সুখের অলিন্দে

সুখের অলিন্দে

মঞ্জরী ওর স্কুটিটা কোনোমতে সিঁড়ির তলায় ঢোকাল, একতলায় এদিক-ওদিক একবারও না তাকিয়ে দুমদাম করে সিঁড়ি লাফিয়ে ঘরে এসে ঢুকল।

খাটের উপর ওর ব্যাগটা ছুড়ে ফেলে দিয়ে জানলার পাশের ইজিচেয়ারে হেলান দিয়ে বসে নরম রোদে খবরের কাগজ পড়া দেবব্রতর উদ্দেশ্যে বলল, ”আমি জানতাম! আমি জানতাম তুমি ঠিক এইরকম নির্লিপ্তভাবেই বসে থাকবে। এই আমার ভাগ্য, চিরটা কাল তুমি এই নির্বিকার হয়ে কাটিয়ে দেবে, ভালো খবরেও কোনো উচ্ছ্বাস নেই, খারাপ খবরেও কোনো হা-হুতাশ নেই!” দেবব্রতকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকতে দেখে ও স্বামীর মুখের সামনে এসে চোখ বড় বড় করে আবদারের সুরে বলে উঠল, ”আচ্ছা আমি কি একটা জড়পদার্থকে বিয়ে বিয়ে করেছি?”

দেবব্রত খবরের কাগজটা নামাল, নামিয়ে শান্ত স্বরে বলল, ”কি ব্যাপারে তুমি আমার রিয়্যাকশন চাইছ?”

মঞ্জরীর চোখে প্রচ্ছন্ন কৌতুক থাকলেও মুখে ধমকে উঠল, ”সারা বাড়ি সকাল থেকে তোলপাড় হচ্ছে, আর তুমি … ! এই বার যদি আমি তোমার এই কথাটাকে ন্যাকামি বলি তখন আমার হয়ে যাবে মুখ খারাপ, তাই তো!”

দেবব্রত এবার একপেশে হাসল, ”না তোমার এত সুন্দর মুখ কখনো খারাপ হতে পারে? তবে বিয়ের আড়াই বছরের মধ্যেই যেরকম লাথিঝাঁটা জুটতে শুরু করেছে আমার কপালে, তাতে করে আমার মুখ কতদিন ঠিক থাকবে জানি না। অবশ্য লাথিঝাঁটা জোটাটাই স্বাভাবিক। সেলিব্রিটি বউ বলে কথা!”

মঞ্জরীর মুখের ঝিলিকটা মুহূর্তে উধাও হয়ে গেল, এবার ও ক্লান্তস্বরে বলল, ”ইয়ার্কি মারছ কেন? সবসময় ভালো লাগে না ইয়ার্কি।”

মুহূর্তে দেবব্রতর মুখ থেকে হাসি মুছে গিয়ে শক্ত হয়ে উঠল চোয়াল, ”সেটাই তো আমিও বলছি মঞ্জরী! বাড়িতে এটা কি ধরণের সেলফিসনেস চলছে? বাবার কি ভীমরতি ধরল?” নিষ্ফল আক্রোশে এবার ও ফেটে পড়ল, ”আমি যখন বললাম একটা স্টার্ট আপ খুলব, তখন বাবা কি বলেছিলেন মনে আছে তোমার? বাঙালির ছেলে আবার ব্যবসা করতে পারবে নাকি? আমার হাজার অনুরোধেও একটা পয়সাও বাবা ঠেকাননি! আর এখন?” মুখ দিয়ে রাগের শব্দ করল দেবব্রত, ”শালা আমার কপালটা শুধু ভাবি। বউ ধিঙ্গির মতো নেচে নেচে বেড়াচ্ছে, বাবা তাতে সাধ দিচ্ছে, আর নিজেও পাগলামি করে বেড়াচ্ছে।”

মঞ্জরী এবার বুঝল, ও নিজে ঠাট্টার ছলে এতক্ষণ কথা বললেও দেবব্রত তা করেনি মোটেই। শ্লেষ, খোঁচা, বিদ্রূপের তেতো সুর ঝরে পড়ছে ওর বলা প্রতিটা শব্দ থেকে।

ও একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বাবু হয়ে খাটের ওপর বসল। ঘামে কপালের উপরের কুচো চুলগুলো ভিজে গিয়ে লেপ্টে লেগে রয়েছে গালের দু-পাশে, চোখের কাজল ধেবড়ে গলে এসেছে নীচের দিকে। স্বাভাবিক। আজ রবিবার, সকাল থেকে টানা পাঁচখানা নাচের সেশন। সব মিলিয়ে শুধু লোয়ার সেকশনেই ওর দুশোর ওপর স্টুডেন্ট। আপারে আরো শ-খানেক। কৃষ্ণনগর টাউনে তো বটেই, গোটা নদীয়াতেই মঞ্জরীর নাচের অ্যাকাডেমি এখন খুব নামডাক। ভর্তির সময় তো এখন অ্যাডমিশন টেস্ট চালু করতে হয়েছে, রাখতে হয়েছে অফিসের হিসেব, তদারকির জন্য একজন স্টাফ।

রানাঘাট, চাকদা, কাঁচড়াপাড়া, নৈহাটি, এমনকি ব্যারাকপুরের দিক থেকেও ওর অ্যাকাডেমিতে নাচ শিখতে আসে। বছর চারেক খুললেও এত নাম অবশ্য আগে ছিল না, আগের বছর ওর একটা স্টুডেন্ট অল ইন্ডিয়া একটা ডান্স রিয়ালিটি শোতে চ্যাম্পিয়ন হওয়ার পরেই এই বাড়বাড়ন্ত। সেই চ্যাম্পিয়ন ছাত্রীটি তো ইতিমধ্যেই টলিউডে খাতা খুলে ফেলেছে, তার সাথে ভাগ্যের চাকা হু হু করে ছুটতে শুরু করেছে মঞ্জরীরও। কৃষ্ণনগরে স্কুল ফুলেফেঁপে উঠেছে, সম্প্রতি মঞ্জরী কলকাতাতেও একটা সেট আপ চালু করার বন্দোবস্ত শুরু করছে, সপ্তাহে একদিন গিয়ে ক্লাস নিয়ে আসবে।

কিন্তু এক টাকার কয়েনেরও যেমন উলটো পিঠ থাকে, তেমনই এখানে পাল্লা দিয়ে বাড়তে শুরু করেছে দেবব্রতর খিটখিট। অথচ, আজ ভাবলে অবাক হয়ে যায় মঞ্জরী, পাড়ার ফাংশনে ওর নাচ দেখেই কিন্তু দেবব্রতর মুগ্ধতা শুরু হয়েছিল, যেচে এসে আলাপ করেছিল ওর সাথে। প্রথম প্রথম মঞ্জরীর নতুন খোলা নাচের স্কুল নিয়েও দেবব্রতর উৎসাহ ছিল তুঙ্গে, এমনকি অফিসের কলিগদের কাছেও গল্প করত, ওর নাচের ছবি দেখাত, নিজের কানে শুনেছে মঞ্জরী।

কিন্তু বিয়ের পর মঞ্জরী যখন জানিয়েছিল নাচের স্কুলটাকে আর ছোট না রেখে বাড়ি থেকে শিফট করে একদম নেদের পাড়ার মোড়ের শপিং কমপ্লেক্সে বড় করে শুরু করতে চায়, তখন থেকেই শুরু হয় দেবব্রতর আপত্তি। আজও কথাগুলো কানে বাজে মঞ্জরীর, ”বিয়ের পর আর ওসবের কি দরকার মঞ্জু? তুমি নিজের পায়ে দাঁড়াতে চাও তো স্কুল-টুলে পড়াতে পারো, কিংবা টিউশনি। চাকরির পরীক্ষাও দিতে পারো। আমার কোনো আপত্তি নেই। কিন্তু বিয়ের পরেও স্টেজে উঠে নাচা… কি দরকার!”

 মঞ্জরী সেদিন অবাক হয়ে গিয়েছিল, ভেবেছিল দু-বছর ধরে কোন মানুষটার সাথে ও প্রেম করল, যে কিনা এটুকু আজ অবধি বুঝতে পারল না যে নাচই ওর প্যাশন, নাচই ওর ধ্যানজ্ঞান, সেটা নিছকই রোজগারের রাস্তা নয়। নাচ ছাড়া কিসেই বা মনপ্রাণ সঁপেছে ও?

তবু কষ্ট হলেও হয়ত মেনে নিত মঞ্জরী, আর পাঁচটা বাঙালি মেয়ের মতোই সংসারটা অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ ছিল নিজের শখের কাছে। কিন্তু রুখে উঠলেন দেবব্রতর বাবা শক্তিব্রত। শক্তিব্রত শুধুই মঞ্জরীর শ্বশুরমশাই নন, তিনি ছিলেন কৃষ্ণনগরের নামজাদা সরকারি হাই স্কুলের কড়া হেডস্যার। এখন রিটায়ার করেছেন। কাজেই তিনি মঞ্জরীর প্রাক্তন মাস্টারমশাইও বটে।

বিয়ে, বৌভাত, অষ্টমঙ্গলা সব মিটে যাওয়ার পরেও মঞ্জরীর ক্লাস চালু করার কোনো তাগিদ, হেলদোল নেই দেখে শক্তিব্রত জিজ্ঞেস করেছিলেন, ”কি ব্যাপার, মঞ্জরী? নৃত্যমঞ্জরী খুলবি কবে?”

”নৃত্যমঞ্জরী আর খুলব না ভাবছি স্যা — ইয়ে বাবা!” মঞ্জরী মিনমিন করা শুরু করতেই শক্তিব্রত পলকে বুঝে নিয়েছিলেন কারণটা, তারপর সাফ জানিয়েছিলেন, ”দেবু বাগড়া দিচ্ছে তো? আমি জানতাম। ওটাকে তো জন্মে থেকেই চিনি, মুখে খালি বড় বড় কথা, ব্যাটা কাজের বেলায় চিরকালের অর্থোডক্স।” তারপর ভ্রূ কুঁচকে মঞ্জরীর দিকে তাকিয়েছিলেন, ”শোন বাড়ি বসে দিনরাত সিরিয়াল দেখে মোটা হওয়া আর পরের বাড়ি নিয়ে কোঁদলগিরি করা কিন্তু এখানে হবে না। ক-দিন ছুটি কাটাচ্ছিস কাটা, তারপর সোজা গিয়ে স্কুলটা খুলবি।” শক্তিব্রত রাগ রাগ স্বরে বলেছিলেন, ”কেন তোর বাবা যে বলছিলেন তুই নেদের পাড়ায় একটা বড় জায়গা ভাড়া নিবি ভেবেছিস? সেটার কি হল?”

মঞ্জরী কিছু বলার আগেই ওর শাশুড়ি আরেক ধাপ এগিয়ে বক্তব্য রাখতে শুরু করেছিলেন, ”ওমা! ক্লাস ফাইভ থেকে অ্যানুয়াল ফাংশনে গিয়ে তোর নাচ দেখছি। যে বিদ্যেটা আহরণ করেছিস, সেটা অন্যকে শেখাতে না পারলে সেই বিদ্যের মানে কি মঞ্জরী?”

বলাই বাহুল্য, এর পরে দেবব্রতর আপত্তি আর ধোপে টেকেনি। নৃত্যমঞ্জরী আরো বড় মাপে উঠে এসেছে কৃষ্ণনগরের একদম প্রাণকেন্দ্রে।

কিন্তু ইচ্ছার বিরুদ্ধে গিয়ে মঞ্জরীর নাচ, ফাংশান, স্কুল চালিয়ে যাওয়ার রাগটা যে প্রতিনিয়ত দেবব্রত ওর ব্যবহারের প্রতিটা ভাঁজে, উষ্মায় বুঝিয়ে জর্জরিত করে তুলবে, সেটা কি মঞ্জরী ভাবতে পেরেছিল? সম্পর্কের অবনতিতে আরো যেন অনুঘটকের কাজ করলো চাকরি নিয়ে দেবব্রতর চরম ডিসস্যাটিসফ্যাকশন। কৃষ্ণনগর থেকে সল্টলেকে দৈনিক যাতায়াত, তার উপর আইটি সেক্টরের সারাক্ষণের অনিশ্চয়তা যেন কোথায় লুকিয়ে ফেলল পুরনো দেবব্রতকে।

হঠাৎ দেবব্রতর কথায় মঞ্জরীর ঝটকা ভেঙে গেল, ”কি হল, আবার কি ভাবের জগতে চলে গেলে নাকি তুমি?” হিসহিস করে উঠল দেবব্রত, ”এই টাকাটা বাবা আমাকে দিলে …” ব্যর্থতায়, বিষাদে দেবব্রতর গলা কাঁপছে, ”আমি আবার স্টার্ট আপটা শুরু করতে পারতাম!”

মঞ্জরী এবার গলার স্বর শক্ত করে দেবব্রতর দিকে সোজাসুজি তাকাল, ”কিছু মনে কোরো না দেব, তোমার এই বারবার বাবাকে দোষারোপটা কিন্তু অকৃতজ্ঞতা হয়ে যাচ্ছে, না বলে পারছি না আমি। বাবা না হয় লিকুইড মানি দেননি তোমাকে, কিন্তু তোমার নতুন কোম্পানি শুরুর জন্য সল্টলেকে ওই ছোট ফ্ল্যাটটা রেডি করে তো দিয়েছিলেন? মুখে রাগ করলেও দশটা ল্যাপটপও তোতনকে দিয়ে কিনে পাঠিয়েছিলেন। এটা কি কম দেবব্রত? মানুষের উপকারটাকে অ্যাকনলেজ করতে শেখো।”

দেবব্রত এবার চিবিয়ে চিবিয়ে বলল, ”এতে উপকারের কি দেখছ তুমি? কোন বাবা এগুলো করে না? টাকাটা দিলে আমি চাকরিটা ছেড়ে আবার ব্যবসায় মন দিতে পারতাম বরং!”

মঞ্জরী বলতে যাচ্ছিল, ”সবার দ্বারা সব কিছু নয় না দেবব্রত, সেটা মানতে শেখো।” কিন্তু পূর্ব অভিজ্ঞতা থেকে ও বোঝানোর চেষ্টায় দাঁড়ি টানল। কিছু মানুষ আছে যারা শত বোঝানোতেও বোঝে না। দেবব্রতও ইদানীং সেটাই হয়ে যাচ্ছে।

তাছাড়া দেবব্রতর অভিযোগগুলোও অতিরঞ্জিত এবং অনেকটাই মিথ্যে। দেবব্রত তার চাকরিতে খুশি ছিল না, তার ইচ্ছে ছিল নিজের ছোট একটা ওয়েব ডেভেলপমেন্ট কোম্পানি খোলার। শক্তিব্রত মুখে বারণ করেছিলেন, সেটাই ন্যাচারাল। একটা ভালো মাইনের চাকরি ছেড়ে অনিশ্চয়তায় ঝাঁপ দেওয়ার সিদ্ধান্তটা বাবা-মায়ের কাছে প্রথমে গ্রহণযোগ্য না হওয়াই স্বাভাবিক।

কিন্তু পরে যখন দেবব্রত দুম করে আগের চাকরিটা ছেড়ে দিয়ে নিজের কোম্পানি শুরু করল, তখন উপর উপর রাগ করলেও বাবা পাশে তো ছিলেন! সল্টলেকের ফ্ল্যাটটা বাবা বেশ কিছু বছর আগে কিনেছিলেন ভাড়া দিয়ে অবসর জীবনে একটা ফিক্সড আয়ের জন্য, সেই ভাড়াটে বুঝিয়ে সুঝিয়ে উঠিয়ে ফাঁকা ফ্ল্যাটটা দেবব্রতকে ছেড়ে তো দিয়েছিলেন। পাড়ার কম্পিউটারের দোকানের তোতনকে অর্ডার দিয়ে কলকাতা থেকে কম্পিউটার কিনিয়ে সল্টলেকের ফ্ল্যাটে পৌঁছেও দিয়েছিলেন। আর কি করতে পারেন শক্তিব্রত একজন বাবা হিসেবে?

আর তাছাড়া দেবব্রতই বা সেই ব্যবসায় কি সাফল্য দেখাতে পারল যে শক্তিব্রত আরো উৎসাহ দেবেন সন্তানকে? ব্যবসা করার ইচ্ছা থাকলেও তার জন্য যে দূরদর্শিতা, অধ্যবসায় আর ইগোবিহীন ব্যবহার প্রয়োজন, সেই কোনোটাই দেবব্রতর নেই। মঞ্জরীও নিজের আয়ের সিংহভাগই তখন দিয়ে দিত ব্যবসায়। তাতেও কোনো লাভ হয়নি। দেবব্রতর মেজাজের জন্য যে দুটো ইয়ং পরিশ্রমী ছেলেকে নিয়ে স্টার্ট আপটা শুরু হয়েছিল, তারাও একে একে ছেড়ে দিয়ে চলে গেছে, পরপর ভালো কয়েকটা প্রোজেক্ট পাইপলাইনে থাকা সত্বেও দেবব্রতর অতিরিক্ত স্ট্রিনজেন্সির জন্য সেগুলো প্রোপোজাল স্টেটে ভেস্তে গিয়ে দেবব্রতকে সর্বস্বান্ত হতে হয়েছে। লোকসানের পর লোকসানে মুখ থুবড়ে পড়ে অবশেষে সেই কোম্পানি মাস তিনেক আগে তালা চাবি দিয়ে দেবব্রতকে একটা চাকরিতে আবার জয়েন করতে হয়েছে।

মঞ্জরী দেবব্রতর কষ্টটা বোঝে, কিন্তু দেবব্রতরও তো বোঝা উচিত ইচ্ছে থাকলেও সবার দ্বারা সব কিছু হয় না। আর সেইজন্য কাছের মানুষগুলোকে অমূলক দোষারোপ করাটা ঘোরতর অন্যায়।

মঞ্জরী একটা বড় দীর্ঘশ্বাস ফেলে ঘর থেকে বেরোতে যাচ্ছিল, পেছন থেকে দেবব্রত চেঁচিয়ে উঠল, ”আমি অবাক হয়ে যাচ্ছি, আমার এই অবস্থাতেও তুমি বাবাকে সাপোর্ট করছ!”

মঞ্জরী ধরা গলায় দেবব্রতর দিকে তাকাল, ”সাপোর্টের তো কিছু নেই। তোমার স্বপ্নের সময় আমি যেমন পাশে ছিলাম, বাবা-মায়েরও শেষ বয়সের একটা ইচ্ছে সমর্থন করাটা আমার উচিত বলেই মনে হয়। আর তিনি নিজে প্রাইজটা জিতেছেন, সেটা অ্যাভেইল করবেন না প্রাইজমানি তোমায় দেবেন, সেটা তো ওনার ব্যক্তিগত ব্যাপার দেবব্রত!”

দেবব্রত এবার চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে বলল, ”নিজের ছেলের ব্যবসায় ভরাডুবি হল, আর বুড়ো বয়সে আমি বউকে নিয়ে ড্যাং ড্যাং করে আইফেল টাওয়ারের উপর উঠতে যাচ্ছি, এটা ইচ্ছে? এটা ইচ্ছে নয় মঞ্জু, এটা হল স্বার্থপরতা!”

মঞ্জরী বলল, ”আশ্চর্য! স্বার্থপরতা কি করে বলছ তুমি? সারাটা জীবন তো মানুষটা তোমার জন্য, সংসারের জন্যই ভেবেছেন। এই বয়সে এসে স্ত্রীর একটা ছোট সাধ পূরণ করতে তাঁর ইচ্ছে হতে পারে না? এ কিরকম কথা বলছ তুমি?” তারপর ও নরম গলায় বলল, ”বিয়ের পরের দিনই মা আমাকে বলেছিলেন এই ব্যাপারটা। আমার তো মজাই লেগেছিল।”

মজা মঞ্জরীর কাল রাতেও লেগেছিল যখন শক্তিব্রত সলজ্জ মুখে সিদ্ধান্তের কথাটা ওকে জানিয়েছিলেন।

আসল কথাটা অবশ্য ওর শাশুড়ির মুখে শোনা। একবার নয়, বহুবার।

সত্যি ! কত মানুষের কত শখ থাকে! সেই শখের সাথে জুড়ে থাকে কত পুরনো হলদে চিঠির গন্ধের মতো উষ্ণতা, নস্ট্যালজিয়া।

শক্তিব্রত আর আরতির বিয়ে হয়েছিল বছর চল্লিশ আগে, ফুলশয্যার রাতে রাঙা চেলিতে জড়সড় নতুন বউকে যখন প্রথামত শক্তিব্রত আংটি পরিয়ে দিতে গিয়েছিলেন, মৃদু গলায় আরতি আপত্তি করেছিলেন, রিনরিনে গলায় বলেছিলেন, ”সোনার গয়না আমার ভালো লাগে না। আ-আমার সাজতেই ভালো লাগে না।”

শক্তিব্রত অবাকই হয়েছিলেন বটে, তবু কিছুক্ষণ আমতা আমতা করে জিজ্ঞেস করেছিলেন, ”যাহ, তাহলে নতুন বউকে যে কিছু দিতে হয়, কি দেবো?”

আরতি কপালভরা চন্দন নিয়ে কিছুক্ষণ ইতস্তত করেছিলেন, তারপর কাজল পরা চোখে তাকিয়েছিলেন শক্তিব্রতর দিকে, ”আমাকে আইফেল টাওয়ারে নিয়ে যাবেন একবার? দাদা বলেছিল নিয়ে যাবে, কিন্তু আর আসেনি।”

শক্তিব্রত থমকে গিয়ে তাকিয়েছিলেন নতুন বউয়ের দিকে।

বিয়ের সম্বন্ধের সময়েই শক্তিব্রত জেনেছিলেন আরতির দাদা খুব মেধাবী ছাত্র ছিলেন, স্কলারশিপ পেয়ে সেইসময় পড়তে গিয়েছিলেন প্যারিসে। তখনকার দিনের মধ্যবিত্ত বাড়িতে ছেলেমেয়ে বিদেশে পড়তে গেলে যা হয়, চিঠিচাপাটিতেই চলত যোগাযোগ। দাদা ছবি পাঠাত, আর বোন কলকাতার গলির বাড়িতে বসে সেই ছবি দেখে যেন সত্যিই চলে যেত সেখানে, কিশোরী মনে কল্পনা করত সে যেন নোতরদাম গির্জায় ঢং ঢং করে ঘণ্টা বাজাচ্ছে, ওই হেঁটে বেড়াচ্ছে সেইন নদীর পাশ দিয়ে, আইফেল টাওয়ারের উপর থেকে পুরো প্যারিস শহরটাকে দেখে যেন মনে মনে পাখির মতো উড়ে বেড়াচ্ছে চারদিক।

কিন্তু আরতি যখন কলেজে ভর্তি হবেন সেই সময়েই খবর আসে, অতিরিক্ত ঠান্ডায় অনেকদিন ধরেই ভেঙে পড়ছিল ওর দাদার শরীর, অবশেষে সেসব ধরাছোঁয়ার বাইরে চলে গেছে। এমন নিদারুণ দুসংবাদে আরতির বাবা-মা পুত্রহারা হয়ে শোকে পাথর হয়ে যান, তারপর সময়ের সাথে সাথে তাঁরা আঁকড়ে ধরেন একমাত্র কন্যা আরতিকে।

ফুলশয্যার রাতের বাকিটুকু খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে শক্তিব্রত জেনেছিলেন, আরতির একটাই ইচ্ছে, দাদার মতো প্যারিসের আইফেল টাওয়ারে উঠে পুরো শহর দেখা। দাদা প্রচুর ছবি পাঠাত, আরতির স্থির বিশ্বাস, ওখানে গেলেই চিরকালের জন্য হারিয়ে যাওয়া ওর দাদাকে ও আবার যেন অনুভব করতে পারবে।

আরতি আরো জানিয়েছিলেন, কলেজে উঠে ইংরেজি নভেল পড়তে পড়তে অষ্টাদশী তরুণীর স্বপ্নরাজ্যে ধীরে ধীরে আরো দৃঢ় জায়গা দখল করেছিল প্যারিস শহর, দাদার প্রতি শোকে বহুগুণ হয়েছিল সেই আকাঙ্ক্ষা। কিন্তু তখনকার দিনের একলা মেয়ে, কার সাথেই বা যাবেন? তাই জীবনসঙ্গীর সাথেই সেই স্বপ্ন বাস্তবে নামিয়ে আনার বীজ বুনেছিলেন আরতি মনের অন্দরে।

যদিও পুরো ঘটনাটাই আরতির মুখে শোনা, তবু কাল রাতে শক্তিব্রতর মুখ থেকে আড়ষ্ট গলায় মঞ্জরীর শুনতে বেশ লাগছিল, ”জানিস মঞ্জরী, অত বছর আগের সেই বিয়ের রাতে আরতির মুখে ওর ইচ্ছের কথা শুনে আমি থ হয়ে গিয়েছিলাম। ইংল্যান্ড ফ্রান্স তো দূর, তখন কাশ্মীর যাওয়ার পয়সা কোথায়? মাস্টারদের মাইনেই বা কি তখন? বড়জোর বছরে একবার পুরী, একবার দার্জিলিং!” শক্তিব্রত অসহায় চোখে বলছিলেন, ”আরতি অবশ্য ওই একবারই বলেছিল, তারপর থেকে কথাটা আর তোলেনি। কিন্তু আমি যেন সেটা মাথা থেকে তাড়াতেই পারিনি রে। দিন কেটেছে, দেবু হয়েছে, আমরা বুড়ো হয়েছি, তুই এলি। তবু মাঝেমাঝেই আমার মনে হত আহা যে মানুষটা আমার সংসারটাকে আগলে রেখেছে, কখনো মুখ ফুটে কিচ্ছু চায়নি, তাঁর একটা ইচ্ছে আমি রাখতে পারলুম না? তাই ফোনটা পেয়ে আর দ্বিমত করিনি রে! জানি ওরা সব দিলেও নিজের পকেট থেকেও কেনাকাটা, টুকিটাকিতে হাজার পঞ্চাশেক তো যাবেই, অত বড়লোকদের দেশ। তা যাক! শখ মেটানোর এমন সুযোগ তো আর আসবে না, তাই না বল?”

মঞ্জরী হেসে বলেছিল, ”একদমই তাই বাবা। সারাজীবন তো তোমরা আমাদের জন্যই ভাবলে, একবার নিজেদের ইচ্ছেটাও ভাব।”

শক্তিব্রত মঞ্জরীর প্রশ্রয়ে বাচ্চা ছেলের মতো উজ্জ্বল হয়ে উঠেছিলেন, ”আর কি অদ্ভুত দ্যাখ, লাকি কনটেস্টে তো আমার নামটাই উঠল। এ ঈশ্বরের ইচ্ছা ছাড়া আর কি?”

”সে তো ঠিকই।” মঞ্জরী সায় দিয়েছিল।

ব্যাপারটা অভাবনীয়ই বটে। আগের সপ্তাহে শক্তিব্রত আরতির রান্নার সুবিধার জন্য একটা মাইক্রোওভেন কিনে এনেছিলেন, সেই কোম্পানি থেকেই ফোন করে জানিয়েছে, ওদের ওই এক সপ্তাহের ক্রেতাদের মধ্যে নাকি লাকি কন্টেস্ট চলছিল, শক্তিব্রত তাতে সিলেক্টেড হয়ে পেয়েছেন অদ্ভুত এক প্রাইজ। মাইক্রোওভেন কোম্পানির তরফে দেশের একটা প্রথম সারির ট্রাভেল এজেন্সির সাথে দুজন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের সাতদিন ফ্রান্স ভ্রমণের সুযোগ। থাকা-খাওয়া- ঘোরাসমেত। অর্থাৎ যে প্যাকেজের মোট খরচ দুজনের প্রায় তিন লাখ টাকা, সেটা শক্তিব্রত পাবেন বিনামূল্যে।

প্রথমে আমল না দিলেও ট্রাভেল এজেন্সি থেকে যখন পুরো ট্রিপের খুঁটিনাটি এসে পৌঁছল, তখন শক্তিব্রত আর আরতি অবাক হয়ে গেলেন। এ যে অকল্পনীয় ব্যাপার।

কিন্তু তারপর থেকেই দেবব্রতর উষ্মা শুরু হয়েছে। ওর বদ্ধমূল ধারণা বাবা চাইলে ঘোরার অফারটা না নিয়ে সমমূল্যের টাকাও নিতে পারেন যেটা দিয়ে ও আবার সলিলসমাধি হয়ে যাওয়া ব্যবসাটা দাঁড় করাবে।

এ কি আত্মকেন্দ্রিকতা! মঞ্জরী মনে মনে ভাবল, দেবব্রত ক্রোধে অন্ধ হয়ে ভাবতেও পারছে না প্রতিনিয়ত কতটা ছোট করে ফেলছে নিজেকে মঞ্জরীর চোখে!

কথায় কথা বাড়ে। দেবব্রত এমনিতেই তেতে আছে, মঞ্জরী আর কথা না বাড়িয়ে নীচে চলে এল। ওর হঠাৎ মনে হল, ওর নাচে এত সাফল্য, বাবার এই প্রাইজ পাওয়া, কোনো কিছুকেই দেবব্রত সহজভাবে আর নিতে পারছে না। কাছের মানুষগুলোর অ্যাচিভমেন্টে আনন্দের থেকেও ওর কাছে বড় হয়ে উঠছে পরশ্রীকাতরতা, অসূয়ায় ভরে উঠছে মন। কিন্তু স্ত্রী হিসেবে, সহধর্মিণী হিসেবে মঞ্জরী অনেক বুঝিয়েছে, ব্যবসার ভূত মাথা থেকে নামিয়ে চাকরিতে মন বসানোর জন্য কনভিন্স করার চেষ্টা করেছে, জীবনের ছোট ছোট আনন্দগুলোকে একসাথে সেলিব্রেট করতে চেয়েছে। কিন্তু নির্মম উপেক্ষায় দেবব্রত সেগুলোকে দূরে ঠেলে সরিয়ে দিয়েছে, উল্টে স্ত্রীর ক্রমাগত উন্নতির পথে মানসিক নির্যাতন করে তাকে ডিমোটিভেট করাটাই যেন ওর একমাত্র লক্ষ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে।

আরতি চেয়ারে বসে হলদে হয়ে যাওয়া পুরনো অ্যালবাম ঘাঁটছিলেন, মঞ্জরীকে দেখে উচ্ছল হয়ে উঠলেন, ”তোর জন্যই বসেছিলাম। এদিকে আয়, দেখে যা।”

মঞ্জরী কাছে গিয়ে দেখল বিবর্ণ হয়ে যাওয়া একটা সাদাকালো ফোটো, তাতে অবশ্য আইফেল টাওয়ারটা বোঝা যাচ্ছে ঠিক, পাশের চোখ জুড়নো নদীটা দিয়ে চলেছে পুরনো দিনের একটা ছোট নৌকো। ছবিটা সম্ভবত তোলা হয়েছে কোনো উঁচু জায়গা থেকে, একদম সামনেই একজন ভারতীয় যুবক দাঁড়িয়ে, পরনে কোট প্যান্ট। তার মুখের আদলে আরতির সাথে প্রচুর মিল।

আরতি জ্বলজ্বলে চোখে বললেন, ”এই নদীটার নাম সেইন। দাদামণি এই নদীটার পাড়ে গিয়ে জানিস মঞ্জরী, চুপ করে বসে থাকত। এখানকার মতো তো ভিড় নেই ওখানে, ওপাড়ের গির্জায় ঘণ্টা বাজতো ঢং ঢং, দাদামণি ওখানে বসেই আমাকে চিঠি লিখত।” আরতি ছলছলে চোখে মঞ্জরীর দিকে তাকালেন, ”এতদিন বাদে এই সুযোগটা এল, তাও আবার অন্য কোনো দেশ নয়, ফ্রান্স। দাদামণিই নিশ্চয়ই আকাশ থেকে এটা চেয়েছে বল?”

মঞ্জরী আর কিছু বলতে পারল না, এই প্রৌঢ় বয়সেও আরতি যেন সেই কিশোরী অভিমানী বোনটা হয়ে গেছেন, যে আকুল হয়ে অপেক্ষা করত তার দাদামণির জন্য।

ও নিশ্চুপ চোখে আরতির হাতে হাত রাখল।

সব কথার উত্তর কথায় দেওয়া যায় না।

**********

পনেরো দিন পরে যেদিন শক্তিব্রত আর আরতি দমদম থেকে প্লেনে উঠলেন, সেদিন রবিবার হলেও সামান্য কাজের অজুহাতে দেবব্রত গেল না।

মঞ্জরী সব লাগেজ যত্ন করে ট্যুর ম্যানেজারকে বুঝিয়ে দিলো, ওষুধ কখন কি খেতে হবে, পাসপোর্ট, ভিসা, ইউরো কিভাবে সারাক্ষণ ক্যারি করতে হবে, সেগুলোও মনে করিয়ে দিল।

নিজের স্মার্টফোনটা মঞ্জরী গত কয়েকদিন ধরে শিখিয়েছে শক্তিব্রতকে, সেটা শক্তিব্রতর হাতে গুঁজে দিয়ে বলল, ”দেবব্রতর ফোনে হোয়াটসঅ্যাপে ছবি পাঠাবে বাবা, কি করে পাঠাবে মনে আছে তো?”

শক্তিব্রত শিশুর মতো হেসে মাথা নাড়লেন, ”তুই সাহস দিলি বলেই যেতে পারছি মঞ্জরী! কখনো তো এতদূরে যাইনি।”

আরতি মঞ্জরীকে জড়িয়ে ধরলেন, ”সাবধানে থাকিস তোরা।”

মঞ্জরী ফিসফিস করে বলল, ”আইফেল টাওয়ারের উপর উঠে মামাকে বোলো মা, তুই তো নিয়ে এলি না, দ্যাখ দাদা আমি এসেছি!”

আরতির চোখদুটো জলে ভরে এল, শক্ত আলিঙ্গনে মঞ্জরীকে জড়িয়ে রাখলেন তিনি।

ওঁরা এয়ারপোর্টের অলিন্দে ধীরে ধীরে অদৃশ্য হয়ে গেলে মঞ্জরী নীরবে বাঁ হাতের চেটো দিয়ে চোখের জলটা মুছল, তারপর পকেট থেকে পুরনো ঢাউস ফোনটা বের করে ডায়াল করল ট্রাভেল এজেন্সির অফিসে, ”আপনাদের এই ট্যুর ম্যানেজারকে সব ঠিক করে বলে দিয়েছেন তো? আমার শ্বশুর-শাশুড়ি এই চলে গেলেন ওর সাথে। দেখবেন ওঁদের যেন খেয়াল রাখে, আর মাইক্রোওভেন কোম্পানিটার নাম যেন না ভোলে! আর আপনি নিজে ফোন না করলেই ভালো, প্রাইজের খবরটা আপনিই দিয়েছিলেন কিনা, চিনে ফেলতে পারে কণ্ঠস্বর।”

ফোনটা রেখে মঞ্জরীর হঠাৎ নিজেকে তুলোর মতো হালকা মনে হল। ওর মন বলছে, দেবব্রতর ক্রমাগত বেড়ে চলা বিরক্তিতে হয়তো সংসারটা বেশিদিন টিকবে না আর ওদের, হয়ত মঞ্জরীকে সব ছেড়ে চলে যেতে হবে, তবু এই আনন্দের রেশটুকু, আরতির মুখের ওই হাসিটুকু অমলিন হয়ে থেকে যাবে ওর মনে, আজীবন !

ও অনুভব করল, নিজের এতদিনের কঠোর পরিশ্রমের আয় দেবব্রতকে দিয়ে যত না সার্থক হয়েছিল, তার চেয়ে অনেক বেশি তৃপ্তির যেন আরতির এই স্বপ্নটা পূরণ করতে পারাটা!

কখনো কখনো মিথ্যাও কত সুখ বয়ে আনে!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *