০৭. বিপ্লববাদ (১৯০৮-২০)

সপ্তম অধ্যায় – বিপ্লববাদ (১৯০৮-২০)

১. বিপ্লববাদের প্রসার

১৯০৮ সনে মুরারিপুকুর বাগানের গুপ্ত সন্ত্রাসবাদীদের আড্ডা ভাঙ্গিয়া গেল এবং ইহার সংশ্লিষ্ট বিপ্লবীগণ কারারুদ্ধ অথবা আন্দামানে নির্বাসিত হইলেন। কিন্তু সন্ত্রাসবাদের ভিত্তি টলিল না, বরং ক্রমেই ইহার কর্মপদ্ধতি নানা আকারে ও ব্যাপকভাবে কেবল বঙ্গদেশে নহে, ইহার বাহিরেও ছড়াইয়া পড়িল। স্বাভাবিক বিবর্তন ছাড়াও ইহার দুইটি প্রধান কারণ নির্দেশ করা যায়।

প্রথমতঃ আলিপুর বোমার মোকদ্দমার কাহিনী সমগ্র বঙ্গদেশে তথা ভারতবর্ষে বিষম উত্তেজনা সৃষ্টি করে। এক হিসাবে বলা যায়, আলিপুর আদালত সমগ্র ভারতের বিপ্লবের যে প্রেরণা জোগাইয়াছিল, বারীন ঘোষের শত চেষ্টাতেও তাহা সম্ভবপর হইত না। সশস্ত্র বিপ্লব যে ভারতে সম্ভবপর ইহা দেশের লোকের, বিশেষতঃ তরুণদের, মনে গভীরভাবে মুদ্রিত হইল।

ভারত-উদ্ধারের এক নূতন পথের সন্ধান যেন অকস্মাৎ আত্মপ্রকাশ করিল। যাহা কেহ কখনও ভাবে নাই তাহা এখন অনেকেরই বিশেষ চিন্তা ও কল্পনার বিষয় হইল। যেভাবে নির্ভীক তরুণের দল জীবন তুচ্ছ করিয়া দেশ-উদ্ধারের ব্রত গ্রহণ করিয়াছিল তাহা শত শত যুবককে নূতন প্রেরণা যোগাইল। বোমা ও রিভলভার দ্বারা শত্ৰুনিধন এবং ডাকাতি করিয়া তাহার জন্য অর্থসংগ্রহ–এইসব অভাবিত পন্থা এখন হইতে স্বাভাবিকভাবেই রাজনীতিক ক্ষেত্রে সভা-সমিতির মাধ্যমে আবেদন ও প্রতিবাদের সহিত একই সঙ্গে একটি নূতন পথ বলিয়া স্বীকৃতি লাভ করিল। স্বাধীনতা-লাভ পর্যন্ত এই সশস্ত্র বিপ্লবের পন্থা মহাত্মা গান্ধীর অহিংস আন্দোলনের সঙ্গে সমানভাবেই জনসাধারণকে প্রেরণা দিয়াছিল। ১৯৩৪ সনে গান্ধীজির অহিংস আন্দোলনের পরিসমাপ্তি ঘটে। কিন্তু দেশের অভ্যন্তরে ১৯৪২ খৃষ্টাব্দের সশস্ত্র বিপ্লব, ভারতের বাহির হইতে ১৯৪৪ সনে আজাদ হিন্দ ফৌজের আক্রমণ এবং ১৮৪৬ খৃষ্টাব্দে ভারতীয় নৌবাহিনীর বিদ্রোহ যে ভারতের স্বাধীনতা ত্বরান্বিত করিয়াছিল, সে-বিষয়ে কোন সন্দেহই নাই।

দ্বিতীয় কারণ বাংলা দেশের তিনটি সংবাদপত্র-’সন্ধ্যা, যুগান্তর’ ও ইংরেজী ‘বন্দে মাতরম্’। বিপ্লবাত্মক মনোভাব সৃষ্টি ও আলিপুর বোমার মামলার পরও যে সন্ত্রাসবাদের গতি অব্যাহত ছিল এবং ক্রমশঃ তাহার বেগ বর্ধিত হইতেছিল–প্রধানতঃ এই তিনটি পত্রিকার অবদান বলিয়াই তাহা গৃহীত হইতে পারে। সুতরাং এই প্রসঙ্গে ইহাদের বাণী ও তাহার প্রচার সম্বন্ধে সঠিক ধারণা করিবার জন্য কয়েকটি উক্তি উদ্ধৃত করিতেছি :

(ক) ‘সন্ধ্যা’

‘সন্ধ্যা’ একটি দৈনিক পত্রিকা, বিকালে প্রকাশিত হইত। ইহার সম্পাদক ব্ৰহ্মবান্ধব উপাধ্যায় একজন স্বাধীনচেতা লেখক, ব্যঙ্গরসের মধ্যদিয়া গুরুতর মতবাদ প্রচার করাই ছিল এই কাগজটির বৈশিষ্ট্য। ১৯০৪ সনের ২৬শে নভেম্বর ইহার প্রথম সংখ্যা বাহির হয়।

বরিশাল কনফারেন্সের সময় অনুষ্ঠিত অত্যাচারের প্রতিবাদে সন্ধ্যায় বাহির হইল (২১শে এপ্রিল, ১৯০৬) : “অত্যাচার সহ্য করা সমস্ত জাতির অপমানের নামান্তর। প্রতিহিংসা সকল সময়েই পাপ নয়; জীবনসংগ্রামে এরও যথেষ্ট মূল্য আছে। বরিশাল তাণ্ডবের পর আর বাজে বক্তৃতা শোভা পায় না, বিষস্য বিষমৌষধ। অপমানের প্রতিশোধ নেবার কথা এখনও ভাবতে হবে। আর ফিরিঙ্গির কাছে দরবার না করে প্রতিবিধানের জন্য গোপনে যে প্রস্তুতি হচ্ছে এটাই বর্তমানে প্রধান লাভ।”

ছয়মাস পরে বাহির হইল : “ইংরেজ শক্তের ভক্ত দুর্বলের যম। সে একমাত্র কামান, গোলাগুলির গর্জন, তরবারির ঝনঝনা বুঝতে পারে। বাঙ্গালী শক্তি সঞ্চয় করে মারের বদলে ফিরিয়ে মার দিলেই ইংরেজ বন্ধুত্ব স্থাপনে চেষ্টা করবে।” (২৫শে অক্টোবর, ১৯০৬)।

তিন মাস পরে : “যেমন পারবে সরাসরি মার ফেরত দেবে। যদি কপালে একটা ঘুষি জোটে, সঙ্গে সঙ্গে লাথি মেরে সে ঋণ পরিশোধ করতে ভুল যেন না হয়।…দ্বন্দ্বক্ষেত্রে সঙ্গে সঙ্গে শত্রুর প্রাপ্য ফিরিয়ে দেওয়া শ্রেষ্ঠ নীতি” (১১ই। জানুআরি, ১৯০৭)।

আর একটি সম্পাদকীয় প্রবন্ধে সরাসরি যুদ্ধ ও বোমা-মারার প্রস্তাব : “প্রত্যেক গ্রামাঞ্চল, হাট, বাট, আবাস দুর্গে পরিণত করতে হবে। লাঠি, সড়কি, গুপ্তি, ছোরা প্রভৃতি অস্ত্র প্রতি হাতের শোভাবর্ধন করবে। তীর ধনুক এবং “কালীমায়ির বোমা” প্রচুর পরিমাণে সংগ্রহ করতে হবে। এই বোমা আগুন দিয়ে ধরাতে হবে না। গুণ্ডাদের মধ্যে সামান্য জোরে ফেলে দিলেই প্রচণ্ড শব্দে ফেটে পড়বে, সঙ্গে সঙ্গে দশ-বিশজন ধরাশায়ী হবে। অতি সস্তায় এই অস্ত্র প্রচুর তৈরী হবে, সাবধানে রাখতে বেশী জায়গা নেবে না। দরকার হলেই এ বোমা তৈরী করে নেওয়া যাবে” (১৪ই মে, ১৯০৭।…”অতএব সাহসে ভর কর, আকাঙ্ক্ষিত দিন আগতপ্রায়।”

বলা বাহুল্য, ব্রহ্মবান্ধব একধিকবার বিদ্রোহের অভিযোগে অভিযুক্ত হইয়াছেন। একবার মামলা উঠার সঙ্গে সঙ্গেই তিনি বলিলেন (২৩শে সেপ্টেম্বর, ১৯০৭) :

“সন্ধ্যা পত্রিকার প্রচার ও পরিচালনায় সম্পূর্ণ দায়িত্ব আমি গ্রহণ করছি। আপত্তিকর প্রবন্ধগুলির লেখক আমি। এই মামলায় আমি আর কোন অংশগ্রহণ করতে চাই না। কারণ, আমি বিশ্বাস করি না, যে বিধিনির্দিষ্ট স্বরাজলাভের প্রচেষ্টায় অকিঞ্চিৎকর অংশগ্রহণের জন্য আমাদের বর্তমান শাসকগোষ্ঠীর কাছে আমি কোন জবাবদিহি করতে বাধ্য। আমাদের জাতীয় উন্নতি ও তাদের স্বার্থ পরস্পরবিরোধী।”।

ব্রহ্মবান্ধব জোরগলায় বলিয়াছিলেন, তিনি কখনই ফিরিঙ্গির জেল খাঁটিবেন না। অভিযুক্ত থাকার সময়েই গুরুতর পীড়িত অবস্থায় হাসপাতালে অস্ত্রোপচার হইল। ১৯০৭ সনের ২৬শে অক্টোবর এই নির্ভীক বীরপুরুষের মৃত্যু হয়। এই স্বাধীনতা-সংগ্রামীর বাণী দিনের-পর-দিন বাংলার তরুণ সম্প্রদায়কে কিরূপ অনুপ্রেরণা দিয়াছে এই গ্রন্থের লেখক তাহা নিজে প্রত্যক্ষ করিয়াছেন।

(খ) ‘যুগান্তর’

যুগান্তর-পত্রিকার আবির্ভাবের কথা সম্পাদকের সম্বন্ধে পূর্বেই বলিয়াছি। একজন লেখক যথার্থই বলিয়াছেন, “প্রকৃতপক্ষে এইখান (যুগান্তর পত্রিকার অফিস) থেকে যে অগ্নিস্ফুলিঙ্গ ছড়িয়ে পড়ে তাতেই বিপ্লবের দাবাগ্নি সৃষ্টি হয়ে ভারতকে গ্রাস করেছে এবং প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে ভারতের স্বাধীনতার পথ উন্মুক্ত করে দিয়েছে”।

যুগান্তরের মামলায় বিচারক মন্তব্য করিয়াছিলেন, যুগান্তর’-এর প্রবন্ধগুলি ইংরেজ জাতের উপর প্রচণ্ড ঘৃণা ও বিদ্বেষ প্রচার করেছে। তার প্রতি ছত্র বিপ্লব ঘোষণা করছে। কেমন করে বিপ্লব সংঘটিত হবে’–তার পথের সুস্পষ্ট নির্দেশ দিচ্ছে।” এই সংক্ষিপ্ত বর্ণনাটিতে যে একটুও অতিরঞ্জন নাই ইহা অকপটে স্বীকার করা যায়। অস্ত্রশক্তি’ নামক একটি প্রবন্ধে “কিভাবে অস্ত্রশস্ত্র সংগ্রহ করা যায়, কিভাবে বোমা তৈরী করিতে হয়, কিভাবে গোপনীয়তা রক্ষা করা যায়, দেশীয় সৈন্যদলের সহিত গোপনে বিদ্রোহের ষড়যন্ত্র, যুদ্ধকালে কেবল তাহাদের সাহায্য নহে, কিরূপে তাহাদের দ্বারা অস্ত্রশস্ত্র সংগ্রহ করা সম্ভবপর”-এই সকল বিষয়ে খোলাখুলিভাবে আলোচনা করা হইয়াছে (১৯০৭, ১২ই অগষ্ট)।

২৬শে অগষ্ট তারিখে প্রকাশিত “উন্মাদ যোগী” স্বাক্ষরিত প্রবন্ধে সরকারী ধনসম্পত্তি লুণ্ঠনের সংবাদ ও উহার মধ্যে গেরিলাযুদ্ধের আভাস পাইয়া ইহার লেখক অত্যন্ত আনন্দ প্রকাশ করেন।

যে পত্রিকায় এই বিপ্লবাত্মক অগ্নিবর্ষী নির্ভীক প্রবন্ধসকল দিনের-পর-দিন বাহির হইত তাহার অফিস ও লেখকদের সম্বন্ধে একজন প্রত্যক্ষদর্শীর বিবরণ কিঞ্চিৎ উদ্ধৃত করিতেছি : “তিন চারিজন যুবক মিলিয়া একখানা ঘেঁড়া মাদুরের উপর বসিয়া ভারত উদ্ধার করিতে লাগিয়া গিয়াছেন।…দেখিলাম, লড়াই করিয়া ইংরেজকে দেশ হইতে হটাইয়া দেওয়া যে একটা বেশি কিছু বড় নয়, এ বিষয়ে তাঁহারা সকলেই একমত”।…”ছেঁড়া মাদুর আর একটা ভাঙা বাক্স হল আসবাব। হাতিয়ার হল গোটা দু তিন ভাঙ্গা ষ্টীল পেন…কিন্তু এর ভেতর অনলবর্ষী লেখা চলেছে–যেন দেশের প্রাণপুরুষ ঐ দুই তিনটি যুবকের হাত দিয়া তাহার অন্তরের নিগূঢ় কথা কহিতেছেন।”

পুরাতন যুগান্তর পত্রিকা এখন আর পাওয়া যায় না। কিন্তু ইহার কতকগুলি প্রবন্ধের পুরাপুরি অথবা আংশিক ইংরেজী অনুবাদ সরকারী গুপ্ত তথ্য রক্ষণাগারে রক্ষিত আছে। ইহা হইতে আরও কয়েকটি উক্তি তুলিয়া ধরিতেছি :

“অত্যাচার-জর্জরিত লোক যদি একবার এই সত্য উপলব্ধি করতে পারে যে, জীবন উৎসর্গ না করলে শত বৎসরের দাসত্বমোচন হয় না, সেই মনোভাবই শাসকগোষ্ঠীর বিপদের কারণ।”

“পাঠকের মনে হতে পারে যে, তারা অতি দুর্বল–প্রবল পরাক্রান্ত ইংরেজের বিরুদ্ধে লড়বার শক্তি তাদের কোথায়? উত্তর–মা ভৈঃ! ইটালী রক্তস্রোতে দাসত্বের মসীরেখা মুছে ফেলেছে…আজ কি দশ হাজার বাঙ্গলার সন্তান পাওয়া যাবে না, যারা মৃত্যুর আলিঙ্গনে মাতৃভূমির কলঙ্কমোচন করতে বদ্ধপরিকর?”

“অর্থের প্রয়োজন? এসে যাবে; লুঠ ও ট্যাক্স আদায় করে অভাব মেটাতে পারা যাবে।”

সম্পাদকেরা মাত্র দুইশত টাকা মূলধন সম্বল করিয়া যুগান্তর প্রকাশ করিতে আরম্ভ করিয়াছিলেন। কিন্তু তাহাদের প্রবন্ধাদির প্রভূত জনপ্রিয়তার জন্য ইহার গ্রাহকসংখ্যা অসম্ভব রকমে বাড়িয়া উঠিল। প্রথমে এক হাজার পত্রিকা ছাপা হইত। “এক হাজার হইতে পাঁচ হাজার, পাঁচ হাজার হইতে দশ হাজার, দশ হাজার হইতে এক বৎসরে বিশ হাজারে ঠেকিল।” এ বিষয়ে কয়েকজন ইংরেজের সাক্ষ্য উদ্ধৃত করা যাইতে পারে। কলিকাতা হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতি বলিয়াছিলেন, “যুগান্তরের ক্রেতার ভীড়ে রাস্তায় লোক বা গাড়ী চলাচল বন্ধ হইবার উপক্রম।”

১৯০৮ সনের ১লা জুন ইংলিশম্যান’ পত্রিকায় লেখা হইল : “গত শনিবার (১৯০৮, ৩০শে মে) কয়েক সপ্তাহ বন্ধ থাকার পর যুগান্তর’ আবার প্রকাশিত হইল। মাত্র দুই পয়সায় আধখানা কাগজ ৩০ মে তারিখে বাহির হইয়াছে এবং অতি আগ্রহে লোক তাহা কিনিতেছে। প্রতি বাঙ্গালীর হাতে একখানা দেখিতে পাওয়া গিয়াছে। তাহারা পথে চলিতে চলিতেই উৎসাহভরে পড়িতেছে। বাড়ী গিয়া তাহার স্ত্রী ও মাতার হাতে দিবে, এইভাবে অন্তঃপুরেও বিপ্লবের বার্তা পৌঁছিবে।”

এলাহাবাদের ‘পাইওনীয়র’ পত্রিকা (৮ই জুন, ১৯০৮) লিখিল, “যুগান্তর পত্রিকা হাজারে হাজারে বিক্রয় হইয়াছে। দিন রাত্রি বিরাম নাই। লোকে দামের বিচার করে না। প্রতি সংখ্যা এক টাকা বা তাহারও বেশী দিতে ক্রেতার অনিচ্ছা দেখা যায় না।”

প্রধানতঃ যুগান্তরের প্রচার বন্ধ করার জন্যই সংবাদপত্র দমনের নূতন আইন পাশ হইল (৮ই জুন, ১৯০৮)। ইংলিশম্যান’ কাগজে ছাপা হইল (৫ই নভেম্বর, ১৯০৮) : “চন্দননগর হইতে যুগান্তর প্রকাশিত হইয়াছে। ইহাতে শত্রুর রক্তপানেচ্ছু বাঙ্গালীকে প্রতিহিংসা গ্রহণে উৎসাহ-নির্বিচারে শত্রুর প্রতি রিভলভার ব্যবহার করিতে সাহস দেওয়া হইয়াছে; রিভলভার ব্যর্থ হইলে বোমা সে অভাব দূর করিবে।”

নূতন আইন পাশ হওয়ার ফলে ‘যুগান্তর’ গোপনে কৃচিৎ কদাচিৎ বাহির হইত। ইহার শেষ সংখ্যা প্রকাশিত হইয়াছিল ১৯১০ সালের জুলাই মাসে।

‘যুগান্তরের লেখায় বাঙ্গালীর মনে কীরকম প্রতিক্রিয়া হইয়াছিল উপরে লিখিত ঘটনা ও উদ্ধৃত উক্তি হইতে তাহা প্রমাণিত হইবে।

বলা বাহুল্য, সম্পাদক ভূপেন্দ্রনাথ দত্ত আদালতে অভিযুক্ত ও কারাদণ্ডে দণ্ডিত হইয়াছিলেন। আসামীর কাঠগড়ায় দাঁড়াইয়া ভূপেন্দ্রনাথ বলিলেন, “আমি ভূপেন্দ্রনাথ দত্ত সবিনয়ে জানাচ্ছি যে, আমি যুগান্তর পত্রিকার সম্পাদক এবং মামলার বিষয়ভূত সমস্ত প্রবন্ধের জন্য আমি একাই দায়ী। আমার সরল বিশ্বাসে দেশের প্রতি আমার যা কর্তব্য বলে মনে করেছি তাই পালন করেছি। আমি আর দ্বিতীয় জবানবন্দি দেব না এবং বিচারাধীন মামলায় আমি আর কোনও অংশ গ্রহণ করব না।”

(গ) বন্দেমাতরম্ (ইংরেজী দৈনিক পত্রিকা)

শ্রীঅরবিন্দের প্রিয় ভক্ত নীরদবরণ গুরুর সঙ্গে তাঁহার যে কথাবার্তা হইত তাহা টুকিয়া রাখিতেন। এই সকল কথোপকথন গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হইয়াছে। ইহাতে ‘বন্দে মাতরম্’ পত্রিকার ইতিহাস পাওয়া যায়। ১৯৪০ সনের ১৬ই ফেব্রুআরি যে কথোপকথন হয় তাহার সারমর্ম এই :

অরবিন্দ বলিলেন, “বিপিন পাল পাঁচশত টাকা মূলধন লইয়া ‘বন্দে মাতরম্‌’ পত্রিকা আরম্ভ করেন। তিনি পশ্চিমবঙ্গ পরিভ্রমণে যাইবার সময় আমার উপর সাময়িকভাবে ইহার সম্পাদনার ভার দিয়া যান। তিলক কংগ্রেসের সভাপতি হইয়া কলিকাতায় আসিবেন এই উপলক্ষ্যে আমরা একটি বিপ্লবী কার্যপদ্ধতি (militant programme) গ্রহণ এবং তাহার প্রচারের জন্য নিজস্ব একটি পত্রিকার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করিলাম।

“সুতরাং আমি এ বিষয়ে কথাবার্তার জন্য চরমপন্থী দলের কয়েকজন নেতাকে লইয়া একটি সভা করিলাম। তাহাতে স্থির হইল যে, আমরা একটি কাগজ বাহির করিব এবং সুবোধ মল্লিক ইহার ব্যয়ভার গ্রহণ করিতে প্রস্তুত হইলেন। শ্যামসুন্দর এবং ঘোষ (হেমেন্দ্র?) বিপিন পালের সম্পাদনায় সন্তুষ্ট ছিলেন না এবং বলিলেন যে, তিনি প্রায় নরমপন্থী (too moderate)। তারপর যখন আমার গুরুতর পীড়া হইল-মরণাপন্ন অবস্থা–তখন তাঁহারা আমার সম্মতি না লইয়াই বিপিনবাবুর অনুপস্থিতিতে আমার নাম সম্পাদকরূপে ঘোষণা করিলেন। আমি ইহার প্রতিবাদ করায় তাঁহারা বলিলেন যে, পাল সম্পাদক থাকিলে তাহারা এই পত্রিকার সহিত কোন সম্পর্ক রাখিবেন না। এইভাবে ‘বন্দে মাতরম্’ পত্রিকার সহিত বিপিন পালের সম্বন্ধ ছিন্ন হইল।”

উপরোক্ত ঘটনার চৌত্রিশ বৎসর পরে এইসব কথোপকথন হয় এবং তাহার ত্রিশ বছর পরে ইহা প্রকাশিত হয়; সুতরাং ইহাতে কিছু ভুলভ্রান্তি থাকার সম্ভাবনা। দুইটি কারণে এইরূপ সন্দেহের উদ্রেক হয়। প্রথমতঃ ইহাতে বলা হইয়াছে যে, অরবিন্দের নাম সম্পাদক বলিয়া প্রকাশিত হইয়াছিল। কিন্তু ইহা সত্য নহে। কারণ ‘বন্দে মাতরম্’ পত্রিকায় কোন বিদ্রোহাত্মক রচনার জন্য অরবিন্দ অভিযুক্ত হন। তখন তিনিই যে ইহার সম্পাদক তাহা প্রমাণিত না-হওয়ায় অরবিন্দ মুক্তি পাইলেন। দ্বিতীয়তঃ, নীরদবরণ ‘স্বপ্ন’-নামক প্রবন্ধে ‘বন্দে মাতরম্’ পত্রিকার উদ্ভব সম্বন্ধে অরবিন্দের যে উক্তি উদ্ধৃত করিয়াছেন তাহার মর্ম এই : “বিপিন পাল সামান্য পুঁজি নিয়ে ‘বন্দে মাতর্‌ম আরম্ভ করলেন এবং আমায় তাঁর সঙ্গে যোগ দিতে ডাকলেন, আমি তৎক্ষণাৎ রাজী হয়ে গেলাম…বিপ্লবের জন্য যে প্রচারকার্যের প্রয়োজন তার সুবিধা হল।” এই প্রসঙ্গে বলা যাইতে পারে যে, কালঘাটের সুবিখ্যাত হরিদাস হালদার এই পত্রিকার জন্য পাঁচশত টাকা দান করেন। অরবিন্দ বিপিনচন্দ্রের যে পাঁচশত টাকা মূলধনের কথা বলিয়াছেন, এইভাবেই তাহা সংগৃহীত হইয়াছিল।

‘সন্ধ্যা’ ও ‘যুগান্তর’ যে রাজনীতিক মত ও পথ প্রচার করিত, মূলতঃ তাহার সহিত ‘বন্দে মাতরম্’-এর বিশেষ কোন বিরোধ নাই। কিন্তু রচনাপ্রণালীর মধ্যে গুরুতর প্রভেদ বর্তমান। ঐ দুই বাংলা কাগজে হাল্কাভাবে ব্যঙ্গরসের সঙ্গে যাহা লিখিত হইত তাহার লক্ষ্য ছিল পাঠকের মনে ভাবপ্রবণতার সৃষ্টি করা। ‘বন্দে মাতরম্” পাঠকের বুদ্ধিবৃত্তির উপর নির্ভর করিত। প্রথম দুইটির লক্ষ্য ছিল পাঠকের হৃদয় ও তৃতীয়টির লক্ষ্য ছিল তাহার মস্তিষ্ক। দুই-একটি দৃষ্টান্ত দিলেই ইহা বোধগম্য হইবে।

‘বন্দে মাতরম্’ ইংরেজীভাষায় প্রকাশিত পত্রিকা, আমরা এখানে তাহার বঙ্গানুবাদ দিতেছি :

(১) “সর্বকালের স্বেচ্ছাচারীরাই মনে-মনে এই আশা পোষণ করিয়াছে যে, দুর্বলের উপর অত্যাচার করিয়া নিজের প্রভাব অক্ষুণ্ণ রাখিতে পারিবে, কিন্তু ইহাই তাহাদের ধ্বংসের কারণ হইয়াছে।…জাতীয়তাবোধ, গণতন্ত্র ও স্বাধীনতালাভের আকাঙ্ক্ষা প্রথমে ক্ষীণ থাকে, পরিণামে প্রবল হইয়া উঠে। কিন্তু স্বেচ্ছাচারীর অত্যাচার প্রথমে রুদ্ররূপে প্রকাশ পাইলেও পরিণামে মৃদু হইয়া পড়ে। ইতিহাসের সাক্ষ্য এই যে, স্বেচ্ছাচারী শাসনকর্তা পরিণামে অত্যন্ত দুর্দশাগ্রস্ত হয়, কিন্তু ইহা সত্ত্বেও চিরকাল স্বেচ্ছাচারী শাসকের দল নিজের মনকে মিথ্যা প্রবোধ দিয়াছে যে। তাহার কোন অনিষ্ট হইবে না। ইংরেজ শাসকবর্গও এই আত্মপ্রত্যয়ের মোহে বিভ্রান্ত। মিশর, আয়ল্যাণ্ড ও ভারতে নূতন জীবনের ও নূতন ভাবের যে। ক্রমবিকাশ হইতেছে তাহারা তাহা সম্পূর্ণ উপেক্ষা করিতেছে। কিন্তু বিধিনির্দিষ্ট পরিণাম ঘটিবেই। জগৎ সাগ্রহ চিত্তে চাহিয়া আছে, ইংরেজ এই সকল স্পৃহা ও আকাঙ্ক্ষাকে দমনমূলক আইন অথবা কামান দিয়া রুদ্ধ বা ধ্বংস করিতে পারিবে কি না তাহা দেখিবার জন্য (১৯০৭, ৮ই জুন)।”

(২) “যে ইংরেজ আমাদের চিরশত্রু, তাহার কাছে সাহায্য আশা করা সম্পূর্ণ নিরর্থক। শাসকদের নিকট দরবার না করিয়া দৈহিক শক্তির চর্চা ও মনে সাহস সঞ্চয় করিতে হইবে।…ইহার দ্বারা ব্যক্তিগত অপমান বা নির্যাতনের হাত হইতে আত্মরক্ষা করা সম্ভব হইবে। বর্তমান শিক্ষাপদ্ধতির পরিবর্তন করিয়া প্রাচীনকালের ক্ষত্রিয়ের মত দৈহিক ও মানবিক বল যাহাতে বৃদ্ধি পায় সেইরূপ শিক্ষার ব্যবস্থা করিতে হইবে” (১৯০৭, ১৮ই মার্চ)।

(৩) “দেশের কাজ যাহারা করিতে চান তাঁহারা হইবেন সম্পূর্ণ স্বার্থশূন্য–নেতৃত্ব বা সম্মানের প্রতি লোভহীন, দেশের স্বার্থে নিবেদিতপ্রাণ, আজ্ঞাপালনে তৎপর ও কর্মানুরক্তিতে ভরপুর।”

(৪) “দেশমাতৃকার চরণে আত্মবলিদান করিতে হইবে। স্বাধীনতা-সৌধ গঠনের প্রতিটি প্রস্তর সন্নিবেশের জন্য একটি করিয়া জীবন বলি দিতে হইবে। কেবল বাগাড়ম্বরে স্বরাজ লাভ হইবে না।”

(৫) “জাতীয়তাবাদী আমরা মনে করি, মানুষের জন্ম ও স্বাধীনতা অবিচ্ছেদ্যভাবে জড়িত এবং আমরাও ব্যক্তিগত ও সমষ্টিগত ভাবে সম্পূর্ণ স্বাধীন-কাহারও হুকুম মানিতে আমরা বাধ্য নহি।”

(৬) “নির্যাতন, আরও নির্যাতন, সমগ্র দেশে চলিয়াছে। নির্যাতনের মধ্যে তার মুক্তি, অত্যাচারের পথে সে শক্তি সঞ্চয় করিবে। ইতিহাস স্বাধীনতা সংগ্রামের মাত্র একটি পথই নির্দেশ করিয়া থাকে। অস্ত্রশস্ত্রের, বন্দুক-বারুদের সম্ভার অপেক্ষা জাতির মঙ্গলের জন্য নির্যাতন সহ্য করা এবং মৃত্যুবরণ করার জন্য মনকে গড়িয়া তোলার মূল্য অনেক বেশি।”

বলা বাহুল্য ‘সন্ধ্যা’ ও ‘যুগান্তরের সম্পাদকের ন্যায় ‘বন্দে মাতরম্’-এর সম্পাদক শ্রীঅরবিন্দও রাজদ্রোহ-অপরাধে অভিযুক্ত হইলেন। তিনিই যে ইহার সম্পাদক ইহা প্রমাণ করিবার জন্য সরকারপক্ষ বিপিন পালকে সাক্ষী মানিলেন। কিন্তু বিপিনচন্দ্র বলিলেন, তিনি এই মামলায় কোন অংশ গ্রহণ করিবেন না। বিচারালয়ের প্রতি অবজ্ঞা ও অনাস্থা প্রকাশের জন্য তাঁহার ছয়মাস বিনাশ্রম কারাদণ্ড হইল। কিন্তু অরবিন্দ মুক্তি পাইলেন।

পূর্বেই বলিয়াছি, ‘সন্ধ্যা’-সম্পাদক ব্ৰহ্মবান্ধব উপাধ্যায় ও যুগান্তর-সম্পাদক ভূপেন দত্ত এইভাবেই দৃঢ়তার সহিত বৃটিশ আদালতের সঙ্গে অসহযোগ করিয়াছিলেন। এদেশে অনেকের ধারণা যে, মহাত্মা গান্ধীই আদালতের সঙ্গে এইপ্রকার অসহযোগের পথপ্রদর্শক। কিন্তু গান্ধীর বিদেশীবর্জন ও ইংরেজ সরকারের প্রতিষ্ঠানগুলির প্রতি বর্জননীতি যেমন অরবিন্দ ‘বন্দে মাতরম্’ পত্রিকায় বহুপূর্বেই বিশদভাবে ব্যাখ্যা করিয়াছিলেন, আদালতের সহিত অসহযোগের ব্যাপারেও মহাত্মা গান্ধীর বহুপূর্বেই তিনজন বাঙ্গালীর দৃষ্টান্ত উল্লেখ করা যাইতে পারে।

‘সন্ধ্যা’, ‘যুগান্তর’ ও ‘বন্দে মাতরম্ ছাড়াও কলিকাতায় ও বাঙ্গলার মফঃস্বল শহরে অনেক সাময়িক পত্রিকাও অনুরূপ মতবাদ প্রকাশের দ্বারা বাঙ্গালীর, বিশেষতঃ যুবকদের প্রাণে যে উদ্দীপনা জাগাইয়াছিল তাহাই বঙ্গদেশে বিপ্লববাদ শেষপর্যন্ত জীবন্ত থাকার একটি প্রধান কারণ। উপরন্তু বাংলা হইতে ইহা বাহিরেও ছড়াইয়া পড়িয়াছিল। এইসব কাগজের উগ্র জাতীয়তার বাণী এবং প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে বিপ্লববাদের সমর্থন বন্ধ করার জন্য গভর্নমেন্টকে নূতন নূতন আইন করিয়া সম্পাদক, মুদ্রাকর প্রভৃতির জেল ও জরিমানা এবং কোন কোন স্থলে ক্রমবর্ধমান আমানতের টাকা বাজেয়াপ্ত এবং ছাপাখানা আটক করিয়া ইহাদের মুখ অথবা কাগজ বন্ধ করিতে হইয়াছে। সংবাদপত্র ছাড়া কয়েকখানি প্রাচীন ও আধুনিক গ্রন্থ এবং স্বামী বিবেকানন্দের ‘মা ভৈঃ’ বাণী বিপ্লববাদের অনুভূতির ভিত্তি গড়িয়াছিল। প্রাচীন গ্রন্থ শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা বিপ্লববাদীদের অভূতপূর্ব প্রেরণা জোগাইয়াছিল। দেহ নষ্ট হয়, আত্মা অমর-কর্মে তোমার অধিকার, ফলে নয়-মৃত্যু ও নবজন্ম, জীর্ণবস্ত্র পরিত্যাগ করিয়া নূতন বস্ত্র পরিধান মাত্রস্থান ও কাল অনুসারে নরহত্যা অপরাধ নহে, কর্তব্যের অনুষ্ঠান মাত্র–গীতার এইসব উপদেশ বিপ্লবীদের অনুপ্রাণিত করিত। স্বামী বিবেকানন্দের উদাত্ত বাণী-শক্তি সংগ্রহ কর–”নায়মাত্মা বলহীনেন লভ্যঃ”–তাহাদিগের পথনির্দেশ করিত। বঙ্কিমচন্দ্রের ‘আনন্দমঠ’ বিপ্লবীদের প্রধান ধর্মগ্রন্থ হইয়া উঠিয়াছিল এবং এই গ্রন্মোক্ত সন্তানগণই তাহাদের আদর্শ ছিল। ফরাসী বিদ্রোহে ‘লা মার্সেলিজ’ নামক বিখ্যাত জাতীয় সঙ্গীত যে প্রভাব বিস্তার করিয়াছিল আনন্দমঠের ‘বন্দে মাতরম্‌ সঙ্গীত তাহার সহিত সর্বৰ্থ তুলনীয়। এই মন্ত্র উচ্চারণ করিয়া বিপ্লবীরা অকুতোভয়ে জীবন বিপন্ন করিয়া বিপদের মুখে অগ্রসর হইয়াছে এবং ফাঁসীর রজ্জ্ব গলায় পরিয়াও এই মন্ত্র উচ্চারণ করিতে করিতে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করিয়াছে। স্বাধীনতা সংগ্রামে ‘বন্দে মাতরম্‌’ই ছিল জাতীয় সঙ্গীত-স্বাধীন ভারতে নূতন জাতীয় সঙ্গীত আনুষ্ঠানিকভাবে ইহার স্থান অধিকার করিয়াছে, কিন্তু সেদিন ‘বন্দে মাতরম্ সঙ্গীত আসমূদ্রহিমাচল ভারতবাসীর হৃদয়ের গভীরে যে আসন পাতিয়াছিল কোনদিন তাহা হইতে ভ্রষ্ট হইবে না।

বিংশ শতকে বিপ্লবের আধুনিক পরিস্থিতিতে বাংলাদেশে নূতন সাহিত্য গড়িয়া উঠিল। আনন্দমঠের আদর্শে শ্রীঅরবিন্দ লিখিলেন, ভবানী মন্দির। ১৯০৪ সনে বরোদা হইতে মূল ইংরেজী এবং এই গ্রন্থেরই হিন্দী ও বাংলা অনুবাদ প্রকাশিত হইল। ইহর পরিকল্পনায় ছিল, শহর হইতে দূরে, জনমানবহীন স্থানে, শান্ত ও নির্জন পরিবেশে, সর্বশক্তিরূপিণী দেবী ভবানীর মন্দির প্রতিষ্ঠিত হইবে এবং দেশহিতার্থে নিবেদিতপ্রাণ কর্মীদল ব্রহ্মচর্য পালন করিয়া কায়িক, মানসিক, নৈতিক এবং আত্মিক বল অর্জন করার সাধনায় নিযুক্ত থাকিবে। শক্তিহীনতাই আমাদের পতনের কারণ, সুতরাং প্রথমেই শক্তি অর্জনের তপস্যা করিয়া রাজনৈতিক সন্নাসীদল গঠন করিতে হইবে–ইহাই গ্রন্থখানির বিষয়বস্তু।

‘যুগান্তর পত্রিকায় বিপ্লবী অবিনাশচন্দ্র ভট্টাচার্য লিখিত প্রবন্ধগুলি কয়েকটি একত্র করিয়া মুক্তি কোন্ পথে’-নামক একখানি গ্রন্থ প্রকাশিত হয় (১৯০৭)। বিপ্লবের প্রচারকার্যের জন্য সঙ্গীত, সাহিত্য, যাত্রা, কথকতা ও গুপ্ত সমিতির প্রয়োজনীয়তা, অস্ত্র ও ধন সংগ্রহ, যুদ্ধের প্রস্তুতি, সৈন্যদের ভাগাইয়া আনিয়া বিপ্লবকার্যে নিয়োেগ, দেশের জন্য জীবন উৎসর্গ প্রভৃতি বিষয় এই গ্রন্থে আলোচিত হইয়াছে।

একজন বিদেশী (J. S. Bloch) লিখিত গ্রন্থ-অবলম্বনে বারীন্দ্রকুমার ঘোষ বর্তমান রণনীতি’ গ্রন্থ রচনা করেন (১৯০৭)। আধুনিক ছোট বড় মারণাস্ত্র, সেনাবিভাগের নানা অংশের এবং যুদ্ধে ব্যবহারযোগ্য যন্ত্রপাতির নাম ও বিবরণ, সৈন্যসজ্জার বিধিব্যবস্থা, আক্রমণ ও প্রতিরোধ বিভাগের কার্যপদ্ধতি, গেরিলাযুদ্ধের রীতিনীতি প্রভৃতি বহু তথ্যে পরিপূর্ণ এবং নানা চিত্রে সমৃদ্ধ এই গ্রন্থখানি বিষয়বস্তু হিসাবে বাংলাসাহিত্যে সম্পূর্ণ এক অভিনব সৃষ্টি।

এই বইখানি হইতে প্রমাণিত হয়, বাংলার বিপ্লবীদল তখন রীতিমত সামরিক অভিযানের স্বপ্ন দেখিতেছিল। তাহারা সামরিক পদ্ধতি শিক্ষা ও বোমা তৈরী সম্বন্ধে বহু ইংরেজী গ্রন্থ পাঠ করিত। পুলিশের খানাতল্লাসীতে এই শ্রেণীর বহু পুস্ত ক ধৃত ও বাজেয়াপ্ত হইয়াছে।

বিপ্লবীদলের উপর সাহিত্যের প্রভাব সম্বন্ধে গভর্নমেন্ট খুব সচেতন ছিল। অনেক ইংরেজী ও বাংলা পুস্তক-পুস্তিকা, সংবাদপত্র প্রভৃতির প্রকাশ, প্রচার, আমদানি ও ক্রয়-বিক্রয় নিষিদ্ধ হইয়াছিল। খানাতল্লাসীর সময় পুলিশ কোন বাড়ীতে ‘গীতা’ ও ‘আনন্দমঠ, স্বামী বিবেকানন্দের ভাববার কথা, গিরিশ ঘোেষ প্রণীত ‘সিরাজদ্দৌলা, দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের ‘রাণা প্রতাপ’ প্রভৃতি কোন বই পাইলেই ঐ বাড়ীর তরুণ যুবককে থানায় লইয়া গিয়া জিজ্ঞাসাবাদ করিত। বহু নাটকের অভিনয় এবং অনেক গ্রামোফোন রেকর্ডেরও প্রচার নিষিদ্ধ হয়। বিদেশ হইতে কোন কোন গ্রন্থ ও পত্রিকা এদেশে আমদানি বন্ধ করিয়া দেওয়া হয়। কিন্তু গভর্নমেন্টের কড়া আইন ও ধরপাকড় সত্ত্বেও দেশপ্রেম-উদ্দীপক বহু সঙ্গীত, কবিতা ও গদ্যগ্রন্থ বাংলাদেশে প্রচলিত ছিল। বিপ্লবীরা পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের বিভিন্ন যুগের মুক্তিসংগ্রামের কাহিনীর সঙ্গে পরিচিত ছিল। ১৯০৪-০৫ সনে রাশিয়া ও জাপানের যুদ্ধে ক্ষুদ্র জাপানের হাতে ইউরোপীয় বৃহত্তম দেশ রাশিয়ার শোচনীয় পরাজয় ভারতীয় বিপ্লবীদের প্রাণে নূতন আশা ও প্রচণ্ড উদ্দীপনার সৃষ্টি করিয়াছিল।

২. সন্ত্রাসবাদ

আলিপুর বোমার মামলার ফলে প্রথমযুগের বিপ্লবী, বিশেষতঃ সন্ত্রাসবাদীদের অনেকেই জেলে বা আন্দামানে গেলেন, আর অরবিন্দ অল্প কিছুদিন পরেই রাজনীতি ত্যাগ করিয়া পণ্ডিচেরীতে আশ্রম প্রতিষ্ঠা করিলেন। পুলিন দাস বিনাবিচারে অন্তরীণে আবদ্ধ হইলেন (১৬ই ডিসেম্বর, ১৯০৮)। কিন্তু, যে বিপ্লব ও সন্ত্রাসবাদের বীজ বাংলার মাটিতে ছড়ান হইয়াছিল তাহা হইতে প্রধানতঃ পূর্বোক্ত কারণে আবার নূতন অঙ্কুর বাহির হইল। ক্রমে তাহা বিশাল বটবৃক্ষের আকার ধারণ করিল এবং তাহার শাখা-প্রশাখা বাংলাদেশের বাহিরেও বহুদূর পর্যন্ত বিস্তৃত হইল। অতঃপর সংক্ষেপে এই কাহিনী বিবৃত করিব।

এই বিপ্লবধারার গতি ও প্রকৃতির আলোচনা নিম্নলিখিত কয়েক শ্রেণীতে বিভক্ত করা যায় : (ক) ভারতীয় সৈন্যদের বিপ্লবী মন্ত্রে দীক্ষা। (খ) অস্ত্র সংগ্রহ। (গ) ডাকাতি। (ঘ) সরকারী কর্মচারী ও গুপ্তচর হত্যা। (ঙ) সম্মুখযুদ্ধ।

(ক) ভারতীয় সৈন্যদের বিপ্লবী মন্ত্রে দীক্ষা

পরবর্তীকালে ভারতের অন্যত্র সৈন্যদের বিপ্লব-মন্ত্রে দীক্ষা দিবার যে চেষ্টা হইয়াছিল তাহার তুলনায় বঙ্গদেশে বিশেষ কিছুই হয় নাই। কিন্তু, এ-বিষয়ে বাংলাদেশে একবার মাত্র যে বিফল প্রয়াস হইয়াছিল তাহার কাহিনী এতদিন পর্যন্ত প্রায় অজ্ঞাত ছিল। সম্প্রতি রাশিয়া হইতে তাহার যে বিবরণ পাওয়া গিয়াছে তাহার উল্লেখ করিতেছি। ইংরেজ গভর্নমেন্ট এই ঘটনাটি এতদিন গোপন করিয়া রাখিয়াছিলেন।

১৯০৮ সনে বড়দিনের সময় কলিকাতায় বাংলার ছোটলাট সাহেবের বাড়ীতে একটি নৃত্যের (Ball-dance) আয়োজন হইয়াছিল। বড়লাট, সৈনাধ্যক্ষ প্রভৃতি বড় বড় রাজকর্মচারীগণ এই উৎসবে নিমন্ত্রিত হইয়াছিলেন। স্থির হইয়াছিল যে, ঐ রাত্রে দশম জাঠ’ সৈন্যদল পাহারা দিবে। গুপ্ত বিপ্লবীদলও স্থির করিল যে ঐ সৈন্যদলকে হাত করিয়া নাচের ঘরটি তাহারা বোমা মারিয়া উড়াইয়া দিবে। কলিকাতাস্থিত রাশিয়ান কনসাল লিখিয়াছেন, বাংলার দেশপ্রেমিক গুপ্ত ষড়যন্ত্রকারীরা মনে করিয়াছিল যে ইহার ফলে সারাদেশে যে চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হইবে সেই সুযোগে তাহারা শাসনক্ষমতা নিজেরা হস্তগত করিতে পারিবে।

পুলিশ কিছুই সন্দেহ করে নাই। কিন্তু সৈন্যদেরই একজন বিশ্বাসঘাতকতা করিয়া এই ষড়যন্ত্রের কথা কর্তৃপক্ষের কর্ণগোচর করে। ঐ সময় একটি রাশিয়ান সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়, সৈন্যেরা বিচারের সময় বলিয়াছিল যে, বাংলাদেশে স্বদেশপ্রেমিকদের একটি গুপ্তসমিতিতে তাহারা যোগ দিয়াছিল এবং তাহারা জানিত যে, ভারতে ব্রিটিশ রাজত্ব ধ্বংস করাই এই সমিতির উদ্দেশ্য ছিল। অভিযুক্তরা আরও বলিল যে, তাহারা এই শপথ করিয়া উক্ত সমিতিতে যোগ দিয়াছিল যে, তাহারা এই দলের অনুগত থাকিয়া সৈন্যদলের মধ্যে ইংরেজের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের মনোভাব প্রচার করিবে। সৈন্যদেরই একজন বিচারককে বলিয়াছিল, “মনে করিবে না যে, এইরকম বিদ্রোহী সিপাহীর সংখ্যা মাত্র পঁচিশ জন। এরূপ আরও বহু সিপাহী আছে।” বলা বাহুল্য, ষড়যন্ত্রকারী জাঠ সিপাহীদের কঠোর শাস্তি হইয়াছিল।

এই কাহিনী হইতেই প্রমাণিত হয় যে, মুরারিপুকুরের আচ্ছা ভাঙ্গিয়া যাওয়ার পরও গুপ্ত বিপ্লবী সমিতির আরও অনেকগুলি কেন্দ্র বেশ সক্রিয় ছিল।

(খ) অস্ত্র সংগ্রহ

অস্ত্রের মধ্যে বিপ্লবীদের প্রধানতঃ ছিল বোমা, রিভলভার, পিস্তল ও বন্দুক। এইগুলি সংগ্রহের বিবরণ পৃথকভাবে উল্লেখ করিতেছি। অবশ্য দুই-এক স্থানে ধারালো কাটারিও ব্যবহৃত হইয়াছে, তবে তাহা সর্বত্রই সুলভ।

বোমা : মজঃফরপুরের হত্যাকাণ্ডে সর্বপ্রথম বোমার ব্যবহারের সংবাদ সর্বত্র প্রচারিত হয়। ইহার পূর্বে ১৯০৭ সনের ৫ই ডিসেম্বর ছোটলাট সার এন্ড্রু ফ্রেজার যে রেলগাড়ীতে ছিলেন, বেণীপুর ও নারায়ণগড়ের মধ্যে রেললাইনে বোমা পুঁতিয়া তাহা ধ্বংস করার চেষ্টার কথা পূর্বেই বলা হইয়াছে। কিন্তু, এই সময়ে নারিকেল খোলের মধ্যে বারুদ ভরা হইত। ধাতুনির্মিত আধার প্রস্তুত করা তখনও সহজসাধ্য হয় নাই। মুরারিপুকুর বাগান পুলিশ তন্ন তন্ন করিয়া অনুসন্ধান করিয়াছিল, কিন্তু বোমা-প্রস্তুতির কোন নিদর্শনই পাওয়া যায় নাই। ১৯০৮ সনে নারিকেল খেলে প্রস্তুত বোমার ব্যবহারের কয়েকটি বিবরণ দিতেছি।

(১) কলিকাতা গ্রে স্ট্রীটে কয়েকটি লোক আহত হইয়াছিল (১৫ই মে)।

(২) কাঁকিনাড়া রেলষ্টেশনে একখানি দ্বিতীয় শ্রেণীর কামরায় বোমা নিক্ষিপ্ত হয়, কোন অনিষ্ট হয় নাই (২১শে জুন)।

(৩-৫) তারপর ১২ই অগষ্ট শ্যামনগরের নিকট, ২৪শে নভেম্বর বেলঘরিয়ার কাছে ও ২১শে ডিসেম্বর ট্রেনের উপর বোমা পড়ে।

(৬) রাণাঘাট শক্তি সমিতির সভ্য অতুলকুমার পাল নদীয়ার ম্যাজিষ্ট্রেটের কাছে একটি বোমা-ভরা পার্শেল পাঠান। ১৭ই সেপ্টেম্বর অতুলের পাঁচ বৎসরের সশ্রম কারাদণ্ড হয়।

(৭) ফরাসী-অধিকৃত চন্দননগর বিপ্লবীদের অস্ত্র-সংগ্রহের প্রধান কেন্দ্র ছিল। সেখানে বন্দুক প্রভৃতি আগ্নেয়াস্ত্র রাখা দেশীয় নাগরিকদের পক্ষে নিষিদ্ধ না-থাকায় ফ্রান্স ও অন্যান্য দেশ হইতে বন্দুক বা রিভলভার আমদানি করার বেশ সুবিধা ছিল। ইংরেজ গভর্নমেন্টের অনুরোধে চন্দননগরের মেয়র ইহার প্রতিবন্ধকতা করেন। এই কারণে রাত্রে নৈশভাৈজনের সময় তাহার ঘরে একটি বোমা পড়ে (১১ই এপ্রিল), কিন্তু ইহা ফাটে নাই।

বিশেষ ফলপ্রসূ না হইলেও বোমা-তৈরীর পদ্ধতি অনেকেই শিখিয়াছিল এবং নানা স্থানে ইহা প্রস্তুত হইত। ঢাকা জিলার মুন্সীগঞ্জে এক বাড়ীতে পুলিশ অনুসন্ধান করিয়া নিম্নলিখিত দ্রব্যাদি পায় (১৯১০, ৫ই সেপ্টেম্বর) : (ক) একটা টীনের ক্যানেস্তারার মধ্যে ১১টি বোমা ও খানিকটা বারুদ মশলা, (খ) বোমার ফর্মুলা ও সাঙ্কেতিক অক্ষরে কিছু লেখা, (গ) বিভিন্ন কাজের ভারপ্রাপ্ত ১৩ জনের নাম। অপরাধী ললিতচন্দ্র চৌধুরীর দশ বছর দ্বীপান্তরের দণ্ড হয়।

এরূপ ডাকাতি বা অন্য কোন প্রসঙ্গে পুলিশ বাড়ী খানাতল্লাসী করিয়া অনেক স্থলে অপ্রত্যাশিতভাবে বোমা কিম্বা বোমা-তৈরীর মালমশলা পাইত। গৃহস্বামীর অজ্ঞাতসারে অনেক বাড়ীতে যুবকদল বোমা তৈরী করিত, অকস্মাৎ বিস্ফোরণের ফলে কখন কখন তাহা টের পাওয়া যাইত। যতদূর সংবাদ পাওয়া যায় তাহাতে মনে হয় যে, সর্বাপেক্ষা বড় বোমার কারখানা ছিল কলিকাতার রাজাবাজারে। ১৯১৩ সনের ২১শে নভেম্বর, ২১৬/১নং আপার সার্কুলার রোডের (বর্তমান আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায় রোড) বাড়ী পুলিশ খানাতল্লাসী করে। “দেখা গেল, এই স্থানটি বোমা তৈরীর এক বিরাট কারখানা। এখানে মাল-মশলা, তৈজসপত্র এবং বোমা তৈরীর অন্যান্য উপকরণ প্রচুর পরিমাণে পাওয়া গেল। সঙ্গে সঙ্গে প্রচণ্ড বিস্ফোরণ শক্তিসম্পন্ন বোমা তৈরীর ফর্মুলা এবং ঐ সংক্রান্ত পুস্তকাদিসহ অন্যান্য জিনিসও আবিষ্কৃত হইল।”

১৯১৮ হইতে ১৯২৩ সন পর্যন্ত ডাকাতি খুন প্রভৃতির ন্যায় বোমা-তৈরীরও বিশেষ কোন সংবাদ পাওয়া যায় না। কিন্তু ১৯২৩ সনে গান্ধীর অহিংস আন্দোলন শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বোমার কারখানাও আবার গড়িয়া উঠিল, ইহা পরে বিবৃত হইবে।

রিভলভার ও বন্দুক : রিভলভার ও বন্দুক প্রধানতঃ দুইটি উপায়ে সংগৃহীত হইত। প্রথম উপায় ছিল, গৃহস্থের বাড়ী হইতে অপহরণ অথবা বলপূর্বক আদায়। অনেক ডাকাতি-প্রসঙ্গে ইহার উল্লেখ করা হইয়াছে। দ্বিতীয় উপায় ছিল, বিদেশী জাহাজের খালাসী বা নিম্নস্তরের কর্মচারীদের নিকট হইতে ক্রয় করা। অধিক মূল্যের লোভে ইহারা বিদেশ হইতে আনিয়া বন্দুক ও রিভলভার গোপনে বিপ্লবীদের নিকট বিক্রয় করিত। ইহার বেশীরভাগই অবশ্য রিভলভার, কারণ ইহা গোপনে আনা বা লওয়ার সুবিধা। সাধারণতঃ কলিকাতার বারবণিতা-গৃহে এইসব ক্রয়-বিক্রয় সম্পন্ন হইত। ফরাসী-অধিকৃত চন্দননগরের মাধ্যমেও কেনাবেচা চলিত। লণ্ডন হইতেও কতকগুলি রিভলভার ষ্টীল ট্রাঙ্কের গুপ্ত আধারের মধ্যে লুকাইয়া আনা হইত। ইহার একটি দৃষ্টান্ত পূর্বে উল্লেখ করিয়াছি।

এই প্রসঙ্গে কলিকাতার প্রসিদ্ধ আগ্নেয়াস্ত্র-ব্যবসায়ী রডা কোম্পানীর পিস্তল চুরির একটি বিশেষ চাঞ্চল্যকর ঘটনার কথা উল্লেখ করা প্রয়োজন। এই কোম্পানী বিদেশ হইতে বন্দুক, গুলি, বারুদ প্রভৃতি আমদানি করিত এবং ইহার ১৬ টাকা মাহিনার একজন কাষ্টমস্ অফিসার’ শ্রীশচন্দ্র মিত্র ওরফে হাবুর কাজ ছিল সরকারী গুদামঘর হইতে মাল খালাস করিয়া কোম্পানীর অফিসে লইয়া আসা। প্রকৃতপক্ষে শ্রীশচন্দ্র ছিলেন একজন বিপ্লবী। তিনি অস্ত্র-অপহরণের ঘূঢ় উদ্দেশ্য লইয়াই ১৯১৩ সনের অগষ্ট মাসে রডা কোম্পানীর মাল-খালাসের কাজে নিযুক্ত হন এবং তাহার কার্যে কর্তৃপক্ষের সন্তোষ ও বিশ্বাস অর্জন করেন।

দুর্ধর্ষ বিপ্লবী নেতা শ্ৰীশ পাল শ্রীশ মিত্রের নিকট সংবাদ পাইলেন যে, অন্যান্য অস্ত্রশস্ত্রের সঙ্গে ২০২টি পেটিতে ৫০টি মাউসার পিস্তল ও ৫০,০০০ রাউণ্ড কার্তুজ কাষ্টমস্ হাউসে আসিয়া পৌঁছিয়াছে। ইহা অপহরণের জন্য ষড়যন্ত্র করা হইল। গরুর গাড়ীতে মাল আনিবার সময় ঐগুলি সরাইবার ব্যবস্থা হইল। প্রভুদয়াল হিম্মৎ সিংকারের সাহায্যে বিপ্লবী হরিদাস দত্ত গাড়োয়ানের বেশে সজ্জিত হইলেন, এমনকি, মাথার চুলগুলিও ছোট করিয়া কাটা হইল। ২৬শে অগষ্ট (১৯১৪) সাতখানা গরুর গাড়ী গুদামে হাজির হইবার কথা। ছয়খানা গাড়ী হাজির হইল ও তাহাদের সারি করিয়া মাল বোঝাই করা হইল। সপ্তম গাড়োয়ান দেরীতে আসায় শ্ৰীশ মিত্র তাহাকে ‘উলুক, পাঁঠা’ প্রভৃতি গালাগালি দিয়া সকলের পশ্চাতে রাখিলেন এবং মাউসার পিস্তল ও কার্তুজের বাক্সগুলি সেই গাড়ীতে তুলিয়া দিয়া রডা কোম্পানীর অফিসের দিকে যাত্রা করিলেন। প্রথম ছয়খানা গাড়ী যথাস্থানে পৌঁছিল, কিন্তু সপ্তম গাড়ীখানি রডা কোম্পানীর অফিসে না গিয়া সম্পূর্ণ অন্যপথে গেল। দুইজন সশস্ত্র বিপ্লবী ছদ্মবেশে ইহার সঙ্গে চলিলেন এবং কিছুক্ষণ পরেই শ্ৰীশ মিত্রও তাঁহাদের সঙ্গে যোগ দিলেন। মলঙ্গা লেনে একটি খোলা জায়গায় বাক্সগুলি নামান হইল। বড় বড় এগারোটি বাক্স আনিয়া ২১,২০০ রাউণ্ড বুলেট ঐ বাক্সগুলিতে ভরা হইল। মালভর্তি বাক্সগুলি একজন বিপ্লবীর হেফাজতে রাখিয়া বাকি ২৮,৮০০ রাউণ্ড বুলেট ও সমস্ত পিস্তল (পঞ্চাশটি) বাংলার বিভিন্ন বিপ্লবীদলের মধ্যে ভাগ করিয়া বিভিন্ন স্থানে পাঠানো হইল।

পিস্তল রিভলভার প্রভৃতি কিভাবে গোপনে রাখার ব্যবস্থা ও সর্বত্র পাচার করা হইত তাহার একটি উল্লেখযোগ্য দৃষ্টান্ত দিতেছি। কলিকাতার দক্ষিণ অঞ্চল ভবানীপুরে মেয়েদের একটি কলেজ ছিল–এখনও আছে, নাম Diocesan College। এই কলেজের হোষ্টেলে একটি ছাত্রীর বারোটি টাকা চুরি হওয়ায় সকলের বাক্স-পেটরা অনুসন্ধান করা হইল। চতুর্থ বার্ষিক শ্রেণীর একটি ছাত্রীর বাক্সে দুইটি রিভলভার, দুইটি পিস্তল ও কার্তুজ পাওয়া গেল, ফলে মেয়েটির চারি বৎসর কারাদণ্ড হইল।

(গ) ডাকাতি

ডাকাতি করা উচিত কি না ইহা লইয়া বিপ্লবীদের মধ্যে সংশয় প্রকাশ, তর্ক-বিতর্ক ও বহু আলোচনা হইয়াছে। কেহ কেহ ডাকাতির বিরোধিতায় বিপ্লবপন্থাই ছাড়িয়া দিল। কিন্তু ক্রমশঃই সকলে ইহা উপলব্ধি করিতে লাগিল যে, বিপ্লবীদল চালু রাখিতে হইলে অর্থের প্রয়োজন এবং ডাকাতি ভিন্ন অর্থসংগ্রহের আর কোন উপায় নাই। ১৯০৬-০৭ সনে সুবোধ মল্লিকের বাড়ীতে বিভিন্ন জিলার বিপ্লবীদের এক সম্মেলনে এই বিষয়টি লইয়া আলোচনা হয়। “শ্রীঅরবিন্দ বুঝাইলেন যে, স্বাধীনতার জন্য ডাকাতি করাতে যে নীতিগত দোষ কল্পনা করা হয়, তাহা সম্পূর্ণ অমূলক।” পরে এই মর্মে একটি প্রস্তাব গৃহীত হইল, “আমরা ডাকাতি করিয়া যাহার যত টাকা আনিব তাহার একটা সঠিক হিসাব রাখিব এবং স্বাধীনতা লাভ করিয়া ঐ সমস্ত লোকদিগকে তাহাদের টাকা ফিরাইয়া দিব।” শ্রীঅরবিন্দ ইহা সমর্থন করিয়াছিলেন। দুই-এক স্থলে, যাহার বাড়ীতে ডাকাতি করা হইয়াছে তাহাকে পত্র লিখিয়া জানান হয়, “আপনার নিকট হইতে…(টাকা) ঋণস্বরূপ আমাদের তহবিলে জমা হইয়াছে। স্বাধীনতা লাভ করিয়া আমরা আপনার এই টাকা সুদ-সমেত পরিশোধ করিব।” সদিচ্ছা-প্রণোদিত হইলেও কার্যতঃ এরূপ ব্যবস্থা করা সম্ভবও ছিল না এবং হয়ও নাই–এরূপ চিঠিপত্রও খুব বেশী পাঠান হয় নাই।

তবে নীতিগত অপরাধ যথাসম্ভব ক্ষালনের প্রয়াসস্বরূপ কতকগুলি সাধারণ নিয়ম আদর্শরূপে গৃহীত হইয়াছিল। যেমন, স্ত্রীলোকের গায়ে হাত দিবে না; যাহারা অসৎ উপায়ে অর্থ সঞ্চয় করিয়াছে, কেবলমাত্র তাহাদের বাড়ীতেই ডাকাতি করা হইবে। প্রথমটি সাধারণভাবে মানিয়া চলিলেও দ্বিতীয়টি যে সর্বসময়ে অনুসৃত হইত, তাহা বলা যায় না। অনেক ক্ষেত্রে কেবল টাকা বা অলঙ্কারই নহে, বন্দুকও অপহৃত হইয়াছে। বাংলায় বিপ্লববাদ আরম্ভ হইবার পর হইতে দশ-বারো বৎসর পর্যন্ত, অর্থাৎ ১৯০৮ হইতে ১৯১৭ পর্যন্ত ডাকাতির বহু দৃষ্টান্ত পাওয়া যায়। ইহার বিবরণ তো দূরের কথা, সকলগুলির উল্লেখ করাও এই গ্রন্থে সম্ভবপর নহে। সুতরাং ডাকাতির সাধারণ পদ্ধতি, বড় বড় ডাকাতির উল্লেখ এবং মাত্র অল্প কয়েকটির বিস্তৃত বর্ণনা দিব।

এই সময়ের অনেকগুলি ডাকাতিতেই বিপ্লবীদের আশ্চর্যরকম সুশৃঙ্খলা, সাহস ও কৌশলের পরিচয় পাওয়া যায়। অনেক কাহিনী বিশ্লেষণ করিলে তাহাদের মধ্যে যে কষ্টসহিষ্ণুতা, নিয়মানুবর্তিতা, ক্ষিপ্রকারিতা, নির্ভীকতা ও লোভশূন্য মনোবৃত্তি প্রভৃতির বিকাশ দেখা যায় তাহা সত্যই বিস্ময়কর। শ্রীনলিনীকিশোর গুহ প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা হইতে ইহার যে দুইটি দৃষ্টান্ত দিয়াছেন তাহা নীচে উদ্ধৃত করিতেছি :

বিপ্লববাদীরা স্ত্রীলোকদের গায়ে কখনও হাত দেয় নাই। একবার একস্থানে ডাকাতি হইতেছে, অর্থসংগ্রহ চলিতেছে। যে বাড়ীতে ডাকাতি হইতেছে সেই বাড়ীর একজন মহিলার গলায় একছড়া হার দেখিয়া ঐ হারছড়া লইতে যেই একজন হাত বাড়াইয়াছে অমনই তাহার গণ্ডদেশে এক প্রচণ্ড চড় পড়িল। ঐ আঘাতে বিপ্লববাদী ঘুরিয়া পড়িয়া গেল। একজন বিপ্লববাদী পিস্তল উঠাইয়া বলিল, খুন করে ফেলব, তোমাকে হার কেড়ে নিতে কে বলেছে?’ বিক্রমপুর গাওদিয়া ডাকাতিতে চড় মারিয়াছিল ও শাসন করিয়াছিল রবীন্দ্রমোহন সেন ও বীরেন্দ্র চ্যাটার্জী। ঐ লোকটার ঐ প্রবৃত্তি দেখিয়া বিপ্লববাদীরা তাহাকে হেয় মনে করিতে লাগিল। শাসন তো চলিলই। তাহার উপরে সতর্ক দৃষ্টি রাখিবার আদেশ হইল। যে তাহাকে পাঠাইয়াছে, তাহার কৈফিয়ৎ চাওয়া হইল।

… … …

একস্থানে ডাকাতি অনুষ্ঠান হইতেছে। বাড়ীর বাহিরে গ্রামের লোক জড় হইয়াছে। ভিতরে যে-যাহার নির্দিষ্ট কাজে নিযুক্ত রহিয়াছে। সময় অধিক নাই, অল্প সময়ের মধ্যেই সমস্ত কাজ সারিতে হইবে।

অগণিত অর্থের সন্ধান সেখানে মিলিয়াছে। বিশিষ্ট কর্মীরা ভাবিতেছে, আর এ-সমস্ত কাজ করিবার প্রয়োজন হইবে না। কিন্তু হঠাৎ গুড়ুম করিয়া আওয়াজ হইল। কিসের একটা আঘাত লাগিয়া জনৈক বিপ্লববাদীর হাতের পিস্তল ছুটিয়া গেল-আর তাহা আঘাত করিয়া বসিল অপর বিপ্লববাদীকে। আঘাত সাংঘাতিক। অর্থ সবই হাতে আসিয়াছে কিন্তু যাঁহার হাতে সেদিনকার এ অনুষ্ঠানের ভার তিনি প্রমাদ গণিলেন। অজস্র রক্ত পড়িতেছে। আহত ব্যক্তিকে বহন করিয়া এতদূর লইয়া যাওয়া এক মস্ত সমস্যা। এই অগণিত টাকা, আর এই মানুষ। কেমন করিয়া রক্ষা করা যায়? আহত বিপ্লববাদী দৃঢ়কণ্ঠে বলিল, “এক মুহূর্তও দেরী কোরো না। এত অর্থ সংগ্রহ করতে অনেক বেগ পেতে হবে-আমার মাথাটা কেটে নিয়ে যাও-শীঘ্ন কর।” যাহা করার কয় সেকেণ্ডেই ঠিক করিতে হইবে। অবিচলিত চিত্তে পুনঃপুনঃ সে বলিতে লাগিল, “ভাববার সময় নেই–টাকাগুলোই নিয়ে যাও, তবে চেহারা দেখলে চিনতে পারবে–মাথাটা কেটে ফ্যালো।” কিন্তু মীমাংসার ভার যাহার মাথায় ছিল, তিনি কাজ বন্ধ করিবার বাঁশী বাজাইলেন। সকলেই হাত গুটাইল। যে টাকার তোড়া ধরিয়াছিল, সে ছাড়িয়া উঠিল। আদেশ হইল–টাকা নয়, মানুষ–কাঁধে ভোঁসলা।[৪] ব্যাণ্ডেজ করিয়া নিঃশব্দে আহত বিপ্লববাদীকে বহন করিয়া সকলে চলিল। অর্থের কথা কেহ ভাবিল না। রাস্তায় নানা বাধাবিঘ্ন অতিক্রম করিয়া আসিয়া সুচিকিৎসার বন্দোবস্ত সুনিপুণ গোপনতার মধ্যে অনুষ্ঠিত হইল।[৫] যন্ত্রবৎ অর্থ সংগ্রহ করিতে যাহারা ছুটিয়াছিল তাহারা যন্ত্ৰবই একটি ইঙ্গিতে অর্থসংগ্রহ ত্যাগ করিয়া ছুটিল। বিপ্লববাদীদের দ্বারা অনুষ্ঠিত অনেক ডাকাতিতেই এমনি সুশৃঙ্খলা প্রকাশ পাইয়াছে।

প্রথম প্রথম জলপথে ও স্থলপথেই ডাকাতি হইত। ১৯১৫ সনে মোটরগাড়ীর সাহায্যে ডাকাতি আরম্ভ হয়।

নৌকাপথে ডাকাতির জন্য অনেক ব্যবস্থা করিতে হইত। নৌকার মাঝিমাল্লা সাজিয়া বিপ্লবীরাই নৌকা চালাইত। বিপ্লবীরাই আরোহী সাজিয়া বসিত, মাঝিদের পোষাক-পরিচ্ছদ বা তাহাদের কথ্য ভাষায় বাক্যালাপে কাহারও মনে কোন সন্দেহ হইত না। পরলোকগত ত্রৈলোক্য চক্রবর্তী কালীচরণ মাঝির যে অভিনয় করিয়া গিয়াছেন তাহা অপূর্ব ও অদ্ভুত। প্রবীণ বিপ্লবী আশুতোষ কাহিলী দলের নেতা মাখন সেনের নিকট বিরক্তি প্রকাশ করিয়া জানাইলেন যে, একজন নমঃশূদ্রকে মাঝি করিয়া আনা হইয়াছে। মাখনবাবুও ইহা শুনিয়া রাগান্বিত হইলেন, পরে অনুসন্ধান করিয়া জানিলেন যে কালীচরণ মাঝিই ত্রৈলোক্য চক্রবর্তী। ইনি অনেক ডাকাতি-নৌকায় মাঝিগিরি করিয়াছেন। একবার পুলিশ সন্দেহ করিয়া তাঁহাকে থানায় লইয়া গেল। তাহার কথাবার্তা চালচলন দেখিয়া দারোগাবাবুর কোন সন্দেহ রহিল না। তিনি মাঝিকে জিজ্ঞাসা করিলেন, তাঁহাকে মফঃস্বলে লইয়া যাইতে পারিবে কিনা। মাঝি বলিল, কেরায়াবাই রাজী হইমুনা ক্যান? মাঝির ইচ্ছা ছিল, এই সুযোগে দারোগাবাবুর কয়েকটা বন্দুক সরাইতে পারিবে। কিন্তু ঘটনাক্রমে দারোগাবাবুর মফঃস্বলে যাওয়া হইল না।

আর একটি ঘটনার উল্লেখ করি। বিপ্লবীরা মাঝি সাজিয়া নৌকায় অস্ত্রশস্ত্র লইয়া চলিয়াছে। চারিদিকে জলপুলিশের ছড়াছড়ি-নৌকা দেখিলেই থামাইয়া তল্লাস করে। বিপ্লবী বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের মাথায় এক ফন্দি আসিল। নিকটবর্তী হাট হইতে চৌদ্দ আনা দিয়া একটি বড় কাউঠা’ (কচ্ছপ) কিনিয়া সোজা পুলিশের গ্রীনবোটের নিকট গিয়া বড় দারোগাকে বলিল, “কর্তা এই কাউঠাটা পাইলাম চরে। ভাবলাম দারোগাবাবুরে দিয়া যাই।” দারোগাবাবু কচ্ছপ পাইয়া খুব খুসী, ঐ নৌকা তল্লাস করার কোন প্রশ্নই উঠিল না।

ঘটনার তারিখ ও কাহিনীর রোমাঞ্চকতা হিসাবে বাহা (বাঢ়রা) গ্রামে জলপথে ডাকাতিই সর্বপ্রথমে বিস্তারিতভাবে উল্লেখযোগ্য। প্রত্যক্ষদর্শীর বিবরণের উপর নির্ভর করিয়া শ্রীনলিনীকিশোর গুহ লিখিয়াছেন :

“১৯০৮ সালের ২রা জুন। ভোরের দিকে ঢাকা হইতে দুইটি নৌকা ছাড়ে। এই ডাকাতিতে ৩১ জন যুবক অংশগ্রহণ করে। পূর্বনির্দিষ্ট ব্যবস্থামত বিভিন্ন স্থান হইতে বিপ্লবীরা নৌকায় উঠে। নৌকার দাঁড়ি-মাঝি তাহারাই, বিপ্লবীদের সঙ্গে নূতন ধরনের দূরপাল্লার রাইফেল ছিল, আর ছিল পর্যাপ্ত কার্তুজ, তরবারি ও অন্যান্য অস্ত্রশস্ত্র। দুপুরের পর নৌকায় রান্না নামিল। তাহা আধসিদ্ধ চাউল বলা চলে। তাহাই যথাসাধ্য খাওয়া হইল। এই ডাকাতির প্ল্যান প্রস্তুত করেন ঢাকা অনুশীলন সমিতির নেতা পুলিনবিহারী দাস। বাড়ীর (যে সরকারবাড়ীতে ডাকাতি করা হইবে), রাস্তার, নদীর প্ল্যান ছিল, কোথায় কোথায় সশস্ত্র রক্ষী রাখা হইবে তাহাও আঁকিয়া দেওয়া হইয়াছিল। বাহাতে নৌকা পৌঁছিল রাত্রি আটটায়। নদীটি ছোট। উদ্দিষ্ট বাড়ীটি এই স্থান হইতে সিকি মাইল দূরে। প্ল্যান অনুযায়ী ঘাঁটিতে ঘাঁটিতে লোক রাখিয়া কে কোন্ কাজ কখন করিবে বুঝাইয়া দিয়া ও কাজ ভাগ করিয়া তাহারা উদ্দিষ্ট বাড়ীতে পৌঁছিল। বিপ্লবীগণ বাড়ীটি (বড় পাকা বাড়ী) ঘিরিয়া ফেলিয়াই অবিশ্রান্ত গুলিবর্ষণ করিতে লাগিল। রাত্রি ছিল অন্ধকার। বিপ্লবীদের সঙ্গে ছিল বোতলের মশাল। বাড়ীর মালিক অবস্থার গুরুত্ব বুঝিয়া লোহার সিন্ধুকের চাবি দিয়া দিল। অর্থসংগ্রহের জন্য যাহারা ভারপ্রাপ্ত, কেবলমাত্র তাহারাই অর্থ সংগ্রহ করিল। এদিকে বন্দুকের ভীতিজনক শব্দে–এত অধিক শব্দ গ্রামবাসী কোনদিন শোনে নাই–এবং ডাকাতির সংবাদে গ্রামের বহু মুসলমান ও হিন্দু আসিয়া পড়িল। সময়টা বৈশাখ মাস। বিপ্লবীরা অর্থ লইয়া যখন ফিরিতেছিল–ঝোঁপ-জঙ্গলের মধ্য দিয়াই রাস্তা–তখন গ্রামের লোক অথবা সরকারদেরই কোন লোক বিপ্লববাদীদের লক্ষ্য করিয়া কোঁচ্ বা টেটা (দূর হইতে মৎস্যশিকারের অস্ত্রবিশেষ) নিক্ষেপ করে। একজন বিপ্লবীর (রাজেন্দ্র দত্ত) বাহুতে টেটা বিদ্ধ হয়। বিপ্লবীরা অবিশ্রান্ত গুলিবর্ষণ করিতে থাকে। অন্ধকারে স্থানীয় লোকজনও যে কিছু আহত হয় তাহা উহাদের কথা ও চীৎকারে বুঝা যায়। সিকি মাইল পদব্রজে আসিয়া বিপ্লবীরা দুইটি নৌকায় উঠিয়া নৌকা চালাইয়া দিল। কিন্তু ইতিমধ্যে নদীর দুই পার ধরিয়াই লোক ছুটিয়াছে, আবার দৌড়াইয়া সম্মুখের গ্রামে গিয়া ডাকাত ধরিবার জন্য আমন্ত্রণ করিতেছে। জানাজানি হইয়া গিয়াছে, লোকের ডাকাত ধরিবার উৎসাহ বাড়িয়া গেল। কেবল স্থলপথে নয়, বহুসংখ্যক নৌকায় করিয়া লোক পশ্চাতে পশ্চাতে অনুসরণ করিতেছে। বিপ্লবীগণ অনুসরণের রকম দেখিয়া ঢাকার দিকে না গিয়া অন্যদিকে চলিল। ইতিমধ্যে সংবাদ পাইয়া সাভার থানার দারোগা আসিয়াছেন, কনষ্টেবলগণসহ বন্দুক হুঁড়িয়া নৌকার অনুসরণ করিতেছেন। তখন বিপ্লবীরা বড় নদী হইতে আর একটি ছোট নদীতে পড়িয়াছে। কিন্তু পুলিশবাহিনী, জনতা এবং নৌকা সমানেই অনুসরণ করিতেছে। পুলিশও গুলি ছুঁড়িতেছে, বিপ্লবীরাও নৌকা হইতে গুলিবর্ষণ করিতেছে। প্রথমটায় বিপ্লবীরা নৌকার ভিতরে থাকিয়াই গুলি ছুঁড়িতেছিল, এবার আশু দাশগুপ্ত ও শান্তি মুখোপাধ্যায়ে (পরে সন্ন্যাসী হয়), এবং শিশির গুহরায় নৌকার উপর উঠিয়াই গুলি ছুঁড়িতে থাকে। পুলিশ যথাসম্ভব রাইফেলের পাল্লার বাহিরে থাকিতে চেষ্টা করিতেছে। ডাকাতির দ্বিতীয় দিন, দুইজন বিপ্লবী নৌকার জল সেঁচিতেছিল (গুলি লাগিয়া নৌকায় ছিদ্র হইয়াছিল)। বিপ্লবীদের একজনের (গোপাল সেন) মাথায় পুলিশের গুলি আসিয়া লাগিল। গোপালের আঘাত বেশ মারাত্মক। গোপাল ‘বন্দে মাতরম্’ বলিতে বলিতে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করে। এই সময় নৌকা ধামরাই নামক গ্রামের দিকে আসিয়াছে। গোপালের এই মৃত্যু বিপ্লবীদের মধ্যে এক নূতন প্রেরণা আনিয়া দিল। তাহা সম্মুখসংগ্রামে মৃত্যুবরণের সংকল্প। গোপালের ‘বন্দে মাতরম্’ ধ্বনি, গোপালের মৃতদেহ সম্মুখে, বিপ্লবীরা সমবেত কণ্ঠে ধ্বনি তুলিল ‘বন্দে মাতরম্’। অমৃত হাজরা (পরবর্তীকালে রাজাবাজার বোমার কারখানার শশাঙ্ক) সম্মুখে দাঁড়াইয়া বাহু উত্থিত করিয়া অনাবৃত দেহে উচ্চকণ্ঠে বলিল, ‘বন্দে মাতরম্’। অমৃত হাজরার গৌরবর্ণ বলিষ্ঠ দেহ। এই সময়েই ধামরাই-এর ঐ জনতার একাংশ হইতে ধ্বনি আসিল ‘বন্দে মাতরম্’। গোপালের মৃত্যুর পর উভয়পক্ষ হইতেই গুলি চলিতেছিল। বিপ্লবীদের তরফ হইতে বেশী। কিন্তু জনতার মধ্য হইতে ‘বন্দে মাতরম্’ ধ্বনি উত্থিত হওয়ায় এই প্রথম বিপ্লবীরা বুঝিল, জনতার মধ্যে তাহাদের সমর্থন আছে। তাহারা তখনই গুলিবর্ষণ বন্ধ করিয়া দিল।”….

“পূর্বে বলিয়াছি, তখন দিবাভাগ। দূরে একটা ধোঁয়া দেখা দিল। তখন ধোয়ার দিকে দূরবীণ লাগাইয়া দেখা গেল একটা পুলিশের লঞ্চ। বিপ্লবীরা আরো দূরে সরিয়া যায়। কিন্তু পুলিশের লঞ্চটা এদিকে না আসিয়া বরাবর চলিয়া গেল। বিপ্লবীরা একবার স্থির করিল, গুণ টানিয়া নৌকা লইয়া যাইবে। সশস্ত্র রক্ষীরূপে দুইজন বিপ্লবী সঙ্গে চলিল-নৌকা তখন গুণে চলিয়াছে। ক্রমে রাত্রি হইল– দ্বিতীয় রাত্রি। তখনও পুলিশ এবং কতক লোক দূরে দূরে অনুসরণ করিতেছে, পুরাতন লোকের স্থানে নূতন লোক আসিতেছে। এমন সময় আরম্ভ হইল কালবৈশাখীর ঝড়, বিদ্যুৎ চমকাইতেছে, অন্ধকার রাত্রি, প্রবল ঝটিকাবেগ, –বিপ্লবীরা কিন্তু উহারই মধ্যে আশার আলো দেখিল। নৌকা তখন বড় নদী ধরিয়া যাইতেছিল। এই কালবৈশাখী ঝড়ের সুযোগ লইতেই হইবে। নৌকার মুখ পাল্টাইয়া ঝড়ের গতির দিকেই পাল টাঙানো হইল। পুলিশ জানিত বিপ্লবীরা পশ্চিমদিকেই যাইতেছে। এবার নৌকা চলিল উত্তর-পূর্ব দিকে। বিপ্লবীরা এতক্ষণ যে-পথ অতিক্রম করিয়া আসিতেছিল সেই পথেই ফিরিতে লাগিল। পুলিশ ইহা কল্পনা করে নাই। ঝড়ের দরুন নৌকার পালে অসম্ভব জোর ধরিল। চার ঘণ্টার রাস্তা মাত্র এক ঘণ্টায় আসিল। তাহার পর একটা বাকে পড়িয়া নৌকা একেবারে ভাওয়ালের জঙ্গলে আসিয়া গেল। পুলিশ ও অনুসরণকারীরা বুঝিতে পারিল না নৌকা কোথায় গেল। সেখানে নৌকা ত্যাগ করিয়া (তখনো রাত্রি আছে) বিপ্লবীগণ জঙ্গল ভেদ করিয়া দীর্ঘপথ অতিক্রম করিল। তখন ভোর হইয়াছে। তৃতীয় দিন। ভাগ ভাগ হইয়া অর্থ গেল একদিকে–অস্ত্র গেল একদিকে; অপর কর্মীরাও ভিন্ন ভিন্ন পথে চলিয়া গেল। প্রথম দিন অর্ধসিদ্ধ চাল খাওয়ার পর এই দুইদিন তাহাদের আর আহার জোটে নাই।”

এই বর্ণনার সঙ্গে একজন প্রত্যক্ষদর্শীর উক্তি যাহা শুনিয়াছি তাহার উল্লেখ করিব। কালবৈশাখীর ঝড় যখন আরম্ভ হইল তখন নৌকার একজন বঙ্কিমচন্দ্রের দেবী চৌধুরাণী উপন্যাসের উল্লেখ করিয়া বলিলেন, দেবীরাণী যেমন ঝড়ের গতির দিকেই পাল টাঙাইয়া ইংরেজের হাত হইতে রক্ষা পাইয়াছিলেন আমরাও সেইরূপ চেষ্টা করি। এই পরামর্শ সকলেরই মনঃপূত হইল। এইরূপে বঙ্কিমচন্দ্রের উপন্যাস বিপ্লবীদের প্রাণরক্ষায় সহায়তা করিয়াছিল।

নৌকার ভিতর বিপ্লবী দল পুলিশের গুলি হইতে অনেকটা নিরাপদ ছিল, কিন্তু নৌকায় ছিদ্র হওয়ায় জল তুলিয়া ফেলিবার জন্য দাঁড়াইতে হইত। সুতরাং সুতরাং পুলিশের গুলি লাগিবার সম্ভাবনাও বেশী ছিল। ইহা জানিয়াও গোপাল সেন স্বেচ্ছায় এই কার্যে ব্রতী হইয়াছিল এবং প্রকৃত বিপ্লবীর ন্যায় মৃত্যুকে বরণ করিয়াছিল।

নৌকার যে ভারী লোহার নোঙর ছিল তাহাতে বাঁধিয়া গোপাল সেনের মৃতদেহ নদীর জলে ফেলিয়া দেওয়া হইয়াছিল। যেখানে এই ঘটনা ঘটে তাহার সন্নিকটেই ১৯৭১ সনে বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামে নিহত শহীদগণের স্মৃতিস্তম্ভ নির্মিত হইয়াছে। কিন্তু গোপাল সেনের নামও আজ বাঙ্গালী জানে না। তাঁহার কোন নিদর্শনও নাই।

উপসংহারে উল্লেখযোগ্য যে, লুণ্ঠিত অর্থের পরিমাণ ও গহনার মূল্য ছিল কাহারও মতে তেইশ হাজার এবং কাহারও মতে পঁচিশ হাজার টাকা।

কালানুক্রমে কয়েকটি ডাকাতির উল্লেখ করিতেছি।

১৯০৮ : (১) ৩রা অগষ্ট নাটোরের সন্নিকটে একজন ডাক পিওনের নিকট হইতে কিছু টাকা লুণ্ঠিত হয়। এই প্রকার লুণ্ঠন অপেক্ষাকৃত সহজসাধ্য ও অনেকবারই এইরূপ হইয়াছে। এইসব ক্ষেত্রে প্রকৃত অপরাধীদের গ্রেপ্তার করা খুবই কঠিন, কিন্তু পুলিশ সন্দেহক্রমে অনেক নির্দোষকে চালান দিত। বর্তমান ক্ষেত্রে যে কয়জন গ্রেপ্তার হইয়াছিলেন তাঁহাদের একজন শ্ৰীকালীচরণ ঠাকুর খুব অসুস্থ হইলেও সিভিল সার্জেন ইহা গুরুতর মনে না করায় জামিনের চেষ্টা ব্যর্থ হয়, এবং তাহার মৃত্যু হইলে জেলের সঙ্গী তাহার পুত্রকেও শ্মশানে যাইবার অনুমতি দেওয়া হয় না। কিন্তু বিচারের ফলে জীবিত সকল আসামীই নির্দোষ বলিয়া মুক্তিলাভ করে।

(২) নদীয়া জিলার রাইতা গ্রামে অতিথরাম সাহার বাড়ী হইতে দুই হাজার টাকা লুণ্ঠিত হয়।

(৩) বরিশাল জিলার দেহারগাতি গ্রামেও ডাকাতিতে হাজার তিনেক টাকা লুষ্ঠিত হয়।

(৪) ফরিদপুর জিলার নারিয়া গ্রামে রাত্রি দশটার সময় অস্ত্রশস্ত্রে সুসজ্জিত ৩০। ৩৫ জন যুবক স্টীমার অফিস লুঠ করে, বাজারে আগুন লাগায় এবং দুই তিনটি ব্যবসায়ীর বাড়ী আক্রমণ করে।

ইহা ছাড়াও, যথাক্রমে ময়মনসিংহ জিলার আটকাণাড়া গ্রামে, হুগলী জিলার বিঘাটি ও মোরেহল গ্রামে, হাওড়া জিলার হরিণপাড়ায়, ঢাকা জিলার ভোজেশ্বরে এবং মালদহ জিলার গোপালপুরে ছোটখাট ডাকাতি অনুষ্ঠিত হয়। প্রথম দুইটিতে ডাকাতেরা পুলিশের ছদ্মবেশে বাড়ীতে প্রবেশ করে।

১৯০৯ : (১) নারায়ণগঞ্জের এক পাট-ব্যবসায়ীর তিনজন কর্মচারী সাতটি থলিয়াতে তেইশ হাজার টাকা লইয়া ট্রেনে যাইতেছিল। পথিমধ্যে রাজেন্দ্রপুর স্টেশনে সাত-আটজন যুবক ঐ কামরায় উঠিয়া একজন কর্মচারীকে গুলি করিয়া মারে এবং আর দুইজনকে ছোরা দিয়া আঘাত করে। ছয়টি থলিয়া জানালা দিয়া বাহিরে ফেলিয়া দেয় এবং নিজেরা পরের স্টেশনে নামিয়া পলায়ন করিতে সমর্থ হয়।

(২) ঢাকা জিলার রাজনগরে কয়েকজন সুদখোর ব্যবসায়ীর বাড়ী হইতে নগদ কুড়ি হাজার টাকা এবং আট হাজার টাকার অলঙ্কার প্রভৃতি লুঠ করে।

(৩) ত্রিপুরার অন্তর্গত মোহনপুর গ্রামের বাজারে বিশ-পঁচিশজন নৌকায় আসিয়া দোকানপাট লুঠ করিয়া করিয়া ষোল হাজার চারিশত টাকা লইয়া বিনা বাধায় প্রস্থান করে।

(৪) ঢাকা জিলার মালখানগর গ্রামের ডাকঘরে কয়েকজন ডাকাত অতিশয় নৃশংসতার পরিচয় দেয়। পোষ্টমাষ্টার ও একজন পিওনের গলা ক্ষুর দিয়া কাটে, কিন্তু সিন্দুক ভাঙ্গিতে না পারায় কিছুই লুঠ করিতে পারে নাই।

(৫) ডায়মণ্ডহারবারের নিকট নিতাড়া গ্রামে মুখোস-পরা, রিভলভার-হাতে একদল যুবক গৃহস্বামীকে ভয় দেখাইয়া সিন্দুকের চাবি আদায় করে। হাজার আড়াই টাকা লুঠ করিয়া যাইবার সময় বলিয়া যায় যে, টাকাটা ইংরেজকে তাড়াইবার জন্য ঋণস্বরূপ নিলাম। এই উপলক্ষে ধৃত আসামীদের মধ্যে ছিলেন পরবর্তীকালে প্রসিদ্ধ বিপ্লবী নেতা নরেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য (এম. এন. রায়)। সকল আসামীকেই খালাস দেওয়া হয়।

(৬) ফরিদপুর জিলার দরিয়াপুর গ্রামে পাঁচজন যুবক রিভলভার, হাতুড়ি, টর্চ প্রভৃতি লইয়া প্রায় তিন হাজার টাকা লুঠ করে।

ইহা ছাড়া হুগলী, খুলনা, যশোহর ও নদীয়া জিলায় চারিটি ছোটখাট ডাকাতি হয়। অতঃপর প্রতি বৎসর যে-সকল বড় বড় ডাকাতি সংঘটিত হয় তাহার তালিকা দিতেছি-বামে স্থানের নাম ও দক্ষিণে লুণ্ঠিত টাকার অঙ্ক।

১৯১০: স্থান — লুণ্ঠিত অর্থের পরিমাণ

(ক) দাদপুর (বাখরগঞ্জ) ৫০,০০০

(খ) নন্দনপুর (খুলনা) ১৩,০০০

(গ) কলারগাঁ (ফরিদপুর) ১২,৫০০

(ঘ) ধূলগ্রাম (যশোহর) ৬,০০০

(ঙ) মহেশা (যশোহর) ২,৫০০

(চ) মোহনগঞ্জ (বাখরগঞ্জ) ১,৫০০

(ছ) হলদিয়া হাট (ঢাকা) ১,৫০০

ক-নং ডাকাতিতে পাঁচজন আহত হয়। সরকারী রিপোর্ট অনুসারে সোনারং জাতীয় স্কুলেই পূর্বোক্ত অনেক ডাকাতির ব্যবস্থা করা হয়।

১৯১১: স্থান — লুষ্ঠিত অর্থের পরিমাণ

(ক) পণ্ডিতচর (ফরিদপুর) ৫,৫০০

(খ) গোয়াডিয়া (ঢাকা) (সুহইর) ৭,৫০০

(গ) সুয়াইকর (ময়মনসিংহ) ১,২০০

(ঘ) লক্ষ্মণকাটি (বাখরগঞ্জ) ১০,০০০

(ঙ) চারহাসা (ময়মনসিংহ) ২,০০০

(চ) সিনহেয়ার অথবা সুহইর (ঢাকা) ৭,৫০০

(ছ) কুলিয়াচর (ময়মনসিংহ) ৩,০০০

উপরোক্ত ডাকাতি ছাড়াও বিপ্লবী নেতা পুলিন দাস প্রতিষ্ঠিত সোনারং (ঢাকা) ন্যাশনাল স্কুলের শিক্ষক ও ছাত্রেরা একজন ডাকপিয়নকে মারপিট করিয়া তাহার ব্যাগ কড়িয়া নেয়। তাহাতে মাত্র ৫৫ টাকা ছিল। খ-নং ডাকাতিও সম্ভবতঃ তাহারাই করে। ছ-নং ডাকাতিতে ডাকঘর, পাটবিক্রয়কেন্দ্র, দুইজন সাহার গদি-সবই একসময়ে আক্রান্ত হয়।

১৯১২ : স্থান — লুণ্ঠিত অর্থের পরিমাণ

(ক) লাঙ্গলবাধ (ঢাকা) ১৬,০০০

(খ) বৈগুণতেওয়ারী (ঢাকা) ৩,০০০

(গ) আয়নাপুর (ঢাকা) ৭,০০০

(ঘ) বীরাঙ্গল (বাখরগঞ্জ) ৮,০০০

(ঙ) পানাম (ঢাকা) ২০,০০০

(চ) প্রতাবপুর (বাখরগঞ্জ) ৭,৫০০

শেষোক্ত দুইটি ডাকাতিতে ডাকাতদের সঙ্গে গৃহস্থের খণ্ডযুদ্ধ হয় এবং একটিতে একজন ও অপরটিতে কয়েকজন আহত হয়। ক-নং ডাকাতিতে ঢাকার অ্যাসিস্ট্যান্ট ম্যাজিষ্ট্রেটের পুত্র জড়িত ছিল। তাঁহার বাড়ীতে একটি বাক্সে পাওয়া গেল কার্তুজ, বারুদ, গুলি ও টোটা তৈরীর সরঞ্জাম এবং ঐ ডাকাতিতে লুণ্ঠিত অনেক জিনিস।

১৯১৩ : স্থান — লুষ্ঠিত অর্থের পরিমাণ

(ক) ভরাকর (ঢাকা) (অবসরপ্রাপ্ত পুলিশের দারোগার বাড়ী) ৩,৪০০

(খ) ধুলদিয়া (ময়মনসিংহ) ৯,০০০

(গ) কাওয়াকুরি (ফরিদপুর) ৫,০০০

(ঘ) কামরঙ্গির চর (ঢাকা) ২,২২৫

(ঙ) কেদারপুর (ময়মনসিংহ) ২০,০০০

(চ) সরারচর (ঐ) ৪,৫০০

(ছ) খারামপুর (ত্রিপুরা) ৬,০০০

(জ) পশ্চিমসিং (ঐ) ৩,০০০

খ-নং ডাকাতির ঘটনায় চীৎকার শুনিয়া গ্রামস্থ প্রতিবেশীরা ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়। ডাকাতের দল বোমা ও রিভলভারের গুলি ছোঁড়ে। গ্রামবাসীদের একজন ঐখানেই মারা যায় এবং আরও তিনজন গুরুতররূপে আহত হয়। ঙ-নং ডাকাতি হয় ধনী জমিদার আশুতোষ সাহার বাড়ীতে। পঁচিশজন যুবক বাড়ীতে ঢুকিয়া সিন্দুকের চাবি চায়, প্রাণের ভয়ে জমিদার চাবি দেন। কিন্তু ফিরিবার সময় চৌকিদার ও পাঁচ-ছয়জন গ্রামবাসীর সহিত ডাকাতদলের সংঘর্ষ হয়। চৌকিদার নিহত হয় ও জনপাঁচেক গ্রামবাসী আহত হয়। গ-নং ডাকাতিতে ১৯১২ সনের ক নং ডাকাতির ন্যায় আক্রমণকারী যুবকেরা ‘হর হর বম্ ব’ এই শব্দ করে।

১৯১৪ : স্থান — লুষ্ঠিত অর্থের পরিমাণ

(ক) গোঁসাইপুর (ত্রিপুরা) ৫,৫০০

(খ) বেতাকি (ময়মনসিংহ) ১৮,০০০

(গ) জাজপুর (উড়িষ্যা) ৬,৫০০

(ঘ) মাসুরাবাদ (২৪ পরগণা) ২,০০০

(ঙ) উক্রাশাল (ময়মনসিংহ) ৫,৫০০

(চ) রাধানগর (ত্রিপুরা) ৫,০০০

(ছ) দারাকপুর (ময়মনসিংহ) ২৩,০০০

ঘ-নং ডাকাতিতে বিপ্লবীরা সর্বপ্রথম ‘মসার’ (Mauser) পিস্তল ব্যবহার করে। চ ও ছ-নং ডাকাতিতে বোমা ও পিস্তল উভয়ই ব্যবহৃত হয়।

১৯১৫: স্থান — লুণ্ঠিত অর্থের পরিমাণ

(ক) বাগমারি (ত্রিপুরা) ৪,০০০

(খ) কুরুল (রংপুর) ৫০,০০০

(গ) গার্ডেনরীচ (কলিকাতা) ১৮,০০০

(ঘ) ধারাইল (নাটোর, রাজশাহী) ২৫,০০০

(ঙ) বেলেঘাটা (কলিকাতা) ২০,০০০

(চ) আড়িয়াদহ (২৪-পরগণা) ৫০০

(ছ) বলদা (ত্রিপুরা) ৪,০০০

(জ) প্রাগপুর (নদীয়া) ৩,০০০

(ঝ) আওরাইল (কুমিল্লা) ৪,৫০০

(ঞ) গাজিপুর (বাখরগঞ্জ) ১৫,০০০

(ট) আগরপাড়া (২৪-পরগণা) ১,০০০

(ঠ) হরিপুর (ত্রিপুরা) ১৮,০০০

(ড) চন্দ্রকোণা (ময়মনসিংহ) ১১,০০০

(ঢ) শিবপুর (নদীয়া) ২০,৭০০

(ণ) কলিকাতা (কর্নওয়ালিস স্ট্রীট, দোকান) ৮০০

(ত) কলিকাতা (কর্পোরেশন স্ট্রীট, দোকান) ২৫,০০০

(থ) কলিকাতা (শেঠবাগান, গৃহস্থবাড়ী) ৬,৫০০

(দ) রসুলপুর (ময়মনসিংহ) ৪৬০

(ধ) কারাতোলা (ত্রিপুরা) ১৫,০০০

গ-নং ডাকাতি বেশ একটু নূতন ধরনের। ১২ই ফেব্রুয়ারি কলিকাতার বার্ড কোম্পানীর একজন সরকার ও দুইজন দরোয়ান একখানি ঠিকা ঘোড়ার গাড়ী করিয়া কর্মচারীদের মাহিনা দিবার জন্য দশটি পাটের থলিতে ১৮,৪০০ টাকা লইয়া যাইতেছিল। গার্ডেনরীচ ও সার্কুলার রোডের সংযোগস্থলে একখানা ট্যাক্সি ঐ গাড়ীর পথরোধ করিল। ট্যাক্সি হইতে চারিজন যুবক নামিল আর ছয়জন পূর্ব হইতেই সেখানে উপস্থিত ছিল। তাহারা সরকার ও দরোয়ানদের নামাইয়া দিয়া টাকার থলিগুলি ট্যাক্সিতে উঠাইয়া উধাও হইল। দশটা থলিতে দশ টাকার নোট, টাকা ও খুচরা সব মিলাইয়া প্রায় ১৭,০০০ টাকা ছিল। বারুইপুরের কাছে গিয়া দুইটা তোরঙ্গ কিনিয়া তাহাতে টাকাপয়সা ভরিল। বারুইপুর হইতে প্রথমে ঘোড়ার গাড়ীতে, পরে নৌকায় পেচুয়াখালিতে, সেখানে নৌকা বদল করিয়া ১৫ই দ্বিপ্রহরে টাকী উপস্থিত হইল। সেখানে আরও দুইটা তোরঙ্গ কিনিয়া টাকাকড়ি চারিটি তোরঙ্গে ভাগ করিয়া গরুর গাড়ীতে রেলস্টেশন, রেলগাড়ীতে শ্যামবাজার হইয়া, রাত্রি আটটা পাতিপুকুর পৌঁছিয়া তোরঙ্গগুলি পূর্বনির্দিষ্ট এক ব্যক্তির কাছে পাঠাইয়া দেওয়া হইল। পাতিপুকুর হইতে দুইখানা ঘোড়ার গাড়ী ভাড়া করিয়া সকলে ২০নং ফকিরচাঁদ মিত্র স্ত্রীটে হাজির হইল। পুলিশ সন্ধান করিয়া এই বাড়ীতে হানা দিয়া মসার পিস্তলসমেত একজনকে গ্রেপ্তার করে। ১৮ই ফেব্রুআরি পরবর্তীকালের প্রসিদ্ধ নেতা নরেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্যকে গ্রেপ্তার করা হয় ও ২২শে ফেব্রুআরি আরও কয়েকজন গ্রেপ্তার হন। নরেন্দ্রনাথ জামিনে ছাড়া পাইয়া পলায়ন করেন। কিন্তু প্রমাণাভাবে অপর সকল আসামীকেও ছাড়িয়া দিতে হইল।

ঙ-নং ডাকাতিও ট্যাক্সির সাহায্যে হয়। ফিরিবার সময় গাড়ীর চালক গোলমাল করিলে তাহাকে হত্যা করিয়া পথে ফেলিয়া দিয়া গাড়ী অদৃশ্য হয়।

চ-নং ডাকাতিতে গৃহস্বামীকে লাথি মারিয়া ভূপাতিত করা হয় এবং তাহার স্ত্রীকে দড়ি দিয়া বাঁধিয়া রাখা হয়।

ছ-নং ডাকাতিতেও বাড়ীর লোকদের মারধর করিয়া টাকা দিতে বাধ্য করা হয়।

জ-নং ডাকাতি ও বাহা ডাকাতির মধ্যে অনেক সাদৃশ্য আছে। উভয় ক্ষেত্রেই পুলিশ ও গ্রামবাসীরা ডাকাতের নৌকা অনুসরণ করে। এক্ষেত্রেও প্রবল ঝড়বৃষ্টি আরম্ভ হওয়ায় পালের হাওয়ায় নৌকা তীরবেগে ছোটে এবং ডাকাতেরা পলাইতে সমর্থ হয়। এক্ষেত্রেও বিপ্লবী সুশীল সেন যখন নৌকায় উঠে সেই সময় এক সঙ্গীর হাতের বন্দুক মাটিতে পড়িয়া যায় এবং একটা বুলেট সুশীলকে আঘাত করে। সুশীল সঙ্গীদিগকে বলিল, “বৃথা একটা মৃতদেহ বয়ে নিয়ে সকলকে বিপন্ন কোরো না-আমার মাথাটা কেটে মাথা ও দেহটা জলে ফেলে দাও–তা’ সনাক্ত করা সম্ভব হবে না, সকলেই পুলিশের হাত থেকে বাঁচবে।” তাহাই করা হইল। বাহা ডাকাতির গণেশ সেনের ন্যায় সুশীল সেনের দেহও নদীর জলে ভাসিয়া গেল। বাঙ্গালীর স্মৃতি হইতেও আজ তাহারা ভাসিয়া গিয়াছে!

ঝ-নং ডাকাতিতেও ডাকাতের দল ‘হর হর, বম্ ব’ বলিতে বলিতে গৃহস্থের বাড়ী আক্রমণ করে।

ট-নং ডাকাতিতে ডাকাতরা ধরা পড়ে এবং তাহাদের বিপক্ষে যাহারা সাক্ষ্য দেয় তাহাদের মধ্যে একজনের পিতাকে বিপ্লবীরা খুন করে। এই ডাকাতিতে পরবর্তীকালের প্রসিদ্ধ নেতা বিপিনবিহারী গাঙ্গুলী হাতেনাতে ধরা পড়েন এবং তাঁহার পাঁচবছর সশ্রম কারাদণ্ড হয়। তাঁহার কোলের শিশুটি এবং একজন অনুসরণকারী পুলিশও আহত হয়।

ঠ-নং ডাকাতিতে বাড়ীর লোকেরা বাধা দেওয়ায় দরোয়ান হত ও কয়েকজন আমলা-কর্মচারী আহত হয়। গৃহস্বামীকে আষ্টেপৃষ্ঠে বাঁধিয়া রাখা হয়, এবং টাকা পয়সার সঙ্গে একটি দূরপাল্লার রাইফেল এবং একটি রিভলভারও ডাকাতেরা লইয়া যায়।

ড-নং ডাকাতিতে একটি বাজারের অনেকগুলি দোকান লুঠ হয়। প্রথম দোকানে একটি খণ্ডযুদ্ধের ফলে কয়েকজন আহত হয়, প্রতিরোধকারীরা নিরস্ত হয়। এখানেও ডাকাতেরা একটা বন্দুক ও বেশকিছু কার্তুজ সংগ্রহ করে।

ঢ-নং ডাকাতিতেও সামরিক বেশ পরিহিত এবং মারাত্মক অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত কুড়ি-পঁচিশ জন ডাকাতের সঙ্গে গৃহস্বামী ও তাঁহার লোকজনের এবং গ্রামবাসীদের তুমুল সংঘর্ষ হয় এবং চারিজন গ্রামবাসী নিহত ও অনেকে আহত হয়। এই ডাকাতির অপরাধে তেরজন আসামীর বিচার হয়। একজন রাজসাক্ষী হইয়া মুক্তিলাভ করে, একজনের দশবছর দীপান্তর হয়, এবং আটজনের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয়। বাকী তিনজন মুক্তি পায়। এতগুলি সাহসী বিপ্লবী বিশ বছরের, অর্থাৎ বাকী জীবনের জন্য হিংসাত্মক বিপ্লবের ক্ষেত্র হইতে অপসারিত হওয়ায় ইহার গতি যে ব্যাহত হয়, পরবর্তী ইতিহাসে তাহার আভাস পাওয়া যায়। এ সম্বন্ধে পরে আলোচনা করা যাইবে।

দ-নং ডাকাতিতে একজন লোক খুন হয়।

ধ-নং ডাকাতিতে ডাকাতরা গৃহস্বামী ও আর একজনকে হত্যা করে এবং গৃহস্বামীর দুই পুত্রকে আষ্টেপৃষ্ঠে বাঁধিয়া রখে।

১৯১৬ : স্থান — লুষ্ঠিত অর্থের পরিমাণ

(ক) মুস্তাফাপুর (ফরিদপুর) ৩,৫০০

(খ) সুলতানপুর (ময়মনসিংহ) ৬৯

(গ) শালকিয়া (হাওড়া) ৮,০০০

(ঘ) দফারপুর (হাওড়া) ২,০০০

(ঙ) গাণ্ডোরা (ত্রিপুরা) ১৪,০০০

(চ) নাথগড় (ত্রিপুরা) ১৭,৫০০

(ছ) ধনকাটি (ফরিদপুর) ৪৩,০০০

(জ) হাওড়া (গোপীনাথ রায় লেন) ৯,৮৯১

(ঝ) সহর পদুয়া (ত্রিপুরা) ৩,৩৭০

(ঞ) ললিতাসর (ত্রিপুরা) ১,১০০

(ট) রামদিয়ানালী (ঢাকা) ?

(ঠ) শহিল দেও (ময়মনসিংহ) ৮০,০০০

(ড) পরাইল (ঐ) ৩,০০০

খ-নং ডাকাতিতে প্রৌঢ় গৃহস্বামীকে বুলেটের আঘাতে হত্যা করা হয়।

গ-নং ডাকাতিতে ক্যাশবাক্সের গায়ে আঙ্গুলের ছাপ দেখিয়া আসামী ধৃত হয়। এ সময়ে সন্দেহভাজন ব্যক্তির আঙ্গুলের ছাপ নিয়া তাহার ফটো রাখিবার রীতি প্রবর্তিত হইয়াছিল।

ঙ-নং ডাকাতিতে হাতুড়ি দিয়া লোহার সিন্দুক ভাঙ্গা হয়। ডাকাতদের মধ্যে গৃহস্বামীর জামাতাও ছিল এবং তাহাদের সঙ্গে ‘মসার’ পিস্তল ছিল।

জ-নং ডাকাতিতে বাড়ীর মালিক ডাকাতির পর একখানি সুদীর্ঘ চিঠি পান। চিঠিখানি বাংলায় লেখা। শিরোদেশে ‘বন্দে মাতরম্‌’ ও ‘যুগান্তর দলের প্রতীক এবং তাহার পরেই ঠিকানা-সংযুক্ত ‘স্বাধীন ভারতের বঙ্গদেশ শাখা (Bengal Branch of Independent Kingdom of United India) i fofos vhag :

“আমাদের কলিকাতা রাজস্ব বিভাগের ছয়জন অবৈতনিক কর্মচারী আমাদের মহান উদ্দেশ্য সাধনের জন্য আপনার নিকট হইতে ৯,৮৯১ টাকা এক আনা পাঁচ পাই ধার লইয়া তাহা উপরে লিখিত অফিসে জমা দিয়াছে। আমাদের খাতায় শতকরা পাঁচ টাকা হার সুদে আপনার নিকট হইতে ঋণ বলিয়া ঐ টাকা লিখিত হইয়াছে। ভগবানের কৃপায় আমাদের উদ্দেশ্য সিদ্ধ হইলে সমস্ত টাকা সুদ সমেত ফিরাইয়া দিব। আমাদের নির্দেশ অনুসারে আপনার নিকট যে বন্ধকী গহনা ছিল তাহাতে হাত দেওয়া হয় নাই। কিন্তু টাকার মধ্যে একটি লকেট ও একটি মাদুলি পাইয়াছি। গুপ্তচর সংবাদ দিল যে, ইহাও বন্ধকী মাল। এক পক্ষের মধ্যেই এই দুইটি দ্রব্য আপনাকে ফেরৎ দেওয়া হইবে এই মর্মে ১৩ই আষাঢ় রাত্রে আমাদের সমিতির এক অধিবেশনে একটি প্রস্তাব গৃহীত হইয়াছে।

যদি আপনি কোন রকমে আমাদের বিরোধিতা করেন বা পুলিশে খবর দেন তাহা হইলে আপনার অগাধ ধন-ঐশ্বর্য ভোগ করার জন্য আমরা একজনকেও জীবিত রাখিব না।

আপনার মত লোক সহজেই বুঝিতে পারেন যে, বিদেশীর হাত হইতে দেশ উদ্ধার করিবার জন্য স্বার্থত্যাগ করিতে হইবে। যদি আপনাদের মত লোক নিয়মমত আমাদের চাঁদা দেন তবে আমাদের ডাকাতি করিবার দরকার হইবে না।

জাপানের ধনী ব্যক্তিরা দেশের শক্তি ও সমৃদ্ধি বৃদ্ধির জন্য অকাতরে অর্থ ব্যয় করিয়াছেন। ভগবানের নিকট প্রার্থনা করি, আপনারাও তাহাদের দৃষ্টান্ত অনুসরণ করিয়া আমাদের এই মহৎ কার্যের জন্য অনুরূপ সাহায্য করিবেন।

(স্বাক্ষর) জে. বলবন্ত
সংযুক্ত স্বাধীন
ভারতের বঙ্গদেশ শাখার
অর্থ সচিব

কলিকাতা
১৪ই আষাঢ় ১৩২৩ বঙ্গাব্দ

এইরূপ চিঠি-লেখার আরও কয়েকটি দৃষ্টান্ত পাওয়া যায়।

ঞ-নং ডাকতিতেও গ্রামের লোক পলায়মান ডাকাতদের পশ্চাতে ধাবমান হয়, এবং সংঘর্ষের ফলে রিভলবারের গুলিতে পাঁচজন গ্রামবাসী নিহত এবং পাঁচজন আহত হয়। গ্রামবাসীদের লাঠির আঘাতে একজন ডাকাতের মৃত্যু হয়। কিন্তু ডাকাতরা বলে, সর্পাঘাতেই তাহার মৃত্যু হইয়াছিল। মৃতদেহ জঙ্গলের মধ্যে ফেলিয়া দিয়া ডাকাতেরা পলায়ন করে।

ট-নং ডাকাতি সম্বন্ধে বিশেষ দ্রষ্টব্য যে, অনুশীলন সমিতি-পরিচালিত ঈশান বিদ্যালয়ের অল্পবয়স্ক পাঁচজন ছাত্রই ইহার নেতা, এবং ইহা সম্পূর্ণ ব্যর্থ হইয়াছিল। বাড়ীর মালিকের এক ভ্রাতুস্পুত্র ডাকাতের দলে ছিল–সকলেই ধরা পড়ে এবং প্রত্যেকের সাত বৎসর সশ্রম কারাদণ্ড হয়। লুষ্ঠিত ৫৬৫ টাকা পুলিশের হাতে পড়ে।

ঠ-নং ডাকাতি প্রকৃতপক্ষে দুইটি স্বতন্ত্র ঘটনা। একদল একটি স্ত্রীলোকের বাড়ী হইতে তাহার সমস্ত গহনা সংগ্রহ করে। দ্বিতীয় দল যে-বাড়ীতে যায় তাহার মালিক ৭০ বৎসরের বৃদ্ধ মুসলমান ডাকাতদের বাধা দেয় এবং কয়েকজন গ্রামবাসীও তাহাকে সাহায্য করিতে অগ্রসর হয়। ডাকাতদের রিভলভারের গুলিতে বাড়ীর মালিক নিহত ও পাঁচজন গ্রামবাসী আহত হয়। লুণ্ঠিত অর্থের পরিমাণ ৮০ হাজার টাকা। মনে হয়, অপর কোন একটিমাত্র ডাকাতিতে এত টাকা পাওয়া যায় নাই।

ড-নং ডাকাতিতে ‘মসার’ পিস্তলের গুলিতে গৃহস্বামীর পুত্র নিহত হয়।

১৯১৭: স্থান – লুণ্ঠিত অর্থের পরিমাণ

(ক) কলিকাতা (কাঁটাপুকুর) দোকানের সরকারের ২,০০০ নিকট হইতে রাস্তায় লুণ্ঠিত

(খ) পাইকারচর (ঢাকা) ১,২০০

(গ) জামনগর (রাজসাহী) ২৬,০০০

(ঘ) কলিকাতা (আর্মেনিয়ান স্ট্রীট-অলংকারের দোকান) ৫,৫০০

(ঙ) রাখাজ (রংপুর) ৩১,০০০

(চ) আবদুল্লাপুর (ঢাকা) ২৫,০০০

(ছ) মাঝিয়ারা (ত্রিপুরা) ৩৩,০০০

গ-নং ডাকাতিতে টাকার সঙ্গে একটি দোনলা গাদাবন্দুক ও ১৭০টি কার্তুজও অপহৃত হয়।

ঙ-নং ডাকাতিতে গৃহস্বামী টাকার সন্ধান দিতে অস্বীকৃত হইলে তাহার পুত্রকে গুলি করিয়া হত্যা করা এবং আরও অনেকপ্রকার নির্যাতন করা হয়। এটি একটি চরম নিষ্ঠুরতার দৃষ্টান্ত।

ছ-নং ডাকাতিতে একটি দোনলা গাদাবন্দুকও অপহৃত হয়।

(ঘ) সরকারী কর্মচারী-নিধন ও গুপ্তহত্যা

১৯০৮ : (১) দারোগা নন্দলাল বন্দ্যোপাধ্যায় (৯ই নভেম্বর)। ইনিই প্রফুল্ল চাকীকে গ্রেপ্তার করিয়াছিলেন।

(২) হাওড়ার কেশব দেবিঘাটি ডাকাতি সম্বন্ধে পুলিশে খবর দেয় এই সন্দেহে ইহাকে খুন করিয়া মাটিতে পুঁতিয়া রাখা হয়।

(৩-৪) পুলিশকে গুপ্ত সংবাদ সরবরাহ করার সন্দেহে ঢাকা রমনায় অন্নদাপ্রসাদ ঘোষ এবং ঢাকা জিলার রায়না অঞ্চলের অধিবাসী সুকুমার চক্রবর্তীকে খুন করা হয় (নভেম্বর)।

১৯০৯ : (১) সরকারী উকিল আশু বিশ্বাস আলিপুর বোমার মামলায় গুরুত্বপূর্ণ অংশগ্রহণ করেন। অনেকের বিশ্বাস ছিল, তিনি সরকারের পক্ষে মিথ্যা মামলা সাজাতে এবং আসামীর সাজা ঘটাবার কাজে অদ্বিতীয়”। চারুচন্দ্র বসু নামে একটি যুবক আলিপুর পুলিশকোর্টে রিভলভার দিয়া তাঁহাকে হত্যা করেন (১০ই ফেব্রুআরি)।

চারু জন্মাবধি বিকলাঙ্গ, ডান হাতের তালুটি ছিল না। বাঁ হাতেই গুলি ছুঁড়িয়াছিলেন। ১৯শে মার্চ তাহার ফাঁসি হয়।

(২) ঢাকার বীরেন্দ্র গাঙ্গুলীকে গুপ্তচর সন্দেহে হত্যা করা হয়।

(৩) মামলায় মিথ্যা সাক্ষ্য দান এবং পুলিশকে গোপন সংবাদ সরবরাহ করার জন্য গণেশ (গবেশ) নামে এক ব্যক্তির প্রতি সন্দেহ হয়–কিন্তু সম্ভবতঃ ভুল করিয়া তাহার কনিষ্ঠ ভ্রাতা ষোল বছর বয়সের প্রিয়নাথ চট্টোপাধ্যায়কে ফরিদপুর জিলার ফতেজঙ্গপুর গ্রামে তাহার বাসায় হত্যা করা হয়। বন্দুক-হাতে যে-কয়জন এই বালকের মাতার সম্মুখেই তাহাকে হত্যা করে, তাহারা ঢাকা অনুশীলন সমিতির সদস্য।

১৯১০ : (১) পুলিশের ইন্সপেক্টর সামউল-আলম্ আলিপুর বোমার মামলায় খুব কার্যতৎপরতা দেখাইয়া ডেপুটি সুপারিন্টেণ্ডেট পদে উন্নীত হন। এই বোমার মামলার আসামীরা ইহাকে খুব ভালভাবেই চিনিতেন। তাহাকে শুনাইয়া নিম্নলিখিত ছড়াটি গাহিতেন :

“তুমি সরকারের শ্যাম
আমাদের শূল
(কবে) তোমার ভিটেয় চরবে ঘুঘু
দেখবে চোখে সরষে ফুল।”

হাইকোর্টে যখন ঐ মামলায় আপীল চলিতেছে, তখন একদিন তিনি সিঁড়ি দিয়া নামিতেছেন, পশ্চাতে তাঁহার অস্ত্রধারী দেহরক্ষী। অকস্মাৎ বীরেন্দ্রনাথ দত্তগুপ্ত নামে একটি অল্পবয়স্ক যুবক রিভলভারের গুলিতে তাঁকে খুন করেন। খুন করিয়াই বীরেন ছুটিয়া পলাইতেছিলেন, কিন্তু হেষ্টিংস্ স্ট্রীটে (বর্তমান কিরণশঙ্কর রায় রোড) একজন অশ্বারোহী পুলিশ তাঁহাকে গ্রেপ্তার করে (২৪শে জানুআরি)। বিচারে তিনি আত্মপক্ষ সমর্থন করেন নাই এবং হাসিমুখে ফাঁসিতে গিয়াছিলেন।

(১) গুপ্তচর সন্দেহে রাম দাসকে ঢাকায় গুলি করিয়া হত্যা করা হয় (১৯শে জুলাই)।

১৯১১ : (১) গোয়েন্দা বিভাগের কর্মচারী শ্ৰীশচন্দ্র চক্রবর্তী কলিকাতায় নিহত হন।

(২-৫) ঢাকা জিলার রাউতভোগ গ্রামের মনোমোহন দে এবং ঢাকায় দফাদার রসুল দেওয়ান, আমেরি দেওয়ান ও কালীবিনোদ চক্রবর্তী প্রভৃতি পুলিশের পক্ষের সাক্ষীরা পাইকারী হারে নিহত হয়।

(৬-৭) ময়মনসিংহে গোয়েন্দা বিভাগের সাব-ইন্সপেক্টর রাজকুমার রায় (১৯শে জুন) এবং বরিশালে পুলিশ ইন্সপেক্টর মনোমোহন ঘোষকেও (১১ই ডিসেম্বর) হত্যা করা হয়।

১৯১২ : (১-৩) ঢাকায় গুপ্তচর সুকুমার চক্রবর্তী (১১ই ফেব্রুআরি), ফেণীতে দলের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা করায় সারদাচরণ চক্রবর্তী (জুন) এবং ঢাকায় গোয়েন্দা কনষ্টেবল রতিলাল রায় (২৪শে সেপ্টেম্বর) এই তিনজন নিহত হন।

১৯১৩ : (১-৫) ময়মনসিংহে পুলিশের গুপ্তচর বীরেন্দ্রনাথ বিশ্বাস (১৯শে ডিসেম্বর), দলের বিপক্ষে সাক্ষ্যদাতা ঢাকার দেবেন্দ্রকুমার ঘোষ (১৪ই জানুআরি), পুলিশকে গোপনে দলের বন্ধুদের সংবাদ-সরবরাহকারী বসন্তকুমার ভট্টাচার্য্য (১৬ই নভেম্বর) এবং কলিকাতা গুপ্ত পুলিশ বিভাগের কনষ্টেবল হরিপদ দে (২৯শে সেপ্টেম্বর) নিহত হন। সি. আই. ডি. ইন্সপেক্টর বঙ্কিমচন্দ্র চৌধুরী নিজের বাড়ীতে বিপ্লবীদের বোমার আঘাতে নিহত হন (৩০শে সেপ্টেম্বর)।

১৯১৪ : (১-২) ডিটেকটিভ পুলিশের দক্ষ কর্মচারী নৃপেন্দ্রনাথ ঘোষ (১৯শে জানুঅরি) কলিকাতায় এবং গুপ্তচর রাম দাস ঢাকায় নিহত হন (১৭ই জুলাই)।

১৯১৫: (১) বিখ্যাত বিপ্লবী নেতা যতীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় কলিকাতায় এক বাড়ীতে লুকাইয়া আছেন, এমন সময় নীরদ হালদার প্রবেশ করিয়া বলিল, “আরে যতীন তুমি এখানে”? সঙ্গে সঙ্গে চিত্তপ্রিয় রায়চৌধুরী গুলি করিল (২৪শে ফেব্রুআরি)। আহত নীরদ হাসপাতালে মৃত্যুর আগে যতীন্দ্রের সংবাদ দিয়া গেল।

(২) রংপুরের অতিরিক্ত পুলিশ সুপারিন্টেণ্ডেণ্ট নন্দকুমার বসু নিজের বাড়ীতে গুলিতে আহত হন, তাঁহার একজন দেহরক্ষীর মৃত্যু হয় (১৮ই ফেব্রুআরি)।

(৩) কলিকাতায় হেদুয়ার নিকটে দক্ষ সি. আই. ডি. (C. I. D.) ইন্সপেক্টর সুরেশ মুখোপাধ্যায় ও তাঁহার দেহরক্ষী নিহত হন।

(৪) কুমিল্লা জিলা স্কুলের প্রধান শিক্ষক শরকুমার বসু অতিরিক্ত রাজভক্ত ছিলেন এবং গোয়েন্দাগিরি করিয়া বিপ্লবী ছাত্রদের নাম গোপনে সরকারকে পাঠাইতেন। বাড়ী ফিরিবার পথে তিনজন লোক সাইকেলে আসিয়া তাঁহাকে গুলি করিয়া হত্যা করে (৩রা মার্চ)।

(৫) পুলিশের ডেপুটি সুপারিন্টেন্টে ঝানু কর্মচারী যতীন্দ্রমোহন ঘোষ ময়মনসিংহে তদন্তে গিয়া সন্ধ্যার সময় শিশুপুত্রকে কোলে করিয়া সদর দরজার নিকট বসিয়াছিলেন, পার্শ্বে তাহার স্ত্রী। তিনজন লোক আসিয়া স্ত্রীকে জরুরী কথাবার্তার অজুহাতে ভিতরে যাইতে বলিল। স্ত্রী চলিয়া যাইবামাত্র গুলির আঘাতে যতীন্দ্রমোহনের তৎক্ষণাৎ মৃত্যু হইল (৯ই অক্টোবর), আহত শিশুটিরও কয়েকদিন পরে মৃত্যু হয়।

(৬) সি. আই. ডি. বিভাগের পুলিশ কর্মচারী গিরীন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় কলিকাতায় এক বন্ধু পুলিশ কর্মচারীর বাড়ীতে পাশা খেলিতেছিলেন। আততায়ীর গুলিতে তাঁহার তৎক্ষণাৎ মৃত্যু হইল। পূর্বে একবার তিনি বোমার আঘাত হইতে কোনমতে রক্ষা পাইয়াছিলেন (২১শে অক্টোবর)।

(৭) বিপ্লীদের আড্ডা–এই সন্দেহে কলিকাতার একটি বাড়ীতে কল্লাপনাথ পাঠক নামে এক কনষ্টেবলকে গোপনে কে আসে কে যায় দেখার জন্য নিযুক্ত করা হয়। ৩০শে নভেম্বর তিনজন বিপ্লবী তাহাকে এবং তাহার পশ্চাতে আর একটি লোককে গুলি করে। দুইজনেরই মৃত্যু হয়, কিন্তু দ্বিতীয় ব্যক্তিটি এক হোষ্টেলের নিরপরাধ পাঁচক।

(৮) ময়মনসিংহের বাজিতপুরে দলের বিপ্লবী ধীরেন্দ্রনাথ বিশ্বাসকে পুলিশের গুপ্তচর সন্দেহে হত্যা করা হয় (১৯শে ডিসেম্বর)।

(৯) ডাকাতির আসামী গ্রেপ্তারে পুলিশের সাহায্যকারী মুরারী মিত্রকে হত্যা করা হয় (২৫শে আগষ্ট)।

১৯১৬ : (১-৩) পুলিশের গুপ্তচর সন্দেহে নোয়াখালিতে স্কুলের ছাত্র ২১ বৎসর বয়স্ক শ্রীশচন্দ্র রায় (১০ই নভেম্বর), ময়মনসিংহের শশী চক্রবর্তী (১৯শে জানুআরি ও মালদহ জিলা স্কুলের হেডমাষ্টার নবীনচন্দ্র বসু (২৮শে জানুআরি) নিহত হন।

(৪) সুদক্ষ সি.আই.ডি. কর্মচারী মধুসূদন ভট্টাচার্য কলেজ স্ট্রীচ-কলুটোলা স্ট্রীটের সংযোগস্থলে ট্রাম হইতে নামামাত্র বিপরীতদিকে মেডিকেল কলেজের প্রাচীরের নিকট হইতে ছুটিয়া আসিয়া দুইজন যুবক তাহাকে গুলি করে এবং তৎক্ষণাৎ তাহার মৃত্যু হয়। যুবক দুইটি প্রতাপ চ্যাটার্জি স্ট্রীটে প্রবেশ করে। একদল লোক তাহাদের অনুসরণ করিলেও মাঝে মাঝে গুলিবর্ষণের ফলে একটু দূরে থাকে। যুবকদ্বয় একটা বাড়ীর পাঁচিল টপকাইয়া পলায়ন করে।

(৫) বরাহনগরের উপেন ঘোষ ওরফে দেব্রত ব্রহ্মচারী বিপ্লবীদের সঙ্গে মিশিতেন এবং পুলিশকে সংবাদ সরবরাহ করিতেন। ১০ই আগষ্টের পরে তিনি নিরুদ্দেশ হন। কিছুদিন পর এক ট্রেনের কামরায় পরিত্যক্ত একটি তোরঙ্গের মধ্যে তাঁহার মৃতদেহ পাওয়া যায়। তিনজন বিপ্লবীর বিরদ্ধে এই হত্যার অভিযোগে মামলা হয়, কিন্তু সকলেই মুক্তিলাভ করে।

(৬) পুলিশের নিকট গুপ্ততথ্য সরবরাহ করার জন্য ময়মনসিংহের বলাই লোধের দুর্নাম ছিল। তাহার ক্ষতবিক্ষত মৃতদেহ দেখিয়া সন্দেহ হয়, যে বিপ্লবীদের হাতেই তাহার মৃত্যু হইয়াছিল।

(৭-৮) সি.আই.ডি. বিভাগের কর্তব্য সম্পাদনে অতিরিক্ত তৎপর দুইজন কনষ্টেবল, সুরেন্দ্রভূষণ মুখোপাধ্যায় ও রোহিনীকুমার মুখোপাধ্যায়, ২৩শে জুন বিপ্লবীদের গুলিতে ঢাকার এক গলিতে নিহত হয়।

(৯) গুপ্ত পুলিশ বিভাগের স্তম্ভস্বরূপ ক্ষুরধার-বুদ্ধি, অসমসাহসিক কর্তব্যপরায়ণ বসন্ত চট্টোপাধ্যায়ের হত্যা বিষম চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করে। বিপ্লবীরা তাঁহাকে পরম শত্রু মনে করিত এবং দুইবার তাঁহাকে হত্যার নিষ্ফল চেষ্টা করে। ১৯১৪ সনের ১৯শে জুলাই তিনি যখন বুড়ীগঙ্গা নদীর তীরে বাকলাণ্ড বাঁধ দিয়া বেড়াইতেছিলেন তখন বিপ্লবীরা গোটা কয়েক বুলেট ছোড়ে, বসন্তবাবু নদীবক্ষে ঝাঁপ দিয়া প্রাণ রক্ষা করেন। কিন্তু তাঁহার দেহরক্ষী আহত হয়। ঐ বৎসর ২৫শে নভেম্বর তারিখে কলিকাতায় মুসলমানপাড়া লেনের বাড়ীতে যে-ঘরে তিনি বসিয়াছিলেন তাহার দরজার সম্মুখে ভীষণ শব্দে একটি বোমা ফাটে। ইহার অব্যবহিত পূর্বেই বাড়ীর ভিতরে কার্যান্তরে চলিয়া যাওয়ায় তিনি নিশ্চিত মৃত্যু হইতে রক্ষা পান, কিন্তু তাঁহার দেহরক্ষীর মৃত্যু হয়।

১৯১৬ সনের ৩০শে জুন বসন্তবাবু অফিস হইতে সাইকেলযোগে গৃহে ফিরিতেছিলেন। চৌরঙ্গী রোড হইতে পশ্চিমদিকে শম্ভুনাথ পণ্ডিত স্ট্রীটের মোড় ঘুরিতেছে, পশ্চাতে সাইকেলে দেহরক্ষী-জনাকীর্ণ স্থান, অনতিদূরে হরিশ মুখার্জী রোডে লেখক সান্ধ্যভ্রমণে ময়দানে চলিয়াছেন, পাশে একটা মাঠে ছেলেরা ফুটবল খেলিতেছে, অকস্মাৎ কয়েকটি ভীষণ শব্দ। পরে শুনিলাম, পাঁচ-ছয় জন যুবক বসন্তবাবুকে নয়টি গুলিতে ধরাশায়ী করে ও তাহার মৃত্যু হয়। তাঁহার দেহরক্ষী একজন আততায়ীকে ধরিয়া ফেলে, কিন্তু পায়ে দুইটা গুলি লাগায় সেও ধরাশায়ী হয়। হত্যাকারীরা তখন এলগিন রোড (লালা লাজপৎ রায় রোড) ধরিয়া পূর্বদিকে অগ্রসর হয়। একজন কনষ্টেবল তাহাদের দিকে আসিতে চেষ্টা করিল। আততায়ীরা তাহার দিকে রিভলভার উঁচু করিয়া ধরিলে কনষ্টেবল সরিয়া দাঁড়ায়। যুবকগণ বিনাবাধায় পলায়ন করিতে সমর্থ হয়। জনসমুদ্রের মধ্যে হত্যা করিয়া এইভাবে পলায়ন খুবই বিস্ময়ের বিষয়। কিন্তু ২। ১ বৎসর পূর্বেও, রাজনৈতিক নেতাকে দিবালোকে জনাকীর্ণ রাস্তায় হত্যা করিয়া হত্যাকারীরা অনায়াসে পলাইতে সক্ষম হইয়াছিল, কেহ তাহাদিগের পশ্চাদ্ধাবন পর্যন্ত করে নাই। পরদিন স্টেটসম্যান কাগজের সম্পাদকীয় মন্তব্য হইতে দুইটি উক্তি উদ্ধৃত করিতেছি : “বাংলার বিপ্লবীরা (anarchists) এযাবৎ যত হত্যাকাণ্ড (crime) করিয়াছে, এই ঘটনা তাহাদের মধ্যে সর্বাপেক্ষা দুঃসাহসিক (audacious)। এটি বিপ্লবীদের পক্ষে একটি বিশেষ জয় এবং সরকারের পক্ষে বিশেষ অপমানের (humilation) পরিচয়।”

সিডিশান কমিটির রিপোর্টে মন্তব্য করা হইয়াছে : “পুলিশদের নৈতিক অধঃপতন (demoralisation) সংঘটনই ছিল বিপ্লবীদের প্রাথমিক ও প্রধান উদ্দেশ্যের অন্যতম এবং এই ঘটনা দ্বারা বোঝা গেল যে তাহারা ইহাতে প্রায় কৃতকার্য হইয়াছে। ইহা প্রমাণিত করিল যে সাধারণ আইনের দ্বারা অবস্থা আয়ত্তাধীনে আনা অসম্ভব–বিশেষ আইনের প্রয়োজনীয়তা এখন কেহই অস্বীকার করিতে পারিবে না।” এই মন্তব্য খুব যুক্তিসঙ্গত বলিয়া স্বীকার করা যায় না। ইহাও বিশেষ লক্ষণীয় যে এই ঘটনার তারিখের বহু পূর্বেই (১৯০৮ সন হইতে) সরকার অনেক বিশেষ আইন বিধিবদ্ধ করিয়াছিল।

১৯১৭ : ত্রিপুরাবাসী রেবতী নাগকে হত্যা করা হয়, কিন্তু সিডিশান কমিটির রিপোর্টে বলা হয় যে, রেবতীর অসচ্চরিত্রতার জন্য তাহার সঙ্গীরা তাহাকে খুন করে। রেবতীর দলের লোকেরা বলে সামান্য ত্রুটির (minor lapse) জন্য তাহাকে হত্যা করা হয়।

১৯১৮ : (১) একটি বাড়ী খানাতল্লাসির সময় সাব-ইন্সপেক্টর হরিপদ মৈত্র বিপ্লবীর গুলিতে খুন হন। পুলিশের বড়সাহেব হরিদাসের বিধবা স্ত্রীকে বলেন, তাঁহার স্বামীর হত্যাকারীকে ধরিবার যথাসাধ্য চেষ্টা করা হইবে। মহিলা বলিলেন, ‘ধরা পড়িলে তো তাহার ফাঁসি হইবে, আমার মত আর একজনের সর্বনাশ হইবে। ভগবানের কাছে প্রার্থনা করি, আসামী যেন ধরা না পড়ে।

(২) গোয়েন্দা বিভাগের পুলিশ কর্মচারী প্রসন্নকুমার নন্দী ময়মনসিংহ জিলার কিশোরগঞ্জ ষ্টেশনে এক যুবককে পুঁটুলি হাতে নামিতে দেখিয়া উহা পরীক্ষা

করিতে চাহিলেন।

যুবকটি বিনা আপত্তিতে পুঁটুলিটি দিল। প্রসন্ন ইহা খুলিতে ব্যস্ত, এমন সময় যুবকটির রিভলভারের গুলিতে প্রসন্ন আহত হইলেন (৯ই মে) এবং কয়েকদিন পর তাঁহার মৃত্যু হইল। পুঁটুলিটির মধ্যে ছিল কিছু কার্তুজ আর গোপনীয় কাগজপত্র। যুবকটি নির্বিবাদে প্ল্যাটফর্ম হইতে সরিয়া পড়িল।

সম্ভবত পূর্বোদ্ধৃত রাউল্যাট কমিটির মন্তব্যের অনুসরণ করিয়া সরকার বহু যুবককে বিনা বিচারে অন্তরীণ করেন এবং তাহাদের অনেকের প্রতি অমানুষিক নির্যাতনের ফলে কেহ কেহ উন্মাদ হয়, কেহ কেহ রঞ্জুবন্ধনে আত্মহত্যা করে।

(ঙ) হত্যার বিফল চেষ্টা

(১) কুষ্টিয়ার মিশনারী হিগিনবোথাম সাহেব (I. H. Higginbotham) পুলিশকে গোপনে সংবাদ সরবরাহ করেন এই সন্দেহে তাঁহাকে গুলি করা হয়। (১৯০৮, ৪ঠা মার্চ)।

(১) বাংলার ছোটলাট এনডু ফ্রেজারকে (Sir Andrew Fraser) ১৯০৭ সনের ৫ই ডিসেম্বর তারিখে ট্রেনপথে ভ্রমণের সময় ট্রেনের নীচে বোমা রাখিয়া হত্যার চেষ্টা করা হয়। বোমাবিস্ফোরণে ট্রেনের কোন ক্ষতি হয় নাই। ১৯০৮ সনের ৭ই নভেম্বর কলিকাতার ওভারটুন হলে এক সভায় জনৈক যুবক খুব নিকট হইতে দুইবার রিভলভার টিপিয়া গুলি বাহির করিতে ব্যর্থ হইল।

(২) ঢাকায় পুলিশের গুপ্ত বিভাগের ইন্সপেক্টর শরৎচন্দ্র ঘোষ গুলিতে সামান্য আঘাত পান (১লা সেপ্টেম্বর, ১৯১০)।

(৩) ষোল বছর বয়সের ননীগোপাল মুখোপাধ্যায় পুলিশের একজন বড় অফিসার ডেনহ্যাম সাহেবকে মারিবার জন্য ডালহৌসী স্কোয়ারে (বিনয়-বাদল দীনেশ বাগ) একখানি ঘোড়ার গাড়ীর উপর বোমা ছেড়ে, কিন্তু বোমা গাড়ীর মধ্যে পড়িলেও ফাটে নাই। গাড়ীতেও ছিলেন অন্য এক ব্যক্তি। পরীক্ষায় দেখা গেল বোমাটি বেশ শক্তিশালী ছিল (২রা মার্চ, ১৯১১)।

(৪) ঘটনাস্থল দিল্লী হইলেও ২৩শে ডিসেম্বর ১৯১২ বড়লাট লর্ড হার্ডিং হাতীর পিঠে চড়িয়া শোভাযাত্রা করিয়া যাওয়ার সময় যে বোমা ফাটে এবং যাহার ফলে বড়লাট গুরুতররূপে আহত হন ও দুইটি লোকের মৃত্যু হয়, তাহা ছুঁড়িয়াছিলেন বাঙ্গালী বিপ্লবী বসন্তকুমার বিশ্বাস এবং এই ষড়যন্ত্রের নেতা ছিলেন প্রসিদ্ধ বাঙ্গালী নেতা রাসবিহারী বসু, ইহা পূর্বেই বলা হইয়াছে।

(চ) সম্মুখ সংগ্রাম

বাংলার বিপ্লবীরা কেবল অস্ত্র সংগ্রহ, ডাকাতি ও হত্যাতেই তাহাদের কর্মপদ্ধতি সীমাবদ্ধ রাখে নাই, প্রত্যক্ষ সংগ্রামে ইংরেজদের সঙ্গে লড়াই করিয়া স্বাধীনতালাভের কল্পনাও তাহাদের ছিল। ইহার জন্য ভারতের অন্য প্রদেশের বিপ্লবীদের সঙ্গে তাহাদের সংযোগ ছিল, কারণ কেবলমাত্র নিজেদের চেষ্টায় ইহা সম্ভবপর ছিল না। ইহার জন্য প্রয়োজন ছিল ইংরেজ সরকারের এদেশীয় সৈন্যের বিদ্রোহ ও বিদেশী শক্তি যে সমুদয় ইংরাজের শত্রু তাহাদের সক্রিয় সহায়তা। বিশ্বযুদ্ধের সময় সুযোগ উপস্থিত হইল। জার্মানীতে বসবাসকারী ভারতীয় বিপ্লবীরা সহজেই জার্মান সরকারের নিকট হইতে অর্থ ও অস্ত্রের সাহায্যের প্রতিশ্রুতি পাইলেন। আমেরিকার যুক্তরাষ্ট্রে ভারতীয় বিপ্লবীরা জার্মান রাজদূতের সহায়তায় অর্থ ও জাহাজ বোঝাই অস্ত্র ভারতের পূর্বকূলে (সুন্দরবন বা উড়িষ্যার উপকূলে) পাঠাইবেন এরূপ সংবাদ আসিল। ১৯১৫ সনের জানুআরি মাসে যতীন্দ্রনাথ মুখার্জীর নেতৃত্বে বিপ্লবীদের এক বৈঠকে ভারতব্যাপী সশস্ত্র অভ্যুত্থানের পরিকল্পনা প্রস্তুত হয়। অর্থের জন্য বেলিয়াঘাটা ও গার্ডেনরীচ ডাকাতিতে ৩৮,০০০ টাকা সংগৃহীত হয়, ইহা পূর্বেই বলা হইয়াছে। জার্মানী হইতে ব্যাটেভিয়ার পথে অস্ত্র আসিবে, এই সংবাদে বিপ্লবী নরেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য সি. মার্টিন (C. Martin) নাম গ্রহণ করিয়া যবদ্বীপের ব্যাটেভিয়ায় উপস্থিত হইলেন। এই সম্পর্কে অবনী মুখার্জী জাপান যান এবং ভোলানাথ চ্যাটার্জি পূর্বেই শ্যামদেশের রাজধানী ব্যাঙ্ককে গিয়াছিলেন। নেতা যতীন্দ্রনাথ মুখার্জী বেলিয়াঘাটা ও গার্ডেনরীচ ডাকাতিতে অংশগ্রহণ করিয়াছিলেন, এই সন্দেহে পুলিশ তাঁহার অনুসন্ধান করিতেছিল। সুতরাং তিনি বালেশ্বরে আত্মগোপন করিয়া রহিলেন। বিপ্লব-কার্যের সুবিধার জন্য বিপ্লবী হরিকুমার চক্রবর্তী একটি ব্যবসা-প্রতিষ্ঠান খোলেন। নিজের নামটি বিকৃত করিয়া ইহার নাম রাখা হয় হ্যারি এণ্ড সন্স (Harry and Sons)। ইউনিভার্সাল এম্পোরিয়াম’ নামে বালেশ্বরে ইহার একটি শাখা (সাইকেলের দোকান ছিল।

অভ্যুত্থানের পরিকল্পনার প্রধান অংশ ছিল এইরূপ :

(১) বাংলার বাহির হইতে যাহাতে সৈন্য না আসিতে পারে সেজন্য প্রধান তিনটি রেলপথের বড় বড় কয়েকটি পুল উড়াইয়া দেওয়া।

(২) একদল হাতিয়ায় একটি বাহিনী তৈরী করিয়া প্রথমে পূর্ববঙ্গের জিলাগুলি মুক্ত করিবে এবং পরে ঐ বাহিনী লইয়া কলিকাতা আসিবে।

(৩) আর একদল প্রথমে কলিকাতা ও পার্শ্ববর্তী স্থানের অস্ত্রাগারগুলি দখল করিয়া পরে ফোর্ট উইলিয়ম দখল করিবে।

বঙ্গবিজয়ের এই পরিকল্পনা কিন্তু দুইটি কারণে ব্যর্থ হইল। প্রথমতঃ, ম্যাভেরিক নামে অস্ত্রবোঝাই জার্মান জাহাজটি ভারতে পাঠান সম্ভবপর হইল না। দ্বিতীয়তঃ, নেতা যতীন্দ্রনাথ মুখার্জির গোপন বাসস্থান পুলিশ আবিষ্কার করিল। ইহার একটু বিস্তৃত বিবরণ দেওয়া আবশ্যক।

কলিকাতা-মাদ্রাজ রেলপথ অচল করিয়া দিবার অভিপ্রায়ে যতীন্দ্রনাথ বালেশ্বরে আসিয়াছিলেন। ইতিমধ্যে স্থির হইয়াছিল, অস্ত্রবোঝাই ম্যাভেরিক জাহাজ মহানদী ও সমুদ্রের সঙ্গমস্থলে আসিবে। সুতরাং যতীন্দ্রনাথ ইহার সন্নিকটে “কাপ্তিপোদা” নামক স্থানের একটি জঙ্গলে ঘাঁটি করিয়া ঐ জাহাজের অপেক্ষা করিতেছিলেন। ওদিকে কলিকাতায় হ্যারি এণ্ড সন্সের প্রকৃত স্বরূপ পুলিশ জানিতে পারে এবং ঐ দোকান খানাতল্লাস করিয়া বালেশ্বরের ইউনিভার্সাল এম্পোরিয়ামের খোঁজ পাইয়া সেখানে আসে। ১৯১৫, ৪ঠা সেপ্টেম্বর এই দোকান তল্লাস করিয়া কাপ্তিপোদার’ সন্ধান পায়। পুলিশের আনাগোনা দেখিয়া যতীন্দ্রনাথ চারিজন সঙ্গীসহ জঙ্গলের পথে চলিতে চলিতে ‘বুড়ী বালাম’ নদীর তীরে উপস্থিত হন। নদী পার হওয়ার পরে ডাকাত সন্দেহ করিয়া গ্রামবাসীরা তাঁহাদের নামধাম জিজ্ঞাসা করে এবং তাঁহাদের পথ আটকায়। তখন যতীন্দ্রনাথের দল গুলি করিলে একজন গ্রামবাসী নিহত ও কয়েকজন আহত হয়। ইতিমধ্যেই গ্রামবাসীরা হঁহাদের ডাকাত সন্দেহ করিয়া পুলিশে খবর দেয়। বিপ্লবীদল বাঁধা রাস্তা ছাড়িয়া মাঠে নামেন এবং একটি ছোট নদী পায়ে হাঁটিয়া পার হন। তখন ডেনহ্যাম, টেগার্ট প্রভৃতি পুলিশের হোমরাচোমরা কর্তারা বাছাই-করা সশস্ত্র পুলিশসহ বিপ্লবীদের নিকটে পৌঁছিয়াছে। বন্দুকধারী পুলিশ আসিতেছে দেখিয়া বিপ্লবীগণ নদীর উঁচু বাঁধ বা পাড়ের পশ্চাতে এক উইঢিবির পিছনে আশ্রয় লইলেন। দুইপক্ষেই গুলি বিনিময় আরম্ভ হইল। চিত্তপ্রিয় রায়চৌধুরীর মৃত্যু হইল। নেতা যতীন্দ্রনাথ গুরুতররূপে আহত হইলেন। জ্যোতিষ পালের বক্ষ ভেদ করিয়া গুলি পিঠ দিয়া বাহির হইয়া গেল। তখন যতীন্দ্রনাথ যুদ্ধবিরতির আদেশ দিলেন। নীরেন্দ্রচন্দ্র দাশগুপ্ত ও মনোরঞ্জন সেনগুপ্ত যুদ্ধবিরতির ইঙ্গিত করিলেন। সকলকেই পুলিশ গ্রেপ্তার করিয়া লইয়া গেল। যতীন্দ্রনাথ পরদিন হাসপাতালে বীরের মৃত্যু বরণ করিলেন। জ্যোতিষ সুস্থ হইয়া উঠিল। স্পেশাল ট্রাইবিউন্যালের বিচারে নীরেন্দ্র ও মনোরঞ্জনের মৃত্যুদণ্ড ও জ্যোতিষের চৌদ্দ বৎসর দ্বীপান্তরের আদেশ হইল। আন্দামানে অত্যাচারের ফলে মস্তিষ্ক বিকৃত হওয়ায় তাঁহাকে বহরমপুরের জেলে পাঠান হয় এবং তিনি সম্পূর্ণ সুস্থ হইয়া উঠেন। তাঁহার মুক্তির তারিখ তাঁহাকে জানানো হয়। কিন্তু ঐ তারিখের চারি-পাঁচদিন পূর্বে তাঁহার আত্মীয়দের কাছে টেলিগ্রাম গেল, তিনি গুরুতর পীড়িত। সাতঘণ্টা পরেই আর-একটি তারবার্তায় তাঁহার মৃত্যুসংবাদ জানান হইল। এই রোগের কাহিনী কতদূর সত্য, সে-বিষয়ে যথেষ্ট সন্দেহের কারণ আছে।

(ছ) ছোটখাট সংগ্রাম

পুলিশের সঙ্গে বিপ্লবীদের প্রত্যক্ষ সংগ্রামের ছোটখাট কয়েকটি দৃষ্টান্ত দিতেছি।

১৯১৭ সনের পর সন্ত্রাসবাদ অনেকটা হ্রাস পায়, তাহা পূর্বেই বলা হইয়াছে। কিন্তু তখনও যে কয়েকজন বিপ্লবী জেলে বা অন্তরীণে আবদ্ধ হন নাই, পুলিশ তাঁহাদের অনুসন্ধানে বিশেষভাবে ব্যস্ত ছিল। আসামের গৌহাটিতে তাহাদের দুইটি বাসস্থান ছিল, আটগা ও ফাঁসিগঞ্জে। সন্ধান পাইয়া পুলিশ সাহেব রাত্রি আড়াইটার সময় বাড়ী ঘিরিয়া দরজায় ঠক্ঠক্ শব্দ করিতে লাগিলেন। ফাঁক দিয়া পুলিশকে দেখিয়াই নেতা নলিনী ঘোষ সঙ্গীদের বলিলেন, প্রস্তুত হও (Fall in)। তারপর দরজা খুলিয়াই গুলি চালাইতে লাগিলেন। দুইপক্ষে গুলিবিনিময়ের পর পুলিশ চলিয়া যাইতে বাধ্য হয় এবং বিপ্লবীরা পলাইতে সমর্থ হন। (১৯১৮, ৭ই জানুআরি)। যুদ্ধে বিপ্লবীদেরই জয় হইল। কয়েকজন পুলিশ আহত হইয়াছিল। দুইদিন পরে পলাতকেরা নিকটবর্তী নবগ্রহ পাহাড়ে আশ্রয় গ্রহণ করে। সংবাদ পাইয়া পুলিশ বাড়ীটি সম্পূর্ণরূপে ঘেরাও করে এবং বেশ খানিকক্ষণ গুলিবিনিময় হয়। টোটা নিঃশেষ হইয়া গেলে বিপ্লবীরাও পলাইতে চেষ্টা করেন, কিন্তু সকলেই ধরা পড়েন (৯ই জানুআরি, ১৯১৮)।

ঐ বৎসরই ১৫ জুন ঢাকার কলতাবাজারে একটি বাড়ী পুলিশ ঘেরাও করে এবং বিপ্লবী ও পুলিশের মধ্যে গুলিবিনিময়ের ফলে দুইজন পুলিশ আহত হয়। বিপ্লবী নলিনী বাগচী ও তারিণী মজুমদার দুইজনেই মারাত্মকভাবে আহত হন। নলিনী বাগচী যতক্ষণ বাঁচিয়া ছিলেন পুলিশ তাহাকে বহু প্রশ্ন করে। তাঁহার একই উত্তর–”আমাকে শান্তিতে মরিতে দাও”।

পাবনা জিলার সিরাজগঞ্জ মহকুমায় ‘তেনিজনা গ্রামে বিপ্লবীদের একটি আশ্রয়কেন্দ্র ছিল। পুলিশসাহেব গভীর রাত্রে বাড়ী ঘেরাও করিলেন। দুইটিমাত্র বিপ্লবী সেখানে ছিলেন–নিকুঞ্জ পাল ও গোবিন্দ কর, তথাপি তাঁহারা পুলিশের সঙ্গে গুলিবিনিময় করিলেন। উভয় বিপ্লবীই আহত হইলেন। গোবিন্দ করের দেহে সাতটি গুলি বিদ্ধ হয়। দুইজনেই গ্রেপ্তার হইলেন। পুলিশেরও কয়েকজন আহত হয় (১৯১৭)।

(জ) বিপ্লবী কয়েদীদের উপর অমানুষিক অত্যাচার

বিপ্লবী দমনে গভর্নমেন্টের হাতে একটি অমোঘ অস্ত্র ছিল–বিনা বিচারে কেবলমাত্র পুলিশ বা গুপ্তচরের রিপোর্টের উপর নির্ভর করিয়াই শত শত যুবককে জেলে, অথবা সুদূর গ্রামে, সাধারণের অগম্য জঙ্গলাবৃত-কোথাও কোথাও সর্পসঙ্কুল জনমানবহীন (পুলিশের লোক ছাড়া)-স্থানে বৎসরের পর বৎসর আটক রাখা। অন্তরীণ নামে কুখ্যাত এই শাস্তি যে কী ভয়াবহ তাহার কিছু প্রমাণ পাওয়া যায় অন্তরীণে আবদ্ধ বহু কয়েদীর অস্বাভাবিক মৃত্যু ও মস্তিষ্কবিকার প্রভৃতি ঘটনায়। ইহার দুই-একটি করুণ ও মর্মন্তুদ দৃষ্টান্ত দিতেছি।

(১) মণীন্দ্রনাথ শেঠ এম. এ. পরীক্ষায় গণিতশাস্ত্রে স্বর্ণপদকপ্রাপ্ত দৌলতপুর কলেজের অধ্যাপক ও সহকারী অধ্যক্ষ। ১৯১৭ সনে রংপুর কলেজের অধ্যাপক নিযুক্ত হইলেন, কিন্তু সেখানকার ম্যাজিষ্ট্রেট পুলিশ-রিপোর্টের উপর নির্ভর করিয়া তাঁহাকে এই পদে যোগ দিতে দিলেন না। বাড়ীতে দুই অভিভাবকহীন নাবালক সহোদর। গভর্নমেন্টের নিকট আবেদন-নিবেদনে ফল তো হইলই না, অধিকন্তু তাঁহাকে প্রেসিডেন্সী জেলে সাধারণ কয়েদীর সঙ্গে আটক রাখা হইল। মস্তি স্কবিকৃতির লক্ষণ প্রকাশ পাওয়ায় অন্তরীণের আদেশ হইল। পরে যক্ষ্মারোগাক্রান্ত হওয়ায় এক বৎসরের মধ্যেই মৃত্যু তাঁহার সকল জ্বালা জুড়াইয়া দিল।

(২) বিশ্ববিদ্যালয়ের আর-একজন কৃতবিদ্য ছাত্র রসিক সরকারকে সন্দেহের বশে রাজসাহী জেলে আটক করা হয়। সহসা একদিন গভর্নমেন্ট হইতে ঘোষণা না করা হইল যে, জেলে একটি যুবক পরিধেয় বস্ত্রে কেরোসিন ঢালিয়া আগুন লাগায় এবং তাহাতেই তাহার মৃত্যু হয়। প্রথমে গভর্নমেন্ট মৃতের নাম প্রকাশ করেন নাই। ৪ঠা জুলাই, ১৯১৮ তারিখে বঙ্গীয় আইন পরিষদে প্রশ্নের উত্তরে নাম জানান হয়। এই রহস্যজনক মৃত্যু যে অসহনীয় অত্যাচারের ফল, তাহা সহজেই অনুমান করা যাইতে পারে।

(৩) বিশ বৎসরের যুবক সত্যেন সরকারকে বিনাবিচারে যশোহর জিলার চৌগাছা গ্রামে অত্যন্ত অস্বাস্থ্যকর স্থানে অন্তরীণ করা হয়। ক্ষ্যাপা কুকুরের কামড়ে আহত হইলে গভর্নমেন্ট তাঁহাকে কিছুদিনের জন্য শিলং-এ রাখিয়া চিকিৎসা করান। কিন্তু খুব সম্ভব পুরাপুরি আরোগ্যলাভ করার আগেই তাঁহাকে ফিরাইয়া আনা হয়। কিছুদিন পরেই রোগের সমস্ত লক্ষণ উকট ভাবে দেখা দেয়–বিনা চিকিৎসায় ও বিনা শুশ্রূষায় তাহার মৃত্যু হয়। মৃত্যুর পরে অবশ্য আত্মীয়দের কাছে যথারীতি সংবাদ গিয়াছিল।

(৪) ৬০ বৎসরের বৃদ্ধ কাশীবাসী সারদাকান্ত চক্রবর্তীর আবাসে সময়ে সময়ে বাঙ্গালী যুবকেরা যাইয়া থাকিত–এই অপরাধে তাঁহাকে যশোহর জিলার আলফাডাঙ্গা গ্রামে অন্তরীণ করা হয়। স্থানটি ম্যালেরিয়ার ডিপো। তাঁহার কোন সংবাদ না-আসায় পত্র ও টেলিগ্রাম করা সত্ত্বেও কোন জবাব পাওয়া গেল না। একদিন গভর্নমেন্ট তাঁহার মৃত্যুসংবাদ জানাইয়া চিঠি দিলেন।

(৫) ১৫ বছরের ছাত্র মাখনলাল ঘোষ ডাকাতির অভিযোগে গ্রেপ্তার হইল, কিন্তু বিচারে মুক্তিলাভ করিল। তারপর বহু জেলে অস্বাস্থ্যকর স্থানে তাহাকে অন্তরীণ করার ফলে সে রোগগ্রস্ত হইয়া পড়ে। ইহা সত্ত্বেও তাহাকে বারবার অস্বাস্থ্যকর স্থানেই পাঠানো হইতে থাকে। একবার সে কলেরায় আক্রান্ত হইল। তাহার পরও নানাস্থানে অন্তরীণ করা হইল। তিন বৎসর এইভাবে নানাস্থানে কয়েদ রাখার পর গভর্নমেন্ট হইতে একদিন সংবাদ আসিল, মাখন আত্মহত্যা করিয়াছে।

(৬) বিখ্যাত বিপ্লবী যোগেশচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় তাহার উপর অত্যাচারের বর্ণনা করিয়া বলিয়াছেন, “একজন আমার দুই হাত আর-একজন আমার মাথা চাপিয়া ধরিল। সাহেবী পোশাক-পরা একজন কর্মচারী আমার নাক টিপিয়া ধরিল এবং একটি মেথর এক কমোড-ভরা মলমূত্র আমার মুখে ঢালিয়া দিল। তারপর আমাকে একটি ক্ষুদ্র কক্ষে (cell) আবদ্ধ করিয়া রাখিল, মুখ ধুইবারও কোন সুযোগ দিল না।” এরূপ বহু দৃষ্টান্ত আছে।

এই শ্রেণীর মধ্যযুগীয় বর্বরতার কথা শোনা যায়। কিন্তু, এ-যুগের সুসভ্য ইংরেজ জাতির এই কলঙ্ক কখনও মুছিবে না।

কুখ্যাত হিজলী ক্যাম্পের হত্যাকাণ্ডের সংক্ষিপ্ত উল্লেখ করিয়াই এই অত্যাচার কাহিনী শেষ করিব। মেদিনীপুর জিলায় অবস্থিত এই ক্যাম্পে কয়েকজন সন্দেহভাজন বিপ্লবীকে আটক রাখা হইয়াছিল। মাঝে মাঝে তাহাদের সঙ্গে রক্ষীদের ঝগড়া-বিবাদ হইত। ১৯৩১ সনের ১৬ই সেপ্টেম্বর এইরূপ একটি বচসা হয়। রাত্রি নয়টার সময় প্রায় ৫০ জন পুলিশ, জেলরক্ষী, ওয়ার্ডার প্রভৃতি লাঠি, বেরয়নেট ও বন্দুক লইয়া ব্যারাকের মধ্যে নিরস্ত্র বন্দীদিগকে আক্রমণ করে, লাঠি মারে ও অন্ততঃ একশতটি বুলেট ছোড়ে। কমপক্ষে বিশজন বন্দী আহত হন এবং গুলির আঘাতে দুইজনের মৃত্যু হয়।

তথ্যনির্দেশ

১ R. C. Majumdar, History of the Freedom Movement in India Vol. II. (Revised Edition, 1975). pp. 281.82.

২. শ্রীনলিনীকিশোর গুহ-”বাংলায় বিপ্লববাদ’, ৯৩ পৃষ্ঠা।

৩. শ্রীনলিনীকিশোর গুহ-বাংলায় বিপ্লববাদ’, ৯৬-৯৭ পৃষ্ঠা।

৪. বহনকারীদের অন্যতম ছিলেন আনন্দবাজার পত্রিকার ক্যাশিয়ার পরলোকগত নির্মল দাশগুপ্ত।

৫. দুলদিয়া ডাকাতি-বিখ্যাত বিপ্লবী অমৃত সরকার আহত হন। ঢাকার বিখ্যাত চাঁদসীর ডাক্তার মোহিনীমোহন দাস সংগোপনে চিকিৎসা করেন। এমনি গোপনতার মধ্যে আরো চিকিৎসা হয়।

৬. নলিনীকিশোর গুহ-বাংলায় বিপ্লববাদ’, পৃ. ১০৩-০৬।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *