানিত হিন্দুনেতার যেরূপ অভিমত ছিল তাহা পূর্বেই উল্লিখিত হইয়াছে।

১৯১১ সনে ভূপেন্দ্রনাথ বসু কেন্দ্রীয় ব্যবস্থাপকসভায় Special Marriage Bill উপস্থাপিত করিয়াছিলেন। এই বিল অনুসারে কোন হিন্দু ইচ্ছা করিলে প্রচলিত ধর্মরীতি ও ধর্মানুষ্ঠান ছাড়াও বিবাহ করিতে পারিবে; কিন্তু বরের ও কনের বয়স হইবে যথাক্রমে অন্যূন ১৮ ও ১৪। কোন পুরুষ একাধিক বিবাহ করিতে পারিবে না, এবং এই বিবাহ রেজেস্ট্রী করিতে হইবে। কিন্তু এই প্রস্তাবের সপক্ষে হইল মাত্র ১১ ভোট এবং বিরুদ্ধে হইল ৪২ ভোট। এই বিরোধী ভোটদাতাদের মধ্যে মাত্র ১৭ জন নির্বাচিত বেসরকারী সদস্য ছিলেন। ১৯১৮ সনে বিঠলভাই প্যাটেল অসবর্ণ বিবাহ সিদ্ধ করিবার জন্য একটি আইনের প্রস্তাব করিলেন, কিন্তু ইহাও গৃহীত হইল না; অতিরিক্ত বরপণের বিরুদ্ধেও আন্দোলন হইয়াছিল। ১৯১৪ সনে স্নেহলতা নামে একটি বাঙ্গালী বালিকা যখন শুনিল যে, বরপণ দিবার জন্য তাহার পিতাকে বসতবাটী বন্ধক দিয়া টাকা কর্জ করিতে হইয়াছে তখন সে নিজের কাপড়ে কেরোসিন ঢালিয়া আগুন লাগাইয়া পুড়িয়া মরিল। ইহাতে সমগ্র দেশে বরপণের বিরুদ্ধে বিষম উত্তেজনার সৃষ্টি হইল। বহু। সভা-সমিতিতে বরপণ তুলিয়া দিবার প্রস্তাব গৃহীত হইল। যুবকেরা বহু সভা করিয়া সর্বজনসম্মুখে শপথ করিল, তাহারা বিবাহে কোন পণ লইবে না। কিন্তু, কিছুদিন পরেই সব আন্দোলন থামিয়া গেল এবং বরপণ ক্রমশঃই বাড়িতে লাগিল। (সম্প্রতি ১৯৭৫ সনে বরপণ বেআইনী বলিয়া ঘোষিত হইয়াছে)। এই সমুদয় আন্দোলনের ও স্ত্রী-জাতির অধিকার এবং মর্যাদা বৃদ্ধির জন্য শিক্ষিত সম্প্রদায়ের অধিকতর আগ্রহ ও উৎসাহের ফলে স্ত্রী-জাতির কল্যাণকর অনেকগুলি আইন বিধিবদ্ধ হয়। তন্মধ্যে কয়েকটি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।

(ক) ১৯২৯ সনে বাল্যবিবাহ নিষেধমূলক একটি আইন (Child Marriage Restraint Act) দ্বারা ১৪ বৎসর বয়সের পূর্বে কন্যার অথবা ১৮ বৎসর বয়সের আগে পুত্রের বিবাহ দণ্ডনীয় অপরাধ বলিয়া গণ্য হয়। এই আইনের প্রস্তাবক হরবিলাস সর্দার-নামানুসারে এই আইনটিকে সাধারণতঃ ‘সর্দা আইন’ বলা হয়। ঐ বৎসরই একটি আইন দ্বারা পৌত্রী, দৌহিত্র, ভগ্নী ও ভাগিনেয় উত্তরাধিকারীর তালিকায় স্থান পান।

(খ) ১৯৩৭ সনে এই মর্মে এক আইন পাশ হয় যে, মৃত ব্যক্তির কোন উইল থাকিলে তাহার পুত্র ও বিধবা স্ত্রী তাহার সম্পত্তির সমান অধিকারী হইবে।

(গ) ১৯৪৩ সনের পর এক আইনের (Maternity Benefit Act) ফলে। কলকারখানার নারী-শ্রমিকেরা গর্ভাবস্থায় অনেক সুখসুবিধা ভোগ করিতে পারিবে।

(ঘ) কলকারখানার নারী-শ্রমিকদের দৈনিক কার্যকাল কয়েকটি আইন দ্বারা ক্রমশঃ হ্রাস করা হয়। ১৮৯১ সনের আইনে দৈনিক কার্যকাল অনধিক ১১ ঘন্টা হইবে এবং ইহার মধ্যে দেড়ঘণ্টার অবসর থাকিবে। ১৯৩৪ সনে ইহা কমাইয়া দশ ঘন্টা করা হয়। ১৯৪৮ সনে ইহা কমাইয়া দৈনিক নয় ঘণ্টা এবং সপ্তাহে অনধিক ৪৮ ঘণ্টা করা হয়; শ্রমিকদের অন্যান্য সুবিধাও দেওয়া হয়। ইহা ছাড়াও ১৯২২, ১৯৩২ ও ১৯৪৫ সনে অনেক আইন হয়।৭

১৯১৭ সনে মেয়েদের বিধানসভার নির্বাচনে ভোট দিবার অধিকারের জন্য আন্দোলন আরম্ভ হয়। ভারত সচিব মন্টেগু ভারতে আসিলে সরোজিনী নাইডুর নেত্রীত্বে চৌদ্দজন স্ত্রীলোকের এক ডেপুটেশন তাহার সহিত সাক্ষাৎ করিয়া (১৮ই ডিসেম্বর, ১৯১৭) রাজনীতিক অধিকার ও অন্যান্য ক্ষেত্রে পুরুষের ও স্ত্রীলোকের সমান অধিকার দাবি করে। ইহার ফলে ১৯১৯ সনের ভারতশাসন সংস্কার আইনের নির্দেশ অনুসারে বঙ্গদেশের বিধানসভার নির্বাচনে ভোট দিবার ও ঐ সভার সদস্যপদের প্রার্থী হইবার অধিকারসূচক এক প্রস্তাব বঙ্গদেশের বিধানসভায় গৃহীত হয় (অগষ্ট, ১৯২৫)। ১৯২৯ সনের মধ্যে ভারতের অন্যান্য প্রদেশেও স্ত্রীলোকদের এই অধিকার দেওয়া হয়।

পূর্বোক্ত বিধানগুলি ছাড়াও ১৯৪৬ সনের Hindu Marriage Disability Removal Act, ১৯৫৪ সনের Special Marriage Act, ১৯৫৫ সনের Hindu Succession Act এবং ১৯৫৬ সনের Hindu Adoption and Maintenance Act প্রভৃতি আইনের দ্বারা বিবাহ, উত্তরাধিকার, পোষ্যপুত্রগণ প্রভৃতি বিষয়ে হিন্দু স্ত্রীলোকেরা পুরুষের সহিত সমান অধিকার পাইয়াছে। এই গ্রন্থের আলোচ্য যুগে ইহা যে অনেকাংশে নারী-আন্দোলনের এবং পুরুষের চিন্তাধারার বিবর্তনের ফল তাহাতে কোন সন্দেহ নাই। ইহার প্রমাণস্বরূপ বলা যাইতে পারে যে, কেবল হিন্দু স্ত্রীলোকেরাই ঐ সমুদয় আইন দ্বারা উপকৃত হইয়াছে। মুসলমান বা অন্য কোন অহিন্দু সম্প্রদায় সম্বন্ধে এই আইনগুলি প্রযোজ্য নহে।

৫. বৈপ্লবিক আন্দোলনে নারীর অবদান

আলোচ্য যুগে বঙ্গদেশের নারী-জাগরণের একটি বিশিষ্ট লক্ষণ কেবল রাজনীতিক আন্দোলনে নহে, বিপ্লববাদেও তাহারা সক্রিয় অংশগ্রহণ করিয়াছিল। ১৯০৬ সনে প্রাদেশিক কনফারেন্সে সরোজিনী বসু শপথ নিয়াছিলেন যে, যতদিন গভর্নমেন্ট ‘বন্দে মাতরম্’ সঙ্গীত গাহিবার বা ঐ দুইটি শব্দ উচ্চারণের নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করে ততদিন তিনি সোনার চুড়ি হাতে পরিবেন না। স্বদেশী আন্দোলনের সময় এবং বিলাতীবর্জন আন্দোলনে পিকেটিং প্রভৃতিতে চিত্তরঞ্জন দাশের পত্নী বাসন্তী দেবী এবং আরও অনেকে যে কারাবরণ করিয়াছিলেন তাহা পূর্বেই বলা হইয়াছে। সরোজিনী নাইডু যে আইন-অমান্য আন্দোলনে এবং সাধারণভাবে রাজনীতিক অহিংস সংগ্রামে সক্রিয় অংশগ্রহণ করিয়াছিলেন তাহাও পূর্বেই বলা হইয়াছে। কমলা চট্টোপাধ্যায় অসহযোগ আন্দোলনে সক্রিয় অংশগ্রহণ করিয়া কারাদণ্ড ভোগ করিয়াছিলেন। পরে তিনি ও অন্য কয়েকজন মিলিয়া All India Congress Socialist Party প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি আমেরিকা ও ইউরোপে ঘুরিয়া তথাকার সাম্যবাদীদের (Socialist) সহিত যোগসূত্র স্থাপন করেন। লতিকা ঘোষ ‘মহিলা রাষ্ট্রসংঘ’ প্রতিষ্ঠা করেন। প্রায় ছয়মাসকাল ইহার সদস্যেরা বিলাতীদ্রব্যের দোকানে পিকেটিং করেন এবং পুলিশ অনেককেই গ্রেপ্তার করে। ইহারা স্কুল কলেজেও পিকেটিং করেন। ঊর্মিলা দেবী নারী সত্যাগ্রহ কমিটি প্রতিষ্ঠা করেন এবং সরকারী নিষেধাজ্ঞা অমান্য করিয়া শোভাযাত্রা বাহির করেন। বিদেশীদ্রব্য বর্জন, পিকেটিং, স্বদেশী প্রচার, প্রভাতফেরী, চরকা ও তলির প্রচলন, সভাসমিতি করিয়া স্বদেশী মত প্রচার ও বিদেশী বর্জনের জন্য সর্বত্র মহিলা সমিতির প্রতিষ্ঠা, হিন্দু-মুসলমানের ঐক্য সাধন, পর্দা ও অস্পৃশ্যতা দূরীকরণ, বিনাবিচারে বন্দী যুবকদের আদালতে বিচারের জন্য আবেদন, সর্বত্র মহিলাদিগকে জাতীয় কংগ্রেসে যোগদানের আমন্ত্রণ, প্রভৃতি ইহাদের কর্মসূচির অন্তর্গত ছিল। এইরূপ বহু মহিলা সমিতি বঙ্গদেশের নানা স্থানে প্রতিষ্ঠিত হইয়াছিল।

কেবল অহিংস আন্দোলনে নহে, হিংসাত্মক সশস্ত্র বিপ্লববাদের মন্ত্রেও অনেক বঙ্গনারী দীক্ষিত হইয়াছিলেন। ইঁহাদের মধ্যে প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার সুপরিচিত, তাঁহার নাম পূর্বেই করা হইয়াছে। আর কয়েকজনের বিবরণ সংক্ষেপে উল্লেখ করিতেছি।

১-২। ১৯৩১ সনের ১৪ই ডিসেম্বর কুমিল্লা স্কুলের ছাত্রীদ্বয়-শান্তি ঘোষ ও সুনীতি চৌধুরী কুমিল্লার ম্যাজিষ্ট্রেট C.G.B. Stevens-এর বাড়ীতে তাহাকে রিভলভার দিয়া হত্যা করেন।

৩। কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বার্ষিক কনভোকেশনে (৮ই ফেব্রুআরি ১৯৩২) বীণা দাস (পরে ভৌমিক) চ্যান্সেলার Stanley Jackson-এর প্রতি তিন চারিটি গুলি ছোঁড়েন, কিন্তু গুলি লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়।

৪। কল্পনা দত্ত চট্টগ্রামের সূর্য সেনের দলের বিপ্লবী। তাঁহার যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের আদেশ হয়।

৫। ডায়োসেসন কলেজের ছাত্রী জ্যোতিকণা দত্ত ঐ কলেজের হোষ্টেলে থাকিতেন। তাঁহার নিকট দুইটি ছয়ঘরা রিভলভার, দুইটি পিস্তল আর ৫৩টা কাজ পাওয়া যায় (অগষ্ট, ১৯৩৩)। তাঁহার চারি বৎসর সশ্রম কারাদণ্ড হয়।

৬। দার্জিলিংয়ের নিকটবর্তী লেবং মাঠে লাটসাহেব অ্যাণ্ডারসনকে হত্যা করার নিষ্ফল চেষ্টা হয় (১৯৩৪, ৮ই মে)। উজ্জলা মজুমদার (পরে রক্ষিত) এই ষড়যন্ত্রে লিপ্ত থাকার অপরাধে ধৃত হন। বিচারে ১৪ বৎসর সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডিত হন।

৭। চব্বিশ পরগণার অন্তর্গত টিটাগড়ে বিপ্লবীদের এক আস্তানায় (১৯৩৫, ২০শে জানুআরি) খানাতল্লাসী করিয়া পারুল মুখোপাধ্যায়কে বহু পরিমাণ রাসায়নিক দ্রব্যাদি সমেত একটি ঘরের মধ্যে পাওয়া যায়-তাঁহার সম্মুখে তখন পাকার কাগজপত্র পুড়িতেছে। তাহার তিন বৎসর সশ্রম কারাদণ্ড হয়।

এইসকল বীরাঙ্গনাগণ বিপ্লবে সক্রিয় অংশগ্রহণ করিয়াছিলেন। কিন্তু, আর একদল মহিলা প্রাণের মায়া তুচ্ছ করিয়া বিপ্লবীদের নানাভাবে সাহায্য করিতেন। চট্টগ্রামের বিপ্লবীদের মধ্যে অনেকে নানা স্থানে আত্মগোপন করিয়া বাস করিতে বাধ্য হন। তাঁহাদের সাহায্য করা, তাঁহাদের মধ্যে যোগাযোগ স্থাপন করা, চিঠিপত্র আদান-প্রদান করা, ঔষধপত্র ও জামাকাপড় একস্থান হইতে অন্যস্থানে প্রেরণ করা, বিপ্লবীদের পত্রিকার জন্য লেখা সংগ্রহ করা এবং তাঁহাদের গোপন বাসস্থানে জীবনধারণ করার জন্য অর্থ সংগ্রহ করা–এই সমুদয় কাজে অনেক তরুণী, অধিকাংশই ছাত্রী নিযুক্ত ছিলেন; কারণ, প্রথম প্রথম পুলিশ তাঁহাদের সন্দেহ করিত না। কিন্তু ধরা পড়িলে পরিণাম কী হইবে ইহা জানিয়াও স্বেচ্ছায় এই সমুদয় বিপদ তাঁহারা মাথা পাতিয়া লইয়াছিলেন।[১০]

আর একদল মহিলা প্রাণের ভয় তুচ্ছ করিয়া নিজ গৃহে বিপ্লবীদের আশ্রয় দিতেন। এই প্রসঙ্গে সাবিত্রী দেবীর নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। নূতন আইন (Ordinance) অনুসারে বিপ্লবীদের আশ্রয়দানের জন্য দণ্ড অনেক বাড়ানো সত্ত্বেও চট্টগ্রাম শহর হইতে দশ মাইল দূরে ধলঘাট গ্রামের সাবিত্রী দেবী পলাতক ‘মাষ্টারদা’ (সূর্য সেন), তাহার বিশ্বস্ত অনুচর নির্মল সেন, অপূর্ব সেন ও প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদারকে স্বগৃহে আশ্রয় দিয়াছিলেন। ১৯৩২ সনের ১৩ই জুন রাত্রে পুলিশ ঐ বাড়ী ঘেরাও করে। নির্মল ও অপূর্ব Captain Cameron-এর নেতৃত্বে পুলিশদলকে দোতলায় সিঁড়ি দিয়া উঠিবার সময় গুলি করেন এবং উভয় দলে খণ্ডযুদ্ধ হয়। ইহার ফলে কাপ্তেন সাহেব এবং নির্মল ও অপূর্বের মৃত্যু হয়। কিন্তু এই খণ্ডযুদ্ধের সুযোগে মাষ্টারদা ও প্রীতিলতা বাঁশের মই-এর সাহায্যে রান্নাঘরের টীনের ছাদের উপর নামিয়া লাফ দিয়া মাটিতে পড়িয়া পলাইতে সমর্থন হন। সাবিত্রী দেবী ও তাঁহার পুত্রকে মেদিনীপুর জেলে আটক রাখা হয়। অসুস্থ অবস্থায় জেল কর্মচারীদের অযত্ন ও অত্যাচারে পুত্র রামকৃষ্ণ যখন মৃত্যুপথে অগ্রসর হইতেছিল, তখনও মাতার করুণ মিনতি সত্ত্বেও মাতা-পুত্রের সাক্ষাতের অনুমতি পাওয়া গেল না। রামকৃষ্ণের মৃত্যুর পর “সদাশয় জেল সুপারিন্টেন্টে সাবিত্রী দেবীকে সন্তান দর্শনের অনুমতি দিলেন। মৃতদেহ পড়ে আছে মাটিতে। দুজনের মাঝে লোহার গরাদের ব্যবধান। বাইরে থেকে একবার চোখের দেখা মাত্র। ভিতরে যাবার অনুমতি নাই। সাশ্রু নয়নে সন্তানহারা মা নিজ কারাকক্ষে ফিরে এলেন।”[১১]

প্রীতিলতা ধলঘাট হইতে কোনমতে মৃত্যুর হাত এড়াইলেন–কিন্তু, প্রায় তিন মাস পরেই তাহার বিপ্লবীজীবনের শেষ পরীক্ষা হয়। ১৯৩২ সনের ২৪শে সেপ্টেম্বর চট্টগ্রামের কয়েকজন বিপ্লবী বীরাঙ্গনা প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদারের নেতৃত্বে পাহাড়তলী (চট্টগ্রাম) ইউরোপীয়ান ক্লাব আক্রমণ করেন। সফল আক্রমণের পর সঙ্গীদের বিদায় দিয়ে প্রীতিলতা স্বেচ্ছায় পটাসিয়াম সায়ানাইড খেয়ে আত্মাহুতি দেন। উদ্দেশ্য, ভারতের স্বাধীনতা-সংগ্রামে যোগদানের জন্য প্রেরণা সঞ্চার করা। তাঁর মৃতদেহে জামার ভিতর স্বহস্তে ইংরেজীতে রচিত তাঁর বিদায়বাণী ও বক্ষসংলগ্ন শ্রীকৃষ্ণের একটি ছোট ছবি পাওয়া যায়। ধলঘাট যুদ্ধের পর রচিত প্রীতিলতার একটি প্রবন্ধ সূর্য সেনের গ্রেপ্তারের সময় সামরিক বাহিনীর হস্তগত হয়।”

মাষ্টারদার নিকট পত্রে প্রীতিলতা লিখিয়াছেন, “আমার জন্য ভাবিবেন না। আমার বুকে যিনি আছেন তিনিই আমাকে রক্ষা করিবেন।”১২ এই দৃঢ় ধর্মবিশ্বাস এবং উক্ত প্রবন্ধ ও বিদায়বাণীর উক্তি পড়িলে এই মহীয়সী মহিলার প্রতি শ্রদ্ধায় ও ভক্তিতে মস্তক অবনত হয়। আমরা ছাত্রজীবন হইতে ফরাসী রমণী Joan of Arc এর কাহিনী মুখস্থ করি, কিন্তু প্রীতিলতার নাম জানি না। রবীন্দ্রনাথ লিখিয়াছেন, “মৃত্যু প্রেমের কৃষ্টিপাথর-তুমি কাহাকেও যথার্থ ভালবাস কিনা, তাহার প্রমাণ–তুমি তাহার জন্য মরিতে পার কিনা।” প্রীতিলতা ও আর যেসব বঙ্গরমণী দেশের জন্য প্রাণ দিয়া বা দিতে প্রস্তুত হইয়া দেশপ্রেমের চরম পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হইয়াছেন তাঁহাদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাইয়া বঙ্গদেশে নারী-জাগরণের কাহিনী শেষ করি।

তথ্যনির্দেশ

১. Sadler Commission’s Report, II. P. 5

২. Sadler Commission’s Report, II. P. 5

৩. তদেব, পৃ. ৩

৪. Progress of Education in India, 1932-37 by John Sargent, Vol. I, P. 149

৫. Handbook of Indian Universities, 1940, by Inter-University Board, India, 1940, P. 205.

৬. Pratima Asthana-Women’s Movement in India, P. 143.

৭. History and Philosophy of Social Work in India, Edited by A.R. Wadia-second Edition, Pp. 83-85.

৮. এই প্যারার উক্তির জন্য দ্রষ্টব্য : Pratima Asthana, Women’s Movement in India, Pp. 119-25; Modern Review, 1930, P. 56.

৯. উল্লিখিত কাহিনীগুলির জন্য দ্রষ্টব্য : শ্রীকালীচরণ ঘোষ’জাগরণ ও বিস্ফোরণ।

১০. চট্টগ্রাম বিপ্লবের বহ্নিশিখা’-শ্রীশচীন্দ্রনাথ গুহ সম্পাদিত। এই গ্রন্থে শ্রীযুক্তা প্রমীলা দাস চৌধুরী ও শ্রীযুক্তা অনিমা বিশ্বাস লিখিত বিপ্লবী জীবনের স্মৃতি’ (পৃ. ৯২-১০০, ২৩২-৩৯) দ্রষ্টব্য।

১১. শ্রীকালীচরণ ঘোষ-জাগরণ ও বিস্ফোরণ, পৃ. ৫৬২-৬৪

১২. শচীন্দ্রনাথ গুহ সম্পাদিত চট্টগ্রামে বিপ্লবের বহ্নিশিখা’, ২৬২-৮৮ পৃ. দ্রষ্টব্য।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *