১৯. ধর্ম

ঊনবিংশ অধ্যায় – ধর্ম

 ১. রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশন

উনিশ শতকে বিরাট হিন্দুসমাজের মধ্যে যে সমুদয় ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র সম্প্রদায়ের উদ্ভব হইয়াছিল তাহা এই গ্রন্থের তৃতীয় খণ্ডে বর্ণিত হইয়াছে। বিংশ শতকে তাহাদের অস্তিত্ব থাকিলেও প্রভাব ছিল না। যে ব্রাহ্মসমাজ হিন্দুধর্ম ত্যাগ করিয়া তিনটি শাখায় বিভক্ত হইয়াছিল তাহার মধ্যে প্রথম দুইটি ‘আদি’ ও ‘নববিধান’ সমাজ উনিশ শতকের শেষেই প্রায় লুপ্ত হইয়াছিল। তৃতীয়টির, অর্থাৎ সাধারণ ব্রাহ্মসমাজের সদস্যসংখ্যাও আলোচ্য যুগের শেষে বঙ্গদেশে প্রতি লক্ষ অধিবাসীদের মধ্যে একজনের বেশী ছিল না। ১৯৫২ সনে ব্রাহ্মসমাজের বার্ষিক সম্মেলনে ইহার সভাপতি মন্তব্য করিয়াছেন, “আমরা এখন নগণ্য–দেশে আমাদের কোন মূল্য নাই।[১] ইহার কারণও সহজেই অনুমান করা যায়। কেশবচন্দ্রের আমল হইতেই ব্রাহ্মসম্প্রদায়ের সহিত দেশের অতীত ধর্ম ও সংস্কৃতির কোন নাড়ীর যোগ ছিল না। ব্রাহ্মগণ বলিতেন, যে গ্রন্থ পড়িলে আত্মার স্বরূপ উপলব্ধি ও চরিত্রের উন্নতি হয়–তাহাই আমাদিগের ধর্মগ্রন্থ এবং এইসকল সত্য যাহারা প্রচার করেন তাঁহারাই আমাদের গুরু। একজন প্রসিদ্ধ লেখক ইহার উপর মন্তব্য করিয়াছেন, যে ফুলগাছের শিকড় মাটির তলে থাকে, ব্রাহ্মধর্ম তাহার মত না হইয়া নানা গাছের ফুল ছিঁড়িয়া তাহার মালার মত শোভা পাইত; সুতরাং কিছুদিন পরেই শুকাইয়া গিয়াছিল।[২] ব্রাহ্মসমাজের একজন বিশিষ্ট নেতা পণ্ডিত শিবনাথ শাস্ত্রী লিখিয়াছেন : “আমাদের সম্প্রদায়ে আমাদের প্রাচীন ধর্মগ্রন্থ, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির পরিবর্তে পাশ্চাত্ত্যভাবেরই প্রভাব বেশী। আমরা দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রদর্শিত প্রাচীন হিন্দুর নীরব ধ্যানধারণার অপেক্ষা পাশ্চাত্তের সরব উপাসনা ও আধ্যাত্মিক পদ্ধতির দিকেই বেশী আকর্ষণ বোধ করি। প্রাচীন পদ্ধতির দিকে মনোযোগ দেওয়ার সময় আসিয়াছে, আর বিলম্ব করা উচিত নয়।[৩]

প্রচলিত হিন্দুধর্মেরও অনেক পরিবর্তন ঘটিয়াছে। এই গ্রন্থের তৃতীয় খণ্ডে শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংস ও স্বামী বিবেকানন্দের ধর্মমত আলোচনা করিয়া বলা হইয়াছে যে, স্বামী বিবেকানন্দ হিন্দুধর্মের যে রূপ দেশের সম্মুখে উপস্থাপিত করিয়াছিলেন তাহাই বর্তমান যুগে হিন্দুধর্মের স্বরূপ বলিয়া শিক্ষিত হিন্দুসমাজে গৃহীত হইয়াছে। এই ধর্মের মর্ম এই যে, বহুকালসঞ্চিত কুপ্রথা ও কুসংস্কার বর্জন করিয়া হিন্দুধর্মের যাহা চিরন্তন সত্য তাহাই গ্রহণ করিতে হইবে। এই কুপ্রথা ও কুসংস্কারগুলি সম্বন্ধে তিনি যে সমুদয় কঠোর মন্তব্য করিয়াছেন তৃতীয় খণ্ডে তাহা উল্লেখ করা হইয়াছে।

উনিশ শতকে সনাতন হিন্দুধর্ম ও ব্রাহ্মধর্মের মধ্যে যে প্রভেদ ঘটিয়াছিল রামকৃষ্ণ-বিবেকানন্দ তাহার একপ্রকার সমন্বয় করিয়াছেন এবং ইহাই হিন্দুধর্মের প্রকৃত স্বরূপ বলিয়া শিক্ষিত হিন্দুসমাজ গ্রহণ করিয়াছে। বিবেকানন্দ সংস্কারের পক্ষপাতী ছিলেন, কিন্তু সংস্কারের নামে সংহাররীতি অবলম্বন করেন নাই। হিন্দুধর্মরূপ বিশাল সৌধের একটি প্রধান স্তম্ভ মূর্তিপূজা এবং ইহা প্রথমেই হিন্দু ও ব্রাহ্মধর্মের মধ্যে প্রভেদ বা বিরোধের একমাত্র, অন্ততঃ প্রধান বিষয়বস্তু ছিল। ইহার বিরুদ্ধে রামমোহন ও তাহার অনুবর্তীদের সংগ্রাম যে সম্পূর্ণ ব্যর্থ হইয়াছে, ব্রাহ্মসমাজ স্থাপনার দেড়শত বৎসর পরেও কলিকাতায় শারদীয়া পূজার সময় দ্বিসহস্রাধিক পূজামণ্ডপ জ্বলন্ত অক্ষরে প্রতিবৎসর তাহা ঘোষণা করিতেছে। কিন্তু ঐ সমাজের প্রবর্তিত সমাজসংস্কার-নীতির অধিকাংশই হিন্দুসমাজ গ্রহণ করিয়াছে এবং কোন কোন বিষয়ে, যেমন স্ত্রীজাতির অবস্থার উন্নতি, তাহা অপেক্ষাও অধিকদূর অগ্রসর হইয়াছে। সুতরাং বলা যায়, বর্তমান হিন্দুসমাজ হিন্দু ও ব্রাহ্ম মতের সমন্বয়ে গঠিত হইয়াছে। বর্তমান প্রগতিশীল হিন্দুসমাজের প্রতিষ্ঠাতা স্বামী বিবেকানন্দের জীবনী, ধর্মমত ও সামাজিক আদর্শ এই গ্রন্থের তৃতীয় খণ্ডে বর্ণিত হইয়াছে। রামকৃষ্ণ মঠ ও রামকৃষ্ণ মিশনের প্রতিষ্ঠা এবং কার্যসূচীও সংক্ষেপে উল্লেখ করা হইয়াছে। আলোচ্য যুগে এই মঠ ও মিশন কেবল ভারতের বিভিন্ন প্রদেশে নহে, ইউরোপ ও আমেরিকায়ও বিস্তৃত হইয়াছে। মঠে সাধন ভজন প্রভৃতির ব্যবস্থা ছিল। মিশনের প্রধান কার্য পীড়িতের সেবা ও তজ্জন্য হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা, প্রাথমিক শিক্ষার জন্য পাঠশালা হইতে উচ্চশিক্ষা কেন্দ্র, ডিগ্রী কলেজের প্রতিষ্ঠা ও পরিচালনা এবং আত্রাণ-কার্য, অর্থাৎ দুর্ভিক্ষ, বন্যা, মহামারী প্রভৃতি উপলক্ষে জনগণের সাহায্যে মঠ ও মিশন উভয় কেন্দ্রেই স্বামী বিবেকানন্দের প্রবর্তিত হিন্দুধর্মের প্রচার হইত বাক্যে, কার্যে ও ব্যক্তিগত ব্যবহারে। নানা উপলক্ষে মঠ ও মিশনের উদ্যোগে ইহার জন্য সভা-সমিতির অধিষ্ঠান হইত। অনেক কেন্দ্রে গ্রন্থাগার, ঔষধালয় প্রভৃতির ব্যবস্থাও ছিল।

ইহার জন্য কলিকাতায় সেবা প্রতিষ্ঠানের মত অতি আধুনিক প্রণালীতে গঠিত বৃহৎ চিকিৎসালয় হইতে আরম্ভ করিয়া ক্ষুদ্র গ্রাম্য ডিসপেনসারি প্রতিষ্ঠিত হইয়াছিল। প্রতি কেন্দ্রেই বিশিষ্ট পণ্ডিতদিগের ও সাধু-সন্ন্যাসীদের ধর্ম ও জ্ঞানের নানাবিধ বিষয় সম্বন্ধে বক্তৃতার ব্যবস্থা করা হইত। মোট কথা, লোকশিক্ষা, ধর্মপ্রচার প্রভৃতি বিষয়ে রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশনের অবদান অবিস্মরণীয়। ইহার সবিস্তারে বর্ণনা দেওয়া বর্তমান গ্রন্থে সম্ভব নহে, যাহারা বিস্তারিত বিবরণ জানিতে চাহেন তাঁহারা রামকৃষ্ণ মিশনের বাৎসরিক রিপোর্ট পড়িলে অনেক তথ্য জানিতে পারিবেন। এই গ্রন্থে আলোচ্য যুগের শেষে মঠ ও মিশনের কার্যাবলী সম্বন্ধে ১৯৪৮-৪৯ সনের বার্ষিক রিপোর্টের বিবরণী অবলম্বনে সংক্ষেপে কিছু বলিতেছি। এই প্রসঙ্গে বলা আবশ্যক যে, ভারতবর্ষের কোন কোন কেন্দ্রে কেবল মঠ ও কোন কোন কেন্দ্রে কেবল মিশন আছে, অনেক কেন্দ্রে মঠ ও মিশন দুই-ই আছে।

প্রধান কেন্দ্র বেলুড়ের অধীনস্থ রামকৃষ্ণ মিশন ও মঠের শাখাকেন্দ্রসমূহ

(ক) ভারতবর্ষ

বঙ্গদেশে-(পাকিস্তান সৃষ্টির পূর্বে নিম্নলিখিত স্থানে মিশন ও মঠের কেন্দ্র ছিল) :

কলিকাতা-(দশটি), বরাহনগর, রহড়া, বেলুড়, টাকী, সরিষা, আসানসোল, মেদিনীপুর, তমলুক, চণ্ডীপুর, গড়বেতা, কাঁথি, মালদহ, বাঁকুড়া, জয়রামবাটি, কোয়ালপাড়া, কামারপুকুর, সারগাছি, জলপাইগুড়ি, কালিম্পং, ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, সোনারগাঁও, বালিয়াটি, শ্রীহট্ট, মৈমনসিংহ, বরিশাল, ফরিদপুর, বাগেরহাট, দিনাজপুর।

আসাম-শিলং, শিলচর, চেরাপুঞ্জি ও করিমগঞ্জ। বিহার-পাটনা, কাটিহার, জামসেদপুর, রাচি, দুংরি, দেওঘর ও জামতাড়া। উড়িষ্যাপুরী (দুইটি), ভুবনেশ্বর।

উত্তর প্রদেশ-এলাহাবাদ, কাশী (দুইটি), লক্ষ্ণৌ, কানপুর, বৃন্দাবন, আলমোড়া, মায়াবতী, শ্যামলাতাল, কঙ্খল, কিষণপুর, বালোগঞ্জ।

মাদ্রাজ-মাদ্রাজ (পাঁচটি), কাঞ্চীপুরু, চিঙ্গেলপুট, নট্টরামপল্লী, পেরিয়নৈকেম্পলয়ম, উতাকাম, বিশাখাপত্তনম্, সালেম, কালিকট, মঙ্গালোর।

কোচিন ও ত্রিবাঙ্কুর-ত্রিবান্দ্রম, কালদি, তিরুবন্দু, ত্রিচুর।

ইহা ছাড়া দিল্লী, বোম্বাই শহর, রাজকোট, নাগপুর, বাঙ্গালোর, মহীশূর ও কুর্গের অন্তর্গত পোলামপেট প্রভৃতি স্থানে মঠ ও মিশনের কেন্দ্র আছে।

উল্লিখিত কেন্দ্রগুলি ছাড়াও ভারতের নানা স্থানে শ্রীরামকৃষ্ণ ও স্বামী বিবেকানন্দের নামযুক্ত মঠ ও মিশন আছে, কিন্তু সেগুলি বেলুড় মঠ-কেন্দ্রের দ্বারা শাসিত বা স্বীকৃত নহে।

(খ) ভারতবর্ষের বাহিরে রামকৃষ্ণ মঠের কেন্দ্রস্থল

উত্তর আমেরিকার যুক্তরাজ্যে (United States)-নিউ ইয়র্ক (২টি), বোষ্টন, প্রভিডেন্স, শিকাগো, সেন্ট লুই, সান ফ্রান্সিকো, বার্কলে, হলিউড, পোর্টল্যাণ্ড ও fattica (Seattle)

দক্ষিণ আমেরিকা-বুইনস এয়ারস (Buenos Aires)।

ইহা ছাড়া লণ্ডন, প্যারিস, সিঙ্গাপুর, কলম্বো, রেঙ্গুন (দুইটি), মরিসাস দ্বীপের পোর্ট লুই, এবং ফিজি দ্বীপপুঞ্জের নদি নামক স্থানে মঠ আছে।

(গ) উপসংহার-আপদে-বিপদে রামকৃষ্ণ মিশনের ত্রাণকার্যের সংক্ষিপ্ত বিবরণ

১। ১৮৯৬ হইতে ১৯২০ সনের মধ্যে ৭০টি জিলায় দুর্ভিক্ষের সময় ত্রাণকার্য।

২। ১৮৯৯ হইতে ১৯২৮ সনের মধ্যে ৭৮টি জিলায় বন্যার সময় ত্রাণকার্য।

ইহা ছাড়া প্লেগ, কলেরা, বসন্ত, ম্যালেরিয়া প্রতি সংক্রামক পীড়ায় এবং ঝড়, অগ্নিদাহ, ভূমিকম্প প্রভৃতি প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে, গঙ্গাসাগর সঙ্গমে, কুম্ভমেলায় যাত্রীদিগের সমাগমে নানাপ্রকার সেবা ও সাহায্যদান মিশনের ত্রাণকার্যসূচীর অন্তর্গত ছিল। এই সংক্ষিপ্ত তালিকা হইতে রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশনের কর্মসূচী, প্রভাব ও প্রতিপত্তি সম্বন্ধে মোটামুটি ধারণা করা যাইবে। মূদ্রিত বার্ষিক বিবরণীতে প্রতি কেন্দ্রের কার্যাবলীর সংক্ষিপ্ত বিবরণ আছে। ইহা ছাড়া রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশন হইতে অনেক মূল্যবান গ্রন্থ ও পত্রিকা প্রকাশিত হইয়াছে। এবং মাসিক পত্রিকা ‘উদ্বোধন’ ৭৮ বৎসর যাবৎ ইহার মুখপত্ররূপে প্রকাশিত হইতেছে।

২. ভারত সেবাশ্রম সঙ্ঘ [৪]

উনিশ শতকে বঙ্গদেশে নবগোপাল মিত্র ধর্মীয় ঐক্যের ভিত্তিতে হিন্দুসম্প্রদায়কে ভারতের একটি পৃথক্‌ জাতি কল্পনা করিয়া হিন্দু মেলা’ প্রভৃতি অনুষ্ঠানের মাধ্যমে এই জাতির নবজাগরণের যে চেষ্টা করিয়াছিলেন তাহা এই গ্রন্থের তৃতীয় খণ্ডে আলোচিত হইয়াছে। কিন্তু ভারতের রাজনীতিক মতের বিবর্তনের ফলে এই ধারণা ক্রমশঃ ক্ষীণ হইয়া আসে। বিংশ শতকের দ্বিতীয় দশকে ‘হিন্দু মহাসভা পশ্চিম ও দক্ষিণ ভারতে উক্ত ধারণা পুনরায় উজ্জীবিত করে। বঙ্গদেশে ইহার প্রভাব খুব বেশী ছিল না, সুতরাং বাংলাদেশের ইতিহাসে ইহার বিস্তৃত আলোচনা। অপ্রাসঙ্গিক।

কিন্তু হিন্দু মহাসভা প্রতিষ্ঠার অল্পকাল পরেই ঠিক ঐ মতের অনুবর্তী একটি আন্দোলন স্বতন্ত্রভাবে বঙ্গদেশেও আরম্ভ হয়। ইহার প্রবর্তক ভারত সেবাশ্রম সঙ্। হিন্দুজাতির নবজাগরণ উভয় প্রতিষ্ঠানের মূল উদ্দেশ্য হইলেও লক্ষ্য ও কার্যপদ্ধতিতে দুইয়ের মধ্যে গুরুতর প্রভেদ আছে। দ্বিতীয়টির সহিত রাজনীতিক। আন্দোলনের কোন সংস্রব ছিল না এবং কর্মক্ষেত্র ও ইহার আবেদনের পাত্র ছিল শিক্ষিত মধ্যবিত্ত হিন্দু নহে, তথাকথিত হিন্দুসম্প্রদায়ের অনুন্নত নিম্নশ্রেণী যাহাদিগকে হিন্দুসমাজ অস্পৃশ্যজ্ঞানে সর্বদা দূরে দূরে রাখিত। সুতরাং এই আন্দোলনের কিছু বিবরণ দেওয়া প্রয়োজন।

ফরিদপুর জেলার অন্তর্গত বাজিতপুর গ্রামের বিনোদচন্দ্র দাস নামক একটি কায়স্থ যুবক সতের বৎসর বয়সে (১৯১৩ সনে) নাথ-সম্প্রদায়ের নেতা বাবা গম্ভীরনাথজীর নিকট দীক্ষা গ্রহণ করিয়া স্বামী প্রণবানন্দ নামে পরিচিত হন। ১৯১৬ সনে ধর্মের ভিত্তিতে জাতিগঠনের উদ্দেশ্যে তিনি ভারত সেবাশ্রম সঙ্’ প্রতিষ্ঠা করেন। এই সঙ্ঘের সদস্যেরা সন্ন্যাসী, ব্রহ্মচারী ও (গৃহস্থ) কর্মী–এই তিন পর্যায়ে বিভক্ত ছিলেন।

এই সঙ্ঘের প্রধান কর্মসূচী ছিল হিন্দুসমাজের তথাকথিত নিম্নশ্রেণীকে সামাজিক মর্যাদা দিয়া হিন্দুজাতিকে বলিষ্ঠ করা। এই উদ্দেশ্যে তিনি সদলবলে পূর্ববঙ্গের পল্লীতে পল্লীতে ভ্রমণ করেন এবং পৌ, ক্ষত্রিয়, নমঃশূদ্র, মল্ল ক্ষত্রিয়, রুহিদাস, কপালী প্রভৃতি তথাকথিত নিম্নশ্রেণীভুক্ত জাতিদের গ্রামে জনসভা, পূজা, কীর্তন, শোভাযাত্রা, কোন কোন স্থানে বৈদিক যজ্ঞ ও মহোৎসব সম্পন্ন করিতেন এবং প্রত্যেক স্থানে প্রসাদ বিতরণ করিয়া নিজে তাহাদের সঙ্গে আহার করিতেন এবং তাহাদের প্রদত্ত খাদ্যদ্রব্য গ্রহণ করিতেন।[৫]

এই সঙ্ঘের পাঁচটি প্রধান বৈশিষ্ট্য ছিল–প্রথম, মিলনমন্দির স্থাপন। স্বামীজি নিজেই ইহার ব্যাখ্যা করিয়াছেন, “ইট পাথর গেঁথে গেঁথে লোক মন্দির করে; আমি হিন্দু সমাজের খণ্ডবিখণ্ড অঙ্গগুলো, ছিন্নভিন্ন অংশগুলোকে গেঁথে গেঁথে বিরাট হিন্দু মিলনমন্দির তৈরী করবো। আমার মিলনমন্দির হচ্ছে হিন্দুর সার্বজনীন মিলনক্ষেত্র, সর্বশ্রেণীর হিন্দুর সমবেত ভজনা, উপাসনা এবং যাবতীয় সামাজিক ও জাতীয় সমস্যার সমাধানের ক্ষেত্র, এই মিলনমন্দিরকে অবলম্বন করেই হিন্দু সঙ্ঘবদ্ধ, শক্তিশালী হয়ে উঠবে।”[৬]

দ্বিতীয়, হিন্দুর মহোৎসবকে জাতীয় গঠনের ক্ষেত্রে পরিণত করা। এই প্রসঙ্গে তাঁহার জীবনীলেখক স্বামী বেদানন্দের উক্তি উদ্ধৃত করিতেছি :

“১৯৩৫ খৃষ্টাব্দ হইতে সঙ্ঘের খুলনা সেবাশ্রমে অনুষ্ঠিত রাসপূর্ণিমার বিরাট মহোৎসবকে (স্বামীজি) হিন্দু জাতিগঠনমূলক আকার প্রদান করিলেন। সার্বজনীন বৈদিক যজ্ঞ, সমবেত পূজা, সশস্ত্র আরতি, নাম-সঙ্কীর্তন, ধর্ম ও সমাজ এবং হিন্দুগঠনের প্রয়োজনীয়তা, হিন্দু মিলনমন্দির ও রক্ষীদল গঠন প্রভৃতি বিষয়ক বক্তৃতা, আলোচনা ও প্রস্তাবাদি চলিতে লাগিল। ক্রমে লাঠি, ছোরা, ঢাল, সড়কী প্রভৃতি আত্মরক্ষামূলক ক্রীড়াকৌশলও প্রবর্তিত হইল। এইরূপ কলিকাতায় অনুষ্ঠিত শিবরাত্রি, জন্মাষ্টমী ও কালীপূজার উৎসবকে, বাজিতপুরে অনুষ্ঠিত বাসন্তী পূজা ও নীলপূজা উৎসবকে, রথযাত্রা উপলক্ষে অনুষ্ঠিত পুরী সেবাশ্রমের বার্ষিক উৎসব ও কাশীতীর্থ সেবাশ্রমে অনুষ্ঠিত দুর্গোৎসবকে রূপান্তরিত করিয়া জাতিগঠনমূলক সার্বজনীন হিন্দু সম্মেলনে পরিণত করিলেন। হরিদ্বার ও প্রয়াগে কুম্ভমেলার অধিবেশনেও দিনের পর দিন জনসভায় ধর্ম, সমাজ ও জাতিগঠন বিষয়ে বক্তৃতা ও নানাভাবে মেলায় সমাগত লক্ষ লক্ষ নরনারীর মধ্যে হিন্দুধর্মের প্রচারের ব্যবস্থা করিলেন।”[৭]

তৃতীয়, অস্পৃশ্যতাবর্জন। স্বামীজির উক্তি : “হিন্দু কখনো হিন্দুর নিকট অস্পৃশ্য হতে পারে না, অনাচরণীয় হতে পারে না, শাস্ত্রপ্রণেতা আর্য ঋষিগণ কদাচ একথা স্বীকার করেননি… আত্মবিস্মৃত হিন্দু জনসাধারণ এই কুসংস্কারকে আঁকড়ে ধরে আছে। হিন্দুসমাজের এই অনাচরণীয়তা ও অস্পৃশ্যতার গ্লানিকে মুছে ফেলতে হবে।

“কিন্তু এখানেও সেই কথা। সমাজ যদি বিবেকবুদ্ধিবশতঃ স্বেচ্ছায় এই কুসংস্কার পরিত্যাগ না করে, তবে গায়ের জোরে কেউ তা করতে পারে না। … সমাজস্থ জনসাধারণকে খাঁটি শাস্ত্র ও সদাচার বুঝিয়ে দিতে হবে। চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিতে হবে যে, হিন্দু ঋষি ও শাস্ত্রকর্তৃগণ এই কুসংস্কার প্রবর্তন করেননি, অথচ এই কুসংস্কার কিরূপে হিন্দুসমাজের সর্বনাশসাধন করেছে, আমি মিলনমন্দিরের সাহায্যে জনসাধারণের মধ্যে শাস্ত্র, সদাচার প্রচার এবং অস্পৃশ্যতা ও অনাচরণীয়তার অনিষ্টকারিতা প্রচার করছি, এইভাবে উক্ত পাপের সমূলোচ্ছেদের আয়োজন হচ্ছে”।

চতুর্থ, শুদ্ধি। স্বামীজির উক্তি : “শুধু মুখের কথায় শুদ্ধি হবে না। যে কারণে লক্ষ লক্ষ হিন্দু হিন্দুধর্ম ও সমাজকে পরিত্যাগ করে পরধর্ম ও পরসমাজের আশ্রয় নিয়েছে, সেই কারণগুলি বর্তমান থাকতে হিন্দুসমাজে কি তারা আসতে চাইবে? … আমি চাই তেমন ব্যাপক আন্দোলন, যাতে হাজারে হাজারে ধর্মান্তরিত নরনারী হিন্দুসমাজে প্রবেশ করে আর্য ধর্ম ও আর্য আচার গ্রহণ করবে। আর আমার সেই উদ্দেশ্যসাধনের জন্য আমি মিলনমন্দির কর্মপদ্ধতির পরিকল্পনা করেছি। গ্রামে গ্রামে মিলনমন্দিরের সাপ্তাহিক অধিবেশনে হিন্দুসমাজের আদর্শ, হিন্দু শাস্ত্রোক্ত ঋষিগণের বিধিবিধান…প্রভৃতি বিষয়ক আলোচনার দ্বারা হিন্দু জনসাধারণের হৃদয়কে উদার সমষ্টিচেতনাসম্পন্ন, সহানুভূতিশীল করে তুলবো। তখন সমাজ দুয়ার খুলে দেবে, আর হাজার হাজার লোককে শুদ্ধি করে সমাজে নিতে পারবো।”

পঞ্চম, সেবাকার্য। ভারত সেবাশ্রম সঙ্ঘের সেবাকার্য সমগ্র ভারতে প্রসিদ্ধি লাভ করিয়াছে। বঙ্গদেশে এবং বাহিরে-বিহার ও উড়িষ্যায় জলপ্লাবন, দুর্ভিক্ষ প্রভৃতি প্রাকৃতিক দুর্যোগ ঘটিলে এই সঙ্ দীর্ঘকালস্থায়ী সেবাকার্যের বন্দোবস্ত করে। ইহার ফলে ১৯২৬ সনে ‘পুরী সেবাশ্রম’ নামে সঙ্ঘের অন্যতম তীর্থসংস্কার কেন্দ্র প্রতিষ্ঠিত হয়। পুরী, গয়া প্রভৃতি প্রধান প্রধান বহু তীর্থস্থানে তীর্থযাত্রীদের উপর স্থানীয় পাণ্ডাদের অত্যাচার ও উৎপীড়ন নিবারণে সঙ্ যথেষ্ট সফলতা লাভ করিয়াছে। কুম্ভমেলা প্রভৃতি সাময়িক উৎসব অনুষ্ঠানে সমবেত লক্ষ লক্ষ হিন্দু নরনারী ভারত সেবাশ্রম সঙ্ঘের সাহায্যে অনেক দুর্গতির হাত হইতে নিষ্কৃতি পায়। নানা স্থানে সেবাশ্রম স্থাপন করিয়া এই সঙ্ দরিদ্র অসহায় হিন্দু যাত্রীদের মহৎ উপকার সাধন করিয়াছে।

তথ্যনির্দেশ

১. “We have dwindled into insignificance, ceased to make ourselves felt in the general body politic.” D.S. Sarma-Hinduism through the Ages. (Pp. 76-77). ইহার কারণস্বরূপ তিনি বলিয়াছেন : “There reason is that there is a gulf between what we profess and what we are.”

২. তদেব, পৃ. ৭২-৭৩ 0. “Western ideas appeal more to sympathising hearts among us than the truths treasured up in our own books and in our own usages and customs. We are more concerned with the western modes of spiritual exercise, such as vocal prayer readings and spiritul intercourse than the Hindu methods of meditation and communion to which Maharshi Devendranath showed the way. It is time the attention of our members should be directed to the spiritual resources of our own country and of our own people”. Shivanath Sastri-History of the Brahma Samaj, II (p. 278)

৪. এই সম্মের বিবরণ ও স্বামীজির উক্তিগুলি স্বামী বেদানন্দ প্রণীত “শ্রীশ্রীযুগাচার্য জীবনচরিত” (৪র্থ সংস্করণ, ১৩৭৮ সাল) হইতে গৃহীত।

৫. শ্ৰীশ্ৰীযুগাচার্য জীবনচরিত’ (৪র্থ সং) পৃ. ৩৫২-৫৫

৬. তদেব, পৃ. ৩৮২

৭. শ্ৰীশ্ৰীযুগাচার্য জীবনচরিত (৪র্থ সং), পৃ. ৩৬৬

৮. তদেব, পৃ. ৩৮৫-৮৬

৯. শ্ৰীশ্ৰীযুগাচার্য জীবনচরিত (৪র্থ সং), পৃ. ৩৮৪-৮৫

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *