০১. মাঝরাত

মাঝরাত। সবকিছু নিস্তব্ধ। শহর ঘুমের ঘোরে হারিয়ে গিয়েছে, কিন্তু ঘুম নেই তার চোখে। তার চোখে একটা শঙ্কা, যেটা ছাপিয়েও দু-চোখে দাউ দাউ করে জ্বলছে প্রতিশোধের আগুন। এই আগুন থামবার নয়। এই আগুনে সে যেমন জ্বলছে, তার থেকে বেশি জ্বালাবে এই শহরকে। তাই, রাতগুলো সে বিসর্জন দিয়েছে কাজের কাছে। প্রতিটা ক্ষণ এখন গুরুত্বপূর্ণ। চাইলেও হেলায় সময় নষ্ট করতে পারবে না। এই শহরের প্রতি তার অনেক ঋণ। সব যে ফিরিয়ে দিতে হবে তাকে, দ্বিগুণ হারে। সময় শেষ হওয়ার আগেই সব শেষ করতে হবে।

জানালার পর্দা একটু সরিয়ে সে তাকিয়ে আছে দূর আকাশে চুপি দিয়ে থাকা মেঘে ঢাকা চাঁদটার দিকে। চাঁদটাও মেঘের আড়ালে নিজের অস্তিত্বে খুঁজতে ব্যস্ত। আলোগুলো কেমন মেঘেদের অন্ধকার গলিতে হারিয়ে গেছে। নিস্তব্ধতা কাটিয়ে একটা পেঁচার আর্তনাদ ভেসে আসছে তার কানে। এই রাতে যান্ত্রিকতা ছাড়া কেবল এই একটা প্রাণবন্ত শব্দ। আওয়াজ শুনে সেদিকেও খানিকের জন্য চোখ যায় তার।

বেশিক্ষণ না খুঁজে আকাশের দিকেই চোখ ফেরাল আবার। এই মায়াবী অন্ধকার চাঁদের দিকেই যেন সব তার আগ্রহ। মোহগ্রস্ত হয়ে তাকিয়ে আছে নিভৃতে থাকা চাঁদটার দিকে।

টিক করে হালকা শব্দ হলো। চমকে উঠল সে। চাঁদের প্রতি মায়াটা আজ বেশিই লেগে গিয়েছিল। সময়জ্ঞান খানিকের জন্য মাথায় ছিল না তার। সে পেছনে তাকাল। অন্ধকার রুমে স্রেফ একটা চাইনিজ চার্জলাইট। ফ্লোরে একটা পানিভর্তি বাটি, তার পাশে চার্জলাইট। সেই বাটিতে কয়েকটা পোকা ভিরমি খেয়ে পড়ে আছে। সে সামনের দিকে পা বাড়াতেই বাটিটা কেঁপে উঠল। পানির রাজ্যে একটা সুনামি এসে পোকাগুলোকে নিয়ে কয়েক সেকেন্ডের জন্য হারিয়ে গেল বাটির নিচে।

সে আস্তে আস্তে এগিয়ে গেল। বাটিটা তুলে পোকাগুলোর দিকে তাকিয়ে থাকল কিছুক্ষণ। একটু আগে যেগুলো খানিক আলো পেয়ে ডানা ঝাঁপটে উড়ছিল, এখন সলিল সমাধি হলো সেগুলোর। মানুষের জীবনটাও এরকম। একটু সুখের আশায় পাহাড়সম দুঃখ কাঁধে নিতে সংকোচবোধ করে না। সুখ সেই দিগন্তের মতো, যার পেছনে যতই ছোটা হোক, ধরা যাবে না। বাকিদের কথা জানে না সে। কিন্তু সে পারেনি। এই দুনিয়ার প্রতি তার প্রচণ্ড অভিমান, রাগ আর ক্ষোভ।

একটু দূরে, বামদিকেই একটা টেবিল আছে। বাটিটাকে ওই টেবিলটার উপর রাখল। টেবিলটার উপর বাটি ছাড়াও আরও অনেক গুরুত্বপূর্ণ সরঞ্জাম রাখা। দুইটা চাপাতি, একটা ফিলেটিং নাইফ, দুইটা কালো বোতল, কয়েকটা সিরিঞ্জ, সেগুলোর পাশে একটা এলার্ম ঘড়ি।

সে বাটিতে ডান হাত ডুবিয়ে নিল আলতো করে। পানির স্পর্শ পেয়ে তার গরম মস্তিষ্কটাও একটু নমনীয় হলো। বাটি থেকে তুলে চোখের সামনে ধরল হাতটা। কয়েকটা পোকা হাতে লেগে আছে। সেগুলোকে এক ঝাড়ি দিয়ে ফেলল সে। গ্লাভসজোড়া বের করে নিল পকেট থেকে।

সমস্ত শরীরে তার পিপিই। এই কাজ করার জন্য পিপিই থেকে উত্তম কিছু হয় না। অবশ্য সাদা পিপিইতে লাল রং এর কিছু দাগ আছে। তবুও যেন এই প্লাস্টিকের আবরণটির শুভ্রতার কোনো ভাটা পড়েনি। সামনে পড়ে আছে একজোড়া প্লাস্টিকের গ্লাভস। সেগুলো পরে নিল সে। তার কাজ শেষ, এখন কাজের ফল দেখার পালা।

তার পেছনেই টেবিলের পাশে একটা হ্যাঁঙ্গার ঝোলানো। সেটা ছাদের একটা হুকের সাথে বাঁধা। হ্যাঁঙ্গারে একটা মানুষ ঝুলছে। মৃদু আলোয় দূর থেকে বোঝা যাচ্ছে তার শরীরের ভাঁজগুলো। আরেকটু সামনে এগুতেই স্পষ্ট হলো মেয়েটার মুখ। গায়ে তার একটুও কাপড় নেই। মেয়েটার নগ্ন শরীরের প্রতিটা ভাঁজ দেখে যেকোনো পুরুষের শরীর গরম হয়ে যাবে। কিন্তু সে কোনো সাধারণ পুরুষ না। তার সেই ইচ্ছে নেই। সে যৌনক্ষুধাকে দখল করে নিয়েছে অনেক আগেই। তার যে ক্ষুধা সেটা পৃথিবীর সব ক্ষুধার চেয়ে তীব্র।

মেয়েটির সমস্ত শরীর নীল হয়ে আছে। দু-পায়ে শেকল। শেকলগুলো ফ্লোরের দিকে টানা দিয়ে হুকের সাথে লাগানো। মেয়েটার যোনি একদম উন্মুক্ত। কিন্তু সেটার কাজ পরে। সে টেবিলের রাখা ঘড়িটার দিকে তাকাল। সময় হয়ে গিয়েছে। এবার তার কাজ করার পালা। চাপাতিটা তুলে নিল সে। ঝুলন্ত মেয়েটার নিচে একটা মাদুর পাতা। শীতলপাটি। সে মানুষটা রুক্ষ হলেও বেশ সৌখিন।

সে নুয়ে মাদুরটার উপর চাপাতিটা রাখল। ঠন করে একটা আওয়াজ হলো, রিনরিনে আওয়াজ। আওয়াজ শুনে দেয়ালের তেলোপাকাটাও শব্দ করে একটু নড়ে উঠল, যেন খানিক ভয় পেয়েছে সেটা। তেলাপোকার ডানা ঝাঁপটানোর শব্দে সে চোখ তুলে দেখল জানালার দিকে। জানালাটা খোলা। জানালার কাছে গিয়ে জানালাটা বন্ধ করে দিল। পুরো রুমটা সাউন্ডপ্রুফ না তেমন। তবে জানালা বন্ধ করলে বাইরে থেকে কোনো শব্দ ভেতরে আসবে না, আবার ভেতর থেকে কোনো শব্দ বাইরে যাবে না। যা শুনা যাবে তা বেশ মৃদু, দূরে নতুন বানানো ফ্ল্যাটটার কাছে পৌঁছাবে না।

মেয়েটার কাছে গিয়ে সে মেয়েটার থুতনি ধরে উপরে তুলল। তার চোখ অর্ধনিমীলিত, অঝোরে ঘামছে, চুলগুলো উন্মুক্ত হয়ে বুকের উপর পড়ে আছে। সে চিৎকার করতে পারবে না, সেই শক্তি তার নেই। কিন্তু কষ্ট পাওয়ার শক্তি তার আছে। বেশ মায়াবী মেয়েটা। বিশেষ করে তার চুলগুলো আর চোখগুলো। মেয়েটার পুরো শরীরটা বেশ মোলায়েম। বোঝা যাচ্ছে, শরীর আর রূপের প্রতি কম মায়া ছিল না মেয়েটার।

আফসোস, মেয়েটার এই শরীরের সে যেটা করবে, এটা দেখে শয়তানও কেঁপে উঠবে। আস্তে আস্তে সে মেয়েটার গলা থেকে হাত বুলাতে বুলাতে নিচের দিকে নামল। কোমর থেকে ডান পায়ের উড়ু বেয়ে তার হাত হাঁটুতে নেমে আসলো তার হাত। হাঁটুতে সে চাপ দিল আলতো করে। কেমন একটা শিহরণ বয়ে গেল তার শরীরে। চাপাতিটা তুলে নিল এবার। হাওয়ায় কিছুক্ষণ নাড়িয়ে চাপাতিটাকে পরীক্ষা করে নিল সে।

চাপাতিটা নিয়ে দাঁড়িয়ে গেল হুকের কাছে। হুকগুলো থেকে মেয়েটাকে ছাড়াতে হবে। বাম হাত দিয়ে মেয়েটির মাথা ধরে ডান হাত দিয়ে হুক খুলে ফেলল সে। মেয়েটির তার উপর গড়িয়ে পড়তেই সে মেয়েটিকে মাদুরে নামিয়ে আনল। চাপাতিটা নামিয়ে রাখল নিচে। মেয়েটির দুই পাশে দুটো শেকল পড়ে আছে। মাথায় কাফসহ শেকল। এগুলো দিয়ে হাত বাঁধে সে। যাতে নড়াচড়া না করতে পারে। মেয়েটা অর্ধমৃত, তবুও ভরসা নেই।

শেকল দিয়ে বাঁধতেই সমস্ত শরীর টান হয়ে আছে মেয়েটির। সে চাপাতিটা নিয়ে আস্তে আস্তে মেয়েটির পায়ের কাছে চলে গেল। হাঁটু বরাবর চাপাতিটা নামিয়ে আনল বেশ জোরে। এক আঘাতেই দুই ভাগ হয়ে গেল হাঁটুটা। মেয়েটি এক চিৎকার দিয়ে উপর দিকে উঠে গেল। প্রচণ্ড যন্ত্রণায় ভেসে উঠলমেয়েটির শরীরের শিরা উপশিরাগুলো। কই মাছের মতো লাফ দিল কয়েকবার। শেকলমুক্ত হয়ে পা ছাড়ানোর চেষ্টা করল। পারল না। পাগলের মতো আর্তনাদ করছে মেয়েটি।

সে মেয়েটির মুখের দিকে তাকাল। চোখ বেয়ে অঝোরে পানি পড়ছে মেয়েটির। সেই পানি দেখে যেন তার মন শান্ত হলো। হাঁটুর নিচের দিক থেকে চামড়া কিছুটা লাগানো। হাঁটুটা ধরে টান দিতেই সেটা আলাদা হয়ে চলে আসলো তার হাতে। আরেকবার লাফিয়ে উঠল মেয়েটি। মাথা তুলে তার দিকে তাকানোর চেষ্টা করল, কিন্তু পারল না। ঠোঁট নাড়িয়ে কী যেন বিড়বিড় করে বলল মেয়েটি।

হাঁটুটা শেকল থেকে খুলে টেবিলের কাছে নিয়ে গেল। টেবিলের নিচে বড় ট্রে রাখা। সে ট্রেটার উপর হাঁটুটা রেখে আবার ফিরে আসলো। আরেক পায়ের কাছে চলে গেল সে। মেয়েটি কাতরাচ্ছে, গলার স্বর নেমে আসছে। যতটুকু সঞ্চিত শক্তি ছিল মেয়েটির, সেটাও শেষ হচ্ছে। সে চাপাতিটা আবার হাঁটু বরাবর নামিয়ে আনল সজোরে। এবারও মেয়েটা কই মাছের মতো লাফিয়ে উঠল। এবার আগেরবারের মতো এত জোরে লাফায়নি। এবার নিশ্চিত হলো, আসলেই শক্তি ফুরিয়ে আসছে মেয়েটির। থাকারও তো কথা না। তবে থাকলেই ভালো। নাহলে যে তার মজা শেষ হয়ে যাবে।

মেয়েটির শরীর এবার একদিক থেকে মুক্ত। হাঁটুর নিচ থেকে পা নেই, তাই সেদিক বন্ধনমুক্ত। পা-গুলো অসাড় হয়ে পড়ে আছে রক্তের ফোয়ারার উপর। সে দেরি না করে পাশ থেকে একটা শেকল টান দিয়ে কোমরে পেঁচালো। ডান দিকের দেয়ালে লিভার। লিভারে টান দিতেই কোমরটা চলে গেল বাম দিকে। মেয়েটা আর নড়তে পারল না। মেয়েটার মুখ থেকে গোঙানির শব্দ ভেসে আসছে। সে সেই হাঁটুটা নিয়েও ট্রের উপর রাখল।

আজকের মতো কাজ শেষ। তাকে আরও পাঁচদিন এই কাজ করতে হবে। একদিনে সবকিছু শেষ করার ইচ্ছে তার কোনো কালেই ছিল না। তাকে তার পরিকল্পনা পর্যন্ত এগুতে হবে। সময়ের কাজ সময়ে করতে হবে। এখন ফ্রেশ হয়ে স্বাভাবিক জীবনে ফেরার পালা।

অনেকক্ষণ যাবত মোবাইলটা বাজছে, রিংটোনের সাথে পাল্লা দিয়ে ভাইব্রেশন। দুটোর সম্মিলিত প্রচেষ্টায় আর ঘুমিয়ে থাকতে পারল না শফি। ঘুম ভেঙে যায় তার। মেজাজও গরম হয়ে যায়, তাই সে মোবাইল না ধরার সিদ্ধান্ত নিল। এদিকে আলসেমিতে সাইলেন্ট করাও আর হয়নি। সেই থেকে একটু পরপর মোবাইলটা বেজে উঠছে। কতক্ষণ যাবত বেজে চলছে সেটা খেয়াল নেই আর তার। আধঘুমে প্রায় অবচেতন হয়ে আছে সে। শান্তির ঘুমে বিরক্তির কারণ হিসেবে দাঁড়িয়েছে এই মোবাইলের রিংটোন।

বালিশে মুখ গুঁজে শুয়ে আছে সে। কিন্তু রক্ষে নেই, রিংটোনের আওয়াজ কানে এসে লাগছেই। অসহ্য লাগছে এখন। সেই সকালে প্রথম ফোনটা আসে, এরপর থেকে ফোনটা এখনো বেজেই চলছে। কে এই সকাল সকাল ফোন করে ডিস্টার্ব করছে? এমন সময় তো কারও ফোন আসার কথা না।

প্রতিদিন আরও কয়েক ঘণ্টা পরে ওঠে শফি, যখন সূর্য পূব আকাশের দিগন্ত থেকে বের হয়ে আসে। জানালার পর্দার ফাঁক দিয়ে আলো এসে তখন তার ঘুম ভাঙায়। অথচ এই মোবাইল ফোনের অসহ্য আওয়াজ শুনেই ঘুম ভাঙল আজ।

“এই উঠো না! কতক্ষণ যাবত ফোনটা বাজছে। উঠে ধরো।” পাশ থেকে ঘুম জড়ানো কণ্ঠে বলল অর্পা।

এই নিয়ে কয়েকবার শফিকে ঘুম থেকে ওঠার কথা বলল ও। গতকাল অফিস থেকে ফিরতে অনেক রাত হয়ে যায় শফির। বাসায় এসে দেখে বেবি জেগে আছে। বেবিকে নিয়ে প্রায় মধ্যরাত পর্যন্ত জেগে থাকতে হয় তাকে। আজ কয়দিন যাবত বেবিটার শরীর ভালো যাচ্ছে না। বেবির জন্য অর্পাকে প্রায়ই ছোটাছুটি করতে হয়। কালও সারাদিন বাসার বাইরে ছিল অর্পা। বাসায় ফিরে আবার বেবিকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে যাওয়ায় দুজনেরই ঘুমাতে দেরি হয়ে যায়। সেই সুবাদে ঘুমটা এখনো অপূর্ণ রয়ে গেছে দুজনেরই। ফোনের জন্য শফি যতটা না বিরক্ত, আওয়াজ শুনে মনে হচ্ছে অর্পা তার চেয়ে বেশি বিরক্ত।

“উঠো, ফোনটা রিসিভ করো।” এবার অর্পা উঠে বসল।

শফি চোখ বুজেই আছে। কিন্তু স্পষ্টই বুঝতে পারছে যে অর্পা বিছানা ছেড়ে উঠে গেছে। মেয়েরা পারেও। সারাদিন বাচ্চা, সংসার সামলিয়ে রাতে আবার বাচ্চার অতিরিক্ত জ্বালানি সহ্য করে। ভোর না হতেই আবার উঠে সংসারে ব্যস্ত হয়ে ওঠে। এজন্যই হয়তো পৃথিবীর সব ধর্মে মেয়েদের অনেক উঁচু জায়গা দেওয়া হয়েছে।

“সকাল হয়েছে। উঠে ফ্রেশ হয়ে নাও। আমি চা দিচ্ছি।” উঠে চলে গেল অর্পা।

বিছানার পাশে খয়েরি রং এর সাইড টেবিলের উপর মোবাইলটা কাঁপছে। শফি পাশ ফিরে চোখ খুলে মোবাইলটা হাতে নিল। ঘুম জড়ানো চোখে মোবাইলের স্ক্রিনে দেখল ২৮টা মিসড কল উঠে আছে।

এতগুলো কল কে দিল এত সকালে? মোবাইল খুলে দেখল ডিরেক্টরের নাম ভাসছে। কলিজাটা মোচড় দিয়ে উঠল। জরুরি না হলে এই সকালে ফোন দিত না ডিরেক্টর। শেষ কবে ডিরেক্টর ফোন দিয়েছিল সেটা তার মনে নেই। ব্যাটা বেশ গম্ভীর। অনেক অহংকারীও বটে, এমনটাই মনে হয় শফির কাছে। তবে সিআইডিতে তার বিকল্প কেউ নেই। যেমন কঠোর, তেমন নিজের কাজের প্রতি নিষ্ঠাবান। যদিও শফির সাথে বেশ ভালো সম্পর্ক ডিরেক্টরের। কিন্তু মোবাইলের স্ক্রিনে কালো হরফে ডিরেক্টরের নাম সত্যিই শফির বুক কাঁপলো।

বিছানায় কয়েকবার কুড়ি দিল। হাই তুলে শরীরটাকে মোচড় দিল কয়েকবার। তারপর স্থির হয়ে বসে কলটা ব্যাক করল শফি। কিছুক্ষণ রিং হওয়ার পর ওপাশ থেকে ফোনটা রিসিভ হলো।

“এতগুলো কল দিলাম, একটাও ধরতে পারোনি? তোমাকে সাসপেন্ড করা দরকার।” বাজখাই গলায় বলল ডিরেক্টর।

“সরি স্যার। আসলে শরীর ভালো যাচ্ছিল না তো। কাল আবার ঘুমাতে অনেক দেরি হয়ে যায়। সেইজন্য একটু…,”

শফির কথা শেষ না হতেই ডিরেক্টর বলল, “আচ্ছা ঠিক আছে। তাড়াতাড়ি গ্রিনরোডের ১/ক রোডে আসো।”

ডিরেক্টরের কথায় কিছু বুঝতে পারল না শফি। ওদের অফিস মালিবাগে। প্রথমে সেখানে গিয়ে কাজের এটেনডেন্স দিতে হয়, তারপর অন্য কিছু। কিন্তু ডিরেক্টর সাহেব সরাসরি অফিস ছেড়ে অন্য স্থানে যেতে বলল কেন? নিশ্চয় কিছু একটা ঘটেছে।

শফি প্রশ্ন করল, “কেন স্যার?”

ডিরেক্টর ঠান্ডা গলায় বলল, “একটা লাশ পাওয়া গেছে।”

লাশের কথা শুনে আঁতকে উঠল শফি। সদ্য মার্ডার কেস একদম ভালো লাগে না তার। পুলিশে আজ অনেক বছর ধরে আছে সে। বর্তমানে সিআইডিতে চিফ ইন্সপেক্টর পদে কর্মরত। এত বছরের সার্ভিস ক্যারিয়ারে খুব কম নতুন মার্ডার কেস হাতে নিয়েছে সে। তার অধিকাংশ কেস ছিল পুরনো কেস। কবর খুঁড়ে কঙ্কাল তুলে খুনি বের করাই ছিল মূল কাজ। এমন খুনখারাবি কেস খুব অপছন্দ তার। জয়েন করার পরই বলেছিল সে নতুন খুন হওয়া কোনো কেস নেবে না। পুরনো, চাঞ্চল্যকর কেসে তার সব আগ্রহ। অনেকদিন সেখানেই ছিল। ডিপার্টমেন্টে অনেকে তাকে গোরখোদক বলে ডাকে এজন্য। বসও টিটকারি কম করে না। কিন্তু আজ সব ভুলে এসব নতুন কেসে দিতে চাচ্ছে তাকে।

অনেকদিন গোরখোদকের কাজ করার পর শিফট হলো দুদকের ঘরে। দুদকের হয়ে কাজ করেছে বছরখানেক। মানি লন্ডারিং, কিডন্যাপ, সাইবার ক্রাইম এসব নিয়ে পড়ে থাকে শুধুমাত্র মার্ডার কেস থেকে বাঁচতে। কিন্তু আজ মনে হয় রক্ষে নেই। ডিরেক্টর যেহেতু নিজে ফোন করেছে কেসটা তাকে নিতেই হবে। বসের ফোন, এত বছর বসকে মানিয়ে চলেছে এবার বসের কথা মানতে হবে তার। তবুও একবার শেষ চেষ্টা করা উচিত।

শফি ভয়ে ভয়ে বলল, “স্যার, কেসটা নিয়াজকে দিলে হতো না?”

“চুপ করো। তাড়াতাড়ি আসো।” কথা শেষ করতে পারল না শফি, ডিরেক্টরের ধনক খেয়ে চুপ হয়ে গেল।

“কিন্তু স্যার মার্ডার কেস তো…,”

“তুমি নাও না, তাই তো?”

“জি স্যার।” ভিতু গলায় বলল শফি।

“আমার হাতে অন্য কোনো অফিসার নেই। কিছুদিন আগে এক নেতা খুন হয়েছে। তার কেসে তেইশ জন অফিসার কাজ করছে। এখন তুমি ছাড়া আমার হাতে কেউ নেই। লোকাল থানা থেকে যেটা জানিয়েছে সেটা জানার পর বুঝলাম, সিআইডির কেসে আগে-পড়ে ইনভলভ হতে হবে। এখনি হই আমরা। তুমি যদি কেস না নিতে চাও তাহলে কেসটা ডিবিতে চলে যাবে। তুমি চাও আমি ছোট হই সবার কাছে?”

“না স্যার।”

“তাহলে আপাতত কেসটা নাও। অন্য অফিসার ম্যানেজ হলে তোমাকে আর এই কেস নিয়ে ভাবতে হবে না।”

“আচ্ছা স্যার।”

ডিরেক্টর ফোনটা কেটে দিয়েছে। নিয়াজ কেসটা নিলে ভালো হতো। তাড়াতাড়ি সমাধান হতো। বাংলাদেশের সিআইডির শার্লক হোমস নিয়াজ। একটাও অমীমাংসিত কেস নেই ওর। যদিও সে সব হাই প্রোফাইল কেস নেয়, সাধারণ কোনো কেস নেয় না। সিরিয়াস ক্রাইম ইউনিটের সদস্য ও।

আজকের ক্রাইমটা বোধহয় মতো সিরিয়াস না তাই নিয়াজের বদলে তার ডাক পড়েছে। তবুও ভেতরটা কেঁপে উঠল শফির। এক কেস শেষ করে এসেছে কয়েকদিন হলো। আসার সাথে সাথেই ডাক পড়ল আবার! শেষ কেসে ভজকট পাকিয়ে ফেলে। সেটা থেকে বাঁচতে অবশেষে ডেস্কজবে ব্যস্ত হয়েছে। এখন বুঝতে পারছে, সিদ্ধান্তটা মোটেও ভালো ছিল না তার জন্য। এর থেকে ওএসডি খাওয়া ভালো ছিল। এই কেসটা থেকে বাঁচতে পারত।

বিছানা থেকে উঠে কিছুক্ষণ মাথা নিচু করে বসে রইল শফি। চোখে এখনো অন্ধকার দেখছে সে। মাথাটাও ঝিম ঝিম করছে। চোখগুলো কচলিয়ে বাথরুমের দিকে রওনা দিল সে। খারাপ একটা দিন যাবে আজ। বাথরুমে যাওয়ার আগে জামিলকে একটা ফোন দেয়া দরকার। বিছানার উপর থাকা মোবাইলটা হাতে নিয়ে জামিলের নাম্বারটা ডায়াল করল। কয়েকবার রিং হচ্ছে, কিন্তু কেউ ফোন রিসিভ করছে না। অগত্যা লোকেশনটা মেসেজ করে দিল শফি।

জামিল আজ পাঁচ বছর যাবত শফির সাথে কাজ করছে। অত্যন্ত মেধাবী অফিসার, সেই সাথে কম বয়সী, চতুর, সাহসী আর বিচক্ষণও সে। কয়েকদিন আগে আল রুহামা ব্যাংকের মানি লন্ডারিং এর কেস দুজন মিলেই সমাধান করে। পুরো সিআইডিতে নাম ছড়িয়ে যায় দুজনের। অবশ্য শফির থেকে বেশি নাম কামায় জামিল। চাকরিতে যোগদানের কিছুদিনের মধ্যে এত বড় কেসের সাথে জড়িত হয় এবং সাকসেসফুলি সেই কেস সলভ করতেও সক্ষম হয়। তবে শফির যে সুনাম হয় সেটাও কম না। ইন্সপেক্টর থেকে চিফ ইন্সপেক্টরে পদোন্নতি হয় তার। জামিল হয় চিফ ইন্সপেক্টর আর সিরিয়াস ক্রাইম ইউনিটের ইনভেস্টিগেটর। বন্ধুর পদোন্নতিতে খুশিই হয় শফি।

ফোনটা রেখে বাথরুমে যায় শফি। ফ্রেশ হয়ে ফিরে এসে দেখে টেবিলটার উপর এক কাপ চা রাখা। চায়ের পাশে কয়েকটা বাটার টোস্ট আর দুটো নোনতা বিস্কুট। এসব কোনোটা খাওয়ার সময় নেই এখন। বিছানায় অর্পা বেবিকে নিয়ে শুয়ে আছে। শফি এগিয়ে গিয়ে ওয়ারড্রব খুলে কাপড় পরতে শুরু করল।

বেবিকে দুধ পান করাতে করাতে বলল অর্পা, “এত সকাল সকাল কই যাচ্ছো?”

“একটু ইমার্জেন্সি ডাক পড়েছে। আমাকে বের হতে হবে।” শফি হেসে জবাব দিল।

“নাস্তা তো এখনো হয়নি।“

“নাস্তা বাইরে থেকে করে নিব।” কাপড় পরা শেষ করে এগিয়ে এসে কাপটা হাতে নিয়ে চুমুক দিল শফি।

“বিস্কুট খাও। খালি পেটে চা পান করলে গ্যাস্ট্রিক হবে।”

“সমস্যা নাই। বিস্কুট খাওয়ার সময় নেই। চা খেয়ে মাথাটাকে হালকা করছি।’

“আজও একটু বাইরে যেতে হবে।” বলল অর্পা। অর্পার দিকে তাকাল শফি। অর্পা বেবির পিঠে হাত বুলিয়ে যাচ্ছে।

“আজ আবার কোথায় যেতে হবে?” জানতে চাইল শফি।

“একটু বাইরে কাজ আছে। সন্ধ্যার আগে ফিরব।”

শফি কিছু বলল না। চা শেষ করে বের হয়ে গেল। সে পরিবার নিয়ে রায়ের বাজারে দোতলা একটা বাড়িতে থাকে। মেইন রোড থেকে বাড়িটা খানিকটা ভেতরে। একটু নির্জন হবার কারণে খুব কম দামেই বাড়িটা কিনেছিল। নিচতলায় থাকে তারা, আর উপর তলা খালি পড়ে থাকে। সে চাচ্ছে দোতলাটা ভাড়া দিয়ে দিতে কিন্তু অর্পার জন্য পারছে না। অর্পার ইচ্ছে সমস্ত বাড়িটায় ওরা একাই থাকবে। নির্জনতা অর্পার ভালো লাগে। মেয়েটা প্রচণ্ড ইন্ট্রোভার্ট। শফির থেকেও বেশি ইন্ট্রোভার্ট।

মূল রাস্তায় উঠতে একটা গলি পার হতে হয়, পাঁচ মিনিট হাঁটতে হয় সেজন্য। এলাকার অনেকেই শফিকে চেনে। গত পাঁচ বছর ধরে এখানে আছে তারা। আশপাশে সবার সাথেই ভালো একটা সম্পর্ক গড়ে উঠেছে ওদের। প্রতিদিন অফিসের গাড়ি ব্যবহার করে শফি। যদিও নিজের একটা গাড়ি আছে তার। তবে সেটি অর্পা ব্যবহার করে, নিজেই ড্রাইভ করে ও।

অর্পার সাথে শফির বিয়ে হয়েছে আজ পাঁচ বছর। এরেঞ্জড ম্যারেজ। শফির বাবা-মা কেউই বেঁচে নেই। প্রস্তাবটা আনে তার দূর সম্পর্কের এক ফুফু। সে শুধু মাথা নুইয়ে হ্যাঁ জানিয়েছিল, বাকিটা ঐ ফুফুই করে। তবে শ্বশুরবাড়ির কারও সাথে এখন কোনো যোগাযোগ নেই তাদের। অর্পার শুধু বড় ভাই বেঁচে ছিল। বোনের বিয়ে দিয়েই উনি দেশ ছেড়ে কানাডায় চলে যান। যাবার সময় সকল সম্পত্তি লিখে দিয়ে যান বোনের নামে। বিয়েটা এত জাঁকজমকপূর্ণ না হলেও অনেকেই এসেছিল। অফিসের প্রায় সবাইকে দাওয়াত দিয়েছিল সে।

গাড়িতে বসে স্টার্ট দিল শফি। গেট দিয়ে বের করে গলিতে নিয়ে আসলো। সরু গলি, তাই আস্তে আস্তেই পার হতে হয় সেটা। সামনেই দেখতে পেল কেউ একজন হাত দিয়ে ইশারা করছে তাকে। মাহফুজ সাহেব, শফির একমাত্র প্রতিবেশী ও স্বনামধন্য গাইনোকোলজিস্ট। মাহফুজ সাহেবের সামনে এসে থামল সে। মাহফুজ সাহেব খুব কায়দা করে গাড়ির পাশে এসে দাঁড়াল।

শফি যে গাড়িটি চালায় সেটি একটি পুলিশ জিপ। একদিক দিয়ে গাড়ি গেলে অপরপাশ দিয়ে রিকশা আসারও জায়গা থাকে না এই গলিতে। ভাগ্য ভালো এই গলিতে লোকের চলাচল কম। অবশ্য মাঝেমধ্যে জ্যাম লেগে যায়। দুটো রিকশা পাশাপাশি ঢুকলেই রাস্তা বন্ধ হয়ে যায়।

মাহফুজ সাহেবকে দেখে শফি কাঁচ নামিয়ে নিল। মাহফুজ সাহেব এগিয়ে এসে জিজ্ঞেস করল, “কই যাচ্ছেন শফি সাহেব?”

শফি স্টিয়ারিং-এ চোখ রেখে বলল, “অফিসে যাচ্ছি।“

“যদি কিছু মনে না করেন তাহলে আমাকে একটু সামনে নামিয়ে দিতে পারবেন?” অনুরোধের সুরে বলল মাহফুজ সাহেব।

“অবশ্যই।” গাড়ির দরজাটা খুলে দিয়ে বলল শফি।

মাহফুজ সাহেব এসে বসল শফির পাশে। “দরজাটা লাগান।” বলল শফি।

“ওহ আচ্ছা।” বলে মাহফুজ সাহেব দরজাটা লাগাল।

গাড়ি চলছে। মাহফুজ সাহেব চুপ করে বসে আছে। শফি মাঝেমধ্যে তাকাচ্ছে মাহফুজ সাহেবের দিকে। গলি পার হয়ে গাড়ি মেইন রোডে উঠল। এখন শোঁশোঁ করে ছুটছে গাড়ি।

“কিছু বলবেন?” শফি বলল।

মাহফুজ সাহেব নিরুত্তর। মনে হয় শুনতে পায়নি।

“মাহফুজ সাহেব! কিছু বলবেন?” জোরেই বলল শফি।

শফির দিকে তাকাল মাহফুজ, চমকে উঠল বটে।

“কিছু ভাবছিলেন নাকি?”

“তেমন কিছু না। তবে…,”

“তবে কী?”

“ভাবী কি আজকাল কোনো জব করছে নাকি?” মাহফুজ সাহেব চিকন সুরে বলল।

মাহফুজ সাহেবের এমন প্রশ্নে চমকে উঠল শফি। একটুর জন্য ব্ৰেক ধরেনি। ধরলেই মাহফুজ সাহেব উইন্ডো ফ্রেম ভেঙে ছিটকে পড়ত। কিন্তু ঠিক সময়ে শফি পা নিয়ন্ত্রণ করে। গতি কমিয়ে দিয়ে মাহফুজ সাহেবকে প্রশ্ন করল, “না তো, হঠাৎ এই প্রশ্ন?”

“এমনিই করলাম। ভাবীকে প্রায়ই দেখি আপনি বের হওয়ার পর বের হয়, তাই জিজ্ঞেস করলাম আরকি। কিছু মনে করলেন না তো?” মাহফুজ সাহেব শফির দিকে তাকিয়ে হেসে দিল।

আবার গতি বাড়াল শফি, “না কী মনে করব। বাচ্চাটার শরীর খারাপ তো। তাই প্রায় ওকে নিয়ে ডাক্তারের কাছে যেতে হয়।”

“ওহ।”

দুজনেই চুপচাপ বসে আছে।

“আমাকে সামনের হাসপাতালের সামনে নামিয়ে দিয়েন। “

গাড়িটা এসে হাসপাতালের সামনে থামলে দরজা খুলে নামল মাহফুজ সাহেব।

“ধন্যবাদ।” মুখে হাসি টেনে বলল সে।

শফি হাসি ফিরিয়ে দিয়ে দরজা বন্ধ করে রওনা দিল ক্রাইম সিনের উদ্দেশ্যে।

সকালের খবরের কাগজটা চেক করছে কন্সটেবল সিদ্দিক। প্রথম পৃষ্ঠা থেকে শেষ পৃষ্ঠা পর্যন্ত দেখল। না, খুন সম্পর্কে কোনো খবর ছাপা হয়নি। সব শুধু নির্বাচনের খবর। নির্বাচনের নিচে চাপা পড়েছে খুনের খবর। পত্রিকাটা নিয়ে সিদ্দিক রওনা দিল ওসির দিকে। ওসি দানিয়াল জিপে বসে আছে। ওসির চোখে একরাশ আলস্য। একটু পরপর কেবল হাই তুলছে। সাধারণত এসব কাজে এসআইরা আসে, কিন্তু আজকের কেসটা গুরুতর। তাই সরাসরি ওসি চলে আসলো।

গ্রিনরোডের একটি গলির রাস্তায় লাশটা পাওয়া যায়। রাস্তার দুপাশেই ব্লক করে রাখা হয়েছে। ভয়ে চলাচল বন্ধ করে দিয়েছে মানুষজন। লাশটা একবার দেখেই বমি আসার মতো অবস্থা দানিয়ালের। চারজন পুলিশ লাশটার চারপাশে পাহারা দিচ্ছে। আর ফরেনসিকের লোক পরীক্ষা চালাচ্ছে এখনো। লাশের অবস্থা এমন খারাপ যে অতিরিক্ত ডিএমপি কমিশনার স্পটেই পোস্ট মর্টেম করতে বলে দিয়েছে।

স্যার খবর দেখলাম। কোথাও সংবাদ ছাপা হয় নাই।” সিদ্দিকের কথায় চিন্তায় ছেদ পড়ে দানিয়ালের।

দানিয়াল আকাশের দিকে তাকিয়ে বলল, “ভালো খবর। খবর ছাপলে যে কী অবস্থা হতো আল্লাহই ভালো জানে।

“এখন কি আর এই খবর ছাপার সময় আছে? এখন তো নতুন সরকার নিয়ে সবাই ব্যস্ত। কে কোন মন্ত্রী হইব, বিরোধী দলের রিয়েকশন কী, বিরোধী দলের এখন কী অবস্থা হইব এই নিয়েই তো সব পত্রিকা ব্যস্ত।” সিদ্দিক এক নিঃশ্বাসে সব কথা বলল।

কিন্তু দানিয়াল ভাবছে অন্য কিছু নিয়ে। কেসটা সিআইডিতে গেলে, দানিয়ালকে সহকারী হিসেবে থাকতে হবে। আর সেটা সে কিছুতেই মানতে পারছে না। কমিশনারের সাথে এ নিয়ে তর্ক করেছে, কিন্তু লাভ হয়নি। সবচেয়ে বড় প্রশ্ন হলো, সিআইডির মতো বিশেষায়িত দল সাধারণ পুলিশকে নিয়ে কাজ করবে কেন? এরকম হওয়ার কথা না। সিআইডির কেস সিআইডি সামাল দেবে। অবশ্য এরকম কোলাবোরেশন কেস আগেও হয়েছে। জনবলের অভাব হলে এমন হয়, পুলিশকে ব্যবহার করে সিআইডি।

নতুন সরকার গঠন হলো মাত্র কিছুদিন আগে। দেশের প্রশাসনিক অবস্থা গঠন হওয়া শুরু করেছে মাত্র। এই সময়ে এরকম খুনের খবর মুহূর্তে অস্থিতিশীল করে ফেলবে দেশের অবস্থা। আর সেটা নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হবে না পুলিশের পক্ষে। এই অজুহাত দেখিয়ে অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার এই কেস দানিয়ালকে সহকারী করে সিআইডির উপর ন্যাস্ত করে।

এতে সিআইডির লাভ হবে। সেটাও বেশ সরল সমীকরণ। কেসে ব্যবহার করবে স্কেপগোট হিসেবে। যাতে ঘটনাটা ছড়ালে সিআইডি বলতে পারে, এতদিন লোকাল থানায় ছিল, এখন সিআইডি দেখছে। এতে দোষ থেকেও রেহাই মিলবে, আবার সময়ও পাবে।

“স্যার একটা মাইক্রো আসতেছে। মনে হয় সিআইডির।” সিদ্দিক ঘাড় ফিরিয়ে বলল। চিন্তায় ছেদ পড়ল দানিয়ালের। সিদ্দিকের কথা দানিয়াল ঠিক করে শোনেনি।

“কিছু বলেছো সিদ্দিক?” সিদ্দিককে জিজ্ঞেস করে দানিয়াল।

একটা জিপের দিকে তাকিয়ে বলল সিদ্দিক, “স্যার মনে হয় সিআইডি আসতেছে।”

দানিয়াল জিপ থেকে নেমে সেদিকে তাকাল। সিআইডির একটা জিপ এদিকে এগিয়ে আসছে। কালো রঙের একটা রোভার এসে দানিয়ালের জিপের থেকে একটু দূরে থামল। এক মধ্যবয়স্ক লোক নেমে এল জিপ থেকে। গোল মুখ, উচ্চতা প্রায় ৫ ফুট ১১ ইঞ্চির কাছাকাছি। গায়ে একটা লাল রঙের টি-শার্ট। টি-শার্টের সাথে ম্যাচ করে প্যান্ট পরা। মুখ ক্লিন শেভ, চুলের সামনের দিকে পাক ধরেছে। একদম শরীরবিদদের মতো শরীরের গঠন। দেখে বোঝা যাচ্ছে না সিআইডির অফিসার না কোনো ফুটবল প্লেয়ার। লোকটি ধীরগতিতে হেঁটে আসছে দানিয়ালের দিকেই।

“তুমি কি ইনচার্জ?” দানিয়ালের সামনে এসে বলল শফি।

প্রশ্ন শুনে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল দানিয়াল। সে পুলিশে আজ পাঁচ বছর ধরে চাকরি করছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দর্শনে পাশ করার পর পুলিশের এসআই পদে যোগ দেয়। এখন সে ওসি। তার-ও তো একটা নিজের ব্যক্তিত্ব তৈরি হয়েছে এতদিনে। আর এই লোকটা এসেই তুমি করে বলছে!

“জি স্যার। আমি দানিয়াল। ভারপ্রাপ্ত ইনচার্জ।” দানিয়াল নিচু গলায় জবাব দিল।

শফি ওসির দিকে তাকাল। লোকাল অফিসার হিসেবে যেরকম থাকার কথা সেরকমই। দেখে মনে হচ্ছে বেশ ধার্মিক। বয়সও বেশি হবে না। আটাশ থেকে ত্রিশ হবে। বেশ কম বয়সে ওসি হয়েছে, তা-ও ডিএমপির স্বনামধন্য একটা থানার। লবিং হয়তো করেছে নিশ্চয়। একুশ বাইশে এসআই হলেও সম্ভব। পাঁচ বছর পর সহকারী ইনচার্জ, আর এখন ইনচার্জ। যাকগে, এতে শফির তেমন মাথা ব্যথা নেই।

অন্য দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল শফি, “খবর দিল কে?”

দানিয়াল ছোট করে জবাব দিল, “সিটি কর্পোরেশনের এক কর্মী।”

“মানে সকাল সকাল?”

“তেমনই বলা যায়

“কই সে?”

“আপাতত হেফাজতে আছে।”

“থানায়?”

“জি স্যার।”

“লাশ কই?”

“স্পটেই আছে। পোস্টমর্টেম হচ্ছে।”

“লাশ তুমি নিজে গিয়ে দেখেছো, না কোনো হাবিলদার কিংবা কনস্টেবল দিয়ে কাজ চালিয়ে নিয়েছ?”

দানিয়াল এবার চুপ করে থাকল। বুঝতে পারল খোঁচা দেওয়ার জন্য বলেছে। কর্তৃত্ব ধরে রাখতে সিনিয়র অফিসাররা প্রায়শ এমন করে। ইন্ডিরেক্টলি ভার্সিটির সিনিয়রদের মতো র‍্যাগ করে। তবে সিনিয়র পুলিশ হলে সহ্য হতো, দিয়েছে সিআইডির লোক। শফি হাবিলদারের কথাটা যে দানিয়ালকে তাচ্ছিল্য করে বলেছে তা স্পষ্ট।

দানিয়াল ওয়াকিটকিটা নেড়ে বলল, “আমি প্রথমে নিজে গিয়েই ক্রাইম সিন তদন্ত করি। তারপর উপরের নির্দেশে ফরেনসিক টিমকে খবর দেই।”

শফি এবার দানিয়ালের দিকে তাকিয়ে বলল, “ঘটনাটা খুলে বলো।”

মুখটা শক্ত করে দানিয়াল বলল, “স্যার, সকালে ছয়টা ত্রিশের দিকে আমি থানা থেকে ফোন পাই। আমাকে ফোন করে ওই সময় ডিউটিতে থাকা কনস্টেবল ইয়াসিন বলল, গ্রিন রোড থেকে ফোন আসছে, একটা লাশ পাওয়া গেছে। আমি বাসা থেকে এখানে এসে দেখি ছোটখাটো একটা জট, তারপর ক্লিয়ার করলাম। লাশটা স্যার রাস্তায় ছিল না, ডাস্টবিনে ছিল। একদম ডাস্টবিনের মুখে। লাশটা দেখেই স্যার…!”

দানিয়াল থেমে যাওয়ায় শফি প্রশ্ন করল, “কী?”

দানিয়াল কিছুটা সামনে ঝুঁকে বলল, “স্যার লাশকে সাত টুকরা করে ফেলে রাখা হয়। লাশ একদম পচে গেছে। চুল দেখে বোঝা যায় লাশটা মহিলার। চেহারা বোঝা যায় না, অনেকটাই বিকৃত হয়ে গেছে।”

দানিয়ালের কথা শুনে থমকে গেল শফি। এরকম নৃশংস ঘটনা অহরহ হয় কিন্তু এরকম কাজ করে খুনিরা সাধারণত লাশ লুকিয়ে রাখে। এভাবে মাঝরাস্তায় ফেলে দিয়ে যায় না। ভিক্টিমের পরিচয় লুকাতে সাধারণত খুনিরা লাশকে কেটে টুকরো টুকরো করে। তারপর হয় এসিড দিয়ে নষ্টকরে ফেলে, নাহয় নদী বা কোনো পরিত্যক্ত জায়গায় ফেলে আসে। কিন্তু এ ক্ষেত্রে একদম উল্টো। পকেট থেকে মোবাইলটা বের করে জামিলকে ফোন করল। কিন্তু কেউ ধরছে না। জামিল থাকলে এই বিষয়টা সামলে নিত। লাশের সামনে যেতে সাহসে কুলাচ্ছে না শফির। কঙ্কালের সাথে কাজ করে অভ্যস্ত হয়েছে সে। মাটি খুঁড়ে সত্য বের করত, আর এখন মাটির উপর সত্যকে খুঁজতে অস্বস্তি লাগছে তার।

শফিকে অস্বস্তিতে দেখে সুযোগটা মিস করল না দানিয়াল। বুঝতে পারল লোকটা গোর দেখে অভ্যস্ত না। সিআইডির অন্য কোনো ব্রাঞ্চের লোক সে। তার কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমছে, তাছাড়া চোখের পাতা বেশ দ্রুত ফেলছে। কণ্ঠনালিটাও নড়ছে বেশ। ঘাবড়ে আছে সিআইডি অফিসার। খোঁচা মারার সুযোগটা মিস করা উচিত হবে না। তবে নিতে পারবে কতটুকু তা দেখার বিষয়।

দানিয়াল বলেই ফেলল, “স্যার লাশটা দেখবেন নাকি? যদি না দেখতে চান সমস্যা নাই, ছবি তোলা আছে ফরেনসিক টিমের কাছে। বিকেলের মধ্যে পাওয়া যাবে। চলেন আপনাকে লাশটা দেখিয়ে আনি।”

“আরে না না তুমি দেখেছো না!” মুখে জোর করে হাসি ফুটিয়ে বলল, “তাছাড়া বিকেলে তো ফরেনসিক থেকে ছবি আসবে।”

“তারপরও স্যার। একবার আপনি দেখে নিলে ভালো হয়। যাক, আপনি দেখতে চাচ্ছেন না যেহেতু আর কী করার। বিকেলে আশা করি সব পেয়ে যাব।

শফি শান্ত হয়ে জবাব দিল, “সেটাই ভালো। লাশটা আইডেন্টিফাই করেছো?”

দানিয়াল চট করেই উত্তর দিল, “স্যার চেহারা তো বোঝা যায় না। তবে আর্টিস্ট দিয়ে লাশটার আনুমানিক মুখ এঁকে রেখেছি।”

দানিয়ালকে দেখে প্রথমে অত বুদ্ধিমান মনে হয়নি শফির। এভারেজ হাইট, মাঝাড়ি গড়নের, স্লিম শরীর। সামনের দিক থেকে মাথার চুল কপালের উপর পড়ে আছে, মুখভর্তি দাড়ি, কপালে কালো দাগ ফুটে উঠেছে। ধার্মিক পুলিশ অফিসার। বয়স বেশি না, কিন্তু দাড়ি রাখার কারণে বয়স অনেক মনে হচ্ছে। কিন্তু ছেলেটার উপস্থিত বুদ্ধি দেখে মুগ্ধ না হয়ে পারল না শফি।

শফি বলল, “মনে হচ্ছে রিভেঞ্জ কেস।”

দানিয়ার ভারী গলায় জবাব দিল, “আমার স্যার তেমন মনে হয় না। শফি জিপের বনেটের উপরে বসল। দু-হাত মুঠ করে বলল, “মানে? তুমি কি মনে করছো অন্য কেস? কিডন্যাপিং হলে তো এইভাবে সাত টুকরা করত না। করলেও এভাবে ওপেন রেখে যেত না। আর রাইভাল কেস হলে এইভাবে খুন করার প্রশ্নই আসে না। লাশটা নদীতে ফেলে দিত অথবা পুঁতে ফেলত। লাশটা আনট্রেসেবল রাখার চেষ্টা করত।”

দানিয়াল মনোযোগ দিয়ে শফির কথা শুনল। যুক্তি খারাপ না সিআইডি অফিসারের। তবে এই যুক্তিগুলোর সাথে সহমত না দানিয়াল। তাছাড়া দানিয়ালের মনে অনেক প্রশ্ন জমেছে, আছে অনেক কনফিউশান। কোনো রকম উপসংহারে পৌঁছানোর আগে এই প্রশ্নগুলোর জবাব পেতে হবে।

দানিয়াল নিজের মনের কনফিউশান দূর করতে বলল, “স্যার আমার একটা প্রশ্ন, লাশটা সাত টুকরো করে ডাস্টবিনে রেখে যাওয়ার উদ্দেশ্য কী? যদি রিভেঞ্জ কেস হয় তাহলে কয়েকটা প্রশ্ন থেকে যায়।”

“যেমন?”

“কেন লাশটা ডাস্টবিনে রাখা হলো? সাত টুকরা করে লাশটা এভাবে পাবলিক প্লেসে রাখার উদ্দেশ্য কী? আর যদি ডাস্টবিনে ফেলে যাওয়া উদ্দেশ্য থাকত তাহলে সাত টুকরা করার প্রয়োজন কী? সবচেয়ে বড় প্রশ্ন হল লাশটাকে পচা অবস্থায় কেন ফেলে গেল? সাধারণত রিভেঞ্জ কেসে খুনি ভিক্টিমকে লুকানোর চেষ্টা করে, কিন্তু এখানে একদম উল্টো হলো। খুনি স্যার এই রিস্কটা কেন নিল? লাশ এখানে রাখা অনেকটা ঝুঁকির কাজ। যে কেউ দেখতে পারত। সম্ভাবনা থাকত ধরা পড়ার।” দানিয়াল জবাব দিল।

দানিয়ালের কথা শুনে চিন্তায় পড়ে গেল শফি। খুনির যদি প্ৰতিশোধ নেওয়াই উদ্দেশ্য থাকত তাহলে লাশটা এরকম জনবহুল স্থানে ফেলে যেত না। এত বড় ঝুঁকি নেয়ার দরকার কী? লাশটা পুঁতে ফেলত অথবা নদীতে ফেলে দিত। বড় কথা, লাশটা এতদিন ধরে খুনি নিজের কাছে রাখল কেন? তার একটাই কারণ, খুনি নিশ্চয় ধরা পড়ার ভয়ে ছিল। আর যদি ধরা পড়ার ভয় থাকবে তাহলে এরকম জনবহুল স্থানে লাশ ফেলে গেল কেন? এর কোনো উত্তর আপাতত শফির কাছে নেই।

শফি নিজের যুক্তিকে সমর্থন দেয়ার জন্য বলল, “খুনি হয়তো ভয়ে ছিল। ধরা খাওয়ার ভয় থাকাতো স্বাভাবিক। তাই না? তাই লাশটা সরাতে দেরি করে, ফলে লাশটা পচে যায়। অবশ্য এখানে একটা প্রশ্ন থেকে যায় খুনি যদি লাশ সরাতে এত সময় নেয় তাহলে খুনি এরকম পাবলিক প্লেসে কেন লাশ ফেলে যাবে?”

দানিয়াল আবার চট করে জবাব দিল, “ঠিক বলেছেন। খুনি নিশ্চয় বোকা না। বোকারা কখনো খুনি হতে পারে না।”

এবার শফি দানিয়ালকে সমর্থন করে বলল, “ঠিক বলেছো।”

দানিয়াল এবার ক্রাইম সিনের দিকে মুখ ফিরিয়ে বলল, “আপাতত স্যার, ভিক্টিমের পরিচয় বের না করা পর্যন্ত তদন্ত সামনের দিকে নেয়া যাবে না। আমি স্যার আর্টিস্ট থেকে আঁকানো ছবিটা সব থানায় ফ্যাক্স করে দিয়েছি, কিছু তোলা ছবিও দিয়েছি। আশা করি দুই-তিন দিনের মধ্যেই কোনো খবর পাব। “

শফি অবাক হলো দানিয়ালের কথা শুনে। এই ছেলেটার সিআইডিতে থাকা দরকার। তিন-চার ঘণ্টার মধ্যে প্রায় সারাদিনের কাজ করে ফেলল। ছেলেটা প্রত্যুৎপন্নমতি।

“চলো থানায় যাই, আর তোমার কন্সটেবলকে পাঠিয়ে দাও ফরেনসিক টিমের সাথে প্রাইমারি রিপোর্ট আনতে।” সিদ্দিকের দিকে ইশারা করে বলল শফি।

“সিদ্দিক বিকেলের মধ্যে রিপোর্ট নিয়ে থানায় যাবা। এই নাও জিপের চাবি। আমি স্যারের সাথে যাচ্ছি। তুমি জিপ নিয়ে যাও।” সিদ্দিকের দিকে চাবি দিয়ে বলল দানিয়াল।

“জি স্যার।” সিদ্দিক চাবি নিয়ে বলল।

কালো রংয়ের ভ্যানে করে দুজন রওনা দিল কলাবাগান থানার উদ্দেশ্যে। দানিয়াল ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখল প্রায় একটা ছুঁইছুঁই। আজ রাতে মেয়ে দেখতে যাবার কথা তার। মা অনেকদিন যাবত প্রেশার দিচ্ছে। গতকাল বলেছে আজ যাবে। কিন্তু ভোরেই খবর আসলো এই খুনের। মাকে ফাঁকি দেয়া যাবে না আজ, কিন্তু অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে এই অফিসারের খপ্পর থেকে বের হওয়া মুশকিল হবে। যদিও অফিসার এখন পর্যন্ত কোনো কর্তৃত্ব খাটানোর চেষ্টা করেনি, তবে অহংকারী মনে হয়েছে খুব। এখন পর্যন্ত নিজের নামটাও বলেনি

দানিয়ালকে চুপ থাকতে দেখে শফি প্রশ্ন করল, “কী ভাবছো দানিয়াল?”

দানিয়াল জবাব দিল, “কিছু না, স্যার।”

শফি এক হাতে স্টিয়ারিং ধরে আরেক হাত দিয়ে ব্যাকপকেট থেকে মোবাইল বের করে সামনে এনে রাখল ড্যাশবোর্ডের উপর। তারপর আবার হাত দিয়ে স্টিয়ারিং ধরে দানিয়ালকে জিজ্ঞেস করল, “থাকো কই?”

“কলাবাগানে।”

“ছেলেমেয়ে?”

“স্যার বিয়েই হয়নি।” হেসেই জবাব দিল দানিয়াল।

“বিয়ে করোনি, আরামে আছো। বিয়ের আগ পর্যন্তই জীবন।“

“ম্যাডাম কি খুব প্যারা দেয় স্যার?”

“তা আর বলতে। আমার বউ মানে অর্পা আমাকে নিয়ম করে প্যারা দেয়।”

শফির কথা শুনে দানিয়াল হেসে বলল, “তাহলে স্যার বিয়েটা না করি, এটাই ভালো।”

“বিয়ে না করলে এই সমাজ আঙুল তুলবে দানিয়াল সাহেব। বিয়ে তো করতেই হবে।”

দানিয়াল চুপ করে থাকল। আজকে মেয়ে দেখতে যাওয়ার ব্যাপারটা উনাকে বলা ঠিক হবে কি না সেটাই বুঝতে পারছে না সে। গত কয়েকবছর ধরে একের পর এক মেয়ে দেখা হচ্ছে কিন্তু এখনো কোনো মেয়ে পছন্দ করতে পারছে না তার মা। মায়ের উপরে কিছু বলার সাহসও নেই তার, সে যা বলে তাই করে দানিয়াল।

দানিয়ালকে চুপ থাকতে দেখে শফি আবার বলল, “তোমাকে বোধহয় আমার নাম বলা হয়নি। আমার নাম শফি।”

দানিয়াল সে কথাকে এড়িয়ে বলল, “স্যার কেসে তো মিসিং লিংকেজ ছাড়া কিছুই নেই। কোনো ক্লুও নেই।”

শফি দানিয়ালের দিকে তাকিয়ে বলল, “বডি আইডেন্টিফাই না করা পর্যন্ত কিছুই বলা যাচ্ছে না দানিয়াল। আগে এটা করতে হবে।”

দানিয়াল মাথা নেড়ে বলল, “তা ঠিক।”

দুজনেই চুপ। শফি নিজ মনে গাড়ি চালিয়ে যাচ্ছে। দানিয়াল নীরবতা ভেঙে বলল, “আচ্ছা স্যার, যদি কিছু মনে না করেন একটা প্রশ্ন করি?”

“অবশ্যই।” হাসি দিয়ে জবাব দিল শফি।

দানিয়াল সুযোগ পেয়ে মাথায় ঘুরতে থাকা প্রশ্নটা করেই ফেলল, “স্যার, এই সাধারণ একটা মার্ডার কেসে সিআইডিকে আসতে হলো কেন? কেসটা বড়জোর লোকাল থানা থেকে ক্রাইম ব্রাঞ্চে যেত?”

শফি জবাব দিল, “সেটা আমিও ভাবছি। এই কেসে আমাকে জড়ানো হলো কেন?”

দানিয়াল চুপ করে থাকল। কেসটা বড়জোর ক্রাইম ব্রাঞ্চ এর হাতে যেত কিন্তু সিআইডির কাছে গেল কেন?

শফি গাড়ি চালাচ্ছে আর ভাবছে, এরকম দিনও যে তাকে দেখতে, এটা কখনো ভাবেনি। একজন লোকাল থানার ওসির সাথে কাজ করতে হবে। স্যার তাকে সিআইডি থেকে একটা টিম দিতে পারত। বড্ড বেমানান লাগছে। তাছাড়া তার মধ্যে গাম্ভীর্জতার বেশ অভাব। গম্ভীর থাকলে হয়তো ভালো হতো তার জন্য। সিনিয়রিটি আর সুপিরিয়রিটি বজায় থাকত।

কলাবাগান থানায় বসে আছে শফি। ছোটখাটো গোছানো একটা থানা। লোকের তেমন আনাগোনা নেই। সম্ভবত অপরাধ হওয়া কমে গেছে। নাহলে এই এলাকার মানুষরা সবাই ভালো হয়ে গেছে। কিন্তু সেরকম হওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই। এসব নিয়ে কয়েকটা টেবিল, কিছু ধূলিমলিন ফাইল আর ঝিমাতে থাকা পুলিশ এই থানার প্রধান বৈশিষ্ট্য।

ফেব্রুয়ারি শুরু হয়েছে। আজ ফেব্রুয়ারির দুই তারিখ। শীত তেমন একটা কমেনি, উল্টো বেড়ে গেছে। শীতের শেষ ঠ্যালা, সাধারণ গরম কাপড় পরেও সামলানোর উপায় নেই। গরম হওয়ার জন্য গরম কিছু প্রয়োজন। যেমন এই মুহূর্তে এক কাপ চা পেলে ভালো হতো, কিন্তু চা চাওয়ার মতো কাউকে দেখতে পাচ্ছে না সে।

শফি দানিয়ালকে ডাক দিল, “দানিয়াল?”

“জি স্যার।” পাশে দাঁড়িয়ে জবাব দিল দানিয়াল।

শফির সামনে এক তরুণ বসে আছে। বয়স আঠারো কিংবা উনিশ এর বেশি হবে না, গাল ঝুলে দুপাশে পড়ে আছে, চুল একদম শজারুর কাঁটার মতো দাঁড়িয়ে আছে। ভারী শরীর নিয়ে থানার সরু চেয়ারে কাঁচুমাচু হয়ে বসে আছে সে। চেয়ারটাও তার শরীরের তুলনায় অনেক ছোট হয়ে গিয়েছে।

তার উল্টোপাশে বসে আছে শফি, তাদের মাঝখানে একটা টেবিল, টেবিলের উপর গোছানো ফাইলের ছোটখাটো একটা স্তূপ। সেখানে একটা কলমদানিও আছে। শফি কলমদানি থেকে কলম নিয়ে টেবিলে আস্তে করে কয়েকবার টোকা দিল।

দানিয়ালের দিকে ঘাড় ফিরিয়ে বলল, “এক কাপ চা নিয়ে আসতে বলো।”

“জি স্যার।” বলেই দানিয়াল ডাক দিল, “সিদ্দিক! সিদ্দিক! এক কাপ চা নিয়ে আসো তো।”

“নাম কী?” সামনে বসা ছেলেটিকে প্রশ্ন করল শফি।

ছেলেটি শফির প্রশ্ন শুনে একটু নড়েচড়ে বসে জবাব দিল, “তপন। শফি এবার ধমক দিয়ে বলল, “পুরা নাম বল!”

ছেলেটি ধমক শুনে ভয় পেয়ে গেল, কিছুক্ষণের জন্য মুখ কালো করে তাকিয়ে রইল শফির দিকে। সে হালকা কাঁপছে, সেটা দানিয়াল বুঝতে পারছে। ছেলেটা ভয়ে সিটিয়ে আছে। তাকে এত ধমক দেওয়ার কোনো মানে নেই।

সে কাঁপা কাঁপা গলায় আস্তে আস্তে বলল, “তপন কুমার।

শফি এবার নরম হয়ে জিজ্ঞেস করল, “থাকিস কই?”

“কমলাপুর বস্তিতে।”

“লাশ কি তুই প্রথম দেখছিস, না তোর আগে অন্য কেউ দেখছে?”

“সেটা তো কইবার পারি না স্যার।”

“তোকে কি কেউ ডাক দিয়ে এনে লাশ দেখিয়েছে না তুই নিজেই দেখছিস?”

“না স্যার, আমি নিজেই ময়লা নিতে আইসা দেখছি।

“ঘটনাটা খুলে বল।”

তপন এবার নড়েচড়ে বসল, তার মুখে হালকা চমক ফুটে উঠল। তার ভয় কাটছে। সে ঢোঁক গিলে বলতে লাগল, “স্যার, আমার জীবনেও আমি এমন ভয় পাই নাই, আজ যতটা না ভয় পাইছি। আমার আজ খারাপ দিন যাইব, সেইটা সকালেই বুঝতে পারছি। কেন জানি আজএতসকালে কাজে আসলাম…,”

“অন্যদিন কয়টায় আসিস?” তপনকে থামিয়ে দিয়ে দানিয়াল পাশ থেকে প্রশ্ন করল।

“সাড়ে ছয়টা থাইকা সাড়ে সাতটার মধ্যে। তো স্যার হইছে কী, আইজ তো সকাল আইসা পড়ছি। হাতে নিউমার্কেট থেকে কিনা টর্চ লাইট নিয়া বের হইছিলাম।”

তপন ছোট একটা টর্চ লাইট প্যান্টের পেছন থেকে বের করে শফিকে দেখাল। শফি একনজর টর্চ লাইটটার দিকে চোখ বুলিয়ে নিল। শফি মাথা দিয়ে ইশারা করতেই সে আবার পকেটে ঢুকিয়ে নিল। ছেলেটা বেশি কথা বলে।

“কাজের কথা বল। তারপর কী দেখছিস সেইটা বল।” ধমকের সুরেই শফি বলল।

“একে একে ময়লা তুলতেছিলাম ট্রলিতে। ট্রাক ড্রাইভার দূরে পইড়া ঘুমাইতাছে। আমার ট্রলি দিয়া মাল টাইনা মাল ট্রাকে তুলা লাগে। আমি স্যার এক এক করে ডাস্টবিন পরিষ্কার করে আসতেছিলাম। তো এই ডাস্টবিনটার কাছে আইসাই দেখি একটা মাথা দেখা যায়। আমি ভাবছিলাম কুত্তার মাথা বুঝি। হাতে বেলচাটা নিয়া সামনে গেছিলাম তুলতে। গিয়া দেখি স্যার কুত্তার মাথা না, মানুষের মাথা। টর্চটা ভালো করে মারলাম মাথাটার দিকে। যা দেখলাম স্যার, তারপর থাইকা আমার বুক এখনো ধুরফুর করতাছে। তারপর পাশের ল্যান্ডলাইন থাইকা আমি থানায় কল দিছি।”

কথাটা শোনার পর শফি খানিক চুপ থেকে আবার প্রশ্ন করল, “তুই লেখাপড়া জানিস?”

শফির কথা শুনে দাঁত ভাসিয়ে তপন জবাব দেয়, “হ স্যার, ক্লাস সিক্স পর্যন্ত পড়ছি।”

“কোনো গাড়ি অথবা কাউকে দেখছিস?” শফি প্রশ্ন করল।

“না স্যার।”

“ভালো করে ভেবে বল।”

“স্যার এত সকালে কে আইবো আর। কেউ ছিল না। কোনো কুত্তাও ছিল না রাস্তায়।”

শফি মাথা নুইয়ে কিছুক্ষণ চুপ করে থাকল। শফি দানিয়ালকে নির্দেশ করল, “দানিয়াল, ওর বাসার ঠিকানাটা রেখে পাঠিয়ে দাও।”

“জি স্যার।” দানিয়াল তপনকে নিয়ে বের হয়ে গেল।

শফির প্রথম এমন মার্ডার কেস এটা। এরকম সদ্য খুন হওয়া কোনো কেস প্রত্যক্ষভাবে সমাধান করেনি। ক্যারিয়ারের শুরুতে ওসি থাকা অবস্থায় একটা মিসিং কেস সলভ করেছিল। টানা প্রায় আট মাস পর কেসটার ইতি টানে সে। তারপর সিআইডিতে জয়েন করে। ভাগ্যক্রমে এত বছরের সার্ভিস ক্যারিয়ারে এমন কেসে তেমন কাজ করতে হয়নি। এত বছরের অভিজ্ঞতার উল্টো এরকম কেস। এটা একদম যুক্তির বাইরে। এই ধরনের নৃশংস কেস কোনো অভিজ্ঞ অফিসারকে দিলে সবচেয়ে ভালো হয়, যে এরকম কাজ করে অভ্যস্ত। সে তো পুরনো, ঘুণে ধরা কেস সমাধান করতে এক্সপার্ট।

রাগ দেখাবে কার উপর বুঝতে পারছে না। কেসে পাঠিয়ে দিয়েছে অথচ কোনো লোক দেয়নি। ঝুলিয়ে দিয়েছে লোকাল থানার ওসির সাথে। তবে একদিক থেকে ভালোই হলো। আগের কেসে বেশ দুর্নাম করেছে। এখন এটা সমাধান করতে পারলে আশা করা যায় তার সম্মান আবার পূর্বের জায়গায় ফিরে আসবে।

যে কোনোভাবে এটা সমাধান করতে হবে। নাহয় মুখ দেখানো দায় হয়ে যাবে ডিপার্টমেন্টে। তার সাথে জামিল থাকলে বেশ উপকার হতো। এসব খুনের কেসে জামিলের অনেক অভিজ্ঞতা। তার থেকে ফোন করে একটু দিকনির্দেশনা বা তাকে এই কেসে আনতে পারলে মন্দ হয় না। জামিলের কথা মনে পড়তেই পকেট থেকে ফোনটা বের করে চেক করল। না, জামিলের কোনো কল আসেনি।

জামিলের নাম্বারটা বের করে ফোন দিল।

জামিল ফোন ধরেই বলল, “হ্যালো, শফি।”

শফি লম্বা শ্বাস ফেলে বলল, “আল্লাহ, তাহলে অবশেষে ফোন ধরছো।”

“সরি। মোবাইলে ব্যালেন্স ছিল না তাই কল করতে পারিনি।”

“আচ্ছা ঠিক আছে। চিফ কিছু বলেছে?”

“না তো।”

‘একটা মার্ডার কেস হাতে এসেছে।”

“কত বছর আগের?”

“এবার নতুন ভাই। আজ সকালেই লাশ পেলাম।”

জামিল শফির কথা শুনে ব্যঙ্গ করে বলল, “বলো কী? তুমি আবার এমন মার্ডার কেস কবে থেকে সলভ করা শুরু করলে?”

“আজ সকালেই।”

জামিল ভারী গলায় বলল, “তাহলে ইন্টারেস্টিং কিছু ঘটতে চলেছে।” জামিলের কথা শুনে শফি লম্বা শ্বাস ফেলে বলল, “আর ইন্টারেস্টিং, ভিক্টিম এর যা অবস্থা করেছে।”

কৌতূহলী হয়ে জামিল জিজ্ঞেস করল, “কী করেছে শফি?”

“সাত পিস করে ডাস্টবিনে ফেলে রেখেছে।” শফি দ্রুত জবাব দিল জামিল অবাক হয়ে বলল, “বলো কী?”

শফি জবাব দিল, “হ্যাঁ। তুমি কই?”

“আমিতো ভাই ছুটিতে আছি।”

শফি অবাক হলো। জামিল ছুটিতে গেল অথচ একবারও জানাল না তাকে। জামিল মজা করছে না তো?

“মানে। কী বলো এসব। ছুটিতে গিয়েছো মানে?” শফি প্রশ্ন করল। “আজ সকাল থেকেই ১৪ দিনের ছুটিতে আছি।”

“আচ্ছা ভালো। তাহলে ছুটি কাটিয়েই আসো।”

“জি। তবে ফোনে আপডেট দিও। আমি এখানের ল্যান্ডলাইনের নাম্বার দিয়ে দিচ্ছি।”

“ভালো কথা। আছো কোথায়?”

“ফুফুর বাড়ি আসছি।

“স্যার প্রাইমারি অটোপসি রিপোর্ট আসছে।” দানিয়াল হাতে একটা রিপোর্ট নিয়ে এসে বলল। হয়তো খেয়াল করেনি যে শফি মোবাইলে কথা বলছে।

দানিয়ালের আওয়াজ শুনেই জামিল শফিকে জিজ্ঞেস করল, “শফি, কে?”

“কলাবাগান থানার ওসি। আচ্ছা পরে কথা বলব।” বলে শফি ফোনটা কেটে টেবিলের উপর রাখল।

দানিয়ালের দিকে তাকিয়ে শফি জিজ্ঞেস করল, “রিপোর্টে কী আসছে?”

দানিয়াল ফাইলটা খুলে সম্পূর্ণ একবার চোখ বুলিয়ে নিল পুরো ফাইলে। দেখা শেষ হলে বন্ধ করে ফেলল। হালকা চিন্তিত দেখাচ্ছে তাকে। ধীরে ধীরে কপালের ভাজঁগুলো স্পষ্ট হচ্ছে। দীর্ঘ একটা শ্বাস তার ভিতর থেকে বের হয়ে আসলো অবশেষে।

“স্যার কখনো সাইকোপ্যাথ খুনির কেস পড়েছেন?” ফাইলটা এগিয়ে দিয়ে বলল দানিয়াল।

শফি ফাইলটা হাতে নিয়ে দানিয়ালকে প্রশ্ন করল, “কী হয়েছে বলো।”

“স্যার ভিক্টিমকে ছয় টুকরা করা হয়, আর সেটাও করা হয় ছয়দিন ধরে।”

“ছয়দিনে তো সাত টুকরো হওয়ার কথা।” দানিয়ালকে থামিয়ে দিয়ে শফি বললও।

“ওহ, ভুলে গিয়েছি। ছয়দিনে সাত টুকরো করা হয়। প্রত্যেকটা কাটা ছয়দিনে প্রায় ছয় রকম। যে অস্ত্র ব্যবহার করা হয়েছে সেটার প্রস্থ প্রায় তিন ইঞ্চি, লম্বা প্রায় ৫.৭৫ ইঞ্চি। বলতে গেলে চাপাতি। তবে স্যার সবচেয়ে আশ্চর্জনক হলো, মাথা কাটা পর্যন্ত ভিক্টিম বেঁচে ছিল।” দানিয়াল জবাব দিল।

কথাগুলো দানিয়ালের মুখে বড্ড ভারী শোনাল শফির। মনে হচ্ছে গলা জমে গেছে দানিয়ালের। শফি দানিয়ালের দিকে তাকিয়ে অবাক হয়ে প্রশ্ন করে, “মানে? জীবিত অবস্থায় সাত টুকরা করা হয়?”

“জি স্যার? আর স্যার প্যাথলজিস্ট যেতে বলেছে আমাদের। সম্ভব হলে এখনই যেতে বলেছে।”

“চলো রাস্তায় লাঞ্চ সেরেই যাই।”

“চলেন।”

ফাইলটা দানিয়ালের হাতে দিল শফি। দানিয়াল ফাইলটা হাতে নিয়ে টুপিটা মাথায় পরে নিল। টেবিলের উপর থেকে মোবাইলটা হাতে নিয়ে উঠে পড়ল শফি। তার আগে অর্পাকে একটা ফোন দেয়া দরকার। কিন্তু ফোন দিয়ে লাভ হবে না। অর্পার মোবাইল হয় বন্ধ থাকবে নাহয় সে ফোন রিসিভ করবে না। দুজনেই রওনা হলো সিআইডির ফরেনসিক ডিপার্টমেন্টের দিকে।

ধানমন্ডি ২৭ নম্বরে একটা চারতলা ভবনে ফরেনসিক ডিপার্টমেন্ট অবস্থিত। এক থেকে তিনতলা একটা মল, আর চার তলায় সিআইডির ল্যাব। এক থেকে তিনতলা অবধি লিফট। বাকি এক তলায় যেতে হলে সিঁড়ি বেয়ে যেতে হবে। পার করতে হবে দুটি নিরাপত্তা চৌকি। শফি আর দানিয়াল ফরেনসিক ডিপার্টমেন্টের হলরুমে। যতক্ষণ না প্যাথলজিস্ট এসে দেখা করে ততক্ষণ এখানেই অপেক্ষা করতে হবে। পুরো অফিসটা একদম নীরব। দেয়ালে টাঙানো ঘড়ির টিক টিক শব্দটাও যেন বাজপাখির ডাকের আওয়াজের মতো এসে লাগছে। মাঝেমধ্যে জুতোর আওয়াজে সেই শব্দ খানিকটা হালকা হয়। কেউ হলরুম পার হলেই মাথা তুলে তাকায় দুজনে। কিন্তু যে যাচ্ছে সে ফিরেও তাকায় না। মর্গে যাওয়ার অভিজ্ঞতা দানিয়ালের আগে থাকলেও, শফির এটাই প্রথম।

“আপনি শফি?” হঠাৎ একজন লোক এসে জিজ্ঞেস করল।

শফি মাথা তুলে তাকাল। লোকটার মুখের উপর লাগানো মোটা ফ্রেমের চশমাটা চোখে পড়ল প্রথমে, এরপর নাকের নিচে সাদা গোঁফ। শফি উঠে দাঁড়িয়ে করমর্দন করার জন্য হাত বাড়িয়ে দিল।

“জি আমিই।” করমর্দন করতে করতে বলল।

“আমি মোয়াজ্জেম আলি। আগের কেসটা কী খবর?”

“ঝুলে আছে।”

“বাহ বাহ! আপনিই একমাত্র অফিসার যার ঝুলিতে ডজনখানেক কেস সমাধানের রেকর্ড আছে অথচ সে ফরেনসিক অফিসে একবারও আসেনি।”

শফি এবার লজ্জা পেল। মুচকি হেসে বলল, “লজ্জা দিচ্ছেন স্যার।”

“আর উনি?” দানিয়ালের দিকে নির্দেশ করে বলল মোয়াজ্জেম আলি। “জি আমি দানিয়াল, কলাবাগান থানার ওসি। শফি স্যারের সাথে এসিস্ট করছি এই কেসে।” দানিয়াল শফির পাশ থেকে বলল।

মোয়াজ্জেম আলি শফির দিকে তাকিয়ে বলল, “সিআইডি পুলিশের সাথে কাজ করছে?”

“সমস্যা তো দেখছি না। আমরা সবাই সার্ভিসে আছি। কেউ হয়তো বিশেষ আবার কেউ সাধারণ। একটা আরেকটাকে ছাড়া চলতে পারে না।”শফি জবাব দিল।

“ভালো বলেছেন। চলুন আমার সাথে।” মোয়াজ্জেম আলি হলরুমের পশ্চিম পাশের দরজা দিয়ে ঢুকল। দানিয়াল আর শফিও পেছন পেছন হাঁটতে লাগল মোয়াজ্জেম আলির। এই দরজা দিয়ে ঢোকার পর সরু এক হলওয়ে, যার দু-পাশেই অসংখ্য দরজা। প্রত্যেক দরজার সামনে সাদা পর্দা ঝুলানো। ভেতরে কী হচ্ছে তা বাইরে থেকে একদম বোঝার উপায় নেই। লোকটির বয়স পঞ্চাশের কম হবে না। কিন্তু এই বয়সেও লোকটি খুব দ্রুত হেঁটে এক রুমে ঢুকে গেল।

রুমটি হলওয়ের একদম শেষ মাথায়। দানিয়াল আগে আগে হাঁটছে, আর তার পেছনেই হাঁটছে শফি। দানিয়াল দেখল লোকটি ১১৯ নাম্বার রুমের মধ্যে ঢুকল। সেও দ্রুত হেঁটে পর্দা সরিয়ে ঢুকে পড়ল রুমের ভেতর। রুমে ঢুকতেই দানিয়ালের নাকে তীব্র ফিনাইলের গন্ধ এসে লাগল। সে এই গন্ধটার সাথে আগেও পরিচিত। যতবার সে মর্গে গিয়েছে ততবার এই গন্ধটা এসে তার নাকে লেগেছে।

দানিয়ালের সামনে সারি করে স্ট্রেচার রাখা। সবগুলি স্ট্রেচার ফাঁকা। দানিয়াল ভেতরে ঢুকল, তার পেছন পেছন শফিও। মোয়াজ্জেম আলি মুখে মাস্ক লাগিয়ে নিয়েছে আর হাতে সাদা দস্তানা। দানিয়াল আর শফির দিকে দুটো মাস্ক বাড়িয়ে দিল সে। মাস্ক পরে নিল দুজনেই।

এপ্রোনের পকেট থেকে একটা চাবির গুচ্ছ বের করে নিল মোয়াজ্জেম আলি। চাবিটা নিয়ে ডানপাশের দেয়ালের দিকে গেল। দানিয়ালও গেল তার পেছন পেছন। কাছে গিয়েই বুঝতে পারল দেয়ালের মধ্যে সব লাশ সংরক্ষণের ফ্রিজার। ১২ নাম্বার ফ্রিজারে চাবি ঢুকিয়ে ফ্রিজারটা বের করে আনল মোয়াজ্জেম আলি। লাশটা বের করতেই একটা গন্ধ এসে নাকে লাগল দানিয়ালের। মাস্কও তাকে বাঁচাতে পারেনি দুর্গন্ধ থেকে। সে একটু মাথাটা পিছিয়ে নিয়েই আবার সামনে এনে ফ্রিজারের ভেতর চোখ রাখল।

কী ভয়াবহ অবস্থা! আগে পুরো দেহের আলাদা আলাদা টুকরো ছিল। এখন সবগুলো অঙ্গকে সেলাই দিয়ে একসাথে করা হয়েছে। আগের থেকে বীভৎস লাগছে এখন লাশটাকে। প্রতিটা সেলাইয়ের গোড়া ফুলে আছে, মনে হচ্ছে পিঁপড়া বা মশা কামড় দিয়েছে। চামড়াগুলোকে দেখে মনে হচ্ছে এই বুঝি কালো সুতোর সাথে বের হয়ে আসবে। অসহ্য লাগল দানিয়ালের। চোখ ফেরাল অন্যদিকে। শফি এখনো দূরে দাঁড়িয়ে আছে, দরজার একদম মুখে।

“শফি সাহেব এই দিকে আসেন।” মোয়াজ্জেম আলি বলল।

শফি এগিয়ে এল ফ্রিজারের দিকে। ভেতরে তাকাতেই শফির মাথা গুলিয়ে আসলো। কী বীভৎস হয়েছে লাশটার অবস্থা! সেলাইয়ের গোড়ায় প্রত্যেকটা মাংসপিণ্ড ফুলে আছে। লাশটা একদম সাদা হয়ে গেছে। দেখে ভয় না পেলেও অস্বস্তি না লেগে উপায় নেই। অজান্তেই শফি দুই কদম পিছিয়ে চলে গেল। বমি আসার উপক্রম হলো তার।

“কী জনাব! পুলিশ হয়ে এমন করলে হবে? কাছে আসুন বুঝিয়ে বলছি।” ভর্ৎসনার সুরেই বলল মোয়াজ্জেম আলি।

শফির মনে হলো এখানে আর কয়েক মিনিট থাকলেই সে মাথা ঘুরিয়ে .ড়ে যাবে। এখান থেকে বের হতে হবে তাকে। দানিয়াল ছেলেটার প্রতি তার বিশ্বাস আছে। পরে দানিয়াল থেকেই জানা যাবে মোয়াজ্জেম আলি কী কী বলেছে।

“দানিয়াল থাকুক। সমস্যা নেই। ও আমার সহযোগী।”

“আচ্ছা।” মোয়াজ্জেম আলি ছোট করে বলল।

শফি বের হয়ে গেল মর্গ থেকে।

শফি চলে যাওয়ার পর মোয়াজ্জেম আলী হাসি দিয়ে বলল, “আপনার বসের সিআইডিতে না থেকে ট্রাফিক পুলিশে থাকা দরকার।”

দানিয়াল মুচকি হেসে জবাব দিল, “আমাকে বলেন। আমি স্যারকে জানিয়ে দেব!”

মোয়াজ্জেম আলি পকেট থেকে একটা সার্জিক্যাল পয়েন্টার বের করে নিল। সার্জিকাল পয়েন্টারটা দিয়ে লাশের কপালের একটু উপরে ধরে বলল, “সবচেয়ে পুরনো ক্ষতটা পাওয়া যায় এখানে। পাঁচ থেকে সাত বছর আগেকার ক্ষত। আর শরীরের কোথাও পুরনো ক্ষতের চিহ্ন পাওয়া যায়নি।”

এতটুকু বলার পর মোয়াজ্জেম আলি লাশের পায়ের কাছে গেল। দানিয়ালও গেল ডাক্তারের পেছন পেছন।

“ভিক্টিমের গোড়ালি থেকে হাঁটু পর্যন্ত দুই পা প্ৰথম কাটা হয়। একদিনে কাটা হয়। কী ধরনের অস্ত্র ব্যবহার করা হয়েছে তা প্রাইমারি রিপোর্টে বলেছি আমি। ভিক্টিমের দুই পা আগে কাটা হয়। তারপর দুই হাত দুই দিনে। হাত কাটার পর দুই দিনে হাঁটু থেকে ঊরুর কুচকি পর্যন্ত কাটা হয়। প্রথমে ডান ঊরু, তারপর বাম ঊরু। তারপর সবশেষে কাটা হয় মাথা। এটা নরমালি আমরা যেই অবস্থায় ভিক্টিমকে পেলাম। এখানে একটা অঙ্গ থেকে আরেকটা অঙ্গ কাটার পার্থক্য হলো একদিন করে। মানে ছয়দিনে সাত টুকরো করা হয়। মানে বডিটাকে যদি আমরা টুকরো হিসেবে না ধরি আরকি। কিন্তু কথা হলো লাশের শরীর থেকে আরেকটা জিনিস মিসিং। আসলে একটা অর্গান মিসিং। ভিক্টিমের জরায়ু কেটে নেওয়া হয়েছে।”

দানিয়াল চমকে উঠল। কথা বলতে চেয়েও বলতে পারল না। হতবিহ্বল হয়ে শূন্য চোখে তাকিয়ে রইল মোয়াজ্জেম আলির দিকে। মোয়াজ্জেম আলিও কপাল ভাঁজ করে তাকিয়ে আছে লাশটার দিকে। মনে হচ্ছে, উনিও এরকম জিনিস আর দেখেনি। তার চেহারায়ও অস্বস্তির একটা ভাব ফুটে উঠেছে। নির্বাক হয়ে রইল সে। দুজনের মধ্যে বয়ে গেল কয়েক মিনিটের নীরব মুহূর্ত।

দানিয়াল নিজেকে সামলে নিয়ে বলল, ‘প্যাথেটিক।’

মোয়াজ্জেম আলি ছোট করে জবাব দিল, ‘হ্যাঁ।’

মোয়াজ্জেম আলির হাত আরেকটু উপরে উঠল। ভিক্টিমের তলপেটের দিকে পয়েন্টারটি ধরে বলল, “এখানে কিছু দেখতে পাচ্ছেন?”

দানিয়াল মাথা নামিয়ে দেখল। ছোট একটা কাটার দাগ। কাটা দাগটির দিকে তাকিয়ে বলল, “হ্যাঁ।”

মোয়াজ্জেম আলি আঙুল দিয়ে দাগটির দিকে নির্দেশ করে বলে, “এখান দিয়ে জরায়ু কেটে বের করা হয়।”

দানিয়াল দাগটির দিকে খানিকক্ষণ তাকিয়ে থেকে মোয়াজ্জেম আলিকে জিজ্ঞেস করল, “আচ্ছা একটা প্রশ্ন?”

মোয়াজ্জেম আলি লাশটাকে ঢেকে দিয়ে বলল, “বলেন।”

“ভিক্টিমের মৃত্যু হয় কত দিন আগে?”

মোয়াজ্জেম আলি ছোট করে জবাব দেয়, “প্রায় চারদিন।”

মোয়াজ্জেম আলির জবাব শুনে বিস্ময় প্রকাশ করে বলল দানিয়াল, “সেটা কীভাবে সম্ভব! যদি ছয়দিনে ভিক্টিমকে ব্যবচ্ছেদ করা হয় তাহলে ছয়দিন আগেই মারা যাওয়া দরকার।“

মোয়াজ্জেম আলি পয়েন্টারটি তার পকেটে ঢুকিয়ে দানিয়ালের দিকে তাকিয়ে বলল, “আপনার কথা যুক্তিসঙ্গত। ব্লিডিংয়ের কারণে যেদিন ভিক্টিমের পা কাটা হয় সেদিনই ভিক্টিমের মারা যাওয়ার কথা। কিন্তু ভিক্টিম বেঁচে ছিল। বলতে গেলে তার বেঁচে থাকা অবস্থাতেই তার অঙ্গগুলি আলাদা হয়।”

দানিয়াল বেশ নিরাশ ভঙ্গিতে বলল, “তা অটোপসিতে জেনেছি। এখন প্রশ্ন হলো সে বেঁচে ছিল কী করে?”

মোয়াজ্জেম আলি জবাব দেয়, “বিউটিলিয়াম ৩৬।”

দানিয়াল বুঝতে পারেনি মোয়াজ্জেম আলি কী বুঝাতে চাচ্ছে। তাই দানিয়াল প্রশ্ন করল, “মানে?”

“ব্লিডিং বন্ধ করার সবচেয়ে স্ট্রং ড্রাগ। ভিক্টিমের রক্তে এটা অনেক পরিমাণে ছিল।” মোয়াজ্জেম আলি শান্তভাবে জবাব দিল।

দানিয়াল পরিষ্কার হওয়ার জন্য বলল, “মানে ভিক্টিমকে এই ড্রাগ দিয়ে ব্লিডিং অফ করে রাখা হয়? তারপর সে বেঁচে ছিল আর সেই অবস্থায় তাকে টর্চার করা হয়?”

“হ্যাঁ।”

“তাহলে পুরো শরীরের রক্ত জমে যাওয়ার কথা না।”

“তোমার ব্যাকগ্রাউন্ড কি আর্টস-কমার্স?”

দানিয়াল কেবল মাথা নাড়ালো।

মোয়াজ্জেম আলি মুচকি হেসে বললো, “আমাদের রক্তে তিন রকমের কোষ আছে। শ্বেত, লোহিত রক্তকণিকা আর আর অনুচক্রিকা। মানুষের শরীর কেটে গেলে এই অনুচক্রিকা থ্রোম্পোপ্লাস্টিনের তৈরি করে ফাইব্রোজেনের মাধ্যমে রক্ত জমাট বাঁধতে সাহায্য করে। তোমাকে বেশি ব্যাখ্যা কওে বলিনি আমি। এই বিউটিলিয়াল ৩৬ তোমার অনুচক্রিকার কার্য ক্ষমতা বাড়িয়ে দেয়। তাই শরীরের কোনো অংশ কেটে গেলেই এটা কাজ করবে, রক্ত জমাট বাঁধতে সাহায্য করে। আশা করি বুঝতে পেরেছো।

দানিয়ালের মুখ দিয়ে বের হয়ে আসলো, “জি স্যার!”

“ভিক্টিমের পা উপর দিকে আর মাথা নিচের দিকে ছিল, সেজন্য পর্যাপ্ত পরিমান রক্ত ব্রেইনে যায়, সেজন্যও বেঁচে ছিল।

“খুনি তাহলে এগুলোর সাথে পরিচিত ছিল?”

“এটা বলা মুশকিল, কিন্তু কীভাবে ব্লিডিং বন্ধ করে একটা মানুষকে বাঁচিয়ে রাখা যায় তার এই জ্ঞানটা ছিল।

দানিয়াল চুপ থাকল। তার এই পাঁচ বছরের ক্যারিয়ারে এরকম কেস হাতে পায়নি। সম্পূর্ণ আলাদা একটা কেস এটা।

দানিয়াল বলল, “এত ব্রুটাল কেস আমার হাতে এর আগে আসেনি। দানিয়ালের কথা শোনার পর মোয়াজ্জেম আলি একটা মুচকি হাসি দিয়ে বলল, “কোনো সাইকোপ্যাথ ছাড়া এটা কেউ করতে পারে না। “

“আমারও তাই মনে হয়। সাধারণ খুনিরা মার্সিলেস হয়, কিন্তু ব্রুটাল হয় না।”

“জি।”

মোয়াজ্জেম আলিকে দেখে মনে হচ্ছে তার ব্রিফ এখানেই শেষ। কিন্তু এখনো দরকারি কোনো ক্লু পাওয়া যায়নি যে সামনে এগিয়ে যাবে। তাই দানিয়াল জানার জন্য জিজ্ঞেস করল, “আর কিছু?”

“হ্যাঁ, লাশের সাথে একটা আংটি পাওয়া যায় যেটা লাশের মুখের মধ্যে ছিল।” মোয়াজ্জেম আলি জবাব দিল।

“আংটি?”

মোয়াজ্জেম আলি ছোট করে জবাব দিল, “হ্যাঁ।”

“ধর্ষণের কোনো লক্ষণ?”

“জরায়ু তো নেই, বোঝা মুশকিল। বাট যতটুকু অঙ্গ দেখলাম পুরুষের শুক্রাণু পাইনি। যোনি ঠিক আছে। যোনিতে কিছুই ছিল না।”

“আংটিটা কই?”

“আছে, আমার চেম্বারে।”

দানিয়াল শেষবারের মতো প্রশ্ন করল, “আর কিছু?”

মোয়াজ্জেম আলি হেসে জবাব দিল, “বাকিটা রিপোর্টে দিয়ে দেব।” দানিয়াল আরেকবার লাশটার দিকে তাকিয়ে আল্লাহ তায়ালাকে স্মরণ করল। মেয়েটাকে জীবিত থাকতে নরকের শাস্তি দেয়া হয়েছে। খুনির পাশবিকতা নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই তার। গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল তার। যদি কোনো সাইকো হয় তাহলে সে তার এই কাজ থামাবে না। ধর্ষকামী সাইকোরা বেশ ভয়ংকর হয়। ক্রিমিনাল হিস্টোরি এটাই বলে।

মোয়াজ্জেম আলি দানিয়ালের দিকে তাকিয়ে বলল, “চলেন আপনার বসের কাছে যাওয়া যাক।”

হলরুমে বসেই অপেক্ষা করছে শফি। তার চোখের সামনে লাশটা এখনো ভাসছে। আর যতবার লাশটাকে কল্পনা করছে, ততবার ভয়ে শিহরণ বয়ে যাচ্ছে তার শরীরজুড়ে। লাশটাকে সেলাই করে আরও বেশি বীভৎস করে ফেলেছে। পরিবারের মানুষের কী প্রতিক্রিয়া হবে লাশটাকে দেখে, সেটাই ভাবছে শফি। পায়ের শব্দ শুনে উপর দিকে তাকাল শফি।

মোয়াজ্জেম আলি আসলো না, দানিয়াল একাই ফিরে আসলো! দানিয়ালকে আসতে দেখে শফি দাঁড়িয়ে প্রশ্ন করল, “কোনো ব্লু পাওয়া গেল?”

দানিয়াল শফির সামনে থেমে বলল, “যেতে যেতে বলি?”

মাগরিবের আজান কানে আসলো শফির। সারাদিন অনেক দৌড়াদৌড়ির উপর দিয়ে যায়। দানিয়াল যদি না থাকত তাহলে আরও খারাপ হতো। দানিয়াল ছেলেটা অনেক করিতকর্মা। যেভাবে ছেলেটা কেসটাকে একটা নির্দিষ্ট ফ্রেইমের মধ্যে আনছে, তাতে বোঝা যায়, এসব বিষয়ে সে বেশ অভিজ্ঞ। শফির থেকে বেশি অভিজ্ঞ। এসব লোকদের সিআইডিতে কাজ করা উচিত। এই বিষয়ে ডিরেক্টরের সাথে কথা বলা দরকার।

শফির গাড়িটা যখন বাড়িতে ঢুকল তখন প্রায় অন্ধকার। রাত হয়ে গেছে। পাখিরা ডানা ঝাঁপটিয়ে নীড়ে ফিরছে। শহরের যান্ত্রিকতা কমে আসছে। হালকা হালকা শীত লাগছে শফির। ওদের বাড়িটা উত্তরমুখী। সন্ধ্যা হলেই চারিদিক একদম অন্ধকার। সিটি কর্পোরেশনের স্ট্রিটলাইট এখনো বাড়ি পর্যন্ত আসেনি। পোর্চের লাইটটা বন্ধ থাকলে সমস্ত বাড়িই অন্ধকার হয়ে থাকে।

সন্ধ্যা হয়েছে প্রায় এক ঘণ্টা হলো। মেইন গেটের সামনে জিপটা পার্ক করল শফি। গেট খুলে জিপ নিতে হবে। আস্তে আস্তে গেটের দিকে এগিয়ে গেল সে। কিন্তু খুলতে গিয়ে দেখল গেটে তালা ঝোলানো। তার মানে অর্পা এখনো বাসায় ফেরেনি। কিন্তু অর্পার তো বাড়িতে ফেরার কথা। হয়তো কোনো কাজে আটকে গেছে অর্পা। এ ব্যাপারে আর বেশি ভাবল না শফি। ভ্যানের দিকে পা বাড়াল সে।

ড্যাশবোর্ডে চাবি আছে বাসার। ড্যাশবোর্ড থেকে চাবি নিয়ে এসে গেট খুলল শফি। ক্যাঁচক্যাঁচ করে একটা শব্দ হলো। বাইরের গেট থেকে সরু রাস্তা একদম বাসার মেইন দরজায় পৌঁছে গেছে। এখনো অন্ধকার বেশ ভালোভাবেই চেপে বসেছে। চাবি আনার সময় জিপের হেডলাইটগুলো জ্বেলে এসেছিল সে। সরুরাস্তার বাঁ পাশের লনে জিপটা পার্ক করে বাসায় ঢুকল।

একদম অন্ধকার হয়ে আছে সবকিছু। আরও আগে আসা উচিত ছিল। গাড়ির হেডলাইটগুলো জ্বালিয়ে আসলেই ভালো হতো। অন্ধকারে এখন আন্দাজে সব করতে হচ্ছে। দরজায় আন্দাজে চাবি লাগানো মুশকিল। কিন্তু চেষ্টা করে গেল সে। না, কয়েকবার চেষ্টা করেও হচ্ছে না। মোবাইলটার কথা মনে পড়ল শফির। স্ক্রিনের আলোতে চাবির নবটা দেখা যাবে নিশ্চয়। পকেট থেকে মোবাইলটা বের করে বাটনে চাপ দিয়ে আলো বের করেই চাবির নবটা দেখে নিল সে। চাবিটা দ্রুত নবে ঢুকিয়ে দিয়ে দরজাটা খুলল। দরজা খুলেই ভেতরে ড্রইংরুমে প্রবেশ করল সে। ড্রইংরুমের পাশের দেয়াল ঘেঁষেই বৈদ্যুতিক সুইচ। মোবাইলের আবছা আলোয় শফি ওই দেয়ালের উদ্দেশ্যে এগোতে লাগল।

বাতি জ্বালিয়েই বড় একটা নিঃশ্বাস ফেলল সে। তারপর সোফায় গিয়ে বসে কল দিল অর্পাকে। নাম্বার বন্ধ দেখাচ্ছে। প্রতিদিন এ সময়ে বাসায় ফিরে দেখে অর্পা বাসায় আছে, কিন্তু আজ এখনো ফিরল না। চিন্তা হচ্ছে অর্পার জন্য। বেবিকে নিয়ে কোথায় গেল সে!

রান্নাঘরে গিয়ে ফ্রিজ থেকে পানি নিয়ে আসলো। সাথে একটা আপেলও। আপেলটা শুকিয়ে মিশে যাওয়ার মতো অবস্থা। অনেকদিন আগের আপেল। সোফায় বসে কয়েক কামড় বসিয়ে চোখ বুঝে সোফায় শুয়ে পড়ল। আপেলটা অনেক বিস্বাদ লাগছে। তবুও খেতে হচ্ছে। পেটে প্রচণ্ড ক্ষুধা। আগে জানলে বাইরে থেকেই খেয়ে আসা যেত নাহয় খাবার নিয়ে আসত।

মোবাইল বের করে জামিলের পাঠানো নাম্বারটা দেখল শফি। অৰ্পা বাসায় না আসা পর্যন্ত কথা বলে কাটানো যাক। নাম্বারটা কয়েকবার মনে মনে পড়ে নিল। পাশের টেবিলেই টেলিফোন রাখা। টেলিফোনটা কাছে টেনে নিয়ে নাম্বার ডায়াল করল তাতে। কিছুক্ষণ পরই অপর পাশ থেকে জামিলের উত্তর পাওয়া গেল।

“হ্যালো, কে বলছেন?”

“জামিল, আমি শফি।”

“গুড ইভনিং।

“গুড ইভনিং।“

“কেস কেমন আগালো?”

“একদম আগায়নি। তবে ময়নাতদন্তের রিপোর্ট পেলাম। আর সেই রিপোর্ট পেয়েই বুঝলাম খুনি একটা সাইকো।”

“সাইকো?”

“হ্যাঁ।

‘সেইটা কী করে বুঝলা?”

“তোমাকে তো আগেই বলেছি লাশটাকে সাত টুকরো করা হয়। কিন্তু প্রত্যেকটা অঙ্গ আলাদা করার সময় ভিক্টিম জীবিত ছিল।”

“এতে তো প্রমাণিত হয় না যে খুনি মানসিক বিকারগ্রস্থ ছিল।”

“আগে শোনো। ভিক্টিমকে ব্যবচ্ছেদ করা হয় ছয়দিনে, মানে ছয়টা অঙ্গ পাঁচদিনে আলাদা করা হয়, যদি মাথাটা বাদ দেই। পাঁচ দিনে ছয় টুকরো করা পর্যন্ত ভিক্টিম বেঁচে ছিল।”

“সেটা কী করে সম্ভব?”

“একটা ড্রাগ ব্যবহার করা হয়, নামটা আপাতত মনে পড়ছে না।“

“বিউটিলিয়াম ৩৬?”

“জামিলের জবাব শুনে অবাক হয়ে গেল শফি। “তুমি কী করে জানো?”

“ভুলে যাও কেন আমি ক্যামিস্ট্রিতে গ্র্যাজুয়েট করা।”

“ড্রাগ দেয়ার ব্যাপারটা নরমাল। কিন্তু জরায়ু কেটে নিয়ে যাওয়া?”

“অস্বাভাবিক না। যেমন ভাবছিলাম।”

“মানে?”

“খুনি পিশাচ শ্রেণির কেউ। আমার অনুমান।“

“এমন অদ্ভুত অনুমান?”

“অনুমান তো অনুমানই। তাছাড়া ভাই…,” দরজায় বেল পড়ল। অৰ্পা এসেছে।

“আমি তোমার সাথে পরে কথা বলব।” টেলিফোনটা রেখে শফি দরজা খুলল।

দরজা খোলা মাত্রই হুড়মুড়িয়ে ভেতরে ঢুকল অর্পা। বেবি শালের মধ্যে পেঁচানো। অর্পা পা থেকে মাথা পর্যন্ত লাল রং এর ট্রেঞ্চ কোর্ট পরে আছে। তার উপর বেবিকে জড়িয়ে ধরে উপরে শাল পরেছে। বেবিকে এই ঠান্ডায় রক্ষা করার ভালো পদ্ধতি।

“গাড়ি থেকে খাবার নামিয়ে নিয়ে আসো।” বেডরুমে যেতে যেতে শফিকে নির্দেশ দিল অৰ্পা।

“সারাদিন কই ছিলে?” অর্পার পেছনে যেতে যেতে বলল শফি।

বেডরুম থেকে অর্পা বলল, “আগে খাবারগুলো নিয়ে আসো প্লিজ। ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে।”

অর্পার কথা শুনে ভীষণ রেগে গেল শফি।

“সারাদিন যাচ্ছেতাইভাবে ঘুরে বেড়াচ্ছো আর আমি জিজ্ঞেসও করতে পারব না?” গলা উঁচু করেই বলল সে।

অর্পা ইতোমধ্যে বেডরুমে এসে পড়েছে। বেবিকে বিছানায় নামিয়ে শোয়াল, তারপর কম্বলটা টেনে দিল আলতো করে।

“বাইরে আসো, সব বলছি। এখানে কথা বললে বেবি উঠে যাবে। অর্পা বেডরুম থেকে বের হয়ে বাইরে আসলো। শফির দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে অর্পা। অবশেষে চোখ সরিয়ে সদর দরজা খুলে বাইরে গেল সে। কিছুক্ষণ পর হাতে একটা প্যাকেট নিয়ে ফিরে আসলো। শফি তখন সোফায় বসা। পাশে এসে বসল অর্পা।

“এই নাও খাও, দেরি হয়েছে দেখে বাইরে থেকে খাবার নিয়ে আসলাম।” অর্পা বলল।

শফি নিরুত্তর। সে নিচের দিকে তাকিয়ে রাগ নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করছে। “রেগে যাচ্ছো কেন?” অর্পা প্যাকেট খুলতে খুলতে বলল।

প্যাকেট খুলে পাস্তা বের করে শফির দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলল, “এই নাও, আগে খেয়ে নাও পরে নাহয় যা ইচ্ছা তা বলো, যা ইচ্ছা তা কোরো।”

শফি এখনো নিচের দিকে তাকিয়ে আছে।

“আরে শোনো, আজ না আমার বান্ধবীর সাথে দেখা হয়েছে। বেবিকে নিয়ে যে হাসপাতালে যাই, সে ঐ হাসপাতালের ডাক্তার। আচমকা দেখা হয়েছে তাই ছাড়তে চায়নি ও। এজন্যই দেরি হয়েছে।”

শফিকে বোঝালো অর্পা।

বোঝানোয় কাজ হলো, কিছুটা শান্ত হলো শফি। অর্পা অযথা দেরি করে বাসায় ফেরার লোক না। সে খুব মেপে চলার লোক। কোনো অতিরিক্ত কথাও বলে না, আবার অতিরিক্ত কারও সাথে খাতিরও করে না।

“ফোন করা যেত না?” পাস্তার প্যাকেটটা অর্পার হাত থেকে নিয়ে বলল শফি।

“সরি। মোবাইলে চার্জ ছিল না।”

শফি অভিমানের সুরে বলল, “কত করে বলি মোবাইলে চার্জ দিয়ে রাখো। কোনো ইমার্জেন্সি কিংবা বিপদে পড়লে তখন কী করবা?”

অর্পা শফির দিকে হেসে বলল, “পুলিশ অফিসারের বউ না? বিপদ কি এত সহজে আমার কাছে আসে?”

অর্পার কথা শুনে হেসে উঠল শফি। শফির সাথে সাথে অর্পাও হেসে শফির উপর ঢলে পড়ল। দুজনের হাসির শব্দে এই জনশূন্য বাড়িটা আজ যেন জেগে উঠল।

ছোটখাটো গাড়িটা গলির মাথায় রেখেছে সে। বেশ আস্তে আস্তে গাড়িটা চালিয়েছে, যাতে কেউ টের না পায়। নিজের সেকেন্ড হোম হিসেবে এই বাড়িটা বেছে নেয়ার কারণ হলো শফি। সে আন্দাজ করতে পারেনি যে শফিকে কেসটা দেবে। তাতে অবশ্য কিছু যায় আসেনি, কিন্তু তাকে একটু সাবধানে পা ফেলতে হবে। একটা ভুল দান, সমস্ত কিছু নষ্ট করে দেবে। খেলাটা সবে শুরু। শুরু থেকেই তাকে সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করতে হবে।

দুই দিন আগেও ভাবেনি, সে এমন পচা এলাকায় থাকবে। আজ সকালেই বাসাটা ভাড়া নিয়েছে সে। বাসাটাও একদম সে যেমন চেয়েছে তেমনই। পুরো বাড়িটা দুই তলা। একতলার জন্য টু-লেট ঝোলানো ছিল আর দোতলার কাজ এখনো চলছে। আপাতত অর্থসংকটে মালিক দোতলার কাজ বন্ধ রেখেছে।

মালিকও বেশ একটা আকর্ষণীয় চরিত্র। ভদ্রলোকের বয়স পঞ্চাশের আশপাশে হবে। লম্বা একদম ছয় ফুটের মতো। বলিউডের নায়ক সঞ্জয় দত্তের চেহারার সাথে অনেক মিল। চেহারার মিল হলে কী হবে, শরীর দেখে পাঠখড়িও লজ্জা পাবে। শুকনো আর জীর্ণশীর্ণ। রোগা মুখে একটা মোটা গোঁফ, চুল একদম কালো রং করা, গা থেকে আতরের গন্ধ ভেসে আসে। উনাকে দেখে মনে হয়েছিল সদরঘাটের আশপাশের মানুষ। ধানমন্ডির মতো এই ভদ্রপল্লীতে ওনাকে মানায় না।

কিন্তু বেচারা দেখতে যেমনি হোক ভদ্রলোক অনেক ক্ষমতাকালী মানুষ। এলাকার এমপির শালা, পাশাপাশি মোহাম্মদপুরে একটা মার্কেটের মালিক। পরিবার নিয়ে থাকেন মিরপুরে। ধানমন্ডিতে ওনার কয়েকটা বাড়ি আছে আর এই বাড়িটা নতুন করেছে, মাস ছয়েক আগে। অবশ্য এটার কাজও শেষ করতে পারত যদি তিনি বনানীতে জায়গা না কিনত। বাড়ি করার টাকা দিয়ে নতুন জমি কিনে বনানীতে।

বাড়ি দেখতে যখন এসেছিল তখন ভদ্রলোক বেশ জোর করে তাকে এসব কাহিনি বলে। প্রথমে বিরক্ত না হলেও আস্তে আস্তে সে অনেক বিরক্ত হয়ে পড়ে। অবশেষে দীর্ঘ বক্তৃতার পর সে চাবি দিয়ে দুই মাসের অগ্রিম ভাড়া নিয়ে চলে যায়। যাওয়ার সময় সতর্ক করে যায় বাসার কোনো জিনিস যাতে না ভাঙে, তাহলে দ্বিগুণ টাকা ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। তার তাতে সমস্যা নেই, সে এসেছেই তো শফির উপর নজর রাখতে। তা-ও শুধু কিছুক্ষণের জন্য। কাজ শেষ করে সে আবার ফিরে যাবে নিজের পুরনো জায়গায়। নিজের বানানো নরকে।

ঘড়ির দিকে তাকাল সে। কাঁটায় কাঁটায় দশটা বাজে। যাহোক, বের হওয়ার সময় চলে এসেছে। আয়নার সামনে গেল। পরচুলা ঠিক করে নিল, সাথে আলগা দাড়িটা। একটা মুচকি হেসে সে বের হয়ে আসলো। একটা টয়োটা গাড়ি আছে তার। বাড়িতে আনেনি। গলির সামনে রেখে এসেছিল, একদম রাস্তার মাথায়। গাড়িটা যেহেতু রাস্তার মাথায় রেখেছে, সেটাকে ভেতরে আনার কোনো ইচ্ছে হলো না আর। একটু পর তো এখান থেকে চলেই যাবে।

গাড়ির ডিকিতে চাবি দিল সে। খট করে শব্দ হতেই তার ঠোঁটের কোণে একটা হাসি ফুটে উঠল। অনেকগুলো ছোট ছোট পলিথিন পড়ে আছে। অবশ্য খালি না। এগুলো মালে ভর্তি। সে একটা পলিথিন বের করে নিল। পলিথিনটা চোখের সামনে ধরে পরখ করে নিতে ভুলল না। না, ঠিক পলিথিনটাই নিয়েছে। পলিথিনটা মাটিতে রেখে খুব দ্রুত ডিকি বন্ধ করে ফেলল। হালকা উত্তেজনা কাজ করছে তার মধ্যে। কপালের উপর কয়েক ফোঁটা ঘাম জমার দুঃসাহস দেখাচ্ছে এখন। সে নিজের উত্তেজনাকে পাত্তা না দিয়ে প্যান্টের পকেট থেকে আরেকটা ভারী পলিথিনের শপিং ব্যাগ বের করল। মুটিয়ে আছে শপিং ব্যাগটা। হালকা ঝাড়া দিয়ে ভালো করে মেললো সেটিকে। এদিক সেদিক তাকাল। না, কেউ নেই।

পলিথিনটা মাটি থেকে তুলে আস্তে করে শপিং ব্যগে ঢুকাল। যাক, কাজ আপাতত শেষ হয়েছে। গলি দিয়ে সোজা মূল রাস্তার দিকে হাঁটা দিল সে। তেমন গাড়ি নেই, মানুষজনও কমে গেছে। মূল রাস্তায় উঠে কয়েকটা গাড়ি দেখল। ব্যস্ত ট্যানারি বাজার। সে ফ্যাক্টরির এদিকে না গিয়ে একটু উল্টো দিকে গেল, ফ্যাক্টরিগুলোর পিছন দিক দিয়ে। কটু দুর্গন্ধ এসে নাকে লাগছে। ট্রাকের শব্দ ভেসে আসছে। এসব শব্দে একটু চমকে উঠলেও বেশ ধীরস্থিরভাবে সামনের দিকে হাঁটছে সে।

চারদিকে একদম গাঢ় অন্ধকার না হলেও, যেটুকু অন্ধকার আছে, তাতে অন্ধকারের রাজ্যই বলা যায়। স্ট্রিটলাইটগুলো অন্ধকারকে নিজেদের গায়ে মুড়িয়ে নিয়েছে। আবছা আলোয় সে সামনে একটা ড্রেন দেখতে পেল। একটা ফ্যাক্টরির দূষিত বর্জ্য বের করার ড্রেন। আস্তে আস্তে ড্রেনটার কাছে গেল সে। এদিক সেদিক তাকিয়ে দেখল কেউ আসছে কি না। না কেউ নেই। সে শপিং ব্যগটা খুলল, পলিথিনটা নিচে ধরে উপর করে ড্রেনের উপর ফেলে দিল।

খানিক নোংরা পানি লাফ দিয়ে উপরে উঠার চেষ্টা করল। কিন্তু তাকে ছোঁয়ার আগেই, ফোঁটাগুলো পতিত হলো নোংরা ড্রেনে। একটাশব্দ করে পলিথিন থেকে মালগুলো ড্রেনে পড়ল। আস্তে আস্তে সেগুলো হারিয়ে যাচ্ছে কালো ময়লা পানিতে। সে আরেকবার ইতিউতি তাকাল। না কেউ নেই। চোখ ফেরাল ড্রেনের দিকে। বুদবুদ করে নোংরা পানির নিচে হারিয়ে গেল নরকের কিছু স্মৃতি।

সে একটা মুচকি হাসি দিল। প্রশান্তির হাসি। হাতের পলিথিনটাও ছুঁড়ে মারল ড্রেনে। বুদবুদ করে সেটা নোংরা কালো পানির নিচে চলে গেল পলিথিনটা। সবটা ড্রেনে হারিয়ে যাবে না। পায়ের নিচে কয়েকটা ছোট ইটের টুকরো পড়ে আছে। সে পাথরগুলোকে ডান পা দিয়ে লাথি দিয়ে ড্রেনে ফেলে দিল। মাপা শট। পলিথিনটার উপরে পড়তেই পলিথিনটাকে আর পানির উপরে ভাসতে দেখা যাচ্ছে না। সব ঝামেলা চুকেছে অবশেষে। দুই হাত পকেটে ঢুকিয়ে রওনা দিল শফির বাড়ির দিকে।

রাস্তাতে তেমন লোকজন নেই। রিকশার হুড তুলে ড্রাইভারগুলো জড়সড় হয়ে বসে আছে। রাস্তার উপর পুরনো আবর্জনা আর পলিথিন জড়ো করে কয়েকটা ছেলে আগুন জ্বালিয়েছে, শীত নিবারণের ব্যর্থ চেষ্টা তাদের মুখে বেশ প্রতীয়মান। অদ্ভুত লাগে শহরটাকে। কেউ টাকা পয়সা খরচ করে ইটের দেয়াল বানিয়ে চার দেয়ালে বন্দি থাকে। প্রাচুর্য নামের বেড়াজালে বন্দি রেখে দুনিয়াই দেখতে পারে না। আর কেউ খোলা রাস্তায় পড়ে কাঁপতে কাঁপতে দুনিয়াটাকে বেশ ভালোভাবেই চেনে আর দেখে।

তল্লাবাগ মোড়ে আসতেই দেখল তাবলীগের লোক মসজিদ থেকে বের হয়ে তার দিকে আসছে। সে খানিক দ্বিধায় পড়ে গেল। এরা অনেক বিরক্ত করে। সে মাথা নিচু করে তাদের পাশ দিয়ে হেঁটে গেল। না, তারা কিছু বলল না। সে হাঁটা থামিয়ে তাদের দিকে তাকাল। তারা সামনের দিকে চলে যাচ্ছে। তার দিকে কোনো নজর নেই তাদের। ছোট্ট একটা হাসি দিয়ে বাম দিকে মোড় নিল সে।

মোড়ে ঢুকতে প্রচণ্ড অন্ধকারের মুখোমুখি হলো। নিজের প্রতিদ্বন্দ্বী লাগছে এই গাঢ় অন্ধকারকে। তার ভেতরে যে অন্ধকার, সে যেন এই

অন্ধকার থেকেও আরও গাঢ়। রাত বাড়ার সাথে সাথে এই রাতের অন্ধকার যত গাঢ় হয়, তার ভিতরের অন্ধকারটাও সময় বাড়ার সাথে সাথে তত গাঢ় হয়।

তবে এই রাতের প্রাকৃতিক অন্ধকার থেকে তার ভিতরের অন্ধকারের একটা পার্থক্য আছে। রাত যখন শেষ হয়ে যায়, রাতের অন্ধকারও হারিয়ে যায়। কিন্তু তার অন্ধকার হারায় না। দিনের পর দিন যেন সেটা বাড়তেই থাকে।

সে রাস্তার শেষ মাথায় এসে দাঁড়াল। তেমন বাড়িঘর নেই এদিকে। অনেকটাই নির্জন। সামনে দুটো বাড়ি। একটা বাড়ি একদম অন্ধকার, আরেকটার লনে আলো জ্বলছে। সেই আলোকজ্জল বাড়িটাই শফির বাড়ি। সে একটা হাসি দিল। বেশ শব্দ করে। হাসি শুনে কোথাও যেন একটা ব্যাঙ ডেকে উঠল।

সে হাসিটা থামাল। তার হাসির কারণ হলো শফির এই আলোর দুনিয়াটা কিছুদিনের মধ্যেই অন্ধকার রাজ্যের সামিল হবে। তার রাজ্যের, যে রাজ্য থেকে কেউ বাঁচতে পারবে না। শুধু শফি না, এই শহরও পুড়বে। তার রাগ আর ক্ষোভের আগুনে পুড়বে।

সে পকেট থেকে মোবাইলটা বের করে নিল। পুরো খেলা শুরু করার সময়। নাম্বারটা ডায়াল করে কানে লাগাল সে। ওপাশ থেকে ধরতেই সে মুচকি হেসে বলল, “হ্যালো।”

সিদ্দিকের হাতে রিপোর্ট। একটু আগেই ফ্যাক্সে এসেছে। ফ্যাক্সটা এসেছে বন্দর থানা থেকে। লাশটা চিহ্নিত করা গেছে। দানিয়ালকে ফোন করে সেটা জানিয়ে দিয়েছে সিদ্দিক। মধ্যরাতের আগেই এসেছে ফ্যাক্স। তার ডিউটি ছিল রাত থেকে। সকালে থানায় এসে দেখে ফ্যাক্স চলে এসেছে। সে রিপোর্টটা হাতে নিয়ে পড়া শুরু করল। স্যারকে ছোটখাটো ব্রিফ করতে হয় তাকে। সেজন্য গা ছাড়া হয়ে চলার কোনো সুযোগই নেই। সব বিষয়ে টুকটাক খবর রাখতে হয়।

“কী খবর সিদ্দিক? এত জরুরি তলব?” থানায় ঢুকেই বলল দানিয়াল। থানায় মাত্র একটা কম্পিউটার। সেটা কিছুদিন দানিয়ালের রুমে রাখা ছিল। এটা এখন সাব ইন্সপেক্টরের রুমে। অবশ্য এসআই মনোজ এ ক্ষেত্রে খুব পারদর্শী। তার হাতে পুরো থানার সিংহভাগ পেপারওয়ার্ক। এ নিয়ে কোনো অভিযোগ নেই মনোজের। তবে দানিয়াল জানে, ছেলেটা ফিল্ডেও বেশ সুনাম কুড়াবে, যদি সে সুযোগ সে পেয়ে যায়। মনোজ নিজেই বের হতে চায় না। কয়েকটা কেসের তদন্তের দায়িত্বও দিয়েছিল দানিয়াল। বেশ ভালোই কাজ দেখিয়েছে।

“স্যার ফ্যাক্স আসছে।” সিদ্দিক বলল।

“কখন আসছে?”

“সকালে স্যার। আমি এসে দেখি ফ্যাক্স এসেছে।”

দানিয়াল তার অফিসে ঢুকে জ্যাকেটটা খুলে রাখল ডেস্কের উপর তারপর চেয়ারটা টান দিয়ে বসে পড়ল সে। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখে সাতটা ত্রিশ বাজে। সকালে ঘুম থেকে ওঠার পরই বুঝতে পারল, মাথা ধরেছে তার। চিনচিন করে মাথার চারপাশ ব্যথা করেই চলেছে। এক কাপ চা পান করে বের হওয়া উচিত ছিল। এখন ঠান্ডা মাথায় কাজ করা মুশকিল হয়ে যাবে।

কাল রাতে বাসায় ফিরতে ফিরতে দেরি হয়ে গিয়েছিল। ফরেনসিক থেকে আংটিটা আনতে গিয়েছিল প্রায় সন্ধ্যে সাতটায়। রাস্তায় ছিল ভরা জ্যাম। হেঁটে যাওয়া মুশকিল হয়ে গিয়েছিল। অর্ধেক রাস্তায় নেমে যায় গাড়ি থেকে। কন্সটেবলকে বলে যায় জ্যাম ছাড়লে থানায় ফেরত যেতে। যানজটে ঠেসে থাকা রাস্তাটা পাড় করে আবার পড়ল নতুন বিপদে। কোনো রিকশা নেই। বাধ্য হয়ে হাঁটা শুরু করে। বিশ মিনিট হাঁটার পর গলি মাড়িয়ে বাসায় আসে অবশেষে। সেখান থেকে বাড়ি ফিরে দেখে বাড়ি ভর্তি মেহমান

কলাবাগানে ছোট একটি ফ্ল্যাটে থাকে দানিয়াল। বাসায় দানিয়ালের মা আর কাজের বুয়া ছাড়া কেউ থাকে না। গতকাল সে বাড়িতে প্রবেশ করেই চমকে ওঠে। ভেবেছিল বাসায় ফিরলে মায়ের বকা খাবে। কিন্তু হলো উল্টো। বাড়ি ভর্তি মেহমান। বুঝতে দেরি হলো না যে মেয়েপক্ষ দেখতে এসেছে তাকে। সেই ঝামেলা শেষ করতে করতে প্রায় রাত দুটো বেজে যায়। মেয়েকে আর দেখা হয়নি দানিয়ালের।

মেয়ের বাবা, চাচা আর কিছু নিকট আত্মীয় এসেছিল দানিয়ালকে দেখার জন্য। দুই দিন পর মেয়েকে দেখতে যাবার কথা তাদের, এতটুকুই মায়ের থেকে জেনেছে সে। তারপর ঘুমাতে যাবার পর কেসটার কথা ভাবতে ভাবতেই ঘুম আসতে দেরি হয়ে যায় ওর। তারপর সকালে ঘুম ভাঙার পর থেকেই শুরু হয় তীব্র মাথা ধরা।

দানিয়াল সিদ্দিককে বলল, “সিদ্দিক, কড়া করে এক কাপ চা নিয়া আসো তো। আর রিপোর্টটা দাও।’

“জি স্যার।” সিদ্দিক রিপোর্টটা ডেস্কে রেখে চা আনতে যায়। থানার বাইরেই চায়ের দোকান। থানার সব চা এই চায়ের দোকান থেকেই আসে।

দানিয়াল ডেস্ক থেকে টেলিফোনটা তুলে নিল। শফি স্যারকে ফোন দিয়ে জানানো দরকার। নাহয় পরে জবাব দিতে দিতে হুঁশ থাকবে না। সিআইডির অফিসার কখন না কখন কী করে ফেলে কে জানে। আপাতত সে যেহেতু বস, তাকে সবকিছু জানানো কর্তব্যের মধ্যে পড়ে। নাম্বারটা মনে করার চেষ্টা করল, কাল নাম্বারটা বলেছিল শফি স্যার। দানিয়ালও ঠোঁট নেড়ে নাম্বারটা মুখস্থ করেছিল। হ্যাঁ, মনে পড়েছে, নাম্বারটা ডায়াল করল সে। রিং হচ্ছে ওপাশে।

কয়েকবার রিং হলো, কিন্তু কেউ ধরল না। দানিয়াল টেলিফোনটা রেখে ডেস্কের ওপর থেকে রিপোর্টটা তুলে নিল। এ-ফোর সাইজের একটা পেপার। মিসিং ডায়েরির কপি মনে হচ্ছে। রিপোর্টটা চোখের সামনে ধরল। হ্যাঁ, মিসিং ডায়েরির কপি।

রিপোর্টের এক কোণে পাসপোর্ট সাইজের এক কপি ছবি লাগানো। ছবি দেখেই দানিয়াল চিনতে পারল। রিপোর্টে চোখ বুলালো সে। সেখানে লেখা, নামঃ কেয়া ইসলাম, বয়সঃ ২৭, ঠিকানাঃ বন্দর। হারিয়েছে জানুয়ারির ১ তারিখ। প্রায় এক মাস হয়ে গেল তাহলে। মিসিং ডায়েরি করেছে মেয়েটির স্বামী আজমল শাহী।

ড্রয়ারে পুলিশ ডায়েরি রাখা। ড্রয়ার থেকে পুলিশ ডায়েরিটা বের করে বন্দর থানার নাম্বারটা বের করল দানিয়াল। ভিক্টিমের পরিবারের কাছে লাশটা হস্তান্তর করতে হবে। তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করা যাবে তখন।

দানিয়াল টেলিফোনটা আবার তুলে নিল ডেস্ক থেকে। সরাসরি ওসির নাম্বার ডায়াল করল।

“হ্যালো!”

“আমি দানিয়াল বলছিলাম। কলাবাগান থানার ওসি।

“স্যার আমি কন্সটেব কা…”

কন্সটেবলকে থামিয়ে দিয়ে দানিয়াল বলল, “আপনার স্যার ফিরলে বলবেন আমাকে ফোন দিতে।“

কলটা কেটে দিল দানিয়াল।

পুলিশের চাকরি করার ইচ্ছা ছিল না দানিয়ালের। হুটহাট যেন সবকিছু হয়ে গেল। তার পুলিশের চাকরিতে আসার প্রধান কারণ ছিল খুনির বিচার নিশ্চিত করা। ঘটনাক্রমে জীবনের কিছু কালো অধ্যায়ের সাথে জড়িয়ে যায়। পুলিশের সাথে জড়িয়ে পড়ে বয়স আঠারো পাড় হওয়ার আগেই। সখ্যতা কিংবা শত্রুতা, সবটা ঘিরে আছে এই পেশাটাকে নিয়ে।

মানুষের জীবনটা হলো রেললাইনের মতো। ছোট একটা ভুল বা লাইনের বিচ্যুতি যেমন পুরো ট্রেনটাকে লাইন থেকে ছুঁড়ে ফেলে দেয়। তেমনি মানুষের জীবনের ছোট একটা ঘটনা তার পুরো জীবনটাকে বদলে দেয়। জীবন নিয়ে নানান অভিজ্ঞতা, বিচিত্র সব স্মৃতি সবকিছু কেমন ফিকে হয়ে যায় এসব ঘটনার কাছে। এইসব ঘটনার পিছনে যদি থাকে প্ৰতিশোধ, তাহলে সেটা হয়তো জীবনভর থামে না। প্রতিশোধের আগুন জ্বলতে থাকে সেই চলন্ত ট্রেনের মতো, যেটা বন্ধ হয় কেবল মৃত্যু নামক স্টেশনের মধ্য দিয়ে।

প্রতিশোধ ফেরেশতাসম মানুষকে পিশাচ বানিয়ে দেয়। সবাই ক্ষমা করতে পারে না। অধিকাংশ মানুষ নিজের পশুত্ব ধরে রাখার চেষ্টা করে। দানিয়ালও তেমন। পশুত্ব ছেড়ে দিলে মানুষ হওয়ার স্বাদ হারিয়ে ফেলবে। আশেপাশে মানুষরূপী পশুদের হয়ে যাবে শিকার। তার থেকে ভালো

প্রেডাক্টর হয়ে নিজেই এসব পশুদের শিকার করা। এর আগের কেসে নিজ হাতে এনকাউন্টার করেছিল খুনিকে। এই কেসটাও সমাধান করবে সে, যে করেই হোক।

*****

সকাল থেকেই ফোনটা বাজছে শফির। বালিশে মুখ গুঁজে শুয়ে আছে সে। অর্পা বারবার বলছে ফোনটা ধরতে, কিন্তু কানে নিচ্ছে না। এবার শফির বাহুতে ধাক্কা দিয়ে অর্পা বলল, “এই ওঠো। অফিস থেকে কতবার কল আসলো!”

শফি বালিশে মুখ গুঁজে রেখেই বলল, “আরেকটু ঘুমাই।”

“আরেকটু বলতে বলতে নয়টা বাজিয়ে ফেলেছো। আর কত? ওঠো প্লিজ!” রাগী স্বরে অর্পা বলল।

শফি চোখ খুলে দেখল অর্পা ঝুঁকে আছে। অর্পাকে টান দিয়ে শফি নিচে নামিয়ে চুমু খাওয়ার চেষ্টা করলো। কিন্তু অর্পা ঠেলে সরিয়ে দিয়ে অর্পা বলল, “ঢং।”

“নিজের বউয়ের সাথে রোম্যান্স করা ঢং নাকি?”

অর্পা আড়চোখে তাকাল শফির দিকে।

“হয়েছে। নাস্তা দিচ্ছি, তাড়াতাড়ি ফ্রেশ হয়ে আসো। অফিস থেকে অনেকগুলো ফোন আসছে।” অর্পা বিছানা গোছাতে গোছাতেবলল।

“ইচ্ছে তো হয় চাকরিটা ছেড়ে দিয়ে তোমার সাথেই পড়ে থাকি সারাটা দিন।”

“আহা! তোমার সাথেই পড়ে থাকি!” মুখ ভেংচি দিয়ে বলল অর্পা।

“পড়ে থাকতে সমস্যা কী?”

“ভিক্ষা করতে বসতে হবে পরে।”

“উপরতলা ভাড়া দিয়ে আরামসে দিন কাটিয়ে দিতে পারব।”

“খবরদার ওই কথা মুখে আনবে না।” ধমকের সুরে বলল অর্পা।

বিছানা গুছিয়ে বের হয়ে গেল সে। রেগে গেছে অনেকটা। যতবার দোতলা ভাড়ার কথা বলা হয় অর্পা রেগে যায়।

বিছানা ঘেঁষেই বেডসাইড টেবিল। খয়েরি রংয়ের টেবিল। শফির চোখ যায় টেবিলটার প্যানেলের উপরে। খুব সুন্দর করে নকশা করা প্যানেলগুলো। রেলিংয়ের উপরেই চামেলি ফুলের নকশা আঁকা। এক বছর আগে অর্পা কিনেছে নিউমার্কেট থেকে। এটা শফির মোবাইল রাখার কাজ ছাড়া অন্য কোনো কাজে আসেনি। টেবিলের উপর থেকে মোবাইলটা তুলে নিল। পাঁচটা মিসড কল। নাম্বারটা অপরিচিত। চোখ কচলিয়ে আর আলসেমি ভরা বড় একটা হাই তুলে কল ব্যাক করল সে।

রিং হলো কিন্তু কেউ ধরল না। মোবাইলটা রেখেই ফ্রেশ হতে বাথরুমে ঢুকল শফি। ব্রাশটা তুলে নিয়ে পেস্ট লাগাল, এমন সময় কানে আওয়াজ এল। রিং হচ্ছে মোবাইলে। শফি ব্রাশটা রেখে আয়নার দিকে তাকাতেই ডান কাঁধে একটা লাল চিহ্ন দেখতে পেল। ভালো করে দেখার চেষ্টা করল দাগটা। হ্যাঁ, ছোট একটা লাল ফোঁটা দেখতে পেল সে।

আয়নার দিকে ঝুঁকে বাম হাতের তর্জনী আঙুল দিয়ে ফোঁটাটা মুছতে চেষ্টা করল। অনেকটুকু মুছে গেল। আঙুলটা চোখের কাছে এনে দেখতে পেল আঙুলের মাথা লাল হয়ে আছে। নাকের কাছে এনে গন্ধ শুঁকতে চেষ্টা কল। কোনো গন্ধ আসছে না। মুখে নিয়ে জিহ্বায় লাগানোর পর নোনতা লাগল।

রক্ত! হ্যাঁ, রক্ত। কিন্তু রক্ত এল কোথা থেকে? তা-ও শুকনো রক্ত!

পরক্ষণেই মনে পড়ল, কাল গিয়েছিল মর্গে। সেখান থেকে হয়তো শুকনো রক্ত এসে লেগেছে। মর্গে আবার এসব অনেক জায়গায় ছড়িয়ে থাকে। এমনকি দরজা থেকে শুরু করে, বিছানার চাদর, বিছানার খুঁটিতেও। এমন আরেকবার হয়েছিল। সেবার এক বিখ্যাত শিল্পপতির কেসে ফরেনসিকের কাজে গিয়েছিল, ঢাকার বাইরে এক জেলা সদর হাসপাতালের মর্গে। বাসায় ফিরে দেখে প্যান্টে রক্তের দাগ লেগে আছে।

মোবাইলে কল আসার কথা ভুলে গেল সে। রক্তের কথা মাথায় ঘুরছে এখন। ভয় পায় না, তবে পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখে। মর্গের রক্ত নিয়ে দিব্যি এক রাত পাড় করে দিয়েছে। এটা ভেবেই গা গুলিয়ে উঠছে শফির। বাথরুম থেকে বেড়িয়ে আসলো এক দৌড়ে।

“অৰ্পা! অর্পা!” জোরে ডাক দিল।

অর্পা তখন রান্নাঘরে। সেখান থেকে ছুটে এসে বলল, “কী হলো? এভাবে চেঁচাচ্ছ কেন?”

“কাল ঘাড়ে রক্ত লেগেছিল তুমি খেয়াল করোনি!”

অর্পা ঝুঁকে দেখল। শফি অস্থির হয়ে আছে। অর্পা শফির দিকে তাকিয়ে চেঁচিয়ে বলল, “এটার জন্য ডাকা লাগে? তুমি না অল্পতেই অনেক প্যানিক করো। কাল দেখেছিলাম। সারাদিন অনেক টায়ার্ড হয়েছিলে তাই বলিনি।”

“পাগল হয়েছো তুমি!” শফি বিরক্ত হয়ে বলল।

শফি বিছানায় বসলে অর্পা এগিয়ে এসে আবার দেখল।

“তুমি পুলিশের চাকরি করো কীভাবে! এতটুকু রক্ত দেখে তোমার অবস্থা খারাপ হয়ে যায়। কিছুই হয়নি। সব ঠিক আছে।” অর্পা তিরস্কার করল।

রক্ত নিয়ে সারারাত ঘুমিয়েছে। তা-ও মানুষের রক্ত। কী বিদঘুঁটে ব্যাপার! অর্পা দিন দিন কেমন হয়ে গিয়েছে। তার মধ্যে অনেকটা কঠিন মানুষের ব্যাপার-স্যাপার চলে এসেছে। চলাফেরায়ও অনেকটা আনমনা ছাপ। দেখে মনে হয় সে আর নিজের মধ্যে নেই। করছে এক কাজ আর মাথায় চলছে অন্য কিছু। সব কিছুতেই অমনোযোগিতার চিহ্ন রেখে যাচ্ছে আজকাল অর্পা।

অর্পা চলে গেলে টেবিলের উপর থেকে মোবাইলটা হাতে নিল শফি। অনেকগুলো মিসড কল। কল লিস্ট চেক করতেই দেখল রাতের কয়েকটা কল জামিলের। আর একটা এসেছে একটা অপরিচিত নাম্বার থেকে। সে অপরিচিতি নাম্বারটাতে কল করার সিদ্ধান্ত নিল।

“হ্যালো, কলাবাগান থেকে বলছি।”

“আমি শফি।” শফি নিজের পরিচয় দিল।

“আসোলামু আলাইকুম স্যার। আমি সিদ্দিক, স্যার।”

সিদ্দিক কে? সিদ্দিককে তো চিনতে পারেনি। মনে করার চেষ্টা করল শফি। স্মৃতিশক্তি তার এত খারাপ না। অবশেষে, মস্তিষ্কে আলতো করে চাপ দিতেই, মস্তিষ্ক তার চোখের সামনে সবকিছু মেলে ধরলো।

ওহ হ্যাঁ, সেদিনের কন্সটেবলটা। হ্যাংলা, পাতলা, লম্বাটে সুন্দর ছেলেটা, যে সবসময় দানিয়ালের আশেপাশে থাকে।

শফি এবার সরাসরি প্রশ্ন করল, “দানিয়াল কই?”

“স্যার তো বাইরে গেছে।”

“দানিয়াল কী আমাকে কিছু বলতে বলেছে তোমাকে?”

“জি স্যার। স্যার কইছে তাড়াতাড়ি থানায় আসতেন।”

শফি জবাব না দিয়েই ফোনটা রেখে দিল। কোনো কাজ না থাকলে এভাবে তলব করত না। আর দানিয়াল নিশ্চয় খুঁটিনাটি সিদ্দিককে জানিয়ে যায়নি। তাই তাকে অতিরিক্ত প্রশ্ন করাও বৃথা। সে প্রস্তুতি নিল থানায় যাওয়ার। আবার আরেকটা অস্বস্তিকর ঘটনার মুখোমুখি হতে হবে তাকে। মানুষ কেন যে এত খারাপ হয়। দুনিয়ার শ্রেষ্ঠ প্রাণী মানুষের হাতেই দুনিয়ার সবচেয়ে ঘৃণ্য কাজগুলো ঘটে।

ছোটখাটো একটা ভ্যান দাঁড়ানো কলাবাগান থানার সামনে। একটা পুরনো পুলিশ ভ্যান। ভ্যানের পেছনের দিকে গ্লাসে ফাটল দেখা যাচ্ছে। রংও উঠে গেছে অনেক জায়গায়। পুরনো একটা হাইয়েস মডেল। ভ্যানটা চলাকালীন নিশ্চয় বেশি কার্বন ছাড়ে আর ভটভট করে। লোকে হয়তো ভ্যানটার দিকে আড়চোখে তাকায় আর নাক কুচকে ভ্যান মালিককে গালিও দেয়। কিন্তু পরক্ষণে, গাড়ির পেছনদিকে পুলিশের স্টিকার দেখে জিহ্বায় কামড় দেয়, ভয়ে দৌড়ও দেয়। যদিও গাড়ির মধ্যে থাকা কোনো পুলিশের এসব নিয়ে মাখা ঘামানোর সুযোগ নেই।

ভ্যানটার বাম পাশেই প্রাচীর। প্রাচীর থেকে এমনভাবে হিসেব করে ভ্যানটা পার্ক করা হয়েছে যাতে একজন মানুষ অনায়াসে নামতে পারে। ডানপাশের দরজাটা খোলা। সেই দরজাটার বাইরে একটা পা শুধু দেখতে পাচ্ছে শফি। খাকি পরা পা। বুটটা দিয়ে একটু পরপর পায়ের সামনের অংশটা মাটির সাথে বাড়ি দিচ্ছে। পা নাচাচ্ছে। বোঝা যাচ্ছে, ভেতরে বসা লোকটা বেশ আয়েশি লোক।

সামনে এগিয়ে গেল শফি। বারান্দায় এসে ভিতরে উঁকি দিল। ‘খুট’ করে শব্দ হতেই পিছনে ফিরল সে। ভ্যানের দিকে তাকাতেই দেখল, মোটা গোঁফওয়ালা একজন পুলিশ গাড়ির ড্রাইভিং সিটে বসে আছে। চোখ বোজা। একটু পরপর গলা দিয়ে গড় গড় শব্দ বের হচ্ছে। হাতদুটো মাথার উপর দিয়ে লোকটা অনায়াসে ঘুমুচ্ছে।

থানার ভেতরে প্রবেশ করল শফি। ভেতরে ঢোকার পর চাপা কান্নার শব্দ এসে কানে লাগল। থানাটা আজ অনেক কোলাহলপূর্ণ। ভেতরে ও ছোটখাটো একটা জটলা। কনস্টেবলগুলো যার যার কাজে ব্যস্ত। কয়েকজনকে দেখা গেল থানার ভেতর থাকা সিভিলিয়ানের সাথে কথা বলতে। দুজন এসআই ব্যস্ত। একজন কম্পিউটারে টাইপ করে যাচ্ছে অনবরত আর অপরজন হাতে কলম নিয়ে কথা বলছে এক মধ্যবয়স্ক লোকের সাথে।

শফিকে দেখে এসআই চোখ তুলে একবার তাকাল, কিন্তু কোনো ভ্রূক্ষেপ না করেই সে নিজের কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ল আবার। হয়তো শফিকে চিনতে পারেনি। চিনলে দাঁড়িয়ে একটা সালাম ঠুকতো। শফি নেইম প্লেটে এসআই এর নামটা দেখে নিল, ছোট করে লিটন লেখা।

থানার মধ্যে একটা কলরব। চারপাশে শফি চোখ বুলালো। ভেতরে সিভিলিয়ান অনেক, তাই এতকোলাহল। কারও মুখ বন্ধ নেই, কিছু না কিছু বলে যাচ্ছে। মাছবাজারে পরিণত হয়েছে থানাটা। তবুও এই কোলাহলের শব্দ কাটিয়ে চাপা কান্নার শব্দটা কানে আসলো শফির।

কান্নার উৎসটা বের করতে চেষ্টা করল সে। দরজা দিয়ে ঢুকেই যে খোলা জায়গা, সেটায় সব এসআই, কন্সটেবল আর সিভিলিয়ানের বসার জায়গা। সিভিলিয়ানের বসার জন্য বিশাল বিশাল দুইটা বেঞ্চ দেয়ালের সাথে লাগানো। সেই একটা বেঞ্চ থেকেই কান্নার শব্দটা আসছে। শফি একটু এগুতেই বেঞ্চটাতে বসা এক প্রৌঢ়াকে দেখতে পেল।

বোরকা পরে আছে মহিলা। মাথা থেকে কালো রঙের স্কার্ফটা সামনের দিকে একটু বের হয়ে আছে। মহিলা মাথা নুইয়ে কান্না করছে অনবরত। গলার স্বর বেশ ফেটে আছে। সম্ভবত অনেকক্ষণ ধরে কান্না করছে। মহিলার মুখ দেখা যাচ্ছে না। স্কার্ফের মাথা দিয়ে মুখ ঢেকে কাঁদছে। শফির কৌতূহল শেষ হতেই মহিলাকে ডিঙিয়ে দানিয়ালের রুমের দিকে এগুলো।

ভেতরে ঢুকতেই দানিয়ালকে দেখতে পেল শফি। দানিয়ালের ডেস্কের সামনে বসা আরেক পুলিশ। হাতে ফাইল নিয়ে নেড়েচেড়ে দেখছে। দানিয়াল শফিকে দেখতেই উঠে দাঁড়াল। সটান স্যালুট ঠুকল একটা। দানিয়ালের দিকে তাকিয়ে একটা মুচকি হাসি দিল শফি। হাত দিয়ে ইশারা করল বসতে।

পুলিশ অফিসারটি বসেই ঘাড় ঘুরিয়ে শফির দিকে তাকাল। চোখে অনেক সংশয় আর সন্দেহ। সে দোটানায় পড়ে আছে, স্যালুট করবে কি না তা নিয়ে।

“আসেন স্যার।” দানিয়াল আবার নিজের চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়াল। চেয়ারটা শফির জন্য ছেড়ে পাশে দাঁড়ানোর জন্য উঠল সে। শফি হাত দিয়ে ইশারা করে বসার নির্দেশ দিলে কোনো কিছু না বলে বসে পড়ল দানিয়াল।

শফি এগিয়ে গিয়ে ডেস্কের একটি চেয়ার টেনে বসল। পাশে থাকা পুলিশের গা থেকে সিগারেটের গন্ধ আসছে। তার দিকে তাকাল। চোখ বুলিয়ে নিল একবার। কাঁধে স্টার দেখে বুঝল ওসি। বেশ পরিপাটি মানুষ হিসেবে তাকে আখ্যায়িত করা যাবে না। খাকির অধিকাংশ জায়গায় লম্বা ভাঁজ, বুটে লেগে আছে কাঁদার ছিটেফোঁটা। মুখে খোঁচা খোঁচা দাড়ি আর চোখগুলোতে কেমন অদ্ভুত এক বিষ্ণুাতা।

তাকে দেখে ব্যাচেলর জীবনের অগোছালো জীবনের কথা মনে পড়ল শফির। শফিরও একসময় ছিল এলোমেলো চুল, কাঁচাপাকা দাড়ি, বেশি বড় না, ছোট ছোট। প্যান্টের নানান জায়গায় ভাঁজ পড়ে থাকত, ছেঁড়া স্যান্ডেল কিংবা জুতোর উপর ময়লা ছিল নিত্যদিনের সঙ্গী। শফি সেখান থেকে উঠে এসেছে। কিন্তু ওসি সাহেব ব্যাচেলর জীবন পার করে এসেছে ঠিকই, কিন্তু এখনো সে ছাপটা জীবন থেকে সরাতে পারেনি। ওসি সাহেব এখন ফাইল দেখছে। সিরিয়াস ভাব নিয়ে শফির চোখ থেকে বাঁচতে চাচ্ছে হয়তো।

“সাবের সাহেব। ইনি শফি সাহেব, সিআইডি অফিসার। অফিসিয়ালি কেসটা উনি হ্যাঁন্ডেল করছেন।” শফির দিকে নির্দেশ করে বলল দানিয়াল।

ফাইল থেকে চোখ সরিয়ে পুলিশটি শফির এর দিকে তাকাল এবার সাবের করমর্দন করার জন্য হাত বাড়াল। শফি কিছু না বলেই মুখে হাসির টান ফুটিয়ে করমর্দন করল সাবেরের সাথে। সাবের মুখে জোর করে হাসি ফুটিয়ে বলল, “সরি স্যার, চিনতে পারিনি।”

সাবেরের বয়স বেশি হবে না। শফির সমবয়সীই হবে। শফি বলতে যাবে তার আগেই দানিয়াল ফোড়ন কাটল, “স্যার, উনিই বন্দর থানার ওসি।”

বন্দর থানার ওসি এখানে কী করে? শফি দ্বিধায় পড়ে গেল। দানিয়ালের দিকে তাকাল, চোখে প্রশ্ন নিয়ে।

“স্যার, ভিক্টিমের পরিচয় পাওয়া গেছে।” দানিয়াল বলল।

সকালে আসা ফ্যাক্সের কপিটা ডেস্ক থেকে তুলে শফির হাতে তুলে দিল দানিয়াল। হাত বাড়িয়ে রিপোর্টটা নিয়ে নিল শফি। কয়েকটা কাগজ স্ট্যাপলার মেরে বান্ডেল করা। রিপোর্টের প্রথমে থাকা মেয়েটার ছবির দিকে চোখ যায় শফির। কী অসম্ভব রূপবতী একটা মেয়ে।

টানা টানা চোখ, সরু নাক। সাদা কালো ছবিতেই মেয়েটাকে অসাধারণ লাগছে। অথচ মেয়েটাকে খুন করে কী বীভৎস করেছে খুনি! ভাবতেই গায়ের লোম দাঁড়িয়ে গেল শফির। রিপোর্টটা দ্রুত পড়ে নিল সে।

“আপনিই তদন্ত করেছিলেন?” সাবেরকে প্রশ্ন করে শফি।

শফির হঠাৎ প্রশ্ন শুনে নড়েচড়ে বসে সাবের। একটু আগে সামনে বসে থাকা ওসির প্রশ্নের জবাব দিতে দিতে তার দম বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়েছিল। দানিয়াল নামের ওসি তাকে প্রশ্ন করে করে জর্জরিত করেছে। এখন মনে হচ্ছে তাকে আরও প্রশ্নবাণে জর্জরিত করবে এই অফিসার।

“জি স্যার।” অজান্তেই সাবেরের মুখ থেকে স্যার শব্দটা বের হয়ে আসে।

“কতদিন তদন্ত চালিয়েছিলেন?”

“স্যার তদন্ত চলছিল।”

“আচ্ছা!” তাচ্ছিল্যের সুরেই বলল শফি। “প্রাইমারি সাসপেক্ট তো দেখি স্বামীকে দিয়ে রেখেছেন।” রিপোর্টের দিকে চোখ রেখেই বলল শফি।

রিপোর্টে অভিযুক্তদের কোনো তথ্য নেই। আন্দাজে ঢিল মারল শফি 1 এই ধরনের কেসে অভিযুক্ত হিসেবে স্বামীকে সবার উপরে রাখা হয়। শফির কথা শুনে প্রথমবারের মতো চমকে উঠল সাবের। তার চোখে-মুখে বিস্ময়ের চিহ্ন ফুটে উঠল। ভাবছে, এটা কীভাবে জানল?

হাত দিয়ে মুখটা আড়াল করে হাসি দিল দানিয়াল। সাবেরের চেহারা দেখে হাসি আটকাতে পারল না সে। আসলে শফির চালটা বুঝে গেছে সে। সাবেরকে ঘাবড়ে দেয়ার জন্য এটা বলেছে শফি।

“জি স্যার। আমি তদন্ত করে জেনেছি যে স্বামীর চরিত্র এত সুবিধার ছিল না তাই….”

“চরিত্র সুবিধার ছিল না মানে?” সাবেরের মুখ থেকে কথা কেড়ে নিয়েই বলল শফি।

“এই তো মেয়ে-টেয়ে। বুঝেন না স্যার!” বিচ্ছিরি হাসি দিয়ে সাবের বলল।

“এত দিন হলো কোনো কূল-কিনারা করতে পারলেন না?”

স্যার আমি যথাসম্ভব চেষ্টা করছি। বলা নেই, কওয়া নেই মেয়েটা গুম হয়ে যায়। খোঁজখবর নিয়ে দেখছি মেয়েটার চরিত্র ক্লিন ছিল। কোনো পরকীয়া বা অন্য কারও সাথে কোনো সম্পর্ক ছিল না। আজকালের মেয়েরা বুঝেনই তো!” মুখে আবার বিচ্ছিরি হাসি দিয়ে বলল সাবের।

শফির বিরক্তি লাগল। এই ঠুনকো পুলিশ অফিসারকে আর কিছু জিজ্ঞেস করে লাভ হবে না। তার থেকে ভালো হবে ভিক্টিমের পরিচিতদের জেরা করা।

শফি রিপোর্টে চোখ বুলাতে বুলাতে ডাক দিল, “দানিয়াল?”

“জি স্যার?”

“লাশ কি থানায় আসবে?”

“স্যার এসে পড়েছে।“

“কই?”

“বাইরে ভ্যানে রাখা।

“তাহলে ক্লিয়ার করো না কেন?”

“আপনার জন্য আটকে রাখছিলাম।”

বাইরে রাখা গাড়িতে তাহলে লাশটা রাখা, ভাবে শফি।

“সাবের সাহেব, লাশ নিতে আপনার সাথে ভিক্টিমের কে কে আসছে?”

“অনেকেই আসছে। জামাই, মা, বড় ভাই, বড় মামা আর কয়েকটি ছোঁকড়া।”

“কাল সবাইকে পুলিশ ভ্যানে করে থানায় পাঠাবেন। স্পেশালি স্বামী আর শ্বশুর-শাশুড়িকে। আর যাদের আপনার সন্দেহ হয় তাদের।”

“জি স্যার।”

হাত থেকে রিপোর্টটা ডেস্কে রাখল শফি। দূর থেকে জোহরের আজানের শব্দ কানে আসছে। ঘড়ির দিকে তাকাল, ১টা বাজে। দিনটা আজ খুব দ্রুত চলে গেল মনে হচ্ছে। সকালে ঘুম থেকে উঠে থানায় আসলো। এইতো, অথচ অর্ধপ্রহর চলে গেল ইতোমধ্যে। সবই কিয়ামতের লক্ষণ। শেষ জামানায় নাকি এইভাবে দিন দ্রুত ফুরিয়ে যাবে।

দানিয়ালের দিকে তাকিয়ে শফি আদেশ করল, “দানিয়াল, উনাকে বিদায় কর।“

“সাবের সাহেব আজ তাহলে আসেন। এতদূর আসার জন্য ধন্যবাদ।“

সাবের উঠে দাঁড়াল। ফাইলটা বাঁ হাতে নিয়ে ডান হাতটা দানিয়ালের উদ্দেশ্যে বাড়িয়ে দিল। দানিয়ালের সাথে করমর্দন করার পর হাত বাড়াল শফির দিকে। মুচকি হেসে করমর্দন করল শফি।

হাত ছাড়তেই ফাইলটা বগলদাবা করে সালাম ঠুকলো শফিকে। তাতে অবশ্য শফি কিংবা দানিয়ালের চেহারার কোনো পরিবর্তন হলো না।

“আসি স্যার।” ফাইলটা হাতে নিয়ে বলল সাবের। কথা শেষ করে দানিয়ালের দিকে তাকিয়ে বলল, “কোনো দরকার হলে বলবেন আমাকে।”

দানিয়াল কিছু বলল না। শুধু ডাক দিল, “লিটন! লিটন!”

এক এসআই ছুটে এল।

“উনাকে এগিয়ে দিয়ে আসো।” সাবেরকে দেখিয়ে লিটনকে নির্দেশ করল দানিয়াল।

“ঠিক আছে স্যার। দেখা হবে আবার, ইনশাআল্লাহ।” দানিয়াল সাবেরের দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বলল।

জবাবে মুচকি হাসল সাবের। লিটনের সাথে বের হয়ে গেল সাবের। দানিয়াল ডেস্ক থেকে ফাইনাল অটোপসি রিপোর্টটা বের করল।

“কী এটা?” জিজ্ঞেস করল শফি।

“ফাইনাল অটোপসি রিপোর্ট।”

“বিশেষ কিছু?”

“জি স্যার। অনেক বড় তথ্য পাওয়া গেছে।”

“কী?”

“স্যার মেয়েটা প্রেগনেন্ট ছিল।”

“হোয়াট!” চমকে উঠে বলল শফি।

“জি স্যার। প্রাইমারি স্টেজ। হরোমোনাল চেঞ্জের কারণে প্রেগন্যান্সি ধরা পড়ে।”

“পরিবারকে জানিয়েছো?”

“না স্যার।”

‘সেটা জানাওনি কেন?”

“স্যার জানাব। এখন বললে নিতে পারবে না। এমনি যা দেখলাম, সবাই ভেঙে পড়েছে। এই মুহূর্তে এটা জানালে থানাটা বিলাপের বাজারে পরিণত হবে। তাছাড়া একটু বাজিয়ে দেখতে হবে এটা নিয়ে। সময় মতো জানাব।”

শফি জবাবে কিছু বলল না। ভাবতে লাগল সারাদিন কী করবে। আজকের মতো আর কাজ নেই। পর্যাপ্ত তথ্য নেই যে ঘেটে দেখবে। যা আছে তার উপর একবার চোখ বুলানো যায়। তবে সেটা বাসায় গিয়েও করা যাবে। অফিসে একটু ঢুঁ মারতে হবে। ডিরেক্টরের সাথে কথা বলে জানাতে হবে সব। পাগলা ডিরেক্টর কখন ক্ষেপে গিয়ে আবার এরকম কেস দিয়ে দেয়, সেটার ঠিক নেই। এখন পেট ক্ষুধায় চোঁচোঁ করছে।

শফি দানিয়ালের দিকে তাকিয়ে বলল,”চলো দানিয়াল খেয়ে আসি।“

“দুঃখিত স্যার। আমার একটা দাওয়াত আছে। নামাজ পড়ে ওইখানে যাব।” দানিয়াল যথাসম্ভব ভদ্রভাবে না করল।

শফির অবশ্য কোনো সমস্যা হবে না। সে একা খেতেই পছন্দ করে। সৌজন্যতার জন্য দানিয়ালকে বলেছিল। যাওয়ার পথে মক্কা বিরিয়ানি থেকে, মোরগ পোলাও, চপ, জালি কাবাব আর বোরহানি খাবে, মন্দ হবে না দুপুরের খাবারটা আজ।

“আচ্ছা। তাহলে উঠি।”

শফি উঠে দাঁড়াল। শফির দেখাদেখি দানিয়ালও উঠল। কিছু না বলে বাইরের দিকে পা বাড়াল শফি। দানিয়াল মাথায় টুপিটা চাপিয়ে বাইরে বের হয়ে আসলো শফির সাথে। বাইরে রোদ খাঁ খাঁ করছে। বসন্তের কোমলতাকে ছাড়িয়ে আস্তে আস্তে গ্রীষ্মের রুক্ষতা বাড়ছে বেশ জোরেশোরে। শরীরে রোদের আলো পড়ে উষ্ণতার বদলে কেমন যেন একটু জ্বলে ওঠে। চিনচিন করে ওঠে লোমকূপ

আজ মেয়ে দেখতে যাবে দানিয়াল। সেখানেই দুপুরের খাওয়ার কথা। বাড়ি থেকে আগে কাপড় বদলিয়ে নিতে হবে। তারপর মাকে নিয়ে মেয়ে দেখতে যেতে হবে অনেক দূরে। এই ঝামেলা করতে করতে তার হুঁশ নেই। পকেট থেকে প্রতিনিয়ত টাকা যাচ্ছে। তার সমপদের ওসিরা মফস্বলে থেকেও সম্পদের পাহাড় করেছে, আর সে সেখানে এখন পাত্রী দেখার খরচ চালাতে হিমশিম খাচ্ছে। সৎ থাকার পুরস্কার এটা।

তবে ধনী না হওয়া নিয়ে দানিয়ালের কোনো আফসোস নেই। সে কোনোদিনই রিজিকের চিন্তা করেনি। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা রিজিক নির্দিষ্ট করে দিয়েছেন। তাছাড়া আল্লাহ তায়ালা সবাইকেই তার যতটুকু দরকার ততটুকুই রিজিক দেন। যেমনটা আল্লাহ তায়ালা সূরা শুরা এর ২৭ নাম্বার আয়াতে বলেন, “আল্লাহ তার সব বান্দাদের জীবনোপকরণে প্রাচুর্য দিলে তারা পৃথিবীতে অবশ্যই বিপর্যয় সৃষ্টি করত। কিন্তু আল্লাহ তাঁর ইচ্ছে মতো যথাযথ পরিমাণে রিজিক অবতীর্ণ করেন। তিনি তাঁর বান্দাদের ভালোভাবে দেখেন ও জানেন।”

যিনি এত বড় করেছেন, তিনি মৃত্যু পর্যন্তও চালিয়ে নেবেন। সুতরাং অর্থবিত্ত নিয়ে হতাশা করা কেবল শয়তানকে মনের ভেতর জায়গা করে দেয়ার একটা রাস্তা। মনের অজান্তেই একটা শুকরিয়া জানিয়ে দানিয়াল বাসার দিকে রওনা দিল। শফিও গাড়িতে বসে মুচকি হেসে বিদায় জানাল দানিয়ালকে।

[অসম্পূর্ণ]

1 Comment
Collapse Comments

বাকি অংশ কোথায় পাব? রিপ্লাই প্লিজ

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *