১৫. সাহিত্য

পঞ্চদশ অধ্যায় – সাহিত্য

রবীন্দ্রনাথ

উনিশ শতকের শেষ দশক এবং বিংশ শতকের প্রথম চারি দশক–এই অর্ধশতাব্দী কাল বাংলাসাহিত্যে রবীন্দ্রনাথের যুগ। অবশ্য সাহিত্যের নানা বিভাগে এই যুগে আরও অনেক শক্তিশালী লেখকের আবির্ভাব হইয়াছিল; কিন্তু রবির প্রখর দীপ্তিতে তারার ন্যায় তাঁহারা কতকটা ম্লান হইয়াছেন। সাহিত্যে প্রায় এমন কোন বিভাগ নাই যাহা রবীন্দ্রনাথের প্রতিভায় সমুজ্জ্বল হয় নাই। সাধারণ ঐতিহাসিক গ্রন্থে রবীন্দ্রনাথের বিশাল সাহিত্যিক অবদানের সম্যক্ পরিচয় দেওয়া অসম্ভব–সুতরাং খুব সংক্ষেপে তাঁহার সম্বন্ধে মোটামুটি একটি বিবরণ দিব।

রবীন্দ্রনাথের সাহিত্যিক প্রতিভা বহুমুখী হইলেও কবিতাই তাঁহার শ্রেষ্ঠ অবদান। কবিতার মধ্যদিয়া তিনি নিজের অন্তরের সূক্ষ্ম ও গভীর অনুভূতিকে যে রূপ দিয়াছেন এবং নিজের অন্তরের সর্বোচ্চ আধ্যাত্মিক চেতনাকে যেভাবে প্রকাশ করিয়াছেন তাহার প্রকৃষ্ট প্রমাণ পাওয়া যায় তাহার প্রথমযুগের কবিতা-সংকলন মানসী’ (১৮৯০) ও ‘সোনার তরী’ (১৮৯৩) এই দুইখানি গ্রন্থে। এই কবিতাগুলি যেমন অভিনব, তেমনি অপূর্ব রসাস্বাদ লইয়া বাংলাসাহিত্যের এক নূতন দ্বার উদ্মাটন করিল। একথা বলিলে বিশেষ অত্যুক্তি হইবে না যে, মানুষের মনে যেসব সুখ-দুঃখ, আশা-আকাঙ্ক্ষা, চিন্তা-ভাবনা প্রভৃতির স্রোত অনবরত প্রবাহিত হয় তাহা ভাষায় প্রকাশ করিতে না-পারায় মানুষ একটি অব্যক্ত বেদনা অনুভব করে। তাহাদের মধ্যে প্রায় সকলগুলিই রবীন্দ্রনাথের কবিতায় মূর্ত হইয়া উঠিয়াছে। রবীন্দ্রনাথ নিজেই ‘প্রকাশ বেদনা’ নামক একটি ছোট কবিতায় ইহার উল্লেখ করিয়াছেন। ইহার কিয়দংশ উদ্ধৃত করিতেছি :

আপন প্রাণের গোপন বাসনা
টুটিয়া দেখাতে চাহিরে,
হৃদয় বেদনা হৃদয়েই থাকে,
ভাষা থেকে যায় বাহিরে।
শুধু কথার উপরে কথা,
নিষ্ফল ব্যাকুলতা
বুঝিতে বোঝাতে দিন চলে যায়
ব্যথা থেকে যায় ব্যথা।

মর্মবেদন আপন আবেগে
স্বর হয়ে কেন ফোটে না?
দীর্ণ হৃদয় আপনি কেন রে
বাঁশি হয়ে বেজে ওঠে না?

কবিতার লক্ষ্য কী–কবি সে-সম্বন্ধে ‘পুরস্কার’-নামক কবিতায় লিখিয়াছেন :

যুগে যুগে লোক গিয়েছে এসেছে,
দুঃখীরা কেঁদেছে  সুখীরা হেসেছে
প্রেমিক যে জন ভালো সে বেসেছে।
আজি আমাদের মত।
… … …
বহু মানবের প্রেম দিয়ে ঢাকা
বহু দিবসের সুখে দুঃখে আঁকা
লক্ষ যুগের সঙ্গীতে মাখা
সুন্দর ধরাতল;
… … …

শুধু বাঁশিখানি হাতে দাও তুলি’
বাজাই বসিয়া প্রাণ মন খুলি;
পুষ্পের মত সঙ্গীতগুলি
ফুটাই আকাশ ভালে।
অন্তর হতে আহরি বচন
আনন্দলোক করি বিরচন,
গীত রসধারা করি সিঞ্চন
সংসার ধূলিজালে। …
ধরণীর শ্যাম করপুটখানি
ভরি’ দিব আমি সেই গীত আনি;
বাতাসে মিশায়ে দিব এক বাণী।
মধুর অর্থভরা।
… … …
প্রেয়সী নারীর নয়নে অধরে
আরেকটু মধু দিয়ে যাব ভরে,
আরেকটু স্নেহ শিশুমুখ পরে
শিশিরের মত রবে।
না পারে বুঝাতে আপনি না বুঝে
মানুষ ফিরিছে কথা খুঁজে খুঁজে,
কোকিল যেমন পঞ্চমে কূজে
মাগিছে তেমনি সুর;
কিছু ঘুচাইব সেই ব্যাকুলতা
কিছু মিটাইব প্রকাশের ব্যথা,
বিদায়ের আগে দুচারিটা কথা
রেখে যাব সুমধুর।

রবীন্দ্রনাথের গীতিকবিতায় অতি উচ্চস্তরের দুইটি বৈশিষ্ট্য আছে। “মানবিক ভাবাবেগ বিস্তারের দ্বারা তিনি বহিঃপ্রকৃতিকে নবীন রূপে ও রসে মণ্ডিত করিয়া নিসর্গসৃষ্টির পরিচিত পুরানো পটে নব নব ছবি ফুটাইয়াছেন। রবীন্দ্রকাব্যের মধ্যদিয়া আমরা বিশ্ব-প্রকৃতিকে নূতন করিয়া দেখিতে পাই এবং তাহার মধ্যে মানবের ভূমিকা নূতন করিয়া বুঝিতে ও মানবের মহিমা নূতন করিয়া উপলব্ধি করিতে পারি”[১]।

এইভাবে ক্রমে ক্রমে রবীন্দ্রনাথের কবিতা একটি দার্শনিক অধ্যাত্ম অনুভবের উচ্চসীমায় পৌঁছিয়াছে। পূর্বোক্ত ‘মানসী’ ও ‘সোনার তরী এই দুইখানি গ্রন্থে ইহার প্রকৃষ্ট পরিচয় পাওয়া যায়। যখন এই দুইখানি গ্রন্থ প্রকাশিত হয় তখন ইহার অন্তর্নিহিত গূঢ় তত্ত্বটি কী তাহা লইয়া যথেষ্ট বাদানুবাদ হইত; এমনকি, অনেকেই এই কবিতাগুলিকে ‘প্রহেলিকা’ মনে করিতেন। বর্তমান যুগের একজন মনস্বী লেখক ইহার যে তাৎপর্য ব্যাখ্যা করিয়াছেন সংক্ষেপে তাহা উদ্ধৃত করিতেছিঃ

“রবীন্দ্র-কাব্য ইতিহাসের দ্বিতীয় ক্রমে কবির আত্মবোধ ধীরে ধীরে একটি বিশেষ অধ্যাত্ম অনুভবে জমিয়া উঠিতেছে। কবিসত্তা যেন এক হইয়াও দ্বিধা রূপ (split personality-এর মতো)। সত্তা এক রূপে অন্তরে থাকিয়া জীবন পরিচালিত করিতেছে, অন্য রূপে বাহিরে থাকিয়া জীবনপথের দিকনির্দেশ করিতেছে।

অন্তর্যামী যেন বিরহিণী বধূ, ‘বঁধু’ জীবনদেবতার খোঁজে অভিসারে সে অগ্রসর।…মানবাত্মা (অন্তর্যামী) যেন স্বয়ংবরা হইয়া পরমাত্মার (জীবনদেবতার) পানে চলিয়াছে, আর পরমাত্মা যেন স্বয়ং বৃত হইবার জন্য মানবাত্মার দিকে আসিতেছেন।…রবীন্দ্রনাথের অন্তর্যামী প্রেমিক আর জীবনদেবতা উদ্দিষ্ট প্রেমাস্পদ…। জীবনদেবতা বাহিরে থাকিয়া কবি-জীবনতরীকে গুণ টানিয়া লইয়া যাইতেছেন, আর অন্তর্যামী অন্তরে বসিয়া কবি-জীবনরথের সারথ্য করিতেছেন।–একই শক্তির দুই প্রকাশ…যিনি জীবনদেবতারূপে বাহিরে তাড়া দিতেছেন তিনিই অন্তর্যামীরূপে ধরা দিয়া কবিমন ভরাইয়া তুলিতেছেন।” “কবিভাবনা পলাতক মায়া-মৃগীর সন্ধানে ধাবিত। মানসী-প্রতিমার রূপ ধরিয়া সে দৃষ্টি এড়াইয়া পলাইয়া বেড়ায়, তবুও সে সোনার তরীতে বোঝাই ফসলে ভাণ্ডার ভরায়”।

ইহাতে অবশ্য মানসী’ ও ‘সোনার তরী এই কাব্যগ্রন্থ দুইখানির স্পষ্ট ইঙ্গিত করা হইয়াছে। তবে অন্যান্য অনেক কবিতায় এই ভাব আরও পরিস্ফুট হইয়াছে।

‘মানসী’ ও ‘সোনার তরী’র পরে কবি কল্পনার রাজ্য ছাড়িয়া সংসারের দুঃখময় বাস্তবজীবনের দৃশ্য প্রত্যক্ষ করিয়াছেন। তাহার ফলে কবির বাস্তববাদী মন যে নূতন আদর্শে অনুপ্রাণিত হইয়াছে, ১৮৯৬ সনে প্রকাশিত ‘চিত্রা’য় তাহা আশ্চর্যরকমে ফুটিয়া উঠিয়াছে এবার ফিরাও মোরে এই কবিতাটিতে। ইহা রবীন্দ্রনাথের অবশিষ্ট জীবনে কেবল কবিতার নহে, সমগ্র সাহিত্যিক রচনার উৎস ও প্রধান প্রেরণা বলিয়া গ্রহণ করা যাইতে পারে। রবীন্দ্রনাথের মানসিক গতি, প্রকৃতি ও লক্ষ্য এই কবিতাটিতে যেরূপ পরিস্ফুট হইয়াছে, তাহা অন্যত্র এমন স্পষ্ট ও বিস্তৃতভাবে দেখা যায় না এবং রবীন্দ্রনাথ স্বয়ং যে-ভাষায় ও যে-ভাবে ইহা ব্যক্তি করিয়াছেন তাহা অতুলনীয় বলিলে কিছুমাত্র অত্যুক্তি হইবে না। সুতরাং যদিও ইহার একটি সুদীর্ঘ অংশ উদ্ধৃত করিতেছি, তথাপি এই কবিতাটি সমগ্র পাঠ করিলে রবীন্দ্রনাথের কবিমানসের ও জীবন-আদর্শের এই নূতন দিকের স্পষ্ট পরিচয় পাওয়া যাইবে না।

প্রথমে অতীত কল্পনাসর্বস্ব কবিজীবনের প্রতি বীতরাগ হইয়া কবি বলিতেছেন:

“সংসারে সবাই যবে সারাক্ষণ শত কর্মে রত,
তুই শুধু ছিন্নবাধা পলাতক বালকের মত
… … … …
সারাদিন বাজাইলি বাঁশি। ওরে তুই ওঠ আজি।
আগুন লেগেছে কোথা? কার শঙ্খ উঠিয়াছে বাজি
জাগাতে জগৎ জনে? কোথা হতে ধ্বনিছে ক্রন্দনে
শূন্যতল? কোন্ অন্ধ কারামাঝে জর্জর বন্ধনে
অনাথিনী মাগিছে সহায়? …
… ওই যে দাঁড়ায়ে নতশির
মূক সবে, ম্লান মুখে লেখা শুধু শত শতাব্দীর
বেদনার করুণ কাহিনী …”

আত্মভর্ৎসনায় মুখর হইয়া কবি বাস্তবজগতের দুঃখকষ্টের এই-যে চিত্র আঁকিয়াছেন, বাংলা কবিতায় তাহার তুলনা মিলে না। তারপর নিজের কর্তব্য নির্দেশ করিয়াছেন–

…“এইসব মূঢ় ম্লান মূক মুখে
দিতে হবে ভাষা, এইসব শ্রান্ত শুষ্ক ভগ্ন বুকে,
ধ্বনিয়া তুলিতে হবে আশা …”

“কবি, তবে উঠে এস, যদি থাকে প্রাণ
তবে তাই লহ সাথে, তবে তাই কর আজি দান।
বড় দুঃখ বড় ব্যথা, সম্মুখেতে কষ্টের সংসার
বড়ই দরিদ্র, শূন্য, বড় ক্ষুদ্র, বদ্ধ অন্ধকার।
অন্ন চাই, প্রাণ চাই, আলো চাই, চাই মুক্ত বায়ু
চাই বল, চাই স্বাস্থ্য, আনন্দ উজ্জ্বল পরমায়ু
সাহস বিস্তৃত বক্ষপট। ঐ দৈন্য মাঝারে, কবি
একবার নিয়ে এস স্বর্গ হতে বিশ্বাসের ছবি।”

“এবার ফিরাও মোরে, লয়ে যাও সংসারের তীরে
হে কল্পনে, রঙ্গময়ি! দুলায়ো না সমীরে সমীরে

তরঙ্গে তরঙ্গে আর! ভুলায়ো না মোহিনী মায়ায়।” জগতে যাহা কিছু সুন্দর, যাহা কিছু উপভোগ্য অথবা যাহা কিছু কুৎসিত ও বেদনাদায়ক, অর্থাৎ যাহা কিছু আমাদের হৃদয়তন্ত্রীকে আঘাত করিয়া নিবিড় অনুভূতি জাগায়, তাহাই রবীন্দ্রনাথের অসংখ্য কবিতা ও সঙ্গীতে ধ্বনিত হইয়াছে। কিন্তু ইহা ছাড়াও অন্যবিধ বহু ছোট বড় কবিতায় একাধারে আমাদের মনে অপূর্ব সৌন্দর্যবোধের ও নানা রসের অপার আনন্দ সৃষ্টি করে।

এই শ্রেণীর কবিতা সম্বন্ধে অনায়াসে বলা যায় যে, যতদিন বঙ্গভাষা জীবিত থাকিবে ততদিন ইহা আনন্দের ও রসানুভূতির অক্ষয় ভাণ্ডাররূপে বিরাজ করিবে। ভগবানের নিকট প্রার্থনা ও আত্মসমর্পণ, পৌরাণিক ও ঐতিহাসিক কাহিনী এবং আমাদের সমাজের চিত্র, দেশভক্তি, শিশুর ও কিশোরের মনোবৃত্তি অবলম্বনে লিখিত এই সমুদয় কবিতার বিস্তৃত বিবরণ তো দূরের কথা, সংক্ষিপ্ত তালিকা দেওয়াও অসম্ভব। যদৃচ্ছাক্রমে সঙ্কলিত এরূপ কয়েকটি কবিতার উল্লেখ করিতেছি–”পুরাতন ভৃত্য’, ‘দুই বিঘা জমি’, ‘উর্বশী’, ‘পতিতা’, ‘শ্রেষ্ঠ ভিক্ষা, ‘দেবতার গ্রাস,’ ‘অভিসার, বন্দী বীর, শাহজাহান, ভারততীর্থ’ (হে মোর চিত্ত, পুণ্য তীর্থে জাগো রে ধীরে), ‘অপমান’ (হে মোর দুর্ভাগা দেশ, যাদের করেছে অপমান) এবং বাঙ্গালীর নিতান্ত ঘরোয়া ব্যাপার অবলম্বনে রচিত ‘মুক্তি’ (ডাক্তারে যা বলে বলুক না কো), ফাঁকি’ (বিনুর বয়স তেইশ তখন), ‘নিষ্কৃতি (মা কেঁদে কয় মঞ্জুলী মোর ঐ তো কচি মেয়ে) এবং মহাকাব্যের গাম্ভীর্যপূর্ণ গান্ধারীর আবেদন, কর্ণ-কুন্তী সংবাদ প্রভৃতি গাথা–এরূপ শতাধিক কবিতা আছে, বিশ্বসাহিত্যে যাহার তুলনা খুব বেশী মিলিবে না।

রবীন্দ্রনাথের সঙ্গীতসম্বন্ধেও কবিত্বহিসাবে ঠিক একই মন্তব্য করা চলে। তাঁহার দেশাত্মবোধক কয়েকটি সঙ্গীত পূর্বেই উল্লেখ করা হইয়াছে। আমাদের জাতীয় সঙ্গীত ‘জনগণমন অধিনায়ক, অয়ি ভুবনমনমোহিনী প্রভৃতি এই শ্রেণীর বহুসংখ্যক সঙ্গীত এবং বর্তমান বাংলা দেশের জাতীয় সঙ্গীত এই তালিকার অন্তর্ভুক্ত হইয়া গীতবিতান’ গ্রন্থে সংগৃহীত হইয়াছে। এই গ্রন্থে মোট ৯৫৫ পৃষ্ঠায় রবীন্দ্রনাথের সঙ্গীতগুলি সংগৃহীত হইয়াছে। এত অধিকসংখ্যক সঙ্গীতের এবং দুইটি দেশের জাতীয় সঙ্গীতের রচয়িতা হিসাবে রবীন্দ্রনাথ যে খ্যাতি ও গৌরবের অধিকারী, জগতে তাহার তুলনা নাই। রবীন্দ্রনাথ তাঁহার কোন কোন কবিতাকে গানে পরিবর্তিত করিয়াছেন এবং তাঁহার অনেক সঙ্গীত গীতিকবিতা-ধৰ্মীয়। তিনি কীর্তন’ গানকে অপূর্ব ও অভিনব ঐশ্বর্যে মণ্ডিত করিয়াছেন।

১৯১৩ সনে গীতিকাব্যের জন্য জগদ্বিখ্যাত ‘নোবেল পুরস্কার’ পাইয়া রবীন্দ্রনাথ জগতের সাহিত্যে বঙ্গভাষা ও সাহিত্যকে যে মর্যাদার অধিকারী করিয়াছেন, কেবল ভারতবর্ষ নহে, এশিয়া মহাদেশের অন্য কোন ভাষা ও সাহিত্য তাহা দাবি করিতে পারে না।

কিন্তু কবিতা ছাড়াও সাহিত্যের অন্যান্য বিভাগে রবীন্দ্রনাথের দান অমূল্য ও অপরিসীম। ইহাদের মধ্যে প্রধানতঃ ছোটগল্প ও উপন্যাস এবং নাটক ও প্রবন্ধের সংক্ষিপ্ত আলোচনা করিব।

গীতিকবিতার সহিত ছোটগল্পের কিছু সাদৃশ্য আছে। কারণ উভয়েরই লক্ষ্য, স্বল্প-পরিসরের মধ্যে একটি ঘনীভূত অখণ্ড ভাবরসের (emotion) সৃষ্টি করা। রবীন্দ্রনাথ সর্বপ্রথম ১২৯১ সালে দুইটি গল্প লেখেন। সাত বৎসর পর ১২৯৮ সাল হইতে জীবনের শেষ পর্যন্ত তাঁহার শতাধিক গল্প বিবিধ মাসিকপত্রে প্রকাশিত হয়। তাঁহার ছোটগল্পের একাধিক সংকলন আছে। ইহার মধ্যে সমধিক প্রসিদ্ধ ‘গল্পগুচ্ছ’ প্রথমে (১৩০৭) দুই খণ্ডে এবং পরে (১৩১৫) নূতন সংস্করণে পাঁচ খণ্ডে প্রকাশিত হয়।

রবীন্দ্রনাথের ছোটগল্পের মধ্যদিয়া প্রধানতঃ গ্রাম ও শহরবাসী মধ্যবিত্ত বাঙ্গালীর দৈনন্দিন জীবনযাত্রা এবং সাংসারিক ও সামাজিক অবস্থার যে চিত্র ফুটিয়া উঠিয়াছে তাহা সুপরিচিত হইলেও পড়িবামাত্রই একটি নূতন সৌন্দর্যের সৃষ্টিরূপে আমাদিগকে মুগ্ধ করে। অতিসাধারণ জিনিসের মধ্যেও যে সৌন্দর্য লুকাইয়া আছে, কবির চোখে তাহার অন্তর্নিহিত রূপ প্রকটিত হইয়া তাঁহার গল্পে প্রতিবিম্বিত হইয়াছে। নষ্টনীড়’ গল্পটি কবির এক অপূর্ব সৃষ্টি। দেবর ও ভ্রাতৃবধূর মধ্যে ঘনিষ্ঠ প্রণয়ের সম্বন্ধ সমাজে অপরিচিত নহে–কিন্তু, তাহার উৎপত্তি প্রকৃতি ও আবেগশীলতা ও চরিত্রের মর্যাদা লঙ্ন না করিয়া এমন নিপুণভাবে অঙ্কিত হইয়াছে যে ইহার করুণ সমাপ্তি আমাদের মনকে একেবারে অভিভূত করে। এই শ্ৰেণীর আর একটি গল্প ‘মেঘ ও রৌদ্র’ অস্ফুট বাল্যপ্রণয়ের অপূর্ব বিকাশে সমুজ্জ্বল। এইরূপ বাৎসল্যরসের মহিমায় উজ্জ্বল কাবুলিওয়ালা’, অতিপ্রাকৃত পরিবেশমণ্ডিত ‘ক্ষুধিত পাষাণ, হৃতসর্বস্ব ধনীসংসারের মর্মান্তিক গল্প রাসমণির ছেলে, মাতৃকল্পা মাসী ও পত্নীবৎসল, কিন্তু পত্নীপ্রেমে বঞ্চিত মৃত্যুপথযাত্রীর কাহিনী শেষের রাত্রি’ প্রভৃতি বহু গল্প বাংলাসাহিত্যের চিরন্তন সম্পদ।

রবীন্দ্রনাথের উপন্যাস সম্বন্ধে একজন সমালোচক লিখিয়াছেন :

“রবীন্দ্রনাথের আগে বাঙ্গালা (তথা ভারতীয়) উপন্যাসে শুধু প্রেমকাহিনীর অথবা ঘরোয়া সুখ-দুঃখের কথারই স্থান ছিল। রবীন্দ্রনাথ উপন্যাসের পরিসর অনেকদূর বাড়াইয়া দিলেন… ভারতীয় সাহিত্যে মনোবিশ্লেষণ এবং তথাকথিত বাস্তবপদ্ধতির প্রবর্তন রবীন্দ্রনাথই করিয়াছেন।”[৩]

ইহার প্রকৃষ্ট নিদর্শন ১৩০৮-০৯ সালে বঙ্গদর্শনে ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত ‘চোখের বালি’ উপন্যাস। এই গ্রন্থখানি সম্বন্ধে উক্ত সমালোচক মন্তব্য করিয়াছেন: “ঘটনার ঘাত-প্রতিঘাতের অপেক্ষা মনের ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার আবর্ত ও তাহার পরিণতির গুরুত্ব আধুনিক উপন্যাসের প্রধান বৈশিষ্ট্য। চোখের বালি’তে পাত্র পাত্রীর দ্বন্দ্ব অবলম্বনে ব্যক্তিত্বের প্রকাশ ও বিকাশ স্বাভাবিক ও সুনিপুণভাবে চিত্রিত। তাই ইহা বাঙ্গালা সাহিত্যের প্রথম আধুনিক উপন্যাস।”[8]

চোখের বালির পরে নৌকাডুবি’ (১৩১৩) ও ‘গোরা’ (১৩১৬) এই দুই উপন্যাসে রবীন্দ্রনাথের প্রসিদ্ধি অনেক বাড়িয়া গেল। গোরা সম্বন্ধে পূর্বোক্ত সমালোচক বলিয়াছেন : গোরা বিরাট ও অভিনব সৃষ্টি। … আধুনিক ভারতবর্ষের কঠিনতম সমস্যা হিন্দুসমাজের এবং ভারতবর্ষীয় সভ্যতার মরণ-বাচনের সমস্যা, এই উপন্যাসের পাত্র-পাত্রীর অন্তর্দ্বন্দ্বের সহিত বিজড়িত। অব্যবহিত পূর্ববর্তী উপন্যাস ‘নৌকাডুবি’তে সামাজিক সংস্কারের সঙ্গে হৃদয়বৃত্তির সংঘর্ষের একটা পরিণাম প্রদর্শিত। গোরায় ব্যক্তির সঙ্গে সমাজের, সমাজের সঙ্গে ধর্মের এবং ধর্মের সঙ্গে মানব-সত্যের বিরোধ ও সমন্বয়ের নির্দেশ উঘাটিত।”[৫] হিন্দুসমাজের অনুদারতা এবং আচারকে ধর্মের স্থানে প্রতিষ্ঠা করার মূঢ়তা প্রভৃতির বিরুদ্ধে স্বামী বিবেকানন্দ উদাত্ত স্বরে যে প্রতিবাদ ঘোষণা করিয়াছিলেন, রবীন্দ্রনাথই সর্বপ্রথম উপন্যাসের মধ্যদিয়া তাহা বাঙ্গালীর অন্তরে প্রবিষ্ট করাইলেন।

ইহা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য যে, রবীন্দ্রনাথ ব্রাহ্ম ও হিন্দুসমাজের দোষ-গুণ উভয়ই নিরপেক্ষভাবে উপন্যাসের চরিত্রের মাধ্যমে প্রকট করিতে দ্বিধাবোধ করেন নাই। বলা বাহুল্য, হিন্দু ও ব্রাহ্ম সম্প্রদায়ের অনেকেই তাঁহার প্রতি ক্ষুব্ধ। রাজনীতিক ক্ষেত্রেও সাহিত্যিক হিসাবে রবীন্দ্রনাথের অপক্ষপাত স্বাধীন মতের প্রকাশ ঘরে বাইরে’ উপন্যাসে (১৯১৬) পরিস্ফুট হইয়াছে। দেশের স্বাধীনতা আন্দোলনে রবীন্দ্রনাথের যে গভীর সহানুভূতি ছিল তাহার প্রকৃষ্ট পরিচয় স্বদেশীগানের উল্লেখ পূর্বেই করিয়াছি। কিন্তু হিংসাত্মক বিপ্লববাদ সম্বন্ধে চার অধ্যায়’ উপন্যাসে (১৯৩৪) তাঁহার স্বাধীন মতামত ব্যক্ত করিতে তিনি কুণ্ঠিত হন নাই। রবীন্দ্রনাথের অন্যান্য উপন্যাসের মধ্যে যোগাযোগ’ (১৯২৯), শেষের কবিতা’ (১৯২৯), ‘দুই বোন’ (১৯৩১) প্রভৃতি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।

‘রাজা ও রানী’ (১৮৮৯) রবীন্দ্রনাথের প্রথম পঞ্চমাঙ্ক নাটক এককালে বিশেষ প্রসিদ্ধি লাভ করিয়াছিল। কিন্তু ইহা অপেক্ষাও তাঁহার কৌতুকনাটকগুলির জনপ্রিয়তা অধিক ও দীর্ঘকাল স্থায়ী। ইহাদের মধ্যে ‘গোড়ায় গলদ’ (১৮৯২), ‘বৈকুণ্ঠের খাতা’ (১৮৯৭), “চিরকুমার সভা’ বা ‘প্রজাপতি নির্বন্ধ’ (১৯০১) বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।

তিনি ১৯০৮ সনে শান্তিনিকেতন বিদ্যালয়ের ছাত্রদের অভিনয়ের জন্য শারদোৎসব’ নাটক রচনা করেন। তারপর একই উদ্দেশ্যে বহুসংখ্যক ক্ষুদ্র নাটিকা রচনা করেন। এই নাটকগুলির অভিনবত্ব সম্বন্ধে একজন সমালোচক বলিয়াছেন যে, পূর্বেকার নাটকে ছিল “মানুষের ব্যক্তিক হৃদয়দ্বন্দ্ব, তাহার জীবনের বিশেষ সমস্যা, সংস্কারের সঙ্গে বিচারবুদ্ধির সংঘর্ষ, হৃদয়বৃত্তির সঙ্গে অহংকার অভিমানের বিরোধ। গোড়ায় গলদ’ ও ‘বৈকুণ্ঠের খাতা’ প্রভৃতি প্রহসনে পাইয়াছিলাম সংলাপাশ্রয়ী বিশ্রদ্ধ কৌতুকরসদীপ্তি। শারদোৎসব’ হইতে দেখি যে, কবিদৃষ্টি মানুষের হৃদয়বৃত্তি ছাড়াইয়া তাহার অনুভাবের সামর্থ্যের উপর পড়িয়াছে। এখানে ভূমিকাগুলি মানুষের অন্নময় শারীরসত্তার ছায়াবহ ততটা নয় যতটা তাহার আননন্দময় রসসত্ত্বের। এইভাবে দেখিলে শারদোৎসবে’ ও পরবর্তী অধিকাংশ নাট্যরচনায় আধ্যাত্মিক রূপকের ঝলক লাগিয়াছে।”

পরবর্তী যুগের এই শ্রেণীর নাটক নাটিকার মধ্যে নিম্নলিখিত গ্রন্থগুলি বিশেষ ভাবে উল্লেখযোগ্য: ফাল্গুনী (১৯১৬), রাজা’ (১৯১০), ‘অচলায়তন’ (১৯১১), ‘ডাকঘর’ (১৯১২), মুক্তধারা’ (১৯২২), রক্তকরবী’ (১৯২৪), নটীর পূজা’ (১৯২৬), চণ্ডালিকা’ (১৯৩৩), ‘তাসের দেশ’ (১৯৩৯) ও বাঁশরী’ (১৯৩৯)।

রবীন্দ্রনাথ বহু প্রবন্ধ লিখিয়াছেন। ইহাদের বিষয়বস্তু সাহিত্য, তত্ত্ব ও গ্রন্থসমালোচনা, প্রাচীন ও আধুনিক সাহিত্য, লোকসাহিত্য, বর্তমান যুগের শিক্ষা, সামাজিক ও রাজনীতিক সমস্যা, ইতিহাস, ধর্মবোধ, বস্তুবিজ্ঞান, শব্দতত্ত্ব প্রভৃতি। তাঁহার ভ্রমণকাহিনী অবলম্বনে ‘য়ুরোপযাত্রীর ডায়ারি’, ‘জাপান যাত্রী’, ‘পশ্চিম যাত্রীর ডায়ারি’, ‘রাশিয়ার চিঠি’ ইত্যাদি। রবীন্দ্রনাথের ‘জীবনস্মৃতি’ (১৯১২)। কেবল তাঁহার জীবনের কাহিনী নহে, নিছক সাহিত্য হিসাবেও উপভোগ্য। ‘পঞ্চভূতের ডায়েরী’ নানাবিধ বিষয় অবলম্বনে এক বিচিত্র রচনা।

২. শরৎচন্দ্র

সাহিত্যের ইতিহাসে এক একটি কালে এক একজন লেখকের এমন প্রভাব দেখা যায় যে, সেই কাল সেই লেখকের দ্বারা এবং সেই লেখক একটি বিশেষ উপাধি। দ্বারা চিহ্নিত হয়। দৃষ্টান্তস্বরূপ আধুনিক বাংলাসাহিত্যে প্রথমে পাই সাহিত্যসম্রাট বঙ্কিমচন্দ্র, তারপর কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ এবং সর্বশেষে অপরাজেয় কথাশিল্পী শরৎচন্দ্র (১৮৭৬-১৯৩৮)।

বাংলাসাহিত্যে শরৎচন্দ্রের আবির্ভাব অতি আকস্মিক। একটি ইংরাজী বাক্য ‘I awoke one morning and found myself famours’ 472 per prata একটি উক্তি পর্বতের চূড়া যেন সহসা প্রকাশ শরৎচন্দ্র সম্বন্ধে সম্পূর্ণরূপে প্রযোজ্য। তাহার বড়দিদি’ বড়গল্প বা ছোট উপন্যাস যখন ‘ভারতী’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয় তখন প্রথম দুই সংখ্যায় লেখকের নাম ছাপা হয় নাই। অনেকেই এই অজ্ঞাতনামা লেখকের গল্প পড়িয়া বিস্মিত হইয়াছিলেন। কেহ কেহ এমনও সন্দেহ করিয়াছিলেন যে ইহা রবীন্দ্রনাথেরই রচনা।

ছয় বৎসর পরে যমুনা” পত্রিকায় প্রকাশিত হইল ‘বিন্দুর ছেলে’, ‘পরিণীতা’, ‘বিরাজবৌ’ ও ‘চরিত্রহীন’ উপন্যাসের এক অংশ। শরৎচন্দ্র “অপরাজেয় কথা শিল্পী” বলিয়া লোকমুখে প্রসিদ্ধি লাভ করিলেন। শরৎচন্দ্রের বড়গল্প ও ছোট উপন্যাসের মধ্যে সীমারেখা নির্দেশ করা কঠিন। তাঁহার গল্প উপন্যাস সংখ্যায় এত বেশি এবং এত সুপরিচিত যে, ইহার সুদীর্ঘ তালিকা বা বিস্তৃত বিবরণ দেওয়ার প্রয়োজন নাই। সুতরাং বৈচিত্র্যের দিকে দৃষ্টি রাখিয়া মাত্র কয়েকখানির উল্লেখ করিতেছি–’পরিণীতা’ ও ‘বিরাজবৌ’ (১৯১৪); ‘পল্লীসমাজ’, ‘চন্দ্রনাথ ও ‘অরক্ষণীয়া’ (১৯১৬); ‘দত্তা’ (১৯১৮), গৃহদাহ’ (১৯২০), দেনা-পাওনা (১৯২৩), পথের দাবী’ (১৯২৬), ‘শেষ প্রশ্ন (১৯৩১) এবং বিপ্রদাস’ (১৯৩৫)। শ্রীকান্তের চারি পর্ব লিখিত হইয়াছিল যথাক্রমে ১৯১৭, ১৯১৮, ১৯২৭ ও ১৯৩৩ সনে।

বর্তমান গ্রন্থ বাংলাসাহিত্যের ইতিহাস নহে, বাংলাদেশের সর্বাঙ্গীণ ইতিহাস এবং সাহিত্যের ইতিহাস ইহার একটি অংশ বা অধ্যায় মাত্র। এই শ্রেণীর গ্রন্থে শরৎচন্দ্রের সাহিত্যিক প্রতিভা বিচারের একটি গুরুতর অসুবিধা ঘটিয়াছে। ঐতিহাসিক সাহিত্য-সমালোচকের স্থান অধিকার করিতে পারে না। সুতরাং এ বিষয়ে বিশেষজ্ঞদের মতের সহিত সামঞ্জস্য রাখিয়া তাহাকে মন্তব্য বা আলোচনা করিতে হয়। বাংলাসাহিত্যের ইতিহাস সম্বন্ধে এ-বিষয়ে বর্তমান যুগের শ্রেষ্ঠ লেখক শ্রীসুকুমার সেনের বাঙ্গলা সাহিত্যের ইতিহাস’ গ্রন্থের উপর আমি অনেকটা নির্ভর করিয়াছি, বিশেষতঃ রবীন্দ্রনাথের সম্বন্ধে। কিন্তু শরৎচন্দ্র সম্বন্ধে সুকুমারবাবুর ধারণা এবং তিনি যে মতামত প্রকাশ করিয়াছেন তাহা আমি আমার ক্ষুদ্র বুদ্ধিতে কোনমতেই সমর্থন করিতে পারি নাই। আমার নিজের মতামতের উপর নির্ভর করিতেও আমি অনিচ্ছুক, কারণ শরৎচন্দ্রের সহিত আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধুত্ব ছিল এবং আমি বহুদিন হইতেই তাহার গল্প-উপন্যাসের একজন পরম (হয়ত অন্ধ) ভক্ত, সুতরাং প্রথমে আমার নিজের মতামত ব্যক্ত না করিয়া কয়েকজন বিশিষ্ট ভিন্ন ভিন্ন সাহিত্য-সমালোচকদের মত উদ্ধৃত করিয়া উপসংহারে আমার নিজের মতামত ব্যক্তি করিব।

মোহিতলাল মজুমদার তাঁহার ‘আধুনিক বাংলা সাহিত্য-গ্রন্থে লিখিয়াছেন : “বঙ্কিমচন্দ্রের পর আমরা রবীন্দ্রনাথকে এখন কতকটা বুঝিতে পারিতেছি। কিন্তু রবীন্দ্রনাথের অব্যবহিত পরেই শরৎচন্দ্রের আবির্ভাব যেন একটি অতর্কিত, অপ্রত্যাশিত আমাদের সাহিত্যের ধারাটি যেন একটি ভিন্ন মুখে প্রবাহিত হইতে চলিয়াছে।…

“রবীন্দ্রনাথের দুরারোহিণী কল্পনার ঊর্ধ্বশাখায় যে ফুল গুচ্ছে গুচ্ছে ফুটিয়া উঠিল তার সবটুকু শোভা সকলের চোখে ধরিল না বটে, কিন্তু সেই ফুলের বীজ নিম্নভূমিতে একটি নূতনরূপে অঙ্কুরিত হইল। তাই হঠাৎ যখন দেখা গেল, একেবারে পথের ধারেই লতাগুল্মের বেড়াগুলি এক নূতন ধরনের ফুলে ভরিয়া উঠিয়াছে, তার বর্ণ গন্ধ যেমন চমকপ্রদ তেমনি অতি সহজেই প্রাণ মন অভিভূত করে, তখন আর বিস্ময়ের সীমা রহিল না। এ যে চিরদিনের দেখা জিনিস অথচ এমন করিয়া কখনও তো দেখি নাই।”

মোহিতলালের পূর্বোক্ত উক্তি অনুসরণ করিয়া প্রখ্যাত ঔপন্যাসিক তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় লিখিয়াছেন : রবীন্দ্রনাথ বর্তমানে শরৎচন্দ্রের তিরোধান ঘটলেও শরৎ-সাহিত্যই বাঙ্গালীর সাহিত্যের ভাবধারার অব্যবহিত পূর্বধারা… রবীন্দ্রনাথের দৃষ্টি থেকেই লাভ করা রূপবোধ নিয়ে শরৎচন্দ্র আবিষ্কার করলেন দুঃখপ্রীড়িত দুর্গতদের পতিত জীবনের পটভূমিতে মানুষের সেই সত্য, যে সত্য সবার উপরে সত্য–সবার উপরে মানুষ সত্য তাহার উপরে নাই। প্রকৃত অতীন্দ্রিয়লোকের অস্তিত্ব শরৎ-সাহিত্যে একেবারে নাই তা নয়। তবু শরৎ-সাহিত্যে বাস্তবজীবন প্রধান। পূর্ববর্তী জীবনধারা থেকে নূতন কালের জীবন ধারণের প্রয়াসের কালে যে বিপ্লব অবশ্যম্ভাবী জাগতিক জীবনধারণ ব্যবস্থার বিপর্যয়ের ফলে যা আমাদের মধ্যেও সঞ্চারমান হয়েছিল অথচ স্পষ্টরূপে প্রকাশ পাচ্ছিল না, তার আবেগ এনেছেন রবীন্দ্রনাথ, কিন্তু তার প্রথম প্রকাশ হয়েছে শরৎ-সাহিত্যে।[৭]

সুপণ্ডিত ও সাহিত্য-সমালোচক অধ্যাপক সুবোধচন্দ্র সেনগুপ্ত লিখিয়াছেন : “আমাদের দেশে অন্য দুইজন বড় ঔপন্যাসিক অর্থাৎ বঙ্কিমচন্দ্র ও রবীন্দ্রনাথের রচনার সঙ্গে শরৎচন্দ্রের তুলনা করিলে দেখা যাইবে যে তাহার উপন্যাসে দৈনন্দিন জীবনের পরিচয় অপেক্ষাকৃত ঘনিষ্ঠ ও নিবিড়। তিনি যাহা বর্ণনা করিয়াছেন তাহাকে এত সূক্ষ্মভাবে দেখিয়াছেন যে তাহা আমাদের কাছে একান্তভাবে স্পষ্ট হইয়া উঠিয়াছে, তাহাকে ভুল করিবার বা ভুলিবার উপায় নাই, এই পুঙ্খানুপুঙ্খতা তাঁহার সৃষ্টিকে প্রত্যক্ষ ও সজীবতা দান করিয়াছে। কৃষ্ণকান্তের উইল’, ‘চোখের বালি’ দৈনন্দিন জীবনের ইতিহাস, আমাদের গার্হস্থ্য জীবনে ভ্রমর, সূর্যমুখী, রোহিনী বা আশাকে দেখা যায়, রাজলক্ষ্মীর মত রমণী তাহাদের অপেক্ষা অনেক বেশী বিরল। কিন্তু রাজলক্ষ্মী ও শ্রীকান্তের প্রেমের চিত্রে অনেক ছোটখাট, খুঁটিনাটি পদার্থের বর্ণনা আছে, তাহার জন্য রাজলক্ষ্মীকে অনেক কাছের লোক বলিয়া মনে হইবে।…

“শরৎচন্দ্রের দরদ যত বেশীই থাক, তিনি বহু ত্রুর স্বার্থান্বেষীর নির্মম চিত্রও আঁকিয়াছেন। কিন্তু সেইখানেও দেখি এইসব হৃদয়হীন ব্যক্তিদের হৃদয়হীনতা প্রকাশ পাইয়াছে অতি সহজে, তাহাদের তুচ্ছতম বাক্য ও ক্ষুদ্রতম কার্যের মধ্য দিয়া। তাই রাসবিহারী ও রাসী বামনী আমাদের অতি নিকটে আসিয়াছে; শরৎ সাহিত্যের বাহিরে যে-সকল পাষণ্ডের চিত্র পাওয়া যায় তাহাদিগকে এত কাছের লোক বলিয়া মনে হয় না। সামাজিক জীবনের যে ছবি শরৎ-সাহিত্যে ফুটিয়া উঠিয়াছে তাহাও হৃদয়গ্রাহী হইয়াছে এই কারণে। বাংলা দেশে ম্যালেরিয়ার প্রকোপের কথা কে না জানে, কিন্তু সাহিত্যে এই বিভীষিকার সর্বাপেক্ষা তীব্রতম বর্ণনা পাওয়া যায় পোড়াকাঠের একটি নিতান্ত তুচ্ছ উক্তিতে। সে বলিয়াছে সে। গ্রামে সাপের উপদ্রব আছে সত্য কিন্তু সর্পাঘাতে আর কত লোক মরে, লোক যা মরে সব মালোয়াড়িতে।

“শরৎচন্দ্রের উপন্যাস হাস্যরসের জন্য বিখ্যাত, আমাদের দেশের কোন সাহিত্যিকই এই বিষয়ে তাঁহার সমকক্ষতা দাবী করিতে পারেন না। তাঁহার সৃষ্টির একটি প্রধান গুণ এই যে, তিনি উপহাসের বস্তুকে সমবেদনার রসে অভিষিক্ত করিয়াছেন। বোধ হয় এই সুগভীর সহানুভূতির জন্যই তাঁহার চরিত্রসৃষ্টি এত গভীর সরস ও বৈচিত্র্যময় হইয়াছে। এইখানেও তাঁহার পর্যবেক্ষণের তীক্ষ্ণতা ও বর্ণনার পুঙ্খানুপুঙ্খতা লক্ষণীয় হইবে। প্রিয়নাথ ডাক্তার, রতন নবশাখ ও গিরিশ উকিল প্রভৃতি চরিত্রের সমালোচনা করিলে দেখা যাইবে কত তুচ্ছ কাজ ও তুচ্ছতর কথার সাহায্যে এই সকল চরিত্রকে সজীব করা হইয়াছে”।[৮]

‘বিশ্ব সাহিত্যিক শরৎচন্দ্র’ এই শিরোনামায় প্রবীণ সাহিত্যিক অতুলচন্দ্র গুপ্ত লিখিয়াছেন :

“শরৎচন্দ্রের গল্প ও উপন্যাস বহু ভারতীয় ভাষায় অনূদিত হইয়াছে। এই অনুবাদের ফলে শরৎ-সাহিত্য কেবল বাঙ্গালা সাহিত্যেই সীমাবদ্ধ নহে, তাহা ভারতের বিভিন্ন প্রদেশের সাহিত্যে একটি বিশিষ্ট স্থান অধিকার করিয়াছে।…

“শরৎ-সাহিত্যে অন্ন বস্ত্রের সমাধান নাই এবং কিভাবে জাতিকে মহৎ ও উন্নত করা যায় সে-বিষয়েও তিনি কিছু বলেন নাই, কিন্তু তিনি আমাদের আনন্দ দান করিয়াছেন, যে আনন্দ ভারতবর্ষের সর্বত্র পরিব্যাপ্ত হইয়াছে। …সভ্যতার বড় সৃষ্টি আনন্দের সৃষ্টি, শরৎচন্দ্র উহা অকৃপণভাবে বিতরণ করিয়াছেন। সমগ্র ভারতবর্ষ তাহা ভোগ করিয়াছে, কালে সমগ্র সভ্যসমাজ সে আনন্দ উপভোগ করিবে।[৯]

উপসংহারে আমি শরৎ-সাহিত্যের একটি উপেক্ষিত দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করিয়া যাহা লিখিয়াছিলাম তাহার কিয়দংশ উদ্ধৃত করিতেছি।

“ Proletariat নামে সমাজের যে নিঃস্ব শ্রেণীর দাবির সমর্থনে সারা জগতে আজ কমিউনিষ্ট অভিযান চলছে বাংলা কথা-সাহিত্যে তাদের চিত্র শরৎচন্দ্রের গল্পে ও উপন্যাসেই প্রথম পাই। কিন্তু কমিউনিষ্ট মতের প্রবর্তক কার্ল মার্কসের Communist Manifesto যাদের নিঃস্ব শ্রেণীর অন্তর্ভুক্ত করেছে-শরৎচন্দ্রের নিঃস্ব সম্প্রদায় সম্বন্ধে ধারণা তার চেয়ে আরও ব্যাপক। স্ব, অর্থাৎ আপন বলতে যে-শ্রেণীর ধন-সম্পদ বা আর্থিক বিভব কিছুই নাই, কমিউনিষ্টরা Proletariat বলতে তাদেরই নির্দেশ করেন। কিন্তু শরৎচন্দ্রের দরদী মন কেবল তাদেরই নিঃস্ব বলে গণ্য করেনি। যারা সামাজিক নীতিভঙ্গের অপরাধে আত্মীয় বন্ধু দ্বারা পরিত্যক্ত এবং সমাজে ঘৃণিত ও লাঞ্ছিত-সামাজিক মানমর্যাদা, সম্ভ্রম ও সহানুভূতি থেকেও বঞ্চিত-অর্থাৎ, ধনে বা মানে যে-কোন দিক থেকেই নিঃস্ব তাদেরও মানুষের মত বাঁচার দাবি আমাদের সামনে তুলে ধরেছেন। তারাও যে মানুষের অধিকার নিয়ে জন্মেছে, অথচ তা পায়নি বা হারিয়েছে–এমনকি তা দাবি করবারও আর সাহস নেই–তাদের দাবি সম্বন্ধে সমাজকে সচেতন করবার এমন সার্থক প্রয়াস শরৎচন্দ্রের পূর্বে বাংলা কথাসাহিত্যে কেউ করেছেন বলে আমার জানা নেই। ‘মহেশ’, ‘অভাগীর স্বর্গ’ প্রভৃতি গল্পে তিনি কার্ল মার্ক-বর্ণিত নিঃস্ব সম্প্রদায়ের চিত্র এঁকেছেন, কিন্তু যে-সকল নারী দৈবাৎ কোন কারণে নৈতিক চরিত্রের আদর্শ হতে বিন্দুমাত্রও ভ্রষ্ট হয়েছে বলে হিন্দুসমাজে স্থান পায়নি এবং বাংলা কথাসাহিত্যের সম্রাট বঙ্কিমচন্দ্রও রোহিণীর ন্যায় যে-শ্রেণীর নারীর মৃত্যু ছাড়া আর কোন পরিণতি কল্পনা করতে পারেননি, সেই শ্রেণীর সাবিত্রীকে তিনি এমনভাবে আমাদের সামনে তুলে ধরেছেন যাতে আমাদের মনে এই কর্তব্যবোধ জেগে ওঠে যে, প্রথম শ্রেণীর নিঃস্বের ন্যায় এই দ্বিতীয় শ্রেণীর নিঃস্বও মানুষের অধিকার দাবি করতে পারে। আনুষ্ঠানিকভাবে সতীত্বের মর্যাদা রক্ষা করলেই শুধু সেই কারণে শরৎচন্দ্রের ‘সতী’ গল্পের নায়িকা নির্মলা নারীর মহিমা ও মর্যাদার পূর্ণ অধিকার লাভ করে। কিন্তু, দৈবাৎ মুহূর্তের ভ্রমে এই সতীত্বের আদর্শ থেকে বিন্দুমাত্র ভ্রষ্ট বলেই, বহু গুণ থাকা সত্ত্বেও সাবিত্রীর ন্যায় নারী সমাজে স্থান পায় না–এই। অন্যায় বৈষম্যের ও অবিচারের নগ্নচিত্র আমাদের সামনে তুলে ধরে অপূর্ব। শিল্পকৌশল তিনি আমাদের বিবেক ও মনুষ্যত্বকে শাস্ত্র ও সংস্কারের কঠিন মোহ ও নিগড়বন্ধন থেকে মুক্ত করতে চেষ্টা করেছেন। শরৎচন্দ্রের যুগের অনেক লব্ধপ্রতিষ্ঠ সাহিত্যিক শরৎচন্দ্রের উপন্যাসকে ‘গণিকা সাহিত্য বলে নিন্দা করেছেন। প্রবাসী’, ‘সাহিত্য ও ভারতবর্ষ’ প্রভৃতি প্রসিদ্ধ পত্রিকার সম্পাদকেরা শরৎচন্দ্রের চরিত্রহীন’ উপন্যাস ছাপতে অস্বীকার করেন এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে ডি. লিট উপাধি দ্বারা সম্মানিত করার প্রস্তাবে বাংলা সাহিত্যবিভাগ থেকেই। সবচেয়ে প্রবল আপত্তি উঠেছিল। তবু যে আমি শরৎচন্দ্রকে অকুণ্ঠচিত্তে শ্রদ্ধা করি তার প্রধান কারণ, তিনিই সর্বপ্রথম হিন্দুসমাজের এই নৈতিক নিঃস্বশ্রেণীর প্রতি আমাদের কর্তব্যবোধকে জাগ্রত করার চেষ্টা করেন এবং কথাসাহিত্যের মাধ্যমে তারস্বরে ঘোষণা করেন

“শোনরে মানুষ ভাই
সবার উপরে মানুষ সত্য তাহার উপরে নাই।”[১০]

৩. এই যুগের অন্যান্য সাহিত্যিক

পূর্বেই বলিয়াছি রবীন্দ্রযুগে আরও অনেক খ্যাতনামা লেখক সাহিত্যের নানা বিভাগে প্রসিদ্ধি লাভ করিয়াছিলেন। ইহাদের মধ্যে কয়েকজনের নাম এই গ্রন্থের তৃতীয় খণ্ডে আলোচনা করিয়াছি।

কবিতা ও সঙ্গীত

এই যুগের কবিদের মধ্যে দ্বিজেন্দ্রলাল রায় (১৮৬৩-১৯১৩) বিশেষ প্রসিদ্ধ। তাঁহার হাস্যরসযুক্ত কবিতা ও সঙ্গীত, বিশেষতঃ তাঁহার দেশপ্রেমের কবিতা ও সঙ্গীতগুলি রবীন্দ্রনাথের এই শ্রেণীর কবিতাগুলির ন্যায় জনপ্রিয় হইয়া উঠিয়াছিল। ‘বঙ্গ আমার জননী আমার ধাত্রী আমার দেশ ইত্যাদি গান বঙ্গসাহিত্যের অক্ষয় সম্পদ। তাঁহার কাব্যগ্রন্থ ‘ম’ ও ‘আষাঢ়ে’ দুইখানি প্রসিদ্ধ কবিতাগ্রন্থ।

অন্যান্য কবিদের মধ্যে রজনীকান্ত সেন (১৮৬৫-১৯১০) হাস্যরসাত্মক, স্বদেশী ও ভক্তিমূলক সঙ্গীতরচনার জন্য প্রসিদ্ধ ছিলেন।

লক্ষ্ণৌ-প্রবাসী অতুলপ্রসাদ সেন (১৮৭১-১৯৩৪) তাহার সঙ্গীতের জন্য যে খ্যাতি ও প্রসিদ্ধি লাভ করিয়াছিলেন আজও তাহা অক্ষুণ্ণ আছে।

অন্যান্য কবিদের মধ্যে সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত (১৮৮২-১৯২২) স্বরচিত কবিতা ও বিদেশী কবিতা অনুবাদের জন্য প্রসিদ্ধ।

এই যুগের অন্যান্য কবিদের মধ্যে

দেবেন্দ্রনাথ সেন (১৮৫৫-১৯২০) করুণানিধান বন্দ্যোপাধ্যায় (১৮৭৭-১৯৫৫) যতীন্দ্রমোহন বাগচী (১৮৭৮-১৯৪৮) কুমুদরঞ্জন মল্লিক (১৮৮২-১৯৭০) কালিদাস রায় (১৮৮৮-১৯৭৫) মোহিতলাল মজুমদার (১৮৮৮-১৯৫২) বিশেষ প্রসিদ্ধ। কাজী নজরুল ইসলাম এখনও অসুস্থ অবস্থায় জীবিত আছেন।[১১] তাঁহার কবিতা ও সঙ্গীত দুই-ই বিশেষ উপভোগ্য।

নাটক

অভিনেতা ও নাট্যকার গিরিশচন্দ্র ঘোষ (১৮৪৪-১৯১২) ও অমৃতলাল বসুর (১৮৫৩-১৯২৯) কথা তৃতীয় খণ্ডে আলোচিত হইয়াছে। আলোচ্য যুগেও গিরিশচন্দ্রের নাট্যরচনা অব্যাহত ছিল। নাটকের সংখ্যা, বৈচিত্র্য ও রচনার উৎকর্ষের জন্য গিরিশচন্দ্র জীবিতকালে বাংলাসাহিত্যে সর্বশ্রেষ্ঠ নাট্যকার বলিয়া বিবেচিত হইতেন, কিন্তু তাঁহার এই যশ “সমসাময়িক কালের গণ্ডী উত্তীর্ণ হইয়া আসিতে পারে নাই।”[১২]

আলোচ্য যুগের শ্রেষ্ঠ নাট্যকার দ্বিজেন্দ্রলাল রায় সম্বন্ধে তৃতীয় খণ্ডে আলোচনা করা হইয়াছে। তাহার ঐতিহাসিক, সামাজিক এবং পৌরাণিক নাটক ও প্রহসনের মধ্যদিয়া “নাট্য সাহিত্যের আধুনিক যুগের সকল বৈশিষ্ট্য পরিপূর্ণ মাত্রায় প্রকাশ পাইয়াছে। রচনার আঙ্গিক, ভাষা ও ভাবের দিক হইতে তিনি বাংলা নাটকের মধ্যে সম্পূর্ণ নূতনত্বের সৃষ্টি করিলেন।”[১৩]

অপরেশচন্দ্র মুখোপাধ্যায় (১৮৭৫-১৯৩৪) সুদক্ষ অভিনেতা ও নাট্যকার ছিলেন। তাঁহার রচিত কর্ণার্জুন’ (১৯২৩) ও যোগেশচন্দ্র চৌধুরীর (১৮৮৯-১৯৪১) সীতা’ নাটক কলিকাতার রঙ্গমঞ্চে বিশেষ জনপ্রিয় হইয়াছিল। শচীন্দ্রনাথ সেনগুপ্ত (১৮৯২-১৯৬১) কয়েকখানি রাজনীতিক ও সামাজিক নাটক রচনা করেন। শ্ৰীমন্মথ রায় (১৮৯৯) একাঙ্ক নাটকের স্রষ্টা ও অনেকগুলি একাঙ্ক নাটক রচনা করিয়াছেন। তিনি পঞ্চাঙ্ক ঐতিহাসিক নাটক ‘অশোক’ রচনা করিয়াছিলেন, কিন্তু নাটক হিসাবে উৎকৃষ্ট হইলেও রঙ্গমঞ্চে ইহা বিশেষ সফলতা লাভ করে নাই।

বনফুল’ (১৮৯৯) নামে প্রসিদ্ধ শ্রীবলাইচাঁদ মুখোপাধ্যায় মধুসূদন দত্ত ও ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের জীবনী অবলম্বনে নাটক রচনা করিয়া এক নূতন শ্রেণীর নাট্যগ্রন্থের অবতারণা করেন।

প্রহসনের মধ্যে রবীন্দ্রনাথ মৈত্রের মানময়ী গার্লস স্কুল এবং শ্রীপ্রমথনাথ বিশীর (১৯০১) ঋণৎ কৃত্বা’ (১৯৩৫) ও ‘গৃতং পিবেৎ’ (১৯৩৬) বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। সমসাময়িক অবস্থান অবলম্বন করিয়া রচিত শ্রীবিজন ভট্টাচার্যের নবান্ন (১৯৪৪) ও জনপদ’ (১৯৪৫) নামক দুইখানি নাটক অভিনব পথের প্রদর্শক।

ছোটগল্প ও উপন্যাস

বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যার সামাজিক চিত্র হিসাবে রবীন্দ্রনাথের সমসাময়িক যতীন্দ্রমোহন সিংহ (১৮৫৮-১৯৩৭) ধ্রুবতারা’ (১৯০৭), ‘বেহার চিত্র’ (১৯২১) ও উড়িষ্যার চিত্র (১৯০০)- এই তিনখানি উপন্যাস রচনা করিয়াছিলেন। ইহার মধ্যে ধ্রুবতারা এককালে বিশেষ প্রসিদ্ধি লাভ করিয়াছিল।

পরবর্তীকালে প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায় (১৮৭২-১৯৩১) ছোটগল্প ও উপন্যাস লিখিয়া যশস্বী হইয়াছিলেন। প্রথমে রবীন্দ্রনাথের প্রভাব থাকিলেও ক্রমে তিনি ইহা অতিক্রম করিয়া স্বকীয় বৈশিষ্ট্যে প্রতিষ্ঠালাভ করিয়াছিলেন। তাঁহার দুইখানি ছোটগল্পের বই ‘সোড়শী (১৯০৬) এবং দেশী ও বিলাতী’ (১৯১০) এককালে খুব সমাদর লাভ করিয়াছিল। শেষোক্ত গ্রন্থখানিতে বিলাতপ্রবাসী বাঙ্গালী ছাত্রের চিত্র বাংলা গল্পসাহিত্যে বিষয়বস্তু হিসাবে অভিনব বলা যাইতে পারে। তাহার উপন্যাসের মধ্যে নবীন সন্ন্যাসী’ (১৯১২), রত্নদ্বীপ’ (১৯১৫) ও ‘সিঁদুর কৌটা’ (১৯১৯) বিশেষ উল্লেখযোগ্য।

ছোটগল্প ও উপন্যাস রচনার জন্য চারুচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় (১৮৭৭-১৯৩৮) এককালে খুব যশস্বী ছিলেন। তাহার দশখানি উপন্যাসের বিষয়বস্তু বিদেশী গ্রন্থ হইতে গৃহীত। মৌলিক উপন্যাসের মধ্যে পরগাছা’ (১৯১৭) প্রভৃতি কয়েকখানি গ্রন্থ খুবই সমাদৃত এবং পঙ্কতিলক’ (১৯১৯) যৌন আবেদনের ইঙ্গিতপূর্ণ হওয়ায় খুবই নিন্দিত হইয়াছিল। তিনি অনেকগুলি উপন্যাস ও ছোটগল্প রচনা করেন। তাঁহার ‘দুই তার’ (১৯১৮) এবং হেরফের’ উপন্যাস রবীন্দ্রনাথের নিকট হইতে প্রাপ্ত প্লট বা কাহিনী অবলম্বনে লিখিত।

বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় (১৮৯৪-১৯৫০) বহু ছোটগল্প ও উপন্যাস লিখিয়া যশস্বী হইয়াছেন। পথের-পাঁচালী’ (১৯২৯) উপন্যাসখানি তাঁহাকে অক্ষয় কীর্তি দান করিয়াছে। ইহার অনুবৃত্তি ‘অপরাজিত’ (১৯৩২), আরণ্যক (১৩৪৫), ‘আদর্শ হিন্দু হোটেল’ (১৩৪৭) ও আরও অনেক উপন্যাস রচনা করিয়াছেন। পল্লীগ্রামের চিত্র ও সমাজ তাহার উপন্যাসে উজ্জ্বল হইয়া ফুটিয়া উঠিয়াছে।

শ্ৰীমনীন্দ্রলাল বসুর (১৮৯৭) রমলা’ (১৩৩০) নবীন রোমান্টিক লেখকদের সর্বাপেক্ষা উল্লেখযোগ্য উপন্যাস।

গোকুলচন্দ্র নাগ (১৮৯৪-১৯২৫) বাংলাসাহিত্যে আধুনিকতার পত্তনকারীদের অন্যতম। ১৩৩০ সালে গোকুলচন্দ্র ও ছোটগল্পের লেখক দীনেশরঞ্জন দাশ (১৮৮৮-১৯৪১) কল্লোল’-নামক যে পত্রিকাটি বাহির করেন তাহা সাত বৎসর ধরিয়া “আধুনিক সাহিত্যের ঘাঁটি আগলাইয়া ছিল”।১৪ শ্ৰীশৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায় (১৯০০) ও মণিলাল গঙ্গোপাধ্যায় (১৮৮৮-১৯২৯) প্রসিদ্ধ রোমান্টিক লেখক ছিলেন।

প্রমথনাথ চৌধুরী (১৮৬৮-১৯৪৬) কয়েকটি প্রবন্ধ ও উৎকৃষ্ট গল্প লেখেন। কিন্তু ‘সবুজপত্রে’র সম্পাদক এবং সাহিত্যে সাধুভাষার পরিবর্তে চলিতভাষার প্রবর্তনের আন্দোলনের নেতা হিসাবেই তিনি প্রসিদ্ধি লাভ করেন।

তাঁহার এই আন্দোলন যে ফলপ্রসূ হইয়াছে তাহাতে সন্দেহ নাই, কিন্তু একথা অনেকেই ভুলিয়া যান অথবা জানেন না যে তাঁহার পূর্বে স্বামী বিবেকানন্দ চলিত ভাষায় উৎকৃষ্ট গ্রন্থ লিখিয়াছিলেন।

নরেশচন্দ্র সেনগুপ্ত (১৮৮২-১৯৪১) অনেকগুলি সুপাঠ্য গল্প ও উপন্যাস রচনা করেন। ইহাদের মধ্যে ‘শুভা’ (১৯২০), শান্তি’ (১৯২১) ও পাপের ছাপ’ (১৯২২) এই তিনখানি উপন্যাস সম্বন্ধে একজন বিশিষ্ট সমালোচক লিখিয়াছেন যে, “যৌন ভাবাশ্রিত ক্রিমিন্যাল মনোবৃত্তির চিত্রণ বাংলা উপন্যাসে এই প্রথম।”১৫ এই যুগে বঙ্গসাহিত্যে বস্তুতন্ত্রতা বা বাস্তবপ্রবণতা নামে এক অভিনব আন্দোলন হয়। যৌন আবেদন ও সমাজের কুৎসিত অবজ্ঞাত ও ছায়াচ্ছন্ন অংশের দিকেই নিবদ্ধদৃষ্টি ইহার মূল। পূর্বোক্ত সমালোচকের মতে “এই বাস্তব বিলাসিতার বা বাস্তব দৃষ্টির প্রথম উন্মোচন ভারতী’র আসরে লালন খানিকটা নারায়ণের পৃষ্ঠায়। স্পষ্ট যৌন আবেগমূলক রোচক সাহিত্যের গুরু হইলেন শ্রীযুক্ত নরেশচন্দ্র সেনগুপ্ত।১৬ এই নেতা নরেশচন্দ্রের তরুণ অনুবর্তীরাই কল্লোল যুগ’ এই নূতন সাহিত্যিক গোষ্ঠী নামে খ্যাতি বা কুখ্যাতি লাভ করে। স্পষ্ট যৌন আবেগমূলক রচনার প্রাধান্য স্থাপনই ছিল ইহার লক্ষ্য। এককালে খুব সোরগোল সৃষ্টি করিলেও সমষ্টিগত আন্দোলন হিসাবে ইহার অস্তিত্ব লুপ্ত হইয়াছে। তবে ব্যক্তিগতভাবে এই ভাবের ধারক ও বাহক কোন কোন সাহিত্যিক এখনও বর্তমান আছেন।

শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায় (১৮৯৯-১৯৭০) ডিটেকটিভ গোয়েন্দা উপন্যাস লিখিয়া প্রসিদ্ধি লাভ করিয়াছেন। তিনি কয়েকখানি উৎকৃষ্ট ঐতিহাসিক ও সামাজিক উপন্যাসও লিখিয়াছেন।

কেদারনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় (১৮৬৯-১৯৪৯) মধ্যবিত্ত বাঙ্গালীর জীবনযাত্রা অবলম্বনে এক বিশিষ্ট সরস রচনাভঙ্গীতে কয়েকখানি উপন্যাস ও ছোটগল্প লিখিয়াছেন।

প্রবোধকুমার সান্যাল (১৯০৭) (গল্প, উপন্যাস, স্মৃতিকথা, ভ্রমণকাহিনী প্রভৃতি বিষয়ে) প্রায় ৭০খানি গ্রন্থ লিখিয়াছেন।

সরস ব্যঙ্গগল্প রচনায় রাজশেখর বসু (১৮৮০-১৯৬০) অসাধারণ দক্ষতার পরিচয় দিয়াছেন। গড্ডলিকা’ (১৯২৪), কজ্জলী’ (১৯২৭) ও হনুমানের স্বপ্ন (১৯৩৭) প্রভৃতি রচনায় সহজ ও সরস ভঙ্গীতে বাঙ্গালীর চরিত্রের অনেক দিক ব্যঙ্গরসে উজ্জ্বল হইয়া ফুটিয়াছে। পরিমল গোস্বামীও (১৮৯৯) সরস কৌতুকপূর্ণ গল্প ও নাট্য রচনায় দক্ষতার পরিচয় দিয়াছেন।

আলোচ্য যুগের শেষভাগে আরম্ভ করিয়া যাহারা পরবর্তীকালে বিশেষ খ্যাতি অর্জন করিয়াছেন তাহাদের মধ্যে কয়েকজন বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় (১৮৯৮-১৯৭১) রাইকমল’ (১৯৩৫) হইতে আরম্ভ করিয়া হাঁসুলী বাঁকের উপকথা (১৯৪৭) এবং এ দুইয়ের মধ্যে বহু গল্প ও উপন্যাস লিখিয়া পাঠকসমাজে সুপ্রতিষ্ঠিত হন এবং পরবর্তীকালে তিনি আরও খ্যাতি অর্জন করেন। বনফুল’ এই ছদ্মনামে পরিচিত শ্রীবলাইচাঁদ মুখোপাধ্যায় (১৮৯৯) শ্ৰীঅন্নদাশঙ্কর রায় (১৯০৪), শ্রীপ্রমথনাথ বিশী (১৯০১) ও শ্রীবিভূতিভূষণ মুখোপাধ্যায় (১৮৯৩) প্রভৃতি লেখক বহুকাল পূর্বে লব্ধপ্রতিষ্ঠ হইয়াও এখনও সাহিত্যচর্চায় নিযুক্ত আছেন।

আলোচ্য যুগে সর্বপ্রথম বাংলাভাষায় আধুনিক বিজ্ঞানসম্মত প্রণালীতে ঐতিহাসিক গ্রন্থ রচিত হয়। রমাপ্রসাদ চন্দ্র প্রণীত ‘গৌড়রাজ মালা ও অক্ষয়কুমার মৈত্রেয় প্রণীত ‘গৌড় লেখমালা’ এই উভয় গ্রন্থই ১৩১৯ সালে রাজসাহীর বরেন্দ্র অনুসন্ধান সমিতি’ নামক গবেষণামূলক প্রতিষ্ঠান হইতে প্রকাশিত হয়। প্রথম গ্রন্থে হিন্দুযুগে বাংলার রাজনৈতিক ইতিহাস ও দ্বিতীয় গ্রন্থে ইহার প্রধান উপকরণ প্রাচীন শিলালিপি ও তাম্ৰশাসনগুলির মূল ও অনুবাদ প্রকাশিত হয়। ইহার অল্পকাল পরেই রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায় (১৮৮৬-১৯৩০) প্রথমে হিন্দুযুগের ও পরে মুসলমান যুগের ইতিহাস রচনা করেন। প্রাচীন মুদ্রা ভারতের ইতিহাসের একটি প্রধান উপকরণ। রাখালদাস প্রাচীন মুদ্রা নামে এই বিষয়ে বাংলাভাষায় সর্বপ্রথম গ্রন্থ রচনা করেন। রাখালদাস বঙ্গভাষায় কয়েকখানি উপন্যাস রচনা করেন। ইহাদের মধ্যে সম্রাট শশাঙ্ক, ধর্মপাল ও স্কন্দগুপ্তকে কেন্দ্র করিয়া যে তিনখানি উপন্যাস লিখিয়াছিলেন তাহা তকালে প্রসিদ্ধি লাভ করিয়াছিল। রবীন্দ্রনাথের ‘ঘাটের কথা’ ও ‘রাজপথের কথা’র অনুকরণে রাখালদাস ‘পাষাণের কথা’ নামক গ্রন্থে সহজ ভাষায় অনেক পুরাকাহিনী লিপিবদ্ধ করিয়াছিলেন।

তথ্যনির্দেশ

১. শ্রীসুকুমার সেন, বাঙ্গলা সাহিত্যের ইতিহাস, তৃতীয় খণ্ড (১৩৭৬), পৃ. ১৮

২. শ্রীসুকুমার সেন, বাঙ্গলা সাহিত্যের ইতিহাস, তৃতীয় খণ্ড, পৃ. ১৯-২২

৩. শ্রীসুকুমার সেন, বাঙ্গলা সাহিত্যের ইতিহাস, তৃতীয় খণ্ড, পৃ. ৩৬৫

৪. তদেব, পৃ. ৩৭১-৭২

৫. তদেব, পৃ. ৩৮৭

৬. শ্রীসুকুমার সেন, বাঙ্গলা সাহিত্যের ইতিহাস, তৃতীয় খণ্ড, পৃ. ২৭২

৭. শরৎ সমিতি কর্তৃক ১৯৪৮ সনে প্রকাশিত শরৎ স্মরণিকা’, পৃ. ৩-৯

৮. শরৎ সমিতি কর্তৃক ১৯৪৮ সনে প্রকাশিত শরৎ-স্মরণিকা, ১১-১২

৯. তদেব, পৃ. ১

১০. তমলুকে নিখিল ভারত বঙ্গ সাহিত্য সম্মেলনের ৪৬তম অধিবেশনে পঠিত এবং ইহার স্মারক গ্রন্থের (১৯৭৪) ২৫-২৬ পৃষ্ঠায় মুদ্রিত।

১১. বর্তমানে লোকান্তরিত।

১২. শ্রী আশুতোষ ভট্টাচার্য-বাংলা নাট্য সাহিত্যের ইতিহাস, প্রথম খণ্ড, পৃ. ৩৪২

১৩. তদেব, ২য় খণ্ড, ২৮।

১৪. শ্রীসুকুমার সেন, বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস’ (৪র্থ খণ্ড), পৃ. ২৯৩

১৫. তদেব, পৃ. ২৮৯

১৬. শ্রীসুকুমার সেন, বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস’, (৪র্থ খণ্ড), পৃ. ২২৭

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *