৩. দায়িত্বশীলতা ও সচেতনতা

তৃতীয় অধ্যায় (দায়িত্বশীলতা ও সচেতনতা)

সরস চিঠি

এক

গোধূলি পেরিয়ে সন্ধ্যা নেমেছে। আশপাশের দালানগুলোতে আলো জ্বলতে শুরু করেছে। সেই আলোর প্রতিবিম্ব পুকুরের স্বচ্ছ পানিতে নেচে বেড়াচ্ছে। থেকে থেকে মৃদু দুলছে। এভাবে অনেকটা সময় পেরিয়ে গেছে। সন্ধ্যা পেরিয়ে রাত হয়েছে। হঠাৎ পেছন থেকে টুব করে কে যেন ঢিল ছুড়ল। আলোগুলো ঝপাৎ করে কেঁপে উঠল।

‘এই কে রে!’ হন্তদন্ত হয়ে বলে উঠল হাসান। তাকিয়ে দেখে- আদিব খিলখিল করে হাসছে।

‘কী রে! এই অসময়ে তুই এখানে?’ কিছুটা বিস্ময় হাসানের কণ্ঠে

আদিব বলল, ‘তোকে বাসায় না পেয়েই এখানে আসা।’

‘ও আচ্ছা! তো আমি এখানে বুঝলি কী করে?’

‘তোর বাসায় গিয়েছিলাম। দরজা নক দিলে ভাবি দরজা না খুলেই বলে দিল- আপনার ভাই বাসায় নেই। পুকুরপাড় গিয়ে দেখুন। তাই চলে আসলাম। ব্যাপার কী হাসান? কিছু হয়েছে?’

‘না তেমন কিছু না। আচ্ছা বস এখানে।’ এই বলে একটু সরে বসে আদিবকে বসতে দিল। আদিব এগিয়ে এসে বসে পড়ল। এরপর ফিসফিস করে বলল, ‘ঝগড়া হয়েছে?’

হাসান মাথা নাড়ল- ‘হুম।’

‘স্বামী-স্ত্রীর মাঝে ঝগড়া টুকটাক হতেই পারে। কিন্তু তাই বলে তুই তো রাগ করে বাইরে চলে আসার ছেলে না! সিরিয়াস কিছু হয়নি তো?’ আদিবের উৎকণ্ঠা মনের পূর্ণ মনোযোগ হাসানের প্রতি।

হাসান অস্ফুটে বলল, ‘আর পারছি না রে আদিব। বড় ভুল করে ফেলেছি।’

‘মানে? কী ভুল?’ আদিবের বিস্মিত জিজ্ঞাসা।

‘অনেক বড় ভুল।’

‘ধুর ব্যাটা। বুঝিয়ে বল কী হয়েছে।’

‘ম্যাচ হচ্ছে না। কোনোকিছুতেই ম্যাচ হচ্ছে না। একদম সহ্য হচ্ছে না। কিচ্ছু ভালো লাগছে না।’

যেমন? একটু খুলে বলবি?’

‘আর শুনে কী হবে? আমি ডিভোর্সের সিদ্ধান্ত নিয়ে নিয়েছি।’

‘হোয়াট! ডিভোর্স?!’

‘হ্যাঁ, পুরো পাঁচটা বছর দেখেছি। আর পারছি না।’

‘কিন্তু কী এমন হলো যে এমনকিছুই ভাবতে হলো?’

হাসান চুপসে আছে। পুকুরে পিটপিট করে জ্বলতে থাকা দালান দেখছে। সেই দালানের গাঁ বেয়ে ঊর্ধ্বাকাশে দৃষ্টি ফিরিয়ে আদিব বলল, ‘বুঝেছি, আবহাওয়া বেশ উত্তপ্ত। একপশলা ঝুম বৃষ্টির প্রয়োজন…।’

হাসান এখনো কিছু বলছে না। আদিব পুনরায় বলল, ‘এই শোন, আজ বাসায় যা। আর কাল বিকেলে তোর ভাবিকে নিয়ে তোর বাসায় বেড়াতে আসব। তোর বাসায় আসি না অনেকদিন হলো। তবে সেই কিপ্টামোপনা ছেড়েছিস তো নাকি?’

হাসান ফিক করে হেসে ফেলল। বলল, ‘তা জানি না, তবে বাসায় আসলে দু’জন দু’কাপ চা ছাড়া যে আর কিছু পাবি না, এটা নিশ্চিত।’

‘ধুর শালা। আর মানুষ হলি না।’ আদিব এই বলতেই হাসান হেসে ফেলল। আদিবও হেসে বলল, ‘আচ্ছা আমরা যা নিয়ে আসব তা-ই একটু বেরে-টেরে দিস। নাকি তা-ও লুকিয়ে রাখবি? একা একাই খাবি? আর আমাদের শুধু চা খাইয়েই বিদায় করবি? কোনটা?’

হাসান আদিবের পেটের চামড়ায় সজোরে চিমটি দিয়ে চেপে ধরে ফিসফিসিয়ে বলল, ‘তোর মতো ভাবিস নাকি হ্যাঁ? আগে তো আয়। এরপর দেখ, শুধু চা খাইয়েই বিদায় করি, নাকি চা বানিয়ে তোর মাথায় ঢালি!’

‘এ্যহ্! আসছে! কালই দেখা যাবে। কে কার মাথায় ঢালে। আচ্ছা ওঠ এখন। আর রাগ করিস না। বাসায় গিয়ে খাওয়া-দাওয়া সেরে আরাম কর। ওঠ।’ এই বলে আদিব উঠে দাঁড়াল। হাসানও মাটিতে ভর করে উঠে দাঁড়িয়ে হাত দিয়ে জামার পেছনটা ঝেড়ে নিল।

হাসান সোজা বাসায় চলে গেল। আদিবের বাসা একটু দূরে। ১৫-২০ মিনিট হাঁটতে হবে। পুকুরপাড় থেকে বেরিয়ে রাস্তায় উঠতেই ফোনটা হাতে নিয়ে কাউকে কল দিল। ওপাশ থেকে রিসিভ করতেই আদিব বলল, ‘আসোলামু আসোলাইকুম, কে বলছেন?’ উত্তর এলো- ‘ওয়া আলাইকুমুসসালাম। ও আচ্ছা! আমি কে বলছি?’

‘জি, পরিচয়টা বলুন প্লিজ।’

‘আপনি ফোন করলেন আবার আপনিই পরিচয় চাচ্ছেন? আপনি কার কাছে ফোন করেছেন?’

‘আমি এই ফোনের মালিকের কাছে ফোন করেছি। আপনি কে? এই ফোন আপনি কোথায় পেলেন?’

ঐ মিয়া ঐ! পেয়েছেনটা কী হু! মেয়েদের কণ্ঠ পেলে আর হুশ থাকে না?’

‘এই যে ম্যাডাম শুনুন! বাজে বকবেন না! একদম বাজে বকবেন না বলে দিচ্ছি! আপনিও তো কম না! সোজাসাপ্টা বলে দিলেই তো হয় আপনি কে? আর এই ফোনের মালিক কোথায়? আমাদের মতো ইন্নোসেন্ট ছেলেদের আকর্ষণীয় ভয়েস শুনে শুধুশুধুই কথা বাড়াচ্ছেন। ভালো হয়ে যান।’

টুট টুট টুট…

ফোনটা কেটে গেল। আদিব রিডায়াল করে এখন বন্ধ পাচ্ছে। যা হোক, এশার নামাযের সময় হয়ে গেছে। পাশেই মসজিদ। নামায সেরে মসজিদ থেকে বের হয়ে হাঁটতে-হাঁটতে বাসার গেইটে এসে গেছে আদিব।

‘আসোলামু আলাইকুম! স্নেহা! এই স্নেহা!’ আদিব এই বলে দরজা নক করছে। কিন্তু কোনো সাড়া নেই। একবার, দুইবার এভাবে তিনবার ডাকার পর মাহির এসে দরজা খুলে দিল।

‘আ….ব্বু…!’ এই বলে ঝপাৎ করে আদিবের কোলে উঠে গেল। আদিব ওকে জড়িয়ে নিয়ে সোজা ঘরে ঢুকে স্নেহার পাশে গিয়ে বসল।

‘আব্বু তুমি একটু বারান্দায় খেলতে যাও তো।’ এই বলে মাহিরকে বারান্দায় পাঠিয়ে স্নেহাকে আদিব বলল, ‘কী ব্যাপার! আজ দরজা তুমি না খুলে মাহিরকে পাঠালে যে? তুমি জানো না! ঘরে এসে সাথে সাথেই তোমাকে না দেখলে আমার কষ্ট হয়? তোমার হাতের একগ্লাস শরবত না খেলে রাতটাই আমার মাটি হয়? কী? কী হয়েছে হুম?’

স্নেহা অস্ফুটে বলল, ‘আমি ভালো হতে চেষ্টা করছি। তোমার মতো ইন্নোসেন্ট ছেলের সাথে কথা বলতে আমার বয়েই গেছে!’

‘ওহ হো! সেই মোবাইল চোর মেয়েটা তাহলে তুমিই?’

‘কী…!’ এই বলেই আদিবকে কিল উঠাল স্নেহা। আদিব তো হাসতে হাসতে লুটোপুটি খেয়ে দৌড়!

‘অ্যাই! যাচ্ছ কোথায়! আমার পরিচয় নেবে না? কে আমি? ফোনের মালিকের সাথেও তো কথা বলা হলো না! আসো আসো! মালিকের সাথে কথা বলো!’ এই বলে স্নেহাও আদিবের দিকে এগিয়ে গেল। স্নেহা কাছে আসতেই সিরিয়াস মুড নিয়ে আদিব বলল, ‘এই এই দাঁড়াও!’ স্নেহা কিছু না বুঝেই থেমে গেল।

‘কী?’

‘আমার দিকে তাকাও।’

‘হুম, তাকালাম। কী? ‘

অমনি আদিব কষে একবার চোখ মেরে দিল!

স্নেহা কিছুক্ষণ ভ্রু-কুঁচকে তাকিয়ে রইল আদিবের দিকে। এরপর ফিক করে হেসে দিয়ে বলল, ‘তুমি ভালো হবে কবে শুনি?’

আদিব স্নেহার বাজুতে শক্ত করে ধরে বলল, ‘কোনোদিন না! কোনোদিন না! কোনোদিন না!’

স্নেহা অস্ফুটে বলল, ‘যেদিন থেকে তুমি ভালো হয়ে যাবে, ঠিক সেদিন থেকেই আমি মরে যাব। অন্তত আমাকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য হলেও তুমি আজীবন এমনই থেকো। কোনোদিন ভালো হবার দরকার নেই। কোনোদিন না! কোনোদিন না!’

স্নেহার চোখ ছলছল করে উঠল। গাল বেয়ে টুপ করে দু’ফোঁটা ভালোবাসা গড়িয়ে পড়ল। মনের গহীনে প্রেমের সরোবর যেন উথলে উঠল। হ্যাঁ, এটাই ভালোবাসা। ভালোবাসা শুধু জড়িয়ে ধরার নাম না। কখনও কখনও কাজল ধোয়া চোখের পানিও ভালোবাসা হয়। একদম নিখাঁদ ভালোবাসা।

আদিব স্নেহার চোখদুটো আলতো করে মুছে দিয়ে বলল, ‘তুমিও এমন পাগলীটিই থাকবে। কোনদিন এরচেয়ে বেশি ভালো হবে না! একদম না!’

এরমধ্যেই বারান্দা থেকে মাহির চলে এসে- ‘আ…ব্বু…! আজ না দাদু ফোন করেছিল! কালই চলে আসবে। আমি না অনেএএএক্ষণ কথা বলেছি…!’

মাহিরের আকস্মিক এমন হাঁক ছাড়ায় স্নেহা চমকে উঠেছে। তারচেয়ে বেশি লজ্জা পেয়েছে। আদিব চট করে স্নেহার বাজু ছেড়ে দিল। ভাবছে, ধরে থাকা অবস্থায় মাহির আবার দেখে ফেলল কি না! দেখলে কী লজ্জা!

আদিব হেসে দিয়ে মাহিরকে কোলে তুলে নিয়ে বলল, ‘আব্বু, দাদু আর কী বলল?’

আধো বুলিতে মাহির বলল, ‘দাদু বলেছে- তুমি যদি আম্মুকে বকা দাও তাহলে আমি যেন তোমাকে বোপ করে দিই। বো…প! এভাব…!’

ওরে বাবা! তাই! তাহলে তো তোমার আম্মুকে আ…র বকা দেওয়া যাবে না! চলো, এবার খেতে যাই।’

খাওয়া-দাওয়া সেরে ফ্রেস হয়ে একটুপর সবাই শুয়ে পড়ল। কিছুক্ষণের মধ্যেই মাহির ঘুমিয়ে গেল। স্নেহারও বুঝি চোখ লেগে আসল। কিন্তু হঠাৎ কপালে সুড়সুড়ি পেয়ে চোখ মেলে দেখে- আদিব!

‘কী ব্যাপার হুম? ওপাশ থেকে ছেলেকে ডিঙিয়ে এপাশে কী?’ ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করল স্নেহা।

আদিব অস্ফুটে বলল, ‘এপাশেই তো আমার সব! আমার দিনের ব্যস্ততা আর রাতের নির্জনতা সবটা ঘিরেই তো তুমি। শুধুই তুমি।’ এই বলে বলে আলতো করে স্নেহার কপাল ছুঁয়ে দিচ্ছে আদিব।

নিশ্চুপ স্নেহা আদিবের চোখের দিকে অপলক তাকিয়ে আছে।

‘কী দেখছো?’ আদিবের ক্ষীণ প্রশ্ন।

স্নেহা বলল, ‘আমাকে।’

‘আমাকে মানে?’

‘কেন! চোখাচোখির বর্ণহীন ভাষা গভীরতা পেলে একের চোখে অন্যকে দেখা যায়। জানো না?!’

আদিব লজ্জা পেয়ে গেল। চোখ নামিয়ে স্নেহার গাল টেনে দিয়ে বলল, ‘তো নিজেকে কেমন দেখলে শুনি?!’

‘নিজেকে দেখলাম- বেশ বুড়ি হয়ে গেছি।’

‘ঐ! বুড়ি মানে?’

‘এক বাচ্চার মা, বুড়ি না তো কী! চেহারার আগের সেই চমক কি আর আছে!’

‘বলে কী! আমি তো মাঝে মাঝে খটকা খেয়ে যাই। মানুষ দিন গেলে ফ্যাকাসে হয়ে যায়, আর তুমি দিনদিন যুবতী হয়ে উঠছো! দেখলে না! ওপাশ থেকে কীভাবে এপাশে চলে এলাম!’

স্নেহা হাত দিয়ে মুখ ঢেকে নিল। হেসে ফেলল। আদিবও স্নেহাকে আলতো করে বুকে টেনে নিল।

একটু পর আদিব বলল, ‘এই শোনো!’

‘হুম, বলো!’

‘হাসানের অবস্থা খুব একটা ভালো না।’

‘কেন কী হয়েছে?’

‘ও ডিভোর্সের সিদ্ধান্ত নিয়েছে।’

স্নেহা হতচকিত হয়ে বলল, ‘মানে!’

‘হুম, আজ হাসানের সাথে কথা হয়েছে। যেটুকু বুঝলাম, বিশেষ কোনো সমস্যা না, সামান্য মনোমালিন্য ও কিছু ভুল বুঝাবুঝি আছে দু’জনের মাঝে।’

‘মাইশা তো এমন মেয়ে না! যথেষ্ট বুদ্ধিমতী মেয়ে ও! ও আর আমি একসাথেই বড় হয়েছি। গলায়-গলায় মিল ছিল আমাদের। আমি অল্পতেই রেগে গেলে ও আমাকে কতশত বুঝিয়ে থামিয়ে রাখতো, বুঝাতো। ওর সাথে তো এমন হওয়ার কথা না! আমি কালই ওর বাসায় যাব।’

‘তা আর বলতে হবে না। তোমার আগেই আমি হাসানের কাছ থেকে ইনভাইটেশন কনফার্ম করে এসেছি।’

‘আচ্ছা তাহলে তো আরও ভালো হলো।’

‘জি, এবার চোখটা বন্ধ করুন, তাহলে আরও অনে…ক ভালো হবে।’

‘ঐ দুষ্টু! কী ভালো হবে হুম?’

‘বলা যাবে না! আগে চোখ বন্ধ…!’

‘আচ্ছা! এই যে বন্ধ…!’

দুই

‘চাচা, ফুটটা উঠিয়ে দিন তো। খুব রোদ লাগছে।’

রিক্সাওয়ালাকে উদ্দেশ্য করে বলল আদিব। চাচা রিক্সা থামিয়ে ফুট উঠিয়ে দিয়ে পুনরায় চলতে শুরু করল। মাহির আদিবের কোলে বসা। কিছু ফাস্টফুড আইটেম নিয়েছে হাসানের বাসায় নেওয়ার জন্য। ওটা স্নেহার হাতে।

স্নেহা বলল, ‘এই বিকেলে হাসান ভাইয়াকে বাসায় পাব তো?’

‘হুম থাকবে। কথা হয়েছে।’ আদিব এই বলতেই রিক্সার এক ঝাঁকুনিতে স্নেহার সাথে আলতো করে ধাক্কা খেল। অমনি মাহির বলে উঠল, ‘এই আব্বু! তুমি আম্মুর সাথে ছোঁয়া দিলে কেন? জানো না মেয়েদেরকে ছুঁতে হয় না? ভালো ছেলেরা মেয়েদেরকে ছোঁয় না। আমি দাদুকে বলে দেব আব্বু পঁচা হয়ে গেছে। আজ আম্মুকে ছুঁয়ে দিয়েছে, হুম।’

রিক্সাওয়ালা চালা খিলখিলিয়ে হেসে ফেলল। আদিবের জিহ্বায় কামড়! স্নেহা চোখ নামিয়ে চুপ করে আছে। ‘এই ছেলেটাকে নিয়ে আর পারা গেল না। দাদু একবার যেটা বলেছে সেটা নিয়েই, যখন-তখন…! আল্লাহ…!’ বিড়বিড় করে বলল আদিব।

আদিবের কথা শুনে স্নেহাও খিটখিটিয়ে হেসে উঠল। আড়চোখে আদিবকে দেখতে লাগল। আদিবের ‘বে-চারা’ ভাব মাখানো চেহারাটা দেখে মজা নিতে লাগল। অমনি আরেক ঝাঁকুনি! এ’এহ্

ঝাঁকুনিতে স্নেহার মাথা ফুটের সাথে বারি খেলে ‘উফ’ করে উঠল

‘ইয়া আল্লাহ! ব্যথা পেলে? দেখি দেখি!’ এই বলে আদিব মাথায় হাত দিয়ে দেখতে গেলে অমনি মাহির বলে উঠল, ‘উঁহু আব্বু, আমি দিখি। তুমি এই সুযোগে আম্মুকে ছুঁয়ে ফেলবে। পঁচা হয়ে যাবে। আমি আমি! দিখি আম্মু দিখি…!’

স্নেহা মাথা ডলতে ডলতে এবারও হেসে ফেলল। ‘কিছু হয়নি না আব্বু, সেরে গেছে সাথে সাথেই। ‘

ওদের কথাবার্তা শুনে রিক্সাওয়ালা চাচা এখনও হাসছে। আদিব বলল, ‘চাচা আপনি হাসছেন? আমি পড়েছি মহা বিপদে। কেন যে আমার আম্মু ওর সামনে এগুলো বলে আর শেখায়…!’

‘পোলাডার নাম কী বাজান?’

‘ওর নাম মাহির, চাচা।’

‘ম্যালা সুন্দর নাম। অনেক বড় হোক আপনের পোলাডা। দোয়া করি।’

দেখতে দেখতেই হাসানের বাসার কাছে এসে গেছে। ‘চাচা নামিয়ে দিন আমাদের।’ আদিব এই বলে পকেট থেকে টাকা বের করছে। স্নেহার কোল থেকে মাহির টুপ করে একটা লাফ দিয়ে নেমে গেল। স্নেহাও নামল। চাচার ভাড়া দিয়ে আদিব ফোন বের করে হাসানকে কল দিল।

হাসান রিসিভ করতেই আদিব কন্ঠ পরিবর্তন করে বলল, ‘হ্যালো হাসান সাহেব বলছেন?’

‘জি বলছি। কে বলছেন আপনি?’

‘আমি ডিবি অফিস থেকে এসেছি। আপনার সাথে একটু জরুরি দেখা করতে চাই। একটু বাইরে আসুন প্লিজ।’

অমনি পেছন থেকে একটি কাগজের গোল্লা ছুঁড়ে মেরে হাসান বলল, ‘জি স্যার আমি বাইরেই আছি। তো ডিবি অফিস থেকে আসলে বিবি সাথে কেন?’

আদিব জিহ্বায় কামড় দিয়ে হেসে ফেলল। এরপর বলল, ‘উনি হলেন মহিলা ডিবি। আপনার স্ত্রীও অপরাধী। তাই তাকে আনা।

‘শালা তাহলে বাচ্চা এনেছিস কেন?’

‘ব্যাটা বাচ্চার কারণেই আজ বেঁচে গেলি। নইলে তোকে…!’

‘নইলে কী?’

‘বলব না। বাচ্চা শিখে ফেলবে। এখন গেইট খোল এসে।’

হাসান খিটখিটিয়ে হাসতে হাসতে কাছে এসে সালাম দিল। ‘আসোলামু আসোলামু ভাবি, কেমন আছেন?’

স্নেহা হাসিমুখে উত্তর দিল, ‘ওয়া আলাইকুমুসসালাম, জি ভাইয়া, আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছি। আপনি ভালো আছেন?’

‘এই তো আছি, আলহামদুলিল্লাহ।’

‘তো আসুন ভেতরে আসুন।’ এই বলে গেইট খুলে ভেতরে গিয়ে রুমের দরজা খুলতে লাগল। নীচতলায়ই থাকে ওরা। হাসান দরজা খুলে ভেতরে ঢুকতেই আদিব বলল, ‘কী রে! শুধু ভাবিকেই ভেতরে ঢুকতে বললি। আমাকে বলবি না?’

‘কান টানলে মাথা আসে। মাথা আলাদা করে টানতে হয় না। হা হা হা…!’

স্নেহা একটু চিন্তায় পড়ে গেল। আমাকে কিছু বলল না তো? আদিবও স্নেহার দিকে তাকিয়ে ভাবছে, শালা বউয়ের সামনেও বাঁশ দিতে ছাড়ল না। এক মাঘে যে জীবন যায় না, এটা ওর বোঝা উচিত ছিল। যা হোক, ‘আসো আব্বু, ভেতরে আসো।’ এই বলে মাহিরকে হাত ধরে ভেতরে নিয়ে গেল আদিব।

হাসান ওদেরকে ড্রয়িংরুমে বসতে দিয়ে মাইশার রুমে চলে গেল।

বেলকনিতে গ্রিল ধরে দাঁড়িয়ে আছে মাইশা। হাসান পেছন থেকে এসে বলল, ‘মাইশা, তোমার বান্ধবী স্নেহা আর ওর হাজবেন্ড এসেছে। হাল্কা চা-নাস্তা করে দাও।’

হাসানের কথা শুনে মাইশা ঘুরে দাঁড়াল। বলল, ‘সাথে ওদের পিচ্চিটা এসেছে?’

‘হুম, মাহিরও এসেছে।’

‘আচ্ছা, আমি চা-নাস্তা রেডি করছি। তুমি স্নেহাকে আমার রুমে আসতে বলো। মাহিরকে নিয়ে ভাইয়া আর তুমি গেস্টরুমেই বসো।’

‘আচ্ছা ঠিক আছে।’

হাসান গিয়ে বলল, ‘ভাবি, আপনি ভেতরে ওর রুমে চলে যান। আমরা এখানে বসি।’

‘আচ্ছা ভাইয়া, সেটাই ভালো হবে। মাহির আসো আব্বু।’

লাভ ক্যান্ডি ‘ভাবি, মাহির আমাদের সাথে থাকুক।’

‘আচ্ছা ঠিক আছে।’ এই বলে স্নেহা ভেতরে চলে গেল। কিছুক্ষণ পর চা-নাস্তা হয়ে গেলে মাইশা হাসানকে ডেকে বলল, ‘এই শুনছো! নাস্তাটা নিয়ে যাও!’

হাসান এসে নাস্তা নিয়ে গেল। আদিব আর হাসান ওদের চা পর্ব শুরু করে দিল। মাহিরের জন্য আদিবকে বেশ ভদ্রতা দেখাতে হচ্ছে আজ। দেখা যাক, সুযোগটা হাসান কীভাবে কাজে লাগায়।

তিন

স্নেহা ভেতরে আসল। মাইশার রুমে ঢুকে বোরকা খুলতেই মাইশা হুড়মুড়িয়ে ওর কাছে এসে ওকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেলল।

‘সে কী! কী হয়েছে মাইশা? এভাবে কান্না কেন রে? ধুর বোকা। বস তো এখানে। একদম কাঁদবি না। এখনও সেই ছোট্টোটি রয়ে গেলি। কী হয়েছে? খুলে বল সব। আজ তোর সবকিছু শোনব। কিচ্ছু লুকোবি না আমাকে। বল।

মাইশা কিছুক্ষণ অঝোরে কাঁদল। এরপর ক্ষীণ কণ্ঠে বলল, ‘স্নেহা জানিস! হাসান আমাকে ডিভোর্স দেওয়ার সিদ্ধান্ত জানিয়ে দিয়েছে।’

স্নেহা একটু শক্ত হয়ে বলল, ‘সিদ্ধান্ত জানিয়েছে। দেয়নি তো?’

মাইশা একটু থমকে গেল। স্নেহা এমন করে বলল কেন? ওকে কিছু বলতে না দিয়েই স্নেহা পুনরায় বলল, ‘কেন এমন সিদ্ধান্ত নিতে যাবে না বল? আমার তো মনে হয় আরও আগে এমন সিদ্ধান্ত নেয়া উচিত ছিল।’

‘কী বললি তুই? আমার বান্ধবী হয়ে এমন কথা তুই বলতে পারলি?’ স্নেহার অমন কথা শুনে মাইশার চক্ষু তো চড়কগাছ! কী বলল এটা স্নেহা! আরও আগে এমন সিদ্ধান্ত নেয়া উচিত ছিল?

স্নেহা ওর জামার একটা কোণা ধরে বলল, ‘এটা কী পরেছিস?’

‘কেন?’

‘বল কী পরেছিস?’

‘তো বাসার মধ্যে আর কী পরব?’

‘কেন আর ভালো জামা নেই? নতুন কাপড় নেই?’

‘আছে।’

‘তো?’

‘ওগুলো কোথাও বের হলে পরি। এমনিতে বাসায় এগুলোই পরি।‘

‘কোথাও বের হলে বোরকা পরিস না?’

‘তা তো অবশ্যই। ‘

‘তাহলে তখন ভেতরে এসব স্বাভাবিক জামাগুলো পরলেই বা ক্ষতি কী! কেউ তো আর দেখবে না! আর বাসায় তো তোর স্বামী দেখবে। এত কষ্ট করে টাকা কামাই করে সেটা দিয়ে তোর জন্য সুন্দর সুন্দর জামা কিনে দেয় সেটা তুই পরবি, সে দেখবে। দু’চোখ ভরে দেখবে। ছেলেদের সুখ এটা। তো আজ এসে তোকে যা পরা দেখলাম, এতে তো আমারই বিতৃষ্ণা তৈরি হচ্ছে। ভাবছি ভাইয়া এতদিন সহ্য করল কী করে?’

‘তুই কি আমাকে ইনসাল্ট করছিস?’

স্নেহা মাইশার হাত ধরে খাটে বসাল। মুখটা ওর দিকে ঘুরিয়ে গালদুটো টেনে দিয়ে বলল, ‘শোন পাগলী, ছেলেরা সৌন্দর্যের পাগল। বাইরে কতশত সুন্দরী ইচ্ছায়-অনিচ্ছায় চোখে পড়ে, অনেকসময় প্রয়োজনে কথাও বলতে হয়, তো নফস তখন খুব ওয়াস-ওয়াসা দেয়, ধোকা দেয়, ঐ নারীর প্রতি পুরুষদেরকে আকৃষ্ট করতে চায়। কিন্তু সে ব্যক্তিত্ববান হওয়ায় সেই ফাঁদে পা দেয় না। নিজ স্ত্রীর সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করে না। তো দিনশেষে সে যখন ঘরে ফিরে, তখন তার স্ত্রীকে যদি বাইরে দেখে আসা সুন্দরীদের চেয়ে অধিক সুন্দরী আর পরিপাটি হিসেবে না পায়, তবে ধীরেধীরে সে এই স্ত্রীর প্রতি আকর্ষণ হারাতে থাকে। বাইরের সেই নারীদের প্রতি আকৃষ্ট হতে থাকে। আর এভাবে চলতে থাকলে বিপথগামী হতে সময় লাগে না। এখানে দোষ কার বলতে পারিস? আসলে দোষ না। এখানে স্ত্রীর অলসতা আর উদাসীনতাই দায়ী।’

এটুকু বলতেই স্নেহাকে থামিয়ে দিয়ে মাইশা বলল, ‘শোন, আমি বিয়ের কিছুদিন পর থেকেই দেখছি, প্রথম কয়েকমাস বেশ ভালোই ছিল। এরপর থেকে কেমন যেন বদলে যেতে থাকে। ঘরের সব কাজকর্ম আমি নিজ হাতে করি। তার মা-বাবা সহ পরিবারের সবার সাথে অত্যন্ত ভালো ব্যবহার করি, যখন যেভাবে বলে সেভাবেই করি, তবুও যত দিন যাচ্ছে আমার প্রতি তার অবহেলা যেন বেড়েই চলছে। কী করব আমি বল? আজকের হাসান আর সেই আগের হাসান নেই। অনেক বদলে গেছে সে। অনেক।’

‘কিছু শক্ত কথা বলি?’

মাইশা কিছু বলছে না।

‘কী মনে করবি জানি না, তবে বলা উচিত বলে মনে করছি। একটা কথা সবসময় মনে রাখবি, কারও মনের অবস্থা বুঝতে চাইলে সর্বপ্রথম নিজেকে তার স্থানে বসাবি।

এরপর তার মতো করে কিছুক্ষণ ভাববি, তার স্থানে তুই নিজে থাকলে কী করতি। এই প্রশ্নটি নিজেকে সবসময় করা দরকার। এতেকরে অন্যকে বোঝা সহজ হয়। যেমনটা আমি নিজে করি। আমিও তো একটা মেয়ে। আর প্রায় কাছাকাছি সময়েই আমাদের বিয়ে হয়েছে। আমার হাসবেন্ড আর হাসান ভাইয়া দু’জনই খুব রসিক ও ভালো মনের মানুষ। আমি তো বেশ ভালো আছি, আলহামদুলিল্লাহ। কিন্তু তোর ক্ষেত্রে এমন হলো কেন?’

মাইশা নিশ্চুপ। স্নেহা বলে যাচ্ছে…

‘আজ খোলামেলা কিছু কথা তোকে না বললেই নয়। ছোট থেকেই তোকে জানি আমি। তাই ভূমিকা না রেখে যা বলার সরাসরি বলছি।

একটা জিনিস মনে রাখবি, দিনশেষে ছেলেরাও কিন্তু মানুষ। আবেগ, অনুভূতি আর অভিমান এদেরও আছে। আছে প্রস্ফুটিত জুঁই-চামেলির ন্যায় কোমল একটি হৃদয়। আছে নিষ্পাপ শিশুসুলভ ছেলেমানুষি একটি মনও। কিন্তু দায়িত্ব আর বাস্তবতার ভারে সেগুলো চুপসে যায়। ভুলিয়ে দেয় এসবের কথা!

এরা মেয়েদের ন্যায় আবেগ, অনুভূতি আর অভিমানের বহিঃপ্রকাশ কেন যেন করতে পারে না। এটা কি এদের ব্যর্থতা? না সত্যিই দায়িত্ব আর বাস্তবতার ভার? ভেবে দেখা উচিত।

জানিস! এরা বড় নিষ্ঠুর প্রকৃতির হয়। নিজের জন্যও এরা একটু কাঁদতে পারে না। এটা কি ঠিক? অন্তত নিজের জন্য হলেও কি একটু কাঁদতে পারা উচিৎ নয়? আমার মনে হয় কী জানিস? কাঁদাটা বোধহয় এদের সাথে মানায়ই না।

এরা অনেকটা রাবার প্রকৃতির হয়। যত ইচ্ছা টেনে ছেঁড়ে দিবি, মুহূর্তেই আগের জায়গায় ফিরে আসবে।

এরা অনেকটা রোবটের ন্যায়। চাহিদার সুইচ অন করলেই পটাপট চাহিদা মিটিয়ে যায়। কি করা? এদের নিয়ন্ত্রণ যে ‘মেয়ে’ নামক এক কোমল কী প্যাডের মাঝে। এদের অস্তিত্বই যেন চাহিদা মিটিয়ে যাওয়ার নিমিত্তে।

মেয়েদের অভিমানী অভিপ্রায়-এর বিপরীতে এসকল রোবটিক ছেলেদের অভিমানের অধিকার থাকতে নেই। থাকতে নেই মুখ লুকিয়ে নিভৃতে একটু অশ্রুসিক্ত হওয়ার অধিকার। সেসবকি এদের মানায় বল? এরা এসব ন্যাকামো করলে কাজ করবে কখন? একটু পরেই যে আবার চাহিদার সুইচ অন হয়ে যাবে! মা-বাবা, ভাই-বোন, স্ত্রী-সন্তান সহ সকল প্রয়োজন মেটাতে সবাই তখন ডাকবে। সেখানে ব্যর্থ হলে কত লাঞ্চিতই না হতে হয়, সেটা আমরা মেয়েরা কি একটু বোঝার চেষ্টা করি?

অনেক সময় আমরা নিজেই সেই লাঞ্চনার নায়িকা বনে যাই! আর মা-বাবা? সে তো এক পায়ে! ভাই-বোন কিংবা প্রতিবেশী? সে যেন বাতাসে উড়ে…

জানিসই তো, কবি-লেখকদের অনুভূতিশক্তি হয় মারাত্মক ধরণের। তারা জীবনপ্রবাহের নানান ঠুনকো বিষয়কেও শব্দালংকারের যাদুতে জীবন্ত করে তুলতে পারে। কিন্তু এই অভাগা ছেলেদের অব্যক্ত কথন সেই কবি-লেখকদের অনুভূতিকেও ছুঁতে পারে না। এজন্য দেখবি, কবিদের কলম শুধু মেয়েদেরকে ঘিরেই নাচে, ছেলেদেরকে যেন তারা চেনেই না।

অভাগা হওয়া ভালো, তাই বলে এতটা? তুই’ই বল, এটা কি ঠিক? এরা যে এতটা অভাগা ও অপয়া হয় আগে বুঝিনি আমি।

এদের কাজ শুধু ছাঁয়া দিয়ে যাওয়া। এই রোবটিক জীবনপ্রবাহে ছাঁয়া পাবার অধিকার থাকতে নেই এদের। থাকতে নেই অসুস্থতার বাহানায় বিশ্রাম নেওয়ার অধিকারও।

এদের কাজ রক্ত পানি করে চাহিদা মিটিয়ে যাওয়া। কিন্তু রক্তবর্ধক খাবার খাওয়ার সময়টুকুও এদের নেই। সর্বদা খাইখাইপনা এদের জন্য না। কোনরকম ঠেলেঠুলে মুখে কিছু পুরে দিয়ে ঢোক ঢোক করে কয়েকগ্লাস পানি সাপ্লাই দিয়ে দিলেই ব্যাস…

রোদে পুড়ে কালো হয়ে যাওয়া, ধুলোবালিতে নোংড়া হয়ে যাওয়া, হাত-পা টুকটাক কেটেকুটে যাওয়া এসব নিয়ে তেমন মাথা ব্যথা নেই এদের

সৌন্দর্যটা এদের জন্য নাথিং। চামড়ার রঙ দিয়ে এরা কী করবে? এটা কারো প্রয়োজন নেই, প্রয়োজন যেটার সেটা হলো ‘টাকা’! এটা হলেই হয়, ছেলেদের চামড়া-টামড়া অত ধর্তব্য নাহ। আর মেয়েদের সাদা চামড়া ছাড়া অন্যকিছু গ্রহণযোগ্য নাহ!

কেননা আজকাল মেয়েদের মান হলো রঙে, আর ছেলেদের মান ধনে। এজন্যই তো কেউ দৃষ্টি দেয় না কারো মনে। বড় আজব দুনিয়া তাই না?

ধুলোবালি? ও তো গোসল দিলেই ফিনিশ। আর টুকটাক কেটেকুটে গেলে মুখ থেকে একটু লালা লাগিয়ে দিয়ে কাজে মনোযোগী হওয়াই বেটার।

জানিস! এদিকে হাতে প্রচণ্ড কাজ আর কপালে চিন্তার ভাঁজ নিয়ে একটি ছেলে যখন ক্লান্ত বদনে ঊর্ধ্বাকাশে দৃষ্টি ফেরায়, তখন সে কী ভাবে? কাকে ভাবে? কেন ভাবে? যেহুতু জানিস না, এতদিন জানার চেষ্টাও করিসনি, সেহেতু অজানাই থাকুক। সব বিষয়ই যে জানতে হবে এমন তো কোন কথা নেই…

আর ওদিকে কেউ একজন ভাবে, ও আর আগের মতো নেই, আগের সেই কেয়ারিং-শেয়ারিং আর ভালোবাসা এখন শুধুই স্মৃতি।

প্রিয়তমা? মা-বাবা? ভাইবোন? এমন ভাবনার বাইরে কেউ-ই আর অবশিষ্ট থাকে না। সকলের এক সুর- ‘ও আর আগের মত নেই।’

এই কথাটি যখন কোন ছেলেকে সরাসরি বলা হয় তখন ছেলেটির কেমন লাগে? ওর ভেতরটাতে কেমন অনুভূত হয় তখন? জানা আছে কি?

তবে কী জানিস! আমি নিজেও মাঝেমাঝে ভাবি, আচ্ছা! আসলেই কি ছেলেরা কিছুদিন পর আর আগের মত থাকে না? নাকি দায়িত্ব ও বাস্তবতার ভারী বোঝা তাকে আর আগের মতো থাকতে দেয় না? এ দুয়ের মাঝে কোনটা হতে পারে?

তোর মনে কী উত্তর আসে? ওদেরকে নিজের মত করে এভাবে অনুভব করার চেষ্টা কর। দেখবি, কষ্ট হবে না। হুটহাট প্রতিক্রিয়া দেখাবি না। হজমশক্তি বাড়ানোর চেষ্টা কর। যার শারীরিক হজমশক্তি ভালো, সে সুস্থ থাকে। আর যার কথা হজম করার শক্তি ভালো, সে সুখি হতে পারে। বিদ্রোহী মেয়েরা সুখের মুখ দেখতে পারে না। আর অলস মেয়েরা সুখ ধরে রাখতে পারে না।’

একমনে স্নেহার কথাগুলো শুনে যাচ্ছিল মাইশা। অবাক চোখে স্নেহার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘তুই ছেলেদেরকে এতটা ফিল করতে পারিস!’

‘ঠিক তা না। আমি আমার স্বামীকে আমার সর্বোচ্চটা দিয়ে ফিল করার চেষ্টা করি। ওর মন যা চায় সেটাকে বলার আগেই করে ফেলার চেষ্টা করি। আর রবের কাছে অবিরাম দু’আ করি। ব্যস। আল্লাহ আমাকে অনেক সুখে রেখেছেন, আলহামদুলিল্লাহ।’

‘খুব ঈর্ষা হচ্ছে রে।’

দেব চুলটানা! নেকামো রেখে যা বললাম ঠিকঠিক পালন করার চেষ্টা করবি। আর একটা বিষয় হলো, একবার যেটা বলে দ্বিতীয়বার সেটা যেন আর তাকে বলতে না হয়। খুব সিরিয়াস থাকবি এই বিষয়টাতে।

কারণ, ভালোবাসা হলো পেন্সিল-রাবারের মতো। পেন্সিল ভুল লিখলে রাবার তা মুছে দেয়। কিন্তু একই ভুল পুনঃপুন লিখতে থাকলে শেষমেশ খাতাটিই কিন্তু ছিঁড়ে যায়!

স্নেহার কথাগুলো মাইশাকে খুব ছুঁয়ে যাচ্ছে। ভেতরটা তোলপাড় করে ফেলছে। ওর চাহুনি, অঙ্গভঙ্গি এমনটাই বলছে। পরম আকুলতা মাখানো করুণ চাহুনি স্নেহার প্রতি। জমে থাকা রাজ্যের অভিযোগ শুরু করার আগেই যেন যথাযথ প্রেসক্রিপশন দিয়ে দিল। যেমনটা অভিজ্ঞ ডাক্তারদের ক্ষেত্রে হয়। এক আকাশ বিস্ময় নিয়ে মৃদু স্বরে স্নেহাকে জিজ্ঞেস করল, ‘এই স্নেহা! আমার জন্য তুই একটু দু’আ করিস। আমার মন বলছে, তুই দু’আ করলে কিছু একটা হবে। করবি তো?’

স্নেহা ওর কপালের চুলগুলো সরিয়ে গালের পাশে আলতো করে দু’হাতে চেপে ধরে বলল, ‘কেন করব না হুম? তবে তার চেয়ে বেশি কাজ হবে তুই নিজে দু’আ করলে। আচ্ছা বল তো, নিজের জন্য, নিজের স্বামীর জন্য মনভরে দু’আ করেছিস কখনও?’

স্নেহার প্রশ্ন শুনে মাইশা ক্ষানিকটা বিব্রত হলো। কী উত্তর দেবে স্নেহাকে? দু’আ তো দূরে থাক, নামাযটাই ইদানীং নিয়মিত আদায় হচ্ছে না। কিন্তু এসব স্নেহাকে বলা যাবে না। যেই আমি কি না স্নেহাকে নামাজের জন্য কতশত বলে বুঝাতাম, আজ সেই আমিই… ছিঃ ছিঃ।

মাইশা এভাবে কিছুক্ষণ নিজেকে প্রবোধ দেওয়ার পর সম্বিত ফিরে পেয়ে বলল, ‘আচ্ছা স্নেহা, তুই তোর স্বামীর জন্য কী কী দু’আ করিস?’

‘সেটা একান্ত আমার পার্সোনাল বিষয়। তুই তোর স্বামীকে যেমন দেখতে চাস তোর রবের কাছে তেমন দু’আ করবি। তুই তোর সংসারকে যেভাবে সাজাতে চাস, তোর রবের কাছে সেভাবে চাইবি।’

মাইশা ভাবনার জগতে কিছুক্ষণের জন্য হারিয়ে গেল। সে তার স্বামীকে কেমন দেখতে চায়?

ওর ভাবনায় ছেঁদ ফেলে স্নেহা বলল, ‘পাশাপাশি নিজেকেও এমনভাবে গড়তে হবে, যেভাবে তোর স্বামী চায়। সেটাও রবের কাছ থেকে চেয়ে নিতে হবে। প্রয়োজনে স্বামীর কাছ থেকেও সাহায্য নেয়া যেতে পারে।

তবে আর একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় স্মরণ হলো, তোরা এখনও সন্তান নেওয়ার কোনো প্লান করিসনি কেন?’

মাইশা নিশ্চুপ। ক্ষানিকটা লজ্জা পেয়ে গেল। কিছু বলতে পারল না। স্নেহা আবার প্রশ্ন করল, ‘কারও শারীরিক কোনো সমস্যা?’

মাইশা মাথা দুলাল, ‘উঁহুম, সমস্যা নেই।’

‘তো!’ স্নেহা কিছুটা রেগে গেল।

‘কারো কোনো সমস্যা নেই তবুও পাঁচটি বছর চলে গেল সন্তান নেওয়ার কোনো প্লান করিসনি কেন? আমি তো একদম শুরুতেই তোর ভাইয়াকে জানিয়ে দিয়েছি, আমরা সন্তান নিতে দেরি করব না। উনিও আর নিষেধ করলেন না। তাই প্রথম থেকেই আমরা কোনো ফ্যামিলি প্ল্যানিং-এর মধ্যে যাইনি। আলহামদুলিল্লাহ এখন আমাদের সন্তানের বয়স প্রায় চার বছর। বিশ্বাস করবি কি না জানি না, সন্তান নেওয়া পর থেকে আমাদের ভালোবাসা দিনদিন আকাশচুম্বী হয়েছে। মাঝেমাঝে যদিও টুকটাক মান-অভিমানের বালাই হানা দিয়েছিল, কিন্তু সন্তানের মুখটা দেখলে সেসবকিছু হাওয়া হয়ে গেছে। এই সন্তানটা আমাদের জন্য অনেকটা অঘোষিত বিচারক হিসেবে কাজ করেছে। এখনও করছে। আমাদের দুজনের মধ্যে দোষ যে-ই করুক, সন্তানের মুখের দিকে চোখ পড়লে অকপটে দোষটা নিজের ঘাড়ে নিয়ে নিই। ব্যস, ওর সেই নিষ্পাপ চেহারাই আমাদের মাঝে মিমাংসার রায় দিয়ে দেয়। প্রতিটা মেয়েরই এমনটা করা উচিত। বিয়ের পর যত দ্রুত সম্ভব সন্তান নিয়ে নেওয়া উচিত। এতে করে সংসারের ভিত মজবুত হয়। অন্যথায় সংসারটি দোদুল্যমান থাকে। সামান্য বাকবিতণ্ডায় ডিভোর্স লেটার চোখে ভাসে। শুরুতে বেবি না নিয়ে বড় ভুল করে ফেলেছিস।’

স্নেহার কথা শুনে মাইশা কী বলবে ঠিক বুঝে উঠতে পারছে না। কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, ‘আসলে প্রথমে কিছুদিন একটু রিল্যাক্স থাকতে চেয়েছিলাম। শুরুতে তোর ভাইয়া বলেছিল, আমরা সন্তান নেওয়ার বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিয়ে নিই কিন্তু আমি ভাবলাম, শুরুতেই বেবি নিলে জীবনটা কেমন একপেশে হয়ে যাবে। তাই কিছুদিন একটু রিল্যাক্স থেকে জীবনকে ইনজয় করি। ফ্রেস থাকি। এরপর সময় করে না হয়…।’

‘থাক। এখন তাহলে ডিভোর্স লেটার হতে নিয়ে চিরদিনের জন্য রিল্যাক্স হয়ে যা। ইনজয় কর জীবনকে। আমি গেলাম।’

এই বলেই স্নেহা উঠে দাঁড়িয়ে গেল। ‘এই এই রাগ করিস না, প্লিজ। ভুল করে ফেলেছি। এখন কিছু একটা কর। আর নইলে আমাকে গলা টিপে মেরে ফেল। এরপর চলে যা। ভয় নেই, নিজেকে দায়ি করে চিরকুট লিখে যাব।’

রাগে গা জ্বলছিল স্নেহার। কিন্তু মাইশার অভিমানী কথা শুনে মন ভিজে গেল। বসে পড়ে বলল, ‘শোন পাগলী, তোর সাথে আমি রাগ করে থাকতে পারি? অনেক দু’আ করি তোর জন্য। কিন্তু আমি দেখছি তোর নিজের কিছু ভুলের কারণেই আজ তোর এই দশা।’

‘এখন কী করতে পারি আমি? আমাকে স্পষ্ট করে কিছু বল।’

মাইশার দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকাল স্নেহা। বলল, ‘তো এতক্ষণ যা বলেছি তা কি অস্পষ্ট করে বললাম?’

মাইশা কিছুটা লজ্জা পেল।

‘বুঝেছি, টেনশনে কিচ্ছু কানে ঢুকেনি। জানতাম ঘণ্টাখানেক বকবক করার পর বলবি, কী যেন বললি! যেমনটা সেই প্রাইমারি থেকে করে আসছিস। আজও সেই অভ্যাস গেল না। এজন্য আমিও একটি চিঠি নিয়ে এসেছি।

‘বাব্বাহ! চিঠি! কী চিঠি দেখি! কার চিঠি?’

‘এটা বিয়ের কয়েকদিন পর প্রথম যখন আমাদের বাড়ি বেড়াতে গেলাম তখন আমার বড় ভাবি আমাকে দিয়েছিল। চিঠিটা ভাবির বিয়ের সময় তাকেও কেউ একজন দিয়েছিল। ভাবি আমাকে খুব আদর করে। যেকোনো সমস্যা আমি নির্দ্বিধায় ভাবিকে বলতে পারি। তো তিনিই আমাকে শেষমেশ কানেকানে বলে দিয়েছিল, দ্রুত যেন সন্তান নেওয়ার জন্য সিদ্ধান্ত নিয়ে নিই। আমি খুব লজ্জা পেয়েছিলাম তখন। তবে তার কথাটি খুব ভালোভাবে মনে গেঁথে নিয়েছিলাম। মূলত ভাবির সেই পরামর্শটিই আমার জীবনে সুখ এনে দিল। বাকিটা আমার দু’আ, চেষ্টা আর তোর ভাইয়ার আন্তরিকতা। সর্বপরি রবের এহসান। সুখের প্রকৃত মালিক তো তিনিই। তাকে অসন্তুষ্ট করে কখনও কেউ সুখি হতে পারে না। অথচ এই সহজ সমীকরণটিই আমরা বুঝি না।’

‘হাজার সালাম তোর বড় ভাবিকে।’

‘শুধু হাজার সালামে কাজ হবে না। নিজেরও সেই পরামর্শ অনুযায়ী আমল করতে হবে। এখন ভাইয়ার সাথে আলোচনা করে খুব দ্রুত সন্তান নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিবি। আর যেই বিষয়গুলো বললাম, মাথা ঝাঁকিয়ে সেগুলো মনে করে করে আমল করার চেষ্টা করবি। আর এই নে চিঠিখানার একটা ফটোকপি। আসল চিঠিটা

আমার কাছে। ওটাকে আমি আজীবন আগলে রাখব ইন-শা-আল্লাহ। আচ্ছা আজ আসি রে। সন্ধ্যা হতে চলল। বাসায় গিয়ে মাহিরের আব্বুর জন্য আজ একটা স্পেশাল আইটেম বানাব। ভালো থাকিস

স্নেহা এই বলে চিঠিটা মাইশার হাতে দিয়ে বোরকাটা পরে নিয়ে রুম থেকে বের হলো। ‘মাহিরের আব্বু চলো, সন্ধ্যা হতে চলল। সন্ধ্যার আগে বাসায় ফিরতে হবে।

‘ভাবি, অনেকদিন পর আসলেন। আজ না হয় থেকে যান!

‘ধন্যবাদ ভাইয়া। আর একদিন সকাল থেকে না খেয়ে থেকে বিকেল হলেই চলে আসব। রাতে আচ্ছামতো খেয়েদেয়ে মাইশার সাথে ইচ্ছেমতো গল্পগুজব করে সারারাত পার করে দেব। আজ তো খেয়ে এসেছি। তাই সরি। যাই ভাইয়া?’

স্নেহার কথা শুনে হাসান বেশি না, গুনে গুনে দুইটা কাশি দিল। আদিব মুখ ঘুরিয়ে উপরে তাকিয়ে আছে। স্নেহা বলল, ‘কী ব্যাপার মাহিরের আব্বু, চলো না!’

‘ও হ্যাঁ, চলো।’

চার

মাইশা সেই চিঠিখানা হাতে নিল। আগ্রহভরে চিঠির প্রতি চোখ ফেরাল। চিঠিটা হাতে নিয়ে বিছানায় গা এলিয়ে দিয়ে তা পড়তে লাগল। গভীর মনোযোগ দিয়ে প্রতিটি কথা মনের মধ্যে গাঁথতে লাগল।

সেই চিঠিতে লেখা ছিল-

বিয়ের পর শুরুতেই আপনার স্বামীর জ্ঞান ও যোগ্যতার স্তর সম্পর্কে ধারণা নিন। আপনার চেয়ে কম বা বেশি যেটাই হোক- তার মতামত, ইচ্ছা ও সিদ্ধান্তকে ঠেকায় পড়ে নয়; সন্তুষ্টচিত্তে প্রাধান্য দিন।

স্বামীকে সম্মান করুন। শ্রদ্ধা করুন। মনে রাখবেন- সম্মান ও শ্রদ্ধাহীন সম্পর্ক এবং কচু পাতার পানির মানো কোনো পার্থক্য নেই। আজ না হয় কাল- পড়ে যাবে।

কেবল নিষিদ্ধ বিষয় ছাড়া অবশিষ্ট সকল বিষয়ে তার প্রতি পূর্ণ অনুগত থাকুন। কতটা অনুগত? যতটা অনুগত থাকার জন্য হুজুর সা. একথা বলেছেন- ‘আল্লাহ তা’য়ালা ছাড়া অন্য কাউকে যদি সিজদাহ করা জায়েজ হতো, তাহলে আমি স্ত্রীদেরকে হুকুম করতাম তারা যেন তাদের স্বামীকে সিজদাহ করে।’

সদা হাস্যজ্জল থাকুন। একথার অর্থ এই নয় যে, সারাক্ষণ পাগলের মতো হাসতে হবে। এর অর্থ হলো, স্বামীর সাথে হাসিমুখে কথা বলুন।

তার সাথে জেদ করবেন না। আড়াআড়ি করবেন না। মনে রাখবেন- স্বামীর সাথে জেদ করা মানে নিজের পায়ে নিজে কুড়াল মারা।

পুরুষ নারীর নমনীয়তাকে ভালোবাসে। কোমলতাকে ভালোবাসে। তার কাছে অমূল্য হতে চাইলে নিজেকে নমনীয় রেখে কোমল ব্যবহার রপ্ত করুন। সুখি হবেন।

লাজুক হোন। লাজুকতা পুরুষত্বকে আকর্ষণ করে। স্বামীর মনকে চুপিচুপি চুরি না করে সরাসরি ডাকাতি করে।

অতিরিক্ত সন্দেহ করা থেকে বিরত থাকুন। বিয়ের আগে অভিভাবকের মাধ্যমে ছেলের চারিত্রিক স্তর মেপে নিন। তবুও বিয়ের পর বিচ্যুতি দেখা দিলে বা সন্দেহ হলে গোয়েন্দাগিরি না করে তার যত্ন নেয়া নাড়িয়ে দিন। তার নানা-মাকে আগের চেয়ে বেশি ভালোবাসুন। তাদের প্রতি খুব খেয়াল রাখুন। স্বামীর কাপড়-চোপড় সহ কখন কী প্রয়োজন ও ব্যবহৃত জিনিসপত্র সহ সাংসারিক টুকিটাকি বিষয় নখদর্পণে রাখুন। তার সবকিছুতে যত্নের ছোঁয়া লাগিয়ে দিন। তার ভালো লাগা বিষয়কে নিজেও পছন্দ করুন, আর অপছন্দনীয় বিষয় থেকে বিরত থাকুন।

তাকে একথা বুঝিয়ে দিন- পৃথিবীতে আপনার চেয়ে বেশি ভালোবাসা তাকে আর কেউ দিতে পারবে না! তবে সাবধান! মুখে নয়; কাজে প্রমাণ করুন। পারলে সুযোগ বুঝে চিরকুটে কিছু লিখে তার টেবিলে, জামার পকেটে অথবা সহজে চোখে পড়ে এমন স্থানে রেখে দিন। ম্যাজিক হবে ম্যাজিক।

অলসতা ঝেড়ে ফেলুন। খুব ভোরে ওঠার অভ্যাস করুন। এটা স্বামীর বাড়ি। শ্বশুর-শাশুড়ি, দেবর-ননদ সবাই আছে এখানে। তাদের মন বুঝুন। সবাইকে বশে নিয়ে আসুন। বশে আনতে তাবিজ-কবচ লাগে না। সুন্দর ব্যবহার করুন। কর্মঠ, বুদ্ধিমতী ও চপলমতি হোন। এমনিই নশে চলে আসবে।

আলস্য ও গোমড়া মুখকে মেটিয়ে বিদায় করুন। না হয় এগুলোই আপনার সুখকে দাফন করে দেবে। তবুও অনাকাঙিক্ষত কিছু দেখা দিলে ঘরের কথা বাইরে না বলে সবর করুন। চুপ থাকুন। এক আল্লাহকে মন খুলে সব বলুন।

আপনার স্বামী আপনাকে রেখে অন্য কারো দিকে ঝুঁকে পড়ে কখন? কেন? নিজেকে প্রশ্ন করেছেন কখনও? অনেক স্ত্রী নিজেকে এই প্রশ্ন করলেও অধিকাংশই একটি সরল উত্তর পায়। তা হলো- আমার স্বামী আসলে চরিত্রহীন। চোখ খারাপ। ভণ্ড। এর কাছে এসে আমার জীবনটাই ব্লা ব্লা…!

থামুন! একজন দ্বীনদার ও ব্যক্তিত্ববান স্বামীকে এসব বলতে লজ্জা করুন। আল্লাহকে ভয় করুন। বরং এসব কল্পনা করা থেকেও বিরত থাকুন। নতুবা সংসারের শান্তি স্রেফ উরে যাবে। ভালোবাসার অচিন পাখি আগামীকালের পরিবর্তে আজই ফুড়ুৎ করে উড়ে যাবে।

আপনার স্বামী নিজের চরিত্র ও নজরকে হেফাজত করতে কী পরিমাণ স্ট্রাগল করে তা আপনি বুঝবেন না। কর্মস্থলে, পথেঘাটে, ডানেনামে, দেওয়ালে, এমনকি নিচের দিকে তাকিয়ে হাটলেও রাস্তায় পড়ে থাকা পেপার, কাগজ, বিভিন্ন লিফলেট ও বিজ্ঞাপনে নোংরা নিউটি কুইনদের অর্ধ-উলঙ্গ কামনীয় দেহ আকুপাকু করে তাকে ফুসলাতে থাকে। আর বেচারা স্বামীর চেয়েও এক ইঞ্চি বড় দ্বীনদার (!) ইনলিশ সাহেব সেদিক থেকে খাহেশাতের বিষাক্ত তীর ঠিক তার হার্ট বরাবর ছুঁড়ে মারে। এই তীরের প্রভাব যে কতটা তীব্র হয় তা অন্যক্ত।

এছাড়াও কর্মস্থলে ও পথেঘাটে ইচ্ছা-অনিচ্ছায় কতশত সুন্দরী রমণীর মোহনীয় রুপের ছটায় সে বিধ্বস্ত হয় সে খবর কী আপনার আছে? এই বিধ্বস্ত অবস্থায় বেচারা যখন ঘরে ফিরে- সে তখন বাইরে থেকে দেখে আসা সুন্দরীদের চেয়েও অধিক সুন্দরী কারো সোহাগ চায়। আল্লাহ আপনাকে যেটুকু দিয়েছেন সেটুকুতেই আপনি তার কাছে ভুবনজয়ী সুন্দরী। তা না হলে সে আপনাকে নিয়ে করতো না।

মনে রাখবেন, জগতের প্রতিটি স্ত্রীই তার স্বামীর কাছে অপরূপা হয়। তো আপনার যেটুকু আছে এটুকুই একটু পরিপাটি করে ডিসপ্লে করুন না!

বাইরে বের হতে গেলে বোরকার নিচেও যেটুকু সাজুগুজু করেন, আপনার স্বামীর জন্য অন্তত এটুকু সাজুগুজুও আপনি করেন না। স্বামীর সামনে ঝলসে যাওয়া ড্রেসটা পরেন। চুলগুলো পাটের বস্ত্র বানিয়ে রাখেন। সাংসারিক কাজ করে

ঘেমে-নেয়ে এক্কেবারে জবুথবু হয়ে থাকেন। স্বামী বেচারা আপনাকে দেখলে তার ক্লান্ত শরীর আরও ক্লান্ত হয়ে যায়। অরুচি ধরে যায়। আর নফস ঠিক তখনই চান্স পেয়ে যায়। নাইরে দেখে আসা সুন্দরীদের নিয়ে নানান জল্পনা-কল্পনা শুরু হয়ে যায়। এখানে দোষটা কার? নফস থেকে কেউ মুক্ত না। আসলে দোষ না। ব্যর্থতা। স্ত্রী হিসেবে আপনার ব্যর্থতাই আপনার স্বামীকে অন্যত্র চোখ ফেরাতে বাধ্য করছে। রিমাইন্ড ইউরসেল্ফ। প্রশ্ন করুন নিজেকে।

স্বামী ঘরে আসার আগেই গোসল করে, সুন্দর-আকর্ষণীয় জামাকাপড় পরে, পারফিউম (অবশ্যই হালাল হতে হবে। নারীদের জন্য নিজের স্বামীকে খুশি করতে নিরাপদ পরিবেশে সুগন্ধী ব্যবহার করা জায়েজ। অন্যথায় নাইরে বের হবার সময় অথবা অন্য পুরুষের নাকে যেতে পারে এমন আশঙ্কা হলে নারীদের জন্য সুগন্ধি / পারফিউম ব্যবহার করা জায়েজ নেই।) ব্যবহার করে, টুকিটাকি সাজুগুজু করে নিজেকে বাইরের ফাহেসা নারীদের চেয়ে বেশি সুন্দর করে সাজিয়ে তৈরি রাখুন।

বাহির থেকে আসলে দরজা পর্যন্ত গিয়ে তাকে এগিয়ে আনুন। হাতে কিছু থাকলে নিজহাতে নিয়ে পাশে রেখে দিয়ে আগে বসতে দিন। একটু বাতাস করুন। জামার বুতামটা খুলে দিন। মিনিটখানেক পর একগ্লাস শরবত করে দিন।

ব্যাস… ড্রাগ চেনেন ড্রাগ? দ্রোগ নিলে যেমন নেশায় ধরে, আপনার স্বামীকেও তেমন নেশায় ধরবে। আপনার নেশা। ভালোবাসার নেশা! হালাল নেশা!

তাকে প্রচণ্ড ভালোবাসুন। সন্দেহ জড়িয়ে নয়, নিশ্বাসের মোড়কে সিরিয়াস রকমের ভালোবাসুন। আর এই বিশ্বাসের ভিত্তি এটাই মজবুত রাখুন, যাতে সন্দেহের সাইক্লোন এসেও তা টলাতে না পারে।

প্রতিজ্ঞা করুন- আপনার স্বামীর প্রতি অন্যকোনো মেয়ের ভালোবাসা যাতে আপনার চেয়ে বেশি হতে না পারে। কেমন স্ত্রী আপনি? আপনার স্বামীকে অন্য একটা মেয়ে আপনার চেয়ে বেশি ভালোবাসা দেখিয়ে ছিনিয়ে নিতে চায়! রক্ত আছে আপনার শরীরে? জেদ হয় না? হ্যাঁ, স্বামীকে ভালোবাসা দিয়ে সেই জেদ মিটিয়ে নিন। জিতে যাবেন। ছেলেদের প্রচুর ইগো। কোনোভাবে তাকে অপমান করবেন না। কটাক্ষ করবেন না। কোনো ত্রুটি নজরে আসলে যখন-তখন প্রতিক্রিয়া দেখাবেন না। সারাক্ষণ ঘ্যানরঘ্যানর করবেন না। সকাল-বিকাল অভিযোগ করবেন না।

একান্ত সময়ে, বিনয়ের সাথে, ভালোবাসা মাখিয়ে বুঝিয়ে বলুন, রাজা-রাজ্য সটাই আপনার হবে। ট্রাস্ট মি…

বিয়ের পর স্বামীর সাজানো বাগানে এসে তাতে পানি ঢালুন। দেখবেন, একসময় পুরো বাগানটিই আপনার হয়ে গেছে। কাউকে প্রতিদ্বন্দ্বী ভেনে কাস্তে চালাবেন না। তাহলে দেখবেন, অজান্তে নিজেই ঝড়ে যাবেন।

স্বামীকে রাজার মতো মানুন। রানীর মর্যাদা পাবেন। গোলামের মতো ভাবলে- নান্দির মতো থাকবেন। চয়েজ আপনার।

স্বামী বাইরের পরিবেশ থেকে কেমন মন নিয়ে ফিরে আসে তা অজ্ঞাত। আপনার আশা- সে আজ গোলাপ হাতে ঘরে ফিরবে। আদর করে খোঁপায় গেথে দিয়ে সোহাগ করবে।

কিন্তু এমনও তো হতে পারে- বেচারা আজ অ্যাক্সিডেন্টের হাত থেকে এ যাত্রায় কোনোমতে বেচে ফিরল! নার্ভাসনেস তার রন্দ্রে-রন্দ্রে। রোমান্স গেছে আজ সোজা চান্দে! কী অসম্ভব কিছু? সবকিছু হয়তো বলে না আপনাকে। আপনি দুঃশ্চিন্তা করবেন তাই। আপনি সারাদিন তার অপেক্ষায় থাকলেন। আর সে এসেই ধপাশ করে শুয়ে পড়ল। অমনি আপনি অপ্পপ্পপ্প… বুঝলেন না বেচারাকে। বিশ্বাস করুন! আপনার প্রতি ধীরে ধীরে এভাবেই তার রুচি নষ্ট হয়ে যায়।

আপনার ইচ্ছা- সারাক্ষণ স্বামী আপনার পাশে থাকবে। আপনাকে ভালোবাসবে। আদিখ্যেতায় আপনাকে মাতিয়ে রাখবে। হে বোন! আপনার স্বামীর

মনেও একই ইচ্ছা। একই আশা। স্বাদ-আহ্লাদ তারও কম নেই। কিন্তু দিন শেষে আপনার মুখে দু’মুঠো খাবার কে তুলে দেবে? আপনার অসুস্থতায় পাগলের মতো ছোটাছুটি করে ডাক্তারের পেছনে যেহিসাব টাকা কে বিলানে? আপনার অনাগত সন্তানের দুলনিটা কে কিনে দেবে? বাবুর প্যাম্পাস, ছোটছোট নতুন কাপড় আর নানানপদের খেলনা কে এনে দেবে?

বোন আমার! যে মানুষটি বিয়ের আগে দুরন্তপনায় একাধিক হাওয়াই নোবেল পেয়েছে, গুরুজন কর্তৃক অকর্মার ঢেকি উপাধিতে ভূষিত হয়েছে, ঠিক সেই মানুষটিই আজ আপনার ও আপনার সন্তানের একটু নিরাপদ আশ্রয়ের জন্য, দু’মুঠো ভাতের যোগান দেওয়ার জন্য, সুনিশ্চিত এক ভবিষ্যতের জন্য নিজেকে গোলাম বানিয়েছে, স্রেফ গোলাম। তাই সর্বদা তার থেকে তাজা গোলাপের আশা না করে মাঝেমধ্যে নিজেও একটি গোলাপ তাকে উপহার দেওয়া যায় না? তাজা লাগবে না, জাস্ট কাগজে আকা খেলনা গোলাপ। কী! যায় না?!

আর হ্যাঁ, শাশুড়ির বিষয়টি সর্বদা মথায় রাখবেন। মনে রাখবেন, এই মানুষটি হলো আপনার সংসার নামক গাছের শেকড়। এখানে নিয়মিত পানি ঢালুন, সুস্বাদু ফল উপহার পাবেন। এখানে কুড়াল চালাবেন তো নিজেও মরবেন, স্বামীকেও মারবেন।

তিনি যেহেতু আপনার সবচেয়ে প্রিয় মানুষটার মা, তাই তাকে তার প্রাপ্য সম্মানটা দেওয়ার চেষ্টা করুন।

আজ যাকে পেয়ে আপনি গর্বিত, যে স্বামীর কারণে আপনি অন্যদের চেয়ে নিজেকে ভাগ্যবান মনে করেন, তাকে এই পর্যন্ত নিয়ে আসতে তিলতিল করে যেই মানুষটি নিজের রক্ত পানি করে দিয়েছেন, নিজে না খেয়ে তাকে খাইয়েছেন, নিজের পুরোটা সত্তা তার জন্য বিলিন করে দিয়েছেন, যার ফলস্বরূপ আজকের আপনার এই স্বামী।

গাছ লাগিয়েছেন তিনি, আদর-যত্ন করে বড় করেছেন তিনি, এখন ফল ধরার মৌসুমে গাছটিকে আপনার হাতে সোপর্দ করেছেন। আপনাকে গিফট দিয়েছেন। সেক্ষেত্রে এমন মানুষটির ব্যাপারে আপনার কী পরিমাণ কৃতজ্ঞ ও বিনয়ী হওয়া উচিত ভাবতে পারেন?

একটা জিনিস খেয়াল রাখবেন, ছেলেদের প্রতি সবচেয়ে বেশি অধিকার থাকে তার মায়ের। আর মেয়েদের প্রতি সবচেয়ে বেশি অধিকার থাকে তার স্বামীর।

তাই বিশেষ কোনো সমস্যা না হলে স্বামীকে আলাদা থাকার জন্য চাপ দেবেন না। কারণ প্রতিটি মায়েরই তার ছেলে ও ছেলের বউকে নিয়ে অনেক স্বপ্ন থাকে। তারা সাধারণ কিছু সেবা-যত্নের আশা লালন করে। আপনি যখন শাশুড়ি হবেন তখন বুঝবেন। সেই দিকটাতে একটু দৃষ্টি রাখুন।

শাশুড়ির সামনে স্বামী-স্ত্রী স্বাভাবিক থাকুন। রোমান্স না খুনসুটিতে মজবেন না। তবে মাঝে মাঝে তাকে নিয়ে একসাথে কিছু সময় কাটাতে ও আনন্দ করতে পারেন। ভালো লাগবে।

তর্ক করবেন না। কথার পিঠে কথা বলতে যাবেন না। ভালো ও সত্য কথা হলেও না। তার আচরণে কখনও নেগেটিভ কোনো রিএ্যাক্ট করবেন না। অকারণে কোনো কটু কথা বললেও এক কান দিয়ে শুনে অপর কান দিয়ে লিক করে দিন। ভেতরে জমা রাখবেন না। অপারগ না হলে স্বামীর কাছেও এসব জানাবেন না। জাস্ট হজম করে নিন।

শাশুড়ির সংসারে এসেই ড্রাইভার সাজতে যাবেন না, হেল্পার হিসেবে থাকুন। যখন যা করবেন সবকিছু জিজ্ঞেস করে নিন। কী রান্না করবেন, কী দিয়ে করবেন, কতটুকু করবেন সরাসরি জিজ্ঞেস করে নিন। যেভাবে বলে সেভাবেই করুন। নিজের জানা থাকলেও সাময়িক ছাত্রীর পরিচয় দিন। তার রান্নার প্রশংসা করুন। কাজের প্রশংসা করুন। তার ঔষধের বাটি, কাপড়-চোপড় এগুলোর দিকে লক্ষ্য রাখুন। তার ভালো লাগা ও মন্দ লাগার বিষয়গুলো সহ টুকিটাকি সকল বিষয়ে পাই-টু-পাই জ্ঞান রাখুন ও সেভাবে চলার চেষ্টা করুন।

শুরুতেই খুব বেশি মিশতে যাবেন না। উনাকে বুঝার চেষ্টা করুন। অবসরে জমিয়ে গল্প করুন। মনোযোগ দিয়ে উনার কথা শুনুন। নয়স্করা বলতে ভালোবাসে। যে যত বেশি তাদের কথা মন দিয়ে শোনে তারা তাকে তত বেশি আপন মনে করে। তার কষ্টের কথায় ব্যথিত হোন, সুখের কথায় আপ্লুত হোন।

অত্যধিক জুলুম না হলে তার যেসব ব্যবহার ভালো না লাগনে ওসব ব্যাপার নিজের নানার বাড়ি না স্বামী কাউকে কিছু বলবেন না।

দ্বীন-দুনিয়া কোনো বিষয়ে তাকে পরামর্শ দিতে যাবেন না। এটার জন্য তার ছেলে আছে। প্রয়োজনে আপনার স্বামীকে সুন্দর করে বুঝিয়ে বলে তার মাধ্যমে কিছু চেষ্টা করুন। আপনি জাস্ট তার সাথে মিশে যান। প্রতিপক্ষ হবেন না। পাশাপাশি নিজের আমল, দ্বীনদারিত এসবের প্রতিও সিরিয়াস থাকুন। তাতে ত্রুটি দেখা দিলে একান্ত সময়ে স্বামীকে বলুন। আবার যখন-তখন না।

মাঝেমানো শাশুড়ির জন্য স্বামীকে কিছু গিফট কিনে আনতে বলুন। আর সেটা নিজ হাতে তাকে দিন। নিজের জন্য শপিং করার সময় তার জন্যও কিছু না কিছু কিনুন।

দেবর, ননদ ওদের প্রতি সদয় হোন। ওদের জন্যও মাঝেমধ্যে কিছু কেনাকাটা করুন। ওদের ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবুন, স্বামীর সহযোগী হোন, ওদের হিতাকাঙ্ক্ষী হোন। ওদেরকে নিজের ভাই-বোনের মতো মনে করুন। তবে দেবরের সাথে পর্দার বিষয়টি সর্বদা মাথায় রাখুন। প্রয়োজন ছাড়া দেবরের সাথে অহেতুক কথা বলবেন না। নিজের একটা ওয়েট এক্ষেত্রে ধরে রাখুন। তবে ননদিনীর সাথে ফ্রি থাকুন। তাকে বান্ধবী বানিয়ে নিন। বিপদে ঢাল হিসেবে কাজে দেবে।

এসবের ভিড়ে শ্বশুরকেও ভুলে যাবেন না। সাধ্যের মধ্যে তার প্রতিও খেয়াল রাখুন। কখন কী প্রয়োজন হয় তা গুছিয়ে এনে দিন। তবে সরাসরি শারীরিক কোনো সেনা করা থেকে বিরত থাকুন। যেমন হাত-পা টিপে দেওয়া ইত্যাদি।

এতকিছুর পরেও শাশুড়ি না তার বাড়ির অন্য কারও দ্বারা কষ্ট পেলে আল্লাহর জন্য সবর করুন। এর বিনিময়ে নেকির আশা রাখুন। স্বামীর সাথে এসব নিয়ে মনোমালিন্য করবেন না। সব কথা মন খুলে আপনার রবের কাছে প্রকাশ করুন। একান্ত অপারগ হলে শান্ত মনে স্বামীর কাঁধে মাথা রেখে তার কাছে নিজেকে মেলে ধরুন। কষ্টের জায়গাগুলো একে একে তুলে ধরুন।

বলে রাখা ভালো, শ্বশুর-শাশুড়ির খেদমত করার জন্য যদিও আপনি বাধ্য নন, কিন্তু আপনার স্বামীর আদেশ মানতে আপনি বাধ্য। স্বামীকে খুশি রাখতে, তার সন্তুষ্ট অর্জন করতে সর্বাত্মক চেষ্টা করা আপনার প্রধান দায়িত। তাই তাদের সাধারণ খেদমতের বিষয়টি যদি আপনার স্বামীর আদেশ হয়ে থাকে সেক্ষেত্রে এটা আপনার জন্য জরুরি বটে। কারণ, ইসলামের বিরুদ্ধে না যায় স্বামীর এমন সব

আদেশ মানা স্ত্রীর জন্য ওয়াজিন। আর তার আদেশ যদি ইসলামের বিরুদ্ধে যায় এমন হলে আপনি বাধ্য নন। তবে স্বামীরও উচিত স্ত্রীর প্রতি যেন জুলুম না হয় সেদিকে সজাগ দৃষ্টি রাখা।

অতঃপর…

এভাবে নিজের সর্বোচ্চটা দিয়ে যখন আপনার সংসারটিকে জান্নাতের বাগান বানাতে শেষরাতে রবের কাছে দু’হাত তুলবেন, চোখের পানিতে কাজল মুছবেন- ইন-শা-আল্লাহ আপনি বিজয়ী হবেন। জি বোন, আপনিই বিজয়ী হবেন।’

ডিমান্ড & সাপ্লাই

১০

দু’হাতে হাঁটু পেঁচিয়ে মাথাটা নুইয়ে হাঁটুর সাথে মিশিয়ে ফ্লোরে বসে আছে অধরা।

অপরাহ্ন পেরিয়ে বিকেল হতে চলল। চার টা ছুঁইছুঁই। বসন্তের দিনগুলো এমনিতেই ক্ষণজন্মা। শুরু হতেই শেষ হবার তোড়জোড়। সারাদিনের এত এত কাজ সব শেষ করে অধরা এখন ক্লান্ত-শ্রান্ত। অমনি আকাশ এসে ধড়াম ধড়াম করে কয়েকটি শব্দ করল। কিছু একটা রেখেছে বোধহয়।

সে যাকগে, আজ অধরাকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাওয়ার কথা। কিছুদিন ধরে ওর ঘুম হচ্ছে না। মাঝে মাঝেই পেটে খাঁমচে ধরা ব্যথা উঠে। ভেতরের সবকিছু একেবারে ছিঁড়ে যেতে চায় যেন। খাবারদাবারেও রুচি নেই। কেমন উষ্কখুষ্ক চুল। ফ্যাকাসে চেহারা। মাসখানেক ধরে আকশকে বলে বলে অবশেষে রাজি হয়েছে আজ নিয়ে যাবে বলে।

আকাশকে দেখে এগিয়ে গিয়ে বলল, ‘কখন বের হবেন?’

আকাশ চড়া গলায় উত্তর দিল, ‘এখনই। চলো। ঘণ্টাখানের মধ্যে শেষ করে ফিরতে হবে। আর একটা কাজ আছে আজ।’

অধরা তড়িঘড়ি করে তৈরি হওয়া শুরু করল। ওয়াশরুম থেকে ফ্রেস হয়ে এসে কোনরকম হাতমুখ মুছেই বোরকা পরতে গেলে আকাশ হাত থেকে বোরকাটি ছোঁ মেরে নিয়ে গেল। অধরা কিছু বুঝে উঠতে পারার আগেই আকাশ ঝাড়ি মেরে বলল, ‘এসব ঝামেলা করতে পারবে না। এমনি চলো।’

অধরা অস্ফুটে বলল, ‘বোরকা ছাড়া যাব কী করে?’

একথা বলতেই ‘চুপ! একদম চুপ!’ এই বলে অধরার চোখ বরাবর আঙ্গুল উঁচিয়ে শাসিয়ে উঠল আকাশ। নির্বাক মেয়েটি ছলছল দৃষ্টিতে আকাশের রক্তচক্ষুর দিকে অপলক তাকিয়ে আছে।

আকাশ এবার একটু নিশপিশ করে হাতটি উঁচিয়ে বলল, ‘আর একবার যদি বোরকার নাম শুনি, তবে তোর দাঁতগুলো আমি ফেলে দেব। ফ্রেন্ডদের সাথে একটা প্রোগ্রামেও অ্যাটেন্ড করতে পারি না এই তোর জন্য। গেঁয়ো ভুত কোথাকার!’

একথা শুনে অধরা করজোড় করে বলছে, ‘তোমার সব কথা আমি মাথা পেতে নেব, কিন্তু প্লিজ তুমি আমায় আমার রবের হুকুমের বিরুদ্ধে চলতে বাধ্য কোরো না!’

একথা বলতে দেরি অমনি ‘ঠাশ!’ করে ওঠা শব্দের সাথে অধরা বিছানার ওপর আছড়ে পড়ল!

আঘাতটি যেন অধরার গাল নয়; ওর কলিজাকে রক্তাক্ত করে দিল। তাইতো গালে নয়; বুকে হাত দিয়ে বিছানায় পড়ে গেল অধরা। যেন ভেতর থেকে কলিজাটি বেরিয়ে না পড়ে।

আকাশ এরপর অধরার একমাত্র বোরকাটি পায়ের নিচে রেখে সজোরে টান মেরে দু’টুকরো করে ওর মুখের উপর ছুঁড়ে মেরে বলল, ‘কথাটা মনে থাকে যেন!’ এই বলেই ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।

কলিজার উপচে পড়া রক্ত বন্ধ করতে ছেঁড়া বোরকাটি বুকের মাঝে খুব জোরে চেপে ধরেছে অধরা। নিস্তব্ধ ঘরে এবার বুকের সবটুকু শক্তি দিয়ে চিৎকার করে ‘ইয়া আল্লাহ…!’ বলেই কান্নায় ভেঙে পড়ল।

এর বেশিকিছু আর বলতে পারছে না মেয়েটি। এরপর বিছানায় আলতো করে গা এলিয়ে দিল। দীর্ঘক্ষণ পর জ্ঞান ফিরলে দেখে, ওর ৫-৬ বছরের একমাত্র কলিজার টুকরো ছেলে রাহাত খেলাধুলা করে এসে না খেয়েই ঘুমিয়ে পড়েছে। অধরা নিজেকে একটু সামলে নিয়ে ওয়াশরুম থেকে ফ্রেস হয়ে এসে রাহাতের পাশে শুয়ে পড়ল।

শুয়ে একা একাই বিড়বিড় করে বলছে, ‘আর না, অনেক হয়েছে। এই সাত’টি বছরে বোধহয় সাত’বারও বাবার বাড়ি যাওয়ার ভাগ্য হয়নি। যতবার গিয়েছি তার প্রতিবারই বোরকা পরা নিয়ে তুলকালাম বাধিয়েছে। আজ বছরখানেক ধরে প্রায়ই অকারণে পেটে ব্যথা হয়, ডাক্তারের কাছেও যেতে চাইনি শুধুমাত্র বোরকা ছাড়া যেতে হবে বলে। ২৪ ঘণ্টার মধ্যে কোনদিন ন্যূনতম তিন-চার ঘণ্টাও ঘুমানো হয়ে উঠেনি। দৈনিক তিনবেলার একটি বারও গরম খাবার নসিবে জুটেনি। সারাদিন বাদির মত খেটে যাচ্ছি, উপরন্তু পান থেকে চুন খসলেই মা-বাবা সহ চৌদ্দগুষ্টি উদ্ধার করে ছাড়ে। তবুও আমার রাহাতের দিকে তাকিয়ে জীবনটি এভাবেই কাটিয়ে দিতে চেয়েছিলাম। শুধু আমাকে আমার রবের হুকুমটা মানতে দিলে আমি আর কিছুই চাই না, কিচ্ছু না। কিন্তু আমাকে সেটাও দেবে না!

আর না! আমার রবের হুকুমের সাথে কোন আপোষ নেই। আমি আর আমার এই মুখ ওকে দেখাব না। আজই আমি আমার দু’চোখ যেদিকে যায় সেদিকে হারিয়ে ফেলব নিজেকে। চিরদিনের জন্য হারিয়ে যাব ওর জীবন থেকে।’

এসব বলেই দু’হাতে মুখটা ঢেকে নিয়ে শেষ কান্নাটা কেঁদে নিচ্ছে পাগলীটি।

আবার মনে মনে ভাবছে, আমি যে কোনোদিন একা পথ চলিনি, একা বের হইনি, কোন রাস্তাও চিনি না। মাত্র কয়েক কিলোমিটার পরই বাবার বাড়ি, সেখানেও একা একা যেতে পারি না। তবে কীভাবে আমি হারিয়ে যাব? আর কোথায়ই বা গিয়ে উঠব?

এই ভাবতে ভাবতে ওর হাত-পা কেঁপে উঠল। আবারও অশ্রুশিক্ত হয়ে একদম চুপসে গেল।

কিন্তু না! ও আর থাকতে রাজি নয়। নিজেকে সামলে নিয়ে ছোট একটি ব্যাগে একসেট কাপড় আর কানের, নাকের জিনিষগুলো খুলে ভরে নিল। আকাশ বাড়ি ফিরলে ঘুমিয়ে গেলেই বেরিয়ে পড়বে অজানায়! নিজেকে হারিয়ে ফেলবে কোন এক দূর সীমানায়…।

রাত ১টা ছুঁইছুঁই! আকাশ এসেই বিছানায় শুয়ে পড়ে বলল, ‘আমি বাইরে থেকে খেয়ে এসেছি, খেয়ে নে তুই। আমি না আসা পর্যন্ত তো আবার খাবার টেবিলে যাস না।’ এই বলেই কম্বল মুরি দিয়ে ঘুমিয়ে পড়ল।

অধরা চুপচাপ অনক্ষণ বসে থেকে ব্যাগটি হাতে নিয়ে উঠে দাঁড়াল। রাত প্রায় ২টা এখন! শীতে হাত-পা ব্যথা হয়ে যাচ্ছে। তাতে কী, ওকে আজ হারাতেই হবে। শেষবারের মত কলিজার টুকরোটাকে একটু দেখে নিচ্ছে সামনে থেকে।

ঘুমের মধ্যে রাহাতের ঠোঁটদু’টি মৃদু নড়ছে দেখে অধরা ভাবছে, আমার রাহাত বুঝি আম্মুনি…আম্মুনি… বলে ডাকছে আমাকে। এই ভেবেই বুকটা খিঁচে ধরল ওর। ব্যাগটা ফেলে রেখে ওকে একটু আদর করতে চাইল, কিন্তু ধরলে যদি জেগে যায়? তাহলে তো আর হারাতে দেবে না।

আবার ব্যাগটা হাতে নিয়ে সোনা মানিকটাকে প্রাণভরে দেখে নিচ্ছে। যেন ও বড় হলে যদি কখনও পথে-ঘাটে দেখা হয় ঠিক ঠিক চিনতে পারে।

এবার ওপাশে গেল আকাশকে শেষবারের মত একপলক দেখেই পা বাড়াবে। আকাশ মাথাটা বের করে কম্বল গায়ে দিয়ে ঘুমুচ্ছে। ওর দিকে তাকাতেই অধরার চোখে আর বাঁধ মানল না। আষাঢ়ের বাদল নামল অঝোর ধারায়। বুকে ব্যথা শুরু হয়ে গেছে। শরীরে কম্পন উঠে যাচ্ছে। ভাবছে শেষবারের মত পাষণ্ডটার কপালে একটু ভালোবাসার আলতো ছোঁয়া এঁটে দিয়েই ওর জীবন থেকে ইতি টানবে। দুষ্টুটার এই শেষ ছোঁয়াটুকুর স্বাদ নিয়েই না হয় বাকিটা জীবন কাটিয়ে দেবে।

এই ভাবতে ভাবতে মুখটা ওর কপালের দিকে নিয়ে যেতেই চোখের কাজল ধোয়া পানির কয়েকটি ফোঁটা আকাশের চেহারার উপর পড়ার উপক্রম- অমনি পেছনে সরে এসে মুখে ওড়না চেপে মেঝেতে বসে পড়ল অধরা। কলিজা চেরা নোনতা রক্তগুলো বুঝি আর কিছু অবশিষ্ট থাকবে না, সবটুকুই আজ উপচে পড়ে ভেতরটা যেন মরুদ্যান হয়ে যাবে।

নাহ! ক্ষীণ দেহের সবটুকুন নির্জাস বুঝি শেষ হয়ে গেল। উঠে দাঁড়াতেও বড্ড বেগ পেতে হচ্ছে এবার। শেষ আশা টুকুনও উড়িয়ে দিয়ে ভাবছে, ‘আমার চোখের এই নোঙরা পানিতে ওর ঘুমটা ভেঙে গেলে নাজানি আবার বলে বসে যে, ওকে বালিশ চেপে মারতে গিয়েছি! যাকগে, ওর জীবন থেকে সরে যখন যাচ্ছিই তখন আর আহ্লাদ দেখিয়ে কাজ নেই।’ এই বলে ব্যাগটা হাতে নিয়ে পা বাড়াল দরজা অভিমুখে…

দরজাটা আস্তে করে খুলতেই অধরার পা’টা কেমন যেন অবস হয়ে গেল। হাত থেকে ব্যাগটা পড়ে গেল। চোখে যেন কেমন অন্ধকার দেখছে সব! মুহূর্তেই মাথা ঘুরে মেঝেতে ধপাস করে লুটিয়ে পড়ল।

ওর পড়ে যাওয়ার শব্দে আকাশের ঘুম ভেঙে গেল। আকাশ দৌড়ে এসে ওকে কোলে তুলে নিয়ে বিছানায় শুইয়ে দিল। বোধহয় টয়লেটে যাবার সময় পা পিছলে পড়ে গেছে, এই ভেবে ওর গায়ে কম্বল বিছিয়ে দিয়ে আবার শুয়ে পড়ল। ঘুমের ঘোরে আর কিছু বলল না।

এই পর্যন্ত বলে আদিব থামল।

সেদিন নীলিমার গল্প শোনানোর পর হাসান জোর করে ধরেছিল আরও একটি গল্প শোনাতে। তাই আজকের অধরার উপস্থিতি। দু’জনই আদিবের পরিচিত। ঘটনা দু’টি নিছক বলার জন্য বলা নয়।

এরপর হাসানকে উদ্দেশ্য করে আদিব বলল, ‘এরকম মেয়েদের দিয়ে আসলে কিচ্ছু হবে না। কিচ্ছু না। বরাবরের মত এবারের যাত্রাটিও ভেস্তে গেল অধরার। আসলে একটা জিনিস আমাকে খুব ভাবায়।

সবাই বলে- একজন ভালো স্ত্রী পৃথিবীর অমূল্য সম্পদ। জগতের শ্রেষ্ঠ নিয়ামত। কথা ঠিক না।

কিন্তু একজন ভালো স্বামীও যে কত বড় নিয়ামত, এটা খুব একটা শোনা যায়

স্ত্রী বুঝবান ও দ্বীনদার না হলে ছেলেদের কতটা কষ্ট হয় সেটা সবাই কমবেশি জানি। কিন্তু এটাও কি ভেবেছি যে, স্বামী যদি বুঝবান ও দ্বীনদার না হয় তাহলে সেটা মেয়েদের জন্য কতটা কষ্টের হয়?

স্বামী চাইলে স্ত্রীকে বিদায় দিয়ে অন্যকাউকে গ্রহণ করতে পারে। কিন্তু স্ত্রী? সে কি চাইলেই অন্য কোন স্বামী গ্রহণ করতে পারে?

তার সন্তান! তার ভগ্নদেহ! তার সামর্থ্য! সবকিছু যেন একেকটি পাহাড় হয়ে দাঁড়ায়। তার পরিবার ও সমাজ এক্ষেত্রে তার জন্য ‘The great wall of China’ এর ভূমিকা পালন করে।

জীবনের শেষ সময়টুকু পর্যন্ত মেয়েটিকে একই চুলোর অদৃশ্য অনলে থেকেথেকে জ্বলতে হয়। পুড়ে ভষ্ম হতে হয়। আর সময়-অসময়ে কলিজা পোড়া ভ্যাপসা গন্ধে চৈতন্য হারায়। এর মধ্যদিয়েই আবার স্বামী, সন্তান ও শ্বশুরালয়ের সবার চাহিদাও মিটিয়ে যেতে হয়।

দিনশেষে মেয়েটি একটি যুদ্ধবিধ্বস্ত রণক্ষেত্রের মৃতপ্রায় সৈনিক হয়ে বিনা চিকিৎসায় কোঁকাতে থাকে। কিন্তু আফসোস! মেয়েটির এই কোঁকানো আওয়াজ, ছেলের গাড়ি-বাড়ি-টাকা দেখে বিয়ে দেওয়া লোভী ও অচেতন মা-বাবা সহ কারো কান অবধি পৌঁছে না। আর মেয়েটিও অভিমান, শঙ্কা আর ভয়ে কাউকে কিছু বলে না…

একজন ভালো দ্বীনদার স্বামীর প্রয়োজনীয়তা, মর্ম ও মর্যাদা এই ভুক্তভোগী মেয়েটি ছাড়া অন্যদের জন্য বুঝতে পারাটা বেশ কষ্টকর। নিজে পতিত হবার আগপর্যন্ত সকলের চোখ থাকে ঐ বাড়ি-গাড়ি-টাকার প্রতিই।

কী দুনিয়াদার আর কী দ্বীনদার! ছেলে শুধু দ্বীনদার কিন্তু গরীব হলে তখনই থলের বিড়াল বেরিয়ে আসে। আর সে বিড়ালের বিষাক্ত আঁচড়ে ক্ষতবিক্ষত হয় অবলা মেয়েটি।

হায়! সকল মা-বাবাদের যদি একটু বোধোদয় হতো! তাদের মেয়েগুলো তাহলে দুনিয়াতেই স্বৰ্গীয় সুখ পেত!’

হাসান বলল, ‘আমাদের সমাজটাই কেমন যেন হয়ে গেছে রে।’

আদিব বলল, ‘সমাজ নয়, বল আমরাই কেমন হয়ে গেছি। কারণ সমাজ আলাদা কোনো সত্তা নয়। আমাদেরকে নিয়েই সমাজ। আমরা ভালো হলেই সমাজ ভালো হয়ে যাবে। এজন্য সর্বপ্রথম আমার নিজেকে ভালো হতে হবে। পাশাপাশি সচেতনতা বাড়াতে হবে।’

মানলম, কিন্তু তুই তো শুধু ছেলেদের দোষটাই দেখলি। মেয়েটাকে স্বাধীনতা দিচ্ছে না। টর্চার করছে। আবার শেষে এসে গার্ডিয়ানকে কিছুটা দোষারোপ করলি। তো মেয়েরা কি সব দুধে-আলতা? ওদের কোনো দোষ নেই?’

হাসানের কথা শুনে আদিব বলল, ‘এইখানে বস।

এই বলে ঘাসের ওপর বসে পড়ল। হাসানও বসল।

‘দাঁড়িয়ে-দাঁড়িয়ে আর কতক্ষণ! পা ভার হয়ে এসেছে। আরাম করে বস। আজ

তোর একটি ক্লাস নেব।’

‘ক্লাস নিবি? কী ক্লাস?’

‘ডিমান্ড & সাপ্লাই এর ক্লাস।’

‘কীসের ডিমান্ড আর কীসের সাপ্লাই?’

‘আগে তো শোন!

‘আচ্ছা বল।’

‘খুব মনোযোগ না থাকলে কিন্তু কিছুই বুঝবি না। বি এলার্ট।’

‘হুম, বল।’

আদিব বলতে শুরু করল, ‘ইকোনমিকস-এ একটি থিওরি পড়েছিলাম।

চাহিদা রেখা যদি যোগান রেখাকে ছেদ করে তাহলে মূল্য রেখা হয় ঊর্ধ্বমুখী। অর্থাৎ ডিমান্ড যদি সাপ্লাই-এর চেয়ে বেশি হয় তাহলে পণ্যের দাম বেড়ে যায়।

আবার যোগান রেখা যদি চাহিদা রেখাকে ছেদ করে তাহলে মূল্য রেখা হয় নিম্নমুখী। অর্থাৎ সাপ্লাই যদি ডিমান্ড-এর চেয়ে বেশি হয় তাহলে পণ্যের দাম তখন কমে যায়।

মোটকথা পণ্যের দাম ওঠানামার সম্পর্ক হলো পণ্যের ডিমান্ড ও সাপ্লাইয়ের মধ্যকার ব্যবধান কত সেটার ওপর। সহজ কথায়- পণ্যের দাম কমবেশি হয় পণ্যের চাহিদা ও যোগানের মাঝে যে ব্যবধান থাকে সেটার পরিমাণের ওপর।

থিওরিটি ভালোভাবে বুঝে নে আগে। প্রয়োজনে আবার রিভিউ করি। করব?’

‘না বুঝতে পেরেছি। এরপর বল।’

‘আচ্ছা, এবার তাহলে মূল কথায় আসি।

ছেলেদের দিক থেকে সুন্দরী মেয়েদের চাহিদা আকাশচুম্বী! কিন্তু এর যোগান খুবই সীমিত। অর্থাৎ এখানে চাহিদা রেখা যোগান রেখাকে ছেদ করেছে। আর তাই অল্পসংখ্যক সুন্দরী মেয়ে যারা আছে তাদের দামও অনেক বেশি।

আবার তুলনামূলক কম সুন্দরী ও গরীব/মধ্যবিত্ত মেয়ের চাহিদা তুলনামূলক কম। কিন্তু বাস্তবতা হলো- এমন মেয়ের সংখ্যাই সমাজে বেশি। অর্থাৎ এখানে যোগান রেখা চাহিদা রেখাকে ছেদ করেছে। আর তাই এসকল মেয়ের দামও খুব কম।

মোটকথা যোগানের তুলনায় যে পণ্যের চাহিদা বেশি, সেটার দাম বেশি। সচেতন ব্যবসায়ীমহল সেই পণ্যের দিকেই মনোযোগী হন এবং সেটার উৎপাদন বাড়াতে সক্রিয় হয়ে উঠেন। অন্যদিকে যে পণ্যের চাহিদা কম সেটার উৎপাদনশীলতা স্বভাবতই হ্রাস পায়। সক্রিয় উৎপাদকগনও নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়েন।’

‘একটু বুঝি বল বিষয়টা।’

‘এখানে মেয়েদেরকে আমি পণ্যের সাথে তুলনা করছি না। জাস্ট বুঝার সুবিধার্থে উদাহরণ দিচ্ছি। ভুল বুঝিস না। এবার আসল কথা শোন- আমরা ছেলেরা মেয়েদের সৌন্দর্যকে সর্বাধিক প্রাধান্য দেই বলে মেয়েরাও নিজেদেরকে বেশির থেকে বেশি সুন্দরী হিসেবে প্রমাণ করতে দুনিয়া জুড়ে তুলকালাম বাধিয়ে ফেলছে।

আবার গুনগত মান, শিক্ষা, দ্বীনদারী ও নৈতিকতাকে সৌন্দর্যের চেয়ে প্রাধান্য কম দেই বলে মেয়েরাও নিজেদের গুনগত মান, সুশিক্ষা, দ্বীনদারী ও নৈতিকতা সুদৃঢ়করণে নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়ছে।

কাজেই নারীদের অগ্রযাত্রা ও সার্বিক উন্নয়নের জন্য পুরুষের চাহিদার ধরণ বদলাতে হবে আগে।

সৌন্দর্যের তুলনায় আমরা যখন নারীর গুনগত মান, সুশিক্ষা, দ্বীনদারী ও নৈতিকতাকে প্রাধান্য দেব তখন নারীরাও মাত্রাতিরিক্ত রূপচর্চায় মত্ত না হয়ে নিজেদের কোয়ালিটি বাড়াতে সচেষ্ট হবে।

সুতরাং আমরা পুরুষরা আমাদের চাহিদাকে শুধরে নিই, নারীরাও তাদের সাপ্লাই দেওয়াটাও শুধরে নেবে। একটু ভেবে দেখ হাসান! সামাজিক এক বিপ্লব হয়ে যেতে পারে যদি এই একটি বিষয় আমরা সংশোধন করে নিতে পারি।

এককথায়, নারীরা নিজেদেরকে পুরুষের আকাঙ্ক্ষিত কিছু হিসেবে তৈরি করতে সদা উদগ্রীব থাকে। এটা তাদের কমন সাইকোলজি। এখন পুরুষের আকাঙ্ক্ষিত বিষয়টি শুধরাতে পারলেই গুণগত মান, সুশিক্ষা, দ্বীনদারী ও নৈতিকতাসম্পন্ন নারী প্রতিটি ঘরে ঘরে তৈরি হবে।

মেয়ের তো অভাব নেই, কিন্তু বিয়ের জন্য মেয়ে খুঁজতে গেলে দেখি ভালো কোনো মেয়েই নেই- এই কথাটিকে আমরা খুব শীঘ্রই তাহলে রহিত ঘোষণা করতে পারব ইন-শা-আল্লাহ।’

আদিবের কথা শেষ হতেই হাসান বলে উঠল, ‘আমার বিয়ের ঘটকটা যে তুই কেন হলি না…।’

‘ঐ বেটা, তখন তো আমার নিজের জন্যই মেয়ে দেখা হচ্ছিল। সেসময় তোর জন্য কীভাবে কী করতাম?’

‘হুম বুঝেছি তুই আমার কেমন বন্ধু।’

‘কী বুঝেছিস জানি না, তবে একবার একজনের জন্য ঘটকালি করতে গিয়ে মেয়ে পক্ষ বরকে নিয়ে কথা না বলে আমার নাম-ঠিকানা জিজ্ঞেস করা শুরু করেছিল। কী একটা ব্যাপার বল তো দেখি! সেই থেকে নাক ধরেছি ঘটকালি আর করব না। অন্তত বিয়ের আগে তো না-ই! বিয়ের পরও কয়েকবাচ্চার বাবা না হওয়া পর্যন্ত এই লাইনে আর উঁকি দেব না।’

‘দোস্ত, সেই মেয়েটা কে ছিল রে?’

‘ধুর শালা। আর ভালো হলি না। চল, আজ তোকে মাসুদ ভাইয়ের স্পেশাল চটপটি খাওয়াব।

‘এসব মেয়েদের খাবারদাবার। গ্রীল খাব আজ।’

‘যা, বাসায় গিয়ে জানালার সবগুলো গ্রিল একটা একটা করে খা। আমি বউয়ের জন্য চটপটি কিনে বাসায় গেলাম।’

‘এই এই দাঁড়া! আরে অ্যাই ব্যাটা দাঁড়া…!’

মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ

১১

‘উপার্জনের জন্য বিদেশগমন নাজায়েজ ঘোষণা করা দরকার।’

আদিবের কথা শুনে রীতিমতো গা জ্বলে উঠল হাসানের। এক কাজিনের জন্য পরামর্শ চাইলাম, কোথায় একটু পরামর্শ দেবে তা না, উল্টো বয়ান শোনাচ্ছে। এক প্লাটুন রাগ মিশিয়ে নাকমুখ এক করে হাসান প্রত্যুত্তর করল, ‘কী বললি তুই?’

আদিব এক-পা পিছিয়ে বিনয়ের সাথে বলল, ‘দাঁড়া, তেড়ে আসবি না। আগে শোন আমার কথা।

শত হলেও আদিব অহেতুক রাগিয়ে দেওয়ার মতো কথা বলার ছেলে না। কিন্তু এমন একটি কথা বলার কারণই বা কী! হাসান ভাবছে। আদিব ওর ভাবনায় ছেদ ফেলে বলল, ‘একটু রিল্যাক্স হয়ে ভেবে দেখ হাসান। আমারা আমাদের পরিবারকে সুখী করতে ও নিজে স্বচ্ছল হতে একগাদা টাকা খরচ করে বিদেশ পাড়ি জমিয়ে যে অমানবিক কষ্ট করি, সেই টাকা ও সেই পরিশ্রম যদি দেশে ইনভেস্ট করতাম তবে আমি মনে করি পরিবার নিয়ে বেশ ভালো থাকতাম।

কিন্তু সমস্যা হলো আমাদের ইগো। বিদেশ গিয়ে সুইপার হতে রাজি। আর দেশে একটা চায়ের দোকান দিতে বা চটপটি বেঁচতে রাজি না। সেখানে কী মানবেতর জীবন অতিবাহিত করতে হয় তা ভাবলে গা শিউরে ওঠে।

মাসুদ ভাইকে তো চিনিস! আজ অনেকদিন হলো আমাদের বাসার পাশেই চটপটি বিক্রি করে। একদিন জিজ্ঞেস করে জানতে পারি, দৈনিক তার ৫-৬ হাজার টাকার মতো বিক্রি হয়। এরমধ্যে ২-৩ হাজার টাকা তার লাভ থাকে। অর্থাৎ মাসে ৬০-৯০ হাজার টাকা! ভাবতে পারিস?’

হাসান ক্ষানিকটা বিব্রত বোধ করল। বিশ্বাস হতে চাইল না, একজন চটপটিওয়ালা মাসে ৬০-৯০ হাজার টাকা আয় করে! কিন্তু ঐ যে! দেশে থাকলে সবাই চটপটিওয়ালা বলবে। আর বিদেশ গেলে তো ভাবই আলাদা। হই না সুইপার। কেউ কি গিয়ে দেখছে নাকি আমি কী করি না করি…

আসলে ঠিক এভাবে বলার জন্য আমি সরি। কিন্তু তোর কাছে মন খুলে কিছু বলতে না পারলে আর বলবই বা কার কাছে বল? আমি জানি, এভাবে বলাটা প্রবাসীদের জন্য কষ্টের কারণ হতে পারে, কিন্তু তবুও ধরে নে, একবার ইচ্ছে করেই না হয় একটু কষ্ট দিলাম। তাই তাদের সকলের কাছে আমি সরি বলে নিচ্ছি।

আজ কেন এটা করলাম জানিস? আর কেনই বা ক্ষমা চাইলাম! আমি জানি, প্রবাসীরা সেখানে অনেক অবর্ণনীয় কষ্ট করছেন। তাদের মাধ্যমে অনেক বৈদেশিক মুদ্রাও আমরা অর্জন করছি। এই দেশ প্রচুর রেমিট্যান্স পাচ্ছে। কাজেই আমাদের দেশ ও দেশের রেমিট্যান্স যোদ্ধা এই প্রবাসীদের প্রতি বাহ্যত বিরূপ মন্তব্য করায় আমার এই ক্ষমা চাওয়া। এবার শোন তাহলে কেন এমনটা করলাম।’

‘আচ্ছা বল তোর এমন কথার হেতু, বল।’

আদিব পুনরায় বলতে শুরু করল, ‘ইনসাফের সাথে একটু ভাবা উচিৎ। একটি মেয়ে তার শেকড় ছেড়ে অপরিচিত কোনো ছেলের কাছে নিজেকে সপে দেয় কীসের আশায়! এর পেছনে কি কেবল আর্থিক চাহিদাই থাকে? না। থাকে শারীরিক ও মানুষিক কিছু চাহিদাও। স্ত্রী হিসেবে যে মানুষটি আমার ঘরে পড়ে আছে, দিনরাত খেটেখুটে তার আর্থিক চাহিদা তো আমরা দিব্বি পূরণ করছি। সেজন্য ধন্যবাদ। কিন্তু তার শারীরিক ও মানুষিক চাহিদা কে পূরণ করবে?

সরি টু সে! একটি মেয়ে স্বামী ব্যতীত সর্বোচ্চ চার মাস নিজেকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারে। এর বেশী হলে তার খুব কষ্ট হয়। কত কষ্ট? এককথায় ‘খুব কষ্ট’। এটা বলা যায় না। বলার জিনিস না।

মেয়েটি যদি খুব বেশি ধার্মিক না হয় সেক্ষেত্রে অধিকাংশ মেয়েই পরকীয়া নামক বিষাক্ত জীবাণুতে মারাত্মকভাবে আক্রান্ত হয়ে পড়ে। সামাজিক মূল্যবোধ ধরে রাখতে চাইলে পরকীয়ায় না জড়িয়ে ইন্টারনেটের অন্ধকার জগতে দিনরাত ডুবে থাকে, এবং একপর্যায়ে অনিয়ন্ত্রিত হয়ে গিয়ে নিজের হাত বা অন্যকিছুকে নিজের স্বামী বানিয়ে নেয়। এসব কথা মুখে বলতেও লজ্জা হচ্ছে আমার। কিন্তু তবুও এই সমাজকে বাঁচাতে হলে আমাকে বলতে হবে।

তো এর ফলাফল দাঁড়ায়- পরকীয়ার কারণে সামাজিক নানান জটিলতা সহ যত্রতত্র অবৈধ সন্তানের ছড়াছড়ি। আর সমেহনের কারণে স্বামীর চাহিদা ধীরে ধীরে হ্রাস পায়। এবং খুব সহজেই বিভিন্ন মরণঘাতী রোগ বাসা বাঁধে। একপর্যায়ে স্বামীর আর কোন প্রয়োজনই সে বোধ করে না।

যৌবন ফুরিয়ে টাকার বস্তা নিয়ে স্বামী যখন দেশে আসবে, তখন যদি এসে দেখে স্ত্রী লাপাত্তা, সেটা খুব একটা অস্বাভাবিক হবে না। আর যদি এমনটা না-ও হয়, সেক্ষেত্রে শুরু হবে কারণে-অকারণে তিলকে তাল বানিয়ে রেষারেষি আর মনোমালিন্যতা। এভাবে জীবনের অবশিষ্ট প্রতিটি ক্ষণ বিষিয়ে উঠবে!

আর মেয়েটি যদি দ্বীনদার ও লাজুক প্রকৃতির হয় তাহলে সে এসব গুনাহে জড়াতে পারে না। আবার কোন সমাধানও পায় না। এমনকি কাউকে এই চাপা কষ্টের কথা বলতেও পারে না।

এই ব্যাপারে একবার ডা. রাকিব স্যারকে আমি কিছু প্রশ্ন করেছিলাম। যে স্যার, এমতাবস্থায় এমন মেয়েদের ঠিক কী ধরণের সমস্যায় পড়তে দেখা যায়? বা কী ধরণের সমস্যা হওয়ার আশঙ্কা দেখা দেয়?

স্যার তখন খুব গুরুত্বপূর্ণ কিছু আলোচনা করেছিলেন। বেশকিছু সমস্যা ও তার সমাধানের কথাও আমাকে বলেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, এমনসব মেয়েদের প্রচণ্ড মানুষিক চাপ ও বিষণ্নতায় শারীরিক ও মানুষিক নানান জটিল সব সমস্যা দেখা দেয়। সারাক্ষণ আনমনা হয়ে থাকা, চেহারা, চুল ও ত্বক উষ্কখুষ্ক হওয়া, স্বাস্থ্য ভেঙ্গে যাওয়া, ঘুম না হওয়া, মেজাজ খিটখিটে হওয়া, নির্জনতাপ্রিয় হওয়া, কোনকিছুতেই ভালো না লাগা এমনকি সুইসাইড পর্যন্ত আগাতে পারে।

এবার তুই বল, একটা মেয়ের এসব সমস্যার মূল কারণ যেটা, তার স্বামী দূরে থাকা, এই কথা, এই ব্যথা সে কোথায় বলবে! কার কাছে বলবে!’

আদিবের কথাগুলো হাসান খুব মন দিয়ে শুনছে। এই পর্যায়ে এসে হাসান আদিবকে জিজ্ঞেস করল, ‘তো স্যার কি স্পেসিফিকভাবে কোনো পেসেন্টের অবস্থা শেয়ার করেছে? বা তুই জিজ্ঞেস করেছিস? না নীতিকথার মত কিছু শুনিয়ে দিল আর তুইও সেটা…’

হাসানকে থামিয়ে দিয়ে আদিব বলল, ‘না, স্যারকে তখন আমি স্পষ্ট জিজ্ঞেস করেছি, স্যার, এধরণের কোনো পেসেন্ট আপনি পেয়েছেন কি না?’

‘তো স্যার কী বলল?’

‘স্যার তখন বলল, এধরণের অনেক পেসেন্ট আসে। একবার এক পেসেন্ট এসেছে ব্যথা নিয়ে। পুরো শরীর ব্যথা। বিশেষকরে বুকে ও মাথায়। কিছু খেতে পারে না। দিনদিন চুপসে যাচ্ছে। হাসপাতাল ঘুরে ঘুরে ফকির হবার পালা এবার। কোন রোগ ধরাও পড়ছে না। আবার সারছেও না। হিস্ট্রি শুনে দেখি কোন এক কারণে তার স্বামী আজ দীর্ঘদিন যাবত তার কাছ থেকে দূরে। একটু টাচ দিয়ে ক্লিয়ার হলাম এটাই তার এই অসুস্থতার কারণ। হ্যাঁ, এটাই।

এই কয়েকদিন আগেও আরেক পেসেন্ট এসে তো সরাসরি অভিযোগই করে বসল তার স্বামীর ব্যাপারে! সে চায় তার স্বামী দেশে থেকে দিন আনবে দিন খাবে। তবুও সে তার পাশে থাকুক। কিন্তু এটা তাকে না পারছে বলতে না পারছে সইতে। শেষমেশ সমেহনের দ্বারা শারীরিক কোন ক্ষতি হয় কি না জানতে চাইল। আমি অবাক হইনি। অবাক হওয়ার কিছু নেই-ও। খুব অল্প দিনেই এই পেশায় বিচিত্রসব অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হয়েছি। কী করবে এখন বেচারি! কপট রাগ বা ঘৃণা না দেখিয়ে ঠাণ্ডা মাথায় এর ক্ষতিকর প্রভাব ও গুনাহের বিষয়টি তাকে জানিয়ে দিই। এবং ধৈর্য ধরার পরামর্শের পাশাপাশি এটাও বলে দিই- অনেক চেষ্টার পরেও আপনি যদি একান্ত অপারগ হন, কোনো প্রকার সমাধানের পথ না পান তাহলে আপনার অভিভাবক ডেকে ভিন্ন ব্যবস্থা নিতে পারেন। অর্থাৎ বিচ্ছেদ ঘটিয়ে অন্য স্বামী গ্রহণ করতে পারেন। যদিও এটা বলতে আমার বুক কাঁপছিল, কিন্তু তার কন্ডিশন দেখে তার বেঁচে থাকার স্বার্থে এমনকিছু না বলেও আমি পারিনি।

আমার কথা শুনে তিনি কেঁদে ফেললেন। শুধুমাত্র সন্তানের কথা ভেবে তিনি সবকিছু মেনে নিয়ে নিজেকে শেষ করে দিতেও রাজি হয়ে চুপ হয়ে গেলেন। শেষে বললেন, আমার সন্তানের জন্য নিজেকে আমি উৎসর্গ করে দিলাম স্যার। আমি অন্যকিছু ভাবতে গেলে ওদের জীবনটা নষ্ট হয়ে যাবে। এরপর আমাকে ধন্যবাদ দিয়ে চলে গেল। সেই মুহূর্তে কিছু সময়ের জন্য আমি বাকরুদ্ধ ছিলাম।

স্যার এই পর্যন্ত বলে থামলেন। আচ্ছা হাসান, এই পেসেন্টের স্থানে তোর বোন থাকলে তুই কী করতি! আর ডাক্তারের ভূমিকায় তুই নিজে থাকলে তখন-ই বা এই পেসেন্টকে ঠিক কী পরামর্শ দিতি! তোর কাছে কি আছে এর কোনো বিকল্প?’

আদিবের কথাগুলো হাসানকে স্তব্ধ করে দিল। কী বলবে কিছু বুঝে উঠতে পারছে না। সেটা বুঝতে পেরে আদিব পুনরায় বলল, ‘এজন্য হযরত ওমর ফারুক রা. বিবাহিত মুসলিম সৈন্যদের চার মাসের বেশি বাইরে রাখতেন না। এমনকি বর্তমানে বিশ্বব্যাপী প্রচলিত ‘দাওয়াত ও তাবলীগ’-এর শীর্ষস্থানীয় ওলামায়ে কেরামের নিকট থেকে জিজ্ঞেস করে জেনেছি যে, সেখানেও তাদের সফর করার সময়সীমা একাধারে সর্বোচ্চ চার মাস। ছয় মাস বা এক বছরের জন্যও অনেকে যায়, তবে সেক্ষেত্রে সে বিবাহিত হলে চার মাস পর তাকে তার বাড়িতে যাওয়ার জন্য সুযোগ করে দেওয়া হয়। অথবা তার এলাকার কাছাকাছি কোনো জামাতের সাথে তাকে দেওয়া হয়। যাতে সে স্ত্রীকে কয়েকদিন সময় দিয়ে আবার যথারীতি সফর করতে পারে। অথবা তার স্ত্রীর পূর্ণ সমর্থন নিয়ে এবং তার অন্যান্য যাবতীয় চাহিদা পূরণ করে, নিরাপত্তা নিশ্চিত করে এরপর যায়।

অর্থ উপার্জনের জন্য বিদেশগমনের এই ব্যাপারটিতে কোন ফতোয়া আছে কি না জানি না, যদি না থাকে তাহলে দেশের শীর্ষস্থানীয় ওলামাদের প্রতি একটি দরখাস্ত পেশ করব যে- দু’টি শর্ত পূরণ করতে না পারলে বিবাহিত পুরুষদের জন্য বিদেশগমন নাজায়েজ ঘোষণা করা হোক।

১। বিদেশে যেতে চাইলে বিয়ের আগে যতদিন ইচ্ছা থেকে আসুক। কিন্তু বিয়ের পর বিদেশে গেলে তার স্ত্রীকে সাথে করে নিয়ে যেতে হবে। নতুবা চারমাস পরপর দেশে এসে স্ত্রীকে ন্যূনতম কিছু সময় দিতে হবে।

২। এর বেশি থাকতে হলে আগে স্ত্রীর সন্তুষ্ট বিধান নিশ্চিত করতে হবে। পাশাপাশি তার শারীরিক, মানুষিক ও আদর্শিক বিপর্যয় যাতে না ঘটে সেটাও নিশ্চিত করতে হবে।

কোনো প্রকার ফাঁকফোকর এখানে একদম চলবে না। স্ত্রীকে সাধারণভাবে পাশ কাটিয়ে গেলেও হবে না। ভাসাভাসা একটা কিছু জিজ্ঞেস করে ফর্মালিটি রক্ষা করলে হবে না। একান্ত সময়ে তার মনের প্রকৃত অভিব্যক্তি জানতে হবে। এরপর সিদ্ধান্ত। ভয় হয়, তাদের ভরণপোষণের জন্য এত কষ্ট করার পরেও ময়দানে হাশরে তাদের এই হক্ব অনাদায়ে না আবার পাকড়াও হতে হয়! তাই এসব মামলা এখনই চুকিয়ে নেয়া উচিত। আল্লাহর পানাহ …

একান্ত অপারগ হয়ে কথাগুলো বললাম। পরকীয়া আর সমেহনের বিষাক্ত পয়জনে আমার বোনদের স্বাস্থ্য, ঈমান, আমল সব শেষ হওয়ার পাশাপাশি সামাজিক অবকাঠামো আজ একেবারে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে। তাই প্রবাসী ভাইদের প্রতি এবং যারা প্রবাসে যেতে চাচ্ছে তাদেরকে করজোড়ে আবেদন করব- বিষয়টি আমলে নিয়ে আমাদের এই সমাজকে সামাজিক অবক্ষয় ও ধ্বংসের হাত থেকে বাঁচান। আমার এই আবেদনটি প্রবাসে যেতে চাওয়া তোর সেই কাজিনকে পৌঁছে দিতে পারবি হাসান?’

আদিবের কথার প্রেক্ষিতে এক দীর্ঘশ্বাস হাসানের। দোদুল্যমান হয়ে আদিবের প্রতি অপলক তাকিয়ে আছে। কাজিনকে এই কথাগুলো পৌঁছাতে পারবে কি না ভাবছে। ঠিক কীভাবে শুরু করবে আর কোথায় গিয়ে শেষ করবে সেটাও নির্ণয় করার চেষ্টা করছে। কিন্তু ওদের সাংসারিক টানাপোড়েনের কথা মাথায় আসতেই সবকিছু যেন গুলিয়ে যাচ্ছে। শেষমেশ অস্ফুটে বলল, ‘আদিব, তোর কথাগুলো মোটেই ফেলনা নয়।

কিন্তু ওদের সার্বিক অবস্থা বিবেচনায় প্রবাসে যাওয়ার কোনো বিকল্পও যে আপাতত দেখছি না। এমতাবস্থায় এই কথাগুলো আমি ওকে কীভাবে বলি!’

হাসানের কাঁধে হাত রেখে আদিব বলল, ‘শোন, বুঝতে পারি আমি, একটা নিম্নবিত্ত পরিবার ঠিক কোন পর্যায়ে এসে ভিটেমাটি বেঁচে হলেও পরিবারের ছেলেটিকে প্রবাসে পাঠায়। আগেই বলেছি, এর সমপরিমাণ শ্রম ও টাকা যদি দেশে ইনভেস্ট করতে পারতো তাহলে হয়তো কিছু একটার ব্যবস্থা হয়েই যেত। কিন্তু তবুও যদি একান্তই নিরূপায় হয়ে পড়ে, সেক্ষেত্রে তার স্ত্রী, মা-বাবা সহ পরিবারের সবাইকে কিছু বিষয় খোলাখুলিভাবে বলা উচিত।’

‘যেমন?’

‘যেমন, একান্ত নিরিবিলি একটা সময় বেছে নিয়ে তাদেরকে কথাগুলো খুব গভীরভাবে বুঝানো। তুই নিজেই কাজটির দায়িত্ব নে।’

‘আ… আমি?’

‘হুম, তুই।’

‘আচ্ছা কীভাবে কী বলতে হবে এক্ষেত্রে একটু হেল্প কর তাহলে।’

‘শোন, জন্মের পর শিশুকাল পেরিয়ে কিশোর থেকে আজ আমি একজন পুরুষ। একটি পরিবারের ড্রাইভার, ইঞ্জিন, ডিজেল সবই আমি। আবেগ, অভিমান আর ভালোবাসা আমারও আছে। আছে আর দশজনের মত একটি মন। আছে অন্যদের মত কিছু আশা আর স্বপ্ন। কিন্তু ভুলে গেলে চলবে না, আমি এখন পুরুষ। এই আমার ওপর নির্ভর করছে একটি পরিবারের মা-বাবা, ভাই-বোন, স্ত্রী-সন্তান প্রত্যেকের একগাদা স্বপ্ন, আশা আর আকাঙ্ক্ষা। তাদের প্রতি দায়িত্বশীলতার ভারে ন্যুব্জ হয়ে পড়া এই আমি’র তেমন কোন আশা ও স্বপ্ন আজ আর বেঁচে নেই। বেঁচে থাকলেও তাতে প্রাণ নেই। প্রাণ থাকলেও সেদিকে ফিরে তাকানোর যোঁ নেই।

দিগ্বিদিক হয়ে আমার এই ছুটে চলা, বায়োডাটা নিয়ে অফিসে অফিসে দৌড়ানো, কোটা নিয়ে রাস্তায় রাস্তায় আন্দোলন করে বেড়ানো, শেষমেশ দিশা হারিয়ে বিদেশ পাড়ি জমানো এসবকিছু বৃদ্ধ মা-বাবা আর অসহায় স্ত্রী-সন্তানের চাঁদমুখের একফালি হাসি দেখে মরতে পারার জন্য।

হ্যাঁ, এভাবে মরতে পারাও যে অনেক শান্তির! ক’জন পারে এই হাসিটুকু ফুটানোর পর মরতে! অফিসে অফিসে দৌড়ে ব্যর্থ হওয়া দেশের লক্ষাধিক বেকার যুবকরা পারেনি, সরকারি চাকরিতে কোটার ফ্যারে পড়ে অনেক মেধাবীরাও পারেনি, বিদেশ পাড়ি দিয়েও দালালের খপ্পরে পড়ে আরও অনেকেই পারেনি।

হায়! আমি যদি সেই হাসিটুকু ফুটিয়ে মরতে পারাদের দলে থাকতে পারতাম! এই আকুতি প্রতিটি পুরুষের। প্রতিটি ছেলের। প্রতিটি বাবার। প্রতিটি স্বামীর…

বোনদের উদ্দেশ্য করে বলছি- হ্যাঁ বোন, আমি এসব সত্যি বলছি। পুরুষের রক্তের প্রতিটি অণুচক্রিকায় মিশে আছে এই একটি মাত্র আকুতি! তাদের এই আকুতির রেশ হয়তো আপনাদের পর্যন্ত পৌঁছে না। কার্যত পৌঁছতে দেওয়া হয় না। আসলে পৌঁছতে দেয় না এই পুরুষগুলো।

এরপরেও দিনশেষে আপনার চাহিদার পরিধি যখন সীমা ছাড়িয়ে যায়, আপনার স্বামীর সামর্থ্যকে ডিঙ্গিয়ে যায় তখন বেচারা স্বামী কতটা হীনমন্যতায় ভোগে জানেন! কতটা লজ্জা আর হতাশায় কুঁকড়ে ওঠে জানেন! যতটা গরমে নিরীহ কোন প্রাণী জিহ্বা বের করে হাসফাস করতে থাকে ততটা। যতটা শীতে কাঁপুনির প্রকোপে দেহটা আড়ষ্ট হয়ে যায়, রক্তকণিকা জমাট বেঁধে যেতে চায় ঠিক ততটা।

উপায়ন্তর না পেয়ে অবশেষে চোখ বন্ধ করে হাত চালায়। আপনার আকাশছোঁয়া চাহিদা মিটানোর অভিপ্রায় নিয়ে সে হাত গিয়ে পড়ে কখনও কারো মাথায়, পিঠে আর কখনো গলায়…! চুরি, ডাকাতি, সুদ, ঘুষ, স্মাগলিং আর দুর্নীতি সহ নানান অপরাধমূলক বিষয়ের সাথে যে সকল পুরুষগুলো জড়িত এরা প্রত্যেকেই কিন্তু আপনাদেরই কারো না কারো স্বামী!

বোন! একান্ত সময়ে পবিত্রতার মিষ্টি ছোঁয়া তার কপালে ছুঁইয়ে যদি বলতেন- আমি পাঁচতলা নয়, টিনসেডেই আমার জান্নাতি বাগান ফুলেফলে ভরাতে চাই। নিত্য মাছ-গোস্ত নয়, ডালভাতে জীবন কাটাতে চাই। কিরণমালা, জামদানি আর নামী দামী ব্রান্ডের কসমেটিক্স নয়, সাদামাটা সুতি কাপড় আর পূর্ণিমার জ্যোৎস্না মেখে তোমার রানী সাজতে চাই!

তাহলে আমার মনেহয় কমনসেন্স আছে এমন কোন পুরুষ আর অবৈধ পথে পা বাড়াবে না। আপনাদের সবাইকে ছেড়ে পারিবারিক বন্ধন আর ভালোবাসার ঘাড় মাড়িয়ে বছরের পর বছর স্বেচ্ছায় প্রবাস নামক কারাবাস গ্রহণ করবে না।

হে বোন! আপনার চাহিদাকে আপনি আমার ভাইয়ের সামর্থ্যের ভেতরে গুটিয়ে নিন, আমি আশাবাদী- আমার ভাই আপনার অন্যান্য সকল চাহিদা পূরণ করা ও আপনাকে একান্তে সময় দিতে আর অক্ষমতা প্রকাশ করবে না ইন-শা-আল্লাহ…

ব্যস, এভাবে বলতে পারবি না?’

আদিব থামলো। হাসান কিছুক্ষণ মাথা চুলকিয়ে বলল, ‘আচ্ছা আমার কাজিনের বাসায় তুইও না হয় চল একদিন আমার সাথে।’

আদিব ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে প্রত্যুত্তর করল, ‘এমন গা বাঁচিয়ে চলা বাদ দিয়ে দায়িত্বশীল হতে শেখ। মেয়েরা দায়িত্বশীল স্বামী পছন্দ করে। শুধু শুধুই কি আর ভাবি আমার ওয়াইফের কাছে নালিশ দেয়? আহারে বেচারি। এই বলদ বন্ধুটাকে নিয়ে আমার জীবনটাই তো শেষ। সে যে কীভাবে আছে কে জানে…

‘শেষমেষ বাঁশটা না দিলেও পারতিস। আচ্ছা তোর যেতে হবে না। যেভাবে পারি মেনেজ করে নেব।’

‘এবার তাহলে একটা ধন্যবাদ দে।’

‘মানে?’

‘এই যে বাঁশ দিয়ে হলেও তোকে একটা কাজের জন্য তৈরি করতে পেরেছি। এজন্য একটা না, মিনিমাম কয়েকটা ধন্যবাদ আমি পেতেই পারি।’

হাসান কপট রেগে গিয়ে বলল, ‘আচ্ছা ধন্যবাদ আদিব স্যার। ধন্যবাদ আদিব সাহেব। ধন্যবাদ আদিব ভাই। ধন্যবাদ শালা আদিব্বা… 12

আদিব হেসে ফেলল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *