১৭. শিক্ষা

সপ্তদশ অধ্যায় – শিক্ষা

১. কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়

১৮৫৭ খ্রীষ্টাব্দে লণ্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের আদর্শে কলিকাতা, বোম্বাই ও মাদ্রাজে তিনটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হইয়াছিল, ইহা পূর্বেই বলা হইয়াছে। অর্ধশতাব্দীকাল ইহার একমাত্র কার্য ছিল পাঠ্যপুস্তক নির্বাচন ও পরীক্ষা গ্রহণ করা। লর্ড কার্জন যেমন পৌরসভা (Corporation) ও প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের সংস্কার করেন সেইরূপ বিশ্ববিদ্যালয়গুলিরও সংস্কারসাধনে মনোনিবেশ করেন। এই উদ্দেশ্যে তিনি একটি কমিটি নিযুক্ত করেন এবং ইহার প্রস্তাব অনুসারে ১৯০৪ সনে এক নূতন আইন বিধিবদ্ধ হয় (Indian Universities Act)। বিংশ শতকের প্রথম দুই দশকে বঙ্গদেশে শিক্ষাব্যবস্থার যে গুরুতর পরিবর্তন ঘটে এবং যাহা মোটামুটি ইংরেজরাজত্বের শেষ পর্যন্ত কার্যকরী ছিল (এবং এখনও আছে) তাহা প্রধানতঃ এই আইনেরই ফল বলা যাইতে পারে। সুতরাং এই আইনের ফলে বঙ্গদেশে শিক্ষার বিভিন্ন স্তরে, বিশেষতঃ উচ্চশিক্ষায় ক্রমশঃ যে পরিবর্তন সাধিত হয় তাহা সংক্ষেপে বিবৃত করিতেছি।

১৮৫৭ সালে যখন কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয় তখন নিয়ম ছিল যে ছাত্রগণ প্রবেশিকা (Entrance, পরে Matriculation) পরীক্ষার পর চারি বৎসর কলেজে অধ্যয়ন করিয়া পরীক্ষা দিয়া পাশ করিলে বি.এ. ডিগ্রী পাইবে। কিন্তু বি.এ. পাশ করিবার পর কোন কলেজে অধ্যয়ন না করিয়াই এম.এ. পরীক্ষা দিতে পারিবে। ১৯০৪ সনের আইনের নিয়মাবলী অনুসারে বি.এ. পাশ করিবার পর অন্ততঃ দুই বৎসর অধ্যয়ন না করিলে এবং অন্যথায় তিন বৎসর অতিবাহিত না হইলে কেহই এম.এ. পরীক্ষা দিতে পারিবে না। নূতন আইনের ফলে এম. এ. পরীক্ষায় প্রতি বিষয়ের পাঠ্যসূচী এরূপভাবে পরিবর্তিত ও পরিবর্ধিত হইল যে ইহার মান (standard) অনেক ব্রিটিশ বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্যসূচীর সমকক্ষ হইল।

যে-সময়ে এই নূতন আইন বিধিবদ্ধ হয় সে-সময়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষাদানের কোন ব্যবস্থা ছিল না এবং কেবল একটি কলেজে এম.এ. পঠন-পাঠনের উপযুক্ত ব্যবস্থা ছিল। মাত্র দুই-একটি বিষয়ে অন্য কলেজেও ইহার যে পঠন-পাঠন হইত তাহার বিশেষ কোন মূল্য ছিল না। অথচ এই দুই-একটি ব্যতীত অন্য কোন কলেজের ছাত্র এম.এ. পরীক্ষা দিবার অধিকারী বলিয়া বিবেচিত হইত না (not affiliated to the M.A. standard); এই অভাব দূর করিবার জন্য ১৯০৪ সনের নূতন আইনে নির্দেশ দেওয়া হইল যে, বিশ্ববিদ্যালয়গুলি এম.এ. পরীক্ষার অধ্যাপনার জন্য প্রফেসর ও লেকচারার নিযুক্ত করিবে এবং লাইব্রেরী, ল্যাবরেটরী, মিউজিয়ম স্থাপন এবং ছাত্রদের আবাসের উপযুক্ত ব্যবস্থা করিবে।

শিক্ষার এই সমুদয় সুব্যবস্থার সঙ্গে সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপর সরকারী প্রভাব দৃঢ় করিবার জন্য নির্দেশ দেওয়া হইল যে, বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ পরিচালক সমিতি অর্থাৎ সিনেটের (Senate) সদস্যগণের শতকরা ৮০ জন গভর্নমেন্ট মনোনীত করিবেন। বড়লাট হইবেন ইহার আচার্য (Chancellor) এবং ছোটলাট হইবেন রেক্টর (Rector)। ইংরেজরাজত্বের শেষ পর্যন্ত এই নিয়ম বলবৎ ছিল কেবল ১৯১৯ সনের শাসন-সংস্কারের পরে বাংলার গভর্নর বিশ্ববিদ্যালয়ের চ্যান্সেলর হইলেন।

১৯০৪ সনের আইন অনুযায়ী পরিবর্তন সাধনের উদ্দেশ্যে যে নূতন নিয়মাবলী (Regulations) প্রণয়ন করা হয় এবং যাহার দ্বারা পরবর্তীকালে বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালিত হইত, আশুতোষ মুখোপাধ্যায় প্রথমে তাহার খসড়া করেন এবং এই সময় হইতে মৃত্যুকাল (১৯২৪) পর্যন্ত তিনিই যে কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্ণধার ছিলেন ইহা অনায়াসে বলা যাইতে পারে। এই নূতন নিয়মাবলী ১৯০৯ সন হইতে কার্যকরী হয়।

এতদিন পর্যন্ত পরীক্ষা গ্রহণ করাই বিশ্ববিদ্যালয়ের একমাত্র কার্য ছিল–এখন নূতন নিয়ম অনুসারে সাধারণ কলেজে এম.এ. শিক্ষার ব্যবস্থা প্রায় অসম্ভব হইল। সুতরাং বিশ্ববিদ্যালয়কেই এই দায়িত্ব গ্রহণ করিতে হইল। পরীক্ষা গ্রহণের সঙ্গে উচ্চশিক্ষা প্রদান ও গবেষণার ব্যবস্থা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান কার্যরূপে পরিণত হইল। অবশ্য অধীনস্থ কলেজগুলির ও ছাত্রগণের বসবাসের তদারকি প্রভৃতিও বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যতম কর্তব্য বলিয়া নির্ধারিত হইল। ইহার জন্য বিশ্ববিদ্যালয় একজন উচ্চপদস্থ কর্মচারী (Inspector of Colleges) নিযুক্ত করেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান সমস্যা হইল এম.এ. শিক্ষাদানের ব্যবস্থা করা। প্রথম প্রথম বিভিন্ন কলেজের উপযুক্ত শিক্ষকদিগকে সপ্তাহে ২৪ ঘণ্টার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষা দিবার জন্যও নিযুক্ত করা হইত। ইঁহারা নিজেদের কলেজের কার্যের অবসরে প্রয়োজনমত নানা বিষয়ে সপ্তাহে অল্প কয়েকটি লেকচার দিতেন। কিন্তু ছাত্রসংখ্যা ক্রমশঃ বাড়িয়া যাওয়ায় স্থায়ীভাবে নিজস্ব শিক্ষক নিযুক্ত করার ব্যবস্থা হইল। ১৯০৮-০৯ সনে দুইজন মাত্র এইরূপ শিক্ষক ছিলেন। ১৯১২-১৩ সনে ইহাদের সংখ্যা ছিল ৫৪ এবং ১৯১৬-১৭ সনে ৪৬।

ইহা ছাড়াও কয়েকটি বিশিষ্ট প্রফেসরের পদ সৃষ্টি করা হইল। প্রসিদ্ধ পণ্ডিতগণ কয়েক বৎসরের জন্য এইরূপ কয়েকটি পদে নিযুক্ত হইতেন। দৃষ্টান্ত স্বরূপ কয়েকজনের নাম করা যাইতে পারে।

১। অর্থনীতির মিন্টো অধ্যাপকের পদে-প্রথমে মনোহর লাল, পরে সি.জে. হ্যাঁমিল্টন (C.J. Hamilton)।

২। দর্শনে পঞ্চম জর্জ অধ্যাপক-প্রথমে ব্রজেন্দ্রনাথ শীল, পরে সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণণ।

৩। গণিতের হাডিং অধ্যাপক-ডব্লিউ.এইচ.ইয়ং (W.H. Young)।

৪। প্রাচীন ভারতের ইতিহাস ও সংস্কৃতির কাৰ্মাইকেল অধ্যাপক-জর্জ থিবো (George Thibaut), পরে দেবদত্ত রামকৃষ্ণ ভাণ্ডারকর। এই প্রকার অধ্যাপক ও অন্যান্য শিক্ষকের নিয়োগের ফলে বিশ্ববিদ্যালয়ের এম.এ. ক্লাসের ছাত্রের সংখ্যা ক্রমশঃ বাড়িতে লাগিল এবং কলেজে ইহাদের সংখ্যা কমিতে লাগিল। ১৯১৬ সনে প্রেসিডেন্সি কলেজে দশটি বিভিন্ন বিষয়ে এম.এ. ক্লাসের ছাত্রসংখ্যা ছিল ৩২৬। তখন স্কটিশ চার্চ কলেজে (কেবলমাত্র দর্শনশাস্ত্রে এম.এ. পড়াইবার ব্যবস্থা ছিল) ছাত্রসংখ্যা ছিল ২৩। অন্যদিকে বিশ্ববিদ্যালয়ে এম.এ. ক্লাসের ছাত্রসংখ্যা ছিল ১১৭২।

ইহার ফলে একদিকে কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে একটা রেষারেষির ভাব উদয় হইল এবং কলেজ-কর্তৃপক্ষদের আশঙ্কা হইল যে, বিশ্ববিদ্যালয় ক্রমে ক্রমে স্নাতকোত্তর (Post-Graduate) শিক্ষার ব্যবস্থা করিবে। অন্যদিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতকোত্তর বিভাগের পাঠ্যবিষয় ও ছাত্রসংখ্যা যেভাবে বাড়িয়া চলিয়াছিল তাহাতে তখনকার শিক্ষাদান-পদ্ধতি মোটেই পর্যাপ্ত ছিল না। বিশেষতঃ, কলেজের পক্ষে উচ্চমানের এম.এ. পরীক্ষার্থীদের জন্য উপযুক্ত ও পর্যাপ্ত শিক্ষক, লাইব্রেরী ও ল্যাবরেটরীর ব্যবস্থা করা সম্ভব ছিল না এবং এম.এ. ক্লাসে পড়াইবার উপযুক্ত শিক্ষকের সংখ্যাও খুব বেশি ছিল না। সুতরাং অনেকে মনে করিতেন, কলেজে স্বল্পসংখ্যক ছাত্রের জন্য এম.এ. পড়াইবার ব্যবস্থা সঙ্গত নহে। একদিকে সরকারী কলেজ, বিশেষতঃ কলিকাতা প্রেসিডেন্সী কলেজ, এম.এ. ক্লাসের জন্য অতিরিক্ত ও উপযুক্ত অধ্যাপকের দাবি করিত বাংলা গভর্নমেন্টের কাছে, এবং স্নাতকোত্তর বিভাগের উপযুক্ত ব্যবস্থার জন্য বিশ্ববিদ্যালয় অধিকতর অর্থের দাবি করিত ভারত গভর্নমেন্টের কাছে।

এই সঙ্কট মোচনের জন্য কেহ কেহ প্রস্তাব করিলেন যে, এ-বিষয়ে অনুসন্ধান ও পথ নির্দেশের জন্য একটি কমিটি নিযুক্ত করা হউক। এ সময়ে ভারত-সরকার যে আশুতোষ মুখার্জির উপর বিরূপ ছিল তাহার কারণ ও বিস্তৃত বিবরণ পরে দেওয়া হইবে। ইহার প্রমাণস্বরূপ বর্তমান প্রসঙ্গে এইটুকু বলিলেই যথেষ্ট হইবে যে, ১৯১৪ সনে আশুতোষকে কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য (Vice Chancellor) পদ হইতে সরাইয়া দেবপ্রসাদ সর্বাধিকারীকে ঐ পদে নিযুক্ত করা হয়। কিন্তু, তথাপি বিশ্ববিদ্যালয়ে আশুতোষের এরূপ প্রভাব ও প্রতিপত্তি ছিল যে, ভারত-সরকারের শিক্ষা-সদস্য বাটলার ১৯১৫ সনের ৪ঠা অক্টোবর যে-মন্তব্য লিপিবদ্ধ করেন তাহার সারমর্ম এই : “আশুতোষ এখনও বিশ্ববিদ্যালয়ে সর্বশক্তিমান (all powerful) এবং তিনি ভারত-সরকারকে সর্বান্তঃকরণে ঘৃণা করেন (hates the Government of India very cordially)। এখন কোন কমিটি নিযুক্ত করিয়া কোন ফল হইবে না। বিশেষতঃ, বাংলা গভর্নমেন্ট আশুতোষকে ঐ কমিটির সদস্য নিযুক্ত করিবার প্রস্তাব পাঠাইয়াছেন। আমরা আশুতোষের দলের কয়েক জনকে সিনেটের সদস্যের পদ হইতে সরাইয়াছি (removed), ইহার ফল ভাল হইয়াছে।”[২]

কিন্তু অনতিকাল পরেই হারকোট বাটলারের পরিবর্তে শঙ্করণ নায়ার বড়লাটের শাসন-পরিষদের শিক্ষাবিষয়ক সদস্য নিযুক্ত হইলেন। তিনি বাংলা সরকারের সম্মতি লইয়া একটি কমিটি নিযুক্ত করিলেন। এই কমিটির কার্য হইল কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতকোত্তর বিভাগের শিক্ষাপ্রণালী সম্বন্ধে অনুসন্ধান করা এবং বর্তমানে ইহার জন্য যে অর্থ ব্যয় হয় ও অন্যান্য ব্যবস্থা আছে, তাহার সম্পূর্ণ সদ্ব্যবহার করার নির্দেশ দেওয়া (to make suggestions whereby the existing expenditure and available resources for M.A. classes may be put to the best use)। ইহাও বলা হইল যে, স্নাতকোত্তর বিভাগের শিক্ষার জন্য বর্তমানে সরকার যে টাকা দেয়, অদূর ভবিষ্যতে তাহা বৃদ্ধি পাইবার সম্ভাবনা নাই।

এই কমিটির সভাপতি ছিলেন সার আশুতোষ এবং অন্য আটজন সদস্যের মধ্যে ছিলেন ব্রজেন্দ্রনাথ শীল, প্রফুল্লচন্দ্র রায়, এবং ছয়জন ইংরেজ। এই কমিটি সর্বসম্মতিক্রমে ১৯১৬ সনের ১২ই ডিসেম্বর তারিখে যে রিপোর্ট দাখিল করে তাহা ভারত-সরকার বিশ্ববিদ্যালয়ের মতামতের জন্য পাঠাইয়া মন্তব্য করিল যে, যদি সিনেট মোটামুটি ইহার সমর্থন করে তাহা হইলে ভারত-সরকার ইহা গ্রহণ করিবে।

কমিটির প্রধান সিদ্ধান্ত ছিল দুইটি :

(১) অতঃপর কলিকাতায়, একমাত্র বিশ্ববিদ্যালয়েই M.Sc. ও M.A. পড়াইবার ব্যবস্থা হইবে, কোন কলেজে এই ব্যবস্থা থাকিবে না। (কলিকাতার বাহিরের কলেজে এ-বিষয়ে পূর্ব ব্যবস্থাই বলবৎ থাকিবে, অর্থাৎ ঢাকা কলেজে ও গৌহাটির কটন কলেজে এম.এ. পড়াইবার ব্যবস্থা বজায় রহিল)। (২) এম.এ. এবং এম.এস-সি. শিক্ষার জন্য দুইটি কাউন্সিল গঠিত হইবে-Council of Post Graduate Teching in Arts 47 Council of Post-Graduate teaching in Science. ইহাদের প্রত্যেকের একজন সভাপতি ও একটি কার্যকরী সমিতি থাকিবে। প্রত্যেক পাঠ্যবিষয়ের জন্য স্বতন্ত্র Board of Studies গঠিত হইবে। ঐ বিষয়ের সকল শিক্ষকই ইহার সদস্য হইবেন। এই সমুদয় রূপায়িত করিবার জন্য Regulations অর্থাৎ বিস্তারিত নিয়মাবলী গঠিত হইবে।

কমিটির রিপোর্টের বিরুদ্ধে সিনেটে তীব্র প্রতিবাদ হয়, বিরুদ্ধদলের নেতা ছিলেন সার গুরুদাস ব্যানার্জি ও ভূপেন্দ্রনাথ বসু।

চারিদিন তর্কবিতর্কের পর কমিটির প্রস্তাব অনুমোদিত হইল। নূতন নিয়মাবলী ভারত-সরকার অনুমোদন করিল (২৬শে জুন, ১৯১৭)। ঐ বৎসর সেপ্টেম্বর মাস হইতে নূতন নিয়ম প্রবর্তিত হইল। সার আশুতোষ দুইটি কাউন্সিলেরই সভাপতি নির্বাচিত হইলেন।

এইভাবে স্নাতকোত্তর বিভাগের যে বনিয়াদ পত্তন হইল তাহার উপর বিরাট সৌধ নির্মাণ করাই আশুতোষের অবিনশ্বর কীর্তি। কিন্তু, এই ‘সৌধ’ কথাটি কেবল রূপক অর্থেই ব্যবহৃত নহে, সত্য সত্যই বিরাট ‘বিজ্ঞান ভবন’, ‘দ্বারভাঙ্গা ভবন’ নির্মিত হইল এবং শিক্ষাদানের বিষয়ের ব্যাপকতার সঙ্গে সঙ্গে অধিকতর সংখ্যায় উপযুক্ত শিক্ষক নিযুক্ত হইল–ইহা সম্পন্ন করিবার জন্য অর্থ সংগ্রহও করিতে হইল। ইহার প্রত্যেকটির সম্বন্ধে সংক্ষিপ্ত বিবরণ দিতেছি।

নূতন ভবন

দ্বারভাঙ্গার মহারাজা রামেশ্বর সিংহ বিশ্ববিদ্যালয়কে আড়াই লক্ষ টাকা দান করেন। সরকার দুই লক্ষ টাকা এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের তহবিল হইতে আরও দুই লক্ষ, মোট এই সাড়ে ছয় লক্ষ টাকা ব্যয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের তখনকার একমাত্র ভবন সিনেট-গৃহের পশ্চিমে ও হিন্দু হোষ্টেলের পূর্বে যে বিশাল খোলর ঘরের বস্তী ছিল তাহা কিনিয়া তাহার স্থানে চারিতলা ‘দ্বারভাঙ্গা ভবন নির্মিত হইল। এই ভবনে এম.এ. ও আইনের ক্লাস, লাইব্রেরী ও অফিস প্রভৃতির জায়গা হইল। সিনেট-গৃহের দক্ষিণে মাধববাবুর বাজার বসিত। এই স্থানটিও কেনা হইল এবং পরে এখানে আশুতোষ ভবন নির্মিত হয়। ইহারও অনেক পরে প্রাচীন সিনেট গৃহ ভাঙ্গিয়া তাহার জমির উপর বিরাট লাইব্রেরী ভবন নির্মিত হইয়াছে। ইহা ছাড়াও সার্কুলার রোডে বিরাট ‘বিজ্ঞান ভবন’ আশুতোষের আমলেই নির্মিত হয়। পরে হাজরা রোডেও একটি বিশাল ভবন নির্মিত হয়; এখানে বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্ব ছাপাখানা প্রতিষ্ঠিত হয় এবং নানা বিষয়ে এম.এ. ক্লাসের অধ্যাপনা হয়।

অর্থসংগ্রহ ও অধ্যাপক নিয়োগ

বহুকাল পূর্বে প্রসন্নকুমার ঠাকুরের দানে আইনবিষয়ক বক্তৃতা ও রায়চাঁদ প্রেমচাঁদের দানে ঐ নামে একটি বৃত্তি দিবার ব্যবস্থা হইয়াছিল। কিন্তু তাহার পর প্রায় চল্লিশ বৎসরের মধ্যে বিশেষ কোন উল্লেখযোগ্য দান কেহ করেন নাই। আশুতোষের আমলে ১৯১২ সনে ১৫ই জুন বিখ্যাত ব্যারিষ্টার তারকনাথ পালিত বিজ্ঞান শিক্ষার উন্নতির জন্য নগদ ও জমি–উভয়ে মিলিয়া সাত লক্ষ টাকা দান করেন। পরে ঐ বৎসরেই ৮ই অক্টোবর এইভাবে আরও সাত লক্ষ টাকা দান করেন। প্রসিদ্ধ উকীল রাসবিহারী ঘোষ ১৯১৩, ১৯১৯ এবং ১৯২১ সনে তিন দফায় ২৪,৫০,৫০০ টাকা দান করেন। ইহার দ্বারা বিজ্ঞান কলেজের চারিজন অধ্যাপক নিযুক্ত হন ও গবেষণার জন্য আটটি বৃত্তি প্রদানের ব্যবস্থা হয়। এই টাকা দিয়া নিম্নলিখিত অধ্যাপকগণ নিযুক্ত হন :

১। রসায়নে পালিত অধ্যাপক প্রফুল্লচন্দ্র রায়। ২। পদার্থবিদ্যায় পালিত অধ্যাপক-চন্দ্রশেখর ভেক্টর রমন। ৩। ফলিত গণিতে রাসবিহারী ঘোষ অধ্যাপক-গণেশ প্রসাদ। ৪। রসায়নে রাসবিহারী ঘোষ অধ্যাপক-প্রফুল্লচন্দ্র মিত্র। ৫। পদার্থবিদ্যায় রাসবিহারী ঘোষ অধ্যাপক–দেবেন্দ্রমোহন বসু। ৬। উদ্ভিদৃবিদ্যায় রাসবিহারী ঘোষ অধ্যাপক–এস.পি, আঘরকার।

ইহা ছাড়াও বিশেষ বক্তৃতা দিবার (Readership Lectures) জন্য বহু দেশী বিদেশী প্রসিদ্ধ পণ্ডিতকে আমন্ত্রণ করা হয়। আর ইহারই ফলে কয়েক বৎসরের মধ্যে মেঘনাদ সাহা, সত্যেন্দ্রনাথ বসু, জ্ঞানচন্দ্র ঘোষ, নীলরতন ধর প্রভৃতি বহু খ্যাতনামা ব্যক্তি (প্রথমে ছাত্র ও পরে শিক্ষক) তাঁহাদের বৈজ্ঞানিক গবেষণার দ্বারা জগতে প্রসিদ্ধিলাভ করিয়াছেন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বাধা দূর করিয়া আশুতোষ কী কৌশলে বড়লাট লর্ড হার্ডিংয়ের নিকট হইতে চারিটি অধ্যাপক পদের অনুমোদন লাভ করেন তাহা পরে বিবৃত হইবে। এইরূপে নানা উপায়ে যে সমুদয় নূতন নূতন অধ্যাপকের পদ সৃষ্টি হয় এবং আশুতোষ কয়েকজন বিখ্যাত ভারতীয় ও বৈদেশিক পণ্ডিতকে অধ্যাপক নিযুক্ত করেন তাহা পূর্বেই বলিয়াছি। প্রসিদ্ধ ফরাসী পণ্ডিত সিলভা লেভী, জার্মান পণ্ডিত উইন্টারনিজ, জ্যাকোবি এবং ওলডেনবার্গ, রাশিয়ান পণ্ডিত পল ভিনগ্রাডফ, জাপানী য়মকামি, কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ড. ফোর্সাইল প্রভৃতি পণ্ডিতগণ আশুতোষের আমন্ত্রণে কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে বক্তৃতা করেন।

আরও কয়েকটি দানের কথা উল্লেখ করিতেছি। গুরুপ্রসন্ন ঘোষ আড়াই লক্ষ টাকা দান করেন–এই টাকার সুদ হইতে ছাত্রদিগকে বৃত্তি দিয়া শিল্প (arts and industries) শিক্ষার জন্য ইউরোপ, আমেরিকা ও জাপান পাঠান হইত।

খয়রার কুমার গুরুপ্রসাদ সিংহ বিশ্ববিদ্যালয়কে অনেক অর্থ দান করেন। ইহা লইয়া মামলা হয়। মামলার ফলে খয়রার রাণী বাগীশ্বরী দেবী কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়কে নগদ ৬,৫০,০০০ টাকা দিয়া মিটমাট করেন। এই টাকায় শব্দতত্ত্ব, দর্শন, রসায়ন, কৃষি ও ভারতীয় শিল্প–এই পাঁচটি বিষয়ে পাঁচটি অধ্যাপকের পদ সৃষ্টি হয়। মেঘনাদ সাহা, অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর, সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় প্রভৃতি প্রসিদ্ধ পণ্ডিতগণ এইসব অধ্যাপকের পদে নিযুক্ত হইয়াছিলেন।

স্নাতকোত্তর বিভাগে পাঠ্যবিষয়-রসায়ন, পদার্থ প্রভৃতি বিজ্ঞানশাস্ত্র, প্রধান প্রধান ভাষা ও সাহিত্য (ইংরেজী, সংস্কৃত, পালি, আরবী, ফার্সী), গণিত, দর্শন, ইতিহাস, অর্থনীতি প্রভৃতি বিষয়ের পঠন-পাঠন প্রথম হইতেই প্রচলিত ছিল। পরে ভারতের বিভিন্ন প্রাদেশিক ভাষায় এম.এ. পরীক্ষার প্রবর্তন আশুতোষের একটি অক্ষয় কীর্তি। তাঁহার পূর্বে কোন বিশ্ববিদ্যালয়ে ইহার কল্পনাও কেহ করে নাই। এই উদ্দেশ্যে ১৯১৮ সনে প্রসিদ্ধ কয়েকটি ভাষায় রচিত গ্রন্থ হইতে অতি প্রাচীনকাল হইতে বর্তমান কাল পর্যন্ত সাহিত্যের নির্বাচিত অংশের সঙ্কলন প্রকাশিত হয়। ১৯১৯ সনে বিভিন্ন প্রাদেশিক সাহিত্যে এম.এ. পরীক্ষা দিবার ব্যবস্থা হয়। প্রতি পরীক্ষার্থীকেই মাতৃভাষায় সাহিত্যে পারদর্শিতার সঙ্গে অন্য আর একটি প্রাদেশিক ভাষায় মোটামুটি জ্ঞানলাভ করিতে হইবে, এইরূপ ব্যবস্থা হয়।

বাংলা, অসমীয়া, ওড়িয়া, হিন্দী, উর্দু, মৈথলী, গুজরাতী, মারাঠী, তেলুগু, তামিল, কানাড়ী, মলয়ালম্ ও সিংহলী ভাষা বিশ্ববিদ্যালয়ের এম.এ. পরীক্ষার পাঠ্যসূচীর অন্তর্ভুক্ত হয়।

অন্যান্য নূতন এম.এস-সি, ও এম. এ. পরীক্ষার পাঠ্যবিষয়ের মধ্যে উদ্ভিদ fanst (Botany), analfanti (Zoology), 6720 (Physiology), galallagio ভাষাতত্ত্ব (Comparative Philology), নৃতত্ত্ব (Anthropology) ও পরীক্ষামূলক মনস্তত্ত্ব (Experimental Psychology) প্রভৃতির উল্লেখ করা যাইতে পারে। শিল্পকলা সম্বন্ধে শিক্ষা দিবার জন্য বাগীশ্বরী অধ্যাপকের পদ সৃষ্টি করা হয়। অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রথম এই পদে নিযুক্ত হন। ১৯১৭ সনে ব্যবসা বাণিজ্য (Commerce) ও টেকনোলজি বিভাগ খোলা হয়।

আইন অধ্যয়নের সুব্যবস্থা করা আর-একটি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য ঘটনা। আইন বিষয়ে পরীক্ষা দিয়া ডিগ্রীলাভের ব্যবস্থা ছিল এবং এই ডিগ্রী না পাইলে উচ্চ আদালতে, বিশেষতঃ হাইকোর্টে ওকালতি করা যাইত না। কিন্তু ইহার অধ্যয়নের ব্যবস্থা নিতান্ত অপর্যাপ্ত ছিল। সাধারণ কলেজে প্রাতঃকালে দুই-একজন উকিল কোর্টে যাইবার পথে আসিয়া বক্তৃতা দিতেন-খুব কম ছাত্রই উপস্থিত থাকিত, বা মন দিয়া তাহা শুনিত। পরে নোটবই মুখস্থ করিয়া বি.এল. পরীক্ষায় পাশ হইয়া ওকালতী করিত। আইনবিষয়ক গ্রন্থের লাইব্রেরী এইসব কলেজে ছিল না বলিলেই হয়। ১৯০৮ সনে ১৮টি সাধারণ কলেজে এইপ্রকার আইন পড়িবার ব্যবস্থা ছিল। প্রথমে সরকারী কলেজে, পরে কলিকাতার অন্যান্য কলেজে আইনের ক্লাস উঠিয়া যায়। কেবলমাত্র রিপন কলেজে আইনের ক্লাস ছিল। আশুতোষের প্রস্তাবে ১৯০৮ সনে সিনেটে সর্বসম্মতিক্রমে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্যক্ষ অধীনে একটি আইন কলেজ প্রতিষ্ঠার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। ১৯০৯ সনের জুলাই মাসে ইহা কার্যে পরিণত হয়। কলেজের একজন অধ্যক্ষ নিযুক্ত হন। ইনি অন্যান্য অধ্যাপকগণের মত ওকালতী করিতে পারিবেন না–কেবলমাত্র পড়াইবেন ও কলেজের তত্ত্বাবধান করিবেন এবং ভাল ভাল উকীল ব্যারিষ্টার সপ্তাহে নির্দিষ্ট কয়েকটি বক্তৃতা দিবেন, এইরূপ ব্যবস্থা হয়। টিউটোরিয়াল ক্লাস, মুট কোর্ট (Moot Court) প্রভৃতির ব্যবস্থা হয়। ভারত গভর্নমেন্ট ও বাংলা গভর্নমেন্ট ইহার খরচ বাবদ বার্ষিক নির্দিষ্ট পরিমাণ টাকা মঞ্জুর করেন। বেসরকারী দানও অনেক পাওয়া যায়। প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার ফলে নির্বাচিত ছাত্রগণকে বৃত্তি দিবার জন্য কাশিমবাজারের মহারাজা মণীন্দ্রচন্দ্র নন্দী ৫০,০০০ টাকা দেন। মহারাজা প্রদ্যোকুমার ঠাকুর একটি আইনবিষয়ক লাইব্রেরী স্থাপনের জন্য নগদ দশ হাজার টাকা এবং তাঁহার খুলু-পিতামহ প্রসন্নকুমার ঠাকুরের আইনগ্রন্থাবলী দান করেন। আশুতোষ নিজে মাঝে মাঝে ছাত্রদিগের নিকট আইন সম্বন্ধে বক্তৃতা দিতেন এবং মুট কোর্টের বিচারপতি হইতেন।

সর্ববিষয়ে মৌলিক গবেষণার ব্যবস্থা এবং তাহার উপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করা আশুতোষের আর-একটি বৈশিষ্ট্য। রায়চাঁদ প্রেমচাঁদ বৃত্তি প্রথমে পরীক্ষার প্রতিযোগিতার দ্বারা দেওয়া হইত। আশুতোষ নিয়ম করিলেন, মৌলিক গবেষণাই এই বৃত্তিলাভের একমাত্র উপায় হইবে। প্রতি শিক্ষককে তিনি মৌলিক গবেষণায় প্রেরণা দিতেন এবং শিক্ষকের শ্রেষ্ঠতা কেবল ছাত্রদের শিক্ষাদান দ্বারা নিরূপণ করা হইত না–তাঁহার মৌলিক গবেষণার উপর জোর দেওয়া হইত। তরুণ শিক্ষকগণকে প্রেরণা ও উৎসাহ দেবার জন্য তিনি বার্ষিক কনভোকেশনের ভাষণে শিক্ষকদের গবেষণামূলক রচনার উল্লেখ করিতেন। পরবর্তী উপাচার্যগণও বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতকোত্তর বিভাগের শিক্ষক ও ছাত্রদের গবেষণার ভূয়সী প্রশংসা করিয়াছেন। রাধাকৃষ্ণণ কমিশনের রিপোর্টে স্পষ্টই বলা হইয়াছে যে, আশুতোষই সর্বপ্রথম গবেষণাকে বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়ন ও অধ্যাপনার একটি বিশিষ্ট অঙ্গে পরিণত করিয়াছিলেন। কিন্তু ১৯৪৫ সনের পর হইতে গবেষণার উৎসাহ ও প্রেরণা হ্রাস পায়।[৩]

সার আশুতোষ মুখোপাধ্যায় যখন কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের পঠন-পাঠনে যুগান্তর আনয়ন করিতেছিলেন তখন ভারত-সরকার ক্রমশই বিরূপ হইতেছিল। অনেকে মনে করেন যে, ইহার জন্য ভারত-সরকারের শিক্ষাবিভাগের সেক্রেটারী হেনরী শার্প (H. Sharp) সাহেবই দায়ী। তিনি প্রথমে পূর্ব বাংলা ও আসাম’ প্রদেশের Director of Public Instruction ছিলেন। তাঁহার প্রভু ছোটলাট ফুলার সাহেবকে কী কারণে পদত্যাগ করিতে হয় তাহা পূর্বেই বিবৃত হইয়াছে। এই ব্যাপারে যে আশুতোষের হাত ছিল তাহা অনস্বীকার্য। কিন্তু ইহাই শার্প সাহেবের আশুতোষের প্রতি ক্রোধ বা বিরূপতার একমাত্র কারণ ছিল এরূপ অনুমান করা হয়ত অসঙ্গত। সে-যুগে স্বদেশী আন্দোলনের সময় এবং তাহার পূর্বেই যে নূতন জাতীয়তাবোধ বাংলাদেশে প্রথম প্রকট হয়, তাহার ফলে বাঙ্গালীদের সাহেবরা যে ভাল চক্ষে দেখিবেন না ইহাই স্বাভাবিক। লর্ড কার্জনের আমল তাহার পূর্ব হইতেই যে বাঙ্গালীর প্রতি এই কারণে সাহেবরা বিরূপ হইয়া উঠিতেছিলেন তাহাতে সন্দেহ নাই। ১৯০০ সনের ১৪ই ফেব্রুআরি তারিখে লর্ড কার্জন কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ফ্রান্সিস ম্যকলীনকে এক চিঠিতে লেখেন, “কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে এমন অনেক পাঠ্যপুস্তক অনুমোদিত হয় যাহা আমাদের দিক হইতে অনভিপ্রেত (not desirable)। দৃষ্টান্তস্বরূপ ১৯০১ সনে বি.এ. পরীক্ষার পাঠ্য Burke-প্রণীত ‘ফরাসী বিদ্রোহ’ (French Revolution) গ্রন্থের উল্লেখ করিতেছি। ইহা রচনার দিক দিয়া উৎকৃষ্ট পুস্তক হইলেও ভারতীয় ছাত্রদের দিক হইতে অতি বিপজ্জনক (Certainly dangerous food for Indian students)। ইংরেজদের এই মনোভাবের আর-একটি দৃষ্টান্ত দেই। বিশ্ববিদ্যালয়ের নূতন বিধি অনুসারে ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষার পাঠ্যপুস্তকের তালিকা হইতে ইংলণ্ডের ইতিহাস বাদ দেওয়া হইল, কারণ ইহা হইতেই তরুণ বাঙ্গালী ছাত্রদের মনে দেশাত্মবোধ জাগ্রত হইয়াছে।[৫] ইহার বদলে সরকারের ফরমায়েস অনুসারে লিখিত ‘England’s Work in India পাঠ্য করা হইল। ইংরেজ ভারতের কী কী উপকার করিয়াছে এই গ্রন্থে তাহার বিস্তৃত বিবরণ আছে। ইংরেজ গভর্নমেন্টের এই মনোবৃত্তির প্রকৃষ্ট পরিচয় দিবার জন্য অধ্যাপক নিয়োগ সম্বন্ধে আশুতোষের একখানি পত্রের বিষয়ে ভারত-সরকারের সচিবদের মতামতের সংক্ষিপ্ত বিবরণ দিতেছি।

আশুতোষ এক চিঠিতে লিখিলেন যে, স্নাতকোত্তর বিভাগে ইংরেজী, সংস্কৃত, পালি, আরবী, ফারসী, দর্শন, ইতিহাস, অর্থনীতি ও গণিতের অধ্যাপনার ব্যবস্থা হইয়াছে এবং এই সমুদয় বিভাগের অনেক অধ্যাপকের নাম করিলেন। ইতিহাস বিভাগ সম্বন্ধে লিখিলেন : “ইতিহাসের প্রায় সব বিভাগেরই ইংলণ্ড, প্রাচীন প্রাচ্য দেশ এবং আধুনিক ভারতের ইতিহাস অধ্যয়নেরও ব্যবস্থা হইয়াছে। অক্সফোর্ড বা কেব্রিজের ডিগ্রীপ্রাপ্ত মি. রসুল, লি. জয়সোয়াল, লি. খুদাবক্স, মি. গুপ্ত, মি. বসু ও মি. হাফিজ-ইঁহারা অতিরিক্ত বক্তৃতা (Special Lectures) দিবেন।[৬]

এই চিঠির উপর শার্প সাহেব নোট দিলেন : “এই রসুলটিই কি আমাদের কংগ্রেসওয়ালা বন্ধু? এম.এ. শিক্ষার এইরূপ ব্যবস্থা নিতান্তই কাঁচা। জানিতে পারিলাম যে, রসুল সুরেন্দ্রনাথ ব্যানার্জির চেলা ও আন্দোলনকারী (agitator) আব্দুল রসুল। সবচেয়ে আপত্তিজনক ব্যক্তি হইলেন কাশীপ্রসাদ জয়সোয়াল–বিপিনচন্দ্র পাল ও ইংলণ্ডে সাভারকরের সঙ্গে এঁর খুব যোগাযোগ ছিল এবং ইনি সম্প্রতি মিশরের জাতীয়তাবাদী দলের সঙ্গে মিশিয়াছেন। ইহারা ইতিহাসের কিরকম বক্তৃতা দিবেন তাহা ভাবিলে অবাক হইতে হয়। সুরাওয়ার্দি ও রসুলের মতো কুখ্যাত অবাঞ্ছিত (notorious and undersirable) লোকেরা সরকারী টাকায় নিযুক্ত হইবে? ইহাদের নিয়োগ অনুমোদন না করাই উচিত।”

ইহার উপর ক্র্যাডক (Craddock) মন্তব্য করিলেন : “উপাচার্যের মতো লোকের এতবড় আস্পর্ধা যে এইসব নাম পাঠায়? ইহা ভবিষ্যতে অরাজকতার বীজ বুনিবে। এঁদের নিয়োগ আমরা কিছুতেই অনুমোদন করিব না। যে উপাচার্য এইসব লোকের নাম পাঠান, তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য পদের অযোগ্য।”[৭]

বলা বাহুল্য, ভারত-সরকার সুরাওয়ার্দি, রসুল ও জয়সোয়ালের নিয়োগ বাতিল করিয়া দিলেন। এই সম্পর্কে আশুতোষ যে তেজোব্যঞ্জক ও যুক্তিপূর্ণ চিঠি লিখিয়া সরকারের আচরণের অসঙ্গতি দেখাইয়াছিলেন তাহা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।[৮]

কিন্তু এই সুদীর্ঘ পত্র এস্থলে উদ্ধৃত করা সম্ভব নহে। সিনেট সভায় গুরুদাস বন্দ্যোপাধ্যায়, ভূপেন্দ্রনাথ বসু ও রাসবিহারী ঘোষ বিষয়টি পুনর্বিচারের জন্য অনুরোধ করিয়া যে প্রস্তাব ও তাহার সমর্থনে যে বক্তৃতা করেন এবং আশুতোষের চিঠির উপর ভারত-সরকারের কর্মচারিগণ ব্যঙ্গ ও বিদ্রূপ করিয়া যে সমুদয় মন্তব্য করেন তাহার আলোচনাও সম্ভব নহে। বলা বহুল্য, ভারত-সরকারের শিক্ষাসদস্য মি. বাটলার (H. Butler) শার্প সাহেবকে পুরাপুরি সমর্থন করিলেন এবং পূর্বোক্ত তিনজন শিক্ষকের নিয়োগ বাতিল করিবার আদেশই বজায় রহিল। কিন্তু এ সমুদয়ের মধ্যদিয়া ভারত সরকারের নিম্নলিখিত দুইটি সিদ্ধান্ত পরিস্ফুট হইয়াছে। প্রথম-কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উচ্চশিক্ষার নূতন বিধি যাহাতে অব্যাহত থাকিয়া বাংলার তথা ভারতের রাজনীতিক ক্ষেত্রে ইংরেজ-বিদ্বেষে ইন্ধন না জোগায় তাহার প্রতি খরতর দৃষ্টি রাখিতে হইবে। দ্বিতীয়-কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপর আশুতোষের প্রভাব দূর করিতে, অন্ততঃ হ্রাস করিতে হইবে।

ভারত-সরকারের মুস্কিল হইল এই যে, বাংলার লাটসাহেব আশুতোষকে সমর্থন করিতেন, অন্ততঃ তাহার বিরোধী ছিলেন না। সুতরাং প্রথমে চেষ্টা করা হইল যে আশুতোষের কার্যকাল শেষ হইলে একজন বেতনভোগী সাহেবকে পুরা সময়ের জন্য উপাচার্য (wholetime Vice-Chancellor) নিযুক্ত করা। ভূতপূর্ব পূর্ববাংলা ও আসামের একজন উচ্চপদস্থ কর্মচারী ন্যাথানকে (R. Nathan, I.C.S.) এই পদে নিযুক্ত করার প্রস্তাব গোপনে সেক্রেটারী অব স্টেটের নিকট পাঠান হইল। কিন্তু ইহা জানাজানি হইয়া যাওয়ায় এই প্রস্তাব বাতিল করিতে হইল। তখন ১৯১৪ সনে আশুতোষের চতুর্থবার ভাইস-চ্যান্সেলারের কার্যকাল শেষ হইলে দেবপ্রসাদ সর্বাধিকারীকে ঐ পদে নিয়োগ করা হইল। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যাপারে আশুতোষের প্রভাব-প্রতিপত্তি কিছুমাত্র কমিল না। শার্পসাহেব দুঃখের সহিত মন্তব্য করিলেন যে, নূতন উপাচার্য ও বাংলা গভর্নমেন্ট এখনও আশুতোষের প্রভাব হইতে মুক্ত হইতে পারেন নাই। শার্প সাহেব ১৯১৫ সনের ২৯শে এপ্রিল একটি মন্তব্য লিপিবদ্ধ করিলেন যে, “কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থসাহায্য বন্ধ করিয়া ইহাকে শায়েস্তা করা হউক।”[৯]

তারপর স্থির হইল, একটি কমিটি নিয়োগ করা হউক। তদনুসারে ১৯১৬ সনে যে কমিটি হয়, এবং বাটলার সাহেবের স্থানে শঙ্করণ নায়ার বড়লাটের শাসন-পরিষদে শিক্ষা-সচিব হওয়ায় কিভাবে আশুতোষ এই কমিটির সভাপতি হন এবং অধিকাংশ সদস্য ইংরেজ হওয়া সত্ত্বেও এই কমিটি স্নাতকোত্তর শিক্ষার জন্য যে নূতন প্রস্তাব করে তাহাতে আশুতোষের সম্পূর্ণ জয় হয় এবং তাহার ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়-ফলে স্নাতকোত্তর বিভাগে তাহার পরিকল্পনা সম্পূর্ণরূপে কার্যকরী হওয়ার সুযোগ পায়, এ সমুদয় পূর্বেই উক্ত হইয়াছে।

আর কালবিলম্ব না করিয়া শার্পসাহেব এবার তাঁহার শেষ অস্ত্র নিক্ষেপ করিলেন।

১৯১৭ সনের ৬ই জুলাই ভারত-সরকার ঘোষণা করিলেন যে, কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার অবস্থা সম্বন্ধে অনুসন্ধানপূর্বক ইহার দোষত্রুটির পরিপ্রেক্ষিতে কিরূপ সংস্কার প্রয়োজন তাহার নির্দেশ দিবার জন্য একটি কমিশন নিযুক্ত করা হইবে। ঐ বৎসর ১৪ই সেপ্টেম্বর এই কমিশনের সদস্যগণের নাম ঘোষিত হইল।

ইহার সভাপতি হইলেন লিডস্ (Leeds) বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস-চ্যান্সেলর ড. এম.ই. স্যাডলার (Dr. M. E. Sadler)। আশুতোষ তখন কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য না হইলেও ইহার সদস্য মনোনীত হইলেন।

কিন্তু শঙ্করণ নায়ার বাটলার সাহেবের স্থানে নিযুক্ত হওয়াতেই যে ইহা সম্ভব হইল এরূপ অনুমান করা অসঙ্গত নহে। ১৯১৯ সনের মার্চ মাসে এই কমিশনের রিপোর্ট প্রকাশিত হইল। মূল রিপোর্ট পাঁচ খণ্ড এবং পরিশিষ্ট আরও সাত খণ্ড। এই বিশাল রিপোর্টে আশুতোষের স্নাতকোত্তর শিক্ষারীতি সমর্থিত হইল এবং স্কুল ও ইন্টারমিডিয়েট কলেজগুলি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে না রাখিয়া ইহার জন্য পৃথক একটি বোর্ড প্রতিষ্ঠার নির্দেশ দেওয়া হইল। এই নির্দেশ অনেক বিশ্ববিদ্যালয় কার্যে পরিণত করিয়াছিল। কিন্তু কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে এই কমিশনের কোন নির্দেশই কার্যে পরিণত হয় নাই। সুতরাং এই বিশাল রিপোর্ট পরবর্তীকালে স্বাধীন ভারতের শিক্ষাসম্বন্ধীয় অন্য দুইটি বিশাল রিপোর্টের মতই গুদামে পচিতে লাগিল। ভারত-সরকারের সহিত কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্বন্ধ এইখানেই শেষ হইল।

১৯১৯ সনের নূতন ভারত শাসন আইন (Government of India Act, 1919) অনুসারে ১৯২১ সনে কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় বাংলা সরকারের অধীনে আসিল, বঙ্গের গভর্নর ইহার চ্যান্সেলর হইলেন এবং শিক্ষা হস্তান্তরিত বিষয় হওয়ায় শিক্ষামন্ত্রীর হস্তেই বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্তৃত্ব ন্যস্ত হইল। কিন্তু কর্তার পরিবর্তন হইলেও নীতির পরিবর্তন হইল না। শিক্ষামন্ত্রী প্রভাসচন্দ্র মিত্র ও শার্প বাটলারের মধ্যে এ-বিষয়ে বিশেষ প্রভেদ দেখা গেল না। তবে লাটসাহেব লর্ড রোনাল্ডসে আশুতোষের কাজের খুব প্রশংসা করেন এবং ১৯২১ সনে পুনরায় তাঁহাকে উপাচার্য পদে নিযুক্ত করিলেন।

১৯২১ সনে বিশ্ববিদ্যালয় উচ্চশিক্ষার জন্য বাংলা সরকারের নিকট দশ লক্ষ টাকা এককালীন দান ও স্নাতকোত্তর বিভাগের শিক্ষকদের বেতনের জন্য ১,৭৫,০০০ টাকার জন্য আবেদন করিল। সরকার ঐ বিভাগের উন্নতির জন্য ঐ পরিমাণ টাকা এবং কারিগরী শিক্ষার জন্য ১০,০০০ টাকা দিয়া বলিলেন, অতঃপর সরকার এইরূপ কোন টাকার দাবি মঞ্জুর করিবেন না এবং অর্থের অনটনের জন্য স্যাডলার কমিশনের কোন প্রস্তাব কার্যে পরিণত করিতে তাহারা অক্ষম।

১৯২২-২৩ সনের বাজেটে বার্ষিক দেয় ১,৪১,০০০ টাকার বেশী আর কিছু বরাদ্দ হইল না। ১৯২৩ সনের ১লা মার্চ শিক্ষামন্ত্রী প্রভাসচন্দ্র মিত্র বিধানসভায় ঘোষণা করিলেন যে, কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের যে পাঁচলক্ষ টাকা ঘাটতি হইয়াছে তাহা অপব্যয়ের ফল (thoughtless expansion of the University in the past)। টাকা পাইবার আশায় স্নাতকোত্তর বিভাগের এরূপ সম্প্রসারণ গুরুতর অপরাধ (It was almost criminal thoughtlessness to have ignored the financial aspect of the question in their enthusiasm for expansion)[১০] ইহার কয়েকদিন পরে (১৮ই মার্চ) বার্ষিক কনভোকেশনের অধিবেশনে আশুতোষ বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থব্যয়ের সমর্থনকল্পে নানা যুক্তি ও ঘটনার উল্লেখ করিলেন। ১৯২২ সনের ২৩শে অগষ্ট বাংলা গভর্নমেন্ট আটটি শর্ত পালন সাপেক্ষে আড়াই লক্ষ টাকা দিতে স্বীকৃত হইলেন। এই প্রস্তাব আলোচনার জন্য সিনেট একটি কমিটি গঠন করিল। এই কমিটির রিপোর্ট ১৯২২ সনের ২রা ডিসেম্বর সিনেটের অধিবেশনে আলোচিত হইল। আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায় বলিলেন :

“The conditions which have been imposed are so humilliating, so gallingly derogatory to our self-respect, that we had better close down the concern, lock up the gates of the university and go about the country for support. We are threatened with a national disaster. We should gird up our loins and see that the noble heritage which has been granted to us is not bartered for a mess of pottage.[১১]

ইংরেজ অধ্যক্ষ হাওয়েলস (Howells) গভর্নমেন্টের তীব্র নিন্দা করিয়া বলিলেন যে, বাংলা সরকারের ঘাটতির পরিমাণ ৮৭ লক্ষ টাকা, অথচ সামান্য কয়েক লক্ষ টাকার জন্য অযাচিত উপদেশ শুনিয়া বলিতে ইচ্ছা হয়–ডাক্তার, আগে নিজের চিকিৎসা কর। উপসংহারে বলিলেন, “It will be a betrayal of the great trust imposed on us as a university, if we yield.[১২]

এই উপলক্ষে আশুতোষ যাহা বলিলেন তাহা স্বর্ণাক্ষরে বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বারদেশে ক্ষোদিত করিয়া রাখার যোগ্য। বহুল-প্রচারিত এই ভাষণের এক অংশের মূল ইংরেজী পাঠ উদ্ধৃত করিতেছি, কারণ বাংলা অনুবাদে ইহার স্বরূপ ফুটিয়া উঠিবে না।

“Take it from me that as long as there is one drop of blood in me, I will not participate in the humiliation of this university. The university will not be a manufactory of slaves. We want to think truly, we want to teach freedom, we shall inspire the rising generation with thoughts and ideas that are high and ennobling. We shall not be a part of the Secretariat of the Government. Forget not that what is offered is not even a periodical grant, much less a perpetual grant. What is the offer? Two and a half lakhs. And you solemnly propose that you should barter away your independence for it. If you give me slavery on the one hand and money in the other, I despise the offer. We will not take the money, we shall retrench and we shall live within our means. We shall go from door to door all through Bengal. We shall rouse the public conscience of Bengal. … and make the people of Bengal realize their responsibility for the maintenance. In a state of efficiency, of their chief seat of learning… our post-graduate teachers will starve themselves. rather than give up their freedom…

… I call upon you as members of the Senate to stand up for the rights of your university. Forget the Government of Bengal. Forget the Government of India. Do your duty as senaters of this university as true sons of your Alama Mater. Freedom First, Freedom Second, Freedom Always, nothing else will satisfy me. [১৩]

অবশেষে গভর্নমেন্ট নতি স্বীকার করিল এবং বিনা শর্তে আড়াই লক্ষ টাকা মঞ্জুর করিল।

কিন্তু শীঘই আবার গোলযোগ বাধিল। গভর্নমেন্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কার সাধন এবং মাধ্যমিক শিক্ষার জন্য একটি বোর্ড (Board of Secondary Education) স্থাপনের জন্য দুইটি বিল এবং বিধানসভার দুইজন সদস্য শ্রীসুরেন্দ্রনাথ মল্লিক এবং যতীন্দ্রনাথ বসুর প্রস্তাবিত দুইটি বিল বিশ্ববিদ্যালয়ের মতামতের জন্য পাঠাইলেন। সিনেট সরকারী বিল দুইটি জনসাধারণের মধ্যে প্রচার করার পরামর্শ দিল এবং অন্য দুইটি বিল অনুমোদন না করিয়া মন্তব্য করিল যে, এই দুইটি বিলের একমাত্র উদ্দেশ্য বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যাপারে মন্ত্রীর প্রভুত্ব প্রতিষ্ঠা করা। সিনেটের মতে এই চারিটি বিলই স্যাডলার কমিশনের মতের বিরোধী।

এই সমুদয় মন্তব্য গভর্নমেন্টের মনঃপূত হইল না এবং আশুতোষের প্রভাবেই যে সিনেট এইরূপ সিদ্ধান্তে উপনীত হইয়াছে ইহা চ্যান্সেলার লর্ড লিটন অনায়াসেই বুঝিলেন। সুতরাং তিনি আশুতোষকে বশীভূত করিবার জন্য এক নূতন উপায় উদ্ভাবন করিলেন। ১৯২৩ সনের ৩রা এপ্রিল আশুতোষের বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য পদের কাল উত্তীর্ণ হইবে। তিনি ২৪শে মার্চ তাঁহাকে এক চিঠি লিখিলেন। ইহার মর্ম এই যে, যদি আশুতোষ প্রতিশ্রুতি (assurance) দেন যে, অতঃপর তিনি গভর্নমেন্টের বিরোধিতা না করিয়া সম্পূর্ণভাবে সহযোগিতা করিবেন, তবেই তিনি তাঁহাকে পুনরায় উপাচার্যপদে নিযুক্ত করিবেন। বলাবাহুল্য, আশুতোষ ইহা ঘৃণার সহিত প্রত্যাখ্যান করিলেন। উপসংহারে তিনি লিখিলেন :

“I send you without hesitation the only answer which an honourable man can send, an answer which you and your advisers expect and desire. I decline the insulting offer you have made to me.”[১৪]

গভর্নমেন্ট ভূপেন্দ্রনাথ বসুকে উপাচার্য পদে নিযুক্ত করিলেন। এই বলিষ্ঠ প্রত্যাখ্যানই আশুতোষের জীবনব্যাপী সংগ্রামের শেষ অঙ্ক। ইহার পরেই যবনিকা পড়িল, ১৯২৪ সনের ২৫শে মে পাটনায় তাঁহার মৃত্যু হইল। তাঁহার মৃত্যুর পর সিনেটের শোকসভায় লর্ড লিটন আশুতোষের সুদীর্ঘ ও উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করিয়া বলিয়াছিলেন, “বহুবৎসর পর্যন্ত আশুতোষই কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় ছিলেন (Ashutosh was in fact the university and the university Sir Ashutosh.)SC ইহা যে কতদূর সত্য পূর্বোক্ত বিবরণ হইতে তাহা সহজেই বুঝা যাইবে।

এই প্রসঙ্গে উল্লেখ করা যাইতে পারে যে, ১৯০৪ সনের যে আইনকে রূপায়িত করিয়া আশুতোষ স্নাতকোত্তর শিক্ষার বিরাট সৌধ নির্মাণ করিয়াছিলেন, সমভাবে সেই আইন কলিকাতা, মাদ্রাজ ও বোম্বাই–এই তিনটি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতি প্রযোজ্য ছিল। অথচ অপর দুই বিশ্ববিদ্যালয়ে যাহা নির্মিত হইয়াছিল, কলিকাতার সৌধের তুলনায় তাহা পর্ণকুটির মাত্র। এই ব্যতিক্রমের কৃতিত্ব যে অন্ততঃ পনেরো আনা আশুতোষের প্রাপ্য সে-বিষয়ে কোন সন্দেহ নাই। আশুতোষ যখন উপাচার্য নিযুক্ত হন তখন স্নাতকোত্তর বিভাগের নিজস্ব একজন শিক্ষকও ছিলেন না। আশুতোষের মৃত্যুকালে ইহাদের সংখ্যা ছিল ১৭০, বার্ষিক ব্যয়ের পরিমাণ ছিল সাড়ে পাঁচ লক্ষ টাকা–নির্দিষ্ট স্থায়ী আয় ছিল মাত্র এক লক্ষ টাকা। তথাপি অনিচ্ছুক সরকারের সহিত সংগ্রাম করিয়া ও অন্য উপায়ে তিনি এই বিরাট প্রতিষ্ঠানটি বজায় রাখিয়াছিলেন।

আশুতোষের মৃত্যুর পর আরও ২৪ বৎসর কালের ইতিহাস এই গ্রন্থের আলোচ্য বিষয়। অতঃপর এই যুগের উল্লেখযোগ্য কয়েকটি বিশেষ পরিবর্তন ও পরিবর্ধনের সংক্ষিপ্ত বর্ণনা করিতেছি।

স্নাতকোত্তর বিভাগের অর্থকৃতা বহুকাল চলিয়াছিল, কিন্তু মোটের উপর অর্থের অভাবে শিক্ষাকার্য ব্যাহত হয় নাই।

আশুতোষের মৃত্যুর তিনমাস পরে (২৭শে সেপ্টেম্বর, ১৯২৪) সিনেট একটি কমিটি গঠন করে। ইহার রিপোর্ট-অনুসারে স্নাতকোত্তর বিভাগের শিক্ষকনিয়োগ ও অন্যান্য বিষয়ে কিছু পরিবর্তন সাধিত হয় এবং সিনেট গভর্নমেন্টের নিকট বার্ষিক তিন লক্ষ টাকা দানের জন্য আবেদন করে (মে, ১৯২৫)। ইহার কয়েক মাস পূর্বে বার্ষিক কনভোকেশনে আচার্য গভর্নর লিটন ভরসা দিয়াছিলেন যে, এই স্নাতকোত্তর বিভাগের কার্য সুষ্ঠুভাবে নির্বাহের জন্য যে অর্থ প্রয়োজন তাহা দিবেন এবং কার্যতঃ তিনি প্রার্থিত বার্ষিক তিন লক্ষ টাকার আবেদন মঞ্জুর করিলেন।

উক্ত কমিটির প্রস্তাব-অনুসারে কোন কলেজে উপযুক্ত শিক্ষক থাকিলে স্নাতকোত্তর বিভাগের কোন কোন বিষয় সম্বন্ধে তাহার দ্বারা লেকচার দেওয়ার প্রথা প্রবর্তিত হইল। এই extra-mural lecture দ্বারা বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজগুলির শিক্ষাদানের মধ্যে যোগসেতু স্থাপিত হয়, এবং বিশ্ববিদ্যালয়েরও কিছু ব্যয়সংক্ষেপ হয়। সংস্কৃত, ইসলামীয় সভ্যতা এবং মধ্য ও আধুনিক যুগের ভারতের ইতিহাসের জন্য আশুতোষের নামে তিনটি নূতন অধ্যাপকের পদ সৃষ্টি হয়।

১৯১৯ সনে প্রাচীন ভারতীয় ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিষয়ে এম.এ. ডিগ্রী দিবার ব্যবস্থা হইয়াছিল। ১৯৩২ সনে ইতিহাস বিভাগ হইতে পৃথক করিয়া এই বিষয়ের জন্য একটি নূতন বিভাগের সৃষ্টি হয়।

এই বিষয়ের অধ্যাপকেরা বহু গবেষণা করেন এবং দেবদত্ত রামকৃষ্ণ ভাণ্ডারকর দশ বৎসর এই বিভাগে কাৰ্মাইকেল প্রফেসর ছিলেন। তিনি এবং এই বিভাগের অধ্যাপক ও ছাত্রগণ প্রাচীন ভারত সম্বন্ধে যেরূপ গবেষণা করিয়াছেন, অন্য কোন বিশ্ববিদ্যালয়ে তাহা হয় নাই। আশুতোষ এই বিষয়ে অধ্যাপনার জন্য যেসব তরুণ অধ্যাপক নিযুক্ত করিয়াছিলেন পরবর্তীকালে তাঁহাদের অনেকেই পাণ্ডিত্যের জন্য খ্যাতি লাভ করিয়াছেন।

যদিও আশুতোষের মৃত্যুর পরও প্রায় দশ-পনের বৎসর পর্যন্ত কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্ববিভাগই গবেষণার জন্য সমগ্র ভারতে বিশেষ প্রসিদ্ধি লাভ করিয়াছিল, তথাপি ইহা অনস্বীকার্য যে তাঁহার পর হইতেই এই খ্যাতি ক্রমশঃ ক্ষীণ হইয়া আসিয়াছে। অন্যান্য কারণ যাহাই থাকুক, আশুতোষের ন্যায় পরবর্তী কর্তৃপক্ষের উৎসাহ ও প্রেরণার অভাব যে ইহার একটি প্রধান কারণ সে-বিষয়ে সন্দেহ নাই। তবে অন্য কারণও আছে। ১৯৪৮ সনের ৪ঠা নভেম্বর সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণণের নেতৃত্বে যে ইউনিভারসিটি কমিশন গঠিত হয় সেই কমিটি মন্তব্য করিয়াছেন, বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণার প্রকৃষ্ট যুগ ছিল ১৯২০-৪৫। কিন্তু বর্তমানে ইহার দ্রুত অবনতি হইতেছে। ইহার অন্যতম কারণস্বরূপ এই কমিশন মন্তব্য করিয়াছেন যে, সর্বোচ্চ সরকারী চাকুরীতে ভারতীয় ছাত্রগণ অধিক সংখ্যায় নিযুক্ত হওয়ায় শ্রেষ্ঠ ছাত্রগণ সেই দিকেই আকৃষ্ট হয়; সুতরাং অধ্যাপনা ও গবেষণার ক্ষেত্রে তাহাদের সংখ্যা ক্রমশঃ হ্রাস পাইতেছে১৬

এই প্রসঙ্গে উল্লেখ করা যাইতে পারে যে বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়াও কলিকাতায় আরও দুইটি বৈজ্ঞানিক গবেষণাগার ছিল। প্রথম ১৮৭৬ সনে মহেন্দ্রলাল সরকার affordo “Indian Association for the Cultivation of Science 47: Tota ১৯১৭ সনে জগদীশচন্দ্র বসু প্রতিষ্ঠিত Bose Research Institute-এই দুইটিই। আলোচ্য যুগে বিশেষ প্রসিদ্ধি লাভ করিয়াছিল।

স্যাডলার কমিশন প্রস্তাব করিয়াছিলেন যে, বিশ্ববিদ্যালয়ে এম. এ. পড়াইবার ব্যবস্থা হইবে এবং ইহার অধীনস্থ কলেজগুলিতে কেবলমাত্র বি.এ. পরীক্ষার জন্য ছাত্র ভর্তি করিবে। মাধ্যমিক শিক্ষা (Intermediate Course) এবং স্কুলগুলি বিশ্ববিদ্যালয়ের তত্ত্বাবধানে না রাখিয়া তাহাদের পরিচালনার জন্য একটি পৃথক বোর্ড নিযুক্ত হইবে। আশ্চর্যের বিষয় এই যে, ভারতের অনেক বিশ্ববিদ্যালয় এই ব্যবস্থা গ্রহণ করিলেও, যে কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কারের জন্য এই কমিশন নিযুক্ত হইয়াছিল সেই বিশ্ববিদ্যালয় আলোচ্য যুগের মধ্যে এই ব্যবস্থা গ্রহণ করে নাই। ইহা লইয়া বাংলা সরকার ও কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে বহু আলোচনা হইয়াছে, কিন্তু ১৯৪৭ সন পর্যন্ত পূর্বব্যবস্থাই বলবৎ ছিল। পরে ১৯৫০ সনে এই বোর্ড গঠনের প্রস্তাব গৃহীত হয়।

রাধাকৃষ্ণণ কমিশনের মতে স্কুল ও ইন্টারমিডিয়েট কোর্সের শিক্ষা ও পরীক্ষার মান সর্বত্রই খুব নিম্ন। বি.এ. ডিগ্রী (পাশ ও অনার্স কোর্স) সম্বন্ধেও ঐ কমিশন অনুরূপ মন্তব্য করিয়াছেন। কলেজগুলির বাড়ী, আসবাবপত্র, যন্ত্রপাতি, দুই-তিন ভাগে (Shift) একই ক্লাসের লেকচার ও বিজ্ঞান বিভাগে ছাত্রদের practical work সম্বন্ধেও এই কমিশন বিরূপ মন্তব্য করেন।১৭

কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় স্কুলের শিক্ষার অনেক পরিবর্তন করে। স্যাডলার কমিশন মন্তব্য করিয়াছিলেন যে, স্কুলে ইংরেজীভাষায় শিক্ষাদান ও পরীক্ষাগ্রহণ ছাত্রদের পক্ষে অনিষ্টকর এবং ইংরেজী ও গণিত ব্যতীত অন্য সব বিষয়ের পঠন পাঠন মাতৃভাষায় হওয়া উচিত। অনেক আলোচনার পর কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেট-সভায় এই প্রস্তাব-অনুযায়ী নূতন বিধি (Regulation) গৃহীত হয় (৭ই জুলাই, ১৯২২)। কিন্তু বাংলা সরকার ১৯২৪ সনের অগষ্ট মাসে এই প্রস্তাবে সম্মতি না দিয়া মন্তব্য করেন যে, মাতৃভাষায় শিক্ষাদান ও পরীক্ষায় প্রশ্নের উত্তর লেখা বাধ্যতামূলক করিলে অনেক ক্ষেত্রে অসুবিধা ও আপত্তি হইবার সম্ভাবনা। ইহা ছাড়াও অনেকগুলি নূতন নিয়ম সম্বন্ধে গভর্নমেন্ট আপত্তি করেন। বহুদিন যাবৎ ইহা লইয়া নানাভাবে আলোচনার পর সিনেট ১৯৩২ সনের ১৩ই অগষ্ট পূর্বেকার বিধির অনেক পরিবর্তন করিয়া যে নূতন বিধি (Regulation) অনুমোদন করেন তাহাতে শিক্ষা ও পরীক্ষার ভাষা সম্বন্ধে বলা হইয়াছে যে, “ইংরেজী ব্যতীত অন্য সকল বিষয়ে মাতৃভাষায় শিক্ষা দিতে হইবে এবং অন্য কোনরূপ নির্দেশ না থাকিলে সাধারণতঃ ইংরেজী বা অন্য ইউরোপীয় ভাষা ছাড়া অন্যান্য সকল বিষয়ের পরীক্ষায় প্রশ্নের উত্তর ভারতীয় ভাষায় (Major Vernacular) লিখিতে হইবে।” তিন বৎসর পরে ১৯৩৫ সনের জুন মাসে গভর্নমেন্ট এই প্রস্তাব গ্রহণ করেন। এইভাবে একটি যুগান্তকারী পরিবর্তনের সূচনা হইল।১৮ ১৯৪০ সনের পরীক্ষা হইতে এই নূতন বিধি কার্যকরী হয়।

এই প্রসঙ্গে বলা যাইতে পারে যে, ১৯৩৭ সনে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কনভোকেশনে বাংলায় ভাষণ দেন এবং বাংলাভাষায় গবেষণামূলক রচনা (Thesis) লিখিয়া একজন ডক্টরেট (Ph. D.) উপাধি পান।

উচ্চ ইংরেজী স্কুল সম্বন্ধে ইতিপূর্বে আর-একটি প্রস্তাব গৃহীত হইয়াছিল (১৯২৫, ৩১শে জুলাই)। তদনুসারে প্রত্যেক স্কুলের জন্য একটি কমিটি নিয়োগ করিতে হইবে এবং স্কুলসম্বন্ধীয় ব্যাপারে এই কমিটির মতামত গ্রহণ করিতে হইবে। প্রতি সপ্তাহে একবার ইহার অধিবেশন হইবে। ইহার যাবতীয় সিদ্ধান্ত সিণ্ডিকেটের অনুমতিসাপেক্ষ হইলেও সাধারণতঃ সিণ্ডিকেট ইহা অগ্রাহ্য করিত না। স্কুলের শিক্ষকদের শিক্ষার জন্যও বিশ্ববিদ্যালয় ব্যবস্থা করেন।

১৯২৪ সনে কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে ৪৬টি কলেজ ছিল, ১৯৩২ সনে ইহা বাড়িয়া ৫৬টি হয়। বাংলা গভর্নমেন্ট বেসরকারী কলেজের জন্য প্রতি বৎসর ১,২৯,০০০ টাকা দিতেন। নূতন নূতন বিষয়ে শিক্ষাদানের ব্যবস্থার জন্য কলেজের ব্যয় বৃদ্ধি হয়। কিন্তু ছাত্রসংখ্যা কম হওয়ায় আয় হ্রাস পায়। ইহা সত্ত্বেও গভর্নমেন্ট বার্ষিক অনুদানের পরিমাণ অর্ধেক, অর্থাৎ ৬৪,০০০ টাকা করেন। বিশ্ববিদ্যালয় পুনঃ পুনঃ এ-বিষয়ে গভর্নমেন্টের দৃষ্টি আকর্ষণ করিলেও কোন ফল হয় না।

পূর্বেই বলা হইয়াছে যে, কলেজগুলি পরিদর্শনের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় একজন উচ্চপদস্থ কর্মচারী নিযুক্ত করেন। কিন্তু ইহাদের উন্নতির জন্য বিশেষ কোন ব্যবস্থা করা সম্ভব হয় নাই। ১৯০২ সনে কলেজের ছাত্রসংখ্যা ছিল, ৮,১৫০; ১৯১৭ সনে ২৮,৬১৮; ১৯২৭ সনে ৩০,২০২; ১৯৩৭ সনে ৩৫,৩৫৭ এবং ১৯৪৭ সনে ৪৫,০০৮ (সমস্ত ভারতীয় ছাত্রের এক-পঞ্চমাংশ)।১৯

আলোচ্য যুগে বিশ্ববিদ্যালয়ের আর কয়েকটি প্রয়োজনীয় ব্যবস্থার উল্লেখ এখানে করিতেছি।

১. বাংলাভাষায় শিক্ষা ও পরীক্ষার ব্যবস্থা হইলে বাংলা বানান সম্বন্ধে একটি নির্দিষ্ট নিয়মাবলী ও পরিভাষা সঙ্কলনের প্রয়োজনীয়তা অনুভূত হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের নির্দেশে এই সম্বন্ধে একটি পুস্তিকা প্রকাশিত হয়, কিন্তু ইহা বিশেষ কার্যকরী হয় নাই। এ-সম্বন্ধে বাংলাসাহিত্যের অরাজক অবস্থা ও উদ্ধৃঙ্খলতা ক্রমশঃ শোচনীয় হইয়া উঠিয়াছে।

২. একই উদ্দেশ্যে বিশ্ববিদ্যালয় বাংলায় কতকগুলি পাঠ্যপুস্তক রচনার ব্যবস্থা করে। এই চেষ্টাও সফল হয় নাই।

৩. বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্যবিষয়ের সম্প্রসারণ এবং ইহার জন্য নূতন নূতন বিভাগ (Faculty, Curriculum) প্রতিষ্ঠার ফলে পরীক্ষার সংখ্যা বাড়িতে থাকে। ১৯৩৩ সনে এই সংখ্যা ছিল ৩০; দশ বৎসর পরে ইহা বাড়িয়া হয় ৩৭; পরবর্তী দশ বৎসরে বাড়িয়া এই সংখ্যা হয় ৬৪। নূতন বিভাগের মধ্যে সামরিক শিক্ষা, গ্রন্থাগারিকের শিক্ষা, সাবান তৈরীর শিক্ষা প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য। এই সকল পরীক্ষায় উত্তীর্ণ ছাত্রদের ডিপ্লোমা দেওয়া হয়।

৪. ১৯৪৩ সন হইতে নূতন নিয়ম হয় যে, ইন্টারমিডিয়েট, বি.এ., বি.এস-সি. ও বি.কম. পরীক্ষা সব বিষয়ে একসঙ্গে না দিয়া দুই ভাগে দেওয়া যাইতে পারে (compartmental system)।

৫. বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইব্রেরীতে বই রাখার ব্যবস্থার অনেক উন্নতি হয় এবং অনেকে তাঁহাদের মূল্যবান পুস্তক-সহ বিশ্ববিদ্যালয়কে দান করেন।

৬. কেবলমাত্র পরীক্ষার প্রশ্ন ছাপাইবার নিমিত্ত ১৯০৯ সনে প্রতিষ্ঠিত প্রেসটি আলোচ্য যুগের শেষে একটি বিশাল ছাপাখানায় পরিণত হয়। বাংলাদেশে স্ত্রী-শিক্ষার বিশেষ প্রসার হইয়াছিল। ১৯৩২ হইতে ১৯৩৭-এই পাঁচ বৎসরে সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মোট ছাত্রীসংখ্যা ৩,৫৯,৭১২ হইতে বাড়িয়া ৭,৩৩,৩৮৯ হইয়াছিল।

এই অধ্যায়ের পরিশিষ্টে ১৯৪৭ সনে কলিকাতার কলেজ ও ছাত্রদের সম্বন্ধে রাধাকৃষ্ণণ কমিশন যে সমুদয় মন্তব্য করিয়াছেন তাহা উদ্ধৃত করিয়াছি। ইহা হইতে কয়েকটি কলেজের উৎপত্তি এবং আলোচ্য যুগে শিক্ষার গতি ও প্রকৃতি সম্বন্ধে স্পষ্ট ধারণা করা যাইবে। এই কমিশনে বহু গণ্যমান্য শিক্ষাবি সদস্য ছিলেন এবং স্বাধীন ভারতে (১৯৪৮-৪৯) বহু সাক্ষ্য গ্রহণ ও বহু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পরিদর্শন করিয়া তাঁহারা যে মন্তব্য করিয়াছেন তাহার সত্যতা ও মূল্যসম্বন্ধে কোনরূপ সন্দেহ জাগিতে পারে না।

১৯৪০ সনে কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্বন্ধে Inter-University Board, India নিম্নলিখিত বিষয়গুলির বিস্তৃত বিবরণ দিয়াছেন।[২০]

১. বিশ্ববিদ্যালয়ে (স্নাতকোত্তর বিভাগে) প্রতি বিষয়ের অধ্যাপকদের (Professor) এবং অন্যান্য শিক্ষকদের নাম। বিষয়গুলির সংখ্যা ২৩।

২. বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্তর্ভুক্ত কলেজগুলির অধ্যক্ষদের নাম। কলেজগুলির সংখ্যা ৭৩।

৩. ১৯৩৮-৩৯ সনে বিভিন্ন বিভাগের ছাত্রসংখ্যা, এবং বিভিন্ন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ ছাত্রের সংখ্যা।

৪. লাইব্রেরী, ল্যাবোরেটরি, মিউজিয়ম।

৫. বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক প্রকাশিত বিশিষ্ট গ্রন্থাবলীর নাম।

৬. সামরিক শিক্ষা, স্ত্রী-শিক্ষা, শিক্ষকগণের শিক্ষা প্রভৃতির ব্যবস্থা।

৭. বিভিন্ন পরীক্ষার জন্য নির্দিষ্ট পাঠ্যবিষয়ের তালিকা।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সম্বন্ধেও অনুরূপ বিবরণ আছে।

এই গ্রন্থে আলোচ্য যুগের শেষভাগে বঙ্গদেশে শিক্ষার ব্যবস্থা সম্বন্ধে উল্লিখিত বিবরণ হইতে একটি স্পষ্ট ধারণা করা যাইবে।

পরিশিষ্ট (Appendix)

Extract from the Report of the University Education Commission (1948-49), presided over by S. Radhakrishnan (P.p. 484-88):

5. Encouragement of Private colleges : The 1882 Commission advocated the transfer of Government colleges to non-official agencies and following this policy the college at Midnapur was transferred to the control of the Municipality in 1887 and that at Berhampore to the control of the Maharaja of Kasimbazar. The growth of new colleges under private management was encouraged and so in the last two decades of the century many such institutions were established. Among these may be mentioned particularly three colleges in Calcutta, the Ripon College (1884), the Bangabasi College (1887) and the Central College (1896). The Maharaja of Burdwan started a college in 1882 at Burdwan and colleges were started at Dacca, Cooch Behar, Barisal, Pabna, Mymensing and other places.

6. Growth o Numbers : The Jurisdication of the Calcutta University was not circumscribed by provincial limits and among the affiliated institutons were not only the colleges in Bengal, Bihar, Orissa and Assam but also those in the United Provinces, Central Provinces, Burma and Ceylon. The establishment of new Universities restricted its sphere of work, but did not curtail its numbers. The increase in the number of students has been referred to in the first chapter and it may be emphasised here again. The total number of college students was 3,827 in 1882; 8,150 in 1902; 28,618 in 1917; 30,202 in 1927; 35,357 in 1937 and 45,008 in 1947. In the last mentioned year there were 2,41,794 students in the twenty Universities of India taken together and of those nearly 20% was the enrolment of the Calcutta University. The partition of the province did not lead to any substantia decrease in the number of students, as in 1948 the University still had over 41,000 students and to-day it has 74 affiliated colleges of which 36 are in the city of Calcutta. Five of the Calcutta Colleges-Vidyassagar College (formerly Metroplolitan), Surendranath College (formerly Ripon), City, Bangabasi and Asuthos (formerly South Suburban) have between them are enrolment of 30,492 students.

7. Overcrowding : The building and equipment of these colleges are far from satisfactory, for they have not been able to keep pace with the increase in the number of students. The total area on which some of these colleges are built does not extend to even one acre and the rooms cannot accommodate more than a fraction of the students on the rolls. Lectures in double and treble shifts, practical work in 30 to 40 sections mark the organisation of some of these institutions which have been carrying on without any help from the Government and have been mainly responsible for the higher education of the province. The condition in which many of the sutdents of these colleges live are extermly unsatisfactory.

8. Post-Graduate Education in Arts and Science : Post Graduate education in the University is under its direct control. The University Colleges of Arts and Science were started with high hopes and their early work largely justified the original expectations. Generous donations from philanthropists like Taraknath Palit, Rashbihari Ghosh and Kumar G.P. Singh were supplemented by Government grant for a few chairs but the mainstay of the University was its fee-income-the income derived from the thousands of examinees flocking to its portals, anxious for a University certificate or diploma.

The University College of Science and Technology and the University College of Arts, are almost entirely devoted to post graduate training and research in 14 different branches of science and a similar number in arts, though some departments do a certain amount of under-graduate teaching. The total budget is about 25 lakhs. Though graduate study in the American sense was first organised in these colleges in 1915, due to the initiative and foresight of the great educationist, Sir Asutosh Mukherji, and though the Calcutta University Commission gave unstinted support for the philosophy and organisation of such studies, these University post graduate colleges have not made satisfactory progress in the last 30 years. They have been, however, the centres of great research schools in fundamental sciences, Arts, History, Philosophy, and oriental Studies. Some depeаrtments like Botany, Zoology, Anthropology; Physiology, Geography, Statistics and Geology have been housed in insufficient temporary buildings for the last 30 years. With adequate financial support University College of Science might have developed along the lines of the Imperial College of Science in London, for after a long period of inactivity, a new scheme of expansion has now been launched; it has already organised, thanks to the liberal grants given by the Central Government, an Institute of Nuclear physics, an Institute of Radio-physics and Electronics and has expanded its activities in Applied physics and Chemistry. There are other schemes of Development in contemplation. The University has now got an Institute of Jute Technology, out of endownments given by the jute merchants and manufacturers of Calcutta, and an Institute of Social Studies endowed by the Central Government.

9. Conditions since the Calcutta University Commision : In the first chapter we have mentioned the work of the Calcutta University Commission and its recommendations. During the thirty years which have elapsed since the publication of its report no steps have been taken to implement these recommendations and as a resul of thirty years of inaction, the organisation and management of colleges have suffered.

(i) Disparity between Government and Private Institutions : There is extreme disparity in equipment and efficiency and in the salaries of teachers due to the differences in origin of the Institution. As teachers doing the same kind of work get widely different scales of salary, there is a dangerous undercurrent jealousy, suspicion and ill-will between teachers of government colleges and those of private colleges.

(ii) University control on private colleges nominal : The control of the University in enforcing standards of efficiency and reasonable scales of salary for the teaching profession in the colleges affiliated to its is in most cases merely nominal as it has no funds at its disposal to give effect to these proposals, and has control over appointments either in government or in other affiliated colleges. The Goverment of the country, though it is now national has as yet assumed no real responsibility to improve the conditions of the private colleges by helping them to acquire land, for building places of instruction, residences for students and hostels and to raise the scale of salaries of teachers to the standard of even living wages.

(iii) Stagnation of Government Institutions : Some of the colleges under the direct control of the Government have either declined in efficiency, or remained in a state of stagnation during the last 30 years, since the Calcutta University Commission reported on their condition. This is partly due to the fact that neither the principal nor the corresponding Ministry (e.g. from the Ministry of Education for Arts, Science and Enginerring Colleges, or from the Ministry of Health in the case of Medical Colleges). The Governing bodies of these institutions have little power and meet infrequently.

10. Other defects : The position is further complicated by the following factors :

(i) Indiscipline : The spirit of indiscipline among students which has been aroused by the leaders of the country in their struggle for freedom has now become a habit. This spirit of indiscipline, once excited, is very difficult to put down in spite of the best efforts of the leaders and Government.

(ii) Location in congested area : The University and other educational institutions are located the most congested area where students are constantly distracted from their studies by different types of confusion and disorder.

(iii) City congestion : There has been terrible overcrowding in the city due to war conditions and the influx of refugees from East Bengal. It is now estimated that greater Calcutta from which the colleges draw their students has a population of 6 millions which is almost a fourth of the whole population of West Beangal. Such sudden increase of population generally creates stresses, which it is difficult for any administration to overcome in a short time. This has also resulted in overcrowding in the Calcutta Colleges and the University and there has been no improvement in residential arrangement for the students.

(iv) Problems of discontented student and teachers : We are afraid that the problems of Calcutta have not only local but general significance. Movements for the overthrow of the present system of Government already exits in an embryonic form there, movements in which the discontented elements of the students population get involved. The total student population of Calcutta has assumed huge proportions and there are also those who have left their studies and have not been able to obtain employment. The baren of this discontent is furnished by a large number of poorly paid teachers of schools, colleges and universities who find it extremely difficult to scrape a livelihood on their meagre salaries, which even in normal times were insufficient as was noticed by the Calcutta University Commission thirty years ago but now owing to inflation can hardly enable them to keep boody and soul together.

(v) Undemocratic Constitution : Further, the constitution of the Calcutta University is still governed by the undemocratic Act of 1904. 80% of members of the Senate, which is the supreme executive and policy-making body are nominated by the Chancellor on the advice of the Vice-Chancellor, though he is not bound to accept his suggestions. 20% are elected by the faculties and the registered graduates. When a Senate is formed, it proceeds to form the different faculties out of its own members. The faculties in turn co-opt a number of teachers of the university and the private colleges to its own body.

Much criticism has been levelled against this system. It has been allleged that nominations have not always represented academic interests. Before the partition a deliberate attempt was made to capture the university by nominations based entirely on communal consideration.

২. ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

১৯০৫ সনের বঙ্গভঙ্গের কথা পূর্বেই বলা হইয়াছে। সেই সময় পূর্ববঙ্গ ও আসাম প্রদেশের রাজধানী ঢাকায় একটি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করার প্রস্তাব হয় এবং এ সম্বন্ধে একটি রিপোর্টও লেখা হয়। কিন্তু এই পরিকল্পনা কার্যে পরিণত হইবার পূর্বেই বঙ্গভঙ্গ রহিত হওয়ায় এ-সম্বন্ধে আর-কোন আলোচনা হয় নাই। বঙ্গভঙ্গ রহিত হওয়ার ফলে পূর্ববঙ্গের মুসলমানেরা যখন ক্ষুব্ধ ও উত্তেজিত হইয়া উঠিলেন তখন বড়লাট লর্ড হার্ডিং তাঁহাদের সন্তোষবিধানের জন্য আশ্বাস দিলেন যে, ঢাকায় একটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হইবে। কিন্তু যুক্তবাংলার হিন্দুগণ এই প্রস্ত বের তীব্র প্রতিবাদ করিলেন। হিন্দু নেতাগণ এই মত প্রকাশ করিলেন যে, ইহার ফলে রাজনীতিক বিভাগের পরিবর্তে সংস্কৃতির দিক হইতে বঙ্গদেশকে আবার দুইখণ্ডে বিভক্ত করা হইবে। সভা-সমিতিতে ও সংবাদপত্রে পূর্ব ও পশ্চিম বাংলায় ঢাকায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বিরুদ্ধে তুমুল আন্দোলন চলিতে লাগিল। ইহাতে কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অনিষ্ট হইবে, এই আশঙ্কায় আশুতোষও এই প্রস্তাবের বিরুদ্ধে ছিলেন। প্রকাশ্যে কোন সক্রিয় অংশগ্রহণ না করিলেও আশুতোষই যে বিরোধীদলের প্রকৃত নেতা ছিলেন ইহা অনেকেই সন্দেহ করিত এবং গভর্নমেন্টও তাহা বিশ্বাস করিত। কিন্তু অকস্মাৎ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিরুদ্ধে আন্দোলন হ্রাস পাইল। ইহার প্রকৃত কারণ কী তখন কেহই জানিত না। এ বিষয়ে আশুতোষ নিজে এই গ্রন্থের লেখককে যাহা বলিয়াছিলেন নিম্নে তাহার সারমর্ম যথাসম্ভব আশুতোষের ভাষায় দিতেছি :

“একদিন হাইকোর্টে এক জরুরী চিঠি পেলাম, কোর্ট থেকে ফিরবার পথে বড়লাট হার্ডিং সাহেবের সঙ্গে যেন দেখা করি। যাওয়ামাত্রই বড়লাটের কাছে নিয়ে গেল। মামুলি দু’চার কথার পর লাটসাহেব বললেন, স্যার আশুতোষ, তুমি জান যে আমি কূটনীতি বিভাগে (Diplomatic Service) কাজ করেছি। তোমাকে খোলাখুলি বলছি, এই যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিরুদ্ধে আন্দোলন চলছে তুমিই আছ তার পেছনে। অবশ্য, তার যুক্তিযুক্ত কারণ আছে তা আমি অস্বীকার কর্ব না। কিন্তু আমি তোমাকে বলছি, এ বিশ্ববিদ্যালয় আমি করবই–তার পেছনেও অনেক যুক্তিযুক্ত কারণ আছে। কিন্তু, আমি তোমার সঙ্গে বিরোধিতা কর্তে চাই না। কি মূল্য পেলে তোমার বিরোধিতা প্রত্যাহার কর্বে সেই কথা জানতে চাই। আমি বললাম, বড় বড় অনেক নেতারাই তো এর বিরুদ্ধে আন্দোলন কচ্ছেন। লাটসাহেব বললেন, ওসব আমি গ্রাহ্য করি না, কিন্তু আমি তোমার সঙ্গে বিবাদ কর্তে চাই না। সুতরাং আমি ভোঁসলাখুলি জিজ্ঞাসা কৰ্ছি, কি পেলে তুমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনে আপত্তি কর্বে না–আমি এখনই সেটা জানতে চাই। আমি মনে মনে ভেবে দেখলাম, ওরা তো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কবেই, তবে এই সুযোগে আমি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য কিছু যদি আদায় কর্তে পারি, ক্ষতি কী? সুতরাং আমি বললাম, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের যদি চারটি অধ্যাপকের পদ সৃষ্টি করে গভর্নমেন্ট বরাবর তার খরচ বহন করেন, আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সম্বন্ধে কোন আপত্তি কর্ব না। লাটসাহেব বললেন, আমি তোমার শর্ত মেনে নিলাম। আমাদের এই ব্যবস্থা ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চুক্তিপত্র (Dacca University Pact) বলে ইতিহাসে অভিহিত হবে।

হার্ডিং তাঁর কথা রেখেছিলেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের চারটি অধ্যাপকের পদ তিনি সৃষ্টি করেছিলেন।”

হিন্দুদের বিরুদ্ধতায় হয়ত কিছু ফল হইয়াছিল। কারণ, হার্ডিং ঘোষণা করিলেন যে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় হইবে আবাসিক বিশ্ববিদ্যালয় (Residential University), কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের মত ইহার অধীনে কোন কলেজ থাকিবে না। সমস্ত শিক্ষাই বিশ্ববিদ্যালয়ে দেওয়া হইবে এবং ঢাকা শহরের দশ মাইল পরিধির বাহিরে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের কোন কর্তৃত্ব থাকিবে না। এখানে ইন্টারমিডিয়েট ক্লাস থাকিবে না–বি.এ., বি.এস-সি., এম.এ., এম.এস-সি. ও আইন পড়ান হইবে। ঢাকা শহরে যে দুইটি কলেজ ছিল-ঢাকা কলেজ ও জগন্নাথ কলেজ-অতঃপর সেখানে কেবলমাত্র ইন্টারমিডিয়েট (Intermediate Course) পড়ান হইবে এবং ইহার প্রশাসনের জন্য একটি পৃথক বোর্ড স্থাপিত হইবে। এই দুইটি কলেজ ছাড়া পূর্ববঙ্গের মাদ্রাসা প্রভৃতি ইসলামীয় ধর্মের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলিও এই বোর্ডের অধীনে থাকিবে।

যদিও এই ব্যবস্থায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিরুদ্ধে প্রধান যুক্তি, অর্থাৎ বাঙালী হিন্দুর সাংস্কৃতিক বিভাগের আশঙ্কা দূরীভূত হইল, তথাপি বাঙ্গালী হিন্দুরা, এমনকি ঢাকার হিন্দুরাও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতি বিদ্বেষভাবাপন্ন রহিয়াই গেল।[২১]

এই পরিস্থিতির মধ্যে ১৯২১ সনের জুলাই মাসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হইল। ইহার কয়েক মাস পূর্বেই লণ্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিষ্ট্রার (Academic Registrar) পি.জি. হার্টগ সাহেব ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য নিযুক্ত হইয়া এদেশে আসেন এবং শিক্ষক নিয়োগ, নিয়মাবলী-প্রণয়ন প্রভৃতি প্রাথমিক কার্যগুলি সম্পন্ন করেন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় একটু রাজসিক আড়ম্বরের মধ্যেই কার্য আরম্ভ করিল। উপাচার্যের মাসিক বেতন হইল ৪,০০০ টাকা, প্রফেসরদের ১০০০ হইতে ১৮০০ টাকা এবং রিডারদের ৬০০ হইতে ১২০০ টাকা। ইহা ছাড়া ঢাকা শহরের উত্তরে অবস্থিত রমনা নামক একটি জনশূন্য প্রান্তরে ভূতপূর্ব পূর্ববঙ্গ ও আসাম গভর্নমেন্ট অফিসের জন্য যে বিরাট প্রাসাদ ও ঊর্ধ্বতন (প্রধানতঃ ইংরেজ) কর্মচারীর জন্য বিস্তীর্ণ উদ্যান ও হাতাসম্বলিত সুরম্য বাসভবন নির্মাণ করিয়াছিলেন তাহার প্রায় সবগুলিই বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিকারে আসিল। ভারতের আর কোন বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষে তখন শিক্ষিকদের এরূপ বেতনের হার ও বাসভবন স্বপ্নেরও অগোচর ছিল।

কিন্তু বিধি বাদ সাধিলেন। ১৯১৯ সনের নূতন ভারত শাসন বিধি অনুসারে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বঙ্গদেশের শিক্ষামন্ত্রী প্রভাসচন্দ্র মিত্রের কর্তৃত্বাধীনে আসিল। কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় সম্বন্ধে তাঁহার সহিত আশুতোষের বিরোধিতার কথা পূর্বেই বলিয়াছি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিও তিনি বিরূপ মনোভাবই পোষণ করিতেন। বাঙ্গালী হিন্দুরা যে-কারণে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠায় অসুখী হইয়াছিলেন কতকটা সেই কারণে এবং সম্ভবতঃ পূর্ববঙ্গের প্রতি পশ্চিমবঙ্গের স্বাভাবিক ঔদাসীন্য বা বিদ্বেষবশতঃ তিনি প্রথম হইতেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রভাব প্রতিপত্তি খর্ব করিতে কৃতসংকল্প হইলেন। তিনি প্রথমেই ঘোষণা করিলেন যে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বার্ষিক মাত্র পাঁচ লক্ষ টাকা পাইবে। বলা বাহুল্য, ভারত সরকারের অনুমোদনক্রমে শিক্ষকদের পূর্বোল্লিখিত যে বেতনের হার নির্দিষ্ট হইয়াছিল, এই টাকায় তাহা দেওয়া অসম্ভব। হার্টগ সাহেব ভারত-সরকারের নিকট আবেদন করিলেন। ভারত-সরকার বলিলেন, নূতন শাসনবিধি-অনুসারে শিক্ষাসংক্রান্ত বিষয়ে বাংলা সরকারের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে তাঁহার হস্তক্ষেপ করার কোন ক্ষমতা নাই। ঐ সময়ে একটি গুজব প্রচলিত ছিল যে, আশুতোষ নাকি হার্টগকে পরামর্শ দিয়াছিলেন ইহা লইয়া বাংলা সরকারের সহিত লড়াই করিতে (অথবা বলিয়াছিলেন, আমি হার্টগ-এর অবস্থায় পড়িলে সহজে ছাড়িতাম না)। কিন্তু হার্টগ আশুতোষ নহেন, সুতরাং তিনি বাংলা সরকারের আদেশ বা নির্দেশ মানিয়া নিলেন।

ঢাকায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার কল্পনা যখন হয় তখন হইতেই ভারত-সরকার প্রতি বৎসর ইহার জন্য পাঁচ লক্ষ টাকা একটি স্থায়ী তহবিলে জমা রাখিতেন। ভারতের নূতন শাসনবিধি প্রচলনের সময় এই তহবিলে যে ৫৫ লক্ষ টাকা জমা হইয়াছিল, ভারত-সরকার তাহা বাংলা গভর্নমেন্টের হাতে দিয়াছিলেন। হার্টগ সাহেব এই টাকা দাবি করলে প্রভাস মিত্র বলিলেন, ঢাকা শহরে রমনায় যে বাড়ীগুলি বিশ্ববিদ্যালয় দখল করিয়াছে তাহার মূল্যবাবদ বাংলা গভর্নমেন্ট ঐ টাকা নিয়াছেন। অতঃপর শিক্ষকদের প্রতিশ্রুত বেতনের হার কমাইতে হইল। প্রফেসরদের বেতন ১৮০০ টাকা হইতে কমাইয়া হাজার টাকা হইল, অন্যান্য শিক্ষকদেরও এই অনুপাতে বেতনের হার কমিল।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিচালনার জন্য কয়েকটি সমিতি ছিল। কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের নেট ও সিণ্ডিকেটের অনুরূপ ছিল Court ও Executive Council- এই দুইটিতে হিন্দু ও মুসলমান সদস্যের সংখ্যা ছিল সমান। ইহা ছাড়া অ্যাকাডেমিক কাউন্সিল (Academic Council), বোর্ড অব স্টাডিস্ (Board of Studies) প্রভৃতিও ছিল।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশেষত্ব ছিল ছাত্রগণের বাসের ব্যবস্থা। তিনটি বড় বড় হোষ্টেল রমনায় ছিল। ইহাদের বলা হইত (ইংরেজীর অনুকরণে) হল। দুইটি হল’ ছিল হিন্দু এবং একটি মুসলমান ছাত্রদের জন্য। এই তিনটিতে প্রায় ছয়-সাত শত ছাত্র থাকিত। যেসব ছাত্র বাহিরে থাকিত তাহাদের প্রত্যেকেই একটি হলে’র সঙ্গে যুক্ত (attached) থাকিত। টিউটোরিয়াল (tutorial) ক্লাসে ৪৫ জন করিয়া ছাত্র থাকিত এবং একজন শিক্ষকের নির্দেশমত তাহারা বাড়ী হইতে কোন বিষয়ে যে-প্রবন্ধ লিখিয়া আনিত এই ক্লাসে তাহার আলোচনা হইত। ইহা ছাড়া প্রতি শিক্ষকই একটি হলের সঙ্গে যুক্ত থাকিতেন এবং যেসব ছাত্র হলে থাকিত না তাহাদের ১৫-২০ জন এক একজন শিক্ষকের তত্ত্বাবধানে থাকিত। শিক্ষক প্রতি মাসে ২।১ বার প্রতি ছাত্রের সঙ্গে সাক্ষাৎ করিয়া তাহাদের নৈতিক চরিত্র, পড়াশুনা, খেলাধুলা এবং অন্যান্য শিক্ষাবহির্ভূত ব্যাপারের খোঁজখবর লইয়া উপদেশ দিতেন। প্রতি হলে ছাত্রদের ইউনিয়ন (Union) এবং ইহার মাধ্যমে ক্রীড়া, নাট্যাভিনয়, সাহিত্যচর্চা, সমাজসেবা (Social Service) বিতর্কসভা প্রভৃতির ব্যবস্থা ছিল এবং প্রতি বিভাগের জন্য প্রতি বৎসর একটি ছাত্র সেক্রেটারি নির্বাচিত হইত।

প্রতি ‘হল’ হইতে একটি বার্ষিক পত্রিকা প্রকাশিত হইত। তাহাতে ছাত্র ও শিক্ষকদের রচনা প্রকাশিত হইত, ছাত্র ও শিক্ষকেরা একত্রে নাটক অভিনয় করিত।

পরবর্তীকালে প্রসিদ্ধ নাট্যকার মন্মথ রায় ও সাহিত্যিক বুদ্ধদেব বসুর এই বিষয়ে হাতেখড়ি হইয়াছিল তাহাদের হলেই। বস্তুতঃ হলে’র এই ছাত্রজীবন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান বিশেষত্ব ছিল। ইহা সুষ্ঠুভাবে পরিচালনা করিবার জন্য একজন প্রফেসর ইহার অধ্যক্ষ ছিলেন–তাঁহাকে বলা হইত ‘প্রভোস্ট (Provost) এবং তাহার অধীনে দুইজন গৃহশিক্ষক (House-tutor) থাকিতেন। ছাত্রাবাসের কাছেই ইঁহাদের নির্দিষ্ট বাসস্থান ছিল। কয়েক বৎসর পরে ছাত্রীগণেরও এইরূপ পৃথক বাসভবনের ব্যবস্থা করা হইয়াছিল এবং তাহাদেরও হলের ন্যায় পৃথক ইউনিয়ন (Union) ছিল।

প্রতি বত্সর প্রতি হলে প্রাক্তন ও বর্তমান ছাত্রদের সম্মেলন হইত। সেখানে ঢাকা বা জগন্নাথ কলেজের পুরাতন ছাত্রেরা হলের নূতন ছাত্রদের সহিত মিলিত হইতেন। পুরাতন ছাত্রজীবনের স্মৃতিমন্থন, নাট্যাভিনয় ও বিপুল ভোজের মধ্যদিয়া এই উৎসব সম্পন্ন হইত।

প্রাচীন কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে নবীন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গুরুতর প্রভেদগুলিই উল্লেখ করিলাম। কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ন্যায় এখানেও গবেষণার উপযুক্ত ব্যবস্থা ছিল এবং এই বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক শিক্ষক ও ছাত্র গবেষণার জন্য প্রসিদ্ধি লাভ করিয়াছেন। প্রসঙ্গক্রমে বলা যাইতে পারে যে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞান বিভাগের তিনজন অধ্যাপক-সত্যেন্দ্রনাথ বসু, কৃষ্ণান ও মাহেশ্বরী বিলাতের রয়্যাল সোসাইটির ফেলো নির্বাচিত হইয়াছিলেন। এরূপ সম্মান কলিকাতা বা আর কোন বিশ্ববিদ্যালয় দাবি করিতে পারে না। ইঁহারা ছাড়াও হরপ্রসাদ শাস্ত্রী, নরেশচন্দ্র সেনগুপ্ত, জ্ঞানচন্দ্র ঘোষ, চারু বন্দ্যোপাধ্যায়, মোহিতলাল মজুমদার, হীরেন্দ্রলাল দে, মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্, হরিদাস ভট্টাচার্য, সুশীলকুমার দে প্রভৃতির ন্যায় বিশিষ্ট অধ্যাপক ছিলেন।

এই বিশ্ববিদ্যালয়ের তরুণ শিক্ষক মামুদ হাসান ও মুহম্মদ হুসেন পরবর্তীকালে পাকিস্তানে যথাক্রমে রাজদূত ও মন্ত্রীর পদ অধিকার করিয়াছিলেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বহু মুসলমান ছাত্র পাকিস্তানে অনেক উচ্চপদে অধিষ্ঠিত ছিলেন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফলেই পূর্ববঙ্গের মুসলমানসমাজে একটি শিক্ষিত মধ্যশ্রেণীর উদ্ভব সম্ভবপর হইয়াছিল, ইহা বলিলে বিশেষ অত্যুক্তি হইবে না।

আবাসিক বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রকৃত বৈশিষ্ট্য ছাত্রদের ব্যক্তিত্ব ও চরিত্রগঠনে সহায়তা করা। হিন্দু ও মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ের মধ্যেই বিশ্ববিদ্যালয়ের এই অবদানের যথেষ্ট পরিচয় পাওয়া গিয়াছে।

৩. বিশ্বভারতী

১৮৬৩ সনে কলিকাতা হইতে প্রায় ১০০ মাইল দূরে বর্তমান বোলপুর রেলওয়ে ষ্টেশনের দেড় মাইল উত্তরে জনহীন এক বিস্তীর্ণ উন্মুক্ত প্রান্তরে মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর শান্তিনিকেতন আশ্রম’ স্থাপন করেন। কারণ রায়পুর যাইবার পথে এই প্রান্ত রটি দেখিয়া তাহার মনে হইয়াছিল, ভগবানের আরাধনার পক্ষে ইহা খুব উপযুক্ত স্থান। অতঃপর ১৯০১ সনে (১৩০৮ সালের ৭ই পৌষ) ঐখানে রবীন্দ্রনাথ ‘ব্রহ্মচর্যাশ্রম’ নামে একটি বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন। তাঁহার আহ্বানে যে কয়জন শিক্ষাব্রতী এই বিদ্যালয়ে যোগদান করেন তাঁহাদের মধ্যে ব্রহ্মবান্ধব উপাধ্যায়, সতীশচন্দ্র রায়, মোহিতচন্দ্র সেন, অজিতকুমার চক্রবর্তী, চার্লস ফ্রিয়র অ্যান্ড্রুজ, উইলিয়ম পিয়ার্সন প্রভৃতির নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। ক্রমে রবীন্দ্রনাথ ও ইঁহাদের মনে হইল যে, যে-আদর্শে অনুপ্রাণিত হইয়া ব্রহ্মচর্যাশ্রম’ বিদ্যালয়টি স্থাপিত হয় তাহার জন্য ইহা পর্যাপ্ত নহে এবং একটি বৃহত্তর প্রতিষ্ঠানের প্রয়োজন। তদনুসারে বিশ্বভারতী’ নামে একটি আন্তর্জাতিক বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৩২৮ সালের ৮ই পৌষ (১৯২১ ডিসেম্বর) রবীন্দ্রনাথ বিশ্বভারতাঁকে সর্বসাধারণের উদ্দেশ্যে উৎসর্গ করেন এবং ১৩২৯ সালের ২রা জ্যৈষ্ঠ (১৯২২ সনের ১৬ই মে) বিশ্বভারতীর প্রথম সংবাদ রেজিষ্ট্রী করা হয়। ইহাতে রবীন্দ্রনাথ বলেন যে, বিশ্বভারতীর লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য এই : (১) অধ্যয়ন ও গবেষণার দ্বারা প্রাচ্যের বিভিন্ন সংস্কৃতি ও সভ্যতার অন্তর্নিহিত ঐক্যের সন্ধান; (২) এই ঐক্যের ভিত্তিতে তাহাদের এবং প্রাচ্য ও পাশ্চাত্ত্য সভ্যতা ও সংস্কৃতির মধ্যে ঘনিষ্ঠ সম্বন্ধ স্থাপন; (৩) এই মিলনের ভিত্তিতে বিশ্ববাসীর মধ্যে ঐক্য ও শান্তি স্থাপন; এবং (৪) এই উদ্দেশ্য সাধনের জন্য শান্তিনিকেতনে নিম্নলিখিত বিষয়গুলির অধ্যয়ন ও গবেষণার উদ্দেশ্যে একটি সাংস্কৃতিক কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা। বিষয়গুলি এই–হিন্দু, বৌদ্ধ, জৈন, ইসলামীয়, শিখ ও খ্রীষ্টানদের ধর্ম, সাহিত্য, ইতিহাস, বিজ্ঞান, শিল্প এবং পাশ্চাত্ত্য সংস্কৃতি। এই সংবিধান-অনুসারে একটি পরিষদের উপর বিশ্বভারতীর পরিচালনার দায়িত্ব ন্যস্ত হইল। এই পরিষদে দুই শ্রেণীর সদস্য ছিলেন-সাধারণ সদস্য ও আজীবন সদস্য। এই সদস্যগণ সংসদ বা পরিচালক সমিতি, কর্মসচিব ও অর্থসচিব নিয়োগ করিতেন। সদস্যগণকর্তৃক নির্বাচিত সভ্য ছাড়াও বিভিন্ন বিভাগের প্রতিনিধিগণ সংসদের সভ্য হইতেন। রবীন্দ্রনাথ আজীবন ইহার আচার্য ছিলেন। তাঁহার মৃত্যুর পর অবনীন্দ্রনাথ ও সরোজিনী নাইডু আচার্যপদ গ্রহণ করেন। সংবিধান-অনুসারে একটি শিক্ষা পরিষদ্ (Academic Council) গঠনের ব্যবস্থাও ছিল।

বিশ্বভারতীর কয়েকটি বৈশিষ্ট্য ছিল। ইহা ছিল প্রধানতঃ এবং মূলতঃ একটি আবাসিক শিক্ষায়তন এবং ভারতের বিভিন্ন প্রদেশ হইতে আগত ছাত্রগণ হোষ্টেলে একত্রে বাস করিত। তবে অল্পসংখ্যক ছাত্র নিজেদের বাসভবন হইতে যাতায়াত করিত। ছাত্র ও ছাত্রীদের জন্য পৃথক হোষ্টেল ছিল এবং খেলাধুলার জন্য বিভিন্ন ব্যবস্থা ছিল। শিক্ষকেরাও শিক্ষায়তনের নিকটেই বাস করিতেন। এই কারণে ইহার ছাত্রছাত্রীরা সংখ্যায় বেশী না-হওয়ায় শিক্ষক ও ছাত্রদের মধ্যে ঘনিষ্ঠ সম্বন্ধ বর্তমান ছিল। আচার্য রবীন্দ্রনাথও এখানে প্রায়ই আসিয়া বাস করিতেন, স্বয়ং শিক্ষা দিতেন এবং তাঁহার ভবনে ছাত্রদের অবারিত দ্বার ছিল। নানা উৎসব, আমোদ-প্রমোদ, নৃত্য সঙ্গীত, অভিনয় প্রভৃতির মাধ্যমে ছাত্রদের চরিত্রগঠন ও ব্যক্তিত্ব বিকাশের যথেষ্ট সুযোগ ও অবসর ছিল। প্রকৃতির উন্মুক্ত পরিবেশে স্বাধীনভাবে স্বচ্ছন্দ বিচরণের ফলে তাহাদের চিন্তাধারা সৃষ্টিধর্মী হইবার অবকাশ পাইত। প্রথম প্রথম ভারতের প্রাচীন আদর্শে বৃক্ষতলের ছায়ায় ছাত্রদের ক্লাস হইত।

এই গ্রন্থের আলোচ্য যুগের শেষে বিশ্বভারতীর নিম্নলিখিত প্রতিষ্ঠানগুলিই ছিল বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।

১। পাঠভবন (স্কুল)

২। শিক্ষাভবন (কলেজ)

এই দুইটিতে কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইন্টারমিডিয়েট ও বি.এ. ডিগ্রী এবং সঙ্গে সঙ্গে বিশ্বভারতীর নিজস্ব পাঠক্রম (course) অনুসারে প্রবেশিকা (Matriculation), মধ্য (Intermediate) এবং অন্ত্য (B.A. Degree) পরীক্ষার ব্যবস্থা ছিল। ১৯২৫ সন হইতে কলেজের 1.A., I.Sc. ও B.A. পাঠক্রম কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বীকৃতি পাইয়াছিল (recognised)।

৩। বিদ্যাভবন–প্রাচ্যভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি বিষয়ে উচ্চশিক্ষা ও গবেষণার কেন্দ্র।

৪। চীনা ভবন-১৯৩৭ সনে অধ্যাপক তান য়ুন সানের সহায়তায় ভারত চীন ঐতিহ্যের আলোচনা ও গবেষণার জন্য এই বিভাগটি স্থাপিত হয়।

৫। হিন্দীভবন-হিন্দী ভাষা ও সাহিত্য পাঠের জন্য ১৯৩৯ সনে ইহার। প্রতিষ্ঠা হয়।

৬। রবীন্দ্রভবন–রবীন্দ্র-সাহিত্যের চর্চার জন্য ১৯৪২ সনে ইহা প্রতিষ্ঠিত হয়। ইহার সংশ্লিষ্ট বিচিত্রা’-নামক গৃহে রবীন্দ্রনাথের গ্রন্থের পাণ্ডুলিপি, তাঁহার অঙ্কিত চিত্র, চিঠিপত্র, এবং পুস্তকরক্ষণ এবং তাহার জীবন ও সাহিত্যসম্বন্ধে নানা তথ্য সংগ্রহের ব্যবস্থা আছে।

৭। সঙ্গীতভবন–এখানে সঙ্গীত, সেতার, এস্রাজ প্রভৃতি বাদ্য ও নৃত্য (প্রধানতঃ মণিপুরী ও দক্ষিণ ভারতীয়) শিক্ষার ব্যবস্থা আছে।

৮। কলাভবন–এখানে নন্দলাল বসুর তত্ত্বাবধানে চিত্রকলা শিক্ষার ব্যবস্থা ছিল। এ-সম্বন্ধে পরবর্তী অধ্যায়ে বলা হইবে। এখানকার গ্রন্থাগার ও বিভিন্ন রকমের দুষ্প্রাপ্য ছবির সংগ্রহ বিশেষ মূল্যবান। এখানে পাঁচ বৎসরে চিত্র ও অন্যান্য কারুকার্য (কাষ্ঠখোদাই, স্থাপত্য-পরিকল্পনা, লিথোগ্রাফি, সূচীর কার্য) শিক্ষা দেওয়া হইত।

৯। শান্তিনিকেতনের নিকটবর্তী শ্রীনিকেতনে পল্লী-সংগঠন বিভাগে পল্লী উন্নয়নের জন্য বহুবিধ শিক্ষা দেওয়া ও ব্যবস্থা করা হয়–স্বাস্থ্যের জন্য দাঁতব্য চিকিৎসালয়, সংক্রামক ব্যাধির প্রতিষেধ, ধাত্রীবিদ্যা, শিক্ষার জন্য বালক বালিকার পাঠশালা, ইহার শিক্ষকদের শিক্ষণব্যবস্থা, বয়স্ক জনসাধারণের শিক্ষার ব্যবস্থা, আর্থিক উন্নতির জন্য তন্তুবায়, চর্মকার, সূত্রধর এবং অন্যান্য শিল্প ব্যবসায়ের পুনরুজ্জীবন এবং পশুপালন। উন্নত বীজ ও সার-উৎপাদন প্রভৃতির প্রদর্শনীর ব্যবস্থাও আছে। শ্রীনিকেতন ও ইহার সংশ্লিষ্ট শিক্ষাসত্র, শিল্পসদন প্রভৃতি বিভিন্ন শাখার সাহায্যে এই সকল অনুষ্ঠানের জন্য লেনার্ড এলমহার্স্ট (Leonard Elmhurst) বিশেষ কৃতিত্বের পরিচয় দিয়াছেন।

১০। ১৯২২ সনে রবীন্দ্রনাথ তাঁহার রচিত সমগ্র বাংলা গ্রন্থের স্বত্ব বিশ্বভারতাঁকে দান করেন। ইহার ফলে প্রকাশন বিভাগের সৃষ্টি হয় এবং বিশ্বভারতীর নিজস্ব মুদ্রাযন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়।

১১। বিশ্বভারতীর গ্রন্থাগারটিও বিশেষ মূল্যবান। এখানে অনেক দুপ্রাপ্য গ্রন্থ ও পুঁথি সংরক্ষিত আছে। পুঁথিসংগ্রহ ও সম্পাদনার জন্য ইহার একটি বিশেষ বিভাগও ছিল।

১২। ১৯৩৬ সনে ‘লোকশিক্ষা সংসদের উদ্বোধন হয়। যাহাতে বিদ্যালয়ে ভর্তি না হইয়া ঘরে বসিয়াই ইতিহাস এবং বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের অনুশীলন করিয়া বিশ্বভারতীর উচ্চতম মানের উপাধি অর্জন করা যায়, তাহার জন্যই এই ব্যবস্থা করা হয়।

বিশ্বভারতীর প্রতিষ্ঠায় রবীন্দ্রনাথের মহান আদর্শ সমগ্র জগতের শ্রদ্ধা আকর্ষণ করিয়াছিল। বিদেশের বহু প্রসিদ্ধ পণ্ডিত (Sylvain Levi, winternitz, Sten Konow, Tucci) বিশ্বভারতী পরিদর্শন করিতে আসিয়াছিলেন। কিন্তু, এই আদর্শ বিশ্বভারতীর মাধ্যমে কতটা রূপায়িত হইয়াছে তাহা বলা কঠিন। রবীন্দ্রনাথের অসাধারণ ব্যক্তিত্ব ইহার পশ্চাতে থাকিলেও ইহার প্রত্যক্ষ ফলস্বরূপ এখানে কোন বিশিষ্ট গবেষণা হইয়াছে বা ইহার কোন শিক্ষক বা ছাত্র পাণ্ডিত্য ও গবেষণা দ্বারা জগতের বিদ্বজ্জনসভায় আদৃত ও সম্মানিত হইয়াছেন এরূপ কোন প্রমাণ নাই। ইহার সমকালীন আবাসিক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সহিত তুলনা করিলে এ-বিষয়ে গুরুতর প্রভেদ লক্ষিত হইবে। ১৯২২ সন হইতে ১৯৪৭ সনের মধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও ছাত্রগণ যে কৃতিত্বের পরিচয় দিয়াছেন, তাহার সহিত তুলনা করিলে ঐ সময়ের মধ্যে বিশ্বভারতীর কৃতিত্ব এ-বিষয়ে নগণ্য বলিলে বিশেষ অত্যুক্তি হইবে না। ছাত্রদের চরিত্রগঠন এবং মনুষ্যত্ব-বিকাশেও যে অন্যান্য সাধারণ বিশ্ববিদ্যালয়ের তুলনায় বিশ্বভারতী খুব বেশী সার্থক হইয়াছিল তাহারও স্পষ্ট কোন প্রমাণ নাই। কেবল চিত্রকলা ও নৃত্য গীত অনুষ্ঠানকে ইহার ব্যতিক্রম বলা যায়। এই দুই বিষয়ে বিশ্বভারতীর অবদান অনস্বীকার্য। বিশ্বভারতীর কয়েকজন অধ্যাপক ইহার উন্নতিকল্পে জীবন উৎসর্গ করিয়াছিলেন। ইহাদের মধ্যে বিধুশেখর শাস্ত্রী (ভট্টাচার্য), ক্ষিতিমোহন সেন, নেপালচন্দ্র রায় ও জগদানন্দ রায়ের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। বিধুশেখর বহুভাষাবিদ ও বৌদ্ধশাস্ত্রে সুপণ্ডিত ছিলেন এবং তিব্বতীয় অনুবাদ হইতে অধুনালুপ্ত মূল সংস্কৃতগ্রন্থের উদ্ধারসম্বন্ধে অনেক গবেষণা করিয়াছেন। ক্ষিতিমোহন সেন মধ্যযুগে ভারতীয় সংস্কৃতির সম্বন্ধে বহু গবেষণা করিয়াছেন। উভয়েই কয়েকখানি পাণ্ডিত্যপূর্ণ গ্রন্থ রচনা করিয়াছেন। কিন্তু, এই সকল গ্রন্থ বঙ্গভাষায় রচিত বলিয়া তাঁহাদের খ্যাতি-প্রতিপত্তি বাংলাদেশেই সীমাবদ্ধ।

তথ্যনির্দেশ

১. Hundred Years of the University of Calcutta Published by the University of Calcutta (1957), তৃতীয় খণ্ড-৫২, ১০৪, ১৪৬, ৩৩৫ পৃ.।

২. N.K. Sinha-Ashutosh Mookerjee (1966), P. 104.

৩. আশুতোষের উৎসাহ ও অনুপ্রেরণা বিশ্ববিদ্যালয়ের তরুণ শিক্ষকগণের গবেষণাকার্যে সফলতা লাভের কিরূপ সহায়ক ছিল, এই গ্রন্থের লেখকের সে-বিষয়ে যথেষ্ট ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা আছে। আশুতোষের মৃত্যুর পর যে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকগণের এ-বিষয়ে অবনতি হয়, এই উৎসাহ ও অনুপ্রেরণার অভাব ইহার প্রধান কারণ না হইলেও অন্যতম কারণ, সে-বিষয়ে সন্দেহ নাই।

৪. N.K.Sinha-Ashutosh Mookerjee (1966), P. 69

৫. তদেব, পৃ. ৭০

৬. N.K.Sinha-Ashutosh Mookerjee (1966), P.95

৭. তদেব, পৃ. ৯৫-৯৭

৮. তদেব, পৃ. ৯৭-৯৯

৯. N.K.Sinha-Ashutosh Mookerjee (1966), P. 104

১০. A.P.Das Gupta-Ashutosh Mookerjee (1973), P. 93

১১. তদেব, পৃ. ৮৫-৮৬

১২. N. A.P.Das Gupta-Ashutosh Mookerjee (1973),p. 93

১৩. তদেব, পৃ. ৮৫-৮৬

১৪. সমগ্র পত্রের জন্য N. K. Sinha-Ashutosh Mookerjee (1966), Pp. 124-40 দ্রষ্টব্য।

১৫. A.P.Das Gupta-Ashutosh Mookerjee (1973), Pp. 99-100

১৬. Report of the Radhakrishnan Commission-Vol. I, Pp. 145-47.

১৭. Report of the Radhakrishnan Commission-Vol. I, P. 485

১৮. বিস্তৃত বিবরণের জন্য “Hundred Years of the University of Calcutta” Published by the University of Calcutta (1957) pp. 339, 345 দ্রষ্টব্য Sa. Report of the Radhakrishnan Commission-Vol. I, P. 484. 10. Hand Book of Indian Universities, 1940, by Inter-University Board, India issued by the Secretary of the Board.

২১. এই গ্রন্থের নবম অধ্যায় শাসননীতি (১৯২১-২৬)] দ্রষ্টব্য।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *