সেকেন্ড ইনিংস

সেকেন্ড ইনিংস

এতদিন বাদে দূর থেকে প্রবীরকে দেখে কাঁকনের বুকের ভেতরটা হঠাৎ কেমন কেঁপে উঠল, ঠিক দেখছে তো?

সত্যিই প্রবীর?

একি রে বাবা! সবে বিয়েবাড়িতে ঢুকেছে, ঢুকতে না ঢুকতেই এইরকম সমাপতন?

মকটেলটা নিতে যাওয়ার অছিলায় একটু তফাতে চলে এল ও। ইদানীং সব বিয়েবাড়িতেই বারের কায়দায় সফট ড্রিঙ্কস কাউন্টার শুরু হয়েছে, তাতে বিভিন্ন ধরনের ফ্র্যুট জ্যুস বা ককটেলের ব্যবস্থা রয়েছে। আর এদের তো আরো এলাহি ব্যাপার, বিশাল বড় একটা বাগানবাড়ির একেকটা দিককে একেকরকম থিমে সাজানো হয়েছে, কোথাও স্টার্টার, কোথাও শুধুই মেইন কোর্সের খাওয়া দাওয়া, কোথাও বিয়ে হবে, কোথাও শুধু ড্রিঙ্কস আর আইসক্রিম, কোথাও আবার নির্ভেজাল আড্ডার ব্যবস্থা করা। একদিকে আবার বিশাল এলসিডি টিভি লাগানো হয়েছে, সেখানে বিয়ের যাবতীয় রিচুয়াল লাইভ সম্প্রচার করা হবে।

নবনীতাদি বেশ বয়সেই বিয়ে করছে, এতদিন পয়সা কামিয়েওছে প্রচুর, সুতরাং খরচা তো করবেই।

সত্যি, কার সাথে কার কিভাবেই না আলাপ হয়! নবনীতাদি ছিল কাঁকনের ডিভোর্স লইয়ার। যদিও ওদের ডিভোর্সের সময় জটিলতা কিছুই হয়নি, ও ভালো চাকরি করে, ফলে কোনো খোরপোষও দাবি করেনি। তবু নিয়মমাফিক একজনকে তো লাগেই। তাছাড়া, প্রবীর ছেলেমানুষি গোঁ ধরে বসেছিল যে ডিভোর্স পেপারে কিছুতেই সাইন করবে না, পরে অবশ্য কাঁকনের রাগ দেখে মেনে নেয়। সেই থেকেই কাঁকনের সঙ্গে নবনীতাদির যোগাযোগ আজও অটুট! তেমন মাখামাখি না থাকলেও সুন্দর একটা সম্পর্ক গড়ে উঠেছে দুজনের। মাঝে মাঝেই ফোন করে খোঁজ নেয় দুজন দুজনের, কোনো অকেশনে দুজনেই দুজনকে নিমন্ত্রণ করে।

কাঁকন বেশি কিছু চিন্তা না করে একটা ব্ল্যু লেগুন নিয়ে একটু দেয়াল ঘেঁষে আড়াল হয়ে গেল। বিয়েবাড়িতে ঢুকে অবধি এখনো নবনীতাদির সঙ্গে দেখাই করেনি ও, তবু কাঞ্জিভরমের ভারি আঁচলটাকে আর ফ্যাশনের তোয়াক্কা না করে টেনে পেছন দিক দিয়ে নিয়ে এসে কোমরে গুঁজল, তারপর স্ট্র-টা মুখে দিয়ে আড়চোখে দেখতে লাগল একটু দূরে দাঁড়িয়ে থাকা লোকটাকে।

হ্যাঁ, কোনো সন্দেহ নেই। প্রবীরই বটে। সেই একইরকম ঘাড় বাঁদিকে বেঁকিয়ে ডান হাতটা কোমরে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা, সেই ঢেউখেলানো চুল, আর সেই চিরাচরিত ঠোঁট বেঁকিয়ে হাসি। একসময় ওই হাসি দেখেই প্রেমে পড়েছিল কাঁকন, আবার একটা সময় এমন এসেছিল যে ওই হাসিটা দেখলেই রাগে সারা শরীরটা জ্বলে যেত।

কিন্তু এখন ভালোলাগা খারাপলাগা কিছুই মনে হল না, কেমন যেন একরাশ কৌতূহল এসে ভিড় করল মনে।

প্রবীর কলকাতায়!

ডিভোর্সের পর যতদূর শুনেছিল প্রবীর ট্রান্সফার নিয়ে দিল্লি চলে গিয়েছিল। ওখানেই তো ওর বাড়ি ছিল। বাড়ি বলতে অবশ্য নিজেরই একটা ফ্ল্যাট, এমনিতে তো তিনকুলে কেউ ছিল না। তারপর প্রায় পাঁচ বছর হয়ে গেছে ওর আর কোনো খবরই পায়নি কাঁকন।

পাওয়ার চেষ্টাও যে করেছে তা নয়।

প্রথম প্রথম প্রবীরের নাম শুনেই রাগে ঘৃণায় মুখ কুঁচকে উঠত, কোথা থেকে কান্না এসে ভরে যেত চোখের জল, অস্থির লাগত, মনে হত এক্ষুনি শেষ করে ফেলে জীবনটা, কি হবে এভাবে বেঁচে?

কখনো কখনো আবার দুর্বলও হয়ে পড়ত, মনে হত কোর্টকাছারি, কাদা ছোঁড়াছুঁড়ি সব ভুলে ছুটে চলে যায় ওর কাছে, তখন অনেক কষ্টে নিজেকে কন্ট্রোল করতে হত।

তারপর সময়ের সাথে সাথে সেই প্রাথমিক অভিব্যক্তিটা থিতিয়ে গেছে, মনে যে একেবারেই পড়ত না, তা নয়, কিন্তু ওই টুকুই, ওর সংসারটা ভাঙার জন্য আর কষ্ট হত না খুব একটা।

তবে হ্যাঁ, শূন্যতা তো একটা থেকেই যায়, বিশেষ করে একা থাকলে।

বরং বছরখানেক আগে নেহাৎ কৌতূহল থেকেই ফেসবুকে খোঁজাখুঁজি করেছিল একবার, পেয়েও ছিল, কিন্তু প্রবীর যে ফেসবুকে ইনঅ্যাক্টিভ, সেটা কাঁকন বুঝেছিল। ছবি, আপডেট কিছুই ছিল না তেমন।

কাঁকন শেষ হয়ে যাওয়া জ্যুসের গ্লাসটা ওয়েস্টবক্সে রাখার ছল করে আরো খানিকটা ওদিকে সরে গেল, প্রবীর কিন্তু বেশ মুটিয়েছে, শার্টের উপর দিয়ে ভুঁড়িটা বোঝা যাচ্ছে ভালোই, সামনের চুলটাও একটু পাতলা হয়েছে। বিয়ে তো আর করেনি বলেই জানে, তবু সত্যি কি করেনি?

ও একটু উঁকিঝুঁকি দিল, নাহ! আশপাশে কাউকে দেখাও যাচ্ছে না।

কাঁকনের চিরকালই একটু বেশি কৌতূহল সবেতে, ঘাড় বেঁকিয়ে বারবার দেখতে গিয়ে একটা কাণ্ড হল, একজন শেরওয়ানি পড়া ভদ্রলোক আইসক্রিম নিয়ে বেরোচ্ছিলেন, কাঁকনের হঠাৎ পিছিয়ে আসাতে তিনি হুড়মুড়িয়ে পড়লেন কাঁকনের গায়ে, আর ওনার হাতের চকোসিরাপ দেওয়া বাটারস্কচ আইসক্রিমটা পিছলে পড়ে গেল ঠিক কাঁকনের ঘাড়ে, মুহূর্তে সেটা গড়িয়ে পড়ে ওর পিঠ, ব্লাউজ মাখামাখি হয়ে গেল।

কাঁকন প্রথমে হকচকিয়ে গেল, তারপর ভদ্রলোকের দিকে এমন আগুনঝরা দৃষ্টিতে তাকাল, কলিযুগ না হলে শিওর ভদ্রলোক ভস্ম হয়ে যেতেন, ‘শিট! আপনি কি চোখে দেখতে পান না? কি করলেন বলুন তো? কোনো মানে হয়?’

ভদ্রলোক মুহূর্তে মিইয়ে গেলেন, ‘না মানে আমি ঠিক ইচ্ছে করে…!’

ভদ্রলোক কিরকম একটা চেনা চেনাও লাগছিল, কোথাও দেখেছে কি এর আগে? দেখলেও তা নিয়ে ও একেবারেই মাথা ঘামাল না, এমনিতেই ওর পিঠটা চটচট করছিল, দেখতে না পেলেও বুঝতে পারছিল ওর সাধের দামি ব্লাউজটার পুরো বারোটা বেজে গেছে। ইশ! পুজোর সময় কত বুটিক ঘুরে এই ব্লাউজটা কিনেছিল।

ও ঝাঁঝিয়ে উঠল, ‘ইচ্ছে করে কেউ খুনও করে না বুঝলেন, সেটাও আর কোনো উপায় না থাকাতেই করে! দেখছেন দাঁড়িয়ে আছি, দেখেশুনে হাঁটবেন না? আমার সাড়ে বারো হাজার টাকার কাঞ্জিভরম…!’ শোকে দুঃখে কাঁকন প্রায় মূর্ছা যেতে বসল।

ভদ্রলোক বললেন, ‘আই অ্যাম এক্সট্রিমলি স্যরি ম্যাডাম! আসলে আমি একটু আগেই এসেছি, আমার ভাগনে তো নিতবর, হঠাৎ বায়না করল যে…!’

এইসব আবাল পাবলিকগুলো কোথা থেকে আসে মাইরি?

আর নবনীতাদিকেও বলিহারি, কোনো কাণ্ডজ্ঞান নেই! এতবড় দুঁদে সিভিল লইয়ার, একটা স্ট্যান্ডার্ড দেখে নেমন্তন্ন করবে তো! লোকটা পড়েছে জমকালো পোশাক, এদিকে দ্যাখো, কোনো বেসিক ম্যানারিজম নেই!

ততক্ষণে আশপাশ থেকে পাঁচ-ছরকমের উপদেশ উড়ে আসতে চলেছে, একটা লোক বলল, ‘দিদি, বাথরুমে গিয়ে ধুয়ে নিন বরং নাহলে উঠবে না পরে, কোকো তো!’

কাঁকন ইয়র্কার মারার ভঙ্গিতে তীক্ষ্নচোখে সোজা তাকাল লোকটার দিকে, ‘ধুয়ে দিলে এখন কি পড়ে থাকব আমি?’

লোকটা অপ্রস্তুত হয়ে আমতা আমতা করতে লাগল।

তখন আরেকজন মোটা ভদ্রমহিলা বক্তব্য রাখলেন, ‘তুমি বরং বাড়ি চলে যাও, দামি ব্লাউজ তো, ওই দাগ নাহলে আর উঠবে না!’

কাঁকনের অসহ্য লাগছিল, কি একটা বলতে যাবে হঠাৎ দেখল প্রবীর এদিকে এগিয়ে আসছে। ও ঝট করে পেছন ফিরে যাওয়ার চেষ্টা করল, কিন্তু পারল না, তার আগেই প্রবীরের গলা শোনা গেল, ‘আরে কি হল, সুপ্রিয়দা চলুন, এসেই এদিকে চলে এলেন কেন, ওদিকে রেজিস্ট্রার বসে আছে তো!’

এটুকু বলেই প্রবীর দমল না, সোজা এগিয়ে আসতে লাগল কাঁকনের দিকে, ‘আরে ম্যাডাম, উনি তো ইচ্ছে করে করেননি বলুন, বরকে এইভাবে এখানে আটকে রাখলে হবে? লগ্ন তো বয়ে যাচ্ছে। আজকের দিনে তো উনিই…!’ বলতে বলতে প্রবীর কাঁকনের মুখোমুখি হয়ে থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল।

ওর দিকে তাকিয়ে প্রবীর যেন বিস্ময়ে স্থবির হয়ে গেল।

কাঁকনের হৃৎপিণ্ডটা এমনিই খরগোশের মতো লাফাচ্ছিল, তার ওপর প্রবীরের কথা শুনে ও প্রায় ভির্মি খায় আর কি!

এই আধবুড়ো লোকটা বর?

কি লজ্জার কথা! ছি ছি, বরকেই কিনা ও এতগুলো কথা শুনিয়ে দিল?

এইবার যদি নবনীতাদির বাড়ির লোকই ওকে দুটো কথা শুনিয়ে দেয়?

ও খুব কনফিউজড হয়ে গেল, আড়চোখে দেখল বরবাবাজি তখনো ওর মুখের দিকে বেশ অসন্তুষ্টভাবে তাকিয়ে আছেন। নবনীতাদি বলেছিল ওর বরও নাকি উকিল।

ওদিকে আশপাশের ফিসফাস ওর ব্লাউজের সংকটময় ভবিষ্যতের চিন্তা ছেড়ে এখন ‘ওমা, এটাই বর! বুঝতেই পারিনি!’ তে দাঁড়িয়েছে।

পুরো জায়গাটায় যেন হঠাৎ করেই কাঁকন ভিলেন হয়ে গেল।

কাঁকন আর ভাবল না, তড়িৎ গতিতে সরে এল জায়গাটা থেকে, যত তাড়াতাড়ি এই গ্যাদারিং থেকে কেটে পড়া যায় ততই ভালো। একদিকে ভালই হয়েছে এই বিশাল বাগানবাড়িটায়, এতবড় ক্যাম্পাস, ও অনেকটা লন দিয়ে হেঁটে খুব সুন্দর করে সাজানো একটা ছোট্ট লেকের সামনে চলে এল।

কিরকম একটা অস্বস্তি হচ্ছে। এক প্রবীরের আকস্মিক আবির্ভাব, দুই খোদ বরের সাথে ঝামেলা।

উফ, কাঁকনের সাথেই এইরকম হয় সবসময়।

ও কি না খেয়েই বেরিয়ে যাবে? এসে থেকে তো নবনীতাদির সঙ্গে দেখাই করা হল না, অফিস থেকে সোজা এসেছে, খিদে পেয়েছে বলে প্রথমেই জ্যুস খেতে চলে গিয়েছিল। গিফটটাও দেওয়া হয়নি এখনো!

কি বিচ্ছিরি লাগছে। একে তো চটচটে ভেজা ব্লাউজ, তার উপর এই উটকো ঝামেলা। দূর থেকে একটু দূরের হিন্দি গানের সঙ্গে কয়েকজনের উদ্দাম নাচ এখান থেকেই ও দেখতে পাচ্ছিল।

আচ্ছা বরটাই বা কেমন, নিজেই চলে এসেছে ভাগনের জন্য আইসক্রিম নিতে? আর কেউ ছিল না? না কপালে চন্দন, না গলায় মালা, কি করে চিনবে কাঁকন?

কোনো মানে হয়?

হঠাৎ ও অনুভব করল এই ফাঁকা জায়গায় ওর পাশে এসে কে দাঁড়িয়েছে। পাশে তাকাতেই ও প্রবীরকে দেখতে পেল।

প্রবীর ওর পেছন পেছন চলে এসেছে?

প্রবীর বলল, ‘তুমি!’

কাঁকন অন্যদিকে তাকিয়ে যতটা সম্ভব স্বাভাবিক থাকার চেষ্টা করতে করতে নিরুৎসাহিত গলায় বলল, ‘হ্যাঁ, আমি। কে-কেমন আছ?’

প্রবীরের চোখ থেকে তখনো বিস্ময় যায়নি, ‘আমি বিশ্বাসই করতে পারছি না, তোমার সঙ্গে আমার কখনো দেখা হবে।’

কাঁকন কি বলবে বুঝতে পারল না, ডিভোর্স হয়ে যাওয়া বরের সাথে দেখা হলে কি বলা উচিত?

ও কিছুক্ষণ একটু উসখুস করল, তারপর বলল, ‘তুমি দিল্লিতে ছিলে না?’

প্রবীর বলল, ‘হ্যাঁ, দিল্লি থেকেই এসেছি।’

লেকের চারপাশে আলোর মালা দিয়ে সাজানো থাকলে কি হবে, লেকের জলটা বেশ অপরিষ্কার, সবুজ শ্যাওলার দিকে তাকিয়ে কাঁকন একটা ঢোঁক গিলল, ‘বিয়ে করেছ?’

প্রবীর বলল, ‘পাগল! ন্যাড়া বেলতলায় ক-বার যায় বল! তুমি করেছ নিশ্চয়ই?’

প্রবীরের এই ঠেস মেরে কথা বলার বদভ্যাসটা আর গেল না, মনে মনে কাঁকন ভাবল। এখনো পালটায়নি। অবশ্য এখন আর পাল্টাবেই বা কেন! যখন সংসার পেতেছিল দুজনে, তখনই পালটায় নি, আর এখন তো ছাড়া গোরু!

আজও অফিস থেকে এসে ক্লান্ত শরীরে যখন বিছানায় গা এলিয়ে দেয় কাঁকন, ওর সাততলার জানলা থেকে দূরের ব্যস্ত রাস্তাটার উল্কার গতিতে ছুটে চলা গাড়িগুলোর হেডলাইট চোখে পড়ে, ভাবে, সত্যিই যে ওদের ডিভোর্সটা কেন হল! লোকের সংসার ভাঙার কত গুরুত্বপূর্ণ কারণ থাকে। তৃতীয় ব্যক্তি, টাকা পয়সা, কম্প্যাটিবিলিটি! ওদের এসব কিছুই সমস্যা ছিল না। দুজনেই ভালো রোজগার করত, ভালোবাসতো দুজন দুজনকে মন থেকে। কিন্তু, তবু ওদের আলাদা হয়ে যেতে হল।

আচ্ছা, এই জন্য কি কাঁকন দায়ী?

কাঁকন মাথা নাড়ল, ‘আমিও যখন ন্যাড়া, তখন আমিও বা বেলতলায় যেতে যাব কোন দুঃখে? একাই বেশ আছি।’

প্রবীর হেসে ফেলল, ‘তুমি কিন্তু আগের মতোই আছ, একটু মুটিয়েছ, আর চুলটা ছোট করে ফেলেছ, বাট এখন বেশ লাগছে।’

নাহ, প্রবীর একচুলও বদলায়নি! ঠিক একইরকমভাবে প্রশংসার মধ্যে খুঁতগুলোকে ঢুকিয়ে একটা জ্বালাধরানো মুড তৈরি করে দেবে, এসব করে যে ও কি সুখ পায়!

কাঁকন সঙ্গে সঙ্গে বলল, ‘তুমিও তো ভাই। বুড়ো হয়ে গেছ একদম!’

প্রবীর এবার শব্দ কর হাসল, ‘যা ভেবেছিলাম! ঠিক একইরকম ঝগড়ুটে রয়ে গেল!’

কাঁকন আর কথা বাড়াল না, ‘নাহ যাই, গিফটটা দিতে হবে!’ ও এগোতে উদ্যত হল।

কাঁকন হাঁটতে শুরু করতেই প্রবীর খপ করে হাতটা ধরল, ‘কোথায় যাচ্ছ? খবরদার যেয়ো না! সুপ্রিয়দা তোমাকে এখন পাগলের মতো খুঁজছে, দেখতে পেলেই বউয়ের বাড়ির কাছে চালান করে দেবে। হুলুস্থুলু বেঁধে গেছে একদম, সবাই খুঁজছে তোমায়।’

কাঁকন ভ্রু কুঁচকে প্রবীরের দিকে তাকালো, সত্যি বলছে না মিথ্যে, কিছুই বোঝার উপায় নেই।

প্রবীর ওকে চুপ করে যেতে দেখে বলল, ‘তার চয়ে চলো একটু বাইরে ঘুরে আসি। সামনের ওই কফিশপটায় যাবে?’

লেক পেরিয়ে রাস্তার ওপাশে একটা কফিশপ।

কাঁকন আবার চিরকালই একটু হিসেবি, বিনে পয়সায় এখানে এত খাবার থাকতে বেকার পয়সা খরচা করে এখন কফি খেতে যাবে? ও না বলতে যাচ্ছিল, কিন্তু খিদেও পেয়েছে বেজায়, এদিকে এখন খাওয়ার জায়গায় যেতে ঠিক ভরসা হচ্ছে না। বাধ্য হয়েই ও ঘাড় হেলাল।

ওরা অনেক বছর বাদে পাশাপাশি হেঁটে রাস্তা পেরোচ্ছিল।

দুজনে কফিশপটায় এসে একটা ছোট্ট টেবিলের দুদিকে মুখোমুখি বসল।

প্রবীর দু-কাপ কফির অর্ডার দিয়ে ওর দিকে তাকাল, ‘তারপর? কি খবর ম্যাডামের?’

কাঁকন বলল, ‘ভালো।’ তারপর একটু আমতা আমতা করে বলল, ‘বাই দ্য ওয়ে, তুমি এখানে কিভাবে ইনভাইটেড হলে?’

প্রবীর মিটিমিটি হাসল, ‘তুমি যেভাবে ইনভাইটেড হয়েছ সেভাবেই।’

‘বুঝলাম না।’ কাঁকন অবাক।

প্রবীর একটা সিগারেট ধরাল, ফস করে খানিকটা ধোঁয়া ছেড়ে বলল, ‘সুপ্রিয়দা’-কে ভুলে গেলে নাকি? আমার ল-ইয়ার ছিল তো!’

কাঁকন হাঁ হয়ে গেল। মানে!

ওকে অবাক হয়ে যেতে দেখে প্রবীর সিগারেটের খানিকটা ছাই টোকা দিয়ে ফেলে হাসল, ‘কি হল, বিশাল অবাক হয়ে গেছ মনে হচ্ছে! কেন তুমি জানো না নাকি? মালদুটো আমাদের ডিভোর্স করিয়ে দিল, আর সেখান থেকে নিজেরাই লটকে গেল।’

কাঁকনের বিস্ময়ের ঘোর তখনো কাটছিল না, সেইজন্য বরটাকে চেনা চেনা লাগছিল, ‘মানে আমাদের কেস চলার সময় ওদের অ্যাফেয়ার শুরু হয়েছিল?’

প্রবীর বলল, ‘ইয়েস! তুমি তো ডিসাইড করে নিয়েছিলে কিছুতেই আর আমার সঙ্গে থাকবে না, কারণটা যে কি, আজও বুঝলাম না। কাউকে বিয়েও তো করলে না! মাঝখান থেকে এরা দুজনে ফিটিং হয়ে গেল।’

কাঁকন কিচ্ছু বলতে পারল না। প্রবীরের কথাটা যে খুব ভুল তা নয়। ওদের সংসারে কোনো বড় গণ্ডগোল ছিল না। কিন্তু কাঁকনের হঠাৎ করেই যেন দমবন্ধ লাগতে শুরু করেছিল। প্রবীর প্রায়ই ট্যুরে বেরিয়ে যেত, কাঁকনেরও অফিসে দায়িত্ব বাড়তে শুরু করেছিল, দুজনের দুজনের সাথে সময় কাটানোটা এতটাই কমতে শুরু করেছিল যে যেটুকু সময় কাটাত, সেইটুকুতে বাসা বাঁধতে শুরু করেছিল পারস্পরিক অবিশ্বাস, খোঁচা আর শ্লেষ। প্রবীর কিছু বললে কাঁকন সহজভাবে নিতে পারত না, কাঁকন কিছু বললে প্রবীর উল্টোভাবে ধরত।

কাঁকন চিরকালই অধৈর্য, দুম করে একদিন ঠিক করে নিয়েছিল, এইভাবে জন্তুর মতো পাশাপাশি থাকার চেয়ে মানুষের মতো আলাদা থাকা অনেক সন্মানের, অনেক শান্তির!

এখন এই কয়েক বছরের একাকী জীবনে মাঝে মাঝে অবশ্য ও ভাবে, সত্যিই কি ওর ডিসিশনটা ঠিক ছিল? প্রবীর তো ডিভোর্স চায়নি, চেয়েছিল সব মিটিয়ে নিতে। কিন্তু কাঁকনই ওই বাঁধন থেকে বেরিয়ে আসতে পাগল হয়ে উঠেছিল।

ও কি ঠিক করেছিল? নাকি তখন ওদের উচিত ছিল দুজন দুজনকে আর সময় দেওয়া!

ওর হঠাৎ করে নবনীতাদির ওপর অসম্ভব রাগ হচ্ছিল। কই ওকে তো এতদিন একবারও বলেন যে নবনীতাদি ওদেরই কেসের রাইভ্যালকে বিয়ে করতে চলেছে?

রাগে ওর মুখ লাল হয়ে গেল, ‘তুমি জানতে এই ব্যাপারটা?’

প্রবীর আরো একটা লম্বা ধোঁয়া ছাড়ল, ‘অফ কোর্স! ওইজন্যই তো দিল্লি থেকে এসেছি। তোমার সঙ্গে যে ওই ঝগরুটে মহিলার খুব দোস্তি সেটা তো আগেই জানতাম!’ একটু থেমে ও কাঁকনের দিকে গাঢ় চোখে তাকাল, ‘তুমি কি ভেবেছ আমি এই বিয়েবাড়ি অ্যাটেন্ড করতে এসেছি? ধুস! আমি তো এসেছি তোমাকে দেখতে!’

কাঁকন আড়ষ্টভাবে চোখ নামিয়ে নিল প্রবীরের দিক থেকে, একটু থেমে গিয়ে বলল, ‘এ-এটা কিন্তু সম্পূর্ণ বেয়াইনি! দাঁড়াও না, আমি কোর্টে মামলা করবো।’

প্রবীর থতমত খেয়ে গেল, ‘মামলা? কিসের মামলা? কার এগেনস্টে মামলা?’

কাঁকন তেড়ে উঠল, ‘ওই দুজনের এগেনস্টে। আমাদের কেসে ওরা দুজন দুজনের অপোনেন্ট ছিল, তারপরেও তেলে জলে এক হল কি করে? তার মানে এটাই দাঁড়াচ্ছে যে তারা আদৌ নিজেদের কাজে লয়্যাল ছিল না। মাঝখান থেকে আমরা কিনা বলির পাঁঠা হয়ে গেলাম।’

প্রবীর এবার হো হো করে হেসে উঠল, ‘আমরা বলির পাঁঠা হলাম? এসব কি বলছ কাঁকন? আমি পাঁচ মাস অবধি তোমায় ঝুলিয়ে রেখেছিলাম কারণ আমি চেয়েছিলাম যাতে শেষ অবধি ডিভোর্সটা না হয়। কিন্তু তোমার আর তোমার ওই উকিল বুড়িটার জেদে আমাদে শেষে সই করতে হল।’

কাঁকন চুপ করে গেল। তখন সত্যিই কাঁকন একটু বেশিই হয়তো গোঁ ধরে বসেছিল।

এখন এতদিন বাদে মনে হয় সেগুলোর সত্যিই কি কোনো দরকার ছিল? এই যে এতদিন ধরে ও একা একা রয়েছে, নিজের মতো জীবন কাটাচ্ছে, কেউ কিছু বলার নেই, কেউ ঘর নোংরা করার নেই, ভিজে তোয়ালেটা খাটের উপর রাখার কেউ নেই, খুব সুখে আছে কি?

মাঝে মাঝে তো ভীষণ একা লাগে, তখন প্রবীরের আদর করে খাওয়ানো, ভালোবেসে কথাগুলো কি ঝোড়ো হাওয়ার মতো মনে পড়ে না?

কাঁকন বলল, ‘তুমি ফেসবুকে নেই?’

প্রবীর এবার হাসল, ‘আছি তো! তবে ছদ্মনামে। লুকিয়ে ফলো করি তোমায়। আগের মাসেই কেমন একা একা অরুণাচল ঘুরে এলে! আমার সেগুলো দেখে আমাদের হানিমুনের কথা মনে পড়ে গেল। সেই খাজিয়ারের ভ্যালি! সেই ডালহৌসির রাত! আচ্ছা…’ ও হঠাৎ ঝুঁকে এল সামনের দিকে, ‘তুমি কি আমাকে একটুও মিস করো না?’

সেদিনের পর প্রায় তিন মাস কেটে গেছে। কাঁকন আজ খুব ব্যস্ত। ছুটির দিন ঠিকই, কিন্তু আজ ও নবনীতাদি আর সুপ্রিয়দা-কে খেতে বলেছে ওর বাড়িতে।

সেদিন ওই ডামাডোলে আর বিয়েবাড়িতেই ফেরেনি ও, সোজা চলে এসেছিল বাড়ি। নবনীতাদিকে পরে বলেছিল গায়ে আইসক্রিম পড়ে গিয়েছিল বলে চলে আসতে হয়েছে।

নবনীতাদি আর সুপ্রিয়দা এল প্রায় বেলা সাড়ে দশটা নাগাদ। কাঁকন প্রথমে একটু ঠান্ডা শরবত করে দিয়েছিল, সেটা খেয়ে একটু জিরোতেই নবনীতাদি বলল, ‘উফ! কি গরম পড়েছে বলো কাঁকন! তোমার জামাইবাবু তো আলিস্যি করে বেরতেই চাইছিল না, আমিই জোর করে…!’

নবনীতাদির কথা শেষ হতে না হতেই ভেতরের ঘর থেকে ফালি করে কাটা আমের প্লেট নিয়ে কাঁকনের রাত দিনের কাজের লোক সবিতা ঢুকল, পেছন পেছন যে ঢুকল তাকে দেখে সুপ্রিয়দা ভূত দেখার মতো চমকে উঠল, ‘একি প্রবীর, তুমি এখনো!’

নবনীতাদিও বেজায় চমকেছে। বিস্ফারিত চোখে কাঁকনের দিকে তাকাল, ‘প্রবীর এখানে…!’

কাঁকন মিষ্টি হেসে নবনীতাদির হাত থেকে ফাঁকা শরবতের গ্লাসটা নিল, ‘ওই জন্যই তো তোমাদের আরো ডাকলাম গো। আমাদের বিয়ে ভাঙতে গিয়ে তোমরা নিজেরাই এক হয়ে গিয়েছিলে আমি তো জানতামই না!’

‘না মানে!’ নবনীতাদি একটু তোতলাচ্ছিল, ‘তুমি শুনলে আসলে কি ভাববে তাই…!’

কাঁকন বলল, ‘বিবেকের দিক দিয়ে কোনো খারাপ লাগা এল না? মনে হল না যে যে অন্য দুজনের সংসার ভাঙ্গার জন্য সালিশি করলাম, আবার নিজেরাই জুড়ে গেলাম?’

নবনীতাদি প্রচণ্ড অপ্রস্তুত হয়ে পড়ল, ‘তুমি প্লিজ এভাবে নিও না কাঁকন, আমারও ভীষণ খারাপ লাগছিল। প্লিজ ভুল বুঝো না আমাদের…!’

কাঁকন গম্ভীরভাবে বলল, ‘তোমাদের আমরা ক্ষমা করতে পারব? কি মনে হয়?’

আনন্দের পরিবেশ মুহূর্তে থমথমে।

নবনীতাদি চুপ।

সুপ্রিয়দা একটু গলাখাঁকারি দিয়ে বলতে গেল, ‘না কাঁকন, তুমি ওভাবে নিও না, ওটা তো আমাদের প্রোফেশান ছিল, তারপর তোমাদের সাথে…!’

নবনীতাদি বলল, ‘কাঁকন আমাদের প্লিজ ক্ষমা করে দাও, মনে কোনো রাগ পুষে রেখো না, তখন তো তুমিও খুব একগুঁয়ে হয়ে বসেছিলে বলো। আমি এইজন্যই তোমাকে কিছু বলতে পারিনি…!’

কাঁকন উত্তেজিতভাবে বলল, ‘তখন তো আসলে বুঝিইনি, যে সব মানুষেরই ভালমন্দ আছে নবনীতাদি! নিজের ইগো আর দম্ভের বশে বুঝিইনি যে দৈনন্দিন রাগটাও একরকমের ভালোবাসা। এখন বুঝি, ভালো আর মন্দ দুটোকে মেনে নিয়ে একসাথে থাকাটাই ভালোবাসা। একাএকা থাকার মধ্যে কোনো ক্রেডিট নেই, কিন্তু দুটো মানুষ ঝগড়া করুক, ঝাঁটি করুক, সুখে দুঃখে একে অন্যের পাশে থাকাটাই আসল, তাতেই আসল আনন্দ!’ কথাটা শেষ করে ও একটু থামল।

নবনীতাদি আর সুপ্রিয়দা হাঁ করে তাকিয়ে আছে ওদের দিকে।

কাঁকন এবার গম্ভীরমুখে বলল, ‘ক্ষমা করতে পারি, একটা শর্তে।’

সুপ্রিয়দা বলল, ‘শ-শর্ত! কি শর্ত?’

কাঁকন এবার হেসে ফেলল, ‘ডিভোর্স হয়ে যাওয়ার পর যদি স্বামী-স্ত্রী আবার বিয়ে করতে চায় সে ব্যাপারে তোমাদের আইনি নিয়মকানুন কি আছে বলে ফ্যালো জলদি!’

নবনীতাদি চোখ গোলগোল করে ওদের দুজনের দিকে তাকিয়ে নিল, অকৃত্রিম আনন্দের গলায় বলল, ‘মানে! আমার তো বিশ্বাসই হচেচ্ছ না যে…!’

কাঁকন মুচকি হাসল, ‘দুই উকিল মিলে আমাদের বিয়ে ভেঙেছিল, এবার দুজনকেই জুড়তে হবে কিন্তু!’ কথাটা বলেই ও পাশে দাঁড়িয়ে থাকা প্রবীরের হাতটা জড়িয়ে ধরল।

যত ঝড়ঝাপটাই আসুক, এই হাত ও আর কোনোদিনও ছাড়বে না!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *