মঞ্চনাটক

তিন গোয়েন্দা ভলিউম ১১৪/২ – মঞ্চনাটক – কাহিনি রচনা: কাজী শাহনূর হোসেন – তিন গোয়েন্দায় রূপান্তর: শামসুদ্দীন নওয়াব – সেবা প্রকাশনী – প্রথম প্রকাশ : ২০১০

পূর্ব কথা

গরমের এক দিনে, পেনসিলভেনিয়ার ফ্রগ ক্রীক উডসে রহস্যময় এক ট্রী হাউস উদয় হয়।

তিন গোয়েন্দা হিরু চাচার বাসায় বেড়াতে এসে আবিষ্কার করে ওটা। ট্ৰী হাউসে উঠে ওরা দেখে ওটা বই দিয়ে ঠাসা।

শীঘ্রি ওরা জানতে পারে ট্রী হাউসটা জাদুর। বইতে উল্লেখ করা নানান জায়গায় ওদেরকে নিয়ে যেতে পারে। ওদেরকে শুধু কোন একটা ছবিতে আঙুল রেখে সেখানে যাওয়ার ইচ্ছে প্রকাশ করতে হয়। ওরা যখন অভিযানে বেরোয়, ফ্রগ ক্রীকের সময় তখন স্থির থাকে।

এক পর্যায়ে তিন বন্ধু আবিষ্কার করে ট্রী হাউসটার মালিক মরগ্যান লে ফে। রাজা আর্থারের রাজ্য ক্যামেলটের এক জাদুকরী লাইব্রেরিয়ান এই মরগ্যান। টাইম আর স্পেসে ভ্রমণ করে বই সগ্রহ করে সে।

এবার জিনার বাবা-মার সঙ্গে হিরু চাচার বাসায় বেড়াতে এসেছে। কিশোর আর জিনা।

তারপর…

কিশোর আর জিনা বারান্দায় বসে ছিল। গ্রীষ্মের উষ্ণ সন্ধেয় জোনাকি জ্বলছে।

আরি, উল্কা! বলে উঠল জিনা। আকাশের দিকে তর্জনী তাক করল।

মুখ তুলে চাইল কিশোর। আকাশে আঁকাবাঁকা আলোর ঝলকানিটা শেষ মুহূর্তে দেখতে পেল। ফ্রগ ক্রীক উডসের উপরে দুমুহূর্ত ঝুলে রইল আলোটা। তারপর মিলিয়ে গেল গাছের মাথাগুলোর আড়ালে।

শ্বাস চাপল কিশোর। ঘাড় কাত করে জিনার দিকে চাইল।

ওটা উল্কা না, বলল ও।

ঠিক, বলল জিনা।

লাফিয়ে উঠে দাঁড়াল ওরা। ফ্রণ্ট হল-এর ভিতর থেকে ব্যাকপ্যাক তুলে নিল কিশোর।

হিরু চাচা! আমরা একটু বাইরে যাচ্ছি, চেঁচিয়ে বলল। এখুনি ফিরব!

দেরি করিস না কিন্তু! হিরু চাচা বলল।

ঠিক আছে! বলল কিশোর। দরজা লাগিয়ে দিল। জলদি চলো!

উঠনের উপর দিয়ে আড়াআড়ি দৌড় দিল কিশোর আর জিনা। একটু পরে ছুটে চলল রাস্তা ধরে। ছুটতে ছুটতে বনভূমিতে প্রবেশ করল। সবচাইতে বড় ওক গাছটার কাছে এসে থামল। মুখ তুলে চাইল ওরা।

যা ভেবেছিলাম, বলল জিনা।

কিশোর মৃদু হাসল। মুখে কথা জোগাল না ওর।

আমাদের উল্কা, বলল জিনা। জাদুর ট্রী হাউস।

দড়ির মই চেপে ধরে উঠতে লাগল ও। অনুসরণ করল কিশোর।

ট্রী হাউসের ভিতরে ঢোকার পর দুজনেই শ্বাস চাপল। ছায়াময় এক কোণে দাঁড়িয়ে লম্বা, সাদা চুলের অপরূপা এক মহিলা।

কেমন আছ, কিশোর-জিনা? বলল মরগ্যান লে ফে।

মরগ্যান! প্রায় চেঁচিয়ে উঠল কিশোর আর জিনা।

মরগ্যানকে জড়িয়ে ধরল ওরা।

আপনি এখানে কেন? প্রশ্ন করল জিনা। আমাদেরকে কী করতে হবে বলুন।

তোমরা ইতিমধ্যেই আমার জন্যে অনেক করেছ, বলল মরগ্যান, এবং রাজা আর্থার আর ক্যামেলটের জন্যে। এবার আমি চাই তোমরা নিজেদের জন্যে কিছু করো। তোমরা এবার জাদু শিখবে।

বলেন কী, সোসাহে বলে উঠল জিনা। আমরা জাদুকর ইব? আপনি আমাদেরকে জাদু মন্ত্র শেখাবেন?

হেসে উঠল মরগ্যান।

কোন কোন জাদুতে মন্ত্র লাগে না, বলল সে। তোমরা পরের অভিযানগুলোয় একটা করে বিশেষ জাদু খুঁজে পাবে।

কীভাবে? কিশোরের প্রশ্ন।

গোপন এক ছড়া তোমাদেরকে প্রতিটা অভিযানে গাইড করবে, বলল। মরগ্যান। এই নাও।

জিনা মরগ্যানের হাত থেকে ছড়াটা নিয়ে জোরে জোরে পড়ল:

টু ফাইণ্ড আ স্পেশাল ম্যাজিক,
ইউ মাস্ট স্টেপ ইনটু দ্য লাইট
অ্যাণ্ড উইদাউট ওয়্যাণ্ড, স্পেল, অর চার্ম,
টার্ন ডেটাইম ইনটু নাইট।

দিনকে রাত করা? প্রশ্ন করল কিশোর, তা কীভাবে সম্ভব?

স্মিত হাসল মরগ্যান।

সেটাই তো তোমাদেরকে জানতে হবে, বলল।

কিশোরের মনে অনেক প্রশ্ন ছিল। কিন্তু ও আর কোন কথা জিজ্ঞেস করতে পারার আগেই, আকস্মিক আলোর ঝলকানিতে আলোকিত হয়ে উঠল ট্রীহাউস। আলো থেকে বাঁচতে চোখ বুজে ফেলল ও। চোখ যখন খুলল, মরগ্যান লে ফে উধাও। সে যেখানে দাঁড়িয়ে ছিল সেখানে একটা বই পড়ে রয়েছে।

মিরগ্যান আমাদেরকে সব কথা বলেনি, বলল কিশোর।

তবে এই রিসার্চ বইটা রেখে গেছে, বলল জিনা। বইটা তুলে নিল।

এটা থেকে জানা যাবে প্রথমে আমাদের কোথায় যেতে হবে। জানালার ম্লান আলোর কাছে বইটা ধরল ও।

প্রচ্ছদে দেখা গেল ব্যস্ত এক নদী, বেশ কিছু নৌকা আর একটা সেতু। শিরোনাম বলছে: মেরি ওল্ড ইংল্যাণ্ড

তারমানে আমরা জাদু খুঁজতে প্রাচীন ইংল্যাণ্ডে যাচ্ছি? বলল জিনা। শুনতে তো দারুণ লাগছে। তুমি রেডি?

হুঁ, বলল কিশোর। ও অবশ্য ভাবছিল মরগ্যানের কাছ থেকে আরও কিছু তথ্য পেলে ভাল হত। কিন্তু ও রিসার্চ বইটার প্রচ্ছদে আঙুল রাখল।

আমরা ওখানে যেতে চাই, বলল।

বাতাস বইতে শুরু করল।

ট্রী হাউস ঘুরতে লাগল।

বাতাস ক্রমেই জোরাল হচ্ছে।

এবার সব কিছু স্থির হয়ে গেল।

একদম নিথর।

গনগনে রোদ এসে ঝাঁপিয়ে পড়েছে ট্রী হাউসের ভিতরে। কিশোর চোখ মেলল।

জিনার পরনে অ্যাপ্রন সহ লম্বা এক পোশাক। কিশোরের গায়ে ফোলা। হাতাওয়ালা শার্ট, নী-লেংথ প্যান্ট আর টাইটস। দুজনের পায়েই চামড়ার চটি। কিশোরের ব্যাকপ্যাক বদলে গিয়ে এখন এক চামড়ার ব্যাগ।

কাপড়গুলো অদ্ভুত, বলল কিশোর। ওর গলার স্বর চাপা পড়ে গেল নীচ থেকে আসা ওয়াগনের চাকার গুড়গুড় শব্দে।

কী হচ্ছে এখানে? জিজ্ঞেস করল জিনা।

দুজনেই বাইরে তাকাল।

ট্রী হাউসটা চওড়া, বাদামি এক নদীর কাছে, গাছ-গাছালির এক জটলার মধ্যে নেমেছে। ওয়াগন, ঠেলাগাড়ি আর মানুষ-জন এগিয়ে যাচ্ছে নদীর দিকে। পারাপারের নৌকা, পাল তোলা জাহাজ আর সাদা রাজহাঁস ভেসে বেড়াচ্ছে পানিতে।

বাব্বা, একেবারে জমজমাট! বলল জিনা।

কিশোর ওদের গবেষণার বইটা খুলে পড়ল:

১৬০০ খ্রিস্টাব্দে, এক লাখের বেশি
মানুষ বাস করত ইংল্যাণ্ডের লণ্ডন শহরে। সে
সময় ইংল্যাণ্ড শাসন করতেন রানী
প্রথম এলিজাবেথ। জনগণ তাকে
খুব ভালবাসত।

রানী? ভাল তো, বলল জিনা।

কিশোর নোটবই বের করে তথ্যগুলো টুকে নিল।

এরকম ব্রিজ আগে দেখিনি, বাঁ দিকে চেয়ে বলল জিনা।

কিশোরও ওর সঙ্গে চাইল। নদীর উপরে বিশাল এক পাথুরে সেতু। সেতুটা অনেকটা যেন ছোটখাট এক শহরের মত। ওটায় গিজগিজ করছে বাড়ি-ঘর, দোকান-পাট। এমনকী একটা গির্জাও রয়েছে।

কিশোর সেতুটার একটা ছবি খুঁজে পেল গবেষণার বইটায়। জোরে জোরে পড়ল ও:

লণ্ডন শহরের কেন্দ্রস্থলে ছিল লণ্ডন সেতু।
সেতুটা ছিল টেমস নদীর উপরে। ইতিহাসের নানান
সময়ে সেতুটা ধসে পড়ে। কিন্তু ওটাকে
বারবারই মেরামত করা হয়।

এইবার বুঝেছি, বলে উঠল জিনা। গানটা কোত্থেকে এসেছে। ও গাইল, লণ্ডন ব্রিজ ইয় ফলিং ডাউন, ফলিং ডাউন…

জিনা গান গাইছে, কিশোর নোটবই বের করে তথ্যগুলো লিখে নিল।

এবার জাদুটা খুঁজি চলো বলল জিনা। মরগ্যানের চিরকুটটা পড়ল আবারও:

টু ফাইণ্ড আ স্পেশাল ম্যাজিক,
ইউ মাস্ট স্টেপ ইনটু দ্য লাইট
অ্যাণ্ড উইদাউট ওয়্যাণ্ড, স্পেল, অর চার্ম,
টার্ন ডেটাইম ইনটু নাইট।

কিশোর চোখ পিটপিট করে আকাশের দিকে চাইল। মেঘশূন্য গাঢ় নীল। আকাশ।

এটা সম্ভব নয়, বলে মাথা নাড়ল ও।

কিন্তু ও গবেষণার বই আর নোট বইটা চামড়ার ব্যাগের ভিতরে ছুঁড়ে দিল। এবার জিনাকে অনুসরণ করে দড়ির মই বেয়ে নামতে লাগল। মাটিতে নেমে নদীর উদ্দেশে হেঁটে চলল।

এহ! বলে নাক টিপে ধরল জিনা।

নদী থেকে দুর্গন্ধ আসছে।

অন্য কেউ অবশ্য দুর্গন্ধটাকে পরোয়া করছে না। লোকজন খোশমেজাজে গাদাগাদি করে নৌকায় উঠছে, কিংবা সেতুর দিকে এগোচ্ছে। সবার মুখের চেহারায় খুশির ছাপ। কোথাও আমোদ-ফুর্তি করতে যাচ্ছে যেন।

এক দল রাস্তার ছেলে কিশোর আর জিনার পাশ দিয়ে চলে গেল। বারো-তেরো বছর বয়স হবে। হাসাহাসি করছে। কোনদিকে ভ্রূক্ষেপ নেই।

জলদি চল! দেরি হয়ে যাবে! একজন চেঁচিয়ে উঠল।

ছেলেগুলো সেতুর পাথুরে তোরণটার উদ্দেশে দৌড় দিল।

কীসের দেরি? প্রশ্ন করল জিনা। ব্রিজের ওপাশে কী আছে? ওদের এত তাড়াহুড়ো কীসের?

কে জানে, বলল কিশোর। গবেষণার বইটা টেনে বের করল। দেখি বইতে কী বলে।

না, চলো আমরাও যাই-নইলে দেরি হয়ে যাবে! বলল জিনা, ছুট দিল।

আচ্ছা, আচ্ছা, বলল কিশোর।

বইটা ঢুকিয়ে রেখে, জিনার পিছু পিছু লণ্ডন ব্রিজের দিকে দৌড় দিল।

পাথুরে তোরণের নীচ দিয়ে লণ্ডন ব্রিজের দিকে পা বাড়াল কিশোর আর জিনা।

সেতুতে ওঠার পর, অবাক হয়ে গেল কিশোর। সেতুটা ভয়ানক কোলাহলমুখর। আর বাতাসে কীসের যেন দুর্গন্ধ। খোয়া বাধানো পথের উপর দিয়ে বাজের মত শব্দ তুলে গড়িয়ে চলেছে ওয়াগনের চাকা। মালগাড়িতে ঠনঠন শব্দে পাত্রে পাত্রে ঠোকাঠুকি। ঘোড়ারা হেষাধ্বনি করছে। দোকানদাররা তারস্বরে চেঁচাচ্ছে।

অ্যাই পাই! পাই!

অ্যাই ভাজা মটরশুটি! ভাজা মটরশুটি!

অ্যাই পিন! পিন!

চাই জুতা! সাবান! লবণ!

এক দোকানীর সঙ্গে কিশোরের চোখাচোখি হয়ে গেল।

কিছু লাগবে, বাবু? চেঁচিয়ে প্রশ্ন করল সে।

না, ধন্যবাদ, চলতে চলতেই বলল কিশোর।

সাবধান! এক মালগাড়ির চালক চেঁচাল।

কিশোর জিনার হাত ধরে রাস্তা থেকে টেনে সরিয়ে আনল। মালগাড়িটা সরু রাস্তা ধরে ওদের পাশ দিয়ে চলে গেল।

দেখো! দেখো! বলে উঠল জিনা। মালগাড়ির পিছনে কাঠের খাঁচায় বন্দি এক ভালুক। সারা গায়ে বাদামী লোম। মাথা নোয়ানো।

মালগাড়িটাকে এগিয়ে যেতে দেখে মাথা নাড়ল কিশোর।

এবার কী? প্রশ্ন করল।

ওদিকে দেখো, বলে মুখ তুলে চাইল জিনা।

কয়েকটি বাড়ির ছাদের কিনারায় কুঁজো হয়ে বসে থাকা কালো রঙের বিশালকায় পাখিগুলোকে আঙুল ইশারায় দেখাল ও। পাখিগুলো ঠায় বসে নীচ দিয়ে চলে যাওয়া মালগাড়ি, মানুষ-জন আর জীব-জন্তুদের দেখছে। কিশোর শিউরে উঠে নীরব, দানব পাখিগুলোর দৃষ্টি এড়াতে দ্রুত পা চালাল।

শেষমেশ সেতুর শেষ প্রান্তে চলে এল ও আর জিনা। পা রাখল নদীর তীরে। এখানে থমকে দাঁড়িয়ে চারধারে চোখ বুলাল।

ছেলেগুলো গেল কোথায়? বলল জিনা।

কিশোর লক্ষ করল সেতুর সংযোগ রাস্তাটি ধরে এগিয়ে চলেছে জনতা। টোকাই ছেলেগুলোর ছায়া দেখা গেল না।

গবেষণার বইটা বের করল কিশোর। লণ্ডন ব্রিজের ছবি খুঁজে নিল। জোরে জোরে পড়ল:

লণ্ডন ব্রিজ ছিল নদীর দক্ষিণ তীরের সঙ্গে
লণ্ডনের সংযোগ সেতু। লণ্ডনবাসী
ওখানে যেত বিনোদনের জন্য। বেয়ার
গার্ডেন ছিল জনপ্রিয় একটি স্পট।

বেয়ার গার্ডেন? সোৎসাহে বলে উঠল জিনা। কোথায় সেটা?

কিশোর দক্ষিণ তীরের এক ম্যাপ খুঁজে পেল। গোল এক দাগের মধ্যে বেয়ার গার্ডেন চিহ্নিত করা হয়েছে।

এখানে, বলল ও। মুখ তুলে চাইল। আর…এখানে! দূরের কালো, গোল এক বিল্ডিঙে আঙুল রাখল।

দারুণ! বলে উঠল জিনা। বাগান ভর্তি ভালুক দেখতে চাই আমি।

পড়ে দেখি- শুরু করেছিল কিশোর।

গিয়ে দেখি! বলল জিনা। বেয়ার গার্ডেনের উদ্দেশে হাঁটা দিল।

কিশোর বইটা ঢুকিয়ে রেখে ওর পিছু নিল। কাছাকাছি হতেই, জোরাল। চেঁচামেচি আর হাসাহাসির শব্দ শুনতে পেল গোল বাড়িটার ভিতর থেকে।

থেমে দাঁড়াল জিনা।

দাঁড়াও, বলল ও। জায়গাটা মনে হচ্ছে ভাল না। আরেকটু বরং পড়ে দেখো।

কিশোর বইটা আবারও খুলল। জোরে জোরে পড়ল:

বেয়ার গার্ডেন নামের মল্লভূমিতে, দর্শকরা
কুকুরের সঙ্গে ভালুকের লড়াই দেখত।
প্রাচীন ইংল্যাণ্ডে পশুর লড়াই ছিল
প্রচলিত এক খেলা, আজকে এটা
আইন করে বন্ধ করে দেয়া হয়েছে।

কুকুরের সাথে ভালুকের লড়াই? ছি! বলল জিনা। আমি এসব সইতে পারব না!

আমিও না, বলল কিশোর। চলো চলে যাই। হাঁটা দিল।

অ্যাই, কিশোর! ওদিকে তাকাও! বলে উঠল জিনা। কাছের এক মালগাড়ি আঙুল-ইশারায় দেখাল। এই ভালুকটা ব্রিজে আমাদের পাশ দিয়ে গেছিল!

মালগাড়িটার কাছে দৌড়ে গেল কিশোর আর জিনা। ওটার পিছনদিকে একটা খাঁচা। খাঁচার ভিতরে বিশাল এক বাদামি ভালুক।

জানোয়ারটা জবুথুবু হয়ে বসা। মাথা এখনও নিচু। মালগাড়িটায় এক সাইনবোর্ড লাগানো। তাতে লেখা; নাচুনে ভালুক ডন।

ডন? প্রশ্ন করল জিনা। তুমি কি মারামারি করবে?

নিঃসঙ্গ চেহারার ভালুকটা প্রকাণ্ড মাথা তুলে জিনার দিকে চেয়ে রইল। ওটার কালো চোখজোড়া বিষণ্ণ। নিচু এক গোঙানি বেরিয়ে এল ওটার বুক চিরে।

বুঝতে পারছি, বলল জিনা। তুমি লড়তে চাও না। তুমি চাইছ আমি যাতে তোমাকে দূরে কোথাও নিয়ে যাই। ভালুকের খাঁচার দরজার দিকে হাত বাড়াল ও।

সরে যাও ওখান থেকে! ক্রুদ্ধ চিৎকার ছাড়ল কে একজন। ওটা আমার ভালুক!

চরকির মতন ঘুরে দাঁড়াল কিশোর আর জিনা। মালগাড়ির চালক রীতিমত তেড়ে আসছে ওদের দিকে।

ও আমার! আমি ওকে বিক্রি করব! গর্জাল লোকটি।

চলে এসো, জিনা, বলল কিশোর। জিনাকে টান দিয়ে রাস্তা ধরে হেঁটে চলা মানুষের ভিড়ের মধ্যে নিয়ে এল।

কিন্তু ডনকে যে আমার উদ্ধার করতে হবে! জরুরী কণ্ঠে বলল জিনা। কাঁধের উপর দিয়ে চাইল। ওই লোকটা ওকে লড়াইয়ের জন্যে বেচে দিতে

জানি, বলল কিশোর। কিন্তু আমরা তো ওকে চুরি করে নিয়ে যেতে পারি না। লোকটা হাজার হলেও ওর মালিক।

চারধারে নজর বুলাল ও। ভালুকটার উপর থেকে জিনার মনোযোগ সরাতে চাইছে। সেই টোকাই ছেলেগুলোকে দেখতে পেল। গোলাকার, সাদা। এক-দালানের দিকে হেঁটে চলেছে ওরা।

সেই ছেলেগুলো! বলে উঠল কিশোর। চলো, দেখি ওরা কোথায় যায়।

ডনের কী হবে?

পরে ভাবা যাবে, জিনার প্রশ্নের জবাবে বলল কিশোর। এখন চলো। ছেলেগুলোকে ফলো করি।

সাদা দালানটার দিকে জিনাকে এগিয়ে নিয়ে চলল সে। কাছে আসার পর, কিশোর সামনে লাগানো সাইনবোর্ডটা পড়ল:

গ্লোব থিয়েটারে নাটক
আ মিডসামার নাইটস ড্রিম

ভাল! ভাবল কিশোর। জিনা নাটক ভালবাসে। স্কুলে অভিনয়ও করে।

থিয়েটারের দরজায় দাঁড়িয়ে ছিল এক লোক। হাতে একটা বাক্স।

স্ট্যাণ্ডের জন্য এক পেনি! স্ট্যাণ্ডের জন্য এক পেনি! চেঁচাচ্ছে।

টোকাই ছেলেগুলো বাক্সে কয়েন ফেলে ভিতরে প্রবেশ করল।

মাত্র এক পেনি! বলল কিশোর। একদম সস্তা!

কিন্তু আমাদের কাছে তো পেনি নেই, বলল জিনা। তা ছাড়া, আমি চাই ফিরে নিয়ে ভালুকটাকে মুক্তি দিতে।

দীর্ঘশ্বাস ফেলল কিশোর।

মুক্তি যদি দিতেও পারো কী করবে ভালুকটাকে নিয়ে? জিজ্ঞেস করল।

কিছু একটা ভেবে বের করে ফেলব, জানাল জিনা।

মালিকটা যখন কাছেপিঠে থাকবে না তখন ভেবে বের কোরো, বাতলে দিল কিশোর। এখন এই নাটকটা সম্পর্কে কিছু জানা যাক।

চটপট গবেষণার বইটা বের করল ও। গ্লোব থিয়েটারের এক ছবি খুঁজে নিল। ও চায় জিনা ভালুকটার কথা ভুলে যাক, তাই আবেগ ঢেলে পড়ল:

প্রাচীন ইংল্যাণ্ডে প্রথম থিয়েটার গঠিত
হয়। তখনকার দিনে যেহেতু বিদ্যুৎ
ছিল না, দিনের আলোয় নাটক
মঞ্চস্থ হত। প্রায় সবাই নাটক দেখতে
যাওয়ার সামর্থ্য রাখত।

ভাল না? বলল কিশোর।

দীর্ঘশ্বাস ফেলল জিনা।

কিশোর দরাজ, নাটুকে কণ্ঠে পড়তে লাগল:

দর্শনীর তারতম্যের উপরে দর্শকদের বসার
স্থান নির্ভর করত। যারা বেশি
টাকা দিত তারা মঞ্চের উপরে উঁচু গ্যালারিতে
বসত। অন্যরা দাঁড়াত নীচে—

এই, ছেলে! কে একজন চেঁচিয়ে উঠল।

মুখ তুলে চাইল কিশোর।

এক লোক শশব্যস্তে ওদের দিকে এগিয়ে এল। লোকটার পা দুখানা লম্বা, পরিপাটী করে ছাঁটা দাড়ি আর উজ্জ্বল একজোড়া চোখ।

বাহ, তুমি তো ভারী চমৎকার করে পড়তে পারো! বলল লোকটা। আমি ওখান থেকে শুনছিলাম!

কিশোর লাজুক হাসল।

না, সত্যি অসাধারণ তোমার আবৃত্তি! লোকটা বলল। ঠিক তোমার, মতই একটা ছেলে খুঁজছি আমি!

ভাল আবৃত্তি করে এরকম ছেলে দরকার কেন আপনার? লোকটিকে জিজ্ঞেস করল জিনা।

কারণ একটু আগে আমি দুটো পরীকে হারিয়েছি! জবাব এল। কিশোরের দিকে আঙুল নির্দেশ করল। তুমি দুজনেরটাই পড়তে পারবে?

আপনি একটা পাগল, ভাবল কিশোর।

আচ্ছা, চলি, দেখা হবে, বলল ও। জিনাকে কনুইয়ের আলতো তো মেরে এগোতে বলল।

দাঁড়াও, দাঁড়াও, বলল জিনা। লোকটার দিকে ঘুরে চাইল। ও দুজনেরটাই পড়তে পারবে মানে কী? কোথায় পড়তে হবে ওকে?

দুটো ছেলের পরীর অভিনয় করার কথা ছিল, কিন্তু তারা আসেনি, বলল লোকটি। কিন্তু এই ছেলেটা কী সুন্দর আবেগ দিয়ে পড়ে! ও আমাদের উদ্ধার করতে পারবে!

কিশোর একদৃষ্টে চেয়ে রইল। লোকটা জেনেশুনে কথা বলছে তো?

আপনি কিশোরকে আপনার নাটকে নিতে চান? প্রশ্ন করল জিনা।

হ্যাঁ! বলে উঠল, লোকটি। তিন হাজার লোক এসেছে আমার লেখা নাটক দেখতে! তাদেরকে আমরা হতাশ করি কীভাবে!

তিন হাজার? বলল কিশোর।

হ্যাঁ! জানাল লোকটি। এবং তাদের মধ্যে একজন দুনিয়ার সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ মানুষ!

না, সম্ভব নয়। আমি পারব না, বলল কিশোর। আমাদের অন্য কাজ আছে।

দাঁড়াও, দাঁড়াও, বাধা দিল জিনা। ফিরে তাকাল লোকটির দিকে। আপনার দুটো পরী দরকার, তাই না?

হ্যাঁ, বলল লোকটি।

হুম… মাথা কাত করে বলল জিনা। গলা চড়ে গেল ওর। আমিও ভাল আবৃত্তি জানি।

হ্যাঁ! জিনাকে নিয়ে নিন, বলল কিশোর। ও ভাল আবৃত্তি জানে। দুটো পরীর কাজ একাই চালিয়ে নিতে পারবে!

তা তো বুঝলাম, কিন্তু জিনা তো মঞ্চে উঠতে পারবে না, নরম কণ্ঠে জানাল লোকটি।

কেন পারব না? প্রশ্ন করল জিনা।

ভ্রূ উঁচু করল লোকটি।

আইনে মেয়েদের নাটক করা নিষেধ, বলল সে। ছেলেরাই মেয়েদের পার্ট করে।

কিন্তু এটা কেমন কথা! বলে উঠল জিনা।

জানি ভাল কথা নয়। কিন্তু কী করব, আইন বলে কথা, বলল লোকটি। কিশোরের দিকে ঘুরে চাইল। তো, কিশোর! তুমি অভিনয় করছ তো?

না, ধন্যবাদ, বলল কিশোর। পা বাড়াতেই জিনা ওর বাহু চেপে ধরল।

আমি জানি কিশোর কী চাইছে, লোকটিকে বলল ও। আমাকে নিলেই শুধু নাটকে অভিনয় করবে ও।

আমি তা চাইছি না, জিনা, শ্বাসের নীচে বলল কিশোর।

কিন্তু, কিশোর, ভেবে দেখো কত মজা হবে, ফিসফিস করে বলল জিনা। ভয়ের কী আছে! তুমি শুধু তোমার পার্টটা পড়ে যাবে। মুখস্থ তো করতে হচ্ছে না।

কিশোর উপলব্ধি করল জিনা নাটকে অংশ নেয়ার জন্য উন্মুখ। ভালুকটার দিক থেকে ওর মন সরানোর জন্য এটা একটা ভাল পথ হতে পারে।

আচ্ছা, ঠিক আছে, দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল ও। লোকটির দিকে চাইল।

জিনাকে নিলে আমি আপনার নাটকে কাজ করতে রাজি।

লোকটি জিনার দিকে চাইল। জিনা তার দিকে চোখে আশা নিয়ে চেয়ে রয়েছে। মুখে মৃদু হাসি।

লোকটিও পাল্টা হাসল।

বেশ তো, অসুবিধে কী? বলল সে। কিন্তু জিনাকে ভান করতে হবে ও মেয়ে নয়, ছেলে। চুল গোটাতে হবে ওকে। আমরা ওকে অ্যাণ্ডি বলে ডাকব।

ঠিক আছে। ধন্যবাদ, হাসি মুখে বলল জিনা।

থিয়েটারের ভিতরে ট্রাম্পেট বেজে উঠল।

জলদি চল, নাটক এখুনি শুরু হবে! লোকটি বলল। কিশোর আর জিনার হাত ধরে নিয়ে চলল।..

আপনার নামটা তো জানা হলো না, বলল জিনা।

আমার নাম উইল, বলল লোকটা। এসো, কিশোর আর অ্যাণ্ডি! ছায়ার মত দ্রুত চলো।

নামটা শুনে খটকা লাগল কিশোরের। লোকটার চেহারা প্রথম থেকেই কেমন যেন চেনা-চেনা লেগেছে ওর। কে এই উইল?

উইল কিশোর আর জিনাকে এক দরজার ভিতর দিয়ে গ্লোব থিয়েটারের পিছন দিকে নিয়ে এল। এবার ওদেরকে পিছনে নিয়ে অন্ধকারাচ্ছন্ন এক সিঁড়ি দিয়ে উঠতে লাগল।

উপরে উঠছে, দর্শকদের হাসির শব্দ শোনা গেল। কিশোর নার্ভাস বোধ করল।

এদিকে, বলল উইল।

তাকে অনুসরণ করে জনাকীর্ণ, স্বল্পালোকিত এক কামরায় প্রবেশ করল কিশোর আর জিনা। চারদিকে অভিনেতাদের ব্যস্ত ছোটাছুটি। সবাই যেন তার নিজস্ব জগতে বিরাজ করছে। একজন আলখিল্লা পরছে। আরেকজন কোমরে রশি বাঁধছে। তৃতীয়জন ফিসফিস করে নিজের সাথে কথা বলছে।

আমি তোমাদের পোশাক খুঁজে দিচ্ছি, বলল উইল।

উইল কাপড় ভর্তি বিশাল এক ঝুড়ির মধ্যে হাত ভরে দিল। কিশোর আর জিনা কস্টিউম রূমের চারপাশে নজর বুলাল। কামরাটা চটকদার গাউন, বেগুনী আর নীল আলখেল্লা, সোনালী-রূপালী পরচুলা, হ্যাট, মুখোশে ঠাসা।

চমৎকার, ফিসফিস করে বলল জিনা। একটা গাধার ও একটা সিংহের মুখোশ স্পর্শ করল। এগুলো দারুণ ছদ্মবেশ হতে পারে, তাই না?

জিনার শান্ত-শিষ্ট ভাব দেখে একটু অবাকই হলো কিশোর। ও কি ভুলে গেছে ওদেরকে তিন হাজার মানুষের সামনে দাঁড়াতে হবে? ভাবনাটা মাথায় আসতেই ঢোক গিলল কিশোর। পেটের ভিতরে প্রজাপতির নাচ অনুভব করল।

এই নাও! বলল উইল। ওদের হাতে সবুজ পোশাক, হ্যাট আর চটী তুলে দিল। এগুলো পরে নাও! একদম সময় নেই! শীঘ্রি তোমাদের পালা। আসবে!

কিশোর আর জিনা সাত করে এক পর্দার আড়ালে গিয়ে পোশাক পাল্টে নিল। হ্যাট পরার সময় জিনা ওর পিগটেইল লুকাল।

ওরা বেরিয়ে এলে, উইল দুজনের হাতেই একটা করে গোটানো, ছোট কাগজ তুলে দিল।

এগুলো তোমাদের রোল, বলল সে। শুধু তোমাদের লাইনগুলোই এতে আছে, অন্য কারওটা নেই।

নিজের কাগজটা আনরোল করল কিশোর। ওকে দুটো লম্বা ভাষণ পড়তে হবে।

এক সেকেণ্ড, বলল সে। আমি ভেবেছিলাম অল্প কয়েক লাইন। কিন্তু এ তো দেখছি মহাভারত।

চিন্তা কোরো না, বলল উইল। শুধু মনে রেখো-স্পষ্ট করে আর আবেগ দিয়ে পড়তে হবে। এবং সবচেয়ে বড় কথা একদম স্বাভাবিক থাকতে হবে!

স্বাভাবিক থাকতে হবে! ভাবল কিশোর। টেনশন হচ্ছে, এ অবস্থায়। স্বাভাবিক থাকা যায়?

ঠিক এসময় বেঁটে, গোলগাল এক লোক হুড়মুড় করে ঢুকে পড়ল কস্টিউম রূমে। লোকটার মাথায় কোঁকড়া চুল। গালজোড়া টকটকে লাল। পরনে আপাদমস্তক সবুজ পোশাক।

হায় ঈশ্বর! আতঙ্কিত ফিসফিসে স্বরে বলল সে। এখন কী হবে, উইল?

ভেবো না! দেখো কাদেরকে পেয়েছি! এরা দুজনেই পড়তে পারে! জানাল উইল। কিশোর আর জিনাকে সামনে ঠেলে দিল। কিশোর আর অ্যাণ্ডি, তোমরা রাতের বেলা মনের আনন্দে ঘুরে বেড়ানো পাকের সঙ্গে পরিচিত হও। ও তোমাদেরকে মঞ্চে নিয়ে যাবে। গুড লাক!

জিনা স্মিত হাসল। কিশোর গুঙিয়ে উঠল।

এসো, ছেলেরা! বলল পাক। আমার সঙ্গে এসো!

কিশোর আর জিনাকে পিছনে নিয়ে কস্টিউম রূম ত্যাগ করে হলওয়েতে বেরিয়ে এল পাক। এবার ওদেরকে মঞ্চের পিছনদিকে আঁধার মত এক জায়গায় নিয়ে এল।

অভিনেতারা নীরবে কাছেই দাঁড়ানো, মঞ্চে ওঠার অপেক্ষায়। একজন পরেছে চমৎকার এক সাদা গাউন। অন্যদের গায়ে ছেঁড়াখোঁড়া বাদামি পোশাক।

কিশোর এক ধনুকাকৃতি খিলান ভেদ করে মঞ্চের ছাদ দেখতে পেল। নীলের পটভূমিতে অজস্র তারা আর একটা চাঁদ জ্বলজ্বল করছে। মঞ্চের ঠিক সামনে দাঁড়িয়ে বিশাল এক জনতা। উপরের গ্যালারি থেকে দেখছে আরও বেশি দর্শক।

ইংল্যাণ্ডের সমস্ত মানুষ এখানে জ্বড় হয়েছে! ভাবল কিশোর। জিনার কথায় আমি রাজি হলাম কীভাবে?

আমি আগে তোমাকে মঞ্চে নিয়ে যাব, পাক ফিসফিস করে কিশোরকে বলল। আমি যখন বলব, হাউ নাও, স্পিরিট! উইদার ওয়াণ্ডার ইউ? তুমি তোমার লাইনগুলো পড়তে শুরু করবে। বুঝতে পেরেছ? বা কোনমতে মাথা ঝাঁকাল কিশোর। ওর গলা শুকনো ঠেকছে। ঢোক গিলতে চেষ্টা করে পারল না।

পাক এবার জিনার দিকে ঘুরে দাঁড়াল।

তুমি পরী রানীর সাথে মঞ্চে যাবে, ফিসফিস করে বলল। মনোলোভা সাদা গাউন পরা অভিনেতাটিকে আঙুল ইশারায় দেখাল ও। ও যখন তোমাকে গান গেয়ে ঘুম পাড়াতে বলবে, তখন তুমি তোমার গানটা শুরু করবে।

সুর? প্রশ্ন করল জিনা।

বানিয়ে নিয়ে যা খুশি একটা, বলল পাক। ওরা যদি উল্টোপাল্টা বলে, চেঁচামেচি করে, তবুও থামবে না। স্রেফ

কারা উল্টোপাল্টা বলবে, চেঁচামেচি করবে? হস্তক্ষেপ করল কিশোর।

গ্রাউণ্ডলিংরা একটু বুনো স্বভাবের হয়ে থাকে আরকী, বলল পাক।

গ্রাউণ্ডলিং কারা? কিশোরের প্রশ্ন।

যে সব উচ্ছঙ্খল লোকেদের বাসায় জায়গা নেই, বলল পাক। ওরা মঞ্চের কাছে দাঁড়িয়ে আছে। দুএকজন পচা ফল ছুঁড়লেও থেমো না। চালিয়ে যেয়ো।

অনেক হয়েছে আর নয়, ভাবল কিশোর।

মঞ্চে উঠতে পারবে না ও-যখন উচ্ছঙ্খল দর্শকরা পচা ফল ছুঁড়বে, তিন হাজার দর্শক নাটক দেখবে, অসংখ্য লাইন পড়তে হবে-এবং ওকে যে মুহূর্তে অভিনয় করতে হবে।

পাক আর জিনা যখন নাটক দেখছে, আলগোছে সরে পড়ল কিশোর। বেরনোর পথ খুঁজছে। সিঁড়ি খুঁজে পেয়েছে, এমনি সময় ধাক্কা খেল উইলের সঙ্গে।

চললে কোথায়? উইল ফিসফিসিয়ে প্রশ্ন করল।

শরীর খারাপ করছে! বলল কিশোর। আমি পারব না।

আঁতকে উঠল উইল। পরমুহূর্তে কিশোরের কাঁধে দুহাত রেখে শান্ত স্বরে কথা বলল।

এক মুহূর্তের জন্যে চোখ বোজো, কিশোর, বলল

চোখ বুজল কিশোর। বুক ধড়ফড় করছে।

ভয়ের কিছু নেই, ফিসফিস করে বলল উইল। কল্পনা করো তুমি একটা পরী। গরমের এক রাতে বনের ভিতরে রয়েছ। মাথার উপরে রূপালী চাঁদ দেখতে পাচ্ছ? শুনতে পাচ্ছ পেঁচার ডাক? হু-হুঁ।

উইলের গভীর ফিসফিসানি যেন মন্ত্রমুগ্ধ করে দিল কিশোরকে। শরীর মন শিথিল হয়ে এল ওর। রূপালী চাঁদের ছবি ফুটে উঠল মনের পর্দায়। কানে এল পেঁচাঁদের ডাক।

তুমি কি গরমের এক দিনে বনের ভিতরে রয়েছ? প্রশ্ন করল উইল।

কিশোর মাথা ঝাঁকাল।

তুমি এটা বিশ্বাস করলে দর্শকরাও করবে, ফিসফিস করে বলল উইল।

কই, এসো! ফিসফিসাল পাক। মোটাসোটা অভিনেতাটি দৌড়ে এল কিশোরের কাছে। ওকে হাত ধরে টেনে নিয়ে চলল।

কিছু বুঝে ওঠার আগেই নিজেকে মঞ্চে আবিষ্কার করল কিশোর!

উজ্জ্বল সূর্যালোকে মঞ্চে দাঁড়াল কিশোর। তিন হাজার জোড়া চোখ ওর দিকে একদৃষ্টে চেয়ে।

হাউ নাও, স্পিরিট! চড়া গলায় বলল পাক। উইদার ওয়াণ্ডার ইউ?

নিজের স্ক্রলের দিকে চোখ নামিয়ে চাইল কিশোর। এবার মুখ খুলল। কোন শব্দ বেরোল না।

এক গ্রাউণ্ডলিং হিসিয়ে উঠল।

হাউ নাও, স্পিরিট! এবারে গলা আরও চড়াল পাক। উইদার ওয়াণ্ডার ইউ?

চোখ বুজল কিশোর। গরমের রাতের অনুভব নিল। গভীর শ্বাস টানল। গলা খাকরাল। ভাষণটার দিকে চাইল।

এবার পড়তে শুরু করল:

ওভার হিল, ওভার ডেল,
থ্রু বুশ, থু ব্রায়ার,
ওভার পার্ক, ওভার পেল,
থ্রু ফ্লাড, থ্রু ফায়ার,
আই ডু ওয়াণ্ডার এভরিওয়্যার,
সুইফটার দ্যান দ্য মুনস স্ফিয়ার;
অ্যাণ্ড আই সার্ভ দ্য ফেয়ারি কুইন… 

কিশোর যখন পড়ছে, দর্শকরা শান্ত হয়ে এল। কিশোর ভুলে গেল ও যে কিশোর। রাতের বেলা বনভূমির ভিতরে, পাকের সঙ্গে কথা বলছে যেন সে।

ওর পড়া শেষ হলে কেউ হিসিয়ে উঠল না কিংবা কোন কিছু ছুঁড়ে মারল না।

পাক তার লাইনগুলো পড়তে আরম্ভ করলে বুক ভরে শ্বাস টানল কিশোর। ওকে আরেকটা ভাষণ পড়তে হবে। বুকের ভিতরে ধড়াস-ধড়াস করছে ওর। ভয়ের কারণে যতটা না তার চাইতে বেশি উত্তেজনার ফলে।

দ্বিতীয় বক্ততার সময় তৈরি ছিল কিশোর। এবার স্পষ্টভাবে আর আবেগ ঢেলে পড়ল ও। চেষ্টা করল যথাসম্ভব স্বাভাবিকতা ফুটিয়ে তুলতে। ওর পড়া শেষ হলে দর্শকরা হাত তালিতে ফেটে পড়ল।

কীভাবে মঞ্চ ত্যাগ করল বলতে পারবে না কিশোর। উইল ওর জন্য অপেক্ষা করছিল।

সাবাস! বলে কিশোরের পিঠ চাপড়ে দিল উইল। তুলনাহীন!

লজ্জায় লাল কিশোর উইলের স্ক্রলটা ফিরিয়ে দিল। এত লোকের সামনে পারফর্ম করেছে বিশ্বাস হতে চাইছে না ওর। এবং জিনার কথা মত সত্যিই আনন্দ পেয়েছে ও।

ছায়ার আড়ালে দাঁড়িয়ে জিনার পড়া শেষ হওয়ার অপেক্ষা করতে লাগল কিশোর। পরী রানী এবং অন্যান্য পরীদের সঙ্গে ওকে মঞ্চে উঠতে দেখল ও।

রানী যখন পরীদেরকে বলল তাকে গান গেয়ে ঘুম পাড়াতে, জিনা এগিয়ে গেল। ওর স্ক্রল থেকে পরিষ্কার কণ্ঠে এবং আবেগ ঢেলে গেয়ে উঠল:

ইউ স্পটেড স্নেকস, উইথ ডাবল টং,
থর্নি হেজহগস, বি নট সীন;

জিনা এমনভাবে হাত নাড়ল যেন সাপ আর কাঁটাচুয়াদের তাড়িয়ে দিচ্ছে।

নিউটস অ্যাণ্ড ব্রাইণ্ড ওয়র্মস, ড নো রং,
কাম নট নিয়ার আওয়ার ফেয়ারি কুইন…

জিনা তর্জনী তুলে গোসাপ আর অতি ছোট চোখবিশিষ্ট পোকাদের শাসাল। দর্শকরা হাসিতে ফেটে পড়ল।

জিনা গান গেয়ে চলল। গানের কথার সঙ্গে মিলিয়ে অঙ্গ ও মুখভঙ্গি করছে। ও এমনকী খানিক নাচও জুড়ে দিল গানটির সঙ্গে।

ওর যখন শেষ হলো, দর্শকরা তখন হাততালি দিচ্ছে, হর্ষধ্বনি করছে আর মাটিতে পা ঠুকছে।

অসাধারণ, অ্যাণ্ডি! জিনা মঞ্চ ত্যাগ করলে বলল উইল।

দারুণ দেখিয়েছ! কিশোর বলল।

ধন্যবাদ! বলল জিনা। স্ক্রলটা উইলকে ফিরিয়ে দিল। আমাকে কি আবার মঞ্চে যেতে হবে?

নাটক শেষ হোক, আমরা সবাই যখন অভিবাদন জানাব তখন যাবে, জানাল উইল।

এসময় দর্শকদের আবারও হাসাহাসি করতে শুনল কিশোর। নাটক দেখতে মন চাইল ওর। কাজেই থিয়েটারের পিছনদিকে আবছায়া এক জায়গা খুঁজে নিয়ে সেখান থেকে দেখতে লাগল।

নাটকের চরিত্রদের কথা-বার্তা সব না বুঝলেও কাহিনিটা ঠিকই বুঝতে পারল ও। প্রেম-ভালবাসা নিয়ে নাটক। কিন্তু কেউই পছন্দের মানুষটিকে বিয়ে করতে পারছে না।

সবচেয়ে মজার অংশটা পরী রাজা ও পরী রানীকে নিয়ে। রাজা পাগল রানীর জন্য। তাই সে রানীর চোখের পাতায় জাদুর ফুলের রস চিপে দেয়, রানী যাতে যাকে প্রথমে দেখবে তার প্রেমে পড়ে যায়।

পাক কাজ করে রাজার পক্ষে। সে আরেকটু কায়দা করতে চায়। গেঁয়ো এক লোককে গাধার মাথা পরায় সে। ঘুম ভাঙতেই রানী গর্দভ মানবটিকে দেখে। জাদুর বলে রানী পাগলের মত লোকটির প্রেমে পড়ে যায়।

পরী রাজা শেষমেশ জাদুর মায়া কাটিয়ে দেয়। গর্দভ মানব যখন ঘুমিয়ে ছিল পাক তখন তাকে আবার মানুষ বানিয়ে দেয়। ঘুম ভাঙার পর লোকটা ভাবে সে স্বপ্ন দেখেছে।

ইতোমধ্যে কিশোরের পাশে, এক দল অভিনেতা জড় হয়েছে নাটকের শেষ দৃশ্যের জন্য।

আমার সিংহের মুখোশটা পাচ্ছি না! একজন হাহাকার করে উঠল। মুখোশ ছাড়া সিংহ সাজব কীভাবে!

আস্তে, মুখোশ ছাড়াও চলবে, বলল উইল। স্রেফ গর্জন ছেড়ো! দুবার হুঙ্কার দিলেই হবে।

অভিনেতাদেরকে মঞ্চের দিকে ঠেলে দিল উইল। ভ্রূ জোড়া মুছে নিল। এবার নজর পড়ল কিশোরের উপরে।

অ্যাণ্ডিকে নিয়ে এসো! বলল সে। নাটক শেষ হয়ে এসেছে প্রায়।

জিনা? কোথায় জিনা? ভাবল কিশোর। বেশ কিছুক্ষণ ওকে দেখেনি ও। কস্টিউম রূমে উঁকি দিল। নেই।

বুকের ভিতরে ধড়াস করে উঠল কিশোরের। মাথায় এল ভয়ঙ্কর এক ভাবনা…

না, ফিসফিসিয়ে বলল।

সিঁড়ি ভেঙে দৌড়ে নেমে এল কিশোর। দরজা খুলল। জিনাকে থিয়েটারের পিছনের গাছ-গাছালির আড়াল থেকে দৌড়ে আসতে দেখে স্বস্তি ফিরে পেল।

এখন অভিবাদন জানানো হবে! বলে জিনার হাত চেপে ধরল। কোথায় গেছিলে? কী করছিলে?

পরে দেখাব! বলল জিনা।

ওরা দুজন দুদ্দাড় করে সিঁড়ি ভেঙে উপরে উঠে গেল।

উইল আর কজন অভিনেতা অপেক্ষা করছিল।

পাক তখন মঞ্চে তার শেষ বক্তৃতা দিচ্ছে:

সো গুড নাইট আনটু ইউ অল।

গিভ মি ইয়োর হ্যাণ্ডস ইফ উই বি ফ্রেণ্ডস…

কিশোর! অ্যাণ্ডি! বলল উইল। ওদের হাত চেপে ধরল।

পাক তার বক্তব্য শেষ করল। করতালিতে ফেটে পড়ল দর্শকরা। সে সঙ্গে শিস দিচ্ছে, তারস্বরে চেঁচাচ্ছে।

কিশোর আর জিনা উইল আর অন্যান্য অভিনেতাদের সঙ্গে দৌড়ে মঞ্চে গিয়ে উঠল। জনতার উল্লাসধ্বনির মধ্যে একবার…দুবার…তিনবার মাথা নুইয়ে অভিবাদন জানাল ওরা।

উইল সামনে এগিয়ে গিয়ে দুহাত উঁচু করল। জনতা ধীরে ধীরে শান্ত হয়ে এল।

আপনাদের সবাইকে ধন্যবাদ, বলল সে। এবং দুনিয়ার সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ মানুষটি, ধন্যবাদ আপনাকেও। তিনি আজকে উপস্থিত থেকে আমাদের সবাইকে কৃতজ্ঞ করেছেন।

মঞ্চের উপরে গ্যালারি, সেদিকে নত হয়ে এক মহিলার উদ্দেশে অভিবাদন জানাল উইল। মুক্তোখচিত সাদা এক পোশাক আঁর পরনে। নেকারে মুখ ঢাকা।

মহিলা উঠে দাঁড়িয়ে ধীরে ধীরে নেকাব সরালেন। ফ্যাকাসে, কুঁচকানো চামড়া আর ছোট ছোট কালো চোখ দেখা গেল। মাথায় লাল পরচুলা।

দর্শকরা সশ্রদ্ধ শ্বাস চাপল। ধপ করে হাঁটুর উপর বসে পড়ল সবাই।

রানী এলিজাবেথ দীর্ঘজীবী হোন! বলল উইল।

রানী এলিজাবেথ দীর্ঘজীবী হোন! চেঁচিয়ে উঠল জনতা।

রানী এলিজাবেথ দীর্ঘজীবী হোন! চেঁচাল কিশোর আর জিনা।

রানী স্মিত হাসলেন। তার দাঁতগুলো সব কালো! দর্শকরা ব্যাপারটাকে যেন পাত্তাই দিল না। আরও জোরে উল্লাসধ্বনি করে উঠল।

রানী একটা হাত তুলতেই মুহূর্তে নিশ্চুপ হয়ে গেল জনতা।

আমি আপনাদের ধন্যবাদ জানাচ্ছি, বললেন রানী। এবং আমি সব কজন দক্ষ অভিনেতাকে ধন্যবাদ জানাচ্ছি। আজকে তারা আমাদেরকে উপহার দিয়েছেন বিশেষ এক জাদু-নাটকের জাদু। তাঁরা দিনকে রাত করে দিয়েছেন।

আরি, ফিসফিস করে বলল কিশোর। এই তো-সেই বিশেষ জাদু। ওদের মিশন শেষ হয়েছে।

দর্শকরা আবারও হর্ষধ্বনি করে উঠল। অভিনেতারা মঞ্চত্যাগের পর। উইলকে ঘিরে ধরে অভিনন্দন জানাল।

জিনা একপাশে টেনে নিয়ে গেল কিশোরকে।

পেয়ে গেছি! বলল ও। আমাদের জাদু!

জানি! বলল কিশোর। উইল আমাদেরকে সাহায্য করেছে। চলো ওকে ধন্যবাদ জানাই!

পরে, বলল জিনা। আগে তোমাকে একটা জিনিস দেখাতে চাই। তোমার সাহায্য দরকার! জলদি!

জিনা কিশোরকে পিছনে নিয়ে, নীচে নেমে এসে বাইরে বেরিয়ে এল। লোকজন দলে দলে গ্লোব ছেড়ে বেরোচ্ছে। সূর্য পাটে বসেছে।

এদিকে, বলল জিনা। থিয়েটারের পিছনে, গাছ-গাছালির জটলার উদ্দেশে পা বাড়াল ও।

ও আর কিশোর অন্ধকারময় ছাউনির ভিতরে ঢুকতেই, এক গাছের কাছে। অদ্ভুতদর্শন এক অবয়ব দেখতে পেল কিশোর। বেগুনী এক আলখেল্লা ওটার লোমশ পিঠ ঢাকতে পারেনি। সোনালী এক পরচুলা আর সিংহের মুখোশ লুকোতে পারেনি লোমশ মাথাটা।

ঢোক গিলল কিশোর।

সেই ভালুকটা! তুমি ওকে চুরি করেছ!

করতে বাধ্য হয়েছি, জানাল জিনা। আমি যখন মালগাড়িটার কাছে যাই তখন কেউ ওখানে ছিল না। ওর গায়ে পোশাক পরিয়ে দিই। যাতে এখানে আসার পথে কেউ দেখলে মনে করে ও-ও একজন অভিনেতা।

কিন্তু তুমি ওকে এভাবে চুরি করতে পারো না! বলল কিশোর।

আমি চুরি করিনি। ওকে রক্ষা করেছি, বলল জিনা। ওকে নিয়ে এখন কী করব বুঝতে পারছি না। তুমি কী বলে?

ঠিক এমনিসময় ভালুকের মালিক ধেয়ে এসে জঙ্গলে ঢুকল।

আমার ভালুক কোথায়? গর্জে উঠল। মুখের চেহারা লাল। কটমট করে চেয়ে রয়েছে। মুখ খিস্তি করছে। চোরের দল! চেঁচিয়ে উঠল। ওকে ফিরিয়ে দে! আমি ওকে লড়াইয়ের জন্যে বিক্রি করব!

না! বলল জিনা। লোকটা আর ভালুকটার মাঝখানে দাঁড়িয়ে রয়েছে। ও নিরীহ ভালুক! যোদ্ধা নয়!

ও ঠিকই বলেছে! কথাটাকে সমর্থন করল কিশোর। তা ছাড়া ভালুক লড়াই ভাল নয়! মোটেই ভাল নয়!

সত্যি কথা, গমগম করে উঠল একটি কণ্ঠ।

কিশোর, জিনা আর ভালুকের মালিক পাই করে ঘুরে দাঁড়াল। জঙ্গলের। কিনারে দাঁড়িয়ে উইল আর পাক।

আপনি সুবিধের লোক নন, ভালুকের মালিকের উদ্দেশে তিরস্কার করে বলল উইল। নিরীহ এক ভালুককে কিনা লড়াইয়ের জন্যে বেচে দিতে চান। যাকগে, আমি একটা নাটক লেখার কথা ভাবছি, যেখানে ভালুকের জন্যে। একটা পার্ট থাকবে। কাজেই এই টাকা কটা নিয়ে কেটে পড়ুন।

ভালুকের মালিকের হাতে কটা সোনার মুদ্রা গুঁজে দিল উইল।

লোকটার চোখজোড়া বিস্ফারিত হয়ে গেল। হেসে উঠল সে।

বেশ তো, ওকে নিতে চান নিন না! বলল। তারপর হাঁটা ধরল।

ধন্যবাদ! চেঁচিয়ে বলল উইল। এবার পাকের দিকে ফিরল। আমাদের নতুন অভিনেতাটিকে আস্তাবলে নিয়ে যাও। সবাইকে বোলো কেউ যেন ওকে ভয় না পায়। ভালুকটা ওদের সবার চাইতে শান্ত।

চল আমার সাথে, বলল পাক। ভালুকটাকে এক হাতে জড়িয়ে ধরে গাছের জটলা থেকে বের করে নিয়ে গেল। মঞ্চ ভাল লাগবে তোর, বুড়ো খোকা।

বাই, পাক! বাই, ডন! বলে উঠল জিনা।

পাক মৃদু হেসে হাত নাড়ল। ভালুকটার দৃষ্টি দুমুহূর্ত স্থির হয়ে রইল কিশোর আর জিনার উপর। ওর চোখে কৃতজ্ঞতার ছাপ। এবার টলতে টলতে চলে গেল পাকের সঙ্গে।

ডনকে সাহায্য করার জন্যে ধন্যবাদ, উইল, বলল জিমা। এবং আমাদেরকেও সাহায্য করার জন্যে।

ধন্যবাদ তো আমি তোমাদেরকে দেব, বলল উইল। তোমাদের জন্যেই তো আজকের দিনটা ভালয় ভালয় পার করা গেছে।

আসলে বলতে চাইছেন রাতটা, বলল কিশোর।

ঠিক বলেছ, বলল উইল। ওহ, এই যে তোমার ব্যাগ। তুমি এটার। কথা ভুলে গেছ। কিশোরের হাতে চামড়ার ব্যাগটা তুলে দিল। এবার ওদের স্ক্রল দুটো তুলে ধরল।

তোমরা এগুলো রাখতে পারো, বলল উইল। কিশোরের হাতে তুলে দিতেই ও স্ক্রল দুটো ব্যাগে ঢুকিয়ে রাখল। এখন কোথায় যাবে তোমরা? প্রশ্ন করল উইল।

লণ্ডন ব্রিজের ওপাশে, জানাল জিনা।

ও, তা হলে চলো তোমাদেরকে আমার নৌকায় করে পৌঁছে দিই। এসো।

ধুলোময় এক পথ ধরে ওদেরকে নদীর দিকে নিয়ে চলল উইল। পড়ন্ত বিকেলের আলো গাছ-পালা ভেদ করে তেরছা হয়ে পড়েছে। শীঘ্রিই ওরা টেমস নদীতে ভেড়ানো ছোট্ট এক দাঁড় টানা নৌকা দেখতে পেল।

উঠে পড়ো, বলল উইল।

ওরা তিনজন একে একে নৌকায় চড়ল। উক থেকে নৌকার বাঁধন খুলল উইল। এবার দাঁড় বাইতে লাগল।

আকাশের বেগুনী-গোলাপী রং প্রতিফলিত হচ্ছে নদীর পানিতে। ছোট ছোট ঢেউ। এমুহূর্তে অল্প কটা সাদা রাজহাঁস ভেসে বেড়াচ্ছে নদীর বুকে। আগের মতই দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে নদীটা, কিন্তু কিশোর এবার আর কিছু মনে করল না। ওর সহ্য হয়ে গেছে।

নোটবই আর পেন্সিল বের করল ও।

কী করছ? উইল জিজ্ঞেস করল।

নোটবইতে কিছু স্মৃতি লিখে রাখতে চাই, জানাল কিশোর।

আমি আমার স্মৃতির বইতে তোমাদের দুজনের নামই লিখে রাখব, বলল উইল।

মুচকি হাসল কিশোর।

আমার একটা প্রশ্ন আছে, উইলের উদ্দেশে বলল জিনা। রানী এলিজাবেথের দাঁতগুলো অমন কালো কেন?

অতিরিক্ত চিনি, বলল উইল।

ওঁর নিশ্চয়ই খুব খারাপ লাগে, বলল জিনা।

না, না। রানী জানেনই না তাকে, কেমন দেখায়। গত বিশ বছর ধরে। আয়না দেখেন না তিনি, জানাল উইল।

সত্যি? জিনা অবাক।

হ্যাঁ, বলল উইল। রানী ভান করেন তার বয়স কম এবং তিনি সুন্দরী। ঠিক তুমি যেমন ভান করেছ তুমি ছেলে, আর ভালুকটা যেমন ভান করেছে ও অভিনেতা। আসলে গোটা দুনিয়াটাই একটা রঙ্গমঞ্চ।

কথাটা মনে ধরল কিশোরের। নোটবইতে টুকে নিল।

পাশ কাটানোর সময় লণ্ডন ব্রিজের দিকে মুখ তুলে চাইল কিশোর। সেতব দোকান-পাটগুলো বন্ধ হয়ে গেছে। নাটকের দর্শকদের ভিড় পাতলা হয়ে আসছে।

ভীতিকর কালো পাখিগুলোকে আর ছাদে দেখা গেল না। মাটিতে নেমে এসে খাবার খুঁটে খাচ্ছে।

প্রদর্শনী শেষ।

ওরা যখন নদী তীরে পৌঁছল তখন আঁধার ঘনাচ্ছে। বেশ ঠাণ্ডা পড়েছে। উইল তার নৌকা বেঁধে রেখে কিশোর আর জিনার সঙ্গে তীরে নামল।

অনেক ধন্যবাদ, কিশোর বলল। বাকি পথটুকু আমরা নিজেরাই যেতে পারব।

তোমরা কোথায় থাকো? উইল জানতে চাইল।

ফ্রগ ক্রীকে, জানাল জিনা।

কোন দিক দিয়ে যাবে? উইলের প্রশ্ন।

শুনলে আপনি বিশ্বাস করবেন না, বলল জিনা। আমরা দড়ির মই বেয়ে এক ট্রী হাউসে উঠব। ট্রী হাউসটা রয়েছে ওই গাছটার উপরে। তারপর একটা বই খুলে

ইচ্ছা প্রকাশ করব শুধু, বলল কিশোর। ব্যস, বইয়ে উল্লেখ করা জায়গায় চলে যাব।

উইল মৃদু হাসল।

জীবনটা বড়ই অদ্ভুত, তাই না?

হ্যাঁ! বলল জিনা।

কিশোর মাথা ঝাঁকাল। জীবনের প্রতি উইলের দৃষ্টিভঙ্গি ভাল লাগে ওর।

এক কাজ করো, বলল উইল। তোমরা না হয় এখানে থেকে যাও। গ্লোব থিয়েটারে নাটক করবে। জিনা, আমি রানীকে অনুরোধ করব মেয়েদের নাটক করার বিধি নিষেধ থেকে তোমাকে বাদ দিতে-কারণ তুমি অসম্ভব ভাল অভিনয় করো। আর আমি তোমাদের দুজনকেই নাটক লেখা শিখিয়ে দেব।

সত্যি? একসঙ্গে প্রশ্ন করল কিশোর আর জিনা।

এর চাইতে আনন্দের আর কিছু কিশোরের কল্পনায় এল না। কিন্তু তারপরই চাচা-চাচীর কথা মনে পড়ল।

কিন্তু আমাদের গার্জেনরা–বলল ও।

আমরা তাদেরকে খুব মিস করব, বলল জিনা।

মৃদু হাসল উইল।

বুঝতে পারছি, বলল সে। এবং তাদের জায়গায় আমি হলে আমিও তোমাদেরকে মিস করতাম। বুকে হাত রাখল উইল। শুভ রাত্রি, শুভ রাত্রি। বিচ্ছেদ বড় মধুর বেদনা।

ঠিক বলেছেন, মাথা ঝাঁকিয়ে বলল জিনা।

বিদায়! বলল উইল। হাত নাড়ল।

কিশোর আর জিনা পাল্টা হাত নাড়ল। এবার গোড়ালির উপর ঘুরে গিয়ে নৌকার দিকে পা বাড়াল উইল।

কিশোর আর জিনা দড়ির মইয়ের কাছে এসে ট্রী হাউসে উঠে পড়ল। ভিতরে ঢুকে; জানালা দিয়ে বাইরে চাইল ওরা।

উইল বৈঠা বেয়ে ফিরে যাচ্ছে। সাদা এক রাজহাঁস পানি কেটে ওর নৌকার পাশে পাশে ভেসে চলেছে। আকাশে উঁকি দিচ্ছে রুপোলী চাঁদ।

সে মুহূর্তে, মধুর বেদনা অনুভব করল কিশোর। প্রাচীন, আনন্দময় ইংল্যাণ্ডে আরও কিছু সময় থাকতে পারলে ভাল লাগত, ওর।

দাঁড়ান, উইল! চেঁচিয়ে উঠল কিশোর।

কিন্তু জিনা পেনসিলভেনিয়ার বইটা তুলে নিয়েছে।

আমরা বাড়ি ফিরে যেতে চাই, বলল সে।

বাতাস বইতে শুরু করল।

ঘুরতে লাগল ট্রী হাউস।

বন-বন করে ঘুরছে।

এবার সব কিছু নিথর।

একদম স্থির।

১০

কিশোর চোখ খুলল।

ওদের পরনে এখন আবার আগের সেই পোশাক। ট্রী হাউসের ঘনায়মান আঁধারে জোনাকির ঝিকিমিকি।

জিনা মরগ্যানের চিরকুটটা তুলে নিল। ছড়াটা পুনরাবৃত্তি করল ও:

টু ফাইও আ স্পেশাল ম্যাজিক,
ইউ মাস্ট স্টেপ ইনটু দ্য লাইট
অ্যাণ্ড উইদাউট ওয়্যাণ্ড, স্পেল, অর চার্ম,
টার্ন ডেটাইম ইনটু নাইট।

আমরা স্পেশাল ম্যাজিকটা খুঁজে পেয়েছি, বলল জিনা। নাটকের জাদু!

হ্যাঁ।

কিশোর ওর ব্যাকপ্যাক খুলল। উইলের দেয়া স্ক্রল দুটো বের করে নিল। ওরা। আনরোল করার পর কিশোর দেখতে পেল উইল কিছু একটা লিখেছে। জোরে জোরে পড়ল সে:

আমাকে সাহায্য করার জন্য তোমাদের
দুজনকে ধন্যবাদ।
তোমাদের বন্ধু

–উইলিয়াম শেক্সপীয়ার

উইলিয়াম শেক্সপীয়ার! সেই বিখ্যাত নাট্যকার! বলে উঠল জিনা। বিস্মিত।

নাম আর চেহারা দেখেই সন্দেহ হয়েছিল, বলল কিশোর। শেক্সপীয়ারের ছবি তো অনেক দেখেছি।

গবেষণার বইটা বের করল ও। ইনডেক্সে শেক্সপীয়ার খুঁজে নিল। একটা পৃষ্ঠা উল্টে জোরে জোরে পড়ল:

উইলিয়াম শেক্সপীয়ার (১৫৬৪-১৬১৬)। তিনি
সাঁইত্রিশটি নাটক এবং অনেক সনেট আর কবিতা
লিখে গেছেন। অনেকে তাকে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ
সাহিত্যিকের মর্যাদা দেয়।

সর্বশ্রেষ্ঠ? বলে উঠল জিনা। আমাদের উইল?

উইলিয়াম শেক্সপীয়ারের অটোগ্রাফের দিকে অবাক বিস্ময়ে চেয়ে রইল কিশোর।

অ্যাই, আমরা মরগ্যানের নোটের সাথে আমাদের স্ক্রল দুটো রেখে দিতে পারি, বলল জিনা। তা হলে ও জানতে পারবে আমরা বিশেষ এক জাদু খুঁজে পেয়েছিলাম।

স্ক্রল দুটো ওরা মেঝেতে চিরকুটটার পাশে রেখে দিল। এবার দড়ির মই বেয়ে নামতে লাগল।

জঙ্গলের ভিতর দিয়ে হাঁটছে, মৃদুমন্দ বাতাসে কেঁপে উঠল গাছের পাতা। ছায়ারা সরে সরে যাচ্ছে। পাখিরা অলক্ষে কিচিরমিচির করছে।

জাদুর বনটার কথা মনে আছে? চাপা গলায় বলল জিনা। পরী রানী আর পরী রাজার কথা?

কিশোর মৃদু হেসে মাথা ঝাঁকাল।

আর পাক, রাতের বেলা মনের আনন্দে যে ঘুরে বেড়ায়? বলল জিনা। আর উইল, আমাদের উইল।

কিশোর আবারও মাথা ঝাঁকাল।

দারুণ সময় কেটেছে আমাদের, তাই না? প্রশ্ন করল জিনা।

দীর্ঘশ্বাস ফেলল কিশোর।

হ্যাঁ, বলল ও। এবার গভীর শ্বাস টানল। স্পষ্ট উচ্চারণে গলায় আবেগ ঢেলে বলল:

বড় অদ্ভুত এক দৃশ্য দেখেছি আমি।

স্বপ্ন দেখেছি….

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *