০৯. শাসন নীতি (১৯২১-২৬)

নবম অধ্যায় – শাসন নীতি (১৯২১-২৬)

প্রথম ব্যবস্থাপকসভা (১৯২১-২৩)

১৯২০ সনে কলিকাতা ও নাগপুরের অধিবেশনে কংগ্রেস তাহার নূতন সংবিধান অনুসারে ব্যবস্থাপকসভা বর্জন করার যে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করিয়াছিল তাহা ষষ্ঠ অধ্যায়ে বলা হইয়াছে। কংগ্রেস দলের কোন সদস্য নির্বাচনপ্রার্থী না হইলেও ব্যবস্থাপকসভায় পুরাতন মডারেট-পরবর্তী লিবারেল-দলের সদস্যগণ এবং আরও অনেকে প্রার্থী হইলেন। সুতরাং ব্যবস্থাপকসভার নির্বাচন ব্যাহত হইল না, উদারনীতিক (লিবারেল) দলের সদস্যগণই অধিক সংখ্যায় নির্বাচিত হইলেন। ১৯১৯ সনের ভারতের নূতন সংবিধানে ব্যবস্থাপকসভার (Council) মোট সদস্যসংখ্যা ছিল ১৪০। ইহাদের মধ্যে সরকারী কর্মচারী ও মনোনীত সদস্যদের সংখ্যা ছিল ২৬ এবং নির্বাচিত হিন্দু ও মুসলমান সদস্যের সংখ্যা ছিল যথাক্রমে ৫৭ ও ৩৯। ইউরোপীয়, অ্যাংগ্লো ইণ্ডিয়ান, ব্যবসায়ী সম্প্রদায়, অনুন্নত শ্রেণীর হিন্দু প্রভৃতি সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যদলের নেতা সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, প্রভাসচন্দ্র মিত্র এবং নবাব নবাবআলি চৌধুরী–এই তিনজন সদস্য মন্ত্রীপদে নিযুক্ত হইলেন। ইঁহারা ১৯২১ সনের জানুআরি হইতে ১৯২৩ সনের শেষ–অর্থাৎ ব্যবস্থাপকসভার স্থিতিকাল পর্যন্ত মন্ত্রীপদে বহাল ছিলেন।

অসহযোগ আন্দোলনের ফলে এই সময়ে গভর্নমেন্ট যে দমনমূলক কঠোর নীতি অবলম্বন করিয়াছিলেন তাহা পূর্ববর্তী অধ্যায়ে বিবৃত হইয়াছে। বঙ্গদেশের প্রথম গভর্নর লর্ড কারমাইকেল ১৯১৭ সনের ৩১শে মার্চ অবসর গ্রহণ করিলে লর্ড রোনাল্ডশে তাঁহার স্থানে গভর্নর নিযুক্ত হন। নির্বাচন শেষ হইলে প্রথমেই মন্ত্রীনিয়োগের প্রশ্ন উঠিল। এ সম্বন্ধে সুরেন্দ্রনাথ ব্যানার্জী তাঁহার আত্মজীবনীতে যাহা লিখিয়াছেন তাহার সারমর্ম দিতেছি :

“আমি ব্যারাকপুর মহকুমার মিউনিসিপ্যালিটির কেন্দ্র হইতে বিনা বাধায় নির্বাচিত হইয়াছিলাম (অর্থাৎ তাহার বিরুদ্ধে আর কোন প্রার্থী ছিল না)।

“বাংলার লাটসাহেব রোনাল্ডশে আমাকে মন্ত্রীর পদ দিতে চাহিলেন, আমি সম্মত হইলাম। তিনি বলিলেন, তিনজন মন্ত্রী নিযুক্ত হইবেন–দুইজন হিন্দু, একজন মুসলমান। শাসনকার্যের সুবিধার জন্য শাসনের বিষয়গুলি তিনভাগে বিভক্ত হইয়াছে। আমি স্বায়ত্তশাসন ও চিকিৎসা বিভাগ গ্রহণ করিলাম। তারপর তিনি দ্বিতীয় হিন্দু মন্ত্রী বিষয়ে আমার মত জিজ্ঞাসা করিলেন। আমি বিনাদ্বিধায় প্রভাসচন্দ্র মিত্রের নাম করিলাম। লাট সাহেব বলিলেন, তিনি শিক্ষাবি নহেন (প্রভাসচন্দ্র উকীল ছিলেন)। আমি বলিলাম, কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের যে-কোন গ্র্যাজুয়েট আমাদের শিক্ষাসমস্যা সম্বন্ধে মোটামুটি ওয়াকিবহাল আছেন এবং প্রভাসচন্দ্র বহুদিন যাবৎ ‘সাউথ সুবার্বান স্কুলের সেক্রেটারী ছিলেন। লাট সাহেবের অভিপ্রায় ছিল তিনি একজন শিক্ষাবিষয়ে বিশেষজ্ঞকে মন্ত্রী করিবেন। নির্বাচিত সদস্যগণের মধ্যে এরূপ কেহ না-থাকায় কোন শিক্ষাবিদকে সদস্য মনোনীত করিয়া তাহাকেই মন্ত্রী করিতে চাহিলেন। আমি বলিলাম, এইরূপ নিয়োগ সংবিধানসম্মত হইবে না এবং মনে হইল তিনি তাহা মানিয়া লইলেন।”

শ্রীপ্রভাসচন্দ্র মিত্রই শিক্ষামন্ত্রী নিযুক্ত হইয়াছিলেন এবং তাঁহার কার্যাবলী হইতে নিঃসন্দেহে প্রমাণিত হয় যে, এই নিয়োগবিষয়ে সুরেন্দ্রনাথ অপেক্ষা ছোটলাট রোনাল্ডশে সাহেব অধিকতর অভিজ্ঞতা ও বিচক্ষণতার পরিচয় দিয়াছিলেন। কলিকাতা ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সম্বন্ধে তাঁহার ধারণা ও আচরণ পরবর্তী এক অধ্যায়ে বিবৃত হইবে। এই দুইটি বিশ্ববিদ্যালয়েরই যে তিনি বহু অনিষ্টসাধন করিয়াছিলেন তাহাতে বিন্দুমাত্র সন্দেহ নাই। বঙ্গদেশের শিক্ষাসমস্যা সম্বন্ধে সুরেন্দ্রনাথের ধারণা হাস্যকর বলিয়াই মনে হয়। শিক্ষামন্ত্রী নিয়োগের অনতিকাল পূর্বেই কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্বন্ধে তদন্ত করিবার জন্য বহু প্রসিদ্ধ শিক্ষাবিদ লইয়া স্যাডলার সাহেবের (Sadler) নেতৃত্বে ভারত গভর্নমেন্ট একটি কমিশন গঠন করেন। আশুতোষ মুখোপাধ্যায় এই কমিশনের অন্যতম সভ্য ছিলেন। সুরেন্দ্রনাথের মতে বাংলা দেশের যে-কোন বি. এ. পাশ স্কুলের সেক্রেটারিই শিক্ষাসমস্যা সমাধানের উপযুক্ত ব্যক্তি।

সুরেন্দ্রনাথের সমর্থনে অবশ্য বলা যাইতে পারে যে, ভারতবর্ষ স্বাধীনতালাভের পর কেন্দ্রীয় সরকারে যাহারা শিক্ষামন্ত্রীর পদে নিযুক্ত হইয়াছিলেন তাঁহাদের বুদ্ধি ও বিবেচনা সুরেন্দ্রনাথের ন্যায়, রোনাল্ডশের ন্যায় নহে।

মুসলমান মন্ত্রী সম্বন্ধেও রোনাল্ডশে সম্ভবতঃ ড. আবদুল্লা আলমামুন সুরাওয়ার্দিকেই যোগ্য মনে করিতেন এবং সুরেন্দ্রনাথের নিকটও তিনি তাহার বুদ্ধি ও চিত্তবৃত্তি সম্বন্ধে বহু প্রশংসা করিয়াছিলেন। কিন্তু, ময়মনসিংহের জমিদার নবাব নবাবআলি চৌধুরী মুসলমানদের খিলাফৎ আন্দোলন ও দেশের অসহযোগ আন্দোলনের বিরুদ্ধে এক পুস্তিকা প্রচার করিয়া ইউরোপীয় মহলে ও সরকারের বিশেষ প্রিয়পাত্র হইয়াছিলেন। বিশেষতঃ দুইজন হিন্দু মন্ত্রীই পশ্চিমবঙ্গের অধিবাসী এবং নবাবআলি পূর্ববঙ্গের লোক। সম্ভবতঃ এইসব কারণেই নবাবআলি চৌধুরীই মন্ত্রী নিযুক্ত হইলেন। তাঁহার লেখাপড়ার জ্ঞানের অভাব ও ইংরেজীভাষায় সম্পূর্ণ অনভিজ্ঞতা সম্বন্ধে অনেক কৌতুককাহিনী প্রচলিত আছে। এইরূপ লোককে মন্ত্রী নিযুক্ত করায় মুসলমান-সম্প্রদায়ের মধ্যেও ঘোর অসন্তোষের সৃষ্টি হইয়াছিল। এ সম্বন্ধে সুরেন্দ্রনাথ মন্তব্য করিয়াছেন, “এরূপ আপত্তি বা অসন্তোষের ভাব স্বাভাবিক কিন্তু যুক্তিসঙ্গত নহে। কারণ পুঁথিপড়া বিদ্যা (High literary qualifications) থাকিলেই যে ভাল শাসনকর্তা হওয়া যায় এরূপ মনে করিবার কারণ নাই।” এই প্রসঙ্গে তিনি আকবর, শিবাজী, হায়দর আলি ও রণজিৎ সিংহের নাম করিয়াছেন।২ সুরেন্দ্রনাথ অতীত ইতিহাস হইতে যেসব দৃষ্টান্ত দেখাইয়া নবাবআলি চৌধুরীর যোগ্যতা প্রমাণ করিয়াছেন তাহা এতই হাস্যকর যে ইহার সম্বন্ধে কোন মন্তব্য করা অনাবশ্যক। কিন্তু তিনি কি ভুলিয়া গিয়াছিলেন যে I.C.S. পরীক্ষার দ্বারাই বিলাতে ইংরেজ গভর্নমেন্ট নিজেদের দেশের ও ভারতবর্ষের উচ্চপদস্থ শাসকসপ্রদায় নিযুক্ত করিতেন? যিনি নিজেই ঐ পরীক্ষা পাশ করিয়া ম্যাজিষ্ট্রেটের পদে নিযুক্ত হইয়াছিলেন, তিনিই লিখিলেন উচ্চশিক্ষার সঙ্গে শাসনক্ষমতার কোন অঙ্গাঙ্গী সম্বন্ধ নাই।

নূতন গভর্নমেন্টের শাসনকালের বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য ঘটনা-কলিকাতা মিউনিসিপ্যালিটির সংস্কার। ১৯৮১ সনে লর্ড কার্জন এক নূতন আইন করিয়া কিভাবে কলিকাতা কর্পোরেশনে নাগরিকদের শাসনক্ষমতা খর্ব করিয়াছিলেন এবং ইহার বিরুদ্ধে প্রতিবাদস্বরূপ সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় ও অন্য ২৭ জন কমিশনার একযোগে পদত্যাগ করিয়াছিলেন তাহা এই গ্রন্থের তৃতীয় খণ্ডে বিবৃত হইয়াছে। অদৃষ্টচক্রে সুরেন্দ্রনাথ ত্রিশ বছর পরে এই অন্যায়ের প্রতিকারস্বরূপ পুরাতন আইনের বদলে সম্পূর্ণ নূতন এক আইন করিয়া কলিকাতার নাগরিকদের হস্তেই কলিকাতা মিউনিসিপ্যালিটির দায়িত্বভার অর্পণ করেন। ১৯২৩ সনের মার্চ মাসে এই নূতন কলিকাতা মিউনিসিপ্যাল অ্যাক্ট পাশ হয়।

অবশ্য বাংলা দেশ গভর্নরের শাসনাধীন হইবার পর লর্ড কারমাইকেলের সময়ে এইরূপ চেষ্টা আরম্ভ হয় এবং ১৯১৭ সনে কাউন্সিলে এ-বিষয়ে একটি বিল উপস্থিত করা হয়। পরে ইহা প্রত্যাহার করা হয়। সুরেন্দ্রনাথ ১৯২১ সনে যে বিল আনেন তাহাতে মিউনিসিপ্যাল সদস্যদের শতকরা আশী জন করদাতা কর্তৃক নির্বাচিত করার ব্যবস্থা হয়। ইহার অধ্যক্ষ মেয়র (Mayor) ও প্রধান কার্যাধ্যক্ষ (Chief Executive Officer) জনগণের প্রতিনিধি দ্বারা নির্বাচিত হন। ভোটদাতাদের সংখ্যা অনেক বাড়ানো হয়, স্ত্রীলোকেরাও ভোট দিবার অধিকারিণী হন। সুরেন্দ্রনাথ দাবি করিয়াছেন, তিনি কলিকাতা কর্পোরেশনে–যাহার আয় গোটা বাংলার রাজস্বের এক-পঞ্চমাংশ-স্বরাজ্য প্রতিষ্ঠিত করিয়াছিলেন। নূতন বিলে শহরতলীর অনেক অংশ কলিকাতা মিউনিসিপ্যালিটির অন্তর্গত করা হয়।

সুরেন্দ্রনাথ প্রথমে যে বিলের প্রস্তাব করেন তাহাতে কোন সম্প্রদায়েরই পৃথক ভোট দ্বারা স্বীয় প্রতিনিধি নির্বাচনের ব্যবস্থা ছিল না। কিন্তু পরে এই প্রকার সাম্প্রদায়িক নির্বাচনের ব্যবস্থা বিলের অন্তর্ভুক্ত করা হয়।

প্রকৃতপক্ষে এই বিলের আলোচনার সময়ে সম্প্রদায় হিসাবে পৃথক নির্বাচন ও মুসলমান সদস্যের সংখ্যাবৃদ্ধি–এই দুইটি বিষয় লইয়াই গুরুতর মতভেদ হয়।

সুরেন্দ্রনাথের প্রস্তাব ছিল, মুসলমানদের জন্য ১৩টি সদস্যপদ সংরক্ষিত হইবে, কিন্তু সদস্যগণ হিন্দু-মুসলমানের যুক্ত ভোটে নির্বাচিত হইবেন। হিন্দু সদস্যগণ ইহা সমর্থন করিলেন, কিন্তু অধিকাংশ মুসলমানসদস্য দাবি করিলেন মুসলমানসদস্যের সংখ্যা বৃদ্ধি করিতে হইবে এবং মুসলমানেরা পৃথকভাবে ভোট দিয়া তাঁহাদের প্রতিনিধি নির্বাচন করিবেন। সৈয়দ নাসিম আলি এইরূপ প্রস্তাব করায় আবদুল্লা সুহাওয়ার্দি ইহার প্রতিবাদ করেন। ইহা লইয়া তুমুল তর্কবিতর্ক প্রায় কলহে পরিণত হয়। নাসিম আলি বলিলেন, বঙ্গীয় প্রাদেশিক মুসলিম লীগই বাংলার মুসলমানদের প্রতিনিধিস্বরূপ। উত্তরে সুহাওয়ার্দি বলিলেন, নাসিম আলি যেন কলিকাতার কোন ওয়ার্ডে খিলাফৎ দলের বিরুদ্ধে সদস্যপদ প্রার্থী হইয়া ইহার সত্যতা প্রমাণ করেন। একাধিক মুসলমান বক্তা তর্কে যোগ দিয়া বলেন, তাঁহারাই মুসলমানদের প্রকৃত প্রতিনিধি বা মুখপাত্র। তর্ক ও আলোচনার ফলে বোঝা গেল, অধিকাংশ মুসলমানসদস্যই স্বতন্ত্রভাবে সাম্প্রদায়িক নির্বাচনের সপক্ষে। অবশেষে প্রস্তাবিত বিলে সেই ব্যবস্থাই করা হইল।

কোন কোন ব্যাপারে সাধারণ বিষয়ও যে সাম্প্রদায়িক আকার ধারণ করিত, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যয় সম্বন্ধে বাজেট-আলোচনায় তাহার প্রমাণ পাওয়া যায়। বঙ্গভঙ্গ রহিত হইয়া যাওয়ায় যখন পূর্ববঙ্গের মুসলমানদের মধ্যে দারুণ অসন্তোষ দেখা দেয় তখন বড়লাট লর্ড হার্ডিং তাহাদের মনস্তুষ্টির জন্য ঢাকায় একটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত করিবার প্রতিশ্রুতি দেন। ইহাতে হিন্দুসম্প্রদায় খুব ক্ষুব্ধ হইল এবং সাধারণের মধ্যে এই ধারণা জন্মিল যে বঙ্গদেশকে শাসনের দিক দিয়া দুইভাগ করার বদলে শিক্ষা ও সংস্কৃতির দিক দিয়া দুইভাগে বিভক্ত করা হইতেছে। এই ধারণার বশবর্তী হইয়া আশুতোষ মুখোপাধ্যায়, রাসবিহারী ঘোষ প্রমুখ বড় বড় হিন্দুনেতারা ইহার বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু করিলেন। লর্ড হার্ডিং তখন ঘোষণা করিলেন, ঢাকায় একটি আবাসিক বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপিত হইবে এবং ঢাকা শহরকে কেন্দ্র করিয়া দশ মাইল বৃত্তাকারের মধ্যেই এই বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিকার সীমিত থাকিবে। বঙ্গদেশের অবশিষ্ট অংশ পূর্ববৎ কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্তর্ভুক্ত থাকিবে। পূর্বসিদ্ধান্ত কিছুটা পরিবর্তনের ফলে আন্দোলন বন্ধ হইল বটে, কিন্তু হিন্দুসম্প্রদায় পূর্ববঙ্গের, এমনকি ঢাকার হিন্দুরাও এই নূতন বিশ্ববিদ্যালয়কে সুনজরে দেখিত না, মনে করিত ইহা মুসলমানদেরই বিশ্ববিদ্যালয়। মুসলমানেরা, বিশেষতঃ পূর্ববঙ্গের শিক্ষিত মুসলমান সম্প্রদায় খুব ন্যায্য ও সঙ্গত কারণেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালকে সমর্থন করিত। কারণস্বরূপ একথা নিঃসন্দেহে বলা যাইতে পারে–যেমন হিন্দু কলেজ ও কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় হিন্দুদের এবং আলিগড় কলেজ ও আলিগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয় উত্তরপ্রদেশ ও পঞ্জাবের মুসলমানদের শিক্ষা ও সংস্কৃতির যেরূপ উন্নতির কারণ, তেমনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ও পূর্ববঙ্গ ও আসামের মধ্যবিত্ত মুসলমান সম্প্রদায়ের শিক্ষা ও সংস্কৃতির ঠিক সেইরূপই উন্নতি সাধন করিয়াছে। এই আশা ও উদ্দেশ্য লইয়াই বাংলার মুসলমানেরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠা সমর্থন করিত। যদিও ১৯২১ সনেই (এমনকি তাহার পূর্বেই বঙ্গভঙ্গের সময়) ঢাকায় বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের প্রস্তাব করা হয়, কিন্তু প্রথম বিশ্বযুদ্ধ ও অন্যান্য কারণে নয় বৎসর পরে ১৯২১ সনে ইহা প্রতিষ্ঠিত হয়। নূতন শাসনব্যবস্থার ফলে ভারত-গভর্নমেন্টের হাত হইতে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্তৃত্ব ও দায়িত্ব বঙ্গদেশের শিক্ষামন্ত্রী প্রভাসচন্দ্র মিত্রের উপর ন্যস্ত হয়। ভারত গভর্নমেন্ট প্রতি বৎসর পাঁচলক্ষ টাকা এই বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য মঞ্জুর করিয়া যে একটি পৃথক তহবিলের সৃষ্টি করিয়াছিলেন তাহাও বাংলা গভর্নমেন্টের হাতে আসে। বাংলা গভর্নমেন্ট কিভাবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে বঞ্চিত করিয়া তহবিল আত্মসাৎ করে এবং শিক্ষকগণ যে মাহিনায় নিযুক্ত হইয়াছিলেন তাহা প্রায় অর্ধেক কমাইয়া দেয় তাহা সপ্তদশ অধ্যায়ে বিস্তৃতভাবে আলোচিত হইবে।

১৯২১ সনের কাউন্সিলে বাজেটের আলোচনায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বরাদ্দ টাকা কমাইয়া দেওয়ার প্রস্তাবে কাউন্সিলে যে গুরুতর মতভেদ ও তর্ক-বিতর্কের সৃষ্টি হয় তাহা সাম্প্রদায়িকতার আকার ধারণ করে। দুইটি উক্তি উদ্ধৃত করিলেই ইহা প্রতিপন্ন হইবে।

ঢাকার নবাববাড়ীর খাজা মুহম্মদ আজাম বলেন : “বাংলা দেশের মোট আয়ের অধিকাংশ পূর্ববঙ্গ হইতে সংগৃহীত হইলেও তাহা পশ্চিমবঙ্গের জন্য খরচ হয়, আমরা ইহাতে আপত্তি করি না। কিন্তু আমি বুঝিতে পারি না সামান্য কয়েক লক্ষ টাকা–যাহা বহুদিন পূর্বে প্রস্তাবিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য খরচ হওয়ার কথা, অথচ হয় নাই–দেওয়ার জন্য পশ্চিমবঙ্গের মানুষের এত আপত্তি কেন এবং কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়েরই বা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতি এত হিংসা কেন?”

সেসময় নেতা ফজলুল হককে হিন্দুরাও সাম্প্রদায়িক দোষ হইতে মুক্ত বলিয়া মনে করিতেন-এবং ইহার সঙ্গত কারণও ছিল। সেই ফজলুল হক বলিলেন :

“আমার মনে হয় যে বহু বৎসর পূর্বে প্রতিশ্রুত বহু বিলম্বিত ও বহু আকাঙ্ক্ষিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠার কথা লর্ড হার্ডিং যেদিন ঘোষণা করেন সেইদিন হইতেই ইহা কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের পণ্ডিতদের চক্ষুশূল হইয়াছে। আমি বেশী কিছু বলিতে চাই না-কিন্তু ঢাকার জন্য টাকা দিবার কোন প্রস্তাব হইলেই পশ্চিমবাংলার যেসব বন্ধুগণ তাহাতে আপত্তি করেন তাঁহাদিগকে সতর্ক করিয়া দিতেছি-খবর্দার! সাবধান! এইরূপ করিলে দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে যে বিভেদ সৃষ্টি হইবে তাহাতে শাসনকার্যের চরম অনিষ্ট ঘটিবে।

“আমি কেবল পূর্ববঙ্গের মুসলমানদের পক্ষ হইতে নহে, পূর্ববাংলার জন সাধারণের পক্ষ হইতে বন্ধুগণের নিকট আবেদন করিতেছি তাহারা যেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য বাজেটে যে টাকা ধার্য হইয়াছে তাহার বিরুদ্ধে কোন আপত্তি তোলেন।”

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কথা সবিস্তারে আলোচনা করিলে বোঝা যায় যে পাকিস্তানের বীজ বহুদিন পূর্ব হইতেই দেশের মাটিতে রোপিত হইয়াছিল।

কিন্তু কোন কোন বিষয়ে বিরোধ সম্প্রদায়গত না হইয়া সংস্কারগত কারণে ঘটিয়াছিল। স্ত্রীলোকদের ভোট দিবার অধিকার সম্বন্ধে প্রাচীনপন্থী অল্পসংখ্যক হিন্দু মুসলমান সদস্যদের দুই-তৃতীয়াংশের সঙ্গে মিলিত হইয়া প্রতিবাদ করিয়াছিল।

কলিকাতা কর্পোরেশন সম্বন্ধে নূতন আইন ছাড়া আরও কয়েকটি নূতন আইন পাশ হইয়াছিল। ১৯২৩ সনে অনেকগুলি নূতন আইন পাশ হয়–গুণ্ডামী ও স্ত্রীলোকের ব্যভিচারিতা দ্বারা অর্থ উপার্জনের ব্যবসা দমন, প্রজাদের খাজনা ও জমিতে স্বত্বাধিকার প্রভৃতি এই আইনগুলির লক্ষ্য ছিল। বাজেটের বিভিন্ন খাতে যে-সকল ব্যয়ের দাবি ছিল তাহা কমাইবার জন্য প্রথম কাউন্সিলে প্রায় দুই হাজার প্রস্তাব আনা হয়। শাসন-সংস্কারের উন্নতির জন্য প্রথম বৎসরেই ১৩৫টি প্রস্তাব আলোচিত হয়। সরকারী শাসনের নানা বিষয়ে তথ্যসংগ্রহের জন্য ১৯২১ সনে প্রায় ১৩০০ প্রশ্ন জিজ্ঞাসা ও তাহার উত্তর দেওয়া হয়।

উল্লিখিত বিষয়গুলি হইতে নবগঠিত কাউন্সিলের সদস্যেরা নূতন সংবিধান প্রদত্ত অধিকারগুলির কিরূপ ব্যবহার করিয়াছিলেন তাহার ধারণা করা যাইবে। এই কাউন্সিলের সদস্যেরা নির্দিষ্ট রাজনীতিক দলে বিভক্ত ছিলেন না। যদিও কংগ্রেসের নির্দেশ লঙ্ঘন করিয়া সদস্যেরা কাউন্সিলের সদস্য হইয়াছিলেন, তথাপি তাহারা যে গভর্নমেন্টের প্রতি সর্বদা অনুরক্ত ছিলেন তাহা নহে। অন্ততঃ ৫০ জন নির্বাচিত সদস্য গভর্নমেন্টের কতকগুলি দমনমূলক আইন-১৯০৮ সালে প্রবর্তিত এবং ১৯২০ সনে সংশোধিত (amended) ফৌজদারী আইন এবং ১৯১১ সনের বিদ্রোহাত্মক সভাসমিতি আইন (Seditious Meeting Act) বাতিল করার প্রস্তাবে ভোট দিয়াছিলেন। তাঁহাদের বিরুদ্ধে মন্ত্রী, সরকারী কর্মচারীরা মিলিয়া মাত্র ৩৬ জন ভোট দিয়াছিলেন। এই সমুদয় দমনমূলক আইন বাতিল করার প্রস্তাবের সমর্থনে যাহারা ভোট দিয়াছিলেন তাঁহাদের যুক্তি ছিল যে, এইসব কঠোর আইনই অসহযোগ আন্দোলন জীয়াইয়া রাখিয়াছে। ইহাদের পরিবর্তে সাধারণ আইনের সাহায্যেই অবস্থা আয়ত্তের মধ্যে আনা যাইতে পারে। এইসব সদস্যেরা নির্বাচিত সদস্যদের ক্ষমতাবৃদ্ধি-বিশেষতঃ আয়-ব্যয় নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতা–দাবি করিতেন।

মন্ত্রীরা নির্বাচিত সদস্যদের মুখপাত্র হিসাবে কাজ করিবেন এবং তাঁহাদের দ্বারাই নিয়ন্ত্রিত হইবেন–ইহাই সংবিধানের উদ্দেশ্য হইলেও কার্যতঃ তাহা হইত না। ইহার কারণ হিসাবে বলা যায়, সরকারী কর্মচারী, বেসরকারী ইউরোপীয় সদস্যগণ, অ্যাংগ্লো-ইণ্ডিয়ান সদস্যেরা এবং বহু মুসলমানসদস্য মন্ত্রীদেরই সমর্থন করিতেন। হিন্দুসদস্যদের কতক মন্ত্রীদের পক্ষে, কতক মন্ত্রীদের বিপক্ষে ভোট দিতেন। মন্ত্রীদের বিরুদ্ধে সংঘবদ্ধ কোন রাজনীতিক দল ছিল না। তথাপি যদি কোন ব্যাপারে মন্ত্রীরা ভোটে পরাজিত হইতেন তবু গভর্নরের অতিরিক্ত ক্ষমতার বলে তিনি মন্ত্রীদের মতের বিরোধী অথচ অধিকসংখ্যক ভোটে সমর্থিত অভিমতও নাকচ করিয়া দিতে পারিতেন। সুতরাং মোটের উপর ব্যবস্থাপকসভার ভোটাধিকার সমর্থন না পাইলেও মন্ত্রীদের পদত্যাগ করিতে হইত না-কার্যতঃ মন্ত্রীদের নিয়ন্ত্রণ করিবার ক্ষমতা কাউন্সিলের ছিল না বলিলেই হয়।

উপসংহারে কলিকাতা কর্পোরেশনের নূতন বিল সম্বন্ধে দুই-একটি কথা বলা আবশ্যক মনে করি। মোটের উপর সুরেন্দ্রনাথের ইচ্ছা ছিল, রাজনীতির প্রভাব হইতে মুক্ত থাকিয়া কর্পোরেশন কেবলমাত্র নগরীর সুখ-সৌকর্যার্থেই নিযুক্ত থাকিবে। কিন্তু ১৯২৩ সনে মিউনিসিপ্যাল বিল পাশ হইবার পরেই স্বরাজ্য দল ব্যবস্থাপকসভা এবং কর্পোরেশনের সদস্যপদ দখল করিল এবং সেই অবধি কর্পোরেশনের নির্বাচন ও কার্যপদ্ধতিতে রাজনীতিক প্রভাব প্রবল হইয়াছে।

নূতন বিলে মেয়র সভাপতিরূপে বিলাতি পার্লামেন্টের কমন্সসভায় (House of Commons) Speaker-এর ন্যায় কার্য করিবেন এবং কার্যাধ্যক্ষ আভ্যন্তরীক শাসন-বিষয়ে স্বাধীন হইবেন। ইহা ছাড়া নাগরিকদের মধ্যে বিশিষ্ট পাঁচজন ব্যক্তি অলডারম্যান (Alderman) নিযুক্ত হইবেন। কিন্তু কলিকাতা করপোরেশন স্বরাজ্য দলের হাতে আসায় মেয়র হইলেন চিত্তরঞ্জন দাশ, কার্যাধ্যক্ষ হইলেন নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসু; এবং রবীন্দ্রনাথ, জগদীশচন্দ্র বসু প্রভৃতির ন্যায় বিশিষ্ট নাগরিকরা না হইয়া স্বরাজ্য দলের প্রতিনিধিরাই অলডারম্যান নির্বাচিত হইলেন। সুরেন্দ্রনাথ তাঁহার আত্মজীবনীতে এইসকল পরিবর্তনের উল্লেখ করিয়া দুঃখ প্রকাশ করিয়াছেন। বিগত পঞ্চাশ বৎসরের অভিজ্ঞতার ফলে সুরেন্দ্রনাথের সমালোচনা খুব অসঙ্গত মনে হয় না।

২. দ্বিতীয় ব্যবস্থাপকসভা (১৯২৪-২৬)

১৯২৩ সনের শেষভাগে প্রথম ব্যবস্থাপকসভার মেয়াদ শেষ হইয়া গেলে দ্বিতীয় সভার নির্বাচনের ব্যবস্থা হইল। কংগ্রেস প্রথমে ব্যবস্থাপকসভা বর্জন করিয়াছিল, কিন্তু চিত্তরঞ্জন দাশ ও মতিলাল নেহেরুর নেতৃত্বে গঠিত স্বরাজ্য দল কিভাবে কংগ্রেসের অন্তর্ভুক্ত হইয়াও কাউন্সিলে প্রবেশের অনুমতিলাভ করিয়াছিল তাহা পূর্বেই উল্লিখিত হইয়াছে। যদিও এই সিদ্ধান্তের অনতিকাল পরেই নূতন ব্যবস্থাপকসভার নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়, তথাপি চিত্তরঞ্জন দাশের কঠোর পরিশ্রম, অধ্যবসায় ও জনপ্রিয়তার ফলে-এবং সম্ভবতঃ প্রথম ব্যবস্থাপকসভার দেশহিতকর সংস্কারাদি পুরাপুরি আশানুরূপ না-হওয়ায় ‘লিবারেল’ দলের প্রতি ভোটদাতাদের বীতশ্রদ্ধতাবশতঃ–এই নির্বাচনে লিবারেল দলের গুরুতর পরাজয় হইল। দলপতি সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় নিজে পরাজিত হইলেন এবং নূতন সভায় তাহার দলের প্রভাব-প্রতিপত্তি বিলুপ্ত হইল। যতীন্দ্রনাথ বসু ও প্রভাসচন্দ্র মিত্র প্রমুখ অল্প কয়েকজন মাত্র নির্বাচিত হইলেন।

স্বরাজ্য দলের ন্যায় সুগঠিত কোন রাজনীতিক দল প্রথম ব্যবস্থাপকসভায় ছিল না। যদিও সংখ্যায় এই দলে মাত্র ৪৭ জন সদস্য ছিলেন, তাঁহারা চিত্তরঞ্জনের নেতৃত্ব মানিয়া চলিতেন। এইরূপ আর-একটি দল Nationalist অর্থাৎ ‘জাতীয়তাবাদী’ নামে অভিহিত হইত। ইহার নেতা ছিলেন ব্যারিষ্টার ব্যোমকেশ চক্রবর্তী। ১৯২৪ সনের মার্চ মাসে এই দলের সদস্যসংখ্যা ছিল ১৯। এই দল অনেক বিষয়েই স্বরাজ্য দলের পক্ষে ভোট দিত। এতদ্ব্যতীত অন্য যেসব বেসরকারী সদস্য ছিল, তাহাদের মধ্যে মুসলমান সদস্যের একটি দল ও সরকার কর্তৃক মনোনীত সদস্যেরা সাধারণতঃ গভর্নমেন্টকে সমর্থন করিত। অবশিষ্ট নির্দলীয় সদস্যেরা কোন বিশিষ্ট দলের সঙ্গে স্থায়ীভাবে যুক্ত ছিল না–কখনও স্বরাজ্য দল, কখনওবা মন্ত্রীদের সমর্থন করিত। স্বরাজ্য দলের প্রধান লক্ষ্য ও আদর্শ ছিল সরকারী প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করা, বিশেষতঃ বাজেট ও মন্ত্রীদের বেতন নামঞ্জুর করিয়া তাঁহাদের পদত্যাগ করিতে বাধ্য করিয়া শাসনযন্ত্র অচল করা।

এই নির্বাচনে চিত্তরঞ্জনের বিরাট সাফল্যের নিদর্শন হিসাবে সাতকড়িপতি রায়ের নিকট বিখ্যাত ব্যারিষ্টার ও অ্যাডভোকেট জেনারেল চিত্তরঞ্জনের নিকট আত্মীয় এস. আর. দাসের পরাজয় এবং রাজনীতিক্ষেত্রে নবাগত বিধানচন্দ্র রায়ের নিকট সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের পরাজয়ের উল্লেখ করা যাইতে পারে।

দেশবন্ধুর পরিশ্রম ও অধ্যবসায় সফল হইল। বাংলর ব্যবস্থাপকসভায় স্বরাজ্য দলের নির্বাচিত সদস্যসংখ্যা অন্য যে-কোন দলের অপেক্ষা সংখ্যায় বেশি হইল। যদিও এই দল হইতে নির্বাচিতের সংখ্যা মোট সভ্যসংখ্যার অর্ধেক হইল না, তথাপি সাধারণ রীতি অনুসারে গভর্নর লর্ড লিটন চিত্তরঞ্জন দাশকে সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা হিসাবে মন্ত্রীসভা গঠন করিবার জন্য আমন্ত্রণ করিলেন। ইহাতে ইংরেজসম্প্রদায় ক্ষুব্ধ ও উত্তেজিত হইয়া উঠিল এবং ইংরেজী দৈনিক পত্রিকা Statesman তীব্র ভাষায় লিটনকে গালি দিল। বিষয়টি আলোচনার জন্য European Association-এর এক অধিবেশন হইল, তাহাতে অধিকাংশ সভ্যই লিটনের কার্যের প্রতিবাদ করিল। চিত্তরঞ্জন দাশ কিন্তু মন্ত্রীপদ গ্রহণ করিলেন না।

তখন গভর্নর লর্ড লিটন কয়েকজন সদস্যের সঙ্গে আলাপ-আলোচনার পর তিন জনকে মন্ত্রী নিযুক্ত করিলেন।

১। এ. কে. ফজলুল হক

২। এ. কে. গজনভি

৩। সুরেন্দ্রনাথ মল্লিক

কিন্তু মন্ত্রীপদে নিযুক্ত হইবার কিছুকাল পরেই আদালতের বিচারে সুরেন্দ্রনাথ মল্লিকের নির্বাচন বাতিল হইল। সুতরাং কেবল দুইজন মুসলমান মন্ত্রীই রহিলেন। ব্যক্তিগতভাবে কয়েকজন সদস্য ইহাদের সমর্থক ছিলেন–তাহা ছাড়া ইউরোপীয় সদস্য, সরকারী কর্মচারী এবং পুরানো লিবারেল দল নীতিগতভাবে মন্ত্রীদের সমর্থন করিতেন।

১৯২৪ সনের ২৩শে জানুআরি ব্যবস্থাপকসভার প্রথম অধিবেশন বসিল। স্বরাজ্য দলের সদস্য যতীন্দ্রমোহন সেনগুপ্ত প্রস্তাব করিলেন, “বঙ্গদেশে যেসব লোককে ১৮১৮ সনের ৩ আইন অনুসারে বিনা বিচারে আটক রাখা হইয়াছে তাহাদের সকলকে মুক্ত করা হউক।” এই উপলক্ষে চিত্তরঞ্জন যে-বক্তৃতা করেন তাহা বিশেষভাবে স্মরণীয়। লাটসাহেব বলিয়াছিলেন যে “এইসব বন্দীদের সম্বন্ধে দুইজন বিচারক দলিলপত্র ও সাক্ষীর মৌখিক উক্তি বিবেচনা করিয়া সকলকেই দোষী বলিয়া মত প্রকাশ করিয়াছেন।” চিত্তরঞ্জন বলিলেন, “দলিলপত্র তো কেবলমাত্র সরকারী কর্মচারীর রিপোর্ট। আর যে সাক্ষীকে বিচারকের সম্মুখে উপস্থিত করিয়া জেরা করিবার সুযোগ দেওয়া না হয় তাহার উক্তি সর্বদা অগ্রাহ্য। এইরূপ প্রমাণের উপর নির্ভর করিয়া অভিযুক্ত ব্যক্তি দোষী কিনা সে-সম্বন্ধে সিদ্ধান্ত করেন এরূপ বিচারকও জগতে আছেন ইহাই আশ্চর্যের বিষয়।” এই ভাষণে চিত্তরঞ্জনের আরও কয়েকটি উক্তি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। একটি এই : “গভর্নমেন্ট বলিয়াছেন তাঁহারা বলপ্রয়োগে ভীত হইয়া কিছু করিবেন না। বলপ্রয়োগ যদি শারীরিক পীড়ন বুঝায়, তবে আমি ইহা স্বীকার করি; কিন্তু যদি এই উক্তির অর্থ হয় যে গভর্নমেন্ট জনমতকে গ্রাহ্য করিবেন না–তাহা হইলে আমি প্রতিবাদ করি। গভর্নমেন্ট যদি বলেন, তাঁহারা লোকের বলপ্রয়োগে নত হইবেন না, তবে আমিও দেশবাসীর পক্ষ হইতে বলিতেছি যে তাহারাও গভর্নমেন্টের বলপ্রয়োগে নতি স্বীকার করিবে না।”

যতীন্দ্রমোহন সেনগুপ্তের প্রস্তাব সম্বন্ধে প্রথমে মৌখিক ভোট গ্রহণ করা হয়। সভাপতি বলেন, প্রস্তাবের বিরুদ্ধে অধিক ভোট হওয়ায় ইহা অগ্রাহ্য হইল। বিধানসভার নিয়মানুযায়ী ভোটদাতাগণকে তখন দুই দলে ভাগ করিয়া পৃথক পৃথকভাবে গণনা করা হইল। দেখা গেল, ৭৬ জন সদস্য প্রস্তাবটির পক্ষে এবং বিপক্ষে ৪৫ জন। ফলে প্রস্তাবটি গৃহীত হইল।

ইহার পর আরও দুইটি প্রস্তাব–অন্যান্য রাজনীতিক অপরাধের জন্য কারারুদ্ধ ব্যক্তিগণকে মুক্তি দেওয়া এবং যেসব আইনের বলে এইসব ব্যক্তিকে কারারুদ্ধ করা হইয়াছিল তাহা তুলিয়া দেওয়া-ব্যবস্থাপকসভায় গৃহীত হইল। শেষোক্ত প্রস্তাবটি গৃহীত হয় ২৮শে জানুআরি ১৯২৪।

গভর্নরের কার্যনির্বাহক সভার সদস্য সার আবদুর রহিম মন্তব্য করিলেন, যাঁহারা এইসব আইন তুলিয়া দিতে চান তাঁহারা কিন্তু নিজেরা শাসনকার্যের দায়িত্ব গ্রহণ করিতে প্রস্তুত নহেন। ইহা অবশ্য চিত্তরঞ্জনের মন্ত্রীত্বগ্রহণে অসম্মতির প্রতি ব্যঙ্গোক্তি। চিত্তরঞ্জন তৎক্ষণাৎ জবাব দিলেন, “যে-মুহূর্তে দেশ-শাসনের উপর লোকের পূর্ণ ক্ষমতা প্রতিষ্ঠিত হইবে, আবদুর রহিম দেখিবেন আমরা সকলেই শাসনের দায়িত্ব গ্রহণ করিতে সম্মত হইয়াছি।”

এই তিনটি প্রস্তাব গভর্নমেন্টের বিরোধিতাসত্ত্বেও গৃহীত হওয়ায় প্রমাণিত হইল যে, গভর্নমেন্ট সম্পূর্ণরূপে জনপ্রিয়তা হারাইয়াছেন। স্বরাজ্য দল সংখ্যাগরিষ্ঠ হইলেও অন্য দলের সাহায্যে এক জাতীয় দল গঠন করিতে হয়ত সমর্থ হইবে। কারণ, স্বরাজ্য দলের সদস্য ছাড়াও অনেক হিন্দু ও মুসলমান সদস্য স্বরাজ্য দলের প্রস্তাবের পক্ষে ভোট দিয়াছিলেন।

কয়েকদিন অবসরের পর ১৮ই ফেব্রুআরি (১৯২৪) ব্যবস্থাপকসভার অধিবেশন বসিলে ২০শে তারিখে মন্ত্রীদের প্রতি অনাস্থাসূচক একটি প্রস্তাব এক ভোটে পরাজিত হইল। কিন্তু আর কয়েকটি প্রস্তাবে গভর্নমেন্টের পরাজয় হইল। ইহাদের মধ্যে ডাক্তার প্রমথনাথ ব্যানার্জীর একটি প্রস্তাব বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। ইহাতে গভর্নমেন্টকে অনুরোধ করা হয় যে, ভূমি-রাজস্ব, ইউরোপীয় ও অ্যাংগ্লো ইণ্ডিয়ানদের শিক্ষা এবং হিসাব পরীক্ষা (Local Fund Audit) ব্যতীত শাসনের অন্য সকল বিভাগই হস্তান্তরিত বিষয়গুলির অন্তর্ভুক্ত করা হউক। প্রস্তাবটি ৭১ ভোটে গৃহীত হইল, ইহার বিপক্ষে ছিল মাত্র ৪৯ ভোট।

২০শে ফেব্রুআরি (১৯২৪) ব্যবস্থাপকসভার অধিবেশনে মন্ত্রীদের প্রতি অনাস্থাসূচক প্রস্তাব অগ্রাহ্য হয়। পরবর্তীকালের হিন্দু-মুসলমানের সম্বন্ধ বিবেচনায় ঐ দিনের একটি ঘটনা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। তখন কলিকাতার টাউন হলে ব্যবস্থাপকসভার অধিবেশন হইত। অধিবেশনের অনতিকালপূর্বে একদল মুসলমান বালক শোভাযাত্রা করিয়া টাউন হলে ঢুকিল-তাহাদের হাতের পতাকায় লিখিত ছিল : “হিন্দুদের মুসলমান মন্ত্রী নষ্ট করিবার ষড়যন্ত্রে যোগ দিও না, সাবধান থাকিও”। আলোচনা আরম্ভ হইবার পর ঐরূপ সতর্কবাণী-সম্বলিত কতকগুলি ছাপা কাগজ মুসলমান সদস্যদের মধ্যে বিলি করা হইল। উহাতে লেখা ছিল : “মুসলমান মন্ত্রী বাঁচাও, আমাদের পরম শত্রুদের চাটুবাক্য ও প্রতারণায় ভুলিও না,” ইত্যাদি। এইরূপ সাম্প্রদায়িক মনোবৃত্তির পরিচয় পাওয়া যায় নবাব মুসার হোসেনের একটি প্রস্তাবেও। ইহাতে গভর্নমেন্টকে নির্দেশ দেওয়া হইতেছে, ভবিষ্যতে সরকারী চাকুরী খালি হইলে শতকরা আশীটি পদ যেন মুসলমান প্রার্থীকে দেওয়া হয়–যতক্ষণ পর্যন্ত না বিভিন্ন সরকারী চাকুরীতে মুসলমানের সংখ্যা শতকরা ৫৫ জন হয়। এই প্রস্তাব সম্বন্ধে চিত্তরঞ্জন সংশোধন প্রস্তাব আনিলেন, এই প্রস্তাবের আলোচনা অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত রাখা হউক। এই সংশোধক প্রস্তাবটি গৃহীত হইল।

১৮ই মার্চ (১৯২৪) আয়-ব্যয় অর্থাৎ বাজেটের বিভিন্ন প্রস্তাবে ভোট নেওয়া আরম্ভ হইল। জাতীয় দল ইহার বিরুদ্ধে ভোট দিবে জানিয়া গভর্নমেন্ট খুব বিচলিত হইল। লাটসাহেব পূর্বে কোন সংবাদ না দিয়াই আইনসভার অধিবেশনে আসিয়া বাজেট পাশ না হইলে তাহার ফল কী হইবে তাহা বিশদভাবে ব্যাখ্যা করিলেন। হস্তান্তরিত যেসব বিষয়ের ভার মন্ত্রীদের হাতে, সেসব বিষয়ে প্রস্তাবিত অর্থ মঞ্জুর না হইলে গভর্নর নিজের ক্ষমতাবলে তাহার জন্য কোন অর্থ ব্যয় করিতে পারেন না, সুতরাং শিক্ষা, চিকিৎসা, কৃষি, শিল্প প্রভৃতি বিভাগে কোন সরকারী অর্থ ব্যয় করা যাইবে না। দৃষ্টান্তস্বরূপ বলিলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় গভর্নমেন্টের টাকাতেই চলে–ইহার আর কোন আয়ের পন্থা নাই-সুতরাং, শিক্ষাসংক্রান্ত বাজেট পাশ না হইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দরজা বন্ধ করিতে হইবে। কিন্তু ইহা সত্ত্বেও যখন বাজেট সম্বন্ধে ভোট আরম্ভ হইল, তখন জাতীয় দল অর্থমঞ্জুরের বিরুদ্ধে ভোট দিল। সর্বপ্রথম রাজস্ববিভাগের অর্থের বরাদ্দের জন্য ভোট লওয়া হইলনা দিবার পক্ষে ৬৫ ভোট এবং বিরুদ্ধে ৬৩ ভোট–সুতরাং এই অর্থের দাবি নাকচ হইল। এইরূপে দ্বিতীয় ও তৃতীয় দফার অর্থ দাবির একটি এক ভোটের আধিক্যে মঞ্জুর হইল, এবং আর-একটি এক ভোটে নামঞ্জুর হইল। পরদিনও চারিটি অর্থদাবির মধ্যে তিনটি নামঞ্জুর হইল। মন্ত্রীদের বেতন মঞ্জুরের পক্ষে হইল ৬২ ভোট, বিপক্ষে হইল ৬৩ ভোট। এইরূপে প্রায় সমস্ত দফার দাবিই নামঞ্জুর হইল।

৩১শে মার্চ তারিখে গভর্নর তাঁহার দলের লোকদের ডাকিয়া গোপনে পরামর্শ করিলেন। পরদিন সভার অধিবেশন আরম্ভ হইলেই জাতীয় দল ইহার প্রতিবাদ করিল এবং গভর্নরকে এবিষয়ে অনেক প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করিল। তারপর অর্থমঞ্জুরের দাবি আরম্ভ হইল। প্রথম দাবিটি মঞ্জুর হইল। চিত্তরঞ্জন কে কোন্‌দিকে ভোট দিয়াছে তাহার তালিকায় দেখিলেন যে, তাঁহার দলের কয়েকজন তোক গভর্নমেন্টের পক্ষে ভোট দিয়াছে। তখন তিনি মন্তব্য করিলেন, পূর্বদিনের গোপন মন্ত্রণার ফলেই সহসা এইরূপ মত পরিবর্তন ঘটিয়াছে। সরকারী পক্ষ না-না বলিয়া তুমুল সোরগোল করায় চিত্তরঞ্জন বলিলেন, “হাজার বার হা” এবং মন্তব্য করিলেন যে ইহার পর আর বিধানসভার অধিবেশনের কোন অর্থ হয় না। এই মন্তব্য করিয়াই তিনি আইনসভাকক্ষ ত্যাগ করিলেন এবং তাঁহার দলের সদস্যেরাও তাঁহার অনুসরণ করিলেন। অতঃপর অন্য সব অর্থের দাবি বিনা-আলোচনায় একসঙ্গে মঞ্জুর হইল। কিন্তু ব্যাপারটা অনেকদূর গড়াইল। মন্ত্রীদের বেতনের দাবি মঞ্জুর হয় নাই, ইহা পূর্বেই বলা হইয়াছে। তাহারা বলিলেন, বিনা মাহিনাতেই কাজ করিবেন। কিন্তু গভর্নর ইহাতে রাজী হইলেন না, কারণ তাঁহার মতে ইহা ভারত-গভর্নমেন্টের আইনের যে-অভিপ্রায় তাহার বিরোধী হইবে। সুতরাং তিনি ব্যবস্থাপকসভার এক অধিবেশন আহ্বান করিলেন, এবং ইহার আলোচ্য বিষয়ের মধ্যে মন্ত্রীদের বেতন অন্তর্ভুক্ত করিলেন। স্বরাজ্য দল ইহা অবৈধ মনে করিয়া কলিকাতা হাইকোর্টে মামলা দায়ের করিল। ব্যবস্থাপকসভার অধিবেশনের ধার্য তারিখ ৭ই জুলাই, কিন্তু ঐদিনই বিচারপতি চারুচন্দ্র ঘোষ ব্যবস্থাপকসভার সভাপতিকে আদেশ দিলেন যে ঐ নালিশের বিচার না-হওয়া পর্যন্ত মন্ত্রীদের বেতন সম্বন্ধে ব্যবস্থাপকসভায় যেন কোন আলোচনা না হয়। সভাপতি ঐ সভা মুলতুবি রাখিলেন। ২১শে জুলাই ইংলণ্ডে ভারত-সচিব নিয়মাবলী সংশোধন দ্বারা গভর্নরের ব্যবস্থা আইনসঙ্গত করিলেন। অতঃপর ২৬শে অগষ্ট (১৯২৪) বিধানসভার এক অধিবেশনে মন্ত্রীদের বেতন এবং অন্যান্য যে-সকল ব্যয় মঞ্জুরের দাবি ব্যবস্থাপকসভায় পূর্বে গৃহীত হয় নাই, তাহা পুনরায় আলোচনার জন্য উপস্থাপিত করা হইল। অখিলচন্দ্র দত্ত মন্ত্রীদের বেতনের দাবি প্রত্যাখ্যান করিয়া যে সংশোধক প্রস্তাব করিলেন তাহার পক্ষে ৬৮ এবং বিপক্ষে ৬৬ জন ভোট দিলেন। সুতরাং মন্ত্রীদের বেতনের দাবি এবারও গৃহীত হইল না। ফলে মন্ত্রীরা পদত্যাগ করিলেন। স্বরাজ্য দলের পুরাপুরি জয় হইল। বাংলার গভর্নর হস্তান্তরিত বিষয়গুলির শাসনভার স্বহস্তে গ্রহণ করিলেন। মন্ত্রীদের বেতন নামঞ্জুর করিয়া তাহাদের পদত্যাগ করিতে বাধ্য করা এবং ইহার ফলে নূতন সংবিধান অনুযায়ী দ্বৈতশাসন ধ্বংস করাই ছিল স্বরাজ্য দলের সর্বপ্রধান প্রচেষ্টা। তাহা ছাড়াও তাহারা প্রায়ই রাজনীতিক অপরাধীদের প্রতি কঠোর দণ্ড ও জেলে শারীরিক পীড়ন ও অন্যান্য দুর্ব্যবহারের প্রতিবাদমূলক প্রস্তাব আনিত।

১৯২৪ সনের ২৫শে অক্টোবর বঙ্গদেশের সন্ত্রাসবাদীদের দমনের জন্য এক নূতন সামরিক আইন (ordinance) জারী হইল এবং পরে (৭ই জানুআরি, ১৯২৫) ইহার মেয়াদ পাঁচবৎসর বাড়াইয়া দেওয়া হইল (The Bengal Criminal Law Amendment Bill)। এই আইনের বলে :

(১) সাধারণ বিচারালয়ের পরিবর্তে তিনজন সদস্য লইয়া গঠিত কমিশনের হাতে বিচারভার দেওয়া হইল।

(২) কেবলমাত্র সন্দেহবশে যে-কোন ব্যক্তির গতায়াত ও বাসস্থান নিয়ন্ত্রিত করার, এমনকি তাহাকে জেলে রাখার ক্ষমতা সরকারকে দেওয়া হইল।

(৩) কোন ওয়ারেন্ট ব্যতীতই যে-কোন বাড়ী অনুসন্ধান এবং যে-কোন ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করিবার ক্ষমতাও গভর্নমেন্টকে প্রদত্ত হইল।

এই বিলের আলোচনার সময় শ্রীপ্রভাসচন্দ্র মিত্র, যিনি রাউল্যাট কমিটির সদস্য ছিলেন, তিনিও ইহার তীব্র প্রতিবাদ করিয়া বলিলেন, এই বিলটি যেন ব্যাধির উপশমের জন্য ডাক্তারের ঔষধের পরিবর্তে হাতুড়ে গেঁয়ো বৈদ্যের ব্যবস্থা। বিলটির সপক্ষে ৫৭ এবং বিপক্ষে ৬৬ ভোট হওয়ায় বিলটি আইনে পরিণত হইল না। অসুস্থ চিত্তরঞ্জনকে চেয়ারে বসাইয়া সভায় আনা হইয়াছিল। ইহার ফলে কেহ কেহ বিলের বিরুদ্ধে ভোট দিয়াছিলেন। ভোটে পরাজিত হইলেও গভর্নর নিজের ক্ষমতাবলে এই বিল আইনে পরিণত করিলেন।

১৭ই ফেব্রুআরি (১৯২৫) সার আবদুর রহিম প্রস্তাব করিলেন যে, পরবর্তী বাজেটে মন্ত্রীদের বেতনের জন্য অর্থের বরাদ্দ করা হউক। স্বরাজ্য দলের আপত্তি সত্ত্বেও ইহা গৃহীত হইল। কারণ, নিরপেক্ষ সদস্যদের মধ্যে কেহ কেহ ইহার পক্ষে ভোট দিলেন অথবা ভোট দিতে বিরত রহিলেন। প্রস্তাবটির পক্ষে ভোট হইল ৭৫ এবং বিপক্ষে ৫১। গভর্নর সন্তোষের রাজা মন্মথনাথ রায় এবং নবাব আলি চৌধুরীকে মন্ত্রী নিযুক্ত করিলেন। কিন্তু তাঁহাদের বেতনের ১,২৮,০০০ টাকার দাবি যখন ব্যবস্থাপকসভায় উপস্থাপিত করা হইল তখন স্বরাজ্য দল এই দাবি হইতে ১,২৭,৯৯৮ টাকা কমাইবার সংশোধক প্রস্তাব আনিলেন। ইহার অর্থ–প্রত্যেক মন্ত্রী মাত্র এক টাকা করিয়া বার্ষিক বেতন পাইবেন। আশ্চর্যের বিষয় যে, ফজলুল হক এবং জমিদার শিবশেখরেশ্বর রায় স্বরাজ্য দলের প্রস্তাব সমর্থন করিলেন। সংশোধক প্রস্তাবটি পাশ হইল। ইহার পক্ষে ছিল ৬৯ এবং বিপক্ষে ৬৩ ভোট। গভর্নমেন্ট স্থির করিল (১৩ই জুন ১৯২৫) যে, বর্তমান ব্যবস্থাপকসভার কার্যকালের মধ্যে আর মন্ত্রী নিযুক্ত করা হইবে না। ১৯২৫ সনের ১৩ই জুন হইতে ১৯২৭ সনের ২১শে জানুআরি পর্যন্ত বঙ্গদেশে দ্বৈত শাসন স্থগিত করা হইল।

১৯২৫ সনের ১৬ই জুন চিত্তরঞ্জনের মৃত্যু হয় এবং যতীন্দ্রমোহন সেনগুপ্ত স্বরাজ্য দলের নেতা হন। কয়েকজন বন্দীকে শীতের রাতে গরম কাপড় না-দিয়াই এক জেল হইতে অন্য জেলে পাঠান হয়–এই আচরণের প্রতিবাদস্বরূপ যতীন্দ্রমোহন প্রস্তাব করেন যে, সেদিনকার মত ব্যবস্থাপকসভার কাজকর্ম স্থগিত থাকুক (adjournment of the House)। এই প্রস্তাব গৃহীত হইল, সপক্ষে ৫৮, বিপক্ষে ৫০ ভোটে। এইরূপ প্রস্তাব গ্রহণে গভর্নমেন্টের প্রতি নিন্দাই সূচিত হয়।

ইতিমধ্যে কেন্দ্রীয় সরকারের ব্যবস্থাপকসভায় স্বরাজ্য দলের নেতা পণ্ডিত মতিলাল নেহেরু ১লা মার্চ (১৯২৬) ঘোষণা করিলেন, গভর্নমেন্টের শাসন সংস্কারের প্রতি ঔদাসীন্য, রাজনীতিক কর্মীদের উপর অত্যাচার এবং তাহাদের দমনের জন্য কঠোর নীতি অবলম্বনের প্রতিবাদস্বরূপ স্বরাজ্য দল এই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করিয়াছে যে, তাহারা আর গভর্নমেন্টের সহযোগিতা করিবে না। যাহাতে গভর্নমেন্ট তাহার বর্তমান ভুয়া শাসন-সংস্কারের পরিবর্তে প্রকৃত শাসনক্ষমতা ভারতীয়দের হাতে দিতে বাধ্য হয় অতঃপর তাহারা সেই চেষ্টা করিবে। ঘোষণা শেষ করিয়া মতিলাল ও স্বরাজ্য দলের সদস্যেরা সভাকক্ষ ত্যাগ করিয়া চলিয়া গেলেন।

১৫ই মার্চ (১৯২৬) বাজেট আলোচনার জন্য বাংলা দেশের ব্যবস্থাপকসভার অধিবেশন হইল। সভার কার্য আরম্ভ হইবার পূর্বে যতীন্দ্রমোহন সেনগুপ্তও মতিলাল নেহেরুর ন্যায় মন্তব্য করিয়া স্বরাজ্য দলের সকল সদস্যসহ সভাগৃহ ত্যাগ করিলেন। নিরপেক্ষ দলের নয়জন সদস্যও তাঁহাদের অনুসরণ করিল। ব্যবস্থাপকসভায় অসহযোগ আন্দোলনের যবনিকা পতন হইল।

স্বরাজ্য দল যে-সময়ে বিধানসভায় প্রবেশ করে, সেই সময়ে কলিকাতা কর্পোরেশনেও তাহাদের শাসনক্ষমতা প্রতিষ্ঠিত হয়। সুরেন্দ্রনাথ ব্যানার্জী যখন মন্ত্রী ছিলেন তখন নূতন সংবিধান দ্বারা এই কর্পোরেশনের পুনর্গঠনের ব্যবস্থা হয়। স্মরণ রাখিতে হইবে যে, লর্ড কার্জনের আমলে যখন তিনি কর্পোরেশনে জনসাধারণের কর্তৃত্ব খর্ব করিয়াছিলেন তখন ইহার প্রতিবাদস্বরূপ সুরেন্দ্রনাথ ও অন্য ২৭ জন সদস্য পদত্যাগ করেন। সুরেন্দ্রনাথ নিজে এই বিভাগের মন্ত্রী হইয়া ইহাতে জনসাধারণের কর্তৃত্ব পুনরায় প্রতিষ্ঠিত করেন। ১৯২৩ সনের কলিকাতা মিউনিসিপ্যাল অ্যাক্ট অনুসারে ইহার সদস্যগণ নিম্নলিখিতভাবে নির্বাচিত হইতেন।

অমুসলমান সাধারণ নাগরিকবৃন্দ-৪৮

মুসলমান নাগরিক-১৫

ব্যবসা বাণিজ্য সংক্রান্ত দল-১০

কলিকাতার পোর্ট কমিশনার-২

এইসকল নির্বাচিত সভ্যেরা পাঁচজন সদস্য (অল্ডারম্যান) নির্বাচিত করিতেন, বাংলা গভর্নমেন্টও দশজন সদস্য মনোনীত করিতেন। এইভাবে একটি সরকারী প্রতিষ্ঠানে জনসাধারণের ক্ষমতা প্রতিষ্ঠিত হয়। প্রথম নির্বাচনে স্বরাজ্য দল সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে। চিত্তরঞ্জন মেয়র (Mayor) অথবা সর্বাধ্যক্ষ এবং তাঁহার অধীনে সুভাষচন্দ্র বসু প্রধান কর্মকর্তা (Chief Executive Officer) নির্বাচিত হন। ইহার ফলে এটি যে রাজনীতিকক্ষেত্রের অপর একটি শাখায় পরিণত হয় সে বিষয়ে সন্দেহ নাই। সুরেন্দ্রনাথ নিজেই ইহার তীব্র ও বিরূপ সমালোচনা করিয়াছেন। কিন্তু স্বরাজ্য দল যে কলিকাতা নগরীর অনেক উন্নতিবিধান করিয়াছিল তাহাতে সন্দেহ নাই।

সরকারী রিপোর্টে চিত্তরঞ্জন ও সুভাষচন্দ্রের কার্যাবলী প্রশংসালাভ করিয়াছে। সাধারণের স্বাস্থ্য ও চিকিৎসার ব্যবস্থা, প্রাথমিক শিক্ষার বিস্তার প্রভৃতি অনেক লোকহিতকর কার্য স্বরাজ্য দলের শাসনকালে ঘটিয়াছিল।

তথ্যনির্দেশ

১. Surendranath Banerjee, A Nation in Making, pp. 337-38

২. Surendranath Banerjee, A Nation in Making, pp. 339.

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *