২৭. উনিশশো তেত্রিশ সাল

তিন বৎসর পর। উনিশশো তেত্রিশ সাল।

জেলার সদর শহরের জেল-ফটক খুলিয়া গেল। ভোরবেলা; সূর্যোদয় তখন হয় নাই, শুধু চারিদিকের অন্ধকার কাটিয়া সবে প্রত্ষালোক জাগিতেছে। পূর্ব দিগন্তে জ্যোতিলেখার চকিত ক্ৰমবিকাশের লেখাও শুরু হয় নাই। পাখিরা শুধু ঘন ঘন ডাকিতেছে।

জেল-ফটক খুলিয়া গেল। দেবু বাহিরে আসিল। উনিশশো ত্রিশ সালের আইন অমান্য আন্দোলনে সে দণ্ডিত হইয়াছিল। দণ্ডিত হইয়াছিল দেড় বৎসরের জন্য। ত্রিশ সালের জুন মাসে বাংলা মাসের আষাঢ় মাসে জেলাময় সভা, শোভাযাত্রা নিষিদ্ধ করিয়া আদেশ জারি হইয়াছিল। সেই আদেশ অমান্য করিয়া সে শোভাযাত্রা পরিচালনা করিয়াছিল—সভা করিয়াছিল। শুধু দণ্ডিতই হয় নাই, মাথায় আঘাত পাইয়া সে আহতও হইয়াছিল, দেড় বৎসর অতীত হইবার পূর্বেইগান্ধী-আরউইন চুক্তির ফলে তাহার মুক্তি পাওয়ারই কথা ছিল। অধিকাংশ দণ্ডিত কর্মীই মুক্তি পাইল; কিন্তু মুক্তির প্রায় সঙ্গে সঙ্গে সে আটক আইনে বন্দি হইয়া সঙ্গে সঙ্গেই আবার জেলে ঢুকিয়াছিল। মুক্তির আদেশ আসিয়াছে। আজ সে মুক্তি পাইল। ট্রেন খুব সকালে, পূর্ব সন্ধ্যায় মুক্তির আদেশ আসিবার সঙ্গে সঙ্গেই দেবুর মনটা অত্যন্ত চঞ্চল হইয়া উঠিয়াছিল; কর্তৃপক্ষকে সে বলিয়াছিল—ভোরের ট্রেন যাতে ধরতে পারি তার ব্যবস্থা যদি করে দেন, তবে বড় ভাল হয়।

কর্তৃপক্ষ সে ব্যবস্থা করিতে অবহেলা করেন নাই। ভোরবেলায় স্টেশনে যাওয়ার জন্য। মোটর বাসও বলিয়া দিয়াছেন। দেবু বাহিরে আসিয়া দাঁড়াইল। দূরে মোটর বাসের হর্ন শুনা যাইতেছে। জেলখানায় পাঁচিলের চারিপাশেও প্ৰকাণ্ড জেল-ক্ষেত, সমস্তটাকে ঘিরিয়া বেশ উঁচু। এবং মোটা মাটির পগারের উপর বড় বড় ঘনসন্নিবদ্ধ গাছের সারি; সেই সারির মধ্যে কতকগুলি সুদীর্ঘ-শীর্ষ ঝাউ গাছ ভোরের বাতাসে শনশন শব্দে ডাক তুলিতেছে; সদ্যমুক্ত দেবুর মনে সে ডাক বড় রহস্যময় মনে হইল। মনে কোন্ দূরান্তে ধ্বনিত আকুল আহ্বানের কম্পন ওই গাছের মাথায় মাথায় অনুরণিত হইয়া উঠিতেছে। পরক্ষণেই সে হাসিল। কে তাহাকে ডাকিবে?

আবার মনে হইল—আছে বৈকি! সে তো দেখিয়া আসিয়াছে—পঞ্চগ্রামের মানুষের বুকে সে কি উচ্ছাস-সমুদ্রের জোয়ারের মত জোয়ার—তাহাদের উচ্ছ্বসিত প্রাণের কত মমতা তাহার প্রতি, তাহারাই ডাকিতেছে। গৌর, জগন, হরেন, সতীশ, তারাচরণ, ভবেশ, হরিশ, ইরসাদ, রামনারায়ণ, অটল, দুর্গা, দুর্গার মা—সকলেই তাহার পথ চাহিয়া আছে, সকলেই তাহাকে ডাকিতেছে। স্বৰ্ণস্বর্ণ তাহার পথ চাহিয়া আছে। স্বর্ণ এতদিনে বোধহয় ম্যাট্রিক দিবার চেষ্টা করিতেছে। জেলে থাকিতে সে সংবাদও পাইয়াছে—সে পড়িতেছে। স্বর্ণ নিজেও তাহাকে পত্ৰ লিখিয়াছে, তাহার হাতের লেখা, তাহার পত্রের ভাষা দেখিয়া দেবু খুশি হইয়াছে। মধ্যে মধ্যে চমক লাগিয়াছে।

এই দীর্ঘদিনের বন্দিত্বের মধ্যে তাহারও অনেক পরিবর্তন হইয়াছে। বন্দিত্বের বেদনাদুঃখ। সত্ত্বেও এই সময়ের মধ্যে নানা আটক-বন্দিদের সঙ্গে থাকাটাই সে জীবনের একটা আশীৰ্বাদ বলিয়া মনে করিয়াছে। পড়াশুনাও সে করিয়াছে অনেক। দীর্ঘকাল পর মুক্ত পৃথিবীর বুকে দাঁড়াইয়া সে অনুভব করিল-পৃথিবীর রঙ যেন বদলাইয়া গিয়াছে, সুরের যেন বদল হইয়াছে। আগের কালে, এই জেলে যাওয়ার পূর্বে ওই ঝাউগাছের শব্দ কানে আসিলেও হয়ত মনে এমন করিয়া ধরা পড়িত না; পড়িলেও ওটাকে মনে হইত ওপারের সাড়া বিলু-খোকনের ডাক ময়ূরাক্ষীর বাঁধের ধারে, সন্ধ্যার পর, নির্জন তালগাছের পাতায় একটা বাতাসের সাড়া যে ডাকের ইঙ্গিত দিয়া তাহাকে এতটা দেশ-দেশান্তরে ঘুরাইয়া লইয়া ফিরিয়াছিল বুঝি সেই ডাক।

বাসটা আসিয়া দাঁড়াইল। দেবু বাসে চড়িয়া বসিল।

পূর্বমুখে বাসটা চলিয়াছে। শহরের প্রান্তদেশ দিয়া প্রান্তরের বুকের লাল ধুলায় আচ্ছন্ন রাজপথ। সম্মুখে পূর্বদিগন্ত অবারিত। আকাশে জ্যোতিলেখার খেলা চলিয়াছে, মুহুর্মুহুঃ বর্ণদ্টার রূপান্তর ঘটিয়া চলিয়াছে। রক্তরাগ ক্রমশ ঘন হইয়া উঠিতেছে। সূর্য উঠিতে আর দেরি নাই। গ্রাম সম্বন্ধেই সে ভাবিতেছিল। জেলে বসিয়া সে চিন্তা করিয়াছে, অনেক বই পড়িয়াছে, যাহার। ফলে একটি সুন্দর পরিকল্পনা লইয়া সে ফিরিতেছে। এবার সুন্দর করিয়া সে গ্রামখানিকে গড়িবে। যে উৎসাহ, যে জাগরণ, কঙ্কালের মধ্যে যে মহাসঞ্জীবনীর সঞ্চার সে দেখিয়া আসিয়াছে, তাহাতে সে কল্পনা করিতেছিল, পঞ্চগ্রামের লোকেরা শোভাযাত্ৰা করিয়া চলিয়াছে। ভাঙা পথ সংস্কার করিয়া, নদী-নালায় সেতু বাঁধিয়া, কাঁটার জঙ্গল সাফ করিয়া, শ্মশানের ভাগাড়ে হাড়ের টুকরা সরাইয়া পথ করিয়া তাহারা ঋদ্ধির পথে চলিয়াছে।

বাসখানা স্টেশনে থামিল।

দেবু নামিয়া পড়িল। একটা সুটকেস এবং একপ্রস্থ বিছানা ছাড়া অন্য জিনিস তাহার ছিল। নাসে দুইটা নিজেই হাতে করিয়া নামিয়া পড়িল।

স্টেশন প্ল্যাটফর্মটা উত্তর-দক্ষিণে লম্বা। সামনেই পূর্বদিক। সূর্য উঠিতেছে। স্টেশনের সামনের প্রান্তরটার ও-মাথায় কয়েকখানা পাশাপাশি গ্রাম, সেখানে সকালেই ঢাক বাজিতেছে। আশ্বিন মাস। পূজার ঢাক বাজিতেছে। দেবু প্ল্যাটফর্মটায় ঘুরিতে ঘুরিতে একটা মিষ্ট গন্ধ পাইল। এ যে অতি পরিচিত তাহার চিরদিনের প্রিয় শিউলিফুলের গন্ধ! চারিদিকে চাহিতেই তাহার নজরে পড়িল প্ল্যাটফর্মের রেলিঙের ওপাশে স্টেশনের কর্মচারীদের কোয়ার্টার্স শ্রেণীর পাশে একটি বড় শিউলি গাছ। তলায় অজস্র ফুল পড়িয়া আছে, সকালের বাতাসে এখনও টুপটাপ করিয়া ফুল খসিয়া পড়িতেছে; তাহার মনে পড়িল নিজের বাড়ির সামনের শিউলি ফুলের গাছটি। সকালের বাতাসের মধ্যেও তাহার সমস্ত শরীর যেন কেমন করিয়া উঠিল—চোখের দৃষ্টি হইয়া উঠিল স্বপ্নপুর।

টিকিটের ঘণ্টায় তাহার চমক ভাঙিল। টিকিট করিয়া সে আবার প্ল্যাটফর্মে আসিয়া দাঁড়াইল।

প্ল্যাটফর্মে ক্রমশ ভিড় বাড়িতেছে। যাত্রীর দল এখানে-ওখানে জিনিসপত্র মোট-পোটলা লইয়া বসিয়া আছে দাঁড়াইয়া পাঁচজনে জটলা করিতেছে। দুই-চারিজনের চেনামুখও দেবু দেখিতে পাইল। তাহারা সকলেই সদরের লোক; কেহ উকিল, কেহ মোত্তার, কেহ ব্যবসায়ী। দেবু তাহাদের চেনে। সে আমলে দেবুরও মনে হইত, ইহারা সব মাননীয় ব্যক্তি, তাই তাহার মনে পরিচয়ের একটা ছাপ রাখিয়া গিয়াছে। দেবুকে তাহারা চেনে না! হঠাৎ নজরে পড়িল, কঙ্কণার একজন জমিদারবাবুও রহিয়াছেন। দিব্য শতরঞ্জি পাতিয়া প্ল্যাটফর্মের উপরেই আসর জমাইয়া ফেলিয়াছেন, গড়গড়ায় নল দিয়া তামাক টানিতেছেন। ভদ্রলোকের সে আমলের চালটি এখনও ঠিক আছে। যেখানেই যান, গড়গড়া তাকিয়া সঙ্গে যায়—আর গঙ্গাজলের কুঁজা। গঙ্গাজল ছাড়া উনি অন্য কোনো জল খান না। নিয়মিত কাটোয়া হইতে একদিন অন্তর গঙ্গাজল আসে। সেকালে দেবু এই গঙ্গাজলপ্রীতির জন্য ভদ্রলোককে খাতির করিত। যাই হোক, তাহার ওই। নিষ্ঠাটুকু তিনি বজায় রাখিয়াছেন। সে তখন ভাবিত, গঙ্গাজলের ফল কোনো কালেও ফলিবে না। সে আজ হাসিল।

–আপনাকে একটা কথা জিজ্ঞাসা করব?

দেবু মুখ ফিরাইয়া দেখিল—তাহার পাশেই দাঁড়াইয়া আছে সস্তা সাহেবি পোশাক-পরা একজন ভদ্রলোক। সাহেবি পোশাক হইলেও ভদ্রলোকটিকে আধময়লা ধুতি-জামা-পরা বাঙালি ভদ্রলোকের মতই মনে হইল, নিতান্ত মধ্যবিত্ত মানুষ।

দেবু বলিল—আমাকে বলছেন?

–আজ্ঞে হ্যাঁ। আপনার বাড়ি কি শিবকালীপুর?

–হ্যাঁ। কেন বলুন তো? দেবু আন্দাজ করিল, লোকটি গোয়েন্দা বিভাগের লোক।

–আপনার নাম বোধহয় দেবনাথ ঘোষ?

–হ্যাঁ। দেবুর স্বর রূঢ় হইয়া উঠিল।

–একবার এদিকে একটু আসবেন?

–কেন?

–একটু দরকার আছে।

–আপনার পরিচয় জানতে পারি?

–নিশ্চয়। আমার নাম জোসেফ নগেন্দ্র রায়। আমি ক্রিস্টান। এখানেই এককালে বাড়ি ছিল কিন্তু পাঁচ-ছ বছর হল আসানসোলে বাস করছি। কাজও করি সেইখানে। এখানে এসেছিলাম আত্মীয়দের বাড়ি, আজ ফিরে যাচ্ছি আসানসোলে। আমার স্ত্রী বললেন– উনি আমাদের পণ্ডিত দেবনাথ ঘোষ। আপনার কথা তার কাছে অনেক শুনেছি। আপনার জেল এবং ডিটেনশনের সময়ও খবর নিয়েছি এখানে। আজ বুঝি রিলিজড হলেন?

দেবু অবাক হইয়া গেল, কিছুই সে বুঝিতে পারি না, শুধু বলিল–হ্যাঁ।

—আমার স্ত্রী একবার আপনার সঙ্গে দেখা করতে চান।

–আপনার স্ত্রী।

–হ্যাঁ। দয়া করে একবার আসতেই হবে। ওই তিনি দাঁড়িয়ে আছেন।

দেবু দেখিল—একটি দীর্ঘাঙ্গী শ্যামবৰ্ণ মেয়ে জুতা পায়ে আধুনিক রুচিসম্মত ভাবে ধবধবে পরিষ্কার একখানি মিলের শাড়ি পরিয়া তাহাদের দিকেই চাহিয়া আছে। পাশেই তাহার আঙুল ধরিয়া আড়াই-তিন বছরের ছোট একটি ছেলে। তাহার খোকনের মত।

মেয়েটিকে দেখিয়াই দেবুর মনে বিস্ময়ের চমক লাগিল। কে এ! এ তো চেনা মুখ! বড় বড় চোখে উজ্জ্বল নিৰ্নিমেষ দৃষ্টি, এই টিকলো নাক—ও যে তাহার অত্যন্ত চেনা! কিন্তু কে? অত্যন্ত চেনা মানুষ অপরিচিত আবেষ্টনীর মধ্যে নূতন ভঙ্গিতে অভিনব সজ্জায় সাজিয়া দাঁড়াইয়া আছে, যার মধ্যে চাপা পড়িয়া গিয়াছে তাহার নাম ও পরিচয়। বিস্মিত স্থিরদৃষ্টিতে চাহিয়া দেবু অগ্রসর হইয়া চলিয়াছিল, মেয়েটিও কয়েক পা আগাইয়া আসিল—বোধহয় ঘনিষ্ঠ মুখোমুখি দাঁড়াইতে বিলম্ব তাহার সহ্য হইতেছিল না। হাসিয়া মেয়েটি বলিল—মিতে!

পদ্ম! কামার-বউ! দেবুর বিস্ময়ের আর অবধি রহিল না। অপরিসীম বিস্ময়ে সে পদ্মের মুখের দিকে চাহিয়া রহিল। সেই পদ্ম? চোখে জ্বলজ্বল অসুস্থ দৃষ্টি, শঙ্কিত সন্তর্পিত অপরাধীর মত পদক্ষেপ, জীৰ্ণ কাপড়, শীর্ণ দেহ, কণ্ঠস্বরে উন্মা, তিক্ততা, কথায় উগ্রতা—সেই কামার-বউ?

পদ্ম আবার বলিল—মিতে! ভাল তো?

দেবু আত্মস্থ হইয়া বলিল—মিতেনী? তুমি!

–হ্যাঁ। চিনতে পার নি—না?

দেবু স্বীকার করিল–না, চিনতে পারি নি। চিনেছি, মন বলছে চিনি, হাসি চেনা, টানা চোখ চেনা, লম্বা গড়ন চেনা—তবু ঠাহর করতে পারছিলাম না–কে।

পদ্মের মুখ অপূর্ব আনন্দের হাসিতে উদ্ভাসিত হইয়া উঠিল—সে শিশুটিকে বুকে তুলিয়া লইয়া বলিল—আমার ছেলে।

এক মুহূর্তে দেবুর চোখে জল ভরিয়া উঠিল। কারণ সে জানে না। চোখ দুইটা যেন স্পর্শকাতর, রস-পরিপূর্ণ ফলের মত পদ্মের ওই দুইটি শব্দের ছোঁয়ায় ফাটিয়া গেল।

পদ্মই আবার বলিল–ওর নাম কি রেখেছি জান?

দেবু বলিল–কি?

–ডেভিড দেবনাথ রায়।

পাশ হইতে নগেন রায় বলিল—আপনার নামে নাম রাখা হয়েছে। উনি বলেন ছেলে আমাদের পণ্ডিতের মত মানুষ হবে।

দেবু নীরবে হাসিল।

পদ্ম দেশের লোকের খবর লইতে আরম্ভ করিল; প্রথমেই জিজ্ঞাসা করিল দুর্গার কথা।

দেবু বলিল—ভালই থাকবে। আমি তো আজ তিন বছর পর ফিরছি মিতেনী!

পদ্ম বলিল-লক্ষ্মী পুজোর দিন দুর্গার কথা মনে হয়। লক্ষ্মী তো আমাদের নাই; কিন্তু আমাদের জমি আছে, ধান উঠলে নতুন চাল ঘরে এলে পিঠে করি, সে দিন মনে হয়। ষষ্ঠীর দিনে মনে হয়। ষষ্ঠীর কথা মনে পড়ে।

দেবু হাসিল। আনন্দে তাহার বুক যেন ভরিয়া গিয়াছে। পদ্মের এই রূপ দেখিয়া তাহার তৃপ্তির আর সীমা নাই।…

—এই এই ঘণ্টি মারো, ট্রেন আতা হ্যায়।…

দেবু ফিরিয়া দেখিলনীল প্যান্টালুন ও জামা গায়ে একজন লোক লাইন ক্লিয়ারের লোহার গোল ফ্রেমটা হাতে করিয়া চলিয়াছে, মুহূর্তে তাহার মনে পড়িয়া গেল অনি-ভাইকে। সে কিছুতেই নিজেকে সংবরণ করিতে পারি না, বলিল অনি-ভাই মধ্যে ফিরে এসেছিল। মিতেনী।

পদ্ম স্থিরদৃষ্টিতে দেবুর দিকে চাহিয়া রহিল।

দেবু বলিল—সে কলকাতায় মিস্ত্রির কাজ করে অনেক টাকা নিয়ে এসেছিল।…

বাধা দিয়া পদ্ম বলিলতার কথা থাক্ মিতে। তোমাদের সে কামার-বউ তো এখন আমি নই।

তাহার কথা শুনিয়া দেবু আশ্চর্য হইয়া গেল। পদ্মের কথাবার্তার ধারাসুদ্ধ পাল্টাইয়া গিয়াছে।

পদ্ম বলিল—সে দুঃখ-কষ্ট—অভাবের হাত থেকে রেহাই পেয়েছে—সুখের মুখ দেখেছে। শুনে আমার আনন্দ হল। কিন্তু আমি এই সবচেয়ে সুখে আছি পণ্ডিত। আমার খোকন—আমার ঘর-পণ্ডিত, অনেক দুঃখে আমি গড়ে তুলেছি। পরকাল?—বলিয়াই সে হাসিয়া বলিল পরকাল আমার মাথায় থাক্। এ কালেই আমি স্বর্গ পেয়েছি। আমার খোবন!—বলিয়া সে ছেলেটিকে বুকে চাপিয়া ধরিল। ঠং ঠং ঠুং ঠন্‌–করিয়া ট্রেনের ঘণ্টা পড়িল।

দেবু বলিল–তা হলে যাই মিতেনী!

নগেন রায় তাহার হাতখানা চাপিয়া ধরিয়া বলিল—আপনার সঙ্গে আমি কিন্তু আজ কথা বলতে পেলাম না!

দেবু বলিল—আপনার ছেলের বিয়েতে আমাকে নেমন্তন্ন করবেন, যাব আমি।

পদ্ম বলিল—তুমি আসবে পণ্ডিত? আমাদের বাড়ি?

—আসব বৈকি মিতেনী!

ট্রেনে চাপিয়া চোখ বন্ধ করিয়া সে পদ্মের ওই অপরূপ ছবিখানি মনে মনে যেন ধ্যান করিতে বসিল। পদ্মের ছবি মিলাইয়া গিয়া অকস্মাৎ মনে পড়িল স্বর্ণকে। লেখাপড়া শিখিয়া স্বর্ণ এমনই সার্থক হইয়া ওঠে নাই! নিশ্চয় উঠিয়াছে।

জংশনে সে যখন নামিল, তখন বেলা দশটা।

শরতের শুভ্র দীপ্ত রৌদ্রে চারিদিক ঝলমল করিতেছে। আকাশ গাঢ় নীল—মধ্যে মধ্যে সাদা হালকা খানা-খানা মেঘের টুকরা ভাসিয়া চলিয়াছে দ্রুততম গতিতে। ময়ূরাক্ষীর কিনারা ধরিয়া বকের সারি দেবলোকের শুভ্র পুষ্পমাল্যের মত ভাসিয়া চলিয়াছে। প্ল্যাটফর্ম হইতেই ময়ূরাক্ষীর ভরা বুক দেখা যাইতেছে জল আর এখন তেমন ঘোলা নয়; ভরা নদীতে ওপার হইতে এপারের দিকে খেয়ার নৌকা আসিতেছে। জংশনের কতকগুলা চিমনিতে ধোঁয়া উঠিতেছে।

সে প্ল্যাটফর্ম হইতে বাহির হইয়া আত্মগোপন করিয়াই একটা জনবিরল পায়েচলা পথ ধরিল। এখানে প্রায় সকলেই তাহার চেনা মানুষ। তাহাকে দেখিলে তাহারা সহজে ছাড়িবে না। তাহারা তাহাকে ভালবাসে।

 

ময়ূরাক্ষীর ঘাটে গিয়া সে নামিল। খেয়া-নৌকাটা ওপার হইতে এপারে আসিতেছে।

এপারের ঘাটে অনেকের সঙ্গে দেখা হইল। ওপারের ঘাটেও অনেকে দাঁড়াইয়া ছিল, তাহারাও দেবুকে দেখিল। কয়েকটি ছেলে দাঁড়াইয়া ছিল—তাহারাও ওপার হইতে চিৎকার করিয়া উঠিল—দেবু-দা! দেবু-দা! জনদুয়েক ছুটিয়া চলিয়া গেল গ্রামের দিকে। দেবু হাসিমুখে হাত তুলিয়া তাহাদের সম্ভাষণ করিল।

খেয়া-মাঝি শশী ভল্লা স্মিতমুখে বলিলপণ্ডিত মশায়! ফিরে এলেন আপনি?

–হ্যাঁ! ভাল আছ তুমি?

শশী একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিয়া বলিল-আমাদের আবার ভাল থাকা পণ্ডিত মশায়! কোনোরকমে বেঁচে আছি, নেকনের (অদৃষ্ট লিখনের) দুঃখু ভোগ করছি আর কি।

দেবুর অন্তরের আনন্দ-দীপ্তি লোকটির কথার সুরের ভঙ্গিমায় ম্লান হইয়া গেল। পাশে যাহারা দাঁড়াইয়া ছিল, তাহারাও সকলেই কেমন স্তিমিত স্তব্ধ; সামান্য দুই-একটা প্রশ্ন করিয়া সকলেই চুপ করিয়া রহিল। শশীর সঙ্গে দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিল কিন্তু সকলেই।

দেবু মৃদুস্বরে প্রশ্ন করিল ছেলেপিলে সব ভাল আছে?

—আজ্ঞে হ্যাঁ! ওই বেঁচে আছে কোনো রকমে। জ্বর-জ্বালা, ঘরে খেতে নাই, পরনে কাপড় নাই, এই ভাদ্দ মাস-বুঝলেন, দুঃখ-কষ্টের আর অবধি নাই।

সেই পুরনো কথা।–অন্ন নাই, বস্ত্র নাই। অনাহারে রোগে আবার–আবার পঞ্চগ্রাম মরিতে বসিয়াছে।

দেবু আশ্বাস দিয়া বলিল—এবার বর্ষা ভাল; ধানও ভাল—আর কদিন গেলেই ধান উঠবে। অভাব ঘুচবে। ভয় কি?

শশী অদ্ভুত হাসিয়া বলিল—আর ভয় কি! ভরসা আর নাই পণ্ডিত মাশায়। সব গেল।

—দেবু-ভাই! দেবু!… চিৎকার করিয়া বাঁধের উপর হইতে কে যেন ডাকিতেছে। দেবু ফিরিয়া দেখিল। জগন-ভাই, ডাক্তার ডাক্তার তাহাকে ডাকিতেছে। খবর পাইয়া সে ছুটিয়া আসিতেছে। দেবু নৌকার উপরে দাঁড়াইয়া হাত তুলিয়া বলিল-জগন-ভাই!

ডাক্তার চিৎকার করিয়া উঠিল—বন্দে মাতরম্ সঙ্গে সঙ্গে ছেলেগুলিও চিৎকার করিয়া উঠিল–বন্দে মাতরম্‌।

দেবুও হাসিয়া বলিল–বন্দে মাতরম্।

ডাক্তার হাঁপাইতেছে, সে ছুটিয়া আসিয়াছে বোধহয়। সে বেশ অনুমান করিল, সমস্ত গ্রামের লোক বোধহয় শ্ৰেণীবদ্ধ হইয়া গ্রাম হইতে বাহির হইয়া আসিতেছে।

শিবকালীপুরের ঘাটে নামিতেই ডাক্তার তাহাকে বুকে জড়াইয়া ধরিল। ছেলেগুলির মুখ। প্রদীপ্ত হইয়া উঠিয়াছে। আগে প্রণাম করিবার জন্য তাদের মধ্যে কাড়াকাড়ি পড়িয়া গেল। হাসিমুখে দেবু তাহাদের মাথায় হাত দিয়া বলিল-ওই হয়েছে। ওই হয়েছে!

তবু তাহারা মানে না, কিশোর প্রাণের আবেগে চাঞ্চল্যে তাহারা অধীর হইয়া উঠিয়াছে। দেবুর হাতের সুটকেস এবং বিছানার মোটটা কাড়িয়া লইয়া নিজেরাই মাথায় করিয়া লইল। সারিবন্দি হইয়া পায়ে চলার পথে কিশোরবাহিনী আগাইয়া চলিলদৃপ্ত উল্লসিত পদক্ষেপে। কিন্তু তবু যেন দেবুর মনে হইল, এ বাহিনী সম্পূর্ণ নয়। কই? গৌর কই? সর্বাগ্রে যাহার চলিবার কথা, সে কই? দেবু বলিল—ডাক্তার, গৌর কোথায় বল তো?

–গৌর! ডাক্তার বলিল—জেল থেকে এসে সে তো এখান থেকে একরকম চলেই গিয়েছে।

–চলে গিয়েছে?

–হ্যাঁ। সে কলকাতায় কোথায় থাকে। মধ্যে মধ্যে আসে, দু-চার দিন থাকে; আবার চলে যায়। এই কদিন আগে এসেছিল।

–চাকরি করছে?

–চাকরি না; ভলেন্টিয়ারি করে। কি করে ভাই, সে-ই জানে।–তাহারা বাঁধের উপর উঠিল।

দেবু বলিল-স্বর্ণ? স্বৰ্ণ কেমন আছে ডাক্তার? সে কি–সে বোধহয় জংশনেই আছে, না?

–হ্যাঁ। জংশনে সেই থেকে মাস্টারি করে। ওখানে থাকে। ভারি চমৎকার মেয়ে হে। এবার ম্যাট্রিক দেবে।

দেবু একবার পিছন ফিরিয়া জংশনের দিকে চাহিল। কিন্তু দাঁড়াইবার অবকাশ ছিল না। কিশোরবাহিনী আগাইয়া চলিয়াছে। তাহারা থামিতে চায় না।

সম্মুখেই পঞ্চগ্রামের মাঠ। আশ্বিনের প্রথম। বর্ষাও এবার ভাল গিয়েছে। ধান এবার ভাল। ইহারই মধ্যে ঝাড়েগোড়ে খুব জোরালো হইয়া উঠিয়াছে। নয়া ধান গাছের ঝাড় যেন কালো মেঘের মত ঘোরালো। মধ্যে মধ্যে কোনো নালার ধারে জমির আলের উপর কাশের ঝাড়ের মাথায় সাদা ফুল ফুটিয়াছে, আউশ ধানের শীষ উঠিয়াছে, ওই কঙ্কণা, ওই কুসুমপুর, ওই তাহার শিবকালীপুর! ওই মহাগ্রাম! মহাগ্রাম নজরে পড়িতেই সে যেন একটা প্রচণ্ড ঘা খাইয়া দাঁড়াইয়া গেল। মুহূর্তের জন্য সে চোখ বুজিল। দেহের সকল স্নায়ু ব্যাপ্ত করিয়া বহিয়া গেল একটা দুঃসহ অন্তর-বেদনার মর্মান্তিক স্পর্শ। জগন পিছন হইতে বলিল দেবু!

একটা গভীর দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিয়া দেবু আবার অগ্রসর হইল; বলিল–ডাক্তার।

ডাক্তার বলিল—কি হল ভাই? দাঁড়ালে?

দেবু সে কথার উত্তর দিল না, প্ৰশ্ন করিল-ঠাকুর মশায়? ঠাকুর মশায় আর এসেছিলেন?

ডাক্তার একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিয়া বলিল–না।… কিছুক্ষণ চুপ করিয়া থাকিয়া ডাক্তার বলিল–বিশ্বনাথের খবর জান তুমি?

–জানি।–জেলেই খবর পেয়েছিলাম।

বিশ্বনাথ নাই। বিশ্বনাথ জেলের মধ্যেই মারা গিয়াছে।

কিছুক্ষণ পর আত্মসংবরণ করিয়া দেবু মুখ তুলিল। বিশ্বনাথের জন্য অন্ধকার রাত্রে জেলখানার গরাদ-দেওয়া জানালায় মুখ রাখিয়া সে রাত্রির পর রাত্ৰি দিয়াছে। আর তাহার কান্না আসে না।

ওই দেখুড়িয়া। বিস্তীর্ণ মাঠখানায় বুকভরা নমনীয় চাপ-বধা ধান কমনীয় সবুজ; বাতাসের দোলায় মুহূর্তে মুহূর্তে দুলিয়া ঢেউয়ের পর ঢেউ তুলিতেছে। কিন্তু কোথাও কোনো লোকের সাড়া আসিতেছে না। পাশাপাশি আধখানা চাঁদের বেড়ের মত পাঁচখানা গ্রাম স্তিমিত স্তব্ধ।

অনেকক্ষণ নীরবে চলিয়া দেবু বলিলতারপর জগন-ভাই, কি খবর বল দেশের

—দেশের?

–হ্যাঁ। আমাদের এখানকার!

—সব মরেছে, সব গিয়েছে, সব শেষ হয়ে গেল। খায়দায় আধ পেটা, ঘুমোয়, ব্যস। সে সব আর কিছু নাই।

–বল কি?

–দেখবে চল।

আবার নীরবে তাহারা চলিল। ছেলেগুলি নিজেদের মধ্যে মৃদুস্বরে গোলমাল করিতেছে। দেবুর মুখের দিকে কয়েকবার ফিরিয়া দেখিয়া তাহাদের কলরবের উৎসাহ নিভিয়া গিয়াছে। ধান-ভরা মাঠে কানায় কানায় ভরিয়া জল বাঁধিয়া দেওয়া হইয়াছে। আশ্বিন মাস-কন্যারাশি। কন্যা কানে কান—বিনা বায়ে তুলা বর্ষে—কোথা রাখিবি ধান! আশ্বিনে মাঠ ভরিয়া জল দিতে হয়।

মধ্যে নিড়ানের কাজ চলিতেছে। দেবু বিস্মিত হইল, কৃষকেরা অপরিচিত। সাঁওতাল সব।

সে বলিল—এরা কোথেকে এল ডাক্তার?

জগন বলিল—শ্ৰীহরি ঘোেষ আর ফেলু চৌধুরী আনিয়েছে দুমকা থেকে ওদের।

দেবু আর একটু বিস্মিত হইয়া ডাক্তারের মুখের দিকে চাহিল।

ডাক্তার বলিল—এসব জমি প্রায় সব শ্ৰীহরি আর চৌধুরীর ঘরে ঢুকেছে।

দেবু স্তম্ভিত হইয়া গেল; পঞ্চগ্রামের মানুষ সর্বস্বান্ত হইয়া গিয়াছে!

শিবপুরের পাশ দিয়া মজা চৌধুরী-দিঘিটা ডাইনে রাখিয়া দুধারে বাঁশবাগানের মধ্য দিয়া কালীপুরের প্রবেশের পথ।

ডাক্তার বলিল–চৌধুরী খালাস পেয়েছেন।

দেবু একটা ম্লান হাসি হাসিল। হ্যাঁ–খালাস পাইয়াছেন বটে।

ছেলের দল গ্রামে প্রবেশের মুখে আর মানিল না। তাহারা হাকিয়া উঠিল-জয়, দেবু ঘোষ কি জয়।

গ্রামের ভিতর হইতে কে ছুটিয়া আসিতেছে।

দেবু নিজের চোখকে যেন বিশ্বাস করিতে পারিতেছে না। ও কি দুৰ্গা? হ্যাঁ, দুর্গাই তো। ক্ষারে-ধোওয়া একখানি সাদা থান কাপড় পরিয়া, নিরাভরণা, শীর্ণ দেহ, মুখের সে কোমল লাবণ্য নাই, চুলের সে পারিপাট্য নাই—সেই দুৰ্গা এ কি হইয়া গিয়াছে।

দেবু বলিল-দুর্গা? এ কি তোর শরীরের অবস্থা দুর্গা? তুই এমন হয়ে গিয়েছিস কেন?

দুর্গার সব গিয়াছে—কিন্তু ডাগর চোখ দুইটি আছে, মুহূর্তে দুর্গার বড় বড় চোখ দুইটি জলে। ভরিয়া উঠিল।

ডাক্তার বলিল-দুর্গা আর সে দুর্গা নাই। দান-ধ্যান-পাড়ায় অসুখ-বিসুখে সেবা–

দুর্গা লজ্জিত হইয়া বলিলথামুন ডাক্তার-দাদা। তারপরেই বলিলউঃ, কতদিন পর এলে জামাই!

পথ হইতে চণ্ডীমণ্ডপের উপর শ্রীহরিকে দেখা গেল। শ্ৰীহরির কপালে তিলকফোঁটা। জগন বলিল—শ্ৰীহরি এখন খুব ধৰ্ম-কর্ম করছে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *