নিতু বলছি – ৫

রাত তিনটা সাতচল্লিশ। ঘুম আসছে না।

মাঝে মধ্যেই এমনটা হয় আমার। অনেক রাত, এমনকি ভোর পর্যন্ত জেগে থাকি আমি। আকাশের শুকতারা মুছে যাওয়া দেখি। দীর্ঘ সময় কানে ইয়ারফোন লাগিয়ে গান শুনি। আমার পছন্দের কয়েকটা গান আছে। এরমধ্যে একটা গানের বেশ কিছু লাইন আমার খুব ভালো লাগে। আমার ভিনদেশি তারা।

গানটার এক জায়গায় আমার গা কাঁটা দিয়ে উঠে। যখন দ্বিতীয় অন্তরায় অনিন্দ্য বলে, প্লিজ, ঘুম হয়ে যাও চোখে, আমার মন খারাপের রাতে। তখন আমি পুরো শরীরে থর থর করে কাঁপতে থাকি। জ্বরের মতো। কেঁপে কেঁপে কাঁদি। হাউ মাউ করে কাঁদি। বিছানা-বালিশে নাক-মুখ গুঁজে কাঁদি।

.

আমার কাছে ঘুমের ওষুধ আছে। একটা নয়। কয়েক পাতা। কিন্তু খাই না। ইচ্ছে হয় না। জমিয়ে রেখেছি। কোনো একদিনের জন্য।

ওষুধগুলো অবশ্য সংগ্রহ করা। তাসলি আপুর কাছ থেকে।

তাসলি আপু আমাদের বাড়িওয়ালার একমাত্র কন্যা। যথারীতি বাবার অর্থের সঠিক অপব্যবহারের অংশ হিসেবে, একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে, কম্পিউটার সায়েন্স, সেকেন্ড ইয়ার। আর অত্যন্ত পচা পচা জোক্‌স বলে। যা শোনামাত্রই যে কারো ভালো লাগে তাকে। যেমন আমি ও রাফিয়া। তার অন্ধভক্ত, ফ্যান।

অন্যদিকে তাসলি আপু আবার ফ্যান এসব অ্যান্টি ডিপ্রেসিভ ঘুমের ওষুধের। অবশ্য আমার ধারণা শুধু তাসলি আপু নয়, ঢাকা শহরের বিশোর্ধ অধিকাংশ মেয়েরাই এসবের ‘বান্ধা কাস্টমার’ কিংবা ফ্যান। কারণ, ডাক্তাররা বিশোর্ধ্ব কোনো মেয়ে রোগী দেখলেই প্রেসক্রিপশন লেখা শুরু করেন—- ব্রোমাজিপাম, ক্লোনাজিপাম, ডায়াজিপাম…। আর কিশোরী-তরুণী দেখলে তো কথাই নেই! প্রেসক্রিপশনের সাইজটা বাড়তে শুরু করে ডাক্তার সাহেবের সময়ক্ষেপণের ওপর নির্ভর করে। ফ্রেনজিট, এনডেভার, ফ্রিজিয়াম নামের আজগুবি অ্যান্টি-অ্যাংজাইটি ড্রাগ যোগ হতে শুরু করে এদের সাথে। ডাক্তারদের কাছে অনিদ্রার অপর নাম সম্ভবত ছ্যাঁকা। প্রেমে ব্যর্থতা।

.

আমাদের পুরো বাসা আজ নিস্তব্ধ। বাবা-মা ঘুমে। এবং আমি আমার ঘরে। একাকী টেবিলে লেখালেখি করছি।

আমার ঘরে বাতি জ্বালানো দেখে, বাবা সম্ভবত উঠে এলেন।

বুড়ি? ও বুড়ি? কী করিস এত রাতে?

বুড়ি আমার পিতৃপ্রদত্ত আদুরে নাম। মন-মেজাজ খুব ভালো থাকলে এই নামে আমাকে ডাকেন বাবা। সুতরাং আমিও বেড়ালসুলভ জড়ো ভাবটা কাজে লাগালাম।

জি বা-বা, কি-ছু না।

বলেই নিজের টেবিলে ল্যাজ গুটিয়ে বসে রইলাম।

হাল্কা কাশতে কাশতে বাবা আমার ঘর পর্যন্ত চলে এলেন।

এত রাতে পড়ার টেবিলে বসে কী করছিস! হাদিসে আছে, রাত হল বিশ্রামের সময়। আর বাচ্চাদের তো রাত জাগা একদম হারাম।

আমি বাচ্চা?

টেবিলে বসেই বাবার দিকে আহলাদী মুখ তুলে প্রশ্ন করলাম আমি।

বাবা হাসলেন। মুচকি হাসি।

নাহ্। কে বলেছে! তুই তো হলি ইম্মা মোরানো। তামাম দুনিয়ার সবচেয়ে বৃদ্ধা নারী। একশত আঠার বছর…

বাবা আবারও হাসছেন। তবে এবার শব্দ করে।

এই হল আমার বাবা। মধ্যবিত্ত পরিবারের আর সব বাবাদের মতন। অতি ভদ্র। অতি নম্র। সন্তানের প্রতি অন্ধ স্নেহশীল। যথারীতি কন্যা অষ্টম শ্রেণি অতিক্রম করা মাত্রই নিজ ধর্ম-কর্মে মনোযোগী।

সারাদিন অফিসের ব্যস্ততা। সারারাত বিশ্রাম। বিকেল থেকে রাত অবধি মসজিদে যাতায়াত। ন’টা বাজতেই টিভির সামনে চোখ। দেশ ও দশের সংবাদে মন রাখা। এবং যথারীতি ভুলে যাওয়া যে, তার আদরের একমাত্র কন্যাসন্তানটি, এখন আর ছাদে উঠে ‘ওপেনটি বায়োস্কোপ’ খেলার মতো বয়সে নেই।

কী ব্যাপার! কী এমন মন দিয়ে পড়ছিস?

ওহ্ হো, বলতে তো ভুলেই গেছি। ইদানিং আবার আরবি শব্দ ও ধর্মীয় কথাবার্তা বলার চর্চা শুরু হয়েছে বাবার। কথায় কথায় আরবি বলেন। তবে সব শুদ্ধ নয়। ভুলভাল ও ইচ্ছেমতো। মনের মাধুরী মিশিয়ে। যা শুনলেই আমার বিরক্তি আসে। মনে হয়, স্কুলের মৌলভি স্যার। এক্ষুনি রাগিয়ে দেই।

তবে এই মুহূর্তে রাগানোর পরিবর্তে আমার সারা চোখে-মুখে একটা তীব্র অভিজ্ঞতার ভাব নিয়ে আসলাম। টেবিল থেকে চোখ তুলে বাবার দিকে তাকালাম।

কই বাবা, পড়ছি না তো!

পড়ছিস-না, তো টেবিলে কেন?

একটা ফিল্মের স্কেচ করছি।

কিসের?

বাবার হাসি থেমে ভ্রু কুঁচকে গেল। আমি সেদিকে ভ্রূক্ষেপ না করে বিজ্ঞের মতো বলতে লাগলাম।

ফিল্ম। ফিল্ম মানে ছবি। ছায়াছবির পটভূমি লিখছি।

তোর কথার আগা-মাথা শানে নুযুল কিছুই তো বুঝতে পারছি না।

শোনো বাবা। শব্দটা শানে নুযুল নয়। হবে তরজমা-তফসির অর্থাৎ ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ। আমি, স্যরি, আমি আর রাফিয়া দু’জন মিলে একটা ছবি বানাব ভাবছি। তার প্লট স্কেচ করছি।

এই বয়সে ফিল্ম?

রবীন্দ্রনাথ তাঁর প্রথম কবিতা ছেপেছেন তের বছর বয়সে। পিকাসো তাঁর বিখ্যাত ছবি ‘পিকাদর’ আঁকেন, বয়স যখন মাত্র আট। আর বর্তমান বিশ্বের সবচেয়ে পিচ্চি ফিল্ম ডিরেক্টরের বয়স কত জানো! মাত্র সাড়ে সাত! নেপালের সওগাত বিস্তা।

বাবা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন।

ছবির দুনিয়াদারি অনেক মুছিবাত্‌ আর মুকিলাহ্-এ ভর্তি রে মা। অর্থ, শ্রম, পরিচিতি অনেক কিছুর জরুরত সেখানে।

এগেইন আ মিস্টেক বাবা। আগেই তো বললাম, রাফিয়া ইজ অল ইন অন। আমি শুধু ডিরেক্টর এন্ড স্ক্রিপ্ট রাইটার।

শোন নিতু। রাফিয়ারা সমাজের উঁচু শ্রেণির মানুষ। ওদের সাথে তোমাকে-আমাকে তুলনা করাটা কিংবা অনুকরণ করাটা তোমার অনুচিত।

হঠাৎ বাবা তুই থেকে তুমিতে উঠে এসেছেন। সুতরাং নিশ্চিত যে, তার মেজাজের সূচক এখন ঊর্ধ্বমুখী। আমি যথারীতি মেজাজের গতি বাড়াতে অনুপ্রাণিত হলাম। কারণ, বাবার মেজাজ চড়ানো আমার খুব পছন্দের গেমস্-এর মধ্যে একটি। আমার ধারণা, আমি কেন, আমার বয়সী সবারই এটা একটা প্রিয় খেলা।

স্টোরিটা শুনলে-না তুমিও অবাক হবে বাবা! আমাদের স্টোরি হল, দি লাইফ অফ আ ক্রো অ্যান্ড কু-কু। ওর বাসায় একটা মিনি স্টুডিও সেট তৈরি করা হয়েছে। সেখানে জাত-বিজাতের সব দেশি পাখি হাজির। টুনটুনি, মুনমুনি, আচা-খাওয়া, কাউয়া সব।

বাবার চোয়াল শক্ত হতে শুরু করেছে। চোখে-মুখে স্থিরতা। আমি আমার পথেই এগোতে লাগলাম।

আমাদের ফিল্ম কিন্তু ইউনেস্কো ফিল্ম ফেস্টিভালে পাঠানো হবে বাবা। একবার ভেবে দ্যাখো, মালালা ইউসুফজাই-এর মতো আমরাও কিন্তু ফিল্ম জগতের নোবেল আনতে পারি। অস্কার, কান, গোল্ডেন গ্লোব, বাপটার সব উৎসবে থাকবে ছবিটা। বল, ইন্টারেস্টিং লাগছে না!

কাহিনীর চেয়ে তোমার খোয়ায়েশকেই বেশি ইন্টারেস্টিং বলে মনে হচ্ছে আমার। যাই হোক। এ ব্যাপারে প্রয়োজনে তোমার মা তোমার সাথে কথা বলবেন। আমি উঠি। ফজরের সময় হয়ে এসেছে।

বাবা এ পর্যায়ে উঠে দাঁড়ালেন। এবং অতিদ্রুত মা’র ঘরের দিকে পা বাড়ালেন। এটি তার মেজাজের চূড়ান্ত পর্ব। কারও ওপর প্রচণ্ড রেগে গেলে তিনি ‘বিদায় হও’ বলার পরিবর্তে নিজেই অতিদ্রুত বিদায় হন। এবং নিজ বিছানায় বসে কিছুক্ষণ আনমনে দোয়া-দরুদ পড়েন। পারলে পরবর্তী এক ঘণ্টা এবং ক্ষেত্রবিশেষে এক দিন পর্যন্ত তার সাথে কথা বন্ধ রাখেন।

.

মা অবশ্য এসব চরিত্রে ভিন্ন।

মায়ের মেজাজ মানেই ‘এক থাপ্পড় খাবি’ বলা। এবং বাক্য শেষ হবার আগেই তার প্রয়োগ যথার্থ স্থানে বসানো। যথারীতি একটু পর ডাক পড়বে, ‘নিতু। এদিকে আয়। চা নিয়ে যা। মাথা ঠাণ্ডা কর।’

আমি নিশ্চিতমনে টেবিলে বসে বসে পা নাচাতে লাগলাম। আর গাল শক্ত করে চায়ের অপেক্ষা করতে লাগলাম। রাত জাগায় চায়ের বিকল্প শুধুই চা।

আমাকে অবাক করে দিয়ে বাবা দ্বিতীয় দফা প্রবেশ করলেন।

ওহ্ হো নিতু, একটা কথা তো বলতেই ভুলে গেছি। তোর স্কুল থেকে অ্যাডমিন মিস কল করেছিলেন। আমাকে না-কি প্রিন্সিপাল স্যার দেখা করতে বলেছেন। ইজ দেয়ার অ্যানি বিগ প্রবলেম?

বিগ নয় বাবা। স্মল, ভেরি স্মল। গত তিনদিন আমি টানা হোম ওয়ার্ক করিনি। তাই কমপ্লেইন দেবেন।

বাবা এ দফায় হো হো করে হেসে উঠলেন। যেন হোম ওয়ার্ক না- করাটা বিশাল আনন্দের সংবাদ।

আমি প্রশ্ন করলাম, তুমি হাসলে কেন বাবা?

কারণ, এটা আমার জীবনে প্রথমবার। আমার অতি গুণবতী ও রূপবতী কন্যা তার দশ বছরের স্কুলজীবনের মধ্যে প্রথমবারের মতো এই অভিযোগ শোনাল।

কথাটা অবশ্য মিথ্যে বলেননি বাবা। গুণের কথা বাদ দিয়ে শুধু রূপের দিকটা ধরলেও, কথাটা যথার্থ এবং সর্বসম্মতভাবে স্বীকৃত। কারণ আমি সুন্দরী। শুধু সুন্দরী না। অপূর্ব সুন্দরী। চল্লিশ দশকের নায়িকাদের মতো সুন্দরী। চণ্ডীদাসের সাথে আমার দেখা হলে বেচারা নাকি বলে বসতেন,

আঁখি-তারা দুটি বিরলে বসিয়া; সৃজন করেছে বিধি
নীলপদ্ম ভাবি লুবধ ভ্রমরা; ছুটিতেছে নিরবধি।

এই মন্তব্যটা অবশ্য আমার নয়। রেজা স্যারের।

বাবা আমার নিশ্চুপতা দেখে বললেন।

আচ্ছা বুড়ি, কালকে যেন কী বার?

আমি মোবাইল টিপে টিপে উত্তর দিলাম, বৃহস্পতিবার।

এবং বলেই থমকে গেলাম!

বাবা বলতে লাগলেন।

ওহ্ স্যরি! কালত আমাদের অফিসে একটা স্পেশাল মিটিং আছে। তোমার স্যারকে বলবে ইনশাল্লাহ্ আগামী শনিবার আমি তার সাথে দেখা করব।

.

আমার আর কোনো কথা কান দিয়ে ঢুকছে না। আমি যেন শব্দহীন অন্য কোনো জগতে পৌঁছে গেছি।

তার মানে আজ বুধবার!

হিসাবমতে আগামীকাল আর একটি শুভদিন। বৃহস্পতিবার।

বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় আসিফ আসবে রাফিয়ার বাসায়। আমাদের মধুকুঞ্জে। মোটামুটি সব চুড়ান্ত। ওই দিন ফাইনাল ক্লাইমেক্সে সেক্স সিন রেকর্ড করা হবে প্যাটনার। দি ফুল অ্যান্ড ফাইনাল ভারসন।

3 Comments
Collapse Comments

Totally rubbish. I wastaged my valuable time.

নাঈম আহমেদ December 16, 2022 at 6:08 pm

খুব ভালো লাগলো। কিশোর মনের কিছু দিক সাবলীল ভাবে তুলে ধরা হয়েছে।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *