৩০. ডুমুরের ফুল হয়ে

৩০

‘মশাই দেখছি ডুমুরের ফুল হয়ে গেছেন। সেই যে গালটি একবার দেখিয়ে সরে পড়লেন আর দর্শন নেই।’

পাঁচু ভাদুড়ী শিবনাথের হাত চেপে ধরে জোরে। তার দরজার সামনে দিয়ে শিবনাথ বাঁ- দিকের গলিতে রমেশের চা-এর দোকানে চা খেতে যাচ্ছিল।

‘না ভেবেছি, আজ আর না, কাল সন্ধ্যার দিকে এসে মাথা ও মুখটা সাফ করব।’

‘আচ্ছা লোক আপনি!’ আক্ষেপের সুরে পাঁচু ভাদুড়ী বলল, ‘আমরা সেলুন খুলেছি ব’লে কি সারাক্ষণ ঐসব চিন্তা করছি ঠাউরেছেন নাকি। কেন, দেশের কথা, ফাইভ ইয়ার প্ল্যান নিয়ে দু’টো চারটে কথা বলার উপযুক্ত নই ব’লে ঘেন্না করেন বুঝি।’

‘না না, ছি!’ শিবনাথ এভাবে আক্রান্ত হবে বুঝতে পারেনি। ‘কাজে কর্মে ব্যস্ত তাই–’

‘সকাল ডেলি পেপারখানা আমরাও একটু আধটু দেখি স্যার, একেবারে ক্ষুর কাঁচি দিয়ে পড়ে থাকি যদি মনে করেন অবিচার করা হবে, হা হা–’ পাঁচু হাসল।

‘না না, সে আমি কখনো মনে করি না। কি ব্যাপার?’ শিবনাথ আর হাতটা ছাড়াতে চেষ্টা করল না।

‘আসুন স্যার, ভিতরে আসুন। আপনাকে একটু দরকার।’

শিবনাথ প্রায় ঘেমে উঠল। কিন্তু উপায় নেই। এই পরিবেশে যতক্ষণ আছে এদের এড়িয়ে চলা শক্ত। পাঁচুর সঙ্গে সে ‘উর্বশী হেয়ার কাটিং সেলুনে’ ঢুকল।

‘বসুন স্যার, এই চেয়ারটায় বসুন।’

পাঁচু আঙুল দিয়ে যে চেয়ারে বসে লোকে চুল কাটে, দাড়ি কামায়, তারই একটা দেখিয়ে দিল। শিবনাথ বসে লক্ষ্য করল ওধারে আর একটা উঁচু চেয়ারে বিধু মাস্টার বসে আছে। মাথায় হাত দিয়ে মাটির দিকে তাকিয়ে কিছু ভাবছে মনে হয়।

‘সিগারেট খান।’

পাঁচুর বাড়িয়ে দেওয়া প্যাকেট থেকে শিবনাথ একটা সিগারেট তুলল। ‘কি খবর, কি ব্যাপার, আমাকে দরকার হল হঠাৎ?’

ওধারে থেকে বিধু বলল, ‘আর কে আছে বাড়িতে বলুন। এসব বিষয়ে কন্সালট্ করতে কি আর ছাগল গোরুকে ডাকব। তাছাড়া শেখর ডাক্তার তো মেয়ের মামলা নিয়ে হিমসিম খেয়ে যাচ্ছে, শুনেছেন?’

‘হ্যাঁ একটু একটু কানে এসেছে–’ শিবনাথের বলার ইচ্ছা ছিল না তবু তাকে বলতে হল। এধার থেকে পাঁচু বলল, ‘অবশ্য ব্যবসা-বাণিজ্যের ব্যাপারে আমি রমেশের সঙ্গেও পরামর্শ করতে পারতাম, কিন্তু জানেন তো, বলেছি আপনাকে হারামজাদার সঙ্গে আমার কী সম্পর্ক শালার ছায়া মাড়াতে আমার ঘেন্না হয়, মশায় বলব কি–

‘আহা তুমি ওর কথা আবার তুলছ কেন? চোর। ব্ল্যাকমার্কেটিয়ার নাম্বার ওয়ান। যদি মহা সদ্ভাবও থাকত তোমাদের মধ্যে দুষ্টু বুদ্ধি ছাড়া আর কিছু দিত না পাঁচু; আমি হলপ করে বলতে পারি।’

পাঁচু কথা বলল না।

‘আপনি কি বলাইকে দেখেছেন আজ বা কাল? রাতারাতি ব্যাটার চেহারা পাল্টে গেছে লক্ষ্য করেন নি?’

‘না তো!’ শিবনাথ একটা শুকনো ঢোক গিলল ও মৃদু হেসে প্রশ্ন করল, ‘কাজকর্মের কিছু সুবিধা করেছে বুঝি?’

‘বলছে না। কিন্তু আই ডাউট সামথিং, বুঝলেন মশায়। ওর গায়ে নতুন শার্ট, পায়ে নতুন চটি। পরশু ছেঁড়া গেঞ্জি ছেঁড়া লুঙ্গি ছিল, আপনার চোখে পড়েছে নিশ্চয়।’ বিধু মাস্টার তার দাড়ির জঙ্গলে হাত বুলিয়ে বলল, ‘দুদিন ধরে দেখছি তৃপ্তি নিকেতনের সামনে দিয়ে যেতে আসতে বলাইটা রমেশের সঙ্গে কি যেন ফিসফাস গুজুর গাজুর করছে।’

‘মাস্টারের যেমন কথা।’ এবার পাঁচু মুখ খুলল : ‘এ বাজারে দু চার আনার সাবান বেগুন বেচে কেউ পেট চালাতে পারে না। তা-ও কি একটা। তিনটে মুখ। তা রমেশ যদি ওকে বড়রকমের একটা ব্যবসা-বাণিজ্যে টেনে নেয় তো হিংসা করার আছে কি? তবু খেয়ে বাঁচুক অমলের যেমন দশা হয়েছে। কোথায় গেছে ও ঘোলপাড়ায়। বলাইচরণকেও আমরা হারাতুম। তা ওর রমেশবাবা যদি ওকে রক্ষা করে মন্দ কি, কি বলেন স্যার?’ কাটা ঠোঁট ফাঁক করে পাঁচু হাসে। শিবনাথ নীরব। ক্লান্ত, সত্যি ভীষণ ক্লান্তিবোধ করছিল সে এদের এ সমস্ত কথাবার্তা, অমল, বলাই কি রমেশ সংক্রান্ত নিন্দাবাদ শুনে। কিন্তু হুট করে উঠে পড়ার উপায়ও ছিল না। অগত্যা নিরুপায় হয়ে সে সময় দেখতে এদিক ওদিক তাকায়। পাঁচুর সেলুনে সব আছে, ঘড়ি নেই।

‘মশায় সে-কথাই এতক্ষণ বোঝাচ্ছিলাম পাঁচু ভায়াকে। ওপরের ঘরখানা কাউকে ভাড়াটাড়া না দিয়ে সে নিজেই রাখুক। এবং আমি ক্রমাগত দুদিন চিন্তা করে ওকে যে বুদ্ধিটা দিলুম তাতে সে মোটেই সাহস পাচ্ছে না। বলছে চলবে না–’

কি বুদ্ধি–প্রশ্নটা মুখ দিয়ে বার করল না শিবনাথ। একটু উৎসুকভাবে সে মাস্টারের মুখের দিকে তাকাল। পাঁচু শিবনাথের দিকে তাকিয়ে হাসছিল। ‘আমি কি আর কাউকে ডেকে আনছি ঘরভাড়া দিতে, বুঝেছেন স্যার? যেন খবর পেয়ে মাছির মত সব উড়ে এসে আমায় ছেঁকে ধরছে। পঞ্চানন তলার রাখহরি সরখেল বলছিল আমায় দাও, ষাট টাকা সেলামী নাও, আমি আমার বেহালা হারমোনিয়ামের দোকান ওদিক থেকে তুলে এদিকে নিয়ে আসি, সেখানে সুবিধা হচ্ছে না; চিংড়িঘাটার তারিণী চক্রবর্তী চেয়েছিল এ্যালোপ্যাথি ওষুধের দোকান খুলতে, নব্বুই টাকা সেলামী সাধল; মঠপুকুরের মোহন চাইছে এটাকে তার দাঁত তোলাই বাঁধাই- এর চেম্বার করতে; পাগলডাঙ্গার সেই চাঁদসীর ডাক্তার কি যেন নাম, ওপরের একখানা ঘরের জন্যে তিনবার এসে ঘুরে গেছে দু’মাসের এ্যাডভান্স ভাড়া নিয়ে।’

পাঁচু থামতে বিধু মাস্টার বলল, ‘আরো বল, থামলে কেন, সেই যে চীনা-বাজারের সোনার দাঁত পরা বুড়ো চীনাটা কত টাকা যেন সেলামী সেধেছিল? সলভেন্ট পার্টি, কিন্তু পাঁচু ভায়া তাকেও বিদায় করে দিলে এক কথা বলে।’

কি কথা, যেন জানতে উৎসুকভাবে শিবনাথ পাঁচুর দিকে তাকায়। পাঁচু কিছু বলে না। নতুন সিগারেট ধরিয়ে দরজায় সামনে দাঁড়িয়ে রাস্তার দিকে মুখ করে কি ভাবে। পাঁচুর হয়ে বিধু বলল, ‘এক কথা ভায়ার আমার : সেলামীর টাকা বিষ্ঠা, ও আমি হাত দিয়ে ছুঁই না। আমার কি রোজগারে ভাঁটা পড়েছে যে, ইয়ে নিয়ে হাত কালো করব। দেখুন দেখুন, শিবনাথবাবু, আজও যে পৃথিবীতে ধর্ম আছে, চন্দ্র-সূর্য ওঠে পাঁচু তার বড় প্রমাণ। না, পাঁচুর সামনেই আমি বলি, মদ খাক আর ইয়ে বাড়ি যাক, পাঁচুর অন্তরটা মহৎ, সে কত খাঁটি আমি তার পরিচয় পেয়েছি। চোখের সামনে তো দেখলাম, সাধারণ একটা ঘরভাড়া দেওয়ার ব্যাপারে–’

যেন প্রশংসার উচ্ছ্বাসে মাস্টারের চোখে জল এসে গেল। দরজা থেকে স’রে এসে পাঁচু শিবনাথের সামনে দাঁড়ায়। শিবনাথ উঠি উঠি করে উঠতে পারছে না।

‘যাকগে, আসল কথা বলি আপনাকে শিবনাথবাবু, পাঁচু যদি একান্তই এখন কাউকে ঘর না দেয়, আমি বলছিলাম কি, উঠতি অঞ্চল, লোকজনের বিলাস-ব্যসনও বেড়েছে খুব, শহরে অবশ্য এর অভাব নেই, ক্যানেল সাউথ রোডে আজ যদি একটা ম্যাসেজ-ক্লিনিক খোলা যায় ভাল চলে। এ-সম্পর্কে আপনার কি অভিমত?’

শিবনাথ ফ্যাল্ ফ্যাল্ চোখে বুড়ো মাস্টারের দিকে তাকিয়ে রইল। বিধু মাস্টার হেসে মাথা নেড়ে বলল, কাল রাত্রে আইডিয়াটা আমার মাথায় এল। চামেলীকে পড়িয়ে ওখান থেকে বেরিয়ে, বুঝলেন শিবনাথবাবু, খালপার ধ’রে হাঁটছি আর প্রবলেম্‌ম্স অব প্রেজেন্ট ডেজ্‌–এই ধরুন খাওয়া-পরার কষ্ট, জিনিসপত্রের মহার্ঘতা, দেশের বেকার সমস্যা, কুটির-শিল্প ইত্যাদি হাজারটা ভাবনা আমার মাথায় কুট কুট করছিল, এমন সময় হঠাৎ খেয়াল হ’ল আমাদের এ-অঞ্চলে ডাইং ক্লিনিং, চুল কাটার সেলুন আছে, সিনেমা, রেস্টুরেন্ট ইত্যাদিও দিন দিন বাড়ছে, কিন্তু অবশ্য আমি পাঁচুকে বলছি না যে, আমার সাজেশানটা চূড়ান্ত, এসম্পর্কে তুমি আরো দু’ একজন ভাল লোকের সঙ্গে পরামর্শ ক’রে দ্যাখো, আমার তো মনে হয় ওপরের কামরাটায় একটা ম্যানেজ-ক্লিনিক স্টার্ট দিলে ভাল চলে, আপনার কি মত?’

শিবনাথ কথা বলার আগে পাঁচু হাসল।

‘মাস্টার তো ব’লে খালাস, কিন্তু ম্যাও ধরে কে। ক্লিনিক খোলার হাঙ্গামা অনেক দাদা।’

‘কেন, হাঙ্গামাটা কি?’ বিধু মাস্টার উত্তেজিত হয়ে বলল, ‘কিছু হাঙ্গামা নেই, এ তোমার রেস্টুরেন্ট কি হোটেল না যে, চিনি বা চালের জন্যে পারমিট যোগাড় করতে হাঁটাহাঁটি ক’রে পায়ের ছাল তুলতে হবে,–ভাল ক’রে একখানা সাইনবোর্ড করাতে হবে আর যৎসামান্য ফার্নিচার। খুব যে একটা মোটারকমের ক্যাপিটেলের দরকার আমার তো তা মনে হয় না, কি বলেন, স্যার?’

শিবনাথ একটুখানি ‘হুঁ’ শব্দ ক’রে শুধু মাথা নাড়ল। যেন কি ভেবে ঈষৎ হেসে ঠাট্টার সুরে পাঁচু বলল, কিন্তু তা’তে মাস্টারের যে খুব একটা সুবিধা হবে আমার তো মনে হয় না, আপনি বলুন শিবনাথবাবু, দোকান টোকান হ’লে কানু না হয় দাঁড়িপাল্লা ধ’রে দু’টো পয়সা রোজগার করতে পারত; আমাকে মেয়েমানুষ রাখতে হবে বাবুদের গায়ে তেল মাখাতে, নরম হাতের ব্যবস্থা না রাখলে এই শহরতলীতেও আমি ম্যাসেজ-ক্লিনিক চালাতে পারব না। লস্ খাব।’

কথা শেষ ক’রে পাঁচু টেনে টেনে হাসতে লাগল। শিবনাথের কপালের দু’ দিকের রগ টিপটিপ করছিল। কিন্তু তা হলেও এমন একটা সুযোগ উপস্থিত হচ্ছিল না যে, এই প্রসঙ্গের ইতি জানিয়ে ‘আচ্ছা উঠি আমি, কাজ আছে–’ বলে উর্বশী হেয়ার কাটিং সেলুনের চৌকাঠ ডিঙ্গিয়ে রাস্তায় নামবে।

অসহায় চোখে তাকিয়ে থেকে শিবনাথ বিধু মাস্টারের উত্তর শুনল।

‘পাঁচু, তুমি কারবারে হাত দিয়েছ আর আমার ছেলেকে প্রভাইড করার দরুন তা অমনি ফেল্ পড়ল, অন্তত আমি যতক্ষণ বেঁচে আছি হ’তে দেব না। জান তো আমার পেশা গুরুগিরি। মাস্টারি। শিল্পে, সংস্কৃতিতে জাতি যাতে উন্নতির পথে চলে, মানুষকে সেই শিক্ষা ও প্রস্তাব দেওয়াই আমার কাজ। আমি কানু সম্পর্কে অন্যরকম চিন্তা করে রেখেছি। রাত্রে ভেবে সব প্ল্যান ঠিক করেছি। কানুকে মালিশের কাজে রাখা হবে না। ও থাকবে বাইরে। বাবুদের ডেকে আনবে। এই খোট্টা পাড়ায় এখনো যেখানে অসভ্য অশিক্ষিতের সংখ্যা বেশি, ডোম আর ধোপাদের প্রাধান্য, আজ হঠাৎ সেখানে যে তুমি চমৎকার একটি ম্যাসেজ-ক্লিনিক, যার আর এক নাম হেল্থ-ক্লিনিক, খুলে বসেছ তা একটু এদিক-ওদিক ঘোরাঘুরি করে ভদ্রলোকদের না জানিয়ে দিলে তাঁরা টের পাবেন কেন, আসছেনই বা কি ক’রে, কি বলেন শিবনাথবাবু, আপনি রেগুলারলি কাগজ পড়েন। হেলথ-ক্লিনিকের নাম শুনেছেন নিশ্চয়ই।’ কথা শেষ ক’রে মাস্টার টেনে টেনে হাসতে লাগল।

পাঁচু কথা না ব’লে দরজায় দাঁড়িয়ে সিগারেট টানল।

বিধু মাস্টার ঘাড়টা সেদিকে ফিরিয়ে বলল, ‘বেশ, না হয় সেভাবে কানুকে প্রভাইড করা হোক, বাঁধা মাইনে দিতে তোমার আপত্তি, না হয় কমিশন বেসিসে কাজ করুক, কি বলেন মশাই, আপনি চুপ ক’রে আছেন কেন, পাঁচুকে পরামর্শ দিন।

শিবনাথের মেজাজ গরম হয়ে উঠল। এখানে অবশ্য ছেলের গাড়ি-চাপা পড়া, কি মেয়ের ভাবি বরের হাতে ছোরা খাওয়ার আশঙ্কার মামলা না। ছেলের চাকরির প্রশ্ন।

‘কি মশাই বলুন!’ বিধু অধীরভাবে অপেক্ষা করছিল।

শিবনাথ বলল, ‘মন্দ কি।’

উত্তেজিত হয়ে বিধু মাস্টার বলল, ‘না, একেবারে সবগুলো ম্যাসেজ-ক্লিনিক খারাপ ব’লে যে কাগজে আজকাল লেখালেখি হ’চ্ছে তা আমি বিশ্বাস করছি না, এখানে আদার পার্টির এই ইন্ডাস্ট্রিটা নষ্ট করার অথবা এই ইন্ডাস্ট্রির মিথ্যা বদনাম তুলে প্রেজেন্ট গভর্নমেন্টকে ঘায়েল করার চেষ্টা আছে। সব আইনই আইন না, সব আনন্দই খারাপ না। স্ট্যান্ডার্ড হেল্থ ক্লিনিক ব’লে আমেরিকা, ফ্রান্স, ইংলন্ডে, এমন কি এত যে প্রগতিশীল দেশ রাশিয়া সেখানেও প্রচুর আছে। এবং আর পাঁচজন পারছে না ব’লে পাঁচুও যে স্ট্যান্ডার্ড ঠিক রেখে এই অঞ্চলে একটা হেল্থ ক্লিনিক চালাতে পারবে না, আমি তা বিশ্বাস করি না। ওর সেলুনখানা দেখুন কত সুন্দর। কত ভদ্র। একটা ভদ্রলোকের ড্রইংরুম ব’লে মনে হয়।’

পাঁচু কথা বলছে না।

শিবনাথ এবার সুযোগ পেল : ‘হ্যাঁ, ওটা আপনাদের দুজনের মধ্যে কথাবার্তা ব’লে ঠিক ক’রে নিন, এ-সম্পর্কে আর কি বলব, তা’ছাড়া–’

‘হেল্থ ক্লিনিক সম্পর্কে আপনার আইডিয়া কম, এই তো বলতে চান।’ দাড়ির জঙ্গলে হাত বুলিয়ে মাস্টার বলল, ‘আমার একেবারেই নেই। তবে পাঁচু–আমিও কথার কথা বলছি, একটা বুদ্ধি দিচ্ছি শুধু। যদি এরকম একটা কিছু খোলা যায় তো মন্দ হয় না। এবং খুললে কানুকেও কাজে লাগানো যায়, হ্যাঁ ফর দি ডেভলাপমেন্ট অব্ দি ইন্ডাস্ট্রি। বাবুদের ডেকে আনা মানে ম্যাসেজ-ক্লিনিকের একটা পাবলিসিটি দেওয়া। না মশাই, আমার অত প্রেজুডিস নেই। আমার ছেলে যদি ম্যাসেজ ক্লিনিকের, কি হোটেলের কি রেস্টুরেন্টের কি অন্য কোনরকম এস্টাবলিসমেন্টের বয়গিরি ক’রে দু’টো পয়সা ঘরে আনতে পারে, আমি তা’তে তাকে নিরুৎসাহ করব না। কে. গুপ্ত যে তার মেয়েটাকে রেস্টুরেন্টে ঢুকিয়ে দিয়েছে এইজন্য পাগল ছাগল হ’লেও কে. গুপ্তর স্পিরিটটাকে আমি প্রশংসা করি। তবু তো রমেশ ক্ষিতীশের অনুকম্পা বা দয়ায় যা-ই বলুন, পরিবারটা, এখনো দাঁড়িয়ে আছে। যা দিনকাল পড়েছে। মা জগদম্বা!’

বলতে বলতে মাস্টার দুই হাতে মুখ ঢেকে হঠাৎ যেন গভীর চিন্তায় মগ্ন হয়ে গেল। পাঁচু ভাবছে আর সিগারেট টানছে আর তার কপালের রগ দু’টো এক একবার ফুলে ফুলে উঠছে লক্ষ্য ক’রে ‘আচ্ছা চলি’ বলে শিবনাথ সেখান থেকে বেরিয়ে রাস্তায় নামল।

শিবনাথ দ্রুত হাঁটছিল। বিধু মাস্টার পিছন থেকে এসে সজোরে তার হাত চেপে ধরল। একটু অভদ্রের মতই শিবনাথ হাতটা ছাড়াতে চেষ্টা ক’রে বলল, ‘আবার কি, আমার কাজ আছে দেখতে পাচ্ছেন।’

‘শুনুন শুনুন। পাঁচুর সামনে তো আর বলতে পারিনি। আসল কথা হল কি-

মাস্টারের মুখের পচা ভ্যাপসা গন্ধটা শিবনাথের নাকে লাগতে তাড়াতাড়ি সে পকেট থেকে রুমাল বার ক’রে নাকের ওপর চেপে ধ’রে বলল, ‘আমি তো বলেছি, এসব আপনাদের ব্যাপার, আমাকে আর এর মধ্যে ডেকে নিয়ে–’

‘আচ্ছা, আপনি রাগ করছেন।’ মাস্টার নাছোড়বান্দা। ‘শুনুন স্যার, আসল কথা হল কি, পাঁচু ঘর দু’টো অমনি ফেলে রাখবে, দেখবেন, বাড়তি কিছু টাকাপয়সা খাঁটিয়ে যে একটা কারবার টারবার খুলবে তাকে দিয়ে তা আশা করা যায় না। বলবেন কেন? আপনি নিশ্চয় খোঁজ রাখেন, সন্ধ্যে হতে ব্যাটা গিয়ে শুঁড়িখানায় ঢোকে, সেখান থেকে বেরিয়ে বাজারে মেয়ে-মানুষের ঘরে যায়,–অর্থাৎ মেজর পোর্শন অব হিজ ইনকাম এভাবেই সে নষ্ট ক’রে ফেলছে। এদিকে কিছু করব করব ক’রে কাউকে ভাড়া দিচ্ছে না ঘর দু’টো। এখন আমার কথা হচ্ছে কি, ওই যে বললাম ম্যাসেজ-ক্লিনিক—’

নোংরা দাঁতগুলো বার ক’রে বিধু মাস্টার হাসতে লাগল। যেন নিরুপায় হয়ে দাঁড়িয়ে শিবনাথ সেই হাসি দেখল।

মাস্টার বলল, ‘আপনি বুঝতে পারছেন কেন আমি তাকে এ ধরনের একটা সাজেশান দিলাম? হা–হা। এখানে অপজিট সেক্স নিয়ে কারবার। বলতেই পাঁচু নিমরাজী হয়েছে। না হয়ে উপায় কি। কথায় বলে যেমন দেবতা তেমন তার নৈবদ্য সাজাতে হয়, তবেই দেবতা সন্তুষ্ট থাকে–হ্যাঁ হা। এখন নিশ্চয়ই আপনি পাঁচু ভায়াকে এ ধরনের একটা প্রস্তাব দেয়ার তাৎপর্য রিয়েলাইজ করতে পারছেন।’ একটু থেমে এদিক-ওদিক তাকিয়ে মাস্টার ফিসফিস করে বলল, ‘ক্লিনিক খুলে ও তার ভেতর যা খুশি তা করুক, আমার কি, আমার ছেলেকে তো আর রাখা হচ্ছে না। বাইরে থেকে ও কাজ করবে। মানে যে দিনকাল পড়েছে। এনি হাউ পাঁচু একটা কিছু আরম্ভ করলে কানুটার যদি একটা প্রভিশন হয়ে যায়, তাই এত কথা–’

‘ভাল।’ সংক্ষেপে উত্তর সেরে শিবনাথ হাঁটবার উপক্রম করল। কিন্তু মাস্টার সঙ্গ ছাড়ল না। হাঁটা অবস্থায় বলল, ‘আগেও বলেছি আপনাকে, মান সম্মান বোধটা আমার একটু কম। আমার কেন, আমার মত অবস্থায় পড়লে সকলেরই কমে যাওয়া উচিত এদিন, কি বলেন?

কিছু বলল না শিবনাথ এবং মাঝখানে বেশ একটু ফাঁক রেখেই সে বিধু মাস্টারের সঙ্গে হাঁটতে লাগল। কিছুমাত্র হতোদ্যম না হয়ে মাস্টার জঙ্গলে ভর্তি মুখটা ওদিকে ফিরিয়ে রেখে বলে চলল, ‘তার ওপর মশাই বুঝতে পারছেন, আমার ওয়াইফ, অর্থাৎ লক্ষ্মী এবার বিট্রে করবে বলে মনে হচ্ছে। ওই যে বলে বাঘ এলো, বাঘ এলো, এবং বাঘ এলো যেদিন সেদিন আর কেউ গেল না। ঠিক সেই অবস্থায় পড়বে সাধনার মা, দেখবেন আপনারা স্বচক্ষে। অম্বলের বেদনা উঠতেই ব্যথা উঠেছে চিৎকার করতে করতেই একদিন ঠিক ডেলিভারী পেনটি ডেকে আনবে। অর্থাৎ যেদিন আমার হাতে একটি আধলাও থাকবে না। এবং এ- বাড়িতে এমন একটি লোক নেই জানেন যে পাঁচ আনা পয়সা কর্জ চেয়ে পেয়ে পরে তা দিয়ে আমি এম্বুলেন্স ডাকতে টেলিফোন করব। কি বলেন?’

৩১

একটা বাক্স বোঝাই মোষের গাড়িকে আড়াল করে শিবনাথ তাড়াতাড়ি বাঁদিকের গলিতে ঢুকে পড়ল। লক্ষ্মীমণির ব্যথা-বেদনার কথা বলছিল যখন, তখন প্যাকিংবাক্স বোঝাই গাড়িটা বিপরীত দিক থেকে এসে মাস্টারকে আড়াল করে দিয়ে শিবনাথকে রক্ষা করল। ‘আচ্ছা চলি টা আর শিবনাথকে বলতে হ’ল না।

জন্তু জানোয়ার! মাস্টারের চেহারা, চুল দাড়ি পোশাকের সঙ্গে ম্যাসেজ ক্লিনিকের প্রস্তাবটার সামঞ্জস্য কোথায় যেন মনে মনে খুঁজতে খুঁজতে ক্লান্ত হয়ে সে রমেশের রেস্টুরেন্টে এসে ঢুকল।

‘আসুন স্যার, আসুন। সারাদিন ছিলেন কোথায়?’ গুমোট থাকাতে রমেশের মাথায় টুপি : কি হাতে দস্তানা নেই।

‘এই নানা কাজে ঘোরাঘুরি।’ শিবনাথ সরাসরি চায়ের কথা বলতে গিয়ে কাউকে দেখতে পেল না।

‘বসুন স্যার, জলটা ফুটছে।’

শিবনাথের চায়ের নেশা পেয়েছে লক্ষ্য করে রমেশ খুশি হয়ে বলল, ‘আমিও একটু খাব।’ বলে ঠিক এক মিনিট অপেক্ষা করার পর উঠে পর্দার ওপারে চলে গেল। শিবনাথ একমিনিট সময় চেয়ারে একলা বসে পিছনে ফেলে আসা শেখর ও বিধুমাস্টারের কথা চিন্তা করল না, কেননা সেখানেই সে ওদের সঙ্গে সম্পর্ক শেষ করে এসেছে, নিজের একটু বিশেষ দরকারী কাজে সে এত রাত্রে রেস্টুরেন্টে ঢুকেছে। তা ছাড়া চা। ‘দোকানে আরো খোলা রাখবেন নাকি?’ রমেশ নিজের হাতে দু’বাটি চা করে নিয়ে আসতে শিবনাথ প্রশ্ন করল, ‘ওরা কোথায়? আপনার ভাই, বেবি, কাউকে দেখছি না।’

‘আপনি কি মনে করেন যে, কর্মচারীরা না থাকলে মালিক ম্যানেজাররা চুপ করে বসে খদ্দের এসে চা না খেয়ে ফিরে যাচ্ছে চোখের ওপর দেখতে পারে? তা, তাহলে গণেশ ওল্টাতেও বেশিদিন বাকী থাকে না।’

‘না না, তা না।’ শিবনাথ একটু লজ্জিত হ’ল। হাত বাড়িয়ে রমেশের হাত থেকে চা-টা তুলে নিল।

‘তারপর আপনি দেখা করেছিলেন?’

শিবনাথ চায়ে চুমুক দিয়ে ঘাড় নাড়ল।

‘উত্তম চা। আপনি দেখছি মশাই সকল রকমে গুণী।’

‘হতে হয় স্যার, দিনকাল যেমন খারাপ পড়েছে ভাল চা করাটা শেখা থাকলে বেগতিক দেখলে কোনো রেস্টুরেন্টে চাকরি নিয়ে পেট চালাতে পারব।’ কথা শেষ করে দুবার টেনে টেনে হেসে রমেশ পরে গম্ভীর হয়ে গেল।

শিবনাথও গম্ভীর হয়ে রইল।

‘তারপর, আপনার কদ্দুর, কিছু সুবিধা হবে বলে সেখানে মনে করেন?’

শিবনাথ ইতস্তত করল প্রথমটায়, তারপর দীপ্তিরাণীর সঙ্গে আলাপের আদ্যোপান্ত গল্পটা রমেশের কাছে বলে ফেলল।

‘তবে আর কি।’ রমেশ চোখ বুজে মাথা নেড়ে বলে, ‘যখন অন্তরের কথাগুলো আপনাকে বলে ফেলেছেন তখন জানবেন যে, আপনাকেই পছন্দ ঠিক হয়েছে। দেখবেন ও-বাড়ির পার্মানেন্ট প্রাইভেট ট্যুইশানি আপনি ক’রে যাচ্ছেন, বছরের পর বছর। টাকা-পয়সা কোনদিক থেকে কোনদিন আটকাবে না। অর্থাৎ আপনি এখানে আমাদের সঙ্গে একজন স্থায়ী বাসিন্দা হয়ে গেলেন। তা ভদ্রলোকরা থাকতে আরম্ভ করেছেন যখন জায়গাটা খুব খারাপ না। শুনতে খারাপ শোনায় আর কি। কুলিয়াটেংরা। যেন সব কুলি থাকে। আর ওরা মরা টেংরা মাছ খায়।

শিবনাথ চুপ করে রইল।

পুরু ঠোঁট দুটো টিপে হেসে রমেশ আবার প্রশ্ন করল, ‘কতক্ষণ ছিলেন ওখানে?’

‘আধঘণ্টা।’

‘এই ফিরলেন বুঝি?’

‘না, মশাই, আপনাদের এখানে এত বিচিত্র রকমের মানুষও আছে’, বলে আর একটু ইতস্তত করতে করতে শিবনাথ হাসল।

‘বলুন না, আমি সব জানি, এখানকার ইতিবৃত্তান্ত আপনি আমাকে কিছু নতুন শোনাবেন কি?’ রমেশ তার কোটের থেকে নস্যির কৌটো বার করল। রুপোর। শিবনাথ আজ এই প্রথম লক্ষ্য করল ওটা।

ডাক্তারের মেয়ে-সংক্রান্ত গল্পটা শিবনাথ বলতে রমেশ দাঁতে এবং নাকে একসঙ্গে হাসল। ‘মশাই, ওসব হবে আমি জানি। এক উঠোনের উপর আছি। সহ্যও করা যায় না, আবার বলতে যাওয়াও বিপদ। স্বয়ং প্রভাতকণা ওই ছোকরাটাকে পেয়ে প্রথম থেকে যেমন ঢলাঢলি করছিল, তখনই জানি এ প্রেমবন্যার পরিণতি সাংঘাতিক।’ কিছুক্ষণ চুপ থেকে চা-টা শেষ করে পরে চোখ দুটো বড় ক’রে রমেশ প্রশ্ন করল, ‘বলেন কি? স্ট্যাব্ করবে সুনীতিকে না পেলে? সুধীর শাসিয়ে গেছে বুঝি শেখরকে?

‘শুনছি তো।’

রমেশ রায় কিছু মন্তব্য করল না।

শিবনাথ বলল, ‘তা সব বস্তিতেই এরকম একটা দু’টো পরিবার থাকে।

‘আপনি জানবেন এর মূল কারণটা অর্থনৈতিক।’ বড় বড় চোখে রমেশ শিবনাথের দিকে তাকায়। ‘মশাই, এখন যে সুনীতির মারও না করবার উপায়টি নেই। এখন সুধীরকে না করতে গেলে সুধীর সব ফাঁস ক’রে দেবে।’

‘কি রকম?’

‘অনেক তেল খেয়েছে ডাক্তারের গিন্নী। বুঝেছেন মশাই। জামাইয়ের আদর দেখিয়ে সুধীরের মাথায় হাত বুলিয়ে অনেক তেল শুষে নিয়েছে চালাক মেয়ে প্রভাতকণা। আর সেই তেল দিয়ে ভেট্‌কি মাছ আর ধাপার বাজারের বড় বড় গলদা চিংড়ি ভেজেছেন।’

একটু চুপ থেকে শিবনাথ বলল, ‘তবে যে শুনেছি ডাক্তারের রোজগার ভাল, তেলিপাড়ায় জেলেপাড়ায় ওর মেলাই পয়সাওয়ালা পেসেন্ট।’

‘ওই শুনতেই সোনার গাঁ, কে মশায় তলায় আর হাত দিয়ে দেখতে গেছে কা’র কত মাসিক ইনকাম। এসব গুহ্য খবর। দেখে আমাদের পরিবারের চোখ টাটাবে। ভাই সুধীরের কাছ থেকে টাকা কর্জ চেয়ে নিয়ে মা মেয়ে সুধীরকে দিয়েই দ্বারিক আর ভীমনাগের সন্দেশ আর বড়বাজারের আপেল আতা আনিয়ে খেয়ে খেয়ে ধ্বংস করেছে। শুনলাম আমার স্ত্রীর কাছে সব। ভুবনবাবুর ওয়াইফ ওকে বলেছে।’

‘তাই নাকি?

‘হ্যাঁ।’ দুই চোখ বিস্ফারিত করে রমেশ নাসারন্ধ্র স্ফীত করল এবং এতটা নস্যি নিল।

নস্যি নেওয়া শেষ করে বলল, ‘কাজেই টাকা আদায় না-করা পর্যন্ত সুধীর এখান থেকে নড়ছে না, আর সুনীতির গা থেকে হাত নামাচ্ছে না। এখন বাধা দিতে গেলেই রক্তারক্তি।’

‘কি বিশ্রী ব্যাপার!’

শিবনাথ নিজের মনে বিড়বিড় করে উঠল। এবং আবহাওয়াকে একটু তরল করার চেষ্টায় সে বিধুমাস্টারের গল্পটা তুলল।

বলা শেষ করতে রমেশ খুক করে হেসে বলল, ‘আমি শুনেছি। আমার কাছে ক’দিন ইতিমধ্যে ঘুর ঘুর করছিল টাকার জন্যে। ছেলেকে দিয়ে কী ব্যবসা খোলার ইচ্ছা। আমি স্রেফ না বলে দিয়েছি। কেন দেব বলুন, ব্যবসা তো করবে না, টাকাগুলো জলে ফেলে দেবে পুত্রধন কানু।

‘চরিত্র-টরিত্র?’ শিবনাথ প্রশ্ন করতে রমেশ ভ্রূকুঞ্চিত করে মাথা নেড়ে বলল, ‘সেদিক থেকে এখন কিছু বলব না। আসলে ওই টাকা পেয়ে লক্ষ্মীমণির ছেলে বাবাজীবন কানু কি করবে তাই বলছি শুনুন। রবীন্দ্র গ্রন্থাবলীর পুরো সেট কিনিয়ে ফেলাবে ছেলেকে দিয়ে লক্ষ্মীমণি, হ্যাঁ, সব কবিতার বই। ‘

‘লক্ষ্মীমণির বুঝি খুব কবিতা পড়ার শখ?’

‘হ্যাঁ, বিয়ের আগে থাকতে। বিধু সেদিন আমায় তার স্ত্রীর গল্প শোনাচ্ছিল।’ রমেশ ব্যঙ্গের সুরে হেসে উঠল। ‘সেই শখ বিয়ের পর এবং এখনো পুরোমাত্রায় আছে। বলছিল, বিধু। এতগুলো গর্ভে এসেছে বলে লম্বা কবিতা মুখস্ত করার এখন সময় পান না। তাই ছোট ছোট ছড়া মুখস্ত করে রেখেছে গিন্নী। ভোরবেলা ছেঁড়া কাঁথায় শুয়ে এক কুড়ি বাচ্চা নিয়ে সেগুলোর চর্চা করে।’

‘না না, এতগুলো হবে না।’ শিবনাথ ‘কুড়ি’ কথাটায় আপত্তি জানিয়ে মৃদু হাসল। ‘আহা যা-ই হোক, না হয় চৌদ্দটা। কিন্তু মাস্টারের আয়টা কি? গিন্নী যে বড় সবগুলোকে ইস্কুলে পাঠিয়ে সরস্বতী গণেশ করতে উঠে পড়ে লেগেছে আর কবিতার বই কিনছে, ওদিকে যে মাস্টার হালে পানি পাচ্ছে না।’

শিবনাথ চুপ করে রইল।

‘আর একবার কার কাছ থেকে গোটা ত্রিশ টাকা এনেছিল বিধু, সব বলল আমায়, ছোটটাকে একটা বিস্কুট পাঁউরুটি লজেঞ্জুস বাতাসা এবং সম্ভব হলে তার সঙ্গে একটা তেলেভাজার দোকান খুলে পাড়ার মধ্যে কোথাও এক জায়গায় বসিয়ে দেবে।’

‘তারপর?’

রমেশ বলল, ‘কিন্তু ঢাকা বারান্দায় সুবিধামত জায়গা পাওয়া গেল না। কে দেবে, কার ক’খানা পাকা ঘর আছে এ পাড়ায়। কাজেই–‘

ব্যাপারটা বুঝতে পেরে শিবনাথ আস্তে মাথা নেড়ে বলল, ‘ওদিকে রাস্তার ধারে একটা গোটা কামরা ভাড়া নেবারও ক্ষমতা নেই।‘

‘সেই টাকাটা ঘরে রেখে মধুসূদন গ্রন্থাবলী, হেমচন্দ্রের কাব্য, আরও কি কি সব কাব্যের বই কিনে লক্ষ্মীমণি খরচ করে ফেললেন।’

‘রুচিটা মন্দ ছিল না। যেন কি আর একটু বলতে গিয়ে শিবনাথ রমেশের দিকে তাকিয়ে হাসল। রমেশ চোখ দুটো বড় করে বলল, ‘হ্যাঁ, এখন সব কাব্য ঘরে রেখে তিনি যাচ্ছেন হাসপাতালে, কাজেই পয়সার ধান্দায় বিধু এখন ছেলেকে তাড়াতাড়ি একটা কিছুতে লাগাবার জন্যে পাঁচুকে ওই ধরনের একটা কিছু খুলে বসতে পরামর্শ দেবে বৈকি।’

শিবনাথ কিছু বলবার আগে রমেশ দাঁতের আগায় হিসহিস করে উঠল :

‘মাস্টার শেষ পর্যন্ত জুটেছে ভাল লোকের সঙ্গেই। পাঁচুর একটা ঠোঁট কাটা, আপনি লক্ষ্য করেছেন কি?’

শিবনাথ মাথা নাড়ল।

‘বাজারের কামিনী ওর ঠোঁট কেটে দিয়েছিল।’ রমেশ ছোট্ট নিশ্বাস ফেলে বলল, ‘পাঁচু ভায়া আমাদের টাকা-পয়সাটা বেশি চেনে কিনা, তাই একটা পয়সার জন্যে ও হাতের ক্ষুরখানা কারো গলায় বসাতে ভ্রূক্ষেপ করে না।’

শিবনাথ ফ্যালফ্যাল ক’রে রমেশকে দেখছিল।

‘একদিন পাঁচু আট বোতল কালিমার্কা কামিনীর ঘরে বসে খেয়ে কামিনীকে বেহুঁশ করে দিয়ে ওর গলার সাড়ে পাঁচশ’ টাকার বিছা হারখানা চুরি ক’রে নিয়ে সরে পড়েছিল।’

‘তারপর?’

‘সেই টাকায় পাঁচুর সেলুন। যান নি কোনোদিন? ধূপকাঠি জ্বালিয়ে রাখে। খুব সাজানো গোছানো দোকান।

একটু ভেবে পরে শিবনাথ প্রশ্ন করল, ‘তা কামিনী এখন কোথায়? পাঁচুর ঠোঁট কাটল কখন?’

‘তখনই। দুদিনের মধ্যেই হারের শোকে কামিনী পাগল হয়ে যায়। এ-সব গরীব অঞ্চল। কত টাকাই বা উপায় করে একটা মেয়ে, তা যত সুন্দরী হোক, ঘর থেকে কারোর পাঁচশ টাকার হার চুরি গেলে তার মাথা ঠিক রাখা কঠিন, বুঝেছেন।

‘‘ভীষণ লোক ভাদুড়ী।’ শিবনাথ বিড় বিড় করে উঠল।

‘কাজেই সাহায্যের জন্যে বিধু পাঁচুকে ধরবে না তো ধরবে কাকে?’

রমেশ আবার নস্যি টিপ নিল।

শিবনাথ কিছু বলল না।

এবার চোখ দুটো ছোট করে রমেশ প্রশ্ন করল, ‘কানুকে কি কাজে লাগাবে বললে। মাসাজ ক্লিনিক তো মেয়েমানুষ দিয়ে চালাতে হয়। আপনি গিয়েছেন কি এক আধটাতে? আমার বন্ধু রাসমণিবাজারের রমণী রায় একবার একটাতে আমায় নিয়ে গিয়েছিল। কাজেই এ সম্পর্কে এক-আধটু আইডিয়া রাখি।’

‘আমি যাইনি’,ঈষৎ হেসে শিবনাথ বলল, ‘কানুকে কমিশন বেসিসে কাজ করানোর প্রস্তাব। খদ্দের ডেকে আনবে।’

‘ভাল, আনুক।’ রমেশ রাস্তার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘জন্তু জানোয়ারগুলোর কথা আমায় বলবেন না। মাস্টার হলে কি হবে। বিধুটার মাথায় পদার্থ বলে কিছু নেই। আর থাকবেই বা কি করে। ইস্কুলের চাকরি ছাড়াও যদি আট টাকা, ছ’ টাকায় রাত বারোটা পর্যন্ত ঘুরে ঘুরে ট্যুইশনি করতে হয় তো মাথা খারাপ হবে না তো কি?’

‘তরকারির ব্যবসা করতে বলেছিল মাস্টার ছেলেকে। কথা শোনে নি।’ শিবনাথ বলল, ‘তাঁর স্ত্রীর বুদ্ধিটাই একটু বাঁকা; কানুকে তিনি নিষেধ করেন।’

‘আর নিষেধ শুনবে না। সেদিন মাস্টার আমার কাছে টাকা চেয়ে না পেয়ে রাগ করে প্রতিজ্ঞা করে গেছে। অপমানের হাত থেকে বাঁচবার জন্যে যে-কোন মেহনতির কাজে ছেলেকে ঢুকিয়ে দেবে। লোকের নিন্দাবাদ কানে তুলবে না। আর যদি গিন্নী বাড়াবাড়ি করে তো হাসপাতালে যাত্রা করার আগে পেটে লাথি মেরে গিন্নীকে যমালয়ে পাঠাবে।’

‘হ্যাঁ ওই এক খেয়াল মাথায় চেপেছে বিধু মাস্টারের। সেদিন হঠাৎ কি একটা কারণে আমার সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে ম্যানুয়েল লেবার ম্যানুয়েল লেবার বলে খুব চেঁচাচ্ছিল।’

.

আলাপটা বাধা পেল।

বলাই কিন্তু বেশিক্ষণ দাঁড়াল না। শিবনাথকে দেখা সত্ত্বেও বলাই এমন ভান করল যেন দেখেনি। ভিতরে ঢুকে সোজা রমেশের সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। ঘাড়টা নামিয়ে রমেশের কানে কানে ফিসফিস ক’রে কথা বলে অন্য কোনদিনকে না তাকিয়ে আবার গটগট ক’রে বেরিয়ে যায়।

চামড়ার পেটে লাগিয়ে ক্ষুর দিয়ে ঘাড়টা চেঁছে পালিশ করা হয়েছে বলে এবং চমৎকার রঙের নতুন একটা হাফশার্ট গায়ে ও পকেটে নীল একখানা রুমাল থাকাতে এবং পায়ে কালো ভেলভেটের চটি দেখে শিবনাথের প্রথম চিনতে কষ্ট হচ্ছিল বলাইকে। যেন বাকি চুলে অনেকটা তেল ঢেলে স্নান করা হয়েছে। মাথায় অতিরিক্ত তেলটা চাঁছা ঘাড় চুঁইয়ে সার্টের মধ্যে ঢুকছিল। সেইজন্যে নতুন সার্টের কলারে একদিনেই দাগ ধরে গেছে।

বলাইকে ডেকে শিবনাথের বলতে ইচ্ছা হচ্ছিল যেন কলারের চারদিকে রুমালটা সে এই বেলা জড়িয়ে নেয়। তবে আর তেলের হলদে দাগ ধরবে না জামায়। কিন্তু সেরকম কোন কথা বলতে দেবার সুযোগ না দিয়ে অতি পরিচিত বলাই যখন রেস্টুরেন্ট থেকে বেরিয়ে গেল, তখন রমেশ বলল, ‘মশাই দেখেছেন। সংসারে সকলেই অক্ষম না। সক্ষম লোকও আছে। কে. গুপ্তর কথা ছেড়ে দিন। ওটা পাগলের পর্যায়ে পড়ে। পড়ে কেন, পাগলই বলুন। মাথার ঠিক নেই। আপনার এই পোস্টের জন্যে বিধু মাস্টারকেও পাঠিয়েছিলাম। হয়নি। কেন হয়নি শুনেছেন বোধ করি?’

হ্যাঁ, শিবনাথ ঘাড় নেড়ে বলল, ‘ভয়ানক ডার্টি। দীপ্তি বলছিলেন।’ শিবনাথ হাসল।

‘কে. গুপ্তও প্রার্থী হয়েছিল।’

রমেশ বলল, ‘অমলকেও গোড়ায় আর একটা সৎ পরামর্শ দিয়েছিলাম, কিন্তু নিতে পারলনা, জানেন বোধ হয়। কোথায় আছে হতভাগাটা এখন? শুনেছেন কিছু?’

‘ঘোলপাড়ায়।’

‘মরুক গে। যত ঝি ক্লাসের মেয়েছেলে আর গাঁটকাটা পকেটকাটার দল থাকে বাড়িটায়। আমি শুনেছি।’ রমেশ শিবনাথের দিকে না তাকিয়ে রাস্তার দিকে চোখ রেখে বলল, ‘দেখুন, এখন কাজের মানুষ কে। কথাটা বলতে চট্ করে ধরে ফেলেছে বলাই এবং সেটা কাজে লাগিয়ে কাল রাত্রেই একটা ভাল প্রফিট পেয়েছে?’

শিবনাথ রমেশের চোখে চোখে তাকাতে রমেশ চোখ দুটো গোল করে ফেলল, ‘বুঝতে পেরেছেন?’দাঁতে হিস হিস করে রমেশ জানায় : ‘চোখ-কান একটু সজাগ রেখে চললে এদিনে ঠকতে হয় না। অন্তত উপোসে মরতে হয় না। মিছা বলছি?’

শিবনাথ ঘাড় নাড়ল।

‘বলাই কি কোন বস্ত্র ব্যবসা-ট্যাবসা?’

‘তা বলতে পারেন; হ্যাঁ, ব্যবসা ছাড়া কি।

শিবনাথের চোখে কৌতূহল।

‘মশাই, চশমখোর হাড়কিপ্টে বলে আমার অনেক বদনামই আছে। আমি দুমুঠো ভাত খেয়ে আছি তাই এর-ওর চোখ টাটায়। টাটাবেই। কিন্তু আমি তা গ্রাহ্য করব কেন। কিন্তু এ- ও আপনাকে বলে রাখছি, দান-খয়রাত, সাহায্য, সহানুভূতি অপাত্রে ঢেলে পরে সেটা জলে গেল বলে হায়-আপসোস করব, সে-পাত্র আমি না।’

শিবনাথ কথা বলল না।

রমেশ শূন্যে হাত ঘুরিয়ে বলল, ‘ব্যবসা করতে বিধু টাকা চেয়েছিল। কি ব্যবসা করবে তুমি? তা-ও বলেছি তো আপনাকে, টাকাটা একবার ঘরে গেলে ওটা তার গিন্নী হাত করতো। আর যদি বা মাস্টার গিন্নীকে ফাঁকি দিয়ে সরাসরি সেটা খাঁটিয়ে কিছু আরম্ভ করে দেয়, ঐ তো বললাম, গাছতলায় তেলে-ভাজা দোকান, নয়তো ধাপার বাজারের লাউ কুমড়ো কিনে নিয়ে আর এক বাজারে বসে তার দোকানদারী। ক পয়সা আয় তাতে, কত মুনাফা থাকে?’

শিবনাথ ঠোঁট টিপে হাসল।

‘ও লোকটার দৃষ্টিভঙ্গীই এমন অথচ রাতদিন গালভরা কথা–বিজনেস, বিজনেস।’ রমেশ গম্ভীর হয়ে বলল, ‘কাজেই ব্যবসার জাত আছে, কারবারের রকম আছে। আপনাকে আমি অবশ্য সব এখন ডিসক্লোজ করব না; কিন্তু কাল বিকেল বলাই যখন এসে বলল, দাদা মাথা ঠিক করেছি, এই এই বিষয়, কাজেই কিছু টাকা না হলে কারবারে হাত দিতে পারছিনে। শুনে মনটা এত ভাল লাগল, তখনই বুঝলাম, শক্ত ধাত। কে. গুপ্ত না, অমল না, বিধু না–মাথাটা ঠিক রেখে চলে। না হলে, চোখের ওপর তো দেখছিলেন, উপোসে কি ও আর ওর পরিবার কম থেকেছে।’

‘তা তো বটেই।’ শিবনাথ ঘাড় কাত করল।

যেন কি একটু চিন্তা করে রমেশ পরে বলল, ‘আমার কানে সবই আসে। এখন থেকেই নাকি বলাইর নামে বাড়ির মাতব্বররা বদনাম গাইতে শুরু করেছে। আপনি শুনেছেন কিছু?’

‘না।’

শিবনাথ এদের সব ব্যাপার থেকে দূরে থাকতে চায়। সেইজন্য তার সতর্কতাও কম না। আছে এদের মধ্যে, কাজেই একথা সেকথা শুনতে হয়। শুনে ইংরেজিতে যাকে বলে, ‘ডিটো’ দিয়ে যাওয়া–হুঁ-হাঁ করে, তারপর সুযোগ বুঝে সরে আসে। কাজেই তখন সেলুনে পাঁচু ভাদুড়ী কি বিধু রমেশ বা বলাই সম্পর্কে কি সব কথাবার্তা বলছিল, এখন এখানে শিবনাথ তার বিন্দু-বিসর্গও প্রকাশ করল না। কেবল আগের মত ঘাড় কাত করে বলল, ‘ওদের সঙ্গে আমার তেমন কথাবার্তাই বা কি হয়। তখন হঠাৎ রাস্তায় বিধুর সঙ্গে দেখা হল, আর বকর বকর করে সাত-পাঁচ কত কি বললে সব মনেও নেই।’

রমেশ কতক্ষণ আর কিছু বলল না।

শিবনাথ উঠি-উঠি করছিল, এমন সময় দোকানে ক্ষিতীশ ঢুকল। সঙ্গে বেবি।

ক্ষিতীশ একটি কথা না বলে সরাসরি পর্দার ওপারে চলে গেল। বেবি, যেন খুব ক্লান্ত, মেঝের ওপর বসে পড়ল। উষ্কখুষ্ক চুল। হাত-পাগুলো দুদিনে আরও শীর্ণ হয়ে পড়েছে শিবনাথ লক্ষ্য করল।

‘কি ব্যাপার, ভাইকে দেখে এলি, এবেলা কেমন আছে?’ রমেশ প্রশ্ন করল। বেবি মুখ তুলল না। ‘ভাল না।’ বলল ও অস্পষ্ট গলায়।

‘ভাল মন্দ যেন তুই কত বুঝিস।’রমেশ অল্প হেসে শিবনাথের দিকে ঘাড় ফেরায়। শিবনাথ কিছু প্রশ্ন করবার আগে পর্দার ওপার থেকে ক্ষিতীশ বলল, ‘যেন ভাইকে কত ও দেখে এসেছে; ভাইকে দেখতে হাসপাতালে যাবে বলে বেলা দুটো না বাজতে দোকান থেকে বেরিয়ে শেয়ালদা ছুটে গেলেন তিনি। তখনই আমার সন্দেহ হয়েছিল।’

ক্ষিতীশ থামতে রমেশ একবার পর্দার দিকে তাকিয়ে পরে মাটিতে মুখ গুঁজে বসা বেবির দিকে চোখ রাখল।

‘কিরে, রুণুকে দেখিসনি?’

‘দেখেছি।’ ভয়কাতর বিমর্ষ মুখখানা একবার একটু সময়ের জন্য কে. গুপ্তর মেয়ে তুলে ধরল। বেবির চোখের কোনা চিকচিক করছে।

‘আজ আবার মারধর করেছিলি নাকি?’ পর্দার দিকে বিরক্ত চোখে তাকাল রমেশ রায়। ‘কি ব্যাপার! তুই কি চা করছিস নাকি?’

‘হুঁ!’ রুক্ষ অপ্রসন্ন স্বর ক্ষিতীশের। বাটির মধ্যে চামচ নাড়ার দ্রুত কঠিন শব্দ হল দু- তিনবার। তারপর ক্ষিতীশ বেরিয়ে এল।

‘কি হয়েছে তুই আমার পরিষ্কার করে বল্ না।’ রমেশ সোজা হয়ে বসল।

‘কি হয়েছে তুমিই জিজ্ঞেস কর না। আদর দিয়ে তুমিই তো ওর ইহকাল-পরকাল ঝরঝরে করে দিচ্ছ।’ ক্ষিতীশ গরম চা-য়ে চুমুক দিতে দিতে দরজার কাছে সরে গেল। চাপা একটা নিশ্বাস ফেলল রমেশ। এবার শিবনাথের নজরে পড়ল বেবির ফ্রকটা পিঠের দিকে একটা জায়গা ছিঁড়ে গেছে। যেন কিসের সঙ্গে খোঁচা লেগে সম্পূর্ণ নীরব ও নিরপেক্ষ থেকে সে দু ভায়ের কথা শুনল।

দরজা থেকে সরে এসে ক্ষিতীশ বেবি ও রমেশের মাঝখানে দাঁড়িয়ে বিকৃতকণ্ঠে বলল, তখনই আমার সন্দেহ হয়েছিল। হাসপাতাল খোলে বেলা চারটেয়। হেঁটে গেলেও শেয়ালদা যেতে আধ ঘণ্টার বেশি লাগে না। আর তিনি সেই ভরদুপুরে ছুটলেন, মনে মনে ভাবি বিষয় কি–’ কথা শেষ না করে ক্ষিতীশ কটমট করে আনতমুখী বেবির দিকে তাকাল।

রমেশ অসহিষ্ণু গলায় বলল, ‘কী হয়েছে, কি করেছে, ওখানে গিয়ে, তুই কি আমায় জানাবি না?’

বাকি চা-টা গলায় ঢেলে বাটিটা ঠক্ করে টেবিলের ওপর রেখে ক্ষিতীশ বলল, ‘আমি পৌনে চারটেয় এখান থেকে বেরোই। একপেটি চা ও আমার নিজের জন্যে একটা গামছা কিনতে এমনিও আজ আমাকে শেয়ালদা যেতে হত। ভাবলাম, অমনি কে. গুপ্তর ছেলেকেও একবার দেখে আসব। এক উঠোনে আছি, এক ইঁদারার জল খাই। তাছাড়া বেবি আমাদের দোকানে আছে, এদিক থেকেও ওদের সঙ্গে একটা সম্পর্ক দাঁড়িয়ে গেছে বৈকি। কী বলব দাদা তোমাকে, হাসপাতালের উল্টো দিকে হ্যাঁ, ঠিক সার্কুলার রোর্ডের ওপর একটা বেশ বড়সড় নতুন চায়ের দোকান হয়েছে–তুমি খেয়াল করেছ কি না, জানি না, হ্যাঁ শিখের রেস্টুরেন্ট ওটা। তখন ক’টা, এই ধরো সাড়ে পাঁচটা, চা ও গামছা কিনে আমি তাড়াতাড়ি হাসপাতালের দিকে যাচ্চি, উল্টো দিকের ফুটপাথে দেখলাম ফ্রক-পরা একটা মেয়ে। বেশ বড়, হ্যাঁ, আমাদের রুণুর চেয়ে মাথায় লম্বা, সুটফুট পরা ভারি কেতাদুরস্ত কোন ছেলের হাত ধরে গুটগুট করে যেন সেই রেস্টুরেন্টে গিয়ে ঢুকল। কত গণ্ডা মেয়েছেলে রাস্তায় চলে, হঠাৎ তো আর পিছনটা দেখে বোঝা যায় না, কিন্তু দোকানের চৌকাঠ ডিঙিয়ে ভেতরে ঢোকবার সময়, ওই যে কথায় বলে দুর্বল মন, কুকাজ করবার আগে ভয় পাচ্ছে কেউ দেখেছে কি না, গলাটা ঘুরিয়ে বেবি যখন টুক করে রাস্তার লোকজন দেখে নিচ্ছিল, তখনই আমি চিনে ফেললাম বজ্জাত মেয়েকে।’

‘তারপর!’ রুদ্ধশ্বাস হয়ে রমেশ ভাইয়ের কথা শুনছিল। ‘তারপর?’

‘তারপর তুমি বুঝতেই পারছ আমার রক্ত মাথায় উঠে গেল। হাসপাতালে আর যাব কি, লাফিয়ে রাস্তা পার হয়ে আমি সেই শিখের চায়ের দোকানে ঢুকলাম।’

‘গিয়ে কি দেখলি, ছেলেটার সঙ্গে বসে চা খাচ্ছিল? শুধু চা, না আর কিছু?’রমেশ বেবির দিকে একটা অগ্নিদৃষ্টি নিক্ষেপ করে পরে শিবনাথের দিকে তাকায়। ‘কি রকম বোঝেন মশাই। ‘

ক্ষিতীশ গলায় অদ্ভুত শব্দ করে বলল, ‘তুমিও যেমন পাঁচটা খদ্দেরকে না দেখিয়ে চা খাবে বলে কে. গুপ্ত মেমসাহেবের ইস্কুলে পড় গুণী মেয়ে বন্ধুর হাত ধরে বেছে বেছে ওই পর্দা- খাটানো খুপরি-করা রেস্টুরেন্টেই ঢোকে। নইলে আর পীরিত জমবে কেন?’

‘কতক্ষণ ছিল? ছেলেটা কোথায় থাকে, কে হয় ওর?’

‘কেউ না।’ ক্ষিতীশ হাতের দুটো আঙুল দেখিয়ে বলল, ‘এক বাটি চা নিয়ে ঠায় দু ঘণ্টা বসে থেকে ওখানে শিরদাঁড়া বেঁকিয়ে ফেলেছি। তা কি আর বেরোয় খুপরি থেকে। পর্দার এপিঠ থেকে আমি ওধারে হারামজাদীর খিলখিল হাসির শব্দ শুনেছি। তুমি এবার জিজ্ঞাসা করে দ্যাখো না কি বলে?’

‘এই, ওই ছেলের সঙ্গে তোর জানাশোনা কবে থেকে? কোথায় থাকে ও?’ চোখ লাল করে রমেশ প্রশ্ন করল।’

‘কথা বলছিস না কেন, উত্তর দে। কোথায় থাকে ছোঁড়া?’

‘পার্ক স্ট্রীট।’

‘তোর সঙ্গে কোথায় দেখা, আগে পরিচয় ছিল?’

বেবি মাথা নাড়ল।

‘হাসপাতালে দাদাকে দেখতে এসেছিল সন্তোষ। দাদার ফ্রেন্ড। ওদের পাড়ায় আমরা ছিলাম।’

‘তা তো ছিলিই, কিন্তু এতক্ষণ চায়ের দোকানের খুপরির মধ্যে বসে দুজন করছিলি কি? দাদার ফ্রেন্ড।’ বিশ্রী একটা শব্দ করলে রমেশ গলার।

বেবি নীরব।

‘দাদার ফেরেন্ড্, কাজেই ইনিরও বন্ধু। সহজ কথাটা তুমি ধরতে পারছে না কেন।’ক্ষিতীশ রমেশের দিকে না তাকিয়ে বেবিকে দেখছিল। ‘এ্যা, আমার চোখে ধুলো! তুই আমায় অন্ধকারে রেখে তোর পার্ক স্ট্রীটের সন্তোষকে নিয়ে চায়ের দোকানে বসে ঢলাঢলি করবি। এত বড় বুকের পাটা! বেরিয়ে যা এখান থেকে–আমি–আমি—’

ক্রুদ্ধ ক্ষিতীশকে শান্ত করতে রমেশ একটা হাত শূন্যে বাড়িয়ে দিল। ‘আহা, তুই এত বেসামাল হয়ে পড়লে চলবে কেন। দাঁড়া আমি বলছি, আমি বোঝাই–’

‘তুমি বুঝিয়েছ! তোমার বোঝানোর বড় তোয়াক্কা করে সেয়ানা মেয়ে। ও যে দিনকে দিন কত বড় বজ্জাত, বদমাস হতে চলেছে, তা তুমি টের পাবে কি করে। আমাকে তোমাকে ঘুমে রেখে ও ওর কাজগুলি ঠিক করে যাচ্ছে।’

‘কথা বলছিস্ না কেন?’ রমেশ আর বসে নেই। উঠে দাঁড়িয়ে গর্জন করে উঠল। ‘কি কথা হচ্ছিল এতক্ষণ পার্ক স্ট্রীটের সেই ছোকরার সঙ্গে। কি নিয়ে হাসাহাসি হচ্ছিল?’

বেবি নখ খুটছিল। মুখ তুলে আস্তে বলল, ‘হাসিনি তো।’

‘আলবৎ হেসেছিলি।’ক্ষিতীশ চিৎকার করে উঠল। আবার মিধ্যে কথা বলবি তো কিলিয়ে হাড় ভেঙ্গে দেব। আমার কানকে ফাঁকি। তুই ডালে ডালে চলিস, আমি চলি পাতায় পাতায়। অ্যা, হাসিনি! কানে আমি তুলো গুঁজে বসেছিলাম সেখানে।’

বেবি চুপ করে কাঁদছিল।

রমেশ আবার চেয়ারে বসে পড়ল।

শিবনাথ একদিন কপিক্ষেতে বেড়াতে গিয়ে ঝোঁপের পাশে দাঁড়িয়ে বলাইর মেয়ে ময়না ও রুণুকে পার্ক স্ট্রীটের টাই স্যুট-পরা সন্তোষকে নিয়ে কথা বলতে শুনেছিল, আজ তার মনে পড়ল। এবং সন্তোষ মাঝে মাঝে রুণুর সঙ্গে দেখা করতে এ-বাড়িতে এসেছে। আজ রুণুকে হাসপাতালে দেখতে আসা অস্বাভাবিক না এবং বেবিকে নিয়ে রেস্টুরেন্টে গিয়ে চা খাওয়াও অসম্ভব না। কিন্তু সেখানে দু ঘণ্টা বসে দুজনে গল্পসল্প বা হাসাহাসি সত্য কি মিথ্যা বুঝতে না পেরে শিবনাথ শুধু হাঁ করে তাকিয়ে বেবির কান্না, ক্ষিতীশের আস্ফালন এবং রমেশের কখনো গর্জন করে ওঠা, কখনো শান্ত হয়ে থাকার ছবি দেখতে লাগল।

‘বোঝাও, তুমি বুঝিয়ে দেখ কে. গুপ্তর মেয়েকে যদি লাইনে আনতে পার। আমার দোকানও না, কর্মচারীও না। ঠেকতে তুমিই ঠেকবে, আমার কি।’ বলে ক্ষিতীশ পেরেকে ঝোলানো একটা র‍্যাপার টেনে নিয়ে সেটা গায়ে জড়াতে জড়াতে আরো কি নিজের মনে বিড়বিড় করতে করতে দোকান থেকে হনহন করে বেরিয়ে গেল।

‘বুঝলেন, মশাই, আমার হয়েছে সব দিকে বিপদ।’

রমেশের কথায় শিবনাথ চোখ তুলল শুধু, কথা বলল না। রমেশ অনেকটা নিজের মনে ভাবতে লাগল। ‘ঘরে হাঁড়ি চড়ে না দিনের পর দিন উপোস থাকা হয়, ভাল মনে আমি জায়গা দিলুম এখানে, তা এরকম করলে, চলাফেরা সংশোধন না করলে বাধ্য হয়ে আমাকে ছাড়িয়ে দিতে হবে।’

বেবি চোখ মুছছিল।

‘তা তুই মনে মনে কি ঠিক করছিস?’

‘এখন আমি বাড়ি যাব। মা চিন্তা করছে।’

রমেশ সজোরে মাথা নাড়ল।

‘হ্যাঁ, তা তো যাবিই। আমিও এইবেলা দোকান বন্ধ করব। তা এখন নিয়ে কথা হচ্ছে না। কথা হচ্ছে প্রত্যেক দিন নিয়ে। ভাইকে দেখতে গেলি হাসপাতালে। গিয়ে চায়ের দোকানে বসে আড্ডা মারা হ’ল একটা বাঁদরের সঙ্গে। এসব একেবারে বন্ধ করতে হবে যদি আমার কাছে থাকতে চাও। আর তাছাড়া,–একটা ঢোক গিলে আপাদমস্তক বেবিকে দু’তিনবার লক্ষ্য করে রমেশ শিবনাথের দিকে চোখ ফিরিয়ে বলল, ‘তুমি যে এখনো কচি খুকিটি আছ সেকথা ভুলে যাও। রীতিমত বড় মেয়ে হয়ে গেছ, কি বলেন?’

শিবনাথ নিঃশব্দে ঘাড় নেড়ে রমেশকে সমর্থন করল। বেবি গায়ের ফ্রকটা হাঁটুর নিচে টেনে দিয়ে তেমনি মুখ গুঁজে বসে।

‘যাও আজ ঘরে যাও। যে কথাগুলো বললাম মনে রেখো। ক্ষিতীশ আজ আবার ভয়ানক চটেছে তোমার ওপর। কেন ও মাঝে মাঝে এমন চটে নিশ্চয়ই বুঝতে পার। তুমি ছোট না। ‘

রমেশ থামতে বেবি আস্তে আস্তে উঠে দোকান থেকে বেরিয়ে গেল।

রাস্তার দিকে বেশ কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে রমেশ কি যেন ভাবে।

শিবনাথ ভাবছিল। হঠাৎ আপনা থেকে মুখ দিয়ে বেরিয়ে পড়ল–’কে. গুপ্তর ছেলে কি শীগির সেরে উঠবে?’

প্রশ্নটা রমেশের কানে যেতে সেদিকে ঘাড় ফিরিয়ে দার্শনিকের মত একটুখানি হাসল। ‘জানি না, ও ছেড়ে দিন মশাই, যাদের ছেলে তারা কত খোঁজ রাখছে দেখছেন তো, আর খোঁজ রেখে হবেই বা কি?’ রমেশ আর হাসল না। চোখ দুটো গোল করে গলার স্বর ফিসফি করে তুলল। ‘আপনিতো ভিতরের খবর জানেন না। বাড়িওয়ালার জুলুম চলবে ন, বাড়িওয়ালার গাড়ি রুখতে যাওয়া এসব হ’ল বানানো কথা, সাজানো গল্প। আসলে ব্যাপার আরও গুরুতর।’

‘কি রকম?’ শিবনাথ দম বন্ধ করে রমেশের কথা শুনছিল।

‘হারামজাদা, হ্যাঁ, কে. গুপ্তর ওই অতটুকুন ছেলে আরো কতগুলো গুণ্ডার সঙ্গে মিশে গাড়িটা আটকাতে গেছল অন্যরকম উদ্দেশ্য নিয়ে, পারিজাত গাড়িতে ছিল না। ছিল তার দারোয়ান আর তার এখানকার কারবারের আমদানী নগদ হাজার ত্রিশেক টাকা। জায়গা ভাল না, তাই টাকাটা এখানে না রেখে পারিজাত রামসিংকে দিয়ে বালিগঞ্জে বাপের কাছে পাঠিয়ে দিচ্ছিল, কাল ব্যাঙ্কে জমা দেওয়া হবে বলে।

‘রামসিং বলল একথা?’ চোখ গোল করল শিবনাথ : ‘পলিটিক্যাল রবারি?’

‘পলিটিক্যাল কি না জানি না মশাই।’ রমেশ বিশেষ প্রসন্ন হ’ল না শিবনাথের কথা শুনে বরং চেহারাটা আরো বিকৃত করে বলল, ‘চারদিকে বেকার সমস্যা, ভাতের সমস্যা, রুজি আছে তো তার সঙ্গে টেক্‌কা দিয়ে চলতে পারছে না মানুষ। জিনিসপত্র দিনকে দিন আক্রা হচ্ছে। অভাব মশাই, সর্বত্র অভাব। আর তার ফলে চোরের সংখ্যা বাড়ছে, গাঁটকাটার দল বাড়ছে, ডাকাতি, রাহাজানি রাতদিন লেগেই আছে।’

যেন দম দিতে একটু থেমে পরে রমেশ বলল, ‘এই বেলেঘাটা চিংড়িঘাটা টেংরা নারকেলডাঙ্গায় মিলিয়ে না হলেও কমসে কম পঞ্চাশটা গ্যাঙ আছে, তার খবর রাখেন কিছু?’ রমেশ টেবিলের ওপর আঙুলের বাড়ি দিয়ে বলল, ‘পলিটিক্যাল বলছেন, সেসব মশাই আগে ছিল, যবে ব্রিটিশ ছিল, এখন স্রেফ খাদ্য-সমস্যা মানুষকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছে এবং যাবে দেখুন না, আরো দুদিন সবুর করুন না।’

কথাটা বলে ভুল করেছে বুঝতে পেরে শিবনাথ লজ্জায় ঈষৎ হাসল। ‘হ্যাঁ, সেসব এখন এক রকম নেই। অবাক লাগছে এই বয়সে রুটা কেমন ক’রে এসব দলে গিয়ে মিশল।’

রমেশ হঠাৎ কথা বলল না। রাস্তার দিকে চোখ রেখে গভীরভাবে আবার যেন কি চিন্তা করল। তারপর এক সময় ঘাড় ফিরিয়ে সতর্ক চাপা গলায় বলল, ‘কি ক’রে মিশল, কখন মিশল সেসব তো পরের কথা, রাম সিং ইচ্ছা করে চাপা দিয়েছে, না বেমক্কা ছুটতে গিয়ে ছোঁড়া গাড়িচাপা পড়ল, সেসব আলোচনা পর্যন্ত এখন বন্ধ রাখুন। আমি আজ সকালে কে. গুপ্তকেও এখানে ডেকে এনে বুঝিয়েছি। কেন আপনি বুঝতে পারছেন? এসব নিয়ে এখন বেশি নাড়াচাড়া করতে গেলে বিশ্রী ব্যাপার দাঁড়াবে। যতটা সম্ভব চুপচাপ থাকা ভাল, হ্যাঁ, আমাদের সকলের। আমরা সবাই এক বাড়িতে আছি, এটা তো আর অস্বীকার করা যায় না। একটা ডাকাতি মামলায় ছোঁড়া জড়িয়ে পড়লে আমাদের পাঁচজনকে পুলিস টানা-হেঁচড়া করবে।’

‘তা তো বটেই, তা খুবই সত্য।’ শিবনাথ ছোট্ট একটা নিশ্বাস ফেলে দু’বার মাথা নাড়ল।

‘পলিটিক্যাল আন্দোলন, এই ধরুন যেমন ভাড়া বন্ধ কর, বাড়িওয়ালার জুলুম চলবে না, ট্যাক্স-দান রহিত কর–এসব কেস্ বরং পুলিশ আজকাল একটু নরম চোখেই দেখছে, কেন- না কেবল এই ধুয়া খেয়ে সরকারের গায়ের চুল চাঁদেরা খুব কমই ছিঁড়তে পারছে। কিন্তু ডাকাতি-ফাঁকাতি উঁহু–দেখলেন তো পর পর কলকাতা শহরের ওপর ভরদুপুরে ক’টা লুঠ হয়ে গেল। পুলিস হদিসই পেলে না কিছু। কাজেই এখন আমাদের পাড়ায় এরকম একটার চেষ্টা হয়েছে এবং এক আসামী পালাবে দূরে থাক, জখম হয়ে হাসপাতালে আছে জানতে পারলে পুলিস সব ব্যাপারটা কেমন কড়া হাতে চেপে ধরবে খেয়াল রাখেন?’

‘তা তো বটেই।’ শিবনাথ আবার মাথা নাড়াল। ‘পারিজাত কি পাল্টা কেস্-ফেস্—’

কথা শেষ হবার আগে রমেশ মাথা নাড়ল। ‘পারিজাত সেই ছেলেই না মশাই, পাক্কা জেন্টেলম্যান, ওর তো আর ঘরে খাওয়ার অভাব নেই যে একটা কথা শুনে অমনি হুট করে মেজাজ খারাপ করবে। তা ছাড়া, আপনারা তার প্রজা, রুণু এ-বাড়ির ছেলে ভাল ভাবে জানে সে। যা হবার হয়েছে। হ্যাঁ, তবে যদি গুপ্ত এই নিয়ে থানা-পুলিস করতে যায় তো বিপদ আছে। পারিজাত কিছুতেই ছাড়বে না। কাজেই ও যখন চুপ করে গেছে, আমাদেরও এই নিয়ে আর—’

‘তা তো বটেই, তা তো বটেই।’

রমেশ লম্বা একটা নিশ্বাস ছাড়ল। ‘যাকগে অনেক বাজে কথা হ’ল। কি যেন তখন বলছিলাম হ্যাঁ, বলাই ব্ল্যাকমার্কেটের ব্যবসায় নেমেছে, পাঁচু শালা নিন্দাবাদ শুরু করেছে। আরে চুরি কে না করে, তোরা করিস, আমি, আপনি করেন, সুবিধা পেলে। আমি মিথ্যা বললাম? জিজ্ঞাসা করবেন, কি রকম? ধরুন, আজ রাস্তায় বেরোলেন। পকেটে পয়সা শর্ট আছে। ট্রাম কি বাস-এ চলতে গিয়ে দেখলেন কন্ডাক্টার ভুলে পয়সাটা আর চাইলে না। নামবার সময় মনে পড়ল, টিকিট কাটা হয়নি, তখন কি আর ডেকে কন্ডাক্টারকে পয়সাটা দিয়ে দেবেন আপনি, আমি তো দিই না, কেউ দেয় না। সুবিধে পেলে, বুঝেছেন, পাঁচশো টাকা মাইনের চাকুরে হোক, কি বেগুন ফিরি করে খাক, সবাই গাঁটের পয়সাটা ধরে রাখতে চায়। একটা নকল দু’আনি হাতে এসে গেলে আপনি সেটা জলে ফেলে দেন কখনো? আমি তো দিই না। কেউ দেয় না। বরং ফাঁকে-ফিকিরে দু’পাঁচ জায়গায় চেষ্টা করে ওটা চালিয়ে দেবার দিকেই আমাদের নজর থাকে; এগুলো কি চুরি না, আইনকে ফাঁকি দেওয়া না? বলুন, চুপ করে আছেন কেন? কথার শেষে রমেশ মৃদুমন্দ হাসল এবং অত্যন্ত স্বাভাবিকভাবে শিবনাথের দিকে তাকাল।

যুক্তিগুলো সরাসরি অস্বীকার করতে পারল না শিবনাথ। সামান্য হেসে সেও মাথা নাড়ল।

রমেশ বলল, ‘রায় সাহেবের বাড়ির ছেলেপুলেকে পড়াতে গিয়ে সেখান থেকে গলাধাক্কা খেয়ে বিদায় হয়ে এসে বিধু এখন লোকের নামে নিন্দা গাইবে, পাঁচুর সেলুনে বসে ওকে, নিজের ছেলে খেটে পয়সা আনবে বলে তাড়াতাড়ি একটা তেল-মালিশের দোকান খুলতে পরামর্শ দেবে, এ তো জানা কথা। উল্লুকটাকে দেখলে আমার গা ঘিনঘিন করে মশাই।’

বলাই ও রমেশ সম্পর্কে নিন্দাবাদটা ইদানীং একটু বেশি আরম্ভ করেছে বলে বিধু মাস্টারের ওপর রমেশ ভীষণ চটে আছে, শিবনাথের বুঝতে কষ্ট হয় না। তবু প্রসঙ্গটা এখানে শেষ হলে ভাল হয় এবং শিবনাথও উঠতে পারে চিন্তা করে সে বাইরের দিকে তাকিয়ে যখন উস করছিল, রমেশ হঠাৎ মুখটা সরিয়ে এনে মোলায়েম গলায় বলল, ‘ভাল কথা, দীপ্তি কি আপনাকে চা টা দিয়েছিল?’

শব্দ না করে শিবনাথ হাসল। নিজের পরিচ্ছন্ন বেশভূষা, হাত-পা নখ, নতুন রং-করা জুতোর দিকে একবার চোখ বুলিয়ে ও হাত দিয়ে দাড়ি-কামানো পালিশ গালটা অনুভব করে শিবনাথ বলল, ‘না, বলেছি আপনাকে আজ পারিজাতের মহিষীর মেজাজ খুব ভাল ছিল না; গিয়ে বসতেই সে-সব কথা শুরু করে কাঁদাকাটা করলেন। ‘

‘বুঝেছি, বুঝেছি, শুনলাম তো বললেন তখন। তবে এটা সাময়িক। টেম্পোরারি অশান্তি বড়লোকের ঘরেও থাকে বৈকি। যাকগে, চিন্তা করবেন না, আপনার সেখানে হয়ে যাবে। হয়ে গেছে ধরে নিন। কেন বললাম, বুঝতে পারছেন, নিশ্চয়।’ একটা চোখ বুজে রমেশ হাসতে শিবনাথ ঠোঁটবাঁকা করে হাসল। ‘আচ্ছা, চলি আজ।’

‘আসুন।’

রাস্তায় বেরিয়ে শিবনাথ রমেশের অন্য সব ভুল গিয়ে দু’টো কথাই চিন্তা করল বেশি। নোংরা বিধুঁকে পারিজাত-গিন্নী অর্ধচন্দ্র দিয়ে বিদায় করেছেন, আর শিবনাথ সেখানে পা দিতে না দিতে তার কাছে অন্তরের সব কথা খুলে বলেছেন। শিবনাথকে চা খেতে দেওয়া হয়েছিল কি–রমেশের এই প্রশ্নটাও বার বার তার ছোটখাটো কথা সাধারণ এক একটা ঘটনা কত বেশি সাহায্য করে, অন্ধকারে রাস্তায় চলতে চলতে শিবনাথ ভাবল। ভাবনায় ছেদ পড়ল তার বাদামগাছের তলায় এসে। এখানেই কে. গুপ্তর ছেলে কাল গাড়ি চাপা পড়ে। ঝিঁঝিঁ ডাকছিল অল্প হাওয়ায় গাছের পাতাগুলো খসখস করছিল। যতটা সম্ভব দ্রুত ব্যস্ত পায়ে শিবনাথ গাছটা পার হয়ে গেল। আজ গ্যাসের বাতিটা কেন জ্বালানো হয়নি, নাকি জ্বালানো হয়েছিল নিভে গেছে, চিন্তা করল সে।

৩২

‘অ-মশাই, একবারে রাজ্য জয় করে ফিরছেন বলে মনে হয়। শুনুন।’

এখানেও অন্ধকার। আজ শিবনাথ এই প্রথম দেখল রাত ন’টা না বাজতে বনমালীর দোকানের ঝাঁপ বন্ধ। দোকানের আলো পড়ে সামনেটা যা-হোক খানিকটা ফরসা থাকে। এখন দেখা গেল আবছা অন্ধকারে পায়া-ভাঙা বেঞ্চটায় কে. গুপ্ত একলা চুপচাপ ভূতের মত বসে।

‘কি বলুন।’ বেশ একটু বিরক্ত হয়ে শিবনাথ দাঁড়ায়। প্রত্যেকদিন বাড়িতে ঢোকার সময় লোকটা ডেকে বাধা দিচ্ছে, মুখে সেটা প্রকাশ না করলেও শিবনাথ মনে মনে অত্যন্ত অপ্রসন্ন হয়। আজ এমনি তার এখানে ওখানে বসে দেরি হয়ে গেছে।

‘মশাই, এদিকে যে ভয়ানক ঘটনা ঘটে গেল।’

‘কি ঘটনা?’ শিবনাথ খুব একটা কৌতূহল প্রকাশ করল না। এমন কি হাসপাতালে রুণু কেমন আছে সেই প্রশ্নটাও সে সতর্কতার সঙ্গে চেপে যায়।

‘পাখি আমাদের মায়া কাটল।’ গুপ্ত হাল্কা গলায় হাসল। ‘ভয়াবহ কিছু না তবে আকস্মিক হি-হি।’

পাগলটা কি বলতে চাইছে, কার কথা বলছে ভাবতে গিয়ে শিবনাথের একটা কথা মনে পড়তে হুট করে তৎক্ষণাৎ মন্তব্য করল, ‘সেই পাখি তো কালই মায়া কাটিয়ে ঘোলপাড়ায় গিয়ে বাসা বেঁধেছে, সেই খবর তো স্যার পুরোনো হয়ে গেছে। আপনার বন্ধুর বইয়ের নায়িকা কিরণের কথা বলছেন তো।’

‘হোপলেস।’ গুপ্ত আর হাসল না। ‘আপনি দেখছি রসের র-ও বোঝেন না। পাঠ্যাবস্থায় কি করে কবিতা লিখতেন?’

শিবনাথ নীরব।

‘মশাই কিরণ মায়া কাটায়নি। তাকে তাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। আজও সে আপনার স্ত্রীর কথা জিজ্ঞেস করলে, এ-বাড়ির বারো ঘরের আরো পাঁচজনের খোঁজ খবর নিলে। তার কথা আপনি আমায় বলবেন কি। কমলা। ইয়েস, দ্যাট্ হোর্। বলিনি আপনাকে কবে একদিন? এইমাত্র ভাড়াটাড়া চুকিয়ে ঘর ছেড়ে দিয়ে সুটকেস বিছানা নিয়ে বেরিয়ে গেল।’

‘কোথায় গেল?’

‘সে আপনি ওই যে কী নাম, মুর্গির মাংস দিয়ে ভাতটাত খেয়ে কমলার বিছানায় সারা দুপুর গড়িয়ে গেল, তাকে গিয়ে জিজ্ঞেস করুন। কোথায় গেছে সে-খবর দিয়ে কাজ কি, কার সঙ্গে গেছে সেটাই বরং জেনে রাখুন।’

‘শিশিরবাবু, ভদ্রলোকের নাম।’

শিবনাথ বলল, ‘কমলা তাঁর সঙ্গে গেছে কি করে জানলেন! ‘

‘জানব কি, চোখে দেখলাম মশাই। কর্তা স্বয়ং এসেছিলেন। এই তো ট্যাক্সিতে করে দুজন বেরিয়ে গেল।

শিবনাথ একটু সময় কথা বলল না। ভদ্রলোক বিবাহিত, এ বাড়ির কার মুখে সে শুনেছিল। কিন্তু সেসব আলোচনা চাপা দেবার জন্য ইচ্ছা করে সে হেসে বলল, ‘তা গেছে ভালই হয়েছে। হয়তো ভাল ঘর পেয়েছে। বস্তিতে চিরকাল পড়ে থাকবে তার কি মানে আছে। সুযোগ পেলে এঘর ছেড়ে দেওয়াই তো বুদ্ধিমানের কাজ।’

‘যাকগে মশাই, আপনার সঙ্গে কথা বলা আর গাছের সঙ্গে কথা বলা এক।’ গুপ্ত আক্ষেপের সুর বার করল, ‘যাওয়ায় যাওয়ায় বেশ কম আছে, ছাড়ায় ছাড়ায় তফাৎ আছে। নতুন ঘর পেয়েছে আপনাকে কে বললে। আমি তো এখানে সন্ধ্যা থেকে বসা। শুনলাম ট্যাক্সিতে উঠে বারুটি শেয়ালদার একটা হোটেলের নাম করলে। আজ সেখানে রাত্রিবাস।

শিবনাথ কি বলতে যাচ্ছিল, গুপ্ত বাধা দিল।

‘আমি, গোড়া থেকে বলে আসছি দাদা, শী ইজ ব্যাড় টাইপ। আপনারা তো আর আমার কথায় বিশ্বাস করেন না। এই বেলা দেখুন। আরে চালচলন দেখলে বোঝা যায় না? আর, তা ছাড়া হারামজাদী যে ভদ্রলোকের ঘরের সন্তান না, সেতো আমি ওর হাতঘড়ি পরার কায়দা আর জুতো পরে হাঁটার নমুনা দেখেই বুঝেছি। হ্যাঁ, এখানে পা দিয়ে আমি বনমালীকে প্রথম দিন বলেছিলাম। দাসীর মেয়ে ধোবা নাপিতের মেয়ে। শহরে এসে নার্সগিরির চাকরি নিয়ে এখন খুব তড়পাচ্ছে আর খোলা হাত-পা ছুঁড়ে মেলা জল ছিটোচ্ছে। কত দেখলাম এ-টাইপের মেয়ে।’

একটু থেমে গুপ্ত লম্বা নিশ্বাস ছেড়ে বলল, ‘কথা তো সেটা নয়। দুঃখ হয় ওই কি যেন নামটা বললেন, ছাগলটার জন্যে। বৌ-বাচ্চা আছে শুনেছি। আরে মেয়েমানুষ আমরাও এ-জীবনে কম দেখিনি। তা বলে কি তুই একেবারে গলায় গেঁথে নিবি। আহাম্মক। মদ খাবি, গ্লাসটা দাঁত দিয়ে চিবোবি কেন, সিগারেট খা যত খুশি, জিহ্বায় ছাই মাখাবি কেন, জল খেতে গিয়ে পুকুরে নেবে কাদার মধ্যে মুখ গুঁজে দেওয়া, তুই দেখছি সেই রাস্তার পথিক। ইডিয়েট। বুঝেছেন, কাল কমলার ঘরে খাওয়া-দাওয়া ঘুমটুম দেখেই তো আমি বুঝলাম শালার হয়ে গেছে।

‘যাকগে, এই নিয়ে আমাদের মাথা ঘামিয়ে লাভ নেই।’ শিবনাথ বলল, ‘যদি তাই হয় তো আপনার আমার মাথা গরম না করাই ভাল।’

ভাল-মন্দর কথা হচ্ছে না, বলছিলাম, আমি অবশ্য পয়লা দিন এই উঠোনে পা দিয়েই মেয়েটাকে দেখে ধরে ফেলেছিলাম, ভেরি ব্যাড টাইপ। ঐ যে বলে ছুঁচ হয়ে ঢোকে লাঙলের ফাল হয়ে বেরোয়। শিশিরকে শুষে ছিবড়ে বার করে তারপর আমের আঁটির মত ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে আর একজনকে ধরবে। এই ওরা করে, এ-ই ওদের পেশা। কতখানি পাজি হলে কত বড় জিহ্বা হলে একটা ম্যারেড ম্যানকে তার স্ত্রী-পুত্রের কাছ থেকে টেনে নিতে পারে, আপনি পুরুষ হয়ে কি বুঝতে পারছেন না। এর চেয়ে বাজারের ওরা অনেক ভাল, অনেক ধার্মিক।’

বক্তৃতা শুনে শিবনাথ হাসল।

‘তবু ভাল যে এবাড়ির কোনো পুরুষের ওপর কমলার লোভ জাগেনি।’

‘জাগলে কি আর রক্ষে থাকত, জুতোর বাড়ি খেতো, আমিই জুতো মারতাম। ধরুন, আপনাকে নিয়ে যদি এরকম লটখটি বেঁধেছে দেখতাম, আর ওদিকে ঘরে আপনার ওয়াইফ আপনার মেয়ে কাঁদাকাটা করছে, কেটে ফেলতুম ওকে। কে. গুপ্ত পাগল, কিন্তু এসব বিষয়ে ভয়ানক পার্টিকুলার। একবার জিজ্ঞেস করে আসুন বেবির মাকে। মেয়েমানুষ পিঁপড়ের মত গায়ে হাঁটত। কিন্তু ঐ রাত ন’টা অবধি। দশটার মধ্যে আমি বাড়ি ফিরে গিয়ে বেবির মার হাতের বাড়া ভাত খেয়ে শুয়ে পড়েছি। রোজ।’

শিবনাথ একটা নিশ্বাস ফেলল।

‘আচ্ছা চলি আমি।’

গুপ্ত হঠাৎ কথা বলল না।

‘এই ঠাণ্ডার মধ্যে বসে আছেন কেন, বাড়ি গিয়ে–’ শিবনাথ কেটে পড়ার মতন একটা কথা বলে পা বাড়াতে চেষ্টা করতে গুপ্ত বলল, ‘শুনুন।’

‘কি?’

‘আনা দুয়েক পয়সা হবে?’

শিবনাথ অবাক হয় না। আকাশের দিকে চোখ তুলে একটু চিন্তা করে শুধু। ফিরে আসবে না পয়সাগুলো ঠিক। কিন্তু তবু, তা হলেও এই সামান্য কয়েক আনা পয়সার তুলনায় তার সম্মান ভদ্রতা আভিজাত্য– আর না ভেবে চট করে পকেট থেকে একটা দু’আনি তুলে সে হাসল। ‘সিগারেট ফুরিয়েছে বুঝি।’ ইচ্ছা করেই সিগারেটের কথাটা বলল যদিও।

‘না মশাই।’ কে. গুপ্ত পয়সা হাতে পেয়ে ঘাড় নাড়ল। দুপুর থেকে শালা এমন কাঁইকুঁই করছে। বেলা দশটা এগারোটা পর্যন্ত কিন্তু আজ খুবই ঠাণ্ডা ছিল। কাল রাত্রে কিরণের বাড়িতে আমাদের ভারি রকমের ফিষ্টি হয়েছিল, শুনছেন তো।’

‘শুনেছি, বলেছেন।’সংক্ষেপে উত্তর সেরে শিবনাথ এবার লম্বা পা ফেলে হাঁটতে লাগল। এবং ইতিপূর্বে আরো বহুবার যেমন করা হয়েছে তেমনি এখন কে. গুপ্তকে ‘আর একবার গম্ভীরভাবে অনুকম্পা করতে সে ভুলল না। কি হ’ত ভাবল সে কমলার জঘন্য চরিত্রের কথা চিন্তা করে কে. গুপ্ত মনমেজাজ খারাপ করে অন্ধকারে একলা বসে রাত্রির প্রহর গুনছে,–এই অবস্থায় তার ছেলে হাসপাতাল থেকে ফিরে আসবে কি আসবে না বা এ-সম্পর্কে আর কিছু করা উচিত ভেবে দেখেছে কিনা, শিবনাথ যদি প্রশ্ন করতে কে. গুপ্ত চটে গিয়ে হয়তো গালিগালাজ আরম্ভ করত : ‘বেরসিক, মশাই, আপনি রসের বুকে ছুরি বসাবে ওস্তাদ, –এ যে দেখছি ধান ভানতে শিবের গীত শুরু করছেন।’ ইত্যাদি।

নীরব থেকে শিবনাথ বুদ্ধিমানের কাজ করেছে ভাবল। তা ছাড়া রমেশ রায়ের মুখ থেকে বৃত্তান্ত শোনার পর এই ব্যাপারে মুখ বন্ধ করে থাকা ছাড়া উপায়ই বা কি।

ঘরে এসে শিবনাথের মনমেজাজ অবশ্য প্রফুল্ল হয়ে উঠল। মনে মনে সে হিসাব করে দেখল দীপ্তির ওখান থেকে বেরিয়ে আসার পর রাস্তায় এই আড়াই ঘণ্টা তিন ঘণ্টা বিধু পাঁচু ক্ষিতীশ (রমেশকে অবশ্য সে এ-দলে ফেলে না) কে. গুপ্ত ইত্যাদি অনেকগুলো কদর্য চেহারার সামনে তাকে উপর্যুপরি কয়েকবার দাঁড়াতে হয়েছে এবং নানারকম অপ্রয়োজনীয় ও অপ্রীতিকর কথা শুনতে হয়েছে। কিন্তু এখানকার পরিবেশ সম্পূর্ণ আলাদা।

মন প্রফুল্ল হয়ে ওঠার বিশেষ কারণ শিবনাথ ঘরে পা দিয়েই বীথিকে দেখল। রুচির সঙ্গে কথা বলছে। বীথি এ-ঘরে আসুক, রুচির সঙ্গে একটু মেলামেশা করুক –কেন জানি প্রথম থেকেই শিবনাথের এই ইচ্ছা। ইচ্ছাটা গোপন। এবং বীথির সম্পর্কে আজ পর্যন্ত রুচির কাছে সে কোনরকম কথা বলেনি যদিও। এক উঠোনের ওপর বাস করে দূরে থেকে যতটুকু দেখার শিবনাথ চোখ ভরে সুশ্রী সুঠাম যৌবনবতী এই কুমারীকে চলতে ফিরতে কথা বলতে হাসতে ঝগড়া করতে, বেলা নটা বাজতে স্নান করে খেয়ে সেজেগুজে কাজে বেরিয়ে যেতে এবং সন্ধ্যার পর কোনোদিন একটু শুকনো মুখে কোনো দিন বা একটু বেশি হাসিখুশি হয়ে ঘরে ফিরতে দেখেছে। দেখছে, আর বহুকাল আগের পড়া সুন্দর একটা কবিতার লাইন তার বুকের মধ্যে গুনগুন করে উঠছে : ‘আঠারোটি বসন্ত দিয়ে ঘেরা যে যৌবন কেমনে নন্দিব তারে।’ এটা যে কিছু দোষের শিবনাথের মনে হয় না। হত, যদি তার মনে প্রশ্ন জাগত বীথি তার সম্পর্কে উৎসুক কিনা এবং প্রশ্নের উত্তর পাবার আশায় সারাক্ষণ সে বিব্রত বোধ করত। সে-সব কিছুই না। কেবল যতক্ষণ দেখার সেই সময়টুকু সে তাকিয়ে থাকে ওর দিকে। একটা ফুল, একটা পাখির দিকে মানুষ যে চোখে তাকায়।

রুচি খাটের ওপর বসা। বীথি পাশে দাঁড়িয়ে। এতবড় একটা রিবন, বেণীর মাঝামাঝি জায়গায় প্রজাপতির মত সুন্দর করে বাঁধা। বেণীটা যতখানি চওড়া ওর শাড়ির কালো পাড়টা ও ততখানি চওড়া। একটু বেশি না কম না। সাদা জুতো হাতে ছোট্ট ব্যাগ, মিশমিশে কালো বেণী, কালো রিবন ও লম্বা পালক ঘেরা কালো চোখে পরনের সাদা শাড়ি ব্লাউস ও জুতোর সাদাটাকে আরো বেশি উজ্জ্বল পরিচ্ছন্ন করে তুলেছে। শিবনাথ, বলতে কি, কেমন একটা পবিত্রতা বোধ করছিল কুমারী মেয়েটির পিছনে দাঁড়িয়ে। আর সে সবচেয়ে বেশি অভিভূত ও রোমাঞ্চিত হ’ল ওর চুলের গন্ধে। বিকেলে চৌরঙ্গির রাস্তায় বিদেশিনীর মাথার চুল থেকে চুরি করে যে গন্ধ সে খানিকটা বুকে পুরে নিয়েছিল, তাই-ই যেন বীথি অকৃপণ হাতে ঢেলে দিতে এসেছে তার ঘরে, ঘরের বাতাসে। উত্তেজনায় শিবনাথ প্রায় বিড়বিড় করে ওঠে।

‘চলি এখন!’

‘কেন, এত তাড়া কি।’ রুচি বলল, ‘একটু বসবে না।’

‘না, বৌদি।’ ঘাড়টা ঠিক ঘোরালো না বীথি, যেন অত্যন্ত সতর্কভাবে আড়চোখে শিবনাথকে একবার দেখে নিয়ে খাটের এ-পাশে ঘুমন্ত মঞ্জুকে মনোযোগ দিয়ে দেখতে লাগল।

‘একটু রোগা হয়ে গেছে মনে হয়।’

‘না শরীর ভালো যাচ্ছে না তেমন। সর্দি কাশিতে খুব ভুগছে মেয়েটা।

‘আমার তো মনে হয় কডলিভার অয়েল টয়েলের মত একটা কিছু ওকে ঠাণ্ডার সময়টা দিতে পারেন। তাতে সর্দি কাশি তো বটেই, জেনারেল হেলথটাও ভাল করবে।’

রুচি বীথির এই প্রস্তাবে কোন মন্তব্য করল না। আড়চোখে না, পরিপূর্ণ দৃষ্টি মেলেই সে বীথির পিছনে দাঁড়ানো শিবনাথকে দেখল।

শিবনাথ কথা না কয়ে একটা ছোট নিশ্বাস ফেলল।

‘তোমার বাবার শরীরটা একটু ভালর দিকে?’

‘না, ঐ-তো বুড়ো হয়েছে, এখন আর–’ একটু থেমে মঞ্জুর মুখের ওপর থেকে চোখ সরিয়ে নিয়ে বীথি রুচির দিকে তাকাল। ‘ওই শুয়ে শুয়েই কাটবে আর কি, যে ক’দিন আছেন। চলি!

রুচি ঘাড় নাড়ল।

শিবনাথ দরজা ছেড়ে এক পাশে সরে দাঁড়ায়। বীথি মাথা নিচু করে আস্তে আস্তে বেরিয়ে যায়।

‘কেন এসেছিল?’ রুচির চোখের দিকে তাকিয়ে শিবনাথ অল্প হাসে।

‘একটা ইংরেজী শব্দের মানে জানতে এসেছিল।’

‘কি শব্দ।’ হাসি না নিভিয়ে শিবনাথ ভুরু কুঁচকোয়।

রুচি কথা বলল না। মঞ্জুর মশারি খাটাতে ব্যস্ত। মশারি খাটানো শেষ করে সে খাট থেকে নামল।

‘দেরি করে ফিরলে?’

‘হ্যাঁ, দু’চার জায়গায় বসতে হল, কথায় কথায় রাত হয়ে গেল।’ শিবনাথ কোথায় কার সঙ্গে কথাবার্তা বলেছে বলল না যদিও।

‘জামাকাপড় ছেড়ে খেয়ে নাও।’ ব’লে রুচি এক পাশে সরে গিয়ে থালা গ্লাস ধুয়ে শিবনাথকে ঠাঁই করে দেয়। যেন আজ আবার একটু বেশি গম্ভীর ও। খেতে বসে আবহাওয়াটা তরল করার লোভে শিবনাথ বলল, ‘আজ পারিজাতের স্ত্রীর সঙ্গে আলাপ হ’ল। চমৎকার মানুষ।

রুচিও খাচ্ছিল। কথা না করে ও জলের গ্লাস মুখে তুলল। যেন কথা বলবে না বলে মুখটা ও আড়াল করল। পিছনে টিনের বেড়ায় রুচির মাথার ছায়াটার দিকে চোখ রেখে শিবনাথ একটা নিশ্বাস ফেলে আস্তে আস্তে বলল : ‘ওখানে হয়ে যাবে। তাঁর কথায় বুঝলাম।’

রুচি চোখ বড় করল।

‘তা হলে আজো পাকাপাকি কোনো কথা পাওনি?’

‘হ্যাঁ, একরকম–’ এবার শিবনাথ মুখের কাছে জলের গ্লাস তুলল। একটু পর গ্লাসটা নামিয়ে রেখে নিচু গলায় বলল, ‘ওই ওদের মানে পারিজাতের সামনে ইলেকশন আসছে, তাই খুব ছুটোছুটি করতে হচ্ছে। আজ সে বাড়িতেই ছিল না। দেখি কাল একবার গিয়ে-

রুচি নীরব।

‘ও, আর একটা কথাই তোমাকে বলা হয়নি।’ শিবনাথ একবার জোর করে একটুখানি শব্দ করে হাসল। ‘বীথি তোমায় বলেছে কিছু?

‘কি?’

তেমনি বড় বড় চোখ রুচির।

শিবনাথ আবার দমে যায় কিন্তু তা হলেও সে চুপ করে রইল না। ‘নতুন চাকরি পেয়ে বীথি দীপালি সঙ্ঘের সেক্রেটারী পদে রিজাইন দিয়েছে। দীপ্তি এখন মুশকিলে পড়েছেন। তেমন কাউকে পাচ্ছেন না, যাকে আবার সেক্রেটারী করা যায়।’

‘তা ওটা তো মেয়েদের সঙ্ঘ, তোমার কি।’ কেমন একটু রুঢ় গলায় কথাটা বলল রুচি। শিবনাথ আহত হল। যেন আঘাত ঢাকতে তাড়াতাড়ি সে হেসে ফেলল। ‘দীপ্তির ইচ্ছা তোমাকে এই পোস্ট দেয়।’

খাওয়া শেষ হয়েছে রুচির। হাত ধুয়ে সে উঠে পড়ে।

‘আমার আর খেয়েদেয়ে কাজ নেই।’ মুখ মুছতে মুছতে বলল সে, ‘তা ছাড়া ওটা পারিজাতের গিন্নীর আর পাঁচটা খেয়ালের একটা খেয়াল। সমিতি না ছাই। কিছু কাজ হয়? আমার কানে সবই আসে। একটা শো দাঁড় করিয়ে রেখেছেন বড়লোকের বৌ। দু চার আনা চাঁদা চাইলে দেওয়া যায়, কিন্তু ঐ পর্যন্ত। ওখানে যাওয়া-আসা করা আর দীপ্তিরাণীর পায়ে তেল মাখান আমার পোষোবে না।’

শিবনাথ রীতিমত জব্দ হয়ে গেল।

‘তোমায় বলছিল নাকি আমাকে সেক্রেটারী করবেন?’ রুচি প্রশ্ন করল।

‘না, ঠিক আমার কাছে এখনো কথাটা তোলেননি। মদন ঘোষ বলছিল। ওর সঙ্গে কথা হয়েছে।’ শিবনাথ বিরক্ত। প্রসঙ্গটা তুলতে না তুলতে রুচি এতটা কড়া মেজাজ দেখাবে সে ভাবেনি। উঠে সে হাত মুখ ধুয়ে মুছে সিগারেট ধরায় এবং কি একটু ভেবে পরে আস্তে আস্তে বলে, ‘সমিতির সেক্রেটারী হলে দীপ্তির পায়ে তেল মাখাতে হবে এটা আমি ঠিক বুঝলাম না কিন্তু।’

‘তা ছাড়া কি, আমি বস্তিতে থাকি, তিনি প্রসাদে থাকেন, আমাদের কী চোখে দেখেন সহজেই বুঝতে পার।’

‘না, না,–অ সেই চিন্তা, রিয়্যালি, দীপ্তি সে-ধরনের মেয়ে না, অন্তত আমার তো তাই মনে হল। খুব ভদ্র মার্জিত অমায়িক।’

‘যাকগে, তোমার কাছে যখন তিনি এখনো প্রস্তাব তোলেননি, এ নিয়ে এখন গবেষণা করে লাভ কি। তুমি কি শুয়ে পড়বে?’

‘হ্যাঁ, না, ভাল কথা–’ শিবনাথ এতক্ষণ পর আবার স্বাভাবিক হতে পারল। বীথি যেন কি জিজ্ঞেস করতে এসেছিল, ইংরেজী শব্দের মানে, কি শব্দ বললে না তো।’

‘লিউক-ওয়ার্ম।’

‘খুব সাধারণ কথা।’ শিবনাথ হাসল। ‘অবশ্য ওয়ার্ম ও লিউক-ওয়ার্ম নিয়ে অনেকেই গোলমালে পড়ে। লিউক-ওয়ার্ম মানে টেপিড অর্থাৎ আমরা যাকে বলি কুসুম কুসুম গরম, খুব গরম না, বলে দাওনি?’

রুচি মাথা নেড়ে গম্ভীর হয়ে বলল, ‘আমি জাতে মাস্টারনী ভুলে যাচ্ছ কেন। যতটা সম্ভব পরিষ্কার করে শব্দের অর্থ বোঝাতে চেষ্টার ত্রুটি করি না।’

‘তা তো বটেই।’শিবনাথ আর হাসল না। আজ আবার স্ত্রীর কথায় ব্যবহারে এতটা ঝাঁজ অসন্তোষ ফুটে ওঠার কারণ কি ভাবে সে। কিন্তু একেবারে চুপ করে যাওয়া বুদ্ধিমানের কাজ না, চিন্তা করে তৎক্ষণাৎ প্রশ্ন করল, ‘আর আর কি জিজ্ঞেস করেছিল’?

‘ডিজার্ট-স্পুন বলতে ঠিক কত বড় চামচ বোঝায়। ‘

‘ওরে বাবা, সব যে ডাক্তারি ব্যাপার দেখছি।’ শিবনাথ হাসবার মতন গলায় খুক করে একটা শব্দ করল। ‘টি-স্পুন, ডিজার্ট-স্পুন, হ্যাঁ, একটু গোলমেলেই, আমার,–আমারও খুব ভাল জানা নেই ওটা ঠিক কাকে বলে।’

‘ডিজার্ট মানে খাওয়ার পর যে প্যাস্ট্রি পুডিং ফলটল খেতে দেওয়া হয়, তাকে বলে। এবং সেসব সার্ভ করার জন্যে যে চামচ ব্যবহার করা হয়, ইংরেজীতে তাকেই ডিজার্ট-স্পুন বলে। ওটা সাহেবসুবোর ব্যাপার।’

‘তার মানে সাধারণ চামচ না, বড় সাইজের।’ শিবনাথ এবার শব্দ ক’রে হাল্কা গলায় হাসল। ‘তা বীথির হঠাৎ এত সব শব্দের মানে জানতে আসার কারণ?’

‘আমি কি ক’রে বলব। আমি এবাড়িতে থাকি কতক্ষণ।’ আরও খানিকটা ঝাঁজ। ‘হয়তো নতুন চাকরি করতে গিয়ে এসব শব্দের মানে জানার দরকার হচ্ছে।’কথাটা বলে রুচি জানালার কাছে সরে গিয়ে চুলে চিরুনি চালাতে আরম্ভ করল।

শিবনাথের বুক দরুদুর করছিল। বীথি কোথায় চাকরি করছে, কি ধরনের কাজ রুচি জানে না নিশ্চয়। শিবনাথ জানে। এক রাত্রে ডোম-পাড়ার আগুন দেখতে গিয়ে সে বীথি ও কমলার কথাবার্তা চুরি করে শুনে প্রায় সবই জেনেছে। এখন রুচি না হুট্ করে শিবনাথকে প্রশ্ন করে বসে বীথির চাকরিটা কি–এই আশঙ্কায় সে ভিতরে ভিতরে বিব্রতবোধ করছিল বৈকি। বীথির কাজটা একটু অদ্ভুত রকমের। রুচি কোনমতেই তা সহজভাবে নিতে পারবে না শিবনাথ বেশ বুঝতে পারে।

কিন্তু শিবনাথের আশঙ্কা তৎক্ষণাৎ দূর হয়। রুচি এই নিয়ে মাথা ঘামায় না, তার পরের কথা থেকে বোঝা গেল। ‘দুটো ইংরেজী শব্দের মানে জানতে এসেছিল, তার অর্থ ভাল একখানা শাড়ি পরেছে, নতুন জুতো পায়ে উঠেছে, মাথায় দামী তেল মেখেছে আমাকে জানিয়ে গেল, দেখিয়ে গেল।’

একটু নিশ্চিন্ত হল শিবনাথ। কিছুক্ষণ চুপ থেকে পরে আস্তে হেসে মাথা নাড়ল। ‘না, আমার মনে হয় না। জানি না অবশ্য।’ মুখে বলল, একথা আর স্ত্রীর দিকে বেশ একটু অনুকম্পার চোখে তাকিয়ে সে মনে মনে বিড়বিড় করে উঠল : ‘কমপ্লেক্স, ইনফিরিয়রিটি কমপ্লেক্স। দীপ্তির সমিতিতে যোগ দেওয়া নিয়ে রুচির আপত্তি করার মূলেও তাই–এই মনোভাব।

‘কে?’

‘আমি।’

‘বেবি! কি চাই?’

‘বৌদিকে।’

শিবনাথ দরজা থেকে চোখ সরিয়ে স্ত্রীর দিকে তাকায়। চিরুনি রেখে রুচি মাথায় কাপড় তুলল। ‘আমার হয়ে গেছে, এখুনি যাচ্ছি। তোমার মা’র জ্বরটা এখন কেমন?’

‘আছে, কমেনি।’ বেবি চৌকাঠে দাঁড়িয়ে। যেন শিবনাথকে ঘরে দেখতে পেয়ে চট করে ভিতরে ঢুকতে সাহস পায় না। তেমনি চুল উষ্কখুষ্ক আছে, হাত পা এখনো অপরিচ্ছন্ন, গায়ে সেই ছেঁড়া ফ্রকটা। ক্লান্ত বিষণ্ণ চোখ।

‘তুমি যাও, আমি যাচ্ছি।’

কি একটু কাজ সারতে রুচি খাটের উল্টোদিকে মাটিতে রাখা বাসন-কোসনের কাছে সরে গেল।

বেবিও আর দাঁড়ায় না। শিবনাথের দিকে আর একবারও চোখ না তুলে ঘাড় ঘুরিয়ে ও আস্তে আস্তে দরজা ছেড়ে চলে গেল। অনুকম্পার আর একটা চাপা নিশ্বাস ফেলে অস্ফুট- গলায় শিবনাথ বলল, ‘কী দুরবস্থায় পড়েছে পরিবারটা।’

কথাটা রুচি শুনল কিনা বোঝা গেল না। কেননা, তার মুখের কোনো ভাবান্তর লক্ষ্য করল না শিবনাথ। কুঁজো থেকে এক গ্লাস জল গড়িয়ে এনে রুচি শিবনাথের পাশে কেরোসিন কাঠের বাক্সটার ওপর রাখল। একটা পুরোনো পোস্টকার্ড গ্লাসের মুখে চাপা দিয়ে বলল, ‘আমি একটু বেবিদের ঘরে যাচ্ছি।’

অবাক হয়ে শিবনাথ স্ত্রীর মুখের দিকে তাকায়।

‘বেবির মা’র অসুখ করেছে বুঝি। জ্বর, কবে হ’ল?’

‘জানি না, সম্ভবত আজই হয়েছে।’

‘এখন পক্স ফক্স-এর দিন।’ চিন্তান্বিত শিবনাথ। ‘গা হাত পায়ে ব্যথা নেই তো। হঠাৎ তোমাকে?’

‘রুণু হাসপাতালে।’

‘হ্যাঁ, ও তো, কি সব ছেলে! তুমি ভিতরের ব্যাপার জানো? আমি সব শুনে এলাম বাইরে।’

‘পারিজাত গাড়ি চাপা দিয়েছে।’

‘কে বললে?’ শিবনাথ প্রবলবেগে মাথা নাড়ল। ‘আসল খবর তুমি শোননি।’

‘ময়না সঙ্গে ছিল। মাঠ থেকে ফিরছিল দু’জন। ময়নার চেয়ে বড় সাক্ষী কে। বাদামগাছের নিচে পারিজাত অ্যাক্সিডেন্ট করেছে।’ রুচি এক নিশ্বাসে বলল।

‘ধ্যেৎ!’ ফিসফিসে গলায় শিবনাথ ধমক দিয়ে উঠল। ‘বলাইর মেয়েটা একটা লায়ার। আসলে আমি জানি, আমি নিজের চোখে দেখেছি দু’টিকে একসঙ্গে, ময়নার লাভার রুণু, হ্যাঁ কে. গুপ্তর ছেলেটা। পারিজাত চাপা দিয়েছে এসব বানানো কথা। সাংঘাতিক কাজ করতে গেছিল বেবির ভাই, অতটুকুন ছেলে, বুঝলে।

রুচি ভুরু কুঁচকোয়।

শিবনাথ চোখ বড় ক’রে স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে রইল। কিছুক্ষণ দু’জন কথা বলল না। ‘যাকগে।’ ঢোক গিলে, কি একটু ভেবে পরে রুচি বলল, ‘ভদ্রমহিলা দু’বার খবর দিয়েছেন, যাইনি, এখন একবার দেখা ক’রে আসি।’

‘দরকার নেই।’ শিবনাথ ব্যস্তভাবে মাথা নাড়ল। ‘প্রতিবেশী হিসাবে আমাদের যথেষ্ট সহানুভূতি আছে, থাকবে। কিন্তু এখন না, দু’চার দিন ওই ঘরে যাওয়া-আসা স্রেফ বন্ধ রাখতে হবে।’

‘কেন?’রুচি গলার স্বর কঠিন করল। ‘আমি ঠিক বুঝতে পারছি না তুমি কি বলতে চাইছ। কি করেছে রুণু। কা’র মুখে শুনলে সব? পারিজাতের স্ত্রী বলছিল বুঝি?

গম্ভীর হয়ে শিবনাথ বলল, ‘পারিজাতের স্ত্রীর অন্য চিন্তা, এসব ছাই-ভস্ম নিয়ে তার মাথা ঘামাবার মোটেই সময় নেই। তা ছাড়া বিশ ত্রিশ কি পঞ্চাশ হাজার টাকা যদি এক রাত্রে লুঠ হয়, খুব বেশি ওরা মাথা ঘামাবে বলে মনে হয় না। পারিজাতের চেয়েও দীপ্তির বাপের বাড়ির অবস্থা ভাল। আঙুলে এত বড় একটা হীরের আঙটি। তুমি তো কোনোদিন ওর সামনে যাওনি, কাছে দাঁড়িয়ে দেখোনি দীপ্তিকে। মেয়েদের গায়ের চামড়া এত সফ্‌ট পালিশ, এমন সুন্দর, আমি কিন্তু আগে আর দেখিনি। হ্যাঁ, ঐ যে বলে আপেল-আপেলের মতন চামড়া আর রং। তা ছাড়া আজো, এখনো বয়েস খুব বেশী না যদিও, কিন্তু এতগুলো বাচ্চা হয়েছে এটা তো ঠিক। বোঝা যায় কত সুখ বিলাসের মধ্যে বড় হয়েছে সে।’

রুচির চোখের তারা দু’টো একবার জ্বলে উঠল, শিবনাথ লক্ষ্য করল না, আর রুচিও তৎক্ষণাৎ সামলে নেয়। না কি শিবনাথ লক্ষ্য করেছে কিনা বাজিয়ে নিতে রুচি ঠাট্টার সুরে ব’লে উঠল, ‘সেজন্যেই কি পারিজাতের ছেলেমেয়েদের ট্যুইশনটা পাবার জন্যে উঠে পড়ে লেগেছ–রোজ একবার বাচ্চাদের মা-টিকেও দেখা চলবে।’

‘কী যে বল তুমি।’ শিবনাথ রাগ করল না, হাসল। ‘আমার সম্পর্কে এ-ধরনের রিমার্ক, কই আগে তো তুমি কোনোদিন করনি—’

‘না, এখন করছি।’ হঠাৎ আবার শক্ত গলায় রুচি উত্তর করল।

শিবনাথ কথা বলল না।

‘তুমি শুয়ে পড়তে পার, দোরে খিল দেবে না, এখনি ফিরছি আমি, পাল্লা দুটো ভেজিয়ে রাখো।’

‘অর্থাৎ তুমি বেবিদের ঘরে যাবেই?’

‘হ্যাঁ।’ রুচি চৌকাঠের দিকে পা বাড়ায়। শিবনাথ তার হাত চেপে ধরে।

‘তুমি এখন মাঝরাত্রে কে. গুপ্তর ঘরে গেলে কী ব্যাপার দাঁড়াবে জানো?’

‘কি?’

‘কাল আমাদের ঘরে পুলিশ আসবে। তোমার কি, তুমি তো কমলাক্ষী গার্লস স্কুলের টিচারি করছ, বড় সার্টিফিকেট। মুশকিল বাধবে আমাকে নিয়ে। কে. গুপ্তর ছেলে রুণু একটা মস্ত বড় গ্যাঙে আছে। পারিজাতের গাড়ি আটকে টাকা লুট করতে গেছল। এখন সে-ঘরে বেশি যাওয়া- আসার অর্থ দাঁড়াবে আমার সঙ্গেও দলের যোগাযোগ আছে। তা ছাড়া আমি–আমার চাকরি- বাকরি নেই, বেকার, কথাটা তেমন চাপা নেই।’ এক নিশ্বাসে কথাগুলো বলে শিবনাথ হাঁপায়।

‘মিথ্যা কথা।’রুচি হাত ছাড়াবার চেষ্টা করল না। অত্যন্ত নিস্পৃহ গলায় আস্তে আস্তে বলল, ‘আমি জানি, শুনেছি সব, আসল ঘটনা চাপা দিতে অনেকরকম মিথ্যা গল্প এখন সাজানো হচ্ছে, যা হয়।’

‘মোটেই মিথ্যা নয়। খুব রিলায়েবল সোর্স থেকে এ-খবর পাওয়া গেছে।’ আর ফিসফিস ক’রে না, উত্তেজনায় রীতিমত বড় গলায় শিবনাথ বলল, ‘তা সত্যি মিথ্যা এসব আমাদের যাচাই ক’রে লাভ নেই,–আমাদের কথা, ওঘরে তুমি যেতে পারবে না। ব্যস, ফুরিয়ে গেল।’ রুচির হাত আর ধ’রে রাখার প্রয়োজন বোধ না ক’রে শিবনাথ বিরক্ত হয়ে ঝাড়া দিয়ে তা সরিয়ে দেয়। ফলে রুচির হাতটা বাক্সের ওপর রাখা কাঁচের গ্লাসে লাগতে সেটা উল্টে নিচে পড়ে টুকরো টুকরো হয়ে যায় আর বিশ্রী ঝনঝন শব্দ হয়।

রুচিও উত্তেজিত হয়ে ওঠে। ‘একটু ভদ্র হ’তে শেখ। আর একটা গ্লাস কিনতে ছ’ আনা খরচ করতে হবে ভুলে যেও না।’

‘ভারি তো একটা কাঁচের গ্লাস।’ শিবনাথ ঠোঁট উল্টোয়। ‘অ, তোমার পয়সায় কেনা বলে এত লাগছে। মনে ছিল না, মাপ করো।’

‘আমার পয়সা শুধু কেন, তুমিও তো সেদিন ধার ক’রে পঞ্চাশ টাকা এনে সংসারে সাহায্য করেছ, দরকার হলে আবার ধার করবে।’ রাগে কাঁপতে কাঁপতে রুচি নুয়ে কাঁচের টুকরোগুলো একত্র ক’রে তুলে একটা কাগজে মুড়ে একপাশে সরিয়ে রাখে।

একটা বড় রকমের খোঁচা খেয়ে শিবনাথ কতক্ষণ চুপ থাকে। রুচি ফের দরজার দিকে এগোয়।

‘অভদ্র আমি না, অভদ্র তুমি। বস্তিতে এসে কথা ব্যবহার দিনদিন সেরকমই হচ্ছে।’ রুচি না বলে পারল না।

‘বটে।’শিবনাথ উত্তর করল, ‘তার প্রমাণ দিচ্ছ রাত দুপুরে একটা লোফার একটা পাগলের ঘরে তোমার যাওয়া চাইই।’

রুচি ঘুরে দাঁড়ায়। চট করে কি উত্তর দেবে বুঝতে না পেরে গম্ভীর হয়ে আস্তে আস্তে বলে, ‘বেশিদিন বেকার গরিব থাকলে মানুষ লোফার হয়, পাগল হয় হয়তো। আমি ঠিক জানি না কে. গুপ্ত পাগল কি না, কিন্তু তাঁর স্ত্রী বেবির মা অপ্রকৃতিস্থ নন। ভদ্রমহিলা অসুস্থ, তার ওপর তাঁর এই বিপদ। টাকাপয়সা দিয়ে সাহায্য করতে পারব না জানি। কিন্তু তিনি দু’বার ডেকেছেন, একবার তাঁর সঙ্গে দেখা করতেই হবে। তাঁর সঙ্গে কথা বললে থানা পুলিশের বিপদ আছে, আর সেই ভয়ে আমি চুপ করে ঘরে বসে থাকব–এতটা কাপুরুষ তুমি হ’তে পার, আমি নই। ‘ রুচি চৌকাঠের বাইরে পা বাড়াবার উপক্রম করল।

শিবনাথ বলল, ‘আহা, থানা পুলিশের ভয় হয়তো এখনও তেমন নেই, কেন-না এ-পক্ষ যখন চুপ ক’রে আছে, চেপে গেছে, তখন পুলিশ গায়ে পড়ে অ্যাক্সিডেন্টের তদন্ত করতে আসবে না ঠিক। কিন্তু আরও একটা কথা আছে। আফ্‌টার অল একটা আনপ্লেজেন্ট ব্যাপার। পারিজাতের দোষ কি রুণুর দোষ তার প্রমাণ যারা ঘটনা চোখে দেখেছে তারা। কিন্তু এখন কে. গুপ্তর ফ্যামিলির সঙ্গে বেশি মেলামেশা করতে গেলে আমি ও-বাড়ির ট্যুইশনিটা পাব না। এটা সত্য কথা। কাজেই–’

‘তাই বলো, সেই দুশ্চিন্তায় তুমি সারা হয়ে যাচ্ছ, পারিজাতের বাচ্চাদের পড়াতে পারব না, দীপ্তিকে রোজ একবার দেখা হবে না, মরুক না কে. গুপ্তর ছেলে হাসপাতালে পচে, –ছি ছি–’ বলে দরজায় শব্দ ক’রে দ্রুত পায়ে রুচি ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।

‘ছোটলোক, মিন্, লো-হার্টেড ক্রিচার–’ উত্তেজনায় শিবনাথ স্ত্রীর পশ্চাদ্ধাবন করে চৌকাঠ পর্যন্ত ছুটে গেল, তারপর থমকে দাঁড়াল। পাশের কোন্ ঘরে যেন হাসির রোল উঠেছে। হাসিটা যখন বন্ধ হ’ল কথাগুলি পরিষ্কার বোঝা গেল।

‘অশান্তি আবার কি নিয়ে হয়, টাকাপয়সা দিদি, রূপচাঁদ। ওতে টান ধরলে সব প্রেমেই ভাঁটা পড়ে, চারদিক দেখেশুনে এখনো কি তোমার বুঝতে বাকি রইল?’

‘কি ভাঙল, কাঁসার থালা না কাঁচের বোয়ম। জোর আওয়াজ হ’ল। যেন অন্য ঘর নিচু গলায় মন্তব্য করল।

‘দেখিনি, কারো ঘরে চুপি দেয়া স্বভাব না বোন। আছি নিজের ঘরেই আছি, শাকভাত মাছভাত যেদিন জোটে খাই। পরের ফুটোয় চোখ গলিয়ে করব কি।’

অন্য ঘর কি বলে আর বোঝা গেল না। ‘আরাম হারাম হ্যায়।’ বিধু মাস্টার গলা বড় ক’রে ছেলেমেয়েদের বোঝাচ্ছিল। ‘নেহরুর কথাগুলো দামী। আমিও অবশ্য গোড়া থেকে তোমাদের বলে আসছি–আলস্য করো না। অলসতায় বৃথা কালক্ষেপ করলে অশেষ দুর্গতি থাকে কপালে। আলস্য পাপ।’ বিধুর গলাও অবশ্য দেখতে দেখতে চাপা পড়ে গেল ভুবনের চিৎকারে। খুশি গলা : ‘না না, দেড়পো আমি হজম করতে পারব না। ঐ একপো দুধ যথেষ্ট, তিন ছটাকও রাখতে পারিস, বরং তুই তোর গলাটা একবার ডাক্তারকে দেখা মা পয়লা মাসের মাইনেটা পেয়ে, বলছিলি দু’দিন পর পর সর্দি-কাশি হয়।’ বীথি কি বলল শোনা গেল না। মেয়ের হয়ে ভুবনের স্ত্রী চড়া গলায় উত্তর দেয়, ‘ও গলা-ফলার দোষ এখন এমনিতে সেরে যাবে। দু’দিন একটু নিয়ম ক’রে মাছটা ডিমটা খাক না। থাকবে না এসব। প্রীতির মাইনের টাকায় তো আর আমি সবাইকে নিত্য মাছ খাওয়াতে পারিনি। দশদিকের খরচ মিটিয়ে আর কুলানো যাচ্ছিল না। ‘

দেখতে দেখতে ভুগনগিন্নীও চাপা পড়ে গেল। রমেশগিন্নী মানে মল্লিকার খিলখিল হাসি বাড়ির উঠোনকে ততক্ষণে পুলকিত করে তুলেছে। ‘সিবিল মারিজ’ খাতায় নাম লিখিয়ে কমলা শিশিরবাবুকে বিয়ে করছেন, প্রমথর দিদিমা, আমাদের হিন্দুদের মত ছাদনাতলায় সাতপাক খাওয়া বিয়ে না। এখন বুঝতে পারলেন?’

‘শিশিরের না স্ত্রী আছে শুনলাম?’ পাশের ঘর থেকে প্রমথর বুড়ী দিদিমা, খনখনে গলায় হাসে। ‘তা এখানেই তো ভাল ছিল, ডুব দিয়ে দিয়ে একাদশী ঠাকুর জল খেতে আসত। এখন বিয়ে করলে জানাজানি হবে কোঁদল বাধবে যে আগের পক্ষের সঙ্গে।’

‘তা বলে কমলা শুনবে কেন। ধান খেলি মুর্গি যাবি কোথা। সেয়ানা মেয়ে। ব্যাঙ্কে মোটা টাকা আছে শিশিরের, পরশু দুপুরে ভাত রেঁধে খাইয়ে কমলা পেটের ভিতরের কথা টেনে বার করেছে, তারপর সোজা বিয়ের প্রস্তাব। নিজেই হেসে হেসে সব বলল রওনা হবার আগে।’

‘হরি হরি!’ প্রমথর দিদিমা আর হাসে না। লম্বা নিশ্বাস ছেড়ে দেবতার নাম নিয়ে বলে, ‘যা করেছে ভালই করেছে, কোনরকমে ঝুলে পড়া নিয়ে কথা। মেয়েছেলের আইবুড়ো হয়ে থাকার মত অশান্তি আছে নাকি কিছু। আমাদের কমলা পাকা কাজ করেছে। দোজবরে কী আসে যায়। এখন সতীনের সাথে মিলে-মিশে ঘর করুক, কি বলো বোন?’

মল্লিকা চুপ। শিশির কমলাকে নিয়ে হোটেলে তুলবে, তারপর সুবিধামত ছোটখাট একটা ঘর নেবে কোথাও,আগের পক্ষকে বিন্দুবিসর্গও জানানো হবে না–ইত্যাদি কোন কথা বুড়ীর কাছে হুট্ করে প্রকাশ করতে যেন মল্লিকার বাধল। দিনকাল ঘুরে গেছে; পুরুষ মেয়ের মেজাজমর্জি আর আগের মতন নেই বললেও বুড়ী মানবে না বরং কমলার এ-প্রস্তাব শুনলে আবার হাউ হাউ করে উঠবে চিন্তা করে মল্লিকা আর কথা বলল না।

‘হরি হরি!’ ও-ঘরে বুড়ী পাশ ফিরে শুয়ে আবার ঠাকুর দেবতার নাম নিয়ে একটা আক্ষেপের নিশ্বাস ফেলল। দুদিনের মধ্যে দুটো ঘর খালি হয়ে গেল। কাল পরশু আবার কোন্ ঘরের লোক আমাদের মায়া কাটাবে কে জানে।’

বলতে বলতে মনে হল টুপ্ করে যেন প্রমথর দিদিমা একসময় ঘুমে তলিয়ে গেল।

তারপর সারা বাড়ি নিঃসাড়। অমল ও কমলার ঘরের তালা দুটো দু’বার অল্প বাতাসে নাড়া খেয়ে ঠুকুস ঠুকুস শব্দ করে থেমে যেতে বারো ঘরের উঠোনে পায়ের শব্দ হয়। যেন কে বাড়িতে ঢুকল। প্রথমে বুঝা যায় না কোন্ ঘরের বাসিন্দা। কান খাড়া করে একটু মনোযোগ দিয়ে শুনলে টের পাওয়া যায় চার নম্বর ঘরের দরজার হুড়কা খোলা হয়েছে। অর্থাৎ শেখ ডাক্তার ঘরে ফিরেছে। আজ আর প্রভাতকণার সাড়াশব্দ নেই। সন্ধ্যা থেকে নীরব। ডাক্তারও এত রাত অবধি ডিস্পেন্সারীতে বসে সুধীরের সঙ্গে কথা কাটাকাটি তর্কবিতর্ক করে এসে ঘরে ঢুকে কারো সঙ্গে একটা কথা না বলে এক ঘটি জল খেয়ে সোজা নিজের বিছানায় চলে গেল। প্রভাতকণা মেঝের একধারে আলাদা শয্যা নিয়েছে। কেবল একলা জেগে আছে সুনীতি। পড়ার টেবিল হ্যারিকেনের আলোয় মাথা গুঁজে বসে কাগজ পেন্সিল নিয়ে অনেকক্ষণ ধরে কি যেন আঁকাআঁকি করছিল। পাখি, একটা সুপুরি গাছ? কিন্তু আঁকতে গিয়ে সুনীতি লক্ষ্য করল কোনোটাই ঠিক হচ্ছে না। কোনদিন সে ছবি আঁকতে পারবে না বুঝতে পেরে হতাশ হয়ে একসময় পেন্সিলটা কাগজ থেকে তুলে সেটা গালে ঠেকিয়ে সুনীতি বেড়ার টিনের দিকে চুপচাপ তাকিয়ে থাকে। একটু আগে ও-ঘরের মল্লিকা যখন প্রমথর দিদিমাকে ‘সিবিল মারিজ ব্যাখ্যা ক’রে শোনাচ্ছিল, সুনীতি কান খাড়া রেখে সব শুনেছে। তারপর বড় বড় চোখ মেলে চাদর মুড়ি দিয়ে মেঝেয় শুয়ে থাকা মা’র দিকে তাকিয়েছে। অন্যদিন হ’লে কমলার এই ধরনের বিয়ের গল্প শুনে প্রভাতকণা শয্যা ছেড়ে লাফিয়ে উঠে দাঁত বার করে হি-হি করে হাসত আর সুনীতিকে তার বিয়ের পিঁড়িতে কোন্ ‘ফুল চিত্রি করা’ হবে তাই ব্যাখ্যা করে শোনাত। আজ প্রভাতকণার মনের অবস্থা অন্যরকম। যেন কথাটা বুঝতে পেরে সুনীতি একসময় বেড়ার টিন থেকে চোখ সরিয়ে অত্যন্ত সতর্কভাবে তক্তাপোশের ওপর লেপ মুড়ি দিয়ে শুয়ে থাকা বাবার দিকে তাকিয়ে কি ভাবে। এদিকে হ্যারিকেনের তেল ফুরিয়ে গিয়ে সলতের আগুন থেকে থেকে লাফিয়ে উঠে ফুটফাট শব্দ করছে।

৩৩

আর ঘুম নেই প্রীতি ও বীথির চোখে।

তিনদিন চাকরি করার পর বড় বোন প্রীতির কাছে বীথি তার কাজের ধরনটা আজ বর্ণনা না ক’রে পারল না। কমলা থাকলে হয়তো তার কাছেই বলত, হ্যাঁ, যে তাকে এমন চমৎকার কাজ জুটিয়ে দিয়েছে। নাকে মুখে ভাত গুঁজে ঘড়ির কাঁটার সঙ্গে পা মিলিয়ে ছুটে গিয়ে হাজিরা খাতায় নাম সই করার বালাই নেই। কি মেরুদাঁড়া সটান রেখে সারাক্ষণ ত্রস্ত আঙুলে টেলিফোন বোর্ডের চাবি টেপা। আর একটু এদিক-সেদিক হ’লে পান থেকে চুন খসলে ওপরওয়ালার ধমক, নয়তো যে বাবুটি লাইনের ওপার থেকে নম্বর চাইলেন, তাঁর ব্যস্ত অধৈর্য গলায় হুঙ্কার, কুৎসিত গালি। ‘ছুঁড়িগুলোকে নিয়ে আর পারা গেল না…হ্যালো মিস টু নাইন জিরো টু নাইন জিরো..সারাদিন বসে মাগীগুলো গল্প করবে তো কারেক্ট নাম্বার দেবে কখন, যতসব…’ইত্যাদি। পিঠ ব্যথা করে, হাতের আঙুল টনটন করে, চোখের জল আসে, কানের ভিতর ঝিঁ ঝিঁ ডাকার মতন শব্দ হ’তে থাকে কাজ সেরে অফিস থেকে বেরিয়ে আসার পরও। একদিন না, অনেক দিন প্রীতি ছোট বোন বীথির কাছে, মা’র কাছে নিজের চাকরির অবস্থা ব্যাখ্যা ক’রে শুনিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলেছে। হাড়ভাঙা খাটুনি। সুযোগ পেলে সে আজই একাজ ছেড়ে দেয়।

তা তো বটেই। সেই তুলনায় বীথি কত সুখী।

‘কি বলছিল মিহিরবাবু,–মিহির ঘোষাল তো ভদ্রলোকের নাম?’আধবোজা চোখে বীথির গালের কাছে মুখটা সরিয়ে নিয়ে প্রীতি কথাটা আবার শুনতে চায়। পাশাপাশি শুয়ে দুই বোন। সেই ছোটবেলা থেকে একটা কম্বল ভাগাভাগি ক’রে গায়ে দিয়ে এসেছে। আজ অবশ্য আর কম্বল না। শীতের রাত্রে টিনের ঘরে ঠাণ্ডা লাগে। প্রীতি গত বছর তাদের দু’জনের জন্য এবং বাবার জন্য লেপ তৈরি করেছিল। মা আর ছোট ভাই-বোনগুলোর মেঝের ওধারে ভুবনের বিছানার পাশাপাশি আলাদা বিছানায় শোয়। দু’টো কাঁথা এবং প্রীতি বীথির পুরোনো কম্বলটা এখন ওরা ব্যবহার করছে। ঠাণ্ডাটা একেবারে নেই, বরং কেমন গুমোট লাগছিল ব’লে বীথি লেপটা পায়ের কাছে ঠেলে দিয়েছে। প্রীতি অবশ্য ওটা এখনো গলা পর্যন্ত জড়িয়ে আছে। ‘মিহির ঘোষাল আজ বলেছে তোকে এ-কথা, না কাল?’

‘আজ।’

একটু চুপ থেকে প্রীতি বলল, ‘তা করবেন কি ভদ্রলোক। মা-মরা ছেলে নিয়ে মুশকিলে পড়েছেন। ছেলেটা এমনিতে কেমন খুব দুষ্টু,–কি নাম যেন?’

‘টুটুল।’ বীথি বলল, ‘এমনি খুব ঠাণ্ডা, শান্ত ছেলে। কিন্তু আমি একটু বাথরুমে গেছি কি অন্যমনস্কও হয়েছি তো চিৎকার। সে কী ভীষণ কান্না! আধ ঘণ্টা কোলে নিয়ে আদর করব, পায়চারি করব, এটা ওটা মুখে তুলে দেব, ছড়া কাটব তারপর যদি ঠাণ্ডা হয়।’

‘কি খায়?’

‘টিনের দুধ।’ বীথি বলল, ‘দুধ, কোয়েকার ওটস্, সুজি, নেবুর রস, টমেটোর রস। এক চামচ ক’রে ডিমের কুসুমও দিতে হয়। আর একটু তরকারির জুস্। মশলা ছাড়া।’

‘দাঁত উঠেছে?’

‘একটা।’

‘তবে দু’টো দু’টো ভাত দিলেই পারিস? অবশ্য যতটা হজম করতে পারে।‘

বীথি অল্প হাসল।

‘এ কি আর আমাদের ঘরের বাচ্চা দিদি। বড়লোকের ছেলে। মিহিরবাবু তো স্রেফ দু। আর নেবুর রস এ্যাদ্দিন চালিয়ে আসছিলেন। অতটুকুন বাচ্চাকে ভাত দেবার কথা ভদ্রলোক হয়তো স্বপ্নেও ভাবতে পারেন না। তবুতো শুনলাম, এদিকে খুব কাঁদাকাটা করত বলে ডাক্তার দেখানো হয়েছিল। কিছু অসুখ নেই ডাক্তার বলেছে। কেবল খাওয়াটার পরিবর্তন করে দিয়েছে। দুধ ছাড়াও সুজি, ওটস্, ডিম, একটু সেদ্ধ আলু, তরকারির জুস্, টমেটোর রস মিলিয়ে এতবড় এক ফর্দ তৈরি করে দিয়েছে। এবং কখন কোনটা খাবে তার ঘড়ি ধরা সময়। একটু নড়চড় হ’লে চলবে না।’

‘মা-মরা ছেলে বড় ক’রে তোলা শক্ত কাজ।’ প্রীতি মন্তব্য করল। দু’ বোনের কথাবার্তা শুনে মা’র ঘুম ভেঙে গেছে। ভুবনগিন্নী একবার কাশল। কিন্তু প্রীতি বীথি তা গ্রাহ্য না ক’রে কথা বলতে লগাল। তা ছাড়া বীথি কাল মাকেও তার কাজটা কোথায়, কি ধরনের বলেছে। বলছে এবং বুঝিয়েছে। অফিসে এক গাদা পুরুষের সঙ্গে বসে কাজ করার চেয়ে বরং এটা অনেক ভাল। আর কত নির্দোষ কাজ। একটি মা-হারা শিশুক মানুষ করার দায়িত্ব এবং মহত্ত্ব সন্তানের জননী হয়ে ভুবনগিন্নী অস্বীকার করতে পারেনি। শুনে এ সম্পর্কে কোনোরকম বিরূপ মন্তব্য করা দূরে থাক, বেশ সহানুভূতির সঙ্গে বড় বোনের সঙ্গে এই নিয়ে কথা বলছে শুনে মা আরো বেশী নিশ্চিন্ত হয়। এবং আরো একটু সময় দু’ মেয়ের কথায় কান পেতে থেকে পরে গলা পরিষ্কার ক’রে আস্তে আস্তে বলল, ‘নিয়মিত তেলটেল মাখাস তো খোকার গায়ে?’

‘ধ্যেৎ’ মা’র কথা শুনে বীথি শব্দ করে হাসল। ‘কি তেল, সর্ষের তেল? হি-হি। মিহিরবাবু যদি তোমাকে এ-কাজে বহাল করত তবেই হয়েছিল আর কি। গাদা গাদা তেল মাখিয়ে আর তেলতেলে কাজল পরিয়ে ছেলেটাকে সারাদিন সঙ সাজিয়ে রাখতে।’

‘রমেশের ঘরের বাচ্চাটাকে যেমন রাখা হয়।’ প্রীতি একটা দৃষ্টান্ত তুলল।

ভুবনগিন্নী একটা ছোট্ট নিশ্বাস ছেড়ে বলল, ‘তোদেরও রেখেছি ছোট বেলায়। তখন দিনকাল ভাল দিল, টাকায় তিন সের সর্ষের তেল পাওয়া গেছে। এখন তোদের ছোট ভাই ষষ্ঠীটার সময়ই তো আর তেলটেল মাখাতে পারলাম না। সর্দিতে ভুগছে সারা বছর।’

বীথি বলল, ‘না মা, বড়লোকের বাচ্চা। মিহিরবাবু সর্ষের তেলের পক্ষপাতী না। অলিভ অয়েল এনেছেন বাচ্চার জন্যে, দু’রকমের পাউডার, দু’ বাক্স সাবান! আধ ডজন তোয়ালে তো কেবল ওই বাচ্চাটার জন্যেই সর্বদা ধুইয়ে মজুত রাখা হয় দেখছি। আমাকে পরশু খোকার জিনিস-পত্র সব বুঝিয়ে দিতে চোখে পড়ল।’

কথা বলল না ভুবনের স্ত্রী।

প্রীতি ছোটবোনের পেটে আঙুলের ছোট একটা গুঁতো দিয়ে বলল, ‘মাকে বল্ না, মিহিরবাবু আজ তোকে আসবার সময় কি বলছিল।’

বীথি হঠাৎ কথা বলল না।

লজ্জা পেয়ে কথা প্রকাশ করছে না অনুমান ক’রে মা বলল, ‘কি বল্ না। খেতে টেতে বলছিল? ফাজিল ফক্কর লোক না, কাল তোর কথা থেকে বুঝলাম। চলাবলায় ভদ্রলোকের সন্তান। কি আরো শাড়িটাড়ি কিনতে মাস না পুরতেই আবার কিছু টাকা দিতে চেয়েছিল নাকি?’

বীথির হয়ে প্রীতি বলল, ‘রাতে ওখানে থাকতে পারবে কি না জিজ্ঞেস করছিল। অবশ্য এটা তোমাদের অনুমতি নিয়েই হবে। তোমার আর বাবার। আলাদা কামরা আছে, মানে বীথি যে-ঘরে থাকবে। ভিতর থেকে চাবি আটকাবার ব্যবস্থা। সেদিক থেকে ভয়ের কিছু নেই।’

ভুবন-গিন্নী হঠাৎ কথা বলল না।

বীথি বলল, ‘কেবল তাই না। রাস্তার উল্টোদিকের বাড়ি তার দাদার শ্বশুরের। মিহিরবাবু,–মানে আমি যদি ইচ্ছা করি সেখানেও রাত্রে শুতে পারেন। সেদিক থেকে সমস্ত রকম বন্দোবস্তই আছে। তারাও মস্ত বড়লোক, কামরার পর কামরা খালি পড়ে থাকে। লোক নেই থাকবার। ‘

‘তা তুই কি বলে এলি?’ ভুবন-গিন্নী প্রশ্ন করল।

‘বা-রে! তোমাদের অনুমতি না নিয়ে আমি এ-কথার কি জবাব দিই?’

‘প্রীতি কি বলছিস্?’

‘আমি কি বলব।’ প্রীতি মাকে বোঝায়, ‘তুমি মা, তুমি বলবে বীথির এখন এ-কথায় রাজী হওয়া উচিত হবে কি না। তবে আমার বোন। এই হিসাবে বলতে পারি, শক্ত মেয়ে, সেদিক থেকে ভাবনার নেই। এখন ছেলে যদি বেশি কাঁদাকাটা করে। মিহিরবাবুর যদি একেবারেই না রাখতে পারেন তবে ভদ্রলোক রাত্রে থাকতে পারে বাড়িতে এমন নার্সই হয়তো রাখতে চেষ্টা করবেন পরে। কি করে বলি এখন?’

‘কান্না ব’লে কান্না’, বীথি মাকে শোনাল, ‘আমার ব্লাউজ কামড়ে ধরে কাঁদছিল অতটুকুন বাচ্চা যখন কোল থেকে নামিয়ে তাঁর হাতে দিই। আসতে পারি না।’

প্রীতি বলল, ‘আমি হলে এতটা হত না। আমি দু’দিনেই অত আদর ঢালতে পারতাম না আর এক বাড়ির বাচ্চা ছেলের ওপর। অর্থাৎ ভিতর বার দু’টোই আমার একটু বেশি শক্ত। বীথির এদিকটা চিরকালই কেমন কাঁচা। দ্যাখো না কতদিন আমাদর ষষ্ঠীটাকে নিয়ে কী হৈ- চৈ করে।’

‘হ্যাঁ, মা হওয়ার ধাত কারো কারো একটু বেশি থাকে। বীথির মধ্যে এটা বেশি আমি স্বীকার করি।’ ভুবন-গিন্নী লম্বা নিশ্বাস ফেলল, ‘এখন ভদ্রলোকের ছেলেকে আড়াই দিনেই এমন মায়া ধরিয়ে দিলি। রাত্রে তিনি শিশু রাখার কি ব্যবস্থা করেন। বিপদের কথা বৈকি।’

ভেবে দ্যাখো।’ বীথি দিদির গলা জড়িয়ে ধরল। ‘যদি বোঝ দিদি এখন যে টাকা পাচ্ছে তা দিয়েই আমাদের বড় সংসারের সব খরচ চলে যাবে আর টাকার দরকার নেই বা এই নিয়ে দিনরাত মাথা ফাটাফাটি চিৎকার হল্লা করবে না, তবে কাল আমি ‘না’ বলে আসি। কেননা আমারও এভাবে সারাদিন আদর ক’রে খাইয়ে ঘুম পাড়িয়ে কোলে রেখে তারপর সন্ধ্যাবাতি লাগতে একটা শিশুকে একলা ফেলে রেখে আসতে খুব কষ্ট হয়। পুরুষমানুষ বাচ্চাকে কতটা আদর দিতে পারে তা তুমিও ভাল জান। আড়াই দিনে আমার ওপর মায়া ধরেছে। আর দু’দিন না গেলে সেটা ভুলে যাবে। ভাল নার্স পাওয়া গেলে এবং রাত্রে কাছে শুতে পারলে মিহিরবাবুর ছেলের স্বাস্থ্য আরো ভাল হবে, আমি বাচ্চাটাকে কোলে নিয়েই কাল টের পেয়েছি।’

ভুবন-গিন্নী নীরব।

এবং আমারও আর ঠিক করে কোথায় চাকরি হবে তার কিছু ঠিক নেই। এখন কমলাদিও এবাড়ি ছেড়েছে। কাজেই কেবল দিদির দিকে তাকিয়ে আমার সম্পর্কে কি ব্যবস্থা করবে বাকি রাত ভেবে ঠিক কর। দিদির কানে সেজন্যেই একটু আগে কথাটা তুলেছিলাম।’

প্রীতি বালিশের মধ্যে মাথা গুঁজল। যেন ঘুম পেয়েছে। চোখ দু’টো একেবারে বুজে বড় রকমের একটা হাই তুলে বলল, ‘বিশ্বাস মা, বিশ্বাস। ঈশ্বরের ওপর বিশ্বাস রেখেই তো তুমি আমাদের এতগুলো ভাইবোনকে জন্ম দিয়েছিলে। ভরসা ক’রে এসেছ, তোমরা যদি খাওয়াতে না পারো তো ঈশ্বর এদের কাউকে উপোস রেখে মরতে দেবেন না। একভাবে তিনি চালিয়ে নেবেনই–’

যেন ভুবন-গিন্নী কি বলতে চাইল। কিন্তু আরম্ভ করার আগেই প্রীতি বলল, ‘সেই ভগবানকে ডেকে প্রথমদিনে আমায় বাইরে পাঠিয়েছিলে চাকরি করতে মনে আছে? তা-ও দেখতে দেখতে তিন বছর ঘুরল। অঘটন যখন ঘটাইনি, বীথিও তা করবে না। রাত্রে থাকাটা তো বড় কথা না। খারাপ রাস্তায় যে যাবার দিনের বেলাও তার রাস্তা খোলা থাকে। ‘

প্রীতি শেষবারের মত চোখ খুলে বেশ একটু বড় গলায় মাকে বলল, ‘বীথিকে কালই আবার কাজ ছাড়িয়ে বাড়িতে বসাও, আমার আপত্তি নেই। কিন্তু আমি সামনের মাস থেকে ষাট টাকা ক’রে দিতে পারব না ব’লে রাখছি। গত মাসেই কথাটা বলব ভেবেছিলাম। অন্তত পাঁচটা টাকা ক’রে রাখতে না পারলে আমার পলিসির প্রিমিয়াম চালাতে পারব না। অন্তত কিছুদিন তো দিই, দিয়ে না হয় পরে পেড়-আপ করে রাখা যাবে। না, না, ইন্সিওর যখন করিয়েছি, সামান্য ক’টা টাকার জন্যে সেটা নষ্ট হ’তে দেব না।’

‘না, কেন নষ্ট হ’তে দিবি।’ ভুবন-গিন্নী নিশ্বাস ফেলল। ‘ভারি তো দু’টি হাজার টাকা। তা- ও যদি ভবিষ্যতের মতন নিজের একটা সম্বল ক’রে না রাখবি তো উপায়ই বা কি। বিয়ে থা তো আর শীগির হবে এমন আশা দেখছিনা। তবু না হয় ভাবতাম একটা খুঁটি থাকবে আপদে বিপদে।’

বীথি লেপের বাইরে মুখ এনে বলল, ‘থাক মা, রাত দুপুরে তুমি এখন প্রজাপতির বিলাপ গাইতে শুরু করো না। বিয়ে বিয়ে ক’রে ওঘরের ডাক্তারনী সুনীতিকে কি অবস্থায় এনে ফেলেছে শুনলে তো সব। এখন আমি কাল গিয়ে ভদ্রলোককে কি বলব, সেটা ঠিক কর।’

কথাটা শেষ করার সময় বীথি হাল্কা গলায় একটু হাসল। প্রীতি হাসল! মা হাসল। হেসে বলল, ‘সত্যি প্রভাতকণার না হয় মাথা খারাপ, কিন্তু সুনীতিটা কী! তুই রোজগেরে বাপের মেয়ে। তুই যদি বিয়ের নামে অইটুকুন বয়েস থেকে অজ্ঞান হ’তে আরম্ভ করিস তো মুশকিলের কথা।’

‘চাবুক মারতে হয় এসব মেয়েকে।’ প্রীতি দাঁতে দাঁত ঘষল। টাইপ বস্তির মেয়ে। ঘরে থেকে এরা যত দুর্নাম, কেলেঙ্কারি ছড়াচ্ছে, যারা চাকরি করতে গেল তাদের দিয়ে তার ছটাকও হচ্ছে না। তারাই বরং এখন ভাল।’

‘সুনীতিটাকে দেখলে আমার গা ঘিন ঘিন্ করে।’ বীথি দিদির কোমরে হাত রাখল। ‘এত বড় একটা খোঁপা। আলতা। রঙিন সায়া। চুড়ি। মাকড়ি। ওয়াক্ থুঃ, সারাক্ষণ বিয়ের কনেটি সেজে আছে।’

‘ওই থাকে এক এক জাতের মেয়ে।’ প্রীতি আর চোখ খুলল না। ‘খেয়ে আর বিয়ে ক’রে কতকগুলো শেয়ালকুকুরের জন্ম দিতে কেবল সংসারে বেঁচে থাকতে চায়। এখন বড় হয়েছিস। একটু একটু করে চিনতে পারবি, চেহারা দেখলে বুঝবি কোন্ মেয়ের কি চরিত্র।’

বীথি কথা না ব’লে কি যেন ভাবে। তারপর আস্তে আস্তে অনেকটা নিজের মনে এক সময় বলল, ‘ইস ভুলে গেছি। টঙ্কার কথাটার মানে জিজ্ঞেস করা হ’ল না। তোর মনে আছে দিদি।’

‘না…না।’ প্রীতির ভীষণ ঘুম পেয়েছে। তন্দ্রাচ্ছন্ন গলায় বলল, ‘কি হবে ওই শব্দ দিয়ে, কোথায় পেলি?’

‘আর বলো না। টুটুলের বিলিতি দুধের টিনে ব্যাটারা এমন সব লম্বা লম্বা কাগজ ঢুকিয়ে রাখে, অবশ্য ওগুলো দেখে সেই নিয়মে বাচ্চাদের ফুড় খাওয়াতে হয়। সব কটা ইংরেজী শব্দের মানে বুঝতে পারিনি। আজ এসেই বারো নম্বরের রুচিদিকে জিজ্ঞেস করে দু’টো শব্দের মানে জেনে নিয়েছি। টলার আর জিজ্ঞেস করা হ’ল না।’

‘কে রুচিদি? ইংরেজী ভাল জানেন বুঝি?’

‘অই তো সেদিন এল স্বামী-স্ত্রী। একটা ছোট্ট মেয়ে আছে। বৌ-টা মাস্টারি করে। ভদ্রলোক খুব সম্ভব বেকার।’ বীথি ভয়ে ভয়ে বাবার প্রশ্নের জবাব দিল। মেয়েদের কথাবার্তায় ভুবনের ঘুম ভেঙেছে বোঝা গেল। এই মাত্র তার হাই তোলার শব্দ হল। ‘বুঝেছি বুঝেছি, এখন বুঝতে পেরেছি।’ ভুবন অন্ধকারে মাথা নাড়ল।

এতক্ষণ পর ভুবন-গিন্নী কথা বলল।

‘বেশ আছে ভদ্রলোক। খুকির বাবা। বৌয়ের রোজগারে খায় দায়। ফরসা কাপড় জামা পরে বেড়ায়। দাড়িগোঁফ কামায়, মুখখানা আয়নার মত ক’রে রাখে। সিগারেটও মুখে দেখি। কাচ্চাবাচ্ছা বেশি নেই। অই একটা মোটে মেয়ে। তাই বৌ যা আনছে কুলিয়ে যায়। ঝঞ্ঝাট কম। সন্তান বেশি থাকলে আমাদের মত ঠেকত। ইস্কুলের মাস্টারের চেয়ে টেলিফোন অফিসের মাইনে বেশি। প্রীতি কি আমার কম আনছে। কিন্তু কুলাতে পারছি কই। বীথিটাকে ও লেখাপড়া সাঙ্গ দিয়ে চাকরিতে ঠেলতে হ’ল। উপায় কি। কিন্তু বীথিরটা যোগ করলেও এই রাবুণে সংসারের সব দিকের অভাব যে আমি মেটাতে পারব মনে তো হয় না।’

ভুবন আর কথা বলল না। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। কেন না, সে একটা কথা বললে স্ত্রী এখন আটটা কথা বলবে। চাল ডাল ঘরভাড়া ঘুঁটে কয়লা কেরোসিন ইত্যাদি মাসের মোটা মোটা খরচ থেকে হিসাবটা গিয়ে ভুবনের আফিং এবং সামান্য এক-পো দুধের ওপর গিয়ে চড়াও হবে ভয়ে চুপ থেকে একটা দীর্ঘশ্বাস দিয়ে তার সকল অসহায়তা ঘোষণা করল।

বীথি লেপের মধ্যে মুখ ঢুকিয়ে চুপ করে রইল। মা-বাবার কথা আরম্ভ হলে তারা কথা বলে না। প্রীতির রীতিমত নাক ডাকছিল।

পরদিন বেলা দশটা পর্যন্ত আকাশ ঘোলাটে হয়ে রইল। পাতলা মেঘ তার কুয়াশায় মিলে বিশ্রী আবহাওয়া। না, এই কুয়াশায় ঘাস ভিজে না, গাছের পাতা শুকনো থাকে। কুয়াশার ধার কমে গেছে। আর কি, এইবেলা ছেঁড়া লেপ-কম্বল-কাঁথা গুটিয়ে ফেল, আর পাঁচ সাত দিন। ঠাণ্ডা বলে ঠাণ্ডা, টিন তেতে এমন হয়ে থাকবে যে, লেপ কম্বল কাঁথার দিকে চোখ গেলে বমি-বমি করবে। তা ছাড়া তেলে ময়লায় ধোঁয়ায় ধূলায় এক এক ঘরে বিছানার চেহারা এমন হয়ে আছে যে এমনিও ওগুলোর দিকে তাকাতে এখনই আর ইচ্ছা করে না। আর কি। শীত গেল।

এ বাড়িতে লক্ষ্মীমণি সকলের আগে ছেঁড়া কাঁথা কম্বলগুলো একটা ইঁদুরে খাওয়া চটের মধ্যে পুরে বাঁধতে বসে।

‘তোমার সবটাতেই এবার তাড়াহুড়া সাধনার মা, লক্ষণ ভাল না।’ বুড়ী প্রমথর দিদিমা জানালায় গলা বাড়িয়ে দিয়ে ভাঙা খনখনে গলায় হাসছিল।

আর সেই হাসির শব্দে রকে চৌকাঠে সিঁড়ি কুয়াতলার সিমেন্টের ওপর কালো হয়ে বসে থাকা মাছিগুলো নড়েচড়ে উঠছিল। ঠাণ্ডা কমছে আর মাটির ঝাঁক বড় হচ্ছে, বাড়ছে।

ওদিকে স্নানের ধুম পড়ে গেছে। মেয়েদের। এবাড়িতে এখন মেয়েরা ছাড়া আর এত সকালে স্নান করে কারা। রুচি প্রীতি বীথির সকালে কাজে বেরোতে হয়। তাছাড়া মল্লিকারও সকালে স্নানটি ক’রে তবে রান্নাটি চড়াতে হবে। রমেশ এই বিষয়ে ভাষণ সতর্ক। রাত্রিবাসের পর স্ত্রী ওমনি হেঁসেলে ঢুকবে তা সে কোনমতেই সহ্য করবে না। মল্লিকা হেসে হেসে কুয়াতলায় অন্যান্য স্নানার্থিনীকে প্রত্যেক দিন বেলা সাতটায় স্নান করতে এসেই খবরটা জানিয়ে দেয়। আজও সে নিয়মের ব্যতিক্রম ঘটল না। স্নান করতে আসে প্রমথর বুড়ী দিদিমা। অর্থাৎ লক্ষ্মীমণিকে সঙ্গে নিয়ে স্নান করতে আসবে ইচ্ছাতেই বুড়ী তার জানালায় উঁকি দিয়েছিল। কিন্তু লক্ষ্মীমণি তখন কাঁথাকম্বল গুটাতে ব্যস্ত।

মাছি আর ময়লার গন্ধ। দিনটা ভাসা হলে, কোন কারণে রোদ অনুপস্থিত থাকলে আর রক্ষা থাকে না। কাঁচা ড্রেনের গন্ধে বাতাস ভারী হয়ে ওঠে। অবশ্য কুয়াতলায় বীথির দামী সাবানের গন্ধটাও বারো ঘরের উঠোনকে কম আমোদিত করছিল না।

অর্থাৎ বারো ঘরের উঠোন বারান্দা সিঁড়ি চৌকাঠের মাছির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ির পিছনে আমগাছটা ছেয়ে যেমন গুটি এসেছে, তেমনি ময়লার দুর্গন্ধ ছাপিয়ে বীথির দামী মাখনের মত তকতকে নতুন নরম সাবানটা গন্ধ ছড়াচ্ছিল।

এমন সময় প্রীতি বীথির হাসি বন্ধ হয়ে গেল। লক্ষ্মীমণির সকাল সকাল হাসপাতাল যাওয়ার গল্প একটু সময়ের জন্য স্থগিত রইল। অর্থাৎ ঠাট্টা থামিয়ে, প্রমথর দিদিমাও খবরটি মনোযোগ দিয়ে শুনল।

যেন মাঘের শেষে ফাল্গুন ছুঁই-ছুঁই সকালের এক টুকরো মিষ্টি হাওয়া সংবাদটা সকলের কানে কানে রটিয়ে দিয়ে গেল।

মুখে বলতে হয়নি। হাওয়া মারফত জানাজানি হয়ে গেল।

এমন কি চিকেন্ পক্স-এ আক্রান্ত শয্যাশায়ী ও-ঘরের বিমল পর্যন্ত কি ক’রে খবরটা পেয়ে গেছে। মশারীর তলা থেকে মুখ বাড়িয়ে দিয়ে হিরণকে বলছে, ‘যাও না, ভাল ক’রে জেনে এসো, সত্যি কি গুজব।’

মুখে আঁচল চাপা দিয়ে হিরণ খুক খুক্ হাসছে।

‘গুজব হবে কেন, ডাক্তার ছুটে বেরিয়ে গেছে পুলিশে খবর দিতে! ‘

‘তা কখন, রাত ক’টায় পালিয়েছে? কার সঙ্গে পালাল, এ্যাঁ, এমনিতে দেখতে ভেজা বেড়ালটি মনে হ’ত।’

এবার মুখের আঁচল সরিয়ে হিরণ খিলখিল করে হাসল। ‘মেয়েদের দেখতে আবার শুকনো দেখায় কখন।’

‘তা বটে, কারণে অকারণে তোমরা অষ্ট প্রহর ভিজে আছ।’ হি-হি হেসে বিমল প্রশ্ন করল, ‘কার সঙ্গে সুনীতি পালিয়েছে বললে? কি করে গেল?’

হাসি থামিয়ে হিরণ বলল, ‘আর কার সঙ্গে, ওই সুধীর মামা, এটা আবার বলতে হয় নাকি। কি ক’রে গেছে তা জানে কে। সুনীতির মা তো বলছে, দরজায় খিল দিয়ে ডাক্তার আসবার আগে সন্ধ্যাসন্ধিই শুয়ে পড়েছিল। ডাক্তার ফেরে রাত সাড়ে বারোটায়। সুনীতিই দরজা খুলে দেয়। অনেক রাত পর্যন্ত জেগে কি একটা নাকি বই পড়ছিল।’

‘কি আবার বই। নাটক নভেল হবে।’ বিমল হালদার গলায় একটা শব্দ করল। ‘ওই কুমারী বয়সে মেয়েদের নাটক নভেল পড়তে দিলে আর সিনেমা দেখতে দিলে এই অবস্থাই হয়। ছি ছি, শেষ পর্যন্ত বাপ মাকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে সুনীতি পালাল। বজ্জাত, আজকাল মেয়েগুলো এক একটা যেন বজ্জাতের ধাড়ি। কী বা চলাফেরার রকম, কী বা কথা বলার ঢং। গালার ফ্যাক্টরিতে যেতে-আসতে আমি তো ওদের ভিড়ের ঠেলায় অস্থির, বাসে উঠতে পারি না, বসতে পারি না, বাস থেকে নামতে পারি না। আর তলে তলে এদিকে করছেন এসব কর্ম। উঁহু। আপিস করছেন যিনি তিনিও যেমন, ঘরে থেকে চালের কাঁকর বাছেন, কি বুড়ো বাপের ছেঁড়া কোটে তালি লাগান, তিনিরাও এখন সেই চরিত্রের হয়েছেন। ফাঁক পেলেই পীরিত, সুবিধে পেলেই পালিয়ে যাওয়া।’

বুড়ী দিদিমা খনখনে গলায় মল্লিকাকে বলল, ‘আর একটা প্রাণী এবাড়ির মায়া কাটাল। কাল গেছে কমলা, পরশু গেল কিরণ আর অমল।’

‘কমলা শিশিরকে সিবিল মারিজ করছে শুনেই তো প্রভাতকণার মেয়ে মামার সঙ্গে ঝুলে পড়ল। বিয়ের জন্য মুখপুড়ির ক’রাত চোখে ঘুম ছিল না কে জানে। আ কলঙ্ক।’

‘বলি সুধীর হারামজাদা কত রাতে ঢুকেছিল এবাড়ি কে জানে। উঠোনে ঢুকেছিল?’ লক্ষ্মীমণি চোখ বড় করে মল্লিকার কানে কানে কি বলতে মল্লিকা মাথা নাড়ল। ‘আমিও চার নম্বর ঘরের দরজায় আঙুলের টোকা শুনলাম। ক’টা তখন রাত? হ্যাঁ, তিনটা হবে।’

‘আমিও শুনেছি। একবার ভাবলাম ও-ঘরের দরজায় টিকটিকি ডাকছে। কিন্তু তারপর আর একবার টোকা পড়তে বুঝলাম মানুষ।’

বীথির মা’র দিকে তাকিয়ে লক্ষ্মীমণি বলল, ‘তা দিদি এখন শোনা আর দেখা, একই কথা। জানালার পাল্লাটা ফাঁক করে অন্ধকার উঠোন, তবু দেখে বেশ বুঝলাম মানুষ। একটা মানুষের মূর্তি। তারপর দু’টো মানুষের মূর্তি যেন দরজার কাছ থেকে সরে এসে আবার উঠোনে নামল। উঠোন পার হয়ে সদর দিয়ে বেরিয়ে গেল।’

‘লক্ষ্মীমণির বড় বড় চোখের দিকে তাকিয়ে কুয়াতলার লোকগুলো চুপ ক’রে রইল। তাদেরও চোখ বড় হয়ে গেছে, ঠোঁট ফাঁক হয়ে আছে।

‘তা তখন ডেকে কিছু বলতে যাওয়া বিপদ।’ ঢোক গিলে লক্ষ্মীমণি হেসে সকলকে বোঝাল।

‘না না দিদি, ভালই করছেন। কার ঘরে কি হচ্ছে আমরা বলবার কে। থালা ঘটি চুরি গেলে তবু দুটো কথা বলি, কলেরা যক্ষ্মায় গেলে দোরে উঁকি দিয়ে চোখ মুছি কিন্তু এ-ব্যাপার তো ভীষণ গুরুতর ব্যাপার। আমরা কথা বলার কে। চুপ ক’রে থাকা ভাল।’

অর্থাৎ এ-সম্পর্কে আর কোনো আওয়াজ উঠল না। বাতাসে ভর ক’রে একটা চাপা ফিসফিসানি উঠোনের এ-মাথায় ঘুরঘুর করতে থাকল, এ-দরজা থেকে আর এক দরজায়।

৩৪

এই নিয়ে শিবনাথ এবং রুচি হাসাহাসি করত। কিন্তু গত রাত্রে নিজেদের মধ্যে ঝগড়া হওয়াতে সকাল থেকে দু’জন খুব গম্ভীর।

স্নান খাওয়া সেরে রুচি স্কুলে বেরোবার জন্য তৈরী হচ্ছিল, এমন সময় ময়নার হাত ধরে হঠাৎ বলাই দরজায় এসে দাঁড়াল।

এই প্রথম বলাই শিবনাথের চৌকাঠের সামনে পা রাখল।

কি ব্যাপার? না শিবনাথকে চাই না। ‘মঞ্জুর মাকে দরকার।’

রুচির সঙ্গে বলাইর কি পরামর্শ থাকতে পারে। ভেবে শিবনাথ পিছনে তার মেয়েকে দেখল। আঁচলে চোখ মুছছে ময়না। হাতে একটা ভাঙা শ্লেট ও একটা বই। বর্ণবোধ। এত বড় মেয়ের হাতে দু আনা দামের লাল চটি বইটা দেখে ভিতরে ভিতরে শিবনাথ হাসল। কথা বলল না। বলাইর দরকার রুচিকে। তাই রুচিকে চৌকাঠের বাইরে যেতে পথ করে দিয়ে শিবনাথ একপাশে সরে দাঁড়ায়।

‘ময়নাকে ইস্কুলে দিতে চাই।’

‘ভাল কথা।’ রুচি শিক্ষয়িত্রীসুলভ মন্তব্য করল। ‘আরো আগেই দেয়া উচিত ছিল।’ বলাই আঙুল দিয়ে নিজের কপাল দেখাল। ‘দুর্ভোগ না কাটলে কিছু হয় না দিদি। চোখের ওপর তো দেখছিলেন। সব আমার কেমন গণ্ডগোল হয়ে গেছল। বড়বাজারের ফলের দোকান দিয়ে আমি অকূল সাগরে নিমজ্জিত হয়েছিলাম।’

ফেরিওয়ালার মুখে এতটা শুদ্ধ ভাষা শিবনাথ আর কোনোদিন শোনেনি। চিন্তা করল কিন্তু হাসিটা সে প্রকাশ করল না।

‘কোন্ স্কুলে দেবেন ঠিক করেছেন?’

‘আমি আপনাকে জিজ্ঞেস করতে এলাম।’ বলাই আড়চোখে একবার শিবনাথকে দেখে রুচির দিকে তাকায়। ‘না, এসব ধারে-কাছের ইস্কুলে মেয়েকে আমার দেবার ইচ্ছা নেই। তাই তো মেয়ে ঘরে থেকে এ দু’বছরে আরো বড় হয়ে ওঠার কারণ। এখানকার ইস্কুল সব চোর– চামার ইতর হা-ভাতের ছেলেমেয়েদের জন্যে। এগুলো বস্তির ইস্কুল! আমি শহরে পড়াবো মেয়েকে।’

রুচি নীরব।

যেন বলাইর এতটা ঔদ্ধত্য সহ্য করতে না পেরে শিবনাথ চৌকাঠের এপার থেকে মন্তব্য করল, ‘এখানকার স্কুলে এখন অনেক ভাল ভাল লোকের ছেলেমেয়ে পড়ছে। চোর-চামার যেমন আছে, ভদ্রলোকও বিস্তর।’

শিবনাথের কথার জবাব দিন না বলাই। পকেট থেকে একটা নতুন কেনা মণিব্যাগ তুলে একটা পাঁচ টাকার নোট বার করে রুচির দিকে বাড়িয়ে দিল।

‘ধরুন। আমার ইচ্ছা আপনার সঙ্গেই যাবে আসবে শহরে। কাজেই আপনার ইস্কুলে ভর্তি করিয়ে দিন। আমি কাল রাত্রে এই নিয়ে আমার স্ত্রীর সঙ্গে পরামর্শ করলাম। না, চিংড়িঘাটার বেলেঘাটার বিদ্যা ঢেলে মেয়েকে আমি তৈরী করতে চাই না দিদি। কাজেই আজই ওকে আপনি সঙ্গে নিয়ে যান। ভর্তি করে নিন।

দেখা গেল আবার আঁচলে চোখ-চাপা দিয়েছে ময়না। হাত থেকে লাল চটি বইটা মাটিতে পড়ে গেল। শ্লেটটা পড়ল না যদিও।

‘বঁটি দিয়ে তোর গলা আমি দু’ফাঁক করে দেব বানর মেয়ে। ইস্কুলের নামে এখন কান্না। এতকাল খরচে কুলোতে পারিনি, ধেই ধেই করে পাড়ায় ঘুরে খুব পেয়ারা জাম খাওয়া হয়েছে। আর না। এই বেলা–’

নুয়ে মাটি থেকে বইটা তুলে মেয়ের হাতে গুঁজে দেয় বলাই। ধমক খেয়ে কান্না থামিয়ে ময়না আবার চোখ মোছে।

টাকাটা হাতে নিয়ে রুচি বলল, ‘হয়তো আরো কিছু লাগতে পারে। তা দেখা যাবে। অবশ্য টেস্ট না করলে এখনও আমি বলতে পারছি না কোন্ ক্লাশের অ্যাডমিশন দেয়া হবে।’

‘আমি মেয়ে আপনার হাতে তুলে দিলাম। যা খুশি যেমন খুশি এখন করুন। আমি চাই না দুপুর বেলাটা বাড়িতে থেকে পাড়ায় থেকে আর ও সময় নষ্ট করে। এখানকার হালচাল আপনার তো অজানা নেই খুকির মা।’ বলাই গম্ভীর গলায় মন্তব্য করল।

‘আচ্ছা।’ রুচি পরে ময়নাকে ডাকল। ‘আমার কাছে আয়।’ ময়না রুচির সামনে গিয়ে দাঁড়াতে রুচি সস্নেহে তার মাথায় হাত রাখল।

ইতর। ইতর ছাড়া এখানে মনিষ্যি বাস করে নাকি।’ বলাই হঠাৎ ওপাশের সবগুলো ঘরের দিকে একবার চোখ বুলিয়ে বলল, ‘আপনি বলুন মঞ্জুর মা, বয়সে কি যায় আসে। লেখাপড়া যে-কোন বয়সে আরম্ভ করতে পারে মানুষ। কথাটা মিছা বলছি?’

‘না।’ রুচি বলল, ‘গরিব দেশ। ঠিক সময়ে ছেলেমেয়েকে সবাই স্কুলে দিতে পারছে না। আমি তো দেখছি। আমার স্কুলে ময়নার চেয়েও বড় মেয়ে একেবারে নিচের ক্লাসে পড়তে আসে।’

‘তবেই বুঝুন।’ বলাই চোখ বড় করল। ‘আর কাল নাকি, আমি পরে ঘরে এসে শুনলাম, বিধুমাস্টারের কোন্ মেয়ে মুখ বেঁকিয়ে ঠাট্টা করছিল–এখন যদি ময়না বর্ণপরিচয় ধরে, তবে আই-এ বি-এ পাশ করতে ঠানদি হয়ে যাবে। আই-এ বি-এ পাশ! ওই যে কথায় বলে, ছাল নেই কুত্তার বাঘা ডাক। বলি বিধুমাস্টারের ঘর তো লেখাপড়ার আওয়াজে আটপহর গমগম করছে। আর খবর পাই ওদিকে তিন দিন ধরে চলছে মাসকলাই সিদ্ধ। পরশু, আপনি বিশ্বাস করবেন, চার গণ্ডা পয়সা ধার চেয়ে বিধুমাস্টার আমার পায়ে ধরা বাকি। এই তো অবস্থা। ঘরে মা মেয়ের বিদ্যার বকবকানি শুনে মরে যাই–’

‘থাক, এসব আলোচনায় এখন দরকার নেই।’ রুচি গম্ভীরভাবে বলল, ‘ময়নাকে আমার ইস্কুলেই ভর্তি করতে চেষ্টা করব। হয়তো আজকেই করানো যাবে না। দেখা যাক, কতদূর কি হয়।’

‘তাই দেখুন, আরো টাকা লাগলে আমি দেবো।’ বলাই ময়নার দিকে চোখ হেলাল। ‘তবে তাই কর্। এনার সঙ্গে চলে যা। দুপুরের জলখাবারের পয়সা নিবি?’

‘না।’ মুখ না তুলে ময়না জবাব দিল।

‘আচ্ছা, আমি চলি। দেখুন আমার যদি এই উপকারটা করতে পারেন।’ বলাই আর কোনদিকে না তাকিয়ে হনহন করে উঠোন পার হয়ে ঘরে ঢুকল না, সোজা বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেল। গায়ে নতুন শার্ট, পায়ে নতুন চটি।

কাপড়-চোপড় পরে রুচিও বেরিয়ে পড়ে। সঙ্গে বলাইয়ের মেয়ে আর মঞ্জু।

শিবনাথ তখন রুচির সঙ্গে খেতে বসেনি। অন্যদিন তা-ই করে। কিন্তু আজ, আজ মাথায় অনেক চিন্তা, মন বিক্ষিপ্ত

অবশ্য রুচি বেরিয়ে যাবার সঙ্গে সঙ্গেই পেটের ক্ষুধা সে সুন্দরভাবে অনুভব করে।

তার সময়মত ক্ষুধা হয়, স্বাস্থ্য আজ পর্যন্ত অটুট আছে মনে করে শিবনাথ কম খুশি হল না।

শিবনাথ আয়নার নিজের মুখ দেখল! হাত দিয়ে গাল অনুভব করল।

স্ত্রী রোজগার করে খাওয়াচ্ছে। চাকরি করে সংসার খরচ চালাচ্ছে। এই অহঙ্কারের বিরুদ্ধে রুচির এই দু’বছরের আত্মম্ভরিতার সামনে দাঁড়িয়ে লড়বার মত যদি কিছু থেকে থাকে শিবনাথের তো তার এই অপরিমিত স্বাস্থ্য এবং প্রায় সবদিক থেকে সুশ্রী এই চেহারা। আয়নার নিজের মুখ দেখে শিবনাথ আর একবার খুশি হয়ে উঠল এবং তৎক্ষণাৎ হাত থেকে আরশি নামিয়ে শিস দিতে দিতে সে কুঁজো থেকে এক গ্লাস জল গড়িয়ে নিয়ে ওধার থেকে চট করে একটা থালা তুলে নিয়ে ডেক্‌চির সবটা ভাত ও বাটির সবটুকু ডাল ঢেলে খবরের কাগজ বিছিয়ে বিছানার ওপরই খেতে বসল, যা সে কোনোদিনই করে না। কিন্তু আজ সে অনেকক্ষণ ধরে আধশোয়া হয়ে বসে আরামে খেতে খেতে রুচির চরিত্র সমালোচনা করবে বলেই এটা করল। তাছাড়া পিঁড়িটা একটু অপরিচ্ছন্ন লক্ষ্য করেই শিবনাথ আর সেটা টানল না।

হ্যাঁ, মোক্ষম কথা আজ শুনিয়ে গেছে স্বামীকে কমলাক্ষী গার্লস স্কুলের টিচার। ভোরবেলা বিছানায় থেকে অন্তরের গুপ্তকথা বেরিয়ে পড়েছে।

না, বড়লোকের বাড়ির ট্যুইশন নিয়ে কাজ নেই। হাতের কাছে আর একটা এখন পাওয়া যাচ্ছে না? না যায় দেখা যাবে। এমনি তো ক’মাস ঘরেই বসা। কাজেই, এভাবে না হয় আরো কিছুদিন কাটুক। অভাব? নতুন কিছু না। এবাড়ির আর পাঁচটা পরিবার যে ভাবে আছে, সেভাবেই থাকতে হবে, উপায় কি বল। শিবনাথ ডালমাখা ভাতের গ্রাস হাতে তুলে স্ত্রীর সৎপরামর্শটা মনের মধ্যে নাড়াচাড়া করে অত্যন্ত নিশ্চিন্ত হল। কিন্তু জিনিসটা তার কাছে নতুন ঠেকল। আর পাঁচটা লক্ষ্মীছাড়া পরিবারের মত হাজার অভাব স্বীকার করে এখানে এই বাড়িতে থেকে যাওয়ার সুমতি রুচির কখন থেকে আরম্ভ হয়েছে তা-ই সে অবাক হয়ে ভাবে। কাল রাত্রে কে. গুপ্তর ঘরে গিয়ে রুণুর জন্য বেবির মাকে সহানুভূতি জানানো ও আজ বলাইর প্রস্তাবে রীতিমত খুশি হয়ে ময়নাকে সঙ্গে নিয়ে বেরোনোর সঙ্গে গার্লস স্কুলের টিচারের বস্তি- প্রীতিটা সুন্দরভাবে খাপ খেয়েছে। ভাল ভাল ভাল। রুচির শিক্ষয়িত্রীসুলভ চরিত্রের পরিচয় এতকাল পর পরিষ্কার টের পাওয়া যাচ্ছে। ঢক্ ঢক্ করে গ্লাসের জলটা গলায় ঢেলে শিবনাথ একটু স্থির হয়ে চিন্তা করল। দি ভেরি আউটলুক। হবেই, হতেই হবে। যে কাজে তার স্ত্রী আজ ক’বছর লেগে আছে, তা বিচার করলে এর চেয়ে উন্নত উদার বা মহৎ দৃষ্টিভঙ্গি তার কাছ থেকে আশা করা অন্যায়। দীপ্তির সমিতিতে যোগ দেওয়ার প্রস্তাবে শিক্ষয়িত্রীর মন কুঁকড়ে এতটুকু হয়ে গেছে, দীপ্তির ছেলেমেয়েকে পড়ানোর নামে শিউরে উঠছে। কিন্তু এসব আসে কোথা থেকে, এই মূঢ়তা, পঙ্গু অসহায়ের মত নিয়তিকে মেনে নেওয়ার প্রবৃত্তি মনের কোন্ সংকীর্ণ ছিদ্র দিয়ে রুচির মধ্যে এসে বাসা বাঁধল, তা কি আর বোঝা যায় না। হ্যাঁ, শিবনাথ হাতমুখ ধুয়ে একটা বিড়ি ধরিয়ে একলা ঘরে রীতিমত উচ্চারণ ক’রে বলল, দীপ্তি তোমার চেয়ে বড়লোক এবং রূপসী তো বটেই। সেই হিংসায় আক্রোশে বিধুর মতন বলাইর মতন বিমল হালদারের মতন বস্তির মাটি কামড়ে পড়ে থাকতে যদি সাধ হয়ে থাকে এবং দরকার হলে বাড়িওয়ালার জুলুম-চলবে-না-দলের ছেলে-মেয়েকে নিয়ে আর একটা পাল্টা সমিতি দাঁড় করিয়ে বস্তি উন্নয়নের কাজে লেগে যাও তো আমি আশ্চর্য হই না। করতে পার।

কবে একবার, শিবনাথের মনে আছে, বেতন বাড়ানো নিয়ে শহরের মাস্টার আর মাস্টারনীরা দল বেঁধে শোভাযাত্রা বার ক’রে লালদীঘির দিকে ছুটেছিল। শিবনাথের তখন চাকরি ছিল। অনেক বলে কয়ে এমন কি শেষটায় রীতিমত ধমক লাগিয়ে সেদিন স্ত্রীকে দলে যোগ দিতে নিবৃত্ত করে সে। দল ছাড়া হয়ে থাকলে বিপদ। তাই ‘অসুখ’ বলে মিথ্যে একটা দরখাস্ত লিখিয়ে রুচিকে স্কুলে পাঠাবার ব্যবস্থা করে দিয়েছিল শিবনাথ। হাতে নিশান নিয়ে স্ত্রী পথে পথে ঘুরবে, শিবনাথ সেদিন কোনমতেই স্বাভাবিকভাবে নিতে পারছিল না। তার রুচিতে বাধছিল। অতটা সাধারণ এতখানি নীচ মধ্যবিত্ত হতে সে আজও রাজী না।

‘আর পাঁচটা পরিবার কায়ক্লেশে যেমন টিকে আছে’—‘বড়লোকের বাড়ির ট্যুইশনিতে দরকার নেই’ কথার ভিতর দিয়ে উপবাসী ছারপোকার মত বেতনভোগী স্কুল-মিসট্রেসের অভিমান বিক্ষোভ আজ অন্যভাবে ফুটে উঠেছে। ভাল। শিবনাথ আরামে চোখবুজে বিড়ি টানে আর দরকার নেই রাতারাতি একটা কিছু করতে হবে বলে ব্যস্ত হয়ে এখানে-ওখানে হাঁটাহাঁটি করার। শিবনাথ কদিন নিশ্চিন্ত হ’য়ে জিরোতে পারে। সহধর্মিণীকে সে আস্তে আস্তে অনুসরণ করতে আরম্ভ করবে কি। অর্থাৎ বস্তিকে ভালবাসতে? চিন্তা করে শিবনাথ মনে মনে হাসল। হ্যাঁ, পারে সে ভালবাসতে এ-বাড়ির উঠোন, এ-বাড়ির সিঁড়ি-বারান্দা, যদি মাছি ময়লা কাঁচা নর্দমার গন্ধটা না থাকে, বিধুমাস্টারের ঝাঁক কলেরায় লোপাট পায়, পাগল কে. গুপ্ত, মূর্খ বিমল ও মেটিরিয়া-মেডিকা-পণ্ডিত শেখর সপরিবারে রাতারাতি ঘোলপাড়া কি ধুবিতলার আরো সস্তা ঘরে চলে যায়। রমেশ ক্ষিতীশ চলে গেলেও আপত্তি নেই। প্রমথদের এমন কি অভাব অসুবিধা আছে যে এই উঠোনের মাটি কামড়ে পড়ে আছে। গোঁয়ার বলাই শিবনাথের চক্ষুশূল, ঠোঁটকাটা পাঁচু তার দোকানঘরের ওপরের কামরা দু’টো দিব্যি নিজের কোয়ার্টার হিসাবে এখন ব্যবহার করতে পারে। তবে আর কে রইল, আর কোন্ কোন্ পরিবার এবাড়িতে থেকে গেলে শিবনাথ খুশি? হ্যাঁ, রুচি ও মঞ্জুকে নিয়ে তার নিরিবিলি ছোট্ট সংসার, আর উল্টোদিকের ঘরের রুগ্ন ভুবনের পরিবার। কিন্তু ওদের তো লোক বেশি, রাতদিন চেঁচামেচি লেগেই আছে, অনেক সন্তান ভুবনের। তা হোক, তা হলেও সে ঘরে এমন কেউ আছে যার দিকে তাকিয়ে শিবনাথ বস্তিজীবনের সব গ্লানি কতক্ষণের জন্য ভুলে থাকবে। বীথি। বলতে কি, যদি এ-বাড়িতে বীথি না থাকে শিবনাথ দরকার হলে রুচি ও মঞ্জুকে ফেলেই হয়তো পরদিন কেঁদে পালিয়ে যাবে। ‘হ্যাঁ এই রকম সত্যটা আমি তোমার মুখের ওপর বলতে এখন আর দ্বিধা করছি না।’ শিবনাথ জানালায় দাঁড়িয়ে কমলাক্ষী গার্লস স্কুলের সেকেন্ড টিচারের সঙ্গে কথা বলল ও দুই চোখ মেলে অনেকটা রুচির ওপর আক্রোশ নিয়ে ওঘরের বীথিকে দেখতে লাগল। কাপড় পরেছে, খোঁপায় প্ল্যাস্টিকের একটা ফুলের মালা জড়িয়েছে। আরশি সামনে ধরে ঠোঁটটাকে কামড়ে লাল করেছে। হাত থেকে আরশি নামিয়ে রাখল। ওটা কে? বীথির ছোট ভাই ষষ্ঠী। দিদি স্নান করিয়েছে, খাইয়েছে, এখন ঘুম না পাড়িয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে দেখে ষষ্ঠীচরণ কেঁদে আকুল–চিৎকার করে বাড়ি মাথায় তুলছে। ভুবনগিন্নী তাড়াতাড়ি ষষ্ঠীকে কোলে নিয়ে বীথির সামনে এসে দাঁড়ায়। ‘দে, আর একটা চুমু দিয়ে যা সারা দুপুর তো আর তোর কোলে উঠবে না।’

‘ওই আমি করি, একটু তাড়াতাড়ি বেরোব, তা-ও তোমাদের জন্যে আর হয় না। জানো ওদিকে মিহিরবাবু মা-মরা ছেলে নিয়ে কী ভীষণ জানো ভীষণ কষ্ট করছেন।’

এত বিরক্ত হয়ে বীথি কথা বলল যে মা ও ষষ্ঠীচরণ দু’জনেই হঠাৎ চুপ করে গেল। প্ল্যাষ্টিকের সুন্দর ব্যাগটা হাতে ঝুলিয়ে বীথি বারো ঘরের উঠোন পার হয়ে বেরিয়ে গেল। শিবনাথের বুক থেকে একটা লম্বা নিশ্বাস উঠে এল। মনে মনে হেসে সে সার্কুলার রোডের ছোট্ট এক গলির মাথায় হলদে দোতলা বাড়ির অর্থাৎ কমলাক্ষী গার্লস স্কুলে থার্ড ক্লাসের কামরায় হাতল-ভাঙা চেয়ারে বসা রুচিকে সম্বোধন করে আজ আবার বলল, ‘অশান্তি ভুলতে কে. গুপ্ত মদ খায়, মোহিত আর এক নেশায় ডুবে আছে এবং চাকরি যোগাড় করতে না পারার ব্যথা ভুলতে আমি প্রাণভরে অষ্টাদশী বীথিকে দেখছি। ছোট দুঃখের জন্যে ছোট নেশা। তুমি চাকরি করছ, কাজেই আমার কিছু না করাটা তেমন কিছু সাংঘাতিক ব্যাপার না। আগে মন খারাপ করলেও এখন আর তুমি তা গায়ে মাখছ না। চারদিকের অভাব দেখে আমাদের অভাবটাও ইদানীং তোমার বেশ সয়ে গেছে দেখতে পাচ্ছি। কেবল মাঝে মাঝে আমার মন খারাপ হয় তোমার পয়সায় কেনা একটা কাঁচের গ্লাস ভাঙলে, কি তোমার পয়সায় অতিরিক্ত এক প্যাকেট সিগারেট কিনে খেতে চাইলে যখন তুমি মুখ ভার কর, কি ছোটো-খাটো এক আধটা মন্তব্য ক’রে খোঁচা দাও–অথবা–’ শিবনাথ হঠাৎ স্ত্রীর সঙ্গে কথা বন্ধ করে বীথির মত ঠোঁট কামড়ে উঠোনময় কালো মাছির ঝাঁকের দিকে তাকিয়ে থেকে একটু সময় কি ভাবল, তারপর ঠোঁটটাকে বিকৃত করে হাসল। ‘অথবা অফুরন্ত রূপযৌবনের অধিকারিণী আর এক নারী, হ্যাঁ, রায় সাহেবের পুত্রবধূ দীপ্তির মুখখানা দিনে অন্তত একবার দেখব তা তোমার অসহ্য। সেই অখণ্ড বেদনা ভুলতে আমি বীথির দিকে তাকিয়ে থাকি। বীথি কাজে বেরিয়ে গেলে একবার প্রীতিকে দেখব। প্রীতি আজ এমন টকটকে লাল শাড়িটা পরল কেন—’

‘শালা কি সব বলে গেল আমার নামে, শুনলেন?’

শিবনাথ চমকে উঠল। বিধু মাস্টার জানালায় দাঁড়িয়ে দাঁত বার করে হাসছে।

শিবনাথের রক্ত মাথায় উঠে গেল। জানালার পাল্লা দুটো দড়াম করে বন্ধ করে দেবে কি না একবার ভাবল। মুখ বিকৃত ক’রে বলল, ‘কি হয়েছে, কার কথা বলতে এসেছেন আমাকে?’

‘বলাই, শুনলেন না? ব্ল্যাকমার্কেটে নেমে শালা কাঁচা পয়সার মুখ দেখছে তাই এমন গরব। আমার ঘরে কলাই সিদ্ধ চলছে, আট আনা পয়সা ধার পেতে নাকি ওর পায়ে ধরেছিলাম।’

চেহারাটা একটুও প্রসন্ন না করে শিবনাথ বলল, ‘আমি কি করব। আপনাদের বস্তির লোক এ ওর নামে চিরকালই তো বদনাম গেয়ে আসছে। এখানে এসে অবধি শুনছি।’

‘হুঁ।’ বিধু মাথা নাড়ল। ‘আপনার ওয়াইফকে ধরে মেয়েকে শহরের স্কুলে পাঠাল।’

‘বেশ করেছে। আপনার পয়সা থাকে আপনিও পাঠান না।’ শিবনাথ জানালার একটা পাল্লা বন্ধ করে দিল।

‘আপনি রাগ করছেন। আমার পয়েন্ট সেটা না, তাছাড়া কলকাতার স্কুলে কি আর খুব ভাল লেখাপড়া হয়? দেখুন না গত তিন বছরের ম্যাট্রিকুলেশনের রেজাল্ট। তা না। আমি বলছি, তোর মেয়ে কোনদিনই বর্ণ পরিচয়ের ধাপ পার হতে পারবে না। বছর বছর ফেল করবে।’

‘কেন। খুব পেকে গেছে নাকি?’ শিবনাথ সামান্য খুশির ভাব দেখাল। ‘আপনি কি করে জানলেন বলাইর মেয়ের মাথায় কি আছে না আছে?’

‘গোবর।’ বিধু শব্দ করে হাসল। ‘মশাই, ফাদার মাদার দু’জনেই যদি অশিক্ষিত হয়, সন্তানকে অক্ষর শেখানো বড় কঠিন।’

‘তা কঠিন সহজ বলাই গিয়ে বুঝুক। আপনি এখন যান। আমি শোব।’ শিবনাথ জানালার আর একটা পাল্লায় হাত রাখল।

‘ও, শোবেন।’ মুখে বলল বিধু কিন্তু জানালা থেকে নড়ল না। ‘খবর শুনেছেন বোধ করি?’

‘কি খবর।’ শিবনাথ ভুরু কুঁচকোয়।

‘শেখরের কন্যাকে নিয়ে সুধীর ইলোপ করেছে।

‘বেগতিক দেখলে আপনার কন্যাকে নিয়েও কেউ ইলোপ করবে।’ শিবনাথ নিরুপায় হয়ে কথাটা বলে ফেলল। ‘যান।’

কিন্তু বিধু মাস্টার তা গায়ে মাখল না।

‘আরাম হারাম হ্যায়, বুঝেছেন শিবনাথবাবু। শেখর আর তার বৌ মেয়েকে খুব আরামে রেখেছিল আর জল বিক্রির পয়সায় মাছ দুধ খাইয়েছিল। তার রেজাল্ট। আমার মেয়ে? একটি না। সুনীতির কাছাকাছি বয়সের তিনটি। মমতা সাধনা নীলিমা। উঁহু, এতটা সেক্সকন্সাস হবে তার সময় কই। লেখাপড়া নেই? বাটনা বাট, রান্না কর, কাপড় আছড়াও। হি-হি।’ মুখ বিকৃত করে বিধু হাসল। ‘শেখর নিজেকে একটা লর্ড মনে করত। হ্যাঁ, ওই হোমিওপ্যাথিক ডাক্তার হয়েই। আমাকে তো ও, ইদানীং এতটা বেড়েছিল যে, মানুষ বলেই মনে করত না। এখন? মুখে চুনকালি পড়ল তো? গড়। আপনাকে বলেছি বোধ হয় আর একদিন। ওপরে একজন আছেন, যিনি সব অন্যায়ের বিচার করেন। একদিন একটা টাকা কর্জ চেয়েছিলাম বলে তুই আমায় ইনসাল্ট করেছিলি। বার্থ কন্ট্রোল কর। মূর্খের মত এত ছেলেমেয়ে হইয়ে তুমি কি সব দিকে ঝাঁঝরা হয়ে যাবে। এখন? তোর তো একটি ইসু। তবে তোর ঘরে এই সর্বনাশ ঢোঁকে কেন। কি মশাই চুপ করে আছেন কেন?’

শিবনাথ সশব্দে পাল্লাটা বন্ধ করে দিল।

.

‘হ্যালো–মিস্টার।’

চারু রায়। চারু রায়কে দেখেই শিবনাথ এক-পা এক-পা করে বনমালীর দোকানের সামনে গিয়ে দাঁড়াল। শুধু কে. গুপ্ত বসে আছে দেখলে সে রমারম রাস্তায় নেমে যেত।

কিন্তু দুর্ভাগ্য শিবনাথের, কে. গুপ্ত প্রথম কথা বলল।

‘হ্যাঁ, একটা এনগেজমেন্ট আছে একজনের সঙ্গে।’ শিবনাথ কে. গুপ্তর দিকে তাকাল না, চারু রায়ের চোখে চোখ পড়তে বলল, ‘নমস্কার, কতক্ষণ এসেছেন?’

‘এই তো।’ চারু রায় হাত দু’টো একত্র করল। ‘বসুন।’

গুপ্ত মুখে বলল না, হাত বাড়িয়ে শিবনাথের একটা হাত ধরে বলল, ‘বসুন, মশাই বসুন। এখানে আসার দিন থেকে তো শুনছি আপনার কাজ আর কাজ। আমরা না হয় অ-কর্মার ঢেঁকি তা বলে পাঁচ-সাত মিনিট আমাদের সঙ্গে বসে গল্প করলে আপনার লাখ টাকা কিছু ক্ষতি হবে না, বসুন।’ একটু ধমকের সুরে গুপ্ত হাসছিল। শিবনাথ বিব্রতবোধ করল। চারু রায় অল্প হাসল। বনমালী খাতা থেকে মুখ তুলল বলল, ‘বসুন স্যার।’

পায়া ভাঙা বেঞ্চের একপাশে শিবনাথকে বসতে হল।

‘এইমাত্র আপনার কথা হচ্ছিল।’

‘তুই থাম গাধা, তুই থাম। আমি বলছি।’ কে. গুপ্ত বলল, ‘ময়নাকে সঙ্গে নিয়ে বেরোল দেখলাম আপনার স্ত্রী?’

শিবনাথ মাথা নাড়ল।

‘ব্যাপার?’

কে. গুপ্তর প্রশ্ন এবং ঠোঁট-চাপা হাসিটা শিবনাথের মোটেই ভাল লাগল না। দাঁতে দাঁত চেপে গম্ভীর হয়ে বলল, ‘বলাই ওর হাতে পায়ে এসে ধরেছে। এখানে মেয়ে স্কুলে যেতে পারে না, সতের বছর বয়সে বর্ণপরিচয় পড়ছে দেখে বিধুর মেয়েরা ঠাট্টা করে। কাজেই শহরের ইস্কুলে ভর্তি হওয়া ছাড়া উপায় নেই।

‘গুড আইডিয়া।’ কে. গুপ্ত নিজের কাঁধে একটা ঝাঁকুনি দিল। ‘মেয়েটা দেখতে মন্দ না। বলাইটা যদিও চাষা। তা হলেও, চেষ্টা থাকলে ময়নাটা লেখাপড়া শিখতে পারেব। বেশ বেশ ভাল। না, আমি কিন্তু আপনাদের সম্পর্কে আর একটা কথা শুনেছি।

‘কি কথা।’শিবনাথের দুই কান গরম হয়ে উঠল। শিবনাথ বনমালী এবং চারু রায়ের দিকে তাকাল। একটা কুকুর পাশের নর্দমা থেকে কার জুতোর একটা ছেঁড়া শুকতলি মুখে করে এসে শিবনাথের পায়ের কাছে রেখে ছুটে পালাল। ‘ননসেন্স’ বলে চারু রায় নাকে রুমাল গুঁজল। ‘কাল রাত্রে কি নিয়ে খুব গণ্ডগোল হয়েছে আপনার ঘরে? কি সব জিনিস টিনিস নাকি ভেঙেছে?’

একটা ঢোক গিলল শিবনাথ। কিন্তু তৎক্ষণাৎ সূক্ষ্ম হেসে বলল, ‘একটা কাঁচের গ্লাস। অসাবধানে নাড়াচাড়া করতে গেছলেন শ্রীমতী। আপনি তখন ঘরেই ছিলেন?’

‘আরে ধেৎ মশাই! ঘরে। আমাকে রাত বেশি হলে ঘরে ঢুকতে দেয় নাকি বেবির মা। তা ছাড়া স্বদেশী মাল টেনে গেলে তো কথাই নেই। শুনলাম, টাকাপয়সা নাকি আরো কি সব কথা নিয়ে খুব ঝগড়াঝাটি করেছেন স্ত্রীর সঙ্গে’। বলে কে. গুপ্ত ঘাড় ফিরিয়ে বনমালীর দিকে তাকাতে বনমালী হিসাবের খাতা থেকে মুখ তুলল।

তুমি নিজের চরকার তেল দাও গুপ্ত, নিজের চাকা চালু কর। কার ঘরে কি নিয়ে ঝগড়া হ’ল, খোঁজ নিয়ে তোমার কি হবে।’

শিবনাথের মুখটা কালো হয়ে গেল। কিন্তু বুদ্ধিমান সে। এক সেকেন্ড মাটির দিকে চেয়ে থেকে পরে চোখ তুলে হাসল। ‘আজ সকালে বুঝি ঘরে গিয়ে স্ত্রীর মুখে সব শুনলেন। হ্যাঁ, রাত্রে আমার ওয়াইফ আপনার স্ত্রীকে দেখতে গেছল। জ্বরটা কমেছে তো, আজ ভাল?’

‘আপনি দেখছি খুব সিরিয়সলি এটা নিচ্ছেন?’ গুপ্ত অট্টহাস্য করে উঠল। ‘আরে না না মশাই, এমনি জিজ্ঞেস করলাম। মেয়েদের মুখে শুনে নাচানাচি করা আর তাই নিয়ে আর একজনকে জেরা করা আমার নেচার না। ও কিছুই না। এমনি বললাম। আসলে হয়েছে কি, একটু আগে বিধুর ছোট ছেলেটা কি যেন নাম, হুলা এসেছিল বনমালীর দোকানে এক পয়সার নুন কিনতে। পেট-মোটা সরু-ঠ্যাং ঘটির মত ঘাড়-বেঁটে ইঁচড়ে পাকা হুব্লাকে আপনি দেখেন নি? হারামজাদা এসেই এক গাল হেসে বলছিল, কাল বারো নম্বরের শিবদাদা বৌকে বেজায় মারধর করেছে, রাগ করে থালা-ঘটি ভেঙেছে। আমরা শুনে থ।’

বনমালী বলল, ‘ছেড়ে দাও ছেড়ে দাও, বিধুর ঝাঁক হ’ল গিয়ে মাছি। এখানের ময়লা ওখানে টেনে নেয়, ওঘরের খবর এঘরে আনে। আর মিছা কথা। তিলকে তাল করতে, মরার মুখে কথা বলাতে ওদের জুড়ি নেই।’

‘ওইটুকুন বাচ্চা ছেলে, কত বড় এক একটা দাঁত। আর কী পাকা কথা। আমি কথা শুনব কি, ওর বলার ঢং দেখে হেসে বাঁচি না।’ চারু রায় শিবনাথের দিকে তাকাল।

‘বস্তির চেলেমেয়ে এর চেয়ে ভাল হবে আপনি আশা করতে পারেন না নিশ্চয়ই, মিস্টার রায়।’ শিবনাথ সঙ্গে সঙ্গে হাসল।

‘হ্যাঁ, আমি তো চড় মারতে চেয়েছিলাম।’ কে. গুপ্ত তার লম্বা শীর্ণ হাতটা শূন্যে তুলে ধরল। তারপর আর হারামজাদা এখানে দাঁড়ায়নি। এক দৌড়ে গিয়ে বাড়িতে ঢুকল।’

কে. গুপ্তর হাত-নাড়া দেখে বনমালী, চারু রায় এবং শিবনাথ একসঙ্গে হেসে উঠল। ‘থাকগে। কি আর করা যায় এসব ছেলেমেয়েদের, দোষ গার্ডিয়ানদের। একমাত্র পিটি করা ছাড়া উপায় নেই। আমি তো, ঐ যে বসে আছি বটে এখানে, কিন্তু হাঁসের মত। কাদা লাগতে দিই না গায়ে।’ শিবনাথ মুখ্যত চারুর দিকে তাকিয়ে বলল, ‘সেদিন লাইট-হাউসের সামনে কথায় কথায় আমি এ ধরনের একটা আভাস দিয়েছিলাম আপনাকে মনে আছে?–নরকবাস এখানে থেকে।

‘খুব মনে আছে।’ মিহি সুন্দর গলায় চারু রায় মেয়েদের মত হাসল। এবং তারপর কি একটু ভেবে টিন থেকে দুটো সিগারেট তুলে শিবনাথ এবং কে. গুপ্তর হাতে গুঁজে দিয়ে বলল, ‘আচ্ছা ব্রাদার, আমি এখন পালাই। ক’টা বাজে? অ গড়।’ হাতঘড়ির দিকে তাকিয়ে চারু অকস্মাৎ উঠে পড়ল। এবং একটা হাত নেড়ে ‘বাই বাই’জানিয়ে কারো দিকে আর না তাকিয়ে রাস্তার ওপাশে সোজা সুপুরিগাছের দিকে ছুটল।

ছোট্ট হলদে গাড়িটা একটু পোড়া তেলের গন্ধ ছড়িয়ে চোখের নিমেষে অদৃশ্য হয়।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *