ম্যাজিক শো

তিন গোয়েন্দা ভলিউম ১১৪/২ – ম্যাজিক শো – রকিব হাসান – সেবা প্রকাশনী – প্রথম প্রকাশ : ২০১০

স্টেজ থেকে আট সারি পিছনে বসেছি আমরা–আমি মুসা আমান, আমার মা-বাবা ও আমার খালাত বোন ফারিহা। স্টেজে খেলা দেখাচ্ছে জাদুকর গ্রেট ক্ল্যাণ্ড। বাড়ি আয়ারল্যাণ্ডে। পৃথিবীর নানা দেশ ঘুরে রকি বিচেও খেলা দেখাতে এসেছে। জ্যাকেটের পকেট থেকে একটা রুমাল বের করে ঝাড়া দিল ও। চারটে ঘুঘু পাখি বেরিয়ে উড়ে গেল। একটা পাখি উড়ে এল আমাদের দিকে। রঙিন কাগজের দলা হয়ে টুপ করে ঝরে পড়ল আমার কোলের ওপর।

সত্যিই অবাক করা জাদুর খেলা। ম্যাজিক আমি অনেক দেখেছি। স্কুলের ট্যালেন্ট শোতে আমি নিজেও ছোটখাট ম্যাজিকে অংশ নিয়েছি। কিন্তু গ্রেট ক্ল্যাণ্ডরের কোন তুলনা হয় না।

রকি বিচের প্যাসিফিক থিয়েটার হলে এই ম্যাজিক দেখানোর ব্যবস্থা। করা হয়েছে। থিয়েটার হলের বাইরে দেয়ালে পোস্টার লাগানো হয়েছে : হুডিনির চেয়ে বড় ম্যাজিশিয়ান গ্রেট ক্ল্যাক্স। প্রথমে বিশ্বাস করিনি। এখন ওর খেলা দেখে বুঝলাম, ঠিকই লিখেছে। একের পর এক অসম্ভব অবিশ্বাস্য সব ম্যাজিক দেখিয়ে চলেছে ও।

শূন্য জগ দুধ দিয়ে ভরে ফেলল, সেই দুধ সাদা বল হয়ে ওপরে উঠে। গেল, ছাতে ড্রপ খেতে লাগল। জগ ওপরে তুলে বলটাকে ডেকৈ এনে আবার তাতে ভরল জাদুকর, আবার দুধ হয়ে গেল বলটা।

একটা লম্বা বেলুনকে ফুলিয়ে নিয়ে কাঁচি দিয়ে কেটে ছয় টুকরো করে ছোট ছোট বেলুন বানাল। একটা বেলুনও ফাটল না কিংবা বাতাস বেরোল না। বেলুনগুলো ছুঁড়ে দিল দর্শকদের দিকে। নেয়ার জন্য হুড়াহুড়ি লাগিয়ে দিল ছেলেমেয়েরা।

ফারিহাও একটা টুকরো কুড়িয়ে আনল। ওর হাত থেকে নিয়ে ভাল করে দেখলাম বেলুনটা। স্বাভাবিক বেলুন। কোথাও কোন ফাঁকিবাজি ধরতে পারলাম না। বাবাও দেখে অবাক হয়ে মাথা নাড়ছে। আমার মতই তারও ম্যাজিকে আগ্রহ আছে। এসব কাণ্ড কীভাবে করছে ক্ল্যাণ্ডর, বুঝতেই পারলাম না। উত্তেজনায়, আনন্দে পাগল হয়ে গেছে যেন মুগ্ধ দর্শকরা।

তাই ছোটদের মধ্য থেকে যখন একজন ভলান্টিয়ার চাইল ক্ল্যাণ্ড, জাদুর খেলায় ওকে সহযোগিতা করার জন্য, চতুর্দিক থেকে অসংখ্য হাত উঠে গেল। ওপরে, আমারটা সহ। কয়েকটা ছেলেমেয়ে তো চেয়ারে দাঁড়িয়ে হাত নাড়তে লাগল, ক্ল্যাণ্ডরের দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য। কিন্তু অন্য কারও দিকে তাকাল না ও। শুরু থেকেই আমাদের ওপর নজর ছিল।

ওই ছোট্ট মেয়েটা হলে কেমন হয়, লাল টি-শার্ট পরা? ফারিহাকে দেখিয়ে বলল ও। এই মেয়ে, কী নাম তোমার?

ফারিহা, বোনের হয়ে জবাব দিলাম আমি।

হ্যাঁ, ফারিহা, স্টেজে আসবে, আমাকে সাহায্য করার জন্য? জাদুকর ডাকল।

আমি হাত তুলেছিলাম, ফারিহা তোলেনি, কিন্তু ডাক পড়ল ওরই। যেতে চাইল না ও। চেয়ারে গুটিয়ে গেল।

যাও না, অসুবিধে কী? আমি বললাম। পায়রা, টিয়া, কিছু একটা বানিয়ে দেবে। কুকুরও বানাতে পারে। তবে তাতে কোন অসুবিধে নেই। বাড়ি নিয়ে গিয়ে জেমির সঙ্গে রেখে দেব।

মুসা ভাইয়া, তুমি চুপ করবে! রেগে উঠল ফারিহা। চেয়ারে আরও নিচু করে ফেলল শরীরটা।

আপনারা কি বলেন লেডিজ অ্যাণ্ড জেন্টলম্যান? হাসিমুখে দর্শকদের জিজ্ঞেস করল জাদুকর। ছোট্ট ওই মিষ্টি মেয়েটাকে স্টেজে এনে বাতাসে উড়িয়ে দিলে কেমন হয়?

শুরু হলো চিৎকার-চেঁচামেচি। সবাই অনুরোধ করছে ফারিহাকে। বাবা ওর হাত ধরে টেনে দাঁড় করিয়ে দিয়ে বলল, আরে যাও না, ও তোমাকে খেয়ে ফেলবে না। গিয়ে দেখো, মজা পাবে। তোমাকে যে ডেকেছে, এটাই তো তোমার ভাগ্য।

অনিচ্ছাসত্ত্বেও সিঁড়ি বেয়ে স্টেজে উঠে গেল ফারিহা। জাদুকরের মুখোমুখি দাঁড়াল।

ফারিহা, দাঁড়িয়ে থাকো, কোন ভয় নেই! চেঁচিয়ে সাহস দিলাম ওকে।

হাত তুলে দর্শকদের চুপ করতে অনুরোধ করল গ্রেট ক্ল্যাণ্ডর। আমি এই ছোট্ট মেয়েটাকে সবার চোখের সামনে গায়েব করে দেব।

আতঙ্কিত হয়ে পড়ল ফারিহা। স্টেজ থেকে দৌড়ে পালাতে চাইল। ধরে ফেলল ক্ল্যাণ্ডর। হেসে উঠল কিছু খুদে দর্শক।

চিন্তার কিছু নেই, আমাদের দিকে তাকিয়ে বলল জাদুকর। এই মেয়েটার যদি কিছু হয়ে যায়, একই রকম নতুন আরেকটা মেয়ে এনে দেব আপনাদেরকে।

আবার হাসি।

ঘুরে দাঁড়াল গ্রেট ক্ল্যাণ্ডর। ওর পিছনে বড় একটা কাঠের আলমারি রাখা। লাল রঙ করা। সারা গায়ে সোনালি রঙে নানা ধরনের সাঙ্কেতিক চিহ্ন আঁকা। আলমারিটা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দর্শকদের দেখাল জাদুকর। কোথাও কোন। ফাঁকফোকর নেই। গায়ে চাপড় দিয়ে বোঝাল, নিরেট কাঠের তৈরি। আলমারির দরজা খুলল ও। ভিতরে কালো রঙ করা।

ফারিহার দিকে তাকাল ক্ল্যাণ্ডর। অন্ধকারকে তো ভয় পাও না তুমি, তাই না?

চোখ বড় বড় হয়ে গেল ফারিহার। না, পাই। গলা কাঁপছে ওর।

ঠিক আছে, আলোর ব্যবস্থা করছি। আস্তিন ঝুঁকি দিল জাদুকর। পরক্ষণে হাতের মুঠোয় দেখা গেল একটা টর্চ। ফারিহার হাতে দিয়ে বলল, নাও।

টর্চটা নিল ফারিহা। হাতটা কাঁপছে, পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছি। ভীষণ ভয় পেয়েছে ও। মনে হচ্ছে, টর্চটা ফেলে দেবে হাত থেকে।

ফারিহার হাত ধরে আলমারির কাছে নিয়ে চলল জাদুকর। গায়েব। হওয়ার আগে কাউকে কিছু বলার আছে তোমার? গম্ভীর স্বরে জিজ্ঞেস করল। ও। ভয়ে ভয়ে মাথা নাড়ল ফারিহা। আলমারির ভিতর ওকে ঠেলে দিল ক্ল্যাণ্ডর। দরজা লাগাল না।

আমি ভাবছি, আলমারির তলায় নিশ্চয় কোনও চোরা দরজা আছে, ট্র্যাপ, ডোরের মত কিছু, ক্ল্যাণ্ডর বাইরের দরজাটা বন্ধ করলেই ওই দরজা খুলে নীচ থেকে ফারিহাকে টেনে নেবে জাদুকরের সহকারী। আমার মনের কথা পড়তে পেরেই যেন একপাশে সরে দাঁড়াল ক্ল্যাণ্ডর। আলমারির দিকে হাত তুলে। আদেশ দিল, ওপরে! কেঁপে উঠল আলমারিটা। দুলতে দুলতে ওপরে। উঠতে শুরু করল। তিন-চার ফুট উঠে থেমে গেল। ভিতরে দাঁড়িয়ে আছে। ফারিহা। আমাদের দিকে চোখ। আতঙ্কে জমে গেছে যেন। দরজার দিকে হাত তুলে ইশারা করল ক্ল্যাণ্ডর। দড়াম করে লেগে গেল দরজার পাল্লা। ভীষণভাবে দুলতে শুরু করল আলমারিটা। দরজার ফাঁক থেকে ধোঁয়ার মত কী যেন বেরোচ্ছে। প্রায় ঢেকে ফেলল দরজাটাকে। তারপর হঠাৎ করেই আবার খুলে গেল পাল্লা। আলমারির ভিতর ফারিহা নেই।

ফারিহার ফিরে আসার অপেক্ষায় রইলাম। খানিকটা ভানভণিতা করে এখুনি হয়তো ফিরিয়ে নিয়ে আসবে ওকে ক্ল্যাণ্ড, জাদুকররা সাধারণত যা করে থাকে। কিন্তু ও সেটা করল না। ফারিহার কথা যেন বেমালুম ভুলে গিয়ে অন্য খেলায় মন দিল। ভিতরে ভিতরে উদ্বিগ্ন হলাম। কোথায় পাঠাল ফারিহাকে? স্টেজের নীচে? ও কি ভয় পাচ্ছে? মাত্র সাত বছর বয়েস ওর অন্ধকারে একা ফেলে রেখেছে? টর্চটার কথা ভেবে খানিকটা ভরসা পেলাম। একেবারে অন্ধকারে থাকতে হবে না ওকে। : শো শেষ হয়ে আসছে। এর মধ্যে একটিবারের জন্য ফারিহার কথা উল্লেখও করেনি জাদুকর। সমস্ত খেলা শেষ করে আবার আলমারির দিকে এগোল ও। বিড়বিড় করে কী সব বলল। তারপর দরজা খুলল।

ভিতরে কেউ নেই। এমন ভঙ্গি করতে লাগল জাদুকর, যেন কোথায় কী একটা মস্ত ভুল হয়ে গেছে। জাদুকরদের এসব অভিনয়ের কথা আমার জানা আছে।

হাত তুলে আবার আদেশ দিল আলমারিটাকে, ওপরে!

লেগে গেল দরজার পাল্লা। কাঁপতে কাঁপতে ওপরে উঠতে লাগল আলমারিটা। তিন-চার ফুট ওপরে উঠে স্থির হলো। ধোঁয়া বেরোতে শুরু করল। আবার ঝটকা দিয়ে খুলে গেল পাল্লা। দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলাম আমার ছোট বোনটাকে। হাতে জ্বলন্ত টর্চ। ওকে ঘিরে পাক খাচ্ছে ঘন ধোঁয়া। দর্শকদের উন্মত্ত হাততালিতে কানে তালা লাগার জোগাড় হলো।

ক্ল্যাণ্ডর আদেশ দিতেই আপনাআপনি স্টেজে নামল আলমারিটা। হাত বাড়াল ও। এবার নির্দ্বিধায় ওর হাত ধরল ফারিহা। আলমারি থেকে বেরিয়ে এল। ভয় পাচ্ছে না এখন আর। জাদুকরের দিকে তাকিয়ে হাসল বলেও মনে হলো। ক্ল্যাণ্ডরের ঠোঁট নড়তে দেখলাম। কী যেন বলছে ওকে। কিন্তু দর্শকদের হই-চইয়ে কী বলল কিছুই শুনতে পেলাম না।

জাদুকরের হাতে টর্চটা ফিরিয়ে দিয়ে সিঁড়ি বেয়ে স্টেজ থেকে নেমে এল ফারিহা। সিটের সারির মাঝখান দিয়ে এগিয়ে আসতে দেখছি ওকে। সবাই ওর প্রশংসায় পঞ্চমুখ। কিন্তু কারও দিকে তাকাচ্ছে না ও। মাথা নিচু করে এগোচ্ছে। সিটের নম্বর গুনতে গুনতে আসছে, যেন ভুলে গেছে কোন সিটটায় বসেছিল। অবাক হলাম। জাদুর খেলা খেলতে গিয়ে মাথাটা গুলিয়ে গেল নাকি ওর!

আমাদের কাছে পৌঁছে মুখ তুলে তাকাল ও। বসবে কি না, দ্বিধা করছে। আমি বললাম, কী হলো? চিনতে পারছ না? বোসো।

চুপচাপ বসে পড়ল ফারিহা। আমাদের সঙ্গে কথা বলল না। ক্ল্যাণ্ডরের দিকে তাকিয়ে আছে।

বাউ করছে তখন জাদুকর। থ্যাংক ইউ ভেরি মাচ, লেডিস অ্যাণ্ড জেন্টেলম্যান। আজ রাতের শো এখানেই শেষ।

উঠে দাঁড়াল দর্শকরা। জাদুকরের উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করছে সবাই। ও যে কতবড় ম্যাজিশিয়ান বার বার বলছে সেকথা। কয়েকবার বাউ করার ভঙ্গিতে মাথা নোয়াল ক্ল্যাণ্ডর, হাত তুলে দর্শকদের শান্ত হতে বলল, যেন জরুরি কিছু বলতে চায়। হাততালি বন্ধ হলো। হট্টগোল থামল। ঘরে পিনপতন নীরবতা। গলা লম্বা করে সবাই সামনে মুখ বাড়িয়ে দিয়েছে, জাদুকর কী বলে শোনার জন্য। কিন্তু কথা না বলে হঠাৎ দুই আঙুলে তুড়ি বাজাল জাদুকর, চোখের পলকে আলোর ঝিলিকের মত অদৃশ্য হয়ে গেল। স্টেজ থেকে। একটা মুহূর্ত স্তব্ধ হয়ে রইল সবাই। তারপর সম্বিত ফিরে পেয়ে যেন হাততালি আর চিৎকারে ফেটে পড়ল। আর সবার মতই আমিও হতবাক। এ রকম আশ্চর্য ম্যাজিক আর কখনও দেখিনি।

তালি দিতে দিতে হাত ব্যথা করে ফেলেছি। ফারিহার দিকে তাকালাম। হাততালি দিচ্ছে না। চোখে অদ্ভুত শূন্য দৃষ্টি। কোন উত্তেজনা নেই চেহারায়। এ যেন আমার বোন নয়, অন্য এক ফারিহাকে দেখছি!

.

গাড়িতে করে বাড়ি ফিরছি। বাবা গাড়ি চালাচ্ছে। পাশে প্যাসেঞ্জার সিটে মা বসেছে। পিছনের সিটে বসেছি আমি ও ফারিহা। জাদুকর ওকে কীভাবে গায়েব করেছিল, জানার জন্য অস্থির হয়ে উঠেছি আমি। নানা কথা জিজ্ঞেস করতে লাগলাম : কীভাবে ওকে গায়েব করল ক্ল্যাণ্ড, স্টেজ থেকে নিয়ে গিয়ে কোথায় রেখেছিল ওকে, ভয় পেয়েছিল কি না? কিন্তু আমার একটা প্রশ্নেরও জবাব দিল না ও। সোজা সামনের দিকে তাকিয়ে আছে, সেই একই রকম ভাবলেশহীন চেহারা, চোখে শূন্য দৃষ্টি। যে ফারিহার বকবকানির ঠেলায় একেক সময় পাগল হওয়ার জোগাড় হয় আমার, তাকে এ রকম চুপ করে থাকতে দেখে ভীষণ অবাক লাগছে আমার।

মা! আর সহ্য করতে না পেরে বললাম, ফারিহা কিন্তু অদ্ভুত আচরণ করছে!

ফিরে তাকিয়ে হেসে মা বলল, আসলে তোমাকে খেপাচ্ছে। এখুনি হেসে উঠবে, দেখো। আবার বকবক শুরু করবে।

কিন্তু অনেকক্ষণ পেরিয়ে গেল। হাসল না ফারিহা। কথাও বলল না। একভাবে বসে থেকে শূন্য দৃষ্টিতে সামনের দিকে তাকিয়ে রইল।

না, কিছু বুঝতে পারছি না! বোধহয় আমাকে যন্ত্রণা দেয়ার জন্যই এ রকম করছে ও। ওর জ্বালাতন করার কৌশলগুলো অদ্ভুত। কখনও আমার ঘরে ঢুকে অকারণেই মুখ ভেঙচায়। রাগের চোটে একেক সময় মনে হয় জানালা দিয়ে ছুঁড়ে ফেলে দিই। কখনও বা আমি যখন হোমওঅর্কে ব্যস্ত, দরজায় এসে দাঁড়িয়ে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে আমার দিকে, কোন কথা বলে না, আমার ওপর থেকে চোখ সরায় না। ওর ভঙ্গিতে রাগ হতে থাকে আমার। স্নায়ুর ওপর প্রচণ্ড চাপ সৃষ্টি হয়। ধাক্কা দিয়ে ঘর থেকে বের করে দিয়ে মুখের ওপর দরজা লাগিয়ে দিই। মিনিট দশেক পরে ও চলে গেছে। ভেবে আবার যখন খুলি, দেখি একই ভঙ্গিতে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। ও, সেই একই রকম বিরক্তিকর ভঙ্গিতে চুপচাপ আমার দিকে তাকিয়ে। আজ আমাকে খেপানোর আরেকটা নতুন ভোল ধরেছে, ভাবলাম।

জাদুকর যদি তোমাকে ফিরিয়ে না আনলেই ভাল করত! রেগেমেগে বললাম।

অকারণে ওকে ধমকাচ্ছ কেন? রেগে গেল মা। চুপ করে আছে, থাক। হয়তো ক্লান্তি লাগছে।

চুপ হয়ে গেলাম।

এতক্ষণে আমার আমার দিকে ফিরে হাসল ফারিহা, মা আমাকে ধমকানোতে বোধহয় আনন্দ পেয়েছে। কেমন ভূতুড়ে লাগল হাসিটা। গা ছমছম করে উঠল আমার। অবাক কাণ্ড! ওর হাসি দেখে আগে তো কখনও এমন হয়নি আমার!

পরদিন আরও বেশি অদ্ভুত আচরণ করল ফারিহা। রোবটের মত একঘেয়ে যান্ত্রিক স্বরে কথা বলে। ঘরের কোন কিছুই যেন চিনতে পারে না। যেন অপরিচিত একটা বাড়িতে ঢুকেছে। ড্রেসারের ওপর রাখা একটা পুতুল হাতে নিয়ে এমনভাবে তাকিয়ে রইল, যেন জীবনেও দেখেনি ওটা।

নাস্তার সময় দুই বাটি সজি খেয়ে ফেলল, যে জিনিস অন্যদিন বকাবকি করেও, মুখে দেয়াতে পারে না ওকে মা। স্কুলে গিয়ে ওর বন্ধুদের সঙ্গে কথা বলল না, যেন ওদের চিনতে পারছে না। স্কুল ছুটির পর বাড়ি ফিরে টিভিতে ওর সবচেয়ে প্রিয় সিরিয়ালটা দেখতে বসে এমন বিরক্তি প্রকাশ করতে লাগল, যেন এরচেয়ে বাজে নাটক আর হয় না। নাটকের কুকুরটার ভাড়ামি দেখে হাসল না, বরং চোখমুখ কুঁচকে রাখল। খাবার টেবিলে বাবার। রসিকতায় কান দিল না, নিজের প্লেটের দিকে তাকিয়ে চুপচাপ খেয়ে চলল।

ডিনারের পর লিভিং রুমের মেঝেতে উপুড় হয়ে শুয়ে রং-তুলি নিয়ে ছবি আঁকতে লাগল। বাবা তখন টিভিতে খবর দেখছে। দুজনের কেউ আমার দিকে তাকাল না। একটা মুহূর্ত চুপচাপ দাঁড়িয়ে ফারিহার ছবি আঁকা দেখলাম। কোথায় যেন কী একটা অস্বাভাবিক লাগছে আমার কাছে। হঠাৎ বুঝে ফেললাম।

আরে! বললাম আমি, ডান হাতে আঁকা শুরু করলে কবে থেকে?

আমার দিকে মুখ তুলে শূন্য দৃষ্টিতে তাকাল ও।

তুমি না বাইয়া? আবার বললাম। ডান হাতে আঁকছ কী করে? হলোটা কী তোমার?

নির্বিকার ভঙ্গিতে হাতের তুলিটার দিকে তাকাল ফারিহা। আবার ছবি আঁকায় মন দিল।

গা ছমছম করে উঠল আমার। ফারিহার আচরণ মোটেও স্বাভাবিক লাগছে না। বাবার দিকে তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করলাম, বাবাও ব্যাপারটা লক্ষ করেছে কি না; কিন্তু বাবার মনোযোগ টিভির দিকে।

রান্নাঘরে এলাম। টেবিলে বসে বাজার করতে কত খরচ হয়েছে, হিসেব করছে মা। মা, আজ ফারিহার কী হয়েছে, বলো তো? খালি উল্টোপাল্টা কাজ করছে। নাকি আমারই মাথা খারাপ হয়ে গেল!

মুখ তুলে তাকাল মা। কেন, কী হয়েছে?

ডান হাতে ছবি আঁকছে ও, আমি বললাম। ও যে বাইয়া, ভুলেই গেছে। যেন। সারাটা দিন রোবটের মত কথা বলল। খেয়াল করনি?

ছোটরা এ রকম উল্টোপাল্টা কাণ্ড করেই থাকে, তাতে অবাক হওয়ার কিছু নেই। আবার হিসেবে মন দিল মা।

কিন্তু এটা উল্টোপাল্টা নয়, রীতিমত উদ্ভট। ওর সামনে গেলেই আমার। গা ছমছম করে।

মুখ তুলে তাকিয়ে বিরক্ত ভঙ্গিতে হাতের কলমটা টেবিলে রেখে দিল মা।

মুসা, ওর বয়েসে তুমি কি করেছ জানো? পুরো একটা সপ্তা কুকুর সেজে থেকেছ। শেষে কুকুরের ঘরে গিয়ে টুটুর সঙ্গে ঘুমোতে চেয়েছ।

লজ্জা পেলাম। বললাম, তখন তো পিচ্চি ছিলাম আমি!

সেজন্যই বলছি, হাসল মা। ছোটরা এ রকম উল্টোপাল্টা কাণ্ড করেই থাকে, তাতে অবাক হওয়ার কিছু নেই!

কিন্তু এখন মার এই কথাটা মানতে পারলাম না আমি, অন্তত ফারিহার ব্যাপারে।

.

সেদিন রাত দুটোয় হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেল আমার। পিপাসা পেয়েছে। পানি খেতে উঠলাম। ঘর থেকে বেরিয়ে দোতলার বারান্দা ধরে এগোলাম। পুরো বাড়িটাই নীরব হয়ে আছে। ।

এক গ্লাস পানি খেয়ে, আবার পিপাসা পেলে খাওয়ার জন্য আরেক গ্লাস পানি হাতে ওপরে উঠলাম। আমার পাশের ঘরটা ফারিহার। ওটার পাশ কাটানোর সময় হঠাৎ পায়ে ঠাণ্ডা বাতাস লাগল। দরজার নীচের ফাঁক দিয়ে আসছে।

নভেম্বর মাস। রাতে প্রচণ্ড ঠাণ্ডা পড়ে। বাতাস আসছে, তারমানে জানালা খুলে রেখেছে ফারিহা। এই শীতের মধ্যে জানালা খুলে ঘুমাচ্ছে! অবাক লাগল আমার। গরমকালেও জানালা খুলে শুতে ভয় পায় ও। অথচ এই শীতের মধ্যে…তারমানে, আরেকটা অস্বাভাবিক কাণ্ড করছে ও!

দরজার নব চেপে ধরে আস্তে মোচড় দিলাম। শব্দ করে ওর ঘুম ভাঙাতে চাইলাম না। ধীরে ঠেলে পাল্লা খুলে নিঃশব্দে ঘরে ঢুকলাম। ঠিকই অনুমান করেছি। জানালা খোলা। এক ঝলক জোরালো বাতাস পর্দা দোলাল। গরম কাপড় গায়ে দিয়ে আসিনি। শীতে কেঁপে উঠলাম। হাতের গ্লাসটা ড্রেসারের ওপর রেখে এগিয়ে গিয়ে জানালার পাল্লা লাগালাম। কাঁচের শার্সির ভিতর দিয়ে বড় মেইপল গাছটাকে চাঁদের আলোয় ভূতুড়ে দেখাচ্ছে। পর্দাগুলোও টেনে দিলাম ভালমত।

ঘুরে দাঁড়িয়ে দরজার কাছে ফিরে যাব, এ সময় ফারিহার বিছানার দিকে। চোখ পড়ল। শূন্য বিছানা। ফারিহা নেই। ওর বেডক্লথগুলোও নেই। খোলা গদিটা দেখা যাচ্ছে। বালিশটার কভার নেই।

দৌড়ে সুইচবোর্ডের কাছে এসে সুইচ টিপে আলো জ্বেলে ঘরের ভিতর খুঁজলাম। বাথরুমে গেছে কি না দেখার জন্য দরজা ধাক্কা দিলাম। পাল্লা খোলা। ভিতরে কেউ নেই।

ঘাবড়ে গেলাম। কেউ ওকে কিডন্যাপ করল না তো! জানালার কাছে। এসে আবার পাল্লা খুললাম। জানালা দিয়ে মাথা বের করে আঙিনাটা দেখলাম। কেউ নেই। কিছুদূরে রাস্তা থেকে কুকুরের ডাক শোনা গেল। নীচে তাকালাম। জানালার চৌকাঠে পড়া বালিতে দুটো ছোট পায়ের ছাপ চোখে পড়ল। আঙুলগুলো বাইরের দিকে ফেরানো। জানালার কাছের মেইপল

গাছটার দিকে মুখ করে চৌকাঠে দাঁড়িয়ে ছিল কেউ। ফারিহা ছাড়া আর কেউ না, পায়ের ছাপই বলে দিচ্ছে।

ঘরের আলোয় আরেকটা জিনিস দেখতে পেলাম। মেইপল গাছের ডালে বাঁধা একটা সাদা চাদর। অন্ধকারে বাতাসে দোল খাচ্ছে চাদরটা।

জানালার পাল্লা দুটো আবার বন্ধ করলাম। আলো নিভিয়ে বেরিয়ে এলাম ফারিহার ঘর থেকে। দৌড়ে ফিরে এলাম নিজের ঘরে। তাক থেকে টর্চটা নিলাম। জানালা খুলে মাথা বের করে দিলাম ঠাণ্ডা বাতাসে। আলো ফেললাম মেইপল গাছের ডালে বাঁধা চাদরটায়। প্রথম চাদরের এক কোণায় আরেকুটা। চাদর বাঁধা। দ্বিতীয় চাদরটার নীচে একইভাবে গিট দেয়া একটা কম্বল। সামনের লনের প্রায় ঘাস ছুঁয়েছে কম্বলের নীচের কোণা।

স্তব্ধ হয়ে গেছি। রাত দুপুরে এভাবে চাদর আর কম্বল বেঁধে দড়ির মত বেয়ে বেরিয়ে যাবে, বিশ্বাস করতেও কষ্ট হচ্ছে। এত সাহস ও কোথায় পেল? বিছানার কিনারে বসে ভাবতে লাগলাম। কী করা যায়? মাকে ডাকব?

দরজার দিকে এগোলাম। অর্ধেকটা পেরিয়েছি, এ সময় বাইরে একটা মচমচ শব্দ কানে এল। জানালার দিকে ফিরলাম। গাছের ডালপাতাগুলোকে ওপরে-নীচে দুলতে দেখলাম চাঁদের আলোয়। ঝকি খাচ্ছে। নিঃশব্দে জানালার কাছে ফিরে এসে নীচে উঁকি দিলাম। একেবারে সময়মত পৌঁছেছি। চাদর বেয়ে উঠে এসে জানালার চৌকাঠে পা রাখছে তখন ফারিহা!

একটা মুহূর্ত চৌকাঠে দাঁড়িয়ে রইল ও। এত বেশি গরম কাপড় পরেছে, একটা পুঁটুলির মত লাগছে ওকে। দাঁত দিয়ে কামড়ে ধরে প্রথমে একটা দস্তানা খুলে হাতে নিল, তারপর আরেকটা খুলল। দস্তানা দুটো ঘরের ভিতর ছুঁড়ে ফেলে ডালে বাঁধা চাদরের গিট খুলতে শুরু করল। কোনরকম উত্তেজনা কিংবা তাড়াহুড়া নেই ওর মাঝে, পুরোপুরি শান্ত। অথচ মাটি থেকে প্রায় বিশ ফুট ওপরে রয়েছে। চাঁদরুটা খুলে নিয়ে ভিতরে লাফিয়ে পড়ল ও। ভালমত দেখার জন্য আরও খানিকটা মুখ বাড়ালাম জানালার বাইরে। চাদরের কোণা ধরে টেনে দ্বিতীয় চাদর ও কম্বলটা ভিতরে নিয়ে গেল ফারিহা। পাল্লা লাগানোর শব্দ শুনলাম।

যতটা সম্ভব শব্দ না করে আমার জানালার পাল্লা লাগালাম। নিজের বিছানায় শুয়ে চোখ বুজে ভাবতে লাগলাম, যা দেখলাম সত্যি দেখলাম? নাকি স্বপ্ন!

আবার যখন চোখ মেলোম, জানালা দিয়ে রোদ ঢুকছে ঘরে। সকাল। হয়ে গেছে।

মনে পড়ল, গতরাতের কথা। নাহ, এখনও বিশ্বাস হচ্ছে না। নিশ্চয় স্বপ্ন দেখেছি। ফারিহাকে যা করতে দেখেছি, সেটা কেবল স্বপ্নেই সম্ভব, বাস্তবে নয়।

নাস্তা খেতে নীচে নামলাম। ফারিহা আগেই উঠে পড়েছে। চুপচাপ টেবিলে বসে খাচ্ছে। খেতে খেতে আড়চোখে ওর দিকে তাকাচ্ছি। ভেবে পাচ্ছি না, হঠাৎ করেই আমার ছোট্ট বোনটি এতটা দুঃসাহসী হয়ে উঠল কী করে? আর এতটা বদলেই বা গেল কেন? কেন ওর দিকে তাকালে আমার গা ছমছম করে?

রান্নাঘরে ঢুকল মা। উদ্বিগ্ন লাগছে মাকে। ফারিহাকে জিজ্ঞেস করল, আমার গহনায় হাত দিয়েছ আবার? ওগুলো নিয়ে খেলেছ?

নীরবে খেয়ে যাচ্ছে ফারিহা। জবাবও দিল না, মুখও তুলল না।

এই মেয়ে, আমি তোমাকে একটা প্রশ্ন করেছি, মা বলল। আমার কিছু গহনা খুঁজে পাচ্ছি না। ওগুলো পরে খেলেছিলে তুমি?

দরজায় এসে দাঁড়াল বাবা। মা আর ফারিহার দিকে তাকিয়ে আছে। এক হাতে বাবার ক্যামেরাটা, আরেক হাতে ফিল্মের একটা রোল।

না, ম্যাডাম, মুখ না তুলে জবাব দিল ফারিহা।

পরস্পরের দিকে তাকাতে লাগল মা আর বাবা।

কী হয়েছে, ফারিহা? ঘরে ঢুকতে ঢুকতে বাবা জিজ্ঞেস করল। ক্যামেরা আর ফিল্মটা রাখল টেবিলে। তুমি এমন করছ কেন? খালাকে ম্যাডাম ডাকছ। অস্বাভাবিক ভঙ্গিতে কথা বলছ। কোনও সমস্যা হয়ে থাকলে আমাদের বলতে পারো।

কিছু হয়নি, জবাব দিল ফারিহা।

আবার বাবার দিকে তাকাল মা। নীরবে কাঁধ ঝাঁকাল বাবা। ফিল্মটা তুলে নিয়ে বলল, আমি কাজে বেরোচ্ছি। দোকান থেকে কিছু আনতে হবে?

বাবার সঙ্গে লিভিং রুম থেকে বেরিয়ে গেল মা। ফারিহার দিকে তাকালাম আমি। বাবার ক্যামেরটার দিকে চেয়ে আছে ও।

খাওয়া শেষ করে খাবারের এঁটো প্লেট আর বাটি নিয়ে সিংকে চলে এলাম। ধোঁয়া শেষ করে ফিরে তাকিয়ে দেখি, ফারিহা নেই। নেই টেবিলে রাখা বাবার ক্যামেরাটাও।

স্কুলে যাবার সময় হয়েছে। বাস আসবে যে কোন সময়। তৈরি হতে হবে। আমাকে। দৌড়ে ওপরতলায় উঠে নিজের ঘরে ঢুকলাম। কাপড় বদলে ব্যাকপ্যাকটা বাধলাম পিঠে। বারান্দায় বেরিয়ে দেখি, ফারিহার ঘরের দরজাটা খোলা। দরজার কাছে এসে ভিতরে উঁকি দিলাম। বিছানাটা সুন্দর করে গোছানো। বোঝাই যায় না, এই বিছানা থেকে চাদর আর কম্বল তুলে গাছের ডালে বেঁধে নেমে গিয়েছিল ও। নাহ, স্বপ্নই দেখেছি আমি! পা বাড়াতে যাব, এ সময় এমন একটা জিনিস চোখে পড়ল, চমকে উঠলাম।

ফারিহার ড্রেসারের ওপর রাখা পানি ভর্তি একটা গ্লাস। আমিই রেখেছি। পরে ঘর থেকে বেরিয়ে আসার সময় অতিরিক্ত উত্তেজনায় নিতে ভুলে গেছি। এই গ্লাসটা প্রমাণ করছে, কাল রাতে যা দেখেছি, সত্যি দেখেছি, স্বপ্ন ছিল না!

সেদিন স্কুল থেকে ফিরে, আমার ছিপের এক বাণ্ডিল সুতো খুঁজে বের করলাম। নাইলনের সুতো, খুব শক্ত। ফারিহা নীচতলায় টেলিভিশনে কার্টুন দেখছে। এটাই সুযোগ। নিঃশব্দে ওর ঘরে ঢুকে জানালার হুড়কোর সঙ্গে সুতোর এক মাথা বাঁধলাম। বাণ্ডিলটা আমার জানালার কাছে মেইপল গাছের একটা ডালের ওপর ছুঁড়ে দিলাম। খানিকটা সুতো খুলে গিয়ে বাণ্ডিলের বাকি অংশটা ডালে ঝুলে রইল। পাল্লা লাগালাম। আমার শোবার ঘরে এসে জানালা দিয়ে হাত বাড়িয়ে সুতোর বাণ্ডিলটা টেনে আনলাম ঘরের ভিতর।

একটা টিনের মগে আমার সমস্ত পেন্সিল আর কলম রাখি। সেগুলো ডেস্কের ওপর ঢেলে দিয়ে শূন্য মগটা এনে রাখলাম ড্রেসারের কিনারে। সুতোর আরেক মাথা বেঁধে দিলাম মগের হাতলে। মগের ওপর একটা বই রেখে তার ওপর রাখলাম একটা খালি কোকের টিন।

ফারিহার ঘরের জানালাটা এখন খুললেই সুতোয় টান পড়বে, মগে টান লেগে ওপরে রাখা সমস্ত জিনিসপত্র নিয়ে মাটিতে পড়বে ওটা। শব্দ হবে। তাতে আমার ঘুম ভেঙে যাবে। রাতে আমার অজান্তে ঘর থেকে বেরোতে পারবে না ও।

ভীষণ ঠাণ্ডার মধ্যেও সুতোটার কারণে সেরাতে আমার জানালাটা খোলা রাখতে হলো। বাইরে বেরোনোর কাপড় পরে শুলাম

জিনসের প্যান্ট, জ্যাকেট, পায়ে হাইকিং বুট। মাথায় একটা মাংকি ক্যাপও পরেছি, কানের ওপর টেনে দিয়েছি, যাতে গরম থাকে কান। পকেটে টর্চ লাইট তো নিয়েছিই, বাড়তি ব্যাটারিও নিয়েছি। ফারিহা, এত রাতে বাইরে গিয়ে কী করে, দেখতেই হবে আমাকে।

ঘুমানোর চেষ্টা করলাম। ঠাণ্ডা আর উত্তেজনাও ঘুম ঠেকাতে পারল না। ঘুমের মধ্যে দুঃস্বপ্ন দেখতে লাগলাম। একটা পাগলা কুকুর আমাকে তাড়া করে যখন প্রায় ধরে ফেলেছে, ঠিক তখনই প্রচণ্ড শব্দে চোখ মেলোম। প্রথমে কোথায় আছি, কী করছি, কিছু বুঝতে পারলাম না। তারপর মনে পড়ল টিনের মগটার কথা। ঘুমের মধ্যে ওটা পড়ার শব্দ শুনেছি।

লাফ দিয়ে বিছানা থেকে উঠে দৌড়ে গেলাম জানালার কাছে। মুখ বের করে বাইরে উঁকি দিলাম। গাছের ডালে দ্বিতীয় চাদরটা বাধা শেষ করেছে তখন ফারিহা।

পা টিপে টিপে চলে এলাম নীচতলায়। সামনের দরজার ছিটকানি খুলে পাল্লা ফাঁক করলাম কয়েক ইঞ্চি। লনের ঘাসের ওপর ঝুলতে দেখছি ফারিহার কম্বলের কোণা। ওটা বেয়ে মাটিতে লাফিয়ে নামল ও। দাঁতে কামড়ে ধরে রেখেছে ওর বালিশের কভারটা। ভারি কোন জিনিস রয়েছে। ওটার ভিতরে। মাটিতে নেমে কভারটা দাঁত থেকে হাতে নিয়ে কাঁধে ঝুলিয়ে রওনা হলো রাস্তার দিকে।

আস্তে করে ঘর থেকে বেরিয়ে এসে নিঃশব্দে ওর পিছু নিলাম। অসম্ভব জোরে হাঁটছে ও। ওর সঙ্গে তাল রাখতে গিয়ে রীতিমত দৌড়াতে হলো আমাকে। এত শক্তি কোথায় পেল ও, বুঝলাম না।

চাঁদের আলোয় অনুসরণ করে চলেছি ওকে। চলেছে তো চলেছেই ও, থামার নাম নেই। একটুক্ষণের জন্য গতি কমাচ্ছে না। ঠাণ্ডার মধ্যেও ঘেমে নেয়ে গেছি আমি। হাঁপাচ্ছি। অথচ ওর যেন কিছুই হচ্ছে না।

শহরের প্রান্তে চলে এসেছি, এ সময় একটা ছেলেকে দেখলাম। বয়েস ফারিহার সমানই হবে। হাতে একটা বাজারের থলে। ভিতরের জিনিসগুলো বেশ ভারি, বহন করার ভঙ্গি দেখেই বোঝা যাচ্ছে। একই দিকে চলেছে। দুজনে, রাস্তার দুই পাশ ধরে। কেউ কারও দিকে তাকাচ্ছে না। দুজনেই চুপচাপ হেঁটে চলেছে যেন ঘোরের মধ্যে, নজর সামনের দিকে।

শহরের কিনারে এসে মূল রাস্তা থেকে আরেকটা সরু রাস্তা ঘুরে বনে ঢুকে গেছে। মোড় নিয়ে সেই রাস্তায় নেমে বনে ঢুকল দুজনে। আমিও ঢুকলাম। রাস্তার বাতি নেই এখানে। তবে চাঁদের আলো আছে। সেই আলোয় পাতাগুলো ভেজা ভেজা দেখাচ্ছে। বনতলে অন্ধকার।

গা ছমছম করছে আমার।

গাছপালার ফাঁকফোকর দিয়ে এগিয়ে চলেছে ছেলেমেয়ে দুটো। ওদের পিছু নিয়ে যতটা সম্ভব নিঃশব্দে হাঁটার চেষ্টা করছি আমি। অন্ধকারে গতি বাড়াতে পারছি না। টর্চ জ্বাললে ফারিহা ও ছেলেটার চোখে পড়ে যাবু।

কতক্ষণ হেঁটেছি বলতে পারব না। তবে অনেকক্ষণ, তাতে কোন সন্দেহ নেই। হঠাৎ আমার পিছনে মট করে শুকনো ডাল ভাঙার শব্দ হলো। ধড়াস করে এক লাফ মারল আমার হৃৎপিণ্ড! তাড়াতাড়ি একটা গাছের আড়ালে লুকিয়ে ফিরে তাকালাম।

প্রথমে কিছু চোখে পড়ল না। তারপর দেখলাম। একটা গাছের পাশ কাটিয়ে বেরিয়ে এল ও। আরেকটা বাচ্চা ছেলে। ওর পিছনে আরও একজন। আমার পাশ কাটিয়ে চলে গেল ছেলে দুটো, ফারিহা আর অন্য ছেলেটা যেদিকে গেছে।

গাছের আড়াল থেকে বেরিয়ে এসে পা টিপে টিপে ছেলেগুলোর পিছু নিলাম। আরও কিছুটা এগোনোর পর দূরে আলো চোখে পড়ল। যতই এগোচ্ছি, আলোটা বাড়ছে। আরও কাছে আসার পর দেখলাম, বেশ বড়সড় একটা অগ্নিকুণ্ড।

আগুন ঘিরে দাঁড়িয়ে রয়েছে দশ-বারোটা ছেলেমেয়ে। কেউ কথা বলছে। না। মূর্তির মত স্থির। আগুনের আভায় লালচে দেখাচ্ছে ওদের মুখগুলো। ওদের সঙ্গে ফারিহাকে দেখলাম। ওর পাশে দাঁড়ানো ছেলেটাকে চিনতে পারলাম। আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধু রবিনের কাজিন কিটু! রবিনের এক মামার ছেলে। ফারিহার বয়েসী। ফ্লোরিডায় থাকে। রকি বিচে খালার বাড়িতে বেড়াতে এসেছে।

ওদের সবার হাতেই কোন না কোন ধরনের ব্যাগ-কাপড়ের থলে, প্ল্যাস্টিকের ব্যাগ; একমাত্র ফারিহার হাতেই বালিশের কভার।

আমার পিছনে নড়াচড়া টের পেয়ে আবার লুকালাম. একটা বড় গাছের গোড়ায়। ভাবলাম, আবার কোন বাচ্চাটাচ্চা হবে। আড়াল থেকে সাবধানে উঁকি দিয়ে দেখি, বাচ্চা নয়, বড় মানুষ। কালো আলখেল্লা পরা। হুড দিয়ে মাথা ঢাকা। দ্রুতপায়ে এগিয়ে চলেছে আগুনের দিকে।

আমার পাশ দিয়ে গেল লোকটা। গাছের গায়ে নিজেকে চেপে ধরে। মিশিয়ে ফেলতে চাইলাম।

তবে আমার দিকে তাকাল না লোকটা। বোধহয় নিজের চিন্তায় মশগুল। আমার মাত্র দুই হাত দূর দিয়ে চলে গেল ও। আমাকে দেখল না।

পায়ের শব্দ দূরে সরে গেলে বেরিয়ে এলাম গাছের আড়াল থেকে। আগুনের কাছে গিয়ে দাঁড়াল লোকটা, ছেলেমেয়েগুলোর কাছে। আগুনের লাল আভার পটভূমিতে কালো একটা মূর্তি। হুড় দিয়ে এমন করে মুখ-মাথা ঢাকা, চেহারা বোঝা যাচ্ছে না। তবু চেনা চেনা লাগল ওকে। কোথায় যেন দেখেছি।

আলখেল্লার ভিতর থেকে বড় একটা কাপড়ের থলে বের করল লোকটা। সেটার মুখ খুলে সামনে বাড়িয়ে ধরল। এক এক করে ছেলেমেয়েরা এগিয়ে এসে ওদের সঙ্গে আনা থলে থেকে সেই ব্যাগের ভিতর সমস্ত জিনিসপত্র ঢেলে দিতে লাগল। রূপার টি সেট থেকে শুরু করে সোনার ব্রেসলেট, গহনা। ভর্তি গহনার বাক্স, অনেক কিছুই আছে।

ফারিহার পালা এল। বালিশের কভারের ভিতর হাত ঢুকিয়ে কয়েকটা গহনা বের করে লোকটার বাড়িয়ে ধরা ব্যাগের মধ্যে ফেলল ও। নিশ্চয় মার গহনা, যেগুলো খুঁজে পাচ্ছিল না। আবার বালিশের কভারে হাত ঢোকাল ও। এবার বের করল একটা ক্যামেরা। বাবার ক্যামেরাটা। লোকটার ব্যাগে ওটা ফেলার সময় আগুনের আলোয় ফারিহার চোখ চকচক করতে দেখলাম। অদ্ভুত দৃষ্টি সে-চোখে।

জিনিসপত্র সব নেয়া হয়ে গেলে আগুনের দিকে হাত বাড়াল লোকটা। বিড়বিড় করে কী বলল। সঙ্গে সঙ্গে নিভে গেল আগুন।

চাঁদের আলোয় দেখলাম, কালো মূর্তিটা আমার দিকে এগিয়ে আসছে। আবার গাছের আড়ালে লুকালাম। এবারও আমার পাশ দিয়ে চলে গেল লোকটা, আমাকে দেখল না। এরপর ছেলেমেয়েগুলো চলে গেল আমার পাশ দিয়ে। গাছের গায়ে মিশে রইলাম, যাতে আমাকে দেখতে না পায়। দুরে সরে যেতে থাকল পায়ের শব্দ। আড়াল থেকে বেরোলাম, বনটা নীরব হয়ে যাবার পর।

যখন বাড়ি ফিরলাম, ফারিহার জানালা তখন বন্ধ। মেইল গাছে কম্বল আর চাদরগুলো নেই। সামনের দরজা দিয়ে ভিতরে ঢুকলাম। পা টিপে টিপে উঠে এলাম ওপরতলায়। জানালা খোলা রেখে গিয়েছিলাম। বরফ-শীতল হয়ে আছে আমার ঘর। জানালাটা লাগিয়ে দিয়ে এসে কম্বলের নীচে ঢুকলাম।

তোমার কাজিন কি ইদানীং অদ্ভুত আচরণ করে, খেয়াল করে দেখেছ?

পরদিন স্কুলে জিজ্ঞেস করলাম আমার বন্ধু রবিনকে। লাঞ্চের সময় টিফিন খাচ্ছি। একই বেঞ্চে আমার পাশে বসেছে ও। কিশোর নেই আমাদের সঙ্গে। ওর মামা অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে আছেন। ওঁকে দেখতে বাংলাদেশে চলে গেছে ও।

জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে আছে রবিন। কয়েকটা ছেলেকে ছোটাছুটি করে খেলতে দেখা যাচ্ছে।

অদ্ভুত আচরণ? পাউরুটি চিবাতে চিবাতে আনমনে জিজ্ঞেস করল ও। বুঝলাম না, কী বলতে চাও।

সিনেমার রোবটের মত কথা বলে? এমন কিছু খায়, যা আগে মুখেও তুলত না? এ রকম নানা ধরনের পরিবর্তন।

জানালার দিক থেকে চোখ ফেরাল রবিন। আমার দিকে তাকাল। তুমি কী করে জানলে?

ফারিহাও ইদানীং অস্বাভাবিক আচরণ করছে। বললাম ওকে। ওর দিকে তাকালে গা ছমছম করে, কেমন ভূতুড়ে লাগে। ওর কাজকর্ম কিছুই আর এখন আগের মত মনে হয় না আমার। রবিনের ভাইকেও গতরাতে আমার বোনের সঙ্গে বনে ঢুকতে দেখেছি, উদ্ভট কাণ্ড করেছে দুজনেই, এ কথাটা তখুনি বলতে চাইলাম না ওকে, যদি বিশ্বাস না করে। বরং বললাম, আমার কেন যেন মনে হচ্ছে, তোমার ভাইও অদ্ভুত আচরণ করে।

হ্যাঁ, করে, মাথা ঝাঁকাল রবিন। জানালা দিয়ে আবার তাকাল খেলার মাঠের দিকে। অসংখ্য ছেলেমেয়ে জড় হয়েছে ওখানে। কয়েক দিন ধরে অদ্ভুত আচরণ করছে–দেখে মনে হয় স্মৃতিবিলোপ হয়েছে ওর। ওর জন্য খুব দুশ্চিন্তা হচ্ছে আমার।

হুঁ!বাড়ি থেকে স্যাণ্ডউইচ বানিয়ে দিয়েছে মা। সেটার শেষ টুকরোটা, মুখে পুরে চিবাতে লাগলাম। রাত দুপুরে চুপি চুপি ঘর থেকে বেরিয়ে যায় না তোমার কিটু?

হাসল রবিন। বলতে পারব না। সন্দেহও হয়নি, তাই দেখতেও যাইনি। কেন, ফারিহা বেরিয়ে যায় নাকি?

যায়। সেজন্যই তো বলছি। একটা মুহূর্ত চুপ করে থেকে জিজ্ঞেস করলাম, কিটু কবে থেকে ওরকম কাণ্ড শুরু করেছে?

সপ্তাখানেক হলো, যদূর মনে পড়ে, রবিন বলল। জাদুকর ক্ল্যাণ্ডরের ম্যাজিক শো দেখে আসার পর থেকে। কবে যেন সেটা? হ্যাঁ, মনে পড়েছে। গত বৃহস্পতিবার।

ঘাড়ের পিছনে শিরশির করে উঠল আমার। বড়ই কাকতালীয় ব্যাপার। ক্ল্যাণ্ডর কি কিটুকে স্টেজে যেতে বলেছিল?

হ্যাঁ, বলেছিল, রবিন বলল। একটা আলমারির মধ্যে ঢুকিয়ে কিটকে গায়েব করে দিয়েছিল। তোমাকে বলিনি?

না, মাথা নাড়লাম। ফারিহাকেও নিয়ে গিয়ে আলমারিতে ঢুকিয়েছিল। বনের মধ্যে অগ্নিকুণ্ডের সামনে দাঁড়ানো হুড পরা মূর্তিটাকে চেনা চেনা কেন। লাগছিল, বুঝে ফেললাম। আসলে জাদুকর ক্ল্যাণ্ডরকেই দেখেছি।

রবিনকে সব জানালাম। ফারিহা কী করেছে, কীভাবে ওর পিছু নিয়ে বনে গিয়েছি, কী কী দেখেছি, কোন কথাই গোপন করলাম না।

চিন্তিত ভঙ্গিতে মাথা ঝাঁকাল রবিন। হু! তাহলে এখন কী করা যায়?

এক মুহূর্ত চিন্তা করে বললাম, আজ রাতে তোমাদের বাড়িতে ঘুমোব।

কিটু কী করে দেখতে চাও?

বুঝে ফেলেছ। মাথা ঝাঁকালাম। হ্যাঁ। রাতে যদি বেরিয়ে যায় কিটু, ওর পিছু নেব আমরা। যদি বনে ঢোকে, আমরাও ঢুকব। এভাবে জিনিস চুরি করার মানেটা কী, জানা জরুরি।

স্কুল থেকে সোজা রবিনদের বাড়িতে চলে গেলাম। মাকে ফোন করে দিলাম, রাতে আর বাড়ি ফিরছি না।

রবিনের বাবা-মা আর কিটুর সঙ্গে বসেই খেলাম আমরা। রবিনদের বাড়িতে থাকি মাঝে মাঝে, এটা নতুন কিছু নয়, তাই আঙ্কেল-আন্টি কোন প্রশ্ন তুললেন না। কিটু কারও দিকে তাকাল না। চুপচাপ খেয়ে গেল। আচরণ। অনেকটা রোবটের মত।

রাতে খাওয়ার পর রবিনের শোবার ঘরে চলে এলাম ওর সঙ্গে। না ঘুমিয়ে বসে রইলাম বিছানায়, কথা বলে সময় কাটাতে লাগলাম। আমাদের জ্যাকেটগুলো খুলে হাতের কাছেই রেখে দিয়েছি, বাইরে বেরোনোর প্রয়োজন পড়লেই যাতে সঙ্গে সঙ্গে পরে নিয়ে দৌড় দিতে পারি।

মূল্যবান জিনিস বিক্রি করে টাকা পাবে, সেজন্যই ছেলেমেয়েদের দিয়ে চুরি করায় জাদুকর, রবিন বলল।

উঁহুঁ, মাথা নাড়লাম। আমার তা মনে হয় না। যে সব জিনিস দেয়। ছেলেমেয়েরা, সেগুলো এত মূল্যবান নয় যে এর জন্য এত ঝামেলা করবে। জাদুকর। তা ছাড়া, টাকা চাইলে, শুধু শো দেখিয়েই তো বিরাট ধনী হয়ে। যেতে পারে ও।

তাহলে?

সেটাই তো রহস্য। জানতে চাই।

কিটু কোনখান দিয়ে বেরোয়, জানা নেই আমাদের

ওর ঘরের জানালা, দিয়েও বেরোতে পারে, কিংবা বাড়ির যে কোনও দরজা দিয়ে। রাত বাড়ছে। কথা বলা কমিয়ে দিলাম আমরা, যাতে কিটুর ঘরে সামান্যতম শব্দ হলেও কানে আসে আমাদের।

বালিশে পিঠ দিয়ে আধশোয়া হয়ে রইলাম। হঠাৎ পাঁজরে কনুইয়ের গুঁতো লাগতে চমকে উঠে বসলাম। আগের রাতে ভাল ঘুম হয়নি, তাই ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। রবিনের দিকে তাকালাম। ঠোঁটে আঙুল রেখে আমাকে কথা বলতে নিষেধ করল ও। ইশারায় আমাদের পিছনের দেয়ালটা দেখাল। পাশের ঘরে কিটুর নড়াচড়ার শব্দ শোনা যাচ্ছে।

নিঃশব্দে বিছানা থেকে নেমে পড়লাম আমরা। জ্যাকেট পরে নিলাম। জানালার কাছে গিয়ে পর্দা সরিয়ে উঁকি দিলাম। ঘরের দরজার কাছে গিয়ে। পাল্লায় কান ঠেকিয়ে রেখেছে রবিন, বাইরে কী হচ্ছে শোনার জন্য। দম বন্ধ করে অপেক্ষা করছি আমরা।

হঠাৎ আমার দিকে তাকিয়ে হাত নাড়ল রবিন। ছুটে গেলাম। আস্তে পাল্লাটা খুলে ফেলল ও। দরজা দিয়ে সাবধানে দুজনে মুখ বাড়ালাম বারান্দায়। কিটুর ঘরের দরজা খুলে গেছে। বেরিয়ে আসতে দেখলাম ওকে।

কিটুর পিছু নিলাম দুজনে। আরও কয়েকটা ছেলেমেয়েকে দেখলাম, একই দিকে চলেছে। বেশ খানিকটা দূরত্ব রেখে চলেছি আমরা। কেউ কারও দিকে তাকাচ্ছে না ছেলেমেয়েগুলো। মনে হচ্ছে যেন ঘোরের মধ্যে রয়েছে।

শহরের শেষ বাড়িটাও ছাড়িয়ে এলাম। বনে ঢুকে পড়ল ছেলেমেয়েগুলো। আমরাও পিছু নিলাম। চলতে চলতে গাছের ফাঁক দিয়ে আগুনের আলো নাচতে দেখে ওর হাত টেনে ধরলাম।

ওটাই সেই অগ্নিকুণ্ড, হাত তুলে দেখালাম। চলো, উল্টো দিক দিয়ে ঘুরে যাই। এদিক দিয়ে গেলে আলখেল্লা পরা লোকটা আমাদের পিছন থেকে এসে হাজির হবে। কাল আমাকে দেখেনি, তবে রোজ রোজ কপাল ভাল। না-ও হতে পারে। ওর চোখে পড়া চলবে না কোনমতে।

মাথা ঝাঁকাল রবিন।

অনেকখানি ঘুরে অগ্নিকুণ্ডের উল্টো দিকে চলে এলাম আমরা। কথা শোনা যাবে, এমন দূরত্বে একটা ঘন ঝোপের মধ্যে গা ঘেঁষাঘেঁষি করে বসলাম। আগুনের কিনারে ফারিহা আর কিটুর সঙ্গে দাঁড়ানো কয়েকটা ছেলেমেয়েকে চিনতে পারলাম। আমাদের স্কুলেই পড়ে, নীচের ক্লাসে।

পুলিশ অফিসার জন হাওয়ার্ডের ছেলে ডোরি না ওটা? রবিন জিজ্ঞেস করল আমাকে।

মাথা ঝাঁকালাম। ফিসফিস করে বললাম, হ্যাঁ।

গুনে দেখলাম, পনেরোটা ছেলেমেয়ে এসেছে। অগ্নিকুণ্ডের কিনারে গোল হয়ে দাঁড়িয়ে আছে চুপচাপ, সম্মোহিতের মত। সবার হাতেই একটা করে থলে কিংবা ব্যাগ। শুধু ফারিহার হাতে বালিশের কভার।

উপুড় হয়ে শুয়ে আছি আমরা। আগুনের এত কাছে রয়েছি, লাকড়ি পোড়ার পটপট আওয়াজও শুনতে পাচ্ছি।

হঠাৎ ধড়াস করে এক লাফ মারল আমার হৃৎপিণ্ড। গাছপালার অন্ধকার ফুড়ে কালো আলখেল্লা পরা মূর্তিটাকে বেরিয়ে আসতে দেখেছি। আগুনের কাছে এসে দাঁড়াল ও। আগুনের আভা পড়েছে হুড পরা মুখে। গ্রেট ক্ল্যাণ্ডকে চিনতে আজ আর অসুবিধে হলো না।

হিক গ্রুম ব্রুম, এক সারিতে দাঁড়াও, জাদুকর বলল। এক সারিতে ওর সামনে দাঁড়িয়ে গেল ছেলেমেয়েরা। আলখেল্লার ভিতর থেকে বড় একটা কাপড়ের থলে টেনে বের করল ক্ল্যার। মুখ খুলে বাড়িয়ে ধরল।

হিক গ্রুম ব্রুম, তোমাদের জিনিসপত্র এই থলেতে রাখো, আদেশ দিল জাদুকর। এক এক করে এগিয়ে গিয়ে সমস্ত জিনিসপত্র ওর ব্যাগে ঢালতে লাগল ছেলেমেয়েরা। একটা ছোট মেয়ে একটা মানিব্যাগ রাখল জাদুকরের থলেতে। নিজের ব্যাগ থেকে একটা সোনার চেন টেনে বের করল একটা ছেলে। কিটুর পালা এল। রবিন আর আমি দুজনেই গলা লম্বা করে তাকিয়ে আছি। আগুনের আলোয় ঝিকিয়ে উঠল রূপার প্লেটটা, তারপর অদৃশ্য হয়ে গেল জাদুকরের থলেতে। নিজের খালার রান্নাঘর থেকে প্লেটটা চুরি করে এনেছে কিটু।

ফারিহার পালা এল। বালিশের কভারের ভিতর থেকে একটা সাদা বল। বের করল ও। দেখে আর সহ্য করতে পারলাম না, লাফিয়ে উঠে বসলাম। হায় হায়, ওটা দিয়ে দিচ্ছে! আমার ক্রিকেট বলটা!

হাত ধরে টেনে আমাকে মাটিতে শুইয়ে দিল রবিন। আমার মুখ চেপে ধরল। কানের কাছে রাগত স্বরে ফিসফিস করে বলল, করছ কী, শুনে ফেলবে তো!

সরি, সামলে নিয়েছি নিজেকে। শচীন টেন্ডুলকারের অটোগ্রাফ নিয়েছিলাম ওটাতে। আমার বোন হয়ে ও এ কাজ করবে, ভাবতেই পারিনি।

সারির শেষ ছেলেটাও তার জিনিস ভরে দিল জাদুকরের থলেতে।

শয়তানি হাসি খেলে যেতে দেখলাম ক্ল্যাণ্ডরের মুখে। শীতল চোখ দুটো আগুনের আলোয় চকচক করছে। ছেলেমেয়েদের মাথার ওপর হাত উঁচু করে আদেশের সুরে বলল, হিক গ্রুম ব্রুম, আরও জিনিস চুরি করে নিয়ে এসো। আমার জন্য! আগুনের দিকে হাত নাড়ল ও। কয়েকবার ফটফট করে নিভে গেল আগুন।

সোমবার দুপুরে স্কুলের টিফিন পিরিয়ডে ক্লাসে বসে রবিনের অপেক্ষা করছি। ঘণ্টা বাজার সঙ্গে সঙ্গে ওর টিফিন বক্সটা আমার কাছে রেখে বেরিয়ে গেছে। এখনও আসছে না। খিদেয় পেট জ্বলছে আমার। থাকতে না পেরে আমার ব্যাগ থেকে একটা আপেল নিয়ে খাওয়া শুরু করলাম।

হঠাৎ একটা বই হাতে ঘরে ঢুকল ও। ভীষণ উত্তেজিত।

কাছে এসে বইটা ফেলল আমার সামনে ডেস্কের ওপর। হাঁপাতে হাঁপাতে বলল, লাইব্রেরি থেকে আনলাম।

দেখলাম, একটা ইংরেজি কবিতার বই। বই খুলে একটা কবিতা বের করে তার ওপর আঙুল চেপে ধরল ও। এটা পড়ো!

দা স্টোলেন চাইল্ড, নামটা পড়লাম আমি। বাই উইলিয়াম বাটলার ইয়েস্ট।

ইয়েস্ট না, ইয়েস্ট না, ইয়েটস! কী উল্টোপাল্টা পড়ছ! ভুরু কোঁচকাল ও। বিখ্যাত আইরিশ কবি, নোবেল পুরস্কার পাওয়া। তার এই কবিতাটা পড়েছিলাম আমি। হঠাৎ মনে পড়ল, তাই বইটার জন্য লাইব্রেরিতে চলে গিয়েছিলাম।

কী আছে এতে?

ক্ল্যাণ্ডর সমস্যার সমাধান। পড়েই দেখো না! তাগাদা দিল রবিন। পড়ো!

জোরে জোরে পড়তে লাগলাম। স্থির দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে আছে রবিন।

এ তো পরীর কবিতা, কয়েক লাইন পড়ে বললাম। এতে ক্ল্যাণ্ডর সমস্যার সমাধান দেখলে কোথায়?

আইরিশ লোককাহিনী বলে, রবিন বলল, ওখানকার রূপকথার প্রাণীরা মানুষকে যন্ত্রণা দিতে পছন্দ করে।

লেপ্রেকন জাতীয় কোন প্রাণী?

হ্যাঁ, লেপ্রেকনই! উত্তেজিত ভঙ্গিতে মাথা ঝাঁকাল রবিন। আইরিশ লেপ্রেকনরা ভীষণ পাজি। দেখতে মানুষের মত হওয়ায় খুব সহজেই মানুষের সঙ্গে মিশে যেতে পারে এরা।

পুরো কবিতাটা পড়ে ফেললাম। মুখ তুলে তাকালাম ওর দিকে

এবার বুঝলে তো? জিজ্ঞেস করল রবিন।

না, বুঝিনি। এতে বলা হয়েছে, কয়েকটা রূপকথার প্রাণী একটা মানুষের বাচ্চাকে চুরি করেছে।

এত সহজ কথাটা বুঝলে না? অধৈর্য ভঙ্গিতে হাত নাড়ল রবিন।

আইরিশরা বিশ্বাস করে, লেকেরা সুযোগ পেলেই মানুষের বাচ্চা চুরি করে নিয়ে যায়। তাদের জায়গায় চেইনজেলিং রেখে যায়।

চেইনজেলিংটা আবার কী?

নকল, নকল! যে বাচ্চাটাকে চুরি করে, তার নকল, অবিকল এক রকম দেখতে। কেউ বুঝতে পারে না, আসল বাচ্চাটা চুরি হয়ে গেছে।

তাতে লাভটা কী?

এটা লেপ্রেকনের স্বভাব, লাভ-লোকসান ওরাই জানে।

তারমানে তুমি বলতে চাইছ, জাদুকর ক্ল্যাণ্ডর আইরিশ লেপ্রেকন?

হলে অবাক হওয়ার কিছু আছে কি? রবিন বলল। ও যে সব কাণ্ড করছে, তাতে লেপ্ৰেকন মনে হওয়াটা স্বাভাবিক। যে ফারিহা আর কিটুকে দেখছি এখন আমরা, ওরা হয়তো আসল নয়।

তারমানে…চেইনজেলিং?

আমার তো তা-ই ধারণা, রবিন বলল। নিশ্চয় ক্ল্যাণ্ডর আসল বাচ্চাদের চুরি করে নিয়ে গিয়ে নকল বাচ্চা দিয়ে ভরিয়ে ফেলছে আমাদের শহরটা, ওদেরকে দিয়ে জিনিসপত্র চুরি করাচ্ছে।

ভয়ঙ্কর ব্যাপার!

হ্যাঁ, ভয়ঙ্কর ব্যাপার! আমার কথার প্রতিধ্বনি করল যেন রবিন। চোরাই জিনিসগুলো নিয়ে গিয়ে ক্ল্যাণ্ডর কী করে, সেটার জবাবও পাওয়া গেল।

কী করে?

জমিয়ে রাখে। এটাও ওদের স্বভাব। মানুষের ওপর প্রচণ্ড আক্রোশ ওদের। মানুষের বাচ্চা চুরি করে, ওদের দিয়ে ওদেরই জিনিস চুরি করায়। সেগুলো নিজের ঘরে জমিয়ে রেখে আনন্দ পায়। একটু থেমে রবিন বলল, আমাদের শহরের ছেলেমেয়েগুলোকেও ধরে নিয়ে গিয়ে ওদের জায়গায় চেইনজেলিং পাঠাচ্ছে ক্ল্যাণ্ডর। এই চেইনজেলিংরা ওর কথায় ওঠে-বসে। শহরের কেউ বুঝতেই পারছে না, আসল বাচ্চাগুলো হারিয়ে যাচ্ছে।

আমার মনে হচ্ছে এই ইয়েস্ট লোকটা তোমার মাথা খারাপ করে দিয়েছে, আমি বললাম।

ইয়েস্ট নয়, ইয়েটস! চেঁচিয়ে উঠল রবিন।

আস্তে বলো, নিচুস্বরে বললাম। সবাই তাকাচ্ছে। কিছুদূরে আরেকটা ডেস্কে বসা দুটো ছেলেকে আমাদের দিকে তাকাতে দেখে হেসে বললাম, রবিন একটা পরীর কবিতা পড়ে উত্তেজিত হয়ে গেছে। আমাদের দিক থেকে চোখ ফিরিয়ে আবার খাওয়ায় মন দিল ছেলে দুটো।

ভাল করে ভেবে দেখো, মুসা, ফিসফিস করে বলল রবিন। ফারিহাকে আলমারিতে ভরে গায়েব করে দেয়ার অনেকক্ষণ পর ফিরিয়ে এনেছে। জাদুকর। এত দেরি করল কেন? ব্যাপারটা অস্বাভাবিক লাগেনি তোমার?

তা লেগেছে, অস্বীকার করলাম না।

কেন দেরি হয়েছে, বোঝনি এখনও? ভুরু নাচাল রবিন। ওর মত দেখতে একটা চেইনজেলিং বানিয়েছে। আর তাতেই সময়টা লেগেছে ওদের।

কাদের?

জাদুকরের সহকারীদের।

ওরাও কি লেপ্রেকন?

মনে হয় না। ওর সহকারীরা নিশ্চয় নৌম কিংবা ট্রোল। এরাও রূপকথার প্রাণী। কোন মানুষের নকল বানানোয় ওস্তাদ।

.

ভাবতে ভাবতে বাড়ি ফিরলাম। রবিনের কথাগুলো কোনমতেই মন থেকে সরাতে পারছি না। ওর ব্যাখ্যাটা অদ্ভুত, অবিশ্বাস্য। কিন্তু যে অবস্থায়

আলমারি থেকে ফিরে এল ফারিহা, সেটাও তো কম অদ্ভুত নয়। দেখতে অবিকল এক রকম হলেও ও এখন ভিন্ন এক ফারিহা।

কী করব বুঝতে পারছি না। এমন একটা অদ্ভুত অবিশ্বাস্য অবাস্তব গল্প বিশ্বাস করব? মনটা খুঁতখুঁত করতেই থাকল। নাহ্, এর একটা বিহিত করতেই হবে।

বাড়ির সামনের দরজাটা বন্ধ দেখে পিছনের রান্নাঘরের দরজার দিকে এগোলাম। ওটা খোলা থাকতে পারে। এ সময় দেখতে পেলাম কুকুরটাকে। দেয়াল ঘেঁষে আরাম করে শুয়ে ঘুমাচ্ছে। ওকে দেখেই বুদ্ধিটা এসে গেল আমার মাথায়। ডাক দিলাম, জেমি! জেমি!

লাফিয়ে উঠে দাঁড়াল কুকুরটা। ঠিক আমাদের পোষা নয়, রাস্তার কুকুরই, তবে আমাদের বাড়িতে মাঝে মাঝে এসে থাকে। আঙিনায় ঘুমায়। খাবার দিলে খায়। ফারিহা নাম রেখেছে জেমি। নাম ধরে ডাকলে সাড়াও দেয় কুকুরটা। আমার দিকে তাকিয়ে উত্তেজিত ভঙ্গিতে জোরে জোরে লেজ নাড়তে লাগল। তারপর চিত হয়ে শুয়ে পা তুলে দিল আকাশের দিকে। চাইছে, আমি ওর পেট চুলকে আদর করে দিই।

এখন পারব না, কড়া গলায় বললাম। জরুরি কাজ আছে। আয় আমার সঙ্গে।

কুকুরটাকে নিয়ে ঘরে ঢুকলাম। আলমারি থেকে একটা কুকুরের গলার শিকল আর বেল্ট বের করে জেমির গলায় পরালাম। আগে একটা পোষা কুকুর ছিল আমার। রাস্তা থেকে ধরে এনেছিলাম। অসুখ হয়ে মরে গিয়েছিল কুকুরটা। বেল্ট আর শিকলটা তারই। যাই হোক, জেমি ভাবল, বেড়াতে নিয়ে যাব। দরজার দিকে দৌড় দিতে গেল। শিকল টেনে থামালাম। টেনে নিয়ে চললাম দোতলায় ওঠার সিঁড়ির দিকে।

দোতলার বারান্দা দিয়ে ফারিহার ঘরের দরজায় এসে থামলাম। থাবা দিলাম পাল্লায়। দরজা শুঁকছে জেমি। লেজ নাড়াচ্ছে।

এসো, ভিতর থেকে ডাকল একটা ভোতা নিরুত্তাপ কণ্ঠ। পাল্লাটা আমি পুরো খোলার আগেই মাথা দিয়ে ঠেলে ফাঁক করে ঘরে ঢুকে পড়ল জেমি। বিছানায় বসা ফারিহার দিকে ছুটল। তারপর হঠাৎ যেন দেয়ালে ধাক্কা খেয়ে দাঁড়িয়ে গেল। একপাশে মাথা কাত করে রাগে গরগর শুরু করল। মেঝে শুকল। আমার দিকে তাকিয়ে ঘেউ ঘেউ করে কিছু বোঝাতে চাইল। তারপর ফারিহার দিকে তাকিয়ে গজরাতে লাগল।

বই পড়ছিল ফারিহা। বইয়ের পাতা থেকে চোখ সরিয়ে জেমির দিকে তাকাল। সঙ্গে সঙ্গে ভয়ে কুঁকড়ে গেল কুকুরটা, লেজ ঢুকিয়ে দিল দুই পায়ের ফাঁকে। কুঁই কুঁই করে শিকল সহ দরজার দিকে টেনে নিয়ে চলল আমাকে, যেন পালাতে পারলে বাঁচে। এত জোরে ছুটল, আমি ওকে সামলাতে হিমশিম খেয়ে গেলাম। শেষে এক ঝাঁকিতে আমার হাত থেকে শিকলটা ছুটিয়ে নিয়ে। দিল দৌড়।

সিঁড়ি বেয়ে নেমে এসে পিছনের দরজার কাছে ওকে দেখতে পেলাম। দুই পা দিয়ে দরজা আঁচড়াচ্ছে, বাইরে বেরোনোর জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছে। আবার ওর শিকল ধরে টেনে নিয়ে চললাম। আমার সঙ্গে আর যেতে চাইছে না ও। আবার যখন দোতলায় নিয়ে চললাম, কয়েক ধাপ উঠে সিঁড়ির ওপর বসে পড়ল। অনেক টানাটানি করেও ওকে তুলতে পারলাম না।

অথচ ফারিহাকে অসম্ভব ভালবাসে জেমি। ফারিহাই বেশির ভাগ সময়। কুকুরটার সঙ্গে খেলা করে। কিন্তু এখন ওকে দেখে এতটাই আতঙ্কিত জেমি, ওর সামনে যেতেও নারাজ। আমি জানি, এমন অনেক কিছুই টের পেয়ে যায়। কুকুররা, মানুষ যা পায় না। ফারিহার চেহারা সবাইকে ফাঁকি দিলেও জেমিকে দিতে পারেনি। ওর গায়ের গন্ধ, কণ্ঠস্বর অপরিচিত লেগেছে কুকুরটার কাছে। বুঝে গেছে, ও ফারিহা নয়।

আর কোন সন্দেহ রইল না আমার। রবিনের কথাই ঠিক।

জেমিকে আবার বাইরে ছেড়ে দিলাম। বাইরে বেরিয়ে একটা মুহূর্ত আর দাঁড়াল না, দৌড়ে বেরিয়ে গেল আমাদের বাড়ির সীমানা থেকে।

ফিরে গিয়ে দোতলায় উঠলাম। ফারিহার ঘরের দরজাটা খোলা। ভিতরে উঁকি দিয়ে দেখলাম, আগের মতই বিছানায় বসে আছে ফারিহা, কোন ভাবান্তর নেই।

ফারিহা, দরজায় দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করলাম, আমার ক্রিকেট বলটা দেখেছ, শচীন টেণ্ডুলকারের সই নিয়েছিলাম যেটায়? ড্রেসারের ওপর ছিল।

বই থেকে মুখ তুলল না ফারিহার চেহারার মেয়েটা, কিংবা, আইরিশ রূপকথার চেইনজেলিংটা। জবাব দিল, না, দেখিনি। ..

কয়েক সেকেণ্ড দাঁড়িয়ে থেকে চুপচাপ দেখলাম ওকে।

কে তুমি? সাহস করে শেষে জিজ্ঞেসই করে ফেললাম। নিজের কানেই বেখাপ্পা আর কর্কশ শোনাল আমার কণ্ঠ। ধড়াস ধড়াস লাফাচ্ছে হৃৎপিণ্ডটা।

মুখ তুলে তাকাল মেয়েটা।

অস্বস্তি বোধ করতে লাগলাম।

কঠিন হাসি ছড়িয়ে পড়ল ওর মুখে। কেন, আমি তোমার খালাত বোন ফারিহা, চিনতে পারছ না??

বদলে গেছে ওর কণ্ঠস্বর। ভয় পেয়ে গেলাম। তাড়াতাড়ি ওর ঘর থেকে বেরিয়ে ছুটে এসে ঢুকলাম নিজের ঘরে। দরজা বন্ধ করে ভিতর থেকে তালা। আটকে দিলাম। বিছানায় বসে দুই হাতে মাথা চেপে ধরে ভাবতে লাগলাম, এরপর কী করব?

আমি এখন শিওর, টেলিফোনে বললাম রবিনকে, তোমার কথাই ঠিক। ওই মেয়েটা আমার বোন নয়। কিন্তু কী করব এখন? কাউকে বিশ্বাস করাতে পারব না আমাদের কথা।

আসল ছেলেমেয়েগুলোকে কোথায় লুকিয়ে রেখেছে ক্ল্যাণ্ডর জানতে হবে আমাদের, রবিন জবাব দিল। ওদের ফিরিয়ে আনতে পারলেই বিশ্বাস করবে।

একজন শয়তান জাদুকর ফারিহাকে চুরি করে নিয়ে আটকে রেখেছে, ভাবতে ভীষণ রাগ হলো আমার। ভয়ও পেলাম। যদি ইতিমধ্যেই ওর কোন ক্ষতি করে ফেলে থাকে জাদুকর!

হঠাৎ একটা বুদ্ধি এল মাথায়। বললাম, কী করে ওদের খুঁজে বের করতে হবে, বুঝে গেছি।

কী করে?

জাদুকরের ম্যাজিক আলমারিতে ঢুকতে হবে আমাকে, জবাব দিলাম।

ওপাশে দীর্ঘ নীরবতার পর রবিন বলল, সেটা করা ঠিক হবে না, মুসা। ভয়ানক বিপজ্জনক কাজ। যদি আর ফেরার পথ না থাকে তোমার?

ফেরার পথ নিশ্চয় আছে, আমি বললাম। আসল ছেলেমেয়েগুলোকে যেখানে নিয়ে যাওয়া হয়, নিশ্চয় সেখান থেকেই বেরিয়ে আসে। চেইনজেলিংরা।

হয়তো, রবিন বলল।

যদি তা-ই হয়ে থাকে, তাহলে ফেরার পথ নিশ্চয় আছে। আসল বাচ্চাগুলো যে পথে যায়, নকলগুলো ঠিক সেপথেই বেরিয়ে আসে। আমি সব জেনেশুনে তৈরি হয়ে যাচ্ছি, সাবধান থাকবযাতে আমাকে আটকে ফেলতে না পারে জাদুকর।

আবার নীরব হয়ে গেল রবিন। কয়েক মুহূর্ত পর জবাব দিল, আমার ভয় লাগছে। এ রকম ঝুঁকি নিয়ে বিপদের মধ্যে ঢাকা তোমার ঠিক হবে না।

যা হয় হোক, ওই আলমারিতে আমি ঢুকবই, জবাব দিলাম। ফারিহা, কিটু, আর যাকে যাকে নিয়ে গেছে, সবাইকে বের করে আনব। যদি আমাকে সাহায্য করতে চাও, আজ সন্ধ্যায় ক্ল্যাণ্ডরের শো শুরু হওয়ার আগেই প্যাসিফিক থিয়েটার হলের সামনে চলে এসো। যদি না আসো, একাই যাব। মোট কথা, ওই আলমারিতে ঢুকবই আমি।

তৃতীয়বারের মত চুপ হয়ে গেল রবিন। বুঝতে পারছি, কিটুর কথা ভাবছে। অবশেষে বলল, ঠিক আছে, আমি যাব।

.

শো শুরু হওয়ার বিশ মিনিট আগে থিয়েটার হলে পৌঁছলাম। টিকেট কাউন্টার থেকে দুটো টিকেট কিনলাম–একটা আমার জন্য, একটা রবিনের জন্য। বার বার ঘড়ি দেখছি আর পায়চারি করছি, ওর আসার অপেক্ষা করছি।

থিয়েটার হলের সামনের অংশটা প্রচুর আলো দিয়ে সাজানো। আমার দুই পাশ দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে হাসিখুশি অসংখ্য পরিবার, প্রায় সবার সঙ্গেই বাচ্চা ছেলেমেয়েরা রয়েছে। চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে করল : যেয়ো না, যেয়ো না, ওই ক্ল্যাণ্ডর সাধারণ ম্যাজিশিয়ান নয়–ও একটা দুষ্ট লেপ্রেকন, বিদেশী রূপকথার পাতা থেকে উঠে আসা মনস্টার, অসামান্য ক্ষমতার অধিকারী!

কিন্তু বলতে পারলাম না। জানি, কেউ আমার কথা শুনবে না। পাগল ভাববে।

থিয়েটার হলের সামনে দেয়ালে লাগানো গ্রেট ক্ল্যাণ্ডরের ছবিওয়ালা বড় বড় পোস্টার। ছবির নীচে লিখে দিয়েছে : গ্রেট ক্ল্যাণ্ডর হুডিনির চেয়ে বড় জাদুকর। ছবিটার দিকে যতটা সম্ভব কম তাকানোর চেষ্টা করলাম, তাকালে অস্বস্তি বোধ করি, ভয় বাড়ে।

আবার ঘড়ির দিকে তাকালাম। হঠাৎ আমার কাঁধে একটা হাত পড়ল। ভীষণ চমকে গিয়ে চরকির মত পাক খেয়ে ঘুরে দাঁড়ালাম।

সরি, রবিন বলল। তোমাকে চমকে দিতে চাইনি।

ওর টিকেটটা ওর হাতে ধরিয়ে দিলাম। একসঙ্গে বসব না আমরা, বুঝলে। কোনভাবেই ক্ল্যাণ্ডরের সন্দেহ জাগাতে চাই না।

দরজায় দাঁড়ানো দারোয়ানের হাতে টিকেট দিয়ে ভিতরে ঢুকলাম দুজনে। দুই পাশে ছোট ছোট তামার খুঁটি বসিয়ে ওগুলোর মাথায় ছিদ্র করে তার ভিতর দিয়ে লাল দড়ি ঢুকিয়ে বেড়া দেয়া হয়েছে, মাঝখান দিয়ে সরু রাস্তা। সেটা ধরে হেঁটে চললাম। অডিটরিয়ামের দরজার কাছে পৌঁছলাম। ভিতরে ঢুকলাম। দর্শকে ভর্তি হয়ে আছে। হাসি আর উত্তেজিত কথা শোনা যাচ্ছে চতুর্দিকে। শো শুরুর অপেক্ষা করছে সবাই। অডিটরিয়ামের চারপাশে চোখ বোলালাম। আমার বয়েসী, আমার চেয়ে ছোট-বড়, প্রায় শখানেক ছেলেমেয়ে এসেছে ম্যাজিক দেখতে। এত ছেলেমেয়ের মধ্য থেকে ক্ল্যাণ্ডরের দৃষ্টি আকর্ষণ করব কীভাবে? কী করে নিশ্চিত হব, আমাকেই ভলান্টিয়ার হিসেবে বেছে নেবে ও?

রবিনের দিকে ফিরলাম। আমাদের দুজনকেই কাজ করতে হবে। আমি গিয়ে ওকে আমাকে আলমারিতে ঢোকাতে বলব।

আর আমি? রবিন জিজ্ঞেস করল।

আমি আলমারিতে ঢুকে যাবার পর এমন কিছু করবে তুমি, যাতে আমি কাজ করার সময় পাই। ওপাশে গিয়ে কী দেখব তা তো জানি না, তবে কিছু করার জন্য সময় দরকার হবে। সেই সময়টা তুমি আমাকে করে দেবে।

এখান থেকে দুজনে আলাদা হয়ে গেলাম আমরা। সিটের মাঝখানের গলিপথ ধরে তৃতীয় সারিতে ঢুকে পড়লাম আমি। দুটো পরিবারের মাঝখানে একটা খালি সিট দেখে বসলাম। ফিরে তাকিয়ে দেখি, পিছনের সারিতে চলে গেছে রবিন। আমার দিকে তাকিয়ে মৃদু হেসে যেন অভয় দিতে চাইল।

ঘুরে তাকালাম স্টেজের দিকে। লাল মখমলের পর্দাটা ঝুলে রয়েছে। ওটার ওপাশে কোন শয়তানির খেলা চলছে আমি জানি না। গায়ে কাঁটা দিল। চারপাশের অসংখ্য হাসিখুশি মুখের দিকে তাকালাম আরেকবার।

আবার ফিরে তাকালাম, রবিন কী করছে দেখার জন্য। ওর পাশে বসা। পরিবারটার সঙ্গে ভাব জমিয়ে নিয়েছে। হাসছে, কথা বলছে। ভঙ্গি দেখে, মনে হচ্ছে যেন কতকালের চেনা।

এই সময় আলো কমতে শুরু করল। চুপ হয়ে গেল দর্শকরা। লাল পর্দার ওপর গোল একটা স্পটলাইটের উজ্জ্বল আলো পড়ল। পর্দা সরে গিয়ে শূন্য স্টেজ দেখা গেল। তারপর, স্পটলাইটের আলোর মাঝখানে ধোঁয়ার ফিতে দেখা গেল। কুণ্ডলী পাকিয়ে ওপরে উঠছে ফিতেটা। বাড়তে লাগল ধোঁয়া। মোটা হলো অনেক। এত জোরে পাক খেতে শুরু করল, যেন টর্নেডো হচ্ছে। হঠাৎ করেই সেই ধোঁয়ার ভিতর থেকে বেরিয়ে এল ক্ল্যাণ্ডর। ওর কালো আলখেল্লার কোনা উড়ছে বাতাসে। দর্শকদের ঘন ঘন হাততালি আর চিৎকার-চেঁচামেচিতে কান ঝালাপালা।

শো শুরু হলো।

নানারকম খেলা দেখাতে লাগল ক্ল্যাণ্ডর, এসব খেলা আগেও দেখেছি; প্রথম যেদিন এসেছিলাম। সেরাতে আনন্দ পেয়েছিলাম, আজ হতে লাগল রাগ।

একই রকম খেলা দেখিয়ে যাচ্ছিল ক্ল্যাণ্ডর, তবে বাধা পড়ল তাতে। বাধা দিলেন অফিসার হাওয়ার্ড। পাঁচ নম্বর সারিতে বসেছেন তিনি। উঠে দাঁড়িয়ে চ্যালেঞ্জ করে বসলেন জাদুকরকে।

এই যে, মিস্টার ক্ল্যাণ্ডর, হই-হট্টগোলের মধ্যে চেঁচিয়ে বললেন তিনি। পোস্টারে লেখা রয়েছে আপনি হুডিনির চেয়ে বড় জাদুকর।

কপালে হাত রেখে আলো আড়াল করে দর্শকদের সারির দিকে তাকাল ক্ল্যাণ্ডর। অফিসার হাওয়ার্ডের দিকে তাকিয়ে বলল, হ্যাঁ, ঠিকই লিখেছে! বাধা দেয়ায় রেগে গেছে ও।

বেশ, তাহলে দেখব এটা থেকে কী করে মুক্তি পান, একটা হাতকড়া তুলে দেখালেন হাওয়ার্ড। হাতটা আরেকটু উঁচু করলেন তিনি, যাতে সিটে বুসা দর্শকরাও হাতকড়াটা দেখতে পায়। বহু কষ্টে এটা জোগাড় করে এনেছি, পরীক্ষা করে দেখার জন্য। আজ দেখব, সত্যি আপনি হুডিনির চেয়ে। বড় জাদুকর কি না।

চেঁচাতে লাগল দর্শকরা। কেউ জোরে শিস বাজাল। কেউ জোরে পা ঠুকতে লাগল মেঝেতে। রাগত দৃষ্টিতে দর্শকদের ওপর চোখ বোলাল ক্ল্যাণ্ডর। চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করল ও।

এ তো বাচ্চাছেলের খেলা, কর্কশ কণ্ঠে বলল ক্ল্যাণ্ড।

উল্লসিত চিৎকার করে উঠল দর্শকরা। হাতকড়াটা নিয়ে স্টেজে উঠলেন অফিসার হাওয়ার্ড।

দর্শকদের দিকে পিছন ফিরে দাঁড়াল ক্ল্যাণ্ডর। দুই হাত পিছনে নিয়ে এল। ওর কব্জিতে হাতকড়া পরিয়ে তালা লাগিয়ে দিলেন হাওয়ার্ড। পকেটে রাখলেন চাবিটা। চুপ হয়ে গেছে দর্শকরা। পিনপতন নীরবতা। উত্তেজনায় কখন যে সামনে ঝুঁকে বসেছি, বলতে পারব না। আবার ঘুরে দাঁড়াল ক্ল্যাণ্ডর, দর্শকদের মুখোমুখি।

ঠোঁট নড়তে আরম্ভ করল ওর। কী বলে শোনার জন্য কান খাড়া। করলাম। বার বার একই কথা, সুর করে ছন্দের মত করে বলে গেল ও, গ্রুক ফ্রক ধ্রুম! গ্রুক ফ্রক ধ্রুম! এক ফুক ধ্রুম!

হঠাৎ ঝটকা দিয়ে হাত দুটো সামনে নিয়ে এল ক্ল্যাণ্ডর। একহাতে ধরে ঝুলিয়ে রেখেছে হাতকড়াটা। দুটো আংটাই ভোলা। দর্শকদের প্রচণ্ড চিৎকারে কানের পর্দা ফাটার জোগাড় হলো। স্তম্ভিত হয়ে গেছেন হাওয়ার্ড। শিকলটা হাতে ধরিয়ে দিয়ে স্টেজ থেকে তাঁকে নামিয়ে দিল ক্ল্যাণ্ডর। গম্ভীর মুখে সিটে ফিরে এলেন হাওয়ার্ড। চোখের বিস্ময় কাটছে না।

স্টেজের দিকে ফিরলাম। ছায়ার মধ্যে আলমারিটা দেখা যাচ্ছে এখন।

আমার পরের খেলার জন্য, দর্শকদের মাঝ থেকে আমি একজন ছোট্ট সহকারী চাই, ক্ল্যাণ্ডর বলল।

অসংখ্য হাত ঝটকা দিয়ে উঠে গেল ওপরে। সিটের সারিগুলোর বা দিকে তাকিয়ে আছে জাদুকর। ওর নজর দেখেই বুঝতে পারছি, কোন বাচ্চাটাকে পছন্দ করেছে ও। মনে হলো, শো শুরু হওয়ার আগে থেকেই বাছাই করে রেখেছিল। হাত লম্বা করে আঙুল তুলে সেদিকে নির্দেশ করল।

লাফিয়ে উঠে দাঁড়ালাম। তাড়াহুড়া করার জন্য আমার সামনের দুই সারি সিট ডিঙিয়ে স্টেজের কাছে চলে এলাম। আমার কাণ্ড দেখে কাত হয়ে। জায়গা করে দিল অবাক দর্শকরা, তবে সবাই ওরা ছোট ছেলেমেয়ে। বড়রা ধমকে উঠল। কান দিলাম না। যে ছেলেটাকে বাছাই করেছে ক্ল্যাণ্ডর, সে আসার আগেই স্টেজে উঠে ক্ল্যাণ্ডরের মুখোমুখি দাঁড়ালাম।

ভুরু কুঁচকে আমার দিকে তাকাল জাদুকর। রাগে বাঁকা হয়ে গেছে। ঠোঁটের দুই কোণ। এই ছেলে! হিসিয়ে উঠল ও। ওর গরম নিঃশ্বাস লাগল আমার গলায়। আমি তো তোমাকে ডাকিনি। ভাল চাও তো সিটে ফিরে যাও।

বিশাল হলঘর জুড়ে আবার পিনপতন নীরবতা।

না, সার, ফিসফিস করে বললাম, আমি আপনার সহকারী হব! পিছনের দর্শকদের সারি থেকে হাততালি শোনা গেল। ফিরে তাকিয়ে দেখার চেষ্টা করলাম। উজ্জ্বল আলোর ভিতর দিয়ে দেখা কঠিন। কপালে হাত তুলে আলো আড়াল করে দেখলাম, হাততালি দিচ্ছে রবিন। চেঁচিয়ে সুর করে বলল ও, মুসা তুমি এগিয়ে চলো! আমরা আছি তোমার সাথে! ওর পাশে বসা পরিবারটাও ওর সঙ্গে গলা মেলাল। আরও অনেকেই গলা মেলাল, একইসঙ্গে হাততালি দেয়া শুরু করল। কয়েক সেকেণ্ডের মধ্যে সমস্ত দর্শকরাই যেন আমার পক্ষে চলে এল। আমাকে নিতে অনুরোধ করছে জাদুকরকে।

আমার দিকে তাকিয়ে ভ্রুকুটি করল ক্ল্যাণ্ডর। আমাকে ভলান্টিয়ার হিসেবে নিতে রায় দিয়েছে দর্শকরা। না নিয়ে আর উপায় নেই ওর। রাগে হিসিয়ে উঠে ফিসফিস করে বলল, কীসের মধ্যে ঢুকতে যাচ্ছ, জানো না তুমি। বেশ, এতই যখন ইচ্ছে, তোমাকেই নিলাম। দর্শকদের দিকে তাকিয়ে হাসল ও। কিন্তু ওই হাসির আড়ালে ওর অস্বস্তিটা টের পেলাম আমি।

আলমারিটা স্পটলাইটের নীচে টেনে আনল ক্ল্যাণ্ডর। দরজা খুলে আগের দিনের মতই দর্শকদের দেখাল ভিতরে কিছু নেই। থাবা দিয়ে বোঝাল, নিরেট কাঠ।

আমার পাশে এসে দাঁড়াল। দর্শকদের শুনিয়ে আমাকে বলল, অন্ধকারকে নিশ্চয় ভয় পাও না তুমি, তাই না?

মাথা নাড়লাম।

দর্শকদের হাসি শোনা গেল। কে একজন বলল, সাহস আছে। ছেলেটার।

আমি কোনদিকে তাকাচ্ছি না, সোজা তাকিয়ে আছি ক্ল্যাণ্ডরের চোখের দিকে। আমি আপনাকে ভয় পাই না, নিচুস্বরে বললাম।

দীর্ঘ একটা মুহূর্ত আমার দিকে তাকিয়ে রইল ও। মনে হলো, আমি যে ওর গোপন কথা সব জানি, সেটা যেন বুঝে গেছে। একটা ভুরু উঁচু করল। তোমাকে বিদেয় করাটা সত্যিই এখন জরুরি হয়ে পড়েছে, ইয়াং ম্যান। জ্বলন্ত চোখে আমার দিকে তাকিয়ে ফিসফিস করে বলল ও।

লাল আলমারিটার কাছে আমাকে টেনে নিয়ে গেল ক্ল্যাণ্ডর। হঠাৎ করেই হাঁটু কাঁপতে শুরু করল আমার, তবে আমি যে ভয় পেয়েছি ওকে সেটা বুঝতে দিলাম না। আলমারিতে ঢুকে দরজার দিকে ঘুরে দাঁড়ালাম। ভিতরটা বেশ গরম। করাতের গুঁড়ো আর আঠার ঝাঁঝাল গন্ধ।

ক্ল্যাণ্ডরের চোখের দিকে তাকালাম না, সম্মোহিত হওয়ার ভয়ে। দর্শকদের দিকে তাকিয়ে রইলাম। মেঝে থেকে উঠতে আরম্ভ করল আলমারিটা। মনে হলো, এলিভেটরে চড়ছি। দুরুদুরু করছে বুকের ভিতর। হৃৎপিণ্ডটা লাফাচ্ছে। রবিনের দিকে তাকালাম। সাদা হয়ে গেছে ওর মুখ। ঠোঁট কামড়ে ধরেছে। Obr

তারপর, দড়াম করে বন্ধ হয়ে গেল দরজাটা। গাঢ় অন্ধকারে নিমজ্জিত হলাম।

মনে হতে লাগল, গভীর অন্ধকার মহাশূন্য থেকে নীচে পড়ছি আমি। কানের পাশে বাতাসের শোঁ-শোঁ শব্দ। গর্জন করে বয়ে চলেছে যেন ঝোড়ো বাতাস।

ধুপ করে পড়লাম পাথরের মেঝেতে। আমাকে ঘিরে পাক খেতে লাগল ঘন কুয়াশা। দুই কব্জি চেপে ধরল ঠাণ্ডা দুটো হাত। টানাটানি করে ছাড়ানোর চেষ্টা করলাম। পারলাম না। মনে হচ্ছে বরফ-শীতল সাঁড়াশি দিয়ে চেপে ধরা হয়েছে আমার হাত দুটো টেনে খাড়া করল আমাকে। কুয়াশা সরে যাচ্ছে। আলো চোখে পড়ল। অন্ধকার একটা পাথরের সুড়ঙ্গে রয়েছি আমি। দুই দেয়ালে লাগানো মশাল জ্বলছে। যেন প্রাচীন কোনও সময়ে চলে এসেছি।

আমার দুই পাশে প্রায় গায়ের ওপর চেপে রয়েছে দুটো প্রাণী। আমার চেয়ে খাটো। কিন্তু অনেক বেশি চওড়া কাঁধ, ভারি শরীর, গরিলার মত হাতের মস্ত ঠাণ্ডা থাবা দুটোতে প্রচণ্ড শক্তি। পরনে কালো কাপড়ের পোশাক। গল্পের বইয়ে এ রকম প্রাণীর ছবি দেখেছি। আইরিশ রূপকথার দুষ্ট নৌম কিংবা ট্রোল-এর ঠিক কোনটা ওরা, বুঝতে পারলাম না। অদ্ভুত, দুর্বোধ্য, বিচিত্র ভাষায় পরস্পরের সঙ্গে কথা বলছে, একটা বর্ণও বুঝলাম না। কথা। বলার সময় ঘোঁৎ-ঘোৎ আর চি-চি শব্দ বেরোচ্ছে গলা থেকে।

হাত ছাড়ানোর জন্য আবার ধস্তাধস্তি শুরু করলাম। ব্যর্থ হলাম এবারও। অন্ধকার সুড়ঙ্গ দিয়ে আমাকে টেনে-হিঁচড়ে নিয়ে চলল ওরা। ইস্পাতের তৈরি একটা বন্ধ দরজার সামনে এনে দাঁড় করাল। আড়াআড়ি লোহার ডাণ্ডা লাগিয়ে রাখা হয়েছে দরজাটায়। দুই পাশে দেয়ালে গাঁথা দুটো মশাল জ্বলছে।

বিড়বিড় করে কী যেন বলল একটা প্রাণী। আলিবাবার গুহার দেয়ালের মত আপনাআপনি খুলে গেল দরজাটা। মস্ত একটা গুহায় আমাকে টেনে ঢোকাল প্রাণী দুটো। গুহাটা মশালের আলোয় আলোকিত। চারপাশের দেয়াল ঘেঁষে অনেকগুলো ছেলেমেয়েকে দেখলাম, শিকল দিয়ে বাঁধা। ভীত, ক্লান্ত দেখাচ্ছে ওদের। দেয়ালের কাছে একটা খালি জায়গায় আমাকে টেনে নিয়ে গেল প্রাণী দুটো, দেয়ালে গাঁথা আংটা থেকে লোহার শিকল ঝুলছে। এখানে।

হঠাৎ মুসা ভাইয়া, মুসা ভাইয়া! ডাক শুনলাম। কাঁধের ওপর দিয়ে ঘাড় ঘুরিয়ে ফিরে তাকালাম। ফারিহাকে দেখতে পেলাম। পরনে এখনও সেই লাল রঙের টি-শার্ট। অন্য ছেলেমেয়েগুলোর মতই পাথরের দেয়ালের সঙ্গে শিকল দিয়ে বাঁধা রয়েছে ও। চোখ থেকে পানি গড়িয়ে পড়ছে। আরও একবার ধস্তাধস্তি করে প্রাণী দুটোর হাত থেকে ছোটার চেষ্টা করলাম। লাভ হলো না।

আমার কব্জি আর গোড়ালিতে আংটা পরিয়ে আটকে দিল প্রাণী দুটো। তারপর পিছিয়ে গিয়ে দীর্ঘ সময় ধরে তাকিয়ে রইল আমার দিকে। বুঝলাম, ভালমত দেখে নিচ্ছে আমাকে, আমার চেহারার চেইনজেলিং বানানোর জন্য। বানানোর পর আমার নকলটাকে বের করে দেবে জাদুকরের আলমারির ভিতর দিয়ে। আর সেটা দেখে হাততালি দেবে দর্শকরা। লেপ্রেকনের শয়তানি কিছুই বুঝতে পারবে না।

বড় দরজাটা দিয়ে গুহা থেকে বেরিয়ে গেল প্রাণী দুটো। ঝনঝন শব্দে বন্ধ হয়ে গেল দরজা। ফারিহার দিকে তাকালাম।

কিছু একটা করো, মুসা ভাইয়া, কাতরকণ্ঠে অনুরোধ করল ফারিহা। বাঁচাও আমাদের!

গুহার চারপাশে চোখে বোলালাম। আতঙ্কিত কিটুকেও দেখলাম। বনের ভিতর অগ্নিকুণ্ডের কাছে এদেরকে-না না, এদের চেইনজেলিংকে দেখেছি। মশালের আলোয় প্রতিটি ছেলেমেয়ের মুখের দিকে তাকালাম। রকি বিচ থানার অফিসার জন হাওয়ার্ডের ছেলে ডোরিকে চিনতে পারলাম।

টানাটানি করে শিকল খোলার চেষ্টা করলাম। ব্যথাই পেলাম শুধু, কিছুই করতে পারলাম না। দেয়ালে বাড়ি খেয়ে ঝনঝন শব্দ তুলল লোহার শিকল।

ভাবছি, রবিন এখন কী করছে?

১০

শো প্রায় শেষ। আর একটা কী দুটো খেলা দেখানোর পর আলমারি দিয়ে মুসার চেইনজেলিংটাকে বের করবে জাদুকর–ভাবছে রবিন। জাদুকরকে দেরি করানোর জন্য কিছু একটা করা দরকার। উঠে দাঁড়াল ও। অডিটরিয়াম থেকে বেরিয়ে এসে দড়ির বেড়া দেয়া সরু রাস্তাটায় অস্থির ভঙ্গিতে পায়চারি করতে লাগল। ভাবনার ঝড় বইছে মাথায়। গলার ভিতরটা শুকিয়ে গেছে। একটা কোকটোক পেলে ভাল হতো। এদিক ওদিক তাকিয়ে একটা ড্রিংকের স্টল দেখে সেদিকে এগোল। ড্রিংক খেতে খেতে দেখল, স্টলের পাশে একটা দরজার গায়ে লেখা : সর্বসাধারণের প্রবেশ নিষেধ।

দরজার নবে মোচড় দিল রবিন। তালা নেই। ফিরে তাকিয়ে দেখল, কেউ দেখছে কি না। না, কেউ তাকাচ্ছে না ওর দিকে। আস্তে করে পাল্লা ঠেলে খুলে দ্রুত চলে এল ভিতরে। টেনে লাগিয়ে দিল আবার পাল্লাটা।

লম্বা একটা করিডর দেখতে পেল ও। বাতিল জিনিসপত্রে ঠাসা–পুরানো বালতি, ঝাড়, ব্রাশ, রঙের টিন, এসব। একটা মইয়ের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় দেখল, ওপরে স্পটলাইট নিয়ন্ত্রণ করছে একজন লোক। ওখানে না থেমে করিডর ধরে এগিয়ে চলল ও। চলে এল স্টেজের পিছন দিকে।

এই, কে তুমি? জিজ্ঞেস করল একটা কণ্ঠ। পাক খেয়ে ঘুরে গেল রবিন। শ্রমিকের পোশাক পরা বিশালদেহী একজন লোককে ভুরু কুঁচকে তাকিয়ে থাকতে দেখল ওর দিকে। এখানে আসার অনুমতি কে দিল তোমাকে?

আ-আমি ট-ট-ট-ট-ট্রম! তুতলে জবাব দিল রবিন। অন্ধকারে ঢিল ছুঁড়ল, আপনাদের ইলেকট্রিশিয়ানের ছেলে।

রুক্ষকণ্ঠে লোকটা বলল, কিন্তু ওর কোন ছেলে আছে বলে তো জানতাম না, কখনও বলেনি। যাকগে, কোন কিছুতে হাত দেবে না, বুঝলে?

স্টেজের পিছনে দাঁড়িয়ে ক্ল্যাণ্ডরকে দেখতে পাচ্ছে রবিন। শেষ খেলাটার আগের খেলাটা দেখাচ্ছে এখন ও। শো শেষ হতে আর মাত্র কয়েক মিনিট বাকি।

কী করা যায় ভাবছে ও। একপাশে একটা মোটরের মত যন্ত্র চোখে পড়ল ওর। ওটার সঙ্গে লাগানো কয়েকটা দাঁতওয়ালা চাকা। ওগুলো গিয়ার, বুঝতে পারল ও। একটা গিয়ারের কেন্দ্রে ঢোকানো লোহার ডাণ্ডায় পেঁচানো দড়ির অন্য মাথাটা পুলির ওপর দিয়ে চলে গেছে ছাতের দিকে। দড়িটা কোথায় গিয়ে শেষ হয়েছে গলা বাড়িয়ে দেখার চেষ্টা করল রবিন। আবার ফিরে তাকাল মোটরটার দিকে।

কোমর থেকে বেল্টটা খুলে নিয়ে লেজের দিকটা দুটো চাকার দাঁতের ফাঁকে খাড়া ঢুকিয়ে দিল। তারপর টান মারল মোটরের একটা লিভার ধরে। গুঞ্জন তুলে চালু হয়ে গেল মোটর, ঘুরতে শুরু করল পুলি, স্টেজের ওপর নেমে যেতে থাকল লাল পর্দাটা। খেলা দেখাতে দেখাতে আচমকা থেমে গেল ক্ল্যাণ্ড। পর্দার দিকে তাকিয়ে আছে অবাক হয়ে। বেল্টের চামড়া ছেঁড়ার শব্দ হলো। দাঁতগুলো আটকে গিয়ে ঘোরা বন্ধ করে দিল। ওদিকে মোটর চলছে। পোড়া গন্ধ আর ধোঁয়া বেরোতে লাগল মোটর থেকে। স্টেজের তিন-চার ফুট ওপরে এসে থেমে গেল পর্দার ঝুল।

ফিরে তাকাতে রবিনের ওপর চোখ পড়ল ক্ল্যাণ্ডরের। প্রচণ্ড রাগে চেঁচিয়ে উঠল, জলদি পর্দা তোলো!

ধাক্কা দিয়ে রবিনকে সরিয়ে দিল শ্রমিকের পোশাক পরা লোকটা। উল্টো দিকে ঠেলে দিল মোটরের লিভার। কঁকি দিয়ে বন্ধ হয়ে গেল মোটর।

আটকে গেছে, ক্ল্যাণ্ডকে জানাল ও। এই ছেলেটা কিছু করেছে… কোন ছেলেটা দেখাতে গিয়ে ফিরে তাকাল লোকটা। রবিনকে দেখল না। ও ততক্ষণে সরে পড়েছে।

অডিটরিয়ামে ফিরে রবিন দেখল, পর্দা সরিয়ে স্টেজের এপাশে বেরিয়ে। আসছে ক্ল্যাণ্ড। হট্টগোল করতে থাকা দর্শকদের উদ্দেশ্যে হাত তুলে বলল, প্লিজ, লেডিজ অ্যাণ্ড জেন্টলম্যান, আপনারা শান্ত হোন। একটা যান্ত্রিক গোলযোগ ঘটেছে। এখনই ঠিক হয়ে যাবে। প্লিজ, শান্ত হোন আপনারা।

পর্দার ঝুল উঁচু করে আবার ওপাশে চলে গেল ক্ল্যাণ্ডর।

১১

গুহার দেয়াল ঘেঁষে তখন শিকলে আটকে রয়েছি আমি, ওপরে অডিটরিয়ামে যে এত কিছু ঘটছে, তার কিছুই জানি না। হঠাৎ করেই আবার খুলে গেল গুহার ইস্পাতের দরজাটা। সেই প্রাণী দুটো ঢুকল। ওদের পিছন পিছন আসছে আরেকজন। কে, দেখতে পাচ্ছি না। কাছে আসার পর যখন আমার দৃষ্টিপথ থেকে সরে দাঁড়াল প্রাণী দুটো, তখন দেখলাম, অবিকল আমার মত দেখতে একটা ছেলে দাঁড়িয়ে আছে। একেবারে আয়নায় দেখা আমার প্রতিরিম্বের মত!

বার বার আমার দিকে আর আমার চেইনজেলিংটার দিকে তাকাচ্ছে প্রাণী দুটো। মিলিয়ে নিচ্ছে কোথাও কোন অমিল আছে কি না। বিড়বিড় করে নিজেদের মধ্যে দুর্বোধ্য ভাষায় কথা বলছে। এপাশ থেকে, ওপাশ থেকে, সমস্ত দৃষ্টিকোণ থেকে আমাকে দেখার পর নকল ছেলেটাকে নিয়ে আবার বেরিয়ে গেল ওরা। সম্ভবত, যেসব জায়গায় খুঁত রয়েছে সেসব মেরামত করতে। নাকি সন্তুষ্ট হয়ে ফিরে গেছে ওটাকে আলমারি দিয়ে বের করে দেয়ার জন্য? তা হলে তো মরেছি!

তাড়াতাড়ি কিছু একটা করতে বলছে আমাকে ফারিহা। ওর সঙ্গে গলা মিলিয়ে বাকি ছেলেমেয়েগুলোও ওদেরকে মুক্ত করতে অনুরোধ করছে। ওদের মধ্যে বয়েসে বড় আমি। একমাত্র আমিই এখন ওদের আশা-ভরসা। আবার শিকলের আংটা খোলার চেষ্টা করলাম। কিন্তু এত শক্ত শিকল ছেঁড়া সম্ভব হলো না। প্রাণী দুটো আর আসছে না। ক্রমেই দমে যাচ্ছি। মনে হচ্ছে, আলমারিতে ঢুকে ভুল করেছি। অন্যদের সঙ্গে আমিও আটকা পড়েছি লেপ্রেকনের কারাগারে। আর কোনদিন বেরোতে পারব না এই বন্দিশালা থেকে!

আমার বাবাকে বলে গিয়ে, কেঁদে উঠে বলল একটা ছেলে। আমাকে এসে নিয়ে যাক! চোখ তুলে তাকালাম। ডোরি। অফিসার হাওয়ার্ডের ছেলে। আমার বাবাকে গিয়ে বলো, প্লিজ!

খুব খারাপ লাগছে আমার। বেরিয়ে গিয়ে ওর বাবাকে খবর দেয়াটা যে এত সহজ নয়, বুঝতেই পারছে না ছেলেটা। ও জানে না, এ মুহূর্ত অডিটরিয়ামে বসে অন্য দর্শকদের সঙ্গে ম্যাজিক শো উপভোগ করছেন ওর বাবা। তার ছেলে যে নিখোঁজ হয়েছে, ঘুণাক্ষরেও বুঝতে পারেননি। বরং যে লোকটা তার ছেলেকে গায়েব করে দিয়েছে, তার জাদুর খেলা দেখে উচ্ছ্বসিত হয়ে হাততালি দিয়ে নিশ্চয় অভিনন্দন জানাচ্ছেন।

অফিসার হাওয়ার্ডের কথা ভাবতে হঠাৎ করেই বুদ্ধিটা মাথায় এল আমার। জাদুকরের হাতে শিকল পরিয়ে দিয়েছিলেন তিনি। মন্ত্র পড়ে শিকলের তালা খুলে ফেলেছিল ক্ল্যাণ্ডর। ও বলছিল: গ্রুক ফুক ধ্রুম! গ্রুক ফুক ধ্রুম! গ্রুক ফুক ধ্রুম!

জোরে জোরে সুর করে বললাম কথাগুলো। সঙ্গে সঙ্গে কাঁপতে শুরু করল আমার হাত-পায়ের কড়াগুলো। গরম হয়ে গেল।

আবার বললাম; গ্রুক ফুক ধ্রুম! গ্রুক ফুক ধ্রুম! গ্রুক ফুক ধ্রুম! খসে পড়ে গেল কড়াগুলো। আমি এখন মুক্ত।

ফারিহার কাছে দৌড়ে এলাম। চেঁচিয়ে বললাম, বলো, গ্রুক ফ্রক ধ্রুম? বার বার বলতে থাকো। অ্যাই, সবাই তোমরা সুর করে বলো কথাগুলো। বলে যাও, যতক্ষণ না কড়া খোলে।

অনেকগুলো কণ্ঠ সুর করে গেয়ে উঠল, এক ফ্রক ধ্রুম! গ্রুক ফ্রক ধ্রুম! এক ফুক ধ্রুম!

মুক্ত হয়ে গেল সবাই। আমাকে জড়িয়ে ধরল ফারিহা। ওর চোখে পানি। আমাকে ঘিরে নাচতে শুরু করল ছেলেমেয়ের দল। আনন্দে হই-হই করতে লাগল। দরজার কাছে ছুটে গেলাম। খোলার চেষ্টা করলাম। পারলাম না। এ সময় বাইরে পায়ের আওয়াজ শুনলাম। ক্রমেই কাছে। আসছে।

অ্যাই, সবাই যার যার জায়গায় গিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ো! যে যেখানে বাঁধা ছিলে! জলদি! এমন ভান করে থাকো, যেন এখনও শিকলে বাঁধা রয়েছ। আমি না বলা পর্যন্ত কেউ জায়গা থেকে নড়বে না, কেউ কোন কথা বলবে না। যাও!

সবাই দৌড়ে গিয়ে দেয়াল ঘেঁষে দাঁড়াল। দুই হাত পিছনে। সবাই উত্তেজিত। মুক্তির আনন্দে অস্থির। ব্যাপারটা এখন প্রাণী দুটো লক্ষ না করলেই হয়!

ফারিহা, ডেকে বললাম। আমি তোমার দিকে তাকিয়ে মাথা ঝাঁকানোর সাথে সাথে চেঁচানো শুরু করবে, যত জোরে পারো, বুঝলে?

মাথা ঝাঁকিয়ে সায় জানাল ও।

খুলে গেল দরজাটা। প্রাণী দুটো ঘরে ঢুকল, ছেলেটাকে নিয়ে। অবিকল আমার মত দেখতে। কোন খুঁত বের করতে পারলাম না। এমনকী কাপড় চোপড়গুলোও আমারগুলোর মত। চেঁচিয়ে উঠল ফারিহা।

ভয় নেই, চুপ করে থাকো, আমি বললাম।

আমার সামনে এসে দাঁড়াল প্রাণী দুটো। চেইনজেলিংটাকে দাঁড় করাল আমার পাশে। একবার আমার দিকে একবার চেইনজেলিংটার দিকে তাকিয়ে কোথাও কোন অমিল আছে কি না বোঝার চেষ্টা করছে ওরা। নিজেদের কাজে সন্তুষ্ট মনে হলো ওদের। বিড়বিড় করে দুর্বোধ্য ভাষায় কথা বলছে দুজনে। ওদের কাঁধের ওপর দিয়ে ফারিহার দিকে তাকালাম। ইশারা করল ও।

মাথা ঝাঁকিয়ে ইঙ্গিত করলাম। আর সঙ্গে সঙ্গে এমন এক বিকট চিৎকার দিল ও, আমি পর্যন্ত চমকে গেলাম। পাথরের দেয়ালে প্রতিধ্বনি তুলল সে-চিৎকার। চোখ-মুখ কুঁচকে ফেলল প্রাণী দুটো। ফারিহার দিকে

ফিরে তাকাল। চেঁচিয়েই চলল ফারিহা। কী হয়েছে বোঝার জন্য ওর দিকে ঘুরে দাঁড়াল প্রাণী দুটো। আমার ইচ্ছে সফল হলো। কাত হয়ে চেইনজেলিংটার কানে কানে হিক গ্রুম ব্রুম, নিজের হাতে শিকল লাগাও! [ঠিকই আছে এখানে] বলে সরে গেলাম। সামান্যতম দ্বিধা না করে আমার জায়গাটায় সরে এসে নিজের হাতে কড়া লাগিয়ে দিল ওটা।

এতক্ষণে চিৎকার থামাল ফারিহা। পরস্পরের দিকে তাকিয়ে বিড়বিড় করে কী বলল প্রাণী দুটো, তারপর আমাদের দিকে ঘুরল। একবার আমার। মুখের দিকে, একবার চেইনজেলিংটার মুখের দিকে তাকাতে লাগল। দুরুদুর করছে আমার বুকের ভিতর। ভয় পাচ্ছি, ধরা না পড়ে যাই। কিন্তু কিছু বুঝতে পারল না ওরা। সন্তুষ্ট হয়ে আমাকে নিয়ে দরজার দিকে রওনা হলো।

দুজনের পিছনে রয়েছি আমি। ফিরে তাকিয়ে দেখলাম, আমার দিকে তাকিয়ে রয়েছে সবাই। ঠোঁটে আঙুল রেখে ওদের কথা বলতে নিষেধ করলাম। দরজার কাছে পৌঁছে দরজাটা খুলল প্রাণী দুটো। ওদের পাশ কাটিয়ে বাইরে চলে এলাম। একটানে দরজার পাশের দেয়াল থেকে খুলে নিলাম একটা মশাল। জ্বলন্ত দিকটা ওদের মুখের কাছে ঠেলে দিলাম।

চেঁচিয়ে উঠে গুহার ভিতর পিছিয়ে গেল প্রাণী দুটো।

এসো তোমরা! ছেলেমেয়েদের উদ্দেশ্যে চেঁচিয়ে বললাম। জলদি বেরিয়ে এসো!

একদৌড়ে দরজার কাছে চলে এল ওরা। যতক্ষণ না সবাই সুড়ঙ্গে বেরোল, আগুন দেখিয়ে ঠেকিয়ে রাখলাম প্রাণী দুটোকে।

দৌড়াও! থেমো না! ছেলেমেয়েদের বললাম। আমি তোমাদের পিছনেই আসছি!

ফিরে তাকালাম আমার চেইনজেলিংটার দিকে। শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে ওটা, ভাবলেশহীন মুখ। ওই জায়গাটায় এখন আমার থাকার কথা, আর ওটা চলে যেত জাদুকরের আলমারি দিয়ে বেরিয়ে, আমাদের বাড়িতে ভেবে শিউরে উঠলাম!

প্রাণী দুটোকে গুহার মধ্যে শিকলে আটকে রেখে যেতে পারলে খুশি হতাম। কিন্তু ভিতরে ঢুকলেই যদি দরজাটা বন্ধ করে দেয় ওরা, আর খুলতে পারব না। তাই ঝুঁকি নিলাম না। ওদের দিকে মুখ করে পিছিয়ে যেতে থাকলাম সুড়ঙ্গ ধরে। আগুনের ভয় দেখিয়ে ওদের কাছে আসতে দিচ্ছি না। রাগে বিড়বিড় করে দুর্বোধ্য ভাষায় কিছু বলছে ওরা, বোধহয় আমাকে গালি দিচ্ছে। দিক। বুঝতেও পারছি না। আর পারলেও মাথা ঘামাতাম না। আমার এখন একটাই উদ্দেশ্য, এখান থেকে বেরিয়ে যাওয়া।

সুড়ঙ্গের শেষ মাথায় পৌঁছে দেখলাম, আমার জন্য অপেক্ষা করছে ছেলেমেয়ের দল। হাসি চলে গেছে সবার মুখ থেকে। আবার ভীত হয়ে পড়েছে ওরা। কারণ, সুড়ঙ্গের মুখ বন্ধ!

ভয় পেয়ো না, কাঁধের ওপর দিয়ে ফিরে তাকিয়ে সাহস জোগালাম ওদের। এখান থেকে বেরিয়ে যাবই আমরা, যে করেই হোক!

ঠিক এ সময় ধোঁয়া দেখা গেল। সবাইকে ঘিরে পাক খেয়ে ঘুরছে। কী ঘটছে, বুঝলাম। সুড়ঙ্গের মুখ খুলে দিয়েছে জাদুকর। চেইনজেলিংকে আলমারিতে ঢোকার পথ করে দিচ্ছে। যা করার তাড়াতাড়ি করতে হবে এখন আমাকে!

আচমকা জ্বলন্ত মশালটা প্রাণী দুটোর দিকে ছুঁড়ে দিলাম। ভয়ে লাফ দিয়ে পিছিয়ে গেল ওরা। দৌড় দিলাম সামনে। পিছনে ছুটন্ত পায়ের শব্দ। নিশ্চয় আমাকে ধরতে আসছে প্রাণী দুটো। সামনে ছেলেমেয়েগুলোকে দেখা যাচ্ছে না আর। ধোঁয়ার ভিতর অদৃশ্য হয়েছে। আমিও কোন দিকে না তাকিয়ে ঝাঁপ দিলাম তাতে।

পায়ের নীচে মাটি নেই। মনে হলো শূন্যে উড়ছি। হাত-পা ছুঁড়তে ছুঁড়তে কোথায় যে পড়ছি, কে জানে! এক সময় করাতের গুড়ো আর আঠার। আঁঝাল গন্ধ নাকে এল। বুঝলাম, আলমারিতে ফিরে এসেছি। অনেকগুলো ছেলেমেয়ের সঙ্গে আমিও জড়াজড়ি করতে লাগলাম বদ্ধ জায়গাটায়। ছোট একটা আলমারিতে এতজনের জায়গা হলো কী করে, ভেবে অবাক লাগল।

ঝটকা দিয়ে খুলে গেল আলমারির দরজা। কুয়াশার ভিতর দিয়ে উজ্জ্বল। আলো এসে চোখে লাগল। ধোঁয়ার মত গলগল করে খোলা দরজা দিয়ে। বেরোতে লাগল কুয়াশা। স্টেজের কয়েক ফুট ওপরে শূন্যে ভেসে রয়েছে আলমারিটা। চিৎকার-চেঁচামেচি করে ওপর থেকেই স্টেজে লাফিয়ে পড়তে শুরু করল ছেলেমেয়েরা। দল বেঁধে আমাদেরকে বেরোতে দেখে হাততালিতে ফেটে পড়ল দর্শকরা। হল জুড়ে প্রচণ্ড হট্টগোল। চারদিকে ছুটোছুটি করছে ছেলেমেয়েরা। চেঁচাচ্ছে। হাসছে। লাফাচ্ছে। নিরাপদে আবার পরিচিত পৃথিবীতে ফিরে আসার আনন্দে অস্থির।

ভয়ঙ্কর দৃষ্টিতে ওদের দিকে তাকিয়ে আছে ক্ল্যাণ্ডর। সবার শেষে আলমারি থেকে বেরোলাম আমি। দর্শকদের হাততালি আর হট্টগোল আরও বেড়ে গেল। আমার দিকে ছুটে এল জাদুকর। চোখে চোখে তাকিয়ে রইল। শক্ত করলাম নিজেকে। চোখ সরালাম না। দাঁত খিচাল একবার ক্ল্যাণ্ডর। তারপর ধাক্কা দিয়ে আমাকে সরিয়ে লাফ দিয়ে উঠে পড়ল আলমারিতে। ভিতর থেকে টান দিয়ে দড়াম করে দরজা লাগাল।

তাকিয়ে আছি। দুলতে শুরু করল আলমারিটা। গুমগুম শব্দ আসছে ভিতর থেকে। দুলতে দুলতে ওপরে উঠে গেল ওটা। ঘুরতে লাগল। কালো ধোঁয়া বেরোচ্ছে ছাত থেকে। গা থেকে বৈদ্যুতিক ফুলিঙ্গের মত আলোর কণা বেরিয়ে ছরছর করে স্টেজের ওপর পড়ছে। ক্রমেই ঘোরার গতি বাড়ছে আলমারিটার। কালো ধোঁয়া! ফুলিঙ্গ! সব কিছুর মাঝে ঝাপসা লাল রঙটা বন্ করে ঘুরছে!

পিছিয়ে এলাম। অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে দর্শকরা। সবার চোখ এখন গুঞ্জন তুলে ঘুরতে থাকা আলমারিটার দিকে। হট্টগোল থেমে গেছে।

ঘুরতে ঘুরতে একসময় মিলিয়ে গেল আলমারিটা। রয়ে গেল শুধু কালো ধোঁয়ার কুণ্ডলী। পাক খেয়ে উড়তে উড়তে ছাতের দিকে চলে গেল।

এরপরও বেশ কিছুক্ষণ নীরব হয়ে রইল দর্শকরা। তারপর হঠাৎ করেই লাফিয়ে উঠে আবার করতালি আর চিৎকার-চেঁচামেচিতে ফেটে পড়ল। এমন ম্যাজিক জীবনে দেখেনি কেউ!

সিটের সারির গলিপথ ধরে আমার দিকে দৌড়ে আসতে দেখলাম রবিনকে। মুখে হাসি ছড়িয়ে পড়েছে।

অ্যাই, তোমার নাম কী? কাছে এসে জিজ্ঞেস করল ও।

মুসা।

এবার বলো, আমার নাম কী?

হেসে বললাম, আর পরীক্ষা করতে হবে না, রবিন! আমি চেইনজেলিং নই, তোমার বন্ধু, মুসা। আমি আসল না হলে আমাকে দেখে পালাত না জাদুকর!

মাথা দোলাল রবিন। তা ঠিক।

.

পরদিন স্থানীয় খবরের কাগজে এই ম্যাজিক শো নিয়ে খবর বেরোল। বড় বড় হেডলাইন দিয়ে ক্ল্যাণ্ডরের প্রশংসা করে বেশ ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে প্রথম পৃষ্ঠাতে খবরটা ছেপেছে। শেষ কথা লিখেছে : দুঃখের বিষয় হলো, আজকের শো-টা অনিশ্চিত হয়ে পড়ল। হাজার হাজার টাকার টিকিট বিক্রি করে মাথায় হাত দিয়ে বসেছে প্যাসিফিক থিয়েটার হল কর্তৃপক্ষ, কারণ ক্ল্যাণ্ডরের বাড়িতে খোঁজ নিয়ে ওকে পাওয়া যায়নি। কোথায় গেছে, কেউ জানে না।

খবরটা পড়ে মুচকি হাসলাম। আমি জানি, কোথায় গেছে। ক্ল্যাণ্ডর আয়ারল্যাণ্ডে, ওর নিজের দেশে। চেইঞ্জেলিংগুলোও নিশ্চয় কোনও অলৌকিক উপায়ে ওর সঙ্গে চলে গেছে। আর জাদুকরের বাড়িতে খুঁজে জিনিসপত্রগুলো সব উদ্ধার করল পুলিশ, ছেলেমেয়েদের দিয়ে যেগুলো চুরি করিয়ে নিয়ে গিয়েছিল ক্ল্যাণ্ড।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *