২৫. রমেশ রায়ের সই-করা চিঠি

২৫

রমেশ রায়ের সই-করা চিঠির ওপর দ্রুত চোখ বুলিয়ে পারিজাত মুখ তুলল। শিবনাথের বুক দুরদুর করছিল। সুশ্রী সুবেশ পরিচ্ছন্ন এবং অতিরিক্ত রকম মার্জিত এই লোকটির সামনে ব’সে শিবনাথের রীতিমত ভয় করছিল পাছে না সে কোনরকম অসৌজন্য, অভদ্রতা, নোংরামি কি কথার উত্তর দিতে গিয়ে নির্বুদ্ধিতা প্রকাশ করে।

আর শিবনাথ তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছিল পারিজাতের ড্রইংরুম।

অতিরিক্ত রকম আধুনিক। পরিচ্ছন্ন এবং সুসজ্জিত তো বটেই।

একটা শোফার ওপর শিবনাথ মেরুদাঁড়া বেঁকিয়ে বসে ছিল। আর পারিজাত তার সুন্দর বাঘছাল চটি পায়ে পায়চারি করছিল। টিন থেকে সিগারেট তুলে পারিজাত মুখে গুঁজল এবং দেশলাই জ্বেলে তাতে অগ্নিসংযোগ করল। শিবনাথকে সিগারেট অফার করা হ’ল না।

‘মশাই আপনারা বি-এ, এম-এ পাশ করেছেন কিন্তু আপনাদের শিক্ষা দেওয়ার পদ্ধতি ভাল না।’

‘কি রকম?’ প্রশ্ন করতে গিয়ে শিবনাথ করল না। কেন না পারিজাতের বক্তব্য তখনো শেষ হয়নি।

‘আপনি কি আট নম্বর বস্তিতে থাকেন?’

শিবনাথ ঘাড় নাড়ল।

‘আপনি আর কিছু করেন কি?’

‘আমি আপাতত কিছু করছি না। তবে একটু ব্যাবসাট্যাবসা করব ইচ্ছা আছে।’

পারিজাত অল্প শব্দ করে হাসল।

‘ব্যবসা করবেন, কিছু টাকা সংগ্রহ হয়েছে বুঝি?’

‘ঠিক তা না।’ শিবনাথ বলল, ‘আমার ওয়াইফও গ্র্যাজুয়েট। তিনি কমলাক্ষী গার্লস হাই ইস্কুলের টিচার। আমার ট্যুইশানির টাকাটা জামিয়ে আমি ছোটখাটো কিছু স্টার্ট দিতে চাই।’

‘গুড আইডিয়া।’

পারিজাত একসঙ্গে প্রচুর ধোঁয়া উদ্গিরণ করে শিবনাথের চোখের দিকে এতক্ষণ প তাকাল। রমেশের সই-করা চিঠিটা ছিঁড়ে দু টুকরো করে ফেলল।

‘না, বলছিলাম আপনাদের বস্তির আর এক ভদ্রলোক সেদিন এসেছিলেন। এম-এ পাশ উঃ, আমার সাত আট বছরের দু’টো বাচ্চাকে পড়াতে বসে তিনি আধ ঘণ্টার মধ্যে আশিটা ইংরেজী শব্দ বলে ফেললেন। আমি ওদের পড়ার ঘরেই তখন ছিলাম।’

‘কি পড়াচ্ছিলেন?’ শিবনাথের হাসি পেল।

‘প্রাথমিক স্বাস্থ্য-বিজ্ঞান।’ পারিজাত এখন আর হাসছিল না। ‘বাংলা শব্দগুলোর বাংলা মানে তিনি ভুলে গেছেন বলে মনে হ’ল। অপরিচ্ছন্ন বোঝাতে ডার্টি, বাষ্প বোঝাতে ভেপার, বীজাণু বোঝাতে ব্যাক্টেরিয়া ইত্যাদি আমদানি করলেন। চতুর্থ শ্রেণীতে পড়ে আমার ছেলে দু’টি। একবার চিন্তা করুন।

শিবনাথ চুপ ক’রে রইল।

‘কি নাম ভদ্রলোকের, হ্যাঁ, কে. গুপ্ত। এককালে তিনি কোন অফিসের ভয়ানক বড় অফিসার ছিলেন শুনেছি।’ পারিজাত এবার মৃদু হাসল!

‘তারপর!’ কৌতূহল দমন করতে না পেরে শিবনাথ বলে ফেলল, ‘তাই বলুন।’

‘তারপর আর তাকে আমি আসতে নিষেধ করলাম।’ পারিজাত বলল, ‘আমার ছেলেরা বাঙালী, সাত থেকে আট বছর ওদের বয়েস। পড়াতে বসে যিনি কথাটা ভুলে যান তাকে আমি শিক্ষক বলি না!’

শিবনাথের হাসি পেল এবং দুঃখও হ’ল। তখন রায় সাহেবের নাতিদের পড়ানোর প্রস্তাবে বনমালীর ওপর কে. গুপ্তর ক্ষিপ্ত হওয়ার দৃশ্যটা মনে পড়তে শিবনাথ লোকটিকে মনে মনে করুণা না ক’রে পারল না।

‘কাজেই বুঝতে পারছেন—’ শিবনাথ ঘাড় নাড়ল।

পারিজাত অধিক কিছু বলল না।

‘ভাল কথা, আপনি পড়াতে চাইছেন, আমার আপত্তি নেই। আপনি ওদের মার সঙ্গে কথা বলুন। এই ডিপার্টমেন্ট শ্রীমতীর। হাজার কাজে আমায় এত বেশি এনগেজ্ড থাকতে হয় যে এদিকে আর–’ বাক্য শেষ না করে পারিজাত স্ত্রী নাম ধরে ডাকলেন। পর্দা সরিয়ে মহিষী ড্রইংরুমে এসে ঢুকলেন। যেন পর্দার ওপারে দীপ্তি অপেক্ষা করছিলেন। হয়তো এতক্ষণ দু’জনের কথাবার্তাও শুনেছেন।

শিবনাথ হাত তুলে নমস্কার করল। প্রতিনমস্কার জানিয়ে তিনি স্বামীর পাশে দাঁড়ান।

‘আপনি আমাদের আট নম্বর বস্তিতে থাকেন?’

শিবনাথ ঘাড় নাড়ল। ‘আমরা নতুন এসেছি!’

‘তা জানি।’ দীপ্তি মাত্র একবার শিবনাথের আপাদমস্তক নিরীক্ষণ করে তারপর আর সেদিকে তাকালেন না। টেবিলের ফুলদানিটা একদিক থেকে সরিয়ে আর একদিকে রাখেন। একদৃষ্টে সেদিকে তাকিয়ে থেকে শিবনাথ অন্য প্রশ্নের উত্তর দিতে প্রস্তুত হয়।

‘এঁর স্ত্রী গ্র্যাজুয়েট। একটা স্কুলে আছেন।’ পারিজাত স্ত্রীকে বলল। কিন্তু দীপ্তি তাতে বিশেষ মনোযোগ দিলেন না। কথাটা তিনি আদৌ শুনলেন কিন্তু বুঝতে না পেরে শিবনাথ অস্বস্তিবোধই করল। সিগারেট মুখে রেখে পারিজাত কথা বলে।

‘চলতি কথায় প্রাইভেট টিউটর বলতে যা বোঝায় আমি আমার ছেলেদের জন্যে সেরকম কিছু চাইছি না।’ দীপ্তি এবার মুখ ফেরান। ‘আমি জানি, জানতাম এসব জায়গায় এসে বাস করলে আর যা-ই হোক, বাচ্চাদের লেখাপড়া হবে না।’

ক্ষুব্ধ কণ্ঠস্বর, শিবনাথের বুঝতে কষ্ট হ’ল না।

‘কেন, সেই যে, কি নাম? এদের নামগুলো আমি যখন তখন ভুলে যাই,–বুড়ো মাস্টারকে তোমার পছন্দ হ’ল না? ভেটারেন স্কুলমাস্টার শুনছি।’

স্বামীর দিকে তাকিয়ে দীপ্তি শিবনাথকে বললেন, ‘আপনাদের বাড়ির বিধুমাস্টারের কথা বলছেন উনি। আপনার সঙ্গে পরিচয় হয়েছে নিশ্চয়ই।’

হ্যাঁ, পরিচয় মানে একদিন দু-একটা কথা হয়েছে, এই পর্যন্ত।’ মহিলার কণ্ঠস্বরে তাচ্ছিল্যের ভাব লক্ষ্য করে শিবনাথ সতর্ক হ’য়ে উঠল। ‘এঁদের কারোর সঙ্গে আমার তেমন—’

‘তা তো হবেই, তা তো বটেই।’ পারিজাত বলল, ‘এদের মধ্যে যারা অশিক্ষিত তারা তো বটেই, লেখাপড়া-জানা লোকগুলোও কেমন আনকালচার্ড রাস্টিক, কথা বার্তায় এমন একটা–’

‘ব্রুট ব্রুট।’ দীপ্তি একটা শোফায় বসে পড়লেন। কণ্ঠস্বর তাচ্ছিল্যের চেয়ে ঘৃণা বেশি, বিরক্তির চেয়ে রাগ। ভ্রমরকৃষ্ণ ভ্রূযুগলের কুঞ্চন প্রসারণ লক্ষ্য করতে গিয়ে একটু বেশি সময় শিবনাথ মহিলার মুখের দিকে তাকিয়ে রইল।

‘বিধুঁকে ডাকিয়ে একদিন ট্রায়াল দিয়েছিলাম। উঃ’ দীপ্তি মুখখানা আবার বিকৃত করলেন। ‘একে এমন নোংরা বেশভূষা, পড়াতে বসে একটা কাঠি দিয়ে দাঁত খোঁচাতে লাগল, থুতু ফেলল জানালার গরাদে, সেই কাঠি আবার কানে গুঁজে নোংরা হাত ছেলেদের বই খাতার ওপর রাখল, আপনি কল্পনা করতে পারেন? দাঁড়িয়ে আমি দৃশ্যটা দেখলাম। আমার মাথা ঘুরছিল। অ্যাঁ, এই লোক আমাদের ছেলেদের মানুষ করবে!’

‘তারপর?’শিবনাথও ঘৃণায় মুখ কুঞ্চিত করল। ‘আমি স্কামটার সঙ্গে কথাই বলি না। মুখে দুর্গন্ধ।

‘বস্তির লোক। এর চেয়ে ওর কাছ থেকে আর কি ভাল আশা করতে পার।’ পারিজাত শব্দ করে হাসল। ‘সেদিনই মাস্টারকে জানিয়ে দিতে হ’ল আমাদের ছেলেদের পড়াতে হবে না।’ পারিজাত শিবনাথের দিকে তাকায়।

.

শিবনাথের দুই কান লাল হয়ে গেল। কিন্তু মুখের হাসি নিভতে দিল না। ‘আমার ধারণা ছিল এখানে,–অবশ্য কম খাক বেশি খাক, সেটা বড় কথা নয়, চলাফেরায়, কথাবার্তায় অন্তত এরা সভ্য সুশ্রী হবে, কিন্তু এখন দেখছি অন্যরকম।’ শিবনাথ পারিজাতকে বোঝাতে চেষ্টা করল। ‘শহরে ঘর একরকম পাওয়াই যাচ্ছে না। ফাইন্ডিং নো আদার অলটারনেটিভ, বুঝলেন না, নিরুপায় হয়ে আজ এখানে আমি আছি–অন্যত্র সুবিধামতন ঘর পেলেই–’

পারিজাতের আগে দীপ্তি শিবনাথের দুঃখটা বুঝলেন। ‘অবশ্য সবাই যে বিধুমাস্টারের মতন, আমি তা বলব না। ভদ্রসমাজে মিশতে পারে এমন লোকও দু’ একজন আছে, এই ধরুন আপনাদের রমেশ। আমার তো বেশ পছন্দ হয় লোকটিকে।’

‘ও রমেশ! হি ইজ ওয়ান্ডারফুল।’ পারিজাত মাথা নাড়ল। অথচ দেখুন লেখাপড়া একরকম জানে না বললেই চলে। তবু কত সভ্য, মার্জিত।’

‘তা ছাড়া যাকে বলে সেল্ফ-মেড্ ম্যান। ভয়ানক গরিব ছিল যখন এখানে আসে। আমি শ্বশুরমশায়ের কাছে শুনেছি। কিন্তু মাথা খেলিয়ে এটা-ওটাকরতে করতে বেশ দু’টো পয়সা ক’রে ফেলেছে।’

‘আমি শুনেছি, আমায় বলেছেন সব রমেশেবাবু।’ শিবনাথ গর্বিতভাবে দীপ্তির চোখে চোখ রাখল। ‘অবসর সময়টা আমি তাঁর চায়ের দোকানে বসেই কাটাই।’

‘আমি তাই ভাবি’। পারিজাত বলল, ‘শুনি লোকে উপোস থাকছে, বাড়িভাড়ার টাকা যোগাড় করতে পারে না, স্ত্রী-পুত্র-কন্যার পরনে কাপড় জামা নেই,–কিন্তু কেন এমন হয়, নিশ্চয়ই তাদের বুদ্ধির দোষে এমন হচ্ছে।’

‘আরো কারণ আছে।’ দীপ্তি একটা বক্তৃতার সুরে বললেন, ‘অলসতা, কর্মবিমুখতাও দারিদ্র্যের লক্ষণ। না হলে ধরুন, এই অমল, তেমন লেখাপড়াও জানে না, বেশ তো, চাকরি ছিল না, তুমি ফিরি করে এটা-ওটা যেমন লজঞ্চুস বিস্কুট কি তেল সাবান বিক্রি ক’রে দুটো পয়সা রোজগার করতে পারতে, নিশ্চয়ই তাতে তোমার সম্মান ক্ষয়ে যেতো না।’

পারিজাত বলল, ‘যোয়ান ছেলে, রিক্সা টানতে পার, মোট বয়ে পেট চালাতে তোমার মত লোকের আপত্তি করা উচিত না, কি বলুন?’

ক্ষীণ হেসে শিবনাথ বলল, ‘এসব ওদের বোঝায় কে বলুন-–’

বাধা দিয়ে উত্তেজিত স্বরে পারিজাত বলল, ‘বোঝাতে যাওয়া বিপজ্জনক, সদুপদেশ কেউ দিতে গেলে তারা তার অন্য রকম অর্থ ধরে নেয়। নিয়েছে। এ্যাজ ফর ইন্‌স্ট্যান্‌স, রমেশ বুঝি বলেছিল তার স্ত্রীকে না হয় আমাদের গেঞ্জির কলে কাজ নিতে, অ্যান্ড দ্যাট্ বাগার ওয়েন্ট আপ টু কিল্ হিম, অমলকে নাকি ইন্‌সাল্ট করা হয়েছে একথা বলার দরুন,–বুঝুন মারতে চেয়েছিল সে রমেশকে।

‘শুধু তাই?’ শিবনাথ লক্ষ্য করল দীপ্তিও কম উত্তেজিত হন নি। চোখে ইঙ্গিতে স্বামীকে দেখিয়ে বললেন, ‘এপর্যন্ত ওঁর সম্পর্কেও নানারকম কথা বলতে অমল ভ্রূক্ষেপ করেনি,–মোজার কলে গেঞ্জির কলে মেয়েদের ঢোকানো হচ্ছে এটা কিছুতেই অমল আর তার দলের লোকেরা ভাল চোখে দেখছে না—’

‘মূর্খ।’ অস্ফুটে বলল শিবনাথ।

‘এরকম সমস্ত ব্যাপার।’ পারিজাত উত্তেজনাটা একটু প্রশমিত করে সিগারেটের পরিবর্তে এবার পাইপ ধরায়। তারপর আস্তে আস্তে পায়চারি করে বলে, ‘এদের ভাল করতে যাওয়া উচিত না, ভাল করতে গেলে তাতে মন্দের অংশ কতটা দাঁড়িপাল্লা নিয়ে ওজন করতে বসে, উপকার করতে গেলে তাতে কী পরিমাণ ত্রুটি আছে খুঁজতে আরম্ভ করে। ঘরের অভাব, শহর শহরতলিতে লোকের সংখ্যা বেড়ে গেছে, জঙ্গল কেটে খানা ডোবা বুজিয়ে খরচপত্র করে টিনটালি দিয়ে আস্তানা তৈরী করে মানুষকে থাকতে দেওয়া হল, অমনি নিন্দা আরম্ভ হ’ল বস্তি বসানো হয়েছে গরিবদের এক্সপ্লেয়েট করতে,–কেপিটেলিস্ট রায় সাহেব আর তার ছেলের আর পাঁচটা কারবারের মত এটাও বড় রকমের একটা বিজনেস।’

পারিজাত চুপ করতে দীপ্তি বললেন, ‘এ্যাজ ফর ইন্‌স্ট্যান্‌স, এখানে মেয়েদের একটি সমিতি আছে, সমিতি মানে পাঁচটি মেয়ে একত্র হয়ে আমাদের বাড়ির পিছনের জমিতে কানামাছি খেলত, এসে দেখেছি, তারপর আমি টাকা দিলাম, বই এল, পাঁচরকমের খেলাধূলার সরঞ্জাম এল, মেয়েরা নাচ গান, সূচের কাজ, রান্না, রুগীর সেবা শিখতে পারে তার সবরকম ব্যবস্থাই করে দিলাম। কিন্তু অন্যদিক থেকে আরম্ভ হ’ল এডভার্স ক্রিটিসিজম, কি, না– ‘ কথা অসমাপ্ত রেখে দীপ্তি স্বামীর দিকে তাকান। মুখ থেকে পাইপ সরিয়ে পারিজাত শিবনাথের দিকে তাকিয়ে মৃদু হেসে কথাটা, শেষ করল : বড়লোক গরিবদের শোষণ করছে, কিন্তু বড়লোকের গিন্নী সমিতি টমিতি ক’রে সোশ্যাল ওয়েলফেয়ার দেখাচ্ছেন। মানে ইলেকশন আছে কিনা, স্ত্রীর মারফত্ পারিজাত ভোটের অঙ্ক বাড়াবার ফিকিরে আছে–বুঝুন।

.

শিবনাথ মৃদু হাসল।

‘কাজেই আমিও ঠিক করেছি, ওদের ভালো আর করব না।’ প্রায় দাঁতে ঘষে পারিজাত বলল, ইচ্ছা ছিল আপনাদের বাড়ির সামনের রাস্তাটা পাকা করে দেব, কিন্তু দিলে হবে কি, বলবে বস্তির লোকের সুবিধার জন্য কি আর পারিজাত এটা করছে, জলকাদায় নিজের গাড়ি চালাবার অসুবিধা হয় দেখে এদিকে নজর পড়েছে।’

‘তুমি অতি সহজেই ডিসহার্টেড্ হয়ে পড়ো।’ স্বামীর কথা শুনে দীপ্তি রুষ্ট হন। কুঞ্চিত ভ্রূযুগল। শ্বশুরমশায় অসুস্থ। নিজে এসে দেখাশোনা করতে পারেন না। কিন্তু তাই বলে তুমি যদি হাল ছেড়ে দাও, তবে কিছুই থাকবে না। বস্তি এখন বড় কথা না। ব্যবসা বাণিজ্য ছড়িয়ে আছে, সেগুলো দেখতে হবে; বোঝ বেশি বাড়াবাড়ি করছে আস্তানা ভেঙে দাও, দরকার নেই আমার, বেকার বাউণ্ডুলে সব ভাড়াটে বসিয়ে ফি মাসে ঘরভাড়া আদায়ের হাঙ্গামা পোহানো।’

‘না না, তা হবে না।’ পারিজাত আবার ধীরে ধীরে পায়চারী করছিল। ‘আই হ্যাভ ডিসাইডেড–’ স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে বলল, ‘আঠারো টাকা ভাড়া দেবার সামর্থ্য নেই, কিন্তু চল্লিশ টাকা ভাড়া গুনতে পারে এমন লোকেরও অভাব হবে না। বাবার সঙ্গে কনসাল্ট করতে পারছি না, কর্পোরেশনের সঙ্গে হাঙ্গামাটা চুকছে না তাই। আরো কিছু টাকা ঢালতে হবে হয়তো। ড্রেনের মামলাটা চুকে গেলে আমি ওখানে পাকা বাড়ি তুলব। বেকার বাউন্ডুলের বস্তি আর রাখছি না। ‘

‘তাই কর, তাই করা উচিত।’ দীপ্তি স্বামীর দিকে না শিবনাথের দিকে তাকান। কুৎসিত কদর্য ওয়ান পাইস ফাদার-মাদারদের বাড়ির কাছে রেখে জায়গাটাকে নরক করে রেখো না, কি বলেন?’ সুন্দর অধরোষ্ঠের বঙ্কিম ভঙ্গিমা শিবনাথকে মুগ্ধ করল। ‘নিশ্চয়ই।’ মাথা নাড়ল সে।

দীপ্তি আলস্যভঙ্গের হাই তুলে বললেন, ‘যাকগে, এখন কাজের কথায় আসা যাক, রমেশ পাঠিয়েছে, তুমি কি এই ভদ্রলোককে ছেলেদের টিউটার রাখবে ঠিক করলে?’

‘হ্যাঁ সেজন্যেই তো এত কথাবার্তা।’ পারিজাত স্ত্রীর দিকে তাকাল। ‘তুমি কি আজই এঁকে ট্রায়াল দিয়ে দেখতে চাও?’

‘আজ, ও বাবা, ভীষণ টায়ার্ড আমি। তা ছাড়া, ওরা এখন পর্যন্ত ফিরলেই না। আসবে, বিশ্রাম করবে, পোশাক বদলাবে, দুধ খাবে-পড়া আরম্ভ করতেই অনেক রাত। ওরা আজ পড়বে না, তা ছাড়া, অতক্ষণ কি উনি বসে থাকবেন?’

চারিদিকে তাকিয়ে যেন অন্ধকারে ঢিল ছোঁড়ার মতন শিবনাথ প্রশ্ন করল : ‘বাচ্চারা বুঝি এখনো বেড়িয়ে ফেরেনি?

‘হ্যাঁ, ওদের জন্যে নতুন গাড়ি কেনা হয়েছে আজ। খুব বেড়াচ্ছে, সারাদিন বেড়িয়েছে, একটু আগে সরকারকে সঙ্গে দিয়ে শহরে পাঠালুম। আমার ওষুধও আনা হবে, ওদের বেড়ানো হবে।’

কি ওষুধ, খাওয়ার কি লাগাবার, অসুখটা কোথায় ইত্যাদি জানবার জন্যে শিবনাথ ভিতরে ভিতরে অত্যন্ত কৌতূহলবোধ করল, কেননা শোফার ওপর ঈষৎ হেলে বসা পারিজাত- গিন্নীর পেঁয়াজ রঙের একটা ওভারকোটে গলা পর্যন্ত ঢাকা নাতিবৃহৎ তনু, শঙ্খের মত গ্রীবা, আপেলমসৃণ লালাভ গালের কোথাও অসুখ থাকতে পারে শিবনাথ চিন্তা করতে পারল না। বাঁ হাতের অনামিকায় একটা হীরের আঙটি। উজ্জ্বল কালো চোখের তারা। চোখেরও কোন অসুখ নেই, এ সম্পর্কে শিবনাথ নিশ্চিন্ত ছিল। একবারও চোখের পাতা একত্র না ক’রে শিবনাথ তাঁর দুধে-আলতা রং আঙুলের নখগুলি দেখতে লাগল। প্রসারিত বাঁ হাতটা দীপ্তি একটা হাঁটুর ওপর রেখে পা-টা একটু নাড়ছিলেন।

‘আমরাও এই সবে বেড়ানো শেষ করে ঘরে ফিরলাম।’ পারিজাত বলল।

‘তা তো দেখতেই পাচ্ছি।’ রমেশের চিঠি নিয়ে শিবনাথ বিকেল থেকে এখানে অপেক্ষা করছিল। বাইরে বারান্দায় বসে ছিল। তাঁরা বাড়ি ফিরে তাকে ড্রইংরুমে এনে বসিয়েছেন।

‘আজ দু’জন একলা বেড়াতে বেরিয়ে আমরাও অনেকদূর গিয়েছিলাম।’ দীপ্তি বললেন, ‘তা আপনি কাল একবার আসুন।’

‘কখন, সকালে না কি–’ শিবনাথ মেরুদাঁড়া সোজা করল।

‘ও বাবা, সকালে হবে না, মেয়ের গানের মাস্টার আসে, আমাকেও কাছে থাকতে হয়– ‘বেশ তো, না হয় বিকেলে, মানে সন্ধ্যার পর এমন সময়–’ ইতস্তত করছিল শিবনাথ ‘আসুন।’

শিবনাথ উঠে দাঁড়াবে এমন সময় বাইরে কলরব শোনা গেল। গাড়ি এসে দাঁড়িয়েছে দরজায় বোঝা গেল।

‘ওরা এসেছে।’ পারিজাত ভুরু তুলল।

‘এ্যাঁ, বেড়ানো হয়ে গেল! দীপ্তি তড়াক্ করে সোফা ছেড়ে উঠে দাঁড়ান। ‘বাবলু–মোনা–চন্দন–কেয়া–রেবা রঞ্জু–শোভন, ওকি এর মধ্যেই তোমাদের হয়ে

গেল! সরকার মশায় কোথায়?’

দরজায় দাঁড়িয়ে দীপ্তি রীতিমত হাঁপাতে থাকেন, আর সব ভিড় করে মাকে ঘিরে দাঁড়ায়। বড় বড় চোখ, কালো কোঁকড়া চুল, পাকা ডালিমদানার মতন গায়ের রং। ছেলেগুলো সুন্দর কি মেয়েগুলো বলা শক্ত। শিবনাথ হাঁ করে তাকিয়ে দেখল। দেখে যেমন সেদিন খালপাড়ে বিস্মিত অভিভূত হয়েছিল, এখনও তার মনের অবস্থা তাই হল। দীপ্তির দিক থেকে শিবনাথ চোখ ফেরাতে পারছিল না। গর্ভধারিণী। যেন বিশ্বাস হয় না, বিশ্বাস করতে বাধছিল শিবনাথের। হঠাৎ তার খেয়াল হয় সবাই তার দিকে তাকিয়ে মনোযোগ দিয়ে দেখছে। শিবনাথ লজ্জা পায়।

‘কে মা, ইনি কি,–‘

‘তোমাদের নতুন মাস্টারমশায়—’

‘এখনো হয়নি, কাল ঠিক হবে।’ পারিজাতের দিকে রুষ্ট ভ্রাভঙ্গি হেনে দীপ্তি বাচ্চাদের বললেন, ‘আট নম্বর বাড়িতে থাকেন।’

‘ও, সেই বস্তিতে, ধ্যেৎ! বড় ছেলেটি তৎক্ষণাৎ আপত্তিসূচক মাথা নাড়ল।

বড় মেয়েটি গাল ফোলাবার মতন চেহারা করে বাবার দিকে তাকায়। ‘ইস্ মন্টুদার মতন মাস্টার এখানে পাব না বাবা, উনি কি আমার অঙ্ক বোঝাতে পারবেন?’

মেজ ছেলেটি বড় ছেলেটির কাঁধ ঘেঁষে দাঁড়ায়।

‘আপনি কি ফুটবল খেলা দেখেন, বলুন তো এবার ইস্টবেঙ্গল মোহনবাগানের কাছে এত মার খেল কেন?’

শিবনাথ অবাক হ’ল এবং খুশিও হ’ল শিশু প্রশ্নকর্তাদের গম্ভীর চেহারা দেখে।

মেজ মেয়েটি বলল, ‘আমি জানি, এবার নিউ এম্পায়ারে যে গীটার বাজনা হয়ে গেল, আপনি দেখতে যাননি। লম্বা মেয়েটার দেশ কোথায় আপনি জানেন? জানেন না। নরওয়ে। নরওয়েজিয়ান গার্ল। নাম মিস রুবেলা।’

‘আঃ, এত কঠিন প্রশ্নের দরকার কি?’ বড় ছেলেটি বোনকে ধমকে দেয়। ‘তুই চুপ কর কেয়া, আমি একটা সহজ প্রশ্নে ভদ্দরলোককে কাবু করে দিচ্ছি। আচ্ছা বলুন তো, একটা পার্টিতে আপনি উপস্থিত থাকেন। এক গ্লাস গেলার পর আপনি আর ড্রিংক করতে চাইছেন না। তখন কি করবেন?’

চোখ বড় করে শিবনাথ পারিজাতের বড় ছেলেকে দেখছিল। প্রশ্ন করে ছেলেটি হাতের ঘড়ি দেখছে। আট বছরের ছেলের হাতে সুন্দর রিস্টওয়াচটি দেখে শিবনাথ যত না পুলকিত হয়, তার চেয়ে বেশি হয় তার ঘড়ি দেখার ভঙ্গি দেখে। এক, দুই। দু’ মিনিট পার হবার পরও শিবনাথ প্রশ্নের জবাব দিতে পারল না দেখে ছেলেটি মুখ তুলে মার দিকে তাকিয়ে মাথা নাড়ল। কিস্তু না, বোগাস। জেনারেল নলেজে পণ্ডিত।’

দীপ্তির মুখে এতবড় একটা সিল্কের রুমাল।

অর্থাৎ শিবনাথ বাচ্চাদের হাতে ভীষণ ঘায়েল হচ্ছে দেখে তিনি হাসি লুকোন। পারিজাত পাইপের তামাক পাল্টায়।

‘বাবলু, তোমরা ভুলে যাচ্ছ ইনি ব্যারিস্টার হয়ে বিলাত থেকে আসেননি। সাধারণ মধ্যবিত্ত ঘরের ছেলে। তা হলেও একজন গ্র্যাজুয়েট। তাঁর স্ত্রী গ্র্যাজুয়েট। আট নম্বর বস্তিতে আছেন এঁরা, কাজেই আমাদের প্রজা বলা চলে। সুতরাং বিলাতী কালচার জানা না থাকলেও আমাদের প্রজা হিসাবে এঁদের যতটা সম্ভব সুযোগ সুবিধা দেওয়াই আমাদের উচিত। আজ আর সময় হবে না। কাল তোমার মা টেস্ট ক’রে যদি বোঝেন রাখা চলে, তবে আপাতত এঁকেই তোমাদের প্রাইভেট-টিউটার হিসাবে এপয়েন্টমেন্ট দেয়া হবে, আমরা ঠিক করেছি। এতক্ষণ এই নিয়ে কথা হচ্ছিল।’

বাবলু অর্থাৎ বড় ছেলেটি বাবার কথা শুনে বিষণ্ন মুখে চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল।

দীপ্তি মুখের রুমাল সরিয়ে শিবনাথকে বলেন, শ্বশুরমশায় বেশি অসুস্থ ছিলেন বলে গত বছর আট ন’মাস আমাকে বাচ্চাদের নিয়ে বালিগঞ্জের বাড়িতে থাকতে হয়েছিল। সেখানে মন্টু ব্যানার্জি ওদের মাস্টার ছিল। ব্যারিস্টারি পাশ করে পসার জমাতে পারছিল না বললে ওর ওপর অবিচার করা হয়, আমি বলি পসারের দিকে ওর মন ছিল না, নেই। বাচ্চা পড়িয়ে বেড়ানো হবি। তা-ও কি খুব একটা বেশি টাকা নিত, একশ টাকা। আমার তো মনে হয় সে- টাকার ওর মাসের সিগারেটের খরচ উঠত না।’

‘তিনি এখন কোথায়?’ মুখ দিয়ে হঠাৎ বেরিয়ে পড়ল শিবনাথের।

অত্যন্ত করুণ চেহারা ক’রে দীপ্তি বললেন, ‘তিনি কি আর বেলেঘাটা চিংড়িঘাটায় আসবেন আমার ছেলেমেয়েদের পড়াতে। তাই তো বলি, এখানে জমিদারী ব্যবসা ফেঁদে সবচেয়ে ক্ষতি হ’ল আমারই, আমার ছেলেমেয়েদের পড়াশোনার সুবিধা হচ্ছে না।’

‘তুমি একটুতেই ডিসহার্টেনড় হয়ে পড়ো, দীপ। শীগিরই সবগুলো ইংরেজী বাংলা কাগজে বিজ্ঞাপন ছাড়া হবে। এখানেও অনেক লেখাপড়া-জানা লোক আছে। আগে এদের চান্স দেবার কারণ টাকার ডিমান্ড এরা খুব একটা করবে না। মন্টু ব্যানার্জির মত প্রাইভেটদের এখানে আনিয়ে পড়াতে গেলে আড়াই শো হাঁকবে।’ পারিজাত পাইপে আগুন দিল।

‘তাই তো বলি, টাকা–সন্তানের চেয়েও টাকার মমতা বেশি তোমার, আমি একথা প্রথম থেকে বলে আসছি।’ অভিমানাহত কণ্ঠস্বর স্ত্রীর।

‘এরকম ধারণা করা তোমার অন্যায় দীপ।’ পারিজাত শক্ত ভঙ্গিতে একটা দেয়াল মুখ করে দাঁড়াল। সেখানে একটা বড় চওড়া ফ্রেমে বাঁধানো আরশি টাঙ্গানো। পারিজাত নিজের চেহারা দেখতে দেখতে বলল, ছেলেমেয়েদের জন্যে আমি কী করছি, কতটা করছি, তোমার চেয়ে বেশি আর কারো তা জানবার কথা নয়। আমার কথা হচ্ছে মন্টু ব্যানার্জি তো হাতে আছেই। এরা গরিব।’ আয়নার মধ্য দিয়ে শিবনাথের দিকে দৃষ্টি সঞ্চালন করল পারিজাত। ‘প্রজাদের মধ্যে যদি শিক্ষিত লোক থাকে আর আমি তাদের সুযোগ-সুবিধা না দিই তো ল্যান্ডলর্ড হিসাবে আমার কি বদনাম উঠবে তা তুমি জান।’

‘পাক্কা কমুনিস্ট বনে গেলেই পার।’ হাতের রুমালটা দিয়ে দীপ্তি কপাল মোছেন। গলাবন্ধ ওভারকোটের দরুন এবং পারিজাতের কথার দরুন বিরক্ত হয়ে ঘেমে উঠেছে তিনি। ঘন ঘন নিশ্বাস ফেলছেন। বক্ষস্পন্দন দেখেই শিবনাথ অনুমান করল।

‘এদিনে একটু ডেমোক্রেটিক আইডিয়া নিয়ে চলতে হয় বৈকি। তাছাড়া সামনে ইলেকশন। সবদিক বুঝে শুনে না চললে বিপদ আছে। স্থানীয় লোকদের সাপোর্ট আমার খুব বেশি দরকার।’

‘যা বোঝ তা-ই করো।’ যেন এই নিয়ে বাক্যবয় করে দীপ্তি আর ক্লান্ত হতে নারাজ। ছেলেমেয়েদের হাত ধরে তিনি পাশের ঘরে চলে যান।

তিনি চলে যাবার পরও দরজার ঘন নীল ভারি পর্দাটা কাঁপতে থাকে। সেদিকে কতক্ষণ তাকিয়ে থেকে পারিজাত পরে এদিকে ঘাড় ফেরায়। শিবনাথের দিকে তাকায়। ‘দেখেছেন মশাই, আপনারা তো আমাদের–বড়লোকদের মানে ক্যাপিটেলিস্টদের উঠতে বসতে বাপান্ত করছেন। শালারা সমাজের মাথায় বসে কেবল সুখ লুটছে। স্বর্গের সুখ। কিন্তু এখানেও পাতালের দুঃখ, অগাধ অন্ধকার। একবার নিজের দেখে যান ভিতরটা।’

বলে পারিজাত শিবনাথের চোখে চোখে রেখে দার্শনিকের মত হাসল ও ক্লান্ত নিশ্বাস ফেলল। শিবনাথ কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে পরে আস্তে বুদ্ধিমানের মত বলল, ‘বালিগঞ্জ ছেড়ে এখানে এসে তাঁর অসুবিধা হচ্ছে,–-থাকতে।’

‘তা তো হবেই। মশাই ব্যারিস্টার মাস্টার রেখে ছেলেমেয়েদের লেখাপড়া শেখাবার মেজাজ তৈরী করে দিয়েছেন দীপ্তির বাপ–মেয়ের। এখানে এলেই তাঁর খুঁতখুঁত আরম্ভ হয়। মানে, শ্বশুরের ওখানে ওটা মিথ্যা কথা, থাকেন তিনি সেখানে তাঁর বাপের বাড়িতেই। বালিগঞ্জ তাঁরও বাপের বাসা। হুঁ, আমার বাবার চেয়ে ওর বাবার পয়সা বেশি। আর ওবাড়ির সঙ্গেই মন্টু ব্যানার্জির ঘনিষ্ঠতা।’

শিবনাথ অধোবদন হয়ে শুনল।

পরিজাত, বোঝা গেল, স্ত্রী ওপর ভয়ঙ্কর ক্রুদ্ধ আছে কোনো ব্যাপারে। গম্ভীরভাবে ঘরময় পায়চারি করতে লাগল। একটু পর শিবনাথ মনে সাহস সঞ্চয় করে বলল, ‘আচ্ছা স্যার, আজ চলি, কাল একবার দেখা করব।’

‘আসবেন। মহিষী তো জানিয়ে দিয়েছেন। আমি বলেছি তো আপনাকে এসব আমার ডিপার্টমেন্ট না। কাল এসে তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ করুন। তাঁকে প্লিজ করুন। বহাল হয়ে যাবেন। অআ, কোনোদিন শিখতে পারবে না যে-সব বখাটে ছেলেমেয়ে, তাদের শিক্ষাদীক্ষা, সম্পর্কে ভেবে সময় ব্যয় না করে আমাকে অন্য অনেক কিছু করতে হয়।’

পারিজাত আবার দ্রুতভঙ্গিতে পাইপে তামাক পুরল, তারপর তাতে অগ্নিসংযোগ করে এবং এক সেকেন্ডও আর অপেক্ষা না করে ছুটে বাইরে গিয়ে ‘গাড়ি’, ‘গাড়ি’ বলে চীৎকার করে উঠল।

যেন গ্যারেজ থেকে গাড়ি বেরিয়ে এল। পারিজাত গিয়ে গাড়িতে উঠল। শিবনাথ শব্দ শুনে আন্দাজ করল। আরো একটু সময় বসে কান পেতে থেকে পরে পারিজাতের ড্রয়িং- রুম থেকে শিবনাথ যখন রাস্তায় নামল তখন শুনতে পেল বাড়িতে কে পিয়ানো বাজাচ্ছে। ও-বাড়িতে দীপ্তি ছাড়া আর কে পিয়ানো বাজাতে পারে কল্পনা করতে করতে শিবনাথ রাস্তায় নেমে এল। ‘আমরাও মশাই শ্রেণী-সংগ্রামের অসহ্য যাতনা ভোগ করছি। আমার বাবার চেয়ে দীপ্তির বাবা বেশী বড়লোক। এই গরমে স্ত্রী স্বামীর জীবন অহরহ পুড়িয়ে মারছে। নিষ্ঠুরা দীপ্তিকে একবার আপনারা চোখে দেখুন।

রাস্তায় চলতে চলতে পারিজাতের করুণ হা-হুঁতাশ মাখা চোখ দু’টোর অর্থ শিবনাথ এখন বেশ বুঝতে পারল। বুঝতে পেরে নিজের মনে ঠোঁট টিপে হাসলো।

কিন্তু সবচেয়ে বড় কথা–’ওকে প্লিজ করুন, বহাল হয়ে যাবেন।’ পারিজাতের সুন্দর উক্তিটা শিবনাথের কানে পাকা হয়ে রইল।

২৬

বলাই ও রমেশ রায় গভীর কোনো বিষয় নিয়ে আলোচনা করছে।

তাই শিবনাথ তাদের পাশ কাটিয়ে চলে যেতে পারল। কথায় মত্ত বলে রমেশ রায় শিবনাথকে দেখতে পেল না। তাই আর তাকে ডাকল না। না হলে শিবনাথকে আবার রেস্টুরেন্টে ঢুকে চা খেতে হত এবং এবাড়িতে আর কে ঘরভাড়া দিতে পারছে না এবং তার সম্পর্কে শীগির কি ব্যবস্থা করা হবে ইত্যাদি গল্প শুনে অনেক সময় নষ্ট করতে হত। কিন্তু শিবনাথ এখন আর সময় নষ্ট না করে তাড়াতাড়ি ঘরে ফিরে রুচিকে খবরটি দিতে চাইছে। একটা সুখবর; হ্যাঁ, এমন ভাল ট্যুইশানিটা তার হয়ে যাচ্ছে। একজন ব্যারিস্টার এই পদের প্রার্থী। খবরটা বেশ রসালো করে রুচিকে শোনাবার জন্যে শিবনাথের জিহ্বা চুলবুল করছিল। হ্যাঁ, আর একটা কথা। টাকাপয়সা থাকলেই মানুষ দাম্পত্য জীবনে সুখী হয় না। আজ ক’মাস শিবনাথের চাকরি নেই বলে রুচির রাগারাগি (তার চাকরি আছে। আজও চারবার করে খাওয়া-দাওয়া চলছে এ-ঘরে)। ‘আর ওদিকে বালিগঞ্জ থেকে মন্টু ব্যারিস্টারকে এখানে আমদানি ক’রে বাড়িতে রেখে ছেলেমেয়েদের মাস্টার হিসাবে পুষবার ক্ষমতা (ইচ্ছা?) পারিজাতের নেই বলে স্বামীর ওপর দীপ্তির ক্রোধ ও মানাভিমানের জাত এক। এ আর তলিয়ে দেখতে হয় না।’ রাস্তায় চলতে চলতে শিবনাথ, রুচিকে বলল মনে মনে।

.

‘মশাই, শুনুন। আপনাকে ডাকছি।’

পিছন থেকে তারা তাকে গলা বড় করে ডাকল। ঘাড় ফিরিয়ে শিবনাথ বনমালী, কে. গুপ্ত ও চারুকে দেখতে পেল।

একটু রাত হয়েছে।

এই মাত্র শিবনাথ ঘরে ফিরছে। আজ তার মেজাজ ভাল। বাড়িওয়ালার বাড়ির প্রাইভেট টিউটার হবে শুনে রুচি পর্যন্ত গলে গেছে।

বলতে কি রাত্রে আজ মাছ খেতে ইচ্ছে রয়েছে শুনে রুচি তার ব্যাগ খুলে তৎক্ষণাৎ একটা দু’টাকার নোট শিবনাথের হাতে তুলে দিয়েছে। শেয়ালদা থেকে ইলিশ মাছ আর বাঁধাকপি নিয়ে আসুক।

আজ এ-বাড়ির নতুন ভাড়াটেদের ঘরে একটা ভারি খাওয়া-দাওয়া হবে, রুচি ও শিবনাথের চলাবলা দেখে বাড়ির বাকি ঘরগুলো টের পেল। অধিকাংশ দিনই দুবার উনুন ধরে না। কিন্তু আজ রাত্রে রুচি রান্না করবে। কাল একটা পাবলিক হলি-ডে, তাই ইস্কুল নেই। একটু বেশি রাত জেগে খাওয়া-দাওয়া করলেও ক্ষতি হবে না। কাল বেলায় উঠবে বিছানা থেকে। রুচির গলার স্বরে একটা গড়িমসি প্রকাশ পাচ্ছিল।

তাড়াতাড়ি শেয়ালদা ছুটে গিয়ে আস্ত একটা ইলিশ মাছ ও একটা বড় বাঁধাকপি কিনে বাড়ি ফেরে শিবনাথ। বাড়িতে ঢুকবার মুখে বনমালীর দোকানের সামনে তারা তাকে পাকড়াও করল। তিনজন প্রতিবেশীর সম্মিলিত ডাক শিবনাথের উপেক্ষা করবার ক্ষমতা ছিল না। সে দাঁড়াল। ‘কি ব্যাপার?’

‘মশাই আছেন সুখে।’ কে. গুপ্ত মুখ থেকে সিগারেট নামিয়ে বলল, ‘সন্ধ্যাবেলা যে এ পাড়ায় ভীষণ ঘটনা ঘটল, তার খবর রাখেন কিছু?’

কিছুই জানে না, শিবনাথ এরূপ চেহারা করতে যাচ্ছিল, তারপর তার মনে পড়ে গেল অমলকে। সকালে অমলকে এ-বাড়ি থেকে তুলে দেবার ঘটনা।

ঘটনাটা সে দেখে গিয়েছে চোখের এমন ভাব ক’রে শিবনাথ সেই সম্বন্ধে বরং আরও নতুন রকম প্রশ্ন করল : ‘কেন, দশ নম্বরে মানে অমলের খালি ঘরটায় নতুন ভাড়াটে এসেছে বুঝি, সেই খবর?’ বলে সে হাসল!

‘আরে ধ্যেৎ মশাই, ভাড়াটে!’ গুপ্ত রুষ্ট হয়ে উঠল। ‘এরকম খবর কি আর আমাদের পার্লামেন্টে ওঠে যে তাই নিয়ে আমরা সারাদিন মাথা ঘামাব? অমলের খবর তো দুপুরের পরই বাসি হয়ে গেছে মশাই। অমল এখন ভিজে তুলতুলে হয়ে আছে। সন্ধ্যাসন্ধি চারু কলকাতা থেকে খবর নিয়ে এসেছে, সাতদিনের মধ্যেই অমলের দেড়শ টাকার চাকরি হচ্ছে। সেই সুবাদে যে মশাই আজ সন্ধ্যায় ঘোলপাড়ায় অমলের বাড়িতে আমাদের বড় রকমের ফিস্টি হয়ে গেল। কিরণ রান্না করেছিল। ইলিশ মাছ ভাজা আর খিচুড়ি। দেখুন না চারুর পেটটা কতটা ফুলে উঠেছে। ওকে খাওয়ানো উপলক্ষেই এই অনুষ্ঠান। খরচটা অবশ্য আজকের মতন চারুই চালিয়েছে। এতটা যখন করল আর এইটুকুন বাদ থাকে কেন। সুতরাং—’

শিবনাথ থলের হাত পাল্টায়।

বনমালী চালাক লোক। শিবনাথকে লক্ষ্য ক’রে বললে, ‘বাবা গুপ্ত, ভদ্রলোককে যে কথা বলতে ডেকেছ তাই বলে দাও, তোমাদের অমল-কিরণের কেচ্ছা ওকে শুনিয়ে কি হবে!’

‘তুই শালা চুপ কর্।’ গুপ্ত বনমালীকে ধমক লাগায়। ‘তুই মুদি–লোকের গলায় দা বসাতে এখানে দোকান খুলেছিস। আমাদের, ভদ্রলোকদের চাকরি-সম্বল শিক্ষিত বাঙালী ছেলেদের দুরবস্থা সম্পর্কে এখানে কথা হচ্ছে। হ্যাঁ, বড় যে তোদের এখানকার মনিব পারিজাত অপমান করতে চেয়েছিল অমলকে আর তার বৌকে–এখন ওরা দু’টিতে কেমন কাঁচকলা দেখিয়ে ঘোলপাড়ায় অল্প টাকায় আরো ভাল ঘর পেয়ে বাসা বেঁধেছে, সেই কথাটা ইনিকে শোনাচ্ছিলাম। ধর ইনিরই যদি কাল চাকরি গেল, তখন–’

‘ইনির স্ত্রী চাকরি করেন।’

‘হ্যাঁ, তা করেন বটে।’ বনমালীর যুক্তি তৎক্ষণাৎ কেটে দিলে কে. গুপ্ত। স্ত্রীর চাকরি যেতে কতক্ষণ। এক চাকরি চিরকাল থাকবে এতবড় দার্শনিক আমরা বা আমাদের স্ত্রীরা কেউ হ’তে পারি নি, কি বলেন মশাই।’

‘হুঁ’ তা বটে।’ শিবনাথ মৃদু ঘাড় নাড়ল।

‘তুই মুদি, অশিক্ষিত, তুই কতটা বুঝবি আমাদের শিক্ষিত লোকের দুর্গতি কত, আজ চারু আছে বলে অমল বেঁচে গেল। কাল যখন মদন ঘোষ আমাকে কি বাড়ির আর কোনো ডিফলটার ভাড়াটেকে তুলে দেবে, তখন উপায় হবে কি আমাদের সেই ভাবনা।’

বনমালী আর কথা না বলে হিসাবের খাতার পাতাটা ওলটায়।

শিবনাথ আবার হাত পাল্টায় তার থলের। কপি ও মাছে বেশ ভারি হয়েছে থলেটা।

কে. গুপ্ত চারুর টিন থেকে একটা সিগারেট তুলে মুখে গুঁজে বলল, ‘মশাই, বললে বিশ্বাস করবেন না, সেই বাড়িতে গিয়ে একটা বিকেলের মধ্যে কিরণ কতটা ফ্রি হয়ে গেছে। হ্যাঁ, আমি লক্ষ্য করেছি এ-বাড়ির পেত্নিগুলো, মানে আমাদের কমলা বীথি প্রীতি মাস্টারের মেয়েগুলো কিরণকে দেখলে খামোকা নাক সিঁটকাতো। অপরাধ? পাড়াগাঁ থেকে এসেছে, লেখাপড়া জানে না। আরে তোরা যে কিরণের পায়ের দাসী, তোরা যে ওর আঙুলের নখ ছোঁবারও যুগ্যি নস কেউ, সে কথাটাই এ-বাড়ির আর একজন বাসিন্দা হিসাবে আমি আপনাকে শোনাচ্ছিলাম। আপনিও চোখে দেখেছেন মশাই, অহংকারী পাজী মেয়েগুলোর মধ্যে থেকে কিরণ কতটা অসুখী ছিল। আজ দূরে সরে যেতে বোঝা গেছে কত সুন্দর ভদ্র ফরোয়ার্ড মেয়ে কিরণ।’

চারু রায় হেসে উঠল। ‘থাক। কিরণের প্রশংসা আর ওঁকে শুনিয়ে লাভ নেই; ওঁর স্ত্রী নিশ্চয় কাজ থেকে সবে ঘরে ফিরেছেন। তিনি অপেক্ষা করছেন, ইনি বাজার নিয়ে গেলে রান্নাবান্না খাওয়াদাওয়া হবে। দু’জনেই টায়ার্ড। তোমার মতন তো মুক্তপুরুষ সবাই না। এঁকে এখন ছেড়ে দাও।’

‘হ্যাঁ, ছেড়ে তো দেবই, বৌয়ের হাতের রান্না খাওয়া, তা-ও কপালের ভাগ্যি, আমার তো মশাই বৌ থেকেও সেটি হয় না।’ রুক্ষ লম্বা চুলগুলোর মধ্যে হাত ঢুকিয়ে কে. গুপ্ত ক্লান্ত ভঙ্গিতে হাসল। কেন হয় না বলল না যদিও।

শিবনাথ একটু অসহিষ্ণু হয়ে বলল, ‘কি যেন ঘটনার কথা বলছিলেন, বলে ফেলুন।’

‘না তেমন কিছু কি’….যেন কথাটা বলবে কিনা ভেবে গুপ্ত ইতস্ততঃ করছিল।

বনমালী বলল, ‘তা ছাড়া এই ভদ্রলোককে বলেই বা কি হবে। এ-বাড়ির কোনো ভাড়াটেকে এখন বলে কিছু হবে না। যে যার, নিজের মাথা আগলাতে ব্যস্ত। তোমার নিজের মামলা এটি। থানায় গিয়ে ডাইরি করাবে কি না তুমি বুঝে দেখ।’ কথা শেষ করে বনমালী একবার শিবনাথকে দেখে পরে আবার কে. গুপ্তর দিকে ঘাড় ফেরায়।

চারু রায় শিবনাথের চোখে চোখ রেখে বলল, ‘মশাই, এই একটু আগে এখানে রাস্তার ওখানটায় অ্যাক্সিডেন্ট করেছে পারিজাতের গাড়ি। হ্যাঁ, আপনাদের ল্যান্ডলর্ড।’ কে. গুপ্ত থুতনি দিয়ে বাদামতলাটা দেখিয়ে দিল।

শিবনাথ একটু অবাক হয়ে সকলের মুখের দিকে তাকাল।

‘আমার ছেলে রুণুকে চেনেন তো? ওই হারামজাদার পায়ের হাড় ভেঙ্গেছে। পারিজাতের গাড়ির তলায় চাপা পড়ে মরতে গেছল।’

‘মরেনি।’বনমালী বলল, ‘তখনি ব্রেক কষতে পেরেছিল পারিজাতের ড্রাইভার। শিখের বাচ্চা, হাত ভাল।’

একটু সময়ের জন্য সবাই চুপ।

সিগারেটে শেষ টান দিয়ে চারু রায় বলল, ‘হাসপাতালে আছে কে. গুপ্তর ছেলে কেম্বেলে, আমি গাড়ি করে দিয়ে এলাম।’

‘আপনিও কি ঘটনার সময় ছিলেন নাকি?’ বুদ্ধিমানের মত শিবনাথ প্রশ্ন করল।

‘না, আমি ছিলাম ঘোলপাড়ায় কিরণের ওখানে, ওখানে খাওয়া-দাওয়া সেরে কে. গুপ্ত আমার আগেই এখানে চলে আসে। এসে ওর মুখে শুনলাম এই ঘটনা।’

‘দুর্ঘটনার সময় আপনি ছিলেন কি?’

বনমালী মাথা নাড়ল। ‘আমি তো এই সবে কোলকাতা থেকে ফিরেছি। এইমাত্র দোকান খুললাম। সওদা আনতে বড়বাজার যেতে হয়েছিল। রাত হ’ল ফিরতে। এসে শুনলাম রমেশ রায় নাকি ছিল তখন।’

‘আর বলাই।’ কে. গুপ্ত বলল, ‘কিন্তু ওরা বলছে অন্যরকম।’

‘কি রকম?’ শিবনাথ স্থির হয়ে সোজা হয়ে দাঁড়ায়। যেন আরো কি একটা ব্যাপার আছে এর মধ্যে।

‘মশাই, সত্যও হতে পারে, মিথ্যাও হতে পারে।’ কে. গুপ্ত তাঁর লম্বা চুলের মধ্যে আঙুল ঢোকাল। আমি রিপোর্ট পেলাম, আমার পুত্র শ্রীমান রুণু ও বলাইয়ের মেয়ে ময়না হাত ধরাধরি ক’রে মাঠে হাওয়া খেয়ে বাড়ি ফিরছিল। ওরা যখন বাদাম গাছটার নীচে তখন অ্যাক্সিডেন্ট হয়। গাড়ির ধাক্কা লেগে রুণু মাটিতে পড়ে যায়। ময়না এমনিও ছেলেমেয়েমানুষ, তার ওপর মেয়েছেলে,–কি আর করে, ছুটে গিয়ে বাড়িতে নাকি খবর দিতে যাচ্ছিল, এমন সময় সেখানে রমেশ ও বলাই এসে পড়ল।’

‘ও, চাপা পড়েনি, ধাক্কা লেগেছিল?’ প্রশ্নটা ক’রে শিবনাথ কে. গুপ্তর দিকে তাকাতে কে. গুপ্ত ধমক দিয়ে উঠল। হ্যাঁ, মশাই হ্যাঁ, কিছু না, মাইনর ইঞ্জুরি–রমেশও তাই বলছে ব’লে কে. গুপ্ত বনমালীর দিকে তাকাল। বনমালী বলল, ‘এমন সময় সেখানে চারুবাবু এসে পড়েন। এই তো তিনি রুণুকে হাসপাতালে রেখে ফিরছেন।’

শিবনাথ আবার ঘাড় ফিরিয়ে অদূরে বাদামতলাটা দেখতে চেষ্টা করল। জায়গাটা অন্ধকার। ভাল দেখা যায় না। শিবনাথ আবার এদের দিকে মুখ ফেরায়। ‘তা রমেশ বলাই কি বলছে?’

বনমালী বলল, ‘কি বলছিল এঁকে শুনিয়ে দাও গুপ্ত।’

চারু শিবনাথের দিকে চোখ ফিরিয়ে বলল, ‘মশাই, রমেশ রায় বলছে অন্যরকম। রুণু ও এ-পাড়ার আরো চার পাঁচটা ছেলে নাকি এ-বাড়ির ভাড়াটে অমলকে তুলে দেয়ার পর থেকেই আজ সারাদিন রাস্তায় মাঠে ঘুরে ঘুরে চেঁচামেচি করছিল। বাড়িওয়ালার জুলুম চলবে না, ঘরভাড়া কমিয়ে দাও,–এইসব। কে. গুপ্ত বলছে, রুণুর সঙ্গে বলাইয়ের মেয়ে ছাড়া আর কেউ ছিল না, আমি মেয়েটাকে দেখিনি অবশ্য। রুণুটা একলা মুখ থুবড়ে মাটিতে পড়ে ছিল। রমেশ বলে–রুণু ও তার সঙ্গীরা নাকি পারিজাতের গাড়ীটা আটকাতে গিছল।’

‘কী ভীষণ কথা!’ যেন নিজের মনের কথা বলল শিবনাথ

কে. গুপ্ত ও বনমালী চুপ। টিন থেকে চারু রায় আর একটা সিগারেট তুলল। কি একটু ভেবে শিবনাথ পরে প্রশ্ন করল, ‘বলাই? বলাই কি বলছে?’

‘জানি না।’ কে. গুপ্ত হঠাৎ আকাশের দিকে মুখ তুলে বলল, ‘আমি তো শালা তখন রাস্তার ওধারটায় ছিলাম। এদিকে নজর দিইনি। দেখছিলাম খুব স্টাইল ক’রে নতুন শাড়ি জুতো পরে ভুবনের মেয়ে বীথিটা রাস্তা দিয়ে যাচ্ছিল। আচ্ছা মশাই, ও কি একটা চাকরি পেয়েছে শুনলাম। আপনি শুনছেন নাকি কিছু। বড় যে রাতারাতি শ্রীমতীর চেহারা পালটে গেল। দেখেছেন?’

শিবনাথ কিছু বলবার আগে বনমালী কে. গুপ্তকে ধমক লাগায়।

‘কোথায় তোমার ছেলে গাড়ি চাপা পড়েছে, থানায় ডাইরি করানো হবে কিনা কথা হচ্ছে, তা না তুমি ভুবনের মেয়ের শাড়ি জুতোর ব্যাখ্যা করছ। তোমায় নিয়ে আর পারা গেল না।

‘বেশ হয়েছে, মরে যাক ছেলে।’ আকাশ থেকে চোখ নামিয়ে কে. গুপ্ত বনমালীর দিকে তাকিয়ে একটু সময় কি ভাবল। চারু রায়ের টিন থেকে একটা সিগারেট তুলে নিয়ে আস্তে আস্তে বলল, ‘হারামজাদা শ্লোগান তুলতে গেছল কিনা বাড়িওয়ালার জুলুম চলবে না। তাইতে আমি কেস্ করতে গেলে ওরা উল্টো পলিটিক্যাল কেস্ করবে!

‘না, এভাবে পলিটিক্যাল শ্লোগান তোলা ঠিক হয়নি। এতে কেস্ পারিজাতের ফেভারে যাবে।’–শিবনাথ না বলে পারল না।

‘বেশ তো ছিলি বাবা, প্রেম করছিলি ময়নার সঙ্গে কপি ক্ষেতে বসে। আমি মশাই সব রিপোর্ট পাই। আমি সংসারের দিকে চোখ রাখতে পারছি না ব’লে ছেলেমেয়ে দু’টো একেবারে গোল্লায় যেতে বসেছে।’

বনমালী চুপ ক’রে রইল। চুপ থেকে শিবনাথের চোখে চোখ রাখল।

কে. গুপ্ত বলল, ‘সেদিন চায়ের দোকানে রমেশ রায়ের ভাই ক্ষিতীশ বেটিটাকে চুলের মুঠি ধরে খুব মেরেছে।

‘কেন?’ শিবনাথ ইচ্ছে ক’রে ঢোক গিলে তৎক্ষণাৎ প্রশ্ন করল, ‘আপনি ওকে রমেশের দোকানে যেতে এলাউ করেন কেন?’

কে. গুপ্ত চোখ বড় করে শিবনাথের দিকে তাকাল। ‘কেন, আপনি কি মশাই বলছেন আমি বারণ করলে বেবি সেখানে যাওয়া বন্ধ করবে?

‘হ্যাঁ করবে, কেন করবে না।’ শিবনাথ কণ্ঠস্বর দৃঢ় করল। ‘আপনি বাপ, গার্ডিয়ান। ‘

মাথা নেড়ে বনমালী বলল, ‘আপনি মশাই দেখছি পাগলের সঙ্গে কথায় মেতে উঠলেন। যান তো নিজের ঘরে। বৌদিমণি রান্না করবেন বাজারের আশায় ব’সে আছেন। কা’কে আপনি উপদেশ দিচ্ছেন। একবেলা খেতে দিতে পারে না, নিজে উপোস থাকছে বেলার পর বেলা। অর্ডার করলে ছেলেমেয়েরা এখন তা শুনবে কেন? তাছাড়া যেমন ছেলেটা তেমনি মেয়েটা। বয়স তো আর একটিরও কম হয়নি। যদি আপনারা দশজনে মিলেও আজ বেবিকে নিষেধ করেন, দরকার নেই মাগনা চা-চিনি এনে, তোদের সংসারের সব খরচ আমরা চালাব, আর রমেশ রায়ের দোকানে গিয়ে কাজ নেই, তবু যাবে। ক্ষিতীশ যদি এখন জুতোও মারে তবু বেবিকে যেতে হবে দু’বেলা ওই দোকানে। মানে সর্বনাশ যতটুকুন হবার হয়ে গেছে। কাজেই আপনি আমি মুখ ভরিয়ে এখন আর করব কি। চুপ থাকুন।’

শিবনাথ একটু স্বস্তিবোধ করে বাড়ির দিকে পা বাড়াবার জন্যে প্রস্তুত হয়।

চারু রায় বলল, ‘মশাই, আমার ইচ্ছা ছিল লালবাজারে একটা ফোন করে দিই। আমার বন্ধু পুলিশের বড়কর্তা। শুনলে অবশ্য এসে স্টেপ নেয়। কিন্তু দেখলাম কে. গুপ্ত নিজেই সাইলেন্ট থাকতে চাইছে। তাছাড়া, তাছাড়া–’

সিগারেটের ছাই জমছিল, সেটা ঝেড়ে ফেলে দিয়ে চারু বলল, ‘কিন্তু আমার পক্ষেও সেটা সুবিধা বা সম্ভব হয় না। কেননা, এই অঞ্চলে আমাকে ঘনঘন যাওয়া আসা করতে হচ্ছে। এখানে আমার নিজের ইন্টারেস্ট বেশি না। পাবলিকের প্রতি দায়িত্বটাই গুরুতর। লিমিটেড কোম্পানী, মাইনে করা চাকর আমি। আজ এখানে ছবির মেটেরিয়েল জোগাড় করতে এসে যদি এখানকার ল্যান্ডলর্ডকে ক্ষেপিয়ে তুলি, তো আমার আসা সকলের আগে বন্ধ হবে। হেভি লস্ হবে কোম্পানীর। কোম্পানী ডুববে। তার অর্থ আপনাদের মত পাবলিক,–এমনি কয়েকটা নিরীহ লোক মারা যাবে। অর্থাৎ যারা দেশের ফিল্ম ইন্ডাষ্ট্রির উন্নতি হবে ভেবে ব্যাঙ্কের জমানো সর্বস্ব আমাদের হাতে দিয়েছে, ওদের ঘুমে মারা হবে।

কথা শেষ করে চারু রায় ঈষৎ হাসতে শিবনাথও হাসল।

‘আরে ছি ছি!’ কে. গুপ্ত দাঁত দিয়ে জিভ কাটল। ‘আমিও, রায়, তোমাকে বলব না খামোকা একটা বাজে মামলায় জড়িয়ে শেষটায় তোমাদের কোম্পানী হেভি লস্ খাক। ওই বনমালীই ঠিক বলেছে! আমার সর্বনাশ শুরু যেদিন থেকে পারিজাতের টিনের শেডের তলায় এসে আশ্রয় নিয়েছি। বাস্তবিকই তো, ক’দিক থেকে লোক এসে আমার ছেলেমেয়েদের রক্ষা করবে! আজ পলিটিক্যাল কেস্ থেকে রুণুকে বাঁচাব। কালই পড়বে হারামজাদা রেপ্ কেসে। রাতদিন বলাইর মেয়েটার পিছনে ঘুরছে, আমি লক্ষ্য করছি।’

এবার অবশ্য শিবনাথ আর বলল না, ‘এই মেয়ের সঙ্গে আপনার ছেলেকে মিশতে নিষেধ করুন।’

কেননা, তার আগেই কে. গুপ্ত মাথার লম্বা চুলগুলোর মধ্যে তার রোমশ শীর্ণ হাতখানা ঢুকিয়ে বলেছে, ‘আমি খেতে দিতে পারি না তো ওরা এভাবে না হয় সেভাবে মরবে, এটা তো দিনের আলোর মত সবাই পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছে। কেন আমি বলব, একে-ওকে মশাই, ওদের পিছনে ঝুপ করে কিছু টাকা ঢালুন। আমি এই বিপদে পড়েছি।’

চারু আনত চোখে হাতঘড়ির কাঁটা দেখছিল।

শিবনাথ সুযোগ বুঝে বলল, ‘আচ্ছা আমি চলি মশাই, ওদিকে আবার—’

‘হ্যাঁ, আপনার গৃহিণী অধীর হয়ে উঠছেন। জানি আপনাদের খাওয়া-দাওয়া হবে। সুতরাং আপনাকে আর বেশিক্ষণ ধরে রাখব না, আচ্ছা, আপনি কি জানেন, সন্ধ্যার পর পারিজাত বাড়িতে ছিল না গাড়ি নিয়ে বেরিয়েছিল? কিছু খবর রাখেন, কারেক্ট ইনফরমেশন দিতে পারেন?’

‘কেন বলুন তো?’ শিবনাথ প্রশ্ন না ক’রে পারল না। কেননা মদের জিহ্বা ব’লে সব কথাই একটু হিউমার ক’রে বেশ জড়িয়ে জড়িয়ে এতক্ষণ বলছিল কে. গুপ্ত। তার এই স্বর শুনেই শিবনাথ অভ্যস্ত। এখন হঠাৎ লোকটির মুখে একটু কড়ারকম ভাষা শুনে শিবনাথ চমকে উঠল। কিন্তু কিছুমাত্র ইতস্তত করল না চট ক’রে বলতে, ‘আমি কি ক’রে বলব। আমি তো এইমাত্র বাজার সেরে ফিরলাম।’

‘তাঁর ঘরভাড়া আটকে থাকে না যে, তিনি পারিজাতের খোঁজ রাখবেন। কখন রায়সাহেবের ছেলে এলো, কখন গেল। নাকি পারিজাত এবার নিজেই জমিদারী রাখতে তোমাদের ভাড়াটেদের শায়েস্তা করতে ছুটে এল। মনিবের চলাফেরার দিকে নজর রাখা তোমাদের কাজ। তোমার, বলাইর। অমল উঠে গেছে, রক্ষা পেয়েছে।’ হিসাবের খাতা থেকে মুখ তুলে বনমালী আর একটা ধমক লাগাতে কে. গুপ্ত আকাশের দিকে তাকাল।

চারু রায় উঠে দাঁড়াল এবং আর একবার হাতের ঘড়ি দেখতে দেখতে বলল, ‘আমি আর ওয়েট্ করতে পারছি না গুপ্ত। তোমরা বসে গল্প করো, আমাকে ছুটি দাও। এখান থেকে গাড়ি নিয়েও বাড়ি ফিরতে বারোটা বাজবে।’

‘হ্যাঁ, ব্রাদার, তুমি চলে যাও। আমরা একটু সিরিয়স্ টক্ করছি।’

‘বাই–বাই!’ শিবনাথের হাতে একটু ঝাঁকুনি দিয়ে চারু রায় ক্ষিপ্র পায়ে রাস্তায় নেমে তার টু-সীটারের দিকে ছুটল। গাছের অন্ধকারে গাড়ীটা শিবনাথ এতক্ষণ দেখতে পায়নি।

এবার কে. গুপ্ত সিরিয়স্ হওয়ার আগে শিবনাথ কড়া সুরে কথা ব’লে উঠল, ‘আমায় ছেড়ে দিন মশাই, ঘরে কাজ আছে।’ ব’লে শিবনাথ স্পষ্টত বাড়ির দিকে পা বাড়াতে চেষ্টা করল।

‘আহা, আমি তো ঠিক আপনাকে আটকাচ্ছি না। মশাই, রমেশ রায়ের গলার সুরটা আমার ভাল লাগল না। জিজ্ঞেস করতেই বলল, পারিজাতের তিনদিন ইনফ্লুয়েঞ্জা। বিছানা থেকেই উঠছে না। সে গাড়ি নিয়ে বেরোবে কি! গাড়িটা রায়সাহেবের ফ্যামিলির হতে পারে। তা সরকার বা ড্রাইভার বা পারিজাতের কোনো আত্মীয় বা কোনো কর্মচারী যে চালিয়ে না যাচ্ছিল তখন, তা কি করে জানলেন। আর তাছাড়া, আপনি যখন নম্বর রাখেন নি। কাজেই কি করেই বা পুলিশকে বোঝাবেন যে ওটা পারিজাতের গাড়ি। এ রাস্তায় উটকো অনেক গাড়ি রাত-বেরাতে ছুটোছুটি করে।

কে. গুপ্ত কথা শেষ করতে শিবনাথ বলল, ‘তা হবে, আমি জানি না। আমি তো আর রমেশ রায়ের মত রায়সাহেবের বাড়িতে রাত দিন যাওয়া-আসা করছি না। হয়তো ওরা জানে, হয়তো রমেশ যা বলছে তাই ঠিক। আমি কি ক’রে কারেক্ট ইনফরমেশন দিই।’

বলে শিবনাথ লম্বা পা ফেলে বাজারের থলে হাতে বাড়ির ভিতর ঢুকল।

২৭

রুচির সঙ্গে এই নিয়ে শিবনাথ খুব বেশি কথা বলল না। এটা তার নিজস্ব চিন্তা। রাত্রে খাওয়া-দাওয়ার পর কে. গুপ্তর প্রশ্নটা আর একবার মাথায় নাড়াচাড়া করে শিবনাথ তার ঘরের অন্ধকার জানলায় বাড়ি উঠোনের দিকে চোখ রেখে সিগারেট টানতে লাগল। বিছানায় মঞ্জু ঘুমিয়েছে। রুচি ঘুমিয়ে পড়েছিল। এইমাত্র জেগে উঠে এক গ্লাস জল খেয়ে আবার শুয়েছে। হয়তো ইতিমধ্যে আবার ঘুমিয়ে থাকবে।

আর মস্ত বড় উঠোন বুকে নিয়ে বারোটা ঘর রাত্রির জলে সাঁতার কাটছিল।

আজ সব ঘরেকে টেক্কা দিয়েছে বীথিদের ঘর। অফিস-ফেরতা বীথির সাজসজ্জার চমক বীথি একটা নতুন ডিজাইনের ল্যাম্প কিনে এনেছে। কেরোসিনের যদিও। কিন্তু বাতিটার বিচিত্র গড়ন আর হুবহু ডিমের মত দেখতে চিমনিটার স্বচ্ছতা ও দীপ্তি সন্ধ্যা থেকে বাড়ির লোকগুলোর দৃষ্টি আকর্ষণ করছিল।

বলতে কি, আজ উঠোনে বেশি লোকের চলাফেরা নেই। শব্দও কম। তাছাড়া বাড়িতে লোকও কমেছে এই দুদিনে। অমল নেই, তার স্ত্রী।

কমলা আজও রাত্রে বাড়ি ফিরছে না। রমেশের ঘরে খাওয়া-দাওয়া ক’রে ঘুমিয়েছে ডাক্তারের ঘর চুপচাপ। বিধুমাস্টার এতক্ষণ তার দুই মেয়ের চলাফেরা এবং কথাবার্তা সংশোধন ক’রে দিতে দিতে বলছিল, কানুর আশা আমি ছেড়ে দিয়েছি। তাছাড়া ও পুরুষ, ধৈর্য কম। ভেঙে পড়ে ওরা সহজে। মানে বাজে দেমাক আছে, আসল কাজে মর্জি নেই। কোন্‌খান থেকে টাকা রোজগার করে আনবি, আমার জানা আছে। যদি ঘরে কিছু আসে, যদি বুড়ো বাপ-মাকে দুটি খেতে দিতে পারে এদিনে তো সে ছেলেরা না, মেয়েরা। এটা মেয়ের যুগ। এখন আর এত মান-সম্মান লাজ-লজ্জা নিয়ে বসে থাকলে চলে না। কারোর মেয়েই থাকতে পারছে না। কাজ করতে হবে, বিয়ে যদ্দিন না হচ্ছে। গৌরীদানের যুগ চলে গেছে, কথাটা মনে রাখবি।’

বিধুমাস্টারের স্ত্রী কথা বলছিল না।

তেমনি সংশোধন করা হচ্ছিল আর এক ঘরের মেয়েকে। বড় গলা ক’রে বলাই বলছিল, ‘তুই, কথায় বলে সমর্থ মেয়ে আমার ঘরে। হুট্-হাট্ ঘর থেকে বেরিয়ে যাস্ কোন্ আক্কেলে? কপি, মূলো? কেন ক’বেলা ভাত খাস না যে, লোকের ক্ষেতে চুরি করতে যাস্। আমার কি হাতে বাত নেমেছে য়ে, তুই রোজগার ক’রে আনবি আর তাই পেটে দিয়ে আমার জীবন কাটাব। আজ থেকে ঘরের বাইরে পা বাড়ানো নিষেধ। এইটুকুন বলে রাখলাম। ঘরে থেকে মার কাজে সাহায্য করবি, তবেই আমার চলবে।’ যেন চাকা ঘুরে গেছে, উপার্জনের ভাল রাস্তা বলাই খুঁজে পেয়েছে।

শিবনাথ কান পেতে রইল।

যেন ময়না হুস-হুঁস্ করে কাঁদছিল। বলাই আবার বলছিল, ‘দিন কারোর সমান যায় না। শনির চক্র য’দিন থাকে মানুষকে ঘোরাবেই। আমারও শনির দশা ছিল। না হলে আর টিনের ঘরে মাথা গুঁজব কেন। কিন্তু দশা এবার কাটল।’

শিবনাথ চমকে উঠল।

বলাইকে কাল বাড়ি থেকে তুলে দেবার কথা। সে এমন কি রাতারাতি সুবিধা করে ফেলল যে আর সে কিছু ভয় করছে না? খচ্ ক’রে কথাটা মনে পড়তে শিবনাথ বেশ কিছুক্ষণ বলাইর ঘরটার দিকে চোখ রেখে অন্ধকারে গলা বাড়িয়ে দিয়ে চুপ করে রইল।

‘সব শালা এ-বাড়িতে, এ-পাড়ায় স্বার্থপর। বনমালী দেখল না, কে. গুপ্ত নিজে দেখল না, চারু রায় পরে এসেছে। তবে কে দেখতে পেয়েছে শুনি কে. গুপ্তর ছেলের সঙ্গে ময়না ছিল? যে-শালা একথা বলে, আমি তাকে মজা দেখাচ্ছি, আর দুটো দিন সবুর।’

বলাইর গলার স্বরে সারা বাড়িটা গুমগুম করছিল। যেন এ-কথার উত্তর দিতে কেউ নেই। সব চুপ।

প্রতিবাদ করতে গেলে ঝগড়ার সৃষ্টি হবে। বস্তিবাড়ির দস্তুর। শিবনাথ ক’দিন অনেক ঝগড়া দেখেছে। তাই আর কোন ঘরে কথা নেই।

অবশ্য রুণুর, এ-বাড়ির একটি কিশোরের হঠাৎ এই দুরদৃষ্টের সংবাদ পেয়ে অস্থির হয়ে পড়েছে, এমন লোকও আছে।

আত্মীয় না। অপর লোক। একটা উঠোনের ওপর আজ কতদিন একত্রে আছে এই সম্পর্ক,–পরমাত্মীয়ের মতন কেঁদে উঠেছিল বর্ষীয়সী। প্রমথর দিদিমা।

প্রমথ রুণুর সমবয়সী, সাথী, সেই সুবাদে রুণুরও দিদিমা। গত আশ্বিন মাসে সব ছেলের মধ্যে অগ্রণী হয়ে রুণু বাড়ন্ত লাউ গাছটা প্রমথদের দরজার ওপর ঘরের চালে বাড়িয়ে দিতে সাহায্য করছিল। সেই স্মৃতি বুড়ীর মনে আছে। আজ সন্ধ্যাবেলা রুণুকে ওরা ধরাধরি করে হাসপাতালে নিয়ে গেছে এবং অক্সিজেনের জোরে এখন পর্যন্ত বাঁচিয়ে রেখেছে, সংবাদটা বুড়ীর কানে পৌঁছে গেছল। তারপর থেকে মাঝে মাঝে কেঁদে উঠেছিল।

কিন্তু ডুকরে বেশিক্ষণ কাঁদতে পারেনি প্রথমর দিদিমা। সেই ঘরের পুরুষ বুড়ীকে সাবধান করে দিয়েছে : ‘দরকার নেই অত আত্মীয়তা ফলিয়ে। গেছে অমুক নম্বর ঘরের লোক গেছে, আমাদের কি–শহরে, শহরতলিতে রাতদিন অ্যাকসিডেন্ট হচ্ছে। যাদের ঘরে আজ হল না, কাল তাদের ঘরে হবে। আফসোসের কিছু নেই। কাজেই এত কাঁদাকাটা করে একদিনে সব ফুরিয়ে লাভ নেই জেঠী। তাছাড়া এসব ক্ষেত্রে পুলিশ এনকোয়ারি আছে, জিজ্ঞাসাবাদ আছে, অমুক ঘরের ছেলে, তোমার কে হয়, তুমি কে,–ওদের সংসারে রোজগেরে নেই, তো দিনের পর দিন খাচ্ছে কি, উপার্জনের রাস্তা কোনটা—’

পুরুষ গলা বড় ক’রে বার বার ঘরের জ্যাঠাইমাকে বোঝাচ্ছিল, প্রতিবেশীর জন্য এতটা শোকবিহ্বল হতে গেলে ঘরে বিপদ ডেকে আনা হবে। কেননা, রুণুর সমান বয়সের আর একটি ছেলে প্রমথ। এ-ঘরের বাসিন্দা। কাজেই ‘বাড়িওয়ালার জুলুম চলবে না’–দলে কে কে ছিল ইত্যাদির এনকোয়ারি শেষটায় এখানে আসবে। সুতরাং চুপ থাকা বুদ্ধিমানের কাজ।

প্রমথর দিদিমা আর কাঁদেনি। অল্পবিস্তর সব ঘরই রুণু সম্পর্কে এরকম নিস্পৃহ থাকার মনোভাব দেখাচ্ছে, বাড়িতে পা দিয়ে শিবনাথ টের পেয়েছে এবং এতটা রাত অবধি জেগে সে সব শুনছে।

প্রমথদের ঘরই সবচেয়ে স্পষ্ট ও নির্ভীক ভাষায় জানিয়ে দিলে : ‘না রুণুর সঙ্গে প্রমথ ছিল না। কোনদিন মেশে না। রুণু ছেলেটা চিরকালই বদ এবং শহরের ছেলেদের সঙ্গে ওর আড্ডা। পার্ক সার্কাসের দুটো-একটা বন্ধু এখনো মাঝে মাঝে এখানে আসে আড্ডা দিতে। হয়তো ও ওদের শলাতে পড়ে পারিজাতের গাড়ি আটকে মারতে ছুটেছিল। তাই না এই অনর্থ ঘটল। এখন? ঠ্যালা সামলাও। কে দেখে, কে যায় হাসপাতালে দুবেলা খবর নিতে–খাবার দিতে। এই রকম ছেলে ঘরে না থাকা ভাল। বংশের কুলাঙ্গার। ওদিকে বাপ তো ‘বোতল’, ‘বোতল’ ক’রে রাস্তায় ফ্যা ফ্যা করে ঘুরছে।

বলে প্রমথর বাবা সজোরে দরজার দুটো বন্ধ করেছিল। বাড়িটা কাঁপছিল সেই শব্দে।

বলাইর মত প্রমথর বাবাও বড় গলায় বলছিল, ‘আমার ছেলে দলে ছিল কেউ বললে আমি তার ঠ্যাং ভেঙে দেব, দিয়ে বুড়ো বয়সে জেলে যাব’—-ইত্যাদি।

তারপর আর বারো ঘরে এ সম্পর্কে কথা শোনা যায়নি।

কেবল প্রমথর বাবার হুঁকো টানার ঘড়াৎ ঘড়াৎ আওয়াজ।

অর্থাৎ এ-বাড়িতে আসার পর যত ঘটনা ঘটেছে, এটাই সবচেয়ে বড় এবং বিশ্রী এবং এর জন্য প্রত্যেকটি ঘর এখন সতর্ক। ফিরিওয়ালার পয়সা চুরি যাওয়ার পর থেকে ডোমপাড়ার মস্ত বড় আগুন, বৌকে ধরে অমলের রাত দুপুরে মার, কি রাত দুটোয় কলেরা কেস সেরে এসে শেখর ডাক্তারের স্ত্রী প্রভাতকণাকে ঘুমিয়ে পড়েছিল বলে অশ্লীল ভাষায় গালিগালাজ বা অমলকে বাড়ি থেকে তুলে দেওয়ার কাহিনী বা হঠাৎ অবিশ্বাস্য রকম বীথির একটা ভাল চাকরি পেয়ে যাওয়ার সংবাদ সঙ্গে এ ঘটনার একেবারে মিল নেই।

সে-সব ঘটনায় এ ওর পক্ষ নিয়েছে এবং আর একদল গেছে বিপক্ষে। কিন্তু আজ প্রায় সবাই নিরপেক্ষ থাকতে চেষ্টা করছে।

আর আর প্রত্যেকটা ঘটনায় ঝগড়া-বিবাদ হয়েছে, কথা কাটাকাটি হয়েছে। প্রভাতকণার মেয়ে সুনীতি সেদিন এ-বাড়ির সকলকে দেখিয়ে সিনেমা দেখে এসেছে, রেস্টুরেন্টে খেয়ে এসেছে,–ঘটা করে সবিস্তারে যা সব বলছিল–এবাড়ির আর একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা। সেই ঘটনাকে কেন্দ্র করে কম ঝগড়া-বিবাদ হয়নি।

অর্থাৎ প্রভাতকণা স্থির করে ফেলেছে সুধীর ভাবি জামাতা। কিন্তু শেখর ডাক্তার বাইরে থেকে একটা ‘কারেক্ট ইনফরমেশন’ নিয়ে আসে, সেজন্য সুধীরকে আর কোনমতেই বর করা চলে না। এমনকি, তার সঙ্গে মেয়েকে মিশতে দেওয়াও অনুচিত।

বিকেলে মেয়েকে সিনেমা দেখাতে পাঠিয়েছিল প্রভাতকণা সুধীরের সঙ্গে। যে গহনাগুলো সুনীতির বিয়েতে দেবার জন্য গড়ানো, সেগুলো পরে সুনীতি সুধীর মামার সঙ্গে সিনেমা দেখতে বেরোয় আর সেই রাত্রে খবর নিয়ে আসে সুনীতির বাবা। শেখর ডাক্তার পামারবাজার রোডে তার বন্ধু উমাপদবাবুর কাছে সুধীরের সব বৃত্তান্ত জেনে এসেছে। শিলচরের লোক উমাপদ ভট্টাচার্য। ডাক্তার। এলোপ্যাথ। এখানে কলকাতায় এসে একটা সূত্রে পরিচয় ঘটেছে শেখরের সঙ্গে।

‘বুড়ো মানুষ–মিথ্যা কথা বলেন না। আর তা ছাড়া সুধীরের বাবার সঙ্গে তার শত্রুতাও নাই। দেশে থাকতে সুধীর উমাপদবাবুর কাছে তার অসুখের চিকিৎসা করায়। বড়লোকের ছেলে বেশ পয়সা খরচ করতে পেরেছিল তখন নিজের ব্যাধিটি সারাতে। প্রায় সেরে এসেছিল। বাপের ব্যবসা সংক্রান্ত কাজে হুট্ করে হঠাৎ চলে আসে কলকাতায়। অসুখটি জটিল। সম্পূর্ণরূপে আজও আরোগ্য হয়েছে কিনা উমাপদবাবু ব্লাড একজামিন না করে বলতে পারেন না। তবে ছেলে বুদ্ধিমান। বাপের সম্পত্তি বাড়াতে না পারলেও কমতে দেবে না, এইটুকুন গ্যারান্টি দেওয়া যায়। এই হিসাবে পাত্র খারাপ না,–ইত্যাদি।

‘এখন কর্তব্য কি?’

সব বলা শেষ করে শেখর ডাক্তার রাত্রে স্ত্রীকে প্রশ্ন করল। শুনে প্রভাতকণা চুপ করে থাকে।

কিন্তু খবর সেখানেই চাপা থাকে না। কুয়োতলায় যাবার সময় ডাক্তারের ঘরের ভেজানো পাল্লার সামনে একটু সময়ের জন্যে আড়ি পেতে থেকে প্রীতি-বীথি রমা সব শুনে ফেলেছে।

ঘরে এসে বলেছে সে মেয়েদের কাছে।

তাই নিয়ে দু’বোন সারা রাত বিছানায় শুয়ে থেকে-থেকে হেসে উঠেছে। বেশ জোরে। অর্থাৎ উত্তরের অপেক্ষায় তখন সুনীতির বাবা প্রভাতকণার মুখের দিকে তাকিয়ে : এই অবস্থায় সুধীরের হাতে মেয়েকে দেওয়া উচিত হবে কি না, তুমিই বল। সুনীতির সর্বনাশ হবে, ভবিষ্যতে ওর গর্ভে যে সন্তানটি আসবে, তারও সর্বনাশ হবে।’

মুখ অন্ধকার করে প্রভাতকণা স্বামীর মুখের দিকে তাকিয়েছিল।

সেই সময় প্রীতি ও বীথির খলখল হাসি তার কানে যায়।

তখনই একটা কিছু সন্দেহ করছে। পরদিন সকালে প্রভাতকণার বুঝতে বাকি থাকে না। সুনীতি কুয়োতলায় মুখ ধুচ্ছে, এমন সময় বীথি গিয়ে সেখানে পড়ে। সুনীতিকে দেখে গত রাত্রির কথা মনে পড়তে বীথি খুক খুক করে হেসে ওঠে। ঘরে ফিরে সুনীতি মাকে কথাটা বলতে প্রভাতকণা তৎক্ষণাৎ আঁশবঁটি নিয়ে ছুটে গিয়েছিল বীথিদের ঘরের দরজায় : ‘আপিসে নাম লেখাইয়া আইছিস, তুই আমার মাইয়ার সুখ দেইখ্যা হিংসায় মরবি না তো মরবে কে, হারামজাদী–আয় তর নাক কাটুম, পোড়ারমুখী—’

হাতের বঁটি আন্দোলিত করে রণমূর্তি প্রভাতকণা আস্ফালন করছিল আর চিৎকারে বারোটা ঘরের চালা কাঁপিয়ে তুলছিল। বীথি ভয় পেয়ে দরজার আড়ালে আশ্রয় নেয়, কিন্তু বড়বোন প্রীতি ছুটে এসে চৌকাঠের বাইরে দাঁড়ায়। ‘আমি থানায় খবর দেব, তোমাকে পুলিশে দেব, বজ্জাত মাগি।’ প্রীতির গলাও কিছু কম যায় না : ‘তোমার মেয়েকে দেখে বীথি হেসেছে বেশ করেছে, আমি হাসব, পাশের ঘরের লক্ষ্মীদি হাসবে, হিরণ বৌদি হাসবে, কমলা হাসবে, রুচিদি সাহবে। সবাই হাসবে। বড় যে মেয়ের বিয়ে বিয়ে করে তড়পাচ্ছ, দাও না এখন সুধীরমামার সাথে বিয়ে। সুধীরের কি রোগখানা আছে, এখনো খবর পাওনি বুঝি। আঁশবঁটি নিয়ে ছুটে এসেছ এখানে, কত বড় বুকের পাটা–’ প্রীতি দম নিচ্ছিল, আর সেই ফাঁকে প্রভাতকণা বুঝি তার ফুসফুস ফেটে যায়, এমন জোরে চিৎকার করে বলছিল : ‘আয় কুত্তি, আগে তর গলা কাটি–টেলিফুন আপিসের রোজগার খাইয়্যা গতরে তর চর্বি জমছে বেশি, আয় চর্বি চাইছা দেই বঁটি দিয়া–’ ইত্যাদি—

প্রীতি দরজার কাঠ নিয়ে ছুটে এসেছিল প্রভাতকণাকে মারতে। একটা রক্তারক্তি হত কিন্তু বিধুমাস্টারের স্ত্রী, রুচি এবং আরও দু’ একজন গিয়ে দু-পক্ষকে থামিয়ে দেয়।

আজকের ঘটনায় রক্তপাত আছে, কিন্তু এই জন্যই কি তার গুরুত্ব বেশি। কথাটা চিন্তা করছিল শিবনাথ। রক্তপাত ছাড়াও অন্য জিনিস আছে। রাজনীতি, পুলিসের তদন্ত, মামলা মকদ্দমা, ক্ষতিপূরণ, জেল। অত্যন্ত বিশ্রী ব্যাপার। শিবনাথ চিরকাল এগুলিকে ঘৃণা করে। তার সাদামাঠা জীবনে এসবের স্থান নেই। চিরকাল সে এ সব থেকে দূরে থেকেছে। বোধ করি, বাড়ির বাকি ঘরগুলোর এ সমস্ত ভয় আছে বলেই চুপ করে আছে, এখন বুঝতে কষ্ট হল না তার। আর একটা সিগারেট ধরিয়ে শিবনাথ নিশ্চুপ বসে থেকে তাই লক্ষ্য করছিল। কিন্তু সবচেয়ে অবাক হয়ে সে দেখল, যাদের ছেলেকে নিয়ে এই হাঙ্গামা, তারা যেন সকলের চেয়ে বেশি নীরব। বনমালীর দোকানের সামনে বেঞ্চে বসা কে. গুপ্তর চেহারা মনে পড়ে শিবনাথের হাসি পেল এই কারণে যে, না হলে না হয়, জিজ্ঞেস না করে নিতান্ত খারাপ দেখায় তাই কে. গুপ্ত তাকে তখন উটকো প্রশ্নটা করে বসল। ‘মশাই, পারিজাত গাড়ি নিয়ে বেরিয়েছিল, আপনি জানেন কিছু?’

প্রকৃত ঘটনার সঙ্গে রমেশের কথার নড়চড় থাকতে পারে আশঙ্কা ক’রে যে কে. গুপ্ত এ প্রশ্ন করছিল না, শিবনাথ এ সম্পর্কে নিশ্চিন্ত ছিল।

মোটর অ্যাক্সিডেন্টের প্রসঙ্গ ওঠার আগে তখন কি নিয়ে কে. গুপ্ত তার চারু বন্ধুর সঙ্গে আলাপে মগ্ন ছিল চিন্তা করে শিবনাথ এখন অন্ধকারে নিজের মনে হাসল। আর ঘাড় ফিরিয়ে কে. গুপ্তর ঘরখানা দেখতে লাগল। এ-বাড়ির সবচেয়ে নীরব ঘর।

.

ঘরে আলো নেই। কেউ জেগে আছে কি না, তাও বোঝা যায় না। দরজার পাল্লার একৗশ খোলা, একটা ভেজানো।

যেন এইমাত্র হাঁটু অবধি ধুলো নিয়ে বেবি ঘরে ফিরেছে। হয়তো হাসপাতাল থেকে। কেননা, বাড়িতে ঢুকে শিবনাথ রুচির কাছে জানতে পারে, ছেলের গাড়িচাপা পড়ার পর খবর শুনে রুণুর মা সুপ্রভা চুপ করে অনেকক্ষণ চৌকাঠ ধরে স্থির হয়ে দাঁড়িয়েছিল। এ সম্পর্কে কাউকে আর কোন প্রশ্ন করেনি। যেন নিজের মনে কি চিন্তা করল। তারপর ঘরে গিয়ে শুয়ে পড়েছে। সন্ধ্যার পর ঘর থেকে আর তাকে কেউ বেরোতে দেখেনি। এত রাত অবধি শিবনাথও দেখল না। বেবীকে ক্ষিতীশ দোকান থেকে ছুটি দিয়েছিল রুণুর সঙ্গে হাসপাতালে যেতে। সম্ভবত ও এই হাসপাতাল থেকে ফিরে এল।

শিবনাথ অনুমান করল, হাসপাতালের খবর তেমন খারাপ হলে ঘরে অন্তত এখন একটা কান্নাকাটি শোনা যাবে। কিন্তু তা শোনা না যাওয়াতে সে নিশ্চিন্ত হল। বেবি পায়ে হেঁটে শেয়ালদার ক্যাম্বেল হাসপাতাল থেকে ঘরে ফিরছে। তাই পায়ে ধুলো। বীথিদের জানালার আলোটা বেবীদের বারান্দায় এসে পড়েছিল বলে শিবনাথ ধুলোটা দেখতে পায়। সম্ভবত বাস পাওয়া যায়নি। বাস পেলেও বেবিকে হেঁটে হাসপাতাল থেকে ফিরতে হত কিনা চিন্তা করে শিবনাথের পয়সার প্রশ্নটা মনে ওঠে।

রমেশ বা ক্ষিতীশ এই সময় দু’চার-আনা মেয়েটাকে সাহায্য করবার মত সদয় ছিল কিনা, শিবনাথের সংশয় ছিল।

পারিজাত নিজে সেই গাড়িতে ছিল না–তিন-দিন ইনফ্লুয়েঞ্জায় শয্যাগত। যদি কে গুপ্তকে রমেশ এই মিথ্যা সংবাদটা বলে থাকে তো কেন রমেশ তা করল বুঝতে শিবনাথের খুব বেশি ভাবতে হল না।

পারিজাত রমেশের একদিকে মনিব, অন্যদিকে বন্ধু। বড়লোক বন্ধু হলে রমেশ রায়ের মত ‘করে খাওয়ার’ লোকেরা বন্ধু বিপদে পড়েছে দেখলে বন্ধুকে সাহায্য করে। কে. গুপ্ত বুঝতে না পারলেও শিবনাথ এ সম্পর্কে যথেষ্ট সচেতন। হয়তো ইতিমধ্যে বনমালীও এক- আধটা পাঁইট দিয়ে কে. গুপ্তকে একটু ঠাণ্ডা রাখতে চেষ্টা করবে। কেন বনমালী তা করবে, শিবনাথ তা-ও বেশ বুঝতে পারছিল।

বনমালীর এই দোকান-ঘর এখনি ডবল টাকায় ভাড়া দেওয়া যায়, যদি তাকে এখন তুলে দেওয়া হয়। মুখে সে যতই পারিজাতের নিন্দাবাদ করুক, উচ্ছেদের মামলায় টাকা ঢালাঢালির প্রতিযোগিতায় সে যে কোনমতেই পারিজাতের সঙ্গে এঁটে উঠতে পারবে না, বনমালী এ সম্পর্কে যথেষ্ট সজাগ। তাই এ ব্যাপারে সেও নীরব। নিজের চোখে অ্যাকসিডেন্ট দেখেছে এবং কে রুণুকে গাড়ি চাপা দিলে সত্য কথা পুলিসকে বললে বিপদ হবে চিন্তা করে যে বনমালী ‘বড়বাজারের মাল কিনতে গিয়েছিল’ মিথ্যা কথাটা বলেছে, শিবনাথের মনে তা- ও ইশারা দিয়ে গেল। আর থাকে চারু রায়। চারু রায় পরিষ্কার খুলেই বলেছে তার ব্যবসা- বাণিজ্যের স্বার্থ আছে এ-তল্লাটে। সন্ধ্যার দিকে যখন ঝিঁঝি ডাকছিল, বাদাম গাছের নিচে যে জায়গায় অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছে শিবনাথ দেখে এসেছে সেই জায়গা। বেশ অন্ধকার থাকে তখন ওধারটা। অন্তত কিছুক্ষণের জন্য। তারপর অবশ্য কর্পোরেশনের লোক গ্যাসের বাতিটা জ্বালিয়ে দিয়ে যায়। এই আলো জ্বলবার পর রাস্তাটা ভাল দেখা যায় বলে আবার লোকজনের চলাফেরা আরম্ভ হয়। বাড়ির অধিকাংশ লোক তখনই ঘরে ফেরে। রুচি ফেরে, প্রীতি ফেরে। কমলা কোনদিন ফেরে, কোনদিন না। রুচি এবং ভুবনবাবুর দুই মেয়ে আজ দুর্ঘটনার আগেই বাড়ি ফিরেছে। কমলা ফেরেনি। আর ফিরলেও যদি সে স্বচক্ষে দুর্ঘটনা দেখত, ঘরে এসে রুণুর মা সুপ্রভাকে এসে ঠিক কি বলতো চিন্তা করল শিবনাথ।

শিবনাথ প্রত্যেকের বিষয়ে আলাদাভাবে চিন্তা করল এজন্য যে, এ-বাড়ির রুণুর গাড়িচাপা পড়াও পারিজাতের হঠাৎ একটা অ্যাকসিডেন্টের মামলায় জড়িয়ে পড়ার সঙ্গে শিবনাথের ঠিক কালই ও-বাড়ির ট্যুইশানি পাওয়ার একটা সম্পর্ক আছে। এর জন্য, এই গোলমালে পড়ে পারিজাত কি তাঁর স্ত্রী হয়তো শিবনাথের সঙ্গে কাল কথাই বলবে না। অর্থাৎ সবটা জিনিস পিছিয়ে যাবে। হয়তো ট্যুইশানিটা সে আর পাবেই না। তার কারণ রমেশ যেখানে বলছে পারিজাত অসুস্থ, তিন দিন শয্যাশায়ী, শিবনাথ বলবে ঘটনার একটু আগে বিকেলে সে পারিজাতের ছেলেমেয়েদের প্রাইভেট টিউটারের পদপ্রার্থী হয়ে রায় সাহেবের বাংলোয় ছিল এবং তখন সে দেখে এসেছে, পারিজাত গাড়ি নিয়ে বেরিয়েছে। অর্থাৎ রমেশের রিপোর্ট ভুল। কিন্তু —

আবার এ-ও চিন্তা করল শিবনাথ, সেখান থেকে বেরিয়ে বাড়ি এসে পরে সে বাজারে যায়। হয়তো সে যখন বাজারে ছিল, তখন অ্যাকসিডেন্ট হয়। কিন্তু সে সময়ে, অর্থাৎ বৌয়ের সঙ্গে রাগ করে গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে মাঝ রাস্তা থেকে আবার যে পারিজাত বৌয়ের মান ভাঙাতে তখন ঘরে ফিরে যায়নি, তা-ই বা কে জানে। অর্থাৎ একটা পিঁপড়েকেও চাপা না দিয়ে? কিন্তু রমেশের ইনফ্লুয়েঞ্জার বর্ণনাটাই সব গোলমাল করে দিচ্ছিল।

একটা মিথ্যা অনেক মিথ্যাকে টেনে আনে।

বস্তুত বলতে কি, কে. গুপ্তকে হুট করে মিথ্যা কথাটা বলে এসে শিবনাথের মন খুঁতখুঁত করছিল।

করছিল আর যেন কেমন একটু অপরাধীর চোখে সে কে. গুপ্তর ঘর দেখছিল।

রাত্রে ওদের খাওয়া-দাওয়া কিছু হয়নি অনুমান করা শক্ত না, কেননা, এখানে এসেছে পর থেকে শিবনাথ শুনছে পাশের ঘরে রুণু কিছু শাকসবজি সংগ্রহ করে আনলে তবে সেটা দিয়ে রাত্রির পর্ব সারা হয়। সিদ্ধ বা কাঁচা।

আজ রুণু অনুপস্থিত।

বেবি যে হাসপাতালে যাবার আগে মাকে একটু চা-বিস্কুট খাইয়ে গেছে, সেটাও বিশেষ ভরসা করা যায় না।

সারা বাড়ি নিঝুম।

এক বীথি যদি ওধারের বারান্দায় দাঁড়িয়ে ওর ভিজে তোয়ালের জল ঝাড়তে ফটাস্ করে একটা শব্দ না করত, তো শিবনাথের মনে হত সারাটা বাড়িই বুঝি হাসপাতালে রুণুর অবস্থা এখন কিরকম ভাবনা-চিন্তায় বিষণ্ণ মৃতপ্ৰায়।

কিন্তু তা না, শিবনাথ হৃষ্টমনে ন’নম্বর ঘরে নতুন কিনে আনা ল্যাম্পটার স্বচ্ছ আলো বিভাসিত আঠারো বসন্তঘেরা একটি যুবতীর বক্ষ দেখে শিউরে উঠল।

এক সেকেন্ড। এক সেকেন্ড কাপড়টা বুক থেকে সরিয়ে বীথি আর একবার তোয়ালেটা চেপে ধরে বাকি জলটুকু শুষতে চাইল, কিন্তু অন্ধকারে কেউ তাকিয়ে দেখছে, কোনো ঘরের খোলা জানালায় পুরুষ দাঁড়িয়ে, টের পেয়ে যেন বিদ্যুৎস্পৃষ্ট বীথি বারান্দা ছেড়ে এক ঝটকায় ঘরের ভিতর অদৃশ্য হল। আলোটা নিভল। কেউ ওদের তাকিয়ে দেখছে টের পেতে সংসারে মেয়েদের জুড়ি নেই। যেন গন্ধে ওরা টের পায়। শিবনাথ নিজের মনে হাসল এবং চাপা রুদ্ধ একটা নিশ্বাস ফেলে তার জানালার পাল্লা দুটোও ভেজিয়ে দিল। রাত বেশি হয়েছে। না, বিছানায় শুয়ে শিবনাথ এটাকে একটা কিছু অপমান বলে মনে করল না। এবং তার নিজের দিক থেকেও এভাবে চুরি করে বীথিকে দেখাটা অপরাধ বলেই গণ্য করতে পারল না। বরং যেন শিবনাথের মনে একটা তুলনামূলক সমালোচনা এল। যেমন জীবনের তীব্র ট্র্যাজেডি ভুলতে বড়লোক মোহিত বেশ্যাসক্ত হয়েছে বা জীবনের চরম ব্যর্থতা ভুলতে কে. গুপ্ত মদের আশ্রয় নিয়েছে, তেমনি শিবনাথও যেন একটা অস্বস্তিকর অপ্রীতিকর ঘটনা ভুলতে কতক্ষণের জন্য মনটাকে অন্যদিকে ব্যাপৃত রাখতে চাইল। এই অন্ধকার একটা ঘরে হাতের কাছে সে আর কী নেশা পাচ্ছি যে, পাশের ঘরের ছেলেটির গাড়িচাপা পড়ার দুঃসংবাদ পেয়ে এবং এই নিয়ে বনমালীর দোকানের সামনে সে নিজেও কিছুক্ষণ কথাবার্তা বলে এসে এখানে অনিদ্রার বিশ্রী অবাঞ্ছিত সময়টা কাটাতে পারতো।

এদিক থেকে শিবনাথ দুঃখী বৈকী।

রাত্রির এই গাঢ় প্রহরে স্ত্রীর সঙ্গে দুটো কথা বলে মন হাল্কা করার ভাগ্য শিবনাথের নেই। কেননা, রুচিকে ঘুমোতে না দিলে কাল সারাদিন স্কুলে তার শরীর মেজাজ ভাল থাকবে না।. তার ঘুমের দরকার। বস্তুত আয়তনে ছোট হলেও শিবনাথের একটা দুঃখ তো বটেই।

এবং বড় দুঃখ ভুলতে বড় বড় নেশার যেমন দরকার, তেমনি ছোট দুঃখ, একটু আধটু ব্যথা ভুলতে হাত বাড়ালেই অনেক ছোটখাটো নেশার দ্রব্য পাওয়া যায় জীবনে, এই অভিজ্ঞতা নতুন না হলেও শিবনাথ আর একবার তার স্বাদ অনুভব করে রোমাঞ্চিত হয়। এবং অন্ধকারে অনেকক্ষণ ঘুমোতে চেষ্টা করেও যখন ঘুমের পরিবর্তে বীথির নগ্ন সুডোল কুমারী বুকের ছবিটা চোখের সামনে ভেসে উঠতে লাগল, তখন অতি সন্তর্পণে সেই অদ্ভুত জ্বলন্ত নেশা ভুলতে ভয়ে ভয়ে নিজের হাতখানা বাড়িয়ে রুচির (তখন মৃতপ্রায় বলা চলে) এখানে ওখানে একটু আধটু হাড় বের হওয়া কোমরের ওপর সেটা রাখল ও ঘুমোতে চেষ্টা করল।

২৮

এ সম্পর্কে খুব বেশি কৌতূহল কি জিজ্ঞাসাবাদ না করাই বুদ্ধিমানের কাজ হবে চিন্তা করে শিবনাথ পরদিন প্রায় সারাদিন বাইরে বাইরে কাটাল। মনে এই নিয়ে দুশ্চিন্তা হ’ত যদি সে বাড়িতে বসে থাকত। তার হাতে কাজ নেই, তা ছাড়া কে. গুপ্তর ঘর তার ঘরের লাগোয়া, এ সম্পর্কে একটা দু’টো কথাও তার কানে এলে খামোকা মনটা খারাপ হ’তে পারে চিন্তা করে যেন শিবনাথ রুচি বেরোবার প্রায় পিঠেই পাঞ্জাবি ও একটা র‍্যাপার গায়ে চড়িয়ে অতিরিক্ত দুটো টাকা পকেটে পুরে সোজা শেয়ালদার বাসে চাপল।

হ্যাঁ, অনেকদিন পর সে লাইটহাউসে একটি ছবি দেখল। ভাল একটা দোকানে একটু চা খেল এবং হাতে আরো দু’টো একটা টাকা থাকলে সে লাইটহাউসের পাশের দোকানের সেই পিতলের ওপর কাজ-করা সুন্দর ফ্লাওয়ার-ভাসটা কিনতে পারত। কিন্তু টাকার অভাবে কিনতে না পারলেও বেশ কিছুক্ষণ দোকানের শো-কেস-এর সামনে দাঁড়িয়ে চীনা শিল্পীর হাতের তৈরী জিনিসটি দেখতে অবহেলা করল না। এবং সেটা দেখতে দেখতে শিবনাথ এইটুকু প্রমাণ করল যে, কান এক ট্যাংরা-বেলেঘাটায় বস্তিবাসী হয়েছে বলে সে তার শিল্পবোধ, শিক্ষিত রুচিসম্মত সুন্দর মনটাকে বিসর্জন দেয়নি।

ফুলদানি দেখা শেষ করে সে ঘড়ি দেখল। সন্ধ্যাসন্ধ্যি সে বাড়ি ফিরতে চায়।

মানে এখান থেকে এখন রওনা হলে এক ঘণ্টার মধ্যে সে ওখানে গিয়ে পৌঁছবে। বেড়ানো শেষ করে ইতিমধ্যে পারিজাত, দীপ্তি ও তাঁদের ছেলেমেয়েরা নিশ্চয় ঘরে ফিরবেন। শিবনাথ একান্তভাবে আশা করছিল যদি এই ট্যুইশানি হয়ে যায় তবে তার সংসার মোটামুটি স্বচ্ছল হবে। ব্যবসা-বাণিজ্য তার মনের কথা। যদি সেটা সম্ভব না-ও হয়, ওবাড়িতে যাওয়া- আসা, পারিজাতের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হওয়ার একটা মূল্য আছে বৈকি! চাটে পাট–বড়লোকের সঙ্গ রাখা ভাল। রমেশ রায়ের কথাটা তার মনে আছে।

দোকানের সামনে থেকে সরে এসে শিবনাথ বাস ধরতে বড় রাস্তার দিকে এগোয়। এমন সময় আর একটা দোকান থেকে বেরিয়ে প্রায় লাফিয়ে পেভমেন্ট-এর ওপর এসে দাঁড়ায়, হাঁ, শিবনাথের সঙ্গে তেমন মাখামাখি না থাকলেও ক’দিনে অনেক রকম কথাবার্তা হয়েছে লোকটির সঙ্গে, কে. গুপ্তর বন্ধু, চারু রায়।

‘আপনি এখানে?’

হ্যাঁ, এই বইটা দেখবার লোভ সংবরণ করতে পারলাম না।’ শিবনাথ আজ চারু রায়কে সিগারেট অফার করল।

ওয়ান্ডারফুল! চারু রায় আড়চোখে আলোর ফুলকি-পরা লাইটহাউসের আকাশস্পর্শী গম্বুজের দিকে তাকিয়ে ঈষৎ হাসল। ‘আমি দেখব–আমার দেখার ইচ্ছা আছে, সময় ক’রে উঠতে পারছি না।’

‘এখানে, এই দোকানে?

চারু রায়ের সুন্দর বেশভূষা ও মেয়েলি মুখখানা আবার ভালো ক’রে দেখল শিবনাথ! ‘মার্কেটিং?’

‘হ্যাঁ, তা,–’ পকেট থেকে লাইটার বের করে সেটা সিগারেটের আগায় ধরাল।

‘অন্য কিছু না।’ মুখ থেকে বাড়তি ধোঁয়াটা বের করে দিয়ে চারু বলল, ‘আমার ক্যামেরার ফিল্ম ফুরিয়েছে তাই কিনতে এসেছিলাম।’

যেন একসঙ্গে অনেক কথা মনে পড়ল শিবনাথের। কিন্তু সে-সব সম্পর্কে এখন আর একটিও প্রশ্ন না ক’রে বলল, ‘যে তল্লাটে বাসা নিয়েছি সেখানে ভাল হাউস নেই এবং যে-সব ছবি সে-অঞ্চলে দেখানো হয় তা কোন রুচিসম্পন্ন লোক বসে দেখতে পারে না।’

‘বটেই তো।’ চারু ঘাড় নাড়ল। এবং যেন কি ভাবল। তারপর মেয়েদের মত সবগুলো নির্মল পরিচ্ছন্ন দাঁত একসঙ্গে বের ক’রে দিয়ে হাসল। ‘তা বড় যে একলা? মানে আমি ওদের–আপনার স্ত্রী ছেলেমেয়েদের কথাই বলছিলাম। না কি তিনি–আপনার ওয়াইফ বিলাতী ছবি দেখতে ভালবাসেন না?’

‘বাসেন না মানে?’ শিবনাথের নাক দিয়ে হাসির মৃদুরকম শব্দ বার করল। ‘দেশী ছবিতে কিচ্ছু থাকে না, রাতদিন তো কমপ্লেন্ করে শুনি এবং ছ’মাসের মধ্যে সে কোন বাংলা কি হিন্দী বই দেখেছে বলে আমার মনে পড়ে না। আমিও দেখি না। অন্য আরো দু’টো একটা কাজে আমাকে এদিকে আসতে হয়েছিল। বইটা দেখে ফেললাম। তাছাড়া স্কুল সেরে এখানে এসে তার সিনেমা দেখা সম্ভব হয় না। বেশ দূর পড়ে যায়। ছুটির দিন ও দেখবে।

চারু রায় সিগারেটের ছাই ঝাড়ল। ‘প্লিজ এক্সকিউজ মি।’ যেন কি মনে করে হাসল। ‘আপনি কিছু মনে করবেন না। আই হ্যাভ সিন সো মেনি পিপল্। যাঁরা, কেন জানি ফ্যামিলিম্যান হওয়া সত্ত্বেও, এমন কি অত্যন্ত সলভেন্ট যারা তাঁরাও, ভীষণ একলা একলা ছবি দেখতে ভালবাসেন কেন বলুন তো?’

‘মানে একেবারে নির্ঝঞ্ঝাট হয়ে স্বার্থপরের মত তাঁরা এই আমোদটি উপভোগ করেন। তখন দারা-পুত্র-পরিবার কেউ না।’ শিবনাথও ঘাড় দুলিয়ে হাসল।

‘ইয়েস একজ্যাক্টলি সো। কেন এমন হয় বলুন তো? আমি তো, আমার অবশ্য ছবি তোলাই পেশা। কিন্তু যখন বসে দেখি তখন বৌ ছেলেমেয়েরা ডাইনে বাঁয়ে না থাকলে বোরিং মনে হয়,–তা যত ভাল ছবি হোক না—’

‘আমি পারি না, আমারও ভাল লাগে না।’ হাসিটাকে না নিভিয়ে শিবনাথ বলল, ‘টু স্পীক দি টুথ, রোড্‌ টু হোপ দেখতে দেখতে আমি, ওরা আজ সঙ্গে ছিল না বলে নিরাশই হচ্ছিলাম। ছুটির দিন ওদের নিয়ে এসে আবার দেখতে হবে, সকলে মিলে আবার দেখব এ-বই।’

‘দি আইডিয়া!’ চারু চোখ বুজে যেন স্বগতোক্তি করল। তারপর শিবনাথের মুখের ওপর সবটা দৃষ্টি মেলে ধরে অত্যন্ত গম্ভীর হয়ে বলল, ‘তা যত খুশি এখন দেখুন ইংরেজি ছবি। বাংলা ভাল ছবি যখন আজো তৈরী হ’ল না তো করা কি। কিন্তু বলে রাখছি ‘মায়াকানন’ যেদিন রিলিজড় হবে সেদিন আবার আপনাকে সপরিবারে সে বই দেখতে হবে,–না দেখে শান্তি নেই, হা–হা।’ কথা শেষ করে চারু শব্দ করে হাসল।

নিশ্চয় দেখব। এবং আমি আশা করছি দ্যাট উইল বি এ গ্রেট পিচার। হা-হা। আপনি সত্যিকারের একটা বড় জিনিসে হাত দিয়েছেন, এ আমি সর্বদাই ভাবছি।’শব্দ করে শিবনাথ হাসল।

দু’জনের হাসির শব্দে পথচারীরা ঘাড় ফিরিয়ে এদিকে তাকাল। এক তরুণী মেমসাহেব দুটি বাচ্চার হাত ধরে গুটি গুটি চলে যাচ্ছিল। যেন অবাক চোখে বাঙালী ভদ্রলোক দু’জনকে সাহেবপাড়ায় দাঁড়িয়ে এতটা প্রগলভভাবে কথা বলতে, উচ্চরবে হাসতে দেখে মেয়েটি একটু সময়ের জন্য থমকে দাঁড়াল এবং তারা যে উচ্চাঙ্গের শিল্প নিয়ে আলোচনা করছে বিদেশিনীর তা-ও বুঝি বুঝতে কষ্ট হল না অনুমান করে শিবনাথ ভিতরে ভিতরে অত্যন্ত গর্ববোধ করল। চাকা ঘুরে গেছে, শ্রীমতী বুঝুক, কেবল যে দেশ স্বাধীন হয়েছে বলে বাঙালী ছেলেরা চৌরঙ্গীর ছবি ঘরগুলোতে ইংরেজী ছবি দেখতে এসে আজ ভিড় করছে, তা নয়, তাদের সূক্ষ্ম শিল্পবোধ, ফিল্ম আর্ট সম্পর্কে চিন্তাধারা কতটা অগ্রসর–শিবনাথের চিন্তায় ছেদ পড়ল।

‘আচ্ছা, চলি নমস্কার। ‘

‘নমস্কার।’ শিবনাথ দু’হাত একত্র করল।

আর কোন কথা না ব’লে নীরব মেয়েলী হাসিটা ঠোঁটের আগায় ঝুলিয়ে চারু পেভমেন্ট ছেড়ে রাস্তায় নামল এবং এতক্ষণ পর শিবনাথের চোখে পড়ল সেখানে হলদে টু-সীটার দাঁড়িয়ে। হাজারটা গাড়ি ভিড়ের মাঝখান দিয়ে পথ ক’রে ক’রে কেমন আশ্চর্য নিপুণতার সঙ্গে চারু রায় বেরিয়ে গেল চুপ করে কতক্ষণ দাঁড়িয়ে শিবনাথ দেখল। ছোট্ট হলদে গাড়িটা অদৃশ্য হ’তে সে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। কত ভদ্র কত মার্জিত রুচি! মনে মনে বলল শিবনাথ। এত কথা এতটা আলোচনার মধ্যে একবারও যে চারু ট্যাংরা-বেলেঘাটা বস্তি, বনমালীর দোকান, এমন কি কে. গুপ্তর প্রসঙ্গ তোলেনি সেজন্য শিবনাথ মনে মনে শ্রদ্ধা জানাল লোকটিকে। সত্যিই তো, এখানে এই বিলাসী পাড়ায় এমন গমগমে আবহাওয়ায়, যেখানে শুধু হাসি, বিলিতি বাজনা, বর্ণাঢ্য পোশাকের চমক, আর প্রসাধনের মিষ্টি গন্ধে বাতাস ভুরভুর করছে, সেখানে হঠাৎ বেকার বাউণ্ডুলে হতভাগ্য কে. গুপ্ত’র কথা কেমন বেমানান ঠেকত। যেন চারুর সঙ্গে একটু সময়ের আলাপের পর তার শরীর মন আরো ঝরঝরে প্রফুল্ল হয়ে গেছে। প্রায় শিস দিয়ে উঠল শিবনাথ এবং বাস ধরতে সামনের দিকে এগোতে লাগল। ফুরফুরে মিষ্টি গন্ধটা কিসের, চিন্তা করতে করতে পরে শিবনাথের বুঝতে কষ্ট হয় না হেয়ার অয়েল, প্যারিসিয়ান পপি। কে মেখেছে, কার মাথায়, ভাবল সে, ভেবে পরে অনুমান করল নিশ্চয় সেই মেয়েটি। বাচ্চা দুটোর হাত ধরে বিদেশিনী তরুণী কেন জানি এবার এই ফুটে এসে শিবনাথের আগে আগে চলেছে। অনেকদিন পর বুক ভরে শিবনাথ প্যারিসিয়ান পপি মাখা চুলের গন্ধ নিল। বিয়ের সময় আরো হাজারটা প্রসাধন সামগ্রীর সঙ্গে দু’শিশি পপি উপহার পেয়েছিল রুচি। সেই থেকে শিবনাথ ওটার প্রেমে পড়ে যায়।

বলতে কি বাস-এ উঠে আবার একটা অস্বস্তির কাঁটা তার বুকের মধ্যে খচখচ্ করছিল। আবার সেই মুখগুলি–বলাই, পাঁচু, বিধুমাস্টার, শেখর ডাক্তার, কে. গুপ্ত, নর্দমা, ময়লা, মোষের গাড়ি, ধোঁয়া ও ধুলোর ছবি চোখের সামনে ভেসে উঠতে শিবনাথের কেমন যেন মাথা ঝিমঝিম করছিল। সেখানে সে ফিরে যাচ্ছে।

মন খারাপ করে বাসের বাইরে চোখ রেখে চুপ করে বসে রইল শিবনাথ। ধৈর্য ধারণ করা ছাড়া এখন তার কাছে আর কিছুই নেই, সুযোগ এবং সময় যতদিন না আসে। না কি আজ সে পারিজাত ও তার স্ত্রীর সঙ্গে দেখা করতে যাচ্ছে এখান থেকেই সুসময়ের আরও। এই সুযোগ? সিগারেট খেতে ভীষণ ইচ্ছা হ’ল শিবনাথের। কিন্তু সঙ্গে আর নেই বলে তৃষ্ণাটা দমন করল। যেন বেলেঘাটায় ফিরে যাওয়ার মত এখন এই ব্যাপারে সে নিরুপায়। উপমাটা মনে পড়তে শিবনাথ নিজের মনে হাসল, কিন্তু হাসিটা তার তৎক্ষণাৎ থেমে যায়। হাঁ ওটাই ক্যাম্বেল ‘হাসপাতাল। গাড়ি চাপা পড়ে, ঠ্যাং ভেঙে কে. গুপ্তর ছেলে ওই লাল বাড়ির কোনও এক কামরায় শুয়ে আছে। ঘটনাটা যতই মর্মান্তিক হোক শিবনাথের পক্ষে অপ্রীতিকর, অশুভ। দু’দিন আগে হতে পারত, পরে হতে পারত দুর্ঘটনা। আধ মিনিট সময় স্টপেজে বাস্ দাঁড়ায় আর আধ মিনিট সময়ই হাজারটা দুশ্চিন্তায় শিবনাথের মন কালো হয়ে যায়। হাজার দুর্ভাবনা এসে ভিড় করে দাঁড়ায় সামনে।

ব্যাপারটা সেখানেই চাপা পড়ে আছে না পারিজাতকে নিয়ে টানাটানি হচ্ছে? অবশ্য বেলা দশটা পর্যন্ত এই নিয়ে সাড়াশব্দ বা উচ্চবাচ্য হয়নি পাড়ায় শিবনাথ দেখে এসেছে। কিন্তু দুপুরের পর, এবেলা, এখন?

স্টপেজ ছেড়ে বাস্ হাসপাতাল পিছনে রেখে চলতে আরম্ভ করার পর তবে শিবনাথ স্বস্তিবোধ করে। কিছুই হয়নি, কিছুই হবে না। ভাবতে চেষ্টা করল সে। তা ছাড়া রমেশ রায় যে আসলে পারিজাতের হয়ে মিথ্যা সাক্ষ্য দিচ্ছে তার প্রমাণ কি? ইনফ্লুয়েঞ্জা? গাড়ির ভিতর পঞ্চাশটা মুখের দিকে যেন কতক্ষণ হাঁ করে একদৃষ্টে তাকিয়ে থেকে শিবনাথ ইনফ্লুয়েঞ্জার লক্ষণ কি, রোগ কতটা প্রবল হয়ে পীড়িত ব্যক্তি শয্যা নেয়, ঠিক কত দিন কত ঘণ্টা শুয়ে বিশ্রাম নেবার পর আবার সে কর্মক্ষম হয়, কথা বলে, হাঁটে, কাজ করে এবং নিজের গাড়ি থাকলে তাতে চেপে বেড়াতে বেরোয় ইত্যাদি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে শিবনাথ চিন্তা করল বৈ কি।

.

একটা দু’টো কথা কয়ে শিবনাথ স্তব্ধ হয়ে গেল। দীপ্তির ব্যবহারে বিস্মিত হ’ল।

চারিদিকে তাকিয়ে ঢোক গিলে পরে সতর্কভাবে প্রশ্ন করল, ‘তিনি কি তা’লে আজ একেবারেই ফিরছেন না?’

‘না।’

শিবনাথ চুপ ক’রে রইল।

পারিজাতের বাচ্চারা সামনের লনে হুটোপুটি করে খেলা করছে। অদূরে গ্যারেজের সামনে দাঁড়িয়ে মদন ঘোষ মেথরকে দিয়ে গ্যারেজের ভিতরটা সাফ করাচ্ছে, তেল মাখা তুলো, কালিভুসো মাখা ন্যাকড়ার পিণ্ড।

গাড়ি নেই। গাড়ি নিয়ে পারিজাত সেই সকালে আরামবাগ চলে গেছে। সামনে ইলেকশন। সেখানে তার রাজনৈতিক বন্ধুদের সঙ্গে পরামর্শ চলেছে রাতদিন।

দীপ্তি তার লাল ফোলা ফোলা চোখ তুলে বলল, ‘আপনারা ভাবেন রায় সাহেবের বাড়ির বৌ দীপ্তিরাণী অগাধ সুখে ডুব মেরে আছে। এখন সুখটা দেখে যান।’

শিবনাথ চোখ নামাল।

‘আপনি কি মনে করেন আমিও খুব বেশি ভাবি ছেলেমেয়েদের লেখাপড়ার জন্যে, একটুও না। যেদিন এ বাড়িতে বিয়ে হয়ে পা দিয়েছি, সেদিন জেনেছি এখানে আমার গর্ভে যে-সব সন্তান জন্মগ্রহণ করবে, তারা আর যা-ই করুক, লেখাপড়া শিখে সাধারণ মানুষের মত থাকতে চাইবে না।’

দীপ্তি বারান্দায় পায়চারি করতে থাকেন। ‘এ্যাঁ, আমার বেলায় দোষ, আমি মন্টু আর মন্টুর বন্ধুদের নিয়ে ব্যাডমিন্টন খেলি, আর লেকের জলে নৌকা ভাসাই। এখানে এসে তো পর পর আমি অনেকগুলো রিপোর্ট পেলাম। আরামবাগের কুঞ্জে যখন বোতল আর পলিটিক্স চলে তখন ষোল আর সতেরো বছরের দু’টি নাবালিকা এক একটি বুড়ো ধাড়ির মুখের কাটলেট কেড়ে খায়।’

দীপ্তি ঠিক শিবনাথের দিকে তাকায় না, পায়চারি বন্ধ ক’রে হঠাৎ দাঁড়িয়ে পড়ে বারান্দার লাগোয়া একটা স্বর্ণচাপা গাছকে লক্ষ্য ক’রে তর্জনী তুলে প্রায় চিৎকার করে বলেন, ‘তার চেয়ে একশগুণে ভাল মন্টুরা, আমাদের পাড়ায় বড়লোক ছেলেরা পলিটিক্স-এর মুখোশ পরে রাত্রে প্রস্টিটিউট নিয়ে ফুর্তি করে না। তারা ঘরে থাকে। খাঁটি গৃহস্থের জীবনযাপন ক’রে সংসারের সুখদুঃখ ভালবাসা বিচ্ছেদকে অনুভব করে। তারা অনেক বেশি ভদ্র, নিরীহ। তোমাদের মত নারীমাংসলোলুপ কুকুর নয়। রাতারাতি যারা বড়লোক হয় তারা, তাদের ছেলেরা এই শ্রেণীর আমি কি জানতাম না, আমি কি তখনি চিন্তা করিনি–’

হঠাৎ এত জোরে দীপ্তি চিৎকার করে উঠল যে শিবনাথ হতভম্ব হয়ে গেল, ভয় পেল।

বাইরে শিশুগুলো খেলা ফেলে ছুটে এসে সিঁড়ির কাছে থমকে দাঁড়াল। গ্যারেজ ঝাঁট দিচ্ছিল ঝাড়ুদার, চমকে মুখ তুলে এদিকে তাকাল। আস্তে আস্তে সামনে এসে দাঁড়াল বাড়ির সরকার মদন ঘোষ। তো আপনি এদের সামনে এসব বলছেন কেন, এরা বাবুর প্রজা, ভাড়াটে। এতে তো আপনারও সম্মান যাবে। আপনি ভিতরে গিয়ে একটু বিশ্রাম করুন।’

মদন ঘোষ শিবনাথের দিকে তাকাল। শিবনাথ নীরবে মুখ নামিয়ে হাতের নখ খুঁটতে লাগল।

দীপ্তি চুপ করলেন। কিন্তু ক্রোধ চাপতে গিয়ে বুকটা একবার পাহাড়ের মত উঁচু হয়ে উঠে তারপর লম্বা একটা নিশ্বাসের সঙ্গে সেটা নেমে গেল। শিবনাথ লক্ষ্য করল।

যেন মা এক্ষুণি আবার উত্তেজিত হচ্ছে না, চেহারা দেখে বুঝতে পেরে বাচ্চারা এবার সাহস করে ঘাস ছেড়ে বারান্দায় উঠে মার হাত ধরে বলল, ‘আমরা খাব মা, আমাদের খিদে পেয়েছে।’

ওদের হাত ধরে নিঃশব্দে দীপ্তি ভিতরে চলে গেলেন। ফুল ও পাখি-আঁকা-পর্দাটা শিবনাথের চোখের সামনে দুলতে থাকে।

.

শিবনাথের স্ত্রী উচ্চশিক্ষিতা, ইস্কুলে চাকরি করছেন, এই হিসাবে মদন ঘোষ গোড়া থেকেই শিবনাথকেও একটু সমীহ করে আসছে। মদন চোখের ইশারায় শিবনাথকে ডাকতে সে উঠল এবং সরকারের সঙ্গে বেরিয়ে রাস্তায় নেমে এল।

‘কি ব্যাপার?’

গলা পরিষ্কার করে শিবনাথ প্রশ্ন করতে মদন ঘোষ অল্প শব্দ করে হাসল।

‘ব্যাপার তো চোখে দেখে এলেন। কানে শুনলেন স্যার।

‘কিন্তু আমার সেই ব্যাপারের কিছু যে–’

শিবনাথ চিন্তিত এবং চাপা গলায় সে কথাটা তুলতেই মদন মাথা নাড়ল ও খুক্ করে কাশবার মতন শব্দ করে হেসে নিকেলের চশমার ফাঁক দিয়ে আড়চোখে আর একবার পারিজাতের বাংলোর দিকে তাকিয়ে নিয়ে শিবনাথের কাছে মুখটা সরিয়ে আনল। ‘মশাই, আপনি দেখছি, ওই যে কথায় বলে উনুনে হাঁড়ি চাপিয়ে চাল কিনতে এলাম বাজারে, সবুর সয় না।’

শিবনাথ লজ্জিত হয়ে চুপ রইল।

‘রাগ করলেন।’ মদন নিজেও লজ্জা পেল যেন বেমক্কা কথাটা বলে ফেলে। খাতির দেখাবার জন্য একটা হাত শিবনাথের কাঁধের ওপর রাখল। শিবনাথ রাগ করল না বা হাতটা সরাল না। টের পেয়ে মদন ঘোষ হেসে বলল,–

–‘মশাই, বড়লোকের বাড়ির কাজ, বুঝতে পারছেন না? আপনাকে তিনি কি বললেন? কর্তা আরামবাগে গেছেন, কখন ফিরবেন জানি না–এই তো?’

শিবনাথ ঘাড় নাড়ল।

‘মশাই, কাল থেকে ভয়ানক হুলস্থুলু বাড়িতে। হ্যাঁ, আণ্ডাবাচ্চাগুলোর প্রাইভেট মাস্টার রাখা নিয়ে। কর্তা চাইছেন এখানকার লেখাপড়া জানা লোককে দিয়ে কাজ চালাতে, গিন্নীর শখ তাঁর ও-পাড়ার মানে বালিগঞ্জের ছোকরা কেউ এসে পড়াক।’

একটা তিক্ত ঢোক গিলে শিবনাথের প্রশ্ন করল, ‘তাই নাকি, তা কিছু মীমাংসা হ’ল এর?’

‘জানি না,’ তেমনি বিরসকণ্ঠে মদন বলল, ‘শুনছিলাম সকালে চায়ের টেবিলে রসে দু’জনার ঝগড়া। আরে মশাই, আপনি শিক্ষিত মানুষ আমাদের বস্তিবাড়িতে, আপনাকে বললে কথাটার মানে ধরতে পারবেন। অর্থাৎ আসলে বড়মানুষ হলে কি হবে। এঁরা আমাদের মতন গরিবলোকের ঘরে যে-সুখ আছে, তার ছটাকও পায় না। মশাই বললে বিশ্বাস করবেন না, বাচ্চাগুলোর সামনেই, তর্কাতর্কি করতে করতে দু’জন দু’জনকে মারতে রুখেছিল।’

অধৈর্য হয়ে শিবনাথ বলল, ‘তা তো হবেই, এখানে আইডিয়ার প্রশ্ন। দু’জনেই বড় মানুষের সন্তান। কেউ কারো কাছে নিচু হতে চায় না। তারপর, ঝগড়ার শেষে কি স্থির হ’ল? কর্তা রাজী হলেন বালিগঞ্জের মন্টু ব্যানার্জিকেই আমদানি করতে?’

‘ক্ষেপেছেন?’ ঝুপ্ করে আবার মাথাটা নিচু করে মদন ফিসফিস করে বলল, ‘আপনার হাত ধরে বলছি মশাই, কাউকে যেন কথাটা প্রকাশ করবেন না।’

‘ক্ষেপেছেন?’শিবনাথ বলল, ‘আমাদের কি, ওরা ঘরে বসে এ-কারণে সে-কারণে রাতদিন ঝগড়া কি মারামারি করুক। আমরা তৃতীয় লোক, কেন সে-সব প্রকাশ করতে যাব, শুনি কি ব্যাপার?’

‘আর, ব্যাপার!’ মদন ঘোষ এবার নাকে শব্দ করে হাসল। তো আমি অবশ্য বৌদিমণির তেমন দোষও দেখি না, দেখছেন তো, এতগুলো বাচ্চার পরও যৌবন যেন এখনো সারা শরীরে খিলখিল করে হাসছে। তা আরামবাগের আমোদ-ফূর্তির কথাটি জেনেছেন পর থেকে তো আর কথাটিই নেই। তিনিও সুবিধা পেয়েছেন। মন্টুকে এখানে এনে রাখতে পারিজাতের যদি আপত্তি তো সে-ও আরামবাগে যাতায়াত বন্ধ রাখুক, গিন্নীর এই শর্ত।’

‘এই নিয়ে বুঝি সকালে খুব একচোট–’

‘হ্যাঁ, মশাই হ্যাঁ, প্রায় চুল ছেঁড়াছিঁড়ি। তা উনি জেদ ক’রে করবেন কি। বলে কিনা যার জোরে পারিজাতের জোর, রাজনীতির আসরে গদি পেতে যার তোয়াজ না করলে রায়সাহেবের ছেলে কালই গলা জলে ডুবে যাবে, বৌয়ের বায়না সে শুনবে কেন। আরামবাগের শশাঙ্ক বাগচির নাম শোনেন নি? তেরো বার জার্মানীতে আর ন’বার রাশিয়ায় ঘুরে এসেছে? যার দাপটে এখন এদেশের ঘাটে ঘাটে বাঘে-গরুতে একত্র জল খায়।

‘কি জানি, কাগজে হয়ত দেখে থাকব নাম,–তেমন চিনি না।’

‘তা চিনে কাজ নেই আমার-আপনার। এখন কথা হচ্ছে বৌদিমণি যতই রাগারাগি ঝাঁপাঝাঁপি করুক, শশাঙ্ক বাগচির আরামবাগের পার্টিতে গিয়ে দুচার পাত্র গলায় না ঢেলে একটু ইয়েটিয়ে নিয়ে ফুর্তিটুর্তি না করে পারিজাত এখানে বসে বৌয়ের মান ভাঙাবে সে ছেলেই নয়। আমি তো কর্তার আমল থেকে এবাড়িতে–’

অস্বস্তি বোধ করছিল শিবনাথ কিন্তু মদন ঘোষ তা গ্রাহ্য না ক’রে বলল, ‘এটা ভাল, আমি এইজন্য পারিজাতের প্রশংসা করি, মশাই, মেয়েমানুষকে যে-পুরুষ আস্কারা দেয়, জীবনে তার উন্নতি নেই–হা-হা। খাওয়া পরা কোটির অভাব রাখছে পারিজাত যে বৌদিমণির এই আটেপনা?’

‘আমাকে তা হলে এখন কি করতে হবে,–কাজের কথাটা যে ভাল করে তোলাই হ’ল না।’

‘হবে হবে, তাই তো বলছিলাম মশাই, দুটো দিন যেতে দিন, রাগটা একটু পড়ুক। বাচ্চাদের মাস্টার তো রাখতেই হবে। মন্টু ব্যানার্জি এখানে আসছে না আপনি ধরে রেখে দিন।’

একটা আমগাছের নিচে দাঁড়িয়েছিল দুজন। অন্ধকার হয়ে গেছে। ঘাড় ফিরিয়ে শিবনাথ একবার রায়সাহেবের বাড়িটা দেখল। সেখানে তেমন ভাল আলো-টালো যেন জ্বলছে না আজ।

‘কে. গুপ্ত এসেছিল তিনি পছন্দ করলেন না, বিধুমাস্টার এসেছিল তিনি পছন্দ করলেন না।’

‘আমাকেও তো মনে হয়–’ শিবনাথ অস্ফুটস্বরে বলতে যাচ্ছিল, মদন ঘোষ মাথা নড়ল ‘তা কি আর বারবার এসব চলে, উঁহু পারিজাত তো মশাই আজ পষ্টাপষ্টি বলে গেল শুনলাম, যদি এখানকার কাউকে মাস্টার রাখা হয় ভাল, না হয় বাচ্চাদের আর লেখাপড়া শেখাবে না সে, একটু বড় হলে সবগুলোকে কারখানায় ঢুকিয়ে দেবে।’ কথা শেষ করে মদন হাসল।

শিবনাথ একটা চাপা নিশ্বাস ফেলল।

‘তাতে আপনার বৌদিমণি কি বললেন?’

‘কি আর বলবেন, পারিজাত গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে যাবার পর খুব খানিকটা হৈ-চৈ করলেন, চুল আঁচড়াতে গিয়ে চিরুনি ভাঙলেন, বাচ্চাগুলোকে মারধর করলেন, টেবিলের ফুলদানিটা ভাঙলেন, কাঁচের গ্লাস ছুঁড়ে মারলেন দু’বার দুটো।’

‘খুব অশান্তি এদের মধ্যে,’ শিবনাথ বলল, ‘মাঝখান থেকে ছেলেমেয়েগুলোর কষ্ট।’ তাই তো বলছিলাম স্যার–আমরা খাটো কাপড় পরে শাকভাত খেয়ে এর চেয়ে ঢের বেশি শান্তিতে আছি, অনেক বেশি সুখে আছে আমাদের বাচ্চারা।’

‘আমি কি পরে আর একবার এ-বাড়িতে এসে দেখা–’

হ্যাঁ, সে কথাই তো আপনাকে বলতে এখানে ডেকে নিয়ে এলাম, স্যার। আপনি এর মধ্যে নিরাশ হয়ে পড়েছেন দেখে অবাক লাগছে। শুনুন শুনুন, কথায় বলে বাড়ির গরু ঘাটের ঘাস খায় না, তা খাবে, পারিজাত শক্ত ছেলে, কে. গুপ্ত কি বিধুঁকে পছন্দ হয়নি বলে যে গিন্নীর কাছে নিত্য নূতন মাস্টার এনে হাজির করাবে সে পাত্রই সে নয়। বললাম তো বাড়ি থেকে বেরোবার আগে কি মোক্ষম কথাটাই আজ সে শুনিয়ে গেল গিন্নীকে–হা-হা। তা ছাড়া গলার স্বরটাকে হঠাৎ খাদে নামিয়ে মদন বলল, ‘তা ছাড়া আপনাকে যে বৌদিমণির খুব একটা অপছন্দ হয়েছে আমার কিন্তু মনে হয় না।’

‘কি রকম?’ এই প্রথম আশার আলোকবর্তিতা দেখল যেন শিবনাথ। প্রকাণ্ড একটা ঢোক গিলে মদনের মুখের দিকে হাঁ ক’রে তাকাল।

‘বড় চাকরি পেয়ে ভুবনবাবুর মেয়ে বীথি সমিতির সেক্রেটারীর পদ ছেড়ে দিতে চাইছে। দিয়েছে। কাল পদত্যাগপত্র পাঠিয়ে দিল এবাড়ি। এখন সেই পদের জন্য লোক খোঁজাখুঁজি হচ্ছে। কাল সন্ধ্যেবেলা বৌদিমণির হঠাৎ আপনার স্ত্রীর কথা আমায় জিজ্ঞেস করলেন, বলছিলেন তাঁকে দীপালী সঙ্ঘের সম্পাদিকার পদটা নিতে অনুরোধ করা যায় কিনা, তাঁর কি সময় হবে। যদিও অনারারী পোস্ট, তা হলেও–’

পর পর দুটো ঢোক গিলে শিবনাথ বলল, ‘কি বললেন আপনি?’

‘হেঁ হেঁ, আমি তো মশাই কত বড় সার্টিফিকেট দিলাম, তা আপনি যদি তখন কাছে থাকতেন নতে পেতেন। আমি বললাম, ‘এইরকম একটা দায়িত্ব-সম্পন্ন কাজের ভার যারা সত্যিকারের ক্ষিতা, ভদ্র এবং উন্নতমনা–সেই সব মেয়েদের হাতে ছেড়ে দেওয়া উচিত। বললাম, আট স্বরের বস্তি কেন, এ তল্লাটে এমন উপযুক্ত লোক আছে কি না সন্দেহ।’

‘কি বললেন তিনি?’ রুদ্ধস্বরে শিবনাথ প্রশ্ন করল, ‘এ সম্পর্কে কি দীপ্তিরাণী কিছু সেটেল্ রলেন, মানে পাকাপাকি কোন সিদ্ধান্ত?’

‘না হয়নি করা, যদ্দুর মনে হল, তারপরই শুরু হ’ল কি না প্রাইভেট টিউটার রাখা নিয়ে মগড়া,–হবে, হয়ে যাবে, আমি খুব করে বলে দিয়েছি আপনার স্ত্রী সম্পর্কে।’

এতক্ষণ পর শিবনাথ পকেট থেকে সিগারেটের প্যাকেট তুলল। ‘চলবে নাকি একটা সরকার মশাই।’ একটা সিগারেট মুখে গুঁজে শিবনাথ প্যাকেটটা মদন ঘোষের দিকে বাড়িয়ে দেয়।

‘সিগারেট আবার কেন, আমি তো বিড়িতেই সন্তুষ্ট মশাই। দিশি জিনিস। তা দিন, আদরের ধন ঠেলতে নেই।’

সিগারেট ধরিয়ে মদন ঘোষ বলল : ‘এই বেলা দামী কথাটা বলছি শুনুন। হাল ছাড়বেন না। চুলে পাক ধরেছে মশাই আমার, তা ছাড়া অনেকদিন তো হয়ে গেল এ বাড়ির চাকরি, হাবভাব, রকমসকম দেখে পারিজাত কি তার গিন্নীর, এমন কি বাচ্চাগুলোর চরিত্রও কিছু কিছু বুঝতে শিখেছি। ঠিক হয়ে যাবে আপনার এখানে দেখুন। কাল আপনার স্ত্রীর কথা জিজ্ঞেস করলেন, আজ আপনি এখানে পা না দিতে কেমন ঝরঝর করে কেঁদে ফেলে হৃদয়ের কথাগুলো বলে ফেলল। বড়লোকের বাড়ির মেয়েদের দস্তুরই ওটা যদিও মশাই, তারা, আমি অর্থাৎ বাড়ির সরকার কাছে থাকলে তার কাছে, চাকর বাকর কি বামুনঠাকুর থাকলে তাদের কাছে, আরদালি-পিওন কি বাড়িতে মাস্টার থাকলে তার কাছে, অক্লেশে মনের কান্না বলে যায়। মানে আপনপর জ্ঞানই কম। পুরুষ হলেই হল। ওকি আপনি মাথা নোয়াচ্ছেন কেন? না না মশাই, এটা যে আমি মনিব-পত্নীর নিন্দা করছি তা না, আপনি ভেবে দেখুন, তারা তোয়াক্কা করে না সুনামের। ধরুন কাল যদি দীপ্তিরাণী এই আস্তানা ছেড়ে বাপের বাড়ি চলে যান তো আর আপনার তেমন সুযোগ আসবেই না। কি মাইনের কথাও যদি ওঠে আমি বলতে পারি পারিজাত বারো বারো চব্বিশ আর বলে-কয়ে যদি ত্রিশ করা যায় তো ঐ। আর কিছু না। এক বাটি চা না। আর আপনি যদি অন্দরমহল দিয়ে ঢোকেন, হাঁ, বৌদিমণির কথা বলছি, তাঁর মন ভিজিয়ে কাজটি বাগিয়ে ফেলতে পারেন তো পঞ্চাশ টাকা মাইনে ঠিক করবেন উনি আপনার। রোজ চা পাবেন হালুয়া পাবেন। টিফিন,–বিকেলে গেলে গরম সিঙাড়া খেতে পাবেন। মশাই, চুলগুলো পেকে গেছে। তা ছাড়া আই-এ, বি-এ পাশ করিনি। বিদ্যে কম মাস্টার হবার যুগ্যি নই। নয়তো এই সুযোগ আমি হাতছাড়া করতুম নাকি।’

‘না, ব্যারিস্টার যেখানে ক্যান্ডিডেট্।’ শিবনাথ স্বগতোক্তির মত খেদ প্রকাশ করে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। ‘আমার হবে না।’

‘আরে ধ্যেৎ মশাই, ব্যারিস্টার! ব্যারিস্টার রাখবার পারিজাতের এখন ক্ষমতা কই।’ মদন ঘোষ আচমকা ধমক দিয়ে উঠল। ‘ইলেক্‌শন ইলেক্‌শন করে ও এখন পাগল। জলের মত টাকা ঢালছে শশাঙ্ক বাগচির পায়ে। মদে আর মেয়েমানুষে দুজনে লেপালেপি। আপনি মশাই সুরৎ করে এই ছিদ্র দিয়ে বাড়িতে ঢুকে পড়ুন। আপনার কাছে আজ যেমন মনের কথা খুলে বলেছে, এমন আর কারো কাছে বলতে শুনিনি বৌদিমণিকে। তাই বলছি আপনার হবে। কেন বলছি বুঝতে পারছেন? জমিদার বাড়ির সরকারি করে খাই মশাই, মাথায় বৈষয়িক বুদ্ধি একটু রাখি। কই বার করুন তো আর একটা সিগারেট।’ সরকার এবার গুজগুজ করে হাসল।

শিবনাথ নিঃশব্দে প্যাকেটটা তার হাতে তুলে দিল।

সিগারেট ধরিয়ে মদন ঘোষ বলল, ‘কে. গুপ্তটা পাগল, বিধুটাকে দেখলে এখন জঙ্গল থেকে উঠে এসেছে বলে মনে হয়। এই বড় বড় চুল মাথায়, দাড়ির ঝোঁপ মুখে। আচ্ছা মশাই, আপনাদের বাড়ির বীথিরাণী কি চাকরিটি পেয়েছেন বলতে পারেন? এ্যাঁ, এটি দেখছি পোশাক-আশাকে আমার এবাড়ির বৌদিমণিকে টেক্কা দিতে চলল, কি মশাই, চুপ করে আছেন কেন কথা বলুন।’

শিবনাথ চুপ থাকলেও মদন চুপ করে রইল না। ‘আহা, তখন দেখলাম আপনার স্ত্রীকে। একেবারে ছেলেমানুষ। ইস্কুল সেরে বুঝি ফিরছিলেন। সঙ্গে মেয়েটি। না, আপনার মেয়ে মার মতন শরীরের গড়ন পায়নি, তেমন চেহারারই না। আহা, দেখে কষ্ট হচ্ছিল! আপনার একটা সুবিধাটুবিধা হয়ে যাক। একটা চাকর কি বাঁধা ঝি রাখবার অবস্থা হলে খুকির মার একটু এদিকের কাজের সুবিধা হয়, কি বলেন?’ বলে মদন ঘোষ প্যাকেট থেকে পরে খাবে বলে অতিরিক্ত একটা সিগারেট তুলে আস্তে আস্তে বাংলোর দিকে এগিয়ে চলল। ‘কথাটা, মনে রাখবেন কিন্তু।’ যেতে যেতে দু’বার ঘাড় ফিরিয়ে বলল ঘোষ। শিবনাথ ঘাড় কাত করল।

‘আমি বুড়ো হয়ে গেছি, গায়ে ইউনিভার্সিটির ডিগ্রী নেই’। ঝিঁঝির ডাকের মত দু’কানে কথাগুলো বাজছিল শিবনাথের। আমতলা পার হয়ে যে রাস্তায় নামল। জায়গাটা এখানেও অন্ধকার। পারিজাতের আম-জাম-সুপারির বাগান এই অবধি চলে এসেছিল বলে গাছের ঘন পাতার আড়ালে রাস্তার গ্যাসের ডোমটা ঢেকে গেছে।

শিবনাথ এখানে এসে আর একবার মন্টু-বিরহিণীর দীর্ঘশ্বাস ছাওয়া অন্ধকার পুরীর দিকে কতক্ষণ ফ্যাল্ ফ্যাল্ করে তাকিয়ে থেকে পরে সোজা পুবদিকে এগিয়ে চলল। যেন মদন ঘোষের বৈষয়িক বুদ্ধির কথা মনে হতে শিবনাথ এখানে অন্ধকারে দাঁড়িয়ে সেদিকে এখন কেবল চেয়ে থাকলে কাজ অগ্রসর হবে না, চিন্তা ক’রে আপাতত এক পাক চা খাওয়া ও বিশ্রাম করার উদ্দেশ্যে রমেশের চায়ের দোকানের দিকে লম্বা পা ফেলে হাঁটতে লাগল। চলতে চলতে সে পারিজাতের ছেলেমেয়েদের আজকের দুরবস্থার কথাটাই চিন্তা করল বেশি। আজ বাপমা’র মধ্যে প্রেম জমেনি বলে তাদের কেউ গাড়িতে নিয়ে বেড়াতে বেরোয়নি। বেচারারা অনাথা হয়ে সারাটা বিকেল লনে গড়াগড়ি করছিল। ওদের এক একটি প্রশ্নের ঠেলায় সেদিন শিবনাথ কেমন নাস্তানাবুদ হয়েছিল, তা-ও এখন মনে হ’ল। আর মনে হতে নিজের মনে হেসে সিগারেটের শূন্য প্যাকেটটা ছুঁড়ে রাস্তার পাশে ফেলে দিল। মদন শেষ সিগারেটটি তুলে খালি বাক্সটাই শিবনাথের হাতে ফিরিয়ে দিয়েছিল।

২৯

রাস্তায় শিবনাথকে শেখর ডাক্তার আটকায়, তার ডিসপেনসারীর দরজা হনহন করে সে পার হচ্ছিল।

যেন ডিস্পেনসারীর ভিতর চেয়ারে বসা ছিল ডাক্তার। শিবনাথকে দেখে লাফিয়ে রাস্তায় নামল। ‘আপনাকেই আমি খুঁজছি মশায়, সেই সন্ধ্যা থেকে। কোথায় ছিলেন সারাদিন? ছুটি ফুরিয়ে গেছে নাকি?’

হাতটা ছাড়িয়ে নিয়ে শিবনাথ, যেন অনেকটা ধৈর্য সংবরণের মত গলার স্বর গম্ভীর করে আস্তে আস্তে বলল, ‘কেন? আমাকে আপনার কিসের দরকার?’

‘অনেক দরকার মশায়, এক জায়গায় আছি, এক বাড়িতে খাওয়া-শোয়া হয় দু’জনের, সকালে ঘুম ভাঙিলেই দরজা খুলে আপনার মুখদর্শন। আপনাকে এড়িয়ে চলবে সেই সাধ্য কোথায়? আসুন তামাক খেয়ে যান।’

যেন ডাক্তার বুঝতে পেরেছেন এভাবে ছুটে এসে হঠাৎ হাত চেপে ধরায় শিবনাথ রুষ্ট হয়েছে। একটু লজ্জা পেয়ে শেখর প্রশ্ন করল, ‘বিশেষ ব্যস্ত নাকি?

‘না।’

শিবনাথ অন্যদিকে ঘাড় ফিরিয়ে কথা বলল। অর্থাৎ বিরক্তি গোপন করল। তবে স্যার ভিতরে আসুন, বড় বিপদে পড়ে গেছি, আপনার সঙ্গে একটু কনসাল্ট করার দরকার হয়ে পড়েছে।’

হঠাৎ এ-রকম করুণ স্বর শুনে শিবনাথ চমকে উঠল। ‘কি হয়েছে আপনার?’ঘাড় ফেরাল সে ডাক্তারের দিকে।

‘আসুন স্যার, ভেতরে আসুন। না বসে বলতে পারব না।’ শেখর আবার শিবনাথের হাত ধরল।

শিবনাথ বুঝল নিছক বসে গালগল্প করতে লোকটা ছুটে এসে তার হাত চেপে ধরেনি। একটা উঠোনের ওপর আছে সেই আত্মীয়তার দাবীতে বিপদে পরামর্শ চাইতে তাকে হিড়হিড় করে টেনে নিয়ে যাচ্ছে।

‘বসুন বসুন।’ ডাক্তার ঘরে ঢুকে একটা চেয়ার দেখিয়ে দিল। শিবনাথ এই প্রথম ডিস্পেনসারীর ভিতর ঢুকল। চেয়ারটা দেখিয়ে দিয়েই ক্ষান্ত হ’ল না শেখর। নিজের কাপড়ের খুঁট দিয়ে ধুলো মুছে দিল। ‘বসুন।’

চেয়ারে বসে লক্ষ্য করল শিবনাথ টেবিল, আলমারির কাঁচ, এমন কি ঘরের দেয়ালগুলো পর্যন্ত ধুলোয় আচ্ছন্ন

‘এত ধুলো আসে কোথা থেকে?’

‘রাস্তার। শালার রাতদিন লরী আর মোষ চলছে। আমরা কি আর এখানে মানুষের মত বাস করছি!’

ডাক্তারের এই উক্তিতে শিবনাথ কিছু মন্তব্য করল না। আলমারির মাথায় বসানো টাইমপীসটায় সময় দেখছিল সে। সেটাও ধুলোতে ঢাকা। ময়লা কাঁচের মধ্য দিয়ে অনেক কষ্টে সে সময়টা দেখতে পেল। সাতটা দশ।

সময় দেখে শিবনাথ এদিকে ঘাড় ফেরাল।

‘কি বলুন?’

যেন ডাক্তার মাটির দিকে তাকিয়ে কি ভাবছিল। যখন মুখ তুলল শিবনাথ দেখে বুঝল লোকটি খুবই চিন্তান্বিত।

কিন্তু ডাক্তারের দিক থেকে সরে তৎক্ষণাৎ তার দৃষ্টি বা-দিকে চলে গেল কোনার দিকে বেঞ্চটায় একটি ছেলে বসে আছে মুখে গুঁজে। জায়গাটা একটা বাক্সের আড়ালে আছে বলে অন্ধকারমতন। এতক্ষণ পর শিবনাথ ছেলেটিকে দেখতে পেয়ে চিনল।

‘এর নাম সুধীর। আমাদের বাড়িতে দেখেছেন।

ডাক্তারের দিকে চোখ রেখে শিবনাথ মাথা নাড়ল। ‘এবং ছেলেটি সম্পর্কে অনেক কথা কানে এসেছে আমার’–বলা উচিত ছিল শিবনাথের, কিন্তু বলল না। গম্ভীরভাবে শুধু আর একবার সুধীরের দিকে তাকাল।’

‘আর এঁর নাম শিবনাথবাবু, ইনি একজন গ্র্যাজুয়েট, তাঁর স্ত্রী গ্র্যাজুয়েট। হাইলি কালচার্ড ফ্যামিলী।’

ডাক্তার পরিচয় দিতে সুধীর হুট্ করে একবারটি শিবনাথের আপাদমস্তক লক্ষ্য করে ফের মাটির দিকে চোখ নামাল এবং পূর্ববৎ কাঠের মত স্থির ও শক্ত হয়ে চুপ করে বসে রইল। যেন চিন্তান্বিত না, সুধীর রাগান্বিত।

‘বাড়িতে আরো পাঁচটা লোক আছে।’ ডাক্তার সুধীরের দিক তাকাল না, শিবনাথের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘কিন্তু সেগুলোকে আমি কুকুর ভেড়ার মতন দেখি। কে. গুপ্তটার বেকার থেকে থেকে মাথা খারাপ। বিধুটা বাচ্চা পয়দা করে আর ছেলে ঠেঙ্গিয়ে নিজে একটা জন্তুতে পরিণত হয়েছে। পাঁচুটা মদে বেশ্যায় নিমগ্ন। বলাই মূর্খ, বুদ্ধি বলতে কিছু নেই। রমেশটা চোর, ওর ভাই ক্ষিতীশটা ডাকাত। অমলটা ছিল বৌ-পাগ্‌লা বাউণ্ডুলে, বৌ ছাড়া সাতও চিনত না পাঁচও চিনত না, আর বিমলটা ফাজিল চালিয়াত। কাজেই এদের কাউকে ডেকে এনে তো আর আমি এ-মামলার বিচারক সাজাতে পারি না, এদের কি-ই-বা বুদ্ধি বিবেচনা, আর আমায় পরামর্শই বা দেবে কি ছাই। তাই অনেক চিন্তা করে আপনাকে ডাকলুম।’

‘বলুন।’ শিবনাথ আর একবার ধুলোর পলেস্তারার ভিতর দিয়ে ঘড়ির কাঁটা দুটো দেখতে চেষ্টা করল।

‘আমি পারব না শিবনাথবাবু, আপনি বলুন, আপনি চেষ্টা ক’রে যদি এই মূর্খকে বোঝাতে পারেন যে, নিজের ব্লাড শুদ্ধ কি অশুদ্ধ এটা জেনে নিয়ে বিবাহ এবং তারপর স্ত্রীর সঙ্গে সম্পর্কে স্থাপন করার প্রশ্ন এখানে ওঠে কি না?’

‘কি ব্যাপার?’ শিবনাথ এই প্রথম শুনছে এসব কথা, মুখের এমন ভান করে অত্যধিক গম্ভীরভাবে আড়চোখে আর একবার সুধীরকে দেখে নিল।

‘এটি আপনার কে হয়?’

‘দূর সম্পর্কে শালা,’ ডাক্তার মাথা নেড়ে বলল, ‘অবশ্য এই আত্মীয়তায় বিবাহ আটকায় না। কিন্তু যে স্থলে তোমার এমন একটা মারাত্মক ব্যাধি ছিল, এখন সেটা থেকে সম্পূর্ণরূপে মুক্ত হয়েছে কিনা, আমার মেয়েকে তোমার হাতে তুলে দেবার আগে একথা জানবার রাইট আমার আছে কিনা আপনি বলুন, আপনি এই মহামান্য জ্ঞানীগুণী আসামের শিলচর নিবাসী সুধীরবাবুকে বলে বোঝান

‘কি রোগ?’ শিবনাথের মুখ দিয়ে বেরিয়ে পড়ল এবং আড়চোখে আরো একবার সুধীরকে দেখল।

‘অতি বিশ্রী রোগ।’ শেখর ডাক্তার ঘৃণায় মুখ বিকৃত করল। ‘মশাই, ভাগ্যিস পামারবাজারের ইয়ে ডাক্তার আমায় খবরটি বলল–’

‘আপনি যা-তা কথা বলবেন না, আমি বলে দিচ্ছি। ওধারে থেকে যেন বারুদের মত জ্বলে উঠল সুধীর। আমার কোনোদিন এসব অসুখ ছিল না। ইয়ে ডাক্তার মিথ্যাবাদী।’

‘কিন্তু সেইজন্যেই তো বলেছিলাম, বাপু একটা ব্লাড এগজামিন করিয়ে নাও, তাতে তোমার আপত্তি কি?’ শেখরও জোরে ধমক দিয়ে উঠল সুধীরকে।

‘বেশ তো! যদি মনে করেন আমার ইয়ে ব্যারাম আছে, আমি আসব না, আমি তো চাই না আপনার বাড়ীতে আসতে, আপনারা ডাকেন।’

যেন রাগটা চাপতে শেখর কতক্ষণ গম্ভীর হয়ে থেকে পরে প্রশ্ন করল, ‘কে ডাকে তোমাকে শুনি?’

‘সুনীতি, সুনীতির মা।’সুধীর পকেটে হাত ঢুকিয়ে যেন কি খুঁজছিল। ‘এই দেখুন কালকে সকালে আপনার ওয়াইফ চিঠি দিয়েছে : ‘ভাই সুধীর, বিকেলে সময় পেলে একবারটি অবশ্যই এসো। তোমার জন্যে পেঁপের মোহনভোগ তৈরী ক’রে রেখেছি।’ বলে সুধীর পকেট থেকে ডাকঘরের ছাপমারা একটা খাম বার করল। ‘দেখুন বিশ্বাস না হয়।’

প্রভাতকণার হাতের লেখা। শেখর ডাক্তার দূর থেকে দেখে চিনল। খামটি আর হাতে নিল না। যেন আর একটু কি ভেবে পরে বলল, ‘না, আর চিঠি যাবে না, আমি ওদের সব বলে দিয়েছি, হ্যাঁ, সুধীরের ইয়ে আছে—’

আর বসে থাকা প্রয়োজন মনে না ক’রে যেন সুধীর বেঞ্চ ছেড়ে উঠে দাঁড়াল। একটু সময় গুম মেরে থেকে পরে ডাক্তারের দিকে কটমট ক’রে তাকিয়ে বলল, ইডিয়েট, আপনাকে একটা ইডিয়েট পেয়ে পামাররাজারের ইয়ে ডাক্তার ধাপ্পা মেরেছে- ব’লে পরে মুখটাকে বিকৃত ক’রে সুধীর হাসল।

‘বটে!’ শেখর ডাক্তার তেলে-বেগুনে জ্বলে উঠলো। ‘কী স্বার্থ তার! তোমার নামে ভদ্রলোক কি খামোকা?–যা ফ্যাক্ট তাই বলেছেন।’

‘স্বার্থ আছে বৈকি।’ প্রকাণ্ড একটা ঠাট্টা দুই ঠোঁটে ধরে রেখে সুধীর হাতের আঙুল দিয়ে শূন্যে একটা ছবি আঁকল। ‘পামারবাজারের ইয়ে ডাক্তারের সুনীতিকে দেখে খুব পছন্দ হয়েছে। সেদিন যখন সুনীতিকে নিয়ে আমি সিনেমায় যাচ্ছি, বাসে আপনার সেই বিখ্যাত বন্ধুটির সাথে দেখা, তিনি বাসে উঠে আমাকে ধাক্কা মেরে সিটটা থেকে তুলে দিয়ে সুনীতির পাশে ব’সে পড়েন আর সারা রাস্তা সুনীতির ঘাড়ের ওপর হাত রেখে বললেন–মা মা, তুই আমার বাড়িতে একবারটি যাবি মা, আহ! তুই আমার বন্ধু শেখরের মেয়ে, আমার কত আদরের জন তৈার জ্যাঠাইমা তোকে দেখতে পাগল। কুলিয়া-ট্যাংরা থেকে পামারবাজার তো খুব বেশি দূরে না পাগলী–ইত্যাদি–’

বলে সুধীর খুক্ ক’রে হেসে ফেলল।

‘মিথ্যাবাদী, লায়ার! ইয়ে ডাক্তার কখনই এতবড় মেয়ের ঘাড়ে হাত রেখে কথা কইবে না। তুমি স্কাউন্ডেল, এমন বানানো কথা বললেই আমি বিশ্বাস করব?’

‘স্কাউন্ড্রেল, ইডিয়েট’,সুধীরও চোখ লাল করল : ‘তুমি গিয়ে সুনীতিকে একবার জিজ্ঞেস করো, বুড়ো তার কাঁধে হাত রেখেছিল কিনা শেয়ালদা পর্যন্ত। গাড়ি থেকে নেমেই সুনীতি আমাকে কথাটা বলল।’ বলেই সুধীর সুনীতির মার নিমন্ত্রণপত্রটা পকেটে পুরে নতুন বার্মিজ স্যান্ডেলের মচ্ মচ্ আওয়াজ তুলে ও কড়া একটা সেন্টের গন্ধে ঘরের বাতাসকে ভারাক্রান্ত ক’রে দিয়ে বেরিয়ে গেল।

বেরিয়ে যাবার সঙ্গে সঙ্গে শেখর একটা নিঃশ্বাস ছেড়ে বলল, ‘দেখলেন তো কেমন গোঁয়ার, কী সব কথাবার্তা, ওই পাজি হারামজাদা হবে আমার মেয়ের জামাই, রাস্তার গুণ্ডার শ্বশুর হব আমি?’

শিবনাথ বলল, ‘আর আসবে না। ব’লে দিয়েছেন যখন লজ্জায় আর হয়তো-

‘ছাই বুঝেছেন আপনি। আপনি হারামজাদাকে কদ্দুর চিনলেন শিবনাথবাবু! আপনি আসবার আগে ও কী সব কথাবার্তা বলছিল আমাকে, শুনলে আপনি কানে আঙুল দিতেন! ‘

শিবনাথ মাথা নত করল।

‘আবার আসবে। ও আমার সর্বনাশ করতে বদ্ধপরিকর হয়ে এখানে মাথা ঢুকিয়েছিল।’

শিবনাথ চুপ ক’রে রইল।

ডাক্তার পায়চারি করছিল।

‘আবার আসবে। জানেন? আপনি আসবার আগে আমায় সে প্রেমতত্ত্ব শোনাচ্ছিল। বলছিল, আমি মূর্খ, বলছি সুনীতি যদি তার অসুখ আছে জেনেও তার পত্নী হ’তে স্বীকার করে তো আমি বাধা দেবার কেউ নই। সুনীতির বয়েস অনেকদিন আঠারো পার হ’য়েছে।

ঘড়ি দেখতে ঘাড় ফেরাতে শিবনাথ বেশ কিছুক্ষণ ছটফট করছিল, কিন্তু ডাক্তার এমন সব হৃদয়বিদারক কাহিনী শোনাচ্ছিল যে যেন অনেকটা লজ্জা ও ভদ্রতার খাতির সে একটু সময়ের জন্য ওদিকে তাকানো মুলতুবী রাখল এবং মনোযোগ সহকারে সুধীরের কাহিনী শুনল।

‘কিউপিড ইজ ব্লাইন্ড। হারামজাদা আমায় বোঝাচ্ছিল, আমি সেক্সপীয়র পড়িনি একটা অকাট মূর্খ। মেটিরিয়া মেডিকা মুখস্থ করা লোক মানুষের মনের কামনা বাসনার তথ্য বুঝতে পারে না। বলছিল, আগেই নাকি সুনীতিকে এসব কথা বলাটলা হয়ে আছে এবং সুধীরের যে আর অসুখের চিহ্নটি নেই সুনীতি তার বড় প্রমাণ, তার অধিক কিছু নাকি এ সম্পর্কে আমাকে আর বলার নেই।’

শিবনাথ জোর ক’রে ঘড়ি দেখতে ঘাড় ফেরাল।

‘কই শিবনাথবাবু, আপনি আমাকে বুদ্ধি দিন, আমাকে পরামর্শ দিন। এই বিপদ থেকে আমি কী ক’রে উদ্ধার পাব, বিদ্বান শিক্ষিত মানুষ আপনি যদি আমাকে এড়িয়ে যান আমি কোথায় দাঁড়াই বলুন।’

খুব অনিচ্ছা সত্ত্বেও এদিকে তাকাল শিবনাথ এবং অত্যন্ত নীরস কণ্ঠে প্রশ্ন করল, ‘আর কিছু বলেছে আমি আসার আগে?’

‘বলেছে আমার সর্বনাশ হয়ে যাবে। আমি যদি এখন সুনীতিকে বাধা দিই বাড়াবাড়ি করি : সুধীরের সঙ্গে মেলামেশা না করতে তো ফর লাইফ্ আমাকে অনুতাপ করতে হবে।’

আপনি সুনীতিকে বুঝিয়ে বলুন যে, সুধীরের অসুখ আছে কি নেই–না জানা পর্যন্ত যাতে সে তার নিজের দিক থেকে অন্তত সাবধান থাকে। বিয়েতে তার অনিচ্ছা থাকাটাই এখন বড় কথা।’

‘মশাই!’ শেখর ডাক্তারের গলা দিয়ে যেন শব্দ বেরোচ্ছিল না, খসখস করছিল কথাগুলো। ‘বেশি সর্বনাশ করেছে সুনীতির মা। বিয়ে বিয়ে করে মেয়ের কানের ফুলকা দু’টো উনি ঝাঁজরা ক’রে ফেলেছেন। মানে, সর্বনাশ শুরু হয়ে গেছে আমি চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছি, শিবনাথবাবু। তাই তো ডেকে এনেছি আপনাকে কী বলছি এসব।’

‘সুনীতি আপনাকে কিছু বলেছে?’

‘আমার সঙ্গে কথা বলছে না। কাল রাত্রে খায়ওনি। আজও এখন পর্যন্ত উপবাস।’

অত্যন্ত অপ্রিয় প্রসঙ্গ।

কিন্তু বাধ্য হয়ে শিবনাথকে ফের প্রশ্ন করতে হল : ‘মা আপনার স্ত্রী কি বলছেন? সুধীর সম্পর্কে কিছু বুঝিয়েছিলেন কি তাঁকে?’

‘ফেলিয়োর হয়েছি মশায়, ব্যর্থকাম হয়েছি বোঝাতে গিয়ে। কী বলতে তবে আপনাকে আমি ডেকে আনলাম ডিপেনসারীতে। আমাদের হোমিওপ্যাথিক শাস্ত্রে মশায় এ-ধরনের রোগিণীও আছে। হু লাভস্ হার ডটার্স লাভার। দ্যাট টাইপ প্রভাতকণা, হ্যাঁ, আমার স্ত্রী দ্যাট টাইপ অব উম্যান, আপনাকে বলতে পেরে আমার বুকটা হাল্কা হয়েছে, ধ’রে দেখুন শিবনাথবাবু।

ব’লে খপ্ ক’রে শিবনাথের হাত চেপে ধ’রে শেখর প্রায় জোর ক’রে সেটা টেনে তার বুকের কাছে নিয়ে যেতেই শিবনাথ হাত সরিয়ে আনল।

‘আমায় মশায় যেতে দিন, কাজ আছে। এ ব্যাপারে আপনাকে আমি কী সাহায্য করতে পারি!’

যেন লজ্জিত হ’ল শেখর ডাক্তার, ঘরের বাতাসে সুধীরের পরিত্যক্ত সেন্টের গন্ধটা টেনে নেবার মত ক’রে জোরে নিশ্বাস টেনে বলল, ‘না, আমার এটা প্রাইভেট লাইফের কথা। লোকে টাকাপয়সার অভাবে ভোগে, আমি ভুগছি বাড়ির যিনি কর্ত্রী, ঘরের গৃহিণী তিনি একটা মারাত্মক ব্যাধিতে ভুগছেন দেখে।

ব’লে ডাক্তার হাতের দু’টো আঙুল দিয়ে কপালের রগ টিপে ধরল।

টাইমপীস্ ঘড়িটার টিক্ টিক্ আওয়াজ শোনা যাচ্ছিল। যেন আজ ঠাণ্ডাটা খুব কম। গুমোট। কতকক্ষণ স্থির হয়ে ভেবে নিয়ে কথাটা চিন্তা করার পর ডাক্তার বলল, ‘আমার ব্যক্তিগত জীবন কত দুঃখের তাই আপনাকে শোনাচ্ছিলাম।’ ব’লে ডাক্তার সুধীর সম্পর্কে নিজের স্ত্রীর কথাবার্তা ও ব্যবহারগুলো একটা একটা ক’রে খুলে বলল। ছেলের অসুখ আছে কথাটাই প্রভাতকণা বিশ্বাস করতে চাইছে না। কেন? তার কারণ কি শুনতে গিয়ে প্রশ্নটা করামাত্র শেখর স্ত্রীর কাছে ধমক খেয়েছে। বলছে, মেয়ের বয়স হয়ে গেছে। তা অসুখে ওরা ভুগুক। তোমার কি, ছেড়ে দাও। সুনীতি যখন মাথা পেতে সব ঝুঁকি নিতে চাইছে, তখন তুমি আর অমত করো না।’ ইত্যাদি।

বলা শেষ ক’রে ডাক্তার বলল, ‘বুঝেছেন মশায়, এটা হ’ল ক্যান্থারিসের লক্ষণ। সেদিন ভাতের গরম ফ্যান পড়ে সঙ্গে সঙ্গে আমার স্ত্রীর হাতে এতবড় ফোস্কা পড়ে যায়। ঝোঁকের মাথায় আমি তাড়াতাড়ি এক কাপ জলের সঙ্গে খানিকটা স্ট্রং টিংচার ওকে খাইয়ে দিলাম। তার জের চলছে। ফোস্কাটি সারল, কিন্তু ওই যে ক্যান্থারিসের যা সিম্পটম, বুড়ো বয়সে প্রভাতকণা আজ তাতেই ভুগছে। স্ট্রং সেক্সুয়্যাল ডিজায়ার, অত্যধিক সেক্স-কন্সাসনেস। হ্যাঁ, প্রভাতকণা তার সন্তানের বয়স বলুন, যৌবন বলুন, মা হয়ে আগেভাগে মাথা পেতে, বলতে গেলে গায়ে পড়ে যেন অনুভব করতে চাইছে। ফিলিং। দ্যাট্ ব্লাডি সমস্ত ইন্দ্রিয়গুলোর অস্থিরতা বা ক্ষুধাতৃষ্ণা যাই বলুন বেড়ে গেছে ওর। অ্যান্টিডোট? ছিল–আছে। কিন্তু আমার কপাল মন্দ, এর পর কিছুতেই বলে কয়ে আর এক ফোঁটা ওষুধ সুনীতির মাকে গেলাতে পারলাম না মশায়। ভগবান বিরূপ। না হলে সমস্ত হোমিওপ্যাথিক মেডিসিনের ওপর ওর বিতৃষ্ণা জাগবে কেন। ন্যাশ্ বলেন—’

‘আচ্ছা, আমি উঠি।’

শিবনাথ চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল।

‘না মশায়, আপনাকে বিরক্ত করলুম। পাৰ্ডন মি, ক্ষমা চাইছি। আসল কথা হচ্ছে, শালা–হ্যাঁ ওই সুধীর ছোকরা, আস্ত গুণ্ডা। আমি যদি বাড়ির মেয়েদের ওপর আরো বেশি কড়াকড়ি করি এবং তার এখানে আসা একেবারে বন্ধ ক’রে দিই, তো স্কাউড্রেল আমাকে গুণ্ডা লাগিয়ে মারতে পারে। সেই আশঙ্কা আছে।’

‘তা আমি করব কি।’ অসহিষ্ণু হয়ে শিবনাথ রাস্তা করতে ডাক্তারকে হাত দিয়ে সরাতে গেল। হাতখানা ডাক্তার এবারও খপ্ ক’রে ধরে ফেলে অস্থিরভাবে বলল, ‘আমি তাই আপনার সাজেশন চাইছি, স্যার। এ বাড়িতে ছাগল গোরুকে তো আর ডেকে এনে সব সিক্রেসি আউট করা যায় না। তাই আপনাকে জিজ্ঞেস করছিলাম থানায় একটা ডাইরী ক’রে রাখব কি? যে একটা গুণ্ডা প্রকৃতির ছেলে আমার বাড়িতে আসা-যাওয়া করছে। আমি নিষেধ করলেও মানছে না। কিছু বলতে গেলে উল্টে ধমক দেয়?’

‘তা করতে পারেন।’শিবনাথ এবার না হেসে পারল না। অবশ্য শব্দ করল না। ঠোঁট মুচড়ে হেসে বলল, ‘বাড়িতে সুধীর ঘোষ কার কাছে আসে, কেন আসে, থানায় কিন্তু তা আপনি গোপন করতে পারবেন না। সিক্রেসি সেখানে আউট করতেই হবে—’

‘তা হোক গে, তাতে আমি গ্রাহ্য করি না, কিন্তু আপনাকে আমি বলে রাখছি, আই শ্যাল টিচ্ দ্যাট্ রাস্কেল এ গুড লেসন। দরকার হলে আপনি উইটনেস্ হবেন। থানার লোক যদি এসে জিজ্ঞেস করে পাড়াপ্রতিবেশী কাউকে তো–আমি আঙুল দিয়ে আপনাকে দেখিয়ে দিয়ে বলব, এঁকে প্রশ্ন করুন। প্রতিবেশী হিসাবে আমি এঁকে সবচেয়ে উচ্চ সমান দিই। কি বলেন? স্কাউন্ডেলটা যে সুনীতিকে না পেলে আমার মাথা দুফাঁক ক’রে দেবে তার চেহারা, চাউনি, কথাবার্তায় আপনার সেই ধারণা জন্মাতে তো আর বাকি নেই; সুতরাং এখন আমাকে সেভ্ করুন স্যার।’

‘সে দেখা যাবে।’ব’লে শিবনাথ শেখরকে রীতিমত ঠেলে সরিয়ে দিয়ে চৌকাঠ পার হয়ে তাড়াতাড়ি রাস্তায় নেমে এল।

থানা আর পুলিশ। আসামী। সাক্ষী। অর্থাৎ আর একটি দুশ্চিন্তা। কে. গুপ্তর ছেলে রুণু গাড়ী চাপা পড়েছে সেই মামলায় দারোগার কাছে রায় সাহেবের ছেলে পারিজাত ইনফ্লুয়েঞ্জায় কাতর হয়ে তিনদিন বিছানায় পড়ে আছে কিনা সত্য সাক্ষী হ’তে কাল শিবনাথকে যেমন কে. গুপ্ত অনুরোধ জানিয়েছিল। আজ ডাক্তার তাকে ‘রিকোয়েস্ট’ করছে মেয়ের সঙ্গে মিশতে সুধীরকে নিষেধ করা হয়েছে, এখন সুধীর গুণ্ডা লেলিয়ে তাকে মারধর করবে, এমন কি ‘মার্ডার’করতেও পারে, দারোগা এসে জিজ্ঞাসাবাদ করলে শিবনাথ এসব নিজের কানে শুনেছে বলে যেন দেয়। যত সব মাথাখারাপ! রাস্তায় চলতে চলতে শিবনাথ নিজের মনে বিড়বিড় ক’রে উঠল। তা ছাড়া লোকটাকে, তার চালচলন, বেশভূষা এখানে এসে পা দেওয়ার পর থেকে দেখে দেখে এতটুকু সহানুভূতি শিবনাথের মনে সৃষ্টি হয়নি। সে পারতপক্ষে শেখর ডাক্তারকে এড়িয়ে চলছিল। কী সব ঘটনা! পাত্রের কুৎসিত রোগ। বাপ সন্দেহ করছে। মা মেয়ে কথা শুনছে না। গুণ্ডা। মারামারি। তুমি তার সাক্ষী থাকবে।

কাঁধ থেকে ধুলো ঝাড়ার মতন শিবনাথ হোমিওপ্যাথের প্রস্তাবগুলোকে মন থেকে তাড়িয়ে দিলে। কী কদর্য পরিবেশের সৃষ্টি করে সুধীরজাতীয় প্রেমিক ও সুনীতিজাতীয় প্রেমিকারা সমাজে। চিন্তা ক’রে ও তাদের মনে মনে অনুকম্পা ক’রে লম্বা নিশ্বাস ছাড়তে গিয়ে শিবনাথ ছাড়তে পারল না। এখানে নিশ্বাস ফেলে জিরোবার, নিজের সম্পর্কে চিন্তা করবার সময় নেই বুঝল সে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *