৪০. কাশী

৪০

কাশী!

নিজের বাড়ির সামনে গিয়ে দীপঙ্কর কাশীকে ডাকতে গিয়ে বুকটা ছ্যাঁৎ করে উঠলো হঠাৎ। অন্যদিন বাড়ির ভেতরে ঢুকে প্রথমে মা’কে দেখতে পেত। আজ আর তা হবে না। আজ সমস্ত বাড়িটাই ফাঁকা। সারা কলকাতা শহরটা ঘুরে বেড়িয়েও যেন নিঃসঙ্গতা কমেনি। সমস্ত থেকেও যেন কিছু নেই। দীপঙ্করের মনে হলো–সে যেন নিঃসম্বল হয়ে গেছে। সমস্ত জীবনটাই যেন বিস্বাদ হয়ে গেছে তার। কেউ নেই, কিছু নেই।

–কাশী!

কাশী বোধহয় ঘুমোচ্ছিল। কাজ নেই। বাড়ি পাহারা দিতে দিতে ঘুমিয়ে পড়েছিল। কাশীর দিকে চেয়ে দীপঙ্করেরও হঠাৎ মনে হলো সে আর কাশী যেন আজ একাকার হয়ে গেছে। তারও মা নেই, দীপঙ্করেরও মা নেই। কাশীর দিকে একদৃষ্টে চেয়ে দেখলে খানিকক্ষণ। কাশী কিছু বুঝতে পারলে না। দীপঙ্কর জিজ্ঞেস করলে–কী রে, তোর ভয় করছিল কাশী?

–না।

সত্যিই তো, ভয় করবে কেন তার! কাশী বললে–না তো–

–বেশ বেশ, তোর তো খুব সাহস আছে দেখছি, একলা তোর ভয় করলো না। মোটে! খুব বীর তো তুই?

কথাটা বলে দীপঙ্কর যেন নিজেকেই হাল্কা করতে চাইলে। সত্যিই তো, ভয় করতে যাবে কেন তার! হয়ত দীপঙ্করেরই ভয় করছিল। সমস্ত বাড়িটা ফাঁকা। গা ছম ছম করতে লাগলো। কেন এমন হয়! মা তো কারো চিরকাল থাকে না। মা যখন থাকবে না তখন তো দীপঙ্করকে একলাই থাকতে হবে। এই সমস্ত বাড়িটাতে একলা। কাশী কিন্তু কাজের লোক হয়েছে বেশ। বেশ আপন মনে কাজ করে চলেছে। দীপঙ্কর দোতলায় উঠে দেখতে লাগলো। উঠোনের ওপর কাপড়গুলো শুকোতে দিয়েছিল সেগুলো তুললে কাশী। কল থেকে বালতি করে জল তুলে রান্নাঘরে রাখলে। দীপঙ্কর নিজের ঘরে গিয়ে একবার দাঁড়াল। তারপর মার ঘরে গিয়ে দাঁড়াল। দোতলায় দুটো ঘর পাশাপাশি। মা’র ঘরটা আজ খালি। কয়েকটা ঠাকুর দেবতার ছবি টাঙিয়েছে মা দেয়ালে। মা ভোরবেলা ঘুম থেকে উঠেই ছবিগুলোকে প্রণাম করে তবে নিচে নামে। পাশে দীপঙ্করের ঘরে ঢুকে জাগিয়ে দিয়ে যায় বরাবর। বিছানার কাছে এসে ডাকে–ও দীপু, দীপু, ওঠো বাবা–

পাশের বালিগঞ্জ স্টেশনের ইঞ্জিনের শান্টিং-এর শব্দ, উত্তরে ট্রাম চলার আওয়াজ, সব তখন কানে আসে। দীপঙ্কর সেই ভোরে উঠেই পশ্চিমের আকাশের দিকে চেয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। তখন আবার সমস্ত কথা মনে পড়ে যায়। অতীত-বর্তমানের ভবিষ্যতের সমস্ত সমস্যাগুলো ভিড় করে আসে মাথায়। তখন খবরের কাগজ দিয়ে যায়। তখন মা জল-খাবার করে দিয়ে যায় দীপঙ্করকে। তারপর শুরু হয়ে যায় দিনগত যুদ্ধ। জীবন ধারণ আর জীবিকা উপার্জনের যুদ্ধ। এমনি প্রতিদিন চলে আসছে। সূর্য প্রতিদিন পুব দিক থেকেই ওঠে, যেমন উঠতো ঈশ্বর গাঙ্গুলী লেনে। কিন্তু দীপঙ্করের কত কিছু বদলে গেছে। সেই দীপু দীপঙ্কর হয়েছে। সেই কাশীও এখন বড় হয়েছে। তারও দায়িত্ব বেড়েছে। এমনি করেই দীপঙ্করের পর আরও হাজার হাজার দীপু এই পৃথিবীতে জন্মাবে, বড় হবে, কিন্তু সূর্য চন্দ্র গ্রহ নক্ষত্র, কিছুই বদলাবে না। সূর্য ঠিক ওই জায়গা থেকেই উঠবে। ঠিক সময়েই সকাল হবে, আবার নিয়ম করে সন্ধ্যা হবে কলকাতায়, নিয়ম করে শীত পড়বে, গরম পড়বে, বৃষ্টি হবে, ফুল ফুটবে গাছে, ফুল ঝরে যাবে। কিন্তু তবু মনে হলো কাল সকালে বোধহয় কিছুই হবে না। মা সকাল বেলা আর ডাকবে না, আর জলখাবার নিয়ে কাছে আসবে না। এতক্ষণ মা-ও হয়ত দীপুর কথাই ভাবছে। এখন ট্রেনটা কতদূর, কোথায় চলেছে! চাকার আর ইঞ্জিনের সেই ঝ ঝক্ শব্দ হচ্ছে একটানা। মা হয়ত বাইরের অন্ধকারের দিকে চেয়ে আছে একভাবে।

কাশী হঠাৎ ঘরে এল। বললে–একটা কথা বলতে ভুলে গেচি দাদাবাবু–

–কী কথা রে?

কাশী বললে–সেই লোকটা আবার এসেছিল আপনাকে খুঁজতে, সেই সেদিন পিরোনাথ মল্লিক রোড থেকে এসেছিল!

–কখন? কখন এসেছিল সে?

–আপনি আসবার আগে, দুপুরবেলা।

দীপঙ্কর লাফিয়ে উঠলো বিছানা থেকে। আশ্চর্য, শম্ভু এসেছিল আর তার দেখা না পেয়েই চলে গেছে!

বললে–কী বললে সে? কিছু বলে গেছে তোকে?

কাশী বললে–আমি বলুম দাদাবাবু রাত্তিরে আসবে, তা শুনে কিছু বললে না, চলে গেল

–তা একটু বসতে বললি না কেন? আমি তো আজ আপিসে যাইনি রে। তুই তো জানিস সব, তুই একটু বসতে বলতে পারলি না? তোর কোনও বুদ্ধি নেই!

রাগ হয়ে গেল কাশীর ওপর। শম্ভু এল অথচ তাকে বসতেও বললে না কাশী! এখন কী হবে? সে কি আর রাস্তায় এখন আছে? হয়ত সতীর খবর দিতেই এসেছিল। দীপঙ্কর উঠলো। এখন কোথায় যাবে সে! কোথায় গেলে আবার খবর পাওয়া যাবে শম্ভুর! এতক্ষণে কি আর আছে সে। হয়ত খবর দিতে এসেছিল। দীপঙ্করকে কোনও নতুন খবর দিতে এসেছিল।

–আবার কোথায় যাচ্ছেন, দাদাবাবু?

দীপঙ্কর বললে–দাঁড়া, আমি একটু ঘুরে আসি–

জামা-কাপড় বদলেই দীপঙ্কর বেরোচ্ছিল। কাশী বললে–খাবার তৈরি হয়ে গেছে দাদাবাবু, খেয়ে গেলে হতো

দীপঙ্কর বললে–থাক, আমার যদি দেরি হয় একটু, তুই খেয়ে নিস

রাস্তায় বেরিয়ে কিন্তু মনে হলো কোথায়ই বা যাবে সে। কোথাও তো তার যাবার নেই। সমস্ত রাস্তায় ট্রাম বাস চলেছে উদ্দাম বেগে! এর মধ্যে সে কি খুঁজে পাবে শম্ভুকে? হয়ত সতীই তাকে পাঠিয়েছিল তার কাছে। হয়ত তার ঘরের দরজা সে খুলেছে এতদিনে। হয়ত এতদিনে শাশুড়ীর দয়া হয়েছে। হয়ত এতদিনে সনাতনবাবুর কথায় শাশুড়ী কান দিয়েছে। বলেছে–যা হয়েছে হয়েছে, ওকে যেতে দাও, ওর যেখানে খুশি যাক–

হয়ত সনাতনবাবু বলেছে–কোথায় যাবে তুমি? কোথায় যেতে চাও?

সতী হয়ত বলেছে–যেখানে হোক আমি চলে যাবো, এখানে আর থাকবে না আমার ভালো-মন্দের কথা তোমাদের ভাবতে হবে না।

–আমরা তোমার ভাল মন্দ দেখবো না তো কে দেখবে? বা রে

সতী হয়ত বলেছে আমার ভাল-মন্দ দেখবার অনেক লোক আছে। আমি আমার বাবার কাছে চলে যাবো।

–তা বাবার কাছে কি একলা যেতে পারবে? তাকে আগে চিঠি লিখি, তিনি আসুন, তিনিই না-হয় তোমাকে নিয়ে যাবেন!

অনেক কথা কল্পনা করে দীপঙ্কর নিজের মধ্যেই অশান্তি ভোগ করতে লাগলো। এমনও হতে পারে হয়ত শরীর খারাপ হয়েছে খুব। অত্যাচারে, অনিয়মে রাগে রোষে একেবারে অচল হয়ে গিয়েছে শরীর। হয়ত শয্যাশায়ী হয়ে পড়েছে। ডাক্তার হয়ত বলে গিয়েছে–আর বাঁচবে না। হয়ত সেই খবরটাই দৌড়ে দিতে এসেছিল শম্ভু।

দীপঙ্কর ট্রামে উঠে পড়েছিল। হাজরা রোডের মোড়ে পৌঁছতেই ট্রাম থেকে নেমে পড়লো। ঝাপসা হয়ে এসেছে জায়গাটা। দু’একটা আলো জ্বলতে আরম্ভ করেছে দোকানে দোকানে। এ-পাশের ফুটপাথে দাঁড়িয়ে দীপঙ্কর অনেকবার ভাবতে লাগলো। আবার সেই সতীর বাড়িতে যাবে! যদি আবার তাড়িয়ে দেয় সতীর শাশুড়ী! দারোয়ান যদি ঢুকতে না দেয়! কেমন যেন দ্বিধা হতে লাগলো বার-বার। দীপঙ্করের মনে হলো সতী যেন তার প্রতীক্ষায় বসে আছে। দীপঙ্কর ছাড়া সতীর যেন আর কেউ নেই। হোক অপমান, হোক অত্যাচার, নিজের বাড়ির বউই হোক, আর ছেলেই হোক কাউকে অত্যাচার করবার কোনো অধিকার নেই কারো। এ তো সহ্য করাও অন্যায়!

সামনেই কে একজন আসছিল। দীপঙ্করের মনে হলো যেন চেনা মুখ। কাছে আসতেই দীপঙ্কর সামনে এগিয়ে গিয়ে পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করলে।

–কে বাবা, আমি তো তোমাকে ঠিক চিনতে পারছি না!

গায়ে খদ্দরের পাঞ্জাবি, পায়ে সেই শু্য জুতো, গোড়ালির দিকটা দুমড়ে চটি জুতোর মতন হয়ে গেছে। এক মুখ পান। আরো বুড়ো হয়ে গেছে।

দীপঙ্কর বললে–স্যার, আমি দীপঙ্কর।

–ওঃ তুমি দীপঙ্কর! কেমন আছো বাবা? কী করছো এখন?

সঙ্গে আরো দু’চারজন লোক ছিল। তাদেরও পরনে খদ্দরের ধুতি-পাঞ্জাবি। তারাও বোধহয় কংগ্রেসের লোক সব। শুনে প্রাণমথবাবু বললেন–খুব খুশী হলাম, তোমার মা তোমাকে অনেক কষ্টে লেখাপড়া শিখিয়েছিলেন–তার কষ্টও সার্থক হয়েছে–

দীপঙ্কর বললে–আপনি সাহায্য না করলে কিছুই হতো না–

প্রাণমথবাবু সে-কথার ধার দিয়ে গেলেন না। বললো ভাল কথা, সেই তোমাদের অঘোর ভট্রাচার্যির বাড়ির দুটি ছেলে এসে সেদিন কংগ্রেসের মেম্বার হয়ে গেল, তোমার নাম করছিল তারা–

মনে আছে প্রাণমথবাবুকে এতদিন পরে দেখে দীপঙ্করের সেই পুরোন কথাগুলো কেবল মনে পড়ছিল। সেই কিরণ, সেই কিরণের কথাও এতদিন পরে মনে পড়েছিল। সেই প্রাণমথবাবুর জেলে যাওয়া, সেই ‘বন্দে মাতরম’ বলা, সেই ফুলের মালা দেওয়া। সমস্ত। সুভাষ বোসকে কংগ্রেস থেকে তিন বছরের জন্য তাড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল তখন। তাই নিয়েই খবরের কাগজে লেখালেখি চলেছে।

দীপঙ্কর প্রাণমথবাবুর সঙ্গে কথা বলতে বলতে চলতে লাগলো।

প্রাণমথবাবু বলতে লাগলেন–তোমরা সব আমার ছাত্র, তোমরা বড় হয়েছ, মানুষ হয়েছ দেখলে আমারই বেশি আনন্দ হয়–

দীপঙ্কর বললে–কী আর হয়েছি স্যার, আপনার স্নেহ পেয়েছিলাম, তবু জীবনে কিছুই হতে পারলাম না, রেলের চাকরি নিয়ে জীবন কাটিয়ে দিতে হলো

–তাতে কি হয়েছে বাবা? সবাইকেই আমি কি কংগ্রেসের কাজ করতে বলি? কংগ্রেসের মেম্বার না হয়েও দেশের কাজ করা যায়। সৎপথে থাকবে, সৎ আচরণ করবে, তাতেও দেশ-সেবা হয়। রেলের কাজই মন দিয়ে করো না, সে-ও তো একরকম দেশ সেবা!

দীপঙ্কর কথাগুলো শুনে যেন অন্তরের মধ্যে উৎসাহ পেলে। বললে–কিন্তু বড় নীচতা বড় হীনতার মধ্যে চাকরি করতে হয় স্যার–

প্রাণমথবাবু বললেন–কোথায় নীচতা নেই বলো? ও সব জায়গাতেই আছে। রাজনীতিতে কি নীচতা-হীনতা নেই? এই দেখ না সুভাষবাবুকে কীভাবে সরানো হলো কংগ্রেস থেকে, এখন আবার গ্রে ইডিসিপ্লিন-এর চার্জে তিন বছরের জন্যে তাড়িয়ে দেওয়াও হলো–এও তো একরকম নীচতা–কিন্তু এসব ভাবলে চলবে না, এর মধ্যে থেকেই কাজ করে যেতে হবে আমাদের–

তারপর হঠাৎ থেমে বললেন–আর হ্যাঁ, সেই কিরণ, কিরণ এখন কোথায়?

দীপঙ্কর বললে–তার তো কোনও সন্ধান নেই স্যার, সেই টেররিস্ট পার্টির মধ্যে ছিল, একদিন হঠাৎ নিরুদ্দেশ হয়ে গিয়েছিল আর কোনও খবর পাইনি–

–ওই দেখ, ওই একটা ছেলে, নিজের বিশ্বাসের পথে ধরেই চলেছে, ওকেও আমি দোষ দিতে পারি না। নিজের মনের কাছে খাঁটি থাকলে কোনও কাজই দোষের নয় বাবা, নিজের মনের কাছে খাঁটি থেকো, তাহলেই স্বদেশের সেবা করা হবে–

আরো অনেক কথা হয়েছিল সেদিন। সেই প্রাণমথবাবু! আজীবন কংগ্রেসের কাজ করে গেলেন, শেষকালে সেই তাঁর কপালেই যে অমন মর্মান্তিক পরিণতি আছে তা-ও কি তিনি জানতেন? কিন্তু সে তো অনেক পরের কথা।

প্রাণমথবাবু সদলবলে চলে গেলেন। দীপঙ্কর তার কথা ভাবতে ভাবতেই আবার হাজরার মোড়ের দিকে ফিরে এল। নিজের মনের কাছে খাঁটি থাকলে কাকে সে ভয় করবে? মনে আছে আস্তে আস্তে মোড়টা পেরিয়ে প্রিয়নাথ মল্লিক রোডের দিকে এগোতে লাগলো। নিজের বিশ্বাসের পথ ধরে চলেছে সে। নিজের মনের কাছে সে খাঁটি। সুতরাং কোনও অন্যায় নেই তার। হয়ত বাড়িতে ডাক্তার এসেছে, বাড়ির সামনে গেলেই বোঝ যাবে ডাক্তারের গাড়ি দাঁড়িয়ে থাকবে সামনে। ভেতরে যাবার অনুমতি যদি না-ও পায়, শম্ভুর সঙ্গেও দেখা হয়ে যেতে পারে। শম্ভু তাকে দেখে নিশ্চয় কাছে আসবে।

.

কিন্তু বাড়িটার সামনে গিয়ে দেখলে একেবারে ফাঁকা রাস্তা। দু’একজন লোক যাতায়াত করছে। সমস্ত বাড়িটা নিঝুম। ভেতরের জানলায় জানলায় আলো জ্বেলে দিয়েছে। কিন্তু দরজায় তালা-চাবি ঝুলছে। দূর থেকে দীপঙ্কর দেখতে পেলে-তালা চাবি বন্ধ গেটের ভেতরে সেই দারোয়ানটা চুপচাপ বসে পাহারা দিচ্ছে।

দীপঙ্কর সামনে যেতেই দারোয়ান চিনতে পারলে। উঠে দাঁড়াল। দীপঙ্করকে সেলাম করলো। কিন্তু গেটের চাবি খুললে না।

দীপঙ্কর বললে–সনাতনবাবু আছেন?

–জী হাঁ, আছেন।

দীপঙ্কর বললে–একবার খবর দাও তো-বলো গিয়ে দীপঙ্করবাবু এসেছেন—

দারোয়ান ভেতরে খবর দিতে চলে গেল।

খানিক পরেই আবার দারোয়ানটা ফিরে এল। বললে–নেই হুজুরদেখা হবে না এখন–

–কেন? সনাতনবাবু বাড়িতে আছেন?

–আছেন, লেকিন দেখা হবে না—

দীপঙ্কর তবু জিজ্ঞেস করলে-সনাতনবাবুকে তুমি আমার নাম বলেছ?

–দাদাবাবুকে বলিনি, মা-মণিকে বলেছি, মা-মণির বে-হুঁকুমে তো আমি গেট খুলতে পারি না হুজুর।

দীপঙ্কর কী যেন ভাবতে লাগলো কিছুক্ষণ। অনেকখানি আগ্রহ, অনেকখানি উত্তেজনা নিয়ে এসেছিল। আসবার সময় অনেক দৃঢ় সংকল্পের জাল বুনেছিল মনে মনে। দীপঙ্কর ভেবেছিল সেই দিনকার ঘটনার পর হয়ত সব মিটমাট হয়ে গেছে। হয়ত সতী সংসারে তার ন্যায্য দাবির প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছে। হয়ত শাশুড়ী তার ভুল বুঝতে পেরেছেন। হয়ত মানিয়ে-গুনিয়ে নিয়েছেন সমস্ত। কিন্তু তাহলে কেন শম্ভু আবার এসেছিল! কেন তাহলে এখনও পর্যন্ত গেটে তালা-চাবি দেওয়া! এখনও কি তাহলে সতীর ওপর সেইরকম অত্যাচারই চলছে?

দীপঙ্কর নিজের মনেই ভাবতে লাগলো দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে। সব জেনেও কি তার ফিরে যাওয়া উচিত? অন্তত সনাতনবাবুর সঙ্গে দেখা করে অবস্থাটা পরিষ্কার করা উচিত। দীপঙ্কর অন্তত বলে যাবে তাকে যে দীপঙ্করের জন্যেই সতীর ওপর যদি কোনও অন্যায় কোনও অত্যাচার হয় তো তার সমস্ত দায়িত্ব দীপঙ্করের নিজেরই। দীপঙ্কর অন্তত সতীর শাশুড়ীর সঙ্গে দেখা করে বলে যাবে যে আপনি সতীকে এত কষ্ট দেবেন না। বলবে আমি সতীর কেউ নই, সতীও আমার কেউ নয়। আপনি বিচক্ষণ মানুষ, আপনি তো সমস্ত বুঝতে পারেন, আমি সতীর শুভাকাঙ্খী ছাড়া আর কিছু নই। আমি চাই সতী সুখী হোক, সতী শান্তি পাক। ওর কোনও দোষ নেই। ওর মা নেই, আপনিই ওর মায়ের মতন। আপনিই ওর ভাল-মন্দের সব ভার নিন। ওর অন্যায় হলে ওকে বোঝান, আপনার পায়ে পড়ি ওকে আর এমন করে কষ্ট দেবেন না–

শাশুড়ী হয়ত বলবে-আমার বৌ-এর ব্যাপার, আমি বুঝবো, তুমি কে? তুমি কেন আমাদের ঘরোয়া ব্যাপারে মাথা গলাতে আসো বাবা?

তখন কী বলবে দীপঙ্কর? তখন কী জবাব দেবে? সত্যিই কি সতীর ভালো-মন্দের ব্যাপারে দীপঙ্করের কোনও দায়িত্ব নেই! সেই গেটের সামনে দাঁড়িয়েই আকাশ-পাতাল ভাবতে লাগলো দীপঙ্কর। এত ভীরু সে! এত দুর্বল! সামান্য বাধাটুকু ঠেলে ভেতরে ঢাকবার সাহসও নেই তার! কিসের ভয়? এখনি তো চিৎকার করে বাইরে থেকে ডাকা যায় সনাতনবাবুর নাম ধরে। এই বাড়ির ভেতরেই একজন মেয়েমানুষের ওপর অত্যাচার হচ্ছে, এ-কথা এখানে দাঁড়িয়ে উঁচু গলায় তো ঘোষণা করা যায়। প্রাণমথবাবুর কথাও তো ঠিক। নিজের মনের কাছে খাঁটি থাকলেই তো হলো। এই ত্রিপুরী কংগ্রেস থেকেই তো বোঝা গেছে। সর্দার বল্লভভাই প্যাটেল, গোবিন্দবল্লভ পন্থ, মৌলানা আবুল কালাম আজাদ, ডাঃ রাজেন্দ্রপ্রসাদ, ভুলাভাই দেশাই, সরোজিনী নাইডু, পণ্ডিত নেহেরু–পনেরো জনের মধ্যে প্রায় তেরো জন ওয়ার্কিং কমিটির মেম্বারই নিজেদের নাম তুলে নিয়েছে। সুভাষ বোস কংগ্রেসের প্রেসিডেন্ট থাকলে আমরা কেউ কমিটিতে থাকবো না। তোমার কাজ আমরা অচল করে তুলবো।

প্রাণমথবাবুর মত লোকও বলেছিলেন–ঠিক এই সময়েই কিনা মহাত্মা গান্ধী গেলেন রাজকোটে হাঙ্গার স্ট্রাইক করতে-ত্রিপুরী কংগ্রেসের পরে গেলেই তো চলতো! কিন্তু…

সঙ্গের একজন তোক বলেছিলেন–কিন্তু মাস্টারমশাই, সুভাষবাবু তো দু’শো পাঁচ ভোটে পউভি সীতারামিয়াবাবুকে হারিয়ে দিলেন, তবু মহাত্মাজী বললেন–After all, Subhas Babu is not an enemy of his country–

আজকের এ-ঘটনা হয়ত কাল লোকে ভুলে যাবে। কালকের নতুন সমস্যার ভিড়ে আজকের এই অভিমন্যু-বধের পালার কথা হয়ত কারো মনে থাকবে না। কিন্তু আজ থেকে দশ বছর পরে, কুড়ি বছর পরে, কি পঞ্চাশ বছর পরে হয়ত কোনও সাহিত্যিক এই ঘটনা নিয়েই উপন্যাস লিখবে। উনিশ শো পঞ্চাশ, কি উনিশ শো ষাট সত্তর সালে হয়ত আবার এই ঘটনাটাই নতুন করে লিখতে বসবে কোনও ঐতিহাসিক। সেদিন ইতিহাস-বিধাতা কি মুখ বুজে চুপ করে বসে থাকবে! সব তো চিত্রগুপ্তের খাতায় লেখা থাকছে। সেদিন হয়ত দীপঙ্কর থাকবে না, এই প্রাণমথবাবু থাকবেন না, ওই মৌলানা আবুল কালাম আজাদ, ভুলাভাই দেশাই, ওই সর্দার বল্লভভাই প্যাটেল, সরোজিনী নাইডু, কেউই থাকবেন না-সেদিন কে মুখ বন্ধ করবে তাদের? ইতিহাস তো কারো হাত-ধরা পুতুল নয়। ঋগবেদের যুগ থেকে শুরু করে, সমুদ্রগুপ্ত, অশোকের যুগ পেরিয়ে মহম্মদ ঘোরীর আমলও পার হয়ে পৌঁছিয়েছে ব্রিটিশ-যুগে। কেউ চেপে রাখতে পেরেছে ভারত-বিধাতাকে! কেউ ঘুষ দিতে পেরেছে ভারত-ভাগ্য-বিধাতাকে! কেউ কাউকে কড়ি দিয়ে কিনতে পেরেছে চিরকালের জন্যে? লর্ড লিনলিথগো, লর্ড আরউইন–কেউ পেরেছে? কেউ পারবে?

দারোয়ানটা তখনও চুপ করে দাঁড়িয়ে ছিল দীপঙ্করের মুখের দিকে চেয়ে।

দীপঙ্কর তখনও প্রাণমথবাবুর কথাই ভাবছিল। প্রাণমথবাবুর মত লোক, তিনিও কিনা বলে গেলেন–নিজের মনের কাছে খাঁটি থাকাটাই আসল কথা! সত্যিই তো, কিরণ তো ভুল করেনি। কিরণ তো নিজের বিশ্বাসের পথই বেছে নিয়েছে। মনের কাছে সে তো খাঁটি থেকেছে! আজ যদি কেউ তাকে দেখতে পায় এখানে, হয়ত ভাববে দীপঙ্কর এখানে কেন? এ-রকম সময়ে এ-বাড়ির সামনে কেন? এই তালা-বন্ধ দরজার সামনে সে কী করছে একলা-একলা! আজ এখন দীপঙ্করের নিজের বাড়িটা ফাঁকা। কাশী হয়ত এতক্ষণে রোয়াকের উপর শুয়ে শুয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে। হয়ত খাওয়াও হয়নি তার। কোনও কাজ তো নেই, কোনও দায়িত্বই নেই। মা হয়ত এতক্ষণ ঘুমিয়ে পড়েছে ট্রেনের মধ্যে। হয়ত কমলালেবু খায়নি, ডাবও খায়নি হয়ত। সন্তোষকাকা কি আর পীড়াপীড়ি করবে খাবার জন্যে! দায় পড়েছে সন্তোষকাকার!

হঠাৎ দীপঙ্কর কান খাড়া করে উঠলো। কে যেন কাঁদছে না! যেন অনেক দূরে আকাশের উঁচু থেকে কার নিঃশব্দ কান্না ভেসে আসছে! অঘোরদাদু তুমি ভুল বলেছিল, আমায় ছেলেমানুষ পেয়ে তুমি ভুল বলেছিলে, আমায় ছেলেমানুষ পেয়ে তুমি ভুল শিখিয়েছিলে। কিছু কেনা যায় না কড়ি দিয়ে। আমি তোমার কথা শুনবো না। তেত্রিশ টাকার ঘুষ দিয়ে রেলের চাকরিই শুধু কেনা যায়, সম্মান প্রতিপত্তি প্রতিষ্ঠাই শুধু কেনা যায়। কিন্তু তার বেশি কিছু কেনা যায় না। স্বাধীনতা কেনা যায় না, শান্তি কেনা যায় না কড়ি দিয়ে। পরের কষ্ট দূর করা যায় না কড়ি দিয়েপরকে সুখী করা যায় না কড়ি দিয়ে!

হুশিয়ার বাবুজী, হুঁশিয়ার–

হঠাৎ যেন চমক ভাঙলো দীপঙ্করের। এতক্ষণ কত কী আবোল-তাবোল ভাবছিল ঠিক ছিল না। হঠাৎ পেছনে বিরাট লম্বা একটা মোটর একেবারে তার গা ঘেঁষে এসে দাঁড়াল। গাড়িটা গেটের সামনে আসতেই দারোয়ান গেটের তালা খুলে দিলে। গাড়িটা বাড়ির ভেতরে ঢুকে গেল। অনুমতি নিতে হলো না, দরবার করতে হলো না। গাড়িটা গেটের সামনে আসতেই দারোয়ান শশব্যস্ত হয়ে তালা খুলে দিয়ে সেলাম করলে। রাস্তার গ্যাসের আলোটা গাড়ির ভেতরে পড়তেই দীপঙ্কর অবাক হয়ে দেখলে–নির্মল পালিত। নির্মল পালিত গাড়ির ভেতর বসে বসে সিগারেট টানছে!

নির্মল পালিত এত রাত্রে এ-বাড়িতে কেন? নির্মল পালিত হয়ত দেখতে পায়নি। দেখতে পেলে সে-ও অবাক হয়ে যেত এখানে দীপঙ্করকে দেখে! হয়ত কোনও মামলা মোকর্দমা আছে হাইকোর্টে। হয়ত জমি-জমা নিয়ে ঘোষবাড়ির মামলা চলছে। ঘোষবাড়ির পক্ষের ব্যারিস্টার হয়ত নির্মল পালিত।

দীপঙ্কর আবার ফিরে চলে আসছিল। এখানে এমনভাবে দাঁড়িয়ে থেকে কোনও লাভ নেই। গলিটার বাইরে কোলাহলের জগৎ এখন আরো চঞ্চল হয়ে উঠেছে। অফিস ফেরত লোকের ভিড় বেড়েছে রাস্তায়। দীপঙ্কর চলেই আসছিল। হঠাৎ একেবারে মুখোমুখি শম্ভুর সঙ্গে দেখা।

দীপঙ্করই প্রথমে চিনতে পেরেছে। বললেশম্ভু না?

শম্ভুর হাতে একটা কিসের ঠোঙা। হয়ত দোকান থেকে কিছু কিনে নিয়ে আসছিল। বললে–আমি তো আপনার কাছেই গিছলাম দাদাবাবু–

দীপঙ্কর বললে–আমিও তো সেইজন্যেই এলুম-কী খবর বলল শম্ভু? তোমার বৌদিমণি কেমন আছে?

শম্ভু বললে–খবর ভাল নয় আজ্ঞে, বৌদিমণি কিছু খায় না দায় না, একেবারে শুকিয়ে রোগা হয়ে গেছে খুব, সেই জন্যেই তো আপনার কাছে গিয়েছিলুম আমি।

দীপঙ্কর বললে–তা আমি কী করতে পারি বলো তো? আমি তো তোমার দাদাবাবুর সঙ্গে দেখা করতেই এসেছিলুম, কিন্তু দাদাবাবুর কাছে তো খবরই পৌঁছল না, তোমার মা-মণি তো দরজা খুলতেই বারণ করলেন দারোয়ানকে। কতক্ষণ আর দাঁড়িয়ে থাকবো, শেষে চলে আসছিলুম, এমন সময় তোমার সঙ্গে দেখা হয়ে গেল

শম্ভু বললে–আপনি দেখা করতে চান বৌদিমণির সঙ্গে?

–দেখা করবো? আমি? তুমি বলছো কী শম্ভু?

দীপঙ্কর অবাক হয়ে গেল শম্ভুর কথা শুনে।

শম্ভু বললে–আমি দেখা করিয়ে দিতে পারি, কিন্তু বিপদও আছে–যদি মা-মণি টের পায় তো আপনারও সব্বনাশ, আমারও সব্বনাশ, বৌদিমণিরও সব্বনাশ–

দীপঙ্কর বললে–থাক, তার দরকার নেই, তার চেয়ে যদি মা-মণির সঙ্গে আমার দেখা করিয়ে দিতে পারো তো সেই ভালো

শম্ভু বললে–মা-মণি আপনার সঙ্গে দেখা করবে না হুজুর,–

–তাহলে, দাদাবাবু! দাদাবাবুর সঙ্গে অন্তত দেখা করিয়ে দিতে পারো আমার?

শম্ভু বললে–মা-মণি না বললে দাদাবাবু দেখা করবে না আজ্ঞে, মা-মণির কথা ছাড়া দাদাবাবু এক পা নড়েন না–

–তাহলে আমি আর কী করতে পারি বলো? আমার দ্বারা আর কী হতে পারে?

শম্ভুও কী বলবে বুঝতে পারলে না।

দীপঙ্কর জিজ্ঞেস করলে–তুমি আমার কাছে কী করতে গিয়েছিলে আজ?

শম্ভু বললে–এই সব কথা বলতেই গিয়েছিলাম। বাতাসীর মা, ভূতির মা, সবাই বড় ভাবছে আজ্ঞে, তারাই তো আপনার কাছে আমায় যেতে বললে। সবাই ভয় পেয়ে গেছে কি না!

–কেন? ভয় কিসের?

শম্ভু বললে–আজ্ঞে ভয় হবে না? বৌদিমণি কি কিছু খাচ্ছে? খায় না, দায় না, শুধু চুপ করে থাকে, না-খেলে শরীর টিকবে কী করে?

দীপঙ্কর জিজ্ঞেস করলে–বৌদিমণি দরজা খুলেছে?

শম্ভু বললে–হ্যাঁ খুলেছে। একদিন পরে মা-মণি গিয়ে বলার পর দরজা খুলেছে–

–আর তোমার দাদাবাবু কোথায় শোয়? কার ঘরে শোয়?

শম্ভু বললে–আজ্ঞে মা-মণি কি দাদাবাবুকে বৌদিমণির কাছে যেতে দেয়? আমাদের কাউকেই যে যেতে দেয় না। শুধু ভূতির মা গিয়ে বৌদিমণিকে খাবার দিয়ে আসে-তা খায় না কিছুই বৌদিমণি, নামমাত্তোর শুধু ভাত ছুঁয়ে হাত গুটিয়ে নেয়!

–তা মা-মণি কিছু বলে না তোমার বৌদিমণিকে?

শম্ভু বললে–সেই নিয়েই তো ঝগড়া বাধলো আবার নতুন করে। মা-মণি সেদিন গেল বৌদিমণির ঘরে। বৌদিমণির ঘরের সামনে গিয়ে দরজায় ধাক্কা দিতে লাগলো। বললে–বৌমা দরজা খোল, খোল দরজা–

আমরা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সব দেখছি দূর থেকে।

সতীর শাশুড়ী তখনও দরজা ঠেলছে। দু’দিন জলগ্রহণ করেনি সতী।

–দরজা খোল বলছি বৌমা, আমার বাড়িতে বসে তুমি আত্মঘাতী হবে, তা আমি হতে দেব না, দরজা খোল।

সতী দরজা খুললো। দু’দিন খায়নি। দু’দিনেই যেন রোগা হয়ে গেছে প্যাকাটির মত। দরজাটা খুলেই শাশুড়ীর মুখোমুখি হয়ে দাঁড়ালো।

শাশুড়ী বললেন–বলি, তুমি কি ভেবেছ বলো দিকি বৌমা, তুমি ভেবেছ কী? দুদিন–খেয়ে তুমি কার মাথা কিনলে? তুমি ভাবছো আমি তোমার মতলব বুঝতে পারিনি? তুমি কি আমার হাতে পুলিসের হাত-কড়া লাগাবে ঠিক করেছ?

সতী তেমনি চুপ করে রইল। কিছু উত্তর দিলে না।

রাগ দেখিয়ে তুমি যে খুব দরজায় হুড়কো লাগিয়ে দাঁতকপাটি মেরে পড়ে রইলে, আমি তোমার কী এমন ক্ষতি করেছি শুনি? আমি তোমায় এমন কী বলেছি? আমি তোমার মায়ের তুল্য মানুষ, গুরুজন, আমি যদি তোমার ভালোর জন্যে দুটো কড়া কথা বলেই থাকি তো কী এমন অন্যায়টা করেছি বলো তো?

তারপর একটু থেমে আবার বলতে লাগলেন-তোমার কী বৌমা, তুমি তো শুধু খাচ্ছ দাচ্ছ ঘুমোচ্ছ–তাতেই তোমার ল্যাঠা শেষ, কিন্তু আমাকে যে হাজারোটা জ্বালা সইতে হচ্ছে দিনরাত, তার খবর তো তোমরা কই রাখতে আসো না! তার বেলায় তো তোমরা কেই বলো না-মা আপনি বসুন, আপনি পুজো-আচ্চা নিয়ে থাকুন, আমরা আপনার হয়ে সংসারের ঘানি টানছি। এই যে হাইকোর্টের মামলা-মোকদ্দমা উকিল মুহুরি-ব্যারিস্টার সব আমি সামলাচ্ছি, কউ, তার বেলায় তো তুমি একটু মুখের কথা বলেও শাশুড়ী মাগীকে একটু সাহায্য করতে আসো না। আমি লেখাপড়া-জানা বউ করেছিলুম, ভেবেছিলুম, বিধবা, মানুষ আমার একটু সুরাহা হবে বৌ ঘরে এনে! তা যথেষ্ট হয়েছে মা, যথেষ্ট শিক্ষা হয়েছে আমার। আমরা লেখাপড়া শিখিনি, ভগবান আমাদের বাঁচিয়েছেন, তা যেমন হয়েছে আমার ছেলে, তেমনি হয়েছে আমার বউ-আমার কপালে খুব সুখ হয়েছে, আর সুখের দরকার নেই মা, সুখের কপালে পেন্নাম করি আমি,–

সতী তখনও দরজার দুটো পাল্লা ধরে দাঁড়িয়েছিল। শাশুড়ীর কথা কানে গেল কি কানে গেল না বোঝা গেল না।

শাশুড়ী বললেন–তা বলি এখন খেয়ে আমায় উদ্ধার করবে, না কী? আমার অনেক কাজ! সকাল থেকে ভালো করে জপ-তপ পর্যন্ত করতে পারলাম না–ওদিকে সরকারবাবু হিসেবের খাতাপত্তোর নিয়ে হাঁ করে বসে আছে–আমি কোন দিক সামলাই!

তারপর ভূতির মাকে ডেকে বললেন–দে, বৌমাকে চা এনে দে তো ভূতির মা, আহা মুখটা বাছার শুকিয়ে গেছে উপোস করে–

তারপর যাবার আগে বললেন–তোমার মা নেই তো, মা থাকলে বুঝতে–আর আমার দেখ দিকিনি, মা-বাপ দু’জনের দু’দিক সামলাতে হচ্ছে। তা তোমাকে এ-সব বলা বৃথা বৌমা, তুমি এত কথা বললেও বুঝবে না। বাপ বরাবর টাকা পাঠিয়েছে, আর তুমি পরের বাড়িতে থেকে লেখাপড়া করেছ, বৈষয়িক ব্যাপারের হ্যাপা তুমি বুঝবে কী করে বৌমা? তোমার বাবা হলে বুঝতেন, তিনি জানতেন টাকা উপায় করা যত শক্ত, টাকা রাখা তার চেয়ে আরো শক্ত! আর এসব যে আমি করছি, সব কার জন্যে? আমার জন্যে? আমি তো দুদিন পরে ড্যাং ড্যাং করে চলে যাবে, তখন তোমাদেরই তো ভুগতে হবে! তোমাদেরই সংসার নয়-ছয় হয়ে যাবে। আমি আর ক’দিন? পিঠে খেতে তো সকলেরই আরাম, পিঠের ফোড় গুনতে তো সেই আমি–

কথাগুলো বলে শাশুড়ী চলে যাচ্ছিলেন।

সতী হঠাৎ বললে–আমার বাবাকে একটা চিঠি লিখে দিন, আমাকে এসে তিনি নিয়ে যাবেন।

শাশুড়ী ফিরে দাঁড়ালেন। বললেন–কী বললে?

বললাম আমার বাবাকে আপনি চিঠি লিখে দিন, তিনি যেন আমাকে এখান থেকে নিয়ে চলে যান। এখানে থাকলে আমারও জালা, আপনাদেরও জ্বালা

শাশুড়ী কী যেন ভাবলেন একটু। তারপর বললেন–তাতে বাপের জ্বালা বাড়বে বই কমবে না তো! তুমি কি ভাবছো বাপের কাছে গেলে তোমার জ্বালা কমবে? নিজেও জ্বলবে, বাপকেও জ্বালাবে–

–জ্বলি যদি তো সে জ্বালায় আমিই জ্বলবো, আমার নিজের বাবাকে জ্বালাবো! আপনাদের জ্বালাতে আসবো না।

শাশুড়ী বললেন–খুব মেয়েকে জন্ম দিয়েছিল বটে তোমার বাবা! এক মেয়ে বাড়ি থেকে পালিয়ে গিয়ে জ্বালিয়েছে, আবার তুমিও শ্বশুরবাড়ি থেকে পালিয়ে গিয়ে জ্বালাও। আমি হলে এমন মেয়েকে ঝাঁটা মেরে বিদেয় করতুম না–

সতী কঠিন হয়ে উঠলো। বললে–আমার বাবাকে খবর দেবেন কিনা বলুন?

–তুমি আমায় ভয় দেখাচ্ছ নাকি?

শাশুড়ীও এতক্ষণে কঠোর দৃষ্টিতে চাইলেন সতীর দিকে।

সতী দমলো না। বললে–ভয় দেখানো যদি মনে করেন তো ভয়ই দেখাচ্ছি, আর নইলে আপনার দুটি পায়ে পড়ছি আমায় আমার বাবার কাছে পাঠিয়ে দিন, নইলে আমি আর পারছি না–

শাশুড়ী বললেন–বৌমা, তোমার এই ছিচকাদুনে কান্না শুনলে আমার গা জ্বালা করে, তোমার আমি কী হেনস্থা করেছি যে তুমি আর পারছো না? তোমার কোন্ অভাবটা আমি রেখেছি শুনি? তোমায় পেট ভরে খেতে দিই নি? তোমায় শাড়ি গয়না পরতে দিই নি? তুমি বুড়ো মানুষের মুখের সামনে মিছে কথাটা বলতে পারলে?

সতী কিছু উত্তর দিলে না।

শাশুড়ী আবার বলতে লাগলেন-সোনাকে তো তোমার ঘরে শুতে বারণ করিনি। তুমিই ঢং করে দরজায় হুড়কো লগিয়ে মটকা মেরে পড়ে রইলে। তা বাছা আমার কোথায় শোয় বল দিকিনি! সে তো আর আমার ছেলে বলে বানের জলে ভেসে আসেনি! তা তাই আমি তাকে বললাম-বৌমা দরজায় হুড়কো দিয়েছে তা কী হয়েছে, তুই আমার ঘরে শো! আমি তো এখনও মরিনি! আমি যদ্দিন বেঁচে আছি তদ্দিন তোর কোনও ভাবনা নেই, আমি মলে তখন ওই বউই তোর গলায় ঠ্যাং দিয়ে তোকে ঘেঁলে মারবে, দেখে নিস–

রাত্রে মা-মণি বললেন–সোনা, আজকে তুমি তোমার ঘরেই শোওগে যাও বাবা,–

সনাতনবাবু বললেন–কেন মা? আমার তো কোনও অসুবিধে হচ্ছে না–

–তা না হোক, বৌমা দরজা খুলেছে, তুমি তোমার ঘরেই যাও–

সনাতনবাবু সতীর ঘরে গিয়ে দরজা ঠেলতে লাগলেন। সতী অনেকক্ষণ পরে দরজা খুলে দিলে। বললে–এ কি? তুমি এলে যে?

সনাতনবাবু বললেন–আজ এ-ঘরেই শোব আমি—

বলে ঘরের ভেতরে ঢুকতে যাচ্ছিলেন। সতী রাস্তা আটকে দাঁড়িয়ে রইল।

সনাতনবাবু বললেন–কী হলো, পথ ছাড়ো–

সতী বললে–না, এ-ঘরে তোমায় শুতে হবে না, তুমি যে-ঘরে শুচ্ছিলে সেখানেই যাও–

–তার মানে?

সনাতনবাবু বিচলিত হলেন না। যেন রুখে দাঁড়ালেন সতীর সামনে।

সতী বললে–তার মানে তোমাদের দয়ার দান নিয়ে আর আমি বেঁচে থাকতে চাই। ভেবেছ আমার কাছে শুয়ে আমাকে তুমি কৃতার্থ করে দেবে? ভেবেছ তুমি আমার পাশে শুলে আমি ধন্য হয়ে যাবো? আমার নারী-জন্ম সার্থক হবে?

বলতে বলতে হঠাৎ সনাতনবাবুর বুকের ওপর মাথা রেখে হাউহাউ করে কাঁদতে লাগলো সতী। সে-কান্না আর থামতে চায় না যেন। সনাতনবাবুর বুকের মধ্যে ব্যাকুল হয়ে মাথা ঘষতে লাগলো।

সনাতনবাবু বিব্রত হয়ে পড়লেন–বললেন–আরে, ছি ছি, এ কি, কাঁদতে আরম্ভ করলে কেন? কী করেছি আমি?

সতী মুখ তুললো। বললে–আজ তুমিই বলছো তুমি কী করেছ? তুমি যদি অন্যরকম হতে তাহলে আমার ভাবনা? তুমি যদি আমার দিকে হতে তো আমি এমন করে দগ্ধে দগ্ধে মরি? তুমি আমার সহায় হলে আমি যে সব কষ্ট সব দুঃখ হাসিমুখে সহ্য করতে পারতুম–

সনাতনবাবু বললেন–তা আমি তো তোমারই দিকে, আমি তো তোমারই–কী যে ছেলেমানুষি করো!

সতী বললে–তুমি যদি আমার হবে তো আমার অপমান হলে তোমার তো কই গায়ে লাগে না! তুমি যদি আমারই হবে তো আমার জন্যে তো তুমি এতটুকু ভাবো না

–কে বললে তোমার জন্যে আমি ভাবি না–

–ভাবো? আমার জন্যে ভাবো তুমি? আমার কথা সারাদিনে একবারও তোমার মনে পড়ে? তাহলে আমার ঘরে অচেনা লোককে নিয়ে এলে তুমি তো জিজ্ঞেস করো না, কে সে। আমি যখন বাড়ি থেকে বেড়াতে চলে চলে যাই, তুমি তো জিজ্ঞেস করো না কোথায় গিয়েছিলুম। এই যে আমাকে বাড়িতে আটকে বন্দী করে রাখা হয়েছে, কাউকে চিঠি লিখতে দেওয়া হয় না, কারোর সঙ্গে কথা বলতে দেওয়া হয় না, তার জন্যে তুমি তো কিছু বলল না। তুমি তো আমাকে বকো না, তুমি তো আমাকে শাসন করো না–

সনাতনবাবু অবাক হয়ে গেলেন। বললেন–শাসন করবো? তোমাকে? কেন তুমি কি করেছ?

সতী বললে–তা শাসন যদি না-ই করলে তো আদরও তো করো না–

–বা রে, তা বলা নেই কওয়া নেই, আদরই বা হঠাৎ করতে যাবো কেন?

–তা আদর যদি না করবে তো কেন বিয়ে করতে গিয়েছিলে? কে তোমাকে মাথার দিব্যি দিয়ে বিয়ে করতে বলেছিল? কেউ তো তোমার হাত-পা বেঁধে জোরজবরদস্তি করে আমার গলায় ঝুলিয়ে দেয়নি?

সনাতনবাবুর বুকে তখন সতী মাথাটা হেলিয়ে রখেছে। সনাতনবাবু বললেন– এসব কী আবোল-তাবোল বলছো বলো দিকিনি তুমি? আমি কিছুছু বুঝতে পারছি না তোমার কথার মাথামুণ্ডু–

সতী হঠাৎ নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে নিলে। সনাতনবাবুকে দূরে ঠেলে দিয়ে বললে এইটুকু যদি বুঝতে না পারো তো যাও, বুঝেও দরকারও নেই তোমার। তোমাকে বুঝতেও হবে না–কেন তুমি তাহলে আমার ঘরে শুতে এসেছিলে? যেখানে শুচ্ছিলে সেখানেই শুতে যাও না–কে তোমায় ডেকেছে? কে বলেছে তোমায় আসতে? যাও তুমি, তোমার মুখ দেখতে চাই না আমি–

বলে ঘরের দরজাটা সনাতনবাবুর মুখের ওপরেই দড়াম করে বন্ধ করে দিলে সতী। তারপর ভেতরে খিল দেওয়ারও শব্দ হলো।

সনাতনবাবু সেইখানেই খানিকক্ষণ হাঁ করে দাঁড়িয়ে রইলেন।

সদর গেটে তালা খোলার শব্দ হলো হঠাৎ। দীপঙ্কর চেয়ে দেখলে নির্মল পালিতের যে-গাড়িটা কিছুক্ষণ আগে ভেতরে ঢুকেছিল, সেটা আবার রাস্তায় বেরিয়ে এল। তারপর রাস্তায় পড়ে সোজা হাজরা রোডের দিকে চলে গেল।

শম্ভু বললে–এই ব্যারিস্টারবাবুর গাড়ি—

দীপঙ্কর জিজ্ঞেস করলে ব্যারিস্টারবাবু কি রোজ আসে তোমাদের বাড়িতে?

শম্ভু বললে–হ্যাঁ, রোজই তো আসে, মামলা বেধেছে কিনা। মা-মণির সঙ্গে ব্যারিস্টারবাবুর পরামর্শ হয়। দাদাবাবু তো মামলা-মোকদ্দমার কিছু বোঝে না, মা মণিই সব করে–

–তা এত মামলা-মোকদ্দমাই বা কিসের? কী নিয়ে মামলা?

–তা জানিনে, মামলা তো লেগেই আছে চিরকাল দেখে আসছি বাড়িতে। তা সম্পত্তি থাকলেই হয়ত মামলা হয়–

অনেক দেরি হয়ে যাচ্ছিল। দীপঙ্কর জিজ্ঞেস করলে–তা যাক গে, তারপর কী হলো?

–আজ্ঞে তারপর আর কী হবে, দাদাবাবু আস্তে আস্তে বেরিয়ে এসে বারান্দা দিয়ে সিঁড়ির দিকে এল। তারপর সিঁড়ি দিয়ে নিচে একতলায় নিজের লাইব্রেরী ঘরে গিয়ে আবার বইপত্তর নিয়ে পড়তে বসলো। পড়তে বসলে তো আর দাদাবাবুর জ্ঞান থাকে না কোনও দিকে–

–তা ঘুমোলেন কখন?

শম্ভু বললে–এই চেয়ারে বসে পড়তে পড়তেই কখন মাথাটা টেবিলের ওপর কাত করে দিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছেন, খেয়াল ছিল না। আমি যখন ভোর বেলা ঘর ঝাট দিতে গেছি দেখি তখনও ঘরে বাতি জ্বলছে, আর দাদাবাবুর মাথাটা টেবিলের ওপর হেলে পড়েছে।

আমি গিয়ে ঠেলে তুললাম। বললাম–দাদাবাবু, পড়ে যাবেন যে, উঠুন, ও দাদাবাবু–

দাদাবাবু ধড়মড় করে উঠলো। চারদিকে চেয়ে যেন খেয়াল হলো সব। বললে ক’টা বাজলো রে শম্ভু? এখন কত রাত্তির?

আমি বললুম-রাত কোথায় দাদাবাবু, এখন যে সকাল হয়ে গেছে, আমি ঘর ঝাঁট দিতে এসেছি, উঠুন, আপনি যে পড়ে যাচ্ছিলেন–

আমার কথা শুনে দাদাবাবু উঠে দাঁড়িয়ে চোখ মুছতে লাগলো। দাদাবাবুর কাণ্ড দেখে আমারও মায়া হলো। ভাবলুম দাদাবাবুর কপালের দুর্ভোগ। নইলে দাদাবাবুই বা কী দোষ করেছে! আর কাকেই বা দোষ দেব বলুন! কারোর তো দোষ নেই–

বাড়ি ফিরে আসবার পথে দীপঙ্কর সেই কথা ভাবছিল। কার দোষ! কে দোষী! সতী? না সনাতনবাবু? নাকি সতীর শাশুড়ী! কাকেই বা দোষ দেওয়া যায়। মামলা মোকদ্দমা নিয়ে সতীর শাশুড়ী তো ব্যতিব্যস্ত। সেই কতকাল আগে একদিন সমস্ত ভার মাথায় পড়েছিল তার। এমনি শক্ত হাতে সব না সামলালে কি এতদিনে এই সংসার টিকতো! সেদিনকার সেই পূর্বপুরুষের আমলের সমস্ত নিয়ম-কানুন সমস্ত ক্রিয়া-অনুষ্ঠান সবই তো চালিয়ে যাচ্ছেন। মামলা-মোকদ্দমা তো করছেন নিজে। কোথায় সংসারের কোন্ কোণে কী ঘটছে, সব কিছুর ওপরেই তো তাকে নজর রাখতে হচ্ছে। তিনি ছাড়া আর কে আছে? তিনি যদি হাল ছেড়ে দেন, তাহলে সমস্ত যে রসাতলে যাবে। তিনি যদি ছেলের বউকে শাসন না করেন, যদি নিজের ইচ্ছামত তাকে শিখিয়ে পড়িয়ে না নেন, তো তার অবর্তমানে সব যে ধ্বংস হয়ে যাবে! সংসার তো করলেই হলো না, সংসারের আরামের দিকটাও যতখানি, সংসারের কর্তব্যের দিকটাও যে ততখানি। মা আছে বলেই দীপঙ্কর এতদিন সংসারের সেই দিকটা বুঝতে পারেনি। আর দীপঙ্করের আর কতটুকুই বা সংসার। ভাড়াটে বাড়ি–দুটো মাত্র লোক। তবু তাই নিয়েই তো মা হিমশিম খেয়ে যায় দিনরাত। কিন্তু সতীদের বাড়ির চাকর-বাকর, ঝি, মালী, ড্রাইভার, দারোয়ান, মেথর, ঠাকুর, গাড়ি, বাগান, মামলা, ট্যাক্স, পুজো, আহ্নিক–সমস্ত কিছুর পেছনে যে একটিমাত্র মানুষ। সেই একটি মানুষই যে আজীবন, এ-বাড়িতে বৌ হয়ে আসার পর থেকেই একলা সব চালিয়ে আসছে। সে-মানুষ যদি কড়া না হয় তো চলবে কী করে।

শম্ভু বলেছিল–আপনি যদি বৌদিমণির সঙ্গে দেখা করতে চান তো বলুন, আমি দেখা করিয়ে দিতে পারি–

দীপঙ্কর অবাক হয়ে গিয়েছিল–কী করে দেখা করাবে?

শম্ভু বলেছিল–সে আমি সব পারি, পেছনের খিড়কির দরজার আমি ডবল-চাবি করে নিতে পারি, যখন সবাই ঘুমোবে, তখন সেই দরজা দিয়ে আমি আপনাকে বৌদিমণির ঘরে নিয়ে যেতে পারি–

দীপঙ্কর বললে–না থাক, তার দরকার নেই–তার চেয়ে একটা কাজ করতে পারো?

–কী কাজ?

–তোমার বৌদিমণির বাবার ঠিকানাটা যোগাড় করে দিতে পারো? আমি তাহলে তাকে একটা চিঠি লিখে দিতে পারি সমস্ত কিছু জানিয়ে। এরকম করে থাকলে তোমার বৌদিমণি আর কতদিন বাঁচবে? বাবা এলে তিনি হয়ত একটা কিছু ব্যবস্থা করতেও পারেন–কিম্বা টেলিগ্রামও করে দিতে পারি তাঁকে, যাতে শিগগির চলে আসেন

শম্ভু কী যেন ভাবলে। বললে–আমি বলে দেখবো।

দীপঙ্কর বললে–তুমি ঠিকানাটা পেলেই আমার বাড়িতে আমাকে দিয়ে যেও–

শম্ভু বললে–তাহলে আসি দাদাবাবু, ভূতির মা’র মুড়ি আনতে গিয়েছিলুম, এতক্ষণে মুড়ি বোধহয় মিইয়ে গেল–আমি কালকেই বৌদিমণির কাছ থেকে ঠিকানাটা নিয়ে আপনাকে গিয়ে দিয়ে আসবো—

৪১

শম্ভু চলে গেল। গড়িয়াহাট পর্যন্ত এসেও দীপঙ্কর সেই কথাই ভাবছিল। এই যে আশে পাশে কত মানুষ ট্রামে-বাসে চলেছে, সকলেই কি নিজের নিজের সমস্যায় জর্জর। সকলেই কি দীপঙ্করের মত নানা কথা ভাবছে। নানা ভাবনায় জড়িয়ে পড়েছে। সকলেরই তো ফরসা জামা-কাপড়, সকলেরই তো দাড়ি-কামানো পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন। চেহারা। দীপঙ্করের মতই কি সবাই সকাল থেকে গভীর রাত পর্যন্ত অক্লান্ত চিন্তায় অস্থির? কই, কারোর মুখ দেখে তো তা বোঝা যাচ্ছে না। কেউ নিরুদ্বিগ্ন মনে বই পড়ছে, কেউ জানলার বাইরে চেয়ে আছে, কেউ পাশের লোকের সঙ্গে হাসি ঠাট্টা-গল্প করছে। হয়ত সবাই তার মত। কিম্বা হয়ত কেউ-ই তার মত নয়। উদয়াস্ত পরিশ্রম করে জীবিকা অর্জন করছে, সহজভাবেই গ্রহণ করছে জীবনকে। যা না চাইতেই আসে, তাও প্রত্যাখ্যান করে না, আর যা না চাইলেও পায় না, তার জন্যেও হা-হুঁতাশ করে মরে না। সেই রকমই তো ভাল ছিল। তবে কেন দীপঙ্কর এমন হলো! কেন বিধাতাপুরুষ তাকে এমন করে গড়লে? কেন সহজভাবে সব কিছু গ্রহণ করতে পারে না সে? কেন ভুলতে পারে না সে কিছুই? কী করলে সবকিছু ভোলা যায়? ভুলের দেবতা তুমি ভোলানাথ! কী করলে তোমাকে তুষ্ট করা যায়! কী করলে ভোলানাথ হতে পারে সে!

গড়িয়াহাটের মোড়ের কাছে আসতেই হঠাৎ খেয়াল হলো।

এই তো! একটু হেঁটে গেলেই তো লক্ষ্মীদির বাড়ি। এখনি গিয়ে তো লক্ষ্মীদির কাছ থেকে ভুবনেশ্বরবাবুর ঠিকানাটা যোগাড় করা যায়। কিন্তু লক্ষ্মীদি কি ঠিকানা দেবে?

সামনেই একটা ট্যাক্সি দাঁড়িয়েছিল। দীপঙ্কর ট্যাক্সির দরজা খুলে ভেতরে গিয়ে বসলো। বললে–ঢাকুরিয়া লেভেল-ক্রসিং–

পাঞ্জাবী ট্যাক্সি ড্রাইভার। সার সার অনেকগুলো ট্যাক্সি দাঁড়িয়েছিল। একজনের বরাত খুলে গেল। ট্যাক্সিটা চলতে আরম্ভ করতে মনে হলো একটু তাড়াতাড়ি করাই ভালো। কাশীটা অনেকক্ষণ হয়ত বসে আছে জেগে কিম্বা হয়ত না-খেয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে। কাশীকে আর-একটা গেঞ্জি কিনে দিতে হবে। দুটো মাত্র গেঞ্জি। দুটো গেঞ্জিতে ঠিক চলে না ওর। ওই বয়েসে দীপঙ্করও অনেক কষ্ট করেছে। কিন্তু পরের বাড়িতে তার মত চাকরের কাজ করতে হয়নি।

–এই রোখকে!

কখন লেভেল-ক্রসিংটা পেরিয়ে এসেছিল খেয়াল ছিল না। হঠাৎ খেয়াল হয়েছে। রাস্তাটির বেঁকবার মুখে। দীপঙ্কর বললে–আরেকটু পিছে হটো, আর একটু পিছে–

দরকার নেই। এটুকু হেঁটে গেলেই চলবে। কিন্তু তার পরেই মনে হলো ট্যাক্সিটা ছেড়ে দিয়েই বা কী হবে। আগে দেখা যাক, লক্ষ্মীদিরা এখানে আছে কিনা। হয়ত লক্ষ্মীদি এখানে আর নেই এখন। কিন্তু বাড়িটা তেমনই আছে। সেই সামনে একটা নর্দমা। নর্দমাটা পেরিয়ে বাড়ির ভেতরে ঢুকতে হয় একটা গলি দিয়ে। গলির মুখে একটা দরজা। দরজাটা তখনও খোলা। ঢুকতে গিয়েও কেমন একটু দ্বিধা হতে লাগলো। অনেকদিন পরে ঢুকছে, সেই দিনকার সেই ঘটনার কথাটাও মনে পড়লো। এখনও কি সেই অনন্তবাবু আছে এখানে? লোকটা সত্যিকারের স্কাউড্রেল! আর দাতারবাবু!

গলিটা দিয়ে একটু এগিয়ে যেতেই যেন অনেক লোকের গলার আওয়াজ পাওয়া গেল। গলির শেষেই ঘরটা। সেখান থেকেই আওয়াজটা আসছে।

যেন কেউ চিৎকার করছে। আবার সঙ্গে সঙ্গে হাসির আওয়াজ। আবার অনেক লোকের কথা। বিভিন্ন ভাষায় কথা বলছে সবাই। এত লোক এ-বাড়িতে কোথা থেকে এল? এরা সব কারা? এখানে কী করতে এসেছে? তবে কি লক্ষ্মীদিরা চলে যাবার পর অন্য লোকেরা এসেছে এ-বাড়িতে! অন্য লোকেরা বাস করছে!

একটু এগিয়ে গিয়েই একটা জানালা। জানালাটা খোলা ছিল। খোলা জানালার ভেতর দিয়ে সব দেখা গেল এ নিমেষে।

আশ্চর্য! অনেকদিন পরে যখন এই ঘটনার কথা মনে পড়েছে দীপঙ্করের তখন অবাক হয়ে গিয়েছে। এমন অবস্থার মধ্যে দিয়ে যাকে কাটাতে হয়েছে, সেই লক্ষ্মীদিই বা জীবনের মোড় এমন করে কী করে ফেরালে! কোন মন্ত্র জানতো লক্ষ্মীদি! কোন জাদু জানতো! দীপঙ্করের কতবার মনে হয়েছে লক্ষ্মীদি এ কী করেছে। এ যে সর্বনাশের চুড়োয় উঠেছে লক্ষ্মীদি। এখান থেকে পা ফসকালে যে একেবারে রসাতলে তলিয়ে যাবে। লক্ষ্মীদির মুখের দিকে তখন ভালো করে তাকানোও যেত না। চেয়ে দেখলে ঘেন্না হতো। লক্ষ্মীদির চোখ দুটোর চারপাশে কালো দাগ পড়ে গিয়েছিল। সেই গালের লাল আভাটুকু কোথায় উবে গিয়েছিল। ভাবাও যেত না, একদিন এই লক্ষ্মীদিই পায়ে ঘুঙুর পরে নাচতো। গায়ের শাড়িটা আঁট করে কোমরে জড়িয়ে নাচতো। সেদিন সেই লক্ষ্মীদির হাতের মার খাবার জন্যেই কত লোভ হতো দীপঙ্করের। সেই লক্ষ্মীদিকে দেখবার জন্যে পাড়ার ছেলেরা তার কলেজে যাবার সময় জটলা করে দাঁড়িয়ে থাকতো। যারা গান গেয়ে গেয়ে বন্যার চাঁদা চাইতে আসতো তারা দোতলায় লক্ষ্মীদির দিকে চেয়ে গান গাইতে ভুলে যেত। সেসব দিনের কথা কি দীপঙ্কর জীবনে ভুলতে পারবে।

আজ এতদিন পরে আবার সেই লক্ষ্মীদির কাছেই আসতে হয়েছে। যদিও দীপঙ্কর আর সে-দীপঙ্কর নেই। সেদিনকার সেই গরীব দীপঙ্কর এখন চাকরি করছে। ভাল চাকরি করছে। দশজনের মাথায় উঠেছে। সবাই খাতির করে, সবাই নমস্কার করে তাকে। এখন সমীহ করে কথা বলে। চাকরির জন্যে, প্রমোশনের জন্যে, কনফার্মেশনের জন্যে খোশামোদ করে অনেকে। কিন্তু কেউ জানে না ভেতরে সে বদলায়নি। অন্তরের অন্তস্তলে এখনও সেই শিশুটি তার লুকিয়ে আছে। সে এখনও বেগুনী-ফুলুরি তেলেভাজা খেতে চায়, এখনও আনন্দে আত্মহারা হয়ে ওঠে, বেদনায় বুক ফেটে কান্না বেরিয়ে আসে।

জানালা দিয়ে দেখতে দেখতেও লজ্জায়-ঘেন্নায় দীপঙ্করের বুকটা যেন ফেটে যেতে লাগলো।

বোধহয় পাঁচ-ছ’জন লোক মেঝেয় মাদুরের ওপর বসে আছে। বসে বসে তাস খেলছে। শুধু তাস খেলছে নয়, সকলের সামনে গ্লাস রয়েছে। গ্লাসের মধ্যে যা রয়েছে তা দীপঙ্কর চিনতে পারলে। আর সকলের মাঝখানে টাকা নোট পয়সা জমা রয়েছে অনেক। এক হাতে টাকা ছুঁড়ছে আর এক হাতে তাস। আর গা ঘেঁষে বসে রয়েছে লক্ষ্মদি! লক্ষ্মীদি খেলা দেখছে আর হাসছে খিলখিল করে।

যারা খেলছে তাদের চিনতে পারলে না দীপঙ্কর। এরা কারা? অনন্তবাবু তো নেই এদের মধ্যে! সে কোথায় গেল?

একজন হঠাৎ চিৎকার করে উঠলো–কুইন অব স্পেড্‌স্‌–

আরও যেন কী সব বললে। দীপঙ্কর বুঝতে পারলে না। তাস খেলতেই জানে না দীপঙ্কর তো তাসের কথা বুঝতে পারবে কী করে! আর বোঝবার উপায়ও ছিল না। সেই ভদ্রলোকের চিৎকারের সঙ্গে সঙ্গে একটা হট্টগোল উঠলো। সে হট্টগোল আর থামে না।

একজন বললে–আমি সীন খেলেছি, আমার কী দোষ–

কিন্তু হট্টগোল আর থঅমে না। চিৎকার হৈ চৈ হট্টগোল। লক্ষ্মীদি হঠাৎ একজনের পাশে গিয়ে গা ঘেঁষে বসে তার হাত দুটো চেপে ধরলে। বললে–তুমি চুপ করো সুধাংশু–

সুধাংশু বললে–বারে, তুমি আমাকে চুপ করতে বলছো! আমি ব্লাইন্ড খেলেছি–আমি কেন চুপ করবো?

–আমি বলছি তুমি চুপ করো সুধাংশু–

লক্ষ্মীদি এমনভাবে চাইলে সুধাংশুর দিকে যে দীপঙ্করও সে-চাউনি দেখে চমকে উঠলো। এরকম তো ছিল না লক্ষ্মীদি! লক্ষ্মীদির চোখের চাউনিতেই ভদ্রলোক চুপ করে গেল। বললে–ঠিক আছে, মিসেস দাতার যখন বলছে তখন আমি ছেড়ে দিচ্ছি, কিন্তু চৌধুরী, এবার থেকে কেয়ারফুল হয়ে খেলবে–

–এবার কার ডীল?

লক্ষ্মীদি বললে–এবার চৌধুরীর ডীল–

নতুন করে আবার তাস দিতে লাগলো একজন। আবার নতুন করে তাস তুলে নিলে সবাই। লক্ষ্মীদি সকলের কাছ ঘেঁষে তাস দেখতে লাগলো। আবার ডাক চলতে লাগলো। টাকা পয়সা নোট আবার পড়তে লাগলো মাদুরের ওপর। একটা চাকর এসে আবার গ্লাস ভর্তি করে দিয়ে যেতে লাগলো। আবার হাসি, আবার তর্ক, আবার ঝগড়া। যে জিতেছে সে স্তূপাকার টাকা-নোট-পয়সা সব নিয়ে নিচ্ছে। তার থেকে ভাগ দিচ্ছে লক্ষ্মীদিকে। লক্ষ্মীদি আবার সেই টাকা নিয়ে একটা ব্যাগে রেখে দিচ্ছে। এইরকম চললো অনেকক্ষণ ধরে। সবাই অবস্থাপন্ন, সবাই বেশ শিক্ষিত ভদ্রলোক বলে মনে হলো। কী আনন্দেই আছে এরা! কী উৎসাহ খেলায়! পৃথিবীর কোথায় কী ঘটছে, কোথায় কী চলছে, কোনও দিকেই এদের খেয়াল নেই। সবাই যেন এক ছকে বাঁধা। এরা সবাই কি এখানে এই বাড়িতেই থাকে নাকি? কোথায় শোয়? কোথায় খায়? কোথায় চাকরি করে? এরা কারা?

–ট্রায়ো!

চিৎকার করে উঠলো একজন। হাসির হুল্লোড় পড়ে গেল সঙ্গে সঙ্গে। ভদ্রলোক তাড়াতাড়ি টাকা-পয়সাগুলো নিজের কোলের দিক টেনে নিলে। লক্ষ্মীদিও তার থেকে ভাগ নিলে। নিজের ব্যাগে রাখলে।

লক্ষ্মীদি বলে উঠলো–চৌধুরীর আজকে লাক্ ফিরে গেছে সুধাংশু-ওর সঙ্গে পারবে না–

সুধাংশু বললে–আমার তো বরাবরই লাক খারাপ মিসেস দাতার–

–দাঁড়াও, আমি তোমার লা ভাল করে দিচ্ছি—

বলে লক্ষ্মীদি সরে গিয়ে সুধাংশুর ঠিক পেছনে একেবারে তার পিঠ ঘেঁষে বসলো। তারপর আবার খেলা চলতে লাগলো। সঙ্গে সঙ্গে সব টাকা-পয়সাগুলো জমতে লাগলো। সুধাংশুর পকেটে।

চৌধুরী বললে–ওকে বড় জিতিয়ে দিচ্ছেন মিসেস দাতার–একটু আমাদের দিকেও কুপা-বর্ষণ করুন–

লক্ষ্মীদি বললে–তোমার লাক ফিরিয়ে দিলে আগে তুমি কী দেবে বলো?

চৌধুরী খেলতে খেলতে বললে–আমি আপনাকে সব দিতে পারি মিসেস দাতার–

লক্ষ্মীদি তেমনি হাসতে হাসতেই বললে–সব দিলে তোমার বউ-এর জন্যে কী থাকবে চৌধুরী?

–বউ-এর জন্যে রইল আমার দেনা!

বলে হো হো করে হেসে উঠলো চৌধুরী। সঙ্গে সঙ্গে সবাই হেসে উঠলো। আবার চাকরটা এসে গ্লাস ভর্তি করে দিয়ে গেল। লক্ষ্মীদি এক মনে খেলা দেখতে লাগলো সুধাংশুর পিঠ ঘেঁষে।

সুধাংশু লক্ষ্মীদিকে একটা সিগারেট এগিয়ে দিয়ে বললে–সিগ্রেট খাবেন নাকি মিসেস দাতার?

লক্ষ্মীদি বললে–দিচ্ছ খাবো–

বলে সত্যি সত্যিই সিগারেট মুখে দিলে লক্ষ্মীদি আর সুধাংশু দেশলাই ধরিয়ে দিলে। আর সত্যি সত্যিই লক্ষ্মীদি সিগারেট টানতে লাগলো। ধোয়াও বেরোতে লাগলো মুখ দিয়ে। মুখ থেকে ধোঁয়া ছাড়বার কায়দা দেখে দপিঙ্করের মনে হলো লক্ষ্মীদি যেন সিগারেট খেতে জানে। সিগারেট খাওয়ার অভ্যেস আছে বেশ। খেয়ে যেন বেশ আরাম পেতে লাগলো।

দীপঙ্কর আর দাঁড়াতে পারল না। সমস্ত শরীরটা যেন রি-রি করে উঠল। এখানে যেন না-এলেই ভাল হতো। না-এল তো আর এ জিনিস দেখতে হতো না। কেন সে এল। কেন দীপঙ্কর এখন এখানে আসতে গেল। কে তাকে আসতে মাথার দিব্যি দিয়েছিল!

ট্যাক্সিটার ভাড়া মিটিয়ে দেওয়া হয়নি। এখনও দাঁড়িয়ে আছে রাস্তায়।

দীপঙ্কর গলিটা দিয়ে আবার ফিরে চলতে লাগলো। এ সব কী হয়ে গেল! সমস্ত যেন আমূল বদলে গেল মানুষের সমাজের। বেশ তো ছিল লক্ষ্মীদি! বেশ তো ছিল সতী। বেশ তো ছিল মিস মাইকেল! বেশ তো ছিল ছিটে-ফোঁটাও! বেশ তো ছিল বিন্তিদি! কিন্তু কোথায় যেন একটা সুতোয় টান পড়লো আর বদলে গেল সবাই। দীপঙ্করের চোখের সামনেই যেন সব বদলে গেল। সমস্ত কলকাতা শহরটাই বদলে গেল। শুধু ভূগোলই বদলায়নি, শুধু ইতিহাস বদলায়নি। ভূগোল ইতিহাসের ধারণাটাই বদলে গেল যেন! শুধু কালীঘাট বদলায়নি, বালিগঞ্জ বদলায়নি। কালীঘাট বালিগঞ্জের মানুষগুলোই বদলে গেল। আর শুধু মানুষই-বা কেন, মানুষের মনগুলোও যেন বদলে গেল। কোন অদৃশ্য লোকের ইঙ্গিতে যেন কালীঘাট বালিগঞ্জ কলকাতা পৃথিবী সব কিছু অন্যরকম হয়ে গেল। শুধু তো পৃথিবী নয়। বিগত বর্তমান অনাগত সমস্ত কিছুই অন্যরকম হয়ে গেল। এ কী আশ্চর্য! দীপঙ্করই কি একরকম আছে! দীপঙ্করের সেই বয়েসটা না-থাক, দীপঙ্করের চোখটাও কি সেই একরকম আছে! দীপঙ্কর কি এখনও সেই আগেকার মত রাস্তায় ছেঁড়া জামা ছেঁড়া চটি পরে ঘুরতে পারে! সেই আগেকার মত তেলেভাজা, আগেকার মত চিনেবাদাম চিবোতে চিবোতে ঘুরে বেড়াতে পারে! এখন তো তার ফরসা জামা-কাপড় ফরসা কোট-প্যান্ট ফরসা ধুতি-শার্ট দরকার হয়। ফরসা জামা-কাপড়ের সঙ্গে তার মনটাও কি বেশি ফরসা হয়েছে! তার খাতির হয়ত বেড়েছে, তার মাইনে হয়ত বেড়েছে, কিন্তু মনুষ্যতু কি এক তিল বেশি বেড়েছে তার! মনুষ্যত্ব বাড়লে দীপঙ্কর তো আজ সনাতনবাবুর সঙ্গে দেখা করে কথা বলে আসতো! কথা বলে সতীর অপমানের প্রতিকার চাইতো। মনুষ্যত্ব বাড়লে তো আজ দীপঙ্কর লক্ষ্মীদির সঙ্গে দেখা করে কথা বলে আসতো! কথা বলে লক্ষ্মীদির অধঃপতনের প্রতিকার করতো!

দীপঙ্কর বাইরে এসে আবার ট্যাক্সিতে উঠলো–শিখ ড্রাইভার তখনও হাঁ করে বসেছিল। তার ভাড়া উঠছে মিটারে।

দীপঙ্কর বললে—হ্যাঁ–চলো—

কিন্তু অসহায়ের মত যদি শুধু সমস্ত কিছু দেখা ছাড়া আর কিছুই সে করতে পারবে না, তা হলে কেন সে এসেছির এখানে? দীপঙ্কর কি ভয় পেয়ে গেল নাকি? লক্ষ্মীদিকে তার এখনও ভয়? লক্ষ্মীদিকে ভয় করবার এখন আর কী আছে! এখনও কি লক্ষ্মীদি তার চেয়ে বড় আছে? এখনও কি লক্ষ্মীদি তাকে সেই ছোটবেলাকার মত চাটি মারতে পারে? আশ্চর্য! লক্ষ্মীদির চেহারাটা তার চোখের সামনে স্পষ্ট ভেসে উঠলো। লক্ষ্মীদি যেন তখনও তার চোখের সামনে খিলখিল করে হাসছে আর সিগারেট খাচ্ছে। যেন কায়দা করে তখনও লক্ষ্মীদি তার চোখের সামনে সিগারেটের ধোঁয়া ছাড়ছে। দীপঙ্কর নিজের দুর্বলতায় নিজেই লজ্জায় পড়লো। তারও তো অধিকার আছে। অধিকার আছে প্রতিকার করবার। অধিকার আছে প্রতিবাদ করবার।

হঠাৎ চিৎকার করে উঠলো দীপঙ্কর–ঘুরিয়ে নিয়ে চলোট্যাক্সি ঘুরাও—

ড্রাইভার অবাক হয়ে গেছে। পেছন ফিরে চাইলে দীপঙ্করের দিকে।

দীপঙ্কর বললে–যেখান থেকে উঠেছিলাম, ওখানেই নিয়ে চলো আবার—

ট্যাক্সি আবার ঘুরলো। আবার গিয়ে দাঁড়াল লক্ষ্মীদির বাড়ির সামনে।

সত্যিই তো, তারও তো অধিকার আছে প্রতিকার করবার! অধিকার আছে প্রতিবাদ করবার!

আবার সেই গলি রাস্তা। তখনও দরজাটা তেমনি খোলা। দীপঙ্কর একেবারে শেষ প্রান্তে গিয়ে দাঁড়াল। সেই খোলা-জানালার সামনে তখনও সুধাংশুর পিঠ ঘেঁষে বসে আছে লক্ষ্মীদি। তখনও হাসছে খিখিল করে। তখনও লাভের ভাগ নিচ্ছে। তখনও চাকর এসে সকলের গ্লাস ভর্তি করে দিচ্ছে। যেমন চলছিল, ঠিক তেমনই চলছে। এদের আসর এমনি কতক্ষণ চলবে কে জানে!

দীপঙ্কর হঠাৎ ডাকলে–লক্ষ্মীদি!

ডাকটা শুনেই লক্ষ্মীদি চমকে পেছন ফিরে দেখলে।

তারপর বললে–কে?

বলে উঠে বাইরে চলে এল।

অন্ধকারে প্রথমে চিনতেই পারেনি লক্ষ্মীদি। কিম্বা হয়ত এতদিন পরে দেখছে বলে না চেনাটাই স্বাভাবিক। দীপঙ্করও তো এতদিন পরে দেখছে লক্ষ্মীদিকে। খানিকক্ষণ যেন হাঁ করে চেয়ে দেখলে দীপঙ্করের মুখের দিকে।

বললে–কে আপনি? কাকে চান?

–আমি লক্ষ্মীদি, আমি! দীপু!

–ও তুই? কী রে? এতদিন পরে তুই কোত্থেকে?

লক্ষ্মীদি যেন বিব্রত হয়ে পড়লো মনে হলো। দীপঙ্করকে কোথায় বসাবে, এই নিয়ে যেন চিন্তান্বিত হলো। কিন্তু সে এক মুহূর্তের জন্যে। হঠাৎ দীপঙ্কর বললে–আমি অনেকক্ষণ এসেছি লক্ষ্মীদি-সব দেখেছি।

পিঙ্করের মুখের দিকে ভালো করে। যেন সন্দেহ হতে লাগলো। দীপঙ্কর বললে–আমি এসেছিলাম একটা কাজে–

লক্ষ্মীদি সে-কথার ধার দিয়েও গেল না। বললে–কী দেখেছিস?

দীপঙ্কর বললে–আমার মুখে সে না-ই বা শুনলে।

লক্ষ্মীদি বললে–আমি সিগ্রেট খাই, আমি মদ খাই, এই তো?

–শুধু তাই নয়, আরো অনেক কিছু দেখেছি।

লক্ষ্মীদি বললে–লুকিয়ে লুকিয়ে পরের বাড়ির ভেতর চেয়ে দেখতে তোর লজ্জা করে না?

লক্ষ্মীদির গলাটা যেন একটু তীক্ষ্ণ শোনালো।

দীপঙ্কর বললে–পর মনে করলে তো আমি চেয়ে দেখতাম না। আর তোমাকে পর মনে করলে তোমার সঙ্গে কথা না-বলেই চলে যেতাম। চলে যেতে গিয়েও চলে যেতে পারলাম না, ফিরে এসে তোমাকে ডাকলুম!

লক্ষ্মীদি কথাটা শুনে কিছুক্ষণ চুপ করে রইল। তারপর বললে–এখন কী কাজে এসেছিলি বল?

দীপঙ্কর বললে–তুমি খুব ব্যস্ত, আমি জানি। আমার সঙ্গে কথা বললে তোমার সময় নষ্ট হবে তাও জানি। সুতরাং নিজের কাজটা সেরেই আমি চলে যাবো-তোমাকে বিরক্ত করতে আর কখনো আসবো না তোমার বাড়িতে

–কিন্তু আমার সঙ্গে তোর কাজটা কী?

দীপঙ্কর বললে–তোমার বাবার ঠিকানাটা দাও-ঠিকানাটা আমার দরকার—

হঠাৎ ভেতর থেকে কে যেন ডাকলে-মিসেস দাতার—

লক্ষ্মীদি সে-ডাকের উত্তর না দিয়ে বললে–কেন? ঠিকানা নিয়ে কী করবি তুই?

–মিসেস দাতার? কোথায় গেলেন আপনি?

বলতে বলতে সেই ভদ্রলোক বাইরে এসে হাজির। এরই নাম সুধাংশু। তার পেছনে চৌধুরীও এল। তার পেছনে আরও দুজন ভদ্রলোক এল। দীপঙ্করকে দেখে তারা অবাক হয়ে গেছে।

লক্ষ্মীদি তাদের দিকে না-চেয়েই বলতে লাগলো–ঠিকানা নিয়ে তুই আমার বাবাকে জানাবি ভেবেছিস? কেন? বাবাকে জানিয়ে তোর কিসের লাভ? কী হবে বাবাকে জানিয়ে? আমাকে অপমান করবার জন্যে? আমাকে ভালো করবার জন্যে? কী মতলব করে এসেছিস, বল না আমাকে

দীপঙ্করের মুখ দিয়ে কোনও কথা বেরোল না। এতগুলো লোক, তারাও কিছু বুঝতে পারছে না। কে দীপঙ্কর, লক্ষ্মীদির সঙ্গে দীপঙ্করের কী সম্পর্ক, তারা তাও জানে না।

লক্ষ্মীদি আবার প্রশ্ন করলে-কথা বলছিস না কেন, কথা বল?

ভদ্রলোকরা দীপঙ্করের মুখের দিকে তখনও হাঁ করে তাকিয়ে আছে। সিগারেট খাচ্ছে সবাই। দীপঙ্করের চেহারা, দীপঙ্করের হাব-ভাব দেখে মিসেস দাতারের সঙ্গে তার সম্পর্কটা আন্দাজ করবার চেষ্টা করছে।

সুধাংশু জিজ্ঞেস করলে–ইনি কে, মিসেস দাতার?

লক্ষ্মীদি সে-কথার উত্তর দিলে না। বললে–কীরে, বোবা হয়ে গেলি নাকি?

দীপঙ্কর একটু থেমে বললে–না, বোবা হইনি, বোবা হলেই অবশ্য ভালো হতো। তোমার কাণ্ডজ্ঞান দেখে যোবা হওয়াই স্বাভাবিক, কিন্তু থাক, এখন আমি যাই–

–কার সঙ্গে কথা বলছেন মিসেস দাতার, কে এ ভদ্রলোক?

লক্ষ্মীদি বললে–তোমরা থামো…..তা যে-কাজের জন্যে এসেছিলি, তা না বলে চলে যাচ্ছিস কেন?

সুধাংশু বললে–আপনি রাগ করছেন কেন স্যার, খেলবার যদি ইচ্ছে থাকে তো আপনিও খেলুন না, আমাদের কোনও আপত্তি নেই, আপনার লা ভাল থাকলে আপনি জিতবেন, আমরা রাগ করবো না। যে-যার ভাগ্য নিয়ে এসেছি আমরা-জীবনটাই তো জুয়া–

দীপঙ্কর বললে–না, আপনারাই খেলুন, আমি তাস খেলতেই জানি না, আপনাদের সময় নষ্ট করার জন্যে আমায় ক্ষমা করবেন-আমি এখনি চলে যাচ্ছি

তারপর একটু থেমে বললে–আর তাছাড়া আপনাদের মত আমি জীবনটাকে জুয়া বলে মনে করি না। জীবনের আরো অনেক মানে আছে। জুয়া খেলে নষ্ট হবার জন্যে মানুষ সৃষ্টি হয়নি। সে-সব নিয়ে মাথা ঘামানোর সময় আপনাদের নেই, আর আমারও সময়ের দাম আছে-নইলে এ নিয়ে অনেক কথা বলা যায়–

চৌধুরী সিগারেটে টান দিয়ে বললে–ঠিক বলেছেন দাদা, টাইম ইজ মনি–

অন্য সবাই চৌধুরীর কথা বলার ঢং দেখে হো-হো করে হেসে উঠলো। লক্ষ্মীদিও হেসে উঠলো সকলের সঙ্গে। দীপঙ্করের মনে হলো যেন সবাই ঠাট্টা করছে তাকে। সবাই হাসির পাত্র পেয়েছে তাকে। কিন্তু এর চেয়েও অনেক অপ্রিয় ঘটনার মধ্যে জড়িয়ে পড়েছে দীপঙ্কর। এতে বিচলিত হলে চলে না। দীপঙ্করের মনে হলো, এদের সে চেনে। এরাই হলো কোট-প্যান্ট-পরা ছিটে-ফোঁটা। আসলে ছিটে-ফোঁটার সঙ্গে, এদের ভেতরের কোনও তফাত নেই। ঠিটে-ফোঁটারা কালীঘাটের বাজারে যেত, আর এরা এসেছে লক্ষ্মীদির বাড়িতে। উদ্দেশ্য এদের একই। এরাই অনন্তরাও ভাবে, এরাই ঘোষাল সাহেব, এরাই মিস মাইকেলের টম-ডিক-হ্যারি। এদের কোনও জাত নেই। এরা সারা পৃথিবী জুড়ে রয়েছে। পৃথিবী জুড়ে রাজত্ব করছে।

সুধাংশু হঠাৎ বললে–মিসেস দাতারকে আপনি একলা পেতে চান বুঝি?

লক্ষ্মীদি সে-কথার প্রতিবাদ করলে। বললে–তুমি থামো সুধাংশু, কার সঙ্গে কী কথা বলতে হয় জানো না–

তারপর দীপঙ্করের দিকে চেয়ে বললে–তুই এখন যা দীপু, এখন চলে যা-রাত্তিরে আর কখনও আসিসনি আমাদের বাড়িতে–

দীপঙ্কর চেয়ে দেখলে লক্ষ্মীদির মুখের দিকে। লক্ষ্মীদির মুখের কথা যেন বড় করুণ হয়ে বাজলো দীপঙ্করের কানে। লক্ষ্মীদি পিঠে হাত দিয়ে দীপঙ্করকে দরজার দিকে নিয়ে চললো। অন্ধকার চারিদিক এখানটায়।

দরজার কাছে এসে দীপঙ্কর থামলো। বললে–এর পরেও আসতে বলো তুমি আমাকে?

লক্ষ্মীদি বললে–আর কখনও আসিসনি তুই–

দীপিঙ্কর বললে–আসবার সময় অনেক কিছু ভেবে এসেছিলাম, অনেক কথাও ছিল তোমার সঙ্গে। কিন্তু কিছুই বলা হলো না–

লক্ষ্মীদি বললে–কিন্তু প্রাণ গেলেও বাবার ঠিকানা তোকে আমি দিতে পারবো না–

দীপঙ্কর বললে–বিশ্বাস করো, তোমার কথা আমি বাবাকে জানাবো না। আমি সতীর জন্যে ঠিকানাটা নিতাম–

–সতী? সতী কোথায়?

লক্ষ্মীদি সতীর নাম শুনেই চমকে উঠলো!

বললে–সতীর জন্যে বাবাকে চিঠি লিখবি? কেন, সতীর কী হয়েছে?

দীপঙ্কর বললে–সতী তোমার চেয়ে কষ্টে আছে, তোমার তবু যা খুশি করবার স্বাধীনতা আছে, কিন্তু তার তাও নেই। তার কষ্টের প্রতিকার কেবল তোমার বাবাই করতে পারেন।

–কিন্তু সতীর তো বিয়ে হয়েছে বড়লোকের বাড়িতে! বাবা তো নিজেই অনেক দেখেশুনে তার ভাল জায়গায় বিয়ে দিয়ে গেছেন! তার তো অনেক টাকা!

–তা শুধু টাকা হলেই কি সুখ হয় সংসারে?

লক্ষ্মীদি বললে–আমার টাকা থাকলে কি আজ এইরকম করে সংসার চালাতে হতো? টাকা নেই বলেই তো আমার এত কষ্ট!

দীপঙ্কর বললে–সেসব কথা থাক, তুমি ঠিকানাটা দাও–আমি আজই চিঠি লিখে দেব। আমি কথা দিচ্ছি, তোমার কথা লিখবো না চিঠিতে।

লক্ষ্মীদি কী যেন ভাবলে। বললে–আমার সঙ্গে যে তোর দেখা হয়েছে, তাও জানাবি না তো?

দীপঙ্কর বললে—না–

–আমার বিয়ের আগে তুই যে শম্ভুকে গিয়ে চিঠি দিয়ে আসতিস, তাও জানাবি না তো?

–না, তাও জানাবো না।

লক্ষ্মীদি আবার বললে–ভেবেছিলাম বাবার কাছ থেকে চলে এসে নিজের এক নতুন সংসার গড়ে তুলবো, আমার অহঙ্কার, আমার অভিমান, সবকিছু বজায় রাখতে পারবো আমি নিজের পায়ে নিজে দাঁড়িয়ে আকাশে মাথা ঠেকিয়ে রাখবো, কিন্তু সব সাধ ধুলোয় লুটিয়ে গেল। আমি একেবারে ফুরিয়ে গেলাম রে–

বলে লক্ষ্মীদি মাথা নিচু করে কিছুক্ষণ চুপ করে রইল।

দীপঙ্কর বললে–তোমার মায়াকান্না শোনবার সময় আমার নেই, তুমি ঠিকানাটা দেবে তো দাও-আমার নিজেরও অনেক সমস্যা আছে, আমার নিজেরও অনেক কাজ আছে–

লক্ষ্মীদি মুখ তুলে চাইল দীপঙ্করের দিকে।

দীপঙ্কর বললে–তোমাকে দেখছি আর ভাবছি, তুমি এখনও সেই রকমই আছো, সেই একইরকম, কিন্তু পৃথিবী কত বদলে যাচ্ছে দিন-দিন, সেদিকে তোমার কোনও খেয়ালই নেই–মান-অভিমান সব মানুষেরই থাকে, কিন্তু একটা বয়েসের পরে তা আর মানায় না–

লক্ষ্মীদি কথা বোধহয় বুঝতে পারলে না।

দীপঙ্কর বললে–লোকের বয়েস বাড়ে, সঙ্গে সঙ্গে তার জ্ঞানও বাড়ে কিন্তু তোমার এ কীরকম বলো তো, যত বয়েস বাড়ছে, তত তুমি ছেলেমানুষ হয়ে যাচ্ছো

–তার মানে?

–তার মানে আমি তোমাকে বার-বার বোঝাতে পারবো না, তুমি বুঝবেও না–তোমার মুখে এখন মদের গন্ধ পাচ্ছি, যদি তুমি সুস্থ থাকতে তো তোমায় বোঝাতুম

লক্ষ্মীদি হঠাৎ আরো গম্ভীর হয়ে গেল। বললে–তুই যখন ওই কথা বললি, তাহলে আয়, আমার সঙ্গে আয়, দেখে যা

বলে লক্ষ্মীদি দীপঙ্করের হাতটা খপ্‌ করে ধরে ফেললে।

দীপঙ্কর বললে–-ছাড়ো, হাত ছাড়ো–

–না তোকে দেখতেই হবে, তুই নিজের চোখেই আজ দেখে যা–

দীপঙ্কর বললে–আমি দেখেছি, যা-দেখবার আমি সব দেখেছি–

–না, তুই কিছুই দেখিসনি, তোর দেখবার অনেক বাকি—

বলে লক্ষ্মীদি হিড়হিড় করে দীপঙ্করকে টেনে ভেতরে নিয়ে চললো আবার।

দীপঙ্কর বললে–তোমার ঘরে ওরা সব রয়েছে, ওরা কী ভাববে বলো তো! ছাড়ো–

লক্ষ্মীদি দীপঙ্করকে নিয়ে একেবারে সোজা ঘরের মধ্যে গিয়ে দাঁড়াল। মনে আছে, দীপঙ্করকে সেই অবস্থায় দেখে ঘরের মধ্যে যারা ছিল, সবাই অবাক হয়ে গিয়েছিল সেদিন। তারা ভেবেছিল যেন হয়ত দীপঙ্করও তাদের মতো একজন এসে হাজির হলো। ভেবেছিল দীপঙ্করও তাদের মত রোজ সেখানে গিয়ে তাস খেলবে, তাদের মত দান ফেলবে, আর সময়ের আর মাংসের সদ্ব্যবহার করবে।

কিন্তু লক্ষ্মীদির কথায় সবাই চমকে উঠলো।

লক্ষ্মীদি বললে–তোমরা এখন ওঠো সুধাংশু চৌধুরী–তুমিও ওঠো–তোমরাও ওঠো আজ সকলে–

চৌধুরী বললে–সে কি মিসেস দাতার, এখনও যে নাইট ইজ ইয়াং–

–হোক, আজ দীপু এসেছে, দীপুর সঙ্গে আজ আমার একটু কাজ আছে–আজ ওঠো তোমরা–

লক্ষ্মীদির চোখের চাওয়ায় বোধহয় রুতা ছিল একটা। কেউ আর বেশি আপত্তি করলে না। আস্তে আস্তে উঠতে লাগলো সবাই। যেন অনিচ্ছে রয়েছে উঠতে। স্যুট-পরা ভদ্রলোক সব। হয়ত ভাল চাকরি করে সবাই। আপিসের কোনও বড়সাহেব হয়ত। গভর্নমেন্ট আপিসের বিগ-বস হয়ত। এদেরই ভয়ে হয়ত আপিসের ক্লার্করা কাঁপে। দামী সিগ্রেট খাচ্ছে, দামী আংটি পরেছে, দামী সময়-জ্ঞান। সময় নষ্ট না করে এখানে টাকা উপায় করতে এসেছে। কিন্তু লক্ষ্মীদির সামনে সবাই মাথা নিচু করে ফেললে।

সুধাংশু বললে–গুড লাক টু ইউ বয়–

লক্ষ্মীদি বললে-–চুপ সুধাংশু দীপু আমার ভাই-এর মতন—

চৌধুরী হঠাৎ বলে উঠলো–ভাই-ভাতারি বুঝি?

লক্ষ্মীদি আর থাকতে পারলে না। ঠাস করে চৌধুরীর গালে এক চড় কষিয়ে দিয়েছে। হঠাৎ চড় খেয়ে চৌধুরী যেন টলে পড়ছিল। কিন্তু সামলে নিলে। লক্ষ্মীদি বললে–কার সঙ্গে কী কথা বলতে হয় জানো না তো চুপ করে থাকতে পারো না–

চৌধুরী আর কোনও কথা বললে না। আস্তে আস্তে আহত কুকুরের মত নিজের জুতো জোড়া পায়ে পরতে লাগলো। সুধাংশুও সিগারেটের টিনটা হাতে তুলে নিয়ে বাইরে গিয়ে দাঁড়াল। তারপর সবাই বাইরে চলে যাবার পর লক্ষ্মীদি বললে–কেশব, বাইরের দরজায় খিল দিয়ে দিগে যা–

কেশব চলে যেতেই দীপঙ্কর লক্ষ্মীদির মুখের দিকে চাইলে। একেবারে অন্য চেহারা হয়ে গেছে তখন। আবার একেবারে অন্য মানুষ। লক্ষ্মীদির সামনে দাঁড়িয়ে থাকতেও যেন ভয় পাচ্ছিল। কেশব আসতেই লক্ষ্মীদি বললে–এসব সরিয়ে নিয়ে যা, সব পরিষ্কার করে ফেল–

খানিকক্ষণের মধ্যেই সব পরিষ্কার হয়ে গেল। সিগারেটের ছাইদানি, মদের গ্লাস, চায়ের কাপ যা কিছু সব। লক্ষ্মীদি বাক্সের ভেতরে কী যেন খুঁজছিল। টাকা-পয়সার আওয়াজ হলো। একটা টাকা নিয়ে কেশবের হাতে দিলে। বললে–যা তো কেবশ দুটো মিষ্টি নিয়ে আয় তো দোকান থেকে, রসগোল্লা হোক পান্তুয়া হোক–

দীপঙ্কর অবাক হয়ে গেল। বললে–মিষ্টি কী হবে? আমার জন্যে?

লক্ষ্মীদি বললে—হ্যাঁ তুই খাবি,–

দীপঙ্কর বললে–কিন্তু, আমি তো এখুনি বাড়ি যাবো, আমার তো কাছেই বাড়ি–

–কাছেই? কোথায়?

দীপঙ্কর বললে–এই তো স্টেশন রোডেই বাড়ি ভাড়া করেছি, মা ত ছে, একটা চাকরও আছে, আমি তো আর ঈশ্বর গাঙ্গুলী লেনে নেই–

লক্ষ্মীদি বললে–তা হোক, এখন তো আপিস থেকেই আসছিস্, একটু না-হয় খেলিই দিদির বাড়ি–

তারপর হঠাৎ বললে–তবে জুয়ার টাকায় যদি তোর খেতে আপত্তি থাকে তা হলে জোর করবো না!

দীপঙ্কর বললে–তুমিও তো জুয়ার টাকাতেই খাও–

–আমার কথা আলাদা! আমি আর তুই কি এক? তোর হয়ত এখানে বসতেই ঘেন্না হচ্ছে!

–কিন্তু এতই যদি ঘেন্না তোমার তাহলে কেন ওদের আসতে দাও?

লক্ষ্মীদি বললে–কেন আসতে দিই তাই দেখতেই তো তোকে ডাকলুম ভেতরে! অনন্তও একদিন এসেছিল আমার উপকার করতে, আমাকে সাহায্য করতে! আমার সব খরচ দিচ্ছিল, আমার বাড়ি ভাড়া, আমার খাওয়া-খরচ, আমার ছেলের….

–তোমার ছেলে?

দীপঙ্কর চমকে উঠলো। লক্ষ্মীদির আবার ছেলে আছে নাকি?

এমন সময় কেশব এসে ঢুকল খাবার নিয়ে। একটা রেকাবি করে মিষ্টি দুটো সামনে এগিয়ে দিলে। এক গ্লাস জলও দিলে। দিয়ে চলে যাচ্ছিল।

লক্ষ্মীদি বললে–বাবুর ঘরের দরজাটা খুলে দিয়ে আয় তো কেশব–

দীপঙ্কর বললে–তোমার ছেলে মানে? তোমার ছেলে আছে নাকি লক্ষ্মীদি?

লক্ষ্মীদি বললে–মিষ্টি দুটো খেয়ে ফেল। আমার নিজের ছেলেও ওই টাকাতেই খায়, ওই টাকাতেই পড়ে, তাকে আমি যখন দিতে পারি, তখন তোকে দিতে আপত্তি নেই–

–কিন্তু তোমার সে-ছেলে কোথায়?

লক্ষ্মীদি বললে–সে অনেক দূরে, দেরাদুনে, আমার কাছ থেকে তাকে অনেক দূরে রেখেছি, সে যেন আমার ছোঁয়াচ না পায়, তাই!

–কিন্তু এতদিন তো জানতুম না।

লক্ষ্মীদি হাসতে লাগলো। বললে–মানুষের সবটা কি জানা যায়?

তারপর দীপঙ্করের মুখ-চোখের ভাব দেখে বললে–কিন্তু কার ছেলে সে তা জিজ্ঞেস করলি না তো?

দীপঙ্কর মিষ্টিটা মুখে দিয়েও গিলতে পারলে না। লক্ষ্মীদির মুখের দিকে চেয়ে অবাক হয়ে রইল।

–কার ছেলে মানে?

লক্ষ্মীদি বললে–মানে শম্ভুর না অনন্তর?

দীপঙ্করের অবাক হওয়ার আগেই আর একজন ঘরে ঢুকলো আস্তে আস্তে। লক্ষ্মীদি সেই দিকে চেয়ে বললে–এসো এসো, বোসো–

বলে লক্ষ্মীদি গিয়ে তাকে ধরলে।

ভূতের মতন একটা ছায়া-শরীর সামনের দিকে এগিয়ে এল। যেন হাওয়ায় ভাসছে। একটা মোটা আধ-ময়লা পাঞ্জাবি গায়ে, মোটা ধুতি। মাথার চুলগুলো পাতলা। গাল তোবড়ানো, চোখ দুটো ঢোকা। বৃদ্ধ, অথর্ব, পঙ্গু একটা মানুষ। দীপঙ্করের ভয় করতে লাগলো।

লক্ষ্মীদি জিজ্ঞেস করলে-একে চিনতে পারছো তুমি?

লোকটা চাইলো দীপঙ্করের দিকে। কিন্তু ঝাপসা দৃষ্টি। সে-চোখে কোনও দৃষ্টি নেই যেন।

দীপঙ্করের দিকে চেয়ে লক্ষ্মীদি বললে–তুই চিনতে পারিস?

দীপঙ্কর বললে–কে ইনি?

লক্ষ্মীদি বললে–এই হলো দীপু, আমাদের দীপঙ্কর, সেই তোমাকে যে কালীঘাটের মন্দিরে গিয়ে চিঠি দিয়ে আসতো। মনে নেই?

সে যেন কত যুগ আগের কথা। সেই মানুষ এমন হতে হয়। সেই মানুষেরই এই চেহারা হতে হয়! কোথায় রইল সেই ঘন-ঘন সিগারেট খাওয়া, সেই স্যুট টাই! বিংশ শতাব্দীর ট্রেড ডিপ্রেশনের ভূতই যেন সেদিন দীপঙ্করের সামনে উদয় হয়েছিল সশরীরে। সারা পৃথিবীর পীড়িত মানবাত্মা যেন নিঃশব্দে আর্তনাদ করে উঠেছিল সেদিন সেই দাতারবাবুর মধ্যে দিয়ে। দাতারবাবু লক্ষ্মীদির কথায় একটু চোখ তুললো। ছোট দুটোও যেন একটু ফাঁক হলো। কিন্তু চিনতে পারলে কি চিনতে পারলে না বোঝা গেল না।

দীপঙ্করের দিকে চেয়ে লক্ষ্মীদি বললে–আগের চেয়ে এখন অনেক ভালো হয়েছে, আগে সারাদিন চিৎকার করতো, এখন চুপচাপ থাকে–

তারপর দাতারবাবুর দিকে চেয়ে বললে–ক্ষিদে পেয়েছে?

দাতারবাবু ঘাড় নাড়লে।

লক্ষ্মীদি বললে–ভাত খাবে?

সব কথাতেই ঘাড় নাড়তে লাগলো দাতারবাবু।

লক্ষ্মীদি বললে–দেখছিস তো, এখন তবু চেনা যায়, এখন তবু বেঁচে আছে বলে বোঝ যায়, আগে তো একেবারে আশাই ছেড়ে দিয়েছিলুম-ডাক্তার বলেছে, আরো বছর খানেক লাগবে পুরোপুরি সারতে–

দীপঙ্কর জিজ্ঞেস করলে–কী করে সারিয়ে তুললে তুমি?

লক্ষ্মীদি বললে–টাকার জোরে।

টাকার জোরে। কথাটা খট করে কানে বাজলো দীপঙ্করের। টাকার জোরে মানুষকে বাঁচানো যায়। পৃথিবীতে টাকাই সব তাহলে! অঘোরদাদু কি তাহলে ঠিক কথাই বলেছিল! অঘোরদাদু তাহলে তাকে ভুল শেখায় নি? অঘোরদাদুর কথা যদি সত্যিই হবে তো কেন অমন মর্মান্তিক পরিণতি হলো তার শেষকালে।

–কিন্তু এত টাকা তুমি কোথা থেকে পেলে?

লক্ষ্মীদি বললে–অনন্ত টাকা দিত, অনন্ত তো অনেক টাকা উপায় করতো–তোদের ঘোষাল সাহেবকে ঘুষ দিয়ে অনেক কন্ট্রাক্ট পেয়েছিল, সব আমাকে দিত, সেই টাকাতেই তো বাড়িভাড়া মিটিয়েছি, ছেলেকে মাসে-মাসে পাঠিয়েছি, শম্ভুর চিকিৎসা চালিয়েছি–

–কিন্তু সেই অনন্তবাবু কোথায় এখন? তাকে তো দেখছি না এখানে!

দাতারবাবু হঠাৎ যেন কী বললে। ভালো করে বোঝা গেল না কথাগুলো। দীপঙ্কর বুঝতে পারলে না। লক্ষ্মীদিও বুঝতে পারলে না। লক্ষ্মীদি দাতারবাবুর মুখের কাছে মুখ নিয়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করলে-কী বলছো তুমি? কিছু বলছো?

দাতারবাবু আবার কিছু বললে।

দীপঙ্কর তবু বুঝতে পারলে না।

লক্ষ্মীদি বললে–বলছে ঘুম পাচ্ছে–

তারপর লক্ষ্মীদি দাতারবাবুকে ধরে পাশের ঘরে নিয়ে গেল। যাবার আগে বললে একটু বোস তুই দীপু, আমি শম্ভুকে ঘুম পাড়িয়ে আসি–

দীপঙ্কর বসে রইল একলা। খানিক পরে লক্ষ্মীদি আবার ফিরে এল। দীপঙ্করের পাশে বসে বললে–এখন অনেকটা ভালো, দেখলি তো-ও-ঘরে গিয়ে তোর নাম বলছিল, তোকে চিনতে পেরেছে জানিস–

দীপঙ্কর বললে–এবার ভাল হয়ে উঠলে তুমি দাতারবাবুকে নিয়ে কোথাও দূরে চলে যাও লক্ষ্মীদি-কলকাতা তোমার জন্যে নয়–

লক্ষ্মীদি বললে–কিন্তু কলকাতা ছেড়ে গেলে এত টাকা কোত্থেকে আসবে? কলকাতার মতন এত জুয়াড়ী কোথায় পাবো?

দীপঙ্কর বললে–আমি দেব–

–তুই কেন দিবি? কিসের দায় তোর?

দীপঙ্কর বললে–কোন দায় নেই, ভেবে নাও এমনিই–

–কিন্তু এমনি আমি কিছু নেব না, জীবনে কখনও কারো কাছে ভিক্ষে করিনি। খালি হাতে কখনও টাকা নিইনি কারো কাছে।

দীপঙ্কর বললে–কিন্তু অনন্তবাবু? অনন্তবাবুও কি তোমার কাছ থেকে কিছু চেয়েছে?

লক্ষ্মীদি বললে–চেয়েছে বৈ কি। চেয়েছে আর পেয়েছেও

–বলছো কি তুমি?

লক্ষ্মীদি স্পষ্ট করেই বললে–সত্যি কথাই বলছি, কিন্তু অনন্তরই ভুল, অনন্ত ভেবেছিল টাকাটাই বুঝি আমার কাছে সবচেয়ে বড়! অনন্ত জানতো না টাকা আমার দরকার বটে, কিন্তু আগে শম্ভু, আগে আমার ছেলে, তারপর টাকা–সে আমার ছেলেকে পর্যন্ত ভুলিয়ে দিতে চেয়েছিল–আমি যে মা সে কথাও সে ভোলাতে চেয়েছিল আমাকে, সে ভেবেছিল আমি বুঝি বাজারের একজন মেয়েমানুষ–

–তারপর?

–তারপর তাকে জুতো মেরে তাড়িয়ে দিলুম একদিন। আমাকে তো সে চেনে না! আমি মেয়েমানুষ হতে পারি কিন্তু আমি তো মা, আমি তো স্ত্রীও বটে+সেই কথাটাই তাকে জুতো মেরে বুঝিয়ে দিলুম একদিন।

–তার মানে?

লক্ষ্মীদি বললে–অনন্ত ভেবেছিল সে চলে গেলে আমি উপোস করে মরবো, শম্ভুর চিকিৎসা হবে না, আমার ছেলের স্কুলে দেরাদুনে টাকা পাঠানো হবে না কিন্তু কলকাতা শহরকে তো আমি ভালো করে চিনে গিয়েছি তখন-কলকাতা শহরের সভ্য শিক্ষিত মানুষদের তখন আমি বুঝে নিয়েছি। আমি জুতো মেরে তাকে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিলুম। বললুম–আমার সঙ্গে মদ খেতে দিয়েছি বলে কি আমি তোমার কেনা মেয়েমানুষ হয়ে গেছি–

লক্ষ্মীদির কথা শুনতে শুনতে দীপঙ্কর যেন অন্য এক জগতে চলে গিয়েছিল সেদিন।

.

উনিশ শশা সাঁইত্রিশ, আটত্রিশ ঊনচল্লিশ সালের সেই কলকাতা। একদিকে কংগ্রেসের মিটিং একদিকে স্বদেশী সভা-সমিতির হিড়িক, আর একদিকে উছুঙ্খল মানুষের নৈশ-বিহার। একদিকে প্রাণমথবাবুদের অক্লান্ত নিষ্ঠা, কিরণদের আত্মোৎসর্গ, আর একদিকে ছিটে-ফোঁটাদের উৎপাত। চৌরঙ্গীর শুরু থেকে একেবারে মিউজিয়াম পর্যন্ত সোজা লম্বা ফুটপাথটার ওপর ঘোড়ার গাড়ির গাড়োয়ানদের জটলা। কোনও লোক পাশ দিয়ে গেলেই গাড়োয়ানরা পাশ দিয়ে যেতে যেতে কানের কাছে ফিসফিস করে বলে যায়। যারা নূতন তারা একটু চমকে যায়। সমস্ত শরীরটা সিরসির করে ওঠে। গলি রাস্ত রি মোড়ে মোড়ে ফিটনগাড়িগুলো নিঃশব্দে ঝিমোয়। তারপর দৈবাৎ একটা-একটা শিকার জুটে গেলে সোয়ারীকে নিয়ে গিয়ে তোলে একেবারে পার্ক স্ট্রীটে আর ফ্রি-স্কুল স্ট্রীটের ফ্ল্যাট বাড়িগুলোতে মিস মাইকেলদের পাড়ায়। সেখানে টাকা-পয়সার লেন-দেন চলে, মাংস কেনাবেচা চলে, আর কখনও কখনও ব্ল্যাকমেলিংও চলে।

লক্ষ্মীদি একদিন সেজেগুজে এসে সেইখানেই দাঁড়াল। ঠোঁটে লিপস্টিক মেখে, চোখে সুর্মা এঁকে দাঁড়াল এসে একেবারে রাজপথে। আপিস-ফেরত জনতার মুখোমুখি। একেবারে ট্রাম-বাস রাস্তার মোড়ে। তারপর একজন দু’জন আশে-পাশে ঘুরতে লাগলো। কাছাকাছি দাঁড়িয়ে সিগারেট টানতে লাগলো। লক্ষ্মীদি একজনের দিকে চেয়ে একটু কটাক্ষ করলে আর চলতে লাগলো দক্ষিণমুখো। আর সঙ্গে সঙ্গে তারাও চলতে লাগলো পেছন-পেছন।

–তারপর?

লক্ষ্মীদি তখন পরের দিন কী খাবে তার ব্যবস্থা নেই। ছেলেকে দেরাদুনে টাকা পাঠাতে হবে–পঞ্চাশ টাকা। তারও যোগাড় নেই। দাতারবাবু তখনও তালাবদ্ধ ঘরের মধ্যে বসে চিৎকার করছে। রাত্রে তাকে কী খেতে দেবে তারও যোগাড় নেই।

লক্ষ্মীদি বললে–আমি তখন আর কিছু ভাববার সময় পাইনি, যা করে হোক, যেমন করে হোক আমাকে বাঁচতেই হবে, আমাকে দাঁড়াতেই হবে। আমি শাড়িটাকে আরো আঁট করে গায়ে লাগিয়ে নিলাম, তারপর একবার আড়চোখে চেয়ে দেখলাম, লোকটা তখনও আমার পেছনে-পেছনে আসছে। আমি আস্তে আস্তে চলতে লাগলাম, লোকটা তখন একেবারে কাছে এসে গেল–একেবারে আমার কাছাকাছি। তারপর একটা ট্যাক্সি যাচ্ছিল, তাকে থামিয়ে আমি উঠলুম, লোকটাও সাহস পেয়ে উঠে বসলো ট্যাক্সিতে

–তারপর?

লক্ষ্মীদি গল্প বলতে বলতে হঠাৎ দাঁড়িয়ে উঠলো। বললে–তুই বাবার ঠিকানা চেয়েছিলি না।

দীপঙ্কর জিজ্ঞেস করলে–তারপর কী হলো বললে না?

লক্ষ্মীদি বললে–তারপর সেই প্রথম সুধাংশু এল আমার বাড়িতে। তারপর নিয়ে এল চৌধুরীকে, তারপর একে একে অনেকেই এসে হাজির হলো, তাসের আড্ডা জমলো, শম্ভুর চিকিৎসাও চলতে লাগলো সঙ্গে সঙ্গে–

–কিন্তু তোমার যে ছেলে আছে তা আমি জানতাম না।

–কেউ জানে না। শম্ভুও জানে না। হয়ত ছেলে না থাকলে এতদিনে কোথাও ভেসে চলে যেতাম, কেউ আমাকে খুঁজে পেত না, হয়ত শম্ভুও বাঁচতো না

মনে আছে, সেদিন লক্ষ্মীদির সেই ঘরে বসে লক্ষ্মীদিকে যেন বড় রহস্যময়ী মনে হয়েছিল। কোথায় গেল সেই কলেজে পড়া মেয়ে ছোট লক্ষ্মীদি! ভাগ্যের কত ঘাট পেরিয়ে কোথা দিয়ে কেমন করে মাথা উঁচু করে দাঁড়াবার আপ্রাণ চেষ্টা করছে। বাইরে থেকে দীপঙ্কর এতদিন তা জানতে পারেনি। এতদিন যেন ঘৃণা করে এসেছে দীপঙ্কর লক্ষ্মীদিকে–আর সেদিন যেন কৌতূহল হলো লক্ষ্মীদির জন্যে। এ তো হলো, কিন্তু তারপর? তারপর কোথায় যাবে? কোথায় গিয়ে পৌঁছোবে লক্ষ্মীদি? কোন্ আঘাটায় গিয়ে লক্ষ্মীদির নৌকো ঠেকবে?

লক্ষ্মীদি বললে–তারপর একদিন মানস মানুষ হবে,–

–মানস কে?

–আমার ছেলের নাম রেখেছি মানস। এই দ্যাখ তার ছবি–

বলে লক্ষ্মীদি একটা ফোটো বার করে দিলে বাক্স থেকে। দীপঙ্কর চেয়ে দেখলে। আশ্চর্য সুন্দর মোটা-সোটা থলথলে চেহারার একটা শিশু। বড় বড় চোখ।

লক্ষ্মীদি কাছে ঘেঁষে দাঁড়াল। বললে–কার মত দেখতে হয়েছে বল তো? আমার মতন, না শম্ভুর মতন?

ল। বললে–কার মত দেখতে হয়েছে বল তো? আমার মতন, না শম্ভুর মতন?

লক্ষ্মীদির মুখের চেহারাটা যেন একেবারে অন্যরকম দেখালো। লক্ষ্মীদিকে যেন মায়ের মত মনোরম মনে হলো হঠাৎ। আশ্চর্য, একটু আগেই যে লক্ষ্মীদিকে মদ খেতে দেখে ঘৃণায় মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিল দীপঙ্কর, সেই লক্ষ্মীদির মুখেই যেন কেমন কমনীয় লাবণ্য ফুটে উঠলো। নিষ্পাপ নিষ্কলঙ্ক মাতৃমূর্তি।

–মা!

কেশব এসে দাঁড়াল বাইরে। লক্ষ্মীদি বললে–কি রে?

কেশব বললে–বাবু ডাকছে–

–আমাকে?

লক্ষ্মীদি বললে–দাঁড়া দীপু আমি আসছি। শুনে আসি কী বলছে শম্ভু, বোধহয় ক্ষিদে পেয়েছে আবার–

দীপঙ্কর বললে–আমি এখন উঠি লক্ষ্মীদি, অনেক রাত হয়ে গেল, আর একদিন বরং আসবো, তুমি তোমার বাবার ঠিকানাটা দাও–

লক্ষ্মীদি বললে–আমার কথা লিখবি না তো?

দীপঙ্কর বললে–না, আমি তো তোমায় কথা দিয়েছি–

–আমার ঠিকানাও জানাবি না তো?

–বলছি তো না! আমি শুধু সতীর কথা লিখবো। শুধু লিখবো তিনি যেন এসে সতীকে নিয়ে যান নিজের কাছে, সতী শ্বশুরবাড়িতে বড় কষ্ট পাচ্ছে

লক্ষ্মীদি একটা কাগজে খচ খচ করে ঠিকানাটা লিখে দিলে। তারপর দীপঙ্করের দিকে এগিয়ে দিয়ে বললে–দেখিস আমার কথা যেন লিখিস নি–

দীপঙ্কর কাগজটা নিয়ে উঠে দাঁড়াল।

লক্ষ্মীদি বললে–কেশব, যা দরজাটা বন্ধ করে দিয়ে আয়—

বলে লক্ষ্মীদি পাশের ঘরে চলে গেল।

৪২

স্টেশন রোডে সমস্ত বাড়িটা বড় ফাঁকা ফাঁকা মনে হতে লাগলো। এতক্ষণ ট্রেনটা বোধহয় ধানবাদ ছেড়ে গেছে। মা হয়ত না-খেয়েই ঘুমিয়ে পড়েছে। হয়ত দপিঙ্করের কথাই ভাবছে মা। দীপঙ্করকে ছেড়ে এই-ই মা’র প্রথম বাইরে থাকা। মা না থাকলেদীপঙ্করেরও যেন কেমন ফাঁকা লাগে সমস্ত। পাশেই মা’র ঘর। অন্যদিন দীপু না আসা পর্যন্ত মা জেগে থাকে। বিছানায় শুয়ে শুয়েই উসখুস করে। বার বার কাশীকে বলে-ওরে দ্যাখ তো, এই দীপু এল বোধহয়–দীপু আমার কড়া নাড়ছে–

কিম্বা অনেক দিন মা মেঝেতে পা ছড়িয়ে সলতে পাকাতে বসে। সন্ধ্যেবেলা ঠাকুরঘরে পিদিম জ্বালাবার সলতে। তারপর দীপু এলে খাবার এগিয়ে দেয়। পাশে বসিয়ে খাওয়ায়। মা নিরামিষ খায়, কিন্তু দীপঙ্করের জন্যে মাছ করে, মাংস করে।

দীপঙ্কর বলে–আমার জন্যে কেন এসব করো মা তুমি?

–কেন রে? রান্না ভালো হয় নি বুঝি?

–না, রান্নার জন্যে নয়, হাত পুড়িয়ে এসব করার দরকারটা কী! মা বলে–আমি তো রাধিনি, বেঁধেছে ক্ষীরোদা, সন্তোষের মেয়ে দীপঙ্কর জিজ্ঞেস করে–তা ওরা বুঝি থাকবে এখেনে?

মা বলে–থাকবে বলেই তো এসেছে–এখন ধরেছে তোর সঙ্গে বিয়ে দেবে মেয়ের–তা মেয়েটাও ভাল খুব, মা নেই তো, রান্নাবান্না শিখেছে কেবল–

দীপঙ্কর এসব কথায় কান দেয় না তেমন।

মা বলে-”হ্যাঁ রে, লেখাপড়া জানা মেয়ে না-হলে কি তোর পছন্দ হবে না? এরা তো দিতে-থুতে পারবে না কিছু, সন্তোষের পয়সা-কড়ি কিছু নেই। নিলে রাঙা সুতো বেঁধে মেয়েকেই শুধু নিতে হয়–

এতেও দীপঙ্কর কিছু কথা বলে না।

খানিক পরে মা আবার জিজ্ঞেস করে-সন্তোষকে এখন কী বলি বল তো? ও তো খুব চেপে ধরেছে। বলেক্ষিরির মতন এমন বৌ তুমি পাবে না বৌদি। ও এক হাতে তোমার সংসারের সবদিক সামলাবে।

দীপঙ্কর চুপ করে খাচ্ছিল তখনও। মা আবার জিজ্ঞেস করলে–তুই কী বলিস দীপু-কী বলি আমি সন্তোষকে?

দীপঙ্কর বললে–আমি ও সম্বন্ধে কী বলব মা? ওকথা তো ভাবিনি আমি–

–তা না ভেবেছিস তো এখন না-হয় ভাবলি–

দীপঙ্কর বললে–এখন কি ভাববার সময় আছে মা, রবিনসন সাহেব চাকরি ছেড়ে চলে যাবে, সেইসব নিয়েই সবাই ব্যস্ত–

–তা সন্তোষকে তো একটা জবাব দিতে হবে, ওতো নাছোড়বান্দা একেবারে, বলে তোর সঙ্গে মেয়ের বিয়ে দেবেই-আহা গরীব লোক তো! মেয়েটাও বড় লক্ষ্মী! এই কদিনেই বড় ন্যাওটা হয়ে পড়েছে আমার, ঠিক বিন্তিটার মতন

বলে মা আঁচলে চোখ দুটো মুছে নিলে।

দীপঙ্কর বলেছিল–তা তোমার যা-খুশী বলে দাও না, আমি তোমার কথায় কোনও দিন আপত্তি করেছি?

অন্ধকার রাত্রে বিছানায় শুয়ে শুয়ে সেইসব কথাই মনে আসছিল। হয়ত কাশী থেকে ফিরেই মা আবার কথাটা পাড়বে। সন্তোষকাকা যখন আছে তখন কোনও ভাবনা নেই। আর পাণ্ডাও চেনা-শোনা। গাঙ্গুলীবাবুদের পুরোন পাণ্ডা। বুড়ো মানুষকে যেন হাতে ধরে রাস্তা পার করে দেয়। আর কাশীর সেই সরু সরু গলি! শুনেছে গলিগুলোতে নাকি ভীষণ ভিড়। বড় বড় ষাঁড় রাস্তা জুড়ে দাঁড়িয়ে থাকে।

ঘড়ির দিকে চেয়ে দেখলে দীপঙ্কর, রাত এগারোটা বেজে গেছে। কাশী রান্নাঘর ধুয়ে মুছে বাইরের বারান্দাটায় শুয়ে পড়েছে। আহা বেচারী!

দীপঙ্কর বাইরে উঠে গিয়ে একবার দেখে নিলে। সদর দরজায় খিল দিয়েছে কি না। শেষকালে চোর ঢুকলে ছেলেমানুষকে দোষ দেওয়া চলবে না। বালিগঞ্জ স্টেশনের দিকে অনেকদূর থেকে একটা আপ ট্রেন আসবার শব্দ শোনা গেল। কোল ট্র্যাফিক। কয়লার ওপন ওয়াগন চলেছে। ডকে গিয়ে আনলোডিং হবে।

দীপঙ্কর পকেট থেকে ঠিকানাটা বার করলে। লক্ষ্মীদির বাবার ঠিকানা।

একটা চিঠির প্যাডের খাতায় চিঠি লিখতে বসলো। কাল সকালেই অফিসে যাবার পথে পোস্টবক্সে ফেলে দিলেই চলবে। এক সপ্তাহের মধ্যেই চিঠিখানা ভুবনেশ্বরবাবুর হাতে গিয়ে পৌঁছোবে।

দীপঙ্কর লিখতে লাগলো:

শ্রীচরণেষু,

আপনি আমাকে চিনিতে পারিবেন না। আমি ঈশ্বর গাঙ্গুলী লেনের অঘোর ভট্টাচার্যের বাড়িতে আগে থাকিতাম। আপনার কন্যা শ্রীমতী সতী ঘোষের সঙ্গে সেইখানেই আমার পরিচয়। শচীশবাবুকে এবং তাঁহার স্ত্রীকে আমি কাকাবাবু ও কাকিমা বলিয়া ডাকিতাম। আমি তাহাদের বিশেষ স্নেহের পাত্র ছিলাম। সম্প্রতি একটি বিশেষ জরুরী কারণে আপনাকে এই চিঠি লিখিতে বাধ্য হইয়াছি। আপনার কন্যা শ্রীমতী সতীর জীবন তাহার শ্বশুরবাড়িতে নানা কারণে অত্যন্ত দুঃসহ হইয়া উঠিয়াছে। তাহার সমস্ত স্বাধীনতা খর্ব করা হইয়াছে। আপনাকে সে চিঠি লিখিতেও পায় না। ঘটনাটা আমার কানে আসাতে অন্য কোনও উপায় না দেখিয়া আপনাকে এই পত্র দ্বারা সমস্ত অবগত করাইলাম। আপনি অবিলম্বে কলিকাতায় আসিলে সমস্তই জানিতে পারিবেন। আমি সতীর একান্ত শুভাকাঙ্খী বলিয়াই আপনাকে এই পত্র লেখা অনিবার্য বিবেচনা করিয়াছি। পত্র পাঠ যথাকৰ্তব্য করিবেন।

ইতি, ভবদীয়
দীপঙ্কর সেন।

চিঠিটা বার বার করে পড়ে দেখলে দীপঙ্কর। চিঠিটা পেলেই হয়ত ভুবনেশ্বরবাবু টেলিগ্রাম করে বসবেন মেয়েকে। কিম্বা যদি জাহাজ পাওয়া যায়, তখনি চলে আসবেন। খুব চিন্তিত হয়ে পড়বেন ভদ্রলোক। অনেক কাজের মানুষ তো তিনি। তারপর আচমকা একেবারে সতীর শ্বশুরবাড়িতে এসে উঠবেন। সতীর শাশুড়ী চমকে উঠবেন। সনাতনবাবুও অবাক হয়ে যাবেন। সতীও কম অবাক হবে না! কে চিঠি লিখলো তাকে? কে তাঁকে খবর দিলে? ভুবনেশ্বরবাবু বলবেন-কে একজন দীপঙ্কর সেন, আমি তাকে চিনতে পারলাম না–

দীপঙ্কর আবার চিঠিটা পড়তে লাগলো। চিঠিটা যেন পছন্দ হলো না। বাংলায় চিঠি লেখা অভ্যেস নেই দীপঙ্করের। বাংলায় চিঠি লিখতে গেলে কেমন যেন বক্তব্যটা স্পষ্ট হয় না ঠিক। আবার পড়ে দেখলে গোড়া থেকে। বার বার পড়ে দেখলে। না ঠিক লেখা হয়নি। ফস ফস করে চিঠিটা টুকরো টুকরো করে ছিঁড়ে ফেললে। তারপর ভেঁড়া চিঠির টুকরোগুলো কুণ্ডলী পাকিয়ে জানালা দিয়ে বাইরে রাস্তায় ফেলে দিলে। কুণ্ডলীটা রাস্তায় পড়ে গড়াতে গড়াতে গ্যাসের তলায় নর্দমায় গিয়ে পড়লো।

সমস্ত প্ল্যাটফরমটা আলোয় আলো হয়ে আছে তখনও। দোতলা থেকে প্ল্যাটফরমটা স্পষ্ট দেখা যায়। শেষ প্যাসেঞ্জার ট্রেনটা তখন চলে গিয়েছে ডায়মণ্ডহারবারের দিকে। কয়েকটা রাস্তার কুকুর লাইনের ওপর খাবার খুঁটে খুঁটে খাচ্ছে। আর নিজেদের মধ্যে ঝগড়া করছে ঘেউ ঘেউ করে। প্যাসেঞ্জারদের ফেলে যাওয়া খাবারের খালি ঠোঙা নিয়ে কাড়াকাড়ি চলেছে ওদের।

দীপঙ্কর আলো নিভিয়ে দিয়ে বিছানায় শুয়ে পড়লো। মা এতক্ষণ কত দূরে? হয়ত বর্ধমান পেরিয়ে গেছে। ধানবাদও পেরিয়ে গেছে হয়ত। ডাবটা খায়নি, কমলালেবুও খায়নি। চাদর মুড়ি দিয়ে মুখ ঢেকে শুয়ে পড়েছে মা সন্ধ্যেবেলাই। কেন যে মাকে পাঠালো দীপঙ্কর! আর যদি পাঠালোই তো দীপঙ্কর নিজে সঙ্গে গেলে পারতো! রবিনসন সাহেব চলে যাবার পর অফিসের ঝামেলা মিটে গেলেই পাঠালে হতো মা’কে! মাও তো দীপঙ্করের সঙ্গে যেতে চেয়েছিল।

এবার অন্যরকম করে চিঠি লিখতে হবে। সহজ সাদাসিধে চিঠি। মনে মনে চিঠিটা মকশো করতে লাগলো দীপঙ্কর।

শ্রীচরণেষু,

আপনি অবিলম্বে একবার কলকাতায় এলে ভাল হয়। আপনার মেয়ে শ্রীমতী সতী ঘোষ-এর অনুরোধ মত আমি এই চিঠি আপনাকে লিখছি। আমাকে আপনি চিনতে পারবেন না। এখানে এলে সব জানতে পারবেন–

ইতি দীপঙ্কর সেন

বাস্! আর কিছু লেখার দরকার নেই। এইটুকু লিখলেই যথেষ্ট। এর চেয়ে বেশি কিছু লিখতে গেলেই ব্যাপারটা আরও জটিল হয়ে উঠবে।

হঠাৎ একটা শব্দে দীপঙ্কর চমকে উঠেছে।

–দীপু, ও দীপু!

বিছানা ছেড়ে উঠতেই দীপঙ্কর অবাক হয়ে গেছে।

-–মা, তুমি? ফিরে এলে যে?

মা বললে–না বাবা, আমার কাশী-গয়া দরকার নেই বাবা, আমি চলে এলুম, আমার মন-কেমন করতে লাগলো তোর জন্যে–

-–সে কি মা, অত করে সব ব্যবস্থা করে দিলাম, আর তুমি কিনা ফিরে এলে?

মা বললে–বর্ধমান ইস্টিশানেই নেমে পড়লাম বাবা সন্তোষকে বললাম, আমায় কলকাতায় ফিরিয়ে নিয়ে চলো সন্তোষ, আমি বাবা বিশ্বনাথকে ফেলে কোথাও যাবো না আর, দীপুই আমার বাবা বিশ্বনাথ। দীপুই আমার ঠাকুর-দেবতা সব–

বলে মা বিছানার উপর বসে পড়লো।

দীপঙ্কর বললে–কিন্তু ফিরে আসতে কষ্ট হলো তো খুব তোমার! ট্রেনে জায়গা পেয়েছিলে?

–তা পেয়েছিলাম বাবা, আর না-পেলেও আমি ফিরে আসতাম। তোকে ছেড়ে বাবা বিশ্বনাথের কাছে গিয়েও আমার মন টিকতো না–তোকে ছেড়ে আমি আর কোথাও যাবো না।

বলে মা সেখানে বসেই দীপুর মাথায় হাত বোলাতে লাগলো। দীপঙ্করের মনে হলো মা ফিরে এল ভালোই হলো। মাকে ছেড়ে তারও মন টিকছিল না বাড়িতে। মাকে ছেড়ে দীপঙ্করও যেন কেমন ছন্নছাড়া হয়ে গিয়েছিল সারাদিন মাকে স্টেশনে পৌঁছে দিয়ে পর্যন্ত তারও মনে শান্তি ছিল না। একবার সতীদের বাড়ির কাছে গিয়েছে, একবার লক্ষ্মীদির বাড়িতে গিয়েছে। এতক্ষণে যেন শান্ত হলো দীপঙ্কর।

দীপঙ্কর ডাকলে–মা, ও মা–

-–মা কোথায়, আমি, আমি এসেছি–

ভোর তখনও ভাল করে হয়নি। ঘরের ভেতরটায় তখনও অন্ধকার। দীপঙ্কর আস্তে আস্তে চোখ খুললো।

-–আমি এসেছি, এই যে, আমি–

দীপঙ্কর সামনে সতীকে দেখে অবাক হয়ে গেছে।

তাড়াতাড়ি বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়াল। বললে–তুমি? কোত্থেকে? এত ভোরে? সতী বললে–আমি চলে এলুম–

এতণ তবে স্বপ্ন দেখছিল নাকি দীপঙ্কর!

সতী বললে–তোমার চাকরটা আমায় দরজা খুলে দিয়েছে। শম্ভুর কাছ থেকে তোমার ঠিকানাটা নিয়ে চলে এসেছি–

–কিন্তু কী করে এলে? তোমাকে আসতে দিলে?

সতী সমস্ত গায়ে ভালো করে চাদর জড়ালো। ঘোমটার ফাঁকে শুধু ফরসা মুখটা বেরিয়ে আছে।

বললে–দারোয়ানটা ঘুমিয়ে পড়েছিল–একটা ট্যাক্সি ধরে চলে এসেছি, তা মাসীমা কোথায়?

দীপঙ্কর বললে–মা তো কাশীতে গেছে তীর্থ করতে–বাড়িতে চাকর ছাড়া আর কেউ নেই এখন–

–তা না-ই বা থাকলো। মাসীমা কবে ফিরে আসবেন?

-–মা তো সবে কাল দুপুরবেলা গেছে। ফিরতে পাঁচ-সাত দিন দেরি।

সতী চেয়ারটায় বসলো। বললো–একটা দিন তোমার এখানে থাকতে দেবে না? একটা দিন থেকে তারপর যা-হয় একটা কিছু ব্যবস্থা করে নেব–

–কিন্তু কেউ যে নেই বাড়িতে!

সতী বললে–না-ই বা থাকলো, আমি তোমার কোনও অসুবিধে করবো না– ট্যাক্সিটা বাইরে দাঁড়িয়ে আছে, ওর ভাড়াটা তুমি মিটিয়ে দাও–

কথাগুলো বলতে বলতে সতী থর থর করে যেন কাঁপছিল। দীপঙ্কর কী করবে কী বলবে বুঝতে পারলে না। আস্তে আস্তে পকেট থেকে মনিব্যাগটা নিয়ে নিচে চলে গেল।

চিত্র

ছোটবেলায় স্কুলে বইতে পড়েছিল দীপঙ্কর যে মানুষের জীবনটা নাকি ঠিক নদীর মত। দু’পাশের উঁচু তীর দিয়ে আট-ঘাট বাঁধা। শুধু সামনে দৌড়তে হয় দুর্নিবার বেগে। প্রয়োজন হলে বাধা-বিপত্তি অতিক্রম করে লক্ষ্যস্থলে পৌঁছতে হয়। দিন নেই রাত্রি নেই, জীবন একটানা বয়েই চলেছে। মাঝে মাঝে সে-জীবনে বন্যা আসে, মাঠ-ঘাট সব ভাসিয়ে দেয় সে-বন্যাতে, কিন্তু আবার এক সময়ে সেই স্রোত স্তিমিত হয়ে আসে। আবার একটানা বয়ে চলে দূর-সমুদ্রকে লক্ষ্য করে।

ছোটবেলায় কথাটা দীপঙ্কর বিশ্বাসও করেছিল। সেই ঈশ্বর গাঙ্গুলী লেন থেকে উৎপত্তি হয়েছিল তার। তারপর দিনে-রাত্রে দুর্নিবার গতিতে কেবল এগিয়েই চলেছে সে। প্রথমে কালীঘাট, তারপর ভবানীপুর, তারপর টালিগঞ্জ বালিগঞ্জ, তারপর সমস্ত কলকাতা সমস্ত পৃথিবীতে যেন সে পরিব্যাপ্ত হতে চলেছে।

কিন্তু বড় হবার পর দীপঙ্করের মনে হয়েছিল নদী নয়–যেন আকাশ। মানুষের জীবনটা যেন আকাশ। যে-আকাশ ফ্রেমে আঁটা জানালার ভেতর দিয়ে দেখা যায়, সে আকাশ নয়। যে-আকাশ সঙ্কীর্ণ সংসারের ফুটো দিয়ে দেখা যায়–সে আকাশও নয়। সেই আকাশ–যেখানে দিকচক্রবালের শেষ সীমারেখাটা পর্যন্ত ভাস্বর, যেখানে দিনের বেলায় সূর্য উঠলে উজ্জ্বল হয়, সুস্পষ্ট হয়, আবার রাত্রি হলে যেখানে রহস্যের হাতছানি রোমাঞ্চিত হয়ে ওঠে। মানুষের সেই আকাশে সুখ-দুঃখ স্মৃতি-বিস্মৃতির গ্রহ-তারা নীহারিকা-ধূমকেতুর দল কত খেলা খেলে চলেছে, শীতে শরতে বর্ষায় কত তার রূপ কত আলো-আঁধারি! কখনো ঘন হয়ে আসে দুর্যোগের মেঘ, কখনো উচ্ছল হয়ে ছড়িয়ে পড়ে আনন্দের সূর্য-কিরণ, কখনো আবার সজল হয়ে আসে বর্ষায় লাবণ্য। কখনও আবার রুক্ষ-কঠিন হয়ে আসে দৈন্যের গ্রীষ্ম! কাউকে কি ভুলতে পারে আকাশ? কাউকে কি ত্যাগ করতে পারে? সবাইকে নিয়েই তো মানুষ। সবাইকে নিয়েই তো দীপঙ্কর। দীপঙ্করের আকাশেও তো এমনি করে কত বর্ষা, কত শরৎ, কত ধূমকেতুর উদয় হয়েছে–কাউকে তো ভুলতে পারেনি সে? আজ এতদিন পরে সেই আকাশটার দিকে চেয়ে দেখলে মনে হয় যেন সবাই সেখানে রয়েছে। কেউ হারিয়ে যায় নি! কিছুই হারায় না মানুষের জীবনে! নইলে এত কথা মনে থাকলো কী করে?

সেদিন বোধহয় ধূমকেতুর মতই সতী এসে উঠেছিল তাদের বাড়িতে। দীপঙ্করের অন্তত তাই মনে হয়েছিল। একতলায় গিয়ে ট্যাক্সির ভাড়া মিটিয়ে দিয়ে কিছুক্ষণ চুপ করে দাঁড়িয়েছিল সেই রোয়াকের ওপর। সতী এল! সতী সত্যিই এল! এখন? এখন কী করবে সে?

যেদিন বর্মা থেকে প্রথম সতী ঈশ্বর গাঙ্গুলী লেনের বাড়িতে এসেছিল সেদিনকার আসার সঙ্গে এই আসার কত তফাৎ!

দীপঙ্কর বললে–তুমি যে এমনি করে চলে এলে, তারপর?

সতী বললে–তারপর কী?

দীপঙ্কর বললে–বাঃ, তারপরের কথা ভাবতে হবে না? সনাতনবাবু, তোমার শাশুড়ী, তোমার শ্বশুরবাড়ির বংশমর্যাদা, সে-সব কথা কিছু ভাবতে হবে না?

কাশী যেন কেমন তীক্ষ্ণ দৃষ্টি দিয়ে দেখছিল সতীর দিকে। সে নতুন লোক, সে সতীকে আগে দেখে নি। দীপঙ্কর তাড়াতাড়ি তাকে গিয়ে চা-জলখাবার করতে বলে এসেছিল।

ভোর তখনও ভাল করে হয় নি। দীপঙ্করের বিছানা তখনও অগোছালো। দীপঙ্কর ও তখন ঠিক সতীর মুখোমুখি দাঁড়াবার জন্যে প্রস্তুত নয়। দীপঙ্করের আকাশ তখন ঝাপসা। সে-আকাশে তখনও যেন সূর্যোদয় হবার লগ্ন হয় নি। তার আগেই যেন মেঘ করে এল।

সতী দীপঙ্করের বিছানাতেই দীপঙ্করের বালিশের ওপর মাথা নিয়ে তখন শুয়ে পড়েছে।

সতী বললে–আমি একটু ঘুমোই তোমার বিছানায়, কতদিন যে প্রাণভরে ঘুমোতে পারি নি–

–কিন্তু ওরা যদি খবর পায়, ওরা যদি জানতে পারে তুমি এখানে এসেছো, তাহলে?

সে-কথার উত্তর না দিয়ে সতী বললে–তোমার চাকরকে কিছু খাবার করতে বলেছ? আমি ক’দিন কিছু খাই নি, জানো–

দীপঙ্কর বললে–মা থাকলে এখন খুব ভাল হতো, কিন্তু আমি তো চা খাই না, তবু কিছু জলখাবার করতে বলে এসেছি–

সতী বললে–আর ভাতও খাবো সকাল-সকাল–পেট ভরে ভাত খাবো অনেকদিন পরে–

দীপঙ্কর বললে–তার ব্যবস্থা আমি করছি, তুমি বরং মা’র বিছানাটায় শোও—

-–কেন, এ-বিছানায় কী দোষ হলো?

দীপঙ্কর বললে—হ্যাঁ চাদর-বালিশ সব ময়লা, আমি ফরসা চাদর পেতে দিচ্ছি মা’র বিছানায়, ওখানে শোওয়াই তোমার পক্ষে ভালো—এসো–

সতী বললে–আমার এখন আর উঠতে ইচ্ছা করছে না—

বলে চাদরটা টেনে নিয়ে আরাম করে চোখ বুজলো।

তারপর শুয়ে শুয়ে চোখ বুজেই বললে–অনেকদিন থেকে ভাবছিলাম তোমার এখানে চলে আসবো, কিন্তু কিছুতেই সুযোগ পাচ্ছিলাম না এত কড়া পাহারা চারদিকে। আজ দারোয়ানটা একটু ঘুমিয়ে পড়েছিল, সেই ফাঁকে চলে এসেছি। তা-ও হাজরা রোডের কাছে ট্যাক্সির জন্যে একটু দেরি হলো, নইলে বেরিয়েছি সেই রাত সাড়ে তিনটার সময়–

দীপঙ্কর বললে–সনাতনবাবু কিছুই জানতে পারেন নি?

সতী বললে–সে-মানুষের তখন মাঝ-রাত, নাক ডাকিয়ে আয়েস করে ঘুমোচ্ছেন তখন–

–কিন্তু ঘুম থেকে উঠে যখন দেখবেন তুমি পাশে নেই, তখন?

সতী বললে–তখন আবার পাশ ফিরে শোবেন–

–সে কি? তোমার জন্যে ভাবনা হবে না তাঁর! তাঁর স্ত্রী কোথায় গেল, তিনি একবার খোঁজ করবেন না?

সতী হাসলো। বললে–আমি কি এক ঘরে শুতাম যে তিনি টের পাবেন! আর তিনিই যদি আমার খোঁজ করবেন তো আমার ভাবনা কিসের! খোঁজ করলে তো আমি বেঁচে যেতাম, তবু বুঝতাম আমার জন্যে তাঁর একটু ভাবনা হয়।

–কী বলছো তুমি সতী! নিজের স্ত্রী কোথায় গেল তা খবর নেবেন না তিনি? তাই কখনও হয়?

সতী চোখ বুজেই বললে-–হয়, হয়। তুমি আর ক’টা স্বামী দেখেছ, আর ক’টা স্ত্রীই-বা দেখেছ তুমি জীবনে!

–কিন্তু এ যে বিশ্বাস করতে পারছি না আমি। তুমি হঠাৎ বলা-নেই কওয়া নেই একেবারে আমার এখানে এসে উঠলে! তারপর আমার মা-ও নেই আবার বাড়িতে, এ তো বড় মুশকিল হলো দেখছি–

সতী বললে–মাসীমা তো দু’দিন পরেই আসবে, তার জন্যে আর তাড়াতাড়ি কিসের! আমার খাওয়া-দাওয়ার কথা ভাবছো? তুমি যা খাবে, আমিও তাই খাবো

দীপঙ্কর কথাটা মুখ দিয়ে উচ্চারণ করতে পারলে না। বললে–না, সে-কথা ভাবছি না–

সতী বললে–তাহলে খরচের জন্যে ভাবছো! যা খরচ হয় আমি না-হয় পরে শোধ করে দেব–

দীপঙ্কর হাসলো না। সতীর রসিকতায় হাসবার মতন মনের অবস্থা ছিল না তখন! সতী নিজেই আবার বলতে লাগলো-এ কাপড়ে চলে এসেছি। দু’একটা শাড়ি আমায় কিনতে হবে, তা সে টাকাও বাবার কাছ থেকে নিয়ে পরে তোমায় শোধ করে দেব–

কাশী নিজের বুদ্ধি খাঁটিয়ে জলখাবার করে এনে দিলে। সতী খাবারের গন্ধ পেয়ে নিজেই উঠে বসলো। বললে–এগুলো সবই আমার?

দীপঙ্কর বললে–হ্যাঁ সবই তোমার, যদি এতে না পেট ভরে তো আরো দিতে বলবো–

সতী বললে–যখন ঘাড়ে এসে পড়েছি তখন তোমাকে একটু কষ্ট করতে হবে বৈ কি!

দীপঙ্কর বললে– কিন্তু আর ফিরে যাওয়া যায় না?

সতী খেতে খেতে বললে–কোথায়?

দীপঙ্কর বললে– প্রিয়নাথ মল্লিক রোডে, তোমার শ্বশুরবাড়িতে?

সতী বললে–ওখান থেকে যখন একবার চলে এসেছি তখন আর যাবো না–

–তাহলে কোথায় থাকবে?

-–কেন, এখানে!

দীপঙ্কর চমকে উঠলো। বললে–আমার এখানে?

সতী বললে–ভয় পেও না, খরচ যা লাগে সব দেব আমি–

দীপঙ্কর বললে–খরচের কথা বোল না, কিন্তু আমার এখানে তোমার একদিনও থাকা চলবে না–

–কেন? আমার কিন্তু অসুবিধে হবে না! আর তোমারই বা কিসের অসুবিধে?

দীপঙ্কর বললে–আমার অসুবিধে আছে।

–কিসের অসুবিধে? তোমার এখানে তো অনেক ঘর রয়েছে!

দীপঙ্কর বললে–কিন্তু রাত্রে কোথায় থাকবে?

সতী বললে–কেন এই ঘরে–আর যদি এ-ঘরে থাকলে তোমার অসুবিধে হয় তো পাশে মাসীমার বিছানা রয়েছে–

–তবু হবে না।

-–কেন? মাসীমার বিছানাটা তো খালিই পড়ে রয়েছে, ওতে শুলে দোষ কী?

দীপঙ্কর বললে–দোষ আছে। বাড়িতে মা থাকলে কিছু বলতুম না, কিন্তু যতদিন মা না আসছে ততদিন এক বাড়িতে তোমার আমার থাকা চলে না-–হয় তুমি এখানে থাকো, তাহলে আমাকে অন্য জায়গায় অন্য কোথাও গিয়ে রাত কাটাতে হয়–আর নয়তো……

সতী বললে–রাতটাকেই বুঝি ভয়?

দীপঙ্কর বললে–ভয় থাকুক আর না-থাকুক তুমি এ-বাড়িতে থাকলে আমার থাকা চলবে না! আর তা ছাড়া, তুমি এ-রকম হুট করে চলে এলেই বা কেন? শাশুড়ী সকলেরই ও-রকম হয়, কিন্তু সনাতনবাবু তো কোনও অন্যায় করেন নি, তিনি তো দেবতুল্য লোক, তাঁর সঙ্গেও তুমি বনিবনা করে চলতে পারলে না! তাহলে সংসারে কার সঙ্গে তুমি ঘর করবে! এইটুকু সহ্য করতে না পারলে কেন মেয়েমানুষ হয়ে জন্মেছিলে!

সতী হঠাৎ যেন গম্ভীর হয়ে গেল। দীপঙ্করের মুখের দিকে একবার চাইলে। বললে–ঠিক বলেছ তুমি দীপু, মেয়েমানুষ হয়ে জন্মানোই আমার অপরাধ হয়ে গিয়েছিল–

বলে সতী উঠে দাঁড়াল। বিছানার চাদরটা ঠেলে সরিয়ে দিয়ে বললে–আমারই ভুল হয়ে গিয়েছিল, আমি ভেবেছিলাম, কলকাতা শহরে একটা জায়গায় অন্তত আমার আশ্রয় মিলবে–

দীপঙ্কর বললে–কী হলো? উঠলে যে?

সতী বললে–দয়া করে শুধু একটা ট্যাক্সি ডেকে দাও–আর যদি সম্ভব হয় কিছু টাকা দাও আমাকে–পরে আমি সব শোধ করে দেব–সঙ্গে কিছু টাকাকড়ি আনতে পারি নি আমি–

–কিন্তু কোথায় চললে তুমি?

সতী তখন গায়ের শাড়িটা ঠিক করে নিয়েছে। বললে–এ তো বড় মুশকিল হলো দেখছি, তুমি থাকতেও দেবে না আবার কৈফিয়ৎও চাইবে?

দীপঙ্কর বললে–কিন্তু আমি তো তোমাকে এখনই চলে যেতে বলি নি, বলেছি রাতটা এখানে তোমার কাটানো উচিত নয়।

সতী বললে–তুমি এখনও সেই ছেলেমানুষটি রয়ে গেলে দীপু। এত বয়েস হলো, এখনও এত ভীরু? এখনও এত ভয়? আমার সঙ্গে এক বাড়িতে রাত কাটালে তোমার চরিত্র নষ্ট হয়ে যাবে? এই তোমার পৌরুষ? এত ঠুনকো তোমার চরিত্র? নিজের ওপর তোমার এতটুকু বিশ্বাস নেই?

বলে সত্যি-সত্যিই সতী দরজার দিকে এগিয়ে গেল। আবার বললে– সত্যিই আমার ভুল হয়ে গিয়েছিল, আমি ভেবেছিলাম, আর যেখানে যা কিছু হোক, এখানে অন্তত আমার দরজা খোলা আছে–

দীপঙ্কর বললে– সতী, শোন–সতী–

সতী তখন সিঁড়ি দিয়ে নামতে শুরু করেছে। বললে–আজকের মধ্যে যা হোক একটা ব্যবস্থা করতেই হবে, তুমিই যখন তাড়িয়ে দিলে তখন আর একটা জায়গায় সন্ধান আজকেই করতে হবে আমাকে–

দীপঙ্কর পেছনে নামতে নামতে বললে–তুমি ভুল বুঝলে আমাকে সতী, আমি তো তোমাকে চলে যেতে বলি নি–

সতী ততক্ষণে নেমে গিয়েছে একতলায়। সদর দরজাটা লক্ষ্য করেই সোজা যাচ্ছিল। দীপঙ্কর পেছনে পেছনে গিয়ে বললে–কিন্তু কোথায় যাচ্ছো তুমি?

সতী এ-কথার কোনও উত্তর দিলে না। ভোরবেলা যেমনভাবে বাড়ি থেকে বেরিয়ে এসেছিল, ঠিক সেইভাবেই আবার চলে যাচ্ছিল। তখনও বেলা হয় নি বেশি। সতীর কি সত্যিই মাথা খারাপ হয়েছে? সতী কি সত্যিই একলা রাস্তায় বেরিয়ে পড়বে নাকি? সতী গিয়ে সদর-দরজার খিলটা খুলতে যেতেই দীপঙ্কর তার হাতটা চেপে ধরেছে।

বললে–কোথায় যাবে তুমি? যাবে কোথায়?

সতী মুখ ফিরিয়ে দীপঙ্করের দিকে চাইলে।

দীপঙ্কর আবার বললে–তোমার কি মাথা খারাপ হয়েছে? যেতে হয় পরে যেও, এখুনি কি তোমাকে যেতে বলেছি আমি? রাত্রে তোমাকে থাকতে বারণ করেছি বলে এখনি চলে যেতে হয়?

সতী বললে–তোমার ছেলেমানুষির বয়েস থাকতে পারে, কিন্তু আমার নেই। আমায় যেতে দাও–

–কিন্তু কোথায় যাবে তুমি?

সতী বলল–যেখানেই আমি যাই না, তোমার জেনে কী লাভ?

দীপঙ্কর বললে–পাগলামিরও একটা সীমা আছে। শেষকালে কি একটা কেলেঙ্কারি বাধিয়ে বসবে নাকি? কলকাতা শহরে একলা কোথায় যাবে? কার কাছে যাবে? কে আছে তোমার এখানে?

সতী বললে–তুমি হাত ছাড়ো আমার, আমি নিজেই ট্যাক্সি ডাকতে পারবো– দীপঙ্কর এবার কঠিন হয়ে উঠলো। সতীর হাতটা আরো জোরে চেপে ধরলো। বললে–আমি যেতে দেব না–

সতী দীপঙ্করের দিকে চেয়ে চুপ করে রইল।

দীপঙ্কর বললে–চলো, ওপরে চলো, রাত্রের এখনও অনেক সময় আছে, অনেক ভাববার সময় পাওয়া যাবে, এখন যখন একবার বেরিয়ে এসেছো বাড়ি থেকে, তখন মাথা ঠাণ্ডা করে সব ভাবতে হবে–চলো, চলো ওপরে চলো–

সতী বললে–কিন্তু ওখানে আমি আর ফিরে যাবো না–

–কেন? কী এমন দোষ করেছে ওরা? সংসারে বাস করতে গেলে এ-রকম একটু সহ্য করতেই হয়!

সতী বললে–সে তুমি বুঝবে না–

দীপঙ্কর বললে–তাহলে তুমি এখানে থাকো, আমি বরং সনাতনবাবুকে ডেকে নিয়ে আসি, দু’জনে বোঝাপড়া করে তারপর যা ঠিক হয় তাই করবে না-হয়–

সতী বললে–বোঝা-পড়ার দিন চলে গেছে আমাদের–

দীপঙ্কর বললে–স্বামী-স্ত্রীতে এ-রকম রাগ তো হয়েই থাকে, কত ঝগড়া হয়, কত মনোমালিন্য হয়, তা বলে এমন করে বাড়ি ছেড়ে কি বেরিয়ে আসতে আছে?

সতী বললে–তোমার সঙ্গে আমি তর্ক করতে আসি নি দীপু, আমি যখন এসেছি তখন সব ভাল-মন্দ বিচার করেই এসেছি, সুতরাং আমাকে তুমি আর বোঝাতে এসো না। হয় এখানে আমাকে থাকতে দাও আর না হয় আমার যেদিকে দু’চোখ যায় যেতে দাও–এত বড় কলকাতা শহরে একটা মানুষের জায়গা হবেই–

দীপঙ্কর বললে–আমি তো তোমাকে তাড়িয়ে দিই নি, আমি তো শুধু বলছি তুমি ওপরে চলো

সতী বললে–তুমি আগে কথা দাও আমাকে এখানে থাকতে দেবে, আমার যত দিন ইচ্ছে ততদিন আমাকে থাকতে দেবে?

দীপঙ্কর বললে–তা থাকো না তুমি, আমি কি আপত্তি করছি? মা নেই এখানে তাই তোমাকে বলেছিলাম। মা থাকলে তোমাকে থাকতে দিতে কেন আপত্তি করবো? তুমি যতদিন ইচ্ছে এখানে থাকো, খাও, আমার কী? আমার কিসের অসুবিধে?

তারপর সতীর হাতটা ধরে টানতে লাগলো। বললে–চলো, ওপরে চলো–

সতী ওপরে উঠলো আবার।

দীপঙ্কর বললে–এখনো তোমার সেই ছোটবেলাকার তেজ রয়েছে দেখছি, ঠিক সেই আগেকার মতন–

সতী ওপরে উঠে এবার একটা চেয়ারে বসল।

দীপঙ্কর বললে–খুব ক্লান্ত লাগে তো শুয়ে পড়ো না, সারারাত তো ঘুমোও নি বলছো, তারপর খাবার সময় ডেকে দেবো

সতী আবার বিছানায় গিয়ে হেলান দিলে বালিশে। সত্যিই যেন বড় ক্লান্ত দেখাচ্ছিল সতীকে। আবার চোখ বুজলো।

বললে–তুমি আজ আপিসে যাবে না?

দীপঙ্কর বললে–তা তো যেতেই হবে–

সতী আবার জিজ্ঞেস করলে–মাসীমা কবে আসবে?

দীপঙ্কর বললে–মা আজ এতক্ষণে বোধহয় পৌঁছে গেছে কাশীতে, আজকে যদি চিঠি ফেলে তো কাল পাবো–আর তিন-চারদিনের মধ্যেই এসে যেতে পারে–আর তা ছাড়া, আমাকে ছেড়ে মা’র তো এই প্রথম বাইরে যাওয়া, মা একদিনও টিকতে পারবে না!

তারপর একটু হেসে বললে–জানো, তুমি আসার ঠিক আগে আমি মা’কেই স্বপ্ন দেখছিলুম, স্বপ্ন দেখছিলুম যেন মা মাঝপথ থেকে ফিরে এসেছে–এমন সময়ে ঘুম ভেঙে গিয়ে দেখি তুমি–

সতী কিছু কথা বললে না।

দীপঙ্কর বললে– মা’র ঘরে তোমার বিছানা করে দেব?

সতী বললে–কেন, এখানে তো আমার কোনও অসুবিধা হচ্ছে না–

দীপঙ্কর বললে–না, একটু নিরিবিলিতে ঘুমোতে পারতে!

সতী বললে–আমার কোনও অসুবিধে হচ্ছে না–

দীপঙ্কর বলে–তাহলে তুমি ঘুমোও–আমি দেখিগে কাশী কতদূর কী করছে– যেতে গিয়েও আবার ফিরে দাঁড়াল দীপঙ্কর। বললে–আর একটা কথা, তুমি কী খাবে আজ? মাছ না মাংস না কী বলো তো! মা তো বাড়িতে নেই, আমাকেই সব ভাবতে হবে–

–যা খুশি তোমার! তুমি যা খাবে আমিও তাই খাবো

বলে সতী ও-পাশ ফিরে শুলো। দীপঙ্করের পাশ-বালিশটা নিয়ে বালিশে মাথা গুঁজে দিলে।

.

কাশীর বুদ্ধি আছে বেশ। চালও নিয়েছে বেশি করে। ডাল চড়াচ্ছে। কিছুই বলতে হয় নি তাকে। বুঝে নিয়েছে যে, সতীর এ-বাড়িতে থাকবার অধিকার আছে। তার দাদাবাবুর আপনার জন। কাশী তো জানে না সতী শুধু দীপঙ্করের আপনার জন নয়, পরম আপনার জন। সেই ছোটবেলা থেকে যেদিন প্রথম এসেছিল সতী কলকাতায় সেই দিন থেকেই। বলতে গেলে সতী কলকাতায় আসবার আগে থেকেই দীপঙ্করের আপনার জন হয়ে গিয়েছিল। কিরণের মতই আপন। কিরণকে যতখানি ভালবেসেছিল দীপঙ্কর, ঠিক ততখানি ভালবেসেছিল সতীকে। ভালবেসেও সতী ছিল দীপঙ্করের দূরের মানুষ। সতী ছিল স্বপ্নের মানুষ। সেই সতী শেষকালে কিনা এত কাছে এসে গেল! একেবারে এত কাছাকাছি! একেবারে তার নাগালের মধ্যে!

কাশী বললে–মাছ আনতে হবে দাদাবাবু–

দীপঙ্কর বললে–মাছ তো আনতেই হবে, আর মাংস রাঁধতে পারবি তুই?

কাশী বললে– মাংস তো রাঁধি নি কখনও–

দীপঙ্কর বললে–তাহলে থাক, ওরা বড়লোক, তোর রান্না কি খেতে পারবে? কী মাছ আনবি?

–যে-মাছ আনতে বলবেন!

দীপঙ্কর কী করবে বুঝতে পারলে না। যেন বিব্রত হয়ে পড়লো খুব। সতী এসেছে অথচ এমন করে কেন আসতে গেল! এমন করে ধূমকেতুর মতন কেন এল! কোথায় থাকবে সতী, কোথায় শোবে! পাশাপাশি ঘরে রাত কাটাবে! সে কী করে হয়! সতীর সঙ্গে এক বাড়িতে থাকলেও দীপঙ্করের ঘুম আসবে না। সতী পাশের ঘরে শুলে কি ঘুম আসে!

–আপনি আজ আপিসে যাবেন দাদাবাবু?

আপিসে যাবে না! বলে কি কাশীটা! সতী এসেছে বলে আপিসে যাওয়া বন্ধ হবে নাকি? কাশীও কি জানতে পেরেছে নাকি দীপঙ্করের দুর্বলতাটুকু! কাশীও কি ধরতে পেরেছে! ভাল করে চেয়ে দেখতে কাশীর দিকে। কাশী বেশ রান্নাঘর জুড়ে রান্না করতে বসেছে। রান্নাঘরে দীপঙ্কর কখনও আসে না। বিশেষ করে সন্তোষকাকা তার মেয়েকে নিয়ে আসবার পর থেকে দীপঙ্কর আর এদিকে ঘেঁষে না। কাশী শিল-নোড়া নিয়ে বাটনা বেটে ফেলেছে, বালতিতে কলের জল ধরেছে। তারপর ঝাঁটা নিয়ে ঘরদোর উঠোন সব ঝাঁট দিয়ে ফেললে। কলঘরের ভেতর থেকেও দীপঙ্কর কাশীর ঝাঁট দেওয়ার শব্দ শুনতে পেলে। আজ সকালেই বর্মায় ভুবনেশ্বরবাবুকে চিঠি দিতে হবে একটা। সেখানে সে চিঠি পৌঁছোতে তিন-চার দিন সময় লাগবে। তারপর সব কাজ-কর্ম গুছিয়ে আসতে বেশ কিছুদিন সময় লাগবে বৈ কি! বৰ্মা তো এখানে নয়! চিঠি পেয়েই দৌড়ে আসা যায় না! জাহাজেই লাগবে চার-পাঁচ দিন। ততদিন কোথায় থাকবে সতী! ততদিনে যদি মা না এসে পড়ে, তাহলে? এই সময়ে আজই মা এসে পড়লে ভালো হতো।

–কাশী ওপর থেকে আমার জামা-কাপড়টা নিয়ে আয় তো!

স্নান করে উঠে কাঁচা-কাপড় পরে একেবারে সোজা বাজারে গেলে হয়! দীপঙ্করের জন্যে যা-ইচ্ছে রান্না করুক কাশী, তাতে কিছু আসে যায় না। কিন্তু সতী কী করে যা তা দিয়ে খাবে! সতী তো বাবার আদরের মেয়ে! ঈশ্বর গাঙ্গুলী লেনের বাড়িতেও দীপঙ্কর দেখেছে কাকীমা সতীর জন্যে কত যত্ন করে রান্না করতো! সতী লক্ষ্মীদি দু’জনের জন্যে। দু’জনেই যা-তা দিয়ে খেতে পারে না।

জামা-কাপড় দিতেই দীপঙ্কর জিজ্ঞেস করলে–হ্যাঁরে কাশী, দিদিমণি কী করছে দেখলি, ঘুমোচ্ছে?

কাশী বললে—হ্যাঁ–

–তুই শব্দ করিস নি তো?

কাশী বললে–আমার পা লেগে চেয়ারটা কাত হয়ে গিয়েছির তবু ঘুম ভাঙে নি—

ঘুমোক, আহা! কতদিন ঘুমোয় নি হয়ত! তা না হলে নতুন জায়গায় এসে এই সকালবেলা কেউ ঘুমোতে পারে?

দীপঙ্কর বললে–আজ খুব ভালো করে রান্না করবি বুঝলি কাশী, যেন সেদিনকার মত ডালে নুন দিতে ভুলে যাস নি আবার! আর আমি আপিসে চলে যাবার পর যত্ন করে খেতে দিবি–খুব বড়লোক ওরা, বুঝলি, জিজ্ঞেস করে করে খাওয়াবি

ধুতি আর গেঞ্জিটা পরে খবরের কাগজের পাতাগুলো উল্টোতে লাগলো দীপঙ্কর। এখনও সেই কংগ্রেসের মধ্যে ঝগড়া চলছে। ফরওয়ার্ড ব্লক বলে নতুন একটা দল খুলেছে সুভাষ বোস। বাঙালীদের সঙ্গে কোনও দিন কারো বনবে না দেখছি। ওয়ার্ধাতে কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটির মিটিং। জওহরলাল নেহরু স্পেশাল ইন্‌ভিটেশন পেয়ে হাজির ছিলেন। বাঙলা থেকে মেম্বার ছিলেন ডাক্তার বিধানচন্দ্র রায়, প্রফুল্লচন্দ্র ঘোষ। মহাত্মাজীও হাজির ছিলেন রোজ। বম্বেতে মদ খাওয়া বন্ধ হয়ে গেল। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর চিত্তরঞ্জন অ্যাভিনিউতে ‘মহাজাতি সদনে’র ভিত্তি প্রতিষ্ঠা করেছেন। ওদিকে মস্কোতে জার্মান-রাশিয়ান প্যাক্ট সই হয়ে গেছে। কী যে সব হচ্ছে! হিটলার পোল্যান্ড চেয়ে বসেছে। ও ঠিক নেবে পোল্যান্ড। কেউ ঠেকাতে পারবে না। যতই ইংল্যান্ডের সঙ্গে পোল্যান্ডের মিউঁচুয়্যাল অ্যাসিসটেন্সের প্যাক্ট থাক্। খবরের কাগজের মোটা-মোটা হেডিং-এর ওপর চোখ বুলোতে লাগলো দীপঙ্কর। তারপর হঠাৎ কাগজটা পাশে সরিয়ে রাখলে।

কোনও দিকে ভালো করে মন যাচ্ছে না সকাল থেকে। ভুবনেশ্বরবাবুকে নিজে চিঠি না লিখে সতীকে দিয়ে লেখালে হয়। সতীই লিখুক। সতীর কথাতেই বেশি গুরুত্ব দেবেন তিনি। তাছাড়া, দীপঙ্করকে তিনি চোখে দেখেন নি, দীপঙ্করকে তিনি চেনেন না, নামও শোনেন নি দীপঙ্করের–তার চিঠি পেয়ে তিনি অবাকই হয়ে যাবেন বরং। তার চেয়ে সতী লিখলেই তো ভালো হবে।

কাশী এল। দীপঙ্কর বললে– আমার জামার পকেট থেকে টাকা নিয়েছিস?

কাশী বললে–এই যে নিয়েছি–

–ভালো দেখে মাছ নিবি, আলু নিবি, পটল নিবি–দামের জন্যে ভাবিস নি, বুঝলি? আর আসবার সময় দই মিষ্টি কিনে নিয়ে আসবি। আমি তোর সঙ্গেই যেতাম, কিন্তু খালি বাড়ি ছেড়ে যাই কী করে–

কাশী চলে গেল। সদর দরজাটা বন্ধ করে দিয়ে দীপঙ্কর বাইরের দিকে জানালা দিয়ে চেয়ে দেখতে লাগলো। মা হয়ত এতক্ষণে পৌঁছে গেছে কাশীতে। এ-সময়ে কাশীর ক্লাইমেট্‌টা ভালো। গাঙ্গুলীবাবুদের পুরোন পাণ্ডা এসে হয়ত নিয়ে গিয়ে তুলেছে ধর্মশালায়। আর মা’র হাতেও তো টাকা দিয়েছে দীপঙ্কর। যা খুশি কিনবে। নিজের পছন্দ মত সংসারের টুকিটাকি সব। আর তারপর ধুলো পায়েই বিশ্বনাথ দর্শন করতে হয়!

একটা পোস্ট অফিসের পিওন এক তাড়া চিঠির ব্যাগ নিয়ে রাস্তা দিয়ে ওধারে চলে গেল। আজ যদি মা চিঠি ফেলে তো কাল এই সময়ে হয়ত চিঠি এসে পৌঁছোবে। মা ছাড়া দীপঙ্করকে কে আর চিঠি লিখবে! যদি কিরণ কখনও চিঠি লেখে! আর কে লিখবে তাকে চিঠি? আর কারো সঙ্গেই তো দীপঙ্করের চিঠি লেখার সম্পর্ক নেই। ছোট থেকে বড় হয়েছে, মানুষ হয়েছে, চাকরি করছে। চাকরিকেই সার করেছে জীবনে। খবরের কাগজ পড়লে বুঝতে পারা যায় পৃথিবীতে কত দেশ, পৃথিবীতে কত মানুষ। দীপঙ্করের মতই সব মানুষ সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে আছে। ওই পোল্যান্ড, ওই জার্মানী, ওই ওয়ার্ধা, ওই ইংল্যান্ড, ওখানেও দীপঙ্করের মতই সব মানুষরা আপিসে যায়, খবরের কাগজ পড়ে। ওখানেও হয়ত সতীদের মত মেয়েরা শাশুড়ীর অত্যাচারে বাড়ি থেকে পালিয়ে আসে, ওখানেও হয়ত লক্ষ্মীদির মত মেয়েরা বাড়িতে জুয়ার আড্ডা বসিয়ে সংসার চালায়। ওখানেও হয়ত বিন্তিদির মত মেয়েরা হতাশায় আত্মহত্যা করে। ওখানেও নিশ্চয়ই ছিটে-ফোঁটারা আছে। জওহরলাল নেহরুর ভাষায় এখানেও হয়ত আছে ওইরকম ইতিহাসের ডাস্টবিন সব। ওখানেও প্রাণমথবাবু, কিরণ, রায় বাহাদুর নলিনী মজুমদার আর নির্মল পালিত আর লক্ষ্মণ সরকাররা আছে। ওখানেও কে-জি-দাশবাবু, মিস মাইকেল, রবিন্‌সন সাহেব, রামলিঙ্গমবাবু আছে। হয়ত নামই আলাদা, মানুষগুলো একরকম। একই মানুষের বিভিন্ন রকমফের শুধু। সেখানেও সবাই যুদ্ধ নিয়ে, দেশ নিয়ে, টাকা নিয়ে, পার্টি নিয়ে, চাকরি নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছে। সেখানেও দীপঙ্করেরা তেত্রিশ টাকা ঘুষ দিয়ে চাকরিতে ঢুকে হয়ত এখন সেন সাহেব হয়ে বসেছে। কেউ কাউকে আমরা চিনি না। অথচ এই একই সূর্য সেখানেও আলো দেয় সকালবেলা, একই চাঁদ সেখানেও সন্ধ্যেবেলা আকাশে ওঠে!

হঠাৎ যেন দোতলায় একটা শব্দ হলো।

সতী বোধহয় ঘুম থেকে উঠলো এখন।

দীপঙ্কর সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠলো। দোতলায়। দরজাটা তেমনি খোলা রয়েছে।

কিন্তু বিছানাটার ওপর সতী তেমনি অঘোরে ঘুমোচ্ছে। এবার এ-পাশ ফিরে ঘুমোচ্ছে। বড় নিশ্চিন্ত, বড় প্রশান্ত সতীর মুখের চেহারাটা। দীপঙ্করের মনে হলো সতী যেন দীপঙ্করের বিছানার ওপর তার পরম নির্ভরতার স্বস্তি পেয়েছে। অন্তত মুখের ভঙ্গি দেখলে তাই মনে হয়। মাথার কোঁকড়ানো চুলের ভারি খোঁপাটা এলিয়ে পড়েছে বালিশের ওপর। সিঁথিতে পাতলা সিঁদুরের রেখাটা তখনও স্পষ্ট। দুটো ভুরুর মধ্যেও একটা সিঁদুরের টিপ। সরু জ্যামিতিক রেখার মত নাকটা নিঃশ্বাস ফেলবার সঙ্গে সঙ্গে কেমন যেন একটু ফুলে ফুলে উঠছে। চোখের পাতা দুটো বোজা আর পাতলা ঠোঁট দুটো জোড়া। দীপঙ্কর একদৃষ্টে চেয়ে দেখতে লাগলো। এমন করে সতীকে একদৃষ্টে চেয়ে দেখবার সুযোগ আগে কখনও পায় নি দীপঙ্কর। সতী এত সুন্দর! এত সুন্দর দেখতে সতীকে! অথচ সাজেনি, গোজেনি কিছু না। কাল রাত্রে যেমন অবস্থায় ছিল তেমনি ভাবেই চলে এসেছে। সতীর আপাদ-মস্তক চেয়ে দেখতে লাগলো দীপঙ্কর। রঙিন একটা শাড়ি পরেছে। ঘুমোবার সময়ে গা থেকে খসে গেছে আঁচলটা। মোটা লাল চওড়া পাড় শাড়িটার। পায়ের গোছটা বেরিয়ে গেছে। কী সুন্দর পা। শুকনো পা-জোড়া। কবে বুঝি একদিন আলতা পরেছিল–তার চিহ্ন লেগে রয়েছে অস্পষ্ট। আঙুলের নখগুলো পাতলা সাদা ধপ্ ধপ্ করছে। গায়ের রং-এর সঙ্গে যেন মিলে একাকার হয়ে গেছে ঘুমের ঘোরে নিঃশ্বাস টানার সঙ্গে সঙ্গে বুকটা ওঠা নামা করছে তালে তালে। আশ্চর্য, এমন বউকে নিয়ে সুখী হলো না সতীর শাশুড়ী! এমন স্ত্রীকে সনাতনবাবু বাড়িতে রাখতে পারলেন না! এমন মেয়ের কপালে এত কষ্ট! দীপঙ্কর নিঃশ্বাস বন্ধ করে একদৃষ্টে চেয়ে দেখতে লাগলো।

অথচ কিসের অভাব ছিল এই মেয়ের। ভুবনেশ্বরবাবুর তো টাকার শেষ নেই। তাঁর সমস্ত টাকা তো এই মেয়েই পাবে। তাঁর তো ছেলে নেই, লক্ষ্মীদি তো তাঁর জীবন থেকে মুছে গিয়েছে। সনাতনবাবুদেরও তো অনেক টাকা, অনেক ঐশ্বর্য! কলকাতায় বাড়ি, গাড়ি, ঝি-চাকর-ঠাকুর, বাগান মালী, দারোয়ান, জমিদারী, কিছুরই তো অভাব নেই। অঘোরদাদু চেষ্টা করে যা জমিয়েছে, সতী বিনা চেষ্টায় জন্মেই তা পেয়েছে। তার ওপর পেয়েছে তার এই রূপ। এই দুধে-আলতায় মাখা গায়ের রং, এই স্বাস্থ্য, এই চুল,,

এই ঠোঁট, এই চোখ, এই সব! ঈশ্বর যেন সব কিছু দিয়েছিল সতীকে উজাড় করে।

একটা মাছি কোথা থেকে হঠাৎ সতীর গালের ওপর বসলো।

কোথা থেকে জানালা দিয়ে হয়ত সকালের রোদ পেয়ে ঘরে ঢুকে পড়েছে। ঢুকে সতীর গালের ওপর বসে পাখা নাড়াচ্ছে। ছোট ছোট পা-দুটো দিয়ে পাখা পরিষ্কার করছে।

আহা! এমন আরামে ঘুমোচ্ছে সতী, আর ঘুমটা ভেঙে দেবে!

দীপঙ্কর পাখাটা আরো বাড়িয়ে দিলে। পাখাটা আরো জোরে বন্ বন্ করে ঘুরতে লাগলো সতীর মাথার ওপর। কোঁকড়ানো চুলগুলো একটু দুলে উঠলো। মাছিটা তবু নড়ে না।

দীপঙ্কর আরো কাছে সরে এল। একেবারে সতীর মুখের কাছাকাছি। মুখের কাছে হাতটা নিয়ে এসে মাছিটাকে তাড়াতে চেষ্টা করলে। মাছিটা নড়লো বটে, কিন্তু আবার নাকের ওপর বসলো। নাকের ওপর থেকেও যদি বা নড়লো, কপালের ওপর গিয়ে বসলো আবার।

ছোট্ট ছাই রং-এর মাছি একটা।

দীপঙ্কর এবার আরো নিচু হয়ে মাছিটাকে সরিয়ে দেবার চেষ্টা করলে। কিন্তু সতী যদি জেগে ওঠে, যদি আচমকা সতীর গালে হাতে লেগে যায়!

যদি সতী সন্দেহ করে! অন্য একটা উপায় আছে। ঘর অন্ধকার করে দিলে মাছিটা হয়ত চলে যেত পারে। দীপঙ্কর পুব দিকের জানালা দুটো নিঃশব্দে বন্ধ করে দিলে। অন্ধকার হয়ে এল ঘরটা। দিনের বেলাই যেন রাত্রি নেমে এল। সেই রাত্রির অন্ধকারে সেই নিস্তব্ধ ঘরের মধ্যে দাঁড়িয়ে দীপঙ্করের মনে হলো যেন সতী বড় ঘনিষ্ঠ হয়ে উঠেছে। যেন বড় কাছাকাছি। বড় একাত্ম। মাছিটা তখন কোথায় নিরুদ্দেশ হয়ে গেছে। সেই অন্ধকারের মধ্যে দীপঙ্কর সতীর মুখের কাছাকাছি নিজের মুখটা নামিয়ে দেখতে লাগলো–কোথায় গেল মাছিটা। তখনও ঘুমোচ্ছে সতী। তখনও পরিপূর্ণ নির্ভরতার চিহ্ন সতীর সর্বাঙ্গে। একটানা নিঃশ্বাসের মৃদু শব্দ কানে আসে। দীপঙ্কর সেইখানে দাঁড়িয়ে চোরের মত সতীর দিকে একদৃষ্টে চেয়ে সেই শব্দ যেন সমস্ত ইন্দ্রিয় দিয়ে অনুভব করতে লাগলো।

আর সঙ্গে সঙ্গে দীপঙ্করের এতদিনের শিক্ষা, দীক্ষা, সভ্যতা, সততা সব যেন ভেসে যাবার উপক্রম করলো। দীপঙ্করের মনে হলো অনেক না পাওয়ার বঞ্চনায় যেন হাহাকার করে উঠলো আদিম একটা মানুষের আত্মা। দীর্ঘদিনের নৈরাশ্যের পর আজ যেন সে আশার আমন্ত্রণ জানাতে এসেছে তাকে! যুগের পর যুগ কেটে গেছে শুধু প্রতীক্ষার ক্লান্তিতে। সেই কবে একদিন মানুষের জন্ম হয়েছিল বুভুক্ষার অতৃপ্তি নিয়ে। কবে একদিন বন্য সমাজের একটি প্রান্তে একটি মানব-শিশু জন্মা-লগ্নেই ক্ষুধা, আলো আর আশার জন্যে আকাশে হাত বাড়িয়েছিল। এতদিন কেউ সে-আশা তার মেটায়নি, কেউ পরিতৃপ্তির বাণী, পরিত্রাণের বাণী শোনায়নি তাকে। আজ যেন হাতের কাছে এসে পৌঁছিয়েছে সেই অমৃত অযাচিতভাবে! এতদিন শুধু বয়েসই বেড়েছে, এতদিন শুধু বাঁধাবুলির গৎ মুখস্থ করে বঞ্চনাই বাড়িয়েছে! এতদিন জীবন, ধর্ম, দেশ, প্রকৃতি সব কিছু নিয়ে কেবল বিড়ম্বিতই করেছে নিজেকে। অথচ…….

হঠাৎ সতী যেন নড়ে উঠলো।

নড়তেই দীপঙ্কর তিন-পা পেছিয়ে এসেছে। আশঙ্কায় আতঙ্কে একেবারে থর থর করে কেঁপে উঠেছে সমস্ত শরীরটা।

সতী চোখ খুললো আস্তে আস্তে। তারপর আড়মোড়া খেয়ে যেন কোথায় আছে ভাবতে চেষ্টা করলে। তারপর দীপঙ্করকে দেখতে পেয়ে বললে–কী হলো?….কে?

দীপঙ্কর সহজ হবার চেষ্টা করে বললে–কিছু না, তুমি ঘুমোও–আমি–

সতী বললে–কত রাত্তির হলো? তুমি আপিসে যাও নি?

দীপঙ্কর বললে–না, এখন তো সকাল–

–তাহলে এত অন্ধকার কেন?

দীপঙ্কর বললে–আমি জানলা বন্ধ করে দিয়েছি, মাছি আসছিল কিনা–

সতী একটু থেমে বললে–ওরা কেউ আসে নি?

–কারা?

দীপঙ্কর বুঝতে পারলে না। আবার বললে–কারা?

সতী বললে–ওই প্রিয়নাথ মল্লিক রোড থেকে–?

–না কেউ তো আসেনি! কারো আসবার কথা ছিল নাকি?

সতী বললে–না, তাই জিজ্ঞেস রছি, জানলাটা খুলে দাও, বড্ড অন্ধকার লাগছে, দেখতে পাচ্ছি না কিছু

দীপঙ্কর বললে–না-ই বা খুললাম, তুমি ঘুমোও না–আমি চলে যাচ্ছি—

সতী হঠাৎ বললে–অন্ধকারে কী করছিলে তুমি একলা একলা?

দীপঙ্কর ভাবনায় পড়লো। হঠাৎ কোনও কথা তার মুখ দিয়ে বেরোল না। বললে– কিছু করছিলুম না–এমনি–

–তাহলে তুমি দাঁড়িয়ে ছিলে কেন অমন করে? আমার মনে হলো যেন অনেক রাত হয়ে গেছে, আর ঘরের মধ্যে যেন কে ঢুকেছে, ভয় পেয়ে গিয়েছিলুম খুব। দাও, জানলাটা খুলে দাও, তোমার মুখ দেখতে পাচ্ছি না

বলতে বলতে সতী উঠে বসলো। বললে–ও-বাড়িতে এতক্ষণে যে কী হচ্ছে কে জানে–!

দীপঙ্কর জানালা দুটো খুলে দিতে যাচ্ছিল। সতী আবার বললে–সত্যি, যদি কেউ খুঁজতে আসে আমাকে, কী হবে? কী বলবে তুমি?

দীপঙ্কর কিছু উত্তর দিলে না।

সতী বললে–বলে দিও আমি এখানে নেই–

দীপঙ্কর বললে–তা আমি বলতে পারবো না–তার চেয়ে তোমাকে আমি নিয়ে যাচ্ছি চলো সনাতনবাবুর কাছে, আমি সমস্ত মিটমাট করে দেবো। আর তাতেও যদি রাজী না থাকো তো আমি সনাতনবাবুকে গিয়ে ডেকে আনছি–

সতী বললে–তাই যদি যাবে তো আমি এখানে এলুম কেন–তোমার এখানে এলাম কি সেই জন্যে?

দীপঙ্কর ততক্ষণ জানালা দুটো খুলে দিয়েছে। সকাল বেলার পুব দিকের রোদ এসে আবার ঘরে পড়েছে। দীপঙ্কর একটা চেয়ারে বসলো। বললে–কিন্তু তাহলে কী করবে?

হঠাৎ নিচেয় কড়া নাড়ার শব্দ হলো। ওই বোধহয় কাশী এসেছে!

তাড়াতাড়ি নিচেয় গিয়ে দীপঙ্কর সদর দরজা খুলে দিয়ে এল। মা চলে যাবার পর থেকে এই হয়েছে। সদর দরজা বন্ধ করা, খোলা–এও একটা কাজ! যখন কিছু ছিল না দীপঙ্করের তখন কোনও কাজও ছিল না। কিন্তু এখন বাড়ি ভাড়া করেছে, এখন বাড়িতে বাসন-কোসন আছে, আলমারি, ট্রাঙ্ক আছে। জামা-কাপড় আছে। সংসার করতে গেলে যা কিছু দরকার সব আছে। দিনে দিনে খুঁটি-নাটি বেড়ে বেড়ে জঞ্জাল জমে গেছে। কলকাতা শহরের আরো দশজন মানুষের মত দীপঙ্করেরও ঐশ্বর্য হয়েছে, সমৃদ্ধি হয়েছে, বিত্ত হয়েছে। সঙ্গে সঙ্গে ভাবনাও বেড়েছে। একা দীপঙ্কর কত দিকে দেখবে! আশ্চর্য, অথচ যারা আরো বিত্তবান, যারা আরো সমৃদ্ধশালী, যারা অনেক ঐশ্বর্যের মালিক, তারা কেমন করে বাঁচে, তারা কেমন করে শান্তি পায়!

বাজারের থলিটা খুলে দেখলে দীপঙ্কর। কাশী অনেক কিছু বেছে বেছে এনেছে। আলু, মাছ, বেগুন, কত কী!

দীপঙ্কর বললে–ভালো করে রাঁধবি, জানিস! নুন তেল দিবি ভাল করে, নইলে খেতেই পারবে না–ওরা খুব বড়লোক, বুঝলি

তারপর একটু থেমে বললে–আমি একটু বেরোচ্ছি, বুঝলি কাশী–

কাশী বললে–আপনি আপিসে যাবেন না?

দীপঙ্কর বললে–আপিসে যাবো না কী রে? এখুনি ফিরে আসছি, ফিরে এসেই ভাত খেয়ে আপিসে যাবো

রাস্তায় বেরিয়েই দীপঙ্কর খানিকক্ষণ চুপ করে দাঁড়াল। কিছু কিছু লোক আপিসে বেরোচ্ছে অত সকালেই রাস্তাতে তখনি ভিড় বেড়ে গেছে। কিন্তু কোথায় যাবে দীপঙ্কর? কার কাছে? সনাতনবাবুর কাছে? সনাতনবাবুর কাছে গিয়ে কী বলবে?

বাড়িতে সতীকে তেমনি বিছানায় বসিয়ে রেখে এসেছে। ঘুমের ঘোরে সতীকে সত্যিই বড় সুন্দর দেখাচ্ছিল। দীপঙ্করের নিজের মনেই বড় লজ্জা হলো। এমন করে লুকিয়ে লুকিয়ে দেখা উচিত হয় নি। সতীর দিকে অমন করে লুকিয়ে দেখা অন্যায়।

প্রথমেই সনাতনবাবুর কাছে যাওয়া ভালো। ভদ্রলোক অমায়িক মানুষ। কোনও সাতে-পাঁচে থাকেন না কারো। নিজের বই আর নিজের চিন্তার জগতে তিনি সব-সময় ব্যস্ত। সমস্ত বাইরের পৃথিবী থেকে তিনি বিচ্ছিন্ন।

সমস্ত কলকাতার মানুষকে সেই সকালবেলা যেন বড় বিভ্রান্ত মনে হলো। এত সকালে কখনও রাস্তায় বেরোয় না দীপঙ্কর। অন্তত এত সকালে এদিকে আসতে হয় না তাকে। আরো ঘণ্টা দু’এক পরে তবে দীপঙ্করের জীবনযুদ্ধ আরম্ভ হয়। কিন্তু তবু বাড়ি থেকে বেরিয়েই যত মানুষ নজরে পড়লো, সবাই যেন বিভ্রান্ত! সমস্ত মানুষই কি দীপঙ্করের মত এমনি বিভ্রান্ত হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে? সকলের বাড়িতেই কি মা নেই! আজ মা থাকলে দীপঙ্করকে এত ভাবতে হতো না। ঠিক এই সময়েই কেন মাকে কাশী পাঠিয়ে দিলে!

প্রিয়নাথ মল্লিক রোডে ঢোকবার মুখেই একটা মন্দির। কী একটা ঠাকুর। খুব ঘটা করে পুজো হচ্ছে। গৃহ-বিগ্রহের পুজো। অনেকদিন থেকে দেখে আসছে দীপঙ্কর মন্দিরটা। ভেতরে ঘণ্টা বাজছে, শাঁখ বাজছে। আগে কোনওদিন ভালো করে নজর করে দেখে নি। একমাত্র ছোটবেলাতেই মাকালীর মন্দিরে গিয়ে প্রত্যেক দিন ফুল দিয়ে এসেছে, নমস্কার করেছে। তারপর কত দিন, কত বছর কেটে গিয়েছে–কালীঘাটের মন্দিরে আর যাওয়ার সুযোগ হয়নি। কোনও ঠাকুরকেই আর নমস্কার করা হয় নি। আর কার জন্যেই বা নমস্কার করবে?

দীপঙ্কর মন্দিরে মুখোমুখি দাঁড়িয়ে সামনে চাইলে।

ভেতরটা অন্ধকার। পকেট থেকে একটা পয়সা বার করতে যাচ্ছিল। দেবতার প্ৰণামী।

–বাবু একটা পয়সা!

দীপঙ্কর হঠাৎ গলা শুনে পাশে চেয়ে দেখলে।

–বেরো, পয়সা হবে না, যা এখান থেকে!

একটা ছোট ভিখিরীর মেয়ে। ডান হাতটা নেই। সমস্ত মুখে বসন্তর দাগ। বাঁ হাতে একটা মগ বাড়িয়ে দিয়ে ভিক্ষে করছে। দীপঙ্করের ধমক শুনেও সরতে চায় না।

দীপঙ্কর আবার ধমক দিলে–বেরো এখান থেকে, যা–

ভিখিরী–মেয়েটা হতাশ হয়ে চুপ করলো। বোধহয় নিরুৎসাহ হয়ে গেলে এবার।

দীপঙ্কর আবার ঠাকুরের দিকে চেয়ে দেখলে। পকেট থেকে পয়সাটা বার করে দিতে গিয়েও কেমন একটু দ্বিধা করতে লাগলো। তারপর ঠিক সেই ছোটবেলার মতন পয়সাটা ছুঁড়ে ভেতরে ফেলে দিলে। অভ্যাসমত হাত দুটোও জোড়া করলে। ঢং ঢং করে কাঁসর-ঘণ্টা বাজছে। ঠাকুর-দেবতার সামনে দাঁড়িয়ে কিছু কামনা করতে হয়। কিছু চাইতে হয়। কিন্তু কী চাইবে? চাওয়ার তো অনেক কিছু আছে সংসারে। দীপঙ্করেরও তো অনেক কিছু চাইবার আছে। কিন্তু কী চাইবে? কার মঙ্গল চাইবে? মা’র মা-ও এতক্ষণ এই সময়ে হয়ত বিশ্বনাথের মন্দিরে দাঁড়িয়ে দীপঙ্করেরই মঙ্গল কামনা করছে। মা-ও হয়ত ঠিক এমনি করে ঠাকুরের বেদীতে এক পয়সা দক্ষিণা দিয়ে ছেলের ভবিষ্যৎ সুখ-শান্তি সম্বন্ধে ঠাকুরের কাছে গ্যারান্টি চাইছে! আশ্চর্য, কত পয়সা এমনি করে কত লোক প্রতিদিন প্রতি মুহূর্তে দক্ষিণা দিচ্ছে ঠাকুরকে! আর ঠাকুর?

ঠাকুরের মন্দিরের ভেতরে প্রদীপের আলো জ্বলছে টিম্ টিম্ করে। আবার মাথার ওপর ইলেকট্রিকের বাল্বও ঝুলছে। একজন পুরুত দাঁড়িয়ে উঠে ডান হাতে পঞ্চপ্রদীপ, আর বাঁ হাতে ঘণ্টা নাড়াচ্ছে। ঘণ্টার শব্দে আরো অনেক রাস্তার লোক জড়ো হয়ে গেল। ভেতর থেকে ধূপ-ধুনোর গন্ধ এসে লাগছে নাকে ৷

আর কার মঙ্গল কামনা করবে দীপঙ্কর? মা’র কথা তো বলা হয়ে গেছে ঠাকুরকে! এবার সতীর কথা?

হঠাৎ নিজেরই মনে হলো দিন দিন যেন সে অবিশ্বাস হয়ে উঠছে। সেই ছোটবেলাকার বিশ্বাস যেন তার ক্রমেই হারিয়ে যাচ্ছে। তেমন করে ঠাকুর-দেবতার ওপর যেন আর ভক্তি নেই। ঠাকুর-দেবতাকে প্রণাম করতে গেলে যেন আগেকার মত ভক্তিতে মাথা নুইয়ে আসে না তার। কেন এমন হলো? এ কি অধঃপতনের লক্ষণ? ঠাকুর তো সেই একইরকম আছে। সেই পলকহীন পাথরের চোখ, সেই স্তব্ধ দৃষ্টি। তবে সেই কি নাস্তিক হয়ে পড়েছে! কেন নাস্তিক হবে সে? কোন্ দেবতাকে সে পুজো করছে আজকাল? কে তার মঙ্গল করবে? তার নিজের মঙ্গলের জন্যে কার মন্দিরে সে গিয়ে দাঁড়াবে?

আর বেশি সময় নেই। অফিস যাবার সময় হয়ে এল। হঠাৎ রাস্তায় একটা হৈ-হৈ শব্দ উঠলো। তারপরেই একটা মোটরগাড়ির ব্রেক-কষার শব্দ! দীপঙ্কর উঠে মুখ ফেরাল।

আর সঙ্গে সঙ্গে যারা কাছে ছিল তারও একটা অস্ফুট শব্দ করে উঠলো–ইস্– দীপঙ্কর ফুটপাথ ছেড়ে রাস্তায় গেল দৌড়ে। কিন্তু তার আগেই অনেক ভিড় জমে গেছে। অনেক মানুষ দৌড়তে দৌড়তে ঘটনাস্থলে গিয়ে দাঁড়াচ্ছে। চারপাশে একটা বিরাট জনতা জমে গেল সেই সকালবেলাই।

দীপঙ্কর গাড়িটার কাছ পর্যন্ত পৌঁছতে পারলো না।

–কী হয়েছে স্যার এখানে?

দীপঙ্কর বললে–কী জানি, বোধহয় গাড়ি চাপা পড়েছে কেউ–

বলে আরো ভিড়ের মধ্যে এগিয়ে যাবার চেষ্টা করলে। ভেতরে উঁকি দেবার চেষ্টা করলে। কার যেন কান্নার শব্দ উঠলো হঠাৎ। মেয়েমানুষের গলা।

একজন চিৎকার করে উঠলো–মার শালাকে, শালা গাড়ি চালাচ্ছে, একেবারে নবাব হয়ে গেছে নাকি–

দু’একটা পুলিস এসে গেল। তারা ভেতরে ঢুকে এগিয়ে গেল সামনের দিকে।

দীপঙ্কর তখনও কিছু দেখতে পাচ্ছে না। হাজরা রোডের মোড়ে সকালবেলা কখনও ভিড় জমাবার লোকের অভাব হয় না ৷

পাশ থেকে একজন বললে–অন্ধ নাকি মশাই? চোখে দেখতে পায় না?

আর একজন বললে–ওরা তো গাড়ি চাপা পড়বার জন্যেই জন্মেছে মশাই, ও মরেছে বেশ হয়েছে–

ততক্ষণে পুলিস দু’জন সামনে যেতেই এদিকটা ভিড় একটু পাতলা হলো। সেই ফাঁকের মধ্যে হঠাৎ দীপঙ্করের নজরে পড়লো ঠিক গাড়ির দুটো চাকার মধ্যিখানে একটা ছোট মেয়ে পড়ে আছে। আর এক হাতে তখনও সেই ফাঁকা মগটা। ঠোঁটের ফাঁক দিয়ে রক্ত গড়িয়ে পড়ছে পিচের রাস্তার ওপর।

–গাড়ি যদি চালাতে না জানে তো গাড়ির লাইসেন্স কেড়ে নেওয়া হোক—

আর একজন বললে–এদের জেলে পুরে ফাঁসি দেওয়া উচিত মশাই–

দীপঙ্কর তখনও একদৃষ্টে চেয়েছিল সেই ফাঁকা মগটার দিকে। একটা পয়সা চেয়েছিল এই মেয়েটাই। দীপঙ্করই দূর-দূর করে তাড়িয়ে দিয়েছিল। হাতটা তখনও যেন তার দিকে বাড়িয়ে রয়েছে। তখনও যেন মগটা বাড়িয়ে দিয়ে নিঃশব্দে বলছে–বাবু, একটা পয়সা–

আশ্চর্য! দীপঙ্করের পিঠের ওপর যেন চাবুক পড়লো। দীপঙ্করই যেন মেয়েটাকে খুন করে ফেললে। একটা পয়সা দিলে কী এমন তি হতো তার? ঠাকুরকে পয়সা না দিয়ে মেয়েটাকে দিলেই হতো! ঠাকুরকে দিয়ে কী লাভ হলো? কার মঙ্গল হলো? কার স্বর্গলাভ হলো? সমস্ত শরীরটা থর থর করে কাঁপতে লাগলো দীপঙ্করের। পাশে বুঝি তা মা আর্তনাদ করে উঠলো–কী সব্বনাশ হলো গো, তুই কোথায় গেলি মা–

হাজরা রোডের আকাশ-বাতাস সেই কান্নায় যেন বড় মন্থর হয়ে উঠলো। যত মন্থর হলো, মানুষের উত্তেজনা তত বাড়তে লাগলো। মেয়েটা তখনও পড়ে আছে। যার গাড়ি, সে ভদ্রলোক তখনও গাড়ির ভেতরে। সবাই মিলে তাকে ধরেছে। পেছন থেকে স্পষ্ট দেখা যায় না। গাড়ির ড্রাইভারকেও সবাই চেপে ধরেছে। সবাই তাদের নিয়ে ব্যস্ত। কিন্তু মেয়েটার কথা কেউ ভাবছে না। দীপঙ্করের মনে হলো এখন এই মুহূর্তে যদি মেয়েটা বেঁচে উঠে তার কাছে পয়সা চায় তো তার পকেটে যা-কিছু আছে সব যেন তাকে দিয়ে দিতে পারে। মেয়েটা যেন দীপঙ্করকে পরীক্ষা করতেই এসেছিল। যেন জীবন দিয়ে মেয়েটা দীপঙ্করকে শিক্ষা দিয়ে গেল। কী হলো ঠাকুরকে পয়সা দিয়ে? সত্যিই তো, কী লাভ হলো?

মাথার মধ্যে তার সমস্ত গোলমাল হয়ে গেল। কেন এমন করলে সে! যেন মেয়েটার মৃত-আত্মা তার দিকে চেয়ে খিল-খিল করে হাসছে। বললে–বেশ হয়েছে, কেমন জব্দ! বেশ হয়েছে, বেশ হয়েছে! কী করতে এসেছিল সে এখানে? কী তার কাজ? সনাতনবাবুর সঙ্গে দেখা করতে? তাহলে সনাতনবাবুর সঙ্গে দেখা করতে না গিয়ে এখানে এই মন্দিরের সামনে দাঁড়িয়ে কেন সে ভক্তির ভান করছিল? কেন সে মাটির মানুষকে অবহেলা করে পাথরের ঠাকুরকে নিয়ে মেতে উঠেছিল? দীপঙ্করের মনে হলো–এত বড় ভুল যেন জীবনে সে আর কখনও করেনি! মনে হলো তার ভণ্ডামি যেন হঠাৎ সকলের সামনে ধরা পড়ে গেছে। সেই ভণ্ডামিটুকু প্রকাশ করে দেবার জন্যেই যেন মেয়েটা ভিখিরি সেজে তার সামনে এসে ভিক্ষে চেয়েছিল। ঠাকুরই যেন পরিচয়পত্র দিয়ে তাঁর দূতকে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন দীপঙ্করের কাছে। কই, আমি তো ঈশ্বর মানি না, আমি তো ভগবানের অস্তিত্বে বিশ্বাস করি না! ছোটবেলা থেকে ঠাকুরকে যে ফুল দিয়ে এসেছি সে তো অভ্যেসের ফলে! দীপঙ্করের আবার মনে হলো এতদিন যে ঈশ্বরকে ফুল দিয়ে এসেছে, সেই ঈশ্বরই যেন পিচের রাস্তার ওপর মরে পড়ে আছে। ঈশ্বরের ঠোঁটের ফাঁক দিয়েই যেন রক্ত গড়াচ্ছে। ময়লা ছেঁড়া জামা পরা ঈশ্বর মাটিতে লুটোচ্ছে। ঈশ্বরকে চাপা দিয়ে মেরে ফেলেছে আমেরিকামেড মোটর গাড়ি।

দীপঙ্কর আরো এগিয়ে গেল। মেয়েটার মা মাটিতে রাস্তায় বসে তখনও বুক চাপড়ে কাঁদছে চিৎকার করে। পকেট থেকে দীপঙ্কর সব টাকাগুলো বার করলে। দশ-বারো টাকা ছিল পকেটে। পাঁচ টাকার দু’খানা নোট আর খুচরো দুটো টাকা। সবগুলো নিয়ে মায়ের হাতে দিলে।

বললে–এই রূপেয়া লেও মাতাজী–

কাঁদতে কাঁদতেও মেয়েটার মা যেন একবার থমকে চেয়ে দেখলে দীপঙ্করের দিকে। এ মুহূর্তের বিরতি। প্রথমে বিশ্বাস করতে পারেনি। টাকাগুলোর দিকে একবার চা এল।

দীপঙ্কর বললে–লেও রূপেয়া, টাকা নাও–

আশেপাশের লোকগুলো যারা এতক্ষণ দেখছিল তারাও দীপঙ্করের দিকে ভাল করে চেয়ে দেখলে। মেয়ে মরে গেছে যার তাকে কি টাকা দিয়ে খুশী করা যায়? টাকাতে কি মেয়ের অভাব পূরণ হয়?

দীপঙ্কর বললে–তা হোক, তুমি গরীব লোক, টাকা কটা নাও–আমি দিচ্ছি–

আশ্চর্য, টাকা-ক’টা নিলে মেয়েটার মা। আর সঙ্গে সঙ্গে দীপঙ্কর ভিড়ের ভেতর থেকে বেরিয়ে পালিয়ে আসছিল। চোখের সামনে যেন অঘোরদাদুর মুখটা ভেসে উঠলো। দুই হাতে মুখটা ঢেকে দীপঙ্কর ভিড়ের বাইরে চলে আসছিল।

হঠাৎ কানে গেল কে যেন বললে–দেব্‌তা, তুমি?

রাস্তার কতগুলো ছেলে। এতক্ষণ তারাই তম্বি করছিল। এতক্ষণে চিনতে পেরেছে। দীপঙ্কর চলে যেতে গিয়ে পেছন ফিরে দেখে অবাক হয়ে গেছে। ফোঁটা! গাড়ির মালিক ফোঁটা! আশ্চর্য, চেনা যায় না একেবারে। ক’দিনেই যেন আরো মোটা হয়েছে। গাড়ির বাইরে এসে দাঁড়িয়ে সকলকে বোঝাবার চেষ্টা করছে।

ফোঁটা বললে–ভাই, আমিও তোমাদের মত রাস্তার লোক, গাড়ি কিনেছি বলে তো আর বড়লোক হয়ে যাইনি। আমি বিলিতি কাপড় পরি না, এই দেখ খদ্দর পরেছি–মায়ের দেওয়া মোটা কাপড়–

বলে ফোঁটা তার গায়ের খদ্দরের চাদরটা দেখালে।

দীপঙ্করও দেখে অবাক হয়ে গিয়েছিল। ফোঁটার চেহারা যেন বদলে গেয়ে রাতারাতি। কোঁচানো ধুতি, ফরসা ধবধবে পাঞ্জাবি–সমস্ত খদ্দরের। একটা ফরসা খদ্দরের চাদরে সারা শরীর ঢাকা। চুলগুলো বড় বড় করে মাথার ওপর উড়ে বেড়াচ্ছে। ফোঁটা বলতে লাগলো–তোমরা ভাবছো আমার কষ্ট হয় নি? মানুষ চাপা দিলে কার না কষ্ট হয়? কে এমন পাষণ্ড আছে? আর তাছাড়া আমি তো কংগ্রেসের লোক, আমি ভাই এখানকার কংগ্রেসের ভাইস-প্রেসিডেন্ট–

–দেবতা তুমি?

এতক্ষণে ফোঁটার পুরোন সাগরেদদের কেউ একজন বোধহয় চিনতে পারলে। বললে–আরে, ইনি আমাদের দেবতা যে!

–দেবতা মানে?

–দেবতা মানে, ফটিকবাবু! ফটিকবাবুকে চেনেন না?

ফোঁটা বললে–থাক থাক, এসব বলবার দরকার নেই,–আমি ভাই দেশের সামান্য একজন কংগ্রেস—সেবক–

লোকেরা কিন্তু তখন ক্ষেপে গেছে। এতক্ষণ একজন কংগ্রেসের লোককে তারা মিছিমিছি হয়রানি করছিল।

একজন বললে–আরে ছোটলোকেরা কি রাস্তায় চলতে জানে মশাই? আপনি চলে যান স্যার, কেউ আপনার গায়ে হাত দেবে না

ফোঁটা বললে–না ভাই, আইন মানতে আমি বাধ্য, ফাইন দিতে হলে ফাইনও দেব, মানুষের প্রাণ নিয়ে ছিনিমিনি খেলা চলে না, তা সে গরীব লোকই হোক আর বড়লোকই হোক–আমার কাছে সকলেরই প্রাণের দাম সমান–

ফোঁটার কথা শুনে দীপঙ্কর আরো অবাক হয়ে গেল।

ততক্ষণে মেয়েটাকে গাড়িতে তোলা হয়েছে। মেয়েটার মাও গাড়িতে উঠলো। পুলিস দুটো উঠলো গাড়ির পা’দানিতে।

ফোঁটা বললে–পুলিসের হাজতে যেতে ভয় নেই ভাই আমার, সারা জীবনই তো দেশের জন্যে জেল খাটছি, কংগ্রেসের লোক আমরা, জেলের ভয় করলে তো চলে না– চলো–

ফোঁটার সাগরেদ চিৎকার করে উঠলো–বন্দে মাতরম্–

সবাই সেই সুরে সুর মিলিয়ে চিৎকার করলে–বন্দে মাতরম্–

ফোঁটা সকলের দিকে হাত বাড়িয়ে বললে–শান্ত হও ভাই তোমরা, উত্তেজিত হয়ো না–আমরা অহিংসার সাধক, পুলিসের ওপর কেউ যেন ভাই ঢিল ছুঁড়ো না–আমি যদি অন্যায় করে থাকি তো শাস্তি নিতে বাধ্য–

তারপর ভিড়ের মধ্যে হঠাৎ দীপঙ্করকে দেখে চমকে উঠেছে।

–আরে, দীপুবাবু যে? তুমি এখেনে?

দীপঙ্কর বললে–আমি এদিকে এসেছিলাম–তোমার খবর কী?

ফোঁটা বললে–খবর তো এই দেখছো, দেশ-সেবার পুরস্কার! যাচ্ছিলুম কংগ্রেস অফিসে, আমাদের মীটিং ছিল, এখন রাস্তার মধ্যে এই কাণ্ড–যাহোক, পরে দেখা হবে–

বলে মুখে একরকম প্রশান্ত করুণ একটা হাসি ফুটিয়ে গাড়ি ছেড়ে দিলে ফোঁটা। অঘোরদাদুর সেই ফোঁটা। ফোঁটা আবার গাড়ি কিনলে কবে! রীতিমত সভ্য ভদ্রলোক হয়ে উঠেছে! হয়ত পয়সা হবার সঙ্গে সঙ্গে ভদ্রলোক হওয়া যায়! ভাল ভাল কথাও বেরোয় মুখ দিয়ে। কংগ্রেসের ভাইস-প্রেসিডেন্ট হয়ে গেছে! কী চমৎকারভাবে ভিড় শান্ত করলে। তখনও বন্দে মাতরম্-এর সুরটা বাতাসে ভাসছে। আস্তে আস্তে ভিড় পাতলা হতে লাগলো। সবাই যে-যার কাজে যেতে লাগলো।

একজন বললে–মশাই, কংগ্রেসের লোক তো, তাই অত ভদ্রলোক–অন্য কেউ হলে দেখতেন চাপা দিয়ে গাড়ি নিয়ে পালিয়ে যেত–

আর একজন বললে–আরে মশাই, দোষ তো আমাদেরই, আমরাই কেমন করে রাস্তায় হাঁটতে হয় জানি না-ও ভদ্রলোকের দোষ কী?

পাশ থেকে একজন বললে–ওই তো বাঙালীদের দোষ মশাই। পরের ভালো দেখতে পারি না যে আমরা–আমাদের নিজেদের মধ্যেই ইউনিটি নেই, শিক্ষা নেই, এ জাত আবার স্বরাজ চায়—ছোঃ–

নানারকম মন্তব্য করতে করতে সবাই চলে গেল। দীপঙ্করের হঠাৎ খেয়াল হলো, কেউ নেই তার চারপাশে। সে একলা দাঁড়িয়ে আছে। যে জায়গাটায় মেয়েটা চাপা পড়েছিল সেখানে তখনও রক্তের দাগ ঘন হয়ে আছে। আশ্চর্য! আসলে কেউই জানলো না, ফোঁটাও জানলো না, ওই মৃত্যুটার জন্যে কে দায়ী!

আস্তে আস্তে ফুটপাথটা ধরে দীপঙ্কর আবার রসা রোডে এসে পড়লো।

৪৩

সেদিন সেই ঘটনার পর আর সনাতনবাবুর বাড়ি যাবার ইচ্ছে হয়নি! সেখান থেকেই সোজা চলে এসেছিল দীপঙ্কর। অফিসেরও দেরি হয়ে যাচ্ছে। তাছাড়া সতীর শাশুড়ী হয়ত দীপঙ্করের কথাগুলো ঠিক বুঝতেন না। তিনি যে যুগের যে পরিবারের মানুষ সেখানে এত বড় অপরাধের হয়ত ক্ষমা নেই।

সেখান থেকেই সোজা একেবারে চলে এসেছিল লক্ষ্মীদির বাড়ি।

এর আগে সকালবেলা এখানে কখনও আসেনি দীপঙ্কর।

এ সেই উনিশশো ঊনচল্লিশ সাল। পৃথিবীর মানুষের জীবনের এক চরম সন্ধিক্ষণ! জীবনের সবটুকু নোংরা সবটুকু গ্লানি লোক-চক্ষের আড়ালে রেখে দেবার সেই প্রাণান্তকর চেষ্টায় যুগ। যেন প্রকাশ না হয়ে পড়ে। যেন ধামা চাপা থাকে। সমস্ত কলঙ্ক যেন ঢাকা থাকে আড়ালে, কেউ যেন জানতে না পারে। মুখোশ খুলো না। সবাই তোমার বিদ্যে-বুদ্ধি যাচাই করে ফেলবে। ভদ্র সমাজের যেটুকু ঐতিহ্য তাই দিয়েই বাইরে ব্যান্ডেজ বেঁধে রাখো। দরকার নেই ঘাঁটিয়ে ৷ বাড়ি থেকে যদি সতীরা বেরিয়ে যায় তো যাক, কেউ জানতে না পারলেই হলো। তোমার যদি ভাত না জোটে তো মুখে প্রকাশ কোর না, রাস্তার দোকান থেকে এক পয়সার পান কিনে ঠোঁট রাঙিয়ে নিও। ফর্সা জামা কাপড়ে সাজাও নিজেকে, তাহলে লোকে তোমাকে শিক্ষিত ভদ্রলোক বলবে। কান্না পেলে চোখের জল ফেলো না, তাতে কেউ সহানুভূতি দেখাবে না। সে বড় করুণ যুগ, সেই উনিশশো উনচল্লিশ সাল। কোথাও যুদ্ধ নেই, কিন্তু হাজার-হাজার লোক মরে যায় কলেরায়, বসন্তে আর ম্যালেরিয়ায়। কোথাও দুর্ভিক্ষ নেই, কিন্তু তবু মানুষের সংসারে সংসারে অরন্ধন। কিরণই কি একলা রাস্তার ডাব কুড়িয়ে খেয়েছে? আরও কত ছেলে কত রকম করে দাঁতে দাঁত চেপে হাসি ফুটিয়েছে মুখে। কত গাঙ্গুলীবাবুরা কো অপারেটিভ থেকে লোন নিয়ে বউকে গয়না কিনে দিয়ে নিজেদের মান বাঁচিয়েছে। কত কিরণের মা’রা বাড়িতে একখানা গামছা পরে দিন কাটিয়েছে আর পৈতে কেটেছে। কত লক্ষ্মীদিরা চৌরঙ্গী থেকে গভর্নমেন্ট অফিসারদের ধরে নিয়ে এসেছে বাড়িতে। কত বিন্তিদিরা আত্মবিসর্জন দিয়েছে আদিগঙ্গার কালীদহে। আবার কত ছিটে-ফোঁটা খদ্দর পরে মহামানব সেজেছে, চরকার ব্যবসা করেছে, ন্যাশনাল ফ্ল্যাগের ব্যবসা করেছে। স্বদেশীর নাম করে কটন মিল খুলেছে। বন্দে মাতরম্ বলেছে। জেলে গিয়েছে। শহীদ হয়েছে। প্রাতঃস্মরণীয় হয়েছে। আবার ওদিকে সাহেব-পাড়ায় কত মিস মাইকেল ভিভিয়ান লে-র স্বপ্ন দেখেছে। কত ঘোষাল সাহেবরা সাউথ ইন্ডিয়ান সেজে প্যালেস কোর্টে ক্লাউনের পার্ট করেছে। সেই জন্ম থেকে শুরু করে উনিশশো ঊনচল্লিশ সাল পর্যন্ত কত জীবন, কত মানুষ, কত চরিত্র, কত সংসার দেখেছে দীপঙ্কর–সব, সব তার মনে আছে। হে ভোলানাথ, কেন তুমি তোমার মত ভুলতে শেখালে না দীপঙ্করকে! সমস্ত ভুলে দীপঙ্করও তোমার মত ভোলানাথ হয়ে জীবন কাটিয়ে দিতে পারতো। যেমন আর দশজন অফিসার চাকরি, ওয়াগন, ঘুষ, গ্রেড, প্রমোশন, সাহেব নিয়ে মেতে থাকে, সে ও তেমনি মেতে থাকতে পারতো। প্রমোশন আর গ্রেডের জন্যে সাহেবের মনস্তুষ্টির পথ আবিষ্কারের চিন্তা নিয়েই কাটিয়ে দিতে পারতো। এর সঙ্গে ওর ঝগড়া লাগিয়ে দিয়ে স্বার্থসিদ্ধির শিখরে গিয়ে উঠতো। কেন সে ভুলতে পারে না! কেন সে সব মনে রাখে! কেন তার সমস্ত মনে থাকে!

কিন্তু একদিন সব প্রকাশ হয়ে পড়লো।

একদিন সব লজ্জা বে-আব্রু হয়ে গেল। একদিন সব ঘা উলঙ্গ হয়ে গেল। চেম্বারলেন থেকে শুরু করে ঈশ্বর গাঙ্গুলী লেনের ছিটে-ফোঁটা সবাই সবাই। সেই উনিশশো ঊনচল্লিশ সালের পয়লা সেপ্টেম্বর।

কিন্তু সে-কথা এখন থাক।

মনে আছে দরজার কড়া নাড়ার শব্দ শুনেই কেশব দরজা খুলে দিয়েছিল।

দীপঙ্কর জিজ্ঞেস করেছিল–লক্ষ্মীদি আছে?

সরু রাস্তাটা পার হয়েই উঠোন। দিনের বেলায় জায়গাটাকে যেন বড় অচেনা লাগলো দীপঙ্করের। রাত্রে এই রাস্তাটাকেই কতদিন দীপঙ্করের মনে হয়েছে যেন একটা সুড়ঙ্গ। এই সুড়ঙ্গের মধ্যে দিয়েই যেন সভ্যতার সমস্ত পাপ সমস্ত কলঙ্ক এখানে এসে ঢোকে। এখান দিয়েই যেন লক্ষ্মীদির আত্মা রাত্রির অন্ধকারে ব্যভিচার করতে বেরোয়। আজ মনে হলো এটা যেন আরো দশটা গৃহস্থ বাড়ির মত। রাস্তাটার লম্বা-লম্বি তেকোণা জায়গায় একটা ফুলগাছের টব। মাটির টবের উপর একটা তুলসী গাছ। আশ্চর্য! লক্ষ্মীদি কি তুলসী গাছও পুঁতেছে এত যত্ন করে! তুলসী গাছের ওপরেও কি লক্ষ্মীদির শ্রদ্ধা আছে নাকি আবার! অবা কাণ্ডই বটে!

দীপঙ্কর উঠোনে গিয়ে দাঁড়াতে আরো অবাক হয়ে গেল।

লক্ষ্মীদি পেছন ফিরে ছিল। জিজ্ঞেস করলে–কে রে কেশব? কে এসেছে?

সিমেন্টে বাঁধানো উঠোনের ওপর সেই দাতারবাবু চুপ করে বাবু হয়ে বসে আছে। আর লক্ষ্মীদি ঘটি করে জল নিয়ে দাতারবাবুকে স্নান করাচ্ছে। গাছকোমর বেঁধে নিয়েছে শাড়িটা। ভিজে চুলগুলো মাথায় জড়িয়ে এলো খোঁপা করে নিয়েছে। এক গোছা চাবি ঝুলছে পিঠে। নিচু হয়ে ঝুঁকে দাতারবাবুকে জল ঢেলে স্নান করিয়ে দিচ্ছে। সাবান মাখিয়ে দিচ্ছে। গামছা দিয়ে ঘষে ঘষে গায়ের ময়লা পরিষ্কার করিয়ে দিচ্ছে।

হঠাৎ পেছন ফিরে দীপঙ্করকে দেখেই লক্ষ্মীদি বললে–ওমা তুই? এত সকালবেলা যে?

দীপঙ্কর প্রথমে কিছু কথাই বলতে পারলে না। কে বললে কালকের রাত্রের সেই লক্ষ্মীদি এই!

লক্ষ্মীদি বললে–বোস বোস, ওই চেয়ারটা টেনে নিয়ে বোস–রাত্তিরে আসতে বারণ করেছিলাম বলে সকালে এলি বুঝি?

দীপঙ্কর তবু বসলে না। দাঁড়িয়ে রইল সেখানেই। বললে–একটা জরুরী কাজে তোমার কাছে এসেছি–

চান করাতে করাতে পেছন ফিরেই লক্ষ্মীদি জিজ্ঞেস করলে–কী কাজ? তোর অফিস নেই আজ?

তারপর আর এক ঘটি জল দাতারবাবুর মাথায় ঢেলে পিঠে সাবান ঘষতে লাগল।

বললে–জানিস, আগে মোটে চান করতে চাইত না শম্ভু, জল দেখলে চিৎকার করতো, এখন দেখছিস তো কেমন চুপ করে চান করছে–

তারপর দীপঙ্করকে আবার জিজ্ঞেস করলে–তুই বাবাকে চিঠি লিখেছিস?

দীপঙ্কর বললে–অনেক কাণ্ড হয়েছে এর মধ্যে! আজ ভোররাত্রে হঠাৎ সতী এসে হাজির হয়েচে আমার বাড়িতে–

–সতী?

লক্ষ্মীদির হাতের ঘটিটা হঠাৎ থেমে গেল।

দীপঙ্কর বললে–তোমার এখান থেকে ঠিকানা নিয়ে গেলুম, তোমার বাবাকে চিঠি লিখবো বলে। গিয়েই একটা চিঠি লিখলুম। কিন্তু পছন্দ হলো না বলে সে-চিঠি ছিঁড়ে ফেলেছিলাম। তারপরে ভেবেছিলাম সকালে লিখবো, কিন্তু ভোর হবার আগেই সতী এসে হাজির। তাকে রেখেই তোমার কাছে এলাম–

–কেন? সতী চলে এলো কেন?

দীপঙ্কর বললে–শ্বশুরবাড়িতে খুব কষ্ট পাচ্ছিল। তার স্বামীকে পর্যন্ত সতীর ঘরে শুতে দিত না–

–কেন? কী করেছিল সতী?

দীপঙ্কর বললে–সে অনেক কথা। সব কথা বলবার সময়ও নেই এখন–

–তা সেই জন্যে সতী একেবারে শ্বশুরবাড়ি ছেড়ে চলে আসবে?

দীপঙ্কর বললে–আমি তাকে অনেক বুঝিয়েছি। আমি নিজে তাকে তার শ্বশুরবাড়িতে রেখে আসবো বলেছিলাম, তাতেও রাজী নয়। ভেবেছিলাম তার স্বামীকে গিয়ে খবর দেব, তা তাও হলো না, এখন আমার বাড়িতেও আবার মা নেই, মা কাশীতে গেছে। আমি একলা রয়েছি–এখন কী করি বলো তো? তাই তোমার কাছে এলাম–

লক্ষ্মীদি বললে–কিন্তু সতী তো ছেলেমানুষ নয়, লেখাপড়া শিখেছে, বুদ্ধিসুদ্ধি হয়েছে, সেখান থেকে চলে এল? তারপর? তারপর কী হবে একবার ভাবলে না? আর শ্বশুরবাড়ি যদি না থাকে তো যাবে কোথায়? কার কাছে থাকবে? সে-সব কথা ভাবছে না?

দাতারবাবু এতক্ষণ কোনও দিকে লক্ষ্য করেনি। হঠাৎ বলে ফেললে–দী-পু বা-বু–

লক্ষ্মীদি বললে–ওই দেখ, দেখলি? তোকে চিনতে পেরেছে রে–

তারপর দাতারবাবুর মুখের কাছে মুখ নিয়ে গিয়ে বললে–চিনতে পেরেছ ওকে? সেই দীপু আমাদের–খুব ছোটবেলায় দেখেছিলে ওকে। ও এখন মস্ত বড় হয়েছে। অনেক টাকা উপায় করছে, অফিসার হয়েছে–

দাতারবাবু তখনও দীপঙ্করের দিকে চেয়ে ফাঁকা হাসি হাসছিল। দাঁতগুলো বেরিয়ে গেছে। যেন খুব আনন্দ হয়েছে দীপঙ্করকে দেখে।

দাতারবাবুর স্নান করা হয়ে গিয়েছিল। গামছা দিয়ে গা মুছিয়ে দিতে দিতে

লক্ষ্মীদি বললে–কী যে ভাবনা হয়েছিল এ-মানুষকে নিয়ে কী বলবো তোকে–এখন তো তবু কথা বুঝতে পারে, তোকেও চিনতে পারলে–

দাতারবাবুর গা মুছিয়ে দিয়ে লক্ষ্মীদি ঘরে নিয়ে গেল ধরে ধরে। বললে–একটু দাঁড়া আমি আসছি–

দীপঙ্কর সেই উঠোনে দাঁড়িয়েই দেখতে লাগলো চারিদিকটা। সিমেন্ট বাঁধানো উঠোন। কোণের দিকে তুলসী গাছের টব্। একটা লাউগাছ রান্নাঘরের চালে উঠেছে। বেশ গৃহস্থালী চেহারাটা। রাত্রে এ-বাড়িটার অন্য রূপ। কিন্তু এখন যেন বড় ভাল লাগলো দীপঙ্করের। রান্নাঘরের ভেতরে একটা উনুনে আগুন জ্বলছে। ভাত ফুটছে। বঁটি পড়ে রয়েছে। পাশে কিছু তরকারিও কোটা রয়েছে। কেশব রান্নাঘর গুছোচ্ছে।

লক্ষ্মীদি আবার এল। বললে–জানিস, আজকে মানসের চিঠি এসেছে—

মানস! হঠাৎ মনে পড়লো। লক্ষ্মীদির ছেলে!

লক্ষ্মীদি বললে–এই সকালবেলাই চিঠি পেলুম, এবার ভালো করে পাস করেছে এগ্‌জামিনেশনে–। আমার খুব ভাবনা ছিল কদিন ধরে। এত কষ্ট করে টাকা পাঠাচ্ছি, আর যদি পাস না করতে পারে তো কী হবে বল্ তো–

ছেলে স্বামী–কত কথা বলতে লাগলো লক্ষ্মীদি। কত স্বপ্ন লক্ষ্মীদির। কত আশা লক্ষ্মীদির। কেমন ছোট সংসারটি গড়ে তুলেছে। এখন এই মুহূর্তে যেন ক্ষমা করতে ইচ্ছে হলো লক্ষ্মীদিকে। লক্ষ্মীদির যেন কোনও দোষ নেই। কী চমৎকার সংসার! কী চমৎকার গৃহস্থালী! ছেলের চিঠি এসেছে, ছেলে পাস করেছে, শম্ভুর শরীর ভাল হয়েছে, শম্ভু আবার ব্যবসা আরম্ভ করবে, আবার দাঁড়িয়ে উঠবে। কত আনন্দ মায়ের, কত আশা স্ত্রীর!

শেষকালে লক্ষ্মীদি বললে–তা হলে আমি কী করবো বল?

দীপঙ্কর বললে–আমি তো বলে-বলেও শ্বশুরবাড়িতে পাঠাতে পারলুম না, আমি বলেছিলুম বলে আমার ওপর রাগ করে বাড়ি থেকে চলে যাচ্ছিল, তাই তো তোমার কাছে এলুম–

–কিন্তু শ্বশুরবাড়ি যদি না যায় তো কোথায় যাবে সে?

দীপঙ্কর বললে–বলছে দু’চার দিন আমার বাড়িতে থাকবে, তারপর একটা ব্যবস্থা করে নেবে–আর বাবাকে চিঠি লিখে উত্তর আনতেও তো অনেকদিন। সে-কদিন কোথায় থাকবে?

-–কেন, শ্বশুরবাড়িতে যাবে না কেন? বিয়ের পর মেয়ে বাপের বাড়িতে পড়ে থাকবে চিরকাল?

দীপঙ্কর বললে–বলছে সেখানে প্রাণ গেলেও যাবে না আর–

লক্ষ্মীদি বললে–তার মানে? মেয়েমানুষের আবার কষ্ট কী শুনি? এইটুকু কষ্ট সহ্য করতে পারছে না সতী? শাশুড়ী তো চিরকাল থাকে না কারো?

দীপঙ্কর বললে–সনাতনবাবুর কাছেও থাকবে না–

লক্ষ্মীদি বললে–শেষকালে এত লেখাপড়া শিখে এই বুদ্ধি হলো সতীর! জীবনে কার না কষ্ট আছে? সকলেরই কষ্ট থাকে, দুঃখ থাকে–তা বলে কে শ্বশুরবাড়ি থেকে চলে আসে! আমি কষ্ট করিনি? আমি কষ্ট করছি না?

দীপঙ্কর বললে–সে আমি জানি না। কিন্তু আমার বাড়িতে এখন মা নেই, এই সময়ে যদি আমার কাছে থাকে তো অনেক রকম কথা উঠবে। তার চেয়ে আমি বলি কি তোমার এখানে বরং ক’দিন নিয়ে এসে রাখো–

–আমার এখানে? বলছিস কী তুই?

দীপঙ্কর বললে–যতদিন তোমার বাবা না এসে পৌঁছান, ততদিন অন্তত রাখতে পারো তো–

লক্ষ্মীদি বললে–আমার এখানে সতী থাকবে? এখানে কি কোনও ভদ্রলোকের মেয়ে থাকতে পারে? রাত্রে কি থাকবার মত জায়গা এটা? তুই সব জেনেও এই কথা বলছিস্?

তারপর একটু থেমে বললে–তাছাড়া, আমার যা হয় হোক, কিন্তু সতী! সে যে গেরস্থ ঘরের বউ, তার একটা সম্মান নেই, মর্যাদা নেই?

–কিন্তু তা হলে কী করবো?

দীপঙ্কর আবার বললে–সে আর কোনও থাকবার জায়গা নেই বলেই আমার কাছে এসেছে। তোমার কথা এখনও বলিনি তাকে–!

লক্ষ্মীদি যেন চিন্তিত হয়ে পড়লো সত্যি সত্যিই।

দীপঙ্কর বললে–আমার বাড়িতেই তাহলে থাকবে সে?

লক্ষ্মীদি বললে–সে কি রে, তোর বাড়িতে থাকবে কী রে! তোর মা নেই এখন বাড়িতে। আর তা ছাড়া তোর বিয়ে হয়নি। সে আর তুই কখনও এক বাড়িতে থাকা উচিত? বিশেষ করে রাত্রির বেলা?

দীপঙ্কর বললে–আমিও তো তাই বলছি–

লক্ষ্মীদি বললে–তাতে যে তার শ্বশুরবাড়িতে ঢোকা চিরকালের জন্যে বন্ধ হয়ে যাবে–

–তা হলে?

লক্ষ্মীদি অনেক ভেবে বললে–যতদিন বাবা এসে না-পৌঁছোয় ততদিন শ্বশুর বাড়িতেই থাকুক–শ্বশুরবাড়ি ছাড়া মেয়েমানুষের অন্য কোথাও থাকা উচিত নয়।

দীপঙ্কর বললে–আমি তো সে-কথা বলেছি–

লক্ষ্মীদি বললে–আবার সেই কথাই তুই গিয়ে বল্গে যা–

–কিন্তু সতী কিছুতেই যাবে না। তুমি যদি গিয়ে বলো তো হতে পারে–

–আমি?

লক্ষ্মীদি অবাক হয়ে দীপঙ্করের মুখের দিকে চাইলে। বললে–আমি? আমি গিয়ে বলবো তাকে? আমার কথা সে শুনবে কেন? আমার কথা সে জীবনে কখনও শোনেনি, আর আজ শুনবে? সে বরং তোর কথা শুনলেও শুনতে পারে।

–আমার কথা?

লক্ষ্মীদি বললে–হ্যাঁ, আমি জানি, তোকে সে বরাবর পছন্দ করতো–তোকে তার বরাবর ভালো লাগতো।

দীপঙ্কর হতবাক হয়ে গেল লক্ষ্মীদির কথা শুনে। লক্ষ্মীদি বলছে কী!

লক্ষ্মীদি বললে–হ্যাঁ, সে আমার চোখে ধুলো দিতে পারেনি–তোকে সে সত্যিই ভালোবাসততা বরাবর কথাটা শুনে দীপঙ্করের মাথাটা হঠাৎ নিচু হয়ে গেল।

লক্ষ্মীদি বললে–কিন্তু তা বলে তো এখন আর তোর বাড়িতে থাকা যায় না। এখন তার বিয়ে হয়ে গিয়েছে–তুই একটু দাঁড়া, আমিই যাচ্ছি তোর সঙ্গে, আমিই গিয়ে বুঝিয়ে বলছি তাকে

তারপর লক্ষ্মীদি তাড়াতাড়ি ঘরে গিয়ে গায়ে একটা চাদর জড়িয়ে এল। মাথায় ঘোমটা দিলে। চাকরকে বললে–কেশব, তুই দেখিস্ বাবুকে আমি আসছি এখুনি– আমার বেশি দেরি হবে না, ভাতটা হলে নামিয়ে রাখিস–

তারপর নিজের ঘরটায় তালা লাগিয়ে দিলে।

গায়ের ওপর চাদরটা ভালো করে জড়িয়ে বললে–চল-তাড়াতাড়ি চল–

তখনও দীপঙ্কর মনে-প্রাণে পরিণত হয়নি। অনেক দেখার পরেও অনেক কিছু দেখার বাকি ছিল তার। মানুষকে সহজ করে পেতে গিয়ে নিজেই জটিলতার মধ্যে জড়িয়ে পড়েছিল। সুখ-দুঃখকে শুধু সুখ-দুঃখ বলেই জেনেছিল। সুখ-দুঃখের মধ্যে দিয়েই সুখ-দুঃখাতীতকে পাবার কথা তার মনে হয়নি। আর সে-যুগটাও তখন ভারি জটিল হয়ে উঠেছিল আপাত-আনন্দের জঞ্জালে।

মধুসূদনের রোয়াকে তখন হয়ত আবার আড্ডা বসততা। আবার হয়ত দুনীকাকা খবরের কাগজ নিয়ে আড্ডা জমাতো আগেকার মত। কিন্তু সে-সব দেখবার সময় হয়নি তখন দীপঙ্করের। কিন্তু দেখা যেত অন্যত্র। যে-লোকটা খবরের কাগজ দিয়ে যেত, সে একদিন কাগজ দিয়ে দাঁড়িয়ে গেল। বললে–বাবুজী–

অন্য দিন কাগজটা ভেতরে ফেলে দিয়েই চলে যায়। সেদিন তাকে দাঁড়াতে দেখে কেমন অবাক হয়ে গিয়েছিল দীপঙ্কর। বললে–কেয়া?

লোকটা বললে–লড়াই শুরু হোগা কেয়া, বাবুজী?

দীপঙ্কর বললে–কেন, কে বললে তোমাকে?

লোকটা বললে–সবাই তো বাত-চিত্ করে বাবুজী-কহত্যা হ্যায় কি লড়াই জবর হোগা–

আশ্চর্য! লোকটা নিজেই খবরের কাগজ ফিরি করে, অথচ সেই খবর রাখে না কিছুর! লড়াই হলে যে কী হবে, সে-ধারণা নেই। কিন্তু শুনেছে লড়াই হবে! কাশীও একদিন জিজ্ঞেস করেছিল।

দীপঙ্কর জিজ্ঞেস করেছিল–তোকে কে বললে?

কাশী বলেছিল–বাজারের আলুওয়ালাটা বলছিল-বলছিল আলুর দর চড়বে, লড়াই হবে–

বাড়িতে সেদিন এসে সদর দরজার কড়া নাড়তেই কাশী দরজা খুলে দিলে। কিন্তু কিছু বলবার আগেই পাশে লক্ষ্মীদিকে দেখে অবাক হয়ে গেল। মুখ দিয়ে আর কথা বেরলো না। কাশী এতদিন এ-বাড়িতে আছে, এমন ঘন ঘন অচেনা মেয়েমানুষের আসা দেখেনি।

দীপঙ্কর বললে–দিদিমণি ওপরে কী করছে রে?

কাশী বললে–আপনি চলে যাবার পরেই দিদিমণি রান্নাঘরে এসেছিল। এসে জিজ্ঞেস করছিল–কী রাঁধছি

দীপঙ্কর চলে যাবার পরই সতী ঘর থেকে বেরিয়ে বাইরে এসেছিল। সতী নাকি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে সব দেখেছিল। রান্নাঘরে এসেছিল। রান্না দেখেছিল। তারপর জিজ্ঞেস করেছিল–তোমার নাম কী?

কাশী বলেছিল–কাশী–

–কতদিন চাকরি করছো তুমি?

কাশী বলেছিল–সে কি আজকের কথা দিদিমণি, অনেকদিন ধরে, সেই ছোটবেলা থেকে–

তারপর একটু থেমে সতী নাকি জিজ্ঞেস করেছিল–আলনায় শাড়ি ঝুলছে, ওটা কার?

–শাড়ি? মা’র ঘরে? ও তো দিদিমণির!

-–দিদিমণি কে?

কাশী বলেছিল–সন্তোষকাকাবাবুর মেয়ে, তেনারা সবাই কাশী গেছেন–

–সন্তোষকাকাবাবু কে? কী করেন এখানে?

কাশী বলেছিল–আজ্ঞে তা জানিনে। দিদিমণির সঙ্গে দাদাবাবুর বিয়ে হবে কিনা। বিয়ের পরও কাকাবাবু এখানে থাকবে–

–বিয়ে হবে?

কথাটা শুনে সেদিন খুব রাগ হয়েছিল দীপঙ্করের। সব ব্যাপারে কেন কথা বলে কাশীটা! হয়ত লক্ষ্মীদির সামনেই সেদিন ধমকে দিত দপিঙ্কর। বাড়িতে ভেতরকার এত কথা সতীকে বলবার দরকার কী ছিল! সে তো বাইরের লোক। বললেই হোত–জানি না–

দীপঙ্কর বললে–এত কথা তুই বলতে গেরি কেন? কে তোকে এত সর্দারি করতে বলেছে?

কাশী কিন্তু উত্তর না দিয়ে চুপ করে রইল।

-–তোকে কতবার না বলেছি, তুই চাকর, চাকরের মত থাকবি! সব কথায় কেন এত কথা বলিস তুই? কাজ করবি মাইনে নিবি আর চুপ করে থাকবি, বুঝলি?

বহুদিন পরে এ-ঘটনার কথা মনে হলেই দীপঙ্করের কেমন অনুশোচনা হয়েছে। কাশীর সেই অপরাধীর মত চেয়ে থাকা, কাশীর সেই অপরাধের গুরুত্ব না-বোঝা, তা যেন বহুদিন তার চোখে ভেসেছে। তারপর সেই কাশীই একদিন সব বুঝলো, একদিন চিনতে পারলো সতীকে, চিনতে পারলো লক্ষ্মীদিকে, চিনতে পারলো দীপঙ্করকেও। কাশীও দিন-দিন চালাক-চতুর হয়ে উঠলো। দীপঙ্কর যখন চুপ করে একলা জানলার ধারে বসে বসে ভাবতো, কিম্বা ছাদের কড়িকাঠের দিকে চুপ করে চেয়ে থাকতো, তখন কাশীও কাছে আসতো না। সেই সব দিনগুলো–যখন লোভ-মোহ-দ্বন্দ্বের মধ্যে দীপঙ্করের জীবন জটিল হয়ে উঠেছে, যখন প্রতি মুহূর্তে যন্ত্রণায় জর্জরিত হয়ে উঠেছে দীপঙ্করের আত্মা–যখন সতীই একদিন তাকে প্রতারিত করেছে, তখন কাশীই একলা সব লক্ষ্য করেছে। কাশীই কেবল সে-সব দিনের মূক সাক্ষী হয়ে আছে। যখন মা-ও নেই সংসারে, যখন কেউই নেই দীপঙ্করের, তখনও কাশী ছিল। আর কাশী ছিল বলেই তো দীপঙ্কর সেদিন সতীর সেই অপমান সহ্য করতে পেরেছিল।

সতী বলেছিল–দীপু, তুমি পশু, তুমি জানোয়ার, তুমি ইতর, তুমি ছোটলোক—

আরো কত কী জঘন্য অশ্রাব্য ভাষায় গালাগালি দিয়েছিল সতী। তখন দীপঙ্কর যে কেমন করে মুখ নিচু করে সে-সব সহ্য করেছে, কাশী তা সমস্ত জানতো। কাশীই বুঝতো সব, একমাত্র কাশীই জানতো সব। আর কেউ নয়।

কিন্তু সে তো মা মারা যাবার পর। সে-সব কথা এখন থাক।

.

সতী বোধহয় তখন ঘরের মধ্যে ছটফট করছে। দীপু কোথায় গেল ভাবছে। দীপু হয়ত প্রিয়নাথ মল্লিক রোডে গেছে। হয়ত সেখানে গিয়ে খবর দেবে। হয়ত সেখানে গিয়ে বলে দেবে সমস্ত ঘটনা। ভোর তখনও ভালো করে হয়নি। প্রিয়নাথ মল্লিক রোডের শিরীষ ঘোষের বংশের কুললক্ষ্মী বিংশ শতাব্দীর চতুর্থ দশকে এসে হঠাৎ মুখ ফিরিয়ে দেখলে বাইরের দিকে। কালো অন্ধকার চারদিকে। ঘরের দরজাটা আস্তে আস্তে খুললে। বারান্দায় একটা বাতি সারারাত টিম্ টিম্ করে জ্বলে। সতী সেদিন সে বাতিটা আস্তে আস্তে নিভিয়ে দিয়েছিল।

–কে?

সতীর নিজেরই আত্মা যেন হঠাৎ চমকে উঠে নিজেকেই প্রশ্ন করেছিল–কে? পামারস্টোন সাহেবের দেওয়া সোনা-জহরৎ-টাকা-পয়সা-জমিদারী সমস্ত কিছু সেই প্রশ্নে হঠাৎ একসঙ্গে উত্তর দিয়েছিল–আমি!

–আমি কে?

সতী আস্তে আস্তে বাইরের বারান্দায় এসে দাঁড়িয়েছে তখন। নিচের বাগানে তখন ঝিম-ঝিম্ অন্ধকার। কোথাও কেউ নেই। এ-বাড়ির সমস্ত প্রহরী তখন ঘুমে অচেতন। পামারস্টোন সাহেব কবে কলকাতা ছেড়ে কোথায় কোন্ বার্মিংহামে কিম্বা ডার্বি-শায়ারে চলে গেছেন। শিরীষ ঘোষেও চলে গেছেন। যাঁরা জেগে থাকলে কাজ হতো তাঁরা কেউ নেই। শুধু আছে সিন্দুক, বাড়ি, বাগান, টাকা, বংশ। যা সঙ্গে নিয়ে যাবার নয়। সতী আস্তে আস্তে সিঁড়ি দিয়ে নিচেয় নামলো। সতীর শাশুড়ী একবার ঘুমের ঘোরে কী যেন একটা শব্দ শুনে অন্যদিকে পাশ ফিরলেন। পাশের খাটেই সনাতনবাবু ঘুমোচ্ছিলেন। অনেক রাত্রে ফিরিছেন তিনি। ডাকলেন—সোনা–

সনাতনবাবুর সজাগ ঘুম। বললেন–কী মা?

মা বললেন–বারান্দার আলোটা বুঝি জ্বালতে ভুলে গেছে কৈলাস?

সনাতনবাবু বললেন–কৈলাসকে ডাকবো?

–না থাক। একদিন আলো না থাকলে এমন কিছু ক্ষতি নেই। বললেন–কিছু ভয় নেই, তুমি ঘুমোও বাবা

নিচেয় চাকরদের ঘরে মাদুর বিছিয়ে শুয়ে ছিল শম্ভু। আর তারপরেই কৈলাস। তারপর ঠাকুররা। ভাঁড়ার ঘরের পাশে বাতাসীর মা আঁচল বিছিয়ে ঘুমোচ্ছিল আর মশা তাড়াচ্ছিল।

পাশেই ভূতির মা শুয়ে। বললে–রাত পুইয়ে এল নাকি গা বাতাসীর মা? বাতাসীর

মা বললে–তুই থাম তো বাছা, তোর বকুনির ঠেলায় ঘুমোবার জো আছে–

সতী তখন একেবারে বাগানের সিঁড়িতে। দারোয়ানের ঘরের বাইরে খাঁটিয়ায় শুয়ে অঘোরে ঘুমোচ্ছে দারোয়ান। অন্ধকারে কিছু দেখা যায় না। একটা চাদর মুড়ি দিয়ে বেরিয়েছে সতী। শুধু মুখটা খোলা। খাঁটিয়ার ওপর গেটের চাবিটা পড়ে আছে শেকল বাঁধা। চাবিটা নিঃশব্দে নিতে গিয়েই একটা বাধা পড়লো।

–কে?

সতীর মনে হলো তার নিজেরই আত্মা যেন হঠাৎ চমকে উঠে নিজেকেই প্রশ্ন করলে–কে?

পামারস্টোন সাহেবের দেওয়া সোনা-জহরত-টাকা-পয়সা-জমিদারী সমস্ত কিছু সেই প্রশ্নে হঠাৎ একসঙ্গে উত্তর দিলে–আমি–

সতী তাড়াতাড়ি লোহার গেটটা নিঃশব্দে খুলে বাইরে এসে দাঁড়াল।

–আমি কে?

সতী সে প্রশ্নের জবাব দিলে না। সে প্রশ্নের জবাব খুঁজেও পেলে না। বিংশ শতাব্দীর চতুর্থ দশকেই শিরীষ ঘোষের প্রতিষ্ঠা করা লক্ষ্মী ঘোষবাড়ি থেকে রাস্তার ধুলোয় এসে দাঁড়াল।

লক্ষ্মীদি জিজ্ঞেস করলে–তারপর?

সতী এতদিন পরে লক্ষ্মীদিকে দেখে প্রথমে অবাকই হয়ে গিয়েছিল। বললে তারপর এখানে চলে এলাম, আর কী–

লক্ষ্মীদি বললে–তা তুই কি মনে করেছিস, এখানে থাকলে তোর মান-মর্যাদা বাড়বে?

সতী বললে–দূর থেকে ওসব কথা সবাই বলতে পারে, সংসার করলে তোমরা বুঝতে পারতে! আমি ছেলেমানুষ নই, আমিও বুঝি, আমাকে তুমি মান-মর্যাদার কথা শুনিও না

লক্ষ্মীদি বললে–এতই যদি বুঝিস তো মুখ পোড়ালি কেন এমন করে? সতী বললে–কার মুখ পুড়িয়েছি আমি শুনি?

-–তোর নিজের, আবার কার?

প্রথমে বেশ সহজ করেই কথা আরম্ভ করেছিল সতী। কিন্তু ব্যাপারটা যেন অন্যরকম রূপ নিলে। এতদিন পরে দুই বোনে দেখা। দীপঙ্কর ভেবেছিল সতী অন্তত দিদির কথা শুনবে। দুই বোনের মধ্যে দাঁড়িয়ে দীপঙ্কর চুপ করে দুজনের কথা শুনতে লাগলো।

সতী তখন সত্যিই রেগে গিয়েছে। বললে–লজ্জা করে না তোমার? তুমি আজ এসেছ মান-মর্যাদার কথা শেখাতে?

লক্ষ্মীদি বললে–আমি না তোর বড়? তোর বড় বোন?

সতী বললে–বড় বোনের মর্যাদা তুমি খুব রেখেছ বটে! তোমার জন্যেই তো আমার এই দুর্দশা–। তুমি যদি আমাদের বংশের মুখ না পোড়াতে তো আমার কপালে এমন হতো? তুমিই তো সব সর্বনাশের মূল!

লক্ষ্মীদির দিকে চেয়ে দেখলে দীপঙ্কর। যেন মায়া হতে লাগলো লক্ষ্মীদিকে দেখে দীপঙ্কর সামনে এগিয়ে গেল। বললে–ওসব কথা থাক সতী, এখন আর ও নিয়ে চেঁচিয়ে লাভ কী?

সতী বললে–তুমি সরো দীপু, কেন বলবো না? আমার শাশুড়ী তো সেই নিয়েই দিনরাত খোঁটা দেয়। তা অন্যায় তো বলে না! আমি কারোর কাছে মুখ দেখাতে পারি না ওই জন্যে! শ্বশুরবাড়ির আত্মীয়স্বজন জ্ঞাতি-কুটুম কারোর কাছে আমার মুখ দেখাবার পর্যন্ত উপায় নেই। আর আজ ও এসেছে আমাকে মর্যাদা শেখাতে!

লক্ষ্মীদি বললে–আমি তো জানি আমার বলবার মুখ নেই–সেই জন্যেই তো আমি আসছিলুম না, দীপু বললে বলেই তো এলুম–

দীপঙ্কর লক্ষ্মীদিকে বললে–তুমি কিছু মনে কোর না লক্ষ্মীদি, ছেলেমানুষের কথায় কান দিও না তুমি–

সতী বললে–হ্যাঁ ছেলেমানুষই বটে, ছেলেমানুষ বলেই নিজের শ্বশুরবাড়ি থেকে পালিয়ে এসেছি, ছেলেমানুষ বলেই অমন স্বামীর কাছ থেকে চলে এসেছি–

দীপঙ্কর বললে–তা ছেলেমানুষ হও আর না-হও, তুমি ছেলেমানুষের মত কাজ করেছ, এ সবাই বলবে–

লক্ষ্মীদি বললে–আমি নিজে মন্দ কাজ করেছি বলে কি ভাল কথা বলবার ক্ষমতাও আমার নেই রে!

দীপঙ্কর বললে–ওসব কথা থাক না এখন লক্ষ্মীদি–

সতী বললে–কেন, থাকবে কেন? কিসের জন্যে থাকবে? আজ যখন সর্বনাশ করা হয়ে গেছে, তখন এসেছে দিদির মত উপদেশ দিতে! তখন এসেছে মায়া-কান্না কাঁদতে! গোড়া কেটে এখন আগায় জল দিতে এসেছে–

লক্ষ্মীদি বললে–আমি তো স্বীকার করছি আমি ভুল করেছি, আমি দোষ করেছি, আমি পাপ করেছি, তা তার জন্যে কী শাস্তি আমাকে দিবি দে না! আমি তো মাথা নিচু করেই আছি রে–আমি বাবার মুখে চুনকালি লেপে দিয়েছি, তোর কপাল ভেঙেছি, নিজের স্বামীকে পর্যন্ত সুখী করতে পারিনি, নিজের ছেলেকে পর্যন্ত নিজের কাছে রাখতে পারিনি–আর নিজের সুখের কথা তো ভাবিই না–! তা কী শাস্তি তুই দিবি আমাকে দে না, আমি সব শাস্তি মাথা পেতে নেব–

সতী বললে–তুমি আর ন্যাকামি কোর না লক্ষ্মীদি, তোমার ন্যাকামি শুনলে আমার গা জ্বালা করে–

দীপঙ্কর সতীকে বললে–কেন তুমি অমন করে বলছো সতী? তোমার মায়া-দয়া নেই একটু?

সতী বললে–মায়া-দয়া? আমি যখন দিনের পর দিন কেঁদে রাত কাটিয়েছি, দিনের পর দিন শাশুড়ীর মুখ ঝামটা খেয়েছি, আমি যখন আমার মরাছেলেকে বুকে করে হাহাকার করেছি তখন তো কেউ মায়া-দয়া করেনি আমাকে!

দীপঙ্কর হঠাৎ দেখলে লক্ষ্মীদি শাড়ির আঁচল দিয়ে নিজের চোখ মুছছে।

মুখটা তুলে হঠাৎ লক্ষ্মীদি দীপঙ্করকে বললে–আমি যাই দীপু, আমি আর এখানে দাঁড়াতে পারছি না–

দীপঙ্করও কী বলবে বুঝতে পারলে না।

সতী বললে–হ্যাঁ তুমি যাও, আর কখনও ও-মুখ দেখাতে এসো না–

লক্ষ্মীদি হয়ত চলেই যাচ্ছিল। কিন্তু দীপঙ্কর সামনে পথ আটকে দাঁড়াল। বললে না তুমি যেও না লক্ষ্মীদি, সতীর এখন মাথার ঠিক নেই, ও কী বলছে বুঝতে পারছে না, নিজের ভালো মন্দ বোঝবার ক্ষমতাও নেই ওর–তুমি ওর কথায় রাগ কোর না

লক্ষ্মীদি বললে–তুই তো বলছিস দীপু, কিন্তু এখন তো আর ও ছোট নেই, এখন তো ওর বয়েস হয়েছে, আর আমারও বয়েস হয়েছে, তোরও বয়েস হয়েছে–এখন অবুঝের মত কথা বলা আমাদের সাজে, না অবুঝের মত কথা বলবার সময়ই আছে!

দীপঙ্কর বললে–না, তবু ওর ওপর রাগ করতে পারবে না–ওকে তুমি বুঝিয়ে বলো একটু–

লক্ষ্মীদি বুঝতে পারলে না। বললে–কী বুঝিয়ে বলবো?

দীপঙ্কর বললে–বুঝিয়ে বলে ওকে ওর শ্বশুরবাড়িতে পাঠাও, সেখানে ছাড়া আর কোথাও থাকা সতীর পক্ষে মঙ্গল নয়, এইটে তুমি বুঝিয়ে দাও–স্বামীর সংসারে অত্যাচার হলেও তবু সে স্বামীরই সংসার, শাশুড়ী বকাবকি করলে তবু তো তিনি ওরই শাশুড়ী! আর তাছাড়া সতী থাকবেই বা কোথায়? সেইটেও তো ভাবতে হবে–

সতী বললে–কেন, আমি এখানে থাকবো–

–এখানে? এখানে কী করে থাকবে তুমি?

দীপঙ্কর সতীর দিকে চেয়ে বললে–এখানে কি আমার মা আছে? মা থাকলে তো আমি কিছু বলতুম না তোমাকে–

লক্ষ্মীদি জ্বলে উঠলো––পোড়ারমুখী, দীপুর সঙ্গে কি এক-বাড়িতে তোর থাকা উচিত না থাকা মানায়!

সতী বললে–কেন, কী হয়েছে তাতে?

-–তুই আবার জিজ্ঞেস করছিস কী হয়েছে! দীপু তোর মায়ের পেটের ভাই না আত্মীয়, কে? আর তোর শ্বশুরবাড়িতে যদি পরে কথা ওঠে তো তখন তুই কী জবাবদিহি দিবি? জানতে পারলে তোকে তারা আর ঘরে নেবে?

সতী বললে–কিন্তু তারা নিতে চাইলেও কি আমি সেখানে আর যাবো ভেবেছ?

লক্ষ্মীদি বললে–না গিয়ে কী করবি শুনি? আমার মত সকলের মুখ পোড়াবি? বলতে বলতে লক্ষ্মীদি যেন ভয়ানক হাঁপাতে লাগলো। বলতে লাগলো–আমাকে দেখছিস না তুই? চোখের সামনে আমাকে দেখতে পাচ্ছিস না তুই? আমাকে দেখেও তোর শিক্ষা হয় না? তুই কী বল্ তো সতী? তুই কী?

সতী এতক্ষণ চুপ করেছিল। এবার কথা বললে। বললে–তোমার সঙ্গে আমার তুলনা কোর না লক্ষ্মীদি–! আমি তোমার মত নই, আমার আত্মসম্মান জ্ঞান আছে–। আমি বুঝি কোন্‌টা ন্যায় আর কোটা অন্যায়–

লক্ষ্মীদি বললে–স্বীকার করছি না-হয় তোর আত্মাসম্মান জ্ঞান আছে, তোর ন্যায় অন্যায় বোধ আছে, কিন্তু বড়বোনের কথাটা না-হয় শুনলিই একবার! আমি অনেক ঠকেছি রে, অনেক ভুগেছি, তাই তোকে বলা! ভগবান না-করুন তোকে যেন আমার মতন কখনও ভুগতে না হয় জীবনে, সংসারে কেউ শত্রুও যেন আমার মত এমন করে না ভোগে–। তুই ছোট, তুই এখনও সংসারের কিছু বুঝিস না, স্বামী-শাশুড়ীর আওতায় আছিস, ঝড়-ঝাঁপটা কিছুই তোকে মাথা পেতে নিতে হচ্ছে না! কিন্তু আমি জানি রে, কাকে বলে পৃথিবী কাকে বলে সংসার! এমন কতদিন গেছে আমার যেদিন একটা পয়সা নেই হাতে, একটা চাল পর্যন্ত নেই যে ফুটিয়ে খাবো, এমন এক-একদিন গেছে যখন রাত্তিরে একলা কেঁদে কেঁদে ভাসিয়েছি। সে-কান্না শোনবার মত কেউ ছিল না কাছে– সে-সব দিনের কথা ভাবলে এখনও বুকটা শিউরে ওঠে রে! আমার পরম শত্রুও যেন তেমন করে কষ্ট না-পায়–

তারপর বলতে বলতে সতীর হাত দুটো হঠাৎ ধরে ফেললে। বললে–আমার কথাটা রাখ ভাই, আমি যে ভুল করেছি, তুই যেন সেই ভুল করিস নি আর! শাশুড়ীরা অমন বলেই থাকে, শাশুড়ী কারো চিরদিন থাকে না। তারপর একদিন তোদের আবার ছেলে-মেয়ে হবে, সংসার ভরে যাবে, তখন বলবি দিদি একদিন ঠিক কথাই বলেছিল! তোকে সুখী দেখলে তবু আমি বাঁচবো রে! আমি জীবনে সুখ পেলুম না, কিন্তু তুই তো সুখী হবি তাতেও যে আনন্দ আমার–

কথাগুলো শুনতে শুনতে সতী যেন কেমন হয়ে গেল। লক্ষ্মীদির বুকের ওপর মুখ লুকোল।

সেদিন দুই বোনের সেই ছবি আজো দীপঙ্করের মনে যেন আঁকা রয়েছে। এখনও চোখ বুজলে যেন সেই দুজনের ছবিটা স্পষ্ট হয়ে চোখে ভাসে।

খানিক পরে কাশী খেতে ডাকতে এসেছিল। আপিস যাবার সময় হয়ে গিয়েছিল তখন। তাড়াতাড়ি একতলা থেকে খেয়ে নিয়ে ওপরে এসে দেখেছিল দুই বোনে তখনও জড়াজড়ি করে আছে। তখনও লক্ষ্মীদির বুকের ওপর মুখ লুকিয়ে কাঁদছে সতী।

আপিস যাবার জামা-কাপড় পরে তৈরি হয়ে দীপঙ্কর ঘরে ঢুকে বলেছিল–আমি তাহলে আসি লক্ষ্মীদি, আমার আপিসের দেরি হয়ে যাচ্ছে–

লক্ষ্মীদি বললে–কিন্তু আমিও তো আর বেশিক্ষণ দেরি করতে পারবো না দীপু– ওদিকে যে সে মানুষকে না-খাইয়ে রেখে এসেছি। আমার সংসারেও তো আমি একলা

দীপঙ্কর বললে–তাহলে তুমি ওকে বুঝিয়ে-সুঝিয়ে শ্বশুরবাড়ি পাঠিয়ে দিও–একটা ট্যাক্সি করে একেবারে দরজা পর্যন্ত পৌঁছিয়ে দিয়ে চলে এসো–

তারপর পকেট থেকে একটা দশ টাকার নোট বার করে বললে–আর এই টাকাটাও রেখে দাও, পরে সব কথা বলবো–সতী যেন ভাত খেয়ে যায় এখান থেকে, না খাইয়ে পাঠিও না

যাবার সময় নিচে গিয়ে কাশীকে ডাকলে, কাশী কাছে এল। দীপঙ্কর বললে– ভালো করে খেতে দিস্, বুঝলি-পেট ভরে খেতে দিস্, ‘না’ বললেও শুনিস নি–

তারপর ঘড়িটার দিকে চেয়েই চমকে উঠলো। এত দেরি হয়ে গিয়েছে! রাস্তায় বেরিয়ে হঠাৎ মনে পড়লো। কাল তো মা’র চিঠি আসবার কথা! আজ হয়ত স্টেশনে নেমেই মা চিঠি ছাড়বে। পৌঁছনোর খবরটা দিয়েই চিঠি লিখবে। নিরাপদে পৌঁছানোর খবরটাই পাওয়া দরকার।

কাশী দরজা বন্ধ করে দিতে এসেছিল।

হঠাৎ দীপঙ্কর পেছন ফিরলো। বললে–কাশী, দাঁড়া একটি জিনিস ভুলে গেছি—

বলে আবার দীপঙ্কর ভেতরে ঢুকে সিঁড়ি-দিয়ে ওপরে উঠলো। লক্ষ্মীদির কোলে তখনও মুখ গুঁজে পড়ে রয়েছে সতী। লক্ষ্মীদি বললে–কী হলো, আবার ফিরে এলি যে?

দীপঙ্কর বললে–তোমার বাবাকে তো চিঠি লেখা হলো না! একটা চিঠি লিখে দিলে আমি আপিস যাবার পথে ফেলে দিতে পারতাম–

লক্ষ্মীদি বললে–দাও, কাগজ আর খাম দাও একটা তোমার–

দীপঙ্কর চিঠি লেখবার প্যাড, কলম আর খাম এগিয়ে দিলে। লক্ষ্মীদি সতীকে কোল থেকে সরিয়ে বললে–দে ভাই, বাবাকে একটা চিঠি লিখে দে–আমার কথা কিছু লিখিস নি যেন, তোর কষ্টের কথাই লেখ। লিখে দে তিনি যেন চিঠি পেয়েই চলে আসেন। বেশি আর কিছু লিখতে হবে না। বেশি কথা লিখলে আবার তিনি ভাববেন মিছিমিছি

সতী প্যাডটা নিয়ে লিখতে লাগলো। তারপর চিঠিটা খামের মধ্যে পুরে এঁটে দিলে।

লক্ষ্মীদি বললে–লিখেছিস তো যে তোর খুব কষ্ট হচ্ছে, এখুনি এসে তোকে নিয়ে যেতে!

সতী বললে—হ্যাঁ–

লক্ষ্মীদি বললে–সেই ভালো, এ ক’দিন একটু কষ্ট করে থাক। তারপর বাবা এলে তো আর ভাবনা নেই তখন! এইটুকুতেই এত মুষড়ে পড়লে চলে ভাই! তাহলে আমার মত অবস্থায় পড়লে তুই কী করতিস্ বল্ দিকিনি!

তারপর দীপঙ্করের দিকে ফিরে বললে–তুই যা দীপু, তোর আপিসের আবার দেরি হয়ে গেল হয়ত–আমি ওকে ওর বাড়িতে পৌঁছিয়ে দিয়ে যাবো–

আর দাঁড়ায়নি সেখানে দীপঙ্কর। চিঠিটা নিয়েই সেদিন আপিসে চলে গিয়েছিল সোজা ৷

.

সেইদিনই আপিসে রবিন্‌সন সাহেবের ফেয়ারওয়েল। দীপঙ্কর নিজেও দিয়েছিল চাঁদা। মিস্টার ঘোষালই উদ্যোক্তা। মিস্টার ঘোষাল ট্র্যাফিক আপিসের প্রত্যেক সেকশানের সুপারভাইজারদের ডেকে ডেকে চাঁদা আদায় করেছে। কে-জি-দাশবাবু, রামলিঙ্গমবাবু সেকশন থেকে ক’দিন ধরে চাঁদা চেয়ে চেয়ে সব মিস্টার ঘোষালের হাতে এনে তুলে দিয়েছে। ইউরোপীয়ান ইনস্টিটিউটি মীটিং হবে। খাবারের অর্ডার দেওয়া হয়েছে। এজেন্ট নিজে থাকবে। ক্রফোর্ড সাহেব থাকবে। মিস্টার ঘোষাল থাকবে। ডিপার্টমেন্টের বড় বড় অফিসাররা সবাই থাকবে। সাহেবদের জন্যে একরকম খাবার–ক্লার্কদের জন্যে একরকম।

আপিসের কাজের সমস্ত চাপ এসে পড়েছে দীপঙ্করের ঘাড়ে। রবিন্‌সন সাহেব আসছে না ক’দিন ধরে। সেই কাজ এসে জমেছে মিস্টার ঘোষালের টেবিলে। মিস্টার ঘোষালও ফেয়ারওয়েল নিয়ে ব্যস্ত। সুতরাং তার কাজও এসে জমেছে দীপঙ্করের টেবিলে!

ঘরে ঢুকতেই মধু সেলাম করলে। বললে–হুজুর, ঘোষাল সাহেব খোঁজ করে গেছেন দু’বার–

-–কেন? কিছু বলেছে?

মধু বললে–না–

ঘড়ির দিকে চেয়ে দেখলে দীপঙ্কর। আধ ঘণ্টা দেরি হয়েছে আপিসে আসতে। একেবারে বাড়ির কাছ থেকে সোজা ট্যাক্সিতে আসতে হয়েছে। গাঙ্গুলীবাবু অনেকদিন ধরে বলছে–এইবার একটা গাড়ি কিনুন সেনবাবু–আর মানায় না আপনাকে–

দীপঙ্কর বলেছে–কী হবে গাড়ি কিনে গাঙ্গুলীবাবু, গরীবের ছেলে আমি, অত বিলাসিতা সহ্য হবে না

–কিন্তু আপনার তো টাকা লাগছে না। আপিস থেকেই তো আপনাকে ছ’হাজার টাকা অ্যাডভান্স দেবে! এতেও যদি না কেনেন তো লোকে আপনাকে কৃপণ বলবে। এমনিতেই লোকে বলে আপনি টাকা জমাচ্ছেন! আর তাছাড়া এবার আপনার প্রমোশান হচ্ছে, এখন গাড়ি না কিনলে খারাপ দেখাবে সত্যি!

দীপঙ্কর গাঙ্গুলীবাবুর মুখের দিকে চেয়ে দেখলে। বড় মায়া হলো গাঙ্গুলীবাবুকে দেখে। দীপঙ্করের চাকরিটা গাঙ্গুলীবাবুর হলে গাঙ্গুলীবাবু হয়ত সত্যই সুখী হতো।

–আচ্ছা গাঙ্গুলীবাবু, আপনার স্ত্রী এখন আর আপনার মাইনে বাড়ার কথা বলেন না?

গাঙ্গুলীবাবু বললে–মুখে বলে না, কিন্তু মনে মনে বুঝতে পারি, খুব কষ্ট হয়! অনেকদিন ধরে বলছে কাশ্মীর বেড়াতে যাবে, আমার শালীরা গিয়েছিল কি না–!

দীপঙ্কর বললে–তা যান না একবার, রেলের চাকরি করছেন, একবার ঘুরে আসুন–

গাঙ্গুলীবাবু বললে–কী যে বলেন আপনি, প্রতি মাসে কত সুদ দিতে হয় জানেন, সুদ দিতে দিতেই সব টাকা ফুরিয়ে যায়, তখন আবার টাকা ধার করি–এখন অনেক টাকা ধার হয়ে গেছে।

দীপঙ্কর বললে–একটু টেনে টেনে চললেই হয়–

গাঙ্গুলীবাবু বললে–তা চলবে না, কবিরাজ বলেছে তাহলে আবার পাগল হয়ে যাবে মশাই, আসলে তো আপিস থেকে মাইনে পাই পঁচাশি টাকা, বাড়িতে স্ত্রীকে বলেছি একশো দশ আমার মাইনে!

বলে কী রকম ম্লান একরকম হাসি হাসতে লাগলো গাঙ্গুলীবাবু। নিরুপায় নিঃসম্বলের হাসি।

দীপঙ্কর একদিন বলেছিল– দরকার হলে আমার কাছে আপনি টাকা নেবেন গাঙ্গুলীবাবু, আমি একদিন একসঙ্গে আপনার সঙ্গে চাকরি করেছি, সেই অধিকারেই নেবেন

গাঙ্গুলীবাবু কথাগুলো শুনে কেমন লজ্জিত হতো। বলতো–না, না সে প্রাণ গেলেও নেব না, তাহলে আপনার কাছে এই যখন তখন আসতে পারবো না–

–তাহলে কাশ্মীর যাবেন কী করে?

গাঙ্গুলীবাবু কথাটা শুনে হঠাৎ যেন গম্ভীর হয়ে পড়তো। বলতো–তাও তো ভাবছি, অনেকদিন ঠেকিয়ে রেখেছি কিন্তু এবার আর বেশিদিন ঠেকিয়ে রাখতে পারবো বলে মনে হচ্ছে না, কবিরাজ বলেছে যেমন করে পারেন ধারধোর করে অন্তত নিয়ে যান বউকে, নইলে আবার মাথা খারাপ হয়ে যাবে–

একদিন কে-জি-দাশবাবুকে ঘরে ডেকে এনেছিল দীপঙ্কর। জিজ্ঞেস করেছিল– আচ্ছা কে-জি-দাশবাবু, গাঙ্গুলীবাবু গ্রেড্‌ পাচ্ছেন না কেন?

কে-জি-দাশবাবু একবার একটু অবাক হয়ে গিয়েছিল প্রথমে। বলেছিল–স্যার, গাঙ্গুলীবাবুর চেয়েও সিনিয়র লোক রয়েছে, তাঁরাও কেউ গ্রেড পায়নি–

–কেন পায়নি!

–আমার সেকশানে গ্রেড্‌ যে নেই। সব গ্রেডগুলো এস্টাবলিশমেন্ট সেকশান নিয়ে নিয়েছে।

–কী করে নিলে?

কে-জি-দাশবাবু বললে– আজ্ঞে, সেটা আমি আর কী বলবো, সবই তো এস্টাবলিশমেন্ট সেকশানের হাতে। তারা ইচ্ছে করলে হোয়াইটকে ব্ল্যাক করতে পারে। ওরা বুঝিয়েছে জার্নাল সেকশানটা সবচেয়ে আইনম্পরট্যান্ট সেকশান, সেইজন্যে আগে যে-দুটো গ্রেড্‌ ছিল তাও কেড়ে নিয়েছে–

দীপঙ্কর অনেক ভেবে জিজ্ঞেস করেছিল–আচ্ছা একটা কথা, গাঙ্গুলীবাবুকে ট্র্যাফিকে ট্রান্সফার করা যায় না?

কে-জি-দাশবাবু বলেছিল–ভেকেন্সি তো নেই ওখানে, যদি ভেকেন্সি থাকে তাহলে আপনি চেষ্টা করলে করতে পারেন–

দীপঙ্কর বললে–আচ্ছা আপনি যান,–গাঙ্গুলীবাবু সম্বন্ধে একটা ভালো নোট দিন আমাকে, তাতে লিখবেন যে গাঙ্গুলীবাবু খুব এফিসিয়েন্ট লোক, তারপরে আমি দেখি কী করতে পারি–

বহুদিন পরে অনেক চেষ্টা করে দীপঙ্কর সেই গাঙ্গুলীবাবুকে গ্রেড্‌ পাইয়ে দিয়েছিল, কিন্তু গাঙ্গুলীবাবু তখন সমস্ত গ্রেডের ঊর্ধ্বে উঠে গিয়েছে। আজ দীপঙ্কর অনেক দূর থেকে সেইদিনকার সব কথা ভাবতে গিয়ে সমস্ত ভাবনার ভিড়ে নিরুদ্দেশ হয়ে যায়। আর শুধু কি গাঙ্গুলীবাবু? কে নয়? সমস্ত আপিসটা ছিল যেন একটা চক্র। সে চক্রের সঙ্গে এক সূত্রে যেন সবাই বাঁধা ছিল। সকলের সব ভবিষ্যৎ, সব বর্তমান, সব অতীত যেন দীপঙ্করের চিন্তার সঙ্গে জড়িয়ে গিয়েছিল। কারো উপকার করতে পারেনি সে। কারো ভালো করতে পারেনি। আইনের শেকল দিয়ে তার হাত-পা যেন বেঁধে দিয়েছিল তারা। অথচ ভেকেন্সি না থাকলেও ট্রান্সফার হয়েছে, স্যাংশান না থাকলেও গ্ৰেড্‌ প্রমোশন হয়েছে। কোন্ গোপন সূত্রের নিবিড় সম্পর্কে কার ভাগ্যের উত্থান হয়েছে, আর কার ভাগ্যের পতন হয়েছে তা এত বছর চাকরি করেও দীপঙ্কর জানতে পারেনি। আরো বহু বছর চাকরি করলেও জানতে পারতো না।

গাঙ্গুলীবাবু দুঃখ করেছে। বলেছে–আপনি আর কী করবেন সেনবাবু, আপনি তো আমার জন্যে সবরকম চেষ্টা করছেন–আমার কপালে নেই–

দীপঙ্কর তবু চেষ্টা করেছে। রবিন্‌সন সাহেবকে দিয়ে নোট দিইয়েছে। কিন্তু এস্টাবলিশমেন্ট সেকশান থেকে ফিরে এসেছে যেমন-কে-তেমন। নো-ভেকেন্সি। কিম্বা নো-গ্রেড্‌ অ্যাট্ প্রেজেন্ট। কিছুই হয়নি শেষ পর্যন্ত।

সারাজীবনে অনেক কিছু করবার ইচ্ছে ছিল দীপঙ্করের। অনেক কিছু উন্নতি। শুধু স্টাফের নয়। ট্রেন কেন নিয়ম করে আসবে না? ট্রেন কেন নিয়ম করে পৌঁছোবে না? সকাল আটটার পরে হাওড়ায় এসে পৌঁছলেই তবে টি-এ পাওয়া যায়। ট্রেন এসে পৌঁছোচ্ছে সাতটা পঞ্চান্ন মিনিটে। অফিসারের টি-এ হবে না। সাড়ে আট টাকা লোকসান। তিনি হঠাৎ এলার্ম চেন টেনে দিলেন। কে তাঁর বিরুদ্ধে রিপোর্ট করবে? কার এত সাহস আছে?

দীপঙ্কর ঘরে ঢুকেই মধুঁকে ডাকলে। বললে–দেখে আয় তো মিস্টার ঘোষাল ঘরে আছে কি না–

মিস মাইকেল এক-একদিন ঘরে ঢুকলে আর যেতে চায় না। রসিসন সাহেব অফিসে না এলে মেমসাহেবের কোনও কাজ থাকে না হাতে।

বলে–মে আই কাম ইন সেন?

বয়েস হয়েছে মিস মাইকেলের। তবু সেই মিষ্টি হাসি। তবু সেই মিষ্টি লিপস্টিক। সেই মিষ্টি ফিগার। হাসতে হাসতেই ঘরে ঢোকে।

–আজকে তোমার এত দেরি মিস্টার সেন?

তারপর অনেক আজে-বাজে কথার পর বলে–তুমি শুনে গ্ল্যাড হবে সেন, আমি আমেরিকা যাচ্ছি–

–সে কি? কবে?

–ভিভিয়ান আমাকে চিঠি দিয়েছে মিস্টার সেন। এভরিথিং রেডি। আচ্ছা দেখ তো, আমাকে আরো বিউটিফুল দেখাচ্ছে না?

দীপঙ্কর ভাল করে নজর দিয়ে বলে–খুব সুন্দর দেখাচ্ছে আজ। কেন বলো তো?

এই ধরনের কথা বললে মিস মাইকেল বড় খুশী হয়। সুন্দর দেখাচ্ছে বললে মিস মাইকেলের যেন আর আনন্দ ধরে না। সুন্দর বললে মিস মাইকেল যেন তার সবকিছু উজাড় করে দিতে পারে।

মিস মাইকেল বললে– আমি অফিস থেকে লোন নিয়েছিলাম মিস্টার সেন, তিন হাজার টাকা, আমার চুল কার্ল করিয়েছি, এই দেখ আমার কসমেটিকস্ আনিয়েছি ফ্রান্স থেকে, আমি একজন গার্ল ম্যাসাজিস্ট রেখেছি, তাকে মাসে মাসে হান্ড্রেড চিপস দিই– আর কত করবো! আচ্ছা আমাকে কীরকম সুন্দর দেখাচ্ছে?

দীপঙ্কর বললে–তোমার মত সুন্দরী আমি কখনও চোখে দেখিনি, কেবল ছবিতে দেখেছি।

মিস মাইকেল তাতেও যেন খুশী হয় না। জিজ্ঞেস করে–কারা বো’র চাইতেও সুন্দরী?

দীপঙ্কর বললে–ক্লারা বো’কে তো আমি দেখেনি–

–আচ্ছা, তবে লিলিয়ান গিশ?

কারোরই নাম জানে না দীপঙ্কর। সিনেমাই দেখে না তা জানবে কী! আরো কত কী বলে গেল! আরো কত নাম করে গেল একে একে! তখন কলকাতা শহর সিনেমা সিনেমায় ভর্তি হয়ে গেছে। গ্রেটা গার্বো, জেনেট গেইনর, আরো সব কত নাম। কাউকেই চেনে না দীপঙ্কর।

মিস মাইকেল বললে–ভিভিয়ানের চিঠিটা দেখবে তুমি? আমি এনেছি মিস্টার সেন–

বলে হাতের ব্যাগটা থেকে বার করলে। যেন কত দামী চিঠি। কত অমূল্য রত্ন। কত যত্ন করে রেখে দিয়েছে। কত দিনের স্বপ্ন মিস মাইকেলের। কত জীবনের সাধনা। ভিভিয়ান লে তার রুম-মেট–সে তাকে ডেকেছে। ইন্ডিয়ার রেলের আপিসে তাকে চাকরি করতে হবে না। সেখানেই তার স্বর্গ, সেখানেই তার সুখ। দীপঙ্কর মিস মাইকেলের মুখের দিকে চেয়ে দেখলে। বড় আনন্দ হল। গাঙ্গুলীবাবু জীবনে সুখ পেলে না কিন্তু মিস মাইকেল তো পেয়েছে। সুখী লোকের মুখ দেখেও সুখ।

দীপঙ্কর বললে–সেখানে গিয়ে যেন আমাকে ভুলে যেও না তুমি মিস মাইকেল

–না না, বলছো কী? বড়লোক হয়ে কি সব ভুলে যাবো? জানো, ইউ আর দি ওনলি ইন্ডিয়ান যাকে আমি ভালবাসি। তুমি আমার ঘরে গিয়েছিলে তবু ও-পাড়ায় একদিনও যাওনি। অথচ মিস্টার ঘোষাল–

–মিস্টার ঘোষাল কি এখনও যায় তোমাদের পাড়ায়?

মিস মাইকেল বললে–রোজ রোজ, ডেলি যায়–আর আমাকেই এনটারটেন করতে হয়, আই ক্যানট রিফিউজ, হি ইজ এ বিস্ট–

অনেক কাজ সত্ত্বেও মিস মাইকেলের সঙ্গে কথা বলতে হয়। কথা না বললে মিস মাইকেলের কষ্ট হবে। কারো কষ্ট দেখতে পারে না দীপঙ্কর। এমনি করে মিস মাইকেল সময় পেলেই আসে। আর গল্প করে যায়। দীপঙ্করকে বলতে হয় মিস মাইকেল সুন্দরী কি না। সুন্দরী হলে কার চেয়ে সুন্দরী। ক্লারা বো না লিলিয়ান গিশ না জেনেট গেইনর না গ্রেটা গার্বো, ঠিক কার চেয়ে সুন্দরী। কার মত তার চোখের ভ্রু। কার মত তার ফিগার, কার মত তার লিপস, কার মত আরো অনেক কিছু। যেন শিশুর মত সরল। যেন মোমের মত নরম। মিস মাইকেলকে দেখতে দেখতে দীপঙ্করের বিত্তিদির কথা মনে পড়তো। এমন সরল শিশুর মত ছিল বিন্তিদিও। এমনি করেই জিজ্ঞেস করতো সে সুন্দরী কি না।

সেদিন মধু ফিরে আসবার আগেই মিস্টার ঘোষাল এসে ঘরে ঢুকলো। বাইরে থেকে জুতোর আওয়াজ পেয়েই বুঝেছিল মিস্টার ঘোষাল আসছে। পঞ্চাশ গজ দূর থেকেও মিস্টার ঘোষালের জুতোর আওয়াজ পাওয়া যায়।

–ইউ আর লেট টো-ডে সেন!

চেয়ারের ওপর পা তুলে দিয়ে মিস্টার ঘোষাল চুরুট চানতে লাগলো। যেন কৈফিয়ৎ চাইবার মত গলার সুর।

দীপঙ্কর বললে–ইয়েস, আমি লেট্‌

-–না না, সে-কথা বলছি না। রবিনসন সাহেব তোমাকে খুঁজছিল। হি ব্যাডলি নীডেড্ ইউ।

দীপঙ্কর শশব্যস্ত হয়ে উঠলো। বললে–কোথায়? কোথায় তিনি? অফিসে এসেছেন?

মিস্টার ঘোষাল বললে–না না, এখানে আসেননি, আমি গিয়েছিলুম বাংলোতে। রবিনসনের দোষ কী জানো, বড় গুড়নেচার্ড লোক, ভেরি মাইডিয়ার–কবে আমি ঠাট্টা করে বলেছিলুম, তাই এখনও বিশ্বাস করে বসে আছে আই য়্যাম্ এ সাউথ ইন্ডিয়ান্– আমিও ভুল ভাঙাই না–

বলে চুরুটে টান দিলে ধোঁয়া ছাড়লে।

তারপর বললে–আমাকে জিজ্ঞেস করছিল রবিন্‌স, হোয়্যার ইজ সেন? এতদিন আমি বাড়িতে রয়েছি তুমি তো রোজ আসো ঘোষাল, সব্বাই আসে, সেন তো একবারও আসে না–। তোমার ওপর খুব রেগে আছে ওল্ড ম্যান্–

দীপঙ্কর বললে–আমাকে না-ডাকলে আমি কী করে যাই বলুন? লোকে ভাববে আমি বুঝি প্রমোশনের জন্যে খোশামোদ করতে যাচ্ছি–

–একজ্যাক্টলি সো। তুমি ঠিক করেছ, যাওনি। ওল্ড ম্যান তোমাকে কিছুতেই প্রমোশন দেবে না, আমিও ছাড়বো না। আমি বললুম–সেন ইজ কোয়াইট অল রাইট। শেষকালে অনেক কষ্টে তবে রাজী করিয়েছি বুড়োকে, বুড়ো ক্রফোর্ডকে লিখে দিয়েছে শেষ পর্যন্ত–

–আমার প্রমোশনের জন্যে? দীপঙ্কর অবাক হয়ে গেল।

মিস্টার ঘোষাল বললে– হ্যাঁ, তোমার সম্বন্ধে নোট্ গেছে ক্রফোর্ড সাহেবের কাছে। তুমি আমার জায়গায় প্রমোটেড হবে। আমাকে তোমার ধন্যবাদ দেওয়া উচিত। তোমার গ্রেটফুল থাকা উচিত আমার ওপর।

দীপঙ্কর বললে–কিন্তু আমি তো প্রমোশন চাই না!

–সে কি?

মিস্টার ঘোষাল যেন আকাশ থেকে পড়লো। চুরোটের ছাইটা টপ্ করে ঝরে পড়লো টেবিলের ওপর। বললে–বলছো কি তুমি? প্রমোশন চাও না? ইউ ডোন্ট ওয়ান্ট প্রমোশন?

দীপঙ্কর বললে–না।

তবু মিস্টার ঘোষলের যেন বিশ্বাস হলো না। বললে–য়্যাম্ আই টু বিলিভ ইউ? তুমি প্রমোশন চাও না?

দীপঙ্কর আবার বললে–না। কী হবে প্রমোশন নিয়ে? আমি কার কী উপকার করতে পারবো প্রমোশন পেয়ে? আমার চেয়েও ভালো ভালো কত ক্লার্ক রয়েছে আপিসে, তাদের তো কই প্রমোশন হয় না! তারা নিঃশব্দে কাজ করে যায় মন দিয়ে, অফিসারদের ঘরে গিয়ে তোশামোদ করে না বলে কারো নজরে পড়ে না। প্রমোশন হয় পাশ-ক্লার্ক হরিশবাবুর, প্রমোশন হয় কে-জি-দাশবাবুর, প্রমোশন হয় রামলিঙ্গমবাবুর, প্রমোশন হয় নিবারণবাবুর। কারণ তারা ব্যাাইট করতে পারে কারণ তারা এক্সপ্লয়েট করতে পারে। তার আমরা? আমরা আমাদের দরকারের সময় ক্লার্কদের রসগোল্লা-কচুরি ঘুষ দিয়ে তাদের কাছে কাজ আদায় করি। এখানে কি জাস্টিস আছে? এখানে কি আইন আছে? এখানে কি অনেস্টি আছে?

বলতে বলতে দীপঙ্কর যেন হঠাৎ নিজেকে ভুলে গেল। উত্তেজিত হয়ে উঠলো  ঘোষাল সাহেব অবাক হয়ে দীপঙ্করের কথাগুলো শুনছিল। দীপঙ্কর থামতেই বললে কিন্তু তুমি প্রমোশন চাও না? ঠিক বলছো? তুমি টাকা চাও না?

দীপঙ্কর বললে–না, টাকা চাই না। টাকায় কী হয়! টাকায় কিচ্ছু হয় না মিস্টার ঘোষাল। আমার এক সিস্টার, তার মস্ত বড়লোকের বাড়িতে বিয়ে হয়েছে, তার বাবাও খুব বড়লোক, তাদের গাড়ি, বাড়ি, দারোয়ান, জমিদারি সব আছে। তাদের প্রচুর টাকা, টাকার শেষ নেই তাদের। তবু সে সুখী নয়, জানেন–লক্ষ লক্ষ টাকা দিয়েও তাকে সুখী করা যাবে না–সে আজ সকালে আমার বাড়িতে এসে উঠেছে, শ্বশুরবাড়ি থেকে পালিয়ে এসেছে!

–কে সে?

দীপঙ্কর বলবে না বলেও বলে ফেললে-মিসেস ঘোষ, আপনি তাকে চেনেন—

মিস্টার ঘোষাল চুরোটটাকে আরো বাগিয়ে ধরলে। হঠাৎ চেয়ারে বসে পড়ে বললে–হোয়াট্ ডু ইউ মিন্‌?

মিস্টার ঘোষালের আগ্রহ দেখে সেদিন দীপঙ্করের ঘৃণা আরো শতগুণ বেড়ে গিয়েছিল মনে আছে ৷

মিস্টার ঘোষাল জিজ্ঞেস করলে–কেন পালিয়ে এসেছে কেন? কী হয়েছেল?

দীপঙ্কর বললে–সে অনেক কথা, সব কথা আপনি বুঝতে পারবেন না। অত টাকা, অত বড় বংশ কিন্তু সুখ নেই এক তিল। তাই তো আপনাকে বলছিলাম প্রমোশন আমি চাই না, প্রমোশন নিলেও তো কারোর উপকার করতে পারবো না–ওই তো জার্নাল সেকশানে পি-কে-গাঙ্গুলী রয়েছে, দিলে ওকেও তো প্রমোশন দিতে হয়, মোস্ট এফিসিয়েন্ট ক্লার্ক–তাকে কি প্রমোশন দিতে পেরেছে কেউ?

দীপঙ্কর গড় গড় করে অনেক কথা বলে গেল। ওই যে হরিশবাবু! যেহেতু লোকটা সকলের মনোরঞ্জন করে বেড়ায়, সকলের তোষামোদ করে, ওরও প্রমোশন হয়। কিন্তু আরো হাজার লোক রয়েছে। হাজার-হাজার লোক। আর শুধু রেলই বা কেন? সমস্ত কালীঘাট, সমস্ত বালীগঞ্জ, সমস্ত কলকাতার লোক রয়েছে। কে তাদের প্রমোশন দেবে? তাদের প্রমোশনের জন্যে কার কাছে দরখাস্ত করবে দীপঙ্কর? কে তাদের ভাগ্যবিধাতা? দীপঙ্করের যেন লজ্জা করে। মনে হয় ফরসা জামা-কাপড় পরে যেন সমস্ত মানুষের মুখে চুন-কালি লেপে দিচ্ছে সে। তার নিজের প্রমোশন যেন তার নিজের কাছে লজ্জার সামিল। মিস্টার ঘোষাল শুধু সতীর শ্বশুরবাড়ি থেকে পালিয়ে আসার ঘটনা জানতেই ব্যাকুল। কিন্তু কেন সে পালিয়ে আসে, কেন পালিয়ে এসে তার বাড়িতে এসে ওঠে, তার কারণ অনুসন্ধান করতে চায় না। সমস্তর মূলেই তো সেই টাকা! সতীর টাকার কাঁচে সতীর রূপ, গুণ সব যেন ধূলিসাৎ হয়ে গেছে। সনাতনবাবুর টাকার কাছেও সতীর সতীত্ব যেন নস্যাৎ হয়ে গেছে। এত টাকা তাদের। এত নিশ্চিন্ত জীবন তাদের, সতীর ভালো-মন্দ নিয়ে ভাববার কথা তাদের তাই মনেও আসে না। টাকা কি এমনি অমানুষ করে মানুষকে? দীপঙ্করের মনে হলো, হয়ত এত টাকা থাকা ভাল নয়। জীবন এত নিরুপদ্রব হওয়া উচিত নয়, জীবন এত উদ্বেগহীন হওয়া ঠিক নয়। সনাতনবাবুদের জীবনে একটু উপদ্রব, একটু উদ্বেগ থাকলে বোধহয় সতী এমন করে চলে আসতে পারতো না।

মিস্টার ঘোষাল চলে যাবার পর দীপঙ্কর মধুঁকে ডাকলে।

মধু এল। দীপঙ্কর বললে–এই চিঠিটা ফেলে দিয়ে আয় তো মধু, খুব জরুরী, একেবারে ভুলেই গিয়েছিলাম–

মধু চিঠি নিয়ে চলেই যাচ্ছিল। হঠাৎ দীপঙ্করের কী খেয়াল হলো।

বললে–মধু, শোন্, চিঠিটা একবার দেখি–

সতী নিজের হাতে চিঠি লিখেছে। নিজের হাতে খামটা এঁটেছে। ভেতরে সতী কী লিখেছে দেখবার ইচ্ছে হলো। বাবাকে হয়ত আসতে লিখেছে কলকাতায়। হয়ত লিখেছে খুব জরুরী। যাতে ভুবনেশ্বরবাবু চিঠি পেয়েই চলে আসেন। বলতে গেলে একমাত্র মেয়ে তাঁর। একমাত্র সন্তান। তার চিঠি পেয়েই চলে আসবেন নিশ্চয়। একদিনও দেরি করবেন না।

মধুর হাত থেকে চিঠিটা নিয়ে ওপরের খামটা আস্তে আস্তে খুলে ভেতরের চিঠিটার ভাঁজ খুললে।

কিন্তু চিঠিটা পড়েই দীপঙ্কর একেবারে আকাশ থেকে পড়লো। সতী লিখেছে–

শ্রীচরণেষু,

বাবা, অনেকদিন তোমাকে কোনও চিঠি দিতে পারিনি। তুমি আমার জন্যে ভেবো না। আমার এখানে কোনও কষ্টই নেই। সম্প্রতি আমরা কয়েক মাসের জন্যে দেশ ভ্রমণে বেরোচ্ছি। সময়মত তোমাকে হয়ত চিঠি দিতে পারবো না। তার জন্যে তুমি যেন চিন্তিত হয়ো না। আশা করি, ভালো আছো আমার প্রণাম নিও।

ইতি তোমার,

সতী

দীপঙ্করের কী যে হলো। হঠাৎ চিঠিটা টুকরো টুকরো করে ফেলে দিলে ওয়েস্ট পেপার বাস্কেটের মধ্যে! মধু তখনও দাঁড়িয়ে ছিল। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখছিল সেন সাহেবের কাণ্ড। মধুর দিকে নজর পড়তেই

দীপঙ্কর বললে–এ চিঠি ফেলবার দরকার নেই, তুই এখন যা

হঠাৎ দ্বিজপদ ঘরে ঢুকলো। বললে–হুজুর, রবিন্‌সন সাহেব আপকো সেলাম দিয়া দীপঙ্কর চমকে উঠেছে। বললে–কোথায়? আপিসে না বাঙলোয়?

–বাঙলোয়।

দীপঙ্কর দাঁড়িয়ে উঠে তাড়াতাড়ি বাইরে চলে গেল।

৪৪

সেই সাহেবের ফেয়ারওয়েলের দিনের কথাটাও স্পষ্ট মনে আছে দীপঙ্করের। নৃপেনবাবুর ফেয়ারওয়েলের উৎসবের মতই। তবে তার চেয়ে আরো বড়। আরো জাঁক জমকের। সমস্ত সাহেবরা এসেছে। সমস্ত ক্লার্ক। সবাই চাঁদা দিয়েছে। এরই মধ্যে রটে গিয়েছে দীপঙ্করের প্রমোশনের কথা। এরই মধ্যে অফিস-সুদ্ধ ক্লার্করা তার দিকে আঙুল দিয়ে দেখাচ্ছে। জুনিয়ার অফিসাররা কনগ্র্যাচুলেট করতে লাগলো।

সমস্ত সময়টা দীপঙ্কর চেয়ারের ওপর স্ট্যাচুর মত চুপ করে বসে রইল। কে কী বক্তৃতা দিলে, কে কী বললে, তা-ও যেন কানে গেল না! কেন এমন হয়? কেন দীপঙ্করের এমন হয়? কেন আর দশজনের মত দীপঙ্কর সব জিনিস সহজভাবে গ্রহণ করতে পারে না?

রবিন্‌সন সাহেবের কথাগুলো যেন তার কানে তখনও বাজছিল।

রবিনসন সাহেবের বাঙলোতে বসে সাহেব বলেছিল–আমি সকলের ইচ্ছের বিরুদ্ধে তোমাকে প্রমোশন দিচ্ছি সেন, ইউ মাস্ট অ্যাকসেপ্ট ইট–ইউ মাস্ট–

দীপঙ্কর শিউরে উঠতে লাগলো সাহেবের কথাগুলো শুনে।

সাহেব আবার বললে–আজ ঘোষাল অনেক বললে তোমার বিরুদ্ধে। বাট ঘোষাল ইজ্ এ সাউথ ইন্ডিয়ান, আমি তাকে বিশ্বাস করি, কিন্তু তবু তার কথা রাখিনি। তুমি জানো, ঘোষাল ইজ্ ফ্রেন্ডলি টু ব্রিটেন, উনিশশো ছাব্বিশ সালের স্ট্রাইকের সময়ে ইংলন্ডে সার্ভিস দিয়েছিল-কিন্তু স্টীল, তার কথা আমি রাখতে পারিনি, আমি ক্রফোর্ডকে তোমার সম্বন্ধে নোট দিয়েছি, আই উইশ্ ইউ সাক্‌সেস্ এন্ড হ্যাপিনেস্

দীপঙ্কর হঠাৎ মুখ খুললে–কিন্তু স্যার, হোয়াই?

–বিকজ ইউ ডিজার্ভ ইট। ইউ আর ইনটেলিজেন্ট এন্ড এফিসিয়েন্ট–

দীপঙ্কর বললে–কিন্তু আপনি জানেন না স্যার আমার মত হাজার হাজার ইনটেলিজেন্ট আর এফিসিয়েন্ট লোক আমাদের রেলে রয়েছে তাদের প্রমোশন হয় না– তাদের কেউ দেখে না–। কেউ কেউ আমার চেয়েও ইনটেলিজেন্ট, কেউ কেউ আমার চেয়েও এডুকেটেড্–

রসিসন সাহেব যেন স্তম্ভিত হয়ে গেল কথাটা শুনে। বললে–ইম্পসিবল, হতেই পারে না–আমার অফিসে আমি সকলকে জানি, সকলের বিদ্যেবুদ্ধি আমার জানা আছে, আমার জিমি তাদের চেয়ে ইনটেলিজেন্ট ছিল–পুওর সোল

বলতে বলতে সাহেব নিজের হাত দু’খানা বুকের ওপর ক্রুশের ভঙ্গিতে রাখলে। তারপর কী যেন হলো সাহেবের। বললে–দি ক্লার্কস আর ওয়ার্স দ্যা বীস্টস্, আমাকে মিস্টার ঘোষাল সব বলেছে, ঘোষাল কখনও মিথ্যে কথা বলতে পারে না, হি ইজ্ এ সাউথ ইন্ডিয়ান–

দীপঙ্কর বললে– আমার কথা বিশ্বাস করুন স্যার, আমি আপনার ভালবাসার যোগ্য নই–

সাহেব অবাক হয়ে গেল। বললে–কেন?

দীপঙ্কর একটু দ্বিধা করতে লাগলো প্রথমে। তারপর মাথা উঁচু করে বললে–আজ আপনাকে আমি বলি, আমি ট্র্যাফিক সুপারিন্টেন্ডেন্ট নৃপেন বাবুকে তেত্রিশ টাকা ঘুষ দিয়ে এখানে চাকরি পেয়েছি, সে-লজ্জা সে-কলঙ্ক আমি জীবনে ভুলতে পারবো না-!

সাহেব নৃপেনবাবুর নাম শুনে হতবাক হয়ে গেল। দি নটোরিয়াস স্কাউড্রেল! অনেক কিছু বলে সাহেব অসংখ্য গালাগালি দিয়ে গেল অদৃশ্য নৃপেনবাবুকে

সাহেব বললে–কিন্তু নৃপেন তো ভালো লোক ছিল বলে জানতুম! ভেতরে ভেতরে সে শয়তান–?

দীপঙ্কর বললে–ঘুষ হয়ত আমি একলাই দিইনি, এই অফিসের সেভেনটি ফাইভ পার্সেন্ট লোকই হয়ত ঘুষ দিয়ে চাকরিতে ঢুকেছে স্যার, কিন্তু আমার জীবনে সেই তেত্রিশ টাকার ঘুষ জগদ্দল পাথরের মত ভারি হয়ে চেপে বসেছে। কথাটা ভাবলেই মনে হয় আমি জোচ্চোর, ঠগ, আমিও একটা স্কাউড্রেল, মাইনে নেবার সময় আমার হাত কাঁপে, মনে হয় আমি রেলওয়েকে ঠকাচ্ছি–

সাহেব অনেকক্ষণ ধরে কথাগুলো শুনলে। তারপর বললে–ফরগিভ্ এন্ড্ ফরগেট্, সেন–ঈশ্বর নৃপেনকে শাস্তি দেবে–

দীপঙ্কর বললে–না স্যার, দেখেছি সেই নৃপেনবাবু ঘুষের টাকায় রিটায়ার করার পর বিরাট দোতলা বাড়ি করেছেন, রোজ কালীঘাটের মন্দিরে যান, রোজ গঙ্গায় গিয়ে স্নান করেন, তাঁর ছেলেরা বড় হয়েছে, বড় বড় চাকরি করছে–খুব হ্যাপি লাইফ্ লীড্‌ করছে, ভগবান তো কোনও শাস্তি দেয়নি তাঁকে–

সাহেব বললে–ইউ ওয়েট এন্ড সী, কিন্তু প্রমোশন নিতে চাও না কেন? তুমি কি সুখী হতে চাও না? তুমি কি লাক্সারি কমফোর্ট কিছু চাও না?

দীপঙ্কর চুপ করে রইল। সাহেবকে বোঝানো বৃথা যে রাজার ছেলে সিদ্ধার্থের কিসের অভাব ছিল যে সমস্ত সুখ, সমস্ত ঐশ্বর্য ছেড়ে বনে পর্বতে ঘুরে বেড়াতে হয়েছিল? আলেকজান্ডারের কিসের অভাব ছিল যে হঠাৎ দুর্গম গিরি-নদী-পর্বত পার হয়ে দিগ্বিজয় যাত্রা করবার ইচ্ছে হয়েছিল? রাজ সিংহাসনের আরাম ফেলে রেখে এমন করে ঘর ছাড়ায় কে? সে কি টাকা? সে কি খ্যাতি? সে কি শান্তি? সে কি সুখ? দীপঙ্কর নিজেই ভাল করে বুঝতে পারে না তো সাহেবকে কী বলে বোঝাবে?

সাহেব বললে–যা হোক, আমি নোট দিয়ে ফেলেছি, আমি চাই তুমি আমার নোটের মর্যাদা রাখবে, মিস্টার ক্রফোর্ডের সঙ্গে আমি পরামর্শ করেছি, আমরা দুজনেই একমত।

সাহেবের ফেয়ারওয়েলের সভায় বসে বসে সেই কথাগুলোই ভাবছিল দীপঙ্কর। সত্যিই কেন এমন হয়? যে-চাকরির জন্যে একদিন তার মা দিনরাত ঠাকুরকে ডেকেছে, যে-চাকরির জন্যে কালীঘাটের সমস্ত লোককে মা খোশামোদ করে বেড়িয়েছে, সেই চাকরির প্রায় মাথায় উঠে কেন এমন বিতৃষ্ণা আসে? এ কি তার পাগলামি? এর মূলেও কী সতী? এর মূলেও কি লক্ষ্মীদি? এর মূলে কি অঘোরদাদু? এরই মূলে কি ছিটে-ফোঁটা? সেই ছিটে-ফোঁটা কংগ্রেসের ভাইস-প্রেসিডেন্ট হয়েছে? যে-চেয়ারে এতদিন প্রাণমথবাবু বসেছে সেই চেয়ারেই কি বসেছে ছিটে-ফোঁটা! দীপঙ্করের বিতৃষ্ণা কি সেই কারণেই?

সবাই কী কারণে যেন হাততালি দিয়ে উঠলো।

দীপঙ্কর সচেতন হয়ে বসলো আবার। এতক্ষণ তলিয়ে গিয়েছিল ভাবনার অতলে! এবার চারদিকে চোখ চেয়ে দেখলে। সবাই তাকে দেখছে। হয়ত রবিন্‌সন সাহেব এতক্ষণ তার কথাই বলছিল। কথাগুলো কানে যায়নি। ভালোই হয়েছে। আশ্চর্য, সবাই তাকে ঈর্ষা করছে, সবাই তাকে লক্ষ্য করছে। আজকের ফেয়ারওয়েলের উৎসবে মিস্টার ঘোষাল আর মিস্টার সেনই যেন সকলের লক্ষ্যস্থল। মিস্টার ঘোষাল না-হয় বন্ অফিসার। অফিসার হয়েই ঢুকেছে। কিন্তু দীপঙ্করের উন্নতিটা যেন সকলের চোখে কট্ কটূ করে বিধছে। দীপঙ্করের যন্ত্রণা হতে লাগলো। যেন সারা শরীরে আঘাত পেলে সে। শুধু শরীরে নয়, মনেও। সমস্ত মন তার অসাড় হয়ে এল। একদিন বইতে পড়েছিল দীপঙ্কর যে বিসমার্ক নাকি জার্মানীকে উঁচু করে সমস্ত জার্মান-জাতকে ছোট করে দিয়েছিল। আজ রবিন্‌সন সাহেবও যেন দীপঙ্করকে প্রমোশন দিয়ে সমস্ত মানুষ-জাতকে ছোট করে দিলে!

বাড়ি আসার পথেও কথাটা মনের মধ্যে আনাগোনা করতে লাগলো।

হঠাৎ অনেকক্ষণ পরে সতীর কথা মনে পড়লো। সতী হয়ত আবার গিয়ে উঠেছে প্রিয়নাথ মল্লিক রোডে। হয়ত দারোয়ান সতীকে দেখে দরজা খুলে দিয়েছে। সতীকে পৌঁছে দিয়েই লক্ষ্মীদি হয়ত চলে এসেছে। তারপর গেট পেরিয়ে বাগান। বাগান পার হয়ে বাঁ দিকে সার-সার ঘর। তারপর চাকর-দারোয়ানদের থাকবার জায়গা। তারপর অনেক দূর গিয়ে একেবারে বারান্দার শেষ প্রান্তে সনাতনবাবুর লাইব্রেরী।

সতী সেইখানে গিয়ে দাঁড়াল একবার সিঁড়ির গোড়ায়।

কোথায় যাবে সে? ওপরে নিজের ঘরে? শাশুড়ীর কাছে গিয়ে ক্ষমা চাইবে? এত তেজ করে বেরিয়েছিল বলে শাশুড়ীর পায়ে হাত দিয়ে মাথায় ঠেকাবে?

কিন্তু সতী তো তেমন মেয়ে নয়।

দীপঙ্কর বাড়ি ফিরতে ফিরতে সেই কথাগুলোই মনে মনে ভাবতে লাগলো। সত্যিই তো, সতী তো তেমন মেয়ে নয়। তাকে জোর করে দীপঙ্কর তার শ্বশুরবাড়িতে পাঠিয়ে দিয়ে হয়ত ভুলই করলে। হয়ত দীপঙ্করের নিজের বাড়িতে থাকতে দিলেই ভালো হতো। সতী শান্তি পেতো।

মনে হলো সতী যেন আস্তে আস্তে লাইব্রেরীর সামনে গিয়ে দাঁড়িয়েছে আবার।

সনাতনবাবু ভেতরে পড়ছিলেন রোজকার মত। মোটা বই। বই-এর পাতার দিকে চোখ দুটো নিবদ্ধ ছিল। টের পেলেন না তিনি।

সতী আস্তে আস্তে ভেতরে ঢুকলো। তারপর বলা নেই কওয়া নেই। হঠাৎ সনাতনবাবুর পায়ের ওপর হাত ঠেকালে। আর সঙ্গে সঙ্গে সনাতনবাবু চমকে উঠলেন। হঠাৎ তাঁর পায়ে কী ঠেকলো?

বললেন–কে? কে? কে?

সতী কথা বললে না।

সনাতনবাবু ভালো করে নজর দিতেই দেখলেন সতীকে। বললেন–আরে তুমি? দেখা দিকিনি, তোমাকে নিয়ে খুব খোঁজা-খুঁজি পড়ে গেছে এদিকে। মা বলছিল–তুমি নাকি বেরিয়ে চলে গিয়েছ! আমি বললাম–সে কী? তাই কখনও যেতে পারে বেরিয়ে! নিশ্চয়ই কোথাও লুকিয়ে আছে। ভালো করে চারারে খুঁজে দেখ তোমরা।

সতী তখনও কথা বলছে না।

সনাতনবাবু বললেন–আমি তখুনি জানি তুমি যেতে পারো না কোথাও। কোথায় যাবে তুমি? কী বলো? আমি মাকে বললুম কৈলাসটা চোখের মাথা খেয়ে বসে আছে নিশ্চয়ই! তা কোথায় ছিলে সত্যি বলো তো?

সতী বললে–সত্যি, সত্যি তুমি আমায় খুঁজেছিলে?

–আরে কী যে বলো তুমি! একটা কুকুর-বেড়াল বাড়ি থেকে চলে গেলেও লোকে ভেবে অস্থির হয়, আর তুমি একটা জলজ্যান্ত মানুষ, কেউ খুঁজবে না?

সতী যেন আদরে বিগলিত হয়ে গেল। বললে–সত্যি, বলো না, আমাকে খুঁজেছিলে তুমি?

সনাতনবাবু বললেন–আরে আমি কেন খুঁজতে যাবো, কৈলাস খুঁজছিল–আমি তো একটু ব্যস্ত ছিলুম কিনা!

সতী বললে–তুমি খোঁজনি?

সনাতনবাবু বললেন–দাঁড়াও, কৈলাসকে ডাকি আগে, ও জানে! ওকে বললাম নিশ্চয়ই আছে কোথাও, খুঁজে দ্যাখ ভালো করে। তা এসে মাকে বললে, কোথাও নেই বৌদিমণি। দাঁড়াও কৈলাসকে ডাকি আমি–

বলে সনাতনবাবু দাঁড়িয়ে উঠতে যাচ্ছিলেন।

সতী বললে–থাক–

–থাকবে কেন, আমি এক্ষুনি ডাকছি কৈলাসকে, ওকে তুমি নিজেই জিজ্ঞেস করো, খুঁজতে বলেছি কিনা–

সতী আবার বললে–না, থাক, জিজ্ঞেস করতে হবে না—

সনাতনবাবু আবার চেয়ারে বসলেন বটে। কিন্তু বললেন–মা’কে বলতে হবে–

–কী বলতে হবে?

সনাতনবাবু বললেন–মাকে বলতে হবে কৈলাস কোনও কাজ করে না!

সতী বললেন, তার বলার দরকার নেই। আমি সত্যিই চলে গিয়েছিলাম, যখন তোমরা সবাই ঘুমোচ্ছিলে, তখন সেই রাত তিনটের সময় আমি তোমাদের বাড়ি ছেড়ে চলে গিয়েছিলুম-তোমরা কেউ টের পাওনি!

সনাতনবাবু শুধু বললেন—ও–

সতী আবার বলতে লাগলো-যে ছেলেটাকে আমি নেমন্তন্ন করেছিলাম বাড়িতে, তাদের বাড়িতেই চলে গিয়েছিলুম, ভেবেছিলুম আর কখনও আসবো না, ভেবেছিলুম আর কখনও তোমাদের মুখ দেখবো না!

সনাতনবাবু বললেন–ও, সেই জন্য কৈলাস তোমাকে খুঁজে পায়নি–

সতী তেমনি করেই বলতে লাগলো-ভেবেছিলাম তোমাদের কাছে তোমাদের বাড়িতে বউ হয়ে থাকার চেয়ে রাস্তায় থাকা হাজার গুণ ভালো। ভেবেছিলাম আমি নিজের মুখে কালি মেখে তোমাদের মুখও কালো করে দেব, ভেবেছিলাম আমাকে তোমরা যে-শাস্তি দিয়েছ, সেই শাস্তির শোধ তুলবো তোমাদের বংশের নাম ডুবিয়ে, ভেবেছিলাম আমি নিজে মরে তোমাদেরও মেরে যাবো

তারপর সনাতনবাবুর দিকে চেয়ে হঠাৎ বললে–কী, চুপ করে আছো কেন? কথা বলছো না যে?

সনাতনবাবু যেন হঠাৎ সচেতন হয়ে উঠলেন। বললেন–কী বলছিলে, আর একবার বলো, আমি একটু অন্যমনস্ক হয়ে গিয়েছিলুম

সতীর হঠাৎ যেন বড় ঘৃণা হলো সনাতনবাবুকে দেখে। হঠাৎ যেন বড় রাগ হলো সনাতনবাবুর ওপর। এ মানুষটা কী? এ মানুষটা কি পাথর? এ মানুষটা কি জানোয়ার?

–আচ্ছা, এই যে আমি চলে গিয়েছিলুম, তার জন্যে তোমরা একটুও ভাবোনি?

সনাতনবাবু সে-কথার উত্তর না দিয়ে উঠছিলেন।

সতী হঠাৎ তার হাতখানা ধরে ফেললে। বললে–কোথায় যাচ্ছো?

সনাতনবাবু বললেন–মাকে বলি গে যাই–

–কী বলবে?

সনাতনবাবু বললেন–সকালবেলা মা কৈলাসকে খুব বকেছে কিনা, তাই মা’কে বলিগে যাই যে, কৈলাসের দোষ নেই, সতী বাড়ি থেকে চলেই গিয়েছিল।

সতী বললে–থাক, বলতে হবে না–তুমি বোস, তোমার সঙ্গেই কথা বলতে এসেছি—

সনাতনবাবু বললেন–তা বসছি, কিন্তু তুমি মার সঙ্গে দেখা করেছ?

সতী বললেন, তাঁর সঙ্গে দেখা করবার দরকার নেই, তোমার সঙ্গে আমার বিয়ে হয়েছে, তুমিই আমার স্বামী, তোমার সঙ্গে দেখা করাটাই আগে দরকার–

সনাতনবাবু বললেন–কিন্তু আমার মাথার ওপরে তো মা রয়েছে, মাই তো আমার গুরুজন–

সতী আর থাকতে পারলো না। বললে–তা আমার চেয়ে তোমার মা-ই বড় হলো? আমি কেউ না?

সনাতনবাবু বললেন না, তা কেন হতে যাবে?

–তবে? তবে কেন তুমি মার কথা বলছো বার বার? আমার বাবা কি তোমাকে দেখে বিয়ে দিয়েছে, না তোমার মাকে দেখে? বলো তুমি, তোমাকে বলতেই হবে!

সনাতনবাবু বললেন–তা তো আমি জানি না, দাঁড়াও আমি মাকে জিজ্ঞেস করে আসি—

সতী আর থাকতে পারলে না। বললে–এ-ও তোমার মাকে জিজ্ঞেস করতে হবে?

সনাতনবাবু বললেন–মাকে জিজ্ঞেস না করলে কাকে জিজ্ঞেস করতে যাবো? কে আর জানে?

–তা তুমি নিজে বলতে পারো না?

সনাতনবাবু বললেন–আমার কি এত সব ভাবনার সময় আছে? এই দেখ না, কদিন থেকে এই বইটা কিনেছি, এখনও শেষ করতে পারিনি! আর কবে যে শেষ হবে তাও বলতে পারছি না! সকাল থেকে পড়তে গিয়ে কেবল একটার পর একটা বাধা আসছে

সতী কী বলবে ভেবে পেলে না। একটু থেমে বললে–আমিই তোমার পড়ার ব্যাঘাত করলুম,আমি যাই তাহলে

সনাতনবাবু বললেন–কোথায়?

–যেখানে চলে গিয়েছিলুম, সেখানেই ফিরে যাই।

সনাতনবাবু বললেন–ফিরে আর কেন যাবে, তার চেয়ে বরং চা-টা খেয়ে ঘরে একটু বিশ্রাম করো গে, মা’র সঙ্গে একটু দেখা করো গে, কৈলাসটা তোমার জন্যে খুব বকুনি খেয়েছে!

সতী বললে–এবার আর কাউকেই বকুনি খেতে হবে না আমার জন্যে, আমি একেবারে চলে যাচ্ছি। আর ফিরবো না তোমাদের বাড়িতে। সেবারে না-বলে গিয়েছিলুম, এবার বলেই চলে যাচ্ছি–

সনাতনবাবু বললেন–কিন্তু আমাকে বলে গেলে তো হবে না, মা’কেও বলে যাও—

সতী চলতে গিয়ে ফিরে দাঁড়াল। বললে–কী বললে?

–বললাম আমার মাকে বলে যাও। আর ক’টার সময় ফিরে আসবে সেটাও বলে যেও, নইলে মা আবার ভাববে কিনা!

কথাটা শুনে যেন স্তম্ভিত হয়ে গেল সতী! খানিকক্ষণ চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল সনাতনবাবুর দিকে চেয়ে। তারপর হঠাৎ দৌড়ে সনাতনবাবুর হাত থেকে মোটা বইটা কেড়ে নিয়ে টেনে পাতাগুলো টুকরো টুকরো করে ছিঁড়ে ফেলতে লাগলো। সতীর মনে হলো সে যেন সনাতনবাবুকেই হাতের নখ দিয়ে ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করে ফেলছে।

সনাতনবাবু কিছু বললেন না। তেমনি চুপ করে নিরাসক্ত দৃষ্টিতে সতীর কাণ্ড দেখতে লাগলেন।

খানিক পরে সতী যেন নিজের কাণ্ড দেখে নিজেই হতবাক হয়ে গেছে। সনাতনবাবুর মুখের দিকে চেয়ে দেখলে। সে-মুখে কোথাও বিস্ময় নেই, অভিযোগ নেই, রাগ নেই, অনুরাগও নেই। সতী নিজের অসহায়তায় নিজেই হঠাৎ মুষড়ে পড়লো। তারপর এক সময়ে হঠাৎ সনাতনবাবুর বুকের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে বলতে লাগলো ওগো আমার ঘাট হয়েছে, আমার দোষ হয়েছে, আমাকে তুমি ক্ষমা করো। তোমার পায়ে পড়ছি আমাকে তুমি ক্ষমা করো। আমি ঝোঁকের মাথায় তোমার বইটা ছিঁড়েছি, আমার দোষ হয়েছে। ক্ষমা করতে না পারো তো আমাকে তুমি বকো, আমাকে একবার বকো শুধু তুমি। ক্ষমা করতে হবে না আমাকে, আদর করতেও হবে না, আমাকে শুধু একবার বকো। তোমাদের বাড়ি ছেড়ে চলে যাওয়ার জন্যে বকো, তোমার বই ছিঁড়ে ফেলার জন্যে বকো, তোমাকে ঘরে শুতে না দেবার জন্যে বকো! যা হোক কিছু করো!

বলতে বলতে সতী সনাতনবাবুকে জড়িয়ে ধরে আকুলি-বিকুলি হয়ে ভেঙে পড়তে লাগলো।

আর সেই সময় হঠাৎ পেছন থেকে আওয়াজ হলো:

–সোনা!

–সেনবাবু!

দীপঙ্করের মনে হলো সে যেন ভুল শুনেছে। ‘সোনা’ শুনতে যেন ‘সেনবাবু’ শুনেছে। চমকে উঠে চারিদিকে চাইতেই খেয়াল হলো। এ কোথায় চলেছে সে? এ তো বউবাজার!

গাঙ্গুলীবাবু বললে–এদিকে কোথায় চলেছেন?

দীপঙ্কর এতক্ষণে একমনে বাড়ি যেতে গিয়ে ভাবতে ভাবতে ভুল করে কোন দিকে চলে এসেছে! বললে–এই এমনি একটু বেড়াচ্ছি–আপনি কোন্ দিকে?

গাঙ্গুলীবাবু বললে–বা রে, আমার তো বাড়িই এইদিকে, আমি এখানে কাছেই নামবো–

তারপর আবার বললে–। আজকে রবিন্সন্ সাহেব যে-সব কথাগুলো বললে মীটিং-এ, শুনে আমার খুব ভালো লাগলো–

–কী বললে রবিনসন সাহেব?

গাঙ্গুলীবাবু বললে–কেন, আপনি শোনেন নি? আপনিও তো ছিলেন মীটিং-এ!

দীপঙ্কর বললে–আমার আজকে মনটা ভাল নেই খুব,আমার ইচ্ছে ছিল না মীটিং-এ যাবার, তাছাড়া, আজকে আপিসেই আসতুম না, নেহাৎ বুড়োমানুষ চলে যাচ্ছে তাই আসা

–কেন, শরীর খারাপ নাকি?

দীপঙ্কর বললে–শরীর খারাপ নয়। মা তো নেই, ফাঁকা-ফাঁকা বাড়ি। জীবনে এই প্রথম ফাঁকা বাড়িতে মা’কে ছেড়ে একলা থাকা; তাই কেমন ভাল লাগছে না। বাড়িতে গিয়েও তো সেই ফাঁকা বাড়ি দেখবো, ভাবলেই যেন কেমন লাগছে–

–আপনার বাড়িতে আর কেউ নেই?

দীপঙ্কর বললে–আর কে থাকবে? একজন ছিল, সে-ও আজকে দুপুরবেলা চলে গেছে।

–কে? কোথায় গেছে?

–সে আপনি চিনবেন না। আমাদেরই পাশের বাড়িতে থাকতো ছোটবেলায়। অনেকদিন তার বিয়ে হয়ে গেছে। হঠাৎ আজ সকালে এসেছিল, তারপর আবার চলে গেছে তার শ্বশুরবাড়িতে! আমার মাকে মাসীমা বলে ডাকতো তারা, এখন মা নেই বাড়িতে, সুতরাং আমাদের বাড়িতে থাকা হলো না–

গাঙ্গুলীবাবু জিজ্ঞেস করলে-কাল বোধ হয় বেনারস থেকে চিঠি পাবেন–

দীপঙ্কর বললে–মনে তো হচ্ছে, আজকে সকালে যদি চিঠি ফেলে থাকে তো কাল চিঠি আসবেই–

গাঙ্গুলীবাবু হঠাৎ বললেন–আপনার যদি বিশেষ দরকার না থাকে তো একবার আমাদের বাড়িতে আসুন না, একদিনও তো আসেন নি-একটু চা খেয়ে যাবেন।

দীপঙ্করও ভেবে দেখলে। চা খাবার জন্যে নয়। চা সেই জীবনে একবারই খেয়েছিল দীপঙ্কর। সেই ঈশ্বর গাঙ্গুলী লেনে লক্ষ্মীদির কাছে। কিরণ বলত–চা মানে কুলীদের রক্ত। কিন্তু বাড়িতে এখন গিয়েই বা কী করবে! সেই ফাঁকা বাড়ি। সতীকে একরকম জোর করেই তাড়িয়ে দেওয়া হলো। হয়তো সত্যিই শ্বশুরবাড়িতে গিয়ে আবার কান্নাকাটি করছে। আবার হয়ত সেই দরজা বন্ধ করে উপোস করা আরম্ভ করবে। আবার হয়ত রাগ করে কথাই বলছে না সনাতনবাবুর সঙ্গে। আবার হয়ত শাশুড়ীর সঙ্গে ঝগড়া করছে গলা উঁচু করে। কী ছেলেমানুষ সতীটা! সংসারের কিছু বুঝলো না। সংসারে কি অত একগুয়ে হলে চলে! লক্ষ্মীদি তবু অনেকটা বুঝেছে। তবু সামলে নিয়েছে। মা থাকলে হয়ত সতীকে বোঝাতে পারতো। মার কথা হয়ত শুনতো সতী!

গাঙ্গুলীবাবু বললে–এইখানে নামতে হবে, আসুন–

ছোট গলি। অন্ধকার। কিন্তু দু’পাশের ছোট-ছোট দোকানের আলোয় রাস্তায় যা হোক আলো পড়েছে একটু।

গাঙ্গুলীবাবুর বাড়িটা একতলায়। এতদিন চাকরি করছে দীপঙ্কর। কতদিন লালদীঘিতে ঘাসের ওপর বসে গল্প করেছে দু’জনে। গাঙ্গুলীবাবুর স্ত্রীর কথা কত শুনেছে। কেমন করে পাগল হয়ে গেল স্ত্রী, কেমন করে মধ্যমনারায়ণ তেল মেখে ভাল হয়েছে, সব বলেছে। যেদিন স্ত্রী ভাল হয়ে গিয়েছিল, সেদিন কালীঘাটে গিয়ে পুজো দিয়ে এসেছিল। প্রসাদ দিয়েছিল দীপঙ্করকে।

গাঙ্গুলীবাবু বললে–আমার স্ত্রী যদি আপনাকে আমার মাইনের কথা জিজ্ঞেস করে তো আপনি যেন আবার আসল মাইনেটা বলে দেবেন না সেনবাবু–

–মিথ্যে কথা বলবো?

–হ্যাঁ, কবিরাজ বলেছে যে! আমি তো বলেছি একশো দশ টাকা। আপনি যেন আবার টপ করে বলে দেবেন না পঁচাশি টাকা পাই–দেখবেন

ছোট একখানা বাইরের ঘর। কিন্তু কী চমৎকার সাজিয়েছে। কোথাও কোনও নোংরা নেই। সব গাঙ্গুলীবাবুর স্ত্রীর সাজানো। দেওয়ালে কার্পেটের ছবি ফ্রেমে বাঁধানো। ছবিটা নানারকম রঙিন উল দিয়ে তৈরি নাড়গোপাল। মাথায় লেখা ‘গড ইজ গুড়। চারদিকে দেওয়ালের ড্যাম্পলাগা অন্ধকার। টিটিমে একটা বাল ঝুলছে মাথার ওপর। দুটো তিনটে চেয়ার। একটা টেবিল। টেবিলের ওপর এমব্রয়ডারি করা ঢানি। হলদে পদ্মের চারপাশে লাল পাতা। তা হোক, তবু মনে হলো যেন গৃহিণীর পরিপাটি হাতের ছাপ সর্বত্র। গাঙ্গুলীবাবু দীপঙ্করকে বসিয়েই ভেতরে স্ত্রীকে খবর দিতে চলে গেল। একটু পরেই আবার ফিরে এল। বললে–ময়লা শাড়িটা বলে আসছে–

তারপর চুপি চুপি বললে–কী জিজ্ঞেস করছিল জানেন?

–কী?

গাঙ্গুলীবাবু বললে–আপনি যে আমাদের অফিসার তা বলি নি। শুধু বলেছি আমাদের আপিসের ক্লার্ক। জিজ্ঞেস করছিল–কত মাইনে পান আপনি। আমি বলেছি পঁচাশি–আপনি যেন আবার কিছু মনে করবেন না। যদি শুনতো আপনি চারশো টাকা মাইনে পান তো দেখা করতেই আসতো না–

সত্যি সত্যিই এক সময়ে গাঙ্গুলীবাবুর স্ত্রী ঘরে ঢুকলো। দীপঙ্করের দেখেই মনে হলো যেন এখুনি গয়না শাড়ি পরে সেজেগুজে এসে ঢুকলো। শাড়িটা যেন পাটভাঙা। গয়নাগুলোও যেন আলমারি থেকে বার করে পরেছে। এত গয়না কিনে দিয়েছে গাঙ্গুলী বাবু! আশ্চর্য, এত গয়নাও আছে গাঙ্গুলীবাবুর স্ত্রীর! কী ভারি-ভারি গয়না সব!

দীপঙ্কর উঠে দাঁড়িয়ে নমস্কার করলে। বললে–আপনাদের বিরক্ত করতে এলাম বৌদি–

গাঙ্গুলীবাবুর স্ত্রী বললে–ভালোই করেছেন, আর দুদিন পরে এলে আমাদের দেখাই পেতেন না, ফিরে যেতে হতো–

দীপঙ্কর জিজ্ঞেস করলে–কেন? কোথাও যাবার কথা আছে নাকি?

গাঙ্গুলীবাবুর স্ত্রী বললে–আমরা তো কাশ্মীর যাচ্ছি–আপনি শোনেন নি?

কাশ্মীর! দীপঙ্কর গাঙ্গুলীবাবুর দিকে চাইলে। গাঙ্গুলীবাবু হাসতে লাগলে। কিছু কথা বলতে পারলে না।

বৌদি বললে–কাশ্মীর খুব ভালো জায়গা জানেন? বড় বড় লোকেরা সবাই কাশ্মীর যায়। আমার দিদি আমার জামাইবাবু গিয়েছিল। আমার জামাইবাবু নশো টাকা মাইনে পায়! নশো টাকা কি কম, বলুন তো?

বলে একটু থামলো। থেমে দীপঙ্করের দিকে চেয়ে দেখলে। বললে–ন’শো টাকা মাইনে ছাড়া আবার গাড়িও আছে নিজের, মোটরগাড়ি, আপিস থেকে দিয়েছে। খুব আরাম আমার দিদিদের। জানেন, আমার দিদি পুজোর সময় সাড়ে তিনশো টাকা দিয়ে একটা বেনারসী শাড়ি কিনেছে। আসল কড়িয়াল বেনারসী। আমি হাত দিয়ে দেখেছি, আজকালকার টিসু বেনারসী নয়, একেবারে খাঁটি সোনার ফুল আঁটা-আমার এই যে শাড়িটা দেখছেন–

দীপঙ্কর শাড়িটার দিকে দেখলে ভালো করে।

বৌদি বলতে লাগলো-এটা কী শাড়ি বলুন তো?

দীপঙ্কর জীবনে কখনও শাড়ি নিয়ে মাথা ঘামায় নি। শাড়ির নাম-ধামও জানে না।

বৌদি বললে–বলতে পারলেন না তো? কেউ বলতে পারে না। যারা কাশ্মীর যায়, তারাই কেবল বলতে পারে। দিদি বললে–এটা দেড়শো টাকা দিয়ে কিনেছে। আমাদের সব বোনকে একটা করে এই শাড়ি কিনে দিয়েছে দিদি। তা ন’শো টাকা মাইনে পায় জামাইবাবু, কিনে দেবে না? কী বলেন, হ্যাঁ!

একটা কিছু কথা বলতে হয়। তাই দীপঙ্কর বললে–তা তো বটেই।

বৌদি বললে–আপনি এই শাড়িটা দেখেই অবাক হয়ে যাচ্ছেন, আর আমার বাবা আমাকে বিয়ের সময় যে-বেনারসীটা দিয়েছে সেটা দেখলে আপনি আরো অবাক হয়ে যাবেন। আনবো সেটা? আপনি দেখবেন?

বলে সত্যিই গাঙ্গুলীবাবুর স্ত্রী উঠে ভেতরের দিকে যাচ্ছিল।

দীপঙ্কর বললে–না, না আপনি আর কষ্ট করবেন না মিছিমিছি, অন্য একদিন বরং দেখবো

বৌদি নিরস্ত হলো। বসে পড়লো আবার। বললে–তা আপনি এবার পুজোয় কী শাড়ি কিনলেন স্ত্রীর জন্যে?

গাঙ্গুলীবাবু বললেন, শাড়ি কিনবেন কি, উনি এখনও বিয়েই করেন নি।

–বিয়ে করেন নি?

গাঙ্গুলীবাবুর স্ত্রী একটু অবাক হয়ে গেল। বললে–মাইনে কম বলে বুঝি বিয়ে করেন নি! আচ্ছা আপনাদের আপিসে মাইনে এত কম কেন সকলের? আমার জামাইবাবুর আপিসে তো সবাই বেশি মাইনে পায়!

তারপর হঠাৎ থেমে একটু হাসলো। গাঙ্গুলীবাবুর স্ত্রীকে সত্যিই ভাল দেখতে। কী চমৎকার স্বাস্থ্য! এত হাসি-খুশি! দীপঙ্করের মনে হলো যেন এদের সঙ্গে বহুদিনের পুরোন পরিচয় তার। কোনও সঙ্কোচ নেই জড়তা নেই। প্রাণখোলা কথা বলছে একজন অচেনা লোকের সঙ্গে।

বৌদি হঠাৎ বললে–জানেন, আমার বাবার ইচ্ছে ছিল না এর সঙ্গে আমার বিয়ে দেন–কিন্তু…….

গাঙ্গুলীবাবু বাধা দিলে। বললে–থাক না এখন ও-সব কথা, সেনবাবু আজ প্রথম এলেন, আর আজকেই তুমি ওই সব কথা পাড়লে?

বৌদি বললে–কেন, তোমার গুণের কথা বলছি বলে লজ্জা হচ্ছে বুঝি? বেশ করবো বলবো, হাজারবার বলবো-দেখি তুমি কী করতে পারো আমার! আপনি শুনুন তো ঠাকুরপো, ওর গুণের কথা সব বলছি আপনাকে

তারপর দীপঙ্করের দিকে চেয়ে বললে–আপনি বর্ধমানের সরকারদের নাম শুনেছেন তো?

বর্ধমানের সরকারদের নাম দীপঙ্কর শোনে নি। কী বলবে উত্তরে বুঝতে পারলে না।

গাঙ্গুলীবাবু বললে–আমি তো বলেছি সেনবাবু আপনাকে সরকারদের কথা—

দীপঙ্কর বললে—হ্যাঁ শুনেছি–

বৌদি বললে–কলকাতার বড়লোকেরা সব্বাই বর্ধমানের সরকারদের নাম জানে। বাবার কাছে শুনেছি সেকালে আমাদের তিনটে হাতী বাড়িতে–তা কপাল দেখুন, আমি যখন ঠিক বড় হলুম তখনই আমাদের অবস্থা খারাপ হয়ে গেল। তা বাবা বললে–রেলের চাকরি, বাড়ি-ঘর-দোর নেই, এ-ছেলের সঙ্গে বিয়ে দেব না! তা মা বললে–রেলের চাকরি খারাপ কী? বাবা বললে–রেলেতে ভদ্দরলোক চাকরি করে না। ইনি তখন মাইনে পাচ্ছেন তেত্রিশ টাকা। মা বললে–তা মাইনে কি আর চিরকালই তেত্রিশ টাকা থাকবে? তা বিয়ে তো শেষ পর্যন্ত হলো,–বিয়ে হবার পর প্রথম যখন শ্বশুরবাড়িতে এলুম, দেখি–

এ-সব কথা শুনতে দীপঙ্করের ভালো লাগছিল না। একেবারে গাঙ্গুলীবাবুর ব্যক্তিগত পারিবারিক ব্যাপার সব।

গাঙ্গুলীবাবু বললে–তুমি কি সমস্তক্ষণ কেবল ওই সব কথাই বলবে নাকি সেনবাবুকে?

বৌদি হঠাৎ উত্তেজিত হয়ে উঠলো। বললে–কেন বলবো না শুনি? কেন বলবো? তোমার সঙ্গে বাবা আমার বিয়ে দিতে চায় নি। আমার জামাইবাবুরা দিদিদের কত গয়না কত শাড়ি কিনে দেয়, তুমি দিতে পারো? আমার জামাইবাবুরা দিদিদের প্রত্যেক ছুটিতে কত জায়গায় বেড়াতে নিয়ে যায়, তুমি নিয়ে যেতে পারো? তোমার পয়সা আছে? তুমি তো একশো দশ টাকা মাত্র মাইনে পাও, তোমার লজ্জা করে না?

তারপর হঠাৎ দীপঙ্করকে দেখিয়ে বললে–এই তো দেখ না ঠাকুরপোকে, কম মাইনে পায় বলে এখনও বিয়ে করে নি। যার মাইনে কম তার বিয়ে করার এত শখ কেন শুনি?

গাঙ্গুলীবাবুর আশ্চর্য ধৈর্য! এত কথার পরও গাঙ্গুলীবাবু একটা কথাও বললে না। চুপ করে হাসিমুখে সব সহ্য করতে লাগলো। বোবার শত্রু নেই।

বৌদি বললে–দেখছেন ঠাকুরপো, কেমন বোকার মত হাসছে আবার, লজ্জাও করে না! বউকে যে খেতে-পরতে দিতে পারে না, বৌকে যে শাড়ি-গয়না দিতে পারে না, বৌকে যে বেড়াতে নিয়ে যেতে পারে না, তার গলায় দড়ি, তার গলায় দড়ি, তার গলায় দড়ি–

গাঙ্গুলীবাবুর মুখের চেহারাটা দেখে হঠাৎ দীপঙ্করের ভয় লেগে গেল। সেই হাসিমুখ আর নেই, সেই অমায়িক চেহারা আর নেই। চোখ দুটো বড় বড় হয়ে উঠেছে রাগে। ফরসা কান দুটো লাল হয়ে উঠেছে।

দীপঙ্কর বললে–এবার আমি উঠি বৌদি, আমার রাত হয়ে যাচ্ছে, অনেক দূর যেতে হবে আবার–

গাঙ্গুলীবাবুও আর থাকবার জন্যে পীড়াপীড়ি করলে না।

গাঙ্গুলীবাবুর স্ত্রী জিজ্ঞেস করলে-আবার কবে আসবেন?

দীপঙ্কর বললে–আর একদিন সময় পেলে আসবোখন–

বৌদি বললে–ভাল কথা, আপনি পাঁচুলালের নাম শুনেছেন?

পাঁচলাল! নামটা শুনে দীপঙ্করও দাঁড়িয়ে গেল। গাঙ্গুলীবাবুও দাঁড়িয়ে গেল।

–পাঁচুলালের নামই শোনেন নি? কলকাতার সব বড়লোক পাঁচুলালের নাম জানে। বেনারসে গেলে পাঁচুলালের হাতের শাড়ি দেখে আসে সব্বাই, আমার দিদিদের সব শাড়ি পাঁচুলালের তৈরি! সবাই তো পাঁচুলালের শাড়ি কিনতে পারে না! সকলের অত টাকা কোথায় বলুন?

গাঙ্গুলীবাবু বললে–চলুন সেনবাবু, আপনার রাত হয়ে গেল–

গাঙ্গুলীবাবু স্ত্রী বললে–তা হলে এবার যেদিন আসবেন সেদিন আপনাকে সেইটে দেখাবো মনে থাকে যেন–

দীপঙ্কর বুঝতে পারলে না। বললে–কোনটা?

বৌদি বললে–এরই মধ্যে বুলে গেলেন?

দীপঙ্কর লজ্জায় পড়লো। বললে–কোটা বলুন তো, ঠিক মনে পড়ছে না–

–এই দেখুন, এরই মধ্যে ভুলে বসে আছেন আপনি! সেই বেনারসীটা। যেটা বাবা আমার বিয়ের সময় দিয়েছিল–পাঁচুলালের নিজের হাতে তৈরি। বাবা নিজে পাঁচুলালকে অর্ডার দিয়ে তৈরি করিয়ে এনেছিল কিনা। আপনি তো আমার এই শাড়িটা দেখে অবাক হয়ে যাচ্ছেন, সেটা দেখলে আর চোখ ফেরাতে পারবেন না–

রাস্তায় তখন আরো অন্ধকার হয়ে এসেছে। দোকানে-দোকানে আরো ভিড় বেড়েছে। দীপঙ্করের কানে তখনও গাঙ্গুলীবাবুর স্ত্রীর কথাগুলো বাজছিল।

পাশে গাঙ্গুলীবাবু আসছিল। বললে–দেখলেন তো সেনবাবু, আপনি নিজের কানেই তো শুনলেন, এখন তো অনেকটা সুস্থ, আগে মুখে যা ইচ্ছে-তাই বলে গালাগালি দিত–

দীপঙ্কর কিছু কথা বললে না।

গাঙ্গুলীবাবু বলতে লাগলোতবে এখন একটু রেগে গেলেই কেবল বলে যে বৌকে খেতে-পরতে দিতে পারে না, যে বৌকে শাড়ি-গয়না দিতে পারে না, যে বৌকে বেড়াতে নিয়ে যেতে পারে না তার গলায় দড়ি, তার গলায় দড়ি, তার গলায় দড়ি-ওই রকম করে পা ঠুকে ঠুকে তিন বার করে বললে

দীপঙ্কর সান্ত্বনা দিলে। বললে–ও-সব কথায় আপনি কান দেবেন না–

গাঙ্গুলীবাবু বললে–কত আর সহ্য করা যায় বলুন, তাই এক-এক সময় মনে হয় দিই গলায় দড়ি, গলায় দড়ি দিলে ওর কী-দশাটা হয় একবার বুঝিয়ে দিই

দীপঙ্কর বললে–খবরদার খবরদার, অমন কাজ করবেন না। আপনি বরং কাশ্মীরে নিয়ে যান স্ত্রীকে, দেখুন হয়ত ভাল হয়েও যেতে পারে–

গাঙ্গুলীবাবু বললে–কিন্তু কী করে যাই বলুন, টাকা কোথায় পাবো? একে তো মাইনে পাই পঁচাশি টাকা, ওর কাছে বলেছি একশো দশ, প্রত্যেক মাসে তো ওকে দেখাবার জন্যে এই পঁচিশ টাকা ধার করতে হয় আমাকে–

–তা শোধ করেন কী করে?

গাঙ্গুলীবাবু বললে–শোধ তো করি না! এখন চারদিকে তাই ধার হয়ে গেছে। এখন কাবলীওয়ালারাও আসে সুদ চাইতে। আসল দূরের কথা, সুদও দিতে পারি না কাউকে। দেব কোত্থেকে? ওই পালিয়ে পালিয়ে বেড়াই, আর দু’চার টাকা করে মিটিয়ে দিই

দীপঙ্কর অনেকক্ষণ ভাবলে। বললে–তা হোক, তবু আপনি কাশ্মীরে নিয়ে যান স্ত্রীকে।

গাঙ্গুলীবাবু বললে–বলছেন কি আপনি? কাশ্মীরে যাবো আমি? ওর ভগ্নীপতিরা বড়লোক, তারা ন’শো হাজার মাইনে পায়, তারা যাক কিন্তু আমি যাবো কী করতে?

দীপঙ্কর বললে–তাহলে যে আপনার স্ত্রী বললেন কাশ্মীরে যাচ্ছেন আপনারা?

–সে ওই স্তোক দিয়েছি, আর কি? স্তোক না দিয়ে যে আবার পাগল হয়ে যাবে সেনবাবু!

–কিন্তু স্তোক দিয়ে দিয়ে আর কতদিন এমনি করে ঠেকিয়ে রাখবেন? গাঙ্গুলীবাবু বললে–যদ্দিন পারি। আর তারপর যা-হয় হবে। আমি আর ভাবতে পারি না সেনবাবু। নইলে আমি তো লেখাপড়া শিখেছিলুম, এম-এ পাসও করেছিলুম কিন্তু কে জানতো জার্নাল সেকশানে একবার ঢুকলে আর সেখান থেকে বেরোন যাবে না

দীপঙ্কর বললে–সে আমি যা-হয় করবো, কিন্তু স্ত্রীকে আপনি কাশ্মীরে নিয়ে যান–

–কিন্তু খরচ কে দেবে? দু’এক টাকার ব্যাপার তো নয়, অন্তত আট, নশো টাকা কম করেও।

দীপঙ্কর বললে–তার জন্যে আপনি ভাববেন না, সে আমি দেব–কিন্তু অত টাকা আমি শোধ করবো কি করে?

–সে আপনি যখন হোক শোধ করবেন। আর শোধ না-করতে পারেন, করবেন।

তারপর গাঙ্গুলীবাবুর দিকে ফিরে আবার বললে–ঘটনাচক্রে আমি আপনার চেয়ে বেশি মাইনে পাই, ঘটনাচক্রে আমি আপনার মাথায় গিয়ে বসেছি। কিন্তু আর কেউ না জানুক, আমি তো জানি যে তাতে আমার নিজের কোনও বাহাদুরি নেই। গভর্নমেন্টের আপিস, ওখানে আমার মধুঁকে বসিয়ে দিলেও কাজ চলে যায়, কিন্তু সে-কথা হচ্ছে না, আমার কিছু টাকা আছে এখন হাতে, আপনি যান কাশ্মীরে। ধরে নিন স্ত্রীর এটা রোগ, রোগ হলেও তো ডাক্তার-ওষুধের পেছনে খরচ করতে হতো–! দেখুন না, হয়ত এতেও রোগ সেরে যেতে পারে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *