সুকন্যার সুমতি

সুকন্যার সুমতি

সোদপুর স্টেশন যখন ঢুকছে ট্রেন, তখন ট্রেনের দুলকি চালের সঙ্গে সুকন্যার বুকেও দুম দুম শব্দ হচ্ছে। এত জোরে যে, ও চমকে পাশে বসে থাকা মোটা মহিলার দিকে বারে বারে তাকিয়ে ফেলছে যে সেই শব্দটা অন্যদের কানেও যাচ্ছে কিনা। শরীরের মধ্যে কোথাও কোনো উথাল-পাথাল হওয়ার এই একটা মজা, বাইরের কেউ কষ্ট, আবেগ, উত্তেজনা কিছুই বুঝতে পারে না অথচ নিজের ভেতরটা যেন বাঁধভাঙা নদীর মতো দামাল হয়ে তীরে ভেঙে পড়তে চায়।

ট্রেনের সাইরেন শুনেই চমকে তাকাল ও, হালকা একটা ঝাঁকুনি দিয়ে সোদপুর স্টেশন ছেড়ে দিল ট্রেন! মুহূর্তের জন্য ও কেমন হতবুদ্ধি হয়ে গেল, চোখের কোণে জল চলে এল হঠাৎ করে। ওর আড়াই বছর ধরে গড়ে তোলা তিল তিল করে সাজানো সংসার, ওদের দুজনের জয়েন্ট ইএমআই দিয়ে একটু একটু করে লাউডগার মতো বেড়ে ওঠা দু-কামরার ফ্ল্যাট, ওর ছোট্ট এক চিলতে টেরেসটার পেটোনিয়া গাছটায় আসা নতুন কুঁড়ি, সব কিছু ছেড়ে ও চলে যাচ্ছে চিরকালের মতো, এই প্রথম বার আর এই শেষ বারও। বুকের ভেতরটা যেন দুটো পারস্পরিক বৈপরীত্য ছিঁড়ে খানখান হয়ে যাচ্ছে। একবার মনে হল, এক ছুটে গিয়ে স্টেশনে লাফিয়ে পড়ে, যা হওয়ার হবে। পরক্ষণেই ওর মনের আরেকটা অংশ বাধা দিল, দুম করে মনে পড়ে গেল দুপুর সৈকতের ফোনে বলা কথাগুলো, ‘ন-টা বছর ধরে তো আমার লাইফটা হেল করে দিয়েছ তুমি! আট বছর ধরে প্রেম করে বিয়ে করেও এত সন্দেহ তোমার? বিয়ে করেছিলাম সুখে থাকব বলে, কি ভেবেছিলাম আর কি হল! শুধু তোমার সঙ্গে থাকব বলে নেভির অত ভাল চাকরিটায় জয়েন করলাম না, সকাল সাড়ে ছ-টায় বেরিয়ে তিন ঘণ্টা ধরে ঝুলতে ঝুলতে অফিস যাই, রাত সাড়ে দশটায় ধুঁকতে ধুঁকতে বাড়ি ফিরি শুধু তোমার সঙ্গে থাকব বলে, আর তুমি! আসলে তোমার জীবনে কোনো কিছু প্রব্লেম নেই তো, তাই তুমি নিজে নিজে কাল্পনিক প্রব্লেম ক্রিয়েট করে অন্যকে কষ্ট দিয়ে এক ধরনের স্যাডিস্টিক প্লেজার পাও। তোমার জন্য আসলে অ্যাপ্রোপ্রিয়েট জায়গা হল রাঁচির মেন্টাল অ্যাসাইলাম বুঝলে!’

মনে পড়ে গেল তার ঠিক কুড়ি মিনিট বাদে বলা মায়ের কথাগুলো, ‘অনেক ভাগ্য করে এমন বর পেয়েছিলি, রাখতে পারলি না! ভাল ছেলেটাকে নষ্ট করে দিলি তুই! আমরা যদি এরকম বর পেতাম, মাথায় করে রাখতাম। হু! ছুটির দিনে তো দেখি, স্নান করে বেরোচ্ছিস, তোয়ালে দিয়ে মাথা মুছিয়ে দিচ্ছে, টেবিলে ভাত বেড়ে খাইয়ে দিচ্ছে, সারাক্ষণ পুচু পুচু করে পাগল হয়ে যাচ্ছে। আর তুই? সারাক্ষণ খিঁচিয়ে যাস ছেলেটাকে। তোর বাবা যদি এর এক কণাও কোনোদিনও আমাকে করত, আমি আনন্দে কি করব ভেবে পেতাম না। মাঝখান থেকে আমাদের আর মুখ দ্যাখানোর জায়গা নেই ছেলেটার কাছে!’

চোখের পাতাগুলো এতক্ষণ অনেক কন্ট্রোল করে জলটাকে আটকে রেখেছিল, আর পারল না। বড় বড় দুটো জলের ফোঁটা টপটপ করে ঝরে পড়ল। সামনের সিটে বসা বাচ্চা মেয়েটা অবাক হয়ে সুকন্যার ভ্রূ দিয়ে একটা মজার ভঙ্গি করল বাচ্চাটার দিকে তাকিয়ে। একটু ঝুঁকে মেয়েটার চুলটা আলতো করে ঘেঁটে দিতে যাবে, এমন সময় ফোনটা বেজে উঠল। এই যাহ! তাড়াহুড়োয় ফোনটা তো সুইচড অফ করা হয়নি, এক্ষুণি রাশি রাশি ফোন ঢুকবে স্ক্রিনে বাবার মুখ ভেসে উঠছে বারে বারে। সুকন্যা কবজি উল্টিয়ে ঘড়ি দেখল। হুম, ঠিকই আছে। সাড়ে ছ- টা বাজে। এ সময়েই ও রোজ অফিস থেকে বেরোয়, আর বাবা রুটিন মাফিক একটা করে ফোন করে জিজ্ঞাসা করে ও বেরিয়েছে কিনা।

ফোনটা ঘচাং করে কেটে সুইচড অফ করতে করতে ওর মুখে একটা নিষ্ঠুর হাসি ভেসে উঠল।

হু হু বাবা, এখন আবার মেয়েকে ফোন কেন? তোমাদের মেয়ে তো ভীষণ বাজে, খালি নাকি খেঁচায়। আর জামাই এত ভালো, তাকে নিয়েই থাকো না বাপু!

ফোনটা বন্ধ করেই মনে পড়ল, যাহ ভুল হয়ে গেল। সুইচড অফ থাকার সময় কেউ ফোন করলে পরে যে নোটিফিকেশন অ্যালার্টটা আসে, সেইটা অন করে রাখা হল না তো। সৈকত ফোন করেছে কিনা সেটা বুঝতেও পারবে না তো সুকন্যা।

তড়িঘড়ি অন করে সেইটা অ্যাক্টিভেট করল ও। অবশ্য ও তো আর ঘণ্টা দুই-আড়াইয়ের বেশি পৃথিবীতেই থাকবে না, কে ফোন করল, না করল, তাতে ওর কি আর এল গেল! জলে ভরে আসা চোখটা আলগোছে সামনের বাচ্চাটার অলক্ষ্যে মুছে নিল ও । মরে যাওয়ার কথা ভাবলে ও মরে যাওয়ার পর সবার কি রিঅ্যাকশন হবে, সেটা ভাবলেই চোখে জল আসে বেশি। নিজের অজান্তেই মনের মধ্যে ভিডিও ক্যাসেট চালু হয়ে যায়, প্রথম যখন খবরটা পাবে, সৈকতের কি রিঅ্যাকশন হবে, বাবা কি করবে, মা কি করবে, এসব ভাবতে ভাবতেই মনটা নরম হয়ে যায় ওর।

মিনিট তিনেকের মধ্যে অবশ্য পৃথিবী ছেড়ে চলে যাওয়ার প্ল্যানটা রিজেক্ট করে দিলো সুকন্যা। নাহ, মরে গিয়ে আপাতত তেমন কোনো লাভ ওর নেই। ওর অবজেক্টিভ হচ্ছে, ও যে কত ভালো, সেইটা সবাইকে ফিল করানো, এই যে বাবা-মা সৈকত ওকে আজেবাজে বলল, তাদের মনের মধ্যে প্রচণ্ড অনুতাপ জাগিয়ে তোলাই ওর টার্গেট। সেখানে মরে টরে গেলে ওরা যতই রিগ্রেট করুক, সুকন্যা তো আর কিছুতেই ফেরত আসতে পারবে না! ওর ম্যানেজারের কথায় ক্রিটিকাল সাকসেস কি-টাই ফেল করে যাবে, সেক্ষেত্রে পুরো বাজেটটাই নষ্ট!

নিজের মনেই মাথা নাড়ল সুকন্যা। নাহ, এমন একটা কিছু করতে হবে, যাতে ওরা টেনশনে টেনশনে পাগল হয়ে যায়। হু! খুব বাজে মেয়ে সুকন্যা, না! কি করেছে ও? না কাউকে মেরেছে, না কাউকে বাজে কিছু বলেছে, দোষের মধ্যে সৈকতের হোয়াটঅ্যাপ, ফেসবুক এগুলো একটু চোখে চোখে রাখত। তা অমন হ্যান্ডসাম বর হলে সব মেয়েরই একটু ইনসিকিওরড ফিল করা স্বাভাবিক বাপু!

মনের একটা দিক অমনি ওকে ক্রস কোয়েশ্চেন করে, ‘অ্যাই, ঢপ মারছিস কেন? তুই তো সেই প্রথম থেকেই সৈকতের সব কিছুর পাসওয়ার্ড নিয়ে রেখেছিস, বাজপাখির মতো নজরে রাখিস সব কিছু, কই সৈকত তো কোনোদিনও কিচ্ছু বলেনি? তাই বলে তুই ফেক প্রোফাইল খুলে ওর সঙ্গে চ্যাট করা শুরু করবি? তাও আবার ওরই এক কলিগের নামে? এ তো সাইবার ক্রাইম! তোকে জেলে পোরা উচিত!’

সুকন্যা কাঁচুমাচু হয়ে যাচ্ছিল, হঠাৎ ওর মনের অন্য রণরঙ্গিনী দিকটা দাবিয়ে দিল, ‘থাম! স্বামীর ওপর নজরদারিতে এভরিথিং ইস ফেয়ার। নিজের স্বামীকে চোখে চোখে রাখাটা প্রত্যেক মেয়ের জন্মগত অধিকার, সামঝি তু?’

সুকন্যা হঠাৎ মনে পড়ে যেতে বেশ সোৎসাহে ফোনটা অন করল, এতক্ষণে নিশ্চয়ই সৈকত গোটা পঞ্চাশ বার ট্রাই করে ফেলেছে ওর ফোনে। কিন্তু কোনো নোটিফিকেশন ঢুকল না।

ওর মনটা কেমন উদাস হয়ে গেল। হ্যাঁ, ও স্বীকার করছে যে এইবারটা ও একটু বেশিই বাড়াবাড়ি করে ফেলেছে, কিন্তু তাই বলে সৈকত ওকে এত খারাপ খারাপ কথা বলবে? এত সাহস?

ঘটনাটার সূত্রপাত প্রায় মাসতিনেক আগে হলেও বাড়াবাড়িটা শুরু হয়েছে এক মাস মতো হল। সৈকত এমনিতে সোশ্যাল নেটওয়ার্ক খুব একটা পছন্দ করে না, অবসর সময়ে টুকটাক মুভি দেখা বা গান শুনতেই বেশি ভালোবেসে ও। সুকন্যা আবার ঠিক তার উল্টো, ফেসবুকে দারুণ অ্যাক্টিভ ও। সৈকতেরও ফেসবুক থেকে শুরু করে হোয়াটসঅ্যাপ সব ও-ই হ্যান্ডল করে। ছবি দেওয়া থেকে শুরু করে, পছন্দমতো স্ট্যাটাস আপডেট সব কিছুই সুকন্যা করে দেয়। তার সাথে শ্যেন দৃষ্টি রাখে সৈকতের সব কিছুতে যেন সুকন্যার সাথে জয়েন্ট ছবি থাকে, কেউ এক সেকেন্ডের জন্যেও সৈকতের প্রোফাইল ভিজিট করলে যেন সুকন্যার মুখ দেখে ওর সুন্দর বরটার দিকে হাত না বাড়ায়, এটাই আসলে ওর লক্ষ্য।

তাতে সৈকতের কোনো সমস্যা ছিল না। ইন ফ্যাক্ট, ও এসব নিয়ে মাথাও ঘামাত না। কিন্তু গোলটা বাধল সৈকতের অফিসের পিকনিকে গিয়ে। এমনিতে সুকন্যা সৈকতের অফিসের সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব করে রেখেছে, কোথা থেকে কি খবর পাওয়া যায়। সৈকতের ওই তাদের যোগাযোগ রাখে বেশি।

কিন্তু এইবার পিকনিকে গিয়ে শুনল, সবাই এসেছে কিন্তু অদ্বিতীয়া নাকি আসেনি। কে এই অদ্বিতীয়া? খুব রিসেন্টলি, মেয়েটা নাকি সৈকতের আন্ডারে জয়েন করেছে, সে নাকি ফেসবুক থেকে শুরু করে হোয়াটসঅ্যাপ কিছুই করে না, খুব দেমাক, কারুর সঙ্গে কথা বলে না। সৈকতের আরেকটা কলিগ সুদর্শনা সুকন্যার খুব ভালো বন্ধু, তার কাছ থেকে মেয়েটার ছবি অনেকক্ষণ ধরে দেখে টেখে ও নিজের মনেই স্বীকার করতে বাধ্য হল যে, ওই অদ্বিতীয়া বলে মেয়েটা যাকে বলে ডানাকাটা পরী। যেমন মুখশ্রী, তেমনই ফিগার।

বাড়ি ফিরে কিছুক্ষণ গুম হয়ে রইল সুকন্যা। সৈকত এসে দু-একবার খোঁচাতে ও একবার গম্ভীরভাবে জিগ্যেস করল, ‘এই অদ্বিতীয়া বলে যে মেয়েটা নতুন তোমার টিমে জয়েন করেছে, কই আমায় বলোনি তো?”

সৈকত একটু থমকে গিয়ে বলেছিল, ‘হঠাৎ? ও হ্যাঁ, তোমায় বলতে ভুলে গেছি। নতুন ঢুকেছে। ও তো আজ যায়নি, শরীর খারাপ না কি বলল।’

সুকন্যা চোখ ঘুরিয়ে তাকিয়েছিল।

পরের দিন থেকে অফিসে কাজের ফাঁকে ফাঁকে সুকন্যা আদাজল খেয়ে তদন্ত চালিয়েছিল, যে কোথাও যদি মেয়েটার কোনো ট্রেস, সঙ্গে সঙ্গে সৈকতের প্রোফাইল থেকে ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠিয়ে দেখিয়ে দেবে যে সৈকত বিবাহিত জীবনে কত সুখী।

কিন্তু আদপে কিছুই করা গেল না। মেয়েটা ভার্চুয়াল দুনিয়ায় সম্পূর্ণভাবে অনুপস্থিত, এমন যে আজকের দিকে কেউ হতে পারে ভাবাই যায় না। পরের তিন দিন ধরে কথাচ্ছলে সুকন্যা সৈকতের থেকে আরো কিছু ডিটেইলস বের করল, মেয়েটার কলেজ বাড়ি ইত্যাদি ইত্যাদি। বলা যায় না, যদি অন্য কোনো নামে থেকে থাকে। নাহ! তাতেও পাওয়া গেল না।

মনের মধ্যে খচখচানি নিয়ে সুকন্যা ইনভেস্টিগেশন চালিয়ে যাচ্ছিল, যদি কিছু পাওয়া যায়। মাসখানেক আগে খেতে বসে সুকন্যা খুব নিরীহ মুখে প্রশ্ন করল ‘তোমার ওই অদ্বিতীয়ার কি খবর? কেমন কাজ টাজ শিখছে?’

সৈকত ‘তোমার’ কথাটার প্রচ্ছন্ন খোঁচাটা ধরতে পারল না, কিংবা ধরেও অগ্রাহ্য করে গেল, ‘ভালোই। মেয়েটার ফান্ডা টা বেশ স্ট্রং। চট করে ক্যাচ করে নিতে পারে।’

সুকন্যা মনে মনে আরো জ্বলে উঠল। এই অদ্বিতীয়া পাবলিকটা কি ক্যাচ করতে চাইছে কে জানে! ইদানীং ফোন টোন আসা শুরু হয়েছে তার। টুকটাক কথা বলে সৈকত, আবার রেখে দেয়। মাঝে মাঝে ফোনটা নিয়ে ব্যালকনিতেও চলে যায়।

অদ্বিতীয়ার ফোন এলেই সৈকত ওর সামনে কিরকম আড়ষ্ট হয়ে যায়, খেয়াল করেছে ও। কানটা এত খাড়া করে শোনে সুকন্যা, মাঝেমধ্যে মনে হয় এরকম করে শুনতে চাইলে সুপারসনিক আওয়াজও বুঝি শুনতে পাবে, তবু ও তরফের কথা কানে যায় না। নম্বরটাও ফাঁকতালে নিয়ে রেখেছে সুকন্যা। কিন্তু হতচ্ছাড়ি হোয়াটসঅ্যাপেও নেই!

কৌতূহলে চিন্তায় রাতের ঘুম প্রায় উড়তেই বসেছিল সুকন্যার, এমন সময় মুশকিল আসান হয়ে বাজারে হাজির হল জিও সিম। সে এক মহামারির দশ। বেয়াল্লিশের দাঙ্গার সময় মানুষজন এমন একমুঠো ভাতের জন্য ঘণ্টার পর ঘণ্টা হা-পিত্যেশ করে পড়ে থাকত লঙ্গরখানার সামনে, মোবাইলের দোকানগুলোর সামনে ঠিক সেইরকম ভিড় শুরু হল। ইন্টারনেট এত সহজলভ্য কখনো হয়নি এর আগে। তবে সৈকতকে নিয়ে চাপ নেই সুকন্যার, ব্যাটার ফোনে একটাই সিম ঢোকে, কায়দা করে ওই মডেলটা অনেক খুঁজে খুঁজে গিফট করেছিল সুকন্যা জন্মদিনে। হু হু, ওর বৌয়ের নাম সুকন্যা বস, ডুয়াল সিম থেকে ডুয়াল বৌ রাখা, ওসব চলবে না! অফিস ফেরতা দু-তিন দিন লাইন দিয়ে সুকন্যা নিজের জন্য একটা জিও সিম বাগিয়ে ফেলল।

কিন্তু দরকার একটা হ্যান্ডসেটের। সেটার জোগাড়ও করে ফেলল সুকন্যা একদিন নিজের বাড়িতে গিয়ে। মা-কে আগের বছর পুজোয় একটা স্মার্ট ফোন দিয়েছিল, মা ইউজ করতে পারে না বলেই পড়েই ছিল সেই থেকে। ‘আমার ফোনটা একটু ডিস্টার্ব করছে মা, ক-দিনের জন্য এটা একটু নিয়ে যাচ্ছি।’ বলে ফোনটা বগলদাবা করে নিয়ে চলে এল সুকন্যা। তারপর হোয়াটসঅ্যাপ ইন্সটল আর ফেসবুক থেকে সুদর্শনার একটা গ্রুপ ফোটো থেকে মেয়েটার ছবি ক্রপ করে সেট করা তো কয়েক মুহূর্তের খেল।

প্রথম পিংটা সুকন্যা করল আজ সকালে। এই সময়টা সৈকত অফিস যায়। বাসে বসে থাকে বেশ রিল্যাক্সড হয়ে। প্রথমে ও পাকা খেলোয়াড়ের মতো পুরো প্ল্যানটা সাজিয়ে নিল, কি বলবে না বলবে। একটুখানি অসতর্ক হলেই ধরা পড়ে যাবে ও। মেয়েটার সাথে সৈকত ফোনে আর যাই নিয়ে বকুক, সেটা অফিস রিলেটেড নয়, তাই সুকন্যা সেটা জানবেই। টুক করে ও পিং করল,

‘হাই সৈকতদা! বেশ পাঁচ মিনিট কোনো রিপ্লাই নেই, ক্যাবলাটা খুলছেই না হোয়াটসঅ্যাপ। বাধ্য হয়ে নিজের ফোন থেকে একটা ফটো পাঠিয়ে সুকন্যা ফোন করল সৈকতকে, আদুরে গলায়, ‘অ্যাই হোয়াটসঅ্যাপে একটা ছবি পাঠালাম, দেখো তো কেমন লাগছে?’

তারও প্রায় মিনিটখানেক পর নীল টিক দেখাল ওই নম্বরে, আর সৈকতের পিং ভেসে এল,

—অদ্বিতীয়া! তুমি হোয়াটসঅ্যাপে? সঙ্গে একটা অবাক হওয়ার স্মাইলি।

সুকন্যার বুকের ভেতরটা ধড়াস করে উঠল, অন্য কলিগদের তো সৈকত তুই করেই ডাকে, একে ‘তুমি’ কেন? নিজেকে প্রাণপণ কন্ট্রোল করে ও লিখল,

—কেন, আমি হোয়াটসঅ্যাপ করতে পারি না? সঙ্গে ভেসে এল সৈকতের উত্তর,

—না, তা নয় তুমি তো এসব করো না বলেছিলে!

সুকন্যার চোখে জল এসে গেল হঠাৎ করে। শালা, বৌ ছবি পাঠাল, কোনো উত্তর না দিয়ে অন্য মেয়ের সাথে চ্যাট করছে। রাগে দুঃখে সুকন্যা আরো একটু সাহসী হল,

—তোমার সঙ্গে কথা বলার জন্যই এলাম। অফিসের আর কাউকে বোলো না কিন্তু আমার এই নম্বরটা! অন্যরা বিরক্ত করুক আমি চাই না।

এই কথাটা লেখার পর সুকন্যা একটু ভয়ে ভয়ে তাকিয়ে রইল, সৈকত কিছু সন্দেহ করবে না তো? ওকে ভুল প্রমাণিত করে সৈকত লিখল,

—তুমি নিশ্চিন্ত থাকো। কাউকে বলব না। বাড়ি ফিরে গেছ?

সুকন্যার চোখের জল থেমে গিয়ে বেপরোয়া ভাবটা চলে এল। ঝড়ের গতিতে ও টাইপ করা শুরু করল,

—হ্যাঁ এই ফিরলাম। তুমি আজ অফিসেও এই হোয়াটসঅ্যাপ নিয়ে কোনো কথা বলবে না। আমার সঙ্গেও না।

—কেন?

—আমি লজ্জা পাব।

এই কথাটা লেখার পর সৈকতকে ‘টাইপিং’ দেখিয়েই যেতে লাগল, এতক্ষণ ধরে, যে সুকন্যার অস্থির লাগতে শুরু করল। এদিকে ওরও ট্রেন থেকে নামার সময় হয়ে এসেছে প্রায়। একেই এই অফিস টাইমে ট্রেনে বীভৎস ভিড়, তার উপর আজ সোমবার। অনেক কষ্টে একহাতে ফোনের দিকে চোখ রেখে দরজার দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল ও। প্ল্যাটফর্ম এসে পড়েছে, সৈকতকে তখনো ‘টাইপিং’ দেখিয়েই যাচ্ছে। ও তড়িঘড়ি নামতে যাবে, হঠাৎ ভেসে এল সৈকতের বিশাল মেসেজ,

—তোমাকে বলেছি না অদ্বিতীয়া, একদম লজ্জা পাবে না। আমার কাছে কিসের লজ্জা তোমার? সারা পৃথিবীও যদি তোমার উলটোদিকে চলে যায়, জানবে এই সৈকত বলে বন্ধুটা তোমার পাশে থাকবে, সবসময়।

অফিস টাইমে প্ল্যাটফর্মে নেমে দরজার মুখে স্থবির হয়ে দাঁড়িয়ে পড়লে কি হাল হয় সেটা সমস্ত ডেলি প্যাসেঞ্জারই হাড়ে হাড়ে জানেন। সুকন্যার মাথাটা কেমন দুলে উঠল, হাত-পা কেমন ঠান্ডা হয়ে গিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল ও। পেছন থেকে ঠেলা, সামনে থেকে ঠেলার মাঝামাঝি কেমন স্যান্ডউইচ হয়ে থেমে গেলও।

মিনিট পাঁচেক পরে লোকজনের ঠেলাঠেলিতে বিধ্বস্ত অবস্থায় ও নিজের শরীরটা টেনে হিঁচড়ে নিয়ে গিয়ে প্ল্যাটফর্মের একটা বেঞ্চিতে ফেলল। সঙ্গে সঙ্গে হু হু করে ওর চোখে জল এসে গেল। উপরে ঘটাং ঘটাং ফ্যানের দিকে তাকিয়ে ও সুকন্যা কেমন ঘামতে লাগল।

‘আমার কাছে কিসের লজ্জা?’ সৈকত তার মানে ওই মেয়েটার সঙ্গে বিছানাতেও চলে গেছে? সুকন্যার মুখটা একবারও মনে পড়ল না ওর? সাত পাক ঘুরে অগ্নিসাক্ষী করে বিয়ে, শুভদৃষ্টি, তার আগে অতদিনের প্রেম, সব ভুলে গেল? সুকন্যা আর ভাবতে পারছিল না। এই ওর ভোলাভালা সৈকত? যাকে সুকন্যা একটা নিষ্পাপ শিশু ভাবত? এতবড় প্রতারণা!

দশ পনেরো মিনিট বাদে ঘাড়ে চোখে মুখে জল দিয়ে সুকন্যা উঠল। ও ওর অ্যাজেন্ডা ঠিক করে ফেলেছে। প্রথমে ও সৈকতকে খুন করবে, তারপর নিজেকেই শেষ করবে। সৈকতকে ছাড়া থাকতেও পারবে না, সেই মনের জোর ওর নেই, আর এতবড় বিশ্বাসঘাতকতার পর সৈকতকে ও বাঁচিয়ে রাখবে না।

নিজেকে ও প্রাণপণে সংবরণ করছিল। সৈকতকে কিছুতেই এখন কিচ্ছু টের পাওয়ানো যাবে না। শান্ত সমাধিস্থ হয়ে ফোন করল ও সৈকতকে, ‘পৌঁছে গেছ?’

সৈকতের শান্ত জবাব, ‘না, এই যাচ্ছি।’

সুকন্যা দাঁতে দাঁত চিপে বলল, ‘ও! কি করছ? ছবিটা দেখে কিছু রিপ্লাই করলে না?’ সৈকত বলল, ‘না, একটু ঘুমোচ্ছিলাম। কাল অনেক রাত অবধি খাটাখাটনি করেছি তো, তাই ঘুম পাচ্ছে।’

অন্য দিন হলে এই কথাটায় সুকন্যা খুশি হত, গলে পড়ত আদরে, আদর করার পরবর্তী দিনটায় ঠিক এরকমভাবেই মশকরা করে সৈকত, কিন্তু আজ সেই কথাটাই বুমেরাং হয়ে ফিরে এসে ওর মাথায় আগুন জ্বালিয়ে দিল। ওর ঠোঁট কাঁপতে লাগল, ‘তাই? তা কার সাথে খাটাখাটনি করেছ?’

সৈকত একটু অবাক হয়ে বলল, ‘কার সাথে মানে? আমার এই রসগোল্লাটা থাকতে কার সাথে আবার খাটাখাটনি করব আমি?’

সুকন্যা আর পারল না। একটু আগের ঠিক করা অ্যাজেন্ডা ধোঁয়া হয়ে উড়ে গেল আকাশে, ফেটে পড়ল ও তার স্বর চিৎকার করতে করতে, ‘তাই? তাহলে অদ্বিতীয়ার সঙ্গে কি করো তুমি? চরিত্রহীন লম্পট! লজ্জা করে না তোমার? তুমি এতবড় ঠকাতে পারলে আমায়? কি না করেছি আমি তোমার জন্য!’ বাছা বাছা শব্দ প্রয়োগ করে অশ্লীলতম ভাষায় বকে যেতে লাগল ও আশপাশকে ভ্রূক্ষেপ না করে। ভদ্র পোশাক পরা একজন মেয়ে এরকম ভাষায় কথা বলছে দেখে কেউ কেউ অবাক হয়ে চাইতে লাগল, কেউ বা টিটকিরি ছুড়ে দিল। ও পাত্তা দিল না। সারা সমাজ আজ ওকে টিটকিরি দিলেও ওর কিচ্ছু যায় আসে না। ও যাকে পৃথিবীতে সবচেয়ে বেশি ভালোবেসেছে, নিজের সবটুকু উজাড় করে দিয়েছে, সে আজ ওকে ঠকিয়েছে। মধ্যে মধ্যে সৈকতের কথাগুলো, অনুনয় বিনয়গুলো ওর কানে ঢুকছিল না। হিতাহিতজ্ঞানশূন্য হয়ে ও তুমি থেকে তুইতে নেমে শেষ কথাক-টা ছুড়ে দিল, ‘শালা লম্পট! তুই কি ভেবেছিস তোকে আমি ছেড়ে দেব? আমি এক্ষুণি তোর ওই বেশ্যাটাকে ফোন করছি। তোকে তো শেষ করবই, তার আগে ওটাকেও শেষ করব!’

ফোনটা কেটে দিয়ে নিজের ফোনে সেভ করে রাখা অদ্বিতীয়ার নম্বরটা ডায়াল করল ও। ওপাশ থেকে হ্যালো শুনেই ও আর অপেক্ষা করল না। নিজের পরিচয় দিয়েই কদর্যতম ভাষায় অপমান করে গেল ঝাড়া দশ মিনিট ধরে। মেয়েটার চরিত্র, বংশ কিচ্ছু ছাড়ল না।

নিজের ভেতরের খারাপ দিকটা সম্পূর্ণভাবে উন্মোচিত করে কথা ফুরিয়ে এলে ক্লান্তভাবে ফোনটা রাখল ও। এতক্ষণে একটু বেটার লাগছে। ফোনটা সুইচড অফ করে ও অফিসে ঢুকল।

কিন্তু যত বেলা বাড়তে লাগল, ওর প্রচণ্ড ভয় করতে শুরু করল। কোথায় যাবে ও? সৈকতকে ছাড়া কেমন করে বাঁচবে ও? প্রাথমিক রাগটা কেটে গিয়ে ওর মনে অল্টারনেট প্ল্যান উঁকি দিতে লাগল। আচ্ছা, সৈকত যদি ক্ষমা চায়, ও কি ক্ষমা করে দেবে? তারপর সুযোগ বুঝে খুন করবে?

বসের ঘর থেকে আর্দালি এসে জানাল, ‘ম্যাডাম, আপনার ফোন এসেছে স্যারের ঘরে।’

ও সব দ্বিধাদ্বন্দ্ব কাটিয়ে গিয়ে ফোনটা তুলল, সৈকতের অনুনয়-বিনয় শুনে ও কি বলবে মোটামুটি ছকেই এসেছে ও, কিন্তু ওকে অবাক করে ওপাশ থেকে সৈকতের চিৎকার ভেসে এল, ‘তুমি আমার এতবড়ো সর্বনাশ করতে পারলে? ‘ন-টা বছর ধরে তো আমার লাইফটা হেল করে দিয়েছ তুমি! আট বছর ধরে প্রেম করে বিয়ে করেও এত সন্দেহ তোমার? বিয়ে করেছিলাম সুখে থাকবো বলে, কি ভেবেছিলাম আর কি হল! শুধু তোমার সঙ্গে থাকব বলে নেভির অত ভালো চাকরিটায় জয়েন করলাম না, সকাল সাড়ে ছ-টায় বেরিয়ে তিন ঘণ্টা ধরে ঝুলতে ঝুলতে অফিস যাই, রাত সাড়ে দশটায় ধুঁকতে ধুঁকতে বাড়ি ফিরি শুধু তোমার সঙ্গে থাকব বলে, আর তুমি! আসলে তোমার জীবনে কোনো কিছু প্রব্লেম নেই তো, তাই তুমি নিজে নিজে কাল্পনিক প্রব্লেম ক্রিয়েট করে অন্যকে কষ্ট দিয়ে এক ধরনের স্যাডিস্টিক প্লেজার পাও। তোমার জন্য আসলে অ্যাপ্রোপ্রিয়েট জায়গা হল রাঁচির মেন্টাল অ্যাসাইলাম! তোমাকে আমি সামনে পেলে খুন করে ফেলব।’

সুকন্যা স্তম্ভিত হয়ে গেল। এ তো চোরের মায়ের বড়ো গলা! নিজে ধরা পড়ে মেজাজ দ্যাখাচ্ছে! স্যারের সামনে ও দাঁতে দাঁত চিপে হিস হিস করে বলল, ‘বাবা, বেশ্যাটাকে একটু ধাতানি দিয়েছি বলে এত কষ্ট? ক-বার শুয়েছ ওর সঙ্গে?’

সৈকত পাগলের মতো চিৎকার করছিল, ‘তোর এই মেন্টাল রোগের শাস্তি তুই একদিন পাবি, দেখে নিস! তোর অনেক অত্যাচার, অনেক সন্দেহ সহ্য করেছি, আর না! আগেও তুই আননোন নম্বর থেকে চেক করেছিস আমায়, কিন্তু এবার যা করেছিস, তোকে আমি ছাড়ব না। তুই কোনোদিনও পাল্টাবি না। সাহস থাকলে তোর মেইলটা চেক করে দেখিস। তোকে আমি খুন করবই। পৃথিবীর যেখানেই পালা তুই, আমি তোকে শেষ করে দেব।’

রাগে অস্থির হয়ে গেলেও ভেতরে ভেতরে ভয় পেয়ে যাচ্ছিল সুকন্যা। সৈকত খুব শান্ত ছেলে, এরকম উগ্র রূপ ওর কখনো দেখেনি ও। হতবুদ্ধি হয়ে ও ডেস্কে এসে বসল।

ট্রেনটা জোরে একটা ঝাঁকুনি দিয়ে থেমে যেতেই সম্বিৎ ফিরে পেয়ে সুকন্যা দেখলো, কাঁচড়াপাড়া ঢোকার আগে দাঁড়িয়ে রয়েছে ট্রেন। কাঁচড়াপাড়ায় সৈকতের নিজের বাড়ি, ওর শ্বশুরবাড়ি। স্যরি, ওর এক্স-শ্বশুরবাড়ি, নিজেই নিজেকে শুধরে দিল ও। ছুটিছাটায় আসত ওরা টুকটাক। আর কোনোদিনও আসবে না। ঈশ! ওর এক্স-শাশুড়ি রান্নাটা সলিড করত! আর খেতে পাবে না।

চোখে জল উপচেই পড়ছে। কত চোখের জল মুছবে সুকন্যা! সারা লেডিজ কামরা এতক্ষণে জেনে গেছে ও কেঁদে চলেছে সেই থেকে। মনটা ঘোরাতে ও ফোনটা অন করল। আজ ও সবাইকে ছেড়ে চলে যাচ্ছে, কোথায় ও নিজেও জানে না। ওর সবসময় ভালোবাসার মানুষ আজ ওকে চায় না। এ জীবন রেখে লাভ কি!

নেট অন করার সঙ্গে সঙ্গে নোটিফিকেশন উপচে পড়ল। ফেসবুক, হোয়াটসঅ্যাপের সঙ্গে সৈকতের একটা মেইল ভেসে উঠল স্ক্রিনে। ও হ্যাঁ, এই মেইলটার কথাই বলেছিল তখন। কাঁপা কাঁপা হাতে মেলটা খুলল ও, আরো কত আক্রোশ, কত ঘৃণা জমা করে রেখেছে সৈকত ওর জন্য? মনটা শক্ত করে তাকাল ও, কিন্তু কিছুই দেখতে পেল না। মেইলটায় কোনো লেখা, খেয়াল করে দেখল দুটো অ্যাটাচমেন্ট রয়েছে শুধু।

ডাউনলোড করল সুকন্যা।

একটা বহু পুরনো হলদে হয়ে যাওয়া খবরের কাগজের কাটিং। প্রায় পনেরো বছর আগে একটা পাঁচ বছরের বাচ্চা মেয়ের কয়েকটা বিকৃত পশুর লালসার শিকার হওয়ার গল্প। কাটিংটা পড়লেই বোঝা যায়, সেই সময়ে আলোড়ন ফেলেছিল খবরটা। ওইটুকু মেয়ের গণধর্ষিতা হওয়ার খবর তখনো এতটা কমন হয়নি। খবরটা পড়তে পড়তে শিউড়ে উঠল সুকন্যা। মেয়েটা কোমায় চলে গিয়েছিল, তারপর কিছুটা সুস্থ হয়ে এখন মানসিক স্থিতি হারিয়েছে।

সুকন্যা কিছুই বুঝতে পারছিল না। এটা ওকে পাঠানোর কি অর্থ? খচখচে মনে ও পরের অ্যাটাচমেন্টটা খুলল। এটা একটা ফরোয়ার্ড মেইল। আরে, এটা তো অভিষেকদা পাঠিয়েছে সৈকতকে। অভিষেকদা সৈকতের পুরনো বস, এখন আমেরিকায় অন্য একটা কোম্পানিতে আছে। সুকন্যার সঙ্গেও আলাপ আছে বেশ। মেইলটা এইরকম, ‘সৈকত, তোকে ভাইয়ের মতো দেখি বলেই আবদারটা করতে পেরেছিলাম। মিনুকে তোদের কোম্পানিতে ঢোকাবার জন্য তাকে থ্যাঙ্কস দিয়ে ছোট করব না। শুধু বলব, তুই একটু আমার বোনটাকে দেখিস ভাই। ওই ছোটোবেলায় ওরকম ট্রমার পর তো সব শেষই হয়ে গিয়েছিল। অনেক কষ্টে ওকে নরম্যাল লাইফে নিয়ে আসতে পেরেছি। কিন্তু, ওর জবুথবু ভাবটা এখনো কাটেনি রে। লোকজন দেখলেই গুটিয়ে যায়, একা থাকলেই গুমরে কাঁদে, চিৎকার করে ওঠে। ছেলেদের দেখলেই হিস্টিরিক হয়ে পড়ে। মাথাটা বড় ভালো ছিল রে আমার বোনটার। তুই একটু ওকে সময় দিস, একটু ওর মনের ভয়গুলো দূর করিস, সবাই একরকম যে হয় না, সেটা বোঝাস, যদি ও একটা স্বাভাবিক মেয়ের মতো কখনো হয়ে উঠতে পারে। অফিসের আর কাউকে জানাস না, অবশ্য এটা তোকে না বললেও চলত। আমি তো এতদূর থেকে কিছুই করতে পারছি না। তোর কাছে চিরকাল গ্রেটফুল থাকব ভাই!’

সুকন্যা ভেতরে ভেতরে কেঁপে উঠল। এ কি করল ও? নিজের অহেতুক সন্দেহর জন্য এতবড় ভুল করল? সারা শরীরে কেমন একটা ঝাঁকুনি দিতে শুরু করেছে ওর। আর থাকতে না পেরে ও স্টেশনে নেমে পড়ল। ভেতরটা তোলপাড় হয়ে যাচ্ছে ওর, নিজের প্রতি ঘৃণায়। সৈকত ওর স্বামী, সেই হিসেবে ওর গর্বিত হওয়া উচিত, এমন একজনকে ও বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়ে দিয়েছে বলে, তা না করে ওই মেয়েটাকে আরও একবার আঘাত দিল ও!

আধঘণ্টা পরে ও যখন শ্বশুরবাড়ি পৌঁছল, তখন ও ওর সব কাজের মতো পরবর্তী কোর্স অফ অ্যাকশন ঠিক করে নিয়েছে। সৈকতের বাবা-মা তো দেখে অবাক। ও হু-হা করে বাথরুম থেকে ফ্রেশ হয়ে বেরিয়ে এসে সৈকতকে একটা বড়ো মেসেজ করল, ‘তুমি আমাকে খুন করতে আসতে পারো। আসতেই পারো। ইন ফ্যাক্ট আমি তোমার বাড়িতেই রয়েছি। মানে, আমার শ্বশুরবাড়িতে। কি করব বলো, যে মেয়ে বরের ওপর রাগ করে বাপের বাড়ি গেলে নিজের বাবা-মায়ের কাছেই কথা শুনতে হয়, সে শ্বশুরবাড়ি ছাড়া যাবে কোথায়! তবে হ্যাঁ, তোমায় একটা কথা বলছি। আমি কিন্তু পালটে গেছি। তোমার রসগোল্লা সত্যি সত্যি পালটে গেছে। আর কোনোদিনও আমি তোমায় সন্দেহ করব না কথা দিলাম। আমাকে ক্ষমা করো তুমি।’

কিছুক্ষণ থেমে আবার লিখল, ‘রসগোল্লাকে ক্ষমা করো, প্লিজ!’

মেসেজটা করেই আর রিপ্লাইয়েরে অপেক্ষা করল না ও। চোখ মুছে ফোন লাগাল অদ্বিতীয়াকে। বড়দিদি হয়ে ছোটবোনের কাছে ওকে ক্ষমা চাইতেই হবে। ভুল করেছে তো কি! মানুষ মাত্রই ভুল করে। সেটা বুঝতে পেরে পাল্টানোটাই বড় কথা!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *