৪. প্রসন্নকুমার

প্রসন্নকুমার

চৌকাটের সামনে সেকেলে একটি আয়না। আশেপাশে দাড়ি কামাবার সরঞ্জাম – ভাঁজ করা বিলিত ক্ষুর, সাবান, বুরুশ ইত্যাদি। একটি ছোটো বাটিতে কালো রঙের অল্প পরিমাণ তরল পদার্থ। সকালের স্বচ্ছ আলোয়, জল-চৌকিতে বসে বৃদ্ধ, অথচ সবল, গুরুগম্ভীর এক পুরুষ। হাতে মিনিয়েচার টুথ-ব্রাশের মতো দেখতে একটি তুলি। এটি কালো রঙে ডুবিয়ে অনেক দিনের তা-দেয়া গোঁফে এবং পাট- করা চুলে বুলিয়ে দিচ্ছেন। গায়ে সাদা ফতুয়া এবং পাড়-ছাড়া কুচকানো ধুতি। পায়ে খড়ম! চুল-গোঁফের প্রসাধন সেরে কুচোনো ম্যানচেস্টারি ‘নয়নসুখ ধুতি এবং গিলে-করা ফিনফিনে আদ্দির পাঞ্জাবী পরলেন। ঘরের কোণ থেকে, মাথায় কারুকার্য-করা মোটা লাঠিটি হাতে নিলেন। চালচলনে বিশেষ তাড়া নেই। চুপ ক’রে কী ভাবতে-ভাবতে লাঠিটাকে আবার দেয়ালে হেলান দিয়ে রাখলেন। দেখে মনে হ’ল যেন প্রসাধনের অনুবর্তিতায় কিছু একটা বাদ পড়েছে। পুরোনো, মস্ত বড়ো কাঠের আলমারি খুলে এক টুকরো তুলো, সুগন্ধি আতরে ভিজিয়ে, ডান দিকের কানে গুঁজে দিলেন। আরেকবার আয়নার দিকে তাকিয়ে লাঠি তুলে সন্তর্পণে দোতালায় সিঁড়ি দিয়ে নেমে গেলেন। উঠোনের বাঁ পাশে দোলায়মান পোষা কাকাতুয়াটি প্রত্যহ এইসময় মনিবকে দেখে মহাউল্লাসে তারস্বরে চিৎকার ক’রে ওঠে। তিনি নিজের হাতে তার মুখে দুটি ছোলা পুরে দিয়ে বলেন, ‘বল, হরে রাম হরে কৃষ্ণ’। তারপর উঠোন পেরিয়ে বৈঠক-খানায় তক্তপোশের ওপর তাকিয়া ঠেস দিয়ে বসলেন।

গোপাল!– এই হাঁকে সমস্ত বাড়িটা যেন থরথরিয়ে উঠল। পুরাতন, অতি অনুগত এবং বিশ্বস্ত বিহারী ভৃত্য গোপাল, অম্বুরী তামাক সেজে টিকেতে ফুঁ দিতে- দিতে গড়গড়া রেখে গেল। একটু বাদেই তিনি জুড়িঘোড়ার গাড়িতে চ’ড়ে রোগী দেখতে বেরুলেন। ইনি তৎকালীন পূর্ববঙ্গের অতি খ্যাতনামা বৈদ্যরাজ শ্রীকালীকুমার সেন মহাশয়ের প্রথম পুত্র শ্রীপ্রসন্নকুমার সেন। স্থান উনিশশো পঁচিশ- ছাব্বিশের ঢাকা শহর। পেশা কবিরাজি। পুরুষানুক্রমে অন্তত আড়াইশো বছর ধ’রে সেন-পরিবারে একই পেশা চ’লে এসেছে। এই বংশের প্রথম প্রতিষ্ঠাতা নাকি অনেককাল আগে কাশীধাম থেকে পূর্ববঙ্গে এসেছিলেন।

প্রসন্নকুমারের ঔরসে প্রথম স্ত্রীর গর্ভে পাঁচটি কন্যা এবং তিনটি পুত্র জন্মায়। এই স্ত্রী বিয়োগ হবার পর তিনি দ্বিতীয় স্ত্রী পরিগ্রহণ করেন। তাঁর গর্ভে জন্মায় আরো বারোটি সন্তান– সাতটি পুত্র এবং পাঁচটি কন্যা। মোট কুড়িটি। এমন পুরুষের আকৃ তি এবং প্রকৃতি, কিঞ্চিৎ মেদ থাকা সত্ত্বেও, নর-শার্দুলের মতো হবে এতে আর আশ্চর্য হবার কী আছে। শিরা-উপশিরায় নীলরক্ত না-বইলেও অনেকেই যে তাঁকে ছোটোখাটো জমিদার ব’লে ভুল করবে, এতই-বা দোষের কী। দৈর্ঘ্যে ছয় ফুট। পুরুষ্ট শরীর। বিরাট মুখমণ্ডল– লাল মুলোর মতো রাঙা। এককথায় ডাকসাইটে। এই বিরাট পরিবারে, আমার স্থান, ধারাবাহিকভাবে ছিল সপ্তদশ।

খানিকটা পিতামহের খ্যাতির দরুন খানিকটা নিজের ক্ষমতায়, প্রসন্নকুমারের পশার বেশ জ’মে উঠেছিল। আজ থেকে পঞ্চাশ বছর আগে ঢাকায়, তথা পূর্ব-বঙ্গে খাবার-দাবারের সচ্ছলতা এবং অন্যান্য জিনিসের দাম অবিকল শেরশাহ-র যুগের মতো না-হ’লেও, এত সস্তা ছিল যে আজকের পাঠকেরা শুনে হয়তো তাই মনে করবেন। যেমন দু-আড়াই সেরি ইলিশ মাছ চার আনায়। এক-কুড়ি ডিম দু-আনায়। শীতকালে এক টাকায় কুড়ি সের দুধ। ব্রহ্মদেশের সরু সেদ্ধ চাল তিন টাকায় এক মণ। এক ভরি সোনার দাম ষোল টাকা। ছ’খানা ঘরের বারান্দা-উঠোনওয়ালা বাড়ির ভাড়া কুড়ি টাকা হ’লেও বেশি মনে হ’ত। অন্তত আমাদের জিন্দাবাহার গলি, ইসলামপুর এলাকায়। তাই এত বড়ো পরিবারের লালন-পালন প্রসন্নকুমারের পক্ষে মোটেই কষ্টকর ছিল না।

প্রসন্নকুমারের সাধারণ শিক্ষা কতদূর ছিল জানা নেই। ইংরেজি বলতে তাঁকে কেউ কোনোদিন শোনেনি। কিন্তু সংস্কৃত ভাষায় আয়ুর্বেদশাস্ত্র ছিল তাঁর কণ্ঠস্থ। রোগী পরিক্ষার সময় অনবরত সুশ্রুত, চরক, বাগভট, চক্রপাণি দত্ত থেকে রোগ- সম্পর্কিত উপযুক্ত শ্লোক আওড়াতেন। আয়ুর্বেদ চিকিৎসাবিদ্যা ছিল তাঁর হাতের মুঠোয়। কঠিন রোগে পীড়িত অনেক লোককেই ডাক্তারী চিকিৎসায় বিফল হয়ে, তাঁর ওষুধে সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে উঠতে দেখেছি।

একদিন সকালবেলায় প্রসন্নকুমার যথারীতি বৈঠকখানায় এসে বসেছেন। এমনসময় একটি ঘোড়ার গাড়ি এসে দরজার সামনে এসে দাঁড়াল। লুঙ্গি পরা দুটি লোক একটি অসুস্থ ছেলেকে কোলে তুলে ভেতরে এল। প্রসন্নকুমার তাকিয়ায় ঠেস দিয়ে বসেছিলেন। একটু এগিয়ে, হাত ধ’রে, রোগীকে তক্তপোশে বসালেন। তার দিকে তাকিয়ে একটি সংস্কৃত শ্লোক আওড়ালেন। লোকটির গায়ে ময়লা গেঞ্জি। তারই ভেতর দিয়ে শরীরের প্রত্যেকটি হাড়, পুরোনো ছাতার শিকের মতো ফুটে বেরুচ্ছে। কঙ্কালসার শরীরের অনুপাতে তার মাথাটি এতই বড়ো যে, আমার চোখে পাটকাঠির ডগায় একটি পূর্ণবর্ধিত তালের মতো দেখাল। লোকটি অত্যন্ত দুর্বল। তাই ধুঁকছে। এমন-কি কোটরে ঢোকা চোখদুটি খুলে রাখতেও তার কষ্ট হচ্ছে। পেটের চেহারাটা অবিকল জলে-ভরা ভিস্তির থলিটির মতো। পা-দুটিও অতিকায় মানকচুর মতো ফোলা। দেখেই মনে হয় যে তার আয়ু সীমিত।

রোগীকে ওষুধ দেবার আগে, রোগের ইতিহাস জানা, নাড়ী, চোখ, জিহ্বা ইত্যাদি পরীক্ষা করা- প্রসন্নকুমার, এ-সবের কিছুই প্রয়োজন মনে করলেন না। সরাসরি তাঁর একজন কম্পাউণ্ডারকে ব্যবস্থাপত্র লিখে নিতে বললেন। ওষুধ-গুলোর মধ্যে একটি গালভরা নাম আমার এখনো কানে লেগে আছে। নামটি ছিল বিজয় পটপটি- মুক্তো, সোনা, রুপো, পারদ, বেক্রান্ত অর্থাৎ পোকরাজের মিশ্রণে তৈরি অন্য সব খাবার বন্ধ রেখে ক্রমশ দৈনিক আধ সের থেকে বাড়িয়ে পাঁচ সের পর্যন্ত দুধ খাবার পথ্য স্থির ক’রে দিলেন। রোগীকে এক মাস পরে আবার দেখা করতে বললেন। এবং তাকে এই ব’লে আশ্বাস দিলেন যে, রোগী এবার নিজেই হেঁটে আসতে সমর্থ হবে। প্রসন্নকুমারের এই প্রচণ্ড আত্মপ্রত্যয় দেখে আমি স্তম্ভিত।

সেদিন তিনি মধ্যাহ্নভোজনে বসেছেন। কাঁসার থালার মাঝখানে সরু গোবিন্দভোগ ভাতের একটি নিখুঁত গোলাকার স্তূপ। তার ওপর একটি ছোটো ঘিয়ের বাটি। হঠাৎ দেখলে একটি ক্ষুদ্র সাঁচীস্তূপ ব’লে মনে হ’তে পারে। এই স্তূপের চারিদিকে নানারকম খাবারের বাটি সাজানো। পাশেই মস্ত জলের গেলাস। সব-ক’টি বাসনেই খোদাই-করা ‘প্রসন্নকুমার’ নামটি পশ্চিমের প্রতিক্ষিপ্ত আলোতে জলজল ক’রে উঠেছে। আমি প্রসন্নকুমারের আশেপাশে ঘুরঘুর করছি। আমার মনে একটি প্রশ্ন কিছুক্ষণ থেকেই আনাগোনা করছে। সেটি তাঁকে না জিজ্ঞেস করা পর্যন্ত আমার মনে শান্তি নেই। তিনি আমার দিকে মুখ তুলতেই ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করলাম, ‘আচ্ছা বাবা, ঐ আধমরা লোকটি কি সত্যি-সত্যিই আবার সুস্থ হয়ে উঠবে? তিনি মুখে একটি গ্রাস পুরে দিয়ে শুধু একটি আওয়াজ করলেন, হুঁ-উ-উ। তাঁর এই অতি সংক্ষিপ্ত অথচ সন্দেহাতীত জবাবে বিস্ময়ে আমি সেখানেই জ’মে গেলাম।

এই ঘটনার কয়েক হপ্তার পর একদিন আমি দোতালার রাস্তার ধারের বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছি। নিচে রোগীদের তেমন ভিড় নেই। জ্যৈষ্ঠের প্রচণ্ড গরম। তাই প্রসন্নকুমার তাঁর সমবয়সীদের নিয়ে আজ রোয়াকে বসেছেন। সবাইর হাতে একটি ক’রে হাত-পাখা। সেগুলো থেকে-থেকে হাতির কানের মতো নড়াচড়া ক’রে উঠছে। গাড়ি ঘোড়া এবং লোকজনের চলাচল, ফিরি-ওয়ালার হাঁক-ডাকে আমাদের জিন্দাবাহার গলিটি বেশ রমরমা হয়ে উঠেছে। হুঁকোয় ফুড়ুত-ফুড়ুত টানের মাঝে, আড্ডাও তেমনি জমেছে। এমন সময় আমাদের গলির মুখে মাছরাঙা রঙের বোতামওয়ালা গেঞ্জি এবং সবুজ আর লাল দাবার ছক্কাটা লুঙ্গি-পরা তরতাজা একটি মুসলমান যুবককে এগিয়ে আসতে দেখা গেল। মাথায় এক ঝুড়ি সিঁদুর রঙের আম, আর একটি মস্ত পাকা কাঁঠাল। ডান হাতের তর্জনীতে উপবিষ্ট, কাঁচা সবুজ রঙের রেশমী বলের মতো মোলায়েম ফুটফুটে একটি টিয়ে শাবক। টিয়ে শাবকটি কাছ থেকে দেখবার লোভে আমি তৎক্ষণাৎ রোয়াকে এসে হাজির হলাম। লোকটি ঠিক আমাদের বাড়ির সামনে এসে থামল। ঝুড়িটি নামিয়ে ঢিপ ক’রে প্রসন্নকুমারের পায়ে মাথা ছোঁয়াল। তিনি চমকে পা সরাতে গেলেন। কিন্তু যুবকের হাত তার আগেই, শেকলের মতো পা-দুটি জড়িয়ে ফেলেছে। যুবকটি হাত-জোড় ক’রে বলল, ‘বাবু আপনি আমাকে চিনতে পারছেন না, এই বান্দার নাম সামসুদ্দিন।

আমি উদরী রোগে ভুগে ভুগে প্রায় মরতে বসেছিলাম। আপনার চিকিৎসায় সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে গেছি। অল্পবিস্তর ক্ষেতে কাজকর্মও করছি। বান্দার এই সামান্য উপহার গ্রহণ করলে খুশি হব।’ প্রসন্নকুমারের পক্ষিপ্রীতির কথা অনেকেরই জানা ছিল। তিনি টিয়ে শাবকটি আলতো ক’রে তুলে নিয়ে সেটিকে চুম্বনের স্বরে আদর করতে-করতে লোকটিকে উদ্দেশ্য করে বললেন, ‘এত সব কেন? এই ব’লে গোপালকে একটি খাঁচা আনতে বললেন। এ-ধরনের ঘটনা অভূতপূৰ্ব না-হ’লেও, প্রসন্নকুমারের চোখে-মুখে একটি অস্ফুট পরিতোষের ভাব ক্ষণকালের জন্যে দেখা দিয়ে আবার মিলিয়ে যায়। হুঁকোয় একটি হাল্কা টান দিয়ে বললেন, ‘সবই ঈশ্বরের ইচ্ছা।’

এখন বেলা প্রায় বারোটা। রোগী দেখার পালা শেষ ক’রে প্রসন্নকুমার লাল ডোরাকাটা গামছা পরে স্নানের আয়োজন করছেন। এই মুহূর্তটিতে তিনি পুজো- আহ্নিকের অভ্যেসমতো একটি জরুরী নিয়ম পালন করেন। শত বাধাবিপত্তি অসুবিধে থাকলেও, এ-নিয়ম পালনে কোনোদিন ত্রুটিবিচ্যূতি হ’তে দেখিনি। আলমারি থেকে ছোটো একটি গোল কৌটো বের ক’রে বারান্দায় রাখা জল-চৌকিতে বসলেন। সরষে পরিমাণের একটি বড়ি কৌটোটা থেকে বের ক’রে টক্ ক’রে মুখে পুরে দিয়ে এক গ্লাস জল খেলেন। গোপাল গড়গড়া সাজিয়ে পাশে রেখে গেল। খুব্ হাল্কা টান দিতে-দিতে পশ্চিমের আকাশের দিকে অপলক চোখে তিনি তাকিয়ে আছেন। দৃষ্টি সুমুখের সব বাড়ির ছাদ ডিঙিয়ে দূরে বিশাল বেল গাছটার মাথার ওপর দিয়ে অনন্ত নীলিমায় মিশে যায়। শান্ত সৌম্যকান্তি। ঠিক যেন প্রাচীন মিশরের পাথরে খোদিত ফ্যারাওর একটি মূর্তি। অত বড়ো পরিবারের চিন্তাভাবনা, নানরকম সমস্যা, প্রভুত্ব, ক্রোধ-সব ছুটি নিয়ে অনেক দূরে চ’লে যায়। সম্ভব হ’লে এই সময়টিকে তিনি বেঁধে রাখেন। একটু বাদেই গোপাল এসে মনে করিয়ে দেয় যে স্নানের জল ঠাণ্ডা হয়ে যাচ্ছে।

সেন-পরিবারের সরষে পরিমাণ আফিম খাওয়ার রেওয়াজ নাকি অনেক কালের। আমার ঠাকুরমাকেও খেতে দেখেছি। কী শক্ত বুড়ী। দীর্ঘ পঁচানব্বই বছর অব্দি বেঁচে ছিলেন। আমার দিদিমাও খেতেন, তিনিও প্রায় ঐ-রকম বয়সেই দেহত্যাগ করেছিলেন। সম্পূর্ণ মজবুত দু-পাটি দাঁত এবং লাঠির মতো শক্ত শরীর নিয়ে শেষদিন পর্যন্ত স্বপাক রান্না ভোগ ক’রে গেছেন। এমন সৌভাগ্য ক’জনের হয়। আয়ুর্বেদশাস্ত্রমতে টনিক হিসেবে ঐটুকু আফিম প্রচুর দুধের অনুপানে খেলে নাকি মানুষ সবল ও দীর্ঘায়ু হয়। প্রসঙ্গত ব’লে রাখি যে আমার কনিষ্ঠভ্রাতার যখন জন্ম হ’ল, বাবার বয়স তখন পঁচাত্তর বছর।

প্রসন্নকুমার কীরকম ডাকসাইটে লোক ছিলেন, সে-কথা আগেই বলেছি। মেজাজও ছিল তেমন মানানসই। ছেলেমেয়েদের সামনে স্বভাবতই স্বল্পভাষী এবং গাম্ভীর্যপূর্ণ। আমি তো দূরের কথা, বৈমাত্র দাদা-দিদিদের পর্যন্ত তাঁর সামনে মুখ তুলে কথা বলতে দেখিনি। একদিকে শ্রদ্ধা, আরেকদিকে ভয়–এ দুয়ের মিশ্রণে তাঁর এবং বাড়ির বাসিন্দাদের মাঝে একটি যে অদৃশ্য পাঁচিল গ’ড়ে উঠেছে, সে- সম্বন্ধে তিনি বিন্দুমাত্রও সচেতন নন। প্রভুত্বের প্রচণ্ড অহমিকার দাপটে, এ-পাঁচিল শীতের কুয়াশাচ্ছন্ন পাহাড়ের মতো ঢাকা প’ড়ে থাকে। তাঁর অসন্তোষ এবং ক্রোধ- এ দুটি বৃত্তি যাতে চাড়া না-দিয়ে ওঠে, এ-ব্যাপারে সবাই সতর্ক, কারণ তাঁর ক্রোধ যে কখনো সংযমের বাঁধ ছাপিয়ে যাবে না, এমন কথা কে বলতে পারে।

একদিন গ্রীষ্মের ছুটির দুপুরে শ্লেট পেন্সিল নিয়ে, জানলার ধারে ব’সে অঙ্ক কষছি। খড়খড়ির ভেতর দিয়ে রাস্তার নানরকম দৃশ্য দেখতে-দেখতে কখন যে অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিলাম টেরও পাইনি। হঠাৎ ফসকে গিয়ে আমার হাতের শ্লেটটি জানলার ফাঁক দিয়ে রাস্তায় পড়ে যেতেই মুহূর্তের মধ্যে ঠুনকো কাঁচের গ্লাসের মতো চুরমার হয়ে গেল। বাবা পাশে শুয়ে বিশ্রাম করছিলেন। আওয়াজ শুনতেই আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘কী হ’ল?’ এই গর্জনে দরজা-জানলাগুলো ঠকঠক ক’রে উঠল। আমার মুখ থেকে টু শব্দটি বেরুচ্ছে না। আতঙ্কে ঘরের ভেতর সব-কিছু যেন ধোঁয়া- ধোঁয়া হয়ে গেল। কোন বালকের এত দুঃসাহস যে, এমন পিতার সামনে মিথ্যা উচ্চারণ করে। আওয়াজের কারণ জানবার সঙ্গে-সঙ্গেই চোখমুখ দিয়ে আগুন ঠিকরে পড়ছে। এমন অবস্থায় সাধারণত বেশি নয়, একটি, বড়ো-জোর দুটি, উষ্ণ বচনই দোষীর পক্ষে যতেষ্ট শাস্তি হ’ত। সেদিন কেন জানি না, এতই রেগে গেলেন যে উঠে গিয়ে আলমারি থেকে চাবুকের মতো সরু বেত বের ক’রে আমার হাতে এবং পিঠে সপাং-সপাং ক’রে বেশ-কয়েক ঘা বসিয়ে দিলেন। এমন পরিস্থিতিতে অনেক মায়েরাই অসহায় সন্তানকে পিতার ক্রোদের কবল থেকে রক্ষা করেন। বাবার অস্বাভাবিক রাগ দেখে মা আমার ধারকাছ দিয়ে ঘেঁষবারও চেষ্টা করলেন না। আপাতদৃষ্টিতে, ঘটনাটি মোটেই অসাধারণ নয়। সেটি মনে রাখবার প্রধান কারণ এই যে, তৎকালীন একটি শ্লেটের দাম ছিল, খুব বেশি হ’লে এক আনা কি দু-আনা। তাঁর অত্যধিক গম্ভীর প্রকৃতির আড়ালে একটি স্নেহশীল পিতা যে লুকিয়েছিল, সে- খবরও আমি মাঝে-মাঝেই পেয়েছি। তাই দোষের তুলনায় দণ্ড বেশি হওয়ায়, আমার অভিমান, সমুদ্রে ভাসন্ত, একটি বিরাট তুষার স্তূপের মতো, হৃদয়ে জমাট হয়ে রইল ।

প্রসন্নকুমারের সঙ্গে স্ত্রী হেমাঙ্গিনী দেবীর সম্পর্কটা ছিল একেবারেই অসমান। এতে প্রেম কিংবা বন্ধুত্বের কোনো স্থান ছিল না। অন্তত আপাত-দৃষ্টিতে নয়। তা সত্ত্বেও, যেদিন বাইরে রোগী দেখতে যাবার তেমন তাগিদ থাকত না সেদিন, তিনি নিজের মতো ক’রে স্ত্রীকে সঙ্গ দেন।

এমন একটি দিনে প্রসন্নকুমার গুটি-গুটি ক’রে রান্নাঘরের দিকে এগিয়ে গেলেন। উনুনের ওপর মস্ত একটা লোহার কড়াইতে মাছ কিংবা তরকারির ঝোল টগবগ করছে। হেমাঙ্গিনী দেবী একটা পেতলের হাতা দিয়ে সেটিকে নাড়া-চাড়ায় ব্যস্ত। স্বামীর প্রবেশের সঙ্গে-সঙ্গেই তিনি মাথায় ঘোমটা তুলে দিলেন। প্রসন্নকুমার রান্নার তালিকা জিজ্ঞেস করেন। তার পরের দৃশ্যটি আমার চোখে বিশেষরকম কৌতুকপ্রদ মনে হ’ল। দৃশ্যটি এইরকম–একটি গুরুগম্ভীর পুরুষ; পরনে তাঁর শীতকালের পোশাক-কলারওয়ালা সেকেলে কোট, ভাঁজ-করা গরদের চাদর, গলার দু-পাশ দিয়ে পিঠের ওপর ঝুলে পড়েছে। কুচোনো ‘নয়নসুখ’ ধুতির কোঁচাটি মাটিতে লুটোচ্ছে। পায়ে পালিশ-করা বাদামী রঙের পাম্-শু। এই পোশাকে পুরুষটি, বঁটিদায় ব’সে, পাকা গিন্নীর মতো তরকারি কুটছেন।

স্বামীর প্রতি স্ত্রীর সশ্রদ্ধ ভয় এবং বিস্ময়টাই ছিল বেশি। ছেলেমেয়ে এবং অন্যান্য লোকদের সামনে স্বামীকে তিনি সর্বদাই কর্তা ব’লে সম্বোধন করেন। চালচলনে বস্তুত সবদিক থেকেই স্বামী ছিলেন কর্তা। ইংরেজিতে যাকে বলা হয় ‘ফিউডাল লর্ড’। স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে বয়সের ব্যবধান কম ক’রে হলেও প্রায় ত্রিশ- পঁয়ত্রিশ বছরের। শুনেছি, বিয়ের সময় হেমাঙ্গিনী দেবীর বয়স ছিল পনেরো কি ষোলো। সামান্য লেখাপড়া জানা গরিবঘরের গাঁয়ের মেয়ে। একেই তো এত বড়ো পরিবারে বিয়ে। তারপর, প্রায় সমবয়সী কিংবা বয়োজ্যেষ্ঠ আটটি সৎ-সন্তানের মায়ের ভূমিকা গ্রহণ করা– এই দায়িত্বের গুরুভার পালনে, এত অল্প বয়সের যে- কোনো কুমারীই হকচকিয়ে যাবেন। তাই, মনে-মনে হয়তো কিঞ্চিৎ হীনমন্যতায় ভুগতেন। স্বভাবে তিনি বেশ চাপা ছিলেন। তাছাড়া এমন ডাকসাইটে স্বামীর প্রভাবে কোন্ স্ত্রীই-না সহজে দমে যান!

সবেমাত্র বিকেল হয়েছে। লাল-সাদা ডোরাকাটা গামছা প’রে প্রসন্নকুমার পশ্চিমের বারান্দায় রাখা জলচৌকিতে বসেছেন। পাশে এক বাতি জল। তাতে একটি ছোট্ট পেতলের ঘটি একটি দলচ্যুত কচুরিপানার মতো ভেসে বেড়াচ্ছে। স্নানের আগে আফিম খাওয়ার মতো আরেকটি নিয়ম, তিনি এ-সময় কঠোরভাবে পালন করেন। তাই এ-প্রহরটি আমি ঘড়ির দিকে না-তাকিয়েই ব’লে দিতে পারি। অর্থাৎ কাঁটায়-কাঁটায় সাড়ে চারটা। সুর্য দূরের বিশাল বেল গাছটার মাথায় একটি সোনার অলংকারের মতো ঝকঝক করছে। মধ্যাহ্নভোজনের কিছুকাল পরেই শরীরের পঞ্চভূতের একটির, অর্থাৎ অম্লের আধিক্যে তিনি এতই অস্থির বোধ করেন যে গলায় আঙুল দিয়ে, প্রায় সমস্ত খাবার না বের ক’রে দেয়া পর্যন্ত তিনি স্বস্তি পান না। অথচ এ-অভ্যাসটির ফলে তাঁর কর্মশক্তিতে কোনোই ঘাটতি দেখা যায় না। বরঞ্চ এ-নিয়মটি সেরে, তিনি যেন এক নতুন উদ্যমে বাকি দিনটি কাটান। রোগী দেখার ফাঁকে-ফাঁকে, সমবেত পাড়াপ্রতিবেশীদের আড্ডায় তিনি সক্রিয় অংশ গ্রহণ করেন।

তক্তপোশের ডান ধারে কয়েকটি র‍্যাকে পর-পর কয়েকটি হুঁকো। প্রত্যেকটির ডগায়, সাজানো ককে। সাদা চাদরের পটভূমিকায় এই হুঁকো-ক’টি আমার চোখে অবিকল এক সারি তালগাছের মতো দেখায়। গোপাল, অথবা কোনো কম্পউণ্ডার প্রয়োজনমতো হুঁকো ধরিয়ে দেয়। এ-হুঁকোগুলো শ্রেণী এবং বর্ণের ভিত্তিতে চিহ্নিত। প্রথমটি ব্রাহ্মণদের, দ্বিতীয়টি প্রসন্নকুমার এবং তাঁর বিশিষ্ট কয়েকজন সমবয়সীদের। তৃতীয়টি নিম্নবর্ণের লোকদের এবং চতুর্থটি মুসলমানদের। কোন্ অতিথিকে কখন কোন্ হুঁকো দিতে হবে, এ-বিষয়ে সাধারণত তিনি নিজেই নির্দেশ দেন। কখনো-বা রোগীর সঙ্গে কথা বলতে-বলতে ভুলে যান। এ-রকম সময়ে কম্পাউণ্ডাররা, কর্তাকে বিরক্ত না-ক’রে, নিজেদের বুদ্ধি-বিবেচনায় অতিথিদের হাতে হুঁকো তুলে দেয়। ভুলচুক যে হ’ত না এমন কথা বলা যায় না। এবং হ’লে পর তার ফলাফল কী হ’ত সে-কথায় পরে আসছি। যাই হোক, প্রতিদিন হুঁকো ধরাবার সঙ্গে-সঙ্গে নিয়মিত আগন্তুকেরা প্রত্যেকেই তাঁদের পকেট থেকে একটি ক’রে ছোট্ট কাঠের নল বের ক’রে তাঁদের সমুখে রাখেন। এ-দৃশ্যটি আমার কাছে অত্যন্ত মজাদার লাগে। মনে হয় বুড়োদের এক্ষুনি তাস কিংবা পাশার মতো হুঁকোর নলের একটা খেলা শুরু হবে। এই চাল দিল ব’লে। তাঁদের মধ্যে একজন, অর্থাৎ সীতানাথ মোক্তার, প্রত্যহ একটি কলাপাতার নল বানিয়ে আনেন। তিনি এটি মুখে লাগাবার সঙ্গে-সঙ্গেই আমার কেন জানি মনে হয় যে, ভেঁপুর মতো এটি বেজে উঠবে। হুঁকোটি নগরদোলার মতো চক্রাকারে এক হাত থেকে আরেক হাতে ঘুরে বেড়ায়। সে-সময় যে যার নলটি হুঁকোর ফুটোয় পরিয়ে নেন। বৈঠকখানা ঘর থেকে সুগন্ধি তামাকের ধোঁয়া পাকিয়ে উঠে সারা বাড়িতে ছড়িয়ে পড়ে। আলাপ- আলোচনার বিষয়বস্তু গতানুগতিক হ’লেও ঘরটি গগম্ করে ওঠে

একদিন ঢাকার বিত্তবান্ গন্ধবণিক রূপচাঁদ সাহার কোনো-এক আত্মীয় সূতিকা রোগগ্রস্তা তাঁর স্ত্রীর জন্যে ওষুধ নিতে এসেছেন। প্রসন্নকুমার তাঁর জুনিয়ার কম্পাউণ্ডার অক্রূরকে তামাক পরিবেশন করতে বললেন। তারপর, নিবিষ্ট মনে রোগীর ইতিবৃত্তান্ত শুনতে থাকলেন। অক্রূর হুঁকো ধরিয়ে গন্ধ-বণিকের হাতে দিয়ে গেল! কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই প্রসন্নকুমারের চোখের কোণে লাল রঙ দেখা দিল। তিনি তেরছা নজরে অক্রুরের দিকে একবার কট্‌ট্ ক’রে তাকালেন! আরেকবার তাকাতেই দেখা গেল যে তাঁর চোখ পুরোপুরি রক্তবর্ণ হয়ে উঠেছে। ভ্রূযুগল কুঞ্চিত এবং সংযুক্ত হয়ে যেন একটা গিট লেগে গেছে।

অক্রূরের চেহারা দেখে মনে হ’ল যেন তার বুকে ভূমিকম্প শুরু হয়েছে। ব্রাহ্মণের হুঁকো যে গন্ধবণিকের হাতে চলে গিয়েছে, এ-কথা তার বুঝতে আর বাকি রইল না। নিজের ভূল শোধরাবার উদ্দেশ্যে সে তাড়াতাড়ি র‍্যাকের তৃতীয় হুঁকোটি ধরবার চেষ্টা করতেই প্রসন্নকুমার তাঁর ডান হাতের তর্জনীটি উঁচিয়ে ধরলেন। গন্ধবণিক ওষুধ নিয়ে চ’লে গেলে প্রসন্নকুমার অন্দরমহলে যাবার জন্য উঠে দাঁড়ালেন। ‘কুষ্মাণ্ড!’ তাঁর মুখ থেকে তিন স্বরবিশিষ্ট এ-শব্দটি একটি কামানের গোলার মতো শোনাল। ওষুধে-ভরা কাঁচের আলমারিগুলো, এ-শব্দটির সংঘর্ষে ঠুনঠুনিয়ে উঠল। তারপর ধীরে-ধীরে রাস্তার ঘোড়ার গাড়ির চাকার শব্দে মিলিয়ে গেল।

প্রসন্নকুমারের ধারণায়, এতগুলো সন্তান-সন্ততির বিরাট পরিবারের সুষ্ঠু পরিচালনার পক্ষে, সংসারের শীর্ষে তাঁর অস্তিত্বই যথেষ্ট। তাঁর চোখে পরিবার যেন ঘড়ির মতো একটি যন্ত্র-খাওয়া-পরা নামক চাবিটি দিলেই তা ঠিক-ঠিক চলতে থাকবে। ছেলেমেয়েদের সঙ্গে গপ্পোগুজব, পাঁচরকম বিষয়ের আলাপ-আলোচনা, তাদের অভাব-অভিযোগ সম্বন্ধে অবহিত হওয়া, ছেলেমেয়েদের এমন-কি স্ত্রীর সঙ্গে কোনোরকম ঘনিষ্ঠতা দেখানো, এক কথায় একটি অন্তরঙ্গ পারিবারিক সম্পর্ক গড়ে তোলা, তাঁর গরুগম্ভীর মেজাজের খেলাপ ছিল।

সন্ধের রোগী দেখার পালা শেষ ক’রে প্রসন্নকুমার এখন দোতলায় উঠে এসেছেন। পোশাকী জামাকাপড় ছেড়ে, হাতমুখ ধুয়ে, তিনি খাটে বসলেন। হেমাঙ্গিনী দেবী হাতপাখা দিয়ে হাওয়া করেন। কখনো-কখনো প্রয়োজন হ’লে, হাত-পা টিপে দেন। কর্তার যাবতীয় সেবার জন্যে তিনি এ-সময়টিকে আলাদা ক’রে রাখেন।

গ্রীষ্মের প্রচণ্ড গরম। প্রসন্নকুমার গোপালকে ডেকে বললেন, ‘গড়গড়ায় কিছু কুচিবরফ আর গোলাপজল মিশিয়ে দে তো।’

এ-রকম একটি সন্ধেবেলায় রাঙাদা অর্থাৎ প্রসন্নকুমারের পঞ্চমপুত্র, একটি মস্ত শীল্ড হাতে ক’রে তাঁর সামনে হাজির হ’ল। বলা বাহুল্য, আমাদের মতো কয়েক- জন কনিষ্ঠদের ছাড়া, জ্যৈষ্ঠপুত্রদের সঙ্গে প্রাত্যহিক দেখাসাক্ষাৎ তাঁর কমই হ’ত। লণ্ঠনের আলোয়, কাঠের ঘন কালো বার্নিশের পটভূমিকায়, সদ্য পালিশ-করা রুপোর অলংকরণ থেকে হীরের মতো আলো চমকাচ্ছে। শীল্ডের মাঝখানে দ্রুত- গামী সুপুরুষের হুবহু একটি মূর্তি দেখে আমার চোখ বিস্ফারিত। এই আবছা আলোতে গোটা জিনিসটি জটিল কারুকার্য খচিত একটি মহামূল্যবান্ রাজকীয় সম্পদের মতো দেখাল। দাদার প্রশস্ত বুকের ছাতিটা গর্বে প্রশস্ততর। শীল্ডটি পিতার চোখের সামনে ধ’রে বলল যে, তাদের কলেজের স্পোর্টস প্রতিযোগিতায় চ্যাম্পিয়ন হয়ে সে এ-পুরস্কার পেয়েছে। হুঁকোর টান থামিয়ে তিনি শীল্ডটার দিকে আস্তে ক’রে ঘাড় বাঁকালেন। এক নজর দেখে নিয়ে আবার হুঁকোয় টান দিতে-দিতে বললেন, ‘হুঁ! লেখাপড়া ঠিক চলছে তো? রাঙাদা মাথা নিচু ক’রে শীল্ডটি নিয়ে বেরিয়ে গেল।

প্রসন্নকুমার মস্ত পাশবালিশটিতে, কনুই চেপে হেলান দিয়ে বসেছেন। হাতে গড়গড়ার নল। পাশেই টুলের ওপর কালো পাথরের গেলাসে মিছরির সরবৎ রাখা আছে। হেমাঙ্গিনী দেবী সেটি এগিয়ে দিলেন। কর্তার মেজাজ বুঝে, এই সময় তিনি সংসারের নানা অভাব-অভিযোগের কথা তাঁর সামনে পেশ করেন। অমুকের বই কিংবা জামাকাপড় কিনতে হবে। তমুকের স্কুল কিংবা কলেজের মাইনে দিতে হবে ইত্যাদি। প্রসন্নকুমার চুপ ক’রে সব শুনে বলেন, ‘হুঁ-উ-উ।’

এ-সময়টিতে প্রসন্নকুমার কোনো-কোনো দিন আমাকে এবং আমার অগ্রজকে কাছে ডেকে নেন। পিঠে হাত বুলোতে বুলোতে আমাদের পড়াতে বসান। এমন দিনেই শুধু তাঁর কাছে আমাদের ছোটোখাটো আব্দার করার সাহস হয়। এমন দিন দুর্লভ হ’লেও, পিতৃস্নেহের দীপ্তিতে তাঁর মুখখানি উদ্‌ভাসিত হয়ে ওঠে। আমাদের কল্পলোকের পিতার ছবিখানির সঙ্গে তাঁর এ-মুখখানি হুবহু মিলে যায়।

খানিকক্ষণ বাদেই হেমাঙ্গিনী দেবী স্বামীর রাত্রিভোজনের ব্যবস্থা করেন। ছোটো এক বাটি ঘন দুধ এবং ভেজা ন্যাকড়ায়-জড়ানো গোনাগুতি দুখানা মিহি ময়দার রুটি-এটুকুই তাঁর পক্ষে যথেষ্ট। খাওয়া সারা না-হতেই গোপাল নতুন করে গড়গড় সেজে রেখে যায়। হুঁকোয় মৃদু টান দিতে-দিতে চোখের পাতা ভারী হয়ে আসে। মশারি খাঁটিয়ে দিয়ে হেমাঙ্গিনী দেবী নিজের খাওয়াদাওয়া এবং সংসারের বাকি কাজটুকু সারতে নিচে চ’লে যান।

এখন সকাল প্রায় ন টা। প্রসন্নকুমার যথারীতি রোগীবাড়ি ভিজিটে যাবার সাজ- পোশাক প’রে নিচে নামলেন। পায়রাদের ‘আয় আয়’ ডাকে, উঠোনে মুঠো-মুঠো ধান ছড়ালেন। পায়রারা দলে-দলে নেমে এসে দানা খেতে থাকে। তারপর, কাকাতুয়াটিকে কয়েকটি ভেজা ছোলা পরিবেশন করলেন।

‘বল হরে রাম, হরে কৃষ্ণ’ উচ্চারণ করবার সঙ্গে-সঙ্গে, সাদা পাখিটিও পাখা ঝাপ্‌টা দিতে-দিতে এই নামোচ্চারণ করে। পাশের খাঁচায় রাখা টিয়ে শাবকটির মুখের সামনে কাঁচা লঙ্কা তুলে ধরতেই, শাবকটি সেটিকে টেনে নিল। তার সামনে আরেকটি তুলে ধ’রে মুখে শিস্ দিতে থাকেন। প্রসন্নকুমারের মুখটি তাঁর নিজের নামের মহিমায় ভ’রে ওঠে। শিস্ দিতে দিতে তিনি বৈঠকখানার দিকে এগিয়ে যান।

আমি এবং আমার অগ্রজ, সবেমাত্র পশ্চিমের বারান্দায় আমাদের জলখাবার নিয়ে বসেছি। এমনসময় বৈঠকখানা থেকে প্রচণ্ড এক চিৎকার আমাদের কানে ভেসে এল। আমরা দুই ভাই দৌড়ে সেখানে উপস্থিত হলাম। দেখি একটা জোয়ান ছেলে, তার হাত-পা মোটা দড়ি দিয়ে বাঁধা। কোমরে আরেকটি বাঁধ। ছেলেটির খালি গা। সকালের আলোয় তার ন্যাড়া মাথাটি একটি বড়ো কাঁচা বেলের মতো চক্‌চক্ করছে। রক্তঘন বিস্ফারিত চোখ। তার থেকে আগুন ঠিকরে পড়ছে যেন। তার কোমরের দড়িটিকে একটি লোক দু-হাতে টেনে রেখেছে। আর দুটি লোক তার হাত চেপে ধরেছে। লোকটি এই নাগপাশ থেকে মুক্ত হবার জন্যে আপ্রাণ চেষ্টা করছে। এই ধস্তাধস্তির ফলে তার চিকন কালো ঘর্মাক্ত শরীরের মাংসপেশীগুলো নেচে-নেচে উঠছে। সংসারের বিরুদ্ধে, ঈশ্বরের বিরুদ্ধে তার অভিযোগের সীমা নেই। সেই অভিযোগ তার ভারী কণ্ঠে, গালিগালাজের সংমিশ্রণে একটা প্রচণ্ড হট্টগোলের মতো শুনাচ্ছে। ইতিমধ্যে বৈঠকখানার বাইরে, দু-চারজন পথচারীরও ভিড় জমেছে। প্রসন্নকুমার শান্ত, অবিচলিত। হুঁকোটি নামিয়ে রেখে তিনি গোপালকে ডেকে পাঠালেন। ভেতর থেকে এক গেলাস জল এবং কিছু খাবার আনতে আদেশ করলেন। গোপাল ফিরে এলে তিনি নিজেই জল এবং খাবার যুবকটির মুখের সামনে ধরলেন। যুবকটি প্রসন্নকুমারের মুখের দিকে অপলক দৃষ্টিতে নিঃশব্দে তাকিয়ে রইল। তারপর তার মুখে, ভোরের আলোর মতোই ক্রমশ একটি হাসির রেখা ফুটে উঠল। প্রসন্নকুমার তার ঠোঁটে খাবার ছোঁয়াতেই যুবক সানন্দে তা মুখের মধ্যে টেনে নিল।

প্রসন্নকুমার যুবকের সঙ্গীদের কাছ থেকে তার অসুস্থতার স্থিতিকাল এবং আরো খুঁটিনাটি জেনে নিয়ে নানারকম ওষুধের ব্যবস্থা করলেন-পাঁচন, বিশেষ ধরনের নস্যি, মাথা ঠাণ্ডা রাখবার জন্যে তেমনি বিশেষ ধরনের একটি পট্টি, আরো কত কী! সঙ্গীদের একটি কথা জোর দিয়ে বললেন, রোগী রাতে কোনো কারণেই উত্তেজিত না-হয়, সেদিকে বিশেষ নজর রাখতে।

এই ঘটনার মাস-তিনেক পরেকার কথা। আমি, আমার অগ্রজ প্রতিবেশী আরো দু-তিনটি ছেলে রোয়াকে ব’সে গপ্পোগুজব করছি। এমন সময় একটি স্বাস্থ্যবান্ এবং সুশ্রী যুবক আমাদের দরজার সামনে হাজির হ’ল। মাথায় একঝাঁক ঢেউ-খেলানো চুল। পরনে সাদা পাঞ্জাবি এবং আসমানী রঙের লুঙ্গি। মুখে সলজ্জ হাসি। হাতে একটি বাজারের থলি। বৈঠকখানায় ঢুকে প্রসন্নকুমারকে লক্ষ ক’রে তক্তপোশে মাথা ছোঁয়াল। ‘এটি আমাদেরই পুকুরের’–এই ব’লে থলের ভেতর থেকে একটি রুই মাছ বের ক’রে মেঝেতে রাখল। সেখানে রাখতেই মাছটা একটু ন’ড়ে-চড়ে উঠল সকালের আলোয় তার আঁশগুলো চুকি-বসানো একটি পোশাকের মতো ঝলমলিয়ে উঠল। নিজের পরিচয় এবং কঠিন ব্যাধি থেকে তার সম্পূর্ণ আরোগ্যলাভের কথা বলতেই প্রসন্নকুমার তাকে চিনে ফেললেন। একটি দীর্ঘনিশ্বাস ছেড়ে ডান হাতটি ওপরের দিকে তুলে বললেন, ‘সবই তার ইচ্ছে।’ যুবকটিকে দেখে কে বলবে এই সেই দড়িতে-বাঁধা লোকটি।

এখন ভোরবেলা। পুবের একটি জানালা দিয়ে একফালি কমলা রঙের আলো আমার চোখেমুখে পড়তেই আমার ঘুম ভেঙে গেল। দেখি প্রসন্নকুমার আয়নার সামনে ব’সে চুলে-গোঁফে কলপ দিচ্ছেন। টিকেয় ফুঁ দিতে-দিতে গোপাল গড়-গড়া নিয়ে এল। তিনি গোপালকে বাকি জানালাগুলো খুলে দিতে বললেন। কলপ-দেয়া থামিয়ে তিনি আকাশের দিকে চোখ তুললেন। তাঁকে দেখে মনে হ’ল যে, তিনি জোরে শ্বাস টেনে, এই সকালের হাওয়ায়, কিসের একটা গন্ধ ধরবার চেষ্টা করছেন! গোপাল, বালতি ক’রে হাতমুখ ধোবার জল বারান্দায় রাখতেই তাকে বললেন, ‘দেখে আয় তো নেবু গাছটায় ফুল ফুটেছে কি না।’ একটু বাদেই গোপাল একটি ছোট্ট তাজা ফুল হাতে ক’রে ফিরল। চার পাপড়ির ফুলটির রঙ দুধের ফেনার মতো সাদা। তার কেন্দ্রস্থলে খুব হাল্কা বেগুনী রঙের আভাস। তিনি তাকে জিজ্ঞেস করেন, ‘পূজোর আর ক’দিন বাকি আছে রে।’ ‘মাকে জিজ্ঞেস ক’রে আসি’, এই ব’লে গোপাল নিচে নেমে গেল।

কলপ দেয়া শেষ করে প্রসন্নকুমার বৈঠকখানার দিকে এগিয়ে গেলেন। তাকিয়ায় ঠেস দিয়ে ব’সে তাঁর জ্যেষ্ঠ পুত্র, প্রফুল্লকুমারকে তলব করলেন। প্রফুল্লকুমারের বয়েস পঞ্চাশের ঊর্ধ্বে। চার কন্যা এবং দুটি পুত্রের পিতা। প্রসন্ন- কুমারের সামনে হাজির হয়ে মাথা নিচু ক’রে দাঁড়াতেই তাকে পুজোর আয়োজন করতে বললেন এবং এ-ও বললেন যে গত বৎসরের চাইতে এবারের উৎসব যেন আরো ধুমধাম ক’রে করা হয়। প্রফুল্লকুমার ‘যে আজ্ঞে’ ব’লে ভেতরে চ’লে গেলেন।

শরতের পুবের আকাশটি তামার রঙে আঁকা একটি জলরঙের ছবির মতো দেখাচ্ছে। এমন-এক ভোরে বড়ো-বড়ো গয়নানৌকো ক’রে, প্রসন্নকুমারের নেতৃত্বে আমরা সবাই আমাদের গ্রামের জলপথে রওনা হই। সারি-সারি পালতোলা নৌকোগুলো উত্তুরে বাতাসে শাঁই-শাঁই করে এগিয়ে যায়। যেন কোনো অজানা অভিযানে। শহরের মুক্ত আকাশের তলায় জলে-ভাসার আনন্দ মনকে এক নতুন উচ্ছ্বাসে ভরিয়ে দেয়। বুড়িগঙ্গার ওপারের গ্রামের গাছগুলোর আবছা সবুজ-নীল রেখায় সীমানা টানা। কিছুক্ষণের মধ্যে নদী ছেড়ে আমাদের নৌকো খাল-বিলের মধ্যে দিয়ে এগিয়ে যায়। কখনো-বা যায় জলে-ডোবা ধানক্ষেতের ভেতর দিয়ে। আরেকটু এগুতেই কচুরিপানায় ঢাকা জলপথে নৌকাগুলো ঘষা খেয়ে খস খস আওয়াজ করে। শরীর শিউরে ওঠে। তবু কেন জানি ভালো লাগে। মাদার, জাম, জিওল, জামরুল গাছের ফাঁকে-ফাঁকে সূর্য হঠাৎ-হঠাৎ চমকে ওঠে। একটা লম্বা খাল থেকে বেরিয়ে আবার জলে-ডোবা ধানক্ষেতে পড়তেই দূরে আমাদের পুকুর-পাড়ের গগনচুম্বী অর্জুন গাছটার চূড়া দেখা গেল। সমবেত কণ্ঠে সবাই ব’লে ওঠে, ‘এসে গেছি, এসে গেছি।’

প্রসন্নকুমারের পরিচালনায় আমাদের পুজো-বাড়িটা উৎসবমূর্খর হয়ে উঠতে বিলম্ব হ’ল না।

ঢাকার বোলের সঙ্গে, কাঁসরঘণ্টা শাঁখ আর উলুধ্বনিতে আমাদের বেলতলী গ্রামটা এক সামগ্রিক উত্তেজনায় মেতে উঠল।

দিন শেষ হয়ে সন্ধ্যা নেমে আসে। লাঠি হাতে একটি পুরুষ এসে পুজো- মণ্ডপের মুখোমুখি রাখা একটি চেয়ারে বসলেন। আতরের একটি হাল্কা সুগন্ধ উঠে ধূপের গন্ধকে সুবাসিত ক’রে তুলল। তাঁর পরনে গিলে-করা আদ্দির পাঞ্জাবি আর কালো কুচোনো ধুতি। কোঁচাটি মাটিতে লুটিয়ে প’ড়ে জাপানী হাতপাখার মতো দেখাচ্ছে। পুরুষটি চেয়ারে ঈষৎ হেলান দিয়ে গড়গড়ার নলটি মুখের সামনে ধরলেন। চেহারায় এবং ব্যাক্তিত্বে এ-লোকটি এতই স্বতন্ত্র যে, সমবেত লোকদের জোড়া-জোড়া চোখ এই কেন্দ্রবিন্দুতে মিলিত হ’ল। তাদের মধ্যে কেউ-কেউ তাঁর সঙ্গে কথা বলার উদ্দেশ্যে এগিয়ে এল। ঢাকীরা পিঠে ঢাক বেঁধে নিল। তাদের হাত নিপিশ্ ক’রে ওঠে। পুরুতমশাই পঞ্চপ্রদীপ হাতে ক’রে দাঁড়িয়ে উঠতেই ঢাকের ঐকতানে এবং বোলে, বাহিরবাড়িটি একটি নাচঘরের মতো গগম্ করে উঠল একদিকে ঢাকীদের সঙ্গে ধুনুচি-নর্তকের বেদম প্রতিযোগিতা, অন্যদিকে প্রসন্নকুমারের নির্দেশে তুবড়ি, আতশবাজি, চরকি ইত্যাদির চমকপ্রদ প্ৰদৰ্শনী- সব মিলে বাদ্যকর, নর্তক, দর্শক, এক সাময়িক উন্মাদনায় ক্ষেপে ওঠে। কিছুক্ষণ পরেই প্রসন্নকুমার অন্দরমহলের দিকে এগিয়ে গেলেন।

আজ মহাষ্টমী। পুজোমণ্ডপের সামনে গ্রামবাসীদের মন্তু জমায়েত! প্রসন্নকুমার বাহিরবাড়ির বারান্দায় চেয়ারে বসেছেন। পাশেই অনেক ধুতি এবং লুঙ্গি থাক ক’রে রাখা আছে। এ-উৎসবের দিনে তাঁর মিতব্যয়ী স্বভাব ছুটি নিয়ে, উদারতায়, হৃদয়ের একূল-ওকূল ছাপিয়ে যায়। হিন্দু-মুসলমান ভাগ-চাষী এবং প্রজারা তাঁর পায়ের ধুলো নেয়। তিনি সবার হাতে একটি ক’রে ধুতি কিংবা লুঙ্গি এবং পোড়ামাটির থালাবাসন তুলে দেন। কেউ-কেউ তাঁর কাছে অল্পবিস্তর অর্থসাহায্য পেয়েও ধন্য হয়। ছোটোখাটো জমিদারের ভূমিকা পালন ক’রে, প্রসন্নকুমার তাদের ভূরিভোজনে আপ্যায়িত করেন। সমবেত লোকেরা খুশি হয়ে ‘কর্তা’র স্তুতি গাইতে গাইতে বাড়ি ফিরে যায়।

বিকেলবেলা। প্রসন্নকুমার তাঁর মাতৃদেবীর স্মৃতিমন্দিরটির পাশে এসে বসেছেন। সুমুখে একটি লম্বা খাল। দক্ষিণে একটি পুকুর। খালের ওধারে জলে আধাডোবা বিস্তৃত ধানক্ষেত। দুটি ক্ষেতের মাঝখান দিয়ে একটি সরু নৌকা লগি ঠেলে শাঁই-শাঁই ক’রে এগিয়ে যায়। পুবের আকাশে শরতের মেঘ-মালার চূড়াগুলো অস্তগামী সূর্যের জাফরানী আলোয় তুষারশৃঙ্গের মতো ঝলমল করে। স্মৃতিমন্দিরের দক্ষিণে মাদার এবং জিওলের কয়েকটি ডাল পুকুরের জলে হেলে পড়েছে। ডালে এবং গুঁড়িতে কয়েকটি ডিঙি-নৌকো বাঁধা। এই নৌকোয় ক’রে আমাদের গ্রামবাসী ছাড়াও অন্য গ্রামের বাসিন্দারা তাদের অসুস্থ ছেলে-মেয়ে এবং আত্মীয়-অনাত্মীয়দের নিয়ে বিনামূল্যে প্রসন্নকুমারের চিকিৎসালাভের আশায়, উপস্থিত হয়েছে। পিলে- বের-করা ম্যালেরিয়া রোগী থেকে হাঁপানী, হৃদরোগ, আমাশা, ক্ষয়রোগ–কিছুই বাদ নেই। তিনি তাদের নানারকম ফল-মূল-পাতা-ছালের রস, কচি ডাবের কিংবা কাঁচা মুগ ডালের জল, আমলকীর মোরব্বা, পোড়া বেল, আরো কত-কী টোটকা যে খেতে বলেন, তার ইয়ত্তা নেই। দুরারোগ্য রোগীদের মধ্যে কেউ-কেউ সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে তাঁর কাছে কৃতজ্ঞতা প্রকাশের বাসনায় উপস্থিত। উপহার হিসাবে কারো হাতে একটি কি দুটি অতিকায় লাউ কিংবা কুমড়ো। কারো হাতে-বা এক কাঁদি কলা। উপকারী লোককেই তো সবাই আদর করে। প্রসন্নকুমারের আশ্বাসবাণীতে নিশ্চিন্ত বোধ ক’রে রোগীরা, একে-একে, তাঁর পায়ের ধুলো নিয়ে জলপথে ফিরে যায়।

দিনান্তের রবি আমাদের বাড়ির শেষপ্রান্তের বাঁশঝোঁপের আড়ালে টুক্ ক’রে লুকিয়ে পড়ে। নানা বর্ণের রশ্মি-ক’টি এই ঝোঁপের ডগায় লেগে ময়ূরের পালকের মতো দেখায়। আলো-আঁধারের এক অপরূপ মায়ায় আমাদের বৃক্ষ-লতাপূর্ণ বেলতলী গ্রামটি ঘুমন্ত পরীর দেশের মতো এক গভীর রহস্যে ভ’রে ওঠে। প্রসন্নকুমার লাঠি ভর ক’রে উঠে দাঁড়ালেন। মাতৃমন্দিরের চৌকাঠে মাথা ছুঁইয়ে, ধীরে-ধীরে তিনি পশ্চিম-দালানের দিকে এগিয়ে যান। শরীরটি সামনের দিকে ঈষৎ ঝুঁকে পড়েছে। দূরে বিরাট জামরুল গাছের তলায় অন্ধকারে বৃদ্ধ সুপুরুষের মূর্তিটি ক্রমশ আবছা হয়ে মিলিয়ে যায়।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *