১১. বিপ্লববাদ (১৯২০-৩৫)

একাদশ অধ্যায় – বিপ্লববাদ (১৯২০-৩৫)

১. অস্ত্রসংগ্রহ-বোমা

১৯২৫ সনে পুলিশ দুইটি বোমার কারখানা আবিষ্কার করে। প্রথমে কলিকাতার উপকণ্ঠে দক্ষিণেশ্বর বাচস্পতিপাড়ায় একটি জীর্ণ দোতলা বাড়ীতে হানা দিয়া পুলিশ “বহু বোমা তৈরীর উপকরণ, বন্দুক, রিভলভার, কয়েক বোতল সালফিউরিক ও নাইট্রিক অ্যাসিড, বন্দুক ও রিভলভারের গুলি, কাঁচের নল, ব্যাটারি প্রভৃতি আবিষ্কার করে।”

এখানকার তল্লাসীতে প্রাপ্ত প্রমাণের বলে পুলিশ কলিকাতায় ৪নং শোভাবাজার স্ট্রীটের বাড়ীতে হানা দেয়। তখন সেখানে মাষ্টারদা (সূর্য সেন) ছিলেন। দক্ষিণেশ্বরের সংবাদ পাইয়া তিনি পলায়ন করিতে সমর্থ হইলেও জিনিসপত্র সরাইবার পূর্বেই পুলিশ আসিয়া পড়িল। তল্লাসীর ফলে “রিভলভার, দু’মাপের কার্তুজ ও বিপ্লব সংক্রান্ত বহু কাগজপত্র পুলিশের হস্তগত হয়”। এই কাগজপত্রের মধ্যে বোমা-তৈরীর ফর্মুলা এবং সশস্ত্র অভ্যুত্থানের নানা স্তর ও কার্যক্ষেত্রে প্রয়োগোপযোগী বিধিব্যবস্থা সম্বন্ধে বিস্তারিত বিবরণ পাওয়া যায়।

১৯২৬ সনে পুলিশ কলিকাতার সুকিয়া স্ত্রীটে, হাওড়া জিলার ডোমজুড় গ্রামে, সালকিয়ায় এবং দেওঘরের এক বাড়ীতে বোমা, বোমা-তৈরীর উপকরণ, বিস্ফোরক তৈরীর টাইপকরা ফর্মুলা, রিভলভার, কার্তুজ প্রভৃতি আবিষ্কার করে। ১৯২৯ সনের ১৯শে ডিসেম্বর মেছুয়াবাজারের এক গলিতে পুলিশ বোমা ও বোমা তৈরীর সরঞ্জাম হস্তগত করে। ১৯৩১ সনের ২৩শে সেপ্টেম্বর ময়মনসিংহ জিলার অরণ্যপাশা গ্রামে এক বাড়ীতেও বোমা-তৈরীর উপকরণ, ফর্মুলা প্রভৃতি পাওয়া যায়। এই সময় বাংলার বিপ্লবীরা বোমা-তৈরী সম্বন্ধে উত্তর-ভারতের নানা স্থানের সহিত সংযোগ স্থাপন করেন এবং বোমা-তৈরীর জ্ঞান ও উপকরণ ঐসকল অঞ্চলে রপ্তানি করেন। এই গ্রন্থের লেখক যখন কেন্দ্রীয় সরকারের নির্দেশে স্বাধীনতা আন্দোলনের ইতিহাস লিখিবার কার্যে নিযুক্ত ছিলেন তখন একটি গোপনীয় পুলিশ রিপোর্ট দেখিবার সুযোগ তাঁহার হয়। ঐ রিপোর্টে মৌলানা আবুল কালাম আজাদ (প্রাক্তন কেন্দ্রীয় শিক্ষামন্ত্রী) একবার (অবশ্য বহুদিন পূর্বে) কলিকাতা হইতে বোমা নিবার জন্য লোক পাঠাইয়াছিলেন বলিয়া উল্লেখ আছে। লেখক আজাদ সাহেবকে এই সংবাদ জানাইলে তিনি চুপ করিয়াছিলেন, প্রতিবাদ করেন নাই।

বাঙ্গালী বিপ্লবীরা বাংলার বাহিরে কেবলমাত্র বোমা-তৈরীর জ্ঞান ও উপকরণ যোগায় নাই, সেখানে ইহার ব্যবহারও করিয়াছে। এলাহাবাদ হইতে বম্বের পথে ভুসাওয়াল ও মনমদ ষ্টেশনের নিকট ট্রেনে এক প্রচণ্ড বিস্ফোরণ ঘটায় তিনজনের মৃত্যু হয় ও নয়জন আহত হয়। ঘটনাটি ঘটে ১৯২৮, ৭ই অক্টোবর। পুলিশ দুইজন বাঙ্গালীকে গ্রেপ্তার করে। অনুমান করা হয়, বম্বে শহরে সাইমন কমিশনের সদস্যদের উপর নিক্ষেপ করার জন্যই ঐ দুই বন্ধু নিজেদের তৈরী ডিনামাইট ও বোমা লইয়া ট্রেনে যাইতেছিলেন, পথিমধ্যে এই বিপদ ঘটে। বাংলার বাহিরে বাঙ্গালীরা বোমা তৈরীও করিয়াছে। লাহোরে দুইজন বাঙ্গালী গ্রেপ্তার হয় (২৪শে নভেম্বর, ১৯২৯)। বারাণসীতেও কয়েকজনকে গ্রেপ্তার করা হয়।

১৯২৯, ৮ই এপ্রিল, দিল্লীর কেন্দ্রীয় অ্যাসেম্বলি বা পার্লিয়ামেণ্ট সভায় দর্শকের গ্যালারী হইতে পঞ্জাবী ভগৎ সিংহ ও বাঙ্গালী বটুকেশ্বর দত্ত সভামধ্যে দুইটি বোমা নিক্ষেপ করেন, এবং রিভলভার ছোঁড়েন। কোন লোকের গায়ে যাহাতে আঘাত না লাগে সে-বিষয়ে তাঁহারা খুবই সতর্ক ছিলেন। গোলমালের মধ্যে তাঁহারা অনায়াসে পলাইতে পারিতেন, কিন্তু তাহা না করিয়া স্বেচ্ছায় ধরা দিলেন। বলিলেন, তাহাদের অভিযোগ কোন ব্যক্তির বিরুদ্ধে নয়–গভর্নমেন্টের এই প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে। এই অ্যাসেম্বলি উপকারের পরিবর্তে বহু অপকার করিয়াছে, অথচ সভ্য জগৎকে জানানো হইতেছে যে ইহা জনপ্রতিনিধি কর্তৃক পরিচালিত হয়। এই “ধোকার টাটির” স্বরূপ জগতের সামনে প্রকাশিত করিবার জন্যই বোমা ও বন্দুকের নিনাদ-কাহাকেও মারিবার জন্য নহে।

১৯৩০ সনে কলিকাতার কয়েক স্থানে ও মফঃস্বলে ময়মনসিংহের পুলিশ দারোগার বাসস্থানের উপর বোমা বিস্ফোরণ হয়।

২. ডাকাতি

১৯১৮ হইতে ১৯২২ পর্যন্ত ডাকাতির বিশেষ কোন বিবরণ পাওয়া যায় না। ১৯২৩ হইতে পুনরায় ডাকাতি আরম্ভ হয়।

১৯২৩ : স্থান —  লুণ্ঠিত অর্থের পরিমাণ

(ক) পরৈকোড়া (চট্টগ্রাম) ১,০০০

(খ) পাহাড়তলী (চট্টগ্রাম)

(গ) কোনা (হাওড়া)।

(ঘ) শাঁখারিটোলা (কলিকাতা) ডাকঘর

খ-নং ডাকাতিতে রেল-কর্মচারীদের বেতন নিয়া যে ঘোড়ার গাড়ী যাইতেছিল রিভলভার দেখাইয়া তাহার গাড়োয়ান ও তহবিলরক্ষীদের নামাইয়া দিয়া টাকাসমেত গাড়ী নিয়া ডাকাতেরা প্রস্থান করে। লুণ্ঠিত টাকার পরিমাণ অজ্ঞাত।

গ-নং ডাকাতিতে সংঘর্ষের ফলে ডাকাতেরা দুইজনকে খুন করিয়া একটি ট্যাক্সিতে উঠিয়া পলায়ন করে। পথে ট্যাক্সির চালককে গাড়ি হইতে ফেলিয়া দেয়। ঐ চালকের মৃতদেহ পরে পাওয়া যায়।

ঘ-নং ডাকাতিতে পোষ্টমাষ্টার নিহত হন। ডাকাতেরা পলায়ন করে, কিন্তু একজন ধৃত হয়।

এইরূপ আরও কয়েকটি ছোটখাট ডাকাতি হয়।

১৯৩০: স্থান – লুণ্ঠিত অর্থের পরিমাণ

(ক) রাজশাহী (ডাকপিওনের নিকট হইতে) ৩,৬৫০

(খ) কলিকাতা (আর্মেনিয়ান স্ট্রীটের গদি) ২,৩৪৬

(গ) কলিকাতা (গদি) ১৫,০০০

(ঘ) মূলচর (ঢাকা) ডাকঘরের টাকা ১,০০০

(ঙ) সেরাজদিখান (ঢাকা) ১,৩৪৭

(চ) মাধবপাশা (বরিশাল) ৩,৪৫১

(ছ) টাঙ্গাইলের পথে (সিম্ কোম্পানীর টাকা) ১৫,০০০

(জ) লালবাগ (ঢাকা) ইঞ্জিনীয়ারিং কলেজের ট্রেজারি বেয়ারা (পথে) ২,১০০

(ঝ) টঙ্গিবাড়ী (ঢাকা) ২,১৪৫

১৯৩১ : (ক) কাদিয়াদি (ময়মনসিংহ) ডাকঘরের পিওনের ব্যাগ ১,২৭২

(খ) ঢাকা (ফরাসগঞ্জে) পিওনের ব্যাগ হইতে ১,৫০০

(গ) জামালপুর (ময়মনসিংহ) ৭,৯৯৯

(ঘ) কুয়াপাড়া (ঢাকা) ২,০২২

(ঙ) নাগের গাও (ময়মনসিংহ) পিওনের হাতে ইনসিওর খাম ১,১১৫

(চ) ব্রাহ্মণবাড়িয়া (ত্রিপুরা) ১০,১৪২

(ছ) কাউখালি (ফরিদপুর) ২,৭৮৩

(জ) নন্দাইল (ময়মনসিংহ) ২,২৭৯

(ঝ) শিয়ালদহ রেলওয়ে ষ্টেশনের নিকট) ৪,৯৩৮

(ঞ) গৌরীপুর ঈশ্বরগঞ্জ স্টেশন (ময়মনসিংহ) ১,২০৬

(ট) নিতাইগঞ্জ (নারায়ণগঞ্জ, ঢাকা) ৮,৪৭৯

(ঠ) ঢাকা মিউনিসিপাল অফিস ৬,২০৬

(ড) রঘুনাথপুর (খুলনা) ২,০০০

(ঢ) নিয়ামতপুর (ময়মনসিংহ) ২,৩৩৩

(ণ) গচিহাটা (ঐ) ১,২৪৫

(ত) মাধবপাশা (ফরিদপুর) ১,৯৫০

(থ) কানাইঘাটি (ঐ) ডাকপিওনের ব্যাগ ২,৫০০

(দ) সেওয়া কাণ্ডা (ময়মনসিংহ) ২,৬০৮

(ধ) নরিয়া (ফরিদপুর) মেল পিওনের নিকট হইতে ১,৯০০

(ন) ধরবিলা (রাজশাহী) ডাকপিওনের নিকট হইতে ৯৯৫

আরও ১০/১৫টি ছোটখাট ডাকাতি সংঘটিত হয়, উহা তেমন উল্লেখযোগ্য নয়।

 ১৯৩২: (১) কুলিয়ারচর (ময়মনসিংহ) ২,৬০৮

(২) ঢাকা নীলক্ষেত (ঢাকার অনতিদূরে) রেলওয়ে লেভেল ক্রসিংয়ে ট্রেন হইতে টাকা লুণ্ঠিত হয়। টাকার পরিমাণ অজ্ঞাত।

ইহা ছাড়াও অনেকগুলি ছোটখাট ডাকাতির বিবরণ পাওয়া যায়।

ডাকাতির ঘটনায় পুলিশ আসামীকে হাতেনাতে ধরিতে পারিলে তো কথাই নাই, নচেৎ কয়েকজনকে আসামী খাড়া করিয়া মকদ্দমা চালায়। কোন কোন স্থানে প্রমাণ অভাবে আসামী খালাস পাইলেও অধিকাংশ ক্ষেত্রেই কারাদণ্ড হয়। কোন কোন স্থানে আসামীর যাবজ্জীবন কারাদণ্ড বা দ্বীপান্তর হইয়াছে এরূপ দৃষ্টান্ত পূর্বেই উল্লেখ করা হইয়াছে।

ইহা ছাড়াও যখন পরপর কয়েকটি ডাকাতিতে পুলিশ আসামীকে গ্রেপ্তার করিতে পারে নাই তখন পাইকারি হারে কতকগুলি ব্যক্তিকে নানাস্থানের ও বিভিন্ন সময়ের ডাকাতির অভিযোগে গ্রেপ্তার করিয়া তাহাদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের মামলা (Gang Case) দায়ের করিত; উপরন্তু অনেক ক্ষেত্রেই ডাকাতির সঙ্গে রাজদ্রোহ প্রভৃতি অন্য অনেক অপরাধ যোগ করিয়া দিত। এইরূপ কয়েকটির উল্লেখ করিতেছি।

(১) খুলনা-যশোহর ষড়যন্ত্র মামলা, কলিকাতা হাইকোর্টে (১৯১০) : কাহারও সাজা হয় নাই, সকলকেই মুচলেকাবদ্ধ করিয়া ছাড়িয়া দেওয়া হয়।

(২) হাওড়া ষড়যন্ত্র : দূরদূরান্ত হইতে এগারোটি বিভিন্ন দলের ব্যক্তিকে আসামী খাড়া করা হয়। শতাধিক লোক ধৃত হইয়াছিল, শেষপর্যন্ত ৪৬ জনের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের হইল। তন্মধ্যে মাত্র পাঁচ-ছয় জনের সাজা হয়। কিন্তু সরকারী রিপোর্টে বলা হইয়াছে যে, “প্রায় এক বৎসরব্যাপী ৫০ জন আসামীর বিরুদ্ধে এই মামলার ফলে কলিকাতার আশেপাশে ভদ্রলোকের ডাকাতি একেবারে থামিয়া যায়। পরে ১৯১৪ সনে যতীন্দ্রনাথ মুখার্জী নূতন দল গড়িয়া পুনরায় ডাকাতি আরম্ভ করে। ১৯১০ সনের ১লা ডিসেম্বর হইতে মামলা আরম্ভ হয় এবং ১৯১১ সনের ১৯শে এপ্রিল এই মামলার রায় দেওয়া হয়। ডাকাতির ঘটনা একেবারে বন্ধ হওয়ার মন্তব্য করা হয় ১৯১৮ সনের ১৫ই এপ্রিল। নিম্নলিখিত বিবরণ হইতে এই মন্তব্য কতদূর সত্য তাহা বুঝা যাইবে।

(৩) সেসনে ঢাকা ষড়যন্ত্র মামলার বিচার হয় ২২শে নভেম্বর, ১৯১০, হইতে ৬ই জানুআরি, ১৯১১, পর্যন্ত। অ্যাসেসাররা আসামীদের নির্দোষ বলিলেও জজসাহেব দণ্ড দিলেন : ৩ জনের যাবজ্জীবন দ্বীপান্তর, ১৮ জনের দশ বৎসর সশ্রম কারাদণ্ড ও ১৪ জনের সাত বৎসর সশ্রম কারাদণ্ড। হাইকোর্টে আপীল করিলে ২১ জন মুক্তি পান, ১৪ জনের দণ্ড বহাল থাকিলেও দ্বীপান্তরের ও কারাদণ্ডের মেয়াদ অনেক কমিয়া যায়।

(৪) বরিশালে (১৯১৩) ২৬ জনের বিচার হয়। সাতজনের দ্বীপান্তর (১২, ১০ ও ৭ বছর) ও পাঁচজনের কারাদণ্ড হয়।

(৫) মাদারিপুরে (১৯১৩) ৪৬ জন আসামীকে চালান দেওয়া হয়। কিন্তু সাক্ষী ও প্রমাণের অভাবে মামলা প্রত্যাহার করা হয়।

(৬) বরিশালে (দ্বিতীয় মামলা ১৯১৫) পাঁচজন আসামীর মধ্যে ত্রৈলোক্য চক্রবর্তী ও আর এক জনের ১০ বৎসর এবং তৃতীয় জনের ৭ বছরের দ্বীপান্তর হয়। বাকী দুইজন মুক্তি পান।

বঙ্গদেশের বাহিরে বারানসীতে এক ষড়যন্ত্র মামলা রুজু হয় (১৯১৫-১৬)। বাঙ্গালী শচীন্দ্রনাথ সান্যাল যে বিপ্লবীদল গঠন করেন তাহাদের বিরুদ্ধেই এই মামলা। তিন দফা অভিযোগের প্রত্যেকটিতে শচীন্দ্রনাথের যাবজ্জীবন (সমকালীন) দ্বীপান্তর হয়। আরও পাঁচজন বাঙ্গালী সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডিত হয়।

উত্তরপ্রদেশে লক্ষ্ণৌ হইতে ১৪ মাইল দূরে কাকোরী রেলওয়ে স্টেশন হইতে গাড়ী ছাড়িবার পর ট্রেনে যে ডাকাতি হয় (১৯২৫) তাহার জন্য বিখ্যাত কাকোরী ষড়যন্ত্র মামলা দায়ের হয়। এ মামলার রায়ে একজন বাঙ্গালীর মৃত্যুদণ্ড, চারিজন বাঙ্গালীর যাবজ্জীবন দ্বীপান্তর এবং চারিজন বাঙ্গালীর ৫ হইতে ১৪ বৎসর সশ্রম কারাদণ্ডের আদেশ হয়।

৩. সরকারী কর্মচারী ও গুপ্তচর হত্যা

১৯২৪ : (১) পুলিশ বিভাগের বড়কর্তা চার্লস টেগার্টকে বিপ্লবীরা ন্যায্য কারণেই তাঁহাদের পরম শত্রু মনে করিতেন। তাঁহাকে হত্যা করার জন্য গোপীমোহন সাহা কলিকাতা পার্ক স্ট্রীট ও চৌরঙ্গীর সংযোগস্থলে উপস্থিত হন। টেগার্টের ছবির সহিত সাদৃশ্য দেখিয়া তিনি ভ্রমক্রমে আরনেষ্ট ডে (Enest Day) নামক এক সাহেবকে গুলি করিয়া হত্যা করেন (১২ জানুআরি)। কিন্তু পলায়নের সময় কিছু লোক তাঁহার পিছু ধাওয়া করে এবং তিনি ধরা পড়েন। বলা বাহুল্য, অশেষ নির্যাতনের পর বিচারে তাহার ফাঁসি হয়। এই ঘটনা সম্বন্ধে বঙ্গীয় প্রাদেশিক কংগ্রেস সভায় তাঁহার সম্বন্ধে সপ্রশংস সহানুভূতিসূচক প্রস্তাব গৃহীত হওয়াতে মহাত্মা গান্ধী ও চিত্তরঞ্জন দাশের মধ্যে যে গুরুতর মতবিরোধ ও মনোমালিন্য হয় অন্যত্র তাহা বিবৃত হইয়াছে। বিচারালয়ে মামলা যখন প্রায় শেষ হইয়াছে তখন গোপীমোহন যে উক্তি করেন তাহাতে এই শ্রেণীর বিপ্লবীদের মনোভাবের পরিচয় পাওয়া যায়। এইজন্যই ইহার কিয়ংদশ এখানে উদ্ধৃত করিতেছি :

“আজ আমার বড় শুভদিন। মা আমাকে ডাকছেন, আমি যেন তার বক্ষে চিরতরে আশ্রয় নিতে পারি। আমি সেইজন্য যেতে চাই। গত বৎসরের প্রথমদিকে আমি পত্রিকায় পড়ি যে আমাদের সকল প্রচেষ্টা ব্যর্থ করার জন্য টেগার্ট ফিরে আসছেন। তখন আমি গভীর চিন্তা কর্তে থাকি। যখনই এ বিষয়ে ভেবেছি তখনই আমার মাথা গরম হয়ে উঠেছে। আমি ভাল করে খেতে পারিনি, শান্ত হয়ে দিনে রাতে ঘুমুতে পারিনি। সারা রাত্রি ছাদের ওপর পাইচারি করে বেড়িয়াছি। এমন সময় আমি মায়ের আদেশ শুনতে পেলাম, তার পিছু নাও’।…তারপর ইতিকর্তব্য সম্বন্ধে আমি গভীর চিন্তা কর্তে লাগলাম। মনের যখন এ অবস্থা, তখন মা বললেন, ‘ওকে জগৎ থেকে দূর কর’। নিরীহ যে সাহেবকে আমি খুন করেছি, তাঁর জন্য আমি আন্তরিক দুঃখিত। সাহেব-মাত্রেই আমার শত্রু নয়।….আমার দেহের প্রতি রক্তবিন্দু ভারতের প্রতি গৃহে স্বাধীনতার বীজ রোপণ করবে। যতদিন ভারতবর্ষে জালিয়ানওয়ালাবাগ ও চাঁদপুরের মত অত্যাচার চলবে ততদিন এ অবস্থা বিরাম হবে না।”

(২) সাব-ইন্সপেকটর প্রফুল্লকুমার রায় কয়েকটি বিপ্লবঘটিত ব্যাপারে দক্ষতার সহিত তদন্ত করেন। চট্টগ্রামে পল্টনের মাঠে তাঁহাকে হত্যা করা হয় (২৫শে মে)।

১৯২৬ : সি-আই-ডি বিভাগের স্পেশ্যাল সুপারিনটেনডেন্ট ভূপেন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায় একজন সুদক্ষ কর্মচারী; বহু বিপ্লবীকে ধরিয়া জেলে দিয়াছেন। সুতরাং তাঁহার প্রতি বিপ্লবীদের বিষম আক্রোশ ছিল। আলিপুর সেন্ট্রাল জেলে আবদ্ধ দুইজন বিপ্লবী আসামী লক্ষ করে যে, তিনি প্রতি সন্ধ্যায় অন্য ওয়ার্ডে আবদ্ধ ডেটিনিউ (detenue)-দের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। আসামীদের ধারণা হয়, তিনি নানাপ্রকার প্রলোভন ও আশ্বাস-বাক্য দিয়া তাহাদের নিকট হইতে গুপ্ত সংবাদ সংগ্রহের চেষ্টায় আছেন। সুতরাং তাঁহাকে সরানো দরকার। দুইজন আসামী মিলিয়া তাঁহাকে হত্যা করিবার ব্যবস্থা করিল। একদিন ভূপেন্দ্রকে আসিতে দেখিয়া একজন আসামী ছুটিয়া আসিয়া ওয়ার্ডারকে বলিল, উপর থেকে আমার কাপড়খানা পড়ে গেছে। দরজাটা খুলে দাও, কাপড়খানা নিয়ে আসি। দরজাটা খুলিবামাত্র উক্ত আসামী ভূপেন্দ্রকে ডাক দিল, মশাই, শুনছেন। ভূপেন্দ্র থামিয়া মুখ ফিরাইতেই আসামী ভূপেন্দ্রের নাকে এক বিষম ঘুষি দিল। ওয়ার্ডার তাঁহার সাহায্যে অগ্রসর হইলে দ্বিতীয় আসামী একটা লোহার ডাণ্ডা দিয়া ভূপেন্দ্রের মাথায় সজোরে আঘাত করিতে থাকিলে ভূপেন্দ্রের তৎক্ষণাৎ মৃত্যু হইল। কুস্তি লড়িবার জায়গায় মাটির তলায় এই ডাণ্ডাটি পাওয়া গেল।

১৯২৯ : বরিশাল শহরে টাউন হলে একটি রাজনৈতিক সভা ভঙ্গ হওয়ার পর পুলিশের দারোগা যতীশচন্দ্র রায় সাইকেল চড়িয়া ফিরিবার পথে চৌদ্দ বছর বয়সের বালক রমেশচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের হাতে নিহত হন। রমেশ দ্রুতবেগে ছুটিয়া আসিয়া তাহার বুকে ছুরিকাঘাত করে। যতীশের মৃতদেহ মাটিতে লুটাইয়া পড়ে (২০শে মার্চ)। হত্যাকারী তখনই ধৃত হয় এবং বিচারে প্রথমে মৃত্যুদণ্ড ও পরে হাইকোর্টে আপীলে যাবজ্জীবন দীপান্তর হয়।

১৯৩০ : (১) চাঁদপুর রেলওয়ে ষ্টেশনে দুইজন যুবক রেল পুলিশের ইন্সপেক্টর তারিণী মুখোপাধ্যায়কে হত্যা করে (১লা ডিসেম্বর)।

(২) আইন অমান্য আন্দোলনের সময় মেদিনীপুর জিলার চেচুয়াহাটে পিকেটিং আরম্ভ হয়। বড় দারোগা ভোলানাথ ঘোষ ও তাঁহার সহকারী অনিরুদ্ধ সামন্ত সেখানে উপস্থিত হইয়া চারিজন স্বেচ্ছাসেবককে গ্রেপ্তার করেন। একজনের সঙ্গে কিছু বচসা হওয়ায় তাহাকে বেত দিয়া মারেন, সঙ্গে সঙ্গে কনস্টেবলেরাও বেপরোয়াভাবে লাঠি চালায়। উপস্থিত জনতা এই সময়ে উত্তেজিত হইয়া উঠে। অতিরিক্ত প্রহারের ফলে ভোঁসলানাথের মৃত্যু হয় এবং অনিরুদ্ধকে জনতা ধরিয়া লইয়া যায়। অতঃপর তাহার আর কোন সন্ধান মিলিল না (৩রা জুন)।

(৩) চট্টগ্রাম জিলার কিশোরগঞ্জ রামানন্দ স্কুলের প্রধান শিক্ষক সতীশচন্দ্র রায় নিহত হন (১লা মার্চ)। কারণ অজ্ঞাত।

(৪) গুপ্তচর সন্দেহে ভূপেন্দ্র রাহাকে হত্যা করা হয়। ২৪শে মার্চ তাঁহার ক্ষতবিক্ষত মৃতদেহ ময়মনসিংহ টাউন রেলষ্টেশনের নিকট পাওয়া যায়।

(৫) ঐ একই কারণে রতনভূষণ হাজরাকেও খুন করা হয়। তাহার মৃতদেহ কলিকাতা দেশবন্ধু পার্কে আবিষ্কৃত হয় (২৯শে অগষ্ট)।

এই বৎসর দুইটি বিশেষ গুরুতর ও চাঞ্চল্যকর রাজনীতিক হত্যাকাণ্ড অনুষ্ঠিত হয়–একটি ঢাকায়, আর একটি কলিকাতায়।

(৬) বাংলার গুপ্ত সন্ধান বিভাগের (I. B.) পুলিশপ্রধান (Inspector General of Police, I. B.) মি. লোম্যান ঢাকায় আসিয়া একজন পীড়িত শ্বেতাঙ্গ পুলিশ কর্মচারীকে দেখিবার জন্য প্রাতঃকালে মিটফোর্ড হাসপাতালে যান। সঙ্গে ছিলেন ঢাকার পুলিশ বিভাগের বড়সাহেব হাডসন (২৯শে অগষ্ট)। রোগীকে ‘দেখিয়া হাসপাতালের সুপরিসর প্রাঙ্গণে দাঁড়াইয়া তিনি কথাবার্তা বলিতেছেন, এমন সময় বিপ্লবী যুবক বিনয় বসু প্রায় ২০/২৫ হাত দূর হইতে পাঁচবার গুলি নিক্ষেপ করেন। পাঁচটি গুলিই ঐ দুই সাহেবের গায়ে লাগে। গুলি শেষ হইলেই বিনয় ও তাঁর দুই সঙ্গী ছুটিতে আরম্ভ করিলেন। সত্যেন সেন নামে একজন কন্ট্রাক্টর অদূরে দাঁড়াইয়াছিল। সে একজনকে জাপটাইয়া ধরিল, কিন্তু যুবকটি এক ঝটকায় নিজেকে মুক্ত করিয়া তিনবন্ধুসহ নিকটবর্তী মেডিক্যাল কলেজ হোষ্টেলের মধ্যে অদৃশ্য হইয়া গেল। তারপর আবার তাঁহাদের সন্ধান মিলিল তিনমাস পরে কলিকাতা মহাকরণে। পরে এই ঘটনার বিবরণ লিপিবদ্ধ হইবে। লোম্যান সাহেবকে অস্ত্রোপচারের জন্য কলিকাতায় পাঠান হইল, কিন্তু দুইদিন পরেই তাঁহার মৃত্যু হইল। হাডসন সাহেবের আঘাত অত্যন্ত গুরুতর ছিল বলিয়া তাহাকে কলিকাতায় পাঠান সম্ভব হইল না। স্থানীয় এক বাঙ্গালী ডাক্তার (সুরেশবাবু) অস্ত্রোপচার করেন এবং তিনি বেশ কিছুদিন পরে সুস্থ হইয়া উঠেন।

এই ঘটনার সময় এই গ্রন্থের লেখক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও স্থানীয় এক বৃহৎ ছাত্রাবাসের অধ্যক্ষ ছিলেন। সত্যেন্দ্রবাবু তাঁহার পরিচিত। দুই এক দিন পর তাঁহার নিকট হইতে সকল ঘটনা শুনিয়া গ্রন্থকার তাঁহাকে বলিলেন, “আপনার এই বিশাল পালোয়ানের মত দেহ-একটি ক্ষীণকায় যুবক আপনাকে ঝটকা মারিয়া নিজেকে ছাড়াইয়া লইল, ইহা অনেকে বিশ্বাস করে না-বলে, সত্যেনবাবু তাহাকে পাকড়াইবার একটা ভাণ করিয়া ইচ্ছা করিয়াই পলায়নের সুযোগ দিয়াছেন, যাহাতে সরকারও খুশী থাকে আবার দেশবাসীরাও নিন্দা বা ঘৃণা না করে।” তিনি বলিলেন, “এই কাহিনী রটিলে আমার সর্বনাশ হইবে-আপনি সকলকে বুঝাইয়া বলিবেন।” আমি রাজী হইলাম, কিন্তু সত্যেনবাবুর কথাবার্তার ধরনে মনে হইল যে, লোকের বিশ্বাস একেবারে অমূলক নহে। বিশেষতঃ লেখক বেশ ভালভাবেই জানিতেন যে, তিনি বিনয়কে এবং সম্ভবতঃ তাহার সঙ্গীদ্বয়কেও বিলক্ষণ চিনিতেন। মনে হয়, সত্যেনবাবুর নিকট হইতেই পুলিশ এই যুবকদের নামধাম পায়। ইহা আমার অনুমান মাত্র। কিন্তু দুই-তিন ঘণ্টার মধ্যেই শহরময় ছড়াইয়া পড়িল যে এই আততায়ী বিপ্লবী বিনয়।

পুলিশ মেডিক্যাল কলেজের হোষ্টেলে ঢুকিয়া ছাত্রদের উপর অকথ্য অত্যাচার করে। সমস্ত শহর তাহারা তোলপাড় করিল এবং প্রতিটি রেলওয়ে ও ষ্টীমার ষ্টেশনে পলাতক আততায়ীদের সন্ধানের জন্য ব্যবস্থা করিল। আততায়ীরা কিন্তু ঢাকা শহরেই ছিল। দুইদিন পরে লেখকের বিশেষ পরিচিত ছাত্রাবাসের ডাক্তার তাঁহাকে রুদ্ধশ্বাসে বলিলেন, ঘণ্টাখানেক পূর্বে একটি কুখ্যাত পল্লীর নিকট লুঙ্গিপরিহিত মুসলমানের বেশে বিনয় যাইতেছিল, তাঁহার মুখোমুখী হওয়ায় চোখের ইসারা করিয়া চলিয়া গেল। ইহার বেশ কয়েকদিন পরে বিনয় ও সঙ্গীরা রেলের পথে কলিকাতায় যায়। পথে অন্যান্য কামরায় পুলিশের খোঁজাখুঁজির সংবাদ পাইয়া ছদ্মবেশী বিনয় অসুস্থতার ভান করিয়া শুইয়া থাকে–পুলিশ ঢুকিয়াছিল, কিন্তু তাহাকে চিনিতে পারে নাই।

আর একটি ঘটনার উল্লেখ করিয়াই এই কাহিনীর শেষ করিব। ঘটনার ২০। ২৫ দিন পরে এই লেখকের একটি ছাত্র আসিয়া তাহাকে বলিল, হত্যাকাণ্ডের পূর্বদিন বিনয় ছাত্রাবাসে আসিয়াছিল এবং তাহার এক বন্ধুকে বলিয়াছিল যে, হয়ত বহুদিনের মধ্যে আর দেখাসাক্ষাৎ হইবে না। ছাত্রটি আরও বলিল, ঐদিন তাহার সঙ্গে যে আর একটি যুবক লেখকের বাড়ীতে আসিয়া তাহাকে প্রণাম করিয়াছিল সে-ই বিনয়। লেখকের সঙ্গে বিনয়ের সেই প্রথম ও শেষ সাক্ষাৎ।

(৭) ৮ই ডিসেম্বর ১৯৩০। তিনটি যুবক কলিকাতার এক বাড়ীতে একসঙ্গে বসিয়া পূর্বের ফরমায়েস মত নানাবিধ সুখাদ্যযোগে তৃপ্তির সহিত মধ্যাহ্নভোজন করিয়া সাহেবী পোশাকে বাড়ী হইতে বাহির হইলেন। কয়েকজন পুরুষ ও মহিলা চোখের জলে তাঁহাদের বিদায় দিলেন। এই তিনটি যুবক পূর্বোক্ত বিনয় বসু, সুধীর গুপ্ত (বাদল) ও দীনেশ গুপ্ত। সাড়ে বারোটার সময় তাঁহারা মহাধিকরণের (Writers’ Buildings) বিশাল ভবনের দোতলায় উঠিয়া কারা-বিভাগের প্রধান (Inspector General of Prisons) Fyastal 169677 (N. G. Simpson) PC* প্রবেশ করিয়াই গুলি ছুঁড়িলেন এবং সঙ্গে সঙ্গে সাহেব মাটিতে পড়িয়া গেলেন। পার্শ্বে দণ্ডায়মান বাঙ্গালী কর্মচারীটি টেবিলের তলায় ঢুকিয়া আত্মরক্ষা করিলেন। পুলিশ-প্রধান ও তাঁহার সহকারী গুলির শব্দ শুনিয়া বাহিরে আসিয়াই যুবকদের লক্ষ করিয়া গুলি ছুঁড়িলেন–তাহা কিন্তু কাহারও গায়ে লাগিল না। বিচারবিভাগীয় সেক্রেটারীও বাহিরে আসিবামাত্র তাঁহার ঊরুতে যুবকদের নিক্ষিপ্ত গুলি বিদ্ধ হইলেও কোনরকমে ঘরে ঢুকিয়া তিনি আত্মরক্ষা করিলেন। যুবকত্রয় দীর্ঘ বারান্দা দিয়া চলিতে চলিতে ইহার পূর্বপ্রান্তে পৌঁছিলেন। প্রত্যেকেই যুবকদের রণমূর্তি দেখিয়া ঘরে ঢুকিয়া আত্মরক্ষা করিলেন। একজন শ্বেতাঙ্গ দরজা একটু ফাঁক করিয়া ভিতর হইতেই গুলি ছুঁড়িলেন, উহা লক্ষ্যভ্রষ্ট হইল। যুবকেরা শেষপ্রান্তের কক্ষমধ্যে প্রবেশ করিলেন। চারিদিকে হুলস্থূল–নিকটবর্তী লালবাজার পুলিশকেন্দ্র হইতে পুলিশ আসিয়াছে। অনেকক্ষণ পরে ভয়ে-ভয়ে অতি সন্তর্পণে একটি কনষ্টেবল ঐ শেষ কক্ষটিতে ঢুকিয়া দেখিল, দুইজন গুরুতররূপে আহত ও ভূপতিত–গুলিতে আত্মহত্যার চেষ্টা সফল হয় নাই–রিভলভার ও কার্তুজ পাশেই পড়িয়া আছে। তৃতীয় যুবক চেয়ারে উপবিষ্ট, মাথাটি টেবিলের উপর হেলিয়া পড়িয়াছে। নিকটেই খানিকটা সাদা গুঁড়া পড়িয়া আছে, অর্থাৎ তিনি পটাসিয়াম সায়েনাইড খাইয়া আত্মহত্যা করিয়াছেন। মৃত সুধীরকে শবব্যবচ্ছেদাগারে এবং আহত বিনয় ও দীনেশকে জেল-হাসপাতালে দেওয়া হইল। সামান্য জ্ঞান লাভ করিয়াই বিনয় মাথার ব্যাণ্ডেজ খুলিবার চেষ্টা করিলেন–১৩ই ডিসেম্বর তাঁহার মৃত্যু হইল। মৃত্যুকালে তিনি বলেন, তিনিই লোম্যানের হত্যাকারী।

অস্ত্রোপচার ও চিকিৎসার ফলে দীনেশ সুস্থদেহে কিছুদিন জেলে বাস করেন। ৭ই জুলাই আলিপুর সেন্ট্রাল জেলে তাহার ফাঁসি হয়। সুদীর্ঘকাল সুস্থদেহে জেলে বাস করার সময় দীনেশ আত্মীয়স্বজনের নিকট যে-কয়খানা চিঠি লিখিয়াছিলেন তাহাতে প্রকৃত বিপ্লবীর আদর্শ ও লক্ষ্য এবং মৃত্যুর প্রতি উপেক্ষার মনোভাব অসাধারণরূপে ফুটিয়া উঠিয়াছিল। এই কয়খানি পত্র ‘বসুধারা’ নামক বাংলা মাসিক পত্রিকায় প্রকাশিত হইয়াছিল। মৃত্যুদণ্ডের সংবাদে তাঁহার শোকসন্তপ্তা মাতা ও ভ্রাতৃজায়াকে এই উনিশ বছরের যুবক যে-ভাষায় প্রবোধ দিয়াছেন তাহা পড়িলে মনে হয় গীতার দার্শনিক তত্ত্ব তিনি সম্পূর্ণভাবে জীবনে উপলব্ধি করিয়াছিলেন। জ্যেষ্ঠ ভ্রাতৃজায়াকে লিখিয়াছিলেন, “কিসে যে তোমাদের মনে শান্তি আসিতে পারে তুমি তাহার উপায় আমাকে জিজ্ঞাসা করিয়াছ। …আমরা হিন্দু…আমরা জানি মরণ আমাদের হয় না, হয় এই নশ্বর দেহের। কিন্তু আত্মা অবিনশ্বর। সেই আত্মাই আমি। আর সেই আত্মাই ভগবান…।

“তুমি বলিবে–এসব কথা তো আমিও জানি, কিন্তু মন তো শান্তি মানিতে চায় না। মন শান্ত করিবার একমাত্র উপায় ভগবানে আত্মসমর্পণ। ইহা ভিন্ন শান্তি পাইবার আর কোন উপায় নাই। আমরা যতই জপতপ করি, ফোঁটা তিলক কাটি

কেন, কিন্তু তাঁকে আমরা ভালোবাসিতে পারি কই? তাঁকে যে ভালবাসিতে পারে, মরণ তো আর কাছে একটি ফাঁকা আওয়াজ মাত্র। তাঁকে তেমন করিয়া ভালবাসিয়াছিল বাঙলার নিমাই, প্রেমাবতার যীশুখৃষ্ট–আর আমাদেরই দেশে যেসব ছেলেরা হাসিমুখে মরণকে বরণ করিয়া লইতে পারিয়াছিল তারা।

“তোমার মনে থাকিতে পারে, তোমার চুল দিয়া আমি পুতুল নাচাইতাম; পুতুল আসিয়া গান গাহিত। যে পুতুলের পার্ট শেষ হইয়া যাইত তাহাকে আর ষ্টেজে আসিতে হইত না। ভগবানও আমাদের দিয়া পুতুলনাচ নাচাইতেছেন। আমরা এক-একজন পৃথিবীর রঙ্গমঞ্চে পার্ট করিতে আসিয়াছি! পার্ট করা শেষ হইলে প্রয়োজন ফুরাইয়া যাইবে। তিনি রঙ্গমঞ্চ হইতে আমাদের সরাইয়া লইয়া যাইবেন, ইহাতে আফশোষ করিবার আছে কি?”

এরূপ বহু উদ্ধৃতি দীনেশের চিঠি হইতে দেওয়া যায়, বাহুল্য ভয়ে উহা হইতে নিবৃত্ত রহিলাম। যাহাতে বাংলার তরুণ বিপ্লবীদের চিন্তা ও আদর্শ আমাদের ও ভবিষ্যদ্বংশীয়দের মনে যথোচিত শ্রদ্ধা ও ভক্তি জাগরূক করিতে পারে এবং তাহাদের হিংসাত্মক কার্যাবলী তাঁহাদের প্রকৃত মহত্ত্ব ও মনুষ্যত্বের উচ্চ আদর্শকে আবৃত করিয়া না রাখে, এইজন্যই এত কথা লিখিলাম।

১৯৩০ সনে মহাত্মা গান্ধীর অহিংস আইন অমান্য আন্দোলনে মানবিকতার যে উচ্চ আদর্শের পরিচয় পাই, তাহার সঙ্গে সঙ্গে ঐ বৎসরই বিনয়-বাদল দীনেশের এবং চট্টগ্রামে মাষ্টারদার দলের হিংসাত্মক কার্যে স্বেচ্ছায় ও অকুতোভয়ে আত্মোৎসর্গ, আত্মবিসর্জন এবং মানবিকতার উচ্চ আদর্শের উদাহরণগুলি একই পর্যায়ে পাশাপাশি রাখিলে খুব অসঙ্গত হইবে না। ইতিহাসে কিন্তু এই শেষোক্ত উদাহরণগুলি স্থান পায় নাই–গান্ধীর প্রভাবে রাজনীতিক্ষেত্রেও ইঁহাদের স্মৃতির যথোচিত সমাদর হয় নাই। সুখের বিষয়, কলিকাতার ডালহৌসী স্কোয়ারকে ‘বিনয়-বাদল-দীনেশ (সংক্ষেপে, বি-বা-দী) বাগ’ নামে অভিহিত করিয়া বিনয় বসু, সুধীর গুপ্ত (বাদল) ও দীনেশ গুপ্তের ন্যায় তরুণ বাঙ্গালীর হিংসাত্মক কার্যের মধ্যেও উচ্চ মানবিকতার যে আদর্শ বিরাজমান ছিল, তাহার প্রতি যোগ্য মর্যাদা দেওয়া হইয়াছে।

১৯৩১ : (১) মেদিনীপুরে বিপ্লবীদের গুলিতে পর পর তিনজন জিলা ম্যাজিষ্ট্রেট নিহত হন। তন্মধ্যে জেমস্ পেডিই প্রথম বলি। স্থানীয় কলেজিয়েট স্কুলে এক প্রদর্শনী উদ্বোধনের আমন্ত্রণে ১৭ই এপ্রিল তিনি সেখানে যান। এই জনাকীর্ণ স্থানে দুইজন যুবক তাঁহাকে গুলি করে, পরদিন তাঁহার মৃত্যু হয়।

(২) দীনেশ গুপ্তকে যে জজসাহেব মৃত্যুদণ্ড দিয়াছিলেন তাঁহার নাম গার্লিক (R. R. Garlick)। দীনেশের ফাঁসির ঠিক এক বৎসর কুড়িদিন পরে (২৭শে জুলাই) তিনি আলিপুরের সেসন জজের কোর্টে একটি মামলার শুনানিতে ব্যস্ত ছিলেন; এমন সময় একটি যুবক পশ্চাৎদিকের একটি দরজা দিয়া প্রবেশ করিয়া সাক্ষীর কাঠগড়া হইতে পরপর দুইটি গুলি চালাইলে তাঁহার মৃত্যু হয়। পুলিশ সার্জেন্টের গুলিতে যুবকেরও মৃত্যু হয়। তাহার পকেটে এক টুকরা কাগজে লেখা ছিল, “ধ্বংস হও; অবিচারে দীনেশ গুপ্তের ফাঁসি দেওয়ার পুরস্কার লও। ইতি বিমল গুপ্ত।”

এই যুবকটির প্রকৃত নাম কানাইলাল ভট্টাচার্য। একজন বিপ্লবী নেতার নিকট হইতে তাড়াতাড়ি কোন কাজের ভার পাইবার জন্য সে পীড়াপীড়ি করিতে কে। রিভলভার ছোঁড়ায় প্রথমবার লক্ষ্যভেদ করিতে সমর্থ না হইলেও দ্বিতীয়বারেই কৃতকার্য হওয়ায় নেতা বিস্ময়াভিভূত হন। যুবকটি কলিকাতার নিকটবর্তী জয়নগর মজিলপুরের অধিবাসী এবং অল্পদিন পূর্বেই স্কুলের পড়া শেষ করিয়াছিল।

(৩) ১৪ই ডিসেম্বর প্রাতঃকালে বেলা প্রায় দশটার সময় কুমিল্লার ম্যাজিষ্ট্রেট ষ্টীভেনস্ (C. G. B. Stevens) নিজের বাড়িতে সাবডিভিশন অফিসারের সহিত কথা বলিতেছেন, এমন সময় তাঁহার বেয়ারা একটি কার্ড লইয়া আসিল। কার্ডে ইলা সেন ও মীরা দেবী এই দুইটি দর্শনপ্রার্থীর নাম লেখা ছিল। সাহেব দরজার দিকে আগাইয়া আসিলে একটি মেয়ে তাহার হাতে একখানা দরখাস্ত দেয় এবং অপর মেয়েটি হঠাৎ রিভলবার বাহির করিয়া মাত্র দুই হাতের ব্যবধান হইতে গুলি করে এবং সাহেবের তৎক্ষণাৎ মৃত্যু হয়। পরে জানা যায়, মেয়ে দুইটি অষ্টম মানের ছাত্রী এবং ইহাদের প্রকৃত নাম শান্তি ঘোষ ও সুনীতি চৌধুরী। দুইজনই সঙ্গে সঙ্গে ধরা পড়ে।

“তাদের দেহ তল্লাসীতে যে শালীনতাবর্জিত পদ্ধতি অবলম্বিত হয়েছিল তার তুলনা নাই, এ সকল ব্যাপারে ইংরেজের সমস্ত কুৎসিত ঘটনাকে অতিক্রম করে গিয়েছিল।”[৩] তাহাদের নিকট দুইটি রিভলভার পাওয়া গেল। কোনটারই লাইসেন্স ছিল না। বিচারে তাহাদের যাবজ্জীবন দ্বীপন্তরের আদেশ হইয়াছিল। বিপ্লবী নারীর হাতে রাজকর্মচারীর হত্যার দৃষ্টান্ত বোধ হয় ইহাই প্রথম।

(৪) পুলিশমহলে খুব নামকরা ডি.আই.বি. ইন্সপেক্টর শশাঙ্ক ভট্টাচার্যকে ১৬ই মার্চ চট্টগ্রামের একটি গ্রামে খুন করা হয়।

(৫) ইহার পাঁচ মাস পরে চট্টগ্রামে আর একটি হত্যাকাণ্ড অনুষ্ঠিত হয়। ‘চট্টগ্রাম রিপাবলিক্যান আর্মি’ গঠন, ইহার নেতা সূর্য সেনের (মাষ্টারদা) নেতৃত্বে চট্টগ্রামের অস্ত্রাগার-লুণ্ঠন ও ব্রিটিশসৈন্যের সহিত বিপ্লবীদের সম্মুখসংগ্রামের বিস্তৃত বিবরণ এই গ্রন্থের অন্যত্র দেওয়া হইয়াছে। চট্টগ্রামের ডেপুটি সুপারিনটেনডেন্ট আসানুল্লাহ্ এই ঘটনার পর বিপ্লবী অথবা বিপ্লবীসন্দেহে বহু ব্যক্তির উপর অত্যাচার ও নির্যাতন চালাইতেছিলেন। এজন্য বিপ্লবীরা তাঁহাকে সরাইবার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করিল। ৩০শে অগষ্ট ফুটবল খেলার মাঠে পুলিশদল প্রতিযোগিতায় জয়লাভ করিয়া রেলওয়ে কাপ’ লাভ করে। প্রতিনিধি হিসাবে আসানুল্লাহ্ সাহেব পুরস্কারের কাপটি গ্রহণ করিতে অগ্রসর হইবামাত্র মাষ্টারদার নির্বাচিত তরুণ হরিপদ ভট্টাচার্য ভীড়ের মধ্য হইতে আসিয়া চারিবার গুলি করিল এবং আসানুল্লাহ্ সাহেবের তৎক্ষণাৎ মৃত্যু হইল। যুবক ধৃত হইলে তাহার উপর যে অকথ্য পীড়ন চলিল তাহা বর্ণনা করা সম্ভব নহে। কিন্তু, ব্যাপারটা এখানেই থামিল না, ইহার অব্যবহিত পরেই “চট্টগ্রাম শহরে ও বহু গ্রামাঞ্চলে তদানীন্তন জেলা শাসক ও বেসরকারী ইউরোপীয়ানদের প্ররোচনায় পুলিশ ও মিলিটারী কর্তৃক হিন্দুসম্প্রদায়ের উপর অমানুষিক অত্যাচার, লুণ্ঠন, গৃহ ও দোকানপাট দাহ ও বিবিধ নিগ্রহ” চলিতে থাকিল। দেশপ্রিয় যতীন্দ্রমোহন সেনগুপ্ত নানাস্থানে ভ্রমণ করিয়া অনেক প্রমাণ সংগ্রহ করেন এবং প্রকাশ্যে ঘোষণা করেন, ইহা সাম্প্রদায়িক কলহ নহে এবং জিলা-শাসক, পুলিশবাহিনী ও বেসরকারী ইউরোপীয়গণই এই নৃশংস অত্যাচার ও দমনলীলার জন্য সম্পূর্ণ দায়ী। কলিকাতা টাউন হলে এক বিরাট জনসভায়, যতীন্দ্রমোহন চট্টগ্রামের লোমহর্ষক ঘটনাবলীর মর্মস্পর্শী বিবরণ দিয়া গভর্নমেন্টকে তাঁহার অভিযোগ যে অসত্য বা অতিরঞ্জিত তাহার প্রমাণ দিতে আহ্বান করেন। ইহর ফলে সমগ্র বঙ্গদেশে সরকারী অত্যাচারের তীব্র নিন্দা সোচ্চার হইয়া উঠিল। গভর্নমেন্ট একটি তদন্ত কমিটি বসাইলেন বটে, কিন্তু তাঁহাদের রিপোর্ট প্রকাশ করিলেন না। তবে জানা যায় যে, এইসব নৃশংস অত্যাচারের নেতা পুলিশ বিভাগের বড়সাহেব শুটার (Mr. Shooter) আত্মহত্যা করেন এবং জিলা শাসন Mr. Kemm অবসর গ্রহণ করিয়া দেশে ফিরিয়া যান। ইহা ছাড়াও চট্টগ্রামের পুলিশ কর্মচারীদের মধ্যে কেহ কেহ সাময়িকভাবে পদচ্যুত (suspend) হয়, কেহ বা বদলী হয়।

১৯৩২ : (১) ১৯৩১ সনে নিহত পেডি সাহেবের স্থানে ডগলাস সাহেব (R. Douglas) মেদিনীপুরে ম্যাজিষ্ট্রেট হইয়া আসেন। ৩০শে এপ্রিল জিলা বোর্ডের অধিবেশনের সময় দুইটি যুবক সভাগৃহে ঢুকিয়া তাহাকে গুলি করে এবং চারি ঘণ্টা পরে তাহার মৃত্যু হয়। দুইজন আততায়ীর মধ্যে একজন পলাইয়া যায়। যে ধরা পড়ে তাহার নাম প্রদ্যোকুমার ভট্টাচার্য। তাহার নিকটে প্রাপ্ত রিভলভারটিতে পাঁচটি গুলি ভরাই ছিল, অর্থাৎ কোন কারণে খারাপ হইয়া যাওয়ায় রিভলভার হইতে গুলি বাহির হয় নাই। অবশিষ্ট গুলিটিও নিকটেই পাওয়া যায়। সে যে খুনী নহে নিঃসন্দেহে তাহা প্রমাণিত হইলেও হত্যার চেষ্টা’–এই অপরাধে স্পেশ্যাল ট্রাইবুনাল তাহাকে মৃত্যুদণ্ড দিল–হাইকোর্টে আপীল করিয়াও কোন ফল হইল না, তাহাকে মৃত্যুবরণ করিতে হইল। ধৃত হওয়ার সময় তাহার পকেটে দুই টুকরা কাগজ পাওয়া যায়। একটিতে লেখা ছিল : “হিজলী বন্দীনিবাসের অমানুষিক অত্যাচারের সামান্য প্রতিবাদ। এই সকল মৃত্যু থেকে ইংরেজ শিক্ষা লাভ করুক, আর এই ত্যাগে ভারত জেগে উঠুক।” দ্বিতীয় টুকরায় লেখা ছিল : “আমাদের প্রাথমিক পাটীগণিত।” ইহার অর্থ বুঝা যায় না।

মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত দীনেশ, কানাইলাল প্রভৃতির ন্যায় দণ্ডাজ্ঞা শুনিয়া প্রদ্যোৎও উল্লসিত হয় এবং তাহার দেহের ওজন বাড়িয়া যায়। আঠারো বছরের এই যুবক জেল হইতে জ্যেষ্ঠভ্রাতাকে এক চিঠিতে লিখিয়াছিল : “…জগতে কেউ কখনও চিরদিনের জন্য আসে নাই এবং কেউ জগতে চিরদিন থাকবেও না। প্রাণ বাঁচানই জীবনের উদ্দেশ্য নয়। জীবন যদি জীবনের কাজেই না লাগলো তবে সেরকম জীবনের প্রয়োজন কী?” প্রদ্যোৎ তাহার জননী ও বৌদিদির কাছে যেসব চিঠি লিখিয়াছিল তাহাতে দীনেশ গুপ্তের চিঠির সুরই প্রতিধ্বনির হয় এবং আদর্শ বিপ্লবীদের মনোবৃত্তি ও জীবনবাদের পরিচয় পাইয়া বিস্ময়ে অভিভূত হইতে হয়। মাতাকে সে লিখিয়াছে, “আমার ভাইদের বোলো যে আমার অসমাপ্ত কাজের মধ্যে আমার হৃদয় রেখে গেলাম। আমার জন্য দুদিন চোখের জল ফেলে ভুলে যাওয়ার চেয়ে আমার সেই অসমাপ্ত কাজ সমাপ্ত করতে চেষ্টা করলে আমার ঢের বেশী তর্পণ করা হবে।…আজ একটা আদর্শের জন্য প্রাণ বিসর্জন করছি, তাতে আনন্দ আমার মনের কানায় কানায় ফুটে উঠছে, মন খুশীতে পরিপূর্ণ হয়ে গেছে। ফাঁসির কাঠটা আমার কাছে ইংরেজের একটা পুরানো রসিকতা বলে মনে হচ্ছে।”[৪]

(১) সাবডেপুটি কামাখ্যা সেন উপরওয়ালাদের খুশী করার জন্য বিশেষভাবে নিরীহ আইন অমান্য আন্দোলনকারীদের উপর অমানুষিক অত্যাচার করিতেন। তিনি নিজে বিক্রমপুরের অধিবাসী, অথচ মুন্সীগঞ্জের স্পেশ্যাল ম্যাজিষ্ট্রেট নিযুক্ত হইয়া নরনারী-নির্বিশেষে, এমনকি নিজের আত্মীয়স্বজনের উপরও নির্মম অত্যাচার করিতেন। একদিন ঢাকায় আসিয়া সদর মহকুমার ভারপ্রাপ্ত ডেপুটি ম্যাজিষ্ট্রেটের আতিথ্য গ্রহণ করিয়াছেন। রাত্রিতে একতলার একটি ঘরে নিদ্রিত অবস্থায় বিক্রমপুরের কালীপদ মুখোপাধ্যায় গরাদবিহীন জানালা দিয়া ঢুকিয়া চারিটি গুলি ছেড়ে, কামাখ্যাও মৃত্যুর কোলে ঢলিয়া পড়ে। কালীপদ পলাইতে সমর্থ হয়। নির্বুদ্ধিতাবশতঃ টেলিগ্রাম করিতে ডাকঘরে যায়। টেলিগ্রামে লেখা ছিল, “কামাখ্যার অপারেশন সফল, চিন্তার কারণ নাই।” এই টেলিগ্রামের সূত্র ধরিয়াই কালীপদকে গ্রেপ্তার করা হয়। কালীপদ দোষ স্বীকার করিয়া বলে, “নিরুপদ্রব আইন-অমান্য আন্দোলনে বিক্রমপুরে কামাখ্যা মহিলাদের উপর যে অকথ্য অত্যাচার করেছে এটা তারই প্রতিবাদ। আমি সব স্বীকার করছি, যাতে নিরীহ লোক অত্যাচারের হাত থেকে রেহাই পায়।” পুলিশের বহু নির্যাতন সত্ত্বেও সে রিভলভার কোথা হইতে পাইল তাহা বলে নাই।

(৩) কুমিল্লার আবদুল খালেক পাঠান গুপ্তচর সন্দেহে বন্দুকের গুলিতে নিহত হয় (২০শে ডিসেম্বর)।

(৪) মাণিকতলা ডাকাতি মামলায় সরকারপক্ষের সাক্ষী আশুতোষ নিয়োগী নিজের বাড়ীর দরজায় গুলিতে নিহত হন (৩০শে ডিসেম্বর)।

(৫) “কংগ্রেসের চাই” নামে এককালে প্রসিদ্ধ খুলনার শিশুপাল দত্ত গুপ্তচর সন্দেহে নিজের বাড়ীতে নিহত হন (১৭ই অক্টোবর)।

(৬) কুমিল্লার অতিরিক্ত পুলিশ সুপারিটেনডেন্ট এলিসন সাহেব (E. B. Ellison) সাইকেল চড়িয়া অফিস হইতে বাড়ীতে ফিরিতেছিলেন। সেই সময় তাঁহার পশ্চাতে একটা পটকা ফাটার জোর শব্দ শুনিয়া তিনি ঘাড় ফিরাইতেই একটি যুবক তাঁহাকে তিনবার গুলি করিয়া উধাও হয় (২৯শে জুলাই)। এক সপ্তাহ পরে তাঁহার মৃত্যু হয়।

১৯৩৩ : (১) মেদিনীপুরের দুইজন ম্যাজিষ্ট্রেট বিগত দুই বৎসরে নিহত হন। তারপর তৃতীয় বৎসরের শিকার হইলেন ম্যাজিষ্ট্রেট বার্জ সাহেব (B. E. J. Burge)। ২রা সেপ্টেম্বর দুইজন দেহরক্ষী সঙ্গে লইয়া সাহেব ফুটবল খেলিতে আসিলেন–মাঠেও অনেক পুলিশ মোতায়েন ছিল। সাহেবের অত্যাচারের প্রতিশোধ লইবার জন্য কয়েকটি যুবক তাঁহাকে হত্যা করিতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হইয়াছিল। সাহেব মাঠে আসিবার পূর্বেই তাঁহাদের মধ্যে দুইজন মাঠের ভিতরে একটি বল লইয়া খেলিতেছিলেন। সাহেব মাঠের মধ্যস্থলে উপস্থিত হইবার সঙ্গে সঙ্গে যুবক দুইটির বল গড়াইতে গড়াইতে সাহেবের দিক গেল, তাঁহারাও বলের সঙ্গে সঙ্গে সাহেবের খুব কাছে গিয়া একজন পাঁচটি ও অপরজন তিনটি গুলি ছুঁড়িলেন। মোট আটটি গুলিই সাহেবের গায়ে লাগিল এবং তৎক্ষণাৎ তাঁহার মৃত্যু হইল। দুইজনের মধ্যে একজনের পুলিশের গুলিতে তখনই মৃত্যু হইল, আর একজন নির্মম প্রহারে জর্জরিত হইয়া পরদিন হাসপাতালে মৃত্যুবরণ করিলেন। এই হত্যাকাণ্ডের জন্য দায়ী এগারো জন আসামীর স্পেশাল ট্রাইবুন্যালে বিচার হইল। তিনজনের মৃত্যুদণ্ড ও চারিজনের যাবজ্জীবন দ্বীপান্তর হইল। মাত্র চারজন মুক্তিলাভ করিলেন। বার্জ হত্যার অপরাধে পরে আর-একজনের যাবজ্জীবন দ্বীপান্তর হইয়াছিল।

(২) চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠন সংগ্রামের নেতা ‘মাষ্টারদা’র গ্রেপ্তারের প্রধান কৃতিত্ব অর্জন করিয়াছিলেন পটিয়া থানার দারোগা মাখনলাল দীক্ষিত। ইহার প্রতিশোধ হিসাবে দুইটি যুবক ২৮শে মার্চ গুলি করিয়া তাহাকে হত্যা করে।

(৩) চন্দননগরের পুলিশ কমিশনার কুইন (Quinn) কয়েকটি বাঙ্গালী বিপ্লবীর গোপন আড়ার খবর পাইয়া সেখানে অনুসন্ধান করিতে যান। পলায়নপর বিপ্লবীদের সাইকেলে পশ্চাদ্ধাবনের সময় তাহাদের গুলিতে কুঁইন নিহত হন (৯ই মার্চ)।

১৯৩৪ : (১) গুপ্তচর হীরেন্দ্রনাথ গুহ নারায়ণগঞ্জে নিহত হন।

(২) মাষ্টারদার (সূর্য সেন) আত্মগোপনের আবাসস্থলের সন্ধান দিয়াছিলেন চট্টগ্রামের নেত্ররঞ্জন সেন। ৮ই জানুআরি রাত্রে আহারের কালে একটি যুবকের ধারালো অস্ত্রে তাঁহাকে মৃত্যুবরণ করিতে হয়।

১৯৩৫ : (১) ফরিদপুর জিলার দৌলতপুর গ্রামে রোহিণী বড়য়া অন্তরীণ থাকাকালে দারোগা এরসাদ আলি তাহার প্রতি অত্যন্ত দুর্ব্যবহার করে। যন্ত্রণা ও লাঞ্ছনায় অতিষ্ঠ হইয়া রোহিণী একখানি কাটারি দিয়া দুই-তিনবার আঘাত করিয়া তাহার মুণ্ড ছেদন করে (১৫ই জুন)।

(২) ৩রা জুলাই গুপ্তচর সন্দেহে ঢাকা শহরে বিপ্লবীরা পথে ছোরার আঘাতে হীরালাল চক্রবর্তীকে হত্যা করে।

(৩) ফরিদপুর জিলার এক ইউনিয়ন বোর্ডের কেরাণী কালীপদ ভট্টাচার্য স্থানীয় স্কুলের প্রধান শিক্ষককে সংবাদ দেয় যে তাঁহার ছাত্রেরা রাজদ্রোহমূলক কাগজপত্র বিলি করে। পথিমধ্যে একটি যুবকের ছোরার আঘাতে কালীপদ নিহত হয়। দুইজন ছাত্রের যাবজ্জীবন দ্বীপান্তরের আদেশ হয় (৪ঠা জুন)।

৪. হত্যার বিফল চেষ্টা

(১) কলিকাতা পুলিশ বিভাগের অধিকর্তা ছিলেন একজন বিশেষ সুদক্ষ কর্মচারী। সুতরাং বিপ্লবীদের পরম শত্রু এই চার্লস টেগার্টকে (Charles Tegart) হত্যার চেষ্টা নানা কারণে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। বিপ্লবীরা তাঁহাকে হত্যা করিবার জন্য গোপনে ষড়যন্ত্র করে এবং হুগলী জিলার শ্রীরামপুর নিবাসী গোপীমোহন সাহা এই কার্যের ভার স্বেচ্ছায় গ্রহণ করেন। ১৯২৪ সনের ১২ই জানুআরি পার্ক স্ট্রীট ও চৌরঙ্গীর মোড়ে আর্নেষ্ট ডে (Ernest Day) নামে একজন সাহেব রাস্তা হইতে মুখ ফিরাইয়া একটি দোকানের জিনিসপত্র দেখিতেছিলেন। চেহারার সাদৃশ্যে বিভ্রান্ত হইয়া গোপীমোহন টেগার্ট-ভ্রমে তাঁহাকেই পর পর কয়েকটি গুলি করিয়া হত্যা করেন (১২ই জানুআরি ১৯২৪), কিন্তু পলাইবার সময় ধরা পড়েন। বলা বাহুল্য, তাহার উপর দৈহিক নির্যাতনের সীমা ছিল না। যখন তাঁহাকে দুইদিন পরে আদালতে হাজির করা হয় তখনও তাঁহার “বাম উরুতে তিনটি আঘাত, ডানহাতের কনুইয়ের কাছে বুলেটের দাগ, দক্ষিণ চক্ষুর পাশে তিনটি এবং পৃষ্ঠের বামদিকে একটি বুলেটের ক্ষতচিহ্ন ছিল। যথারীতি তাহার ফাঁসি হয়। পূর্বোক্ত কয়েকজন বিপ্লবীর ন্যায় আদালতে বিচারের সময় তিনি কেবল উদাসীন নহে, বেশ হাসিখুসিতে ভরপুর ছিলেন। সরকারী উকীলকে বলিলেন, “সেরে নি না তাড়াতাড়ি–এত সাক্ষী-সাবুদের দরকার কী-মামলা অযথা লম্বা করে লাভ হচ্ছে কার”? এই মনোভাবের উৎস কোথায় তাহা বুঝাইবার জন্য হাইকোর্টে তাঁহার উক্তির কয়েকটি অংশ পূর্বেই উদ্ধৃত করা হইয়াছে।

২রা জুন (১৯২৪) সিরাজগঞ্জে বাংলার প্রাদেশিক সম্মেলনে গোপীমোহন সাহার দ্বারা হত্যাকাণ্ডের যেমন নিন্দা করা হয়, তেমনি সঙ্গে সঙ্গে তাঁহার সাহস ও ত্যাগের প্রশংসা করিয়া একটি প্রস্তাবও গৃহীত হয়। ইহার ফলে মহাত্মা গান্ধীর সঙ্গে চিত্তরঞ্জন দাশের বিরোধ ঘটে এবং ইহার অত্যল্প কাল পরেই মহাত্মা কংগ্রেসে আর কয়েকজন হত্যাকারী সম্বন্ধে অনুরূপ একটি প্রস্তাব সমর্থন করেন–তাহা পূর্বেই বলা হইয়াছে

ইহার পর আর-একবার টেগার্ট-ভ্রমে আর-একটি ইংরেজকে গুলি করা হয় (২৪ এপ্রিল ১৯২৪), কিন্তু গুলি তাহার গা ঘেঁষিয়া গেলেও কোন ক্ষতি হয় নাই।

তৃতীয়বার টেগার্টের মোটরগাড়ীর দুইপাশে দুইটি বোমা ফাটিল ডালহৌসী স্কোয়ারের কাছেই। টেগার্টের কিছুই হইল না, কিন্তু আক্রমণকারী অনুজাচরণ সেনগুপ্তের রক্তাক্ত মৃতদেহ নিকটেই পাওয়া গেল (২৫শে অগষ্ট, ১৯৩০)। ইহার পরেই টেগার্ট অবসর গ্রহণ করেন।

(১) ঢাকা বিভাগের কমিশনার ক্যাসেলকে (Alexander Cassels) ময়মনসিংহ জিলার টাঙ্গাইল শহরে এক যুবক গুলি করিয়া পলাইয়া যাইতে সমর্থ হয় (২১শে অগষ্ট ১৯৩১)।

(২) ঢাকার ম্যাজিষ্ট্রেট ডুর্নো (L. G. Durno) ঐ শহরের লেভেলক্রসিংয়ের কাছে গাড়ী হইতে নামিবামাত্র দুইজন যুবক কয়েকটা গুলি করিয়া তাহাকে আহত করে, কিন্তু দিবা দ্বিপ্রহরে এই জনাকীর্ণ স্থান হইতে পলাইয়া যাইতে সমর্থ হয় (২৮শে অক্টোবর, ১৯৩১)।

(৩) ইরোপীয়ান অ্যাসোসিয়েশনের প্রেসিডেন্ট ভিলিয়ার্স (E. Villiers) নিজের অফিসঘরে তিন ব্যক্তির সহিত আলাপ করিতেছিলেন, এমন সময় বিমল দাশগুপ্ত ঘরে ঢুকিয়াই পর পর তিনটি গুলি নিক্ষেপ করিলে সাহেব টেবিলের নীচে প্রবেশের চেষ্টা করেন। একটি গুলি তাঁহার পিঠে বিদ্ধ হইলেও তিনি প্রাণে রক্ষা পান। যুবকটি ধৃত হয় (২৯শে অক্টোবর ১৯৩১)।

(৪) কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের কনভোকেশনে গভর্নর জ্যাকসন চ্যান্সেলার হিসাবে বক্তৃতা দিতেছেন। অকস্মাৎ উপবিষ্ট ডিপ্লোমাপ্রাপ্ত ছাত্রছাত্রীদের মধ্য হইতে শ্রীমতী বীণা দাস উঠিয়া গিয়া ১০। ১১ ফুট দূর হইতে গভর্নরের দিকে তিন-চারিটি গুলি ছোড়েন (৬ই ফেব্রুআরি ১৯৩২)। দুইজন ভদ্রলোক তাঁহাকে ধরিয়া ফেলেন। শ্রীযুক্তা বীণা দাস (বর্তমান ভৌমিক) এখনও জীবিত। তাঁহার পিতা বেণীমাধব দাস একজন সুযোগ্য শিক্ষক ছিলেন। নেতাজী সুভাষচন্দ্র ছিলেন তাঁহারই প্রিয় ছাত্র।

(৫) কলিকাতার সুপ্রসিদ্ধ ইংরেজী দৈনিক সংবাদপত্র ‘স্টেটসম্যান’ (Statesman)-এ বিপ্লবীদের বিরুদ্ধে তীব্র মন্তব্য করিয়া তাহাদিগকে কঠোরভাবে দমন করিবার জন্য সরকারকে উত্তেজিত করায় একদল বিপ্লবী এই পত্রিকার সম্পাদক ওয়াট্‌ন (Alfred Watson) সাহেবকে হত্যা করিতে মনস্থ করে। চৌরঙ্গীতে তাঁহার অফিসের সম্মুখেই একজন তাঁহার গাড়ীর ভিতরে ঢুকিয়া গুলি চালাইল, কিন্তু গুলি সাহেবের গায়ে লাগিল না। আততায়ী বিষপানে তৎক্ষণাৎ আত্মহত্যা করিল (৫ই অগষ্ট ১৯৩২)। ইহার কিছুদিন পরেই ২৮শে সেপ্টেম্বর পুনরায় তাঁহার গাড়ী লক্ষ্য করিয়া পার্শ্বস্থ আর-এক গাড়ীর আরোহী এক যুবক তাঁহাকে গুলি করে এবং দুইটি গুলি তাঁহার গায়ে লাগে। ওয়াটসনের গাড়ী দ্রুতবেগে চলিতে থাকিলেও পূর্বোক্ত গাড়ী হইতে আবার তাহার প্রতি গুলি নিক্ষিপ্ত হয়। ওয়াটসন সামান্য আহত হন। দুইজন আততায়ী বিষপানে আত্মহত্যা করে, বাকী দুইজন ধরা পড়ে।

(৬) রাজশাহীর জেল সুপারিনটেনডেন্ট লিউক সাহেব (C.A.w. Luke) মোটরগাড়ীতে যাইতেছিলেন, এমন সময় একজন তাঁহার গাড়ীর সামনে একখানা সাইকেল ফেলিয়া দিতেই তাঁহার গাড়ী থামিয়া গেল; সঙ্গে সঙ্গে দুই ব্যক্তি তাঁহাকে গুলি করিল। আঘাত গুরুতর হইলেও সাহেবের প্রাণ রক্ষা হয় (১৮ই নভেম্বর, ১৯৩২)।

(৭) ঢাকার গোয়েন্দা বিভাগের অতিরিক্ত পুলিশ সুপারিনটেনডেন্ট এ্যাম্বী সাহেব (C. G. Grassby) নবাবপুরে লেভেল-ক্রসিং-এর গেট অসময়ে বন্ধ দেখিয়া গাড়ী থামান ও এক সঙ্গী দেহরক্ষীকে ইহার কারণ অনুসন্ধানের জন্য পাঠান। এই সময়ে একটি যুবক তাঁহাকে গুলি করিল। গ্যাসবীর সঙ্গী শ্বেতাঙ্গ পুলিশ সার্জেন্টটি গাড়ীর সঙ্গে সঙ্গে যাইতেছিলেন, তিনিও আততায়ীকে গুলি করিলেন। সাহেবের গায়ে গুলি লাগিলেও প্রাণ রক্ষা হয়, আততায়ীও আহত অবস্থায় ধৃত হয় (২২শে অগষ্ট, ১৯৩২)।

(৮) শ্রমিকের ছদ্মবেশে চট্টগ্রামের সাহেবদের ক্লাবঘরের নিকটে গিয়া দুইটি যুবক পুলিশ সাহেবের গাড়ীতে তিনটি বোমা নিক্ষেপ করে। প্রথম বোমাটি ফাটিলেও সাহেব অক্ষত রহিলেন। পরের দুইটি বোমা ফাটিল না। দুইজন যুবকেরই পুলিশের গুলিতে মৃত্যু হয় (৭ই জানুআরি, ১৯৩৪)।

(১০) আয়াণ্ডের বিপ্লব-দমনে অসামান্য সফলতার খ্যাতি লইয়া অ্যাণ্ডারসন (John Anderson) সাহেব বাংলার লাট হইয়া আসেন। তাঁহাকে মারিবার জন্য বিপ্লবীরা ষড়যন্ত্র করে। দার্জিলিংয়ের নিকটবর্তী লেবং নামক স্থানের ঘোড়দৌড়ের মাঠে দুইজন যুবক খুব নিকট হইতে অ্যাণ্ডারসন সাহেবকে গুলি করে, কিন্তু সমস্ত গুলিই লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়। আততায়ীদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের অপরাধে পুলিশ মামলা আনে। স্পেশ্যাল ট্রাইবুন্যালে বিচার হয়। তিনজন আসামীর মৃত্যুদণ্ড ও শ্ৰীমতী উজ্জ্বলা মজুমদারের ১৪ বৎসর সশ্রম কারাদণ্ডের আদেশ হয়। শ্রীমতী উজ্জ্বলা মজুমদার প্রসিদ্ধ বিপ্লবী ° ভূপেন্দ্রকিশোর রক্ষিতকে বিবাহ করেন এবং এখনও জীবিত আছেন।

৫. চট্টগ্রামে অস্ত্রাগার লুণ্ঠন

বিপ্লবীদের সহিত ব্রিটিশ গভর্নমেন্টের প্রত্যক্ষ সংগ্রামের চরম নিদর্শন ঘটে চট্টগ্রামে ১৯৩০ সনে। কিন্তু ইহার প্রকৃত ইতিহাস আরম্ভ হয় অনেক পূর্বে।

পূর্বেই বলা হইয়াছে, মহাত্মা গান্ধীর এক বৎসরের মধ্যে স্বরাজলাভের প্রতিশ্রুতিতে আকৃষ্ট হইয়া অনেক বিপ্লবীই সাময়িকভাবে হিংসাত্মক পন্থা ত্যাগ করিয়া কংগ্রেসে যোগ দেন। কিন্তু নিরাশ হইয়া ক্রমে ক্রমে আবার তাঁহারা পূর্বেকার বিপ্লবী পদ্ধতিতেই কার্য করিতে বদ্ধপরিকর হন। ১৯২৮ সনে কলিকাতায় জাতীয় কংগ্রেসের যে বাৎসরিক অধিবেশন হয় তাহার একটি বিশিষ্ট অঙ্গ হিসাবে দেখা দেয় বিরাট এক “স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী”। ইহার সর্বাধিনায়ক ছিলেন সুভাষচন্দ্র বসু। ইহার পূর্বেই বিপ্লবী বন্দীরা প্রায় সকলেই মুক্তিলাভ করিয়াছেন এবং ইতিমধ্যে কংগ্রেসে তাঁহাদের প্রভাব প্রতিষ্ঠিত হইয়াছে। তাহারা অনেকেই বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবক দলের অধিনায়ক হইলেন। সৈনিকের কায়দায় কুচকাওয়াজ ও অন্যান্য সামরিক রীতি শিখিবার জন্য প্রায় ২৫০০ যুবক (তাঁহাদের মধ্যে বিপ্লবীও অনেক ছিলেন) এই স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীতে যোগ দিলেন।

কংগ্রেসের অধিবেশন শেষ হইবার পরে এই স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীই সুভাষচন্দ্রের নেতৃত্বে “বেঙ্গল ভলান্টিয়ার্স” (B.V.)-রূপে সারা বাংলাদেশে ছড়াইয়া পড়িল। ইহার প্রধান নেতৃবর্গের মধ্যে ছিলেন অনন্ত সিং, গণেশ ঘোষ ও লোকনাথ বল। ইঁহাদের ও অন্যান্য কয়েকজনের সহায়তায় চট্টগ্রামের প্রবীণ বিপ্লবী নেতা সূর্য সেন (মাষ্টারদা নামেই সমধিক পরিচিত) পূর্ণ উদ্যমে সামরিক স্বেচ্ছাবাহিনী গঠন করিতে আরম্ভ করিলেন। এই অসাধারণ ব্যক্তিত্বসম্পন্ন শিক্ষকনেতার নির্দেশে ও গঠননৈপুণ্যে সারা চট্টগ্রাম জেলায় ব্রিটিশের বিরুদ্ধে প্রত্যক্ষ সংগ্রামের প্রস্তুতি আরম্ভ হইল। সূর্য সেনের আশা ছিল, চট্টগ্রামে যে আগুন জ্বলিয়া উঠিবে ক্রমে তাহা সমগ্র দেশে ছড়াইয়া পড়িবে। সমরবাহিনীর নাম দেওয়া হইল ইণ্ডিয়ান রিপাবলিকান আর্মি (Indian Republican Army)। অস্ত্রশস্ত্র, বোমা প্রভৃতি সংগৃহীত হইল, রীতিমত প্যারেড ও অস্ত্রচালনা শিক্ষা চলিতে লাগিল। অর্থভাণ্ডারে প্রায় অর্ধলক্ষ টাকা জমা হইয়াছে। সংগোপনে বিপ্লবীদের চরম বৈঠকে যে-সমস্ত সিদ্ধান্ত গৃহীত হইল তাহার সংক্ষিপ্ত মর্ম নীচে দেওয়া হইল :

(১) ১৮ই এপ্রিল (১৯৩০) রাত্রি দশটায় চট্টগ্রামের অস্ত্রাগার আক্রমণ করা হইবে। দিনটি ছিল ‘গুডফ্রাইডে’। আইরিশ বিপ্লবীদের ‘ইষ্টার বিদ্রোহের

স্মৃতিবিজড়িত বলিয়াই ঐ তারিখটি নির্ধারিত হইয়াছিল। অন্যতম নেতা লোকনাথ বল ইহার উল্লেখ করিয়া লিখিয়াছেন : “আইরিশ প্রজাতন্ত্রী বাহিনীর ইষ্টার বিদ্রোহের রক্তরাঙা স্মৃতি আমাদের তরুণ প্রাণে দিত আগুনের ছোঁয়াচ।”।

(২) সমরবাহিনীর সর্বাধিনায়ক হইলেন সূর্য সেন।

(৩) যুদ্ধের অধিনায়ক কমিটির (War Council) সদস্য হইলেন নির্মল সেন, লোকনাথ বল, অনন্ত সিংহ, গণেশ ঘোষ, অম্বিকা চক্রবর্তী ও উপেন ভট্টাচার্য।

(৪) সর্বসম্মতিক্রমে নিম্নলিখিত কার্যপদ্ধতি স্থির হইল। চারিটি দল একই সময়ে মোটরে রওনা হইয়া যথাক্রমে :

(ক) অনন্ত সিংহ ও গণেশ ঘোষের নেতৃত্বে পুলিশ আর্মারি’ আক্রমণ করিবে।

(খ) নির্মল সেন ও লোকনাথ বলের নেতৃত্বে রেলওয়ে আর্মারি’ আক্রমণ করিবে।

(গ) অম্বিকা চক্রবর্তীর নেতৃত্বে ‘টেলিগ্রাফ ও টেলিফোন এক্সচেঞ্জ আক্রমণ করিবে।

(ঘ) জালিয়ানওয়ালাবাগের নৃশংস হত্যাকাণ্ডের প্রতিশোধস্বরূপ ইউরোপীয়ান ক্লাব আক্রমণ করিয়া সাহেবদের হত্যা করিবে। এই দলের নেতা ছিলেন নরেশ রায় ও ত্রিগুণা (ত্রিপুরা) সেন।

(ঙ) ৩০ জনের এক পদাতিক বাহিনী পুলিশ আর্মারির কাছে গুপ্তস্থানে অপেক্ষা করিবে এবং প্রয়োজনমত উক্ত তিনটি দলের সাহায্যে অগ্রসর হইবে।

(চ) ইহার নিকটেই সূর্য সেন কয়েকজন রক্ষীসহ একটি মোটরে অপেক্ষা করিবেন। প্রথমোক্ত তিনটি দল কার্য সম্পন্ন করিয়া সর্বাধিনায়কের সঙ্গে মিলিত হইবেন।

এই কার্যপদ্ধতি যে যথাযথভাবে এবং মোটামুটি সাফল্যের সহিত অনুসৃত হইয়াছিল তাহাতে কোন সন্দেহ নাই। কারণ এই চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠনের প্রকৃত তথ্য জানিবার যেরূপ নির্ভরযোগ্য ঐতিহাসিক উপকরণ পাওয়া যায়, ভারতের মুক্তিসংগ্রামে হিংসাত্মক কার্যাবলীর অন্য কোনটি সম্বন্ধে অদ্যাবধি সেরূপ কোন তথ্য আবিষ্কৃত হয় নাই। এই ব্যাপারে যাহারা সক্রিয় অংশগ্রহণ করিয়াছিলেন তাঁহাদের অনেকে স্বাধীনতাপ্রাপ্তির পরেও জীবিত ছিলেন-সুখের বিষয় কেহ কেহ এখনও জীবিত আছেন–এবং নেতৃস্থানীয় কয়েকজন নিজেদের স্মৃতিচারণ করিয়া ইহার বিবরণ লিপিবদ্ধ করিয়াছেন। এ-বিষয়ে শ্রীঅনন্ত সিংহ ও লোকনাথ বলের লিখিত গ্রন্থ ও প্রবন্ধ হইতে বাংলার আধুনিক ইতিহাসের এই চিরস্মরণীয় ঘটনার সংক্ষিপ্ত বিবরণী পাঠকের নিকট এখানে উপস্থিত করিতেছি। বিস্তৃত বিবরণ জানিবার জন্য পাদটীকায় প্রদত্ত গ্রন্থগুলি বিশেষভাবে প্রণিধানযোগ্য।* কি জন্য আমরা এই ঘটনাটির উপর এত গুরুত্ব আরোপ করিতেছি, সে সম্বন্ধে দুই-একটি কথা বলা অপ্রাসঙ্গিক হইবে না।

[* অনন্ত সিংহ-চট্টগ্রাম যুব বিদ্রোহ, প্রথম খণ্ড।
অনন্ত সিংহ-অগ্নিগর্ভ চট্টগ্রাম।
শচীন্দ্রনাথ গুহ সম্পাদিত–চট্টগ্রাম বিপ্লবের বহ্নিশিখা।]

এযাবৎ বিপ্লববাদ সম্বন্ধে যাহা বিবৃত হইয়াছে তাহা হইতে স্পষ্টই প্রতীয়মান হইবে যে, বিপ্লবীদের লক্ষ্য ও আদর্শ যাহাই হউক প্রত্যক্ষভাবে অস্ত্রশস্ত্র সগ্রহ, বোমা তৈরী, খুন ও ডাকাতিতেই তাহা সীমাবদ্ধ ছিল।–

ইংরেজের সহিত প্রত্যক্ষ সংগ্রামের পরিকল্পনা ও তাহার জন্য প্রস্তুতি বঙ্গদেশে ও ভারতের অন্যান্য স্থানে পরিলক্ষিত হইলেও প্রকৃতপক্ষে ইহার প্রথম দৃষ্টান্ত চট্টগ্রামে জালালাবাদের যুদ্ধ এবং শেষ ও চরম দৃষ্টান্ত নেতাজী সুভাষচন্দ্রের আজাদ হিন্দ ফৌজের অভিযান। লেখকের উপরোক্ত ধারণাই যে সূর্য সেনের কার্যপদ্ধগ্রিহণকে প্রণোদিত করিয়াছিল, লোকনাথ বলের নিম্নলিখিত মন্তব্যই তাহার প্রমাণ। “বহু বছর ধরে ভারতবর্ষের বিপ্লবী আন্দোলনের কার্যক্রম ডাকাতির ও খুনের ভিতরেই সীমাবদ্ধ ছিল। সরকারী উচ্চ ইংরেজ কর্মচারীকে খুন করা একটা আদর্শ বিপ্লবী কার্য বলে পরিগণিত হত। আমাদের মনে হল প্রচলিত আন্দোলনের গতি ও তার দৃষ্টিভঙ্গীর পরিবর্তন আবশ্যক। ক্ষমতা হস্তগত করাই সমস্ত বিপ্লবী কার্যের উদ্দেশ্য হওয়া উচিত। তদনুযায়ী আমরা সিদ্ধান্ত কর্লাম চট্টগ্রামকে স্বাধীন করে দেশের সামনে একটা আদর্শ স্থাপন কর্ব।”

সুতরাং ব্যাপারটির গুরুত্ববোধে ইহার একটু বিস্তৃত বিবরণ দেওয়া প্রয়োজন।

পূর্বোক্ত কার্যপদ্ধতি অনুযায়ী লোকনাথ বল ও নির্মল সেনের নেতৃত্বে একদল কর্মী রেলওয়ে অস্ত্রাগার আক্রমণ করিলেন। এ সম্বন্ধে লোকনাথ বল যাহা লিখিয়াছেন তাহার সারমর্ম দিতেছি : “১৮ই এপ্রিল রাত্রি প্রায় দশটার সময় আমাদের গাড়ী রেলওয়ে অস্ত্রাগারের সাইড গেটে পৌঁছিল। আমার গায়ে ছিল উচ্চ ইংরেজ সামরিক কর্মচারীর পোষাক এবং অন্যেরা সৈন্যের পোষাক পরিহিত ছিল। অস্ত্রাগারের সম্মুখে আমাদের ছয়জন সাথী আমার নির্দেশানুযায়ী আগে থেকেই অপেক্ষা করছিল, তাদের একজন এসে ধাক্কা দিয়ে গেট খুলে দিলে আমাদের গাড়ী অস্ত্রাগারের প্রাঙ্গণে প্রবেশ করে। অস্ত্রাগারের রক্ষী যথারীতি জিজ্ঞাসা করল ‘কে আসছে? তার জবাবে আমি চেঁচিয়ে উঠলাম ‘বন্ধু’। তারপর আমি রক্ষীকে ডাকলাম-বুকের সামনে রিভলভার লক্ষ্য করে বললাম-”আমরা স্বদেশী, অস্ত্রাগার দখল করতে এসেছি। তুমি পালিয়ে যাও।’ সে এবং অন্য তিনজন রক্ষী রাইফেল ধরবার চেষ্টা করলে আমি এবং আমার সাথীরা গুলি করে তাদের প্রতিহত কর্লাম। প্রথম গুলির আওয়াজ শুনেই অস্ত্রাগারের ভারপ্রাপ্ত ইংরেজ কর্মচারী সার্জেন্ট মেজর ফ্যারেল বেরিয়ে এল। আমরা নিজেদের পরিচয় দিয়ে বললাম, বাধা দিলে তোমার মৃত্যু নিশ্চিত। সে তখন ঘরে ঢুকে রিভলভার নিয়ে বেরুতেই আমাদের গুলিতে আহত হয়ে মাটিতে পড়ে গেল। তার স্ত্রী তখন আমার কাছে তার এবং তার শিশুর জীবন ভিক্ষা চাইলেন। আমি তাঁকে বললাম, ‘আপনি আমাদের মায়ের মত। আপনার স্বামীর মৃত্যুর জন্য আমরা দায়ী নই–আমরা তাকে হুঁসিয়ার করেছিলাম। আপনি নির্ভয়ে ঘরের ভিতর যান। কেউ আপনার অনিষ্ট করবে না।”

নির্ধারিত পদ্ধতিমত অপরদিকে অনন্ত সিংহ ও গণেশ ঘোষের দল পুলিশের অস্ত্রাগার আক্রমণ করিয়াছিল। এ বিষয়ে অনন্ত সিংহের বিবরণ যথাসম্ভব তাঁহার নিজের কথায় উদ্ধৃত করিতেছি।

“মাষ্টারদা (সূর্য সেন) আমাদের বিপ্লবী সমিতির প্রেসিডেন্ট…চট্টগ্রাম শহর আকস্মিকভাবে দখল করে সাময়িক বিপ্লবী সরকার গঠন করার পরিকল্পনার প্ল্যানটি মাষ্টারদা অনুমোদন করলেন। আমাদের লোকবল ও অস্ত্রবল নিয়ে সীমিত সময়ের মধ্যে পরিকল্পনাটি সফল করবার সব ব্যবস্থা সম্পন্ন হল। স্থির হল ১৮ই এপ্রিল, ১৯৩০ রাতের অন্ধকারে ঝটিকাবেগে অতর্কিত আক্রমণে সমস্ত অস্ত্রাগার দখল করা হবে। অস্ত্রাগার আক্রমণের পাঁচ মিনিট আগে টেলিফোন আবাসটি ধ্বংস করা হবে। শহরের বন্দুকের দোকানগুলি করায়ত্ত করা হবে। টেলিগ্রাফ তার ছিন্ন ও দুটি স্থানে রেললাইন তুলে ফেলে বাহির থেকে সৈন্য আমদানীর বিলম্ব ঘটাতে হবে। এই কর্মসূচীকে বাস্তব রূপ দিতে প্রথম আক্রমণ আরম্ভে আমরা চৌষট্টি জন সংঘবদ্ধ হয়েছিলাম।

“কোন্ সময় কাকে কোথায় হাজির হতে হবে, কোন্ কোন্ ঘাঁটি আক্রমণ করতে হবে, অস্ত্রশস্ত্র বিলি করার ঠিকমত ব্যবস্থা, কোন্ কোন্ পথ ব্যবহার করা নিরাপদ, বিভিন্ন নেতা ও বিভিন্ন দলের মধ্যে সংযোগরক্ষার উপায়-সংকেত, সংকেতবাক্য, বিশেষ শ্লোগান, ইত্যাদি সবকিছু বারবার খুঁটিয়ে পরীক্ষা করে দেখা হল।

… … …

“নির্দিষ্ট সময়ে ঘড়ির কাঁটায় কাঁটায় আমাদের গাড়ী ওয়াটার ওয়ার্কসের কাছে এসে পড়ল। হেডলাইট জ্বালিয়েই আসছিলাম। রাস্তাটির বাঁকে পূর্বচিহ্নিত স্থানে মাষ্টারদা একজন বডিগার্ডের সঙ্গে উপস্থিত। রাস্তার ধারে বড় একটি গাছের ব্যাকগ্রাউণ্ডে মোটরের হেডলাইটের আলোতে আপাদমস্তক সাদা পোশাকে সজ্জিত মাষ্টারদাকে অপূর্ব দেখাচ্ছিল! মাথায় তাঁর খদ্দরের সাদা গান্ধী টুপীর মত শক্ত ইস্তিরি করা উষ্ণীষ। টুপিটির সম্মুখভাগের ডানদিকে টাকার সাইজের উজ্জ্বল ধাতুনির্মিত ভারতবর্ষের প্রতীক। পরনে খদ্দরের লম্বা সাদা কোট। এই পোশাকের সঙ্গে মালকোঁচা দিয়ে পরা সাদা ধপধপে ধুতি ও টেনিস খেলার সাদা জুতো পায়ে মাষ্টারদার অপরূপ বেশ।

“মাষ্টারদার পাশে এসে আমাদের গাড়ি থামল। নিমেষে আমরা ছ’জন নেমে একসারিতে দাঁড়ালাম, গণেশের কমাণ্ডে আমরা ছ’জন মিলিটারী কায়দায় মাষ্টারদাকে অভিবাদন জানালাম। মাষ্টারদা স্যালুট গ্রহণ করে প্রশ্ন করলেন-’সব ঠিক আছে?’ গণেশ উত্তর দিল–সব ঠিক।’

“খুব সংক্ষেপে দু’চারটি কথার পর আমরা দুজন গাড়ীতে উঠে বসলাম। পরস্পর জেনে নিলাম প্রত্যেকের পিস্তল বা রিভলভারের চেম্বারে টোটা ভর্তি আছে কি না।

গাড়ী পঞ্চাশ-ষাট গজ এগিয়ে যেতেই দেখা গেল টিলার উপর রাইফেলধারী প্রহরীরা পায়চারী করছে। আমাদের গাড়ী এসে অস্ত্রাগারের সামনে হঠাৎ থেমে গেল। মিলিটারী ইউনিফরমে খুব উচ্চপদস্থ সামরিক অফিসারের পোশাকে গণেশ ও আমি সামনে, আর আমাদের পেছনে বিধু, হরিপদ, সরোজ ও হিমাংশু। আমরা লক্ষ্য স্থির রেখে ধাপে ধাপে দ্রুত উঠতে লাগলাম। দশ-বারো ফুট টিলাটি উঠতে পাঁচ-ছয় সেকেণ্ড সময়ও লাগেনি। সান্ত্রীর থেকে তিন হাতের ব্যবধানে আমার ও গণেশের পিস্তল একসঙ্গে গর্জন করে উঠল। মূল-উপড়ানো গাছের মত কাঁপতে কাঁপতে সান্ত্রী মাটিতে গড়িয়ে পড়ল। তিন-চার লাফে এগিয়ে গিয়ে আমরা গার্ডরুম আক্রমণ করলাম। ছুটে যাওয়ার সময় ফায়ার করতে করতে এগিয়েছি। আক্রমণের প্ল্যান অনুযায়ী আমরা সমস্বরে গগনবিদারী-ইক্লাব-জিন্দাবাদ, সাম্রাজ্যবাদ ধ্বংস হোক-শ্লোগান দিয়ে-পুলিশ লাইন মুখরিত করে তুলেছি। রাত্রে অতর্কিত আক্রমণ, পিস্তলের গুলি, সান্ত্রীর পতন, গার্ডরুমের দিকে ফায়ার, সঙ্কেত অনুযায়ী পুলিশলাইনের চারপাশে আমাদের ছোট ছোট সাতটি দল গুপ্তস্থান হতে অন্ধকারের নির্জনতা ভঙ্গ করে ইনক্লাব জিন্দাবাদ’ ধ্বনি তুলে যে দারুণ পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছে তাতে পুলিশ কেবল গার্ডরুম থেকে নয়, পুলিশ-ব্যারাক থেকেও ভীতত্রস্ত হয়ে যেখানে যে পেরেছে পালিয়েছে। কয়েক মিনিটের মধ্যেই অস্ত্রাগার আমাদের দখলে এসে গেল। মাষ্টারদা ও ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র সাতটি দল প্ল্যান অনুযায়ী আমাদের সঙ্গে এসে যোগ দিল।

“এবার মাষ্টারদা হুকুম দিলেন, ‘বৃটিশ ইউনিয়ন জ্যাক পুড়িয়ে ফেল।’ মাষ্টারদার আদেশের সঙ্গে সঙ্গে বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদের ঘৃণ্য ইউনিয়ন জ্যাকের বহ্নি উৎসব হল। মাষ্টারদা হুকুম দিলেন, ‘জাতীয় পতাকা তোলা হোক।’ দুজন তরুণ বিপ্লবী বীরদর্পে এগিয়ে গেল। বিজয়গৌরবে জাতীয় পতাকা তোলা হল, আমাদের বিউগল বেজে উঠল। এমন সময় গাড়ীর তীব্র আলো জ্বালিয়ে অম্বিকাদারা সদলবলে এসে পড়লেন। মাষ্টারদা এগিয়ে এসে জিজ্ঞেস করলেন-‘টেলিফোন ভবন নিশ্চিহ্ন হয়েছে তো?’

অম্বিকাদা-’টেলিফোন ভবন এতক্ষণে পুড়ে ছাই হয়ে গেছে।’

মাষ্টারদা-’কোন পক্ষে কেউ হত বা আহত হয়নি তো?’

অম্বিকাদা-‘কেউ-ই না।’

মাষ্টারদা-‘খুব আনন্দ হচ্ছে। বিনা রক্তপাতে সরকারী টেলিফোন ভবন ধ্বংস করার নজীর ভারতের ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে।’

“জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ডের সমুচিত প্রতিশোধ নেবার জন্য নরেশ, ত্রিপুরা, দেবু, অমরেন্দ্র, বীরেন ও মনোরঞ্জন হাতবোমা ও মারাত্মক অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে বৃটিশ শত্রুকে নির্মমভাবে হত্যা করার জন্য ইউরোপীয়ান ক্লাব আক্রমণ করতে গিয়েছিল। তারা খুব ধীর ও মন্থর গতিতে ফিরে এল। মনে হল কোন উৎসাহ নেই, উদ্দীপনা নেই–তারা যেন শ্রান্ত, ক্লান্ত ও নির্জীব হয়ে পড়েছে।

“মাষ্টারদা নরেশকে জিজ্ঞেস করলেন-‘তোমরা একেবারে চুপচাপ কেন? কী হয়েছে তোমাদের?’

নরেশ-‘কিছু হয়নি। আমরা সবাই দৈহিক সুস্থ; কিন্তু আমরা অকৃতকার্য হয়ে ফিরে এসেছি।’

“মাষ্টারদা ব্যাকুল হয়ে প্রশ্ন করলেন-‘নরেশ, তোমরা অক্ষম হয়ে ফিরে এলে? বুঝতে পারছি না। খুলে বল কী হয়েছে।’

নরেশ বলতে লাগল—’আমরা প্ল্যানমত ক্লাবগৃহের কাছে গেলাম। আমরা ঝটিকাবেগে বিভিন্ন দরজা ও জানালা দিয়ে ক্লাবঘরে প্রবেশ করি–কিন্তু আশ্চর্য! হলঘর একেবারে শূন্য। সাহেবরা আটটা ন’টার মধ্যে সবাই বাড়ী চলে গেছে।’

মাষ্টারদা-‘ঐ নিয়ে তোমরা মন খারাপ কোরো না। চট্টগ্রাম শহর আমাদের দখলে, প্রতিশোধ আমরা নেবই।’

“নির্মলদা ও লোকনাথের নেতৃত্বে A. F. I. আর্মারি দখলের একঘণ্টারও পর আমি সেখানে গিয়ে পৌঁছি। আমি গিয়ে তাঁদের অভিনন্দন জানাই।

… … …

“অর্ডার হল–সঙ্গে সবক’টি রিভলভার এবং যতগুলি সম্ভব রাইফেল ও লুইসগান নেওয়া হোক, বাকি সব ধ্বংস কর। কয়েক মিনিটের মধ্যে প্রায় সব রাইফেল ও তিনটি লুইসগান ভেঙ্গে ফেলা হল। কতকগুলি রাইফেল ও দুটি লুইসগান গাড়িদুটিতে বোঝাই করা হল, তারপর A. E. I আর্মারিতে আগুন দেওয়া হল। আর্মারিটিকে বিদায় জানিয়ে আমাদের দুটি গাড়ী পুলিশলাইনের দিকে অগ্রসর হল।

“আমরা পুলিশলাইনের টিলার উপর উঠার সঙ্গে সঙ্গে মাষ্টারদা আগে এসে সবার কুশল সংবাদ জানতে চাইলেন।

“নির্মলদা মাষ্টারদাকে সংক্ষিপ্ত বিবরণ দিলেন ও আমরা সবাই অক্ষতদেহে ফিরে এসেছি জানালেন। তারপর মাষ্টারদাকে বিস্মিত ও স্তম্ভিত করে দিয়ে আমি বললাম, মাষ্টারদা-আমাদের জয়ের গৌরব একেবারে ম্লান হয়ে গেছে। A. F. I. আর্মারিতে রিভলভার, ম্যাগাজিন রাইফেল ও লুইসগান, আমরা প্রচুর পেয়েছি, কিন্তু আশ্চর্য! সেখানে একটি কার্তুজও পাইনি।

মাষ্টারদা-কী? কী? একটি কার্তুজও পাও নি?’

লোকনাথ-‘না-একটিও না।’

‘তা কী করে সম্ভব হতে পারে?’ এই প্রশ্নটুকু করে মাষ্টারদা একেবারে চুপ হয়ে গেলেন।

“পুলিশলাইনে আমাদের অনেক সময় কেটে গেল। বৃটিশের প্রধান ঘাঁটি সব আমাদের দখলে। টেলিফোন-ভবন বিধ্বস্ত, টেলিগ্রাফ-লাইন বহির্জগৎ হতে বিচ্ছিন্ন, দুটি স্থানে রেললাইন ধ্বংস করা হয়েছে, পুলিশেরা সব প্রাণভয়ে পালিয়েছে।

“হঠাৎ বিনা মেঘে বজ্রাঘাত। এ কী? খুব নিকট থেকেই লুইসগান ফায়ার হচ্ছে! অবিরাম ধারায় গুলি চলছে।

বজ্রকণ্ঠে আমাদের মধ্য থেকে হুকুম হল-”ওয়াটার ওয়ার্কস লক্ষ্য করে দ্রুত গুলি চালাও। আমাদের চৌষট্টিটি মাস্কেট্রি একসঙ্গে গর্জন করে উঠল। এই খণ্ডযুদ্ধ মিনিট চার-পাঁচ চলেছে। শত্রুপক্ষ একেবারে নিস্তব্ধ হয়ে গেলে মাষ্টারদা সাময়িক বিপ্লবী গণতন্ত্রী সরকার গঠন করে একটি proclamation দিলেন। ঘোষণাটি নিম্নে দিলাম। মাষ্টারদা ঘোষণা করলেন :

“প্রিয় বিপ্লবী সৈনিকবৃন্দ!

ভারতের বিপ্লবের গুরুদায়িত্ব আজ ভারতীয় গণতন্ত্রী বাহিনীর উপর ন্যস্ত। ভারতবাসীর অন্তরের বাসনা ও উচ্চাকাঙ্ক্ষা পরিপূর্ণ করবার জন্য আমরা স্বদেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে চট্টগ্রামে বৈপ্লবিক কর্ম সম্পন্ন করার গৌরব অর্জন করেছি।

“আজ বিশেষ গৌরবের কথা, আমাদের বাহিনী চট্টগ্রামে বৃটিশ সরকারের ঘাঁটিগুলি অধিকার করেছে; শত্রুর অস্ত্রাগার অধিকৃত, শহরের কেন্দ্রীয় টেলিফোন ভবন বিধ্বস্ত, বহির্জগতের সঙ্গে তারবার্তা বিচ্ছিন্ন, রেললাইন উৎপাটিত। বাইরের সঙ্গে ট্রেন-যোগাযোগ ব্যবস্থার পরিসমাপ্তি ঘটেছে। শত্রুর সেনাবাহিনী পরাস্ত। অত্যাচারী বিদেশী সরকারের অস্তিত্ব লুপ্ত। জাতীয় পতাকা আজ উচ্চে উড্ডীয়মান। জীবন ও রক্তের বিনিময়ে একে সর্বতোভাবে রক্ষা করা আমাদের কর্তব্য।

“ভারতীয় গণতন্ত্রী বাহিনীর চট্টগ্রাম শাখার সভাপতি আমি সূর্য সেন, এতদ্বারা ঘোষণা করছি চট্টগ্রাম শাখার গণতন্ত্রী বাহিনীর বর্তমান পরিষদই সাময়িক বিপ্লবী সরকারে পরিণত হয়ে নিম্নলিখিত জরুরী কাজ সম্পন্ন করার জন্য নির্দেশ দিচ্ছে–

(১) আজকের জয়কে সুনিশ্চিত করবার জন্য প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে;

(২) ভারতের স্বাধীনতার জন্য সশস্ত্র সংগ্রামকে আরও ব্যাপক ও তীব্র করে তুলতে হবে;

(৩) আভ্যন্তরীণ শত্রুদের দমন করতে হবে;

(৪) সমাজদ্রোহী ও লুণ্ঠনকারীদের শাসনে রাখতে হবে;

(৫) এবং এই সাময়িক বিপ্লবী সরকারের পরবর্তী নির্দেশগুলি সম্পন্ন করতে হবে। আমাদের অস্থায়ী বিপ্লবী সরকার চট্টগ্রামে প্রত্যেক সাচ্চা তরুণ-তরুণীর কাছে সম্পূর্ণ বাধ্যতা ও সক্রিয় সহযোগিতার আশা ও দাবী রাখে।

বন্দে মাতরম্।

“মাষ্টারদা ঘোষণাপত্রটি ধীরে ধীরে জোরের সঙ্গে পাঠ করলেন। ঘোষণাপত্রটি পড়া শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই কমাণ্ড এল– In honour of our Provisional Revolutionary Government, Three Round Fire!

আমরা পরপর তিনবার গুলি ছুঁড়লাম। বিউগল বেজে উঠল! তারপর তিনবার জয়ধ্বনি দিলাম-বন্দে মাতরম্।

“একটু আগেই খণ্ডযুদ্ধে শত্ৰু পশ্চাদপসরণ করেছে-লুইসগান নিস্তব্ধ। তবু শত্রু নিশ্চিহ্ন হয়নি। মাষ্টারদা আমার সামনে এগিয়ে এসে বললেন-মেশিনগানের বিরুদ্ধে আমাদের মাস্কেট্রি কী করতে পারবে? আমি কোন উত্তর দিলাম না, চুপ করে রইলাম। মাষ্টারদা পায়চারি করতে করতে আরো তিন-চারবার কাছে এসে বলেছেন বা স্বগতোক্তি করেছেন-মেশিনগানের কাছে আমরা কতক্ষণ? মাস্কেট্রি নিয়ে কতখানি কী করতে পারব? আমাদের হাতে ম্যাগাজিন রাইফেল যদি থাকত! লুইসগান যদি একটিও ব্যবহার করতে পারতাম!

“মাষ্টারদা শেষবারের মত বললেন–’মেশিনগানের বিরুদ্ধে আমাদের মাস্কেট্রি কী করতে পারবে? ঠিক সেই সময়ে আবার শত্রুর মেশিনগান গর্জন করে উঠল–ট্যাট ট্রাট। দ্বিতীয়বার শত্রুর অতর্কিত আক্রমণের প্রত্যুত্তরে আমাদের থেকে volly fire ও মুখে অনবরত ‘বন্দে মাতরম্‌’ ও ‘ইক্লাব জিন্দাবাদ’ ধ্বনি চলল। মেশিনগানের অজস্র গুলিবৃষ্টির জবাব দিচ্ছি মাস্কেট্রি দিয়ে। বেচারা ইংরেজগোষ্ঠী কী আর করে! সাহেবদের কার্তুজ ফুরিয়ে গেল। আবার যুদ্ধ বন্ধ করতে হল।

“আর দেরী করা যায় না। শত্রুপক্ষ যত বেশী সময় পাবে–তত বেশী সুযোগ নেবে। হুকুম হল, পেট্রোল ঢাল-আগুন দাও। হিমাংশু চারিদিকে পেট্রোল ছড়িয়ে আগুন দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে দপ করে যেমন সমস্ত আর্মারিতে আগুন জ্বলে উঠল, ঠিক তেমনি হিমাংশুর সমস্ত পোষাকে চক্ষুর পলকে আগুন ধরে গেল। গুরুতর দগ্ধ অবস্থায় হিমাংশু ছুটে এসে গাড়ীর পিছনের সিটে উঠে পড়ল। গণেশ আমার পাশে। আমি নতুন শেভ্রোলে গাড়ী করে হিমাংশুকে শহরে রাখতে নিয়ে গেলাম।

“মাষ্টারদা, অম্বিকাদা ও নির্মলদা প্রধান দলের সঙ্গে রইলেন। তখন রাত প্রায় তিনটে। হিমাংশুকে রেখে খুব তড়িৎবেগে আবার পুলিশলাইনের দিকে ছুটলাম, কিন্তু ফিরে এসে মাষ্টারদা ও প্রধান বাহিনীর আর দেখা পেলাম না। প্রধান বাহিনী তখন পাহাড়ে আশ্রয় নিয়েছে। চারদিন তাদের সঙ্গে যোগাযোগের বহু চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়ে চট্টগ্রাম ত্যাগ করে চলে গেলাম এবং চন্দননগরে আশ্রয় নিলাম।”

ইহার পরবর্তী ঘটনা সম্বন্ধে অন্যতম বিপ্লবী নেতা গণেশ ঘোষ (ইনি এখনও জীবিত) লিখিয়াছেন :

“সাম্রাজ্যবাদের কর্তৃত্ব ও প্রভাবমুক্ত স্বাধীন চট্টগ্রামে বিদ্রোহীরা তাদের সর্বাধিনায়ক মাষ্টারদা সূর্য সেনের নেতৃত্বে একটি স্বাধীন সাময়িক বিপ্লবী সরকার প্রতিষ্ঠার কথা ঘোষণা করেছে।

চট্টগ্রামে এখন আর বিদেশী বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদের কর্তৃত্ব অথবা নিয়ন্ত্রণ নেই; চট্টগ্রামে নিয়ন্ত্রণক্ষমতা এখন দেশপ্রেমিক বিদ্রোহীদের হাতে।

“কিন্তু বিদ্রোহীদের একথা আদৌ অজ্ঞাত ছিল না যে, এই অবস্থা দীর্ঘকাল চলবে না এবং কিছুতেই চলতে পারে না। আগামী ৪৮ ঘণ্টা, ৭২ ঘণ্টা কিম্বা ৯৬ ঘণ্টা অথবা আর অল্প কিছুকালের মধ্যেই বাইরে থেকে নানা পথে এবং নানাভাবে চট্টগ্রামে প্রভূত পরিমাণে সাম্রাজ্যবাদী ফৌজ আসবেই; বিদ্রোহী শক্তির সাথে তাদের একটা বোঝাপড়া অর্থাৎ শক্তিপরীক্ষা হবেই; সমগ্র বিদ্রোহী শক্তিকে তারা সম্পূর্ণভাবে এবং নিঃশেষে ধ্বংস করবার চেষ্টা করবেই; বিদ্রোহের প্রতিশোধ হিসাবে চট্টগ্রামে অমানুষিক নিষ্ঠুর নিপীড়ন করে সাম্রাজ্যবাদ ভারতের যুবশক্তির কাছে, অর্থাৎ ভবিষ্যতের সকল সম্ভাব্য বিদ্রোহীদের কাছে একটি সতর্কতার উদাহরণ নিশ্চয়ই স্থাপন করতে চাইবে।

“তাই বিদ্রোহীদের পূর্বনির্দিষ্ট সিদ্ধান্ত ছিল, সশস্ত্র বিদ্রোহের পর সাম্রাজ্যবাদের সাথে ওই অবশ্যম্ভাবী সংঘর্ষ এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা না করে সাম্রাজ্যবাদের ফৌজের সাথে সামনাসামনি বোঝাপড়ার চেষ্টা করতে হবে, এবং সেই প্রত্যক্ষ সংঘাতে প্রাণ দিতে হবে।

“ভারতবর্ষে তৃতীয় দশকের (১৯২০-৩০) শেষভাগের পরিস্থিতি ছিল অস্বাভাবিক উত্তপ্ত; জনগণের ব্যাপকতম অংশ উত্তরোত্তর অধিকমাত্রায় অস্থির ও চঞ্চল হয়ে উঠেছিল। সমগ্র জনগণের দাবী ছিল অবিলম্বে সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে প্রত্যক্ষ সংগ্রাম আরম্ভ করা হোক; আর বিলম্ব করা চলবে না।

“ভারতীয় পরিস্থিতির এই মূল্যায়নের ভিত্তিতে চট্টগ্রামের বিপ্লবীরা এপ্রিল মাসের ১৮ই তারিখে সশস্ত্র বিদ্রোহ ঘোষণা করেছিল। তাদের বিদ্রোহের মূল লক্ষ্য ছিল অপ্রত্যাশিত অকস্মাৎ আক্রমণে সাম্রাজ্যবাদী প্রশাসনযন্ত্র বিকল করে দেওয়া এবং স্বল্পদিনের জন্য হোলেও রাজনৈতিক ক্ষমতা দখল করে একটি বিকল্প স্বাধীন বিপ্লবী সাময়িক সরকারের প্রতিষ্ঠা ঘোষণা করা ও ঐ সরকারের রক্ষার জন্য প্রতিটি দেশপ্রেমিক বিদ্রোহীর প্রাণপণ করে সংগ্রাম করে যাওয়া ও শেষ পর্যন্ত প্রাণ বিসর্জন করে দেওয়া। ঐ বিকল্প সাময়িক বিপ্লবী সরকার শেষপর্যন্ত কিছুতেই রক্ষা করা যাবে না–একথা বিদ্রোহীরা সঠিকভাবে জানতেন এবং বুঝতেন। তাই সেই সরকার রক্ষার জন্য সংগ্রাম করে যাওয়ার অর্থ সুনিশ্চিত ও অবধারিত মৃত্যু, একথাও তারা খুব ভাল করেই জানতেন এবং সেইভাবে নিজেদের প্রস্তুত করেছিলেন। মৃত্যুই ছিল সুনিশ্চিত লক্ষ্য; সেইজন্য চট্টগ্রামের বিপ্লবী দল সশস্ত্র বিদ্রোহের মাধ্যমে জাতীয় মুক্তি অর্জনের যে কর্মসূচী গ্রহণ করেছিলেন, এককথায় তাকে তাঁরা বলতেন, ‘মৃত্যুর কর্মসূচী’ (Programme of death)।

“চট্টগ্রামের বিপ্লবীরা সশস্ত্র বিদ্রোহ এবং মৃত্যুর কর্মসূচী নিয়েছিলেন ঐ সময়ে এবং ভারতবর্ষের ঐ পরিস্থিতিতে এই উদ্দেশ্যে যে, দেশের জনগণের কাছে শুধুমাত্র একটি সম্ভাব্য এবং অর্জনীয় আদর্শ স্থাপন করবার জন্য। একটি স্থান সাময়িকভাবে সাম্রাজ্যবাদের কবলমুক্ত হোলেই সমগ্র ভারতবর্ষ মুক্ত হয়ে যায় না। সত্য; কিন্তু একটী স্থানের বীরত্বপূর্ণ একটী ঘটনা দেশের সমগ্র যুবশক্তিকে না হোলেও যুবশক্তির একটি বড় অংশকে ঐ দৃষ্টান্ত অনুসরণে অনুপ্রাণিত করবে; বিদ্রোহের ঐ পথ গ্রহণে অবশ্যই উদ্বুদ্ধ করবে। এই ছিল বিপ্লবীদের আশা।

“অস্ত্রাগার দখল করে বিদ্রোহীরা পেয়েছিলেন প্রচুর পরিমাণে মাস্কেট্রি রাইফেল এবং তার গুলি। মাস্কেট্রি রাইফেল অপেক্ষা বহুগুণে শ্ৰেষ্ঠ ফৌজী রাইফেলের (.৩০৩ রাইফেল) গুলি বিদ্রোহীরা পাননি; তাই বহু পরিমাণে ফৌজী রাইফেল পেলেও সেগুলি বিদ্রোহীদের কোন কাজে লাগেনি।

“আসন্ন আক্রমণকারী সাম্রাজ্যবাদী সৈন্যদের কাছে থাকবে ফৌজী রাইফেল এবং মেশিনগান। বিদ্রোহী বাহিনীর হাতে আছে কেবলমাত্র মাস্কেট্রি রাইফেল। এই নিকৃষ্ট ধরনের অস্ত্র নিয়েও সাম্রাজ্যবাদী ফৌজের বিরুদ্ধে কিছু পরিমাণে দৃঢ় প্রতিরোধ করা সম্ভব হবে যদি আসন্ন সংঘর্ষের সময় কোন একটি উঁচু পাহাড়ের উপর বিদ্রোহীরা নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করতে পারে। এই কথা বিবেচনা করেই বিদ্রোহীরা বিভিন্ন দিনে বিভিন্ন পাহাড়ের উপর ঘাঁটি করে বসেছিলেন।

“সেদিন জালালাবাদ পাহাড়ে। দিন ২২শে এপ্রিল। প্রকাশ্য বিদ্রোহ ঘোষণার পর চতুর্থ দিন। সময় বৈশাখ মাস। দিনের বেলা অসহ্য গরম! জালালাবাদ পাহাড়ে বড় গাছ নেই, তাই ছায়াও নেই, ছোট ছোট লতাগুল্ম ছায়াও দিতে পারে না, সূর্যের তাপও হ্রাস করতে পারে না। সকালবেলা আটটা-নয়টার মধ্যেই সকলের জলপাত্রের জল প্রায় সবটুকু ফুরিয়ে যায়। তারপরই আরম্ভ হয় অবর্ণনীয় কষ্ট। যতই দিন বাড়তে থাকে অবস্থা সেই পরিমাণে উত্তরোত্তর অসহনীয় হয়ে উঠতে থাকে। রোদের গরমে টিনের জলপাত্র এবং মাস্কেট্রি রাইফেল এত উত্তপ্ত হয়ে ওঠে যে, হাত ঠেকানো যায় না। মনে হয় ফোস্কা পড়ে যাবে। অসহনীয় তৃষ্ণায় বুকের ভিতরটা জ্বলতে থাকে, মুখের লালা শুকিয়ে যায়, জিহ্বা আড়ষ্ট হয়ে পড়ে, কথা বলাই যায় না। অজান্তে কারও কারও হাত শূন্য জলপাত্র তুলে মুখে নিয়ে যায়; অত্যুত্তপ্ত টিনের পাত্র ওষ্ঠ স্পর্শ করলেই সম্বিত ফিরে আসে। গতকাল দুপুরবেলা একজন অসহ্য তৃষ্ণায় থাকতে না পেরে রাইফেল পরিষ্কার করবার খানিকটা তেল গলায় ঢেলে দিয়েছিল। দিন মনে হয় অস্বাভাবিক দীর্ঘ। কখন যে সূর্য অস্ত যাবে, সন্ধ্যা আসবে! সূর্য যে একসময়ে সত্যিই অস্ত যায়, সন্ধ্যা যে যথার্থই আসে, গরম যে বাস্তবিকই কমে যায় এবং রাত্রিকালে ঠাণ্ডা হাওয়ার পরশ লাগে–একথা দিনের বেলা ঐ অবস্থায় অনেকেরই বিশ্বাস হয় না।

“আজ তিন দিন ধরে দিনের বেলা এই অবস্থাই চলছে। দ্বিপ্রহর থেকে সন্ধ্যার মধ্যে বেশীর ভাগ যুবকই নিশ্চল অনড় হয়ে পড়ে থাকে। দেখে মনে হয় তাদের মধ্যে কেউ কেউ হয়ত অসহ্য তৃষ্ণায় এবং অসহনীয় গরমে অচৈতন্য হয়ে পড়ে আছে। শুধু অতিমাত্রায় সজাগ ও সতর্ক হয়ে থাকে পাহাড়ের ওপরের চারিদিকের প্রহরীরা। দুপুরের পর অত্যধিক গরমে যখন হাওয়া অতিশয় উত্তপ্ত হয়ে ওঠে, তখন দূরে নীচে মরীচিৎকার মত দেখা যায়। চোখের উপর হাত রেখে জ কুঁচকে দৃষ্টি প্রখর করে প্রহরীরা একদৃষ্টিতে সম্মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে যদি অকস্মাৎ অস্বাভাবিক কিছু দেখা যায়। এমনি করে দুইঘণ্টা তিনঘণ্টা সতর্ক থাকতে হয়। এইটুকু সময়ের জন্য মনে হয় তাদের তৃষ্ণা বা গ্রীষ্মবোধ থাকে না।

“সাম্রাজ্যবাদী ফৌজের আসন্ন আক্রমণের সম্ভাবনায় সর্বাধিনায়ক মাষ্টারদা সূর্য সেন বিপ্লবী বাহিনীর নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব লোকনাথ বলের উপর ন্যস্ত করে দিয়েছিলেন।

“সেদিন ২২শে এপ্রিল। দ্বিপ্রহর অতীত হয়ে গিয়েছে। সমগ্র পাহাড়টি নীরব নিস্তব্ধ। পাহাড়ের উপরে প্রায় সবটা জায়গায় দুইজন তিনজন করে, বেশীর ভাগ জায়গায় একা একা সশস্ত্র বিপ্লবী যুবকেরা ছড়িয়ে পড়ে আছে। হয়তবা এখানে ওখানে দুই-একজন অনুচ্চকণ্ঠে কথা বলছে; এত নিম্নস্বর যে ঠিক পাশেই সব কথা শোনা যাচ্ছিল না। কারণ, প্রধানতঃ শুষ্ক মুখে শুষ্ক জিহ্বার আড়ষ্টতা।

“তখন অপরাহ প্রায় চারটা; পাহাড়ের উপরের প্রহরীরা এবং আরও অনেকে দেখতে পেল কিছুদূরের ঐ রেললাইনের উপর দিয়ে ধোঁয়া উড়িয়ে শহরের দিক থেকে একখানা ট্রেন এলো। ট্রেনটি কিন্তু সোজা চলে গেল না, ঐ দূরে একটি জায়গায় গিয়ে থেমে গেল। যে জায়গায় ট্রেনটি থামল সেই জায়গাটি পাহাড়ের উপর থেকে দেখা যায় না, জায়গাটি ঘন ঝোঁপঝাড় জঙ্গলের আড়ালে। জায়গাটি কিন্তু একটি রেলস্টেশন নয়। ঐ অস্বাভাবিক জায়গায় ট্রেনটিকে থামতে দেখে পাহাড়ের উপর প্রায় সকলেরই মনে হোল ঐ ট্রেনটি একটি সৈন্যবাহী ট্রেন, শহর থেকে বহু সৈন্য নিয়ে এসেছে।

“পাহাড়ের উপরের বিদ্রোহী সেনারা স্পষ্ট বুঝতে পারল এতদিন যার জন্য এত কষ্টের মধ্যেও অপেক্ষা করা হয়েছে আজ সেই বহুপ্রত্যাশিত আক্রমণ আসন্ন হয়ে এসেছে। মাষ্টারদা আবার লোকনাথ বলকে ডেকে আদেশ দিলেন, সমগ্র বিপ্লবী বাহিনীকে পরিচালিত করে আসন্ন আক্রমণ পরাভূত করবার জন্য প্রস্তুত হোতে। লোকনাথ বল বিদ্রোহী সৈনিকদের সম্বোধন করে অনুচ্চকণ্ঠে নির্দেশ দিলেন, সকলেই যেন আসন্ন আক্রমণের জন্য প্রস্তুত হয়ে থাকে। লোকনাথ বল আরও বললেন, দেশের স্বাধীনতার জন্যে আসন্ন যুদ্ধে প্রাণ দেবার জন্যে প্রস্তুত হওয়া বড় কথা নয়; সর্বাপেক্ষা বড় প্রয়োজন সাম্রাজ্যবাদের আসন্ন আক্রমণ প্রতিহত করা, সাম্রাজ্যবাদী ফৌজকে পরাজিত করা, দেশপ্রেমের আদর্শ সমুজ্জ্বল রাখা এবং এই দায়িত্ব পালনের পথে প্রাণ দেবার জন্য প্রস্তুত থাকা। লোকনাথ বল বিশেষ জোর দিয়ে আরও বললেন, তাঁর দ্বিতীয় আদেশের পূর্বে কেউ যেন নিজের রাইফেল থেকে একটি গুলিও না নিক্ষেপ করে। সকলেই রাইফেলে গুলি ভর্তি করে রুদ্ধ নিঃশ্বাসে দ্বিতীয় আদেশের অপেক্ষায় মুহূর্ত গুণতে আরম্ভ করল।

“উপর থেকে দেখা গেল সাম্রাজ্যবাদী ফৌজের ৪। ৫ জনের কিম্বা ২। ৩ জনের ছোট ছোট এক একটি দল হঠাৎ এক ঝোঁপের আড়াল থেকে অতি দ্রুত ছুটে গিয়ে অপর একটি ঝোঁপের আড়ালে লুকিয়ে পড়েছে, এবং এমনি করে বহুসংখ্যক ফৌজী সেপাই নীচে থেকে ক্রমশঃ উপরের দিকে উঠে আসছে। উপরের বিপ্লবী সৈন্যরা ক্রমশঃই অধৈর্য হয়ে উঠছে; কিন্তু সেনাপতির আদেশ না পেলে গুলি নিক্ষেপ করবার উপায় নেই। সকলেই অপরিসীম আগ্রহে এবং অস্থির ব্যাকুল অন্তরে সেনাপতির দ্বিতীয় আদেশের জন্য প্রতীক্ষা করে আছে।

“অল্প কয়েক মুহূর্ত পরেই, অন্যদের কাছে মনে হচ্ছিল যেন এক যুগ, যখন সেনাপতি লোকনাথ বল নিশ্চিত হলেন যে শত্রুদের আর উপরে উঠতে দেওয়া নিরাপদ নয় তখন তীব্র তীক্ষ্ণ স্বরে সেনাপতির আদেশ শোনা গেল–”হল্ট”। এবং এক মুহূর্ত পরেই সেই প্রত্যাশিত নির্দেশ ফায়ার’। সঙ্গে সঙ্গেই প্রায় ৬০ জন অধীর বিপ্লবী যুবকের হাতের রাইফেল একসাথে গর্জন করে উঠল এবং অদূরবর্তী নীচু ঢালু অংশে সুনিশ্চিত মৃত্যুর অমোঘ পরোয়ানা ছড়িয়ে দিল।

“যারা নীচে থেকে অতি নিঃশব্দে উপরে উঠে আসছিল এবং আশা করছিল চুপে চুপে উপরে উঠে এসে অকস্মাৎ অপ্রত্যাশিত বেয়নেট আক্রমণে উপরের অসতর্ক সমগ্র বিদ্রোহী বাহিনীকে শুধু ছত্রভঙ্গ করেই ফেলবে না, তাদের আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য করবে নতুবা তাদের সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস করে ফেলবে, তারাই উপর থেকে সম্পূর্ণ অপ্রত্যাশিত আক্রমণে একেবারে হতভম্ব হয়ে গেল। এবং অবস্থা বুঝতে পারার আগেই তাদের মধ্যে অনেকে প্রাণ হারিয়ে, অনেকে মারাত্মকভাবে আহত হয়ে নীচে গড়িয়ে পড়ে গেল। তাদের অবস্থিতি প্রকাশ হয়ে পড়েছে। ঐ স্থানে আর তাদের নিজেদের গোপনে অথবা আড়ালে রাখা সম্ভব হবে না। এবং পাহাড়ের ঐ ঢালু গায়ে প্রচণ্ড গুলিবর্ষণের বিরুদ্ধে আশ্রয় পাওয়ার কোনরূপ সম্ভাবনা নেই এবং উপর থেকে ঐ গুলিবর্ষণের মধ্যে পাহাড়ের ঐ প্রায় খাড়াই অংশটুকু কিছুতেই খুব দ্রুত উঠে যাওয়া সম্ভব হবে না বুঝতে পেরে সমগ্র সাম্রাজ্যবাদী ফৌজ মুহূর্তে পেছন দিকে ফিরে ছুটে নীচে নেমে যেতে আরম্ভ করল। সেই সময়ে আরও অনেকে প্রাণ হারিয়ে গড়িয়ে পড়ল, আরও অনেকে গুরুতর আহত হয়ে পড়ে গেল। অনেকের পা গেল, অনেকের হাত গেল, বাকী সকলে ছুটে গিয়ে নীচে অদূরবর্তী একটি শুষ্ক নালার মধ্যে আশ্রয় নিল; এই নালার ভিতরের অংশ পাহাড়ের উপর থেকে দেখা যায় না; এপাশের একটি উঁচু ঢিপি এবং ঘন বনজঙ্গল ঐ নালাটিকে উপরের দৃষ্টি থেকে আড়াল করে রেখেছে।

“উপরে বিদ্রোহী বাহিনীর প্রত্যেকটি যুবকই যত দ্রুত সম্ভব এবং এবং যত বেশী সম্ভব গুলিবর্ষণ করে চলেছে এবং সঙ্গে সঙ্গে ‘বন্দে মাতরম্, ইনকিলাব জিন্দাবাদ, সাম্রাজ্যবাদ ধ্বংস হোক’ প্রভৃতি রণধ্বনি চিৎকার করে চলেছে।

“এদিকে উপরে উঠতে ব্যর্থ এবং অসমর্থ হয়ে সাম্রাজ্যবাদী ফৌজের সেপাইরা প্রাণভয়ে নীচে নালার মধ্যে জড় হবার পর ফৌজের অফিসার কর্তৃক তারা প্রচণ্ডভাবে ভসিত হয়। অফিসারেরা তাদের ভীরু, কাপুরুষ, অপদার্থ প্রভৃতি গালাগালি দিয়ে পুনরায় আদেশ দেয়, প্রত্যেকেই যেন নিজের নিজের রাইফেলে বেয়নেট লাগিয়ে যথাসাধ্য দ্রুতবেগে ছুটে উপরে উঠবার চেষ্টা করে। অফিসারেরা এই বলে সেপাইমনে সাহস এনে দেবার চেষ্টা করল যে অতগুলি সাহসী সৈন্যের হাতে পড়ন্ত রোদে ঝ ঝ করা বেয়নেট দেখেই উপরের বাঙ্গালী লেড়কা লোগ ভয়েই আত্মসমর্পণ করবে, তাদের হাতে আর রাইফেল চলবে না।

“অফিসারদের এইসব কথায় সেপাইদের মনে কতখানি বিশ্বাস এবং সাহস এসেছিল সেকথা জানা যায়নি, কিন্তু পুনরায় আক্রমণের আদেশ পেয়ে সেপাইরা ঐ অসম্ভব কাজে আবার এগিয়ে আসতে বাধ্য হোল। এবারও সেনাপতির নির্দেশে দেশপ্রেমিক বিদ্রোহী বাহিনী প্রচণ্ড গুলিবর্ষণ আরম্ভ করে এবং সঙ্গে সঙ্গে প্রচণ্ড চিৎকারে সমগ্র জালালাবাদ পাহাড় প্রকম্পিত করে তোলে।

“অসম্ভব! ঐ গুলিবর্ষণের মুখে সেপাইদের এক পাও অগ্রসর হয়ে এগিয়ে যাওয়া সম্ভব হোল না; আগের বার তারা যতটুকু উঠতে পেরেছিল, এবার ততটুকুও তারা এগিয়ে যেতে পারেনি। পূর্বোপেক্ষা আরও অল্প সময়ের মধ্যেই হতাহতের সংখ্যা এবার আরও বেশী হোল।

মুহূর্তে সেপাইরা পেছন ফিরে আবার জোর দৌড়ে নীচের সেই শুষ্ক নালার মধ্যে গিয়ে জড় হোল। পাহাড়ের উপর তখন প্রচণ্ডভাবে গুলিবর্ষণের সাথে অবিরাম প্রচণ্ড চিৎকারে বিপ্লবের জয় ও সাম্রাজ্যবাদের ধ্বংস কামনা করা হচ্ছিল ও যুদ্ধে সাম্রাজ্যবাদী ফৌজের পরাজয় ঘোষণা করা হচ্ছিল।

“এবার সামরিক অফিসারেরা নিজেদের ভুল বুঝতে পারল যে, এইভাবে বিদ্রোহী বাহিনীর ঐ প্রচণ্ড গুলিবর্ষণের মুখে কিছুতেই পাহাড়ে ওঠা সম্ভব হবে না এবং বাঙ্গালী লেড়কা লোগকো’ ভয় দেখিয়ে আত্মসমর্পণে বাধ্য করা যাবে না। তখন যে কয়জন অফিসার ওখানে উপস্থিত ছিল, পরামর্শ করে স্থির করল জালালাবাদ পাহাড়ের উপরে প্রচণ্ড গুলিবর্ষণ করে বিদ্রোহীদের ধ্বংস করতে হবে। এই সিদ্ধান্ত অনুযায়ী দুইটি মেশিনগান গ্রুপ জালালাবাদ পাহাড়ের দুইদিকে চলে গেল।

“এদিকে দ্বিতীয়বার আক্রমণের চেষ্টার পর বেশকিছু সময় কেটে গেল। বিদ্রোহীবাহিনীর নেতারা বুঝতে পারছেন না এবার আক্রমণ কিভাবে কোন্ দিক থেকে আসবে। পাহাড়ের উপরের প্রত্যেকটি সৈন্য এবং নেতৃবৃন্দ অতিমাত্রায় সতর্ক হয়ে রইলেন। সেনাপতি আজ্ঞা দিলেন, কেউই যেন অনর্থক রাইফেলের গুলির অপব্যবহার না করে।

“নিস্তব্ধতা এবং অনিশ্চয়তা বেশীক্ষণ রইল না। অকস্মাৎ অদূরবর্তী দুইটি পাহাড়ের উপর থেকে মেশিনগানের প্রচণ্ড গুলিবর্ষণ আরম্ভ হোল। সঙ্গে সঙ্গে বিদ্রোহীবাহিনীর যুবকেরাও প্রচণ্ড গুলিবর্ষণ করে এবং সাথে গগনবিদারী রণধ্বনি চিৎকার করে সাম্রাজ্যবাদী ফৌজের নতুন আক্রমণের প্রত্যুত্তর দিতে আরম্ভ করল। যে দুইটি পাহাড় থেকে মেশিনগানের গুলি আসছিল সেই দুইটি পাহাড়ে মাস্কেট্রি রাইফেলের গুলি পৌঁছায় না, অথচ সেখান থেকে মেশিনগানের গুলি এসে মারাত্মকভাবে এই পাহাড়ে পড়ছিল।

“তখন সূর্য ঠিক অস্ত যাচ্ছে।

“দুইপক্ষ থেকেই প্রচণ্ড গুলিবর্ষণ চলছে। বিদ্রোহীদের পক্ষে একটি বিপদ দেখা দিল। কয়েকটি গুলিবর্ষণের পরেই ধোয়া এবং কালিতে মাস্কেট্রি রাইফেল অচল হয়ে পড়ছিল। নির্মলদা পাহাড়ের এককোণে বসে ঐসব অচল রাইফেল পরিষ্কার করে, তেল দিয়ে পুনরায় চালু করে দিচ্ছিলেন। এবং সর্বাধিনায়ক মাষ্টারদা গড়িয়ে গড়িয়ে এবং বুকে হেঁটে বিভিন্ন যুবকদের কাছ থেকে তাদের অচল রাইফেল এনে নির্মলদার কাছে পৌঁছে দিচ্ছিলেন এবং পরে আবার সেগুলি যথাস্থানে ফিরিয়ে দিচ্ছিলেন। এর ফলে বিদ্রোহীবাহিনীর গুলিবর্ষণের পরিমাণ এবং প্রচণ্ডতা কোন সময়েই হ্রাস পায়নি।

“কিন্তু দুইদিক থেকে মেশিনগানের গুলি আসার ফলে জালালাবাদ পাহাড়ের উপর বিপর্যয় আরম্ভ হোল। প্রথমেই দুরন্ত চঞ্চল অসমসাহসী বেপরোয়া বিদ্রোহী বালক টেগ্রার (হরিগোপাল বল) বুকে গুলি লাগে এবং টেগরা প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই প্রাণত্যাগ করে। অল্প কিছুক্ষণের মধ্যেই টেরাকে অনুসরণ করে শহীদের মৃত্যু বরণ করে অমরত্ব লাভ করেন ত্রিপুরা সেন, নির্মল লালা, পুলিন ঘোষ, শশাঙ্ক দত্ত, মধুসূদন দত্ত, প্রভাস বল, নরেশ রায়, বিধু ভট্টাচার্য, জিতেন দাশগুপ্ত, মতি কানুনগো এবং অর্ধেন্দু দস্তিদার। এঁদের মধ্যে মতি কানুনগো এবং অর্ধেন্দু দস্তিদার আরও কয়েক ঘণ্টা বেঁচে ছিলেন। অম্বিকাদা, বিনোদ দত্ত এবং বিনোদ চৌধুরীও গুরুতরভাবে আহত হয়েছিলেন, কিন্তু তারা জালালাবাদ পাহাড় পরিত্যাগ করে সেই রাত্রেই চলে যেতে পেরেছিলেন। এই তিনজনের মধ্যে শেষোক্ত দুইজন সেই মুক্তিযুদ্ধের গৌরব বহন করে আজও আমাদের মধ্যে আছেন।

“দুইটি মেশিনগান থেকে অল্পসময়ের মধ্যে প্রচণ্ডভাবে কয়েক সহস্র রাউণ্ড গুলিবর্ষণ করেও জালালাবাদ পাহাড়ের মুষ্টিমেয় বিদ্রোহী বাঙালী লেড়কার’ রাইফেল স্তব্ধ করা সম্ভব হোল না। এদিকে সন্ধ্যার অন্ধকারও ঘিরে আসছে। কী হবে? যদি বেপরোয়া বিদ্রোহী যুবকেরা সন্ধ্যার অন্ধকারে চুপি চুপি এসে এই দুইটি মেশিনগানের ছোট পাহাড় ঘিরে ফেলে দেয় তাহলে কী হবে?

আর ইতস্ততঃ না করে সমগ্র সাম্রাজ্যবাদী ফৌজ তখনিই যথাসম্ভব দ্রুত পদক্ষেপে গিয়ে অপেক্ষমাণ ট্রেনে শহরের নিরাপত্তায় ফিরে যায় এবং স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে।

সাম্রাজ্যবাদী ফৌজের অফিসারদের হিসাবে, অভিজ্ঞতায় এবং জ্ঞানে গুরুতর ভুল ছিল। তারা বেতনভুক্ত সৈন্য পরিচালনা করে অভ্যস্ত। সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধী মুক্তিকামী একজন দেশভক্ত তরুণ দেশপ্রেমে উদ্দীপ্ত হয়ে কত সহজে মৃত্যুকে অবজ্ঞা করতে পারে এবং জাতীয় মুক্তির জন্য কী করতে পারে সে-ধারণা তাদের কোথা থেকে আসবে? তাই তো সেদিন তাদের ঐ শোচনীয় পরাজয় বরণ করতে হয়েছিল। মুষ্টিমেয় দেশভক্ত তরুণ বিদ্রোহীদের ভয়ে সেদিন বহুসংখ্যক সাম্রাজ্যবাদী ফৌজকে স্পর্ধিত বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদের পতাকা গুটিয়ে নিয়ে পলায়ন করে চলে যেতে হয়েছিল। বিচারের সময় একথা তো তারা শত চেষ্টা করেও অস্বীকার করতে পারেনি।

একসময়ে মেশিনগানের গুলিবর্ষণ বন্ধ হোল। বিদ্রোহীদের গুলিবর্ষণ কিন্তু অব্যাহত রইল–অবশ্য একতরফাভাবে। ক্রমে ক্রমে তাও কমে এসে একসময়ে বন্ধ হয়ে গেল এবং সমগ্র পাহাড়ে আবার নীরবতা নেমে এল।

সমগ্র জালালাবাদ পাহাড় তখন অন্ধকারে আচ্ছন্ন এবং নীরব-নিস্তব্ধ।

বিদ্রোহী সৈন্যেরা শুনতে পেল ঐ দূর দিয়ে সেই ট্রেনখানি তীব্রস্বরে বাঁশী বাজিয়ে অন্ধকারের মধ্যে শহর অভিমুখে চলে গেল।

সেদিন ২২শে এপ্রিল ১৯৩০ সাল।

মাষ্টারদার নির্দেশে এবং বিদ্রোহীবাহিনীর সৈন্যাধ্যক্ষ লোকনাথ বলের আদেশে সমগ্র বিপ্লবী বাহিনী সমবেত হয়ে শহীদ সাথীদের প্রতি শেষ সম্মান ও গভীর শ্রদ্ধা প্রদর্শন করে।

তারপর দুইভাগে ভাগ হয়ে বিদ্রোহী তরুণেরা জালালাবাদ পাহাড় থেকে ধীরে ধীরে নেমে নীচে গাঢ় অন্ধকারের মধ্যে অদৃশ্য হয়ে মিলিয়ে যায়।

পাহাড়ী পথের অন্ধকারে মাষ্টারদা, নির্মল সেনের দল লোকনাথ বলের দল থেকে বিচ্ছিন্ন হইয়া যায়, কিন্তু অনেক দুঃখকষ্ট ভোগ করিয়া অবশেষে কোয়াপাড়া গ্রামে তাঁহারা মিলিত হন।

বিপ্লবীরা চট্টগ্রাম হইতে পাহাড়ের দিকে যাইবার পরই দুইদিনের মধ্যে সশস্ত্র সৈন্য ও পুলিশ সমস্ত শহর অধিকার করিয়া অকথ্য অত্যাচার আরম্ভ করিল। কেবলমাত্র গুখাসৈন্যের সংখ্যা ছিল পনেরো হাজার। নির্মল সেন মাষ্টারদাকে বলিলেন, ‘মৃত্যুপাগল ক’টি ভাইকে ছেড়ে দিতে হবে। কেন? পাহাড়তলীর ফিরিঙ্গীরা পুলিশের সঙ্গে যুক্ত হয়ে সারা শহরে অকথ্য অত্যাচার চালিয়ে যাচ্ছে–সবার আত্মপ্রত্যয় লুপ্ত হবে এখুনি কোন প্রত্যুত্তর না দিলে। মাষ্টারদা অনুমতি দিলেন। ছয়টি যুবক চট্টগ্রামের শ্বেতাঙ্গঅধ্যুষিত অঞ্চলে গিয়া দেখিলেন, ঐ পল্লীতে পুলিশ, আই. বি. ও সান্ত্রীদের সদাসতর্ক পাহারা। পুলিশ শীঘই তাহাদের সন্ধান পাইল। দ্রুতবেগে তাহারা নৌকায় কর্ণফুলি নদী পার হইয়া কালারপোল গ্রামে পৌঁছিলেন। রাত্রিতে পুলিশ ও গ্রামবাসীরা সেখানে তাঁহাদের গতিরোধ করিল। যুদ্ধ শুরু হইল। দুইজন আহত অবস্থায় বন্দী হইলেন, বাকী চারিজন গুরুতররূপে আহত হইয়াও মাটিতে বুক রাখিয়া গুলিবর্ষণ করিতে লাগিলেন এবং দেশজননীর চরণে জীবনের শেষ রক্তবিন্দু ঢালিয়া দিয়া মহাপ্রয়াণ করিলেন।

চারিজন বিপ্লবী ভাটিয়ারী রেলওয়ে ষ্টেশনে কুমিল্লার টিকিট কিনিয়া যখন গাড়ীতে উঠিলেন, স্টেশন মাষ্টারের তখন সন্দেহ হইল। তারযোগে তাহার সন্দেহের কথা জানাইলেন। ফেনী ষ্টেশনে সদলবলে দারোগা আসিয়া যুবকগণের দেহ তল্লাসী করিতে আদেশ দিলেন। বিপ্লবীদের পিস্তল গর্জিয়া উঠিল। বিস্তর গুলিবর্ষণে পুলিশের কিছু লোক আহত হইল। ষ্টেশনের লোকজন ও প্যাসেঞ্জাররা চারিদিকে ছুটাছুটি করিতে লাগিল, এই সুযোগে বিপ্লবীগণ পলাইয়া যাইতে সমর্থ হইলেন।

চট্টগ্রামের কয়েকজন বিপ্লবী নেতা অনন্ত সিংহ, গণেশ ঘোষ, লোকনাথ বল ও আরও দুইজন চন্দননগরে আশ্রয় পাইলেন যুগান্তর’-কর্তৃপক্ষের একটি গোপন আস্তানায়। রেলওয়ে কর্মচারী শশধর আচার্য দলের একজন বিশ্বস্ত কর্মী এবং দলেই আর একজন খাঁটি বিপ্লবী মহিলা সুহাসিনী দেবী। তাঁহারা পরস্পরের তেমন পরিচিত না হইলেও প্রতিবেশী ও পুলিশের সন্দেহ দূর করিবার জন্য স্বামী স্ত্রীর ন্যায় বাস করিতেছিলেন। এখানেই চট্টগ্রামের বিপ্লবীদল আশ্রয় পাইলেন। কিন্তু গোপনে সংবাদ পাইয়া টেগার্ট প্রমুখ বড় বড় পুলিশ কর্মচারী ফরাসী সরকারের অনুমতি না লইয়াই চন্দননগরের এই বাড়ী ঘেরাও করিলেন। লড়াই করিয়া বিপ্লবীদের একজন মৃত্যু বরণ করিলেন, বাকী কয়েকজনকে পুলিশ গ্রেপ্তার করিল (১লা সেপ্টেম্বর, ১৯৩০)।

নারীবিপ্লবী প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদারসহ কয়েকজন বিপ্লবীকে লইয়া সূর্য সেন চট্টগ্রাম হইতে দশ মাইল দূরে ধলঘাটে এক গৃহস্থবাড়ীতে গোপনে বাস করিতে লাগিলেন। গৃহকত্রী ছিলেন বর্ষীয়সী বিধবা সাবিত্রী দেবী। ইহাই হইল ইণ্ডিয়ান রিপাবলিকান আর্মির গোপনীয় হেডকোয়ার্টার। কর্মীরা এখানে যাতায়াত করেন। এবং এখান হইতেই সর্বত্র নির্দেশ যায়। ১৩ই জুন (১৯৩২) অকস্মাৎ একদল সিপাহী এই আস্তানাটি ঘিরিয়া ফেলিল এবং তাহাদের নেতা ক্যাপ্টেন ক্যামারন। বাড়ীতে ঢুকিয়া খোলা রিভলভার লইয়া দোতলায় উঠিতেছেন, এমন সময় অপূর্ব সেন সাহেবকে গুলি করিলেন-ক্যামারনের মৃত্যু হইল, সঙ্গে সঙ্গে সিপাহীর গুলিতে অপূর্বও নিহত হইলেন। ইতিমধ্যে রাইফেলধারী পুলিশের একটি নূতন দল কামান লইয়া ঘটনাস্থলে উপস্থিত হইল। দোতলা হইতে নির্মল সেন গুলি চালাইতে লাগিলেন। কামানের গোলাবর্ষণও চলিল। কিছুক্ষণ পরে উপর হইতে আর কোন শব্দ পাওয়া গেল না। পুলিশও সারারাত্রি বাড়ীটি ঘিরিয়া রাখিল। প্রভাতে দোতলায় উঠিয়া নির্মল সেনের মৃতদেহ দেখিতে পাইল। কিন্তু মাষ্টারদার খোঁজ নাই। বহুপূর্বেই তিনি ও প্রীতিলতা বাঁশের মইয়ের সাহায্যে রান্নাঘরের করোগেটেড টিনের ছাদে নামেন। সেখান হইতে লাফ দিয়া নীচে পড়িয়া জলেডোবা দুর্গম পিচ্ছিল পথে অন্ধকারের আড়ালে অদৃশ্য হইয়া যান। পরদিন আশ্রয়দাত্রী সাবিত্রী দেবী তাঁহার পুত্র-কন্যাসহ গ্রেপ্তার হইলেন। তাঁহাদের উপর যে নির্মম অত্যাচার ও নির্যাতন চলিয়াছিল তাহা বর্ণনা করা বাহুল্যমাত্র।

প্রীতিলতা ও মাষ্টারদার পরিণামের কথা সংক্ষেপে বলিয়াই চট্টগ্রাম-যুদ্ধের অবিস্মরণীয় কাহিনী শেষ করিব।

ধলঘাট হইতে পলায়ন করিয়া মাষ্টারদা ও প্রীতিলতা কাট্টলীতে আশ্রয় লইলেন। এই সময় নারীনেতৃত্বে একটি খণ্ডযুদ্ধ পরিচালনার কল্পনা প্রীতিলতার মাথায় আসিল। চট্টগ্রামের পাহাড়তলী ইউরোপীয়ান ক্লাব আক্রমণ ১৮ই এপ্রিলের (১৯৩০) কার্যপদ্ধতির অন্তর্ভুক্ত ছিল। কিন্তু, সাহেব-মেমরা পূর্বেই পলায়ন করায় ইহা কার্যে পরিণত করা সম্ভব হয় নাই, সেকথা পূর্বেই বলা হইয়াছে।

১৯৩২ সনের ২৪শে সেপ্টেম্বর প্রীতিলতার নেতৃত্বে এক বিদ্রোহী দল রাত্রি দশটার সময় নৃত্যগীতমুখরিত ক্লাবগৃহে হানা দিল। উপস্থিত প্রায় ৪০ জন শ্বেতাঙ্গ পুরুষ ও মহিলার মধ্যে অকস্মাৎ বোমা ফাটিল। সঙ্গে সঙ্গে ধুম্রাচ্ছন্ন ক্লাবকক্ষে মুহূর্মুহূ বুলেটের শব্দে ভীতত্রস্ত শ্বেতাঙ্গ নরনারীর আর্তনাদ ও ছুটাছুটি আরম্ভ হইল। তাহাদের মধ্যে একজন হত ও বারোজন আহত হয়। প্রায় তিন মিনিটের মধ্যে কার্য শেষ করিয়া নেত্রীর নির্দেশমত বিপ্লবীরা প্রস্থান করিল। দূরে সন্ধানী আলো ফেলিয়া মিলিটারি গাড়ী আসিতেছে। কিন্তু হঠাৎ খেয়াল হইল প্রীতিলতা আসেন নাই। একজন ছুটিয়া গিয়া বলিল, “আসুন দিদি, শীগগীর চলে আসুন পুলিশ এসে গেছে। নিজের রিভলভারটি ঐ তরুণের হাতে তুলিয়া দিয়া বলিলেন, সবাই চলে যাও, একটুও দেরী কোরো না। বারে বারে আঘাত হেনে শত্রুকে পরাজিত করার চেষ্টা কোরো, এই আমার শেষ অনুরোধ। যাও ভাই, শুভেচ্ছা সবার জন্য-প্রণাম মাষ্টারদাকে। উর্ধ্বে অঙ্গুলি তুলিয়া বলিলেন, ‘ঐ আমার গন্ত ব্য স্থান। শহিদকুল আমাকে ডাকছেন। এই কথা কয়টি বলিয়াই সায়ানাইড মুখে দিয়া প্রীতিলতা চিরজন্মের মত বিদায় লইলেন। অন্যান্য জিনিসের সঙ্গে তাঁহার জামার ভিতর সেলাই-করা শ্রীকৃষ্ণের একখানি ছবি ছিল।

ধলঘাটে সংঘর্ষের পর মাইল-তিনেক দূরে গৈরালা গ্রামে বিশ্বাসদের বাড়ীতে সূর্য সেন আস্তানা লইয়াছিলেন। দশহাজার টাকা পুরস্কারের লোভে নেত্ররঞ্জন সেন নামে এক দুশ্চরিত্র ঋণগ্রস্ত জমিদার পুলিশকে সন্ধান দেন। ২রা ফেব্রুআরি (১৯৩৩) পুলিশ বারিটি ঘেরাও করিল। বাড়ীর পশ্চাতেই বেড়ার ওধারে ঝোঁপজঙ্গল। কয়েকজন বেড়া টপকাইয়া পলাইলেন। মাষ্টারদা একটি বড় গাছের গুঁড়ি ধরিয়া বেড়া টপকানোর চেষ্টা করিতেই একটি গুর্খা সিপাহী তাঁহাকে ধরিয়া ফেলিল। মাষ্টারদার ফাঁসি হইল (১৩ই জানুআরি ১৯৩৪)। ইহার প্রতিশোধে নেত্র সেনের হত্যার কথা পূর্বেই বলা হইয়াছে।

মাষ্টারদার গ্রেপ্তারের পর তারকেশ্বর দস্তিদার নেতা হইলেন। তিনি ও কল্পনা দত্ত গৈরালা হইতে পলাইয়া গভীর অন্ধকারে জঙ্গলের মধ্যদিয়া গহিরায় এক গৃহস্থবাড়ীতে আসিয়া আশ্রয় লন। জেল হইতে মাষ্টারদার ও অপর বন্দীদের উদ্ধার করার চেষ্টা ব্যর্থ হয়। হঠাৎ ১৮ই মে (১৯৩৩) পুলিশ ও মিলিটারি বাহিনী গৈরালার বাড়ী ঘিরিয়া ফেলিল। সংঘর্ষ আরম্ভ হইল–আশ্রয়দাতা ও গৃহবাসী দুইজন নিহত হইলেন, তারকেশ্বর আত্মসমর্পণ করিলেন। পুলিশ সকলকেই গ্রেপ্তার করিল।

১৯৩৪ সনের ৭ই জানুআরি বিপ্লবের শেষ শিখা জ্বলিয়া উঠিল চট্টগ্রামে।

১৯৩৩ সনের ১৪ই ফেব্রুআরি মাষ্টারদা ও তারকেশ্বর দস্তিদার ফাঁসির দণ্ডে দন্ডিত হইলেন। এই দণ্ডাদেশের প্রতিবাদে নিজাম পল্টনের মাঠে ক্রিকেটক্রীড়ারত সাহেবদের উপর চারজন বিপ্লবীর রিভলভার গর্জিয়া উঠিল। সংঘর্ষের ফলে দুইজন নিহত ও দুইজন আহত হইলেন। এই দুইজনেরই মৃত্যুদণ্ড হইল।

তথ্যনির্দেশ

১. শ্রীকালীচরণ ঘোষ, ‘জাগরণ ও বিস্ফোরণ, ৪৮৬-৮৭ পৃ.।

২. শ্রীকালীচরণ ঘোষ, জাগরণ ও বিস্ফোরণ, ৫২৬-২৭ পৃ.।

৩. শ্রীকালীচরণ ঘোষ, জাগরণ ও বিস্ফোরণ, ৫৪৭ পৃ.।

৪. শ্রীকালীচরণ ঘোষ, জাগরণ ও বিস্ফোরণ, ৫৬১-৬২ পৃ.।

৫. ইহার নাম অনেক গ্রন্থেই গোপীনাথ সাহা লিখিত হইয়াছে, এবং এই গ্রন্থেও পূর্বে অনেক স্থলে ঐভাবেই নামটি লেখা হইয়াছে (দশম অধ্যায়) কিন্তু তাঁহার প্রকৃত নাম গোপীমোহন সাহা। আদালতের নথিপত্রেও এই নামই পাওয়া যায়। শ্রীকালীচরণ ঘোষ এই তথ্যটি আমাকে জানাইয়াছেন, এজন্য আমি তাঁহার নিকট কৃতজ্ঞ। এরূপ দেশভক্ত যুবকের প্রকৃত নামটি দেশের লোকের জানা আবশ্যক। এই জন্য এই বিবরণীতে প্রকৃত নাম ব্যবহার করিলাম।

৬. শচীন্দ্রনাথ গুহ সম্পাদিত চট্টগ্রাম বিপ্লবের বহ্নিশিখা’, ২৯ পৃ.।

৭. সূর্য সেন স্মৃতি গ্রন্থ থেকে সংকলিত

৮. শচীন্দ্রনাথ গুহ সম্পাদিত চট্টগ্রাম বিপ্লবের বহ্নিশিখা’, পৃ. ৪-১২।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *