০১. মহাশ্বেতার শরীরে গণ্ডগোল

উপকণ্ঠে – গজেন্দ্রকুমার মিত্র

উৎসর্গ
শ্রীপ্রমথনাথ বিশী
শ্রীমতী সুরুচি বিশী
করকমলে

‘কলকাতার কাছেই’ বই যখন প্রকাশিত হয় তখন তাতে লিখেছিলাম। “এই পাত্র-পাত্রীদের নিয়েই আরও দু’খানি উপন্যাস রচনার ইচ্ছা আছে। ” বর্তমান গ্রন্থ সেই সংকল্পেরই ফল। এই খণ্ডকে যতদূর সম্ভব স্বয়ংসম্পূর্ণ করবার চেষ্টা করেছি বলেই ‘কলকাতার কাছেই’ নামের সঙ্গে যুক্ত করি নি। প্রথম বইখানি পড়ার পর বহু সাহিত্যিক, বন্ধু ও অগ্রজাপরিচিত ও অপরিচিত বহু পাঠক- পাঠিকাওউমার সম্বন্ধে লেখকের অকারণ নির্মমতার অনুযোগ করেছিলেন। এমন কি একান্ত নিরাসক্ত মানুষ রাজশেখর বসু মহাশয়ও বলেছিলেন, ‘পরের খণ্ডে উমার একটু ভাল ব্যবস্থা করবেন তো?’ তাঁর এই উক্তি আমার ঐ গ্রন্থ রচনার সবচেয়ে বড় পুরস্কার বলে মনে করি। বর্তমান গ্রন্থে তাঁর আদেশ স্মরণ করেই উমার জীবনে যথাসাধ্য মিলনান্ত ছেদ টানবার চেষ্টা করেছি। তার যা ভাগ্য তাতে এর চেয়ে বেশি কিছু ভাল হওয়া সম্ভব নয়, তার জীবন আরও ব্যর্থ, আরও শোচনীয়ভাবেই শেষ হওয়ার কথা। পরিশেষে আরও একবার বলে রাখি, এই উপন্যাসের পাত্র- পাত্রী ও ঘটনা সবই কাল্পনিক। কোন বাস্তব ঘটনা বা মানুষের সঙ্গে দৈবাৎ যদি কোন ঘটনা বা চরিত্রের সাদৃশ্য লক্ষিত হয়তো বুঝতে হবে তা নিতান্তই কাকতালীয়।

লেখক
২০শে ভাদ্র ১৩৬৭

প্রথম পরিচ্ছেদ

॥ ১॥

সেবার আশ্বিনের প্রথম থেকেই মহাশ্বেতার শরীরে একটা কি গণ্ডগোল দেখা দিল। দিনরাতই গা-বমি-বমি করে, কেমন যেমন ঢিশ-ঢিশ্ করে শরীর।

কিছুই ভাল লাগে না। কেবল শুয়ে থাকতে ইচ্ছা করে। দিনকতক এইভাবে যেতে যেতেই সত্যিকার বমি শুরু হল। যা খায় কিছু পেটে তলায় না। মহাশ্বেতার স্থির বিশ্বাস হল এবার সে মারা যাবে।

স্বামীকে ডেকে এক দিন বললেও, ‘হ্যাঁ গো, তোমরা কি ডাক্তার-বদ্যি দেখাবে না, আমি এমনি বেঘোরে মারা যাব?’

ঘুমের ঘোরে জড়িয়ে-জড়িয়েই অভয়পদ সাড়া দেয়, ‘ও, তুমি মরছ নাকি? তা তো জানতুম না।’

‘তা জানবে কেন। তোমার আর কি, আমি মরলেই তো তোমার সুবিধে। আমি কালো পেঁচী। আমাকে তোমার মনে ধরে নি, তা কি আর আমি জানি না। সেইজন্যেই বুঝি আমার চিকিচ্ছে করাচ্ছ না? মরতে তর্ সইবে না আর একটা বিয়ে করে আনবে!

‘তা তো সত্যিই। নইলে আমার চলবে কি করে বল!’

পরক্ষণেই অভয়পদ নিশ্চিন্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়ে। নিঃশ্বাসের শব্দ গম্ভীর হয়ে আসে।

মহাশ্বেতা যেন কিছু বুঝতে পারে না। লোকটা তো সত্যি এত খারাপ নয়, যা করা উচিত বলে মনে করে। তা তো কোনটা পড়ে থাকে না। তবে ওর এমন অসুখ দেখেও নিশ্চিন্ত হয়ে থাকে কি করে?

শাশুড়িও তেমনি নির্বিকার। তিনিও তো দেখছেনাকৈ কখনও তো বলেন নাযে একটা ডাক্তার ডাক, কি হাসপাতাল থেকে এক মোড়া ওষুধ এনে খাওয়া। বরং আজকাল যেন একটু বেশি টিক্‌টিক্ করেনচলাফেরা সবেতেই টিক্‌টিক্। সন্ধ্যের পর বড়-একটা ঘরের বার হতে দেন না, ঘাটে যাওয়া তো একেবারে বারণ হয়ে গেছে, বাইরের কারুর সামনে পর্যন্ত যেতে দেন না তাতে নাকি নজর লাগবে। আর এক নতুন উপসর্গ হয়েছে, সন্ধ্যার আগেই খোঁপাতে একটা খড়কে কাঠি গুঁজে দেন। এ আবার কি অদ্ভুত ব্যাপার বোঝে না মহাশ্বেতা। দু-একদিন জিজ্ঞাসাও করেছে শাশুড়িকে, জবাব পায় নি, মুখ টিপে হেসেছেন ক্ষীরোদা।

অবশেষে একদিন থাকতে না পেরে সে শাশুড়ির মুখের ওপরই বলে বসল, ‘মা আমাকে একবার বাপের বাড়ি পাঠাবেন?”

‘তা কেন পাঠাব না বৌমা? কিন্তু হঠাৎ এ খেয়াল কেন গা বাছা!’

‘মনে হচ্ছে আর তো বেশি দিন বাঁচব না। শেষ দেখা দেখে আসি!’ মুখখানাকে যতটা সম্ভব গিন্নীবান্নীর মত গম্ভীর করে বলে মহাশ্বেতা।

‘ষাট্! ষাট্! ওমা ও কি অলুক্ষুণে কথা গা বৌমা। ষাট! তুমি মরতে যাবে কি দুঃখে মা? ষাট্! ষাট্ অ মেজবৌমা পাগলীর কথা শুনে যাও মা!‘

প্রমীলা এসে দাঁড়াল কিন্তু কোন কথা কয় না। মুখে আঁচল দিয়ে ফুলে ফুলে হাসে। মহার হাড় জ্বালা করে ঐ হাসি দেখলে!

সে বলে, ‘আপনাদের আর কি মা। একটা বৌ যাবে আর একটা আসবে। …আমি তো আমার শরীর বুঝি! কিছুই পেটে তলাচ্ছে না। এমন করে ক’দিন বাঁচব? মার কাছে গিয়ে পড়লে মা যেমন করেই হোক। ধার দেনা করে, ভিক্ষে করেও ডাক্তার দেখাবে। তার তো আমি বড় মেয়ে!’

শাশুড়ি রাগ করেন, ‘সে দরকার বুঝলে আমরাও দেখাব বৌমা! কিন্তু ডাক্তার দেখাবার মত হয়েছেই বা কি? এ অবস্থায় বমি হবে না? এ আবার কি ছিষ্টিছাড়া কথা বাছা?’

মাথাটা আরও গুলিয়ে যায় মহাশ্বেতার। সে কিছুই বুঝতে পারে না। ফ্যাল ফ্যাল করে চেয়ে থাকে। হয়তো আরও কিছুই বলত, কিন্তু প্রমীলা ওকে টানতে টানতে নিয়ে যায় রান্নাঘরে। তার পর গলায় আঁচল দিয়ে ওকে বার বার নমস্কার করে, ‘ধন্যি বাবা ধন্যি! এই গড় করি তোমার পায়ে। সত্যি দিদি, তোমার জন্যে আমি কোনদিন হাসতে হাসতে পেট ফেটে মরে যাব!’

আরও রেগে যায় মহাশ্বেতা।

কারুর সর্বনাশ কারুর পৌষ মাস। এদের হয়েছে তাই। তার এত বড় একটা অসুখ হয়েছে। অন্য কারুর হলে তো ছুটোছুটি পড়ে যেত। এরা সবাই মিলে এমন করছে যেন কি একটা হাসির ব্যাপার।

‘আ মর্। অমন করিস্ কেন? আমার যা হয়েছে তা আমিই বুঝি! আমি মরব বলে তোদের সবাইকার ফুর্তি পড়ে গেছে খুব, না?”

‘তোর কি হয়েছে তাই বল্ তো দিদি?’ কোনমতে জিজ্ঞেস করে মুখে কাপড় গুঁজে দেয় প্রমীলা। ছুটির দিন, ভাসুর বাড়িতে আছে, বাগানে খুট্ খুট্ করে কি কাজ করছেন। ভাদ্র-বৌয়ের চটুল হাসির শব্দ ভাসুরের কানে যাওয়া বড় নিন্দের কথা।

‘কী হয়েছে তাই যদি জানব তো আর ভাবনা কি। তবে মরতে চলেছি এটা তো বুঝি! যা খাচ্ছি উঠে যাচ্ছে, কী খেয়ে বাঁচব বল্। ছেলেবেলা শুনেছি পিঁটকীর অমনি হয়েছিল। কোন্ দরগা থেকে জল-পড়া এনে খাইয়ে দিতে পেট থেকে দুটো এত বড় বড় কিমি বেরিয়ে গেল। তবে ভাল হল। আমারও বোধ হয় তাই হয়েছে। …এরা তো কথাটা গেরাহ্যি করে না, হেসেই উড়িয়ে দেয়। নইলে না হয় আনারসের গর্ভপাতা রস করে খেতুম। শুনেছি ওতে কিমি বেরিয়ে যায়। খাব নাকি, হ্যাঁলা মেজ বৌ?

‘হ্যাঁ, তা খাবে না! নইলে আর চলবে কেন! তা হলে শাশুড়িতে আর তোমার মায়েতে মিলে জ্যান্ত পুঁতবে উঠোনে।’

কথাটা আরও দুর্বোধ্য হয়ে ওঠে মহাশ্বেতার কাছে। সে ফ্যাল্ ফ্যাল্ করে চেয়ে থাকে।

অকস্মাৎ প্রমীলা উনুনের পাড় থেকে ছোট মাটির ডেলা ভেঙ্গে ওর হাতে দিয়ে বলে, ‘খাবে দিদি?’

‘মাটি খাব কি লে?’

‘খেয়ে দ্যাখ না। আচ্ছা, গন্ধটা শুঁকে দ্যাখখেতে ইচ্ছে করবে।’

আস্তে আস্তে নাকের কাছে ধরে মহাশ্বেতা। বেশ লাগে গন্ধটা।

‘সত্যিই খেতে ইচ্ছে হচ্ছে যে লো!’

‘খেয়ে দ্যাখ না। ভাল লাগবে।’

একটু ভেঙে মুখে দেয় সে। বেশ লাগে। ক্রমে ক্রমে সবটাই খেয়ে ফেলে। ছেলেমানুষের মত সকৌতুক ঔৎসুক্যে চেয়ে থাকে প্রমীলার মুখের দিকে।

আর এক বার হাসিতে ভেঙে পড়ে প্রমীলা। তারপর হাসির গমক থামলে জিজ্ঞাসা করে, ‘আচ্ছা তুমি কি সত্যিই কিছু বুঝতে পার না?

মহাশ্বেতার এবার যেন কি একটা সন্দেহ হয়। এরা সবাই এমন করছে তার মানেটা কি? তেবে কি তার আচরণ সত্যিই হাস্যকর হয়ে উঠেছে? সে কি আবারও কিছু বোকামি করেছে?

প্রমীলা ইতিমধ্যে বেশ ঢ্যাঙা হয়ে উঠেছে। দীর্ঘাঙ্গী কিশোরী, সুরূপা না হলেও সুশ্রী। বেশ চটক আছে ওর চেহারায়। মহাশ্বেতা বেঁটে। প্রমীলার চেয়ে অনেকখানি মাথায় নিচু। প্রমীলা হঠাৎ হাঁটুর ওপর ভর দিয়ে উঠে দু হাতে ওর গলাটা জড়িয়ে ধরে, ‘ওগো নেকী, তোমার ছেলে হবো ছেলে! বুঝেছ?’

অকম্মাৎ চোখের ওপর থেকে কালো পর্দাটা সরে যায় মহাশ্বেতার। একঝলক আলো। আশারও বটে, সুখেরও বটে। একসঙ্গে যেন কানের কাছে অনেকগুলো বাজনা বেজে ওঠো আনন্দের একটা দমকা বাতাস বয়ে যায় মনের ওপর দিয়ে।

ছেলে হবে ওর? ছেলে?

কিন্তু এ কি সত্যি। এবার ওর শাশুড়ির আচরণ, স্বামীর নিশ্চিন্ত ঔদাসীন্য, প্রমীলার হাসি সবেরই একটা অর্থ খুঁজে পায় সে।

তবু সংশয়ও ঘোচে না। সন্দিগ্ধ সুরে প্রকাশ করে, ‘তুই কি করে জানালি? তোর তো হয় নি!’

‘আ মর্। আর কারুর দেখি নি বুঝি? আমার ভাই বোন নেই? কাকী জেঠি পিসীআমাদের তো রাবণের গুষ্টি। …তোমারও তো মায়ের অনেকগুলো হয়েছে। তাঁর অরুচি হয় না? দ্যাখনি কখনও?’

‘অ-মানে ঐ বমি?’ একটু থমকে ভেবে নেয় মহাশ্বেতা, ‘না, মা দুটো- একটা দিন বমি করে বটে দেখেছি। কিন্তু সে কি এই জন্যে? কে জানে! কৈ, বেশি বমি-টমি করে না তো আমার মত!’

‘সকলের কি হয়? এই আমার ছোট পিসী। মোটে কিচ্ছু হয় না। আমরা টেরই পাই না।’…

প্রমীলা আরও বহু গল্প করে। মহাশ্বেতা হাঁ করে শোনে। যেন গেলে কথাগুলো।

যাই বল বাপু, মেজ বৌ জানে ঢের। মনে মনে স্বীকার করতে বাধ্য হয় সে। …

সেদিন রাত্রে কি ভাগ্যি মহাশ্বেতা যখন শুতে গেল অভয়পদ তখনও জেগে পিদিমের আলোতেই কী একটা করছিল খুটখাট করে। দুজনে প্রায় একসঙ্গেই শুল।

এমন দুর্লভ সুযোগ কদাচিৎ আসে। স্বামীর গায়ে হাত বুলোতে বুলোতে একথা সেকথার পর হঠাৎ জিজ্ঞেস করে, হ্যাঁ গো, একটা কথা বলব রাগ করবে না? আচ্ছা মেজ বৌ যা বলছিল তা কি সত্যি?’

‘কী বলছিল মেজ বৌমা?’

তবু কথাটা বলতে পারে না চট্ করে মহাশ্বেতা। স্বামীর দাড়ির একটা প্রান্ত ধরে টানাটানি করে।

‘কি গো। বলবে না?’ অভয়পদই তাগাদা দেয়।

‘মেজ বৌ বলছিল, আমার আমার নাকি ছেলেপুলে হবে?’

‘ও, বলছিল বুঝি? তোমার কি মনে হয়?’ অভয়পদ মুখ টিপে হেসে প্রশ্ন

“জানি না, যাও। …আমি বোকা বলে তোমরা সব বুঝি মজা দ্যাখ, না? কেন, তুমি বলে দিতে পার নি?”

‘আমি কি করে জানব, বা রে! এ বুঝি পুরুষের বলবার কথা?’

‘তুমি সব জান। কেবল আমার সঙ্গে বদমাইশি কর।’

সে অভ্যাসমত স্বামীর দেহের খাঁজে মুখটা লুকোয়।

অভয়পদ সস্নেহে তার গায়ে একটা হাত রাখে শুধু। কিছু বলে না।

খানিক পরে আবার মুখ তুলে বলে মহাশ্বেতা, ‘আমার কিন্তু বড্ড ভয় করছে বাপু, যাই বল!”

‘ভয় কিসের। ছেলেপুলে তো লোকের হামেশাই হয়।’

তারপর হঠাৎ বলে বসে অভয়পদ, কিছু যদি খেতে-টেতে ইচ্ছে করে তা মাকে বলো।’

‘হ্যাঁ বয়ে গেছে। মাকে বুঝি বলতে পারি? আমার লজ্জা-ঘেন্না নেই?

তার পর একটু চুপ করে থেকে বলে, ‘হ্যাঁ গো!, কী হবে। ছেলে না মেয়ে?’

‘তা কি জানি।’

‘ছেলে হয় তো বেশ হয়। …কিন্তু মেয়েই বা মন্দ কি? সকাল করে কুটুম হয়কি বল?’

কিন্তু ততক্ষণে অভয়পদ তন্দ্রাচ্ছন্ন হয়েছে। ওর গভীর নিঃশ্বাসের শব্দেই বুঝতে পারে মহাশ্বেতা। সেও একটা নিঃশ্বাস ফেলে পাশ ফেরে। এ দুঃখের নিঃশ্বাস নয়। বরং বলা যেতে পারে, তৃপ্তির, ভরসার নিঃশ্বাস। স্বামীর ওপর আজকাল ওর একটা ভারী ভরসা এসেছে। সবেতেই, সব অবস্থাতেই লোকটার ওপর ভরসা রাখা যায়, এই বিশ্বাসটা বদ্ধমূল হয়েছে।

মহাশ্বেতা দীর্ঘরাত্রি পর্যন্ত ঘুমোতে পারে না। ওর সন্তান হবে, ও হবে মাএ কথাটা এত দিন যেন কল্পনাই করে নি। আজ সব কথাটাই তার নতুন বোধ হচ্ছে, আশ্চর্য মনে হচ্ছে। মনে মনে যতই আলোচনা করে, ভবিষ্যতেই যত ছবিই আঁকে। অবাক লাগে ওরা। আনন্দ? সবই কি আনন্দ? ওর যেন সত্যিই একটু ভয়-ভয়ও করে।

॥ ২॥

সাত বছরের মেয়ে মহাশ্বেতা এ-বাড়িতে এসেছে। ওর স্বামী অভয়পদর তখনই বাইশ বছর বয়স।

এ রকম অ-সম বিবাহ না দিয়ে ওর মা শ্যামার উপায় ছিল না। শ্যামার স্বামী নরেন একেবারেই অমানুষ। কতকগুলি সন্তান ছাড়া সে ইহজীবনে স্ত্রীকে কিছুই দিতে পারে. নি কিন্তু নিয়েছে ঢের। এখনও দৈবাৎ যখন সে এসে পড়োবলতে গেলে শ্যামার ভিক্ষান্নের সঞ্চয় থেকেওচুরি বা জুচ্চুরি করে কিছু নিয়ে সরে পড়তে তার এতটুকু বাধে না। তাই তার আশ্রয়দাতা সরকারদের গিন্নী মঙ্গলা যখন এই বিবাহের প্রস্তাব নিয়ে এসেছিলেন, সে আর ‘না’ বলতে পারে নি। ভিখারীর আবার বাছ-বিচার কি? একটা মেয়ে কোনমতে পার হয়ে যাচ্ছে। এই ঢের। শ্যামার ভয় ছিল। তবে সে অন্য কারণে। বয়স বেশি-কম নিয়ে মাথা ঘামানো তার পক্ষে অকারণ বিলাস। সে শুধু ভেবেছিল নিজের অদৃষ্টের কথা, মা কালীর কাছে, সত্যনারায়ণের কাছে শুধু এই কথা বলেই মাথা খুঁড়েছিল। জামাই না অমানুষ হয়। মা কালী ঐটুকু মুখ তুলে চেয়েছেন অমানুষ সে হয় নি। বরং বুদ্ধি বিবেচনা ঔদার্য প্রভৃতি বহু গুণ তার মধ্যে আছে। অমন জামাই পাওয়া সৌভাগ্য। বড় জামাইয়ের জন্যেই আজ সে খেতে পাচ্ছে ছেলে হেমকে অভয়পদই চাকরিতে ঢুকিয়ে দিয়েছিল। তারই ভরসাতে মেজ মেয়ে ঐন্দ্রিলার সুদ্ধ বিয়ে দিতে পেরেছে শ্যামা।

কিন্তু বয়স যা। সে তুলানাতে ঢের বেশি গম্ভীর, বেশি ভারিক্কী অভয়পদ। সুতরাং বাড়িতে এসে পর্যন্ত স্বামীকে ঠিক স্বামী বলে ভালবাসতে পারে নি মহাশ্বেতা। ভয়? হয়তো ঠিত ভয় নয়গুরুজনের মত সমীহ করেছে। বিপদে ভয়ে ভরসা করেছে তার ওপর, জড়িয়ে ধরেছে পরম ও নিরাপদ আশ্রয় জেনে। কিন্তু প্রেম-বিহ্বল আকুলতাতে স্বামীকে আলিঙ্গন করা যে কি তা মহাশ্বেতা বোধ হয় কল্পনাও করতে পারে না।

স্বামী শাশুড়ি সবাইকেই সে সমীহ করে এসেছে। বাপের বাড়িতে মা, সরকারগিন্নী বার বার এই উপদেশই দিয়েছেন, ‘সকলকার কথা শুনবি, কাজকর্ম করবি, শাশুড়ির সেবাযত্ন করবি যেন শ্বশুরবাড়িতে দুর্নাম না হয়। আমরা ত হলে মুখ দেখতে পারব না। শ্বশুরবাড়ি নিন্দে হলে আগে বাপ-মার ওপর টান পড়ে। বলবে মা-মাগী কিছু শেখায় নি, মেয়েটাকে ধিঙ্গি বেহায়া ঢ্যাটা করেছে!’

সে-উপদেশ অক্ষরে অক্ষরে পালন করেছে সে। বালিকা বধূ তাই কোনদিনই গৃহিণী হবার সুযোগ পায় নি। বয়স বেড়েছে, যৌবন যথা-সময়ে তার কাজ করে চলে গিয়েছে। কিন্তু সে শুধু দেহেরই ওপর। মন আজও বালিকা আছে। আজও আছে তার চোখে সেই প্রথম দিনের অসীম কৌতূহল এবং অগাধ বিস্ময়। আজও ঘোচে নি তার পরনির্ভরতা এবং ভয়ের ভাব। এমন কি তারই চোখের সামনে তার অনেক পরে মেজ জা প্রমীলা এসে কেমন সহজভাবে তাকে ডিঙিয়ে অনায়াসে, জ্যেষ্ঠার মর্যাদাপ্রায় গৃহিণীর মর্যাদাতেই কখন সুপ্রিতিষ্ঠিত হয়ে গেছে তা জানতেও পারে নি মহাশ্বেতা। অথচ সে যে খুব প্রীতির সঙ্গে বা অনায়াসে মেনে নিয়েছে তাও তো নয়। কিন্তু প্রতিবাদ করতে পারে নি, প্রতিকারও করতে পারে নি। ছেলেমানুষের মত আড়ালে আমড়াগাছ বা পুকুরপাড়ের সুযুনি লতাগুলোকে শুনিয়ে মনের নিষ্ফল ও নিরুদ্ধ আক্রোশ প্রকাশ করেছে মাত্র আর কিছুই করতে পারে নি।

সুতরাং আজ যদি তার সন্তান-সম্ভাবনার সংবাদটা তাকে পরের মুখ থেকে সংগ্রহ করতে হয় তো দোষ দেওয়া যায় কি?

এর পরেও কয়েকদিন ধরে যেন বিস্ময়ের ঘোরটা কাটে না মহাশ্বেতার। বরং বলা চলে সে-ই কাটতে দিতে চায় না। সংবাদটার অভাবনীয়তাটুকু যেন চেখে চেখে একটু একটু করে অনুভব করতে চায় সে।

এমনভাবে অনুভব করার আর একটা কারণও আছে। সে যেন এর ভেতর। কতকটা নিজের অবচেতনেই একটা প্রতিহিংসার আনন্দও টের পায়।

প্রমীলা সবেতেই তাকে ডিঙিয়ে গেছে। এটা ঠিক। কিন্তু এই একটা দিকে তো পারল না। তার পেটেই প্রথম সন্তান এল, বংশের প্রথম সন্তান। আর, আর যদিভাবতেও যেন ভরসায় কুলোয় না, এত সৌভাগ্য কোন দিন হবে তার?যদি ছেলে হয় তা হলে তো কথাই নেই। ভবিষ্যৎকালে সে-ই হবে বাড়ির কর্তা। উত্তরপুরুষের সে-ই হবে জ্যেষ্ঠ!

আর সেই জ্যেষ্ঠের, এই বাড়ির কর্তারামহাশ্বেতাই হবে মা। প্রমীলা নয়। মহাশ্বেতা আজকাল সন্ধ্যার সময় ঠাকুরঘরের বদ্ধদ্বারের (এ বছর ওদের পালা নয়, জ্ঞাতি ভাসুরদের পালা। তাই ওদের দিকের দরজা এখন বন্ধই থাকে) সামনে পিদিম রেখে অনেকক্ষণ ধরে প্রণাম করে ঠাকুরকে ডাকেঠাকুর আমার একটা ছেলে দাও, যেমন করে হোক ছেলে দাও। মেজ বৌ-এর খোঁতা ভোঁতা হোক।

বিধিনিষেধগুলো বেশি করে মানে সে। সন্ধ্যাবেলা উঠোনে পর্যন্ত নামতে চায় না। যদি কিছু ভালমন্দ একটা হয়? বাপরে!

॥৩॥

শাশুড়ি পাড়ার একটি বয়স্কা স্যাক্‌রাদের বৌকে দিয়ে খবর পাঠালেন। বোধ হয় বেয়ানকে অপ্রস্তুত করার একটা গোপন অভিসন্ধি ছিল তাঁর। নইলে অম্বিকা এমন কি দুর্গাপদকে দিয়েও খবর পাঠাতে পারতেন। কিন্তু শ্যামা এ ইঙ্গিত বোঝে, সেও ঠকার মেয়ে নয়। স্যাক্‌রা-বৌকে দাওয়ায় বসিয়ে ছুটে গিয়ে মঙ্গলাকে খবরটা দিয়ে আট আনা পয়সা ধার করে আনে। সরকারগিন্নীও বিনা ওজরে আধুলি একটা বার করে দেন। একে তো আনন্দের খবর। খুবই আনন্দের, মঙ্গলাই ঘটকালি করেছিলেন এ বিয়ের। সে জন্য তিনি একটু গৌরবও অনুভব করেন এবং সেই সঙ্গে এটাও বোঝেন যে কুটুমের কাছে কোনমতেই ছোট হওয়া চলবে না তার ওপর আজকাল আর শ্যামা ঠিক সেই আগের নিঃস্ব পুজুরী বামুনের বৌ নেই। ওঁদের বাড়িতে বিনা ভাড়ায় থাকে, ওঁদের বিগ্রহের পূজা করে ঠিকই এখনও লুকিয়ে-চুকিয়ে বাগানের ফলপাকুড় ঝ্যাটাকাটি বেচে খায় এও ঠিক। তবু হেম রোজগার করে এখন, ধার দিলে পয়সা তাড়াতাড়ি আদায় হবে। এ বিষয়েও তিনি নিশ্চিন্ত। ‘এই একটা গুণ আছে বামনীর। তাগাদা করতে হয় না। মনে করে শোধ দিয়ে যায়।’ মেয়েকে শুনিয়ে আজও একবার কথাটা বললেন মঙ্গলা।

পয়সা আট আনা চেয়ে এনে সবটাই স্যাক্‌রা-বৌয়ের হাতে দেয় শ্যামা।

‘এ আবার কেন আঁবুই মা, এ আবার কেন?’ বার দুই বলে স্যাক্‌রা-বৌ।

‘ওমা সে কি কথা। আনন্দের খবর দিলে, সুখবর! এ তো তোমার পাওনা বাছা। ছেলেপুলেদের জন্য মিষ্টি কিনে নিয়ে যেও।’

তাই বলে তাকেও অমনি ছাড়ে না শ্যামা। আগের দিন কারা যেন মানসিকের পুজো দিয়ে গেছে ঠাকুর-ঘরে, সেই দুটি মোণ্ডা তোলা ছিল সযত্নে। দুই জামাই হবার পর এই ধরনের মূল্যবান মিষ্টি কিছু এসে পড়লে প্রাণে ধরে শ্যামা তা ছেলেমেয়েদের তখনই খেতে দিতে পারত না। যদি কেউ এসে পড়ে তো মানরক্ষা হবে। একেবারে গন্ধ হয়ে গেলে বা ছাতা ধরে গেলে তবেই তা ছেলেদের ভাগ্যে জুটত। আজও সে দুটি কাজে লেগে গেল। দুটি মোণ্ডার সঙ্গে খানকতক বাতাসা একটা কলাপাতায় সাজিয়ে স্যাক্‌রা-বৌয়ের সামনে ধরে দেয় শ্যামা। সন্ধ্যা অবধি থেকে ভাত খেয়ে যেতেও অনুরোধ করে। কিন্তু স্যাক্‌রা-বৌ রাজী হয় না কিছুতেই।

‘ওমা না না। সন্ধ্যের পর একা কখনও এতটা পথ যেতে পারি? আমাকে এখুনি উঠতে হবে মা। একটু পরেই চারে বাবুরা ফিরতে থাকবে তাদের সামনে দিয়ে যাওয়াসে বড় লজ্জার কথা মা। হাজার হোক এখনও তো বুড়ো হাবড়া হই নি!’

শ্যামা মনে মনে হাসে। স্যাক্‌রা-বৌয়ের বয়স পঞ্চাশের কম নয়।

‘তবে যাও মা। কি আর বলব।’

একটা পানও সেজে দেয় শ্যামা। পানটা হাতে দিয়ে বিদায় দেবার সময় কুট করে একটা কামড় দিতে ছাড়ে না কিন্তু। মুচকি হেসে বলে, ‘বেয়ানকে বলো মেয়ে। এমন সুখবরটা দিয়ে পাঠালেন তোমাকে শুধু-হাতে। তাঁর তো ছেলের ছেলে, আসল নাতি, বংশরক্ষের কথা। আমাদের জন্যে দুখানা বাতাসাও পাঠালেন না। পাড়ার লোককে কি বলব?’

অপ্রতিভ স্যাক্‌রা-বৌ ঢেকে নেয়, ‘সে এখন কি গা আঁবই মা। একেবারে ছেলে হবার খবর যখন আনব। তখন হাঁড়ি ভরে মিষ্টি আনব!’

.

ভাল দিন দেখে শ্যামা মেয়েকে আনতে পাঠায় হেমকে দিয়ে।

অনেক মতলব করেই পাঠায় সে। এখন না আনালে পরে আনাতে হবে অর্থাৎ আতুড় তোলার কাজটা তাকে সারতে হবে। একরাশ খরচ। তার চেয়ে এখন দু মাস এনে রাখাই সুবিধা।

কিন্তু দেখা গেল ক্ষীরোদাও তার চেয়ে কম বোঝেন না, তিনি বললেন, ‘এখন আর কেনআবার দু চার দিনের জন্যে সুস্থ শরীর ব্যস্ত করা। এখন এই অবস্থায় তো হাঁটিয়ে নিয়ে যেতে পারবে না। পালকি করতে হবে, অন্তত আট গণ্ডা দশ গণ্ডা পয়সা খরচা। এখন পাঠালে আবার এই মাসেই আনতে হবে। সামনের মাস জোড়া মাস, তার পরই পঞ্চামৃত, কাঁচাসাধ, ভাজাসাধসব পর পর আসছে। আমি বলি কি, একেবারে ন-মাসে সাধ দিয়ে তোমাদের বাড়ি পাঠিয়ে দেব। প্রথম পোয়াতি, মার কাছে গিয়ে বিয়োনোই ভাল। ছেলেমানুষ ভয়-টয় পাবে! আর সে তোমার মা’র মনও মানবে না নইলে। কেমন? মাকে গিয়ে বুঝিয়ে বলো!’

অগত্যা হেম ফিরে আসে। শ্যামা সব শুনে গজ্ গজ্ করতে থাকে, ‘মিটমিটে ডান, ছেলে খাবার রাক্কোস! মাগী কম ফমবাজ!…দিলে বিয়েন তোলার খরচাটি আমার ওপর চাপিয়ে!’

মঙ্গলা সব শুনে হা হা করে হেসে ওঠেন |

‘তা রাগ করিস কেন বামনী। তুইও তো সেই চাল চালতে গিয়েছিলি! সেয়ানে সেয়ানে কোলাকুলি যে। অমনিই হয়। …নে মন খারাপ করিস নি। যা-হয় করে হয়েই যাবে। এখন সাধের কাপড়খানা যোগাড় দ্যাখ। ওইখানেই সাধ দিক আর যাই করুক। তোকেও তো দিতে হবে একটা। সে শাশুড়ি মাগী ঠিক বুঝে নেবে এখন। গিয়ে দাঁড়ালেই আগে প্যাঁড়া খুলবে। দেখি তোমার মা কি কাপড় দিলে বৌমা!’

তিনি আর এক দলা দোক্তা তাঁর মসীকৃষ্ণ মুখগহ্বরে নিক্ষেপ করেন।

শ্যামার অঙ্গ হিম হয়ে যায় কথাটা শুনে। একখানা ভাল কাপড়। যেমন তেমন করে হোক। আড়াইটে টাকা দাম। তার ওপর পাঁচ ব্যান্নন কবে খাওয়ানো আছে। আবার আঁতুড় তোলার খরচ।

মনে মনে একটা হিসাব করতে গিয়ে চোখে অন্ধকার দেখে শ্যামা।

।।৪।।

এ সংসারে কোন দুই পক্ষ যখন একই সুবিধার জন্য বিধাতার শরণাপন্ন হয়–তখন সাধারণত দেখা যায় বিধাতা এক পক্ষের প্রতিই প্রসন্ন দৃষ্টিপাত করলেন–অপর পক্ষ হতাশ হল। কিন্তু দৈবাৎ এর ব্যতিক্রমও হয় বৈকি! সেক্ষেত্রে দুই পক্ষেরই মনস্কামনা পূর্ণ হয়–বঞ্চিত হয় কোন বেচারী তৃতীয় পক্ষ।

শ্যামা ও ক্ষীরোদার বেলাও তাই হল।

বিধাতা এক বিচিত্র কৌশলে দুই পক্ষকেই খুশি করলেন।

মহাশ্বেতার সেটা আট মাস–সবে আট মাসে পড়েছে সে। হঠাৎ এক দিন খবর এল ওর বড় ননদের খুব অসুখ–বাড়াবাড়ি চলছে। অফিস থেকে যেতে আসতে চার ক্রোশ, রাত্রে ফিরতে পারে কিনা সন্দেহ। অথবা ফেরবার মত অবস্থা থাকবে কিনা তা-ই বা কে জানে? সুতরাং অভয়পদ বলে গেল, ‘আমাদের জন্যে বসে থেকো না মা–আজ রাতে খুব সম্ভব ফেরা হবে না। মাকড়দার ওদিকে পথঘাটও ভাল নয়। বেশি রাত্তিরে না ফেরাই ভাল। সেই কাল ভোরে–অফিস যাবার সময়ে ফিরব। যদি খুব দেরি হয়ে যায় তো আমি সোজা অফিস চলে যাব, খোকা ফিরবে–ওর মুখেই খবর পাবে।’

অম্বিকাপদের অফিসের কাজ–সাড়ে নটায় ওর হাজরে। সে দাদার বেশ খানিকটা পরে অফিসে রওনা হয়। তা ছাড়া এখন গাড়ি হয়েছে–সে উসানি স্টেশনে গিয়ে ট্রেন ধরে। অভয়পদ চিরদিনই হেঁটে যায়–এখনও সে হাঁটা বজায় রেখেছে।

সে যা-ই হোক–বাড়িতে রইল এরা ক-টি প্রাণী। ক্ষীরোদা, মহাশ্বেতা এবং দুর্গাপদ। মহাশ্বেতা প্রসব হতে বাপের বাড়ি গেলে অন্তত চার পাঁচ মাস আটকে পড়বে, এই অজুহাতে প্রমীলা একরকম ঝগড়াঝাঁটি করেই বাপের বাড়ি চলে গেছে। তাকে কোনমতে আটকাতে না পেরে প্রতিশোধস্বরূপ অম্বিকাপদ সুকৌশলে বোন বুড়ীকে ওর সঙ্গে দিয়েছে–অর্থাৎ বাপের বাড়ি যাতে বিষময় হয়ে ওঠে। গোপনে মাকে বলেছে, ‘বুড়ীটার শরীর তো মোটে ভাল থাকছে না–ওকে মেজ বৌয়ের সঙ্গে পাঠিয়ে দাও না, একটু ঠাঁইনাড়া হয়ে আসুক?’

‘ওমা–সে আবার বেয়াইরা কি মনে করবে! আচ্ছা, মেজ বৌকে বলে দেখি–’

তিনিও প্রকাশ্যে না বলে মেয়ে বুড়ীকে টিপে দিলেন। সে সোজা বায়না ধরল, ‘আঁমি মেঁজবৌদির সঙ্গে যাঁব–মাঁ।’

‘ওমা, ওমা, ও কি কথা রে। ও যাচ্ছে দুটো মাস জুড়োতে–তুই যাবি কি?’

অম্বিকাপদ ভেতর থেকে বললে, “তা যাক না–ছেলেমানুষ বায়না নিচ্ছে। পরের বাড়িতে পাঠাতেই তো হবে দু বছর পরে। তার চেয়ে বড়লোকের বাড়ি ভাল মন্দ খেয়ে শরীরটা সেরেই আসুক না। ও আর এত কি জ্বালাবে সেখানে?’

এই বলেই অম্বিকাপদ বেরিয়ে গিয়েছিল, স্ত্রীর অগ্নি-দৃষ্টি অনুভব করলেও চোখ দিয়ে দেখে নি। এখন মাস দুই দেখতে হবেও না–সে নিশ্চিন্ত হয়েই কথাটা বলেছিল।

অগত্যা প্রমীলাকে বলতে হয়েছিল, ‘তা চলুক না মা। …আমাদের অবিশ্যি গরিবের সংসার–সবাই তা জানে, তাই বলে অমন খোঁটা দিয়ে কথা বলবার কি আছে তাও জানি না। তবে হ্যাঁ–ডাল ভাত আমাদের সংসারেও খেতে পাবে। বাগানে-ডুমুর-থোড়-মোচা কাঁচকলারও অভাব নেই। বুড়ি চলুক না!’

‘ওমা–সত্যিই যাবে নাকি?’ যেন আকাশ থেকে পড়েছিলেন ক্ষীরোদা, ‘তা যাক তা হলে। খুব লক্ষ্মী হয়ে থাকবি কিন্তু, সেখানে যেন চাট্টি নিন্দে কুড়োস নি!’

সুতরাং প্রমীলা বুড়ী কেউ নেই।

শাশুড়ি অনেক ভেবে চিন্তে বললেন, ‘যে দিনকাল, ঘরগুলো এমনি ফেলে রাখা ঠিক নয় বৌমা–কি বল? দুগ্‌গো না হয় মেজ বৌয়ের ঘরে শুল, তুমি তোমার ঘরে থাক–আমি এ ঘর চৌকি দিই!’

মহাশ্বেতার মুখ শুকিয়ে উঠল, ‘আমার যদি ভয় করে মা–আমাশা মত হয়েছে–’

‘ওমা, ভয়ের কি আছে মা?…এই তো গায়ে-গায়ে ঘর। ডাক দিলেই উঠে পড়ব। তুমি কিচ্ছু ভয় করো না বড় বৌমা, তুমি ঘর থেকেই ডেকো, আমি ঠিক উঠে যাব। আমার সজাগ ঘুম–’

তিনি নিশ্চিন্ত হয়ে দোর দিয়ে শুয়েছিলেন।

মহাশ্বেতার ঘুম আসে নি। এতখানি বয়স পর্যন্ত কোন দিন তাকে একা শুতে হয় নি–না বাপের বাড়ি, না শ্বশুর বাড়ি। আজ একা শোবার প্রস্তাব আসতেই গা ছম্ছম্ করতে লাগল। বাইরে গাছের পাতা নড়লে মনে হয় কে ঘরের মধ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছে। ‘আর তেমনি কি নানা রকম শব্দ এ পোড়ার দেশে!’ আপন মনেই গজ্ গজ্ করে মহাশ্বেতা, ‘ভাম আছে, ভোঁদড় আছে, কাঠবেড়াল আছে–ইঁদুর বেড়াল–নেই কি? জাজ্বলিম্যান সংসার! মুখে আগুন তোদের, কেবল সব শব্দ করে বেড়াবে!”

অবশেষে আর থাকতে না পেরে উঠে হাতড়ে লণ্ঠনটা জ্বালল–এটা নতুন সম্পদ ওদের ঘরে, পিদিম ঘুচেছে। অভয়পদ অফিস থেকে এনেছে গোটাতিনেক, কেরোসিন তেলে জ্বলে। কিন্তু আলো জ্বালতে যেন আরও ভয় বাড়ে। মনে হয় জানালার পাশে বাইরে কারা সব দাঁড়িয়ে আছে এদিকে চেয়ে, তারা দেখছে অথচ সে দেখতে পাচ্ছে না। মরীয়া হয়ে উঠে গিয়ে একসময় জানলাটা বন্ধ করে দিল। অসহ্য গরম, তা হোক–গরমে কিছু মানুষ মরে যায় না। …

কিন্তু জানলা বন্ধ করেও স্বস্তি পায় না। ঘরের মধ্যেই যেন কারা সব ঘাপ্‌টি মেরে রয়েছে মনে হয়। হেঁট হয়ে তক্তপোশের তলা দেখে। তাই কি ছাই–দেখবার জো আছে? যত রাজ্যের ডেয়ো ঢাকনা, যার যা আছে আপদ বালাই সব এই ঘরে রাখবার জায়গা হয়েছে। …লাঠি দিয়ে এটা ওটা সরিয়ে দেখে। না, কেউ তো নেই বলেই মনে হচ্ছে। …

এরই মধ্যে একসময় পেট্‌টা মুচড়ে ওঠে।

ওর যেন কান্না পেয়ে যায়।

বন্ধ দোরের ভেতর থেকে ডাকে, ‘মা, ওমা–মা শুনেছেন?’

ক্ষীরোদার ‘সজাগ’ ঘুম ভাঙে না।

তখন নিজের দোরেই গুম্ গুম্ করে ঘুষি মারে। এইবার শুনতে পান ক্ষীরোদা–তাড়াতাড়ি উঠে দোর খুলে বাইরে আসেন, ‘কি হয়েছে, বৌমা, বাগানে যাবে? চল না মা। দোরটা খোলা।’

দোর খুলে যেন বাঁচে। কিন্তু বাগান থেকে ফিরে এসে আবার সেই সমস্যা।

ভয়ে ভয়ে বলে, ‘এ ঘরে তো বিশেষ কিছু নেই মা। চাবি দিয়ে আমি আপনার কাছেই যাই না?’

‘ওমা কিছু নেই–বল কি?’ শাশুড়ি অবাক্ হয়ে গালে হাত দেন, ‘ছিষ্টির জিনিস রয়েছে যে! তা ছাড়া এই তো ডাকলে আর উঠে এলুম। এত ভয়েরই বা কি হয়েছে তাও তো বুঝি না। বেশ তো, লণ্ঠনটা না-হয় জ্বালাই থাক। …তবে কমিয়ে দিও বৌমা, মিছি তেল নষ্ট।’

অগত্যা দোর বন্ধ করে এসে অবার শুয়ে পড়তে হয়।

প্রাণপণে ঘুমোবার চেষ্টা করে চোখ বুজে; না, ভয় কি? সে ঘুমোবেই। রাম-রাম-রাম–দুর্গা-দুর্গা-দুর্গা। –রাম-রাম-রাম–

বোধ হয় শেষ অবধি ঘুমিয়েই পড়েছিল, অকস্মাৎ কি একটা বিকট আওয়াজে চমকে ঘুম ভেঙে গেল ওর–চিৎকার করে উঠে বসল।

চালটা কাঁপচে–। দরজা জানলার পাল্লাগুলোয় কে অমন করে লাথি মারছে–?

ভয়ে দম বন্ধ হয়ে যাবে নাকি মহাশ্বেতার? প্রথম চিৎকারের পর ভয়ে গলা দিয়ে আওয়াজও বেরোয় নি আর। দু হাতে বুকটা চেপে ধরে কাঠ হয়ে বসে ছিল।

ও, ঝড় উঠেছে। তাই বল!

মহাশ্বেতা হাঁফ ছাড়ে। দোর-জানলায় তারই আওয়াজ। গোঁ গোঁ করছে বাতাস চালের বাতা আর কপাটের খাঁজে খাঁজে। বাঁশ-বনে কটূ কট্ করে উঠছে বাঁশগুলো–ভীষণ দুর্যোগ।

প্রথমকার ভয়টা কমলেও দুর্যোগের ভয়টা একটু একটু করে পেয়ে বসে ওকে। অভয়পদ যদি থাকত, তার বুকের মধ্যে মুখটা গুঁজে আরামে ঘুমোতে পারত সে। মুখে আগুন মুখপোড়ার, বোনের উপর দরদ উথলে উঠল একেবারে!

ঝড় যেন বাড়তেই থাকে। গোঁ-ও-ও করে হাওয়ার দমক যখন আসে–মনে হয় ঘরটা কাঁপছে। চালাটা উড়িয়ে নিয়ে যায় যদি? শাশুড়ি মাগী তো বেশ ঘুমোচ্ছে, ওর আর কি–পাকা ঘর, ছেলে আবার সেদিন সারিয়ে দিয়েছে–

ইস্! পেট্‌টা আবার মুচড়ে ওঠে দারুণ।

বাইরে এ কী কাণ্ড চলছে, যেন অনেকগুলো বুনো মোষ ক্ষেপে উঠেছে। বাগানে যাবে কি করে? নারকেলের পাতাগুলো খসে পড়ছে–গাছই হয়তো কত উপড়ে ফেলবে–

কিন্তু আর থাকতেও পারে না সে। পেটা বড্ড ব্যথা করছে। এবার হয়তো সে মরেই যাবে, ইস্–পেট কেটে কেটে দিচ্ছে যেন–কে–

‘মা ওমা, মা আমি মরে গেলুম যে—’

দুম-দাম কিল মারতে থাকে সে।

কিন্তু ঘুম ভাঙে না ক্ষীরোদার। অথবা ঝড়ের আওয়াজে শুনতে পান না।

‘মা আমি মরে যাব যে–কেউ জানতেও পারবে না। ওমা–’

মরীয়া হয়ে, যন্ত্রণায় থাকতে না পেয়ে দোর খুলে বেরিয়ে আসে সে। পাগলের মত শাশুড়ির দোরে ঘা মারতে থাকে।

দেখতে দেখতে জলের ছাটে ওর গা মাথা ভিজে ওঠে। বাইরে প্রলয় কাণ্ড চলছে। লক্ষ লক্ষ অগ্নিময় সর্পশিশু ছুটোছুটি করছে আকাশে–নিচে মত্ত মাতালের মত বাতাসের চলছে দাপাদাপি।

‘মা, ওমা–’

ক্ষীরোদা শশব্যস্তে দোর খোলেন।

‘ওমা, এ কি মা! এসো এসো। ইস্ ভিজে গেলে যে মা। আলোটা–তাই তো, দেশালাইটা আবার কোথায় ফেললুম দ্যাখ। অ দুগ গো–এ আবার কি বিপদ হল–’

‘মা, বড্ড–বড্ড পেট ব্যথা করছে, আমি আর দাঁড়াতে পারছি না। উ–মাগো মরে গেলুম–’

ধনুকের মত বেঁকে ঝুঁকে পড়ে সে সামনে–

‘তুমি ভেতরে এসো বৌমা, নইলে এখানেই বরঞ্চ বসে পড় মা, আমি মোক্ত করব এখন–এই ঝড়ে মাঠে আর যায় না—’

কিন্তু কোথাও বসবাব আগেই এক বিপর্যয় ঘটে যায়।

কি যে হয় তা বুঝতে পারে না মহাশ্বেতা। ওটা কি পড়ল!

‘মা–গো!’

অসহ্য আর্তনাদ করে ওঠে মহাশ্বেতা।

প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই আর একটা বিদ্যুৎ-স্ফুরণে ক্ষীরোদাও দেখতে পান।

‘ওমা, এ কী সর্বনাশ হয়ে গেল মা! তোমার যে ছেলে পড়ে গেছে। অ দুগ্‌গো!’

সে চিৎকারে দুর্গাপদরও ঘুম ভাঙে। সে ছুটে বেরিয়ে আসে।

‘ওরে শিগগির, ঐ তোর বড়দার ঘরে আলোটা আছে–নিয়ে আয় নিয়ে আয়।’

মহাশ্বেতার সব চৈতন্য আছন্ন হয়ে আসছে তখন। কি এক মহা শান্তি ও শ্রান্তিতে হাত-পা অবশ হয়ে এলিয়ে আসছে। সে টলে পড়ে যাচ্ছিল, অন্ধকারেই কেমন করে বুঝতে পেরে ক্ষীরোদা বুকে জড়িয়ে ধরলেন তাড়াতাড়ি।

‘আহা তাই তো মা। তুমি এখানে এইখানটায়–এই মেঝেতেই শুয়ে পড়।

কোনমতে ওকে শুইয়ে দিয়েই ছুটে গিয়ে শিশুটাকে তুলে নেন কোলে। ততক্ষণে দুর্গাপদ আলো নিয়ে এসেছে। আটমাসের অপুষ্ট শিশু, তার ওপর মাথায় চোট লেগেছে পড়বার সময়। তবু কিন্তু প্রাণ আছে মনে হচ্ছে।

‘ওরে অ দুগ্‌গো–দাইকে ডাকার কি হবে বাবা?’

‘সে আমি পারব না। এই ঝড়জলে। আর সে-ই বা আসবে কেন?’

তাও তো বটে। …

সেই ভাবেই বাকী রাতটুক। মহাশ্বেতা মেঝেতে পড়েই অঘোরে ঘুমোতে লাগল আর ক্ষীরোদা শিশুটাকে বুকে করে বসে রইলেন। মহাশ্বেতাকে একটা শুকনো কাপড় পরাবার কথাও তাঁর মনে পড়ল না।

শেষরাত্রে ঝড় থামতে দুর্গাপদ গিয়ে দাই ডেকে আনল। তখন ক্ষীরোদা তাড়াতাড়ি পুকুরে একটা ডুব দিয়ে এসে গরম জল চাপালেন। আঁতুড় ঘরেরও ব্যবস্থা হল–ছেঁড়া মাদুরের ওপর একটা কাঁথা পেতে।

দুর্গাপদ তারই ফাঁকে দাইকে জিজ্ঞাসা করল, ‘কী হয়েছে শশীর মা, খোকা না খুকী?’

‘খোকা হয়েছে গো ছোড়দা, খোকা।’ একরাশ পান-দোক্তার মধ্যে থেকে কোনমতে উত্তর দেয় শশীর মা।

‘বেঁচে যাবে তো?’

‘কেন যাবে না। ষাট্ ষাট্–ও কি অলুক্ষুণে কথা? তবে শশীর মা আছে কী করতে! বলি তোমরাও তো ক-ভাইবোন এ শশীর মা’র হাতেই–

তা সত্যিই শশীর মা তার হাতযশ দেখালে। ভোরবেলা অভয়পদ যখন এসে পৌঁছল তখন ক্ষীণ হলেও–শিশুকণ্ঠের কান্না পরিষ্কার শোনা যাচ্ছে, ওঁয়া-ওঁয়া–ওঁয়া-ওঁয়া।

দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ

॥ ১॥

মহাশ্বেতার যে এক মামশ্বশুর আছেন, সেটা বিয়ের দিন থেকেই আকারে-ইঙ্গিত শুনে আসছে সে। আকারে ইঙ্গিতে বলাও হয়তো ভুল, স্পষ্ট উল্লেখ শুনেছে। কিন্তু সঙ্গে-সঙ্গেই দেখেছে যে কথাটা চেপে যায় সবাই। অভয়পদ যদিও কোন দিনই নাম করে নি–এক বারও না, কিন্তু ক্ষীরোদা করে ফেলেছেন–আর করবার সঙ্গে-সঙ্গেই, মহাশ্বেতা দেখেছে যে তাঁর মুখখানা কেমন হয়ে যায়, কথাটা ঘুরিয়ে নেন তৎক্ষণাৎ। ব্যাপারটা বোঝে না সে–অবশ্য এর ভেতর যে বোঝবার কিছু আছে তা-ও হয়তো মহাশ্বেতা কোনদিন বুঝত না যদি না প্রমীলা তাকে বুঝিয়ে দিত। সে-ই প্রথম বলে, হ্যাঁরে দিদি–কী ব্যাপারটা বল্ দিকি এদের? মামার নাম করে না কেন? নাম যদি বা মা করে ফেলেন, পুরুষরা কী রকম কটূ কট্ করে চায় মা’র দিকে তা দেখেছিস? অনি যেন মা গুটিয়ে এতটুকু হয়ে যান, কেন্নোর গায়ে হাত লাগার মত অবস্থা হয়। কেন বল্‌ দেখি!’

মহাশ্বেতা বিস্ময়ে চোখ বড় বড় করে চেয়ে থাকে। সত্যিই তো–এ কথাটা তো কোনদিন ওর মাথায় যায় নি। মেজবৌটার বুদ্ধি কিন্তু খুব, পুরুষমানুষ হলে লেখাপড়া শিখে ‘জজ মেজেস্টার’ হত! সে সপ্রশংস মূঢ় দৃষ্টিতে মেজবৌয়ের দিকে খানিক চেয়ে থেকে বলে, তা কি জানি–কেন বল্‌ না!’

‘তাই যদি জানব তা হলে আর তোমাকে জিজ্ঞেস করব কেন? বঠাকুরকে শুধিও না এক বার কথাটা। আমাদের এ মিন্‌সেকে বললে চোখ পাকিয়ে বলে–সব তাতেই তোমাদের মাথা ঘামানোর দরকারটা কি? মামা আছে এক জন এই পর্যন্ত। আমার বাবার সঙ্গে শ্বশুরবাড়ির বনত না–যাওয়া আসা নেই তাই–এই বলে উড়িয়ে দেয়, বোঝ না? যাওয়া-আসা নেই তো–বিয়েতে নেমন্তন্ন করে কেন?’

‘নেমন্তন্ন করে বুঝি?’ মহাশ্বেতা অবাক হয়ে প্রশ্ন করে, ‘কৈ, এসেছিল তোর বিয়েতে?’

‘নেকু! বাড়িতে থাক তুমি, খবর রাখ না? আমি তো নতুন বৌ, বৌ সেজে বসে আছি, আমি জানব কেমন করে?…তবু আমি খবর রেখেছি। তোমার বিয়েতেও তো করা হয়েছিল। কখনও আসে না, কে একজন সরকার না গোমস্তাকে পাঠায়। তা তোমার বিয়েতে নাকি একটা টাকা ঠক্ করে দিয়ে গিয়েছিল–আমার ভাগ্যি ভাল আমাকে মুখ-দেখানি দিয়েছিল চার টাকা। সেই কথা নিয়ে ভাসুরে আর শাশুড়িতে কথা হচ্ছিল, ওরা বলছিল, আগের বার হয়তো সে লোকটাই কিছু সরিয়ে থাকবে, তাই তো আমি শুনলুম!’

ও, হ্যাঁ হ্যাঁ–তাই তো! মহাশ্বেতার মনে পড়ে যায় কথাটা। কে এক জন তাকে একটা টাকা দিয়ে গিয়েছিল বটে, তখন অতটা সে খেয়াল করে নি। শুনেছিল কলকাতার কে এক আত্মীয়–এই পর্যন্ত।

‘ও, তা হলে সে-ই মামাশ্বশুরের লোক।’

‘হ্যাঁ গো সীতে–সে-ই!’ প্ৰমীলী হেসে লুটিয়ে পড়ে, ‘তুমি কোন্ জগতের লোক দিদি, তাই ভাবি!’

‘নে বাপু তোর রঙ্গ রাখ। অত-শতয় কী দরকার আমার!’ মহাশ্বেতা মুখটা ঘুরিয়ে নেয়।

কিন্তু প্রশ্ন সে করেছিল ঠিকই। এক দিন অভয়পদ জেগে থাকার এক দুর্লভ সুযোগে সে কথাটা বলেই ফেলেছিল, ‘আচ্ছা তোমাদের তো এক মামা আছেন, না? তা তোমরা মামার বাড়ি যাও না কেন?’

‘কেন বল দেখি–হঠাৎ এ খোঁজ।’ অভয়পদর প্রশান্ত কণ্ঠস্বরে একটুখানি কি কৌতূহল ধরা পড়ে?

পড়লেও মহাশ্বেতার তা টের পাবার কথা নয়, সে পায়ও না। সে বলে, ‘না তাই বলছি। শুনি কিনা–এক জন আছেন, অথচ তোমাদের তো কখনও যেতে দেখি না। তাঁরাও তো আসেন না।

‘কথাটা কি তোমার মাথাতেই গেছে বড় বৌ…’

‘মাথাতে যাওয়া-যাওয়ির আর আছে কি? সোজা কথা জিজ্ঞেস করছি, পছন্দ হয় উত্তর দিও, না হয় দিও না।’…রাগ করে বলে মহাশ্বেতা, ‘মেজবৌও বলছিল বটে–’

‘তাই বল!’ অভয়পদ হাসে একটু, তার পর বলে, ‘যাই না, আসা-যাওয়া নেই। নিজেদের দুঃখের ধান্দায় ঘুরব, না অত দূর উজোন ঠেলে যাব!’

‘তা কৈ, তাঁরাও তো আসেন না!’

‘বড়লোক আর কবে গরীব আত্মীয়ের খবর নেয় বল!’

‘তারা বুঝি খুব বড়লোক?’

‘খুব!’

খানিকটা চুপ করে থাকে মহাশ্বেতা। তারপর বলে, বড়লোক তো তোমাদের কিছু দেয় না কেন? তোমাদের অভাব তো! আমাদেরও তো গয়নাগাঁটি দিতে পারত!’

‘অত দিলে-থুলে কি বড়লোক হতে পারে মানুষ? পয়সা জমালেই বড়লোক হয়!’

যুক্তি অকাট্য–অন্তত মহাশ্বেতার তাই মনে হয়েছিল। সে নিশ্চিন্ত হয়ে ঘুমিয়েছিল।

কিন্তু অত সহজে ভোলে নি প্রমীলা। মহাশ্বেতার মুখে কথাগুলো শুনে বলেছিল, ‘উঁহুঁ। কথাটা অত সোজা নয় ভাই, তা তুই যতই বলিস। এর ভেতর আরও কথা আছে।’

‘আবার কি কথা থাকবে?’ অবাক্ হয়ে প্রশ্ন করে মহাশ্বেতা।

‘আছে বাবা, আছে। সে আমি ওদের ঐ ঢাক-ঢাক গুড়-গুড় ভাব দেখেই বুঝতে পারি। আচ্ছা আমিও রইলুম–মামাশ্বশুরও রইল। এক দিন আমি কথাটা বার করবই। আমাকে ফাঁকি দেওয়া অত সোজা নয়।’

তবু কথাটা ঐখানেই চাপা পড়ে গিয়েছিল।

এসব মহাশ্বেতার ছেলে হওয়ার আগেকার কথা। ছেলের অন্নপ্রাশনে ঘটা হয় নি–দেইজিদের বাড়ি আর পাড়া-ঘরে বলা হয়েছিল দু’চার জনকে। অপুষ্ট রুগ্ন ছেলে, বারো মাসই ভোগে। ওর ওপর কারুর আশা-ভরসা নেই। নেহাত নিয়ম-রক্ষা করা তাই। সুতরাং সেক্ষেত্রে মামাশ্বশুরকে নিমন্ত্রণ করার প্রশ্নই ওঠে নি

তার পরও তোলবার ফুরসত পায় নি মহাশ্বেতা। কারণ ছেলে হবার পর থেকে স্বামী তার কাছে দুষ্প্রাপ্য হয়ে উঠেছে।

সাধ্যমত অভয়পদ সে-ঘরে শোয় না। ওদিকে একটা আধ-চালা মত করে নিয়েছে–গরমের সময় সেইখানে একটা বেঞ্চিতে শুয়ে ঘুমোয়। বেঞ্চিটাও নিজে তৈরি করেছে–কতকগুলো ভাঙা কাঠ জোড়া দিয়ে। হঠাৎ ঝড় জল হলে কোনদিন ঘরে আসে–নয়তো বেঞ্চিটা তুলে নিয়ে চলনে এসে শোয়। মহাশ্বেতা অনুযোগ করলে বলে, ‘যা তোমার ছেলের ঘ্যানঘ্যানানি-খাঁটিখুটি ঘুমটা ভাল না হলে চলে?’

মহাশ্বেতার কান্না পায় যেন। এর চেয়ে–ওর মনে হয়–ছেলে না-হওয়া ভাল ছিল। ছেলে তো ভারি–এক এক সময় হতাশ হয়ে পড়ে সে। এ ছেলে কি বাঁচবে শেষ অবধি, কোনদিন মানুষ হবে?

এক-এক দিন ছেলেকে নিয়ে সারারাত জেগে বসে থাকতে হত। কিন্তু আশ্চর্য, সে-সব রাতগুলোতে যেন ঘুমের মধ্যেও টের পেত অভয়পদ–ওর অবস্থাটা। না ডাকতেই এসে বলত, ‘তুমি একটু গড়িয়ে নাও, আমি, বসছি ওর কাছে।’ কিংবা কোনদিন ঝড় উঠলে, কি বড় রাস্তা দিয়ে মড়া নিয়ে গেলে–ঠিক উটে এসে নিচু গলায় ডাকত, ‘বড় বৌ, ভয় পেও না। আমি জেগে আছি।’ ঝড়ের সময় সোজাসুজি ঘরে এসেই শুত। ওর রকম-সকম দেখে মহাশ্বেতার এক-এক সময় সন্দেহ জাগত–লোকটা কি তা হলে জেগেই থাকে সারারাত?…

যাই হোক–এর ভেতরেই হঠাৎ এক দিন মামাশ্বশুরের কথাটা উঠল! কারণটাও বড় অদ্ভুত।

রাজা আসবেন, রাজা আসবেন, চারিদিকে রব উঠেছে। কাটা বাংলা আবার জোড়া লাগবে। বাংলার লড়াই মিটেছে–জয় হয়েছে বাঙালিরই, তাদেরই জেদ বজায় থেকেছে। সেই উপলক্ষে নতুন রাজা–মহারাণীর নাতি–ভারতবর্ষে আসবেন, কলকাতাতেও আসবেন। মহারাণীর বড় নাতি নন–তিনি মারা গেছেন। বিয়ের সব নাকি ঠিক ঠাক, এমন সময় মারা যান বেচারী, সেই কনের সঙ্গে এই নতুন রাজার তখন বিয়ে হয়। কনে এসে গিয়েছিল–তখন তো আর তাকে ফেরত দেওয়া যায় না। আরও কত কি গল্প–কেন কনেকে ফেরত দেওয়া গেল না, সে সম্বন্ধে মনগড়া অবাস্তব যত কাহিনী। কত কথাই যে মানুষের উর্বর মাথায় গজিয়ে উঠল। রাজা নাকি বাঙালিদের বড় ভালবাসেন (‘ভারতীয়’ শব্দের তখন ব্যবহার ছিল না, ব্যাপক অর্থেও বাঙালিকে বোঝাত, আবার হিন্দু শব্দের বদলেও বাঙালি কথার ব্যবহার ছিল), তিনি এখানেই থাকতে চান। কিন্তু তা হলে বিলেতে চলবে না। তাই তারা আসতে দিতে চায় না। অনেক বলে-কয়ে এবার রাজা আসতে পেরেছেন। আমাদের ভালবাসেন বলেই সাহেবদের রাগ–তাতে নাকি তাদের ইজ্জত থাকে না। এইসব নানা অবান্তর এবং অসম্ভব কাহিনী লোকের মুখে মুখে ছড়িয়ে এই সুদূর পল্লীগ্রামের ডোবার জলেও যেন তরঙ্গ তুলেছে, এখানকার শান্ত নিরুদ্বিগ্ন কূপমন্ডুকের জীবনেও জাগিয়েছে বহির্বিশ্বের কৌতূহল।

রাজাকে দেখতে হবে।

এ দুর্লভ সুযোগ ছাড়া হবে না। আর কি এ সুযোগ মিলবে?

কোন্ সাত সমুদ্র তেরো নদীর পারে থাকেন এই রাজা। দয়াময়ী মহারাণীর নাতি। এর আগে আর কোন রাজা এদেশে আসেন নি। এঁর বাবা এক বার এসেছিলেন, তবে তখনও তিনি রাজা নন–যুবরাজ মাত্র। তাও সে বহুকালের কথা–মহাশ্বেতার জ্ঞানে দেখে নি, হয়তো জন্মেরও আগে। তা ছাড়া শুধু তো রাজা দেখাই নয়–রাজা আসা উপলক্ষে শহর সাজানো হবে–আলো দেওয়া হবে। ভারতবর্ষের অন্য রাজা-রাজড়ারাও এখানে আসবেন। রাজধানী জায়গা, এখানে এসেই মহারাজারা সেলাম জানাবেন তাঁদের রাজচক্রবর্তীকে। তাঁদেরও দেখা পাওয়া যাবে–সেই বা কম কথা কি? লোকে বলে রাজদর্শনে মহাপুণ্য।

মহাশ্বেতা যে মহাশ্বেতা–সে-ও বায়না ধরে বসল, ‘আমাদের বাপু রাজা দেখাতে হবে, তা বলে রাখছি।’

অভয়পদ চমকে ওঠে, ‘পাগল নাকি? সেই ভিড়ে তোমরা কোথা থেকে দেখবে? গোটা দেশটা ভেঙে পড়বে ক’দিন কলকাতায়। তার মধ্যে আমরা কেমন করে যাব?’

‘তা জানি না। যেমন করে হোক্ ব্যবস্থা কর। তুমি সব পার।’ অভয়পদ তখনও উড়িয়ে দেয় কথাটা।

কিন্তু অবিরাম নানা কাহিনী এসে পৌঁচচ্ছে। পাড়া-প্রতিবেশী কারুর মুখেই আর অন্য কথা নেই। পুকুরে বাসন মাজতে কি গা-ধুতে গেলেও এ-ঘাটে ও- ঘাটে ঐ প্রসঙ্গ।

‘মহারাণী মরবার আগে পই-পই করে বলে গেছেন, আমার বংশের যে যবে রাজা হোক–বাঙালিদের ভাল করে দেখবে। ওরা আমার বড় প্রিয়।’

‘তা তো বলবেনই ন-খুঁড়ী। আহা এদের যে তাঁর প্রাণ ছিল। যে দিন দেখলেন যে কোম্পানির হাতে ঠিক শাসন হচ্ছে না, সেই দিনই তো ওদের তাড়ালেন। তিনি তো তাই বলেছিলেন, ‘ওরা সবাই আমার সন্তান। শাসন করতে হয় আমি করব–কোম্পানি কে?’

,

‘তিনি মা সাক্ষাৎ ভগবতী ছিলেন। বলে রাজার পুণ্যে রাজ্য। নইলে আর আজ ইংরেজ রাজত্বের এমন দবদবা–সুয্যি কখনও পাটে বসে না এদের রাজত্বে!

‘তা ছাড়া তিনি নাকি বলে গিয়েছেন সবাইকে–ওটা হল ধম্মের দেশ। অধম্ম করে শাসন করলে আমাদের রাজত্ব থাকবে না। সাবধান। …সেই জন্যেই তো শুনছি রাজা এসে বাংলা আবার জোড়া দিয়ে যাবে?’

‘হ্যাঁ দিদ্‌মা। রাজা আমাদের মত ভাত খায়?’

‘ওমা তা খায় না! এখানকার যা সরেস চাল সবচেয়ে তাই ত ওখানে যায়। আগে কি খেত–আগে খেত না। শুধু মাংস, তাও শুনেছি ঝল্সানো মাংস খেয়ে থাকত! মহারাণীই পেরথম নিয়ম করলেন, আমার প্রেজারা যা খায় আমিও তাই খাব! তারপর থেকেই তো হন্দর হন্দর চাল যাচ্ছে ওদেশে। নইলে বালাম চালের এত দর কেন? সাহেবরা যে আজকার সবাই ভাত খাচ্ছে।’

দিনরাত এই চলছে।

.

সে নূতন হাওয়া এসে ক্ষীরোদাকেও লাগে। তাঁর সেই একান্ত স্তিমিত ও সীমিত জীবনেও নাড়া দেয় সে হাওয়া। অতীত জীবনের রোমন্থন-করা চিত্তে স্মৃতির তরঙ্গ তোলে।

তিনি ঠাকুরঘরের বন্ধ দরজায় ঠেস দিয়ে বসে বলেন, ‘আমরা তখন সবে হয়েছি কি হই নি–মনে নেই, মা’র মুখে শোনা–জানো মেজ বৌমা, কথাটা উঠল যে সেপাইরা নাকি সায়েব দেখছে আর কাটছে। ইংরেজ-রাজত্ব আর থাকবে না। আমরা মামারা, দাদামশাই সব পশ্চিমে চাকরি করতেন। কথা উঠল যে বাঙালিদেরও কাটছে, ওরা সায়েবদের দিকে বলে। সে এক-এক দিন এক-এক কাণ্ড মা। মা গল্প করত আর হাসত একান্তে। এক দিন রান্না চড়ানো–এক জন এসে দিদি-মাকে বলে গেল, অ বামনি হাঁড়ি নামা, হাঁড়ি নামা। শুনিস নি? বেজাকে আর তোর বেটাদের সব কেটে রেখে গেছে সেপাইরা? …ওমা, তখনই উনুনে জল ঢেলে দেওয়া হল–বাড়িতে মড়া কান্না। আমার মা’র ঠাকুর্দা তখন বেঁচে ছিলেন। তিনি কোথায় যেন গিছলেন, ঘাড়ি এসে কান্না দেখে তিনিও প্রথমটা আছড়ে পড়েছিলেন, তার পর খানিক পরে খেয়াল হল–খবরটা দিলে কে? ঐ যে ওপাড়ার দত্তগিন্নী। দত্তগিন্নী খবর পেল কোথায়? আজ সাত দিন কোন ডাক আসে নি, খবর আসে নি। …খোঁজ খোঁজ–দত্তগিন্নী পালিয়ে বেড়ায়–শেষে সটেপটে ধরতে বললে, আমি স্নপ্ন দেখেছিলুম। এমনি নিত্যি–এক-এক দিন এক-এক ঢেউ।’

তার পর খানিক থেমে ছড়ানো পায়ে নিজেই হাত বুলুতে বুলুতে বলেন, –তা জানো গা মেজ বৌমা, সেই সব খবর মহারাণীর কানে পৌঁছল। সেপাইরা হেরে যেতে গোরাগুলো বললে, আমাদের যত সায়ের মরেছে এদের পেত্যেকের জন্যে আমরা এক হাজার করে বাঙালি কাটব। কথাটা শুনে মহারাণী বললেন, কখনো না। ওরা সব আমার ছেলে, কুপুত্র যদ্যপি হয় কুমাতা কদাচ নয়। দাওয়ানকে তখুনি ডেকে হুকুম দিলেন, কোম্পানির কাছ থেকে সব বুঝে-পড়ে নাও। আজ থেকে আমার লোক শাসন করবে। সেই জন্যেই তো বৌমা, মহারাণী যখন মারা গেলেন, সব্বাই দেশসুদ্ধ অশৌচ নিলে। গাঁয়ে গাঁয়ে ছাদ্দ হল। অমন রাণী আর হবে না। সেই সেকালে শুনেছি রাণী ভবানী, একালে মহারাণী ভিক্টোরিয়া।’

.

রাণী ভবানীর কথায় মহাশ্বেতার একটা কথা মনে পড়ে যায়।

সে হি-হি করে হেসে বলে, ‘জানেন মা–আমার দিদিমার ওখানে এক বুড়ো আমওলা আম দিতে আসত, সে যা মজার কথা বলত। বলত, রাণী ভবাণীরে মুই চিনি নে, ইয়া মোচ, ইয়া দাড়ি, চারদিকে চার গ্যার্দা বালিশ, তার মধ্যে বসে আছেন মা যেন গজেন্দ্রগামিনী। আবার তার দুদিকে চ্যানির হাঁড়ি, ফ্যাচ্ছে ম্যাচ্ছে চ্যানি খাচ্ছে!…হি হি!’

সেই প্রসঙ্গে হঠাৎ বলে বসেন ক্ষীরোদা, ‘তোমার মাসী তো কলকাতায় থাকেন বড় বৌমা, সেখানে গিয়ে উঠলে কি হয়–রাজা দেখা যায় না?’

মুখ ম্লান হয়ে আসে মহাশ্বেতার। সে বলে, ‘সেদিন কি আর আছে। দিদিমা মারা দিয়ে তাদের এখন হাঁড়ির হাল। একখানা ঘর ভাড়া করে থাকে তিনটি প্রাণী, সেখানে গিয়ে কি ওঠা ভাল দেখাবে? আর তাদেরই বা কী ব্যবস্থা হবে কে জানে! তারা কি আর আমাদের রাজা দেখাতে পারবে?’

হঠাৎ দুম্ করে প্রমীলাই কথাটা বলে ফেলে, ‘আপনার তো ভাই-ই রয়েছেন মা, শুনেছি তিনি খুব বড় মানুষ–সেখানেই চলুন না কেন! আমাদের তো মামা হন–আমাদেরও তো জোর আছে খানিকটা!’

মুখখানা নিমেষে যেন বিবর্ণ হয়ে যায় ক্ষীরোদার, কেমন যেন অপ্ৰতিভ ভাবে বলেন, ‘ওমা, সে কি হয়?’

‘কেন হবে না মা। এক দিন ভাইয়ের বাড়ি গিয়ে ওঠা যায় না? তবে আর আত্মীয়তা কিসের…বড়লোক, এক বেলা খাওয়াতে কি এত কষ্ট হবে? তা না হয় আমরা চাল-ডাল বেঁধে নিয়ে যাব।’

মহাশ্বেতাও জোর দেয়,’তাই চলুন মা, সে বেশ হবে।’

বিষম বিব্রত হয়ে পড়েন ক্ষীরোদা। সেটা তাঁর ভাব দেখেই বোঝা যায়। তিনি কথাটা ঘুরিয়ে দেবার জন্যে বলেন, ‘দেখি না অভয়পদ কী ব্যবস্থা করে!

‘ও আপনি কথা চাপা দিচ্ছেন মা।’ প্ৰমালীর দয়া-মায়া নেই।

‘কে জানে বাপু। ছেলেরা একথা শুনলে রাগ করবে!’ অসহায়ভাবে বলেন ক্ষীরোদা।

‘ওমা, এ আবার কি কথা! জন্মে একদিন মামার বাড়ি যাবার কথায় রাগ করবে? আপনি বুঝিয়ে বলবেন, তা হলে আর রাগ করবে না।’

ক্ষীরোদা বিপন্ন মুখে বলেন, ‘আমার কি, আমি না-হয় বলব–কিন্তু–না মেজ বৌমা, অম্বিকে অভয় সবাই রাগ করবে।’

মহাশ্বেতার পক্ষে এই ক-টি কথাই হয়তো যথেষ্ট হত কিন্তু প্রমীলা সে মেয়েই নয়, সে তার ডাগর ভাসা চোখদুটির দৃষ্টি শাশুড়ির দৃষ্টিতে স্থির করে বললে, ‘কেন বলুন তো মা–বুঝি কোন গোলমাল আছে?’

ক্ষীরোদার মুখ সেই সায়াহ্নবেলার আকাশের মতই রক্তিম হয়ে ওঠে। সেটা, এমন কি মহাশ্বেতার চোখেও, চাপা থাকে না।

তিনি তাড়াতাড়ি বলেন, ‘গোলমাল আবার কি থাকবে। তোমার বাপু এক কথা। না–মানে, ওরা পছন্দ করে না তাই। আচ্ছা আজ ছেলেরা আসুক, বলি কথাটা–’

তিনি উঠে যান তাড়াতাড়ি।

রাত্রে রান্না করতে করতে প্রমীলা বলে মহাশ্বেতাকে, ‘ঐ মামার বাড়ি গিয়ে তবে ছাড়ব। দেখিস্–নইলে আমি বাপের বেটী নই। মা বেটা সবাইকেই তুরকী নাচিয়ে ছাড়ব।’

‘কে জানে বাপু। তোর খুব সাহস। আমি হলে কিছুতেই ও কথাটা বলতে পারতুম না।’ স-প্রশংস দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে মহাশ্বেতা।

‘হুঁ! সাহস! অত ভয়ই বা কিসের?’

উনুনে একটা হাল্কা দেখে কাঠ গুঁজে দিয়ে প্রমীলা বলে, ‘কাঁদি নামলে তো আর আমরা একটা কলাও চোখে দেখতে পাব না–দুটো পাকা কলা পেড়ে রেখেছি দিদি, একটু কাসুন্দি বার কর্ দিকি, কলা-কাসন খাব।’

‘ওমা, রাত্রিরে কাসুন্দির হাঁড়িতে হাত দোব কি লো?’

‘রাগ দিকি তোমার শান্তর। কাঁচা কাপড়ে বার করলেই তো হল।’

।।২।।

পরের দিনটা কী একটা ছুটির বার। দুই ভাইকে একসঙ্গে খেতে দিয়ে ক্ষীরোদা কথাটা পাড়লেন, ‘বৌমারা ধরে পড়েছে মামার বাড়ি গিয়ে ঐখান থেকে রাজা দেখবে।’…তার পর একটু থেমে কুণ্ঠিতভাবে বললেন, ‘ওদের বোঝানো যাচ্ছে না, বলে মামার বাড়ি–নিজের মামা–সেখানে যাব না-ই বা কেন। কী এমন হয়েছে তাদের সঙ্গে?’

অভয়পদ ভাতে ডাল মাখতে মাখতে সংক্ষেপে জবাব দিল, ‘না, সে হয় না। তুমি বলে দিও, সেখানে যাওয়া আমরা পছন্দ করি না। ব্যস! অত কৈফিয়তে কী দরকার।’

কিন্তু বোঝা গেল যে প্রমীলা শুধু শাশুড়ির ওপর বরাত দিয়ে বসে থাকে নি। সে যে ‘বাপের বেটী’ তা প্রমাণ করার জন্য রাত্রে অন্য ব্যবস্থাও করেছে। অম্বিকাদপ এতক্ষণ হেঁট হয়ে একমনে ভাতের মধ্যে থেকে ফড়িং চোষা দানাগুলো বাছছিল, সে একটু কেশে গলাটা সাফ করে নিয়ে বললে, ‘কিন্তু আমি বলছিলুম যে তাতে দোষই বা কি? কথাটা কিছু চিরদিন চাপা দিয়ে রাখতে পারবে না। বরং বেশি ঢাকাঢাকি করতে গেলেই সন্দেহ বাড়বে। তারা চেষ্টা করবে বাইরে থেকে খবরটা যোগাড় করতে। …তাছাড়া বৌয়েরা তো আর এখন কচি খুকী নেই। অত চাপবার দরকারই বা কি?’

অভয়পদ তার নিরাসক্ত চোখ দুটি তুলে ভাইয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘বড় বৌয়ের জন্যে কোন চিন্তা নেই। সে অত বুঝাতেও পারবে না। বৌমার জন্যেই আমি ইতস্তত করছিলুম। তুমি যদি অসুবিধা বোধ না কর তো আমার আপত্তি কি?’ সে আবার ভাতের থালায় মন দিলে।

‘না,’–অম্বিকাপদ তাড়াতাড়ি বুঝিয়ে বলতে চেষ্টা করে, ‘আমি বলছিলুম যে, আগে থাকতে খবর দিয়ে রাখলে তারাও কি একটু সতর্ক থাকবে না? তাদেরও তো একটা বিবেচনা আছে।’

‘তাদের বিবেচনাটা আশা করতে পারো কিন্তু তার ওপর ভরসা করাটা কি ঠিক হবে? কেন কাজ করার আগে খারাপ ফলটা ভেবে নিয়ে করাই ভাল। যাক্, তুমি যদি ভাল বোঝ তো তাদের খবর দাও, আমার কোন আপত্তি নেই!’

ক্ষীরোদারও তখন রাজা দেখার ইচ্ছা প্রবল হয়ে উঠেছে। ধনী ভাইয়ের বাড়িতে গেলে সেদিকে সুরাহা হওয়ার সম্ভাবনা বেশি-এটা তিনিও বুঝেছেন। তিনি তাড়াতাড়ি অম্বিকাপদকেই সমর্থন করলেন, ‘না না। তাদের আক্কেল- বিবেচনা না থাক, লজ্জাও তো আছে। তুই তাই কর্–ওদের একখানা চিঠি দে। নইলে না হয়–কাল অফিস ফেরতা দেখা করে মতটা নিয়ে আয়। …যদি তেমন বোঝে তো ওরাই বারণ করে দেবে। ওরা তো আর ছেলেমানুষ নয়।’

অম্বিকাপদ আড়-চোখে দাদার মুখের দিকে চাইল, কিন্তু সে-মুখ পাথরের মুখ। সেখান দিয়ে একটা কথাও বার হওয়া যে আর সম্ভব নয় তা সে জানে। অভয়পদর হিসেবে সে অনেক কথা বলে ফেলেছে। সুতরাং সেও চুপ করে গেল।

চিঠি লেখার চেয়ে হেঁটে গিয়ে খবরটা নিয়ে আসা সোজা।

এই সোজা পথটাই ধরল অম্বিকা।

অভয় এখনও তার হাঁটা-পথ অব্যাহত রেখেছে কিন্তু অম্বিকা যাতায়াত করে ট্রেনে। সেইটেই নাকি সুবিধে। মাত্র তিন পোয়া পথ হেঁটে গেলেই স্টেশন, আর হাওড়ায় নামলে তো কথাই নেই। আধ ক্রোশের ভেতরেই অফিস। মিছিমিছি অত হাঁটা–দাদার মত–ও তার ধাতে সয় না।

অম্বিকা ফেরে সাধারণত সাড়ে পাঁচটার ট্রেনে, বড় জোর ছটা। সেদিন আটটার গাড়ি এমন কি সাড়ে আটটার গাড়িও পার হয়ে যেতে শাশুড়ি প্রমীলাকে ডেকে বললেন, ‘হাঁড়ি-হেঁসেল তুলে ফ্যালো মেজ বৌমা, খেয়ে- দেয়ে নাও তোমরা। অম্বিকা বোধ হচ্ছে খেয়েই আসবে।’

‘খেয়ে আসবে?…তার মানে?’ মহাশ্বেতা অবাক হয়ে প্রশ্ন করে।

‘মামার বাড়ি গেছে–এটা বুঝছ না দিদি? মামার বাড়ির আদর খেয়ে আসছে। …নইলে এত রাত হয়! কান পেতে শোন না–সাড়ে আটটার গাড়ি সাঁকরেলের পোলে উঠেছে–তার মানে নটা বেজে গেছে কখন!

‘যদি না খেয়ে আসে?’

‘ভাত ডাল তো সবই রইল। কেউ তো আর কারুর ভাগের খাচ্ছে না। –চল চল আমরা ভাত বেড়ে নিই। এমনিই সারতে সারতে রাত এগারোটা বাজে।’

দেখা গেল প্রমীলাদের অনুমানই ঠিক। রাত এগারোটা নাগাদ বাড়ি ফিরে জুতোর ফিতে খুলতে খুলতে অম্বিকা বললে, ‘আজ রাত্তিরে আর খাব না। খেয়ে এসেছি।’

‘তা বুঝিছি। মানিকতলা গিয়েছিলি বুঝি?’

‘হ্যাঁ।’

সাগ্রহে প্রশ্ন করেন ক্ষীরোদা, ‘কী খেলি রে? ভালমন্দ খাওয়ালে তো?’

প্রমীলা ঘরের মধ্যে থেকে ফিস্ ফিস্ করে মহাশ্বেতাকে বলল, কেমন আছে তারা, কাজের কথার কী হল–এসব চুলোয় গেল–আগে ওঁকে কৈফিয়ত দাও, কী ভালমন্দ খাওয়ালে!’

অম্বিকাও সেইখানে মায়ের পাশে বসে পড়ে ফিরিস্তি পেশ করে, তা খুব। পরোটা করেছিল, যে পরোটা লুচির বাড়া, পাটে-পাটে ঘি আর এ-ই পাতলা–তার সঙ্গে সুতোর মত আলু ভাজা, বেগুন ভাজা, শোল মাছের কালিয়াপাকা শোল মাছ, কী বলব মা যেন খাসি খাচ্ছি–আলুবখরার চাটনি, আর রাবড়ি। রাবড়ি নাকি ওদের ঘরে তৈরি হয়।’ বলতে বলতেই যেন অম্বিকাপদর রসনা লালাসিক্ত হয়ে ওঠে।

ক্ষীরোদা ছেলের পিঠে হাত বুলোতে বুলোতে বলেন, ‘তা ভাল, ভাল। পেট ভরে খেয়ে নিয়েছিস তো। বারো মাস এই ডাঁটা-চচ্চড়ি খাওয়া, একঘেয়ে–পেটে চড়া পড়ে গেল।’

তারপর একটু থেমে জিজ্ঞসা করলেন, ‘তা ওরা কী বললে রে? রাজী হল?’

হ্যাঁ–তা হয়েছে। মামার খুব ইচ্ছেটা ছিল না, রতন বললে–তা কী হয়েছে, আসুক না। আমাদের তো গাড়ি রয়েছে, দেখার সুবিধা হবে।’

‘তখন তোর মামা কি বললে?’

‘আর কিছু বললে না। আমিও আর ঘাঁটাই নি। আমারই যখন গরজ–তখন অত খুঁচিয়ে লাভ কি? কথা আছে আগের দিন গিয়ে ওখানেই থাকব।’

‘তা ভাল।’

.

অন্ধকারে ক্ষীরোদার মুখ দেখা গেল না। তবে কণ্ঠস্বরে বোঝা গেল যে তিনি খুশীই হয়েছেন।

সে রাত্রিতে প্রমীলা ও মহাশ্বেতা অনেক রাত পর্যন্ত ঘুমোতে পারল না। রান্নাঘর সারার নাম করে বসে বসে গল্প করতে লাগল। কলকাতা যাবে, আলো দেখবে, ভিড় দেখবে, রাজা দেখবে–কিন্তু সেটাও বুঝি সব নয়, মামাশ্বশুরদের রহস্যটা পরিষ্কার হবে, কেন এরা তাদের প্রসঙ্গ তোলে না, কনে এরা যেতে চায় না সেখানে–তারাই বা কেন আসে না, এতদিন পরে সেইটে জানা যাবে–এই-ই বোধ হয় সব চেয়ে বেশি আকর্ষণ।

জল্পনা-কল্পনারও অন্ত থাকে না। মুখখানা খুব গম্ভীর করে ভুরু দুটো কুঁচকে ভাববার ভঙ্গি করে মহাশ্বেতা বলে, ‘আমার মনে হয় ওরা কেরেস্তান হয়ে গেছে।’

‘দূর! তা হলে আর এত ছাপাছাপির কী ছিল। আমার মনে হয় তা নয়–মামা বোধ হয় নোট জাল করে জেল খেটেছে। আমি মা’র মুখে গল্প শুনেছি, কে এক জন নোট জাল করে খুব বড় মানুষ হয়েছিল। লোকে সন্দেহ করে নি আগে, কিন্তু একদিন হল কি জানিস–জানবাজারের রাজবাড়িতে খেতে এল শালের জোড়া গায়ে দিয়ে। ফেটিং গাড়ি থেকে নামতে যাবে–কোন্ খোঁচায় আটকে গেল। একটু থেমে ছাড়িয়ে নিলেই হত, তা সে বাবু থামলেন না। বরাবর সটান চলে গেলেন, শালও ছিঁড়তে ছিঁড়তে গেল। যখন অনেকখানি ছিঁড়েছে তখন শালখানা খুলে ফেলে দিলেন গা থেকে। আড়াই হাজার টাকার শাল! পয়সায় এত দুখদরদ কম–আলপকা টাকা না হলে তো হয় না। তখনই পুলিশের সন্দ হল, সটেপটে ধরলে চেপে। ব্যস্–একেবারে দ্বীপান্তর হয়ে গেল। …আমার মনে হয় এ ও তেমনি কিছু হবে!’

‘কে জানে বাপু!’

আরও বহুরাত্রি অবধি জেগে বসে রইল ওরা। শেষে এক সময় অম্বিকা বেরিয়ে ধমক দিতে তখন রান্নাঘরের কপাটে তালা লাগিয়ে শুতে গেল।

কিন্তু তবুও কি ঘুম আসে।

শুধু সেরাত্রি কেন–তারপর বহু রাত্রিই ভাল করে ঘুম এল না। সেই অত্যাশ্চর্য রাত্রি যেদিন ওরা গিয়ে মানিকতলায় মামাশ্বশুরের বাড়ি রাত কাটাবে, সেই রাত্রিটির জন্য অধীর আগ্রহে প্রতীক্ষা করতে লাগল।

॥৩॥

হাওড়ায় নেমে একখানা বার্ড ক্লাস ঘোড়ার গাড়ি ভাড়া করে অম্বিকা-পদ। হেঁটে যাওয়ার কথাই ছিল ওদের, কিন্তু ঠিক বেরোবার মুখে অভয়পদ ভাইকে ডেকে সংক্ষেপে বলে দিল, ‘নেমে একখানা গাড়ি নিও, হাঁটিয়ে নিয়ে যেও না।’

কথাটা বিশেষ করে অভয়পদের মুখে এমনই বেমানান যে অম্বিকা হাঁ করে দাদার মুখের দিকে তাকিয়ে রইল কিছুকাল। তখন অভয়পদই ব্যাখ্যা করে দিল, ‘যেখানে যাচ্ছ, তাদেরও সম্মান আছে তো! হেঁটে গেলে তাদের চাকর- বাকররা মানতে চাইবে না যে!’

তা বটে! কথাটার যৌক্তিকতা অম্বিকাপদও স্বীকার করে। যদিচ গা করকর করে তার এই বাজে খরচে। হাওড়া থেকে ওর মামার বাড়ি আট আনার কম রাজী হল না কোন গাড়োয়ানই। অগত্যা তাতেই রাজী হয়ে সমস্ত পথটা গজ্‌ গজ্ করতে করতে যায় সে, ‘ডাকাতি, ব্যাটাদের স্রেফ দিনে ডাকাতি। –এইটুকু পথ আট আনা! রাজা আসবে তো–ভিড় হয়েছে শহরে, ব্যাটার অমনি হাতে মাথা কাটছে!’

মহাশ্বেতা ও প্রমীলার এদিকে কান ছিল না। শাশুড়ি যে সমানে বকবক করে চলেছেন তাতেও না। তারা অবাক্ হয়ে কলকাতার বাড়ি-ঘর দেখছিল। গাড়ি বড়বাজার পেরিয়ে সিঁদুরেপটি হয়ে একসময় এসে নতুনবাজারে পড়ল। গাড়িভাড়ার শোক ভুলে অম্বিকাপদ ওদের দিকের খড়খড়িটা ভাল করে খুলে দিয়ে বললে, ‘ভাল করে দেখে নাও, রাজেন্দর, মল্লিকের নতুনবাজার।’

মহাশ্বেতা বললে, ‘জানি জানি। ছোটবেলায় গিরি ঝিয়ের সঙ্গে এখানে বাজার করে গেছি কতদিন। গিরি বলত টাকা ফেললে নতুন-বাজারে আর্ধেক রাত্তিরে বাঘের দুধ মেলে। দিদিমা বলতেন, এই নতুনবাজার ঝেঁটিয়েই ওঁদের চিড়িয়াখানার খরচ চলে।’

এবার প্রমীলার অবাক হবার পালা, সে বলে, ‘চিড়িয়াখানা?’

‘কে জানে বাপু। গিরিও বলত ঝিয়েদের আর চোখ রাঙিও নি বাপু, খেতে না পাই। রাজেন মল্লিকের চিড়িয়াখানা তো কেউ ঘোচায় নি!’

তখন ব্যাখ্যা করেন ক্ষীরোদাই, ‘হ্যাঁ হ্যাঁ–রাজেন মল্লিকের জন্তু- জানোয়ার পোষার যে ভারি শখ, তাই ওর বাগানকে চিড়িয়াখানা বলে। ঐখানেই আবার ওর অতিশালা। দুপুরবেলা অবারিত দ্বার–যে যাবে ভাত ডাল আর একটা ঘ্যাঁট তরকারি বাঁধা। হপ্তায় নাকি এক দিন মাছও দ্যায়। নতুনবাজারের তোলা তুলেই ওর খরচ চলে। এসব দাদার মুখে কতদিন গল্প শুনেছি।’

হঠাৎ হি হি করে হাসতে হাসতে মুখে কাপড় চাপা দেয় মহাশ্বেতা, ‘হ্যাঁ মা, রাজেন মল্লিকের মা নাকি একটা করে কলা খেয়ে থাকেন? রাজেন মল্লিক মরবার পর নাকি কিছু খান নি আর? গিরি বলত।

‘কে জানে বাছা, ওসব কথা কখনও তো শুনি নি।’

ততক্ষণে গাড়ি ছাতুবাবুর বাজার পেরিয়ে চলেছে। মহাশ্বেতা, খোলা জানলা দিয়ে দেখে বলে, ‘ওমা, এই তো ছাতুবাবুর বাজার। এ তো আমার দিদিমাদেরই পাড়ায় এসে গেলুম সব। এই তো এইখানে কোথায় থাকতাম আমরা–’

অম্বিকা এইবার ওদের দিকের জানালাগুলো আবার তুলে দেয়। বৌ-রা জানালা খুলে এসেছে–এ ভারি লজ্জার কথা।

মহাশ্বেতা কিন্তু খড়খড়ি ফাঁক করে দেখে। মানিকতলা স্ট্রিট পেরিয়ে সংকীর্ণ গলিতে ঢোকে গাড়ি, তা থেকে পাশ কাটিয়ে আরও একটা–। দুপাশে মেয়ে-পুরুষ রাস্তায় বসে বসে বাঁশের চ্যাঁচাড়ি বার করে চুপড়ি বুনছে। নিকষ কালো তাদের দেহ, যদিও স্বাস্থ্যের খুব চিহ্ন নেই কোথাও। বরাং যেন কেমন কেমন। কে জানে কী জাত!–

অবশ্য ভাববারও সময় পায় না বেশি, এরই মধ্যে একটা প্রকাণ্ড তিনতলা বাড়ির সামনে এসে অম্বিকা হঠাৎ চেঁচিয়ে ওঠে, ‘এই গাড়োয়ান, রোকো রোকো। এই যে, এই বড় বাড়ি–।’

তারপর অকারণেই মেয়েদের ধমক দ্যায়, ‘নাও, সব নামো। জড়ভরত হয়ে থেকো না। বৌদি তোমার কাঁদুনে ছেলে সাবধান!

যদিও মহাশ্বেতার ছেলে তখন অগাধে ঘুমোচ্ছে মা’র কোলের ভেতর।

গাড়ি থেকে নেমে কিন্তু সত্যিই হকচকিয়ে যায় মহাশ্বেতা। বিরাট বাড়ি। বাইরেই এক বিশালকায় দারোয়ান বসে (পরে শুনেছিল–ওরা ভোজপুরী দারোয়ান), সে তাড়াতাড়ি সেলাম করে এসে গাড়ির দরজা খুলে দাঁড়াল। –বাইরের রক থেকে শুরু করে চলন, মায় ওপরের সিঁড়ি পর্যন্ত সব কেমন একরকম চকচকে পাথরের। টালির মত চৌকো চেকো–কোনটা সাদা কোনটা কালো। অবাক হয়ে পা বুলিয়ে বুলিয়ে অনুভব করছে দেখে অম্বিকা ফিস্ ফিস্ করে বললে, ‘দেখছ কি, সব মার্বেল পাথর। এই পাথরের দামে আমাদের একটা দোতলা বাড়ি হয়ে যায়!’

চলন পেরিয়ে উঠানের আগেই সিঁড়ি। কিন্তু অম্বিকা সেদিকে গেল না। রক দিয়ে গিয়ে বাঁ পাশের একটা ঘরে ঢুকল। সেখানে চৌকিতে ধপ্ ধপে ফরাস পাতা, তাতে তাকিয়া ঠেস দিয়ে বসে ফরসিতে তামাক টানছেন বিশালকায় এক প্রৌঢ় পুরুষ। তাঁর শুভ্র গৌরবর্ণের সঙ্গে মাথার শুভ্র কেশ এবং বিস্তৃত বক্ষে শুভ্র যজ্ঞোপবীত–ভারি মানিয়েছে। যদিও চুল যতটা সাদা ততটা বুড়ো হয়তো নন–কারণ গায়ের চামড়া এখনও টাটান্ আছে, কপালেও তেমন রেখা পড়ে নি। সামনে একখানা বই খোলা–সম্ভবত তামাক খেতে খেতে ঐখানাই পড়ছিলেন। –ওদের পায়ের আওয়াজ পেয়ে এবার মুখ তুলে চাইলেন।

ক্ষীরোদা তাড়াতাড়ি এগিয়ে গিয়ে প্রণাম করলেন। তারপর বৌদের দিকে ইঙ্গিত করে বললেন, ‘তোমাদের মামা–পেন্নাম কর। দাদা, বৌদি কোথায় গো?’

মামা বসন্তরঞ্জন ঈষৎ ভ্রূকুঞ্চিত করেই ছিলেন, তেমনি অবস্থাতেই সংক্ষেপে জবাব দিলেন, ‘কালীঘাট গেছে। ফিরতে দেরি হবে।’

তারপরই প্রণত বৌদের উদ্দেশে–’থাক্-থাক্’ বলে হাত তুলে আশীর্বাদের ভঙ্গি করে বললে, ‘রতনের সঙ্গে দেখা করে নেবে তো এই বেলা নাও গে। –জামাই আসবার সময় হল। –তোমাদের জন্যে তিনতলার ঘর বোধ হয় ঠিক করে রেখেছে। সেইখানে চলে যেও। জামাইয়ের সামনে আর বেরুবার দরকার নেই। যা বেশভূষা!’

শেষের কথাটা খুব আস্তে বললেও মহাশ্বেতার কান এড়ায় নি। তারা দূর থেকেই চৌকিতে মাথা ঠেকিয়ে প্রণাম করেছিল–মামাশ্বশুরের পায়ে হাত দেবার রেওয়াজ নেই–তবু মনে হল যেন ওদের জামা কাপড়ের গন্ধ এড়াবার জন্যেই তিনি আর কিছু না পেয়ে ডিবে থেকে একখিলি পান তুলে নিয়ে শুঁকতে লাগলেন।

মহাশ্বেতা যতই বোকা হোক্–অনাদর না বোঝবার মত বোকা নয়। অপমানে তার কান মাথা গরম হয়ে উঠল। ছেলে কোলে করে সে তাড়াতাড়ি বাইরে এসে দাঁড়াল। অভয়পদর কেন আপত্তি ছিল এখানে আসতে–এবার যেন সে একটু একটু বুঝতে পারলে।

অম্বিকাপদও এক রকম মাকে ঠেলেই বার করে আনলে সে ঘর থেকে। বসন্তরঞ্জন আবার তাঁর নভেল ও আলবোলায় মন দিলেন।

এবার সোজা দোতলায়। নিচের দুটি ঘরের ওপর একটা টানা বড় ঘর। বিরাট ঘর কিন্তু সবটাই যেন আসবাব ঠাসা। ঘরে কোথাও একটু জায়গা নেই। অন্তত মহাশ্বেতার তাই মনে হল। আর এইসব আসবাবের মধ্যে তারা যে একান্ত বেমানান–সেটাও কেমন করে যেন অনুভব করতে লাগল মনে মনে।

চৌকাঠের বাইরেই বড় পাপোশ। অম্বিকাপদ চাপা ধমক দিয়ে বললে, ‘পা মুছে নাও ভাল করে।’ যদিচ ওরা আসবার আগে নিচের কলতলা থেকে পা ধুয়ে এসেছিল; পায়ে ময়লা থাকবার কথা নয়।

মহাশ্বেতা প্রমীলা ওরা দু’জনেই একটু পিছনে রইল, ক্ষীরোদা এবং অম্বিকাপদই আগে। তবু তাদের ফাঁক দিয়ে দেখতে কোন অসুবিধা নেই। কৌতূহল মহাশ্বেতারই বেশি। আধা-ঘুমন্ত ছেলেটাকে ট্যাকে নিয়ে ঘাড়টা বাড়িয়ে দেখে নেয় সে। প্রকাণ্ড ঘর, তার একপ্রান্তে তেমনি প্রকাণ্ড খাট। বিচিত্র কারুকার্য সে খাটের গাঢ় কালচে বাদামী রঙ–কত টাকাই না জানি দাম নিয়েছে! তার ওপর প্রায় দেড় হাত পুরু বিছানা। ওপর নিচে ঝালর দেওয়া বালিশ, দু’পাশে বিরাট পাশ-বালিশ। মাথার দিকে (অথবা পায়ের দিকে কে জানে!) এক ফালি জায়গা, তাতে ভারী একটা লোহার সিন্দুক, তার ওপর কাঁচের ঢাকার মত মধ্যে ছোট্ট একটা ঘড়ি। তার নিচে একটা পুতুল। ঠিক তখন সাড়ে পাঁচটা বাজার সময়, পুতুলটা এগিয়ে গিয়ে একটা ঘা মারলে কিসে, ঠাং করে একটা আওয়াজ হল। আরও কত কি এটা-ওটা জিনিস লোহার সিন্দুকের ওপর, এত দূর থেকে ঠাওর হল না। খাটের পাশে একটা পাথরের টেবিল। তাতে সোনালী রঙের আলো। তার পাশে আর একটা ঘড়ি, সে আবার ঘণ্টা বাজায় না, বাজনা বাজে তাতে, পনের মিনিট অন্তর। ফুলদানিও একটা আছে সেখানে, তাতে টাটকা ফুল সাজানো। এদিকে বিরাট আলমারি দুটো। একটার পাল্লায় আয়না বসানো। আর একটা কাঁচের পাল্লা। তার ভেতর দিয়ে সারি সারি বই দেখা যাচ্ছে। এ ছাড়া বিরাট দাঁড়া-আয়না। তার গিলটির ফ্রেমে অজস্র শৌখিন কাজ। ওপরের দেওয়ালে তেমনি ফ্রেমে আঁটা বড় বড় ছবি–কিন্তু মহাশ্বেতা এক বার সেদিকে চেয়েই আপনা-আপনি জিভ কাটলে, গুরুজনদের পাশে দাঁড়িয়ে ওদিকে তাকানো যায় না। এই সব ছবি মানুষ ঘরে টাঙায়–ছি! আর এ ছাড়া আছে খাটের নিচে মেঝেতে বিরাট একটা ঢালা বিছানা–ধপ্ ধপ্ করছে ফরসা, তার চারদিকে গোটা বারো বড় বড় তাকিয়া। এবং সেই তাকিয়ারই একটাতে ঠেস দিয়ে আধ-শোয়া অবস্থার শুয়ে আছে পরমাসুন্দরী একটি মেয়ে তার পায়ের ওপর খানিকটা পর্যন্ত একখানা শাল চাপা, তাতে আগাগোড়া সূক্ষ্ম সুচের কাজ, তাকিয়ায় আধ-কাত হয়ে শুয়ে পাশের একটা টেবিল-ল্যাম্পের আলোতে বাংলা বই পড়ছে।

সে মেয়েটি এদের দেখতে পায় নি, পায়ের আওয়াজও পায় নি বোধ হয়। অথবা হাতের বইখানাতেই ডুবে গিয়েছিল। সে মুখ তুললো না। অগত্যা ক্ষীরোদাই ডাকলেন,– রতন!’

রতন এবার বই নামিয়ে মুখ তুলে তাকাল, ‘কে পিসীমা? এসো এসো। কী ভাগ্যি! রাজদর্শনে যে পরম পুণ্য সেকথা মিছে নয়–তার নামেই তোমার পায়ের ধুলো পড়ল। …বাব্বা, আট বছর পরে তোমাকে দেখলুম।’

একটু কষ্ট করেই উঠে বসে রতন। বয়স এখনও অল্প, তবু এরই মধ্যে যেন ভারী হয়ে পড়েছে সে। যতটা পর্যন্ত মেদ থাকলে ভাল দেখায়, তার চেয়েও বেশি জমেছে তার দেহে।

সন্তর্পণে শালখানা সরিয়ে উঠে এসে একটা প্রণাম করে সে। ক্ষীরোদা তাতেই যেন অতিভূত হয়ে পড়েন, ‘থাক্ থাক্ মা, হয়েছে হয়েছে। বেঁচে থাকো, গতরখানি সুখে থাকুক। রাজরাজেশ্বরী হও।’

খট করে কথাটা কানে লাগে–এমন কি মহাশ্বেতারও। সধবা মেয়ে মাত্রেই প্রণাম করলে ক্ষীরোদা হয় বলেন, ‘সাবিত্রী সামন হও মা, নোয়া সিঁদুর বজায় থাক্’–নয়তো বলেন, ‘হাতের নো ক্ষয় থাক, পাকাচুলে সিঁদুর পর।’ এইসব। মহাশ্বেতা তাকিয়ে দেখলে প্রমীলাও বিচিত্র দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তার দিকে।

ততক্ষণে রতন এগিয়ে এসেছে।

‘এইটি বুঝি আমাদের বৌদি? আর ইটি? অম্বিকের বৌ? বেশ বেশ। বসবে একটু? আমি বলি কি এখন আর বসে কাজ নেই। এখনই হয়তো তোমার জামাই এসে পড়বেন, তখন লজ্জায় পড়ে যাবে। …অম্বিক, বরং এদের নিয়ে সোজা তিনতলায় চলে যাও। মোক্ষদা কোথায় গেল, সে সব জানেশানে, দেখাশুনা করবে।’

এই বলে গলাটা একটু চড়িয়ে ডাকে, ‘অ মুকি, মোক্ষদা–!’

‘কী গো দিদিঠাকরুন!’ বেশ শক্ত–সমর্থ খাণ্ডারনী গোছের এক ঝি এসে দাঁড়ায় কোমরে হাত দিয়ে। চওড়া পাড়পা–শাড়ি পরনে–গাছকোমর করে বাঁধা, তার ওপর রুপোর গোটা ঝুলছে।

‘এই আমার পিসীমা এসেছেন। ওপরে নিয়ে যা। এদের খাওয়া-দাওয়া বিছানা পত্তর,–সব ভার তোর। দ্যাখ, এখন কী দরকার। খোকার দুধ চাই কি না সব দ্যাখ। আর যেন আমাকে কোন খবর নিতে না হয়!’

অকারণে এতখানি জিভ কাটে মোক্ষদা, ‘ওমা পিসীমা বুঝি? কী হবে মা।’

সে গড় হয়ে প্রণাম করে ক্ষীরোদাকে, পায়ের ধুলো নিয়ে কপালে জিভে দেয়। তার বর সবাইকে একটা করে প্রণাম সেরে বলে, আশীর্বাদ করো যেন ধম্মে মতি থাকে। আর জন্মে কত পাপ করে এসেছিলুম–তাই এজম্মে ভুগতিছি। আবার যেন সামনের জম্মে ভুগতে না হয়!’

রতন হেসে একটু ধমক দেয়, ‘ঐ শুরু হল মুকির বক্তৃতা। ওদের নিয়ে গিয়ে কোথায় বসাবি একটু, তেতেপুড়ে এল সবাই–না বক্ শুরু করলে। যা পালা, এখুনি তোর দাদাবাবু এসে পড়বে।’

‘যাচ্ছি গো যাচ্ছি। তুমি খালি বকতেই দ্যাখ। চল গো পিসীমা, ওপরে চল। এসো বাপু বৌদিরা–’

মহাশ্বেতা এতক্ষণ অবাক হয়ে রতনকে দেখছিল, বলা যায় বাহ্যজ্ঞানশূন্য হয়েই। মাসীরও খুব রূপ, তার মাও ফেলনা নয় কিন্তু এ যেন আর-এক রকম। তাদের গরীবের সংসার বলেই হয়তো অতটা বোঝা যায় না। এরা বড় মানুষ, সাতজম্মে কাজকর্ম করে না–তাই হয়তো এতটা জেল্লা আছে। তবু চোখ ফেরানো যায় না বাপু এটা ঠিক। চোখ, ভুরু, কপাল, নাক, গলা–সব নিখুঁত, একটার সঙ্গে আর একটা যেন ওজন করে বসিয়েছে ভগবান। আর তেমনি কি গায়ের রং–যেন দুধে-আলতা।

ওর সেই শ্রদ্ধা-তদ্‌গত বিস্মিত দৃষ্টিরে দিকে চোখ পড়তে রতন হেসে ফেলে বললে, ‘কী গো বৌদি? ভাবছ এমন জানোয়ারটা কোথা থেকে এল, না কি? তোমাকে বাপু আর পেন্নাম করলুম না, তুমি আমার চেয়ে বয়সে ঢের ছোট। …অভয়দা আমার চেয়ে নাকি মোটে দু’ বছরের বড়। অম্বিক আমার সমবয়িসী, বয়সে ছোটকে পায়ে হাত দিয়ে পেন্নাম করতে নেই, অকল্যেণ হয়।’

।।৪।।

তিনতলার ঘরে পৌঁছে দিয়ে মোক্ষদা বললে, ‘ঐ হোথাকে ছাদের ওপরই গঙ্গাজলের চৌবাচ্চা। হাত পা মুখ সবই ধুতে পারবে। স্যেতখানা কিন্তু নিচে I বিছানা-পত্তর সব করাই আছে। খোকার দুধ নিয়ে আসছি। চা জলখাবার ঠাকুর ওপরে দিয়ে যাবে’ খন।’

প্রকাণ্ড ঘর। এক পাশে কিছু কিছু ডেয়োঢাকনা সরিয়ে রাখা হয়েছে। মাঝখানে তোশক পেতে দুটো ঢালা বিছানা

‘এ কার ঘর গো, মা মোক্ষদা?’ ক্ষীরোদা প্রশ্ন করেন।

মোক্ষদা মুখে কাপড় চাপা দিয়ে কেন যেন খুব খানিক হাসে।

বলে, ‘এ এমনি খালিই পড়ে থাকে। কেউ এল-গেল তবেই ব্যাভার হয়। নইলে এটা-ওটা থাকে। আর মুখপোড়া ঠাকুর আত দুপুরে মাঝে মাঝে এখানে এসে শোয়।’

‘কেন গা, তার ঘর নেই?’

‘থাকবে না কেন। নিচে সব আলাদা আলাদা ঘর। ঐ যে আর-এক ঝি এসে জুটেছে গোলাপী বলে–। দিদিঠাকরুনের পেয়ারের–আর বল কেন।

আভাস দেওয়া ইঙ্গিতটাকে শেষ না করেই বলে মোক্ষদা, ‘ঐ দ্যাখ আমার মনের ভুল! চা খাবে, ‘হ্যাঁ গো পিসীমা?’

‘সে আবার কী মা? জানি নে তো!’

‘আ আমার পোড়া কপাল! এখন তো ঘর ঘর চলতেছে এক রকমের গাছের পাতা যা, দুধ চিনি দিয়ে তৈরি হয়। দিব্যি খেতে, এই শীতে বেশ লাগবে!’

লোভে ও কৌতূহলে ক্ষীরোদার চোখ দুটি উৎসুক হয়ে ওঠে। তবু তিনি বলেন, ‘কে জানে বাপু কখনও তো খাই নি। বিধবা মানুষ–! বৌরা না হয় খাক।’

‘ওমা, চায়ে কোন দোষ নেই। গিন্নীমার মা-গোসাঁই আসেন, কী নিষ্ঠে তার–তিনিও খান। রবিশ্যি তাঁর চা গঙ্গাজলে হয়। তা তিনি তেমনি গঙ্গাজল ছাড়া কিছুই খান না।’

‘তা তবে না হয়ে নিয়ে এসো বাপু। দেখো কোন দোষ হবে না তো?

মোক্ষদা চলে গেল। ক্ষীরোদা গেলেন ট্যাঙ্কের জলে মুখ-হাত ধুয়ে দশ বার জপটা সেরে নিতে। অম্বিকা নিঃশব্দে একতলার উদ্দেশে সরে

পড়ল।

প্রমীলা যেন এতক্ষণে হাঁপিয়ে মরছিল, মুখের ঘোমটা খুলে ফিস্ ফিস্ করে প্রশ্ন করলে, ‘ওলো দিদি, ঠাকুরঝির কপালে সিঁদুর কৈ লো? ওধারে তো ঠাকুর-জামাই রয়েছে জলজ্যান্ত!’

‘ওমা, নেই বুঝি? কী করে দেখলি তুই? আমি তো অত লক্ষ্য করি নি।’

‘তুমি যা নেকু। নোয়াও তো দেখলুম না।’

‘কেন বল দিকি? এইস্ত্রী মানুষ–!’

‘মাকে জিজ্ঞেস কর না।’

‘ও বাবা, সে আমি পারব না। আমার অত সাহস নেই। তুমি জিজ্ঞেস কর, বুকের পাটা থাকে তো!’

‘করবই তো। সোজা কথা জিজ্ঞেস করার অত ভয় কিসের?’

আর করলেও প্রমীলা! ক্ষীরোদা আহ্নিক সেরে ঢুকতেই প্রমীলা সোজা প্ৰশ্ন করে বসল, ‘হ্যাঁ মা, ঠাকুরঝির সিঁথেয় সিঁদুর নেই কেন?…নোয়াও তো দেখলুম না।’

নিমেষে যেন কেমন হয়ে যান ক্ষীরোদা। শেজ-এর ম্লান আলোতেও সে বিবর্ণতা ধরা পড়ে।

আহ্নিক হয়ে গেছে কিন্তু জপের মালা তখনও হাতে। তাড়াতাড়ি সেটা মাথায় ঠেকিয়ে একটা পেরেকে টাঙিয়ে বলেন, ‘কে জানে বাপু, হয়তো মাকালীর কাছে নোয়া-সিঁদুর বাঁধা রেখেছে!…জিজ্ঞেস করব না হয়!’

প্রমীলার তীক্ষ্ম চোখ দুটো এড়াতেই বোধ হয় আবার বাইরে বেরিয়ে পড়েন। ততক্ষণ ঠাকুর চা নিয়ে এসেছে, এদের সব কাপে–ক্ষীরোদার জন্যে পাথরের বাটিতে, তার সঙ্গে দুখানা করে হিংয়ের কচুরি। একটা কাঁসার বাটিতে খোকার দুধ।

একেবারে রাত সাড়ে আটটায় মোক্ষদা আবার এল। একবাটি খয়ের গোলা গরম করে এনে চৌকাঠটার কাছে পা ছড়িয়ে বসল, ‘হেসো নি বাপু বৌদিরা, ভেবো নি যেন আলতা পরতিছি। পাঁকুইয়ের জ্বালায় মরে গেলুম, তাই একটু খয়ের দিচ্ছি!’

ক্ষীরোদা তখন সেখানে নেই। তাঁর বৌদি ফিরেছেন কালীঘাট থেকে, দেখা করতে গিয়েছেন নীচে। কে জানে কেন বৌদের নিয়ে যাবার কথা তিনি তোলেন নি। অম্বিকাও কী একটা কাজে গিয়েছে যেন। খোকা ঘুমিয়েছে। শুধু দুই বউ বসে মৃদু স্বরে গল্প করছিল।

মহাশ্বেতা বললে, ‘এমন শীতকালে পাঁকুই কী গো?’

‘আমার কথা আর বলো না বড় বৌদি। আমার বারো মাস হাজা। … আমায় তো দিনেরেতে রর্ধেক সময় ভিজে কাপড়ে থাকতে হয়। …তাও সে তেমন তেমন ভিজে কাপড় নয়, টপ্ টপ্ করে জল ঝরে পড়া চাই!’

‘কেন গো মোক্ষদা!’

আর কেন, পাপের ভোগ। …গিন্নীমার যে দুর্দান্ত ছুঁচিবাই। …আমি ছাড়া অত কষ্ট করবে কে বল? পুরোনো লোক বলতে তো এক আমিই। …আমার নইলে আর কারুর কাজ পছন্দও হয় না!…তাও ভাবি মানুষটা না খেয়ে মরে যাবে হয়তো–আমিই না হয় একটু কষ্ট করি।’

‘এমন চুঁচিবাই?’

‘আর বল কেন। মাথা খারাপ। আর মাথা খারাপ হবার অপরাধ কি বল! এত পাপ কি সহ্যি করতে পারে? হাজার হোক বামুনের মেয়ে তো!’

বলার সঙ্গে সঙ্গেই মোক্ষদার মুখখানা কেমন হয়ে যায়। অকম্মাৎ নিজের দুই গালে নিজেই ঠাঠাস্ করে চড় মারে, ‘এই এই!…দ্যাখ; কী বলতে কী বলে ফেলেছিলুম!…একে মনিব তায় গুরুজন–মহাপাপ! মহাপাপ!

মহাশ্বেতা তো অবাক।

প্রমীলাই কিন্তু কথাটা ঘুরিয়ে দেয়, ‘কাজ চুকল তোমার?’

‘এই এখনকার মত চুকল। কত্তাবাবুর খাবার হয়ে গেল। ঠাকুরকে যোগাড় দিয়ে এলুম। …এখন তোমাদের–সে ঠাকুরই করে নিতে পারবে, নয়তো গোলাপী আছে। আবার সেই দিদিঠাকুরুনের খাবার সময় হলে আমার ডাক পড়বে। কত্তাবাবুর ঠিক সাড়ে আটটা, দিদিঠাকরুন আর দাদাবাবুর রাত এগারোটায়–এ একেবারে ঘড়িধরা। একটু এদিক-ওদিক হবার উপায় নেই।’

অকম্মাৎ এই সময় নীচে থেকে ঝনঝন করে বাসন ছুঁড়ে ফেলবার শব্দ পাওয়া গেল, আর তার সঙ্গে চাপা গালাগালের আওয়াজ। মোক্ষদা ‘ঐ–আবার বাধল আজ!’ বলেই ঊর্ধ্বেশ্বাসে নীচে ছুটল।

মহাশ্বেতা অবাক হয়ে প্রমীলার মুখের দিকে তাকাল।

‘ও দিদি, বুঝলে কিছু?’ মুখ টিপে হেসে প্রমীলা প্রশ্ন করলে।

‘না ভাই। অত চট্ করে আমার মাথায় কিছু আসে না।’

‘আমি বুঝেছি।’

‘তুই বুঝ গে যা। আমার অত ভাল লাগে না।

সত্যিই তার ভাল লাগছিল না। আসলে মাসীদের জন্য মন কেমন করছিল তার। এই কাছেই তারা কোথায় আছে। এদিকে পথঘাট দেখেই সে চিনেছে। বিশেষ ঐ নতুনবাজার যখন অত কাছে তখন ওদের সিমলের বাড়ি দূর হবে না। তবু দেখা হবে কি না কে জানে! তারা কি এই সব আলোটালো দেখতে পাবে? কে-ই দেখায়! মা-বেচারী পড়ে রইল কোথায়। অনেক বার মনে হয়েছিল–তবু শেষ পর্যন্ত মুখ ফুটে অভয়পদকে মা’র কথাটা বলতে পারে নি।…’

একটু পরেই মোক্ষদা আবার এল, হাঁপাতে হাঁপাতে চাপা গলায় বললে, ‘ধন্যি নোলা বুড়োর বাবা, নিত্যি নিত্যি এই কেলেঙ্কার! পান থেকে চুন খসলেই থালা বাসন ছোঁড়াছুঁড়ি হবে, আর বামুনের বাপান্ত!

‘কী হল গো মোক্ষদা?’

‘আর কী হবে বল। রাত্তিরে কত্তাবাবুর পরোটা হয়, তা সে পরটা তো নয়, লুচির বাড়া। ওঁর ছ’খানি পরোটাতে পুরো এক পোয়া ঘি লাগে। মচ্‌মচ্ েহবে কিন্তু কালো দাগ পড়লে চলবে না। বাসিধোপ কাপড়ের মত ধপধপে হওয়া চাই। বল দিকিন বাপু, বারো মাস তিরিশ দিন অত নিক্তির রোজনে করা যায়? পাতলা কাপড়ের মত হবে, অথচ ভাঁজে ভাঁজে খোলা যাবে–কত নটখটি! আমি ছাড়া রমন কেউ বেলতেই পারে না, তা বেলে-টেলে দিয়ে এসেছি, ঠাকুর ভেজে ভেজে দিচ্ছি, একখান বুঝি একটু কাঁচা থেকে গেছে, রমনি থালা বাসান ভাঙল, ঠাকুরের চোদ্দপুরুষ স্বগে উঠল!…আর পারা যায় না বাপু!’

‘ঠাকুর সহ্য করে?’ প্রমীলা প্রশ্ন করল।

‘এমনি কি আর করে! এক দিন করে ঐ কাণ্ড হয় আর পরের দিন দিদিঠাকরুন মোটা বখশিশ দিয়ে ঠাণ্ডা করেন। মাইনেও তো মোটা। পেটে খেলে পিটে সয়–এই আর কি!’

‘মামাবাবু রাত্তিরে কি খান?’

.

‘ঐ তো। পরোটা হবে–চার-পাঁচ রকম ভাজা। দুটো ডালনা চাই, তা শীতকালে এঁচোড় আর গরমকারে কপি না খেলে চলে না। এ ছাড়া হয় মাগুর মাছ না হয় শোল মাছের কালিয়া–আত্তিরে মাংস চলে না ওঁর। এর রোপর আছে রাবড়ি আর সন্দেশ, বাঁধা বরাদ্দ। শেষের পরোটাখানি কড়া করে ভাজতে হবে, সেইটি গুঁড়িয়ে বাবড়ি আর সন্দেশে মেখে খাবেন। গরমকাল হলে তাতেই পড়বে ন্যাংড়া বোম্বাই আম। দাদাবাবুর আত্তিরে কোনদিন কোর্মা হবে, কোনদিন দো-পেঁয়াজি। আবার কত্তাবাবুর যেদিন ইচ্ছে হবে সেদিন দিনের বেলায় মাংস চাই।’

‘একটা ঠাকুর পারে এত?’ মহাশ্বেতা অবাক্ হয়ে প্রশ্ন করে।

‘আঃ পোড়া কপাল! ঠাকুর তো দু’জন। ঠিকে এক জন আছে, সে আমাদের সাজার রান্না রেঁধে চলে যায় দু’বেলা। …এর তো কত্তাবাবুর আর দিদিঠাকরুনের আন্না করতেই বাজিভোর হয়ে যায়! ওর সময় কখন?

প্রমীলা আস্তে আস্তে প্রশ্ন করে,– মামাবাবু দিনের বেলা কী খান?’

‘সে আর বলো নি। শুক্তো ঘণ্টা চচ্চড়ি ডালনা ডাল ভাজা–কী নয়? দু’রকম মাছ চাই-ই। তার সঙ্গে পোস্ত চাই, সেও বাঁধা একেবারে। কালিয়ে পোলাও যাই হোক না কেন–পোস্তটি চাই। চিরকালের রব্যেস, মাছ মাংস তো জোটে নি কখনও, ঐ পোস্ত দিয়েই ভাত ঠেলতে হয়েছে! শুধু কি তাই–যেদিন মাংস খাবেন সেদিন আবার সাদা ভাতের সঙ্গে এত কটি পোলাও চাই। সে পোলাও যেমন তেমন করে আঁধলে চলবে না। তা হলে থালা ছুঁড়ে ফেলে দেবেন! মুয়ে আগুন নোলার! এ নোলার জন্যেই তো এত বড় পাপ করা। নইলে এ কী ভদ্দর লোকের কাজ, না বামুনের কাজ?’

‘কী করেছেন গা মোক্ষদা? সেই থেকে বলছ?’ প্রমীলা গা টিপে দেবার আগেই মহাশ্বেতা দুম করে প্রশ্ন করে বসে।

‘ঐ দ্যাখ!–কী বলতে কী বলে ফেলেছিলুম!–বুড়ো হয়ে মরতে চললুম, জিভ এখনই শায়েস্তা হল না। …না বৌদি, আমরা হাজার হোক ঝি চাকর। তোমরা হলে আপনার লোক। …আমাদের ওসব কথায় থাকবার দরকার কি? যা মেজাজ, শুনতে পেলে বুকে বসে জিভ রোপড়াবে। গরীব মানুষ গরীবের মত থাকাই ভাল। এই এই–নাক কান মলা–এসব কথা আর ওঠাব নি!’

সত্যি-সত্যিই নাক কান মলে মোক্ষদা।

প্রমীলা কথাটা ঘুরিয়ে নেয় তৎক্ষণাৎ, ‘তোমার আর কে কে আছে মোক্ষদা?’

‘কেউ নেই গো বৌদি–শুধু এক মেয়ে, শিবরাত্তিরের সলতে। কেমন কপাল দ্যাখ না। বলতে গেলে বিনা পণে মেয়েটাকে ছেড়ে দিলুম–জামাই ভাল হবে মনে করে। কলকাতার কোন্ দোকানে কাজ করে, মোটা মাইনে, মনিবের বাড়ি খায়–নিখরচার বারো টাকা মাইনে। …তা আমার এমন কপাল, জামাইটা রেঁড়েল মাতাল হয়ে উচ্ছন্নয় গেল!….কখনও-কখনও বাড়ি আসে–কালে ভদ্দরে। একগাদা ছেলেমেয়ে, মেয়েটা যে কী করে দিন চালায় তা সে-ই ভালো জানে। এই আমি গুঁজছি এখান থেকে নিহাত দিদিঠাকরুন ভালবাসে তাই–নইলে মাইনে আর কি বল না? নিজের তবু এক পয়সা জমে না, বুড়ো বয়সে যে কার দোরে গিয়ে দাঁড়াব তা জানি না। আমাদের যতক্ষণ গতর ততক্ষণ রাদর। ছ’মাস পড়ে থাকলে ভাত জুটবে?…তাও কী বলব বৌদি, আজ তিন মাস ধরে এমন রক্ত-আমাশা ধরেছে মেয়েটার–পাত হয়ে গেল একেবারে, বাঁচে কি না সন্দেহ!’

প্রমীলা বলে, ‘ওমা, ও তুমি ভেবো না মোক্ষদা। রক্ত-আমাশার খুব ভাল ওষুধ আছে আমার বাপের বাড়ি। আনিয়ে দেব। একদিন খেলেই সেরে যাবে!’

‘আহা, তা হলে তো বেঁচে যাই। তাই দিও বৌদিদি, তাই দিও। … ভাগ্যিস কথাটা উঠল।’

নীচে থেকে কে যেন কী বলে ডাকলে, মোক্ষদা ‘আসছি ভাই বৌদি’ বলে দ্রুত নেমে গেল।

মহাশ্বেতা ঈষৎ অভিমানের সুরে বললে, ‘তোর বাপের বাড়ি এত ভাল ওষুধ আছে মেজ বৌ, কই গত মাসে আমার খোকাটা যখন ভুগল, তখন তো তোর মনে পড়ল না।

‘তুই থাম দিকি দিদি। তোর বোকামি দেখলে আমার গা-জ্বালা করে। ওষুধ কোথা পাব? ওকে এখন বললুম–আসল কথাটা তো ওর পেট থেকে টেনে বার করতে হবে!’

মহাশ্বেতা অবাক হয়ে গালে হাত দেয়।

॥৫॥

এরা দু’জনে বসে গল্প করছিল। প্রমীলা রতনদের কথাই বলছিল। মহাশ্বেতার মনটা কিন্তু বারবারই শ্বশুরবাড়ি চলে যাচ্ছিল কথার ফাঁকে ফাঁকে। মানুষটা একেবারে একা থাকবে। বুড়ীটা পর্যন্ত ওখানে নেই। যদি অসুখ–বিসুখ করে।

অবশ্য বেশিক্ষণ নয়–দশ মিনিট পরেই মোক্ষদা ফিরে এল।

‘আজ আবার বিলিতি হোটেল থেকে খাবার এল দিদিঠাকরুনদের। তা এক রকম ভাল। আজ ঐ খেয়েই চলবে–এধারে আর আঁধতে হবে নাঃ উলটে মাংসটা আমাদের ভোগে লাগবে।’

প্রমীলা সে কথায় কান না দিয়েই বলে, ‘তোমার মেয়ের বয়স কত আমাকে বলো–সেটাও জানতে হবে কিনা–আর একখানা পোস্টকাট এনে দিও। কালই আমি চিঠি লিখে দেব। ..আহা, দু’মাস ধরে ভুগছে, তার দেহে রইল কী?

‘তবেই বল বৌদি। তুমিই দ্যাখ। তোমরা হলে মানুষের ঘরের মেয়ে, তোমরা বলবে না তো কে বলবে বল। কত মায়া দয়া তোমাদের! এখানে যাঁরা আছেন, তাঁরা একটা কথা বললেও উদ্দিশ করেন না–তোর মেয়েটা রইল কি মল! দিদিঠাকরুনের কাছে কান্নাকাটি করলে বড় জোর পাঁচটা টাকা ফেলে দেবেন–যা তোর মেয়েকে পাঠাগে যা!

‘হ্যাঁ গো মোক্ষদা দিদি,’ প্রমীলার কণ্ঠস্বর যৎপরোনাস্তি কোমল হয়ে ওঠে, ‘আমাদের ঠাকুরঝি বুঝি নেওয়া-সিঁদুর বাঁধা রেখেছে ঠাকরুন-বাড়ি?’

‘পোড়া কপাল!’ ওষ্ঠাধরে বিচিত্র বক্রহাসি ফুটে ওঠে মোক্ষদার, ‘নোয়াসিঁদুর হল কবে যে বাঁধা পড়বে!’

‘সে কী গো? কী ব্যপার দিদি বল তো!’

হঠাৎ চমকে ওঠে মোক্ষদা, ‘ঐ দ্যাখ আমার বুদ্ধির ছিরি! কী বলতে কি বলে ফেললুম দ্যাখ!…এই, এই!’

আবারও নিজের গালে মুখে চড় মারে মোক্ষদা। কিন্তু পরই কেমন এক রকম যেন মরীয়া হয়ে ওঠে সে, বলে—-তা দোষই বা কি! তোমরা হলে আপনার লোক, জানতে পারবেই একদিন না একদিন। পিসীমা তো জানেই, দাদাবাবুরাও সব জানে–তোমাদের কাছে বুঝি বলে নি এত দিন? তা চাপা কথা কত দিন চাপা রাখবে তাই শুনি! জানতে তো পারবেই। তবে বাপু একটা কথা–বলো নি যেন আমি বলেছি, তা হলেই অমনি তোমাদের শাশুড়ি টুনটুন করে লাগাবে, মাঝে থেকে আমার চাকরি যাবে। তবে এটাও ঠিক–আমি গেলে এক দিনও চলবে না এ সংসারে। এত টেনে করবে কে? গিন্নীমাকে সামলাবে কে?’

এক নিঃশ্বাসে এতগুলো কথা বলে যেন দম নেবার জন্যেই থামে একবার মোক্ষদা। তারপর গলা নামিয়ে বলে, ‘ঐ মিসে, ঐ যে কত্তাবাবু–ঐ হ’ল গো যত নষ্টের মূল। ওঁর ঐ আখাম্বা নোলা। নোলাই কাল হ’ল একেবারে। মুয়ে আগুন নোলার! ভদ্দরলোকের ছেলে, বামুনের ছেলে–এই কি পিরবিত্তি তোর!…এমন খাওয়া মুখে তোলার আগে নিজের মুখে নিজের নুড়ো জ্বেলে দিতে পারলি না? …আমরা তো ছোটলোক, তবু আমরা কখনও এমন পয়সায় নবাবি করত পারতুম না।’

আরও এক পর্দা গলা নামায় মোক্ষদা। প্রায় ফিস্ ফিস্ করে বলে, ‘কত্তাবাবুর কী ছেল? কাটা কাপড়ের দোকানে চাকরি করত, আট টাকা মাইনে–এদিক ওদিক দু-চার পয়সা উপরি, এই তো। রবিশ্যি বোনের বে দিতে হয়নি, সে ওনার বাবাই দিয়ে গেছল–যা শুনছি তাই বলছি বৌদিদি–সত্যি মিথ্যে ভগবান জানেন–তা বোনের বে নাই বা দিতে হ’ল চারটে প্রাণীর সংসারই কি কম? কত্তা-গিন্নী, দুই মেয়ে–আট আনা ভাড়ায় খোলার ঘরে থাকত। তা এমন কি আর থাকে না? ক্রেমশ তো মাইনেও বাড়ত, শুনেছি ছাড়বার আগে বারো টাকা অব্‌দি উঠেছেল। কিন্তু পোড়াকপাল আমার–নোলার জন্য দেনায় দেনায় মাথার চুল পজ্জন্ত বিকিয়ে থাকত বারো মাস, বারো মাসই পাওনাদারদের তাগাদা শুনতে হত। এখন ভগবানের ও বলিহারী কীত্তি–মেয়ে দুটো হল–মানুষ তো নয় একেবারে পরী। যে দেখত চোখ ফেরাতে পারত না–এমন রূপ। ঐ রূপ আর বাপের নোলা-কাল হল। বস্তিতে থাকে তো, দিদিঠাকরুনের যখন সবে বারো-তেরো বছর বয়স, রাস্তার কলে জল নিচ্ছিল গামছা পরে–কে এক হালদার সায়েব ব্যালেস্টার যাচ্ছিল ঐ পথে গাড়ি করে। কী যে চোখে লাগল। ব্যস্–দালারও ছিল হাতধরা, কুট্‌ী লাগালো। এসে বললে হাজার টাকা নগদ আর এক গা গয়না দেবে–সায়েবের বাগান বাড়িতে যেতে হবে!…এমন কথা আমাদের বললেও আমরা মাগীকে ঝেঁটিয়ে বিষ ঝেড়ে দিতুম। ওমা–তা নয়, মিন্‌সে বললে, আচ্ছা ভেবে দেখি দু’দিন। তারপর বললে, তা হবে না, আমার মেয়ে যাবে না, ভাল দেখে বাড়ি ভাড়া করে ঘর সাজিয়ে দিক্, আমার মেয়ের ঘরেই আসবেন সায়েব। আর, হাজার নয়–দশ হাজার টাকা, আশি ভরি সোনা। সায়বেরও তখন রোখ চেপেছে–সে তাতেই রাজী হয়ে গেল। টাকা-কড়ি সোনা-দানা তো দিলেই, বাড়ি ভাড়া করে রাসবাবপত্তরে সাজিয়ে দিলে, মাসে মাসে দেড়-শ টাকা মাইনেও বরাদ্দ হয়ে গেল। ব্যস্ বুড়ো নিশ্চিন্ত–এসে বসে পায়ের ওপর পা দিয়ে খেতে শুরু করলে–মচ্ছি-মুলোয় পাঁচ বেন্ননে! মুয়ে আগুন অমন বামুনের!’

রুদ্ধ নিঃশ্বাসে শুনছিল মহাশ্বেতা। তাঁর চোখ দুটো যত দূর সম্ভব বিস্ফারিত হয়ে উঠেছে ততক্ষণে, মনে হচ্ছে যেন ঠিকরে বেরিয়েই আসবে। কিন্তু প্রমীলা আশ্চর্য রকম স্থির হয়ে বসেছিল, সে শুধু প্রশ্ন করলে, ‘সেই হালদার সায়েবই বুঝি এলেন এখন?’

‘না না। তিনি এই পাঁচ বছর হ’ল মারা গেছেন। কী নাকি মদের বোতলে হাত কেটে বিষিয়ে উঠে মারা গেলেন দু’দিনে। তা এতকাল যার কাছে রইল, ছেঁড়ে-মূষে দুয়ে নিলে–তাই কি দুটো দিন তার জন্যে শোক করলে, না বুড়োরই সবুর সইল! এ যেন কোথাকার রাজা বাপু–শামপুকুর না ঝামপুকুর, না কি ঐ রকম কোথাকার। রাজা খেতাব–তবে ঐ পজ্জন্ত। হালদার সায়েবের মত কাঁচা পয়সা এর নয়। এই যে বাড়ি ঘরদোর দেখছ–এসব সেই তার পয়সায়। কী দিল–দরাজ মানুষ ছেল বাপু কী বলব! তা হ্যাঁ বলছিলুম, এ মিসে যেন ওত পেতে ছেল। সাত দিনের মাথাতেই এসে বসল। পাঁচ হাজার টাকা নগদ, দুঃশ মাইনে, জড়োয়া গয়না। তবে হ্যাঁ–লোকটা ভদ্দর, হালদার সায়বের মত মদ খায় না, চেঁচামেচি হুল্লোড় নেই। খেলেও সে কোন কোন দিন একটু-আধটু–যেমন আজ! সে কেউ টের পায় না।

‘আর-এক ঠাকুরঝির কী হল?’ প্রমীলা প্রশ্ন করে।

‘হুঁ–হুঁ, সে বড় শক্ত মেয়ে বাবা। সেও যেমন তেরো বছরেরটি হ’ল, কত্তাবাবু কোন্ এক মারোয়াড়ী বাবু জুটিয়ে আনলে। সেও মোটা টাকা কবুল করেছিল। মেয়ে সটান বাবুর সামনে বেরিয়ে এসে বললে, মাল আমার, বেচতে হয় আমি হাত পেতে তার দাম নেব। তুমি বাড়ি ভাড়া কর, লোক রাখ, আমাকে নিয়ে চল। নিজে হাতে আমি টাকা গুনে নেব। বাবার হাতে টাকা দিলে আমি কিছু জানি না। জোর করতে এলে এই ক্ষুরে নাক কান কেটে দেব–তা বলে রাখছি! এই বলে সে কোমার থেকে ইয়া এক ক্ষুর বার করে দেখালে!…মারোয়াড়ী খুব খুশী–সে তিন দিনে সব ব্যবস্থা করে দিলে। উঃ, সে বুড়োর কী আক্কোশ! চেঁচিয়ে, গাল দিয়ে, চুল ছিঁড়ে বাড়ি মাথায় করলে একেবারে। কিন্তু মেয়ে একবগ্‌গা ঘোড়ার মত জেদ ধরেই রইল–এতটুকু নুইল না। বললে, আমি দিরি মত অত বোকা নই। তুমি আমার যদি এত বড় সব্বনাশ করতে পারো তো তুমি আমার কিসের বাবা, কিসের গুরুজন! টাকার ওপর বড় যদি কিছুই না থাকে তো টাকা আমিও চিনব এখন থেকে, তোমাকে দেব কেন? তা সে বেশ আছে,–এরই মধ্যে দুখানা বাড়ি করে ফেলেছে, মারোয়াড়ীর দেখা-দেখি নাকি ফাট্‌কা খেলে, তাতেও অনেক পয়সা কামিয়েছে!

তাঁর নাম কি দিদি? কৈ, তাঁর নাম তো কখনও শুনি নি!’

‘শুনবে কি করে! কত্তা বলেন, সে মরে গেছে। তার নাম ধনু,–রতনমণি আর ধনমণি, আদর আদর করে নাম, রাখা হয়েছিল।’

মোক্ষদা এতক্ষণ পরে একটু চুপ করে থাকে। এরাও নিঃশব্দে বসে যেন কথাটা সম্পূর্ণ বোঝবার চেষ্টা করে কিছুক্ষণ ধরে। তার পর প্রমীলাই আবার প্রশ্ন করে, ‘তা মামীমা কিছু বলেন নি?’

‘বলে নি আবার!’ কান্নাকাটি উপোস মাথা-খোঁড়াখুঁড়ি অনেক কিছুই করেছিল। কিন্তু এ দস্যির সঙ্গে পারবে কি করে? চণ্ডাল রাগ–এখনও, ঘেন্নার কথা বলব কি, এই ঝি-চাকরদের সামনেও, ধরে ধরে চোরের মার মারে। এইসব জন্যেই তো কতকটা গিন্নী-মায়ের মাথাটা কেমন হয়ে গেছে! ঐ দেবতাধম্ম বারব্রত নিয়ে থাকে, ছুঁচি-বাই বেড়েছে। আদ্দেক দিন তো খাওয়াই হয় না। আমি ভিজে কাপড়ে সব যোগাড় করে দেব, উনি নিজে দুটো ফুটিয়ে খাবেন! খাওয়া তো ছাই, এক বেলা শুধু দুটো ভাতে ভাত; তাও দুধ নয়, ঘি নয়, কিছু নয়। তাই কি সব দিন পেটে যায়? বাড়িময় মাছ-মাংসের হুল্লোড়, কাকচিলেরও অভাব নেই। উনুনের ধারে মাছের কাঁটা এসে পড়ল কি জলের ছিটে লাগল–একটু সন্দ হলেই খাওয়া-দাওয়া বন্ধ। বলে তো–নিহাত আপ্তঘাতী হওয়া পাপ তাই–নইলে কবে গলায় দড়ি দিতুম। এমনি করে যদ্দিন যায় যাক–আমার আর ভালমন্দ খেয়ে বাঁচবার সাধ নি। তা বলবেই না বা কেন বল–গিন্নীমা যে খুব বড় বংশের মেয়ে। কী রূপ ছেল বয়েসকালে। আমরাও দেখেছি সোনার পিতিমে। এখন অবিশ্যি তার কিছুই নেই। না খেয়ে আর কেঁদে কেঁদে পোড়া কাঠ হয়ে গেছে!’

বলতে বলতেই কান খাড়া হয়ে ওঠে মোক্ষদার। অভ্যস্ত কানে অতি ক্ষীৰ্ণ পদশব্দও বুঝি পৌঁছায়। তাড়াতাড়ি নিজের কান নিজে মলে ফিসফিসিয়ে বলে, ‘কী বলতে কি সব বলে ফেললুম দ্যাখ। দেখো বৌদিরা, জানে মেরো নি যেন!’

সিঁড়ির কোণ থেকে ছাদের অন্ধকারেই সাদা কাপড় পরা দুটি মূর্তি স্পষ্ট হয়ে ওঠে। ক্ষীরোদা আসছেন–তাঁর সঙ্গে আর এক জন।

ক্ষীরোদা হেঁকে বলেন, ‘কৈ গো বৌমারা, কোথায় গেলে গো সব। তোমাদের মামীমা এসেছেন–পেন্নাম করোসে–’

অত্যন্ত শীর্ণ–প্রায় ছায়া-মূর্তির মতই একটি মহিলা এসে দাঁড়ালেন। মূর্তিমতী বিষাদের মত মুখখানি। এ মুখ যে এককালে অত্যন্ত সুশ্রী ছিল, প্রায় রতনের মতই ছিল–অনেকক্ষণ চেয়ে দেখলে তাঁর একটা আঁচ পাওয়া যায় মাত্র। টানা চোখ দৃষ্টিতে আগের সে আবেশ আর নেই–তবু বিস্তৃতিটা আছে। গায়ের রং পুড়ে তামাটে হয়ে গেছে। বেশভূষাও তেমনি, কঙ্কালসার হাত দুটিতে শুধু শাঁখা আর কড়। দেহের কোথাও একরত্তি সোনা নেই। পরনেও সাধারণ কস্তাপাড় নতুন–ওঠা দেশী মিলের গুণচটের মত শাড়ি।

মহাশ্বেতা গিয়ে প্রণাম করে পায়ের ধুলোর জন্যে হাত বাড়াতেই তাড়াতাড়ি হাত দুটো ধরে বুকে টেনে নিলেন তিনি, মাথায় পিঠে হাত বুলিয়ে বললেন, ছি মা, পায়ে হাত দিতে নেই। সতীলক্ষ্মী তোমরা পায়ে হাত দিলে সে পাপ রাখার যে ঠাঁই থাকবে না মা!’

ততক্ষণ কিন্তু প্রমীলা এক ফাঁকে তাঁর পায়ের ধুলো নিয়ে নিয়েছে। তাকেও বুকে টেনে নিয়ে দুহাতে দুজনকে চেপে ধরে বললেন, ‘সীতা সাবিত্রীর মত স্বামীপুত্র নিয়ে ঘর করো মা, বংশের মুখ উজ্জ্বল করো, সন্তানদের কল্যাণ করো। আমাদের আশীর্বাদের কোন মূল্যই নেই মা, হয়তো অধিকারও নেই। মা, সতীকুলরাণী তোমাদের রক্ষা করুন–এইটুকুই শুধু তাঁকে কায়মোনোবাক্যে জানাই প্রতিদিন–

বলতে-বলতেই তাঁর দুই চোখের কূল ছাপিয়ে ঝর ঝর করে জল ঝরে পড়ল।

ক্ষীরোদা তাড়াতাড়ি ওঁর বাহুমূলটা একটু টিপে দিতেই যেন অনেকক্ষণের চেষ্টায় নিজেকে সামলে নিয়ে বললেন, ‘তোমরা এইবার নীচে যাও মা, ঠাকুরঝির জল খাওয়া হয়ে গেছে। তোমরা যাহোক দুটো মুখে দিয়ে নাও। …মোক্ষদা মা, এদের নিয়ে যাও —

মহাশ্বেতা বললে, ‘কিন্তু ঠাকুরপো এল না যে– ‘

ক্ষীরোদাই বৌদির হয়ে জবাব দিলেন, ‘সে গেছে গড়ের মাঠে আলো দেখতে, তার ফিরতে অনেক রাত হবে। তোমরা খেয়ে নাও গে, তাতে কোন দোষ নেই! সে যখন হোক এসে খাবে’খন। ঠাকুরের হাঁড়ি হেঁসেল তুলতে তুলতে যার নাম রাত বারোটা। ততক্ষণে সে এসে পড়বে।

মোক্ষদা তাড়াতাড়ি ওদের প্রায় টেনে নিয়েই নীচে নেমে গেল।

তৃতীয় পরিচ্ছেদ

॥১॥

শ্যামার মা রাসমণি জমিদারের স্ত্রী হয়েও ভাগ্যচক্রে একই সঙ্গে স্বামী শ্বশুরবাড়ি এবং স্বামীর ঐশ্বর্য সব হারিয়ে বসেছিলেন। শুধু পেয়েছিলেন তাঁর নিজস্ব অলঙ্কার এবং কাঁঠালকাঠের দুই বড় সিন্দুক বোঝাই কাঁসার বাসন। তাইতেই তিনি দীর্ঘকাল স্বতন্ত্রভাবে আলাদা বাড়ি ভাড়া করে থেকে সম্ভ্রান্ত বংশের গৃহিণীর মর্যাদাতেই জীবন কাটিয়ে যেতে পেরেছিলেন। তবে তিনি বেঁচেও ছিলেন অনেকদিন। তাই তাঁর মৃত্যুর সময় বিশেষ কিছুই আর অবশিষ্ট ছিল না। ফলে তিনি যেদিন চোখ বুজলেন সেদিন তাঁর স্বামী-পরিত্যক্তা কন্যা উমা চোখে অন্ধকার দেখল। তাঁর স্বামী শরৎ এক বিচিত্র মানুষ। সে ফুলশয্যার রাত্রে প্রথম প্রণয়-সম্ভাষণের পরিবর্তে শুনিয়ে দিয়েছিল যে সে এক রক্ষিতাকে ভালোবাসে–এবং তাঁকে ছাড়া আর কাউকেই ভালবাসতে সে পারবে না। মা জ্বালাতন করছিল বলেই শুধু সে উমাকে বিয়ে করেছে। এবং সত্যি সত্যিই তার সঙ্গে আর কোন সম্পর্ক সে রাখে নি। শাশুড়ির নির্যাতন অসহ্য হওয়াতে যখন পাশের বাড়ির একটি মহিলা তাকে উদ্ধার করে এনে রাসমণির কাছে রেখে যান তখনও সে কোন খোঁজ নেওয়া দরকার মনে করে নি। অবশ্য তারপর দু একবার দেখা হয়েছিল বৈকি। মা যেদিন মারা যান সেদিনও সে পাশে দাঁড়িয়েছিল ঠিকই, হয়তো বা কিছু সাহায্যও করতে পারত, কিন্তু যে স্বামী কোনদিন তাকে–ভালোবাসা দূরে থাক–স্পর্শ পর্যন্ত করলে না, সে স্বামী স্পষ্টতই এক বার-নারীর প্রেমে আকণ্ঠ মগ্ন–তার কাছ থেকে তার অবহেলিত দেহটাকে রক্ষা করার জন্য পয়সা ভিক্ষা করার চেয়ে দেহটাকে শেষ করে ফেলাও যে ঢের সহজ। না, উমা ভিক্ষা চায় নি।

অথচ সেদিন আর কোন আশ্রয়ই ওর ছিল না। রাসমণি তিনটি মেয়েরই বিয়ে দিয়ে গিয়েছিলেন সত্য–কিন্তু কারুরই নিশ্চিন্ত বা নিরাপদ ব্যবস্থা করতে পারেন নি। উমার বড় বোন কমলা অবস্থাপন্ন চরিত্রবান লোকের হাতেই পড়েছিল কিন্তু অত্যন্ত অকালে বিধবা হওয়ার ফলে সেও আজ নিরাশ্রয়। সামান্য গহনা-বেচা কটি টাকার সুদে কায়ক্লেশে তার সংসার চলে। উমার যমজ বোন শ্যামা–তার স্বামী নরেন তো আরও অমানুষ। সমস্ত পৈতৃক সম্পত্তি উড়িয়ে দিয়ে স্ত্রী-পুত্রকন্যাকে ভিখারীর পর্যায়ে দাঁড় করিয়েও সে থামে নি। একেবারেই পথে বসত ওরা, কোনমতে পদ্মাগ্রামের সরকার বাড়ির নিত্য সেবার কাজটা যোগাড় হয়েছিল তাই মাথা গোঁজবার মত একটু আশ্রয় এবং দৈনিক আধ সের আতপ চালের এই ব্যবস্থাটুকু হয়েছে। তাও সে কাজটুকুও তার দ্বারা হয়ে ওঠে না, ঠাকুরের ভার একরকম ঠাকুরের নিজের ওপরই। সমস্ত সংসারের ভার তরুণী স্ত্রীর ওপর তুলে দিয়ে অনায়াসে সে দীর্ঘকাল অজ্ঞাতবাস করত এবং মধ্যে মধ্যে অকস্মাৎ এসে তাদের ভিক্ষান্নে ভাগ বসিয়ে, এমন কি কিছু চুরি করেও আবার গা-ঢাকা দিত।

সুতরাং কার কাছে যায় উমা? শুধু দেহধারণের প্রশ্নই নয়। নবীন বয়স এবং অসামান্য রূপ, এই দুটি পরম শত্রুর কাছ থেকে আত্মরক্ষা করার জন্য একটু নিরাপদ আশ্রয়ও চাই।

অগত্য কমলার কাছে এসে দাঁড়াতে হয়েছিল তাকে। সিমলের কোন সংকীর্ণ গলির এক প্রাচীন বাড়ির একতলায় দুটি অন্ধকার ঘর ভাড়া করে দুই বোন তাদের জিনিসপত্র নিয়ে এসে কোনমতে মাথা গুঁজে ছিল। উমা দু টাকা এক টাকা মাইনের কয়েকটি টিউশনি করত, আর কমলার ছিল মাসিক ষোলটি টাকা বাঁধা আয়। তাইতেই কোনমতে চলত ওদের। এরই মধ্যে গোবিন্দর লেখাপড়া শেখার খরচাও ছিল। সুতরাং অবসর বস্তুটি ওদের জীবনে একেবারেই ছিল না–না চিন্তার, না বিলাসের। –তবু সেই অন্ধকার ঘরেও একদা খবরটা এসে পৌঁছায় ‘রাজা আসছেন’।

উমা যেখানে যেখানে মেয়ে পড়ায়, সব জায়গাতেই দেখে আয়োজন। গোবিন্দ ইস্কুল থেকে খবর দেয়–তারা দুদিন বাড়তি ছুটি পাবে আর তাদের লেবু-সন্দেশ খাওয়ানো হবে। ‘কিন্তু রাজা দেখার কী হবে মা?’ মার দিকে উৎসুক মুখ তুলে গোবিন্দ প্রশ্ন করে।

কমলা উত্তর দিতে পারে না। ওদের বাড়িওয়ালা কাকে ধরে একখানা গাড়ির ব্যবস্থা করেছে। তা ষেটের কোলে ওদেরই তো চৌদ্দ জন–মেয়েছেলে আর ছোট ছেলে মিলিয়ে। কী করে ধরবে কে জানে! বুড়ো গিন্নী বলেছেন, ‘সে আমরা যেমন করে পারি ধরাব। তবে ওর বেশি আর হবে না’–কতকটা কমলাদের শুনিয়েই শেষের কথাগুলো বলা।

অবশ্য ধরেও ওদের ঐ ছেলে বুড়ো চোদ্দ জন একখানা গাড়িতে–তা কমলা নিজের চোখেই দেখেছে। কর্তার ভায়রা-ভাই এক প্রেসের ম্যানেজার। বুঝি কোন্ থিয়েটারের প্লাকার্ড ছাপে, মধ্যে মধ্যে মেয়েদের এক গাড়ি পাস দেয়। তখন ঐ একখানা গাড়ির মধ্যে আশ্চর্য কৌশলে ওঁরা ধরান ঐ চোদ্দ জনকে। প্রতিদিনই কমলার ভয় হয় বুঝি সর্দিগর্মি হয়ে দু-একটা ছোট ছেলেমেয়ে মরে–কিন্তু প্রতিদিনই সে আশঙ্কাকে উপহাস করে ফেরবার সময় দুখানা গাড়ি চড়ে ফেরে ওরা। যাবার সময় অবশ্য চার আনা ভাড়ার ওপর আরও দু আনা বখশিশ দিতে হয়–কিন্তু তাতে লোকসান নেই। গাড়ির ছাদের ওপর খাবারের ঝুঁড়ি, জলের কুঁজো, পাখা, কাঁথা, বালিশের পুঁটুলি নিয়ে ওঁরা সন্ধ্যার আসেই হৈ-হৈ করতে করতে চলে যান–ফেরেন একেবারে ভোরবেলা। আজকাল রেওয়াজ হয়েছে দুখানা আড়াইখানা করে নাটক হয় সারারাত ধরে–এক-এক দিন বেশ বেলাও হয়ে যায়। তাছাড়া আগে আরম্ভ হ’ত রাত ন’টায়, এখন সাতটা না বাজতে বাজতে শুরু হয়–ছেলেমেয়েদের দুধ, বার্লি কাঁথা সবই গুছিয়ে নিয়ে যেতে হয়।

কিন্তু সে যাক–কমলার ওদিকে কোন আশা নেই। উমা যাদের বাড়ি পড়ায় তাদের মধ্যে এক ডাক্তারের একখানা গাড়ি আছে– সেই গাড়িটির ভরসাতে নাকি একরাশ কুটুম্ব এসে জড়ো হয়েছে। তবু তাঁরা উমাকে বলেছিলেন যে এক দিন অন্ততঃ আলো দেখাতে নিয়ে যাবেন তাতে কিন্তু উমা রাজি হয় নি। দিদিকে ফেলে, বিশেষ করে গোবিন্দকে ফেলে যাওয়া সম্ভব নয়।

এক উপায় আছে গাড়ি ভাড়া করে আলো দেখতে যাওয়া কিন্তু তাতেও দুটি বড় বাধা, প্রথমত, একটু শক্তগোছের পুরুষমানুষ না হলে শুধু গোবিন্দর ভরসাতে অচেনা গাড়োয়ানের সঙ্গে যাওয়া যায় না–দ্বিতীয়ত সব চেয়ে বড় বাধা হল–টাকা। গাড়িওয়ালারা নাকি হাতে মাথা কাটছে। আলো দেখাতে ভাড়া চাইছে দুই টাকা তিন টাকা পর্যন্ত–রাজা আসবার দিন নাকি পাঁচ টাকা ছ টাকা পড়বে–এ ওদের সাধ্যাতীত।

সুতরাং কমলা শুষ্ক মুখে ঘাড় নাড়ে, ‘কী বলব বাবা, আমাদের কী সে ক্ষমতা আছে?’

গোবিন্দ ম্লান চোখ দুটি মাটিতে নামিয়ে চুপ করে বসে থাকে। সে আর নিতান্ত ছোট্ট ছেলেটি নেই। গত কয়েক বছরেই সে এটুকু বুঝে নিয়েছে, অন্য অন্য ছেলেদের মত আব্দার করা তার সাজে না।

এরই মধ্যে এক দিন সকালে অতি-পরিচিত একটি কণ্ঠের ডাক কানে এসে পৌঁছয়, কৈগো দিদি কোথায় গেলে? উমি। উমি বাড়ি আছিস নাকি?

প্রথমটায়–পরিচিত হলেও ঠিক মনে করতে পারে নি উমা। তারপর হঠাৎ মনে পড়ে গেল। এ গলার আওয়াজ ভগ্নীপতি নরেনের।

তাড়াতাড়ি বেরিয়ে এল সে। আর যাই হোক নরেন তাদের এ ঠিকানা খুঁজে বার করবে এ আশঙ্কা সে কখনও করে নি। পাঁচ জনের সঙ্গে বাস, বাড়িওয়ালা, বিশেষত বুড়ো গিন্নী বড় বেশি কৌতূহলী, তাঁর মুখও বড় প্রখর। হয়তো এই নিয়ে অন্ততঃ বিশ দিন খোঁটা দেবেন। নরেনের তো কোন কাণ্ডজ্ঞান নেই, হয়তো এমন বেশভূষায় এসে দাঁড়াবে যে পরিচয় দিতেই লজ্জা করবে। আর তেমনি তার কথাবার্তাও

উমা বেরিয়ে এসে দেখলে তার অনুমান সবটা ঠিক না। বেশভূষাটা আজ অন্তত চলনসই। একটা ধোয়া থান পরনে এবং গায়ে একটা ফরসা উড়ুনি। হয়তো সদ্য কোন ক্রিয়া-কর্মে পাওয়া। যদিও কাপড়টা হাঁটুর ওপর তুলে পরা এবং অবিরত রোদে-জলে চলার ফলে পা দুটির অবস্থা বঙ্কিমের বিদ্যাদিগ্‌গজের পায়ের মতই, তবু এক জোড়া নতুন চটি থাকায় খানিকটা ভদ্রতা বজায় আছে। হাতে অতি পুরাতন এবং ছেঁড়া একটি ক্যাম্বিসের ব্যাগ, তার সঙ্গে দড়ি দিয়ে বাঁধা একটি থেলো হুঁকো ও কলকে। বেশ প্রশান্ত এবং সহাস্য মুখে ওধারে সারি সারি দাঁড়ানো বাড়িওলাদের দিকে তাকিয়ে আছে। উমা যত তাড়াতাড়িই বেরিয়ে আসুক–বুড়ী গিন্নী তারও আগে এসে দাঁড়িয়েছেন এবং নিঃশব্দ-কৌতুকে নিরীক্ষণ করছেন আগন্তুকটিকে।

উমা বেরিয়ে আসতেই তিনি মুখ টিপে প্রশ্ন করলেন, ‘কে হয় গা তোমাদের, মা উমা?’

উম উত্তর দেবার আগে নরেন নিজেই উত্তর দিলে,’আজ্ঞে আমি ওদের ভগ্নীপতি হই গো মা-ঠাকরুন। এ বাড়ির আমি মেজজামাই!’

‘বেশ জামাই!’ আবারও মুখ টিপে বলেন তিনি।

প্রীত এবং গদ্‌গদ্ কণ্ঠে নরেন উত্তর দেয়, ‘সে যা বলেন নিজ গুণে, হেঁ হেঁ। তা ভাল, ভাল–খোঁজখবর যে রাখেন এই ভাল। আপনাদের ভরসাতেই তো এখানে ফেলে রাখা। সত্যিই ধরুন দুটো সোমাত্থ মেয়ে থাকে–হুঁট করে অমনি পুরুষ আসা তো ঠিক নয়।’

‘তুমি বাছা বুঝি এদের গার্জেন? তা কৈ এতকাল তো দেখি নি কোন দিন?’

‘দেখবেন কী করে মা, নিজের শুয়োরের পাল দেখব না এদের দেখব। মাগী তো বিইয়েই খালাস–কী জ্বালা তা আমিই জানি। দেখেশুনে ইচ্ছে হয় এক-এক দিন দিই গোরবেটার জাতকে কেটে কুচি কুচি করে গঙ্গার জলে ভাসিয়ে। কেউ মানুষ হবে ভেবেছেন? কেউ না, কেউ না।’

উমা তার বিরক্তি চেপে রাখতে পারে না। বাড়িওলাদের সবাই হাসছে। পাগল বা সং দেখলে যেমন হাসে। সে প্রাণপণে দাঁত দিয়ে ঠোঁট চেপে নিজেকে সামলায়। বলে, ‘ভেতরে আসবেন, না সারাদিন উঠোনে দাঁড়িয়ে বকবেন!’

‘না–না–এই যে যাই।’

ভেতরে এসেই বলে, ‘ও চামডাইনী বুড়ী কে রে? বাড়িউলী বুঝি? মাগীর চিপ্‌টেন কেটে কেটে কথা দ্যাখ না একবার

ততক্ষণে কমলা এসে দাঁড়িয়েছে।

‘এই যে দিদি, দাও দিকি একটু চা তৈরি করে। এ আবার পোড়ার এক অব্যেস করে ফেলেছি। ভয় নেই, চা-চিনি সব নিয়ে এসেছি যোগাড় করে। তারপর উমি, সব ভালো তো?’

উমা সে প্রশ্নের জবাব না দিয়ে বলে, ‘এখানকার ঠিকানা কে দিলে আপনাকে? ছোটদি?’

‘বজ্জাত মাগী দিতে কি চায়? কত করে বললুম হারামজাদীকে–কিছুতেই দিলো না। আমিও তেমনি–বিছানার নীচে থেকে তোদের পুরোনো একখানা চিঠি টেনে বার করলুম। তাতেই তোদের ঠিকানা লেখা ছিল এ বাড়ির। তা সেও হয়ে গেল অনেকদিন। ছ মাস আগের কথা–ঘুরতে ঘুরতে এদিকে আসাই হয় না–নিহাত এই রাজা আসছে শুনলুম তাই! কলকাতায় আসতে হবে, মনে পড়ল, ব্যাগের মধ্যে থেকে টেনে বার করলুম চিঠিখানা। বলি আস্তানা যখন একটা আছেই তখন আর ভাবনা কি? এই নাও যোগাড় সব—’

চা-চিনির মোড়ক দুটো বার করে দিয়ে নিজে তামাক সাজতে বসে নরেন।

কমলা তাড়াতাড়ি প্রশ্ন করে, ‘তা ওরা সব আছে কেমন?’

‘আছে, আছে–ভালই আছে।’ মুরুব্বীয়ানার ভঙ্গিতে উত্তর দেয় নরেন। উমা বিরক্তি আর গোপন করে না। বলে, ‘তুমিও যেমন দিদি, ও তাদের কি খবর রাখবে? ছ মাস আগে একবার গিয়েছিল তা তো শুনলেই।’

হা-হা করে প্রায় অট্টহাস্যে হেসে ওঠে নরেন।

‘বেড়ে বলিছিস বাই। জিতা রহ। যাই বল দিদি, উমিটার কেলেভার আছে। আর নইলে কি ম্যাস্টারি করতে পারে। কথাটা বলেছে মন্দ নয়। কতকটা তাই বটে। তবে কি জানিস উমি, ওরা ভালই থাকবে তা আমি জানি। ও মাগীর কি মরণ আছে? মলে ওরও হাড় জুড়োয়–আমারও হাড় জুড়োয়। যমের অরুচি। ওদের মরণ নেই–বুঝলি, ওদরে মরণ নেই। আকন্দর ডাল মুড়ি দিয়ে বসে আছে–’

আরও এক দফা হেসে নিয়ে কলকেতে ফুঁ দিতে থাকে নরেন। অসহ্য ক্রোধ দমন করতে না পেরে উমা সরে পড়ে।

কমলা চা এনে ধরে দিয়ে বললে, ‘তারপর? মতলবটা কি?

‘মতলব! ঐ যে বললুম রাজা আসছে, বাজি পুড়বে, আলো জ্বলবে, তাই দেখতে এলুম। তা আস্তানা তো চাই। তোমরা থাকতে আর কোথায় যাব বল।’

‘এখানে থাকবে কোথায়? আমরা এক ঘরে থাকি কোনমতে। ও ঘরটা তো মালে ঠাসা। এর ভেতরে পুরুষ মানুষ তুমি থাকবে কোথায়?’

‘ও, সেজন্য কিছু ভেবো না দিদি। সে আমি ঠিক করে নেব। ঐ যে বাড়ি ঢুকতে চলনটায় বেঞ্চি গাঁথা রয়েছে একটা? ঐখানেই তোফা শুয়ে থাকব এখন। আমরা পুরুষ মানুষ, সব অব্যেস আছে। বলে কত রাত গাছতলায় কেটে যায়, তো পাকাবাড়ির ব্যবস্থা। সেজন্যে কিছু ভেবো না। তুমি এখন রান্না চড়াও দিকি, বেশ হিং-আদা-মৌরি দিয়ে যেমন রাধো বিউলির ডাল, অনেক দিন খাই নি। আর কড়াইশুঁটির ডালনা। সেবার খেয়ে গিয়েছিলুম যেন অমর্ত, আজও মুখে লেগে আছে। খাওয়ায় আমার কোন গোল নেই। বেগুন- পোড়ার সঙ্গে দু’কুচি আদা পিঁয়াজ দিও–তাতেই দিব্যি খাওয়া হয়ে যাবে। আর একটু আলু ভাতে। ব্যস্!’

চা শেষ করে নরেন হুঁ কোয় টান দেয়।

।।২।।

বিকেলবেলা টানা একটা ঘুম দিয়ে উঠে নরেন বলে, ‘দিদি যাবে নাকি আলো দেখতে? যাবে তো চলো। গোবিন্দ কী বলিস?’

গোবিন্দর চোখ আগ্রহে, ঔৎসুক্যে জ্বলতে থাকে। সে মার মুখের দিকে তাকায়।

কমলা তখনই কিন্তু কোন উত্তর দিতে পারে না। বিব্রত মুখে উমার দিকে তাকায়।

নরেন আবারও বলে, ‘চল না দিদি, সেই তো গাড়ি করতেই হবে একটা–তোমাদেরও দেখা হয়ে যাবে।’

‘তুমি কি গাড়ি করবে নাকি?’

‘ওমা তা করব না! তোমাদের কি নিয়ে যাব হাঁটিয়ে হাঁটিয়ে? আমি একা হলে আলাদা কথা–

‘বেশ তো তুমিই যাও না ভাই!’

‘সে কী কথা। তা কখনও হয়। এলুম যখন, তোমাদেরও কেউ নেই–আমার তো এটা কত্তব্যের মধ্যে পড়ল গো।’

কমলা উমার মুখের দিকে চায়।

উমা ঘাড় নাড়ে, ‘না দিদি, আমি কোথাও যাব না।’

কমলা বলে, ‘তা হলে আমিই বা যাব কেমন করে। তুমি একাই যাও ভাই–’

‘তাই তো, যাবে না? গোবিন্দটা–? গোবিন্দ না হয় চলুক।’

উমা দৃঢ়স্বরে বলে, ‘না, গোবিন্দ একা আপনার সঙ্গে যাবে না।’

‘যাবে না? তবে থাক।’

গোবিন্দ মিনতি করে, ‘তুমি চল না ছোট মাসী। তুমি গেলেই আমাদের সকলে যাওয়া হয়। তোমাদের দুটি পায়ে পড়ি ছোট মাসী–চল—’

সেদিকে চেয়ে একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে উমা।

কমলা সমস্ত বুঝে বলে, ‘যাই চলনা। কোথাও তো যাস না!’

নরেন মহা উৎসাহে গিয়ে গাড়ি ডেকে আনে।

.

এ পাড়া থেকে বেরিয়ে বৌবাজার ধর্মতলা হয়ে সাহেব-পাড়া পড়বার মুখে গাড়ি আটকে গেল। বিষম ভিড়, অসংখ্য গাড়ি, ল্যাণ্ডো, ব্রুহাম, ভিক্টোরিয়া, ফিটন, টমটম–ভাড়াটে পাল্কি গাড়ি–কিছুরই অভাব নেই। সদ্য আমদানি দু-একখানা মোটারগাড়িও আছে। এদিক ওদিকের গাড়ি এমন ‘জ্যাম’ হয়ে আছে যে কোন দিকেই কোন গাড়ি নড়ছে না। –শুধু চারিদিক থেকে চেঁচামেচি হচ্ছে।

এরই মধ্যে একটা ডাক আসে কোথা থেকে, ‘বড় মাসীমা ছোট মাসীমা–শুনছ!’

মহাশ্বেতার গলা। উমা ত্রস্তেব্যস্তে চারিদিকে চায়।

‘এই যে এদিকে!’ আবারও শোনা যায়।

‘আঃ! চুপ কর না বৌমা। চারদিকে পুরুষ মানুষ সব–কী মনে করবে।’ কার চাপা-গলার শাসনও কানে যায়।

অর্থাৎ খুবই কাছে। কিন্তু দেখা যায় না।

অবশেষে নরেনই দেখতে পায়। ঠিক ওদের গাড়ির সমান্তরালে বিপরীতমুখী গাড়ি একটা। মাঝ আর একখানা বিপুল বগিগাড়ি দাঁড়িয়ে থাকায় এরা দেখতে পায়নি। কোচবক্সের নিচে একটা খাঁজ দিয়ে মহাশ্বেতা দেখেছে।

নরেনই নেমে গেল। কোনমতে ঘোড়ার মুখ বাঁচিয়ে গলে চলে গেল ওদের গাড়ির ফাঁকে।

‘তুই এখানে কোথা থেকে রে?’ ও এই যে বেয়ান, প্রাতঃপেন্নাম।

এই যে বাবাজী–

‘আঃ কী যে কর বাবা। আমার মেজ দ্যাওর।’

‘অ বেশ বেশ। তা তোরা কোত্থেকে? কার গাড়ি এ?’

মহাশ্বেতা উত্তর দেবার আগেই অম্বিকা তাড়াতাড়ি উত্তর দেয়, ‘আমার মামার এক বন্ধুর গাড়ি—’

‘এসেছ কোথায় বাবাজী?’

‘আমার মামার বাড়ি।’

‘তা বেশ বেশ। ঠিকানাট দাও–কাল সকালে দেখা করব’খন।’

‘আজ্ঞে হ্যাঁ দেব বৈকি। বরং আপনাদেরটাই দেন না–কাল সকালে এদের নিয়ে যাব’খন।

অম্বিকাপদ চট করে ওদিক থেকে নেমে পড়ে।

‘আমি যাব তোমার সঙ্গে ঠাকুরপো?’ ব্যগ্রকণ্ঠে প্রশ্ন করে মহাশ্বেতা।

‘পাগল! এই গাড়ি ঘোড়ার মধ্যে দিয়ে?’

কিন্তু এর ভেতরই গাড়ির ভিড় পাতলা হয়ে আসে। এদের গাড়োয়ানও ঘোড়ার পিঠে চাবুক দেয়! অম্বিকাপদ আবার গাড়িতে চড়তে যায়।

‘বাবাজি একটা কথা–’

ওর জামার হাত ধরে টানে নরেন; চুপি চুপি বলে, ‘একটা টাকা হবে বাবা? আমি বাড়ি ফিরেই পাঠিয়ে দেব। কুটুমের ঋণ রাখব না..দ্যাখ না, এরা ধরলে এত করে–না বলতে পারি না। তা পয়সা কিছু কম পড়ে গেল–’

অত্যন্ত অপ্রসন্ন মুখে অম্বিকাপদ একটা টাকা বার করে দিয়ে গাড়িতে চড়ে বসল। গাড়ি তার আগেই চলতে শুরু করেছে।

নরেনের গাড়িও ছেড়ে দিয়েছে। পুলিশ এসে সরিয়ে দিচ্ছে গাড়ি। নরেন ছুটতে ছুটতে এসে নিজেদের গাড়িতে চড়ে বসল। …

সাহেব-পাড়ায় আলো দেখে নরেন বেলভেডিয়ার যাবার প্রস্তাব করেছিল কিন্তু উমা বেঁকে দাঁড়াল। সে এখনই ফিরবে। তার ভাল লাগছে না একটুও। তাছাড়া নরেনকে সে চিনে নিয়েছে এই ক বছর বেশ ভাল রকমই। ওর এই আত্মীয়তাতে সে স্বস্তি পাচ্ছিল না। কোথা দিয়ে কী করে বসবে–হয়তো সে ভয়ও একটু ছিল।

অগত্যা ফিরতে হয়–গোবিন্দ এবং নরেনের ঘোরতর অনিচ্ছাতেও। বাড়ি ফিরে এল ওরা রাত এগারোটার পর। ভিড়েই দেরি বেশি হয়েছে ঘণ্টা হিসাবে গাড়িভাড়া–পাঁচ টাকা ভাড়া পাওনা হয়ে গেছে গাড়োয়ানের।

কমলারা নেমে ভেতরে চলেই যাচ্ছিল, হঠাৎ একটা অদ্ভুত শব্দ শুনে দুজনেই ফিরে দাঁড়াল।

পাগলের মত ঘুরপাক খাচ্ছে নরেন, আর অনবরত মুখে একটা চাপা ‘হায় হায়’

‘হায় হায়’ ধ্বনি করছে।

‘কী সর্বনাশ! এ কী বিপদে পড়লুম গো!… এখন কী করব গো!’

‘কী, হয়েছে কী?’ কমলা এগিয়ে আসে তাড়াতাড়ি–

‘ট্যাকে–ট্যাঁকে টাকা কটা রেখেছিলুম দিদি–সে টাকা ফরসা। বললে বিশ্বাস না কর–এই দ্যাখো–।’

সে উডুনিটা তুলে ট্যাঁকটা দেখাবার ভঙ্গি করে একটা।

‘এখন উপায়?’

প্রায় কাঁদো কাঁদা হয়ে নরেন বলে, ‘নিশ্চয় ঐ ওদের সঙ্গে যখন দেখা করতে গেছি–তখনই কোন্ ব্যাটা আমার এই সব্বনাশটি করে বসে আছে!…দোহাই দিদি, এই নাককান মলছি আর কখনও যদি করি এমন–এ যাত্রা মান বাঁচাও। যেমন করে পারি আমি সাত দিনের মধ্যে–।’

কমলা উমা দুজনেই স্তম্ভিত হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। আর যাই হোক–এতটার জন্যে তারা কেউ প্রস্তুত ছিল না। মাসিক ত্রিশ টাকারও কম আয়ে তাদের তিনটি প্রাণীকে ঘরভাড়া দিয়ে সংসার চালাতে হয়–তার ভেতর পাঁচ টাকা অপব্যয় করার কথাটা ধারণা করতেও দেরি হয় বৈকি।

কোেছ এসে নরেন বলে, ‘টাকা যদি না থাকে তো দু-এক কুচো সোনা- ফোনা রেখে না হয় বাড়িউলী মাগীর কাছ থেকেই ধার নিয়ে চালিয়ে দাও দিদি–আমি কাল সেটা পোদ্দারের কাছে রেখে ওদের টাকা মিটিয়ে দেব। ….আমি এই কথা দিচ্ছি দিদি, যেমন করে হোক–। সাত দিনও যাবে না! দেখে নিও–’

স্তম্ভিত স্থাণুবৎ কমলার হাতে একটা টান দিয়ে উমা বলে, ‘চলে এসো দিদি। যাওয়াটাই ভুল হয়েছে। এখন আর ভেবে লাভ কি। যা হোক করে বাক্স ঝেড়ে দিয়ে দাও। এত রাত্তিরে আর কেলেঙ্কারি বাড়িও না। এরা এখনো ফেরে নি তাই রক্ষে, নইলে এতক্ষণে সার দিয়ে এসে দাঁড়াতে।’

সত্যিই তখন আর দেরি করার সময় নেই। গাড়োয়ান অসহিষ্ণু হয়ে উঠেছে। কণ্ঠস্বর তাঁর বেশ চড়ে উঠেছে ইতিমধ্যেই–

অগত্যা কোনমতে পা ধুয়ে ভেতরে গিয়েই বাক্স খুঁজতে বসতে হয়। এ কৌটো ও কৌটো করে শেষ অবধি ‘পাঁচ টাকা পুরো হয় বটে–তবে পরের দিনের জন্যে পাঁচ পয়সাও পড়ে থাকে না ওদের। মাসের শেষ–রাজা আসার হ্যাঁঙ্গামে সকলেই ব্যস্ত–কমলার সুদ এবং উমার মাইনে কবে পাওয়া যাবে তারও ঠিক নেই–সবটাই অনিশ্চিত। উমার যেন কান্না পেয়ে যায়।

কমলা নরেনের হাতে দিতে যাচ্ছিল টাকাটা–উমা বললে, ‘না দিদি, গোবিন্দ দিয়ে আসুক। আবার যদি কিছু হারায় ও থেকে তো আর কোন উপায় থাকেব না।’

নরেন অগ্নি দৃষ্টিতে তাকায় উমার দিকে কিন্তু কথা বলতে পারে না।

গাড়োয়ান ততক্ষণে রীতিমত চেঁচামেচি শুরু করে দিয়েছে।

মুখহাত ধুয়ে তাড়াতাড়ি দুপুরের তৈরি রুটি তরকারি নরেন আর গোবিন্দকে খেতে দেয় কমলা। নরেনের দুঃখ আর অনুতাপ ততক্ষণে কমে গেছে, সে মহা উৎসাহে গোবিন্দকে বোঝাতে লাগল, আলিপুরের দিকে গেলে এর চেয়ে ঢের বেশি আরও ভালো ভালো আলো দেখতে পাওয়া যেত।

কমলার অসহ্য বোধ হচ্ছিল সত্যি কথা, তবু সে নিজে বোধ হয় কিছুই বলতে পারত না–কড়া কথা তার মুখ দিয়ে বেরোয় না–উমা বাইরে থেকে ডেকে বললে, ‘ওকে বলে দাও দিদি, কাল সকালেই যেন অন্য কোথাও ব্যবস্থা করেন। এখানে আর সুবিধে হবে না। আর এক পয়সাও ঘরে নেই যে ওকে খাওয়াব–’

একেবারে যেন আগুনের মত জ্বলে উঠে নরেন, ‘দিদি, তোমরা কি ভাবছ আমি মিছে কথা বলছি, আমার চুরি যায় নি। কোন্ বেজন্মা মিছে কথা বলে, কোন্ শুয়োরের বাচ্ছা মিছে কথা বলে। আমি তাহলে এ দায় ঘাড়ে করব কেন। নিজে তো পায়ে হেঁটে দেখতে পারতুম —

হঠাৎ গোবিন্দ বলে ওঠে, ‘মোসোমশাই, তখন ঐ যে ও-গাড়ির সেই ভদ্দরলোকের কাছ থেকে টাকা না কি চেয়ে নিয়ে চট্ করে পেটকাপড়ে বেঁধে ফেললেন–সেটাও কি চুরি গেছে?’

ক্ষোভে এবং অভিমানেই বোধ করি নরেনের বাকরোধ হয়ে যায়। খানিক পরে–খাওয়া শেষ করে উঠে বলে, ‘বেশ–বললেই হত সোজাসুজি যে জায়গা হবে না–ছেলেবুড়ো সবাই মিলে এমন অপমান করবার কি দরকার ছিল?…আমারই ভুল হয়েছিল এখানে আসা। হাজার হোক্ এ-ও সেই বেউড় বাঁশের ঝাড় তা! ঝকমারি হয়েছিল–’

গজ গজ করতে করতে ব্যাগ এবং হুঁকো কলকে গুছিয়ে নিয়ে নরেন সেই রাত্রেই বেরিয়ে পড়ল।

কমলা পুজো-আহ্নিক শেষ করে বাইরে এসে উমার কাছে দাঁড়াল।

উমা এসে পর্যন্তই উঠোনের দিকের অন্ধকার রকে বসেছিল, আর ওঠে নি। কমলা কোমল কণ্ঠে বললে, ‘উমা চল, খাওয়া-দাওয়া সেরে নিবি—’

তুমি খাও দিদি, আমি–আমার শরীরটা ভাল লাগছে না।’

উঠান অন্ধকার কিন্তু ওপরের সিঁড়ির মুখে কেরোসিনের একটা দেওয়াল- আলো জ্বালা ছিল, তার ম্লান আভাতেও ওর গালে জলের চিহ্ন কমলার চোখ এড়াল না। সে আর কথা কইলে না, অনুরোধও করলে না। সেও নিঃশব্দে পিছনটায় বসে পড়ল। শুধু উমা নয়, সে-ও দেখেছে–আর একটি মেয়েছেলে সঙ্গে নিয়ে শরৎ আলো দেখে বেড়াচ্ছে। উমার স্বামী শরৎ।

দুজনেই সেই অন্ধকারে বসে থাকে বহুক্ষণ। কেউই কথা কয় না, কওয়ার প্রয়োজনও নেই। পেছন থেকেই কমলা বুঝতে পারে ঠিক কাঁদার মত ফুঁপিয়ে না কাঁদলেও উমার কপোল বেয়ে জল ঝরছেই, আর উমাও বোঝে যে তার অবস্থা দিদির অজানা নেই।

ঘণ্টার পর ঘণ্টা কেটে যায়।

দূর রাজপথে যখনও উৎসব-যাত্রীদের গাড়ির আওয়াজ উঠতে থাকে মধ্যে মধ্যে। আরও দূরে কোথায় থিয়েটার হচ্ছে, মাঝে মাঝে তার সঙ্গীতের শব্দ শোনা যাচ্ছে। একঘেয়ে ভাবে পাশের বাড়ির কলে জল পড়ে যাচ্ছে। বোধ হয় বাড়িতে কেউ নেই, যাবার সময় কারুর কল বন্ধ করার কথা মনে হয় নি। …ঝিঁ ঝিঁ পোকো ডাকছে অবিশ্রান্ত।

কমলারও কত কথা মনে পড়ে যায়। শ্যামার বিয়ের কথা। কি না ছিল ওদের, জাজ্বল্যমান সংসার। ভালভাবে চললে পায়ের ওপর পা দিয়ে বসে খেতে পারত। সব উড়িয়ে দিলে দুটি ভাই–দেবেন আর নরেন। তবু দেবেন আরা না কোথায় ডাক্তারি করে সংসার চালাচ্ছে। নরেন একেবারে নির্বিকার কোন দিন কোন দায়িত্ব বহন করল না আজ পর্যন্ত। তার তুলনায় কমলার নিজের বরাতও এমন কি ঢের ভাল। ভাবতে ভাবতেই মনে পড়ে তার স্বামীর কথা। বিবাহিত জীবনের অতি সুখে ও স্বাচ্ছন্দ্যে কাটা স্বল্প ক’টি বৎসর। তারপর বর্তমান অনিশ্চিত অবস্থা। গোবিন্দ কি মানুষ হবে?…. সে আরও কত দিন পরে?

উমাটা–। সত্যিই ওর কি আছে? কি নিয়ে থাকবে?

শরৎকে বুঝতে পারে না কমলা। আসত তো ওদিকে মধ্যে মধ্যে। বেশ কথাবার্তা, যেন উমার ওপর মায়াও আছে মনে হয়। তবে এমন কি করে হয়? অমন তো কত পুরুষেরই ‘বার-টান’ আছে, ঘরের বৌকে ছোঁবে না তাই বলে? ওদের অদৃষ্টে সবই যেন উল্টো হয়। …

নিজেকেই দায়ী মনে হয় কতকটা। মা অনেক ইতস্তত করেছিলেন। কমলাই জেদ করেছিল সেদিন। কার্তিকের মত রূপ ছিল শরৎ-জামাইয়ের আচার আচরণেও অতি ভদ্র। কেমন করে যে ও এত নিষ্ঠুর হল!…

হৈ-হৈ করতে গাড়ি বোঝাই করে বাড়িওলারা এসে পড়ে। তখন রাত দুটো বেজে গেছে। এদের দু’জনেরই একসঙ্গে যেন চমক ভাঙে। এখনই যত বাজে গল্প আর কে কতটা দেখতে পেল তার হিসেব-নিকেশ শুরু হবে। চট্ করে ঘরে ঢুকে আলোটা নিভিয়ে দেয় উমা। কমলাও ঘরে ঢুকে হাতড়ে হাতড়ে ঘরদোর সেরে শুয়ে পড়ে। সেরাত্রে দু’জনের কারুরই খাওয়া হয় না।

চতুর্থ পরিচ্ছেদ

॥১॥

গোবিন্দ সেদিন ইস্কুল থেকে ফিরলই জ্বর নিয়ে। সামান্য জ্বর–রাত নটা নাগাদ ছেড়ে গেল। এমন একটু-আধটু হয়ই। তা নিয়ে কেউই মাথা ঘামাল না। পরের দিন সুজির রুটি আর মাছের ঝোল খেয়ে ইস্কুলে গেল। সেদিন কিন্তু ছুটির আগেই ফিরে এল। শরীর অবসন্ন হয়ে পড়েছে দেখে মাস্টার মশাইরা গায়ে হাত দিয়ে দেখে ছেড়ে দিয়েছেন। পরের দিন আর ইস্কুলে গেল না। কিন্তু সেদিনও ঠিক দুটো নাগাদ জ্বর এল। খুব বেশি নয় হয়তো–তবু জ্বরই।

কমলা চিন্তিত হয়ে পড়ল। বাড়িওলাদের গিন্নী ব্যবস্থা দিলেন বেলপাতা আর শিউলিপাতার রস। একজন বললেন জোলাপ দিতে। এইভাবে টোটকা- টুটকি চলল তিন-চার দিন। কিন্ত জ্বর বন্ধ হ’ল না। রোজই দুটো নাগাদ আসে, রাত নটা-দশটা নাগাদ ছেড়ে যায়। উমা কমলা দু’জনেরই মুখ শুকিয়ে উঠল। বাড়িওলা-গিন্নী শুনিয়ে গেলেন, ‘উঠতি বয়স, খুব সাবধান বাছা। এই বয়সটাতেই বড্ড থাইসিস হয় শুনেছি। ডাক্তার দেখাও!’

গলির মোড়ে চারু ডাক্তার কী নতুন এক রকম চিকিৎসা করেন–হোমিওপাথির মতই। বাড়িওলার মেয়ে মালতীর পরামর্শে তাঁকেই ডাকা হল। মালতী বলল, ‘খরচাও বেশি নয়, আট আনা ভিজিট আর দু’ পয়সা করে ওষুধের পুরিয়া–কিন্তু ওষুধ ওঁর শুনেছি ডাকলে কথা কয়।’

সাত দিনের দিন তাঁকে ডাকা হ’ল। তিনি এসে দশ আনা পয়সা নিয়ে চার দাগ ওষুধ দিয়ে গেলেন। নাড়ী দেখে আঠারো রকম প্রশ্ন করে বলে গেলেন, ‘ভয় নেই, এই চার পুরিয়াতেই সারবে–বড় জোর আর চার পুরিয়া।

‘কী জ্বর, প্রশ্ন করাতে উচ্চাঙ্গের হাসি হেসে বললেন, ‘কেন, জানলে কি নিজেরাই চিকিৎসা করবেন?’

তিন-চারে বারো পুরিয়া ওষুধ খাওয়ানো হয়ে গেল–আরও একটা ভিজিটও নিলেন তিনি, কিন্তু জ্বর বন্ধ হ’ল না। সে ঠিক নিজের নিয়মে আসে, নিজের নিয়মে যায়। মাঝখান থেকে হেলে নেতিয়ে পড়ছে। আর উঠে কলঘরেও যেতে পারে না–এত দুর্বল হয়ে পড়ল।

বুড়ী গিন্নী বললেন, ‘করছিস কি মাগী, ছেলেটাকে কি মেরে ফেলবি? এই বয়সে ভাতার খেয়েও আক্কেল হ’ল না। আবার ছেলেটাকেও খেতে চাস? ভাল ডাক্তার দ্যাখ।’

কমলা আছড়ে পড়ে কাঁদতে লাগল, উমাই ধমক দিলে বুড়ীকে, ‘কি বলছেন যা তা। আমাদের ছেলে, টানটা আমাদেরই বেশি। ভাবনার কথা–সে কি আমরা বুঝি না। অবস্থা বুঝে ব্যবস্থা করতে হবে তো!’

‘দরকার হলে ঘটিবাটি বেচতে হবে, মা। ওর পাঁচটা নয় দশটা নয় ঐ একটা। …ওর কষ্ট দেখতে পারি না বলেই বলা। তুমি কি বুঝবে মা? পেটে একটা ধরতে তো বুঝতে!’

তিনি খর খর করে চেলে যেতে যেতে সবাইকে শুনিয়ে গেলেন, ‘যার জন্যে চুরি করি সেই বলে চোর। এদিকে তো এক কড়ার মুরোদ নেই–বাক্যি দ্যাখ না!’

বাড়িওলা লোকটি মন্দ নন। তিনি সব শুনে মালতাঁকে দিয়ে বলে পাঠালেন, ‘এ পাড়ায় ডাক্তার বটব্যালের খুব নামডাক। দু’টাকা করে ফী,–বলে কয়ে এক টাকা করে দিতে পারি। ডাকতে চান কি?’

কমলা উমার মুখের দিকে চাইল। অগত্যা। উমা বললে, ‘তাই ডেকে দিতে বল ভাই, দরকার হলে ঘটিবাটিই বেচতে হবে–কী করব!’

ডাক্তর বটব্যাল এক টাকা করে ভিজিট নিতে রাজী হলেন বটে কিন্তু ওষুধপত্তরে রোজ একটি করে টাকা বেরিয়ে যেতে লাগল। নিজেদের বাজার বন্ধ করে দিলে–শুধু আলু-ভাতে ভাত খাওয়া, জীবনধারণের মত–কমলার মুখ দিয়ে ভাতই গলতে চাইত না, নেহাত উমার ধমকে কিছু মুখে তুলত সে। উমা বলত, ‘ছেলের মুখ চেয়েই মুখে দিতে হবে। ওর সেবা করা চাই তো। তুমি বিছানায় যদি পড় তো দেখবে কে?’

তবু খরচা কমানো যায় না কিছুতেই। বাক্স; ঝেড়ে দু-এক কুচি সোনা যা ছিল সব বার করে দিলে কমলা মালতীর বাবাকে। কিন্তু দেখা গেল সোনা কিনতে যা দাম, বেচবার সময় তার তিন ভাগের দুভাগও পাওয়া যায় না।

তা হোক–গোবিন্দ ভাল হয়ে উঠুক–তা হলেই হ’ল। কমলা মা কালীকে সোনার বেলপাতায় বুকের রক্ত মানসিক

মানসিক করল। উমা আগেই জোড়াসত্যনারায়ণ মেনেছিল। কিন্তু না দেবতাদেরে কৃপা আর না বটব্যালের ওষুধ–কিছুতেই কিছু হ’ল না। ঠিক দুটো থেকে রাত দশটা পর্যন্ত ঘুষঘুষে জ্বর চলতে লাগল প্রত্যহ।

এরপর ডাকতে গেলে আর. এল. দত্তকে ডাকতে হয়। কিন্তু সে একগাদা টাকার দরকার। অঙ্কটা শুনে দু’জনেরই মুখ শুকিয়ে উঠল। তাও একবার এলেই হবে কিনা ঠিক কি। বারবার যদি ঐ টাকা দিয়ে আনতে হয়– ‘

পাড়ার একটি বিধবা বৌয়ের সঙ্গে গঙ্গাজল পাতিয়েছিল কমলা, সে পরামর্শ দিল, ‘শিবপুরে দীনো ডাক্তারের কাছে নিয়ে চল গঙ্গাজল। শুনেছি ধম্বন্তরি–গেলেই সারবে।

উমা ঘাড় নেড়ে বললে, ‘না, সে সম্ভব নয়। ছেলে বিছানার সঙ্গে মিশিয়ে গেছে একেবারে, এখন গাড়িতে তুলে অত পথ নিয়ে গিয়ে দেখানো যাবে না। গাড়ির ধকল সইতে পারবে না।’

দুই বোন দুপুরবেলা বাক্স-পেটরা খুলে দেখতে বসল–কোথায় কি আছে। মোটামুটি হিসেব তো আছেই–তবু মনে হয় যদি আর কিছু বেরোয়।

থাকার মধ্যে আছে উমার দু’গাছা বালা, যা সেহাতে পরে থাকে বারো মাস–আর গোবিন্দর পৈতের আংটি। আরও দুটি জিনিস আছে বটে কিন্তু সেদিকে চেয়ে দু’জনেই স্তব্ধ হয়ে গেল। গোবিন্দর বাবার বিয়ের আংটি–এটি নাকি তাঁর বড় প্রিয়। বিয়ের পর মৃত্যুর আগ পর্যন্ত কখনও খোলে নি। আর রাসমণির সোনা-বাঁধানো নাভিশঙ্ঘ একটি। এটি নাকি রাসমণিরও মায়ের চিহ্ন। দুটোর কোনটাই বেচতে মন সরে না।

অনেক্ষণ পরে উমা বললে, দু’গাছা লাল রুলি কিনে এনে এই বালা দুটোই খুলে দিই দিদি–গোবিন্দ বেঁচে থাকলে আমার সব রইল। এ বালার দাম কি?’

হঠাৎ কমলার মনে পড়ে গেল। সে বললে, ‘না তার দরকার হবে না। মা গোবিন্দর বৌয়ের জন্যে যা দিয়ে গেছেন, সেটা আমি রেখে দিয়েছি আলাদা করে। দুটো বালা আর একজোড়া কেরাপাত। তাই বার করি।’

‘ছি। মা’র চিহ্ন গোবিন্দর বৌ ভোগ করবে না?’

কমলা ম্লান হেসে বললে, ‘বাঁচলে তবে বিয়ে, তবে বৌ। বাঁচুক আগে–’ উমা তবু জেদ করে বললে, ‘আগে আমার বালাটাই যাক না দিদি —

‘না বোন। আমি মন স্থির করেছি।’

.

সেই দিনই যা হয় ব্যবস্থা করা দরকার। আর সময় নেই একেবারে। কমলা গহনাগুলো নিয়ে মালতীর বাবার কাছে যাচ্ছিল, উমা তার হাত চেপে ধরলে। বললে, না দিদি–আমার কেমন সন্দেহ হচ্ছে। হয়তো আমারই অন্যায়–কিন্তু তবু দেখি না একটু হাত বদল করে। সোনার দাম বাইশ টাকা, কালও পথে এক স্যাক্‌রার দোকানে জিজ্ঞাসা করে এসেছি,অথচ মামাবাবু বেচতে গেলেই পনেরোর বেশি দাম পান না।

‘কি করবি তবে, কাকে দিবি?’

‘আমি যার বাড়ি চার টাকার টিউশনি করি, রসময়বাবু–বুড়ো মানুষ, বেশ ধর্মভীরু বলেই মনে হয়। তাঁকেই গিয়ে দিই না?’

‘দ্যাখ যা হয় কর। কিন্তু তাঁকে এখন পাবি?’

‘দেখি। না হয়–না হয় নিজেই যাব কোন পোদ্দারের দোকানে—’

‘সে কি রে। না না, তুই যাস নি।’

‘কেন যাব না দিদি। সবই করছি, বাইরে বেরিয়ে পুরুষ মানুষের মত রোজগার করছি, আর এইটেই পারব না? একদিন না একদিন করতেই তো হবে সব। কেউ যখন নেই–তখন কতকাল আর পরমুখাপেক্ষী হয়ে এমন করে ঠকব ॥’

উমা আর দাঁড়াল না।

কিন্তু রসময়বাবু বাড়ি ছিলেন না। তিনি কি সব বিলিতী ওষুধের কারবার করেন। দুপুরবেলা খেতে আসেন ঠিকই–দুটো আড়াইটেয় আবার বেরিয় যান। আর কেউ তেমন পুরুষও নেই তাঁদের বাড়ি, যাকে সঙ্গে করে নিয়ে যাওয়া যায়।

উমা আর অপেক্ষা করল না। মালতীর বাবাকে দুপুরবেলা বলেই দেওয়া হয়েছে আর.এল.দত্তকে ডাকতে। টাকা নিয়ে না গেলে দাঁড়িয়ে অপমান।

উমা সোজা নতুন বাজারের দিকে এগিয়ে গেল। লাল শালু টাঙানো সার সার পোদ্দারের দোকান। কিন্তু ফুটপাথ পেরিয়ে ওদিকে যেতে গিয়েও থমকে দাঁড়িয়ে গেল একবার।

আজন্ম সংস্কার। কী মনে করবে লোকগুলো কে জানে। ভদ্রঘরের মেয়েছেলে পোদ্দারের দোকানে এসেছে মাল বেচতে–হয়তো বিশ্বাসই করবে না। হয়তো ভাববে সে ‘ঐ সব’ ঘরের মেয়ে। –ছি, ছি কেন এ সাহস করতে গেল সে! দিলেই হ’ত মালতীর বাবাকে। –ভয়ে লজ্জায় উমার যেন কান্না পেতে লাগল।

কিন্তু উপায় বা কি? দেরি করা চলবে না। এখনই যা হয় করা দরকার।

প্রাণপণে উদগত অশ্রু দমন করে দৃঢ় পদক্ষেপে ওপারে গেল উমা।

ওদিকে চাইতেও পারছে না। তখনও অপরাহ্নের ভিড় দেখা দেয় নি। দোকানদাররা বেশির ভাগই অলসভাবে বসে রয়েছে। ওকেই দেখছে নিশ্চয়, ওর দিকেই চেয়ে আছে। এইটে কল্পনা করে যেন উমা আর ওদিকে চেয়ে দেখতে পারলে না। সে ভেবেছিল ওরই মধ্যে বুড়ো-মত একটা দোকানদার দেখে তার কাছে যাবে। কিন্তু অতগুলি কৌতূহলী চোখের সামনে ওদিকে তাকিয়ে কে বুড়ো আছে খোঁজা একেবারেই অসম্ভব–ইতিমধ্যেই হয়তো ওদের মধ্যে জল্পনা-কল্পনা শুরু হয়ে গেছে তাকে নিয়ে। …সুতরাং কোন দিকে না তাকিয়ে ঠিক সামনে যে দোকানটি পড়ল–উমা সেখানে গিয়েই উঠল।

‘কি চাই বাছা তোমার?’ কণ্ঠস্বরে যেন একটু অবজ্ঞা এবং বিদ্রূপ। অপমানে এবং বিরক্তিতে যেন কান-মাথা ঝাঁ ঝাঁ করে উঠল। প্রাণপণে নিচের ঠোঁটটা কামড়ে ধরে অতিকষ্টে নিজেকে সামলে নিলে উমা। তার পর যথাসাধ্য নির্লিপ্ত কণ্ঠে বললে, ‘এইটে বেচতে চাই।’

বালা জোড়াটা দোকানদারের সামনে নামিয়ে রাখলে।

‘অ।’ কেমন একটা নৈর্ব্যক্তিক শব্দ করলে দোকানী। তার পর এক গাছা বালা তুলে নিয়ে ভ্রূ কুঁচকে অনেকক্ষণ ধরে উল্টে পাল্টে দেখলে।

‘এ তো দেখছি সেকেলে জিনিস, এ তো এখানকার নয়। এ যে চোরাই মাল নয় কেমন করে জানব আমি?’

সিঁদুরের মত রাঙা হয় উঠল উমার মুখ।

‘চোরাই মাল। কি বলছেন আপনি। চোরাই মাল নিয়ে এসেছি আপনাকে বেচতে।

‘কি জানি বাছা।’ বিরসকণ্ঠে বলে দোকানদার, হ্যাঁঙ্গাম-হুঁজ্জতের মধ্যে আর যেতে ইচ্ছে করে না। –আনে, তোমাদের মত মেয়েরা হামেশাই আনে–বাবু না থাকলে যখন মধ্যে মধ্যে কষ্টে পড়ে তখন গয়না বেচেই খেতে হয় যে–কিন্তু সে সব জিনিস আমরা দেখলেই চিনতে পারি। চক্ষু বুজে নিই। নতুন জিনিস, হয়তো রসানও ওঠেনি। কিন্তু এ অন্তত পঞ্চাশ বছরের মাল হবে, সিন্দুকে তোলা ছিল!’

উমা আর থাকতে পারলে না। রাগে দুঃখে অপমানে তার চোখে জল এসে গিয়েছিল। সে প্রায় রুদ্ধকণ্ঠে বললে, ‘আপনি মুখ সামলে কথা বলুন। কি ভেবেছেন আমাকে। আমার সিঁথিতে সিঁদুর দেখছেন না! নিতে হয় নেবেন না হয় ফিরিয়ে দেবেন, খদ্দেরকে অপমান করতে আসেন কোন সাহসে?–আমাকে তুমি তুমি করে বলেই বা কথা বলছেন কেন–আপনি বলতে পারেন না। ‘

সে বালা জোড়াটা কুড়িয়ে নিয়ে দোকান থেকে নেমে আবার ফুটপাতে এসে পড়ল। এরপর কি করবে কোথায় যাবে–তা সে জানে না, শুধু ক্ষোভে, লজ্জায়, একটা উপায়হীন ক্রোধে তার সেইখানেই মাথা কুটে মরে যেতে ইচ্ছে করছিল। –সে ভেবেও দেখে নি কিছু ভাববার ক্ষমতাও ছিল না, বোধ করি সহজাত সংস্কারেই কোনমতে রাস্তা পেরিয়ে একেবারে এ পাশের ফুটপাতে এসে থমকে দাঁড়াল।

কিন্তু এইবার ভগবান বোধ করি মুখ তুলে চাইলেন। অতি পরিচিত একটি কণ্ঠস্বর কানে এসে পৌঁছল, ‘এ কি, এখানে কি করছ? মুখ চোখ এমন কেন? কি হয়েছে? কারুর কোন বিপদ-আপদ–?’

দুই চোখ তখনও অশ্রুতে ঝাপ্‌সা, তবু চিনতে দেরি হ’ল না। সেই বাষ্পাকুল চোখ দুটি তুলে শরতের দিকে তাকিয়েই সে যেন ফেটে পড়ল, ‘তোমার মত পুরুষ যার স্বামী তার কি হতে বাকি থাকে বল–সিঁথিতে সিঁদুর হাতে নোয়া থাকতেও শুনতে হল যে আমি বেশ্যা। –এর চেয়ে বিধবা হওয়াও ঢের ভাল ছিল।’

বলতে বলতে ঝরঝর করে দুই চোখ দিয়ে অজস্র ধারায় জল পড়তে লাগল। কোনমতে–কিছুতে নিজেকে সামলাতে পারলে না সে।

তখনও পথে লোকজন বেশি চলতে শুরু করে নি বটে, তবু যে দু’একজন ওদিক দিয়ে যাতায়াত করছিল, তারা অবাক হয়ে চাইতে লাগল। বিব্রত শরৎ ব্যাকুলভাবে বললে, ‘কী হয়েছে কি, ব্যপারটা কি খুলেই বল না ছাই!–একটু এদিকে এস, সবাই ফিরে ফিরে দেখছে–চল বরং কোম্পানির বাগানের ঐ বেঞ্চিটায় বসবে চল।’

‘না, ওখানে বসতে আমি পারব না। সরকারী বাগানে বসে পরপুরুষের সঙ্গে কথা কইলেই আমার ষোলকলা পূর্ণ হয় বটে!

পর পুরুষ!

কী একটা কৗতুক করতে গিয়েও শরতের উদ্যত রসনা লজ্জায় থেমে যায়।

‘তা এখন ব্যাপরটা কি আমাকে বলবে তো। কে অপমান করলে তোমাকে?’

‘ঐখানে একজন পোদ্দার। মুখের ওপরই আমাকে শুনিয়ে দিলে যে সে আমাকে বেশ্যা বলে মনে করে এবং চোর বলে সন্দেহ করে।’

‘তা তুমিই বা একা এমনভাবে পোদ্দারের দোকানে গিয়েছিলে কেন?

‘কী করব? আমার আর কে আছে বল! গয়না বেচতে হবে যখন তখন পোদ্দারের দোকানে না গিয়ে উপায় কি?’

‘কী সর্বনাশ। তুমি কাউকে চেনা না–জান না, গয়না বেচতে গিছলে? ওদের মধ্যে এক-একটি সাংঘাতিক লোক আছে যে!’

‘উপায় কি! গোবিন্দর আজ তিন সপ্তাহ অসুখ। বড় ডাক্তার ডাকতে হবে, বাড়িতে একটি টাকা নেই। নিজের গয়না নয়, সে সবও তা ঘুচে গিয়েছে। সব সময় টিউশনিও থাকে না তেমন, বেচে বেচেই চালাতে হয়। এই বালাজোড়া গোবিন্দর বৌয়ের জন্যে দিদিকে মা দিয়ে গিয়েছিলেন। এছাড়া আর কিছুই নেই বেচবার মত।’

‘ইস্! তাই তো!’

শরৎ কিছুক্ষণ চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল। ইতিমধ্যেই দূরে তিন-চারজন অলস কৌতূহলী লোক জমে গিয়েছে, এখানে এই অবস্থায় দেরি করাও যায় না। সব সংকোচ দমন করে সে শেষ পর্যন্ত বলে ফেলে, ‘শোন এক কাজ কর–তুমি ফিরে যাও। বালা বেচতে হবে না। আমি আধ ঘণ্টার মধ্যে টাকা নিয়ে যাচ্ছি।’

অনেক–অনেকখানি ভরসা যেন। এই কথা, এই ধরনের কথা শোনবার জন্যেই তো তার নারী-জীবেনর পূর্ণপাত্র সাজিয়ে বসে আছে সে–কতকাল, কতকাল ধরে। একটা স্বস্তির, একটা কৃতজ্ঞতার নিঃশ্বাসই বেরিয়ে আসে তার বুক থেকে–

কিন্তু সেই সঙ্গেই মনে পড়ে যায় কয়েকদিন আগেরকার একটি দৃশ্য। গাড়ি-ঘোড়ার ভিড়ের মধ্যে একটি পুরুষ ও একটি স্ত্রীলোক, একেবারে গা ঘেঁষাঘেঁষি করে বেড়াচ্ছে আলো দেখে। পরস্পরের প্রতি একান্ত নির্ভরতা এবং প্রীতি তাদের মুখচোখে মাখানো। —

নিমেষে কঠিন হয়ে ওঠে উমার মুখ। সে বলে, ‘না, পথ ছাড়। আমি বেচেই যাব এ বালা–যেমন করে পারি আমার দায় আমিই দেখব।

দুই হাত জোড় করে শরৎ। মিনতি করে বলে, ‘মান-অভিমানের সময় এ নয়। অন্তত গোবিন্দর অসুখের কথাটা ভাব। তুমি বাড়ি যাও। আমি যাচ্ছি।’

তবুও উমা কি বলতে যাচ্ছিল, শরৎ বাধা দিয়ে বললে, ‘ধর, আমি বাঁধা রাখছি বালাজোড়া। তুমি জান না, এ বেচতে গেলে তুমি আধা কড়িও পাবে না। মাঝখান থেকে বিস্তর অপমান ও বাঁকা কথা শুনতে হবে। তা ছাড়া দরকারের তো এই শেষ নয়। যদি সত্যিই কোন ভারী অসুখ হয়, গয়না বেচবার ঢের সময় পাবে। দোহাই তোমার, এখন তুমি বাড়ি যাও।’

উমা আর কিছুই বলতে পারে না। কিন্তু অকারণে আবারও তার দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে আসে। সে শরতের দিকে তাকায় না, কোন কথাও বলে না–নিঃশব্দে বাড়ির পথ ধরে।

॥২॥

বড় ডাক্তার এসে তিন দিনেই জ্বর ছাড়িয়ে দিলেন বটে কিন্তু সেই সঙ্গে একটি ব্যবস্থা যা দিয়ে গেলেন তা এদের পক্ষে সাধ্যাতীত। বলে গেলেন, ‘একে কোথাও চেঞ্জে পাঠানো দরকার। পশ্চিমের কোন জায়গায়, দেওঘর, মধুপুর বা ঐরমকম কোথাও। নইলে আবারও এই রকম হতে পারে–আর এবার হলে সারানো শক্ত হবে।’

শরৎ অনেক সাহায্য করেছে। তারও ছোট্ট কারবার, আলাদা থাকে–সে একটা পুরো সংসার, এদিকে মা এখনও বেঁচে–বস্তুত দুটো সংসার চালাতে হয়। তাকে আর বলাও উচিত নয়। কমলাই বারণ করলে, বললে, ‘কানে শুনলে হয়তো সে ধার-দেনা করেও দেবে। তাকে আর শোনায় নি। …যা হয় হবে।

কিন্তু ‘যা হয় টা যে কি তা কেউ বলতে পারে না। দুই বোন দুই বোনের মুখের দিকে তাকায়। অথচ ছেলেটার দিকেও চাওয়া যায় না। এই বছরেই ওর পাস দেবার কথা। আর দু’মাস পরে ওর পরীক্ষা। এই অবস্থায় পরীক্ষা দেবেই বা কী করে? পাসের পড়া নাকি দিনরাত পড়তে হয়। ভাত যেদিন দেওয়া হ’ল সেদিনিই গোবিন্দ বইখাতা নিয়ে বসেছিল–কিন্তু আধঘণ্টা পড়ার পরই মাথা ধরে উঠল। কমলা এসে জোর ক’রে বই কেড়ে নিয়ে শুইয়ে দিলে।

অথচ এই ‘পাসে’র দিকে চেয়েই আছে বলতে গেলে কমলা। চাকরি একটা হয়তো গত বছরেই হয়ে যেত। মালুর বাবার অফিসে, পনেরো টাকা মাইনের দপ্তরির চাকরি একটা খালি ছিল। মালুর বাবা নিজে থেকেই খবরটা দিয়েছিলেন, বলেছিলেন–’অফিসের চাকরি, কোনমতে ছুঁচ হয়ে সেঁধোনোর ওয়াস্তা। তারপর ঠিকমত বড়বাবুকে তেল দিতে পারলে সে ছুঁচ ফাল হতে কতক্ষণ।’

শ্যামার বড় জামাই অভয়পদও একটা চাকরির খোঁজ দিয়েছিল। কারখানার চাকরি, লোহা-পেটানো কাজ বলে কমলার পছন্দ হয় নি। এত সাধের ছেলে তার, ওর বাবা কী দরের মানুষ ছিলেন, তাঁর ছেলে করবে লোহা- পেটানো কাজ? থাক্ গে, এতদিনই যখন কষ্ট করে কাটল, কোনক্রমে আর একটা দুটো বছর কাটবে না? একটা পাাস করতে পারলে ভাল চাকরির অভাব কি?… অনেক স্বপ্ন আছে কমলার, গোবিন্দ বড় সরকারী চাকরি পেলে কি কি করবে সে।

কিন্তু শরীরটাই যদি বিগড়োয় তো পাস করবে কে? এমনিতেই গোবিন্দর একটু বেশি বয়স হয়ে গেছে। এই পাড়াতেই ওর বয়সী অনেক ছেলে আছে তারা কেউ কেউ সামনের বছর দুটো পাস দেবে। একজন তো এ বছরই সে পরীক্ষা দিচ্ছে। গোবিন্দর স্বাস্থ্যও তেমন ভাল নয়, বুদ্ধসুদ্ধি এখনও ছেলেমানুষের মত। নানা দুর্বিপাকের মধ্যে একটা বছর নষ্টও হয়ে গেছে।

এই সব দিনরাত তোলাপাড়া করে কমলা মনে মনে। ছেলের রক্তশূন্য মুখের দিকে চায় আর বুক শুকিয়ে ওঠে ওর।

উমার সঙ্গে রোজই রাত্রে পরামর্শ চলে তার, কোন দিন বলে, ‘হ্যাঁ রে আসল থেকে দু’শ টাকা ওঠাব? কতই বা সুদের তফাত হবে? কষ্ট করে চালিয়ে নিতে পারব না?’

উমা বলে, ‘সে টাকা তো যখন তখন ওঠানো যায় না শুনেছি। পারবে কি? অত হ্যাঁঙ্গামা করবেই বা কে?

‘না হয় যে গয়নাগুলো বেচতে যচ্ছিলি, সেইগুলোই বেচে দিই শেষ অবধি–কী বলিস?’

‘কিন্তু দিদি টাকা হলেই তো হবে না। পাঠাবে কোথায়? কার সঙ্গে? সবাই মিলে গেলে একগাদা টাকা খরচা। মা সেবার গিয়েছিলেন রাঘব ঘোষালের সঙ্গে, কতগুলি টাকা গলে গেল, মনে নেই?

সুতরাং কোন মীমাংসাই হয় না।

ডাক্তারের কথাগুলো বিভীষিকার মত ওদের দিনের আহার এবং রাত্রের তন্দ্রা বিষাক্ত করে তোলে শুধু।

গোবিন্দের পড়াও হয় না। পড়তে পারে না সে কিছুতেই। ক্রমশ পরীক্ষার আশা সুদূরপরাহত হয়ে যায়।

শরৎ আসে মধ্যে মধ্যে, ফল-টল দিয়ে যায়। কিন্তু পাঁচ মিনিটের বেশি বসে না। তাকে দেখলে আজও চোখ জুড়িয়ে যায় কমলার। যেমন চেহারা, তেমনি ভদ্র কথাবার্তা, তেমনি বিবেচনা। …সঙ্গে সঙ্গে উমার জন্য হাহাকার ওঠে মনের মধ্যে। এমন স্বামী ভোগ করতে পেলে না। …কত বিচিত্র মানুষ হয়–আশ্চর্য। তাদের বরাতেই এমন হয় শুধু…আর কারুর তো এমন হতে শোনে নি।

ছেলের চিন্তার মধ্যেও কালীকে ডাকে সে, ‘হে মা কালী, শরৎ জামাইয়ের সুমতি দাও মা। জোড়া পাঁঠা দেব তোমাকে। হে মা সংকটা, মহাসংকট বার করব তোমার রাস্তার ধুলো খেয়ে।

উমার মনের কথা মুখে ফোটে না…শরৎ এলেই সে বাইরে চলে যায়। স্বামীর সঙ্গে কথা যে একেবারে কয় না তা নয়, কিন্তু সে দৈবাৎ।

হেম আসে মাঝে মাঝে খবর নিতে।

এবার এল অনেকদিন পরে।

গোবিন্দর অসুখের সে কিছুই জানত না। এখন ওর শরীরের অবস্থা দেখে সে অবাক।

এরা কোন খবরই দেয় নি। দেবার মত মানসিক অবস্থা বা অবসরও ছিল না। কিন্তু হেম যখন মৃদু অনুযোগ করলে তখন কমলা মুখের ওপর সে কথাটা বলতে পারলে না, এও বলতে পারলে না যে তাদের খবর দিয়ে কোন লাভ ও হ’ত না। চুপ করেই রইল।

একথা সেকথার পর চেঞ্জে যাবার কথাও উঠল।

হেম খানিকটা চুপ করে থেকে বললে, ‘একটা কাজ করলে হয় বড় মাসীমা।

আমার জ্যাঠা এতদিন পরে এখানে এসেছে, জান?’

‘তাই নাকি? কবে রে?’

নরেনের দাদা দেবেন।

যথাসর্বস্ব উড়িয়ে দেবার পর যখন আর কিছুই রইল না তখন নরেন বিচলিত হয় নি কিন্তু দেবেন হয়েছিল। সে একদা বেরিয়ে গিয়েছিল নিজের ভাগ্যান্বেষণে.. বহু দূর, পশ্চিমে কোথায়…আরা না কী এক জায়গায়। সে সব জায়গায় নামও শোনেনি ওরা। খোট্টার দেশ, এই জানত। সেইখানেই কয়েকটা ওষুধ নিয়ে নাকি রাতারাতি ডাক্তার হয়ে বসেছিল। তখন এলোপ্যাথি বলেই চালাত–এখন বুঝি হোমিওপ্যাথি বইও নিয়ে গেছে একখানা। কিছুদিন ডাক্তারি করার পর একদিন এসে স্ত্রীকে নিয়ে চলে যায়। আর একবার মাত্র এসেছিল এখানে, ওদের মা মরবার সময়–তারপর আর কেউ কোন খবরই পায় নি। বেঁচে আছে কি মরে গেছে তাও কেউ জানত না।

‘এই মাসখানেক হ’ল। অনেক খুঁজে খুঁজে আমাদের বার করেছেন। ওখানে গিছলেন এই দিন-পনেরো দিন আগে।’

‘তার পর? কী করেছে রে?’

‘সেই ডাক্তারিই নাকি করছেন এখনও। আমার সে দাদা মারা গেছে–জান? এখন আবার জ্যাঠাইমার খুব অসুখ। তাই এখানে নিয়ে এসেছন জ্যাঠাইমারই এক ভাই এখানে বুঝি ডাক্তার হয়েছে–মেডিকেল কলেজে চাকরি করে–তারই ভরসায় এনে ফেলেছে।

জ্যাঠাইমা নাকি বাঁচবে না।

‘তা তাঁর কথা কি বলছিলি?’

‘ভাবছিলুম জ্যাঠামশাই তো যাবেনই দিনকতক পরে। তার সঙ্গে গোবিন্দকে পাঠালে কেমন হয়?’

‘হ্যাঁ–তোর জ্যাঠাইমা রইল এখানে–তাকেই কে খেতে দেয়ে তাঁর ঠিক নেই–তাঁর সঙ্গে আমার রোগা ছেলে পাঠিয়ে তাকে আরও আতান্তরে ফেলি আর কি!’

কথাটা সেদিনকার মত ওখানেই চাপা পড়ে গেল।

কিন্তু একেবারে পড়ল না।

হেমের মুখে খবর পেয়ে শ্যামা এল বোনপোকে দেখতে।

বরাবর হেঁটেই আসে সে। সেদিনও ছোট ছেলেটাকে কোলে নিয়ে এবং তার ওপরের বোনটাকে হাঁটিয়ে দুটো ডাব এবং আরও কি কি ফল পুঁটলি করে ঝুলিয়ে এই দীর্ঘ চার ক্রোশ পথ হেঁটে এসে উঠল। হাঁটু অবধি ধুলো, চোখ- মুখের অবস্থা দেখলে আতঙ্ক হয়; মেয়েটা তো নেতিয়ে পড়েছে।

‘কেন, এ কাজ করিস শ্যামা, কোদিন পথেই মুখ থুবড়ে মরবি। তুই নিজে যা হয় কর, ঐটুকু মেয়েকে হাঁটিয়ে এনেছিস কী বলে?’

‘ওদের অত কষ্ট হয় না। সারা দুপুরই তো টো টো করে ঘুরে বেড়ায় এ- বাগানের ও-বাগানে–এক দণ্ড কি পায়ের বিশ্রাম আছে! সবটা জড়িয়ে কক্রোশ হয় তা দ্যাখ না!’

‘হ্যাঁ–সেই সঙ্গে এতটা পথ একটানা হেঁটে আসা সমান হ’ল?’

‘একটানা তো আসি নি। পথে অনেকবার বসেছি। একটানা পারব কেন?…আমার সঙ্গে দু’দুটো মোট। হাত বদলালেও মাঝে মাঝে বসতে হয়। পথে খাইয়েও নিয়েছি ওকে। ক্ষুদভাজার নাড়ু গোটাকতক করে নিয়ে বেরিয়েছিলুম, তাই ওকে দুটো দিয়েছি, নিজেও খেয়েছি। …গোবিন্দকে খেতে দেবে কিনা জানি না তো, তবে ওর জন্যেই আরও করা। খেতে ভালবাসে–খাবে কি খাবে না, খানিক দোনোমোনো করে শেষ অবৃদি নিয়েই এলুম। খায় খাবে, নয়তো উমি খাবে’খন।’

পুঁটলির একপ্রান্ত থেকে নাড়ুগলো বার করে–কলাপাতায় জড়ানো। ক্ষুদের নাড়ু–অর্থাৎ চালের ক্ষুদ ভেজে গুঁড়িয়ে গুড় দিয়ে নাড়ু বাঁধা।

সরকার বাড়িতে চালের ক্ষুদ দিয়ে আগে মাছ কেনা হ’ত–আজকাল মেছুনীরা নিতে চায় না, সেই ক্ষুদগুলো শ্যামা সংগ্রহ করে। বেশি জমলে ডাল বা ডালের ক্ষুদ মিশিয়ে এক-আধ দিন খিচুড়ি হয়, আর নইলে গুড়ের যদি যোগাড় থাকে–এই মিষ্টান্নটি তৈরি হয়। প্রথম একদিন খুব সংকোচের সঙ্গেই শ্যামা এনেছিল এ বাড়ি, কিন্তু গোবিন্দ খুব উৎসাহ প্রকাশ করায় আজকাল প্রত্যেকবারই এই পদার্থটি তৈরি করে আনে। ক্ষুদের নাড়ু কি নারকেল নাড়ু। নারকেল সংগ্রহ করা কঠিন আজকাল–সরকার বাড়ির ছেলেমেয়াও কান খাড়া করে থাকে কখন একটা নারকেল পড়বে–সেই শব্দের দিকে। তাদের চোখে ধুলো দিয়ে যোগাড় করা কঠিন। তা ছাড়া হাতে পেলেও খরচ করত মন চায় না। নারকেল বিক্রি হয় সহজে। তাই নারকেল ভেঙে নাড়ু করা আর বড় একটা হয়ে ওঠে না।

মুখহাত ধুয়ে ঠাণ্ডা হয়ে শ্যামা বললে, ‘আরও ঐ জন্যই এলুম আমি। হেম যেদিন ফিরল এখান থেকে–কী বার যেন, হ্যাঁ সোমবার, অফিস ক’রে বাড়ি ফিরল তো–সেদিনিই বঠাকুর গেলেন আবার। হেমের মুখে সব শুনে ওকে দিয়েই কথাটা বলালেন। ওঁর খুব ইচ্ছে, বললেন, আমার তো বাড়ি পড়েই আছে। চাকরও আছে রাতদিনের। দুটো ভাত ফুটিয়ে নেওয়া, তা আমাকে গিয়ে করতেই হবে, আর তোদের জ্যাঠাইমা তো ছ-মাস পড়ে, সেই আমাকেই তো সব করতে হয়েছে। আমি যদি একমুঠো ফুটিয়ে নিতে পারি ওকেও তা থেকে দিতে পারব। তার জন্যে আমার বাড়তি কোন খাটুনি তো নেই। চমৎকার জায়গা. আবহাওয়া খুব ভাল..চট্‌পট সেরে উঠবে। টাকায় ষোল সের সতের সের দুধ..তাও আদ্ধেকদিন কিনতে হয় না, রুগীরাও ঘটি ঘটি দুধ দিয়ে যায়। দুধ-ঘি অজস্র, তবে হ্যাঁ, মাছ পাওয়া যায় না। তা আমি শুনে ভাবলুম গোবিন্দ তো আমাদের মাছের তত ভক্তও নয়। ডালটাই ভালোবাসে বেশি। যাক না, ঘি-দুধ আছে যখন জলও ভাল, চট্‌পট সেরে উঠবে। লোকটা যখন অত আগ্রহ করে নিয়ে যেতে চাইছে–কী বলিস উমি?’

প্রস্তাব খুবই লোভনীয়, বিশেষ যখন কোথাও পাঠানোর কোন ব্যবস্থাই হচ্ছে না। বরং কতকটা দৈবপ্রেরিত বলেই মনে হয়।

তবু উমা খানিকটা চুপ করে থাকে। একটু পরে বলে, ‘তোমার আত্মীয় তুমি বুঝে দ্যাখ। এরপর এ নিয়ে কোন কথা-টথা উঠবে না তো?

‘কথা আবার কি উঠবে? আর ওঠে উঠবে। আমাদের যখন দরকার তখন অত ভাবলে চলবে কেন? যেমন করে হোক আমাদের দিন কিনে নিতে পারলেই হ’ল। এরপর কথা উঠলেও কাজটা তো ফিরবে না।’

সংসারের বাস্তব পাঠাশালায় শ্যামা এই জ্ঞানই লাভ করেছে—

সহস্র অভিজ্ঞতার ফল এটা।

প্রয়োজনের কাছে কিছুই বড় নয়–দুটো কথা তো তুচ্ছ!

গালাগাল গায়ে বেঁধে না, দুর্নাম তো নয়ই।

অপমানের জ্বালা?

ক্ষুধার জ্বালা তার চেয়ে ঢের বেশি সত্য, ফের বেশি বাস্তব।

যাদের পেট ভরা আছে, তারাই মানুষের ‘কথা’ নিয়ে মাথা ঘামাতে পারে।

শ্যামা আবারও কণ্ঠস্বরে জোর দেয়, ‘রেখে বোস্ দিকি। কে কী বলবে আর কে কী ভাববে সে কথা এখন ভাববার সময় নয়। যেমন ক’রে হোক ছেলেটাকে বাঁচাতে হবে তো!’

তা বটে। কিন্তু তবু উমা খুঁত খুঁত করে। বলে, ‘সেখানে গিয়ে যদি আবার অসুখ-বিসুখ করে? রোগা ছেলে–ওর একটু তোয়াজও দরকার। সে ভদ্দরলোক শেষ অবধি যদি বিপদে পড়েন? দূরের পথ, হুট করতেই গিয়ে পড়তে পারব না। তাছাড়া সে বাড়িতে মেয়ে-ছেলে নেই, আমাদের যাওয়াও চলবে না। ..সব কথাগুলো ভেবে দ্যাখ দিদি ভাল করে।

কমলার মায়ের প্রাণ। ছেলের রোগপাণ্ডুর মুখের দিকে চেয়ে তারও আশার দিকটাই দেখতে ইচ্ছে করে। …শ্যামার মতো সে-ও প্রয়োজনটাকে আঁকড়ে ধরে প্রাণপণে।

গলায় জোর দিয়ে বলে, ‘সে-ও তো একটা ডাক্তার, এতদিনে কি আর কিছুই শেখেনি!…নইলে ওখানকার লোক এখনও তাকে পয়সা দিচ্ছে কেন? ক’রেই পেট চালাচ্ছে এটা তো ঠিক। কিছু একটা হলে সে কি আর একটু- আধটু ওষুধ দিতে পারবে না!’

‘একটু-আধটু ওষুধ তো এখানকার দুজন ডাক্তার দিয়েছিল দিদি, কী হ’ল তা তো দেখলেই। ‘

‘তা তোর বড় ডাক্তারই তো ওকে চেঞ্জে পাঠাতে বলছে। সব জায়গাতে যে আর.এল.দত্ত নেই–সে কথা সে-ই তো সব চেয়ে বেশি জানে।’

উমা দিদির মনোভাব বুঝে চুপ করে যায়।

সত্যিই–কীই বা করবার আছে। এখানে একতলার এই স্যাঁতসেঁতে ঘরে রেখেই কি বাঁচাতে পারবে? সেখানকার টানের হাওয়াতে আপনিই ভাল হয়ে উঠবে হয়তো।

তার নীরবতাকে সম্মতি বলে ধরে নিয়ে কমলা সাগ্রহে প্রশ্ন করে শ্যামাকে ‘তা হলে তার সঙ্গে যোগাযোগটা হবে কি ক’রে?’

‘এই তো কাছেই থাকেন বঠাকুর। ঝামাপুকুরে মামাশ্বশুর-বাড়ি উঠেছেন যে! এখান থেকে নাকি বেশি দূরে নয়। আমি ঠিকানা দিয়ে দিয়েছি তাঁকে, যাবার আগে দেখা ক’রে যাবেন। যদি তোমাদের পাঠানো মত হয় তো উনিই এখান থেকে তুলে নিয়ে যাবেন যাবার আগে।’

॥৩॥

দেবেন সত্যি-সত্যিই একদিন এদের সঙ্গে দেখা করতে এল। দিন তার ঠিকই ছিল…দিন এবং গাড়ির সময়ও জানিয়ে দিয়ে গেল। বললে, ‘মোটঘাট থাকবে সঙ্গে, গাড়ি করতেই হবে একটা…অমনি ওকে তুলে নিয়ে যাব। …ওর সঙ্গে কিছুই দেবেন না, শুধু ওর জামা-কাপড় দিলেই হবে। বিছানা-ফিছানা সেখানে ঢের আছে–সে সব কিছু লাগবে না।’

কমলা কথা কয় নি। মাথায় ঘোমটা টেনে দূরে বসে ছিল। উমাই আসন পেতে বসালে, জলখাবার দিলে। কথাও কইতে হ’ল তাকে। বললে, ‘দিদি এখনও ভাল হলেন না–আপনি চলে যাচ্ছে, তিনি তো আরও কাতর হয়ে পড়বেন।

‘তা কী করব বল। আমাকে তো ক’রে খেতে হবে। আর এক ব্যাটা ডাক্তার এসে বসেছে যে সেখানে। এ-ই তাই আমি দেড়মাস নেই, রুগীগুলো সব বোধ হয় তার খপ্পরে গিয়ে পড়ল। …তোমাদের দিদি আর কি বাঁচবে–শেষ অবধি হয়তো মরবেই–মিছিমিছি আমার রুজি রেজগারটা খোয়াই কেন?’

একটু যেন চটেই উঠে সে।

অগত্যা উমা চুপ ক’রে যায়।

এই ধরনের মানুষের সঙ্গে ঐটুকু ছেলেকে পাঠাতে তার মোটেই ভাল লাগে না কিন্তু আর কোন উপায়ও যে নেই। ‘এবার হলে সারানো শক্ত হবে’ ডাক্তারের সাংঘাতিক কথাগুলো কানে বজ্রগর্জনের মতই নিত্য ধ্বনিত প্রতিধ্বনিত হচ্ছে। ..তাছাড়া কমলা যেন প্রাণ-পণে আঁকড়ে ধরেছে প্রস্তাবটাকে। এখন বাধা দিতে গেলে অনেকখানি ঝুঁকি নিয়েই দিতে হয়। এর পর…ঈশ্বর না করুন যদি সত্যিই গোবিন্দর কোন সংকটাপন্ন অসুখ হয়…উমা মুখ দেখাতে পারবে না দিদির কাছে। …

সুতরাং যাওয়াই সাব্যস্ত হয়।

নির্দিষ্ট দিনে দেবেন এসে গাড়িতে তুলে নিয়ে যায়।

গোবিন্দ এই সম্পূর্ণ অপরিচিত মানুষটার সঙ্গে যেতে আগে রাজি হয়নি। এতদিন পর্যন্ত মাকে ছেড়ে সে থাকে নি কোথাও এক দিনও–ইদানীং উমা ওদের সঙ্গে বাস করতে আসার সময় থেকে মাসীও তার জীবনের অপরিহার্য অঙ্গরূপে জড়িয়ে গেছে–এই দুজনের স্নেহাঞ্চল থেকে এই প্রথম তার বাইরে যাওয়া। বিদেশে যাওয়ার আগ্রহ এবং ঔৎসুক্য তর কম নেই তাই বলে এই কাঠ-খোট্টা অপরিচিত মানুষটার সঙ্গে অত দূর দেশে যেতে তার একটুও ভাল লাগছিল না। নিতান্ত মা অনেক ক’রে বুঝিয়ে বলাতেই সে রাজি হয়েছে। তা ছাড়া এইভাবে ইস্কুল কামাই ক’রে ঘরে বসে থাকতেও তার খুব বিশ্রী লাগছিল–দুর্বল শরীর, মা-মাসীর পুতুপুতু ভাব, অর্ধেক জিনিস খাওয়া নিষিদ্ধ, এগুলোও প্রীতিকর নয় একটুও। যদি দু-চার দিন বাইরে থেকে ঘুরে এলে সহজ স্বচ্ছন্দ জীবন ফিরে পাওয়া যায় তো না হয় চোখ-কান বুজে কাটিয়ে দেব। কিন্তু তবু গাড়িতে বসে মা-মাসীর মুখের দিকে চেয়ে তার দুই চোখ জ্বালা ক’রে জলে ভরে এল। গলির বাঁকে বাড়ি এবং মা-মাসী অদৃশ্য হবার আগেই তার ঝাপসা চোখের সামনে থেকে তারা মুছে গেল। …

এরপর দুটো দিন কমলা এবং উমার আহার-নিদ্রা রইল না। এমন কি দুজনে যেন নিঃশ্বাসটাও ধরে রেখেছিল উৎকণ্ঠিত প্রতীক্ষায়। গোবিন্দর নিজের হাতের লেখা পোস্টকার্ডখানা এসে পৌঁছতে তবে প্রথম ওদের স্বাভাবিক নিঃশ্বাস পড়ল।

তারপর শুরু হ’ল দিন গোনা।

মুশকিল এই যে কতদিন থাকলে ডাক্তারের মতে ‘চেঞ্জ’ হয়, তা এরা কেউই জানে না। তাঁকে জিজ্ঞাসা করাও হয়নি। তেমনি কী ক’রে এবং কার সঙ্গে গোবিন্দ ফিরবে তাও এরা জানে না। দেবেনকে সে প্রশ্ন করার কথা মনেও পড়ে নি। স্ত্রী সাংঘাতিক অসুস্থ যার সে মাঝে মাঝে আসবে নিশ্চয়ই। এবং যেমন সঙ্গে ক’রে নিয়ে গেছে তেমনি আবার যেদিন আসবে সঙ্গে ক’রেই নিয়ে আসবে এই রকম একটা বিশ্বাস গড়ে উঠেছিল আপনা-আপনিই।

ওরা দিন গুনতে থাকে প্রথম থেকেই। এক দিন এক দিন ক’রে সপ্তাহ, সপ্তাহ থেকে পক্ষ এবং পক্ষ থেকে যখন মাস গড়িয়ে গেল তখন এরা দুজনেই হাঁপিয়ে উঠল। চিঠি দেয় গোবিন্দ নিয়মিতই–কিন্তু তবে চিঠি ও মানুষে অনেক তফাত। শেষে কমলা উমাকে দিয়ে দেবেনের নামেই চিঠি লেখালে–অনেকদিন তো হয় গেল, এতদিনে নিশ্চয়ই গোবিন্দ সুস্থ হয়ে উঠেছে। যদি ওঁর এখন দুচার দিনের ভেতর আসার সম্ভাবনা না থাকে তো আর কোন চেনা লোককে দিয়ে পাঠানো যায় না? পড়াশুনার ক্ষতি হচ্ছে, তাছাড়া উমাদেরও অসুবিধা হচ্ছে খুব। বাজার-হাট করার দ্বিতীয় কোন লোক নেই। ইত্যাদি–

পরের ডকেই দেবেনের জবাব এল।

সে লিখেছে..

‘পরম শুভাশীর্বাদ বিজ্ঞাপনঞ্চ বিশেষ এই যে তুমি একান্ত বুদ্ধিমতী হইয়াও এমন অবুঝের মত পত্র লিখিয়াছ কেন বুঝিলাম না। হাওয়া বদল করিতে গেলে কোথাওকার জলহাওয়া সহ্য হইতেই পনেরো দিন লাগিয়া যায়। শ্ৰীমান আসিয়াছে মাত্র এক মাস, ইহারই মধ্যে কী এমন তাহার গায়ে শক্তি বাড়িবে? এতই কষ্ট যখন করিয়াছ তখন অধীর হওয়ার কোন অর্থ নাই। আরও কিছুদিন চালাইয়া লও, আগামী মাসের প্রথম দিকে আমার যাওয়ার কথা আছে, সেই সময় আমিই সঙ্গে করিয়া লইয়া যাইব। এখানে তেমন কোন আস্থা-ভাজন লোক নাই যে নিশ্চিন্ত হইয়া শ্রীমানকে পাঠাইব। তোমার দিদিকে আমার নমস্কার জানাইবে, তুমি আমার আশীর্বাদ লইবে। ইত্যাদি।

আরও এক মাস।

দুজনের কারুরই ভাল লাগল না কথাটা। এতদিনে হয়তো পড়াশুনা সব ভুলেই বসে রইল। তার ওপর কেমন জায়গা, মানুষজন সব কেমন কিছুই জানা নেই–কাদের সঙ্গে মিশছে, স্বভাব বিগড়োচ্ছে কিনা তাই বা কে জানে!…মানুষটিও তো ঐরকম, চোয়াড় কাঠখোট্টা…ওর হাওয়াও বেশি দিন গায়ে লাগা ভাল নয়।

উমা অপ্রসন্ন দুখে বলে, ‘কে জানে লোকটার মতলব কি। আমার বাপু ভাল লাগছে না রকম-সকম!’

কমলা ভেতরে ভেতরে তেমন আশ্বাস বোধ না করলেও মুখে জোর দেয়, মতলব আবার কি! তোর যেমন কথা!

‘বলা যায় না!’ মেজ জামাইবাবুর দাদা তো!’

।।৪।।

চিঠিখানা পাবার বোধ হয় তিন-চার দিন পরেই হঠাৎ দেবেন এসে হাজির হ’ল। সে একা–গোবিন্দ আসে নি সঙ্গে।

বিবর্ণ মুখে কোনমতে প্রশ্ন করলে কমলা, ‘খোকা, আমার খোকা কোথায়?’

সে যে দেবেনের সঙ্গে কথা বলে নি এর আগে কোনদিন, তাও ভুলে গেল।

‘ভয় নেই, সে ভাল আছে। আমি এধার থেকে টেলিগ্রাম পেয়ে হঠাৎ চলে এসেছি। তোমাদের দিদির খুব বাড়াবাড়ি–বোধ হয় এই শেষ অবস্থা।’

‘তা তাকে নিয়ে এলেন না কেন?’ উমা প্রশ্ন করে, ‘সে একা রইল ওখানে…’

‘ঠিক একা হয়। ঐ হতভাগা বাঁদরটা গিয়ে পড়ল কিনা। আমারও হঠাৎ চলে আসা–বাঁদরটা বললে, আমি এলুম সবে, অমনি চলে যাব? আমিও থাকি গোবিন্দও থাক। তুমি যদি এর ভেতর না এসো তো আমি ওকে নিয়ে দিন সাতেক পরে রওনা হব।’

সহস্র আশঙ্কায় কণ্টকিত উমা প্রশ্ন করলে, ‘কে গিয়ে পড়ল? কার কথা বলছেন?’

‘কে আবার? তোমার গুণধর মেজ জামাইবাবু। বৌমা তো ঠিকানা জেনেছেন–সেখান থেকে ঠিকানা জেনে বিনা টিকিটে মূর্তিমান গিয়ে হাজির একেবারে।’

‘কী সর্বনাশ!’ প্রায় অসাড় কণ্ঠ থেকে শব্দটা আপনিই বেরিয়ে যায়।

দেবেন যেন এবার একটু বিরক্তই হয়। বলে, ‘ও আবার কী কথা। সর্বনাশ আবার এর মধ্যে কী হ’ল। সে কি বাঘ না ভালুক যে তোমাদের ছেলের কাঁচা মাথাটা কড়মড় ক’রে চিবিয়ে খাবে?…সাত দিনে এমন কি সর্বনাশ করবে শুনি?…এত যদি তোমাদের ভয়-এত নিধি যখন–তখন বাপু তোমাদের ছেলে চোখছাড়া করা উচিত হয় নি। …তাছাড়া ছেলেও বললে–মেসোমশায় যখন এসেছেন, দু’দিন থেকেই যাই। তাদের খাওয়া- দাওয়ার সব ব্যবস্থা করে রেখে এসেছি। খুচরো টাকা পয়সা দিয়ে এসেছি গোবিন্দর হাতে–পাছে ঐ হতচ্ছাড়া ছোঁড়া উড়িয়ে দেবে সব–ভয়টা কিসের এত?’

এরপর আর কথা বলা চলে না। কুটুম্ব মানুষ–সেধে উপকারই করতে এসেছে। কী-ই বা বলা যায় আর।

কিন্তু নেয়ে খেয়ে ঘুমিয়ে স্বস্তি থাকে না এদের।

উমা বলে, ‘চল দিদি, আমরা দুজনে চলে যাই, ওকে ফিরিয়ে নিয়ে আসি। জিজ্ঞেস ক’রে ক’রে চলে যাব এখন ঠিক!’

‘ওমা কী বলিস!’ কমলা অবাক হয়ে যায় উমার কথা শুনে, ‘দু’-দুটো সোমথ মেয়েছেলে একলা যাব এতটা পথ? কোন্ দিক দিয়ে কী করে যেতে হয় তাই তো জানি নে।’

‘সেটা জেনে নিলেই হবে দিদি। কত তো কাঙাল-গরীবে মেয়েছেলে একা একা ঘুরছে। আমরাই বা তার চেয়ে এমন ভাল কিসে?’

‘দ্যাখ না-সাতটা দিনই তো! এর মধ্যে সে আর কী করবে তোর ছেলের?’ ‘কী যে সে না করতে পারে তা তো জানি না।’ হয়তো এর মধ্যেই মদ ভাঙ খাওয়াতে শেখাবে–তা দ্যাখ!

উমার আশঙ্কা শুধু যে সত্য তাই নয়–সত্য কল্পনাকেও ছাড়িয়ে যায়। সাতদিনের দিন গোবিন্দ নয়–একখানা চিঠি এসে পৌঁছল। চিঠির লেখক নরেন। উমাকে সম্বোধন ক’রে লেখা।

যদিচ চিঠির ভাষা প্রাঞ্জল, অজস্র বর্ণাশুদ্ধি থাকলেও দুর্বোধ্য নয়–তবু দুই বোনই চিঠিখানা বারতিনেক ক’রে পড়ে পরস্পরের মুখের দিকে চেয়ে স্তব্ধ হয়ে বসে রইল। মনে হ’ল যেন ও-চিঠির একটি বর্ণও তাদের মস্তিষ্কে প্রবেশ করেনি।

নরেন লিখেছে–

‘পরম সুভাসীর্বাদ সুভঞ্চ বিষেসঃ-

কল্যাণীয়া উমা, একটি পরম সুভসংবাদ জানাইয়া এই পত্র দিতেছি। শৃমান গোবিন্দের পিত্রিদেব জিবীত নাই, কিন্তু আমরা আছি, তাহার প্রেতি অভিভাবকদের যাহা কত্তব্য তাহা অবশ্যই আমরা প্রাণপণে করিয়া যাইব। অবস্য যতটা সামথ্যে কুলায়। শৃমান গোবিন্দ বয়সপ্রাপ্ত হইয়াছে–দশবিধ সংস্কারের পর পর ক্রেম অনুসারে এখন তাহার বিবাহ দেওয়া আবস্যক। আমার শর্গগত জৈষ্ট ভায়রা বাঁচিয়া থাকিলে সে কত্তব্যের কথা আমাদের ভাবিতে হইত না, তিনিই ভাবিতেন। কিন্ত কী বলিব আমাদের দুর্ভাগ্গক্রমে তিনি অকালে গত হইলেন। যাহা হউক শৃমানেরও খুব সাধ সে একটি যোগ্য পাতৃ দেখিয়া বিবাহ করে, তাহার সাধ-আহ্লাদ মিটানো আমাদের কত্তব্য। এমত বিধায়, আগামী কালই এ মাসের শেষ বিবাহের দিন থাকায়–কালই একটি সুপার সহিত তাহার বিবাহ সম্পন্য করাইয়া দিয়াছি। পাটি শুমানদের পাটি ঘর–নৈকস্যি কুলীন। দেখিতে দিব্য সুশৃ। পাতৃ দেখিয়া শৃমান বড়ই আল্লাদিত হইয়াছে। যাহা হউক আজ কুসুমডিঙ্গা সারা হইল, আমি আগামীকাল ফুলসজ্জা সারিয়া আগামী পরশুই ছেলে বৌ লইয়া রওনা দিব। তোমরা সব ঠিক করিয়া রাখিও। দিদিকে প্রেণাম দিও, তুমি আশীব্বাব লইও। যদি পারো তো সে মাগীকেও একটা সংবাদ দিও। ইতি–নিয়ত আশীব্বাদক শূনরেন্দ্র নাথ সম্মা।’

॥৫॥

চিঠিখানা যখন আসে তখন উনুনে রান্না চড়েছিল ওদের। তরকারিটা পুড়ে কয়লা হয়ে সেটাও যখন জ্বলে উঠল–তখন চৈতন্য হ’ল। উনুনটা একেবারে নামিয়ে দিয়েই এসে বসল উমা। আহারের কথা–অথবা আহার্য প্রস্তুত করার কথা এখন আর কল্পনা করাও সম্ভব নয়।

সর্বনাশ যা হবার তা হয়েই গেছে। কোথাও কিছু বাকি রাখে নি নরেন।

বিয়ে শুধু নয়–কুশণ্ডিকাও শেষ ক’রে তবে চিঠি দিয়েছে–সে চিঠি পাবার আগেই সম্ভবত বৌভাত এবং ফুলশয্যার অনুষ্ঠান সারা হয়ে গেছে। কে করলে সে সব ব্যবস্থা–কারা করলে বা কী অধিকার করলে সে প্রশ্ন অবান্তর। সেরকম তুচ্ছ কথা নিয়ে বা সংস্কার নিয়ে মাথা ঘামাবে এমন পাত্র নরেন নয়।

অনেকক্ষণ–অনেকক্ষণ পর শুষ্ক কণ্ঠ দিয়ে কমলার স্বর বেরোয়। সে কেমন এক রকম অশ্রুর মতই করুণ হাসি হেসে কতকটা অসংলগ্নভাবে বলে, ‘ঠাট্টা করেছে বোধ হয় নরেন জামাই–কী বলিস?’

উমা জবাব দেয় না। তার তুই চোখ দিয়ে আগুন বেরিয়ে আসে।

কেন, কেন ও লোকটা তাদের এমন সর্বনাশ করবে?

কেন, কেন–কী অধিকারে?

‘এবার এলে আমি তাকে জুতো মারব দিদি। গুরুজনই হোক আর যাই হোক। তুমি দেখে নিও। ‘

কমলা সে কথার উত্তর দেয় না। এসব কথা তাঁর মাথাতেই ঢোকে না।

বিশ্বাসও হয় না হয়তো।

প্রাণপণে ঝাপসা চোখ দুটো মুছে আবার ও চিঠিটা পড়ে।

উমা দাঁতে দাঁতে চেপে বলে, ‘এ বিয়ে আমরা মানব না দিদি, ও বউ আমরা নেব না। যার সঙ্গে ষড় ক’রে করেছে তাঁর কাছেই রাখুক মেয়ে!..তারা জানে না, নেকা! মা রইল এখানে, তাকে জানানো হ’ল না–বিয়ে দিয়ে দিলে!’

কমলা একটু ভয়ে ভয়ে তাকায় বোনের দিকে, কতকটা যেন মিনতির মতই বলে, ‘কিন্তু মেয়েটার দোষ কি বল। যদি সত্যিই জাতের মেয়ে হয় তো–বাপ মার পাপে তাকে অত বড় শাস্তি কী ক’রে দিবি? নিজের কথাটা ভেবে দ্যাখ উমা, মেয়েছেলের এতই বড় অভিশাপ আর নেই।

চাবুকের মত কথাটা এসে পড়ে উমার বুকে।

সত্যিই তো, সে নিজেই তো সবার ঘৃণিত, অভিশপ্ত। বিনা অপরাধে এই গুরু দণ্ড বহন ক’রে চলেছে, সে আবার পরকে দণ্ড দেবার কথা মুখে আনে কোন লজ্জায়।

নির্জনে গিয়ে চৌকাঠে নিজে-নিজেই মাথা খোঁড়ে।

আজ দিদিরি মুখেও এ খোঁটা শুনতে হ’ল।

.

সে দিন এবং সে রাত্রি কাটল দুই বোনের অব্যক্ত এক যন্ত্রণার মধ্যে দিয়ে।

ছেলের মা, অকারণে নিরম্বু থাকতে নেই, তাতে ছেলের অকল্যাণ হয়–শুধু সেইজন্যেই রাত্রে একটু গুড় গালে দিয়ে দুই বোন জল খেলে এক ঘটি ক’রে–তাও উমাই কথাটা মনে করিয়ে দিলে। কমলার সে স্তম্ভিত ভাবটা সারা দিনেও কাটেনি।

ভোরবেলা দেবেন এল রাধারানীর মৃত্যু-সংবাদ নিয়ে

পরশু শেষ রাত্রে মারা গেছে সে। কাল দুপুরে ফিরেছে ওরা শ্মশান থেকে। তারপর আর আসা হয় নি। আজ ভোরেই বেরিয়ে পড়েছে।

কমলা এবং উমা দুজনেই ছলছল চোখে চেয়ে দাঁড়িয়ে রইল। সামান্য পরিচয় ওদের, কিন্তু শ্যামার মুখে দুজনেই অনেক কথা শুনেছে–অনেক দিনের কাহিনী। সে হিসেবে ওদের খুবই পরিচিত যেন।

দেবেনের মুখের দিকে তাকানো যায় না–সে যেন দু’দিনেই অনেকখানি বুড়ো হয়ে গেছে। বাহ্যত কোন শোক প্রকাশ করলে না বটে, সহজ এবং সাধারণভাবেই সংবাদটা দিলে কিন্তু ঠিক অত সহজে যে সে ঘটনাটা নিতে পারে নি তা স্পষ্ট প্রকাশ পেল ওর চেহারায় এবং উদ্ভ্রান্ত দৃষ্টিতে। রগ দুটো যেন আরও বসে গেছে, চোখের কোলে গভীর কালি, গাল দুটো ঢুকে গেছে মুখের ভেতর–এমন কি চুলগুলোও যেন পাকা দেখাচ্ছে।

দু’একটা কথার পরই দেবেন হঠাৎ প্রশ্নটা করে বসল—-সে আসে নি, নরেন? করছে কি এখনও?’

এই শোকের মুখে সংবাদটা দেওয়া উচিত হবে কিনা কমলা মনে মনে এতক্ষণ এই চিন্তাই করছিল–কথাটা উঠতে সে নীরবে চিঠিখানা বার ক’রে ওর সামনে ফেলে দিলে।

দেবেন চিঠি পড়ে ক্ষেপে উঠল একেবারে।

‘আমি ওকে খুন করব। ওকে গুলি করে মারব। জুতো মারতে মারতে মেরে ফেলব–হ্যারামজাদা শুয়োরের বাচ্চাকে। ওর গলায় পা দিয়ে জিভ টেনে বার করব! কী ভেবেছে ও? আমি মরে গেছি। … ছি ছি, এত বড় আস্পদ্দা ওর। নিশ্চয় ঘুষ খেয়েছে দিদি, মোটা টাকা খেয়েছে। নৈকুষ্যি কুলীন না ছাই–এ সেই ভুবন ঘোষালের দামড়া মেয়েটা। আমি বাজি রেখে বলতে পারি। মেয়েটা যদি গোবিন্দর চেয়ে বয়সে বড় না হয় তো কী বলেছি।’

সে যেন দাপাদাপি ক’রে বেড়াতে লাগল।

চেঁচামেচিতে বাড়িওলারা সচকিত হয়ে উঠলেন। উঁকিঝুঁকি মারতে লাগল দু’একজন। আগ্রহ ও ঔৎসুক্য বুড়ী গিন্নীরই বেশি। রসালো প্রসঙ্গের আভাস পেয়ে তাঁর দৃষ্টি লুব্ধ হয়ে উঠল।

কমলা বিপন্ন হয়ে বললে, ‘আপনি শান্ত হোন। যা হবার তা তো হয়েই গেছে। বিয়ে তো আর ফিরবে না–হিন্দুর বিয়ে, শালগ্রাম শিলা আগুন আর ব্রাহ্মণ সামনে রেখে ভার যদি সে নিয়েই থাকে–

‘কিসের ভার নেওয়া, কিসের বিয়ে!–বার করছি সব। বাড়ি ঢুকতে দেবেন না–একদম চৌকাঠের বাইরে থেকে মেয়েটাকে গলাধাক্কা দিয়ে বার ক’রে দেবেন–সেজন্য দায়ীক আমি। ..উঁ–গছিয়ে অমনি দিলেই হ’ল!’

আর এক পাক যেন নেচে এসে অপক্ষোকৃত নরম গলায় আবার বললে, ‘ওরা তিন পুরুষ ঐখানেই আছে–ক্ষেত-খামার দেখে, জমি-জায়গা নিয়ে নেড়ে চেড়ে খায়। একদম দেহাতী চাষা, বুঝলেন?

ওদের মেয়ের বিয়ে হবে কোথায়–কে নেবে? ওখানে তেমন বাঙালিই নেই, বামুন তো খুব কম। যা আছে দূরে দূরে–কে বা সম্বন্ধ করে আর কে বা কি!–মেয়েটা এমনি দেখতে মন্দ নয় কিন্তু কালো। তার ওপর নেই বাপের পয়সার জোর। –গোবিন্দকে দেখে এস্তক্ ছোঁক ছোঁক করছে, ভরসা ক’রে আমার কাছে কথাটা পাড়তে পারে নি। পাড়তে এলে ধুধুড়ি নেড়ে দিতুম–তা জানে। এখন আমি নেই…ঐ হারামজাদা শুয়োরের বাচ্চাকে ঘুষ খাইয়ে কাজ সেরে নিয়েছে। জাতটা তো বাঁচল–তার পর তুমি নাও না-নাও, না হয় ঘরেই পুষবে। এমনেও পুষতে হচ্ছিল অনেও পুষবে। কম ফন্দিবাজ ধুত্তু মানুষ এ ঘোষালটা!’

আরও খানিকটা চেঁচামেচি ক’রে দেবেন উঠে পড়ল।

‘আমি চলুম হাওয়া ইস্টিশনে। ঐখানে জুতো মারতে মারতে যদি গোরবেটাকে মেরে না ফেলি তো আমার নাম নেই। ঐখান থেকেই সে ছুঁড়িকে আমি ফিরিয়ে দেব–কিচ্ছু ভাববেন না। ‘

কমলা এবং উমা দুজনে ব্যস্ত হয়ে পড়ল।

উমা বললে,’কাল থেকে আপনার নিশ্চয়ই খাওয়া-দাওয়া হয় নি, আপনি ব্যস্ত হবেন না। বসুন একটু। অন্তত একটু খেয়ে যান। আমাদের অদৃষ্ট–আপনি আর কি করবেন?

দেবেন প্রথমটা প্রবল আপত্তি তুলল।

‘না, না। ওসব থাক। আর এক দিন হবে। আমার মন-মেজাজের ঠিক নেই ছোড়দি। ওসব ভাল লাগছে না। ছি ছি, বলতে গেলে জোর ক’রেই আমি নিয়ে গেলুম ছেলেটাকে–যদি রেখে না আসতুম তো এমন কাণ্ড ঘটত না। …এর বারো আনা দায়ীক যে আমি হয়ে পড়লুম।

আরও খানিকটা পীড়াপীড়িতে একটু বসে এক ঘটি শরবত খেয়েই রওনা দিলে সে।

যাবার সময় কমলা বলে দিলে, ‘যা হবার হয়ে গেছে উমা, ওঁকে বুঝিয়ে বলে দে মিছিমিছি এর ওপর আর কেলেঙ্কার না করেন।’

দেবেন চলে যেতেই মালতীরা ভিড় ক’রে এসে দাঁড়াল।

মালতীর ঠাকুমা বললেন, ‘কী হয়েছে গা মেয়ে–বলি ব্যাওরাটা কি? তাঁর রসনা সরস হয়ে উঠেছে ভালরকম একটা কেলেঙ্কারির গন্ধ পেয়ে, ধৈর্য ধরা কঠিন

চুপ ক’রে থাকলে চলবে না। চাপা দেবার চেষ্টাও বৃথা। একই বাড়ি, বলতে গেলে একই কথা। একটু পরেই হয়তো ওরা এসে হাজির হবে। তখন সকলেই জানতে পারবে সব কথা।

কমলা নতমুখে সব কথাই খুলে বললে। উমা অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে স্তব্ধ হয়ে বসে রইল।

বুড়ী গিন্নী গালে হাত দিয়ে কিছুক্ষণ স্তম্ভিত হয়ে দাঁড়িয়ে থেকে বললেন, ‘অবাক করেছে মা। …মিনসে এত বড় শয়তান। ঘুষ খেয়ে পরের ছেলে বেচে দিয়ে বসে রইল? বলি তোমাদের আত্মীয় তো সব বেশ। –তা যখন সম্পর্কেরই লোক–তখন বিশ্বাস ক’রে ছেলে ছাড়া তোমার উচিত হয়নি বাছা, স্পষ্ট কথা যা বলব।’

মালতীর মা শাশুড়ির সামনে আজও চেঁচিয়ে কথা কন না। ঘোমটার মধ্যে থেকে বললেন ‘তা কি করবে এখন ঠিক করলে খোকার মা?’

‘কী করব?’ কমলা বিপন্নভাবেই বলে, ‘রে বেচারীর দোষ কি বল। তাকে কোথায় ফেলব। হাজার হোক ছেলেরই বৌ, ছেলে যখন তাকে বিয়ে করেছে।’

বুড়ী গিন্নী এদের নির্বুদ্ধিতায় বিরক্ত হয়ে ওঠেন, ‘ওমা, তাই বলে অমনি বৌ ঘরে তুলবে নাকি। অমন কাজও ক’রো না। অমন লোকের মেয়ে যখন তখন সেও ধাড়ী শয়তান। গুণতুক্ সব শিখে আসেছ, এই বলে দিলুম–তোমাদের হাড়ীর হাল ক’রে ছাড়বে। যাকে ঘুষ দিয়ে ঐ মেয়ে গছিয়েছে তার সঙ্গে বুঝুক, তোমরা ঝ্যাঁটা মেরে বাড়ি থেকে বার ক’রে দাও।

কমলা চুপ করে থাকে।

ওর মনের ভাবটা আন্দাজ ক’রে নিয়ে মালতীর মা আবারও ফিস্ ফিস্ ক’রে বলেন, ‘বলি তা যদি না পার তো এধারে উয্যুগ সঞ্জুগ কর।

‘ওমা, উয্যুগ নেই? বরণ করতে হবে না? ন্যাটা মাছ চাই না? দুধ? বলি নিত-কিত আছে তো সব!’

মালতীর মা কাজের মানুষ। তিনি এদের কাণ্ডকারখানা দেখে অবাক হন। এতক্ষণে কমলারও হুঁশ হয়। সে ওর হাত ধরে বলে, ‘যা হয় তুমি কর বৌদি, আমি বরং গোটা দুই টাকা দিই–আমি আর কিছু পারছি না। ‘

মোটামুটি একটা আয়োজন করতে না করতেই সদরের বাইরে একটি ঘোড়ার গাড়ি এসে দাঁড়াবার শব্দ হ’ল। ছেলেমেয়েরা উন্মুখ হয়েই ছিল–তারা ছুটে গিয়ে দেখেই হৈ-চৈ ক’রে উঠল। মালতী একটা শাঁখ বাজাতে বাজাতে ছুটে এল–মালতীর মা এসে হাত ধরে বৌকে নামিয়ে নিলেন।

অপরাধীর মত মাথা হেঁট করে নেমে দাঁড়াল গোবিন্দ। বেচারী মা-মাসীর দিকে চাইতেও পারছিল না।

একাই এসেছে ওরা।

কারণ নরেন আর যাই হোক–নির্বোধ নয়। সে গাড়ি ভাড়া ক’রে ওদের চাপিয়ে দিয়ে হাওড়া থেকেই সরে পড়েছে। তবে গাড়ি-ভাড়াটা নাকি যাবার আগে দিয়ে গেছে গোবিন্দর হাতে।

ওর এতখানি বিবেচনায় উমা এবং কমলা দুজনেই বিস্ময় বোধ করে।

বৌ দুধে-আলতায় এসে দাঁড়াতে মালতীর মা তার মুখটা তুলে বললেন, ‘না ঠাকুরঝি, দিব্যি বৌ–খুব ঠকো নি বাপু, যাই বল।

এতক্ষণ কমলা সেদিকে তাকাতে পারে নি সত্যিই।

বহুদিনের আশা গড়ে উঠেছিল তার এই একমাত্র ছেলেকে কেন্দ্র ক’রে। বৈধব্যের পর ভবিষ্যতের সব আশা গিয়ে সংহত হয়েছিল ঐ জীবনটিতে। ছেলে বিদ্বান হবে, বড় হবে–মানুষের মত মানুষ হবে।

সেই সমস্ত আশায় ছাই দিয়ে দুর্গ্রহের মত, বোঝার মত যে এসে ঘাড়ে চাপল তার প্রতি একটা দারুণ বিতৃষ্ণা যে কমলার অন্তর ছাঁপিয়ে উঠবে–এটা খুব স্বাভাবিক। প্রবল একটা বিদ্বেষ, দুর্নিবার একটা রোষ অনুভব করে সে। এক সময় মনে হয় সত্যিই টুকরো টুকরো ক’রে ফেলে সে মেয়েটাকে, দু’হাতে গলা টিপে শেষ ক’রে দেয় সে ঐ সর্বনাশীকে।

তাতে নিজের জীবন যায় যাক–ছেলের জীবন তো স্বচ্ছন্দ, নিরাপদ হবে।

প্রাণপণে প্রবল হৃদয়-দ্বন্দ্ব দমন করবার চেষ্টা করে সে। দুহাতে বুকটা চেপে ধরে।

উমার দিকে ফিরে বলে, ‘তুই যা বোন–যা করতে হয় কর।’

উমা ঘাড় নেড়ে বলে,’না! আমার দুর্ভাগ্যের ছোঁয়াচ এখনই আর ওর লেগে কাজ নেই দিদি। তুমি মা। শুধু তো ছেলেরই নও, আজ থেকে ওর-ও মা!’

সামান্য একটু সময়। সকলেই একটা নাটক অনুভব করছে বাতাসে। মালতীয় ঠাকুরমার মুখে প্রচ্ছন্ন কৌতুকের হাসি। মালতীর মা বিপন্ন বোধ করেন নিজেকে। এমন সময় নতুন বৌ-ই এক কাণ্ড ক’রে বসল। হয়তো বাপ- মা শিখিয়ে দিয়েছিল আসবার সময়। কিংবা নরেনই–কে জানে! সে দুধে- আলতার পাত্র থেকে হেঁটে এগিয়ে এসে কমলার পায়ের কাছে বসে পড়ে ওর একটা পায়ে হাত রেখে বললে, ‘আমাকে মাপ করুন মা!’

আহা, বাছা রে!

এই শব্দটাই বুঝি বেরিয়ে আসতে চায় কমলার মুখ দিয়ে — প্ৰথম প্রতিক্রিয়া হিসাবে।

সমস্ত নিষ্ফল ক্ষোভ, সমস্ত ব্যর্থ রোষ নিমেষে এক সীমাহীন সহানুভূতিতে রূপান্তরিত হয়।

‘ষাট ষাট’ বলে সে দু’হাতে তুলে ধরে বৌকে।

মালতীর মা মিছে বলে নি। কালো নয়–তবে ফরাসাও নয়। শ্যামাঙ্গী বলা যেতে পারে। কিন্তু মুখখানি অপূর্ব। প্রতিমার মতো ঢেউ খেলানো চুলের ভার, গড়নও নিখুঁত। তবে গোবিন্দর পাশে হয়তো একটু বেমানানাই লাগবে। অপূর্ব স্বাস্থ্যবতী মেয়েটা। সেই কারণেই অনেকখানি বড় দেখাচ্ছে ওর পাশে। নইলে মুখ এখনও কচি আছে। খুব বেশি হলেও গোবিন্দর সমবয়সী হবে।

মালতীর ঠাকুমা সকলকে শুনিয়ে ফিস্ ফিস্ ক’রে বলেন, ‘ভাল হয়েছে, বৌ ছোট ভায়ের হাত ধরে কোম্পানির বাগানে বেড়াতে যাবে’খন।’

কমলা কিন্তু বৌয়ের মুখের দিকে চেয়ে অপূর্ব একটা তৃপ্তি অনুভব করে মনে মনে। এমনি একটি বৌ-ই বুঝি তার স্বপ্ন ছিল মনের অবচেতনে। সে ওকে বুকের মধ্যে জড়িয়ে ধরে বলে, ‘এসো মা এসো। তোমার অপরাধ কি মা। আমার ভাগ্য!…আজ, আজ তিনি থাকলে এ তো আনন্দেরই হ’ত।’

দুই চোখ আর বাধা মানে না–হুঁ-হুঁ ক’রে কেঁদে ফেলে কমলা।

অনেকক্ষণ, অনেক বিপরীত মনোভাবের সঙ্গে লড়াই করেছে সে। সব ঝড়ের প্রশান্তি হয় বুঝি এই বর্ষণেই। শান্ত, প্রকৃতিস্থ হয় সে।

বৌটি বেশ সপ্রতিভ ধরনের মেয়ে।

পশ্চিমে মানুষ হয়েছে বলেই বোধ হয় এদেশী চালচলনে ততটা অভ্যস্ত নয়। সোজা চোখ তুলে তাকায়, স্পষ্ট স্পষ্ট কথা বলে,–হাসির কথায় শব্দ ক’রে হাসে। বধূসুলভ লজ্জা নেই–সে অভাবটা সম্বন্ধে তেমন সচেতনও নয়।

বৌয়ের নাম তারা।

সে নিজেই ব্যাখ্যা করলে, ‘ঠাকুমার দেওয়া নাম কালীতারা। তা কালী আবার আমার দিদিমারও ডাকনাম–তাই মা ডাকেন শুধু তারা বলে।’

দেবেনের অনুমানই ঠিক। ভুবন ঘোষালেরই মেয়ে সে।

উমা প্রশ্ন করলে, ‘জামাইবাবুর দাদার সঙ্গে দেখা হয়নি তোমাদের হাওড়াতে?’

‘কৈ না তো!’ অবাক হয়েই উত্তর দিলে তারা, ‘তাঁর যাবার কথা ছিল নাকি?’

উমা কথাটা একটু ঘুরিয়ে বললে, ‘না, খবরটা পেয়ে তিনি খুব রেগে গিছলেন কিনা। তাই ভাবলুম যদি সেখানে গিয়ে পড়ে একটা রাগারাগি চেঁচামেচি করেন–

তারা আরও অবাক হয়ে বললে, ‘কেন তিনি তো জানতেন।‘

‘সে কি!’ একই সঙ্গে কমলা ও উমার মুখ দিয়ে প্রশ্নটা বেরিয়ে আসে। গোবিন্দ এতক্ষণ একটিও কথা বলেনি মাথা হেঁট ক’রেই বসে ছিল। সে এবার মুখ তুললে। বললে, ‘ওরা কেউ কম নয় মা। উনি আমার শ্বশুরের কাছে তিনশ টাকা ধার করেছিলেন ক-বারে, এক পয়সাও দিতে পারেন নি, শ্বশুর শেষে ওঁকে বলে যে এই বিয়ে ঠিক ক’রে দাও, তা হলে আর তোমায় টাকা দিতে হবে না। তখন থেকে জপাচ্ছে আমাকে। নিহাত চলে আসলে হ’ল তাই–তাও মেসোমশায়কে পাহারা রেখে এল। বাড়ি থেকে বেরোতে দিত নাকি আমাকে? চোখে চোখে রাখত দিনরাত। মেসোও দুশ’খানি টাকা খেয়েছে। …তার ওপর আজ এখানে নেমে দানের বাসনগুলোও হাতাবার তালে ছিল। নিহাত–,’ খানিকটা থেমে আরক্ত-কপোলে কোনমতে কথাটা শেষ করে গোবিন্দ, ‘নিহাত ও ঝগড়া করলে বলে তাই। গাড়িভাড়ার টাকা-কড়ি সব শ্বশুর মশাই বুঝিয়ে দিয়েছিলেন কিনা–আমি তা জানতুমও না, সব ও-ই আদায় করেছে!’

দু’দুবার স্ত্রীর কথাটা উল্লেখ করার লজ্জায় গোবিন্দর কান দুটো আবীরের মত রাঙা হয়ে উঠল

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *