১২. বাংলা ও ভারতের রাজনীতি (১৯২৫-৩৫)

দ্বাদশ অধ্যায় – বাংলা ও ভারতের রাজনীতি (১৯২৫-৩৫)

১. রাজনীতিক দল

চিত্তরঞ্জন দাশের মৃত্যুর পর স্বরাজ্য দলের এক অধিবেশনে তাহার ফরিদপুর অভিভাষণের সম্পূর্ণ সমর্থন এবং বার্কেহেডের মনোভাবে অসন্তোষ জ্ঞাপন করিয়া এক প্রস্তাব গৃহীত হইল। কিন্তু ইতিমধ্যেই গান্ধীর মত সম্পূর্ণ পরিবর্তিত হইল এবং তিনি পুনরায় কংগ্রেসকে রাজনীতিক আন্দোলনের প্রধান কেন্দ্ররূপে প্রতিষ্ঠার সংকল্প গ্রহণ করিলেন। ইহার ফলে সংগঠনমূলক কার্য (সূতাকাটা, খদ্দরবোনা) একটি সম্পূর্ণ পৃথক অথচ কংগ্রেসের অধীনস্থ একটি কমিটির হাতে ন্যস্ত হইল এবং স্বারাজ্য দলের রাজনীতিক আদর্শ ও উদ্দেশ্যই এখন কংগ্রেস পুরাপুরি গ্রহণ করিল।

কিন্তু দুঃখের বিষয়, স্বরাজ্য দলের মধ্যেই ভাঙ্গন ধরিল। একদল স্থির করিল, সম্পূর্ণ অসহযোগনীতির পরিবর্তে বালগঙ্গাধর তিলকের নীতিই অনুসরণ করিবে অর্থাৎ গভর্নমেন্টের যেসব কার্যাবলী দেশের পক্ষে কল্যাণকর তাহা সমর্থন করিবে এবং অনিষ্টকর কার্যের প্রতিবাদ করিবে-সঙ্গে সঙ্গে পূর্ণ স্বরাজের দাবিও অব্যাহত রাখিবে। ইহাকে সুবিধাবাদীর দল’ (Responsive Co-operation) বলা যাইতে পারে। এইরূপে কংগ্রেসের সদস্যগণ পুনরায় দুইটি দলে বিভক্ত হইল-স্বরাজ্য ও সুবিধাবাদী। অবিলম্বে মুসলমানেরা স্থির করিল, তাহারা হিন্দুর সহিত মিলিত হইয়া অসহযোগ আন্দোলন করিবে না, এবং নূতন শাসনপদ্ধতি গ্রহণ করিবে। সঙ্গে সঙ্গে একদল হিন্দু প্রচার করিল, যদি মুসলমানেরা গভর্নমেন্টের সঙ্গে যোগ দেয় এবং হিন্দুরা অসহযোগ করে, তাহা হইলে পরিণামে হিন্দুদের স্বার্থহানি হইবার সম্পূর্ণ সম্ভাবনা। সুতরাং হিন্দু মহাসভাও একটি রাজনীতিক দল হিসাবে পরিগণিত হইল।

১৯২৬ সনের নির্বাচনে বিধানসভায় তিনদলের সদস্য দেখা গেল–স্বরাজ্য, সুবিধাবাদী ও মুসলীম লীগ। বাংলা দেশে মুসলীম লীগের সহায়তায় গভর্নমেন্ট ১৯১৯ সনের ভারতীয় শাসন-সংস্কার অনুযায়ী মন্ত্রীবর্গের সাহায্যে শাসনকার্য চালাইতে লাগিল। ইহার বিবরণ পরে দেওয়া হইবে।

২. সাম্প্রদায়িক বিরোধ

গান্ধীজি খিলাফত আন্দোলনে যোগ দিয়া হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে মিলনের সেতু গড়িবার প্রয়াস করিয়াছিলেন। তুরস্ক কর্তৃক খলিফার পদটি অর্থাৎ খিলাফৎ বিলোপ করার সঙ্গে সঙ্গে এই আন্দোলন বালির বাঁধের ন্যায় ধসিয়া পড়িল এবং হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে সাম্প্রদায়িক বিরোধ ও দাঙ্গা-হাঙ্গামা পূর্বের ন্যায় আবার দেখা দিল। পূর্বের মতোই মহরমের শোভাযাত্রা উপলক্ষে হিন্দুর চোখে পবিত্র অশ্বথগাছের ডাল কাটা, মসজিদের সম্মুখে সঙ্গীত এবং ঈদ-পরব উপলক্ষে প্রকাশ্য স্থানে গোহত্যা ও বাদ্য প্রভৃতি লইয়াই এইসব দাঙ্গা-হাঙ্গামা আরম্ভ হইত, উপরন্তু তাহা মাঝে মাঝে গুরুতর আকার ধারণ করিত। তবে ইহার মুখ্য কারণ– পরস্পরের প্রতি অবিশ্বাস ও দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে শিক্ষা, সংস্কৃতির পার্থক্য ও গুরুতর অর্থনীতিক বৈষম্য। মুসলমানেরা তানজিম’ ও ‘তাবলিখ’ নামে দুইটি সাম্প্রদায়িক আন্দোলন আরম্ভ করিল। ইহার জবাবে হিন্দুদের দ্বারা শরীরচর্চা ও অস্পৃশ্যতা দূর করিবার জন্য সংগঠন, ধর্মান্তরিত হিন্দুদের পুনরায় হিন্দুধর্মে ফিরাইয়া আনিবার জন্য ‘শুদ্ধি আন্দোলন শুরু হইল। ১৯২৩ সনে প্রায় সাড়ে চারি লক্ষ মালকানা রাজপুত-যাহাদের পূর্বপুরুষ ইসলামধর্ম গ্রহণ করিয়াছিল– পুনরায় হিন্দুধর্মে ফিরিয়া আসিল। মুসলমানদের বিশ্বাস হইল, এইগুলির উদ্দেশ্য সামাজিক সংস্কার নহে, মুসলমানদের সহিত সংগ্রামে হিন্দুর আত্মরক্ষার শক্তি বৃদ্ধি করা।

উভয় সম্প্রদায়ের নেতৃবর্গ এই সাম্প্রদায়িক বিরোধ মিটাইবার জন্য সচেষ্ট হন। ডা. আনসারি ও লালা লাজপৎ রায় একটি জাতীয় চুক্তিপত্রে (Indian National Pact) এবং চিত্তরঞ্জন দাশ শুধু বাংলার জন্য এরূপ একটি চুক্তিপত্রের (Bengal Pact) খসড়া করেন। দুইটি চুক্তিপত্রই কোকনদ কংগ্রেস অধিবেশনে (১৯২৩) আলোচিত হয়। জাতীয় চুক্তিপত্রটি পুনরায় আলোচনার জন্য একটি সমিতি গঠিত হয়, কিন্তু বাংলার চুক্তিপত্র চারিঘণ্টা তর্কবিতর্কের পর অগ্রাহ্য করা হয়। ইহার বিপক্ষে ছিল ৬৭৮ ভোেট এবং সপক্ষে মাত্র ৪৫৮ ভোট।

বাংলা-চুক্তির প্রধান শর্তগুলি : (১) ব্যবস্থাপকসভায় লোকসংখ্যা অনুসারে সদস্যসংখ্যা নির্ধারিত হইবে এবং প্রতি সম্প্রদায় স্বতন্ত্রভাবে সদস্য নির্বাচন করিবেন।

(২) স্থানীয় স্বায়ত্তশাসন প্রতিষ্ঠানগুলিতে সংখ্যাগরিষ্ঠ ও সংখ্যালঘিষ্ঠ সম্প্রদায়ের প্রতিনিধির সংখ্যা যথাক্রমে লোকসংখ্যার শতকরা ৬০ ও ৪০ ভাগ নির্দিষ্ট হইবে।

(৩) মসজিদের সম্মুখে গীতবাদ্য নিষিদ্ধ হইবে।

(৪) ধর্মানুষ্ঠানের জন্য গোহত্যা নিষিদ্ধ হইবে না এবং কেহ তাহাতে কোনপ্রকার বাধা দিবে না।

(৫) এইসব শর্ত যাহাতে যথাযথ প্রতিপালিত হয় তাহা দেখিবার জন্য প্রতি মহকুমায় একটি সমিতি গঠিত হইবে–এই সমিতির অর্ধেক সদস্য হিন্দু ও অর্ধেক মুসলমান হইবে।

ইহার বিনিময়ে ব্যবস্থাপকসভার মুসলমানসদস্যেরা স্বরাজ্য দলের পক্ষে ভোট দিবে। বিশেষতঃ মন্ত্রীর বেতন হ্রাস ও জাতীয় দাবি পূরণ না-হওয়া পর্যন্ত গভর্নমেন্টের সমস্ত প্রস্তাব এবং বাজেট অগ্রাহ্য হইবে অথবা স্থগিত থাকিবে।

১৯২৩ সনে কোকনদ কংগ্রেসে গৃহীত না হইলেও সিরাজগঞ্জে বাংলা প্রাদেশিক কনফারেন্সে বাংলা-চুক্তি গৃহীত হয় (১৯২৪ মে-জুন)। গান্ধী, লাজপৎ রায়, মদনমোহন মালব্য প্রভৃতি নেতাদের “ঘোর আপত্তি ও সতর্কবাণী সত্ত্বেও চিত্তরঞ্জন “স্বরাজের পথে জাতির অগ্রগতিতে ইহার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করিয়াছিলেন। হিন্দুসম্প্রদায়ের আপত্তি ও অসন্তোষ সৃষ্টি ছাড়াও সিরাজগঞ্জে এই প্রস্তাব গ্রহণের বিরুদ্ধে একটি প্রবল যুক্তি ছিল এই যে, যেহেতু প্রাদেশিক কনফারেন্স কংগ্রেসেরই শাখাবিশেষ, সেইহেতু যে-প্রস্তাব কংগ্রেস অধিবেশনে অগ্রাহ্য হইয়াছে তাহা প্রাদেশিক সম্মেলনে গৃহীত হওয়া অসঙ্গত। এ যুক্তির সারবত্তা অস্বীকার করা কঠিন। সুতরাং বাংলার চুক্তিতে যে হিন্দুর জনমত গুরুতরভাবে ক্ষুব্ধ হইয়াছিল তাহাতে আশ্চর্য হইবার কিছুই নাই। বরং ইহাতে যে সিরাজগঞ্জে হিন্দুসদস্যেরা সম্মতি দিয়াছিলেন তাহাই আশ্চর্যের বিষয় এবং চিত্তরঞ্জনের অসাধারণ ব্যক্তিত্বের প্রভাব সূচিত করে, তাহাতে কোন সন্দেহ নাই।

৩. কংগ্রেস

নাগপুর কংগ্রেস অধিবেশনে চিত্তরঞ্জন দাশ গান্ধীজির অসহযোগ আন্দোলনে যোগ দেওয়ার ফলে গান্ধীর নেতৃত্ব সুপ্রতিষ্ঠিত হইল। নেহেরু মন্তব্য করিয়াছিলেন, অতঃপর গান্ধীই কংগ্রেসের চিরস্থায়ী অধিনায়ক (Permanent Super-President of the Congress), এবং অর্ধনগ্ন বিনম্র সাধু হইলেও ভারতের রাজনীতিক সম্রাটের (imperious) পদে উন্নীত হইলেন। চিত্তরঞ্জন ও মতিলাল নেহেরু সাময়িকভাবে তাঁহার বিরোধী হইলেও পরিণামে তাঁহারা প্রায় আজ্ঞাবহ সেবকে পরিণত হইয়াছিলেন। চিত্তরঞ্জনের মৃত্যুর পর গান্ধী অবিসংবাদিতভাবে সর্বভারতের রাজনীতিক পদ অধিকার করিয়াছিলেন। ইহার বিস্তৃত বিবরণ বর্তমান গ্রন্থে অপ্রাসঙ্গিক–সুতরাং, বাংলা দেশের উপর তাঁহার প্রভাবই আলোচিত হইবে।

ভারতের জাতীয় কংগ্রেসকে পুরাপুরি গণতান্ত্রিক রূপ দিবার জন্য কংগ্রেসের গঠনপ্রণালীর কিছু কিছু পরিবর্তন করা হয়। ইহার মধ্যে এখানে কয়েকটির উল্লেখ করিতেছি।

(১) প্রতি পঞ্চাশ হাজার অধিবাসী কংগ্রেসের একজন প্রতিনিধি (delegate) নির্বাচিত করিবে।

(২) কংগ্রেসের সদস্যপদের জন্য বার্ষিক চারি আনা চাঁদা দিতে হইবে। (৩) প্রতি জিলায় একটি কংগ্রেস কমিটি গঠিত হইবে।

(৪) রাজ্যশাসনে মন্ত্রীগোষ্ঠীর (Cabinet) অনুরূপ প্রতি বৎসর কংগ্রেসের একটি কার্যকরী সমিতি (Working Committee) নির্বাচিত হইবে।

চিত্তরঞ্জন বাংলা দেশে অনেকাংশে এইসব পরিবর্তন আনিয়াছিলেন, এখন সর্বভারতে তাহা গৃহীত হইল। এইসব কমিটির সংখ্যা ছিল চারিটি (১৯১৮)। ক্রমে তাহা বাড়িয়া এই নূতন নিয়ম অনুসারে ১৯১৯ সনে ১৬টি এবং ১৯২১ সনে ২৯টি হইল। নিখিল ভারতীয় কংগ্রেস কমিটির (A. I. C. c.) প্রতিনিধি আগে কলিকাতা হইতেই বেশীর ভাগ নির্বাচিত হইত। কিন্তু ক্রমশঃই মফঃস্বল হইতে নির্বাচিতের সংখ্যা বাড়িতে লাগিল। ১৯২১ সনে ২৫ জনের মধ্যে ২১ জনই কলিকাতা হইতে নির্বাচিত হইয়াছিল-ক্রমে ইহার সংখ্যা দাঁড়াইল ১৯২২ সনে। ৪৮ জনের মধ্যে ২৭ জন এবং ১৯২৩ সনে ৪৮ জনের মধ্যে ২৫ জন। এই প্রসঙ্গে উল্লেখ করা আবশ্যক যে মোটামুটিভাবে কলিকাতা ও মফঃস্বলের কংগ্রেসকর্মীদের মধ্যে একটু রেষারেষির ভাব ছিল (যেমন সাধারণতঃ পশ্চিম ও পূর্ববঙ্গের মধ্যে দেখা যায়)। নৃপেন্দ্রচন্দ্র ব্যানার্জী–যিনি উচ্চ সরকারী চাকুরীতে ইস্তফা দিয়া চিত্তরঞ্জনের আহ্বানে অসহযোগ আন্দোলনে যোগ দিয়াছিলেন–তিনি তাঁহার আত্মজীবনীতে কলিকাতায় কংগ্রেসের নেতাগণকে লক্ষ্য করিয়া লিখিয়াছেন, চট্টগ্রামের রেলওয়ে ও ষ্টীমার-কর্মচারীর বন্ধ’-এর (strike) ব্যাপারে কলিকাতার কংগ্রেস দল (Calcutta Congress Coterie) অনেকটা উদাসীন ছিলেন-যদিও সারা পূর্ববঙ্গে ইহা বিষম আলোড়ন সৃষ্টি করিয়াছিল।

৪. রাজনীতিক দল

চিত্তরঞ্জনের মৃত্যুর পর বাংলার তথা ভারতের রাজনীতিতে বিশেষ কয়েকটি পরিবর্তন ঘটে। এ-যাবৎ কংগ্রেসে মোটামুটি দুইটি দলই ছিল। স্বরাজ্য ও দৃঢ় গান্ধীবাদী। কিন্তু ক্রমশঃই দল ও উপদলের সংখ্যা বাড়িয়াই চলিল। দলগুলির সংখ্যা, ইহাদের আদর্শ ও লক্ষ্য, মোটেই স্থিতিশীল ছিল না। অনেক সময় ইহাদের বৈশিষ্ট্য ও পরস্পরের মধ্যে স্বাতন্ত্র প্রভৃতি নির্ণয় করাও বেশ কষ্টসাধ্য ছিল। মডারেট বা নরমপন্থী দল ছাড়া ১৯২০ সনের পূর্বে দক্ষিণপন্থী ও বামপন্থী এই দুইটির প্রভেদই ছিল বিশেষভাবে লক্ষণীয়। অর্থাৎ, যাহারা প্রত্যক্ষভাবে সশস্ত্র বিপ্লবীদলের সদস্য ছিল না–সভা-সমিতি, কংগ্রেস, কাউন্সিল প্রভৃতির সহিত যুক্ত ছিল–তাহারাই ছিল দক্ষিণপন্থী। যাহারা গুপ্ত সমিতির মাধ্যমে হিংসাত্মক পদ্ধতি অনুসরণ করিত তাহাদেরই বলা হইত বামপন্থী। ধীরে ধীরে এই দুইটির মধ্যবর্তী কয়েকটি দলের আবির্ভাব হইল। প্রথমতঃ, সমাজবাদী (Socialists) কংগ্রেসভুক্ত দল কংগ্রেসের মধ্যেই একটি বিশিষ্ট দলরূপে গড়িয়া উঠিল ও তাহা ১৯৩৪ সনে কংগ্রেসের অন্তর্ভুক্ত একটি স্বতন্ত্র উপদলরূপে স্বীকৃতি লাভ করিল। দ্বিতীয়তঃ, রাশিয়ার কমিউনিস্ট নীতির আদর্শে বিশ্বাসী একটি দল কংগ্রেসের মধ্যেই গড়িয়া উঠিল, এবং ক্রমশঃ একটি স্বতন্ত্র কমিউনিস্ট দল মানবেন্দ্রনাথ রায়ের নেতৃত্বে প্রতিষ্ঠিত হইল। ইহা ছাড়াও কলিকাতা এবং পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে কারখানার শ্রমিকদের সঙ্ঘবদ্ধ করিয়া রাজনীতিক নেতারা ছোটখাট দলের সৃষ্টি করিল এবং ১৯২৫ হইতে ১৯৩৫ সনের মধ্যে বহু শ্ৰমিকসঙ্ গড়িয়া উঠিল। ১৯২০-২১ সনে কারামুক্ত বহু বিপ্লবী কমিউনিস্টদের সহিত জাতীয়তাবাদের যোগ করিয়া এরূপ অনেক দল গড়িল–তাহারাও সক্রিয় রাজনীতিতে অংশগ্রহণ করিতে লাগিল।

চিত্তরঞ্জনের মৃত্যুর প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই বাংলার কংগ্রেস দলের ঐক্য বিলুপ্ত হইল। শরৎচন্দ্র বসু ও সুভাষচন্দ্র বসুর দল অনেকটা পূর্বেকার কংগ্রেস হইতে স্বতন্ত্র স্বরাজ্য দলের আদর্শ অনুসরণ করিয়া চলিত। আর একদল নির্বিচারে গান্ধীজির নেতৃত্ব মানিয়া চলিত। কিন্তু ইহাদের মধ্যেও একটি উপদল কেবল গান্ধীর রাজনীতিক নেতৃত্বে এবং অপর একটি দল গান্ধীজির জীবনযাত্রা অর্থাৎ চরকা-কাটা খদ্দর-বোনা নিষ্ঠার সহিত মানিয়া চলিত। প্রথম উপদলে ছিলেন যতীন্দ্রমোহন সেনগুপ্ত, বিধানচন্দ্র রায়, নলিনীরঞ্জন সরকার প্রভৃতি এবং দ্বিতীয় দলে ছিলেন প্রফুল্লচন্দ্র ঘোষ, সুরেশচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় এবং নৃপেন্দ্রচন্দ্র ব্যানার্জী প্রভৃতি।

ইঁহাদের মধ্যে সর্বকনিষ্ঠ সুভাষচন্দ্র বসুই পরবর্তীকালে সর্বভারতীয় নেতৃবর্গের মধ্যে উচ্চস্থান অধিকার করিয়াছিলেন। তিনি ছিলেন সুরেন্দ্রনাথ ব্যানার্জী, বিপিনচন্দ্র পাল, চিত্তরঞ্জন দাশ ও শ্রীঅরবিন্দ ঘোষের শ্রেণীভুক্ত বাংলার শেষ রাজনীতিক নেতা। ভারতের মুক্তিসংগ্রামে তাঁহার অবদান চিরদিন স্বর্ণাক্ষরে লিখিত থাকিবে। মহাত্মা গান্ধীর নিজস্ব গণ্ডীর বাহিরে তিনিই কেবল শেষপর্যন্ত নিজের স্বাতন্ত্র্য বজায় রাখিয়া নিজের মত ও পথ নিজেই সৃষ্টি করিয়াছিলেন। সুতরাং তাহার জীবনী, চরিত্রের বৈশিষ্ট্য ও কর্মপদ্ধতি সম্বন্ধে সাধারণভাবে কিছু বলা একান্ত আবশ্যক।

উড়িষ্যার রাজধানী কটকের প্রসিদ্ধ উকিল জানকীনাথ বসুর ষষ্ঠ ও কনিষ্ঠ পুত্র সুভাষ ১৮৯৭ সনে জন্মগ্রহণ করেন। সুভাষ কলিকাতা প্রেসিডেন্সী কলেজের প্রতিভাবান ছাত্র ছিলেন। ঐ কলেজের একজন ইংরেজ অধ্যাপক ওটেন সাহেবের সঙ্গে কলেজের মধ্যেই ছাত্রদের গোলযোগ হয় এবং ওটেনকে ছাত্র বা ছাত্রেরা প্রহার করে। সুভাষ ছাত্রদলের নেতাহিসাবে কলেজ হইতে বিতাড়িত হন (১৯১৬)। কিন্তু, খুব সম্ভব সার আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের ব্যক্তিগত চেষ্টায় পরে তিনি স্কটিশ চার্চ কলেজে ভর্তি হন (১৯১৭) ও এই কলেজ হইতেই দর্শনশাস্ত্রে অনার্সসহ প্রথম শ্রেণীতে দ্বিতীয় স্থান অধিকার করেন।

পিতার ইচ্ছানুসারে সুভাষচন্দ্র সিভিল সার্ভিস পরীক্ষার জন্য বিলাতে যান (১৯১৯)। বিলাতে পৌঁছিবার আট মাস পরেই ঐ পরীক্ষায় চতুর্থ স্থান অধিকার করেন। তৎপরবর্তী ঘটনাসম্বন্ধে তাঁহার আত্মজীবনীতে যাহা পাওয়া যায় তাহার সারমর্ম দিতেছি।

“১৯২০ সনে আমি ইংলণ্ডে সিভিল সার্ভিস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হই। কিন্তু আমি দেখিলাম যে একসঙ্গে ব্রিটিশ রাজসরকার এবং জন্মভূমির সেবা করা অসম্ভব। সুতরাং, ১৯২১ সনের মে মাসে আমি সরকারী (আই. সি. এস.) চাকরীতে ইস্তফা দিয়া দেশে ফিরিয়া আসিলাম যাহাতে দেশের মুক্তিসংগ্রামে যোগদান করিতে পারি। ১৬ই জুলাই বম্বে পৌঁছিয়াই আমি বিকেলে মহাত্মা গান্ধীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করি। গত কয়েক বৎসর জগতের নানা স্থানে বিপ্লবের গতি ও প্রকৃতি সম্বন্ধে অধ্যয়ন করিয়াছি, এবং মহাত্মা গান্ধী মুক্তিসংগ্রাম কী প্রণালীতে চালাইতে মনস্থ করিয়াছেন সে-সম্বন্ধে একটি স্পষ্ট ধারণা করিবার জন্যই তাঁহার নিকট যাই। কিন্তু তাঁহার সহিত আলাপ করিয়া মনে হইল যে তিনি ঠিক কী পদ্ধতিতে অভীতি লক্ষ্যের দিকে ক্রমশঃ অগ্রসর হইবেন সে-সম্বন্ধে তাহার নিজের মনে কোন স্পষ্ট ধারণা নাই। মহাত্মা আমাকে কলিকাতায় পৌঁছিয়া শ্ৰীচিত্তরঞ্জন দাশের সহিত সাক্ষাৎ করিতে বলিলেন। তাঁহার সহিত আলাপ করিয়া মনে হইল–এই লোকটির কী চাই’ সে-সম্বন্ধে স্পষ্ট ধারণা আছে। তিনি নিজেও সর্বস্ব ত্যাগ করিতে পারেন এবং অপরের নিকট হইতেও যথাসাধ্য দাবি করিতে পারেন। কথাবার্তা যখন শেষ হইল তখন আমি মন স্থির করিয়া ফেলিয়াছি–এতদিনে একজন প্রকৃত নেতা পাইলাম এবং তাঁহাকেই অনুসরণ করিব।”

এই সিদ্ধান্ত অনুসারে চিত্তরঞ্জনের জীবনের শেষদিন পর্যন্ত সুভাষচন্দ্র তাঁহার সর্বাপেক্ষা বিশ্বস্ত কর্মঠ ও অনুরক্ত সহকর্মী ছিলেন–ইহা বলিলে বিশেষ অত্যুক্তি করা হইবে না। এই প্রসঙ্গে ইহাও বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য, বিলাতে থাকিতেই তিনি চিত্তরঞ্জনের প্রতি দেশসেবক হিসাবে গভীর শ্রদ্ধা পোষণ করিতেন এবং তাঁহাকে দুইখানি চিঠি লিখিয়া জানাইয়াছিলেন যে তিনি দেশের কার্যে জীবন উৎসর্গ করিবার ইচ্ছা পোষণ করেন।

ভারতে ফিরিয়া আসিয়া চিত্তরঞ্জনের সঙ্গে সাক্ষাৎ করিবার পর হইতেই অসহযোগ আন্দোলনে অনেক গুরুতর কর্তব্য ও দায়িত্ব সুভাষের উপর অর্পিত হয়। প্রথমেই তিনি জাতীয় কলেজের অধ্যক্ষ নিযুক্ত হন।

ইংলণ্ডের যুবরাজ যখন ভারতে আসেন, বিক্ষোভ হিসাবে তখন ভারতের সমস্ত বড় বড় শহরে হরতাল পালিত হয়। কলিকাতার হরতাল যে পুরাপুরি সার্থক হইয়াছিল তাহার প্রধান কৃতিত্ব সুভাষচন্দ্রেরই প্রাপ্য। চিত্তরঞ্জন যখন কলিকাতা মহানগরীর মেয়র ছিলেন সুভাষচন্দ্র তখন তাহার দক্ষিণহস্তস্বরূপ প্রধান কর্মকর্তার পদে নিযুক্ত ছিলেন।

স্বরাজ্য দলের মুখপত্র Forward’ পত্রিকার সম্পাদকমণ্ডলীর মধ্যেও সুভাষ ছিলেন। উত্তরবঙ্গের বন্যার সময়ও ত্রাণকার্যের পরিচালকরূপে সুভাষকে আমরা

দেখিতে পাই এবং জনসেবার ক্ষেত্রেও তাঁহার অনন্যসাধারণ দক্ষতার পরিচয়ও সমগ্র দেশ উপলব্ধি করে। অসহযোগ আন্দোলনের সময় তিনি কারাগারে চিত্তরঞ্জনের সঙ্গী ছিলেন। বাংলার বিপ্লবীদলের সহিত সুভাষচন্দ্রের সঠিক সম্বন্ধ কী ছিল তাহা বলা কঠিন। এই দলের প্রতি তাঁহার সম্পূর্ণ সহানুভূতি ছিল এরূপ মনে করিবার কারণ থাকিলেও তিনি সক্রিয়ভাবে বিপ্লবীদের সঙ্গে যোগদান করিয়াছিলেন ইহার কোন প্রমাণ পাওয়া যায় না। কিন্তু বিপ্লবীদলের মধ্যে ছদ্মবেশী গুপ্তচরের উক্তির উপর নির্ভর করিয়া গভর্নমেন্ট অন্যান্য বিপ্লবীদের সঙ্গে তাঁহাকেও ১৯২৩ সনের শেষভাগে গ্রেপ্তার করে এবং বিচারে তাঁহার তিন বৎসরের সশ্রম কারাদণ্ড হয়। দণ্ডভোগের অধিকাংশ সময়ই তিনি ব্রহ্মদেশে মান্দালয় জেলে আবদ্ধ ছিলেন। এখানে তিনি জেলে থাকিতেই চিত্তরঞ্জনের মৃত্যু হয়।

চিত্তরঞ্জনের মৃত্যুর পর রাজনীতিক ক্ষেত্রে যেসব বিভিন্ন দলের উদ্ভব হইয়াছিল তাহা পূর্বেই উল্লেখ করিয়াছি। চিত্তরঞ্জনের জীবদ্দশাতেই তাঁহার নিজ দলের কলিকাতা ও মফঃস্বলের সদস্যদের মধ্যে চিরন্তন বিরোধের আভাস পাওয়া গিয়াছিল। ইহার একটি বিশেষ প্রমাণ পাওয়া যায় কলিকাতা মিউনিসিপ্যাল কর্পোরেশনের প্রধান কর্মকর্তার (Chief Executive Officer) নিয়োগ উপলক্ষে। মেদিনীপুরের প্রবীণ নেতা বীরেন্দ্রনাথ শাসমল এই পদের প্রার্থী ছিলেন। সাহিত্যিক ও স্বরাজ্য দলের বিশিষ্ট কর্মী হেমেন্দ্রনাথ দাশগুপ্ত লিখিয়াছেন যে, মফঃস্বলবাসী একজন কলিকাতা-নগরসংক্রান্ত ব্যাপারে সর্বময় কর্তা হইবে, কলিকাতাবাসী অনেকের ইহা মনঃপূত হইল না। তাঁহাদের চেষ্টায় সুভাষচন্দ্র এই পদে নিযুক্ত হইলেন।

সম্ভবতঃ এই মনোবৃত্তিরই আভাস পাওয়া যায় চিত্তরঞ্জনের রাজনীতিক উত্তরাধিকারী নির্বাচনে। চিত্তরঞ্জন ছিলেন কলিকাতা কর্পোরেশনের মেয়র, বঙ্গীয় প্রদেশ কংগ্রেস কমিটির সভাপতি এবং বাংলার ব্যবস্থাপকসভায় স্বরাজ্য দলের নেতা। চলতি কথায় এই তিনটি ‘রাজমুকুট’ মহাত্মা গান্ধী যতীন্দ্রমোহন সেনগুপ্তের (সাধারণতঃ জে. এম. সেনগুপ্ত নামে পরিচিত) মাথায় পরাইয়া দিলেন। যতীন্দ্রমোহন চট্টগ্রাম (চিটাগাং) শহরে ব্যারিষ্টার ছিলেন এবং স্বরাজ্য দলের একজন বিশিষ্ট কর্মী ও চিত্তরঞ্জনের একজন প্রবীণ সহকারী নেতাও ছিলেন।

আদালতবর্জনের প্রস্তাব প্রচলিত থাকা সত্ত্বেও যতীন্দ্রমোহন পুনরায় ব্যারিষ্টারি আরম্ভ করায় অনেকে তাঁহার বাংলা প্রদেশ কংগ্রেস কমিটির সভাপতিপদে নির্বাচন অসঙ্গত বলিয়া মনে করিতেন। সুতরাং গান্ধীর নির্দেশমত কার্য হইলেও আপত্তির মৃদু গুঞ্জন প্রথম হইতেই শোনা গিয়াছিল। অনতিকাল মধ্যেই যতীন্দ্রমোহন ও সুভাষচন্দ্রের নেতৃত্বে দুইটি প্রতিদ্বন্দ্বী দলের বিরোধ বাংলার রাজনীতিক আকাশে ও বাতাসে প্রবল দুর্যোগের সৃষ্টি করিল।

বাংলার কংগ্রেসেও দুইটি বিভিন্ন দলের মধ্যে বিরোধ দেখা দিল। একটি দলের শীর্ষস্থানে ছিলেন ধন, মান, ঐশ্বর্যে কলিকাতায় বিশেষ মাননীয় ডাক্তার বিধানচন্দ্র রায়, ব্যারিষ্টার শরৎচন্দ্র বসু, নির্মলচন্দ্র চন্দ্র, বিখ্যাত অ্যাটর্নি তুলসীচন্দ্র গোস্বামী (শ্রীরামপুরের জমিদার) এবং নলিনীরঞ্জন সরকার (ইনি অতিশয় সামান্য অবস্থা হইতে শিল্পজগতে বিশেষ খ্যাত ও ধনী হইয়াছিলেন)। ইঁহারা সাধারণের নিকট হইতে ‘Big Five’ (পঞ্চপ্রধান) এই আখ্যা পাইয়াছিলেন। দ্বিতীয় দলটি গড়িয়াছিলেন কারাগার হইতে সদ্যমুক্ত কলিকাতা অঞ্চলের বিপ্লবীগণ। এই দলের নাম ছিল কর্মী সংঘ’। ইহার সভাপতি ছিলেন বিপ্লবী অমরেন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায় এবং সম্পাদক ছিলেন সুরেশচন্দ্র দাস। এই দুইদলই কলিকাতা শহরের দল, সুতরাং তাহারা ক্রমে চট্টগ্রামবাসী যতীন্দ্রমোহনের বিরুদ্ধে একমত হইয়া সুভাষচন্দ্র বসুকে যতীন্দ্রমোহনের প্রতিদ্বন্দ্বী নেতারূপে খাড়া করিলেন।

কিছুদিন পর্যন্ত এই দুইজনেই একযোগে কাজ করিলেন। ১৯২৮ সনে বঙ্গীয় প্রাদেশিক কনফারেন্সে সুভাষের পূর্ণ স্বাধীনতার প্রস্তাব এবং সতীশচন্দ্র দাশগুপ্তের খদ্দর ও চরকা প্রচলনের প্রস্তাব অনুমোদিত হইল। এই সভায় কংগ্রেস ও স্বরাজ্য দলের মুসলমান-সদস্যেরা খুব কমই উপস্থিত ছিলেন। পূর্বোক্ত বাংলা চুক্তির সপক্ষে চিত্তরঞ্জন কংগ্রেসে যে বিষম তর্কযুদ্ধের সৃষ্টি করিয়াছিলেন তাহার চিহ্নবিশেষ কিছু রহিল না। সুতরাং ব্যবস্থাপকসভায় অতঃপর স্বরাজ্য দলের প্রভাব কমিয়া গেল এবং তাহাদের আনীত অধিকাংশ প্রস্তাবই বিপক্ষের ভোটাধিক্যে বাতিল হইয়া গেল।

১৯২৮ সনে সুভাষ বসু কলিকাতা কর্পোরেশনের মেয়র পদে প্রার্থী হইলেন। যতীন্দ্রমোহন সেনগুপ্ত তাঁহাকে সাহায্য করিলেন। কিন্তু কংগ্রেস লিবারেল দলের (কংগ্রেসের পূর্বতন নরমপন্থী বা মডারেট দল কংগ্রেস ত্যাগ করিয়া এই নামে এক নূতন রাজনীতিক দল গঠন করিয়াছিলেন) সদস্য বি. কে. বসু মেয়র নির্বাচিত হইলেন। ইহার ফলে বাংলা কংগ্রেসের বিভিন্ন দলের মধ্যে সন্দেহ ও বিরোধের সূচনা হইল।

এই সময় যতীন্দ্রমোহন সেনগুপ্ত বাংলা কংগ্রেসের দায়িত্বভার সুভাষ বসু ও কিরণশঙ্কর রায়ের হস্তে অৰ্পণ করিলেন। তিনি কেবলমাত্র ব্যবস্থাপকসভার নেতা রহিলেন। তিনটি মুকুটের মধ্যে মাত্র একটি রহিল।

১৯২৯ সনে সুভাষচন্দ্র বাংলা প্রাদেশিক কনফারেন্সের রংপুর অধিবেশনে সভাপতি হইয়াছিলেন। এই সভায় কৃষক ও শ্রমিকদের সঙ্গে কংগ্রেসের ঘনিষ্ঠ সম্বন্ধ স্থাপন করার প্রস্তাব হয়। সুভাষচন্দ্র এই বিষয়ে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেন এবং নিখিল ভারত শ্রমিক সঙ্ সম্মেলনের (All India Trade Union Congress) সভাপতি নির্বাচিত হন (১৯২৯)। বহু যুব-সম্মিলনী ও ছাত্রদের প্রতিষ্ঠানে তিনি ভাষণ দিতেন।

কিন্তু, এই ১৯২৯ সনেই সুভাষচন্দ্র ও যতীন্দ্রমোহনের বিরোধ চরমে পৌঁছিল। এই বিরোধ যতীন্দ্রমোহনের মৃত্যু (১৯৩২) পর্যন্ত চলিয়াছিল। নিখিল ভারত কংগ্রেস কমিটির প্রতিনিধি নির্বাচন লইয়া এই কলহের সূচনা হয়। বিধানচন্দ্র রায় একটি আপোসের প্রস্তাব করেন, কিন্তু যতীন্দ্রমোহন তাহা গ্রহণ করেন নাই। অবশেষে কংগ্রেসের কার্যকরী সমিতিই স্থির করিয়া দেয় বঙ্গদেশ হইতে নিখিল ভারত কংগ্রেস কমিটির সদস্য কে কে হইবেন। গান্ধী নিজেই ১৯৩০ সনে কংগ্রেসের কার্যকরী সমিতির (Working Committee) সদস্যদের তালিকা প্রস্তুত করেন। ইহাতে যতীন্দ্রমোহন সেনগুপ্তের নাম থাকিলেও সুভাষচন্দ্রের নাম ছিল না। সুভাষকে এই সমিতির সদস্যপদের জন্য প্রস্তাব করা হইল, কিন্তু গান্ধী রাজী হইলেন না। ইহাতে একদিকে যেমন বাংলার একদল সেনগুপ্তের পক্ষে গেল, তেমনি আর একদল তাহাকে গান্ধীর ‘জো-হুঁকুম’ ভৃত্য বলিয়া গণ্য করিত। সুভাষচন্দ্র এইরূপে প্রত্যাখ্যাত হইয়া Congress Democratic Party নামে স্বতন্ত্র একটি দল গঠন করিলেন; কিন্তু ১৯৩০ সালে তিনি কারারুদ্ধ হওয়ায় এই দল বিশেষ প্রতিপত্তি লাভ করিতে পারে নাই।

ভারতের রাজনীতি (১৯৩০-৩৪)

১৯৩০ হইতে ১৯৩৪ সন–এই চারি বৎসর ভারতের ইতিহাসে একটি নূতন অধ্যায়ের সূচনা করে এবং বাংলার রাজনীতি ইহার পরিপ্রেক্ষিতেই গড়িয়া উঠে। সুতরাং এই বিশাল পটভূমিকার সংক্ষিপ্ত বিবরণ দেওয়া আবশ্যক।

১৯২৪ সনে বিলাতে মন্ত্রীদলের পরিবর্তন হয়, শ্রমিকদলের (Labour Party) পরিবর্তে সনাতনপন্থী দল (Conservative Party) রাজ্যশাসনের ভার গ্রহণ করে।

সাইমন কমিশন

১৯১৯ সনে ভারত-শাসনসংক্রান্ত যে নূতন বিধানের কথা পূর্বেই বলা হইয়াছে তাহাতে একটি নির্দেশ ছিল যে, দশ বৎসর এই সংবিধান অনুযায়ী ভারত-শাসনের পর ইহার ফল কিরূপ হইয়াছে তাহা নির্ণয় করিবার জন্য একটি নূতন কমিশন ভারতে সরেজমিনে তদন্ত করিবেন এবং ইহার রিপোর্ট অনুসারে ভারত-শাসনে ভারতীয়দের ক্ষমতা বর্ধিত, পরিবর্তিত বা সীমিত করা হইবে। তদনুযায়ী ঐ সময়ের পূর্বেই (৮ই নভেম্বর, ১৯২৭) ব্রিটিশ গভর্নমেন্ট ঘোষণা করিলেন যে ব্রিটিশ পার্লিয়ামেন্টের সাতজন সদস্য লইয়া সার জন সাইমনের (Sir John Simon) নেতৃত্বে এই উদ্দেশ্যে একটি কমিশন গঠিত হইয়াছে।

ভারত-শাসনসংক্রান্ত ব্যাপার যে কমিশন তদন্ত করিবে তাহার মধ্যে একটিও ভারতীয় সদস্য নাই–এই ব্যবস্থায় সমগ্র ভারতবর্ষে বিশেষ অসন্তোষ ও চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হইল। এই বিষয়ে ভারতের সবকয়টি রাজনৈতিক দল এবং জাতিবর্ণনির্বিশেষে সমস্ত ভারতীয়দের মধ্যে যে মতৈক্য দেখা গেল তাহার অনুরূপ আর কোন দৃষ্টান্ত নাই।

সমস্ত রাজনীতিক দল, এমনকি পূর্বতন মডারেট বা নরমপন্থী এবং পরবর্তীকালে লিবারেল নামে পরিচিত দল একযোগে সাইমন কমিশন বর্জন করিল। সমগ্র ভারতব্যাপী বহু সভা-সমিতিতে জনসাধারণ কমিশন-বর্জনের এই প্রস্তাব গ্রহণ করিল। ভারতের জাতীয় কংগ্রেস নির্দেশ দিল, যেদিন সাইমন কমিশন ভারতে পৌঁছিবে সেইদিন সমগ্র ভারতে এবং যে যে দিনে তাহারা যে যে নগরীতে যাইবে সেইদিন সেই নগরীতে হরতাল প্রতিপালিত হইবে ও বিক্ষোভকারীদের শোভাযাত্রা পরিচালিত হইবে। তদনুসারে ১৯২৮ সনের ৩রা ফেব্রুআরি কমিশন জাহাজ হইতে বম্বে নগরীতে অবতরণ করিবামাত্র সর্বত্র হরতাল অনুষ্ঠিত হইল। শোভাযাত্রাকারী নাগরিকগণ বড় বড় কাপড়ের উপর ‘সাইমন ফিরিয়া যাও’-এই কথাগুলি লিখিয়া তাহা এবং কৃষ্ণ পতাকা বহন করিয়া সমগ্র শহর প্রদক্ষিণ করিল।

সাইমন কমিশনের প্রতি বিক্ষুব্ধ দলগুলির প্রতিনিধিরা পণ্ডিত মতিলাল নেহেরুর নেতৃত্বে একটি কমিটি স্থাপন করিলেন এবং এই কমিটির রিপোর্ট অনুযায়ী কলিকাতায় এক সর্বদলীয় সম্মেলনে সমবেত হইয়া (২২শে ডিসেম্বর ১৯২৮) প্রতিনিধিবর্গ ভারতের সংবিধানের খসড়া প্রস্তুত করিতে চেষ্টা করিলেন। কিন্তু হিন্দু ও মুসলমান প্রতিনিধিদের মতানৈক্য হওয়ায় এই সম্মেলনে কোন ফল হইল না। বঙ্গদেশের প্রতিনিধিস্বরূপ সুভাষচন্দ্র বসু ও যতীন্দ্রমোহন সেনগুপ্ত এই সম্মেলনে যোগ দিয়াছিলেন, আর এই সম্মেলনেই মুহম্মদ আলি জিন্না মুসলমানদের নেতারূপে প্রসিদ্ধিলাভ করিলেন।

নেহেরু কমিটির রিপোর্টে ভারতীয়দের হাতে অবিলম্বে দায়িত্বশীল গভর্নমেন্টের সম্পূর্ণ ক্ষমতা অর্পণ করার দাবি করা হইয়াছিল। ১৯২৮ সনের ২২শে ডিসেম্বর কলিকাতায় কংগ্রেসের বার্ষিক অধিবেশনে নেহেরু কর্তৃক পরিচালিত একদল পূর্ণস্বাধীনতার দাবি জানাইল। গান্ধী তাঁহাদের সঙ্গে আপোস করার উদ্দেশ্যে প্রস্তাব করিলেন, যদি নেহেরু কমিটির রিপোর্ট অনুযায়ী শাসন সংস্কারের প্রস্তাব এক বৎসরের মধ্যে ব্রিটিশ গভর্নমেন্ট গ্রহণ না করেন তবে সরকারী রাজস্ব না-দেওয়া এবং অন্যান্য প্রকারে অহিংস অসহযোগ আন্দোলন আরম্ভ করা হইবে। ইতিমধ্যে কংগ্রেসের নামে পূর্ণস্বাধীনতা আন্দোলন করায় কোন বাধা থাকিবে না।

এই প্রস্তাব উপস্থিত করার সময় গান্ধী বলিলেন, যদি কংগ্রেসের দাবি গভর্নমেন্ট এক বৎসরের মধ্যে পূরণ না করে তবে তিনিও পূর্ণস্বাধীনতা আন্দোলনে যোগ দিবেন। কিন্তু ইহা সত্ত্বেও সুভাষচন্দ্র এই মর্মে এক সংশোধক প্রস্তাব আনিলেন যে পূর্ণস্বাধীনতা ছাড়া কংগ্রেস আর কিছুতেই সন্তুষ্ট হইবে না। এই সংশোধক প্রস্তাবের পক্ষে ৯৭৩টি ও বিপক্ষে ১৩৫০টি ভোট পড়ায় গান্ধীর প্রস্তাবই গৃহীত হইল। কিন্তু গান্ধী ও মতিলাল নেহেরুর ন্যায় প্রবীণ নেতাদের সমর্থন সত্ত্বেও যে ৯৭৩ জন প্রস্তাবের পক্ষে ভোট দিল তাহাতে কংগ্রেসে তরুণদলের প্রভাব ও প্রতিপত্তি প্রমাণিত হইল। বিশেষতঃ, তাঁহার প্রস্তাব গৃহীত না হইলে তিনি কংগ্রেস পরিত্যাগ করিবেন, গান্ধীর এই হুঁসিয়ারির জন্য অনেক সদস্যই স্বীয় মতের বিরুদ্ধেও গান্ধীর প্রস্তাবের পক্ষে ভোট দিয়াছিলেন, এবং তজ্জন্যই এই ভোটাধিক্য, ইহাতে কোন সন্দেহ নাই।

কংগ্রেসের এই অধিবেশনেই সুভাষচন্দ্র সর্বভারতীয় তরুণদলের নেতা বলিয়া প্রসিদ্ধি লাভ করিলেন–কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে মহাত্মার অন্ধভক্তেরা অতঃপর তাঁহার শত্রু হইয়া দাঁড়াইল।

এই কংগ্রেসের অধিবেশনেই সুভাষচন্দ্র সম্পূর্ণ মিলিটারী কায়দায় মিলিটারী পোশাক-পরিহিত স্বেচ্ছাসেবকদল গঠন করিয়া নিজে G. O. C. (General Officer Commanding) হইয়াছিলেন। তাঁহার মিলিটারী পোশাক কলিকাতার এক ব্রিটিশ দোকানে তৈরী হইয়াছিল। সুভাষের উদ্দেশ্যে প্রেরিত একখানি টেলিগ্রামে ‘G. 0. C.’ এই পদবী দেখিয়া ডাকপিয়ন ইহা ফোর্ট উইলিয়ম দুর্গে বিলি করিয়াছিল।

১৯২৮ সনের কংগ্রেস অধিবেশন এবং বিশেষতঃ গান্ধীর প্রস্তাবসম্বন্ধে সুভাষচন্দ্রের নিম্নলিখিত মন্তব্যটি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। কারণ ইহাতে বাংলার গান্ধীপন্থী ছাড়া অন্য দলের, বিশেষ করিয়া তরুণ রাজনীতিকদের, মনোভাব সূচিত হইয়াছে এরূপ অনুমান করা অসঙ্গত নহে। মাদ্রাজ কংগ্রেসে (১৯২৭, ডিসেম্বর) পূর্ণস্বাধীনতা দাবির প্রস্তাব গৃহীত হইয়াছিল–ইহার উল্লেখ করিয়া সুভাষচন্দ্র লিখিয়াছেন :

“মাদ্রাজ কংগ্রেসের যে ফল হইয়াছিল তাহার পর কলিকাতা কংগ্রেসের ফল হইল একেবারে উল্টা রকমের। নির্বাচিত সভাপতি যেদিন আসিয়া পৌঁছিলেন সেদিন তাঁহাকে যে বিপুল সংবর্ধনা জানানো হয় তাহা রাজা-মহারাজাদেরও ঈর্ষার উদ্রেক করিত; কিন্তু যখন তিনি প্রস্থান করিলেন তখন প্রত্যেকের মুখে হতাশা স্পষ্ট হইয়া ফুটিয়া উঠিল। আরম্ভের সময়ে সমগ্র দেশব্যাপী দারুণ উদ্দীপনা লক্ষ্য করা গিয়াছিল এবং প্রত্যেকেই আশা করিয়াছিলেন যে, কংগ্রেস সাহসের সহিত কাজ করিবে। কিন্তু দেশ যখন প্রস্তুত তখন নেতারা প্রস্তুত ছিলেন না। মহাত্মার স্বদেশবাসীর দুর্ভাগ্য যে তিনি কোনও আলো দেখিতে পান নাই। এইজন্যই কংগ্রেসের কলিকাতার অধিবেশনে গৃহীত দায়সারা প্রস্তাবটি কেবল মূল্যবান সময় নষ্ট করিল। উন্মাদ বা মূর্খ ব্যতীত অন্য কাহারও পক্ষে বিশ্বাস করা অসম্ভব বলিয়া মনে হয় যে, ঔপনিবেশিক স্বায়ত্তশাসনও প্রবল-প্রতাপান্বিত ব্রিটিশ গভর্নমেন্ট বিনাবাধায় মানিয়া লইবেন। কংগ্রেসের অধিবেশন চলিবার সময় জাতির স্বাধীনতাসংগ্রামে সংহতি প্রদর্শন ও ক্ষুধার্ত শ্রমিকদের বিষয় বিবেচনার জন্য আবেদন জানাইবার উদ্দেশ্যে ১০,০০০ শ্রমিকের এক শোভাযাত্রা কংগ্রেস-মণ্ডপে উপস্থিত হয়। কিন্তু অভ্যুত্থানের এইসকল লক্ষণ নেতাদের মনে কোনও রেখাপাত করিল না। সাইমন কমিশন নিয়োগের সঙ্গে সঙ্গে এবং নিশ্চয়ই কলিকাতা কংগ্রেসের পূর্বেইযে-সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা উচিত ছিল, ১৯২৯ সালের ডিসেম্বরে লাহোর-কংগ্রেসের পূর্ব পর্যন্ত তাহা গৃহীত হইল না। কিন্তু তখন রাজনীতিক অবস্থার অনেক অবনতি হইয়াছে।”

এই প্রসঙ্গে উল্লেখযোগ্য যে, চৌরীচৌরার দুর্ঘটনা উপলক্ষ করিয়া গান্ধী যখন অসহযোগ আন্দোলন বন্ধ করেন তখন চিত্তরঞ্জন দাশও জেলে বসিয়া গান্ধীর সম্বন্ধে অনুরূপ মন্তব্য করিয়াছিলেন।

১৯২৮ সনের শেষে গান্ধীর পূর্বোক্ত প্রস্তাব গৃহীত হইবার ফলে ১৯২৯ সনে ভারতে রাজনীতিক আন্দোলন অনেকটা হ্রাস পায়, কিন্তু সন্ত্রাসবাদ ও বিপ্লববাদের পুনরাবির্ভাব হয়। ইহার বিস্তৃত বিবরণ অন্যত্র দেওয়া হইয়াছে। বিপ্লবী বাঙ্গালী যতীন দাসের লাহোর জেলে ৬৮ দিন অনশনে থাকিয়া মৃত্যুবরণ (১৩ই সেপ্টেম্বর ১৯২৯) সমগ্র ভারতে গভীর শোক, বিষম উত্তেজনা ও অভূতপূর্ব চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করিয়াছিল। তাঁহার মৃতদেহ যখন লাহোর হইতে কলিকাতায় আনীত হয় তখন প্রত্যেক রেলওয়ে ষ্টেশনে বিপুল জনতা (কোথাও সহস্রাধিক) তাহার প্রতি শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করে। অনেকেই জানেন যে, ইংরেজের বিরুদ্ধে মুক্তিসংগ্রামে আইরিশ বীর টেরেন্স ম্যাকসুইনি (Terence McSwiney) ঠিক এইভাবেই প্রাণ বিসর্জন দিয়াছিলেন। যতীনের মৃত্যুসংবাদ শুনিয়া ম্যাকসুইনের পরিবারবর্গ নিম্নলিখিত তারবার্তা পাঠাইলেন : “টেরেন্স ম্যাকসুইনির পরিবারবর্গ যতীন দাসের মৃত্যুসংবাদে গভীর শোক ও গর্ব বোধ করিয়াছে–স্বাধীনতা আসিবেই।”

যতীন দাসের এই মৃত্যুবরণে ইংরেজ গভর্নমেন্টও বিচলিত হইয়াছিলেন। জেলের যে-সকল কঠোর নিয়মাবলীর বিরুদ্ধে প্রতিবাদস্বরূপ যতীন দাস ও অন্যান্য বন্দীরা অনশত-ব্রত পালন করিয়াছিলেন, গভর্নমেন্ট তাহার অনেক পরিবর্তন করেন। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয়, সমগ্র ভারতব্যাপী এই শোকোচ্ছাসের মধ্যে একমাত্র মহাত্মা গান্ধীই এ-সম্বন্ধে কোন উচ্চবাচ্য করেন নাই। তাহার কোন বক্তৃতায় বা তৎসম্পাদিত ‘ইয়ং ইণ্ডিয়া’ পত্রিকায় যতীন দাসের কোন উল্লেখ করেন নাই।

যতীন দাসের মৃত্যুতে সারাভারতে যুব-আন্দোলন ও ছাত্র-সভা খুব বৃদ্ধি পায়। ১৯২৯ সনে বিপ্লববাদীদের কর্মতৎপরতা এবং শ্রমিক আন্দোলন ও হরতাল বা বন্ধে’র সংখ্যাও অনেক বাড়িয়া যায়। এই বৎসর ১৫ই জুলাই কংগ্রেস কার্যনির্বাহক সমিতি ব্যবস্থাপকসভা বর্জনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। নিখিল ভারত কংগ্রেস কমিটি কিন্তু এই সিদ্ধান্ত বাতিল করিয়া দেয় (১৯২৯, ২৬শে জুলাই) এবং পরবর্তী কংগ্রেস অধিবেশনে এই বিষয়টির বিবেচনা করা হইবে, এই প্রস্তাব গ্রহণ করে।

গান্ধীজি পুনরায় কংগ্রেসে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেন। বাংলাদেশে কংগ্রেসের দুইদলের মধ্যে বিরোধ প্রবল হইয়া উঠে। এ-বিষয়ে অন্যত্র আলোচিত হইবে।

১৯২৯ সনের বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা হইল, বিলাতে শ্রমিকদলের (Labour Party) নূতন মন্ত্রীসভা গঠন। প্রধানমন্ত্রী র‍্যামসে ম্যাকডোনাল্ড (Ramsay Macdonald) ভারতীয়দের রাজনীতিক দাবিসম্বন্ধে খুব সহানুভূতিশীল বলিয়া পরিচিত ছিলেন। তিনি ভারতের বড়লাট লর্ড আরউইনকে (Lord Irwin) লণ্ডনে আহ্বান করিলেন এবং আরউইন ফিরিয়া আসিয়া একটি ঘোষণাপত্র (Statement) প্রকাশিত করিলেন (৩১শে অক্টোবর, ১৯২৯)। ইহাতে বলা হইল “ব্রিটিশ গভর্নমেন্টের অনুমতি-অনুসারে আমি পরিষ্কার ভাষায় বলিতেছি যে, ১৯১৭ সনের ঘোষণার নিহিতার্থ এই যে, ভারতে ক্রমশঃ বিধিসঙ্গত উপায়ে ‘ঔপনিবেশিক শাসন প্রতিষ্ঠিত হইবে।” অপর দুইটি ব্রিটিশ রাজনীতিক দল (লিবারেল ও কনসারভেটিভ) এবং বিলাতের সংবাদপত্রগুলি ইহার তীব্র সমালোচনা করিল। কলিকাতা কংগ্রেসের চূড়ান্ত দাবির পর তাহার উত্তরস্বরূপ এই ঘোষণায় ভারতীয় রাজনীতিবৃন্দ খুবই উৎফুল্ল হইয়া উঠিলেন–কিন্তু ক্রমে দেখা গেল যে, ঐ ঘোষণার কোন মূল্যই হয় না। শ্রমিকদলভুক্ত প্রধানমন্ত্রীর হয়ত ইচ্ছা ছিল, কিন্তু প্রতিপক্ষের প্রবল বাধা তাহাকে প্রতিনিবৃত্ত করিল।

গান্ধী ও মতিলাল নেহেরু বড়লাটের সঙ্গে সাক্ষাৎ করিয়া ঔপনিবেশিক স্বায়ত্তশাসন সম্বন্ধে কোন প্রতিশ্রুতি দূরে থাকুক, সামান্য আশা বা ভরসাও পাইলেন না। বড়লাট পরিশেষে বলিলেন (২৩শে ডিসেম্বর, ১৯২৯), ভারতের বিভিন্ন রাজনীতিক দল এবং ব্রিটিশ গভর্নমেন্টের প্রতিনিধিরা লণ্ডনে এক বৈঠকে মিলিত হইয়া সাইমন কমিশনের রিপোর্ট বিচার-বিবেচনা করিয়া ভারতের ভবিষ্যৎ সংবিধান প্রস্তুত করিবেন, তাহার পূর্বে এ-বিষয়ে কোন সিদ্ধান্ত গ্রহণ বা মতামত প্রকাশ করা সমীচীন নহে।

গান্ধী বলিলেন, আমার সকল আশা ভরসা নির্মূল হইল (I have burnt my boats)। কলিকাতা কংগ্রেসে (১৯২৮) গৃহীত তাহার প্রস্তাব অনুসারে তিনি ঘোষণা করিলেন যে, অতঃপর পূর্ণ স্বাধীনতার জন্যই আন্দোলন করিব।

কংগ্রেসের অন্তর্বিরোধ মিটিয়া গেল। লাহোরে জওহরলালের সভাপতিত্বে পরবর্তী কংগ্রেসের বার্ষিক অধিবেশনে (ডিসেম্বর, ১৯২৯) কলিকাতা কংগ্রেসের প্রস্তাব-অনুযায়ী নিম্নলিখিত সিদ্ধান্ত গৃহীত হইল :

(১) (মতিলাল) নেহেরু রিপোর্ট বাতিল হইল–অতঃপর ঔপনিবেশিক স্বায়ত্তশাসনের পরিবর্তে পূর্ণস্বাধীনতাই কংগ্রেসের একমাত্র লক্ষ্য ও দাবি হইবে।

(২) পূর্ণস্বাধীনতা লাভের জন্য সংগ্রামের প্রথম পদক্ষেপস্বরূপ কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক ব্যবস্থাপকসভা এবং সকল সরকারী কমিটি বর্জন করিতে হইবে। যাহারা এইগুলির সদস্য আছেন তাঁহারা পদত্যাগ করিবেন এবং ভবিষ্যতে এইসমস্ত নির্বাচনে পদপ্রার্থী হইবেন না বা কোনপ্রকারে সহায়তা করিবেন না। এখন হইতে কংগ্রেসের সদস্যগণ কেবল গঠনমূলক কার্যে আত্মনিয়োগ করিবেন। নিখিল ভারত কংগ্রেস কমিটিকে ক্ষমতা দেওয়া হইল যে উপযুক্ত সময় বুঝিয়া আইন-অমান্য-আন্দোলন (Civil Disobedience) আরম্ভ করিবেন এবং সর্বত্র কিংবা কোন নির্বাচিত স্থানে সরকারী খাজনা বন্ধ করা এই আন্দোলনের অংশ বলিয়া পরিগণিত হইবে।

এই প্রসঙ্গে গান্ধী বলিয়াছিলেন, সম্প্রতি দেশে যেরূপ অরাজকতা ও হিংসাত্মক কার্য, অর্থাৎ গুপ্তহত্যা প্রভৃতির প্রাদুর্ভাব হইয়াছে তাহাতে এই অসহযোগ আন্দোলন ব্যতীত দেশরক্ষার আর কোন উপায় নাই।

১৯২৯ সনের ৩১শে ডিসেম্বর মধ্যরাত্রে, ঠিক বারোটা বাজিবার সঙ্গে সঙ্গে, কলিকাতা কংগ্রেসে প্রস্তাবিত এক বত্সরের মধ্যে ঔপনিবেশিক স্বায়ত্তশাসন দেওয়ার দাবির মেয়াদ উত্তীর্ণ হইল আর সেই মুহূর্তে লাহোর কংগ্রেসের সভাপতি জওহরলাল নেহেরু ও তাঁহার পশ্চাতে কংগ্রেসের সদস্যগণ ধীর গম্ভীর পদক্ষেপে সেই নিদারুণ শীতের রাত্রে রাভী নদীর তীরে আসিয়া পৌঁছিলেন এবং জওহরলাল ত্রিবর্ণরঞ্জিত স্বাধীনতার পতাকা উত্তোলন করিলেন। সেই পতাকা যখন ধীরে ধীরে ঊর্ধ্বে উঠিতেছিল তখন সমবেত বিপুল জনতার হৃদয়ে যে গভীর উন্মাদনা ও ভবিষ্যতের আশা আকাঙ্ক্ষা ও গর্বের ভাব ভাসিয়া উঠিতেছিল তাহা ভাষায় বর্ণনা করা সম্ভব না হইলেও সহজেই তাহা অনুমেয়।

ভাবপ্রবণতার দিক হইতে ১৯২৯ সনের লাহোর কংগ্রেসের মূল্য খুব বেশী হইলেও স্থিরমস্তিষ্কে একটু চিন্তা করিলে অপরদিকে অনেক গুরুতর অনিষ্টের সম্ভাবনা এবং ত্রুটি-বিচ্যুতির কথাও মনে স্বভাবতঃই উদয় হয়। ইহার ফলে, পরিণামে ভারতীয়, বিশেষতঃ বাংলার, রাজনীতিক ক্ষেত্রে অনেক সমস্যা দেখা। দিয়াছিল–তাহার সংক্ষিপ্ত আলোচনা প্রয়োজন।

পূর্বেই বলা হইয়াছে, জুলাই মাসে কংগ্রেসের কার্যনির্বাহক সমিতিতে গান্ধীবাদীদের অসহযোগ আন্দোলন, বিশেষ করিয়া ব্যবস্থাপকসভা বর্জনের প্রস্তাব, নাকচ করা হয় এবং বাঙ্গালী প্রতিনিধিদ্বয়-যতীন্দ্রমোহন ও সুভাষচন্দ্র দুইজনেই গান্ধীজির এই প্রস্তাবের বিরুদ্ধে ছিলেন। কিন্তু পাঁচমাস পরেই যতীন্দ্রমোহন কংগ্রেস অধিবেশনে গান্ধীর প্রস্তাব সমর্থন করেন।

দ্বিতীয়তঃ, আইন অমান্য আন্দোলনের প্রস্তাব করা হইল; কিন্তু ইহার কার্যপদ্ধতি, আরম্ভের স্থান ও কালনির্ণয় সম্বন্ধে কিছুই স্থির হইল না। যদিও ইহা স্থির করিবার ভার নামেমাত্র নিখিল ভারত কংগ্রেস কমিটির হাতে রহিল, প্রকৃতপক্ষে গান্ধীই ইহার একমাত্র নায়ক ও নিয়ামক হইলেন। মোটের উপর গান্ধী আবার কংগ্রেসের উপর তাঁহার একাধিপত্য দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত করিলেন।

কিন্তু সর্বাপেক্ষা গুরুতর বিষয়রূপে দেখা দিল সাম্প্রদায়িক সমস্যার মীমাংসার প্রশ্ন। গান্ধীজির প্রস্তাবে বলা হইল, যেহেতু মতিলাল নেহেরুর রিপোর্টে প্রস্তাবিত সাম্প্রদায়িক সমস্যার সমাধান শিখ, মুসলমান প্রভৃতি সংখ্যালঘু সম্প্রদায়গুলি সন্তোষজনক মনে করে না, সেহেতু কংগ্রেস তাহাদিগকে এই আশ্বাস দিতেছে যে, ভবিষ্যতে কোন সাম্প্রদায়িক সমস্যার প্রস্তাবিত সমাধান সংখ্যালঘিষ্ঠ সম্প্রদায়গুলির নিকট সম্পূর্ণ সন্তোষজনক না হইলে কংগ্রেস তাহা গ্রহণ করিবেন না।

মনুষ্যচরিত্র সম্বন্ধে যাহাদের বিন্দুমাত্র অভিজ্ঞতা আছে তাহারা বুঝিতে পারিবে যে এই প্রস্তাবের ফলে মুসলমান ও অন্যান্য সম্প্রদায় তাহাদের দাবির সংখ্যা ও পরিমাণ ক্রমশঃই বাড়াইতে থাকিবে। কোনকালেই সকল সম্প্রদায়কে খুশী করার মত কোন প্রস্তাব আর উদ্ভাবন করা সম্ভব হইবে না, কারণ ইহা মানুষের সাধ্যাতীত। ভবিষ্যতে ঠিক ইহাই ঘটিয়াছিল এবং মুসলমানদের দাবি ক্রমশঃ স্বতন্ত্র একটি স্বাধীন রাজ্যের দাবিতে পৌঁছিল। একথা বলিলে বিশেষ অত্যুক্তি হইবে না যে, ১৯২৯ সনের এই প্রস্তাব গ্রহণ করিয়া ভারতে জাতীয় কংগ্রেস পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার সুদৃঢ় ভিত্তি গড়িয়া দিল।

১৯২৯ সনের কংগ্রেস অধিবেশনের পরেই বেশ বুঝা গেল যে, গান্ধীজি কংগ্রেসে তাঁহার একাধিপত্য স্থাপন করিতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। বামপন্থী ও তাঁহার বিরোধীদলের অন্যতম নেতা জওহরলাল নেহেরুকে তিনি বশীভূত করিলেন একপ্রকার যাদুমন্ত্রদ্বারা। কারণ, নেহেরু নিজেই লিখিয়াছেন, “গান্ধীর প্রস্তাব ও আচরণ আমার নিকট সম্পূর্ণ অযৌক্তিক মনে হইলেও আমি তাঁহাকে অনুসরণ করি, অন্যথা করিতে পারি না।” কংগ্রেসের কার্যনির্বাহক সমিতি হইতে বামপন্থীদের সকলকেই গান্ধী বাদ দিলেন। এই সমিতি গঠনের সময় নিখিল ভারত কংগ্রেস কমিটির অনেকেই অনুরোধ করিয়াছিলেন, অন্ততঃ সুভাষচন্দ্র বসু ও শ্রীনিবাস আয়েঙ্গারকে এই সমিতিতে রাখা হউক। কিন্তু গান্ধী ইহাতে সম্মত হইলেন না। বলিলেন, যাঁহারা সম্পূর্ণ একমতাবলম্বী (অর্থাৎ যাঁহারা তাঁহার মতে নিশ্চিত সায় দিবেন) কেবল তাঁহারাই কার্যনির্বাহক সমিতির সদস্য হইবেন। অর্থাৎ স্বাধীন মতামত পোষণ করা কংগ্রেসের সদস্যপদের অযোগ্যতার প্রমাণ বলিয়া গৃহীত হইবে। সুভাষচন্দ্র গান্ধীর এই মনোবৃত্তির কঠোর সমালোচনা করিয়াছেন। কার্যনির্বাহক সমিতির সদস্যদের নাম প্রস্তাব করিয়া গান্ধী বলিলেন, এই তালিকাভুক্ত নামগুলি ভোটের দ্বারা একসঙ্গে হয় বর্জন, নয় গ্রহণ করিতে হইবে। প্রকারান্তরে সকলকেই বুঝাইয়া দিলেন, ঐ তালিকা সমগ্রভাবে গ্রহণ না করিলে তিনি কংগ্রেস পরিত্যাগ করিবেন। নিখিল ভারত কংগ্রেস কমিটি গান্ধীকে বাদ দিয়া কার্য চালাইতে অনিচ্ছুক অথবা অক্ষম ছিলেন, সুতরাং গান্ধীর তালিকাই গৃহীত হইল।

এই নূতন কার্যনির্বাহক সমিতি তাহার প্রথম অধিবেশনেই (২রা জানুআরি ১৯৩০) সর্বপ্রথম নির্দেশ দিল, ব্যবস্থাপকসভার (কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক) সদস্যগণকে পদত্যাগ করিতে হইবে এবং ইহাদের স্থলে যে নূতন নির্বাচন হইবে তাহাতে কেহ কোন অংশগ্রহণ করিতে পারিবেন না। তদনুসারে সকল সদস্যেরাই ১৯৩০ সনের ফেব্রুআরি মাসের মধ্যে পদত্যাগ করিলেন। বাংলা দেশে প্রাদেশিক ব্যবস্থাপকসভার পদত্যাগকারী সদস্যদের সংখ্যা ছিল ৩৪।

অতঃপর এই নূতন কার্যনির্বাহক সভা স্থির করিল যে, সমগ্র ভারতে ২৬শে জানুআরি পূর্ণ স্বরাজ দিবস’-রূপে প্রতিপালিত হইবে। প্রতি শহরে ও গ্রামে গান্ধীর লিখিত একটি ঘোষণাপত্র প্রকাশ্যে পঠিত হইবে এবং শ্রোতৃবৃন্দ হাত তুলিয়া ইহাতে তাঁহাদের সম্মতি বিজ্ঞাপিত করিবেন।

এই সুদীর্ঘ ঘোষণাপত্রে দফায় দফায় অর্থনীতিক, রাজনীতিক, সাংস্কৃতিক ও আধ্যাত্মিক বিষয়ে ইংরেজ সরকার যে-সকল কুকর্ম দ্বারা দেশের ঘোরতর অনিষ্ট করিয়াছে তাহার বর্ণনা করিয়া পরে গান্ধী যাহা লিখিয়াছেন তাহার সারমর্ম এই, “এই চতুর্বিধ দুষ্কৃতির উৎস ব্রিটিশশাসন মানিয়া চলিলে আমরা ঈশ্বর ও মানুষের কাছে অপরাধী হইব। আমরা বিশ্বাস করি যে, হিংসাত্মক কার্যের দ্বারা স্বাধীনতা লাভ করা যাইবে না। সুতরাং গভর্নমেন্টের সহিত সমস্ত প্রকার সহযোগিতা বর্জন করিব, আইন-অমান্য আন্দোলন ও রাজস্বপ্রদান বন্ধ করিব এবং পূর্ণ স্বরাজ প্রতিষ্ঠা করিবার জন্য কংগ্রেসের নির্দেশ পালন করিব।”

কিন্তু ইহার অব্যবহিত পরেই গান্ধী তাঁহার Young India পত্রিকায় ১১-দফা শাসন-সংস্কারের তালিকা দিয়া বলিলেন যে, এই কয়েকটি সংস্কার সাধন করিলেই আর আইন অমান্য আন্দোলনের প্রশ্ন উঠিবে না এবং গভর্নমেন্টের কনফারেন্সে কংগ্রেস যোগ দিবে। গান্ধীর অন্ধভক্ত ব্যতীত সকলেই তাঁহার ঘোষণা ও উপরোক্ত উক্তির মধ্যে যে অসঙ্গতি বিদ্যমান তাহা লক্ষ্য করিলে বিস্মিত হইবে, যে গান্ধী ঔপনিবেশিক স্বায়ত্তশাসনের প্রতিশ্রুতি না পাইলে গোলটেবিল বৈঠকে যোগদান করিতে অসম্মত হইয়াছিলেন তাঁহার মুখে এই কথা! যিনি পূর্ণস্বরাজের দাবি করেন ও যাহার জন্য অহিংস সংগ্রামে দেশবাসীকে উদ্বুদ্ধ করিয়াছেন তাহার পক্ষে শাসন-সংস্কারের আবেদন করা কি ভূতের মুখে রামনামের মত শোনায় না?

সুতরাং গান্ধীর এই সকল উক্তিতে কর্ণপাত না করিয়া কার্যনির্বাহক সমিতি পরবর্তী অধিবেশনে (১৪-১৬ই ফেব্রুআরি ১৯৩০) আইন অমান্য আন্দোলনের প্রস্তাব অনুমোদন করিলেন এবং গান্ধীর উপরই ইহার ব্যবস্থার ভার ন্যস্ত হইল। সমগ্র দেশ উৎকণ্ঠিত হইয়া উঠিল। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের প্রশ্নের উত্তরে গান্ধী জানাইলেন, “আমি দিবারাত্রি অনন্যমনা হইয়া গভীরভাবে চিন্তা করিতেছি, কিন্তু অন্ধকারের মধ্যে আলোক দেখিতে পাইতেছি না।”

অবশেষে দেড়মাস পরে আলোক দেখা দিল–গান্ধী স্থির করিলেন, তিনি তাঁহার সাবরমতী আশ্রম হইতে দুইশত মাইল দূরে সমুদ্রতীরে ডাণ্ডী নামক গ্রামে সমুদ্রের জল হইতে লবণ প্রস্তুত করিয়া আইন ভঙ্গ করিবেন। তাহার পূর্বে কিন্তু অনেক কাকুতি-মিনতি করিয়া পূর্বোক্ত শাসন-সংস্কারের প্রার্থনা জানাইয়া বড়লাটকে পত্র লিখিলেন, এবং তাহার সঙ্গে এ বিষয়ে আলোচনার জন্য সাক্ষাতের অনুমতি চাহিলেন। কিন্তু বড়লাট গান্ধীকে সাক্ষাতের অনুমতি দিলেন না। ঐতিহাসিক ঈশ্বরীপ্রসাদ যথার্থই মন্তব্য করিয়াছেন : “যাহারা সাধারণ মানুষ, সাধুসন্ত বা মহাত্মা নহেন তাঁহারা গান্ধীর আচরণের সঙ্গে লাহোরের কংগ্রেসে গৃহীত প্রস্তাবের কোন সামঞ্জস্য খুঁজিয়া পাইবেন না।”

বড়লাট লর্ড আরউইন যখন গান্ধীর আবেদনে কর্ণপাত করিলেন না তখন অগত্যা গান্ধী ৭৯ জন অনুচর সঙ্গে লইয়া সাবরমতী হইতে পদব্রজে ডাণ্ডী অভিমুখে যাত্রা করিলেন (১৯৩০, ১২ই মার্চ) এবং ৫ই এপ্রিল ডাণ্ডী পৌঁছিলেন। গান্ধীর আবেদন ও কাকুতি-মিনতি যতই অসঙ্গত হউক তাঁহার এই পদযাত্রায় সমগ্র দেশে অসম্ভব উত্তেজনা দেখা দিল। জনসাধারণ নানাপ্রকারে আইন ভঙ্গ করিয়া এই আন্দোলনের সার্থকতা প্রতিপাদন করিল। গভর্নমেন্টও কঠোরহস্তে আইনভঙ্গকারীদের দমন করিল। হাজার হাজার লোক পুলিশের আঘাতে জর্জরিত ও কারারুদ্ধ হইল। বাংলা দেশের ইতিহাসে তাহার বিস্তৃত বিবরণ অপ্রাসঙ্গিক।

মেদিনীপুর জিলায় সরকারী খাজনা বন্ধ করার আন্দোলন প্রবল বেগ ধারণ করিল। গভর্নমেন্টের অত্যাচারও তদনুরূপ গুরুতর হইল। পুলিশের নির্দয় প্রহারে জর্জরিত পলায়নপর কংগ্রেস স্বেচ্ছাসেবকগণকে কোন গৃহস্থ আশ্রয়, খাদ্য, এমনকি পানীয় জল পর্যন্ত দিলে তাহার জেল হইত। সামান্য একটু উপলক্ষ পাইলেই পুলিশ গুলি করিত। মেদিনীপুরের এক গ্রামে সরকারী খাজনা না দেওয়ার জন্য এক ব্যক্তির গৃহের জিনিসপত্র ক্রোক করা হইতেছিল এবং তাহা দেখিবার জন্য লোক জড়ো হইয়াছিল। সমবেত লোকগুলির উপর পুলিশ গুলি চালাইল-একজন নিহত ও কয়েকজন আহত হইল। চেচনা গ্রামে পলায়নপর জনতার উপর গুলিবর্ষণ করায় ছয়জন নিহত ও আঠারো জন আহত হইল। কাঁথি শহরে লবণ-তৈরী দেখিবার জন্য অনেক লোক জড়ো হইয়াছিল। তাহাদের উপর পুলিশ গুলি চালাইলে ২৫ জন আহত হইল। খেরসাই গ্রামে একজন লোককে গ্রেপ্তার করিলে অনেক লোক ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়। পুলিশ তাহাদের সরিয়া যাইতে বলে, না-যাওয়ায় পুলিশ গুলি করে এবং তেরোজন লোক নিহত হয়।

কলেজের ভিতর ক্লাসে ঢুকিয়া ছাত্রদের উপর পুলিশ লাঠি চালাইত। বরিশাল শহরে মাত্র একদিনে ৫০০ লোক পুলিশের মোটা রেগুলেশন লাঠির আঘাতে আহত হয়। তমলুকে পুলিশ সত্যাগ্রহী ও তাহাদের প্রতি সহানুভূতিসম্পন্ন অধিবাসীদের বাড়ীতে আগুন দিয়া আসবাবপত্র পোড়াইয়া ফেলে। স্ত্রীলোকদের উপর অত্যাচারের কাহিনীও শুনা গিয়াছে।

কিন্তু, সরকারের এইসব কঠোর দমনকার্যের মধ্যেও কোন কোন সত্যাগ্রহী অসাধারণ মনুষ্যত্বের পরিচয় দিয়াছেন। গোপীনাথপুর গ্রামে পুলিশ নির্দয়ভাবে কংগ্রেস-স্বেচ্ছাসেবকদের প্রহার করে, ইহাদের মধ্যে একটি মুসলমান বালকও ছিল। গ্রামের লোক ইহাতে ভীষণভাবে উত্তেজিত হইয়া কয়েকজন পুলিশকে ধরিয়া স্থানীয় স্কুলঘরে বন্ধ করিয়া আগুন দেয়। কিন্তু দুইজন স্বেচ্ছাসেবক নিজেদের প্রাণের মায়া তুচ্ছ করিয়া দরজা ভাঙ্গিয়া ঘরে ঢুকিয়া পুলিশ কয়টিকে উদ্ধার করে।

ভারতের অন্যান্য প্রদেশেও অনুরূপ অত্যাচার চলে।

ব্যবস্থাপকসভায় এক প্রশ্নের উত্তরে সরকারী মহল নিরস্ত্র জনতার উপর পুলিশের গুলিতে হতাহতের যে-সংখ্যা দিয়াছিলেন তাহা হইতে বাংলা দেশের কয়েকটি স্থানের উল্লেখ করিতেছি

স্থানের নাম – তারিখ – নিহত – আহত – মন্তব্য

কলিকাতা – ১ এপ্রিল – ৭ – ৫৯ – একজন আহতের মৃত্যু হয়।

কলিকাতা – ১৫ এপ্রিল – — – ৩ – একজন আহতের মৃত্যু হয়।

২৪ পরগণা জিলা – ২৪ এপ্রিল, ১ – ৩

চট্টগ্রাম – ১৮-২০ এপ্রিল – ১০ – ২ – দুইজন আহতেরই মৃত্যু হয়

চট্টগ্রাম – ২৪ এপ্রিল – ১

হাওড়া – ৬ মে – ০ – ৫

চট্টগ্রাম ৭ মে – ৪ – ৬ – তিনজনের পরে মৃত্যু হয়

ময়মনসিংহ – ১৪ মে – ১ – ৩০ হইতে ৪০

মেদিনীপুর – ৩১ মে – ২ – ২

বড়লাটের নিকট একখানি পত্রে গান্ধী নানাস্থানে পুলিশের যে নিষ্ঠুরতার বিবরণ দেন তাহা ইয়ং ইণ্ডিয়া’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয় (১৯৩০, ৮ই মে)। তিনি লিখিয়াছেন, “বঙ্গদেশে স্বেচ্ছাসেবকদের হাত হইতে পতাকা ছিনাইয়া নেওয়া উপলক্ষে পুলিশ অভাবনীয় নিষ্ঠুরতার (unthinkable cruelties) পরিচয় দেয়। …বাংলাদেশ হইতে সর্বাপেক্ষা অধিকসংখ্যক লোককে কয়েদ করা হয়। ১৯৩০ সনে বিদেশী বস্ত্র বিক্রয় ১৯২৯ সন হইতে শতকরা ৯৫ ভাগ হ্রাস পায়।”

জেলের মধ্যেও কয়েদীদের উপর পাশবিক অত্যাচার হয়। আলিপুর সেন্ট্রাল জেলে সুভাষচন্দ্র বসু ও আরও কয়েকজন বিশিষ্ট সত্যাগ্রহী কয়েদীর উপর নিষ্ঠুর মারপিট হয় (এপ্রিল, ১৯৩০)। সুভাষ সম্মুখভাগে ছিলেন, তিনি মাটিতে পড়িয়া যান এবং একঘণ্টার উপর অজ্ঞান অবস্থায় থাকেন। গভর্নমেন্ট এ-বিষয়ে অনুসন্ধান কমিটি নিযুক্ত করিতে অসম্মত হয়। কিন্তু একটি মেডিক্যাল বোর্ড আহতদের পরীক্ষা করিয়া রিপোর্ট দেয়।

সত্যাগ্রহ (আইন-অমান্য) আন্দোলন বন্ধ করিবার জন্য সরকার কেবল পুলিশের লাঠি ও বন্দুকের গুলির উপর নির্ভর করে নাই; দমনমূলক নূতন আইন ও গ্রেপ্তার-এই দুইটি অস্ত্রও ব্যবহৃত হইয়াছিল।

সংবাদপত্র দমনের জন্য নূতন আইন পাশ হয় (২৭শে এপ্রিল, ১৯৩০)। ইহার বলে ১৩১টি সংবাদপত্রের নিকট হইতে জামিনবাবদ দুইলক্ষ চল্লিশ হাজার টাকা আদায় করা হয়। নয়টি পত্রিকা ইহা দিতে অস্বীকার করায় এগুলি বন্ধ হইয়া যায়। সরকারী রিপোর্ট-অনুসারে রাজনীতিক অপরাধে ষাট হাজারেরও বেশী সত্যাগ্রহীকে জেলে পাঠান হয়। ইহা ছাড়াও চুরি, ভয়-দেখানো, হাঙ্গামা সৃষ্টি, প্রভৃতি মিথ্যা অভিযোগে আরও বহু সত্যাগ্রাহীকে জেলে আটক রাখা হয়। কংগ্রেসের কার্যনির্বাহক সমিতির হিসাবমতো কয়েদীদের সংখ্যা ছিল প্রায় ৭৫,০০০। জওহরলাল নেহেরু, সুভাষচন্দ্র বসু প্রভৃতি অনেক নেতার জেল হয়। অবশেষে ১৯৩০, ৪ঠা মে গান্ধীকেও গ্রেপ্তার করা হয়।

আইন অমান্য আন্দোলনে ও গভর্নমেন্টের সন্ত্রাসবাদী দমননীতিতে যখন সমস্ত ভারতবর্ষে বিষম উত্তেজনার স্রোত প্রবাহিত হইতেছে, সেই সময়–গান্ধীর গ্রেপ্তারের একমাস পরে-সাইমন কমিশনের রিপোর্ট প্রকাশিত হইল (১৯৩০, ৭ই জুন)। এই রিপোর্টে দেখা গেল, প্রাদেশিক ব্যবস্থাপকসভাগুলির সদস্যসংখ্যা বৃদ্ধি করা হইবে, প্রাদেশিক ব্যাপারে মন্ত্রীরাই সর্বেসর্বা হইবেন, তবে গভর্নর মনে করিলে তাহাদের কোন কোন সিদ্ধান্ত বাতিল করিয়া দিতে পারিবেন। কংগ্রেস ও দেশবাসীরা অনেকেই ইহাতে সন্তুষ্ট হইল না। কিন্তু গভর্নমেন্ট তাহাতে বিন্দুমাত্র বিচলিত না হইয়া বিলাতে গোলটেবিল বৈঠকের অধিবেশনের ব্যবস্থা বজায় রাখিল।

১৯৩০ সনের ১২ই নভেম্বর হইতে ১৯৩১-এর ১৯শে জানুআরি পর্যন্ত লণ্ডনে এই বৈঠকের অধিবেশন হইল। কংগ্রেস ইহাতে যোগদান করিল না। এই বৈঠকে যে-সকল সিদ্ধান্ত গৃহীত হইয়াছিল তাহাতে প্রাদেশিক গভর্নমেন্টের মন্ত্রীদের হাতে অনেক ক্ষমতা দেওয়া হয়।

কংগ্রেস ইহাতে সন্তুষ্ট হইল না। তবে কংগ্রেসের নেতাগণ যখন কারারুদ্ধ এবং গভর্নমেন্টের দমননীতি পুরাপুরি চলিতেছে, এমতাবস্থায় কংগ্রেস কোন নূতন সিদ্ধান্ত গ্রহণ না করিয়া আইন অমান্য আন্দোলন যেমন চলিতেছে তেমনই চলুক–এই ব্যবস্থাই অনুমোদন করিল। সম্ভবতঃ ইহারই প্রতিক্রিয়াস্বরূপ গভর্নমেন্ট কংগ্রেসের কার্যনির্বাহক সমিতির সদস্যগণকে মুক্তি দিল। কার্যনির্বাহক সমিতি গান্ধীকে এ-বিষয়ে গভর্নমেন্টের সহিত বোঝাপড়া করিবার সম্পূর্ণ ক্ষমতা দিল। গান্ধী ও কার্যনির্বাহক সমিতির সদস্যগণ দিল্লী গেলেন এবং একসঙ্গেই অবস্থান করিলেন। গান্ধী কয়েকদিন বড়লাটের সঙ্গে কথাবার্তা চালাইবার পর দুইজনের মধ্যে একটি চুক্তি (Pact) সম্পাদিত হইল। ইহাতে স্থির হইল, ভারতীয়দের হাতে শাসনভার ন্যস্ত করা হইবে। কিন্তু দেশরক্ষা, বহির্জগতের সহিত সম্বন্ধ, সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের স্বার্থ এবং অর্থনৈতিক দায়িত্ব ইংরেজ গভর্নমেন্ট ভারতের স্বার্থে নিজের হাতেই রাখিবে। অপরদিকে আইন অমান্য আন্দোলন প্রত্যাহার করা হইবে।

৪ঠা মার্চ রাত্রি (অথবা প্রাতঃকাল) দুইটার সময় গান্ধী এই চুক্তি করিয়া ফিরিয়া আসিলেন। লাহোরের কংগ্রেস অধিবেশনে যে পূর্ণস্বাধীনতার দাবি করা হইয়াছিল–যাহার জন্য সহস্র সহস্র ভারতীয় দুঃখকষ্ট, কারাবরণ ও মৃত্যুবরণ করিয়াছিলেন, এইরূপে তাহার সমাধি ঘটিল। অবশ্য কংগ্রেসনেতারা গান্ধীর জয় জয়কার করিলেন। সৌভাগ্যের বিষয়, গান্ধীপ্রমুখাৎ এই চুক্তির কথা শুনিয়া পণ্ডিত জওহরলাল নেহেরুর প্রকৃত মনোভাব কিরূপ হইয়াছিল তাহা তিনি নিজেই লিখিয়া গিয়াছেন। মহাত্মা গান্ধীর অপ্রতিদ্বন্দ্বী নেতৃত্বের গূঢ় রহস্য যাঁহারা জানিতে ইচ্ছুক, নেহেরুর এই স্বগতোক্তি পড়িলে তাহার কতকটা আভাস পাইবেন, এই কারণেই ইহার কিয়দংশ উদ্ধৃত করিতেছি :

“৪ঠা মার্চ আমরা লাভবন হইতে গান্ধীর প্রত্যাবর্তনের অপেক্ষায় মধ্যরাত্রি পর্যন্ত জাগিয়া ছিলাম। রাত্রি দুইটার সময় আমাদের নিদ্রা হইতে জাগাইয়া তুলিল। শুনিলাম, একটি চুক্তিপত্র স্বাক্ষরিত হইয়াছে। আমরা চুক্তিপত্র দেখিলাম। ইহার অন্যান্য শর্তগুলি আমি মোটামুটি জানিতাম, কারণ এগুলি লইয়া পূর্বে অনেক আলোচনা হইয়াছিল, কিন্তু গোড়ার দিকে যেসব বিষয়ের দায়িত্ব ও ক্ষমতা ইংরেজের হস্তে থাকিবে তাহার তালিকা পড়িয়া আমি বিমূঢ় হইয়া পড়িলাম (gave me a tremendous shock)। কারণ আমি ইহার জন্য একেবারেই প্রস্তুত ছিলাম না। আমি কোন কথা বলিলাম না। সকলে শুইতে গেল।…আমি দেখিলাম, আমাদের লক্ষ্য ও মূল উদ্দেশ্যপূর্ণ স্বাধীনতা–তাহাও বিলীন হইল। ইহার জন্যই কি আমার দেশবাসী এক বছর ধরিয়া বীরের মত লড়িয়াছিল? এত যে বড় বড় কথা (brave words) ও দুঃসাহসিক কাজ (brave deeds) –তাহার পরিণাম কি এই? এইরূপ ভাবনায় আচ্ছন্ন হইয়া ৪ঠা মার্চ রাত্রিতে বিছানায় পড়িয়া রহিলাম-মনে হইল, মনপ্রাণ যেন শূন্য হইয়া গিয়াছে, যেন কোন মহামূল্য দ্রব্য হারাইলাম, জীবনে আর তাহা ফিরিয়া পাইব না।”

পরদিন ভোরে গান্ধী নেহেরুকে ঐ আপত্তিজনক শর্তের অন্যরকম এক ব্যাখ্যা দিলেন। ইহার উল্লেখ করিয়া নেহেরু লিখিয়াছেন :

“গান্ধীর ব্যাখ্যা আমার কাছে যুক্তিসঙ্গত মনে হইল না–এ যেন গায়ের জোরে নিজের মনোমত ব্যাখ্যা করার প্রয়াসমাত্র। তবু, অনেকক্ষণ তাঁহার সহিত কথা বলিয়া বিক্ষুব্ধ মনটা একটু শান্ত হইল। আমি চুক্তির ভাল-মন্দ বিচার ছাড়িয়া দিয়া বলিলাম যে, তিনি অকস্মাৎ এইভাবে আমাদের সম্পূর্ণ অজ্ঞাতসারে এমন একটি কাণ্ড করিয়া বসেন যাহাতে আমরা ভয় পাই–তাহার মধ্যে আমার অজানা এমন একটা কিছু আছে যাহা চৌদ্দ বৎসর ঘনিষ্ঠভাবে মিশিবার পরও আমি ঠিক বুঝিতে পারি না। কিন্তু আমার সমস্ত মন ভয়ে কাঁটা দেয় (filled me with apprehension)”!

তিনি স্বীকার করিলেন যে, তিনি নিজেও জানেন যে তাঁহার মধ্যে একটি অজ্ঞাত রহস্য আছে, কিন্তু তিনি ইহা এড়াইতে পারেন না এবং ইহা তাঁহাকে কোন্ পথে লইয়া যাইবে তাহাও আগে বুঝিতে পারেন না।

“এক কি দুই দিন পর্যন্ত আমার মন অস্থির হইয়া রহিল–কী করিব ভাবিয়া ঠিক করিতে পারিলাম না। গান্ধী যে চুক্তি করিয়া আসিয়াছেন তাহার বিরোধিতা বা নাকচ করার কোন প্রশ্নই উঠে না। সুতরাং মানসিক দ্বন্দ্ব ও শারীরিক যন্ত্রণা সত্ত্বেও গান্ধী-আরউইন চুক্তি মানিয়া লইয়া তাহা অনুসরণ করাই আমি স্থির করিলাম। মাঝামাঝি কোন পথ দেখিলাম না।”

গান্ধীর প্রতি অচলাভক্তি না থাকিলে ইহা কেহই অস্বীকার করিতে পারিবে না যে, কংগ্রেস লাহোরে যে পূর্ণস্বাধীনতার দাবি করিয়াছিল–কেবল তাহাই নহে, বড়লাটের সহিত সাক্ষাৎকারে (২৩শে ডিসেম্বর, ১৯২৯) গান্ধী ও মতিলাল নেহেরুর ঔপনিবেশিক স্বায়ত্তশাসনের দাবি যাহা অগ্রাহ্য করায়, লণ্ডনের কনফারেন্সে যোগ না-দেওয়া ও আইন-অমান্য আন্দোলনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয় এবং এই আন্দোলনের সময় কংগ্রেস যে লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য ব্যক্ত করিয়াছিল গান্ধী। আরউইন চুক্তি এ-সকলের মূলেই কুঠারাঘাত করিল। ১৯৩১ সনের ২২শে জানুআরি কার্যনির্বাহক সমিতি ঘোষণা করিয়াছিল যে, কংগ্রেসকে বাদ দিয়া লণ্ডনে যে গোলটেবিল বৈঠক বসিয়াছে তাহাকে প্রতিনিধি বলিয়া গ্রহণ করা যায় না। সুতরাং বৈঠকের শেষে ইংরেজ গভর্নমেন্টের প্রধানমন্ত্রী যে সরকারী সিদ্ধান্ত ঘোষণা করিয়াছিলেন তাহাতে কংগ্রেসের আইন অমান্য আন্দোলন পরিহার করিবার কোন কারণ নাই, অথচ সেই গোলটেবিল বৈঠকের সিদ্ধান্ত ও প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণার ভিত্তিতে আলোচনার জন্য দ্বিতীয় গোলটেবিল বৈঠকে গান্ধীর চুক্তি অনুসারে কংগ্রেস যোগ দিল-কোন আপত্তি করিল না। এ-বিষয়ে কোন সন্দেহ নাই যে, যে-চুক্তির দ্বারা গান্ধী গভর্নমেন্টের সঙ্গে আপোষ রফা করিলেন-আইন অমান্য আন্দোলনে সহস্র সহস্র লোকের নির্যাতন ব্যতীতও তাহা অনায়াসেই সম্পাদক করা যাইত।

এতসব সত্ত্বেও গান্ধীভক্তগণ প্রচার করিতে লাগিল যে, বড়লাটের সহিত তর্কযুদ্ধে গান্ধী জয়লাভ করিয়াছেন। গান্ধী বলিলেন, তাহার বা বড়লাটের কাহারও জয় হয় নাই। কিন্তু অনেকেই এই চুক্তিতে হতাশ হইলেন এবং সুভাষচন্দ্র বসু পূর্ণস্বাধীনতার আদর্শ প্রচার করিতে লাগিলেন। তাঁহার অনুবর্তী যুবক-দল’ (Youth Organisation) প্রকাশ্যে এই চুক্তির প্রতিবাদ করিতে লাগিল। সুভাষ নিজে গান্ধীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করিয়াও তাঁহার মতের কোন পরিবর্তন ঘটাইতে সমর্থ হইলেন না। বলা বাহুল্য যে, করাচীতে কংগ্রেসের অধিবেশনে (২৯শে মার্চ, ১৯৩১) গান্ধী-আরউইন চুক্তি অনুমোদিত হইল। সভাপতি সর্দার প্যাটেল লাহোর-অধিবেশনের প্রস্তাব বিসর্জন দিয়া ঔপনিবেশিক স্বায়ত্তশাসনের গুণগান করিলেন। আরও আশ্চর্যের বিষয় এই যে, কংগ্রেস যে-প্রস্তাবে গান্ধী আরউইন চুক্তির অনুমোদন করিল, সেই প্রস্তাবেই বলা হইল যে, কংগ্রেস ইহা পরিষ্কারভাবে ঘোষণা করিতেছে যে আমাদের পূর্ণ স্বরাজের লক্ষ্য অটুট ও অক্ষুণ্ণ রহিয়াছে। যে-চুক্তিতে অর্থনীতি, বৈদেশিক সম্বন্ধ, সৈন্য-বিভাগ-এ সকলের উপরই ব্রিটিশের ক্ষমতা অব্যাহত রহিল, সেই চুক্তি গ্রহণ করিয়াও আমাদের পূর্ণস্বরাজের আদর্শ কিরূপে অক্ষুণ্ণ রহিল-মহাত্মা বা মহাত্মার শিষ্যগণ ব্যতীত আর কাহারও তাহা বুঝিবার ক্ষমতা নাই। পণ্ডিত জওহরলাল নেহেরু এইরূপ অদ্ভুত ও অসঙ্গত প্রস্তাব কংগ্রেসের অধিবেশনে উপস্থিত করিতে সম্মত হন নাই। তিনি বলিলেন, ইহা তাঁহার মত ও যুক্তির বিরোধী (It went against his grain)। পরে অবশ্য যথারীতি তিনিই শেষমুহূর্তে (গান্ধীর আজ্ঞায় বা অনুরোধে?) এই প্রস্তাব আনিলেন এবং তখন বিপুল হর্ষধ্বনির মধ্যে কংগ্রেস সদস্যগণ গান্ধীজির জয়ধ্বনিতে সভামণ্ডপ সচকিত করিয়া এই প্রস্তাব গ্রহণ করিলেন।

১৯৩১ সনের ১৭ই এপ্রিল লর্ড আরউইনের স্থানে লর্ড উইলিংডন বড়লাট হইয়া আসিলেন এবং সরকারের কঠোর দমননীতি পুনরায় আরম্ভ হইল। গান্ধী অভিযোগ করিলেন যে, আরউইনের সঙ্গে তাঁহার যে চুক্তি হইয়াছিল, গভর্নমেন্ট তাহা পুনঃপুনঃ লঙ্ঘন করিতেছে। গভর্নমেন্ট অস্বীকার করিল। গান্ধীর সঙ্গে সরকারের পত্ৰযুদ্ধ চলিল; কিন্তু কোন ফল হইল না। গান্ধী লিখিলেন, চুক্তিভঙ্গ হইয়াছে বা হইতেছে কি না তাহা নির্ণয়ের জন্য একটি নিরপেক্ষ সমিতি গঠন করা হউক। গভর্নমেন্ট রাজী হইল না। অবশেষে গান্ধীরও ধৈর্যভঙ্গ হইল। তারযোগে বড়লাটকে তিনি জানাইলেন যে, (১৩ই অগষ্ট ১৯৩১) লণ্ডনের গোলটেবিল বৈঠকে যোগ দিবেন না। কার্যনির্বাহক সমিতিও এই সিদ্ধান্ত সমর্থন করিল।

কিন্তু পণ্ডিত জওহরলাল গান্ধীর স্বরূপ যথার্থই বুঝিয়াছিলেন, অর্থাৎ মহাত্মার মনের গতি “দেবা ন জানন্তি কুতো মনুষ্যাঃ”। ভারতের রাজনীতিক রঙ্গমঞ্চের দ্রুত পটপরিবর্তন হইল। গান্ধী বড়লাটের সঙ্গে সাক্ষাতের জন্য তারযোগে অনুমতি চাহিলেন। অনুমতি পাইয়া বল্লভভাই প্যাটেল ও জওহরলালকে সঙ্গে লইয়া বড়লাটের সঙ্গে তিনি সাক্ষাৎ করিলেন। আবার চুক্তি হইল–গভর্নমেন্ট সুরাট জিলার কয়েকটি গ্রামে রাজস্ব-আদায় উপলক্ষে প্রজাদের উপর অত্যাচারের অভিযোগ সম্বন্ধে অনুসন্ধান করিতে সম্মত হইল। কিন্তু, স্পষ্ট ভাষায় বলিল যে, “আইন-অমান্য আন্দোলনে পুলিশের জুলুম সম্বন্ধে এ-যাবৎ গান্ধী ও কংগ্রেসের পক্ষ হইতে যে-সকল অভিযোগ করা হইয়াছে সে-বিষয়ে কোন অনুসন্ধান করা হইবে না।” গান্ধী এই শর্তে সম্মত হইলেন। তাঁহার এই বিজয়বার্তা কংগ্রেসের ইতিহাসে চিরকালের জন্য লিপিবদ্ধ হইয়া রহিল। গান্ধীর এক অনুরক্ত ভক্ত গান্ধীর মত-পরিবর্তনের দার্শনিক ব্যাখ্যা দিলেন : “(অন্ধকার রাত্রে) বিদ্যুতের আলোকের ন্যায় গান্ধীর চোখে ঘটনার স্বরূপ সহসা উদ্ভাসিত হইয়া উঠিত এবং সেই মুহূর্তের ভাবপ্রেরণায় তিনি তাঁহার মত ও পথ নির্ণয় করিতেন। প্রকৃত সাধু ইহার নির্দেশেই চলেন-যুক্তি বা বুদ্ধির ধার তিনি ধারেন না।” বলা বাহুল্য, কংগ্রেসের কার্যনির্বাহক সমিতি-গান্ধী গোলটেবিল বৈঠকে যাইবেন না এই সিদ্ধান্তও যেরূপ উৎসাহ-সহকারে অনুমোদন করিয়াছিলেন, অবস্থার বিশেষ কোন পরিবর্তন না হওয়া সত্ত্বেও তিনি গোলটেবিল বৈঠকে যোগ দিবেন, এই সিদ্ধান্তও সেইরূপ আনন্দের সহিতই অনুমোদন করিলেন।

লণ্ডনের দ্বিতীয় গোলটেবিল বৈঠক

১৪৩১ সনের ৭ই সেপ্টেম্বর লণ্ডনে দ্বিতীয় গোলটেবিল বৈঠকের অধিবেশন আরম্ভ হইল। ইতিমধ্যে ব্রিটেনে গুরুতর রাজনীতিক পরিবর্তন হইয়াছে। শ্রমজীবী দলের (Labour Party) মন্ত্রীত্বের অবসান ঘটিয়াছে। নূতন ‘জাতীয় দলের মন্ত্রীত্বে পূর্বতন প্রধানমন্ত্রী র‍্যামসে ম্যাকডোনাল্ড স্বীয় পদে অধিষ্ঠিত থাকিলেও ইহাতে রক্ষণশীল (Conservative) দলেরই প্রাধান্য ছিল এবং ভারত-সচিব স্যার স্যামুয়েল হোর ভারতের শাসন-সংস্কারে গুরুতর কোন পরিবর্তনের পক্ষপাতী ছিলেন না।

মাহাত্মা গান্ধী ১২ই সেপ্টেম্বর লণ্ডনে পৌঁছিলেন এবং কনফারেন্সে অবিলম্বে ভারতে পূর্ণস্বরাজ প্রতিষ্ঠার দাবি করিয়া অনেক বক্তৃতা করিলেন। সম্ভবতঃ তিনি বিস্মৃত হইয়াছিলেন যে দেশরক্ষা, অর্থনীতি, সামরিক নীতি ও বৈদেশিক নীতির উপর কোন ক্ষমতা ইংরেজ গভর্নমেন্ট ছাড়িয়া দিবে না। প্রথম গোলটেবিল বৈঠকের এই সিদ্ধান্ত মানিয়া লইয়াই তিনি দ্বিতীয় বৈঠকে যোগদান করিয়াছিলেন। বলা বাহুল্য, তাঁহার পূর্ণ স্বাধীনতার দাবিতে ইংরেজ গভর্নমেন্ট কর্ণপাত করিল না এবং এ-সম্বন্ধে কোন আলোচনা বা তর্কবিতর্কও হইল না। প্রথম বৈঠকের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী নিয়মাবলী গঠিত হইল।

সাম্প্রদায়িক সমস্যার সমাধানই ছিল এই বৈঠকের প্রধান আলোচ্য বিষয়। বলা বাহুল্য, এ-বিষয়ে সর্বসম্মতিক্রমে কোন সিদ্ধান্তে আসা সম্ভব হইল না। মুসলমান, হিন্দুদের মধ্যে অস্পৃশ্য ও অনুন্নত জাতি, অ্যাংগ্লো-ইণ্ডিয়ান ও দেশীয় খ্রীষ্টানগণ-একজোটে যে প্রস্তাব করিল, হিন্দু ও শিখেরা তাহা গ্রহণ করিল না। গান্ধী হিন্দুদের মধ্যে অনুন্নত শ্রেণীর পৃথক সম্প্রদায় হিসাবে ভোট দিবার অধিকারের তীব্র প্রতিবাদ করিলেন। আম্বেদকর প্রস্তাব করিলেন যে, যুক্ত ভোট হোক–কিন্তু অনুন্নত শ্রেণীর জন্য নির্দিষ্টসংখ্যক সদস্যপদ সংরক্ষিত থাকিবে। গান্ধী তাহাতেও আপত্তি করিলেন। তখন একজন প্রস্তাব করিলেন, এ সমস্যা সমাধানের ভার ইংরেজ গভর্নমেন্টের হাতেই ছাড়িয়া দেওয়া হউক। ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী প্রশ্ন করিলেন যে, উপস্থিত সভ্যেরা প্রত্যেকে এই-অনুযায়ী লিখিত এক অনুরোধপত্রে স্বাক্ষর করিতে এবং তাঁহার সিদ্ধান্ত মানিয়া লইতে প্রস্তুত আছেন কি না? অধিকাংশ সভ্যই এইরূপ অনুরোধপত্র লিখিয়া দিলেন।

১৯৩১ সনের ১১ই ডিসেম্বর দ্বিতীয় বৈঠক শেষ হইল। এই অধিবেশনে পূর্ব বৈঠকের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী কিছু কিছু নিয়ম-প্রণালী বিধিবদ্ধ করা ছাড়া আর বিশেষ কিছুই হইল না। গান্ধী ২৮শে ডিসেম্বর ভারতে ফিরিয়া আসিলেন এবং স্বীকার করিলেন যে, তিনি শূন্য হাতে ফিরিয়া আসিয়াছেন। কিন্তু গান্ধীভক্তেরা গান্ধীকে বিজয়ী বীরের সম্বর্ধনা করিলেন। তাঁহাদের মতে এরূপ বিপুল সম্বর্ধনা ইহার পূর্বে আর কোন ভারতীয় নেতার ভাগ্যে ঘটে নাই। ইহা সত্য হইলে বলিতে হইবে যে, এরূপ অদ্ভুত হাস্যকর দৃশ্যও আর ভারতের রাজনীতিক ইতিহাসে দেখা যায় নাই।

ইহার পর একদিকে গভর্নমেন্টের কঠোর দমননীতি ও অপরদিকে বিপ্লবীদের হিংসাত্মক কার্য চলিতে লাগিল। গান্ধী বলিলেন, তাঁহার সহিত বড়লাট আরউইনের যে চুক্তি হইয়াছিল গভর্নমেন্ট তাহা লঙ্ন করিয়াছে। এ-বিষয়ে কথাবার্তার জন্য বড়লাটের সহিত সাক্ষাতের প্রস্তাব করিলেন। বড়লাট উত্তর দিলেন যে, “গান্ধী তাঁহার সহিত দেখা করিতে পারেন, কিন্তু গভর্নমেন্ট দেশে শান্তি রক্ষার জন্য যে সকল নীতি ও ব্যবস্থা অবলম্বন করিয়াছে সে-সম্বন্ধে কোন আলোচনা করা হইবে না।” অতঃপর দুইপক্ষের মধ্যে অনেক টেলিগ্রাম বিনিময় হইল। এইভাবে একসপ্তাহ (১৯৩১, ২৯শে ডিসেম্বর হইতে ১৯৩২, ৩রা জানুআরি) অতিক্রান্ত হইবার পর কংগ্রেস পুনরায় আইন অমান্য আন্দোলন আরম্ভ করিল।

৪ঠা জানুআরি গভর্নমেন্ট দমনমূলক চারিটি কঠোর আইন (ordinane) পাশ করিল এবং গান্ধী ও বল্লভভাই প্যাটেলকে গ্রেপ্তার করিল। জওহরলাল জেলেই ছিলেন। দলে দলে নেতারা দিনের-পর-দিন কারারুদ্ধ হইলেন। প্রায় নব্বই হাজার লোক আদালতে কারাদণ্ডে দণ্ডিত হইল। কারাগারের ভিতরে কয়েদীদের উপর এবং প্রকাশ্যে জনসাধারণের উপর পুলিশ যে অকথ্য নৃশংস অত্যাচার করিয়াছিল তাহার বিস্তৃত বিবরণ প্রত্যক্ষদর্শী নিরপেক্ষ বিদেশীগণও লিপিবদ্ধ করিয়াছেন। ইহার বিস্তৃত বর্ণনা এই গ্রন্থে অপ্রাসঙ্গিক।

যখন সারাদেশে এই বীভৎস অত্যাচারের তাণ্ডবনৃত্য চলিতেছিল তখন গান্ধী এক নাটকীয় দৃশ্যের অবতারণা করিয়া সমগ্র দেশকে বিভ্রান্ত করিয়া তুলিলেন। পূর্বেই বলা হইয়াছে যে, দ্বিতীয় গোলটেবিল বৈঠকে ভারতীয় সদস্যগণ এ-বিষয়ে চূড়ান্ত মীমাংসার ভার ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর হাতে ছাড়িয়া দিয়াছিলেন এবং এ-বিষয়ে তাঁহার সিদ্ধান্ত নির্বিচারে গ্রহণ করিবেন, এই মর্মে লিখিয়াও দিয়াছিলেন। ১৯৩২ সনের ১৭ই অগষ্ট প্রধানমন্ত্রী র‍্যামসে ম্যাকডোনাল্ড তাঁহার সিদ্ধান্ত ঘোষণা করিলেন। ইহার সারমর্ম নিম্নে বর্ণিত হইল :

(১) মুসলমান, শিখ ও ভারতের ইউরোপীয় সম্প্রদায় পৃথক পৃথক সম্প্রদায় হিসাবে তাহাদের নির্দিষ্টসংখ্যক প্রতিনিধি নির্বাচিত করিবেন। তবে দশ বৎসর পরে সম্প্রদায়গুলির মতানুসারে ইহার পরিবর্তন করা যাইতে পারিবে।

(২) হিন্দুগণ সকলেই সাধারণভাবে হিন্দুদের জন্য রক্ষিত সদস্যগণের নির্বাচনে ভোট দিতে পারিবে। কিন্তু নির্দিষ্টসংখ্যক সদস্যপদ কেবল অনুন্নত শ্রেণীর জন্যই রক্ষিত থাকিবে ও কেবলমাত্র অনুন্নত শ্ৰেণীই ইহাদের নির্বাচনে ভোট দিতে পারিবে। ইহার অর্থ এই যে, অনুন্নত শ্রেণীর হিন্দুরা সাধারণ হিন্দু সদস্যপদের নির্বাচনে এবং সংরক্ষিত পদগুলির নির্বাচনে–উভয় নির্বাচনেই প্রার্থী হইতে এবং ভোট দিতে পারিবে। কারণ শিক্ষা ও সংস্কৃতিতে তাহারা এত পশ্চাৎপদ যে, সাধারণ নির্বাচনে এই শ্রেণীর সদস্যের জয়লাভ করা প্রায় অসম্ভব। তবে ইহার পরিবর্তে বর্ণহিন্দু ও অনুন্নত শ্রেণীর হিন্দুরা সকলে যদি একমত হইয়া অন্য কোনরূপ ব্যবস্থা করিতে পারে, ব্রিটিশ গভর্নমেন্ট তাহা অনুমোদন করিবে।

সাধারণ লোকের মধ্যে তখন অনেকেরই মত ছিল এবং এখনও আছে যে, প্রধানমন্ত্রীর এই সিদ্ধান্ত অত্যন্ত সঙ্গত ও যুক্তিযুক্ত–অন্ততঃ ইহা অপেক্ষা উস্কৃষ্ট ও সর্বজনগ্রাহ্য কোন প্রস্তাব কেহ উদ্ভাবন করিতে পারেন নাই।

কিন্তু মহাত্মা গান্ধী অস্বাভাবিকরূপে বিচলিত হইলেন। যদিও তিনি প্রতিশ্রুতি দিয়াছিলেন যে, ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর সিদ্ধান্ত বিনাবিচারে মানিয়া লইবেন, তথাপি ইহা প্রকাশিত হইবার পরদিনই (১৮ই অগষ্ট, ১৯৩২) তিনি প্রধানমন্ত্রীকে পত্র লিখিলেন যে, তিনি ২০শে সেপ্টেম্বর হইতে আমরণ অনশন ব্রত’ গ্রহণ করিবেন, অর্থাৎ যতদিন অনুন্নত সম্প্রদায়ের পৃথক ভোটের ব্যবস্থা রহিত না হয় ততদিন তিনি মৃত্যু পর্যন্ত অনশন-ব্রত পালন করিবেন। ২০শে সেপ্টেম্বর অনশন আরম্ভ হইল।

বলা বাহুল্য, সমগ্র দেশে বিষম চাঞ্চল্য উপস্থিত হইল। স্বাধীনতার জন্য আইন অমান্য আন্দোলন ও সহস্র সহস্র সত্যাগ্রহীর গভর্নমেন্টের হস্তে কঠোর নির্যাতন ও লাঞ্ছনা-সকল চাপা পড়িয়া গেল। যে-কোন উপায়েই হউক গান্ধীজীর প্রাণ রক্ষা করিতে হইবে–এবং তাহার একমাত্র উপায় অনুন্নত শ্রেণীর সঙ্গে আপস-রফা করা। সুতরাং, হিন্দুনেতারা অনুন্নত শ্রেণীর নেতা আম্বেদকরের সঙ্গে বোঝাপড়া করার জন্য এক কনফারেন্সে সমবেত হইলেন। আম্বেদকর গান্ধীজীর জীবনের মূল্য জানিতেন, তাই খুব চড়া দামেই এই জীবন রক্ষা করার ব্যবস্থা হইল।

ইহার প্রধান শর্তগুলি হইল এই :

(১) বিভিন্ন প্রাদেশিক ব্যবস্থাপকসভায় ৭১ জনের পরিবর্তে ১৪৮ জন সদস্য অনুন্নত শ্রেণী হইতে নির্বাচিত হইবেন।

(২) কেন্দ্রীয় ব্যবস্থাপকসভায় ব্রিটিশশাসিত ভারতের মোট নির্বাচিত সদস্যের শতকরা ১৮ জন অনুন্নত শ্রেণী হইতে নির্বাচিত হইবেন।

(৩) অনুন্নত শ্রেণীর জন্য সংরক্ষিত প্রত্যেকটি আসনের প্রার্থীদের মধ্য হইতে প্রথমে কেবলমাত্র অনুন্নত শ্রেণীর ভোটে চারিজন নির্বাচিত হইবেন। পরে সমস্ত হিন্দুদের ভোটে এ চারিজনের মধ্য হইতে একজন নির্বাচিত হইবেন।

মোটের উপর, র‍্যামসে ম্যাকডোনাল্ডের সিদ্ধান্তের এই পরিবর্তনে অনুন্নত শ্ৰেণী দুইপ্রকারে লাভবান হইল। প্রথমতঃ, প্রাদেশিক ব্যবস্থাপকসভায় তাহাদের সদস্যসংখ্যা দ্বিগুণ হইল। দ্বিতীয়তঃ, পৃথক সাম্প্রদায়িক নির্বাচনের সুবিধাও একেবারে লোপ পাইল না।

এই বন্দোবস্ত পুণাতে হইয়াছিল (২৫শে সেপ্টেম্বর) বলিয়া ‘পুণা-চুক্তি’-নামে ইহা অভিহিত। ব্রিটিশ সরকার পুণা-চুক্তি গ্রহণ করিয়া তদনুসারে প্রস্তাবিত শাসন সংস্কার পরিবর্তন করিলেন। গান্ধীজী অনশন ত্যাগ করিলেন (২৬শে সেপ্টেম্বর)। বর্ণহিন্দুরা পূর্বপুরুষের পাপের কথঞ্চিৎ প্রায়শ্চিত্ত করিবার সুযোগ পাইল।

‘পুণা-চুক্তি’ ভাল কি মন্দ, তাহা বিচার করিবার প্রয়োজন নাই। কিন্তু গান্ধীর এই অনশন-ব্রত যে রাজনীতিক দিক হইতে সম্পূর্ণ অসঙ্গত ও অযৌক্তিক, গান্ধীভক্ত ছাড়া কেহই তাহা অস্বীকার করিবে না। যখন স্বাধীনতালাভ অর্থাৎ ইংরেজশাসন বিলুপ্ত করার জন্য সমগ্র ভারতবর্ষে সংগ্রাম চলিতেছে, তখন এই শাসনের সংস্কার কী হইবে না হইবে–এ প্রশ্ন নিতান্তই অবান্তর। অথচ সংগ্রামের সেনাপতি যুদ্ধক্ষেত্রের দিকে দৃষ্টি না দিয়া এই অবান্তর প্রশ্নের সমাধানের জন্য জীবন বিসর্জন দিতে উদ্যত হইলেন–সাধারণ লোকের কাছে ইহা চিরকালই একটি রহস্য থাকিয়া যাইবে। এ-সম্বন্ধে গান্ধীভক্ত জওহরলাল নেহেরু গান্ধীর অপরিণামদর্শিতা ও রাজনীতির সহিত ধর্মনীতির সংমিশ্রণের কঠোর সমালোচনা ও তীব্র নিন্দা করিয়াছেন, তাহা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। গান্ধীর প্রতি অন্ধভক্তি যাহাদিগের বিচারদৃষ্টিতে আক্ষরিকভাবে অন্ধ করে নাই, তাঁহারাও ইহা পড়িলে উপকৃত হইবেন। আমাদের স্বাধীনতাসংগ্রামে গান্ধীর এই অনশন-ব্রত যে নানাভাবে কতদূর অনিষ্টসাধন করিয়াছে তাহার বিশ বৰ্ণনা করিয়া উপসংহারে নেহেরু লিখিয়াছেন : “রাজনীতিক প্রশ্নের সমাধানের জন্য ধর্ম ও হৃদয়ের অনুভূতির উপর নির্ভর করা এবং এই প্রসঙ্গে পুনঃপুনঃ ভগবানের দোহাই দেওয়াতে গান্ধীর প্রতি আমার বিষম ক্রোধের উদ্রেক হইল (I felt angry with him)। ভগবান তাঁহাকে কেবল অনশন নহে, কোন্ তারিখে ইহা আরম্ভ করিতে হইবে, তাহারও নাকি নির্দেশ দিয়াছেন। কী বীভৎস দৃষ্টান্ত (What a terrible example to set)!”

পণ্ডিত জওহরলাল নেহেরু ব্যতীত আরও অনেকে যে এইরূপ মনোভাব পোষণ করিতেন (যদিও ব্যক্ত করেন নাই) এ-বিষয়ে কোন সন্দেহ নাই। মুক্তিসংগ্রাম যখন চরমে পৌঁছিয়াছে তখন গান্ধীর আচরণে ইহার গতি মন্দীভূত হইল। আরও দুঃখ ও আশ্চর্যের বিষয় এই যে, অতঃপর গান্ধী যেন মুক্তিসংগ্রাম হইতে সরিয়া গিয়া অস্পৃশ্যতাবর্জনেই তাঁহার সমস্ত শক্তি নিয়োগ করিলেন। অবশ্য ইহা সত্ত্বেও মুক্তিসংগ্রাম একেবারে বন্ধ হইল না। ২৬শে জানুআরি স্বাধীনতা দিবস’ যথারীতি পালিত হইল। কিন্তু, পুলিশ লাঠির প্রহারে শোভাযাত্রা ভাঙ্গিয়া দিল। হুগলী জিলার বদনগঞ্জ গ্রামে কংগ্রেসের শোভাযাত্রার উপর পুলিশ গুলি চালাইল।

সরকারী আইনে নিষিদ্ধ হইলেও কলিকাতায় কংগ্রেসের অধিবেশন অনুষ্ঠিত হইল (৩১শে মার্চ, ১৯৩৩)। বিভিন্ন স্থান হইতে নির্বাচিত দুই হাজারেরও অধিক প্রতিনিধির মধ্যে কলিকাতায় পৌঁছিবার পূর্বেই এক হাজারকে পুলিশ গ্রেপ্তার করিল-ইহাদের মধ্যে ছিলেন পণ্ডিত মদনমোহন মালব্য (কংগ্রেসের নির্বাচিত সভাপতি), পণ্ডিত জওহরলাল নেহেরুর বিধবা জননী এবং আরও কয়েকজন নেতা। প্রায় এক হাজার ব্যক্তি সমবেত হইলেন, শ্রীযুক্তা নেলী সেনগুপ্তা (যতীন্দ্রমোহন সেনগুপ্তের পত্নী) সভাপতির কাজ চালাইলেন। একদিকে পুলিশ লোহা-বাঁধান মোটা লাঠি দিয়া জনতাকে প্রহার করিতে আরম্ভ করিল, অন্যদিকে পূর্ণস্বাধীনতা, আইন অমান্য আন্দোলন এবং বিদেশী বস্ত্র বর্জনের প্রস্তাব সভায় গৃহীত হইল। প্রায় ২৫০ জনকে (তন্মধ্যে ৪০ জন স্ত্রীলোক) গ্রেপ্তার করা হইল। অনেককেই ছাড়িয়া দেওয়া হইল, কিন্তু নেলী সেনগুপ্তার ছয়মাস কারাদণ্ড হইল। এইসময় দেশের অবস্থা সম্বন্ধে মদনমোহন মালব্যের অপঠিত সভাপতির ভাষণ হইতে কয়েক লাইন উদ্ধৃত করিতেছি : “গত পনেরো মাসে প্রায় এক লক্ষ কুড়ি হাজার লোক কারারুদ্ধ হইয়াছে। ইহাদের মধ্যে কয়েক হাজার স্ত্রীলোক ও অনেক শিশুও আছে। সকলেই জানে যে, সরকার ভাবিয়াছিলেন যে অত্যাচারের ফলে ছয় সপ্তাহের মধ্যেই আইন অমান্য আন্দোলন থামিয়া যাইবে। কিন্তু পনেরো মাসেও তাহা হয় নাই।”

১৯৩৩ সনের ৩১শে মার্চ এইভাবে কলিকাতায় কংগ্রেসের অধিবেশন হইল। বেশ বোঝা গেল, গান্ধীজীর উপবাস এবং রাজনীতিক ব্যাপারে ঔদাসীন্যসত্ত্বেও দেশের লোক দমিয়া যায় নাই। কিন্তু, ১৯৩৩ সনের ৮ই মে তারিখে গান্ধীজী ঘোষণা করিলেন, হরিজনদের (হিন্দুসমাজের অনুন্নত ও অস্পৃশ্য জাতির) উন্নতিকল্পে তাঁহার নিজের ও সঙ্গীগণের চিত্তশুদ্ধি এবং দেশবাসীর দৃষ্টি আকৃষ্ট করিবার জন্য তিনি ২১ দিন অনশন করিবেন।

ভারত-সরকার গান্ধীর মহৎ উদ্দেশ্য উপলব্ধি করিয়া তাহাকে কারাগার হইতে মুক্ত করিলেন (৮ই মে)। মুক্ত হইয়াই তিনি কংগ্রেসের সভাপতিকে অনুরোধ করিলেন যেন একমাস কি দেড়মাসের জন্য আইন অমান্য আন্দোলন স্থগিত রাখা হয়। কারণ হরিজনের উন্নতি ছাড়া আর কোন বিষয়ের চিন্তা তাঁহার মাথায় আসিলে অনশনের মুখ্য উদ্দেশ্য ব্যর্থ হইবে। তাঁহার অনশনের জন্য আইন অমান্যকারীদের মনে বিষম উদ্বেগের সৃষ্টি হইবে এবং গভর্নমেন্টের কঠোর দমনের ফলে জনসাধারণের মনে ভীতির সঞ্চার হইয়াছে। ইহার উপর টীকা অনাবশ্যক। স্মরণ রাখিতে হইবে যে, গান্ধী তখন জেলে, আইন অমান্য আন্দোলনের সঙ্গে তাঁহার প্রত্যক্ষ কোন সম্বন্ধ ছিল না বলিয়া ভাবনারও প্রয়োজন ছিল না। আর, তাঁহার আমরণ অনশনের মধ্যে ও পরে যখন আইন অমান্য আন্দোলন বন্ধ হয় নাই তখন ২১ দিনের অনশনকালে ইহা বন্ধ করার প্রয়োজন থাকিতে পারে না।

অবশ্য ঋষিকল্প গান্ধীর উক্তি ও অনুরোধই তাঁহার ভক্ত ও অনুচরগণের পক্ষে যথেষ্ট-ইহার যুক্তিযুক্ততা বিচার করা নিতান্তই তুচ্ছ ব্যাপার। কিন্তু বড়লাট ঋষি বা সাধু ও মহাত্মার ধার ধারিতেন না। সুতরাং গান্ধী যখন এই প্রসঙ্গে তাহাকে অনুরোধ করিলেন যে, দমনমূলক নূতন বিধিগুলি বর্জন করিয়া আইন অমান্যকারীদের কারাগার হইতে মুক্তি দেওয়া হউক, তখন লর্ড উইলিংডন কর্ণপাতও করিলেন না।

কংগ্রেসের অস্থায়ী সভাপতি শ্রীযুক্ত অ্যানে গান্ধীর অনুরোধে প্রথমে ছয় সপ্তাহ ও পরে আরও ছয় সপ্তাহের জন্য আইন অমান্য আন্দোলন স্থগিত রাখিলেন। গান্ধী অনশনের পর সুস্থ হইলে ১৯৩৩, ১২ই জুলাই কংগ্রেসসেবীদের এক ঘরোয়া সভা হইল। ইহাতে দলবদ্ধ বা ব্যক্তিগতভাবে আইন অমান্য আন্দোলন বন্ধ করার প্রস্তাব হইলেও তাহা গৃহীত হয় নাই। স্থির হইল, গান্ধী বড়লাটের সঙ্গে সাক্ষাৎ করিয়া একটা আপস করিবেন। কিন্তু বড়লাট গান্ধীর সহিত সাক্ষাৎ আলোচনার প্রস্তাব অগ্রাহ্য করিলেন। তখন স্থির হইল যে, দলবদ্ধভাবে আইন অমান্য আন্দোলন বন্ধ হউক–তবে যাঁহার ইচ্ছা হয় বা সামর্থ্য থাকে তিনি ব্যক্তিগতভাবে আইন অমান্য করিতে পারেন। দলবদ্ধ আইন অমান্য আন্দোলনের জন্য কংগ্রেস যে সকল ব্যবস্থা করিয়াছিল তাহা বন্ধ করিয়া দেওয়া হইল।

ইহার পর গান্ধী ১৮ বৎসর পূর্বে প্রতিষ্ঠিত শবরমতী আশ্রম জন্মের মত ত্যাগ করিলেন। তিনি ব্যক্তিগতভাবে আইন-অমান্যের ফলে গ্রেপ্তার হইলেন (১লা অগষ্ট ১৯৩৩) ও কারাগারে অস্পৃশ্যতা-বর্জন আন্দোলন চালাইবার সুযোগ না-দেওয়ায় অনশন আরম্ভ করিলেন (১৬ই অগষ্ট)। তাঁহার শারীরিক অবস্থার অবনতি হওয়ায় গভর্নমেন্ট তাঁহাকে মুক্তি দিলেন। ব্যক্তিগত আইন অমান্য আন্দোলনের উপরেও ১৯৩৩ সনের সঙ্গে সঙ্গেই যবনিকা পতন হইল।

বাংলার রাজনীতি (১৯৩০-৩৫)

১. রাজনীতিক দলাদলি

১৯৩০ সনের আইন অমান্য আন্দোলনে সেনগুপ্ত ও সুভাষের দল স্বতন্ত্রভাবে কার্য করিতে থাকে। পরে দুইজনেই কারারুদ্ধ হন। জেলে তাঁহাদের উপরে অনেক শারীরিক অত্যাচার হয় এবং সেনগুপ্তের স্বাস্থ্য ভাঙ্গিয়া পড়ে। গান্ধী আইন অমান্য আন্দোলনের জন্য অভিযুক্ত অনেক কয়েদীর মুক্তির ব্যবস্থা করিলেও বাংলার রাজনীতিক বন্দীদের অনেকেই মুক্তি পায় নাই। অনেক বাঙ্গালী নেতাদের ও বন্দীদের মনে ধারণা হইয়াছিল যে, গান্ধী তাঁহাদের মুক্তির জন্য বিশেষ চেষ্টা করেন নাই। এই অভিযোগ কতদূর সত্য তাহা বলা কঠিন। কিন্তু এই উপলক্ষে পূর্বোক্ত গান্ধী-আরউইন চুক্তিসম্বন্ধে বাংলায় বিরূপ সমালোচনা হয়। সেনগুপ্ত গান্ধীকে সমর্থন করেন, কিন্তু সুভাষচন্দ্র এই চুক্তির শর্তগুলির তীব্র নিন্দা করেন এবং দ্বিতীয় গোলটেবিল বৈঠকে গান্ধীর ভারতের একমাত্র প্রতিনিধিরূপে যাওয়ার ব্যবস্থারও কঠোর সমালোচনা করেন।

গান্ধী ব্যর্থ মনোরথ হইয়া গোলটেবিল বৈঠক হইতে ফিরিবার পর পুনরায় আইন অমান্য আন্দোলন আরম্ভ হয় এবং কেবল গান্ধী নহেন, সেনগুপ্ত, সুভাষচন্দ্র ও জওহরলাল নেহেরুও কারারুদ্ধ হন। ইহার পরে পূর্বোক্ত পুণা-চুক্তির সংবাদ প্রকাশিত হইলে বাংলায় বর্ণহিন্দুদের মধ্যে বিষম অসন্তোষের সৃষ্টি হয়। কারণ, এই চুক্তির শর্ত অনুসারে বাংলার ব্যবস্থাপকসভায় ৮০ জন সাধারণ হিন্দুসদস্যের মধ্যে ইংরেজ প্রস্তাবিত অন্যূন ১০ জনের পরিবর্তে ৩০ জন সদস্য তপশীলভুক্ত জাতির মধ্য হইতে নির্বাচিত হইবেন। মোট ২৫০ জন সদস্যের মধ্যে সাধারণভাবে নির্বাচিত হিন্দুর সংখ্যা আশীর বেশী হইবে না। ইহা তাঁহারা খুবই অসঙ্গত মনে করিয়া স্বীয় স্বার্থ রক্ষার জন্য Congress Nationalist Party নামেও এক নূতন দল গঠন করিলেন। ইহার ফলে সাম্প্রদায়িক সমস্যা আরও বাড়িয়া গেল।

১৯৩৩ সনে গান্ধী আইন অমান্য আন্দোলন বন্ধ করিয়া সাময়িকভাবে কংগ্রেসের সহিত সম্বন্ধ ছিন্ন করিলেন। সুভাষচন্দ্র পুনরায় কারারুদ্ধ হওয়ায় তাঁহার স্বাস্থ্যহানি হইল এবং চিকিৎসার জন্য ইউরোপ গেলেন। পরবর্তী পাঁচ বৎসরের মধ্যে অধিকাংশ সময়ই তিনি ইউরোপে কাটাইয়াছেন।

১৯৩৩ সনে যতীন্দ্রমোহনের মৃত্যু এবং পর বৎসর হইতে সুভাষচন্দ্রের অনুপস্থিতির ফলে বাংলার রাজনীতিক্ষেত্রে অনেক পরিবর্তন হইল। সেনগুপ্তের পরে প্রফুল্লচন্দ্র ঘোষ গান্ধীদলের নেতা হইলেন, কিন্তু তাহার প্রভাব-প্রতিপত্তি খুব বেশী ছিল না। তিনি ও সুরেশচন্দ্র ব্যানার্জী ‘অভয়-আশ্রম’ নামক প্রতিষ্ঠানে চরকা, খদ্দর প্রভৃতির কার্য চালাইতেন। প্রফুল্ল ঘোষ পরবর্তীকালে বাংলার মুখ্যমন্ত্রী হইয়াছিলেন এবং এখনও জীবিত আছেন। বিধানচন্দ্র রায় ও নলিনীরঞ্জন সরকার গান্ধীর দলে ভিড়িলেন এবং বাংলাদেশে কংগ্রেসের নেতা হইলেন। বিধান রায়-শরৎ বসু ও সুভাষ বসুর বন্ধু ছিলেন। ১৯৩৪ সনে গান্ধীর সহায়তায় বিধান রায় স্বরাজ্য দলকে পুনরুজ্জীবিত করিতে চেষ্টা করেন। তিনি ১৯৩৫ সনে বাংলাদেশ কংগ্রেস কমিটির সভাপতি হন এবং দুই বৎসর পরে পুনরায় এই পদ অধিকার করেন ও কংগ্রেস কার্যনির্বাহক সমিতির সদস্য নির্বাচিত হন। কিন্তু এইসময় শরৎ বসু বিধানসভার প্রার্থী নির্বাচন করেন এবং শরৎ বসু ও সুভাষ বসুর সহিত বিধান রায়ের ঘনিষ্ঠতা হ্রাস পায়।

নলিনীরঞ্জন সরকার সামান্য অবস্থা হইতে নিজের বুদ্ধি ও অধ্যবসায়ের বলে হিন্দুস্থান কো-অপারেটিভ ইনসিউর্যান্স কোম্পানির অতি নিম্নপদস্থ কর্মচারী হইতে ইহার সর্বময় অধ্যক্ষ হন। ব্যবসায়-জগতে প্রসিদ্ধি লাভ করিয়া ক্রমে বেঙ্গল ন্যাশনাল চেম্বার অব কমার্স এবং ইণ্ডিয়ান ফেডারেশন অব চেম্বার্স অব কমার্সের সভাপতি হন। বাংলার ব্যবস্থাপকসভায় তিনি একজন ক্ষমতাশালী সদস্য ছিলেন। এবং পরে তিনি বাংলাদেশের মন্ত্রী ও কেন্দ্রীয় বড়লাট সভার মন্ত্রী হইয়াছিলেন। কলিকাতার ধনকুবের ও ব্যবসায় জগতে প্রসিদ্ধ ঘনশ্যাম দাস বিড়লা, গান্ধীর একজন বিশ্বস্ত অনুচর ছিলেন। তিনি বলিতেন, তিনি কংগ্রেসের সদস্য নহেন, কিন্তু গান্ধীজীর শিষ্য। তিনি গান্ধীকে প্রচুর অর্থ দিয়া সাহায্য করিতেন এবং গান্ধীর অনুগ্রহে বাংলার রাজনীতিক্ষেত্রে পরোক্ষভাবে তাঁহার যথেষ্ট প্রভাব ছিল।

এই সময়ে কমিউনিষ্ট দলও বাংলার রাজনীতিজগতে অনুপ্রবেশ করে। এম. এন. রায় (মানবেন্দ্রনাথ রায়) সর্বপ্রথম ভারতের রাজনীতিক্ষেত্রে ইহার বীজ রোপণ করেন। এই উদ্দেশ্যে তিনি কংগ্রেসের মধ্যে একটি কৃষক ও শ্রমিক সমিতি গঠন করিতে চেষ্টা করেন। কিন্তু ইহা খুব কার্যকরী হয় নাই। বাংলা দেশে রায়ের অনুচর মুজফফর আহমদও কমিউনিষ্ট-প্রভাব বিস্তার করিতে চেষ্টা করেন। নবেশচন্দ্র সেনগুপ্ত, অতুলচন্দ্র গুপ্ত, কাজী নজরুল ইসলাম প্রভৃতি সাহিত্যিকদের এবং অন্যান্য কয়েকজনের সহায়তায় মুজফফর বাংলা কৃষক ও শ্রমিক সমিতি’ প্রতিষ্ঠিত করিয়া (১৯২৪-২৫) ইহার মুখপত্র হিসাবে ‘লাঙ্গল’ নামে একটি সাপ্তাহিক পত্রিকা প্রকাশিত করেন। ক্রমে ক্রমে ভারতীয় কমিউনিষ্ট দল কংগ্রেসের মধ্যে প্রবেশ করে। ১৯৩৫ হইতে ১৯৪০ সনের মধ্যে বাংলা দেশের মুজফফর আহমদ, প্রমোদ দাসগুপ্ত, হরেকৃষ্ণ কোঙার, সোমনাথ লাহিড়ী, হীরেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়, বিশ্বনাথ মুখোপাধ্যায় প্রভৃতি কমিউনিষ্টগণ কংগ্রেসে যোগদান করেন এবং ইহাদের মধ্যে কেহ কেহ বাংলার প্রাদেশিক অথবা জিলা কংগ্রেস কমিটির কার্যকরী (Executive) সভার সদস্য ছিলেন। তাঁহাদের উদ্দেশ্য ছিল, কংগ্রেসের সোস্যালিস্ট পার্টিতে নিজেদের প্রাধান্য স্থাপন করিয়া ক্রমে ক্রমে কংগ্রেসেও ক্ষমতাশালী হইবেন। ১৯৪০ সনে তাঁহারা সোস্যালিস্ট দল হইতে বিতাড়িত হন এবং ১৯৪১ সনে কংগ্রেসের সহিতও বিবোধ ঘটে। ইঁহাদের পরবর্তী ইতিহাস ভারতবর্ষের ইতিহাসের অংশ, বাংলার ইতিহাসে ইহার বিস্তৃত আলোচনা অনাবশ্যক ও অপ্রাসঙ্গিক।

২. তৃতীয় বিধান সভা

তৃতীয় বিধান সভার প্রথম অধিবেশন হইল ১৯২৭ সনের জানুআরি মাসে। ২১শে জানুআরি পর্যন্ত দ্বৈতশাসন স্থগিত রাখার কথা পূর্বেই বলিয়াছি। ২১শে জানুআরি দ্বৈতশাসন পুনরায় আরম্ভ হইল। সার আবদুল রহিম এই শর্তে মন্ত্রী নিযুক্ত হইলেন যে, তিনি একজন হিন্দু-সহযোগী স্থির করিবেন। কিন্তু তিনি ইহা করিতে না পারায় ব্যোমকেশ চক্রবর্তী ও এ. কে. গজনভি মন্ত্রী নিযুক্ত হইলেন। কিন্তু তাঁহাদের সম্বন্ধে অনাস্থা প্রস্তাব গৃহীত হওয়ায় তাঁহাদের পদত্যাগ করিতে হইল এবং গভর্নর নিজে শাসনভার গ্রহণ করিলেন। ১৯২৭ সনের অক্টোবর মাসে প্রভাসচন্দ্র মিত্র এবং নবাব মশারফ হোসেন মন্ত্রী নিযুক্ত হইলেন। প্রভাসচন্দ্র গভর্নরের কার্যনির্বাহক সমিতির (Executive Council) সদস্যপদে উন্নীত হওয়ায় নসীপুরের রাজা তাঁহার স্থানে মন্ত্রী নিযুক্ত হইলেন।

স্বরাজ্য দলের অবসানের পর হিন্দু ও মুসলমানের রাজনীতি ক্রমশঃ স্বতন্ত্র পথে অগ্রসর হইল। হুসেন সুরাওয়ার্দি ও অন্যান্য যে-সকল মুসলমানগণ পূর্বে স্বরাজ্য দলভুক্ত ছিলেন তাঁহারা পৃথক নির্বাচন ও মুসলমানদের লোকসংখ্যা অনুপাতে বিধানসভার সদস্যপদের দাবি করিলেন। বাংলা জাতীয় দল’ (Bengali Nationalist Party) নামে কংগ্রেসের ভিতর হইতে স্বতন্ত্র একটি রাজনীতিক দল গড়িয়া উঠিল। গান্ধীর অনশনের ফলে যে ভাবে অনুন্নত হিন্দুশ্রেণীর তুলনায় উচ্চবর্ণের হিন্দুসদস্যের সংখ্যা বিধানসভায় হ্রাস পাইয়াছিল, তাহার প্রতিবাদেই এই দল ১৯৩৪ সনের কেন্দ্রীয় বিধানসভার নির্বাচনে কংগ্রেসের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করিয়া পৃথক সদস্য মনোনীত করিল এবং আশাতীতরূপে সফল হইল। ইহার ফলে মুসলমানদেরও রাজনীতিক ক্ষেত্রে হিন্দু-সম্প্রদায় হইতে স্বাতন্ত্র্য বজায় রাখার প্রয়াস বৃদ্ধি পাইল।

১৯২৮ সনে সাইমন কমিশনের ভারতে আগমন উপলক্ষে ভারতের সর্বত্র নানা গোলযোগের সৃষ্টি, ১৯২৯ সনে গোলটেবিল বৈঠকের অধিবেশন, ১৯৩০ সন হইতে আইন অমান্য আন্দোলন আরম্ভ, ১৯৩১ সনে গান্ধীর দ্বিতীয় গোলটেবিল বৈঠকে যোগদান, ১৯৩২ সনে আইন অমান্য আন্দোলনের পুনরায় আরম্ভ, ১৯৩৩ সনে এই আন্দোলনের পরিসমাপ্তি–এই সমুদয় পূর্বেই আলোচনা করা হইয়াছে।

এই কয় বৎসরে বঙ্গদেশের ইতিহাসে পৃথকভাবে উল্লেখযোগ্য বিশেষ কিছু ঘটে নাই। নিখিল ভারতীয় রাজনীতিক আন্দোলনে তাহারা অন্য প্রদেশের ন্যায়ই অংশগ্রহণ করিয়াছে।

তবে হিন্দুর ন্যায় মুসলমানদের মধ্যেও বিভিন্ন রাজনীতিক দলের উদ্ভব হইয়াছে। বঙ্গদেশে মুসলিম লীগের প্রাধান্য খুব বেশী ছিল না। স্বতন্ত্র বাংলা মুসলিম দল (Bengal Muslim Party) অধিকতর শক্তিশালী ছিল। সর্বাপেক্ষা শক্তিশালী ছিল ফজলুল হক-প্রতিষ্ঠিত কৃষক-প্রজা’ দল। এইসময় মুজফ্ফর আহমদ ও অন্য কয়েকজন কমিউনিষ্ট নেতা মুসলমানদের মধ্যেও প্রভাব বিস্তার করিতেছিলেন। কবি নজরুল ইসলামের কবিতাও ইহাতে উদ্দীপনা যোগাইয়াছিল।

১৯২৯ সনে স্বরাজ্য দল বিধানসভা বর্জন করার ফলে বাংলার বিধানসভায় মুসলমান দল সরকারী কর্মচারী ও হিন্দুদের মধ্যে লিবারেল ও সরকারের অনুরক্ত সদস্যের সহায়তায় শাসনকার্য (হস্তান্তরিত বিষয়গুলি) বিনাবাধায় চালাইতে লাগিল। মন্ত্রী পরিবর্তন হইলেও প্রাথমিক শিক্ষা, স্থানীয় স্বায়ত্তশাসন এবং দরিদ্র প্রজাদের ঋণদায় হইতে মুক্তি প্রভৃতি লোকহিতকর অনেকগুলি ব্যবস্থা করা সম্ভবপর হইয়াছিল। মুসলমানগণ বাংলাদেশে সংখ্যাধিক্যের বলে নূতন শাসনব্যবস্থায় নিজেদের সুখ-সুবিধা বাড়াইবার যে-শক্তির পরিচয় এই প্রথম পাইল, তাহাই ক্রমশঃ তাহাদিগকে পাকিস্তান, অর্থাৎ পৃথক স্বতন্ত্র মুসলমান রাজ্যের দাবিতে অনুপ্রেরণা জোগাইয়াছিল–কেহ কেহ এরূপ মন্তব্য করিয়াছেন।

ইহা কতদূর সত্য বলা যায় না, কিন্তু যে-যুগের আলোচনা করিতেছি সেই যুগেই যে বাংলার বাহিরে মুসলমানদের পৃথক রাজ্যের কথা আলোচিত হইয়াছিল তাহার বিশিষ্ট প্রমাণ ১৯৩০ সনের ডিসেম্বর মাসে এলাহাবাদে মুসলিম লীগের অধিবেশনে সভাপতি সুপ্রসিদ্ধ মুসলমান কবি মহম্মদ ইকবালের ভাষণ। ইহাতে তিনি দাবি করেন, পাঞ্জাব, উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ, সিন্ধু ও বেলুচিস্থান লইয়া একটি স্বতন্ত্র স্বাধীন মুসলমানরাজ্য গঠিত হউক। তিনি অবশ্য বাংলা দেশের নাম করেন নাই। কিন্তু স্বতন্ত্র স্বাধীন মুসলমানরাজ্যের মধ্যে যে প্রদেশে মুসলমানেরা সংখ্যাগরিষ্ঠ, তাহাও যে ইহার অন্তর্ভুক্ত করার দাবি শীঘ্রই উঠিবে ইহাই স্বাভাবিক এবং পরবর্তী বৎসরই একজন মুসলমান যুবক কাশ্মীরকেও প্রস্তাবিত মুসলমানরাজ্যের অন্তর্ভুক্ত করার প্রস্তাব করেন।

এই প্রসঙ্গে উল্লেখ করা যাইতে পারে যে, ১৯২৫ সনে লালা লাজপৎ রায় হিন্দু-মুসলমানের সাম্প্রদায়িক বিরোধের অবসানের জন্য ভারতের উত্তর-পূর্ব ও উত্তর-পশ্চিম সীমান্তে দুইটি স্বতন্ত্র মুসলমান প্রদেশ গঠনের প্রস্তাব করেন (১৯২৩ সনে, অর্থাৎ অসহযোগ আন্দোলন শেষ হইবার সঙ্গে সঙ্গেই)।

হিন্দু-মুসলমানের বিরোধ তীব্র হইয়া উঠিল। এই বৎসর মে মাসে কলিকাতায় আর্যসমাজের এক শোভাযাত্রা মসজিদের সম্মুখ দিয়া যাইবার সময় সঙ্গীত বন্ধ করে নাই বলিয়া কয়েকদিন ধরিয়া ভীষণ দাঙ্গাহাঙ্গামা হয় এবং দুইপক্ষেরই বহু লোক হতাহত হয়।

১৯২৪ সনে বকরঈদ উপলক্ষে দিল্লীতে এবং মহরম উপলক্ষে ‘নিজামের রাজ্য গুলবর্গায় ভীষণ দাঙ্গা হয়। ঐ বৎসরই উত্তর-পশ্চিম প্রদেশে কোহাট নামক স্থানে মুসলমানেরা হিন্দুর উপর যে ভীষণ অত্যাচার করে তাহার তুলনা নাই বলিলেও চলে।

১৯২৫ সনে ভারতের নানা স্থানে ষোলটি সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হয়। ইহার মধ্যে দিল্লী, আলিগড়, মধ্যপ্রদেশের অন্তর্গত আর্বি নামক স্থানে এবং শোলাপুর নগরের দাঙ্গা অতিশয় তীব্র আকার ধারণ করে।

১৯২৬ সনে মসজিদের সম্মুখে সঙ্গীতসহ শোভাযাত্রা উপলক্ষে কলিকাতায় ৩রা, ৪ঠা ও৫ই এপ্রিল ভীষণ দাঙ্গা সংঘটিত হয়। ইহার ফলে মন্দির ও মসজিদ পোড়ানো ও লুটতরাজ হয়; ৪৪ জন হত ও ৫৮৪ জন আহত হয়। ২২শে এপ্রিল আবার দাঙ্গা বাধে, ইহাতেও ৬৬ জন হত এবং ৩৯১ জন আহত হয়। ১১ই হইতে ২৫শে জুলাই পর্যন্ত আর একটি দাঙ্গায় ২৮ জন হত এবং ২২৬ জন গুরুতররূপে আহত হয়।

বরিশাল জেলার পটুয়াখালিতে মসজিদের সম্মুখে সঙ্গীত করার চিরপ্রচলিত অধিকার প্রতিষ্ঠা করিবার জন্য হিন্দুরা সত্যাগ্রহ করিয়াছিল এবং চারিটি বিভিন্ন দলে একশত জন কারাবরণ করিয়াছিল।

কেন্দ্রীয় বিধানসভায় মসজিদের সম্মুখে সঙ্গীতের ব্যাপারটি আলোচিত হইয়াছিল (১৮ই অগষ্ট, ১৯২৬), কিন্তু সিদ্ধান্ত বা প্রস্তাব গৃহীত হয় নাই। সরকারী তরফ হইতে এই প্রসঙ্গে বলা হইয়াছিল যে, বিগত তিন বৎসরে ৭১টি বিভিন্ন স্থানে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা-হাঙ্গামা হয় এবং ইহার ফলে ২৬০ জন হত এবং তিন হাজার ব্যক্তি আহত হইয়াছিল। ইহা সত্ত্বেও মহাত্মা গান্ধী এ-বিষয়ে সম্পূর্ণ উদাসীন ও নীরব ছিলেন। সম্ভবতঃ ১৯২৪ সনে লাহোরের দাঙ্গার ব্যাপারে অকৃতকার্য হওয়ায় তিনি এ-সম্বন্ধে মৌত অবলম্বন করিয়াছিলেন।

১৯২৬ সনে মতিলাল নেহেরু ও আবুল কালাম আজাদ দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে একটা বোঝাপড়ার চেষ্টা করিয়াছিলেন, কিন্তু তাহাতে কোন ফল হয় নাই। কিন্তু ঐ বৎসরেই সার আবদুল রহিম বাংলার ব্যবস্থাপকসভায় যে-সকল মুসলমান সদস্য স্বরাজ্য দলভুক্ত নহে তাহাদের লইয়া বাংলা মুসলমান নামে একটি দল গঠন করেন। কারণ তাঁহার মতে ভারতের রাজনীতিক দলমাত্রেই সাম্প্রদায়িক ভিত্তির উপর গঠিত।

১৯২৬ সনের ডিসেম্বর মাসে কাংড়াতে গুরুকুলের প্রতিষ্ঠাতা এবং আর্যসমাজের তথা ভারতের প্রসিদ্ধ নেতা স্বামী শ্ৰদ্ধানন্দের হত্যা একটি বিশেষ গুরুতর ঘটনা। অসহযোগ আন্দোলনের সময় তাহার কৃতিত্বের জন্য তিনি হিন্দু ও মুসলমান উভয় সম্প্রদায়েরই শ্রদ্ধা অর্জন করিয়াছিলেন, কিন্তু আর্যসমাজের শুদ্ধি আন্দোলনের (ধর্মান্তরিত হিন্দুদের পুনরায় হিন্দুসম্প্রদায়ে গ্রহণ করা) জন্য মুসলমানেরা, অন্ততঃ তাহাদের কোন কোন সম্প্রদায়, তাঁহার বিরুদ্ধে ঘৃণা ও ক্রোধ পোষণ করিত। স্বামীজি গুরুতর পীড়া হইতে তখন ধীরে ধীরে আরোগ্যলাভ করিতেছিলেন। ২৩শে ডিসেম্বর তিনি শয্যাশায়ী ছিলেন, এমন সময় একটি মুসলমান সেইদিন মিথ্যা ওজরে তাঁহার সহিত সাক্ষাৎ করিবার ছলে তাহার শয়নকক্ষে প্রবেশ করিয়া ছুরিকাঘাতে তাঁহাকে হত্যা করে। সমগ্র ভারত এই সংবাদে বিষাদ ও ক্রোধে অভিভূত হইয়া পড়ে।

এই ভয়ঙ্কর ঘটনার তিনদিন পরে কংগ্রেসের বার্ষিক অধিবেশন হয়। ইহার একটি প্রস্তাবে কার্যকরী সমিতিকে অনুরোধ করা হয় যেন দুই সম্প্রদায়ের নেতাদের সঙ্গে পরামর্শ করিয়া সাম্প্রদায়িক বিরোধের প্রতীকারের উপায় উদ্ভাবন করা হয় এবং ১৯২৭ সনের ২৭শে মার্চের মধ্যে এ-বিষয়ে রিপোর্ট পাঠানো হয়। কিন্তু ইহাতে বিশেষ কোন ফল হয় নাই।

১৯২৭ সনেও সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার বিরতি হয় নাই। বরিশাল জিলার কুলকাঠি গ্রামে সরকারী অনুমতিক্রমে একটি হিন্দু-শোভাযাত্রা বাহির হইয়াছিল, কিন্তু মুসলমানগণ তাহাদের গতিরোধ করিবার জন্য সমবেত হয়। পুলিশের গুলিতে ১৭ জন মুসলমান হত এবং ১২ জন আহত হইয়াছিল। সরকারী রিপোর্ট হইতে জানা যায়, ১৯২২ হইতে ১৯২৭ সনের মধ্যে ছোটখাট হাঙ্গামা বাদ দিয়াও ১১২টি সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ঘটে এবং ইহাতে প্রায় ৪৫০ জন নিহত ও পাঁচ হাজার লোক আহত হইয়াছিল। ১৯২৭ সনেই ৩১টি দাঙ্গা সংঘটিত হইয়াছিল।

গোলটেবিল বৈঠকের পরে ব্রিটিশ রাজমন্ত্রী বিধানসভার নির্বাচনে যে সাম্প্রদায়িক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন তাহা পূর্বেই উল্লিখিত হইয়াছে। এই প্রসঙ্গে কংগ্রেসের কার্যকরী সমিতি বহু তর্কবিতর্কের পর যে-সিদ্ধান্তে পৌঁছিল তাহার সারমর্ম এই :”কংগ্রেস প্রতিজ্ঞাবদ্ধ যে, সকল সম্প্রদায় বা দল মিলিয়া যে-কোন প্রস্তাব করিবে, তাহাই গ্রহণ করিবে এবং কোন একটি দলও যদি কোন প্রস্তাবে সম্মত না হয় তবে তাহা গ্রহণ করিবে না।” ইহার ফলে সাম্প্রদায়িক সমস্যার সমাধান যে মনুষ্যের শক্তি ও সাধ্যের অতীত হইল সে-সম্বন্ধে কোন সন্দেহ নাই। এই অদ্ভুত প্রস্তাবের কথা পূর্বেই আলোচিত হইয়াছে।

আলোচ্য যুগের শেষে ভারতীয় রাজনীতিক্ষেত্রের বিবরণ সংক্ষেপে দিতেছি। কারণ ইহার পরিপ্রেক্ষিতেই বাংলা দেশের ইতিহাসের বিবর্তন বুঝিতে হইবে।

আইন অমান্য আন্দোলন বন্ধ হইবার পর আবার কংগ্রেসের একদল স্বরাজ্য দলের পুনঃপ্রতিষ্ঠা করিবার জন্য উদ্যোগী হইল। দিল্লীতে ১৯৩৪ সনের ১লা মার্চ এক কনফারেন্সে স্থির হইল যে, আবার নিখিল ভারতীয় স্বরাজ্য দল গঠন করা হউক। গান্ধী ইহার পুরাপুরি সমর্থন করিলেন। ১৯২০ সনের কাউন্সিল বর্জন, ১৯২৩ সনের স্বরাজ্য দলের কাউন্সিলে প্রবেশ, ১৯২৯ সনে আবার বর্জন এবং ১৯৩৪ সনে আবার প্রবেশ-অসহযোগ আন্দোলনের এই চারিটি পরিবর্তন হইয়া ইহার অবসান হইল। এইসঙ্গে আইন অমান্য আন্দোলনেরও অবসান হইল এবং কংগ্রেসের কার্যকরী সমিতি প্রকাশ্যে ইহা ঘোষণা করিলেন (২০ মে, ১৯৩৪)।

এই প্রসঙ্গে ইহা স্মরণ রাখা আবশ্যক যে অতঃপর ভারতের মুক্তিসংগ্রামে মহাত্মা গান্ধী আর কোন সক্রিয় অংশগ্রহণ করেন নাই। ১৯৪২ সনের ১৪ই জুলাই কংগ্রেস কার্যকরী সমিতি ইংরেজ গভর্নমেন্টকে ভারত ছাড়িয়া যাইতে অনুরোধ করে এবং সতর্ক করিয়া বলে যে, তাহা না করিলে আবার অহিংস আন্দোলনের মাধ্যমে ভারত মুক্তিসংগ্রাম শুরু করিবে।

বলা বাহুল্য, ইংরেজ ভারত ছাড়িয়া যাইবে এরূপ কোন লক্ষণ দেখা গেল না। সুতরাং নিখিল ভারতীয় কংগ্রেস কমিটির বোম্বাই অধিবেশনে (৭ই অগষ্ট, ১৯৪২) এই সিদ্ধান্ত গৃহীত এবং স্থির হইল যে, গান্ধীর নেতৃত্বে এই অহিংস মুক্তিসংগ্রাম আরম্ভ হইবে। গান্ধী বলিয়াছিলেন যে, “এই শেষ অনুরোধ-ইহার পর ইংরেজের সঙ্গে আর কোন আপসের প্রশ্ন ওঠে না, এই শেষ বিদ্রোহ-ইহাতে হয় ভারতের পূর্ণ স্বাধীনতা লাভ করিব, নয় প্রাণ দিব।” কংগ্রেস কমিটির অধিবেশন ৮ই অগষ্ট রাত্রে শেষ হইল। সেই রাত্রি শেষ হইবার আগেই অতিপ্রত্যূষে গান্ধী ও অন্যান্য নেতৃবৃন্দ গ্রেপ্তার হইলেন। ইহার ফলে সারা ভারতে যে হিংসাত্মক বিপ্লব আরম্ভ হইয়াছিল, গভর্নমেন্ট তাহা ছয়মাসের মধ্যেই দমন করিল। গান্ধী নিজে গভর্নমেন্টকে পত্র লিখিয়া জানাইয়াছিলেন, ইহার সহিত তাঁহার কোন সম্বন্ধ নাই এবং ইহা তাঁহার মতের বিরোধী।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *